০২. আরব জাতিসমূহ

ঐতিহাসিকরা আরব জাতিসমূহকে তিন ভাগে করেছেন।
এক. আরব বারেবা
আরব বারেবা বলতে আরবের সেইসব প্রাচীন গ্রোত্র এবং সম্প্রদায়ের কথা বোঝানো হয়েছে যারা সম্পূর্ন বিলীন হয়ে গেছে। এসব গ্রোত্র ও সম্প্রদায় সম্পর্কে প্রয়োজনীয় বিস্তারিত তথ্য এখন আর জানা যায় না। যেমন- আদ,সামুদ,তাছাম,জাদিছ আমালেকা প্রভূতি জাতি।
দুই. আরব আবেরা
এ দ্বারা যেসব গ্রোত্রের কথা বোঝানো হয়েছে, যারা ছিলো ইয়ারুব ইবনে ইয়াশজুব ইবনে কাহতানের বংশধর। এদেরকে কাহতানি আরবও বলা হয়।
তিন. আরব মোস্তাবিরা
এরা সেসব গ্রোত্র, যারা হযরত ইসমাঈল (আ)-এর বংশধর। এদেরকে আদনানী আরবও বলা হয়।
আরবে আরেবা অর্থাৎ কাহতানি আরবদের প্রকৃত বাসস্থান ছিলো ইয়েমেনে। এখানেই এদের পরিবার ও গ্রোত্রের বিভিন্ন শাখা প্রসার লাভ করে। এদের মধ্যে দু’টি গ্রোত্র বিশেষ খ্যাতি লাভ করে।
যথাঃ
(ক) হেমইয়ারঃ এদের বিখ্যাত শাখার নাম হচ্ছে যাইদুল যমহুর কোযাআহ এবং যাকাসেক।
(খ) কাহতানঃ এদের বিখ্যাত শাখার নাম হচ্ছে হামদান,আনমার,তাঈ,মাযহিজ,কেন্দাহ,লাখুম,জুযাম আযদ,আওস,খাজরাযএবং জাফনার বংশধর। নিজস্ব এলাকা ছেড়ে এরা সিরিয়ার আশে পাশে বাদশাহী কায়েম করেছিলো। পরে এরা গাসসান নামে পরিচিত লাভ করে। সাধারন কাহতানি গ্রোত্রসমূহ পরবর্তীকালে ইয়েমেন ছেড়ে দেয় এবং আরব উপদ্বীপের বিভিন্ন এলাকায় বসতি স্থাপন করে। এরা সেই সময় দেশ ত্যাগ করেছিলো, যখন রোমকরা মিসর ও সিরিয়া অধিকার করার পর ইয়েমেনবাসীদের জলজপথের বাণিজ্যও নিজেদের অধিকার এনেছিলো। এর ফলে কাহতানিদের বাণিজ্যক সুযোগ-সুবিধা সম্পূর্ন বিনিষ্ট হয়ে গেয়েছিলো।
এমন হতে পারে,কাহতানি এর হেমইয়ারি গোত্রসমূহের মধ্যে বিবাদ-বিসম্বাদ দেখা দেখায় কাহতানিরা দেশত্যাগে বাধ্য হয়েছিলো। এরূপ মনে করার এটাই কারণ যে, কাহতানি গোত্রসমূহ দেশত্যাগ করেছিলোম, কিন্তু হিমইয়ারী গ্রোত্রসমূহ তাদের জায়গা অটল ছিল। যেসব কাহতানি গ্রোত্র দেশ ত্যাগ করেছিলো, তাদের চারভাগে করা যায়। যথা-
(এক) আযাদঃ এরা তাদের সর্দার এমরান ইবনে আমর মুযাইকিয়ার পরামর্শে দেশ ত্যাগ করে। প্রথমে এরা ইয়েমেনে এক জায়গা থেকে অন্যত্র স্থানান্তরিত হয় এবং অবস্থা সম্পর্কে খোঁজ খবর নেয়ার জন্যে বিভিন্ন দল পাঠাতে থাকে। এরপর উত্তর দিকে অগ্রসর হয়ে বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্নভাবে বসতি স্থাপন করে। এদের বিস্তারিত বিবরন নিম্নরূপ :
ছা’লাবা ইবনে আমর : এই ব্যক্তি প্রথমে হেজায অভিমুখে রওয়ানা হয়ে ছা’লাবা এবং জিকার এর মাঝখানে অবস্থান গ্রহন করেন। তার সন্তানতা বড় হলে এবং খান্দান শক্তিশালী হলে তখন মদীনা অভিমুখে রওয়ানা হন এবং মদীনাতেই বসবাস করেন। এই ছা’লাবার বংশ থেকেই আওস এবং খাযরাজের জম্ম। আওস এবং খায়রাজ ছিলো ছা’লাবার পুত্র হারেজার সন্তান।
হারেজ ইবনে আমারঃ তিনি ছিলেন খোজাআর সন্তান। এই বংশধারার লোকেরা হেজায ভূমির বিভিন্ন জায়গায় ঘোরাফেরার পর মাররায যাহরানে অবস্থান নিয়ে পরে মদীনায় হামলা করে। মক্কা থেকে বনি জুরহুম গ্রোত্রের লোকদের বের করে দিয়ে নিজেরা মক্কায় বসতি গড়ে।
এমরান ইবনে আমরঃ এই ব্যক্তি এবং তার সন্তানরা আম্মানে বসবাস করতে থাকেন। এ কারনে এদেরকে আযদে আম্মান বলা হয়ে থাকে।
নাসর ইবনে আযাদঃ এই ব্যক্তির সাথে সম্পৃক্ত গ্রোত্রসমূহ তোরামায় অবস্থান করে। এদের আযদে শানুয়াত বলে থাকে।
জাফনা ইবনে আমরঃ এই ব্যক্তি সিরিয়ায় চলে যান এবং সেখানে সপরিবারে বসবাস করেন। তিনি ছিলেন গাসসানী বাদশাহদের প্রপিতামহ। সিরিয়ায় যাওয়ার আগে এরা হেজাযে গাসসান নামক একটি জলাশয়ের কাছে কিছুদিন অবস্থান করেন।
(দুই) লাখম জুযাম গোত্র, লখমের বংশধরদের মধ্যে নসর ইবনে রবিয়া ছিলেন অন্যতম। তিনি হীরার শাসনকর্তাদের
(যাদের বলা হতো আলে মোনযে) পূর্বপুরুষ ছিলেন।
(তিন) বনু তাঈ গোত্র, এই গোত্র বনু আযাদের দেশত্যাগের পর উত্তর দিকে রওয়ানা হয় এবং আজা ও সালমা নামে দু’টি পাহাড়ের মাঝখানে বসবাস করতে শুরু করে। তাঈ গ্রোত্রের কারণে এই দু’টি পাহাড় বিখ্যাত হয়ে ওঠে।
(চার) কিন্দা গোত্র, এ গোত্রের লোকেরা প্রথমে বাহরাইনের বর্তমান আল আহতমা নামক স্থানে বসতি স্থাপন করে। কিছুকাল পর তারা হাতরামাউতে যায়। কিন্তু সেখানেও তারা টিকতে পারেনি। অবশেষে নাজদে গিয়ে বসতি স্থাপন করে এবং এবং সরকার প্রতিষ্ঠা করে, কিন্তু সে সরকারও স্থায়ী হয়নি। কিছুকালের মধ্যেই তাদের নাম নিশানাও মুছে যায়।
কাহতান ছাড়া হেমইয়ারের আর একটি গোত্র ছিল, তার নাম ছিল কাজাআ। এ গ্রোত্রের নাম হেমিরি হওয়র ব্যাপারে মতভেদ রয়েছে। এরা ইয়েমেন থেকে চলে গিয়ে ইরাকের বাদিয়াতুস সামাওয়াতের বসবাস করতে থাকে।
আরবের মোস্তাবেরা এদের পূর্ব পুরিষ ছিলেন সাইয়েদানা হযরত ইবরাহীম (আ)। তিনি ছিলেন প্রকৃতপক্ষে ইরাকের উয শহরের অধিবাসী। এ শহর ফোরাত নদীর পশ্চিম উপকুল কুফার কাছে অবস্থিত ছিলো। ফোরাত নদী খননের সময়ে পাওয়া নিদর্শনসমূহ থেকে এ শহর সম্পর্কে অনেক তথ্য জানা গেছে। হযরত ইবরাহীম (আ) এর পরিবার এবং উয শহরের অধিবাসী ও তাদের ধর্মবিশ্বাস সম্পর্কেও অনেক তথ্য এতে উদঘাটিত হয়েছে।
হযরত ইবরাহীম (আ) দ্বীনের তাবলীগের জন্যে দেশের ভেতর ও বাইরে ছুটোছুটি করেন। একবার তিনি মিসরে যান। হযরত ইবরাহীম (আ)-এর স্ত্রী সারার কথা শোনার পর ফেরাউনের মনে মন্দ ইচ্ছা জাগে। অসৎ উদ্দেশ্যেসে হযরত সারাকে নিজের দরবার ডেকে নেয়। তারপর তা চরিতার্থ করতে চায়। হযরত সারা আল্লাহর দরবারে দোয়া করেন। তার দোয়ার বরকতে আল্লাহ তায়ালা ফেরাউনকে এমনভাবে পাকড়াও করেন, অসহ্য যন্ত্রণায় ছটফট করতে শুরু করে। এতে সে বুঝতে পারে যে, হযরত সারা আল্লাহর খুবই প্রিয়প্রাত্রী এবং পূণ্যশীলা রমনী। হযরত সারার এ বৈশিষ্ট্যে মুগ্ধ হয়ে ফেরাউন তার কন্যা হাজেরাকে হযরত সারার হাতে তুলে দেন। হযরত সারা হযরত হাজেরাকে তাঁর স্বামী হযরত ইবরাহীম (আ.) এর সাথে বিবাহ দেন।
হযরত ইবরাহীম (আ) হযরত সারা ও হযরত হাজেরাকে সঙ্গে নিয়ে ফিলিস্তিন ফিরে যান। এরপর আল্লাহ রাব্বুল আলামীন হযরত ইবরাহীম (আ) কে হযরত হাজেরা গর্ভ থেকে একটি সন্তান দান করেন। উল্লেখ্য, হযরত সারা ছিলেন নিঃসন্তান। ভূমিষ্ট সন্তানের নাম রাখা হয় ইসমাইল। আস্তে আস্তে হযরত সারা হযরত হাজেরার প্রতি ঈর্ষান্বিত হয়ে ওঠেন এবং নবজাত শিশুসহ হযরত হাজেরাকে নির্বাসনে দিতে হযরত ইবরাহীম (আ)কে বাধ্য করেন। পরিস্থিতি এমন হয়েছিলো যে, হযরত ইবরাহীম (আ) কে একথা মানতে হয় এবং তিনি হযরত হাজেরা এবং হযরত ইসমাইলকে সঙ্গে নিয়ে মক্কায় গমন করেন। বর্তমানে যেখানে কাবাঘর রয়েছে, সেই ঘরের কাছে হযরত ইবরাহীম (আ) স্ত্রী পুত্রকে রেখে যান। সে সময় কাবাঘর ছিলো না। একটি টিলার মতো কাবা ঘরের স্থানটি উঁচু ছিলো। প্লাবন এলে সেই টিলার দু’পাশে দিয়ে পানি চলে যেতো। সেখানে মুসজিদুল হারামে উপরিভাগে-পাশেই যমযমের কাছে একটি বড় বৃক্ষ ছিলো। হযরত ইবরাহীম (আ) সেই গাছের পাশে স্ত্রী হাজেরা এবং পুত্র ইসমাইলকে রেখে আসেন। সে সময় মক্কায় পানি এবং মানব বসতি কিছুই ছিলো না। একারণে হযরত ইবরাহীম (আ) একটি পাত্রে কিছু খেজুর এবং একটি মশকে কিছু পানি রেখে আসেন। এরপত তিনি ফিলিস্তিন চলে যান। কিন্তু কয়েকদিনর মধ্যেই সে খেজুর এবং পানি শেষ হয়ে যায়। কঠিন দুঃসময় দেখা দেয়। সেই করুণ দুঃসময়ে আল্লাহর রহমতের ঝর্ণাধারা যমযমরূপে প্রকাশ লাভ করে এবং দীর্ঘদিন যাবত বহু মানুষের জীবন ধরণের উপকরনরূপে ব্যবহৃত হয়। এর বিস্তারিত বিবরণ সবার মোটামুটি জানা। কিছুকাল পরে ইয়েমেন থেকে একটি গ্রোত্র মক্কায় আসে। ইতিহাসে এ গ্রোত্র জুরহুমে সানি বা দ্বিতীয় জুরহুম নামে পরিচিত। এ গোত্র ইসমাইল (আ)-এর মায়ের অনুমতি নিয়ে মক্কায় বসবাস শুরু করে। বলা হয়ে থাকে যে, এ গ্রোত্র আগে মক্কার আশেপাশের এলাকায় বসতি স্থাপন করেছিলো। উল্লেখ্য রয়েছে যে, এই গ্রোত্রের লোকেরা হযরত ইসমাইল (আ) এর আগমনের পরে এবং তাঁর যুবক হওয়ার আগে যমযমের জন্যে মক্কায় আসে। এ পথে তারা আগেও যাতায়াত করেছিলো।
হযরত ইবরাহীম (আ) স্ত্রী-পুত্রের দেখাশোনার জন্যে মাঝে মাঝে মক্কায় যেতেন। এভাবে কতোবার যাতায়াত করেছিলেন, সেটা জানা যায়নি। তবে ঐতিহাসিক তথ্য থেকে কমপক্ষে চারবার যাওয়া আসার প্রমাণ পাওয়া যায়।
(এক) পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, হযরত ইবরাহীম (আ) কে আল্লাহ তায়ালা এ মর্মে স্বপ্ন দেখান যে, তিনি তাঁর পুত্র হযরত ইসমাইলকে যবাই করেছেন। এ স্বপ্ন ছিলো আল্লাহর এক ধরণের নির্দেশ। পিতা পুত্র উভয়েই এ নির্দেশ পালনে প্রস্তুত হন। উভয়ে আল্লাহর ইচ্ছার কাছে আত্নসমর্পণ করার পর পিতা তার পুত্রকে মাটিতে শুইয়ে দিয়ে যবাই করতে উদ্যত হলেন। এ সময় আল্লাহ তায়ালা বললেন, হে ইবরাহীম, তুমি স্বপ্ন সত্য করে দেখেয়েছো। আমি পুণ্যশীলদেরকে এভাবে বিনিময় দিয়ে থাকি । নিশ্চতই এটা ছিলো একটা সুস্পষ্ট পরীক্ষা। আল্লাহ তায়ালা এই পরীক্ষাই উত্তীর্ণ হওয়ার পুরস্কারস্বরূপ হযরত ইবরাহীম (আ) কে কোরবানীর মহান গৌরব দান করেন।
বাইবেলে উল্লেখ্য রেয়েছে যে, হযরত ইসমাইল (আ) হযরত ইসহাক (আ) এর চেয়ে তেরো বছরের বড় ছিলেন। কোরআনের বর্ণনা রীতি থেকে বোঝা যায় যে, এ ঘটনা ঘটেছিলো হযরত ইসহাক (আ) এর জন্মের আগে। কেননা সমগ্র ঘটনা বর্ণনা করার পর এখানে হযরত ইসহাকের জন্মের সুসংবাদে উল্লেখ্য করা হয়েছে।
এ ঘটনা থেকে প্রমাণিত হয় যে, হযরত ইসমাইল (আ) এর যুবক হওয়ার আগে হযরত ইবারাহীম (আ) কমপক্ষে একবার মক্কায় সফর করেছিলেন। বাকি তিন বারের সফরের বিবরণ বোখারী শরীফের দীর্ঘ বর্ণনায় উল্লেখ্য রয়েছে।
(দুই) হযরত ইসমাইল (আ) যুবক হলেন। জুরহাম গোত্রের লোকদের কাছে আরবী ভাষা শিক্ষা করেন। গোত্রের লোকেরা হযরত ইসমাইলের সাথে তাদের এক কন্যাকে বিবাহ দেন। এ সময়ে হযরত হাজেরা ইন্তিকাল করেন। এদিকে হযরত ইবরাহীম (আ) তাঁর স্ত্রী পুত্রকে দেখতে মক্কায় আসেন। কিন্ত হযরত ইসমাইলের সাথে দেখা হয়নি। পুত্রবধু সাথে দেখা হলে তিনি অভাব অনটনের কথা ব্যক্ত করেন। হযরত ইবরাহীম (আ) পুত্রবধূকে বলে এলেন যে, ইসমাইল এলে তাকে বলবে, সে যেন ঘরের চৌকাঠ পাল্টে ফেলে। পিতার এ উপদেশের তাৎপর্য হযরত ইসমাইল বুঝে ফেললেন। তিনি স্ত্রীকে তালাক দেন এবং অন্য একজন মহিলার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী ছিলেন জুরহাম গ্রোত্রের সরদার মাজায ইবনে আমরের কন্যা।
(তিন) হযরত ইসমাইল (আ) এর দ্বিতীয় বিয়ের পর হযরত ইবরাহীম (আ) পুনরায় মক্কায় আগমন করেন। কিন্তু এবারও পুত্রের সাথে দেখা হয়নি। পুত্রবধূর কাছে ঘর সংসারের অবস্থা জিজ্ঞার করার পর তিনি আল্লাহ প্রশংসা করেন। পুত্রবধূর মখে আল্লাহর প্রশংসা শোনার পর হযরত ইসমাইল (আ) এবারে পুত্রবধূকে বলেন যে, ইসমাইল এলে তাকে বলবে সে যেন তার ঘরের চৌকাঠ ঠিক রাখে। এরপর হযরত ইসমাইল (আ) ফিলিস্তিন ফিরে যান।
(চার) চতুর্থবার হযরত ইসমাইল (আ) মক্কায় এসে দেখতে পান, তাঁর পুত্র ইসমাইল (আ) যমযমের কাছে বসে তীর তৈরী করছেন। পরস্পরকে দেখা মাত্র উভয়ে আবেগে একে অন্যকে জুড়িয়ে ধরলেন। দীর্ঘকাল পর কোমল হৃদয় পিতা এবং অনুগত পুত্রের সাক্ষাৎ হয়েছিলো। এই সময়েই পিতাপুত্র মিলিতভাবে কাবাঘর নির্মাণ করেন। মাটি খুঁড়ে দেয়াল তোলেন এবং হযরত ইসমাইল (আ) সমগ্র বিশ্বের মানুষকে হজ্ব পালনের আহবান জানান।
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মাজায ইবনে আমরের কন্যার গর্ভে হযরত ইসমাইল (আ) কে বারোটি পুত্র সন্তান দান করেন। তাঁদের নাম ছিলো (১) নাবেত বা নিয়াবুত (২) কায়দার (৩) আদবাইল (৪) মোবশাব (৫) মেশমা (৬) দুউমা (৭) মাইশা (৮) হাদদ
(৯) তাইমা (১০) ইয়াতুর (১১) নাফিস ও(১২) কাইদমান।
এই বারোজন পুত্রের মাধ্যমে বারোটি গোত্র তৈরি হয়। এরা সবাই মক্কাতেই বসাবাস করেন। ইয়মেন, মিসর এবং সিরিয়ায় ব্যবসা করে তারা জীবিকা নির্বাহ করতো। পরবর্তীকালে এসব গ্রোত্র জাযিরাতুল আরবের বিভিন্ন এলাকা এবং আরবের বাহিরে ছড়িয়ে পড়ে। এদের অবস্থা সম্পর্কিত বিবরণ মহাকালের গভীর অন্ধকারে হারিয়ে গেছে। শুধু নাবেত এবং কাইদার বংশধরদের সম্পর্কে কিছু তথ্য জানা যায়।
নাবেতিদের সংস্কতি হেজাযের উত্তরাংশে বিকাশ লাভ করে। তারা একটি শক্তিশালী সরদার প্রতিষ্ঠা করে আশেপাশের লোকদের ওপর আধিপত্য বিস্তার করে। বাতরা ছিলো তাদের রাজধানী। তাদের মোকাবেলা করার মতো শক্তি কারো ছিলো না। এরপর আসে রোমকদের যোগ। রোমকরা নাবেতিদের পরাজিত করে। মাওলানা সাইয়েদ সোলায়মান নদভী (র) দীর্ঘ গবেষণা ও আলোচনার পর প্রমাণ করেছেন যে, গাসসান বংশের লোকেরা এবং আনযারনি অর্থাৎ আওস ও খাযরাজ কাহতানিরা আরব ছিলো না। বরং এ এলাকাই ইসমাইলের পুত্র নাবেতের অবশিষ্ট বংশধর বসবাস করতো।
হযরত ইসমাইলের পুত্র কাইদারের বংশের লোকেরা মক্কায় বসতি স্থাপন করতে থাকে এবং কালক্রমে এদের বংশবৃদ্ধি ঘটে। পরবর্তীকালে আদনান এবং তৎপুত্র মায়া’দ এর যমানা আসে। আদননী আরবদের বংশধারা সঠিকভাবে এ পর্যন্তই সংরক্ষিত আছে।
আদনান ছিলেন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উনিশতম পূর্ব পুরুষ। কোন কোন বর্ণনায় রয়েছে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর বংশধারা বর্ণনা করার সময় আদনান পর্যন্ত পৌঁছে থেমে যেতেন। তিনি বললেন বংশধারা বিশেষজ্ঞরা ভুল তথ্য পরিবেশন করে থাকে। তবে এসব পূর্ব-পুরুষদের সব বংশধারাও বর্ণনা করা সম্ভব। অনেকে উপরোক্ত বর্ণনাকে যঈফ বলে আখ্যায়িত করেছেন। মতে আদনান এবং হযরত ইবরাহীম (আ) এর মধ্যে চল্লিশ পুরুষের ব্যবধান রয়েছ।
মোটকথা মায়া’দ এর পুত্র নাযার থেকে কয়েকটি পরিবার জন্ম নেয়। এদের সম্পর্কে বলা হয় যে, উল্লিখিত মায়া’দ এর পুত্র ছিলো মাত্র একজন, তাদের আম নাযার। নাযার এর পুত্র সংখ্যা ছিলো চার এবং প্রত্যেক পুত্রের বংশধর থেকে একটি করে গ্রোত্র গড়ে ওঠে। সেই চার পুত্রের নাম ছিলো ইয়াদ, আনমার, রবিয়া এবং মোদার। শেষোক্ত দুটি অর্থ্যাৎ রবিয়া ও মোদার গোত্রের বহু শাখা প্রশাখা বিস্তার লাভ করেছে। রবিয়া আসাদ ইবনে রবিয়া,আনযাহ, আব্দুল কায়স ওয়ায়েল, বকর, তাগলা এবং বনু হানিফাসহ বহু গোত্র বিস্তার লাভ করে।
মোদার এবং বংশধররা দু’টি বড় গোত্রে বিভক্ত হয়েছিলো। (এক) কায়স আইনাম ইবনে মোদার এবং (২) ইলিয়াস ইবনে মোদার।
কায়স আইলাম থেকে বনু সুলাইম বনু হাওয়াজেন, বনু গাতফান, গাতফান থেকে আরাস, জরিয়াস, আশজা এবং পানি বিন আস্থুর ওর গোত্রসমহূ বিস্তার লাভ করে।
ইলিয়াস ইবনে মোদার থেকে তামিম ইবনে মাররা,বুদাইন ইবনে মাদরেকা, বনু আসাদ ইবনে খোয়ায়মা এবং কেনানা ইবনে খোযায়মার গোত্রসমহূ বিস্তার লাভ করে। কেননা থেকে কোরায়শ গোত্র অস্তিত্ব লাভ করে। এ গোত্রের লোকরা ছিলো দেহের ইবনে মালেক, ইবনে নযর এ ও ইবনে কেনানার বংশধর।
পরবর্তী সময়ে কুরায়শরাও বিভিন্ন শাখায় বিভক্ত হয়ে পড়েছিলো। কোরায়শ বংশের বিখ্যাত শাখাগুলো হলো: জমেহ, ছাহমা, আদী, মাখজুম, তাইম, কোহরা। কুসাই ইবনে কেলাবের পরিবার অর্থ্যাৎ আবদুদ দার, আসাদ ইবনে আব্দুল ওযযা ইবনে মান্নাফ। এ তিনজন ছিলেন কুসাইয়ের পুত্র। এদের মধ্যে আবদে মান্নাফের পুত্র ছিলো চারজন। সেই চার পুত্র থেকে নিম্নোক্ত চারটি গোত্রের উৎপত্তি হয়। আবদে শামস,নওফেল, মোত্তালেব এবং হাশেম। হাশেমের বংশধর থেকে আল্লাহ তায়ালা আখেরী নবী হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে মনোনিত করেন।
রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, আল্লাহ তায়ালা ইবরাহীম (আ) এর বংশধরদের মধ্য থেকে ইসমাইল (আ) কে মনোনীত করেন। এরপর ইসমাইল (আ) এর বংশধরদের মধ্য থেকে কেনানাকে মনোনীত করেন। কেনানার বংশধরদের থেকে কোরায়শকে মনোনীত করেন।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) বর্ণনা করেছেন রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, আল্লাহ তায়ালা মাখলুক সৃষ্টি করার পর আমাকে সবোর্ত্তম দলের মধ্যে সৃষ্টি করেন। এরপর সেই দলকে দুই ভাগে বিভক্ত করেন এবং আমাকে দুই দলের মধ্যে উৎকৃষ্ট দলের মধ্যে রাখেন। এরপর গোত্রসমহূ বাছাই করেন এবং আমাকে সবচেয়ে ভালো গোত্রের মধ্যে সৃষ্টি করেন। সবশেষে পরিবার বাছাই করেন এবং আমাকে সবচেয়ে ভালো পরিবারে সৃষ্টি করেন। কাজেই আমি গোত্রের দিক থেকে উৎকৃষ্ট গোত্রজাত এবং পরিবার বা খান্দানের দিক থেকেও সর্বোত্তম।
মোটকথা, আদনানের বংশ যখন বিস্তার লাভ করে, তখন তারা খাদ্য পানীয়ের সন্ধানে আরবের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। আবদে কায়স গোত্র, বকর ইবনে ওয়ায়েলের কয়েকটি শাখা এবং বনু তামিমের পরিবারসমহূ বাহরাইন অভিমুখে রওয়ানা হয় এবং সেই এলাকায় গিয়ে বসাবাস শুরু করে। বনু হানিফা ইবনে স’ব ইবনে আলী ইবনে বকর ইয়ামামা গমন করে এবং ইয়ামামার কেন্দ্রস্থল হেজর নামক জায়গায় বসাবাস শুরু করে।
বকর ইবনে ওয়ায়েলের অবশিষ্ট শাখাসমহূ ইয়ামামা থেকে বাহরাইন, কাজেমার উপকূল ইরাকত উপদ্বীপের আশেপাশে, ইবলা এবং হিয়াত পর্যন্ত এলাকায় বসতি স্থাপন করে।
বনু তাগলাব ফোরাত উপদ্বীপ অঞ্চলে ব্সতি স্থাপন করে। তবে তাদের কয়েকটি শাখা বনু বকরের সাথে বসবাস করতে থাকে।
বনু সালিম মদীনার কাছে বসতি গড়ে তোলে। ওয়াদিউল কোরা থেকে শুরু করে তারা খয়বর মদীনার পূর্বাঞ্চল হয়ে হাররায়ে বনু সোলাইমের সাথে সংশ্লিষ্ট দুটি পাহাড় পর্যন্ত ছিলো তাদের বসিত এলাকা।
বনু ছাকিফ গোত্র তায়েফে বসতি স্থাপন করে। বনু হাওয়াজেন মক্কার পূর্বদিকে আওতাস প্রান্তরের আশেপাশে বসতি গড়ে। তাদের বাসস্থান ছিলো মক্কা-বসরা রাজপথের দুই পাশে।
বনু আসাদ তাইমার পূর্বে এবং কুফার পশ্চিমে বসবাস করতে থাকে। এদের এবং তাইমার মধ্যে বনু তাঈ গোত্রের একটি পরিবার বসবাস করতো। এ পরিবারের লোকদের বলা হতো বোহতার। বনু আসাদের বাসস্থান এবং কুফার মধ্যেকার দূরত্ব ছিলো পাঁচ দিনের পথ।
বনু জুবিয়ান তাইমার কাছে হাওয়ান এলাকার আশেপাশে বসবাস করতো।
বনু কেনানা পরিবার তোহামায় বসবাস করতে থাকে। এদের মধ্যে কোরায়শী পরিবারসমহূ মক্কা এ তার আশেপাশে বসবাস করতো। এরা বিচ্ছিন্নভাবে জীবন যাপন করতো। পরবর্তীকালে কুসাই ইবনে কেলাব আবির্ভূত হন এবং তিনি কোরায়শদের ঐক্যবৃদ্ধ করে মর্যাদা, গৌরব এবং শ্রেষ্ঠত্বের আসনে সমাসীন করেন।