ছিন্নভিন্ন হতে থাকি কাস্তের আঘাতে

আকাশের গায়ে গোধূলির জাফরানি ওড়না সেঁটে রয়েছে। চওড়া
গলি আর আধ-পুরনো বাড়িগুলো ওপারে ট্রাফিকের ঝিমিয়ে
পড়া গর্জন। অগোছালো কিছু বই আর কাগজপত্রের মধ্যে প্রায়
গা ঢাকা-দেওয়া টেলিফোন সেটা পরিচিত সুরে বেজে ওঠে টেবিলের
ওপর। চেয়ারে বসে আকাশ পাতাল ভাবছিল সে, উড়ে যাচ্ছিল গোধূলি
মেঘের ভেতর, কখনও পৌঁছে যাচ্ছিল মানস সরোবরে অথবা
এলদেরাদোয়। টেলিফোনের আওয়াজ তাকে ফিরিয়ে আনে নিজের
ঘরের টেবিলের ধারে। হাত বাড়িয়ে রিসিভার তুলে নিয়ে নিজস্ব কণ্ঠের
জানান দেয়। ওপার থেকে মধুর কিন্তু চমকিত কণ্ঠস্বরের প্রশ্ন, ‘কে
আপনি? আপনাকে তো চিনতে পারছি না। অনেকগুলো অগোছালো বই
আর কাগজপত্রের মধ্যে বসবাসকারী লোকটি নিজের স্বরভঙ্গের কথা বলে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই তার কথায় ভাসমান মেঘমালা আর সব পেয়েছির
দেশের স্পর্শ এবং ঘ্রাণ পেয়ে চিনতে আর বিন্দুমাত্র অসুবিধা হলো না
লোকটি কে। সেই তো তার চিরচেনা মনের মানুষ। অন্যান্য দিন
লোকটি বেশিরভাগ সময় নীরবতার স্তব্ধ দিঘিতে ডুবসাঁতার দেয়। অথচ
আজ সে কেমন বাঙ্ময় হয়ে উঠেছে। মধূরভাষিণীর আকুল মিনতি
যাতে সে বেশি কথা না বলে, কারণ তার কণ্ঠস্বরের ক্ষতি হবে। অথচ
লোকটা স্বল্পবাক বলে এতদিন কত অনুযোগই না করা হয়েছে। মৌন
দিয়ে সে অনুযোগগুলোকে আদর করে।

কয়েকটি ঘোড়া, শাদা, বাদামি, কালো, ওর চারদিকে চক্রাকারে
ঘোরে। কখনও কখনও এত কাছে এসে ওরা, ওদের নিঃশ্বাসের
তাপ এবং গন্ধ সে টের পায়। ঘোড়াগুলোর চোখে ভাঙা প্রাসাদ, উজাড়
বাগানে এবং দালানের গায়ে দাপটে গড়িয়ে ওঠা আগাছার নাচ, জলসা
ঘরে প্রায় অস্তমিত আভিজাত্যের মাতলামি, ওস্তাদের ঠুমরি, সারেঙ্গিত
সুর, নর্তকীর নূপুর ধ্বনি। একটি বাদামি ঘোড়ার কেশরে হাত বুলোতে
ভারি ইচ্ছে হলো তার। ঘোড়ার তরঙ্গিত কেশরের দিকে হাত বাড়াতেই
সেই সুন্দর প্রাণী হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। তবে কি সে স্বপ্ন দেখছিল? এই
মুহূর্তে সেই খোওয়াব মুছে গ্যাছে একেবারে? কিন্তু ঘোড়াদের সতেজ
নিঃশ্বাস এখনও তার মুখে লেগে আছে যেন। স্বপ্ন আর বাস্তবের মধ্যে
কতটুকু ফারাক, নিজেকে প্রশ্ন করে সে। এই যে আমি ঘোড়াগুলোর
চোখের ভেররে ছবিগুলো দেখলাম একটু আগে, সেগুলো কি
আগাগোড়াই অলীক, এই জিজ্ঞাসা তার কাছে হাজির হয় কাঠঠোকরা
রূপে। মাঝে মাঝে স্বপ্ন আর বাস্তবের অপরূপ রাসায়নিক মিশ্রণ মন্দ
কী?

অনেকক্ষণ হাঁটছে সে। পথের দু’ধারে সারি সারি দীর্ঘ গাছ।
ছায়ায় ছায়ায় পথ চলতে ভালো লাগে। কোথাও কোনও জনমনিষের দেখা নেই।
কখনও কখনও একটি কি দু’টি পাখি ডেকে ওঠে, পাখির ডাক
চারদিকের নীরবতাকে অধিক গাঢ় করে তোলে। এইমাত্র একটা
শিঙঅলা হরিণ ছুটে গেল তার পাশ ঘেঁষে। ঈষৎ ভড়কে গিয়ে নিজেকে
সামলে নেয় সে। অনেকটা পথ হেঁটে এসেছে, অথচ কোথাও কোনও
ঘরবাড়ি নেই। অনেকক্ষণ ধরে একটা পোস্ট অফিস খুঁজছে সে, চোখে পড়ে
নি। একটা জরুরি চিঠি পাঠাবার প্রয়োজন তাকে তাগিদ দিয়ে চলেছে
ক্রমাগত। নিরুপায় লোকটা এদিক ওদিক তাকায় গোয়েন্দায় মতো।
কিন্তু কোথাও একটা ডাকঘর নেই। ডাকঘরের কাউন্টারে দাঁড়িয়ে সে
জরুরি চিঠিটা লিখবে। কী লিখবে তা সে জানে না। তবে এটুকু জানে
চিঠিটা একান্ত জরুরি এবং ত্বরিত প্রেরিতব্য। আরও কিছুদূর হাঁটার পর
একটা গোল দিঘি দেখতে পায় পথচারী। ক্লান্তি হরণের জন্যে দিঘির
পাড়ে বসে সে, তাকায় দূরের পাটল আসমানের দিকে। দিঘিতে
সাবলীল ফুটে আছে কয়েকটি নীল পদ্ম। পথচারী নীল পদ্ম এর আগে
কখনও দ্যাখোনি। আমাদের চারপাশে সুন্দর প্রকাশিত হয়ে আছে কত
রূপে, আমরা অন্যমনস্কতা আর হেলায় লক্ষ্যই করি না, ভাবে সেই
একলা পথচারী। জরুরি চিঠির কথা আবার তার মনে পড়ে মেঘের বুকে
নিদ্যুল্লতার মতো। অথচ চিঠিতে কী লিখবে আর কাকেই বা পাঠাবে,
সবার তার অজানা। আর এখানে কোথাও কোনো ডাকঘর নেই।
আমার ঘাড়ে তো থাবা প্রচণ্ড বসিয়ে দিয়েছিল, সে ভাবে, ক’জন
দুর্জন। শরীর থেকে মাংসখণ্ডগুলো খসে ঠাঁই নিত ওদের নখাগ্রে আর
সবাই দশদিকের লোকজন ধিক্কারে আর ঘেন্নায় আমার বিকৃত রূপে থুতু
ছিটিয়ে যে যার ঘরে পৌঁছে রটাত কত কেচ্ছা, ভেবে সে কুঁকড়ে যায়
ভেতরে ভেতরে। সেই মুধুরভাষিণী ভালোবাসার ঐশ্বর্যে শ্বাপদের
হিংস্রতাকে স্তব্ধতায় পরিণত করেছে এবং আমি আমার ভেতরে
অন্ধকারের পরিবর্তে অঢেল জ্যোৎস্না দেখতে পেলাম, সে নিজেকে
আশ্বস্ত করে দূর দিগন্তের দিকে দৃষ্টি ছড়িয়ে। তার দু’চোখে কৃতজ্ঞতার
শিশির। ভালোবাসা এমন মহিমাময়, ওর জানা ছিল না। এ খবর কাউকে
পৌঁছে দেওয়ার মতো কোনও ডাকঘর কোথাও নেই। এখনও মাঝে
মাঝে তার বুকের বোবা চিৎকার।
ইথারে ভেসে আসে শুনি, আমার হৃদয়ে না কি গ্রহণ লেগেছে, জং
ধরেছে অনুভূতিমালায়। ইথারে বাহিত ধ্বনি কেন যে আমাকে টেনে
নিয়ে যায় অনুশোচনার গুহায় আর আমি বিলাপ করি অনবরত,
কিছুতেই বুঝতে পারি না। আমি তো স্যাটার্নের মতো স্বর্গের অধিকার
নিয়ে লড়িনি অলিম্পিয়ানদের বিরুদ্ধে কিংবা প্যারিসের মতো হরণ
করিনি কোনও সুন্দরীতমা হেলেনকে, তবে কেন আমাকে বিলাপ করতে
হবে অন্ধ গুহায়, কেন আমার এই অরণ্যে রোদন? কেন বিপুল ধ্বংসে
এই অতন? দূরের আকাশে ঐ যে নিভৃত গোধূলি রঙ, সে কি আমার
ব্যর্থতার স্মৃতি? কখনও কখনও মনে হয়, আমার মাথার ভেতর অজস্র
মোমাছির পীড়ন, কতগুলো ছেঁড়া কাগজের কাদাজলে হুটোপুটি, কাটা
ঘুড়ির ঝাপ্টা, বুনো শূয়োরের দাপাদাপি, একজন পঙ্গুর ক্রাচের খটখট
শব্দ, হারিয়ে যাওয়া পথের বিভ্রম, চকচকে মরীচিকা। বয়সের কোপে
ছিন্নভিন্ন হতে থাকি যেমন কাস্তের আঘাতে লতাপাতা। তবু ভালোবাসার
জমি বেদখল হতে দিইনি; ঘোর অমাবস্যায় মাঝে মাঝে হারিয়ে
ফেলার ভাবনা আমার অস্তিত্বের আনন্দ ও বেদনায় সূর্যাস্ত টেনে আনে।
মৃত্যু তার সারা শরীর আর মুখ খরখরে কালো চাদরে মুড়ে খুব কাছে
থেকে আমাকে শাসায়। চুলোয় যাক মৃত্যুর চাদর। এখন এই মুহূর্তে
সামনে এসে দাঁড়াক আমার প্রিয়তমা, আমি তার বুকে চন্দ্রোদয় আর
দু’চোখে বসন্তোৎসব দেখব। এই পর্যন্ত লিখে সে ঘুমিয়ে পড়ে বিছানায়।
ভোরবেলা ঘুমভাঙা চোখে দ্যাখে কাগজ থেকে বাক্যগুলো কে যেন
মুছে ফেলেছে। শাদা কাগজে শুধু ভোরের আলোর কৌতুকময় হাসি।