৩য় অধ্যায় – ধর্মসংস্কারপ্রকরণ

মনুসংহিতা
তৃতীয় অধ্যায়
ধর্মসংস্কারপ্রকরণ

‘অসপিণ্ডা চ যা মাতুরসগোত্রা চ যা পিতুঃ।
সা প্রশস্তা দ্বিজাতীনাং দারকর্মণি মৈথুনে।।
যে নারী মাতার সপিণ্ড না হয় (অর্থাৎ সাতপুরুষ পর্যন্ত মাতামহবংশজাত না হয় এবং মাতামহের চতুর্দশ পুরুষ পর্যন্ত সগোত্রা না হয়) এবং পিতার সগোত্রা বা সপিণ্ডা না হয় (অর্থাৎ পিতৃস্বসাদিব সন্তান সম্ভব সম্বন্ধ না হয়) এমন স্ত্রী-ই দ্বিজাতিদের (ব্রাহ্মণ-ত্রিয়-বৈশ্য) পক্ষে ভার্যাত্বসম্পাদক বিবাহব্যাপারে এবং মৈথুন বা জনন কাজে বিধেয়। (৩/৫)।

‘মহান্ত্যপি সমৃদ্ধানি গোহজাবিধনধান্যতঃ।
স্ত্রীসম্বন্ধে দশৈতানি কুলানি পরিবর্জয়েৎ।।’
ব্ক্ষ্যমান দশটি কুল (বংশ বা পরিবার) গরু, ছাগল, ভেড়া প্রভৃতি পশু এবং ধন ও ধান্যে বিশেষ সমৃদ্ধিশালী হলেও স্ত্রীসম্বন্ধ-ব্যাপারে সেগুলি বর্জনীয়। (৩/৬)।

‘হীনক্রিয়ং নিষ্পুরুষং নিশ্ছন্দো রোমশার্শসম্।
ক্ষয্যাময়াব্যপস্মারিশ্চিত্রিকুষ্ঠিকুলানি চ।।’
(এই কুলগুলি হল-) যে বংশ ক্রিয়াহীন (অর্থাৎ যে বংশের লোকেরা জাতকর্মাদি সংস্কার এবং পঞ্চমহাযজ্ঞাদি নিত্যক্রিয়াসমূহের অনুষ্ঠান করে না), যে বংশে পুরুষ সন্তান জন্মায় না (অর্থাৎ কেবল স্ত্রীসন্তানই প্রসূত হয়), যে বংশ নিশ্ছন্দ অর্থাৎ বেদাধ্যয়নরহিত, যে বংশের লোকেরা লোমশ (অর্থাৎ যাদের হাত-পা প্রভৃতি অঙ্গে বড় বড় লোম দেখা যায়), যে বংশের লোকেরা অর্শ অর্থাৎ মলদ্বারাশ্রিত রোগ বিশেষের দ্বারা আক্রান্ত, যে বংশের লোকেরা ক্ষয়রোগগ্রস্ত, যে বংশের লোকেরা আময়াবী (আমাশয়রোগাক্রান্ত বা মন্দাগ্নি অর্থাৎ ভুক্ত দ্রব্য যাদের ঠিকমতো পরিপাক হয় না), যে বংশের লোকেদের অপস্মার রোগ (যে রোগ স্মৃতিভ্রংশ প্রভৃতি ইন্দ্রিয়বৈকল্য ঘটায়) আছে, যে বংশের লোকদের শ্বেতরোগ আছে এবং যারা কুষ্ঠরোগদ্বারা আক্রান্ত। এই দশটি বংশের কন্যাকে বিবাহ করা চলবে না। (৩/৭)।

‘নোদ্বহেৎ কপিলাং কন্যাং নাধিকাঙ্গীং ন রোগিণীম্।
নালোমিকাং নাতিলোমাং ন বাচাটাং ন পিঙ্গলাম্।।’
কপিলা কন্যাকে (যার কেশসমূহ তামাটে, কিংবা কনকবর্ণ) বিবাহ করবে না; যে কন্যার অঙ্গুলি প্রভৃতি অধিক অঙ্গ আছে (যেমন, হাতে বা পায়ে ছয়টি আঙ্গুল আছে), যে নারী নানা রোগগ্রস্তা বা চিররোগিণী বা দুষ্প্রতিকার্য ব্যাধির দ্বারা আক্রান্ত, যে কেশশূন্যা (অথবা যে নারীর বাহুমূলে ও জঙ্ঘামূলে মোটেই লোম নেই, সে অলোমিকা), যার শরীরে লোমের আধিক্য দেখা যায়, যে নারী বাচাল (অর্থাৎ অতিপ্রগল্ভা) এবং যে নারীর চোখ পিঙ্গলবর্ণের- এই সমস্ত নারীকে বিবাহ করবে না। (৩/৮)।

‘নর্ক্ষবৃক্ষনদীনাম্নীং নান্ত্যপর্বতনামিকাম্।
ই পক্ষ্যহিপ্রেষ্যনাম্নীং না চ ভীষণনামিকাম্।।’
ঋক্ষ অর্থাৎ নক্ষত্রবাচক নামযুক্তা (যেমন, আর্দ্রা, জ্যেষ্টা প্রভৃতি), বৃক্ষবাচক নামযুক্তা (যেমন, শিংশপা, আমলকী প্রভৃতি), নদীবাচক শব্দ যার নাম (যেমন, গঙ্গা, যমুনা প্রভৃতি), অন্ত্যনামিকা অর্থাৎ অন্ত্যজজাতিবোধক নামযুক্তা (যেমন, বর্বরী, শর্বরী প্রভৃতি), পর্বতবাচক নামযুক্তা (যেমন, বিন্ধ্যা, মলয়া প্রভৃতি), পক্ষিবাচক নামযুক্তা (যেমন, শুকী, সারিকা প্রভৃতি), সাপবোধক নামযুক্তা (যেমন, ব্যালী, ভুজঙ্গী প্রভৃতি), ভৃত্যবাচক নামযুক্তা (যেমন, দাসী, চেটী প্রভৃতি) কন্যাকে এবং (ডাকিনী, রাক্ষসী প্রভৃতি) ভয়বোধক যাদের নাম এমন কন্যাকে বিবাহ করবে না। (৩/৯)।

‘অব্যঙ্গাঙ্গীং সৌম্যনাম্নীং হংসবারণগামিনীম্।
তনুলোমকেশদশনাং মৃদ্বঙ্গীমুদ্বহেৎ স্ত্রিয়ম্।।’
যে নারীর কোন অঙ্গ বৈকল্য নেই (অর্থাৎ অবয়বসংস্থানের পরিপূর্ণতা বর্তমান), যার নামটি সৌম্য অর্থাৎ মধুর, যার গতি-ভঙ্গি হংস বা হস্তীর মতো (অর্থাৎ বিলাসযুক্ত ও মন্থরগমনযুক্তা), যার লোম, কেশ ও দন্ত নাতিদীর্ঘ, এবং যার অঙ্গসমূহ মৃদু অর্থাৎ সুখস্পর্শ (অর্থাৎ যে নারী কোমলাঙ্গী), এইরকম নারীকেই বিবাহ করবে। (৩/১০)।

‘যস্যাস্তু ন ভবেদ্ভ্রাতা ন বিজ্ঞায়েত বা (বৈ) পিতা।
নোপযচ্ছেত তাং প্রাজ্ঞঃ পুত্রিকাধর্মশঙ্কয়া।।’
যে কন্যার কোনও ভ্রাতা নেই, প্রাজ্ঞ ব্যক্তি সেই কন্যাকে ‘পুত্রিকা’ হওয়ার আশঙ্কায় [ভ্রাতৃহীনা কন্যাকে পিতা ইচ্ছা করলে পুত্রের মত বিবেচনা করতে পারতেন, এইরকম কন্যাকে পুত্রিকা বলা হত। আবার ভ্রাতৃহীনা কন্যার কোনও পুত্র হলে সে নিজে পুত্রস্থানীয় হয়ে সপিণ্ডনাদি কাজ সম্পন্ন করবে- অপুত্রক পিতার এইরকম অভিসন্ধি থাকলে সেই কন্যাকে পুত্রিকা বলা হত।] অথবা যে কন্যার পিতা সম্বন্ধে কিছু জানা যায় না তাকে জারজ বা মদ্যপব্যক্তির দ্বারা জাত সম্ভাবনায় অধর্ম হওয়ার ভয়ে বিবাহ করবে না। [অতএব, পুত্রিকাশঙ্কায় ভ্রাতৃহীনা কন্যা অবিবাহ্যা এবং যার পিতৃসম্বন্ধ অজ্ঞাত-জারজত্ব সম্ভাবনায় এইরকম কন্যা অধর্মাশঙ্কায় অবিহাহ্যা]। (৩/১১)।

‘সবর্ণাহগ্রে দ্বিজাতীনাং প্রশস্তা দারকর্মণি।
কামতস্তু প্রবৃত্তানামিমাঃ স্যুঃ ক্রমশো বরাঃ।।’
ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য- এই দ্বিজাতিগণের দারপরিগ্রহব্যাপারে সর্বপ্রথমে (অর্থাৎ অন্য নারীকে বিবাহ করার আগে) সমানজাতীয়া কন্যাকেই বিবাহ করা প্রশস্ত। কিন্তু কামনাপরায়ণ হয়ে পুনরায় বিবাহে প্রবৃত্ত হলে [অর্থাৎ সবর্ণাকে বিবাহ করা হয়ে গেলে তার উপর যদি কোনও কারণে প্রীতি না জন্মে অথবা পুত্রের উৎপাদনের জন্য ব্যাপার নিষ্পন্ন না হলে যদি কাম-প্রযুক্ত অন্যস্ত্রী-অভিলাষ জন্মায় তাহলে] দ্বিজাতির পক্ষে ব্ক্ষ্যমাণ নারীরা প্রশস্ত হবে। (৩/১২)।

‘শূদ্রৈব ভার্যা শূদ্রস্য সা চ স্বা চ বিশঃ স্মৃতে।
তে চ স্বা চৈব রাজ্ঞশ্চ তাশ্চ স্বা চাগ্রজন্মনঃ।।’
একমাত্র শূদ্রকন্যাই শূদ্রের ভার্যা হবে; বৈশ্য সজাতীয়া বৈশ্যকন্যা ও শূদ্রাকে বিবাহ করতে পারে; ক্ষত্রিয়ের পক্ষে সবর্ণা ক্ষত্রিয়কন্যা এবং বৈশ্যা ও শূদ্রা ভার্যা হতে পারে; আর ব্রাহ্মণের পক্ষে সবর্ণা ব্রাহ্মণকন্যা এবং ক্ষত্রিয়া, বৈশ্যা ও শূদ্রা ভার্যা হতে পারে। [এটা ‘অনুলোম’ বিবাহের প্রসঙ্গ। উচ্চবর্ণের পুরুষের সাথে নীচবর্ণের কন্যার বিবাহকে অনুলোম বিবাহ বলে। এর বিপরীত বিবাহ অর্থাৎ তুলনামূলক উচ্চবর্ণের কন্যাকে নিম্নবর্ণের পুরুষ কর্তৃক বিবাহের নাম প্রতিলোম বিবাহ। প্রতিলোম বিবাহ সকল স্মৃতিকারদের দ্বারাই নিন্দিত। মনু মনে করেন, প্রথমে সজাতীয়া কন্যার সাথে বিবাহই প্রশস্ত। পুনর্বিবাহের ইচ্ছা হলে অনুলোম-বিবাহের সমর্থন দেয়া হয়েছে]। (৩/১৩)।

‘হীনজাতিস্ত্রিয়ং মোহাদুদ্বহন্তো দ্বিজাতয়ঃ।
কুলান্যেব নয়ন্ত্যাশু সসন্তানানি শূদ্রতাম্।।’
ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য এই দ্বিজাতিরা যদি মোহবশতঃ (ধনলাভজনিত অবিবেকবশতই হোক অথবা কামপ্রেরিত হয়েই হোক) হীনজাতীয়া স্ত্রী বিবাহ করেন, তাহলে তাদের সেই স্ত্রীতে সমুৎপন্ন পুত্রপৌত্রাদির সাথে নিজ নিজ বংশ শীঘ্রই শূদ্রত্ব প্রাপ্ত হয়। (৩/১৫)।

‘শূদ্রাবেদী পতত্যত্রেরুতথ্যতনয়স্য চ।
শৌনকস্য সুতোৎপত্ত্যা তদপত্যতয়া ভৃগোঃ।।’
শূদ্রা স্ত্রী বিবাহ করলেই ব্রাহ্মণাদি পতিত হন,- এটি অত্রি এবং উতথ্যতনয় গৌতম মুনির মত। শৌনকের মতে, শূদ্রা নারীকে বিবাহ করে তাতে সন্তানোৎপাদন করলে ব্রাহ্মণাদি পতিত হয়। ভৃগু বলেন, শূদ্রা স্ত্রীর গর্ভজাত সন্তানের সন্তান হলে ব্রাহ্মণাদি দ্বিজাতি পতিত হয়। [মেধাতিথি ও গোবিন্দরাজের মতে, কেবলমাত্র ব্রাহ্মণের শূদ্রা স্ত্রীর ক্ষেত্রেই এই পাতিত্য বুঝতে হবে। কুল্লুক ভট্টের মতে, ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য- এই তিনজাতির শূদ্রা স্ত্রী সম্বন্ধেই এই পাতিত্য হবে]। (৩/১৬)।

‘শূদ্রাং শয়নমারোপ্য ব্রাহ্মণো যাত্যধোগতিম্।
জনয়িত্বা সুতং তস্যাং ব্রাহ্মণ্যাদেব হীয়তে।।’
সবর্ণা স্ত্রী বিবাহ না করে শূদ্রা নারীকে প্রথমে বিবাহ করে নিজ শয্যায় গ্রহণ করলে ব্রাহ্মণ অধোগতি (নরক) প্রাপ্ত হন; আবার সেই স্ত্রীতে সন্তানোৎপাদন করলে তিনি ব্রাহ্মণত্ব থেকে ভ্রষ্ট হয়ে পড়েন [অতএব সমানজাতীয়া নারী বিবাহ না করে দৈবাৎ শূদ্রা বিবাহ করলেও তাতে সন্তান উৎপাদন করা ব্রাহ্মণের উচিত নয়]। (৩/১৭)।

‘দৈবপিত্যাতিথেয়ানি তৎপ্রধানানি যস্য তু।
নাশ্লন্তি পিতৃদেবাস্তং ন চ স্বর্গং স গচ্ছতি।।’
শূদ্রা ভার্যা গ্রহণের পর যদি ব্রাহ্মণের দৈবকর্ম (যথা, দর্শপূর্ণমাস যজ্ঞ প্রভৃতি এবং দেবতার উদ্দেশ্যে যে ব্রাহ্মণভোজনাদি হয়, তা), পিত্র্যকর্ম (পিতৃপুরুষের প্রতি করণীয় কর্ম, যথা, শ্রাদ্ধ, উদক-তর্পণ প্রভৃতি) এবং আতিথেয় কর্ম (যেমন, অতিথির পরিচর্যা, অতিথিকে ভোজন দান প্রভৃতি) প্রভৃতিতে শূদ্রা ভার্যার প্রাধান্য থাকে অর্থাৎ ঐ কর্মগুলি যদি শূদ্রা স্ত্রীকর্তৃক বিশেষরূপে সম্পন্ন হয়, তাহলে সেই দ্রব্য পিতৃপুরুষগণ এবং দেবতাগণ ভক্ষণ করেন না এবং সেই গৃহস্থ ঐ সব দেবকর্মাদির ফলে স্বর্গেও যান না (অর্থাৎ সেই সব কর্মানুষ্ঠান নিষ্ফল হয়)। (৩/১৮)।

‘ব্রাহ্মো দৈবস্তথৈবার্যঃ প্রাজাপত্যস্তথাসুরঃ।
গান্ধর্বো রাক্ষসশ্চৈব পৈশাচশ্চাষ্টমোহধমঃ।।’
ব্রাহ্ম, দৈব, আর্য, প্রাজাপত্য, আসুর, গান্ধর্ব, রাক্ষস ও সর্বাপেক্ষা নিকৃষ্ট (নিন্দিত) পৈশাচ- বিবাহ এই আটরকমের। (৩/২১)।

‘ষড়ানুপূর্ব্যা বিপ্রস্য ক্ষত্রস্য চতুরোহবরান্।
বিট্শূদ্রয়োস্তু তানেব বিদ্যাদ্ধর্ম্যানরাক্ষসান্।।’
(প্রথম থেকে) ক্রমানুসারে ছয়-প্রকার বিবাহ (ব্রাহ্ম, দৈব, আর্য, প্রাজাপত্য, আসুর, গান্ধর্ব) ব্রাহ্মণের পক্ষে ধর্মজনক (অতএব বিহিত); শেষ দিকের চারটি বিবাহ (আসুর, গান্ধর্ব, রাক্ষস ও পৈশাচ) ক্ষত্রিয়ের পক্ষে বিহিত; এবং রাক্ষস ভিন্ন শেষের বাকী তিনটি বিবাহ (আসুর, গান্ধর্ব ও পৈশাচ) বৈশ্য ও শূদ্রের পক্ষে বিহিত বলে জানবে। (৩/২৩)।

‘আচ্ছাদ্য চার্চয়িত্বা চ শ্রুতিশীলবতে স্বয়ম্।
আহূয় দানং কন্যায়া ব্রাহ্মো ধর্মঃ প্রকীর্তিতঃ।।’
শাস্ত্রজ্ঞান ও সদাচার সম্পন্ন পাত্রকে (কন্যার পিতা) স্বয়ং আহ্বান করে (অর্থাৎ বরের দ্বারা ঐ পিতা প্রার্থিত না হয়ে) নিজের কাছে আনিয়ে বর ও কন্যাকে (দেশ অনুসারে যথাসম্ভব যথাযোগ্য) বস্ত্রদ্বারা আচ্ছাদিত করে এবং অলঙ্কারাদির দ্বারা অর্চনা করে (অর্থাৎ বিশেষ প্রীতি ও বিশেষ সমাদর দেখিয়ে) ঐ বরের হাতে কন্যাকে যে সম্প্রদান করা হয়, তাকে ব্রাহ্মবিবাহরূপ ধর্মব্যবস্থা বলা হয়। [ব্রাহ্মবিবাহ সর্বোৎকৃষ্ট; এই বিবাহে যে কন্যাদান করা হয়, তাতে কোনও শর্ত বা স্বার্থ থাকে না]। (৩/২৭)।

‘যজ্ঞে তু বিততে সম্যগৃত্বিজে কর্ম কুর্বতে।
অলংকৃত্য সুতাদানং দৈবং ধর্মং প্রচক্ষতে।।’
জ্যোতিষ্টোমাদি বিস্তৃত যজ্ঞ আরম্ভ হলে সেই যজ্ঞে পুরোহিতরূপে যজ্ঞকার্যনিষ্পাদনকারী ঋত্বিক-কে যদি সালঙ্কারা কন্যা দান করা হয়, তাহলে এইরকম বিবাহকে মুনিগণ দৈব নামক শাস্ত্রবিহিত বিবাহ বলে থাকেন। [ব্রাহ্মবিবাহে নিঃশর্তভাবে কন্যাদান করা হয়। দৈববিবাহে কন্যাদান করা হয় বটে, কিন্তু যজ্ঞকর্মে নিযুক্ত ঋত্বিকের কাছ থেকে পূণ্যফল লাভের সম্ভাবনা থাকায় এই কন্যাদানটিকে একেবারে শুদ্ধদানের পর্যায়ে ফেলা যায় না]। (৩/২৮)।

‘একং গোমিথুনং দ্বে বা বরাদাদায় ধর্মতঃ।
কন্যাপ্রদানং বিধিবদার্ষো ধর্মঃ স উচ্যতে।।’
ধর্মশাস্ত্রের বিধান-অনুসারে বরের কাছ থেকে এক জোড়া, বা দুই জোড়া গোমিথুন (অর্থাৎ একটি গাভী ও একটি বলদ) গ্রহণ করে ঐ বরকে যথাবিধি কন্যাসম্প্রদান ধর্মানুসারে আর্য-বিবাহ নামে অভিহিত হয়। [এখানে বরের কাছ থেকে গোমিথুন-দানগ্রহণ একটি ধর্মীয় ব্যাপার। তাই এটি কন্যার শুল্ক বা বিনিময় মূল্যস্বরূপ নয়। কাজেই এখানে কন্যা-বিক্রয় করা হচ্ছে এমন মনে করা উচিত নয়। টিকাকার মেধাতিথির মতে, এখানে অল্পই হোক, বা বেশিই হোক, কোনও ঋণপরিশোধের ব্যাপার নেই]। (৩/২৯)।

‘সহোভৌ চরতাং ধর্মমিতি বাচানুভাষ্য চ।
কন্যাপ্রদানমভ্যর্চ্য প্রাজাপত্যো বিধিঃ স্মৃতঃ।।’
‘তোমরা দুইজনে মিলে একসঙ্গে গার্হস্থ্যধর্মের অনুষ্ঠান কর’- বরের সাথে এইরকম চুক্তি করে এবং তার কাছ থেকে প্রতিশ্রুতিরূপে স্বীকৃতি আদায় করে, অলঙ্কারাদির দ্বারা বরকে অর্চনাপূর্বক কন্যাসম্প্রদান প্রাজাপত্যবিবাহ নামে স্মৃতিমধ্যে অভিহিত হয়েছে। [সম্ভবতঃ এই বিবাহে বর নিজে থেকে প্রার্থী হয়ে উপস্থিত হন। প্রাজাপত্যবিবাহে যে কন্যাদান করা হয়, সে দান শুদ্ধ নয়, কারণ এখানে দানের শর্ত আরোপ করা হয়]। (৩/৩০)।

‘জ্ঞাতিভ্যো দ্রবিণং দত্ত্বা কন্যায়ৈ চৈব শক্তিতঃ।
কন্যাপ্রদানং স্বাচ্ছন্দ্যাদাসুরো ধর্ম উচ্যতে।।’
কন্যার পিতা প্রভৃতি আত্মীয়স্বজনকে নিজের ইচ্ছা অনুযায়ী (কিন্তু শাস্ত্র-নির্দেশ অনুসারে নয়) এবং যথাশক্তি অর্থ দিয়ে এবং কন্যাটিকেও স্ত্রীধন দিয়ে যে কন্যর ‘আ-প্রদান’ অর্থাৎ কন্যাগ্রহণ করা হয়, তা আসুরবিবাহ নামে অভিহিত হয়ে থাকে। [আসুর-বিবাহের ক্ষেত্রে লক্ষ্যণীয় যে, এই বিবাহে স্বেচ্ছানুসারে ধন দিয়ে অর্থের জোরে কন্যা গ্রহণ বা ক্রয় করা হয়, কিন্তু শাস্ত্রের নির্দেশ অনুসারে নয়। এখানেই আর্য-বিবাহ থেকে আসুর-বিবাহের পার্থক্য। আর্যবিবাহে যেমন গোমিথুন নির্দিষ্ট করা হয়, আসুর বিবাহে তেমন হয় না। এখানে বর কন্যার রূপ ও গুণে আকৃষ্ট হয়ে এবং স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে তার সামর্থ অনুযায়ী কন্যার মূল্যস্বরূপ অনির্দিষ্ট পরিমাণ শুল্ক বা অর্থের বিনিময়ে কন্যা গ্রহণ বা সংগ্রহ করা হয়]। (৩/৩১)।

‘ইচ্ছয়ান্যোন্যসংযোগঃ কন্যায়াশ্চ বরস্য চ।
গান্ধর্বঃ স তু বিজ্ঞেয়ো মৈথুন্যঃ কামসম্ভবঃ।।’
কন্যা ও বর উভয়ের ইচ্ছাবশতঃ (অর্থাৎ প্রেম বা অনুরাগবশতঃ) যে পরস্পর সংযোগ (কোনও একটি জায়গায় সঙ্গমন বা মিলন) তা গান্ধর্ব-বিবাহ; এই বিবাহ মৈথুনার্থক অর্থাৎ পরস্পরের মিলন বাসনা থেকে সম্ভূত এবং কামই তার প্রযোজক বা কারণস্বরূপ। (৩/৩২)।

‘হত্বা চ্ছিত্ত্বা চ ভিত্ত্বা চ ক্রোশন্তীং রুদতীং গৃহাৎ।
প্রসহ্য কন্যাহরণং রাক্ষসো বিধিরুচ্যতে।।’
বাধাপ্রদানকারী কন্যাপক্ষীয়গণকে (আহত) নিহত করে, (অঙ্গ) প্রত্যঙ্গ ছেদন করে এবং গৃহ প্রাচীর প্রভৃতি ভেদ করে যদি কেউ চীৎকারপরায়ণা ও ক্রন্দনরতা কন্যাকে গৃহ থেকে বলপূর্বক অপহরণ করে, তবে একে রাক্ষস-বিবাহ বলা হয়। (৩/৩৩)।

‘সুপ্তাং মত্তাং প্রমত্তাং বা রহো যত্রোপগচ্ছতি।
স পাপিষ্ঠো বিবাহানাং পৈশাচশ্চাষ্টমোহধমঃ।।’
নিদ্রাভিভূতা, মদ্যপানের ফলে বিহ্বলা, বা রোগাদির দ্বারা উন্মত্তা কন্যার সাথে যদি গোপনে (বা প্রকাশ্যে) সম্ভোগ করা হয়, তাহলে তা পৈশাচ-বিবাহ নামে অভিহিত হবে; আটরকমের বিবাহের মধ্যে এই অষ্টম বিবাহটি পাপজনক ও সকল বিবাহ থেকে নিকৃষ্ট (এই বিবাহ থেকে ধর্মাপত্য অর্থাৎ ধর্মজ-পুত্র জন্মে না)। [পৈশাচবিবাহে মিথ্যা বা ছল আশ্রয় করে গোপনে কন্যা সংগ্রহ করা হয় বলে এ বিবাহ খুবই নিন্দিত। তবে টিকাকারদের অভিমত এই যে, পরে হোমসংস্কারের দ্বারা ঐ নিন্দনীয় সকল বিবাহেরই স্বীকৃতি দেয়া হয়]। (৩/৩৪)।

‘যত্র নার্য্যস্তু পূজ্যন্তে রমন্তে তত্র দেবতাঃ।
যত্রৈতাস্তু ন পূজ্যন্তে সর্বাস্তত্রাফলাঃ ক্রিয়াঃ।।’
যে বংশে স্ত্রীলোকেরা বস্ত্রালঙ্কারাদির দ্বারা পূজা বা সমাদর প্রাপ্ত হন, সেখানে দেবতারা প্রসন্ন থাকেন (আর প্রসন্ন হয়ে তাঁরা পরিবারের সকলকে অভীষ্ট ফল প্রদান করেন), আর যে বংশে স্ত্রীলোকদের সমাদর নেই, সেখানে (যাগ, হোম, দেবতার আরাধনা প্রভৃতি) সমস্ত ক্রিয়াই নিষ্ফল হয়ে যায়। (৩/৫৬)।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *