স্বর্ণদ্বীপ ২

মাসুদ রানা ২৩০ – স্বর্ণদ্বীপ ২ – কাজী আনোয়ার হোসেন – সেবা প্রকাশনী

প্রথম প্রকাশ: ১৯৯৫

০১.

সোর-হামনার উত্তর-পশ্চিম কোণে থেমেছে ইভনিং স্টার, বেয়ার আইল্যাণ্ডের সর্বদক্ষিণ প্রান্ত থেকে তিন মাইল উত্তর-পুবে। সোর-হামনার আদল ইংরেজি ইউ অক্ষরের সঙ্গে মেলে, দক্ষিণ দিক খোলা, চওড়ায়, অর্থাৎ পুব-পশ্চিমে এক হাজার গজের কিছু বেশি হবে, আর লম্বায় অর্থাৎ উত্তর-দক্ষিণে প্রায় এক মাইলের কাছাকাছি। হারবারের পুব বাহু খুব বেশি দূর এগোয়নি, ওদিকে ছোট একটা উপদ্বীপ আছে, সম্ভবত তিনশো গজ লম্বা সেটা, এরপর পানির একটা দুশো গজ ফাঁক, পানিতে মাথা তুলে আছে বিভিন্ন আকৃতির দ্বীপ। শেষ মাথার দ্বীপটাই আকারে সবচেয়ে বড়, ওটার নাম মাকেল, পুব-পশ্চিমে অত্যন্ত সরু, উত্তর দক্ষিণে প্রায় আধ মাইল লম্বা। হারবারের উত্তর ও পুব দিকের জমিন নিচুই বলা যায়, দক্ষিণ দিককার মত এদিকের পাহাড়গুলো আকাশ ছোঁয়নি, সবচেয়ে উঁচু পাহাড়টার চূড়া চারশো ফুটের বেশি নয়, তবে এদিকের জমিন বরফে ঢাকা।

বেয়ার আইল্যাণ্ডে নোঙর ফেলার জন্যে সোর-হামনা অর্থাৎ সাউথ হেভেন-ই সবচেয়ে আদর্শ জায়গা। পশ্চিমা বাতাস থেকে পুরোপুরি বাঁচতে হলে জাহাজগুলোকে এখানে আশ্রয় নিতে হবে, এখানে আশ্রয় নিলে উত্তুরে বাতাস থেকেও অনেকটা রেহাই পাওয়া যায়। তবে বাতাস যদি পুব দিক থেকে বয়, নিরাপদ আশ্রয় মেলে কি না নির্ভর করবে বাতাসের গতিবেগ আর ক্যাপ হিয়ার ও মাকেল দ্বীপ দুটোর মধ্যবর্তী ফাঁকটার ওপর। সে-কথা মনে রেখেই খুব ব্যস্ততার সঙ্গে কার্গো খালাস করা হচ্ছে জাহাজ থেকে। নোঙর ফেলা অবস্থায় সহজেই। বাতাসের হুমকি মোকাবিলা করতে পারবে ইভনিং স্টার, কিন্তু সমস্যা হলো নোঙর। ফেলার বদলে লাইমস্টোন জেটির সঙ্গে বাঁধা হয়েছে ওটাকে। বেয়ার আইল্যাণ্ডের যে আবহাওয়া, লোহা বা কাঠের কাঠামো টিকবে না বলেই লাইমস্টোন দিয়ে তৈরি করা হয়েছে জেটিটা। কালের আঁচড়ে সেটারও এখন ভগ্নদশা। শুরুতে ওটার আকৃতি ছিল ইংরেজি টি অক্ষরের মত, কিন্তু টি-র বাম বাহু গায়েব হয়ে গেছে। দড়িদড়া দিয়ে বাঁধা অবস্থায় দোল খাচ্ছে ইভনিং স্টার, দক্ষিণ-পুব থেকে আসা বাতাস লাগছে ওটার স্টারবোর্ডে। কার্গো নামাবার কাজে সবাই ব্যস্ত হয়ে উঠলেও, কাজটা এগোচ্ছে খুব ধীরগতিতে। জেটির সঙ্গে জাহাজের ঘন ঘন ধাক্কা লাগায় জাহাজের কোন ক্ষতি হবার ভয় না থাকলেও, জেটির লাইমস্টোন মাঝেমধ্যেই ভেঙে পড়ছে সোর-হামনায়, বড় আকারের দুএকটা পাথর ছিটকে এসে ইভনিং স্টারের ডেকেও পড়ছে। ভয়ের ব্যাপার হলো, এখনও ওদের বেশির ভাগ ফুয়েল ও অন্যান্য কার্গো ডেকেই পড়ে রয়েছে।

দুপুরের দিকে প্রথম যখন জেটির পাশে পৌঁছুল ওরা, কার্গো নামানোর। কাজটা বেশ সুষ্ঠুভাবেই শুরু হয়। তখনও ইভনিং স্টারকে বাধাছাদার কাজ শেষ হয়নি, আফটার ডেরিক থেকে প্রথমে ষোলো ফুট লম্বা একটা ওঅর্ক-বোট নামানো হয় পানিতে, তারপর সামান্য ছোট অপর একটা বোট। দশ মিনিট পর ফরোয়ার্ড ডেরিক থেকে অদ্ভুত আকৃতির সাবমেরিনটাকে নামানো হয় পানিতে। কোন ঝামেলা হয়নি, চমৎকার ভাসতে থাকে সেটা, কৃতিত্বটা চার টনী কাস্ট-আয়রন ব্যালাস্ট-এর। এরপর কোনিং টাওয়ার জোড়া লাগাবার জন্যে পজিশন মত আনা হয়, এবং তারপর থেকেই দেখা দেয় সমস্যা।

কি কারণে কে জানে, জোড়া লাগানো অসম্ভব মনে হলো। এরিক কার্লসন, মিখায়েল ট্যাকার ও ক্লার্ক বিশপ, এই তিনজনই শুধু টেস্ট করার সময় উপস্থিত ছিলেন। তাঁরা সবাই জানালেন, টেস্ট করার সময় বোল্ট লাগাতে কোন সমস্যা হয়নি। তারপর কারণটাও জানা গেল। ধাক্কা লাগায় তুবড়ে গেছে কোনিং টাওয়ার, তাই ফিট করছে না। সমাধানও আছে, তোবড়ানো অংশ হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে সোজা করে নিতে হবে। কিন্তু মুশকিল হলো, জাহাজে কোন দক্ষ প্লেট লেয়ার নেই। যে কাজ কয়েক মিনিটে হবার কথা, সেটা সারতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লেগে গেল। পানি থেকে আবার তোলা হলো কোনিং টাওয়ার, আনাড়ি লোকজনের হাতে হাতুড়ি ধরিয়ে দিয়ে কাজটা করানোর চেষ্টা হলো।

এ-সব কারণে ক্যাপটেন ডানহিল মোটেও উদ্বিগ্ন নন, কারণ কোন কিছুতে উদ্বেগের ভাব প্রকাশ করা তাঁর স্বভাব নয়। তবে সোর-হামনায় ওরা পৌঁছুনোর পর থেকে কফি ছাড়া আর কিছু খাননি তিনি, অর্থাৎ লাঞ্চও করেননি। তিনি যদি উদ্বিগ্ন হন, এটাই তার একমাত্র লক্ষণ। ইভনিং স্টারের নিরাপত্তার দিকটাই সবার আগে বিবেচনা করেন ভদ্রলোক। প্যাসেঞ্জারদের ব্যাপারে তার কোন মাথাব্যথা নেই। তবে তিনি চাইছেন ফোরডেক যত তাড়াতাড়ি সম্ভব খালি হয়ে যাক। প্রয়োজন ছিল না, তবু ফন গোলডা তাকে মনে করিয়ে দিয়েছেন যে চুক্তিতে আছে। ইভনিং স্টার হ্যামারফেস্টের উদ্দেশে রওনা হবার আগে প্যাসেঞ্জার ও কার্গো নামিয়ে দিতে হবে। এদিকে কাজ এগোচ্ছে না, অথচ বাতাসের গতিবেগ ধীরে ধীরে বাড়ছে, এগিয়ে আসছে রাতও।

এ-সব সমস্যা হওয়ায় লাভ হয়েছে এইটুকু যে ল্যারি আর্চারের নিখোঁজ রহস্য নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় পাচ্ছেন না ক্যাপটেন। তবে ইতিমধ্যে ডক্টর মাসুদ রানাকে তিনি জানিয়েছেন, হ্যামারফেস্টে পৌঁছে তাঁর প্রথম কাজ হবে পুলিসকে ব্যাপারটা জানানো। এই পর্যায়ে তাকে দুটো কথা বলার ছিল ওর, তবে বলেনি। প্রথম কথা, পুলিসকে জানিয়ে কি লাভ হবে? দ্বিতীয় কথা, ওর ধারণা, হ্যামারফেস্টে আসলে তার পৌঁছুনোই হবে না। কিন্তু এ-সব কেন ও ভাবছে, তা ব্যাখ্যা করার সময় এটা নয়। ক্যাপটেনের মেজাজ খুব একটা ভাল নেই।

ধাতব গ্যাংওয়ে ধরে নিচে নেমে এল রানা। গ্যাংওয়ের মরচে ধরা হুইলগুলো ইভনিং স্টারের প্রতিটি দোল খাওয়ার সঙ্গে আগুপিছু করছে। প্রাচীন জেটিতে থামল ও। ছোট একটা ট্র্যাক্টর আর একটা এ-ক্যাট দেখতে পেল, দুটোর সঙ্গেই টোইং পেজ লাগানো রয়েছে। কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে এরিক কার্লসন কার্গো লোড করছেন ওগুলোয়, জেটির শেষ মাথা থেকে বিশ গজ দূরের ঘরগুলোয় নিয়ে যাওয়া হবে। কাজে সবাইকে খুব আন্তরিক বলে মনে হলো, আন্তরিক না হলে ফ্রিজিং পয়েন্টের চেয়ে পনেরো ডিগ্রী নিচের টেমপারেচারে কারও পক্ষে হাত চালিয়ে কাজ করা সম্ভব নয়। ওদের পিছু নিয়ে ঘরগুলো পর্যন্ত এল রানা।

প্রাচীন জেটির সঙ্গে কোন মিল নেই, ঘরগুলো যেন ইদানীং তৈরি করা। হয়েছে। সব মিলিয়ে পাঁচটা কাঠামো, একটার সঙ্গে অপরটার যথেষ্ট দূরত্ব। আর্কটিকে আগুন হলো অন্যতম শত্রু, দূরত্ব রক্ষা করার সেটাই কারণ, একটা ঘরে আগুন লাগলে তা যাতে অন্য ঘরগুলোয় ছড়িয়ে পড়তে না পারে।

ফাঁকা একটা জায়গার এক ধারে চারটে ঘর, ওগুলো ফুয়েল, রসদ, ইকুইপমেন্ট আর বাহনের জন্যে। মাঝখানের কাঠামোটা অদ্ভুত আকৃতির, প্রকাণ্ড একটা স্টারফিশ যেন। কেন এই ডিজাইন, আন্দাজ করা কঠিন, ডিজাইনার হয়তো ভেবেছে এই আকৃতির কারণে ঘরগুলোর বাতাস গরম থাকবে। মাঝখানের এই কাঠামোর ভেতর রয়েছে থাকার, খাবার ও রান্নার ঘর-তারকার প্রতিটি বাহুই ছোট আকারের একটা কামরা। তেল ভরা হিটার দেয়ালে আটকানো আছে, ঘর গরম রাখার জন্যে। কোলম্যান কেরাসিন ল্যাম্প জ্বেলে অন্ধকার দূর করা হয়। রান্নাবান্নার কাজ চলে সাধারণ স্টোভে। রানা জানতে পেরেছে, ফন গোলডা সঙ্গে করে কোন বাবুর্চি আনেননি; কুক মানেই বাড়তি খরচা।

মোনাকা ছাড়া বাকি সবাই, এমনকি দুর্বল ও আনাড়ি হুপারও, এই প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় বিরতিহীন কাজ করে যাচ্ছে। সবাই তারা চুপচাপ ও বিষণ্ণ, যদিও তাদের কারও সঙ্গেই ল্যারি আর্চারের ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব ছিল না। আসলে শ্যুটিং স্পটে পৌঁছুনোর আগেই ফুড পয়জনিঙের ঘটনাটা তাদেরকে একটা বিষম ধাক্কা দিয়ে গেছে, আর্চারের নিখোঁজ রহস্য তার সঙ্গে যোগ হওয়ায় হতভম্ব হয়ে গেছে তারা। মিখায়েল ট্যাকার আর জক মুর, যারা একান্ত প্রয়োজন ছাড়া পরস্পরের সঙ্গে কথা বলেন না, এই মুহূর্তে একটা টিম হয়ে কাজ করছেন-ফুয়েল, রসদ, খাবারদাবার, কাপড়চোপড়, ইকুইপমেন্ট ইত্যাদি চেক করছেন। ফন গোলডা অত্যন্ত সাবধানী মানুষ, সব কিছু নিখুঁত অবস্থায় দেখতে চান। এমনকি মরগানকেও খুব ব্যস্ত দেখা গেল, ডাঙায় নামার পর সে তার মেজাজের লাগাম খানিকটা টেনে ধরেছে। হেনেরিক ব্রায়ান পরীক্ষা করছে তার সাউণ্ড ইকুইপমেন্ট। আর কাউন্ট বডিউলা চেক করছেন তার ক্যামেরা ইকুইপমেন্ট। রানাও বসে থাকল না, ওর মেডিকেল কিটটা দেখে নিল। বেলা তিনটের দিকে, ইতিমধ্যে সন্ধে হয়ে গেছে, সবাই যে যার কাজ শেষ করল। ইতিমধ্যে যে-সব মালপত্র জেটিতে নামানো হয়েছিল তা সরিয়ে আনা হয়েছে, জেটি এখন খালি। ছোট কেবিন বরাদ্দ করা হয়েছে, প্রতিটি ক্যাম্প-বেড়ে তোলা হয়েছে কম্বল সহ পিপিং ব্যাগ।

অয়েল স্টোভ জ্বালল ওরা, ইলেকট্রিশিয়ান এডিকে তিন দেবতার সঙ্গে রেখে ইভনিং স্টারে ফেরার জন্যে তৈরি হলো। রানা যাচ্ছে ব্যক্তিগত কারণে, চ্যাঙ ওয়েনের সঙ্গে কথা বলতে হবে। বাকি কয়েকজন যাচ্ছে ঘরগুলোর চেয়ে ইভনিং স্টারে বেশি উত্তাপ ও আরাম পাবার আশায়। ইভনিং স্টারে ওরা পৌঁছুবার। কিছুক্ষণের মধ্যেই অনেকগুলো ঘটনা ঘটে গেল।

তিনটে দশে সাবমেরিনের সেন্ট্রাল সেকশনের সঙ্গে অপ্রত্যাশিতভাবে জোড়া লাগানো সম্ভব হলো কোনিং টাওয়ার। কিম্ভুতকিমাকার কাঠামোটাকে ইতিমধ্যে আবার নামানোও হয়েছে পানিতে।

তিনটে পনেরোয় ফোরডেক কার্গো আনলোড শুরু হলো, দায়িত্বে রয়েছে চ্যাং ওয়েন। রানা তাকে বিরক্ত করল না, কারণ এই মুহূর্তে তার সঙ্গে নিরিবিলিতে কথা বলা সম্ভব নয়। নিচে নিজের কেবিনে চলে এল ও। মেডিকেল ব্যাগ থেকে কাপড়ে মোড়া একটা প্যাকেট নিল, ডাফেল ব্যাগে ভরল সেটা।

তিনটে বিশে আবার ওপরে উঠে এল রানা। কার্গো খালাসের কাজ বেশিদূর এগোয়নি, কিন্তু ওয়েনকে কোথাও দেখতে পেল না। মনে হলো, যেন ওর কয়েক মিনিটের অনুপস্থিতির সুযোগেই চোখের আড়ালে সরে গেছে লোকটা। উইম্যানকে জিজ্ঞেস করল রানা, ব্যস্ত উইঞ্চম্যান জানাল ওয়েন তাকে কিছু বলে যায়নি।

ওয়েনের কেবিনে চলে এল রানা, তারপর ব্রিজে দেখল, দেখল চার্ট-হাউস ও সেলুনে, কিন্তু কোথাও সে নেই। প্যাসেঞ্জার ও ক্রুদের জিজ্ঞেস করল, কেউ তাকে কোথাও দেখেনি। ইতিমধ্যে অন্ধকার গাঢ় হয়ে গেছে, আর্ক ল্যাম্পের আলোয় তা দূর হবার নয়। সবার চোখকে ফাঁকি দিয়ে অনায়াসে যে-কেউ ইভনিং স্টার থেকে নেমে যেতে পারে।

ক্যাপটেন ডানহিলকেও কোথাও দেখল না রানা। তাকে অবশ্য খুঁজছে না, তবে আশপাশে কোথাও থাকলে দেখতে না পাবার কথা নয়। বাতাস এখন দক্ষিণ-দক্ষিণ-পুব দিক থেকে বইছে, বইছেও বেশ জোরে, ক্রমশ আরও বাড়ছে গতি। জেটির পাচিলের সঙ্গে এখন প্রায় নিয়মিত ধাক্কা খাচ্ছে ওদের জাহাজ, প্রচণ্ড ঝাঁকির সঙ্গে ধাতব আর্তনাদ শোনা যাচ্ছে প্রতিবার।

 তিনটে ত্রিশে ইভনিং স্টার থেকে নেমে এল রানা, জেটি হয়ে ঘরগুলোর দিকে ফিরছে। প্রায় সব ঘরই খালি, শুধু ইকুইপমেন্ট হাট-এ এডিকে দেখা গেল, ডিজেল জেনারেটর চালু করার কাজে ব্যস্ত। রানা ঢুকতেই মুখ তুলে তাকাল।

জাহাজের মেটকে দেখেছেন? চ্যাং ওয়েনকে?

দশ মিনিট আগে। আমাদের কাজ কেমন চলছে দেখার জন্যে উঁকি দিলেন। কেন? কিছু ঘটেছে নাকি?

তিনি কিছু বললেন?

কি বলবেন?

কোথায় যাচ্ছেন? কি করছেন?

না। ঘাড় ফিরিয়ে তিন দেবতার দিকে তাকাল এডি, ওদের নির্লিপ্ত চেহারা দেখে বোঝা যায় কোন প্রশ্নেরই উত্তর পাওয়া যাবে না। পকেটে হাত ভরে স্রেফ ওখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন মিনিট দুয়েক, আমরা কি করছি দেখলেন, দুএকটা কথা জিজ্ঞেস করলেন, তারপর চলে গেলেন।

কোন দিকে?

বলতে পারব না। আবার তিন দেবতার দিকে তাকাল এডি, একযোগে মাথা নাড়ল তারা। কিছু ঘটেছে নাকি, ডক্টর রানা?

তেমন কিছু না। জাহাজ ছাড়ার সময় হয়ে এসেছে, ক্যাপটেন তাকে খুঁজছেন। ওয়েনের খোঁজে রানা আর সময় নষ্ট করল না। জরুরী কাজ ফেলে সে যদি কোথাও যায়, নিশ্চয়ই তার কারণ আছে। বোঝা যাচ্ছে, সবার চোখকে ফাঁকি দেয়াই তার ইচ্ছে।

তিনটে পঁয়ত্রিশে ইভনিং স্টারে ফিরে এল রানা। এবার ক্যাপটেন ডানহিলের দেখা পাওয়া গেল। ওর ধারণা ছিল, খেপে ওঠা তার দ্বারা বোধহয় সম্ভবই নয়, কিন্তু সেলুনের দরজায় দাঁড়ানো ভদ্রলোককে দেখে ধারণাটা বদলে গেল। তার হাত শক্ত মুঠো পাকিয়ে রয়েছে, রাগে লাল হয়ে উঠেছে চেহারা, উজ্জ্বল হলুদ চোখ দুটো জ্বলছে। গত কয়েক মিনিটে লোকজনকে তিনি কি বলেছেন তার একটা বিবরণ শোনালেন রানাকে। আবহাওয়া ক্রমশ খারাপের দিকে যাচ্ছে, তাই জেমিসনকে টুনহেইম-এর সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন তিনি, আবহাওয়ার পূর্বাভাস জানার জন্যে। কিন্তু যোগাযোগ করতে সফল হয়নি জেমিসন। তারপর জানা যায়, ট্রান্সসিভারটা ভেঙে ফেলা হয়েছে, মেরামত করা সম্ভব নয়। অথচ এক কি দেড় ঘণ্টা আগে রিসিভারটা অক্ষতই ছিল-ওয়েন অন্তত তাঁকে তাই জানিয়েছিল। সর্বশেষ যে আবহাওয়া বার্তা এসেছে, সেটা ওয়েনই লিখে নেয়। কিন্তু হঠাৎ করে ওয়েনকে কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। সে গেছে কোথায়?

তিনি জাহাজ ছেড়ে নেমে গেছেন।

নেমে গেছেন? নেমে গেছেন? আপনি কিভাবে জানলেন? তীক্ষ্ণকণ্ঠে জানতে চাইলেন ক্যাপটেন।

ইমানুয়েল কেসলার ওরফে এডির সঙ্গে কথা বললাম এই মাত্র। ওয়েন কিছুক্ষণ আগে ওখানে গিয়েছিলেন।

ওখানে গিয়েছিলেন? কিন্তু তাঁর তো কার্গো নামানোর কথা, ওখানে কি করতে গেছেন?

তার সঙ্গে আমার দেখা হয়নি, বলল রানা।

আপনিই বা ওখানে কি করতে গিয়েছিলেন, ডক্টর রানা?

ইউ আর ফরগেটিং ইওরসেলফ, ক্যাপটেন ডানহিল। আই অ্যাম নট রেসপনসিবল টু ইউ। তিনি দ্বীপ ছেড়ে চলে যাবার আগে স্রেফ দুটো কথা বলতে চেয়েছিলাম। আপনি জানেন, তার সঙ্গে আমার সম্পর্ক দাঁড়িয়েছে…বন্ধুত্বই বলতে পারেন।

বন্ধুত্ব, কেমন? এমন সুরে জিজ্ঞেস করলেন ক্যাপটেন, কথাটার যেন বিশেষ কোন তাৎপর্য আছে। তারপর তিনি হাঁক ছাড়লেন। জেমিসন!

স্যার?

মি. চ্যাং ওয়েন! সার্চ পার্টি! আমি নিজেই নেতৃত্ব দেব। আবার ক্যাপটেন রানার দিকে ফিরলেন। রানার দুপাশে ফন গোলডা আর ক্লার্ক বিশপও দাঁড়িয়ে। রয়েছেন, কাজেই বোঝা গেল না পরের কথাগুলো কাকে বললেন তিনি, আমরা আধ ঘণ্টার মধ্যে বেয়ার আইল্যাণ্ড ত্যাগ করে যাব, মি. ওয়েনকে পাই বা না পাই।

সেটা কি ঠিক হবে, ক্যাপটেন? প্রশ্ন করলেন ফন গোলডা। তিনি হয়তো কাছেই কোথাও একটু হাঁটতে বেরিয়েছেন, তারপর হয়তো অন্ধকারে পথ হারিয়ে ফেলেছেন…।

আমাকে জানালেন রিসিভার থেকে মেসেজ পাচ্ছেন, কিন্তু যেই দেখলাম সেটা ভাঙা অমনি তিনিও নিখোঁজ হয়ে গেলেন, এ থেকে কি ধরে নেয়া উচিত আপনিই বলুন?

চুপ করে গেলেন ফন গোলডা, তবে ক্লার্ক বিশপ এগিয়ে এলেন এক পা, বললেন, আমার ধারণা মি. গোলডা ঠিকই বলছেন, ক্যাপটেন। অদ্ভুত যে-সব কাণ্ড ঘটছে সে-সব মনে রেখে বলতেই হবে যে রেডিও ভাঙার ব্যাপারটা সত্যি সিরিয়াস। তবে এর জন্যে মি. ওয়েনকে দায়ী করাটা বোধহয় ভুল হবে। তিনি আপনার একজন সিনিয়র অফিসার, রেডিও ধ্বংস করার ভয়াবহ পরিণতির কথা তার জানা আছে। আর ওটা নষ্ট করে পালিয়ে যাওয়া মানে নিজের অপরাধ স্বীকার করা, তা তিনি করবেন না। সবচেয়ে বড় কথা, পালিয়ে তিনি যাবেনই বা কোথায়? বেয়ার আইল্যাণ্ডে পালিয়ে যাওয়া স্রেফ সম্ভব নয়। আমার ধারণা, তিনি সম্ভবত পথ হারিয়ে ফেলেছেন। আপনি অন্তত সকাল পর্যন্ত তার জন্যে অপেক্ষা করতে পারেন।

ক্যাপটেনের চেহারায় অনিশ্চিত একটা ভাব দেখা গেল। কিন্তু পরমুহূর্তে আবার কঠিন হলেন তিনি। কি? এই গাঢ় অন্ধকারে অপেক্ষা করব? জেমিসন! গ্যাবন! সবাই এসো তোমরা! তারপর বাকি তিনজনের দিকে ফিরে গলা সামান্য নিচু করে বললেন, দুঃখিত, আপনাদের অনুরোধ রক্ষা করা সম্ভব নয়। মি. ওয়েন ফিরুন আর না-ই ফিরুন, আধ ঘণ্টার মধ্যে জাহাজ ছেড়ে দেব আমরা। হ্যামারফেস্ট, জেন্টেলমেন। হ্যামারফেস্ট অ্যাণ্ড দা ল।

গ্যাংওয়ে ধরে নেমে গেলেন তিনি, পিছনে পাঁচ-ছয়জন ক্রু।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ক্লার্ক বিশপ বললেন, আমাদেরও বোধহয় সাহায্য করা দরকার। গ্যাংওয়ের দিকে এগোলেন তিনি, এক মুহূর্ত ইতস্তত করে তার পিছু নিলেন ফন গোলডাও।

রানা নড়ল না। ওয়েন যদি গা ঢাকা দিয়ে থাকতে চায়, নিশ্চয়ই তার সঙ্গত কারণ আছে, কাজেই তাকে খুঁজে বের করতে চায় না ও। নিজের কেবিনে ফিরে ছোট্ট একটা নোট লিখল, তারপর ডাফেল ব্যাগটা নিয়ে খুঁজতে বেরুল মরিসনকে। বিশ্বাস করার মত একজনকে দরকার ওর, ওয়েন অদৃশ্য হয়ে গিয়ে বিপদেই ফেলে দিয়েছে ওকে। বিকল্প হিসেবে একমাত্র মরিসনের কথাই ভাবতে পারছে। লোকটা গোয়ার ও সন্দেহপ্রবণ, তবে বোকা নয়। সেদিন সকালে ক্যাপটেন তাকে জেরা করার পর, ইতিমধ্যে নিশ্চয়ই রানাকে আরও বেশি সন্দেহ করছে সে, তবু তাকেই ওর দরকার।

লোকটাকে পনেরো মিনিট বোঝাবার পর সাহায্য করতে রাজি হলো। জিজ্ঞেস করল, আমাকে আপনি বোকা বানাবেন না তো, ড. রানা?

এ-কথা চিন্তা করাটাই তো বোকামি। ভেবে দেখুন না, আমার কোনও লাভ আছে?

ঠিক আছে তাহলে, বলে অনিচ্ছাসত্ত্বেও ডাফেল ব্যাগটা নিল সে। আইল্যাণ্ড থেকে নিরাপদে দূরে সরে যাবার পর…।

হ্যা। ওটা, আমার চিঠিটা। ক্যাপটেনকে। তার আগে নয়।

আপনি আমাকে বলতে পারেন না ব্যাপারটা কি নিয়ে?

যদি জানতামই, মি. মরিসন, ভেবেছেন আমি কি তাহলে এই অভিশপ্ত দ্বীপে থেকে যেতাম?

এই প্রথম হাসল মরিসন। জ্বী, স্যার, তা থাকতেন বলে মনে হয় না।

আপার ডেকে ফিরে এল রানা, দুমিনিট পর সার্চ পার্টি নিয়ে ফিরে এলেন। ক্যাপটেন ডানহিলও। মাত্র বিশ মিনিটে ওরা ফিরে আসায় বা ওয়েনকে না। পাওয়ায় একটুও অবাক হয়নি রানা। ম্যাপে বেয়ার আইল্যাণ্ড একটা বিন্দু হলেও, দ্বীপটা তিয়াত্তর বর্গমাইল জায়গা দখল করে রেখেছে, অন্ধকারের ভেতর বরফ ঢাকা পাহাড়গুলোয় তল্লাশি চালাতে কয়েক দিন লাগার কথা। সন্দেহ নেই নিজের বোকামি বুঝতে পেরে ফিরে এসেছেন ক্যাপটেন, তবে ওয়েনকে না পেয়ে বেয়ার। আইল্যাণ্ড ত্যাগ করার ঝোঁকটা আরও বেড়েছে তার। ডেকগুলো থেকে কার্গো নামানো শেষ হতেই সবাইকে সবিনয়ে বিদায় জানালেন তিনি আর তার চীফ এঞ্জিনিয়ার আর্থার জেংকিনস। তাড়াতাড়ি তীরে নেমে এল ওরা। জেটি থেকে খোলা হলো দড়িদড়া।

জাহাজ থেকে সবার শেষে নামলেন ফন গোলডা। গ্যাংওয়ের মাথায় দাঁড়িয়ে তিনি বললেন, তাহলে সেই কথাই রইল, ক্যাপটেন ডানহিল। বাইশ দিন, তাই না? বাইশ দিনের দিন ফিরে আসবেন আপনি। ভয় নেই, মি. গোলডা, আপনাদেরকে আমি এই শীতকালে এখানে ফেলে রাখব না। বাইশ দিন, খুব বেশি হলে বাইশ দিন। হ্যামারফেস্ট অত দূরে নয়, ইচ্ছে করলে বাহাত্তর ঘণ্টায় ওখান থেকে ফিরে আসা সম্ভব। আপনাদের জন্যে আমার শুভ কামনা রইল।

বাহাত্তর ঘণ্টা সম্পর্কে কি বললেন তার কোন ব্যাখ্যা না দিয়েই গ্যাংওয়ে তোলার নির্দেশ দিলেন তিনি, তারপর উঠে গেলেন ব্রিজে। তবে ব্যাখ্যা না দিলেও ধরে নেয়া চলে যে তিনি হয়তো ভাবছেন বাহাত্তর ঘণ্টার মধ্যে হ্যামারফেস্ট থেকে একদল নরওয়েজিয়ান পুলিসকে নিয়ে ফিরে আসা যায় কিনা। রানা অবশ্য ব্যাপারটা নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামাল না, কারণ জানে রাত শেষ হবার আগেই ভদ্রলোক তার সিদ্ধান্ত পাল্টাবেন।

যাই হোক, ওদেরকে বেয়ার আইল্যাণ্ডে রেখে চলে গেল ইভনিং স্টার।

.

বড়সড় লিভিং কেবিনের পরিবেশ খুব একটা সুবিধের নয়। অয়েল স্টোভগুলো ভালই জ্বলছে, আর এডি ডিজেল জেনারেটর চালু করার পর দেয়ালে লাগানো ইলেকট্রিক হিটারগুলোও এতক্ষণে গরম হতে শুরু করেছে। কিন্তু বহুকালের জমাট বাঁধা ডীপ-ফ্রিজ পরিবেশ মাত্র এক ঘণ্টায় বদলে যাবার কথা নয়-ভেতরের তাপমাত্রা এখনও ফ্রিজিং পয়েন্টের নিচে। সবাই একটা করে কিউবিকল বরাদ্দ পেয়েছে, কিন্তু কেউ সেখানে ঢুকতে রাজি নয়, কারণ সেন্ট্রাল লিভিং স্পেস-এর চেয়ে ওখানে ঠাণ্ডা আরও বেশি। আর্কটিকে কিভাবে বেঁচে থাকা সম্ভব, এর ওপর দীর্ঘ একটা ভাষণ দিলেন এরিক কার্লসন। সাইবেরিয়ায় অনেক দিন ছিলেন তিনি, সম্ভবত সেজন্যেই ধরে নিয়েছেন এ-ব্যাপারে বক্তৃতা দেয়ার অধিকার তার আছে। কিন্তু কেউ তার কথা মন দিয়ে শুনল বলে মনে হলো না। খানিক পর ফন গোলডা আর রবার্ট হ্যামারহেডের সঙ্গে পরামর্শ করতে বসলেন, আবহাওয়া অনুমতি দিলে কাল শূটিং করবেন। দেখা গেল, তাতেও কেউ খুব একটা উৎসাহ বোধ করছেন না। আরও খানিক পর সবার মনোযোগ কেড়ে নিল ডগলাস হিউম। কার্লসনকে সে বলল, শীতকালে, আর্কটিকে, আপনার টর্চ দরকার হবে, ঠিক?

হ্যাঁ।

আমাদের টর্চ আছে কি?

অনেক। কেন?

কারণ আমার একটা দরকার। আমাকে বাইরে যেতে হবে। এখানে আমরা কতক্ষণ আছি? পনেরো মিনিট? বিশ মিনিট? আমি জানি না। আছি আমরা সবাই। শুধু একজন বাদে। হয়তো ফ্রস্ট বাইটে মারা যাচ্ছে সে। কিংবা তার একটা পা ভেঙে গেছে। নয়তো কোন কারণে অসুস্থ হয়ে পড়ে আছে। অথচ আমরা এখানে আরাম করছি। অন্তত মানবিক কারণে…।

শান্ত হও, আহ শান্ত হও, ডগলাস, বললেন ফন গোলডা। মি. ওয়েনকে দেখে সব সময় মনে হয়েছে আমার, নিজেকে তিনি রক্ষা করতে জানেন। ওয়েনকে একটা শ্বেত-ভালুকের সঙ্গে লড়তে দেখলেও সম্ভবত এই কথাই বলতেন তিনি।

যদি সত্যি কেয়ার না করেন, মুখ ফুটে তা বলছেন না কেন? শান্ত অথচ দৃঢ় কণ্ঠে প্রশ্ন করল হিউম। তার চরিত্রের এই বৈশিষ্ট্য নতুন লাগল রানার কাছে। ড. রানা, আমি ভেবেছিলাম, প্রস্তাবটা আপনার তরফ থেকেই প্রথম আসবে।

আমার দ্বিতীয় হতে আপত্তি নেই, বলল রানা।

এরপর সবাই ওরা বেরুবার জন্যে তৈরি হলো, শুধু ফন গোলডা বাদে। শরীরটা ভাল লাগছে না বলে এড়িয়ে গেলেন তিনি। তার কথা শেষ হতে মোনাকা বলল, গোটা ব্যাপারটা আমার কাছে অপ্রয়োজনীয় বলে মনে হচ্ছে। মি. ওয়েন হঠাৎ যেমন চলে গেছেন, আবার হঠাত্র তিনি ফিরে আসবেন। অর্থাৎ সে-ও বাইরে বেরুতে রাজি নয়।

প্রত্যেকে ওরা একটা করে টর্চ নিল। কথা হলো, সবাই যতটা সম্ভব কাছাকাছি থাকবে। যদি বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, ত্রিশ মিনিটের মধ্যে ফিরে আসতে হবে।

উত্তর দিকে সোর-হামনা, সেটাকে নাক বরাবর সামনে রেখে ঢাল বেয়ে উঠতে শুরু করল দলটা। দলে সবাই আছে, শুধু রানা বাদে। সোজা ইকুইপমেন্ট হাট-এ চলে এল ও, এখানে ডিজেল জেনারেটর রয়েছে। দলের সবাই ছড়িয়ে পড়েছে, কেউ অনুপস্থিত থাকলে সহজে ব্যাপারটা জানাজানি হবে না। মরীচিৎকার। পিছনে ছোটার চেয়ে এই গরম জায়গায় বসে থাকাটাই বেশি পছন্দ করছে ও। হাতের টর্চ না জ্বেলে ঘরটার সামনে চলে এল, দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল, বন্ধ করল সেটা, তারপর পা বাড়াতেই নরম কিসের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে পড়ে যাবার উপক্রম করল। ভারসাম্য ফিরে পেয়েই টর্চ জ্বালল।

হাত-পা ছড়িয়ে পড়ে আছে এক লোক। লোকটা ওয়েন দেখে রানা তেমন বিস্মিত হলো না। নড়ে উঠল সে, গোঙাল, কাত হলো সামান্য, হাত তুলে টর্চের আলো থেকে চোখ দুটোকে আড়াল করার ব্যর্থ চেষ্টা করল, তারপর আবার স্থির হয়ে গেল। তার চোখ দুটো এখন বন্ধ, বা দিকের চোয়ালে রক্তের দাগ দেখা যাচ্ছে। আবার নড়ে উঠল ওয়েন, গোঙানোর আওয়াজ বেরিয়ে আসছে গলা থেকে। প্রায় অচেতনই বলা যায়।

খুব ব্যথা করছে, মি. ওয়েন?

আগের মত শুধু কাতর শব্দ করল ওয়েন।

এক মুঠো জমাট তুষার দিয়ে চোয়ালটা ঘষেছেন আপনি, ঠিক কোথায় বলুন তো? প্রশ্ন করল রানা।

স্থির হয়ে গেল ওয়েন, কাতর ধ্বনিও আর বেরুচ্ছে না।

আপনার কমেডিয়ান ভূমিকা নিয়ে পরে আলোচনা করা যাবে, ঠাণ্ডা সুরে বলল রানা। তার আগে দয়া করে উঠবেন কি, ব্যাখ্যা করবেন এমন বোকার মত আচরণ করার কি কারণ?

জেনারেটর কেসিঙের গায়ে টর্চটা খাড়া করে রাখল রানা, আলোটা যাতে ওপর দিকে তাক করা থাকে। ফলে খুব একটা আলো পাওয়া গেল না, তবে দেখা গেল অলসভঙ্গিতে নিজের পায়ে সিধে হলো চ্যাং ওয়েন, চেহারায় সযত্নে ধরে রেখেছে নির্লিপ্ত একটা ভাব। কি বলতে চান আপনি? জিজ্ঞেস করল সে।

বিসিআই পীপার, ওয়ান-সেভেন-ওয়ান, আসল নাম ফুয়েন তাঙ ফু, কাজ করছিল ভারত মহাসাগরে, জাহাজটার নাম সী ড্রাগন, আপাতত সবাই তোমাকে চ্যাং ওয়েন বলে চেনে। কি বলতে চাইছি, পরিষ্কার?

দেখা যাচ্ছে সত্যি আমি একটা বোকা, বলল ওয়েন। ভাল হয় যদি আপনার পরিচয়টাও জানতে পারি।

মাসুদ রানা, বলল রানা। রানা ইনভেস্টিগেশন এজেন্সির ডিরেক্টর। রানা এজেন্সি বিসিআই-এর একটা কাভার। বিসিআই কি জিনিস, আশা করি তা ব্যাখ্যা করে বলার দরকার নেই?

মাথা নাড়ল ওয়েন।

চার বছর চার মাস আগে বিসিআই পীপার হিসেবে নির্বাচন করা হয় তোমাকে, তখন তুমি একটা লেবানিজ ট্যাংকারে চীফ অফিসার হিসেবে কাজ করছিলে। আমাদের ধারণা ছিল, তুমি অত্যন্ত বুদ্ধিমান, এই পেশায় তোমার ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল। এমনকি চার মাস আগেও তোমার সম্পর্কে এই ধারণা ছিল আমাদের। কিন্তু এখন আমি ততটা নিশ্চিত নই।

হাসল ওয়েন, তবে স্বতঃস্ফুর্ত বলা যাবে না। আপনি আমাকে বেয়ার আইল্যাণ্ডে বরখাস্ত করতে পারেন না।

ইচ্ছে করলে তোমাকে আমি টিমবাকটুতেও বরখাস্ত করতে পারি, বলল রানা। হ্যাঁ, শোনাও এবার, কি বলার আছে তোমার?

রানা এজেন্সি সম্পর্কে আমার কোন ধারণা ছিল না, বলল ওয়েন। মাসুদ। রানা নামটাও আমার পরিচিত নয়। আপনি আরও আগে নিজের পরিচয় দিতে পারতেন। তবে এ-কথা ঠিক যে আমার সন্দেহ হতে শুরু করেছিল। কিন্তু আমার জানা ছিল না যে আমি ছাড়াও জাহাজে আমাদের লোক আছে।

তোমার জানার কথা নয়। কথা ছিল তোমাকে যা বলা হয়েছে তুমি শুধু তাই করবে। শুধু ওইটুকু, তার বেশি নয়। লিখিত নির্দেশে কি বলা হয়েছে, মনে নেই? শেষ লাইনটা? লাইনটার নিচে দাগ দেয়া ছিল। মিলটন-এর একটা উদ্ধৃতি। আমি নিজে দাগ দিই।

দে অলসো সার্ভ হু ওনলি স্ট্যান্ড অ্যাণ্ড ওয়েট, বলল ওয়েন। আমি ভেবেছিলাম স্রেফ হেঁয়ালি বা কৌতুক।

প্রশ্ন হলো, তুমি কি দাঁড়িয়ে ছিলে? অপেক্ষায় ছিলে? না! পরিষ্কার নির্দেশ দেয়া হয়েছে, যে-কোন পরিস্থিতিতে জাহাজ ছেড়ে তুমি কোথাও যাবে না, যতক্ষণ না কেউ তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করে। আরও বলা হয়েছে, নিজে থেকে তদন্ত করতে যাবে না বা কিছু আবিষ্কার করার দরকার নেই। একজন মার্চেন্ট নেভি অফিসারের ভূমিকায় নিখুঁত অভিনয় করে যাবে তুমি। কিন্তু নির্দেশ পালনে তুমি ব্যর্থ হয়েছ। তোমাকে আমার ইভনিং স্টারে দরকার ছিল, ওয়েন। এই মুহূর্তে ওখানে তোমাকে আমার দরকার ছিল। কিন্তু কি দেখতে পাচ্ছি? বেয়ার আইল্যাণ্ডের একটা ঘরে রয়েছ তুমি। কেন, ওয়েন? কেন তুমি সহজ একটা নির্দেশ মানতে পারলে না?

ঠিক আছে, আমারই দোষ। তবে নিজেকে আমার একা মনে হয়েছিল। পরিস্থিতি সব কিছু বদলে দেয়, ঠিক কিনা? চারজন লোক মারা গেল, আরও চারজন মরতে মরতে বাচল, তারপর চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকব, কিছু করব না? এমন কি নিজের কথাও ভাবব না?

ভাববে না, যতক্ষণ না তোমাকে ভাবতে বলা হয়। দেখতে পাচ্ছ, কি অবস্থা করেছ তুমি আমার? একটা হাত এখন আমার পিছনে। ইভনিং স্টার আমার সেই দ্বিতীয় হাত, সেটা থেকে তুমি আমাকে বঞ্চিত করেছ। রাতদিন চব্বিশ ঘণ্টা ওই হাতটার ওপর নজর রাখা দরকার। ওই হাতটা যে-কোন মুহূর্তে দরকার হতে পারে আমার, কিন্তু এখন আর পাব না। ইভনিং স্টারে এমন কেউ আছে কি, যে অন্ধকার রাতে ঝড়ের মধ্যে তীর ঘেঁষে সোর-হামনায় পৌঁছুতে পারবে? তুমি জানো, তেমন কেউ নেই।

তারমানে কি আপনার সঙ্গে রেডিও আছে? ইভনিং স্টারের সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্যে?

অবশ্যই। আমার মেডিকেল কেসের সঙ্গে আটকানো। ছোট, তবে যথেষ্ট রেঞ্জ।

যদি বলেন তো আবার আমি ক্ষমা চাইতে পারি, কিন্তু এই পরিস্থিতিতে তাতে কোন লাভ আছে বলে মনে হয় না।

রাইট, শান্ত গলায় বলল রানা। তুমি যখন এখানে রয়েই গেছ, এখন আর নিজের পিছন দিকে কড়া নজর রাখার দরকার নেই আমার।

তারমানে, ওরা যে-ই হোক, ইতিমধ্যে আপনার পিছনে লেগেছে?

অবশ্যই পিছনে লেগেছে। যা যা জানে সংক্ষেপে বলে গেল রানা, তবে সন্দেহ বা অনুমানের কথাগুলো বাদ রাখল, কারণ নিজের মত ওয়েনকেও দিশেহারা অবস্থায় দেখতে চায় না। সবশেষে বলল, প্রথম কথা, নিজেদের রক্ষা। করতে হবে। কেউ যদি শারীরিকভাবে তোমার ক্ষতি করার চেষ্টা করে, তাকে ধরাশায়ী করার অধিকার তোমাকে দেয়া হলো।

জেনে খুশি হলাম। এই প্রথম হাসি পাওয়ায় হাসল ওয়েন। তবে আরও বেশি খুশি হতাম যদি জানতে পারতাম কাকে আমার ধরাশায়ী করতে হবে। আর আনন্দে আত্মহারা হতে পারতাম যদি জানার সুযোগ হত একজন বিসিআই পীপার কি করছে এখানে, বিসিআই-এর কাভার রানা এজেন্সির ডিরেক্টর মি. মাসুদ রানাই বা এই অভিশপ্ত দ্বীপে কি করছেন?

বিসিআই সব সময় দেশের স্বার্থ দেখে। উল্লেখ করার দরকার নেই যে নাগরিকত্ব পাবার পর থেকে তুমিও একজন বাংলাদেশী। বিসিআই-এর এবারের উদ্বেগ টাকা নিয়ে। আরও স্পষ্ট করে বলতে হলে, সোনা নিয়ে। কালো বাজারের সোনা বা বিদেশী সোনা নয়, আমাদের নিজেদের সোনা। সে লম্বা এক ইতিহাস, শুরু হয় দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়। আপাতত শুধু এটুকু জেনে রাখো, বিসিআইকে অন্যান্য দেশও সাহায্য করছে এই অ্যাসাইনমেন্টে।

শুনতে যেন কেমন লাগছে! বেয়ার আইল্যাণ্ডে বাংলাদেশের সোনা? ওয়েন। রীতিমত হতভম্ব। লোকে শুনলে হাসবে, বলবে গাঁজাখুরি গল্প।

কিন্তু যারা জানে? যারা জড়িত ছিল? কিংবা যারা ইতিহাস ঘেঁটেছে? তারাও কি হাসবে?

ইতিহাস?

তাহলে শোনো, বলল রানা। সময় নেই, কাজেই সংক্ষেপে বলি, কেমন?

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ তখন তুঙ্গে। অবিভক্ত বাংলায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল, জাপানীরা আসছে। গুজব নয়, সত্যি সত্যি বার্মা দখল করে নিল জাপানীরা, বোমা ফেলল কোলকাতা বন্দরে। বড় বড় শহরগুলোয় সে-সময় সবাইকে চমকে দিয়ে সাইরেন বেজে উঠত, এই বুঝি বোমা পড়ল। এরকম এক অস্থির ও আতঙ্ককর পরিস্থিতিতে পূর্ব বাংলার নবাব আর জমিদাররা গোপন এক বৈঠকে বসলেন। ঢাকায়। সঠিক জানা যায় না প্রথম বৈঠকে তাদের সঙ্গে চট্টগ্রামের নামকরা সব সওদাগররা ছিলেন কিনা, তবে দ্বিতীয় ও তৃতীয় বৈঠকে যে ছিলেন তার লিখিত প্রমাণ পাওয়া যায়। সব মিলিয়ে একশো একুশজন অংশগ্রহণ করেন সর্বশেষ বৈঠকে। সেই বৈঠকে সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত হয়, সংশ্লিষ্ট সবার যার যত স্বর্ণমুদ্রা। ও অলঙ্কার আছে সব এক জায়গায়, অর্থাৎ চট্টগ্রামে জড়ো করা হবে, তারপর ইভনিং স্টারে ট্রান্সসিভার নষ্ট হয়ে যাওয়ায় যোগাযোগ করা সম্ভব নয়। কিন্তু কেন সেটা নষ্ট হলো? কারণ ব্রিজে দাঁড়িয়ে তুমি বললে প্রয়োজনে রেডিওর মাধ্যমে ন্যাটোর আটলান্টিক ফোর্সের কাছ থেকে সাহায্য চাওয়া যাবে, আর তোমার সেই কথা চালাক কোন লোক আড়াল থেকে গোগ্রাসে সব গিলে ফেলল। জানি, তুষারের ওপর তাজা পায়ের ছাপগুলো আমারই ছিল, সেই সঙ্গে এ-ও জানি যে ওই ছাপের ওপর পা ফেলেই কেউ হেঁটে এসেছিল, তোমার কথা শোনার জন্যে। এরপর সে একটা হাতুড়ি নিয়ে ফিরে আসে। না পারুক, জাপানীরা যে অন্তত বাংলা দখল করবে, এ-ব্যাপারে তাদের মনে কোন সন্দেহ ছিল না। এ-ধরনের একটা সিদ্ধান্ত নেয়ার পিছনে সেটাই ছিল একমাত্র কারণ। একশো একুশ জনের একটা তালিকা তৈরি করা হয়, প্রত্যেকের নামের পর লেখা হয় কার কি পরিমাণ সোনা জমা করা হলো। পরিমাপের কাজ সের ও মন-এর হিসেবে করা হয়। আসল কথা, সোনার পরিমাণ যাদের কম তারা এই তালিকায় স্থান পাননি বা পাবার চেষ্টাও করেননি। সবচেয়ে কম সোনা জমা পড়ে কুমিল্লার এক জমিদারের, মাত্র এক মন তিন সের। সবচেয়ে বেশি জমা পড়ে ঢাকার নবাববাড়ির এক নবাবপুত্রের নামে-ছয় মন বারো সের। সব মিলিয়ে প্রায় তিনশো মন সোনা। শুধু সোনাই নয়, সোনার সঙ্গে হীরা ও অন্যান্য দামী রত্নও ছিল প্রচুর। হীরা বা অন্যান্য রত্নের কোন লিখিত হিসাব অবশ্য পাওয়া যায়নি।

বৈঠকে আরও সিদ্ধান্ত হয়, বাছাই করা বিশ্বস্ত একদল প্রাক্তন সৈনিককে রাখা হবে জাহাজে, তারাই পাহারা দিয়ে সুন্দরবনে নিয়ে যাবে রত্নালঙ্কার ও তিনশো মন সোনা, তাদের সবার কাছে অস্ত্র ও গোলাবারুদ থাকবে। সংখ্যায় তারা হবে পঁচিশজন, সুন্দরবনের গভীর প্রদেশে পৌঁছুনোর পর তাদের কাজ হবে দুর্গম ও নির্জন কোন এলাকায় মাটির তলায় ওই সোনা লুকিয়ে রাখা, এবং পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত ওখানেই পাহারায় থাকা। মাস ছয়েক চলার মত প্রয়োজনীয় রসদ ইত্যাদি তাদের সঙ্গেই থাকবে। নির্দিষ্ট সময়সীমা নির্ধারণ করা হয় এক মাস, এই সময়ের মধ্যে সবার সোনা চট্টগ্রামে পৌঁছুতে হবে। কিন্তু আরাকানে জাপানীদের উপস্থিতি ও কোলকাতা বন্দরে বোমাবর্ষণের ঘটনা উদ্যোক্তাদের অস্থির করে তোলে, সময় সীমা কমিয়ে পনেরো দিন করা হয়।

নির্দিষ্ট সময়েই চট্টগ্রামের প্রাচীন এক মন্দিরে পৌঁছে যায় তিনশো মন। সোনা। ইতিমধ্যে পঁচিশজন প্রাক্তন সৈনিককে নিয়োগ করা হয়েছে, তারাই পঁচিশটা বড় আকারের কাঠের বাক্সে সেগুলো ভরে জাহাজে তোলার জন্যে। জাহাজ মানে ঝক্কর মার্কা একটা স্টিমার, যথাসময়ে চট্টগ্রাম থেকে রওনা হয়ে যায়। সুন্দরবনের উদ্দেশে। এরপরের ইতিহাস খুবই রহস্যময়।

কঙ্গা বা মারঝাটা নদীর মোহনায় শেষবার দেখা গেছে স্টিমার হংসকে। অসমর্থিত খবরে বলা হয়, ওখানে পৌঁছুনোর আগেই স্টিমারে কলেরা ছড়িয়ে পড়ে, ফলে পাহারাদারদের ছজন বাদে বাকি সবাই মারা যায়। তারপর হংসকে দেখা যায় নাফ নদীতে, গন্তব্যের সম্পূর্ণ উল্টোদিকে। হংসকে নাকি টো করে নিয়ে যাচ্ছিল একটা জাপানী গানবোট, হংসের ডেকেও জাপানী সৈনিকদের অস্ত্র হাতে পাহারা দিতে দেখা গেছে। ছজন বাঙালী পাহারাদারের ভাগ্য সম্পর্কে কিছু জানা যায়নি। ধরে নেয়া চলে তাদেরকে জাপানীরা মেরে ফেলেছিল।

পরবর্তী ইতিহাস আরও অস্পষ্ট। ঘটনার সময় আর কিছু জানা না গেলেও, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শেষ হয়ে যাবার পর ব্রিটিশ মিউজিয়ামের ওঅর হিস্টরী ডিপার্টমেন্ট থেকে পাওয়া তথ্য-প্রমাণ অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে হয়। সে-সব তথ্যে উল্লেখ করা হয়েছে, যুদ্ধের শেষ দিকে একদল জাপানী সৈনিক একটা জাহাজ নিয়ে বার্মা থেকে স্বদেশের পথে রওনা হয়, তাদের সঙ্গে ভারত থেকে লুঠ করা পাঁচশো মন সোনা ছিল। সিঙ্গাপুর হয়ে, দক্ষিণ চীনসাগর পেরিয়ে, প্রশান্ত মহাসাগরের দিকে যাচ্ছিল তারা। পথে তাদেরকে বাধা দেয় একটা জার্মান গানবোট। জাপানীদের মেরে ফেলে জার্মান নৌ-বাহিনীর সৈনিকরা, তারপর দখল করে নেয় জাহাজটা। ধারণা করা হয়, ব্রিটিশ মিউজিয়ামের ওঅর হিস্টরী-তে যেটাকে ভারতীয় সোনা বলে উল্লেখ করা হয়েছে সেটাই আসলে বাংলার নবাব ও জমিদারদের সোনা। জাপানীদের জাহাজে তার সঙ্গে সম্ভবত অন্যান্য এলাকা থেকে লুঠ করা সোনাও ছিল, সেজন্যেই পাঁচশো মন আন্দাজ করা হয়েছে।

বাংলার এই সোনা জার্মানীতে নিয়ে যাওয়া হয়, লুকিয়ে রাখা হয় অন্যান্য দেশ থেকে লুঠ করা বিপুল ধনরাশির সঙ্গে। ধনরাশি বলতে শুধু সোনা নয়, তার সঙ্গে ছিল অমূল্য শিল্পকর্ম, সিকিউরিটি বণ্ড ইত্যাদি। জার্মান ব্যাংকের ইস্যু করা সিকিউরিটি বণ্ড আজও বাতিল করা হয়নি।

হাতঘড়ি দেখল রানা, বলল, তোমার উদ্বিগ্ন বন্ধুরা তোমার খোঁজে বেয়ার। আইল্যাণ্ড চষে ফেলছে। আধ ঘণ্টা খুঁজবে ওরা। তোমার অচেতন শরীরটা মিনিট পনেরোর মধ্যে ওদের সামনে হাজির করতে হবে আমাকে।

গোটা ব্যাপারটা আমার কাছে বিদঘুঁটে লাগছে, বলল ওয়েন। মানে সোনার কথা বলছি। এতদিন পর ওগুলো কি আর সত্যি আছে? থাকলে কতটুকুই বা আছে?

নির্ভর করে তোমার দৃষ্টিভঙ্গির ওপর। জার্মানীতে জমা হওয়া সোনাদানা। বেশিরভাগই মিত্রপক্ষ নিয়ে যায়। মিত্রপক্ষ বলতে আমি ব্রিটেন, আমেরিকা আর রাশিয়ার কথা বলছি। সর্বমোট ঐশ্বর্যের দুই তৃতীয়াংশ চোরের ওপর বাটপারি হয়ে যায়। বাকি এক ভাগ নাসীরা সঙ্গে নিয়ে পালায়। কম করে ধরলেও, ওয়েন, চলতি বাজারে তার মূল্য হবে এই ধরো-পাঁচশো মিলিয়ন পাউণ্ড।

হাঁ হয়ে গেল ওয়েন।

আরও বড় কথা, বলল রানা, মিত্রপক্ষ যে সোনা নিয়ে যায় তার মধ্যে বাংলার সোনা ছিল না। তারমানে আমাদের সোনা থেকে যায় নাৎসীদের হাতে। শুধু আমাদের সোনা নয়, তার সঙ্গে নাৎসীদের হাতে বেশ কিছু সিকিউরিটি বণ্ডও থেকে যায়, অমূল্য কিছু শিল্পকর্ম সহ। কিছু বণ্ড অবশ্যই গোপন ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা করা হয়। কিছু শিল্পকর্ম অস্ট্রিয়ান আলপাইন লেকের তলায় ডুবিয়ে রাখা হয়েছে, এখন পর্যন্ত বলা হচ্ছে ওগুলো আর উদ্ধার করা যাবে না। আমি বুয়েনস আয়ার্সের এক মিলিওনিয়ারকে চিনি, যার সেলার গ্যালারিতে এক জোড়া রাফায়েল আছে, একটা মাইকেল অ্যাঞ্জেলো আছে রিও-তে, নিউ ইয়র্কে আছে একাধিক রুবেনস। সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সরকারের সঙ্গে এগুলোর বর্তমান মালিকদের খুব ভাল সম্পর্ক, কাজেই বেআইনীভাবে এ-সব রাখার দায়ে কখনোই তাদেরকে বিপদে পড়তে হবে না। উনিশশো সত্তর সালে ত্রিশ মিলিয়ন পাউণ্ড মূল্যের সিকিউরিটি বণ্ড ছাড়া হয় লণ্ডন, নিউ ইয়র্ক আর জুরিখের মানি মার্কেটে, কিন্তু মালিকানা প্রমাণ না করা পর্যন্ত ওগুলো ভাঙাতে অস্বীকৃতি জানায় ফেডারেল ব্যাংক অভ জার্মানী। অর্থাৎ এগুলো যে উনিশশো পঁয়তাল্লিশ সালে রাইখ ব্যাংক এর ভল্ট থেকে সরানো হয়েছিল, এটা একটা ওপেন সিক্রেট।

তবে ত্রিশ মিলিয়ন পাউণ্ড সামান্য ভগ্নাংশ মাত্র, বেশিরভাগটাই গোপনে কোথাও লুকিয়ে রাখা হয়েছে। যুদ্ধ শেষ হলেও, অবৈধ মালিকরা সেগুলো ভাঙাতে সাহস পায়নি। শুধু এই ব্যাপারটা নিয়ে মাথা ঘামাতে শুরু করে ইটালি সরকারের রিকভারি অফিস। অফিসের বড়কর্তা প্রফেসর সিভাইরো বলছেন, কম করেও সাতশো শিল্পকর্ম এখনও নিখোঁজ। আরেকজন বিশেষজ্ঞ, শিমন ওয়াজেনথাল, প্রায় একই কথা বলেছেন। তিনি আরও জানিয়েছেন যে অসংখ্য নাৎসী অফিসার, তাদের মধ্যে উচ্চপদস্থ এসএস কর্মকর্তারাও আছেন, গোটা ইউরোপে ছড়িয়ে। থাকা গোপন ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে নিয়মিত সিকিউরিটি বণ্ড ভাঙিয়ে দিব্যি বিলাসবহুল জীবন যাপন করছেন।

প্রফেসর সিভাইরো আর শিমন ওয়াজেনথাল এ-ধরনের উদ্ধার-কর্মে বৈধ বিশেষজ্ঞ হিসেবে সুপরিচিত। সব মিলিয়ে তাদের সংখ্যা তিন কি চারজনের বেশি হবে না। কিন্তু আইনের বাইরে থেকে উদ্ধার-কর্মে লেগে আছে এমন বিশেষজ্ঞ লোকের সংখ্যা অনেক। এরাও পরিচিত, কিন্তু এদেরকে ছোঁয়া যাবে না, কারণ প্রকাশ্যে কোন অপরাধের সঙ্গে এরা জড়িত হয় না। এরা আসলে আন্তর্জাতিক পর্যায়ের ক্রিমিনাল। এদেরই একজন আমাদের সঙ্গে এবার বেয়ার আইল্যাণ্ডে এসেছেন। তার নাম এরিক কার্লসন।

কার্লসন!

আমাদের কার্লসন এ-লাইনে খুব বড় একটা প্রতিভা।

কিন্তু কার্লসন! তা কি করে সম্ভব! কার্লসন? কিন্তু তিনি তো মাত্র দুবছর আগে…।

জানি! মাত্র দুবছর আগে সাইবেরিয়া থেকে পালিয়ে আসেন তিনি। লণ্ডনে পৌঁছনোর পর টিভি আর খবরের কাগজগুলো তাকে নিয়ে মেতে ওঠে, তা-ও জানি। সেই থেকে ছবি বানাবার কাজে ব্যস্ত রয়েছেন ভদ্রলোক। কাজেই তার দ্বারা কিভাবে সম্ভব, এই তো?

কার্লসন আসলে গভীর পানির মাছ, ওয়েন। আমরা চেক করে দেখেছি, হ্যাঁ, ভিয়েনার একটা মুভি স্টুডিওর আংশিক মালিকানা ছিল তাঁর, তার পার্টনারও ছিলেন ফন গোলডা। এটা যুদ্ধের ঠিক আগের কথা। আমরা এ-ও জানি যে যুদ্ধ শুরু হবার পর ফন গোলডা যে পথ ধরেন, কার্লসন ঠিক তার উল্টো পথ। কমিউনিজমের প্রতি সহানুভূতি থাকার কারণে থার্ড রাইখ-এ সম্মানিত অতিথি হিসেবে স্বাগত জানানো হয় তাকে। এর পরে ডাবল-ক্রস, ট্রিপল-ক্রসের ঘটনা। ঘটতে শুরু করে। কার্লসনকে রাশিয়ায় পালিয়ে যাবার সুযোগ করে দেয়া হয়। ওখান থেকে তাকে ফেরত পাঠানো হয় জার্মানীতে। জার্মান সরকার তাকে নির্দেশ দেয়, সম্ভাব্য সব রকম বিভ্রান্তিকর সামরিক তথ্য পাচার করো রাশিয়ায়।

কিন্তু কেন? কেন তিনি এ কাজ করলেন?

কারণ তিনি যখন ধরা পড়েন, একই সময়ে ধরা পড়ে তার স্ত্রী, দুটো বাচ্চা সহ। কারণ হিসেবে যথেষ্ট এটা? মাথা ঝাঁকাল ওয়েন। তারপর যুদ্ধ শেষ হলো। বার্লিন দখল করে নিল রাশিয়া। এসপিওনাজ রেকর্ড ঘটতেই বেরিয়ে পড়ল কার্লসনের আসল চরিত্র। ফলে তাঁকে নির্বাসনে পাঠানো হলো সাইবেরিয়ায়।

ভাবছি এরকম একটা অপরাধের জন্যে তাঁকে ওরা গুলি করে মারেনি কেন?

মারত, তবে না মারার কারণ ছিল। আগেই বলেছি, কার্লসন গভীর জলের মাছ। কার্লসন আসলে, যুদ্ধের সময়, রাশিয়ানদের পক্ষে কাজ করছিলেন। চার বছর ধরে তিনি তাঁর রুশ মনিবদের কাছে মিসলিডিং রিপোর্ট পাঠাচ্ছিলেন, এ কথা ঠিক। রিপোর্টগুলো কোড করার কাজে তাকে সাহায্য করছিল জার্মান। ইন্টেলিজেন্স, কিন্তু জার্মান ইন্টেলিজেন্স অফিসাররা খোঁজ নিয়ে দেখেননি যে প্রথম। থেকেই তাঁদের কোড ফেলে রেখে নিজের কোড করা মেসেজ পাঠাচ্ছেন। কার্লসন। যুদ্ধের শেষে রাশিয়ানরা তাকে সাইবেরিয়ায় পাঠানোর নাটক করে। তারই নিরাপত্তার কথা ভেবে। বিসিআই-এর ইনফরমেশন হলো, সাইবেরিয়ায় তিনি কখনোই যাননি। আমাদের বিশ্বাস তার স্ত্রী ও দুই বিবাহিতা কন্যা এখনও মস্কোয় খুব আরামেই আছে।

এবং তিনি সেই থেকে রাশিয়ার হয়ে কাজ করছেন?

হ্যা। বলা হয়েছে আট বছর তিনি সাইবেরিয়ায় কাটিয়েছেন। কিন্তু এই আট বছরে বিভিন্ন ছদ্মবেশে তাকে উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা, দক্ষিণ আফ্রিকা, ইসরায়েল ও লণ্ডনে দেখা গেছে। আমরা জানি, কিন্তু প্রমাণ করা সম্ভব নয় যে এ সব জায়গায় তিনি ঘুরে বেড়িয়েছেন রাশিয়ানদের জন্যে নাৎসী ট্রেজার খোজার কাজে। নাৎসী পার্টি, এসএস ও ইন্টেলিজেন্স-এর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল তার, এই কাজের জন্যে তাঁর মত উপযুক্ত লোক আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। সাইবেরিয়া থেকে পালানোর পর ইউরোপে তিনি দুটো ছবি বানিয়েছেন। একটা প্রভেন্স-এ। ওখানকার এক বৃদ্ধা বিধবা অভিযোগ করেছেন যে তার গোলাঘর থেকে পুরানো কিছু শিল্পকর্ম চুরি গেছে। দ্বিতীয় ছবিটা করেছেন পাইডমন্ট-এ, ওখানকার এক উকিল পুলিসকে ডেকে বলেছেন যে তার অফিস থেকে পুরানো দলিল-দস্তাবেজ ভর্তি একটা বাক্স চুরি গেছে। শিল্পকর্ম বা দলিলগুলোর কোন মূল্য আছে কিনা তা আমাদের জানা নেই, জানা নেই ওগুলো চুরি যাবার সঙ্গে কার্লসনের আদৌ কোন সম্পর্ক ছিল কিনা।

একবারে এত কিছু হজম করা কষ্টকর লাগছে আমার, অভিযোগের সুরে বলল ওয়েন।

তৈরি হয়ে নাও, ওয়েন। পাঁচ মিনিটের মধ্যে তোমাকে আমার নিয়ে যেতে হবে।

ঠিক কিভাবে নিয়ে যেতে চাইছেন, বস্?

টেনে-হিঁচড়ে, স্বভাবতই।

কয়েক সেকেণ্ড চিন্তা করল ওয়েন, তারপর বলল, তারমানে আপনাকে জানতে হবে বেয়ার আইল্যাণ্ডে কি করছেন কার্লসন?

হ্যাঁ, সেজন্যেই এখানে আমরা এসেছি।

তাঁর উদ্দেশ্য সম্পর্কে আপনি সঠিক কিছু জানেন না?

না, জানি না। ধারণা করতে পারি। নাৎসীদের লুকিয়ে রাখা টাকার পিছনে লেগেছেন তিনি। এখানে টাকা বলতে আমি সোনার কথাও বোঝাতে চাইছি।

এর সঙ্গে কি ফিল্ম কোম্পানীর কোন সম্পর্ক আছে? তাঁর পুরানো বন্ধু ফন গোলডার সঙ্গে? নাকি তিনি ওঁদেরকে স্রেফ ব্যবহার করছেন?

আমার ঠিক জানা নেই।

আর এলিনা স্টুয়ার্ট? গোপনে সে কার্লসনের সঙ্গে কি কথা বলল? কি সম্পর্ক ওদের দুজনের?

ওই একই উত্তর। মেয়েটা সম্পর্কে খুব কম জানি আমরা। আমরা তার আসল নাম জানি, কখনোই তা গোপন করেনি সে। জানি জন্মস্থান, বয়েস, জাতীয়তা ইত্যাদি। লাটভিয়ায় জন্ম তার, রাশিয়া দখল করে নেয়ার আগে জায়গাটার নাম লাটভিয়াই ছিল। তবে শুধু তার মা লাটভিয়ান। এই তথ্যটা সে দেয়নি, আমরা জেনেছি। এলিনার বাবা জার্মান।

আচ্ছা! নিশ্চয়ই আর্মিতে ছিলেন? ইন্টেলিজেন্সে? এসএস?

এই যোগাযোগটাই খুঁজে বের করতে হবে। আমরা জানি না। এলিনার ইমিগ্রেশন ফর্মে বলা হয়েছে তার মা-বাবা দুজনেই মারা গেছেন।

তারমানে তার সম্পর্কেও বিসিআই খোঁজ-খবর নিয়েছে?

মার্ভেলাস প্রোডাকশন্সের সঙ্গে জড়িত প্রত্যেকের সম্পর্কে রিপোর্ট সংগ্রহ করেছি আমরা।

যদিও কোন ফ্যাক্টস পাইনি। অনুমান, সন্দেহ?

আমাদের পেশায় ও-সবের তেমন গুরুত্ত্ব নেই।

আমার মাথায় দুটো প্রশ্ন জাগছে। খুবই অস্বস্তিকর। একটা হলো, এরিক কার্লসন খুব বড় মাপের আন্তর্জাতিক ক্রিমিনাল, ঠিক?

ঠিক।

আমার জানা মতে, এই মাপের ক্রিমিনালরা ভায়োলেন্স এড়িয়ে চলে, কথাটা কি ঠিক নয়?

সম্পূর্ণ ঠিক।

আপনি কখনও শুনেছেন কার্লসন ভায়োলেন্সের সঙ্গে জড়িত হয়েছেন?

না, কোন রেকর্ড নেই।

কিন্তু গত কদিন ভায়োলেন্স আমরা কম দেখলাম না। তাহলে, এর জন্যে যদি কার্লসন দায়ী না হন, কে দায়ী?

কার্লসন দায়ী নন, এ-কথা আমি বলিনি, বলল রানা। চিতা তার রঙ বদলাতে পারে। তিনি হয়তো এমন বিপজ্জনক একটা পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে গেছেন যে ভায়োলেন্সের সাহায্য না নিয়ে কোন উপায় দেখতে পাচ্ছেন না। কিংবা তিনি হয়তো চাইছেন না, কিন্তু তার সঙ্গী-সাথীরা সহজ সমাধান হিসেবে ভায়োলেন্সের সাহায্য নিচ্ছেন। আবার এমনও হতে পারে, যা ঘটে গেছে তার সঙ্গে কার্লসনের কোনই সম্পর্ক নেই।

ধন্যবাদ, বস্। আমার দ্বিতীয় প্রশ্ন। বন্ধুরা যদি আপনার পিছনে লেগে থাকে, ধরে নিতে হবে আমার পিছনেও লেগেছে তারা। ব্রিজে আমরা কথা বলেছি, আড়াল থেকে ওরা কেউ শুনেছে।

শুধু ব্রিজে দাঁড়িয়ে কথা বলার জন্যে নয়, ওদের সন্দেহ হবে তুমি জাহাজ ছেড়ে পালিয়ে আসায়। সবাই হয়তো ব্যাপারটাকে তেমন গুরুত্ব দেবে না, তবে দুএকজন অবশ্যই ভাববে কাজটা তুমি বিশেষ কোন উদ্দেশ্যে করেছ। তুমি এখন চিহ্নিত এক লোক, ওয়েন।

তারমানে আপনি যখন আমাকে টেনে-হিঁচড়ে বের করে নিয়ে যাবেন, অধম ওয়েনের জন্যে অকৃত্রিম দুঃখে কেউ কাতর হবে না? আমার ক্ষতগুলোর। অকৃত্রিমতা সম্পর্কে প্রশ্ন উঠবে?

ওরা কোন প্রশ্ন করবে না। তবে খুব ভালভাবেই বুঝতে পারবে। যদিও আমাদের অভিনয়ে কোন খুঁত থাকা চলবে না।

উচিত কাজ হবে আপনিও যদি আমার পিছন দিকে নজর রাখেন, মাঝে মধ্যে।

নানা কাজে আমি খুব ব্যস্ত থাকব, তবে কথাটা আমার মনে থাকবে।

বরফের ওপর দিয়ে ওয়েনকে টানতে টানতে নিয়ে আসছে রানা। পাঁচ মিনিটের মধ্যে মেইন কেবিনের দরজার কাছাকাছি পৌঁছে গেল ওরা। এক জোড়া। টর্চের আলো পড়ল ওদের গায়ে।

আপনি তাহলে পেয়েছেন ওঁকে? ক্লার্ক বিশপের গলা, পাশে এডি। বাঁচালেন, ভাই! হঠাৎ হাইপারসেনসিটিভ হয়ে ওঠা রানার কানেও বিশপের প্রতিক্রিয়া নির্ভেজাল লাগল।

হ্যাঁ, প্রায় সিকি মাইল দূরে। ঘন ঘন হাঁপানোর আওয়াজ করছে রানা, যেন দুশো পাউণ্ড বোঝা টেনে আনতে দম বেরিয়ে গেছে ওর। একটা নালার ভেতর পড়ে ছিলেন। আমাকে একটু সাহায্য করুন, প্লীজ।

ওদের সাহায্য নিয়ে ভেতরে আনা হলো ওয়েনকে, সযত্নে শোয়ানো হলো। একটা ক্যাম্প-কটে।

গুড গড, গুড গড, গুড গড! অবিরত হাত কচলাচ্ছেন ফন গোলডা, চেহারায় উদ্বেগ। বেচারার কি হয়েছিল? কামরায় আর মাত্র একজন রয়েছে, মোনাকা। অয়েল স্টোভটা প্রায় দখল করে বসে আছে সে, সেটা ছেড়ে নড়ল না, ভাল করে একবার তাকালও না ওয়েনের দিকে।

ঠিক বলতে পারব না, হাঁপাতে হাঁপাতে বলল রানা। নালার মাথা থেকে নিচে পড়ে গিয়েছিলেন। একটা পাথরে মাথা ঠুকে যায়। দেখে অন্তত তাই মনে হচ্ছে।

খুলি ফেটেছে, নাকি শুধু খুলির চামড়া ছিঁড়ে গেছে?

খুলি বোধহয় ফাটেনি। ওয়েনের চুলে আঙুল ঢোকাল রানা। এক জায়গায় খুলি সামান্য উঁচু লাগায় বলল, এই তো!

চোখে প্রত্যাশা নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থাকল সবাই।

ব্র্যাণ্ডি, ফন গোলডাকে বলল রানা। তারপর স্টেথস্কোপ বের করে পরীক্ষা। করল ওয়েনকে। ইতিমধ্যে জ্ঞান ফিরলেও চোখ মেলছে না ওয়েন, গোঙাচ্ছে সে। খানিকটা ব্র্যাণ্ডি খাওয়ানো হলো তাকে। তারপর নরম সুরে রানা তাকে জানাল, আপনার দুর্ভাগ্য, ইভনিং স্টার আপনাকে ফেলেই চলে গেছে।

ওয়েনকে যারা খুঁজতে বেরিয়েছিল এতক্ষণে তারা দুজন দুজন করে ফিরে আসতে শুরু করেছে। স্বাভাবিক দৃষ্টিতে সবার দিকেই একবার করে তাকাল রানা, লক্ষ করল ওয়েনকে দেখে তারা কেউ স্বস্তি বা বিস্ময় বোধ করছে কিনা। না, কেউ যদি বিস্মিত হয়েও থাকে, ভাবটা সে গোপন করে রাখতে পেরেছে।

দশ মিনিট পর ওয়েনের ওপর আর কারও মনোযোগ থাকল না, কারণ সার্চ পার্টির দুজন লোক এখনও ফিরছে না। তারা হলো মিখায়েল ট্যাকার ও চার্লস হুপার। এত থাকতে ওই দুজনের দেরি হওয়াটাকে প্রথমে রানার কাকতালীয় বলে মনে হলো। কিন্তু বিশ মিনিট পর ব্যাপারটা সবার জন্যেই উদ্বেগের বিষয়। হয়ে উঠল। অয়েল স্টোভের দখল ছেড়ে উঠে দাঁড়াল মোনাকা, দুই হাত শক্ত করে ধরে পায়চারি শুরু করল, পা ফেলছে খানিকটা এলোমেলো। তারপর এক সময় রানার সামনে থামল সে। আমার ভাল ঠেকছে না, মোটেও ভাল ঠেকছে না! প্রায় ধরা গলায় বলল সে। এ তার অভিনয়ও হতে পারে, যদিও রানার তা মনে হলো না। কেন এত দেরি করছে ও? এত দেরি করার কি কারণ থাকতে পারে? ওই হুপার ছোকরাটার সঙ্গে গেলই বা কেন! কিছু একটা নিশ্চয়ই ঘটেছে। আমি জানি, আমি জানি! রানা কিছু বলছে না দেখে আবার বলল সে, ব্যাপার কি, আপনারা ওকে খুজতে যাবেন না?

 ঠিক যেভাবে আপনি মি. ওয়েনকে খুঁজতে গিয়েছিলেন? জিজ্ঞেস করল রানা। জানে, জবাবটা কঠিন হয়ে গেল, কিন্তু এ তার প্রাপ্যও গোটা ব্যাপারটা আপনার কাছে অপ্রয়োজনীয় বলে মনে হচ্ছে না? মি. ট্যাকার হঠাৎ যেমন গেছেন, তেমনি হঠাৎই ফিরে আসবেন…হয়তো।

কথা না বলে রানার দিকে তাকিয়ে থাকল মোনাকা, তবে ঠোঁট দুটো নড়ছে। তার দিকে তাকিয়ে, আজ দ্বিতীয়বারের মত উপলব্ধি করল রানা, স্বামীকে ঘৃণা করে বলে যে গুজব শোনা যায় তা আসলে সত্যি নয়, স্বামীর জন্যে অন্তরের কোথাও খানিকটা হলেও দরদ তার আছে। চলুন, আবার বেরুনো যাক। কে কে যাবেন?

ডগলাস হিউম, ব্র্যাড ফার্গুসন, হ্যানস ব্ৰাখটম্যান আর হেনেরিক ব্রায়ান পিছু নিল রানার। স্বেচ্ছাসেবক অনেকেই হতে চায়, কিন্তু সংখ্যাটা বেশি হয়ে গেলে পরস্পরের কাজে বিঘ্ন সৃষ্টি করবে তারা, হারিয়ে যাবার আশঙ্কাও বাড়বে। ঘর থেকে বেরিয়েই ওরা পাঁচজন ছড়িয়ে পড়ল, উত্তর দিকে যাচ্ছে সবাই, পরস্পরের কাছ থেকে কারও দূরত্বই পনেরো ফুটের বেশি নয়।

হুপারকে পাওয়া গেল ত্রিশ সেকেণ্ডের মধ্যে। বলা যায়, সে-ই ওদেরকে পেল। ওদের টর্চের আলো দেখতে পেল সে, নিজেরটা হারিয়ে ফেলেছে। অন্ধকার বরফের ওপর দিয়ে হোঁচট খেতে খেতে এগিয়ে আসছিল। ক্লান্তিতে বিধ্বস্ত বা মাতালের মত লাগল তাকে, টলছে। কথা বলার সময় আওয়াজগুলো জড়িয়ে গেল মুখে। তার সারা শরীর থরথর করে কাঁপছে। এই অবস্থায় প্রশ্ন করা শুধু অর্থহীন নয়, নিষ্ঠুরতাও। কাজেই তাড়াতাড়ি তাকে ঘরের ভেতর নিয়ে আসা হলো।

অয়েল স্টোভের পাশে একটা টুলে বসিয়ে তাকে পরীক্ষা করল রানা। আজ সকালে একবার আহত হয়েছে সে, তার এবারের ক্ষতগুলোও প্রায় একই ধরনের। অক্ষত চোখটার ওপর চামড়া কেটে গেছে দুজায়গায়, আঁচড়ের দাগ ফুটেছে বামদিকের গালে, নাক আর মুখ থেকে ঝরা রক্ত ইতিমধ্যে জমাট বেঁধে গেছে ঠাণ্ডায়। সবচেয়ে মাকে আঘাত পেয়েছে মাথার পিছনে, খুলির চামড়া কেটে গিয়ে বেরিয়ে পড়েছে হাড়।

এবারের ঘটনাটা কি? জিজ্ঞেস করল রানা। মুখটা পরিষ্কার করে দিচ্ছে ও, কেঁপে কেঁপে উঠছে হুপার।

আমি জানি না, কর্কশ সুরে বলল হুপার। মাথা নাড়ল সে, পরমুহূর্তে গোঙাল, সম্ভবত ঘাড়ে বা মাথায় ব্যথা পেয়েছে। কিছু মনে নেই আমার। কিছুই মনে করতে পারছি না।

আবার তুমি মারামারি করেছ, বলল রানা। কেউ তোমাকে ভাল ধোলাই দিয়েছে।

জানি। বুঝতে পারছি। কিন্তু কিছু মনে করতে পারছি না। অনেস্ট টু গড, আই ডোন্ট রিমেমবার। কি ঘটেছে কিছুই বলতে পারব না।

কিন্তু লোকটাকে নিশ্চয়ই তুমি দেখেছ, বললেন বিশপ। সে যে-ই হোক, নিশ্চয়ই তুমি তার মুখোমুখি হয়েছিলে। গডস সেক, বয়, তোমার শার্ট ছিঁড়ে গেছে, আর কোটের অন্তত দুটো বোতাম নেই। যখন মারল, লোকটাকে তোমার সামনে দাঁড়াতে হয়েছে, তাই না? অন্তত এক পলকের জন্যে হলেও তার চেহারা দেখার সুযোগ তুমি পেয়েছ।

অন্ধকার ছিল, বিড়বিড় করল হুপার। কিছুই দেখতে পাইনি। তখন কিছু অনুভবও করিনি। শুধু মনে পড়ছে, বরফের ওপর আমার জ্ঞান ফেরে, মাথাটা ঘুরছিল, জ্বালা করছিল মুখ। বুঝতে পারি, রক্ত বেরুচ্ছে। প্লীজ, সত্যি আমি জানি না কি ঘটেছে।

অবশ্যই জানো তুমি, অবশ্যই! ভিড় ঠেলে হুপারের সামনে চলে এল। মোনাকা, তার চেহারার পরিবর্তন যেমন বিস্ময়কর তেমনি কুৎসিত। আজ সকালে তার আচরণের কথা মনে থাকায় এ-ধরনের একটা কিছুর জন্যে খানিকটা প্রস্তুত ছিল রানা, তারপরও এই মুহূর্তে তাকে দেখে ভয় লাগল ওর। মোনাকার চেহারা থেকে লালচে আভা সম্পূর্ণ অদৃশ্য হয়েছে, পিছু সরে গিয়ে দাঁতের সঙ্গে সেঁটে আছে ঠোঁট, সবুজ চোখ দুটো সরু ফাটল ছাড়া কিছু বলা যায় না, এবং আজ সকালের মতই নাকের দুপাশে চীকবোন-এর ওপর চামড়া কুঁচকে ওঠায় গোটা মুখের চামড়া টান টান হয়ে গেল। চিৎকার করার সময় ফুলে উঠল তার গলার রগ। মিথ্যেবাদী, শয়তান! ভেবেছ কেউ কিছু ধরতে পারবে না? প্রতিশোধ নিয়েছ, তাই না? বেজন্মা কুত্তা, বল আমার স্বামীর কি করেছিস? শুনতে পাচ্ছিস? কি করেছিস ওর বল? কোথায় ও, কোথায় ওকে ফেলে রেখে এসেছিস?

হতভম্ব হয়ে গেছে হুপার, হাঁ করে তাকিয়ে আছে। বিড়বিড় করে বলল, আমি দুঃখিত, মিস মোনাকা। আপনি কি বলতে চাইছেন আমি বুঝতে পারছি। না…

মোনাকা তার বড় বড় নখ সহ আঙুলগুলোকে বাকা করে খামচি মারতে চেষ্টা করল হুপারকে। তবে অপেক্ষা করছিল রানা, বাধা দেয়ার সময় পেল। অপেক্ষা করছিলেন বিশপ ও হিউমও। ফাঁদে পড়া বুনো বিড়ালের মত ধস্তাধস্তি করল মোনাকা, হুপারকে অশ্রাব্য গালিগালাজ করল। তারপর হঠাৎ শান্ত হয়ে গেল সে, যেন নিস্তেজ হয়ে পড়েছে। এই মুহূর্তে শুধু তার হাপানোর শব্দ পাচ্ছে ওরা। ফোপাচ্ছে সে।

শান্ত হও, প্লীজ, শান্ত হও, মোনাকা, বললেন ফন গোলডা। এটা কোন ভদ্রতা…।

চুপ করো, বুড়ো শয়তান! বাপকে থামিয়ে দিয়ে খেঁকিয়ে উঠল মোনাকা। গুরুজনকে শ্রদ্ধা করতে হয়, অনেক কাল আগেই তা ভুলে গেছে সে। বাপও যেন মেয়ের এই আচরণ স্বাভাবিক বলেই মেনে নিলেন, যদিও তাকে অত্যন্ত নার্ভাস দেখাচ্ছে। আমাকে শান্ত হতে না বলে এই কুত্তার বাচ্চাটা আমার স্বামীর কি করেছে সে খবর নিচ্ছ না কেন? কেন নিচ্ছ না? কেন? ধস্তাধস্তি করে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল সে, একটা টর্চ তুলে নিয়ে ছুটল দরজার দিকে।

ধরুন ওকে, চিৎকার করল রানা।

ব্রাখটম্যান আর ফার্গুসন, দুই পালোয়ান, দরজা আড়াল করে দাঁড়াল।

পথ ছাড়ো! যেতে দাও আমাকে! চিৎকার করল মোনাকা। ফার্গুসন বা ব্রাখটম্যান নড়ছে না দেখে চরকির মত আধপাক ঘুরে রানার দিকে তাকাল সে। কোন অধিকারে আপনি…বাইরে গিয়ে মিখায়েলকে আমি খুঁজতে চাই!

দুঃখিত, মিস মোনাকা, বলল রানা। আপনার অবস্থা বাইরে যাবার মত নয়। উদ্ভ্রান্তের মত ছুটবেন, কোথায় যাচ্ছেন খেয়াল রাখতে পারবেন না, পাঁচ মিনিটের মধ্যে হারিয়ে যাবেন। একটু পর আমরাই যাচ্ছি।

উনি আমার সঙ্গে বিচ্ছিরি আচরণ করবেন অথচ তুমি কিছু বলবে না? রানার দিকে অগ্নিদৃষ্টি হেনে বাপকে বলল মোনাকা। মেরুদণ্ডহীন, তুমি একটা মেরুদণ্ডহীন! তোমার কথার ওপর যে-কেউ কথা বলতে পারে! মেয়ের অভিযোগ শুনে চোখ মিটমিট করলেন ফন গোলডা, তবে কিছু বললেন না। আমাকে না সবাই তোমার মেয়ে বলে জানে? এখানে তোমারই না সবার কর্তা হবার কথা? গডস সেক, কে এখানে নির্দেশ দেয়? তুমি, নাকি রানা?

নির্দেশ তোমার বাবাই দেন, বললেন বিশপ, তিনিই চীফ। তবে মি. রানা একজন ডাক্তার, তাই ডাক্তারী ব্যাপারে তার সঙ্গে একমত না হওয়াটা আমাদের জন্যে বোকামি হবে।

আপনি কি বলতে চাইছেন আমি একটা মেডিকেল কেস? মোনাকার চেহারা থেকে সমস্ত রঙ মুছে গেছে, আগের চেয়েও কুৎসিত লাগছে তাকে। তাই কি? এ-কথাই বলতে চাইছেন? সম্ভবত একটা মানসিক রোগী?

বিশপ শান্ত গলায় বললেন, সে-ধরনের কিছু আমি বলতে চাইছি না। তুমি অস্থির, তুমি উদ্বিগ্ন-এটাই স্বাভাবিক, কারণ তোমার স্বামীকে পাওয়া যাচ্ছে না। তবে ড. রানার সঙ্গে আমি একমত, এই অবস্থায় তোমাকে বাইরে বেরুতে দেয়া যায় না। এখন তুমি যদি সহযোগিতা করো, ট্যাকারকে আমরা খুঁজে আনতে যেতে পারি।

ইতস্তত করছে মোনাকা, নিজেকে নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করছে। তারপর ঝট করে ঘুরে দাঁড়াল সে।

 হুপারের খুলিতে টেপ লাগাল রানা। আমি ফিরে না আসা পর্যন্ত চলবে। পরে খানিকটা চুল ফেলে দিয়ে জায়গাটা সেলাই করতে হবে। দরজার দিকে পা বাড়িয়ে বিশপের পাশে দাঁড়াল ও, কথা বলল নিচু গলায়, মোনাকাকে হুপারের কাছে যেতে দেবেন না, কেমন?

মাথা ঝাঁকাল বিশপ।

লক্ষ রাখবেন সে যেন পামেলাকেও না ছুঁতে পারে।

প্রায় হতভম্ব দেখাল বিশপকে। ওই বাচ্চা মেয়েটাকে…

হ্যাঁ, মোনাকার তালিকায় হুপারের পর ওই বাচ্চা মেয়েটাই আছে। কাজেই সাবধান।

০২.

সেই আগের চারজনকে নিয়েই ঘর থেকে বেরিয়ে এল রানা। সবার শেষে বেরুল হিউম, দরজা বন্ধ করে বলল, জেসাস! মাই চার্মিং লেডি! চীজ বটে একখানা!

বেচারি একটু আপসেট হয়ে পড়েছে, হালকা সুরে বলল রানা।

একটু আপসেট? তাহলে ঈশ্বরের কাছে অনুরোধ, সত্যিকার পাগলামি শুরু করলে আমি যেন অন্য কোন শহরে থাকি। আচ্ছা, ট্যাকারের কি হয়েছে বলুন তো? সে গেল কোথায়?

কি করে বলব। অন্ধকার বলেই মুখের ভাব গোপন করার দরকার হলো না রানার। একটু এগিয়ে হিউমের কানে কানে কথা বলল ও। সবাই ইতিমধ্যে দূরে সরে গেছে। আমরা সবাই এখানে একেকটা উদ্ভট চরিত্র, আশা করি উদ্ভট এক লোকের অদ্ভুত একটা অনুরোধ রক্ষা করা হবে।

আপনি আমাকে হতাশ করলেন, ডাক্তার। ভেবেছিলাম আপনি আর আমিই এখানে একমাত্র সুস্থ মানুষ।

তাহলে আরও ভাল। সুস্থ মানুষের অনুরোধ একজন সুস্থ মানুষ অবশ্যই রক্ষা করবে। একটু বিরতি নিল রানা। জক মুর। তার অতীত সম্পর্কে কি জানেন আপনি?

কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থাকার পর হিউম জিজ্ঞেস করল, তার কি অতীত আছে?

অতীত আমাদের সবার আছে। আপনি যদি বুঝে থাকেন অতীত বলতে আমি তার ক্রিমিনাল রেকর্ড জানতে চাইছি, ভুল করবেন। জক মুরের কোন ক্রিমিনাল রেকর্ড নেই। আমি শুধু জানতে চাইছি তিনি বিবাহিত কিনা, পরিবার আছে কিনা, ইত্যাদি।

আপনি নিজে কেন তাকে জিজ্ঞেস করছেন না?

সে সুযোগ থাকলে কি আপনাকে অনুরোধ করি?

আবার কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল হিউম। আপনার নাম আসলেই কি রানা, ডাক্তার?

রানা। আদি ও অকৃত্রিম মাসুদ রানা। পাসপোর্ট, বার্থ সার্টিফিকেট, ড্রাইভিং লাইসেন্স-সবগুলো একই কথা বলবে।

এবং আপনি সত্যি একজন ডাক্তার?

হ্যাঁ।

এবং সেই সঙ্গে আপনি অন্য কিছুও?

হ্যাঁ।

জক মুর। বৈবাহিক অবস্থা। বাচ্চাকাচ্চা আছে কি নেই। ঠিক আছে, জেনে জানাব। আপনি ডগলাস হিউমের ওপর আস্থা রাখতে পারেন, কেউ কিছু সন্দেহ করবে না।

ধন্যবাদ।

বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল ওরা। উত্তর দিকে যাচ্ছে ওরা দুটো কারণে-বাতাস আর তুষার পিছন থেকে ধাক্কা মারছে, ফলে ওদিকে যাওয়াই সহজ। তাছাড়া, হুপারকে ওরা ওদিক থেকেই ফিরতে দেখেছে। হুপার কিছু মনে করতে ব্যর্থ হলেও, রানার মনে হলো ট্যাকারকেও ওরা ওদিকেই কোথাও পেতে পারে। পেলও তাই।

এদিকে! এদিকে! ব্রায়ানের গলা, চিৎকার করছে সে। ওঁকে আমি পেয়েছি! এদিকে, ওকে আমি পেয়েছি!

তুষারের ওপর হাত-পা ছড়িয়ে পড়ে থাকা লোকটা যে মিখায়েল ট্যাকার তাতে কোন সন্দেহ নেই। দুই হাতের মুঠো পাকানো, শক্ত হয়ে আছে। তুষারে, তার বাম কাঁধের পাশে, বড় একটা পাথর পড়ে রয়েছে, ষাট কি সত্তর পাউণ্ড ওজন হবে। বোল্ডার বলাই উচিত। সেটার ওপর ঝুঁকল রানা, টর্চের আলো ফেলল। পাথরটার গায়ে কালো কয়েক গাছি চুল দেখতে পেল ও, জমাট বাঁধা রক্তের সঙ্গে লেগে রয়েছে। প্রমাণের দরকার থাকলে এটাই সেটা, তবে রানার মনে কোন সন্দেহ নেই যে মিখায়েল ট্যাকারের খুলির পিছনটা গুড়ো করার জন্যে এই অস্ত্রটাই ব্যবহার করা হয়েছে। মৃত্যু হয়েছে তৎক্ষণাৎ।

উনি মারা গেছেন! ফার্গুসনের গলায় অবিশ্বাস।

হ্যাঁ, বলল রানা।

এবং খুন হয়েছেন!

হা। লাশটাকে চিৎ করার ব্যর্থ চেষ্টা করল রানা, তারপর ফাগুসন আর হিউম সাহায্য করল ওকে। ট্যাকারের ওপরের ঠোঁট ছিঁড়ে গেছে একেবারে সেই নাকের ফুটো পর্যন্ত। মুখের ভেতর একটা দাঁত নেই। তার কপালের ডান দিকে লালচে কাঁচা মাংসের মত অদ্ভুত একটা দাগ দেখা গেল।

নিশ্চয়ই প্রচণ্ড একটা মারামারি হয়েছে, খসখসে গলায় বলল ফার্গুসন। কল্পনাও করা যায় না হুপারের মত একটা বাচ্চা ছেলের ভেতর এত আক্রোশ থাকতে পারে।

আমিও তা ভাবতে পারি না, বলল রানা।

হুপার? হিউম বলল। আমার ধারণা, হুপার সত্যি কথাই বলছে। এমন কি হতে পারে…মানে, স্মৃতিভ্রংশের পর তার দ্বারা এই ঘটনা ঘটতে পারে?

মাথায় আঘাত পেলে বিদঘুঁটে অনেক কিছুই ঘটতে পারে, বলল রানা। লাশের চারপাশে তুষারে চোখ বুলাল ও। পায়ের ছাপ রয়েছে, খুব বেশি নয়, তুষারপাতের ফলে এরই মধ্যে মিলিয়ে যেতে শুরু করেছে। না, পায়ের ছাপ থেকে কোন সাহায্য পাবার আশা নেই। ও বলল, চলুন, ওকে নিয়ে ফিরে যাই।

উঁচু-নিচু শক্ত বরফের ওপর নরম তুষার জমেছে, একটা লাশকে বয়ে নিয়ে আসা সহজ কাজ নয়, তাও আবার অন্ধকারে। ট্যাকারের হাত-পা শক্ত লোহা হয়ে গেছে, যে কারণে রানা একার চেষ্টায় তাকে চিৎ করতে পারেনি, সেই একই কারণে তাকে বয়ে নিয়ে আসতে হিমশিম খেয়ে গেল চারজন লোক। মেইন কেবিনের সামনে তুষারের ওপর নামানো হলো লাশটা। ব্রায়ানকে রানা বলল, ভেতরে গিয়ে মি. বিশপকে বলুন এক বোতল ব্র্যাণ্ডি দরকার। বলবেন, আমি চেয়েছি, এই ঠাণ্ডায় ঘুরে বেড়াতে হলে দরকার আমাদের। মি. বিশপকে চুপিচুপি বলবেন, আমি তাকে বাইরে ডাকছি।

খানিক পর দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন ক্লার্ক বিশপ। কিছু নিশ্চয়ই সন্দেহ করেছেন ভদ্রলোক, কারণ বেরিয়েই দরজাটা বন্ধ করে দিলেন। কয়েকটা টর্চ জ্বলছে, কাজেই আলোর কোন অভাব নেই। লাশটা দেখে আঁতকে উঠলেন তিনি। আঁতকে ওঠাটা অভিনয় হতে পারে, কিন্তু অভিনয়ের সাহায্যে মুখের রক্ত নামিয়ে দেয়া কারও পক্ষে সম্ভব নয়। জেসাস ক্রিস্ট! ফিসফিস করলেন তিনি। ডেড?

রানা কথা বলল না, শুধু হিউম আর ফার্গুসনের সাহায্যে লাশটাকে চিৎ করল। এবার কাজটা আরও কঠিন মনে হলো। বিশপের গলার ভেতর থেকে দুর্বোধ্য একটা আওয়াজ বেরুল শুধু, আর কোন প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না। লাশটার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেন।

রানা অনুভব করল বাতাসের তীব্রতা আগের চেয়ে বেড়েছে। আগের চেয়ে ঘনও হয়েছে তুষার। এই মুহূর্তে তাপমাত্রা কত ওর জানা নেই, তবে আন্দাজ করল ফ্রিজিং পয়েন্ট থেকে ত্রিশ ডিগ্রী নিচে হবে। আবছাভাবে খেয়াল করল, শীতে কাঁপছে ওর শরীর। চারপাশে তাকিয়ে দেখল, বাকি সবারও একই অবস্থা। ওদের নিঃশ্বাস নাক থেকে বেরুবার সঙ্গে সঙ্গে স্থির হয়ে যাচ্ছে, তবে বাপ জমাট বাঁধার আগেই ভেসে যাচ্ছে বাতাসের তোড়ে।

অ্যাক্সিডেন্ট? ফিসফিস করলেন বিশপ। আপনার কি মনে হয়, ব্যাপারটা কোন রকম দুর্ঘটনা?

না, বলল রানা। ওঁর খুলি ফাটানোর কাজে যে বোল্ডারটা ব্যবহার করা হয়েছে আমরা সেটা দেখেছি। বিশপ আবার দুর্বোধ্য শব্দ করলেন। লাশটা আমরা এখানে ফেলে রাখতে পারি না, আবার ভেতরেও নিয়ে যেতে পারি না। আমি বলি, ট্রাক্টর শেডে রাখা হোক। আপনি কি বলেন?

হ্যাঁ, হ্যাঁ, ট্রাক্টর শেডেই রাখা হোক, বললেন বিশপ। মনে হলো তার মাথা কাজ করছে না।

মিস মোনাকাকে কে জানাবে? জিজ্ঞেস করল রানা।

কি? বিশপ এখনও নিজেকে নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেননি। কি বললেন আপনি?

ওঁর স্ত্রীর কথা বলছি। তাঁকে তো জানাতে হবে। রানা জানে, ডাক্তার হিসেবে জানাবার দায়িত্বটা ওর ঘাড়েই চাপে।

হঠাৎ দড়াম করে খুলে গেল কেবিনের দরজা, দোরগোড়ায় দেখা গেল মোনাকাকে। তার সঙ্গে কুকুর দুটো রয়েছে। পিছনে কেবিনের আলো, দোরগোড়ায় বেশ কয়েক সেকেণ্ড দাঁড়িয়ে থাকল সে, পিছনের আলোতে অস্পষ্টভাবে ফন গোলডা আর কাউন্টকে উঁকি-ঝুঁকি মারতে দেখা গেল। তারপর এগিয়ে এল সে, দেখে মনে হলো যেন স্বপ্নের ভেতর হাঁটছে। স্বামীর সামনে থেমে ঝুঁকল। কয়েক মুহূর্ত পর সিধে হলো আবার, তাকাল রানার দিকে, চোখে প্রশ্ন। তা মাত্র এক মুহূর্তের জন্যে, অকস্মাৎ চোখ দুটো উল্টে গেল তার, কেউ হাত বাড়িয়ে ধরার আগেই অচেতন হয়ে পড়ে গেল স্বামীর লাশের ওপর।

হিউম আর রানা ধরাধরি করে ভেতরে নিয়ে এল মোনাকাকে, ওদের পিছু পিছু ঢুকলেন বিশপ। যে ক্যাম্প-কটে ওয়েনকে শোয়ানো হয়েছিল সেটায় শোয়ানো হলো তাকে। তার কুকুর দুটোকে দূরে সরিয়ে রাখার জন্যে তাড়া মারতে হলো। মুখ সাদা হয়ে গেছে, খুব ধীরে ধীরে নিঃশ্বাস ফেলছে সে। তার ডান চোখের পাতা আঙুলের ছোঁয়ায় খুলল রানা, আঙুলের ডগায় কোন রকম সাড়া পেল না। কিছু না ভেবেই কাজটা করল ও, মোনাকা অভিনয় করছে বলে সন্দেহ হয়নি ওর। সচেতন, পাশেই দাঁড়িয়ে রয়েছেন ফন গোলডা, চোখ দুটো বিস্ফারিত, মুখ সামান্য খোলা, মুঠো হয়ে আছে হাত।

ও কি ভাল আছে? কর্কশ স্বরে জিজ্ঞেস করলেন তিনি। ও কি…?

এখুনি ওঁর জ্ঞান ফিরে আসবে, জানাল রানা।

স্মেলিং সল্ট, বললেন ফন গোলডা। হয়তো…

না। মাথা নাড়ল রানা। স্মেলিং সল্টের সাহায্যে তিক্ত বাস্তবতায় এখুনি তাকে ফিরিয়ে না আনাই ভাল।

আর ট্যাকার? আমার জামাই? সে কি…মানে…

আপনি তাকে দেখেছেন, প্রায় বিরক্ত হয়ে বলল রানা। তিনি মারা গেছেন।

কিন্তু কিভাবে… কিন্তু কিভাবে…?

তিনি খুন হয়েছেন। আঁতকে ওটার একাধিক আওয়াজ শোনা গেল, জোরে নিঃশ্বাস ফেলল কেউ, তারপর নিস্তব্ধতা নেমে এল ঘরের ভেতর। এখন শুধু কোলম্যান ল্যাম্পের হিসহিস শব্দ শোনা যাচ্ছে। কার কি প্রতিক্রিয়া হচ্ছে দেখার জন্যে রানা এমন কি মুখও তুলল না, কারণ ইতিমধ্যে জেনে ফেলেছে তাতে কোন লাভ নেই। ও শুধু অচেতন মোনাকার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। কঠিন পাত্র মিখায়েল ট্যাকার এই মহিলাকে আজরাইলের মত ভয় পেত। ফন গোলডার মেয়ে হিসেবে মোনাকার যে ক্ষমতা, টাকার কি সেই ক্ষমতাকে ভয় পেত? নাকি এ কথা জানত বলে ভয় পেত যে তার জীবন ও ভাল-মন্দ সবই নির্ভর করে মোনাকার খামখেয়ালির ওপর? নাকি কোন ধরনের ব্ল্যাকমেইলের শিকার ছিল। লোকটা? কিংবা, এমন কি হতে পারে, বাইরে থেকে বোঝা না গেলেও, স্ত্রীকে ট্যাকার অসম্ভব ভালবাসত? প্রচণ্ড, উদ্ভট ভালবাসার কারণে স্ত্রীর লাঞ্ছনা ও নিষ্ঠুরতা সহ্য করে, এমন লোক পৃথিবীতে বিরল নয়। উত্তরটা রানার জানা নেই। আর বোধহয় কোনদিন জানাও হবে না। যদিও এই মুহূর্তে ট্যাকার ওর উদ্বেগের কারণ নয়। ও ভাবছে স্বামীর লাশ দেখে মোনাকার প্রতিক্রিয়ার কথা। তার ওপর স্বামী নির্ভরশীল বলে স্বামীকে ঘৃণা করত সে। শুধু নির্ভরশীল বলে নয়। তার সমস্ত অপমান প্রায় নীরবে সহ্য করত ট্যাকার, সে-কারণেও। অথচ তারপরও স্বামীকে ভালবাসত সে।

মোনাকা নড়ে উঠল। দুএকবার কেঁপে উঠে খুলে গেল চোখের পাতা। সব কথা মনে পড়ে গেল, শিউরে উঠল সে। তাকে ধরে ধীরে ধীরে বসাল রানা। ম্লান দৃষ্টিতে চারদিকে তাকাল সে। কোথায় ও? কথাটা শোনার জন্যে কান খাড়া করতে হলো রানাকে।

সব ঠিক আছে, মিস মোনাকা, আর কি বলবে ভেবে পেল না রানা। আমরা ওঁর ওপর খেয়াল রাখছি।

কোথায় ও? ফোঁপাল মোনাকা। ও আমার স্বামী, আমার স্বামী। আমি ওকে দেখতে চাই।

না দেখাই ভাল, মোনাকা, নরম সুরে বললেন বিশপ। ড. রানা যেমন বলছেন, আমরা তার সব ব্যবস্থা করছি। তুমি তো একবার তাকে দেখেইছ, কোন লাভ নেই…।

 ভেতরে আনুন ওকে, আমি ওকে দেখব, মোনাকার গলায় জোর নেই, তবে কান্না আছে। তা না হলে আমাকে বাইরে যেতে দিন…

দাঁড়াল রানা, দরজার দিকে এগোল। ওর পথ আগলে দাঁড়ালেন কাউন্ট। ভদ্রলোকের অভিজাত চেহারায় আতঙ্ক আর বিস্ময় ফুটে আছে। এ আপনি করতে পারেন না। ব্যাপারটা বীভৎস, ডাক্তার।

কিন্তু উপায় কি? আপনি কি চান মিস মোনাকা এই অবস্থায় বাইরে বেরোন?

কাজেই ট্যাকারের লাশ আনার জন্যে আবার ওরা বেরুল। এবার ওর সঙ্গে থাকল হিউম আর ফাগুসন। ভেতরে আনার পর চিৎ করে শোয়ানো হলো। ট্যাকারকে, যাতে তার মাথার পিছনের বীভৎস ক্ষতটা দেখা না যায়। ক্যাম্প-কট থেকে নেমে এল মোনাকা, অন্ধের মত এলোমেলো পা ফেলে হাঁটছে। স্বামীর পাশে হাটু গেড়ে বসল সে, কিছুক্ষণ একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকল। তারপর একটা হাত বাড়িয়ে ট্যাকারের ক্ষতবিক্ষত মুখটা আঙুল দিয়ে স্পর্শ করল। কেউ কথা বলল না, কেউ নড়ল না। বেশ খানিকটা জোর খাঁটিয়ে লাশের ডান হাত শরীরের পাশে সরিয়ে আনল সে, চেষ্টা করল বাম হাতটাও সরিয়ে আনতে, লক্ষ করল বা হাতটা মুঠো পাকানো রয়েছে। আস্তে-ধীরে, সময় নিয়ে, মুঠোটা খোলার চেষ্টা করল।

লাশের তালুতে বাদামি রঙের গোল কি যেন একটা রয়েছে। জিনিসটা তুলে নিজের তালুতে নিল মোনাকা। তারপর সিধে হলো সে, এখনও হাঁটু গেড়ে রয়েছে, তারপর সবার দিকে ফিরে হাতের তালুটা দেখাল সবাইকে। সবার শেষে হুপারের দিকে লম্বা করল সে তার হাত। তাকিয়ে থাকল হুপারের চোখে।

মোনাকার হাতের তালুতে ওটা একটা বোতাম। হুপারের কোটেও এই একই বোতাম দেখা যাচ্ছে।

০৩.

নিস্তব্ধতা কতক্ষণ জমাট বেঁধে থাকল বলতে পারবে না রানা। নিস্তব্ধতার ভেতর ল্যাম্পের হিসহিস আওয়াজ অসহ্য লাগছে। বাইরে বাতাসের গতিবেগ আরও বেড়েছে, প্রায় একটানা গর্জনের মত আঘাত করছে কানে। বোধহয় দশ সেকেণ্ড পেরিয়ে গেল, কেউ এক চুল নড়ল না। সবাই তাকিয়ে আছে হুপারের দিকে, আর হুপার তাকিয়ে আছে মোনাকার তালুতে পড়ে থাকা বোতামটার দিকে। ছোট্ট বোতামটা সবাইকে যেন জাদু করেছে।

প্রথমে নড়ল মোনাকা। ধীরে ধীরে দাঁড়াল সে, যেন খুব কষ্ট হচ্ছে তার। এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থাকল, চেহারায় ইতস্তত ভাব। এই মুহূর্তে পুরোপুরি শান্ত সে। এরকম প্রতিক্রিয়া হবার কথা নয় তার, সেজন্যেই তাকে পাশ কাটিয়ে রানার দৃষ্টি চলে গেল হিউম আর ওয়েনের দিকে। দুজনের সঙ্গেই চোখাচোখি হলো ওর। মুহূর্তের জন্যে একবার দৃষ্টি নত করল হিউম, যেন একটা ইঙ্গিতে সাড়া দিল। ওয়েন তাকাল মোনাকার দিকে। তারপর হুপারের দিকে এগোল মোনাকা। ওয়েন আর হিউম স্বাভাবিক ভঙ্গিতে পরস্পরের দিকে এগোল, উদ্দেশ্য মোনাকার পথ আটকানো।

দাঁড়িয়ে পড়ল মোনাকা, ওদের দুজনের দিকে তাকিয়ে হাসল। আমাকে বাধা দেয়ার কোন দরকার নেই, বলল সে। বোতামটা ছুঁড়ে দিল, স্বতস্ফূর্ত ক্ষিপ্রতার সঙ্গে সেটা লুফে নিল হুপার। তালুতে নিয়ে চোখের সামনে তুলল সেটা, তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ, তারপর মুখ তুলল মোনাকার দিকে। ওটা তোমার দরকার হবে, তাই না? জিজ্ঞেস করল মোনাকা। ঘুরে নিজের কিউবিকল-এর দিকে এগোল সে।

ঢিল পড়ল রানার পেশীতে। আওয়াজ শুনে বোঝা গেল বাকি সবাইও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছে। মোনাকার দিক থেকে চোখ সরিয়ে হুপারের দিকে তাকিয়েছিল রানা, ভুল হয়েছে সেখানেই। মোনাকার প্রতিক্রিয়া যে স্বাভাবিক নয়, এটা ধরতে পারার পর এত তাড়াতাড়ি পেশীতে ঢিল পড়তে দেয়া উচিত হয়নি ওর।

তুই ওকে খুন করেছিস, তুই ওকে খুন করেছিস! উন্মাদিনীর মত চিৎকার করে উঠল মোনাকা, উন্মত্ত বাঘিনীর মত ছুটে গেল পামেলার দিকে। পিছু হটতে গিয়ে হোঁচট খেলো পামেলা, পরমুহূর্তে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল মোনাকা। মেঝেতে পড়ে গেল দুজনেই, পামেলার ওপর মোনাকা। মোনাকার ধারাল নখ থেকে নিজের মুখটা বাঁচাবার চেষ্টা করছে পামেলা। তুই মাগী আমার স্বামীকে মেরেছিস! তুই, তুই একটা ডাইনী! একটা বেশ্যা! কুত্তী, কুত্তী! আমার স্বামীকে খুন করেছিস! তুই, তুই!

নাক থেকে চমশাটা ছিটকে পড়ায় চোখে কিছুই দেখতে পাচ্ছে না পামেলা। এক হাতের মুঠোয় তার চুল ধরেছে মোনাকা, অপর হাতের নখ দিয়ে আঘাত করতে চাইছে চোখে, এই সময় পৌঁছে গেল হিউম আর ওয়েন। দুজনেই ওরা শক্তিশালী পুরুষ, কিন্তু আক্রোশে অন্ধ মোনাকার শরীরে এত জোর এসে গেছে সেই সঙ্গে বাধা হয়ে দাঁড়াল মোনাকার কুকুর দুটোও-পামেলার ওপর থেকে তাকে টেনে তুলে আনতে বেশ কয়েক সেকেণ্ড লেগে গেল ওদের। তারপরও পামেলার চুল ছাড়েনি সে। বাধ্য হয়ে তার হাতে সজোরে আঘাত করতে হলো ওয়েনকে। কব্জিতে ব্যথা পেয়ে কাতরে উঠল মোনাকা।

টেনে তাকে সিধে করা হলো। এখনও উন্মাদিনীর মত চিৎকার করছে সে, যদিও সেটাকে হিংস্র পশুর গর্জন ছাড়া আর কিছু বলা যায় না। তারপর হঠাৎ থেমে গেল সেটা, তার হাঁটু ভাজ হয়ে গেল, ধীরে ধীরে তাকে মেঝেতে শুইয়ে দিল হিউম আর ওয়েন।

রানার দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করল হিউম, দ্বিতীয় পর্বের অভিনয়?

না। এটায় কোন ভেজাল নেই। আপনি কি দয়া করে ওকে ওর কিউবিকল্ এ নিয়ে যাবেন? পামেলা ফোপাচ্ছে, তবে এখন তার দিকে মনোযোগ না দিলেও চলে রানার। নিজের জখমের কথা ভুলে মেয়েটার পাশে চলে এল হুপার, বসতে সাহায্য করল, রুমাল দিয়ে মুছে দিচ্ছে মুখের ক্ষতগুলো। ওদেরকে রেখে নিজের কিউবিকলে চলে এল রানা, ইঞ্জেকশন দেয়ার জন্যে একটা হাইপডারমিক সিরিঞ্জে ওষুধ ভরল, তারপর ঢুকল মোনাকার কিউবিকলে।

মোনাকার পাহারায় রয়েছে হিউম আর ওয়েন, ওদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন। ফন গোলডা, বিশপ ও কাউন্ট। সিরিঞ্জটার দিকে তাকালেন ফন গোলডা, রানার একটা বাহু আঁকড়ে ধরলেন। ওটা কি…ওটা কি আমার মেয়ের জন্যে? কি। দিচ্ছেন আপনি ওকে? গুড গড, ম্যান, দেখতে পাচ্ছেন না অজ্ঞান হয়ে গেছে ও?

আমি দেখতে চাই তাই যেন থাকেন উনি, বলল রানা। ঘণ্টার পর ঘণ্টা। সেটাই তার জন্যে এবং আমাদের সবার জন্যে ভাল হবে। ঠিক আছে, জানি, আপনার মেয়ে খুব বড় একটা আঘাত পেয়েছেন, সেজন্যে সত্যি আমি দুঃখিত। কিন্তু এখন তার চিকিৎসা দরকার। নাকি আবার একবার পামেলাকে মার খাওয়াতে চান আপনি?

ফন গোলডা ইতস্তত করছেন। রানার সমর্থনে এগিয়ে এলেন ক্লার্ক বিশপ। মি. রানা ঠিক কথাই বলছেন, ফন। তাছাড়া, ইঞ্জেকশনটা দেয়া হচ্ছে মোনাকার ভালর জন্যেই। এ-ধরনের একটা আঘাত পাবার পর দীর্ঘ বিশ্রাম দরকার তার।

দেয়া হলো ইঞ্জেকশন। তারপর মোনাকাকে একটা পীপিং ব্যাগে ঢোকানো। হলো। কুকুর দুটোকে নিজের কিউবিকলে রেখে এল রানা।

মেইন কেবিনে ফিরে এসে দেখল, একটা বেঞ্চে পাশাপাশি বসে রয়েছে হুপার আর পামেলা, হুপার এখনও পামেলার চোখ মুছিয়ে দিচ্ছে। এখন আর ফোঁপাচ্ছে না পামেলা, শুধু মাঝে মধ্যে বড় করে নিঃশ্বাস ফেলছে। মুখে কিছু আঁচড়ের দাগ ছাড়া তার জখম গুরুতর কিছু নয়। কয়েক ফুট দূরে একা দাঁড়িয়ে রয়েছেন জক মুর, কাতর চোখে পামেলার দিকে তাকিয়ে। আপনমনে মাথা নাড়ছেন তিনি। আহা বেচারি! আহা বেচারি! বিড়বিড় করছেন।

উনি সামলে নেবেন, বলল রানা। এমন ওষুধ দেব, মুখে কোন দাগ থাকবে না। ট্যাকারের লাশের দিকে তাকাল ও। প্রথম কাজ, লাশটাকে ট্রাক্টর শেডে সরিয়ে ফেলা।

আমি ওর কথা বলছি না, আবার রানার মনোযোগ আকর্ষণ করলেন জক মুর। বলছি মোনাকার কথা। আহা বেচারি! বড় একা সে! তার দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল ও, মনে মনে জানে চালাকি করা তার স্বভাব নয়। চেহারা দেখে বোঝা যায়, সত্যি তিনি দুঃখ পেয়েছেন।

মি. মুর, বলল রানা, মানুষকে আপনি অবাক করতে জানেন বটে! অয়েল স্টোভ জ্বালল ও, পানি গরম করতে হবে। তারপর ট্যাকারের দিকে ফিরল। হিউম আর ওয়েন, দুজনেই অপেক্ষা করছিল, কিছু বলার দরকার হলো না। ওদের সঙ্গে জক মুরও যেতে চাইলেন-টর্চ ধরে থাকবেন, দরজা খুলবেন। তিনজন ধরাধরি করে লাশটা ট্রাক্টর শেডে রেখে এল ওরা।

ফিরে এসে মেইন কেবিনে ঢুকল হিউম আর ওয়েন, কিন্তু জক মুর তাদের পিছু নিলেন না। বাতাসের তীব্রতা অগ্রাহ্য করে দাঁড়িয়ে থাকলেন তিনি। কিছুক্ষণ থাকি এখানে, বললেন রানাকে। মাথা পরিষ্কারের জন্যে তাজা বাতাসের কোন বিকল্প নেই।

তা নেই, বলল রানা। তাঁর হাত থেকে টর্চটা নিয়ে সবচেয়ে কাছের ঘরটার ওপর আলো ফেলল ও। ওখানে। বাঁ দিকে। মার্ভেলাস প্রডাকশন্সে আর যা কিছুর অভাব থাকুক, অ্যালকোহলের অভাব কখনই হয় না।

মাই ডিয়ার ফেলো। টর্চটা জোর করে ফিরিয়ে নিলেন জক মুর। ওই ঘরের রসদ আমার নিজের তত্ত্বাবধানে তোলা হয়েছে। আমি জানি।

অথচ দরজায় কোন তালা দেয়া হয়নি।

তালা থাকলেই বা কি? মি. গোলডা আমাকে চাবি দিতেন।

মি. গোলডা আপনাকে চাবি দিতেন?

অবশ্যই। আপনি কি আমাকে সিঁধেল চোর মনে করেন? ইভনিং স্টারের লাউঞ্জ লকারের চাবি আমি কোত্থেকে পেলাম? কে দিয়েছিল আমাকে?

কে? মি. গোলডা?

অবশ্যই।

ঠিক কি ধরনের ব্ল্যাকমেইলিঙের সাহায্য নিচ্ছেন?

মি. গোলডা খুব, খুবই দয়ালু, জোর দিয়ে বললেন জক মুর। আমার মনে পড়ছে, এর আগেও কথাটা আপনাকে আমি বলেছি একবার।

ভুলে গিয়েছিলাম। বাম দিকের ঘরটার দিকে এগোলেন জক মুর, চিন্তি তভাবে তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকল রানা, তারপর মেইন কেবিনে ঢুকে পড়ল।

লাশ সরিয়ে ফেলার পর মেইন কেবিনের সবার দৃষ্টি এখন হুপারের ওপর। স্থির হয়ে আছে। হুপারও সে-ব্যাপারে সচেতন। এখন আর সে পামেলাকে জড়িয়ে ধরে রাখেনি, তবে তার ভেজা চোখ রুমাল দিয়ে মুছিয়ে দিতে ইতস্তত করছে না। গত দুদিন যখনই সম্ভব হয়েছে এলিনার সঙ্গ পাবার চেষ্টা করেছে। হিউম, এই মুহূর্তে তার পাশে বসে রয়েছে সে, মেয়েটার হাতে আঙুল বুলাচ্ছে। এলিনার আড়ষ্ট হাসি দেখে বোঝা গেল সামান্য হলেও বিব্রত বোধ করছে সে। ফন গোলডা, ক্লার্ক বিশপ, কাউন্ট বট্রিউলা ও রবার্ট হ্যামারহেড একটা অয়েল স্টোভের কাছে বসে নিচু গলায় আলাপ করছেন। হ্যামারহেড ওখানে কথা বলার জন্যে নয়, রয়েছে বারটেণ্ডার হিসেবে। ফন গোলডার নির্দেশে গ্লাস আর বোতল। সাজাচ্ছে সে।

এইমাত্র যা ঘটে গেল, বললেন গোলডা, এরপর আমাদের সবারই কড়া কিছু দরকার। রানার দিকে তাকালেন তিনি। সেই ফাঁকে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে ওকে নিয়ে কি করব আমরা।

কাকে নিয়ে?

হুপারকে নিয়ে।

ও। ভাল কথা, আমি দুঃখিত-আলোচনা ও মদ্যপান, দুটো থেকেই রেহাই দিতে হবে আমাকে। হুপার আর পামেলার দিকে তাকাল রানা, তারাও ওর দিকে মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে আছে। আমার কাজ এখনও শেষ হয়নি।

অয়েল স্টোভ থেকে গরম পানি নিয়ে নিজের কিউবিকলে চলে এল ও। টেবিলের ওপর সাদা একটা কাপড় বিছিয়ে সেটার ওপর একটা বেসিন, ইস্ট্রমেন্ট ও ওষুধ-পত্র যা যা দরকার সব জড়ো করল, তারপর আবার ফিরে এল মেইন কেবিনে। কেবিনে উপস্থিত বাকি সবার মত এলিনা ও হিউমও নিচু গলায় কথা বলছে, প্রায় ফিসফিস করে। অবাক হয়ে রানা দেখল হিউম এখন এলিনার একটা হাত ডলে দিচ্ছে। রানা বলল, আপনার ফাস্ট-এইডে বাধা দেয়ার জন্যে সত্যি দুঃখিত। মি. হুপারের চিকিৎসা দরকার, ভাবছি এলিনা ডিয়ার আপনি পামেলা ডার্লিঙের ওপর একটু নজর রাখবেন কিনা।

এলিনা ডিয়ার? উৎসাহী হয়ে উঠল হিউম। শুনতে দারুণ লাগে! এলিনা, আমিও কি তোমাকে এভাবে সম্বোধন করতে পারি?

ঠিক বলতে পারছি না, এলিনা সিরিয়াস হবার কৃত্রিম ভান করল। যদি কপিরাইটের কোন ব্যাপার থাকে…

কপিরাইট রেজিস্ট্রি করে নিতে পারেন উনি, বলল রানা। আমার তরফ থেকে কোন আপত্তি তোলা হবে না। আপনারা দুজন এতক্ষণ ধরে কি ফিসফিস করছিলেন?

ও, হ্যাঁ, বলল হিউম। আপনার মতামত দরকার, ডাক্তার। ওখানের ওই পাথরটা, মানে বলতে চাইছি যে পাথরটা দিয়ে মি. ট্যাকারের মাথা ফাটানো হয়েছে। আমার অনুমান সেটার ওজন হবে কম করেও সত্তর পাউণ্ড। আপনি কি বলেন?

আমারও তাই অনুমান।

এলিনাকে আমি জিজ্ঞেস করলাম সে ওই পাথরটা মাথার ওপর তুলতে পারবে কিনা, উত্তরে এলিনা বলল, প্রলাপ বোকো না।

উনি যদি ছদ্মবেশী অলিমপিক-ওয়েট-লিফটার না হন, তাহলে আপনি অবশ্যই প্রলাপ বকছেন। উনি পারবেন না। কেন?

না, মানে, আপনি একবার তাকান ওর দিকে। হাত বাড়িয়ে পামেলাকে দেখাল হিউম। শুধু হাড় আর চামড়া, তাই না? তাহলে কিভাবে…?

আমি চাই না আপনার এই কথা মি. হুপার শুনতে পান।

আমি কি বলতে চাইছি বুঝতে পারছেন তো? ওই রকম একটা পাথর! মোনাকা তাকে খুনী বললেন। বুঝলাম, সবার সঙ্গে পামেলাও খুঁজতে বেরিয়েছিলেন, কিন্তু কিভাবে তিনি…?

আমার ধারণা মিস মোনাকার মনে অন্য চিন্তাও ছিল, বলল রানা। ওদের দিকে পিছন ফিরে হুপারকে হাতছানি দিয়ে ডাকল ও, তারপর ওয়েনের দিকে ফিরে বলল, আমার একজন সার্জারি অ্যাসিস্ট্যান্ট দরকার। আপনি কি…?

শিওর। দাঁড়াল ওয়েন। আমার একটা কাজও দরকার। আমার সম্পর্কে রিপোর্টে ক্যাপটেন ডানহিল কি লিখছেন, সে-কথা ভোলার জন্যে।

হুপারের মুখে আর কিছু করার নেই রানার, এরপর যা করার প্রকৃতিই করবে; সেলাই করে দিল তার মাথার পিছনের ক্ষতটা। প্রথমে চারপাশের চুল কাটল, ইঙ্গিতে ক্ষতটা দেখাল ওয়েনকে। দেখার পর সামান্য একটু বড় হলো ওয়েনের চোখ, তবে কিছু বলল না সে। আটটা সেলাই দিতে হলো রানাকে, তারপর প্লাস্টার দিয়ে ঢেকে দিল সেটা। কাজ করার সময় কোন কথা বলল না ওরা, ব্যাপারটা লক্ষ করল হুপার।

এক সময় সে বলল, আমাকে আপনার তেমন কিছু বলার নেই, তাই না, ডাক্তার রানা?

কাজের সময় কথা বলা উচিত নয়।

সবাই যা ভাবছে আপনিও তাই ভাবছেন, এই তো?

সবাই কি ভাবছে আমার তা জানা নেই। কাজ শেষ করে সিধে হলো রানা। হয়ে গেছে। সোজাসুজি পিছন দিকে চুল আঁচড়াবেন, তাহলে আর কেউ টের পাবে না যে অকালে টাক পড়েছে আপনার।

ধন্যবাদ। ঘুরে রানার দিকে তাকাল হুপার, ইতস্তত করে বলল, দেখে মনে হচ্ছে খুব বড় একটা বিপদে পড়েছি আমি, তাই না?

একজন ডাক্তারের কাছে তা মনে হবে না।

তবে কি আপনি ভাবছেন কাজটা আমি করিনি?

ব্যাপারটা ভাবাভাবির নয়। জানার। শুনুন, দিনটা আজ আপনার খুব খারাপ। গেছে। নিজেও বুঝতে পারছেন না আপনার ভেতরটা কি রকম কেঁপে গেছে। অ্যানেসথেটিকের প্রভাব কমে গেলে ব্যথা শুরু হবে। আমার পাশের কিউবিকলটাই আপনার, তাই না?

হ্যাঁ, কিন্তু…।

সোজা ওখানে ঢুকে ঘণ্টা দুয়েক শুয়ে থাকুন।

হা, কিন্তু…।

আপনি যান, একটু পর পামেলাকেও পাঠিয়ে দিচ্ছি আমি

কি যেন বলতে গিয়ে থেমে গেল হুপার, তারপর সাবধানে মাথা ঝাঁকিয়ে চলে গেল। ওয়েন বলল, খুব খারাপ অবস্থা। ওঁর মাথার পিছনটার কথা বলছি।

ভাগ্য ভাল যে খুলিটা ফাটেনি।

এক মুহূর্ত চিন্তা করল ওয়েন। দেখুন, আমি ডাক্তার নই, শব্দ নির্বাচনেও তেমন দক্ষ নই, তবে এই ব্যাপারটা কি ঘটনাগুলোর ওপর নতুন আলো ফেলছে। না?

আমি ডাক্তার হিসেবে আপনার ধারণা সমর্থন করি।

আরও কিছুক্ষণ চিন্তা করল ওয়েন। বিশেষ করে মি. ট্যাকারকে ভাল করে দেখার পর?

বিশেষ করে।

এরপর পামেলাকে ভেতরে নিয়ে এল রানা। ম্লান হয়ে আছে তার চেহারা, যেন ছোট্ট একটা মেয়ে হারিয়ে গেছে, তবে ইতিমধ্যে নিজেকে খানিকটা সামলে নিয়েছে সে। ওয়েনের দিকে তাকাল, কথা বলার জন্যে মুখ খুলল, তারপর ইতস্তত করে থেমে গেল। তার মুখের আঁচড়গুলো পরিষ্কার করল রানা, ওষুধ লাগাল, ঢেকে দিল টেপ দিয়ে, তারপর বলল, খানিকটা চুলকাবে, তবে প্লাস্টার তুলে ফেলার ঝোঁকটা যদি দমিয়ে রাখতে পারেন, কোন দাগ থাকবে না।

 ধন্যবাদ, ডাক্তার। চেষ্টা করব। আবার ওয়েনের দিকে তাকাল পামেলা। ডাক্তার, আপনার সঙ্গে একটু কথা বলতে পারি, প্লীজ?

অবশ্যই। মন খুলে কথা বলতে পারেন। আপনার কথা এই ঘরের বাইরে যাবে না।

হ্যাঁ, আমি জানি, কিন্তু…।

ওদিকে মি. গোলডা বিনা পয়সায় স্কচ বিলি করছেন, বলে দরজার দিকে এগোল ওয়েন। এরকম সুযোগ জীবনে মাত্র একবারই পাওয়া যায়, হারালে নিজেকে ক্ষমা করতে পারব না।

বাইরে বেরিয়ে তখনও ওয়েন ভাল করে বন্ধ করেনি দরজা, পামেলা এগিয়ে। এসে রানার কোটের সামনেটা দুহাতে মুঠো করে ধরল। তার চেহারায় ব্যাকুল একটা ভাব ফুটে উঠেছে। হুপার এ কাজ করেনি, মি. রানা! আমি জানি এটা ওর দ্বারা সম্ভব নয়! জানি পরিস্থিতি তার বিরুদ্ধে চলে গেছে-আজ সকালে ওরা মারামারি করল, তারপর এখন আবার আহত হয়েছে, মি. ট্যাকারের হাতে বোতাম, সবই ওর বিরুদ্ধে চলে যাচ্ছে। কিন্তু হুপারকে আমি চিনি, ওর পক্ষে একটা মাছি মারাও সম্ভব নয়। সবচেয়ে বড় কথা, হুপার মিথ্যে কথা বলতে পারে না, মি. রানা। আমাকে তো বলবেই না! বিশ্বাস করানোর জন্যে রানাকে ধরে ঝাঁকাতে শুরু করল মেয়েটা। আমিও না! আমিও করিনি! অথচ উনি আমাকে খুনী বললেন! লোকজনের সামনে আমাকে উনি বললেন আমি একটা খুনী! আমার পক্ষে কাউকে খুন করা সম্ভব নয়, মি. রানা! বিশ্বাস করুন…, এরপর রানার কাঁধে মাথা রেখে ঝর ঝর করে কেঁদে ফেলল সে।

পামেলা, তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিল রানা। শান্ত হোন। আমি জানি।

ঝট করে মাথা তুলে রানার মুখের দিকে তাকাল পামেলা। আপনি জানেন? তারমানে আপনি বিশ্বাস করেন আমি বা হুপার খুনটা করিনি?

করি।

ফোৎ ফোৎ করে নাক টানল পামেলা। আপনি কে আমি জানি না, শুধু এটুকু জানি যে মানুষের মধ্যেই দেবতারা বাস করেন। আর জানি, আপনি আমাদেরকে অভয় দিতে চেষ্টা করছেন…

থামুন, বলল রানা। ব্যাপারটা আমি প্রমাণ করতে পারি।

প্রমাণ করতে পারেন? প্রমাণ করতে পারেন? পামেলার ভেজা চোখে খানিকটা আশার আলো ফুটল। রানার কথা বিশ্বাস করবে কিনা বুঝতে পারছে না। তারপর বিশ্বাস না করারই সিদ্ধান্ত নিল, মাথা নাড়ল এদিক ওদিক, মুন গলায় বলল, উনি বলেছেন আমি তাকে খুন করেছি।

কথাটা উনি সেই অর্থে বলেননি, বলল রানা। যে অর্থেই বলে থাকুন, ভুল করেছেন তিনি। আসলে বলতে চেয়েছেন, তার স্বামীর মৃত্যুর ব্যাপারে আপনারও ভূমিকা আছে। আসলে নেই।

আমার ভূমিকা আছে?

হ্যাঁ। পামেলার হাত দুটো ধরল রানা। এবার আমাকে বলুন, আপনি কি কখনও মি. ট্যাকারের সঙ্গে জোছনা দেখতে বেরিয়েছিলেন?

আমি? আমি মি. ট্যাকারের সঙ্গে?

পামেলা?

 হা, কাতরকণ্ঠে বলল পামেলা। মানে, না।

পরিষ্কার উত্তর, ধন্যবাদ, বলল রানা। তাহলে এভাবে বিবেচনা করা যাক। আপনি কখনও এমন কিছু করেছেন কি যে কারণে মোনাকার সন্দেহ হতে পারে মি. ট্যাকারের সঙ্গে আপনি জোছনা দেখতে বেরিয়েছিলেন?

হ্যাঁ। আবার নাক টানল পামেলা। না, মানে মি. ট্যাকার করেছিলেন। রানা ওর হতভম্ব ভাব গোপন করে রাখল, পামেলার দিকে তাকাল উৎসাহ দেয়ার দৃষ্টিতে। উনি আমাকে তার কেবিনে ডেকেছিলেন, উইক ছাড়ার দিন। কেবিনে তিনি একা ছিলেন। বললেন, ফিল্ম সংক্রান্ত ব্যাপারে আমার সঙ্গে আলোচনা করতে চান।

আপনি সরল মনে তা বিশ্বাস করেন।

রানার দিকে না তাকিয়ে কথা বলে যাচ্ছে পামেলা, কিন্তু উনি ফিল্ম নিয়ে কথা বললেন না। বিশ্বাস করুন, মি. রানা, আমি সত্যি কথা বলছি!

আমি জানি।

দরজা বন্ধ করেই আমাকে তিনি জড়িয়ে ধরলেন…

বিস্তারিত বিবরণ দেয়ার দরকার নেই। ভিলেন যখন আপনার কাছে অন্যায়। মনোযোগ দাবি করছে, এই সময় বাইরের করিডরে হাইহিলের খট-খট আওয়াজ শোনা গেল, তাই না? সঙ্গে সঙ্গে নিজের ভূমিকা বদলে নিল ভিলেন। সে এমন অভিনয় শুরু করল, যেন আপনিই তার কাছে অন্যায় মনোযোগ দাবি করছেন। দরজা খুলে গেল, ঠিক? দোরগোড়ায় দেখা গেল ভিলেনের অর্ধাঙ্গিনীকে। ভিলেন তখন তরুণী কনটিনিউইটি গার্লকে ঠেলে সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে, কান্না জড়ানো গলায় বলে উঠল, প্রিয়তমা, শান্ত হও, এর জন্যে আমি দায়ী নই, প্লীজ! ঠিক?

মোটামুটি। পামেলাকে আগের চেয়েও ম্লান দেখাল। তারপর বড় বড় করল চোখ দুটো। আপনি কিভাবে জানলেন?

ট্যাকাররা দুনিয়ার সবখানে একই চরিত্রের হয়। পরবর্তী দৃশ্যগুলো নিঃসন্দেহে অত্যন্ত বেদনাদায়ক।

পরবর্তী দৃশ্য আসলে দুটো, বেসুরো গলায় বলল পামেলা। পরদিন রাতে আপার ডেকে প্রথমটা। মোনাকা আমাকে বললেন, ব্যাপারটা তিনি তার বাবার কাছে রিপোর্ট করবেন-মি. গোলডার কাছে। আর মি. ট্যাকার বললেন, মোনাকার অনুপস্থিতিতে, আমি যদি গোলমাল পাকাবার চেষ্টা করি তাহলে আমার চাকরি খাবেন। তিনি একজন ডিরেক্টর, আপনি জানেন। পরে, হুপারের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা হতে, উনি হুমকি দিয়ে বললেন দরকার হলে আমাদের দুজনেরই চাকরি খাবেন, ব্যবস্থা নেবেন আমরা যাতে কোন ফিল্মে কাজ না পাই। সব জানার পর হুপার বলল, এ ভারি অন্যায়, এ আমরা মেনে নেব না। তাই…।

তাই মি. ট্যাকারকে উচিত শিক্ষা দিতে গিয়ে আজ সকালে নিজেই উত্তম মধ্যম খেয়েছেন মি. হুপার। ঠিক আছে, ভয় পাবার কিছু নেই। দুজনের কারুরই ভয় পাবার কিছু নেই। আপনি আপনার বীরপুরুষকে পাশের ঘরেই পাবেন, পামেলা। হাসিমুখে তার ফুলে থাকা গাল স্পর্শ করল রানা। আপনি তাকে সত্যি ভালবাসেন, তাই না?

অবশ্যই। সরল দৃষ্টিতে তাকাল পামেলা। মি. রানা?

অ্যাম আই ওয়াণ্ডারফুল?

হাসল পামেলা, প্রায় সুখী দেখাল তাকে, তারপর বিদায় নিল। সে বেরিয়ে যেতেই ভেতরে ঢুকল ওয়েন। কি কথা হয়েছে তাকে জানাল রানা। সে প্রশ্ন করল, এখন কি হবে?

প্রথম কাজ মিথ্যে অভিযোগ থেকে পাশের কামরার প্রেমিক-প্রেমিকাকে মুক্ত করা। কাজটা যদিও এই মুহূর্তে জরুরী নয়, কিন্তু মানুষ হিসেবে ওরা দুজনেই অত্যন্ত অনুভূতিপ্রবণ, আমি চাই বাকি সবার সঙ্গে আবার কথা বলার সম্পর্ক ফিরে পাক ওরা। দ্বিতীয় ব্যাপারটা হলো, আগামী বাইশটা দিন এখানে আমি আটকা পড়ে থাকতে রাজি নই। কে জানে, আমি যদি ঠিক মত চাপ দিতে পারি, অচেনা। লোক বা লোকেরা হয়তো দ্রুত কিছু ঘটনা ঘটাবে।

অ্যাকশন তো ইতিমধ্যে কম দেখিনি আমরা।

তা ঠিক। আরেকটা ব্যাপার হলো, নিজেদের নিরাপত্তার জন্যেই সবার মনে সবার সম্পর্কে সন্দেহ ঢুকিয়ে দেয়ার কথা ভাবছি আমি। সবাই যদি সবার ওপর নজর রাখে, সহজে কেউ পিছন থেকে আমাদের ঘাড়ে লাফিয়ে পড়তে পারবে।

তার মানে এখুনি আপনি অ্যাকশনে যেতে চাইছেন। জড়ো হওয়া ভদ্রলোকদের সঙ্গে আলাপ দিয়ে শুরু করতে চান?

তোমার ধারণা নির্ভুল। হুপারকে দুঘণ্টা বিশ্রাম নিতে বলেছি বটে, তবে হুপার আর পামেলারও ওখানে থাকা দরকার। তুমি যাবে, না আমি?

ওয়েনই গেল। সে চলে যেতে মেইন কেবিনে বেরিয়ে এল রানা। বিশপ, গোলডা আর কাউন্ট হাতে গ্লাস নিয়ে এখনও নিচু গলায় আলাপ করছেন। উপস্থিত বাকি সবার হাতেও গ্লাস দেখা গেল। রানাকে দেখে হাতছানি দিলেন গোলডা।

এক মিনিট, বলে বাইরে বেরিয়ে গেল রানা। ফুসফুঁসে ঠাণ্ডা বাতাস ঢুকতে কাশি পেল ওর। তুষার ঝড় ঠেলে বাম দিকের ঘরটার দিকে এগোল, যেটায় রসদ রাখা হয়।

একটা প্যাকিং কেসের ওপর বসে রয়েছে জক মুর, আদুরে দৃষ্টিতে হাতের গ্লাসটার দিকে তাকিয়ে। ঘরের ভেতর তার টর্চটা জ্বলছে। হাহ, বললেন তিনি। আমাদের সদয় হিলার। আপনি জানেন কেউ যখন এ-ধরনের অমৃত পান। করে…।

অমৃত?

কথার কথা আর কি। যখন কেউ এ-ধরনের দারুণ স্কচ পান করে, চোখ দিয়ে দেখার মধ্যেই আসলে অর্ধেক মজা। অন্ধকারে একা কখনও চেষ্টা করে দেখেছেন? সে অভিজ্ঞতার কোন তুলনা হয় না। গ্লাস সহ হাতটা তুলে দেয়াল ঘেঁষা বাক্সগুলোর দিকে ইঙ্গিত করলেন তিনি। মৃত্যুর পর, পরকালে বার পাব কিনা জিজ্ঞেস করেছিলাম, মনে আছে? বোধহয় পাব, কারণ বেয়ার আইল্যাণ্ডেও যদি বার থাকে…।

মি. মুর, বলল রানা, আপনি আরও বড় সুযোগ থেকে নিজেকে বঞ্চিত করছেন। মি. গোলডা এই মুহূর্তে অমৃত বিলি করছেন। খুব বড় আকারের গ্লাস ব্যবহার করছেন তিনি।

আমি বেরুতে যাচ্ছিলাম, বলে ঢক ঢক করে গ্লাসটা খালি করে ফেললেন জক মুর।

মানবজাতির এই বন্ধুকে নিয়ে মেইন কেবিনে ফিরে এল রানা। মোট কজন আছে, গুনল ও। ওকে নিয়ে একুশজন, হবারও কথা তাই। মোনাকা উপস্থিত থাকলে বাইশজন হত। আবার হাতছানি দিয়ে ওকে ডাকলেন ফন গোলডা। তার দিকে এগোল রানা।

বলতে পারেন এখানে একটা পরামর্শ সভা হয়ে গেছে, গুরুত্ব বোঝাবার জন্যে গম্ভীর সুরে শুরু করলেন তিনি। আমরা একটা উপসংহারে পৌচেছি। এখন আপনার মতামত পেলে খুশি হই।

আমার মতামত কেন দরকার? আমি তো স্রেফ একজন এমপ্লয়ী, বাকি সবার মত-শুধু আপনারা তিনজন আর মিস মোনাকা আলাদা।

মনে করুন আপনি একজন কো-অপটেড ডিরেক্টর, উদার ভঙ্গিতে বললেন কাউন্ট। অস্থায়ী ও অবৈতনিক, অবশ্যই।

আপনার মতামতকে গুরুত্ব দেয়া হবে, বিশপ জানালেন।

কিসের ওপর মতামত?

হুপারকে নিয়ে কি করা হবে তা নিয়ে আমাদের প্রস্তাবের ওপর, বললেন ফন গোলডা। আমি জানি অপরাধ প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত প্রতিটি মানুষকে। নিরপরাধ মনে করতে হবে। তাছাড়া, অমানবিক কিছু করার ইচ্ছেও নেই আমাদের। শুধু নিজেদের নিরাপত্তার স্বার্থে…।

এ-ব্যাপারেই আপনাদের সঙ্গে কথা বলতে চাই আমি, বলল রানা। নিজেদের নিরাপত্তার ব্যাপারে। আমি কথা বলতে চাই সবার সঙ্গে। এখুনি, এই মুহূর্তে সেই প্রস্তাবই রাখছি।

কি কথা বলতে চান আপনি? ভুরু কুঁচকে জানতে চাইলেন ফন গোলডা।

সেটা আমার ছোট্ট ভাষণ শুনলেই জানতে পারবেন। খুব অল্প সময় নেব আমি।

সে অনুমতি আপনাকে আমি দিতে পারি না, বেসুরো গলায় বললেন ফন গোলডা। অন্তত, আপনি কি বলতে চান তার একটা আভাস না পেলে।

আপনার অনুমতি পাওয়া বা না পাওয়ার কোন গুরত্ব নেই, রানা নির্লিপ্ত, ওর গলার সুর ঠাণ্ডা। মানুষের জীবন-মরণ নিয়ে যখন কথা বলি, আমি কারও অনুমতির ধার ধারি না।

আমি আপনাকে নিষেধ করছি। এইমাত্র আমাকে যা মনে করিয়ে দিয়েছেন, আমিও আপনাকে সেটা মনে করিয়ে দিচ্ছি। ফন গোলডার কথা কেবিনের সবাই শুনতে পাচ্ছে, রীতিমত চিৎকার করছেন তিনি। আপনি আমার একজন এমপ্লয়ী, স্যার!

এখন আমি কর্তব্যপরায়ণ এমপ্লয়ী হিসেবে শেষ কাজটা করব, বলে ফন গোলডার বোতল থেকে একটা গ্লাসে খানিকটা স্কচ ঢালল রানা। ফন গোলডা নিজে এবং অন্যান্যরা এই একই বোতল থেকে পান করছেন, কাজেই বোতলের স্কচ নিরাপদ বলে ধরে নিল ও। সবার সৌভাগ্য কামনায়, বলল ও। স্রেফ কথার কথা বা প্রচলিত হালকা অর্থে নয়। এই দ্বীপ থেকে বহাল তবিয়তে ফিরে যেতে আমাদের সবারই ভাগ্যের সহায়তা দরকার হবে। এবার, মি. গোলডা, আপনার-আমার সম্পর্ক। আপনি ধরে নিতে পারেন, এই মুহূর্ত থেকে আমার পদত্যাগ কার্যকর হলো। বোকা লোকদের কাজ করার কোন ইচ্ছে আমার নেই। আর আপনারা শুধু বোকা নন, আনাড়িও

ফন গোলডার চেহারা রঙ হারিয়ে বিবর্ণ হয়ে গেল। দেখে মনে হলো শ্বাস নিতেও সামান্য কষ্ট হচ্ছে তার। আর কাউন্ট যেন চিন্তিত হয়ে উঠলেন। বিশপের চেহারা দেখে তার মনের ভাব কিছুই বোঝা গেল না। কেবিনের চারদিকে তাকাল। রানা।

তারপর বলল, সন্দেহ নেই, আমাদের এই অভিযানে অশুভ কিছুর প্রভাব পড়েছে। শনির কুপ্রভাবও বলতে পারেন। দুঃখজনক ও অদ্ভুত ঘটনার রীতিমত ছড়াছড়ি দেখা যাচ্ছে। ক্লাউড কেডিপাসকে হারিয়েছি আমরা। সেটা একটা দুর্ঘটনা হতে পারে। আবার হত্যাকাণ্ডও হতে পারে-ভুল করে। ভুল করে এই জন্যে বলছি যে কেডিপাস এমন গুরুত্বহীন একটা চরিত্র, যাকে খুন করে কারও কোন লাভ হবার কথা নয়। তাই মনে সন্দেহ জাগে, হয়তো অন্য কাউকে খুন করার আয়োজন করা হয়েছিল, কিন্তু যে-কোন ভুলের কারণে খুন হয়ে যায় বেচারা কেডিপাস।

একই কথা বলা যায় দুজন স্টুয়ার্ড সম্পর্কেও-হ্যানসেন বাক আর টমাস পিটারসন সম্পর্কে। মি. ফন গোলডা, মি. চ্যাঙ ওয়েন, মি. গ্যাবন ও মি, ব্যারনও হয়তো একই ধরনের ভুলের শিকার, কিংবা হয়তো নন। আমি শুধু নিশ্চিতভাবে এটুকু বলতে পারি যে ওঁরা যখন আক্রান্ত হন তখন যদি আমি উপস্থিত না থাকতাম, ওঁদের মধ্যে অন্তত তিনজন মারা যেতে পারতেন।

আপনারা হয়তো ভাবছেন, সাধারণ একটা ফুড পয়জনিং-এর ঘটনা নিয়ে কেন আমি এত কথা বলছি। কারণ হলো, আমি জানি, ঘটনাটা ফুড পয়জনিং ছিল না। সেদিন আমাদের রাতের খাবারের সঙ্গে অ্যাকোনাইটিন নামে মাত্মক একটা বিষ মেশানো হয়েছিল, যদিও আমি তা প্রমাণ করতে পারব না। সেই খাবার খেয়েই সবাই ওঁরা অসুস্থ হয়ে পড়েন।

রানা লক্ষ করল, এমন পাথর হয়ে আছে সবাই যে পরস্পরের দিকে তাকাতেও যেন ভুলে গেছে। সবার চোখ শুধু রানার ওপর স্থির, মনোযোগ দিয়ে ওর কথা শুনছে সবাই।

আর তারপর মি. ল্যারি আর্চার রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হয়ে গেলেন। আমার কোন সন্দেহ নেই ময়না তদন্ত করা হলে তার মৃত্যুর কারণ অবশ্যই জানা যেত, এ-ও নিঃসন্দেহে জানি তার ময়না তদন্ত করা সম্ভব নয়, কারণ বেচারা মি. আর্চার ব্যারেন্ট সী-র তলায় শুয়ে আছেন। আমার বিশ্বাস, এ-ও প্রমাণ করতে পারব না, মি. আর্চার ফুড পয়জনিং-এ মারা যাননি, মারা গেছেন বিষ মেশানো হুইস্কি খেয়ে-হুঁইস্কির ওই বোতলটায় বিষ মেশানো হয়েছিল আমাকে মারার জন্যে। পামেলার দিকে তাকাল রানা-বড় বড় হয়ে আছে চোখ, সাদা মুখে ঠোঁট জোড়া ফাঁক করা। তবে একা শুধু ও-ই ব্যাপারটা লক্ষ করল।

এরপর গায়ের কোটটা খুলল রানা, ঘাড়ের আঘাতের দাগটা দেখাল সবাইকে। কেউ বলতে পারেন, আমি নিজে আহত হয়ে অন্য কারও ওপর দোষ চাপাবার চেষ্টা করছি। কিংবা হয়তো কোথাও পড়ে গিয়েছিলাম। তারপর ধরুন রেডিও ভেঙে ফেলার অদ্ভুত ঘটনাটা।

কিন্তু সবই ধারণা বা অনুমান। জীবনে কাকতালীয় ঘটনা কতই তো ঘটে। কিন্তু সত্যি কি তাই? আমার কথা হলো, আমরা যদি প্রমাণ করতে পারি এ-সব ঘটনা আসলে ঠাণ্ডা মাথায় মানুষ খুন করার প্রচেষ্টা, তাহলে লাভ হবে এই যে, হয়তো এরপর আর এ-ধরনের ঘটনা ঘটবে না।

জানা কথা অপরাধী বা অপরাধীরা তাদের অপরাধের কথা স্বীকার করবে না।

তবে সবই অনুমান নয়, অন্তত একটা যে ঠাণ্ডা মাথায় হত্যাকাণ্ড, প্রমাণ করা যায়। মি. ট্যাকারকে খুন করতে গিয়ে খুনী আনাড়িপনার পরিচয় দিয়েছে। আর বোকামির পরিচয় দিয়েছে খুনটার দায় মি. হুপারের ঘাড়ে চাপাতে চেষ্টা করে। আমি পরিষ্কার করে বলছি, মি. ট্যাকারকে মি. হুপার খুন করেননি। তবে, মি. হুপারের ওপর বিশেষ রাগ বা আক্রোশ খুনীর ছিল না। তাকে ফাঁসাবার চেষ্টা করা হয়েছে স্রেফ নিজেকে বাঁচাবার জন্যে।

মি. হুপার বলেছেন, কি ঘটেছে কিছুই তার মনে নেই। আমি তার কথা বিশ্বাস করি। তাঁর মাথার পিছনে বাড়ি মারা হয়, চামড়া কেটে হাড় বেরিয়ে পড়েছে। খুলিটা কেন যে ফাটেনি, এটা আমার কাছে একটা বিস্ময়। তবে এই আঘাতের পর নিঃসন্দেহে বেশ কিছুক্ষণ অচেতন অবস্থায় তুষারের ওপর পড়ে ছিলেন তিনি। ধরে নিতে হয়, আক্রমণকারী তখনও অক্ষত অবস্থায় ছিল। আর এই অক্ষত অবস্থায় থাকতে পারাটা নিজেকে সন্দেহ-মুক্ত রাখার জন্যে বিরাট সুবিধে করে দেয় তাকে। আমরা কি ধরে নেব মাথায় প্রচণ্ড আঘাত পাবার পর অচেতন হয়ে পড়ে গেলেন মি. হুপার, পরমুহূর্তে লাফ দিয়ে উঠে আক্রমণকারীর। নিতম্ব আর উরুতে খামচি মারলেন? এটা বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হয় না। বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হয়-অচেনা আক্রমণকারী পিছন থেকে চুপিসারে এগিয়ে এসে মি. হুপারের মাথায় আঘাত করে, সম্ভবত কোন পাথর দিয়ে। পাথর ওখানে অনেকগুলোই ছড়িয়ে ছিল। মি. হুপারকে অচেতন করার পর লোকটা তার মুখ খামচায়, কোটের দুটো বোতাম ছিঁড়ে নেয়, দেখে যাতে মনে হয় উনি কারও সঙ্গে মারামারি করেছেন।

একই ঘটনা ঘটেছে মি. ট্যাকারের বেলায়ও, তবে তাঁর আঘাতটা ছিল আরও মাস্তুক। মি. হুপার শুধু জ্ঞান হারালেন, অথচ মি. ট্যাকার মারা গেলেন। কারণটা কি? আমি জানি, ব্যাপারটা কাকতালীয় নয়। আমাদের বন্ধুকে এ-ধরনের ব্যাপারে বিশেষজ্ঞই বলতে হবে, মেরে ফেলতে হলে কতটা জোরে মারতে হবে তা সে ভালই বোঝে। যাই হোক, মি. ট্যাকারকে খুন করার পর তার মুখও। ক্ষতবিক্ষত করে সে। মৃত একজন মানুষের মুখ নিয়ে এ-ধরনের কুৎসিত কাণ্ড যে করতে পারে তার সম্পর্কে আমি কিছু বলতে চাই না, সে কি রকম শয়তান আপনারাই ভেবে দেখুন।

০৪.

কেউ কারও দিকে তাকাল না, কারও চোখ নড়ল না, সবাই রানার দিকে তাকিয়ে।

মি. ট্যাকারের ওপরের ঠোঁট দুভাগ হয়ে ছিল, একটা দাঁত ছিল না, আর কপালে থেঁতলানোর লালচে দাগ দেখেছি আমরা; আমার ধারণা এ-সব করা হয়েছে আরেকটা পাথর দিয়েই। পাথর ব্যবহার করা হয়েছে খুনীর হাতের বা আঙুলের গিঁটের চামড়া যাতে ছড়ে না যায় সেজন্য। মারামারির সময় ক্ষতগুলো সৃষ্টি হলে প্রচুর রক্তক্ষরণ হবার কথা, সেক্ষেত্রে থেতলানো বা কেটে যাবার চেয়ে আঁচড়ের ও চামড়া ছড়ে যাবার ঘটনা বেশি ঘটত। দুটোরই প্রায় কোন অস্তিত্ব নেই, কারণ মি. ট্যাকার আগেই মারা যাওয়ায় তার শরীরে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে। গিয়েছিল। এরপর খুনী তার হাতের তালুতে হুপারের কোট থেকে ছিঁড়ে আনা বোতামটা গুঁজে দেয়। তাছাড়া, মারামারি হলে নরম তুষারে পায়ের এলোমেলো ও গভীর দাগ থাকার কথা, কিন্তু ছিল না।

নিজের গ্লাসে ফন গোলডার স্কচ আরও খানিকটা নিল রানা, তারপর জিজ্ঞেস করল, আপনাদের কারও কোন প্রশ্ন আছে?

জানা কথা, থাকবে না। সবাই আসলে নিজেকে প্রশ্ন করতে ব্যস্ত, রানাকে প্রশ্ন করার সময় নেই কারও।

আশা করি এখন সবাই মেনে নেবেন যে আগের চারটে খুন কাকতালীয় ঘটনা ছিল না। তারমানে, আমরা একজন ধুরন্ধর হত্যাকারীকে নিয়ে আলোচনা করছি। লোকটা হয় পাগল, আ প্যাথলজিক্যাল কিলার, কিংবা একটা পিশাচ, আল্লাহই জানেন এতগুলো প্রাণ কেড়ে নেয়ার পিছনে কি তার উদ্দেশ্য। সে যে-ই হোক বা যা-ই হোক, এই মুহূর্তে আমাদের সঙ্গে এই কেবিনেই রয়েছে। ভাবছি আপনাদের মধ্যে কে সে?

এই প্রথম রানার ওপর থেকে চোখ সরাল সবাই, আড়চোখে পরস্পরের দিকে তাকাল।

সবার ওপর চোখ বুলিয়ে রানা আবার বলল, কে খুনী, আমি তা বলতে পারব না। তবে কে খুনী নয় তা বলতে পারব। মিস মোনাকাকে বাদ দিলে এখানে আমরা বাইশজন রয়েছি, এদের মধ্যে নয়জনের ওপর সন্দেহ করার কোন কারণ আছে বলে আমি মনে করি না।

মার্সিফুল গড! বিড়বিড় করলেন বিশপ। মার্সিফুল গড! ব্যাপারটা অবিশ্বাস্য মি. রানা। আমাদের মধ্যে একজন! যাদেরকে আমরা সবাই চিনি তাদের মধ্যে একজন! আমাদের এক বন্ধুর হাতে পাঁচজন লোকের রক্ত? এ হতে পারে না! এ স্রেফ হতেই পারে না!

তবু মনে মনে জানেন, এ সত্যি, বলল রানা, উত্তরে চুপ করে থাকলেন। বিশপ। আমাকে দিয়েই শুরু করি। সন্দেহের তালিকা থেকে আমাকে বাদ দিতে হবে। কারণ আমার ওপর দুবার হামলা করা হয়েছে। বিষ খাওয়ানোর চেষ্টাটাকেও আমি হামলা বলছি। তাছাড়া, মি. হুপার যখন আহত হন আর মি. ট্যাকার যখন খুন হন, আমি তখন মি. ওয়েনকে ভেতরে নিয়ে আসছিলাম। ওর এই কথার মধ্যে আংশিক সত্যতা আছে, যদিও তা শুধু খুনী জানে, কিন্তু প্রতিবাদ করার উপায় নেই তার। আমার মত মি. ওয়েনও সন্দেহের বাইরে, কারণ সে সময় তিনি যে শুধু অচেতন ছিলেন তাই নয়, তার আগে তাকেও বিষ খাওয়ানো হয়েছিল। তিনি স্বেচ্ছায় বিষ খেয়েছেন, এটা বিশ্বাস করা যায় না।

তাহলে আমিও সন্দেহের বাইরে, ডক্টর রানা! ব্যারনের গলা কর্কশ আর বেসুরো শোনাল। তাহলে আমিও নই, আমার পক্ষেও সম্ভব নয়…

মানলাম, মি. মুনফেস, আপনিও বাদ। শুধু আপনাকে বিষ খাওয়ানো হয়েছিল বলে নয়, আমার ধারণা মি. ট্যাকারকে যে পাথরটা দিয়ে খুন করা হয়েছে ওটা তোলার জন্যে যে শারীরিক শক্তি দরকার তা-ও আপনার নেই। জানা কথা, মি. গোলডাও সন্দেহের বাইরে। তাকে তো বিষ খাওয়ানো হয়েছেই, মি. ট্যাকারের মৃত্যুর সময় তিনি এই কেবিনে ছিলেন। খুনের সঙ্গে হুপারের কোন সম্পর্ক থাকতে পারে না, সম্পর্ক থাকতে পারে না মি. বিশপের সঙ্গেও। অবশ্য যদি আমার কথা আপনারা বিশ্বাস করেন।

ঠিক কি বলতে চান, ডক্টর রানা? স্থির গলায় প্রশ্ন করলেন ক্লার্ক বিশপ।

প্রথমবার যখন মি. ট্যাকারের লাশটা আপনি দেখলেন, আপনার চেহারা থেকে সমস্ত রক্ত নেমে গিয়েছিল। মানুষ তার শরীর নিয়ে অনেক কিছু করতে পারে, কিন্তু সে তার চামড়ার নিচের রক্ত চলাচল ইচ্ছেমত বন্ধ বা চালু করতে পারে না। দৃশ্যটা দেখার জন্যে আপনি যদি মানসিকভাবে তৈরি থাকতেন, আপনার চেহারায় রঙের কোন পরিবর্তন হত না। আমাদের দুই সুন্দরী তরুণীকেও বাদ দিতে হয়, কারণ ওই পাথর তুলে মি. ট্যাকারকে আঘাত করার শক্তি তাদের নেই। আর মিস মোনাকাকেও সন্দেহ করা যায় না। তারমানে, আমার হিসেবে, সন্দেহের তালিকায় থাকছেন আপনারা তেরোজন। কেবিনের চারদিকে তাকিয়ে গুনল রানা। হ্যাঁ, ঠিক আছে আমার হিসাব। তেরোজনই। অর্থাৎ, কোন সন্দেহ নেই, আপনাদের মধ্যে যে-কোন একজনের জন্যে সংখ্যাটা খুবই আনলাকি হতে যাচ্ছে।

ডক্টর রানা, বিশপ বললেন। আমার ধারণা পদত্যাগের সিদ্ধান্ত আপনার প্রত্যাহার করা উচিত।

ধরে নিন প্রত্যাহার করা হয়েছে। ভাবছিলাম চাকরি ছেড়ে দিলে খাব কি! খালি গ্লাসটার দিকে তাকাল রানা, তারপর মুখ তুলল ফন গোলডার দিকে। এখন যখন আমি আবার আপনাদের লোক হিসেবে ফিরে এসেছি, গ্লাসটা ভরে নিতে পারি তো?

অবশ্যই, অবশ্যই! ফন গোলডাকে দেখে মনে হচ্ছে বজ্রপাতে আহত হয়েছেন তিনি, মেদবহুল প্রকাণ্ড দেহটা টুলের ওপর কুঁকড়ে ছোট হয়ে আছে, যেন ফুটো একটা বেলুন। ডিয়ার গড়, এ কি জঘন্য কাণ্ড! আমাদের মধ্যে একজন মার্ডারার! আমাদের মধ্যে কেউ পাঁচ-পাঁচটা লোককে মেরে ফেলেছে! শিউরে উঠলেন তিনি, যদিও ইতিমধ্যে ফ্রিজিং পয়েন্টের চেয়ে বেশ অনেকটা ওপরে উঠে এসেছে কেবিনের তাপমাত্রা। পাঁচজন লোক! পাঁচটা লাশ! আর যে লোক এই কাজ করেছে সে এখানে আমাদের সঙ্গে বসে আছে!

সিগারেট ধরাল রানা, স্কচে চুমুক দিয়ে অপেক্ষায় থাকল আর কে কি বলে শোনার জন্যে। কিন্তু পুরো একটা মিনিট পেরিয়ে গেলেও আর কেউ কিছু বলল না।

মি. ট্যাকার মারা গেছেন। মারা গেছেন আরও চারজন। প্রশ্ন হলো, কে তাদের মৃত্যু চাইতে পারে? খুনগুলোর পিছনে কি কোন উদ্দেশ্য আছে? যদি কোন। উদ্দেশ্য থেকে থাকে, তা কি পূরণ হয়েছে? আর পূরণ যদি না হয়ে থাকে, কিংবা খুনী যদি একজন সাইকোপ্যাথ হয়ে থাকে, এরপর আমাদের মধ্যে কে খুন হতে যাচ্ছে? কে খুন হতে যাচ্ছে আজ রাতে? অর্থাৎ আজ রাতে কেউ আমরা ঘুমাতে পারব না। কিন্তু একরাত না ঘুমিয়ে খুনীকে না হয় ঠেকানো গেল, কিন্তু এভাবে। করাত ঠেকাবেন তাকে? তাকে কি বাইশটা রাত ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব হবে? আমাদের মধ্যে এমন কেউ আছেন কি যিনি নিশ্চিতভাবে বলতে পারবেন ইভনিং স্টার ফিরে আসার পরও তিনি বেঁচে থাকবেন?

কেউ জবাব দিলেন না।

এখানে এখন থেকে আমরা থাকবই বা কিভাবে? সন্দেহের তালিকায় রয়েছেন তেরোজন, তালিকার বাইরে রয়েছেন নয়জন। তাহলে দুটো আলাদা গ্রুপে ভাগ হয়ে যাব আমরা? কিন্তু তেরোজনকে একঘরে করে দিলে বারোজনের ওপর অন্যায় করা হবে, তাই না? আমাদের সম্পর্কটা কি তেল আর পানির মত হবে, মিশতে রাজি নই? তাছাড়া, আপনাদের শ্যটিঙেরই বা কি হবে? মি. গোলডাকে কাল কাউন্ট বট্রিউলার সঙ্গে কাজ করতে হবে-কাউন্ট সন্দেহের। বাইরে নন, মি. গোলডা সন্দেহের বাইরে। শূটিং হলে মি. বিশপও ব্যস্ত থাকবেন, কিন্তু তার পিছনে নজর রাখবে কে? তারমানে সন্দেহের বাইরে রয়েছেন, এমন একজন লোক দরকার হবে তার। লোকেশনের সন্ধানে সোর হামনা ধরে ওঅর্ক-বোট নিয়ে আরও দক্ষিণে যাবার প্ল্যান করছেন মি. এরিক কার্লসন। আমি যতদূর জানি, মি, ফার্গুসন আর মি. ব্রখটম্যান স্বেচ্ছাসেবক হবার প্রস্তাব দিয়েছেন। এখন ধরুন, ফিরে এসে কেউ যদি বলেন দুর্ঘটনায় ওদের একজন বা দুজন মারা গেছেন, তাহলে কি করার থাকবে আমাদের? সমস্যা, তাই না?

গোটা ব্যাপারটা অবিশ্বাস্য! গলা চড়িয়ে বললেন ফন গোলডা। পুরোপুরি অবিশ্বাস্য!

নয়? সমর্থনের সুর রানার গলায়। যদিও মি. ট্যাকারের মতামত চাওয়া যাচ্ছে না। কিংবা কেডিপাস, আর্চার, বাক, বা পিটারসনের। অবিশ্বাস্য, মি. গোলডা, আমি আপনার সঙ্গে একমত। কিন্তু তবু সমস্যাটা বাস্তব সত্য। কেঁপে উঠে বোতলটার দিকে হাত বাড়ালেন ফন গোলডা। আমরা তাহলে এখন করবটা কি?

আমার কোন ধারণা নেই, বলল রানা। সিদ্ধান্ত আসা উচিত ডিরেক্টরদের কাছ থেকে। আপনাদের মধ্যে তিনজন ডিরেক্টর এখনও সিদ্ধান্ত নিতে সমর্থ।

আমাদের এমপ্লয়ী কি ব্যাখ্যা করবেন, ঠিক কি বলতে চান তিনি? হাসতে চেষ্টা করে ব্যর্থ হলেন বিশপ।

আপনারা আপনাদের ছবির সব দৃশ্য এখানে চিত্রায়িত করতে চান, নাকি চান না? কি সিদ্ধান্ত নেবেন আপনারা জানেন। এখন থেকে আমরা সবাই যদি এই কেবিনে থাকি, অন্তত ছজন সারাক্ষণ পাহারায় থাকি, সম্ভাবনা আছে বাইশ দিন পর নিজেদেরকে আমরা বহালতবিয়তে দেখতে পাব। কিন্তু এর মানে হবে, শ্যুটিং করতে পারবেন না, অর্থাৎ আপনাদের পুঁজির সব টাকা পানিতে পড়বে। এ এমন এক সমস্যা, আমি এড়িয়ে যেতে চাই। আপনার স্কচ কিন্তু সত্যি দারুণ, মি. গোলডা।

আপনার যে ভাল লাগছে তা বেশ বুঝতে পারছি, কৌতুক করার চেষ্টা করলেও, ফন গোলডার গলার আওয়াজ কর্কশ ও উদ্বিগ্ন শোনাল।

ডোন্ট বি সো মীন। গ্লাসে স্কচ ঢালল রানা। কার কি রকম, এটা তার পরীক্ষার সময়। রানা আসলে ফন গোলডার কথা ভাল করে শুনছে না, শুনছে ওর মনের কথা। কি খেতে পছন্দ করেন না কাউন্ট? অতিরিক্ত হর্সরাডিস সম্পর্কে কি যেন মন্তব্য করেছিলেন তিনি?

হঠাৎ রানার খেয়াল হলো, কাউন্ট কি যেন বলছেন ওকে। সরি, একটা ব্যাপারে চিন্তা করছিলাম, বলল ও।

সে তো দেখতেই পাচ্ছি, কপালে চিন্তার রেখা, রানার দিকে তাকিয়ে রয়েছেন কাউন্ট। সুযোগ বুঝে দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে চাইছেন, ভাল কথা। কিন্তু আপনি কি করবেন, ডক্টর রানা? হাসলেন তিনি। আবার যদি আপনাকে আমরা অস্থায়ী ও অবৈতনিক ডিরেক্টর হিসেবে কো-অপ্ট করি?

উত্তরটা সহজ। নিজের পিছন দিকে নজর রাখব, চালিয়ে যাব ছবির কাজ।

আচ্ছা। মাথা ঝাঁকালেন ফন গোলডা। তিনি, কাউন্ট ও বিশপ সন্তুষ্ট ভঙ্গিতে পরস্পরের দিকে তাকালেন। কিন্তু এখন, এই মুহূর্তে আপনি কি করবেন?

সাপারের সময় হতে আর কত দেরি?

সাপার? চোখ মিটমিট করলেন ফন গোলডা। সে তো আটটার দিকে।

এখন পাঁচটা বাজে। তিন ঘণ্টা নিজের কিউবিকল ছেড়ে এক চুল নড়ব না। কি করব, পেলেন উত্তর? এবং সাবধান করে দিচ্ছি, আমার কাছাকাছি ভুলেও কেউ আসবেন না-তা অ্যাসপিরিন চাওয়ার জন্যেই হোক বা ছুরি হাতে। কারণ আমি সাংঘাতিক নার্ভাস ফীল করছি।

খুক করে কেশে গলা পরিষ্কার করল ওয়েন। এখন যদি আমি অ্যাসপিরিন চাই, আমাকে কি আঘাত করা হবে? অ্যাসপিরিন বা আরও কড়া কিছু, যা খেলে। একজন মানুষ ঘুমিয়ে পড়তে পারে? মাথাটা এত ব্যথা করছে…

আমি আপনাকে দশ মিনিটের মধ্যে ঘুম পাড়িয়ে দিতে পারি। তবে ঘুম ভাঙার পর মাথাটা আরও বেশি ভারি লাগবে।

তা লাগুক। তবু কড়া কিছু ওষুধ চাই আমার। প্লীজ, ডক্টর, যা দেবার তাড়াতাড়ি দিন।

নিজের কিউবিকলে ঢুকে ছোট ও চৌকো জানালাটার হাতল ধরে কিছুক্ষণ কসরৎ করার পর কবাট খুলে ফেলল রানা। তুমি কি তোমার জানালাটাও এভাবে খুলতে পারবে?

আপনার মাথায় কাজ চলছে, বস।

ভাল হয় যদি তুমি এখানে একটা কট আনতে পারো। মোনাকার ঘরে পাবে একটা।

অবশ্যই, বলল ওয়েন। ওখানের একটা কট আজ রাতে কেউ ব্যবহার করবে না।

.

পাঁচ মিনিট পর জানালা খুলে কেবিনের বাইরে বেরিয়ে এল ওরা। অসহ্য ঠাণ্ডা আর তুমুল তুষারপাত থেকে  বাঁচার জন্যে চোখ ছাড়া গোটা শরীর গরম কাপড়ে মুড়ে নিয়েছে। জানালার কবাটে বাইরের দিকে কোন হাতল নেই, ভাজ করা কাগজ গুঁজে আটকানো হয়েছে সেটা। আবার ভেতরে ঢোকার জন্যে খোলা কোন সমস্যা নয়, রানার সঙ্গে একটা সুইস আর্মি নাইফ আছে। মেইন কেবিনের জানালা থেকে কোলম্যান ল্যাম্পের উজ্জ্বল আলো বেরুচ্ছে বাইরে, কয়েকটা কিউবিকল-এর জানালাও আলোকিত দেখা গেল।

এরকম রাতে ভাল কোন লোক হাঁটতে বেরোয় না, বস, রানার কানের কাছে মুখ সরিয়ে এনে বলল ওয়েন। ভাবছি একটু কম ভাল কারও সঙ্গে যদি ধাক্কা লেগে যায়?

তার বা তাদের অ্যাকশনে যেতে দেরি হবে, বলল রানা। বিস্ময়ের ঘোরটা আগে ভাঙুক তো।

স্টোররূমে চলে এল ওরা, ভেতরে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করে দিল রানা। কোন জানালা নেই, দুটো টর্চই জ্বালা হলো। ব্যাগ, বাক্স, কার্টুন, বস্তা, সবই সার্চ করছে রানা। কিন্তু অস্বাভাবিক কিছুই দেখতে পেল না।

আমরা আসলে কি খুঁজছি বলুন তো? জিজ্ঞেস করল ওয়েন।

বলতে পারব না। এমন কিছু, এখানে যা থাকার কথা নয়।

একটা অস্ত্র? একটা বোতল, গায়ে লেখা-বিষ?

ওই রকম কিছু। বাক্স থেকে হেইগ-এর একটা বোতল তুলে পারকা-র পকেটে ভরল রানা। শুধু ওষুধ হিসেবে ব্যবহারের জন্যে, ব্যাখ্যা করল।

অবশ্যই! সে-ও অন্য কিছু সন্দেহ করেনি বোঝাতে চেয়ে টর্চ ধরা হাতটা নাড়ল ওয়েন, আলোটা ছুটে গেল ঘরের দেয়াল ধরে, তারপর স্থির হলো ওপরের শেলফের তিনটে বাক্সের ওপর। পালিশ করা বাক্স, চকচক করছে।

নিশ্চয়ই খুব উঁচু মানের খাবার আছে ওগুলোয়, বলল সে। মি. গোলডার জন্যে ক্যাভিয়ার, সম্ভবত?

আমার জন্যে স্পেয়ার মেডিকেল ইকুইপমেন্ট। বেশিরভাগ ইন্সট্রুমেন্ট। কোন বিষ নেই। দরজার দিকে পা বাড়াল রানা। বেরিয়ে এসো।

চেক করবেন না?

প্রয়োজন নেই। ওগুলোর ভেতর একটা সাব-মেশিনগান লুকিয়ে রাখা কঠিন। প্রতিটি বাক্স দশ ইঞ্চি লম্বা, আট ইঞ্চি চওড়া।

তবু একবার দেখে নিলে ভাল হত।

ঠিক আছে, অগত্যা বলল রানা। তাড়াতাড়ি করো।

প্রথম দুটো বাক্সের ঢাকনি খুলল ওয়েন, ভেতরের জিনিসগুলো দেখে আবার বন্ধ করে দিল। তৃতীয় বাক্সটা খুলে বলল, ইতিমধ্যেই দেখছি রিজার্ভে হাত দিয়েছেন।

না তো।

তাহলে অন্য কেউ দিয়েছে। বাক্সটা রানার হাতে ধরিয়ে দিল ওয়েন। রানা দেখল নীল ভেলভেট মোড়া দুটো ঘর খালি।

হুম। একটা হাইপডারমিক আর নিডল-এর একটা টিউব নেই।

রানার হাত থেকে বাক্সটা নিয়ে বন্ধ করল ওয়েন, আগের জায়গায় রেখে দিল। ব্যাপারটা আমার ভাল ঠেকছে না, বস্।

সিরিঞ্জ যখন চুরি হয়েছে, নিশ্চয়ই ওটায় কিছু ভরা হবে, বলল রানা। কি সেটা? কোথায় পাওয়া যেতে পারে?

ব্যক্তিগতভাবে নিজে ব্যবহার করার জন্যে ধার নেয়নি তো কেউ? ড্রাগ অ্যাডিক্ট কেউ? ধরুন, তিন দেবতাদের একজন? ব্যাকগ্রাউণ্ড খুঁজলে পেয়ে। যাবেন-পপ ওয়ার্ল্ড, ফিল্মী জগৎ, স্রেফ বাচ্চা।

না, আমার তা মনে হয় না।

আমারও মনে হচ্ছে না, তবে হলে ভাল হত।

এরপর ওরা ফুয়েল হাট-এ চলে এল। দুমিনিটের মধ্যে নিশ্চিত হওয়া গেল এখানে ওদের কিছু পাবার নেই। থাকার কথা নয় এমন কিছু নেই ইকুইপমেন্ট রূমেও, তবে এখান থেকে দুটো জিনিস পকেটে ভরল রানা। একটা হলো স্কুড্রাইভার, পাওয়া গেল এডির টুল-বক্সে, জেনারেটর চালু করার সময় ব্যবহার করেছে। দ্বিতীয়টা হলো এক প্যাকেট স্ক্রু।

এ-সব আপনি কি করবেন? জিজ্ঞেস করল ওয়েন।

জানালার কবাটে স্ক্রু আঁটব, বলল রানা। ঘুমন্ত কোন লোকের কিউবিকলে ঢোকার জন্যে দরজাই একমাত্র প্রবেশপথ নয়, তুমি জানো।

আপনি দেখছি মানুষের ওপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছেন!

আই উঈপ ফর মাই লস্ট ইনোসেন্স।

মিখায়েল ট্যাকারের লাশ থাকায় ট্রাক্টর শেডে বেশিক্ষণ থাকতে মন চাইল না ওদের। টর্চের আলোয় বীভৎস দেখাল তার মুখ। চকচকে চোখ কিছুই দেখছে না, স্থির হয়ে আছে সিলিঙের দিকে। টুল-বক্সগুলো ঘাঁটাঘাঁটি করল ওরা, ধাতব দেরাজগুলো খুলল, এমনকি ফুয়েল ট্যাঙ্ক, অয়েল ট্যাঙ্ক আর রেডিয়েটারেও হাত ভরল, কিন্তু পেল না কিছুই।

এরপর জেটিতে চলে এল ওরা। মেইন কেবিন থেকে দূরত্ব হবে মাত্র বিশ গজ, অথচ খুঁজে পেতে পাঁচ মিনিট লেগে গেল। টর্চ জ্বালার ঝুঁকি নেয়নি, আর তুষার এখন এত ঘন যে দুহাতের ওদিকে দৃষ্টি চলে। অত্যন্ত সাবধানে জেটির শেষ মাথায় পৌঁছুল ওরা। জেটির উত্তর-পশ্চিম কোণে রয়েছে ওঅর্ক-বোটটা, লোহার মই বেয়ে নামল। জেটির অনেক নিচে থাকায় টর্চ জ্বালতে সাহস পেল রানা, তবে আলোটাকে আড়াল করে রাখল। ওঅর্ক-বোট সার্চ করেও কিছু পাওয়া গেল না। এরপর পাশের দ্বিতীয় ওঅর্ক-বোটটা সার্চ করল। ফলাফল সেই একই। এখান থেকে সরে এল নকল সাবমেরিনে-ওটার দুই পাশ আর কনিং টাওয়ারের সঙ্গে একটা লোহার মই আটকানো রয়েছে।

কনিং টাওয়ারের প্ল্যাটফর্মে উঠল ওরা। তারপর হ্যাঁচ ও ছোট একটা মই বেয়ে নেমে এল সাবমেরিনের ডেকে। টর্চ জ্বালল ওরা। ভেতরটা সরু। প্রায় খালিই বলা যায়। ডেকের ওপর আড়াআড়িভাবে রাখা কাঠের তক্তা দেখা গেল, দুদিক আটকে রাখা হয়েছে বাটারফ্লাই নাট-এর সাহায্যে। তক্তাগুলোর নিচে লম্বা ও সরু, বাদামী রঙ করা বার দেখতে পেল ওরা–চার টন লোহা, ব্যালাস্ট হিসেবে কাজ করে। চারটে চৌকো ব্যালাস্ট ট্যাঙ্কও দেখা গেল, নেগেটিভ বয়ান্সি পাবার। জন্যে ওগুলো ভরা যায়। শেল-এর শেষ মাথায় ছোট একটা ডিজেল এঞ্জিন দেখা গেল, ওটার এগজস্ট ডেকের মাথা হয়ে বেরিয়ে গেছে, উঠে গেছে একেবারে সেই কনিং-টাওয়ার পর্যন্ত। ডিজেল এঞ্জিনের সঙ্গে একটা কমপ্রেসর ইউনিটও রয়েছে, ব্যালাস্ট ট্যাঙ্ক খালি করার জন্যে।

আরও কিছু ইকুইপমেন্ট দেখা গেল সাবমেরিনের ভেতর। লাইটওয়েট প্লাস্টিক পেরিস্কোপ, তিন ইঞ্চি কামানের ডামি, দুটো মডেল মেশিনগান-সম্ভবত কনিং-টাওয়ারে ফিট করা হবে। এছাড়াও রঙের ছটা ক্যান ও কয়েকটা ব্রাশ দেখা গেল। ক্যানগুলোয় লেখা রয়েছে-ইন্সট্যান্ট গ্রে।

এর অর্থ?

সম্ভবত দ্রুত শুকিয়ে যায় এমন কোনও রঙ, বলল রানা। চলো ফিরি এবার।

তারমানে আমাদের আজ রাতের অভিযান নিষ্ফল হলো?

বলতে পারো। তবে বেশি কিছু আশাও করিনি আমি।

সেজন্যেই কি আপনি ওদেরকে শুটিং শুরু করতে বারণ করেননি? প্রথমে বারণ করলেন, পরমুহূর্তে উৎসাহ দিলেন, এই জন্যে যে ওদের অনুপস্থিতিতে কিউবিকলগুলো যাতে সার্চ করতে পারেন?

কেন তোমার এ-কথা মনে হলো, ওয়েন?

আশপাশে খুঁজলে কয়েকশো তুষারের স্তূপ পাওয়া যাবে, একজন লোক তার যা খুশি লুকিয়ে রাখতে পারে যে-কোন একটার ভেতর।

সে-কথা আমিও ভেবেছি, হে।

.

রানার কিউবিকলে ফিরে এল ওরা। ফিরেই জানালার কবাটে স্ক্রু আঁটল রানা।

ওয়েন জিজ্ঞেস করল, আমাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত হলো, কিন্তু বাকি সবার কি হবে?

বাকি সবার বেশিরভাগই কোন বিপদের মধ্যে নেই, কারণ তারা আমাদের বন্ধু বা বন্ধুদের জন্যে কোন হুমকি নয়।

বাকি সবার বেশিরভাগই?

মিস মোনাকার জানালাটাও বন্ধ করা দরকার বলে মনে করি আমি।

মিস মোনাকার?

আমার যেন মনে হচ্ছে তিনি বিপদের মধ্যে আছেন। সেটা ভয়ঙ্কর কোন বিপদ কিনা তা আমি বলতে পারব না। কি জানি, এ হয়তো আমার খুঁতখুঁতে মন।

আচ্ছা, আমি ভাবছি, বলল ওয়েন, ডিরেক্টর ভদ্রলোকেরা আইনের সাহায্য কখন নেবেন? অন্তত বাইরের দুনিয়াকে তাদের কি জানানো উচিত নয় যে মার্ভেলাস প্রোডাকশন্সের স্টাফরা পোকামাকড়ের মত পটাপট মারা যাচ্ছে?

ওদের জায়গায় তুমি হলে কি জানাবার সিদ্ধান্ত নিতে?

আমি অপরাধী না হলে অবশ্যই জানাতাম।

আমি অপরাধী নই, অন্তত এই কেসে নই, তবু আইনের সাহায্য চাওয়ার বা বাইরের দুনিয়াকে কিছু জানানোর সম্পূর্ণ বিরোধী আমি। আইন নাক গলানো মাত্র অপরাধীদের সমস্ত তৎপরতা থেমে যাবে। তারমানে পাঁচটা খুনের রহস্য অমীমাংসিতই থেকে যাবে। কারণ অপরাধীকে চেনার কোন উপায় এখনও আমরা পাইনি। কাজেই তাকে বা তাদেরকে ধরতে হলে আরও কিছু করার সুযোগ দিতে হবে।

কিন্তু সেই করাটা যদি আরও খুন হয়?

সেক্ষেত্রে আইনের সাহায্য চাইতে হবে। সাধারণ, নিরীহ লোকজনকে মরতে দেয়া যায় না।

যাক, খানিকটা স্বস্তি পেলাম। কিন্তু এই চিন্তা যদি তাদের মাথায়ও আসে?

সেক্ষেত্রে প্রকাশ্যে টুনহেইম-এর সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করতে হবে। ওখানকার আবহাওয়া অফিসে একটা রেডিও আছে, এমনকি চাঁদের সঙ্গেও যোগাযোগ করা সম্ভব। কিংবা হয়তো প্রস্তাব দিতে হবে টুনহেইমের সঙ্গে যোগাযোগ করার। জায়গাটা এখান থেকে দশ মাইল দূরেও নয়, তবে এই দুর্যোগের মধ্যে ধরে নাও সাইবেরিয়ার দক্ষিণ প্রান্তে। পথে কোন আশ্রয় পাবে না, কাজেই পৌঁছুনো সম্ভব নয়।

সেক্ষেত্রে একটা রাত বাইরে কাটিয়ে ফিরে এসে বলতে পারি, ওখানে যাওয়া অসম্ভব।

কে কি রকম খেলে দেখা যাক আগে, স্কুড্রাইভার আর গুলো তুলে নিয়ে দাঁড়াল রানা। চলো দেখে আসি মিস মোনাকা কেমন আছেন।

দেখা গেল মোনাকা ভালই আছে। জ্বর নেই, পালস রেট স্বাভাবিক, নিয়মিত শ্বাস-প্রশ্বাস বইছে। তবে বলা কঠিন ঘুম ভাঙার পর কেমন লাগবে তার। তার জানালার কবাটে ভ্রু আটার পর মেইন কেবিনে চলে এল ওরা।

অদ্ভুত ব্যাপার, কেবিন প্রায় খালি হয়ে গেছে। অন্তত যে দশজন লোককে দেখতে পাবে বলে আশা করেছিল রানা তারা অনুপস্থিত রয়েছে। উপস্থিত সবার ওপর চোখ বুলিয়ে উপলব্ধি করল, তাতে ভয় পাবার কিছু নেই। ফন গোলডা, ক্লার্ক বিশপ, কাউন্ট বট্রিউলা আর এরিক কার্লসন সম্ভবত নিজেদের একটা কিউবিকলে ঢুকে গোপন সভা করছেন, অধঃস্তন কর্মচারীদের কিছু শুনতে দিতে চান না বলেই কেবিন ছেড়ে চলে গেছেন। আর প্রায় নিঃসন্দেহে বলা যায় জক মুর বাইরে গেছেন তাজা বাতাস খেতে, জানা কথা এই সুযোগে স্টোররূমেও একবার ঢু মারবেন। হুপারের অনুপস্থিতিও ব্যাখ্যা করা যায়, নিশ্চয়ই আবার শুতে গেছে সে। পামেলাও তার সঙ্গে যাবে, হুপারকে তার হাত ধরে থাকার সুযোগ দেয়ার জন্যে। শুধু তিন দেবতার কথা আন্দাজ করা কঠিন, যদিও তাদের অবস্থান সম্পর্কে রানা তেমন উদ্বিগ্ন নয়। ও নিশ্চিত, তাদের দ্বারা কানের পর্দা ছাড়া অন্য কিছুর স্থায়ী ক্ষতি হবার কোন সম্ভাবনা নেই।

 একটা স্টোভের ওপর চড়ানো হয়েছে তিন বার্নার বিশিষ্ট অয়েল কুকার, সেটার ওপর ঝুঁকে রয়েছে ডগলাস হিউম। দুটো বড় প্যান আর একটা বড় পটে কি যেন টগবগ করে ফুটছে। উঁকি দিয়ে তাকাল রানা, পটে তৈরি হচ্ছে কফি, একটা প্যানে সেদ্ধ হচ্ছে মটরশুটি, অপরটায় তৈরি হচ্ছে স্টু। কাজটায় খুব আনন্দ পাচ্ছে হিউম, অন্যতম কারণ তাকে সহায়তা করছে এলিনা।

এখানে এ-সব কি হচ্ছে? জিজ্ঞেস করল রানা। এ-ধরনের কাজের যোগ্য আপনারা? আমার তো ধারণা ছিল, মি. গোলডা বিকল্প বাবুর্চি হিসেবে তিন দেবতাকে দায়িত্ব দিয়েছেন।

তিন দেবতা তাদের মিউজিক্যাল টেকনিক উন্নত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এখানেই বসতে চেয়েছিল তারা, আমি তাদেরকে ইকুইপমেন্ট হাট-এ পাঠিয়ে দিয়েছি। ইকুইপমেন্ট হাট, যেখানে জেনারেটর আছে, আপনি জানেন।

আপনাকে একটা পদক দেয়া উচিত। তোমাকেও, এলিনা।

আমাকেও? হাসল এলিনা। কেন?

মনে আছে, বলেছিলাম ভাল লোক মন্দ লোকের সঙ্গে জোড়া বাঁধবে? দেখে ভাল লাগছে যে তুমি সন্দেহভাজন একজনের ওপর নজর রাখছ। পট বা প্যানের ওপর তার হাত প্রয়োজনের চেয়ে বেশিক্ষণ ঝুলে ছিল কিনা লক্ষ করেছ তো?

এলিনার চেহারা থেকে হাসি মুছে গেল। এটা কোন কৌতুক করার বিষয় হলো না, ডক্টর রানা।

আমিও তা মনে করি না। পরিবেশটাকে হালকা করার ব্যর্থ চেষ্টা। হিউমের দিকে তাকাল রানা। বাবুর্চি সাহেবের সঙ্গে একটু কথা বলতে পারি কি?

চট করে একবার রানার দিকে তাকিয়ে মাথা ঝাঁকাল হিউম, তারপর ঘুরে দাঁড়াল। এলিনা প্রতিবাদ করল, বাহ, চমৎকার। এখানে ওর সঙ্গে কথা বলতে অসুবিধে কি? আমার সামনে?

ওকে আমি একটা কৌতুক শোনাতে যাচ্ছি। তুমি তো আবার আমার কৌতুক তেমন পছন্দ করো না। হিউমকে নিয়ে কয়েক পা হেঁটে এল রানা। মি. মুরের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পেয়েছেন?

না। ব্যাপারটা কি জরুরী?

এখন মনে হচ্ছে জরুরী হতেও পারে। দেখিনি আমি, তবে আমার ধারণা স্টোররূমে আছেন তিনি।

মি. গোলডা যেখানে সঞ্জীবনী সুধা রাখেন?

আপনি নিশ্চয়ই আশা করেন না মি. মুরকে ফুয়েল শেডে পাওয়া যাবে? ডিজেল বা পেট্রলের ওপর তার কোন আকর্ষণ নেই। আমার মনে হয়, উনি যখন ওখানে একা আছেন, এখনই উপযুক্ত সময়। মনপোড়ানি দিয়ে আলাপ শুরু করতে পারেন, মানে হোম-সিকনেস দিয়ে।

হিউমকে ইতস্তত করতে দেখা গেল। ভদ্রলোককে আমি পছন্দ করি। কাজটা আমার ভাল লাগছে না।

এখন আর আমি মানুষের অনুভূতি নিয়ে চিন্তিত নই। চিন্তিত মানুষের প্রাণ নিয়ে। আমি চাই সবাই বেঁচে থাকুক মানে, ভাল মানুষরা আর কি।

ঠিক আছে। মাথা ঝাঁকাল হিউম। মানুষকে কিভাবে রাজি করতে হয় জানেন আপনি। তবে ঝুঁকি নিচ্ছেন, নয় কি? সন্দেহভাজনদের একজনকে বিশ্বাস করে?

যাদেরকে সত্যি সন্দেহ করি তাদের একটা আলাদা তালিকা আছে আমার। কাছে, বলল রানা। তাতে আপনার নাম নেই, কখনোই ছিল না।

তিন-চার সেকেণ্ড রানার দিকে তাকিয়ে থাকল হিউম, তারপর বলল, কথাটা এলিনাকে জানান, প্লীজ। ঘুরে দরজার দিকে এগোল সে।

অয়েল কুকারের কাছে ফিরে এল রানা। হিউম আমার সন্দেহের তালিকায় নেই শুনে হিউম বললেন, কথাটা যেন তোমাকে শোনাই আমি।

সত্যি খুশির কথা। হাসল এলিনা, তবে তার হাসির মধ্যে শীতল একটা। ভাব থেকেই গেল।

এলিনা, বলল রানা। তুমি আমার ওপর অসন্তুষ্ট হয়ে আছ।

কি বলছেন।

কি বলছেন মানে?

আচ্ছা, বলুন তো, আপনি কি আমার বন্ধু?

অবশ্যই।

অবশ্যই, অবশ্যই। রানার বাচনভঙ্গি নিখুঁতভাবে অনুকরণ করল এলিনা। ডক্টর রানা গোটা মানবজাতির একজন বন্ধু।

ডক্টর রানা গোটা মানবজাতিকে সারারাত দুহাতে জড়িয়ে রাখেন না।

আবার হাসল এলিনা, এবার বসন্তের ছোঁয়া থাকল তাতে। আর ডগলাস হিউম?

তাকে আমি পছন্দ করি। অবশ্য জানি না আমার সম্পর্কে তিনি কি ভাবেন।

আমিও তাকে পছন্দ করি, সে-ও আমাকে পছন্দ করে, কাজেই সবাই আমরা পরস্পরের বন্ধু। তাহলে আমাদের যা কিছু গোপনীয়, সব নিজেদের মধ্যে ভাগ করছি না কেন?

মেয়েরা সত্যি এক আজব প্রাণী, বলল রানা। সবকিছুতেই তাদের কৌতূহল!

প্লীজ, আমার সঙ্গে চালাকি করবেন না।

তুমি কি সব সময় গোপন কথা লেনদেন করো? প্রশ্নটা শুনে সামান্য ভুরু কোঁচকাল এলিনা। এসো, বাচ্চাদের খেলার আশ্রয় নিই আমরা। তুমি আমাকে একটা গোপন কথা বলবে, বিনিময়ে আমিও একটা বলব।

মানে? কি বলতে চান?

কাল সকালে তোমার রহস্যময় আচরণ। তুষারে আর আপার ডেকে। যখন তোমাকে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে দেখা গেল এরিক কার্লসনের সঙ্গে।

তীব্র কোন প্রতিক্রিয়া হবে বলে আশা করেছিল রানা, কিন্তু তা দেখতে না। পেয়ে হতাশ হলো। ওর দিকে তাকিয়ে থাকল এলিনা, চিন্তা করছে, তারপর বলল, তারমানে আপনি আমাদের ওপর নজর রেখেছিলেন?

স্রেফ চোখে পড়ে যায়।

বিশ্বাস করা কঠিন। ঠোঁট কামড়াল এলিনা, তবে উদ্বেগে ব্যাকুল বলে মনে। হলো না তাকে। ভাল হত আপনি যদি আমাদেরকে দেখতে না পেতেন।

কেন?

কারণ আমি চাই না মানুষ জানুক।

সেটা বোঝা যাচ্ছে, শান্ত সুরে বলল রানা। কিন্তু কেন?

কারণ ব্যাপারটা গর্ব করার মত নয়, তাই। তাহলে শুনুন। আমাকে কিছু একটা করে বেঁচে থাকতে হয়, ডক্টর রানা। মাত্র দুবছর হলো ইংল্যাণ্ডে এসেছি আমি, আমার কোন কোয়ালিফিকেশন নেই। এমন কি যে কাজটা করছি, এরও আমি যোগ্য নই। আমি খুবই অযোগ্য একজন অভিনেত্রী। নিজেই বুঝতে পারি। সত্যি আমার কোন প্রতিভা নেই। আমার শেষ দুটো ছবি…কি বলব, একেবারে যাচ্ছেতাই। বুঝতে পারছেন না, তারপরও মার্ভেলাস কোম্পানীতে আমি কাজ পেলাম কিভাবে? বেশ, তাহলে শুনুন। কাজ পাচ্ছি, কারণটা হলো এরিক কার্লসন। হাসল এলিনা, কিন্তু খুবই ক্ষীণ। আপনি কি অবাক হলেন, ডক্টর রানা? আমাকে ঘৃণা করছেন?

না।

ক্ষীণ হাসিটুকুও মিলিয়ে গেল এলিনার চেহারা থেকে। তারমানে আমার এই অবস্থা ও পরিচয় বিশ্বাসযোগ্য? সত্যি আমাকে দেখে সস্তা বলে মনে হয়?

না। বলতে চাইছি, তোমার কথা আমি একেবারেই বিশ্বাস করছি না।

ম্লান হয়ে গেল এলিনার চেহারা, এমনভাবে তাকিয়ে থাকল যেন রানার কথা বুঝতে পারেনি। আপনি বিশ্বাস…আপনি বিশ্বাস করেন না আমি এতটা সস্তা একটা মেয়ে হতে পারি?

এলিনা ডিয়ার সস্তা নয়। লক্ষ্মী এলিনা ডার্লিং সস্তা হতে পারে না।

এলিনার চেহারায় খানিকটা রঙ ফিরে এল। এত সুন্দর কথা কেউ কোনদিন বলেনি আমাকে। চোখ নামিয়ে নিজের হাতের দিকে তাকাল সে, যেন ইতস্তত করছে, তারপর মুখ না তুলেই বলল, এরিক কার্লসন আমার মামা। আমার মায়ের আপন ভাই।

তোমার মামা? অনেক সম্ভাবনা নিয়ে চিন্তা করছিল রানা, এটা ওর মাথায় আসেনি।

মামা কার্লসন, আবার হাসল এলিনা, এবারের হাসিটায় দুষ্টামির আভাস লেগে থাকল। আমার কথা বিশ্বাস করার দরকার নেই আপনার। আপনি তাকে গিয়ে জিজ্ঞেস করুন। তবে নিরিবিলিতে, প্লীজ।

০৫.

সেদিন রাতে ডিনারে বসে কেউ খালি পেটে থাকল না বটে, তবে খাওয়া শুরু করতে বা শুরু করার পর শেষ করতে অস্বাভাবিক সময় নিল সবাই। ডিনার শেষ হতে সবার মনোযোগ কেড়ে নিলেন ফন গোলডা।

গত এক বা দুদিনে মর্মান্তিক যে-সব ঘটনা ঘটেছে সে-সম্পর্কে আমি সম্পূর্ণ সচেতন, শুরু করলেন তিনি। আমার কথা শুনে দয়া করে কেউ ভাববেন না যে পরিস্থিতিটাকে আমি হালকাভাবে দেখার চেষ্টা করছি। আমাদের সদয় ডক্টর মাসুদ রানা পরিস্থিতির যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন, সেটা গ্রহণ না করে আমাদের কোন উপায় নেই, আমি জানি। দুর্গম আর্কটিকে আটকা পড়ে আছি আমরা, বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে বিচ্ছিন্ন অবস্থায়। শুধু যে আমাদের মধ্যে কয়েকজন নৃশংসভাবে খুন। হয়েছেন তাই নয়, নৃশংস খুনের ঘটনা আরও ঘটতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে।

এই অসম্ভব একটা পরিস্থিতিতে আমার প্রস্তাব হলো, যুক্তিপূর্ণ, সাহসী ও স্বাভাবিক থাকতে হবে আমাদের, যতটুকু সম্ভব। বিপদের ভয়ে অস্থির আচরণ করলে তাতে বরং ক্ষতি আরও বাড়বে। সব দিক ভেবে আমি ও আমার সহকর্মীরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, হাতের কাজ শেষ করব। আমরা নিজেদেরকে কাজের ভেতর এমনভাবে ব্যস্ত করে রাখব যেন মর্মান্তিক কোন ঘটনাই ঘটেনি। ওগুলো ঘটেনি, এরকম ভান করতে বলছি না। আমি শুধু বলছি আমাদের কাজ দেখে মনে হবে, যেন ঘটেনি।

আবহাওয়া অনুমতি দিলে কাল থেকেই শুরু হবে আমাদের কাজ, ফন গোলডা পরামর্শ করছেন না, নিজেদের কর্মসূচী কি তাই শুধু জানাচ্ছেন। মূল দলটা, মি. রবার্ট হ্যামারহেডের নেতৃত্বে চলে যাবে উত্তরে, সেই লারনারস ওয়ে পর্যন্ত। চলতি শতাব্দীর শুরুতে পরবর্তী বে-তে পৌঁছুনোর জন্যে একটা রাস্তা তৈরি করা হয়েছিল, তবে মনে হয় না ওটার কোন হদিস খুঁজে পাওয়া যাবে। কাউন্ট, হুপার আর ব্যারন তার সঙ্গে যাবেন। আমি নিজেও যেতে চাই। চাই তুমিও যাও, হিউম।

ওখানে আমাকেও কি আপনার দরকার হবে, মি. গোলডা? প্রশ্নটা এল ডোনা পামেলার কাছ থেকে, ক্লাসের স্কুল ছাত্রীর মত মাথার ওপর একটা হাত তুলেছে সে।

ওরা বেশিরভাগই ব্যাকগ্রাউণ্ডের ওপর কাজ করবে…, কথার মাঝখানে। থেমে হুপারের ক্ষতবিক্ষত মুখের দিকে তাকালেন ফন গোলডা, তারপর মুখে উজ্জ্বল হাসি ফুটিয়ে আবার পামেলার দিকে ফিরলেন। তোমার যদি ইচ্ছে হয়, অবশ্যই যাবে। নেকটার, ফিলিপ আর কার্লকে নিয়ে মি. ব্রায়ান চেষ্টা করবেন দ্বীপের শব্দ রেকর্ড করতেগিরিপথের বাতাস, পাহাড়-চুড়ার পাখি, তীরে ভেঙে পড়া ঢেউ ও স্রোতের আওয়াজ। আর মি. কার্লসন ওঅর্ক-বোট নিয়ে রওনা হবেন সাগরের দিকে লোকেশনের খোঁজে, সঙ্গে থাকবে হ্যাঁণ্ড-ক্যামেরা। তার সঙ্গে থাকতে চেয়েছেন হ্যানস ব্রাখটম্যান ও ব্রাড ফার্গুসন।

আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত হলো, আইন বা পুলিসের সাহায্য পাবার চেষ্টা করব আমরা। এটা শুধু আমাদের দায়িত্ব নয়, নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্যেও প্রয়োজন। সাহায্য চাইতে হলে রেডিও দরকার, আর সবচেয়ে কাছে রেডিও পাওয়া যাবে টুনহেইমে, নরওয়ের আবহাওয়া অফিসে। রানা ওয়েনের দিকে তাকাল না, ওয়েনও রানার দিকে তাকাল না। মি. ওয়েন, বলে যাচ্ছেন। ফন গোলডা, এখানে আপনার উপস্থিতি আমাদের জন্যে একটা সৌভাগ্য প্রমাণিত হতে পারে। আমাদের মধ্যে একমাত্র আপনিই প্রফেশনাল সীম্যান। বলুন তো, বোট নিয়ে টুনহেইমে পৌঁছুনো যাবে কিনা?

কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর ওয়েন জবাব দিল, এই আবহাওয়ায় অসম্ভব। কেউ চেষ্টা করলে নির্ঘাত মারা পড়বে সে।

আই সী। অত্যন্ত বিপজ্জনক। কিন্তু সাগর শান্ত হয়ে গেলে, মি. ওয়েন? এবং সাগর শান্ত হতে কতক্ষণ লাগতে পারে বলে আপনার ধারণা?

নির্ভর করে বাতাসের ওপর। আমার ধারণা, পায়ে হেঁটে যাওয়ার চেষ্টা করাই ভাল।

তারমানে পায়ে হেঁটে ওখানে পৌঁছুনো সম্ভব, বলতে চাইছেন?

দেখুন, ঠিক বলতে পারব না। আর্কটিক সম্পর্কে আমি বিশেষজ্ঞ নই। আপনি বরং মি. কার্লসনকে জিজ্ঞেস করুন। ইতিমধ্যে তিনি একটা লেকচার দিয়েছেন।

পানি পথে যা, হাঁটাপথেও তাই-অসম্ভব, রায় দিলেন কার্লসন।

অস্বস্তিকর নিস্তব্ধতা নেমে এল মেইন কেবিনে। তারপর ওয়েন বলল, আমাকে আপনারা সুপারম্যান বলতে পারেন। আবহাওয়া ভাল হলে চেষ্টা করে দেখতে আমার আপত্তি নেই।

কিন্তু সেটা হবে অহত্যার চেষ্টা, প্রতিবাদ করলেন কার্লর্সন। আমরা আপনাকে সেরকম একটা ঝুঁকি নিতে দেব না।

না, কাউকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়া সম্ভব নয়। মাথা নাড়লেন ফন গোলডা।

মি. গোলডা, আমি কিছু বলতে চাই। সম্ভবত আমি কোন সাহায্যে আসতে পারি, হাত তুলে বলল ব্রাখটম্যান।

তুমি? তার দিকে বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে থাকলেন ফন গোলডা, কিন্তু তা এক মুহূর্তের জন্যে মাত্র, তারপরই তার চেহারা স্বাভাবিক হয়ে গেল। হ্যাঁ, অবশ্যই। বুঝতে পেরেছি। অভিনেতাদের ডাবল হিসেবে কাজ করবে এখানে হ্যানস। অভিনেতারা পাহাড়ে উঠতে ভয় পেলে তাদের বদলে সে উঠবে। পাহাড় বাওয়ায় আমরা তাকে এক্সপার্ট বলতে পারি। তা, কিভাবে তুমি সাহায্য করতে চাও, হ্যানস, মাই বয়?

মি. ব্রাখটম্যানকে পেলে আমি ঝুঁকি নিতে রাজি, হ্যানস ব্ৰাখটম্যান জবাব দেয়ার আগে ওয়েন কথা বলে উঠল। যদিও বেশিরভাগ পথ সম্ভবত আমাকে কাঁধে করে বয়ে নিয়ে যেতে হবে তার।

যাক, ব্যাপারটা তাহলে সমাধান হয়ে গেল, বললেন ফন গোলডা। দুজনের প্রতিই অত্যন্ত কৃতজ্ঞ আমি। তবে, ঠিক হলো, শুধু যদি আবহাওয়ার উন্নতি ঘটে, তবেই যাবার প্রশ্ন উঠবে, কেমন? যাক, সবদিক সামলানো গেছে। রানার দিকে ফিরে হাসলেন তিনি। আমাদের কো-অপ্টেড বোর্ড মেম্বার কি বলেন?

ওয়েল, ইয়েস, বলল রানা। যাদেরকে কাজ বুঝিয়ে দিলেন তাদের সবাইকে যদি কাল সকালে এখানে পাওয়া যায় তাহলে কোন অসুবিধে হবে না।

আহ।

আপনি নিশ্চয়ই বলবেন না, আমরা সবাই যে যার কিউবিকলে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ি? কার মনে কি আছে কি করে বুঝব?

ব্যাপারটা নিয়ে আমার সহকর্মীদের সঙ্গে আলোচনা করেছি আমি, বললেন ফন গোলডা। আপনি পাহারা বসাবার প্রস্তাব করছেন?

তাতে আমাদের কারও কারও আয়ু খানিকটা বাড়বে, বলল রানা। দুই কি তিন পা এগিয়ে কেবিনের মাঝখানে চলে এল। এখান থেকে সবগুলো অর্থাৎ পাঁচটা করিডরই দেখতে পাচ্ছি আমি। এখানে যে দাঁড়িয়ে থাকবে তার চোখকে। ফাঁকি দিয়ে কোন কিউবিকল থেকেই আমরা কেউ ঢুকতে বা বেরুতে পারব না।

বোধহয় বিশেষ এক ধরনের মানুষ দরকার হবে, মন্তব্য করল হিউম। অনবরত ঘুরছে এরকম একটা ঘাড়ের ওপর থাকবে তার মাথা।

দুজন লোককে দাঁড় করিয়ে দিলে তার দরকার হবে না, বলল রানা। তারা দুজন শুধু যে করিডরের ওপর নজর রাখবে তা নয়, পরস্পরের ওপরও কড়া দৃষ্টি রাখবে। একজন সন্দেহভাজন ব্যক্তি, অপরজন সন্দেহ-মুক্ত। সন্দেহ-মুক্তদের মধ্যে রয়েছেন দুই সুন্দরী-এলিনা ও পামেলা। কিন্তু মেয়ে বলে ওদেরকে বাদ দেয়া উচিত। আর মি. হুপার এখনও দুর্বল, তার ঘুম দরকার। বাকি থাকলাম তাহলে আমি, মি. গোলডা, মি. বিশপ, মি, ওয়েন, মি. ব্যারন। আমরা পাঁচজন হলাম সন্দেহ-মুক্ত। আরও পাঁচজন সন্দেহভাজন দরকার। তাহলে রাত দশটা থেকে সকাল আটটা পর্যন্ত ডিউটি ভাগ করা সহজ হবে। প্রতি জোড়া দুঘণ্টা করে।

চমৎকার প্রস্তাব, সমর্থন করলেন ফন গোলডা। এবার তাহলে পাঁচজন স্বেচ্ছাসেবক পেতে হয়।

সন্দেহভাজনদের সংখ্যা, তেরো, তারা সবাই একসঙ্গে স্বেচ্ছাসেবক হবার প্রস্তাব দিয়ে হাত তুলল। ঠিক হলো, দশটা থেকে মাঝরাত পর্যন্ত পাহারায় থাকবেন ব্রায়ানের সঙ্গে বিশপ, মাঝরাত থেকে দুটো পর্যন্ত ওয়েনের সঙ্গে হিউম, নেকটারের সঙ্গে রানা দুটো থেকে চারটে পর্যন্ত, চারটে থেকে ছটা পর্যন্ত ফার্গুসনের সঙ্গে ফন গোলডা আর এডির সঙ্গে ব্যারন ছটা থেকে আটটা পর্যন্ত। কাউন্ট আর কার্লসন অবশ্য মৃদু প্রতিবাদ জানালেন, তাদেরকে বাদ দেয়া হয়েছে। বলে। রানা সান্তনা দিয়ে বলল, মন খারাপ করবেন না, আরও একুশ দিন পড়ে আছে সামনে।

এরপর একজন দুজন করে যে যার কিউবিকলে চলে গেল, বাকি থাকল রানা, ওয়েন আর হিউম। চট করে একবার রানার দিকে তাকিয়ে ওয়েনও চলে গেল-ওদের কিউবিকলের দিকে।

কি করে জানলেন আপনি? প্রশ্ন করল হিউম। জক মুর আর তার ফ্যামিলি সম্পর্কে?

জানি না। আন্দাজ করেছি। তিনি মুখ খুলেছেন?

সামান্য। ফ্যামিলি একটা ছিল বটে তার।

ছিল?

ছিল। স্ত্রী আর দুটো মেয়ে। দুটোই বড় হয়েছিল। কার অ্যাক্সিডেন্ট। আরেকটা গাড়ির সঙ্গে ধাক্কা লাগে কিনা বলতে পারব না, বলতে পারব না কে চালাচ্ছিল গাড়িটা। হঠাৎ থেমে গেলেন মি. মুর, যেন অনেক বেশি বলে ফেলেছেন। এমনকি গাড়িতে তিনি নিজে ছিলেন কিনা তা-ও বলতে রাজি হলেন না। ঠিক কবে অ্যাক্সিডেন্টটা হলো, তা-ও বলেননি।

আরও কিছুক্ষণ আলাপ করল ওরা, তারপর ব্রায়ানকে নিয়ে হাজির হলেন। বিশপ। ওদেরকে পাহারায় রেখে নিজের কিউবিকলে ফিরে এল রানা। ক্যাম্প বেডে ওয়েনকে দেখা গেল না। পুরোদস্তুর গরম কাপড় পরে জানালার স্কুটা খুলছে সে। অয়েল ল্যাম্পটা কমিয়ে রেখেছে, ফলে ভেতরটা প্রায় অন্ধকার হয়ে আছে।

বাইরে যাচ্ছ? জিজ্ঞেস করল রানা।

বাইরে কেউ আছে। ভাবলাম সদর দরজা ব্যবহার না করাই ভাল।

কে সে?

জানি না। জানালায় তার মুখ দেখা গেছে, কিন্তু ঝাঁপসা কাঁচ, চিনব কিভাবে। আমি যে তাকে দেখেছি, সে জানে না। এখান থেকে সরে গিয়ে মিস মোনাকার জানালায় টর্চের আলো ফেলল। কেউ লক্ষ করছে জানলে কাজটা করত না। জানালা গলে বেরুতে শুরু করেছে ওয়েন। টর্চটা নিভিয়ে ফেলল, তবে কোন দিকে যাচ্ছে দেখে রেখেছি। জেটির দিকে।

ওয়েনের পিছু পিছু জানালা গলে বেরিয়ে এল রানা, কাগজ গুঁজে বন্ধ করল কবাট। আবহাওয়ার অবস্থা প্রায় আগের মতই-তুষার ঝড় থামেনি, বাতাসের তীব্রতা এখনও প্রবল, চারদিকে গাঢ় অন্ধকার। মোনাকার জানালার দিকে হেঁটে এল ওরা, টর্চের মুখে হাত চাপা দিয়ে বেশিরভাগ আলো বেরুতে দিল না। পায়ের ছাপ খুঁজে নিয়ে জেটির দিকে এগোতে যাবে, হঠাৎ রানার মনে হলো দাগগুলো কোন দিক থেকে এসেছে জানা গেলে মন্দ হয় না।

অচেনা লোকটা যে-ই হোক, যেখানে সম্ভব সেখানেই দেয়াল ঘেঁষে হেঁটেছে। কিন্তু কোত্থেকে এসেছে বোঝা গেল না। গোটা কেবিন এলাকাটাকে ঘিরে বেশ কয়েকবার চক্কর দিয়েছে সে, ফলে হাটার সময় এলোমেলো করে দিয়েছে নরম। তুষার, নির্দিষ্ট কোন কিউবিকলের জানালা গলে বেরিয়েছে জানার উপায় নেই। পায়ের ছাপ এভাবে নষ্ট করা হয়েছে দেখে চিন্তিত হয়ে উঠল রানা। লোকটা যেন জানে তাকে অনুসরণ করা হবে।

সাবধানে জেটিতে চলে এল ওরা। জেটির গোড়ায় পৌঁছে ঝুঁকি নিয়ে টর্চের আলো ফেলল রানা। এক জোড়া পায়ের দাগ দেখা গেল, সামনের দিকে চলে গেছে।

তারমানে, ফিসফিস করে ওয়েন বলল, আমাদের বন্ধু হয় বোটে নয়তো সাবমেরিনে আছে। এখন যদি জেটির শেষ মাথায় যেতে চাই, তার সঙ্গে ধাক্কা লাগার ভয় আছে। আমাদের উপস্থিতি কি তাকে জানাতে চান, বস্?

না। কেউ যদি হাঁটতে বেরোয়, কিছু বলার কেউ নই আমরা। আমরা তার। পিছু নিয়েছি জানতে পারলে বেয়ার আইল্যাণ্ডে যতদিন থাকবে আর কোন ভুল কদম সে ফেলবে না।

সৈকতে কয়েকটা পাথর দেখে সেগুলোর পিছনে আত্মগোপন করল ওরা।

ওয়েন জিজ্ঞেস করল, লোকটার উদ্দেশ্য কি বলুন তো, বস?

তুমি যেখানে আমিও সেখানে। তবে মহৎ কোন উদ্দেশ্য যে নয় তা তো বোঝাই যায়। লোকটা চলে যাবার পর বোট আর সাবমেরিন চেক করব আমরা। যে উদ্দেশ্যেই এসে থাকুক, খুব তাড়াতাড়ি সেটা পূরণ হয়েছে, কারণ দুমিনিট পরই তাকে চলে যেতে দেখল ওরা। তুষারপাত এত বেশি হচ্ছে, অন্ধকার এত গাঢ়, লোকটার হাতে পেন্সিলটর্চ না থাকলে ওরা তাকে দেখতেই পেত না। আরও কিছুক্ষণ স্থির থাকার পর সিধে হলো ওরা।

লোকটার হাতে…ও কি কিছু ক্যারি করছিল?

আমিও সে-কথা ভাবছি, বলল ওয়েন। মনে হলো ভারি কি যেন একটা নিয়ে গেল। তবে স্পষ্টভাবে কিছুই দেখিনি।

পায়ের দাগ অনুসরণ করে জেটির শেষ মাথায় চলে এল ওরা। লোহার মই বেয়ে প্রথমে চড়ল নকল সাবমেরিনে। কনিং-টাওয়ারে লোকটার পায়ের ছাপ রয়েছে। সাবমেরিনের খোলের ভেতর নেমে এল ওরা।

কিছুই বদলায়নি, আগে যেমন দেখে গিয়েছিল সব তেমনই আছে।

লোকটা কিছু নিয়ে গেছে বলে মনে হচ্ছে না, বলল ওয়েন। তাহলে ধরে নিতে হয় কিছু রাখতে এসেছিল। কি হতে পারে সেটা? বোমা নয়তো?

গোটা সাবমেরিন খুঁজেও কিছু পাওয়া গেল না। সবশেষে একটা লকার খুলল ওরা। না, এখান থেকেও কিছু নেয়া হয়নি। তবে রানা লক্ষ করল, রঙের দুটো ক্যান আর দুটো ব্রাশ গায়েব হয়ে গেছে।

লক্ষ করল ওয়েনও, রানার দিকে তাকিয়ে মাথা কঁকাল সে, কেউ কোন কথা বলল না।

ফেরার পথে ওয়েন বলল, ক্যানগুলো লোকটা তার কেবিনে নিয়ে যাবে বলে মনে হয় না। ওগুলো আকারে খুব বড়, কেবিনে লুকিয়ে রাখা সম্ভব নয়।

কেবিনে লুকিয়ে রাখার দরকারও নেই। আমি তো আগেই বলেছি, এদিকে কয়েকশো স্তূপ আছে তুষারের, যে-কোন একটায় তোমার যা খুশি লুকিয়ে রাখতে পারো।

তবে জেটি আর কেবিনের দুপাশের কোন তুষার স্তূপে ওগুলো লুকিয়ে রাখা হয়নি, কারণ দেখা গেল পায়ের দাগ সরাসরি আগের জায়গায় ফিরে এসেছে। সেই দাগ অনুসরণ করে কেবিনের দেয়াল পর্যন্ত এল ওরা, এরপর দাগগুলো আগের এলোমেলো ছাপগুলোর সঙ্গে মিশে একাকার হয়ে গেছে। তবু টর্চের অল্প আলোয় সেগুলো কিছুক্ষণ পরীক্ষা করল ওয়েন।

তারপর সিধে হলো সে, বলল, আগের চেয়ে চওড়া লাগছে দাগ, তারমানে কেবিনকে ঘিরে আরেকবার চক্কর দিয়েছে ব্যাটা।

হয়তো, বলে হাঁটা ধরল রানা, চলে এল নিজেদের কিউবিকল-এর জানালার সামনে। টান দিয়ে কবাট খুলতে যাবে, স্থির হয়ে গেল ওর হাত। জানালার ফ্রেমে টর্চের আলো ফেলে জিজ্ঞেস করল, কিছু লক্ষ করছ?

করছি বৈকি। জানালার ফ্রেমে যে কাগজ ছিল সেটা নেই। পায়ের চারদিকে তুষারের ওপর টর্চের আলো ফেলল সে। আছে, তবে তুষারের ওপর। তারমানে। কেউ ভেতরে ঢুকেছিল।

জানালা গলে ভেতরে ঢুকল ওরা। ওয়েন জানালার স্কু লাগাচ্ছে, রানা তল্লাশি চালাতে শুরু করল। সবচেয়ে আগে নিজের মেডিকেল ইকুইপমেন্ট চেক করল ও। বাহ, চমৎকার! এক ঢিলে দুই পাখি।

মানে, বস? কাজ শেষ করে রানার দিকে ঘুরল ওয়েন।

জানালার কাছে মুখ চেপে ধরেছিল লোকটা, তাই না? আমার ধারণা, কাঁচে মুখ ঠেকিয়ে অন্তত পাঁচ মিনিট দাঁড়িয়ে ছিল সে, যতক্ষণ না তোমার নজর পড়ে তার ওপর। তারপর, তোমার আগ্রহ সম্পর্কে নিশ্চিত হবার জন্যে, মোনাকার জানালায় টর্চের আলো ফেলে। অর্থাৎ এ-সবই সে করেছে আমাদেরকে কিউবিকল থেকে বের করার জন্যে।

বলতে হবে তার উদ্দেশ্য পূরণ হয়েছে। রানার খোলা মেডিকেল কিট-এর দিকে তাকিয়ে রয়েছে ওয়েন। আমি কি ধরে নেব, ওখান থেকে কিছু গায়েব হয়ে গেছে?

তা তুমি নিঃসন্দেহে ধরে নিতে পারো। মেডিকেল কিট-এর ভেতর ভেলভেট মোড়া ফাঁকটা দেখাল রানা। গায়েব হয়েছে এক ফাঁইল মরফিন।

.

দুটো বাজতে পাঁচ মিনিট বাকি থাকতে রানার ঘুম ভাঙাল ওয়েন। তাকে নিয়ে মেইন কেবিনে চলে এল ও। অয়েল স্টোভে এখনও পট চাপানো রয়েছে, হিউমের হাতে একটা কাপ। ভেতরে ঢুকে সামনের দরজার দিকে এগোল রানা। অবাক হয়ে লক্ষ করল, বাতাসের তীব্রতা অনেক কমে গেছে, তুষারপাতও প্রায় বন্ধ হতে চলেছে। সোর-হামনার প্রবেশমুখের ওপর দুএকটা তারার ঝিলিকও দেখতে পেল বলে সন্দেহ হলো ওর। তবে ঠাণ্ডা যেন আগের চেয়ে বেড়েছে। তাড়াতাড়ি দরজা বন্ধ করে ওয়েনের সঙ্গে নিচু গলায় কথা বলল ও।

আপনার কথা শুনে খুব উৎসাহ বোধ করছি, বস, বলল ওয়েন। এত জোর দিয়ে কি করে বলছেন যে ওই পাঁচজন… হাই তুলে, আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে নেকটারকে মেইন কেবিনে ঢুকতে দেখে চুপ করে গেল সে। নেকটার লোকটা রোগা-পাতলা, তার চলাফেরায় আড়ষ্ট একটা ভাব আছে, মাথায় লম্বা চুল।

রানা জিজ্ঞেস করল, ওকে তোমার ভাড়াটে অস্ত্র বলে মনে হয়?

গিটারের সাহায্যে হাঙ্গামা বাধাবার কথা যদি বলেন, হ্যাঁ, তা সে পারবে। তাছাড়া ওর সম্পর্কে আর আমি কিছু ভাবতে পারি না। হিউমের দিকে তাকাল ওয়েন, হাতে একটা কাপ নিয়ে কেবিন থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। আমাদের হিরো সম্পর্কেও সেই একই কথা।

উনি যাচ্ছেন কোথায়?

 প্রিয় রমণীকে খোরাক সরবরাহ করতে যাচ্ছেন, আমার ধারণা। মিস এলিনাও সম্ভবত আমাদের সঙ্গে রাত জেগে পাহারায় থাকছেন।

রাত জেগে এখানে সেখানে ঘুরে বেড়ানোর অভ্যাস আছে এলিনার, রানা জানে। এরিক কার্লসন তার মামা হলেও, এই সম্পর্কটা থেকে তার আগের রহস্যময় আচরণের ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না। তবে মেয়েটা যে খারাপ কোন কাজের সঙ্গে জড়িত, রানা তা মনে করে না।

ওয়েন জিজ্ঞেস করল, আমার টুনহেইমে যাওয়াটা কি জরুরী, বস্?

তোমার সঙ্গে ব্রাখটম্যান থাকবে, তাই না? ওখানে তোমরা পৌঁছুতে পারবে কিনা সেটা নির্ভর করে আবহাওয়া আর রাস্তার অবস্থার ওপর। যদি ফিরে আসতে হয়, আমি খুশি হব, কারণ এখানে তোমাকে আমার দরকার। আর যদি পৌঁছুতে পারো, ওখানেই থেকে যেয়ো।

থেকে যাব? কি করে থেকে যাব, বস্? আমি তো সাহায্য চাইতে যাচ্ছি, তাই না? তাছাড়া ব্রাখটম্যানও তো ফেরার জন্যে চাপ দেবে।

ক্লান্তির কথা বলে যদি বিশ্রাম নিতে চাও, ওরা তোমাকে সমর্থন করবে। ব্রাখটম্যান যদি গোলমাল করে, তাকে একটা ঘরের ভেতর আটকে রেখো ওখানকার মেট অফিসারকে আমার একটা চিঠি দেবে তুমি।

চিঠি? কিন্তু মেট অফিসার যদি আমার কথা না শোনেন?

ওখানে তুমি এমন কয়েকজন লোককে পাবে যারা তোমার অনুরোধ শোনার জন্যে ব্যাকুল হয়ে আছে।

ভুরু কুঁচকে তাকাল ওয়েন। আপনার বন্ধু-বান্ধব, বস্?

একদল বাংলাদেশী আবহাওয়াবিদ, বলল রানা। এই মুহূর্তে ওখানে শুভেচ্ছা সফরে রয়েছেন। পাঁচজন। তবে আসলে তারা আবহাওয়াবিদ নন।

স্বভাবতই, মুখ হাঁড়ি করে বলল ওয়েন। আপনি দেখা যাচ্ছে, বস, অনেক কথাই আমার কাছে গোপন করে গেছেন।

রাগ কোরো না, ভাই আমার। পলিসি, ওয়েন। নির্দেশ আমি সব সময় মেনে চলি, যদি বুঝি মেনে চলা দরকার। গোপন কোন কথা যদি দুকান হয়, সেটা আর গোপন থাকে না। চিঠিটা তোমাকে ভোরের দিকে লিখে দেব, কেমন?

ঠিক আছে। বড় করে একটা নিঃশ্বাস ফেলল ওয়েন। তাহলে বলে দিন, ওখানে গিয়ে যদি ইভনিং স্টারকে দেখতে পাই, আমার কি অবাক হওয়া উচিত হবে?

যেহেতু ব্যাপারটা সম্ভাবনার বাইরে নয়, অবাক না হওয়াই উচিত হবে।

মাথা ঝাঁকিয়ে অয়েল স্টোভের দিকে এগোল ওয়েন। ইতিমধ্যে কেবিনে ফিরে এসেছে হিউম, আরও কফি ঢালছে কাপে। মিনিট দশেক বসে থাকল ওরা, কফির কাপে চুমুক দেয়ার ফাঁকে এটা-সেটা নিয়ে কথা বলল। তারপর হিউম আর ওয়েন চলে গেল। পরবর্তী এক ঘণ্টা কোন ঘটনা ছাড়াই পার হয়ে গেল, তবে। পাঁচ মিনিট পেরুতে না পেরুতেই ঘুমিয়ে পড়েছে নেকটার। প্রয়োজন না হওয়ায় তার ঘুমে রানা কোন ব্যাঘাত সৃষ্টি করল না। চিন্তা-ভাবনা করছে ও, ফলে সময় কাটানো সমস্যা হলো না।

প্যাসেজের একটা দরজা খুলে গেল, কেবিনে ঢুকলেন জক মুর। জানালেন, তার ঘুম আসছে না। যেহেতু তিনি সন্দেহের বাইরে, সতর্ক হবার কোন কারণ দেখল না রানা। কেবিনে ঢুকে ওর পাশের চেয়ারটায় ধপ করে বসে পড়লেন তিনি। ক্লান্ত, বিধ্বস্ত আর বুড়ো লাগছে তাঁকে। গলার আওয়াজটাও স্নান শোনাল।

মহৎহৃদয় হিলার, বললেন তিনি। অসুস্থ লোকজনদের নিরাপত্তার দিকে খেয়াল রাখছেন। মধ্য রাতের ডিউটিতে আমি আপনাকে সঙ্গ দিতে এলাম, মি. রানা।

চারটে বাজতে আর পঁচিশ মিনিট বাকি, মি, মুর, বলল রানা।

কথার কথা বললাম আর কি। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন মুর। ঘুম এল না, বুঝলেন। আপনার সামনে এ-মুহূর্তে একজন অস্থির লোককে দেখতে পাচ্ছেন, ডক্টর।

শুনে দুঃখ পেলাম, মি. মুর।

জক মুরের জন্যে দয়া করে কাঁদবেন না। আমার দুরবস্থার জন্যে আমিই দায়ী। এমনিতেও বুড়ো হওয়া যন্ত্রণাকর। নিঃসঙ্গ বুড়ো হওয়া যে কি যন্ত্রণাময় তা কাউকে বুঝিয়ে বলা যায় না। কিন্তু তার কথা ভাবুন-নিঃসঙ্গ এক বুড়ো, যার বিবেক তাকে অনবরত কামড়াচ্ছে, তার কি অবস্থা? আবার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন মুর। আজ রাতে নিজের জন্যে সাংঘাতিক দুঃখ হচ্ছে আমার, মি. রানা।

এই মুহূর্তে আপনার বিবেক কি করছে?

সবচেয়ে খারাপ কাজটা-আমাকে জাগিয়ে রেখেছে। তবে সান্ত্বনা এই যে যার যাবার সময় হয়ে এসেছে তার এত অস্থির না হলেও চলে।

ওপারের বার? সেই আশায় আছেন?

এই দুনিয়ার জক মুরকে ওই দুনিয়া সাদর আমন্ত্রণ জানাবে না। ভেতরে ঢোকার যোগ্যতা অর্জন করা সম্ভব হয়নি, মাই বয়। হাসলেন ভদ্রলোক, কিন্তু তার দুচোখে বিষাদের ছায়া। মুশকিল হলো, যাবার সময় যে এখান থেকে দুএকটা বোতল নিয়ে যাব সে উপায়ও নেই।

এরপর চুপ করে গেলেন তিনি, চোখ বুজে বসে থাকলেন। রানা ভাবল, ভদ্রলোক সম্ভবত ঘুমিয়ে পড়ছেন। যদিও একটু পর আবার নড়ে উঠলেন, কেশে গলা পরিষ্কার করে, বললেন, সব সময় দেরি হয়ে যায়। সব সময়।

কি সব সময় দেরি হয়ে যায়, মি. মুর?

উপলব্ধি করতে বা ক্ষমা চাইতে। যার দিকে তাকিয়ে আছেন আপনি সে যদি মরা একটা মানুষ হয় তাহলে আপনার মনে শান্তি থাকে কি করে, বলুন? দাঁড়ালেন তিনি, মনে হলো দাঁড়াতে অনেক কষ্ট হলো তার। তবে এখনও সামান্য কিছু উদ্ধার করার সময় আছে। এই মুহূর্তে দুর্ভাগা জক মুর এমন একটা কাজ করতে যাচ্ছে যা তার অনেক বছর আগেই করা উচিত ছিল। তবে তার আগে খানিকটা শক্তি দরকার আমার, প্রাচীন হাড়ে যাতে জোর পাই। সংক্ষেপে, মি. রানা, বলতে পারেন স্কচ কোথায় রাখা হয়েছে?

স্কচ সম্ভবত মি. গোলডা সঙ্গে করে নিয়ে গেছেন।

খুব দয়ালু মানুষ উনি, আমাদের মি. গোলডা। যদিও খানিকটা কৃপণ তাকে আপনি বলতে পারেন। তবে চিন্তার কিছু নেই, স্টোররূমে যথেষ্ট আছে।

কামরা থেকে বেরিয়ে যাচ্ছেন মুর, রানা তাকে বাধা দিল। এরকম বোকামি করলে একদিন দেখা যাবে বাইরে বেরিয়ে বসে পড়েছেন, তারপর ঠাণ্ডায় জমে। মারা গেছেন। বাইরে যাবার কোন দরকার নেই, আমার কিউবিকলে একটা বোতল আছে। আপনি চোখ খোলা রেখে বসে থাকুন, নিয়ে আসছি আমি।

ভদ্রলোক চোখ খোলা রাখলেন কি রাখলেন না, তাতে কিছু আসে যায় না, কারণ বিশ সেকেণ্ডের মধ্যে বোতলটা নিয়ে ফিরে এল রানা। কিউবিকলে ওয়েনকে ঘুমাতে দেখে এসেছে ও, ওর সাড়া পেয়েও নড়েনি।

বোতলটা থেকে নিজের গ্লাসে স্কচ ঢেলে ঘন ঘন চুমুক দিলেন জক মুর। বোতলটার গায়ে হাত বুলিয়ে বললেন, ফিরে এসে শেষ করা যাবে। আগে কাজটা সেরে আসি। কোথায় যাচ্ছেন আপনি? জিজ্ঞেস করল রানা। এত রাতে জরুরী কি কাজ থাকতে পারে তার ভেবে পেল না ও।

মোনাকার কাছে আমার ঋণের কোন শেষ নেই। আমার ইচ্ছে…।

মিস মোনাকার কাছে আপনি ঋণী? রানা বিস্মিত। কিন্তু আপনি তো তাঁর দিকে ফিরেও তাকান না!

সাংঘাতিক ঋণী, জোর দিয়ে বললেন তিনি। আমার ইচ্ছে হিসাবটা এবার চুকিয়ে ফেলি। কি বলছি বুঝতে পারছেন?

না। চারটে বাজতে বাইশ মিনিট বাকি। জরুরী কাজটা এত বছর যখন করেননি, আরও কয়েক ঘণ্টা অপেক্ষা করতে অসুবিধে নেই। তাছাড়া, মিস মোনাকা অসুস্থ। তিনি ঘুমাচ্ছেন। তার ডাক্তার হিসেবে বলছি, আপনি তাকে বিরক্ত করতে পারেন না।

কিন্তু আরও কয়েক ঘণ্টা পর অনেক দেরি হয়ে যাবে, ডক্টর। ঋণ শোধ করব বলে এতদিন ধরে মানসিক প্রস্তুতি নিয়েছি আমি, এখন সেই মুহূর্ত উপস্থিত। এখনই যদি কাজটা সারা না যায়, অনেক দেরি হয়ে যাবে। আর কতক্ষণ ঘুমাবে সে, বলতে পারেন? আপনি কি তাকে ঘুমের ওষুধ দিয়েছেন?

হ্যাঁ। কখন ঘুম ভাঙবে বলা সম্ভব নয়। চার ঘণ্টা পরও ভাঙতে পারে, আবার ছঘণ্টা পরও। ঘুমের ওষুধ এক-একজনের বেলায় এক-এক রকম কাজ করে।

তাহলেই বুঝুন! বেচারি মোনাকা হয়তো সারারাত জেগে আছে, ছটফট করছে বিছানায়। কাউকে দেখে হয়তো খুশিই হবে সে, কথা বলার মত একজন লোক পাবে। তবে বুড়ো জক মুরকে দেখে নয়, জানা কথা। আচ্ছা, আপনি কি ভুলে গেছেন, তাকে ঘুমের ওষুধ দেয়ার পর প্রায় বিশ ঘণ্টা পেরিয়ে গেছে?

সত্যি ভুলে গিয়েছিল রানা। তবে মনে আছে জক মুরের সঙ্গে মোনাকার সম্পর্ক কদিন থেকেই বিরক্ত করছে ওকে। মোনাকাকে কি বলতে চান মুর, জানতে পারলে ওদেরকে ঘিরে যে রহস্য সৃষ্টি হয়েছে তার দুএকটা জট খুললেও খুলতে পারে। তারচেয়ে আমি গিয়ে দেখে আসি কেমন আছেন তিনি। যদি দেখি জেগে আছেন, কথা বলতে পারবেন, তাহলে আপনাকে যেতে দিতে আমার কোন আপত্তি নেই।

মাথা ঝাঁকিয়ে রাজি হলেন মুর। কেবিন থেকে বেরিয়ে এল রানা। নক না করে মোনাকার কিউবিকলে ঢুকল ও। অয়েল ল্যাম্প জ্বলছে, মোনাকাও জেগে। শরীরটা চাঁদরের তলায় টান টান, বাইরে বেরিয়ে রয়েছে শুধু মুখ। চেহারা ধসে গেছে, সবুজ চোখ ঘষা কাঁচের মত লাগল। রানাকে ঢুকতে দেখে নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে তাকাল। একটা টুলে বসল রানা। নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে অন্য দিকে তাকাল মোনাকা। আশা করি ভাল ঘুম হয়েছে আপনার, মিস মোনাকা, বলল রানা। এখন কেমন লাগছে?

আপনি কি এরকম ভোর রাতে রোগীর খবর নিতে আসেন? চোখের মতই মান তার গলা।

সাধারণত আসি না। তবে আজ রাতে পালা করে পাহারা দিচ্ছি আমরা, ঘটনাচক্রে এই মুহূর্তে আমার পালা চলছে। আপনার কি কিছু দরকার?

না। আপনি জানতে পেরেছেন কে আমার স্বামীকে খুন করল?

মোনাকা এত বেশি শান্ত, রানার সন্দেহ হলো এটা আবার হিস্টিরিয়ায় আক্রান্ত হবার পূর্ব-লক্ষণ কিনা। না। আপনার প্রশ্ন থেকে কি তাহলে আমি ধরে নেব, মিস মোনাকা, এখন আর আপনি মি. হুপারকে দায়ী বলে মনে করেন না?

মনে করি না, না। ঘণ্টার পর ঘণ্টা শুয়ে আছি এখানে। ভাবছি। চেহারা ও গলার সুর মান, এখনও মোনাকা ওষুধের প্রভাব কাটিয়ে উঠতে পারেনি। সে দায়ী নয়। যে-ই দায়ী হোক, আপনি তাকে খুঁজে বের করতে পারবেন, তাই না? মি. রানা, লোকে খারাপ মনে করলেও, মিখায়েল আসলে ততটা খারাপ মানুষ। ছিল না। সত্যি বলছি। এই প্রথম ক্ষীণ একটু হাসির রেখা ফুটল তার চেহারায়। সে যে খুব ভাল লোক ছিল, খুব দয়ালু ছিল, ভদ্র ছিল, তা আমি বলছি না। তবে আমার জন্যে ভালই ছিল সে।

 হুম। রানা এমন ভাব দেখাল যেন মোনাকার কথা বুঝতে পারছে, যদিও সবটুকুর অর্থ ওর কাছে পরিষ্কার নয়। আশা করি দায়ী লোকটাকে আমরা চিনতে পারব। এ-ব্যাপারে কাজে লাগতে পারে এমন কিছু বলার আছে আপনার?

আমার আইডিয়ার তেমন কোন দাম নেই, ডক্টর। এই মুহূর্তে আমার চিন্তা ভাবনাও পরিষ্কার নয়।

কিছুক্ষণ গল্প করতে পারবেন, মিস মোনাকা? নাকি খুব ক্লান্ত বোধ করছেন?

গল্পই তো করছি।

আমার সঙ্গে নয়। মি. মুরের সঙ্গে। তিনি আপনার সঙ্গে কথা বলার জন্যে অস্থির হয়ে আছেন।

আমার সঙ্গে কথা বলার জন্যে অস্থির হয়ে আছেন? কৃত্রিম বিস্ময়? হতে পারে। তবে সত্যিও হতে পারে। কিন্তু কেন? আমার সঙ্গে তার কি কথা?

তা বলতে পারব না। বোধহয় ডাক্তারদের উনি বিশ্বাস করতে পারেন না। তবে তার কথা শুনে মনে হলো, আপনার ওপর ভয়ানক কোন অন্যায় করেছেন, হঠাৎ খেয়াল হয়েছে এখুনি সেজন্যে দুঃখ প্রকাশ করা দরকার।

জক মুর দুঃখ প্রকাশ করবেন? এবার মোনাকার চেহারায় নির্ভেজাল বিস্ময় ফুটে উঠল। কি বলছেন আপনি, ডক্টর? আমার কাছে ক্ষমা চাইবেন? না, আমার কাছে নয়। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল সে, তারপর বলল, হ্যাঁ, ঠিক আছে, তার সঙ্গে আমি দেখা করব।

নিজের বিস্ময় গোপন করে মেইন কেবিনে ফিরে এল রানা। ওর মতই বিস্মিত জক মুরকে জানাল, মোনাকা তার সঙ্গে দেখা করতে রাজি হয়েছে। কেবিন থেকে প্যাসেজে বেরিয়ে গেলেন তিনি, তাঁর গমনপথের দিকে তাকিয়ে। থাকল রানা। মোনাকার কিউবিকলে ঢুকলেন, ভেতর থেকে বন্ধ করে দিলেন দরজা। ঘাড় ফিরিয়ে নেকটারের দিকে তাকাল রানা। সে যেন আগের চেয়েও গভীর ঘুমে অচেতন, মুখে হাসি হাসি ভাব, সম্ভবত কোন গোল্ডেন ডিস্ক-এর স্বপ্ন দেখছে।

নিঃশব্দ পায়ে প্যাসেজে বেরিয়ে এল রানা, কান পাতল মোনাকার দরজায়। বন্ধ দরজা, অস্পষ্ট আওয়াজ ঢুকল কানে, বোঝা গেল না কি কথাবার্তা হচ্ছে। নিচু হলো ও, কান ঠেকাল কী-হোলে।

আপনি! মোনাকার গলা। আপনি! আমার কাছে ক্ষমা চাইতে এসেছেন! এত থাকতে আপনি!

আমি, লক্ষ্মী সোনা, আমি। এত বছর পর, এতগুলো বছর পর। জক মুরের। গলা খাদে নেমে যাওয়ায় পরবর্তী কথাগুলো রানা শুনতে পেল না। তারপর তিনি বললেন, অতি জঘন্য, ক্ষমার অযোগ্য নিষ্ঠুরতা, সারাটা জীবন তার প্রতি বুকে ঘৃণা পুষে রাখা…, থেমে গিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন, তারপর আবার বললেন, ক্ষমা করতে পারি না, চেষ্টা করেও ক্ষমা করতে পারি না। জানি, কোন মানুষ পুরোপুরি খারাপ হতে পারে না, সে-ও হয়তো অত খারাপ ছিল না, কিন্তু পাপ পাপই, মোনাকা…।

 মি. মুর! মোনাকার গলায় তীক্ষ্ণ প্রতিবাদ। আমি জানি, আমার স্বামী দেবতা ছিল না, তবে এ-ও জানি যে তাকে শয়তানও বলা যাবে না।

বুঝি, লক্ষ্মী সোনা, আমি তা বুঝি। আমি শুধু বলতে চাইছি…

আপনি আমার কথা শুনবেন? মি. মুর, সে রাতে মিখায়েল গাড়িটায় ছিল না। ওই গাড়ির কাছাকাছিও যায়নি সে।

উত্তরটা শোনার জন্যে কান খাড়া করল রানা, কিন্তু উত্তর এল না।

আবার মোনাকারই গলা ভেসে এল। গাড়িটায় আমিও ছিলাম না, মি. মুর।

এরপর নিস্তব্ধতা দীর্ঘতর হতে থাকল। অনেকক্ষণ পর জক মুর কথা বললেন, কিন্তু এত নিচু গলায় যে কোন রকমে শুনতে পেল রানা। কিন্তু আমাকে অন্য কথা বলা হয়েছিল।

জানি কি বলা হয়েছিল, মি. মুর। গাড়িটা আমারই ছিল, সত্যি। কিন্তু আমি চালাচ্ছিলাম না। আমি বা মিখায়েল, দুজনের কেউ না।

কিন্তু…তুমি নিশ্চয়ই অস্বীকার করবে না যে আমার মেয়েরা সেই রাতে…কি বলব, অসহায় ছিল? অসহায় ছিলে তুমিও? আর তাদের ওই অবস্থার জন্যে তুমিই দায়ী ছিলে?

কিছুই আমি অস্বীকার করছি না। সেই রাতে সবাই আমরা অতিরিক্ত হুইস্কি খেয়েছিলাম…সেজন্যেই তারপর থেকে আমি আর মদ ছুঁই না, মি. মুর। তবে ঘটনাটার জন্যে কে দায়ী তা আমি জানি না। শুধু জানি, আমি বা মিখায়েল। একবারও বাড়ি থেকে বেরোইনি। গুড গড, এতদিন পর, মিখায়েল মারা যাবার পর, এ-সব কথা আপনাকে আমার ব্যাখ্যা করতে হবে?

না, না, দরকার নেই। কিন্তু তাহলে কে? কে সেদিন তোমার গাড়িটা চালাচ্ছিল?

অন্য দুজন। দুজন লোক।

দুজন লোক। এতগুলো বছর ধরে তুমি তাদেরকে রক্ষা করছ?

রক্ষা করছি? না, রক্ষা করছি বলা ঠিক নয়। অন্তত রক্ষা করার জন্যে রক্ষা করছি না। মানে, বলতে চাইছি, আমাদের অন্য একটা স্বার্থ থাকায় চুপ করে থাকতে হয়েছে। সবাই খুব ভাল করেই জানে যে আমি আর মিখায়েল…কি বলব, ক্রিমিন্যাল ছিলাম, তবে সব সময় আমাদের নজর ছিল আসল সুযোগটা কখন আসবে…

দুজন লোক, বিড়বিড় করছেন জক মুর, যেন মোনাকার কথা তিনি শুনতেই পাননি। দুজন লোক। নিশ্চয়ই তুমি তাদেরকে চেনো।

কিছুক্ষণ পর শান্ত গলায় মোনাকা বলল, হ্যাঁ, চিনি বৈকি।

এরপর কি বলা হয় শোনার জন্যে রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করছে রানা, এমন সময় কর্কশ একটা গলা ঢুকল কানে। জানতে পারি, এখানে আপনি কি করছেন, স্যার?

ঝট করে সিধে হলো রানা, প্রকাণ্ড নোঙর আকৃতির শরীরটা দেখে চিনতে পারল ফন গোলডাকে, ঝুলে আছেন ওর ওপর। তার হাত দুটো শক্ত মুঠো পাকানো, চেহারা টকটকে লাল, চোখ দুটো থেকে আগুন ঝরছে। আপনাকে দেখে আপসেট লাগছে, মি. গোলডা, বলল ও। সত্যি কথা বলতে কি, এখানে আমি আড়ি পেতে ওদের কথা শুনতে চেষ্টা করছিলাম। হাত দিয়ে ট্রাউজারের ধুলো ঝাড়ল রানা, যদিও কোথাও ধুলো লেগে আছে কিনা জানে না। ব্যাপারটা আমি ব্যাখ্যা করতে পারি।

আমি আপনার ব্যাখ্যা শোনার জন্যে অপেক্ষা করছি, চাপা গলায় প্রায় গর্জে উঠলেন ফন গোলডা।

বলেছি ব্যাখ্যা করতে পারি। পারি, মি. গোলডা। তারমানে এই নয় যে ব্যাখ্যা করতে চাই। এবার বলুন, আপনি এখানে কি করছেন?

আমি কি করছি? আমি কি করছি? রাগে কাঁপছেন তিনি। ভাষা ফিরে পেতে কয়েক সেকেণ্ড সময় নিলেন। আপনার স্পর্ধা দেখে আমি তাজ্জব হয়ে যাচ্ছি, স্যার! আমি পাহারা দিতে যাচ্ছিলাম। প্রশ্ন করব আমি-আমার মেয়ের দরজায় দাঁড়িয়ে কি করছিলেন আপনি? কী-হোলে চোখ না রেখে কান চেপে রেখেছিলেন, ব্যাপারটা কি?

কারণটা হলো, দেখার কিছু নেই আমার, বলল রানা। মিস মোনাকা আমার রোগী, তাকে আমার দেখতে ইচ্ছে হলে স্রেফ দরজা খুলে ভেতরে ঢুকতে পারি। বেশ, ঠিক আছে, আপনি যখন পাহারা দিতে যাচ্ছেন, আমি তাহলে শুয়ে পড়ি গে। রাত জেগে ক্লান্ত লাগছে।

শুয়ে পড়বেন? শুয়ে পড়বেন? বাই গড, কসম খেয়ে বলছি, মি. রানা, এর জন্যে পস্তাতে হবে আপনাকে! জানতে পারি, আমার মেয়ের সঙ্গে কে আছে?

মি. জক মুর।

মুর! হাঁ হয়ে গেলেন ফন গোলডা। সে কি করছে ওখানে! সরে দাঁড়ান, স্যার! আমাকে ঢুকতে দিন!

রানা তার পথ আগলে দাঁড়াল। না, আপনার জায়গায় আমি হলে এই মুহূর্তে ভেতরে ঢুকতাম না। ভেতরে এখন ওরা খুবই তিক্ত করুণ বিষয়ে আলাপ করছেন। ফিরে গেছেন, বলা ভাল ডুবে গেছেন, সুদূর অতীতে।

হোয়াট দা ডেভিল ডু ইউ মীন? তারমানে কি আড়ি পেতে আপনি ওদের কথা শুনেছেন? আপনি বলতে চাইছেন…?

আপনাকে আমি কিছুই বলতে চাইছি না। তবে আপনি বোধহয় আমার দুএকটা প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেন। সেই কার অ্যাক্সিডেন্টের ব্যাপারটা বলবেন কি? আমার ধারণা, ঘটনাটা নিশ্চয়ই ক্যালিফোর্নিয়ায় ঘটেছিল। অনেক দিন আগের কথা। সেই কার অ্যাক্সিডেন্টে, আমার ধারণা, মি. মুরের স্ত্রী আর ওদের দুই তরুণী মেয়ে মারা গিয়েছিল। ঠিক কিনা?

সমস্ত রক্ত নেমে যাওয়ায় মড়ার মত কুৎসিত হয়ে উঠল চেহারা, ফোঁস ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে ফন গোলডা জিজ্ঞেস করলেন, কার অ্যাক্সিডেন্ট? কি বলতে চান আপনি, স্যার?

জানি না কি বলতে চাই। সেজন্যেই তো আপনাকে জিজ্ঞেস করছি। শুনলাম মি, মুর একটা কার অ্যাক্সিডেন্টের কথা বলছেন, যে অ্যাক্সিডেন্টে তাঁর পরিবারের। সবাই মারা যায়। তার কথা শুনে মনে হলো, ঘটনাটা সম্পর্কে আপনার মেয়ে জানে। আমার ধারণা, আপনিও জানেন।

সে কি বলছে আমার কোন ধারণা নেই। আপনি কি বলছেন সে-সম্পর্কেও আমার কোন ধারণা নেই। হঠাৎ ঘুরলেন ফন গোলডা, বিশাল কাঠামো নিয়ে। অবিশ্বাস্য দ্রুতগতিতে মেইন কেবিনে গিয়ে ঢুকলেন। তার পিছু নিয়ে রানাও ঢুকল, চলে এল বাইরের দরজার সামনে। এখন আর সন্দেহ নেই ওয়েনকে অভিযানে বেরুতে হবে। ঠাণ্ডা আগের মতই প্রচণ্ড হলেও তুষারপাত থেমে গেছে, নিস্তেজ হয়ে গেছে বাতাসও। দরজা টপকে বেরিয়ে এল রানা, এক পা দুপা করে খানিকটা এগোল। পরিষ্কার আকাশে আধখানা চাঁদ উঠে আসছে।

কেবিনে ফিরে এসে দরজা বন্ধ করল ও। জক মুরকে দেখা গেল, কেবিন হয়ে নিজের কিউবিকলের দিকে হেঁটে যাচ্ছেন। এলোমেলো পা ফেলছেন। ভদ্রলোক, যেন চোখে ভাল দেখতে পাচ্ছেন না। রানাকে পাশ কাটালেন তিনি। তার চোখে পানি দেখা গেল। কেন তিনি কাঁদছেন জানতে পারলে ভাল হত। কিন্তু এখুনি তা জানার কোন উপায় নেই। ছোট টেবিলে রেখে যাওয়া স্কচের বোতলটার দিকে একবারও তিনি তাকালেন না। বোতলটার সামনে বসে রয়েছেন। ফন গোলডা, এমন কি তার দিকেও একবার তাকালেন না। আরও অদ্ভুত ব্যাপার, ফন গোলডাও মুখ তুললেন না। রানার ধারণা ছিল, জক মুরকে দেখামাত্র জেরা শুরু করবেন তিনি। কিন্তু না, ইতিমধ্যে তার মেজাজ অনেক বদলে গেছে।

নেকটরের দিকে এগোল রানা, তার ঘুম ভাঙানো দরকার। এই সময় লাফ দিয়ে চেয়ার ছাড়লেন ফন গোলডা, কেবিন থেকে বেরিয়ে এগোলেন তার মেয়ের কিউবিকলের দিকে। ইতস্তত না করে আবার তাকে অনুসরণ করল রানা। ফন গোলডা তাঁর মেয়ের কিউবিকলে ঢুকলেন, ও দাঁড়াল সেই আগের জায়গায়, দরজার বাইরে।

কি বলছিলি তুই? কি বলছিলি? কার অ্যাক্সিডেন্ট? কার অ্যাক্সিডেন্ট? মিথ্যে কথা বলছিলি মুরকে? তুই তো একটা কুৎসিত রাক্ষসী:ব্ল্যাকমেইলার! তুই

বেরোও, বেরিয়ে যাও! চিৎকার করল মোনাকা। আমাকে একা থাকতে দাও, শয়তান বুড়ো। কি, এখনও দাঁড়িয়ে আছ? বেরিয়ে যাও, দূর হও আমার সামনে থেকে।

কবাট আর চৌকাঠের ফাঁকে আরও জোরে কান চেপে ধরল রানা।

বাই গড, এ আমি মেনে নেব না! আমার নিজের মেয়ে আমার সঙ্গে শত্রুতা করবে, এ আর আমি সহ্য করতে রাজি নই। ফন গোলডার মনে নেই নিচু গলায় কথা বলা উচিত তার। সেই অপদার্থ আর তুই আমাকে যথেষ্ট শোষণ করেছিস, আর নয়! বল কি বলেছিস…?

মিখায়েলকে তুমি গাল দিচ্ছ? মোনাকার কণ্ঠস্বর হঠাৎ এত শান্ত হয়ে উঠল যে শুনে রানার গা শিরশির করে উঠল। মরে পড়ে আছে লোকটা, আর তুমি তাকে গাল দিচ্ছ? মরে পড়ে আছে…তাকে খুন করা হয়েছে। আমার স্বামীকে খুন করা হয়েছে। বেশ, প্রিয় জন্মদাতা, তুমি জানো না এমন একটা কথা শোনাই তাহলে তোমাকে। মিখায়েল তোমাকে ব্ল্যাকমেইল করত, তাই না? তোমার ধারণা তোমাকে তার ব্ল্যাকমেইল করার কারণটা আমি জানি না। তুমি ভুল জানো, প্রিয় জন্মদাতা! আমি জানি!

ফন গোলডা কথা বললেন না। সম্ভবত ব্যাপারটা হজম করতে সময় নিচ্ছেন।

জানি যখন, এরিক কার্লসনকে তাহলে বলে দিই, প্রিয় জন্মদাতা?।

তুই একটা সাপ! একটা বিষাক্ত সাপ! গলা শুনে মনে হলো ফন গোলডা নিজের গলা টিপে ধরেছেন।

বিষাক্ত সাপ? আমি? খিলখিল করে হেসে উঠল মোনাকা। তোমার মুখে কথাটা মানাল না, ডিয়ার ফাদার! নিশ্চয়ই তোমার উনিশশো আটত্রিশ সালের কথা। মনে আছে? আমার যখন মনে আছে, তোমার মনে না থাকার কোন কারণ নেই। বেচারা কালর্সন পালাচ্ছেন… পালাচ্ছেন… পালাচ্ছেন, কিন্তু সারাক্ষণ তিনি উল্টো দিকে ছুটছেন। বেচারা কার্লসন কাকা। কাকা বলতে তুমিই আমাকে শিখিয়েছিলে, মনে পড়ে? মনে পড়ে, ড্যাডি ডিয়ার? কার্লসন কাকা।

দরজার সামনে থেকে সরে এল রানা। যতটুকু দরকার ছিল শোনা হয়ে গেছে। বলে নয় শুধু, ওর মনে হলো আলোচনাটা আর বেশি দূর এগোবে না। তাছাড়া, ফন গোলডা মেয়ের দরজার সামনে ওকে দ্বিতীয়বার দেখতে পেলে পরিস্থিতিটা হয়ে উঠবে বিব্রতকর।

এদিকে ব্রাড ফার্গুসন যে-কোন মুহূর্তে বেরিয়ে আসবে তার কিউবিকল থেকে, কারণ পাহারায় আসার সময় হয়ে এসেছে তার। পাহারায় ফন গোলডার সঙ্গী হবে সে।

নেকটারের কাছে ফিরে এল রানা, তবে তার ঘুম ভাঙাল না। আবার ঘুমাও, এ-কথা বলার জন্যে কারও ঘুম ভাঙানো উচিত নয়। গ্লাসে সামান্য স্কচ ঢেলে চুমুক দিয়েছে মাত্র, নারীকন্ঠের চিৎকার ভেসে এল কানে। বেরিয়ে যাও! বেরিয়ে যাও! তারপর দেখল, মেয়ের কিউবিকল থেকে ছিটকে বেরিয়ে এলেন ফন। গোলডা। কেবিনে ঢুকলেন, ছো দিয়ে তুলে নিলেন বোতলটা। বোতল থেকে সরাসরি খেলেন তিনি, ঢক ঢক আওয়াজ তুলে। হাত কাঁপছে, খানিকটা স্কচ তার গলা আর কাপড়চোপড় ভিজিয়ে দিল।

কাজটা আপনি অন্যায় করলেন, মি. গোলডা, তিরস্কারের সুরে বলল রানা। এভাবে নিজের মেয়েকে আপসেট করা আপনার উচিত হয়নি। বেচারি সত্যি অসুস্থ, এখন তার হে আর আদর দরকার!

আদর দরকার? জেসাস! ঢকঢক করে আরও খানিকটা স্কচ খেলেন ফন। গোলডা। তারপর একটা টুলে বসলেন তিনি। ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে এল তাঁর শ্বাস-প্রশ্বাস। চেহারাও শান্ত হয়ে এল। যেন মনে হলো চিন্তিত হয়ে পড়েছেন। যখন কথা বললেন, গলা শুনে মনে হলো না মাত্র কয়েক মিনিট আগে আক্রোশ আর ঘৃণায় এই মানুষটাই থরথর করে কাপছিলেন। যতটুকু খেয়াল রাখা উচিত ছিল ততটুকু খেয়াল হয়তো সত্যি আমি রাখতে পারিনি। কিন্তু তাই বলে মেয়ে তার বাপের সঙ্গে উন্মাদের মত আচরণ করবে? অ্যাকট্রেস টেমপারামেন্ট, ইউ নো। বলতে বাধ্য হচ্ছি, ডক্টর রানা, আপনার ঘুমের ওষুধ খুব একটা কাজ দেয়নি।

ঘুমের ওষুধ কার বেলায় কি রকম কাজ করবে বলা কঠিন, মি. গোলডা।

না-না, আপনাকে আমি দোষ দিচ্ছি না, তাড়াতাড়ি বললেন ফন গোলডা। আদর। হে। বুঝি, বুঝি বৈকি। কিন্তু খানিকটা বিশ্রাম, খানিকটা গভীর ঘুম আরও বেশি দরকার এই মুহূর্তে। আপনি কি বলেন, আরও এক ডোজ ঘুমের ওষুধ দিলে কেমন হয়? আরও জোরাল কিছু? নিশ্চয়ই তাতে কোন বিপদের ভয় নেই?

না। বিপদের ভয় থাকবে কেন। কিন্তু আপনার মেয়ে অত্যন্ত জেদি, যদি ওষুধ খেতে না চান?

হাহ, জেদি! আপনি অন্তত চেষ্টা করে দেখতে পারেন। তারপর মনে হলো। ফন গোলডা আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন, একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকলেন মেঝের দিকে।

ঘুম জড়ানো চোখ ডলতে ডলতে কেবিনে ঢুকল ফাগুসন। নেকটারের কাঁধ। ধরে ঝাঁকাল সে। আরে, ভাই, উঠে পড়ন! এই আপনি পাহারা দিচ্ছেন? শুনুন, আপনার পালা শেষ হয়ে গেছে। যান, নিজের বিছানায় গিয়ে ঘুমান। বিড়বিড় করে ক্ষমা প্রার্থনা করল নেকটার, আড়ষ্ট ভঙ্গিতে দাঁড়াল, এলোমেলো পা ফেলে বেরিয়ে গেল কেবিন থেকে।

ঘুমাচ্ছিল ঘুমাত, বলল রানা। একটু পরই তো আবার তাকে জাগতে হবে।

দুঘণ্টার মধ্যে সবাইকে আমার দরকার, বললেন ফন গোলডা। আবহাওয়া পরিষ্কার হয়ে গেলে চাঁদের আলো পাব আমরা। শূটিঙের জন্যে যার যেখানে যাবার কথা, সবাই রওনা হয়ে যাবে। করিডরের দিকে তাকালেন তিনি। ডক্টর, একবার চেষ্টা করে দেখবেন না?

মাথা ঝাঁকিয়ে করিডরে বেরিয়ে এল রানা। মোনাকার কিউবিকলে ঢুকে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল ও। মাত্র দশ মিনিটের মধ্যে কারও চেহারা এতটা বদলে যেতে পারে, না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। কেউ জানে না মোনাকার বয়স কত, তবে এখন তাকে দেখে প্রায় বৃদ্ধা মনে হচ্ছে। নিঃশব্দে কাঁদছে সে। চোখের পানিতে ভিজে যাচ্ছে গাল, ভিজে যাচ্ছে বালিশ। মেয়েটার জন্যে করুণা জাগল ওর মনে, ইচ্ছে হলো সান্ত্বনা দেয়। বলল, আপনার এখন ঘুমানো দরকার।

কেন? মোনাকার হাত দুটো এমন শক্ত হয়ে আছে, আঙুলের ডগায় রক্ত না থাকায় ধবধবে সাদা লাগছে দেখতে। একটু পরই তো আবার আমাকে জাগতে হবে, তাই না?

হ্যাঁ, তা হবে, বলল রানা। তবে দুঘণ্টা পর। খানিকটা ঘুমিয়ে নিতে পারলে ভাল লাগবে আপনার।

ঠিক আছে, মেনে নিলাম, বলল মোনাকা। কান্নার মধ্যে কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে তার। এমন ওষুধ দিন, ঘুমটা যেন লম্বা হয়।

কাজেই, বোকার মত, মোনাকার জন্যে লম্বা ঘুমেরই ব্যবস্থা করল রানা। আরও বোকামি করল নিজের কিউবিকলে ফিরে এসে শুয়ে পড়ে।

০৬.

 রানার ঘুম ভাঙল চার ঘণ্টা পর। ইতিমধ্যে কেবিন প্রায় খালি হয়ে গেছে। কথামত নিজের লোকজনদের শুটিঙের কাজে পাঠিয়ে দিয়েছেন ফন গোলডা, তিনি বা তার লোকজন ওর ঘুম ভাঙাবার প্রয়োজন বোধ করেননি। আজকের দিনে একমাত্র ওরই কোন কাজ নেই।

মেইন কেবিনে হিউম ছাড়া আর শুধু ফন গোলডা রয়েছেন। দুজনেই কফি খাচ্ছেন, তবে পরনের কাপড়চোপড় দেখে বোঝা গেল এখুনি বেরিয়ে পড়বেন তারাও। রানাকে ভেতরে ঢুকতে দেখে গুড মর্নিং বলল হিউম। ফন গোলডা গুড মর্নিং না বললেও ওকে জানালেন যে তার একটা দল–ক্যাট ও ক্যামেরা নিয়ে। লারনারস ওয়ের দিকে চলে গেছে। দলে আছে হুপার, হ্যামারহেড, কাউন্ট, ব্যারন আর পামেলা। তিনিও হিউমকে নিয়ে এখুনি রওনা হয়ে যাচ্ছেন। ব্রায়ান। আর তিন দেবতা তাদের সাউণ্ড-রেকর্ডিং ইকুইপমেন্ট নিয়ে বোটে চড়েছে। ওয়েনের সঙ্গে টুনহেইমের উদ্দেশে রওনা হয়ে গেছে ব্ৰাখটম্যান, প্রায় ঘণ্টাখানেক আগে। শেষ খবরটা রানার মনে খুঁতখুঁতে একটা ভাব এনে দিল। ভাবল, যাবার আগে ওয়েন অন্তত ওর ঘুম ভাঙাতে পারত। সবশেষে ফন গোলডা জানালেন, অপর ওঅর্ক-বোট নিয়ে রওনা হয়েছেন কার্লসন, সঙ্গে আছে ফাগুসন। কার্লসনের সঙ্গে তার হ্যাঁণ্ড-ক্যামেরা আছে। ভাল লোকেশনের খোঁজে গেছেন তিনি। তাদের সঙ্গে স্বেচ্ছাসেবক হয়েছেন ক্লার্ক বিশপ, ব্ৰাখটম্যানের অনুপস্থিতিতে।

টুল ছেড়ে দাঁড়ালেন ফন গোলডা, শেষ চুমুক দিয়ে খালি করলেন হাতের কাপ। আমার মেয়ে সম্পর্কে, ডক্টর রানা, বললেন তিনি।

উনি সুস্থ হয়ে উঠবেন। আসলে তার আর সুস্থ হবার কোন আশা নেই।

রওনা হবার আগে আমি আমার মেয়ের সঙ্গে কথা বলতে চাই।

রানা কিছু বলল না।

আপনার কোন আপত্তি নেই তো, ডক্টর? জিজ্ঞেস করলেন ফন গোলডা। ডাক্তার হিসেবে?

না। তবে কমনসেন্স বলে তাকে এখন বিরক্ত না করাই ভাল। আপনার মেয়েকে কড়া ঘুমের ওষুধ দেয়া হয়েছে। আপনি তাকে ধরে ঝাঁকালেও ঘুম ভাঙবে বলে মনে হয় না।

কিন্তু…

দুতিন ঘণ্টা পর, মি. গোলডা। আমার পরামর্শ যদি গ্রহণ না করেন, জিজ্ঞেস করার দরকার কি?

মানলাম, মেনে নিলাম। তাহলে ঘুমাক সে। বাইরের দরজার দিকে এগোলেন ফন গোলডা। আজ আপনার প্ল্যান কি, ডক্টর?

এখানে থাকছে কে কে? জিজ্ঞেস করল রানা। আমি আর আপনার মেয়ে ছাড়া?

রানার দিকে তাকালেন ফন গোলডা, ভুরু দুটো কুঁচকে আছে। এলিনা। জক মুর। আর থাকছে এডি ও মরগান। কেন?

তারা কি ঘুমাচ্ছে?

আমি যতদূর জানি। কেন?

মিখায়েলকে কবর দিতে হবে না?

ও, হ্যাঁ, তাই তো। মিখায়েল। দেখুন দেখি কাণ্ড, একদম ভুলে গেছি! সত্যিই তো, তার একটা ব্যবস্থা।

হ্যাঁ।

আপনার প্রতি আমি ঋণী হয়ে থাকলাম, ডক্টর। কি বিচ্ছিরি একটা ঘটনা। জঘন্য, অতি জঘন্য! আবার তিনি দরজার দিকে এগোলেন, ব্যস্ত ভঙ্গিতে। এসো, হিউম, আমাদের দেরি হয়ে যাচ্ছে।

ওরা চলে যেতে এক কাপ কফি খেয়ে বাইরে বেরুল রানা। ইকুইপমেন্ট শেডে ঢুকে একটা কোদাল খুঁজে নিল। তুষার ইতিমধ্যে জমাট বাঁধলেও, খুব একটা শক্ত নয়। তবে কবরটা গভীর করতে চাওয়ায় এক ঘণ্টার ওপর লেগে গেল কাজটায়। কোদালটা ইকুইপমেন্ট শেডে রেখে দ্রুত নিজের কিউবিকলে ফিরে এল কাপড় পাল্টাবার জন্যে। সকালটা খুব ঠাণ্ডা আজ, আকাশে এখনও সূর্য ওঠেনি।

পাঁচ মিনিট পর গলায় বিনকিউলার ঝুলিয়ে আবার বেরুল রানা। দশটার মত বাজলেও, ওরা চারজন এখনও কেউ ওদের চেহারা দেখায়নি। এডি, মরগান বা জক মুরকে নিয়ে ভাবছে না ও, কারণ তিনজনই কায়িক পরিশ্রম এড়িয়ে চলে; ওকে বাইরে যেতে দেখলে ওর সঙ্গে যেতে চাইবে বলে মনে হয় না। তবে এলিনা হয়তো চাইবে, একাধিক কারণে-কৌতূহল, ঘুরে বেড়ানোর শখ, কিংবা তাকে হয়তো ওর ওপর নজর রাখার নির্দেশ দেয়া হয়েছে, অথবা রানার সঙ্গে থাকতে পারলে নিজেকে হয়তো নিরাপদ মনে করবে। তবে রানা যাচ্ছে কার্লসনের ওপর নজর রাখার জন্যে, কাজেই এলিনাকে সঙ্গে রাখার কোন ইচ্ছে ওর নেই।

এরিক কার্লসনের ওপর নজর রাখতে হলে প্রথমে তাকে ওর খুঁজে বের করতে হবে। কিন্তু সোর-হামনার চারদিকে তাকিয়েও ষোলো ফুটী ওঅর্ক বোটটাকে কোথাও দেখতে পেল না ও। অথচ কেবিনের সামনে থেকে গোটা বে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। কোন একটা দ্বীপের আড়ালে থাকতে পারে, বিনকিউলার চোখে অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিল ও। পাঁচ মিনিট পেরিয়ে গেল। কোথাও কিছু নড়ছে না। তার মানে, ধরে নিতে হয়, সোর-হামনা ছেড়ে চলে গেছেন কার্লসন।

রওনা হবার আগে কিছুক্ষণ চিন্তা-ভাবনা করল রানা। পুব দিকে অর্থাৎ খোলা সাগরের দিকে কার্লসন যাবেন না, কারণ ওদিকে রুদ্রমূর্তি ধারণ করে আছে সাগর, আর কার্লসন গভীর পানিকে ভয় পান। সোর-হামনা থেকে বেরিয়ে সম্ভবত দক্ষিণ দিকে অর্থাৎ দ্বিতীয় বে-র দিকে গেছেন। সেদিকেই রওনা হলো ও।

বে-র কিনারা ঘেঁষে নিচু পাহাড় আর পাহাড়ের ঢালগুলোকে এড়িয়ে থাকল রানা, কারণ ওদিকে তিন দেবতাকে নিয়ে দ্বীপের বিচিত্র সব শব্দ রেকর্ড করছে ব্রায়ান।

ঢাল বেয়ে ওঠার সময় হাপিয়ে গেল রানা। তুষার এখনও কোথাও কোথাও জমাট বাঁধেনি, স্তূপগুলোকে এড়াতে ঘুর পথ ধরতে হলো ওকে। ভয় লাগছে ওর, কারণ তুষারে ঢাকা কোন গর্তে পড়ে গেলে খারাবি আছে কপালে। স্বভাবতই ওয়েন আর ব্রাখটম্যানের কথা মনে পড়ে গেল ওর। এর চেয়ে অনেক বেশি দুর্গম এলাকা পাড়ি দিতে হচ্ছে ওদেরকে।

দেড় ঘণ্টা অমানুষিক পরিশ্রম করার পর পাঁচশো ফুট উঁচু একটা চূড়ায় পৌঁছল রানা, পরবর্তী বে এখান থেকে পরিষ্কার দেখা যায়। বের আকতি ইংরেজি ইউ অক্ষরের মত, উত্তর-পুব থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমে বিস্তৃত, লম্বায় এক মাইলের কিছু বেশি হবে, চওড়ায় সম্ভবত আধ মাইল। বে-র গোটা উপকূলে খাড়া পাহাড় প্রাচীর মাথা তুলে আছে।

তুষারের ওপর চিৎ হয়ে শুয়ে থাকল রানা। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে বিনকিউলার তুলল চোখে। গোটা বে খালি পড়ে আছে, প্রাণের কোন চিহ্ন নেই কোথাও। ইতিমধ্যে সূর্য উঠেছে, ঝুলে রয়েছে দক্ষিণ-পুব দিগন্তরেখার কাছে। বে-র পানিতে সী-গাল দেখল ও। উত্তরে কয়েকটা দ্বীপ দেখা যাচ্ছে। ওর সরাসরি নিচে পাহাড়-প্রাচীর, সেগুলোর গোড়ায় কি আছে দেখার উপায় নেই। কার্লসন যদি কোন একটা দ্বীপ বা পাহাড়-প্রাচীরের আড়ালে থাকেনও, বেশিক্ষণ থাকবেন বলে মনে হয় না।

কতক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছে রানা বলতে পারবে না। হঠাৎ খেয়াল করল, প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় ওর শরীর থরথর করে কাঁপছে। শুধু তাই নয়, হাত আর পা প্রায় সম্পূর্ণ অসাড় হয়ে গেছে। আরও একটা ব্যাপারে সচেতন হয়ে উঠল ও। কয়েক মিনিট হলো বে-র দিকে বা উত্তর দিকে নয়, চোখে বিনকিউলার তুলে তাকিয়ে। আছে দক্ষিণ দিকের পাহাড়-প্রাচীরের গোড়ায়। ওখানে, পাহাড়-প্রাচীরের গায়ে, অদ্ভুত একটা ফাঁক দেখা যাচ্ছে। সরু একটা প্রবেশপথ বলে মনে হলো, যদিও এতটা ওপর থেকে দেখছে বলে ছায়ার মধ্যে পরিষ্কার বোঝা গেল না।

বোটটা কি ওখানে থাকতে পারে? কিন্তু না, কেন! একমাত্র লুকিয়ে থাকার দরকার হলে ওই প্রবেশপথে ঢোকার কথা ভাববে কেউ। কার্লসন লুকিয়ে থাকার কথা ভাববেন কেন?

প্রবেশপথটা আরও কিছুক্ষণ দেখার পর রানা উপলব্ধি করল, ওটাকে ভাল করে দেখতে হলে পানি পথ ধরে আসতে হবে, জমিনের ওপর দিয়ে ওখানে পৌঁছুনো এক কথায় অসম্ভব। কেউ যদি চেষ্টা করতে চায়, অন্তত দুঘণ্টা লাগবে ওখানে পৌঁছুতে, ততক্ষণে যদি খাড়া ঢাল থেকে পড়ে তার ঘাড় না ভাঙে। অকারণে এ ধরনের ঝুঁকি নেয়ার কোন মানে হয় না। ফাঁকটার ভেতর কি আছে। তাই বা কে বলবে!

ধীরে ধীরে, আড়ষ্টভঙ্গিতে দাঁড়াল রানা। ফিরে আসার পথ ধরল। ঢাল বেয়ে। নিচে নামছে, কাজেই আগের মত কষ্ট হচ্ছে না। তারপরও কেবিনের কাছাকাছি। পৌঁছুতে বেলা প্রায় একটা বেজে গেল।

কেবিনের দরজা মাত্র কয়েক ফুট দূরে, এই সময় খুলে গেল সেটা, দোরগোড়ায় দেখা গেল এলিনাকে। তাকে এক পলক দেখেই স্থির হয়ে গেল রানা, পেটের ভেতর ঠাণ্ডা আর ভারি কি যেন চেপে বসল। এলিনার চুল এলোমেলো হয়ে আছে, মুখে রক্ত নেই, চোখে ভয়। অন্ধ না হলে যে-কেউ বুঝতে পারবে কোথাও আবার ছোবল মেরেছে মৃত্যু।

থ্যাঙ্ক গড! কেঁদে ফেলল এলিনা। আপনি ফিরে এসেছেন! তাড়াতাড়ি, প্লীজ! দেখে যান কী ভয়ঙ্কর ঘটনা!

কথা শেষ করেই ঘুরে দাঁড়িয়ে ছুটল এলিনা। তার পিছু নিয়ে প্রথমে কেবিনে, তারপর কেবিন থেকে প্যাসেজে বেরিয়ে এল রানা। মোনাকার কিউবিকল-এর দরজা খোলা। ভেতরে ঢুকে দাঁড়িয়ে পড়ল ও। ঘটনা যে ভয়ঙ্কর তাতে কোন সন্দেহ নেই। তবে তাড়াহুড়ো করার আর কোন প্রয়োজন নেই এখন। যে যাবার সে চলে গেছে, ব্যস্ত হয়ে কোন লাভ নেই। কট থেকে পড়ে গেছে মোনাকা, মেঝেতে কাত হয়ে রয়েছে। শরীরটা কম্বলে অর্ধেক ঢাকা, পড়ে যাবার সময় ওটা সঙ্গে নিয়েই পড়েছে। বিছানার ওপর আধ খালি ও খোলা একটা বারবিচুরেট ট্যাবলেটের শিশি পড়ে রয়েছে, চাঁদরের ওপরও ছড়িয়ে রয়েছে কয়েকটা ট্যাবলেট। মেঝেতে পড়ে রয়েছে একটা জিন-এর বোতল, বোতলটার গলা এখনও মোনাকার মুঠোর ভেতর। সেটাও প্রায় খালি বলা যায়। ঝুকল রানা, মার্বেলের মত সাদা কপালে হাত ছোঁয়াল। মোনাকা অন্তত কয়েক ঘণ্টা আগে মারা গেছে। ঘুমটা যেন লম্বা হয়, ওকে বলেছিল মোনাকা। এমন ওষুধ দিন, ঘুমটা যেন লম্বা হয়।

উনি কি…উনি…? লাশ থাকলে মানুষ কথা বলে ফিসফিস করে।

মরে গেছে না বেঁচে আছে দেখে বুঝতে পারো না? প্রশ্নটা নিষ্ঠুরের মত হয়ে গেল, জানে রানা। রাগটা সামলানো কঠিন, যদিও জানে না ঠিক কার ওপর রাগ করা উচিত ওর।

আ-আমি ওঁকে ছুঁ-ছুঁইনি…আমি…।

কখন দেখলে তুমি?

মিনিট খানেক আগে। এক মিনিট বা দুমিনিট আগে। কিছু খাবার আর কফি বানিয়ে দেখতে এলাম…।

বাকি সবাই কোথায়? মি. মুর? এডি, মরগান?

কোথায়…আমি জানি না। ওঁরা কিছুক্ষণ আগে বেরিয়ে গেছেন…বললেন, হাঁটতে যাচ্ছেন।

বাইরে গেলেও, তিনজনের দুজন অন্তত দূরে কোথাও যাবে না। এলিনাকে রানা বলল, ডাকো ওদের। স্টোররূমে পাবে।

স্টোররূমে? ওখানে কেন থাকবেন ওঁরা?

কারণ মি. গোলডা ওখানেই তার স্কচ রাখেন।

বেরিয়ে গেল এলিনা। জিন আর বারবিচুরেটের বোতল একপাশে সরিয়ে। রাখল রানা। এরপর মোনাকাকে বিছানার ওপর শোয়াল। মেঝেতে ফেলে রাখতে খারাপ লাগছিল ওর। সিধে হয়ে কিউবিকলের চারদিকে চোখ বুলাল একবার। কিন্তু বেমানান কিছু চোখে পড়ল না, কিছু হারিয়েছে বলেও মনে হলো না। জানালার কবাট আগের মতই বন্ধ, কাপড়চোপড় একটা চেয়ারের পিঠে নিখুঁত ভাঁজ করা অবস্থায় ঝুলছে। ওর চোখ বারবার জিন-এর বোতলটার ওপর ফিরে আসছে। মিখায়েল তো বলেছিলই, জক মুরকে বলা মোনাকার কথা থেকেও জানে রানা অনেক বছর হলো মদ খাওয়া ছেড়ে দিয়েছে সে। মদ খায় না অথচ ঘরে জিনের বোতল রাখবে, এ হয় না।

জক মুর ভেতরে ঢুকলেন, পিছু পিছু এল এডি আর মরগান, প্রত্যেকের হাতে গ্লাস। বোঝা গেল, সত্যি ওরা স্টোররুমে ছিল। ওদেরকে যে অবস্থাতেই পেয়ে থাকুক এলিনা, এই মুহূর্তে কেউ মাতলামি করছে না। তিনজনই শান্ত ও নির্বাক, পাথরের মত স্থির দাঁড়িয়ে থাকল, তাকিয়ে আছে লাশের দিকে। কেউ কথা বলল না।

 রানা বলল, মি. গোলডাকে জানানো দরকার যে তার মেয়ে মারা গেছেন। উত্তরের বে-তে গেছেন তিনি। খুঁজে পাওয়া কঠিন নয়,–ক্যাটের দাগ অনুসরণ করলেই হবে। সবাই একসঙ্গে যান আপনারা।

গড লাভ আস অল, বিড়বিড় করে বললেন জক মুর। হায় মোনাকা। হায় বেচারি। প্রথমে ওর মনের মানুষ, তারপর ও নিজে। এর শেষ কোথায়, ডক্টর?

জানি না, মি. মুর। মি. গোলডাকে খুঁজতে গিয়ে নিজের মৃত্যু ডেকে আনার দরকার নেই। এর ওপর একজন হার্ট অ্যাটাকের রোগীকে সামলানো যাবে না।

বেচারি মোনাকা, এখনও বিড়বিড় করছেন জক মুর। কিন্তু মি. গোলডাকে কি বলব আমরা? কিভাবে মরল তার মেয়ে? অ্যালকোহল আর পিপিং ট্যাবলেট, ভয়ঙ্কর একটা কমবিনেশন, তাই না?

হ্যাঁ, ক্ষেত্র বিশেষে।

পরস্পরের দিকে অনিশ্চিত ভঙ্গিতে তাকাল ওরা, তারপর কিউবিকল থেকে বেরিয়ে গেল। এলিনা জিজ্ঞেস করল, আমি কি করব?

এখানেই থাকো। গলার কর্কশ আওয়াজে রানা নিজে যেমন বিস্মিত হলো, তেমনি এলিনাও। তোমার সঙ্গে আমার কথা আছে।

হাতে একটা তোয়ালে আর একটা রুমাল নিল রানা, তোয়ালে দিয়ে জিনের। বোতলটা জড়াল, বারবিচুরেটের শিশিটাকে রুমাল দিয়ে। আড়চোখে তাকিয়ে। দেখল বিস্ফারিত চোখে ওর কাজগুলো লক্ষ করছে এলিনা। বিস্মিত হয়েছে বা ভয় পেয়েছে, নাকি দুটোই?

এরপর লাশটা পরীক্ষা করল রানা। বিশেষ করে দেখার ইচ্ছে গায়ে কোন জখমের চিহ্ন আছে কিনা। দেখার বেশি কিছু নেই, কারণ গায়ে কম্বল জড়িয়ে বিছানায় থাকলেও মোনাকার পরনে পারকা আর ফার ট্রাউজার রয়েছে। বেশিক্ষণ পরীক্ষা করার দরকার হলো না। হাতছানি দিয়ে এলিনাকে কাছে ডাকল ও, মোনাকার ঘাড়ের চুল সরিয়ে আঙুল তাক করল খুদে একটা ফুটোর ওপর। শুকনো ঠোঁটে জিভের ডগা বুলিয়ে রানার দিকে তাকাল এলিনা।

হ্যাঁ, বলল রানা। খুন করা হয়েছে। এ-ব্যাপারে তোমার কি অনুভূতি, এলিনা ডার্লিং? সম্বোধনটা আদুরে হলেও সুরটা নয়।

খুন করা হয়েছে! ফিসফিস করল এলিনা। খুন করা হয়েছে! কাপড়ে জড়ানো বোতলগুলোর দিকে তাকাল সে, আবার ঠোঁট ভেজাল, ভাব দেখে মনে হলো যেন কথা বলতে যাচ্ছে, কিন্তু বলতে পারল না।

পেটে খানিকটা জিনও পাওয়া যেতে পারে, বলল রানা। কিছুটা বারবিচুরেটও হয়তো আছে। যদিও আমার সন্দেহ আছে, কারণ অচেতন কোন মানুষকে কিছু গেলানো খুব কঠিন। বোতলটায় বা শিশিটায় আঙুলের ছাপ পাওয়া যাবে না, কারণ ছাপ মুছে ফেলা যায়। কিন্তু ধরো বোতলটায় যদি শুধু মোনাকার তর্জনী আর বুড়ো আঙুলের ছাপ পাওয়া যায়? সেক্ষেত্রে আমার মন্তব্য হবে, দুআঙুলে ধরে কেউ একটা জিনের বোতল প্রায় খালি করতে পারে না। মোনাকার ঘাড়ের ওপর ক্ষুদ্র বিন্দুটা যেন জাদু করেছে এলিনাকে, সেটার ওপর থেকে চোখ ফেরাতে পারছে না। সঠিক বলতে পারব না, তবে আমার ধারণা বেশি মাত্রায় মরফিন ইঞ্জেকশন দিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে তাঁকে। এ-ব্যাপারে তোমার অনুভূতি কি, এলিনা ডিয়ার?

রানার দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকাল এলিনা। কথাটা আপনি আমাকে দুবার বললেন। কেন বলুন তো?

কারণ মোনাকার মৃত্যুতে তোমারও ভূমিকা আছে। বিশ্বাস করো, এ-সব। ব্যাপার আমি খুব ভাল বুঝি। অহত্যার মত করে সাজানো হয়েছে বটে, কিন্তু আমি জানি মোনাকা মদ খেতেন না। আমি শুনতে চাই এ-ব্যাপারে কি বলার আছে তোমার?

আমি তাকে খুন করিনি! ওহ্ গড, আমি না, আমি না!

সেই সঙ্গে ভয় পাচ্ছি মি. ওয়েনের মৃত্যুতেও তোমার ভূমিকা আছে কিনা ভেবে, কর্কশ সুরে বলল রানা। তিনি যদি ফিরে না আসেন, হত্যাকাণ্ডে সহায়তা করার জন্যে তোমাকেও দায়ী করা হবে।

মি. ওয়েন! এলিনার বিস্ময় নির্ভেজাল, তবে রানা এখনও অটল। এলিনা আবার বলল, আপন গড, আপনার কথা কিছুই আমি বুঝতে পারছি না!

তা পারবে কেন! মি. গোলডা আর মি. কার্লসনের মধ্যে কি ব্যাপার চলছে, এ-প্রশ্ন করলেও আমার কথা তুমি না বুঝতে পারার ভান করবে। যদি জিজ্ঞেস করো প্রিয় কার্লসন মামার সঙ্গে তোমারই বা কি ব্যাপার চলছে, তাহলেও তুমি না বোঝার ভান করবে, তাই না?

অবোধ পশুর মত করুণ চোখে তাকিয়ে থাকল এলিনা, এদিক ওদিক মাথা নাড়ছে, চোখে পানি। হঠাৎ তার গালে একটা চড় কষাল রানা। যদিও জানে রাগটা যত না এলিনার ওপর তারচেয়ে নিজের ওপরই বেশি। মারার জন্যে আবার হাত তুলল ও, চোখ বন্ধ করে কাঁপতে থাকল এলিনা, মুখটা একদিকে ঘুরিয়ে। আঘাতটার জন্যে অপেক্ষা করছে। হাতটা শরীরের পাশে নামিয়ে আনল রানা। এরপর যে কাজটা করল, প্রথমে সেটাই করা উচিত ছিল ওর। দুহাত বাড়িয়ে ধরল এলিনাকে, টেনে নিল নিজের বুকে, ধরে রাখল শক্ত করে। এলিনা নড়ল না, নিজেকে ছাড়াবার চেষ্টা করল না, স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল শুধু।

পুওর এলিনা ডিয়ার, বলল রানা। তুমি দুর্বল আর অসহায়, তাই না? পালিয়ে যাবে এমন কোন জায়গা নেই, তাই না? চোখ বুজে রয়েছে এলিনা, কিছু বলল না। এরিক কার্লসন তোমার মামা নন। ইমিগ্রেশন পেপারে বলা হয়েছে। তোমার মা ও বাবা, দুজনেই মারা গেছেন। কিন্তু আমার ধারণা তারা বেঁচে আছেন। আমার আরও ধারণা, কার্লসন তাদেরকে জিম্মি করে রেখেছেন, তুমি যাতে তাঁর কথামত চলো। কার্লসন যে মন্দ লোক এটা আমার ধারণা নয়, আমি জানি। আরও জানি যে তুমি ল্যাটভিয়ান নও, জার্মান। বার্লিনের সামরিক পরিষদে তোমার বাবা উচ্চপদস্থ একজন অফিসার ছিলেন। এই তথ্যটা আসলে রানা জানে না, তবে বুঝতে পারে ওর অনুমান সত্যি হতে বাধ্য। আরও জানি যে গোটা ব্যাপারটায় টাকার একটা ভূমিকা আছে। আসলে টাকারই ব্যাপার এটা। নগদ টাকা নয়, বিনিময়যোগ্য সিকিউরিটিজ আর সোনা। কি, এ-সব সত্যি নয়, এলিনা?

কিছুক্ষণ পর জবাব দিল এলিনা। সবই যখন জানেন, জিজ্ঞেস করার দরকার কি? একটু পিছিয়ে গেল সে, রানার চোখে চোখ রাখল। আপনি তাহলে ডাক্তার নন?

কাউন্টার এসপিওনাজে আছি, বলল রানা। আমি বাংলাদেশী, স্বদেশের স্বার্থ রক্ষা করছি এখানে। ব্রিটেনের ট্রেজারি আমাকে সাহায্য করছে, কারণ এরিক কার্লসন সম্পর্কে ইন্টারেস্ট আছে তাদের। তবে ধারণা ছিল না এরকম খুনোখুনির মাঝখানে পড়ে যাব।

বুঝলাম না কি বলতে চান।

সে অনেক লম্বা কাহিনী, বলতে অনেক সময় লাগবে। হাতে অনেক কাজ, কাজেই…।

মি. ওয়েন? ইতস্তত করছে এলিনা। তিনিও কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সে আছেন? কথা না বলে মাথা ঝাঁকাল রানা। আরও দুসেকেণ্ড ইতস্তত করল এলিনা। আমার বাবা যুদ্ধের সময় সাবমেরিন গ্রুপের কমাণ্ডার ছিলেন। পার্টিতেও খুব বড় পদে ছিলেন তিনি। তারপর নিখোঁজ হয়ে যান…

কোথায় তিনি কমাণ্ড করেন?

শেষ বছরটায় উত্তরে। ট্রমসো, ট্রণ্ডহেইম, নার্ভিক, এই সব জায়গায়…।

তারপর নিখোঁজ হয়ে গেলেন। একজন ওঅর ক্রিমিনাল, তাই না? রানার প্রশ্ন শুনে মাথা ঝাঁকাল এলিনা। এবং এখন একজন বদ্ধ মানুষ? নিঃশব্দে সায় দিল এলিনা। তারপর বয়েসের কারণে ক্ষমা পেয়ে যান?

হ্যাঁ, বছর দুয়েক আগে। তারপর আমাদের কাছে ফিরে আসেন-মি. কার্লসন আমাদের সবাইকে এক করেন, কিভাবে বলতে পারব না।

এরিক কার্লসনের একটা নেপথ্যকাহিনী আছে, যে কাজ নিয়ে এই বেয়ার আইল্যাণ্ডে এসেছেন সে-কাজে তিনি একজন বিশেষজ্ঞ, কিন্তু এ-সব কথা ব্যাখ্যা করার সময় এটা নয়। রানা বলল, তোমার বাবা শুধু ওঅর ক্রিমিনাল নন, তিনি সিভিল ক্রিমিনালও বটেন, অথচ তার জন্যে এত সব করলে তুমি?

মার জন্যে।

দুঃখিত।

দুঃখিত আমিও। আমার কারণে আপনাকে যে ঝামেলা পোহাতে হয়েছে। সেজন্যে সত্যি আমি দুঃখিত। মা ভাল থাকবে তো, আপনার কি মনে হয়?

ভালই থাকবেন, আমার ধারণা।

কিন্তু এখন আমরা কি করব? একের পর এক এরকম সব ভয়ঙ্কর ঘটনা। ঘটছে, আমাদের সত্যি কিছু করার আছে কি?

তোমাকে কিছুই করতে হবে না। যা করার আমি করব।

বেশ। আপনি যা বলেন।

যেমন আছ তেমনি থাকো। এমন ভাব দেখাও কিছুই যেন ঘটেনি। বিশেষ করে মামা কার্লসনকে কিছুই বুঝতে দিয়ো না। আমরা কথা বলেছি, কেউ যেন তা জানতে না পারে।

এমনকি ডগলাসকেও কিছু বলব না?

হিউমকে? না, তাঁকেও কিছু বলা চলবে না। কিন্তু আমি ভেবেছিলাম আপনি তাকে পছন্দ করেন…।

করি বৈকি। কিন্তু তিনি আবার তোমাকে তারচেয়ে অনেক বেশি পছন্দ করেন। এ-সব কথা শোনা মাত্র কার্লসনের মাথা ফাটাবেন তিনি। এক সেকেণ্ড চিন্তা করল রানা। এখন তোমার একটা কাজই করার আছে। কেউ ফিরে আসছে। কিনা লক্ষ রাখো, কাউকে দেখতে পেলেই জানাবে আমাকে। আশপাশটা একবার ঘুরে দেখতে যাচ্ছি আমি।

০৭.

 ফন গোলডার যে-কটা তালা আছে রানার আছে ঠিক সে-কটা চাবি। মার্ভেলাস প্রোডাকশন্সের চেয়ারম্যান, ফিল্ম প্রোডিউসার, সেই সঙ্গে একটা শ্বাসরুদ্ধকর অভিযানের লিডার হিসেবে ব্যক্তিগত অনেক জিনিসই নিয়ে এসেছেন তিনি। কাপড়চোপড়ের কথাই ধরা যাক, সংখ্যায় সেগুলো অগুণতি। শুধু সুটই দেখা গেল বারোটা, যদিও বেয়ার আইল্যাণ্ডে এগুলো তার কি কাজে আসবে বলা কঠিন। দুটো বাদামি রঙের সুটকেস পাওয়া গেল। আসলে এক জোড়া ধাতব উড-বক্স আড়াল করা হয়েছে ওগুলোর ভেতর।

দুটোই খুলল রানা। প্রথমটায় তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু পাওয়া গেল না। প্রচুর পেপার কাটিং দেখল ও, বিশ-পঁচিশ বছরের পুরানো। সে-সব খবর থেকে জানা যায়, সিনেমা জগতে ফন গোলডা একটা দুর্লভ প্রতিভা। দ্বিতীয় উড-বক্সে পাওয়া গেল টাকা-পয়সার হিসাব। কত আয় করেছেন তিনি, কত খরচ করেছেন, এই সব। এগুলোও আগ্রহ সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হলো। তারপর দেখতে পেল কয়েকটা বাতিল করা চেক-বই। যেহেতু বাতিল, আর্কটিকে ফন গোলডার কোন কাজেও আসবে না, তাই নিঃসঙ্কোচে পকেটে ভরল ও। সব আবার আগের মত সাজিয়ে রেখে বেরিয়ে এল তার কিউবিকল থেকে। এরপর ঢুকল ক্লার্ক বিশপের কিউবিকলে।

কোম্পানীর অ্যাকাউন্ট্যান্ট ভদ্রলোক। স্বভাবতই তিনিও তাঁর জিনিসপত্র তালার ভেতর রাখবেন। তবে পরিমাণে কম বলে সার্চ করতে সময়ও লাগল কম। টাকা-পয়সা সংক্রান্ত ব্যাপারেই আগ্রহী রানা, তিনটে আইটেম দেখে কৌতূহল হওয়ায় সেগুলোও পকেটে ভরল পরে ভাল করে পরীক্ষা করার জন্যে। আইটেম তিনটে হলো–মার্ভেলাস প্রোডাকশন্স-এর বেতনের তালিকা, ক্লার্ক বিশপের ব্যক্তিগত ব্যাংক-বুক আর একটা ডায়েরী। ডায়েরীর পাতায় সাঙ্কেতিক সংখ্যা লেখা রয়েছে, তবে বোঝা যায় টাকা-পয়সারই হিসাব।

বাকি আধ ঘণ্টায় আরও চারটে কিউবিকলে হানা দিল রানা। জানত, কার্লসনের কিউবিকলে কিছুই পাওয়া যাবে না, পেলও না। তার যে ইতিহাস আর অভিজ্ঞতা, খুব ভাল করেই জানেন যে রেকর্ড ফাঁইল করার সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা হলো নিজের মাথা। তবে তার কিউবিকলে বেয়ার আইল্যাণ্ডের কয়েকটা লার্জ-স্কেল চার্ট পাওয়া গেল। একটা নিল ও।

রবার্ট হ্যামারহেডের ব্যক্তিগত কাগজ-পত্রের মধ্যে না মেটানো বিলই বেশি। ব্যাংকের তাগাদা-পত্রও রয়েছে। কাউন্টের কিউবিকলে একটা লোড করা অটোমেটিক পাওয়া গেল, পাশেই এনভেলাপে ভরা লাইসেন্স। ফার্গুসন আর ব্রাখটম্যান একই কিউবিকলে থাকে, সেখানে তেমন কিছু পাওয়া গেল না। তবে ফাসনের সুটকেসে ছোট একটা প্যাকেট দেখে অস্বস্তিবোধ করল রানা। প্যাকেটটা সীল করা। সেটা নিয়ে মেইন কেবিনে ফিরে এল ও। এক জানালা থেকে আরেক জানালা পর্যন্ত হাটাহাটি করছে এলিনা। মোট চারটে জানালা, সবগুলোর ওপর নজর রাখছে সে।

ফিরছে না কেউ? জিজ্ঞেস করল রানা। মাথা নাড়ল এলিনা। স্টোভে একটা কেটলি বসাও।

কফি আছে। কিছু খাবারও আছে।

কফি বা খাবার দরকার নেই। গরম পানি দরকার আমার। প্যাকেটটা এলিনার হাতে ধরিয়ে দিল রানা। গরম বাপ লাগিয়ে সীলটা খোলো।

বাষ্প…কি এটা?

জানলে তোমাকে খুলতে বলতাম না।

জক মুরের কিউবিকলে চলে এল রানা। কিন্তু এখানে তাঁর স্বপ্ন ছাড়া কিছুই নেই-একটা পারিবারিক অ্যালবাম, পুরানো অস্পষ্ট ফটোয় ঠাসা। দুএকটা বাদ দিলে, সব ফটোই সম্ভবত জক মুরের নিজের তোলা। প্রথম কয়েকটা ফটোয় সুন্দরী এক তরুণীকে দেখা গেল, কোলে যমজ কন্যা সন্তান। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে জক মুরের স্ত্রীর চুল কাটা ও বাঁধার ধরন পাল্টে গেছে। বয়েস বাড়ার পর বদলে গেছে তাদের যমজ কন্যাদের চেহারা ও পোশাক-আশাক। আরও পরে তাদের চেহারার সঙ্গে মায়ের চেহারার মিল দেখা গেল। শেষ দিকের ফুটোয় মেয়ে দুটোর বয়েস হবে আঠারো। অ্যালবাম বন্ধ করে চোখ বুজল রানা, দুঃখী একজন মানুষের ব্যক্তিগত স্বপ্নের ভেতর উঁকি দেয়ায় সামান্য হলেও অপরাধ বোধ করছে।

এডির কিউবিকলে ঢুকতে যাবে রানা, ওর সামনে এসে দাঁড়াল এলিনা। প্যাকেটটা খুলেছে সে, ভেতরের জিনিস বের করে একটা রুমালে রেখেছে। পাঁচ হাজার পাউণ্ড, বলল সে। দশ পাউণ্ডের নোট, সব নতুন।

পাঁচ হাজার পাউণ্ড অনেক টাকা। ওগুলো শুধু নতুন নয়, সিরিয়াল। নম্বরগুলোও পাশাপাশি। প্রথম ও শেষ নম্বরটা লিখে নিল রানা, খোঁজ নিতে সুবিধে হবে। আবার প্যাকেটে ভরা হলো সব, সীল করা হলো সেটা, তারপর আগের জায়গায় রেখে আসা হলো।

এডি আর ব্রায়ানের কিউবিকলে কিছু পাওয়া গেল না। তবে মরগানের। কিউবিকলে অনেকগুলো স্কচের বোতল পাওয়া গেল, সন্দেহ নেই ফন গোলডার স্টক থেকে সরানো হয়েছে। তিন দেবতার কেবিনে রানা ঢুকল না, জানে ওখানে কিছু পাওয়া যাবে না। ঢুকল না হিউমের কিউবিকলেও।

বেলা তিনটে, আকাশ থেকে আলো মুছে যাচ্ছে। ফন গোলডাকে খবর দিয়ে। ইতিমধ্যে ফিরে আসার কথা দলটার, কিন্তু ফিরছে না তারা। মেইন কেবিনে জোর করে রানাকে খাওয়াতে বসাল এলিনা। শুধু খানিকটা স্টেক আর কফি খেলো ও। ওরা ফিরছে না দেখে উদ্বেগ প্রকাশ করল এলিনা। চিন্তার কিছু নেই, সময় হলে। ফিরবে, বলে নিজের কিউবিকলে চলে এল রানা।

কটে শুয়ে বিভিন্ন কিউবিকল থেকে সংগ্রহ করা আইটেমগুলোর ওপর চোখ বুলাল ও। কোনটার কি গুরুত্ব, বুঝতে অসুবিধে হবার কথা নয়। স্যালারি বুকে নির্দেশগুলো দেয়া হয়েছে স্পষ্টভাবে। ফন গোলডার চেক-বই আর ক্লার্ক বিশপের ব্যাংক-বই, এ-দুটোর মধ্যে করেসপণ্ডেন্স অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ মনে হলো রানার। তবে সবচেয়ে বেশি কৌতূহল জাগাল লার্জ-স্কেল চার্টটা। সোর-হামনার পাশের বে ইভজেবুতা-র বিস্তারিত বিবরণ দেয়া হয়েছে এতে। পাহাড়ের মাথা থেকে এই বে-ই আজ দেখে এসেছে রানা। ফাঁক বা প্রবেশপথটার কথা মনে পড়ল ওর। তারপর অনেকক্ষণ ধরে এলিনার মা-বাবার কথা ভাবল। এক সময় ওর কিউবিকলে এসে ঢুকল এলিনা।

ওঁরা আসছেন।

কে, কারা?

জানি না। অন্ধকার খুব বেশি, তুষারও পড়ছে।

কোনদিক থেকে আসছে?

ওদিক থেকে। দক্ষিণ দিকটা দেখাল এলিনা।

ব্রায়ান আর তিন দেবতা। কাগজগুলো ছোট একটা তোয়ালেতে জড়িয়ে এলিনার হাতে ধরিয়ে দিল রানা। এগুলো তোমার কামরায় লুকিয়ে রাখো। মেডিকেল ব্যাগটা দুমড়ে-মুচড়ে উল্টো করল ও, পকেট থেকে ছোট একটা স্কু ড্রাইভার বের করে ব্যাগটার খুদে চারটে পায়া খুলে ফেলল। ব্যাগটার তলা থেকে আলাদা হয়ে বেরিয়ে এল কালো একটা বাক্স। সেটাও ধরিয়ে দিল এলিনার হাতে। সাবধানে ধরো, খুব ভারি। এটাও লুকিয়ে রাখবে।

কিন্তু কি…?

 জলদি! দরজায় ওদের আওয়াজ পাচ্ছি!

তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গেল এলিনা। ব্যাগের পায়াগুলো আবার জায়গামত লাগিয়ে রাখল রানা। মেইন কেবিনে ফিরে দেখল ব্রায়ান আর তিন দেবতা স্টোভ থেকে নিয়ে গরম কফি খাচ্ছে। ফিরে আসতে পারায় সবাই তারা খুশি। কিন্তু রানার মুখে মোনাকার মৃত্যু সংবাদ শুনে হাঁ হয়ে গেল সবাই। বিস্ময়ের ধাক্কা সামলে উঠতে পারেনি কেউ, এই সময় দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলেন ফন গোলডা। উদ্বেগে ব্যাকুল হয়ে এগিয়ে এলেন তিনি। কোথায় ও? কোথায় আমার মেয়ে?

তাঁর পথ আটকাল রানা। শুনুন, মি. গোলডা, শুনুন। শান্ত হোন, প্লীজ। জানি সাংঘাতিক আঘাত পেয়েছেন…।

কোথায় ও? কোথায় আমার মেয়ে? কর্কশ গলায় আবার জিজ্ঞেস করলেন ফন গোলডা। হাউ ইন গডস নেম…?

তাঁকে তাঁর কিউবিকলেই রাখা হয়েছে, বলল রানা। দ্রুতপায়ে সেদিকে ছুটলেন ফন গোলডা, আবার তার পথ রোধ করে দাঁড়াল রানা। একটু পর যান, মি. গোলডা। প্রথমে আমি একবার দেখব… বুঝতেই পারছেন।

কাঁচা-পাকা ভুরুর ভেতর দিয়ে রানার দিকে এক সেকেণ্ড তাকিয়ে থাকলেন। ফন গোলডা, ধৈর্য হারিয়ে মাথা ঝাঁকালেন দ্রুত। তাড়াতাড়ি করবেন, প্লীজ।

মাত্র কয়েক সেকেণ্ড। এলিনার দিকে তাকাল রানা। মি. গোলডাকে খানিকটা স্কচ দাও।

মোনাকার কিউবিকলে ঢুকে কাজটা সারতে মাত্র দশ সেকেণ্ড লাগল ওর। জিন আর বারবিচুরিটের বোতল কাপড়ে মুড়ে রাখা হয়েছে কেন, প্রশ্ন করতে পারেন ফন গোলডা; সে সুযোগ তাকে দিতে চায় না ও। সেগুলো বের করে রেখে। দিল চোখের সামনে। তারপর ডাকল ফন গোলডাকে।

ভেতরে ঢুকতেই তার একটা বাহু ধরল রানা, লাশের খুব একটা কাছে যেতে দিল না। দেখে আর কি করবেন, চলুন বাইরে যাই।

প্যাসেজে বেরিয়ে এসে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, সুইসাইড, অবশ্যই?

কোন সন্দেহ নেই।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন ফন গোলডা। গড, নিজেকে আমি কোনদিন ক্ষমা করতে পারব না…।

আপনার অপরাধ বোধ করার কোন কারণ নেই, মি. গোলডা। দেখেছেনই তো, স্বামী মারা যাওয়ায় কি রকম ভেঙে পড়েছিলেন তিনি। প্রবল শোক, মি. গোলডা। কারও সাহায্য করার থাকে না।

এরকম সময়ে আপনার মত সদয় লোক পাশে থাকলে মনে বড় শান্তি পাই, বিড়বিড় করলেন ফন গোলডা।

মেইন কেবিনে ফিরে এসে তার হাতে স্কচের গ্লাসটা ধরিয়ে দিল রানা। বাকি সবাই কোথায়? জিজ্ঞেস করল ও।

আসছে। ছুটতে ছুটতে ওদের আগে চলে এসেছি আমি।

ওরা তিনজন আপনাদেরকে খুঁজে বের করতে এত দেরি করল কেন বলুন তো?

শুটিঙের জন্যে দিনটা দারুণ। সবই ব্যাকগ্রাউণ্ডের কাজ, এক স্পট থেকে আরেক স্পটে সরে যাচ্ছিলাম আমরা। তারপর ঘাড়ে চাপল উদ্ধারের কাজটা। মাই গড, লোকেশন ইউনিট যদি এভাবে বাধার মুখে পড়ে…

উদ্ধারের কাজ? শিরশির করে উঠল রানার শরীর।

ব্রাখটম্যান। নিজের দোষে আহত হয়েছে। হাতের গ্লাস নামিয়ে এদিক ওদিক মাথা নাড়লেন ফন গোলডা, যেন এত ভার তার আর সহ্য হচ্ছে না। মি. ওয়েন আর ব্রাটম্যান ঢাল বেয়ে উঠছিল, এই সময় পড়ে যায় সে। গোড়ালি মচকে গেছে, কিংবা হয়তো ভেঙে গেছে, ঠিক বলতে পারব না। আমরা যে লারনারস ওয়ের দিকে যাচ্ছি, ওরা দেখতে পায়। মোটামুটি ওদের দিকেই এগোচ্ছিলাম আমরা, যদিও আমাদের চেয়ে অনেক উঁচুতে ছিল ওরা। মনে হলো। মি. ওয়েনকে একা এগিয়ে যেতে রাজি করিয়ে ফেলে ব্রখটম্যান, তারপর আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করে। আবার মাথা নেড়ে গ্লাসটা তুলে নিলেন। ফন গোলডা।

বুঝলাম না, বলল রানা। এঞ্জিনের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছে। ফিরে আসছে।

 তার উচিত ছিল গলার আওয়াজ শুনতে পাবার মত কাছাকাছি যতক্ষণ না আসি আমরা ততক্ষণ চুপচাপ শুয়ে থাকা, বললেন ফন গোলডা। কিন্তু সে অপেক্ষা করেনি, একার চেষ্টায় ওই পা নিয়ে ঢাল বেয়ে নামতে চেষ্টা করে। তারপর আর কি, তাল সামলাতে না পেরে একটা নালায় পড়ে যায়। ঈশ্বরই জানে কতক্ষণ অচেতন হয়ে পড়ে ছিল, আমরা তার চিৎকার শুনতে পাই বিকেলে। ঢাল থেকে তাকে নামিয়ে আনতে যে কি কষ্ট হয়েছে আমাদের! বাইরে কি এ-ক্যাটের আওয়াজ হচ্ছে?

মাথা ঝাঁকাল রানা। তারপর ফন গোলডার পিছু নিয়ে দরজার দিকে এগোল। আর মি. ওয়েন? জিজ্ঞেস করল ও। তাঁকে আপনি দেখেননি?

মি. ওয়েন? সামান্য অবাক হয়ে রানার দিকে তাকালেন ফন গোলডা। না, প্রশ্নই ওঠে না। আপনাকে তো বললামই, একা চলে গেছেন তিনি।

ও, হ্যাঁ, বলল রানা। ভুলে গিয়েছিলাম।

দরজার কাছে পৌচেছে ওরা, বাইরে থেকে খুলে গেল সেটা। হিউম আর কাউন্ট ঢুকলেন ভেতরে, ওদের দুজনের কাঁধে ভর দিয়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে এল ব্ৰাখটম্যান। ক্লান্তিতে ঝুলে পড়েছে তার মাথা, মুখে ও কপালে আঁচড় আর কাটাকুটির দাগ। ধরাধরি করে একটা কাউচে বসানো হলো তাকে, ডান পায়ের বুটটা খুলে নিল রানা। গোড়ালি সত্যি ফুলে আছে, কয়েক জায়গায় চামড়া উঠে যাওয়ায় সামান্য রক্তও দেখা গেল। এলিনাকে পানি গরম করতে বলল রানা। ব্রাখটম্যানকে ব্র্যাণ্ডি খেতে দিয়ে হাসল ও, আশ্বাস দিয়ে বলল, ভয়ের কিছু নেই, নির্ঘাত মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে যাওয়ায় ধন্যবাদ দিন ভাগ্যকে।

.

বলে মনে করছেন না।

বাকি সবাইকে তো আর জিরো টেমপারেচারে বাইরে বেরুতে হবে না।

কি? তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে রানার দিকে তাকালেন ফন গোলডা। কি বলছেন?

বলছি আর কয়েক মিনিটের মধ্যে ওরা যদি ফিরে না আসেন, চোদ্দ ফুটী বোটটা নিয়ে ওদেরকে আমি খুঁজতে যাব।

হোয়াট! এ সম্পূর্ণ অন্য ধরনের গলা, ফন গোলডার বলে চেনা মুশকিল। টুল ছেড়ে অতি কষ্টে দাঁড়ালেন তিনি। খুঁজতে যাবেন? ওদেরকে আপনি খুঁজতে যাবেন? পাগল হলেন, স্যার? এরকম দুর্যোগের রাতে, অন্ধকারে নিজের হাতও দেখতে পাবেন না। মাফ করবেন। না। ইতিমধ্যে অনেক লোক হারিয়েছি। আমি এর ঘোর বিরোধী।

ভেবে দেখেছেন, ওদের এঞ্জিন নষ্ট হয়ে গিয়ে থাকতে পারে? অসহায়ভাবে। হয়তো ঘুরে মরছে, অথচ এখানে আমরা চুপচাপ বসে আছি।

এঞ্জিন নষ্ট হবার প্রশ্নই ওঠে না, কারণ ওগুলো নতুন এঞ্জিন, আসার আগে পরীক্ষাও করা হয়েছে। তাছাড়া, ফার্সন অত্যন্ত দক্ষ মেকানিক।

তবু আমি যাচ্ছি।

আমি আপনাকে মনে করিয়ে দিতে চাই বোটটা কোম্পানীর সম্পত্তি।

ওটা আমি নিয়ে গেলে কে আমাকে বাধা দেবে?

ফোঁৎ ফোঁৎ করে নাক ঝাড়লেন ফন গোলডা, তারপর বললেন, আপনি বুঝতে পারছেন…?

পারছি। ফন গোলডা ক্লান্ত করে তুলেছেন রানাকে। এই মাত্র আপনি আমাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করেছেন।

আপনি তাহলে আমাকেও বরখাস্ত করুন, বলল হিউম। সবাই ওরা তার দিকে তাকাল। আমিও ডক্টর রানার সঙ্গে যাচ্ছি।

হিউমের কাছ থেকে এটা আশা করতে পারে রানা, কাজেই বিস্মিত হলো না। দেখল হিউমের একটা বাহু ধরে আছে এলিনা, তাকিয়ে আছে তার দিকে, চোখে-মুখে হতাশা। এলিনা যদি ব্যর্থ হয়ে থাকে, ওর চেষ্টা না করাই ভাল, ভাবল রানা।

ডগলাস!ফন গোলডার গলায় কর্তত্বের ধার ও ভার সবটুকু বিদ্যমান। তোমাকে আমি মনে করিয়ে দিতে চাই যে তোমার সঙ্গে কোম্পানীর একটা চুক্তি আছে।

ছিড়ে ফেলে দিন ওটা, বলল হিউম।

চোখে অবিশ্বাস, কয়েক সেকেণ্ড তাকিয়ে থাকলেন ফন গোলডা, বন্ধ করলেন খোলা মুখ, তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে থপথপ করে নিজের কিউবিকলের দিকে চলে গেলেন। তিনি কেবিন থেকে বেরিয়ে যেতেই সবাই একযোগে কথা বলতে শুরু করল। এগিয়ে এসে কাউন্টের পাশে দাঁড়াল রানা। মনের সুখে স্কচ খাচ্ছেন ভদ্রলোক। আপনার যদি তৃতীয় সুইসাইডাল ভলানটিয়ার হবার ইচ্ছে থাকে…

মি. গোলডাকে কতদিন থেকে চেনেন আপনি?

কি বললেন? মুহূর্তের জন্যে হলেও, প্রশ্নটা বুঝতে পারেননি কাউন্ট।

মেইন কেবিনে ব্রাখটম্যান ছাড়াও ষোলোজন লোক বসে আছে। মোনাকা তার কিউবিকলে মরে পড়ে আছে, বোধহয় সে-কথা স্মরণ করেই কেউ তার কিউবিকলে যাচ্ছে না। দুজন, তিনজন করে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসেছে সবাই, কথা বলছে নিচু গলায়, কেউ কেউ নিঃশব্দে স্কচ খাচ্ছে, তবে মাঝে-মধ্যে আড়চোখে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে সবাই। ইতিমধ্যে তুষারপাত আরও বেড়েছে, ঘন হয়েছে অন্ধকার, কিন্তু কার্লসন, বিশপ আর ফার্গুসন এখনও ফেরেনি।

অদ্ভুত ব্যাপার, ফন গোলডা স্কচ খাচ্ছেন না, তার বদলে একটা চুরুট চিবাচ্ছেন তিনি। খানিক আগে তাঁর সঙ্গে কথা হয়েছে রানার। ফন গোলডা আন্দাজ করেছেন, ওরা তিনজনই সম্ভবত ডুবে মরেছে। তার অনুমানের কারণ হিসেবে বলেছেন, তিনজনের কেউই বোট সামলাতে জানে না, এমন কি সাতারও জানে না।

সবাই এই মুহূর্তে চুপ করে আছে। নিস্তব্ধতা ভাঙলেন ফন গোলডা। যেন পরিবেশটাকে হালকা করার জন্যেই তিক্ত হাসি হেসে বললেন, কি ব্যাপার, ডক্টর, আপনার হাতে গ্লাস দেখছি না কেন?

না, বলল রানা। কাজটা ঠিক হবে না। কেবিনের চারদিকে চোখ বুলালেন ফন গোলডা। বাকি সবাই তো বেঠিক তারপর গ্লাসে আরও খানিকটা স্কচ ঢেলে বললেন, ত্রিশ বছরের ওপর। এটা কোন গোপন ব্যাপার নয়। যুদ্ধের আগে, ভিয়েনায়। কিন্তু কি ব্যাপার?

তখনও আপনি ফিল্ম বিজনেসে ছিলেন?

হ্যা এবং না। অদ্ভুত ভঙ্গিতে হাসলেন কাউন্ট। এ-ও রেকর্ডে পাবেন আপনি। আমার তখন রমরমা অবস্থা, ডক্টর। আমি তখন কাউন্ট অর্থে কাউন্ট কাউন্ট বট্রিউলা আইকারভস্কি। আমি ছিলাম মি. গোলডার ফেরেশতা, তার প্রথম পৃষ্ঠপোষক। এবার তার মুখে সকৌতুক হাসি ফুটল। বুঝে দেখুন না, তা না হলে বোর্ডের একজন সদস্য হই কি করে!

উনিশশো আটত্রিশ সালে ভিয়েনা থেকে হঠাৎ গায়েব হয়ে যান এরিক কার্লসন, তাই না? এ-ব্যাপারে কি জানেন আপনি?

কৌতুকের ভাব চেহারা থেকে মুছে গেল, রানার দিকে বোকার মত তাকিয়ে থাকলেন কাউন্ট।

রানা বলল, তারমানে এটা রেকর্ডে নেই। কাউন্ট কিছু বলেন কিনা শোনার জন্যে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল ও। তারপর আবার বলল, সাবধানে থাকবেন, কাউন্ট। নিজের পিছন দিকে নজর রাখতে ভুলবেন না।

আ-আমার…আমার পিছন দিকে?

পিছন থেকে পিঠে ছুরি মারা খুব সহজ, বলল রানা। নাকি লক্ষ করেননি মার্ভেলাস-এর বোর্ড সদস্যরা একে একে খসে পড়ছে? একজন বাইরে মরে পড়ে আছে, আরেকজন ভেতরে মরে পড়ে আছে। আরও দুজনের সম্ভবত সলিল সমাধি ঘটেছে। কেন আপনার মনে হচ্ছে আপনি ভাগ্যবান? নিজে তো সাবধান থাকবেনই, মি. হ্যামারহেড আর মি. মুরকেও সাবধান থাকতে বলে দেবেন, অন্তত আমি চলে যাবার পর। বিশেষ করে মি. মুরকে। আমি খুশি হব আপনি যদি তাকে আমার অনুপস্থিতিতে এই কেবিনের বাইরে বেরুতে না দেন।

০৮.

ঝাড়া এক মিনিট কথা বললেন না কাউন্ট। চেহারা দেখে কিছুই বোঝা গেল না। তারপর মুখ তুলে বললেন, আপনার কথা আমার বোধগম্য হলো না, ডক্টর রানা।

জানি হবে না, বলল রানা, হাত বাড়িয়ে তাঁর কোটের পকেটে টোকা মারল। জিনিসটা এখানে থাকা দরকার, আপনার কিউবিকলে নয়।

মানে?

আপনার নাইন এমএম বেরেটা অটোমেটিক।

কাউন্টকে পাশ কাটিয়ে জক মুরের সামনে এসে দাঁড়াল রানা। তার গ্লাস ধরা হাতটা থর থর করে কাঁপছে। বললেন, আমাদের মহৎপ্রাণ হিলার আবার মানুষকে বাঁচাবার জন্যে ছুটছেন। মাই বয়, আপনাকে নিয়ে কতখানি গর্বিত আমি সে-কথা…।

আমি চলে গেলে কেবিন ছেড়ে কোথাও বেরুবেন না। ভুলেও না, প্লীজ ফর মি, মি. মুর।

মার্সিফুল হেভেনস। হেঁচকি তুললেন জক মুর। শুনলে লোকে ভাববে আমি যেন কোন্ বিপদের মধ্যে আছি।

সত্যি আছেন। বিশ্বাস করুন, সত্যি বিপদের মধ্যে আছেন।

আমি? আমি? দেখে মনে হলো জক মুর সত্যি বিস্মিত হয়েছেন। কিন্তু কে বেচারা বুড়ো মুরের ক্ষতি করতে চাইবে?

সে-সব পরে শুনবেন। আপনি আমাকে কথা দিন, কোন অবস্থাতেই কেবিন ছেড়ে আজ রাতে কোথাও যাবেন না।

ব্যাপারটা আপনার কাছে এতই গুরুত্বপূর্ণ, মাই বয়?

হ্যাঁ।

ঠিক আছে। এখানে বসে আমি শুধু স্কচ সাবাড় করব…

এরপর হিউম আর এলিনার সামনে এসে দাঁড়াল রানা। নিচু গলায় তর্ক করছে ওরা, তবে দুজনের চেহারাতেই তীব্র উত্তেজনার ছাপ। বিচ্ছিন্ন হলো ওরা, এলিনা রানার একটা বাহু আঁকড়ে ধরল। স্ত্রীজ, ডক্টর রানা, প্লীজ! ডগলাসকে আপনি নিষেধ করুন যেতে। আপনার কথা শুনবে ও। শিউরে উঠল মেয়েটা। আমি জানি আজ রাতে ভয়ঙ্কর একটা কিছু ঘটবে।

তোমার ধারণা সত্যি হতে পারে, বলল রানা। মি. হিউম, আমরা কেউ চাই না আপনি খরচ হয়ে যান।

রানার কথা শুনে হকচকিয়ে গেল এলিনা, যেন ওর কথার অন্য কোন গভীর তাৎপর্য ধরা পড়েছে তার কাছে। এবার রানার বাহুটা দুহাতে আঁকড়ে ধরল সে, চোখে রাজ্যের হতাশা নিয়ে আরও কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল, তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে। চলে গেল নিজের কিউবিকলের দিকে।

ওর পিছু নিন, হিউমকে বলল রানা। ওকে বলুন…।

আমি আপনার সঙ্গে যাচ্ছি, ডক্টর। ও জানে।

গলা খাদে নামাল রানা। যা বলছি শুনুন। গিয়ে বলুন জানালাটা খুলে যে কালো বাক্সটা আমি ওকে দিয়েছি সেটা যেন বাইরের তুষারে নামিয়ে দেয়। তারপর জানালাটা বন্ধ করতে হবে।

প্রতিবাদ করে কিছু বলতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিল হিউম, তারপর মাথা কঁকিয়ে চলে গেল। এক মিনিট পরই আবার ফিরে এল সে। দুজনেই ওরা গরম। কাপড়চোপড় পরে তৈরি হলো, সঙ্গে নিল চারটে টর্চ। ওরা বেরিয়ে যাবে, হুপারের পাশ থেকে উঠে এসে রানাকে ডাকল পামেলা। ডক্টর রানা।

সোনালি চুলের যেখানে কান আছে বলে মনে হয় ঠিক সেখানটায় মাথা নামাল রানা, ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, য়্যাম আই ওয়াণ্ডারফুল?

সম্মোহিত ভক্তের মত মাথা ঝাঁকাল পামেলা, চশমার পিছনে চোখ দুটো বিষণ্ণ, আলতোভাবে চুমো খেলো রানাকে। কোন কথা হলো না। বাইরে বেরিয়ে এসে প্রতিবাদের সুরে রানাকে বলল হিউম, মেয়েটা আমাকেও একটা চুমো খেতে পারত।

আপনাকে চুমো খাবার মানুষ এখানে একজন আছে, আমার নেই, বলল রানা।

খানিক দূর এগিয়ে টর্চ নিভিয়ে অপেক্ষা করল ওরা, দেখতে চায় পিছু নিয়ে কেউ আসছে কিনা। এরপর এলিনার জানালার নিচ থেকে কালো বাক্সটা সংগ্রহ করল।

জেটি পর্যন্ত আসতে কোন সমস্যা হলো না। বোটে চড়ে স্টার্ট দিল রানা, হিউম বলল, নরকও বোধহয় এরকম অন্ধকার নয়, ডক্টর। কাজটা আপনি কি করে করবেন?

কি কাজ?

 মি. কার্লসনকে কিভাবে খুঁজে বের করবেন?

কার্লসন বা তার সঙ্গীদের জীবনে আর কখনও যদি দেখতে না পাই, আমার মন একটুও খারাপ হবে না, বলল রানা। ওদেরকে খুঁজে বের করার কোন ইচ্ছেই আমার নেই। সত্যি কথা বলতে কি, ওদেরকে এড়িয়ে থাকার চেষ্টা করব আমরা। বোট চালিয়ে সোর-হামনার উত্তর তীরে চলে এল ওরা, তারপর এঞ্জিন বন্ধ করে দিল রানা। অলসভঙ্গিতে ভাসতে ভাসতে তীরের দিকে এগোল বোট, একটা রশি ছুঁড়ল রানা। চার্ট বলছে, পানি এখানে তিন ফ্যাদম গভীর। আর এক্সপার্টরা বলছে, পঞ্চাশ ফুট রশি ফেললে বোট কোথাও ভেসে যাবে না। পিছনে জমিন থাকায় আকাশের গায়ে বোট বা আমাদের কাঠামো ফুটবে না, অর্থাৎ দক্ষিণ দিক থেকে কেউ এলে দেখতে পাবে না কিছু। ধূমপান নিষেধ, প্লীজ।

আমার খুব মজা লাগছে, বলল হিউম। দক্ষিণ দিক থেকে কে আসবে বলে আপনার ধারণা?

আমরা যাদেরকে খুঁজতে বেরিয়ে খুঁজছি না।

 তারমানে আপনি বলতে চান ওরা কোন বিপদে পড়েনি?

আমি বলতে চাই ওরা আসলে বিপদ ঘটাচ্ছে।

কিছুক্ষণ চিন্তা করল হিউম, তারপর বলল, মনে হচ্ছে আমাদেরকে বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হতে পারে। সময়টা কাটাবার জন্যে আমাকে আপনি একটা রূপকথা শোনাবেন নাকি, মি. রানা।

কাজেই যতটুকু যা জানে বা জানে বলে মনে করে, বলে গেল রানা। শোনার পরও কোন মন্তব্য করল না হিউম। রানা জিজ্ঞেস করল, আমাকে কথা দিচ্ছেন। তো, দেখামাত্র আপনি কার্লসনের মাথা ফাটাবেন না?

দিচ্ছি, অনিচ্ছাসত্ত্বেও দিচ্ছি। শিউরে উঠল হিউম। ওহে যীশু, বড় ঠাণ্ডা!

চুপ!

প্রথমে অস্পষ্ট, তারপর স্পষ্ট এঞ্জিনের আওয়াজ ভেসে এল। তিন মিনিট পর জেটির উত্তর বাহু ঘুরে উদয় হলো কার্লসনের ষোলো ফুটী বোট। এঞ্জিন বন্ধ হলো। সঙ্গে সঙ্গে কার্লসন, বিশপ বা ফার্গুসন তীরে নামল না। জেটির পাশে প্রায় মিনিট দশেক থাকল তারা। অন্ধকারে দেখা গেল না কি করছে, তবে টর্চের আলো দেখা গেল, আর পানিতে ভারি কিছু ফেলার আওয়াজ ভেসে এল। তারপর জেটি ধরে কেবিনের দিকে চলে গেল দলটা।

এখন আমরা কি করব? জানতে চাইল হিউম।

পাশের বে-তে যাব, সংক্ষেপে জবাব দিল রানা। পাহাড়-প্রাচীরের সেই ফাঁকটার কথা ভোলেনি ও।

বোট নিয়ে রওনা হলো ওরা। অনেকক্ষণ চুপ করে থাকার পর হিউম জিজ্ঞেস করল, আমি কি একটা প্রশ্ন করতে পারি?

আপনি এমন কি উত্তরও পেতে পারেন। ভাল কথা, ইভনিং স্টারের কথা মনে আছে আপনার, নাকি ভুলে গেছেন?

সেকি, ভুলব কেন!

আজ রাতে ওটাকে আবার আপনি দেখার সুযোগ পেতে পারেন।

 হোয়াট!

সত্যি বলছি।

ইভনিং স্টার?

আদি ও অকৃত্রিম। মানে, দেখতে পাব বলে আশা করছি আর কি। শুনুন, আজ সকালে বিনকিউলার দিয়ে আমি একটা ফাঁক দেখেছি পাথরের গায়ে, ইভজেবুকতা বে-তে।

ফাঁক মানে?

একটা টানেল। দূর থেকে দেখেছি, তবে আমার ধারণা লম্বায় অন্তত দুশো গজ হবে টানেলটা। চার্টে ওটার একটা নামও আছে-পাল পোটেন। খুঁজে বের করতে হলে বেয়ার আইল্যাণ্ডের একটা লার্জ-স্কেল ম্যাপ দরকার হবে আপনার। আজ বিকেলে সেরকম একটা আমার হাতে এসেছে।

আপনার ধারণা মি. কার্লসন আর তার সঙ্গীরা ওই টানেলে ছিলেন?

আমার ধারণা নেই আর কোথায় থাকতে পারেন ওঁরা। দুটো বে-র এমন কোন জায়গা নেই যেখানে আজ সকালে ওঁদেরকে আমি খুঁজিনি।

দশ মিনিটের মধ্যে দ্বিতীয় বে-তে প্রবেশ করল ওরা। অন্ধকারের ভেতরও পাহাড়চূড়াগুলোর আভাস পাওয়া যাচ্ছে। বোটের সামনে সরে গিয়ে শক্তিশালী একজোড়া টর্চ জ্বালল হিউম। দুমিনিটের মধ্যে কালো পাহাড়-প্রাচীর ওদের দৃষ্টিসীমার ভেতর চলে এল, একশো গজ দূরেও নয়। স্টারবোর্ডের দিকে বাঁক নিল বোট, পাহাড়-প্রাচীর ঘেঁষে উত্তর-পশ্চিম দিকে যাচ্ছে। এক মিনিট পর পাথরের গায়ে একটা ফাঁক দেখা গেল, কিন্তু আকারে সেটা খুবই ছোট। আবার বোট ছাড়ল ওরা, গতি মন্থর। আরও এক মিনিট পর যা খুঁজছিল পেয়ে গেল। টানেলে ঢুকে পড়ল বোট।

দেখে যতটা মনে হয় তারচেয়ে বড় টানেলটা, যদিও ক্রমশ সরু হয়ে গেছে। রানার ধারণা, টানেলটা এক বে থেকে শুরু হয়ে আরেক বে-তে গিয়ে শেষ হয়েছে। কিন্তু সরু হতে হতে সামনের পথ বন্ধ হয়ে গেল। তারপর টর্চের আলোয় ওরা দেখল, টানেলের এক ধারে পাথরের শেলফ রয়েছে, সমতল, চওড়ায় দুই থেকে পাঁচ ফুট। শেলফের ওপর ধূসর রঙে রাঙানো ধাতব বার স্থূপ করে সাজিয়ে রাখা হয়েছে।

কেউ কোন কথা বলল না। বাকি দুটো টর্চও জ্বালল হিউম, শেলফের ওপর এমনভাবে রাখল যাতে চারদিকে আলো পাওয়া যায়। বোট থেকে শেলফে উঠে এল ওরা। ছোট ছুরি দিয়ে একটা বারের রঙ সামান্য একটু তুলল রানা। কেউ কোন কথা বলল না। একটা বোট-হুঁক ফেলে পানির গভীরতা মাপল রানা। পানি এখানে মাত্র পাঁচ ফুট গভীর। নিচের পাথরগুলোকে অদ্ভুত লাগল ওর। হুকটা কিছুক্ষণ নাড়াচাড়া করতে কিছু একটায় আটকাল, পানির ওপর তুলে আনল সেটা। আধ ইঞ্চি চওড়া চেইন একটা, এখানে সেখানে মরচে ধরে গেছে। হুকটা আবার পানিতে ডোবাল ও। এবার তুলল চৌকো একটা বার, আই-বোল্ট-এর সঙ্গে চেইন দিয়ে আটকানো। পানি থেকে তোলা বার আর শেলফের বার, একই আকৃতির, তবে এটার রঙ চটে গেছে। চেইন আর বারটা পানিতে ফেলে দিল রানা।

ছুরিটা আবার হাতে নিয়ে একটা বারের গা পরীক্ষা করল রানা। প্রায় নিশ্চিতভাবে ধরে নেয়া চলে বার-এর গা সীসা দিয়ে তৈরি, তবে খুব পাতলা, শুধু আবরণ হিসেবে কাজ করছে। নিচে রয়েছে শক্ত কিছু। জোরে ছুরি চালিয়ে এক বর্গ-ইঞ্চির মত সীসা চেঁছে ফেলল রানা। টর্চের আলোয় হলুদ কি যেন চকচক করে উঠল।

অ্যাডভেঞ্চারারদের ভাষায় কি বলে? ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল হিউম। গুপ্তধন?

আমার ভাষায় হারানো ধন।

দেখুন এখানে কি পেয়েছি আমি, বলে বারগুলোর পিছন থেকে রঙের একটা ক্যান তুলল হিউম। ক্যান-এর গায়ে লেখা রয়েছে-ইনস্ট্যান্ট গ্রে।

খুব চালাকির সঙ্গে কাজটা করা হয়েছে, বুঝলেন, বলল রানা। একটা বারে আঙুল ছোঁয়াল ও। শুকনো। আই-বোল্ট কেটে ফেলে দিন, তারপর রঙ চড়ান, কি পেলেন?

একটা ব্যালাস্ট বার। নকল সাবমেরিনে যে ব্যালাস্ট বার আছে, রঙ ও আকৃতিতে তার সঙ্গে হুবহু মিলে যাবে।

দশে দশ পেলেন, বলল রানা। একটা বার দুহাতে ধরে তুলে ফেলল ও। বহন করাও সহজ। চল্লিশ পাউণ্ডের একটা ইনগট।

কি করে জানলেন?

বললাম না, হারানো ধন। যার হারায় তাকে অনেক গবেষণা করতে হয়, তা হলে হারানো জিনিস দেখতে পেলেও চিনতে পারবে না। এগুলো সব গহনা ছিল। একাধিক বার হাত বদল হবার ফাঁকে কোন এক সময় গলিয়ে বার বানানো হয়েছে। শেলফের ওপর সব মিলিয়ে কটা বার হবে বলুন তো?

একশো। বেশি।

এগুলো স্রেফ নমুনা, বেশিরভাগ পাওয়া যাবে পানির তলায়। রঙের সঙ্গে কি ব্রাশও আছে?

আছে। হাত বাড়াল হিউম, তাকে বাধা দিল রানা।

থাক, ফিঙ্গারপ্রিন্টের কথা চিন্তা করুন। ওগুলো প্রমাণ হিসেবে কাজে আসবে। চলুন, এবার কেটে পড়া যাক।

ফিরতে প্রায় এক ঘণ্টা লেগে গেল ওদের। জেটিতে প্রথমে উঠল হিউম, তার হাতে কালো বাক্সটা ধরিয়ে দিল রানা, তারপর নিজেও উঠে এল। কালো বাক্সটা চেয়ে নিয়ে ঢাকনি খুলল ও, অন্ধকারের ভেতর আঙুল দিয়ে খুঁজে নিয়ে অন করল সুইচ, তার আগে টেলিস্কোপিক এরিয়ালটা পুরোপুরি লম্বা করে নিয়েছে। আরও একটা সুইচ অন করল ও। মৃদু গুঞ্জন শোনা গেল, সেই সঙ্গে জ্বলে উঠল মৃদু সবুজ আলো। গুঞ্জনটা অবশ্য এক গজ দূর থেকেও শোনা যাবে না।

এ ধরনের খেলনা সত্যি কি কাজ করে? জিজ্ঞেস করল হিউম।

গরম পানিতে সেদ্ধ করুন, বরফে লুকিয়ে রাখুন, ডুবিয়ে রাখুন অ্যাসিডে, চারতলা ছাদ থেকে ফেলে দিন, তারপরও কাজ করবে। এটার এক ছোট বোন। আছে, ন্যাভাল গান থেকে ফায়ার করা যায়।

রেঞ্জ?

 চল্লিশ মাইল। আজ রাতে তার চার ভাগের এক ভাগও দরকার হবে না।

ওটা কি এখন ট্রান্সমিট করছে?

করছে।

এরপর নকল সাবমেরিনের খোলে নামল রানা। দুমিনিট পর আবার ফিরে এল জেটিতে। হিউম জিজ্ঞেস করল, কোনও সমস্যা?

দুটো রঙ হুবহু এক নয়, তবে পার্থক্যটা ধরা সহজ নয়।

০৯.

একা শুধু কার্লসন ব্যাখ্যা দিলেন, শেষ বিকেলে তাঁদের বোটের এঞ্জিন নষ্ট হয়ে গিয়েছিল, মেরামত করতে অনেক দেরি হয়ে যায়। বিশপ কিছু বললেন না, চুপ করে থাকল ফার্গুসনও। ফন গোলডা স্কচ খাবার জন্যে বেশ কয়েকবার অনুরোধ। করলেন, কিন্তু তার অনুরোধ রানা রক্ষা করল না। ওর ইচ্ছে আবার বাইরে। বেরুবে ও। হাতঘড়ি দেখল, বেরুবে আর দশ মিনিট পর, ওর সঙ্গে থাকবেন মার্ভেলাস প্রোডাকশন্সের চারজন ডিরেক্টর আর জক মুর। চারজন ডিরেক্টর কেবিনেই রয়েছেন, অনুপস্থিত শুধু জক মুর। তাঁকে ডাকার জন্যে তার কিউবিকলে নিজেই চলে এল রানা।

জানালা খোলা, কিউবিকল খালি। বিছানায় পড়ে থাকা টর্চটা তুলে নিয়ে। জানালার বাইরে আলো ফেলল রানা। তুষারের ওপর একজোড়া পায়ের দাগ দেখা গেল। তার মানে নিজের ইচ্ছায় যাননি জক মুর, তাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

মেইন কেবিন হয়ে স্টোররুমে চলে এল রানা, কিন্তু এখানেও তাকে পাওয়া গেল না। খবরটা শোনার পর স্বেচ্ছাসেবকের কোন অভাব হলো না, খুঁজতে যেতে এক পায়ে খাড়া সবাই। জক মুর সজ্ঞানে কখনও কারও সঙ্গে শত্রুতা করেননি।

এক মিনিটের মধ্যে খুঁজে পাওয়া গেল তাঁকে। পেলেন কাউন্ট। জেনারেটর। শেডের পিছনে তুষারস্তূপের ওপর পড়ে ছিলেন। জ্ঞান নেই, বোধহয় প্রাণও নেই। পরনে শুধু শার্ট, পুলওভার আর ট্রাউজার; পায়ে কার্পেট পিপার। একদম বরফ হয়ে গেছে শরীর, বোধহয় অনেকক্ষণ থেকে পড়ে ছিলেন তুষারের ওপর। তুষারে হলুদ দাগ দেখা গেল, হাতে ধরা বোতলটা থেকে খানিকটা তরল পদার্থ গড়িয়ে পড়েছে। চিৎ করা হলো তাকে, বুকে কান চেপে ধরল রানা। মনে হলো ক্ষীণ একটু শব্দ যেন হচ্ছে।

কিউবিকলে নিয়ে এসে শোয়ানো হলো কটে। কম্বল দিয়ে মোড়া হলো শরীরটা, হট-ওয়াটার ব্যাগ দিয়ে সেঁক দেয়া চলছে। ইতিমধ্যে নিশ্চিত হওয়া গেছে, তার হার্ট এখনও সচল। তবে বাঁচবেন কিনা বলা কঠিন।

খুঁজে পাবার পনেরো মিনিট পর মনে হলো নিঃশ্বাস ফেলছেন। সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় করে দিল রানা। শুধু পামেলা আর এলিনাকে থাকতে বলল।

আরও পাঁচ মিনিট পর নড়ে উঠল জক মুরের চোখ।

এ কাজ কেন আপনি করলেন? জিজ্ঞেস করল রানা।

আহা! বিড়বিড় করলেন তিনি।

কে আপনাকে বাইরে নিয়ে গিয়েছিল?

 জক মুরের ঠোঁটজোড়া নড়ে উঠল, তবে কোন আওয়াজ বেরুল না। তার ঠোঁটের কাছে কান পাতল রানা। গলার ভেতর থেকে ক্ষীণ আওয়াজ বেরিয়ে এল, দয়ালু এক লোক। খুব দয়ালু এক লোক।

রানার ভয় হলো ঝুঁকি দিলে না মরে যান। জিজ্ঞেস করল, কার কথা বলছেন?

আপনি জানেন কি?

কি জানব?

শেষে কিন্তু দয়া ছাড়া আর কিছুই থাকে না…। আবার চোখ বুজলেন জক মুর।

এলিনার দিকে তাকাল রানা। মি. হিউমকে গিয়ে বলো, কাউন্টকে আমি আমার কিউবিকলে ডাকছি। তাড়াতাড়ি।

কথা না বলে চলে গেল এলিনা। পামেলা বলল, উনি বাঁচবেন তো, ডক্টর রানা?

জানি না।

কিন্তু এখন তো ওঁর শরীর গরম…

ঠাণ্ডায় পড়ে থাকায় মারা যাবেন, ব্যাপারটা তা নয়।

আ-আপনি বলতে চাইছেন…বলতে চাইছেন…মারা যাবেন অ্যালকোহলিক পয়জনিঙে?

যেতে পারেন। জানি না।

ওঁর ওপর আপনার কোন মায়া নেই, তাই না?

 নিজের ওপরই ওঁর কোন মায়া নেই, পামেলা। মি. মুর অনেক দিন আগেই মারা গেছেন।

নিজের কিউবিকলে এসে কাউন্টকে দেখল রানা। কোন ভূমিকা না করে জিজ্ঞেস করল, বুঝতে পারছেন তো, মি. মুরকে মেরে ফেলার চেষ্টা করা। হয়েছিল?

না। তবে সন্দেহ হয়েছে।

আপনি জানেন মোনাকাকে খুন করা হয়েছে?

খুন করা হয়েছে! চেহারা দেখে মনে হলো সাংঘাতিক ঘাবড়ে গেছেন কাউন্ট।

বেশি মাত্রায় মরফিন দিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে তাঁকে। সিরিঞ্জটা আমার, মরফিনটুকুও আমার। কাউন্ট কিছু না বলে হাঁ করে তাকিয়ে আছেন। বুঝতে পারছেন তো, বেআইনী গুপ্তধন খুঁজতে এসে কি বিপদে জড়িয়ে পড়েছেন?

হ্যাঁ, বিপদেই…।

আপনাকে স্বীকার করতে হবে খুনীদের সঙ্গে রয়েছেন আপনি।

হ্যাঁ, এখন বুঝতে পারছি।

আইন আপনার সম্পর্কে কি সিদ্ধান্ত নিতে পারে, আপনার ধারণা আছে?

 আছে।

অস্ত্রটা কোথায়? জিজ্ঞেস করল রানা। ওটা চালাতে জানেন?

আহত দেখাল কাউন্টকে। আমি একজন পোলিশ কাউন্ট, স্যার!

নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন যে আপনার বাঁচার একমাত্র উপায় রাজসাক্ষী হওয়া?

হ্যাঁ, বুঝতে পারছি।

.

মি. গোলডা, মি. কার্লসন, মি. বিশপ ও কাউন্ট বডিউলা, চারজনের নাম উচ্চারণ করল রানা। আপনাদেরকে আমার সঙ্গে একটু বাইরে যেতে হবে, প্রীজ।

কি? বাইরে যেতে হবে? প্রতিবাদ করলেন ফন গোলডা। এই ঠাণ্ডায়? কেন, কেন?

প্লীজ। কেবিনের চারদিকে তাকাল রানা। আমি কৃতজ্ঞ বোধ করব, বাকি সবাই আপনারা যদি আমি না ফেরা পর্যন্ত এই মেইন কেবিন ছেড়ে কোথাও না যান। বিশ্বাস করুন, অনুরোধটা আমি আপনাদের স্বার্থেই করছি। আজ সকাল থেকে আমি জানি আমাদের মধ্যে কে খুনী। তবে তার নাম উচ্চারণ করার আগে মি. গোলডা আর তার সহ ডিরেক্টরদের সঙ্গে আমি একটু আলাপ করে নিতে চাই।

ফন গোলডা কর্কশ সুরে জানতে চাইলেন, আপনি তার পরিচয় জানেন?

জানি।

মানে তার অপরাধ আপনি প্রমাণ করতে পারবেন?

না, তা পারব না।

হাহ্! হেসে উঠলেন ফন গোলডা। কেবিনে উপস্থিত সবার ওপর চোখ বুলালেন। আপনি বাড়াবাড়ি করে ফেলছেন, তাই না, ডক্টর রানা?

কোন্ অর্থে?

লক্ষ করছি, সবার ওপর কর্তৃত্ব ফলাবার একটা চেষ্টা করছেন আপনি। খুনীকে যদি চিনে থাকেন, নামটা বলে ফেললেই তো পারেন, এত নাটক করছেন কেন? ভুলে যাবেন না, আপনিও আমাদের একজন। আপনিও মার্ভেলাসের একজন কর্মচারী…।

মার্ভেলাসের কর্মচারী আমি নই। আমি চাকরি করি বিসিআই-এর-বিসিআই মানে বাংলাদেশ কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স। ব্রিটেনের ট্রেজারি ডিপার্টমেন্টও আমাকে কিছু ক্ষমতা ও দায়িত্ব দিয়েছে, কাজেই বলতে পারেন আমি এখানে ব্রিটিশ সরকারেরও প্রতিনিধিত্ব করছি। আমাকে এখানে পাঠানো হয়েছিল মার্ভেলাস প্রোডাকশন্সের কিছু ব্যাপার তদন্ত করে দেখার জন্যে। আমার তদন্ত শেষ হয়েছে।

ফন গোলডার চোয়াল ঝুলে পড়ল। সরকারী এজেন্ট! সিক্রেট এজেন্ট!

এরিক কার্লসনও যেন গুঙিয়ে উঠলেন। বিসিআই মানে? হোয়াট ইজ দিস!

তদন্ত? কিসের তদন্ত? হাঁপাচ্ছেন ফন গোলডা। একজন ডাক্তারের মুখ। থেকে এ-সব কথা বেরোয় কিভাবে?

মনে পড়ে, ইন্টারভিউ-এর জন্যে সাতজন ডাক্তারকে ডাকা হয়েছিল? কিন্তু হাজির হয় মাত্র একজন-মাসুদ রানা?

ক্লার্ক বিশপ শান্ত সুরে বললেন, আমাদের বোধহয় শোনা উচিত মি. রানার কি বলার আছে।

মি. হিউম, আপনার সঙ্গে কথা আছে, বলে তার দিকে এগোল রানা।

ওর পথ রোধ করলেন ফন গোলডা। যা বলার আমাদের সামনে বলতে হবে, ডক্টর রানা।

পারলে ঠেকান, বলে ফন গোলডাকে ধাক্কা দিয়ে এগোল রানা। হিউমকে নিয়ে চলে এল নিজের কিউবিকলে। আমাদের বন্ধুরা আসছে। এসে যদি আমাকে জেটিতে না পায়, সরাসরি এখানে চলে আসতে পারে। সেক্ষেত্রে, আমি চাই, তাদের আপনি জানাবেন আমাকে কোথায় পাওয়া যাবে। আরও জরুরী কাজ, আমি চাই ফার্গুসনের ওপর আপনি সারাক্ষণ নজর রাখবেন। সে যদি কেবিন থেকে বেরুতে চায়, যুক্তি দিয়ে বুঝিয়ে ঠেকাতে চেষ্টা করবেন। যদি আপনার কথা না শোনে, যেতে দেবেন-তিন ফুট। হাতের কাছে আর কিছু না পান, স্কচের একটা বোতল অন্তত রাখবেন। অবশ্যই মাথার পিছনে মারবেন, যত জোরে খুশি।

আমি বরং কাঁধে মারব। মাথায় মারলে যদি মরে যায়!

.

সঙ্গে করে একটা কোলম্যান স্টর্ম লণ্ঠন নিয়ে এসেছে রানা, এখন সেটা খাড়া মইয়ের একটা ধাপের সঙ্গে ঝুলছে, মইটা নেমে গেছে কনিং-টাওয়ার থেকে নকল সাবমেরিনের ভেতরে। সবাই দাঁড়িয়ে আছেন ওঁরা, দৃষ্টিতে একাধারে বিদ্রূপ ও ক্রোধ, রানার কাজ দেখছেন। ভ্রু খুলে কাঠের একটা পাটাতন সরাল ও, ভেতর থেকে একটা ব্যালাস্ট বার তুলে এনে সাবধানে কমপ্রেসরের ওপর রাখল। ছুরির ফলা দিয়ে বারটার গায়ে খোঁচা দিল বার কয়েক। দেখুন কেমন চকচক করছে, ফন গোলডাকে বলল ও। চকচক করলেই সোনা হয় না, কথাটা সত্যি। তবে। এই বারটা সোনাই।

একে একে সবার দিকে একবার করে তাকাল রানা। কেউ নড়ছেন না, কথাও বলছেন না।

আশ্চর্য, আপনাদের কোন প্রতিক্রিয়া নেই! হাসল রানা, ছুরিটা ভাজ করে পকেটে ভরল। আবার আশ্চর্য হবার কিছু নেই। কারণ আপনারা এই সোনা উদ্ধার করার জন্যেই তো ছবি তৈরি করার নাম করে বেয়ার আইল্যাণ্ডে এসেছেন।

এবারও কেউ কথা বললেন না। রানার দিকে নয়, সবাই তাকিয়ে আছেন সোনার বারটার দিকে, ওটা যেন ওঁদেরকে জাদু করেছে।

 কি হলো? কারও কিছু বলার নেই?

আমার ধারণা, মি. রানা, গম্ভীর গলায় বললেন ফন গোলডা, আপনার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। কারণটাও বুঝি। সেজন্যে আপনার প্রতি আমাদের সবার সহানুভূতি রয়েছে। এই কদিনের ঘটনা আপনার মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে, আপনাকে এখন প্রায় একটা মেন্টাল কেসই বলা যায়।

ধন্যবাদ, আপনার মূল্যবান বক্তব্য শোনার সৌভাগ্য হলো আমাদের। মি. বিশপ, আপনি? কিছু অন্তত বলুন। ভুলে যাবেন না, আপনি আমার কাছে ঋণী। আমি না থাকলে, এই নাটকটার আয়োজন না করলে হপ্তা ঘুরে আসার আগেই আপনি মারা যেতেন।

আমার ধারণা মি. গোলডা ঠিক কথাই বলছেন, শান্ত গলায় বললেন বিশপ। গোটা ব্যাপারটা আপনার অসুস্থ মনের কল্পনা।

চল্লিশ পাউণ্ড ওজনের এই সোনার বারটাও কি কল্পনা? কাঠের পাটাতনের ওপর পা ঠুকল রানা। এর নিচে আরও পনেরোটা বার রয়েছে, সেগুলো? পার্সপোর্টেনের শেলফে রয়েছে এরকম একশোর বেশি বার, সেগুলোও কল্পনা? আর পার্লপোর্টেনের পানির নিচে যেগুলো রয়েছে? সব যখন ফাস হয়ে গেছে, না। বোঝার ভান করে কি লাভ বলুন তো? সব মিলিয়ে চার টন সোনা, পাঁচ টনও হতে পারে। কত দাম হবে?

কেউ কথা বললেন না।

ফিল্ম ইউনিট আসলে একটা কাভার। বলা যায় নিখুঁত কাভার। সবাই জানে সিনেমা লাইনের লোকজন একটু খেয়ালী হয়, তাদের উদ্ভট আচরণকেও স্বাভাবিক। বলে মেনে নেয় মানুষ। বছরের এই সময়টায় বেয়ার আইল্যাণ্ডে দিনের আলো থাকে মাত্র অল্প কিছুক্ষণ, তাহলে শূটিং করতে আসার কি কারণ? কারণ রাতের অন্ধকারে সোনা উদ্ধারের কাজটা যাতে দীর্ঘ সময় নিয়ে নিরাপদে সারা যায়। সঙ্গে করে নিয়ে আসা হয়েছে নকল একটা সাবমেরিন, চিত্রনাট্যে ওটার। প্রয়োজনীয়তার কথা বলা হয়েছে। সাবমেরিনের সঙ্গে ব্যালাস্ট তো থাকবেই। কাস্টমসকে ফাঁকি দিয়ে সোনার বারগুলো ইংল্যাণ্ডে নিয়ে যাবার কৌশল এটা। লোহার ব্যালাস্ট বার ফেলে দিয়ে তার জায়গায় রাখা হবে সোনার বার। কার সাধ্য ধরতে পারে।

সবাই চুপ।

আপনারা সম্ভবত নকল সাবমেরিনটাকে পার্লপোর্টেনে নিয়ে যাবার একটা অজুহাত তৈরি করতেন, বারগুলো সাবমেরিনে তুলতে যাতে সুবিধে হয়। তারপরই রওনা হয়ে যেতেন ফিরতি পথে। চার-পাঁচ টন সোনা, আপনাদের আর পায় কে!

ঠিকই ধরেছেন আপনি। আপনার সব কথাই সত্যি। ফন গোলডা সম্পূর্ণ শান্ত। তবে ব্যাপারটাকে ক্রিমিনাল কেস হিসেবে দাঁড় করাতে পারবেন বলে মনে হয় না। অভিযোগটা কি, শুনি? চুরি? হাস্যকর শোনাবে। সবাই জানে, গুপ্তধন যে পায় তার।

যে পায় তার? মাত্র কয়েক টন সোনা? আর গুপ্তধন বলছেন কেন? পরিচয় দিলাম, তারপরও বুঝতে পারছেন না? বাংলাদেশ কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স, মি. গোলডা। গুপ্তধন নয়, এ সোনা বাংলাদেশ থেকে ছিনতাই করা হয়েছিল। ছিনতাই করেছিল জাপানীরা, আজ থেকে প্রায় পঁয়ত্রিশ বছর আগে। সে-সব। অবশ্য আপনাদের জানার কথা নয়। চোরের ওপর বাটপারি হয়ে যায়, জাপানীদের কাছ থেকে কেড়ে নেয় জার্মানরা। থাক এ-সব কথা। আপনারা বরং মি. কার্লসনের দিকে একবার ভাল করে তাকান। উনি যে কতটা গভীর জলের মাছ, আপনাদের কারও সে ধারণা নেই। কি, মি. কার্লসন, আমি কি ভুল বললাম?

সবাই কার্লসনের দিকে তাকালেন। কিন্তু কার্লসন কারও দিকে তাকালেন না।

আগেই বলেছি, আমি ব্রিটিশ সরকারেরও প্রতিনিধিত্ব করছি। সত্যি কথা বলতে কি, ইউরোপের অনেক সরকারই মি. কার্লসন সম্পর্কে আগ্রহী। মি. কার্লসন, এ-কথা কি সত্যি নয়, আপনি ত্রিশ বছরেরও বেশি সোভিয়েত সরকারের হয়ে কাজ করছেন?

বিস্ফারিত চোখে কার্লসনের দিকে তাকিয়ে থাকলেন ফন গোলডা। কার্লসন নিঃশব্দে ফুঁসছেন, তাকিয়ে আছেন রানার দিকে।

উনি যখন কিছু বলবেন না, আমাকেই তাহলে বলতে হয়। মি. কার্লসন হলেন একজন ট্রেজার-হান্টার, এক্ষেত্রে তার জুড়ি মেলা ভার। তবে শুধু যে। গুপ্তধন খুঁজে বেড়ান, তা নয়। আরও একটা জিনিস খুঁজে বেড়ান তিনি, যদিও সে-সম্পর্কে আপনাদেরকে কিছু বলেননি। উনি শর্ত দেন, গুপ্তধনের বখরা পেতে হলে এলিনা স্টুয়ার্টকে মার্ভেলাসে চাকরি দিতে হবে। তার পরিচয় দেন নিজের ভাগ্নী বলে। যদিও কথাটা সত্যি নয়।

এলিনার বাবা আপনাদের মতই একজন বদ লোক। জার্মান নেভি আর নাৎসী পার্টিতে খুব বড় পদে ছিলেন তিনি। যুদ্ধ শেষ হয়ে আসছে বুঝতে পেরে পালিয়ে যান, তবে খালি হাতে নয়। বিভিন্ন দেশ থেকে লুঠ করা সোনা কোথায় রাখা হয় তিনি জানতেন। যতটা সম্ভব জাহাজে ভরে নিয়ে কেটে পড়েন তিনি। চলে আসেন বেয়ার আইল্যাণ্ডে, লুকিয়ে রাখেন পার্লপোর্টেনে। সম্ভবত জাহাজ নিয়ে নয়, একটা সাবমেরিন নিয়ে এসেছিলেন তিনি।

তবে পার্লপোর্টেনে শুধু সোনা নিয়ে আসা হয়নি। এখানেই এলিনার প্রসঙ্গ এসে পড়ে আবার। সোনার সঙ্গে বিপুল পরিমাণে ব্যাংক বণ্ড বা সিকিউরিটিজও নিয়ে আসা হয়। এ-ধরনের সিকিউরিটিজ এখনও বিনিময়যোগ্য। সম্প্রতি ত্রিশ মিলিয়ন পাউণ্ড বা সমমূল্যের বণ্ড ভাঙাবার চেষ্টা করা হয়, কিন্তু মালিকানা সম্পর্কে প্রমাণের অভাবে জার্মান ফেডারেল ব্যাংক ওগুলোর বিনিময়ে টাকা দিতে অস্বীকার করে। তবে মালিকানা প্রমাণ করা এখন কোন সমস্যা নয়, তাই না, মি. কার্লসন?

আগের মতই চুপ করে থাকলেন এরিক কার্লসন।

কিন্তু কোথায় সেগুলো? ডামি স্টীল ইনগট-এর ভেতর লুকানো আছে? কেউ জবাব না দেয়ায় আবার রানা বলল, কিছু আসে যায় না, যেখানেই থাকুক ঠিকই খুঁজে পাওয়া যাবে। এ-প্রসঙ্গে আরও একটা কথা বলি। ওই ডকুমেন্টগুলোয় আপনি এলিনার বাবার সই ও আঙুলের ছাপ সংগ্রহ করতে পারছেন না।

কে বলল পারছি না? এতক্ষণে এই প্রথম কথা বললেন কার্লসন।

 আমি বলছি।

কিন্তু আপনি ভুলে যাচ্ছেন, অ্যাডমিরাল টুডিয়ার আমাদের হাতে বন্দী।

ওটাই কি এলিনার বাবার আসল নাম? ও, তা-ও আপনি জানেন না?

না। তবে এর কোন গুরুত্ব নেই। না, এলিনার বাবা যে আপনার হাতে বন্দী। তা আমি ভুলিনি। তবে এ-প্রসঙ্গে পরে আসছি। তার আগে আপনার বন্ধুদের প্রসঙ্গে আরও দুএকটা কথা বলে নিই। সরি, বন্ধু বলা বোধহয় ঠিক হলো না। ওদের চেহারা লক্ষ করুন। বন্ধু বলে মনে হচ্ছে কি?

এ অবিশ্বাস্য! চাপা গলায় গর্জে উঠলেন ফন গোলডা। এ অপরাধের কোন ক্ষমা নেই। ভাবা যায়, আমাদের একজন পার্টনার…

জঘন্য ষড়যন্ত্র! হিস হিস করে উঠলেন বিশপ। স্রেফ বেঈমানী!

হা, সিকিউরিটিজ-এর ভাগ আপনাদের উনি দিতেন না। তবে ফাঁকি দেয়ার। কাজে একা শুধু কার্লসনই দক্ষ নন, নিজেদের আসল উদ্দেশ্য গোপন করার ব্যাপারে আপনারাও কেউ কারও চেয়ে কম যান না।

কাউন্টকে ধরুন। আপনাদের তুলনায় তাকে আমি ফেরেশতা বলব, তবে তিনিও ঘোলা জলে মাছ শিকার করতে পটু। বোর্ডে আজ তিনি ত্রিশ বছর ধরে আছেন, প্রাপ্য না হলেও বখরা পাচ্ছেন লাভের। কিভাবে? ভিয়েনা থেকে মি. গোলডা আর মি. কার্লসন যখন পালালেন, কাউন্ট তখন ওখানেই ছিলেন। কার্লসন পালালেন গোলডা তাকে পালাতে প্ররোচিত করায়, কারণ কার্লসন। পালিয়ে গেলে তিনি তার ফিল্ম কোম্পানীর পুঁজি দেশের বাইরে সরিয়ে নিয়ে। যেতে পারবেন। বন্ধুর সঙ্গে বেঈমানী করার সুযোগ পেলে মি. গোলডা কখনোই তা হাতছাড়া করেন না।

কিন্তু গোলডা জানতেন না, কাউন্ট তাঁকে বলেননি, কার্লসন নিখোঁজ হয়ে গেলেন সম্পূর্ণ নিজের ইচ্ছায়। বেশ কিছুদিন থেকে জার্মানদের হয়ে গোপনে কাজ করছিলেন তিনি, এই সময় জার্মানীতে তাকে ডেকে নেয়া হয়। কিন্তু জার্মানরা জানত না যে রাশিয়ানরা আগেই তাকে হাত করেছে। এ-প্রসঙ্গ থাক। আমার বলার কথা হলো, গোলডা জানেন তিনি তার বন্ধুর সঙ্গে বেঈমানী করেছেন, সেই সঙ্গে এ-ও জানেন যে কথাটা কাউন্টের কাছে গোপন নেই। কাউন্ট খুব একটা লোভী লোক নন, তাই মোটা টাকার বেতনেই খুশি থাকলেন। তিনি, হাঁসটাকে জবাই করে সবগুলো ডিম পেতে চেষ্টা করেননি। সেজন্যেই তাঁর বিরুদ্ধে আদালতে কেস দাঁড় করানো কঠিন হবে। আর সেজন্যেই তাকে আমি রাজসাক্ষী হবার প্রস্তাব দিয়েছি। উনি আমার প্রস্তাব গ্রহণও করেছেন। আদালতে উনি ওঁনার সহ-ডিরেক্টরদের বিরুদ্ধে সাক্ষী দেবেন।

ফন গোলডা আর ক্লার্ক বিশপের মত এবার এরিক কার্লসনও অগ্নিদৃষ্টি হানলেন কাউন্টের দিকে।

কিংবা গোলডার কথা ধরুন, বলে চলেছে রানা। বহু বছর ধরে কোম্পানী থেকে মোটা অঙ্কের টাকা সরাচ্ছেন তিনি, বলা যায় ঝাঁঝরা করে ফেলছেন। এবার বিশপ আর কার্লসন ঘৃণা ভরা দৃষ্টিতে গোলডার দিকে তাকালেন। কিংবা বিশপের কথা ধরুন। গোলডা যে টাকা সরাচ্ছেন, দুতিন বছর আগে উনি তা টের পেয়ে যান। সেই থেকে গোলডাকে ব্ল্যাকমেইল করছেন তিনি, বলা যায় প্রায় ফতুর করে ফেলছেন।

এবার আসল প্রসঙ্গ। আপনাদের মধ্যে খুনী কে? নাকি বলা উচিত কারা খুনী? মি. গোলডা, আপনার কিছু বলার আছে?

রানার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকলেন গোলডা। জবাব দিলেন না।

আপনার যে যাবজ্জীবন হবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। আপনার ভাড়াটে দুজন খুনীরও যাবজ্জীবন হবে। ফার্গুসন আর ব্রাশটম্যানের।

ফ্রিজিং পয়েন্টের অনেক নিচে নেমে গেছে কেবিনের তাপমাত্রা, কিন্তু ব্যাপারটা কেউ খেয়াল করছে বলে মনে হলো না।

ফন গোলডা এক মহা পাপী, শয়তান লোক, বলল রানা। তার অপরাধের কোন সীমা নেই। তবে তার কপালটাও খারাপ। শুধু যে আপনারা তাঁকে ব্ল্যাকমেইল করছিলেন তা নয়, তার মেয়ে এবং জামাইও এই কাজে নেমে পড়ে। আজ থেকে পঁচিশ বছর আগে ক্যালিফোর্নিয়ায় একটা কার অ্যাক্সিডেন্টের ঘটনা ঘটে। দুটো গাড়ির একটা ছিল জক মুরের। তাঁর গাড়িতে আরোহী ছিল তিনজন মিসেস মুর আর তাঁদের দুই যমজ মেয়ে। তিনজনই মদ খেয়ে মাতাল অবস্থায় ছিল। অপর গাড়িটা ছিল মিখায়েল ট্যাকারের, তবে গাড়িতে তিনি ছিলেন না। মুরের পরিবার ট্যাকারের দেয়া পার্টি থেকে বেরোন, ওই একই পার্টি থেকে বেরোন গোলডা আর হ্যামারহেড। দ্বিতীয় গাড়িটায় তারা দুজন ছিলেন। বলাই বাহুল্য, মাতাল অবস্থায়। তাই না, মি. গোলডা?

এ-সব প্রলাপ কখনোই প্রমাণ করা যাবে না।

 গাড়িটা চালাচ্ছিলেন গোলডা। অ্যাক্সিডেন্টের পর অচেতন হয়ে পড়েন হ্যামারহেড। জ্ঞান ফেরার পর তাকে জানানো হয়, গাড়িটা তিনিই চালাচ্ছিলেন। হ্যাঁ, গোলডাই তাঁকে জানান। ফলে হ্যামারহেড বুঝলেন, তিনজন মানুষকে খুন করে ফেললেও তার জেল হবে না, শুধু যদি গোলডা মুখ না খোলেন। বেতনের তালিকা থেকে জানা যায়…

বেতনের তালিকা? কোত্থেকে পেলেন আপনি? জিজ্ঞেস করলেন বিশপ।

আপনার কিউবিকল থেকে, ওটার সঙ্গে আপনার ব্যাংক-বুকও পেয়েছি।

…তালিকা থেকে জানা যায়, হ্যামারহেড বছরের পর বছর ধরে অতি সামান্য বেতন পাচ্ছেন। সত্যি, মি. গোলডা, আপনার তুলনা আপনিই। হ্যামারহেডের কাঁধে মৃত্যুগুলোর দায় তো চাপিয়েছেনই, প্রায় বিনা বেতনে তাকে চিরকালের জন্যে ক্রীতদাসও বানিয়ে রেখেছেন।

কিন্তু ট্যাকার জানতেন কে দায়ী, কারণ তার বাড়ি থেকে রওনা হবার সময়। গাড়িটা গোলডাই চালাচ্ছিলেন। কাজেই চুপ করে থাকার বিনিময়ে কোম্পানীতে মোটা বেতনে চাকরি নেন ট্যাকার আর মোনাকা। আপনারা কি জানেন, গোলডা আজ জক মুরকেও মেরে ফেলার চেষ্টা করেছেন? কেন শুনবেন? মারা যাবার মাত্র কিছুক্ষণ আগে মুরকে আসল ঘটনা বলে দিয়েছেন মোনাকা। গোলডা ব্যাপারটা জানতে পেরে আর দেরি করেননি।

বেয়ার আইল্যাণ্ডে ছবি বানাতে আসার প্রস্তাবটা সম্ভবত কার্লসনের। প্রস্ত বিটা একাধিক কারণে লুফে নেন গোলডা। অনেক সমস্যা ছিল তার, এক ঢিলে সবগুলোর সমাধান করতে চেয়েছিলেন। সহজ সমাধানটাই বেছে নেন তিনি। ডিরেক্টরদের পাঁচজনকেই মেরে ফেলবেন। হ্যাঁ, নিজের মেয়েকেও, যে মেয়ে। তাঁকে ঘৃণা করে। সেজন্যেই দুজন ভাড়াটে খুনীকে সঙ্গে করে আনেন। ওরা যে ভাড়াটে, তাতে কোন সন্দেহ নেই। আজ বিকেলে আমি ফার্গুসনের সুটকেস। থেকে পাঁচ হাজার পাউণ্ডের নতুন নোট পেয়েছি। ওদের পরিচয় দেয়া হয়েছে। অভিনেতা হিসেবে, কিন্তু তা ওরা নয়। ক্লার্ক বিশপের দিকে তাকাল রানা। বলেছিলাম, আপনিও মারা যাবেন, মনে আছে কি? গোলডার প্ল্যান ছিল আপনাদের সবাইকে…

ঠিক আছে, বুঝলাম, বললেন বিশপ। কিন্তু ওঁর উদ্দেশ্য শুধু যদি বোর্ড ডিরেক্টরদের মেরে ফেলা হয়…।

তাহলে বাকি লোকগুলো মরল কেন, এই তো? এজন্যে দায়ী করতে হয়। দুর্ভাগ্য আর অব্যবস্থাকে। প্রথম টার্গেট ছিল কাউন্ট। কিন্তু দুর্ভাগ্যের শিকারে পরিণত হয় ক্লাউড কেডিপাস। অতীত খুঁজলে, আমার বিশ্বাস, জানা যাবে যে বিষ। সম্পর্কে গোলডা একজন বিশেষজ্ঞ। সেই রাতে একটা সাইড টেবিল থেকে মেইন টেবিলে খাবার পরিবেশন করা হয়। কাউন্টের প্লেটে সামান্য একটু অ্যাকোনাইট মিশিয়ে দেন তিনি। কিন্তু কেডিপাসের দুর্ভাগ্য হলো, কাউন্ট হর্সর্যাডিশ একেবারেই পছন্দ করেন না। তিনি তাঁর প্লেটটা কেডিপাসকে দিয়ে দেন। ফলে মারা যায় বেচারা।

একই সময়ে কার্লসনকেও বিষ খাওয়াবার চেষ্টা করেন তিনি। কিন্তু সী সিকনেসে অসুস্থ হয়ে তাড়াতাড়ি টেবিল ছেড়ে উঠে পড়েন কার্লসন, প্লেটে হাত না দিয়েই। প্লেটে কেউ হাত দেয়নি দেখে বাবুর্চি মরিসন খাবারটা ফেলে না দিয়ে। রেখে দিল। সেখান থেকে পরিবেশন করা হলো বাক আর পিটারসনকে। সেখান থেকেই খানিকটা চুরি করে খেয়ে ফেললেন ব্যারন। তিনজনই অসুস্থ হয়ে পড়ল, মারা গেল দুজন। দুর্ভাগ্য ছাড়া কি বলা যায়?

কিন্তু গোলডা নিজেও তো বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছিল, তাই না? জিজ্ঞেস করলেন কাউন্ট।

স্বেচ্ছায়, কেউ যাতে তাকে সন্দেহ না করতে পারে। তবে অ্যাকোনাইট নয়, হালকা কিছু। আপনাদের মনে আছে, সেই রাতে গোলডা আমাকে ইভনিং স্টার টুর করতে পাঠালেন, সী-সিকনেসে কে কে অসুস্থ হয়ে পড়েছে জানার জন্যে? আসলে উনি জানতে চাইছিলেন ভুল করে কাকে বা কাঁদেরকে তিনি বিষ খাইয়ে ফেলেছেন। কেডিপাস মারা গেছে শুনে অস্বাভাবিক রেগে যান তিনি, কিন্তু তখন তাঁর এই প্রতিক্রিয়ার অর্থ আমি বুঝতে পারিনি।

সেই রাতে আরও একটা ঘটনা ঘটে। চেক করার জন্যে দুজন লোক ঢোকে আমার কেবিনে। একজন হয় ফার্গুসন বা ব্রাশটম্যান, অপর জন আর্চার। কার্লসনের দিকে তাকাল রানা। সে আপনার লোক ছিল, তাই না?

নিঃশব্দে মাথা ঝাঁকালেন কার্লসন।

কার্লসনের সন্দেহ হয় আমাকে। আমার পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হবার জন্যে আর্চারকে দিয়ে কেবিনটা চেক করান। সন্দেহ হয় গোলডারও, তাঁর ভাড়া করা এক লোক জানতে পারে অ্যাকোনাইট সম্পর্কে একটা আর্টিকেল পড়ছি আমি। কাজেই এরপর তিনি আমাকেও সরিয়ে ফেলার সিদ্ধান্ত নেন-স্কচের বোতলে বিষ মিশিয়ে। আর্চারের দুর্ভাগ্য, আমার মেডিকেল ব্যাগে হাত দেয়া যায়। কিনা দেখতে এসে ওই বোতল থেকে খানিকটা স্কচ খেয়ে ফেলে সে।

বাকি মৃত্যুগুলো ব্যাখ্যা করা সহজ। সবাই মি. ওয়েনকে খুঁজছে, এই সময় ফাগুসন আর ব্রাটম্যান মি. ট্যাকারকে খুন করে। তাদের দ্বারাই আহত হয় মি. হুপার, উদ্দেশ্য ছিল ট্যাকার-হত্যার দায়ে তাকে ফাঁসানো। গোলডা নিজেই তাঁর মেয়েকে মেরে ফেলার আয়োজন করেন। তিনি ফাগুসনকে নিয়ে পাহারায় ছিলেন, খুনটা নিশ্চয়ই ওই সময় ঘটেছে। গোলডার দিকে তাকাল রানা। মোনাকার জানালাটা আপনার চেক করা উচিত ছিল। আমি ওটা স্ক্রু দিয়ে বন্ধ করে রাখি, বাইরে থেকে কেউ যাতে ভেতরে ঢুকতে না পারে। আরও একটা তথ্য-আমার মেডিকেল ব্যাগ থেকে এক ফাঁইল মরফিন ও একটা হাইপডারমিক চুরি গেছে। এ-সব অভিযোগ আপনার স্বীকার করার দরকার নেই, ফাগুসন আর ব্রাখটম্যানই তোতাপাখির মত সব ফাস করে দেবে।

সবই আমি স্বীকার করছি, ফন গোলডা কথা বলছেন আশ্চর্য শান্ত গলায়। আপনার প্রতিটি বর্ণনা সত্যি। তবে আপনার তাতে কোন লাভ হবে বলে মনে করি না। হঠাৎ তার হাতে একটা কালো অটোমেটিক বেরিয়ে এল।

সব অপরাধ স্বীকার করার পর ভাবছেন হাতের ওই অস্ত্র আপনাকে রক্ষা করতে পারবে? রানা দাঁড়িয়ে আছে কনিং-টাওয়ার হ্যাঁচওয়ের সরাসরি নিচে। সাবমেরিনে আসার খানিক পর থেকে ইচ্ছে করেই এখানে পজিশন নিয়েছে ও। ও যা দেখতে পাচ্ছে গোলডা তা দেখতে পাচ্ছেন না। ইভনিং স্টারের কথা ভাবুন, গোলডা। ওটা এখন কোথায় বলুন তো?

কি বলতে চান? ধোঁকা দেয়ার চেষ্টা করে কোনই লাভ নেই! ফন গোলডার আঙুল ট্রিগারের ওপর চেপে বসছে।

ইভনিং স্টার টুনহেইম পর্যন্ত গেছে, তারপর আর এগোয়নি। ওখানে আমার লোকজন আছে, গোলডা। আমার মেসেজ পাবার অপেক্ষায় আছে তারা। এ-কথা সত্যি ইভনিং স্টারের রিসিভার আপনি নষ্ট করে ফেলায় তাদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করা সম্ভব নয়, কিন্তু এখান থেকে চলে যাবার আগে ইভনিং স্টারে আমি একটা রেডিও ডিভাইস তুলে দিয়েছি। ওটাকে আপনি একটা রেডিও হোমার বলতে পারেন। রেডিও ট্রান্সমিটার থেকে ওটায় রেডিও সিগন্যাল পাঠানো যায়। ট্রান্সমিটারটা চালু করা হয়েছে এখন থেকে প্রায় নব্বই মিনিট আগে। রেডিও সিগন্যাল পাওয়া মাত্র কি করতে হবে জানা আছে আমার লোকজনদের। ইভনিং স্টারে এই মুহূর্তে নরওয়ে, ব্রিটেন ও বাংলাদেশের সশস্ত্র লোকজন রয়েছে। বেশিরভাগই সেনাবাহিনীর লোক। প্লীজ, আমার কথা বিশ্বাস করুন। তা হলে শুধু শুধু রক্ত ঝরবে।

রানার কথা বিশ্বাস করলেন না গোলডা। দ্রুত সামনে বাড়লেন তিনি, মুখ। তুলে কনিং-টাওয়ারের দিকে তাকালেন, একই সঙ্গে হাতের অস্ত্রটা তুলছেন। দাঁড়িয়ে আছেন উজ্জ্বল আলোয়, তাকিয়ে আছেন অন্ধকারে। বদ্ধ জায়গার ভেতর গুলির শব্দটা হলো কান ফাটানো। গুলির আওয়াজ আর তার চিৎকার প্রায় একই সঙ্গে শোনা গেল। হাতের অস্ত্রটা সোনার বারের ওপর পড়ায় ধাতব একটা শব্দও কানে এল।

দুঃখিত, বলল রানা। আপনি আমাকে বলার সুযোগও দিলেন না যে ওরা সবাই বাছাই করা সৈনিক।

নকল সাবমেরিনে চারজন লোক উঠে এল। দুজনের পরনে সাদা পোশাক, বাকি দুজন পরে আছেন নরওয়েজিয়ান আর্মি ইউনিফর্ম। সিভিলিয়ানদের একজন। রানাকে বললেন, মি. রানা? মাথা ঝাঁকাল রানা। আমি ইন্সপেক্টর রবার্টসন, আর

ইনি ইন্সপেক্টর সোরেনসন। দেখে মনে হচ্ছে ঠিক সময়েই পৌঁছেছি আমরা।

হ্যাঁ, ধন্যবাদ।

আমরা এখানে পৌঁছেছি বেশ অনেকক্ষণ আগেই। আমরা আপনাকে সাবমেরিনে উঠতেও দেখেছি। উত্তর মাকেল থেকে রাবার ডিঙ্গি নিয়ে তীরে আসি আমরা। ক্যাপটেন ডানহিল রাতের অন্ধকারে সোর-হামনায় আসতে ভয় পাচ্ছিলেন। উনি বোধহয় চোখে ভাল দেখেন না।

তবে আমি দেখি! ওপর থেকে ভেসে এল কর্কশ গলাটা। হাতের অস্ত্র ফেলে দিন! ফেলে দিন, তা না হলে আপনাকে আমি খুন করব! ব্ৰাখটম্যানের উচ্চারণে অবিশ্বাসের কোন অভাব নেই। অস্ত্র দেখা যাচ্ছে মাত্র একজনের হাতে, যে সৈনিকটি গোলডাকে গুলি করেছে। নরওয়েজিয়ান ইন্সপেক্টরদের একজন। তীক্ষ্ণকণ্ঠে নির্দেশ দিতেই হাতের অস্ত্র ফেলে দিল সে। খোলের ভেতর নেমে এল ব্ৰাখটম্যান, চোখে সতর্ক দৃষ্টি, তার হাতের অস্ত্র নিঃশব্দে অর্ধবৃত্ত তৈরি করছে।

সাবাস, ব্রাখটম্যান, সাবাস! ভাঙা কব্জির ব্যথা ভুলে প্রশংসা করলেন ফন গোলডা। তার হাত থেকে এখনও রক্ত ঝরে পড়ছে সোনার বারে।

তারমানে আপনি আরও একটা মৃত্যুর দায়িত্ব নিতে চান? জিজ্ঞেস করল রানা।

চুপ, একদম চুপ! পরিস্থিতি উল্টে গেছে… |

পরিস্থিতি উল্টে গেছে? এমন বোকা লোক তো দেখিনি! ভেবেছেন আমি জানি না ব্রাখটম্যান অচল নয়? আমার ডিগ্রী নেই, তবে ট্রেনিং নিয়ে কিছু কিছু ডাক্তারী ব্যাপার আমাকে শিখতে হয়েছে বৈকি, তা না হলে এখানে আমাকে ডাক্তার হিসেবে পাঠানো হবে কেন? মোটা লেদার বুট ছিল ব্রাখটম্যানের পায়ে। বুট পরা অবস্থায় যেভাবেই আহত হোক, কারও গোড়ালির চামড়া উঠে যাবে না। হ্যাঁ, হাড় ভাঙতে পারে; হাড়ে ফাটলও ধরতে পারে। কিন্তু সেরকম কিছু ঘটেনি। তারমানে গোড়ালির চামড়া ইচ্ছে করে নিজেই উঠিয়েছে সে। ট্যাকারকে খুন করার সময় ভুল করেছিল, মি, ওয়েনকে খুন করার সময়ও ভুল করে। কি, ব্ৰাখটম্যান, অভিযোগটা তুমি অস্বীকার করবে?

না, বলে ব্রাশটম্যান তার হাতের অস্ত্র রানার দিকে তাক করল। মানুষ খুন। করে আমি আনন্দ পাই।

ওটা ফেলে দাও হে, তা না হলে মরবে।

রানাকে গাল দিল ব্রাখটম্যান, তবে ট্রিগার টেনে ধরার সময় পেল না। তার কপালে লাল একটা টিপ জুটল। বেরেটা ধরা হাতটা নিচু করলেন কাউন্ট, মাজল থেকে এখনও কালো ধোয়া বেরুচ্ছে। রানার দিকে ফিরে ক্ষমাপ্রার্থনার সুরে বললেন তিনি, কি, আপনাকে বলিনি, আমি একজন পোলিশ কাউন্ট? তবে অনেক দিন চর্চা নেই তো, জায়গামত লাগাতে পারি না।

হ্যাঁ, বলল রানা, দেখতে পাচ্ছি। লাগাতে চেয়েছিলেন হাতে, লাগল গিয়ে কপালে। তবে আমার ধারণা এই কাজটার পুরস্কার বাবদ রাজকীয় ক্ষমা অবশ্যই আপনি পাবেন।

.

জেটিতে পৌঁছে পুলিশ ইন্সপেক্টররা বিশপ, কার্লসন, এমনকি আহত গোলডার হাতেও হাতকড়া পরাতে চাইলেন। রানা তাদেরকে বোঝাল, কাউন্টকে এখন আর বিপজ্জনক বলে মনে করার দরকার নেই। কার্লসনের সঙ্গে কথা বলার অজুহাতে বাকি সবাইকে কেবিনের দিকে পাঠিয়ে দিল ও।

সবাই চলে যাবার পর কার্লসনকে বলল, হারবারের পানি ফ্রিজিং পয়েন্টের কাছাকাছি। হাতে হাতকড়া, গায়ে এত সব গরম কাপড়, পানিতে পড়লে ত্রিশ সেকেণ্ডের মধ্যে মারা যাবেন। কার্লসনের বাহু ধরে জেটির শেষ মাথায় নিয়ে এল রানা।

ব্রাখটম্যানকে আপনি ইচ্ছা করে মারলেন, তাই না? খসখসে গলায় জিজ্ঞেস করলেন কার্লসন।

অবশ্যই। আপনি তো জানেনই, ইংল্যাণ্ডে মৃত্যুদণ্ড নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এখানে ও-সব আইন অচল। গুডবাই, কার্লসন।

যীশুর কিরে! মেরির কিরে! ঈশ্বরের দোহাই! প্রায় চিৎকার করছেন কার্লসন। আপনাকে আমি কথা দিচ্ছি, এলিনার মা-বাবাকে ছেড়ে দেব…

আপনি নিজের কথা ভাবুন, কার্লসন। সারা জীবন জেলে পচবেন? তারচেয়ে কি ভাল নয় এটা?

হ্যাঁ। থরথর করে কাঁপছেন কার্লসন, কারণটা ঠাণ্ডা বাতাস নয়। হ্যাঁ।

.

কেবিনের পরিবেশ সম্পূর্ণ শান্ত। জানা কথা সবাই পরম স্বস্তিবোধ করছে। রানা। ফেরার আগেই ইন্সপেক্টর রবার্টসন পরিস্থিতির একটা ব্যাখ্যা দিয়েছেন সবাইকে।

ফার্গুসন মেঝেতে পড়ে আছে, ডান হাত দিয়ে ধরে রয়েছে বাম কাধ, ব্যথায় কাতরাচ্ছে। হিউমের দিকে তাকাল রানা, হিউম তাকাল ফার্গুসনের দিকে। আপনার কথামতই কাজ করেছি। কিন্তু বোতলটা ভেঙে গেছে।

দুঃখিত, বলল রানা, মানে স্কচটুকুর জন্যে। পামেলার দিকে তাকাল ও, ফেঁপাচ্ছে সে; তার পিঠে হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দিচ্ছে এলিনা, ওর চোখেও চিকচিক করছে পানি। কাঁদে না, মেয়েরা। বিপদ কেটে গেছে।

মি. মুর মারা গেছেন। পামেলা মুখ তুলে তাকাল, চশমার ভেতর লাল চোখ। দুটো ভেজা। পাঁচ মিনিট আগে।

জক মুরের জন্যে কেউ চোখের পানি ফেলবেন না। আমার কথা নয়, তার নিজের। তবু আমরা দুঃখিত।

মারা যাবার আগে মি. মুর একটা কথা বলে গেছেন, বলল পামেলা। বললেন: দয়ালু হিলারকে বলবেন…হিলার মানে নিশ্চয়ই আপনি?

রানা চুপ করে থাকল।

হিলারকে বলতে বলেছেন, তাঁর হয়ে হিলার যেন সবাইকে কোন একটা বারে স্কচ খাওয়ান।

খাওয়াব, তাঁর শেষ অনুরোধ আমাকে রক্ষা করতে হবে।

ইন্সপেক্টর সোরেনসন ঢুকলেন কেবিনে। স্যার, মি. রানা, ইভনিং স্টার। থেকে এক বাংলাদেশী মেজর রেডিওতে জানতে চাইছেন গহনাগুলোর খোঁজ পাওয়া গেছে কিনা। যদি পাওয়া গিয়ে থাকে, ইভনিং স্টারে ওগুলো লোড করার জন্যে তিনি তার লোকজনদের নিয়ে সকালে সোর-হামনায় চলে আসবেন কিনা।

হ্যাঁ, তাকে জানিয়ে দিন সকালে ওদেরকে আমি এখানে আশা করব।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *