অনন্তের গোধূলি রঙিন পথে

চৈত্রসংক্রান্তির রাতে ডাগর চাঁদের ছলছলে চোখে
তাকিয়ে নদের চাঁদ মহুয়ার কথা ভাবে। তাকে কি কখনও
ফিরে পাবে আর? দূরে কালো গাছ গৌতম বুদ্ধের
ধরনে গভীর ধ্যানী। সে-ও কি হারিয়ে-যাওয়া কোনও
বৃক্ষললনার ভাবনায় মগ্ন? কাল
পুরনোর জাল ছিঁড়ে নতুন তুলবে তার অনাবিল মুখ,
যেন সূর্যোদয়; লতাপাতা, ঘাস, পাখি, পুরনো হ্রদের জল,
ফুলদল, সর্বোপরি মানবেরা স্বাগত জানাবে
তাকে কাল। মৃৎশিল্পী রঙিন পুতুল,
গরু, হাতি, ঘোড়া, হাঁড়ি, গাড়ি, নৌকা বানিয়ে সাজাবে
যখন মাটির ঘরে, মেলার বাজনা বেজে উঠবে
যথারীতি; মেলায় পাবে কি দেখা নন্দিত মুহূর্তে মহুয়ার?

নীলাভ জীনস্‌-পরা যুবা ধোঁয়া ছাড়ে, সিগারেট
পোড়ে ঘনঘন, চোখ নাচে
বিজ্ঞাপনে, কণ্ঠে বাজে র্যাঁপ-সুর; খোঁজে
সোনিয়াকে নিদিষ্ট পথের মোড়ে, সোনিয়া ডার্লিং
তার, দেখা হচ্ছে না ক’দিন। সেই হেতু
মন কি খারাপ খুব? না, মোটেও মনে
জমে না বিষণ্ন মেঘ। সোনিয়াই একমাত্র মেয়ে নয়
জগৎসংসারে;
জোরে শিস দিলে কিংবা মদির তাকালে কিছুক্ষণ,
জুটে যাবে কেউ কেউ সালোয়ার কামিজ অথবা
সিল্কের শাড়িতে ঢেউ তুলে।

সেই যুবা দ্যাখে শানবাঁধানো সড়কে আনাড়ির
মতো হাঁটে সরল নদের চাঁদ, যেন সে হোঁচট খেতে খেতে
গড়াবে রাস্তায় মুখে বিস্তর গাঁজলা তুলে, দু’চোখে দেখবে
তারাদের ফুলঝুরি দিনদুপুরেই।

উৎসবের রঙে মেতে-ওঠা শহরের ঝকমকে
প্রোফাইল দেখে, সেই যুবা ভাবে, এই যে নদের চাঁদ
নামের লোকটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেঁয়ো মহুয়ার
তালাশে ঠোকর খাচ্ছে ক্রমাগত, ওর দিকে টাকাকড়ি ছুঁড়ে
দেখেছি সে হেলায় কিছু না নিয়ে দূরে
সরে গ্যাছে। কেমন আশ্চর্য চোখ তার,
যেখানে হরিণ, সরোবর, কবুতর, উপবন এবং ডাগর চাঁদ
ভেসে ওঠে বারবার। ভিখারি সে নয় কোনওমতে,
বরং প্রেমের অনশ্বর যুবরাজ,-
এই সত্য নীলাভ জীনস্‌-পরা যুবা ঠিক বুঝতে পারেনি।

দুই,

একটি নাছোড় গিরগিটি
আমার স্মৃতিকে চেটে খাচ্ছে অবিরত
একটু একটু করে। তাই ভুলে যেতে থাকি চৈত্রসংক্রান্তির
সেই ঘুড়ি-ওড়ানো বিকেল, মেঘে মেঘে রঙবেরঙের
নানা ছবি দেখা ছাদে বসে। কীরকম ছিল সেই সব ছবি?
কার হাত সিঁড়ির আঁধারে জ্বলে উঠেছিল চাঁদিনীর মতো,
আজ আর মনেই পড়ে না। সেই হাত
আমার ক্ষণিক স্পর্শে কেঁপেছিল কি না, কিংবা
আদৌ তাকে ছুঁয়েছিলাম কি-এর সদত্তর জানে
স্মরণ হরণকারী গিরগিটি। মনে হয়, বহু বঙ্গাব্দের
ছায়ারা সস্নেহে তাকে আড়ালে রেখেছে, শুধু তার
কিছু উজ্জ্বলতা ঝিকমিক করে জোনাকির মতো

চোখে নববর্ষের ঝলক, আগামীর মৃগতৃষা
নিয়ে আছি আজও, দেখি মুণ্ডহীন ধড়গুলো নাচে
বৈশাখের গন্ধে বর্ণে, তাদের ফ্যাকাসে আঙুলের
ডগায় কাঁপছে ভবিষ্যের জন্যে কাতরতা আর
আমার টেবিলে রাখা পানপাত্র, কিন্তু ওরা চক্ষুহারা ব’লে
বাড়াতে পারে না হাত অনন্তর খর ধুলিঝড়ে
মিশে যায়। কারা ওরা, ভেবে সারা হাই; অকস্মাৎ দেখা পাই
নদের চাঁদের, মহুয়াকে পায়নি সে খুঁজে বলে
চৈত্রসংক্রান্তির রাতে-দেখা ডাগর চাঁদের স্মৃতি
পীড়ন করছে তাকে অতিশয়। নদের চাঁদের মুখচ্ছদে
নিজের মুখে কিছু ধূসর আদল দেখে চমকিতে হই
এবং বৈশাখী হাওয়া গীতবিতানের পাতাগুলো
সাদরে ওল্টাতে থাকে, দেবব্রত বিশ্বাসের গানে
শূন্য ঘর পূর্ণ হয়, গাছে গাছে লাগে দোলা, নীলিমাকে ছোঁয়
সুরধারা; অনন্তের গোধূলিরঙিন পথে এক
ডাক-হরকরা সুরে সুর মেলাতে মেলাতে যায়,
পায়ে পায়ে তার রেণু ওড়ে, সম্মুখে লুটিয়ে পড়ে
অগণিত প্রজাপতি, বিরল কুসুম, পক্ষিকুল। যতদূর
জানি, ডাক-হরকরা অবরে-সবরে আসে, কাধে ব্যাগ নেই,
বহন করে না ডাক কোনওদিন, হাতে তার স্পন্দমান অলীক দোতারা!