11 of 11

৬৩.০৩ শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃতে উল্লিখিত ব্যক্তিবৃন্দের পরিচয় (প – য)

পওহারীবাবা [হরভজন দাস] (১৮৪০ – ১৮৯৮) — উত্তর প্রদেশের জৌনপুরের নিকটবর্তী প্রেমপুরে (গুজি) মতান্তরে বারাণসী জেলার গুজি নামক স্থানের নিকটবর্তী এক গ্রামে নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ বংশে জন্ম। পিতা অযোধ্যা তেওয়ারী। শৈশবে বসন্তরোগে তাঁহার একচক্ষু নষ্ট হয়। কাকা লক্ষ্মীনারায়ণ নৈষ্ঠিক ব্রহ্মচারী এবং অল্প বয়সেই সন্ন্যাস জীবন যাপনের জন্য গৃহত্যাগী। বহু বৎসর পরে গাজীপুরের তিন মাইল দক্ষিণে গঙ্গাতীরে কুর্থ নামক গ্রামের আশ্রমে লক্ষ্মীনারায়ণের অবস্থান কালে হরভজন তাঁহার নিকট আসিলে তিনি তাঁহার উপনয়নের পর শাস্ত্রাদি অধ্যয়ন করান। ১৮৫৬ খ্রীষ্টাব্দে লক্ষ্মীনারায়ণের দেহত্যাগের পর আশ্রমের দায়িত্ব গ্রহণ করিয়া বাবাজী পুরী রামেশ্বর, দ্বারকা ও বদ্রীনাথ তীর্থাদি দর্শন করেন। এ সময়ে গির্নার পর্বতে এক যোগীর কাছে উপদেশ লাভ করেন এবং হিমালয়ের এক যোগীর নিকট এক উদ্ভিদের সন্ধান পান যাহা খাইয়া অন্য খাদ্য ব্যতীতই বহুদিন বাঁচিয়া থাকা যায়। আশ্র মে ফিরিয়া সাধুর জীবনযাপন কালে শুধুমাত্র লঙ্কা ও দুধ আহার্য গ্রহণ করিতেন। পরে শুধু বিল্বপত্রের রস পান করিতেন। সেজন্য লোকে পওহারীবাবা বলিত। পুরী যাত্রার পথে মুর্শিদাবাদে বাংলা ভাষা শিখিয়া চৈতন্যচরিতামৃত প্রভৃতি গ্রন্থ পাঠ করেন। তামিল তেলেগু ভাষা শিখিয়া দক্ষিণ ভারতীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের গ্রন্থাদি পাঠ করেন। শ্রীসম্প্রদায়ের এক বৈষ্ণব সাধুর নিকট তিনি দীক্ষিত হইয়াছিলেন। গাজীপুরের নিকটে এক যোগীর কাছে তিনি যোগশিক্ষা করেন। আশ্রমের এক মৃত্তিকা গহ্বরে তিনি যোগাভ্যাস করেন। জনতাকে প্রতি একাদশীতে দর্শন দান করিতেন। পরে বৎসরে একদিন মাত্র দর্শন দানের জন্য বাহিরে আসিতেন। দীর্ঘকাল গুহায় বাস করিয়াছিলেন। তাঁহার গুহাতে শ্রীশ্রীঠাকুরের একটি ফটো ছিল। ১৮৯০ খ্রীষ্টাব্দে স্বামীজী তাঁহার সহিত আলাপাদি করিয়া মুগ্ধ হইয়াছিলেন। কথামৃতে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের সাথে ত্রৈলোক্যের কথোপকথনে পওহারীবাবার প্রসঙ্গ পাওয়া যায়। বাবাজীর দেহত্যাগের অব্যবহিত পরে স্বামীজী তাঁহার উচ্চাবস্থার কথা একটি প্রবন্ধে লিখিয়াছিলেন।

পণ্ডিতজী — বড়বাজারের ভক্ত মারোয়াড়ীর গৃহে (১২ নং মল্লিক স্ট্রীটে) শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণদেবের শুভাগমন কালে পণ্ডিতজী তাঁহার সঙ্গে ঈশ্বরীয় প্রসঙ্গ করেন। তাঁহার পুত্রও ওইদিন ঠাকুরের সঙ্গে কথা বলেন। তিনি মধ্যে মধ্যে দক্ষিণেশ্বরে আসিয়া শ্রীশ্রীঠাকুরের সান্নিধ্যে ভগবৎপ্রসঙ্গ করিতেন।

পদ্মলোচন (পণ্ডিত পদ্মলোচন তর্কালঙ্কার) — বেদান্তবাদী, ন্যায়শাস্ত্রে সুপণ্ডিত এবং শ্রীশ্রীঠাকুরের পরম অনুরাগী। তিনি বর্ধমান মহারাজের সভাপণ্ডিত ছিলেন। পদ্মলোচনের পাণ্ডিত্যের খ্যাতি ও ঈশ্বরভক্তির কথা শুনিয়া ঠাকুর তাঁহাকে দেখিবার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেন। সেই সময়ে পদ্মলোচন ভগ্ন স্বাস্থ্যোদ্ধারের জন্য আড়িয়াদেহের একটি বাগানবাড়িতে ছিলেন। মিলনে উভয়েই আনন্দিত হন। ঠাকুরের মুখে তাঁহার উপলব্ধি সমূহ ও মায়ের গান শুনিয়া তিনি অত্যন্ত অভিভূত হইয়াছিলেন। পণ্ডিতের সিদ্ধাই-এর বিষয় ঠাকুর জানিতে পারিয়াছিলেন বলিয়া তিনি তাঁহাকে সাক্ষাৎ ইষ্টজ্ঞানে স্তবস্তুতি করিয়াছিলেন। কাশীতে তিনি দেহরক্ষা করেন।

পল্টু (প্রমথনাথ কর) — কম্বুলিয়াটোলার ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট রায় বাহাদুর হেমচন্দ্র করের পুত্র। এ্যটর্নী হিসাবে বিখ্যাত। মাস্টার মহাশয়ের ছাত্র হিসাবে খুব শৈশবেই ঠাকুরের সংস্পর্শে আসেন ও তাঁহার ভক্ত হন। ঠাকুর বলিয়াছিলেন “তোরও হবে। তবে একটু দেরিতে হবে।” পরবর্তী জীবনে তিনি বহু পরহিতব্রতী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত ছিলেন এবং দরিদ্রের সেবায় আত্মনিয়োগ করিয়াছিলেন। ১৯৩৭ খ্রীষ্টাব্দে কলিকাতায় দেহত্যাগ করেন ।

পশুপতি (পশুপতি বসু) — নন্দলাল বসুর ভাই। বাসস্থান — বাগবাজার, কলিকাতা। ১৮৮৫ খ্রীষ্টাব্দে ২৮শে জুলাই ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ নন্দ বসুর বাড়িতে রক্ষিত দেবদেবীর সুন্দর ছবিগুলি দর্শনের জন্য শুভাগমন করিয়া সাদর অভ্যর্থনা লাভ করেন। পশুপতি তাঁহাকে দেবদেবীর ছবিগুলি দর্শন করাইয়া সুখী হন। ঐশ্বর্যের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও পশুপতির অহংকারশূন্য মনোভাবের জন্য ঠাকুর তাঁহার প্রতি প্রসন্ন হন ও কিছুক্ষণ নন্দবাবু প্রভৃতির সহিত ঈশ্বরীয় প্রসঙ্গ করেন।

পাগলী — কথামৃতে এক পাগলিনীর উল্লেখ আছে। সে দক্ষিণেশ্বরে ও কাশীপুরে ঠাকুরের নিকট মধ্যে মধ্যে আসিত। শ্রীবিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী এই সুগায়িকা পাগলীকে শ্রীরামকৃষ্ণ সমীপে আনয়ন করেন। কিন্তু ঠাকুরের প্রতি তাহার অন্যভাবে কথা প্রকাশ করায় ঠাকুর বিরক্ত হন। যখন তখন আসিয়া সে ঠাকুরের নিকট গান করিত।

পান্না কীর্তনী (পান্নাময়ী) — বিখ্যাত মহিলা কীর্তনীয়া। পদাবলী কীর্তনে সুখ্যাতি অর্জন করিয়াছিলেন। ১৮৮৪ খ্রীষ্টাব্দের পূর্বে দক্ষিণেশ্বরে কীর্তন উপলক্ষে ঠাকুরের সহিত তাঁহার সাক্ষাৎ হয়। ঠাকুর তাঁহার ভক্ত ঈশানচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের বাড়িতে পান্নার সুকণ্ঠের প্রশংসা করেন এবং তাঁহার ভক্তির কথা উল্লেখ করেন।

পাঁড়ে জমাদার (খোট্টা বুড়ো) — শ্রীশ্রীঠাকুরের দক্ষিণেশ্বরে ভক্তদের নিকট কামিনী-কাঞ্চন প্রসঙ্গে তাহার তরুণী স্ত্রীর রক্ষণাবেক্ষণে তাহাকে উদ্বিগ্ন থাকিতে হইত — উল্লেখ করিয়াছিলেন।

পিগট (মিস্‌) — আমেরিকান পাদ্রী। যোশেফ কুকের সঙ্গে কেশবচন্দ্রের স্টীমারে (২৩-২-১৮৮২) শ্রীশ্রীঠাকুরকে দর্শন করিয়াছিলেন। সেদিন ঠাকুরের গান এবং আধ্যাত্মিক আলোচনা শুনিয়া এবং ঠাকুরের ভাবসমাধির অবস্থা দেখিয়া যোশেফ কুক এবং মিস্‌ পিগট অভিভূত হইয়াছিলেন।

পূর্ণ [শ্রী পূর্ণচন্দ্র ঘোষ] (১৮৭১ – ১৯১৩) — কলিকাতার সিমুলিয়ায় জন্ম। ঠাকুরের সহিত প্রথম সাক্ষাৎ ১৮৮৫ খ্রীষ্টাব্দের মার্চ মাসে। গৃহীভক্তদের মধ্যে শ্রীশ্রীঠাকুর তাঁহাকেই ঈশ্বরকোটি বলিয়া নির্দিষ্ট করিয়াছিলেন। ছাত্রাবস্থায় অতি শৈশবেই মাস্টার মহাশয়ের পরামর্শে দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুরের সংস্পর্শে আসেন। পিতা রায় বাহাদুর দীননাথ ঘোষ — উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী। ঠাকুর পূর্ণকে বলিয়াছিলেন যে যখনই তাহার সুবিধা হইবে তখনই যেন সে ঠাকুরের নিকট আসে। শ্রীশ্রীঠাকুর বলিয়াছিলেন পূর্ণচন্দ্রের ‘বিষ্ণুর অংশে জন্ম’ এবং তাঁহার আগমনে ওই শ্রেণীর ভক্তদের আগমন পূর্ণ হইল। বাহিরে সরকারীকাজে নিযুক্ত থাকিলেও অন্তরে তিনি শ্রীশ্রীঠাকুরের ভাবে ও চিন্তায় মগ্ন থাকিতেন। স্বামীজীর প্রতি তাঁহার গভীর অনুরাগ ছিল। স্বামীজীর মহিলাভক্ত মাদাম কালভে কলিকাতায় যখন আসেন, সে সময় তিনি তাঁহাকে বিবেকানন্দ সোসাইটির সম্পাদক হিসাবে উক্ত সোসাইটির পক্ষ হইতে অভিনন্দিত করেন। মাত্র ৪২ বৎসর বয়সে দেহত্যাগ করেন।

প্রতাপ ডাক্তার (১৮৫১ – ১৯১২) — বিখ্যাত হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক প্রতাপচন্দ্র মজুমদার। নদীয়া জেলার চাপড়া গ্রামে জন্ম। কলিকাতায় চিকিৎসা-বিদ্যায় উচ্চ শিক্ষাপ্রাপ্ত। ১৮৮৫ খ্রীষ্টাব্দে শ্যামপুকুরে ঠাকুরের সহিত প্রথম সাক্ষাৎ হয়। তিনি শ্যামপুকুর ও কাশীপুরে ঠাকুরের চিকিৎসার জন্য গিয়েছিলেন। এই সময়ে ঠাকুরের পূত সঙ্গ লাভ করিয়া এবং তাঁহার অদ্ভুত ভাবাবস্থা দর্শনে বিজ্ঞান জগতের প্রতাপচন্দ্র মোহিত হন। ১৮৯৩ খ্রীষ্টাব্দে চিকাগোতে World’s Columbian Exposition-এ আমন্ত্রিত হন।

প্রতাপচন্দ্র মজুমদার (১৮৪০ – ১৯০৫) — বাসস্থান কলিকাতা। পিতা গিরীশচন্দ্র মজুমদার। প্রতাপচন্দ্র বিখ্যাত ব্রাহ্মধর্ম প্রচারক। জন্ম হুগলী জেলার বাঁশবেড়িয়া গ্রামে মাতুলালয়ে। ব্রাহ্মধর্ম প্রচারের জন্য ভারত ইউরোপ, আমেরিকা ও জাপানের নানাস্থানে ভ্রমণ করেন। ১৮৭৫ খ্রীষ্টাব্দে শ্রীরামকৃষ্ণের সহিত প্রথম সাক্ষাৎ হয়। কেশবচন্দ্র সেনের দেহত্যাগের পর নববিধান ব্রাহ্মসমাজের নেতা হন। শ্রীরামকৃষ্ণের নিকট তিনি বহুবার গিয়াছেন। শ্রীরামকৃষ্ণ সম্বন্ধে তাঁহার বিখ্যাত প্রবন্ধ Hindu Saint জনপ্রিয়তা লাভ করে। Oriental Christ, Paramhamsa Ramakrishna প্রভৃতি গ্রন্থ তাঁহার রচনা। ১৮৯৩ সালে প্রতাপচন্দ্র শিকাগো ধর্মসভায় উপস্থিত হইবার জন্য নিমন্ত্রিত হইয়া ভাষণ দিয়াছিলেন এবং সেখানে স্বামী বিবেকানন্দের সাথে সাক্ষাৎ হয়। কলিকাতায় ৬৫ বৎসর বয়সে তাঁহার জীবনদীপ নির্বাপিত হয়।

প্রতাপ সিং — একজন ডেপুটি। ঠাকুর কামারপুকুরে তাঁহার দানধ্যান ও ঈশ্বরে ভক্তি ইত্যাদি অনেক গুণের কথা শুনিয়াছিলেন। ইনি ঠাকুরকে লইয়া যাইবার জন্য লোক পাঠাইয়াছিলেন।

প্রতাপচন্দ্র হাজরা — হুগলী জেলার মড়াগেড়ে নামক গ্রামে বাড়ি। কামারপুকুরের কয়েক মাইল পশ্চিমে এই গ্রাম। শিহড় গ্রামে হৃদয়ের বাড়িতে প্রথম তিনি শ্রীরামকৃষ্ণের দর্শন পান। কয়েক বৎসর পরে বাড়িতে স্ত্রী-পুত্র-কন্যা ও বৃদ্ধা মাতাকে রাখিয়া দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুরের নিকটে আসেন। কিন্তু তাঁহার কিছু ঋণ ছিল। দক্ষিণেশ্বরে তিনি ‘হাজরামশাই’ নামে পরিচিত ছিলেন। হাজরার নিরাকারবাদের সমর্থন পাইয়া নরেন্দ্রনাথও প্রথমে তাঁহার প্রতি আকৃষ্ট হন। হাজরাকে লক্ষ্য করিয়া ঠাকুর বলিতেন — ‘জটিলে কুটিলে’ থাকলে লীলা পোষ্টাই হয়। নরেন্দ্রনাথের চেষ্টায় হাজরা ঠাকুরের কৃপাপ্রাপ্ত হইয়াছিলেন। জীবনের শেষ ভাগে তিনি স্বগ্রামে ফিরিয়া আসেন। অন্তিম সময়ে ঠাকুরের দর্শন পান। ১৯০০ খ্রীষ্টাব্দে ৬২।৬৩ বৎসর বয়সে স্বগ্রামে হাজরা লোকান্তরিত হন।

প্রতাপের ভাই — শ্রীম-র দক্ষিণেশ্বরে দ্বিতীয় দর্শন দিবসে শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁহার কথা উল্লেখ করেন। বেকার অবস্থায় স্ত্রী-পুত্রকে শ্বশুরবাড়িতে রাখিয়া দক্ষিণেশ্বরে থাকিতে চাহিয়াছিলেন। সেজন্য ঠাকুর তাহাকে গৃহস্থের কর্তব্য সম্বন্ধে সজাগ করিয়া তিরস্কার করিয়াছিলেন। ইনি কোন্‌ প্রতাপের ভাই তাহা জানা যায় না।

প্রসন্ন (প্রসন্নকুমার সেন) — ব্রাহ্মভক্ত। জন্ম — ২৪ পরগণা — গরিফা। কেশব সেনের অনুগামী শিষ্য। ঠাকুরের শুভদর্শন লাভে তিনি আশীর্বাদ ধন্য হইয়াছিলেন। কমলকুটীরে কেশব সেনের অসুস্থ অবস্থায় শ্রীরামকৃষ্ণ কেশবকে দেখিতে গেলে তিনি ঠাকুরকে অন্যমনস্ক করিবার জন্য নানা প্রসঙ্গের অবতারণা করিয়াছিলেন।

প্রসন্ন [সারদাপ্রসন্ন মিত্র — স্বামী ত্রিগুণাতীতানন্দ] (১৮৬৫ – ১৯১৫) — চব্বিশ পরগণা জেলার নাওরা গ্রামে মাতুলালয়ে জন্ম। পিতা শিবকৃষ্ণ মিত্র। মাতামহ পাইকহাটীর নীলকমল সরকার একজন জমিদার। সারদাপ্রসন্ন ছিলেন কথামৃতকার মহেন্দ্রনাথ গুপ্তের ছাত্র। মেধাবী হইয়াও প্রবেশিকা পরীক্ষায় দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য বিশেষ দুঃখ পান। মাস্টার মহাশয় এইজন্য বিষাদগ্রস্ত ছাত্রকে দক্ষিণেশ্বরে লইয়া গিয়া শ্রীরামকৃষ্ণের নির্দেশে তিনি শ্রীশ্রীমায়ের নিকট হইতে লইতেন। অভিভাবকগণ তাঁহার বিবাহের চেষ্টা করিলে তিনি গৃহ হইতে পলাইয়া যান। প্রথমে কাশীপুরে শ্রীরামকৃষ্ণের নিকট যান। পরে পুরীধামে পথে রওনা হন। কিন্তু ফিরিয়া আসিতে বাধ্য হন। মেট্রোপলিটন কলেজ হইতে এফ্‌ এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইয়া বরাহনগরে মঠে যোগ দেন এবং সন্ন্যাস গ্রহণের পরে তাঁহার নাম হয় স্বামী ত্রিগুণাতীতানন্দ। দুঃসাহসিকতার প্রতি একটা স্বাভাবিক আকর্ষণ থাকায় তীর্থ ভ্রমণের সময় অনেক বিপদের সম্মুখীন হইতে হয়। শ্রীশ্রীমা সারদাদেবীর প্রতি তাঁহার অপরিসীম ভক্তির পরিচয় পাওয়া যায়। তীর্থ হইতে ফিরিয়া নানা জনহিতকর কাজে আত্মনিয়োগ করেন। দুর্ভিক্ষে সেবাকার্য, উদ্বোধন পত্রিকার প্রকাশনা এবং ১৯০২ খ্রীষ্টাব্দে বেদান্ত প্রচারে বিদেশযাত্রা তাঁহার কর্মময় জীবনের উল্লেখযোগ্য ঘটনা। আমেরিকার সানফ্রান্সিস্‌কো, ক্যালিফোর্নিয়া প্রভৃতি শহরে বেদান্ত প্রচারের কাজে তাঁহার শেষ জীবন কাটে। ১৯০৬ খ্রীষ্টাব্দে সানফ্রান্সিস্‌কো শহরে হিন্দুমন্দিরের প্রতিষ্ঠা করেন। পাশ্চাত্যে এইটি প্রথম হিন্দুমন্দির। ক্যালিফোর্নিয়ার পার্বত্য অঞ্চলে ‘শান্তি আশ্রম’ নামে একটি শাখাকেন্দ্র শুরু করিয়াছিলেন। Voice of Freedom নামে একটি মাসিক পত্র এবং লস এঞ্জেলস নগরে বেদান্ত সমিতি স্থাপন তাঁহার বিশেষ উদ্যোগের পরিচায়ক। ১৯১৫ খ্রীষ্টাব্দের ১০ই জানুয়ারি তিনি দেহত্যাগ করেন।

প্রাণকৃষ্ণ (প্রাণকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়) — হুগলি জেলার জনাইয়ের মুখোপাধ্যায় বংশীয় শ্রীরামকৃষ্ণে ভক্ত। স্থূলকায় ছিলেন বলিয়া ‘মোটা বামুন’ নামে ঠাকুর তাঁহাকে উল্লেখ করিতেন। কলিকাতায় শ্যামপুকুর অঞ্চলে রামধন মিত্র লেনে থাকিতেন। সওদাগরী অফিসে চাকুরী করিতেন। ঠাকুরকে নিজের বাড়িতে লইয়া গিয়া সেবা করিয়াছিলেন। তিনি প্রায়ই দক্ষিণেশ্বরে যাইতেন এবং বেদান্তচর্চায় আগ্রহ প্রকাশ করিতেন।

প্রিয় [প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়] — শ্রীরামকৃষ্ণের অনুরাগী ভক্ত, ইঞ্জিনীয়ার, বাগবাজারের রাজবল্লভ পাড়ার বাসিন্দা। তিনি মহেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের কনিষ্ঠ ভ্রাতা। উভয়েই থিয়োসফিস্ট হইলেও ঠাকুরের কাছে যাতায়াত করিতেন।

প্রিয় (প্রিয়নাথ সিংহ) — নরেন্দ্রনাথের প্রতিবেশী বন্ধু — ব্রাহ্মভক্ত। দক্ষিণেশ্বরে ও সিমুলিয়ায় শ্রীশ্রীঠাকুরকে তিনি দর্শনাদি করিয়াছিলেন। পরবর্তী জীবনে তিনি খ্যাতনামা শিল্পী হন। ‘গুরুদাস বর্মণ’ এই ছদ্মনামে তিনি ‘শ্রীরামকৃষ্ণচরিত’ রচনা করেন। বাল্য-বয়সেই তিনি শ্রীরামকৃষ্ণের সংস্পর্শে আসেন। স্বামীজীর সম্বন্ধে তাঁহার রচনায় স্বামীজী সম্পর্কে বহু মূল্যবান তথ্য জানা যায়। ‘স্বামীজীর কথা’ পুস্তকে এই স্মৃতিকথা প্রকাশিত হইয়াছে।

ঠাকুর যে নরেন্দ্রনাথকে স্পর্শ দ্বারা অদ্বৈতানুভূতি দান করেন তাহার একটি সুন্দর রঙিনচিত্র তিনি অঙ্কন করিয়াছিলেন।

প্রেমচাঁদ বড়াল — বহুবাজার নিবাসী সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্ম। ব্রাহ্মভক্ত মণি মল্লিকের সিঁদুরিয়াপটীর বাড়িতে ব্রাহ্মসমাজের উৎসবে শ্রীরামকৃষ্ণকে দর্শন করেন। তিনি সঙ্গীতজ্ঞ ছিলেন। তাঁহার পরিবারস্থ লালচাঁদ বড়াল ও রাইচাঁদ বড়াল প্রখ্যাত সঙ্গীত সাধক।

ফকির — প্রকৃত নাম যজ্ঞেশ্বর ভট্টাচার্য। বলরাম বসুর পুরোহিত বংশের সন্তান এবং কিছুকাল বলরামবাবুর পুত্র রামকৃষ্ণ বসুর গৃহশিক্ষকরূপেও নিযুক্ত ছিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণের নিকট যাতায়াত শুরু করেন এবং ক্রমে তাঁহার ভক্ত হন। ঠাকুর ফকিরের মুখে দেবদেবীর স্তব শুনিতে ভালোবাসিতেন।

বঙ্কিম — মহেন্দ্রনাথ গুপ্তের পরিচিত। বাগবাজার স্কুলের ছাত্র। শ্যামপুকুর বাটীতে তাহার খোঁজ লইয়া শ্রীশ্রীঠাকুর মাস্টার মহাশয়কে বলিয়াছিলেন — সে যদি না আসতে পারে, তাহাকে মাস্টার মহাশয় যেন ভগবৎকথা বলেন। তাহা হইলেই তাহার চৈতন্য হইবে।

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৩৮ – ১৮৯৪) — সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম স্নাতক। পেশায় ডেপুটি-ম্যাজিস্ট্রেট। “বন্দেমাতরম্‌” সংগীতের স্রষ্টা। বঙ্গদর্শন পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা। বঙ্কিমচন্দ্র ২৪ পরগণা জেলার কাঁঠালপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম স্রষ্টা বঙ্কিমচন্দ্র শ্রীরামকৃষ্ণকে ১৮৮৪ খ্রীষ্টাব্দের ৬ই ডিসেম্বর শোভাবাজারের অধরলাল সেনের বাড়িতে দর্শন করেন। বঙ্কিমচন্দ্র সেদিন ঠাকুরকে ধর্ম সম্বন্ধে নানাবিধ প্রশ্ন করিয়াছিলেন এবং যথাযথ উত্তর পাইয়া সন্তুষ্ট হইয়াছিলেন। দক্ষিণেশ্বরে শ্রীরামকৃষ্ণ মহেন্দ্রনাথ গুপ্তের নিকট বঙ্কিমচন্দ্রের লেখা ‘দেবী চৌধুরাণী’ গ্রন্থের পাঠ শুনিয়াছিলেন এবং গীতোক্ত নিষ্কাম কর্মযোগ বঙ্কিমবাবু উক্ত গ্রন্থে উল্লেখ করায় খুশি হইয়াছিলেন। কথামৃতে ঠাকুরের সঙ্গে কথোপকথনটি বঙ্কিমবাবুকে গভীরভাবে চিন্তাশীল করিয়াছিল। পরবর্তী কালে মাস্টার মহাশয় ও গিরিশবাবু ঠাকুরের নির্দেশে বক্ষকিমবাবুর সানকীভাঙ্গার বাসায় গিয়া শ্রীরামকৃষ্ণ বিষয়ে আলোচনা করিয়াছিলেন।

বলরাম [বলরাম বসু] (১৮৪২ – ১৮৯০) — বলরামবসু শ্রীরামকৃষ্ণের প্রধান গৃহীভক্তদের মধ্যে অন্যতম। তিনি রসদদারদের মধ্যে একজন। কলিকাতার বাগবাজারে জন্ম। পিতা রাধামোহন। পিতামহ গুরুপ্রসাদের গৃহদেবতা শ্রীশ্রীরাধাশ্যামসুন্দর বিগ্রহের নামানুসারে ওই অঞ্চলের নাম হয় শ্যামবাজার। ওই অঞ্চলের কৃষ্ণরাম বসু স্ট্রীট আজও বলরামের প্রপিতামহের গৌরবময় স্মৃতির সাক্ষ্য বহন করিতেছে। হুগলী জেলার আঁটপুর-তড়া গ্রামে পূর্বপুরুষদর আদি নিবাস। উড়িষ্যার বালেশ্বর জেলায় জমিদারি ও কোঠার মৌজায় কাছারি বাড়ির পত্তন হয় পিতামহের সময়। পিতার তিন পুত্রের মধ্যে বলরাম দ্বিতীয়। শৈশব হইতেই বলরাম ধর্মভাবাপন্ন। এই বৈষ্ণব পরিবারের সকলেই ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি। শ্রীধাম বৃন্দাবনেও শ্রীশ্রীরাধাশ্যামসুন্দর বিগ্রহ স্থাপন করেন পিতামহ গুরুপ্রসাদ। বর্তমানে উহা ‘কালাবাবুর কুঞ্জ’ নামে পরিচিত। বলরাম ১৮৮২ খ্রীষ্টাব্দে প্রথম শ্রীরামকৃষ্ণকে দর্শন করেন দক্ষিণেশ্বরে। শ্রীরামকৃষ্ণের বলরামকে চিনিয়া লইতে দেরি হয় নাই। একমাত্র বলরামের বাড়িতেই শ্রীরামকৃষ্ণের সর্বাধিকবার আগমন ঘটে। বলরামের অন্ন “শুদ্ধ অন্ন” — একথাও ঠাকুরের মুখে শোনা যায়। তিনি বলরামকে শ্রীচৈতন্যের কীর্তনের দলে দেখিয়াছিলেন। বলরামের সহধর্মিণী কৃষ্ণভাবিনীকে শ্রীমতীর (রাধারানীর) অষ্ট সখীর প্রধানা বলিয়া উল্লেখ করিয়াছিলেন। একবার শ্রীমতী কৃষ্ণভাবিনী অসুস্থা হইলে তাঁহাকে দেখিবার জন্য ঠাকুর শ্রীমা শ্রীসারদা দেবীকে দক্ষিণেশ্বের হইতে বলরাম বসুর গৃহে পাঠান। প্রতিবৎসর রথের সময় ঠাকুরকে বাসভবনে লইয়া আসিতেন বলরাম। এখানে ঠাকুর রথের সম্মুখে কীর্তন নৃত্যাদি করিতেন ও রথ টানিতেন। ঠাকুর বলিতেন বলরামের পরিবার সব একসুরে বাঁধা। বলরাম শুধু নিজ পরিবার নয়, আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধবও যাহাতে ঠাকুরের কৃপালাভে ধন্য হইতে পারে সেজন্য তাঁহাদিগকে ঠাকুরের নিকট উপস্থিত করিতেন। শ্রীরামকৃষ্ণের মহাসমাধির দিন পর্যন্ত তিনি ঠাকুরের প্রয়োজনীয় নিত্য আহার্যের দ্রব্যসমূহ যোগাইতেন। ঠাকুরের অদর্শনের পরেও শ্রীরামকৃষ্ণের ত্যাগী সন্তানদের কাছে বলরামের ভবন একটি আশ্রয়স্থল ছিল। এই ভবন বর্তমানে “বলরাম-মন্দির” নামে পরিচিত। এইখানেই রামকৃষ্ণ মিশনের প্রতিষ্ঠা হয়। শ্রীশ্রীমাও এই বাড়িতে মধ্যে মধ্যে আসিয়া বাস করিতেন। বলরামবাবুর পুরীর আবাস এবং বৃন্দাবনের কালাবাবুর কুঞ্জ ছিল ঠাকুরের ত্যাগী সন্তানদের সাধন ভজনের উপযোগী স্থান। শ্রীরামকৃষ্ণ-লীলার ইতিহাসে অন্য কোনও ভক্ত পরিবারের এরূপ সক্রিয় ভূমিকা দেখা যায় না। মাত্র ৪৭ বৎসর বয়সে শ্রীরামকৃষ্ণের ত্যাগী সন্তানদের উপস্থিতিতে বলরাম শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ১৯১৯ সালে কৃষ্ণভাবিনী দেবীর ৺কাশীপ্রাপ্তি হয়।

বলরামের পিতা (রাধামোহন বসু) — ইনি অতি নিষ্ঠাবান বৈষ্ণব ছিলেন। অধিকাংশ সময় কালাবাবুর কুঞ্জে একাকী বাস করিতেন। শ্রীশ্রীরাধাশ্যামসুন্দরের সেবার তত্ত্বাবধান এবং অবসর সময়ে ভক্তিগ্রন্থ পাঠ এবং বৈষ্ণবসেবায় সময় অতিবাহিত করিতেন। কোঠারে থাকাকালেও এইরূপ জীবনযাত্রা নির্বাহ করিতেন। শ্রীরামকৃষ্ণের কৃপায় শান্তির অধিকারী হইয়া বলরাম তাঁহার ধর্মপ্রাণ পিতাকে ঠাকুরের সান্নিধ্যে লইয়া আসিয়াছিলেন। অতঃপর রাধামোহন বসু বহুবার শ্রীরামকৃষ্ণের দর্শনলাভে জীবন ধন্য করেন ও ভগবৎ দর্শনের জন্য ব্যাকুলতা এবং ধর্মজীবনে উদার দৃষ্টিভঙ্গিলাভের প্রেরণালাভ করেন।

বাবুরাম [বাবুরাম ঘোষ — স্বামী প্রেমানন্দ] (১৮৬১ – ১৯১৮) — হুগলী জেলার আঁটপুর গ্রামে মাতুলালয়ে জন্ম। পিতা আঁটপুর নিবাসী তারাপদ ঘোষ, মাতা মাতঙ্গিনী দেবী। বাবুরাম পরবর্তী জীবনে শ্রীরামকৃষ্ণ সঙ্ঘে স্বামী প্রেমানন্দ নামে পরিচিত। শ্রীরামকৃষ্ণ কথিত ছয়জন ঈশ্বরকোটির মধ্যে তিনি একজন। কলকাতায় পড়াশুনা করিবার সময় সহপাঠী রাখালচন্দ্র ঘোষের (পরবর্তী কালে স্বামী ব্রহ্মানন্দ) সহিত দক্ষিণেশ্বরে গিয়া প্রথম শ্রীরামকৃষ্ণকে দর্শন করেন। শ্রীরামকৃষ্ণ সেইদিনই বাবুরামকে আপনজন বলিয়া গ্রহণ করেন। তিনি বাবুরামকে দরদী, ‘বাবুরামের হাড় পর্যন্ত শুদ্ধ’ — বলিতেন। ভক্তপ্রবর বলরাম বসুর স্ত্রী কৃষ্ণভাবিনী দেবী, বাবুরামের জ্যেষ্ঠা ভগিনী। পরম ভক্তিমতী মাতা মাতঙ্গিনী দেবীর নিকট শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁহার এই পুত্রকে তাঁহাকে দেওয়ার জন্য প্রার্থনা করেন। কিছুমাত্র বিচলিত না হইয়া তিনি তৎক্ষণাৎ নিজ সৌভাগ্যজ্ঞানে পুত্রকে ঠাকুরের চরণে সমর্পণ করেন। দক্ষিণেশ্বরে, শ্যামপুকুরে ও কাশীপুরে বাবুরাম নানাভাবে শ্রীশ্রীঠাকুরের সেবা করিয়াছিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণের ভাবধারা প্রচারের জন্য তিনি তিনবার পূর্ববঙ্গে গমন করেন। প্রতিবারেই সেখানে বহুভক্তের মধ্যে প্রভূত উদ্দীপনার সঞ্চার হয়। স্বামী ব্রহ্মানন্দের সহিত দেওভোগ গ্রামে নাগমহাশয়ের বাড়িতে গিয়া ভাবাবেগে নাগ প্রাঙ্গণে গড়াগড়ি দেন। স্বামী প্রেমানন্দ ছিলেন মঠের স্বাধু-ব্রহ্মচারী ও ভক্তগণের জননীর মতো। নানাদেশ হইতে আগত সকলকে তিনি বেলুড়মঠের তখনকার নানা অসুবিধার মধ্যেও মিষ্ট আলাপাদি ও প্রসাদ বিতরণের মাধ্যমে সেবা করিতেন। তাঁহার চেষ্টায় বেলুড়মঠে শাস্ত্রাদি অধ্যয়নের জন্য একটি চতুষ্পাঠী (টোল) স্থাপিত হয়। শ্রীশ্রীমায়ের প্রতি স্বামী প্রেমানন্দের অসীম ভক্তি ছিল। ১৯১৮ খ্রীষ্টাব্দের ৩০শে জুলাই, মঙ্গলবার, বিকাল ৪টা ১৫ মিনিটে বলরাম-মন্দিরে তিনি দেহত্যাগ করেন।

বিজয় [বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী] (১৮৪১ – ১৮৯৯) — শান্তিপুরের বিখ্যাত অদ্বৈত বংশে জন্ম। পিতা আনন্দচন্দ্র গোস্বামী। বাল্যবয়স হইতেই ঈশ্বর অনুরাগ লক্ষিত হয়। বেদান্ত অধ্যয়নের জন্য সংস্কৃত কলেজে ভর্তি হন। ছাত্রাবস্থায় ব্রাহ্মধর্মে আকৃষ্ট হইয়া মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নিকট ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষিত হন। পরে কেশবচন্দ্র সেনের সংস্পর্শে আসেন এবং পরবর্তীকালে ব্রাহ্মসমাজের আচার্য হইয়াছিলেন। কেশবচন্দ্র সেনের কোন কোন আচরণ তিনি সমর্থন করেন নাই। যদিও তিনি নিরাকার ঈশ্বরের প্রতি অনুরাগী ছিলেন তথাপি গয়াতে এক যোগীর নিকট দীক্ষাগ্রহণ এবং যৌগিক সাধন প্রক্রিয়াদি অভ্যাস করিতে থাকেন। মতপার্থক্যের জন্য ১৮৮৬-৮৭ খ্রীষ্টাব্দে ব্রাহ্মসংঘ ত্যাগ করেন এবং সনাতন হিন্দুধর্মে প্রত্যাবর্তন করেন। ঢাকাতে তাঁহার প্রতিষ্ঠিত একটি আশ্রম আজও বিদ্যমান। পরবর্তী কালে তিনি বহু ব্যক্তিকে বৈষ্ণবমন্ত্রে দীক্ষিত করেন। অন্যান্য ব্রাহ্ম নেতাদের ন্যায় শ্রীরামকৃষ্ণের ভাবে আকৃষ্ট হইয়া তিনি বহুবার দক্ষিণেশ্বরে যাতায়াত করিয়াছেন। শ্রীরামকৃষ্ণের প্রতি তাঁহার গভীর শ্রদ্ধা ভক্তির পরিচয় পাওয়া যায়। বিজয়কৃষ্ণের মতে শ্রীরামকৃষ্ণের মধ্যেই তিনি ষোলআনা ভগবদভাবের প্রকাশ দেখিয়াছিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণদেবের অহেতুকী ভালবাসার প্রভাবে তাঁহার ধর্মজীবনে আমূল পরিবর্তন আসে। শেষজীবনে তিনি পুরীধামে সাধন-ভজনে নিযুক্ত থাকিয়া এক শিষ্যমণ্ডলী গঠন করেন। ১৮৯৯ খ্রীষ্টাব্দে এখানেই দেহত্যাগ করেন।

বিজয়ের শাশুড়ী — শ্রীরামকৃষ্ণের অনুরাগী মহিলা ভক্ত। রামচন্দ্র ভাদুড়ীর ভক্তিমতী সহধর্মিণী। তিনি দক্ষিণেশ্বরে ও ব্রাহ্ম উৎসবস্থলে ঠাকুরকে দর্শন করিতে যাইতেন। ঠাকুরের পূতসঙ্গ লাভে এবং তাঁহার নানাবিধ উপদেশ শ্রবণে তিনি শ্রীরামকৃষ্ণের প্রতি বিশেষভাবে আকৃষ্ট হন। আজীবন তিনি ঠাকুরের বিশেষ অনুরাগী ভক্ত ছিলেন।

‘বিদ্যা’ অভিনেতা — প্রকৃত নাম ভোলানাথ বসু। প্রখ্যাত যাত্রাশিল্পী। “বিদ্যাসুন্দর” নাটকে বিদ্যার ভূমিকায় অভিনয় করিয়া তিনি “বিদ্যা অভিনেতা” রূপে খ্যাতি লাভ করেন। ঠাকুর একদা দক্ষিণেশ্বরে “বিদ্যাসুন্দর” যাত্রায় বিদ্যার ভূমিকায় তাঁহার অভিনয় দেখিয়া আনন্দিত হইয়াছিলেন এবং তাঁহাকে ঈশ্বরলাভের জন্য সাধনা করিতে উৎসাহ দিয়াছিলেন।

বিনোদ (বিনোদবিহারী সোম) — মহেন্দ্রনাথ গুপ্তর ছাত্র। বন্ধুদের কাছে তিনি ‘পদ্মবিনোদ’ নামে পরিচিত ছিলেন। ১৮৮৪ খ্রীষ্টাব্দে ছাত্রাবস্থায় শ্রীরামকৃষ্ণদেবকে দর্শন করেন। পরবর্তী কালে গিরিশচন্দ্র ঘোষের নাটকে অভিনয় করিতেন ও সঙ্গদোষে মদ্যপায়ী হন। একদিন থিয়েটার হইতে ফেরার পথে রাত্রিতে মায়ের বাড়ীর সম্মুখে তিনি শ্রীশ্রীমায়ের উদ্দেশ্যে একটি গান করিয়া তাঁহার দর্শন লাভ করেন। এর কিছুকাল পরেই তিনি রোগাক্রান্ত হইয়া হাসপাতালে ভর্তি হন এবং দেহত্যাগ করেন। মৃত্যুর পূর্বে তিনি শ্রীম কথিত রামকৃষ্ণকথামৃত হইতে পাঠ শোনার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। তাঁর শেষ ইচ্ছা পালিত হয় এবং তিনি শ্রীরামকৃষ্ণের নাম করিতে করিতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

বিনোদিনী (১৮৬৩ – ১৯৪২) — কলিকাতার বিখ্যাত মঞ্চাভিনেত্রী। গিরিশচন্দ্র ঘোষ ছিলেন বিনোদিনীর নাট্যগুরু। ১৮৭৫ খ্রীষ্টাব্দে গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটার দলের সঙ্গে ভারত ভ্রমণ করেন। ১৮৭৭ সালে গিরিশচন্দ্রের অনুরোধে ন্যাশনাল থিয়েটারে যোগ দেন। গিরিশচন্দ্রের শিক্ষায় এবং স্বীয় প্রতিভায় বিনোদিনী শ্রেষ্ঠ মঞ্চাভিনেত্রী রূপে খ্যাত হন। তাঁহার নিঃশ্বার্থ কর্মের ফলেই স্টার থিয়েটারের প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়। সহকর্মীদের অবিচারে এবং নানা কারণে তিনি ১৮৮৬ খ্রীষ্টাব্দে অভিনয় জীবন হইতে অবসর গ্রহণ করেন। তাঁহার রচিত গ্রন্থের মধ্যে ‘বাসনা’ (কাব্যগ্রন্থ), কনক ও নলিনী (কাহিনী-কাব্য), ‘আমার অভিনেত্রী জীবন’ উল্লেখযোগ্য। ১৮৮৪ খ্রীষ্টাব্দের ২১শে সেপ্টেম্বর বিনোদিনী ঠাকুরকে প্রথম দর্শন করেন। ওইদিন গিরিশচন্দ্রের ‘চৈতন্যলীলা’ নাটকে চৈতন্যদেবের ভূমিকায় বিনোদিনীর অসামান্য অভিনয় দেখিয়া শ্রীরামকৃষ্ণ অভিভূত হন এবং বিনোদিনীকে আশীর্বাদ করেন। পরবর্তী কালে শ্রীরামকৃষ্ণ বিনোদিনী অভিনীত প্রহ্লাদচরিত, দক্ষযজ্ঞ, ধ্রুবচরিত, বৃষকেতু ইত্যাদি নাটকগুলি দেখেন এবং বিনোদিনীর অভিনয়ের প্রশংসা করেন। ঠাকুরের অসুস্থতার কথা শুনিয়া ব্যাকুলচিত্তে বিনোদিনী কালীপদ ঘোষের সহায়তায় এক ইওরোপীয় পুরুষের ছদ্মবেশে শ্যামপুকুর বাটীতে শ্রীরামকৃষ্ণকে দর্শন করেন। শ্রীশ্রীঠাকুরও বিশেষ প্রীত হন এবং আশীর্বাদ করেন।

বিপিন সরকার — হুগলী জেলার কোন্নগর নিবাসী সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি। ১৮৮৫ খ্রীষ্টাব্দে শ্রীরামকৃষ্ণদেবকে দক্ষিণেশ্বরে প্রথম দর্শন করেন। সেদিন ঠাকুর তাঁহাকে আপ্যায়িত করিয়াছিলেন ।

বিশ্বম্ভরের বালিকা কন্যা — শ্রীরামকৃষ্ণের স্নেহধন্যা ৬।৭ বছরের বালিকা। একদা বলরাম-মন্দিরে রথজাত্রা উপলক্ষে এই বালিকা ঠাকুরের পাদস্পর্শ করিয়া নমস্কার করিলে ঠাকুরও তাঁহাকে মাথা অবনত করিয়া প্রতিনমস্কার জানান। অতঃপর ঠাকুর স্নেহবশে এই বালিকাকে ‘কেলুয়ার গান’ শুনাইয়া আনন্দ দান করেন।

বিশ্বাসবাবু (অম্বিকাচরণ বিশ্বাস) — খড়দহের মর্যাদাসম্পন্ন ধনী জমিদারের দত্তক সন্তান। শ্রীশ্রীমা সারদাদেবীর সঙ্গিনী ‘যোগীন-মা’র স্বামী বলরাম বসুর আত্মীয়। নিজ কর্মদোষে নিঃস্ব এবং মর্যাদাহীন হইয়াছিলেন। অম্বিকাচরণ বলরাম-মন্দিরে শ্রীরামকৃষ্ণের দর্শন লাভ করিয়াছিলেন।

বিষ্ণু — আড়িয়াদহ নিবাসী তরুণ ভক্ত এবং স্কুলের ছাত্র। ঠাকুরের পূতসঙ্গ লাভের জন্য প্রায়ই দক্ষিণেশ্বরে আসিতেন। সংসার-বিতৃষ্ণ বিষ্ণু পশ্চিমাঞ্চলে আত্মীয়ের নিকট অবস্থানকালে নির্জনে ধ্যান করিতেন; এবং নানাবিধ ঈশ্বরীয় রূপ দর্শন করিতেন। এই উদাসী বালক-ভক্তটি গলায় ক্ষুর দিয়া আত্মহত্যা করায় ঠাকুর বলিয়াছিলেন, বোধ হয় — শেষ জন্ম, পূর্বজন্মে অনেক কাজ করা ছিল। একটু বাকি ছিল, সেইটুকু বুঝি এবার হয়ে গেল।

বিহারী (বিহারী মুখোপাধ্যায়) — শ্রীরামকৃষ্ণের ভক্ত। বীরভূমের অধিবাসী, চাকরীর খোঁজে কলিকাতার আসেন। ভাগ্যক্রমে দেবেন্দ্রনাথ মজুমদারের সংস্পর্শে আসেন এবং তাঁহার আশ্রয় লাভ করেন। পরবর্তী কালে তিনি দেবেন্দ্রনাথের সঙ্গে শ্রীরামকৃষ্ণের নিকটে যান এবং তাঁহার আশীর্বাদ প্রাপ্ত হন। শ্যামপুকুর বাটীতে বিহারী কালীপূজা দিবসে স্তব ও গান করিয়াছিলেন।

বিহারীলাল ভাদুড়ী — ভাদুড়ী ডাক্তার — প্রবীন হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক । বাড়ি কর্নয়া লিস স্ট্রীটে। শ্যামপুকুর বাটীতে ঠাকুরের চিকিৎসা করিয়াছিলেন। এইসময়েই তিনি ঠাকুরের কথামৃত পান ও ভাবসমাধি দর্শনের সোভাগ্য লাভ করেন। ডাক্তার ভাদুড়ীর জামাতা ডা: প্রতাপচন্দ্র মজুমদারও ঠাকুরের চিকিৎসার জন্য শ্যামপুকুর বাটীতে আসিয়াছিলেন।

বেচারাম (আচার্য বেচারাম চট্টোপাধ্যায়) — আদি ব্রাহ্মসমাজের আচার্য। জন্ম কলিকাতার নিকটবর্তী অঞ্চল বেহালাতে। সংস্কৃত পণ্ডিত। হাওড়ায় একটি স্কুলের শিক্ষক পরবর্তী কালে ব্রাহ্মধর্ম প্রচারক। ১৮৮৩ খ্রীষ্টাব্দের ২২শে এপ্রিল বেণীমাধব পালের সিঁথির বাগানবাড়িতে ব্রাহ্মোৎসবে শ্রীরামকৃষ্ণকে দর্শন করেন ও তাঁহার ভগবৎপ্রসঙ্গ শ্রবণে আনন্দিত হন।

বেণীমাধব পাল — ব্রাহ্মসমাজভুক্ত, ব্যবসায়ী। কলিকতার উপকণ্ঠে সিঁথিতে তাঁহার উদ্যানবাটিতে শরৎকালে এবং বসন্তকালে ব্রাহ্মসমাজের উৎসব হইত। শ্রীরামকৃষ্ণদেব একাঘিকবার এই উৎসবে আসিয়া ব্রাহ্মভক্তদের আনন্দ দান করিয়াছিলেন। দক্ষিণেশ্বরে তিনি মধ্যে মধ্যে গিয়া শ্রীশ্রীঠাকুরের নিকট ঈশ্বরীয় প্রসঙ্গাদি শুনিতেন। শ্রীশ্রীঠাকুর তাঁহার উৎসবে ও ভক্তসেবায় অর্থের সদ্ব্যবহার দেখিয়া প্রশংসা করিতেন।

বেনোয়ারী কীর্তনীয়া — শ্রীরামকৃষ্ণের সংস্পর্শে আগত জনৈক কীর্তনীয়া। ১৮৮৫ খ্রীষ্টাব্দে রথযাত্রার দিনে শ্রীরামকৃষ্ণের গৃহীভক্ত বলরাম বসু তাঁর বাড়িতে বেনোয়ারীর কীর্তনের ব্যবস্থা করিয়াছিলেন। ঠাকুর সেই আসরে উপস্থিত ছিলেন।

বৈকুণ্ঠ সান্যাল (১৮৫৭-১৯৩৭) — ঠাকুরের গৃহীভক্ত। “শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ লীলামৃত” নামক তথ্যবহুল গ্রন্থের প্রণেতা। নদীয়া জেলার বেলপুকুর গ্রামে জন্ম। পিতা দীননাথ সান্যাল। অনি অল্প বয়সেই শ্রীরামকৃষ্ণের সংস্পর্শে আসেন। ঠাকুরের নিকট দীক্ষিত হইবার পর হইতেই ইষ্ট দর্শন লাভের বাসনা হয়। অতঃপর কল্পতরু দিবসে ঠাকুরের কৃপায় তাঁহার মনোবাসনা পূর্ণ হয়। আজীবন তিনি রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ আদর্শের ঘনিষ্ঠ ও উৎসাহী অনুগামী ছিলেন। তিনি স্বামী বিবেকানন্দের সহযোগীও ছিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণের তিরোধানের পর ঠাকুরের ত্যাগী সন্তানদের তিনি নানাভাবে সহায়তা করিতেন। রামকৃষ্ণ মিশনের হিসাব নিরীক্ষক রূপে বহুদিন কাজ করেন। স্বামী কৃপানন্দ নামে সন্ন্যাস গ্রহণ করিয়া তিনি কিছুকাল উত্তরাখণ্ডে পরিব্রাজক রূপে ভ্রমণ ও তপস্যাদি করিয়াছিলেন।

বৈকুণ্ঠ সেন — কলিকাতার মাতাঘষা পল্লীর অধিবাসী। ব্রাহ্মভক্ত। শ্রীরামকৃষ্ণ-অনুরাগী জয়গোপাল সেনের ভ্রাতা। ১৮৮৩ খ্রীষ্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে ঠাকুরের দর্শন লাভ করেন। গৃহস্থাশ্রম প্রসঙ্গে ঠাকুর তাঁহার প্রশ্নের উত্তরে অতি সুন্দর উপদেশাদি দিয়াছিলেন।

বৈদ্যনাথ — হাইকোর্টের উকিল। ঠাকুরের বিশিষ্ট ভক্ত সুরেশচন্দ্র মিত্রের আত্মীয়। ভক্ত সুরেন্দ্রনাথের বাড়িতে শ্রীরামকৃষ্ণকে প্রথম দর্শন করেন এবং তাঁহার সঙ্গে বহুক্ষণ ভগবৎ বিষয়ক আলোচনা করেন। বৈদ্যনাথের সঙ্গে আলোচনায় ঠাকুর প্রীত হইয়াছিলেন।

বৈষ্ণবচরণ — প্রখ্যাত কীর্তনীয়া। বলরাম বসু, অধরলাল সেন প্রভৃতি অনুরাগীদের বাড়িতে শ্রীরামকৃষ্ণ কয়েকবার বৈষ্ণবচরণের কণ্ঠে কীর্তনগান শোনেন। শ্রীরামকৃষ্ণের নির্দেশে অধর সেন প্রতিদিন তাঁহার নিকট কীর্তন শুনিতেন। বৈষ্ণবচরণের মুখে ঠাকুর এই বিশেষ গানটি শুনিতে ভালবাসিতেন — “দুর্গানাম জপ সদা রসনা আমার, দুর্গমে শ্রীদুর্গা বিনে কে রে নিস্তার ।” বৈষ্ণবচরণের গানে ঠাকুরের ভাবসমাধি হইত এবং ভাবাবিষ্ট অবস্থায় তিনি নৃত্যও করিতেন। বৈষ্ণবচরণ শ্রীরামকৃষ্ণকে বিশেষ ভক্তি করিতেন।

বৈষ্ণবচরণ গোস্বামী — উৎসবানন্দ বিদ্যাবাগিশের পুত্র। কর্তাভজা সম্প্রদায়ের সাধক। কলিকাতার পণ্ডিত সমাজে তাঁর খ্যাতি সুবিদিত। ১৮৬৫ খ্রীষ্টাব্দে পানিহাটীর চিঁড়া মহোৎসবে ঠাকুরকে প্রথম দর্শন করেন। তখন হইতেই ঠাকুর সম্বন্ধে উচ্চ ধারণা পোষণ করিতেন এবং পরবর্তী কালে সর্বসমক্ষে তিনি ঠাকুরকে ঈশ্বরের অবতাররূপে ঘোষণা করেন। একবার ঠাকুর ভাবসমাহিত অবস্থায় বৈষ্ণবচরণের স্কন্ধে আরোহণ করেন। বৈষ্ণবচরণ ইহাতে উৎফুল্ল হইয়া শ্রীরামকৃষ্ণের বন্দনা করিতে থাকেন। বৈষ্ণবচরণ প্রায়ই দক্ষিণেশ্বরে আসিতেন। একবার তিনি ঠাকুরকে কাছিবাগানের তাঁহার কর্তাভজা সমাজে লইয়া গিয়াছিলেন। তাঁহার নিমন্ত্রণেই ঠাকুর কলুটোলার হরিসভাতে গিয়া কীর্তনে যোগ দেন এবং ভাবোন্মত্ত অবস্থায় নৃত্য করিতে করিতে শ্রীগৌরাঙ্গের আসনে আরূঢ় হইয়াছিলেন।

বৃন্দে — পরিচারিকা — প্রকৃত নাম বৃন্দা দাসী। শ্রীরামকৃষ্ণ ‘বৃন্দে’ বলিয়া ডাকিতেন। তিনি ১৮৭৭ হইতে ১৮৮৫ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত দীর্ঘ আট বৎসর শ্রীরামকৃষ্ণ এবং শ্রীশ্রীসারদাদেবীর সেবা করিয়াছিলেন।

ভগবতী দাসী — ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের সান্নিধ্যে আগতা রানী রাসমণির বাড়ীর পুরাতন দাসী। কাশী বৃন্দাবন প্রভৃতি তীর্থদর্শন এবং সাধু-বৈষ্ণবসেবা প্রভৃতি নানা সৎকাজ করিয়াছিল। প্রায়ই সে দক্ষিণেশ্বরে শ্রীশ্রীঠাকুরকে দর্শন করিতে আসিত। প্রথম জীবনে তাহার স্বভাব ভাল ছিল না — কিন্তু পরবর্তী জীবনে তাহার পরিবর্তন হয়।

ভগবান দাস — ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের সান্নিধ্যে আগত জনৈক ব্রাহ্মভক্ত। দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুরের কাছে তাঁহার যাতায়াত ছিল। ১৮৮৪ খ্রীষ্টাব্দের ৯ই মার্চ দক্ষিণেশ্বরে শ্রীরামকৃষ্ণকে দর্শনের কথা কথামৃতে উল্লিখিত আছে। ওই দিন ঠাকুর তাঁহাকে আধুনিক ধর্ম ও সনাতন ধর্ম যথাক্রমে স্বল্পকাল ও অনন্তকাল স্থায়ীত্বের কথা বলিয়াছিলেন।

ভগবান দাস বাবাজী — বর্ধমান জেলার কালনার প্রবীন ও সিদ্ধ বৈষ্ণব। তাঁহার তাগ, শান্ত স্বভাব এবং ভগবৎ প্রেমের কথা সুবিদিত। তাঁহার আধ্যাত্মিক শক্তি ও অলৌকিক ক্ষমতা ছিল। একই অবস্থায় দিনরাত বসিয়া জপ করার ফলে তাঁহার পদদ্বয় পক্ষাঘাতে অবশ হইয়া গিয়াছিল। শ্রীরামকৃষ্ণ একবার কলুটোলা হরিসভায় শ্রীমদ্‌ ভাগবত পাঠ শুনিতে শুনিতে ভাবাবস্থায় শ্রীচৈতন্যের আসনে উপবিষ্ট হইয়াছিলেন। ইহা লোক পরম্পরায় জানিয়া ভগবান দাস বাবাজী তাঁহার উপর ক্রুদ্ধ হন। পরবর্তী কালে শ্রীরামকৃষ্ণ যখন তাঁহার আশ্রমে সর্বাঙ্গ-বস্ত্রাবৃত হইয়া আগমন করেন, তখন ভগবান দাস অনুভব করেন যে, কোন মহাপুরুষ তাঁহার আশ্রমে আগমন করিয়াছেন। বাবাজীকে সর্বদা জপের মালা ঘুরাইতে দেখিয়া ঠাকুরের ভাগ্নে হৃদয় তাঁহাকে প্রশ্ন করেন যে সিদ্ধ অবস্থার পরেও তিনি কেন সর্বদা মালা জপ করেন। তখন তিনি জবাব বেন যে, লোকশিক্ষার জন্য তিনি তা করেন। ঠাকুর ভাবস্থ অবস্থায় তাঁহার কথার প্রতিবাদ করিয়া তাঁহার অহংকার চূর্ণ করেন। শেষ পর্যন্ত বাবাজী শ্রীরামকৃষ্ণের মহত্ত্ব বুঝিতে পারেন এবং স্বীকার করেন যে, তিনিই (ঠাকুরই) কলুটোলা হরিসভার শ্রীচৈতন্য আসনে আরূঢ় হওয়ার উপযুক্ত অধিকারী।

ভগবান রুদ্র — ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের সংস্পর্শে আগত, কলিকাতার এম ডি পাশ চিকিৎসক। তিনি বিপত্নীক ছিলেন। ১৮৮৫ খ্রীষ্টাব্দে ২রা সেপ্টেম্বর চিকিৎসা উপলক্ষে শ্রীশ্রীঠাকুরের সহিত তাঁহার যোগাযোগ হয়। চিকিৎসাকালীন ঠাকুরের অবস্থা দেখিবার উদ্দেশ্যে, ঠাকুরের হাতের উপর একটি রৌপ্য মুদ্রা রাখিয়া তাঁহার সামনে পরীক্ষা করা হয়। হাতে টাকা রাখিবার সঙ্গে সঙ্গেই ঠাকুরের হাতটি বাঁকিয়া গিয়া নিঃশ্বাস বন্ধ হইয়া যায়। টাকাটি স্থানান্তরিত করিবার পর ঠাকুরের তিনবার দীর্ঘনিঃশ্বাস পড়ে এবং হাতটিও স্বাভাবিক হয়। এই ঘটনায় বিজ্ঞানজগতের মানুষ ডাক্তার অতীব বিস্মিত হন এবং ঠাকুরের প্রতি বিশেষভাবে আকৃষ্ট হন।

ভগী তেলি — কামারপুকুর অঞ্চলের শূদ্রজাতীয়া কর্তাভজা সম্প্রদায়ের সাধিকা ভগবতী দাসী। দুষ্টলোকের চক্রান্তে তিনি সাধনপথ হইতে বিচ্যুতা হইয়াছিলেন।

ভবনাথ [ভবনাথ চট্টোপাধ্যায়] (১৮৬৩ – ১৮৯৬) — ঠাকুরের গৃহীভক্ত ভবনাথ চট্টোপাধ্যায়ের বরাহনগরে বর্তমান অতুলকৃষ্ণ ব্যানার্জী লেনে জন্ম। পিতা রামদাস ও মাতা ইচ্ছাময়ী দেবী। পিতামাতার একমাত্র সন্তান ভবনাথ যৌবনের প্রারম্ভ হইতেই নানা জনহিতকর কার্যে নিযুক্ত থাকিতেন। ব্রাহ্মসমাজে যাতায়াত নরেন্দ্রনাথের সহিত বন্ধুত্ব, শিক্ষকতা করা এবং সর্বোপরি ১৮৮১ খ্রীষ্টাব্দ নাগাদ শ্রীশ্রীঠাকুরের সান্নিধ্যলাভ তাঁহার জীবনের স্মরণীয় ঘটনা। নরেন্দ্রনাথের সহিত তাঁহার অন্তরিকতা দেখিয়া ঠাকুর তাঁহাদিগকে ‘হরিহরাত্মা’ বলিতেন। ইহা ব্যতীত ঠাকুর কখনও নরেনকে ‘পুরুষ’ ও ভবনাথকে ‘প্রকৃতি’ বলিতেন। তিনি উভয়কেই ‘নিত্যসিদ্ধ’ ও ‘অরূপের ঘর’ বলিয়া নির্দিষ্ট করিয়াছিলেন। ঠাকুরের দেহরক্ষার পর বরাহনগরে মঠের জন্য মুন্সীদের ভূতুড়ে বাড়ি মাসিক ১০ টাকা ভাড়ায় ভবনাথ যোগাড় করিয়া দেন। তিনি সুগায়ক ছিলেন, বহুবার ঠাকুরকে গান শুনাইয়াছিলেন। ‘নীতিকুসুম’ ও ‘আদর্শনারী’ তাঁহার রচিত দুইখানি গ্রন্থ। তাঁহারই আহ্বানে বরাহনগরের অবিনাশ দাঁ দক্ষিণেশ্বরে আসিয়া তাঁহার ক্যামেরায় ৺বিষ্ণু মন্দিরের দালানে সমাধিস্থ অবস্থায় শ্রীশ্রীঠাকুরের বহুল প্রচারিত ছবি তোলেন। তিনি ঠাকুরকে ধ্রুবর একটি ফটো উপহার দিয়াছিলেন যেটি বর্তমানে দক্ষিণেশ্বর কালীমন্দিরে ঠাকুরের ঘরের শোভাবর্ধন করিতেছে। বরাহনগরমঠ প্রতিষ্ঠার সময় আর্থিক সাহায্য না করিলেও অন্য দিক দিয়া তিনি অনেক সাহায্য করিয়াছিলেন। ঠাকুরের তিরোধানের পর তিনি বি. এ. পাশ করেন। পরে বিদ্যালয় পরিদর্শনের চাকুরী লইয়া কলিকতার বাহিরে চলিয়া যান, ফলে বরাহনগর মঠের সহিত তাঁহার সম্পর্ক ক্ষীণ হইতে থাকে। তিনি ১৮৮৬ খ্রীষ্টাব্দে ভবানীপুরে বিহারী ডাক্তার রোডে বসবাস করিতে থাকেন। এই সময়ে তাঁহার একমাত্র কন্যা প্রতিভার জন্ম হয়। ১৮৯৬ খ্রীষ্টাব্দে কালাজ্বরে আক্রান্ত হইয়া তিনি রামকৃষ্ণ দাস লেনের ভাড়াবাড়িতে দেহত্যাগ করেন।

ভাস্করানন্দ স্বামী (১৮৩৩ – ১৮৯৯) — কাশীর সিদ্ধ সন্ন্যাসী, প্রকৃত নাম মতিরাম। মণিলাল মল্লিক শ্রীশ্রীঠাকুরকে তাঁহার কথা বলিয়াছিলেন। কানপুর জেলার মিথিলাপুর গ্রামে জন্ম। ব্যাকরণ ও বেদান্তাদি শিক্ষার পর ২৭ বৎসর বয়সে সন্ন্যাস গ্রহণ করিয়া কাশীতে শেষ জীবন অতিবাহিত করেন। সেখানে ১৮৮৬ খ্রীষ্টাব্দে শ্রীশ্রীমা তাঁহাকে দর্শন করিয়া এই নির্বিকার পুরুষ সম্বন্ধে স্বীয় উচ্চ ধারণা প্রকাশ করিয়াছিলেন। স্বামীজীও পরিব্রাজক অবস্থায় তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিয়াছিলেন। স্বামী অভেদানন্দও এই ত্যাগী ও নিরহঙ্কার পুরুষের প্রসঙ্গ উল্লেখ করিয়াছিলেন।

ভূধর চট্টোপাধ্যায় — কলিকাতার পটলডাঙা নিবাসী শ্রীশ্রীঠাকুরের ভক্ত। প্রখ্যাত পণ্ডিত শশধর তর্কচূড়ামণির শিষ্য ছিলেন। তাঁহার কলিকাতার বাড়িতে শশধর কিছুদিন অবস্থান করিয়াছিলেন এবং সেই উপলক্ষেই ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের সহিত ১৮৮৪ খ্রীষ্টাব্দে ভূধরের যোগাযোগ হয়। ভূধর চট্টোপাধ্যায়ের প্রণীত ‘সাধুদর্শন’ নামক পুস্তকে (১ম ভাগ, কলিকাতা, ১৯২৪ সাল) রামকৃষ্ণ পরমহংস নামে একটি নিবন্ধ আছে। তাঁহার শেষজীবন কাশীতে অতিবাহিত হয়।

ভুবনমোহিনী ধাত্রী — ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের সংস্পর্শে আগতা, কলিকাতার জনৈকা ধাত্রী এবং মহিলা ভক্ত। ইনি মাঝে মাঝে ঠাকুরকে দর্শন করিতে দক্ষিণেশ্বরে যাইতেন।

ভুবনেশ্বরীদেবী (ভুবনেশ্বরী দত্ত — নরেন্দ্রনাথের মাতা) — অতীব ধর্মপরায়ণা, দয়ালু পরোপকারী মহিলা। তিনি স্বল্প-শিক্ষিতা কিন্তু অসাধারণ স্মৃতিশক্তির অধিকারী ছিলেন। নন্দলাল বসুর একমাত্র কন্যা এবং মাত্র ১১ বছর বয়সে বিশ্বনাথ দত্তের সহিত তাঁহার বিবাহ হয়। অত্যন্ত দক্ষতা ও নিপুণতার সহিত সংসারে বিশাল দায়িত্ব পরিচালনা করিতেন। প্রতিদিন রামায়ণ, মহাভারত পাঠ করিতেন যাহার অধিকাংশই তাঁহার কণ্ঠস্থ ছিল। ইহা ছাড়া দরিদ্র সেবা, বহু কর্তব্যকর্মের মধ্যেও শান্ত সমাহিত চিত্তে ভগবানের সাধনা করা ছিল তাঁহার কাজ। স্বামীর মৃত্যুর পর তাঁহার পরিবার খুব দুর্দশাগ্রস্ত হইয়া পড়ে কিন্তু তিনি কখনো ভাঙিয়া পড়েন নাই। অত্যন্ত ধৈর্য সহকারে তিনি পরিস্থিতির সহিত সামঞ্জস্য রক্ষা করিতেন। নরেন্দ্রনাথের অন্তরের সুকুমার বৃত্তিগুলিকে তঁহার মাতা ভুবনেশ্বরী জাগাইয়া তোলেন। রামায়ণ মহাভারত পাঠের দ্বারা ভারতের প্রাচীন ঐতিহ্য গৌরবকে নরেনের চোখের সামনে তুলিয়া ধরেন। মানুষের প্রতি জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে ভালবাসা, যা নরেনকে বিশ্ববাসীর কাছে প্রিয় করিয়া তুলিয়াছিল তাহার শিক্ষাও তিনি মাতা ভুবনেশ্বরীদেবীর নিকট হইতে পান। তাঁহার জীবনে মাতার প্রভাব পরবর্তী কালে তিনি বহুবার স্বীকার করিয়াছিলেন। ১৯১৪ খ্রীষ্টাব্দে তাঁহার দেহত্যাগ হয়। নরেন্দ্রনাথ কাশীপুরে ঠাকুরের অসুখের সময় ঠাকুরের সেবায় নিয়োজিত থাকেন। পুত্রের অনুপস্থিতিতে উদ্বিগ্ন হইয়া মাতা ছয় বৎসরের বালক পুত্র ভূপেনন্দ্রনাথকে লইয়া তাঁহার সন্ধানে কাশীপুরে আসেন। ভুবনেশ্বরী কাঁকুড়গাছি বাগানবাড়িতে ঠাকুরের পূতাস্থির সমাধিস্থ দিবসে উপস্থিত ছিলেন ও পরবর্তী কালে এই দিবসের অনুষ্ঠানে তিনি শ্রদ্ধা নিবেদন করিতেন।

ভূপতি — কলিকাতার রাজবল্লভ পাড়ায় জন্ম। বলরাম-মন্দিরে ঠাকুরকে প্রথম দর্শন করেন এবং পরে দক্ষিণেশ্বরে যাতায়াত করিতেন। ঠাকুর একদিন ভাবাবিষ্ট হইয়া তাঁহাকে স্পর্শ করিলে তাঁহার উচ্চ অনুভূতি হয়। পরবর্তী কালে তাঁহার শিষ্যগণ বারাসতের হৃদয়পুরের কোঁড়া অঞ্চলে ‘ঋষভ আশ্রম’ প্রতিষ্ঠা করেন।

ভৈরব বন্দ্যোপাধ্যায় — আদি ব্রাহ্মসমাজের একজন নেতা। নন্দনবাগান ব্রাহ্মসমাজে শ্রীশ্রীঠাকুরকে দর্শন করেন।

ভৈরবী ব্রাহ্মণী — যশোহর জেলার বিদুষী ব্রাহ্মণ কন্যা — প্রকৃত নাম যোগেশ্বরী। ইনি শ্রীশ্রীঠাকুরের তন্ত্রসাধনার গুরু। ১৮৬১ খ্রীষ্টাব্দে আনুমানিক ৪০ বৎসর বয়সে তিনি দক্ষিণেশ্বরে আসেন। শ্রীশ্রীঠাকুরকে ইনি চৌষট্টি প্রকার তন্ত্রসাধনা করান এবং ঠাকুরকে অবতার বলিয়া ঘোষণা করেন। ১৮৬৭ খ্রীষ্টাব্দে ইনি ঠাকুরের সহিত কামারপুকুরে গিয়াছিলেন। শ্রীশ্রীমাও যোগেশ্বরীকে শ্বশ্রূমাতার মতোই সেবা করিতেন। কামারপুকুর হইতে তিনি কাশী গমন করেন এবং শেষ জীবন কাশী ও বৃন্দাবনে অতিবাহিত করেন।

ভোলানাথ মুখোপাধ্যায় — দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়ির মুহুরী এবং পরে খাজাঞ্চী হইয়াছিলেন। ইনি ঠাকুরকে অত্যন্ত ভক্তি করিতেন এবং তাঁহাকে মাঝে মাঝে মহাভারত পাঠ করিয়া শুনাইতেন।

মথুরনাথ বিশ্বাস (মথুরামোহন বিশ্বাস — সেজোবাবু) — মথুরামোহন রানী রাসমণির তৃতীয়া কন্যা করুণাময়ীর স্বামী। তিনি রানীর সেজো জামাতা বলিয়া ‘সেজোবাবু’ নামে পরিচিত ছিলেন। করুণাময়ীর মৃত্যুর পর রানীর কনিষ্ঠা কন্যা শ্রীমতী জগদম্বার সহিত তাঁহার বিবাহ হয়। তিনি শ্রীশ্রীঠাকুরের পরমভক্ত, শিষ্য, সেবক ও রসদদার ছিলেন । দীর্ঘ ১৮ বৎসর তিনি ঠাকুরের অসাধারণ সেবা করিয়াছিলেন। ঠাকুরের উপর ছিল তাঁহার অচল বিশ্বাস ও অগাধ বিশ্বাস ও অগাধ ভক্তি। মথুরামোহনই ঠাকুরকে দক্ষিণেশ্বরের মা-কালীর পূজক পদে নির্বচন করিয়াছিলেন। তিনি নানারকম যুক্তি, পরীক্ষা দ্বারা ঠাকুরের অবতারত্ব সম্বন্ধে নিঃসন্দেহ হন, অবশেষে ঠাকুরের ন্যায় প্রকৃত কাম-কাঞ্চনত্যাগী সন্ন্যাসীর পায়ে আত্মনিবেদন করেন। একদা দক্ষিণেশ্বরে শ্রীরামকৃষ্ণের দেহে একসঙ্গে শিব ও কালীমূর্তি দর্শন করেন। তিনি ঠাকুরকে জীবন সর্বস্ব রূপে গ্রহণ করিয়াছিলেন ও সকল বিষয়েই তাঁহার উপর নির্ভর করিতেন। ঠাকুরের পক্ষে দক্ষিণেশ্বরে — সব বাধাবিঘ্ন অতিক্রম করিয়া সর্বরকমের সাধনায় সিদ্ধিলাভ করার ক্ষেত্রে মথুরের ঐকান্তিক সেবা অপরিহার্য ছিল। ঠাকুরকে তিনি নানা তীর্থদর্শন করাইয়াছিলেন। ঠাকুরের সাধনকালে সাধনার যাবতীয় সেবার ভার তিনি গ্রহণ করায় ঠাকুর তাঁহাকে ৺জগদম্বার লীলায় প্রধান রসদদার বলিয়া জানিতেন। শ্রীশ্রীঠাকুর ও মথুরবাবুর অলৌকিক সম্বন্ধ শ্রীরামকৃষ্ণ লীলার এক বিশেষ অধ্যায়। ১৮৭১ খ্রীষ্টাব্দের ১৬ই জুলাই তাঁহার দেহত্যাগ হয়।

মধুসূদন ডাক্তার — ঠাকুরের হাত ভাঙার সময় ইনি চিকিৎসা করিয়াছিলেন। দক্ষিণেশ্বরে নবীন নিয়োগীর বাড়িতে যাত্রাগান শুনিতে গিয়া ঠাকুর ইঁহার চোখে অশ্রুর ধারা দেখিয়াছিলেন। তাঁহার অধিক বয়সে শক্তিসামর্থ্যের কথা শ্রীশ্রীঠাকুর উল্লেখ করিয়াছিলেন।

মাইকেল মধুসূদন দত্ত (১৮২৪ – ১৮৭৩) — বাংলা নবজাগরণের এক নবীন প্রতিভা। খ্রীষ্টান ধর্মে আকৃষ্ট হইয়া হিন্দুধর্ম ত্যাগ করিয়া খ্রীষ্টধর্মে দীক্ষিত হন। ১৮৬২ খ্রীষ্টাব্দে ইংলণ্ডে যান ও ১৮৬৬ খ্রীষ্টাব্দে আইনবিদ্যা অধ্যয়ন করিয়া ভারতে আসেন। ১৮৬৭ খ্রীষ্টাব্দ হইতে কলিকাতা হাইকোর্টে আইন ব্যবসা শুরু করেন। প্রচুর অর্থ উপার্জন করিলেও ব্যয়াধিক্যের ফলে তিনি ঋণগ্রস্ত হইয়া পড়েন ও কলিকাতা ত্যাগ করিয়া উত্তরপাড়ায় চলিয়া যান। ১৮৫৯ – ১৮৬২ খ্রীষ্টাব্দ ছিল মধুসূদনের জীবনের সর্বোত্তম কয়েকটি বছর। এই সময় তাঁহার তিনটি নাটক দুইটি ব্যঙ্গ নাটক ও চারটি কাব্য প্রকাথিত হয়। তাঁহার ‘মেঘনাদ বধ’ কাব্য বাংলা কাব্যে নবজাগরণের সূচনা করে। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সাহিত্যের অত্যুত্তম রচনাসমূহ পাঠে তাঁহার উৎসাহ ছিল। তিনি সমাজের গোঁড়ামির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করিয়া আধুনিক চিন্তাধারা আনিতে চাহিয়াছিলেন। মধুসূদন দত্ত দক্ষিণেশ্বরের মন্দিরের বাগান সংক্রান্ত একটি মামলা পরিচালনা করিতেছিলেন। সেই সময় মধুরামোহনবাবুর জ্যেষ্ঠ পুত্র দ্বারিকানাথের সহিত সেই ব্যাপারে আলোচনা করিতে দক্ষিণেশ্বরে আসিয়াছিলেন। তখন দ্বারিকাবাবু তাঁহাকে তাঁহার ইচ্ছানুসারে শ্রীরামকৃষ্ণের সহিত সাক্ষাৎ করান। দুর্ভাগ্য বশতঃ ঠাকুর তাঁহার সহিত কোনরূপ বাক্যালাপ করিতে পারেন নাই। তবে তিনি মাইকেলকে দুইখানি রামপ্রসাদী গান গাহিয়া শুনাইয়াছিলেন।

মণি মল্লিক (মণিমোহন মল্লিক — মণিলাল মল্লিক) — সিঁদুরিয়াপটী নিবাসী ব্রাহ্মভক্ত। ষাট-পঁয়ষট্টি বছরের বৃদ্ধ মণিমোহন মল্লিক ছিলেন ব্রাহ্মসমাজ ভুক্ত। তিনি খুব হিসাবী মানুষ ছিলেন। পরবর্তী কালে পঁচিশ হাজার টাকা দরিদ্র বালকদের ভরণপোষণার্থে দান করিয়াছিলেন। তাঁহার একটি যুবক পুত্র মারা গেলে তিনি শোকার্ত হইয়া দক্ষিণেশ্বরে আসেন এবং ঠাকুরের কথামৃত ও ভজন গান শুনিয়া তাঁহার শোকের লাঘব হয়। তখন তিনি বলেন, তিনি জানিতেন যে ঠাকুর ছাড়া তাঁহার শোকের আগুন আর কেহ নির্বাপিত করিতে পারিতেন না। ব্রাহ্ম সমাজের বাৎসরিক উৎসবে মণিমল্লিক ঠাকুরকে তাঁহার গৃহে আমন্ত্রণ করেন। ঠাকুর তাঁহার গৃহে প্রায়শঃ যাইতেন, ভাবে নৃত্যগীতাদি করিতেন এবং কখনো সমাধিস্থ হইতেন। ঠাকুর তাঁহাকে আপনার লোক বলিয়া মনে করিতেন।

মণী সেন (মণিমোহন সেন) — পাণিহাটির মণিমোহন সেন ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের ভক্ত ছিলেন। তিনি কখনো একা, কখনো সঙ্গীর সহিত দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুরের নিকট আসিতেন। মথুরবাবুর মৃত্যুর পর তিনি স্ব-ইচ্ছায় ঠাকুরের দৈনন্দিন প্রয়োজন মিটাইবার ভার গ্রহণ করেন। কিন্তু সম্ভবতঃ দেশিদিন তিনি এই দায়িত্ব বহন করেন নাই। মণিমোহন পাণিহাটির ৺রাধাকৃষ্ণ মন্দিরের সেবায়েত ছিলেন। পাণিহাটির বিখ্যাত চিঁড়া মহোৎসবে মণিমোহনের দ্বারা আমন্ত্রিত হইয়া ঠাকুর ভক্তদিগের সহিত গিয়াছিলেন। প্রথমে মণি সেনের গৃহে কিছুক্ষণ বিশ্রাম করিয়া মন্দিরে যান। অতঃপর ভাবাবেশে গলার ব্যাথা ভুলিয়া মণি সেনের গুরু নবদ্বীপ গোস্বামীর সহিত কীর্তনানন্দে মত্ত হইয়া সমাধিস্থ হইতে থাকেন। তখন তাঁহাকে লোকে সাক্ষাৎ শ্রীগৌরাঙ্গ মনে করিয়া তাঁহার চারিদিকে সকলে আনন্দে কীর্তন ও নৃত্য করিতেছিল। পরে মণি সেনের গৃহে জলপান করিয়া তাঁহারা দক্ষিণেশ্বরে রওনা হন। মণি সেন সকলকে দক্ষিণা দিলেও ঠাকুর কিছুতেই দক্ষিণা গ্রহণ করেন নাই।

মণীন্দ্র গুপ্ত [মণীন্দ্রকৃষ্ণ গুপ্ত] (১৮৭১ – ১৯৩৯) — মণীন্দ্র (খোকা) একাদশ বৎসর বয়সে দক্ষিণেশ্বরে প্রথম ঠাকুরকে দর্শন করেন। তিনি তাঁহার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা উপেন্দ্রকিশোর ও ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়ের সহিত আসিয়াছিলেন। ঠাকুরের স্নেহপূর্ণ ব্যবহারে তিনি তাঁহার প্রতি আকৃষ্ট হন। সেই সময়ে তিনি তাঁহার পিতার কর্মস্থল ভাগলপুরে থাকিতেন। তারপর কলিকাতায় যখন ফিরিয়া আসিলেন ঠাকুর তখন শ্যামপুকুরে অসুস্থ অবস্থায় ছিলেন। ১৮৮৫ খ্রীষ্টাব্দে সারদাপ্রসন্নর সহিত ১৫ বৎসর বয়সে তিনি ঠাকুরকে দেখিতে যান। ঠাকুর তাঁহাকে চিনিতে পারেন এবং আবার আসিতে বলেন। পরদিন গেলে ঠাকুর তাঁহাকে স্নেহভরে ক্রোড়ে লইয়া সমাধিস্থ হন। ইহার পর তিনি সেখানে নিত্য যাইতে থাকেন এবং ঠাকুরকে গুরুরূপে বরণ করেন। কাশীপুরে অসুস্থ ঠাকুরকে তিনি পাখার হাওয়া করলতেন। ১৮৮৬ খ্রীষ্টাব্দের দোলযাত্রার দিনে ঠাকুর তাঁহাকে হোলিখেলার জন্য যাইতে নির্দেশ দিলেও তিনি ঠাকুরকে একা রাখিয়া যাইতে সম্মত হইলেন না। ঠাকুর অশ্রু ভারাক্রান্ত নয়নে তাঁহাকে তাঁহার সেই ‘রামলালা’ বলিয়া উল্লেখ করিয়াছিলেন। পরবর্তী কালে বিবাহ করলেও শ্রীরামকৃষ্ণদের শিষ্যদের সহিত তাঁহার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল এবং রামকৃষ্ণ মিশনের আদর্শের প্রতি তাঁহার শ্রদ্ধা ছিল অবিচল।

মণি সেনের সঙ্গী ডাক্তার — শ্রীরামকৃষ্ণের যখন হাত ভাঙিয়া গিয়াছিল তখন ডা: প্রতাপ মজুমদার চিকিৎসা করিয়া ঔষধ লিখিয়া দিয়াছিলেন। পাণিহাটির মণি সেন এই ডাক্তারকে লইয়া আসিয়াছিলেন। ইনি প্রতাপ মজুমদারের ব্যবস্থা অনুমোদন করেন নাই। ইহার বুদ্ধি সম্বন্ধে ঠাকুর বিরূপ মন্তব্য করিয়াছিলেন।

মনোমোহন মিত্র (১৮৫১ – ১৯০৩) — শ্রীরামকৃষ্ণের গৃহীভক্ত। কোন্নগরের মিত্র পরিবারের সন্তান — রামচন্দ্র দত্তের মাসতুতো ভাই। রাখাল তাঁহার ভগ্নীপতি ছিলেন। ১৮৭৯ খ্রীষ্টাব্দের ১৩ই নভেম্বর শ্রীরামকৃষ্ণের সহিত দক্ষিণেশ্বরে প্রথম সাক্ষাৎ হয়। প্রথম জীবনে ব্রাহ্ম সমাজে তাঁহার যাতায়াত ছিল। কিন্তু দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুরের সহিত সাক্ষাৎ এবং তাঁহার প্রতি ঠাকুরের কৃপা মনোমোহন মিত্রের জীবনে এক নূতন অধ্যায়ের সূচনা করে। শ্রীরামকৃষ্ণকে সর্বান্তঃকরেণে গুরুরূপে গ্রহণের ফলে মনোমোহনের জীবনে আমূল পরিবর্তন আসে। তিনি ঠাকুরের একনিষ্ঠ ভক্ত হন। শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁহার গৃহে শুভাগমন করিয়াছিলেন। বরাহনগর মঠে সন্ন্যাসীদের অসুস্থ অবস্থায় মনোমোহন তাঁহাদের দেখাশুনা করিতেন। তত্ত্বমঞ্জরীতে ঠাকুরের সম্বন্ধে তিনি বহু প্রবন্ধ লেখেন। ১৮৯৩ – ১৯০২ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে বহু ভক্ত শ্রীরামকৃষ্ণ-বিষয়ে আলোচনার জন্য তাঁহার গৃহে আসিতেন।

মনোহর সাঁই (গোস্বামী) — প্রসিদ্ধ কীর্তনীয়া। দক্ষিণেশ্বরে ও অধরের বাড়িতে কয়েকবার ঠাকুরকে কীর্তন শুনাইয়া ছিলেন। ঠাকুর তাঁহার কীর্তন খুব পছন্দ করিতেন — মনোহরও ঠাকুরের অনুরাগীভক্ত ছিলেন।

মহলানবীশ (ডাক্তার) — সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের সদস্য। সমাজ মন্দিরের নিকট তাঁহার চিকিৎসা গৃহ ছিল। একবার ঠাকুর ব্রাহ্মভক্ত পণ্ডিত শিবনাথ শাস্ত্রীর বাড়িতে গিয়া তাঁহার সহিত দেখা করিবার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। কিন্তু শাস্ত্রী মহাশয় তখন বাড়িতে না থাকায় ডা: মহলানবীশ ঠাকুরকে অভ্যর্থনা করিয়া সমাজ মন্দিরে লইয়া যান ও শ্রীশ্রীঠাকুরের নিকট ঈশ্বর-প্রসঙ্গ শ্রবণ করেন।

মহিমাচরণ চক্রবর্তী — কাশীপুরনিবাসী মহিমাচরণ বেদান্ত চর্চা করিতেন। তিনি শ্রীরামকৃষ্ণকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করিতেন এবং প্রায়ই দক্ষিণেশ্বরে আসিতেন। ধর্মীয় চিন্তায়, শাস্ত্রাদি অধ্যয়নে তিনি সময় কাটাইতেন। সংস্কৃত, ইংরাজীতে বহুগ্রন্থ পড়িয়া তিনি পাণ্ডিত্য অর্জন করিয়াছিলেন। তাঁহার অনেক গুণ ছিল। কিন্তু তিনি যে বিদ্বান বুদ্ধিমান, ধার্মিক উদার এবং বহুগুণের-সমাবেশ তাঁহার মধ্যে আছে — ইহা সকলের চোখের সামনে তুলিয়া ধরিবার জন্য যে ব্যগ্রতা প্রকাশ করিতেন, ইহা তাঁহাকে অনেকের কাছে হাস্যাস্পদ করিয়া তুলিত। নরেন্দ্রনাথ ও গিরিশ তাঁহার সহিত তর্ক করিতেন। একটি অবৈতনিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করিয়া সাধারণের মধ্যে শিক্ষা বিস্তার করিয়াছিলেন। তাঁহার বাড়িতে অন্নপূর্ণা মূর্তি প্রতিষ্ঠিত ছিল। একটি বিরাট গ্রন্থাগারও তাঁহার ছিল। শ্রীশ্রীঠাকুর তাঁহাকে ভক্তিমার্গের কথাপ্রসঙ্গে বহুবার নারদ পঞ্চরাত্রের শ্লোক আবৃত্তি করাইয়াছিলেন।

মহেন্দ্র কবিরাজ — মহেন্দ্রনাথ পাল — সিঁথি নিবাসী কবিরাজ। শ্রীরামকৃষ্ণের নিকট দক্ষিণেশ্বরে আসিতেন। ঠাকুর তাঁহাকে ‘সিঁথির মহিন্দোর পাল’ বলিতেন। শ্রীরামকৃষ্ণের অন্যতম চিকিৎসক।

মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত (১৮৫৪ – ১৯৩২) — ইনি ‘শ্রীম’ বা মাস্টার মহাশয় নামে অধিক খ্যাত। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতিছাত্র ছিলেন, এবং বিদ্যাসাগর মহাশয়ের মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিয়শনের ও অন্যান্য বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণের সহিত মিলিত হইবার পূর্বে তিনি কেশবচন্দ্র সেনের অনুরাগী ছিলেন। তখনকার দিনের অন্যান্য সকল ইংরেজী শিক্ষিত যুবকের মতো তিনিও পাশ্চাত্য দর্শন ও বিজ্ঞানে অনুরক্ত ছিলেন। কেশবচন্দ্রের আকর্ষণে তিনি ব্রাহ্মধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হইয়াছিলেন। ব্রাহ্মসমাজের সভাতেই তিনি পরমহংসদেবের নাম শুনিয়াছিলেন। তাঁহার নিকট আত্মীয় নগেন্দ্রনাথ গুপ্তের অনুপ্রেরণায় তিনি তাঁহার অপর এক আত্মীয় সিদ্ধেশ্বর মজুমদারের সঙ্গে দক্ষিণেশ্বরে গিয়াছিলেন। ১৮৮২ খ্রীষ্টাব্দে মহেন্দ্রনাথ প্রথম ঠাকুরকে দর্শন করেন। প্রথম দর্শনই তাঁহার হৃদয়-মনকে এতদূর অভিভূত করে যে তিনি চিরজীবনের জন্য ঠাকুরের ভালবাসায় মুগ্ধ হইয়া যান। তাঁহার বিদ্যাশিক্ষা ও জ্ঞানের গর্ব ঠাকুরের প্রভাবে ভগবন্মুখী হইয়া যায়। তিনি বুঝিতে পারেন যে ঈশ্বরকে জানাই আসল জ্ঞান। ঠাকুর প্রথম দর্শনেই মহেন্দ্রনাথের আধ্যাত্মিক সম্ভাবনার কথা জানিয়াছিলেন। ঠাকুরের নিরন্তর উপদেশ অবিরাম শিক্ষা তাঁহাকে ভাগবত জীবনযাপনের শিক্ষা দিতে লাগিল। ঠাকুরের বাণী প্রচার করাই তাঁহার ভবিষ্যত জীবনের কাজ সেজন্য তাঁহাকে ঠাকুর গড়িয়া তুলিতে লাগিলেন। সংসারে থাকিয়াও গৃহী-সন্ন্যাসীর জীবনযাপন, ঈশ্বরের প্রতি অসীম ভক্তি, সাধু সন্ন্যাসীদের সেবা তাঁহার শেষ জীবন অবধি তিনি করিয়া গিয়াছেন। শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁহার ধ্যানে, মননে, তাঁহার সমগ্র চিন্তাকে তন্ময় করিয়া রাখিতেন সর্বদা। তাঁহার বহু ছাত্রকে তিনি ঠাকুরের কাছে লইয়া আসিয়াছেন যাঁহাদের মধ্যে অনেকে পরবর্তী জীবনে রামকৃষ্ণ সঙ্ঘের সন্ন্যাসী হইয়াছিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে ছায়ার মতো তিনি ঘুরিতেন এবং তাঁহার আচরণ পূর্বকথা, বাণী সব লিপিবদ্ধ করিয়া রাখিতেন যাহা তিনি ইংরেজী ছোট পুস্তিকাকারে প্রথম প্রকাশ করেন। ৫০ নং আমহার্ষ্ট স্ট্রীটে ৪র্থ তলের এক ক্ষুদ্র প্রকোষ্ঠে প্রায় ২০ বৎসর বাস ও শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃতের পরিবেশনাই মাস্টার মহাশয়ের জীবনের শ্রেষ্ঠ দান। তিনি কথামৃত ইংরেজীতে ‘গসপেল অফ শ্রীরামকৃষ্ণ’ নামে প্রকাশ করেন যাহা পাঠ করিয়া বহু দেশী-বিদেশী মানুষ প্রভাবিত হইয়াছেন এবং শ্রীরামকৃষ্ণের আদর্শ ও বাণী, দেশ-দেশান্তরের মানুষকে শান্তিলাভের পথে চলিবার প্রেরণা দান করিতেছে।

মহেন্দ্র গোস্বামী — বৈষ্ণব সম্প্রদায়ভুক্ত, শ্রীরামকৃষ্ণের ভক্ত। রামচন্দ্র দত্ত ও সুরেন্দ্রের প্রতিবেশী। ধর্মবিষয়ে গোঁড়ামী না থাকায় তিনি শ্রীরামকৃষ্ণের ভাব এবং উপদেশ লাভে আগ্রহী ছিলেন। রামচন্দ্র দত্তের গৃহে শুভাগমন করিলে ঠাকুরের সহিত ইনি দেখা করিতেন — দক্ষিণেশ্বরেও কিছুকাল ঠাকুরের নিকট ছিলেন ও উদার ভাবাপন্ন বৈষ্ণব হইয়াছিলেন।

মহেন্দ্র মুখোপাধ্যায় — শ্রীরামকৃষ্ণের ভক্ত। বাগবাজার রাজবল্লভ পাড়ার বাসিন্দা। তাঁহার একটি ময়দার কল ছিল আরও অন্যান্য ব্যবসা ছিল, ২৪ পরগণার কেদেটি গ্রামে এবং বাগবাজারে তাঁহার বাড়ি ছিল। ১৮৮৪ খ্রীষ্টাব্দের ২১শে সেপ্টেম্বর স্টার থিয়েটারে যাইবার পূর্বে এবং পরে শ্রীরামকৃষ্ণ মাস্টার মহাশয়ের সহিত মহেন্দ্রের হাতিবাগানস্থিত ময়দা কলের বাড়িতে শুভাগমন করিয়াছিলেন। ঠাকুর সেখানে ভাবস্থ হইয়া শ্রীকৃষ্ণ নাম করিয়াছিলেন। মহেন্দ্র নানাবিধ মিষ্টান্ন দ্বারা তাঁহাকে আপ্যায়িত করিয়াছিলেন এবং ঠাকুর তাঁহার ভক্তি ও সেবায় খুব সন্তুষ্ট হইয়াছিলেন। পরবর্তী কালে মহেন্দ্র মঠের প্রয়োজনীয় ময়দা ও বস্ত্র প্রভৃতি প্রায়ই সরবারাহ করিতেন।

মহেন্দ্রলাল সরকার (ডাক্তার) (১৮৩৩ – ১৯০৪) — হাওড়া জেলার পাইকপাড়া গ্রামে জন্ম। বাল্যে পিতৃবিয়োগের পর মাতার সহিত মাতুলালয়ে থাকিয়া হেয়ার স্কুল, হিন্দু কলেজে শিক্ষা। বৃত্তি লাভ করয়া মেডিকেল কলেজ হইতে এল.এম.এস পরে এম.ডি পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করেন। এলোপ্যাথি ত্যাগ করিয়া হোমিওপ্যাথি মতে চিকিৎসা করিতেন। শিক্ষা ও চিকিৎসাক্ষেত্রে তিনি বিভিন্ন সম্মানসূচক পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। ১৮৭৬ খ্রীষ্টাব্দে তিনি কলিকাতায় (২১০ নং বহুবাজার স্ট্রীটে) ভারতবর্ষীয় বিজ্ঞান সভা (বর্তমানে যাদবপুর নূতন ভবনে স্থানান্তরিত) স্থাপন করেন। মথুরবাবুদের পারিবারিক চিকিৎসক ছিলেন — সেইসূত্রে শ্রীরামকৃষ্ণের চিকিৎসার জন্য তাঁহাকে শ্যামপুকুরে ডাকা হয়। ঠাকুরের সহিত ঈশ্বরীয় কথাপ্রসঙ্গে তিনি মুগ্ধ হইয়াছিলেন চিকিৎসাসূত্রে তিনি প্রায় প্রতিদিন ঠাকুরের নিকট আসিতেন এবং প্রাণ ভরিয়া ঠাকুর ও তাঁহার ভক্তগণের সঙ্গ করিয়া যাইতেন। প্রথম দিনের পর তিনি প্রাপ্য দর্শনীও নিতেন না। ক্রমে ঠাকুরের সহিত তাঁহার হৃদ্যতা জন্মে এবং মানসিক শান্তি লাভ করেন। তিনি একদা জনৈক ডাক্তার বন্ধুর সহিত একত্রে সমাধি অবস্থায় ঠাকুরের শরীর পরীক্ষা করিয়া তাঁহাতে নিস্পন্দভাব লক্ষ্য করিয়া যারপরনাই বিস্মিত হন। মহেন্দ্র বলেন, As a man I have the greatest regard for him. ঠাকুরের চিকিৎসা করিতে আসিয়া তিনি শ্রীরামকৃষ্ণের দ্বারা বিশেষ প্রভাবিত হন।

মানময়ী — শ্রীমহেন্দ্র নাথ গুপ্তের শিশুকন্যা। শ্রীশ্রীঠাকুর পুত্রশোকগ্রস্তা শ্রীম’র সহধর্মিণীকে এই শিশুকন্যাসহ কাশীপুরে আসিয়া শ্রীশ্রীমায়ের নিকট থাকিতে বলেন। শ্রীশ্রীমা কন্যাটিকে স্নেহভরে ‘মানময়ী’ বলিয়া ডাকিতেন।

মারোয়াড়ী ভক্ত — কলিকাতার বড়বাজারের ১২ নং মল্লিক স্ট্রীট নিবাসী জনৈক মারোয়াড়ী ভক্ত। দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের নিকটে তিনি প্রায়ই যাইতেন। ১৮৮৪ খ্রীষ্টাব্দের ২০শে অক্টোবর, সোমবার ‘অন্নকূট’ উপলক্ষে ঠাকুর তাঁহার মল্লিকবাজারের বাড়িতে আমন্ত্রিত হইয়া যান। মারোয়াড়ী ভক্তগণ ঠাকুরের প্রতি তাঁহাদের শ্রদ্ধাভক্তি জ্ঞাপন করেন। ঠাকুর সেখানে তাঁহাদের সহিত সহজবোধ্য হিন্দীতে ভগবৎ প্রসঙ্গ করেন এবং শ্রীশ্রীময়ূর মুকুটধারী বিগ্রহের পূজা দর্শন করিয়া তিনি ভাবসমাধিস্থ হন ও শ্রীবিগ্রহকে চামর ব্যজন করেন। তিনি এই ভাগ্যবান ভক্তের বাড়িতে প্রসাদ গ্রহণ করেন।

মাস্টারের পরিবার (নিকুঞ্জ দেবী) — শ্রীমহেন্দ্রনাথ গুপ্তের সহধর্মিণী। শ্রীরামকৃষ্ণ এবং শ্রীশ্রীমার স্নেহধন্যা মহিলাভক্ত। নিকুঞ্জ দেবী পুত্র শোকে অত্যধিক কাতর হইয়া মানসিক ভারসাম্য হারাইয়া ফেলিলে মহেন্দ্রনাথ তাঁহাকে ঠাকুরের নিকট লইয়া আসেন এবং পরে কাশীপুরে শ্রীশ্রীমায়ের কাছে বাস করিয়া তাঁহার মানসিক পরিবর্তন ঘটে। তিনি শ্রীশ্রীমার সহিত বৃন্দাবনে গিয়াছিলেন। বস্তুতঃ ঠাকুর ও শ্রীশ্রীমায়ের কৃপায় তাঁহার জীবন সার্থক হইয়াছিল।

মিশ্র সাহেব (প্রভুদয়াল মিশ্র) — উত্তর পশ্চিম ভারতের অধিবাসী। এক ভ্রাতার বিবাহের দিনে সেই ভ্রাতা এবং আর এক ভ্রাতার আকস্মিক মৃত্যু ঘটিলে তাঁহার মনে বৈরাগ্যের সঞ্চার হয়। ব্রাহ্মণ হইলেও তিনি খ্রীষ্টের প্রতি আকৃষ্ট হইয়া খ্রীষ্টান হন। কিন্তু তাঁহার সাহেবী পোষাকের অন্তরালে লুক্কায়িত থাকিত গৈরিক বস্ত্র। তিনি কোয়েকার সম্প্রদায়ভুক্ত ছিলেন। তিনি ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের দিব্যদর্শন পূর্বেই পাইয়াছিলেন। ৩৫ বৎসর বয়সে ঠাকুরের সন্ধান পাইয়া তিনি শ্যামপুকুরের ভাড়া বাড়িতে ঠাকুরের দর্শন লাভ করেন। ভাবস্থ ঠাকুরের মধ্যে তিনি যীশুর প্রকাশ প্রত্যক্ষ করিয়া ধন্য হন।

মোহিত সেন (মোহিতচন্দ্র সেন) — জয়কৃষ্ণ সেনের পুত্র। তিনি হেয়ার স্কুল, মেট্রোপলিটন কলেজ ও প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়াশুনা করিয়াছেন । তিনি কেশব সেনের নব ব্রাহ্মসমাজভুক্ত ছিলেন। মোহিত ১৮৮৫ খ্রীষ্টাব্দে শ্রীরামকৃষ্ণকে দর্শন করেন। তাঁহার ধর্মবিষয়ে গভীর অনুরাগ ছিল। তিনি এম.এ. পরীক্ষায় দর্শনে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম স্থান অধিকার করেন এবং নানা কলেজে অধ্যাপনা করেন। ১৮৯৯ খ্রীষ্টাব্দে তিনি সরকারী চাকুরী ত্যাগ করিয়া ব্রাহ্ম ধর্মের প্রচারে সম্পূর্ণ রপে আত্মনিয়োগ করেন। সিস্টার নিবেদিতার সহিত তাঁহার সাক্ষাৎ হয় এবং তিনি তাঁহার জ্ঞানের প্রশংসা করেন।

যোগীন্দ্র [যোগীন্দ্রনাথ রায়চৌধুরী — স্বামী যোগানন্দ] (১৮৬১ – ১৮৯৯) — দক্ষিণেশ্বরের প্রসিদ্ধ সাবর্ণ চৌধুরীর বংশে জন্ম। পিতা নবীনচন্দ্র নিষ্ঠবান ব্রাহ্মণ। দক্ষিণেশ্বরে বাস করিয়াও শ্রীরামকৃষ্ণের সহিত সাক্ষাৎ পরিচয় ছিল না। যোগীনদ্রনাথও প্রথম দর্শনে তাঁহাকে কালীবাড়ির বাগানের মালী মনে করিয়াছিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণ কিন্তু প্রথম দিনেই যোগীন্দ্রকে ‘ঈশ্বরকোটী’ বলিয়া চিনিয়াছিলেন। পরবর্তী কালে একদা নিরঞ্জনানন্দ বলিয়াছিলেন — “যোগীন আমাদের মাথার মণি।” কেশবচন্দ্রের প্রবন্ধাদি পড়িয়া যোগীন শ্রীরামকৃষ্ণের দর্শনে উৎসুক হইয়াছিলেন। প্রথম পরিচয়েই শ্রীরামকৃষ্ণ বলিয়াছিলেন “মহদ্বংশে জন্ম — তোমার লক্ষণ বেশ সব আছে। বেশ আধার — খুব (ভগবদ্ভক্তি) হবে।” তদবধি যোগীন ঘন ঘন ঠাকুরের সঙ্গগুণে তাঁহার মনে বৈরাগ্যের সঞ্চার হইল। পরে চাকুরির চেষ্টায় থাকাকালীন নিতান্ত অনিচ্ছায় বিশেষতঃ মাতার বিশেষ পীড়াপীড়িতে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। এইজন্য অপরাধীর মতো ঠাকুরের কাছে গেলে তাঁহাকে অভয় দিয়া ঠাকুর বলিয়াছিলেন, এখানকার কৃপা থাকিলে লাখটা বিবাহ করিলেও ক্ষতি নাই। সাংসারিক দৃষ্টিতে অনভিজ্ঞ যোগীন্দ্রনাথকে ঠাকুর নানারকম শিক্ষার দ্বারা উপযুক্ত করিয়া তোলেন। তাই তাঁহাকে একসময়ে বলিয়াছিলেন — ভক্ত হবি, তা বলে বোকা হবি কেন? কাশীপুরে তিনি প্রাণপণে ঠাকুরের পরিচর্যা করেন। ঠাকুরের নির্দেশে শ্রীশ্রীমা তাঁহাকে মন্ত্রদীক্ষা দেন। এরপরে প্রায় সবসময়ে শ্রীমায়ের সঙ্গে সঙ্গে থাকিয়া তাঁহার সেবায় বাকি জীবন অতিবাহিত করেন। মধ্যে কয়েকবার তীর্থভ্রমণে যান। অতিরিক্ত কৃচ্ছ্রের ফলে ক্রমাগত পেটের অসুখে ভুগিয়া ভুগিয়া মাত্র ৩৮ বৎসর বয়সে দেহত্যাগ করেন। বেলুড় মঠের জমি ক্রয়ের ব্যাপারে তাঁহার অবদান উল্লখযোগ্য।

যোগীন্দ্র বসু (১৮৫৪ – ১৯০৫) — বর্ধমান জেলার ইলসবা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা মাধবচন্দ্র। ‘বঙ্গবাসী’ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। ১৮৮৪ খ্রীষ্টাব্দে কলিকাতায় অধর সেনের বাড়িতে শ্রীরামকৃষ্ণের সহিত তাঁহার প্রথাম সাক্ষাৎ হয়। ঠাকুরের প্রতি বিশেষ অনুরাগবশত তিনি মাঝে মাঝে দক্ষিণেশ্বর যাইতেন এবং ঠাকুরও তাঁহাকে বিশেষ স্নেহ করিতেন। তাঁহার রচিত গ্রন্থ — কালাচাঁদ, কৌতুককণা, নেড়া হরিদাস ইত্যাদি।

যোগীন্দ্র সেন — কৃষ্ণনগরের অধিবাসী, কলিকতায় সরকারী চাকুরী করিতেন। শ্রীশ্রীঠাকুরের সরল ও অমায়িক গৃহীভক্ত। শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণদেবের গৃহীভক্ত শোকাতুরা ব্রাহ্মণীর বাড়িতে ঠাকুরের শুভাগমনের সময় তিনি উপস্থিত ছিলেন। বৈকুণ্ঠ সান্যাল রচিত শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ লীলামৃত গ্রন্থে যোগীন্দ্রকে শ্রীশ্রীঠাকুরের কৃপার কথা উল্লিখিত আছে। ১৩২০ বঙ্গাব্দের শ্রাবণ মাসে তাঁহার দেহত্যাগ হয়।

যজ্ঞনাথ মিত্র — ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের অনুরাগী ব্রাহ্মভক্ত এবং কলিকাতার নন্দন বাগানের ব্রাহ্মনেতা কাশীশ্বর মিত্রের পুত্র। নিজেদের বাড়ি ছাড়াও তিনি দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুরের সান্নিধ্যে আসেন। পিতার মৃত্যুর পরেও যজ্ঞনাথ তাঁহাদের বাড়িতে শ্রীশ্রীঠাকুরকে আমন্ত্রণ করিয়া লইয়া যাইতেন।

যতীন দেব — কলিকাতার শোভাবাজারের রাজা রাধাকান্ত দেবের প্রপৌত্র যতীন শ্রীরামকৃষ্ণের স্নেহধন্য ভক্ত। তিনি ঠাকুরের বিশেষ অনুরাগী ছিলেন। দক্ষিণেশ্বরে খুব যাতায়াত ছিল।

যতীন্দ্র [যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর] (১৮৩১ – ১৯০৮) — কলিকাতার পাথুরিয়াঘাটার বিখ্যাত জমিবার, দানবীর ও ‘মহারাজা’ উপাধিপ্রাপ্ত বিদ্যোৎসাহী পুরুষ। তিনি “ব্রিটিশ ইণ্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনে”র সম্পাদক, বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভার সভ্য এবং বড়লাটের শাসন পরিষদের সদস্য ছিলেন। হিন্দুধর্মে তাঁহার প্রগাঢ় বিশ্বাস ছিল। যদুলাল মল্লিকের বাগানবাড়িতে ঠাকুরের সহিত তাঁহার প্রথম সাক্ষাৎ হইয়াছিল। ‘কর্তব্য কি?’ ঠাকুরের জিজ্ঞাসার উত্তরে যতীন্দ্র সংসারীদের মুক্তির বিষয়ে সংশয় প্রকাশ করিয়া যুধিষ্ঠিরের নরকদর্শনের কথা উল্লখ করিয়াছিলেন। তাহাতে ঠাকুর বিরক্ত হইয়া তাহার সমুচিত উত্তর দিয়াছিলেন। পরে ভক্ত কাপ্তেন বিশ্বনাথ উপাধ্যায়ের সহিত ঠাকুর সৌরেন্দ্রমোহনের বাড়িতে গিয়া যতীন্দ্রের সহিত সাক্ষাৎ করিতে চাহিয়াছিলেন। কিন্তু যতীন্দ্রমোহন খবর পাইয়া অসুস্থতার সংবাদ পাঠাইয়া ঠাকুরের সঙ্গে দেখা করেন নাই।

যদুলাল মল্লিক (১৮৪৪ – ১৮৯৪) — কলিকতার পাথুরিয়াঘাটা নিবাসী মতিলাল মল্লিকের দত্তক পুত্র; ধনী, বাগ্মী ও ভগবদ্‌ভক্ত। ১৮৬১ খ্রীষ্টাব্দে কৃতিত্বের সহিত এন্ট্রান্স পাশ করিয়া বি.এ. পর্যন্ত পড়েন। কিছুদিন আইন পড়িয়াছিলেন। ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসোয়েশনের সদস্য হিসাবে অনারারি ম্যজিস্ট্রেটরূপে এবং কলিকাতা মিউনিসিপ্যালিটির কমিশনার প্রভৃতি পদে থাকাকালীন উচ্চপদে অধিষ্ঠিত সরকারী কর্মচারীদের কঠোর সমালোচনার জন্য কলিকাতা মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যান স্যর হেনরি হ্যারিসন তাঁহাকে ‘দি ফাইটিং কক্‌’ নাম দিয়াছিলেন। দানশীল এবং শিক্ষার ব্যাপারে যথেষ্ট উদার ছিলেন। ১৮৮৩ খ্রীষ্টাব্দে ২১শে জুলাই শ্রীরামকৃষ্ণ ভক্তসঙ্গে যদুবাবুর পাথুরিয়াঘাটার বাড়িতে গিয়া নিত্যসেবিতা ৺সিংহবাহিনীকে দর্শন করিয়া সমাধিস্থ হন। দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়ির দক্ষিণে গঙ্গাতীরে যদুবাবুর ত্রিতল বাড়ির কিয়দংশ পশ্চিমবঙ্গ সরকার শ্রীরামকৃষ্ণ মহামণ্ডলকে বিক্রয় করেন। বর্তমানে মহামণ্ডল পরিচালিত আন্তর্জাতিক অতিথিভবন এবং ঠাকুরের মর্মরমূর্তি সমন্বিত মন্দির সেই স্থলে অবস্থিত। ওই উদ্যানবাটিতে একটি ঘরের দেয়ালে মাতা মেরীর কোলে বালক যীশুর চিত্র দর্শন করিয়া তিনি খ্রীষ্টীয়ভাবে অনুপ্রাণিত হন এবং ক্রমাগত তিনদিন ওই ভাবে আবিষ্ট থাকিয়া পঞ্চবটীতে যীশুর দিব্যদর্শন লাভ করেন। এই বৈঠকখানা ঘরেই ঠাকুর একদা ভাবাবস্থায় নরেন্দ্রনাথকে স্পর্শ করিলে নরেন্দ্রের বাহ্য সংজ্ঞা লোপ পায় এবং শ্রীশ্রীঠাকুরের জিজ্ঞাসার উত্তরে নরেন্দ্রনাথ তাঁহার এই পৃথিবীতে আগমনের উদ্দেশ্য সম্বন্ধে ও এই বিষয়ে তিনি শ্রীশ্রীঠাকুরের বিশেষ লীলা সহায়ক বলিয়া সমূহ উত্তর প্রদান করিয়াছিলেন। শ্রীশ্রীঠাকুর বহুবার যদুবাবুর এই বৈঠকখানায় ও তাঁহার পাথুরিয়াঘাটার বাড়িতে গিয়া তাঁহাদের পরিবারকে ধন্য করিয়াছিলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *