পারাপার – ০৪

ছোট্ট একটা ভূমিকম্প হয়েছে।

রেকটার স্কেলে এর মাপ দু-তিনের বেশি হবে না। পরপর দুবার সামান্য ঝাঁকুনি। এতেই হৈচৈ, ছোটাছুটি। আমার পাশের ঘরে তাসখেলা হচ্ছিল। গতকাল রাত এগারোটায় শুরু হয়েছিল, এখন সকাল আটটা। এখনো চলছে। ছুটির দিনে পয়সা দিয়ে খেলা হয়। ম্যারাথন চলে। তাসুড়েরা তাস ফেলে প্রথমে হৈচৈ করে বারান্দায় এল, তারপর সবাই একসঙ্গে ছুটল সিঁড়ির দিকে। মনে হচ্ছে, এরা সিঁড়ি ভেঙে ফেলবে।

আমি সিগারেট টানছি। ছুটে নিচে যাবার তেমন কোনো পরিকল্পনা নেই। তবে অবহেলার ভঙ্গি করে বিছানায় শুয়ে থাকারও অর্থ হয় না। প্রকৃতি ভয় দেখাতে চাচ্ছে—আমার উচিত ভয় পাওয়া। বাঁচাও বাঁচাও বলে রাস্তায় ছুটে যাওয়া। ভয় পেয়ে দল বেঁধে ছোটাছুটিরও আনন্দ আছে। আমি দরজার বাইরে এসে দেখি বারান্দায় দবির খাঁ বসে নামাজের অজু করছেন। সকাল ন’টা কোনো নামাজের সময় না। দবির খাঁ প্রায় সারারাত জেগে থেকে শেষরাতে ঘুমিয়ে পড়েন বলে ফজরের নামাজ পড়তে বেলা হয়। দবির খাঁ আমার দিকে তাকিয়ে ভীত গলায় বললেন, হেমু, ভূমিকম্প

আমার নাম হেমু নয়, হিমু। দবির খাঁ কখনো হিমু বলেন না। মনে হয় তিনি ইকারান্ত শব্দ বলতে পারেন না।

‘হেমু সাহেব—ভূমিকম্প। নামেন নামেন, রাস্তায় যান।’

‘আপনি বসে আছেন কেন?– আপনিও যান।’

দবির খাঁ হতাশ চোখে তাকাল। তখন মনে পড়ল—এই লোকের পায়ে সমস্যা আছে। হাঁটতে পারে না। মাটিতে বসে ছেছড়ে ছেছড়ে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যায়। তাঁর পক্ষে দোতলা থেকে একতলায় একা নামা সম্ভব নয়।

‘নিচে নামতে চাইলে আমি ধরাধরি করে নামাতে পারি। নামবেন? নাকি বসে বসে নামাজ পড়বেন? আপনার অজু কি শেষ হয়েছে?’

দবির খাঁ মনস্থির করতে পারছেন না। আমি বললাম, ধরুন শক্ত করে আমার হাত, নামিয়ে দিচ্ছি।

দরিব খাঁ ক্ষীণ গলায় বললেন, যা হবার হয়ে গেছে। আর বোধহয় হবে না।

‘হবে। ভূমিকম্পের নিয়ম হলো—প্রথম একটা ছোট, ওয়ার্নিং-এর মতো। সবাই যাতে সাবধান হয়ে যায়। তারপরেরটা বড়। যাকে বলে হেভি ঝাঁকুনি।’

‘বলেন কী?’

‘নামবেন নিচে?’

‘জি নামব, অবশ্যই নামব।’

দবির খাঁ গন্ধমাদন পর্বতের কাছাকাছি। আমার পক্ষে একা তাঁকে নামানো প্রায় অসম্ভব কাজের একটি। ডুবন্ত মানুষ যেভাবে অন্যের গলা জড়িয়ে ধরে তিনিও সেভাবে দু-হাতে আমার গলা চেপে ধরেছেন। আমরা দুজন প্রায় ফুটবলের মতো গড়িয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামছি।

কলঘরে মেসের ঝি ময়নার মা বাসন ধুতে বসেছে। ভূমিকম্পের বিষয়ে সে নির্বিকার। একমনে বাসন ধুয়ে যাচ্ছে। আমাদের নামার দৃশ্যে সে খানিকটা আলোড়িত হলো। মুখ আঁচল চাপা দিয়ে হাসছে। দবির খাঁ চাপা গলায় বললেন—মাগীর কারবার দেখেন। দেখছেন কাপড়চোপড়ের অবস্থা? এই রকম কাপড় পরার দরকার কী? নেংটা থাকলেই হয়।

ময়নার মা’র স্বাস্থ্য ভালো, সে দেখতেও ভালো। মায়া-মায়া চোখমুখ। কাজেকর্মেও অত্যন্ত ভালো। শুধু একটাই দোষ—তার কাপড়চোপড় ঠিক থাকে না, কিংবা সে নিজেই ঠিক রাখে না। মুখে আঁচল চাপা দিয়ে সে হাসছে। তার ব্লাউজের সবকটি বোতাম খোলা। এদিকে তার ভ্রূক্ষেপও নেই।

দবির খাঁ চাপা গলায় বললেন, হেমু সাহেব! দেখলেন মাগীর অবস্থা! ইচ্ছা করে বোর্ডারদের বুক দেখিয়ে বেড়ায়। শেষ জামানা চলে এসেছে। একেবারে শেষ জামানা। লজ্জা-শরম সব উঠে গেছে। আইয়েমে জাহেলিয়াতের সময় যেমন ছিল—এখনো তেমন।

আমরা রাস্তায় দাঁড়িয়ে ভূমির দ্বিতীয় কম্পনের জন্যে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করলাম। কিছুই হলো না। দবির খাঁকে রাস্তার একপাশে বসিয়ে দিয়েছি। তিনি সিগারেট টানছেন। তাঁকে ঘিরে ছোটখাটো একটা জটলা। কেউ বোধহয় মজার কোনো গল্প করছে। আমি দূরে আছি বলে গল্পের কথক কে বুঝতে পারছি না। আমি ইচ্ছে করেই দবির খাঁর কাছ থেকে দূরে সরে আছি। এই পর্বতকে আবার দোতলায় টেনে তোলা আমার কর্ম নয়। এই পবিত্র দায়িত্ব অন্যকেউ পালন করুক।

‘হিমু না? এদিকে শুনে যান তো?’

আমাদের মেসের মালিক বিরক্তমুখে আমাকে ডাকলেন। এই লোকটা আমাকে দেখলেই বিরক্ত হন। যদিও মেসের ভাড়া আমি খুব নিয়মিত দেই, এবং কখনো কোনোরকম ঝামেলা করি না। আমি হাসিমুখে ভদ্রলোকের কাছে গেলাম। আন্তরিক ভঙ্গিতে হাসার চেষ্টা করতে করতে বললাম, কী ব্যাপার, সিরাজ ভাই? আমার হাসিতে তিনি আরও রেগে গেলেন বলে মনে হয়। চোখমুখ কুঁচকে বললেন, আপনি কোথায় থাকেন কী করেন কে জানে—আমি কোনো সময় আপনাকে খুঁজে পাই না।

‘এই তো পেলেন।‘

‘এর আগে আমি চারবার আপনার খোঁজ করেছি। যতবার খোঁজ নেই শুনি ঘর তালাবন্ধ। থাকেন কোথায়?’

‘রাস্তায় রাস্তায় থাকি।’

‘রাস্তায় রাস্তায় থাকলে খামাখা মেসে ঘরভাড়া করে আছেন কেন? ঘর ছেড়ে দেবেন। সামনের মাসের এক তারিখে ছেড়ে দেবেন।’

‘এটা বলার জন্যেই খোঁজ করছিলেন?’

‘হুঁ।’

‘রাখতে চাচ্ছেন না কেন? আমি কি কোনো অপরাধ-টপরাধ করেছি?’

সিরাজ মিয়া রাগীগলায় বললেন, কাকে মেসে রাখব কাকে রাখব না এটা আমার ব্যাপার। আপনাকে আমার পছন্দ না।

‘ও আচ্ছা।

‘মাসের এক তারিখে ঘর ছেড়ে দেবেন। মনে থাকবে?’

‘হুঁ।’

‘কোনোরকম তেড়িবেড়ি করার চেষ্টা করবেন না। সোজা আঙুলে ঘি না উঠলে আঙুল কি করে বাঁকা করতে হয় আমি জানি।’

সিরাজ মিয়া তর্জনী বাঁকা করে আমাকে বাঁকা আঙুল দেখিয়ে দিলেন। আমি সহজ গলাতেই বললাম এটাই আপনার কথা, না আরো কথা আছে?

‘এইটাই কথা।’

আমি বললাম, কঠিন কথাটা তো বলা হয়ে গেল। এখন সহজ হন। সহজ হয়ে একটু হাসুন দেখি।

সিরাজ মিয়া হাসলেন না। তবে দবির মিয়াকে ঘিরে যে দলটা জটলা পাকাচ্ছিল সে দলটার ভেতর থেকে হো হো হাসির শব্দ উঠল।

হাসির অনেক ক্ষমতার ভেতর একটা ক্ষমতা হলো—হাসি ভয় কাটিয়ে দেয়। এদের ভয় কেটে গেছে। এরা কিছুক্ষণের মধ্যেই মেসবাড়িতে ফিরে যাবে। তাসখেলা আবার শুরু হবে। দবির খাঁ অজু করে তাঁর ফজরের কাজা নামাজ শেষ করবেন।

.

ছুটির দিনের ভোরবেলায় একটা ছোটখাটো ভূমিকম্প হওয়াটা মন্দ না। চারদিকে উৎসব উৎসব ভাব এসে গেছে। বড় একটা বিপদ হওয়ার কথা ছিল, হয়নি। সেই আনন্দের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সহমর্মিতার আনন্দ। বড় ধরনের বিপদের সামনেই একজন মানুষ অন্য একজনের কাছে আশ্রয় খুঁজে। পৃথিবীতে ভয়াবহ ধরনের বিপদ-আপদেরও প্রয়োজন আছে।

মেসে আজ ইমপ্রুভড্ ডায়েটের ব্যবস্থা হচ্ছে। মাসের প্রথম সপ্তাহের বৃহস্পতিবার ইমপ্রুভড্ ডায়েট হয়। আজ তৃতীয় সপ্তাহ চলছে, ইমপ্রুভড্ ডায়েটের কথা না—ভূমিকম্পের কারণেই এই বিশেষ আয়োজন।

আমি ইমপ্রুভড্ ডায়েটের ঝামেলা এড়াবার জন্যে দরজা বন্ধ করে শুয়ে আছি। হাতে দশটা টাকাও নেই। ইমপ্রুভড্ ডায়েটের ফেরে পড়লে কুড়ি-পঁচিশ টাকা চাঁদা দিতে হবে। কোত্থেকে দেব?

এরচেয়ে শুয়ে শুয়ে নিষ্পাপ মানুষের প্রাথমিক তালিকাটা করে ফেলা যাক। একলেমুর মিয়ার নাম লেখা যেতে পারে। ভিক্ষা করা ছাড়া আর কোনো পাপ তার আছে বলে মনে হয় না। ভিক্ষা নিশ্চয়ই পাপের পর্যায়ে পড়ে না। এই পৃথিবীর অনেক মহাপুরুষই ভিক্ষাবৃত্তি করতেন। তাছাড়া একলেমুর মিয়ার কিছু সুন্দর নিয়মকানুনও আছে। যেমন সে ভিক্ষার টাকা জমা করে রাখে না। সন্ধ্যার পর যা পায় তার পুরোটাই খরচ করে ফেলে। অন্য ভিক্ষুকদের রাতের খাওয়া খাইয়ে দেয়।

১। একলেমুর মিয়া পেশায় ভিক্ষুক।

বয়স ৪৫ থেকে ৫৫

ঠিকানা : জোনাকী সিনেমা হলের গাড়ি বারান্দা।

শিক্ষা : ক্লাস থ্রি পর্যন্ত।

২। মনোয়ার উদ্দিন। পেশায় ব্যাংকের জুনিয়ার অফিসার।

শিক্ষা : বিএ অনার্স।

এই পর্যন্ত লিখেই থমকে যেতে হলো। মনোয়ার উদ্দিন আমার পাশের ঘরে থাকেন। তাঁর সম্পর্কে বিশেষ কিছুই জানি না। শুধু মনে হয় লোকটা ভালো। তাঁকে একদিন দেখেছি আমাদের কলঘরে একটা ছ-সাত বছরের বাচ্চার মাথায় পানি ঢালছেন। জিজ্ঞেস করলাম, কী হয়েছে? তিনি জানালেন, ছেলেটা নর্দমায় পড়ে গিয়ে কাঁদছিল। তিনি তুলে নিয়ে এসে গা ধুয়াচ্ছেন।

‘বুঝলেন হিমু সাহেব একটা আস্ত লাক্সসাবান হারামজাদার গায়ে ডলেছি তারপরেও গন্ধ যায় না।‘

মনোয়ার উদ্দিন সাহেবের নামটা রাখা যেতে পারে। ফাইন্যাল স্ক্রুটিনিতে বাদ দিলেই হবে।

আরো দুটা নাম ঝটপট লিখে ফেললাম! প্রসেস অব এলিমিনেশনের মাধ্যমে বাদ দেয়া হবে। এর মধ্যে আছে মোহম্মদ রজব খোন্দকার সেকেন্ড অফিসার লাগবাগ থানা। তিনি একবার আমাকে বলেছিলেন—পুলিশ হয়ে জন্মেছি ঘুস খাব না তা তো হয় না। গোয়ালাকে যেমন দুধে পানি মিশাতেই হয় পুলিশকে তেমনি ঘুস খেতে হয়। আমিও খাব। শিগগির খাওয়া ধরব। তবে ঠিক করে রেখেছি প্রথম ঘুস খাবার আগে তরকারির চামচে এক চামচ মানুষের ‘গু’ খেয়ে নিব। তারপর শুরু করব জোরেসোরে। গুটা খেতে পারছি না বলে ঘুস খাওয়া ধরতে পারছি না। তবে ঘুসতো খেতেই হবে। একদিন দেখবেন আঙুল দিয়ে নাক চেপে চোখ বন্ধ করে এক চামচ মানুষের ‘গু’ খেয়ে ফেলব। জিনিসটা খেতে হয়তবা খারাপ হবে না। কুকুরকে দেখেন না—কত আগ্রহ করে খায়। কুকুরের সঙ্গে মানুষের অনেক মিল আছে।

এখন নাম হলো চারটা–

(১) একলেমুর মিয়া

(২) মনোয়ার উদ্দিন

(৩) মোহম্মদ রজব খোন্দকার।

(৪) রূপা

মনোয়ার উদ্দিনের নাম রাখাটা বোধহয় ঠিক হবে না। বড়ই তরল স্বভাবের মানুষ। তরল স্বভাবের মানুষের পক্ষে পবিত্র থাকাটা কঠিন কাজ। তাঁকে প্রায়ই দেখা যায়। ময়নার মা’র সামনে উবু হয়ে বসে গল্প করছেন। ময়নার মা মুখ ঝামটা দিয়ে বলেছে—একটু সইরা বসেন না—এক্কেবারে শইল্যের উপরে উইঠ্যা বসছেন। হি হি হি।

সেই হাসি প্রশ্রয়ের হাসি। আহ্বানের হাসি। তরল স্বভাবের মানুষ যত পবিত্ৰই হোক এই হাসির আহ্বান অগ্রাহ্য করতে পারবে না।

আমি লালকালি দিয়ে মনোয়ার উদ্দিনের নাম কেটে দিলাম।

দরজায় টোকা পড়ছে। আমি খাতা বন্ধ করে দরজা খুলে দিলাম। মনোয়ার সাহেব দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি অত্যন্ত ব্যস্ত ভঙ্গিতে বললেন, কুড়িটা টাকা ছাড়ুন তো হিমু সাহেব। স্পেশাল খানা হবে—রহমত বাবুর্চিকে নিয়ে এসে খাশির রেজালা আর পোলাও।

আমি শুকনো মুখে বললাম, আমার কাছে একটা পয়সাও নেই।

‘সামান্য কুড়ি টাকাও নেই? কী বলছেন আপনি! দেখি আপনার মানিব্যাগ?’

মনোয়ার সাহেব নাছোড় প্রকৃতির মানুষ। মানিব্যাগ দিয়ে দিলাম। শূন্য মানিব্যাগ তিনি খুবই বিস্ময়ের সঙ্গে দেখলেন।

‘এত সুন্দর একটা মানিব্যাগ খালি করে ঘুরে বেড়ান কী করে?’

‘ঘুরে বেড়াই আর কোথায়, সারাদিনই তো বিছানায় শোয়া।’

‘আচ্ছা থাক, টাকা দিতে হবে না। আপনি আমার গেস্ট। আপনার খরচ আমি দেব। নো বিগ ডিল। তবে আপনাকে কাজ করতে হবে। বসিয়ে রেখে খাওয়াব না।’

‘কী কাজ?’

‘আমার সঙ্গে বাজার-সদাই করবেন। খাশির গোশত দেখেশুনে কিনতে হবে। চট করে প্যান্ট পরে নিন।’

আমি প্যান্ট পরলাম। মনোয়ার সাহেব এলেন পিছু পিছু।

‘খাশির গোশত কেনা কোনো ইজি ব্যাপার না, বুঝলেন ভাই? ইট ইজ এ ডিফিকাল্ট জব। খাশির ওজন হতে হয় সাতসের। এরচেয়ে কম ওজনের হলে মাংশ গলে যায়। বেশি হলে চর্বি হয়ে যায়। বুঝলেন?’

‘জি বুঝলাম।‘

‘খাশির গোশত রান্না করাও খুব ডিফিকাল্ট। এদিক-ওদিক হলে all gone. গোশত নষ্ট হয় কিসে বলুন তো?’

‘বলতে পারছি না।’

‘আলু। আলু দিয়েছেন কী কর্ম কাবার। আলু গলে যায়, সুরুয়া থিক হয়ে যায়…’

 ভদ্রলোকের হাত থেকে যে করেই হোক উদ্ধার পেতে হবে। কোনো বুদ্ধি মাথায় আসছে না।

‘মনোয়ার ভাই।’

‘বলুন।’

‘একটু বসুন তো আমার ঘরে। এক দৌড় দিয়ে নিচ থেকে আসছি—একটা পান খেয়ে আসি। বমি-বমি লাগছে।’

‘যাওয়ার পথে পান কিনে নিলেই হবে।‘

‘না না—এক্ষুনি পান লাগবে।’

আমি ছুটে বের হয়ে এলাম। আর ফিরে না গেলেই হবে। মনোয়ার সাহেব অনেকক্ষণ আমার জন্যে খানিকটা খোঁজখবরও করবেন—তারপর সব পরিষ্কার হবে। তিনি সাতসের ওজনের খাসি কিনতে বের হবেন।

মোড়ের পানের দোকান থেকে একটা পান কিনলাম। পান খাওয়ার কথা বলে বের হয়েছি, না খাওয়াটা ঠিক হবে না। মিথ্যার সঙ্গে খানিকটা সত্য মিশে থাকুক। যদিও ভোরবেলা আমি কখনো পান খেতে পারি না। ঘাস খেয়ে একটা দিন শুরু করার মানে হয় না। ঘাস যদি খেতেই হয় দিনের শেষভাগে খাওয়া ভালো।

কোথায় যাব ঠিক করতে পারছি না। ইয়াকুব সাহেবকে কি বলে আসব—চিন্তা করবেন না—কাজ এগুচ্ছে। নাম লিস্ট করা শুরু হয়েছে। গোটা বিশেক নাম পাওয়া গেছে। সেখান থেকে নাম কাটতে কাটতে একটা নামে আসব। সময় লাগবে। ধৈর্য ধরতে হবে। মানুষের ধৈর্য নেই। মানুষের বড়ই তাড়াহুড়া। পবিত্র গ্রন্থ কোরান শরিফেও বলা হয়েছে—’হে মানব সন্তান, তোমাদের বড়ই তাড়াহুড়া।’

বেশকয়েকটা খালি রিক্শা আমার সামনে দিয়ে যাচ্ছে। রিকশাঅলারা আশা-আশা চোখে তাকাচ্ছে আমার দিকে। খালি রিকশা দেখলেই চড়তে ইচ্ছা করে। ভুল বললাম, খালি রিক্শা চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলে চড়তে ইচ্ছে করে না। চলন্ত খালি রিকশা দেখলে চড়তে ইচ্ছা করে। আমি এরকম চলন্ত একটা রিকশায় প্রায় লাফিয়ে উঠে পড়লাম। রিক্শাঅলা হাসিমুখে ঘাড় ঘুরিয়ে আমাকে দেখল। কোথায় যেতে চাই কিছু জানতে চাইল না। মনে হচ্ছে এ বিপদজনক ধরনের রিকশাঅলা—যেখানে সে রওনা হয়েছে সেখানেই যাবে। মাঝপথে লাফ দিয়ে রিক্শা থেকে নেমে পড়লেও কিছু বলবে না, ভাড়া দেন, ভাড়া দেন, বলে চেঁচাবে না। ঢাকা শহরে রিক্শাঅলাদের সাইকোলজি নিয়ে কেউ এখনো গবেষণা করেননি। গবেষণা করলে মজার মজার জিনিস বের হয়ে আসত।

মতিঝিলের কাছে আমি লাফ দিয়ে রিকশা থেকে নামলাম। রিকশাঅলা আবার হাসিমুখে তাকালো। সে রিকশার গতি কমাল না। যে গতিতে চালাচ্ছিল সেই গতিতেই চালাতে লাগল। আর তখনি বুঝতে পারলাম, এই রিকশাঅলা আমার পূর্ব-পরিচিত। এর নাম হাসান। হাসানের কী যেন একটা ইন্টারেস্টিং গল্প আছে। গল্পটা মনে পড়ছে না। আচ্ছা, হাসানের নামটা কি লিস্টিতে তুলব? আপাতত থাক, পরে কেটে দিলেই হবে। প্রসেস অব এলিমিনেশন। হারাধনের দশটি ছেলে দিয়ে শুরু হবে শেষ হবে এক ছেলেতে।

বড়খালুর অফিস মতিঝিলে।

অনেকদিন পর তাঁর অফিস ঘরে উঁকি দিলাম। ভুরভুর করে এলকোহলের গন্ধ আসছে। খালু সাহেব মনে হয় এলকোহলের মাত্রা বাড়িয়েই দিচ্ছেন। আগে অফিসে এলে এই গন্ধ পাওয়া যেত না। এখন যায়।

‘আসব খালু সাহেব?’

‘আয়।’

বোঝাই যাচ্ছে তিনি প্রচুর পান করেছেন। এমিতে তিনি আমাকে তুমি করে বলেন। মাতাল হলেই—তুই। মাতালরা অন্তরঙ্গ ভঙ্গিতে কথা বলতে ভালোবাসে।

আমি ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললাম, গরমের মধ্যে স্যুট পরে আছেন কেন?

খালু সাহেব ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে রইলেন। মনে হচ্ছে আমাকে চিনতে পারছেন না।

‘বসতে পারি খালু সাহেব? নাকি জরুরি কিছু করছেন?’

‘বোস।’

আমি বসলাম। খালু সাহেবকে বুড়োটে দেখাচ্ছে। চকচকে টাইও তাঁর বুড়োটে ভাব ঢাকতে পারছে না। আমি পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্যে বললাম, ভূমিকম্প টের পেয়েছিলেন? বড় খালু ভূমিকম্পের ধার দিয়ে গেলেন না। নিচু গলায় বললেন—

‘চা খাবি?’

‘হুঁ।’

তিনি যন্ত্রের মতো বেল টিপে চায়ের কথা বললেন। আমি হাসিমুখে বললাম, এলকোহলের গন্ধ পাচ্ছি।

বড়খালু রোবটের মতো গলায় বললেন, টেবিলে বার্নিশ লাগানো হয়েছে। বার্নিশের গন্ধ পাচ্ছিস।

‘ও আচ্ছা। আমি ভেবেছিলাম আপনি বোধহয় আজকাল অফিসেও চালাচ্ছেন।’

‘ঠিকই ভেবেছিস। ভালোমতোই চালাচ্ছি। কেউ এলে বলি—টেবিলে বার্নিশ দিয়েছি। সন্দেহ বাতিকগ্রস্ত লোকজন লজ্জা পেয়ে যায়। তুই যেমন পেয়েছিস।’

‘কিন্তু আপনার সঙ্গে খানিকক্ষণ কথা বলার পরই তো সবাই বুঝে যায় যে বার্নিশ টেবিলে না, আপনি বার্নিশ লাগিয়েছেন আপনার স্টমাকে।’

‘কেউ কিচ্ছু বুঝে না। মানুষের ইন্টেলিজেন্সকে ইনফ্লুয়েন্স করা যায়। হিউম্যান ইন্টেলিজেন্সের এইটাই হলো বড় ত্রুটি। বুঝতে পারছিস?’

‘হুঁ।’

‘নে, চা খা। চা খেয়ে বিদেয় হয়ে যা। টাকাপয়সা লাগবে?’

‘না।’

‘নিষ্পাপ মানুষ খুঁজে বেড়াচ্ছিস?’

‘হুঁ।’

‘পাওয়া গেছে?’

‘গোটা বিশেক নাম পাওয়া গেছে। এদের মাঝখান থেকে বের করতে হবে।’

‘গোটা বিশেক নাম পেয়ে গেছিস? বলিস কী! সারা পৃথিবীতেই তো ২০টা নিষ্পাপ লোক নেই। স্ট্রেঞ্জ। নামগুলি পড় তো শুনি।’

‘পড়া যাবে না। গোপন।‘

‘এই কুড়িটা নাম পেলি কোথায়?’

‘পরিচিতদের মাঝখান থেকে জোগাড় করেছি।’

‘ছেলে কটা,মেয়ে কটা?’

‘ফিফটি ফিফটি। দশটা ছেলে, দশটা মেয়ে।’

বড়খালুকে উত্তেজিত মনে হচ্ছে। চোখ বড় বড় করে তাকাচ্ছেন। মাতাল মানুষ সহজেই উত্তেজিত হয়।

‘বাই এনি চান্স—তোর খালার নাম নেই তো?’

আমি হাসলাম। সেই হাসার যে-কোনো অর্থ হতে পার। বড়খালু সেই হাসি ‘না’ সূচক ধরে নিলেন।

‘গুড। অতি পাপিষ্ঠা মহিলা। সাতটা দোজখের মধ্যে সবচে’ খারাপটায় তার স্থান হবে বলে আমার বিশ্বাস। ‘

‘তাই নাকি?’

‘অবশ্যই তাই। সাতটা দোজখের নাম জানিস?’

‘না।’

‘সাতটা দোজখ হলো :

(১) জাহান্নাম

(২) হাবিয়া

(৩) সাকার

(৪) হুতামাহ

(৫) সায়ির

(৬) জাহিম

(৭) লাজা!’

‘দোজখের নাম মুখস্থ করে রেখেছেন, ব্যাপার কী?’

‘যেতে হবে তো ঐখানেই। কাজেই মুখস্থ করেছি।’

‘আপনি নিশ্চিত যে দোজখে যাবেন?’

‘অবশ্যই নিশ্চিত। তবে আমার স্থান সম্ভবত সাত নম্বর দোজখে হবে। সাত নম্বর দোজখ হল ‘লাজা’। এখানে শাস্তি কম। আমার শাস্তি কমই হবে। বড় ধরনের পাপ বলতে গেলে কিছুই করিনি। যেমন ধর্, মানুষ খুন করিনি।’

‘মানুষ খুন করেননি?’

‘না।’

‘মানুষ খুন করার ইচ্ছা হয়েছে কিনা বলুন।’

‘তা হয়েছে। অনেকবারই ইচ্ছা হয়েছে।’

‘খুন করা এবং খুন করার ইচ্ছা প্রকাশ করা তো প্রায় কাছাকাছি।’

‘তা ঠিক। এই জন্যেই তো আমার স্থান হবে লাজায় কিংবা জাহিমে।’

আমি পকেট থেকে খাতাটা বের করতে করতে বললাম, মজার ব্যাপার কি জানেন বড়খালু—আপনার নাম কিন্তু নিষ্পাপ মানুষদের তালিকায় আছে।

‘বলিস কী?’

বড়খালু হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলেন। মনে হচ্ছে তার মদের নেশা কেটে যাচ্ছে। ‘দেখতে চান?’

‘তুই ঠাট্টা করছিস নাকি?’

‘ঠাট্টা করব কেন?

আমি খাতা খুলে বড়খালুর নাম দেখিয়ে দিলাম। তিনি-থ হয়ে বসে আছেন। টেবিলের উপর রাখা পানির গ্লাসের পানি এক চুমুকে শেষ করে দিলেন।

‘বড়খালু যাই?’

তিনি হ্যাঁ-না কিছুই বললেন না। খক খক করে কাশতে লাগলেন। ভয়াবহ কাশি। মনে হচ্ছে কাশির সঙ্গে ফুসফুসের অংশবিশেষ উঠে আসবে। আমি তাঁর কাশি থামার জন্যে অপেক্ষা করছি। একটা লোক প্রাণপণে কাশছে, এই অবস্থায় তাঁকে ফেলে চলে যাওয়া যায় না।

‘হিমু!’

‘জি।’

‘তুই সত্যিই তাহলে আমার নাম তোর লিস্টে তুলেছিস?’

‘হুঁ।’

‘নামটা খচ করে কেটে ফেল। তুই একটা কাজ কর। পাপীদের একটা লিস্ট কর। সেই লিস্টের প্রথমদিকে আমার নাম লিখে রাখ্—In block letters.

‘আপনি চাইলে করব।’

‘করব না—Do it. এক্ষুনি কর্, এই নে কাগজ।’

‘পরে একসময় লিখে নেব।’

‘নো, এক্ষুণি করতে হবে। রাইট নাউ

বড়খালু হুংকার দিলেন, হুংকারের শব্দে সচকিত হয়ে তাঁর খাস বেয়ারা পরদার আড়াল থেকে মাথা বের করল। বড়খালু বললেন—‘ভাগো। মারেগা থাপ্পড়…।’

বাঙালি-মাতাল যখন হিন্দি বলতে থাকে তখন বুঝতে হবে অবস্থা শোচনীয়। এদের ঘাঁটাতে নেই। আমি দ্রুত পাপীদের একটা তালিকা তৈরি করলাম। এক দুই তিন করে দশটা নম্বর বসিয়ে চার নম্বরে বড়খালুর নাম লিখে কাগজটা তাঁর দিকে বাড়িয়ে ধরলাম।

‘চার নম্বরে কী মনে করে লিখলি? কেটে এক নম্বরে দে। আমার কথা তুই কী আমার চেয়ে বেশি জানিস…গাধা কোথাকার! গিদ্ধড় কী বাচ্চা, Son of গিড়।’

আমি দেরি করলাম না—তৎক্ষণাৎ তাঁর নাম কেটে এক নম্বরে নিয়ে গেলাম। এখন আরেকটা নাম লেখ—মুনশি বদরুদ্দিন।

‘ক’ নম্বরে লিখব?

‘এই লিস্টে না—পুণ্যবানদের লিস্টে।’

মুনশি বদরুদ্দিন একজন পুণ্যবান ব্যক্তি?’

‘হ্যাঁ—এই লোক হলো পূর্ত মন্ত্রণালয়ের একজন ক্লার্ক। এক পয়সা ঘুস খায় না। পূর্ত মন্ত্রণালয়ের ক্লার্ক কিন্তু ঘুস খায় না—–চিন্তা করেছিস কত বড় ব্যাপার?’

‘পূর্ত মন্ত্রণালয়ের ক্লার্কদের কি ঘুস খেতেই হয়?’

‘অবশ্যই খেতে হয়। দৈনিক খাদ্যগ্রহণের মতো খেতে হয়। তুই ঐ লোকের কাছে যাবি। তার পা ছুঁয়ে সালাম করবি। পুণ্যবানদের স্পর্শ করলে মন পবিত্র হয়।‘

‘মুনশি বদরুদ্দিন?’

‘মুনশি বদরুদ্দিন তালুকদার। সিনিয়ার এসিসটেন্ট। বেঁটেখাটো লোক। খুব পান খায়।’

‘আমি তাহলে উঠি বড়খালু?’

‘আরেকটু বোস। তোর সঙ্গে কথা বলতে ভালো লাগছে।’

‘মুনশি বদরুদ্দিন সাহেবের কাছে একটু যাব বলে ভেবেছি…।’

যাব বললেই তো যেতে পারি না। সেক্রেটারিয়েটে ঢুকবি কী করে? পাসের ব্যবস্থা করতে হবে। টেলিফোনে তোর পাসের ব্যবস্থা করে দি—চা খাবি আরেক কাপ?’

‘না।’

মাতালরা অন্যে কী বলছে তা শুনে না। তার কাছে শুধু নিজের কথাই সত্য। বড়খালু হুংকার দিয়ে বলেন, ঐ, চা দিতে বললাম না? তিনি টেবিলের কাবার্ড খুলে—সাদা রঙের চ্যাপ্টা বোতল খুলে এক ঢোক তরল পদার্থ মুখে ঢেলে নিলেন। সঙ্গে সঙ্গে গিলে ফেললেন না। কুলকোচার মতো শব্দ করতে লাগলেন। ভালো জিনিস চট করে গিলে ফেলতে তাঁর মনে হয় মায়া লাগছে। মুখে যতক্ষণ রাখা যায় ততক্ষণই আরাম।

‘হিমু’

‘জি বড়খালু।’

‘তুই কেমন আছিস?’

‘খুব ভালো আছি। আপনার অবস্থা তো মনে হয় কাহিল।’

‘আমিও ভালো আছি। সুখে আছি, আনন্দে আছি। তবে চারপাশের এখন যে অবস্থা এই অবস্থায় আপনাআপনি আনন্দে থাকা যায় না। তরল পদার্থের কিছু সাহায্য লাগে। বুঝতে পারছিস রে গাধা? গিদ্ধড় কী ছানা, বুঝলি কিছু?’

‘বোঝার চেষ্টা করছি।’

‘পারবি। তুই বুঝতে পারবি। তোর বুদ্ধিশুদ্ধি আছে। তুই যে পুণ্যবান আর পাপীদের লিস্ট করছিস—খুব ভালো করছিস। পত্রিকায় এই লিস্ট ছাপিয়ে দিতে হবে। একদিন ছাপা হবে পুণ্যবানদের তালিকা, আরেকদিন ছাপা হবে পাপীদের তালিকা।’

‘উঠি বড়খালু?’

‘এসেই উঠি উঠি করছিস কেন? সেক্রেটারিয়েটে ঢোকার পাসের ব্যবস্থা করে দি।’ বড়খালু টেলিফোন টেনে নিলেন… তাঁর কপাল খুব ঘামছে। মুখ হা হয়ে আছে। টেলিফোনের ডায়ালও ঠিকমতো ঘোরাতে পারছেন না। তিনি ডায়াল ঘুরাচ্ছেন আর মুখে বলছেন—হ্যালো। হ্যালো।

.

মুনশি বদরুদ্দিন তালুকদারকে পাওয়া গেল না। তিনি দুদিন ধরে আসছেন না। আমি তাঁর বাসার ঠিকানা চাইলাম। অফিসের একজন মধুর গলায় বললেন, ঠিকানা দিয়ে কী করবেন?

‘একটু কাজ ছিল।’

‘কী কাজ বলুন। দেখি আমরা করতে পারি কিনা।’

‘উনার সঙ্গেই আমার কাজ ছিল।’

‘উনার সঙ্গে কাজ থাকলে তো উনার কাছে যাবেন। বসুন না, দাঁড়িয়ে আছেন কেন?’

আমি বসলাম। ভদ্রলোক নিচু গলায় বললেন, সিগারেটের বদভ্যাস আছে?

‘খাই মাঝে মধ্যে।’

‘মাঝে মধ্যে খাওয়াই ভালো। বিরাট খরচের ব্যাপার। স্বাস্থ্য নষ্ট। পরিবেশ নষ্ট। নেন সিগ্রেট নেন।’

।তিনি শার্টের পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করলেন। বেনসন এণ্ড হেজেস। সত্তর টাকা করে প্যাকেট। এই কেরানি ভদ্রলোক বেতন কত পান? হাজার তিনেক? তিনি খান বেনসন। ভদ্রলোক নিজেই লাইটার দিয়ে সিগারেট ধরিয়ে দিলেন। সেই লাইটারও কায়দার লাইটার। যতক্ষণ জ্বলে ততক্ষণ বাজনা বাজে। ভদ্রলোক বললেন, কাজটা কি মিউটেশন? নামজারি? বড়ই জটিল কাজ। এই দপ্তরের সব কাজই জটিল। জমিজমা বিষয়-সম্পত্তির কাজ। মানুষের কোনো মূল্য নাই—জমির মূল্য আছে—বুঝলেন কিছু?

আমি বুঝদারের মতো মাথা নাড়লাম। এক একটা নামজারির কাজ দেড় বছর—দু’বছর ঝুলে থাকে।‘

‘নামজারি ব্যাপারটা কী?’

‘নামজারি বুঝলেন না? মনে করুন, আপনি কিছু জমি কিনলেন। যার কাছ থেকে কিনলেন সরকারি রেকর্ডে আছে তার নাম। এখন তার নাম খারিজ করে আপনার নাম লিখতে হবে। এটাই নামজারি।’

‘একজনের নাম কেটে আরেকজনের নাম লিখতে দেড় বছর লাগে?’

‘দেড় বছর তো কম বললাম। মাঝে-মাঝে দুই-তিন বছরও লাগে। নাম খারিজ করা তো সহজ ব্যাপার না।’

‘এটাকে সহজ করা যায় না?’

‘কীভাবে সহজ করবেন?’

‘সবার নাম খারিজ করে দিন। এক্কেবারে লাল কালি দিয়ে খারিজ করে জমির মূল মালিকের নাম লিখে দিন।

ভদ্রলোক হতভম্ব গলায় বললেন, জমির মূল মালিক কে?

‘যিনি জমি সৃষ্টি করেছেন তিনিই মূল মালিক।’

‘সবার নাম কেটে আল্লাহ্র নাম লিখতে বলছেন?’

‘জি।’

‘আপনার কি ব্রেইন ডিফেক্ট?’

‘কিছুটা ডিফেক্ট। দেখুন ভাই সাহেব পৃথিবীর জমি আমরা ভাগাভাগি করে নিয়ে নিয়েছি, নামজারি করছি। জোছনা কিন্তু ভাগাভাগি করে নেইনি। এমন কোনো সরকারি অফিস নেই যেখানে জোছনার নামজারি করা হয়, একজনের জোছনা আরেকজন কিনে নেয়।’

ভদ্রলোক আমার কথায় তেমন অভিভূত হলেন না। পাগলদের মজার মজার কথায় কেউ অভিভূত হয় না, বিরক্ত হয়। তিনি একটা ফাইল খুলতে খুলতে বললেন, আপনি এখন যান। কাজ করতে দিন। অফিস কাজের জায়গা। আড্ডা দেয়ার জায়গা না।

‘একটা সিগারেট দিন। সিগারেট খেয়ে তারপর যাই।’

তিনি এমনভাবে তাকালেন যেন এমন অদ্ভুত কথা তিনি এই জীবনে শুনেননি। আমি হাই তুলতে তুলতে বললাম, সিগারেট না খেয়ে আমি উঠব না। সিগারেট খাব। চা খাব। আর ভাই শুনুন, আমার হাতে কোনো পয়সাকড়ি নেই, আমি যে মুনশি বদরুদ্দিন তালুকদারের বাসায় যাব তার জন্যে আপ এন্ড ডাউন রিকশাভাড়াও দেবেন।

ভদ্রলোক চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছেন। আমি গুনগুন করছি –বিধি ডাগর আঁখি যদি দিয়েছিল তবে আমার পানে কেন পড়িল না…

‘কই ভাই, দিন। সিগারেট দিন।’

ভদ্রলোক সিগারেটের প্যাকেট বের করলেন।

‘মুনশি সাহেবের বাসার ঠিকানা সুন্দর করে একটা কাগজে লিখে দিন।’

‘উনার ঠিকানা জানি না

‘না জানলে জোগাড় করুন। আপনি না জানলেও কেউ-না-কেউ নিশ্চয়ই জানে। সেইসঙ্গে আপনার নিজের ঠিকানাটাও এক সাইডে লিখে দেবেন। সময় পেলে এক ফাঁকে চলে যাব। ভাই, আপনার নাম তো এখনো জানলাম না।’

‘চুপ থাকেন।’

‘ধমক দেবেন না ভাই। পাগল মানুষ। ধমক দিলে মাথা আউলা হয়ে যায়। কয়েকটা শিঙাড়া আনতে বলুন তো। খিদে লেগেছে—।’

কেউ কিছু বলছে না। আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি আনন্দিত গলায় বললাম, ভূমিকম্পের সময় আপনারা কে কোথায় ছিলেন?

‘কথা বলবেন না, চা খান।’

শিঙাড়া আনতে বলুন। ঘুসের পয়সার শিঙাড়া খেয়ে দেখি কেমন লাগে?’

আমি চেয়ারে বসে পা দুলাচ্ছি। অফিসের সবাই মোটামুটি হতভম্ব দৃষ্টিতে আমাকে দেখছে।

.

মুনশি বদরুদ্দিনের যে ঠিকানা তারা লিখে দিল সেই ঠিকানায় এই নামে কেউ থাকে না। কোনোদিন ছিলও না। ওরা ইচ্ছা করে একটা বদমায়েশি করেছে। তবে ওরা এখনো বোঝেনি—আমিও কচ্ছপ প্রকৃতির। কচ্ছপের মতো যা একবার কামড়ে ধরি তা আর ছাড়ি না। পূর্ত মন্ত্রণালয়ে আমি একবার না, প্রয়োজনে লক্ষবার যাব। দরকার হলে পূর্ত মন্ত্রণালয়ের বারান্দায় মশারি খাটিয়ে রাতে ঘুমুব।

সারাদুপুর রোদে রাদে ঘুরলাম। ক্লান্ত পরিশ্রান্ত হয়ে ঘুমুতে গেলাম সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। ভর-দুপুরে ঘুমানোর জন্যে বাংলাদেশ সরকার ভালো ব্যবস্থা করেছেন। ধন্যবাদ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার। পার্কগুলি কোন্ মন্ত্রণালয়ের অধীন জানা নেই। জানা থাকলে ওদের একটা থ্যাংকস দেয়া যেত। গাছের নিচে বেঞ্চ পাতা। পাখি ডাকছে। এখানে-ওখানে প্রেমিক-প্রেমিকারা গল্প করছে। এরা এখন কিছুটা বেপরোয়া। ভরদুপুর হলো বেপরোয়া সময়। কেউ তাদের দেখছে কি দেখছে না তা নিয়ে মাথাব্যথা নেই। স্কুল ড্রেস পরা বাচ্চা মেয়েদেরও দেখা যায়। এরা স্কুল ফাঁকি দিয়ে আসে। একটা আইন কি থাকা উচিত না—আঠারো বছর বয়স না হলে ছেলেবন্ধুর সঙ্গে পার্কে আসতে পারবে না। আইন যাঁরা করেন তাঁদের ডেকে এনে এক দুপুরে পার্কটা দেখাতে পারলে হতো।

সেই লোক মেয়েটির গায়ের নানান জায়গায় হাত দিচ্ছে। মেয়েটি খিলখিল করে হাসছে। চাপা গলায় বলছে—এরকম করেন কেন? সুড়সুড়ি লাগে তো।

লোকটা ঠোঁট সরু করে বলল, আদর করি। আদর করি।

বলতে বলতে মেয়েটাকে সে টেনে কোলে বসিয়ে ফেলল। আমি কঠিন গলায় লোকটাকে বললাম, তুই কে রে?

কোনো ভদ্রলোককে তুই বললে তার আক্কেল গুড়ুম হয়ে যায়। কী বলবে ভাবতে ভাবতে মিনিটখানেক লেগে যায়। আমি তাকে কিছু ভাবার সুযোগ দিলাম না। হুংকার দিয়ে বললাম, এই মেয়ে কে? তুই একে চটকাচ্ছিস ক্যান রে শুয়রের বাচ্চা? তুই চল আমার সঙ্গে থানায়।

আমি ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চের লোক। তোদের মতো বদমায়েশ ধরার জন্যে ঘুমের ভান করে শুয়ে থাকি। মেয়েটাকে কোল থেকে নামা। নামিয়ে উঠে দাঁড়া। কানে ধরে উঠবোস কর।

মেয়েটাকে কোল থেকে নামাতে হলো না। সে নিজেই নেমে পড়ল এবং কাঁদার উপক্রম করল। লোকটি কী যেন বলতে গিয়ে থেমে গেল। তারপর আমার কিছু বুঝবার আগেই ছুটে পালিয়ে গেল।

আমি হাই তুলতে তুলতে বললাম, এই লোক কে খুকি?

‘আমার মামা।’

‘আপন মামা?’

‘উহুঁ।’

‘দূরের মামা?’

‘হুঁ।’

‘পলিন, ঐ লোকটার নাম কী?’

পলিন ফ্যাকাসে হয়ে গিয়ে বলল, আপনি আমার নাম জানেন?

‘আমি তোমার নাড়ি-নক্ষত্র জানি। ঐ লোকটা যে বদ তা কি বুঝতে পারছ?’

পলিন ঘাড় বাঁকিয়ে রাখল। সে লোকটাকে বদ বলতে রাজি নয়।

‘বুঝলে পলিন, লোকটা মহাবদ। বদ না হলে তোমাকে ফেলে পালিয়ে যেত না। বদরাই বিপদের সময় বন্ধুকে ফেলে পালিয়ে যায়।’

‘উনি বদ না।’

‘কোন্ ক্লাসে পড়?’

‘ক্লাস এইট।’

‘এরকম কারোর সঙ্গে যদি আর কোনোদিন দেখি তাহলে কি করব জানো?’

‘না।’

‘না জানাই ভালো। যাও, এখন স্কুলে যাও—এখন থেকে তোমার ওপর আমি লক্ষ্য রাখব। একদিন তোমাদের বাসায় চা খেতে যাব।’

‘আপনি কি চেনেন আমার বাসা?’

‘চিনি না কিন্তু তারপরেও যাব।’

‘আপনি কি আমার মাকে সব বলে দেবেন?’

‘তুমি নিষেধ করলে বলব না।’

‘আপনি কি আমার মা’কে চেনেন?’

‘না।’

পলিন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। তার মুখ থেকে কালো ছায়া সরে যাচ্ছে। সে খানিকক্ষণ ইতস্তত করে বলল—আমার মামাকে আপনি খারাপ ভাবছেন। উনি কিন্তু খারাপ না।

‘তাই নাকি?’

‘উনি খুব অসাধারণ।’

‘বল কী? আমার তো অসাধারণ মানুষই দরকার। ঠিক অসাধারণ নয়—পবিত্র মানুষ। আমি পবিত্র মানুষদের একটা লিস্ট করছি। তুমি কি মনে কর ঐ লিস্টে তাঁর নাম রাখা যায়?’

‘অবশ্যই যায়।’

‘তাঁর কী নাম?’

‘রেজা মামা। রেজাউল করিম।’

আমি পকেট থেকে লিস্ট বের করে লিখলাম রেজাউল করিম। এখন এই পলিন মেয়েটাকে চেনা চেনা লাগছে। কোথায় যেন তাকে দেখেছি। তার ভুরু কুঁচকানোর ভঙ্গি খুব পরিচিত। পলিন চলে যাবার পর বুঝলাম, এই মেয়ে আলেয়া খালার নাতনি। মেয়েটার মা’র নাম খুকি।

পলিন যেখানে বসেছিল সেখানে সে তার পেন্সিল বক্স ফেলে এসেছে। বক্সটা ফিরিয়ে দিয়ে আসতে একদিন যেতে হবে ওদের বাসায়। পবিত্র মানুষ জনাব রেজাউল করিম সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করতে হবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *