11 of 11

৬৩.০৪ শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃতে উল্লিখিত ব্যক্তিবৃন্দের পরিচয় (র – ক্ষ)

রজনীনাথ রায় (১৮৪৯ – ১৯০২) উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী। জন্ম-অধুনা বাংলাদেশে অবস্থিত ঢাকাতে। হিন্দু, তবে পরবর্তী কালে ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করন এবং “সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের” খ্যাতনামা ব্যক্তি হিসাবে পরিচিত লাভ করেন। বাংলাদেশে স্ত্রী শিক্ষা বিস্তারে তাঁহার ভূমিকা অন্যতম। ১৮৮৩ খ্রীষ্টাব্দে ঠাকুরের অন্যতম ভক্ত মণিলাল মল্লিকের কলিকতার সিঁদুরিয়াপটির বাড়িতে ব্রাহ্মসমাজের উৎসবে ঠাকুরের শুভাগমন হইয়াছিল। রজনীনাথ রায় সেই উৎসবস্থলে শ্রীরামকৃষ্ণের দর্শন এবং তাঁহার ঈশ্বরীয় প্রসঙ্গাদি শ্রবণ করেন।

রতন — শ্রীরামকৃষ্ণের অনুরাগী ভক্ত। ঠাকুরের বিশিষ্ট ভক্ত যদুলাল মল্লিকের দক্ষিণেশ্বরের বাগানবাড়িতে তত্ত্বাবধায়ক — এই সূত্রেই তিনি ঠাকুরের পূতসঙ্গলাভের সুযোগ পান। ভক্ত যদুলালের বাড়িতে যাত্রা-গান প্রভৃতি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ঠাকুরকে আমন্ত্রণের জন্য রতন দক্ষিণেশ্বরে যাইতেন। ঠাকুর রতনকে খুবই স্নেহ করিতেন।

রতির মা — শ্রীরামকৃষ্ণের সান্নিধ্যে আগতা কর্তাভজা সম্প্রদায়ের গোঁড়া বৈষ্ণবী। বৈষ্ণবচরণ দাসের শিষ্যা। পাইকপাড়ার রাজা লালাবাবুর স্ত্রী কাত্যায়নী দেবীর ঘনিষ্ঠ সহচরী, অতি শুদ্ধাচারে জীবনযাপন করিতেন। মাঝে মাঝেই দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুরকে দর্শন করিতে আসিতেন। ঠাকুর মা ভবতারিণীকে একবার ‘রতির মার বেশে’ ভাবচক্ষে দেখিয়াছিলেন। কিন্তু তাঁহার গোঁড়ামি ছিল। সেজন্য শ্রীশ্রীঠাকুরকে মা কালীর প্রসাদ গ্রহণ করিতে দেখিয়া তিনি দক্ষিণেশ্বরে যাতায়াত বন্ধ করেন।

রবীন্দ্র — কলিকাতা নিবাসী বৈষ্ণববংশজাত ভক্তিমান যুবক। শ্রীরামকৃষ্ণের কৃপাধন্য। দক্ষিণেশ্বরে পঞ্চবটীতে ঠাকুর তাঁহার জিহ্বায় কিছু লিখিয়া দিয়াছিলেন। একবার বৃষকেতু নাটক দেখিয়া ফিরিবার সময় তাঁহাকে দক্ষিণেশ্বরে আনিয়া তিনদিন নিজের কাছে রাখিয়াছিলেন। ঈশ্বরের প্রসঙ্গে তাঁহার দেহ রোমাঞ্চিত হইত। পরে বরাহনগর মঠেও তাঁহার যাতায়াত ছিল। কিন্তু সেইসময় তিনি অসৎ সঙ্গে মনের ভারসাম্য কিছুটা হারাইয়া ফেলিয়াছিলেন।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১ – ১৯৪১) — বিশ্ববিখ্যাত কবি রবীন্দ্রনাথ ব্রাহ্ম নেতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পুত্র। জন্মকলিকতারা জোড়াসাঁকো অঞ্চলে। ধনীর সন্তান। সেইসময়কালে প্রগতিশীল পরিবার বলিতে এই ঠাকুর পরিবারকে বুঝাইত। অসাধারণ প্রতিভাদীপ্ত রবীন্দ্রনাথ বাল্যকাল হইতেই অন্য সকলের অপেক্ষা একটু আলাদা ধরণের ছিলেন। একাধারে গায়ক, কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী ছিলেন। স্কুল-কলেজের তথাকথিত ডিগ্রী তাঁহার না থাকিলেও রবীন্দ্রনাথের মতো পণ্ডিত ব্যক্তি বিরল। জালিয়ানোয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে তিনি সরকার প্রদত্ত ‘নাইট’ উপাধি ত্যাগ করেন। ১৯১৩ সালে ভারতবাসী হিসাবে প্রথম সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁহাকে ডক্টরেট উপাধিতে ভূষিত করেন। তিনি দক্ষিণেশ্বরে কখনও শ্রীরামকৃষ্ণকে দেখিতে আসেন নাই। কিন্তু ব্রাহ্মসমাজের উৎসবে শ্রীরামকৃষ্ণের দর্শন তিনি পান। নন্দনবাগান ব্রাহ্মসমাজ মন্দিরের উৎসবে শ্রীরামকৃষ্ণ ভক্তসঙ্গে উপস্থিত ছিলেন। সেদিন সেখানে রবীন্দ্রনাথ সহ ঠাকুর বাড়ির অনেকেই উপস্থিত থাকিয়া গান করিয়াছিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণের জন্মশতবর্ষ পূর্তিতে কলিকাতায় যে বিশ্বধর্ম মহাসম্মেলন আহূত হয় তাহার পঞ্চম অধিবেশনে সভাপতির ভাষণে রবীন্দ্রনাথ শ্রীরামকৃষ্ণ সম্পর্কে খুব সুন্দর মন্তব্য করেন। এই উপলক্ষে The Cultural Heritage of India নামে যে স্মারক গ্রন্থ বাহির হয় তাহার ভূমিকাতে The Spirit of India নামে এক বাণী দেন।

রসিক মেথর — দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়ির ঝাড়ুদার। শ্রীরামকৃষ্ণের শরণাগত পরমভক্ত। রসিক শ্রীরামকৃষ্ণকে “বাবা” বলিয়া সম্বোধন করেন। শ্রীরামকৃষ্ণদেব রসিককে স্নেহভরে “রসকে” বলিয়া ডাকিতেন। ঠাকুরের দেহরক্ষার দুই বৎসরের মধ্যেই রসিকের জীবনাবসান ঘটে। জীবনাবসানের অন্তিম মুহূর্তে শ্রীরামকৃষ্ণদেবকে দর্শন করেন এবং “এই যে বাবা এসেছ, বাবা এসেছ” বলিয়া সজ্ঞানে “রামকৃষ্ণ” নাম করিতে করিতে দেহত্যাগ করেন। ঠাকুরের পরমভক্ত রসিক মেথর রামকৃষ্ণভক্ত-মণ্ডলীতে বিশেষ স্থানাদিকারী হিসাবে গণ্য।

রাখাল [রাখালচন্দ্র ঘোষ — স্বামী ব্রহ্মানন্দ] (১৮৬৩ – ১৯২২) — রাখালচন্দ্র ১৮৬৩ খ্রীষ্টাব্দের ২১ জানুয়ারি বসিরহাট মহকুমার অন্তর্গত শিকরা-কুলীন গ্রামে এক অতি সম্ভ্রান্ত বংশে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁহার পিতার নাম আনন্দমোহন ঘোষ। তিনি সঙ্গতিপন্ন জমিদার ছিলেন। পাঁচ বৎসর বয়সে রাখালচন্দ্রের মাতা কৈলাসকামিনীর দেহত্যাগ হইলে তিনি বিমাতা হেমাঙ্গিনীর স্নেহময় ক্রোড়ে মানুষ হইতে থাকেন। উপযুক্ত বয়সে বিদ্যাভ্যাসের জন্য বাটীর নিকটে একটি বিদ্যালয়ে স্থাপনপূর্বক আনন্দমোহন উহাতে রাখলচন্দ্রকে ভর্তি করিয়া দিলে তথায় বালকের সৌম্য সুন্দর আকৃতি ও মাধুর্যময় কোমল প্রকৃতির ছাত্র ও শিক্ষককে আকৃষ্ট করে। বিদ্যালয়ের শিক্ষা ভিন্ন অন্য বিষয়েও রাখালের বিশেষ উৎসাহ ছিল। ক্রীড়াদিতে যেমন তাঁহার সমকক্ষ কেহ ছিল না, কুস্তিতেও তেমনি কেহ তাঁহার সমকক্ষ হইতে পারিত না। বাল্যকাললেই গ্রামের উপকণ্ঠে ৺কালীমন্দিরের নিকটে বোধনতলায় স্বনির্মিত শ্যামামূর্তির পূজাদিতে মগ্ন থাকিতেন। আবার তাঁহাদের বাটীতে প্রতিবৎসর শারদীয়া পূজার সময়ে পূজামণ্ডপে পুরোহিতের পশ্চাতে বসিয়া পূজা দেখিতে দেখিতে তন্ময় হইয়া যাইতেন এবং সন্ধ্যাকালে অনিমেষনয়নে মায়ের আরাত্রিক দর্শন করিতে করিতে নিজেকে কোন্‌ অজ্ঞাত রাজ্যে হারাইয়া ফেলিতেন। সংগীতে তাঁহার অসাধারণ প্রীতি ছিল — সঙ্গীদের লইয়া শ্যামাসঙ্গীত গাহিতে গাহিতে এত তন্ময় হইতেন যে দেশ-কালের জ্ঞান লোপ পাইত। বৈষ্ণব ভিখারির মুখে বৃন্দাবনের মুরলীধর রাখালরাজের গান শুনিয়া অত্মহারা হইতেন। ১২ বৎসর বয়সে কলিকাতায় বিমাতার পিতৃগৃহে থাকিয়া নিকটস্থ “ট্রেনিং একাডেমিতে” পড়াশুনা করিতে থাকেন। এইখানেই নরেন্দ্রনাথের (পরে স্বামী বিবেকানন্দ) সহিত তাঁহার পরিচয় হয় ও উভয়ের মধ্যে গভীর সখ্যের উদয় হয়। নরেন্দ্রের প্রেরণাতেই তিনি ব্রাহ্মসমাজে যাতায়াত করিতেন এবং নিরাকার ব্রহ্মের উপাসনা করিবেন বলিয়া সমাজের অঙ্গীকার পত্রে সাক্ষর দেন।

রাখলচন্দ্রের পিতা পুত্রের ধর্মভাব লক্ষ্য করিয়া তাঁহাকে সংসারে আবদ্ধ করিবার জন্য কোন্নগর নিবাসী ভুবনমোহন মিত্রের কন্যা এবং মনোমোহন মিত্রের ভগিনী একাদশ বর্ষীয়া বিশ্বেশ্বরীর সহিত ১৮৮১ খ্রীষ্টাব্দে বিবাহ দেন। ঠাকুরের নিকট আসিবার পূর্বে ঠাকুর ভাব-নেত্রে তাঁহার মানসপুত্রের দর্শন পান। তাই মনোমোহনবাবু রাখলকে দক্ষিণেশ্বরে লইয়া গেলে ঠাকুর তাঁহার মানসপুত্রকে পাইয়া তাহাকে সন্তানের ন্যায় গ্রহণ করেন। তাঁহারই কৃপায় রাখাল পিতার বাধা এবং স্ত্রীর মায়ামমতা সহজেই কাটাইয়া উঠিয়া ধর্মপথে অগ্রসর হন। নরেন্দ্রনাথ কাশীপুরে ঠাকুরের মুখে রাখালের “রাজবুদ্ধির” প্রশংসা শুনিয়া তাঁহাকে “রাজা” বলিয়া সম্বোধন করিতে সকলকে বলেন। এবং সেইহেতু পরবর্তী কালে তাঁহার রাজামহারাজ নামের প্রচলন। ১৮৮৭ খ্রীষ্টাব্দে তিনি বরাহনগর মঠে সন্ন্যাস গ্রহণ করিয়া স্বামী ব্রহ্মানন্দ নাম ধারণ করেন এবং উত্তর পশ্চিম ভারতের তীর্থাদি ভ্রমণ করেন। ১/৫/১৮৯৭ তারিখে শ্রীরামকৃষ্ণ মিশনের প্রতিষ্ঠা হইলে মিশনের কলিকাতা শাখার সভাপতি হন। কিছুকাল পরেই স্বামীজী তাঁহাকে সঙ্ঘের সমস্ত দায়িত্ব অর্পণ পূর্বক মঠ ও মিশনের সভাপতি পদে অধিষ্ঠিত করেন। তিনি ভারতের প্রায় সর্বত্র গমন করিয়া বহু নূতন শাখা কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি বাঙ্গালোর আশ্রমের নবনির্মিত গৃহের দ্বারোদঘাটন, মাদাজ রামকৃষ্ণ মঠের মিশন ছাত্রাবাসের ও ত্রিবান্দ্রাম আশ্রমের ভিত্তি স্থাপন করেন। ভুবনেশ্বরে রামকৃষ্ণ মঠের প্রতিষ্ঠাতাও তিনিই। বাঙ্গালোরে “শুদ্ধ ব্রহ্ম পরাৎপর রাম” সংকীর্তনটি শুনিয়া সপ্তকাণ্ডাত্মক এই নাম-রামায়ণ সংকলন করিয়া মঠের বিভিন্ন কেন্দ্রে প্রচলন করেন ইহা সর্বসাধারণের মধ্যে বিনামূল্যে বিতরিত হইত। ১৯২২ খ্রীষ্টাব্দের ১০ই এপ্রিল সোমবার রাত্রি পৌনে নয়টায় বলরাম-মন্দিরে শ্রীরামকৃষ্ণের মানসপুত্র রাখাল মহাসমাধিতে মগ্ন হন।

রাখাল ডাক্তার [রাখালদাস ঘোষ] (১৮৫১ – ১৯০২) — শ্রীরামকৃষ্ণের সান্নিধ্যে আগত, কলিকতার কলেজ স্ট্রীট নিবাসী খ্যাতনামা চিকিৎসক। জন্ম কলিকতার নিকট বালীতে। মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। হিল্‌টন কোম্পানীর প্রতিষ্ঠিতা। ১৮৮৫ খ্রীষ্টাব্দের ৩১শে আগস্ট চিকিৎসা উপলক্ষেই ঠাকুরের সঙ্গে তাঁহার যোগাযোগ হয়। দোহারা চেহারার রাখাল ডাক্তারের হাতের আঙ্গুলগুলি মোটা ছিল। সেইজন্য যখন ঠাকুরের গলার ভিতর হাত দিয়া রাখাল ডাক্তার পরীক্ষা করিতেন তখন ঠাকুর খুবই সন্ত্রস্ত হইতেন। রাখাল ডাক্তার প্রায়ই ঠাকুরের চিকিৎসার জন্য দক্ষিণেশ্বরে যাইতেন। ঠাকুর তাঁহাকে খুব স্নেহ করিতেন এবং তিনি দক্ষিণেশ্বরে আসিলে আপ্যায়ন করিতেন।

রাখাল হালদার — শ্রীরামকৃষ্ণের স্নেহধন্য ডাক্তার। নিবাস কলিকাতার বহুবাজারে। ঠাকুরের অন্যতম চিকিৎসক। রাখাল হালদার মাঝে মাঝেই কাশীপুরে ঠাকুরের কাছে যাতায়াত করিতেন। ঠাকুর নানাবিধ উপদেশ দানে তাঁহাকে কৃপা করিয়াছিলেন।

রাখালের বাপ (আনন্দমোহন ঘোষ) — রাখালচন্দ্র ঘোষের (স্বামী ব্রহ্মানন্দ) পিতা সঙ্গতিসম্পন্ন জমিদার। পাঁচ বৎসর বয়সে রাখালের মাতা কৈলাসকামিনীর দেহত্যাগ হয়। অতঃপর রাখালের পিতা দ্বিতীয়বার হেমাঙ্গিনী দেবীকে বিবাহ করেন। তিনি শ্রীশ্রীঠাকুরকে দক্ষিণেশ্বরে দর্শন করিয়াছিলেন। শ্রীশ্রীঠাকুর তাঁহাকে বিশেষভাবে আপ্যায়িত করিয়াছিলেন।

রাখালের বাপের শ্বশুর (শ্যামলাল সেন) — ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের ত্যাগী সন্তান স্বামী ব্রহ্মানন্দের মাতামহ সম্পর্কীয়। রাখালচন্দ্রের পিতা আনন্দমোহন ঘোষ, রাখালের মাতার মৃত্যুর পর ইঁহার কন্যা কে বিবাহ করেন। তিনি সাধক ছিলেন। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের নাম শুনিয়া তিনি জামাতা আনন্দমোহনের সঙ্গে দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুরকে দর্শন করিতে যান। গৃহস্থাশ্রমে থাকিয়াও ঈশ্বর লাভের উপায় সম্পর্কে ঠাকুর তাঁহাদের উপদেশ দান করেন।

রাজনারায়ণ — শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকে চণ্ডীর গান শুনাইয়া তুষ্ট করিবার সৌভাগ্য অর্জন করিয়াছিলেন। তাঁহার দুই পুত্রসহ তিনি গান করিতেন।

রাজমোহন — শ্রীরামকৃষ্ণের সংস্পর্শে আগত পুরাতন ব্রাহ্মভক্ত। নিবাস কলিকাতার সিমুলিয়া পল্লী। ব্রাহ্ম সমাজের উপাসনা উপলক্ষে নরেন্দ্রনাথ (পরে স্বামী বিবেকানন্দ) প্রভৃতি তরুণেরা প্রায়ই তাঁহার বাড়িতে যাইতেন। ইহা শুনিয়া ঠাকুর ১৮৮২ খ্রীষ্টাব্দের ১৬ই নভেম্বর সন্ধ্যার পর রাজমোহনের বাড়িতে শুভাগমন করেন এবং ভক্তগণের উপাসনাদি দেখেন ও নরেন্দ্রনাথের গান শুনিয়াছিলেন। এই উপলক্ষে রাজমোহন ঠাকুরকে জলযোগে আপ্যায়িত করিয়াছিলেন।

রাজেন্দ্র ডাক্তার [রাজেন্দ্রলাল দত্ত] (১৮১৮ – ১৮৮৯) — শ্রীরামকৃষ্ণের ভক্ত। ঠাকুরের চিকিৎসকদের অন্যতম। কলিকাতার বহুবাজারনিবাসী প্রসিদ্ধ ধনী অক্রূর দত্তের বংশধর। বিখ্যাত হোমোওপ্যাথিক চিকিৎসক। স্বনামধন্য ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকার তাঁহার অনুপ্রেরণায় হোমিওপ্যাথিক মতে চিকিৎসা করেন। রাজেন্দ্রলাল প্রথমে এলোপ্যাথিক মতে চিকিৎসা করেন। পরে হোমিওপ্যাথিতে বিশ্বাসী হইয়াছিলেন। চিকিৎসা উপলক্ষে ঠাকুরের সেবার অধিকার পাইয়া তিনি নিজেকে কৃতার্থ মনে করিতেন। তিনি মখমলের যে কোমল জুতাজোড়া আনিয়া স্বয়ং ঠাকুরকে পরাইয়া দিয়াছিলেন আজও তাহা বেলুড় মঠে পূজিত হয়।

রাজেন্দ্রনাথ মিত্র — ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট, ইংরেজ সরকারের প্রথম ভারতীয় অ্যাসিস্টেন্ট সেক্রেটারী, ভাইসরয়ের আইন মন্ত্রী। তিনি শ্রীশ্রীঠাকুরের গৃহীভক্তদ্বয় রামচন্দ্র দত্ত ও মনোমোহন মিত্রের মেসোমশাই ছিলেন। কেশবচন্দ্র সেন ছিলেন তাঁহার বন্ধু। ১৮৮১ খ্রীষ্টাব্দে ডিসেম্বর মাসে মনোমোহনের বাটীতে রামকৃষ্ণদেব শুভাগমন করেন। কেশবচন্দ্র সেন ও রাজেন্দ্র মিত্র সেইস্থলে উপস্তিত ছিলেন। কেশবের অনুরোধে রাজেন্দ্র তাঁহার গৃহে ১০ই সেপ্টেম্বর, ১৮৮১ খ্রী: একটি উৎসবের আয়োজন করেন এবং শ্রীরামকৃষ্ণদেব আমন্ত্রিত হন। পথে সুরেন্দ্র ঠাকুরকে রাধাবাজারের স্টুডিওতে লইয়া গিয়া ফটো তোলান। রাজেন্দ্র মিত্রের গৃহে ঈশ্বরীয় প্রসঙ্গের পর ঠাকুর কীর্তন ও নৃত্য করিতে করিতে সমাধিস্থ হন।

রাধিকা (প্রসাদ) গোস্বামী (১৮৬৩ — ১৯২৪) — বৈষ্ণব ভক্ত। ১৮৮৪ খ্রীষ্টাব্দে তিনি দক্ষিণেশ্বরে আসিয়া ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণকে প্রথম দর্শন ও প্রণাম করেন। তিনি অদ্বৈত প্রভুর বংশধর জানিয়া ঠাকুরও ভক্তিভরে তাঁহাকে হাতজোড় করিয়া নমস্কার করেন। উত্তরকালে ইনি প্রসিদ্ধ সঙ্গীতজ্ঞ হইয়াছিলেন।

রানী রাসমণি (১৭৯৩ – ১৮৬১) — দক্ষিণেশ্বর কালীমন্দিরের প্রতিষ্ঠাত্রী। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের মতে রানী জগন্মাতার অষ্টনায়িকার অন্যতমা। পুণ্যশ্লোকা, পরোপকারিণী, দানশীলা, তেজস্বিনী মহিলা। জন্ম চব্বিশ পরগণা জেলার হালিশহরের কাছে “কোনা” গ্রামে। পিতা হরেকৃষ্ণ দাস। মাতা রামপ্রিয়া দেবী। মাতৃদত্ত নাম রানী, পরবর্তী কালে রানী রাসমণি হিসাবে পরিচিতা। ১১ বৎসর বয়সে কলিকাতার জানবাজারের জমিবার রাজচন্দ্র দাসের সহিত বিবাহ হয়। এই সময় হইতেই ভগবদভক্তির সহিত দৃঢ় ব্যক্তিত্ব, তেজস্বিতা এবং হৃদয়বত্তা তাঁহার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হিসাবে লক্ষিত হয়। মৎস্যজীবিদের জন্য গঙ্গার জলকর রহিত করা তাঁহার অন্যতম কীর্তি। তবে তাঁহার জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি দক্ষিণেশ্বরে প্রায় ৯ লক্ষ টাকা ব্যয়ে মন্দিরাদি নির্মাণ করেন। ১৮৫৫ খ্রীষ্টাব্দে স্নানযাত্রার দিন শ্রীরামকৃষ্ণের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা শ্রীরামকুমার চট্টোপাধ্যায়ের বিধানে এবং পৌরোহিত্যে মন্দিরের এবং ৺ভবতারিণীমাতার বিগ্রহের প্রতিষ্ঠাকার্য মহাসমোরহে সম্পন্ন হয়। অন্য কেহ রাজি না হওয়ায় রামকুমারই দেবীর নিত্য পূজা করিতে থাকেন। ইহার কিছুকাল পরে ঠাকুর এই পূজার ভার গ্রহণ করেন। তখন হইতে শ্রীরামকৃষ্ণ সুদীর্ঘ ত্রিশ বৎসর দক্ষিণেশ্বরে অতিবাহিত করিয়াছিলেন। রানী রাসমণি আজীবন ঠাকুরের শ্রদ্ধা ও প্রীতির পাত্রী ছিলেন এবং ঠাকুরের সব কাজে রানীর সম্মতি থাকার দরুণ দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুরের পক্ষে নির্বিঘ্নে সকলপ্রকার সাধন-ভজন করা সম্ভবপর হয়।

রাম কবিরাজ — নাটাগড়ে বাড়ি ইনি ঠাকুরের পেটের অসুখের সময় দক্ষিণেশ্বরে তাঁহাকে দেখিতে আসেন। ঠাকুরের এই অসুখের ফলে অতি দুর্বল শরীরেও ভগবৎপ্রসঙ্গ করিতে দেখিয়া তিনি আশ্চর্যান্বিত হইয়াছিলেন। তাঁহার চিকিৎসায় ঠাকুরের উক্ত রোগের উপশম হয়।

রামকুমার চট্টোপাধ্যায় (১৮০৫ – ১৮৫৭) –শ্রীরামকৃষ্ণদেবের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা। রামকৃষ্ণদেবের জীবনে তাঁহার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। পিতার ঈশ্বরানুরাগ এবং বৈষয়িক জ্ঞান, উভয়ই তাঁহার চরিত্রে বিদ্যমান ছিল। তিনি সংস্কৃত কাব্য, ব্যাকরণ, জ্যোতিষ প্রভৃতি শাস্ত্রে সুপণ্ডিত ছিলেন। তিনি নিষ্ঠাবান, বাক্‌ সিদ্ধ, সৎ প্রকৃতির পুরুষ ছিলেন। পিতৃবিয়োগের পর সংসারের আর্থিক দুরবস্থা দূর করিবার জন্য তিনি কলিকাতার ঝামাপুকুর অঞ্চলে একটি টোল খুলিয়া ছাত্র পড়াইতে আরম্ভ করেন। ১৮৫৩ খ্রীষ্টাব্দে তিনি কনিষ্ঠ ভ্রাতা গদাধরকে (শ্রীরামকৃষ্ণের পূর্বনাম) কলিকাতায় লইয়া আসেন। রামকুমার ১৮৫৫ খ্রীষ্টাব্দে রানী রাসমণি স্থাপিত দক্ষিণেশ্বর ৺কালীমন্দিরের স্থায়ী নিত্য পূজকের পদ গ্রহণ করেন। ইহার এক বৎসর পরে শারীরিক অপটুতাবশতঃ তিনি গদাধরকে ৺কালীপূজার ভার অর্পণ করেন ও নিজে ৺রাধাকান্তের পূজার ভার নেন। রামকুমার স্বয়ং শ্রীশ্রীঠাকুরকে পূজাবিধি ও চণ্ডীপাঠ সেখান। এইভাবেই তাঁহার প্রচেষ্টা ও শিক্ষায় গদাধর দক্ষিণেশ্বরে স্থায়ী পূজকের পদে নিযুক্ত হন। তিনি কলিকাতার উত্তরস্থ মূলাজোড় নামক স্থানে কার্যোপলক্ষে গমন করিয়া সান্নিপাতিক জ্বরে দেহত্যাগ করেন।

রামচন্দ্র দত্ত (১৮৫১ – ১৮৯৯) — শ্রীশ্রীঠাকুরের পরম ভক্ত। কলিকাতার নিকটবর্তী নারিকেলডাঙ্গায় ৩০/১০/১৮৫১ তারিখে বৈষ্ণব কুলে জন্ম। পিতা নৃসিংহপ্রসাদ, মাতা তুলসীমণি, স্ত্রী কৃষ্ণপ্রেয়সী। প্রথম জীবনে বিজ্ঞানচর্চার ফলে তিনি নাস্তিক ও যুক্তিবাদী হইয়া পড়েন। আকস্মিকভাবে একটি কন্যা সন্তানের মৃত্যুতে তাঁহার তত্ত্বান্বেষণের সূচনা হয়। তাঁহার মাসতুতো ভাই মনোমোহন মিত্রের সহিত তিনি ১৮৭৯ খ্রীষ্টাব্দে দক্ষিণেশ্বরে আসিয়া শ্রীরামকৃষ্ণের দর্শনলাভ করেন। দর্শনমাত্র তাঁহার হৃদয় শান্ত হয়। তিনি ঠাকুরের নিকট যাতায়াত শুরু করেন এবং তিনিই যে তাঁহার আরাধ্য দেবতা তাহা অনুভব করিতে থাকেন। ১৮৮০ এবং ১৮৮১ খ্রীষ্টাব্দে ঠাকুর তাঁহার গৃহে শুভাগমন করেন। ফলে রামচন্দ্রের মন আমূল পরিবর্তিত হইয়া যায়। তিনি ও মনোমোহনবাবু একযোগে ঠাকুরকে অবতার বলিয়া প্রচার করিতে থাকেন এবং এ সম্বন্ধে অনেকগুলি বক্তৃতা দেন। রামচন্দ্র ঠাকুরের জীবিতাবস্থাতেই তাঁহার উপদেশ ও জীবনী অবলম্বনে “তত্ত্বাসার” ও“তত্ত্বপ্রকাশিকা” বা “শ্রীরামকৃষ্ণদেবের উপদেশ” নামক পুস্তক এবং “তত্ত্বমঞ্জরী” নামক মাসিক পত্রিকা সম্পাদনা করিয়া প্রকাশ করেন। কাঁকুড়গাছিতে ঠাকুরের অনুমতিক্রমে একটি বাগানবাড়ি ক্রয় করিয়া বিখ্যাত “যোগদ্যানের” প্রতিষ্ঠান করেন। ১৮৮৩ খ্রীষ্টাব্দে ঠাকুর এখানে শুভ পদার্পণ করেন। পরবর্তী কালে ঠাকুরের দেহরক্ষার পর শ্রীরামকৃষ্ণদেবের মন্দির প্রতিষ্ঠিত করিয়া ওই স্থানটিকে মহাতীর্থে পরিণত করেন। ১৮৯৯ খ্রীষ্টাব্দের ১৭ই জানুয়ারি ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের আজীবন মহাভক্ত শ্রীরামচন্দ্র “যোগোদ্যানে” দেহত্যাগ করেন।

রামচন্দ্র মুখোপাধ্যায় — নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ। পিতার নাম কার্তিকরাম। শ্রীশ্রীমা সারদা দেবীর পিতৃদেব। নিবাস বাঁকুড়া জেলার জয়রামবাটি গ্রামে। স্ত্রী শিহড় গ্রামের হরিপ্রসাদ মজুমদারের কন্যা শ্যামাসুন্দরীদেবী। সারদাদেবী তাঁহাদের প্রথম সন্তান। শ্রীশ্রীমা নিজে তাঁহার পিতার সম্বন্ধে বলিয়াছিলেন — তিনি পরম রাম ভক্ত, নৈষ্ঠিক ও পরোপকারী ছিলেন। ১৮৭২ খ্রীষ্টাব্দের মার্চ মাসে রামচন্দ্র কন্যা সারদাকে লইয়া দক্ষিণেশ্বরে জামাতার (শ্রীরামকৃষ্ণের) নিকট উপস্থিত হন এবং সেখানে কয়েকদিন অবস্থান করেন। ১২৮০ বঙ্গাব্দের ১৮ই চৈত্র রামনবমী তিথিতে জয়রামবাটিতেই তিনি দেহত্যাগ করেন।

রাম চাটুজ্যে — কথামৃতে তাঁহাকেও কখনও রাম চক্তবর্তী বলিয়া উল্লেখ করা আছে। দক্ষিণেশ্বরেই থাকিতেন। ঠাকুরের ভক্ত। ঠাকুর তাঁহার তত্ত্বাবধানের প্রশংসা করিতেন, কারণ ঠাকুরের ভক্তদের আহারাদি সম্পর্কে তিনি সর্বদা যত্নবান ছিলেন। তিনি দক্ষিণেশ্বরে ৺রাধা-গোবিন্দ মন্দিরের পূজারী ছিলেন। দক্ষিণেশ্বর ত্যাগ করিয়া অসুস্থ অবস্থায় ঠাকুর কাশীপুরে থাকাকালীন রাম চাটুজ্যে নিয়মিত তাঁহার খোঁজখবর লইতেন।

রামতারণ — গিরিশচন্দ্র ঘোষের থিয়েটারের অভিনেতা ও সুগায়ক। শ্যামপুকুরে অবস্থানকালে অসুস্থ ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণকে গান শুনাইবার জন্য গিরিশবাবু রামতারণকে লইয়া আসেন। তাঁহার ভক্তিমূলক গান শুনিয়া ঠাকুর ভাবাবিষ্ট হন।

রামদয়াল চক্রবর্তী — শ্রীরামকৃষ্ণের ভক্ত। নিবাস আঁটপুর। বলরাম বসুর পুরোহিত বংশের সন্তান। হোরমিলার ষ্টীমার কোম্পানির ঠিকাদার ছিলেন। কেশব সেনের ব্রাহ্মসমাজে ঠাকুরের কথা শুনিয়া দক্ষিণেশ্বরে যাতায়াত করিতে থাকেন। বাবুরাম মহারাজ (স্বামী প্রেমানন্দ), মাস্টার মশাই মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত প্রভৃতি ঠাকুরের অন্তরঙ্গ ভক্তগণের সঙ্গে রামদয়াল বহুদিন দক্ষিণেশ্বরে রাত্রিবাসও করিয়াছেন। ঠাকুর স্নেহভরে রামদয়ালকে নানা উপদেশ দিতেন। রামদয়ালের আহ্বানেই ভক্ত বলরাম বসু কটক হইতে কলিকাতায় চলিয়া আসেন। কলিকাতায় আসিবার পরের দিনই রামদয়াল বলরাম বসুকে সঙ্গে লইয়া দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুরের নিকট উপস্থিত হইয়াছিলেন। রামদয়াল আজীবন রামকৃষ্ণ মিশনের অনুরাগী ছিলেন। স্বামী বিবেকানন্দের চিঠিতে তাঁহার নাম বহুবার উল্লিখিত আছে।

রামনারায়ণ — ডাক্তার, গোঁড়া হিন্দু। শ্রীশ্রীঠাকুরকে দর্শন করিয়াছিলেন। শ্রীশ্রীঠাকুর তাঁহার সম্বন্ধে ডাক্তার সরকারের নিকট শ্যামপুকুর বাটীতে উল্লেখ করিয়াছিলেন।

রামপ্রসন্ন ভট্টাচার্য — শ্রীরামকৃষ্ণের সান্নিধ্যে আগত রামপ্রসন্ন দক্ষিণেশ্বরের পার্শ্ববর্তী আড়িয়াদহের অধিবাসী। ভক্তবর কৃষ্ণকিশোর ভট্টাচার্যের পুত্র। ঠাকুরের সংস্পর্শে আসার পর রামপ্রসন্ন মাঝে মাঝে ঠাকুরের কাছে বসিয়া প্রাণায়াম করিতেন। একবার রামপ্রসন্ন তাঁহার বৃদ্ধা মায়ের সেবা না করিয়া হঠযোগী সাধুর সেবা করার জন্য ঠাকুর বিরক্তি প্রকাশ করিয়াছিলেন।

রামলাল — ঠাকুরের মধ্যম অগ্রজ রামেশ্বর চট্টোপাধ্যায়ের জ্যেষ্ঠ পুত্র। ঠাকুর তাঁহাকে স্নেহভরে “রামনেলো” বলিয়া ডাকিতেন। এবং বেলুড় মঠের সকলের নিকট তিনি “রামলাল দাদা” নামে পরিচিত ছিলেন। রামেশ্বর দেহত্যাগের পর তিনি দক্ষিণেশ্বরে ৺ভবতারিণীর পূজকের পদে নিযুক্ত হন এবং আজীবন সেই দায়িত্ব পালন করেন। তিনি সুগায়ক ছিলেন। শ্রীশ্রীঠাকুরকে অনেকবার গান শুনাইয়াছেন। ঠাকুর কাশীপুরে কল্পতরু দিবসে রামলালকেও কৃপা করেন।

রামেশ্বর চট্টোপাধ্যায় — (১৮২৬ – ৭৩) — ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের মধ্যম অগ্রজ ভ্রাতা। সাংসারিক বিষয়ে তিনি চিরকাল উদাসীন ছিলেন। তিনি চারিবৎসরকাল দক্ষিণেশ্বরে মা ৺কালীর পূজারী পদে নিযুক্ত ছিলেন। কামারপুকুরে তিনি দেহত্যাগ করেন। তাঁহার পুত্র রামলাল, শিবরাম ও কন্যা লক্ষ্মীমণি।

লক্ষ্মী-দিদি (১৮৬৪ – ১৯২৬) — ঠাকুরের কৃপাধন্য মহাসাধিকা লক্ষ্মীমণি দেবী ঠাকুরের মধ্যম ভ্রাতা রামেশ্বরের কন্যা এবং রামলাল ও শিবরামের ভগিনী। ঠাকুরের ভক্তমণ্ডলীর নিকট তিনি লক্ষ্মী-দিদি নামে পরিচিতা ছিলেন। এগার বৎসর বয়সে বিবাহের অল্প কয়েকদিন পরেই তাঁহার স্বামী চিরদিনের মতো নিরুদ্দেশ হন। ১২ বৎসর অপেক্ষা করিবার পর তিনি শ্বশুর বাড়িতে স্বামীর শ্রাদ্ধাদি সম্পন্ন করিয়া পিতৃগৃহেই বাস করিতে থাকেন। দক্ষিণেশ্বরে শ্রীশ্রীমায়ের সঙ্গিনী হিসাবে তিনি নহবত ঘরে শ্রীশ্রীমায়ের সহিত সর্বক্ষণ থাকিতেন বলিয়া ঠাকুর তাঁহাদের উভয়কে ‘শুক-সারী’ বলিয়া ডাকিতেন। পূর্বে উত্তরদেশীয় এক সন্ন্যাসীর নিকট শক্তি মন্ত্রে দীক্ষা গ্রহণ করিলেও ঠাকুর তাঁহার জিহ্বায় ‘রাধাকৃষ্ণ’ নাম ও বীজ লিখিয়া পুনরায় তাঁহাকে দীক্ষিত করেন। লক্ষ্মী-দিদি শ্রীশ্রীঠাকুরকে গুরু, ইষ্ট ও অবতাররূপে জ্ঞান করিতেন অপরপক্ষে ঠাকুরও তাঁহাকে মা-শীতলার অংশরূপে জানিতে পারিয়া কাশীপুরে থাকাকালীন মা-শীতলারূপে পূজা করিয়াছিলেন। দেব-দেবী সাজিয়া, নাচিয়া গাহিয়া তিনি সকলের আনন্দ বিধান করিতে অতিশয় পারদর্শী ছিলেন। এইরূপ এক আসরে ভগিনী নিবেদিতা স্বয়ং সিংহ সাজিয়া তাঁহাকে ৺জগদ্ধাত্রীরূপে পৃষ্ঠে ধারণ করিয়াছিলেন। লক্ষ্মী-দিদি মন্ত্রদীক্ষা দিয়া অনেককে শিষ্যরূপে গ্রহণ করিয়াছিলেন। ভক্তরাই তাঁহাকে দক্ষিণেশ্বরে একটি দ্বিতল গৃহ নির্মাণ করিয়া দিলে সেখানেই তিনি দীর্ঘ ১০ বৎসর কাটাইয়াছিলেন। পুরীধামের প্রতি তাঁহার বিশেষ আকর্ষণ লক্ষ্য করিয়া ভক্তেরাও সেখানেও তাঁহার জন্য ‘লক্ষ্মীনিকেতন’ নামে একটি পাকা বাড়ি নির্মাণ করিয়া দেন। এই বাড়িতেই ২৪।২।১৯২৬ তারিখে তাঁহার তিরোভাব ঘটে।

লক্ষ্মীনারায়ণ মারোয়াড়ী — শ্রীশ্রীঠাকুরের অনুরাগী ভক্ত, বিত্তশালী ব্যক্তি। কলিকাতায় থাকিতেন। মাঝে মাঝে দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুরের নিকটে আসিতেন। ইনি ঠাকুরকে দশ হাজার টাকা লিখিয়া দিতে চাহিলে ঠাকুর অত্যন্ত বিচলিত হইয়া তাঁহাকে তিরস্কার করেন।

লাটু (রাখতুরাম — স্বামী অদ্ভুতানন্দ) — বিহারের ছাপরা জেলার কোন এক গ্রামে জনৈক মেষ-পালকের গৃহে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর জন্ম-সাল, তারিখ বা তিথি — সবকিছু অজ্ঞাত। জীবিকা অর্জনের জন্য তিনি কলিকাতায় আসেন। শ্রীরামকৃষ্ণের গৃহীভক্ত রামচন্দ্রের গৃহে তিনি কাজ করিতেন। তাঁহার কাজে সন্তুষ্ট হইয়া রামচন্দ্র তাঁহাকে সস্নেহে ‘লালটু’ নামে ডাকিতেন। রামচন্দ্রের সঙ্গে আসিয়া লাল্টু প্রথম দক্ষিণেশ্বরে শ্রীরামকৃষ্ণকে দর্শন করেন। ঠাকুর লালটুকে স্পর্শ করিলে তাঁহার জীবনের গতি অন্যদিকে প্রবাহিত হয়। লালটুর মন অন্য সব ভুলিয়া শ্রীরামকৃষ্ণের দিক ধাবিত হইতে লাগিল। রামচন্দ্রও লালটুকে প্রায়ই দক্ষিণেশ্বরে পাঠাইতেন। অবশেষে শ্রীরামকৃষ্ণ রামচন্দ্রের কাছ হইতে তাঁহাকে সেবকরূপে চাহিয়া লন। শ্রীরামকৃষ্ণের স্নেহময় মুখে লাটু বা নেটোতে পরিণত হইয়াছিল। ঠাকুরের শিক্ষা অনুযায়ী ধীরে ধীরে লাটুর আধ্যাত্মিক জীবন গঠিত হইতে থাকে। ঠাকুরের সন্ন্যাসী শিষ্যগণের মধ্যে তিনিই সর্বপ্রথম ঠাকুরের কাছে আসেন। সেইসময় হইতে ঠাকুরের মহাপ্রয়াণের দিন অবধি দীর্ঘকাল ঠাকুরের সেবা ও সঙ্গলাভ করিবার সৌভাগ্য লাটুর হইয়াছিল। শ্রীশ্রীসারদা দেবীর কাজে সহায়তা করিবার সুযোগও লাটুর জীবনে আসে। শ্রীরামকৃষ্ণের দেহত্যাগের পরে লাটু সন্ন্যাস গ্রহণ করেন। স্বামী অদ্ভুতানন্দ নামে তিনি শ্রীরামকৃষ্ণ সঙ্ঘে পরিচিত। নিজেকে কঠোর জপধ্যানে নিয়োজিত রাখিয়া এবং ভারতের বহু তীর্থ পরিভ্রমণ করিয়া তিনি শেষ জীবন কাশীতে অতিবাহিত করেন। অবশেষে ১৯২০ খ্রীষ্টাব্দের ২৪শে এপ্রিল কাশীতে তিনি দেহত্যাগ করেন।

শম্ভুচরণ মল্লিক — ঠাকুরের দ্বিতীয় রসদদার। কলিকাতার সিঁদূরিয়াপটির কমলনাথ স্ট্রীটের পৈতৃক বাড়িতে সুবর্ণবণিক কুলে জন্ম। সনাতন মল্লিকের একমাত্র পুত্র। সওদাগরী অফিসে মুৎসুদ্দির কাজ করিয়া প্রচুর অর্থ উপার্জন করেন। দক্ষিণেশ্বর-কালীবাড়ির অনতিদূরে তাঁহার উদ্যানবাটিতে যাতায়াত এবং অবস্থান উপলক্ষেই ঠাকুরের সহিত তাঁহার পরিচয় ঘটে। ঠাকুর শম্ভুবাবুর নিকট বাইবেল শ্রবণ করিয়া খ্রীষ্টের জীবনী ও উপদেশ সম্বন্ধে অবগত হন। প্রথমদিকে শম্ভুচরণ ব্রাহ্মধর্মে আকৃষ্ট হইলেও ঠাকুরের সংস্পর্শে আসিবার পর মহামূল্য অধ্যাত্মসম্পদের অধিকারী হন। ঠাকুরকে ‘গুরুজী’ বলিয়া সম্বোধন করিতেন। শম্ভুচরণ ও তাঁহার স্ত্রী উভয়েই শ্রীশ্রীমাকে সাক্ষাৎ দেবীজ্ঞানে পূজা করিতেন। নহবতে শ্রীমায়ের থাকিবার অসুবিধা লক্ষ্য করিয়া তিনি মন্দিরের নিকটেই একটি কুটির নির্মাণ করিয়া দেন। মথুরবাবুর দেহান্ত হইবার কিছুদিন হইতেই ঠাকুরের প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি তিনিই সরবরাহ করিতেন। চার বৎসর একনিষ্ঠ সেবা করিবার পর তিনি মৃত্যুশয্যায় শায়িত হইলে ঠাকুর শম্ভুচরণকে দেখিতে যান। ঠাকুরের জীবদ্দশাতেই শম্ভুচরণের দেহান্ত ঘটে ১৮৭৭ খ্রীষ্টাব্দে।

শরৎচন্দ্র — বরাহনগর নিবাসী সদাচারনিষ্ঠ গৃহস্থ ব্রাহ্মণ যুবক। বরাহনগর মঠে প্রায়ই আসিতেন। কিছুকাল বৈরাগ্যবশতঃ তীর্থে তীর্থে ভ্রমণ করিয়াছিলেন।

শরৎ [শরৎচন্দ্র চক্রবর্তী — স্বামী সারদানন্দ] (১৮৬৫ – ১৯২৭) — শরৎচন্দ্রের জন্ম কলিকাতার আমহার্স্ট স্ট্রীটে। পিতা গিরিশচন্দ্র এবং মাতা নীলমণি দেবী। পিতা ধনী ব্যক্তি ছিলেন। শরৎচন্দ্র মেধাবী ছাত্র হিসাবে হেয়ার স্কুল হইতে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইয়া সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ-এ ভর্তি হন। ছাত্র জীবনে কেশবচন্দ্রের প্রভাবে ব্রাহ্ম সমাজের সদস্য হইয়াছিলেন। কিন্তু খুড়তুত ভাই শশিভূষণ (পরে স্বামী রামকৃষ্ণানন্দ) প্রভৃতির সঙ্গে শ্রীরামকৃষ্ণকে দেখিতে দক্ষিণেশ্বরে যান। শ্রীরামকৃষ্ণের তীব্র বৈরাগ্যের উপদেশ শরতের জীবনে এক অভিনব আলোকসম্পাত করে। শ্রীরামকৃষ্ণের সপ্রেম ব্যবহার আরও দৃঢ়তর রূপে দক্ষিণেশ্বরের দিকে টানিতে লাগিল। কোন কোন দিন দক্ষিণেশ্বরে থাকিয়াও যাইতেন। গভীর রাত্রে ঠাকুর তাঁহাকে তুলিয়া দিয়া পঞ্চবটী, বেলতলা, অথবা ৺ভবতারিণীর নাট মন্দিরে ধ্যান করিতে পাঠাইতেন। পিতামাতার আশীর্বাদ লইয়াই তিনি গৃহত্যাগ করেন। বহুদিন তীর্থে তীর্থে পর্যটন ও তপস্যা করেন। স্বামীজীর আহ্বানে ইংলণ্ডে ও আমেরিকায় গিয়া সাফল্যের সহিত প্রচার কার্য চালাইয়া যান। এরপরে কলিকাতায় ফিরিয়া শ্রীরামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের সাদারণ সম্পাদক নিযুক্ত হন। অবশিষ্ট জীবন এই পদেই অধিষ্ঠিত থাকেন। ১৯০২ খ্রীষ্টাব্দে স্বামী ত্রিগুণাতীতানন্দ আমেরিকায় গমন করিলে উদ্বোধন পত্রিকার সমস্ত দায়িত্ব বহন করেন। নিবেদিতা বালিকা বিদ্যালয়ের রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচালনায় তাঁহার প্রচেষ্টা স্মরণীয়।

বাগবাজার উদ্বোধন অফিসে শ্রীশ্রীমায়ের জন্য বাড়ি নির্মাণ তাঁহার আরেক স্মরণীয় কাজ। স্বামী যোগানন্দের দেহত্যাগের পর হইতে স্বামী সারদানন্দই শ্রীশ্রীমায়ের প্রধান সেবকরূপে পরিগণিত হন। শ্রীশ্রীমা বলিতেন, ‘শরৎ আমার ভারী।’

‘শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণলীলাপ্রসঙ্গ’ মহাগ্রন্থ রচনা, জয়রামবাটীতে শ্রীশ্রীমায়ের জন্মস্থানে মাতৃমন্দির প্রতিষ্ঠা (১৯২৩ খ্রীঃ), ১৯২৬ খ্রীষ্টাব্দে রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের মহাসম্মেলনের ব্যবস্থা করা ইত্যাদি তাঁহার স্মরণীয় কীর্তি। ১৯২৭ খ্রীষ্টাব্দের ১২শে আগস্ট তিনি দেহত্যাগ করেন।

শশধর তর্কচূড়ামণি (১৮৫০ – ১৯২৮) — ফরিদপুর জেলার মুখডোবা গ্রামে যজুর্বেদী কাশ্যপ বংশে জন্ম। পিতা হলধর বিদ্যামণি, মাতা সুরেশ্বরী দেবী। পিতার নিকট তিনি নানা শাস্ত্র অধ্যয়ন করেন। হিন্দুধর্মপ্রচারে আগ্রহী হইয়া বঙ্গদেশের নানাস্থানে বক্তৃতা করিয়া বেড়ান। কাশিমবাজারের রাজার সভাপণ্ডিত নিযুক্ত হন। ১৮৮৪ খ্রীষ্টাব্দের জুন মাসে রামকৃষ্ণদেব তাঁহার বিষয়ে জ্ঞাত হইয়া ভক্ত ঈশান মুখোপাধ্যায়ের ঠনঠনিয়ার বাড়ি হইতে গাড়ি করিয়া তাঁহাকে দেখিতে যান। ঠাকুরের কথা ও উপদেশে মুগ্ধ হইয়া পণ্ডিত এক সপ্তাহের মধ্যেই দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুরের নিকটে আসেন। ওই বৎসরের উল্টোরথের দিন বলরাম-মন্দিরে ঠাকুর ভাবাবিষ্ট অবস্থায় তাঁহার হৃদয় স্পর্শ করেন। পরে আরো কয়েকবার তিনি ঠাকুরের সংস্পর্শে আসেন। শেষ বয়সে তিনি বহরমপুর জুবিলীটোলের অধ্যক্ষ হন। মুর্শিদাবাদের খাগড়ায় স্থায়ী বাড়ি নির্মাণ করিয়া শেষ জীবন সেখানে অতিবাহিত করেন।

শশী [শশীভূষণ চক্তবর্তী — স্বামী রামকৃষ্ণানন্দ] (১৮৬৩ – ১৯১১) –হুগলী জেলার ময়াল-ইছাপুর গ্রামে জন্ম। পিতা ঈশ্বরচন্দ্র তান্ত্রিক সাধক এবং পাইকপাড়ার রাজা ইন্দ্রনারায়ণ সিংহের সভাপণ্ডিত। বাল্যকাল হইতেই শশিভূষণ ধর্মভাবাপন্ন এবং মেধাবী। মাতা অতিশয় উদার হৃদয়া ও সরলা ছিলেন। তিনি এলবার্ট কলেজ হইতে এফ. এ. পাশ করেন এবং মেট্রোপলিটন কলেজে বি. এ. পড়েন। সংস্কৃতে ও অঙ্কে বিশেষ পারদর্শী ছিলেন। ছাত্রজীবনে ব্রাহ্মসমাজের প্রতি আকৃষ্ট হইয়া কেশব সেনের কাছে যাতায়াত করিতেন। কিন্তু শ্রীরামকৃষ্ণের নাম শুনিয়া জ্যাঠতুত ভাই শরতের সঙ্গে দক্ষিণেশ্বরে গিয়া শ্রীরামকৃষ্ণকে দর্শন করেন। প্রথম দিনেই ঠাকুর শশীর মন জয় করিয়া নিলেন। এরপরে ঘন ঘন যাতায়াতের ফলে শশী ক্রমে নরেন্দ্রাদি যুবক ভক্তদের সহিত পরিচিত এবং প্রেমসূত্রে আবদ্ধ হন। ঠাকুর একদিন শশীকে জানাইয়া দেন যে তিনি অর্থাৎ ঠাকুরই তাঁহার অভীষ্ট বস্তু। ইহার পরে হইতে তিনি শ্রীরামকৃষ্ণগতপ্রাণ হইয়া ওঠেন। শরৎ আর শশীকে শ্রীরামকৃষ্ণ প্রাণ ঢালিয়া ঠাকুরের সেবা করেন। তাঁহার দেহত্যাগের পর সন্ন্যাস গ্রহণ করিয়া স্বামী রামকৃষ্ণানন্দ নামে শ্রীরামকৃষ্ণ সঙ্ঘে পরিচিত হন। ঠাকুরের ত্যাগী সন্তানদের মধ্যে ইনি অন্যতম। স্বামীজীর নির্দেশে তিনি মাদ্রাজে গিয়া সেখানেও ঠাকুরের পূজা আরম্ভ করেন। কবি নবীনচন্দ্র এবং ঔপন্যাসিক শরৎচন্দ্রের সঙ্গে রেঙ্গুনে তাঁহার দেখা হয়। স্বামী রামকৃষ্ণানন্দের অক্লান্ত চেষ্টায় মাদ্রাজে ও বাঙ্গালোরে স্থায়ী মঠ গড়িয়া ওঠে। শ্রীশ্রীমা সারদা দেবী দাক্ষিণাত্যে তীর্থভ্রমণে আসিলে স্বামী রামকৃষ্ণানন্দ সর্বতোভাবে তঁহার দর্শনাদির সুব্যবস্থা করেন। ১০৮টি সোনার বেলপাতায় শ্রীশ্রীমা রামেশ্বরে ৺শিবের পূজা করিয়াছিলেন। এইসবই শশী মহারাজের ব্যবস্থায় হয়। তাঁহার লেখা অনেক গ্রন্থ আছে। কলিকতার উদ্বোধনের বাড়িতে তিনি দেহ্যতাগ করেন।

শালগ্রামের ভাই –তার ছেলে বংশলোচনের কারবার ছিল। শ্রীশ্রীঠাকুর তাহার সম্বন্ধে বলিয়াছিলেন যে সে বিরাশি রকমের আসন জানিত ও যোগসমাধির কথা বলিত। হঠযোগীদের দেহের উপর অত্যধিক আসক্তির ফলে তাহাদের মন ঈশ্বরের দিকে অধিকসময় থাকে না। টাকার লোভে সে দেওয়ান মদন ভট্টের কয়েক হাজার টাকার একটি নোট গিলিয়া ফেলে। কিন্তু পরে উহা আদায় হয়, এবং তাহার তিন বৎসর জেল হয়।

শিবচনদ্র — ঠনঠনের বাসিন্দা। দক্ষিণেশ্বরে শ্রীশ্রীঠাকুরের দর্শন লাভ করিয়াছিলেন এবং তাঁহার শ্রীমুখ হইতে ভগবৎপ্রসঙ্গ শুনিয়াছিলেন।

শিবনাথ শাস্ত্রী (১৮৪৭ – ১৯১৯) — শ্রীরামকৃষ্ণের অন্যতম অনুরাগী, ব্রাহ্মসমাজের বিশিষ্ট নেতা, সুলেখক এবং শিক্ষাব্রতী। চব্বিশ পরগণার চাঙ্গড়িপোতা গ্রামে মাতুলালয়ে জন্ম। ব্রাহ্ম নেতা আচার্য কেশবচন্দ্র সেনের সহযোগী। পরবর্তী কালে কেশবচন্দ্রের সহিত মতবিরোধের ফলে, তিনি সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ গঠন করিয়াছিলেন। সংস্কৃত কলেজ হইতে ক্রমে এফ.এ. (১৮৬৮), বি.এ. (১৮৭১) এবং এম. এ. পাস করিয়া ‘শাস্ত্রী’ উপাধি পান। ভবানীপুর সাউথ সুবার্বন স্কুলের প্রধান শিক্ষকের পদে কার্য করিবার সময় শিবনাথ ‘ইণ্ডিয়ন মিরর’ পত্রিকাতে শ্রীরামকৃষ্ণদেবের প্রসঙ্গে পাঠ করেন। আচার্য কেশব সেনের মাধ্যমেই শ্রীরামকৃষ্ণের সহিত শিবনাথ শাস্ত্রীর প্রত্যক্ষ যোগাযোগ ঘটে। শিবনাথ রচিত বহু গ্রন্থ তাঁহার সাহিত্য ও ধর্ম-চর্চারসাক্ষ্য বহন করে। ইহাদের মধ্যে ‘আত্মচরিত’ (১৯১৮), “রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ”, History of the Brahmo Samaj (1911-12), Men I have seen (1919) উল্লেখযোগ্য। তাঁহার শেষোক্ত গ্রন্থের অন্তর্গত ‘রামকৃষ্ণ পরমহংস’ নিবন্ধ হইতে জানা যায় তিনি দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুরের নিকট বহুবার যাতায়াত করেন এবং তাঁহার অহেতুকী স্নেহ ধারায় নিজেকে সিঞ্চিত করেন। শ্রীরামকৃষ্ণের জীবন ও বাণী শিবনাথ শাস্ত্রীর জীবনের বহু আধ্যাত্মিক আদর্শকে রসপুষ্ট করিয়াছিল। ঈশ্বরলাভের জন্য ঠাকুরের ত্যাগ, তিতিক্ষা এবং কঠোর জীবনযাপন শিবনাথকে বিস্মময়াভিভূত করিয়াছিল। শিবনাথের সরলতা ও নিষ্ঠার জন্য ঠাকুর তাঁহাকে পরম স্নেহ করিতেন। ঠাকুর মাঝে মাঝে শিবনাথকে দেখিবার জন্য উতলা হইতেন এবং তাঁহার সহিত ঈশ্বরীয় প্রসঙ্গে আনন্দ পাইতেন। ঠাকুরের অন্তিম অসুখের সময় শিবনাথ দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুরকে শেষবারের জন্য দেখিতে যান। কেবলমাত্র সাহিত্যিক হিসাবেই নয়, সত্যনিষ্ঠা, সরল বিশ্বাস এবং ঐকান্তিকতার জন্য শিবনাথ শাস্ত্রীর নাম আজও সমাজে আদৃত।

শিবরাম চট্টোপাধ্যায় (১৮৬৬ – ১৯৩৩) –ঠাকুরের মধ্যমভ্রাতা রামেশ্বরের কনিষ্ঠ পুত্র। জন্ম কামারপুকুরে। শ্রীশ্রীমায়ের বিশেষ কৃপাধন্য। শিবরামকে ‘ভিক্ষাপুত্র’ বলিতেন। ভক্তমহলে তিনি ‘শিবুদা’ বলিয়া পরিচিত ছিলেন। তাঁহার বিশেষ পীড়াপীড়িতে শ্রীমা নিজেকে ৺কালী বলিয়া স্বীকার করেন। কথামৃতে শ্রীশ্রীঠাকুর শিবরামকে বালকোচিত সারল্যের কথা উল্লেখ করিয়াছেন।

শ্রীনাথ ডাক্তার — শ্রীরামকৃষ্ণের সংস্পর্শে আগত, বেদান্তবাদী চিকিৎসক। নিবাস কলিকাতা। ঠাকুরের অন্তিম অসুখের সময় তিনি চিকিৎসক হিসাবে ঠাকুরের সান্নিধ্যে আসার সুযোগ পান। বেদান্তমতে “সব স্বপ্নবৎ” — একথা সংসারী লোকের পক্ষে ভাল নয় বলিয়া ঠাকুর তাঁহাকে উপদেশ দিয়াছিলেন।

শ্রীনাথ মিত্র — ইনি আদি ব্রাহ্মসমাজভুক্ত কাশীশ্বর মিত্রের পুত্র। ১৮৮২ খ্রীষ্টাব্দে ইনি ঠাকুরের সান্নিধ্যে আসেন। পর বৎসর তাঁহার বাড়িতে অনুষ্ঠিত ব্রাহ্মমহোৎসবে ঠাকুর নিমন্ত্রিত হইয়া গিয়াছিলেন এবং ঈশ্বরীয় প্রসঙ্গান্তে দয়াসিন্ধু ঠাকুর অসুবিধার মধ্যেও আহার করিয়া দক্ষিণেশ্বরে ফিরিয়াছিলেন।

শ্রীরাম মল্লিক — কামারপুকুরে শ্রীশ্রীঠাকুরের বাল্যসঙ্গী; সিওড়ে তাঁহাদের বাড়ি ছিল। বাল্যকালে উভয়ের মধ্যে খুব বন্ধুত্ব ছিল। কিন্তু পরবর্তী কালে শ্রীরাম ঘোরতর বিষয়ী হইয়া পড়েন। চানকে তাঁহার দোকান ছিল।

শ্রীশ মুখোপাধ্যায় — শ্রীরামকৃষ্ণদেবের ভক্ত ঠনঠনে নিবাসী ঈশানচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের পুত্র। শ্রীমহেন্দ্রনাথ গুপ্তের সহপাঠী। বিশ্ববিদ্যালয়ের রত্ন ছিলেন। প্রথমে আলিপুরে ওকালতি করিতেন এবং পরে ডিস্ট্রিক্ট জজ হইয়াছিলেন। তাঁহার গৃহে আগমনকালে ঠাকুরের সহিত তাঁহার ধর্মালোচনা হয়। ঠাকুর তাঁহার শান্তস্বভাব দেখিয়া প্রশংসা করিয়াছিলেন।

শ্রীশ্রীমা [শ্রীশ্রীসারদা দেবী] (১৮৫৩ – ১৯২০) — পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া জেলার জয়রামবাটী গ্রামে ১৮৫৩ খ্রীষ্টাব্দের ২২শে ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার সারদাদেবীর জন্ম হয়। রামচন্দ্র মুখোপাধ্যায় ও শ্যামাসুন্দরী দেবীর প্রথম সন্তান। শিশুকাল হইতেই তাঁহার জীবনে সেবা, পরোপকার, দয়া, ক্ষমা, সত্য প্রভৃতি সদ্‌গুণরাশি বিকশিত হয়। ছয় বৎসরের সারদার বিবাহ হয় ২৪ বৎসরের যুবক শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে। বিবাহের পর কখনও জয়রামবাটীতে কখনও কামারপুকুরে কাটাইতেন। দক্ষিণেশ্বরে সাধনমগ্ন শ্রীরামকৃষ্ণের উন্মত্ততা সম্পর্কে নানাবিধ গুজব শুনিয়া তিনি একবার দক্ষিণেশ্বরে গিয়া দেখিয়া আসিবার সংকল্প গ্রহণ করিলেন। কিছুদিন পর পিতার সঙ্গে দক্ষিণেশ্বরে গমন করেন। ১৮৭২ খ্রীষ্টাব্দের ৫ই জুন ফলহারিণী কালীপূজার দিন তিনি শ্রীরামকৃষ্ণকর্তৃক ষোড়শীরূপে পূজিতা হন। পরে জয়রামবাটী প্রত্যাবর্তন করেন। অসুস্থ শ্রীরামকৃষ্ণের আহ্বানে ১৮৮২ খ্রীষ্টাব্দে পুনরায় দক্ষিণেশ্বরে আগমন ও তাঁহার সেবার ভার গ্রহণ করেন। অপরদিকে সারদাদেবীর জীবনে শুরু হয় শ্রীরামকৃষ্ণের নিকট আদর্শ জীবন যাপনের শিক্ষা — পবিত্র সুন্দর চরিত্র কিভাবে গঠন করিতে হয়, দৈনন্দিন গৃহস্থালির কাজ কিভাবে সুসম্পন্ন করিতে হয়, সমস্ত কর্তব্য সম্পাদনের সঙ্গে সঙ্গে কিভাবে ঈশ্বর-আরাধনায় নিমগ্ন থাকা যায় ইত্যাদি। অসুস্থাবস্থায় শ্রীরামকৃষ্ণ বাটী ও কাশীপুর উদ্যানবাটীতে থাকাকালীন সারদাদেবী তাঁহার সেবাতেই নিযুক্তা ছিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণের দেহান্তে কিছুকাল তীর্থদর্শনাদি ও তপস্যায় অতিবাহিত করেন। তারপর বিভিন্ন সময়ে তিনি কামারপুকুর, জয়রামবাটী, কলিকাতা, ঘুষুড়ী, বেলুড়ে নীলাম্বরবাবুর বাগানবাড়ি প্রভৃতি স্থানে বাস করেন। শেষ কয় বৎসর তিনি কলিকতার বাগবাজারে ১নং উদ্বোধন লেনের বাড়িতে (মায়ের বাড়ি) অতিবাহিত করেন এবং এই বাড়িতেই ১৯২০ খ্রীষ্টাব্দের ২১শে জুলাই তাঁহার মহাসমাধি হয়। সঙ্ঘমাতারূপে তিনি শ্রীরামকৃষ্ণ সঙ্ঘকে নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত করিতেন। তাঁহার জীবন ছিল অনাড়ম্বর ও বাহুল্যবর্জিত। কিন্তু শ্রীমা জগতের সামনে একটি মহৎ জীবন – দর্শনকে তুলিয়া ধরিয়াছেন। ভগিনী নিবেদিতার মতে, ভারতীয় নারীর আদর্শ সম্বন্ধে শ্রীসারদাদেবীই শ্রীরামকৃষ্ণের চরম কথা।

শৈলজাচরণ মুখুজ্জে — কলকাতার বেচু চ্যাটার্জ্জী স্ট্রিটের ৺শ্যামসুন্দর বিগ্রহের সেবক। এই মন্দির প্রাঙ্গণেই ঠাকুরের জ্যেষ্ঠভ্রাতা রামকুমার ঝামাপুকুরে প্রথম টোল খুলিয়াছিলেন। শৈলজাচরণ মিত্রের গৃহে শ্রীরামকৃষ্ণকে দর্শন করিয়াছিলেন।

শোকাতুরা ব্রাহ্মণী (১৮৬৪ – ১৯২৪) — শ্রীরামকৃষ্ণ সঙ্ঘে ‘গোলাপ-মা’ বলিয়া পরচিতা। প্রকৃত নাম অন্নপূর্ণা দেবী নামান্তরে গোলাপসুন্দরী দেবী। কথামৃতে ‘শোকাতুরা ব্রাহ্মণী’ বলিয়া উল্লিখিত। উত্তর কলিকাতার বাগবাজারে ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্ম। তাঁহার একমাত্র কন্যা শ্রীমতী চণ্ডীর সহিত ঠাকুর পরিবারের সৌরীন্দ্র ঠাকুরের বিবাহ হয়। অকালে স্বামী, পুত্র এবং বিবাহিতা কন্যা “চন্ডী”র মৃত্যুতে তাঁহার জীবনে নিদারুণ শোক নামিয়া আসে। সেইসময় যোগীন-মা এই শোকাতুরা মহিলাকে ঠাকুরের নিকট আনিয়া উপস্থিত করিলে ঠাকুরের দিব্য সান্নিধ্যে তাঁহার শোকতাপ দূরীভূত হয়। পরবর্তী কালে ঠাকুরের করুণায় গোলাপ-মা দক্ষিণেশ্বরে নহবত-ঘরে শ্রীশ্রীমা সারদাদেবীর সঙ্গে বাস করিবার সুযোগ পান এবং সেখানে মধ্যে মধ্যে থাকিয়া সেবা করার সুযোগ পাইয়া কৃতার্থ হন। পরবর্তী সময়ে শ্যামপুকুরে এবং কাশীপুরেও তিনি অসুস্থ ঠাকুরের যথাসাধ্য সেবা করিয়াছিলেন। ঠাকুরের তিরোভাবের পর ভাগ্যবতী গোলাপ-মা শ্রীশ্রীমায়ের সেবার ভার গ্রহণ করেন এবং তাঁহার সঙ্গে বহু তীর্থ দর্শন করেন। শেষজীবনে তিনি শ্রীশ্রীমায়ের সঙ্গে বাগবাজারে উদ্বোধন মঠে বাস করিতেন। শ্রীশ্রীমায়ের তিরোভাবের পর তিনি ভক্তদের সেবা ও পরিচর্যার ভার গ্রহণ করেন। ১৯২৪ খ্রীষ্টাব্দের ১৯শে ডিসেম্বর তিনি দেহত্যাগ করেন।

শ্যাম ডাক্তার –১৮৮৩ খ্রীষ্টাব্দের ১৪ই ডিসেম্বর দক্ষিণেশ্বরে শ্রীরামকৃষ্ণদেবকে দর্শন ও তাঁহার নিকট ভগবৎ কথা শুনিয়াছিলেন।

শ্যাম দাস — প্রখ্যাত কীর্তনিয়া। ঠাকুরের গৃহীভক্ত রামচন্দ্র দত্ত তাঁহার নিকট কীর্তন শিখিতেন। ১৮৮৪ খ্রীষ্টাব্দের ৭ই সেপ্টেম্বর একদিন দক্ষিণেশ্বরে শ্যাম দাসের “মাথুর” কীর্তন শুনিয়া ঠাকুর ভাবাবিষ্ট হইয়াছিলেন।

শ্যাম বসু — শ্রীরামকৃষ্ণের বয়স্ক ভক্ত। ১৮৮৫ খ্রীষ্টাব্দের অক্টোবর মাসে শ্যামপুকুর বাটীতে ঠাকুরের দর্শন লাভ করেন। ঈশ্বর চিন্তার প্রতি তাঁহার মন ব্যাকুল হওয়ায় শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁহার প্রতি প্রসন্ন হন এবং তাঁহাকে সাধন সম্বন্ধে নানাবিধ নির্দেশ দান করেন।

শ্যামাপদ ভট্টাচার্য (পণ্ডিত শ্যামাপদ ভট্টাচার্য ন্যায়বাগীশ) — শ্রীরামকৃষ্ণের কৃপাপ্রাপ্ত ভক্ত। নিবাস হুগলী জেলার আঁটপুর। এই নিরহঙ্কার পণ্ডিতকে ঠাকুর বিশেষ স্নেহ করিতেন। ১৮৮৫ খ্রীষ্টাব্দের ২৭শে আগস্ট দক্ষিণেশ্বরে শ্যামাপদর মুখে শ্রীমদ্‌ভাগবতের আবৃত্তি শুনিয়া ঠাকুর সমাধিস্থ হন এবং সমাধিস্থ অবস্থায় শ্যামাপদর ক্রোড়ে ও বক্ষে শ্রীচরণ স্থাপন করিয়া বিশেষ কৃপা করেন।

শ্যামাসুন্দরী দেবী (শ্যামাসুন্দরী মিত্র) — শ্রীরামকৃষ্ণের কৃপাধন্যা মহিলা ভক্ত। ঠাকুরের গৃহীভক্ত মনোমোহন মিত্রের জননী। তাঁহার চারি কন্যা ও তিনি জামাতা শ্রীরামকৃষ্ণের কৃপালাভ করিয়াছিলেন। তাঁহর তৃতীয় জামাতা রাখালচন্দ্র (পরে স্বামী ব্রহ্মানন্দ)। পতিবিয়োগের পর শ্যামাসুন্দরী ঠাকুরের আমন্ত্রণে একবার পুত্র-কন্যাসহ দক্ষিণেশ্বরে আসেন এবং ঠাকুরের নির্দেশমত এক জায়গাতেই প্রসাদ গ্রহণের জন্য বসেন। নিজের ভোজন পাত্র হইতে শ্রীরামকৃষ্ণ বিধবা শ্যামাসুন্দরীকে মাছের মুড়ো দিলে শ্যামাসুন্দরী প্রসাদজ্ঞানে বিনা দ্বিধায় তাহা গ্রহণ করেন। রামচন্দ্র দত্তের বাড়িতে মহোৎসবের সময় নাম-কীর্তন শুনিতে শুনিতে ভাগ্যবতী শ্যামাসুন্দরী ইহলোক ত্যাগ করেন।

শ্যামাসুন্দরী দেবী — শ্রীশ্রীমা সারদাদেবীর মাতৃদেবী। জন্মস্থান — বাঁকুড়া জেলার সিহড় গ্রাম। পিতা হরিপ্রসাদ মজুমদার। জয়রামবাটীর কার্তিকরাম মুখোপাধ্যায়ের জ্যেষ্ঠ পুত্র রামচন্দ্রের সহিত বিবাহ হয়। সারদাদেবী ইঁহাদেরই প্রথম সন্তান। শ্রীরামকৃষ্ণজননী চনদ্রমণি দেবীর জীবনে শ্রীরামকৃষ্ণের আর্বিভাবের পূর্বে যেমন অলৌকিক দর্শনাদি হইয়াছিল, শ্রীশ্রীসারদাদেবীর আবির্ভাবের পূর্বেও তেমন অলৌকিক দর্শনাদি শ্যামাসুন্দরীদেবীর জীবনেও ঘটিয়াছিল। দেব-দ্বিজে ভক্তি-পরায়ণা, অমায়িক, অতিথিবৎসলা শ্যামাসুন্দরী দেবী সম্বন্ধে শ্রীশ্রীমা বলিয়াছিলেন — “আহা, আমার মা ছিলেন যেন লক্ষ্মী। সমস্ত বছর সব জিনিস পত্রটি গুছিয়ে-টুছিয়ে ঠিকঠাক করে রাখতেন ।”

সদরওয়ালা — সাবজজ। ব্রাহ্মভক্ত। সিঁথির ব্রাহ্মসমাজে শ্রীরামকৃষ্ণদেবের সহিত তাঁহার কথোপকথন হয়। (১৯-১০-৮৪)

সরী পাথর — সরস্বতী পাথর। সিহড় নিবাসিনী মহিলা। তিনি “ঘোষপাড়ার মতে”র সাধিকা ছিলেন। ‘পাথর’ তাঁহার পদবী। সরীর সাধনার কথা শুনিয়া ঠাকুর হৃদয়ের সহিত স্বেচ্ছায় তাঁহার বাড়িতে খাইয়া সেখানকার পরিবেশ দেখিয়া অতীব সন্তুষ্ট হইয়াছিলেন। সরীও ঠাকুরকে পরম আন্তরিকতার সহিত আপ্যায়ন করিয়াছিলেন।

সহচরী — শ্রীশ্রীঠাকুরের সান্নিধ্যে আগতা, প্রবীণা ও প্রসিদ্ধা মহিলা কীর্তনিয়া দক্ষিণেশ্বরে শ্রীশ্রীঠাকুরের জন্মোৎসবদিবসে (২৫-৫-১৮৮৪) তিনি কীর্তন পরিবেশন করিয়াছিলেন। এবং ইহা শুনিয়া ঠাকুরের ভাব সমাধি হইয়াছিল। ঠাকুর তাঁহাকে নমস্কার করিয়াছিলেন। ওইদিন তিনি শ্রীশ্রীঠাকুরের শ্রীমুখে ঈশ্বরীয় প্রসঙ্গ, তাঁহার গান, নৃত্য ও সমাধিস্থ অবস্থা দর্শন করিয়া কৃতার্থ হইয়াছিলেন।

সাতকড়ি — নরেন্দ্রনাথের সমবয়স্ক বরাহনগরবাসী যুবক ভক্ত। বরাহনগর মঠে যাইতেন এবং মঠবাসীদের সেবা করিতেন। তাঁহার গাড়িতে নরেন্দ্রনাথ কখন কখন কলিকাতা হইতে মঠে আসিতেন।

সাধু নাগ মহাশয় [দুর্গাচরণ নাগ] (১৮৪৬-১৮৯৯) — শ্রীরামকৃষ্ণের আদর্শ গৃহী ভক্ত। হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা ব্যবসায়ে খ্যাতি সম্পন্ন। ঢাকার দেওভোগ গ্রামে জন্ম। ভক্ত সুরেশচন্দ্র দত্তের সহিত দক্ষিণেশ্বরে যান। (১৮৮২/৮৩ খ্রীষ্টাব্দে)। কাশীপুরে শ্রীশ্রীঠাকুরের রোগ নিজ দেহে আকর্ষণ করিয়া লইতে চেষ্টা করিলে ঠাকুর তাঁহাকে নিরস্ত করেন। শ্রীশ্রীঠাকুর তাঁহাকে ‘জ্বলন্ত আগুন’ বলিয়া উল্লেখ করিয়াছিলেন। শ্রীশ্রীমাকে নাগমহাশয় সাক্ষাৎ ভগবতী জ্ঞান করিতেন। এই জ্ঞানানুভূতির তীব্রতায় আত্মহারা হইয়া পড়িতেন বলিয়া মায়ের নিকট যাইতে তাঁহার অন্যের সাহায্যের প্রয়োজন হইত। তিনি বলিতেন বাপের চেয়ে মা দয়াল। শ্রীশ্রীমা এবং স্বামীজীও তাঁহার অসীম ভক্তি ও মহাপুরুষোচিত গুণাবলীর অশেষ প্রশংসা করিয়াছিলেন। ১৮৯৯ খ্রীষ্টাব্দের ডিসেম্বর নাগ মহাশয় মহাসমাধিতে লীন হইলেন।

সামাধ্যায়ী — ব্রহ্মব্রত সমাধ্যায়ী — এক তার্কিক পণ্ডিত। উত্তরপাড়ার নিকট ভদ্রকালীতে — এক কীর্তনের আসরে ঠাকুরের সহিত প্রথম সাক্ষাৎ হয়। ইহা ব্যতীত কমলকুটীরেও শ্রীশ্রীঠাকুরকে দর্শন করিয়াছিলেন। শ্রীশ্রীঠাকুর পণ্ডিতের ইশ্বর উপলব্ধি হয় নাই বলিয়া তাঁহার বক্তব্যে ক্রটি লক্ষ্য করিয়া মন্তব্য করিয়াছিলেন।

সারদাচরণ — অধরের বন্ধু। পুত্র শোকগ্রস্ত হইয়া তিনি ঠাকুরের নিকট অধরের সহিত দক্ষিণেশ্বরে গিয়াছিলেন। ঠাকুর তাঁহার শোকের কথা শুনিয়া একটি গান গাহিয়া ও উপদেশ দিয়া তাঁহাকে সংসারের অনিত্যতার কথা বলিয়া সান্ত্বনা দিয়াছিলেন। তিনি স্কুলের ডেপুটি ইন্‌স্‌পেক্টর ছিলেন।

সিঁথির গোপাল [গোপাল চন্দ্র ঘোষ — স্বামী অদ্বৈতানন্দ] (১৮২৮ – ১৯০৯) — চব্বিশ পরগণা জেলার জগদ্দলের রাজপুর গ্রামে জন্ম। পিতা গোবর্ধন ঘোষ। শ্রীরামকৃষ্ণের অপেক্ষাও তিনি বয়সে বড় ছিলেন। ঠাকুর তাঁহাকে বুড়ো গোপাল অথবা মুরুব্বি আখ্যা দিয়াছিলেন। ভক্তমহলে তাঁহার নাম গোপালদা। সন্ন্যাসের পরে স্বামী অদ্বৈতানন্দ নামে শ্রীরামকৃষ্ণ সঙ্ঘে পরিচিত। শ্রীরামকৃষ্ণের ত্যাগী সন্তানদের মধ্যে স্বামী অদ্বৈতানন্দ অন্যতম। উত্তর কলিকাতার সিঁথি নিবাসী ব্রাহ্মভক্ত ও ব্যবসায়ী বেণীমাধব পালের কলকাতার চীনাবাজারে একটি দোকানে গোপালচন্দ্র চাকুরী করিতেন। সেই সূত্রেই সিঁথিতে বাস করিতেন। বেণীমাধবের সিঁথির বাড়িতেই ব্রাহ্ম সমাজের উৎসবে গোপালচন্দ্র ঠাকুরকে প্রথম দর্শন করেন। স্ত্রী বিয়োগের ব্যথায় তখন তিনি কাতর হইয়াছিলেন। এই অবস্থায় শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে আসিয়া তাঁহার ভালবাসায় গোপাল বাঁধা পড়েন। অবিরত ভাগবতী কথা ও বৈরাগ্যের অনুপ্রেরণা পাইয়া গোপাল বুঝিলেন যে, সংসার মায়ামরীচিকা এবং একমাত্র বৈরাগ্যই শোকসন্তপ্ত জীবনের মহৌষধ। এইভাবে গোপাল সম্পূর্ণরূপে শ্রীরামকৃষ্ণের শরণাগত হন। শ্রীরামকৃষ্ণের চরণে আত্মসমর্পণের পরে তাঁহার উচ্চ আধ্যাত্মিক জীবন গঠিত হইতে থাকে। অক্লান্তভাবে শ্রীরামকৃষ্ণের সেবা করিয়া তিনি ধন্য হন। শ্রীশ্রীমা সারদা দেবীও গোপালদার কাছে নিঃসন্দেহে কথাবার্তা বলিতেন। তিনি ডাক্তারের নিকট শ্রীরামকৃষ্ণের জন্য বিশেষ পথ্য প্রস্তুতের প্রণালী শিখিয়া যথা সময়ে উহা শ্রীশ্রীমাকে শিখাইয়া দিতেন। শ্রীরামকৃষ্ণের সেবাতে নিজ জীবন চরিতার্থ করিলেও তাঁহার বৈরাগ্যপূর্ণ মন তপস্যার জন্য ব্যাকুল হইত। কাশীপুরে থাকাকালে একবার তীর্থদর্শনে গিয়াছিলেন। অতঃপর কলিকাতায় সমবেত গঙ্গাসাগর-যাত্রী সাধুদের গেরুয়া বস্ত্র, রুদ্রাক্ষের মালা ও চন্দন দিতে চাহিলে ঠাকুর নির্দেশ দিলেন উহা তাঁহার ত্যাগী ভক্তদের মধ্যে বিতরণ করিতে হইবে। ঠাকুরের নির্দেশে দ্বাদশখানি গেরুয়া বস্ত্র ও সমসংখ্যক রুদ্রাক্ষের মালা তিনি ঠাকুরকে অর্পণ করিলে শ্রীরামকৃষ্ণ নিজে উহা নরেন্দ্র, রাখাল, যোগীন্দ্র, বাবুরাম, নিরঞ্জন, তারক, শরৎ, শশী, গোপাল, কালী ও লাটুকে দান করেন। আরেকখানি গেরুয়া বস্ত্র গিরিশের জন্য রাখিয়া দিয়াছিলেন। পরে গিরিশচন্দ্র তাহা গ্রহণ করেন। শ্রীরামকৃষ্ণ সঙ্ঘে এবং গোপালচন্দ্রের জীবনে ইহা স্মরণীয় ঘটনা। ১৯০৯ খ্রীষ্টাব্দের ১৮শে ডিসেম্বর তিনি স্বধামে গমন করেন।

সিঁথির ব্রাহ্মণ — পণ্ডিত ব্যক্তি। কাশীতে বেদান্ত পাঠ করিয়াছিলেন। দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুরকে দর্শন করেন। তাঁহার সহিত দয়ানন্দ ও কর্ণেল অলকটের বিষয়ে আলোচনা হইয়াছিল। ঠাকুর তাঁহাকে সাধুসঙ্গ করার, অনাসক্ত হইয়া দাস ভাবে সংসারে থাকিবার উপদেশ দিয়াছিলেন।

সিধু (সিদ্ধেশ্বর মজুমদার) — উত্তর বরাহনগরের বাসিন্দা। মাস্টার মহাশয় তাঁহার সঙ্গে দক্ষিণেশ্বরে প্রথম গিয়াছিলেন।

সিস্টার নিবেদিতা — [ভগিনী নিবেদিতা] (১৮৬৭ – ১৯১১) — পূর্বনাম মিস মার্গারেট এলিজাবেথ নোবল। স্বামিজীর বিদেশী শিষ্যা। শ্রীরামকৃষ্ণকে দর্শন না করিলেও শ্রীশ্রীমায়ের বিশেষ কৃপা ও স্নেহ লাভ করেন। এদেশে স্ত্রী-শিক্ষায় আত্মনিয়োগ করেন। ভারতবর্ষের মুক্তি আন্দোলনের সহিত জড়িত ছিলেন। তাঁহার বিখ্যাত গ্রন্থ The Master as I saw him, Cradle Tales of Hinduism ইত্যাদি। মার্গারেট যখন প্রচলিত ধর্ম ও গতানুগতিক জীবন সম্পর্কে সংশয়ে দোদুল্যমান, সে সময়ে ইংলণ্ডে স্বামী বিবেকানন্দের সঙ্গে তাঁহার সাক্ষাৎ হয়। স্বামীজীর প্রভাবে তাঁহার জীবনের আমূল পরিবর্তন ঘটে। ১৮৯৮ খ্রীষ্টাব্দে তিনি স্বামীজীর আহ্বানে ভারতে আসেন। ওই খ্রীষ্টাব্দেরই ২৫শে মার্চ স্বামী বিবেকানন্দ তাঁহাকে ব্রহ্মচর্যে দীক্ষিত করিয়া ‘নিবেদিতা’ নামে অভিহিত করেন। নিবেদিতা বিবেকানন্দের কথামত ভারতবাসীর সেবায় নিজ জীবন উৎসর্গ করেন। এই সময়ে তিনি রবীন্দ্রনাথ অবনীন্দ্রনাথ, নন্দলাল প্রমুখ শিল্পীগুরু ও সতীশ মুখোপাধ্যায়ের ‘ডন সোসাইটির’ সংস্পর্শে আসেন। অত্যন্ত পরিশ্রমের ফলে তাঁহার শরীর অসুস্থ হইয়া পড়ে। ভারতের মঙ্গলে নিবেদিত প্রাণ এই বিদেশিনী রোগমুক্তির জন্য দার্জিলিং-এ আচার্য জগদীশচন্দ্র ও লেডী অবলা বসুর আতিথ্য গ্রহণ করেন। ১৯১১ খ্রীষ্টাব্দে দার্জিলিং শহরেই তাঁহার জীবনদীপ নির্বাপিত হয়।

সুবোধ [সুবোধচন্দ্র ঘোষ — স্বামী সুবোধানন্দ] (১৮৬৭ – ১৯৩২) — কলিকাতার ঠনঠনিয়া সিদ্ধেশ্বরী কালীমাতার সেবক শ্রীশঙ্কর ঘোষের পৌত্র। পিতা কৃষ্ণদাস ঘোষ এবং মাতা নয়নতারা দেবী। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করিয়া সুবোধচন্দ্র প্রথমে “অ্যালবার্ট কলেজিয়েট স্কুল” এবং পরে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের বিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেন। ছাত্রাবস্থাতেই সুবোধচন্দ্র প্রথম দক্ষিণেশ্বরে যান। এই সময় শ্রীশ্রীঠাকুরের স্নেহ-সান্নিধ্যে আসিয়া তাঁহার মন বৈরাগ্যপূর্ণ হইয়া উঠে এবং তিনি লেখাপড়া ত্যাগ করিয়া আধ্যাত্মিক জীবনযাপন করিবেন বলিয়া সঙ্কল্প করেন। তাঁহার বালক সুলভ স্বভাবের জন্য তিনি গুরু ভ্রাতাগণের নিকট ‘খোকা মহারাজ’ নামে অধিক পরিচিত ছিলেন। মঠে যোগদানের পর তিনি নানা তীর্থ ভ্রমণ ও তপস্যাদি করিয়াছিলেন। বেলুড়ে মঠ স্থাপিত হইলে সেখানে স্থায়ী ভাবে অবস্থানের সময়ও তিনি কয়েকবার তীর্থ ভ্রমণে যান। স্বামীজী কর্তৃক বেলুড়মঠের জন্য নিযুক্ত ১১ জন ট্রাস্টীর মধ্যে তিনি অন্যতম ছিলেন। তাঁহার অনাড়ম্বর জীবন, বালকসুলভ সরলতা, গভীর আধ্যাত্মিক জ্ঞান ও হৃদয়বত্তা সকলকে মুগ্ধ করত। ১৯৩২ খ্রীষ্টাব্দের ২রা ডিসেম্বর শুক্রবার বিকাল ৩টা ৫ মিনিটে স্বামী সুবোধানন্দ বেলুড় মঠে প্রফুল্লচিত্তে সহাস্যবদনে মহাসমাধিতে লীন হন।

সুরেন্দ্র — [সুরেন্দ্রনাথ মিত্র] (১৮৫০ – ১৮৯০) — ঠাকুরের গৃহীভক্ত, অনত্যম রসদদার। স্পষ্টবক্তা, প্রথম জীবনে নাস্তিক এবং ডষ্ট কোম্পানীর মুৎসুদ্দী ছিলেন। আনিমানিক ত্রিশ বৎসর বয়সে বন্ধু রামচন্দ্র দত্ত এবং মনোমোহন মিত্রের আগ্রহে অত্যন্ত অবিশ্বাসী মনে দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুরকে দর্শন করিতে যান। কিন্তু ঠাকুরের অমৃত বাণী শুনিয়া সমস্ত ভুলিয়া অভিভূত হন। এই সময়ে তিনি সর্বদাই শ্রীরামকৃষ্ণের স্মরণ মনন করিতে থাকেন। তিনি বহুবার দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুরের সান্নিধ্যলাভের জন্য যাইতে থাকেন, অপর পক্ষে শ্রীশ্রীঠাকুরও অনেকবার সিমুলিয়ায় তাঁহার এই ভক্তটির বাড়িতে শুভাগমন করিয়া কৃপা করিয়াছিলেন। এই মহামিলনের ফলে সুরেন্দ্রের অশান্তজীবন শান্ত হয় এবং তিনি ঠাকুরকে ‘গুরু রূপে’ বরণ করেন। সুরেন্দ্রের বাড়িতে ৺অন্নপূর্ণা, ৺জগদ্ধাত্রী প্রভৃতি পূজা হইত। তাঁহার গৃহেই ঠাকুর প্রথম নরেন্দ্রের (বিবেকানন্দ) গান শুনিয়াছিলেন। উৎসবাদিতে প্রচুর ব্যয় হইলেও সুরেন্দ্র তাহা অতিশয় আনন্দের সহিত বহন করিতেন। শ্রীরামকৃষ্ণের কাশীপুরে অবস্থান কালে তিনি অধিকাংশ খরচ বহন করিতেন। ঠাকুর তাঁহাকে ‘রসদদার’ বলিয়া উল্লেখ করিতেন। ঠাকুরের জীবদ্দশাতেই ১৮৮১ খ্রীষ্টাব্দে দক্ষিণেশ্বরে নিজ ব্যয়ে ও উদ্যোগে সুরেন্দ্রনাথই প্রথম “শ্রীরামকৃষ্ণ-জন্মোৎসব” প্রবর্তন করেন এবং পরবর্তী কালেও এই উৎসবের অধিকাংশ খরচ তিনি বহন করিতেন। ঠাকুরের দেহরক্ষার পরও সুরেন্দ্রনাথ ত্যাগী সন্তানদের সেবার জন্য অনেক টাকা দিয়াছিলেন। ১৮৯০ খ্রীষ্টাব্দের ২৫শে মে ঠাকুরের পরমভক্ত সুরেন্দ্রনাথ কলিকাতায় দেহত্যাগ করেন।

সুরেন্দ্রের মেজো ভাই — আদালতের জজ স্বগৃহে তিনি শ্রীশ্রীঠাকুরকে দর্শন করেন এবং তাঁহার সহিত ঈশ্বরের বিষয়ে নানাবিধ আলোচনা করেন।

সেজোগিন্নী (জগদম্বা দাসী) — রানী রাসমণির কনিষ্ঠা কন্যা এবং রানীর সেজ জামাই মথুরামোহন বিশ্বাসের দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী। অতিশয় ধর্মপ্রাণা ভক্তিমতী মহিলা। স্বামীর সহযোগিতায় তিনি নানাভাবে ঠাকুরের সেবা করিয়া গিয়াছেন। মথুরামোহনের মত ঠাকুরকেও তিনি ‘বাবা’ বলিয়া সম্বোধন করিতেন, ঠাকুরের যখন যাহা প্রয়োজন সব সময়ই সেইদিকে লক্ষ্য রাখিতেন। এমনকি ঠাকুর কামারপুকুরে থাকাকালীন যাহাতে কোন রকম অসুবিধে না হয়, সেদিকেও সজাগ দৃষ্টি রাখিতেন। ঠাকুরও এই মহিলা ভক্তটিকে অত্যন্ত স্নেহ করিতেন এবং তাঁহার সরলতার প্রশংসা করিতেন।

সৌরীন্দ্র ঠাকুর — পাথুরিয়া ঘাটার ঠাকুর বংশের হরকুমার ঠাকুরের কনিষ্ঠ পুত্র, রাজা এবং স্যার উপাধি প্রাপ্ত। শ্রীরামকৃষ্ণদেব ইঁহার গৃহে শুভাগমন করিয়াছিলেন। গোলাপ-মার একমাত্র কন্যা চণ্ডীর সহিত ইঁহার বিবাহ হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ অকালেই তাঁহার স্ত্রী-বিয়োগ হয়।

হঠযোগী — শ্রীরামকৃষ্ণের সান্নিধ্যে জনৈক হঠযোগী। কিছুদিনের জন্য দক্ষিণেশ্বরে আসেন এবং পঞ্চবটীতলায় আশ্রয় গ্রহণ করেন। এই উপলক্ষে ঠাকুরের সহিত তাঁহার পরিচয় হয়। একদা ঠাকুরের ত্যাগী সন্তান যোগীন কৌতূহলের বশে হঠযোগীর ক্রিয়া দেখিতে উপস্থিত হইলে ঠাকুর যোগীনকে ওই সব ক্রিয়া দেখিতে বা শিখিতে নিষেধ করেন। ঠাকুরের অন্যতম ভক্ত কৃষ্ণ কিশোরের পুত্র রামপ্রসন্ন এবং আরও কয়েকজন ওই হঠযোগীকে খুব ভক্তি করিতেন। হঠযোগীর আর্থিক অভাব নিবারণের জন্য রামপ্রসন্ন ভক্তদের বলিয়া হঠযোগীর জন্য টাকার ব্যবস্থা করিতে ঠাকুরকে অনুরোধ করেন। ইহার পর রাখাল এবং হঠযোগী নিজেও একই কথা জানাইলে শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁহার কয়েকজন ভক্তকে হঠযোগীর নিকট পাঠাইয়াছিলেন।

হনুমান সিং (দারোয়ান) — শ্রীরামকৃষ্ণের প্রতি অগাধ বিশ্বাসী দক্ষিণেশ্বরের মন্দির রক্ষা কার্যে নিযুক্ত মহাবীর মন্ত্রের উপাসক ও ভক্ত। পাঞ্জাবী মুসলমান পালোয়ানের সহিত মল্লযুদ্ধে তিনি জয়লাভ করেন। প্রতিদ্বন্দ্বিতার পূর্বে তিনি ইষ্টমন্ত্র জপ এবং দিনান্তে একবার আহার করিয়া কাটাইতেন। প্রতিদ্বন্দ্বিতার আগের দিন প্রতিদ্বন্দ্বিতার ফলাফল সম্বন্ধে ঠাকুর হনুমান সিংকে প্রশ্ন করিলে তিনি বলেন, ঠাকুরের কৃপা থাকিলে নিশ্চয়ই তাঁহার জয় হইবে। বলাবাহুল্য তিনি মল্লযুদ্ধে জয়ী হইয়া নিজের দারোয়ানের পদে পূর্বের ন্যায় বহাল ছিলেন।

হরমোহন মিত্র — শ্রীরামকৃষ্ণের বিশেষ কৃপা প্রাপ্ত গৃহীভক্ত। নরেন্দ্রনাথের সহপাঠী ও বন্ধু। কলিকাতার দর্জি পাড়ায় নয়ন চাঁদ মিত্র স্ট্রীটে বাস করিতেন। হরমোহনের মাতা কয়েকবার শ্রীরামকৃষ্ণদেবকে দর্শন করেন। মাতার উৎসাহেই পুত্র হরমোহন দক্ষিণেশ্বরে বহুবার যান এবং বিশেষ কৃপা লাভে ধন্য হন। একদা ঠাকুর তাঁহাকে স্পর্শ করায় তাঁহার ভিতরে দিব্য অনুভূতির সৃষ্টি হয়। ঠাকুরের কল্পতরু হওয়ার দিন তিনি কাশীপুরে উপস্থিত ছিলেন। ঠাকুর এবং স্বামীজীর ভাবধারা প্রচারের জন্য নিজ ব্যয়ে ছাপানো পুস্তক বিনামূল্যে বিতরণ করেন। ঘরে ঘরে শ্রীরামকৃষ্ণের ছবি ও ভাবধারা প্রচারে তিনি বিশেষ উৎসাহী ছিলেন। ম্যাক্সমূলার প্রণীত শ্রীরামকৃষ্ণের জীবনী তিনিই সর্বপ্রথম এদেশে প্রচার করেন।

হরলাল — ব্রাহ্ম ভক্ত, হিন্দু স্কুলের শিক্ষক। সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজের অনুগামী। শ্রীরামকৃষ্ণের প্রতি বিশেষ আকর্ষণে হরলাল দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুরের নিকট যাইতেন। ঠাকুরও তাঁহার সহিত ঈশ্বরীয় প্রসঙ্গ করিয়া আনন্দ অনুভব করিতেন। ঠাকুরের দক্ষিণেশ্বর হইতে কেশবচন্দ্র সেনের সহিত স্টীমারে গঙ্গাবক্ষে ভ্রমণের সময়ে হরলালও উপস্থিত ছিলেন।

হরি — বাগবাজার নিবাসী ব্রাহ্মণ বংশীয় সন্তান। শ্রীরামকৃষ্ণের স্নেহ ধন্য যুবক ভক্ত। ঠাকুরের ভক্ত মুখুজ্যে ভ্রাতৃদ্বয়, মহেন্দ্রনাথ ও প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়ের আত্মীয়। ‘মুখুজ্যেদের হরি’ নামে কথামৃতে পরিচিত। হরি কখনো একাকী, কখনো মুখুজ্যেদের সহিত শ্রীরামকৃষ্ণের নিকটে যাইতেন। ঠাকুরকে গুরুরূপে বরণ করেন। ঠাকুরের এত স্নেহপাত্র ছিলেন যে তাঁহার দক্ষিণেশ্বরে যাইতে কিছুদিন বিলম্ব হইলে ঠাকুর তাঁহাকে ভর্ৎসনা করিতেন। একদা হরি ঠাকুরের নিকট দীক্ষালাভের প্রার্থনা করায় ঠাকুর অসম্মত হন; তবে প্রার্থনা করেন যে যাহারা আন্তরিক টানে তাঁহার নিকট আসিবেন তাহারা যেন সবাই সিদ্ধ হয়। ভাগ্যবান হরির হাত নিজের হাতের উপর রাখিয়া পরীক্ষাপূর্বক ঠাকুর তাঁহার ভাল লক্ষণের কথা জানান এবং তাঁহার ভক্তির প্রশংসা করেন।

হরি [হরিনাথ চট্টোপাধ্যায় — স্বামী তুরীয়ানন্দ] (১৮৬৩ – ১৯২২) — কলিকাতার বাগবাজার অঞ্চলে জন্ম। পিতা চন্দ্রনাথ, মাতা প্রসন্নময়ী। শৈশবেই মাতৃহারা এবং ১২ বৎসর বয়সে পিতৃহীন হন। এই হরিনাথ শ্রীরামকৃষ্ণ সঙ্ঘে স্বামী তুরীয়ানন্দ নামে পরিচিত। গঙ্গাধর (স্বামী অখণ্ডানন্দ) তাঁহার বাল্যবন্ধু। বাল্যকাল হইতেই হরিনাথ নৈষ্ঠিক ব্রহ্মচারী এবং তত্ত্বান্বেষী। ১৩।১৪ বৎসর বয়সে বাগবাজারে দীননাথ বসুর বাড়িতে শ্রীরামকৃষ্ণকে প্রথম দর্শন করেন। ইহার দুই বৎসর পর হইতেই দক্ষিণেশ্বরে শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে যাতায়াত করেন। তাঁহার সঙ্গগুণে সমস্ত সংশয় ও দ্বন্দ্বের অবসান হয়। শ্রীরামকৃষ্ণকে সাক্ষাৎ ঈশ্বর বলিয়া দৃঢ় বিশ্বাস হয়। হরিনাথ বেদান্ত বিচারে আনন্দ লাভ করিতেন। এইসময়ে নরেন্দ্রনাথের সহিত তাঁহার বন্ধুত্ব হয়। ঠাকুরের দেহত্যাগের পরে বরাহনগর মঠে সন্ন্যাস গ্রহণ করেন। ১২ বৎসর ধরিয়া নানা তীর্থে ঘুরিয়া তপস্যা করেন। ১৮৯৯ খ্রীষ্টাব্দে স্বামীজীর সঙ্গে আমেরিকাতে গিয়া বেদান্ত প্রচার করেন। ১৯০২ খ্রীষ্টাব্দে তিনি ভারতে ফিরিয়া আসেন। শেষজীবনে তিনি কাশীধামে ছিলেন। ১৯২২ খ্রীষ্টাব্দের ২১শে জুলাই, শুক্রবার তিনি মায়ার জগৎ হইতে বিদায় লইলেন।

হরিপদ — শ্রীরামকৃষ্ণের বালক ভক্ত। মাস্টার মহাশয় কর্তৃক ঠাকুরের নিকট আনীত। দক্ষিণেশ্বরে মাঝে মাঝে যাইতেন। ঘোষপাড়া মতে সাধন-ভজন করিতেন। কথকতা জানিতেন এবং খুব ধ্যান করিতেন।

হরিপ্রসন্ন — [হরিপ্রসন্ন চট্টোপাধ্যায় — স্বামী বিজ্ঞানানন্দ] (১৮৬৮ – ১৯৩৮) — শ্রীরামকৃষ্ণের কৃপাপ্রাপ্ত, অবিবাহিত, ত্যাগী শিষ্য এবং অন্তরঙ্গ পার্ষদ হরিপ্রসন্ন চট্টোপাধ্যায় স্বামী বিজ্ঞানানন্দ নামে রামকৃষ্ণ সঙ্ঘে পরিচিত। উত্তরপ্রদেশের এটোয়ায় বৈকুণ্ঠ চতুর্দশী তিথিতে ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পিতৃগৃহ ছিল চব্বিশ পরগণার বেলঘরিয়ায়। পিতা তারকনাথ ও মাতা নকুলেশ্বরী দেবী। শৈশবে কাশীতে এবং পরে কলিকতায় বিদ্যাভ্যাস করেন। পরে পুণায় ইঞ্জিনীয়ারিং কলেজে ভর্তি হইয়া পরীক্ষায় দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন। অতঃপর তিনি গাজীপুরে ডিস্ট্রিক্ট ইঞ্জিনীয়ারের সরকারী চাকুরী গ্রহণ করেন। ছাত্রাবস্থাতেই তিনি শ্রীরামকৃষ্ণকে দর্শন করিয়া মুগ্ধ হন এবং মাঝে মাঝে দক্ষিণেশ্বরে যাতায়াত শুরু করেন। ঠাকুরের দেহত্যাগের সময় তিনি বাঁকীপুরে ছিলেন। পরে সরকারী চাকুরী ত্যাগ করিয়া আলমবাজার মঠে যোগদান করেন। এই সময় তিনি “স্বামী বিজ্ঞানানন্দ” এবং গুরুভ্রাতাগণের নিকট “বিজ্ঞান মহারাজ” বা “হরিপ্রসন্ন মহারাজ” নামে পরিচিত ছিলেন। স্বামীজীর আদেশে তিনি ১৯০০ খ্রীষ্টাব্দে প্রয়াগে (এলাহাবাদ) যাইয়া বাস করিতে লাগিলেন। পরে তাঁহার ঐকান্তিক যত্নে মুঠিগঞ্জে একটি স্থায়ী মঠ স্থাপনহয়।

স্বামী অখণ্ডানন্দের দেহরক্ষার পর তিনি রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের চতুর্থ অধ্যক্ষ হন। ঠাকুরের দীক্ষিত ত্যাগী সন্তানদের মধ্যে তিনিই শেষ অধ্যক্ষ ছিলেন। ১৯৩৮ খ্রীষ্টাব্দের ১৪ই জানুয়ারি পৌস সংক্রান্তির দিন তিনি স্বামী বিবেকানন্দের পূর্ব নির্দেশ অনুযায়ী বেলুড়ে মন্দির প্রতিষ্ঠা করিয়া “আত্মারামের কৌটা” বেদীতে স্থাপনপূর্বক মন্দিরের উদ্বোধন করেন। ইহাই তাঁহার জীবনের স্মরণীয় ঘটনা। তাঁহার শেষজীবন এলাহাবাদে কাটে। তীব্র বৈরাগ্যপূর্ণ জীবনযাপনের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্বামী বিজ্ঞানানন্দ। স্বামী বিবেকানন্দ হরিপ্রসন্নকে খুব স্নেহ করিতেন এবং আদর করিয়া ‘পেসন’ বলিয়া ডাকিতেন। অন্যান্য গুরু ভাইদেরও গভীর স্নেহ ভালবাসা তিনি পাইয়াছিলেন। ১৯৩৮ খ্রীষ্টাব্দের ২৫শে এপ্রিল সোমবার এলাহাবাদেই তিনি দেহত্যাগ করেন।

হরিবল্লভ বসু — ঠাকুরের গৃহীভক্ত বলরাম বসুর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা। কটকের উকিল এবং রায় বাহাদুর উপাধি প্রাপ্ত। পিতা বিন্দু মাধব। কলিকাতায় রামকান্ত বসু স্ট্রীটের যে ৫৭ নং বাড়িতে বলরামবাবু সপরিবারে করিতেন এবং কথামৃতে যাহাকে ‘বলরাম-মন্দির’ বলা হইয়াছে — তিনিই উহার মালিক ছিলেন। বলরাম শ্রীরামকৃষ্ণের নিকট যাতায়াত করেন বিশেষতঃ পরিবারস্থ মহিলাদের সেখানে লইয়া যান শুনিয়া হরিবল্লভবাবু বিরক্ত হইয়াছিলেন। কিন্তু শ্যামপুকুর বাটীতে শ্রীরামকৃষ্ণকে দর্শন করিয়া তাঁহার মনোভাবের আমূল পরিবর্তন হয় এবং তিনি ঠাকুরের ভক্ত হন। ‘শ্রীশ্রীলাটু মহারাজের স্মৃতি কথা’ হইতে জানা যায়, একদিন ঠাকুর বলরাম-মন্দিরে শুভাগমন করিলে পর গিরিশচন্দ্রের ব্যবস্থামত হরিবল্লভবাবু আসিয়া ঠাকুরের নিকট বসেন এবং উভয়েই উভয়কে দেখিয়া কাঁদিত থাকেন, কোন কথা হয় নাই।

হরিবাবু (হরি চৌধুরী) — মাস্টার মহাশয়ের প্রতিবেশী ও বন্ধু। মাস্টার মহাশয়ের সহিত দক্ষিণেশ্বরে শ্রীরামকৃষ্ণকে দর্শন করিতে যান (২০।৮।১৮৮৩)। শ্রীশ্রীঠাকুর ইঁহাকে ‘কুমড়োকাটা বঠ্‌ঠাকুর’ না হইয়া ঈশ্বরের পাদপদ্মে মন রাখিয়া সংসারের কাজ করিতে উপদেশ দিয়াছিলেন।

হরিশ (হরিশ কুণ্ডু) — কলিকাতার উপকণ্ঠে গড় পারে বাড়ি। ব্যায়াম শিক্ষকের কার্য করিতেন। মধ্যে মধ্যে দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুরের নিকট আসিতেন। সরল শান্ত স্বভাবের জন্য তিনি ঠাকুরের স্নেহভাজন হন। পরবর্তী কালে তাঁহার মস্তিষ্কবিকৃতি ঘটে।

হলধারী (রামতারক চট্টোপাধ্যায়) — শ্রীরামকৃষ্ণদেবের খুল্লতাত ভ্রাতা। ঠাকুর তাঁহাকে হলধারী বলিতেন। দক্ষিণেশ্বরে প্রথমে কালীঘরে ও পরে বিষ্ণুঘরের পূজারী হইয়াছিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণের সাধকজীবনের বহু ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন।

হলধারীর বাবা — শ্রীকানাইরাম চট্টোপাধ্যায়। শ্রীরামকৃষ্ণের খুল্লতাত। নিষ্ঠাবান, সরল বিশ্বাসী ভগবদ্‌ ভক্ত ছিলেন।

হাজরা — প্রতাপ হাজরা দ্রষ্টব্য।

হীরানন্দ — সিন্ধুপ্রদেশের এক শিক্ষিত ব্যক্তি। ১৮৮৩ খ্রীষ্টাব্দে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় হইতে বি.এ.পাশ করেন। নববিধান ব্রাহ্ম সমাজের অনুগামী ব্রাহ্ম ভক্ত। সিন্ধু প্রদেশের ‘সিন্ধু টাইমস’ এবং ‘সিন্ধু সুধার’ পত্রিকা দুইটির সম্পাদক ছিলেন। ঠাকুরের নিকট তিনি কয়েকবার আসিয়াছিলেন। আচার্য কেশবচন্দ্র সেন, স্বামী বিবেকানন্দ, মাস্টার মহাশয় প্রভৃতি শ্রীরামকৃষ্ণের বিশিষ্ট ভক্তদের সহিত তাঁহার অত্যন্ত হৃদ্যতা ছিল। কাশীপুর উদ্যানবাটীতে অসুস্থ অবস্থায় থাকার সময় ঠাকুর হীরানন্দকে দেখিবার জন্য ব্যস্ত হন এবং সেই সংবাদে হীরানন্দ সুদূর সিন্ধু প্রদেশ হইতে কয়েকদিনের জন্য কলিকাতায় আসেন। ঠাকুর হীরানন্দকে কাছে পাইয়া আনন্দিত হন। ঠাকুরের দেহ রক্ষার পরেও হীরানন্দ কলিকতায় আসিলে বরাহনগর মঠে ঠাকুরের ত্যাগী সন্তানগণের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করিতেন।

হৃদয় (হৃদু, হৃদে — হৃদয়রাম মুখোপাধ্যায়) — ঠাকুরের পিসতুত বোন হেমাঙ্গিনী দেবীর তৃতীয় পুত্র। পিতা কৃষ্ণচন্দ্র। শিহড় গ্রামে বাড়ি। শ্রীরামকৃষ্ণ লীলায় হৃদয়ের একটি বিশিষ্ট ভূমিকা। ১৮৫৫ খ্রীষ্টাব্দে দক্ষিণেশ্বরে আসেন এবং দীর্ঘ পঁচিশ বৎসর ঠাকুরের সহচর হিসাবে তাঁহার সেবা ও দেখাশোনা করেন। দক্ষিণেশ্বরে তিনি প্রথমে মা-কালীর বেশ-কারী ও পরে রাধাগোবিন্দজী ও ভবতারিণীর পূজক রূপে নিযুক্ত হন। প্রকৃতপক্ষে হৃদয়ের আন্তরিক সেবা ভিন্ন সাধনকালে ঠাকুরের শরীর রক্ষা কঠিন হইত। ১৮৮১ খ্রীষ্টাব্দে কর্তৃপক্ষীয়দের বিরাগভাজন হওয়ায় কর্মচুত্য হন। দীর্ঘকাল ঠাকুরের পূত সঙ্গ লাভ করা সত্ত্বেও সংসারের প্রতি হৃদয়ের বিশেষ আসক্তি থাকায় তিনি মাঝে মাঝে ঠাকুরকে ভুল বুঝিতেন ও তাঁহার প্রতি বিরূপ আচরণ করিতেন। শ্রীশ্রীমা সারদাদেবীর প্রতিও তাঁহার আচরণ কোন কোন সময় ভাল ছিল না। মাঝে মাঝে ঠাকুরের অনুকরণে নিজেকে আধ্যাত্মিক জগতে প্রতিষ্ঠা করার নিষ্ফল চেষ্টাও করিতেন। ক্রমে তিনি ঠাকুরের প্রতি দুর্ব্যবহার শুরু করিলে ঠাকুর একসময় গঙ্গায় দেহত্যাগের জন্য গিয়াছিলেন। দোষ ত্রুটি থাকা সত্ত্বেও শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁহাকে অত্যন্ত স্নেহ করিতেন। পরম ভাগ্যবান হৃদয় শ্রীরামকৃষ্ণের কৃপা লাভে ধন্য হইয়াছিলেন। হৃদয়ের প্রতি কৃপাপরবশ ঠাকুর, হৃদয়ের শিহড় গ্রামের বাড়িতেও কয়েকবার শুভাগমন করিয়াছিলেন। ঠাকুরের দেহরক্ষার পরবর্তী কালে হৃদয় কাপড় গামছা বিক্রয় করিলেও দীর্ঘকালের সঙ্গী শ্রীরামকৃষ্ণকে কখনও বিস্মৃত হন নাই। ঠাকুরের অনুরাগী ভক্তদের সহিত মিলিত হইয়া তিনি ঠাকুরের স্মৃতিকথায় মগ্ন হইতেন। শ্রীশ্রীঠাকুরের লীলাবিষয়ক অনেক কথা তাঁহার নিকট হইতে সংগৃহীত। ১৮৯৯ খ্রীষ্টাব্দে স্বীয় জন্মভূমি শিহড় গ্রামে ঠাকুরের এই অন্তরঙ্গ সেবক দেহত্যাগ করেন।

হৃদয়ের মা (শ্রীমতী হেমাঙ্গিনী দেবী) — ঠাকুরের পিসতুতো ভগিনী। শ্রীশ্রীঠাকুরের মহিমা উপলব্ধি করিয়া তাঁহার শ্রীচরণ ফুল-চন্দন দিয়া পূজা করিয়াছিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণ ভাবস্থ অবস্থায় তাঁহাকে বলিয়াছিলেন ‘তোর কাশীতেই মৃত্যু হবে’। ঠাকুরের কৃপালাভে তিনি কৃতার্থ হন।

হেম (রায় বাহাদুর হেমচন্দ্র কর) — ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। শ্রীশ্রীঠাকুরের ভক্ত পল্টুর পিতা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *