জংলী ঘাস থেকে ইট কুড়িয়ে

ক’মাস আগে এক দ্বিপ্রাহরিক আড্ডায় মফিদুল হক
আর শাহরিয়ার কবির বেদনাদীর্ণ কণ্ঠে জানালেন
এক শহরতলিতে সদ্য আবিষ্কৃত একাত্তরের একটি নিঝুম
ছায়াঘেরা বধ্যভূমির কথা। সেখানে মাটি খুঁড়ে পাওয়া
গেছে অনেক গাড়গোড়, মাথার খুলি। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের
তত্ত্বাবধানে অনুসন্ধান চলছে, বিকশিত হচ্ছে
ঐতিহাসিক নির্দয়তা

ঝকঝকে দুপুর নিমেষে অমাবস্যার রাত। আড্ডা
আর এগোয়া না, একটা নিস্তব্ধতা আমাদের স্থবির করেছে,
যেন আমরা স্বজনদের লাশের সামনে বসে আছি বাক্যহারা,
শোকের শেকলে বন্দী, দিশেহারা। সেদিন বিকেলেই কাউকে
কিছু না বলে রওয়ানা হলাম শহরতলিতে সদ্য আবিষ্কৃত
সেই বধ্যভূমির উদ্দেশে। যখন সেখানে বুনো গাছপালা এবং
একটি পুরোনো দালানের ভগ্নাংশের কাছে পৌছলাম, প্রগাঢ়
গোধূলি আমাকে নিবিড় আলিঙ্গন করেছে প্রিয়তমার মতো।
ঝোপঝাড় বুনো আচরণ বিসর্জন দিয়ে ‘এসো এসো’ বলে খুব
ঘনিষ্ঠ জনের মতো ডাকে প্রফুল্ল স্বরে। পুরোনো দালানের
ভগ্নাংশ যেন প্রণতা হয় আমাকে বিশিষ্টতা অর্পণের জন্যে।
অদৃশ্য পায়রা-যুগলের প্রণয়দৃশ্য আমাকে মোহিত করে।

এক পা দু’পা করে এগোই ওদের দিকে। একটা
অচেনা পাখি মানুষের ধরনে কী কথা বলে প্রায় আমার কান
ঘেঁষে উড়ে যায়। পুরোনো দালানের ভাঙাচোরা কঙ্কাল থেকে
হঠাৎ এক তরুণ কণ্ঠ কখনও আবৃত্তি করছে কাজী নজরুল
ইসলামের ‘দুর্গম গিরি, কান্তার মরু, দুস্তর পারাবার হে’
কখনও জীবনানন্দ দাশের ‘তোমরা যেখানে সাধ চলে যাও, আমি
এই বাংলার পারে রয়ে যাবো। সেই পুরোনো দালানের ভাঙাচোরা
ইটে মাথা খুঁড়ে মরলেও সেই তরুণ কণ্ঠস্বরের অধিকারীকে
কোথাও খুঁজে পাবো না। জংলী ঘাস থেকে ইট কুড়িয়ে
নেয়ার সঙ্গে সঙ্গে কানে ভেসে আসে অর্ধশতাব্দীর প্রবীণ,
ছোট দালানের ভগ্নাংশ থেকে এক তরুণী-কণ্ঠের মেদুর
রবীন্দ্রসঙ্গীত ‘যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে/…
বন্ধ হবে আনাগোনা এই হাটে-/ তখন আমায় না-ই বা মনে
রাখলে/তারার পানে চেয়ে চেয়ে নাইবা আমায় ডাকলে

সেই নাম-না জানা তরুণীকে নক্ষত্রমণ্ডলীর দিকে তাকিয়ে
তাকিয়ে আমার গ্লুকোমা-পীড়িত দৃষ্টি ভয়ানক অন্ধকার
হয়ে গেলেও তার নাম আমি জানব না কোনওদিন। তার
পায়ের চিহ্ন সেই কবে মুছে গেছে, হায় হানাবাড়িসদৃশ এই
নিশ্চিহ্নপ্রায় দালানের সব জায়গা থেকে, পাছদুয়ার কিংবা
সামনের মধ্যবিত্ত, বিনীত উদ্যান থেকে, কলেজে যাওয়ার
সরু পথ থেকে। ভাবতেই ইচ্ছে হলো না সদ্য আবিষ্কৃর
বধ্যভূমির হাড়গোড় এবং কয়েকটির মধ্যে রয়েছে
সেই তরুণীর মৃত অস্তিত্বের বিকৃত আদল। অথচ
আমার ভাবনাকে বিন্দুমাত্র গ্রাহ্য করে না নির্দয় সত্য!
২১.১১.৯৯