৯ম অধ্যায় – ব্যবহারিক-ধর্মপ্রকরণ

মনুসংহিতা
নবম অধ্যায়
ব্যবহারিক-ধর্মপ্রকরণ

‘অস্বতন্ত্রাঃ স্ত্রিয়ঃ কার্যাঃ পুরুষৈ স্বৈর্দিবানিশম্।
বিষয়েষু চ সজ্জন্তঃ সংস্থাপ্যা আত্মনো বশে।।’
স্ত্রীলোকদের আত্মীয় পুরুষগণের [অর্থাৎ পিতা, স্বামী, পুত্র প্রভৃতি যে সব পুরুষ স্ত্রীলোককে রাক্ষা করবার অধিকারী, তাদের] উচিত হবে না, দিন ও রাত্রির মধ্যে কোনও সময়ে স্ত্রীলোককে স্বাতন্ত্র্য অবলম্বন করতে দেওয়া [অর্থাৎ স্ত্রীলোকেরা যে নিজেদের ইচ্ছামতো ধর্ম, অর্থ ও কামে প্রবৃত্ত হবে তা হতে দেবে না]। স্ত্রীলোকেরা গান-বাজনা প্রভৃতি বিষয়ে আসক্ত হতে থাকলে তা থেকে তাদের নিবৃত্ত করে নিজের বশে রাখতে হবে। (৯/২)।

‘কালেহদাতা পিতা বাচ্যো বাচ্যশ্চানুপযন্ পতিঃ।
মৃতে ভর্তরি পুত্রস্তু বাচ্যো মাতুররক্ষিতা।।’
বিবাহ-যোগ্য সময়ে অর্থাৎ ঋতুদর্শনের আগে পিতা যদি কন্যাকে পাত্রস্থ না করেন, তাহলে তিনি লোকমধ্যে নিন্দনীয় হন; স্বামী যদি ঋতুকালে পত্নীর সাথে সঙ্গম না করেন, তবে তিনি লোকসমাজে নিন্দার ভাজন হন। এবং স্বামী মারা গেলে পুত্রেরা যদি তাদের মাতার রক্ষণাবেক্ষণ না করে, তাহলে তারাও অত্যন্ত নিন্দাভাজন হয়। (৯/৪)।

‘ইমং হি সর্ববর্ণানাং পশ্যন্তো ধর্মমুত্তমম্।
যতন্তে রক্ষিতুং ভার্যাং ভর্তারো দুর্বলা অপি।।’
স্ত্রীলোককে রক্ষণরূপ-ধর্ম সকল বর্ণের পক্ষে শ্রেষ্ঠ ধর্ম- অর্থাৎ শ্রেষ্ঠ কর্তব্য। এই ব্যাপার বুঝে অন্ধ, পঙ্গু প্রভৃতি দুর্বল স্বামীরাও নিজ নিজ স্ত্রীকে রক্ষা করবার জন্য যত্ন করবে। (৯/৬)।

‘স্বাং প্রসূতিং চরিত্রঞ্চ কুলমাত্মানমেব চ।
স্বঞ্চ ধর্মং প্রযত্নেন জায়াং রক্ষন্ হি রক্ষতি।।’
যে লোক যত্নের সাথে নিজের স্ত্রীকে রক্ষা করে, তার দ্বারা নিজ সন্তান রক্ষিত হয়। কারণ, সাঙ্কর্যাদি দোষ না থাকলে বিশুদ্ধ সন্তান-সন্ততি জন্মে। স্ত্রীকে রক্ষার দ্বারা শিষ্টাচার রক্ষিত হয় এবং নিজের কুলমর্যাদা রক্ষিত হয়। স্ত্রীকে রক্ষা করলে নিজেকেও রক্ষা করা হয় এবং স্ত্রীকে রক্ষা করলে স্বামী তার নিজের ধর্মকেও রক্ষা করতে পারে। (৯/৭)।

‘পতির্ভার্যাং সম্প্রবিশ্য গর্ভো ভূত্বেহ জায়তে।
জায়ায়াস্তদ্ধি জায়াত্বং যদস্যাং জায়তে পুনঃ।।’
পতি শুক্ররূপে ভার্যার গহ্বরমধ্যে প্রবেশ করে এই পৃথিবীতে তার গর্ভ থেকে পুনরায় পুত্ররূপে জন্মগ্রহণ করে। জায়ার (অর্থাৎ ভার্যার) জায়াত্ব এই যে তার মধ্যে পতি পুনর্বার জন্মগ্রহণ করে এবং এই কারণেই ভার্যাকে জায়া বলা হয়। অতএব জায়াকে সর্বতোভাবে রক্ষা করতে হবে। (৯/৮)।

‘যাদৃশং ভজতে হি স্ত্রী সুতং সূতে তথাবিধম্।
তস্মাৎ প্রজাবিশুদ্ধ্যর্থং স্ত্রিয়ং রক্ষেৎ প্রযত্নতঃ।।’
যে পুরুষ শাস্ত্রবিহিত উপায়ে নিজের পতি হয়েছে এমন পুরুষকে যে স্ত্রীলোক সেবা করে, সে উৎকৃষ্ট সন্তান প্রসব করে; আর শাস্ত্রনিষিদ্ধ পরপুরুষ-সেবায় নিকৃষ্ট সন্তান লাভ হয়। সেই কারণে সন্তানের বিশুদ্ধতা রক্ষার জন্য, সর্বপ্রযত্নে যাতে স্ত্রীর পরপুরুষ-সম্পর্ক না হয়, তার জন্য স্ত্রীকে সকল সময় রক্ষা করা কর্তব্য। (৯/৯)।

‘ন কশ্চিদ্যোষিতঃ শক্তঃ প্রসহ্য পরিরক্ষিতুম্।
এতৈরুপায়যোগৈস্তু শক্যাস্তাঃ পরিরক্ষিতুম্।।’
স্ত্রীলোকসমূহকে কেউ বলপূর্বক বা সংরোধ বা তাড়নাদির দ্বারা রক্ষা করতে পারে না। কিন্তু বক্ষ্যমাণ উপায়গুলি অবলম্বন করলে তাদের রক্ষ করা যায়। (৯/১০)।

‘অর্থস্য সংগ্রেহে চৈনাং ব্যয়ে চৈব নিযোজয়েৎ।
শৌচে ধর্মেহন্নপক্ত্যাঞ্চ পারিণাহ্যস্য বেক্ষণে।।’
টাকাকড়ি ঠিকমত হিসাব করে জমা রাখা এবং খরচ করা, গৃহ ও গৃহস্থালী শুদ্ধ রাখা, ধর্ম-কর্ম সমূহের আয়োজন করা, অন্নপাক করা এবং শয্যাসনাদির তত্ত্বাবধান করা- এই সব কাজে স্ত্রীলোকদের নিযুক্ত করে অন্যমনস্ক রাখবে। (৯/১১)।

‘অরক্ষিতা গৃহে রুদ্ধাঃ পুরুষৈরাপ্তকারিভিঃ।
আত্মানমাত্মনা যাস্তু রক্ষেয়ুস্তাঃ সুরক্ষিতাঃ।।’
যে স্ত্রী দুঃশীলতাহেতু নিজে আত্মরক্ষায় যত্নবতী না হয়, তাকে আপ্তপুরুষেরা গৃহমধ্যে অবরুদ্ধ করে রাখলেও সে অরক্ষিতা হয়; কিন্তু যারা সর্বদা আপনা-আপনি আত্মরক্ষায় তৎপর, কেউ তাদের রক্ষা না করলেও তারা সুরক্ষিতা হয়ে থাকে। (৯/১২)।

‘পানং দুর্জনসংসর্গঃ পত্যা চ বিরহোহটনম্।
স্বপ্নোহন্যগেহবাসশ্চ নারীসংদূষণানি ষট্।।’
মদ্যপান, দুষ্ট লোকের সাথে মেলামেশা করা, স্বামীর সাথে বিচ্ছেদ, যেখানে সেখানে ঘুরে বেড়ানো, অসময়ে ঘুমানো এবং পরের বাড়িতে বাস করা- এই ছয়টি বিষয় স্ত্রীলোককে দূষিত করে। (৯/১৩)।

‘নৈতা রূপং পরীক্ষন্তে নাসাং বয়সি সংস্থিতিঃ।
গুরূপং বা বিরূপং বা পুমানিত্যেব ভুঞ্জতে।।’
বস্তুতঃপক্ষে স্ত্রীলোকেরা যে সৌন্দর্যে আসক্ত হয় তা নয় কিংবা পুরুষের বিশেষ বয়সের উপর নির্ভর করে তা-ও নয়। কিন্তু যার প্রতি আকৃষ্ট হয় সে লোকটি সুরূপই হোক বা কুরূপই হোক তাতে কিছু যায় আসে না, যেহেতু ব্যক্তিটি পুরুষ এইজন্যেই তার প্রতি আসক্ত হয় (এবং তার সাথে সম্ভোগে লিপ্ত হয়)। (৯/১৪)।

‘পৌংশ্চলাচ্চলচিত্তাচ্চ নৈঃস্নেহ্যচ্চ স্বভাবতঃ।
রক্ষিতা যত্নতোহপীহ ভর্তৃষবেতা বিকুর্বতে।।’
যেহেতু স্ত্রীলোক স্বভাবত পুংশ্চলী [যে কোনও পুরুষ মানুষ এদের দৃষ্টি-পথে পড়লে এদের ধৈর্য্যচ্যুতি ঘটে- ঐ পুরুষের সাথে কিভাবে সম্ভোগ করবো- এই প্রকার যে চিত্তবিকার, তাই পুংশ্চলীত্ব], চঞ্চলচিত্ত [ধর্মকার্যাদি শুভ-বিষয়ে চিত্তের অস্থিরতা দেখা যায়] এবং স্নেহহীন, সেই কারণে এদের যত্নসহকারে রক্ষা করা হলেও এরা স্বামীর প্রতি বিরূপ হয়ে থাকে। (৯/১৫)।
.
‘শয্যাসনমলঙ্কারং কামং ক্রোধমনার্জবম্।
দ্রোহভাবং কুচর্যাঞ্চ স্ত্রীভ্যো মনুরকল্পয়ৎ।।’
বেশি নিদ্রা যাওয়া, কেবল বসে থাকার ইচ্ছা, শরীরকে অলংকৃত করা, কাম অর্থাৎ পুরুষকে ভোগ করার আকাঙ্ক্ষা, অন্যের প্রতি বিদ্বেষ, নীচহৃদয়তা, অন্যের বিরুদ্ধাচরণ করা এবং কুচর্যা অর্থাৎ নীচ পুরুষকে ভজনা করা- স্ত্রীলোকদের এই সব স্বভাব মনু এদের সৃষ্টি-কালেই করে গিয়েছেন। (৯/১৭)।

‘নাস্তি স্ত্রীণাং ক্রিয়া মন্ত্রৈরিতি ধর্মে ব্যবস্থিতিঃ।
নিরিন্দ্রিয়া হ্যমন্ত্রাশ্চ স্ত্রিয়োহনৃতমিতি স্থিতিঃ।।’
স্ত্রীলোকদের মন্ত্রপাঠপূর্বক জাতকর্মাদি কোনও ক্রিয়া করার অধিকার নেই- এ-ই হলো ধর্মব্যবস্থা। অর্থাৎ স্মৃতি বা বেদাদি ধর্মশাস্ত্রে এবং কোনও মন্ত্রেও এদের অধিকার নেই- এজন্য এরা মিথ্যা বা অপদার্থ, – এই হলো শাস্ত্রস্থিতি। (৯/১৮)।

‘প্রজনার্থং মহাভাগাঃ পূজার্হা গৃহদীপ্তয়ঃ।
স্ত্রিয়ঃ শ্রিয়শ্চ গেহেষু ন বিশেষোহস্তি কশ্চন।।’
স্ত্রীলোকেরা সন্তান প্রসব ও পালন করে বলে [‘প্রজন’ বলতে গর্ভধারণ থেকে সন্তান পালন পর্যন্ত ক্রিয়াকলাপকে বোঝায়] তারা অত্যন্ত সৌভাগ্যবতী [এ কারণে, তারা বস্ত্রারঙ্কারাদি প্রদানের দ্বারা বহুসম্মানের যোগ্য]; এরা গৃহের দীপ্তি অর্থাৎ প্রকাশস্বরূপ হয় [স্ত্রীলোক বাড়িতে না থাকলে কুটুম্ব বা আত্মীয়বর্গের আদর-আপ্যায়ন কিছুই হয় না। পুরুষের ধনৈশ্বর্য থাকলেও যদি ভার্যা না থাকে, তা হলে বাড়িতে বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজনেরা উপস্থিত হলে গৃহস্বামী নিজে তাদের প্রত্যেককে পান-ভোজনাদির দ্বারা আপ্যায়িত করতে পারে না] এই কারণে, স্ত্রীলোকদের সকল সময়ে সম্মান-সহকারে রাখা উচিত, বাড়িতে স্ত্রী এবং শ্রী- এদের মধ্যে কোনও ভেদ নেই। (৯/২৬)।

‘ক্ষেত্রভূতা স্মৃতা নারী বীজভূতঃ স্মৃতঃ পুমান্।
ক্ষেত্রবীজসমাযোগাৎ সম্ভবঃ সর্বদেহিনাম্।।’
নারী শস্যেক্ষেত্রের মতো, আর পুরুষ শস্যের বীজস্বরূপ। এই ক্ষেত্র ও বীজের সংযোগে সকল প্রাণীর উৎপত্তি। (৯/৩৩)।
.
‘বীজস্য চৈব যোন্যাশ্চ বীজমুৎকৃষ্টমুচ্যতে।
সর্বভূত প্রসূতির্হি বীজলক্ষণলক্ষিতা।।’
বীজ এবং যোনি এই দুটির মধ্যে বীজই শ্রেষ্ঠ বলে কথিত হয়। কারণ, সর্বত্র সন্তান বীজের লক্ষণ যুক্ত হয়ে থাকে। (৯/৩৪)

‘যাদৃশং তূপ্যতে বীজং ক্ষেত্রে কালোপপাদিতে।
তাদৃগ্ রোহতি তত্তস্মিন্ বীজং স্বৈর্ব্যঞ্জিতং গুণৈঃ।।’
বপনের উপযুক্ত বর্ষাকাল প্রভৃতি সময়ে উত্তমরূপে কর্ষণ-সমীকরণ প্রভৃতি পদ্ধতির দ্বারা সংস্কৃত ক্ষেত্রে যেরকম বীজ বপন করা হয়, সেই প্রকার ক্ষেত্রে সেই বীজ বর্ণ-অবয়বসন্নিবেশ রস-বীর্য প্রভৃতি নিজগুণের দ্বারা বিশিষ্ট হয়ে শস্যরূপে উৎপন্ন হয়। (৯/৩৬)।

‘অন্যদুপ্তং জাতমন্যদিত্যেতন্নোপপদ্যতে।
উপ্যতে যদ্ধি যদ্বীজং তত্তদেব প্ররোহতি।।’
একরকম বীজ বপন করা হল আর অন্য রকম শষ্য জন্মালো, এরকমটি হতে পারে না; কিন্তু যেমন বীজ বপন করা হয় সেইরকমই ফসল তা থেকে জন্মায়। (৯/৪০)।
.
‘তৎ প্রাজ্ঞেন বিনীতেন জ্ঞানবিজ্ঞানবেদিনা।
আয়ুষ্কামেণ বপ্তব্যং না জাতু পরযোষিতি।।’
অতএব বীজ যখন ঐ রকম প্রভাবসম্পন্ন, তখন প্রাজ্ঞ (যিনি স্বাভাবিক প্রজ্ঞার দ্বারা যুক্ত), বিনীত অর্থাৎ শিক্ষিত, জ্ঞানে (অর্থাৎ বেদাঙ্গশাস্ত্রে) এবং বিজ্ঞানে (অর্থাৎ তর্ক-কলা প্রভৃতি-বিষয়ক শাস্ত্রে) অভিজ্ঞ এবং আয়ুষ্কামী ব্যক্তি নিজশরীরস্থিত ঐ বীজ কখনো যেন পরক্ষেত্রে অর্থাৎ পরস্ত্রীতে বপন না করেন। (৯/৪১)।

‘অত্র গাথা বায়ুগীতাঃ কীর্ত্তয়ন্তি পুরাবিদঃ।
যথা বীজং ন বপ্তব্যং পুংসা পরপরিগ্রহে।।’
পরস্ত্রীতে বীজ বপন করা পুরুষের যে উচিত নয় সে সম্বন্ধে অতীতকালজ্ঞ পণ্ডিতেরা বায়ুকথিত কতকগুলি গাথা অর্থাৎ ছন্দোবিশেষযুক্ত বাক্য বলে গিয়েছেন। (৯/৪২)।

‘নশ্যতীষুর্যথা বিদ্ধঃ খে বিদ্ধমনুবিধ্যতঃ।
তথা নশ্যতি বৈ ক্ষিপ্রং বীজং পরপরিগ্রহে।।’
যেমন অন্যের শরে বিদ্ধ কৃষ্ণশারাদি প্রাণীর শরীরে ঐ বেধজনিত ছিদ্রে অন্য কোনও ব্যক্তির দ্বারা নিক্ষিপ্ত বাণ নিষ্ফল হয়, এবং ঐ মৃগ প্রথম বাণনিক্ষেপকারী পুরুষেরই প্রাপ্য হয়; সেইরকম পরস্ত্রীতে নিক্ষিপ্ত বীজও বীজী পুরুষটির নষ্ট হয়ে যায়, যেহেতু তা থেকে উৎপন্ন সন্তানটি হয় ক্ষেত্রস্বামীর। (৯/৪৩)।

‘এতাবানেব পুরুষো যজ্জায়াত্মা প্রজেতি হ।
বিপ্রাঃ প্রাহুস্তথা চৈতদ্ যো ভর্তা সা স্মৃতাঙ্গনা।।’
স্ত্রী এবং সন্তানকে নিয়ে পুরুষ পরিপূর্ণস্বরূপ হয়, একথা বেদিবদ ব্রাহ্মণগণ বলেন; কাজেই স্ত্রীও যে পতিও সে অর্থাৎ স্ত্রী হলো পতির আত্মভূত অংশস্বরূপ। (৯/৪৫)।

‘দেবরাদ্বা সপিণ্ডাদ্বা স্ত্রিয়া সম্যঙ্ নিযুক্তয়া।
প্রজেপ্সিতাধিগন্তব্যা সন্তানস্য পরিক্ষয়ে।।’
সন্তানের পরিক্ষয়ে অর্থাৎ সন্তান-উৎপত্তি না হওয়ায় বা সন্তান-জন্মানোর পর তার মৃত্যু হওয়ায় বা কন্যার জন্ম হলে তাকে পুত্রিকারূপে গ্রহণ না করায় নারী শ্বশুর-শাশুড়ি-পতি প্রভৃতি গুরুজনদের দ্বারা সম্যকভাবে নিযুক্ত হয়ে দেবর (অর্থাৎ স্বামীর জ্যেষ্ঠ বা কনিষ্ঠ ভ্রাতা) অথবা সপিণ্ডের (স্বামীর বংশের কোনও পুরুষের) সাহায্যে অভিলষিত সন্তান লাভ করবে। (৯/৫৯)।

‘বিধবায়াং নিযুক্তস্তু ঘৃতাক্তো বাগ্যতো নিশি।
একমুৎপাদয়েৎ পুত্রং ন দ্বিতীয়ং কথঞ্চন।।’
বিধবা নারীতে অথবা অক্ষম পতি থাকা সত্ত্বেও সধবাতেও পতি-প্রভৃতি গুরুজনের দ্বারা নিযুক্ত দেবর বা কোনও সপিণ্ড ব্যক্তি ঘৃতাক্ত শরীরে মৌনাবলম্বন করে রাত্রিতে একটিমাত্র পুত্র উৎপাদন করবে, কখনো দ্বিতীয় পুত্র উৎপাদন করবে না [নিশি অর্থাৎ রাত্রিতে কথাটি বলার তাৎপর্য হলো, সেখানে প্রদীপ প্রভৃতি আলো থাকবে না]। (৯/৬০)।

‘দ্বিতীয়মেকে প্রজনং মন্যন্তে স্ত্রীষু তদ্বিদঃ।
অনিবৃতং নিয়োগার্থং পশ্যন্তো ধর্মতস্তয়োঃ।।’
কোনও কোনও সন্তানোৎপত্তিবিদ আচার্য বলেন, একপুত্র অপুত্রের মধ্যে গণ্য, এইজন্য ঐভাবে দ্বিতীয় পুত্র উৎপাদন করানো যায়। অতএব এক পুত্রের দ্বারা নিয়োগকর্তার নিয়োগোদ্দেশ্য সিদ্ধ হয় না বলে শিষ্টাচার অনুসারে ঐ স্ত্রী এবং পূর্ব-নিযুক্ত ব্যক্তিই দ্বিতীয় পুত্র উৎপাদন করতে পারবে। (৯/৬১)।

‘বিধবায়াং নিয়োগার্থে নির্বৃতে তু যথাবিধি।
গুরুবচ্চ স্নুষাবচ্চ বর্তেয়াতাং পরস্পরম্।।’
বিধবা নারীতে যথাবিধি নিয়োগের প্রয়োজন সিদ্ধ হলে [যে কারণে নিয়োগ করা হয়, তা-ই এখানে নিয়োগের বিষয়। তা হলো স্ত্রী-পুরুষের সম্প্রযোগ থেকে ক্রিয়ানিষ্পত্তি অর্থাৎ স্ত্রী-লোকের গর্ভধারণ পর্যন্ত] উভয়ের মধ্যে পূর্ববৎ আচরণই চলতে থাকবে। সেটি হলো গুরুবৎ স্নুষাবৎ; অর্থাৎ পুরুষের পক্ষে ঐ নারী যদি জ্যেষ্ঠভ্রাতার স্ত্রী হয় তা হলে তার প্রতি গুরুর মতো, আর যদি কনিষ্ঠ ভ্রাতার স্ত্রী হয়, তাহলে তার প্রতি পুত্রবধুর মতো আচরণ করবে। (৯/৬২)।
.
‘নিযুক্তৌ যৌ বিধিং হিত্বা বর্তেয়াতান্তু কামতঃ।
তাবুভৌ পতিতৌ স্যাতাং স্নুষাগ-গুরুতল্পগৌ।।’
জ্যেষ্ঠ ও কনিষ্ঠ ভ্রাতা নিয়োগের জন্য নিযুক্ত হয়েও যদি পূর্বোক্ত ঘৃতাক্তাদি নিয়ম লঙ্ঘন করে কামনা চরিতার্থ করার ইচ্ছায় পরস্পরের ভার্যাতে আভিগমন করে, তাহলে জ্যেষ্ঠভ্রাতা পুত্রবধুগমন এবং কনিষ্ঠ ভ্রাতা গুরুপত্নীগমন-রূপ দোষে পতিত হবে। (৯/৬৩)।

‘নান্যস্মিন্ বিধবা নারী নিযোক্তব্যা দ্বিজাতিভিঃ।
অন্যস্মিন্ হি নিযুঞ্জানা ধর্মং হন্যুঃ সনাতনম্।।’
বিধবা নারীকে দ্বিজাতিগণ কখনো অন্য পুরুষে নিযুক্ত করবে না, কারণ, অন্য পুরুষে যারা ঐ ভাবে তাকে নিযুক্ত করে, তারা সনাতন ধর্ম উল্লঙ্ঘন করে। (৯/৬৪)।

‘নোদ্বাহিকেষু মন্ত্রেষু নিয়োগঃ কীর্ত্যতে ক্বচিৎ।
ন বিবাহবিধাবুক্তং বিধবাবেদনং পুনঃ।।’
বিবাহবিষয়ক যে সব মন্ত্র আছে তার কোথাও নিয়োগের প্রসঙ্গ নেই [অর্থাৎ বিবাহসম্পর্কিত যত সব মন্ত্র আছে সেগুলি প্রত্যেকটিতেই বিবাহকারীর নিজেরই উৎপাদিত সন্তানের কথা বলা আছে] আর বিবাহবিষয়ক-শাস্ত্রতেও বিধবা-আবেদনের অর্থাৎ বিধবা বিধবাবিবাহের বা বিধবা-গমনের কথা নেই। (৯/৬৫)।

‘যস্যা ম্রিয়েত কন্যায়া বাচা সত্যে কৃতে পতিঃ।
তামনেন বিধানেন নিজো বিন্দেত দেবরঃ।।’
বিবাহের আগে কোনও বাগদত্তা কন্যার বরের মৃত্যু হলে, নিম্নোক্ত বিধান অনুসারে বরের সহোদর ভ্রাতা তাকে বিবাহ করবে। (৯/৬৯)।

‘যথাবিধ্যধিগম্যৈনাং শুকবস্ত্রাং শুচিব্রতাম্।
মিথো ভজেতাপ্রসবাৎ সকৃৎ সকৃদৃতাবৃতৌ।।’
উক্ত দেবর কন্যাটিকে শাস্ত্রোক্ত নিয়ম অনুসারে বিবাহ করে তাকে গমন-কালীন নিয়মানুসারে বৈধব্যচিহ্নসূচক-শুকবস্ত্র পরিয়ে এবং কায়মনোবাক্যে তাকে শুদ্ধাচারিণী রেখে প্রত্যেক ঋতুকালে তাতে এক এক বার গমন করবে যতদিন না সে গর্ভ-ধারণ করে। (৯/৭০)।

‘ন দত্ত্বা কস্যচিৎ কন্যাং পুনর্দদ্যাদ্বিচক্ষণঃ।
দত্ত্বা পুনঃ প্রযচ্ছন্ হি প্রাপ্লোতি পুরুষানৃতাম্।।’
যার উদ্দেশ্যে কন্যা বাগদত্তা হবে, তার মৃত্যুর পরও বিচক্ষণ ব্যক্তি নিজের ঐ বাগদত্তা কন্যাকে আবার অন্য পুরুষকে সমর্পণ করবে না। কারণ ঐ ভাবে একজনের উদ্দেশ্যে দত্তা কন্যাকে আবার অন্যকে দান করলে পুরুষানৃত প্রাপ্ত হবে অর্থাৎ যে ব্যক্তি ঐরকম করে তাহলে সমগ্র মানবজাতিকে প্রতারণা করার যে পাপ হয়, সে তার ভাগী হয়। (৯/৭১)।

‘বিধিবৎপ্রতিগৃহ্যাপি ত্যজেৎ কন্যাং বিগর্হিতাম্।
ব্যাধিতাং বিপ্রদুষ্টাং বা ছদ্মনা চোপপ্যাদিতাম্।।’
বর যথাবিধি কন্যাকে গ্রহণ করেও যদি দেখে যে মেয়েটি বিগর্হিতা, ব্যাধিতা, বিপ্রদুষ্টা কিংবা তাহার স্বরূপ গোপন করে তাকে সম্প্রদান করা হয়েছে, তা হলে তাকে পরিত্যাগ করবে। (৯/৭২)।

‘উৎকৃষ্টায়াভিরূপায় বরায় সদৃশায় চ।
অপ্রাপ্তামপি তাং তস্মৈ কন্যাং দদ্যাদ্ যথাবিধি।।’
উৎকৃষ্ট অভিরূপ এবং সজাতীয় বর পাওয়া গেলে কন্যা বিবাহের বয়স প্রাপ্ত না হলেও তাকে যথাবিধি সম্প্রদান করবে। (৯/৮৮)।

‘অদীয়মানা ভর্তারমধিগচ্ছেদ্ যদি স্বয়ম্।
নৈনঃ কিঞ্চিদবাপ্লোতি ন চ যং সাহধিগচ্ছতি।।’
ঋতুমতী হওয়ার তিন বৎসর পরেও যদি ঐ কন্যাকে পাত্রস্থ করা না হয়, তাহলে সে যদি নিজেই পতি বরণ করে নেয়, তার জন্য সে কোনও পাপের ভাগী হবে না। কিংবা যাকে সে বরণ করে, তারও কোনও পাপ বা দোষ হবে না। (৯/৯১)।

‘পিত্রে ন দদ্যাচ্ছুল্কন্তু কন্যামৃতুমতীং হরন্।
স হি স্বাম্যাদতিক্রামেদৃতূনাং প্রতিরোধনাৎ।।’
ঋতুমতী কন্যাকে যে বিবাহ করবে সেই ব্যক্তি কন্যার পিতাকে কোন শুল্ক দেবে না। কারণ, সেই পিতা কন্যার ঋতু নষ্ট করছেন বলে কন্যার উপর তার যে অধিকার তা থেকে তিনি বঞ্চিত হয়েছেন। (৯/৯৩)।

‘ত্রিংশদ্বর্ষোদ্বহেৎ কন্যাং হৃদ্যাং দ্বাদশবার্ষিকীম্।
ত্র্যষ্টবর্ষোহষ্টবর্ষাং বা ধর্মে সীদতি সত্বরঃ।।’
ত্রিশ বৎসর বয়সের পুরুষ বারো বৎসর বয়সের মনোমত কন্যাকে বিবাহ করবে, অথবা, চব্বিশ বছর বয়সের পুরুষ আট বছরের কন্যাকে বিবাহ করবে। এর দ্বারা বিবাহযোগ্য কাল প্রদর্শিত হলো মাত্র। তিনগুণের বেশি বয়সের পুরুষ একগুণ বয়স্কা কন্যাকে বিবাহ করবে, এর কমবেশি বয়সে বিবাহ করলে ধর্ম নষ্ট হয়। (৯/৯৪)।

‘উর্দ্ধং পিতুশ্চ মাতুশ্চ সমেত্য ভ্রাতরঃ সমম্।
ভজেরন্ পৈতৃকং রিক্থমনীশাস্তে হি জীবতোঃ।।’
পিতা এবং মাতার মৃত্যুর পর ভাইয়েরা সমবেত হয়ে পিতার এবং মাতার ধন বিভাগ করে নেবে, কারণ, তাঁরা জীবিত থাকতে পুত্রদের কোন স্বামিত্ব বা অধিকার নাই। (৯/১০৪)।

‘জ্যেষ্ঠেন জাতমাত্রেণ পুত্রীভবতি মানবঃ।
পিতৃণামনৃণশ্চৈব স তস্মাৎ সর্বমর্হতি।।’
উৎপত্তির সঙ্গে সঙ্গেই জ্যেষ্ঠ পুত্র অসংস্কৃত থাকলেও তার দ্বারাই মানুষ পুত্রবিশিষ্ট হয় এবং ঐ পুত্র তার পিতৃপুরুষগণকে পুন্-নামক নরক থেকে নিষ্কৃতি দেয়ার জন্য সে পিতৃঋণ থেকে মুক্ত হয়; জ্যেষ্ঠই প্রকৃত অর্থে পুত্রপদবাচ্য। এইরকম বিচার করলে, জ্যেষ্ঠই সমস্ত পিতৃধন লাভ করার যোগ্য। (৯/১০৬)।

‘যস্মিনৃনং সন্নয়তি যেন চানন্ত্যমশ্নুতে।
স এব ধর্মজঃ পুত্রঃ কামজানিতরান্ বিদুঃ।।’
যে জ্যেষ্ঠপুত্রের উৎপত্তিমাত্র পিতা পিতৃঋণ পরিশোধ করেন, এবং যার দ্বারা পিতা মোক্ষ লাভ করেন, সেই জ্যেষ্ঠ পুত্রকে যথার্থ ধর্মজ-সন্তান বলা যায়; অবশিষ্ট পুত্রগুলি সব কামজ, জ্ঞানীরা এইরকম বিবেচনা করেন। (৯/১০৭)।

‘পিতেব পালয়েৎ পুত্রান্ জ্যেষ্ঠো ভ্রাতৃন্ যবীয়সঃ।
পুত্রবচ্চাপি বর্তেরন্ জ্যেষ্ঠে ভ্রাতরি ধর্মতঃ।।’
জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা আহার ও বস্ত্রাদি দান করে সহোদর কনিষ্ঠ ভ্রাতাদের পিতার মতো পালন করবে; এবং কনিষ্ঠ ভ্রাতারাও ধর্মানুসারে জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার প্রতি পিতার মতো আচরণ করবে। (৯/১০৮)।
.
‘জ্যেষ্ঠস্য বিংশ উদ্ধারঃ সর্বদ্রব্যাচ্চ যদ্বরম্।
ততোহর্দ্ধং মধ্যমস্য স্যাৎ তুরীয়ন্তু যবীয়সঃ।।’
জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা পিতার ধন সম্পত্তির বিশ ভাগের এক ভাগ ‘উদ্ধার’ অর্থাৎ অতিরিক্ত পাবে, এবং সকল দ্রব্যের মধ্যে যেটি সেরা সেটিও পাবে। মধ্যম তার অর্দ্ধেক অর্থাৎ চল্লিশ ভাগের এক ভাগ ‘উদ্ধার’ পাবে আর কনিষ্ঠ জ্যেষ্ঠের চতুর্থ ভাগ অর্থাৎ সমগ্র ধন-সম্পত্তির আশি ভাগের এক ভাগ ঐ ‘উদ্ধার’ পাবে। (৯/১১২)।
.
‘স্বেভ্যোহংশেভ্যস্তু কন্যাভ্যঃ প্রদদ্যুর্ভ্রাতরঃ পৃথক্।
স্বাৎ স্বাদংশাচ্চতুর্ভাগং পতিতাঃ স্যুরদিৎসবঃ।।’
ভ্রাতারা স্বজাতীয় অবিবাহিত ভগিনীগণকে নিজ নিজ অংশ থেকে চতুর্থ ভাগ ধন পৃথক করে দান করবে; যদি তারা দিতে অনিচ্ছুক হয় তা হলে পতিত হবে। (৯/১১৮)।

‘যবীয়ান্ জ্যেষ্ঠভার্যায়াং পুত্রমুৎপাদয়েদ্ যদি।
সমস্তত্র বিভাগঃ স্যাদিতি ধর্মো ব্যবস্থিতঃ।।’
কনিষ্ঠ ভ্রাতা যদি মৃত জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার পত্নীতে পুত্রসন্তান উৎপাদন করে, তা হলে সেই পুত্রের এবং তার পিতৃব্যের মধ্যে সমান সমান বিভাগ হবে, এটিই ধর্ম ব্যবস্থা। (৯/১২০)।

‘অপুত্রোহনেন বিধিনা সুতাং কুর্বীত পুত্রিকাম্।
যদপত্যং ভবেদস্যাং তন্মম স্যাৎ স্বধাকরম্।।’
যে লোকের কোন পুত্র সন্তান নেই সে এই বক্ষ্যমান নিয়মে নিজের কন্যাকে ‘পুত্রিকা’রূপে স্থির করবে। কন্যাকে পাত্রস্থ করবার সময় ঐ কন্যার পিতা জামাতার সাথে বন্দোবস্ত করে এই কথা তাকে বলবে- ‘এই কন্যার গর্ভে যে পুত্র জন্মাবে সে আমার পিণ্ডদানকারী হবে’। (৯/১২৭)।

‘যথৈবাত্মা তথা পুত্রঃ পুত্রেণ দুহিতা সমা।
তস্যামাত্মনি তিষ্ঠন্ত্যাং কথমন্যো ধনং হরেৎ।।’
নিজেও যেমন পুত্রও সেইরকম অর্থাৎ আত্মা ও পুত্রতে প্রভেদ নেই; আবার দুহিতা অর্থাৎ ‘পুত্রিকা’ পুত্রেরই সমান। সেই পুত্রিকা-পুত্র স্বয়ং বিদ্যমান থাকতে অন্য কোনও ব্যক্তি ঐ পুত্রিকা-পিতার ধন কেমন ভাবে গ্রহণ করবে ? (৯/১৩০)।

‘পুত্রিকায়াং কৃতায়ান্তু যদি পুত্রোহনুজায়তে।
সমস্তত্র বিভাগঃ স্যাজ্জ্যেষ্ঠতা নাস্তি হি স্ত্রিয়াঃ।।’
পুত্রিকা সম্পাদন করার পর যদি কোনও ব্যক্তির পুত্র জন্মগ্রহণ করে, তাহলে পুত্র ও পুত্রিকা উভয়ের মধ্যে সমান-সমান ভাবে ধনবিভাগ হবে। কারণ, স্ত্রীলোকের জ্যেষ্ঠতা নেই অর্থাৎ জ্যেষ্ঠ পুত্র যে ‘উদ্ধার’ পেত তা ঐ পুত্রিকা পাবে না। (৯/১৩৪)।

‘অপুত্রায়াং মৃতায়ান্তু পুত্রিকায়াং কথঞ্চন।
ধনং তৎপুত্রিকাভর্তা হরেতৈবাবিচারয়ন্।।’
পুত্রিকা যদি অপুত্রক অবস্থায় ঘটনাক্রমে মারা যায়, তাহলে ঐ পুত্রিকার যা কিছু ধন-সম্পত্তি তা তার ভর্তাই বিনা-বিচারে গ্রহণ করবে। (৯/১৩৫)।

‘পুন্নাম্নো নরকাদ্ যস্মাৎ ত্রায়তে পিতরং সুতঃ।
তস্মাৎ পুত্র ইতি প্রোক্তঃ স্বয়মেব স্বয়ম্ভুবা।।’
যে হেতু পুত্র ‘পুৎ’ নামক নরক থেকে পিতাকে উদ্ধার করে এই কারণে স্বয়ং ব্রহ্মা তাকে ‘পুত্র’ এই নামে অভিহিত করেছেন। [পৃথিবীতে যে সব প্রাণীর উৎপত্তি হয় তাদের সেই উৎপত্তিটাকেই পুৎ নামক নরক বলা হয়। পুত্র জন্মালে পিতাকে তা থেকে পরিত্রাণ করে অর্থাৎ পিতা তখন পৃথিবীতে পুনর্জন্ম গ্রহণ না করে দেবলোকে জন্মপ্রাপ্ত হয়। সেই কারণে তাকে ‘পুত্র’ বলা হয়]। (৯/১৩৮)।

‘হরেত্তত্র নিযুক্তায়াং জাতঃ পুত্রো যথৌরসঃ।
ক্ষেত্রিকস্য তু তদ্বীজং ধর্মতঃ প্রসবশ্চ সঃ।।’
গুরুজনদের দ্বারা আদিষ্ট হয়ে যদি কোনও স্ত্রী বিধানানুসারে সন্তানোৎপাদন করে, তাহলে ঐ পুত্র ঔরসপুত্রের মতো পৈত্রিকধন প্রাপ্তির যোগ্য হবে, কারণ শাস্ত্রব্যবস্থা অনুসারে সেই নারীর গর্ভে যে বীজ নিষিক্ত হয়েছিলো, তা ক্ষেত্রস্বামীরই বীজ বলে গণ্য হবে এবং সেই পুত্রটিও ক্ষেত্রস্বামীরই অপত্য হবে। (৯/১৪৫)।

‘ধনং যো বিভৃয়াদ্ ভ্রাতুর্মৃতস্য স্ত্রিয়মেব চ।
সোহপত্যং ভ্রাতুরুৎপাদ্য দদ্যাত্তস্যৈব তদ্ ধনম্।।’
(পূর্বে ধনবিভাগ না করেই) যদি কোনও জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা স্ত্রী রেখে পুত্ররহিত অবস্থায় মারা যায় এবং ঐ মৃত ভ্রাতার বিভক্ত ধনসম্পত্তি যদি পত্নী রক্ষা করতে অসমর্থ হয়, কিন্তু কনিষ্ঠ ভ্রাতা যদি ঐ সম্পত্তি রক্ষা করে এবং ভ্রাতৃপত্নীকে পোষণ করে, তাহলে ঐ কনিষ্ঠ জ্যেষ্ঠভ্রাতৃজায়াতে পুত্রোৎপাদন পূর্বক জ্যেষ্ঠভ্রাতার সমস্ত সম্পত্তি ঐ পুত্রটিকে দেবে। (৯/১৪৬)।

‘সর্বং বা রিক্থজাতং তদ্দশধা পরিকল্প্য চ।
ধর্ম্যং বিভাগং কুর্বীত বিধিনানেন ধর্মবিৎ।।’
যা কিছু ধনসম্পত্তি আছে তা দশ ভাগ করে বিভাগধর্মজ্ঞ ব্যক্তি নিম্নলিখিত ব্যবস্থা অনুসারে ধর্মসঙ্গতভাবে বিভাগ করবেন। (৯/১৫২)।
.
‘চতুরোহংশান্ হরেদ্বিপ্রস্ত্রীনংশান্ ক্ষত্রিয়াসুতঃ।
বৈশ্যাপুত্রো হরেদ্ব্যংশমংশং শূদ্রাসুতো হরেৎ।।’
ব্রাহ্মণীর পুত্র চার অংশ, ক্ষত্রিয়ার পুত্র তিন অংশ, বৈশ্যার পুত্র দুই অংশ এবং শূদ্রার পুত্র এক অংশ লাভ করবে। (৯/১৫৩)।
.
‘যদ্যপি স্যাত্তু সৎপুত্রো হ্যসৎপুত্রোহপি বা ভবেৎ।
নাধিকং দশমাদ্দদ্যাচ্ছুদ্রাপুত্রায় ধর্মতঃ।।’
ব্রাহ্মণীর গর্ভজাত পুত্র বিদ্যমান থাকুক আর নাই থাকুক শূদ্রাস্ত্রীর পুত্রকে দশমাংশের বেশি দেবে না, এ-ই হলো ধর্মসঙ্গত ব্যবস্থা। (৯/১৫৪)।

‘ব্রাহ্মণক্ষত্রিয়বিশ্যাং শূদ্রাপুত্রো ন বিক্থভাক্।
যদেবাস্য পিতা দদ্যাত্তদেবাস্য ধনং ভবেৎ।।’
ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় এবং বৈশ্য এদের শূদ্রা নারীর গর্ভজাত পুত্র ধনাদির অংশ পাবে না। তবে পিতা তাকে স্বেচ্ছায় ধনের যা দিয়ে যাবেন তা-ই তার ধন হবে- তাই তার ভাগস্বরূপ হবে। (৯/১৫৫)।

‘শূদ্রস্য তু সবর্ণৈব নান্যা ভার্যা বিধীয়তে।
তস্যা জাতাঃ সমাংশাঃ স্যুর্যতি পুত্রশতং ভবেৎ।।’
শূদ্রের কিন্তু একমাত্র সবর্ণা স্ত্রী-ই ভার্যা হবে, অন্য কোনও জাতীয়া ভার্যার বিধান নেই। কাজেই শূদ্রের সজাতীয়া পত্নীতে যে সব পুত্র জন্মাবে তারা সংখ্যায় একশ জন হলেও সকলেই পৈতৃক ধনসম্পত্তির অংশ সমান সমানই হবে। (৯/১৫৭)।

‘ঔরসঃ ক্ষেত্রজশ্চৈব দত্তঃ কৃত্রিম এব চ।
গূঢ়োৎপন্নোহপবিদ্ধশ্চ দায়াদা বান্ধবাশ্চ ষট্।।’
ঔরস (সমানবর্ণা ভার্যাতে নিজের উৎপাদিত পুত্র- legitimate son of the body), ক্ষেত্রজ (সমাণবর্ণা ভার্যাতে অন্য ব্যক্তির দ্বারা উৎপাদিত পুত্র- son begotten on a wife of another), দত্তক (অন্যের পুত্রকে নিজ পুত্র হিসেবে গ্রহণ- adopted son), কৃত্রিম (মাতাপিতাহীন বালক, যাকে কেউ টাকা-জমি প্রভৃতির লোভ দেখিয়ে পুত্ররূপে গ্রহণ করেছে- a son made), গূঢ়োৎপন্ন (স্বামীর ভার্যাতে সজাতীয় অজ্ঞাত পুরুষকর্তৃক উৎপন্ন পুত্র- son secretly born), এবং অপবিদ্ধ (যে পুত্র মাতা-পিতাকর্তৃক পরিত্যক্ত এবং অন্যের দ্বারা পুত্ররূপে গৃহীত- a son cast off)- এই ছয় প্রকারের পুত্র গোত্র-দায়াদ এবং বান্ধব (অর্থাৎ এরা সপিণ্ড ও সগোত্রদের শ্রাদ্ধতর্পণ করতে পারে এবং গোত্রধারী ও ধনাধিকারীও হয়- six heirs and kinsmen)। (৯/১৫?)।

‘কানীনশ্চ সহোঢ়শ্চ ক্রীতঃ পৌনর্ভবস্তথা।
স্বয়ংদত্তশ্চ শৌদ্রশ্চ ষডদায়াদবান্ধবাঃ।।’
কানীন (অবিবাহিতা নারীর পুত্র- son of an unmarried damsel), সহোঢ় (বিবাহের আগে যে নারী অন্তঃসত্ত্বা হয় সে যে পুত্রকে বিবাহের সময়ে সঙ্গে নিয়ে আসে- son received with the wife), ক্রীত (যে পুত্রকে তার পিতা-মাতার কাছ থেকে ক্রয় করে পুত্র করা হয়- the son bought from his parents), পৌনর্ভব (পুনর্ভূ অর্থাৎ পুনর্বিবাহিত স্ত্রীলোকের সন্তান- son begotten on a re-married woman), এবং শৌদ্র (দ্বিজের ঔরসে শূদ্রার গর্ভজাত পুত্র- the son of a sudra female)- এই ছয় প্রকার পুত্র গোত্র-দায়াদ নয়, কেবল বান্ধব অর্থাৎ শ্রাদ্ধপিণ্ডাদির অধিকারী হয় মাত্র, ধনাধিকারী নয়। (৯/১৬০)।

‘এক এবৌরসঃ পুত্রঃ পিত্র্যস্য বসুনঃ প্রভুঃ।
শেষাণামানৃশংস্যার্থং প্রদদ্যাত্তু প্রজীবনম্।।’
একমাত্র ঔরসপুত্রই পিতার ধনসম্পত্তির অধিকারী হবে। তবে পাপ পরিহারের জন্য অর্থাৎ না দিলে পাপ হবে বা নিষ্ঠুরতা হবে- এই কারণে সেই ঔরসপুত্র অন্যান্য পুত্রগণের গ্রাসাচ্ছাদানের উপযোগী ধনদানের ব্যবস্থা করবে। (৯/১৬৩)।

‘সর্বাসামেকপত্নীনামেকা চেৎ পুত্রিণী ভবেৎ।
সর্বাস্তাস্তেন পুত্রেণ প্রাহ পুত্রবতীর্মনুঃ।।’
একই ব্যক্তির বহু পত্নী থাকলে তাদের মধ্যে একজনও যদি পুত্রবতী হয়, তাহলে ঐ পুত্রের দ্বারা অন্যান্য সকল পত্নী পুত্রবতী বলে পরিগণিত হবে অর্থাৎ তারা আর দত্তক-পুত্র নিতে পারবে না। -এ কথা মনু বলেছেন। (৯/১৮৩)।

‘সংস্থিতস্যানপত্যস্য সগোত্রাৎ পুত্রমাহরেৎ।
তত্র যদ্ রিক্থজাতং স্যাত্তত্তস্মিন্ প্রতিপাদয়েৎ।।’
কোনও ব্যক্তি যদি অপুত্র অবস্থায় মারা যায়, তাহলে তার স্ত্রী গুরুজনদের দ্বারা নিযুক্ত হয়ে সগোত্র পুরুষের দ্বারা পুত্র উৎপাদন করবে এবং মৃত ব্যক্তির যা কিছু ধনসম্পত্তি তা ঐ পুত্রকে অর্পণ করবে। (৯/১৯০)।

‘অধ্যগ্ন্যধ্যাবাহনিকং দত্তঞ্চ প্রীতিকর্মণি।
ভ্রাতৃমাতৃপিতৃপ্রাপ্তং ষড়বিধং স্ত্রীধনং স্মৃতম্।।’
স্ত্রীধন ছয় প্রকার- অধ্যাগ্নি, অধ্যাবাহনিক, প্রীতিদত্ত, ভ্রাতৃদত্ত, মাতৃদত্ত ও পিতৃদত্ত। অধ্যাগ্নি-স্ত্রীধন হলো বিবাহকালে পিতাপ্রভৃতিদের দ্বারা দত্ত ধন, অধ্যাবাহনিক ধন হলো পিতৃগৃহ থেকে পতিগৃহে নিয়ে আসার সময় যে ধন লব্ধ হয়, প্রীতিদত্ত ধন হলো রতিকালে বা অন্যসময় পতি কর্তৃক প্রীতিপূর্বক যে ধন স্ত্রীকে প্রদত্ত হয়। (৯/১৯৪)।

‘অন্বাধেয়ঞ্চ যদ্দত্তং পত্যা প্রীতেন চৈব যৎ।
পত্যৌ জীবতি বৃত্তায়াঃ প্রজায়াস্তদ্ধনং ভবেৎ।।’
বিবাহের পর পিতা, মাতা, স্বামী, পিতৃ-কুল এবং ভর্তৃকুল থেকে লব্ধ যে ধন তাকে সাধারণভাবে ‘অন্বাধেয়’ বলা হয়। স্ত্রীলোকের ‘অন্বাধেয়’ ধন এবং তার পতিকর্তৃক তাকে প্রীতিপূর্বক প্রদত্ত যে ধন তা-ও স্বামীর জীবদ্দশায় স্ত্রীলোকের মৃত্যু হলে তার সন্তানেরা পাবে। (৯/১৯৫)।

‘ব্রাহ্মদৈবার্ষগান্ধর্বপ্রাজাপত্যেষু যদ্বসু।
অপ্রজায়ামতীতায়াং ভর্তুরেব তদিষ্যতে।।’
ব্রাহ্ম, দৈব, আর্য, গান্ধর্ব ও প্রাজাপাত্য- এই পাঁচপ্রকার বিবাহে লব্ধ যে স্ত্রীধন, তার সবই কোনও স্ত্রীলোক নিঃসন্তান অবস্থায় মারা গেলে তার স্বামীই পাবে। (৯/১৯৬)।
.
‘যৎ তস্যাঃ স্যাদ্ধনং দত্তং বিবাহেষ্বাসুরাদিষু।
অপ্রজায়ামতীতায়াং মাতাপিত্রোস্তদিষ্যতে।।’
আসুর, রাক্ষস ও পৈশাচ- এই তিন প্রকার বিবাহে লব্ধ যে স্ত্রীধন, তা রেখে কোনও স্ত্রীলোক যদি নিঃসন্তান অবস্থায় মারা যায় তাহলে ঐ ধনে ঐ স্ত্রীর মাতার প্রথম অধিকার, কিন্তু মাতার মৃত্যু হলে পিতা অধিকারী হয়। (৯/১৯৭)।

‘অনংশৌ কীবপতিতৌ জাত্যন্ধবধিরৌ তথা।
উন্মত্তজড়মূকাশ্চ যে চ কেচিন্নিরিন্দ্রিয়াঃ।।’
কীব, পতিত (outcastes), জন্মান্ধ, জন্মবধির, উন্মত্ত, জড়-অর্থাৎ বিকলান্তঃকরণ, বর্ণের অনুচ্চারক মূক এবং ঐরকম কাণা প্রভৃতি বিকলেন্দ্রিয় ব্যক্তি- এরা কেউই পিতার ধনসম্পত্তির অংশভাগী হবে না। (৯/২০১)।
.
‘সর্বেষামপি তু ন্যায্যং দাতুং শক্ত্যা মনীষিণা।
গ্রাসাচ্ছাদনমত্যন্তং পতিতো হ্যদদদ্ভবেৎ।।’
তবে যারা রিক্থভাগী অর্থাৎ ধনসম্পত্তি লাভ করবে, তারা সুবিবেচনাপূর্বক যথাশক্তি ঐ সব ক্লীব প্রভৃতিকে যাবজ্জীবন গ্রাসাচ্ছদনের ব্যবস্থা করবে- তা না করলে তার পতিত হবে। (৯/২০২)।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *