০১. সামবেদীয় গর্ভধারন

সামবেদীয় গর্ভধারন (১)

ঋতুস্নানাতে নিষেকদিনে সায়ংসন্ধ্যা সমতীত হইলে শুভ লগ্নে পতি পবিত্র হইয়া (আচমন এবং) স্বস্তিবাচন পূর্ব্বক মূলের লিখিত “আদ্যেত্যাদি অমুকরাশিস্থে” ইত্যাদি বাক্য সঙ্কল্প করিবে। তৎপরে পতি সুগন্ধলিপ্ত ও সুবেশ হইয়া সূর্যদেবতাকে নবসংখ্য অর্ঘ্য প্রদান করিবে। “ওঁ বিশ্বপ্সা বিশ্বতঃ কর্ত্তা” ইত্যাদি যে নয়টি মন্ত্র লিখিত আছে, সেই নয়টি মন্ত্র পাঠ পূর্ব্বক যথাক্রমে নয়টি অর্ঘ্য প্রদান করিতে হয়। তদনস্তর পূর্ব্বাভিমুখে উপবিষ্টা বধুর পশ্চাদ্ভাগে থাকিয়ে তদীয় স্কন্ধোপরিদেশ হইতে দক্ষিণ হস্ত অবতরণ করত শিশ্ন স্পর্শ পূর্ব্বক ‘প্রজাপতির্‌ঋষিরনুষ্টুপ্‌ ছন্দো বিষ্ণু ত্বষ্টৃ-প্রজাপতিধাতরো দেবতা গর্ভাধানে বিনিয়োগঃ। ওঁ বিষ্ণুর্যোনিং কল্পয়তু ত্বষ্টা রূপাণি পিংষতু। আসিঞ্চতু প্রজাপতির্ধাতা গর্ভং দধাতু তে।” এই মন্ত্র পাঠ কইবে।১।

পরে পুনরায় উপস্থ স্পর্শ পূর্ব্বক মূলের লিখিত “প্রজাপতির্‌ঋষি” ইত্যাদি দ্বিতীয় মন্ত্র পাঠ করিতে হয়।২।।

তৎপরে বধুর নাভিদেশে সুবর্ণ স্পর্শ করাইয়া “ওঁ জীববৎসা ভব ত্বং সুপোত্রোৎপত্তিহেতবে। তস্মাত্ত্বং সর্ব্বকল্যাণি অবিঘ্নগর্ভধারিণী।” এই মন্ত্র পাঠ করিবে। পরে পতি বধুর নাভিপদ্ম স্পর্শ পূর্ব্বক “ওঁ দীর্ঘায়ুষং বংশধরং পুত্রং জনয় সুব্রতে” অর্থাৎ হে সুব্রতে! তুমি দীর্ঘায়ু ও বংশধর পুত্র প্রসব কর, এই মন্ত্র পাঠ করিতে হয়। তদনন্তর যথাযথ মন্ত্র দ্বারা পঞ্চগব্য সংশোধিত করিয়া (২) পতিপুত্রবতী নারী দ্বারা বা বিপ্রাবলক দ্বারা বধূকে তাহা পান করাইবে। যৎকালে উহা পান করিবে, তখন বধূ পূর্ব্বাভিমুখী হইয়া সেবন করিবে। তৎপরে পতি ভার্য্যাতে উপগত হইবে।

ইতি সামবেদীয় গর্ভাধান।

———————–
টীকা–ওঁ বিষ্ণুর্যোনিং কল্পয়তু ত্বষ্টা রূপাণি পিংষতু। আসিঞ্চতু প্রজাপতির্ধাতা গর্ভং দধাতু তে। অনুষ্টু বিয়ং গর্ভাধানে বিনিযুক্তা। বিশ্বাদয়ো দেবতাঃ তে ইতি প্রত্যেকমভিসম্বধ্যতে। বে বধু তে তব যোনিং গর্ভস্থানং বিষ্ণুর্বাসুদেবঃ কল্পয়তু প্রসবসমার্থ করোতু। ত্বষ্টা চ দেববিশেষঃ তে তব রূপাণি পিংষতু প্রকাশয়তু। পিষ সংচূর্ণনার্থোপ্যত্র প্রকাশনে বর্ত্ততে। কিঞ্চ প্রজাপতিস্তামেব যোনিং যাবন্মাত্রেণ বীজন গর্ভো ভবতি তাবন্মাত্রমেব যোনিং যাবন্মাত্রেণ বীজেন গর্ভো ভবতি তাবন্মাত্রমেব প্রক্ষেপয়ত্বিত্যররথঃ। কিঞ্চ ধাতা আদিত্যঃ তে তব গর্ভং পুত্রার্থং দধাতু ধারয়তু।।১।।
ওঁ গর্ভয় দেহি সিনীবালি গর্ভং ধেহি সরস্বতি। গর্ভয় তে অশ্বিনৌ দেবাবাধত্তাং পুষ্করস্রজৌ। সিনীবাল্যদয়ো দেবতাঃ পূর্ব্বোক্তা অত্র অমাবস্যা সিনীবালী সা প্রার্থতে। হে ভগবতি সিনীবালী অস্যাং বধ্বাং গর্ভং ধেহি ধারয়। বন্ধ্যতামপনয়। হে সরস্বতি গর্ভং ধেহি।

——————-
(১) আর্য্য-মনীষিগণ বিশেষরূপ পর্যালোচনা করিয়াই আমাদিগের দেশে গর্ভাধানাদি সংস্কারের বিধি প্রচলিত করিয়া গিয়াছেন। আধুনিক অনভিজ্ঞ মূর্খেরা স্বীয় অজ্ঞানতাবশতঃ তাহার প্রকৃত মর্ম্ম বুঝিতে না পারিয়া সেই সকল পরমহিতকর সংস্কারগুলির বিলোপ করিতে উদ্‌যোগী হইতেছে। মনে কর, যেমন চিত্রকর প্রথমতঃ স্থূলভাবে একটি ছবি অঙ্কন করিয়া পুনঃ পুনঃ তুলিকার চালনা করিলে সেই ছবি ক্রমে ক্রমে অঙ্গপ্রত্যঙ্গাদিসমম্বিত ও পরিষ্ফুট হয়, সেইরূপ বিধানে সংস্কারক্রিয়ার ভূয়ঃ প্রয়োগ হইলে মানবদেহে সত্ত্বগুণের পূর্ণ উন্মেষ হইয়া উঠে। এই জন্য শাস্ত্রেও কথিত আছে যে, জন্মনা জায়তে শূদ্রঃ সংস্কারাদ্দ্বিজ উচ্যতে অর্থাৎ জন্ম দ্বারা শূদ্র হয়, সংস্কারদ্বারাই দ্বিজ হইয়া থাকে। সুতরাং বিশেষ বিবেচনা করিয়া দেখিলে স্পষ্টই প্রতীতি হইবে যে, সংস্কার-কার্য্যগুলির লোপ হওয়া নিতান্ত অনুচিত। দেহে আর্য্যগুণের উন্মেষ করিতে দেওয়া সর্ব্বদাই বিধেয়। সংস্কারকার্য্য সাধারণতঃ দশবিধ; ১. গর্ভাধান, ২. পুংসবন, ৩. সীমন্তোন্নয়ন, ৪. জাতকর্ম্ম, ৫. নামকরণ, ৬. অন্নপ্রাশন, ৭. চূড়াকরণ, ৮. উপনয়ন, ৯. সমাবর্ত্তন, ১০. বিবাহ। এই সংস্কারদশটি চারি শ্রেণীতে বিভক্ত;– ১. গার্ভসংস্কার, ২. শৈশব সংস্কার, ৩. কৈশোর সংস্কার, ৪. যৌবন সংস্কার। প্রথম তিনটিকে গার্ভসংস্কার, দ্বিতীয় তিনটিকে শৈশব সংস্কার, তৃতীয় তিনটিকে কৈশোর সংস্কার এবং চতুর্থটিকে যৌবনসংস্কার কহে। গর্ভাধানাদি সংস্কারের উদ্দেশ্য সত্ত্বগুণের উৎকর্ষসাধন। সেই মহোচ্চ উদ্দেশ্যসাধনাভিপ্রায়েই আর্য্যশাস্ত্র বেদমূল হইতে স্থির করিলেন যে, জনক-জননী-দেহে যে সকল দোষ থাকে, তাহাই সন্তানে সংক্রমিত হয়। ইহা স্থির করিয়া গর্ভাধান, গর্ভগ্রহণযোগ্যতা ও তদুপযুক্ত সময় নিরূপণ করত সন্তানোৎপত্তিকালেও যাহাতে জনক-জননীর মন পশুভাবে ইন্দ্রিয়পরতন্ত্র না হইয়া বিশুদ্ধ সাত্ত্বিকভাবে প্রণোদিত হয়, সেই হেতুই আর্য্যশাস্ত্রে গর্ভাধানাদির ব্যবস্থা প্রদর্শিত হইয়াছে। বস্তুতঃ মূলের মধ্যে যে “ওঁ বিষ্ণুর্যোনিং কল্পয়তু” ইত্যাদি মন্ত্রদ্বয় লিখিত আছে, তাহার প্রকৃত মর্ম্ম হৃদয়ঙ্গম করিলেই গর্ভাধানসংস্কারের মহোচ্চ অভিপ্রায় ও পবিত্রভাব উপলব্দি হইবে। উহার ভাবার্থা এই যে, গর্ভাধানসময়ে পতি পত্নীকে বলিতেছেন,– “সর্ব্বব্যাপী বিষ্ণু তোমার গর্ভস্থানকে প্রসবসমর্থ করুন্‌; দেবশিল্পী ত্বষ্টা তোমার রূপ প্রকাশ করুন্‌, যাবন্মাত্র বীজে গর্ভ হয়, প্রজাপতি তোমার জননেন্দ্রিয়ে তাবন্মাত্র বীজ প্রক্ষেপ করুন্‌,; আদিত্যদেব পুত্রার্থ তোমার গর্ভরক্ষা করুন্‌। হে ভবগতি সিনীবালি! তুমি এই বধূতে গর্ভাধান কর; হে সরস্বতি! তুমি ইহাতে গর্ভাধান কর অর্থাৎ ইহার বন্ধ্যত্ব অপনোদন কর। যাঁহাদের অধিষ্ঠানে সমুৎপন্ন সন্তান সর্ব্বদা দেবগন দ্বারা অভ্যুদিত, স্বতঃ বিনয়নম্র, সত্ত্বগুণবান্‌, নারীবিভূষণস্বরূপ, সম্পদ্‌যুক্ত ও আত্মানন্দময় হয়, সেই গদ্মমালাধারী অশ্বিনীকুমারযুগল তোমার গর্ভাধান করুন্‌।” এই প্রকার আনন্দময় পবিত্র, উচ্চ, শুভলক্ষণোদ্দীপক ভাবসমূহ সহকারে সঞ্জাত সন্ততি যে দিব্যভাবযুক্ত ও সর্ব্বস্যলক্ষণে সুলক্ষিত হইয়া জন্মগ্রহণ করিবে, তাহাতে সন্দেহমাত্র নাই। যে সকল ব্যক্তি এই দুইটি মন্ত্রের মধ্যে বৈজ্ঞানিক তথ্যের, মহোচ্চ কবিত্বের, শাস্ত্রের নিগূঢ় তথ্য, সর্ব্বের সর্ব্বাত্মকতাপ্রতীতি এই সকলের সমবেত সমাবেশ দর্শনে বিস্মিত না হইবেন, তাঁহাদিগকে কিছু বলিতে চাহি না। তবে যে সকল ব্যক্তি মন্ত্রের প্রকৃত মর্ম্ম গ্রহণপূর্ব্বক ভক্তিপ্রণোদিত হইবে, তাঁহাদিগকে জানাই যে, তাঁহারা যেন কদাচ ভ্রমেও নিজ নিজ কূলে গর্ভাধানাদি সংস্কারের লোপ না করেন।

(২) পঞ্চগব্য–গোময়, গোমূত্র, ঘৃত, দধি, দুগ্ধ।