দেবী – ২৪ (শেষ)

২৪

ঘর অন্ধকার। কিন্তু চোখে অন্ধকার সয়ে আসছে। আবছামতো সব কিছু দেখা যায়। বাড়িটা কোথায়? শহর থেকে অনেক দূরে কি? কোনো শব্দ নেই। কত রাত এখন? বাড়িতে এখন ওরা কী করছে? বিলু কি ঘুমিয়েছে মশারি ফেলে? না, না—আজ কেউ ঘুমায় নি, আজ সবাই ছোটাছুটি করছে। সবাই খুঁজছে নীলুকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই হয়তো পুলিশের গাড়ির শব্দ শোনা যাবে। বাবা এসে বলবেন—কোনো ভয় নেই মা-মণি।

চেয়ার নড়ার শব্দ হল। লোকটি কি উঠে দাঁড়িয়েছে? তার হাতে ওটা কী? নীলু মনে-মনে বলল, ‘বাবা, আমি একজন অসুস্থ লোকের হাতে আটকা পড়েছি, আমাকে তোমরা বাঁচাও। আমার আর মোটেও সময় নেই বাবা। তোমাদের খুব তাড়াতাড়ি করতে হবে।

লোকটি এগিয়ে আসছে। পেছন থেকে সে খুব ধীর গতিতে এগিয়ে এল সামনে। এখন নীলু আবছাভাবে লোকটির মুখ দেখতে পাচ্ছে। কী সুন্দর একটি মুখ। নীলু বিড়বিড় করে বলল, ‘প্লীজ, দয়া করুন।’ লোকটি অদ্ভুত শব্দ করল। এটি কি হাসির শব্দ? নীলুর গা গোলাচ্ছে। নীলু চিৎ হয়ে থাকা অবস্থাতেই মুখ ভর্তি করে বমি করল। দুঃস্বপ্ন, সমস্তটাই একটা দুঃস্বপ্ন। এক্ষুণি ঘুম ভেঙে যাবে। আর নীলু দেখবে—বিলু বাতি জ্বালিয়েই ঘুমিয়ে পড়েছে। তার বুকের ওপর একটা গল্পের বই। এখানে যা ঘটছে, তা সত্যি হতেই পারে না!

লোকটি তার পাশে দাঁড়িয়ে হাত বাড়াল। নীলু চাপা গলায় বলল, ‘আমার গায়ে হাত দেবেন না, প্লীজ।’ লোকটি হেসে উঠছে শব্দ করে। আর ঠিক তখনই নূপুরের শব্দ শোনা গেল। যেন কেউ একজন এসে ঢুকেছে এ-ঘরে।

লোকটি ভারি গলায় বলল, ‘কে, কে ওখানে?’ তার উত্তরে অল্পবয়সী একটি মেয়ে খিলখিল করে হেসে উঠল। লোকটি চেঁচাল, ‘কে, কে?’ কোনো উত্তর পাওয়া গেল না। শুধু ঘরের শেষ প্রান্তের একটা জানালা খুলে ভয়ানক শীতল একটা হাওয়া এসে ঢুকল ঘরে। সে হাওয়ায় ভেসে এল অদ্ভুত মিষ্টি একটা গন্ধ

নীলুর মনে হল একটি মেয়ে যেন নূপুর পায়ে দিয়ে তার চারপাশ দিয়ে ঘুরতে শুরু করেছে। ঘুরতে-ঘুরতে এক বার মেয়েটি তাকে স্পর্শ করল, আর তক্ষুণি নীলুর মনে হল—আর কোনো ভয় নেই।

নীলু দেখল, লোকটি ক্রমেই দেয়ালের দিকে সরে যাচ্ছে। এক বার সে চাপা স্বরে বলল, ‘তুমি কে?’ মিষ্টি একটি হাসি শোনা গেল তখন। ফুলের গন্ধ আরো তীব্র হল। অন্য কোনো ভুবন থেকে ভেসে এল নূপুরের ধ্বনি। লোকটি গা ঠেকিয়ে বিড়বিড় করে বলল, ‘এসব কী হচ্ছে। কে, এখানে কে?’ কেউ তার কথার জবাব দিল না। একটি দুষ্টু মেয়ে শুধু হাসতে লাগল। ভীষণ দুষ্টু একটি মেয়ে। তার পায়ে নূপুর। তার গায়ে অপার্থিব এক ফুলের গন্ধ। মেয়েটি এবার দু’ হাত বাড়িয়ে এগিয়ে যাচ্ছে লোকটির দিকে। লোকটির কর্কশ কণ্ঠ শোনা গেল, ‘এইসব কী? কে, কে?’ তার উত্তরে সমস্ত ঘরময় মিষ্টি খিলখিল হাসি ঝমঝম করতে লাগল। লোকটি চাপা গলায় বলে উঠল, ‘আমাকে বাঁচাও। বাঁচাও।’ দুষ্টু মেয়েটি আবার হাসল, যেন খুব একটা মজার কথা।

পরিশিষ্ট

থার্ড ইয়ার অনার্সের এই ক্লাসটি মিসির আলি সাহেবকে দেওয়া হয়েছে। সাইকোলজি ফিথ পেপার। মিসির আলি হাসিমুখে ক্লাসে ঢুকলেন। তাঁর মাথা ঝিমঝিম করে উঠল। রানু বসে আছে সেকেন্ড বেঞ্চে। তাঁর দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হল। তিনি মেয়েটির দিকে তাকালেন এবং তাকিয়ে রইলেন। মনে হল, মেয়েটির ঠোঁটের কোণায় হাসি লেগে আছে। মিসির আলি কাঁপা গলায় বললেন, ‘তোমার নাম কি?’

মেয়েটি উঠে দাঁড়াল। স্পষ্ট স্বরে বলল, ‘আমার নাম নীলু। নীলুফার। রোল নাম্বার থার্টি টু।’

‘আমি একটি মেয়েকে চিনতাম। তুমি দেখতে অবিকল তার মতো।‘

নীলুফার শান্ত স্বরে বলল, ‘আমি জানি।’

মিসির আলি সাহেব কপালের ঘাম মুছলেন। সমস্ত ব্যাপারটি ভুলে যাবার প্রাণপণ চেষ্টা করতে-করতে বললেন, ‘আমি তোমাদের পড়াব ফিফ্‌থ্ পেপার। খুব ইন্টারেস্টিং একটি টপিক—’

রানুর মতো দেখতে মেয়েটি তাকিয়ে আছে তাঁর দিকে। মেয়েটির মুখে মৃদু হাসি।

1 Comment
Collapse Comments
S M SADDAM HOSSAIN June 27, 2023 at 9:49 am

বইটি পড়তে খুব ভালো লাগলো! অসাধারণ লিখনি, অনেক কিছুই জানতে পারলাম।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *