11 of 11

৬৩.০২ শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃতে উল্লিখিত ব্যক্তিবৃন্দের পরিচয় (ট – ন)

ঠাকুরদাদা (নারায়ণদাস বন্দ্যোপাধ্যায়) — বরাহনগরনিবাসী ব্রাহ্মণ পণ্ডিতের পুত্র। তিনি কথকতা অভ্যাস করিতেন। সাধারণতঃ “ঠাকুরদা” বলিয়া তিনি পরিচিত। তিনি নিয়মিত সাধন-ভজন করিতেন। ২৭/২৮ বৎসর বয়সে বরাহনগর হইতে পদব্রজে ঠাকুরকে দর্শন করিতে আসেন। ২৩/৩/১৮৮৪-তে ঠাকুরের সহিত দক্ষিণেশ্বরে তাঁহার প্রথম সাক্ষাৎ হয়। তিনি ঠাকুরের কাছে সাধন-ভজন করা সত্ত্বেও মনের অশান্তির কথা জানাইলে এবং তাহা হইতে নিষ্কৃতির উপায় জানিতে চাহিলে ঠাকুর তাঁহাকে সকাল বিকাল হাততালি দিয়া “হরিনাম” করিতে বলেন। ঠাকুরদাদা সেইদিন ঠাকুরকে কতিপয় গান শুনাইয়া বিশেষভাবে প্রীত করেন। ইহা ছাড়া ঠাকুরের উপদেশামৃতশুনিবার সৌভাগ্য তাঁহার হইয়াছিল।

ঠাকুরদাস সেন — ব্রাহ্মভক্তদের অন্যতম। দক্ষিণেশ্বরে শ্রীরামকৃষ্ণের দর্শনলাভে তিনি ধন্য হন। ঠাকুরদাস কেশবচন্দ্র সেনের অনুগামী ছিলেন। কেশব সেন একদা যীশুখ্রীষ্ট বিষয়ে একটি বক্তৃতা করেন। সেই বক্তৃতায় খ্রীষ্টধর্ম বিষয়ে কেশবের মতের পরিচয় পাইয়া ঠাকুরদাস বিস্মিত হন এবং কেশবের নিকট হইতে দূরে সরিয়া যান।

তারক [তারকনাথ ঘোষাল, পরে স্বামী শিবানন্দ] (১৮৫৪ – ১৯৩৪) — তারকনাথের আদি নিবাস চব্বিশ পরগণার বারাসত গ্রামে। জন্ম রানী রাসমণির কাছারী বাড়িতে। পিতা শক্তিসাধক রামকানাই ঘোষাল রানী রাসমণির মোক্তার নিযুক্ত হইয়া তাঁহারই কাছারী বাড়িতে বসবাস করিতেন। মাতা বামাসুন্দরী তারকেশ্বরের বরে পুত্র লাভ করেন। তারকনাথের ৯ বৎসর বয়সে মাতৃবিয়োগ হয়। তারকের পিতা ঘোষাল মহাশয় একদিকে যেমন প্রচুর অর্থ উপার্জন করিতেন, অপরদিকে তেমনই মুক্ত হস্তে ব্যায় করিতেন। মাতা বামাসুন্দরী খুবই ধর্মপ্রাণা ছিলেন। এই তারকনাথ শ্রীরামকৃষ্ণ সঙ্ঘে স্বা মী শিবানন্দ নামে পরিচিত। শ্রীরামকৃষ্ণের ১৬ জন ত্যাগী সন্তানের মধ্যে শিবানন্দ অন্যতম। তিনি শ্রীরামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের দ্বিতীয় অধ্যক্ষ ছিলেন। ১৮৮০ খ্রীষ্টাব্দে ভক্ত রামচন্দ্র দত্তের বাড়িতে প্রথম শ্রীরামকৃষ্ণকে দর্শন করেন। প্রথম দর্শনেই তারকনাথের মন-প্রাণ শ্রীরামকৃষ্ণ-চরণে অর্পিত হইল। ইতিমধ্যে তারকনাথ ব্রাহ্মসমাজের প্রভাবে প্রভাবিত হইয়াছিলেন। দ্বিতীয় দর্শনে সাক্ষাৎ জননীজ্ঞানে ঠাকুরের কোলে মাথা রাখিয়া প্রণাম করিলেন। ঠাকুরও তাঁহার মাথায় হাত বুলাইয়া দিতে লাগিলেন। ঠাকুরের চোখে করুণা ঝরিয়া পড়িতেছে। ক্রমে ক্রমে তারকনাথ তাঁহার নিজের স্থান বুঝিয়া নিয়া দক্ষিণেশ্বরে রাত্রিবাসও করিতে কাগিলেন। তারকনাথ দেখেন আর শেখেন। একসময়ে ঠাকুরের কথা টুকিয়া রাখিতে আরম্ভ করেন, হঠাৎ একদিন ঠাকুর বলিলেন, “তোর ওসব কিছু করতে হবে না — তোদের জীবন আলাদা।” সেদিন হইতে এই সঙ্কল্প বিদায় দিলেন। শিবানন্দ বাণী, শ্রীশ্রীমহাপুরুষ মহারাজের স্মৃতিকথা, মহাপুরুষজীর পত্রাবলী প্রভৃতি গ্রন্থে স্বামী শিবানন্দের বানী সঙ্কলিত হইয়াছে।

তারক (তারক মুখার্জী) — বেলঘরিয়ার অধিবাসী। শ্রীরামকৃষ্ণের আশ্রিত ভক্ত। তিনি শ্রীরামকৃষ্ণের অশেষ কৃপালাভ করিয়াছিলেন। ঠাকুর তাঁহার সম্বন্ধে বলিয়াছিলেন, “মাছের মধ্যে নরেন্দ্র রাঙাচক্ষু বড় রুই, আর বেলঘোরের তারককে মৃগেল বলা যায়।” কথাপ্রসঙ্গে একদিন ১৮৮৫ খ্রীষ্টাব্দে ঠাকুর তাঁহার নিজের ভিতর হইতে এক উজ্জ্বল আলোক শিখা নির্গত হইয়া দক্ষিণেশ্বর হইতে তারকের অনুসরণ করিতেছে এ কথা মাস্টার মহাশয়কে বলিয়াছিলেন। তিনি তারককে কামিনী-কাঞ্চন হইতে সাবধান থাকিতে বলেন এবং তাঁহার নিকট আসিলে তাহার সাধনার বাধা শীঘ্রই দূর হইয়া যাইবে বলিয়া আশ্বাস দেন। কয়েকদিন পরে তারক আসিলে তিনি সমাধিস্থ হইয়া তাহার বক্ষে শ্রীচরণ স্থাপন করেন। ঠাকুর তাহাকে বলিয়াছিলেন, ঈশ্বর সাধনার জন্য বাপ-মার আদেশ লঙ্ঘনে কোন দোষ নাই।

তারাপদ — ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের সান্নিধ্যে আগত সুপ্রসিদ্ধ গায়ক। বলরাম বসুর গৃহে গিরিশচন্দ্র ঘোষ প্রমুখ ভক্তদের সহিত তিনি ঠাকুরের দর্শনলাভে ধন্য হন। সেই সময়ে গায়ক হিসাবে তাঁহার পরিচয় জানিতে পারিয়া ঠাকুর তাঁহার গান শুনিবার আগ্রহ প্রকাশ করেন। তারাপদ গিরিশ ঘোষের “কেশব কুরু করুণা দীনে” গানটি শুনাইলে ঠাকুর সন্তুষ্ট হন এবং ঠাকুরের অনুরোধে তিনি আরও কতকগুলি ভজন ও কীর্তন গাহিয়া শুনাইয়াছিলেন।

তুলসী [শ্রীতুলসীচরণ দত্ত] (১৮৬৩ – ১৯৩৮) — শ্রীশ্রীঠাকুরের অনুরাগী বালক ভক্ত — বাগবাজার লেনে দত্ত পরিবারে জন্ম। তাঁহার বাল্যবন্ধু স্বামী তুরীয়ানন্দ ও স্বামী অখণ্ডানন্দ। ১৮৮৩ খ্রীষ্টাব্দে তিনি ক্যলকাটা স্কুল হইতে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর কিছুকাল কলেজে পড়াশুনা করেন। ১৭/১৮ বৎসর বয়সে বলরাম বসুর গৃহে শ্রীশ্রীঠাকুরকে তিনি প্রথম দর্শন করেন। তখন হইতে তিনি প্রায়ই দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুরের কাছে যাতায়াত করিতেন। ঠাকুরের তিরোধানের পর তিনি বরাহনগর মঠে যোগ দেন এবং পরবর্তী কালে স্বামী নির্মলানন্দ রূপে পরিচিত হন।

তুলসীরাম [তুলসীরাম ঘোষ] (১২৬৫ – ১৩৫২ বঙ্গাব্দ) — আঁটপুর নিবাসী তুলসীরাম শ্রীশ্রীঠাকুরকে দর্শন করিয়াছিলেন। ইনি শ্রীরামকৃষ্ণের অন্যতম অন্তরঙ্গ ভক্ত বাবুরাম মহারাজ তথা স্বামী প্রেমানন্দের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা এবং বলরাম বসুর শ্যালক। তুলসীরাম তাঁহার ভগ্নীপতি ঠাকুরের গৃহীভক্ত বলরাম বসুর সহয়তায় ঠাকুরের সংস্পর্শে আসিয়া তাঁহর ভক্তে পরিণত হইয়াছিলেন। বাবুরাম মহারাজ যখন প্রথম জীবনে সাধুর অন্বেষণে ঘুরিয়া বেড়াইতেছেন তখন তুলসীরামই তাঁহাকে ঠাকুরের সন্ধান দেন।

তেজচন্দ্র [তেজচন্দ্র মিত্র] (১৮৬৩ – ১৯১২) — ঠাকুরের একজন গৃহীভক্ত। বাগবাজার বোসপাড়া অঞ্চলের বাসিন্দা, শ্রীম-র ছাত্র। বাল্যকালেই শ্রীম-র অনুপ্রেরণায় শ্রীশ্রীঠাকুরের দর্শনলাভ করেন। শ্রীশ্রীমায়েরও কৃপাধন্য ছিলেন। তিনি নিয়মিত ধ্যান করিতেন ও মিতভাষী ছিলেন । ঠাকুর তাঁহাকে ‘শুদ্ধ আধার’ জ্ঞান করিতেন এবং আপনার লোক বলিয়া অতিশয় স্নেহ করিতেন।

ত্রৈলঙ্গ স্বামী (আনুমানিক ১৬০৭ – ১৮৮৭ খ্রীষ্টাব্দ) — ভারতবিখ্যাত যোগী মহাপুরুষ। অন্ধ্রপ্রদেশের এক ধনী ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্ম। পূর্বনাম শিবরাম রাও। তাঁহার সুদীর্ঘ জীবনের অধিকাংশ সময় তিনি কাশীতে অতিবাহিত করেন। লোকে তাঁহাকে শিবাবতার বলিত। তিনি অলৌকিক শক্তির অধিকারী ছিলেন। ১৮৬৮ সালে তীর্থভ্রমণকালে তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করেন। সেই সময় তিনি মৌন অবস্থায় ছিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণদেবের সহিত ইঙ্গিতে তাঁহার ঈশ্বরবিষয়ক কথাবার্তা হয়। ঠাকুর হৃদয়কে তাঁহার ‘পরমহংস’ অবস্থার কথা বলিয়াছিলেন।

ত্রৈলোক্য নাথ সান্যাল (১৮৪০ – ১৯১৬) — ব্রাহ্মভক্ত, কেশব সেনের অনুগামী। গীতিকার ও সুগায়ক। বলা যায় কেশব সেনের সংস্পর্শে আসিয়াই ত্রৈলোক্যের নবজন্ম ঘটে। বাল্যকাল হইতেই তিনি গান গাহিতেন। কিন্তু সঙ্গীত এবং পুঁথিগত বিদ্যার বিধিবদ্ধ শিক্ষা তাঁহার কেশবচন্দ্র সেনের গৃহে বসবাসকালে হয়। কেশবচন্দ্রের সঙ্গী হিসাবে তাঁহার শ্রীরামকৃষ্ণের সংস্পর্শে আসিবার সুযোগ ঘটে। দক্ষিণেশ্বরে বহুবার তিনি যান এবং সেখানে মধুর সুললিত কণ্ঠে ঠাকুরকে সঙ্গীত শুনাইবার সৌভাগ্য তাঁহার হইয়াছিল। ঠাকুর তাঁহার রচিত সঙ্গীত ঠাকুরের অত্যন্ত প্রিয় ছিল এবং ঠাকুর স্বয়ং বিশেষ ভাবোদ্দীপক গানগুলি করিতে অনুরোধ করিতেন। তিনি কেশবচন্দ্র কর্তৃক ‘চিরঞ্জীব শর্মা’ উপাধি পান এবং নিজে ‘প্রেমদাস’ নাম গ্রহণ করেন। এই দুই ছদ্ম নামে তিনি সহস্রাধিক ভক্তিসঙ্গীত ও কীর্তন রচনা করেন। তাঁহার রচিত ‘নব বৃন্দাবন’ নাটকে নরেন্দ্রনাথ ‘পাহাড়ী বাবার’ ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। ঠাকুর এই নাটক দেখিয়াছিলেন এবং ত্রৈলোক্যের প্রণীত গ্রন্থ ‘ভক্তিচৈতন্য চনিদ্রকা’ পড়িতে ভক্তদের বলিয়াছিলেন। তাঁহার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলি হইল গীতরত্নাবলী, পথের সম্বল, কেশবরচিত, ভক্তিচৈতন্য চন্দ্রিকা।

ত্রৈলোক্য বিশ্বাস — ত্রৈলোক্যনাথ বিশ্বাস ছিলেন মথুরামোহন বিশ্বাসের পুত্র এবং রাণী রাসমণির দৌহিত্র। ১৮৭১ সালে তিনি দক্ষিণেশ্বরের মন্দিরের সেবাইতের অধিকারী হন এবং আজীবন ওই দায়িত্ব পালন করেন। ত্রৈলোক্যনাথ দায়িত্ব ভার নেওয়ার পর ঠাকুর দক্ষিণেশ্বরে অধিক দিন বাস করিতে পারেন নাই। অসুস্থ হইয়া পড়ায় তিনি অনত্র যান।

দমদমার মাস্টার (শ্রীযজ্ঞেশ্বর চন্দ্র ঘোষ) — দমদমার একটি বিদ্যালয়ের শিক্ষকতা করিতেন বলিয়া তিনি কথামৃতে ‘দমদমার মাস্টার’ বলিয়া পরিচিত। বাঁকুড়া জেলার কাটিকা গ্রামে ইঁহার বাড়ি। শ্রীরামকৃষ্ণদেব ইঁহাকে খুব স্নেহ করিতেন। তিনি নিয়মিত দক্ষিণেশ্বরে যাতায়াত করিতেন। ঠাকুরের দেহত্যাগের পর যজ্ঞেশ্বর বরাহনগর মঠে প্রায়ই আসিতেন। তিনি সকলের বিশেষ প্রিয়ভাজন হন।

দয়ানন্দ সরস্বতী, স্বামী (১৮২৪ – ৮৩) — আর্যসমাজের প্রতিষ্ঠাতা, পূর্বনাম মূলশঙ্কর। বেদ, বেদান্ত তাঁহার কণ্ঠস্থ ছিল; সংস্কৃত ভাষায় অসামান্য ব্যুৎপত্তি ছিল। দয়ানন্দের মতে মূল হিন্দুধর্ম বেদের উপর প্রতিষ্ঠিত এবং মূর্তিপূজা বেদ-বিরোধী কার্য। তিনি ব্রাহ্মণ, খ্রীষ্টান, মুসলমান সকল ধর্মের লোকের সহিত বিচার করিতেন। কাশীতে এক শাস্ত্রীয় সম্মেলনে বিচার সভায় জয়লাভের পর তাঁহার খ্যাতি সর্বত্র ছড়াইয়া পড়ে। শ্রীরামকৃষ্ণ উত্তর কলিকাতার সিঁথিতে নৈনারের (সিঁথির) ঠাকুরদের প্রমোদ কাননে ভক্ত কাপ্তেন বিশ্বনাথ উপাধ্যায়কে সঙ্গে লইয়া তাঁহাকে দর্শন করিতে যান। দয়ানন্দ ১৮৭৫ খ্রীষ্টাব্দে বোম্বাই শহরে প্রথম আর্যসমাজ প্রতিষ্ঠা করেন। দেহত্যাগের পূর্বে তিনি প্রায় ১০০টি আর্যসমাজ আশ্রম প্রতিষ্ঠা করিয়া যান পাঞ্জাব, উত্তরপ্রদেশ, রাজপুতানা ও বোম্বাই ইত্যাদি স্থানে। তিনি জাতিভেদ প্রথা মানিতেন না। স্ত্রী পুরুষের সমান অধিকার, নারীশিক্ষার প্রয়োজনীয়তা সর্বদা স্বীকার করিতেন। তাঁহার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘সত্যার্থ প্রকাশ’।

দারোয়ান — যদু মল্লিকের বাগানের দারোয়ান। শ্রীশ্রীঠাকুরের ভক্ত। শ্রীশ্রীঠাকুরের সমাধিস্থ অবস্থায় হাতপাখা লইয়া বাতাস করিয়াছিলেন। শ্রীশ্রীঠাকুরকে মাঝে মাঝে নিমন্ত্রণ করিয়া সেবা করাইতেন।

দীন মুখুজ্জে (দীননাথ মুখার্জী) — উত্তর কলিকতার বাগবাজার নিবাসী ভক্তিমার্গের গৃহীসাধক। দীননাথের ঈশ্বর ভক্তির কথা জানিতে পারিয়া ঠাকুর স্বেচ্ছায় একদা মথুরামোহন বিশ্বাসের সহিত দীননাথের গৃহে উপস্থিত হন। কিন্তু সেদিন দীননাথের গৃহে উপনয়ন উপলক্ষে সকলে অত্যন্ত ব্যস্ত থাকায় ঠাকুর কাহাকেও আর ব্যতিব্যস্ত না করিয়া ফিরিয়া আসেন।

দীননাথ খাজাঞ্চী — দক্ষিণেশ্বর-মন্দিরের খাজাঞ্চী (কোষাধ্যক্ষ)। ইনি কয়েকবার ঠাকুরের সমাধিস্থ অবস্থা প্রত্যক্ষ করেন।

দুকড়ি ডাক্তার — শ্যামপুকুরে শ্রীশ্রীঠাকুরকে গলরোগের সময় দেখিতে আসিয়াছিলেন। রাজেন্দ্রনাথ মিত্রের বাড়িতে সমাধিস্থ ঠাকুরের চোখে অঙ্গুলি দিয়া তিনি ঠাকুরের সমাধি পরীক্ষা করিয়াছিলেন।

দুর্গাচরণ ডাক্তার — দক্ষিণেশ্বর হইতে ঠাকুর ভক্তদের সাথে কলিকাতায় এই ডাক্তারকে দেখাইতে আসিয়াছিলেন। যদিও তিনি অতিমাত্রায় মদ্যপান করিতেন, তথাপি তাঁহার চিকিৎসার ব্যাপারে খুব হুঁশ থাকিত — ইহা শ্রীশ্রীঠাকুর উল্লেখ করিয়াছেন।

দেবেন্দ্র (দেবেন্দ্রচন্দ্র ঘোষ) — শ্যামপুকুর নিবাসী দেবেন্দ্র ঠাকুরের একজন অনুরাগী ভক্ত। দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুরের কাছে যাতায়াত করিতেন এবং ঠাকুরের নিকট নানা উপদেশ গ্রহণ করিতেন।

দেবেন্দ্র [মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর] (১৮৭১-১৯০৫) — ইনি মনীষী, পরম সাধক, আদিব্রাহ্মসমাজের প্রতিষ্ঠাতা ও বিখ্যাত নেতা। দেবেন্দ্রনাথ ব্রাহ্মসমাজে উপাসনার প্রচলন করেন। কেশবচন্দ্র সেন তাঁহার সংস্পর্শে আসেন। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঈশ্বরচিন্তা করেন শুনিয়া শ্রীরামকৃষ্ণদেব মথুরবাবুর সহিত একদা মহর্ষির বাড়িতে তাঁহাকে দেখিতে যান। প্রথম পরিচয়েই ঠাকুর মহর্ষির ভিতর সাধকের লক্ষণ দেখিতে পান। অত জ্ঞানী এবং ঈশ্বরোপাসক হওয়া সত্ত্বেও মহর্ষিকে সংসারের কাজে ব্যাপৃত দেখিয়া শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁহাকে ‘কলির জনক’ বলেন। ইহার পর তাঁহার অনুরোধে মহর্ষি তাঁহাকে বেদ হইতে কিছু কিছু শোনান। ঠাকুরের ধ্যানাবস্থায় দর্শনের সঙ্গে ইহার মিল ছিল। মহর্ষিও ঠাকুরের সহিত ধর্মালোচনায় প্রীত হন ও তাঁহাকে ব্রাহ্মসমাজের উৎসবে যোগ দিবার আমন্ত্রণ জানান। কথামৃতে ঠাকুর বহুবার মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের কথা উল্লখ করিয়াছেন।

দেবেন্দ্র [দেবেন্দ্রনাথ মজুমদার] (১৮৪৪-১৯১১) — শ্রীশ্রীঠাকুরের গৃহীভক্ত। যশোহর জেলার নড়াইল মহকুমার জগন্নাথপুর গ্রামে ‘মজুমদার’ উপাধিধারী বন্দ্যোপাধ্যায় বংশে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা প্রসন্ননাথ, মাতা বামাসুন্দরী দেবী । প্রথম জীবন তাঁহার দারিদ্রের মধ্যে অতিবাহিত হওয়ায় তিনি কলিকতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারে জমিদারী সেরেস্তায় চাকুরী গ্রহণ করেন। সাহিত্যে চর্চাও করেন। তিনি যোগাভ্যাস করিতেন, এই সময় বহু দেবদেবীর দর্শন হইত। ১৮৮৪ খ্রীষ্টাব্দে দক্ষিণেশ্বরে প্রথম শ্রীরামকৃষ্ণের দর্শন লাভ করেন। এই সময়ে পুস্তকে ‘পরমহংস রামকৃষ্ণ’ কথা দুইটি পড়িয়া তিনি এক মহা আকর্ষণে তৎক্ষণাৎ দক্ষিণেশ্বরে যাইয়া শ্রীরামকৃষ্ণের দেবদুর্লভ আচরণে মুগ্ধ হন। কিন্তু সেইদিনই তিনি আকস্মিক অসুস্থতা লিয়া কলিকাতায় ফিরিয়া আসেন। প্রবল জ্বরে শয্যাগত অবস্থায় তিনি শিওরে শ্রীরামকৃষ্ণকে দর্শন করিতেন। ইহার পর বলরাম বসুর গৃহে ঠাকুরকে পুনরায় দর্শন করিয়া তিনি তখন গৃহ হইতেই মাঝে মাঝে দক্ষিণেশ্বরে যাইতে আরম্ভ করেন। এই সময়ে কলিকাতায় নিজ গৃহে দেবেন্দ্রনাথ একদিন ঠাকুরকে সেবা করিয়াছিলেন। দেবেন্দ্রনাথ ‘সন্ন্যাস’ গ্রহণের জন্য ঠাকুরের নিকট প্রার্থনা জানাইলে ঠাকুর তাহাতে সম্মত হন নাই। পরবর্তী কালে “শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ অর্চনালয়” প্রতিষ্ঠা করিয়া দেবেনদ্রনাথ সেখানে তাঁহার স্বরচিত শ্রীরামকৃষ্ণ ভজন কীর্তনাদি পরিবেশনের ব্যবস্থা করেন এবং এই গানগুলিই পরে ‘দেবগীতি’ নামক পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয়। তাঁহার বিখ্যাত “ভব সাগর তারণ কারণ” ইত্যাদি গুরুবন্দনা ও অন্যান্য ভক্তিমূলক ভজন বহুল গীত হইয়া থাকে।

দ্বারিকানাথ (দ্বারিকানাথ বিশ্বাস) — মথুরবাবুর জ্যেষ্ঠ পুত্র ও শ্রীশ্রীঠাকুরের বিশেষ ভক্ত। তিনি পিতার ন্যায় শ্রীরামকৃষ্ণের পরম অনুরাগী ছিলেন। ঠাকুরও তাঁহাকে বিশেষ স্নেহ করিতেন। একদা দক্ষীণেশ্বরে আগত এক নেপালী ব্রহ্মচারিণীর কণ্ঠে ‘গীতগোবিন্দে’র গান শুনিয়া তিনি ঠাকুরের সম্মুখেই অশ্রুমোচন করিতে থাকিলে ঠাকুর তাঁহার ভক্তির প্রশংসা করিয়াছিলেন। একবার দ্বারিকানাথ তাঁহার মোকদ্দমা সংক্রান্ত প্রয়োজনে আগত ব্যারিস্টার কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তকে ঠাকুরের কাছে লইয়া গিয়াছিলেন। মাত্র ৪০ বৎসর বয়সে ইনি দেহত্যাগ করেন।

দ্বিজ (দ্বিজ সেন) — কথামৃতকার শ্রীম-র শ্যালক। শ্রীরামকৃষ্ণের অনুরাগী ভক্ত। ১৮৮৪ খ্রীষ্টাব্দে শ্রীশ্রীঠাকুরের সহিত তাঁহার প্রথম সাক্ষাৎ হয়। দক্ষিণেশ্বরে যাতায়াতে দ্বিজর বাবার প্রবল আপত্তি ছিল। এ বিষয়ে ঠাকুরের সহিত পিতা আলোচনা করিতে আসিলে ঠাকুর মিষ্ট কথায় তাঁহাকে বুঝান যে অধ্যাত্মগুণসম্পন্ন পুত্র হওয়া পিতার পুণ্যের চিহ্ন। ঠাকুর তাঁহার নিকট দ্বিজর প্রশংসা করেন এবং দ্বিজকে দক্ষিণেশ্বরে আসার জন্য বাধা দিতে নিষেধ করেন। ঠাকুরের প্রতি দ্বিজর একান্ত অনুরাগকে তিনি পূর্ব সংস্কার বলিয়া উল্লেখ করিয়াছিলেন। ঠাকুর মাস্টার মহাশয়ের নিকট ইঁহার আধ্যাত্মিক উন্নতির কথা বলিয়াছিলেন।

দ্বিজর পিতা (ঠাকুরচরণ সেন) — মাস্টার মহাশয়ের শ্বশুর ঠাকুরচরণ সেন শ্রীরামকৃষ্ণদেবকে দক্ষিণেশ্বরে দর্শন করিয়াছিলেন। ইনি কেশবচন্দ্র সেনের জ্ঞাতিভ্রাতা। ইঁহার কন্যা শ্রীমতি নিকুঞ্জবালা দেবীর সহিত শ্রীমর বিবাহ হয়। সওদাগরী অফিসের ম্যানেজার ছিলেন।

ধনী কামারিনী — মধুসূদন কর্মকারের কন্যা ধনীকামারিনী। উপনয়নের উপলক্ষে — ঠাকুরের ভিক্ষামাতা এবং মাতা চন্দ্রমণির ঘনিষ্ঠ সহচরী, কামারপুকুরে লাহাবাবুদের বাড়ির নিকটে এক ক্ষুদ্র কুটীরে এই বিধবা মহিলা বাস করিতেন। ১৮৩৬ খ্রীষ্টাব্দে ঠাকুর ভূমিষ্ঠ হইবার পরমুহূর্তেই ধনীই সদ্যোজাত শিশুকে ভস্মমাখা অবস্থায় উনুনের ভিতর হইতে উঠাইয়া লইয়া এই পৃথিবীতে অবতার পুরুষের প্রথম মুখদর্শন ও প্রথম তাঁহাকে কোলে লইবার পরম সৌভাগ্য অর্জন করেন। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ধনীকে ‘মা’ বলিয়া ডাকিতেন। উপনয়নের সময় তিনি অন্য সকলের মতের বিরুদ্ধে ধনীর নিকট হইতে সর্বাগ্রে ভিক্ষা গ্রহণ করিয়া তাঁহার পূর্বাভিলাষ পূরণে স্বীয় প্রতিশ্রুতি রক্ষা করিয়াছিলেন। ইহা শ্রীরামকৃষ্ণ-জীবনের একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। ভক্তিমতী ধাত্রীমাতা ও ভিক্ষামাতা শ্রীশ্রীঠাকুরকে বাৎসল্যভাবে অত্যন্ত স্নেহ করিতেন এবং অনেক সময়ে তাঁহাকে খাওয়াইয়া তৃপ্তি লাভ করিতেন।

নকুড় আচার্য — কামারপুকুর অঞ্চলের অধিবাসী। শ্রীশ্রীঠাকুর তাঁহার নৃত্যসহ গানের প্রশংসা করিতেন।

নকুড় বাবাজী — বৈষ্ণব ভক্ত, ভাল কীর্তনীয়া। কামারপুকুর গ্রামের অধিবাসী। কলকাতার ঝামাপুকুরে তাঁহার একটি দোকান ছিল। শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁহার জ্যেষ্ঠভ্রাতা রামকুমারের ঝামাপুকুরের বাসায় অবস্থানকালে মধ্যে মধ্যে নকুড়ের দোকানে গিয়া বসিতেন। দেশের লোক হিসেবে নকুড় তাঁহাকে বিশেষ আপ্যায়ন করিতেন। পানিহাটীর রাঘব পণ্ডিতের বিখ্যাত চিঁড়া মহোৎসবে তিনি প্রতিবছর যোগদান করিতেন এবং কীর্তন করিতেন। ফিরিবার পথে দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুরের সহিত তাঁহার প্রতিবার সাক্ষাৎ হইত এবং তিনি পূর্ব পরিচয় অক্ষুণ্‌ণ রাখিতেন।

নগেন্দ্র (নগেন্দ্রনাথ মিত্র) — সুরেন্দ্রনাথ মিত্রের ভ্রাতুষ্পুত্র। দক্ষিণেশ্বরে ও স্বগৃহে তাঁহার শ্রীরামকৃষ্ণকে দর্শন করিবার সৌভাগ্য হইয়াছিল।

নগেন্দ্রনাথ গুপ্ত (১৮৬২-১৯৪০) — বিহার প্রদেশের মতিহারিতে নগেন্দ্রনাথের জন্ম। পিতা মথুরনাথ আরা জেলার সাবজজ ছিলেন। বাল্যেই নগেন্দ্রনাথ নরেন্দ্রনাথের সহিত পরিচিত ছিলেন। উভয়ে একসঙ্গে জেনারেল এসেমব্লিজ ইনস্টিটিউশনে অধ্যয়ন করিতেন। সাংবাদিক ও সাহিত্যিক রূপে তিনি সমধিক খ্যাতি লাভ করিয়াছিলেন। নগেন্দ্রনাথ কেশবচন্দ্রের সহিত স্টীমবোটে সোমড়া পর্যন্ত ভ্রমণকালে (১৮৮১ খ্রীষ্টাব্দে) শ্রীরামকৃষ্ণদেবের সান্নিধ্য লাভ করেন। ঠাকুরের কথা বলার মধুর ভঙ্গি, সাধারণ কথ্য ভাষার বাস্তব উদাহরণের সহিত গভীর ধর্মতত্ত্বের কথা বলার বৈশিষ্ট্য তিনি পরম কৌতুহলের সহিত লক্ষ্য করেন। শ্রীরামকৃষ্ণের স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিরবচ্ছিন্ন জ্ঞান ও ভক্তিপ্রসঙ্গ আলোচনা করিবার ধারাও নগেন্দ্রনাথকে মুগ্ধ করে। যদিও নগেন্দ্রনাথ মাত্র একবারই ঠাকুরকে দর্শন করেন তবুও এই ঘটনাই তাঁহার মনে গভীর রেখাপাত করে। তিনি একটি প্রবন্ধে ঠাকুরের চেহারা হুবুহু বর্ণনা দিয়াছেন। শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত প্রণেতা মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত নগেন্দ্রনাথের এই ভ্রমণের বিবরণ শুনিয়া অনুপ্রাণিত হইয়াছিলেন। তাহার কিছুকাল পরেই মহেন্দ্রনাথ শ্রীরামকৃষ্ণকে দর্শন করেন। প্রবুদ্ধ ভারত, উদ্বোধন, মডার্ণ রিভিউ প্রভৃতি পত্র-পত্রিকায় নগেন্দ্রনাথ শ্রীরামকৃষ্ণ সম্পর্কে কয়েকটি প্রবন্ধ লেখেন। মডার্ণ রিভিউতে নগেন্দ্রনাথের লেখা শ্রীরামকৃষ্ণের সমাধির বর্ণনা পড়িয়া মনীষী রোমা র‌্যোঁলা মুগ্ধ হন।

নটবর (নটবর গোস্বামী) — হুগলী জিলার ফুলুই শ্যামবাজারের পার্শ্ববর্তী বেলটে গ্রামের অধিবাসী। ঠাকুরের অনুরাগী বৈষ্ণব ভক্ত। ঠাকুর নটবর গোস্বামীর গৃহে একবার গিয়াছিলেন। ঠাকুর তাঁহার ভাগ্নে হৃদয়ের সহিত সে সময়ে সাতদিন গোস্বামীজীর গৃহে ছিলেন। গোস্বামীজী ও তাঁহার স্ত্রী উভয়েই ভক্তিভরে ঠাকুরে সেবা করিতেন। ফুলুইয়ে বহু বৈষ্ণবের বাস ছিল এবং তাঁহারা প্রতিদিনই সংকীর্তন করিতেন। ঠাকুরকে সংকীর্তন শুনাইবার বাসনায় গোস্বামীজী নিকটবর্তী স্থান রামজীবনপুর ও কৃষ্ণগঞ্জের বিখ্যাত কীর্তনীয়া ও মৃদঙ্গবাদককে আনয়ন করিয়াছিলেন। শ্রীশ্রীঠাকুরের ভাবসমাধি দর্শনে বৈষ্ণবগণ বিশেষভাবে আকৃষ্ট হইয়াছিলেন। ‘যোগমায়ার আকর্ষণ’ কাহাকে বলে — ইহা ওইখানে ঠাকুর প্রত্যক্ষ করিয়াছিলেন।

নন্দ বসু (নন্দলাল বসু) — ধনী ব্যক্তি। বাগবাজারে বাড়ি। তাঁহার গৃহে নানা দেবদেবীর সুন্দর ছবি আছে জানিতে পারিয়া ১৮৮৫ সালে বলরাম বসুর বাড়ি হইতে তথায় যান। অনেকক্ষণ ধরিয়া সেই সব ছবি দেখিয়া গৃহস্বামী এবং তাঁহার ভাই পশুপতি বসুর সহিত ঈশ্বরীয় প্রসঙ্গ করেন। ঠাকুর ওই ছবিগুলির প্রশংসা করিয়া নন্দবাবুকে যথার্থ হিন্দু বলিয়া সাধুবাদ দিয়াছিলেন।

নন্দলাল সেন — কেশবচন্দ্র সেনের ভ্রাতুষ্পুত্র। কেশবচন্দ্রের মাধ্যমে শ্রীরামকৃষ্ণের সংস্পর্শে তিনি আসেন। শ্রীশ্রীঠাকুরকে কয়েকবার দর্শন করেন। ১৮৮২ সালের ২৭শে অক্টোবর কেশবচন্দ্র সেন ঠাকুরকে এবং আরো অনেককে লইয়া স্টীমারে গঙ্গাভ্রমণের ব্যবস্থা করেন। নন্দলাল সেই দলে ছিলেন। তিনি সেদিন ঠাকুরের ভাবাবিষ্ট অবস্থার প্রত্যক্ষদর্শী এবং বহু আধ্যাত্মিক আলোচনার শ্রোতা হন। নন্দলাল পরবর্তী কালে কেশবচন্দ্র সেনের ও ঠাকুরের অনুগামী ভক্ত হীরানন্দের সহিত সিন্ধু প্রদেশে যান এবং সেখানে সমাজসেবী ও শিক্ষাব্রতী হিসাবে সুনাম অর্জন করেন।

নন্দিনী (নন্দিনী মল্লিক) — ব্রাহ্মভক্ত মণিলাল মল্লিকের বিধবা কন্যা। তিনি ধর্মপরায়ণা ছিলেন এবং ঠাকুরকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করিতেন। এক সময়ে তিনি কিছুতেই ধ্যানে মনঃসংযোগ করিতে পারিতেন না। ঠাকুর এই সমস্যার কথা শুনিয়া তাঁহাকে তাঁহার সর্বাপেক্ষা প্রিয় পাত্রকেই (ভ্রাতুষ্পুত্র) বালগোপাল ভাবিয়া সেবা করিতে নির্দেশ দিয়াছিলেন। ঠাকুরের আদিষ্ট পথ অবলম্বনে ইঁহার আধ্যাত্মিক উন্নতি হইয়াছিল।

নফর বন্দ্যোপাধ্যায় — শিওড় নিবাসী সঙ্গতি সম্পন্ন ভক্তিমান ব্যক্তি। শ্রীরামকৃষ্ণ একবার শিওড় গিয়া কীর্তনানন্দে বিভোর হইয়া পড়েন। নফর সেই সময় শ্রীরামকৃষ্ণের সেবা করিয়া ধন্য হইয়াছিলেন।

নবকুমার — বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীর সঙ্গী। নবকুমার দক্ষিণেশ্বরে শ্রীরামকৃষ্ণকে দর্শন করেন। এবং সেই সময় শ্রীরামকৃষ্ণের মুখে ঈশ্বরীয় প্রসঙ্গাদি শুনেন। পরে বলরাম বসুর সহিত একই নৌকাতে কলিকাতা ফিরেন। আর একদিন ঠাকুরের নিকট ভক্ত সমাগম দেখিয়া দম্ভভরে দরজার কাছ হইতে চলিয়া যাওয়ায়, ঠাকুর তাঁহাকে অহঙ্কারের প্রতিমূর্তি বলিয়া মন্তব্য করিয়াছিলেন।

নবগোপাল কবিরাজ — ১৮৮৬ সালের মার্চ মাসে কাশীপুরে শ্রীরামকৃষ্ণের অসুখ বৃদ্ধি পাইলে গিরিশবাবুর অনুরোধে তিনি শ্রীরামকৃষ্ণকে দেখিতে আসিয়াছিলেন। এইভাবে তাঁহার শ্রীরামকৃষ্ণকে দর্শন করিবার সৌভাগ্য হয়।

নবগোপাল ঘোষ (১৮৩২ – ১৯০৯) — হুগলী জেলার বেগমপুরে গ্রামে জন্ম। শ্রীরামকৃষ্ণের পরমভক্ত। নবগোপাল বাদুড় বাগানের বাসিন্দা। প্রথমবার ঠাকুরকে দর্শনের পর বহুদিন তিনি ঠাকুরের সঙ্গে আর যোগাযোগ করেন নাই। ঠাকুরই তাঁহার বন্ধু কিশোরীর কাছে তাঁহার খবর জানিতে চাহিলে নবগোপাল তাঁহার মত একজন সাধারণ মানুসকেও ঠাকুর স্মরণে রাখিয়াছেন জানিয়া বিস্মিত ও পুলকিত হন। তিনি সস্ত্রীক ঠাকুরকে দর্শন করিতে আসেন। তাঁহার গৃহ ঠাকুরের পদধূলিতে ও নৃত্য গীতে ধন্য হইয়াছিল। নবগোপাল ঠাকুরের মধ্যে শ্রীচৈতন্য রূপ দেখিতে পান। ১৮৮৬-র ১লা জানুয়ারি ঠাকুর যখন কল্পতরু হইয়া সকলকে আশীর্বাদ করিতেছিলেন সেই সময় নবগোপালও উপস্থিত ছিলেন। সেইদিন সমাধিস্থ অবস্থায় তিনি নবগোপালকে তাঁহার নাম বারংবার উচ্চারণ করিতে বলেন। তাহার পর হইতে নবগোপালের মুখে সবসময় “জয় রামকৃষ্ণ” ধ্বনি লাগিয়াই থাকিত। ১৮৯৮ সালে হাওড়ায় নবগোপালের নবনির্মিত গৃহে স্বামী বিবেকানন্দ কর্তৃক শ্রীরামকৃষ্ণের প্রতিকৃত স্থাপিত হয়। সেই শুভমুহূর্তে স্বামীজী “ওঁ স্থাপকায় চ ধর্মস্য সর্বধর্মস্বরূপিণে। অবতারবরিষ্ঠায় রামকৃষ্ণায় তে নমঃ ৷৷” প্রণাম মন্ত্রটি রচনা করেন। সেইসময় বিবেকানন্দের গুরুভাইদের মধ্যেও অনেকেই সেখানে উপস্থিত ছিলেন। নবগোপালের স্ত্রী নিস্তারিণী দেবীকে শ্রীরামকৃষ্ণ বিশেষ স্নহ করিতেন। শ্রীসারদা দেবীও বলিয়াছিলেন — “নবগোপালের পরিবার বড় শুদ্ধ।”

নবদ্বীপ গোস্বামী — ১৮৮৩ সালে পানিহাটীতে রাঘব পণ্ডিতের চিড়ার মহোৎসবে শ্রীরামকৃষ্ণ যোগ দিতে গেলে সেখানে নবদ্বীপ গোস্বামী তাঁহার দর্শন লাভ করেন। সেখানে মণিমোহন সেনের বাড়িতে উভয়ের মধ্যে ধর্মালোচনা হয়। এই উপলক্ষে ঠাকুর গীতার সার কথা “ত্যাগী” বলিলে নবদ্বীপ গোস্বামী তাহা প্রমাণ সহ সমর্থন করেন।

নবাই চৈতন্য — প্রকৃত নাম নবগোপাল মিত্র। শ্রীরামকৃষ্ণের গৃহীভক্ত মনোমোহন মিত্রের জ্যেষ্ঠতাত। তিনি দক্ষিণেশ্বরে প্রায়ই আসিতেন এবং শ্রীশ্রীঠাকুরের কথামৃত শ্রবণপূর্বক উচ্চ সংকীর্তনাদি করিতেন। পানিহাটীর উৎসবে শ্রীশ্রীঠাকুরের বিশেষ কৃপালাভ করিয়া ধন্য হন। তিনি শ্রীরামকৃষ্ণের দর্শন ও কৃপালাভ করিবার পরে সংসারের ভার পুত্রের উপর দিয়া কোন্নগরে গঙ্গাতীরে পর্ণকুটিরে দিবারাত্র জপধ্যান ও কীর্তনাদি করিতেন। ১৮৮২ খ্রীষ্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁহার গৃহে পদার্পণ করিয়াছিলেন।

নবীন নিয়োগী (নবীনচন্দ্র নিয়োগী) — দক্ষিণেশ্বর নিবাসী ভক্ত নবীন নিয়োগী প্রায়ই ঠাকুরকে দর্শন করিতে আসিতেন। ১৮৮৪ খ্রীষ্টাব্দের ৫ই অক্টোবর নবীন নিয়োগীর গৃহে আয়োজিত নীলকণ্ঠ মুখার্জীর যাত্রা উপলক্ষে ঠাকুরের পদার্পণ হয়। সেদিন ঠাকুর নবীনচন্দ্র ও তাঁহার পুত্রের ভক্তির প্রশংসা করেন। ঠাকুর বলিয়াছিলেন তাঁহার যোগ ও ভোগ দুইই আছে। দুর্গাপূজার সময় নবীন ও তাঁহার পুত্র মা-দুর্গাকে ব্যজন করিতেন। সাধনকালে দক্ষিণেশ্বরে ভৈরবী ব্রাহ্মণীকে ঠাকুর মণ্ডল ঘাটে থাকিবার অনুরোধ করিয়াছিলেন। ভৈরবীর সেখানে অবস্থানকালে নবীন নিয়োগীর ভক্তিমতী স্ত্রী তাঁহার সেবা ও যত্নের সুব্যবস্থা করিয়াছিলেন।

নবীন সেন — কেশবচন্দ্র সেনের জেষ্ঠ ভ্রাতা। তাঁহার কলুটোলার বাড়িতে কেশবের মাতাঠাকুরানীর নিমন্ত্রণে ঠাকুর শুভাগমন করিয়াছিলেন এবং ব্রাহ্মভক্তদের হিত কীর্তন করিয়াছিলেন।

নরেন্দ্র [নরেন্দ্রনাথ দত্ত] (১৮৬৩ – ১৯০২) — ইনি পরবর্তী জীবনে শ্রীরামকৃষ্ণসঙ্ঘে বিশ্ববিখ্যাত স্বামী বিবেকানন্দ নামে পরিচিত। পিতা বিশ্বনাথ দত্ত প্রখ্যাত অ্যাটর্নী ছিলেন। তিনি খুব উদার মনোভাবাপন্ন এবং প্রবল ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ ছিলেন। মাতা ভুবনেশ্বরী অতিশয় ভক্তিমতী মহিলা ছিলেন। রামায়ণ-মহাভারত ও পুরাণাদি গ্রন্থপাঠে তাঁহার বিশেষ দখল ছিল। বীরেশ্বর শিবের কৃপায় তিনি পুত্র নরেন্দ্রনাথকে পাইয়াছিলেন। পুত্রের উপর মায়ের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। নরেন্দ্রনাথ অতিশয় মেধাবী এবং তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন ছাত্র ছিলেন। বালক নরেনের বুদ্ধিমত্তায় সকলেই মুগ্ধ ও বিস্মিত হইতেন। সমবয়স্ক ছাত্রদের মধ্যে নরেন্দ্রনাথ ছিলেন ধ্যানপ্রবণ, প্রত্যুৎপন্নমতি এবং অসমসাহসিক ও হৃদয়বান নেতা। একাধারে অনেক গুণের অধিকারী। বাল্যকাল হইতে সত্যনিষ্ঠা এবং দেবদেবীর প্রতি অনুরাগ নরেন্দ্রনাথের মধ্যে বিশেষ লক্ষিত হয়। কলেজের পাঠকালেই ঈশ্বরান্বেষী যুবক নরেন্দ্রনাথ একজন প্রকৃত ঈশ্বরদ্রষ্টাকে খুঁজিয়া বেড়াইতেছিলেন। মন সময়ে ব্রাহ্মধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হইয়া তিনি বহু মনীসীর সান্নিধ্য লাভেও তৃপ্ত হন নাই। অবশেষে দক্ষিণেশ্বরে নরেন্দ্রনাথ শ্রীরামকৃষ্ণের মধ্যে সেই আকাঙ্খিত ঈশ্বরদ্রষ্টার সাক্ষাৎলাভ করেন। শ্রীরামকৃষ্ণ ওই সাক্ষাৎকালে নরেন্দ্রনাথকে জানিতে পারেন যে এই সেই চিহ্নিত ঋষি যিনি লোকহিতার্থে পৃথিবীতে আসিয়াছেন। নরেন্দ্র সেই দিনেই তাঁহার এতদিনের প্রশ্নের উত্তর শ্রীরামকৃষ্ণের নিকট হইতে মহূর্তমধ্যে পাইয়া যান। শ্রীরামকৃষ্ণের দৃঢ়কণ্ঠের উত্তর — তিনি ঈশ্বরকে দর্শন করিয়াছেন; ভগবানকে তিনি নিজেই শুধু দেখেন নাই, অপরকেও দেখাইতে পারেন। শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁহার আধ্যাত্মিক সাধনার সকল শক্তি নরেন্দ্রনাথকে অর্পণ করিয়া মহাসমাধি লাভ করেন। শ্রীরামকৃষ্ণের তিরোধানের পরে শ্রীরামকৃষ্ণের যুবক ভক্তদের একত্র করিয়া বরাহনগর মঠে সন্ন্যাস গ্রহণপূর্বক প্রথমে বিবিদিষানন্দ পরে সচ্চিদানন্দ ও শেষে বিবেকানন্দ নামে তিনি পরিচিত হন। তারপর পরিব্রাজক রূপে ভারতের সর্বত্র পরিভ্রমণ করিয়া দেশের বাস্তবরূপের সহিত তাঁহার প্রত্যক্ষ পরিচয় হিয়াছিল। অবশেষে মাদ্রাজের যুবক ভক্তদের উৎসাহ-উদ্দীপনায় বিবেকানন্দ আমেরিকার শিকাগো শহরে আয়োজিত বিশ্বধর্ম মহাসভায় যোগদান করিতে রওনা হন ১৮৯৩ খ্রীষ্টাব্দের ৩১শে মে। অনেক অসুবিধার মধ্যে অগ্রসর হইয়া শেষ পর্যন্ত তিনি উক্ত সম্মেলনে হিন্দুধর্মের প্রতিনিধিরূপে যোগদান করিয়া হিন্দুধর্মের মহিমা ঘোষণা করেন। উক্ত সম্মেলনে বক্তৃতা দিয়া জগৎসভায় ভারতের প্রতিষ্ঠাপূর্বক বিপুল সাফল্য লাভ করেন। আমেরিকার নানা স্থানে ঘুরিয়া ভারতীয় ধর্ম, সংস্কৃতি, দর্শন ও বেদান্তের প্রচার করা এই সময়ে তাঁহার একমাত্র লক্ষ্য হইয়া দাঁড়ায়। ইউরোপেও তিনি বেদান্ত প্রচার করেন। ১৮৯৭ খ্রীষ্টাব্দে ভারতে ফিরিলে কলম্বো হইতে আলমোড়া পর্যন্ত সর্বত্র অভূতপূর্ব অভ্যর্থনা লাভ করেন। নানাস্থানে বক্তৃতার পরে ভাবী রামকৃষ্ণ মিশন গঠনের কাজে উদ্যোগী হন এবং ১৮৯৭ খ্রীষ্টাব্দের ১লা মে রামকৃষ্ণ মিশনের প্রতিষ্ঠা করেন।

নরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় — অধ্যাপক রাজকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুত্র। তিনি স্ত্রী-পুত্র সহ শ্যামপুকুরে বাস করিতেন। এবং মাঝে মাঝে দক্ষিণেশ্বরে আসিয়া ঠাকুরের সঙ্গলাভে নিজেকে ধন্য মনে করিতেন।

নরোত্তম — কীর্তনীয়া। ঠাকুরের ভক্তেরা নিজেদের গৃহে উৎসবের ব্যবস্থা করিলেই কীর্তনগানের জন্য নরোত্তমকে আমন্ত্রণ করিতেন। ঠাকুর এই কীর্তনীয়াকে খুব স্নেহ করিতেন।

নারায়ণ — কলিকাতার সঙ্গতিপন্ন ব্রাহ্মণ পরিবারের সন্তান। সরল ও পবিত্র স্বভাবের জন্য ঠাকুর তাঁহাকে খুব স্নেহ করিতেন। নারায়ণ কথামৃত প্রণেতা মহেন্দ্রনাথ গুপ্তের ছাত্র। বাড়ির লোকের প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও দৈহিক নির্যাতন সহ্য করিয়া তিনি দক্ষিণেশ্বরে আসিতেন। তাঁহার প্রতি এই শারীরিক অত্যাচারের জন্য ঠাকুর ব্যাথা বোধ করিতেন। অল্প বয়সেই নারায়ণ দেহত্যাগ করেন।

নারায়ণ শাস্ত্রী — রাজস্থানের অধিবাসী। দার্শনিক, পণ্ডিত এবং ঠাকুরের ভক্ত। সাধনকালে তিনিঠাকুরের দিব্যোন্মত্ত অবস্থা দেখিয়াছিলেন। পরে নবদ্বীপ হইতে নবন্যন্যায়ে ব্যুৎপত্তি লাভ করিয়া ফিরিবার পথে ঠাকুরের ভাবময় মূর্তি ও সমাধি দর্শন করিয়া তাঁহার প্রতি আকৃষ্ট হন। তিনি ঠাকুরের মধ্যে শাস্ত্রের সূক্ষ্ম বিষয় সমূহ উপলব্ধ লক্ষ্য করিয়াছিলেন। ঠাকুরের ভাবে আকৃষ্ট হইয়া তিনি দক্ষিণেশ্বরে থাকিয়া যান। পরে ঠাকুরের নিকট সন্ন্যাস গ্রহণ করেন এবং বশিষ্ঠাশ্রমে তপস্যা করিতে চলিয়া যান। ১৮৭৫ খ্রীষ্টাব্দে কেশবের সহিত ঠাকুরের মিলনের আগে তিনি ঠাকুরের নির্দেশে কেশবচন্দ্রের সঙ্গে দেখা করেন এবং ঠাকুরকে জানান যে কেশব জপে সিদ্ধ। দক্ষিণেশ্বরে মাইকেল মধুসূদনের সহিত শ্রীরামকৃষ্ণের সাক্ষাতের সময় শাস্ত্রীজী সেখানে উপস্থিত থাকিয়া মাইকেলের সঙ্গে সংস্কৃতে কথা বলেন।

নিতাই মল্লিক — ডাক্তার নিতাই মল্লিক দক্ষিণেশ্বরে শ্রীশ্রীঠাকুরকে দর্শন করিয়াছিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণের উপদেশও তিনি শুনিয়াছিলেন।

নিত্যগোপাল [নিত্যগোপাল বসু — জ্ঞানানন্দ অবধূত] (১৮৫৫ – ১৯১১) — শ্রীরামকৃষ্ণের স্নেহধন্য ভক্ত। রামচন্দ্র এবং মনোমোহন মিত্রের মাসতুতো ভাই। তুলসীচরণ দত্ত (পরে স্বামী নির্মলানন্দ) নিত্যগোপালের ভাগিনেয়। কলিকাতা আহিরীটোলায় বিখ্যাত বসু বংশের সন্তান। পিতা জনমেজয়, মাতা গৌরী দেবী। নিত্যগোপাল কখনো একা কখনো রামচন্দ্রের সহিত ঠাকুরকে দর্শন করিতে আসিতেন। তিনি সর্বদা ভগবদ্ভাবে বিভোর হইয়া থাকিতেন। শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁহার আধ্যাত্মিক অবস্থা লক্ষ্য করিয়া তাঁহাকে অত্যন্ত স্নেহ করিতেন। ঠাকুর তাঁহার অবস্থা দেখিয়া তাঁহার সম্পর্কে ‘পরমহংস অবস্থা’ বলিতেন। ঠাকুর তাঁহার সম্বন্ধে বলিতেন যে তাঁহার আধ্যাত্মিক অনুভূতিলাভ বিশেষ সাধন-ভজনাদির উদ্যোগ ব্যতীতই হয়। নিত্যগোপালের পৃথক ভাবে জন্য ঠাকুর তাঁহার অন্যান্য ভক্তদের তাঁহার সঙ্গে মিশিতে নিষেধ করিতেন। বলিতেন, “ওর ভাব আলাদা, ও এখানকার লোক নয়।” ঠাকুরের তিরোধানের পর ঠাকুরের অস্থিভস্ম কাঁকুড়গাছির যোগোদ্যানে রাখা হয় এবং নিত্যগোপাল তখন পাঁচ-ছয় মাস কাল ঠাকুরের নিত্যপূজা করিতেন। নিত্যগোপাল সেইসময়ে দিনের অধিকাংশ সময় ধ্যান করিয়া কাটাইতেন। তিনি ‘জ্ঞানানন্দ অবধূত’ নাম গ্রহণ করেন। ১১৩ নং রাসবিহারী এভেনিউতে ‘মহানির্বাণ মঠ’ স্থাপন করেন। পানিহাটিতে তাঁহার প্রতিষ্ঠিত অন্য মঠের নাম কৈবল্য মঠ। তাঁহার রচিত প্রায় ২৫ খানা গ্রন্থের মধ্যে কিছু কিছু ইংরেজীতে অনূদিত হইয়াছে।

নিরঞ্জন [নিত্যনিরঞ্জন ঘোষ — স্বামী নিরঞ্জনানন্দ] (১৮৬২ – ১৯০৪) — নিরঞ্জনের জন্ম ২৪ পরগণার রাজারহাট বিষ্ণুপুরে। তিনি শ্রীরামকৃষ্ণ সঙ্ঘে স্বামী নিরঞ্জনানন্দ নামে সুপরিচিত। শ্রীরামকৃষ্ণের ১৬ জন ত্যাগী সন্তানের মধ্যে স্বামী নিরঞ্জনানন্দ অন্যতম ও ছয় জন ঈশ্বরকোটির অন্যতম। নিরঞ্জনের বাল্যকাল মাতুলালয়ে কাটে। তাঁহার অতি সুন্দর চেহারা ব্যায়ামাদির ফলে সুদীর্ঘ, সবল ও সুঠাম ছিল। তাঁহার প্রকৃতি ও অনুরূপ নির্ভীক ও বীরভাবাপন্ন ছিল। শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে আসিবার পূর্বে তিনি এক প্রেততত্ত্বান্বেষী দলের সহিত যুক্ত ছিলেন। এই প্রেততত্ত্বানুসন্ধিৎসু জনকয়েক বন্ধুর সহিত নিরঞ্জন প্রথম দক্ষিণেশ্বরে আসেন। প্রথম দর্শনে নিরঞ্জন দেখেন শ্রীরামকৃষ্ণ ভক্তপরিবেষ্টিত হইয়া বসিয়া আছেন। সন্ধ্যায় সকলে উঠিয়া গেলে শ্রীরামকৃষ্ণ নিরঞ্জনের এমন অনতরঙ্গভাবে খবর নেন, যেন কতকালের পরিচিত। সেই সময়ই তিনি নিরঞ্জনকে জানাইয়া দেন যে, মানুষ ভূত ভূত করিতে থাকিলে ভূত হইয়া যায়, আর ভগবান ভগবান করিলে মানুষই ভগবান হইয়া যায়। সঙ্গে সঙ্গে নিরঞ্জন স্থির করিলেন যে, ভগবান ভগবান করাই তাঁহার জীবনের লক্ষ্য হওয়া উতিত। প্রথম দিন হইতেই নিরঞ্জনের সরলতা শ্রীরামকৃষ্ণের মন জয় করে। নিরঞ্জনের সরলতা ও বৈরাগ্যের জন্য ঠাকুর তাঁহার প্রতি কতখানি স্নেহপরায়ণ ছিলেন তাহার উদাহরণ কথামৃতের বহু জায়গায় দেখা যায়। বলরামভবনে একদিন বলিয়াছিলেন, “দেখ না নিরঞ্জন কিছুতেই লিপ্ত নয়।” এছাড়া আরও অনেক গুহ্য কথা বলিয়াছিলেন নিরঞ্জন সম্পর্কে। দক্ষিণেশ্বরে একদিন ঠাকুর নিরঞ্জনকে আলিঙ্গন করিয়া আকুলস্বরে ভগবান লাভের জন্য ব্যগ্র হইতে বলিয়াছিলেন। নিরঞ্জন এই ভালবাসায় অভিভূত হন। শ্রীরামকৃষ্ণের প্রতি তাঁর ত্যাগী সন্তানদের এমন প্রাণঢালা ভালবাসা ছিল, যার উদাহরণ নিরঞ্জনের ভাষায়, “আগে ভালবাসা ছিল বটে কিন্তু এখন ছেড়ে থাকতে পারবার যো নাই।” কর্তব্যানুরোধে ও বৈরাগ্যের আবেগে নিরঞ্জনকে আপাতদৃষ্টিতে কঠোর মনে হইলেও তাঁহার চরিত্রে কোমলতার অভাব ছিল না। এককথায় প্রয়োজন বোধে তিনি যেমন বজ্রাদপি কঠোর হইতেন, তেমনি আবার কুসুমাদপি মৃদুও হইতে পারিতেন। ১৮৮৭ খ্রীষ্টাব্দের প্রথম ভাগে সন্ন্যাস গ্রহণের পরে তিনি স্বামী নিরঞ্জনানন্দ নামে অভিহিত হন। স্বামী নিরঞ্জনানন্দের তপস্যার দিকেই বেশি ঝোঁক ছিল। তবে গুরুভাইদের কাহাকেও অসুস্থ দেখিলে তিনি সেখানে ঝাঁপাইয়া পড়িতেন। তাঁহার শেষ সময় হরিদ্বারে অতিবাহিত হয়।

নিরঞ্জনের ভাই — স্বামী নিরঞ্জনানন্দের পূর্বাশ্রমের ভাই। ১৮৮৪ খ্রীষ্টাব্দে কালীপূজার দিনে দক্ষিণেশ্বরে তিনি শ্রীরামকৃষ্ণের সম্মুখে ধ্যান করিয়াছিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁহার সেই ধ্যানের প্রশংসা করেন।

নীলকণ্ঠ [নীলকণ্ঠ মুখোপাধ্যায়] (১৮৪১ – ১৯১১) — ইনি বর্ধমানের ধরণী গ্রাম নিবাসী বিখ্যাত যাত্রাওয়ালা। গোবিন্দ অধিকারীর যাত্রা দলে প্রথম ছীলেন। সুগায়ক নীলকণ্ঠ কৃষ্ণযাত্রায় দূতীর ভূমিকায় অভিনয় করিতেন। তিনি সংস্কৃত ভাল জানিতেন। গোবিন্দ অধিকারীর মৃত্যুর পর তিনি তাঁহার যাত্রা দলের মালিক হন। কবিত্ব শক্তির জন্য বিখ্যাত ছিলেন। তাঁহার রচিত ‘কৃষ্ণযাত্রা’ বর্ধমান, বীরভূম, মুর্শিদাবাদ এবং বাঁকুড়ায় খুব খ্যাতিলাভ করিয়াছিল। ‘কালীর দমন’ (কৃষ্ণলীলা) নীলকণ্ঠের রচিত শ্রেষ্ঠ পালা। তিনি নিজে ওই যাত্রায় রাধার সখীরূপে অত্যন্ত সুন্দর অভিনয় ও গান করিতেন। নবদ্বীপের পণ্ডিতদের নিকট হইতে ‘গীতরত্ন’ উপাধি লাভ করেন। নীলকণ্ঠ দক্ষিণেশ্বরে শ্রীরামকৃষ্ণকে গান শুনাইয়া মুগ্ধ করেন। ঠাকুরও তাঁহাকে গান শুনাইয়া ধন্য করিয়াছিলেন। নীলকণ্ঠের যাত্রা অনুষ্ঠান দেখিতে আগ্রহী শ্রীরামকৃষ্ণ হাটখোলার বারোয়ারী তলায় গিয়াছিলেন। পরে আর একবার ঠাকুর ১৮৮৪ খ্রীষ্টাব্দের অক্টোবর মাসে নবীন নিয়োগীর গৃহে আমন্ত্রিত হইয়া নীলকণ্ঠের যাত্রা শুনেন। সেদিনও তিনি সমাধিস্থ হন। নীলকণ্ঠ ঠাকুরকে প্রশ্ন করেন যে, তাঁহার মতো সংসারী জীবের গতি কি। ঠাকুর তাঁহাকে বলেন যে, তিনি (নীলকণ্ঠ) ভগবান দ্বারা পরিচালিত হইয়াই তাঁহার নামগান, ভক্তিরসের ধারা সাধারণ মানুষের মনে পৌঁছাইয়া দিতেছেন। তাহার পর তিনি নীলকণ্ঠকে মায়ের গান করিতে অনুরোধ করিলেন। মধুর কণ্ঠে গান শুনিয়া তিনি ভাববিভোর হইয়া নৃত্য করিতে আরম্ভ করেন। এইভাবে নীলকণ্ঠ তাঁহার গানের যথার্থ পুরস্কার পাইলেন। ঠাকুর তাঁহাকে বলিয়াছিলেন যে, দুর্লভ রত্ন নীলকণ্ঠের নিজের কাছেই আছে।

নীলমণিবাবু — অধ্যাপক। ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকারের সহিত শ্যামপুকুরে আসিয়া শ্রীরামকৃষ্ণকে দর্শন করেন এবং তাঁহার কথামৃত পান করেন।

নীলমাধব সেন (গাজীপুরের ব্রাহ্মভক্ত) — তিনি গাজীপুর হইতে ঠাকুরকে দর্শন করিতে আসিয়াছিলেন। কেশবচন্দ্র সেন এবং তাঁহার ব্রাহ্মভক্তদের সহিত ঠাকুর যখন গঙ্গাবক্ষে ভ্রমণ করিতেছিলেন, সেই সময় নীলমাধব সেনও উপস্থিত ছিলেন। ঠাকুর সমাধিস্থ হইয়াছিলেন। ধীরে ধীরে তিনি বাহ্যজগতে ফিরিয়া আসিতেছিলেন, তখন নীলমাধব ও অপর একজন ভক্ত ঠাকুরের ছবি ঘরে রাখেন। তাহাদের কথা শুনিয়া ঠাকুর স্মিত হাসেন এবং নিজের দেহের দিকে অঙ্গুলি সংকেত করিয়া বলেন যে শরীরটা কেবলমাত্র খোল।

ন্যাংটা (তোতাপুরী) — শ্রীরামকৃষ্ণদেবের অদ্বৈত বেদান্ত সাধনার গুরু। পাঞ্জাবের লুধিয়ানা মঠের পুরীনামা দশনামা সম্প্রদায়ভুক্ত অদ্বৈতবাদী নাগা সন্ন্যাসী। দীর্ঘ ৪০ বৎসর সাধনার পর নির্বিকল্প সমাধিলাভ করিয়াছিলেন। উত্তর-পশ্চিম ভারত হইতে পুরী ও গঙ্গাসাগর তীর্থ করিয়া ফিরিবার পথে তিনি ১৮৬৫ খ্রীষ্টাব্দে দক্ষিণেশ্বরে আসেন। এখানে ঠাকুরের সহিত তাঁহার সাক্ষাৎকার হয়। তোতাপুরী বাল্যকাল হইতেই সন্ন্যাসীদের মঠে ছিলেন। এই সম্প্রদায়ের সন্ন্যাসীরা দিগম্বর থাকিতেন বলিয়া (ন্যাংটা) নাগা বা নাংগা সাধু সম্প্রদায় বলা হইত। তোতা অল্প বয়সেই গুরুর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন এবং বিশেষ যত্ন সহকারে শিক্ষাপ্রাপ্ত হন। অল্প সময়ের মধ্যে বহু শাস্ত্র অধ্যয়ন করেন। বহুদিন নর্মদাতীরে কৃচ্ছ্রসাধন করেন এবং অবশেষে নির্বিকল্প সমাধি প্রাপ্ত হন। শ্রীরামকৃষ্ণকে দেখিবামাত্র তোতাপুরী তঁহার উচ্চ আধ্যাত্মিক অবস্থা উপলব্ধি করিতে পারেন। তিনি ঠাকুরকে বেদান্ত শিক্ষা দিতে পারেন কিনা প্রশ্ন করিলে ঠাকুর বলেন যে সবই মায়ের ইচ্ছার উপর নির্ভর করে। অবশেষে ঠাকুর মায়ের আদেশানুসারে তোতাপুরীর কাছে বেদান্ত সাধনা করেন। সন্ন্যাসদীক্ষান্তে তিনদিনের মধ্যেই ঠাকুরের নির্বিকল্প সমাধি লাভ হইয়াছিল। তোতাপুরী পরীক্ষা করিয়া দেখিয়াছিলেন যে, ঠাকুরের মন সম্পূর্ণভাবে বাহ্যজগৎ হইতে প্রত্যাহৃত। তাঁহার নির্বিকল্প সমাধি অবস্থা দেখিয়া তোতাপুরী বিস্মিত হইয়াছিলেন। দীর্ঘ ৪০ বৎসরের কঠিন সাধনার পর যাহা তিনি প্রাপ্ত হইয়াছিলেন তাহা শ্রীরামকৃষ্ণ মাত্র অল্প সময়েই লাভ করিয়াছিলেন। তিনদিনের পরিবর্তে ১১ মাস অতিবাহিত করার পর, তোতাপুরী দক্ষিণেশ্বর হইতে চলিয়া যান। যাইবার পূর্বে শ্রীরামকৃষ্ণের সান্নিধ্যবশতঃ তিনি হৃদয়ঙ্গম করেন যে ব্রহ্ম ও শক্তি অভিন্ন, একই সত্তা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *