দরজার ওপাশে – ০৬

পত্রিকার প্রথম পাতায় খবর ছাপা হয়েছে। শিরোনাম : মন্ত্রী অপসারিত। তদন্ত টিম।

মোবারক হোসেন সাহেবের যে ছবি ছাপা হয়েছে তা দেখে সবার মনে হতে পারে, তিনি অপসারিত হওয়ার কারণে খুব আনন্দ পাচ্ছেন। তাঁর মুখ হাসিতে ভরা। ডান হাতের দুটি আঙুলে বিজয়ের ‘ভি’ চিহ্ন দেখাচ্ছেন। সাংবাদিকদের রসবোধ প্রবল। বেছে বেছে এই ছবিটিই তারা ছেপেছে।

ভেতর খবরের সঙ্গে বিজয়ের ‘ভি’ চিহ্ন মোটেই সম্পর্কিত নয়। খবর হলো—মোবারক হোসেন মন্ত্রী থাকাকালীন ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন। দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করেছেন। সরকার এই সমস্ত অভিযোগ তদন্তের জন্য একটি শক্তিশালী তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন। মন্ত্রীর পাসপোর্ট আটক করা হয়েছে এবং তাঁর দেশত্যাগের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে।

জমাট খবর। বিশেষ প্রতিবেদকের নেয়া ইন্টারভ্যু ছাপা হয়েছে :

প্রতিবেদক : আপনার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া কী?

মোবারক : আটচল্লিশ ঘণ্টা পর আপনি তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া জানতে চাচ্ছেন?

প্রতিবেদক : খবর শোনার পর পর আপনার মনের অবস্থা কী হয়েছিল?

মোবারক : বিস্মিত হয়েছিলাম।

প্রতিবেদক : দুঃখিত হননি?

মোবারক : দুঃখিত হবার কারণ ঘটেনি। মন্ত্রীত্ব এমন লোভনীয় কিছু না।

প্রতিবেদক : মন্ত্রীত্ব লোভনীয় না হতে পারে, কিন্তু শোনা যাচ্ছে আপনার বিরুদ্ধে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ আনা হয়েছে। তদন্ত হচ্ছে। অভিযোগ প্রমাণিত হলে শাস্তি হতে পারে।

মোবারক : হতে পারে বলছেন কেন? অভিযোগ প্রমাণিত হলে শাস্তি হওয়াটাই কি অবশ্যম্ভাবী নয়?

প্রতিবেদক : আপনার কি ধারণা, অভিযোগ প্রমাণিত হবে?

মোবারক : অভিযোগ কী তাই এখনো জানি না। জানলে বুঝতে পারতাম অভিযোগ প্রমাণিত হবে কি-না।

প্রতিবেদক : আপনার পাসপোর্ট বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে, এটা কি সত্য?

মোবারক : সত্য নয়। আমার পাসপোর্ট আমার সঙ্গেই আছে। সঙ্গে না থাকলেও কোনো ক্ষতি ছিল না। এই মুহূর্তে দেশের বাইরে যাবার আমার কোনো ইচ্ছা নেই।

প্রতিবেদক : বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে আপনার ব্যাখ্যা কী?

মোবারক : ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে। এর বেশি কিছু না।

প্রতিবেদক : আপনি রাজনীতি থেকে অবসর নেবার কথা ভাবছেন, এটা কি সত্যি?

মোবারক : আমি নিজে কী ভাবছি না ভাবছি তা আমার চেয়ে সাংবাদিকরা বেশি জানেন বলে সবসময় লক্ষ করেছি। কাজেই কিছু বলতে চাচ্ছি না।

ইন্টারভ্যু এখানে শেষ হলেও ‘স্টোরি’ শেষ না। প্রতিবেদক এর পরেও কিছু লিখেছেন। যেমন :

প্রাক্তন মন্ত্রীমহোদয়কে সাক্ষাৎকার গ্রহণকালে খুব হাসিখুশি দেখাচ্ছিল। যদিও এই আপাত খুশির পুরোটাই যে অভিনয় তা বুঝতে কষ্ট হচ্ছিল না। কারণ এই প্রতিবেদক জানতে পেরেছেন, রাজনৈতিক সংকটের পাশাপাশি প্রাক্তন মন্ত্রীমহোদয়ের পারিবারিক জীবনেও সংকট দেখা যাচ্ছে। তাঁর একমাত্র পুত্র দীর্ঘদিন যাবৎ নিখোঁজ। ব্যাপক অনুসন্ধানেও তার কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। প্রাক্তন মন্ত্রীমহোদয়কে তাঁর পুত্র সম্পর্কিত প্রশ্ন করা হলে তিনি বিরক্তি প্রকাশ করে বলেন—‘নিতান্ত ব্যক্তিগত বিষয়ে আমি আপনার সঙ্গে আলাপ করব না।’ প্রাক্তন মন্ত্রীমহোদয়ের স্ত্রীও গুরুতর অসুস্থতার কারণে সম্প্রতি গুলশানের এক ক্লিনিকে চিকিৎসাধীন আছেন। প্রাক্তন মন্ত্রীর একমাত্র কন্যাও মানসিকভাবে অসুস্থ। তিনি দীর্ঘদিন যাবত একজন মনোবিশ্লেষণ চিকিৎসকের চিকিৎসাধীন। জানা গেছে, তার অসুস্থতা সম্প্রতি আরো বৃদ্ধি পেয়েছে।

খবরের কাগজের কোনো খবর দ্বিতীয়বার পড়া যায় না। এটাই আমি দ্বিতীয়বার পড়লাম। দ্বিতীয়বার পড়ে মনে হলো, প্রতিবেদক সাক্ষাৎকারে বিশেষ সুবিধা করতে পারেননি। মোবারক হোসেন সাহেব তাঁকে কোণঠাসা করে ফেলেছিলেন। সেই শোধ তিনি নিয়েছেন কন্যার অসুস্থতার খবর দিয়ে। সত্যের সঙ্গে খানিকটা মিথ্যা ঢুকিয়ে দিয়েছেন।

“দশটি সত্যের সঙ্গে একটা মিথ্যা মিশিয়ে দাও, দেখবে মিথ্যাটি সত্য বলে মনে হবে। কেউ এই মিথ্যা আলাদা করতে পারবে না। কিন্তু দশটি মিথ্যার সঙ্গে যদি একটি সত্যি মিশাও তাহলেও কিন্তু সত্য সত্যই থাকবে। মিথ্যা হবে না।”

এটা আমার বাবার বাণী নয়, এটা আমার নিজের কথা। এসব এখনো পরীক্ষার পর্যায়ে আছে। পরীক্ষা শেষ হলে আমি যদি পুরোপুরি নিশ্চিত হই, তাহলে লিখে ফেলা যাবে।

মোবারক হোসেন সাহেবের বাড়িতে একবার যাওয়া দরকার। কখন যাব বুঝতে পারছি না। সবচে ভালো হয় গভীর রাতে উপস্থিত হলে। রাত দশটায় কোনো বিশিষ্ট মানুষের বাড়িতে গেলে সম্ভাবনা প্রায় একশ ভাগ যে বলা হবে——এত রাতে উনি কারো সঙ্গে দেখা করেন না। এগারোটার দিকে গেলে বলা হবে উনি ঘুমিয়ে পড়েছেন। কিন্তু রাত একটায় উপস্থিত হলে সম্ভাবনা প্রায় নব্বইভাগ যে বিশিষ্ট ব্যক্তি উদ্বিগ্নমুখে উঠে আসবেন। কাজেই গভীর রাতের দিকে যাওয়াই ভালো।

আমি পাঞ্জাবি গায়ে দিলাম, বড় ফুপার অফিসে যাব। মাসের এক তারিখ। টাকাটা নিয়ে আসা দরকার। টাকা পেলে এ মাসেও ফুপার বাড়িতে যাব না।

ফুপা অফিসে ছিলেন। আমাকে দেখে বিরস গলায় বললেন, এসো এসো। মনে মনে তোমাকে এক্সপেক্ট করছিলাম।

‘টাকা নিতে এসেছি, ফুপা।’

‘বুঝতে পারছি। টাকার কথা সবারই মনে থাকে। সংসারত্যাগী সাধু-সন্ন্যাসীদের সবচে বেশি মনে থাকে। বোস চা খাও।’

‘আপনার সামনাসামনি বসব, না খানিকটা দূরে বসব?’

‘সামনেই বস।’

‘আপনি ভালো আছেন তো ফুপা?’

‘ভালো আছি। বাসার অন্য সবাইও ভালো আছে। কাজেই সামাজিক প্রশ্ন-উত্তরপর্ব শেষ। চা কি দিতে বলব?’

‘কফি দিতে বলুন। বড়দরের কোনো অফিসারের কাছে গেলে কফি খেতে ইচ্ছে করে।’

‘ইচ্ছে করলেও খেতে পারবে না। কফি নেই।

‘বেশ, তাহলে চা।’

ফুপা চায়ের কথা বললেন। তার সেক্রেটারিকে বললেন, খানিকক্ষণ ব্যস্ত থাকবেন। কেউ যেন না আসে। ফুপার মুখ থেকে বিরস ভাবটা কেটে যেতে শুরু করেছে।

‘হিমু।’

‘জি স্যার।’

ফুপা ভুরু কুঁচকে বললেন, স্যার বলছ কেন? তোমার উদ্ভট ধরনের রসিকতা আমার সঙ্গে কখনো করবে না। আমি তোমাকে গোটাদশেক প্রশ্ন করব। তুমি ‘হ্যাঁ’ এবং ‘না’ এর মধ্যে জবাব দেবে।

‘সব প্রশ্নের জবাব তো ফুপা ‘হ্যাঁ’ এবং ‘না’ দিয়ে দেয়া যায় না।’

‘আমি এমনভাবে প্রশ্ন করব যেন ‘হ্যাঁ’

‘না’ দিয়ে জবাব দেয়া যায়।’

‘ফুপা, কিছু কিছু ক্ষেত্র আছে যেখানে ‘হ্যাঁ’

‘না’ দিয়ে জবাব দিলেও জবাব সম্পূর্ণ হয় না। যেমন আমি এখন আপনাকে একটা প্রশ্ন করতে পারি যার জবাব ‘হ্যাঁ’

‘না’ দিয়ে দেয়া সম্ভব, কিন্তু জবাব হয় না।’

‘উদাহরণ দাও।’

‘যেমন ধরুন, আমি আপনাকে জিজ্ঞেস করলাম—’আপনি আগে যেমন চুরি করতেন এখনো কি করেন? এর উত্তর কি ‘হ্যাঁ’

‘না’ দিয়ে হবে? আপনি যদি বলেন ‘না’, তার মানে হবে এখন আপনি চুরি করেন না ঠিকই কিন্তু আগে করতেন।’

‘চুপ কর।’

‘জি ফুপা, চুপ করলাম।’

‘তোমার টাকা আলাদা করে রেখেছি, নিয়ে যাও।’

‘থ্যাংকস।’

চা দিয়ে গেছে। ফুপা গম্ভীরমুখে চায়ে চুমুক দিচ্ছেন। মনে হচ্ছে ওষুধ খাচ্ছেন। অথচ চা-টা ভালো হয়েছে। এসি লাগানো ঠাণ্ডা ঘরে বসে গরম চা খাওয়ার আনন্দই আলাদা।

‘হিমু।’

‘জি।’

‘তুমি কি মিথ্যাকথা বল?’

‘আগে কম বলতাম, এখন একটু বেশি বলি।’

‘কেন বল?’

‘একটা পরীক্ষা করছি ফুপা। দশটা সত্যের সঙ্গে একটা মিথ্যা বলে পরীক্ষা করছি সত্যের ক্ষমতা কেমন। একধরনের বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা …..’

‘থামো।’

আমি থামলাম। ফুপা ড্রয়ার থেকে খাম বের করলেন। তিনি টাকা ঠিকই আলাদা করে রেখেছেন। খামের উপর আমার নাম লেখা।

‘হিমু।’

‘জি।’

‘মিথ্যা বলবে না। যা জিজ্ঞেস করব সত্যিই জবাব দেবে। তুমি আমার বাড়িতে যাওনি ঠিকই কিন্তু আমার ধারণা বাদল এর মধ্যে কয়েকবার তোমার সঙ্গে দেখা করেছে। সত্যি না মিথ্যা?’

‘আংশিক সত্য। কয়েকবার আসেনি। একবার এসেছে। তবে বেশিক্ষণ ছিল না। অল্প কিছু সময় ছিল।’

‘আমার ধারণা, এই আধঘণ্টা তুমি তাকে গাছ বিষয়ক কোনো বক্তৃতা দিয়েছ।

‘আপনার ধারণা সত্যি। আমি গাছের রোগ নিরাময়ের ক্ষমতার কথা ওকে বলেছি। আফ্রিকান জুলু জাতির মধ্যে একধরনের নিয়ম প্রচলিত। গুরুতর অসুস্থ কোনো মানুষ শেষ চিকিৎসা হিসেবে স্বাস্থ্যবান কোনো গাছকে জড়িয়ে ধরে দিনের পর দিন পড়ে থাকে। তাদের ধারণা, এতে গাছ তাকে জীবনীশক্তি দেয়। প্রায় সময়ই দেখা যায় স্বাস্থ্যবান গাছটা রোগগ্রস্ত হয়, মানুষটা সেরে উঠে।’

ফুপা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বললেন, আমিও তাই ধারণা করেছিলাম। ও আইডিয়া পেয়েছে তোমার কাছ থেকে। কয়েকদিন ধরেই দেখছি ও আমাদের বাড়ির পেছনের আমগাছটা জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, এসব কী? জবাব দেয় না, হাসে।

‘ওর তো কোনো অসুখ-বিসুখ নেই। শুধু শুধু গাছ জড়িয়ে ধরে আছে কেন?’

‘অসুখ-বিসুখ নেই বলছ কেন? ওর অসুখ ওর মাথায়। ওর ব্রেইন ডিফেক্ট।’

আমি নিচু গলায় বললাম, ব্রেইন ডিফেক্টের ক্ষেত্রে গাছ-চিকিৎসায় লাভ হবে কি-না কে জানে। কাজ হলে একটা ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হবে। দেখা যাবে, বাদল সুস্থ হয়ে গেল কিন্তু গাছটার হয়ে গেল ব্রেইন ডিফেক্ট।

‘হিমু, তুমি কি আমার সঙ্গে রসিকতা করার চেষ্টা করছ?’

‘জি না ফুপা। আমি সিরিয়াসলি ভাবছি—গাছের ব্রেইন ডিফেক্ট হয় কি না। যদি হয় তাহলে গাছ কী করে?’

‘শোন হিমু, তোমার কাছে আমি আরেকটা প্রপোজাল দিচ্ছি।’

‘দিন।’

‘তুমি এই মেস ছেড়ে দিয়ে অন্য কোনো মেসে যাও, যাতে বাদল তোমাকে খুঁজে বের করতে না পারে। পাঁচশ-র বদলে আমি তোমাকে এক হাজার করে টাকা দেব। শুধু তাই না, আই উইল রিমেইন এভারগ্রেটফুল। ছেলেটাকে তোমার ইনফ্লুয়েন্স থেকে বাঁচাতে হবে। সবচে ভালো হয় যদি তোমাকে সারিয়ে তোলা যেত। এতে সমাজের একটা উপকার হতো। আচ্ছা, তুমি কি বিয়ে-টিয়ে করে সংসারী হবার কথা ভাবো?’

‘প্রায়ই ভাবি।’

‘তাহলে বিয়ে করে ফেল। বিয়ের যাবতীয় খরচ আমি দেব। একটা শিক্ষিত মেয়ে বিয়ে কর। আমি মেয়েটার জন্যে একটা ভালো চাকরির ব্যবস্থা করে দেব। তোমরা দুজন আমার বাড়িতেও থাকতে পার। একতলায় দুটা ঘর আমি তোমাদের জন্যে ছেড়ে দেব। ধীরেসুস্থে তোমরা আলাদা সংসার শুরু করবে।’

‘প্রস্তাব খুব লোভনীয় মনে হচ্ছে ফুপা।’

‘আমি শুধু যে প্রস্তাব দিচ্ছি তাই না—আই মিন ইট। তোমার যে একজন পরিচিত মেয়ে আছে—রূপা, ও কি তোমাকে বিয়ে করতে রাজি হবে?

‘বুঝতে পারছি না। কখনো জিজ্ঞেস করিনি।’

‘তাহলে জিজ্ঞেস কর। এখনই কর। টেলিফোন নাম্বার জানা আছে?’

‘আছে।’

‘Then call her, ask her.’

ফুপা টেলিফোন-সেট এগিয়ে দিলেন। আমি হালকা গলায় বললাম, এত তাড়া কিসের ফুপা?

‘তাড়া আছে। তুমি টেলিফোন কর। আমার সামনে কথা বলতে তোমার যদি অস্বস্তিবোধ হয় আমি উঠে যাচ্ছি।’

‘আপনাকে উঠতে হবে না।’

রূপাকে পাওয়া গেল। আমি গম্ভীর গলায় বললাম, কেমন আছ রূপা? সে অনেকক্ষণ কোনো কথা বলল না।

‘হ্যালো রূপা?’

‘বল, শুনছি।’

‘পরীক্ষা কেমন হচ্ছে?

‘ভালো।’

‘কীরকম ভালো?’

‘বেশ ভালো। তুমি হঠাৎ এতদিন পর টেলিফোন করলে কী মনে করে?’

‘জরুরি কাজে টেলিফোন করলাম।’

‘আমার সঙ্গে তো কোনো জরুরি কাজ থাকার কথা না।’

‘রেগে রেগে কথা বলছ কেন, রূপা?’

‘রেগে রেগে কথা বলার কারণ আছে বলেই রেগে রেগে বলছি। তুমি তোমার আস্তানা আবার বদলেছ। পুরনো ঠিকানায় খোঁজ নিতে গিয়ে আমি হতভম্ব। তুমি যে—ঘরে থাকতে সেখানে গুণ্ডা ধরনের এক লোক লাল রঙের একটা হাফপ্যান্ট পরে শুয়েছিল। আমি হতভম্ব। কী যে ভয় পেয়েছিলাম! তোমার কি উচিত ছিল না আমাকে ঠিকানা বদলের ব্যাপারটা জানানো?’

‘অবশ্যই উচিত ছিল।’

‘তোমার কি উচিত ছিল না আমার জন্মদিনে আসা? আমি রাত এগারোটা পর্যন্ত তোমার জন্যে অপেক্ষা করেছি। থাক এসব, এখন তোমার জরুরি কথা বল।’

‘রূপা, তুমি কি বিয়ের কথা ভাবছ?’

‘কী বললে?’

‘তুমি বিয়ে-টিয়ের কথা ভাবছ না-কি?’

‘পরিষ্কার করে বল কী বলতে চাও?’

‘জানতে চাচ্ছিলাম—আমি যদি তোমাকে বিয়ের কথা বলি, তুমি কি রাজি হবে? অল্প কথায় উত্তর দাও। ক্যুইজ ধরনের প্রশ্ন। হ্যাঁ অথবা না।

রূপা শীতল গলায় বলল, তোমার এ জাতীয় রসিকতা আমার ভালো লাগে না। তুমি যে জীবন যাপন কর তাতে এ-ধরনের রসিকতার হয়তো কোনো গুরুত্বপূর্ণ স্থান আছে। আমার জীবনে নেই। তুমি নানান ধরনের এক্সপেরিমেন্ট তোমার জীবন নিয়ে করতে পার। আমি পারি না।

‘তুমি আসল প্রশ্নের উত্তর দাওনি।’

‘সত্যি যদি উত্তর চাও তাহলে বলছি—তুমি চাইলে আমি রাজি হবো। আমি জানি তা হবে আমার জীবনের সবচে বড় ভুল। তারপরেও রাজি হবো। আমি যে রাজি হব তাও কিন্তু তোমার জানা।’

‘আচ্ছা রূপা রাখি, কেমন?’

টেলিফোন নামিয়ে আমি করুণ-চোখে ফুপার দিকে তাকালাম। ফুপা বললেন, মেয়ে কী বলল? আমি দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বললাম, হেসে ফেলল। এখনো বোধহয় হাসছে। আপনার কথায় টেলিফোন করতে গিয়ে আমি একটা লজ্জার মধ্যে পড়লাম। রূপা এমনভাবে হাসছে যেন পাগলের প্রলাপ শুনল। ফুপা আজ উঠি?

ফুপা ক্লান্ত গলায় বললেন, আজ তারিখ কত?

‘আজ হলো আপনার ২২শে চৈত্র

‘বাংলা তারিখ দিয়ে কী করব? ইংরেজিটা বল।’

‘এপ্রিলের পাঁচ তারিখ।’

‘দিনতারিখ কি সব মুখস্থ থাকে?’

‘সব দিন থাকে না। আজকেরটা আছে। আজ পূর্ণিমা। প্রতিপাদ শুরু হবে ১/১৫/৫৫-এ।’

‘প্রতিপাদ ব্যাপারটা কী?’

ব্যাপারটা কী বলতে যাচ্ছিলাম, তার আগেই ফুপা আমাকে থামিয়ে দিলেন। বিরক্ত মুখে বললেন, তুমি যাও। পূর্ণিমা দেখ গিয়ে। ভালো করে দেখ।

আসলেই অনেকদিন পূর্ণিমা দেখা হচ্ছে না। জোছনারাতে পথে বের হলেই পূর্ণিমা দেখা যায় না। তার জন্যে দীর্ঘ প্রস্তুতি লাগে।

পূর্ণিমা দেখতে হলে শরীর হালকা করতে হয়। সারাদিনে কখনো গুরুভোজন করা যাবে না। অল্প আহার—ফলমূল, দুধ। দিনে কখনো চোখ মেলা যাবে না। সূর্যালোক দেখা বা গায়ে রোদ লাগানো পুরোপুরি নিষিদ্ধ। চাঁদ আকাশের মাঝামাঝি পর্যন্ত উঠলে তবেই চোখ মেলা যাবে। তবে তার আগে বরফ-শীতল পানিতে গোসল করে নিতে হবে। পূর্ণিমা দেখতে হবে বনে গিয়ে। আশেপাশে ইলেকট্রিকের আলো, কুপির আলো বা মোমের আলো কিছুই থাকবে না। জোছনা দেখা যাবে, তবে চাঁদের দিকে একবারও তাকানো যাবে না। সঙ্গে দ্বিতীয় কোনো ব্যক্তি থাকতে পারবে না।

এমন কঠিন নিয়মকানুনে এখনো জোছনা দেখা হয়নি। তাছাড়া এভাবে জোছনা দেখা দুর্বলচিত্ত মানুষের জন্যে নিষিদ্ধ। এরা সৌন্দর্যের এই রূপ সহ্য করতে পারে না। প্রচণ্ড ভাবাবেশ হয়। যার ফল হয় সুদূরপ্রসারী। জোছনার অলৌকিক জগতে একবার ঢুকে গেলে লৌকিক জগতে ফিরে আসা নাকি কখনোই সম্ভব হয় না।

খুব শিগগিরই এক রাতে জোছনা দেখতে যাব। এদিকের কাজটা একটু গুছিয়ে নেই। রফিকের সমস্যাটা মিটে যাক। মনে অশান্তি রেখে চন্দ্রস্নাত পৃথিবী দেখার নিয়ম নেই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *