০৬. রেফ আকাশের দিকে তাকাল

রেফ্‌ আকাশের দিকে তাকাল। আকাশ ঘন কাল হয়ে আছে। যে-কোন সময় বৃষ্টি নামবে। এই আকাশ পর্দায় তৈরি নকল আকাশ না। আসল আকাশ। বৃষ্টি যখন নামবে তখন শরীর ভিজে যাবে। দীর্ঘদিন বৃষ্টিতে ভেজা হয় না। রেফ্‌ মনেপ্রাণে চাইছে আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামুক।

সে দাঁড়িয়ে আছে হাইওয়ের পাশে। হাইওয়েটা জংলামত জায়গা দিয়ে গিয়েছে। পাহাড়ি জংলা জায়গা। আকাশ-ছোঁয়া বড় বড় গাছে দিনের বেলাতেও অন্ধকার হয়ে আছে। পৃথিবীতে বিবর্তন প্রক্রিয়ায় মানবসমাজ শুরু হবার আগে আগে যে ধরনের অরণ্য ছিল—এই অরণ্যও সেরকম। এইসব গাছপালা জেনেটিক ইনজিনিয়ারিং প্রক্রিয়ায় তৈরি। বিজ্ঞানীরা পরীক্ষামূলক কিছু নিশ্চয়ই করছেন। নানান জায়গায় নানান ধরনের পরীক্ষা চলছে।

রে আবারো আকাশের দিকে তাকাল। মেঘ ঘন হয়ে আসছে। এই মেঘমালাও কি পরীক্ষার কোন অংশ? সেই সম্ভাবনা আছে। বিশাল এই প্রাচীন অরণ্যের গাছপালার জন্যে প্রচুর বৃষ্টি দরকার। প্রয়োজনমত বৃষ্টির জন্যে দরকার মেঘ। কোন একদিন এই পরীক্ষা শেষ হবে। বিজ্ঞানীরা গাছপালা নষ্ট করে ফেলবেন। হয়ত ঠিক এই জায়গাতেই মরুভূমি তৈরি হবে। বালিয়াড়ির উপর দিয়ে ঝড়ের গতিতে বইবে মবুবায়ু। কিংবা বরফ ঢাকা অঞ্চল তৈরি হবে। পেঙ্গুইনের ঝাক গম্ভীর ভঙ্গিতে ঘুরে বেড়াবে। নতুন কোন এক্সপেরিমেন্ট।

রেফ্‌ আমার কথা শুনতে পাচ্ছ?

রেফ্‌ চমকাল। তবে প্রথমবার যে-ভাবে চমকেছিল সে-ভাবে চমকাল না। কেউ একজন তার সঙ্গে কথা বলছে। কথা বলছে ঠিক তার মাথার ভেতরে। মনে হচ্ছে শস্যের দানার মতো ছোট্ট কোন মানুষ তার মস্তিষ্কের ভজে শুয়ে আছে। তার হাতে মাইক্রফোন। সে কথা বলছে মাইক্রফোনে। অবিশ্বাস্য এই ব্যাপার সকাল থেকে ঘটছে। মাথার ভেতরে যে কথা বলছে সে-ই তাকে এই প্রাচীন অরণ্যে পথ বলে বলে নিয়ে এসেছে।

ব্যাপারটা তার মানসিক ব্যাধির একটা অংশ হতে পারে। সে হয়ত সেনিটোরিয়ামে তার বিছানায় শুয়ে আছে। আধো ঘুম আধো জাগরণের মধ্যে আছে। বাকিটা তার মস্তিষ্কের কল্পনা। উত্তপ্ত অসুস্থ মস্তিষ্ক অনেক অদ্ভুত ঘটনা ঘটায়।

রেফ তুমি কি আমার কথা শুনতে পাচ্ছ?

শুনতে পাচ্ছি।

পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছ?

হ্যাঁ পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছি।

যা ঘটছে তা নিয়ে তুমি কি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত বোধ করছ?

আমি এমিতেই মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। মানসিক রোগগ্রস্ত হিসেবে আমার চিকিৎসা চলছে। আমার ধারণা আমি সেনিটোরিয়ামে আমার নিজের বিছানায় শুয়ে আছি। যা ঘটছে সবই কল্পনা।

এ রকম ভেবে তুমি যদি মানসিকভাবে স্বস্তি পাও তাহলে তাই ভেবে নাও। এই মুহূর্তে মাথা ঠাণ্ডা রাখা তোমার জন্যে খুবই প্রয়োজন।

আপনি কে?

আমি ভবিষ্যতের মানুষ। অনেক দূরের ভবিষ্যৎ থেকে তোমার উপর কাজ করছি।

ও।

আমরা তোমাকে সাহায্য করতে চেষ্টা করছি। সরাসরি সাহায্য করা সম্ভব হচ্ছে না। তুমি নিজের বুদ্ধি-বিবেচনা প্রয়োগ কর।

আমার বুদ্ধি-বিবেচনা কাজ করছে না।

তুমি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ তোমাকে খোঁজা হচ্ছে।

অনুমান করছি।

তোমাকে পালিয়ে থাকতে হবে।

কোথায় পালাব?

চিন্তা কর। ভেবে বের কর। আমরা অতি দূর-ভবিষ্যতের মানুষ। এত দূর থেকে আমরা তোমার অবস্থা বুঝতে পারছি না।

আমি কি আমার নিজের বাড়িতে ফিরে যাবার চেষ্টা করব? নিশ্চয়ই কেউ ভাববে না যে আমি নিজের ঘরে চলে যাব। বাইরে তালা বন্ধ করে ঘরে বসে থাকতে পারি।

বুদ্ধি খারাপ না। তবে তোমার খাদ্যের প্রয়োজন হবে। খাবারের জন্যে তোমাকে বাইরে যেতে হবে। তাছাড়া তোমার ঘরে এর মধ্যেই রক্ষী রোবট পাঠিয়ে দেয়ার কথা।

ঠিকই বলেছেন। এখন কি করব?

এমন কোথাও তোমাকে আশ্রয় নিতে হবে যেখানে কেউ তোমার খোঁজ করার কথা ভাববে না।

সেই জায়গাটা কোথায়?

বিজ্ঞান কাউন্সিলপ্রধান এমরান টির বাড়ি।

সর্বনাশ সেখানে কিভাবে যাব?

আমরা তোমাকে সাহায্য করব।

সাহায্য করুন।

এই মুহূর্ত থেকে তুমি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন রোবটের ভূমিকায় অভিনয় করা শুরু কর। এই রোবটগুলি হিউমেনয়েড। দেখতে অবিকল মানুষের মতো।

আমার পোশাক রোবটদের মতো না। রোবটদের বিশেষ কোড নাম্বার আছে। স্ক্যানারে এই কোড ধরা যায়। তাছাড়া আমার চেহারার ব্যাপার তত আছেই। আপনারা কি আমার চেহারা পাল্টে দিতে পারবেন? আমাকে কোড নাম্বার দিতে পারবেন? আমাকে পোশাকের ব্যবস্থা করে দিতে পারবেন?

পারব না।

তাহলে?

আমরা মানুষের মস্তিষ্কের ভেতর সরাসরি কাজ করতে পারি। মস্তিষ্কের নিউরোন কারেন্ট নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। যারা তোমার কাছে আসবে তারাই তোমাকে রোবট ভাববে। তোমার চেহারা তারা দেখবে না। তারা অন্য চেহারা দেখবে।

মানুষের ব্যাপারে আপনারা এই কাজটা হয়ত-বা করতে পারতেন কিন্তু একজন রোবট যখন আসবে তখন? রোবটদের মস্তিষ্ক নেই-নিউরোন কারেন্ট নেই। ওদের চোখকে ফাঁকি দেবেন কিভাবে?

ওদের চোখকে ফাঁকি দেয়া সম্ভব না। কাজেই তোমাকে অতি দ্রুত পৌঁছে যেতে হবে এমরান টির বাসভবনে। উনি রোবট ঘৃণা করেন, তাঁর বাসভবনে। কোন রোবট নেই। একবার ওনার বাসভবনে পৌছানোর পর তুমি নিশ্চিন্ত থাকতে পারো। তোমার হাতে একটা অস্ত্র দেখতে পাচ্ছি। এটা কি ওমিক্রন গান?

আমি জানি না এটা কি অস্ত্র। শেফ আমাকে এটা দিয়েছে।

তোমার হাতের অস্ত্ৰটা ওমিক্রন গান। এমরান টিকে হাতের মুঠোয় রাখতে হলে এই অস্ত্র লাগবে।

এমরান টিকে আমি কি বলব?

তার কাছে তুমি তোমার সত্যি পরিচয় দেবে।

সত্যি পরিচয় দেব?

হ্যাঁ।

দয়া করে বলুন তো আমার সত্যি পরিচয়টা কি?

তোমার সত্যি পরিচয় হচ্ছে তুমি অতি গুরুত্বপূর্ণ একটা পরীক্ষার অংশ।

পরীক্ষাটা কে করছে।

পরীক্ষাটা করছে ওমেগা পয়েন্ট।

ওমেগা পয়েন্ট কি?

ওমেগা হল মানবজাতির সর্বশেষ অবস্থা। পূৰ্ণ জ্ঞান।

কিছুই বুঝতে পারছি না।

আমরাও বুঝতে পারি না। আমরা যা অনুভব করি তা হচ্ছে মানব সম্প্রদায়ের জ্ঞান-বিজ্ঞান ধাপে ধাপে অগ্রসর হচ্ছে। একসময় মানুষ সব কিছুই জেনে যাবে। সৃষ্টি চলে আসবে তার হাতের মুঠোয়। এই পর‍্যায়টিকেই বলা হচ্ছে ওমেগা পয়েন্ট।

বুঝতে পারছি না।

আমরাও বুঝতে পারি না। বোঝার চেষ্টাও করি না। আমরা ধরে নিচ্ছি–ওমেগা পয়েন্ট তোমাকে দিয়ে একটা পরীক্ষা শুরু করেছে। আমাদের দায়িত্ব হল এই পরীক্ষা যেন ঠিকমত শেষ হতে পারে সেই বিষয়ে সাহায্য করা। আমরা সেই চেষ্টাই করছি।

আমি তাহলে একটা গিনিপিগ?

হ্যাঁ তুমি একটা গিনিপিগ।

গবেষণায় একটা গিনিপিগের মৃত্যু হলে অন্য গিনিপিগ ব্যবহার করা হয়। আমার ক্ষেত্রেও কি সেই ব্যবস্থা?

হয়ত-বা। আমরা জানি না। আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখ। বৃষ্টি নামছে।

হ্যাঁ বৃষ্টি নামছে। এখন বল গিনিপিগকে কি করতে হবে?

তুমি বৃষ্টির মধ্যে হাইওয়েতে দাড়িয়ে ভিজতে থাকবে। কিছুক্ষণের মধ্যেই রক্ষীবাহিনীর একজন কর্মকর্তা এই পথে আসবেন। তাঁর সাহায্যে তুমি এমরান টির বাসভবনে পৌঁছবে।

তোমাদের সঙ্গে আমার যোগাযোগ থাকবে?

শুধু প্রয়োজনের সময়ই আমরা যোগাযোগ করব।

আপনাদের একটা শেষকথা বলতে চাচ্ছি।

বল।

আমি নিশ্চিত যা ঘটছে সবই আমার কল্পনা। আমি একজন মানসিক রোগী। আমার উত্তপ্ত মস্তিষ্ক এইসব কল্পনা করছে।

হতে পারে। কল্পনাকে তার পথে যেতে দাও। তুমি হাইওয়েতে গিয়ে দাঁড়াও। মনে রেখ তোমার ভাবভঙ্গি হবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন রোবটদের মতো।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন রোবটরা কেমন আমি জানি না। আমি রোবট না। আমি মানুষ।

আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নেমেছে। রেফ্‌ অনেকদিন এমন বৃষ্টি দেখে নি। শুধু বৃষ্টি না। বৃষ্টির সঙ্গে বাতাস দিতে শুরু করেছে। মনে হচ্ছে যে-কোন সময় মাথার উপর গাছের ডাল ভেঙে পড়বে।

রেফ্‌ গাছের নিচ থেকে সরে এল। ঢালু জায়গা দিয়ে তাকে নামতে হচ্ছে। হাইওয়েতে নামতে হলে অনেকখানি পথ তাকে নামতে হবে। জুতা ভর্তি হয়ে যাচ্ছে কাদায়। পা টেনে টেনে হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে। বৃষ্টির পানি অস্বাভাবিক ঠাণ্ডা। তার সারা শরীর ঠকঠক করে কাঁপছে। শীতল বাতাসে শরীরের হাড় পর্যন্ত কাঁপছে। কোন একটা গরম বিছানায় গাঢ় হলুদ রঙের কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকতে পারলে কত চমৎকারই-না হত-এ-ই ভাবতে ভাবতে রেফ্‌ নামছে। হাইওয়েকে আগে যত কাছে মনে হচ্ছিল এখন তত কাছে মনে হচ্ছে না। এখন মনে হচ্ছে হাইওয়েটা মরীচিকার মতো। সে যতই কাছে যাচ্ছে, হাইওয়ে ততই সরে যাচ্ছে।

 

একজন মানুষের পক্ষে যতটুকু বিরক্ত হওয়া সম্ভব এমরান টি তারচেয়েও বিরক্ত হলেন। বিরক্তি প্রকাশ করলেন না। তাঁর মুখ আগে যেমন হাসি-হাসি ছিল এখনো হাসি-হাসিই আছে। তিনি তাঁর বাড়ির দক্ষিণের জানালার কাছে চেয়ার টেনে বসেছেন। পর্দা সরিয়ে বৃষ্টি দেখছেন। তাঁর বাড়ি এই সময়ের অন্য বাড়িঘরগুলির মতো না। বাড়ির দেয়াল সত্যিকার কাঠের তৈরি। চেয়ার-টেবিল সবই কাঠের।

এই সময়কার বাড়িঘর আসবাবপত্র সবই কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত ট্ৰেমসি অণুর তৈরি। এই উদ্ভিদ অজৈব যৌগিক অণুকে অতি দ্রুত ঘনীভূত করে যে-কোন রূপ দেয়া যায়। কম্পিউটারের নির্দেশে মুহূর্তের মধ্যে একটা কাঠের ইজিচেয়ার হয়, আবার সেই ইজিচেয়ারকে স্বচ্ছ পালসিক চেয়ারেও রূপান্তরিত করা যায়। পালসিক চেয়ার হল শরীর-সংবেদনশীল চেয়ার। শরীর যেভাবে চায় চেয়ার সেইভাবে তার রূপ পাল্টায়।

এমরান টি রোবট পছন্দ করেন না, ট্ৰেমসি অণুর আসবাবপত্রও পছন্দ করেন না। তাঁর বাড়ির জানালায় ত্রিমাত্রিক আলো প্রতিফলন ক্ষমতাসম্পন্ন পর্দাও নেই। কাজেই তাঁকে নকল দৃশ্যও দেখতে হয় না।

কাঠের চেয়ারে বসে তিনি যে দৃশ্য এখন দেখছেন সেই দৃশ্য একশ ভাগ খাঁটি দৃশ্য। এমন কিছু সুন্দর দৃশ্য না, কিন্তু তার দেখতে খারাপ লাগছে না। বরং বেশ ভাল লাগছে। প্রচুর বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। তিনি বিদ্যুৎ চমকের হিসাব রাখার চেষ্টা করছেন। একেকবার বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে আর তিনি মনে মনে গুনছেন–সতেরো, আঠারো, উনিশ…

এই সময় তাঁর গোনায় বাধা পড়ল। মেজাজ অসম্ভব খারাপ হল। তিনি তাঁর সহকারীর দিকে তাকালেন। সহকারী রোবট না, সে সাধারণ একটি মেয়ে। নাম রেলা। চেহারা অতিরিক্ত সাদাসিধা। মনে হয় সারাক্ষণই ভয়ে অস্থির হয়ে আছে। কাজকর্মেও যে খুব দক্ষ তাও না। কম্পিউটারে কোন একটা ফাইল খুলতে বললে সে প্রথমে আতংকে একটু শিউরে ওঠে। তারপর যেভাবে কম্পিউটারের বোম টেপে তার থেকে যে-কেউ ধারণা করতে পারে যে সে জীবনে কখনো কম্পিউটারের বোতামে হাত দেয় নি। কিংবা বোতামগুলিতে ইলেকট্রিসিটি পাস করছে। আঙুল ছেয়াননা মানেই শক খাওয়া। ফাইলটি একসময় সে অবশ্যি বার করে—ততক্ষণে এমরান টির ধৈর্যচ্যুতি ঘটে। তবে মেয়েটাকে কিছু বলতে পারেন না। বেচারির চেহারায় কিশোরীসুলভ মায়া আছে। তার চোখ যেভাবে ছলছল করতে থাকে তাতে মনে হয় কিছু বললেই সে কেঁদে ফেলবে। কাজেই মনের বিরক্তি মনে চেপে রাখা ছাড়া পথ থাকে না। মেয়েটিকে বদলে অন্য সহকারী নেয়ার কথা তিনি অনেকদিন থেকেই ভাবছেন। শুধুমাত্র আলস্যের কারণে নেয়া হচ্ছে না।

তিনি যখন বিদ্যুৎ চমকানোর হিসাব করছিলেন তখনই রেলা তার চেয়ারের পেছনে দাঁড়িয়ে বলল, আপনার সঙ্গে দেখা করতে চায়।

এমরান টি মহা-বিরক্ত হলেন। বিরক্তির অনেকগুলি কারণ আছে। প্রথম কারণ তিনি মনের আনন্দে বিদ্যুৎ চমকানো গুনছিলেন। সেখানে বাধা পড়ল। দ্বিতীয় কারণ মেয়েটি স্পষ্ট করে কিছু বলে নি। আপনার সঙ্গে দেখা করতে চায়। এই বাক্যটি দিয়ে কিছুই বোঝা যায় না। কে দেখা করতে চায়? কেন দেখা করতে চায়? তৃতীয় কারণ কেউ একজন চাইলেই এমরান টির সঙ্গে দেখা করতে পারে না। সেক্রেটারি হিসেবে রেলার এই তথ্য জানা থাকা উচিত। চতুর্থ কারণ তিনি তাঁর বাড়িতে কারো সঙ্গেই দেখা করেন না।

তিনি তাঁর বিরক্তি প্রকাশ করলেন না। হাসিমুখেই রেলার দিকে তাকিয়ে বললেন, কে দেখা করতে চায়?

মানবিক আবেগসম্পন্ন একটি রোবট আপনার সঙ্গে দেখা করতে চায়।

তুমি তো জান আমি রোবটদের সঙ্গে কথা বলি না। জান নাকি জান না?

জানি। কিন্তু সে বলছে খুব জরুরি।

একজন রোবটের সঙ্গে আমার কোন জরুরি কথা থাকতে পারে না।

রেফ্‌ নামের যে একজনকে খোঁজা হচ্ছে এই রোবটটি সেই বিষয়ে আপনাকে তথ্য দিতে চায়।

এমরান টি বিরক্তির চরম সীমায় পৌঁছেছেন, তারপরেও তিনি তাঁর মুখ হাসি-হাসি রাখলেন। সেক্রেটারি মেয়েটার দিকে তাকালেন। এই মেয়েটিকে আর রাখা যাবে না। তাকে অতি দ্রুত বিদায় করে দিতে হবে। সম্ভব হলে আজই।

এই রোবটটি রেফ্‌ সম্পর্কে আমাকে তথ্য দিতে চায়?

জ্বি।

রেফ্‌ সম্পর্কে কোন তথ্য দিতে চাইলে সে দেবে নগর-পুলিশকে, কিংবা মূল কম্পিউটারকে, আমাকে কেন?

সেটা স্যার আমি বলতে পারছি না। তবে আপনি চাইলে জিজ্ঞেস করে দেখতে পারি।

তোমাকে জিজ্ঞেস করতে হবে না। তুমি তাকে বিয়ে হতে বলবে। এবং তার নাম্বার রেখে দেবে। যাতে আমি কঠিন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা করতে পারি।

আপনি তার সঙ্গে দেখা করবেন না?

না।

কিছু মনে করবেন না স্যার। আমার মন বলছে তার সঙ্গে আপনার দেখা করা উচিত।

তুমি তোমার মনকে বিশেষ গুরুত্ব দিও না। তোমার মন এবং বুদ্ধিবৃত্তি তেমন উচ্চ শ্রেণীর না। কিছু মনে করো না। মাঝে মাঝে সত্যি কথাটা জানা প্রয়োজন হয়ে পড়ে।

স্যার আমি জানি আমার বুদ্ধি খুবই কম। আমি জানি আপনি আমাকে যা করতে বলছেন সেটাই আমার করা উচিত। কিন্তু…

কিন্তু কি?

রোবটটা একটা ওমিক্রন গান নিয়ে এসেছে।

ওমিক্রন গান নিয়ে এসেছে মানে। ওমিক্রন গান তুমি চেন?

জ্বি চিনি। রোবটটি আমাকে বলেছে—তুমি এমরান টি নামের বুঢোটাকে আসতে বল। আমার কাছে রেফ্‌ সম্পর্কে তথ্য আছে। আমি তার সঙ্গে তথ্য আদান-প্রদান করব। বুড়ো হয়ত আসতে চাইবে না। তাকে আমার হাতের ওমিক্রন গানটির কথা বলবে। ও সুড়সুড় করে চলে আসবে।

তোমাকে সে এই কথাগুলি বলেছে?

জ্বি।

এমরান টির কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে শুরু করেছে। তার চেনাজগৎ হঠাৎ খানিকটা এলোমেলো লাগতে শুরু করেছে। এই প্রথম তার মনে হল তিনি নিজেকে যতটা বুদ্ধিমান ভাবেন তিনি আসলে ততটা বুদ্ধিমান না। তিনি বেশ বোকা। ভালমত হিসাবনিকাশ করলে হয়ত দেখা যাবে তিনি রেলা নামের মেয়েটার চেয়েও বোকা। কারণ তিনি নিজে সম্পূর্ণ নিজের ইচ্ছায় তাঁর বাড়িটি এমনভাবে বানিয়েছেন যেন বাড়ির সঙ্গে বাইরের কোন যোগাযোগ না থাকে। এখন ইচ্ছা করলেও তিনি নগর-নিরাপত্তা কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারবেন না। তিনি হতাশ ভঙ্গিতে চেয়ার ছেড়ে উঠলেন। সামান্য একটা রোবট ওমিক্রন গান হাতে নিয়ে তাকে ভয় দেখাচ্ছে—এমন একটা অবিশ্বাস্য ঘটনা কিভাবে ঘটছে?

রেলা ক্ষীণস্বরে বলল, স্যার আমি কি বাড়ি থেকে গোপনে বের হয়ে নগরনিরাপত্তা বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করব?

এমরান টি শান্তগলায় বললেন, তোমাকে কিছুই করতে হবে না। তোমার বুদ্ধিবৃত্তি যে পর্যায়ের তাতে তুমি ব্যাপার আরো জট পাকিয়ে ফেলবে।

 

রোবটটি সোফায় বসে আছে। তার শরীর ভেজা। জুতায় কাদা লেগে আছে। রোবটিকস বিদ্যা অনেকদূর অগ্রসর হয়েছে তা এই রোবটটিকে দেখে বোঝা যাচ্ছে। মানুষের সঙ্গে তার কোন রকম প্রভেদ নেই। ঠাণ্ডায় সে যে কেঁপে কেঁপে উঠছে তাও বোঝা যাচ্ছে। ঠোট পর্যন্ত ঠাণ্ডায় নীল হয়ে আছে। রোবটটির কোলে ওমিক্রন গান। এমন ভয়াবহ অস্ত্র নিয়ে প্রকাশ্যে কেউ হাঁটতে পারে?

এমরান টি-কে ঘরে ঢুকতে দেখেও রোবটটি উঠে দাঁড়াল না। সম্মান প্রদর্শনের ভঙ্গি করল না। সে শুধু একটা হাত ওমিক্রন গানের উপর রাখল। এমরান টি বললেন, কি ব্যাপার? খুব সহজভাবেই বলতে চেষ্টা করলেন। বলতে পারলেন না। তাঁর গলা সামান্য কেঁপে গেল।

রোবটটি বলল, ব্যাপার বলছি। আপনি আমার সামনে বসুন।

আমি বসব নাকি দাঁড়িয়ে থাকব তা আমি ঠিক করব। তোমার ব্যাপারটা কি?

আপনাকে আমি বসতে বলছি আপনি বসুন। যতক্ষণ আমার হাতে ওমিক্রন গান থাকবে ততক্ষণ আমার প্রতিটি কথা আপনাকে শুনতে হবে। আপনাকে আমি বসতে বলছি। আপনি বসুন।

এমরান টি বসলেন। তাঁর কপালে সূক্ষ্মভাবে ঘাম জমতে শুরু করেছে।

রেলা নামের যে মেয়েটা আছে। খুব সম্ভব সে আপনার সেক্রেটারি। তাকে বলুন আমাকে আগুন-গরম কফি বানিয়ে দিতে। শীতে আমি জমে যাচ্ছি।

এমরান টি বললেন, রোবটদের শীতবোধ বা ক্ষুধাতৃষ্ণা থাকে বলে আমি জানি না। তারা শীতবোধ এবং ক্ষুধার অনুকরণ করে। আমার এখানে। অনুকরণের প্রয়োজন নেই।

আমি অনুকরণ করছি না। এবং আমি রোবট নই। আমার নাম রে। আমাকেই আপনারা খুঁজছিলেন।

এমরান টি নিজের বিস্ময় গোপন করার চেষ্টা করতে করতে বললেন, আমি কাউকে খুঁজছি না। বিজ্ঞান কাউন্সিলের সভাপতি কাউকে খোঁজে না। নিরাপত্তা কর্মীরা তোমাকে খুঁজতে পারে এটা তাদের ব্যাপার। আমার কোন ব্যাপার না।

আপনি কি জাগতিক সকল কর্মকাণ্ডের ঊর্ধ্বে?

তুমি বোধহয় ভুলে যাচ্ছ আমি বিজ্ঞান কাউন্সিলের সভাপতি।

কিছুক্ষন পরপরই আপনি এই বাক্যটি বলছেন কাজেই আমি ভুলতে পারছি না। তবে আমি আপনাকে উপদেশ দিচ্ছি আপনি ব্যাপারটা ভুলে যান। আপনি বিজ্ঞান কাউন্সিলের সভাপতি, আপনি একজন মহা-শক্তিধর মানুষ এটা ভুলে যান।

ভুলে যাবার প্রয়োজন কি পড়েছে?

হ্যাঁ প্রয়োজন পড়েছে। আমি ওমিক্রন গান হাতে নিয়ে বসে আছি। কিছুক্ষণের মধ্যেই গানটি লক করা হবে।

এমরান টির চোখ-মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেল। তিনি নিজের হৃদপিণ্ডের ধ্বক ধ্বক শব্দ পরিষ্কার শুনতে পেলেন। তার সামান্য বমি ভাবও হল। তিনি স্বপ্নেও ভাবেন নি তাঁকে এ ধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে। ওমিক্রন গান একটি ভয়াবহ অস্ত্র। এই অস্ত্রটি কাজ করে নিঃশব্দে। ট্রিগার টিপলে ভয়ংকর বিস্ফোরণ হয় না। প্রচণ্ড শক্তিশালী লেজার-রশি সবকিছু লণ্ডভণ্ডও করে দেয় না। এই ভয়ংকর মারণাস্ত্র ব্যক্তিবিশেষের দিকে তাক করে লক করে দিতে হয়। যাকে একবার লক করে দেয়া হয় সে পুরোপুরি অস্ত্রের হাতে বাধা পড়ে যায়। অস্ত্রধারী মানুষ তখন শুধুমাত্র ইচ্ছা প্রকাশ করলেই অস্ত্র কার্যকরী করতে পারে। যাকে লক করা হয়েছে তার তৎক্ষণাৎ মৃত্যু। ওমিক্রন গান যিনি লক করেন শুধুমাত্র তিনিই তা মুক্ত করতে পারেন। ওমিক্রন গান ধ্বংস করা যায়। সমস্যা একটাই, ওমিক্রন গান ধ্বংস মানে যাকে লক করা হয়েছে তারও ধ্বংস হয়ে যাওয়া।

এমরান টি নিচু গলায় বললেন, তুমি কি সত্যি-সত্যি আমাকে লক করছ?

রেফ সহজ গলায় বলল, অবশ্যই।

কেন?

কারণ আমি আপনার এখানে কিছুদিন লুকিয়ে থাকব। আপনাকে ওমিক্রন লকারে লক না করলে তা সম্ভব হবে না। এখন আপনি নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যেই আমাকে বাঁচিয়ে রাখবেন। আমার মৃত্যু মানেই আপনার মৃত্যু।

এমরান টি গলা পরিষ্কার করে বললেন, আমাকে লক করার কোন প্রয়োজন নেই। তুমি লুকিয়ে থাকতে চাচ্ছ তোমাকে লুকিয়ে রাখার ব্যবস্থা করা হবে। আমি তোমার বিষয়ে যথেষ্ট আগ্রহ বোধ করছি।

রে বলল, আপনি যদি বুদ্ধিমান মানুষ হতেন তাহলে আমার ব্যাপারে অবশ্যই আগ্রহ বোধ করতেন। সমস্যা হচ্ছে আপনি বুদ্ধিমান না। আপনি বোকা, ভালই বোকা। কাজেই আপনি বোকার মতো ভাবছেন আমাকে কোনমতে ভুলিয়ে-ভালিয়ে রাখা যাবে। গোপনে নিরাপত্তা বিভাগে খবর দিয়ে ফেলবেন। নিরাপত্তা-কর্মীরা এসে আমাকে ধরে নিয়ে যাবে।

এত নিশ্চিত করে তুমি কিভাবে বলছ যে আমি বোকা।

নিশ্চিত করে আমি আপনাকে বোকা বলছি, কারণ আপনার সেক্রেটারি মেয়েটি যে মানুষ না, অসম্ভব বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন নবম পর্যায়ের রোবট আপনি তা বুঝতেই পারেন নি।

বল কি?

রেফ্‌ তার ওমিক্রন গান তাক করল। এমরান টি তার তলপেটে ছোট্ট ধাক্কার মতো খেলেন। তাঁর মুখ শুকিয়ে গেল। তিনি পরিষ্কার বুঝতে পারছেন তাঁকে লক করা হয়েছে। রেফ্‌ ওমিক্রন গান তাঁর দিকে বাড়িয়ে বলল, এখন এর কাজ শেষ। আপনি ওমিক্রন গানটা নিরাপদ জায়গায় তুলে রাখতে পারেন।

এমরান টি বললেন-তুমি নিশ্চিত যে মেয়েটি একটি রোবট।

হ্যাঁ।

বুঝলে কি করে?

বুদ্ধি খাটিয়ে বের করেছি।

ওমেগা পয়েন্ট

আমার এখানে রোবট দিয়ে রেখেছে কেন?

তা তো জানি না। সম্ভবত আপনার উপর খবরদারি করার জন্যে একে রাখা হয়েছে। গুপ্তচর বিভাগের কাজ হতে পারে। এ জাতীয় রোবট কারা ব্যবহার করে সেটা না জানলে বলা যাবে না। আগে সেটা বের করতে হবে। আপনি চাইলে আমি বের করে দেব। এখন আমি কি বলছি মন দিয়ে শুনুন। আপনি নগর-নিরাপত্তা বাহিনীকে বলুন যেন এই মুহূর্তে আপনার বাড়ি পাহারার ব্যবস্থা করা হয়। একদল রোবট বাড়ি ঘিরে রাখবে যেন কোন মাছিও ঢুকতে না পারে।

আমি জীবনে কখনো আমার বাড়ি পাহারার ব্যবস্থা করি নি? আজ হঠাৎ কেন করব।

আমি করতে বলছি তাই করবেন। আরো একটি যুক্তি আছে। আপনাকে না জানিয়ে মানুষ পরিচয়ে আপনার বাড়িতে এরা একটি নবম শ্রেণীর রোবট রেখে দিয়েছে। কাজেই ধরে নেয়া যেতে পারে আপনাকে নিয়ে ভয়াবহ কিছু সমস্যা আছে। নিরাপত্তা আপনি অবশ্যই চাইতে পারেন।

আচ্ছা।

শেফ নামের অষ্টম পর্যায়ের একটি রোবট আমাকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করেছে। আপনি তাকে এ বাড়িতে আনার ব্যবস্থা করুন। বললেই হবে আপনি জিজ্ঞাসাবাদ করতে চান।

আচ্ছা করছি।

আমার জন্যে গরম কফির ব্যবস্থা করতে বলুন।

এমরান টি রেলাকে কফি আনতে বললেন। মেয়েটি সঙ্গে সঙ্গে কফি নিয়ে এল। সে ভয়ে চোখ তুলে তাকাতে পর্যন্ত পারছে না। একবার এমরান টির দিকে। তাকাচ্ছে আর একবার রেফ-এর দিকে তাকাচ্ছে।

এমরান টি বললেন, রেলা তুমি কি মানবিক আবেগসম্পন্ন নবম পর্যায়ের রোবট।

রেলা স্বাভাবিক গলায় বলল, হ্যাঁ।

তোমাকে আমার এখানে কে দিয়ে গেছে।

গুপ্তচর বিভাগের প্রধান।

কি জন্যে তোমাকে এখানে রাখা হয়েছে।

আমি জানি না কি জন্যে রাখা হয়েছে। আমাকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে যেন আমি যতদূর সম্ভব অল্পবুদ্ধির মানুষদের মতো আচরণ করি। কারণ আপনি আপনার আশেপাশে বুদ্ধিমান মানুষ পছন্দ করেন না।

এই জন্যে বোকা সেজে ছিলে?

জ্বি।

তুমি কি গুপ্তচর বিভাগের সঙ্গে খবর আদান-প্রদান করতে।

জ্বি না। আমাকে সেরকম নির্দেশ দেয়া হয় নি। আমাকে শুধু বলা হয়েছে আপনার উপর লক্ষ রাখতে। আমি তাই করেছি।

তুমি কি ইচ্ছা করলে এই মুহূর্তে গুপ্তচর বাহিনীর প্রধানের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারবে?

পারব। আমার মধ্যে ব্যবস্থা করা আছে, এখান থেকে যে-কোন মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারব।

রে যখন প্রথম এ বাড়িতে ঢুল। তার হাতে ওমিক্রন গান। তুমি কেন তৎক্ষণাৎ নিরাপত্তা বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগ করলে না।

যোগাযোগ করলে আমার পরিচয় প্রকাশ হয়ে যেত। আপনার কাছে পরিচয় গোপন রাখতে আমাকে বলা হয়েছে।

খুব ভাল কথা। এখন তুমি গুপ্তচর বাহিনীর প্রধানের সঙ্গে আমার যোগাযোগ করিয়ে দাও। ওর নাম কি নেসরা?

স্যার, আমাকে অল্প কিছু সময় দিন।

তোমাকে সময় দেয়া হল। এই ফঁাকে তুমি রেফ্‌ ছেলেটির জন্যে শুকনো কাপড়ের ব্যবস্থা কর। ও কোন্ ঘরে থাকবে সেই ঘরটা দেখিয়ে দাও। ও নিশ্চয়ই ক্ষুধার্ত তার খাবারের ব্যবস্থা কর।

এক্ষুণি সব ব্যবস্থা করছি।

রে কফির কাপে চুমুক দিচ্ছে। তাকে সামান্য অস্থির মনে হচ্ছে। কথাবার্তা কি হচ্ছে সে খুব যে মনোযোগ দিয়ে শুনছে তা না।

রেলা এমরান টির দিকে তাকিয়ে বলল, স্যার গুপ্তচর বিভাগের প্রধানের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে। আপনি কথা বলুন।

চেয়ারে বসে কথা বললেই সে শুনবে?

জ্বি স্যার। উনি শব্দ শুনবেন। কোন ছবি দেখবেন না।

ছবি পাঠাবার ব্যবস্থাও কি আছে?

জ্বি আছে। স্যার আমি বোতাম টিপে দিচ্ছি আপনি কথা বলুন।

এমরান টি হাসি-হাসি মুখে বললেন, হ্যালো আমি কার সঙ্গে কথা বলছি?

স্যার আমি নেসরা, গুপ্তচর বিভাগের প্রধান।

শুভ সন্ধ্যা নেসরা।

জ্বি স্যার শুভ সন্ধ্যা।

খুব শুভ কিন্তু না। বাইরে ঝড়-বৃষ্টি হচ্ছে।

আমি যে তোমার সঙ্গে কথা বলছি এতে তুমি কি আশ্চর্য হচ্ছ না। আমার বাসা থেকে বাইরের জগতের সঙ্গে কখনোই কোন যোগাযোগ করা যাবে না এমন বলা হয়েছিল। আমার ধারণা ছিল সেই ব্যবস্থা আছে। এখন দেখছি তা না। আমার বাড়িতে নবম পর্যায়ের একটি রোবট বাস করছে। দিনের-পর-দিন বোকা মানুষের নিখুঁত অভিনয় করে যাচ্ছে।

খুব নিখুঁত অভিনয় করতে পারে নি। করতে পারলে আপনি ধরতে পারতেন না।

তা ঠিক। অভিনয় খুব নিখুঁত হয় নি।

এখন তুমি কি দয়া করে একটু ব্যাখ্যা করবে কোন স্পৰ্ধায় গুপ্তচর বিভাগ এমন একটা কাজ করে। আমি বিজ্ঞান কাউন্সিলের বিশেষ জরুরি অধিবেশন ডাকার ব্যবস্থা করছি।

স্যার এখানে আপনি ছোট্ট একটা ভুল করেছেন। এমন ভয়ংকর অন্যায়। একটা কাজ গুপ্তচর বিভাগ এককভাবে কখনোই করবে না। তোমাদের সঙ্গে আর কে কে আছে জানতে পারি?

আমরা এই কাজটি অনিচ্ছার সঙ্গে করেছি। বিজ্ঞান কাউন্সিলের বিশেষ অনুরোধে।

নেসরা তুমি খুবই বিস্ময়কর একটা কথা বলছ।

স্যার আমি সহজ সত্য কথা বলছি। বিজ্ঞান কাউন্সিল কেন এ ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে আমি কি তাদের হয়ে ব্যাখ্যা করব, নাকি আপনি সরাসরি তাদের কাছ থেকেই শুনবেন?

তোমার ব্যাখ্যা আগে শুনি।

পদার্থবিদ্যার যুগান্তকারী কিছু আবিষ্কার আপনি করেছেন। বলা হয়ে থাকে আপনার মতো প্রতিভাবান পদার্থবিদ অতীতে জন্মান নি। আপনি অল্প কিছুদিন মাত্র কাজ করেছেন তারপর হঠাৎ সবকিছু থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছেন।

তাতে সমস্যা কি?

বিজ্ঞানের ভয়াবহ ক্ষতি হচ্ছে এটাই সমস্যা। বিজ্ঞান কাউন্সিল এটা নিয়েই চিন্তিত। তারা ধারণা করছে—আপনি চুপচাপ ঘরে বসে থাকেন এটা ঠিক না। আপনি নিশ্চয় কিছু-না-কিছু করছেন। সেই কিছুটা যেন হারিয়ে না যায় সেজন্যেই নবম পর্যায়ের একটি রোবট রাখা হয়েছে। সে সব কিছু তার মেমোরি। সেলে ঢুকিয়ে রাখবে।

তোমার অবগতির জন্যে জানাচ্ছি আমি ছড়া লেখা ছাড়া কিছুই করছি না। আগে বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করতাম এখন তাও করি না।

স্যার আমি কি জানতে পারি কেন করেন না?

না জানতে পার না।

আপনি যদি বলেন তাহলে নবম পর্যায়ের রোবটটা আমরা উঠিয়ে নিয়ে যাব।

তার প্রয়োজন নেই। তোমরা কি রেকে খুঁজে পেয়েছ?

এখনো পাই নি।

সামান্য একজন মানুষকে তোমরা খুঁজে পাচ্ছ না। ব্যাপারটা কি বিস্ময়কর না?

হ্যাঁ বিস্ময়কর।

শেফ্‌ নামের যে রোবটটি তাকে দেখাশোনা করত আমি তার সঙ্গে কথা বলতে চাই। তাকে আমার বাড়িতে পাঠাবার ব্যবস্থা কর।

তাকে সেলে বন্দি রাখা হয়েছে। সেখান থেকে তাকে মুক্ত করে আনতে হলে আপনার লিখিত অর্ডার লাগবে।

তুমি কাউকে পাঠাও আমি লিখিত অর্ডার দিয়ে দিচ্ছি। আরেকটি কথা, আমার বাড়ির চারপাশে কঠিন পাহারার ব্যবস্থা কর। যেন একটা মাছিও ঢুকতে না পারে।

স্যার ব্যবস্থা করছি।

 

রেফ্‌ লাইব্রেরি-ঘরে শুয়ে আছে। ঠাণ্ডায় তার শরীর কাঁপছে। জ্বর এসে যাচ্ছে। ঘরের বাতি নেভানো। কে যেন ঘরের ভেতর এসে দাঁড়িয়েছে। রেফ্‌ চোখ মেলে দেখে–শেফ্‌।

শেফ কোমল গলায় বলল, তুমি কেমন আছ।