সঙ্গিনী

সঙ্গিনী

মিসির আলি বললেন, ‘গল্প শুনবেন নাকি?’

আমি ঘড়ির দিকে তাকালাম। রাত মন্দ হয় নি। দশটার মতো বাজে। বাসায় ফেরা দরকার। আকাশের অবস্থাও ভালো না। গুড়গুড় করে মেঘ ডাকছে। আষাঢ় মাস। যে-কোনো সময় বৃষ্টি নামতে পারে।

আমি বললাম, ‘ আজ থাক, আরেক দিন শুনব। রাত অনেক হয়েছে। বাসায় চিন্তা করবে।‘

মিসির আলি হেসে ফেললেন।

আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, ‘হাসছেন কেন?’

মিসির আলি হাসতে-হাসতেই বললেন, ‘বাসায় কে চিন্তা করবে? আপনার স্ত্রী কি বাসায় আছেন? আমার তো ধারণা তিনি রাগ করে বাচ্চাদের নিয়ে বাবার বাড়িতে চলে গেছেন।’

মিসির আলির পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা এবং সামান্য সূত্র ধরে সিদ্ধান্তে চলে যাবার প্রায় অলৌকিক ক্ষমতার সঙ্গে আমি পরিচিত। তবুও বিস্মিত হলাম। আমার স্ত্রীর সঙ্গে আজ দুপুরেই বড় ধরনের ঝগড়া হয়েছে। সন্ধ্যাবেলায় সে স্যুটকেস গুছিয়ে বাবার বাড়ি চলে গেছে। একা-একা খালি বাড়িতে থাকতে অসহ্য বোধ হচ্ছিল বলে মিসির আলির কাছে এসেছি, তবে এই ঘটনার কিছুই বলি নি। আগ বাড়িয়ে পারিবারিক ঝগড়ার কথা বলে বেড়ানোর কোনো মানে হয় না।

আমি সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললাম, ‘ঝগড়া হয়েছে বুঝলেন কী করে?’অনুমানে বলছি।’

‘অনুমানটাই-বা কী করে করলেন?’

‘আমি লক্ষ করলাম, আপনি আমার কাছে কোনো কাজে আসেন নি। সময় কাটাতে এসেছেন। গল্প করছেন এবং আমার গল্প শুনছেন। কোনো কিছুতেই তেমন আনন্দ পাচ্ছেন না। অর্থাৎ কোনো কারণে মন বিক্ষিপ্ত। আমি বললাম, ভাবি কেমন আছেন? আপনি বললেন, ভালো। কিন্তু বলার সময় আপনার মুখ কঠিন হয়ে গেল। অর্থাৎ ভাবির সঙ্গে ঝগড়া হয়েছে। আমি তখন নিশ্চিত হবার জন্যে বললাম, আমার সঙ্গে চারটা ভাত খান। আপনি রাজি হয়ে গেলেন। আমি ধরে নিলাম—রাগারাগি হয়েছে এবং আপনার স্ত্রী বাসায় নেই। আপনার একা-একা লাগছে বলেই আপনি এসেছেন আমার কাছে। এই সিদ্ধান্তে আসার জন্যে শার্লক হোমস হতে হয় না। একটু ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করলেই বোঝা যায়।’

আমি কিছু বললাম না। মিসির আলি বললেন, ‘চা চড়াচ্ছি। চা খেয়ে গল্প শুনুন, তারপর এইখানেই শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ুন। খালি বাসায় একা-একা রাত কাটাতে ভালো লাগবে না। তা ছাড়া বৃষ্টি নামল বলে।’

‘এটাও কি আপনার লজিক্যাল ডিডাকশান?’

‘না—এটা হচ্ছে উইশফুল থিংকিং। গরমে কষ্ট পাচ্ছি—বৃষ্টি হলে জীবন বাঁচে। তবে বাতাস ভারি, বৃষ্টির দেরি নেই বলে আমার ধারণা।‘

‘বাতাসের আবার হাল্কা ভারি কী?’

‘আছে। হাল্কা-ভারির ব্যাপার আছে। বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ যখন বেড়ে যায় বাতাস হয় ভারি। সেটা আমি বুঝতে পারি মাথায় চুলে হাত দিয়ে। জলীয় বাষ্পের পরিমাণের ওপর নির্ভর করে মাথার চুল নরম বা শক্ত হয়। শীতকালে মাথার চুলে হাত দিয়ে দেখবেন একরকম, আবার গরমকালে যখন বাতাসে হিউমিডিটি অনেক বেশি, তখন অন্যরকম।

‘আমার কাছে তো সবসময় একরকম লাগে।’

মিসির আলি ঘর ফাটিয়ে হাসতে লাগলেন। ভাবটা এ-রকম, যেন এর চেয়ে মজার কথা আগে শোনেন নি। আমি বোকার মতো বসে রইলাম। অস্বস্তিও লাগতে লাগল। খুব বুদ্ধিমান মানুষের সঙ্গে গল্প করার মধ্যেও একধরনের অস্বস্তি থাকে। নিজেকে খুব তুচ্ছ মনে হয়।

মিসির আলি স্টোভে চায়ের পানি বসিয়ে দিলেন। শোঁ-শোঁ শব্দ হতে লাগল। এই যুগে স্টোভ প্ৰায় চোখেই পড়ে না। মিসির আলি এই বস্তু কোত্থেকে জোগাড় করেছেন কে জানে! কিছুক্ষণ পরপর পাম্প করতে হয়। অনেক যন্ত্রণা।

চায়ের কাপ হাতে বিছানায় এসে বসামাত্র বৃষ্টি শুরু হল। তুমুল বর্ষণ। মিসির আলি বললেন, ‘আমার বেহেশতে যেতে ইচ্ছা করে না কেন জানেন?’

‘জানি না।’

‘বেহেশতে যেতে ইচ্ছা করে না—কারণ সেখানে ঝড়-বৃষ্টি নেই। এয়ারকুলার বসানো একটা ঘরের মতো সেখানকার আবহাওয়া। তাপ বাড়বেও না, কমবেও না। অনন্ত কাল একই থাকবে। কোনো মানে হয়?

‘আপনি কি বেহেশত-দোজখ এইসব নিয়ে মাথা ঘামান?’

‘না, ঘামাই না।’

‘সৃষ্টিকর্তা নিয়ে মাথা ঘামান?’

‘হ্যাঁ, ঘামাই। খুব চিন্তা করি, কোনো কূল-কিনারা পাই না। পৃথিবীর সমস্ত ধর্মগ্রন্থ কী বলে, জানেন? বলে—সৃষ্টিকর্তা বা ঈশ্বর পারেন না এমন কিছুই নেই। তিনি সব পারেন। অথচ আমার ধারণা তিনি দুটো জিনিস পারেন না, যা মানুষ পারে।’

আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘উদাহরণ দিন।’

‘সৃষ্টিকর্তা নিজেকে ধ্বংস করতে পারেন না—মানুষ পারে। আবার সৃষ্টিকর্তা দ্বিতীয় একজন সৃষ্টিকর্তা তৈরি করতে পারেন না। মানুষ কিন্তু পারে, সে সন্তানের জন্ম দেয়।’

‘আপনি তাহলে একজন নাস্তিক?’

‘না, আমি নাস্তিক না। আমি খুবই আস্তিক। আমি এমন সব রহস্যময় ঘটনা আমার চারপাশে ঘটতে দেখেছি যে বাধ্য হয়ে আমাকে আস্তিক হতে হয়েছে। ব্যাখ্যাতীত সব ঘটনা। যেমন স্বপ্নের কথাটাই ধরুন। সামান্য স্বপ্ন, অথচ ব্যাখ্যাতীত একটা ঘটনা।’

‘ব্যাখ্যাতীত হবে কেন? ফ্রয়েড তো চমৎকার ব্যাখ্যা করেছেন বলে শুনেছি।’

‘মোটেই চমৎকার ব্যাখ্যা করেন নি। স্বপ্নের পুরো ব্যাপারটাই তিনি অবদমিত কামনার ওপর চাপিয়ে দিয়ে লিখলেন—Interpretations of dream; তিনি শুধু বিশেষ একধরনের স্বপ্নই ব্যাখ্যা করলেন। অন্য দিক সম্পর্কে চুপ করে রইলেন। যদিও তিনি খুব ভালো করে জানতেন মানুষের বেশ কিছু স্বপ্ন আছে, যা ব্যাখ্যা করা যায় না। তিনি এই নিয়ে প্রচুর কাজও করেছেন, কিন্তু প্রকাশ করেন নি। নষ্ট করে ফেলেছেন। তাঁর ছাত্র প্রফেসর ইয়ুং কিছু কাজ করেছেন—মূল সমস্যায় পৌছতে পারেন নি, বলতে বাধ্য হয়েছেন যে, কিছু কিছু স্বপ্ন মানুষ কেন দেখে তা বলা যাচ্ছে না। যেমন-একটা লোক স্বপ্ন দেখল, হঠাৎ মাথার উপর সিলিং ফ্যানটা খুলে পড়ে গেল। স্বপ্ন দেখার দু’ দিন পর দেখা গেল সত্যি-সত্যি সিলিং ফ্যান খুলে পড়ে গেছে। এই ধরনের স্বপ্নকে বলে প্রিকগনিশন ড্রীম (Precognition dream)। এর একটিই ব্যাখ্যা— স্বপ্নে মানুষ ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছে-যা সম্ভব নয়। কাজেই এ-জাতীয় স্বপ্ন ব্যাখ্যাতীত।’

আমি বললাম, ‘এমনো তো হতে পারে যে, কাকতালীয়ভাবে মিলে গেছে।’

‘হতে পারে। প্রচুর কাকতালীয় ব্যাপার পৃথিবীতে ঘটছে। তবে কাকতালীয় ব্যাপারগুলিকেও একটা স্ট্যাটিসটিক্যাল প্রবাবিলিটির ভেতর থাকতে হবে। Precognition dream-এর ক্ষেত্রে তা থাকে না।’

‘বুঝতে পারছি না।’

‘বোঝানো একটু কঠিন। আমি বরং স্বপ্ন সম্পর্কে একটা গল্প বলি—শুনতে চান?’

‘বলুন শুনি-ভৌতিক কিছু?

‘না—ভৌতিক না—তবে রহস্যময় তো বটেই। আরেক দফা চা হয়ে যাক।’

‘হোক।’

‘কী ঠিক করলেন? থেকে যাবেন? বৃষ্টি বাড়ছে।’

আমি থেকে যাওয়াই ঠিক করলাম। মিসির আলি চা নিয়ে বিছানায় পা তুলে বসলেন। গল্প শুরু হল।

ছোটবেলায় আমাদের বাসায় ‘খাবনামা’ নামে একটা স্বপ্নতত্ত্বের বই ছিল। কোন স্বপ্ন দেখলে কী হয় সব ঐ বইয়ে লেখা। আমার মা ছিলেন বইটার বিশেষ ভক্ত। ঘুম থেকে উঠেই বলতেন, ‘ও মিসির, বইটা একটু দেখ তো। একটা স্বপ্ন দেখলাম। স্বপ্নের মানে কি বল।’

আমি বই নিয়ে বসতাম।

‘দেখ তো বাবা, গরু স্বপ্ন দেখলে কী হয়।’

আমি বই উল্টে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী রঙের গরু মা? সাদা না কালো?’

‘এই তো মুশকিলে ফেললি, সাদা না কালো খেয়াল নেই।‘

‘সাদা রঙের গরু হলে–ধনলাভ। কালো রঙের গরু হলে—বিবাদ।’

‘কার সঙ্গে বিবাদ। তোর বাবার সাথে?’

‘লেখা নেই তো মা!’

মা চিন্তিত হয়ে পড়তেন। স্বপ্ন নিয়ে চিন্তার তাঁর কোনো শেষ ছিল না। আর কত বিচিত্র স্বপ্ন যে দেখতেন—একবার দেখলেন দুটো অন্ধ চড়ুই পাখি। খাবনামায় অন্ধ চড়ুই পাখি দেখলে কী হয় লেখা নেই। কবুতর দেখলে কী হয় লেখা আছে। মা’র কারণেই খাবনামা ঘাঁটতে ঘাঁটতে একসময় পুরো বইটা আমার মুখস্থ হয়ে গেল। স্বপ্নবিশারদ হিসেবে আমার নাম রটে গেল। যে যা দেখে আমাকে এসে অর্থ জিজ্ঞেস করে। এই করতে গিয়ে জানলাম কত বিচিত্র স্বপ্নই না মানুষ দেখে। সেই সঙ্গে মজার-মজার কিছু জিনিসও লক্ষ করলাম। যেমন—অসুস্থ মানুষরা সাধারণত বিকট সব দুঃস্বপ্ন দেখে। বোকা মানুষদের স্বপ্নগুলি হয় সরল ধরনের। বুদ্ধিমান মানুষরা খুব জটিল স্বপ্ন দেখে। সমাজে প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিরা একটা স্বপ্ন প্রায়ই দেখে, সেটা হচ্ছে কোনো একটি অনুষ্ঠানে সে সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে উপস্থিত হয়েছে। সবার গায়ে ভালো পোশাকআশাক, শুধু সে-ই পুরোপুরি নগ্ন। কেউ তা লক্ষ করছে না।’

মিসির আলি সাহেব কথা বন্ধ করে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এই জাতীয় স্বপ্ন কি আপনি কখনো দেখেছেন?’

আমি বললাম, ‘না। একটা স্বপ্নই আমি বারবার দেখি—পরীক্ষা হলে পরীক্ষা দিতে বসেছি। খুব সহজ প্রশ্ন, সবগুলির উত্তর আমার জানা। লিখতে গিয়ে দেখি কলম দিয়ে কালি বেরুচ্ছে না। কলমটা বদলে অন্য কলম নিলাম সেটা দিয়েও কালি বেরুচ্ছে না। এদিকে ঘন্টা পড়ে গেছে।’

‘এই স্বপ্নটাও খুব কমন। আমিও দেখি। একবার দেখলাম বাংলা পরীক্ষা-প্রশ্ন দিয়েছে অঙ্কের। কঠিন সব অঙ্ক। বাঁদরের তৈলাক্ত বাঁশ বেয়ে ওঠার অঙ্ক। একটা বাঁদরের জায়গায় দুটো বাঁদর। একটা খানিকটা ওঠে, অন্যটা তার লেজ ধরে টেনে নিচে নামায়—খুবই জটিল ব্যাপার। বাঁশের সবটা আবার তৈলাক্ত না, কিছুটা তেল ছাড়া…..’

আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, ‘সত্যিই কি এমন স্বপ্ন দেখেছেন?’

‘জ্বি-না—ঠাট্টা করে বলছি—জটিল সব অঙ্ক ছিল, এইটুকু মনে আছে। যাই হোক, ছোটবেলা থেকেই এইসব কারণে স্বপ্নের দিকে আমি ঝুঁকলাম। দেশের বাইরে যখন প্যারাসাইকোলজি পড়তে গেলাম—তখন স্পেশাল টপিক নিলাম ‘ড্রীম’। ড্রীম ল্যাবোরেটরিতে কাজও করলাম। আমার প্রফেসর ছিলেন ডঃ সুইন হার্ন, দুঃস্বপ্নের ব্যাপারে যাঁকে পৃথিবীর সেরা বিশেষজ্ঞ বলা যেতে পারে। দুঃস্বপ্ন অ্যানালিসিসের তিনি একটা টেকনিক বের করেছেন, যার নাম সুইন হার্ন অ্যানালিসিস। সুইন হার্ন অ্যানালিসিসে ব্যাখ্যা করা যায় না এমন সব দুঃস্বপ্নের একটা ফাইল তাঁর কাছে ছিল। সেই ফাইল তিনি তাঁর গ্রাজুয়েট ছাত্রদের দিতেন না। আমাকে তিনি খুবই পছন্দ করতেন, সম্ভবত সে-কারণেই সেই ফাইল ঘাঁটার সুযোগ হয়ে গেল। ফাইল পড়ে আমি হতভম্ব। ব্যাখ্যাতীত সব ব্যাপার। একটা উদাহরণ দিই—নিউ ইংল্যাণ্ডের একটি তেইশ বছর বয়েসী মেয়ে দুঃস্বপ্ন দেখা শুরু করল। তার নাভিমূল থেকে একটা হাত বের হয়ে আসছে। স্বাভাবিক হাতের চেয়ে সরু—লম্বা-লম্বা আঙুল। হাতটার রঙ নীলচে —খুব তুলতুলে। দুঃস্বপ্নটা সে প্রায়ই দেখতে লাগল। প্রতিবারই স্বপ্ন ভাঙত বিকট চিৎকারে। তাকে ড্রীম ল্যাবোরেটরিতে ভর্তি করা হল। প্রফেসর সুইন হার্ন রোগিণীর মনোবিশ্লেষণ করলেন। অস্বাভাবিক কিছুই পেলেন না। মেয়েটিকে পাঠিয়ে দেওয়া হল নিউ ইংল্যাণ্ডে। তার কিছুদিন পর মেয়েটি লক্ষ করল তার নাভিমূল ফুলে উঠেছে—একধরনের ননম্যালিগন্যান্ট গ্রোথ হচ্ছে। একমাসের মধ্যে সেই টিউমার মানুষের হাতের আকৃতি ধারণ করল। টিউমারটির মাথায় মানুষের হাতের আঙুলের মতো পাঁচটি আঙুল…….’

আমি মিসির আলিকে থামিয়ে দিয়ে বললাম, ‘ভাই, এই গল্পটা থাক। শুনতে ভালো লাগছে না। ঘেন্না লাগছে।’

‘ঘেন্না লাগার মতোই ব্যাপার। ছবি দেখলে আরো ঘেন্না লাগবে। মেয়েটির ছবি ছাপা হয়েছে নিউ ইংল্যাণ্ড জার্নাল অব মেডিসিনে। ছবি দেখতে চান?’

‘জ্বি না।’

‘পিএইচ. ডি. প্রোগ্রামে গিয়েছিলাম, পিএইচ. ডি. না-করেই ফিরতে হল। প্রফেসরের সঙ্গে ঝামেলা হল। যে-লোক আমাকে এত পছন্দ করত, সে-ই বিষ-নজরে দেখতে লাগল। এম. এস. ডিগ্রি নিয়ে দেশে ফিরলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পার্ট টাইম টীচিং-এর একটা ব্যবস্থা হল। ছাত্রদের অ্যাবনরম্যাল বিহেভিয়ার পড়াই। স্বপ্ন সম্পর্কেও বলি। স্বপ্নের সঙ্গে মানুষের অস্বাভাবিক আচরণের একটা সম্পর্ক বের করার চেষ্টা করি। ছাত্রদের বলি, তোমরা যদি কখনো কোনো ভয়ংকর স্বপ্ন দেখ, তাহলে আমাকে বলবে।

ছাত্ররা প্রায়ই এসে স্বপ্ন বলে যায়। ওদের কোনো স্বপ্নই তেমন ভয়ংকর না। সাপে তাড়া করছে, আকাশ থেকে মাটিতে পড়ে যাচ্ছে—এই জাতীয় স্বপ্ন। আমার ইচ্ছা ছিল দুঃস্বপ্ন নিয়ে গবেষণার কিছু কাজ করব। সেই ইচ্ছা সফল হল না। দুঃস্বপ্ন দেখছে এমন লোকজনই পাওয়া গেল না। আমি গবেষণার কথা যখন ভুলে গেলাম, তখন এল লোকমান ফকির।

লোকমান ফকিরের বাড়ি কুমিল্লার নবীনগরে। বয়স ত্রিশ পঁয়ত্রিশ। শিপিং করপোরেশনে মোটামুটি ধরনের চাকরি করে। দু’-কামরার একটা বাড়ি ভাড়া করেছে কাঁঠালবাগানে। বিয়ে করে নি। তবে বিয়ের চিন্তা-ভাবনা করছে। তার এক মামাতো বোনের সঙ্গে বিয়ের কথাবার্তা হচ্ছে। মেয়েটিকে তার পছন্দ নয়। তবে অপছন্দের কথা সে সরাসরি বলতেও পারছে না। কারণ তার এই মামা তাকে পড়াশোনা করিয়েছেন। ছেলেটি এক সন্ধ্যায় আমার সঙ্গে দেখা করতে এল। আমি তাকে দেখে চমকে উঠলাম। মুখ পাণ্ডুর বর্ণ, মৃত মানুষের চোখের মতো ভাবলেশহীন চোখ। যৌবনের নিজস্ব যে-জ্যোতি যুবক-যুবতীর চোখে থাকে তার কিছুই নেই। ছেলেটি হাঁটছে খুঁড়িয়ে-খুঁড়িয়ে, কিছুক্ষণ পরপরই চমকে উঠছে। সে ঘরে ঢুকেই বিনা ভূমিকায় বলল, ‘স্যার, আপনি আমাকে বাঁচান।’

আমি ছেলেটিকে বসালাম। পরিচয় নিলাম। হালকা কিছু কথাবার্তা বলে তাকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করলাম। তাতে খুব লাভ হল বলে মনে হল না। তার অস্থিরতা কমল না। লক্ষ করলাম, সে স্থির হয়ে বসতেও পারছে না। খুব নড়াচড়া করছে। আমি বললাম, ‘তোমার সমস্যাটা কী?’

ছেলেটি রুমাল দিয়ে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে প্রায় অস্পষ্ট গলায় বলল, ‘স্যার, আমি দুঃস্বপ্ন দেখি। ভয়ংকর দুঃস্বপ্ন।

আমি বললাম, ‘দুঃস্বপ্ন দেখে না এমন মানুষ তুমি খুঁজে পাবে না। সাপে তাড়া করছে, বাঘে তাড়া করছে, আকাশ থেকে নিচে পড়ে যাওয়া—এগুলি খুবই কমন স্বপ্ন। সাধারণত হজমের অসুবিধা হলে লোকজন দুঃস্বপ্ন দেখে। ঘুমের অসুবিধা হলেও দেখে। তুমি শুয়ে আছ, মাথার নিচ থেকে বালিশ সরে গেল, তখনো এ-রকম স্বপ্ন তুমি দেখতে পার। শারীরিক অস্বস্তির একটা প্রকাশ ঘটে দুঃস্বপ্নে। আগুনে পোড়ার স্বপ্ন মানুষ কখন দেখে জান? যখন পেটে গ্যাস হয়, সেই গ্যাসে বুক জ্বালাপোড়া করে— তখন সে স্বপ্ন দেখে তাকে জ্বলন্ত আগুনে ফেলে দেওয়া হয়েছে।’

‘স্যার, আমার স্বপ্ন এ-রকম না। অন্য রকম।’

‘ঠিক আছে, গুছিয়ে বল। শুনে দেখি কী রকম।‘

ছেলেটি সঙ্গে-সঙ্গে কথা শুরু করল। মুখস্থ বলে যাবার মতো বলে যেতে লাগল। মনে হয় আগে থেকে ঠিকঠাক করে এসেছে এবং অনেক বার রিহার্সেল দিয়েছে।

কথা বলার সময় একবারও আমার চোখের দিকে তাকাল না। যখন প্রশ্ন করলাম তখনো না।

‘প্রথম স্বপ্নটা দেখি বুধবার রাতে। এগারটার দিকে ঘুমুতে গেছি। আমার ঘুমের কোনো সমস্যা নেই। শোয়ামাত্র ঘুমিয়ে পড়তে পারি। সে-রাতেও তাই হল। বিছানায় শোয়ামাত্র ঘুমিয়ে পড়েছি। সঙ্গে-সঙ্গেই স্বপ্নটা দেখেছি।

‘কী করে বুঝলে শোয়ামাত্র স্বপ্ন দেখেছ?’

‘জেগে উঠে ঘড়ি দেখেছি, এগারটা দশ।’

‘স্বপ্নটা বল।

‘আমি দেখলাম খোলামেলা একটা মাঠের মতো জায়গা। খুব বাতাস বইছে। শোঁ-শোঁ শব্দ হচ্ছে। রীতিমতো শীত লাগছে। আমার চারদিকে অনেক মানুষ, কিন্তু ওদের কাউকে দেখতে পাচ্ছি না। ওদের কথা শুনতে পাচ্ছি। হাসির শব্দ শুনছি। একটা বাচ্চা ছেলে কাঁদছে—তাও শুনছি। বুড়োমতো একটা লোকের কাশির শব্দ শোনা যাচ্ছে, কিন্তু কাউকে আবছাভাবেও দেখতে পাচ্ছি না। একবার মনে হল আমি বোধহয় অন্ধ হয়ে গেছি। চারদিকে খুব তীক্ষ্ণ চোখে তাকালাম—মাঠ দেখতে পাচ্ছি, কুয়াশা দেখতে পাচ্ছি—কিন্তু মানুষজন দেখছি না, অথচ তাদের কথা শুনছি। হঠাৎ ওদের কথাবার্তা সব থেমে গেল। বাতাসের শোঁ-শোঁ শব্দও বন্ধ হয়ে গেল। মনে হল কেউ যেন এসেছে। তার ভয়ে সবাই চুপ করে গেছে। আমার নিজেরও প্রচণ্ড ভয় লাগল। একধরনের অন্ধ ভয়।

তখন শ্লেষ্মাজড়িত মোটা গলায় একজন বলল, ‘ছেলেটি তো দেখি এসেছে। মেয়েটা কোথায়?’

কেউ জবাব দিল না। খানিকক্ষণের জন্যে বাচ্চা ছেলেটির কান্না শোনা গেল, সঙ্গে— সঙ্গে থেমেও গেল। মনে হল কেউ যেন তার মুখে হাত চাপা দিয়ে কান্না বন্ধ করার চেষ্টা করছে। ভারি গলার লোকটা আবার কথা বলল, ‘মেয়েটা দেরি করছে কেন? কেন এত দেরি? ছেলেটিকে তো বেশিক্ষণ রাখা যাবে না। এর ঘুম পাতলা হয়ে এসেছে। ও জেগে যাবে।’

হঠাৎ চারদিকে সাড়া পড়ে গেল। একসঙ্গে সবাই বলে উঠল, ‘এসেছে, এসেছে, মেয়েটা এসেছে।’ আমি চমকে উঠে দেখলাম আমার পাশে একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। খুব রোগা একটা মেয়ে। অসম্ভব ফরসা, বয়স আঠার-উনিশ। এলোমেলোভাবে শাড়ি পরা। লম্বা চুল। চুলগুলি ছেড়ে দেওয়া, বাতাসে উড়ছে। মেয়েটা ভয়ে থরথর করে কাঁপছে। আমি অবাক হয়ে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে আছি। সে অসংকোচে আমার হাত ধরে কাঁপা গলায় বলল, ‘আমার ভয় করছে। আমার ভয় করছে।’

আমি বললাম, ‘আপনি কে?’

সে বলল, ‘আমার নাম নার্গিস। আপনি যা দেখছেন তা স্বপ্ন। ভয়ংকর স্বপ্ন। একটু পরই বুঝবেন। আগে এই স্বপ্নটা শুধু আমি একা দেখতাম। এখন মনে হয় আপনিও দেখবেন।’

মেয়েটা কাঁদতে শুরু করল। আতঙ্কে অস্থির হয়ে আমার গা ঘেঁষে দাঁড়াল। কাঁদতে-কাঁদতেই বলল, ‘আপনি কিছু মনে করবেন না, আমার ভয় লাগছে বলেই আমি এভাবে দাঁড়িয়ে আছি। এরা প্রতি মাসে একবার করে আমাকে এই স্বপ্নটা দেখায়।’

আমি বললাম, ‘এরা কারা?’

‘জানি না। কিচ্ছু জানি না। আপনি থাকায় কেন জানি একটু ভরসা পাচ্ছি। যদিও জানি আপনি কিছুই করতে পারবেন না। কিছুই না, কিছুই না, কিছুই না।’

মেয়েটি হাঁপাতে শুরু করল আর তখন সেই ভারি এবং শ্লেষ্মাজড়ানো কণ্ঠ চিৎকার করে বলল, ‘সময় শেষ। দৌড়াও, দৌড়াও, দৌড়াও।’

সেই চিৎকারের মধ্যে ভয়ংকর পৈশাচিক কিছু ছিল। আমার শরীরের প্রতিটি স্নায়ু থরথর করে কাঁপতে লাগল। চোখের সামনে কুয়াশা কেটে যেতে লাগল-চারদিকে তীব্র আলো। এত তীব্র যে চোখ ধাঁধিয়ে যায়। যাদের কথা শুনছিলাম অথচ দেখতে পাচ্ছিলাম না. এই আলোয় সবাইকে স্পষ্ট দেখতে পেলাম—এরা এরা এরা

‘এরা কী?’

‘এরা মানুষ না, অন্য কিছু—লম্বাটে পশুর মতো মুখ, হাত-পা মানুষের মতো। সবাই নগ্ন। এরা অদ্ভূত একধরনের শব্দ করতে লাগল। আমার কানে বাজতে লাগল—দৌড়াও দৌড়াও আমরা দৌড়াতে শুরু করলাম। আমাদের পিছনে সেই

জন্তুর মতো মানুষগুলিও দৌড়াচ্ছে।

আমরা ছুটছি মাঠের ওপর দিয়ে। সেই মাঠে কোনো ঘাস নেই। সমস্ত মাঠময় অযুত নিযুত লক্ষ কোটি ধারাল ব্লেড সারি-সারি সাজান। সেই ব্লেডে আমার পা কেটে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে—তীব্র তীক্ষ্ণ যন্ত্রণা। চিৎকার করে উঠলাম, আর তখনই ঘুম ভেঙে গেল। দেখি ঘামে সমস্ত বিছানা ভিজে গেছে।’

‘এই তোমার স্বপ্ন?’

‘জ্বি।’

‘দ্বিতীয় স্বপ্ন কখন দেখলে?’

‘ঠিক একমাস পর।

সেই মেয়েটিও কি দ্বিতীয় স্বপ্নে তোমার সঙ্গে ছিল?’

‘জ্বি।’

‘একই স্বপ্ন, না একটু অন্য রকম?’

‘একই স্বপ্ন।’

‘দ্বিতীয় বারও কি তুমি মেয়েটির হাত ধরে দৌড়ালে?’

‘জ্বি।’

‘প্রথম বার যেমন তার সঙ্গে কথাবার্তা হয়েছিল, দ্বিতীয় বারও হল?’

‘জ্বি।’

‘দ্বিতীয় বারও কি মেয়েটি পরে এসেছে? তুমি আগে এসে অপেক্ষা করছিলে?’

‘জ্বি-না—দ্বিতীয় বারে মেয়েটি আগে এসেছিল, আমি পরে এসেছি।’

‘দ্বিতীয় বারের স্বপ্ন তুমি রাত ক’টায় দেখেছ?’

‘ঠিক বলতে পারব না, তবে শেষরাতের দিকে। ঘুম ভাঙার কিছুক্ষণের মধ্যেই ফজরের আজান হল।‘

‘দ্বিতীয় বারও স্বপ্নে মোটা গলার লোকটি কথা বলল?’

‘জ্বি।’

লোকমান ফকির রুমালে কপালের ঘাম মুছতে লাগল। সে অসম্ভব ঘামছে। আমি বললাম, ‘পানি খাবে? পানি এনে দেব?’

‘জ্বি স্যার, দিন।’

আমি পানি এনে দিলাম, সে এক নিঃশ্বাসে পানি শেষ করে ফেলল। আমি বললাম, ‘স্বপ্ন ভাঙার পর তুমি দেখলে, তোমরা দু’টি পা-ই ব্লেডে কেটে ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেছে—তাই না?’

লোকমান হতভম্ব হয়ে বলল, ‘জ্বি স্যার। আপনি কী করে বুঝলেন?’

‘তুমি খুঁড়িয়ে-খুড়িয়ে ঘরে ঢুকলে, সেখান থেকে অনুমান করেছি। তা ছাড়া তোমার পা স্বপ্ন দেখার পর কেটে যাচ্ছে বলেই স্বপ্নটা ভয়ংকর। পা যদি না-কাটত তাহলে স্বপ্নটা ভয়ংকর হত না, বরং একটা মধুর স্বপ্ন হত। কারণ স্বপ্নে একটি মেয়ের সঙ্গে তোমার দেখা হচ্ছে, যে তোমার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। আঠার-উনিশ বছরের রূপবতী একটি মেয়ে, হাত ধরে তোমার সঙ্গে দৌড়াচ্ছে।’

আমার কথার মাঝখানেই লোকমান ফকির পায়ের জুতো খুলে ফেলল, মোজা খুলল। আমি হতভম্ব হয়ে দেখলাম, পায়ের তলা ফালা ফালা করে কাটা। এমন কিছু সত্যি-সত্যি ঘটতে পারে আমি ভাবি নি।

লোকমান ক্ষীণ গলায় বলল, ‘এটা কী করে হয় স্যার?’

‘আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। তবে স্বপ্নের ব্যাপারে পড়াশোনা যা করেছি তার থেকে তোমাকে একটা কথা বলতে পারি—Invert reaction বলে একটা ব্যাপার আছে। ধর, তোমার একটা আঙুল পুড়ে গেল—সেই খবর স্নায়ুর মাধ্যমে যখন তোমার মস্তিষ্কে পৌঁছবে, তখন তুমি তীব্র ব্যথা পাবে। Invertreaction-এ কী হয় জান? আগে মস্তিষ্কে আঙুলটি পোড়ার অনুভূতি পায়, তারপর সেই খবর আঙুলে পৌঁছে। তখন আঙুলটি পোড়া-পোড়া হয়ে যেতে পারে। স্বপ্নের পুরো ব্যাপারটা হয় মস্তিষ্কে। সেখানে থেকে Invert reaction-এ শরীরে তার প্রভাব পড়তে পারে।

এক লোক স্বপ্নে দেখত, তার হাতে কে যেন পিন ফোটাচ্ছে। ঘুম ভাঙার পর তার হাতে সত্যি-সত্যি পিন ফোটার দাগ দেখা যেত। তোমার ক্ষেত্রেও হয়তো তাই ঘটেছে। তবে এমন ভয়াবহভাবে পা কাটা অভশণর্র রণটউধমভ-এ সম্ভব বলে আমার মনে হয় না।

‘তাহলে কী?’

‘আমি বুঝতে পারছি না।’

লোকমান ক্লান্ত স্বরে বলল, ‘এক মাস পরপর আমি স্বপ্নটা দেখি। কারণ পায়ের ঘা শুকাতে এক মাস লাগে।’

আমি লোকমান ফকিরের দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললাম, ‘তুমি এখন থেকে একটা কাজ করবে—ঘুমুতে যাবে জুতো পায়ে দিয়ে। স্বপ্নে যদি তোমাকে দৌড়াতেও হয়—তোমার পায়ে থাকবে জুতো। ব্লেড তোমাকে কিছু করতে পারবে না।’

‘সত্যি বলছেন?’

‘আমার তাই ধারণা। আমার মনে হচ্ছে জুতো পরে ঘুমুলে তুমি স্বপ্নটাই আর দেখবে না।’

লোকমান ফকির চলে গেল। খুব ভরসা পেল বলে মনে হল না। আমি তাকে বলে দিয়েছিলাম এক মাস পর স্বপ্ন দেখা হয়ে গেলে সে যেন আসে। সে এল দেড় মাস পর।

তার মুখ আগের চেয়েও শুকনো, চোখ ভাবলেশহীন। অথর্ব মানুষের মতো হাঁটছে। আমি বললাম, ‘স্বপ্ন দেখেছ?’

‘জ্বি না।’

‘জুতো পায়ে ঘুমুচ্ছ?’

‘জ্বি স্যার। জুতো পায়ে দেওয়ার জন্যেই স্বপ্ন দেখছি না।’

আমি হাসিমুখে বললাম, ‘তাহলে তো তোমার রোগ সেরে গেল। এত মন খারাপ কেন? মনে হচ্ছে বিরাট সমস্যায় পড়েছ। সমস্যাটা কী?’

লোকমান নিচু গলায় বলল, ‘মেয়েটার জন্যে মন খারাপ স্যার। বেচারি একা-একা স্বপ্ন দেখছে। এত ভালো একটা মেয়ে কষ্ট করছে। আমি সঙ্গে থাকলে সে একটু ভরসা পায়। নিজের জন্যে কিছু না। মেয়েটার জন্যে খুব কষ্ট হয়।’

লোকমানের চোখে প্রায় পানি এসে গেল। আমি বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে রইলাম—সে বলে কী!

‘স্যার, আমি ঠিক করেছি জুতো পরব না। যা হবার হবে। নার্গিসকে একা-একা যেতে দেব না। আমি থাকব সঙ্গে। মেয়েটার জন্যে আমার খুব কষ্ট হয় স্যার। এত চমৎকার একটা মেয়ে! আমি স্যার থাকব তার সঙ্গে।’

‘সেটা কি ভালো হবে?’

‘জ্বি স্যার হবে। আমি তাকে ছাড়া বাঁচব না।’

সে কিন্তু স্বপ্নের একটি মেয়ে।’

‘সে স্বপ্নের মেয়ে নয়। আমি যেমন, সেও তেমন। আমরা দু’ জন এই পৃথিবীতেই বাস করি। সে হয়তো ঢাকাতেই কোনো এক বাসায় থাকে। তার পায়ে ব্লেডের কাটা। আমি যেমন সারাক্ষণ তার কথা ভাবি, সেও নিশ্চয়ই ভাবে। শুধু আমাদের দেখা হয় স্বপ্নে।’

মিসির আলি সিগারেট ধরিয়ে বললেন, ‘গল্পটি এই পর্যন্তই।’

আমি চেঁচিয়ে বললাম, ‘এই পর্যন্ত মানে? শেষটা কী?’

‘শেষটা আমি জানি না। ছেলেটি ক্ষতবিক্ষত পা নিয়ে একবার এসেছিল। সে বলল, জুতো খুলে ঘুমানোমাত্রই সে আবার স্বপ্ন দেখে। স্বপ্নে মেয়েটির দেখা পায়। তারা দু’ জন খানিকক্ষণ গল্প করে। দু’ জনকে জড়িয়ে ধরে কাঁদে। এক সময় মানুষের মতো জন্তুগুলো চেঁচিয়ে বলে—দৌড়াও, দৌড়াও। তারা দৌড়াতে শুরু করে।’

‘ছেলেটি আপনার কাছে আর আসে নি?’

‘জ্বি-না।’

‘ছেলেটির বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে আপনি কি কিছু জানেন?’

‘না, জানি না। তবে অনুমান করতে পারি। ছেলেটি জানে জুতো পায়ে ঘুমুলে এই দুঃস্বপ্ন সে দেখবে না, তার পরেও জুতো পায়ে দেয় না। কারণ মেয়েটিকে একা ছেড়ে দেওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়। প্রেমের ক্ষমতা যে কী প্রচণ্ড হতে পারে, প্রেমে না-পড়লে তা বোঝা যায না। ছেলেটির পক্ষে এই জীবনে তার স্বপ্নসঙ্গিনীর মায়া কাটানো সম্ভব না। সে বাকি জীবনে কখনো জুতো পায়ে ঘুমুবে না। সে আসলে দুঃস্বপ্নের হাত থেকে মুক্তি চায় না। দুঃস্বপ্ন হলেও এটি সেইসঙ্গে তার জীবনের মধুরতম স্বপ্ন।’

‘আপনার কি ধারণা, নার্গিস নামের কোনো মেয়ে এই পৃথিবীতে সত্যি-সত্যি আছে?’

মিসির আলি নিচু গলায় বললেন, ‘আমি জানি না। রহস্যময় এই পৃথিবীর খুব কম রহস্যের সন্ধানই আমি জানি। তবে মাঝে-মাঝে আমার কেন জানি এই মেয়েটির হাত ধরে একবার দৌড়াতে ইচ্ছা করে—। আরেক দফা চা হবে? পানি কি গরম করব?’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *