১ম অধ্যায় – সৃষ্টিরহস্য-বিজ্ঞানপ্রকরণ

মনুসংহিতা
প্রথম অধ্যায়
সৃষ্টিরহস্য-বিজ্ঞানপ্রকরণ

০১. সৃষ্টি জিজ্ঞাসা

মনুমেকাগ্রমাসীনমভিগম্য মহর্ষযঃ ।
প্রতিপূজ্য যথান্যাযমিদং বচনমব্রুবন্ ।।১
ভগবান মনু ঈশ্বরে একান্ত মনঃসমাধান করিয়া আসনে সমাসীন রহিয়াছেন, এমন সময়ে ধর্ম্মজিজ্ঞাসু মহর্ষিগণ সন্নিধানে সমাগত হইয়া বিধিমত পূজা-বন্দনাদি করত তাঁহাকে এই কথা জিজ্ঞাসা করিলেন। ১
The great sages approached Manu, who was seated with a collected mind, and, having duly worshipped him, spoke as follows:

ভগবন্ সর্ববর্ণানাং যথাবদনুপূর্বশঃ ।
অন্তরপ্রভবানাং চ ধর্মান্নো বক্তুমর্হসি ।। ২
হে ভগবন্‌! ব্রাহ্মণাদি বর্ণ সকলের ও অম্বষ্ঠ, করণ, ক্ষত্রিয় (ক্ষত্তা) প্রভৃতি অনুলোম-প্রতিলোমজাত সঙ্করজাতির* পৃথক পৃথকরূপে ধর্ম্মসকল আমাদিগকে বলুন।২
(* উচ্চবর্ণ পুরুষের ঔরসে নীচবর্ণা স্ত্রীর গর্ভে সন্তানের নাম অনুলোমজাত আর নীচবর্ণ পুরুষের ঔরসে উচ্চবর্ণা স্ত্রীর গর্ভজাত সন্তানের নাম প্রতিলোমজাত।)
‘Deign, divine one, to declare to us precisely and in due order the sacred laws of each of the (four chief) castes (varna) and of the intermediate ones.

ত্বমেকো হ্যস্য সর্বস্য বিধানস্য স্বযংভুবঃ ।
অচিন্ত্যস্যাপ্রমেযস্য কার্যতত্ত্বার্থবিত্ প্রভো ।।৩
হে প্রভো! যে বেদ বহুশাখায় বিভক্ত হওয়াতে অসীমরূপে প্রতীয়মান হয়, এবং মীমাংসা, ন্যায় প্রভৃতি শাস্ত্রের সাহায্য ব্যতিরেকে যাহার প্রতিপাদ্য ভাগ বুঝা যায় না, কি প্রত্যক্ষ কি স্মৃত্যাদি শাস্ত্র দ্বারা অনুমেয়* সেই অপৌরুষয় ও নিত্য সমগ্র বেদশাস্ত্রে উল্লিখিত যজ্ঞাদি কার্য্য ও ব্রহ্মতত্ত্বের আপনিই অদ্বিতীয় বেত্তা হয়েন। ৩
(* সাক্ষাৎসম্বন্ধে শ্রুতি না থাকিলেও পণ্ডিতেরা স্মৃত্যাদি শাস্ত্রের উপপত্তি করিবার জন্য শ্রুতির কল্পনা করেন।)
‘For thou, O Lord, alone knowest the purport, (i.e.) the rites, and the knowledge of the soul, (taught) in this whole ordinance of the Self-existent (Svayambhu), which is unknowable and unfathomable.’

স তৈঃ পৃষ্টস্তথা সম্যগমিতোজা মহাত্মভিঃ ।
প্রত্যুবাচার্চ্য তান্ সর্বান্ মহর্ষীংশ্রূযতামিতি ।।৪
অসীমতেজঃসম্পন্ন ভগবান মনু মহানুভব মহর্ষিগণ কর্ত্তৃক উক্ত প্রকারের জিজ্ঞাসিত হইয়া, তাঁহাদিগকে পূজা করিয়া ‘শ্রবণ করুন’ বলিয়া প্রকৃতপ্রস্তাবে উত্তর প্রদান করিলেন। ৪
He, whose power is measureless, being thus asked by the high-minded great sages, duly honoured them, and answered, ‘Listen!’

০২. প্রলয়কালে জাগতিক অবস্থা

‘আসীদিদং তমোভূতমপ্রজ্ঞাতমলক্ষণম্।
অপ্রতর্ক্যমবিজ্ঞেয়ং প্রসুপ্তমিব সর্বতঃ।।’

এই পরিদৃশ্যমান বিশ্বসংসার এককালে (সৃষ্টির পূর্বে) গাঢ় তমসাচ্ছন্ন ছিল; তখনকার অবস্থা প্রত্যক্ষের গোচরীভূত নয়; কোনও লক্ষণার দ্বারা অনুমেয় নয়; তখন ইহা তর্ক ও জ্ঞানের অতীত ছিল। এই চতুর্বিধ প্রমাণের অগোচর থাকায় এই জগৎ সর্বতোভাবে যেন প্রগাঢ় নিদ্রায় নিদ্রিত ছিল। (১/৫)।

প্রলয়কালে এই জগৎ এ প্রকারে প্রকৃতিতে লীন ছিল যে, উহা প্রত্যক্ষ, অনুমান ও শব্দ, এই ত্রিবিধ প্রমাণের বিষয় ছিল না; যেন সকল জগৎ নিদ্রিতাবস্থায় ছিল। ৫

This (universe) existed in the shape of Darkness, unperceived, destitute of distinctive marks, unattainable by reasoning, unknowable, wholly immersed, as it were, in deep sleep.

০৩. পঞ্চভূতের স্থূলরূপে প্রকাশ

‘ততঃ স্বয়ম্ভূর্ভগবানব্যক্তো ব্যঞ্জয়ন্নিদম্।
এহাভূতাদিবৃত্তৌজাঃ প্রাদুরাসীৎ তমোনুদঃ।।’

তারপর (প্রলয়ের অবসানে) অব্যক্ত (বাহ্য ইন্দ্রিয়ের অগোচর অর্থাৎ যোগলভ্য) বৃত্তৌজাঃ (অপ্রতিহত সৃষ্টিসামর্থ্যশালী) ষড়ৈশ্বর্যশালী ভগবান স্বয়ম্ভূ (স্বেচ্ছায় লীলাবিগ্রহকারী পরমাত্মা) তমোনুদ হয়ে অর্থাৎ প্রলয়াবস্থার ধ্বংসক, মতান্তরে প্রকৃতিপ্রেরক হয়ে, এই স্থূল আকাশাদি মহাভূত- যা পূর্বে অপ্রকাশ ছিল- সেই বিশ্বসংসারকে ক্রমে ক্রমে প্রকটিত করে আবির্ভূত হলেন। (১/৬)।

প্রলয়ানন্তর বহিরিন্দ্রিয়ের অগোচর, অব্যাহত সৃষ্টি-সামর্থ্য-সম্পন্ন ও প্রকৃতিপ্রেরক পরমেশ্বর স্বেচ্ছাকৃত-দেহধারী হইয়া এই আকাশাদি পঞ্চ ভূত ঈ মহদাদি তত্ত্ব, যাহা প্রলয়কালে সূক্ষরূপে অব্যক্তাবস্থায় ছিল, সেই সমুদয় স্থূলরূপে প্রকাশ করত আপনিই প্রকাশিত হইলেন। ৬

Then the divine Self-existent (Svayambhu, himself) indiscernible, (but) making (all) this, the great elements and the rest, discernible, appeared with irresistible (creative) power, dispelling the darkness.

০৪. মহদহঙ্কারাদির উৎপত্তি

‘যোহসাবতীন্দ্রিয়গ্রাহ্যঃ সূক্ষ্মোহব্যক্তঃ সনাতনঃ।
সর্বভূতময়োহচিন্ত্যঃ স এব স্বয়মুদ্বভৌ।।’

যিনি মনোমাত্রাগ্রাহ্য, সূক্ষতম, অপ্রকাশ, সনাতন (চিরস্থায়ী), সকল ভূতের আত্মাস্বরূপ অর্থাৎ সর্বভূতে বিরাজমান এবং যিনি চিন্তার বহির্ভূত সেই অচিন্ত্য পুরুষ স্বয়ংই প্রথমে শরীরাকারে (মহৎ প্রভৃতিরূপে) প্রাদুর্ভূত হয়েছিলেন। (১/৭)।

যিনি সকল লোক, বেদ, পুরাণ, ইতিহাসাদিশাস্ত্র প্রসিদ্ধ, যিনি মনোমাত্র-গ্রাহ্য, অবয়ববিহীন, নিত্য ও সকল ভূতের অন্তরাত্মা হয়েন, এবং যাঁহার ইয়ত্তা করা যায় না, তিনি স্বয়ংই মহদহঙ্কারাদি কার্যরূপে প্রাদুর্ভূত হইলেন। ৭

He who can be perceived by the internal organ (alone), who is subtile, indiscernible, and eternal, who contains all created beings and is inconceivable, shone forth of his own (will)

০৫. জল উৎপত্তি

‘সোহভিধ্যায় শরীরাৎ স্বাৎ সিসৃক্ষুর্বিবিধাঃ প্রজাঃ।
অপ এব সসর্জাদৌ তাসু বীজমবাসৃজৎ।।’

সেই পরমাত্মা স্বকীয় অব্যাকৃত (unmanifested) শরীর হতে বিবিধ প্রজা সৃষ্টির ইচ্ছা করে চিন্তামাত্র প্রথম জলের সৃষ্টি করলেন এবং তাতে আপন শক্তিবীজ অর্পণ করলেন। (১/৮)।

সেই পরমাত্মা প্রকৃতিরূপে পরিণত আপন শরীর হইতে নানাপ্রকার প্রজা সৃষ্টি করিবার অভিলাষে, কিরূপে সৃষ্টি-সম্পাদন হইবে, এই সঙ্কল্প করিয়া প্রথমতঃ ‘জল হউক’ বলিয়া আকাশাদিক্রমে জলের সৃষ্টি করিলেন ও তাহাতে আপন শক্তিরূপ বীজ অর্পণ করিলেন। ৮

He, desiring to produce beings of many kinds from his own body, first with a thought created the waters, and placed his seed in them.

০৬. ব্রহ্মার শরীর পরিগ্রহ

তদণ্ডমভবদ্ধৈমং সহস্রাংশুসমপ্রভম্ ।
তস্মিঞ্জজ্ঞে স্বযং ব্রহ্মা সর্বলোকপিতামহঃ ।। ৯

অর্পিত বীজ সুবর্ণ-নির্ম্মিতের ন্যায় ও সূর্য্যসদৃশপ্রভাযুক্ত একটি অণ্ড হইল, ঐ অণ্ডে সকল লোকের জনক স্বয়ং ব্রহ্মাই শরীর পরিগ্রহ করিলেন। ৯

That (seed) became a golden egg, in brilliancy equal to the sun; in that (egg) he himself was born as Brahman, the progenitor of the whole world.

আপো নারা ইতি প্রোক্তা আপো বৈ নরসূনবঃ ।
তা যদস্যাযনং পূর্বং তেন নারাযণঃ স্মৃতঃ ।। ১০

নরনামক পরমেশ্বরের দেহ হইতে জলের সৃষ্টি হইয়াছে বলিয়া উহাকে নার বলা যায়। যেহেতু, ঐ জলসকল প্রলয়কালে পরমাত্মার অয়ন অর্থাৎ স্থান হয়, এই জন্য পরমাত্মা নারায়ণ শব্দে কথিত হইয়াছে। ১০

The waters are called narah, (for) the waters are, indeed, the offspring of Nara; as they were his first residence (ayana), he thence is named Narayana.

০৮. ব্রহ্মানামে বিখ্যাত

যত্ তত্ কারণমব্যক্তং নিত্যং সদসদাত্মকম্ ।
তদ্বিসৃষ্টঃ স পুরুষো লোকে ব্রহ্মৈতি কীর্ত্যতে ।। ১১

যে পরমাত্মা সৃষ্টি বস্তুমাত্রেরই কারণ, যিনি ইন্দ্রিয়ের অগোচর, যাঁহারা ক্ষয়োদয় নাই, যিনি সৎপদের প্রতিপাদ্য, এবং যিনি প্রত্যক্ষের বিষয় নহেন বলিয়া অসৎশব্দেও কথিত হইয়াছেন, সেই পরম পুরুষ পরমেশ্বের হইতে উৎপন্ন এই অণ্ডজাত পুরুষ লোকে ব্রহ্মা বলিয়া বিখ্যাত হইয়াছেন। ১১

From that (first) cause, which is indiscernible, eternal, and both real and unreal, was produced that male (Purusha), who is famed in this world (under the appellation of) Brahman.

০৯. পৃথিবী এবং আকাশাদি সৃষ্টি

তস্মিন্নণ্ডে স ভগবানুষিত্বা পরিবত্সরম্ ।
স্বযমেবাত্মনো ধ্যানাত্ তদণ্ডমকরোদ্ দ্বিধা ।। ১২

ভগবান্‌ ব্রহ্মা সেই অণ্ডে ব্রাহ্ম পরিমাণে এক বৎসরকালে বাস করিয়া, অণ্ড দ্বিধা হউক মনে হইবামাত্র স্বয়ং সেই অণ্ডকে দুই খণ্ড করিলেন। ১২

The divine one resided in that egg during a whole year, then he himself by his thought (alone) divided it into two halves;

তাভ্যাং স শকলাভ্যাং চ দিবং ভূমিং চ নির্মমে ।
মধ্যে ব্যোম দিশশ্চাষ্টাবপাং স্থানং চ শাশ্বতম্ ।। ১৩

তিনি সেই দুই খণ্ডের উর্দ্ধ খণ্ডে স্বর্গ ও অপর খণ্ডে পৃথিবী করিলেন, এবং মধ্যভাগে আকাশ, অষ্ট দিক্‌ ও চিরস্থায়ী সমুদ্রনামক জলাধার প্রস্তুত করিলেন। ১৩

And out of those two halves he formed heaven and earth, between them the middle sphere, the eight points of the horizon, and the eternal abode of the waters.

১০. অহং ও মনঃসৃষ্টি

উদ্ববর্হাত্মনশ্চৈব মনঃ সদসদাত্মকম্ ।
মনসশ্চাপ্যহঙ্কারমভিমন্তারমীশ্বরম্ ।। ১৪

ব্রহ্মা পরমাত্মা হইতে পরমাত্মার স্বরূপ হইয়া মনের সৃষ্টি করিলেন, যে মন এক এক সময় এক এক প্রকার জ্ঞানের আধার বলিয়া সৎস্বরূপ, ও প্রত্যক্ষ হয় না বলিয়া অসৎস্বভাব। মনের সৃষ্টির পূর্ব্বে অভিমানের জনক ও স্বকার্য্যসাধনক্ষম অহং অর্থাৎ আমিত্ব-বোধক অহঙ্কারতত্বের সৃষ্টি করিলেন। ১৪

From himself (atmanah) he also drew forth the mind, which is both real and unreal, likewise from the mind egoism, which possesses the function of self-consciousness (and is) lordly;

১১. মহত্তত্ত্ব, অহঙ্কারতত্ত্ব, ত্রিতত্ত্ব, পঞ্চগুণ, পঞ্চজ্ঞানেন্দ্রিয় ও পঞ্চকর্ম্মেন্দ্রিয় সৃষ্টি

মহান্তমেব চাত্মানং সর্বাণি ত্রিগুণানি চ ।
বিষযাণাং গ্রহীতৄণি শনৈঃ পঞ্চৈন্দ্রিযাণি চ ।। ১৫

ব্রহ্মা অহঙ্কারতত্ত্বের সৃষ্টির পূর্ব্বে পরমেশ্বর হইতে মহত্তত্ত্বের সৃষ্টি করিলেন, যে মহত্তত্ব আত্মা হইতে উৎপন্ন বলিয়া আত্মশব্দে কথিত হইয়াছে। আর সত্ত্বরস্তমোগুণযুক্ত অন্য পাদার্থ সকল সৃষ্টি করিলেন, এবং শব্দ স্পর্শ রূপ রস গন্ধের গ্রাহক শ্রোত্র, ত্বক্‌, চক্ষু, জিহ্বা, নাসিকা এই পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয় ও বাক্‌, পাদ, হস্ত, গুহ্য, উপস্থ এই পঞ্চ কর্ম্মেন্দ্রিয় সৃষ্টি করিলেন। ১৫

Moreover, the great one, the soul, and all (products) affected by the three qualities, and, in their order, the five organs which perceive the objects of sensation.

১২. মনুষ্য পশুপক্ষী প্রভৃতি ভূতসৃষ্টি

তেষাং ত্ববযবান্ সূক্ষ্মান্ ষণ্ণামপ্যমিতৌজসাম্ ।
সংনিবেশ্যাত্মমাত্রাসু সর্বভূতানি নির্মমে ।।১৬

অসীম কার্য্যনির্ম্মাণে সমর্থ অহঙ্কার ও তন্মাত্র-পদ-বাচ্য পঞ্চভূত। অহঙ্কারের বিকার ইন্দ্রিয়, তন্মাতর বিকার পঞ্চমহাভূত, তাহাতে তন্মাত্র ও অহঙ্কারের যোজনা করিয়া, মনুষ্য পশু পক্ষী স্থাবর প্রভৃতি সমুদয় ভূতের সৃষ্টি করিলেন। ১৬

But, joining minute particles even of those six, which possess measureless power, with particles of himself, he created all beings.

১৩. ব্রহ্মমূর্ত্তিই শরীর

যন্ মূর্ত্যবযবাঃ সূক্ষ্মাস্তানীমান্যাশ্রযন্তি ষট্ ।
তস্মাচ্ছরীরমিত্যাহুস্তস্য মূর্তিং মনীষিণঃ ।।১৭

যেহেতু মূর্ত্তিসম্পাদক পাঁচটি তন্মাত্র-পদ-বাচ্য সূক্ষ্ম অবয়ব ও অহঙ্কার এই ছয় প্রকৃতির সহিত বর্ত্তমান ব্রহ্মের কার্যরূপে শরীরকে আশ্রয় করে, কেন না, তন্মাত্র হইতে পঞ্চ মহাভূত ও অহঙ্কার হইতে ইন্দ্রিয়ের উৎপত্তি হয়, এই হেতু পণ্ডিতেরা ছয়ের আশ্রয় বলিয়ে ইন্দ্রিয়াদিবিশিষ্ট ব্রহ্মের মূর্ত্তিকে শরীর কহিয়াছেন। ১৭

Because those six (kinds of) minute particles, which form the (creator’s) frame, enter (a-sri) these (creatures), therefore the wise call his frame sarira, (the body.)

১৪. আকাশাদি পঞ্চভূতের অর্থ বিভাগ

তদাবিশন্তি ভূতানি মহান্তি সহ কর্মভিঃ ।
মনশ্চাবযবৈঃ সূক্ষ্মৈঃ সর্বভূতকৃদব্যযম্ ।।১৮

শব্দাদি পঞ্চতন্মাত্রাত্মক ব্রহ্ম হইতে আকাশাদি পঞ্চ মহাভূত আপন আপন কার্য্যের সহিত উৎপন্ন হয়। আকাশের কর্ম্ম স্থানদান, বায়ুর কর্ম্ম বিন্যাস, তেজের কর্ম্ম পাক, জলের কর্ম্ম পিণ্ডীকরণ ও পৃথিবীর কর্ম্ম ধারণ। আর অহঙ্কারাত্মক ব্রহ্ম হইতে সকল ভূতের উৎপত্তির কারণ অবিনাশী মন উৎপন্ন হয়, যে মন শুভাশুভ সঙ্কল্প ও সুখদুঃখাদি কার্য্যের সহকৃত জনক হয়। ১৮

That the great elements enter, together with their functions and the mind, through its minute parts the framer of all beings, the imperishable one.

১৫. পুরুষ ও জগতের উৎপত্তি

তেষামিদং তু সপ্তানাং পুরুষাণাং মহৌজসাম্ ।
সূক্ষ্মাভ্যো মূর্তিমাত্রাভ্যঃ সংভবত্যব্যযাদ্ ব্যযম্ ।।১৯

মহত্তত্ত্ব, অহঙ্কারতত্ত্ব ও পঞ্চ মহাভূত এই সাতটি পরমপুরুষ পরমাত্মা হইতে উৎপন্ন বলিয়া উঁহাদিগকে পুরুষ বলে। উহাদিগের শরীরসম্পাদক যে সূক্ষ্ম অবয়ব, তাহা হইতে এই প্রত্যক্ষ পরিদৃশ্যমান জগতের উৎপত্তি হয়, যে জন্য জগৎ বলিয়া নশ্বর। ১৯

But from minute body (-framing) particles of these seven very powerful Purushas springs this (world), the perishable from the imperishable.

১৬. আকাশাদির গুণ

আদ্যাদ্যস্য গুণং ত্বেষামবাপ্নোতি পরঃ পরঃ ।
যো যো যাবতিথশ্চৈষাং স স তাবদ্ গুণঃ স্মৃতঃ ।।২০

আকাশের গুণ শব্দ, বায়ুর গুণ স্পর্শ, অগ্নির গুণ রূপ, জলের গুণ রস, পৃথিবীর গুণ গন্ধ। প্রথম ভিন্ন প্রত্যেকে স্ব স্ব গুণাতিরিক্ত পূর্ব্ব পূর্ব্বের গুণ গ্রহণ করে; যে যত সংখ্যায় গণিত, তাহার ততই গুণ হয়, অর্থাৎ আকাশের গুণ শব্দ, বায়ুর শব্দ ও স্পর্শ, অগ্নির শব্দ স্পর্শ ও রূপ, জলের শব্দ স্পর্শ রূপ ও রস, পৃথিবীর শব্দ স্পর্শ রূপ রস ও গন্ধ গুণ হয়। ২০

Among them each succeeding (element) acquires the quality of the preceding one, and whatever place (in the sequence) each of them occupies, even so many qualities it is declared to possess.

১৭. মনুষ্যাদির নাম ও কর্ম্মবিভাগ

সর্বেষাং তু স নামানি কর্মাণি চ পৃথক্ পৃথক্ ।
বেদশব্দেভ্য এবাদৌ পৃথক্ সংস্থাশ্চ নির্মমে ।।২১

হিরণ্যগর্ভরূপে অবস্থিত সেই পরমাত্মা সকলের নাম অর্থাৎ মনুষ্যজাতির মনুষ্য, গোজাতির গো ইত্যাদি ও ব্রাহ্মণাদি চাতুবর্ণের বেদোক্ত অধ্যয়নাদি কর্ম্ম, এবং অন্যান্য জাতির লৌকিক কর্ম্ম, অর্থাৎ কুলালের ঘটনির্ম্মাণ, কুবিন্দের পটনির্ম্মাণ ইত্যাদি, প্রথমতঃ বেদশাস্ত্র হইতে অবগত হইয়া, পূর্ব্বকল্পে যাহার যেরূপ ছিল, এ কল্পেও তাহার সেইরূপ নির্দিষ্ট করিয়া দিলেন। ২১

But in the beginning he assigned their several names, actions, and conditions to all (created beings), even according to the words of the Veda.

১৮. দেবগণ ও যজ্ঞাদি সৃষ্টি

কর্মাত্মনাং চ দেবানাং সোঽসৃজত্ প্রাণিনাং প্রভুঃ ।
সাধ্যানাং চ গণং সূক্ষ্মং যজ্ঞং চৈব সনাতনম্ ।।২২

সেই পরমাত্মা প্রাণধারী ইন্দ্রাদি দেবগণ, অপ্রানী কর্ম্মহেতুক পাষাণময় দেবগণ ও সাধ্যনামক সূক্ষ্ম দেবসমূহ এবং জ্যোতিষ্টোমাদি নিত্যযজ্ঞ সকল সৃষ্টি করিলেন। ২২

১৯. বেদোদ্ধার

অগ্নিবাযুরবিভ্যস্তু ত্রযং ব্রহ্ম সনাতনম্ ।
দুদোহ যজ্ঞসিদ্ধ্যর্থং ঋচ্.যজুস্.সামলক্ষণম্ ।।২৩

তিনি যজ্ঞকার্য্যসিদ্ধির নিমিত্ত অগ্নি হইতে সনাতন ঋগবেদ, বায়ু হইতে যজুর্ব্বেদ এবং সূর্য্য হইতে সামবেদ উদ্ভূত করিলেন। ২৩

২০. বৎসরাদি কাল, নক্ষত্র সকল, গ্রহসমূহ ও পর্ব্বতাদি সৃষ্টি

কালং কালবিভক্তীশ্চ নক্ষত্রাণি গ্রহাংস্তথা ।
সরিতঃ সাগরান্ শৈলান্ সমানি বিষমানি চ ।।২৪

ব্রহ্মা সূর্য্যাদির ক্রিয়া-প্রচয়রূপ সামান্য কাল ও মাস, ঋতু, অয়, বৎসরাদি বিশেষ কাল, কৃত্তিকা প্রভৃতি সপ্তবিংশতি নক্ষত্র, আদিত্যাদি গ্রহ সকল, নদী, সমুদ্র, পর্ব্বত, সমস্থান ও উন্নতানত বিষমস্থান সকল সৃষ্টি করিলেন। ২৪

২১. প্রজাপত্যাদি তপস্যা ও চিত্তবিকার প্রভৃতি সৃষ্টি

তপো বাচং রতিং চৈব কামং চ ক্রোধমেব চ ।
সৃষ্টিং সসর্জ চৈবৈমাং স্রষ্টুমিচ্ছন্নিমাঃ প্রজাঃ ।।২৫

তিনি বক্ষ্যমাণ বিবিধ প্রকার প্রজা সৃষ্টি করিবার অভিলাষে প্রথমে প্রাজাপত্যাদি তপস্যা, বাক্য, চিত্তসন্তোষ, অভিলাষ ও নেত্রলৌহিত্যাদির কারণ চিত্তবিকার প্রভৃতি সৃষ্টি করিলেন। ২৫

২২. ধর্ম্মাধর্ম্ম বিভাগ ও তাহার ফল

কর্মণাং চ বিবেকার্থং ধর্মাধর্মৌ ব্যবেচযত্ ।
দ্বন্দ্বৈরযোজযচ্চৈমাঃ সুখদুঃখাদিভিঃ প্রজাঃ ।।২৬

তিনি কর্ত্তব্য ও অকর্ত্তব্য কর্মের বিভাগ জন্য ধর্ম্ম ও অধর্ম্ম পৃথক করিয়া বিভক্ত করিলেন। ধর্ম্মের ফল সুখাদি ও অধর্ম্মের ফল দুঃখাদি, এই সুখদুঃখাদি দ্বারা সমূদয় প্রজাদিগকে সংযুক্ত করিলেন। ২৬

২৩. সূক্ষ্মস্থূলাদি ক্রমে জগৎসৃষ্টি

অণ্ব্যো মাত্রা বিনাশিন্যো দশার্ধানাং তু যাঃ স্মৃতাঃ ।
তাভিঃ সার্ধমিদং সর্বং সংভবত্যনুপূর্বশঃ ।।২৭

পঞ্চ মহাভূতের যে সকল সূক্ষ্ম অংশ এবং স্থূলভাগ, তৎক্রমে অর্থাৎ সূক্ষ্ম হইতে স্থূল, স্থূলভাগ হইতে স্তূলতর ভাগ ইত্যাদি ক্রমে এই জগৎ সৃষ্ট হইল। ২৭

২৪. জীবধর্ম্ম

যং তু কর্মণি যস্মিন্ স ন্যযুঙ্ক্ত প্রথমং প্রভুঃ ।
স তদেব স্বযং ভেজে সৃজ্যমানঃ পুনঃ পুনঃ ।।২৮

প্রজাপতি ব্রহ্মা সৃষ্টিকালে যে জাতিকে যাদৃশ কর্ম্মে,–অর্থাৎ ব্যাঘ্রাদিকে হরিণমারণাদিরূপে নিযুক্ত করিলেন, তাহারা বারংবার সৃষ্ট হইয়াও স্বস্ব কর্ম্মানুসারে সেই সেই কর্ম্মই আচরণ করিতে লাগিল। ২৮

হিংস্রাহিংস্রে মৃদুক্রূরে ধর্মাধর্মাবৃতানৃতে ।
যদ্ যস্য সোঽদধাত্ সর্গে তত্ তস্য স্বযমাবিশত্ ।।২৯

পূর্ব্ববচনের উদাহরণ। সিংহাদির হিংসা, হরিণাদির অহিংসা, ব্রাহ্মণাদির দয়া, ক্ষত্রিয়াদির যুদ্ধাদি, ব্রহ্মচর্য্যাদির গুরুশুশ্রুষাদি ধর্ম্ম ও মাংসমৈথুনসেবাদি অধর্ম্ম, সত্য ও অসত্য ইত্যাদি প্রজাপতি সৃষ্টিকালে যাহার যাহা বিধান করিলেন, উত্তরকালেও সকলে অদৃষ্টবলে তাহাই প্রাপ্ত হইল। ২৯

২৫. স্বস্ব কর্ম্মপ্রাপ্তি

যথর্তুলিঙ্গান্যর্তবঃ স্বযমেবর্তুপর্যযে ।
স্বানি স্বান্যভিপদ্যন্তে তথা কর্মাণি দেহিনঃ ।।৩০

যেমন বসন্তাদি ঋতু আপন আপন অধিকারকালে চুতমঞ্জরী প্রভৃতি আপন আপন চিহ্ন ধারণ করিয়া থাকে, সেইরূপ শরীরধারী পুরুষেরাও আপন আপন কর্ম্ম প্রাপ্ত হইয়া থাকে। ৩০

২৬. ব্রাহ্মণাদি চারিবর্ণ সৃষ্টি

লোকানাং তু বিবৃদ্ধ্যর্থং মুখবাহূরুপাদতঃ ।
ব্রাহ্মণং ক্ষত্রিযং বৈশ্যং শূদ্রং চ নিরবর্তযত্ ।।৩১

সৃষ্টিকর্ত্তা পরমেশ্বর ভূলোকাদি প্রজা বৃদ্ধি করিবার মানসে আপন মুখ, বাহু, উরু ও পদ হইতে ক্রমে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র এই চারি বর্ণের সৃষ্টি করিলেন, অর্থাৎ মুখ হইতে ব্রাহ্মণ, বাহু হইতে ক্ষত্রিয়, উরু হইতে বৈশ্য ও পদ হইতে শূদ্রের সৃষ্টি করিলেন। ৩১

২৭. পুরুষ্ম নারী ও বিরাট্‌ উৎপত্তি

দ্বিধা কৃত্বাঽত্মনো দেহমর্ধেন পুরুষোঽভবত্ ।
অর্ধেন নারী তস্যাং স বিরাজমসৃজত্ প্রভুঃ ।।৩২

সৃষ্টিকর্ত্তা জগদীশ্বর আপন শরীরকে দুই খণ্ড করিয়া অর্দ্ধাংশে পুরুষ ও অর্দ্ধাংশে নারী হইলেন। ঐ উভয়ের পরস্পর সংযোগে বিরাট্‌-নামক পুরুষ উৎপন্ন হইল। ৩২

২৮. মনুর আবির্ভাব

তপস্তপ্ত্বাঽসৃজদ্ যং তু স স্বযং পুরুষো বিরাট্ ।
তং মাং বিত্তাস্য সর্বস্য স্রষ্টারং দ্বিজসত্তমাঃ ।।৩৩

হে দ্বিজসত্তম! সেই বিরাট পুরুষ বহুকাল তপস্যা করিয়া যাহাকে সৃষ্টি করিলেন, আমি সে মনু, আমাকে সৃষ্টিকর্ত্তা বলিয়া অবগত হও। ৩৩

২৯. দশ প্রজাপতি সৃষ্টি

অহং প্রজাঃ সিসৃক্ষুস্তু তপস্তপ্ত্বা সুদুশ্চরম্ ।
পতীন্ প্রজানামসৃজং মহর্ষীনাদিতো দশ ।।৩৪

অনন্তর আমি প্রজা সৃষ্টি করিবার অভিলাষে বহুকাল অতি কঠোর তপস্যা করিয়া প্রথমতঃ প্রজা সৃজনে সমর্থ দশ জন প্রজাপতির সৃষ্টি করিলাম। ৩৪

৩০. দশ প্রজাপতির নাম

মরীচিমত্র্যঙ্গিরসৌ পুলস্ত্যং পুলহং ক্রতুম্ ।
প্রচেতসং বসিষ্ঠং চ ভৃগুং নারদমেব চ ।।৩৫

আমি মরীচি, অত্রি, অঙ্গিরা, পুলস্ত্য, পুলহ, ক্রুতু, প্রচেতা, বশিষ্ঠ, ভৃগু ও নারদ পূর্ব্বোক্ত এই দশ জন প্রজাপতির সৃষ্টি করিলাম। ৩৫

৩১. সপ্তমনু পূর্ব্বাসৃষ্ট দেবতা, দেবতার বাসস্থান ও মহর্ষি সৃষ্টি

এতে মনূংস্তু সপ্তান্ যানসৃজন্ ভূরিতেজসঃ ।
দেবান্ দেবনিকাযাংশ্চ মহর্ষীংশ্চামিতোজসঃ ।।৩৬

এই মারীচ্যাদি দশ প্রজাপতি মহাতেজস্বী অপর সপ্ত মনু সৃষ্টি করিলেন এবং যে দেবতাদিগকে ব্রহ্মা পূর্ব্বে সৃষ্টি করেন নাই, এমন দেবতা ও দেবতাদিগের বাসস্থান এবং কতিপয় মহর্ষির সৃষ্টি করিলেন। ৩৬

৩২. যক্ষ রাক্ষস প্রভৃতি, সর্পাদি, গরুড়াদি পক্ষিগণ, আজ্যপাদি পিতৃগণ, বিদ্যুৎ প্রভৃতি, এবং নানা প্রকার জ্যোতিঃ সৃষ্টি

যক্ষরক্ষঃ পিশাচাংশ্চ গন্ধর্বাপ্সরসোঽসুরান্ ।
নাগান্ সর্পান্ সুপর্ণাংশ্চ পিতৄণাংশ্চ পৃথগ্গণম্ ।।৩৭

ইঁহারা যক্ষ, রাক্ষস, পিশাচ, গন্ধর্ব্ব, অপ্সরা, অসুর, অজগরাদি নাগ ও সর্প, গরুড়াদি পক্ষিগণ, আজ্যপাদি-নামক পিতৃগণকে পৃথক পৃথকরূপে সৃষ্টি করিলেন। ৩৭

৩৩. জন্তু সৃষ্টি

কিন্নরান্ বানরান্ মত্স্যান্ বিবিধাংশ্চ বিহঙ্গমান্ ।
পশূন্ মৃগান্ মনুষ্যাংশ্চ ব্যালাংশ্চোভযতোদতঃ ।।৩৯

কিন্নর, বানর, মৎস্য, নানাপ্রকার পক্ষী, গবাদি পশু, নানাপ্রকার মৃগ, মনুষ্য ও দুই পঙ্‌ক্তি দন্তবিশিষ্ট অশ্বাদি জন্তু এবং সিংহাদি হিংস্র জন্ত সকল সৃষ্টি করিলেন। ৩৯

কৃমিকীটপতঙ্গাংশ্চ যূকামক্ষিকমত্কুণম্ ।
সর্বং চ দংশমশকং স্থাবরং চ পৃথগ্বিধম্ ।।৪০

কৃমি, কীট, শলভ, কেশকীট (উকুন), মক্ষিকা, মৎকুণ (ছারপোকা), দংশ, মশক প্রভৃতি জন্তু ও বৃক্ষলতাদি স্থাবর, পৃথক পৃথকরূপে সৃষ্টি করিলেন। ৪০

৩৪. কর্ম্মানুরূপ দেবমনুষ্যাদি সৃষ্টি

এবমেতৈরিদং সর্বং মন্নিযোগান্ মহাত্মভিঃ ।
যথাকর্ম তপোযোগাত্ সৃষ্টং স্থাবরজঙ্গমম্ ।।৪১

তাঁহারা আমার অনুমতিক্রমে তপোবলে যাহার কর্ম্ম, তদনুরূপ দেব, মনুষ্য, পশু, পক্ষী প্রভৃতি স্বাবর জঙ্গম সমুদয় সৃষ্টি করিলেন। ৪১

৩৫. কর্ম ও জন্মক্রম কথন

যেষাং তু যাদৃশং কর্ম ভূতানামিহ কীর্তিতম্ ।
তত্ তথা বোঽভিধাস্যামি ক্রমযোগং চ জন্মনি ।।৪২

হে মহর্ষিগণ! পূর্ব্বাচার্য্যেরা যে যে জাতির যে-যে প্রকার কর্ম্ম ও যে প্রকারে জন্ম কহিয়াছেন, আমিও ঐরূপ কর্ম্ম ও জন্মক্রম আপনাদিগকে বলিতেছি, শ্রবণ করুন। ৪২

৩৬. জরায়ুজ

পশবশ্চ মৃগাশ্চৈব ব্যালাশ্চোভযতোদতঃ ।
রক্ষাংসি চ পিশাচাশ্চ মনুষ্যাশ্চ জরাযুজাঃ ।।৪৩

পশু, মৃগ, দুই পঙ্‌ক্তি দন্তবিশিষ্ট হিংস্রজন্তু, রাক্ষস, পিশাচ, মনুষ্য ইহারা সকলে জরায়ুনামক গর্ভাবরণ চর্ম্মে প্রাদুর্ভূত হয় ও তাহা হইতে মুক্ত হইয়া ভূমিষ্ঠ হয়। ৪৩

৩৭. অণ্ডজ

অণ্ডজাঃ পক্ষিণঃ সর্পা নক্রা মত্স্যাশ্চ কচ্ছপাঃ ।
যানি চৈবং.প্রকারাণি স্থলজান্যৌদকানি চ ।।৪৪

পক্ষী, সর্প, কুম্ভীর, মৎস্য, কচ্ছপ, স্থলজ কৃকলাসাদি ও জলজাত শঙ্খাদি জন্তু সকল অণ্ডে উৎপন্ন হইয়া তাহা হইতে প্রাদুর্ভূত হয়। ৪৪

৩৮. স্বেদজ

স্বেদজং দংশমশকং যূকামক্ষিকমত্কুণম্ ।
ঊষ্মণশ্চোপজাযন্তে যচ্চান্যত্ কিং চিদীদৃশম্ ।।৪৫

দংশ, মশক, কেশকীট (উকুণ), মক্ষিকা, মৎকুণ (ছারপোকা) ইহারা ক্লেদ হইতে উৎপন্ন হয়, এতদ্ভিন্ন পুত্তিকাপিপীলিকাদিও উম্মা হইতে উৎপন্ন হইয়া থাকে। ৪৫

৩৯. উদ্ভিজ্জ

উদ্ভিজ্জাঃ স্থাবরাঃ সর্বে বীজকাণ্ডপ্ররোহিণঃ ।
ওষধ্যঃ ফলপাকান্তা বহুপুষ্পফলোপগাঃ ।।৪৬

যাহারা বীজ ও ভূমি উদ্ভেদ করিয়া উত্থিত হয়, তাহাদিগকে উদ্ভিজ্জ অর্থাৎ বৃক্ষ বলে। বৃক্ষ দুই প্রকার;–কতকগুলি বীজ হইতে জন্মে, কতকগুলি রোপিতশাখা হইতে উৎপন্ন হইয়া থাকে। যাহারা বিবিধ পুষ্পফলে সুশোভিত হইয়া ফল পরিপক্ক হইলেই বিনাশ পায়, তাহাদিগকে ঔষধি বলা যায়; যেমন ধান্য-যবাদি। ৪৬

৪০. অপুষ্প বৃক্ষ

অপুষ্পাঃ ফলবন্তো যে তে বনস্পতযঃ স্মৃতাঃ ।
পুষ্পিণঃ ফলিনশ্চৈব বৃক্ষাস্তূভযতঃ স্মৃতাঃ ।।৪৭

যাহারা পুষ্পিত না হইয়াই ফলবান হয়, তাহাদিগকে বনস্পতি কহে; আর যাহাদিগের পুষ্প হইতে ফল জন্মে, তাহাদিগকে বৃক্ষ বলে। এইরূপে বৃক্ষ দুই প্রকার বলা যায়। ৪৭

৪১. গুচ্ছ, গুল্ম, প্রতান ও বল্লী

গুচ্ছগুল্মং তু বিবিধং তথৈব তৃণজাতযঃ ।
বীজকাণ্ডরুহাণ্যেব প্রতানা বল্ল্য এব চ ।।৪৮

যাহার মূল হইতে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অনেক লতা উৎপন্ন হয়, তাহাকে গুচ্ছ বলে; যেমন মল্লিকা প্রভৃতি। যাহার এক মূলে অনেক অঙ্কুর জন্মে, তাহাকে গুল্ম বলে; যেমন ইক্ষু, শর প্রভৃতি। উলু প্রভৃতিতে তৃণ বলে। তন্ত্রযুক্ত লতা প্রভৃতিকে প্রতান বলে; যথা–শশা, অলাবু প্রভৃতি; এবং যাহারা ভূমি হইতে বৃক্ষে আরোহণ করে, তাহাদিগকে বল্লী বলে, যেমন গুড়ূচ্যাদি। ইহাদিগের মধ্যে কেহ বীজ হইতে উৎপন্ন হয়, কেহ বা কাণ্ড হইতে জন্মিয়া থাকে। ৪৮

৪২. বৃক্ষাদির চৈতন্য ও সুখ-দুঃখ

তমসা বহুরূপেণ বেষ্টিতাঃ কর্মহেতুনা ।
অন্তস্সংজ্ঞা ভবন্ত্যেতে সুখদুঃখসমন্বিতাঃ ।।৪৯

ইহারা বহুবিধ কর্ম্মফলে তমোগুণে আক্রান্ত হইয়া অবস্থান করে, বহির্ব্যাপার থাকে না, কেবলমাত্র অন্তরে চৈতন্যবিশিষ্ট থাকে। কোন কোন সময়ে ইহাদিগের সুখদুঃখের বিলক্ষণ অনুভব হয়। ৪৯

৪৩. সৃষ্টিবর্ণন সমাপ্তি

এতদন্তাস্তু গতযো ব্রহ্মাদ্যাঃ সমুদাহৃতাঃ ।
ঘোরেঽস্মিন্ ভূতসংসারে নিত্যং সততযাযিনি ।।৫০

এই জন্মমরণসমাকূল অনিত্য অতিভয়ানক সংসারে ব্রহ্মাদি স্থাবর পর্য্যন্ত সমুদয় জীব যেরূপে উৎপন্ন হইয়াছে, তাহা অদ্যোপান্ত বর্ণিত হইল। ৫০

৪৪. প্রজাপতি পরমাত্মাতে অন্তর্হিত

এবং সর্বং স সৃষ্ট্বৈদং মাং চাচিন্ত্যপরাক্রমঃ ।
আত্মন্যন্তর্দধে ভূযঃ কালং কালেন পীডযন্ ।।৫১

হে মহর্ষিগণ! অচিন্ত্যশক্তিসম্পন্ন প্রজাপতি এই প্রকারে স্থাবর জঙ্গম সমুদয় জগৎকে ও আমাকে সৃষ্টি করিয়া প্রলয়কাল দ্বারা সৃষ্টিকালের নাশ করত পরমাত্মাতেই অন্তর্হিত হইলেন। ৫১

৪৫. প্রলয় কথন

যদা স দেবো জাগর্তি তদেবং চেষ্টতে জগত্ ।
যদা স্বপিতি শান্তাত্মা তদা সর্বং নিমীলতি ।।৫২

যখন সেই পরমপুরুষ ব্রহ্মা জাগরিত হয়েন অর্থাৎ সৃষ্টি-স্থিতির ইচ্ছা করেন, তখন এই জগৎ নিশ্বাসপ্রশ্বাসাদি চেষ্টা করে; আর যখন তিনি সৃষ্টির উপসংহারের ইচ্ছা করিয়া নিদ্রিত হয়েন, তখনই এই জগৎ প্রলয় প্রাপ্ত হয়। ৫২

৪৬. প্রজাপতির দেহাদিবিষয়ের ইচ্ছা পরিত্যাগে জীবেরও কর্ম্মনিবৃত্তি

তস্মিন্ স্বপিতি তু স্বস্থে কর্মাত্মানঃ শরীরিণঃ ।
স্বকর্মভ্যো নিবর্তন্তে মনশ্চ গ্লানিমৃচ্ছতি ।।৫৩

প্রজাপতি যখন স্বীয় দেহ ও মনের ব্যাপার রহিত করিয়া সৃষ্টিস্থিতি বিষয়ে ইচ্ছা পরিত্যাগ করেন, তখন স্বস্ব কর্ম্মানুরূপ দেহধারী জীবেরাও দেহধারণাদি কর্ম্ম হইতে নিবৃত্ত হয় এবং মনও বৃত্তিরহিত হইয়া যায়। ৫৩

৪৭. পরমাত্মার সুখশয়ন

যুগপত্ তু প্রলীযন্তে যদা তস্মিন্ মহাত্মনি ।
তদাঽযং সর্বভূতাত্মা সুখং স্বপিতি নির্বৃতঃ ।।৫৪

যখন সেই পরমপুরুষ পরমাত্মাতে সকল ভূত এককালে প্রলয় প্রাপ্ত হয়, তখন তিনি নিশ্চিন্তরূপে পরমসুখে শয়ান হয়েন। ৫৪

৪৮. জীবের দেহান্তরপ্রাপ্তি

তমোঽযং তু সমাশ্রিত্য চিরং তিষ্ঠতি সৈন্দ্রিযঃ ।
ন চ স্বং কুরুতে কর্ম তদোত্ক্রামতি মূর্তিতঃ ।।৫৫

জীব অজ্ঞানদশায় ইন্দ্রিয়ের সহিত বহুকাল অবস্থা করিয়া যখন নিশ্বাসপ্রশ্বাসাদি কোন কর্ম্ম করে না, তখন পূর্ব্বদেহ পরিত্যাগ করিয়া দেহান্তর প্রাপ্ত হয়। ৫৫

৪৯. লিঙ্গশরীর

যদাঽণুমাত্রিকো ভূত্বা বীজং স্থাণু চরিষ্ণু চ ।
সমাবিশতি সংসৃষ্টস্তদা মূর্তিং বিমুঞ্চতি ।।৫৬

সূক্ষ্ম পঞ্চভূত, জ্ঞানেন্দ্রিয়, কর্ম্মেন্দ্রিয়, মন, বুদ্ধি, বাসনা, কর্ম্ম, বায়ু, অজ্ঞান ইহাদিগকে পূর্য্যষ্টক অর্থাৎ লিঙ্গশরীর বলে। যখন জীব এই লিঙ্গশরীরযুক্ত হইয়া স্থাবরবীজে প্রবেশক অরে, তখন বৃক্ষাদি রূপ ধারণ করে; আর যখন জঙ্গমবীজে প্রবেশ করে, তখন মনুষ্যাদি শরীর প্রাপ্ত হয়। ৫৬

৫০. অবস্থাভেদে সৃষ্টি ও সংহার

এবং স জাগ্রত্স্বপ্নাভ্যামিদং সর্বং চরাচরম্ ।
সঞ্জীবযতি চাজস্রং প্রমাপযতি চাব্যযঃ ।।৫৭

এইরূপে সেই অব্যয় পুরুষ ব্রহ্ম আপন জাগরণ ও স্বপ্ন অবস্থা দ্বারা এই স্থাবরজঙ্গমাত্মক জগতের সৃষ্টি এবং সংহার করিতেছেন। ৫৭

৫১. মনুর অধ্যয়ন ও অধ্যাপনা

ইদং শাস্ত্রং তু কৃত্বাঽসৌ মামেব স্বযমাদিতঃ ।
বিধিবদ্ গ্রাহযামাস মরীচ্যাদীংস্ত্বহং মুনীন্ ।।৫৮

হিরণ্যগর্ভ ব্রহ্মা সৃষ্টির প্রথমে এই শাস্ত্র প্রস্তুত করিয়া বিধানক্রমে স্বয়ং আমাকেই অধ্যয়ন করাইয়াছেন, আমি মরীচি প্রভৃতি মুনিগণকে অধ্যয়ন করাইয়াছি। ৫৮

৫২. ভৃগুকে মনুর অনুজ্ঞা

এতদ্ বোঽযং ভৃগুঃ শাস্ত্রং শ্রাবযিষ্যত্যশেষতঃ ।
এতদ্ হি মত্তোঽধিজগে সর্বমেষোঽখিলং মুনিঃ ।।৫৯

ভৃগু এই শাস্ত্র আদ্যোপান্ত তোমাদিগকে শ্রবণ করাইবেন, যেহেতু, তিনি আমার নিকট হইতে এই শাস্ত্র সমস্ত সম্যকরূপ অধ্যয়ন করিয়াছেন। ৫৯

৫৩. ভৃগু কর্ত্তৃক মনু-সংহিতা কথনারম্ভ

ততস্তথা স তেনোক্তো মহর্ষিমনুনা ভৃগুঃ ।
তানব্রবীদ্ ঋষীন্ সর্বান্ প্রীতাত্মা শ্রূযতামিতি ।।৬০

অনন্তর মহর্ষি ভৃগু ভগবান মনু কর্ত্তৃক এই প্রকার অভিহিত হইয়া ‘শ্রবণ করুন’ বলিয়া তাঁহাদিগকে বলিতে লাগিলেন। ৬০

৫৪. স্বায়ম্ভুব মনুর বংশীয় অপর মনুগণের নাম ও বিশ্বসংসার সৃষ্টি

স্বাযংভুবস্যাস্য মনোঃ ষড্বংশ্যা মনবোঽপরে ।
সৃষ্টবন্তঃ প্রজাঃ স্বাঃ স্বা মহাত্মানো মহৌজসঃ ।।৬১

ব্রহ্মার পৌত্র এই স্বায়ম্ভুব মনুর বংশে অপর মহাতেজস্বী মহাত্মা ছয় জন মনু জন্মগ্রহণ করেন, তাঁহারা আপন আপন অধিকারকালে প্রজা সকল উৎপাদন করেন। ৬১

স্বারোচিষশ্চোত্তমশ্চ তামসো রৈবতস্তথা ।
চাক্ষুষশ্চ মহাতেজা বিবস্বত্সুত এব চ ।।৬২

তাঁহাদিগের নাম স্বারোচিষ, ঔত্তমি, তামস, রৈবত, মহাতেজস্বী চাক্ষুষ ও বৈবস্বত। ৬২

স্বাযংভুবাদ্যাঃ সপ্তৈতে মনবো ভূরিতেজসঃ ।
স্বে স্বেঽন্তরে সর্বমিদমুত্পাদ্যাপুশ্চরাচরম্ ।।৬৩

অসীমক্ষমতাসম্পন্ন স্বায়ম্ভুবাদি সপ্ত মনু স্ব স্ব অধিকারকালে এই স্থাবর-জঙ্গম বিশ্বসংসার সৃষ্টি করিয়া প্রতিপালন করেন। ৬৩

৫৫. নিমেষাদি কাল

নিমেষা দশ চাষ্টৌ চ কাষ্ঠা ত্রিংশত্ তু তাঃ কলা ।
ত্রিংশত্ কলা মুহূর্তঃ স্যাদহোরাত্রং তু তাবতঃ ।।৬৪

এক্ষণে মম্বন্তরাদি কালের নিয়ম কহিতেছেন।–চক্ষুর পলকের নাম নিমেষ, অষ্টাদশ নিমেষে এক কাষ্ঠা হয়, ত্রিংশৎ কাষ্ঠায় এক কলা হয়, ত্রিংশৎ কলায় এক মুহূর্ত্ত হয়, ত্রিংশৎ মুহূর্ত্তে এক দিবারাত্রি হয়। ৬৪

৫৬. মনুষ্যের দিবা ও রাত্রি

অহোরাত্রে বিভজতে সূর্যো মানুষদৈবিকে ।
রাত্রিঃ স্বপ্নায ভূতানাং চেষ্টাযৈ কর্মণামহঃ ।।৬৫

দিবাকরের দ্বারা মনুষ্যদিগের ও দেবতাদিগের দিবারাত্রি বিভক্ত হয়। জীবগণের নিদ্রার জন্য রাত্রি ও কর্ম্ম করিবার জন্য দিন নিরূপিত হইল। ৬৫

৫৭. পিতৃলোকের দিবা ও রাত্রি

পিত্র্যে রাত্র্যহনী মাসঃ প্রবিভাগস্তু পক্ষযোঃ ।
কর্মচেষ্টাস্বহঃ কৃষ্ণঃ শুক্লঃ স্বপ্নায শর্বরী ।।৬৬

মনুষ্যদিগের এক মাসে পিতৃলোকের এক দিবারাত্রি হয়, তন্মধ্যে কর্ম্ম করিবার জন্য কৃষ্ণপক্ষকে দিন ও নিদ্রিত থাকিবার জন্য শুক্লপক্ষকে রাত্রি বলে। ৬৬

৫৮. দেবগণের দিবা ও রাত্রি

দৈবে রাত্র্যহনী বর্ষং প্রবিভাগস্তযোঃ পুনঃ ।
অহস্তত্রোদগযনং রাত্রিঃ স্যাদ্ দক্ষিণাযনম্ ।।৬৭

মনুষ্যদিগের এক বৎসরে দেবতাদিগের এক দিবারাত্রি হয়, উহা এইরূপে বিভক্ত হইয়াছে,–উত্তরায়ন ও দক্ষিণায়ন। উত্তরায়ন তাঁহাদিগের দিন ও দক্ষিণায়ন রাত্রি হয়। ৬৭

৫৯. ব্রহ্মার দিবা ও রাত্রি এবং যুগপরিমাণ কথন

ব্রাহ্মস্য তু ক্ষপাহস্য যত্ প্রমাণং সমাসতঃ ।
একৈকশো যুগানাং তু ক্রমশস্তন্নিবোধত ।।৬৮

হে মহর্ষিগণ! ব্রহ্মার দিবারাত্রির ও সত্যত্রেতাদি এক এক যুগের যে পরিমাণ, তাহা আমি ক্রমে ক্রমে সংক্ষেপে আপনাদিগকে বলিতেছি, অবধান করুন। ৬৮

৬০. সত্যযুগ পরিমাণ

চত্বার্যাহুঃ সহস্রাণি বর্ষাণাং তত্ কৃতং যুগম্ ।
তস্য তাবত্শতী সংধ্যা সংধ্যাংশশ্চ তথাবিধঃ ।।৬৯

দৈবপরিমাণে চারি সহস্র বৎসরে সত্যযুগ হয়, সেই যুগের পূর্ব্ব চারি শত বৎসর সন্ধ্যা ও যুগের উত্তর চারি শত বৎসর সন্ধ্যাংশ হয়। ৬৯

৬১. ত্রেতা, দ্বাপর ও কলির পরিমান

ইতরেষু সসংধ্যেষু সসংধ্যাংশেষু চ ত্রিষু ।
একাপাযেন বর্তন্তে সহস্রাণি শতানি চ ।।৭০

ত্রেতা-দ্বাপরাদিতে যুগের পরিমাণ ক্রমে এক সহস্র বৎসর কইয়া ও সন্ধাংশের পরিমান এক শত বৎসর করিয়া ন্যূন হইয়া যায় অর্থাৎ তিনি সহস্র বৎসরে ত্রেতাযুগ, তিনশত বৎসর তাহার সন্ধ্যা ও তিন শত বৎসর সন্ধ্যাংশ। দুই সহস্র বৎসরের দ্বাপরযুগ, দুই শত বৎসর তাহার সন্ধ্যা; দুই শত বৎসর সন্ধ্যাংশ হয়। সহস্র বৎসরে কলিযুগ, এক শত বৎসর তাহার সন্ধ্যা ও এক শত বৎসর সন্ধ্যাংশ হয়। ৭০

৬২. দেবযুগ

যদেতত্ পরিসঙ্খ্যাতমাদাবেব চতুর্যুগম্ ।
এতদ্ দ্বাদশসাহস্রং দেবানাং যুগমুচ্যতে ।।৭১

ত্রেতে-দ্বাপরাদিতে যুগের পরিমাণ ক্রমে এক সহস্র বৎসর করিয়া ও সন্ধ্যাংশের পরিমাণ এক শত বৎসর করিয়া ন্যুন হইয়া যায় অর্থাৎ তিন সহস্র বৎসরে ত্রেতাযুগ, তিন শত বৎসর তাহার সন্ধ্যা ও তিন শত বৎসর সন্ধ্যাংশ। দুই সহস্র বৎসরে দ্বাপরযুগ, দুইশত বৎসর তাহার সন্ধ্যা ও দুই শত বৎসর সন্ধ্যাংশ হয়। সহস্র বৎসরে কলিযুগ, এক শত বৎসর তাহার সন্ধ্যা ও এক শত বৎসর সন্ধ্যাংশ হয়। ৭০

৬৩. ব্রহ্মার দিবা ও রাত্রি

দৈবিকানাং যুগানাং তু সহস্রং পরিসঙ্খ্যযা ।
ব্রাহ্মমেকমহর্জ্ঞেযং তাবতীং রাত্রিমেব চ ।।৭২

দৈবপরিমাণের সহস্র যুগসংখ্যাতে ব্রহ্মার এক দিন হয় এবং ঐ পরিমাণে তাঁহার এক রাত্রি হয়। ৭২

৬৪. অহোরাত্রবেত্তা

তদ্ বৈ যুগসহস্রান্তং ব্রাহ্মং পুণ্যমহর্বিদুঃ ।
রাত্রিং চ তাবতীমেব তেঽহোরাত্রবিদো জনাঃ ।।৭৩

দৈবপরিমাণে সহস্র যুগ পরিসমাপ্তিতে ব্রহ্মার এক দিন হয় ও ঐ পরিমাণে তাঁহার এক রাত্রি হয়। এই পবিত্র দিবারাত্রির পরিমান যাঁহারা অবগত আছেন, তাঁহাদিগকে অহোরাত্রবেত্তা বলা যায়। ৭৩

৬৫. মনঃসৃষ্টি

তস্য সোঽহর্নিশস্যান্তে প্রসুপ্তঃ প্রতিবুধ্যতে ।
প্রতিবুদ্ধশ্চ সৃজতি মনঃ সদসদাত্মকম্ ।।৭৪

পরমাত্মা পূর্ব্বোক্ত স্বীয় অহোরাত্রের অবসানে প্রতিবুদ্ধ হয়েন এবং প্রতিবুদ্ধ হইয়াই ভূলোকাদি সৃষ্টি করিবার জন্য মনকে নিয়োগ করেন। ব্রহ্মার এইপ্রকার নিয়োগের নাম মনঃসৃষ্টি। ৭৪

৬৬. মহত্তত্বের উৎপত্তি

মনঃ সৃষ্টিং বিকুরুতে চোদ্যমানং সিসৃক্ষযা ।
আকাশং জাযতে তস্মাত্ তস্য শব্দং গুণং বিদুঃ ।।৭৫

পরমাত্মা সৃষ্টি করিবার ইচ্ছা করিলে পর সেই ইচ্ছায় প্রেরিত মহত্তত্ব হইতে আকাশ উৎপন্ন হয়। মন্বাদি আকাশের গুণ শব্দ বলিয়াছেন। ৭৫

৬৭. স্পর্শগুণ

আকাশাত্ তু বিকুর্বাণাত্ সর্বগন্ধবহঃ শুচিঃ ।
বলবাঞ্জাযতে বাযুঃ স বৈ স্পর্শগুণো মতঃ ।।৭৬

বিকৃতভাবাপন্ন আকাশ হইতে সুগন্ধ ও দুর্গন্ধবহ প্রবল পবিত্র বায়ু সমুদিত হয়। মন্বাদি উহার স্পর্শগুণ বলিয়াছেন। ৭৬

৬৮. তেজ উৎপত্তি

বাযোরপি বিকুর্বাণাদ্ বিরোচিষ্ণু তমোনুদম্ ।
জ্যোতিরুত্পদ্যতে ভাস্বত্ তদ্ রূপগুণমুচ্যতে ।।৭৭

বিকৃতভাবাপন্ন আকাশ হইতে তমোনাশক, সকল বস্তুর প্রকাশক, দীপ্তমান তেজ উৎপন্ন হয়; ঐ তেজের গুণ রূপ। ৭৭

৬৯. পঞ্চভূতের উৎপত্তিক্রম

জ্যোতিষশ্চ বিকুর্বাণাদাপো রসগুণাঃ স্মৃতাঃ ।
অদ্ভ্যো গন্ধগুণা ভূমিরিত্যেষা সৃষ্টিরাদিতঃ ।।৭৮

তেজ বিকৃতভাবাপন্ন হইলে বিকারজনক তেজ হইতে জল জন্মে, জলের গুণ রস। জল হইতে গন্ধগুণসম্পন্ন পৃথিবী উৎপন্ন হয়, মহাপ্রলয়াবসানে সৃষ্টির প্রথমে পঞ্চভূতের উৎপত্তিক্রম এইরূপ। ৭৮

৭০. মন্বন্তর

যদ্ প্রাগ্ দ্বাদশসাহস্রমুদিতং দৈবিকং যুগম্ ।
তদেকসপ্ততিগুণং মন্বন্তরমিহোচ্যতে ।।৭৯

পূর্ব্বে দ্বাদশ সহস্র সংখ্যায় পরিগণিত দৈবপরিমাণে যে যুগনির্ণয় করা হইয়াছে, তাহাকে একসপ্ততি গুণ করিলে যে ফল হয়, অর্থাৎ (৮,৫২,০০০) আট লক্ষ বাহান্ন সহস্র দৈববৎসর, তাহাকে এক মন্বন্তর বলা যায়। ৭৯

মন্বন্তরাণ্যসঙ্খ্যানি সর্গঃ সংহার এব চ ।
ক্রীডন্নিবৈতত্ কুরুতে পরমেষ্ঠী পুনঃ পুনঃ ।।৮০

পরমেষ্ঠী পিতামহ ব্রহ্মা যেন ক্রীড়া করিতে করিতে বার বার অসংখ্য মন্বন্তর এবং অনন্ত সৃষ্টি ও সংহার করিতেছেন। ৮০

৭১. যুগভেদে ধর্ম্মের স্থিতি

চতুষ্পাত্ সকলো ধর্মঃ সত্যং চৈব কৃতে যুগে ।
নাধর্মেণাগমঃ কশ্চিন্ মনুষ্যান্ প্রতি বর্ততে ।।৮১

সত্যযুগে সকল ধর্ম্মই সর্ব্বাঙ্গসম্পূর্ণ ছিল, মনুষ্যমাত্রেরই মিথ্যা বলা ছিল না, অধর্ম্ম দ্বারা ধনাগম ও বিদ্যাদির উপার্জ্জন ছিল না। ৮১

ইতরেষ্বাগমাদ্ ধর্মঃ পাদশস্ত্ববরোপিতঃ ।
চৌরিকানৃতমাযাভির্ধর্মশ্চাপৈতি পাদশঃ ।।৮২

ত্রেতা যুগে অধর্ম্ম দ্বারা ধন ও বিদ্যাদির আগম জন্য ধর্ম্মের এক এক পদ হীন হইতে লাগিল, অর্থাৎ ত্রেতায় ত্রিপাদ ধর্ম্ম, দ্বাপরে দ্বিপাদ ও কলিতে একপাদ ধর্ম্মামাত্র রহিল। ৮২

৭২. যুগভেদে মনুষ্যের পরমায়ুঃ

অরোগাঃ সর্বসিদ্ধার্থাশ্চতুর্বর্ষশতাযুষঃ ।
কৃতে ত্রেতাদিষু হ্যেষামাযুর্হ্রসতি পাদশঃ ।।৮৩

সত্যযুগে সকলে রোগশূন্য ছিল, যে যাহা কামনা করিত, তৎক্ষণাৎ সমুদয় সম্পন্ন হইত। সকলের চারি শত বৎসর পরমায়ু ছিল, কিন্তু ত্রেতাদি যুগত্রয়ে সকলের এক শত বৎসর করিয়া পরমায়ুর হ্রাস হইতে লাগিল, অর্থাৎ ত্রেতায় তিন শত বৎসর, দ্বাপরে দুই শত বৎসর, কলিতে শত বৎসর পরমায়ু হইল। উক্ত পরমায়ু স্বাভাবিক; অধিক আয়ুস্কর কর্ম্মবশতঃ অধিক আয়ুও হইয়া থাকে। ৮৩

বেদোক্তমাযুর্মর্ত্যানামাশিষশ্চৈব কর্মণাম্ ।
ফলন্ত্যনুযুগং লোকে প্রভাবশ্চ শরীরিণাম্ ।।৮৪

লোকে যুগানুসারেই মনুষ্যদিগের পরমায়ু কাম্য, কর্ম্মের ফলপ্রার্থনা এবং ব্রাহ্মণাদির শাপ, অনুগ্রহ প্রভৃতি প্রভাব ফলিত হইয়া থাকে। ৮৪

৭৩. যুগভেদে ধর্ম্মভেদ

অন্যে কৃতযুগে ধর্মাস্ত্রেতাযাং দ্বাপরেঽপরে ।
অন্যে কলিযুগে নৄণাং যুগহ্রাসানুরূপতঃ ।।৮৫

সত্যযুগে একপ্রকার ধর্ম্ম, ত্রেতায় আর এক প্রকার, দ্বাপরে অন্যপ্রকার এবং কলিযুগেও অন্য একপ্রকার ধর্ম্ম হয়। ফলতঃ যুগের অপচয় অনুসারে ধর্ম্মেরও বৈলক্ষণ্য হইয়া থাকে। ৮৫

তপঃ পরং কৃতযুগে ত্রেতাযাং জ্ঞানমুচ্যতে ।
দ্বাপরে যজ্ঞমেবাহুর্দানমেকং কলৌ যুগে ।।৮৬

সত্যযুগে তপস্যাই প্রধান ধর্ম্ম ছিল, ত্রেতায় জ্ঞানই প্রধান, দ্বাপরে যজ্ঞই প্রধান, কলিতে কেবলমাত্র দানই প্রধান হয়। ৮৬

৭৪. ব্রাহ্মণাদির পৃথক্‌ পৃথক্‌ কর্ম্মব্যবস্থা

সর্বস্যাস্য তু সর্গস্য গুপ্ত্যর্থং স মহাদ্যুতিঃ।
মুখবাহুরুপজ্জানাং পৃথক্ কর্মাণ্যকল্পয়ৎ।। (১/৮৭)

বঙ্গানুবাদ: এই সকল সৃষ্টির অর্থাৎ ত্রিভুবনের রক্ষার জন্য মহাতেজযুক্ত প্রজাপতি ব্রহ্মা নিজের মুখ, বাহু, উরু এবং পাদ- এই চারটি অঙ্গ থেকে জাত ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্রদের পৃথক পৃথক কার্যের ব্যবস্থা করিয়া দিলেন।

৭৫. ব্রাহ্মণের কর্ত্তব্য

অধ্যাপনমধ্যয়নং যজনং যাজনং তথা।
দানং প্রতিগ্রহঞ্চৈব ব্রাহ্মণানামকল্পয়ৎ।। (১/৮৮)

বঙ্গানুবাদ: অধ্যাপন, স্বয়ং অধ্যয়ন, যজন, যাজন, দান ও প্রতিগ্রহ (উপহার বা দান-সামগ্রি গ্রহণ)- এই ছয়টি কাজ ব্রহ্মা ব্রাহ্মণদের জন্য নির্দেশ করে দিলেন।

৭৬. ক্ষত্রিয়ের কর্ত্তব্য

প্রজানাং রক্ষণং দানমিজ্যাধ্যয়নমেব চ।
বিষয়েম্বপ্রসক্তিশ্চ ক্ষত্রিয়স্য সমাসতঃ।। (১/৮৯)

বঙ্গানুবাদ: প্রজারণ, দান, যজ্ঞ, অধ্যয়ন, নৃত্যগীতবনিতাদি-বিষয়ভোগে অনাসক্তি, এই কয়েকটি কাজ ব্রহ্মা ক্ষত্রিয়গণের জন্য সংক্ষেপে নিরূপিত করলেন।

৭৭. বৈশ্যের কর্ত্তব্য

পশূনাং রক্ষণং দানমিজ্যাধ্যয়নমেব চ।
বণিক্পথং কুসীদঞ্চ বৈশ্যস্য কৃষিমেব চ।। (১/৯০)

বঙ্গানুবাদ: পশুদের রক্ষা, দান, যজ্ঞ, অধ্যয়ন, বাণিজ্য (স্থলপথ ও জলপথ প্রভৃতির মাধ্যমে বস্তু আদান-প্রদান করে ধন উপার্জন), কুসীদ (বৃত্তিজীবিকা- টাকা সুদে খাটানো) এবং কৃষিকাজ- ব্রহ্মা কর্তৃক বৈশ্যদের জন্য নিরূপিত হল।

৭৮. শূদ্রের কর্ত্তব্য

এতমেব তু শূদ্রস্য প্রভুঃ কর্ম সমাদিশৎ।
এতেষামেব বর্ণানাং শুশ্রূষামনসূয়য়া।। (১/৯১)

বঙ্গানুবাদ: প্রভু ব্রহ্মা শূদ্রের জন্য একটি কাজই নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন, -তা হলো কোনও অসূয়া অর্থাৎ নিন্দা না করে (অর্থাৎ অকপটভাবে) এই তিন বর্ণের অর্থাৎ ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যের শুশ্রূষা করা।

৭৯. মনুষ্যদেহের পবিত্রতা

ঊর্ধ্বং নাভের্মেধ্যতরঃ পুরুষঃ পরিকীর্তিতঃ ।
তস্মান্ মেধ্যতমং ত্বস্য মুখমুক্তং স্বযংভুবা ।।৯২

পুরুষমাত্রেই সর্ব্বতোভাবে পরিত্র, উহার নাভির উর্দ্ধভাগ পবিত্রতর, তাহা অপেক্ষা মুখ পবিত্রতম হয়। ব্রহ্মা স্বয়ং ইহা কহিয়াছেন। ৯২

৮০. ব্রাহ্মণের প্রভুতার কারণ

উত্তমাঙ্গোদ্ভবাজ্ জ্যেষ্ঠ্যাদ্ ব্রহ্মণশ্চৈব ধারণাত্ ।
সর্বস্যৈবাস্য সর্গস্য ধর্মতো ব্রাহ্মণঃ প্রভুঃ ।। (১/৯৩)

বঙ্গানুবাদ: ব্রহ্মার পবিত্রতম মুখ থেকে উৎপন্ন বলে, সকল বর্ণের আগে ব্রাহ্মণের উৎপত্তি হওয়ায়, এবং বেদসমূহ ব্রাহ্মণকর্তৃক রক্ষিত হওয়ার জন্য (বা বেদসমূহ ব্রাহ্মণেরাই পঠন-পাঠন করেন বলে)- ব্রাহ্মণই ধর্মের অনুশাসন অনুসারে এই সৃষ্ট জগতের একমাত্র প্রভু।

৮১. ব্রাহ্মণের উৎপত্তি

তং হি স্বযংভূঃ স্বাদাস্যাত্ তপস্তপ্ত্বাঽদিতোঽসৃজত্ ।
হব্যকব্যাভিবাহ্যায সর্বস্যাস্য চ গুপ্তযে ।।৯৪

স্বয়ম্ভু ব্রহ্মা তপস্যা করিয়া দেবলোক ও পিতৃপোলের হব্যকব্য বহনের জন্য ও জগৎসংসারের রক্ষার নিমিত্ত স্বকীয় বদন হইতে প্রথমতঃ ব্রাহ্মণের উৎপাদন করিলেন। ৯৪

যস্যাস্যেন সদাঽশ্নন্তি হব্যানি ত্রিদিবৌকসঃ ।
কব্যানি চৈব পিতরঃ কিং ভূতমধিকং ততঃ ।।৯৫

দেবতারা যে ব্রাহ্মণের মুখে হবনীয় দ্রব্যাদি ভোজন করেন, পিতৃলোকেরা যাঁহাদিগের মুখে শ্রাদ্ধাদিতে প্রদত্ত ভোজন করেন, ঈদৃশ ব্রাহ্মণ হইতে আর কে শ্রেষ্ঠ হইতে পারে? ৯৫

৮২. কীটাদি প্রাণীর উত্তরোত্তর শ্রেষ্ঠতা প্রাপ্তি

ভূতানাং প্রাণিনঃ শ্রেষ্ঠাঃ প্রাণিনাং বুদ্ধিজীবিনঃ ।
বুদ্ধিমত্সু নরাঃ শ্রেষ্ঠা নরেষু ব্রাহ্মণাঃ স্মৃতাঃ ।।৯৬

স্থাবর-জঙ্গমাদির মধ্যে সামান্য কীটাদি প্রাণী শ্রেষ্ঠ, যেহেতু, তাহাদিগের সুখ-দুঃখ-বোধ আছে। তাদৃশ প্রাণীদিগের মধ্যে বুদ্ধিজীবী পশ্বাদি শ্রেষ্ঠ, কেননা, তাহারা প্রয়োজনীয় স্থানে যায়, অপ্রয়োজনীয় স্থানে যায় না। বুদ্ধিজীবী জীবের মধ্যে প্রকৃষ্ট জ্ঞানসম্পন্ন মনুষ্যই শ্রেষ্ঠ হয় ও মনুষ্যদিগের মধ্যে মোক্ষে অধিকারী ব্রাহ্মণেরাই শ্রেষ্ঠ হয়েন। ৯৬

৮৩. ব্রাহ্মণের মধ্যে কর্ম্মভেদে শ্রেষ্ঠতা

ব্রাহ্মণেষু চ বিদ্বাংসো বিদ্বত্সু কৃতবুদ্ধযঃ ।
কৃতবুদ্ধিষু কর্তারঃ কর্তৃষু ব্রহ্মবেদিনঃ ।।৯৭

ব্রাহ্মণের মধ্যে জ্যোতিষ্টোমাদি যাগাধিকারী বিদ্বানেরা শ্রেষ্ঠ; বিদ্বানের মধ্যে শাস্ত্রীয় কর্ম্মানুষ্ঠান যাঁহাদিগের কর্ত্তব্যতা-বুদ্ধি আছে, তাঁহারাই শ্রেষ্ঠ; তাঁহাদিগের মধ্যে যাঁহারা কর্ত্তব্য কর্ম্ম করিতেছেন, তাঁহারাই শ্রেষ্ঠ; আবার শাস্ত্রোক্তকর্ম্মকারীদিগের মধ্যে জীবম্মুক্ত ব্রহ্মজ্ঞানী লোকেরাই শ্রেষ্ঠ হয়েন। ৯৭

উত্পত্তিরেব বিপ্রস্য মূর্তির্ধর্মস্য শাশ্বতী ।
স হি ধর্মার্থমুত্পন্নো ব্রহ্মভূযায কল্পতে ।।৯৮

ব্রাহ্মণের দেহ ধর্ম্মের সাক্ষাৎ সনাতন মূর্ত্তি, ধর্ম্মের জন্য উৎপন্ন ব্রাহ্মণ মোক্ষলাভের উপযুক্ত পাত্র হয়েন। ৯৮

৮৪. ব্রাহ্মণ সকলের শ্রেষ্ঠ কেন

ব্রাহ্মণো জাযমানো হি পৃথিব্যামধিজাযতে ।
ঈশ্বরঃ সর্বভূতানাং ধর্মকোশস্য গুপ্তযে ।। (১/৯৯)

বঙ্গানুবাদ: ব্রাহ্মণ জন্মগ্রহণ করা মাত্রই পৃথিবীর সকল লোকের উপরিবর্তী হন অর্থাৎ সমস্ত লোকের অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ হন। কারণ, ব্রাহ্মণই সকলের ধর্মকোষ অর্থাৎ ধর্মসমূহ রক্ষার জন্য প্রভুসম্পন্ন হয়ে থাকেন।

৮৫. ব্রাহ্মণ সমুদয় সম্পত্তির যোগ্য কেন

সর্বং স্বং ব্রাহ্মণস্যেদং যত্ কিং চিত্জগতীগতম্ ।
শ্রৈষ্ঠ্যেনাভিজনেনেদং সর্বং বৈ ব্রাহ্মণোঽর্হতি ।। (১/১০০)

বঙ্গানুবাদ: জগতে যা কিছু ধনসম্পত্তি সে সমস্তই ব্রাহ্মণের নিজ ধনের তুল্য; অতএব সকল বর্ণের মধ্যে শ্রেষ্ঠ বলে ব্রাহ্মণই সমুদয় সম্পত্তিরই প্রাপ্তির যোগ্য হয়েছেন।

স্বমেব ব্রাহ্মণো ভুঙ্ক্তে স্বং বস্তে স্বং দদাতি চ ।
আনৃশংস্যাদ্ ব্রাহ্মণস্য ভুঞ্জতে হীতরে জনাঃ ।। (১/১০১)

বঙ্গানুবাদ: ব্রাহ্মণ যে পরের অন্ন ভোজন করেন, পরকীয় বসন পরিধান করেন, পরের ধন গ্রহণ করে অন্যকে প্রদান করেন, সে সবকিছু ব্রাহ্মণের নিজেরই। কারণ, ব্রাহ্মণেরই আনৃশংস্য অর্থাৎ দয়া বা করুণাতেই অন্যান্য যাবতীয় লোক ভোজন-পরিধানাদি করতে পারছে।

৮৬. মনুসংহিতা রচনার প্রয়োজন

তস্য কর্মবিবেকার্থং শেষাণামনুপূর্বশঃ ।
স্বাযংভুবো মনুর্ধীমানিদং শাস্ত্রমকল্পযত্ ।।১০২

ব্রাহ্মণদিগের কর্ম্মবিবেচনর জন্য ও আনুষঙ্গিক ক্ষত্রিয়াদিরও কর্ম্মবিবেচনার জন্য ব্রহ্মার পৌত্র শ্রীমান ভগবান স্বায়ম্ভুব মনু এই শাস্ত্র রচনা করিয়াছেন। ১০২

৮৭. ব্রাহ্মণই অধ্যাপনার অধিকারী

বিদুষা ব্রাহ্মণেনৈদমধ্যেতব্যং প্রযত্নতঃ ।
শিশ্যেভ্যশ্চ প্রবক্তব্যং সম্যগ্ নান্যেন কেন চিত্ ।।১০৩

এই শাস্ত্র অধ্যয়নের ফলজ্ঞ ব্রাহ্মণগণ প্রযত্নসহকারে এই মানবশাস্ত্র অধ্যয়ন করিবেন এবং শিষ্যগণকে সম্যকরূপে অধ্যয়ন করাইবেন। ক্ষত্রিয়-বৈশ্যাদি অন্য কেহ ইহা অধ্যয়ন করাইতে পারিবেন না। ১০৩

৮৮. মনুপাঠের ফলশ্রুতি

ইদং শাস্ত্রমধীযানো ব্রাহ্মণঃ শংসিতব্রতঃ ।
মনোবাক্দেহজৈর্নিত্যং কর্মদোষৈর্ন লিপ্যতে ।।১০৪

যে ব্রাহ্মণ নিয়মপূর্ব্বক এই মনুসংহিতা অধ্যয়ন করেন, তিনি প্রতিদিন মানসিক, বাচনিক বা কায়িক কোন পাপে লিপ্ত হয়েন না। ১০৪

পুনাতি পঙ্ক্তিং বংশ্যাংশ্চ ? ? সপ্তসপ্ত পরাবরান্ ।
পৃথিবীমপি চৈবেমাং কৃত্স্নামেকোঽপি সোঽর্হতি ।।১০৫

যিনি এই মনুসংহিতা অধ্যয়ন করেন, তিনি পঙ্‌ক্তি পবিত্র করেন, এবং পিত্রাদি সপ্ত পূর্ব্বপুরুষ ও পুত্রাদি অধস্তন সপ্ত পুরুষ পবিত্র করেন; তিনি এরূপ পবিত্র হয়েন যে, একাকীই এই সমস্ত পৃথিবীর দানের পাত্র হয়েন। ১০৫

ইদং স্বস্ত্যযনং শ্রেষ্ঠমিদং বুদ্ধিবিবর্ধনম্ ।
ইদং যশস্যমাযুষ্যং ইদং নিঃশ্রেযসং পরম্ ।।১০৬

এই মনুশাস্ত্রের অধ্যয়ন মহাস্বস্ত্যয়নস্বরূপ, ইহার অভ্যাসে বুদ্ধির বৃদ্ধি হয় এবং উত্তম খ্যাতি লাভ হয় ও পরমায়ু বৃদ্ধি হয় এবং মোক্ষলাভ হয়। ১০৬

৮৯. মনুসংহিতোক্ত বিষয়

অস্মিন্ ধর্মেঽখিলেনোক্তৌ গুণদোষৌ চ কর্মণাম্ ।
চতুর্ণামপি বর্ণানামাচারশ্চৈব শাশ্বতঃ ।।১০৭

এই গ্রন্থে সমুদয় ধর্ম অবিহিত হইয়াছে, বিহিত ও নিষিদ্ধ কর্ম্মের গুণ ও দোষ বর্ণিত হইয়াছে, এবং চাতুর্ব্বর্ণ্যের পরস্পরাগত আচার-ব্যবহারও কথিত হইয়াছে। ১০৬

৯০. পরস্পরগত আচারই ধর্ম্ম

আচারঃ পরমো ধর্মঃ শ্রুত্যোক্তঃ স্মার্ত এব চ ।
তস্মাদস্মিন্ সদা যুক্তো নিত্যং স্যাদাত্মবান্ দ্বিজঃ ।।১০৮

পরস্পরাগত আচার যে উৎকৃষ্ট ধর্ম্ম, ইহা শ্রুতি, স্মৃতি উভয়েই প্রতিপন্ন আছে, অতএব আত্মহিতাভিলাষী ব্রাহ্মণ শ্রুতিস্মৃতিবিহিত আচারের অনুষ্ঠানে সতত যত্নবান থাকিবেন। ১০৮

৯১. আচারহীন ব্রাহ্মণের ফলহীনতা

আচারাদ্ বিচ্যুতো বিপ্রো ন বেদফলমশ্নুতে ।
আচারেণ তু সংযুক্তঃ সম্পূর্ণফলভাগ্ ভবেত্ ।।১০৯

আচারহীন ব্রাহ্মণ বেদের সম্পূর্ণ ফলভাগী হয়েন না, কিন্তু যদি ইনি সদাচারসম্পন্ন হয়েন, তাহা হইলে বেদের সম্পূর্ণ ফলভাগী হয়েন। ১০৯

৯২. আচারই তপস্যার প্রধান কারণ

এবমাচারতো দৃষ্ট্বা ধর্মস্য মুনযো গতিম্ ।
সর্বস্য তপসো মূলমাচারং জগৃহুঃ পরম্ ।।১১০

মুনিগণ আচার দ্বারা ধর্ম্মের গতি অবগত হইয়া আচারকেই সকল তপস্যার প্রধান কারণ বলিয়া গ্রহণ করিয়াছেন। ১১০

৯৩. গ্রন্থের অনুক্রমণিকা

জগতশ্চ সমুত্পত্তিং সংস্কারবিধিমেব চ ।
ব্রতচর্যৌপচারং চ স্নানস্য চ পরং বিধিম্ ।।১১১

এক্ষণে গ্রন্থের অনুক্রমণিকা কহিতেছেন। প্রথমাধ্যায়ে জগতের উৎপত্তিক্রম, দ্বিতীয়াধ্যায়ে জাতকর্ম্মাদি সংস্কারের অনুষ্ঠান, ব্রহ্মচারীর ব্রতাচরণ, গুরু প্রভৃতির অভিবাদনাদি, তৃতীয়াধায়ে গুরুকুল হইতে প্রতিনিবৃত্ত ব্রাহ্মণের উৎকৃষ্ট স্নানবিধি মনু কর্ত্তৃক বর্ণিত হইয়াছে। ১১১

দারাধিগমনং চৈব বিবাহানাং চ লক্ষণম্ ।
মহাযজ্ঞবিধানং চ শ্রাদ্ধকল্পং চ শাশ্বতম্ ।।১১২

ঐ তৃতীয়াধ্যায়ে চাতুর্ব্বর্ণ্যের বিবাহ ও ব্রাহ্মাদি বিবাহের লক্ষণ, বৈশ্বদেবাদি পঞ্চ মহাযজ্ঞ ও নিত্যকর্ত্তব্য শ্রাদ্ধাদি বর্ণিত হইয়াছে। ১১২

বৃত্তীনাং লক্ষণং চৈব স্নাতকস্য ব্রতানি চ ।
ভক্ষ্যাভক্ষ্যং চ শৌচং চ দ্রব্যাণাং শুদ্ধিমেব চ ।।১১৩

চতুর্থাধ্যায়ে শিলোঞ্ছাদিজীবনোপায়ের লক্ষণ, গৃহস্থের নিয়ম। পঞ্চমাধ্যায়ে ভক্ষ্যাভক্ষ্যবিবেচনা, জন্মমরণাদিতে শৌচ এবং জলাদি দ্বারা দ্রব্যাদির শুদ্ধি ইহাতে উক্ত হইয়াছে। ১১৩

স্ত্রীধর্মযোগং তাপস্যং মোক্ষং সংন্যাসমেব চ ।
রাজ্ঞশ্চ ধর্মমখিলং কার্যাণাং চ বিনির্ণযম্ ।।১১৪

ঐ পঞ্চমাধ্যায়ে স্ত্রীলোকদিগের ধর্ম্মোপায়, ষষ্ঠাধ্যায়ে বানপ্রস্থ ধর্ম্ম, যতিধর্ম্ম, সন্ন্যাসধর্ম্ম, সপ্তমাধ্যায়ে নৃপতিদিগের ধর্ম্ম, অষ্টমাধ্যায়ে ঋণদানাদির তত্ত্বনির্ণয় কথিত হইয়াছে। ১১৪

সাক্ষিপ্রশ্নবিধানং চ ধর্মং স্ত্রীপুংসযোরপি ।
বিভাগধর্মং দ্যূতং চ কণ্টকানাং চ শোধনম্ ।।১১৫

ঐ অষ্টমাধ্যায়ে সাক্ষীদিগকে প্রশ্নজিজ্ঞাসা করিবার নিয়ম, নবমাধ্যায়ে স্ত্রীপুরুষের ধর্ম্ম, দায়বিভাগ, দ্যুতবিধান, তস্করাদি নিবারণ করিবার প্রথা লিখিত হইয়াছে। ১১৫

বৈশ্যশূদ্রোপচারং চ সঙ্কীর্ণানাং চ সংভবম্ ।
আপদ্ধর্মং চ বর্ণানাং প্রাযশ্চিত্তবিধিং তথা ।।১১৬

ঐ নবমাধ্যায়ে বৈশ্যশূত্রের কর্ত্তব্যকর্ম্মের অনুষ্ঠান, দশমাধ্যায় অনুলোম-প্রতিলোমজাত সঙ্কীর্ণ জাতির উৎপত্তির বিবরণ, চারি বর্ণের আপৎকালে জীবিকার উপদেশ, একাদশাধ্যায়ে প্রায়শ্চিত্তিবিধি বর্ণিত হইয়াছে। ১১৬

সংসারগমনং চৈব ত্রিবিধং কর্মসংভবম্ ।
নিঃশ্রেযসং কর্মণাং চ গুণদোষপরীক্ষণম্ ।।১১৭

দ্বাদশাধ্যায়ে শুভাশুভ কর্ম্মজন্য উত্তম, মধ্যম, অধম এই ত্রিবিধ শরীরধারণ, আত্মজ্ঞান, বিহিত ও নিষিদ্ধ কর্ম্মের গুণ ও দোষ নির্ণীত হইয়াছে। ১১৭

দেশধর্মান্জাতিধর্মান্ কুলধর্মাংশ্চ শাশ্বতান্ ।
পাষণ্ডগণধর্মাংশ্চ শাস্ত্রেঽস্মিন্নুক্তবান্ মনুঃ ।।১১৮

ভগবান মনু চিরপ্রচলিত স্বস্বদেশে অনুষ্ঠিত ধর্ম্ম, ব্রাহ্মণাদিজাতির ধর্ম্ম, বংশপরস্পরাগত কুলধর্ম্ম এবং বেদোক্ত শুভানুষ্ঠানহীন পাষণ্ডগণের ধর্ম্ম এই সংহিতায় বর্ণন করিয়াছেন। ১১৮

৯৪. প্রতি অধ্যায়ের বক্তব্য বিষয়, ভৃগুকর্ত্তৃক মনুসংহিতা পুনরারম্ভ

যথৈদমুক্তবাংশাস্ত্রং পুরা পৃষ্টো মনুর্মযা ।
তথৈদং যূযমপ্যদ্য মত্সকাশান্নিবোধত ।।১১৯

হে মহির্ষিগণ! পূর্ব্বকালে আমি মহাত্মা মনুকে জিজ্ঞাসা করিলে পর তিনি এই শাস্ত্র আমায় যেরূপ বলিয়াছিলেন, আপনারা আমার মুখে অবিকল সেইরূপ শ্রবণ করুন।

ইতি ভৃগুপ্রোক্ত মানবীয় ধর্ম্মসংহিতায় প্রথমাধ্যায়ের অনুবাদ সমাপ্ত।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *