1 of 11

০৩.০১ শ্রীরামকৃষ্ণের বলরাম-মন্দিরে ভক্তসঙ্গে প্রেমানন্দে নৃত্য

শ্রীরামকৃষ্ণ ভক্তসঙ্গে

প্রথম পরিচ্ছেদ

১৮৮২, ১১ই মার্চ

শ্রীরামকৃষ্ণের বলরাম-মন্দিরে ভক্তসঙ্গে প্রেমানন্দে নৃত্য

রাত্রি ৮টা-৯টা হইবে। ৺দোলযাত্রা। রাম, মনোমোহন, রাখাল, নিত্যগোপাল প্রভৃতি ভক্তগণ তাঁহাকে ঘেরিয়া রহিয়াছেন। সকলেই হরিনাম সংকীর্তন করিতে করিতে মত্ত হইয়াছেন। কয়েকটি ভক্তের ভাবাবস্থা হইয়াছে। নিত্যগোপালের ভাবাবস্থায় বক্ষঃস্থল রক্তিমবর্ণ হইয়াছে। সকলে উপবেশন করিলে মাস্টার ঠাকুরকে প্রণাম করিলেন। দেখিলেন, রাখাল শুইয়া আছেন, ভাবাবিষ্ট ও বাহ্যজ্ঞানশূন্য। ঠাকুর তাঁহার বুকে হাত দিয়া “শান্ত হও” “শান্ত হও” বলিতেছেন। রাখালের এই প্রথম ভাবাবস্থা। তিনি কলিকাতার বাসাতে পিত্রালয়ে থাকেন, মাঝে মাঝে ঠাকুরকে দর্শন করিতে যান। এই সময়ে শ্যামপুকুর বিদ্যাসাগর মহাশয়ের স্কুলে কয়েক দিন পড়িয়াছিলেন।

ঠাকুর মাস্টারকে দক্ষিণেশ্বরে বলিয়াছিলেন, “আমি কলিকাতায় বলরামের বাড়িতে যাব, তুমি আসিও।” তাই তিনি তাঁহাকে দর্শন করিতে আসিয়াছেন। (২৮শে ফাল্গুন, ১২৮৮, কৃষ্ণা ষষ্ঠী); ১১ই মার্চ, শনিবার ১৮৮২ খ্রীষ্টাব্দ, শ্রীযুক্ত বলরাম ঠাকুরকে নিমন্ত্রণ করিয়া আনিয়াছেন।

এইবার ভক্তেরা বারান্দায় বসিয়া প্রসাদ পাইতেছেন। দাসের ন্যায় বলরাম দাঁড়াইয়া আছেন, দেখিলে বোধ হয় না, তিনি এই বাড়ির কর্তা।

মাস্টার এই নূতন আসিতেছেন। এখনও ভক্তদের সঙ্গে আলাপ হয় নাই। কেবল দক্ষিণেশ্বরে নরেন্দ্রের সঙ্গে আলাপ হইয়াছিল।

[সর্বধর্ম-সমন্বয় ]

কয়েকদিন পরে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ দক্ষিণেশ্বরে শিবমন্দিরে সিঁড়ির উপর ভাবাবিষ্ট হইয়া বসিয়া আছেন। বেলা ৪টা-৫টা হইবে। মাস্টার কাছে বসিয়া আছেন।

কিয়ৎক্ষণ পূর্বে ঠাকুর নিজের ঘরে মেঝের উপর বিছানা পাতা — তাহাতে বিশ্রাম করিতেছিলেন। এখনও ঠাকুরের সেবার জন্য কাছে কেহ থাকেন না। হৃদয় যাওয়ার পর ঠাকুরের কষ্ট হইতেছে। কলিকাতা হইতে মাস্টার আসিলে তিনি তাঁহার সঙ্গে কথা কহিতে কহিতে, শ্রীশ্রীরাধাকান্তের মন্দিরের সম্মুখস্থ শিবমন্দিরের সিঁড়িতে আসিয়া বসিয়াছিলেন। কিন্তু মন্দির দৃষ্টে হঠাৎ ভাবাবিষ্ট হইয়াছেন।

ঠাকুর জগন্মাতার সঙ্গে কথা কহিতেছেন। বলিতেছেন, “মা, সব্বাই বলছে, আমার ঘড়ি ঠিক চলছে। খ্রীষ্টান, ব্রহ্মজ্ঞানী, হিন্দু, মুসলমান — সকলেই বলে, আমার ধর্ম ঠিক, কিন্তু মা, কারুর ঘড়ি তো ঠিক চলছে না। তোমাকে ঠিক কে বুঝতে পারবে। তবে ব্যাকুল হয়ে ডাকলে তোমার কৃপা হলে সব পথ দিয়ে তোমার কাছে পৌঁছানো যায়। মা, খ্রীষ্টানরা গির্জাতে তোমাকে কি করে ডাকে, একবার দেখিও! কিন্তু মা, ভিতরে গেলে লোকে কি বলবে? যদি কিছু হাঙ্গামা হয়? আবার কালীঘরে যদি ঢুকতে না দেয়? তবে গির্জার দোরগোড়া থেকে দেখিও।”

[ভক্তসঙ্গে ভজনানন্দে — রাখালপ্রেম — “প্রেমের সুরা” ]

আর এক দিন ঠাকুর নিজের ঘরে ছোট খাটটির উপর বসিয়া আছেন, আনন্দময় মূর্তি — হাস্যবদন। শ্রীযুক্ত কালীকৃষ্ণের[৩] সঙ্গে মাস্টার আসিয়া উপস্থিত।

কালীকৃষ্ণ জানিতেন না, তাঁহাকে তাঁহার বন্ধু কোথায় লইয়া আসিতেছেন। বন্ধু বলিয়াছিলেন, “শুঁড়ির দোকানে যাবে তো আমার সঙ্গে এস; সেখানে এক জালা মদ আছে।” মাস্টার আসিয়া বন্ধুকে যাহা বলিয়াছিলেন, প্রনামান্তর ঠাকুরকে সমস্ত নিবেগন করিলেন। ঠাকুরও হাসিতে লাগিলেন।

ঠাকুর বলিলেন, “ভজানন্দ, ব্রহ্মানন্দ, এই আনন্দই সুরা; প্রেমের সুরা। মানবজীবনের উদ্দেশ্য ঈশ্বরে প্রেম, ঈশ্বরকে ভালবাসা। ভক্তিই সার, জ্ঞানবিচার করে ঈশ্বরকে জানা বড়ই কঠিন।”

এই বলিয়া ঠাকুর গান গাহিতে লাগিলেন:

কে জানে কালী কেমন, ষড় দর্শনে না পায় দরশন।
আত্মারামের আত্মা কালী প্রমাণ প্রণবের মতন,
সে যে ঘটে ঘটে বিরাজ করে ইচ্ছাময়ীর ইচ্ছা যেমন।
কালীর উদরে ব্রহ্মাণ্ড ভাণ্ড প্রকাণ্ড তা বুঝ কেমন,
যেমন শিব বুঝেছেন কালীর মর্ম, অন্য কেবা জানে তেমন।
মূলাধারে সহস্রারে সদা যোগী করে মনন,
কালী পদ্মবনে হংস-সনে, হংসীরূপে করে রমণ।
প্রসাদ ভাষে, লোকে হাসে, সন্তরণে সিন্ধু-তরণ,
আমার মন বুঝেছে, প্রাণ বুঝে না; ধরবে শশী হয়ে বামন।

ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ আবার বলিতেছেন, ঈশ্বরকে ভালবাসা — এইটি জীবনের উদ্দেশ্য; যেমন বৃন্দাবনে গোপ-গোপীরা, রাখালরা শ্রীকৃষ্ণকে ভালবাসত। যখন শ্রীকৃষ্ণ মথুরায় গেলেন, রাখালেরা তাঁর বিরহে কেঁদে কেঁদে বেড়াত।

এই বলিয়া ঠাকুর ঊর্ধ্বদৃষ্টি হইয়া গান গাহিতেছেন:

দেখে এলাম এক নবীন রাখাল,
নবীন তরুর ডাল ধরে,
নবীন বৎস কোলে করে,
বলে, কোথা রে ভাই কানাই।
আবার, কা বই কানাই বেরোয় না রে,
বলে কোথা রে ভাই,
আর নয়ন-জলে ভেসে যায়।

ঠাকুরের প্রেমমাখা গান শুনিয়া মাস্টারের চক্ষুতে জল আসিয়াছে।


 দোলযাত্রার ৭ দিন পরে হইবে। কারণ গুপ্ত প্রেস পঞ্জিকা মতে ওই বৎসর দোলযাত্রা ৪ঠা মার্চ ছিল। শ্রীমও এই পরিচ্ছেদে উল্লেখ করিয়াছেন, ১১ই মার্চ, ১৮৮২, শ্রীরামকৃষ্ণ বলরাম-মন্দিরে আসিয়াছিলেন। — প্র:

 দ্বিতীয় ভাবাবস্থা হইবে বলিয়া আমাদের মনে হয়। মাস্টার মহাশয় নিজেই ১৯ সেপ্টেম্বর, ১৮৮৪-তে উল্লেখ করিয়াছেন ‘রাখালের প্রথম ভাব ১৮৮১’। — প্র:

 কালীকৃষ্ণ ভট্টাচার্য পরে বিদ্যাসাগর কলেজে Senior Professor of Sanskrit (সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যের প্রধান অধ্যাপক) হইয়াছিলেন।

 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *