দেবী – ২৩

২৩

রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রানুর অবস্থা খারাপ হতে লাগল। বারবার বলতে লাগল—উফ্, বড্ড গরম লাগছে। আনিস সমস্ত দরজা-জানালা খুলে দিল, ফ্যান ছেড়ে দিল, তবু তার গরম কমল না। রানু কাতর স্বরে বলল, ‘তুমি আমাকে ধরে থাক, আমার বড্ড ভয় লাগছে।’

‘এই তো আমি তোমাকে ধরে আছি। কিসের এত ভয়, রানু?’

‘আমার সামনে ঐ লোকটি বসে আছে—আমি স্পষ্ট দেখছি। ওর হাতে একটা ক্ষুর।‘

রানু ফোঁপাতে শুরু করল। ওকে ডাক্তারের কাছে নেওয়া উচিত। যত তাড়াতাড়ি নেওয়া যায় ততই ভালো। আনিস ডাকল, ‘জিতু—জিতু মিয়া।’ কিন্তু জিতু মিয়ার ঘুম ভাঙল না। রানু বলল, ‘তুমি আমাকে একা রেখে কোথাও যেতে পারবে না। আমার বড় ভয় লাগছে।’

‘কোনো ভয় নেই রানু।’

‘লোকটি ক্ষুর হাতে বসে আছে। তবু তুমি বলছ ভয় নেই?’

এই সব তোমার কল্পনা। এস, তোমার মাথায় একটু পানি দিই?’

‘তুমি কোথাও যেতে পারবে না। ঐ লোকটি এখন উঠে দাঁড়িয়েছে। তুমি আমাকে শক্ত করে ধরে থাক। আরও শক্ত করে ধর।’

আনিস তাকে জড়িয়ে ধরে বসে রইল। রানু ক্ষীণ কণ্ঠে বলল, ‘আমি তোমাকে একটি কথা কখনো বলি নি। একবার একজন লোক আমাকে মন্দিরে নিয়ে গিয়েছিল।’

‘রানু, এখন তোমাকে কিছুই বলতে হবে না। দয়া করে চুপ করে থাক।’

‘না, আমি বলতে চাই।’

‘সকাল হোক। সকাল হলেই শুনব।’

‘মাঝে মাঝে আমার মনে হয় একজন-কেউ আমার সঙ্গে থাকে।’

‘রানু, চুপ করে থাক।

‘না, আমি চুপ করে থাকব না। আমার বলতে ইচ্ছে করছে। যে আমার সঙ্গে থাকে, তার সঙ্গে আমি অনেক বার কথা বলেছি। কিন্তু আজ সে কিছুতেই আসছে না।’

‘তার আসার কোনো দরকার নেই।’

‘তুমি বুঝতে পারছ না, তার আসার খুব দরকার।’

রাত দেড়টার দিকে নিচ থেকে বিলুর কান্না শোনা যেতে লাগল। অনেক লোকজনের ভিড়। কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে। রানু বলল, ‘বিলু কাঁদছে। বড় খারাপ লাগছে আমার।’

‘রানু, তুমি একটু শুয়ে থাক। আমি জিতুকে ডেকে দিচ্ছি।’

‘তুমি কোথায় যাবে?’

‘আমি একজন ডাক্তার নিয়ে আসব। আমার মোটেই ভালো লাগছে না।’

‘তুমি আমাকে ফেলে রেখে কোথাও যেতে পারবে না।’

রানুর কথা জড়িয়ে যেতে লাগল। এক সময় বিছানায় নেতিয়ে পড়ল। আনিস ছুটে গেল ডাক্তার আনতে। বড় রাস্তার মোড়ে একজন ডাক্তারের বাসা আছে। ডাক্তার সাহেবকে পাওয়া গেল না। আনিস ফিরে এসে ঘরে ঢোকবার মুখেই তীব্র ফুলের গন্ধ পেল। ঘরের বাতি নেভানো। কে নিভিয়েছে বাতি? আনিস ঢুকতেই রানু বলল, এসেছে।’

‘কে? কে এসেছে?’

‘তুমি গন্ধ পাচ্ছ না?’

আনিস এগিয়ে এসে রানুর হাত ধরল। গা ভীষণ গরম। রানু বলল, ‘ও নীলুর কাছে যাবে।’

‘রানু, শুয়ে থাক।’

‘উঁহু, শোব কীভাবে? ও একা যেতে ভয় পাচ্ছে। আমিও যাব ওর সঙ্গে। ও আমাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে।’

বলতে-বলতে রানু খিলখিল করে হাসল।

আনিস বারান্দায় দাঁড়িয়ে ডাকল, ‘রহমান সাহেব, রহমান সাহেব। ভাই, একটু আসুন, আমার বড় বিপদ।’

রহমান সাহেব ঘরে ছিলেন না। তাঁর স্ত্রী বেরিয়ে এলেন। তিনি অবাক হয়ে বললেন, ‘কী হয়েছে?’

‘আপনি একটু আসুন, আমার স্ত্রী কেমন যেন করছে।

ভদ্রমহিলা সঙ্গে-সঙ্গে এলেন। এবং ঘরে ঢুকেই অবাক হয়ে বললেন, ‘নূপুরের শব্দ না?’ রানু কিশোরী মেয়ের গলায় খিলখিল করে হাসল।

‘কী হয়েছে ওনার?’

‘আপনি একটু বসুন ওর পাশে। আমি ডাক্তার নিয়ে আসি।’

আনিস ছুটে বেরিয়ে গেল। ফুলের সৌরভ তীব্র থেকে তীব্রতর হতে লাগল। রানু হাসিমুখে বলল, ‘আমার সময় বেশি নেই, ঐ লোকটি এগিয়ে আসছে।’

‘কোন লোক?’

‘আপনি চিনবেন না। না-চেনাই ভালো।’

ভদ্রমহিলা রানুর হাত ধরলেন। উত্তাপে গা পুড়ে যাচ্ছে। তিনি কী করবেন ভেবে পেলেন না।

আনিস ডাক্তার নিয়ে ফেরার আগেই রানু মারা গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *