১৪. আবিসিনিয়ায় প্রথম হিজরত

যুলুম অত্যাচার ও নির্যাতনের এ ধারা নবুয়তের চতুর্থ বছরের মাঝামাঝি বা শেষদিকে শুরু হয়েছিলো। প্রথমদিকে ছিলো মামুলি কিন্তু দিনে দিনে এর মাত্রা বেড়ে চললো। নবুয়তের পঞ্ঝম বছরের মাঝামাঝি সময়ে তা চরমে পৌছুলো। মক্কার অবস্থান করা মুসলমানদের জন্যে অসম্ভব হয়ে উঠলো। সেই সস্কটময় এবং অন্ধকার সময়ে সূরা কাহাফ নাযিল হয়েছিলো। এতে পৌত্তলিকদের উথাপিত বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেয়া হয়েছে। তাতে বর্ণিত তিনটি ঘটনায় আল্লাহর পক্ষ থেকে মোমেন বান্দাদের ভবিষ্যত সম্পর্কে সুস্পষ্ট ইংগিত দেয়া হয়েছে। আসহাবে কাহাফের ঘটনায় এ শিক্ষা মজুদ রয়েছে যে, দ্বীন ঈমান যখন আশস্কার সম্মুখীন হয় তখন কুফুরী এবং যুলুম -অত্যাচারের কেন্দ্র থেকে সশরীরে হিজরত করতে হবে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, তোমরা যখন ওদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হবে এবং ওরা আল্লাহর পরিবর্তে যাদের ইবাদত করে তাদের কাছ থেকে তখন তোমরা গুহায় আশ্রয় গ্রহণ কর। তোমাদের প্রতিপালক তোমাদের জন্যে তাঁর দয়া বিস্তার করবেন এবং তিনি তোমাদের জন্যে তোমাদের কাজকর্মকে ফলপ্রসূ করার ব্যবস্থা করবেন।
হযরত মূসা (আ) এবং হযরত খিযির (আ) এর ঘটনা থেকে শিক্ষা পাওয়া যায় যে, পরিণাম সব সময় প্রকাশ্যে অবস্থা অনুযায়ী নির্ণিত হয় না। বরং কখনো কখনো প্রকাশ্য অবস্থার সম্পূর্ণ বিরপীতও হয়ে থাকে। কাজেই এ ঘটনায় সূক্ষ্ম ইঙ্গিত রয়েছে যে, মুসমানদের বিরুদ্ধে বর্তমানে যেসব যুলুম-অত্যাচার হচ্ছে, তার পরিনাম হবে সম্পূর্ণ বিপরীত। এসব পৌত্তলিক ও উদ্ধত বিদ্রোহী ঈমান না আনলে একদিন তারা পরাজিত হয়ে বাধ্য হবে মুসলমানদের সামনে মাথা নত করতে এবং তাদের ভাগ্য নির্ধারণের জন্যে মুসলমানদের সামনে আত্নসমর্পণ করবে।
যুলকারনাইনের ঘটনায় নীচে উল্লেখিত কয়েকটি শিক্ষার প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে।
এক. জমীনের মালিকানা আল্লাহর, তিনি বান্দাদের মধ্যে যাকে চান তাকে অংশীদার করেন।
দুই, সাফল্য ঈমানের পথে রয়েছে, কুফরির পথে নেই।
তিন, আল্লাহ পাক মাঝে মাঝে বান্দাদের মধ্য থেকে এমন মানুষদের উথ্বান ঘটান যারা মজলুম ও উৎপীড়িত ,মানুষদের সেই কাফের “ইয়াজুজ মাজুজ”দের কবল থেকে উক্তি দেন।
চার, আল্লাহর পুণ্যশীল বান্দারা ডমীনের অংশীদার হওয়ার সবচেয়ে বেশী উপযুক্ত।
সুরা কাহাফের পর আল্লাহ তাআলা সুরা ঝুমার নাযিল করেন। এতে হিজরতের প্রতি ইশারা করা হয়েছে, এবং বলা হয়েছে যে, আল্লাহর যমীন সংকীর্ণ নয়। আল্লাহ পাক বলেনঃ বলো হে আমার মুমিন বান্দারা, তোমরা তোমাদের প্রতিপালককে ভয় কর। যারা এ দুনিয়ায় কল্যাণকর কাজ করে তাদের জন্য আছে কল্যাণ, প্রশস্ত আল্লাহর পৃথীবি, ধৈয্যশীলকেতো অপরিমিত পুরস্কার দেয়া হবে।
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জানা ছিল যে, হাবশার বাদশাহ আসহামা নাজ্জাশী একজন ন্যায়পরায়ন শাসক। তার রাজ্যে কারো উপর কোন জুলুম অত্যাচার করা হয় না। এ কারণে আল্লার রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) মুলমানদেরকে তাদের দ্বীনের হেফাজতের জন্য হাবশায় হিজরত করার আদেশ দিলেন। এরপর পরিকল্পিত কর্মসুচী অনুযায়ী রজব মাসে সাহাবায়ে কেরামের প্রথম দল হাবশার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। এ দলে বারোজন পুরুষ ও চারজন মহিলা ছিলেন। হযরত ওসমান (রা) ছিলেন দলনেতা। তাঁর সঙ্গে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কন্যা হযরত রোকাইয়া (রা)ও ছিলেন। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের সম্পর্কে বলেনঃ হযরত ইব্রাহিম (আ) এবং হযরত লুত (আ) এর পরে আল্লাহর পথে হিজরতকারী এরা প্রথম দল।
রাতের অন্ধকারে চুপিসারে এরা গন্তব্যস্থলের দিকে অগ্রসর হন। কো্ররাইদের জানতে না দেয়ার উদ্দেশ্যেই এ ধরনে সতর্কতার ব্যবস্থা করা হয়। প্রথমে তারা লোহিত সাগরের শুরাইবা বন্দরের দিকে অগ্রসর হন। সৌভাগ্যক্রমে সেখানে দুইটা বাণিজ্যিক নৌকা পাওয়া গিয়েছিল। সেই নৌকায় আরোহণ করে তারা নিরাপদে হাবশায় গমণ করেন। তারা চলে যাওয়ার পর কুরাইশরা তাদের যাওয়ার খবর পায়। তারা খবর পাওয়ার পরই সমুদ্র উপকুল পর্যন্ত ছুটে যায়। কিন্ত সাহাবায়ে কেরামরা আগেই চলে গিয়েছিলেন। এ কারণে তারা ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসে। ওদিকে মুসলমানরা হাবশায় পৌছে স্বস্তির নিঃশাষ ফেলেন।
সেই বছরই রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হারেম শরীফে গমণ করেন। সেখানে নেতৃস্থানীয় কুরাইশরা সমবেত হয়েছিল। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আকস্মিকভাবে উপস্থিত হয়ে সুরা “নাযম” তেলওয়াত শুরু করেন। একত্রে এত্ত পৌত্তলিক এর আগে কোরআন শুনেনি। কেননা তাদের সিদ্ধান্ত ছিল এরকম যে, কখনো কোরআন শুনা যাবে না, কোরআনের ভাষায়, কাফেররা বলে তোমরা এই কোরআন শ্রবণ করোনা, এবং তা যখন তেলওয়াত করা হয়, তখন শোরগোল করো যাতে তোমরা জয়ী হতে পারো।
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হঠাৎ করে মধুর স্বরে কোরআন তেলওয়াত শুরু করলে পৌত্তলিকরা মোহিত হয়ে পরে। তারা কোরআনের লালিত্যে ভাষার মাধুর্য্যে ছিলো মুগ্ধ ও বিমোহিত। কারো মনে সে সময় অন্য কোন চিন্তাই আসেনি, সবাই এমন অভিভুত হয়ে পরেছিলো। সুরার শেষ দিকের এই আয়াত তিনি তেলওয়াত করলেন “আল্লাহর জন্য সেজদা করো এবং তাঁর এবদাত করো। এই আয়াত পাঠ করার পরই রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেজদায় চলে গেলেন। সাথে সাথে পৌত্তলিকরাও সেজদায় করলো। সত্যের প্রভাব এবং মাধুর্য অমুসলিমদের অহংকার চুর্ণ করে দিয়েছিলো, তারা কেউই নিজেদের মধ্যে ছিলোনা এ কারণে নিজেদের অজ্ঞাতেই সেজদায় নত হয়েছিলো।
সম্বিত ফিরে পেয়ে তারা অবাক হয়ে গেল। যে দ্বীনকে নিশ্চিহ্ণ করতে তারা সর্বোতভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলো, সেই কাজেই তাদের নিয়োজিত হতে দেখে সেখানে অনুপস্থিত পৌত্তলিকরা তাদেরকে তিরস্কার করল। তরিস্কারর কবল থেকে রক্ষা পেতে তারা তখন বললো মোহাম্মদ (সাঃ) তাদের মুর্তির কথা সম্মানের সাথে উল্লেখ করেছেন। নিজেদেরকে নির্দোষ প্রমাণ করতে তারা বললো , মোহাম্মদ (সা) বলেছেনঃ ওরা সব উচ্চমার্গের দেবী এবং তাদের শাফায়াতের আশা করা যেতে পারে।
অথচ এটা ছিল সুস্পষ্ট মিথ্যা কথা। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে সেজদা করে তারা যে ভুল করেছিলো, তার একটা যুক্তিসঙ্গত ওযর পেশ করতে এ গল্প তৈরী করেছিলো। বলা বাহুল্য, যারা রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সব সময় মিথ্যাবাদী বলে রটনা করে তাঁর বিরুদ্ধে নিন্দা কুৎসা রটায় তারা আত্মরক্ষার জন্য এ ধরনের বানোয়াট কথার আশ্রয় নিবে এতে অবাক হওয়ার কিছুই নেই।
কুরাইশদের সেজদা করার খবর হাবশায় হিজরতকারী মুসলমানরাও পেয়েছিলো। কিন্তু তারা ভুল খবর পেয়েছিলো। তারা শুনেছেন যে, কুরাইশ নেতারা মুসলমান হয়ে গেছেন। এ খবর পাওয়ার পর শাওয়াল মাসে তারা মক্কায় ফিরে আসার জন্য হাবশা ত্যাগ করেন। মক্কা থেকে একদিনের দূরত্বে থাকার সময় তারা প্রকৃত খবর পেলেন। এরপর কেউ কেউ হাবশায় ফিরে গেলেন, আবার কেউ কেউ চুপিসারে অথবা কুরাইশদের কোন লোকের আশ্রিত হিসেবে মক্কায় প্রবেশ করেন।