কুরসিনামা

হায় কুরসি, হায় চেয়ার, এই চেয়ারের জন্যে কত
কুকুর-কাজিয়া কত খেয়োখেয়ি অতীতে দেখেছি,
হাল আমলেও দেখতে হচ্ছে। চেয়ারের প্রতি কোনও আর্কষণ
আমার ছিল না কোনও কালে। একবার আমার
ঢের অনিচ্ছা সত্ত্বেও ক’বছরের জন্যে বসতে হয়েছিল
মোটামুটি জাঁদরেল কুরসিত। হ্যাঁ,
তখন পদে পদে দেখতে হয়েছে চেয়ারের
কী মহিমা! কত লোককে আমার সামনে বসে
অথবা দাঁড়িয়ে হাত কচলাতে দেখেছি, দেখেছি লোভের
লকলকে জিভের চমক-লাগানোর প্রদর্শনী,
আমার র্নিরর্থক ভুল প্রশংসার মালা গাঁথাবার
অপপ্রয়াস। জানতাম, আমি যে কুরসিতে সমাসীন,
তার কাছ থেকে দূরে সরে গেলে সেই একই
লোকজন আমার মুণ্ডুপাত করে, কাদা ছিটোয় আমার নামে।

একদিন স্বেচ্ছায় আমি ত্যাগ করি জাঁদরেল
চেয়ারটিকে। কুরসিটি ছেড়ে এসেছিলাম বলে
মনে একরত্তি খেদ নেই। এখন আমি আমার ব্যক্তিগত
চেয়ার বিষয়ে বলবো, যে আমাকে এক যুগ ধরে
বসতে দিচ্ছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। আমার
একান্ত অনুরোধে যিনি চেয়ারটি তৈরি করিয়ে
এনেছিলেন আসবাবপত্রের দোকান থেকে,
তিনি এখন কবরে। ব্যক্তিগত চেয়ারটিকে দিকে চোখ পড়লে
কিংবা বসতে গেলে কালেভদ্রে ভদ্রলোকটির মুখ
মনে পড়ে । আমার এই চেয়ারটিকে খুবই ভালোবাসি।

চেয়ারটি ওর প্রাক্তন শ্রী অনেকটাই হারিয়ে ফেলেছে,
কেমন বিবর্ণ, অথচ সামর্থ্য তেমন
ক্ষুণ্ণ হয়নি, নড়বড়ে তো নয়ই। ধকল
ওকে কম পোয়াতে হয়নি, আজ
অব্দি হচ্ছে। এই ব্যক্তিগত চেয়ারের প্রতি প্রখর
আমার আকর্ষণ। সে আমার জীবনের
অপরিহার্য সপ্রাণ অংশ। ওর সঙ্গে কখনও
কোনও বিবাদ হয় না আমার, সখ্য এমনই প্রবল।

মনে পড়ে, মা যখন কখনও সখনও আমার
আপন এই চেয়ারটির আতিথ্য গ্রহণ
করতেন, বর্তে যেত সে, যেন পুষ্পিত উদ্যান,
ওর বিবর্ণ চেহারা উদ্ভাসিত হতো,
হাজার চেরাগের আলোয়। আমার এই চেয়ারে
অনেক মধ্যরাতে এসে বসেছেন দান্তে, শেক্সপীয়ার,
রবীন্দ্রনাথ, গ্যয়েটে, মধুসূদন দত্ত, শার্ল বোদলেয়ার,
এলুয়ার, চণ্ডীদাস, লালনশাহ, গালিব, জীবনানন্দ,
বসেছেন খুব দয়াপরবশ হয়ে। তাঁদের অমৃত সমান কত
কথা শোনার দুর্লভ সুযোগ হয়েছে
আমার চেয়ারের। কতবার প্রেরণাপরিত্যক্ত প্রায়
নিভু নিভু আমি জ্বলে উঠেছি শিখার ধরনে,
বন্ধ্যা কাগজ ভরে উঠেছে নানা চিত্রকল্প সংবলিত
পঙ্‌ক্তিমালায়, যখন খুব অন্তরঙ্গ হয়ে উঠেছি
ভালোবাসায়, আবদ্ধ হয়েছি নিবিড় আলিঙ্গনে। যখন
কখনও কখনও সে অচিমান করে, তখন আমি বন্ধ্যা মাটির স্তূপ।
১৯.১২.৯৯