স্বর্ণদ্বীপ ১

মাসুদ রানা ২২৯ – স্বর্ণদ্বীপ ১ – কাজী আনোয়ার হোসেন – সেবা প্রকাশনী
প্রথম প্রকাশ: ১৯৯৫

০১.

ট্রলার ইভনিং স্টার-এর সঙ্গে ওটার ক্যাপটেন আলবার্ট ডানহিল ও চীফ এঞ্জিনিয়ার আর্থার জেংকিনস-এর অদ্ভুত মিল লক্ষ করেছে মাসুদ রানা। উনিশশো ষাট সালে অর্থাৎ আজ থেকে ঠিক বিশ বছর আগে আর্কটিক স্টীম ট্রলার ইভনিং স্টারকে অকেজো ও বাতিল বলে ঘোষণা করা হয়েছিল, বয়েসের কথা মনে রাখলে প্রায় ওই একই সময়ে অবসর নেয়ার কথা ছিল ডানহিল আর জেংকিনসের। শান্ত সাগরেও নড়বড় করে ট্রলারটা, দেখে মনে হবে যে-কোন মুহূর্তে ভেঙে পড়বে, তবে এঞ্জিনটা আনকোরা নতুন, ভেতরের ডেকোরেশনেও বিলাসবহুল ইয়টের রূপ ও বৈশিষ্ট্য আমদানি করার চেষ্টা হয়েছে। ক্যাপটেন আর চীফ এঞ্জিনিয়ার সম্পর্কেও এই কথা বলা যায়-বাইরের চেহারা যা-ই হোক, ভেতরে ওদের প্রাণ-প্রাচুর্যের কোন অভাব নেই। ইভনিং স্টার বড় বেশি ফুয়েল খায়, আর ওঁরা দুজন প্রায় সারাক্ষণই স্কচ হুইস্কি গিলছেন।

ইভনিং স্টারের সাধারণ বিচরণ ক্ষেত্র বা গন্তব্য হলো আর্কটিক, কাজেই তুমুল ঝড়-ঝাপটা সহ্য করার মত করেই তৈরি করা হয়েছে ওটাকে। চিত্রতারকাদের নিয়ে এবারের অভিযানও আর্কটিকে, এই মুহূর্তে ওরা রয়েছে আর্কটিক সার্কেল-এর তিনশো মাইল উত্তরে। যথারীতি তুষার ঝড় শুরু হয়েছে গত তিন দিন আগে, কারণ মাসটা অক্টোবর। সেই যে শুরু হয়েছে তারপর আর থামার লক্ষণ নেই। তবে ক্যাপটেন ডানহিল তার চীফ এঞ্জিনিয়ারের সমর্থন পাবার পর আরোহীদের দৃঢ় আশ্বাস দিয়ে বলেছেন যে ইভনিং স্টারের ডুবে যাবার কোন ভয় নেই। হ্যাঁ, ক্যাপটেনের এটা একটা অভ্যাসই বলা যায়, প্রতিটি কথায় চীফ এঞ্জিনিয়ারের সমর্থন অথবা সংশোধন কামনা করা। দুজনেরই বয়েস সত্তরের ওপর, তবে ঠিক কত কেউ জানে না, বিভিন্ন জাহাজে প্রায় অর্ধ শতাব্দী এক সঙ্গে কাজ করেছেন, তারা যাকে বলে মানিক-জোড় বা হরিহর অন্যা।

প্রবল ঝড়ে ইভনিং স্টার সারাক্ষণ দুলছে আর ঝাঁকি খাচ্ছে, কিন্তু তা যেন ওঁরা খেয়ালই করছেন না। শুধু ওঁরা নন, ক্রু বা স্টুয়ার্ডদের মধ্যেও কারও কোন প্রতিক্রিয়া নেই। বিপদ হয়েছে আরোহীদের, প্রায় সবাই সী-সিকনেসে ভুগছে। সিনেমা জগতের লোকজন সব, এ-ধরনের অভিযানে সম্ভবত আগে কখনও বেরোয়নি, ভুগবেই তো। সী-সিকনেস তো আছেই, তার ওপর আছে ডুবে মরার ভয়, যতই না কেন অভয় দিন ক্যাপটেন। ডাইনিং সেলুনে উপস্থিত সবার উপর পালা করে চোখ বুলাচ্ছে রানা। এ-ধরনের অভিযানে আগেও বহুবার এসেছে ও, সী-সিকনেস কাকে বলে জানে না। নিজে একজন দক্ষ নাবিকও বটে ও, ডুবে মরার ভয় ওকে কাবু করতে পারছে না। তবে মনে মনে খুবই উদ্বিগ্ন। উদ্বিগ্ন দুটো কারণে। একটা কারণ নিয়ে এই মুহূর্তে অস্থির না হলেও চলে বলে ওর ধারণা। অপর কারণটা হলো, ইভনিং স্টারে যেহেতু একজন ডাক্তার হিসেবে রয়েছে ও, কারও অসুস্থতা মাত্রা ছাড়িয়ে গেলে তার চিকিৎসা করতে পারবে কিনা। কোন ডাক্তার যদি ভুল চিকিৎসা করে, তার ওপর লোকের সন্দেহ হওয়া স্বাভাবিক। এক্ষেত্রে পরিস্থিতি আরও ভীতিকর, কারণ রানাকে ডাক্তার নয় বলে। সন্দেহ করা হলে বেঁচে থাকা দায় হয়ে উঠবে ওর জন্যে।

ডাইনিং সেলুনটা টিক ফার্নিচার, কার্পেট আর পর্দা দিয়ে সুন্দর সাজানো। খাদ্য হিসেবে যা পরিবেশন করা হয়েছে তা-ও পাঁচ তারা হোটেলের সমমানের। কিন্তু খেতে বসে আরোহীরা প্রায় কেউই তেমন কিছু খেতে পারছে না।

বাইরে ফুঁসছে সাগর, ঝড়ের প্রচণ্ডতা আরও যেন বেড়েছে, যদিও পর্দা টেনে দেয়ায় কেউ কিছু দেখতে পাচ্ছে না। দেখতে না পেলে কি হবে, আন্দাজ করতে পারছে সবাই। একেকটা ঢেউ বিশ-পচিশ ফুটের কম নয়, মাঝে মধ্যে মনে হচ্ছে। ঢেউয়ের মাথা যেন চুম্বকের মত টেনে নিচ্ছে ইভনিং স্টারকে, পানির ঢাল বেয়ে ওপরে ওঠার সময় প্রায় পুরোপুরি কাত হয়ে যাচ্ছে জাহাজ। এই কাণ্ড চলছে আজ তিন দিন, বলা যায়, বিরতিহীনভাবে।

উপস্থিত সবার ওপর আবার একবার চোখ বুলাল রানা। এই পরিস্থিতিতে যে-কেউ জ্ঞান হারাতে পারে। প্রথমে ওর চোখ পড়ল ক্লাউস কেডিপাস-এর ওপর। সুদর্শন, দীর্ঘদেহী, মাথা ভর্তি সোনালি, কোঁকড়ানো, ঝাকড়া চুল। চেহারায় রোমান ছাপ স্পষ্ট। রানার অভিজ্ঞতা বলে বারবার বমি করতে থাকলে একজন লোকের চেহারা, সে যদি শ্বেতাঙ্গ হয়, হালকা সবুজাভ হয়ে উঠবে। কিন্তু কেডিপাসের বেলায়, তার মুখের রঙ হয়েছে কাঁচা আপেলের মত সবুজ। এরকম আগে কখনও হতে দেখেনি রানা। তবে এ-ব্যাপারে ওর কোন সন্দেহ নেই যে এটা নির্ভেজাল অসুস্থতার নির্ভেজাল লক্ষণ। হঠাৎ আরেকবার একটু জোরে ঝাঁকি। খেলো জাহাজ, সীট ছেড়ে লাফ দিল কেডিপাস, অল্প যে-টুকু শক্তি শরীরে অবশিষ্ট আছে তার সবটুকু কাজে লাগিয়ে ছুটল, কারও কাছ থেকে বিদায় না নিয়েই।

পাঁচশো সত্তর টনী জাহাজ ইভনিং স্টার, একশো পঁচাত্তর ফুট লম্বা। সাগর কতটুকু অশান্ত হলে এত বড় জাহাজটাকে নিয়ে লোফালুফি করতে পারে তা চিন্তার বিষয় বৈকি। মাত্র কয়েক সেকেণ্ড পরই এল পরবর্তী ঝাঁকি, আরও তিনজন আরোহী তড়িঘড়ি সীট ছেড়ে বেরিয়ে গেল বাইরে-দুজন পুরুষ, একটা মেয়ে। এভাবে আরও দুমিনিট কাটার পর দেখা গেল ক্যাপটেন ডানহিল, চীফ এঞ্জিনিয়ার জেংকিনস আর রানা ছাড়া ডাইনিং সেলুনে টিকে আছেন আর মাত্র দুজন-ফন গোলডা ও এরিক কার্লসন।

 খুব লম্বা দুটো টেবিলের দুই মাথায় যার যার নির্দিষ্ট আসনে বসে রয়েছেন। ক্যাপটেন আর চীফ এঞ্জিনিয়ার, অসুস্থ আরোহীদের শশব্যস্ত নির্গমন চাক্ষুষ করলেন, সামান্য অবাক হয়ে তাকালেন পরস্পরের দিকে, প্রায় একযোগে মাথা নাড়লেন, তারপর ধীর-স্থির ভঙ্গিতে আবার গ্লাস ভরে নিয়ে চুমুক দিলেন হুইস্কিতে।

ক্যাপটেন ডানহিলের চোখ দুটো উজ্জ্বল নীল, চোখে অন্তর্ভেদী দৃষ্টি। তাঁর কাঁধে কেশরের মত স্থূপ হয়ে আছে সাদা চুল। ডিনারের জন্যে যে টাইটা পরেছেন সেটা প্রায় পুরোটা ঢাকা পড়ে আছে পাকা দাড়িতে। ওই দাড়ি বাইবেলে বর্ণিত অনেক পয়গম্বরের ঈর্ষার কারণ হতে পারে। বরাবরের মত সোনার বোতাম লাগানো, ডাবল-ব্রেস্টেড জ্যাকেট পরেছেন; জ্যাকেটে লাগানো চার সারি মেডাল রিবনগুলোও ঢেকে রেখেছে তার দাড়ি। আপন মনে আরেকবার মাথা নাড়লেন তিনি, চেয়ারের পাশে ডেকের সঙ্গে গাথা লোহার ট্রলি থেকে বোতল তুলে নিয়ে নিজের গ্লাস ভরছেন। সামান্য একটু পানি মেশাতেই গ্লাস উপচে পড়ার অবস্থা হলো। আর ঠিক তখনই আবার একটা ঢেউয়ের মাথায় চড়তে শুরু করল ইভনিং স্টার। তরঙ্গের শীর্ষে উঠে ইতস্তত করছে জাহাজ, তারপর কাত হয়ে পতন শুরু হলো সামনের দিকে, সংঘর্ষ ঘটল ছুটে আসা পরবর্তী ঢেউয়ের সঙ্গে। ক্যাপটেন। ডানহিলের গ্লাস থেকে এক ফোটা হুইস্কিও ছলকায়নি। এই মুহূর্তে তিনি যেন তার লণ্ডন অফিসের কামরায় বসে রয়েছেন, যেখানে তাঁর সঙ্গে প্রথম দেখা হয় রানার। এক চুমুকে গ্লাসটা অর্ধেক খালি করে ফেললেন ভদ্রলোক, তারপর হাত বাড়ালেন পাইপটার দিকে। কেতাদুরস্ত ভঙ্গি বজায় রেখে সাগরে ডিনার খাওয়া চর্চাসাপেক্ষ একটা শিল্পই বলা যায়, বহুকাল আগেই তিনি তা রপ্ত করেছেন।

বোঝা গেল বিশেষ এই শিল্পটি ফন গোলডার আয়ত্তে নেই। তিনি তাকিয়ে আছেন ল্যাম চপ, সেদ্ধ সবজি, ভাজা আলু ও সাদা ওয়াইনের দিকে। ওগুলো যেখানে থাকার কথা সেখানে নেই, রয়েছে তার ন্যাপকিনে, আর ন্যাপকিনটা রয়েছে তার কোলের ওপর। ব্যাপারটা, নগণ্য হলেও, একটা সংকট। এবং যেকোন সংকটে নিজের খোশ-মেজাজ ধরে রাখতে সব সময় অসমর্থ হন ফন গোলডা। তবে তরুণ স্টুয়ার্ড বাক-এর জন্যে ব্যাপারটা রুটিন। তার নিজের ন্যাপকিন হাতেই ছিল, চোখের নিমেষে কোত্থেকে যেন একটা প্লাস্টিকের ছোট বালতিও জোগাড় করে ফেলল। নিপুণ হাতে সব পরিষ্কার করছে সে, চোখ নামিয়ে তার কাজ লক্ষ করছেন ফন গোলডা, চেহারায় রাজ্যের তিক্ততা।

বসা অবস্থায় তার আকার-আকৃতি হাতির সঙ্গেই বেশি মেলে। চওড়া কপাল, মাংসল চোয়াল, বিশাল কান, আণ্ডা-আণ্ডা চোখ। তবে শুধু দাঁড়ালে বোঝা যায় এলিভেটর জুতো পায়ে দিয়েও লম্বায় তিনি মাত্র পাঁচ ফুট দুইঞ্চি। দুশো চল্লিশ পাউণ্ড ওজন, ঘাড়ে-গর্দানে সমান, তবে হাত আর পা অত্যন্ত লম্বা ও সরু। তার কাপড়চোপড় গায়ে একেবারেই ফিট করেনি, সম্ভবত এরকম একটা বেঢপ আকৃতির মাপ নিতে গিয়ে দর্জি বেচারা হাল ছেড়ে দিয়েছিল। বাকের কাজ শেষ হলে মুখ তুলে ক্যাপটেনের দিকে তাকালেন তিনি। তার মুখের রঙ খয়েরি ও বেগুনির মিশ্রণ, এগুলোর সঙ্গে ক্ষীণ লালচে একটু ভাবও আছে। তবে এই মুহূর্তে বেগুনির পরিবর্তে লালচে ভাবটুকুই যেন বেশি ফুটেছে। তারমানে এই নয় যে তিনি রেগে আছেন, কারণ খোশ মেজাজ বজায় রাখতে যখন অসমর্থ হন তখনও তাকে রাগতে দেখা যায় না। অনেকে ধারণা করে রাগতে নাকি তিনি জানেনই। সত্যি কথা বলতে কি, ক্যাপটেন ডানহিল, আমি এর কোন অর্থ খুঁজে পাচ্ছি। বলতে পারেন, এরকম একটা ঝড়ের মধ্যে কেন আমরা এগোচ্ছি?

চীফ এঞ্জিনিয়ারের দিকে তাকালেন ক্যাপটেন ডানহিল, দ্বিতীয় টেবিলে রানার পাশে বসে রয়েছেন ভদ্রলোক। ফোর্স সেভেন, সম্ভবত, মি. জেংকিনস? খুব বেশি হলে ফোর্স এইটের কাছাকাছি?

ধীরেসুস্থে নিজের গ্লাসে হুইস্কি ভরলেন চীফ এঞ্জিনিয়ার জেংকিনস, তারপর হেলান দিলেন চেয়ারে। ক্যাপটেনের মত তার অবয়বও পাকা চুল-দাড়িতে প্রায় ঢাকা। খয়েরি রঙের চামড়া টান টান হয়ে থাকলেও অসংখ্য মিহি রেখা দেখে মনে হবে কোন শিল্পীকে দিয়ে গোটা মুখে নকশা তৈরি করানো হয়েছে। গলাটা লম্বা, মোটা মোটা সব রগ বেরিয়ে আছে। বেশ কয়েকটা মুহূর্ত পেরিয়ে গেল, তারপর সুচিন্তিত মতামত দিলেন তিনি, সেভেন।

সেভেন। বিনা দ্বিধায় তার হিসাব মেনে নিলেন ক্যাপটেন ডানহিল। তারপর মুখ ফিরিয়ে তাকালেন ফন গোলডার দিকে। শুনলেন তো? ফোর্স সেভেন। কিছু না, সামান্য বাতাস। এই মুহূর্তে ত্রিশ ডিগ্রী কাত হয়ে রয়েছে। টেবিলটা, সেটা অ্যাঁকড়ে ধরে চেয়ার থেকে নিজের পতন ঠেকাবার প্রাণপণ চেষ্টা করছেন ফন গোলডা, তাই জবাব দিতে পারলেন না। ঝড় কাকে বলে তা হাড়ে হাড়ে টের পাই প্রথম যে বার আমরা মাছ ধরার জন্যে বেয়ার আইল্যাণ্ডে গেলাম। উনিশশো ঊনচল্লিশ সালের কথা…।

আটত্রিশ, বললেন চীফ এঞ্জিনিয়ার।

উনিশশো আটত্রিশ সালের কথা। ফন গোলডা আর এরিক কার্লর্সনের দিকে। তাকালেন ক্যাপটেন। এরিক কার্লসন রোগা, ছোটখাট মানুষ। তার চেহারা সব সময় ম্লান। হাত দুটো মুহূর্তের জন্যেও স্থির হতে জানে না। হ্যাঁ, সেটাকে বলে ঝড়! অ্যাবারডিন থেকে আসা আরেকটা ট্রলার ছিল আমাদের সঙ্গে, আমি অবশ্য সেটার নাম ভুলে গেছি…

গোল্ড ফিশ, জেংকিনস বললেন।

হ্যাঁ, গোল্ড ফিশ। ফোর্স টেন চলছে, অচল হয়ে গেল ওটার এঞ্জিন। স্রোতের দিকে দুঘণ্টা আড়াআড়ি অবস্থায় ছিল, ঝাড়া দুঘণ্টা চেষ্টা করার পর তবে একটা লাইন ফেলতে পারি গোল্ড ফিশের ওপর। ওটার স্কিপার…ওটার স্কিপার…

ম্যাকফারসন। জন ম্যাকফারসন।

ধন্যবাদ, মি. জেংকিনস। তাঁর ঘাড় ভেঙে যায়। ভাঙা ঘাড় কাঠের ফালি দিয়ে সোজা রেখে বাঁধা হলো, তাঁকে আর তাঁর বোটকে টো করে আনলাম আমরা, ফোর্স টেনের ভেতর ত্রিশ মাইল-তার মধ্যে চার মাইল আসতে হয়েছে। ফোর্স ইলেভেন ঠেলে। ঈশ্বর, পাগল সাগর কাকে বলে তা যদি দেখতেন! ঢেউগুলো:..আমি তো বলব একেকটা পাহাড়। বো ত্রিশ ফুট উঁচু-নিচু হচ্ছে, মাঝে মধ্যে চরকির মত পাক খাচ্ছে বোট, ঘণ্টার পর ঘণ্টা। বমি করতে করতে শুকনো নাড়ি পর্যন্ত বেরিয়ে আসার অবস্থা সবার, শুধু আমি আর মি. জেংকিনস বাদে…। কার্লসন লাফ দিয়ে চেয়ার ছাড়ায় থেমে গেলেন তিনি। তাকিয়ে দেখলেন, সেলুন থেকে ছুটে বেরিয়ে গেলেন ভদ্রলোক, বাকি সবার মত বিদায় না নিয়েই।

আমরা কি নোঙর ফেলতে পারি না? কিংবা এ পরিস্থিতিতে আপনারা যা করেন এবার তা করলে হয় না? কাতর আবেদন জানালেন ফন গোলডা। নিশ্চয়ই কোথাও আশ্রয় নেয়া সম্ভব?

আশ্রয়? কিন্তু কি থেকে পালাতে চাইছেন আপনি? শুনুন তাহলে, আমার মনে পড়ছে…

ক্যাপটেন, বলল রানা, মি. গোলডা আর তার লোকজন সাগর সম্পর্কে আপনার মত অভিজ্ঞ নন।

তা ঠিক, তা ঠিক। নোঙর ফেলব? নোঙর ফেললে ঢেউ তো থামবে না। আর সবচেয়ে কাছের আশ্রয় জান মাইয়েন-তিনশো মাইল পশ্চিমে, ঝড়ের

আমরা ঝড়ের আগে আগে ছুটতে পারি। তা সম্ভব হলে এই অবস্থা থেকে নিশ্চয়ই রক্ষা পাব?

হ্যাঁ, তা আমরা পারি। ইভনিং স্টার শান্ত হয়ে যাবে, সন্দেহ নেই। ঠিক আছে, আপনি যখন তাই চাইছেন, মি. গোলডা। চুক্তিতেও তো তাই আছে, ভেসেলের কোন ক্ষতি না হলে সমস্ত নির্দেশ মেনে চলতে হবে ক্যাপটেনকে।

বেশ, বেশ। তাহলে আর দেরি নয়।

আপনি তো জানেনই, তাই না, মি. গোলডা, এই ঝড় আরও একটা দিন টিকতে পারে?

বর্তমান ভোগান্তির কথা ভুলে সামান্য একটু হাসলেন গোলডা। মা জননী প্রকৃতিকে তো আর আমরা আদেশ করতে পারি না।

আপনি এ-ও জানেন যে পুবদিকে আমাদেরকে প্রায় নব্বই ডিগ্রী বাঁক ঘুরতে হবে?

আমরা আপনার নিরাপদ হাতে থাকব, ক্যাপটেন।

আপনি আসলে ঠিক বুঝতে পারছেন না। এতে আমাদের দুটো, কিংবা হয়তো তিনটে দিন নষ্ট হবে। আর আমরা যদি পুবদিকে যাই, নর্থ কেপ-এর উত্তরে সাধারণত এদিককার চেয়ে খারাপ আবহাওয়াই দেখতে পাওয়া যায়। আশ্রয় পাবার জন্যে আমাদেরকে সম্ভবত হ্যামারফেস্ট-এ যেতে হবে। ওখানে আমরা এক হপ্তা আটকা পড়তে পারি, কিংবা হয়তো আরও বেশি। জাহাজের ভাড়া হিসেবে দৈনিক কত হাজার পাউণ্ড খরচ হচ্ছে আপনার, আমার জানা নেই। তারপর ধরুন, ক্রুদের বেতন আছে। আরও আছে আপনার টেকনিশিয়ানদের বেতন। আর নায়ক-নায়িকাদের কথা কি বলব, শুনতে পাই ওরা নাকি চোখের পলকে লাখ লাখ পাউণ্ড কামাতে পারে… হঠাৎ থামলেন ক্যাপটেন, চেয়ারটা পিছন দিকে ঠেললেন। এ আমি কি নিয়ে কথা বলছি? আপনার মত একজন মানুষের জন্যে টাকা কোন ব্যাপার হতে পারে না। মাফ করবেন, আমি ব্রিজে যাচ্ছি।

এক সেকেণ্ড! চেহারা দেখে মনে হলো এইমাত্র ফন গোলডার মাথায় বজ্রপাত হয়েছে। চলচ্চিত্র মহলে কড়া হিসেবী বলে কুখ্যাতি আছে তার, ক্যাপটেন ডানহিল নিজের অজান্তে ভদ্রলোকের সবচেয়ে স্পর্শকাতর নার্ভে খোঁচা দিয়ে বসেছেন। এক হপ্তা? পুরো একটা হপ্তা নষ্ট হবে?

ভাগ্য যদি আমাদের ভাল হয়, চেয়ারটা আবার টেবিলের কাছাকাছি টেনে আনলেন ক্যাপটেন ডানহিল, হাত বাড়ালেন হুইস্কির বোতলটার দিকে।

কিন্তু এরইমধ্যে আমি তিন দিন নষ্ট করেছি! ফন গোলডার হাত দুটো রানা দেখতে পাচ্ছে না, তবে ধারণা করল ওগুলো তিনি কচলাচ্ছেন। ব্যাকগ্রাউণ্ডের এক ফুট ছবিও তোলা হয়নি!

এদিকে আপনার ডিরেক্টর আর ক্রুরা চারদিন ধরে বিছানায়, ক্যাপটেনের গলায় সহানুভূতির সুর। দাড়ি ও চুলের আড়াল থাকায় বোঝা গেল না তিনি। হাসছেন কিনা। মা জননী প্রকৃতির খেয়াল, মি. গোলডা।

কার্কওয়াল থেকে রওনা হয়ে কার্কওয়ালে ফিরে যাওয়া পর্যন্ত তেত্রিশ দিনের বাজেট, বললেন ফন গোলডা। তিন দিন নষ্ট হয়েছে। আরও এক হপ্তা নষ্ট হবে। রীতিমত অসুস্থ দেখাল তাঁকে। শুধু আবহাওয়া নয়, অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের আশঙ্কাও কাবু করে ফেলছে তাকে। বেয়ার আইল্যাণ্ড আর কত দূরে, ক্যাপটেন ডানহিল?

কমবেশি তিনশো মাইল। সবচেয়ে ভাল গতিতে এগোতে পারলে আটাশ ঘণ্টার পথ।

ভাল গতি আপনি চালু রাখতে পারবেন?

ইভনিং স্টারের কথা আমি ভাবছি না। যে-কোন পরিস্থিতি সামাল দিতে পারবে এ-জাহাজ। চিন্তা আপনার লোকজনদের নিয়ে, মি. গোলডা। ব্যক্তিগত কিছু নয়, তবু না বলে পারছি না যে ওদের উচিত ছিল গ্রামের কোন পুকুর বেছে নেয়া।

হ্যাঁ, বুঝতে পারছি। ডক্টর রানা, আপনার অভিজ্ঞতা কি বলে? এ-ধরনের সী-সিকনেস থেকে সুস্থ হতে কি রকম সময় নেয় একজন লোক?

নির্ভর করে কতটুকু অসুস্থ সে, কিছু চিন্তা না করেই জবাব দিল রানা। কত দিন ধরে ভুগছে। খারাপ আবহাওয়ার ভেতর নব্বই মিনিটের ক্রস-চ্যানেল ট্রিপে আপনি অসুস্থ হয়ে পড়লে সুস্থ হতে সময় নেবেন দশ মিনিট। আটলান্টিকের ঝড়ে চার দিন খাবি খেলে সুস্থ হতে প্রায় ওইরকম অর্থাৎ চার দিন সময় লাগবে।

তবে সী-সিকনেসে কেউ কখনও আসলে মারা যায় না, কি বলেন?

 আমি অন্তত সেরকম কোন কেস পাইনি। প্রায়ই সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগেন। বলে লোকজন তার পিছনে হাসাহাসি করলেও, এই মুহূর্তে খানিকটা বিস্ময়ের সঙ্গে উপলব্ধি করল রানা, ফন গোলডা দৃঢ় ও কঠিন হতেও জানেন, যাকে প্রায়। নিষ্ঠুরতার পর্যায়ে ফেলা যায়। অন্তত শুধু সী-সিকনেস মৃত্যুর কারণ হতে পারেনা । কিন্তু কেউ যদি আগে থেকেই হার্টের অসুখে ভোগেন বা কারও যদি প্রবল হাঁপানি বা পেটে আলসার থাকে…হ্যাঁ, ওই রোগের সঙ্গে সী-সিকনেস যোগ হলে সে মারাও যেতে পারে।

কিছুক্ষণ চুপ থাকলেন ফন গোলডা, সম্ভবত তিনি তার লোকজনের শরীরস্বাস্থ্যের কার কি রকম অবস্থা ভেবে দেখছেন। তারপর বললেন, আমার ক্রু আর আর্টিস্টদের নিয়ে খুব চিন্তা হচ্ছে, ড. রানা। ওদেরকে একবার চেক করে দেখবেন নাকি, প্লীজ? টাকার চেয়ে সুস্থতা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ, তাই না? ছবি বানিয়ে আজকাল লাভ করা!

অবশ্যই, বলল রানা। এখুনি আমি চেক করে দেখব ওদের। গত পঁচিশত্রিশ বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রের ঘরে ঘরে পরিচিত নাম-ফন গোলডা। তার অনেক গুণ আছে, সন্দেহ নেই; সেই সঙ্গে প্রশংসাযোগ্য ভণ্ডামি আর কুট কৌশলেরও অধিকারী তিনি। সী-সিকনেসে কেউ মারা যায় না, প্রথমে এই কথাটা তিনি রানাকে দিয়ে বলিয়ে নিয়েছেন। এখন যদি বলে ও, টেকনিশিয়ান বা আর্টিস্টদের কারও এই আবহাওয়া সহ্য করার শক্তি নেই, তাহলে ফন গোলডা কার কি অসুখ আছে জানতে চাইবেন-প্রমাণ সহ। কারও যদি কঠিন কোন অসুখ থাকেও, রানার পক্ষে তা প্রমাণ করা সহজ কাজ হবে না-জাহাজে পরীক্ষা-নিরীক্ষার সুযোগ খুবই সীমিত। ব্রিটেন ত্যাগ করার আগেই কাজটা করা উচিত ছিল, কিন্তু তখন আবার তাড়াহুড়োর মধ্যে সময় পাওয়া যায়নি। এখন যদি রানা সবার স্বাস্থ্য ভাল বলে রায় দেয়, ফুল স্পীডে বিয়ার আইল্যাণ্ডে যাবার জন্যে চাপ দিতে পারবেন ফন গোলডা। যতই বলুন টাকার চেয়ে সুস্থতা বেশি গুরুত্বপূর্ণ, টাকা বাঁচানোর সুযোগ পেলে তিনি ছাড়বেন না। আর যদি দুর্ভাগ্যবশত কেউ মারা যায়, দায়ী করা হবে রানাকে। আপনি এখানেই থাকছেন তো? চেয়ার ছাড়ল ও।

হ্যাঁ, অবশ্যই। আপনার সহযোগিতার কথা ভুলব না, ড. রানা। আপনি খুবই বুঝদার মানুষ।

উই নেভার ক্লোজ, বলল রানা।

.

চ্যাঙ ওয়েনকে পছন্দ করতে শুরু করেছে রানা, যদিও তার সম্পর্কে প্রায় কিছুই ওর জানা নেই। তাকে অবশ্য জানার কথাও নয় ওর, অন্তত ভালভাবে জানার। পেশাগত দৃষ্টিতে, অর্থাৎ একজন ডাক্তার হিসেবে, এই লোকের সঙ্গে ওর ঘনিষ্ঠতা থাকাটা খুবই বেমানান। পায়ে কার্পেট পিপার পরা অবস্থায় পাঁচ ফুট তিন ইঞ্চি লম্বা সে, ওজন একশো পঞ্চাশ পাউণ্ডের বেশি হবে তো কম নয়, শরীর মানে ইস্পাতের তৈরি পেশীর সমষ্টি-এরকম লোক ঘন ঘন ডাক্তারের চেম্বারে পায়ের ধুলো ফেলে না।

ফাস্ট-এইড কেবিনেটে দেখুন, যা খুঁজছেন পেয়ে যাবেন। হুইলহাউসে আলো খুব কম, ইঙ্গিতে রানাকে এক কোণের কাবার্ডটা দেখিয়ে দিল সে। ক্যাপটেন ডানহিলের নিজস্ব দাওয়াই। শুধু ইমার্জেন্সীর সময় ব্যবহার করেন।

কাবার্ডে বোতল রয়েছে বারোটা, একটা বের করে চার্ট-টেবিলের ল্যাম্পের আলোয় পরীক্ষা করল রানা। অত্যন্ত দামী ব্র্যাণ্ডি–Otard-Dupuy VSOP, পৃথিবীর উত্তর প্রান্তের হিম ঠাণ্ডা পরিবেশে একটা ট্রলারে এ জিনিস আশা করা যায় না। ওয়েনের ওপর রানার ভক্তির মাত্রা আরও একচুল বাড়ল। ইমার্জেন্সী বলতে কি বোঝাতে চায়?

শুকনো গলা।

ছোট একটা গ্লাসে সামান্য ব্র্যাণ্ডি ঢেলে ওয়েনকে সাধল রানা, কিন্তু সে মাথা নাড়ল। নিজেই চুমুক দিল ও, গ্লাসটা সাবধানে নামাল। শুকনো গলা ভেজাবার জন্যে এ জিনিস নষ্ট করা একটা জঘন্য ক্রাইম, বলল রানা। ক্যাপটেন ডানহিল যদি দেখে ফেলেন তাঁর রিজার্ভ হালকা করে দিচ্ছি…

সব কাজে নির্দিষ্ট রুটিন মেনে চলেন ক্যাপটেন। এই সময় তাঁর ব্রিজে আসার কথা নয়-রাত আটটার পর কোনদিনই আসেন না। রাতে আমি আর গ্যাবন দায়িত্বে থাকি-গ্যাবন, পেটি অফিসার। আপনি বোধহয় জানতেন, এখানে। ভিএসওপি পাওয়া যাবে, তাই না? নাকি এখানে আসার অন্য কোন কারণ আছে?

আসলে ডিউটিতে বেরিয়েছি। মি. গোলডার বেতনভুক ক্রীতদাসদের স্বাস্থ্য পরীক্ষার আগে আবহাওয়ার খবর চাই। তঁার ভয়, এই দুর্যোগের ভেতর জাহাজ যদি কোর্স বজায় রাখে তার লোকজন পটাপট মরতে শুরু করবে। আবহাওয়ার অবস্থা, রানা লক্ষ করল, আগের চেয়ে আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে।

 মি. গোলডার আসলে উচিত ছিল আপনাকে বাদ দিয়ে একজন হস্তরেখাবিদকে আনা। শিক্ষিত মানুষ ওয়েন, বোঝা যায় তার বুদ্ধিতেও ধার আছে যথেষ্ট, তারপরও তাকে দেখে মনে হবে কি একটা কারণে যেন ভারি কৌতুক বোধ করছে সে। সন্ধে ছটার রিপোর্টে বলা হয়েছে, আবহাওয়ার অবস্থা আরও খারাপ হবে কি ভাল হবে তা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না।

হেসে ফেলল রানা। আপনার কি ধারণা?

আমি ভাল কিছু আশা করি না। ঘণ্টাখানেক হাঁটাহাঁটি করে ফিরে যান, মি. গোলডাকে বলুন সবাই বহালতবিয়তে আছে, ল্যাঠা চুকে যাক।

আমার ধারণা, মি. গোলডা সন্দেহপ্রবণ মানুষ। তিনি হয়তো চেক করে দেখবেন। হাউএভার, ইফ আই মে…?

মাই গেস্ট, ডক।

ব্র্যাণ্ডির বোতল থেকে আবার খানিকটা নিজের গ্লাসে ঢালল রানা, তারপর বোতলটা কাবার্ডে তুলে রাখল। আগেই ওকে সাবধান করা হয়েছে-ওয়েন কথা। খুব কম বলে। তবে নিস্তব্ধতার ভেতরও পরস্পরের সঙ্গ উপভোগ করছে ওরা। তারপর এক সময় ওয়েনই মুখ খুলল, আমার ঠিক জানা নেই, তবে আন্দাজ করতে পারি-রয়্যাল নেভী, তাই না?

কথা না বলে রানা শুধু মাথা নাড়ল।

দুঃখিত, বোধহয় অনধিকার চর্চা হয়ে গেল, সকৌতুকে হাসল ওয়েন। তা, আপনার এই মি. ফন গোলডা। মানে, উনি সুস্থ তো?

বীমা কোম্পানীর ডাক্তাররা তো তাই ভাবছেন।

আমি ঠিক তা বোঝাতে চাইনি।

আপনি নিশ্চয়ই আশা করেন না, যার নিমক খাব তারই কুৎসা গাইব?

ওয়েনের সাদা দাঁত আবার ঝিক করে উঠল। এক অর্থে আমার প্রশ্নের উত্তর দিলেন আপনি। তবে যা-ই বলুন, ভদ্রলোক কিন্তু সত্যি খেপাটে…শব্দটা আবার অফেনসিভ নয় তো?

অফেনসিভ, তবে শুধু সাইকিয়াট্রিস্টদের কাছে। খেপাটে মানুষদের বিরুদ্ধে আমার কোন অভিযোগ নেই। আমি শুধু আপনাকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, তার রেকর্ড খুব ভাল।

একজন খেপাটে হিসেবে?

ফিল্ম-মেকার ও প্রডিউসার হিসেবেও।

শীত আসছে, এই সময় কোন প্রডিউসার ফিল্ম ইউনিট নিয়ে বেয়ার আইল্যাণ্ডে আসে?

মি. গোলডা তাঁর ছবিতে বাস্তবতা ফোটাতে চান।

খারাপ একটা গাল দিতে ইচ্ছে করছে আমার, সহাস্যে বলল ওয়েন। অনেক কষ্টে সামলে রাখছি নিজেকে। আসল কথা, বছরের এই সময়টায় ওখানকার অবস্থা সম্পর্কে তার কোন ধারণা নেই।

তিনি একজন স্বাপ্নিকও বটেন।

ব্যারেন্ট সীতে স্বপ্নবিলাসীদের ঠাই নেই। আমেরিকানরা যে কী!

কে বলল ফন গোলডা আমেরিকান? সেন্ট্রাল ইউরোপিয়ান। স্বপ্ন রচনা করেন বা স্বপ্ন ফেরি করেন, এরকম লোক পেতে হলে দানিয়ুবের দুই তীরের দিকে তাকাতে হবে আপনাকে।

ইউরোপের অসৎ আর অসুরদেরও ওখানে দেখতে পাবেন আপনি।

হ্যাঁ, ভাল আর মন্দ, দুইই আছে।

কিন্তু দানিয়ুব ছেড়ে অনেক দূরে চলে এসেছেন ভদ্রলোক।

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের আগের সময় সেটা। ভিয়েনা ছেড়ে বহু লোককে তাড়াহুড়োর মধ্যে পালাতে হয়েছিল, তাদের মধ্যে উনিও ছিলেন। পালিয়ে আমেরিকা ছাড়া আসবেনই বা কোথায়? আর আমেরিকায় এলে হলিউড ছাড়া যাবেনই বা কোথায়? ভিয়েনায় তার জমজমাট সিনেমা ব্যবসা ছিল, আমেরিকায় এলেন প্রায় খালি হাতে। ঠিক সময়ে ঠিক কাজটি করতে জানা তার মস্ত এক গুণ। নাৎসী বিরোধী ছবি বানালেন, তারপর দর্শকদের সাইকোলজি বুঝে কমিউনিজম বিরোধী। আমেরিকানরা তাকে লুফে নিল। কিন্তু যে-ই দেখলেন হলিউডের পড়তি দশা, অমনি তিনি হিজরত করলেন ইংল্যাণ্ডে। লণ্ডনে এসে তিনি যে ছবিগুলো বানালেন, সমালোচকরা দারুণ প্রশংসা করলেও দর্শকরা একেবারেই নিল না। সর্বস্বান্ত হয়ে গেলেন ভদ্রলোক।

আপনি দেখা যাচ্ছে তার সব খবরই রাখেন।

তার শেষ ছবিটার প্রসপেক্টাস পড়লে যে-কেউ এ-সব জানতে পারবে। আপনাকে এক কপি দেব আমি। ছবিটা সম্পর্কে কিছু বলা হয়নি, শুধু ফন গোলডার কথা পাবেন। যা লেখা আছে তার ভেতরের অর্থ বুঝে নিতে হবে আপনাকে।

কপিটা পেলে খুশি হব, বলল ওয়েন। কিছুক্ষণ চিন্তা করল সে, তারপর জিজ্ঞেস করল, সর্বস্বান্ত হবার পর আবার ছবি বানাচ্ছেন কিভাবে?

একবার নাম করতে পারলে টাকা যোগাবার লোকের অভাব হয় না।

তা আপনার বন্ধুকে টাকা যোগাচ্ছেন কে?

বন্ধু না, এমপ্লয়ার। আমি জানি না। টাকা-পয়সার ব্যাপারে কড়া গোপনীয়তা রক্ষা করেন মি. গোলডা।

কিন্তু কেউ না কেউ তো পৃষ্ঠপোষকতা করছেনই, তাই না?

হ্যাঁ, তা তো বটেই। হাতের গ্লাস নামিয়ে রেখে উঠে দাঁড়াল রানা। আতিথেয়তার জন্যে ধন্যবাদ।

একের পর এক এতগুলো ছবি ফ্লপ করার পরও? কেমন যেন রহস্যময় লাগছে না?

গোটা ফিল্মী জগৎটাই মস্ত এক রহস্য, মি. ওয়েন।

কিংবা তিনি হয়তো এমন একটা গল্প পেয়েছেন, যেটা সব গল্পকে হার মানাবে।

আপনি দেখছি স্ক্রীনপ্লে-র প্রসঙ্গ তুলে ফেললেন। এ-ব্যাপারে জানতে হলে সরাসরি মি, গোলডাকে প্রশ্ন করতে হবে আপনার। মি. এরিক কার্লসন ছাড়া একমাত্র তিনিই ওটা দেখেছেন। মি. কার্লসন হলেন স্ক্রীন-প্লের লেখক।

হুইল-হাউস থেকে বেরিয়ে এসে রানা দেখল, আবহাওয়ার অবস্থা সত্যিই আগের চেয়ে খারাপ হয়েছে। লী সাইডের স্টারবোর্ড মই বেয়ে নামছে রানা। লী সাইড হলো জাহাজের সবচেয়ে নিরাপদ দিক, কারণ ঝড় আঘাত করছে উল্টো দিকটায়, কিন্তু তা সত্ত্বেও বাতাসের গতি আর প্রচণ্ড শীত আতঙ্কিত করে তুলল। ওকে, মই বেয়ে নামার সময় দুই হাতে ধরে থাকল হ্যাণ্ডরেইল। ইভনিং স্টারের ঝাঁকি ও দোল খাওয়ার মধ্যে কোন নিয়ম বা ছন্দ নেই, মাতালের মত যখন যেদিকে খুশি লাফ-ঝাপ দিচ্ছে। বো মাঝে মধ্যে পঞ্চাশ ডিগ্রী ঘুরে যাচ্ছে, আংশিক বৃত্ত তৈরি করার ভঙ্গিতে। নিজেকে অভয় দিল রানা-তুমি তো একশো ডিগ্রী ঘুরে গেছে এমন জাহাজেও ছিলে, কিন্তু আজও বেঁচে আছ। তবে হ্যাঁ, সঙ্গে আরও এক জোড়া হাত থাকলে সুবিধে হত।

রাত যতই ঘন কালো হোক, সাগর কখনও পুরোপুরি অন্ধকার হয় না। এই যেমন আজ। দিগন্তের ঠিক কোথায় সাগর আর আকাশ মিলিত হয়েছে তা হয়তো চিহ্নিত করা সম্ভব নয়, তবে দিগন্তরেখার কয়েক ডিগ্রী ওপরে বা নিচে তাকিয়ে। যে-কেউ নিশ্চিতভাবেই বলতে পারে যে এখানে আকাশ আর ওখানে সাগর, কারণ সাগর সব সময় আকাশের চেয়ে বেশি গাঢ়। আজ রাতে অবশ্য তা-ও বলা সম্ভব নয়, কারণ সাগরের সারফেসে লেগে রয়েছে স্মোক ফ্রস্ট। এই অদ্ভুত বিচিত্র জিনিসটা শুধু তখনই দেখা যায় যখন আটলান্টিকের গরম বাতাস আর্কটিকের ঠাণ্ডা পানির সঙ্গে মেশে। এই মুহূর্তে রানা শুধু দেখতে পাচ্ছে প্রতিটি ঢেউ থেকে বিচ্ছিন্ন হচ্ছে উপরের অংশ। ওদের লীওয়ার্ড সাইডে লম্বা সাদা রেখা দেখা যাচ্ছে। সারি সারি, ঢেউয়ের মাথা ভেঙে যাওয়ায় ফেনা তৈরি হচ্ছে। আরও দেখল, ইভনিং স্টারের ফোরডেকে উঠে আসছে সাগর।

মই বেয়ে নেমে এগোতে যাবে রানা, কার সঙ্গে যেন ধাক্কা খেলো। মইয়ের পিছনে দাড়িয়ে, ওটাকেই অ্যাঁকড়ে ধরে তাল সামলাচ্ছে। বাতাসে ওড়া চুল মুখটা সম্পূর্ণ আড়াল করে রেখেছে, চিনতে পারা গেল না। তার অবশ্য দরকারও নেই, কারণ গোটা জাহাজে একজনেরই চুল ঠিক যেন পাকা ধানের খড়। যদি বেছে নিতে বলা হয় ওকে, ইভনিং স্টারের কার সঙ্গে ধাক্কা খেতে পছন্দ করবে, কিছু। চিন্তা না করেই এলিনা স্টুয়ার্ট-এর নাম বলবে রানা। এলিনা স্টুয়ার্ট তার আসল নাম নয়, আসল নাম সাবরিনা জেরোনস্কি। আসল নামটা সিনেমা জগতে মানানসই হবে না বুঝতে পেরে এই পরিবর্তন। তবে এত থাকতে একটা স্কটিশ নাম কেন তার পছন্দ হলো, রানা তা বলতে পারবে না।

এলিনা, বলল রানা। এত রাতে, এই দুর্যোগের ভেতর না বেরুলেই তো পারতেন। হাত তুলে তার মুখ স্পর্শ করল ও, ডাক্তার হবার সুবিধে হলো খুন করেও পার পাওয়া যায়। এলিনার ত্বক বরফের মত ঠাণ্ডা। ভেতরে চলুন, ভেতরে চলুন! তার একটা বাহু অ্যাঁকড়ে ধরল ও। হাতটা থরথর করে কাঁপছে অনুভব করে একটুও অবাক হলো না। বাধা দেয়নি, লক্ষ্মী মেয়ের মতই ফিরে আসছে রানার সঙ্গে।

সামনেই একটা দরজা, প্যাসেঞ্জার লাউঞ্জের দিকে চলে গেছে। প্যাসেঞ্জার লাউঞ্জটা সরু হলেও, জাহাজের পুরোটা প্রস্থ জুড়ে বিস্তৃত। শেষ মাথায় একটা বার, পানীয় রাখা হয়েছে কাঁচ ও গ্রীল দিয়ে ঘেরা দরজার পিছনে। দরজাগুলোয় তালা দেয়া থাকে, চাবি থাকে ফন গোলডার পকেটে।

আমাকে টানাহ্যাঁচড়া করার কোন দরকার নেই, ডাক্তার, শান্ত, মিষ্টি গলায় বলল এলিনা। আমি তো স্বেচ্ছায় আপনার সঙ্গে আসছি।

আগে বলুন এই অবস্থায় আপনি বাইরে বেরিয়েছিলেন কেন?

তারমানে কি ডাক্তাররা সবজান্তা নন? কালো লেদার কোটের মাঝখানের বোতামটা ছুঁলো এলিনা। তবে রানা ধারণা করল বমি করার প্রয়োজন না হলেও ঠাণ্ডা আপার ডেকে বেরুত মেয়েটা-সে কারও সঙ্গে বিশেষ কথা বলে না, অন্যেরাও তাকে এড়িয়ে চলে।

মুখ থেকে দুহাত দিয়ে চুল সরাল এলিনা। খয়েরি চোখের নিচে ক্লান্তির কালিমা জমেছে। হোক ল্যাটভিয়ান পাভ, মেয়েটা দেখতে ভারি সুন্দর। সবাই কথাটা মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করলেও, সঙ্গে একটা মন্তব্য জুড়ে দেয়-ওটাই তার একমাত্র সম্পদ। তার শেষ দুটো ছবি বা তার প্রথম দুটো ছবি সাংঘাতিক মার খেয়েছে। মেয়েটা চুপচাপ, একা, ঠাণ্ডা আর নির্লিপ্ত-রানার ভাল লাগার সেটাই কারণ। ও নিজেও তো একা।

 ডাক্তাররা ফেরেশতা নয়, বলল রানা। অন্তত ইনি নন। ডাক্তারী দৃষ্টিতে এলিনার দিকে তাকাল ও। দুনিয়ার এই প্রান্তে একটা ভাসমান পাগলা গারদে কি করছেন আপনি?

ইতস্তত করল এলিনা। প্রশ্নটা ব্যক্তিগত হয়ে গেল।

মেডিকেল প্রফেশনে এটাই তো সুবিধে, ব্যক্তিগত বিষয়ে যে-কোন প্রশ্ন করা যায়। আপনার শরীর-স্বাস্থ্য ভাল তো?

আমি এখানে, কারণ আমার টাকা দরকার।

যদি কখনও আমাকে দরকার হয়, জানাতে ভুলবেন না। হাসল রানা, কিন্তু এলিনা হাসল না। তাকে রেখে কম্প্যানিয়নওয়ে ধরে মেইন ডেকের দিকে এগোল ও।

দুপাশে সারি সারি কেবিন, মাঝখানে সরু প্যাসেজ। আগে এখানেই ছিল ফিশ হোল্ড, স্টীম ওয়াশ করার পরও কড লিভার অয়েলের গন্ধ পুরোপুরি দূর হয়নি। সী সিকনেসে আক্রান্ত হবার দরকার নেই, এমনিতেই বমি পাবে। স্টারবোর্ড সাইডের প্রথম দরজায় নক করে ভেতরে ঢুকল রানা।

এরিক কার্লসন তাঁর বাঙ্কে লম্বা হয়ে আছেন। সরু বুকের ওপর মোমের মত আঙুলগুলো পরস্পরের সঙ্গে জড়িয়ে আছে, চোখ বন্ধ। দেখে বিশ্বাস করা কঠিন এই ভদ্রলোক পুব সাইবেরিয়ায় সোভিয়েত শ্রমশিবিরে বিশ বছর কাটিয়েছেন। কেমন আছেন, মি. কার্লসন?

হায় ঈশ্বর! চোখ মেললেন কার্লসন, তবে রানার দিকে তাকালেন না। গুঙিয়ে উঠলেন একবার, তারপর আবার বন্ধ করলেন চোখ। এর কোন মানে হয়!

দুঃখিত। মি. গোলডা খুবই উদ্বিগ্ন…।

ও তো একটা বদ্ধ উন্মাদ! হঠাৎ ফুসে উঠলেন কার্লসন।

কার্লসনের মন্তব্যের সঙ্গে প্রায় একমত হলেও, ফন গোলডার চাকরি নিয়ে। ইভনিং স্টারে আসায় কথা বলার সময় সাবধান হতে হয় রানাকে। বিশেষ করে কালর্সনের সঙ্গে কথা বলার সময়। কারণ কার্লসন আর গোলডা পরস্পরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। পরস্পরকে তারা চেনেন পঁয়তাল্লিশ বা পঞ্চাশ বছর আগে থেকে, সেই দানিউবিয়ান একটা জিমনেশিয়ামে যখন ছাত্র ছিলেন। ভিয়েনায় যৌথ মালিকানায় ওঁদের একটা স্টুডিও ছিল। ওই স্টুডিওতে কাজ করার সময়ই পরস্পরের সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায় তাদের। গোলডা সঠিক পথ ধরে আশ্রয় নেন হলিউডে। আর কার্লসন ধরেন ভুল পথ। ধারণা করা হয়েছিল মারা গেছেন তিনি। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে বছর তিনেক হলো সাইবেরিয়া থেকে ফিরে আসেন। গোলডাকে খুঁজে বের করেন তিনি, বন্ধুত্বটা আবার তারা ঝালাই। করে নেন। ধারণা করা হয়, কার্লর্সনের অতীত সম্পর্কে একমাত্র গোলড়াই যদি কিছু জানেন, কারণ কার্লসন এ-বিষয়ে কখনও কারও সঙ্গে আলাপ করেন না। ভদ্রলোক সম্পর্কে নিশ্চিতভাবে মাত্র দুটো বিষয় জানা গেছে-নিঃসন্দেহে উনিই। এরিক কার্লসন, যুদ্ধের আগে দশ-বারোটা স্ক্রীন-প্লে লিখে বেশ নাম করেছিলেন। আর্কটিকে ছবি তুলতে আসার ব্যাপারটা তারই আইডিয়া, গোলডাকে প্রয়োজনীয় প্রেরণা তিনিই যুগিয়েছেন। আর দ্বিতীয় যে কথাটা জানা গেছে, তা হলো, গোলডা তার বন্ধুকে নিজের কোম্পানী মার্ভেলাস প্রোডাকশনে অংশীদার হিসেবে গ্রহণ করেছেন। কাজেই, এই পরিস্থিতিতে, কার্লসন যা-ই বলুন না কেন, নিজের কথা নিজের কাছেই চেপে রাখতে হবে রানাকে। আপনার যদি কিছু দরকার হয়…

কিছুই দরকার নেই। এবার চোখ খুলে রানার দিকে তাকালেন কার্লসন। তাকালেন না বলে অগ্নিদৃষ্টি হানলেন বলাই ভাল। চোখ দুটো লালচে হয়ে আছে। আপনি বরং ওই পাগলটার চিকিৎসা করুন, যদি পারেন।

চিকিত্সা?

ওর ব্রেন সার্জারি দরকার। চোখ বুজে কাত হলেন কার্লসন। তাঁকে রেখে বেরিয়ে এল রানা, চলে এল পাশের কেবিনে।

এখানে দুজন রয়েছেন। একজন খুবই কষ্ট পাচ্ছেন, অপরজন বিন্দুমাত্র ভুগছেন না। অসুস্থ রবার্ট হ্যামারহেড, ফিল্ম কোম্পানীর ইউনিট ডিরেক্টর। রানার। দিকে তাকিয়ে স্নান হাসলেন তিনি, প্রায় ক্ষমা প্রার্থনার ভঙ্গিতে, তারপর ফিরিয়ে নিলেন চোখ। রোগাপাতলা তিনি, মুখে উঁচু হয়ে আছে হাড়, কি কারণে কে জানে সারাক্ষণ নার্ভাস থাকেন। তবে নিজের কাজের প্রতি পুরোপুরি নিবেদিত। তাঁকে এরকম অসুস্থ দেখে দুঃখ হলো রানার, তবে ভদ্রলোক ইভনিং স্টারে পা দেয়ার পর থেকেই তার জন্য এই একই অনুভূতি রয়েছে রানার মনে। হ্যামারহেড কথা বলেন ফিসফিস করে, বিড়ালের মত নিঃশব্দে হাঁটেন, যেন সব সময় ভয়ে ভয়ে থাকেন ঈশ্বর না তার ওপর বিরক্ত হন। তার এই আচরণ অর্থহীন বলে মনে হতে পারে, তবে রানার তা মনে হয় না-কোন সন্দেহ নেই, ঈশ্বরকে নয়, তার ভয় আসলে ফন গোলডাকে। গোলডা স্পষ্টই বুঝতে দেন যে তিনি মানুষ হিসেবে লোকটাকে যতটুকু অপছন্দ করেন, একজন আর্টিস্ট হিসেবে ঠিক ততটুকুই পছন্দ করেন। গোলড়া একজন উঁচু স্তরের বুদ্ধিমান মানুষ হওয়া সত্ত্বেও কেন যে এধরনের ব্যবহার করেন রানার তা জানা নেই। কার ভেতর কি আছে কে জানে, গোলডা হয়তো গোটা মানবজাতিকেই ঘৃণা করেন, দুর্বল কাউকে পেলে তার ওপর নির্যাতন চালাবার জন্মগত ঝোকটা দমন করতে পারেন না। বলা যায় না, ব্যক্তিগত কোন আক্রোশ বা রেষারেষির ব্যাপারও হতে পারে। দুজনের কারও সম্পর্কেই বেশি কিছু জানা নেই রানার, কাজেই কারও পক্ষে বা বিপক্ষে কিছু বলার নেই ওর।

ও, আপনি আমাদের গুড হিলার, পিছন থেকে ভারি একটা গলা পেল রানা। ব্যস্ত না হয়ে ঘুরল ও, তাকাল পাজামা পরা ভদ্রলোকের দিকে। বাঙ্কে বসে আছেন তিনি, বাঁ হাতে ধরে আছেন একটা বাল্কহেড স্ট্র্যাপ, ডান হাতে স্কচের একটা বোতল, চার ভাগের তিন ভাগ খালি। দুএক চুমুক চলবে নাকি, মি. রানা?

পরে, মি. মুর, পরে। আপনাকে ডিনারে না দেখে ভাবলাম…আপনি আছেন কেমন, মি. মুর?

মারভেলাস প্রোডাকশনের প্রোডাকশন ম্যানেজার জক মুর। চোখ দুটো স্বচ্ছ নীল, মুখে কাটা-ছেড়ার কোন দাগ নেই। ইভনিং স্টারে পা দেয়ার পর থেকে তাকে যতবারই দেখেছে রানা, হাতে সব সময় স্কচের বোতল ছিল। তার মস্ত গুণ হলো, কারও নিন্দা করতে জানেন না। আমি? কেমন আছি? মাথা পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রী কাত করলেন তিনি, পাকা দাড়ি থেকে ঝরে পড়ল কয়েক ফোটা হুইস্কি। অসুস্থতা কাকে বলে জানি না। ও কিসের শব্দ? কান পেতে কি যেন শোনার। চেষ্টা করলেন।

অশান্ত সাগরে বো আছড়ে পড়ার আওয়াজ পাচ্ছে রানা, তার সঙ্গে তাল মেলাচ্ছে পুরানো জাহাজের কর্কশ কাঁচকাচ আওয়াজ, তাছাড়া আর কিছু রানার কানে ঢুকল না।

কান পাতুন, তিন দেবতা গাইছেন!

এবার রানাও শুনতে পেল। আগেও অনেকবার শুনেছে ও, বলা যায় সেই ইভনিং স্টারে পা দেয়ার পর থেকেই শুনছে। ফিলিপ, নেকটার আর কার্লতিনজনের একটা ব্যাণ্ড, নাম দিয়েছে তিন দেবতা। তিনজনই তাদের অবসর সময় রিক্রিয়েশন রুমে কাটায়। হয় রেকর্ডিং ইকুইপমেন্ট নিয়ে ব্যস্ত থাকে নয়তো গিটার বা ড্রাম বাজায়। কাঁধ পর্যন্ত লম্বা চুল সবার, কাপড়চোপড়ের বাহার দেখলে মনে হবে যাবতীয় হিন্দু গুরুদের লন্ড্রি লুট করে এনেছে। এরকম দুর্যোগের রাতে গান-বাজনা কি কারও ভাল লাগে? বলল রানা।

ডাক শুনে অনেক আরোহী জড়ো হয়েছে ওখানে, বললেন মুর। আমার জানামতে গান-বাজনা অনেক সময় ওষুধের কাজও করে। বাইরে থেকে অকস্মাৎ ড্রাম পেটানোর আওয়াজের সঙ্গে তীক্ষ্ণ একটা আর্তনাদ ভেসে এল, যেন কোন প্রাণী কাতরাচ্ছে। ওই বোধহয় ওদের কনসার্ট শুরু হলো।

ওখান থেকে সোজা রিক্রিয়েশন রুমে চলে এল রানা। তিন দেবতাকে ঘিরে আছে মাইক্রোফোন, অ্যামপ্লিফায়ার, স্পীকার আর অসংখ্য ইলেকট্রনিক ইকুইপমেন্ট, যেগুলো ছাড়া কানের পর্দা ছিন্ন করা যায় না। তিন দেবতা অনবরত লাফ-ঝাপ দিচ্ছে, সেই সঙ্গে দাত-মুখ খিচিয়ে গলা ফাটাচ্ছে, অর্থাৎ নাচ ও গান চলছে সমানে।

শ্রোতাদের দিকে তাকাল রানা। প্রোডাকশনের লোক রয়েছে দশজন, বাকি পাঁচজন অভিনেতা-অভিনেত্রী। সবাই হাঁ করে তাকিয়ে আছে দেবতাদের দিকে। এদের মধ্যে কেউ যদি অসুস্থ হয়ও, সে-কথা আপাতত তার মনে নেই। কাঁধে হাত পড়তে ঘাড় ফিরিয়ে ডগলাস হিউমের দিকে তাকাল রানা।

হিউমের বয়েস ত্রিশ, ছবিতে তার চরিত্রই মুখ্য। তারকা হিসেবে এখনও খ্যাতি অর্জন করতে পারেনি বটে, তবে তার অভিনয়ের প্রশংসা ধীরে ধীরে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। হাসি-খুশি তরুণ সে, সুদর্শন, বাদামী চুল সব সময় ঝুলে আছে চোখের ওপর। তার চোখের রঙ গাঢ় নীল, নিখুঁত দাঁতগুলো মুক্তোর মত। চেহারায় বন্ধু বন্ধু ভাব, মানুষকে সম্মান করতে জানে, অত্যন্ত বিবেচক। হিসেবে পরিচিত-এটা তার স্বভাব, নাকি চর্চার মাধ্যমে অর্জিত তা বলা কঠিন। রানার কানের কাছে হাত দিয়ে চোঙ বানাল সে, বলল, আপনিও কি এ-সবের ভক্ত বলে ধরে নেব আমি, ডাক্তার?

আমি আসলে ডিউটিতে বেরিয়েছি, বলল রানা। মি. গোলডা আপনাদের ব্যাপারে খুব উদ্বিগ্ন।

কসাইখানায় সুস্থ-সবল নধর প্রাণী যোগান দিতে চান বুঝি?

ভুলে গেলে চলবে না আপনাদের পিছনে মোটা অংকের টাকা ইনভেস্ট করেছেন তিনি।

হেসে উঠল হিউম। একদম বাজে কথা। শূটিং শেষ না হওয়া পর্যন্ত একটা পয়সাও কাউকে ঠেকাচ্ছেন না উনি।

আমরা গণতান্ত্রিক যুগে বাস করছি, মি. হিউম। ক্রীতদাস হিসেবে নিজেকে আপনি বিক্রি না করলেও পারেন।

তারমানে ফিল্ম ইণ্ডাস্ট্রি সম্পর্কে আপনি কিছু জানেন না।

সত্যি জানি না।

সিনেমা জগতে ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ মন্দা চলছে এখন। টেকনিশিয়ানদের শতকরা আশি ভাগ বেকার। না খেয়ে মরার চেয়ে ফুটো পয়সা পেলেও কাজ করব আমি, তিক্ত গলায় বলল হিউম, তারপরই আবার নিজের হাসি-খুশি স্বভাব ফিরে পেল। তাকে গিয়ে বলুন, তাঁর লিডিং ম্যান ডগলাস হিউম সম্পূর্ণ সুস্থ। খুশি নয়, মনে রাখবেন, তবে সুস্থ। খুশি হব যদি দেখি জাহাজ থেকে তিনি পানিতে পড়ে গেছেন।

ঠিক আছে, বলব। কামরার চারদিকে চোখ বুলাল রানা। তিন দেবতা এই মুহূর্তে বিশ্রামে রয়েছে, প্রত্যেকের হাতে লেমন জুস-এর গ্লাস। সবাইকে দেখা যাচ্ছে না। কে কে নেই বলুন তো? জিজ্ঞেস করল ও।

নেই? চারদিকে তাকাল হিউম। মি. কার্লসন নেই…।

তাকে আমি দেখে এসেছি। হ্যামারহেড, মুর আর এলিনাকেও। এলিনাকে অবশ্য এখানে আমি আশা করি না।

 সুন্দরী, তাই না? দুঃখ এই যে বড় বেশি নির্লিপ্ত মেয়েটা। নির্লিপ্ত হওয়া দোষের নয়।

না। আমিও তাকে পছন্দ করি, বলল হিউম। তার দিকে তাকাল রানা। এর আগে মাত্র দুবার তার সঙ্গে কথা হয়েছে ওর, অল্প একটু। গলার সুর শুনে বোঝা যায়, অন্তর থেকেই বলা হলো কথাটা। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল হিউম। আমার জোড়া রেসিডেন্ট মাতাহারি না হয়ে এলিনা হলে খুশি হতাম।

আপনি নিশ্চয়ই মিস মোনাকার কথা বলতে চাইছেন না?

অবশ্যই তার কথা বলছি, ভুরু নাচিয়ে কৌতুক করল হিউম। দেখতেই পাচ্ছেন, এখানে নেই সে। অস্থির হবেন না, সঙ্গে দুটো হাউণ্ড আছে-গেলে দেখবেন, ওগুলোকে নিয়ে গড়াগড়ি খাচ্ছে বিছানায়।

আর কে অনুপস্থিত?

কেডিপাস, বলে হেসে উঠল হিউম। কাউন্টের বক্তব্য, কেডিপাসের অবস্থা চরমে, রাতে তার আর বাইরে বেরুবার সম্ভাবনা নেই। কাউন্ট হলেন তার কেবিন-মেট।

ডাইনিং রুম থেকে খুব তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে যেতে দেখেছি তাকে, বলল রানা, হিউমকে রেখে চলে এল কাউন্টের টেবিলে।

সরু, লম্বাটে মুখ কাউন্টের, কালো গোঁফ যেন পেন্সিল দিয়ে অ্যাঁকা, সিগারেট আকৃতির সোজা ভুরু, কাঁচাপাকা চুল কপাল থেকে টান টান হয়ে আছে পিছন দিকে। তাকে দেখে সুস্থ-সবলই মনে হলো রানার। এক হাতে ব্র্যাণ্ডির গ্লাস, প্রশ্ন না করেও বোঝা যায় খুব দামী কনিয়্যাক হবে জিনিসটা। কারণ, মেয়ে হোক বা পোশাক, খানা হোক বা অলংকার, সবচেয়ে দামী জিনিসটা পছন্দ করেন। ভদ্রলোক। এ ধরনের বিলাসিতা তাকে মানায়ও। বর্তমান কালে তিনিই সম্ভবত ইউরোপের সবচেয়ে নামকরা ক্যামেরাম্যান। কনিয়্যাক-এর উৎস সম্পর্কেও আন্দাজ করতে পারে রানা। বাজারে গুজব আছে, ফন গোলডাকে অনেক কাল আগে থেকে চেনেন কাউন্ট, কিংবা এত ভালভাবে চেনেন যে গোলডার সঙ্গে কোথাও যেতে হলে সঙ্গে নিজের সাপ্লাই নেয়ার অনুমতি পেতে অসুবিধে হয় না। তার পুরো নাম কাউন্ট বউিউলা লিখেন জারজাভস্কি, যদিও উচ্চারণ বিভ্রাট ঘটার আশঙ্কায় কেউ তা মুখে আনে না। নিজের পোলিশ জমিদারি ছেড়ে আসার পর থেকে জীবন সম্পর্কে অনেক কিছু শিখেছেন তিনি। শোনা যায় জমিদারিটা বেশ বড়ই ছিল। উনিশশো উনচল্লিশের সেপ্টেম্বর মাসে দেশ ত্যাগ করেন। গুড ইভনিং, কাউন্ট, বলল রানা। একা শুধু আপনাকেই সুস্থ দেখতে পাচ্ছি আমি।

পোলিশ জমিদারের রক্ত। মেয়েদের ব্যাপারে এত সতর্ক থাকি যে রোগবালাই ঘেঁষতে পারে না। ফুলে থাকা জ্যাকেটে চাপড় মারলেন কাউন্ট। কনডম ছাড়া ও-সব করি-টরি না। আধুনিক ডাইনীদের কাছে আপনার পেনিসিলিন অচল।

তাড়াতাড়ি প্রসঙ্গ বদলাতে চেষ্টা করল রানা, মি. গোলডা জানতে চাইছিলেন এই দুর্যোগে কেমন আছেন আপনারা।

আচ্ছা! তা তিনি নিজে কেমন আছেন?

ভালই বলা চলে।

কাউন্টের সুরে খেদ, মনের আশা সব সময় পূরণ হবার নয়।

হিউম বলছিলেন, আপনার রুম-মেট কেডিপাসকে একবার দেখে আসা দরকার।

কেডিপাসের মুখে আসলে কাপড় বা তুলো গুজে দেয়া উচিত। মেঝেতে একেবারে বন্যা বইয়ে দিচ্ছে ছোকরা। কি যে অবস্থা, আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না।

বোধহয় পারছি।

আমার মত সূক্ষ্ম অনুভূতিসম্পন্ন ব্যক্তির জন্যে খুবই বিব্রতকর, বুঝতেই পারছেন।

হ্যাঁ, অবশ্যই।

গড়াগড়ি খেতে দেখে বাধ্য হয়ে বেরিয়ে চলে আসতে হলো আমাকে।

ঠিক আছে, তাকে আমি দেখতে যাব, বলে উঠতে যাবে রানা, ওর পাশের খালি চেয়ারটায় বসে পড়ল মিখায়েল ট্যাকার। ট্যাকার মার্ভেলাস প্রোডাকশনের একজন ফুল পার্টনার, একই সঙ্গে দুটো দায়িত্ব পালন করে সে-কনস্ট্রাকশন ম্যানেজার ও প্রোডাকশন ডিজাইনার। টাকা বাঁচাবার সুযোগ পেলে কখনোই তা হাতছাড়া করেন না ফন গোলডা। টাকার লম্বা, অত্যন্ত সুদর্শন, মুখের সঙ্গে দারুণ মানিয়ে গেছে ছোট করে ছাটা গোঁফ। মাথায় একরাশ কালো সিল্ক, পোলো-নেকড় সোয়েটারের নব্বই ভাগ তাতে ঢাকা পড়ে থাকে। সুদর্শন হলেও, চেহারায় বিপুল শক্তি আর কাঠিন্যের ভাব স্পষ্ট, তার স্বভাব নৈতিকতার ধার ধারে না, এবং সবাই তার বিরূপ সমালোচনার শিকার। গুজব হলো, সে নাকি ফন গোলডার জামাই।

এত রাতে আপনাকে খুব কমই দেখা যায়, ডাক্তার, বলল সে। হাতির দাঁত দিয়ে তৈরি একটা পাইপে রাশিয়ান সিগারেট ভরে ধরাল, কটুগন্ধী ধোঁয়া ছাড়ল এক মুখ। গান-বাজনার টানে চলে এসেছেন? মাথা নাড়ল সে। মনে হয় না টু কূল, টু ডিটাচড, টু ক্লিনিক্যাল, টু অবজারভ্যান্ট–অ্যাণ্ড আ লোনার। রাইট?

একজন ডাক্তারকে ভালই আঁকলেন।

আপনার আগমন কি কর্ম উপলক্ষে?

 হ্যাঁ।

 বাজি ধরে বলতে পারি, বুড়ো শালা আপনাকে পাঠিয়েছে।

পাঠিয়েছেন মি. গোলডা। ধীরে ধীরে আরও বেশি করে উপলব্ধি করছে। রানা, ফন গোলডাকে তার ঘনিষ্ঠ লোকজনরা কেউই ভাল চোখে দেখে না।

তাকেই আমি শালার বুড়ো বলছি। ট্যাকার চিন্তিত ভঙ্গিতে কাউন্টের দিকে তাকাল। আপনি আমার সঙ্গে একমত, কাউন্ট, খাটাশটা অদ্ভুত আচরণ করছে? সবার জন্যে তার এত দরদ আগে তো কখনও দেখা যায়নি। নিশ্চয়ই এর মধ্যে কোন রহস্য আছে।

সিলভার ফ্লাস্ক থেকে গ্লাসে আরও খানিকটা ব্র্যাণ্ডি ঢাললেন কাউন্ট, নিঃশব্দে হাসলেন, কিন্তু কিছু বললেন না।

রানা জানতে চাইল, মিস মোনাকাকে দেখছি না। তিনি ভাল আছেন তো?

না, ভাল থাকে কি করে। কিন্তু আবহাওয়ার কারণে একটা মেয়ের শরীর খারাপ করলে একজন পুরুষ তার কি করতে পারে বলুন। আপনাকে ডাকতে বলছিল, বলছিল ঘুমের ওষুধ দাও, কিন্তু আমি রাজি হইনি।

কেন?

আরে ভাই, এই মরণযাত্রায় রওনা হবার পর থেকে ওষুধ খেয়েই তো বেঁচে আছে সে। এই অ্যান্টাসিড খেলো তো একটু পরই খেলো পেইনকিলার, তার আগে একটার জায়গায় দুটো ট্যাবলেট খেয়েছে যাতে বমি না হয়। তার ওপর যদি ঘুমের ওষুধ খায়, কি ঘটবে বুঝতেই পারছেন।

না, পারছি না। ব্যাখ্যা করুন।

জী?

উনি কি ড্রিঙ্ক করেন? মানে, পরিমাণে বেশি খান?

ড্রিঙ্ক? না। মানে, মদ একেবারে ছোয়ই না।

দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল রানা। আপনি আপনার ছবি নিয়ে থাকুন, ওষুধ-পত্রের দিকটা আমাকে দেখতে দিন। মেডিকেল কলেজের যে-কোন প্রথম বর্ষের ছাত্রই বলতে পারবে যে…থাক, ভুলে যান। তিনি কি জানেন, কি কি ট্যাবলেট কটা করে খেয়েছেন আজ? খুব বেশি হবার কথা নয়, তা হলে এতক্ষণে জ্ঞান হারিয়ে ফেলতেন।

তা হয়তো সত্যি…।

চেয়ার ছেড়ে দাঁড়াল রানা। আমি তাঁকে পনেরো মিনিটের মধ্যে ঘুম পাড়িয়ে দেব।

আপনি ঠিক জানেন…মানে বলতে চাইছি…।

 কোনটা তার রুম?

 প্যাসেজের ডান দিকে, প্রথমটা।

আর আপনার? কাউন্টের দিকে তাকাল রানা।

বাঁ দিকের প্রথমটা।

প্যাসেজে বেরিয়ে এসে ডান দিকের প্রথম কেবিনের দরজায় টোকা দিল রানা। বিড়বিড় করে সাড়া দিল কেউ, কোন রকমে শোনা গেল। দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল ও। বিছানায় পদ্মাসনে বসে রয়েছে মোনাকা। হিউমের ধারণাই ঠিক, তার দুপাশে দুটো স্প্যানিয়েল কুকুর দেখা যাচ্ছে, ভারি সুন্দর। ডাগর ডাগর চোখের পাতা প্রজাপতির ডানার মত ঘন ঘন ঝাপটে রানার দিকে তাকাল। মেয়েটা, মন ভোলানো হাসি দিল-চেহারায় যদিও নার্ভাস একটা ভাব রয়েছে। আপনি আসায় কি যে ভাল লাগছে আমার! তার গলার আওয়াজে আদুরে একটা ভাব আছে, নিমেষে যৌনাবেদন সৃষ্টি করতে পারে। পরে আছে পিঙ্ক কালারের। বেড-জ্যাকেট, গলা ও কাঁধে সবুজ শিফনের স্কার্ফ। একটু ফ্যাকাসে হয়ে আছে। চেহারা। মিখায়েল বলছিল আপনি নাকি কোন সাহায্যে আসবেন না।

মি. ট্যাকার একটু বেশি সাবধানী। বিছানার কিনারায় বসে মোনাকার কজি ধরল রানা। ওর পাশের কুকুরটা গলার ভেতর থেকে গভীর আওয়াজ করল, দাঁত বের করে ভেঙচাল ওকে। আপনার কুকুর যদি কামড়ায়, ওটাকে আমি লাঠিপেটা করব।

 নটি একটা মাছিকেও কামড়ায় না-কামড়াও, নটি?

রানা মাছিদের ব্যাপারে শঙ্কিত না হলেও চুপ করে থাকল।

মোনাকা বিষন্ন হেসে জিজ্ঞেস করল, কুকুর দেখলে আপনার বুঝি অ্যালার্জি হয়?

কুকুরে নয়, আমার অ্যালার্জি কুকুরের কামড়ে।

মোনাকার চেহারা থেকে নিভে গেল হাসিটা, অবশিষ্ট থাকল শুধু বিষাদ। মেয়েটা সম্পর্কে যতটুকু জানে রানা সবই লোকমুখে শোনা। চলচ্চিত্র জগতে তার বন্ধুদের কাছ থেকে শোনা এ-সব কথার শতকরা নব্বই ভাগই মিথ্যে বলে বাতিল করে দিয়েছে ও। সিনেমা জগতে কেউ কারও সম্পর্কে সত্যি কথা বলে না। সুযোগ পেলে সবাই সবার চরিত্রহনন করছে। কাকে ল্যাং মারা যায়, কে কাকে। বিপদে ফেলতে পারে, প্রশংসার সুরে কে কার কতটা নিন্দা করতে পারে, সারাক্ষণ শুধু তারই প্রতিযোগিতা চলছে। ওদের কথা শুনে বোঝা মুশকিল ঠিক কোথায় সত্য শেষ হলো বা কোথা থেকে শুরু হলো মিথ্যা।

জিজ্ঞেস করলে মোনাকার বয়স চব্বিশ। একটু খোঁজ নিলে বিশ্বস্ত মহল। থেকে জানা যাবে, এই দাবি নাকি গত চোদ্দ বছর ধরে করা হচ্ছে। ওই একই মহল থেকে বলা হবে, সেজন্যেই শিফন স্কার্ফ ব্যবহার করে মেয়েটা, কারণ ওটা না থাকলে নাকি আসল বয়স ধরা পড়ে যাবার আশঙ্কা আছে। তাকে ডাইনী বলে আখ্যায়িত করবে, এমন লোকের অভাব নেই। তার স্প্যানিয়েল কুকুর দুটো সম্পর্কেও নোংরা গল্প চালু আছে বাজারে। তবে আবার এ-ব্যাপারে সহানুভূতিসূচক মন্তব্যও পাওয়া গেছে–মানুষকে না হোক, রক্ত-মাংসের কিছু বা কাউকে তো তার ভালবাসতেই হবে, সেই ভালবাসার প্রতিদান কারও বা কিছুর কাছ থেকে তাকে তো পেতেও হবে। শোনা যায়, প্রথমে সে বিড়াল পোষে, কিন্তু তাতে কাজ হয়নি। কারণ প্রতিদান হিসেবে তাকে ভালবাসেনি বিড়াল। তবে। একটা ব্যাপার ধ্রুব সত্য-মোনাকা শুধু গ্রীক দেবীর সৌন্দর্যই ধারণ করে না, তার অভিনয় প্রতিভাও তুলনাবিহীন। মোনাকা মানেই বক্স অফিস হিট। তার ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে যে যাই বলুক, সেখানে রহস্য আর উত্তেজক উপাদান থাকায়। জনপ্রিয়তা আরও যেন বেড়েছে। ব্যক্তিগত জীবন উন্নতির পথে বাধা, অন্তত তার ক্ষেত্রে সে-কথা বলা চলে না। সে ফন গোলডার মেয়ে, হয়তো সেজন্যে কিছু বাড়তি সুবিধে পায়। তবে এ-ও সবাই জানে যে বাপ-মেয়ের সম্পর্ক আদায়কাঁচকলায়। মার্ভেলাস প্রডাকশনের একজন ফুল পার্টনার মোনাকা। ট্যাকারকে যারা তার স্বামী বলে সন্দেহ করে, তারা বলে শুধু বাপকে নয়, স্বামীকেও ভয়ানক ঘৃণা করে মোনাকা।

চেহারা একটু ফ্যাকাসে দেখালেও, তাকে রানার অসুস্থ বলে মনে হলো না। কি কি ট্যাবলেট কটা করে খেয়েছে জেনে নিয়ে একটা ব্যবস্থাপত্র লিখল ও, তারপর বেরিয়ে এল প্যাসেজে। না, কুকুর দুটোর জন্যে ঘুমের ওষুধ বা আর কিছু দেয়নি ও।

কাউন্ট আর কেডিপাসের কেবিনটা প্যাসেজের ঠিক উল্টোদিকে। দুবার নক করল রানা, কিন্তু ভেতর থেকে কেউ সাড়া দিল না। তৃতীয়বার নক না করেই ঢুকে পড়ল ভেতরে, ঢুকেই বুঝতে পারল কেন কোন সাড়া পায়নি। কেবিনে কেডিপাস আছে, কিন্তু রানা কেয়ামত পর্যন্ত নক করলেও শুনতে পাবার কথা নয় তার।

০২.

হাস্যোজ্জ্বল, ফুর্তিবাজ কেডিপাস এত থাকতে ব্যারেন্ট সী-তে এসে মরল! জীবনের সঙ্গে চুটিয়ে প্রেম করছে এমন কাউকে যদি কখনও দেখে থাকে রানা তো সে কেডিপাস। ওর পায়ের কাছে পড়ে আছে লাশ, কিন্তু চোখে দেখেও বিশ্বাস করতে পারছে না।

কাউন্টের কথাই ঠিক, গোটা মেঝে তরল ময়লায় ভরে আছে; টক টক গন্ধটাও পাচ্ছে রানা। বিছানায় নয়, বাঙ্কের নিচে পড়ে রয়েছে কেডিপাস, মাথাটা পিছন দিকে এত বেশি বাঁকানো, যেন পিঠ ছুঁতে চেয়েছিল। রক্তও দেখল রানা, বেশ অনেক রক্ত, এখনও শুকায়নি-কেডিপাসের মুখে আর মুখের পাশে মেঝেতে। অদ্ভুত একটা ভঙ্গিতে পড়ে রয়েছে লাশ, হাত আর পা এমন এলোমেলোভাবে ছড়ানো যে অসম্ভব বলে মনে হয়, আঙুলের গিঁটগুলো সাদা হয়ে রয়েছে। মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছে, বলছিলেন কাউন্ট। রানাও বুঝতে পারছে, খুব কষ্ট পেয়ে মরেছে কেডিপাস। কিন্তু কষ্ট পেলে তো চিৎকার করবে সে, তাই না? গলা বেশিরভাগ সময় খালি ছিল না, তবু চিৎকার করার মত সময় পায়নি এটা বিশ্বাস করা কঠিন। তবে তিন দেবতা সমস্বরে যেভাবে হুঙ্কার ছাড়ছিল, তার চিৎকার কারও শুনতে পাবার কথা নয়। হঠাৎ মনে পড়ল রানার-জক মুরের কেবিনে ছিল ও, মুরের সঙ্গে কথা বলার সময় একটা আর্তনাদ শুনতে পেয়েছিল। ঘাড়ের রোম দাড়িয়ে গেল ওর। রক গায়কদের হুঙ্কার আর একজন মৃত্যুপথযাত্রীর চিৎকার, দুটোর মধ্যে পার্থক্য আছে-সেটা ওর ধরতে পারা উচিত ছিল।

হাঁটু গেড়ে বসল রানা, লাশটা পরীক্ষা করল। তারপর খোলা চোখ দুটো বন্ধ করে দিল, শক্ত হয়ে যাবে ভেবে এলোমেলো হাত-পা সিধে করতে গিয়ে অবাক হয়ে লক্ষ করল ওগুলো একেবারে কাদার মত নরম। কেবিন থেকে বেরিয়ে এল ও, তালা লাগাল দরজায়, এক মুহূর্ত ইতস্তত করে পকেটে ভরল চাবিটা। কাউন্ট যেমন দাবি করেন, সত্যি তিনি যদি সূক্ষ্ম অনুভূতি সম্পন্ন ব্যক্তি হন, রানা চাবি নিয়ে যাওয়ায় খুশি হবেন ভদ্রলোক।

কি বললেন? মুখের রঙ সামান্য একটু গাঢ় হলো ফন গোলডার। আমি কি শুনতে ভুল করলাম? আপনি বলতে চাইছেন, সে নেই?

নেই। ডাইনিং সেলুনে ফন গোলডার সঙ্গে একা রয়েছে রানা। রাত এখন দশটা, ঠিক সাড়ে নটায় ক্যাপটেন ডানহিল আর চীফ এঞ্জিনিয়ার জেংকিনস যে-যার কেবিনে চলে গেছেন। পরবর্তী দশ ঘণ্টা ওখানেই তারা থাকবেন, নিষেধ করা আছে এই সময়টা কেউ যেন তাদেরকে বিরক্ত না করে। ফন গোলডাকে বসিয়ে রেখে স্টুয়ার্ডস প্যানট্রি থেকে ব্র্যাণ্ডির একটা বোতল নিয়ে এল রানা, ফিরে এসে দেখল এখনও সেই একই ভঙ্গিতে বসে আছেন ভদ্রলোক। স্তম্ভিত বিস্ময়ে তাকালেন রানার দিকে, কিন্তু কথা বলতে পারলেন না। রানা ভাবল, আঘাত? নাকি উদ্বেগ? এরকম প্রতিক্রিয়া হবার কারণ কি? সন্দেহ নেই, পরিচিত যে-কারও মৃত্যু সংবাদই একটা আঘাত। মৃত্যুটা যদি নিকট বা প্রিয় কারও হয়, আঘাতটা স্বভাবতই অসাড় করে দেয়। সেক্ষেত্রে বলতে হবে, দুর্ভাগা কেডিপাসের জন্যে ফন গোলডার মনে যদি কোন সেহ-ভালবাসা থাকেও, এতদিন তিনি তা অত্যন্ত। নৈপুণ্যের সঙ্গে গোপন করে রেখেছিলেন। কিংবা তিনি হয়তো অনেকের মত সাগরে কারও মৃত্যু হওয়াটাকে অশুভ বলে মনে করেন। হয়তো ভাবছেন, কেডিপাসের এভাবে চলে যাওয়া তার লোকজনের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে। অথবা তিনি হয়তো এই মুহূর্তে একজন পাকা ব্যবসায়ী হিসেবে মনে মনে বিচলিত বোধ করছেন। কেডিপাসকে নিয়ে তিনটে আলাদা কাজ করিয়ে নিচ্ছিলেন—সে ছিল হেয়ারড্রেসার, মেক-আপ আর্টিস্ট ও ওয়ার্লোব ম্যান। চিন্তার কথা তো বটেই, বিশাল ব্যারেন্ট সাগরে বদলি লোক এখন কোথায় পাবেন। তিনি।

কর্কশ, চাপা গলায় ফিসফিস করলেন ফন গোলডা। এ কিভাবে সম্ভব! কেন মারা গেল? ব্র্যাণ্ডির বোতলটা ছো দিয়ে তুলে নিয়ে গ্লাসে এত জোরে ঢাললেন, সাদা টেবিলক্লথ অনেকটা ভিজে গেল।

হার্ট বন্ধ হয়ে গেছে, তাই।

ঢক ঢক করে গ্লাসটা খালি করে ফেললেন ফন গোলডা। এই আচরণ যদি তার কোন রকম অভিনয় হয়, নিঃসন্দেহ ওভার-অ্যাকটিং হয়ে যাচ্ছে। কিভাবে মারা গেল?

খুব কষ্ট পেয়ে, বলব আমি। কিন্তু যদি জিজ্ঞেস করেন মৃত্যুর কারণ কি, কিছুই বলতে পারব না।

বলতে পারবেন না? কেন বলতে পারবেন না? আপনাকে আমরা সবাই একজন ডাক্তার হিসেবে জানি। সীটে স্থিরভাবে বসে থাকতে কষ্ট হচ্ছে ফন। গোলডার। ইভনিং স্টার দোল খাচ্ছে অনবরত, ফলে এক হাতে টেবিলের কিনারা ধরে থাকতে হচ্ছে। আর বাঁ হাতে ধরা ব্র্যান্ডির গ্লাসটা, মনে হলো, যে কোন মুহূর্তে ভেঙে যেতে পারে। কারণটা কি সী সিকনেক?

সী-সিকনেস তাকে পেয়ে বসেছিল, তাতে কোন সন্দেহ নেই।

কিন্তু আপনি আমাকে বলেছেন সী-সিকনেসে কেউ মারা যায় না।

তা তিনি যাননি।

আপনি বলেছেন কারও যদি হার্টের অসুখ, পেটে আলসার বা হাঁপানি থাকে…।

কেডিপাস মারা গেছেন পয়জনে।

রানার দিকে এক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকলেন ফন গোলডা, চেহারায় কোন প্রতিক্রিয়া নেই। তারপর গ্লাসটা টেবিলে নামিয়ে রেখে এক ঝটকায় চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়ালেন-প্রকাণ্ডদেহী একজন লোকের জন্যে কাজটা সহজ নয়। এই সময় কাত হয়ে পড়ল ইভনিং স্টার। খপ করে গ্লাসটা ধরে ফেলল রানা, তা না হলে টেবিল থেকে পড়ে যেত। ঘাড় ফেরাতে দেখল হোঁচট খেতে খেতে স্টারবোর্ডের দিকে এগোচ্ছেন ফন গোলডা, ওদিকের দরজা দিয়ে আপার ডেকে বেরুনো যায়। হ্যাঁচকা টান দিয়ে দরজাটা খুলে ফেললেন তিনি। বাতাসের হুঙ্কার আর সাগরের গর্জনকে ছাপিয়ে উঠল তার বমি করার শব্দ। কয়েক মুহূর্ত পর ভেতরে ঢুকলেন, বন্ধ করলেন দরজা, টলতে টলতে ফিরে এসে ধপাস করে বসে পড়লেন নিজের চেয়ারে। তার চেহারা সাদা হয়ে গেছে। গ্লাসটা তার হাতে ধরিয়ে দিল রানা, ব্র্যাণ্ডিটুকু ঢকঢক করে খেয়ে ফেললেন, তারপর হাত বাড়ালেন বোতলটার দিকে। আরও কয়েক ঢোক গলায় ঢেলে ফিসফিস করলেন, পয়জন?

দেখে মনে হলো স্ট্রিকনীন।

স্ট্রিকনীন! স্ট্রিকনীন! গ্রেট গড! স্ট্রিকনীন! আপনি… আপনাকে পোস্টমর্টেম করতে হবে।

পোস্টমর্টেম সম্পর্কে আপনার কোন ধারণা নেই, মি, গোলডা, বলল রানা। পোস্টমর্টেম করার জন্যে যে-ধরনের ফ্যাসিলিটি দরকার, ইভনিং স্টারে তা নেই। তাছাড়া, আমিও প্যাথােলজিতে বিশেষজ্ঞ নই। পোস্টমর্টেম করতে হলে কেডিপাসের মা-বাবা অথবা স্ত্রীর অনুমতি লাগবে। ব্যারেন্ট সাগরে এখন আপনি তাদেরকে কোথায় পাবেন? ম্যাজিস্ট্রেট বা সরকারী একজন ডাক্তারের নির্দেশও দরকার হবে আপনার। কোথায় পাবেন তাদের? তাছাড়া, সরকারী ডাক্তার বা ম্যাজিস্ট্রেট পোস্টমর্টেমের নির্দেশ তখনই দেবেন যখন তারা মনে করবেন মৃত্যুটায় কারও হাত আছে। এখানে সে-ধরনের কিছু সন্দেহ করা হচ্ছে না।

সে-ধরনের কিছু সন্দেহ করা হচ্ছে না? কিন্তু আপনি বললেন…।

আমি বলেছি, দেখে মনে হলো স্ট্রিকনীন। স্ট্রিকনীন পয়জনিঙের লক্ষণ হলো, পিঠ এমন অসম্ভব বাঁকা হয়ে যাবে যে মনে হবে শুধু মাথা আর গোড়ালির ওপর বিশ্রাম নিচ্ছে শরীর। খিচুনি উঠবে, কুঁকড়ে যাবে হাত-পা। আর চেহারায় থাকবে আতঙ্ক। কিন্তু আমি তাকে সিধে করার সময় দেখলাম, হাত-পা কুঁকড়ে শক্ত হয়ে যায়নি। তাছাড়া, সময়ের হিসেবটাও মেলে না। স্ট্রিকনীনের প্রথম লক্ষণ ধরা পড়বে দশ মিনিটের মধ্যে, এবং জিনিসটা খাবার আধ ঘণ্টার মধ্যে আপনি শেষ। ডিনারে বসে এখানে আমাদের সঙ্গে অন্তত বিশ মিনিট ছিলেন কেডিপাস, তখন তার মধ্যে অস্বাভাবিক কিছু দেখিনি আমরা। সী-সিকনেস ছিল শুধু। আর তিনি মারা গেছেন এইমাত্র—স্ট্রিকনীন এত সময় নেয় না।

তাছাড়া, বলে সিগারেট ধরাবার জন্যে থামল রানা। তাছাড়া, কেডিপাসের মত ভালমানুষকে কে বিষ খাইয়ে মারতে যাবে? আপনার লোকজনের মধ্যে সেরকম সাইকো কেউ আছে নাকি, যে শুধু মজা পাবার জন্যে খুন করবে? ঘটনাটা আপনার মনে কোন চিন্তা আনছে? কিছু মনে পড়ে যাচ্ছে?

না। না, আমি এর কোন কারণ খুঁজে পাচ্ছি না। কিন্তু… কিন্তু পয়জন। আপনি বললেন…

ফুড পয়জনিং।

ফুড পয়জনিং! কিন্তু মানুষ ফুড পয়জনিঙে মরে না। নাকি আপনি টোমেন পয়জনিঙের কথা বলতে চাইছেন?

না, তা বলছি না, কারণ টোমেন পয়জনিং বলে কিছু নেই। যত খুশি টোমেন খেতে পারেন আপনি, কোন ক্ষতি হবে না। তবে ফুড পয়জনিঙে আপনি। অনেকভাবে আক্রান্ত হতে পারেন-যেমন, মাছে পারদ থাকতে পারে। খাওয়ার যোগ্য ভেবে ব্যাঙের ছাতা খেলেন, কিন্তু দেখা গেল সেটা আসলে খাওয়ার যোগ্য ছিল না। তবে সবচেয়ে জঘন্য হলো স্যালমনেলা। সন্দেহ নেই, ওটায় মানুষ মরে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের শেষ দিকে ওই জাতেরই একটা বিষ-স্যালমনেলা এনটারাইটিডিস-ত্রিশজন লোককে কাবু করে ফেলে। স্টোক-অন-ট্রেন্ট, জায়গাটার নাম। ছজন মারা যায়। এরচেয়েও ভয়ানক হলো ক্লসট্টিডিয়াম বটুলিনাম, বটুলিনাস-এর সৎ ভাই বলা যেতে পারে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ধারণা, এক রাতে গোটা একটা শহর খালি করে ফেলতে পারে। না, এই বিষক্রিয়ার কোন চিকিৎসা নেই। হয় এটা, কিংবা এটার মত কিছু একটা নিশ্চয়ই খেয়েছিল কেডিপাস।

আই সী, আই সী। আরও কয়েক ঢোক ব্র্যাণ্ডি খেলেন ফন গোলডা, তারপর রানার দিকে তাকালেন, চোখ দুটো মুরগীর ডিম হয়ে আছে। গুড গড! এর কি মানে, আপনি বুঝতে পারছেন না, ডক্টর রানা? আমরা সাংঘাতিক ঝুঁকির মধ্যে রয়েছি, আমরা সবাই! কি যেন নাম বললেন…ওই বিষ জঙ্গলে লাগা আগুনের মত ছড়িয়ে পড়তে পারে…

চিন্তা করবেন না। ওটা সংক্রামক নয়।

 কিন্তু গ্যালি…।

ভেবেছেন সে-কথা আমার মনে পড়েনি? বিষটা ওখান থেকে আসেনি। এলে আমরা সবাই এতক্ষণে মারা যেতাম। আমি ধরে নিচ্ছি আমরা যা খেয়েছি। কেডিপাসও তাই খেয়েছিলেন-মানে, তার খিদে নষ্ট হবার আগে। তখন আমি খেয়াল করিনি ঠিক কি খেয়েছিলেন, তবে তাঁর দুপাশে যারা বসেছিলেন তাদেরকে জিজ্ঞেস করা যেতে পারে। মানে কাউন্ট আর মুনফেস, তাই না?

মুনফেস?

মিকি মুনফেস-আপনার ক্যামেরা ফোকাস অ্যাসিস্ট্যান্ট না কি যেন।

ও! আপনি ব্যারনের কথা বলছেন! একজন ব্যারনের চেহারা ও আচরণ। যেমন হবার কথা, মিকি মুনফেসের চেহারা ও আচরণ ঠিক তার বিপরীত, বোধহয় সেজন্যেই তাকে ব্যারন বলা হয়। শয়তানটা কখনও কিছু দেখে নাকি? টেবিল থেকে কখনও চোখ তোলে? তবে বউিউলা-হ্যাঁ, সে সব কিছু লক্ষ করে।

ওদের সঙ্গে কথা বলব আমি। গ্যালি, ফুড স্টোর আর কোল্ড রুমও চেক করব। কেডিপাস নিজের আলাদা কোন খাবার কেবিনে রাখত কিনা তা-ও দেখব। আপনি কি চান, আপনার তরফ থেকে ক্যাপটেন ডানহিলের সঙ্গে দেখা করি আমি?

ক্যাপটেন ডানহিল?

রানা ধৈর্য হারায়নি। ক্যাপটেনকে জানাতে হবে। লগ বুকে লিখতে হবে মৃত্যুর কথা। দরকার হবে একটা ডেথ সার্টিফিকেটের-সেটা, জাহাজে যদি কোন ডাক্তার না থাকেন তারই দেয়ার কথা-তবে আমাকেও তার অনুমতি নিয়ে সার্টিফাই করতে হবে। তাছাড়া, তাকে তো সত্ত্বারের প্রস্তুতিও নিতে হবে। লাশ ভাসিয়ে দিতে হবে সাগরে। আমার ধারণা, কাল সকালে হলেই ভাল হয়।

শিউরে উঠলেন গোলডা। ইয়েস, প্লীজ। প্লীজ, তাঁর সঙ্গে দেখা করুন। হ্যাঁ, তাই তো, ভাসিয়ে দিতে হবে সাগরে। আমি তাহলে যাই, ক্লার্কের সঙ্গে দেখা করে কি ঘটে গেছে বলি তাকে। ক্লার্ক বিশপ একাধারে প্রোডাকশন অ্যাকাউন্ট্যান্ট, কোম্পানী অ্যাকাউন্ট্যান্ট ও মার্ভেলাস প্রোডাকশনের সিনিয়র পার্টনার। কোম্পানীর অর্থনৈতিক দিকটা তিনিই নিয়ন্ত্রণ করেন বলে ধারণা করা হয়। তারপর আমি শুতে যাব। হ্যাঁ, শুতে যাব, কারণ আমার বিশ্রাম দরকার। জানি, শুনতে বিদঘুটে লাগছে, বিশেষ করে বেচারা কেডিপাস ওখানে ওভাবে পড়ে থাকায়। কিন্তু আমি…আমি সাংঘাতিক আপসেট ফিল করছি। সেজন্যে তাকে দায়ী করতে পারল না রানা, এতটা অসুখী মানুষ আগে কখনও দেখেনি। ও।

আপনার কেবিনে কয়েকটা পিপিং ট্যাবলেট দিয়ে আসতে পারি আমি।

না-না। এই অস্থিরতা কাটিয়ে উঠব। তাবু আকৃতির জ্যাকেটের পকেটে ব্র্যাণ্ডির বোতলটা ভরে টলতে টলতে সেলুন থেকে বেরিয়ে গেলেন গোলডা।

স্টারবোর্ড সাইডের দরজার দিকে এগোল রানা, কবাট খুলে বাইরে তাকাল। আবহাওয়ার অবস্থা খারাপ তো বটেই, দ্রুত আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে। বাতাসের তাপমাত্রা এখন ফ্রিজিং পয়েন্টের অনেক নিচে, মাথার ওপর সাদা পর্দার মত দেখা যাচ্ছে প্রথম দফার তুষার। সাগরে ঢেউগুলো এখন আর ঢেউ নয়, বিপুল জলরাশির সচল উচ্ছ্বাসে পরিণত হয়েছে, যখন যেদিকে খুশি ছুটছে, যদিও মূল গতি পুব দিক। ইভনিং স্টার এখন আর শুধু ঝুঁকি বা দোল খাচ্ছে না, ঢেউয়ের মাথা থেকে আছাড় খেয়ে নিচে পড়ছে, পানির সঙ্গে সংঘর্ষে আওয়াজ তুলছে কামান দাগার মত। সামনের দিকে ঝুঁকে ওপর দিকে তাকাল রানা, ফোরমাস্টের মাথায় উড়তে থাকা পতাকাটা দেখে বিস্মিত না হয়ে পারল না। পতাকার ডগা থাকবে সরাসরি স্টারবোর্ডের দিকে, কিন্তু তা নেই, রয়েছে। স্টারবোর্ড কোয়ার্টারের দিকে। তারমানে বাতাস ঘুরে গিয়ে এখন বইছে উত্তরপুবে। এর তাৎপর্য সম্পর্কে ওর কোন ধারণা নেই, তবে ভাল কিছু নয় বলেই সন্দেহ করল। ভেতরে পিছিয়ে এসে অনেক কষ্টে দরজাটা বন্ধ করা গেল। ব্রিজে ওয়েন আছে, সে অত্যন্ত দক্ষ নাবিক, এটাই সান্তনা। স্টুয়ার্ডস প্যানট্রিতে এসে একটা ব্ল্যাক লেবেলের বোতল নিল ও, আগের বোতলটা ফন গোলডা নিয়ে গেছেন।

বোতল নিয়ে ক্যাপটেনের টেবিলে চলে এল রানা, বসল ক্যাপটেনের চেয়ারে। গ্লাসে খানিকটা পানীয় ঢেলে বোতলটা নামিয়ে রাখল ক্যাপ্টেন ডানহিলের ট্রলিতে।

রানা ভাবছে ফন গোলডাকে সত্যি কথাটা বলেনি কেন। সম্ভবত ভদ্রলোককে সুস্থ ও স্বাভাবিক বলে মনে হয়নি, তাই। যে হারে ব্র্যাণ্ডি খাচ্ছিলেন, তাকে বিশ্বাস। করে কথাটা বলতে পারেনি ও।

একটা ব্যাপারে ওর মনে কোন সন্দেহ নেই, কেডিপাস স্ট্রিকনীন খেয়েছিল বলে বা কেউ তাকে স্ট্রিকনীন খাইয়েছিল বলে মারা যায়নি। না, তার মৃত্যুর কারণ ক্লসট্রিডিয়াম বটুলিনাম-ও নয়। নির্দিষ্ট এই অ্যানিরোব থেকে যে টক্সিন পাওয়া যায় তা মাকই, ওর বর্ণনার মধ্যে কোন অতিরঞ্জন ছিল না। তবে সৌভাগ্যই বলতে হবে যে গোলডা জানেন না ইনকিউবেশন পিরিয়ড চার ঘণ্টার কম হওয়াটা বিরল ঘটনা। কোন কোন ক্ষেত্রে এমনকি আটচল্লিশ ঘণ্টা সময়। লাগে। তবে এই দেরির কারণে ফলাফলে কোন পার্থক্য ঘটে না। এমন ঘটার সম্ভাবনা সামান্য হলেও আছে, কেডিপাস হয়তো বাড়ি থেকে টিনে ভরা কোন বিষাক্ত খাবার এনেছিল, বিকেলের দিকে খেয়েছিল তা। কিন্তু তাহলে ডিনার টেবিলে লক্ষণগুলো ধরা পড়ত। অথচ ত্বকের রঙে পরিবর্তন ছাড়া আর কিছু লক্ষ করেনি রানা। তাহলে ধরে নিতে হয়, কোন ধরনের সিসটেম্যাটিক পয়জন তার মৃত্যুর জন্যে দায়ী। কিন্তু মুশকিল হলো এ-ধরনের পয়জন সংখ্যায় অনেক বেশি, আর রানাও এ-বিষয়ে বিশেষজ্ঞ নয়। তাছাড়া, বিষক্রিয়ায় কেউ মারা গেলেই এমন মনে করার কোন কারণ নেই যে তাকে মেরে ফেলা হয়েছে। অ্যাক্সিডেন্টাল পয়জনিঙে প্রতিদিন বহু লোক মারা যাচ্ছে।

লী সাইডের দরজা খুলে গেল, টলতে টলতে ভেতরে ঢুকল দুটো মূর্তি। দুজনই তরুণ, দুজোড়া চোখেই চশমা, বাতাসে ওড়া চুলে দুটো মুখই প্রায় ঢাকা। পড়ে আছে। রানাকে দেখতে পেল তারা, ইতস্তত করল, পরস্পরের দিকে তাকাল, তারপর ফেরার জন্যে ঘুরতে শুরু করল। হাত তুলে ডাকল রানা। দরজা। বন্ধ করে এগিয়ে এল দুজন। টেবিলে বসে মুখ থেকে চুল সরাল। এবার চিনতে পারল রানা-একজন ডোনা পামেলা, ফন গোলডার কনটিনিউইটি গার্ল; অপরজন হুপার। হুপারের পুরো নাম কি, তা বোধহয় কেউই জানে না। কোম্পানীতে তার পদের নাম-ক্ল্যাপার/লোডার। অত্যন্ত অস্থির প্রকৃতির যুবক, সম্প্রতি যাকে বিশ্ববিদ্যালয় ত্যাগ করতে বলা হয়েছে। খুবই বুদ্ধিমান ছেলে সে, তবে যে-কোন কিছুতে দ্রুত উৎসাহ হারিয়ে ফেলে। বুদ্ধিমান, যদিও বুদ্ধিকে কাজে লাগাতে পারে না। তার ধারণা, দুনিয়ায় গ্ল্যামার যদি কোথাও থাকে তো আছে ছবির জগতে।

আপনাকে এভাবে বিরক্ত করার জন্যে দুঃখিত, মি. রানা! ক্ষমাপ্রার্থনা করল হুপার। বোঝা যায়, রানাকে অত্যন্ত সম্মান ও শ্রদ্ধা করে সে। আমরা জানতাম না…সত্যি কথা বলতে কি, আমরা নির্জন একটা জায়গা খুঁজছিলাম।

পেয়েও গেছেন, বলল রানা। এখানে মি. গোলডার স্কচ আছে, ইচ্ছে হলে খেতে পারবেন। স্কচ ওদের দরকারও, দুজনকেই খুব স্নান দেখাচ্ছে।

না, ধন্যবাদ, মি. রানা। আমরা ওসব খাই না। হুপারের মতই ক্ষমাপ্রার্থনার সুরে বলল পামেলা, তার গলাও খুব মিষ্টি। লম্বা চুল পিঠ ঢেকে কোমর ছাড়িয়ে নেমে এসেছে। বোঝা যায়, বহু বছর কোন হেয়ারড্রেসার তার চুলে হাত লাগাবার সুযোগ পায়নি। নিশ্চয়ই মনে একটা খেদ নিয়ে মরেছে কেডিপাস। পামেলার মুখে কোন মেকআপ নেই, এমনকি লিপস্টিকও ব্যবহার করেনি। চমশার কাঁচ দুটো বিরাট, উঁটি দুটো হাড়ের তৈরি। হাবভাব ও চোহারায় স্মার্ট অর্থাৎ নিজেকে আমি রক্ষা করতে পারি ভাব। ভাবটা সম্ভবত কৃত্রিম।

কোথাও কোন জায়গা পেলেন না বুঝি? জিজ্ঞেস করল রানা।

রিক্রিয়েশন রুমে জায়গা থাকলেও নির্জনতা নেই, বলল পামেলা। ওরা তিন…ওরা তিন..

দেবতা, বলল রানা। হ্যাঁ, ওঁরা ওখানে খুব হৈ-চৈ করছেন। কিন্তু লাউঞ্জ তো খালি থাকার কথা।

নেই, বলল হুপার। তার বিরক্ত হবার কথা, যদিও চোখের তারায় কৌতুক দেখা গেল। ওখানে এক ভদ্রলোক বসে আছেন। পাজামা পরে। মি. মুর।

তার হাতে দেখলাম চাবির বিরাট একটা গোছা। ঠোঁট জোড়া পরস্পরের সঙ্গে একবার চেপে ধরল পামেলা। তিনি একটা দরজা খোলার চেষ্টা করছিলেন, ওই দরজার ভেতরই মি. গোলডা তার বোতলগুলো রাখেন।

হ্যাঁ, এ-ধরনের কাজ মি. মুরের পক্ষে সম্ভব, বলল রানা। ওর কোন মাথাব্যথা নয় ব্যাপারটা। ও শুধু আশা করতে পারে কাজটা করার সময় মুর যেন গোলডার চোখে ধরা পড়ে না যান। আপনারা কিন্তু নিজেদের কেবিনে গেলেও পারতেন।

না, অসম্ভব! আমরা সেটা পারি না।

ও, আচ্ছা। হুপারকে নিয়ে কেন নিজের কেবিনে যেতে পারবে না পামেলা, কিংবা পামেলাকে নিয়ে হুপারই বা কেন নিজের কেবিনে যেতে পারবে না? এমন কি হতে পারে, নিজেদের কেবিন পবিত্র দেখতে চায় ওরা? ভাবতে ভাবতে স্টুয়ার্ডস প্যানট্রি হয়ে গ্যালিতে চলে এল রানা।

গ্যালিটা ছোট, সুন্দরভাবে সাজানো আর অত্যন্ত পরিষ্কার। স্টেনলেস স্টীল ও চীনামাটির তৈজসপত্র সবই হাল-ফ্যাশনের। এত রাতে গ্যালিতে কাউকে পাবে না বলে মনে করেছিল রানা, কিন্তু দেখল শেফস হ্যাট পরা চীফ কুক মরিসন রয়েছে। হ্যাটের দুপাশে কাঁচাপাকা চুল বেরিয়ে আছে তার, স্টোভের ওপর ঝুঁকে কি যেন করছে। সিধে হলো সে, ঘাড় ফিরিয়ে রানাকে দেখল। মনে হলো একটু যেন অবাকই হয়েছে।

ইভনিং, মি. রানা। হাসল মরিসন। আমার কিচেনে মেডিকেল ইন্সপেকশন, ডক্টর?

আপনার অনুমতি নিয়ে, হ্যাঁ।

মরিসনের মুখের হাসি অদৃশ্য হলো। ঠিক বুঝলাম না, মি, রানা। ইচ্ছে। করলে কঠিন হতে পারে লোকটা, রয়্যাল নেভীতে প্রায় ত্রিশ বছর কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে।

দুঃখিত। স্রেফ একটা ফরমালিটি। জাহাজে ফুড পয়জনিঙের একটা ঘটনা ঘটেছে। আমি শুধু চারদিকটা ঘুরে দেখছি।

ফুড পয়জনিং? এই গ্যালিকে দায়ী করা যাবে না, নিশ্চয়তা দিয়ে বলতে পারি আমি। সাতাশ বছর কুক হিসেবে ছিলাম রানীর ব্যক্তিগত প্রমোদতরীতে। কেউ যদি বলে আমার গ্যালি স্বাস্থ্যসম্মত নয়…।

 তা কেউ আপনাকে বলছে না, তার মতই কঠিন সুরে বলল রানা। দেখাই যাচ্ছে, জায়গাটা অত্যন্ত পরিচ্ছন্ন। বিষটা যদি এখান থেকেও ছড়ায়, দোষ। আপনার হবে না।

এখান থেকে ছড়াতে পারে না, গম্ভীর সুরে প্রতিবাদ করল মরিসন, তার নীল চোখ কঠিন হয়ে উঠল। মাফ করবেন, এই মুহূর্তে আমি অত্যন্ত ব্যস্ত। রানার দিকে পিছন ফিরল সে, স্টোভে বসানো পাতিলের ওপর ঝুঁকল আবার।

কথা বলার মাঝখানে কেউ পিছন ফিরে দাড়ালে ব্যাপারটাকে সহজভাবে নিতে পারে না রানা, কাজেই ওর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া হলো লোকটাকে আবার নিজের দিকে ফিরতে বাধ্য করে। কিন্তু পরমুহূর্তে ভাবল, মরিসনের অহমিকায় আঘাত লেগেছে, কাজেই তার সঙ্গে রূঢ় আচরণ না করলেও চলে। আপনি দেখছি অনেক রাত পর্যন্ত কাজ করছেন, মি. মরিসন, নরম সুরে বলল ও।

ব্রিজের জন্যে ডিনার তৈরি করছি, শুকনো গলায় বলল মরিসন। মি. রবসন আর মি. গ্যাবনের জন্যে। এগারোটায় ডিউটি শেষ হবে তাঁদের, তখন একসঙ্গে খেতে বসবেন।

আসুন, প্রার্থনা করি, বারোটার দিকে দুজনেই যেন সুস্থ ও স্বাভাবিক থাকে।

রানার দিকে ধীরে ধীরে ঘুরল মরিসন। আপনার এই কথার মানে, ড. রানা?

মানে হলো, একবার যা ঘটেছে, দ্বিতীয়বারও তা ঘটতে পারে। ভেবে দেখেছেন, কি অদ্ভুত আচরণ করছেন আপনি? একবারও তো জানতে চাইলেন না কে বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে বা এখন সে কেমন আছে।

আপনার কথা আমি বুঝতে পারছি না, স্যার।

আপনার বুঝতে না পারাটাও আমার কাছে ভারি অদ্ভুত লাগছে। বিশেষ করে। এই জন্যে যে এই গ্যালিতে তৈরি খাবার খেয়েই লোকটা মাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়ে।

ক্যাপটেন ডানহিলের কাছ থেকে নির্দেশ পাই আমি, বলল মরিসন, চেহারা থমথম করছে। প্যাসেঞ্জারদের কাছ থেকে নয়।

রাতের এই সময় ক্যাপটেন কোথায় আছেন বা কি করছেন, সবাই তা জানে। আমার সঙ্গে একবার আসবেন না, কি করেছেন নিজের চোখে একবার। দেখবেন না? আক্রান্ত লোকটার কথা বলছি।

আমি করেছি? কি করেছি আমি? আবার রানার দিকে পিছন ফিরল মরিসন, স্টোভ থেকে পাতিলটা নামাল, তারপর মাথা থেকে হ্যাটটা। চলুন, দেখা যাক আমি ভয় পাই কিনা।

নিচে নেমে এসে কেডিপাসের কেবিনের দরজা খুলল রানা। সঙ্গে সঙ্গে মগজে ধাক্কা মারল গন্ধটা। ও যেমন ফেলে রেখে গিয়েছিল তেমনি পড়ে আছে কেডিপাস, তবে আগের চেয়ে যেন আরও বেশি মৃত বলে মনে হচ্ছে তাকে মুখ আর হাত থেকে রক্ত নেমে যাওয়ায় স্বচ্ছ সাদাটে দেখাচ্ছে ওগুলো। মরিসনের দিকে ফিরল ও। এবার বলুন, ভয় পাবার মত ব্যাপার নয়?

কথা না বলে লাশটার দিকে প্রায় দশ সেকেণ্ড তাকিয়ে থাকল মরিসন, চেহারা আরও লালচে হয়ে উঠল। হঠাৎ ঘুরল সে, কেবিন থেকে বেরিয়ে প্যাসেজ ধরে হাঁটা দিল। দরজায় তালা লাগিয়ে তার পিছু নিল রানা, প্যাসেজের দুদিকের দেয়ালে ঘন ঘন ধাক্কা খাচ্ছে।

প্যাসেজ থেকে ডাইনিং সেলুনে ঢুকল রানা। ট্রলি থেকে ব্ল্যাক লেবেলের বোতলটা তুলে নিয়ে হুপার আর পামেলার দিকে তাকিয়ে হাসল, আবার প্যাসেজ হয়ে চলে এল গ্যালিতে। হুপার আর পামেলা কি ভাবল কে জানে। ত্রিশ সেকেণ্ড পর গ্যালিতে রানার সঙ্গে যোগ দিল মরিসন। রীতিমত অসুস্থ দেখাচ্ছে তাকে। জীবনে বহু কিছু দেখেছে সে, সন্দেহ নেই, তবে পয়জনিঙে কষ্ট পেয়ে মরা লোককে দেখা ভীতিকর একটা অভিজ্ঞতাই বটে। একটা গ্লাসে খানিকটা স্কচ ঢেলে তাকে দিল রানা, এক ঢোকে সে-টুকু খেয়ে ফেলল সে। কাশল বার কয়েক, বোধহয় সেজন্যেই আগের রঙ খানিকটা ফিরে এল চেহারায়।

কি বিষ? খসখসে গলায় জানতে চাইল সে। কি ধরনের বিষ একটা লোককে ওভাবে মারতে পারে? গড, এরকম বীভৎস দৃশ্য জীবনে আমি দেখিনি।

কি বিষ বলতে পারব না। সেটাই তো জানার চেষ্টা করছি। এবার কি আমি চারদিকটা দেখতে পারি?

গড, হ্যাঁ, অবশ্যই। প্রথমে কি দেখতে চান বলুন।

হাতঘড়ি দেখল রানা। এগারোটা বেজে দশ মিনিট।

এগারোটা বেজে…মাই গড, ব্রিজের কথা তো একদম ভুলে গেছি! অত্যন্ত দ্রুত ও দক্ষতার সঙ্গে ব্রিজের জন্যে ডিনার তৈরি করল মরিসন-দুই ক্যান অরেঞ্জ জুস, একটা টিন ওপেনার, সূপ ভর্তি একটা ফ্লাস্ক; মেইন কোর্স থাকল ঢাকনি লাগানো ক্যারিয়ারে। এ-সব একটা বেতের বাস্কেটে ভরল সে, সঙ্গে থাকল তৈজসপত্র আর বিয়ারের দুটো বোতল, সব মিলিয়ে সময় নিল মাত্র দুমিনিট।

গ্যালিতে মরিসন অনুপস্থিত থাকল দুই কি আড়াই মিনিট। ইতিমধ্যে গ্যালির শেলফ আর রিফ্রিজারেটরে কি কি খাবার জিনিস আছে দেখে নিল রানা। খাদ্যে বিষ আছে কিনা তা পরীক্ষা করার জন্যে যন্ত্রপাতি বা সুযোগ সুবিধে ইভনিং স্টারে তো নেইই, থাকলেও যোগ্যতার অভাবে রানার পক্ষে তা পরীক্ষা করা সম্ভব হত না। কাজেই ওকে এখন নির্ভর করতে হবে নাক, জিভ আর দৃষ্টির ওপর দেখে, স্বাদ নিয়ে আর গন্ধ শুকে। হাতের কাছে যে-সব খাদ্যদ্রব্য পাওয়া গেল। সেগুলোর মধ্যে কোনও গোলমাল আছে বলে মনে হলো না। মরিসনের দাবি যথার্থ, তার গ্যালি অত্যন্ত স্বাস্থ্যসম্মত।

মরিসন ফিরে আসতে রানা বলল, আজ রাতের মেনুটা আবার শোনান।

অরেঞ্জ জুস বা পাইনঅ্যাপেল জুস, ষাড়ের লেজ…।

সবই টিন থেকে? উত্তরে মাথা ঝাঁকাল মরিসন। দুএকটা দেখান। প্রতিটি আইটেমের দুটো করে টিন খুলল রানা, সব মিলিয়ে ছটা, মরিসনের চোখের সামনে স্বাদ ও গন্ধ পরখ করল। টিনজাত খাবারের স্বাদ যেমন হবার কথা, প্রায় কোন স্বাদই পাওয়া গেল না। তবে বিষ যে নেই, এটুকু পরিষ্কার।

মেইন কোর্স? জিজ্ঞেস করল রানা। ল্যাম্ব চপ, ব্রাসেলস, হর্সর্যাডিশ, বয়েল্ড পটেটো?

জ্বী। তবে এ-সব এখানে রাখা হয় না। রানাকে নিয়ে পাশের রুমে চলে এল মরিসন, এখানে ফল আর শাকসজি রাখা হয়। তারপর নিচের কোল্ড রুমে নামল, এখানে হুকে আটকানো সারি সারি ঝুলছে গরু, ভেড়া, ছাগল আর শূকরের মাংস। যা দেখবে বা পাবে বলে আশা করেছিল তাই দেখল ও পেল রানা-কিছুই না। মরিসনকে জানাল, যা ঘটে গেছে তার জন্যে সে দায়ী নয়, তারপর গ্যালি থেকে উঠে এল আপার ডেকে, প্যাসেজ ধরে হাটতে হাটতে চলে এল ক্যাপটেন। ডানহিলের কেবিনের সামনে।

হাতল ধরে ঘোরাবার চেষ্টা করল রানা, কিন্তু ভেতর থেকে তালা দেয়া থাকায় ঘুরল না সেটা। বেশ কয়েকবার নক করল, কোন সাড়া পেল না। এরপর হাত ব্যথা না হওয়া পর্যন্ত ঘুসি মারল কাটে। সবশেষে কয়েকটা লাথি। অবশেষে হাল ছেড়ে দিল ও। ভাবল, রবসন বোধহয় বলতে পারবে এখন কি করা উচিত।

গ্যালিতে ফিরে এল রানা, এখন সেখানে মরিসন নেই। প্যানট্রি হয়ে ডাইনিং সেলুনে চলে এল। বাল্কহেড সেটী-তে বসে আছে পামেলা আর হুপার, চারটে হাত পরস্পরকে অ্যাঁকড়ে ধরে আছে, মান দুটো মুখের মাঝখানে ব্যবধান মাত্র তিন ইঞ্চি, পরস্পরের চোখে তাকিয়ে আছে অদ্ভুত এক সম্মোহিত দৃষ্টিতে। কোথায় যেন শুনেছে বা পড়েছে রানা, প্রেমের অঙ্কুর ডাঙার চেয়ে জলেই নাকি তাড়াতাড়ি উদ্গত হয়। তবু বিস্মিত না হয়ে পারা যায় না, এরকম ঝড়ের রাতে ঝরঝরে একটা ট্রলারে মানুষ রোমান্টিক হয়ে ওঠে কিভাবে!

ক্যাপটেন ডানহিলের চেয়ারে বসল রানা, গ্লাসে সামান্য একটু পানীয় ঢেলে বলল, চিয়ার্স!

শিরদাঁড়া খাড়া করল ওরা, তারপর লাফ দিয়ে বিচ্ছিন্ন হলো-যেন একজোড়া ইলেকট্রনিক পুতুল, রানা বোতামে চাপ দেয়ায় ঝাঁকি খেয়েছে। ডোনা পামেলা অভিযোগের সুরে বলল, আপনি আমাদেরকে ভয় পাইয়ে দিয়েছেন, মি. রানা!

দুঃখিত।

তবে আমরা চলেই যাচ্ছিলাম।

তাহলে আমি সত্যি দুঃখিত। হুপারের দিকে তাকাল রানা। একদম অন্য রকম, না? ইউনিভার্সিটির সঙ্গে মেলে?

পার্থক্য তো আছেই। ওখানে আপনি কি পড়ছিলেন? কেমিস্ট্রি। কতদিন?

তিন বছর। মানে, প্রায় তিন বছর আর কি। আবার সশ্রদ্ধভঙ্গিতে হাসল হুপার। কেমিস্ট্রিতে আমি ভাল করব না, এটা বুঝতেই অতগুলো দিন পেরিয়ে গেল।

আপনার বয়স এখন কত?

বাইশ চলছে।

কিসে ভাল করবেন তা জানার প্রচুর সময় রয়েছে হাতে, বলল রানা। আপনাদের দুজনকেই জিজ্ঞেস করছি, চেষ্টা করে দেখুন জবাব দিতে পারেন কিনা। আজ রাতের ডিনারে তো আপনারাও ছিলেন, তাই না? দুজনেই মাথা

ঝাঁকাল। কেডিপাসের প্রায় সরাসরি উল্টোদিকে বসেছিলেন আপনারা, ঠিক?

আমার তাই ধারণা, বলল হুপার।

কেমন হতে যাচ্ছে শুরুটা! কোথায় বসেছিল সে-সম্পর্কে ধারণা দিতে পারে শুধু। কেডিপাস সুস্থবোধ করছেন না। আমি জানার চেষ্টা করছি, এমন কিছু তিনি খেয়েছিলেন কিনা যা তার পেটে সহ্য হয়নি বা যা খেলে তার অ্যালার্জি হবার কথা। কি কি খেয়েছেন আপনারা কেউ কি লক্ষ করেছেন?

চেহারায় অনিশ্চিতভাব, পরস্পরের দিকে তাকাল ওরা।

মুরগি? উৎসাহ দিয়ে জিজ্ঞেস করল রানা। কিংবা হয়তো ফ্রেঞ্চ ফ্রাইজ?

আমি দুঃখিত, মি. রানা, পামেলা বলল। আমি…আমরা আসলে অত খুঁটিয়ে কিছু দেখি না কখনও।

ওদের কাছ থেকে কোন সাহায্য পাবার আশা নেই। বোঝাই যায়, নিজেদের নিয়ে এত ব্যস্ত ছিল দুজন যে নিজেরা কি খেয়েছে তা-ও সম্ভবত বলতে পারবে না। কিংবা হয়তো খায়ইনি কিছু। তারমানে, স্বীকার করতে হয়, রানা নিজেও খুঁটিয়ে সব কিছু লক্ষ করেনি।

ইতিমধ্যে ওরা দুজন দাড়িয়ে পড়েছে, তাল সামলাবার জন্যে অ্যাঁকড়ে ধরে আছে পরস্পরকে, কারণ পায়ের তলা থেকে সরে যাবার চেষ্টা করছে ডেক। আপনারা যদি নিচে যান, বলল রানা, কাউন্ট বউিউলাকে বলবেন, তার জন্যে এখানে আমি অপেক্ষা করছি। তাঁকে আপনারা রিক্রিয়েশন রুমে পাবেন।

বিছানায়ও থাকতে পারেন, বলল হুপার। ঘুমিয়ে।

আর যেখানেই থাকুন, বলল রানা, বিছানায় অবশ্যই থাকবেন না।

ঠিক এক মিনিট পর হাজির হলেন কাউন্ট। তার মুখ থেকে ভুর ভুর করে ব্র্যাণ্ডির গন্ধ বেরুচ্ছে। অভিজাত চেহারায় বিব্রত ভাব। খুবই অস্বস্তিকর। বলার মত নয়। বলতে পারেন, একটা মাস্টার কী কোথায় পেতে পারি আমি? ওই ছোকরা কেডিপাস একটা ইডিয়ট। ভেতর থেকে কেবিনের দরজা বন্ধ করে ঘুম দিচ্ছে, ভাবতে পারেন? নিশ্চয়ই একগাদা পীপিং ট্যাবলেট গিলেছে। বহু চেষ্টা করেও জাগাতে পারলাম না। ব্যাটা নর্দমার কীট!

ভদ্রলোকের কেবিনের চাবিটা পকেট থেকে বের করল রানা। কেডিপাস ভেতর থেকে তালা দেননি। বাইরে থেকে আমি দিয়েছি।

এক মুহূর্ত রানার দিকে স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকলেন কাউন্ট, তারপর ফ্লাস্কটার দিকে হাত বাড়ালেন। যেন কি ঘটেছে বুঝতে পারাতেই তার চেহারায়। আঘাতজনিত বিস্ময় ফুটে উঠল। বিরাট কোন আঘাত নয়, সামান্যই, তবে রানার মনে হলো সামান্য হলেও তাঁর বিস্ময়টা নির্ভেজাল। ফ্লাস্কটা গ্লাসের ওপর উপুড় করলেন তিনি, দুই কি তিন ফোটা পড়ল মাত্র। হাত বাড়িয়ে খপ করে ব্ল্যাক লেবেলের বোতলটা তুলে নিলেন, বোতল থেকে সরাসরি স্কচ ঢাললেন গলায়হাত একটুও কাঁপছে না। কেডিপাস আমার কথা শুনতে পায়নি? কিছু শুনতে পাবার ঊর্ধ্বে উঠে গেছে সে?

আমি দুঃখিত। সম্ভবত তার খাবারের মধ্যে কিছু। কোন ধরনের কিলার টক্সিন, দ্রুত কাজ করে, শক্তিশালী, মাত্মক কোন পয়জন।

একদম মরে গেছে? মাথা ঝাঁকাল রানা। একদম মরে গেছে? বিড়বিড় করে একই কথা বারবার বলছেন কাউন্ট। আর আমি কিনা তাকে রাগ করে বলে এলাম পোয়াতী মেয়েদের মত দুর্বল হলে কোন পুরুষ মানুষের চলে না! আমি যখন রাগারাগি করে চলে এলাম, তখন সে আসলে মারা যাচ্ছিল? আরও খানিকটা স্কচ খেলেন তিনি, মুখ কোচকালেন।

বেশ, তাকে দেখে আপনার কোন সন্দেহ হয়নি। হ্যাঁ, আপনি যখন কেবিন। ছেড়ে বেরিয়ে আসেন, কেডিপাস তখন মারা যাচ্ছিলেন। আপনি তো ডিনার টেবিলে তাঁর পাশেই বসেছিলেন, তাই না? কি খেয়েছেন আপনি, মনে আছে। আপনার?

স্বাভাবিক খাবার, সবাই যা খায়। কাউন্টকে বিচলিত দেখাল, তার অভিজাত স্বভাব এতটা বিচলিত হওয়া সম্ভবত অনুমোদন করে না। আমি বরং বলব, কেডিপাসই অস্বাভাবিক খাবার খায়।

কাউন্ট বউিউলা, হেঁয়ালি করার সময় এটা নয়।

গ্রেপফুট আর সানফ্লাওয়ার সীডস। মোটামুটি এই দুটো জিনিস খেয়েই বেঁচে ছিল সে। নিরামিষভোজী পাগলদের একজন আর কি।

তাই?

আবার মুখ কোঁচকালেন কাউন্ট। কেডিপাস মাংস খেত না। আলুও পছন্দ করত না। কাজেই সে শুধু স্প্রাউট আর হর্সরাডিশ নিয়েছিল। আমার বিশেষভাবে মনে আছে, কারণ আমি আর মিকি ওকে আমাদের হর্সর্যাডিশ দিয়ে দিই, ও খুব পছন্দ করে বলে। এমন ভঙ্গিতে কেঁপে উঠলেন তিনি, যেন তার গা ঘিন ঘিন করছে। বর্বরদের খাবার, শুধু অজ্ঞ অ্যাংলো-স্যাক্সন জিভের জন্যে। এমন কি মিকিও জিনিসটা সহ্য করতে পারে না। লক্ষ করার মত বিষয়, গোটা ফিল্ম ইউনিটে কাউন্টই একমাত্র মিকি মুনফেসকে ব্যারন বলে সম্বোধন করেন না। সম্ভবত নিজে অভিজাত বলেই চান না যে টাইটেলের অপব্যবহার হোক।

কেডিপাস ক্রুট জুস নিয়েছিলেন?

বাড়ি থেকে তৈরি করে আনা বার্লি ওয়াটার ছিল তার সঙ্গে। ক্ষীণ হাসলেন কাউন্ট। ক্যানে ভরা যে-কোন খাবার সম্পর্কে খারাপ ধারণা ছিল তার। এ-সব ব্যাপারে অত্যন্ত খুঁতখুঁতে ছিল সে।

সূপ নেননি?

অক্স-টেইল?

অক্স-টেইল বা অন্য কিছু?

কেডিপাস তো তার মেইন কোর্সই শেষ করেনি-মানে, স্প্রাউট আর হর্সর্যাডিশ। আপনার হয়তো মনে আছে খুব তাড়াহুড়ো করে উঠে যায় সে।

মনে আছে। জাহাজে উঠলেই কি সী-সিকনেসে ভুগতেন তিনি?

জানি না। তাকে আপনি যখন থেকে চেনেন, আমিও প্রায় তখন থেকে চিনি। গত দুদিন ম্লান আর ফ্যাকাসে দেখা গেছে। তবে সে তো সবাইকেই দেখা গেছে, তাই না?

এই সময় ডাইনিং সেলুনে ক্লার্ক বিশপ ঢুকলেন। বাইরে ঝড়, অথচ তাঁর মাথায় সযত্নে অ্যাঁচড়ানো চুল একটু এদিক ওদিক হয়নি। ব্যাকব্রাশ করা, ঘন কালো, সিঁথিটা মাঝখানে। কেউ যদি বলে আঠাল ক্রীম লাগানো হয়েছে, রানা। অবিশ্বাস করবে না। শুধু চুল নয়, ভদ্রলোকের সব কিছুই অত্যন্ত পরিপাটি আর গোছালো। মানুষটাও তিনি শান্ত, নিজেকে সব সময় নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেন। তার চুলের স্টাইল পিচ্ছিল, কিন্তু তিনি নিজে তা নন-তাঁকে স্রেফ চালাক বলা যায়। ভদ্রলোক খুব লম্বা নন, আবার বেটেও নন; মোটা নন, আবার রোগাও বলা যাবে না। মুখটা মসৃণ, কোন ভাঁজ বা রেখা নেই। গোটা জাহাজে একমাত্র তাকেই পিস্-নে ব্যবহার করতে দেখছে রানা। চেহারার সঙ্গে জিনিসটা এত সুন্দর মানিয়ে গেছে যে ওটা ছাড়া তার ছবি কল্পনাও করা যায় না। চলনে-বলনে অত্যন্ত সভ্য ও ভদ্র তিনি, যতটুকু হওয়া সম্ভব।

র‍্যাক থেকে একটা গ্লাস সংগ্রহ করলেন, ইভনিং স্টারের বেয়াড়াপনার কথা মনে রেখে সাবধানে অথচ দৃঢ় পায়ে এগিয়ে এলেন, বসলেন রানার ডান দিকের চেয়ারটায়, ব্ল্যাক লেবেলের বোতলটা ধরে জিজ্ঞেস করলেন, মে আই?

ইজি কাম, ইজি গো, বলল রানা। মি. গোলডার প্রাইভেট সাপ্লাই থেকে সরিয়েছি আমি ওটা।

স্বীকারোক্তি নোট করা হলো। ক্লার্ক বিশপ নিজের গ্লাসে স্কচ ঢেলে চুমুক দিলেন। আমিও আপনার সহযোগী হলাম। চিয়ার্স।

আমি ধরে নিচ্ছি সরাসরি মি. গোলডার কাছ থেকে এলেন আপনি, বলল রানা।

হ্যাঁ। সাংঘাতিক ঘাবড়ে গেছেন উনি। খুবই মর্মান্তিক… ছেলেটার কথা বলছি। আহা বেচারা! এটাও বিশপের একটা বৈশিষ্ট্য-যে-কোন ঘটনায় প্রথমে তিনি মানবিক দিকটা দেখেন, যদিও বেশিরভাগ কোম্পানী অ্যাকাউন্ট্যান্টের প্রথমে চিন্তা হবে মৃত্যুটা কোম্পানীর কাজে কতটুকু বিঘ্ন সৃষ্টি করবে। তবে রানা ভাবল, মুখে যেটা প্রথম প্রকাশ করেন সেটাই কি তাঁর প্রথম চিন্তা? তারপর তিনি বললেন, জানতে পারলাম, এখনও আপনি মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারেননি।

না, আমি কোন ক্লু পাইনি।

এভাবে কথা বললে কোনদিনই আপনি শার্লক হোমস হতে পারবেন না। তারচেয়েও ভয়ের কথা, আপনার ডাক্তারী সার্টিফিকেট কেড়ে নেয়া হতে পারে।

থাকলে তো কাড়বে, মনে মনে বলল রানা। পয়জন, কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু আর কিছু জানা যাচ্ছে না। সী-গোয়িং মেডিকেল লাইব্রেরি, জাহাজে চড়ার। সময় ডাক্তারদের সঙ্গে সাধারণত যেটা থাকে, আমার সঙ্গেও সেরকম একটা লাইব্রেরি আছে। কিন্তু তাতেও তেমন লাভ হচ্ছে না। একটা বিষকে চিনতে হলে হয় আপনাকে কেমিকেল অ্যানালাইসিস করতে হবে, কিংবা আক্রান্ত রোগীর শরীরে বিষ কিভাবে কাজ করছে তা নিজের চোখে দেখতে হবে। প্রতিটি বিষের অদ্ভুত সব আলাদা আলাদা লক্ষণ আছে। কিন্তু আমি পৌঁছুবার বেশ খানিক আগেই মারা গেছেন কেডিপাস। তাছাড়া, প্যাথলজিক্যাল টেস্ট করার ফ্যাসিলিটি নেই এখানে।

মেডিকেল প্রফেশনের ওপর আমার যেটুকু শ্রদ্ধা ছিল আপনি তা ধ্বংস করে দিচ্ছেন, মি. রানা। সায়ানাইড?

না, অসম্ভব। মাথা নাড়ল রানা। কেডিপাস মরতে সময় নিয়েছে। সায়ানাইড কোন সময়ই দেয় না। তাছাড়া সায়ানাইড মানেই তো খুনের কেস। ভুল করে কেউ সায়ানাইড খেয়ে ফেলেছে বা কাউকে খাইয়ে দেয়া হয়েছে, এমন। ঘটনা কখনও শুনিনি। কেডিপাসের মৃত্যু, আমি নিশ্চিত, মার্ডার নয়অ্যাক্সিডেন্ট।

আরও খানিকটা স্কচ নিলেন বিশপ। কি করে বুঝলেন যে অ্যাক্সিডেন্টই?

অ্যাক্সিডেন্ট নয়, জানে রানা; তাই খুব সাবধানে জবাব দিতে হলো। প্রথমত, বিষ খাওয়ানোর কোন সুযোগ পাওয়া যায়নি। ডিনারের সময় হওয়ার আগে পর্যন্ত পুরোটা বিকেল নিজের কেবিনে একা ছিলেন তিনি। কাউন্টের দিকে তাকাল ও। কেবিনে কি কেডিপাসের নিজের আলাদা কোন খাবার ছিল?

বিস্মিত হলেন কাউন্ট। আপনি জানলেন কিভাবে?

জানি না। আন্দাজ করছি। ছিল?

ছিল না মানে! দুটো বাস্কেটে ভরা একগাদা কাঁচের জার। আপনাকে তো আগেই বোধহয় বলেছি, টিনের খাবার দুচোখের বিষ ছিল কেডিপাসের। জারগুলোয় সে দুনিয়ার ভেজিটেবল প্রোডাক্টস ভরে নিয়ে এসেছিল…আহা, বেচারা!

রহস্যটা হয়তো ওই জারগুলোতেই লুকিয়ে আছে। ক্যাপটেনকে বলতে হবে ওগুলো তিনি যেন নিজের দখলে রাখেন, ফেরার পর পরীক্ষা করাতে হবে। আবার সুযোগের প্রসঙ্গে ফিরে আসি। নিজের কেবিন থেকে সরাসরি এখানে, ডাইনিং সেলুনে চলে আসেন কেডিপাস, আমরা যা খেয়েছি তিনি-ও তাই খেয়েছেন…।

ফ্রুট জুস খায়নি, সূপ খায়নি, ল্যাম্ব চপ খায়নি, আলু খায়নি, বললেন কাউন্ট।

ও-সব খাননি। তবে তিনি যা খেয়েছেন আমরা সবাই তা খেয়েছি। এরপর তিনি সরাসরি নিজের কেবিনে ফিরে যান। দ্বিতীয়ত, তাঁর মত নিরীহ একজন। লোককে কেন কেউ খুন করতে যাবে? তিনি আমাদের সবারই প্রায় অপরিচিত, তাই না? কারণ উইক থেকে জাহাজে ওঠেন, তখনই তাকে আমরা প্রথম দেখি। তাছাড়া, এরকম ছোট একটা জায়গায় কোন পাগল তাঁকে বিষ খাওয়াতে চেষ্টা করবে, বিশেষ করে খুন করে পালিয়ে যাবার কোন উপায় যখন নেই? জানা কথা, উইকে ফিরে দেখব পুলিস আমাদের জন্যে অপেক্ষা করছে।

পাগলটা হয়তো জানে যে সুস্থ একজন মানুষ ঠিক এভাবেই চিন্তা করবে, বললেন বিশপ।

ইংরেজ রাজাটার কি যেন নাম, অতিভোজনের কারণে মারা গিয়েছিলেন? জিজ্ঞেস করলেন কাউন্ট। বাইন বা ওই ধরনের কি যেন একটা মাছ খেয়ে? আমাকে যদি জিজ্ঞেস করেন, আমি বলব আমাদের দুর্ভাগা কেডিপাসও হয়তো হর্সর্যাডিশ বেশি খেয়ে ফেলার কারণে পটল তুলেছে।

যথেষ্ট হয়েছে। চেয়ার ছেড়ে উঠতে গেল রানা। যদিও সঙ্গে সঙ্গে উঠল। কাউন্টের কথাগুলো ওর মাথায় অনেক ভেতরে কোথাও যেন ক্ষীণ একটা বেল বাজিয়ে দিয়েছে, এত দূরে আর অস্পষ্ট যে কান পেতে না থাকলে শুনতেই পেত না। লক্ষ করল, দুজনেই তারা ওর দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল ও। এখন সিদ্ধান্ত নেয়ার সময়। কেডিপাসের জন্যে কিছু সময় দিতে হবে…।

বোধহয় ক্যানভাস দরকার হবে, বললেন বিশপ।

হ্যাঁ, মুড়তে হবে তাকে। তারপর কাউন্টের কেবিন পরিষ্কার করতে হবে। লগবুকে লিখতে হবে মৃত্যুর কথা। ডেথ সার্টিফিকেট। সকারের ব্যবস্থা করতে হবে মি. ওয়েনকে…।

মি. ওয়েন কেন? বিস্মিত হলেন কাউন্ট। কমাণ্ডিং অফিসার নন কেন?

 ক্যাপটেন ডানহিল নিদ্রাদেবীর কোলে, বলল রানা। চেষ্টা করেও তুলে আনতে পারিনি।

উনি যা নেশা করেন, মৃদু অনুযোগের সুরে বললেন বিশপ, ঘুম ভাঙাতে হলে দরজা ভাঙতে হবে।

এক্সকিউজ মি, জেন্টেলমেন। সরাসরি নিজের কেবিনে চলে এল রানা, তবে ডেথ সার্টিফিকেট লেখার জন্যে নয়। ক্লার্ক বিশপকে যেমন বলেছে ও, ইভনিং স্টারে একটা মেডিকেল লাইব্রেরি সত্যি তুলে এনেছে, আকারে সেটা খুব ছোটও নয়। মেডিকেল জুরিসপ্রুডেন্স অ্যান্ড টক্সিকোলজি, টেক্সট বুক অভ ফরেনসিক ফার্মেসী, লিগ্যাল মেডিসিন অ্যাণ্ড টক্সিকোলজি, এরকম আরও কয়েকটা বই শেলফ থেকে নামিয়ে প্রথমে সূচীপত্রের ওপর চোখ বুলাল ও। যা খুঁজছিল পাঁচ মিনিটের মধ্যে পেয়ে গেল।

পরিচ্ছেদটার নাম সিসটেম্যাটিক পয়জনস। প্রথমেই অ্যাকোনাইট অর্থাৎ বিষাক্ত উদ্ভিদের মূল বা শিকড়ের কথা বলা হয়েছে। কোন শিকড়ের কি নাম, সেগুলো থেকে কি ধরনের বিষ পাওয়া যায়, বিস্তারিত লেখা আছে। তার মধ্যে একটা হলো–Aconitum napellus আজ পর্যন্ত যত বিষ আবিষ্কৃত হয়েছে তার মধ্যে এটাই সবচেয়ে মাত্মক। ০:০০৪ গ্রামই একজন মানুষকে মেরে ফেলার জন্যে যথেষ্ট। যেখানে ব্যবহার করা হবে, মনে হবে জায়গাটা জ্বলে যাচ্ছে, ঝিনঝিন করবে, অসাড় হয়ে যাবে; মাত্রা বেশি হয়ে গেলে প্রচণ্ড বমি হবে, নড়াচড়া করার শক্তি থাকবে না, অনুভূতি থাকবে না, বোধশক্তি হারিয়ে যাবে, অসম্ভব কুঁকড়ে যাবে হৃৎপিণ্ড, ফলে মৃত্যু অনিবার্য। তারপর বলা হয়েছে চিকিৎসার কথা। সবশেষে বিশেষ দ্রষ্টব্যে সাবধান করা হয়েছে-অ্যাকোনাইটের শিকড়কে প্রায়ই হর্সর্যাডিশ বলে ভুল করা হয়, হর্যাডিশ ভেবে খেয়ে বহু লোক মারাও যায়।

.

লেখাটার দিকে এখনও তাকিয়ে আছে রানা, তবে পড়ছে না, ধীরে ধীরে উপলব্ধি করছে কি যেন একটা পরিবর্তন ঘটে গেছে ইভনিং স্টারে। এখনও এগোচ্ছে। জাহাজ, এঞ্জিনগুলো বিশ্বস্ততার সঙ্গে চালু রয়েছে, তবে চালচলন যেন আগের মত নয়। বদলে গেছে দোল খাওয়ার ভঙ্গিটা। আগের চেয়ে অনেক বেশি, প্রায় সত্তর ডিগ্রী কাত হয়ে যাচ্ছে। তুলনায় উঁচু-নিচু হবার বা আছাড় খাবার মাত্রা কমে গেছে, অশান্ত সাগরের সঙ্গে বো-র সংঘর্ষ আগের মত কামান দাগছে না।

পাতাটা ভাজ করল রানা, বন্ধ করল বইটা, তারপর টলতে টলতে এগোল প্যাসেজ ধরে। কম্প্যানিয়নওয়ে ধরে উঠল, লাউঞ্জ হয়ে বেরিয়ে এল আপার ডেকে। বাইরে অন্ধকার, তবে এত অন্ধকার নয় যে পানির পাহাড়গুলোকে দেখতে পাবে না। বাতাস অনুভব করে বুঝতে পারল ঝড়টা কোন দিক থেকে বইছে। ঢেউয়ের মাথায় বিস্ফোরিত হচ্ছে সাদা ফেনা। হঠাৎ পানির একটা পাহাড়কে ধেয়ে আসতে দেখে অ্যাঁতকে উঠল রানা, পিছিয়ে এসে হ্যাণ্ডরেইল। অ্যাঁকড়ে ধরে তৈরি হলো রক্ষার জন্যে। ঢেউ বলে চেনা যাচ্ছে না, যেন জ্যান্ত একটা পাহাড়-সাদা ও কালো শিরা দেখা যাচ্ছে, অশুভ, প্রলয়ঙ্করী-মাথাচাড়া দিচ্ছে পোর্টর্সাইডে, বীম-এর ঠিক সামনে। রানার মাথা ছাড়িয়ে আরও অন্তত দশ ফুট উঁচু। নিশ্চিতভাবে জানে ও, কয়েক শো টন পানি নিয়ে ট্রলারের ফোরডেকে আছাড় খেতে যাচ্ছে ঢেউটা। ঘটনাটা না ঘটার কোন কারণ দেখতে পেল না ও, তবু ঘটল না-ঢেউটা ওদের ওপর চড়াও হতে যাচ্ছে, দুই ঢেউয়ের মধ্যবর্তী গহ্বরটা আরও গভীর হলো স্টারবোর্ড সাইডে, আর ঠিক সেই মুহূর্তে চল্লিশ ডিগ্রী কাত হয়ে সেই গহ্বরের ভেতর ডাইভ দিল ইভনিং স্টার, পোর্ট সাইড থেকে ঢেউটার চাপ খেয়ে আরও যেন সেঁধিয়ে গেল নিচের দিকে। তারপর বজ্রপাতের মত পরিচিত আওয়াজটা শুনতে পেল রানা, মান্ধাতা আমলের স্টীল প্লেট আর নাট-বল্টগুলো একযোগে গুঙিয়ে উঠে প্রতিবাদ জানাল। সাদা, বরফ শীতল ফেনা ঢেকে দিল স্টারবোর্ড সাইডের ডেক, ঘূর্ণি সৃষ্টি করল রানার পায়ের চার পাশে, তারপর হুড়মুড় করে নেমে গেল সাগরে। ইতিমধ্যে আবার সিধে হতে শুরু করেছে ইভনিং স্টার, যদিও সিধে হয়ে থামল না, কাত হতে শুরু করল এবার পোর্ট সাইডে।

এ-সবে ভয় পাবার কোন কারণ নেই, নিরাপত্তা বা জীবনের জন্যে কোন হুমকি নয়। ইভনিং স্টার একটা আর্কটিক ট্রলার, এ-ধরনের শাস্তি সহ্য করার মত ক্ষমতা আছে ওটার। উদ্বেগের কারণ হলো, বিশাল আকৃতির ওই ঢেউটা ট্রলারের পোর্ট বোতে লাগায় কোর্স থেকে প্রায় বিশ ডিগ্রী সরে গেছে ওরা। সরে গেল, সরেই থাকল, কেউ ওটাকে আগের পথে ফিরিয়ে আনল না। পরের ঢেউটা অত বড় নয়, তবে আরও পাঁচ ডিগ্রী পুব দিকে সরে গেল ওরা। এবারও সরেই থাকল।

ব্রিজে ওঠার জন্যে মইয়ের দিকে ছুটল রানা। কোন সন্দেহ নেই, মাত্মক কিছু একটা ঘটেছে ওখানে।

০৩.

কার সঙ্গে যেন ধাক্কা খেলো রানা, এক ঘণ্টা আগে ঠিক যেখানে এলিনার সঙ্গে ধাক্কা খেয়েছিল। এবারের ধাক্কাটা আরও নিরেট, প্রতিপক্ষ উফ করে উঠল। ব্যথায় বা হাঁপিয়ে উঠে কোন মেয়ে যখন গোঙায় বা কাতরায়, আওয়াজটা যে পুরুষের নয় তা বেশ পরিষ্কারই বোঝা যায়। রানার মনে হলো, একই জায়গায় একই মেয়ের সঙ্গে আবারও ধাক্কা খেয়েছে সে। মোনাকা নিশ্চয়ই এই মুহূর্তে তার স্প্যানিয়েল দুটোকে নিয়ে বিছানায় গড়াগড়ি খাচ্ছে, আর পামেলা হয় হুপারের সঙ্গে আছে নয়তো হুপারকে স্বপ্ন দেখছে। দুজনের কেউই বাইরে ঘোরাঘুরি খুব একটা পছন্দ করে না।

ক্ষমা চাওয়ার মত করে কিছু বলল রানা, পাশ কাটিয়ে মইয়ের ধাপে পা রাখল, এই সময় ওর বাহু অ্যাঁকড়ে ধরল প্রতিপক্ষ দুই হাতে। কিছু একটা গোলমাল হয়েছে। আমি জানি। কি? এলিনার গলা শান্ত, তবে তার চিৎকার সাগরের গর্জনকে ছাপিয়ে উঠল। ডাক্তাকে ছুটতে দেখলে যে-কেউ ধরে নেবে কোথাও নিশ্চয়ই খারাপ কিছু ঘটেছে, সেটাই স্বাভাবিক। রানা কিছু বলতে যাবে, সুযোগ না দিয়ে এলিনা আবার বলল, সেজন্যেই আমি ডেকে উঠে এসেছি। রানার আর কিছু বলা হলো না, কারণ পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে ওর চেয়ে আগেই বিপদের গন্ধ পেয়েছে সে। তবে অ্যাকোনাইটের শিকড় যে হর্সর্যাডিশের মত দেখতে, এ-কথা এলিনার জানা না থাকায় ওর আর তার চিন্তার মধ্যে পার্থক্য আছে।

জাহাজ কারও নিয়ন্ত্রণে নেই, বলল রানা। ব্রিজে সম্ভবত কেউ দায়িত্ব পালন করছে না। কোর্স থেকে সরে গেছি আমরা।

আমি কোন সাহায্যে আসব?

এলিনা কাজের মেয়ে। অবশ্যই। গ্যালিতে একটা হট-ওয়াটার ইলেকট্রিক হিটার আছে, স্টোভের পাশে। একটা জাগে খানিকটা গরম পানি ঢেলে আনুন, তবে খুব বেশি গরম হলে আবার খাওয়া যাবে না। সঙ্গে একটা মগ আর বেশ খানিকটা লবণ।

মাথা ঝাঁকিয়ে চলে গেল এলিনা। চার সেকেণ্ড পর হুইল-হাউসে ঢুকল রানা। অস্পষ্টভাবে দেখতে পেল চার্ট-টেবিলের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে রয়েছে কে যেন, আরেকটা মূর্তি হুইলের কাছে সিধে হয়ে বসে আছে। ব্যস, শুধু এইটুকুই দেখতে পাচ্ছে। মাথার ওপর বালব দুটো ম্লান হলুদ আভা ছড়াচ্ছে, অন্ধকার তাতে দূর হবার নয়। হুইলের ঠিক সামনে ইন্সট্রুমেন্ট প্যানেলটা আরও পনেরো সেকেণ্ড পর দেখতে পেল রানা, তবে রিয়োস্ট্যাট খুঁজে পেতে দুসেকেণ্ডের বেশি লাগল না। ঘড়ির কাটা যেদিকে ঘোরে, ওটা ধরে সেদিকে সবটুকু ঘুরিয়ে দিল ও। অকস্মাৎ সাদা আলোয় ধাধিয়ে গেল ওর চোখ।

চার্ট-টেবিলে রয়েছে ওয়েন, হুইলে গ্যাবন। ওয়েন কাত হয়ে পড়ে আছে। আর গ্যাবন সিধে হয়ে বসে থাকলেও, তার অবস্থা ফাস্ট মেটের চেয়ে কোনও দিক থেকে ভাল নয়। যে যে-ভঙ্গি বেছে নিয়েছে, তা থেকে নড়ার শক্তি নেই কারও। দুজনের মাথাই বাকা হয়ে হাঁটু ছুঁতে চাইছে, দুজনেই যে যার পেট চেপে ধরে আছে। কেউ কোন শব্দ করছে না। সম্ভবত দুজনের কেউই কোন ব্যথা অনুভব করছে না, শরীরের বিকৃত ভঙ্গি বোধহয় সচেতন কোন প্রয়াসের ফল নয়, শারীরিক মেকানিজমের দ্বারা আপনাআপনি ঘটেছে। আবার এ-ও হতে পারে, ওদের কণ্ঠনালী অকেজো বা অসাড় হয়ে গেছে।

প্রথমে ওয়েনকে পরীক্ষা করল রানা। প্রতিটি জীবনই গুরুত্বপূর্ণ, অন্তত ভুক্তভোগীরা তাই ভাববে, কিন্তু এই কেসে সমষ্টির মঙ্গলকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে ও, আর কাকতালীয়ভাবে সমষ্টির মধ্যে সে-ও একজন-ইভনিং স্টারে যদি কোন বিপদ দেখা দেয়, রানার মনে হচ্ছে ওর পাশে সবচেয়ে জরুরী দরকার ওয়েনকে।

ওয়েনের চোখ খোলা, তার দৃষ্টিতে সচেতনতা বা বুদ্ধিও রয়েছে। এইমাত্র বইটায় পড়ে এসেছে রানা, বুদ্ধি সহজে লোপ পায় না, প্রায় শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অবশিষ্ট থাকে। ওয়েনের এটা কি শেষ মুহূর্ত? বইটায় বলা হয়েছে, নড়াচড়া থেমে যাবে। এখানে দেখা যাচ্ছে গেছেও তাই। তারপর অনুভূতি অসাড় হয়ে যাবে, বোধহয় সেজন্যেই যন্ত্রণায় চিৎকার করছে না ওরা। এমন হতে পারে, কিছুক্ষণ আগে পর্যন্ত সাহায্যের আশায় গলা ফাটিয়েছে ওরা, কিন্তু আশপাশে কেউ ছিল না যে শুনতে পাবে। এখন ওরা কিছুই অনুভব করছে না। রানা লক্ষ করল, মেঝেতে দুটো মেটাল ক্যারিয়ার পড়ে আছে, দুটোই প্রায় খালি। কিন্তু কোথাও কোন বমির চিহ্ন নেই দেখে অবাক হলো ও।

হুইল-হাউসে ঢুকল এলিনা। কাপড়চোপড় ভিজে গেছে, এলোমেলো হয়ে আছে চুল। তবে তাড়াতাড়ি এসেছে সে, জিনিসগুলোও নিয়ে এসেছে, সঙ্গে একটা চামচ। এক মগ পানিতে ছচামচ লবণ মেশান। জলদি, জলদি!

ওয়েনকে ধরে বসার ভঙ্গিতে স্থির করল রানা, এবার তার বগলের তলায়। হাত ঢোকাচ্ছে, এই সময় শুধু জার্সি আর জিনস পরা একজন সীম্যান ঢুকল হুইলহাউসে। জেমিসন, দুজন কোয়ার্টারমাস্টারের মধ্যে সেই সিনিয়র। ডেকের লোক দুজনকে দেখল সে-শুধু তাকাল না। ওয়েন আর জেমিসন একই জাতের সীম্যান। ব্যাপারটা কি, ডাক্তার?

ফুড পয়জনিং।

এ-ধরনের কিছুই হবার কথা। আমি ঘুমিয়ে ছিলাম। কেন যেন ঘুম ভেঙে গেল। মনে হলো, কিছু একটা বিপদ হয়েছে, কেউ আমাদেরকে কন্ট্রোল করছে না। বিশ্বাস করল রানা, যে-কোন অভিজ্ঞ সীম্যান এ-ধরনের বিপদ অ্যাঁচ করতে পারে, এমনকি ঘুমের মধ্যেও। তাড়াতাড়ি চার্ট-টেবিলের পাশে চলে এল সে, কম্পাসের দিকে তাকাল। পুব দিকে পঞ্চাশ ডিগ্রী অফকোর্স, মাই গড!

আমাকে একটু সাহায্য করুন, প্লীজ।

ধরাধরি করে ওয়েনকে পোর্ট সাইডের দরজার দিকে নিয়ে এল ওরা।

মগে চামচ নাড়া থামিয়ে হাঁ করে তাকিয়ে থাকল এলিনা। কোথায় নিয়ে। যাচ্ছেন ওঁকে?

বাইরে, উইঙে। কি ভাবছে এলিনা, ওয়েনকে সাগরে ফেলে দেবে ওরা? তাজা বাতাস এখন ওষুধের চেয়ে বেশি কাজ করবে।

কিন্তু বাইরে তো তুষার পড়ছে। ভয়ানক ঠাণ্ডা।

ওয়েনও ভয়ানক অসুস্থ হতে যাচ্ছে। আপনার লবণের শরবত খেতে কেমন লাগবে চেখে দেখেন।

চামচে খানিকটা পানি নিয়ে জিভে ঠেকাল এলিনা। মুখ বিকৃত করল সে। জহর!

ঢোক গিলতে পারবেন?

আরেকবার চেষ্টা করল এলিনা। কোন রকমে।

মগে আরও তিন চামচ লবণ দিন। ওয়েনকে বাইরে টেনে এনে বসার ভঙ্গিতে রাখল ওরা। ক্যানভাসের একটা পর্দা থাকলেও, বাতাস তাতে খুব একটা আটকাল না। ওয়েনের চোখ খোলা, ওদের কাজ-কর্ম দেখতে পাচ্ছে, কি ঘটছে। সে-ব্যাপারে বোধহয় সচেতনও। মগটা তার ঠোঁটে ধরল রানা, তারপর কাত করল। কাজ হলো না, থুতনি থেকে গড়িয়ে পড়ল লবণ পানি। পরের বার তার মাথাটা পিছন দিকে কাত করল ও, জোর করে ঢুকিয়ে দিল মুখের ভেতর। বোঝা গেল, ওয়েনের অনুভূতি বা বোধশক্তি পুরোপুরি নষ্ট হয়নি-মুখের পেশী আপনা থেকেই কুঁচকে গেল। উৎসাহ বোধ করল রানা, পরের বার পরিমাণে দ্বিগুণ লবণ পানি ঢালল মুখের ভেতর। এবার যেন নিজের চেষ্টাতেই সবটুকু গিলে নিল সে। দশ সেকেণ্ড পর রানার মনে হলো, ওয়েনের মত অসুস্থ মানুষ জীবনে সে দেখেনি। এলিনার প্রতিবাদ ও জেমিসনের ভ্রূকুটি অগ্রাহ্য করে আরও পুরো এক মগ লবণ পানি খাওয়াল ও। ওয়েনের কাশির সঙ্গে রক্ত বেরুতে দেখে মনোযোগ দিল গ্যাবনের দিকে।

পনেরো মিনিট পেরিয়ে গেল। এখনও ওদের হাতে অত্যন্ত অসুস্থ দুজন রোগী। পেটে প্রচণ্ড ব্যথা অনুভব করছে, সেই সঙ্গে সাংঘাতিক দুর্বল। তবে সুসংবাদ হলো, দুর্ভাগা কেডিপাস যে পথে গেছে সে পথে যাচ্ছে না তারা।

হুইলে রয়েছে জেমিসন, ইভনিং স্টার তার কোর্সে ফিরে এসেছে। এলিনা, তার খড় রঙের চুলে এখন তুষার জমেছে, উবু হয়ে বসে আছে গ্যাবনের পাশে, সেবা-শুশ্রুষা করছে। হুইল-হাউসের স্টর্ম-সিল-এ বসার মত সুস্থতা ফিরে পেয়েছে ওয়েন, যদিও ইভনিং স্টার বার বার কাত হচ্ছে বলে রানার একটা হাত ধরে থাকতে হচ্ছে তাকে। সুস্থতা ফিরে আসছে বটে, গলায় এখনও জোর পাচ্ছে না, কথা বললে কোন রকমে শোনা যাচ্ছে।

ব্র্যাণ্ডি, কর্কশ আওয়াজ বেরুল তার গলা থেকে।

বইয়ে বলা হয়েছে না দেয়াই উচিত। মাথা নাড়ল রানা।

ব্র্যাণ্ডি, আবার বলল ওয়েন, যেন রানার কথা শুনতে পায়নি।

উঠল রানা, ক্যাপটেন ডানহিলের ব্যক্তিগত রিজার্ভ থেকে একটা বোতল বের করে আনল। ওয়েনের পেটের ওপর দিয়ে যে ধকল গেছে, কার্বলিক অ্যাসিড ছাড়া অন্য কিছু ওটার আর কোন ক্ষতি করতে পারবে না। বোতল থেকে সরাসরি খেলো সে, এবং সঙ্গে সঙ্গে বমি করতে শুরু করল। রানা বলল, আমার বোধহয়। প্রথমেই তোমাকে কনিয়্যাক দেয়া উচিত ছিল। তবে লবণ পানি অনেক সস্তা পড়ে।

হাসতে চাইল ওয়েন, ব্যথার কারণে চেষ্টাটা দীর্ঘস্থায়ী হলো না। আবার বোতলটা কাত করল সে। এবার পেটেই থেকে গেল কনিয়্যাক। তার পেটের কিনারাগুলো সম্ভবত ইস্পাত বা অ্যাসবেসটস দিয়ে মোড়া। বোতলটা তার হাত থেকে নিয়ে গ্যাবনের দিকে বাড়িয়ে ধরল রানা, চোখ-মুখ কুঁচকে মাথা নাড়ল সে।

হুইলে কে? কর্কশ গলায় জিজ্ঞেস করল ওয়েন, কথা বলার সময় প্রতিবার ব্যথা পাচ্ছে।

জেমিসন।

মাথা ঝাঁকাল ওয়েন, মনে হলো সন্তুষ্ট। শালার জাহাজ, বলল সে। শালার সাগর! আমি সী-সিক, ভাবা যায়! আমি?

আপনি অসুস্থ ঠিকই, বলল রানা, তবে সাগরের সঙ্গে তার কোন সম্পর্ক নেই। ওয়েন আর গ্যাবনকে কেন কেউ মারতে চাইবে? প্রশ্নটা মাথা থেকে সঙ্গে সঙ্গে ঝেড়ে ফেলল রানা, এ-সব নিয়ে পরে চিন্তা করার সময় পাওয়া যাবে। ব্যাপারটা ফুড পয়জনিং। ভাগ্যটা আমার ভাল। সময় মত এখানে পৌঁছুতে পেরেছিলাম।

মাথা ঝাঁকিয়ে চুপ করে থাকল ওয়েন। কথা বললে কষ্টটা বাড়ে।

এলিনা বলল, মি. গ্যাবনের হাত আর মুখ বরফ হয়ে যাচ্ছে, ঠাণ্ডায় কাঁপছেন উনি। তাঁর মত আমিও।

হুইলের সামনে একটা চেয়ারে ওয়েনকে বসিয়ে দিল রানা, তারপর এলিনাকে সাহায্য করল গ্যাবনকে দাঁড় করানোর কাজে। কাজটা ওরা শেষ করল, এই সময় কাউন্ট আর বিশপকে দেখা গেল মইয়ের মাথায়।

ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, শেষ পর্যন্ত আপনাকে পাওয়া গেল। সামান্য একটু হাঁপিয়ে গেছেন বিশপ, তবে চুল তার একটু নড়েনি। আপনাকে কোথায় না খুঁজছি। আমরা… কি ব্যাপার? লোকটা কি মাতাল?

উনি অসুস্থ। কেডিপাসের মতই অসুস্থ, তবে ভাগ্যবান। আপনাদের আতঙ্কের কারণ কি?

একই কেস, ড. রানা। এখুনি আপনাকে যেতে হবে আমাদের সঙ্গে। মাই গড়, এ যে দেখছি মহামারী দেখা দিয়েছে!

এক সেকেণ্ড। গ্যাবনকে হুইল-হাউসের ভেতর নিয়ে এসে কয়েকটা লাইফজ্যাকেটের ওপর বসিয়ে দিল রানা। ফুড পয়জনিং, মি. বিশপ? কে তিনি?

হ্যাঁ, ফুড পয়জনিং…মানে, আপনি যদি তাই বলেন। মি. ফন গোলডা।

পরে রানা মনে করতে পারবে না একটা ভুরু উঁচু করেছিল কিনা। শুধু মনে পড়বে, কথাটা শুনে একটুও অবাক হয়নি ও। যেহেতু অ্যাকোনাইট পয়জনিং, জাহাজের যে-কেউ আক্রান্ত হতে পারে। মিনিট দশেক আগে আমি তাঁর কেবিনে নক করি, বলে যাচ্ছেন বিশপ, কিন্তু ভেতর থেকে সাড়া পেলাম না। ভেতরে ঢুকে দেখি কথা বলার শক্তি নেই, কার্পেটের ওপর গড়াগড়ি খাচ্ছেন।

অপ্রাসঙ্গিক একটা চিন্তা এল রানার মাথায়, শরীরটা প্রায় গোল হওয়ায় কার্পেটে গড়াগড়ি খাওয়ার জন্যে ফন গোলডার আকৃতিটাকে প্রায় আদর্শই বলা যায়। ব্যাপারটার কৌতুককর দিকটা লক্ষ বা উপভোগ করার সামর্থ্য তাঁর অবশ্য থাকার কথা নয়। জেমিসনকে জিজ্ঞেস করল ও, সাহায্য পাবার মত লোক আছে আপনাদের, কাউকে এখানে ডেকে নিতে পারবেন?

কোন সমস্যা নয়, মাথা ঝাঁকাল কোয়ার্টার মাস্টার, ইঙ্গিতে ফোনটা দেখাল। মেস-ডেকে ফোন করলেই কেউ না কেউ চলে আসবে।

কোন দরকার নেই, বললেন কাউন্ট। আমি থাকছি।

ভালই হলো। ওয়েন আর গ্যাবনের দিকে ফিরে মাথা ঝাঁকাল রানা। এখুনি নিচে যাবার মত শক্তি নেই ওঁদের, সে চেষ্টা করলে কিনারা থেকে পানিতে পড়ে

যেতে পারেন। ওদেরকে আপনি কয়েকটা কম্বল এনে দিতে পারবেন?

অবশ্যই। আমার কেবিন…।

তালা দেয়া। আমারটা খোলা। বিছানায় কম্বল আছে, আর আছে হ্যাঙ্গিং লকারের গোড়ায়। কাউন্ট হুইল-হাউস থেকে বেরিয়ে যাবার পর জেমিসনের দিকে ফিরল রানা। ডিনামাইট দিয়ে দরজা ভাঙার চিন্তা বাদ দিলে, ক্যাপটেনের ঘুম ভাঙাবার উপায় কি? রাক্ষস রাবণের মেঝ ভাইকে তো আর আপনি চিনবেন না, ছমাসে একবার ঘুম ভাঙত তার, ঘুমের প্রতিযোগিতায় আমাদের ক্যাপটেন সম্ভবত তাকেও হার মানাবেন।

নিঃশব্দে হাসল জেমিসন, আবার ইঙ্গিতে ফোনটা দেখাল। ব্রিজ ফোনের রিসিভার তার ঠিক মাথার কাছে। সার্কিটে একটা রেজিস্ট্যান্স আছে, ইচ্ছে করলে কল-আপ সাউণ্ড এত জোরে করতে পারি, তার কানের পর্দা ফেটে যাবে।

তাকে বলবেন এখুনি যেন মি. গোলডার কেবিনে চলে আসেন।

 ইয়ে…, ইতস্তত করছে জেমিসন। রাত দুপুরে ঘুম ভাঙানো ক্যাপটেন পছন্দ করেন না। বিশেষ করে সঙ্গত কোন কারণ না থাকলে। ওয়েন আর গ্যাবন যখন সুস্থই হয়ে গেছে…।

তাকে বলবেন, কেডিপাস মারা গেছেন। তবে ফন গোলডা অন্তত মারা যাননি। জাহাজের নাট-বল্ট গোঙাচ্ছে, গর্জন। করছে সাগর, ফুঁসছে ঝড়, তাসত্ত্বেও দরজার বারো ফুট দূর থেকে তার গলা। শুনতে পেল ওরা। বিশপ যেমন বলেছেন, সত্যি তিনি কার্পেটে গড়াগড়ি খাচ্ছেন, দুহাতে খামচে ধরে আছেন গলা, যেন শ্বাসরুদ্ধ করে মেরে ফেলার চেষ্টা করছেন। নিজেকে। তার চেহারা লালচে-বেগুনি হয়ে গেছে, চোখ দুটো রক্তবর্ণ, ঠোঁটের কোণে লালচে ফেনা, ঠোঁট দুটোও মুখের মত লালচে-বেগুনি। ওয়েন আর গ্যাবনের মধ্যে যে-সব লক্ষণ দেখা গেছে সেগুলোর সঙ্গে কোনটাই মিলছে না। মোল্লার দৌড় মসজিদ পর্যন্ত, বিষ বিশেষজ্ঞ হিসেবে রানার দৌড়ও এখানে শেষ।

বিশপকে বলল ও, আসুন, ধরাধরি করে দাঁড় করাই, তারপর বাথরুমে নিয়ে। যাই। কেন নিয়ে যেতে হবে সেটা পরিষ্কার, তবে কাজটা শুধু কঠিন নয়, অসম্ভবও। অসহযোগিতা করছে এমন একটা আড়াইশো পাউণ্ড জেলিফিশকে খাড়া করা ওদের ক্ষমতার অতীত বলে মনে হলো। হাল ছেড়ে দিয়ে ওখানেই। রোগীকে ফাস্ট এইড দেয়ার কথা ভাবছে রানা, এই সময় চীফ এঞ্জিনিয়ার জেংকিনসকে নিয়ে কেবিনে ঢুকলেন ক্যাপটেন ডানহিল। রানার বিস্মিত হবার কারণ হলো, তারা যে শুধু দ্রুত চলে এসেছেন তাই নয়, এসেছেন পুরোদস্তুর ড্রেস পরে। তারপর ড্রেসের ভাজ দেখে উপলব্ধি করল, সমস্ত কাপড়চোপড় পরেই ঘুমিয়েছিলেন তাঁরা। ওয়েন যাতে শিগগির সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠে সেজন্যে সংক্ষেপে একটু প্রার্থনা করল রানা খোদার কাছে।

জানতে পারি, আসলে কি ঘটছে এখানে? এক দেড় ঘণ্টা আগে ক্যাপটেন ডানহিল যে অবস্থায়ই থাকুন না কেন, এই মুহূর্তে তিনি সম্পূর্ণ সজাগ ও স্বাভাবিক। জেমিসন বলল, ইটালিয়ান ছেলেটা নাকি মারা গেছে… রানা ও বিশপ এক পাশে সরে যাওয়ায় এই প্রথম ফন গোলডাকে দেখতে পেলেন তিনি, মেঝেতে পড়ে গোঙাচ্ছেন। জেসাস ওয়েপ্ট! সামনে এলেন তিনি, ভাল করে দেখলেন। কী সর্বনাশ… উনি অমন করছেন কেন?

ফুড পয়জনিং। এই একই বিষ খেয়ে মারা গেছেন কেডিপাস, ওয়েন আর গ্যাবনও মারা যেতে বসেছিলেন। আসুন, ধরুন, ভদ্রলোককে বাথরুমে নিয়ে যেতে হবে।

পয়জন? ঝট করে চীফ এঞ্জিনিয়ারের দিকে তাকালেন ক্যাপটেন, যেন সংশোধন আশা করছেন, আশা করছেন জেংকিনস প্রতিবাদ করে বলবেন, বিষ। হতেই পারে না।

কিন্তু প্রতিবাদ করবেন কি, ক্যাপটেনের কথা সম্ভবত শুনতেই পাননি চীফ এঞ্জিনিয়ার। মেঝেতে মোচড় খাচ্ছেন ফন গোলডা, সেদিকে হা করে তাকিয়ে আছেন তিনি। পয়জন? আমার জাহাজে? কি বিষ? বিষ কোথায় পেল তারা? কে। দিল তাদেরকে? কেন কেউ…?

আমি একজন ডাক্তার, শখের গোয়েন্দা নই। কে, কোথায়, কখন, কেন, কি-এ-সব কিছুই আমি বলতে পারব না। শুধু জানি, আমরা এখানে দাঁড়িয়ে যখন কথা বলছি তখন একজন মানুষ মারা যাচ্ছেন।

ফন গোলডাকে বাথরুমে নিয়ে যেতে চারজন মানুষের আধ মিনিট লাগল। কাজটাই এমন যে আদর-যত্নের সঙ্গে করার কোন সুযোগ নেই। অসম্ভব ভারি, টেনে-হিঁচড়ে বয়ে নিয়ে যাবার সময় অক্ষত থাকলেন এ-দাবি করা যাবে না। তবে সান্তুনা এই যে অক্ষত ও মৃত ফন গোলডার চেয়ে ক্ষতবিক্ষত ও জীবিত ফন গোলডাই সবার কাম্য। বইতে চিকিৎসা, বিকল্প চিকিৎসার কথা লেখা আছে, তবে হাতের কাছে লবণ পানি ছাড়া আর কিছু নেই। ওয়েন আর গ্যাবনের বেলায় যেমন কাজ হয়েছিল, দেখা গেল লক্ষণ না মিললেও গোলড়ার বেলায়ও মাত্র তিন মিনিটের মধ্যে উপকার পাওয়া গেল। আবার তাকে ধরাধরি করে নিয়ে আসা হলো কেবিনে। এই মুহূর্তে তিনি তাঁর বাঙ্কে শুয়ে আছেন। এখনও অবশ্য কাপছেন, দুর্বোধ্য শব্দে গোঙাচ্ছেনও, তবে চেহারা থেকে এরই মধ্যে দূর হয়ে গেছে লালচে-বেগুনি রঙ। ঠোঁটের কোণে সেই ফেনাও আর নেই।

এখন উনি ভালই আছেন বলে মনে হচ্ছে, বিশপকে বলল রানা। তবু দয়া করে আপনি একটু নজর রাখুন। পাঁচ মিনিটের মধ্যে ফিরে আসছি আমি।

রানাকে দরজার কাছে দাঁড় করালেন ক্যাপটেন ডানহিল। যদি কিছু মনে না করেন, মি. রানা, আপনার সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই।

পরে।

এখন। এই ভেসেলের মাস্টার হিসেবে…।

তাঁর কাঁধে একটা হাত রাখল রানা। ইচ্ছে হলো বলে, জাহাজের মাস্টার হিসেবে আকণ্ঠ মদ খেয়ে নাক ডাকছিলেন তিনি, ওদিকে লোকজন সব মাছির মত মারা পড়ছিল। তবে এ-সব কথা বলে লাভ নেই কোন। ওর আসল উদ্বেগ, যা ঘটার কথা নয় তাই ঘটছে ইভনিং স্টারে, এবং ওর কোন ধারণা নেই কে দায়ী। মি. গোলডা বাঁচবেন, মি. ডানহিল, বলল ও। উনি ভাগ্যবান, কারণ ওনার কেবিনে ঢুকতে চেয়েছিলেন মি. বিশপ। কিন্তু আর সবাই তার মত ভাগ্যবান নাও হতে পারেন। হয়তো এই মুহূর্তে অনেকগুলো কেবিনে অনেকগুলো মানুষ মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছে, এত দুর্বল যে দরজার কাছে পৌঁছুতে পারছে না। ইতিমধ্যে আমরা চারজনকে পেয়েছি, সংখ্যাটা বারো কি না বুঝব কিভাবে?

বারোজন? হ্যাঁ-হ্যাঁ, তাই তো! রানাকে অবাক করে দিয়ে আত্মসমর্পণের ভঙ্গি করলেন ক্যাপটেন ডানহিল। চলুন, স্যার, আমিও আপনার সঙ্গে যাব। স্যার বলা হলো ক্ষমা প্রার্থনা বা আদর করার ছলে।

কি দরকার, আমি একাই পারব।

যেমন এখানে, মি. গোলডার বেলায় পেরেছেন?

সরাসরি রিক্রিয়েশন রুমে চলে এল ওরা। সব মিলিয়ে দশজন রয়েছে এখানে, সবাই পুরুষ, বেশিরভাগ চুপচাপ, প্রত্যেকেই অসুখী। এক হাতে সীট ধরে রেখে, অপর হাতে মদের গ্লাস নিয়ে কথা বলা বা উচ্ছ্বাস প্রকাশ করা সহজ কাজ নয়। তিন দেবতা, সম্ভবত ক্লান্তিবশতই, যে যার ইন্সট্রুমেন্ট একপাশে নামিয়ে রেখে তাদের বস হেনেরিক ব্রায়ানের সঙ্গে মদ্য পান করছে। ব্রায়ান ছোটখাট মানুষ, চেহারায় একগুয়েমির ভাব, মধ্যবয়স্ক। তিনি অ্যাঙলো-ডাচ, সারাক্ষণ ভুরু কুঁচকে আছেন। যখন এমনকি কাজ করছেন না তখনও তার শরীরে আটকানো অসংখ্য স্ট্র্যাপ থেকে ইলেকট্রনিক্স ও রেকর্ডিং ইকুইপমেন্ট ঝুলতে থাকে। গুজব, ওগুলো ওভাবে নিয়েই তিনি ঘুমান। মিখায়েল ট্যাকারকে দেখে মনে হলো স্ত্রীকে নিয়ে তার যে দুশ্চিন্তা ছিল এখন আর তা নেই, ডগলাস হিউম ও অন্য দুজন অভিনেতার সঙ্গে কথা বলছে। তাদের মধ্যে একজন ব্রাড ফাগুসন, অপরজন হ্যানস ব্ৰাখটম্যান।

তৃতীয় টেবিলটায় দেখা গেল স্টিল ফটোগ্রাফার ল্যারি আর্চারকে, সঙ্গে প্রপ ম্যান মরগান। কাউকেই গুরুতর অসুস্থ বলে মনে হলো না রানার, অন্তত বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত কোন রোগী এখানে নেই। ওদের দিকে কৌতুহলী হয়ে তাকাল অনেকে, কেউ কেউ প্রশ্নও করল, তবে নিজেদের অপ্রত্যাশিত আগমন সম্পর্কে মুখ খুলতে রাজি হলো না রানা। মুখ খুললেই সময় নষ্ট, আর অ্যাকোনাইটের প্রতিক্রিয়া কারও জন্যে অপেক্ষা করে না।

হুপার আর পামেলাকে লাউঞ্জে পেল ওরা, আর কেউ নেই সেখানে। সবুজ হয়ে গেছে মুখ, তবে পরস্পরের হাত অ্যাঁকড়ে ধরে একজন আরেকজনের দিকে এমন নিবিষ্টভাবে তাকিয়ে আছে যেন আগামীকাল বলে কিছু নেই ওদের। নাক দুটো এত কাছাকাছি, পরস্পরকে ওরা দেখতে পাচ্ছে কিনা সন্দেহ হলো রানার। পামেলাকে এই প্রথম চশমা ছাড়া দেখল ও। হুপারের ভারি নিঃশ্বাস পড়ায় লেন্স ঝাপসা হয়ে গিয়েছিল, সন্দেহ নেই। সাধারণত চশমা খুললে নগ্ন আর অসহায় দেখায় মানুষকে, কিন্তু পামেলার বেলায় ঘটেছে উল্টোটা-তার বয়েস যেন হঠাৎ পাঁচ বছর কমে গেছে, কিংবা বলা চলে তার আসল বয়েসটা ফুটে উঠেছে। চেহারায়, আগের চেয়ে অনেক সুন্দরীও লাগছে দেখতে। একটা ব্যাপারে কোন। সন্দেহ নেই, হুপারের দৃষ্টিশক্তি খুব ভাল।

কাবার্ডটা এক কোণে, সেদিকে তাকাল রানা। কাচমোড়া দরজা অক্ষত দেখা যাচ্ছে, তারমানে জক মুরের চাবির গোছা বেশিরভাগ জিনিসই খুলতে পারে।

এরিক কার্লসন তার কেবিনে ঘুমিয়ে আছেন। ঘুমের মধ্যে এ-পাশ ওপাশ করছেন তিনি, সম্ভবত দুঃস্বপ্ন দেখছেন, তবে অসুস্থ যে নন তা পরিষ্কার বোঝা গেল। পাশের কেবিনটা রবার্ট হ্যামারহেডের, তার বেড-বোর্ড এত উঁচু করা যে তাকে কোন রকমে দেখা গেল। তবে তিনিও ঘুমাচ্ছেন, অঘোরে। জক মুর তাঁর বাঙ্কে শিরদাঁড়া খাড়া করে বসে আছেন, হাত দুটো পেটের ওপর ভাজ করা, ডান হাতটা কম্বলের নিচে। কোন সন্দেহ নেই, একটা বোতলের গলা চেপে ধরে আছে তার ওই হাত। মুখে তৃপ্তির হাসি।

মোনাকার কেবিনকে পাশ কাটিয়ে এল রানা, জানে সে ডিনার খায়নি। ওর জানামতে আর একটা মাত্র কেবিনে মানুষ আছে, সেটায় থাকে ফিল্ম ইউনিটের চীফ ইলেকট্রিশিয়ান-লালমুখো, মোটাসোটা। নাম ইমানুয়েল কেসলার। কনুইয়ের ওপর ভর দিয়ে কাত হয়ে শুয়ে আপেল খাচ্ছে, দেখে মনে হলো খোশমেজাজেই আছে, যা তার স্বভাবের সঙ্গে বেমানান। কেসলারকে সবাই হতাশ ও বিষন্ন। প্রকৃতির মানুষ বলেই জানে। জাহাজের অনেকেই তাকে এডি বলে ডাকে, কারণটা আবিষ্কার করতে ব্যর্থ হয়েছে রানা। তবে গুজব শোনা যায়, নিজের কথা বলার সময় বহুল পরিচিত অপর ইলেকট্রিশিয়ান টমাস এডিসনের কথাও বলতে শোনা গেছে তাকে, একই নিঃশ্বাসে।

দুঃখিত, বলল রানা। জাহাজে ফুড পয়জনিঙের কিছু ঘটনা ঘটেছে। আপনি আক্রান্ত হননি, বোঝাই যাচ্ছে। ইঙ্গিতে দ্বিতীয় বাঙ্কটা দেখাল ও, ওদের দিকে পিছন ফিরে শুয়ে রয়েছে তার রুম-মেট। ব্যারন কেমন আছেন?

মারা যায়নি, দার্শনিকসুলভ, হাল ছেড়ে দেয়ার সুরে বলল এডি। ঘুমিয়ে পড়ার আগে গোঙাচ্ছিল আর পেট ব্যথার কথা বলছিল। গোঙানো তার অভ্যাস, রোজ রাতেই সহ্য করতে হয়। ব্যারন কেমন লোক জানেনই তো, সে তার রসনার কাছে অসহায়।

সবাই তা জানে। মাত্র চারদিনে কোন লোক যদি কিংবদন্তী হয়ে উঠতে পারে তো সে মিকি মুনফেস। এক ঘণ্টারও কম সময় আগে ফন গোলডা সত্যি কথাটাই বলেছেন, শয়তানটা টেবিল থেকে চোখ তুলতে পারে না। সবাই বলাবলি করে, ব্যারনের পেট নাকি পেট নয়, খাঁদ। বিপুল খেতে পারা, খেয়ে হজম করতে পারা, দীর্ঘদিন কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে কাটিয়ে আসা একজন লোকের জন্যে বিস্ময়করই বটে।

আর কিছু না, স্রেফ কৌতুহলবশত এগিয়ে এসে তাকে একবার দেখল রানা। দেখল বলে ধন্যবাদ দিল নিজেকে, কারণ ব্যথায় কাতর তার চোখের ভেতর মণি দুটো দ্রুত ও ঘন ঘন একদিক থেকে আরেক দিকে ছুটোছুটি করছে, ফ্যাকাসে মুখে ফ্যাকাসে ঠোঁট নিঃশব্দে খুলছে আর বন্ধ হচ্ছে, দুহাতের সবগুলো নখ দিয়ে খামচে ধরে আছে পেট, যেন টেনে ছিড়ে ফেলতে চায়।

০৪.

পাঁচ মিনিটের মধ্যে ফন গোলডার কেবিনে ফেরার কথা রানার, ফিরল পঁয়তাল্লিশ মিনিট পর। প্রথম তিনজন রোগী তাড়াতাড়ি চিকিৎসা পেয়েছিল, কিন্তু ব্যারনের বেলায় যথেষ্ট দেরি হয়ে যাওয়ায় তাকে বাঁচাবার কোন উপায়ই দেখতে পেল না রানা। এক সময় হাল ছেড়ে দিল ও। তবে, তারপর জানা গেল, রানার চেয়ে বেশি জেদি সে, তার কঙ্কালসার কাঠামোর ভেতর অজেয় প্রাণশক্তি লুকিয়ে আছে। তাসত্ত্বেও, প্রায় বিরতিহীন কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাস, একটা হার্ট স্টিমুল্যান্ট ইঞ্জেকশন ও প্রচুর অক্সিজেন দেয়া না হলে নির্ঘাত মারা যেত সে-অবশ্য এখন সে নির্ঘাত বাঁচবে।

বিপদটা তাহলে কি কেটে গেছে? সবাই এখন আমরা নিরাপদ? দুর্বল, ঝগড়াটে সুরে জিজ্ঞেস করলেন ফন গোলডা। এখনও তাকে বিবর্ণ আর বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে। খারাপ আবহাওয়ার জন্যে এক ফুট ব্যাকগ্রাউণ্ড ছবি তুলতে পারেননি ভদ্রলোক, এখন আবার গোদের ওপর বিষফোড়ার মত বিষক্রিয়ার ঘটনা, মেজাজ তার খারাপ হবারই কথা। বোঝাই যাচ্ছে ভাগ্য তার পক্ষে নয়।

আমার তাই ধারণা, বলল রানা। বলল বটে, কিন্তু কথাটা বিশ্বাস করে না। জাহাজে একজন খুনী আছে, বিষ খাইয়ে মানুষ মারার চেষ্টা করছে সে। আর কোন রোগী থাকলে ইতিমধ্যে জানা যেত। সবাইকেই আমি পরীক্ষা করেছি।

তাই কি? জিজ্ঞেস করলেন ক্যাপটেন ডানহিল। আমার লোকদেরও? তারাও তো একই খাবার খেয়েছে।

কেন যেন রানার মনে হয়েছিল, বিষক্রিয়ার প্রতিক্রিয়া শুধু ফিল্ম ইউনিটের লোকজনদের মধ্যে দেখা যাবে। ক্যাপটেন ডানহিল সম্ভবত ধরে নিয়েছেন তার লোকদের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক বলে মনে করছে ও। ওরাও একই খাবার খেয়েছে, এটা আমার জানা ছিল না। স্বীকার করছি, আমারই ভুল। আপনি যদি পথ দেখান…

ওদের সঙ্গে চীফ এঞ্জিনিয়ার জেংকিনসও থাকলেন। ক্রুদের কোয়ার্টারে চলে এল ওরা। পাঁচটা আলাদা কেবিন, দুটো ডেক স্টাফদের জন্যে, একটা এঞ্জিনরুম। স্টাফদের জন্যে, একটা দুজন কুকের জন্যে, শেষটা দুজন স্টুয়ার্ডের জন্যে। শেষ কেবিনটায় প্রথমে ঢুকল ওরা।

দরজা খুলে ওখানেই অনন্তকাল দাঁড়িয়ে থাকল ওরা; অন্তত মনে হলো তাই, আসলে পাঁচ-সাত সেকেণ্ডের বেশি দাড়ায়নি। ভাষা ও নড়াচড়ার শক্তি ফিরে পেয়ে রানাই প্রথমে ভেতরে ঢুকল।

দুর্গন্ধটা এত তীব্র, মনে হলো অসুস্থ হয়ে পড়বে। কেবিনটায় যেন একটা যুদ্ধ হয়ে গেছে। উল্টে পড়ে আছে চেয়ার, বাঙ্ক দুটোর কম্বল আর চাদর ছেড়া অবস্থায় মেঝেতে লুটাচ্ছে। তবে যোদ্ধারা এখন দুজনেই শান্ত হয়ে গেছে, মানে চিরকালের জন্যে ঘুমিয়ে পড়েছে। ছেড়া একটা চাদরে প্রায় ঢাকা দেখা গেল। হ্যানসেন বাককে। টমাস পিটারসনের গায়ে কিছু নেই। যুদ্ধ করে মারা গেলেও, কারও গায়ে কোন ক্ষতচিহ্ন নেই।

.

আমি বলি আমরা ফিরে যাব। চেয়ারে বসে শিরদাঁড়া খাড়া করলেন ক্যাপটেন ডানহিল, ভঙ্গিটায় কর্তৃত্ব আনার চেষ্টা। জেন্টলমেন, আপনাদের আমি মনে রাখতে বলব, এই ভেসেলের মাস্টার আমি, ক্রু আর আরোহীদের প্রতি আমার একটা দায়িত্ব আছে। লোহার ট্রলি থেকে বোতল তুলে গ্লাসে স্কচ ঢাললেন। উদারহস্তে, যদিও বাড়ানো হাতটা তার একটু একটু কাঁপছে। কলেরা বা টাইফয়েড হলে কাছাকাছি বন্দরে চলে যেতাম, দেখতাম চিকিৎসার কি ব্যবস্থা করা যায়। তিনজন মারা গেছে, চারজন গুরুতর অসুস্থ। এরপর কে? এরপর কার পালা? রানার দিকে প্রায় অভিযোগের দৃষ্টিতে তাকালেন তিনি, যেন যা কিছু ঘটছে তার জন্যে ও-ই দায়ী। মি. রানা স্বীকার করছেন, এই ফুড পয়জনিঙের কারণ বের করতে ব্যর্থ হয়েছেন তিনি। কাজেই আমাদের ফিরে যাওয়াই উচিত।

উইক এখান থেকে অনেক, অনেক দূরে, বলল ওয়েন, ক্লার্ক বিশপের পাশে গায়ে কয়েকটা কম্বল জড়িয়ে বসে রয়েছে সে। এখনও ক্লান্ত ও বিধ্বস্ত লাগছে। দেখতে। ওখানে ফেরার আগে অনেক কিছু ঘটে যেতে পারে।

উইক, মি. ওয়েন? উইকের কথা কে ভাবছে? হ্যামারফেস্টে পৌঁছুতে মাত্র চব্বিশ ঘণ্টা লাগবে আমাদের।

আরও কম, বললেন জেংকিনস, চুমুক দিলেন রামের গ্লাসে। পোর্ট কোয়ার্টারে বাতাস লাগবে, আর এঞ্জিন রুমে আমি যদি কিছুক্ষণ থাকি, বিশ ঘণ্টার বেশি লাগবে না।

শুনলেন? রানার দিক থেকে ফন গোলডার দিকে তাকালেন ক্যাপটেন। মাত্র বিশ ঘণ্টা।

জুদের মধ্যে আর কেউ অসুস্থ নয় জানার পর ক্যাপটেন ডানহিল ডাইনিং সেলুনে ডাক দেন ফন গোলডাকে। ফন গোলডা তার তিন সঙ্গী ডিরেক্টরকে নিয়ে চলে আসেন এখানে। তিন ডিরেক্টর মানে এরিক কার্লসন, ক্লার্ক বিশপ আর মিখায়েল ট্যাকার। অপর ডিরেক্টর, মিস মোনাকা, ট্যাকারের কথা অনুসারে, ঘুমিয়ে আছে। আশ্চর্য হবার কিছু নেই, রানা তাকে পীপিং ট্যাবলেট দিয়ে। এসেছিল। মীটিঙে কাউন্ট এসেছেন আমন্ত্রণ না পেয়েই, যদিও তাঁর উপস্থিতি স্বাভাবিক বলেই ধরে নিয়েছে সবাই।

সেলুনে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে বললে ভুল হবে। তবে উদ্বেগ আর অনিশ্চয়তাবোধ আছে। সবচেয়ে অস্থির দেখাচ্ছে ফন গোলডাকে, কারণটাও পরিষ্কার-জাহাজ ফিরে গেলে তারই সবচেয়ে বেশি ক্ষতি। আপনার দুশ্চিন্তার কারণটা আমি বুঝি, বললেন তিনি। আমাদের সবার জন্যে আপনি উদ্বেগবোধ করছেন, সেজন্যে আপনার প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। তবে আমার ধারণা, ভয়টা আপনি একটু বেশি পাচ্ছেন, ক্যাপটেন ডানহিল। ইতিমধ্যে ডক্টর রানা আমাদেরকে জানিয়েছেন, বিপদ কেটে গেছে। এখন যদি আমরা ফিরে যাই, এবং ফেরার পথে যদি আর কিছু না ঘটে, খুবই বোকা মনে হবে নিজেদের।

কি মনে হবে সেটার ওপর গুরুত্ব দেয়ার বয়েস আমি পেরিয়ে এসেছি, মি. গোলডা, বললেন ক্যাপটেন। সবাই আমাকে বোকা ভাবুক তাতে আমার আপত্তি নেই, কিন্তু চাই না আর একজন লোক মারা যাক।

আমি মি. গোলডার সঙ্গে একমত, বললেন এরিক কার্লসন, তাঁকেও ম্লান ও ক্লান্ত দেখাচ্ছে। গন্তব্যের এত কাছাকাছি এসে ফিরে যাবার কোনোই মানে হয় না-বেয়ার আইল্যাণ্ড আর মাত্র একদিনের পথ। আমার প্রস্তাব, ওখানে আমাদেরকে নামিয়ে দিন, তারপর হ্যামারফেস্টে চলে যান আপনারা-যেমন প্ল্যান করা হয়েছিল। এর অর্থ হলো, হ্যামারফেস্টে পৌঁছুতে যেখানে চব্বিশ ঘণ্টা লাগার কথা সেখানে লাগবে ষাট ঘণ্টা। শুধু ভয় পেয়ে এই অতিরিক্ত ছত্রিশ ঘণ্টার জন্যে সব কিছু হারানোর কোন মানে হয় না।

আমি ভয় পেয়েছি, এ-কথা আপনি বলতে পারেন না, ভারি গলায় বললেন ক্যাপটেন। আমার প্রথম দায়িত্ব।

কথাটা আমি ব্যক্তিগতভাবে আপনাকে বলিনি, বললেন এরিক কার্লসন।

আমার প্রথম দায়িত্ব আমার অধীনস্থ লোকজনের নিরাপত্তা। তারা আমার দায়িত্ব। তাদের ভাল-মন্দের ব্যাপারে আমি দায়বদ্ধ। সিদ্ধান্ত নেব আমি।

মানি, ক্যাপটেন, মানি। ক্লার্ক বিশপ বরাবরের মত শান্ত ও সহনশীল। তবে সরাসরি হ্যামারফেস্টে গেলে কি ঘটবে সেটাও ভেবে দেখতে হবে। ওখানে হয়তো আমাদেরকে অনির্দিষ্ট কাল আটকা পড়ে থাকতে হবে কোয়ারানটিন-এ। পোর্ট অথরিটি হয়তো এক হপ্তা বা দুহপ্তা পর ক্লিয়ার্যান্স দেবে। তখন কিন্তু অনেক বেশি দেরি হয়ে যাবে, ফলে ছবি করার প্ল্যান বাদ দিয়ে বাড়ি ফিরে যাওয়া ছাড়া উপায় থাকবে না। বিশপ কথা বলছেন, রানার মনে পড়ল ঘণ্টা দুয়েক আগে ফন গোলডার মানসিক সুস্থতা সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করছিলেন এরিক কার্লসন, অথচ এই মাত্র ফন গোলডাকেই সমর্থন করলেন তিনি। একা শুধু তিনিই নন, এই মুহূর্তে একই কাজ করছেন ক্লার্ক বিশপও। মার্ভেলাস। প্রোডাকশনের বিপুল ক্ষতি হয়ে যাবে।

এ-সব কথা আমাকে শোনাবেন না, মি. বিশপ, বললেন ক্যাপটেন। বলুন। বিপুল ক্ষতি হয়ে যাবে বীমা কোম্পানীর।

ভুল, বলল ট্যাকার, তার সুর আর ভঙ্গি দেখে বোঝা গেল মার্ভেলাস প্রোডাকশনের ডিরেক্টরদের মধ্যে কোন দ্বিমত নেই। শিল্পী ও কলাকুশলীদের শুধু বীমা করা আছে। ফিল্ম প্রজেক্ট বীমাযোগ্য নয়-অন্তত প্রিমিয়ামের হার দেখে একথা বলতেই হবে। কাজেই বিপুল ক্ষতিটা আমাদেরই হবে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন মি. গোলডা, কারণ কোম্পানীতে তাঁর শেয়ারই সবার চেয়ে বেশি।

সত্যি আমি অত্যন্ত দুঃখিত, বললেন ক্যাপটেন, তবে তার গলা শুনে মনে। হলো না যে নিজের সিদ্ধান্ত থেকে একচুল নড়বেন। কিন্তু সেটা আপনাদের উদ্বেগ। তাছাড়া, মি. গোলডা, আজ সকালে বলা আপনার কথাটাই আপনাকে আমি স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। আপনি বলেছেন-টাকার চেয়ে সুস্থতা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ, তাই না? ছবি বানিয়ে আজকাল লাভ করা!

হ্যাঁ, মি. গোলডা লাভ করার কথা বলেছেন। প্রয়োজন দেখা দিলে লাভ করার ইচ্ছা তিনি অবশ্যই পরিত্যাগ করতে পারেন, কথা বলছেন বিশপ, অত্যন্ত দৃঢ়কণ্ঠে, ধারাল যুক্তির সঙ্গে। অতীতে এরকম ত্যাগ তিনি স্বীকার করেছেন। লাভ করার সুযোগ ফন গোলডা ছেড়ে দিয়েছেন, এটা কল্পনা করতে কষ্ট হলো। রানার, তবে ওর চেয়ে তাকে বিশপ আরও ভালভাবে চেনেন, সন্দেহ নেই। কিন্তু এখানে আমরা লাভ নিয়ে কথা বলছি না, কথা বলছি সর্বস্বান্ত হওয়া নিয়ে। এত দূর এসে, এত খরচ করার পর ছবিটা যদি করতে না পারি, সবাই আমরা ধ্বংস হয়ে যাব, কারণ এই প্রজেক্টে সবাই আমরা নিজেদের শেষ পয়সাটি পর্যন্ত ইনভেস্ট করেছি। অর্থাৎ, মি. ডানহিল, আপনি আসলে আমাদেরকে পথে বসাবার সিদ্ধান্ত নিতে চাইছেন। কিসের জন্যে? যদি আবার কেউ অসুস্থ হয়ে পড়ি, এই আশঙ্কায়। কিন্তু মি. রানা তো অভয় দিয়ে বলেছেনই, সে ভয় আর প্রায় নেই। বললেই চলে।

ক্যাপটেন ডানহিল কথা বললেন না।

মি. বিশপ একদম খাটি কথা বলেছেন, বললেন ফন গোলডা। বড় একটা পয়েন্ট আপনি খেয়াল করছেন না, ক্যাপটেন ডানহিল। আমার আগে বলা একটা কথা আপনি আমাকে মনে করিয়ে দিয়েছেন। এবার আমি কি আপনার বলা। একটা কথা মনে করিয়ে দিতে পারি? আপনি জানেন…।

মাফ করবেন, বাধা দিল রানা, খুব ভাল করেই জানে কি বলতে যাচ্ছেন ফন গোলডা। ও চায় না কথাটা বলুন উনি। প্লীজ। একটা আপোস রফা। আপনি বেয়ার অ্যাইল্যাণ্ডে যেতে চান। মি. বিশপ আর মি. কার্লসনও তাই চান। যেতে আমিও চাই, কারণ একজন ডাক্তার হিসেবে আমার সুনাম নির্ভর করছে এর ওপর। কাউন্ট?

কোন দ্বিমত নেই, বললেন কাউন্ট। বেয়ার আইল্যাণ্ড।

আর মি. ওয়েন ও মি. জেংকিনসকে জিজ্ঞেস করাটা ঠিক উচিত হবে না। কাজেই আমি প্রস্তাব করছি…।

এটা কোন পার্লামেন্ট নয়, মি. রানা, প্রতিবাদ জানালেন ক্যাপটেন ডানহিল। সাগরের মাঝখানে একটা ভেসেলে ভোটের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত হয় না।

আমি সেভাবে কোন সিদ্ধান্তে আসতে আপনাকে বলছিও না। আমার প্রস্তাব হলো, আসুন একটা চুক্তিপত্র তৈরি করি। তাতে ক্যাপটেন ডানহিলের সুচিন্তিত মন্তব্য লেখা থাকুক। আমি প্রস্তাব করছি, বেয়ার আইল্যাণ্ড মাত্র এক ঘণ্টার পথ হলেও তখন যদি কেউ আবার অসুস্থ হয়, সঙ্গে সঙ্গে জাহাজ ঘুরিয়ে হ্যামারফেস্টে চলে যাব আমরা। আমি একটা এভিডেভিট লিখে সই করব, তাতে উল্লেখ থাকবে যে ক্রু বা প্যাসেঞ্জারদের শারীরিক কোন বিপদ দেখা দিলে তাকে দায়ী করা যাবে না। চুক্তিপত্রে আরও লেখা থাকবে, শুধু ভেসেলের ভাল-মন্দের ব্যাপারে দায়ী করা যাবে তাকে, যা এই মুহূর্তে সবদিক থেকে ভাল। আমাদের এই সিদ্ধান্তের কারণে যদি খারাপ কোন পরিণতি হয়, তার জন্যে শুধু আমরা দায়ী থাকব, ক্যাপটেন নন। তবে জাহাজের নিরাপত্তা সম্পূর্ণ তাঁর দায়িত্ব। চুক্তিপত্রে আমরা সবাই সই করব। ক্যাপটেন ডানহিল?

আমি রাজি। কোন কোন কাজে সময়ক্ষেপণ করতে নেই, এটাকে সে রকম একটা কাজ বলে চিনতে ভুল করলেন না ক্যাপটেন। প্রস্তাবটা নামেই আপোস, তবে খুশি মনেই গ্রহণ করলেন তিনি। এবার ভদ্র মহোদয়গণ, আমাকে মাফ করতে হবে। ভোর চারটের সময় ঘুম থেকে জাগতে হবে আমাকে। গ্যাবন আর ওয়েন অসুস্থ হওয়ায় এ-ছাড়া তার উপায়ও নেই। ডকুমেন্টটা আমি কি ব্রেকফাস্টের সময় হাতে পাব?

হ্যাঁ, অবশ্যই। ক্যাপটেন, খুব ভাল হয় আপনি যদি কেবিনে ফেরার পথে মরিসনকে আমার সঙ্গে দেখা করার কথা বলে যান। আমি নিজেই তাকে ডাকতাম, কিন্তু আমার মত সিভিলিয়ানের কথায় গুরুত্ব একটু কম দেন তিনি।

সারাজীবন রয়্যাল নেভীতে ছিলেন, রাতারাতি ভুলতে পারা সহজ নয়। এখুনি?

দশ মিনিটের মধ্যে। গ্যালিতে।

তারমানে এখনও আপনি তদন্ত চালাতে চাইছেন? দোষটা আপনার নয়, মি. রানা।

ঢেঁকি যদি স্বর্গে গিয়েও ধান ভানে, তাহলে দোষটা আমার নয় কেন?

জেংকিনস আর ওয়েনকে নিয়ে ডাইনিং সেলুন থেকে বেরিয়ে গেলেন ক্যাপটেন। হাত কচলে রানার দিকে তাকালেন ফন গোলডা, প্রশংসার দৃষ্টিতে। আমাদের ধন্যবাদ পাওনা হয়েছে আপনার, মি. রানা। হাসলেন তিনি। কথার মাঝখানে কেউ বাধা দিলে আমি ব্যাপারটাকে সহজভাবে নিতে পারি না, তবে এক্ষেত্রে ব্যাপারটা ছিল সঙ্গত।

বাধা না দিলে এতক্ষণে আমরা হ্যামারফেস্টের পথে থাকতাম। চুক্তিতে আছে, জাহাজের নিরাপত্তা বিঘ্নিত না হলে আপনার সব নির্দেশ মেনে নিতে তিনি বাধ্য, ক্যাপটেনকে আপনি এই শর্তের কথাটা মনে করিয়ে দিতে যাচ্ছিলেন। তারমানে হ্যামারফেস্টে যাবার সিদ্ধান্তটা চুক্তিভঙ্গের সামিল। আর চুক্তি ভঙ্গ করলে ভাড়া বাবদ কোন টাকাই জাহাজ কোম্পানী পাবে না, ফলে ক্যাপটেন ডানহিলের ক্যারিয়ার ধ্বংস হয়ে যাবে। মুশকিল হলো, তার মত মানুষের কাছে। অহমিকা ও গর্বের তুলনায় টাকা কিছু না। আপনি চুক্তির কথা তুললেই উনি বলতেন, গো টু হেল। বলে হ্যামারফেস্টের দিকে ঘুরিয়ে নিতেন ইভনিং স্টার।

আমি বলব, আমাদের সুযোগ্য ডাক্তারের বিশ্লেষণ শতকরা একশো ভাগ খাটি। নিজের গ্লাসে কুলকুল করে ব্র্যাণ্ডি ঢাললেন কাউন্ট। আপনি অল্পের জন্যে বেঁচে গেছেন, ওল্ড ম্যান।

ক্যামেরাম্যান এতটা আদূরে সম্বোধন করায় কোম্পানীর চেয়ারম্যান যদি অস্বস্তিবোধ করেও থাকেন, চেহারায় তা প্রকাশ পেল না। বরং বললেন, আমি একমত। আমরা আপনার প্রতি ঋণী হয়ে থাকলাম, মি. রানা।

প্রিমিয়ার শোতে বিনা টিকেটে একটা চেয়ার, বলল রানা। সমস্ত ঋণ শোধ হয়ে যাবে। ডাইনিং সেলুন থেকে টলতে টলতে বেরিয়ে এল ও, আরোহীদের কেবিনগুলোর দিকে যাবে। লাউঞ্জে সেই আগের জায়গাতেই রয়েছে হুপার আর পামেলা, তবে পার্থক্য হলো পামেলার মাথাটা এখন হুপারের কাঁধে, সম্ভবত ঘুমিয়ে পড়েছে। সৌজন্য দেখিয়ে একবার শুধু হাত নাড়ল রানা, জবাবে হুপারও। মনে হলো, রানার ঘন ঘন উপস্থিতিতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে সে।

নক না করেই ব্যারনের কেবিনে ঢুকে পড়ল রানা, যদি কেউ ঘুমিয়ে থাকে তাকে জাগাতে চায় না। নাক ডাকছে ইলেকট্রিশিয়ান এডি, ওরফে ইমানুয়েল কেলার। গভীর ঘুমে অচেতন। মিকি মুনফেস ওরফে ব্যারনের অসুস্থতা তার নার্ভকে এতটুকু অস্থির করতে পারেনি। ব্যারন জেগেই আছে, দেখে মনে হলো বিধ্বস্ত ও কাহিল, তবে এখনও ভুগছে বলে মনে হলো না-বিশেষ কারণটা হলো এলিনা স্টুয়ার্ট, বিছানার ওপর পাশে বসে তার হাত ধরে আছে। কে বলল এলিনার বন্ধু নেই?

গুড লর্ড! বিস্মিত হলো রানা। আপনি এখনও এখানে?

কি অদ্ভুত কথা, আপনিই তো আমাকে ওর ওপর নজর রাখতে বলে গেলেন!

হ্যাঁ, মনে পড়ছে বটে, তবে এতক্ষণ থাকবেন তা আশা করিনি। ব্যারনের দিকে তাকাল রানা। আগের চেয়ে ভাল বোধ করছেন?

অনেক ভাল, ডাক্তার, অনেক ভাল, যদিও খুবই দুর্বল আওয়াজ বেরুল গলা থেকে।

আপনার সঙ্গে কথা বলতে চাই, বলল রানা। বেশিক্ষণ লাগবে না, দুমিনিট। ঠিক আছে?

মাথা ঝাঁকাল মিকি মুনফেস।

এলিনা বলল, আমি তাহলে উঠি। বিছানা থেকে নামতে গেল সে।

তার কাঁধে একটা হাত রাখল রানা। কোন দরকার নেই। ব্যারনের আর আমার মধ্যে গোপন কোন ব্যাপার নেই। ওর কপালে চিন্তার রেখা ফুটল। তবে ব্যারন যদি কিছু গোপন করে রাখেন সেটা আলাদা কথা।

আমি? গোপন…কি গোপন করে রেখেছি? আকাশ থেকে পড়ল মুনফেস।

সেটাই তো শুনতে চাই। আপনার ব্যথাটা শুরু হলো কখন?

ব্যথা? সাড়ে নটা, দশটা-ধারেকাছে হবে, ঠিক বলতে পারব না। তখন কি আর ঘড়ি দেখার কথা কারও মনে থাকে?

আপনি ডিনারের পর আর কিছু মুখে দেননি তো?

না, আর কিছু খাইনি, ব্যারনের গলাও যথেষ্ট দৃঢ়।

ভেবে দেখুন, টিন থেকে নিয়ে দুএকটা বিস্কিট? বুঝতেই পারছেন, মি. মুনফেস, আমার খুব চিন্তা হচ্ছে। মিস স্টুয়ার্ট নিশ্চয়ই আপনাকে জানিয়েছেন যে আপনি একা নন, জাহাজের আরও অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। সবারই এক কেস, ফুড পয়জনিং। ডিনার খাবার পরপরই ওরা অসুস্থ হয়ে পড়ে। পয়জনিঙের উৎস কি জানার পর ওদের চিকিৎসা করা আমার জন্যে কঠিন হয়নি। তবে আপনার অসুস্থতার নিশ্চয়ই অন্য কোন কারণ আছে, সেই কারণটা আমার জানা নেই, তাই বুঝতে পারছি না কিভাবে চিকিৎসা করব। কাল সকালে অসম্ভব খিদে পাবে আপনার, কিন্তু পেটকে বিশ্রাম দেয়ার জন্যে তারপরও আপনাকে কিছু খেতে দেয়া যাবে না। সময় পেলে ওটা আবার ঠিক হয়ে যাবে।

আমি ঠিক বুঝলাম না, ডাক্তার।

আগামী তিন দিন শুধু চা আর টোস্ট।

চোখে অবিশ্বাস, হাঁ করে তাকিয়ে থাকল ব্যারন। চা আর টোস্ট? গলার আওয়াজ দুর্বল হলেও অত্যন্ত কর্কশ। তিন দিন?

আপনারই ভালর জন্যে, মি. মুনফেস। সান্ত্বনা দেয়ার জন্যে তার কাঁধে একবার চাপড় দিল রানা। তারপর সিধে হলো, যেন বিদায় নিতে যাচ্ছে। আমরা আবার আপনাকে সুস্থ দেখতে চাই, তাই না?

তাহলে বলি..মানে, আমার খুব খিদে পাচ্ছিল, ইতস্তত করে বলল ব্যারন।

কখন?

নটার ঠিক আগে।

তারমানে ডিনারের ঠিক আধ ঘণ্টা পরে?

ঠিক তখনই অসম্ভব বিরক্ত করতে শুরু করে খিদেটা। গ্যালিতে ঢুকে দেখি স্টোভে গরম হচ্ছে একটা পাতিল। কিন্তু এক চামচের বেশি খেতে পারিনি, শুনতে পেলাম কথা বলতে বলতে কারা যেন আসছে। লাফ দিয়ে কোল্ড রুমে চলে যাই আমি।

ওখানে আপনি লুকিয়ে থাকেন?

লুকিয়ে না থেকে উপায় ছিল না। দরজা সামান্য একটু ফাঁক করলেই ওরা আমাকে দেখে ফেলত।

তারমানে ওরা আপনাকে দেখেনি। ওরা চলে গেল। তারপর?

যাবার আগে পাতিলটা একেবারে খালি করে ফেলল ওরা, তিক্ত স্বরে বলল ব্যারন।

আপনি ভাগ্যবান।

ভাগ্যবান?

বাক আর পিটারসন, তাই না? দুজন স্টুয়ার্ড?

আ-আপনি কি-কিভাবে জানলেন?

ওরা আপনার প্রাণ বাঁচিয়েছে, ব্যারন।

ওরা…কি করেছে?

আপনি যা খেতে যাচ্ছিলেন ওরা তা খেয়ে শেষ করে ফেলে। সেজন্যেই আপনি বেঁচে আছেন। ওরা দুজন মারা গেছে।

০৫.

লাউঞ্জ খালি দেখে রানা ধরে নিল হুপার আর পামেলার রাত্রিকালীন অভিসার শেষ হয়েছে। গ্যালিতে মরিসনের সঙ্গে দেখা করার আগে চিন্তা-ভাবনা গুছিয়ে নেয়ার জন্যে হাতে পাঁচ মিনিট সময় আছে ওর। গুছিয়ে নেয়ার আগে অবশ্য খুঁজে পেতে হবে সেগুলো। কোনটাই হলো না, কারণ কম্প্যানিয়নওয়েতে পায়ের আওয়াজ। পাওয়া গেল। এলোমেলো পা ফেলে এগিয়ে এল এলিনা, ওর উল্টোদিকের একটা আর্মচেয়ারে ধপাস করে বসে পড়ল। এমন সুন্দর একটা মেয়ে, অথচ তার মুখ ঝুলে পড়ছে। তার বসার ভঙ্গিই বলে দেয়, ওকে কিছু বলতে এসেছে।

অসুস্থ লাগছে? জিজ্ঞেস করল রানা, দেখল চেয়ারের হাতল ধরা হাতের গিট সাদাটে হয়ে আছে।

তাকিয়ে থাকল এলিনা। যেন মনস্থির করতে পারছে না।

আমার ধারণা ছিল, সাগর আপনাকে কাহিল করতে পারে না, আবার রানাই কথা বলল।

আমার অসুস্থ বোধ করার কারণ অশান্ত সাগর নয়, বলল এলিনা।

আপনার আসলে বিছানায় গিয়ে ঘুমাবার চেষ্টা করা উচিত।

তাই? আপনি জানাবেন আরও দুজন লোক বিষ খেয়ে মারা গেছে, তারপরও আশা করবেন ঘুমাব আমি, ঘুমের মধ্যে মিষ্টি মিষ্টি স্বপ্ন দেখব? দুঃসংবাদ দেয়ার সময় আপনি কোন কৌশল করতে জানেন না।

দুঃখিত, বলল রানা। আমার মনে রাখা উচিত ছিল কেবিনে একজন দুর্বলচিত্ত নারী আছেন।

আমি আসলে সত্যি ভয় পাচ্ছি। ভয় পাওয়াই উচিত, সেটাই স্বাভাবিক। বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত চারজন লোককে সেবা করেছে সে, পরিচিত আরও তিনজন লোকের কথা জানে যারা ওই বিষক্রিয়াতেই মারা গেছে। তবে রানা তাকে এ-সব কিছু বলল না। বলল, ভয় সবাই আমরা মাঝে-মধ্যে পাই, মিস স্টুয়ার্ট।

আপনি আমাকে শুধু এলিনা বলবেন, প্লীজ। আপনিও ভয় পাচ্ছেন?

আমিও।

এখন? আপনি কি এখন ভয় পাচ্ছেন?

না। এখানে ভয় পাবার কি আছে?

মৃত্যু। অসুস্থতা আর মৃত্যু।

মৃত্যুর সঙ্গেই তো আমার বসবাস, এলিনা। মৃত্যুকে আমি ঘৃণা করি, তা ঠিক, তবে ভয় পাই না। যদি পেতাম, আমি ডাক্তার হতে পারতাম না।

 আমি আসলে ঠিক ভাবে বোঝাতে পারিনি। মৃত্যুকে আমি মেনে নিতে পারি, কিন্তু যখন অন্ধের মত আঘাত করে তখন ভয় লাগে। আপনি জানেন, ঠিক অন্ধের মত নয়। যেমন এখানে। মৃত্যু হামলা করছে বেপরোয়াভাবে, কোন যুক্তি বা কারণ ছাড়াই, কিন্তু আপনি জানেন কারণ বা যুক্তি না থেকে পারে না। বুঝতে পারছেন, আমি কি বলতে চাইছি?

মেটাফিজিক্স আমার সাবজেক্ট নয়, বলল রানা। মাফ করবেন।

আমি মেটাফিজিক্স নিয়ে কথা বলছি না। এক করা হাত দুটো এমনভাবে ঝাঁকাল এলিনা, বোঝা গেল রাগ হচ্ছে তার। এই জাহাজে মাক কিছু গোলমাল আছে, মি. রানা।

মারাত্মক গোলমাল? রানার চোখে কৃত্রিম বিস্ময়। কি গোলমাল, এলিনা?

আপনি আমাকে বোকা বলে ব্যঙ্গ করবেন না তো? গম্ভীর সুরে জিজ্ঞেস করল এলিনা।

আপনাকে আমি অপমান করতে পারি না, এলিনা। আপনাকে আমি সত্যিই পছন্দ করি।

সত্যি? ক্ষীণ হাসল এলিনা। ঠিক বোঝা গেল না কৌতুক বোধ করছে নাকি খুশি হয়েছে। আপনি কি সবাইকে এরকম পছন্দ করেন?

করি…আমি দুঃখিত।

জাহাজের পরিবেশ অদ্ভুত লাগছে না আপনার? লোকজনের আচরণ?

মাথা ঝাঁকাল রানা। অন্ধ আর কালা না হলে সবাই ব্যাপারটা দেখতে পাচ্ছে। সবাই সবার সঙ্গে এত বেশি বন্ধুত্ব দেখাচ্ছে, ব্যাপারটা সত্যি দৃষ্টিকটু। আমাদের এমপ্লয়ার মি. গোলডার কথা ধরুন। তিনি তার সহ-ডিরেক্টরদের দুচোখে দেখতে পারেন না, এমনকি নিজের মেয়েকেও নয়। মোনাকা, ট্যাকার, কার্লসন, বিশপ-এরা পিছন ফিরলেই এদের দুর্নাম শুনতে পাবেন তার মুখে। ব্যাপারটা অক্ষমনীয় মনে হতে পারত, যদি এঁরাও মি. গোলডার পিছনে তাঁর দুর্নাম না করতেন। দ্বিতীয় স্তরের লোকজনদের কথা ধরুন। ব্যারন, এডি মুনফেস, ল্যারি আর্চার, হেনেরিক ব্রায়ান ও মরগান–এরা সবাই ম্যানেজমেন্টের ওপর অসন্তুষ্ট। অথচ ম্যানেজমেন্ট তাদের অসন্তোষ বিবেচনা করতে একদম রাজি নয়। আর দুর্ভাগা ডিরেক্টর রবার্ট হ্যামারহেডের ওপর সবাই খেপা। হ্যাঁ, এ সবই আমার চোখে পড়েছে। তবে, মনে রাখতে হবে, এরা সবাই ফিল্ম লাইনের লোকজন।

আমাদের সম্পর্কে আপনার ধারণা খুব একটা ভাল নয়, তাই না?

এ-কথা কেন মনে হলো আপনার?

প্রশ্নের জবাব না দিয়ে আবারও প্রশ্ন করল এলিনা, কিন্তু আমরা সবাই কি খারাপ?

সবাই না। আপনি নন। পামেলা বা হুপারও নয়। তবে তার কারণ সম্ভবত এই যে ওদের বয়স খুব কম, ফিল্ম লাইনে নতুন এসেছে। আরও একজনকে ভাল বলতে পারি আমি-ডগলাস হিউম।

আবার এলিনার ঠোঁটের কোণে ক্ষীণ হাসি দেখা গেল। আপনি মনে করেন, সে-ও আপনার মত চিন্তা করে?

হ্যাঁ। তাকে আপনি চেনেন কি?

গুড মর্নিং বলি আমরা।

তাকে আপনার আরও ভালভাবে চেনা উচিত। আপনাকে চেনার সুযোগ পেলে খুশি হবেন তিনি। আপনাকে তিনি পছন্দ করেন-বলেছেন আমাকে। কিন্তু না, আপনাকে নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল না—অনেক বিষয়ে কথা বলার সময়। আপনার নামটা চলে আসে।

ফ্ল্যাটারার। এলিনার বলার সুরে নিন্দা বা প্রশংসা কোনটাই ফুটল না। তাহলে আমার সঙ্গে আপনি একমত? এখানের পরিবেশে অদ্ভুত কি যেন একটা গোলমাল আছে?

বোধহয়।

বোধহয় নয়, অবশ্যই। অবিশ্বাস, সন্দেহ, ঈর্ষা-এ-সব তো মানুষের মধ্যে থাকবেই, তবে এখানে ও-সব মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। আমি একটা কমিউনিস্ট দেশে জন্মেছি, মানুষও হয়েছি—জানেন তো?

হ্যাঁ। কবে পালিয়ে আসেন?

কয়েক বছর আগে।

কিভাবে?

প্লিজ। অন্যান্যরাও হয়তো সেইপথ ব্যবহার করতে চাইবে।

তাছাড়া, আমি যেহেতু কমিউনিস্টদের কাছ থেকে বেতন পাচ্ছি। অ্যাজ ইউ উইশ।

আপনার খারাপ লাগল? মাথা নাড়ল রানা। অবিশ্বাস, সন্দেহ, ঈর্ষা, মি. রানা। কিন্তু এ-সব ছাড়া আরও কিছু আছে। আরও অনেক কিছু। ঘৃণা আছে, আছে ভয়। আমি এ-সবের গন্ধ পাচ্ছি। আপনি পাচ্ছেন না?

এলিনা, কিছু একটা বলতে চান আপনি, কিন্তু বলার জন্যে বেছে নিয়েছেন কঠিন একটা পথ। নিজেকে এত কষ্ট দেয়ার কোন মানে হয় না। হাতঘড়ি দেখল রানা। আমি রাগ করছি না, কিন্তু আমার ওপর এক লোক রাগ করবে-তাকে অপেক্ষা করিয়ে রেখেছি।

মানুষ যদি পরস্পরকে যথেষ্ট ভয় পায় আর ঘৃণা করে, মাত্মক সব ঘটনা ঘটতে পারে। আপনি বলেছেন, মৃত্যুগুলো হয়েছে দুর্ঘটনাবশত, ফুড পয়জনিঙের কারণে। সত্যি কি তাই, ড. রানা?

এই কথা বলার জন্যে এতক্ষণ ইতস্তত করছেন। আপনার ধারণা, বিষটা ইচ্ছে করেও প্রয়োগ করা হয়ে থাকতে পারে। এই তো আপনার ধারণা?

হ্যাঁ, বলতে পারেন, আমার তাই ধারণা।

কে?

কে? রানার দিকে বিস্মিত হয়ে তাকাল এলিনা, বিস্ময়টা মনে হলো নির্ভেজাল।কে তা আমি কিভাবে জানব? যে-কেউ হতে পারে।

কে যদি বলতে না পারেন, বলুন, কেন?

ইতস্তত করল এলিনা, অন্য দিকে তাকাল, তারপর পলকের জন্যে রানার দিকে দৃষ্টি হেনে চোখ নামাল ডেকে। কেন তা-ও আমি জানি না।

তারমানে কমিউনিস্ট-প্রভাবিত ইন্সটিঙ্কট ছাড়া আপনার এই অবিশ্বাস্য সন্দেহের কোন ভিত্তি নেই।

বুঝতে পারছি, আমার পরিবেশন সুন্দর হয়নি।

পরিবেশন করার কিছু নেইই আপনার, এলিনা। ঘটনাগুলো পরীক্ষা করে দেখলেই বুঝতে পারবেন আপনার সন্দেহ কেমন বিদঘুটে। সব মিলিয়ে সাতজন লোক বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে। ভেবে দেখুন, কারা তারা? একজন ফিল্ম প্রডিউসার, একজন হেয়ারড্রেসার, একজন ক্যামেরা ফোকাস অ্যাসিস্ট্যান্ট, একজন মেট, একজন পেটি অফিসার, আর দুজন স্টুয়ার্ড। অর্থাৎ ভিক্টিম হিসেবে এদেরকে এলোপাতাড়ি বেছে নেয়া হয়েছে। বলতে পারেন, এদের মধ্যে কেউ কেউ কেন বাঁচল, কেউ কেউ কেন মারা গেল? আমাকে ব্যাখ্যা করে বোঝাতে পারবেন ভিক্টিমদের মধ্যে দুজনকে কেন বিষ খাওয়ানো হলো সেলুন টেবিলে, অপর দুজনকে কেন খাওয়ানো হলো গ্যালিতে, এবং আরেকজনকে, ব্যারনকে, গ্যালি বা সেলুনে কেন? পারবেন, এলিনা?

মাথা নাড়ল এলিনা, তার চকচকে খড় অর্থাৎ চুল ঝুলে পড়ে ঢেকে দিল চোখ। কে জানে, সে হয়তো রানার দিকে তাকাতে চাইছে না, কিংবা চাইছে না রানা তার দিকে তাকাক।

আমি বলব, এই হোল-সেল পয়জনিং পুরোপুরি অ্যাক্সিডেন্টাল, ইভনিং স্টারের কোন লোক এই সাতজনকে মেরে ফেলতে চায়নি। রানা অবশ্য বোঝাতে চাইছে না যে ইভনিং স্টারের কোন লোক এর জন্যে দায়ী নয়।

মাথা নিচু করে বসে থাকল এলিনা। উঠল রানা, টলতে টলতে সামনে এগোল। একটা হাত রাখল এলিনার চেয়ারের পিছনে, অপর হাত দিয়ে এলিনার চিবুকটা উঁচু করল সামান্য। সিধে হলো এলিনা, হাত দিয়ে চোখ থেকে চুল সরাল। খয়েরি চোখ দুটোয় এখনও ভয়ের ছায়া ফুটে রয়েছে। হাসল রানা, হাসল এলিনাও, যদিও সে হাসি মেয়েটার চোখ স্পর্শ করল না। সিধে হলো রানা, বেরিয়ে এল লাউঞ্জ থেকে।

গ্যালিতে পৌঁছুতে দশ মিনিট দেরি করে ফেলল ও। স্টুয়ার্ডস প্যানট্রি হয়ে ওখানে ঢোকার আগেই মরিসনের ভারি নিঃশ্বাস পতনের আওয়াজ ঢুকল তার কানে। মরগান লোকটা রোগাপাতলা, আর মরিসন দৈত্যাকার। প্রথমে রানার। মনে হলো মরগানের গলাটা দুহাতে চেপে ধরেছে মরিসন। তারপর দেখল, গলা নয়, গলার কাছে জ্যাকেট। বেচারা মরগান ছাড়া পাবার ব্যর্থ চেষ্টায় ছটফট করছে। মরিসনের কাঁধে টোকা দিল রানা।

আপনি ওকে গলা টিপে মেরে ফেলছেন, নরম সুরে বলল ও।

রানার দিকে একবার মাত্র তাকাল মরিসন, তারপর আবার নিজের কাজে মন দিল।

আবার, নরম সুরেই, বলল রানা, এটা নৌবাহিনীর কোন জাহাজ নয়, আমিও আপনার কমাণ্ডিং অফিসার নই, কাজেই আপনাকে আমি কোন নির্দেশ দিতে পারি না। তবে আমি সাক্ষী হিসেবে আদর্শ। বলতে চাইছি, আমার সাক্ষ্য বিচারক বিশ্বাস করবেন। মামলাটা যদি হয় খুনের চেষ্টা, আপনাকে তো ভুগতে হবেই, সারাজীবন ধরে যা সঞ্চয় করেছেন তা-ও শেষ হয়ে যাবে।

আবার রানার দিকে তাকাল মরিসন, এবার আর দৃষ্টি ফেরাল না। অনিচ্ছাসত্ত্বেও মরগানের জ্যাকেট ছেড়ে দিল সে। তবে ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকল, ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলছে।

মরগান প্রথমে নিজের গলায় হাত বুলিয়ে দেখে নিল ওটা অক্ষত আছে কিনা, তারপর চিৎকার জুড়ে দিল, শুনলে, কুৎসিত বনমানুষ? তোমার নামে মামলা করা হবে। খুনের চেষ্টা…

শাট আপ! ধমক দিল রানা। কিছুই দেখিনি আমি। এখনও দম ফেলতে পারছেন সেজন্যে ভাগ্যকে ধন্যবাদ দিন। মরগানের দিকে ভাল করে তাকাল ও। লোকটা সম্পর্কে তেমন কিছু জানা নেই ওর, পছন্দ করা বা না করার তো প্রশ্নই ওঠে না। নিজেকে সে একজন স্কট বলে পরিচয় দিলেও, তার বাচনভঙ্গিতে লণ্ডনের টান আছে। দুর্বল, খুদে আকৃতি; বাদামি রঙের মুখে অসংখ্য কাটাকুটির দাগ, মাথায় বিরাট টাক, তবে পিছন দিকের চুলগুলো সাদা ও লম্বা। তার চলাফেরায় ক্ষিপ্র একটা ভাব আছে, অনেকটা কাঠবিড়ালির মত। চোখে স্টীল। রিমের চশমা। নিজের জন্মদিন কবে জানে না, এমনকি কোন বছরে জন্ম তা-ও বলতে পারে না। তবে তার বয়স ষাটের কম হবে বলে মনে হয় না।

রানা লক্ষ করল, ডেকে কয়েকটা টিন পড়ে রয়েছে। টিনের গায়ে লেখা আর ছবি দেখে বোঝা গেল, ভেতরে সারভীন মাছ আছে। একটা বড় আকৃতির টিনে গরুর মাংস। আচ্ছা, মধ্য রাতের পেটুক আবার হামলা চালিয়েছে!

তারমানে? মরিসনের চোখে সন্দেহ।

ডিনারের সময় নিশ্চয়ই মি. মরগানকে আপনি পেট পুরে খেতে দেননি, বলল রানা।

মেরীর কিরে, এগুলো আমার জন্যে নয়। আসলে…, তীক্ষ্ণ গলায় প্রতিবাদ জানাল মরগান।

ব্যাটা চোর! খেঁকিয়ে উঠল মরিসন। একটু পিছন ফেরার যো নেই, অমনি চলে আসবে। কিন্তু কিছু চুরি হলে তার জন্যে দায়ী হবে কে, শুনি? সাপ্লাই কম। হলে, ক্যাপটেন কাকে দায়ী করবেন? আশ্চর্য, সবাইকে বিশ্বাস করার এই হলো ফল? আমার উচিত ছিল বুড়োটার ঘাড় ভেঙে পানিতে ফেলে দেয়া…

থাক, উত্তেজিত হয়ে কাজ নেই। মেঝের দিকে তাকাল রানা, তারপর মরগানের দিকে। আপনি কি শুধু এগুলোই নিয়ে যাচ্ছিলেন?

মেরীর কিরে খেয়ে বলছি…।

আহ্, চুপ করুন! মরিসনের দিকে ফিরল রানা। আপনি ঢুকে কি দেখলেন তাই বলুন।

কি আবার দেখব, দেখলাম ফ্রিজের ভেতর মাথা গলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ব্যাটাকে আমি হাতে-নাতে ধরেছি।

ফ্রিজের দরজাটা খুলল রানা। ভেতরে মাখন, পনির, দুধ, শিম আর টিনে ভরা মাংস রয়েছে। মরগানের দিকে তাকাল ও। এদিকে আসুন, আপনাকে আমি সার্চ করব।

কি বলতে চান? আপনি কি সিআইডির লোক, না পুলিস? অ্যাঁ?

ডাক্তার। জানার চেষ্টা করছি আজ রাতে লোকগুলো মারা গেল কেন। মুখ ঝুলে পড়ল মরগানের, চোখ দুটো বিস্ফারিত হয়ে উঠল। আপনি জানেন না বাক আর পিটারসন মারা গেছে?

হ্যাঁ, শুনেছি, বিড়বিড় করল মরগান, জিভের ডগা দিয়ে ঠোঁট চাটল। তার সঙ্গে আমার কি সম্পর্ক?

কি সম্পর্ক জানি না। অন্তত এখনও জানি না।

 কি বলছেন আপনি! মনে হলো কেঁদে ফেলবে মরগান। মিছিমিছি কেন ভয় দেখাচ্ছেন আমাকে? খুন-টুনের সঙ্গে আমার কোন সম্পর্ক নেই…।

তিনজন মারা গেছে, আরও চারজন প্রায় মারা যেতে বসেছিল। কারণটা ফুড পয়জনিং। ফুড আসে গ্যালি থেকে। আমি তাদের সম্পর্কে জানতে চাই, যারা বিনা অনুমতিতে গ্যালিতে ঢোকে। মরিসনের দিকে ফিরল রানা। আমাদের বোধহয় ক্যাপটেন ডানহিলকে খবর দেয়া উচিত।

না! মা মেরী, বাঁচাও আমাকে! মরিসন, ভাই আমার, দোহাই লাগে…মি. গোলডা আমাকে মেরে ফেলবেন!

এদিকে আসুন, ডাকল রানা। মরগান এগিয়ে এল। তাকে সার্চ করল ও। ফ্রিজের খাবারগুলো বিষ মাখাতে হলে একটাই অস্ত্র ব্যবহার করতে পারে সে, হাইপডারমিক সিরিঞ্জ। কিন্তু সার্চ করে কিছু পাওয়া গেল না। টিনগুলো কোথায়, কার কাছে নিয়ে যাচ্ছিলেন আপনি?

মি. মুনফেসের, মানে, ব্যারনের জন্যে। খানিক আগে আমি তার কেবিনে গিয়েছিলাম। বলল, প্রচণ্ড খিদে পেয়েছে তার। না, তা বলেনি। বলল, তার প্রচণ্ড খিদে পাবে, কারণ আপনি নাকি তাকে তিন দিন শুধু চা আর টোস্টের ওপর থাকতে বলেছেন। রানার মনে পড়ল ব্যারনকে কথাটা বলেছিল বটে, তবে তা শুধু তথ্য আদায়ের জন্যে। ওর উচিত ছিল হুমকিটা প্রত্যাহার করে নেয়া, কিন্তু ভুলে গিয়েছিল। মরগানের গল্পের এই অংশটুকু মিথ্যে নয়।

ব্যারন আপনাকে বললেন তার জন্যে এখান থেকে কিছু খাবার নিয়ে যেতে?

না।

আপনি নিজে থেকে বললেন, কিছু খাবার তাঁকে ম্যানেজ করে দেবেন?

না। আমি তাঁকে সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলাম। টিনগুলো দেখে তার চেহারা কেমন হয় দেখতে চেয়েছিলাম।

মরগান হয়তো সত্যি কথাই বলছে। কিংবা মাক কিছু গোপন করার জন্যে বানানো গল্প শোনাচ্ছে। আপনি এখন ফিরে গিয়ে ব্যারনকে জানাতে পারেন, ব্রেকফাস্টের সময় থেকে আবার আগের মতই খাওয়াদাওয়া করতে পারবেন তিনি।

মানে, আপনি বলছেন…আমি যেতে পারি? মি. মরিসন যদি আপত্তি না করেন।

নিজেকে আমি ছোট করব না, বলল মরিসন। এগিয়ে এসে খুদে মরগানের সরু ঘাড়ে পেশীবহুল একটা হাত রাখল সে। কেঁপে উঠল মরগান। তবে আবার যদি কখনও দেখি যে কিছু চুরি করছ, আমি তোমার… ঘাড়ে ধাক্কা দিয়ে গ্যালি থেকে মরগানকে বের করে দিল সে। খুব সহজে বেঁচে গেল, স্যার, অভিযোগের সুরে বলল রানাকে। আপনি এসে পড়ায়।

ওকে মারধর করলে আসলেও নিজেকে ছোট করা হয়, মি. মরিসন। আচ্ছা, আজ রাতে প্যাসেঞ্জাররা ডিনার খাবার পর বাক আর পিটার নাকি এখানে বসে খাওয়াদাওয়া সেরেছিল?

রোজ রাতেই খায়। ওয়েটিং স্টাফরা সাধারণত গেস্টদের আগেই খায়। মরগান চলে যাবার পর খুব নার্ভাস আর উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছে মরিসনকে।

পয়জনের উৎস সম্ভবত খুঁজে পেয়েছি আমি। আমার ধারণা হর্সর্যাডিশে অত্যন্ত মাত্নক বিষ, ক্লসট্রিডিয়াম বটুলিনাম ছিল। কিভাবে এল, তা বলতে পারব না। আপনি সাবধানী নন বলে দোষ দেয়া যাবে না। কারণ রান্নার আগে, রান্নার সময় বা রান্না হয়ে যাবার পরও জিনিসটা দেখে চেনার কোন উপায় নেই। হর্সর্যাডিশ কি খানিকটা রয়ে গিয়েছিল?

খানিকটা, হ্যাঁ। ওটা দিয়ে ক্যাসারোল তৈরি করি বাক আর পিটারসনের জন্যে, বাকিটা সরিয়ে রাখি।

সরিয়ে?

ফেলে দেয়ার জন্যে। এত বেশি ছিল না যে কাউকে পরিবেশন করা যাবে।

তারমানে নেই। আরেকটা দরজা বন্ধ হয়ে গেল, ভাবল রানা।

ভয় নেই। পলিথিন ব্যাগে সীল করে রেখে দেয়া হয়েছে। দুর্যোগের রাত, কাল সকালে ফেলা হবে।

দরজাটা আবার খুলে গেল। আপনি বলতে চাইছেন, জিনিসটা এখানে আছে এখনও?

অবশ্যই। হাত তুলে বাল্কহেডের সঙ্গে আটকানো চৌকো প্লাস্টিকের বাক্সটা দেখাল মরিসন। ওই তো।

এগিয়ে এসে বাক্সের ঢাকনি খুলল রানা।

আপনি সম্ভবত জিনিসটা পরীক্ষা করবেন? জিজ্ঞেস করল মরিসন।

 ইচ্ছে তো তাই ছিল, বলল রানা। বলা উচিত, ভেবেছিলাম পরীক্ষা করার জন্যে রেখে দেব। কিন্তু এখন আর তা সম্ভব নয়। আপনার বাক্সটা খালি।

খালি? ফেলে দিয়েছে সাগরে…এই দুর্যোগের রাতে? এগিয়ে এল মরিসন, শুধু শুধু নিজেও একবার উঁকি দিয়ে বাক্সের ভেতরটা দেখল। অদ্ভুত ব্যাপার। শুধু অদ্ভুত না, নিয়মও ভাঙা হয়েছে।

হয়তো আপনার সহকারী…।

কে, টমাস? ওই হতচ্ছাড়া আলসেটা? অসম্ভব। তাছাড়া, আজ তার ডিউটিও নেই। মাথা চুলকাল মরিসন। যীশুই বলতে পারবেন কেন তারা ফেলে দিল, তবে কাজটা নিশ্চয়ই বাক বা পিটারসনের।

হ্যাঁ, নিশ্চয়ই তাই, বলল রানা।

.

এত ক্লান্ত লাগছে যে নিজের কেবিন আর বাঙ্কের কথা ছাড়া রানার মাথায় আর কিছু ঢুকছে না। ভেতরে ঢুকে খালি বাঙ্কে তাকাবার পরই শুধু মনে পড়ল যে ওর কম্বলগুলো ওয়েন আর গ্যাবনের জন্যে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ঘুমে আধবোজা চোখে ছোট টেবিলটার দিকে তাকাল ও, যেখানে টক্সিলজিক্যাল বইগুলো রেখে গিয়েছিল। সঙ্গে সঙ্গে কোথায় পালাল ঘুম। অ্যাকোনাইটের ওপর তথ্য পাওয়া। গিয়েছিল মেডিকেল জুরিসপ্রুডেন্স-এর মোটা বইটায়, সেটা এই মুহূর্তে টেবিলের এক কোণায় পড়ে রয়েছে, জানা কথা ইভনিং স্টার ঝকি খাওয়ায় ছিটকে গেছে ওদিকে। সিল্ক বুকমার্ক রিবন, বইয়ের মাথায় আটকানো, প্রায় পুরোটা লম্বা হয়ে রয়েছে টেবিলের ওপর। অথচ রানার মনে আছে যে প্রবন্ধটা পড়ছিল সেটা চিহ্নিত করার জন্যে বুকমার্কটা ব্যবহার করেছিল, কেবিন থেকে বেরিয়ে যাবার আগে।

অ্যাকোনাইটের ওপর আর্টিকেলটা পড়েছে ও, এটা কেউ জানে। কে জানে?

.

কেবিনটাকে আর নিরাপদ ভাবতে পারছে না রানা। ট্রলারটাকে যারা ইয়টে রূপান্তর করেছে, কোন কেবিনেই তালা দেয়ার ব্যবস্থা রাখেনি। কেবিনে তালা দেয়া থাকলে জাহাজডুবির সময় লোকজন বেরুতে পারে না, সেজন্যে অনেক জাহাজের কেবিনেই তালা দেয়ার ব্যবস্থা থাকে না। তবে ছিটকিনি বা বোল্ট থাকা উচিত, এটাতে তা-ও নেই।

 রানার মনে পড়ল, সেলুনের কর্নার বাল্কহেডে একটা সেটী আছে, ওখানে আশ্রয় নেয়া যেতে পারে। পিছনে একটা দেয়াল তো থাকবেই, সেটী সীটের নিচে কয়েকটা কম্বলও আছে, ঠাণ্ডার হাত থেকে ভালই বাঁচা যাবে। সবচেয়ে বড় কথা, উজ্জ্বল আলো আছে সেলুনে, লোকজন সব সময় যাওয়া-আসা করছে। যদিও জানালা থেকে কেউ গুলি করলে কিছুই করার থাকবে না।

তারপর রানার মনে পড়ল, ও দেখে এসেছে মার্ভেলাস প্রোডাকশনের বোর্ড মীটিং চলছে সেলুনে। কতক্ষণ আগে? বিশ মিনিট তো হবেই। সম্ভবত আরও বিশ মিনিট পর জায়গাটা খালি হয়ে যাবে। মীটিঙে কোম্পানীর চারজন আছেন, রানা যে তাদেরকে সন্দেহ করে বলে এখুনি ওখানে যেতে চাইছে না, ব্যাপারটা সেরকম নয়। নিচে আলাদা একটা কেবিন থাকতে সেলুনে রাত কাটাবে ও, এটা তাদের দৃষ্টিতে অদ্ভুত বলে মনে হতে পারে।

সময়টা কাটানোর জন্যে, খানিকটা খেয়ালের বশেও, ব্যারন কেমন আছে দেখে আসবে বলে ঠিক করল রানা। সেই সঙ্গে মরগানের কথাটা সত্যি কিনা তা ও যাচাই করা যাবে। বাঁ দিকে তিন নম্বর দরজাটা ব্যারনের। ডান দিকের দ্বিতীয়টা হাঁ-হাঁ করছে। ওটা এলিনা স্টুয়ার্টের কেবিন। ভেতরে আছে সে, তবে ঘুমায়নি। টেবিল আর বাঙ্কের মাঝখানে একটা চেয়ার টেনে বসে আছে, চোখ দুটো পুরোপুরি খোলা, হাত দুটো কোলের ওপর।

কি ব্যাপার? দেখে মনে হচ্ছে জেগে থাকার সাধনা করছেন?

আমার ঘুম পাচ্ছে না।

কিন্তু দরজা খোলা কেন? কাউকে আশা করছেন?

না। দরজা বন্ধ করতে পারছি না।

 সে তো আপনি জাহাজে ওঠার পর থেকেই পারছেন না। তালা নেই।

জানি। আগে কিছু ভাবিনি। ভাবনাটা পেয়ে বসেছে আজ রাতে।

নিশ্চয়ই ভাবছেন না যে আপনি ঘুমালে চুপিসারে কেউ ভেতরে ঢুকবে?

কি ভাবছি নিজেও বুঝছি না। তবে আমি ভাল আছি। প্লীজ।

ভয় পাচ্ছেন? এখনও? মাথা নাড়ল রানা। জাহাজে আরও মেয়ে আছে, তাদের অনেকে একা শুতে ভয় পাচ্ছেন না।

যেমন?

যেমন পামেলা।

 পামেলা একা শোয়নি।

শোয়নি? ঠিক জানেন?

মাথা ঝাঁকাল এলিনা। পামেলা হুপারের সঙ্গে শুয়েছে। রিসেপশন রুমে।

আচ্ছা। তা আপনিও তো ওদের সঙ্গে ভিড়ে গেলে পারতেন। আপনি যদি নিরাপত্তা চান, সংখ্যার মধ্যে তা তো আছেই।

তিনজন মানে ভিড়।

তা বটে। ওখান থেকে বেরিয়ে ব্যারনের কেবিনে ঢুকল রানা। খানিকটা রঙ ফিরে এসেছে তার চেহারায়। জিজ্ঞেস করল কেমন আছে সে।

ভাল না, বলল ব্যারন, পেটে হাত বুলাচ্ছে।

অসুবিধেটা কি?

খিদের জ্বালা, বলল ব্যারন।

আজ রাতে পাবেন না কিছু। কাল থেকে আবার আগের মত শুরু করবেনচা আর টোস্টের কথা ভুলে যান। ও, হ্যাঁ, মরগানকে গ্যালি লুঠ করতে পাঠিয়ে কাজটা আপনি ভাল করেননি। মরিসন তাকে হাতেনাতে ধরে ফেলে।

মরগান? গ্যালিতে? ব্যারনের বিস্ময় নির্ভেজাল বলে মনে হলো রানার। আমি কেন পাঠাব!

নিশ্চয়ই ওখানে যাবার কথা আপনাকে বলেছেন তিনি।

কই, না! দেখুন, ডাক্তার, শুধু শুধু আমার ঘাড়ে দোষ চাপাবেন না

কেউ আপনার ঘাড়ে কিছু চাপাচ্ছে না। সম্ভবত তাঁর কথার ভুল অর্থ করেছি আমি। তিনি স্রেফ হয়তো আপনাকে একটা সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলেনআপনার খিদে সম্পর্কে কি যেন বলছিলেন…

খিদের কথা বলেছি ঠিকই, কিন্তু যীশুর কিরে…।

ঠিক আছে, ঠিক আছে, কারও কোন ক্ষতি হয়নি। গুড নাইট।

বেরিয়ে এল রানা, এলিনার খোলা দরজাটাকে পাশ কাটাল। তার সঙ্গে চোখাচোখি হলো, তবে কোন কথা বলল না দেখে থামল না রানা। নিজের কেবিনে ফিরে এসে হাতঘড়ি দেখল। মাত্র পাঁচ মিনিট পেরিয়েছে, আরও পনেরো মিনিট বাকি। দূর, অতক্ষণ অপেক্ষা করা যাবে না। শরীরটা খসে পড়তে চাইছে। ক্লান্তিতে। কিন্তু সেলুনে যাবার একটা কারণ থাকা চাই ওর। কয়েক সেকেণ্ড চিন্তা করতেই সমস্যার সমাধান পাওয়া গেল। মেডিকেল ব্যাগ খুলে একই জিনিস তিনটে বের করল ও-ডেথ সার্টিফিকেট। কেন বলতে পারবে না, গুণে দেখে রাখল আর কটা রইল ব্যাগে। দশটা। সব মিলিয়ে তেরোটা। কুসংস্কারে বিশ্বাস করে না বলে নিজের ওপর খুশি হলো। মেডিকেল ব্যাগে জাহাজের কিছু নোটপেপারও রয়েছে, আগের মালিক কাজে কোন খুঁত রাখতে জানতেন না। তিনটে সার্টিফিকেটের সঙ্গে কয়েকটা নোট পেপারও নিজের ব্রিফকেসে ভরল ও।

কেবিনের দরজা পুরোপুরি খুলল, বাইরে যতটা বেশি সম্ভব আলো পাবার জন্যে। প্যাসেজে কেউ নেই দেখে দ্রুত হাতে প্যাচ ঘুরিয়ে ডেক-হেড ল্যাম্পটা খুলে ফেলল। ডেকের কাছে কান নামিয়ে ল্যাম্পটা বার কয়েক হাত থেকে ছেড়ে দিল, শুরু করল এক ফুট ওপর থেকে। চারবারের ঝাঁকিতে ল্যাম্পের ফিলামেন্ট ভাঙার স্পষ্ট আওয়াজ পেল রানা। এবার অকেজো ল্যাম্পটা আবার হোল্ডারে আটকাল, তুলে নিল ব্রিফকেস, দরজা বন্ধ করে রওনা হলো ব্রিজের উদ্দেশে।

আপার ডেকে পৌঁছে, মই বেয়ে ব্রিজে ওঠার সময়, রানা দেখল আবহাওয়ার কোন উন্নতি হয়নি। তুষার খাড়া বা তির্যকভাবে পড়ছে না, আড়াআড়িভাবে ছুটছে। তুষারের মাত্রাও আগের চেয়ে বেশি মনে হলো, মাস্টহেডের আলোটা ক্ষীণ একটা আভার মত লাগছে। সাগরকে আগের চেয়ে একটু কম অশান্ত মনে হলেও, ভাবল ঘুম পাওয়ায় হয়তো সেটা ওর দেখার ভুল।

হুইলে রয়েছে জেমিসন। কম্পাসকে নয়, বেশি সময় দিচ্ছে রাডারস্কোপকে। দৃষ্টিসীমা এত কমে গেছে, তার কিছু করারও নেই। রানা জিজ্ঞেস করল, ক্যাপটেন তার ক্রুদের তালিকাটা কোথায় রাখেন বলতে পারবেন? নিজের কেবিনে?

না। ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল জেমিসন। চার্ট-হাউজে। ইতস্তত করল সে। কেন ওটা দরকার আপনার, মি. রানা?

ব্রিফকেস থেকে একটা ডেথ সার্টিফিকেট বের করে কন্ট্রোল প্যানেলের আলোতে ধরল রানা।

গম্ভীর হয়ে গেল জেমিসন। পোর্ট লকারে পাবেন, ওপরের দেরাজে।

তালিকা মানে মোটা একটা খাতা। তাতে ক্রুদের নাম-ঠিকানা, বয়েস, জন্মস্থান, ধর্ম, নিকন্দ্রীয় ইত্যাদি সমস্ত তথ্যই রয়েছে। এক জোড়া সার্টিফিকেট পূরণ করে খাতাটা রেখে দিল ও, রওনা হলো সেলুনের উদ্দেশে।

ফন গোলডা, তার তিন সহ-ডিরেক্টর ও কাউন্ট বট্রিউলাকে আধ ঘণ্টা আগে সেলুনে রেখে গিয়েছিল রানা, এখনও তারা পাঁচজন একটা টেবিলে গোল হয়ে বসে আছেন, প্রত্যেকের সামনে কার্ডবোর্ড মোড়া ফোল্ডার। ফোল্ডারের একটা স্ত প টেবিলের এক ধারে উঁচু হয়ে রয়েছে, স্তুপ থেকে কয়েকটা পড়েও গেছে। ডেকে। মুখের সামনে গ্লাস, গ্লাসের কিনারা দিয়ে রানার দিকে তাকালেন কাউন্ট বট্রিউলা। হাতে ব্র্যাণ্ডির গ্লাস ছাড়া তাকে কল্পনাও করা যায় না।

এখনও টহল দিচ্ছেন, মাই ডিয়ার ফেলো? আপনি আমাদের জন্যে সত্যি অনেক করছেন। এভাবে যদি চালিয়ে যান আমি প্রস্তাব করব আপনাকেও যেন। আমাদের একজন ডিরেক্টর হিসেবে গ্রহণ করা হয়।

সবাই কি আর পেশা বদল করতে চায়। ফন গোলডার দিকে তাকাল রানা। বিরক্ত করার জন্যে দুঃখিত। আমাকে কয়েকটা ফর্ম পূরণ করতে হবে। যদি আপনাদের ব্যক্তিগত আলোচনায় বিঘ্ন সৃষ্টি করে থাকি…

এখানে সে-ধরনের কিছু হচ্ছে না, জবাব দিলেন ক্লার্ক বিশপ। আমরা আসলে পরবর্তী পনেরো দিনের শূটিং স্ক্রিপ্ট পরীক্ষা করছি। শিল্পী আর কলাকুশলীরা সবাই একটা করে পাবেন কাল। এক কপি নেবেন আপনি?

ধন্যবাদ। আগে হাতের কাজটা শেষ করি। কেবিনের আলোটা নষ্ট হয়ে গেছে…আমি আবার ম্যাচের আলোয় কাজ করতে পারি না।

আমরা উঠতে যাচ্ছিলাম। ফন গোলডাকে এখনও ক্লান্ত দেখাচ্ছে, তবে শরীর থামার নির্দেশ দিলেও চালিয়ে যাবার মানসিক দৃঢ়তা তার যথেষ্ট পরিমাণেই। আছে। আমাদের সবারই এখন খুব গাঢ় একটা ঘুম দরকার।

আমিও সেই পরামর্শই দেব। পাঁচ মিনিট পর গেলে অসুবিধে নেই তো?

না, কোন অসুবিধে নেই।

ক্যাপটেন ডানহিলকে আমরা কথা দিয়েছি একটা চুক্তিপত্রে সই করব, তাই? তাতে লেখা থাকবে রহস্যময় অসুস্থতার ঘটনা আবার যদি ঘটে, তাকে দায়ী করা যাবে না। কাগজটা তিনি ব্রেকফাস্ট টেবিলে চেয়েছেন। যেহেতু ভোর চারটের সময় জাগবেন, ভাল হয় কাগজটায় এখুনি যদি আপনারা সই করেন।

মাথা ঝাঁকালেন তারা। কাছাকাছি টেবিলে বসে চুক্তিপত্রটা লিখে ফেলল রানা। পড়ে দেখার পর কেউ ওর লিখিত বিষয়-বস্তুর সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করলেন। না, কিংবা ক্লান্ত বলে ভাল করে পড়ে দেখলেন না, সবাই খসখস করে সই করে দিলেন। সই করলেন কাউন্ট বট্রিউলাও, রানা সতর্ক থাকল ওর চেহারায় যাতে বিস্ময়ের কোন ভাব না ফোটে। তিনিও যে পরিচালকদের সমান স্তরে আছেন, ওর। জানা ছিল না। রানার ধারণা ছিল ভদ্রলোক যেহেতু অত্যন্ত বিখ্যাত ক্যামেরাম্যান, নিশ্চয়ই ফ্রীল্যান্স হবেন এবং সে কারণে কোন ফিল্ম কোম্পানীর বোর্ডে নির্বাচিত হবার যোগ্য নন। তবে ফন গোলডার প্রতি তার শ্রদ্ধার অভাব কেন সেটার অন্তত ব্যাখ্যা পাওয়া গেল।

এবার ঘুমাতে যাব। চেয়ারটা পিছিয়ে নিলেন বিশপ। আপনিও, ডাক্তার?

ডেথ সার্টিফিকেটগুলো পূরণ করার পর।

অপ্রীতিকর একটা দায়িত্ব। রানার হাতে একটা ফোল্ডার ধরিয়ে দিলেন বিশপ। পরে আপনাকে এটা হয়তো খানিকটা হাসির যোগান দিতে পারে।

ফোল্ডারটা নিল রানা।

বিশাল শরীর নিয়ে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালেন ফন গোলডা। অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া, মি. রানা। লাশগুলোকে সাগরের হাতে তুলে দেয়ার ব্যাপারটা। অনুষ্ঠানটা কখন বলুন তো?

নিয়ম হলো দিনের প্রথম আলোয়, বলল রানা। শোকে চোখ দুটো বন্ধ করলেন ফন গোলডা। আপনার ওপর দিয়ে যে ধকল গেছে, মি. গোলডা, আমার পরামর্শ হলো অনুষ্ঠানটায় আপনার থাকার দরকার নেই। কাল আপনি যত বেশি সম্ভব বিশ্রাম নিন। সত্যি বলছেন, আমার বিশ্রাম নেয়া উচিত? মাথা ঝকাল রানা, ফন গোলডার চেহারা থেকে শোকের ছায়া সরে গেল। আমার হয়ে তুমি উপস্থিত থাকবে, ক্লার্ক?

অবশ্যই, বিশপ বললেন। গুড নাইট, ডাক্তার। সহযোগিতার জন্যে অসংখ্য ধন্যবাদ।

হ্যাঁ-হ্যাঁ, ধন্যবাদ আপনাকে, ধন্যবাদ, বললেন ফন গোলডা।

টলতে টলতে বেরিয়ে গেলেন সবাই। ডেথ সার্টিফিকেটের ফর্মগুলো বের করে পূরণ করতে বসল রানা। কাজটা শেষ করে সার্টিফিকেটগুলো সীল করা একটা এনভেলাপে রাখল। আরেকটা এনভেলাপে রাখল সই করা এফিডেভিট, নিজে সই করার পর। এনভেলাপে ক্যাপটেন ডানহিলের নাম লিখল ও, তারপর ব্রিজের উদ্দেশে রওনা হলো। জেমিসনকে বলবে, ভোরে ক্যাপটেন ব্রিজে এলে তাকে যেন দেয়া হয় এগুলো।

কিন্তু ব্রিজে জেমিসন নেই। তার বদলে সারা শরীর কম্বলে মুড়ে, হুইলের সামনে উঁচু একটা টুলে বসে থাকতে দেখা গেল ওয়েনকে। হুইল ধরেনি, আপনা থেকে পালা করে এদিক-ওদিক ঘুরছে ওটা। তার চোখের নিচে কালি, চেহারাটাও ম্লান, তবে এখন আর তাকে অসুস্থ লাগছে না। এত দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠাটা সত্যি বিস্ময়কর।

অটোমেটিক পাইলট, ব্যাখ্যা করল সে। আপনার উচিত ছিল বিছানায় থাকা, রানার গলায় অসন্তোষ।

সেখান থেকে এলাম, এখুনি আবার সেখানেই ফিরে যাব। ফাস্ট অফিসার ওয়েন পুরোপুরি সুস্থ নয়, জানে রানা। এসেছি স্রেফ পজিশন চেক করতে, এই। ফাঁকে জেমিসনকে কফি খাবার সুযোগ করে দিলাম। এ-ও ভেবেছিলাম যে আপনাকে হয়তো এখানে পাব। আপনি আপনার কেবিনে ছিলেন না।

আমি এখন এখানে। আমাকে খুঁজেছিলেন কেন?

ভিএসওপি, বলল ওয়েন। কেমন লাগছে শুনতে?

ভালই, বলল রানা। টুল থেকে নেমে কাবার্ডের দিকে এগোল ওয়েন, ক্যাপটেন ডানহিল তাঁর ব্র্যাণ্ডির বোতলগুলো ওখানেই রাখেন। শুধু এই জন্যে? আমাকে ব্র্যাণ্ডি খাওয়াবেন বলে?

 না। সত্যি কথা বলতে কি, বিশেষ একটা জিনিস মেলাবার চেষ্টা করছি। কিন্তু কাজটায় আমি ভাল নই। ভাবলাম আপনি বোধহয় সাহায্য করতে পারবেন। রানার হাতে একটা গ্লাস ধরিয়ে দিল ওয়েন।

টিম হিসেবে আমরা বোধহয় ভালই করব, বলল রানা।

সামান্য হাসল ওয়েন। তিনজন মারা গেছে। চারজন আধমরা। ফুড পয়জনিং। কি পয়জন?

মরিসনকে যা বলেছে রানা ওয়েনকেও তাই বলল। কিন্তু চ্যাং ওয়েন মরিসন নয়।

বিষটার বোধহয় নিজস্ব বিচার-বুদ্ধি আছে, তাই না? জিজ্ঞেস করল ওয়েন। আমরা সবাই একই খাবার খেলাম, কিন্তু সবাই আক্রান্ত হলাম না।

বিষ সম্পর্কে আসলে সত্যি কিছু বলা কঠিন। পিকনিকে গিয়ে ছজন একই দূষিত খাবার খেলো, তিনজনকে পাঠাতে হলো হাসপাতালে, কিন্তু বাকি তিনজন কিছু টেরই পেল না।

 কিন্তু মারাত্মক একটা বিষ একজনকে মেরে ফেলবে, আরেকজনকে কিছুই করবে না, এ হতে পারে না।

ব্যাপারটা আমার কাছেও খানিকটা অদ্ভুত লেগেছে। আপনার কি ধারণা? কি ভাবছেন?

বিষ আপনা থেকে মিশে যায়নি। মেশানো হয়েছে।

মেশানো হয়েছে? ইচ্ছা করে? ব্র্যাণ্ডির গ্লাসে চুমুক দিয়ে রানা ভাবল, ওয়েনের সঙ্গে কতদূর যাওয়া যায়। খুব বেশি দূর নয়, সিদ্ধান্ত নিল, অন্তত এখুনি নয়। বলল, অবশ্যই তাই, ইচ্ছে করেই কেউ করেছে কাজটা। করা খুব সহজও তো। আমাদের পয়জনারের কাছে, ধরুন, এক ব্যাগ পয়জন আছে। তার কাছে। আর আছে একটা জাদুর কাঠি। কাঠিটা নাড়ল সে, অমনি অদৃশ্য হয়ে গেল। তারপর ডাইনিং টেবিলের চারপাশে হাঁটাহাঁটি শুরু করে দিল। সবার খাবারে বিষ ঢালছে। মি. গোলডাকে দিল এক চিমটি, আমাকে দিল না, আপনাকে দিল এক চিমটি, এক চিমটি গ্যাবনকে, এরিক কার্লসন আর মিকায়েল ট্যাকারকে দিল না, দুই চিমটি দিল কেডিপাসকে, মেয়েদের কাউকে দিল না, ব্যারনকে দিল এক চিমটি, দুচিমটি করে বাক আর পিটারসনকে-এভাবে। খুবই খেয়ালি মানুষ, আমাদের এই অদৃশ্য বন্ধু।

আপনি এড়িয়ে যেতে চাইছেন, প্রতিবাদও করছেন মাত্রা ছাড়িয়ে। নিজেকে আপনি যতই হাবা প্রমাণ করার চেষ্টা করুন, আমি মানব না। আমার মত আপনার মনেও সন্দেহ আছে।

ছিল, সব বাতিল করে দিয়েছি। মোটিভ, সুযোগ, উপায়-পাওয়া অসম্ভব।

তারমানে আপনি সন্তুষ্ট?

যতটুকু সন্তুষ্ট হওয়া সম্ভব।

আই সী। এক সেকেণ্ড চিন্তা করল ওয়েন। আপনি জানেন, রেডিও অফিসে আমাদের একটা ট্রান্সমিটার আছে, উত্তর গোলার্ধের প্রায় সবখানে পৌঁছুতে পারা যায়? আমার কেন যেন মনে হচ্ছে খুব শিগগির ওটা আমাদের ব্যবহার করতে হবে।

কেন?

সাহায্য চাওয়ার জন্যে।

সাহায্য?

হ্যাঁ, সাহায্য-বিপদে পড়লে যা আপনার দরকার হয়। আমার ধারণা, এখুনি আমাদের সাহায্য দরকার।

দুঃখিত, বলল রানা। আপনার কথা আমি বুঝতে পারছি না। তাছাড়া, ব্রিটেন এখান থেকে অনেক দূরে।

ন্যাটোর আটলান্টিক ফোর্স নয়। নর্থ কেপ-এর আশপাশে কোথাও মহড়া দিচ্ছে ওরা।

আপনি দেখছি অনেক খবরই রাখেন। চীনা প্রবাদ-খবর রাখায় লাভ আছে, বিশেষ করে বিপদের সময়, বলল ওয়েন। আমার বুদ্ধির ধার হয়তো বেশি না, তবে একেবারে ছোট করেও দেখবেন না, প্লীজ।

তা আমি দেখছিও না। তবে আমাকেও ওভার এস্টিমেট করবেন না। ব্র্যাণ্ডির জন্যে ধন্যবাদ। স্টারবোর্ড স্ক্রীন ডোর-এর দিকে চলে এল রানা। ইভনিং স্টার এখনও এদিক ওদিক কাত হচ্ছে আর ঝাঁকি খাচ্ছে, তবে বাতাসে ছিন্নভিন্ন নিচের পানি এখন আর দেখতে পাবার কোন উপায় নেই, গোটা দৃশ্যটা ঢাকা পড়ে আছে তুষারে। উইং ব্রিজ ডেকে তাকাল রানা, পায়ের দাগ দেখতে পেল তুষারের ওপর। একজন লোকের পায়ের ছাপ, কিনারাগুলো এত তীক্ষ্ণ আর পরিষ্কার যে মনে হলো এইমাত্র কেউ হেঁটে গেছে। ওখান দিয়ে। তারমানে কেউ একজন ওখানে দাঁড়িয়ে ছিল, দাঁড়িয়ে ওর আর ওয়েনের আলাপ শুনেছে। তারপর ওর মনে পড়ল, মাত্র একজন লোকের ছাপ, ছাপটা ও নিজে তৈরি করেছে। দাগগুলো এখনও নতুনের মত লাগার কারণ হলো, তুষার ঝড় বইছে আড়াআড়িভাবে। ভাবল, ওর আসলে ঘুম দরকার। ঘুমের অভাবেই আজেবাজে কল্পনা আসছে মাথায়। তারপর অনুভব করল, ওর পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে ওয়েন।

আপনি কি আমার সঙ্গে মন খুলে কথা বলতে পারেন না, মি. রানা? জিজ্ঞেস করল সে।

অবশ্যই। নাকি আমাকেই আপনি অদৃশ্যমানব বলে সন্দেহ করছেন, একে এক চিমটি ওকে দুচিমটি দিয়ে বেড়াচ্ছি?

না। তা ভাবছি না। তবে এ-ও বুঝতে পারছি যে আপনি আমার সঙ্গে মন খুলে কথা বলবেন না। ওয়েনের গলা থমথম করছে। এমন হতে পারে আজ কথা না বলায় একদিন হয়তো আফসোস হবে আপনার।

০৬.

সেলুনে ফিরে এসে কোণার সেটীতে শুয়েছে রানা, ক্লার্ক বিশপের দেয়া বুকলেটটা খুলতে যাবে, এই সময় দরজায় শব্দ হলো। কবাট খুলে ভেতরে ঢুকল এলিনা। স্টুয়ার্ট। তার খড় রঙা চুলে তুষার লেগে রয়েছে, পরনে ভারি একটা টুইড। জ্যাকেট।

আচ্ছা, আপনি তাহলে এখানে! দড়াম করে দরজাটা বন্ধ করে বলল সে, অভিযোগের সুরে।

হ্যাঁ, অপরাধ স্বীকার করল রানা, এখানেই আমি।

কেবিনে দেখলাম আপনি নেই। আপনার আলোটা নষ্ট…জানেন কি?

জানি। কিছু লেখালেখির কাজ ছিল, সেজন্যেই এখানে আসতে হয়। কেন, খারাপ কিছু ঘটেছে নাকি?

টলমল করতে করতে এগিয়ে এসে রানার উল্টোদিকের সেটীতে বসে পড়ল। এলিনা। সে তো আগেই ঘটেছে। আমি এখানে থাকলে আপনি কিছু মনে করবেন না তো?

মৃদু হেসে রানা বলল, আপনি চলে গেলে আমি অপমানিত বোধ করব।

জবাবে মৃদু হেসে সেটীটায় ভাল করে বসল এলিনা, কোটটাও ভাল করে জড়িয়ে নিল গায়ে। তারপর চোখ বুজল। কিন্তু বসে থাকায় ইভনিং স্টারের ঝুঁকির সঙ্গে সে-ও ঝুঁকি খাচ্ছে ঘনঘন, ফলে হাত দিয়ে সেটীর কিনারা ধরে পতন ঠেকাতে হচ্ছে। দৃশ্যটা অস্বস্তির মধ্যে ফেলে দিল রানাকে।

আপনি বরং আমার সেটীতে চলে আসুন, ওটার চেয়ে বড় এটা। এখানে অতিরিক্ত কম্বলও আছে।

চোখ খুলল এলিনা। না, ধন্যবাদ।

অগত্যা উঠতে হলো রানাকে। টলমল পায়ে এগিয়ে এসে মেয়েটার গায়ে। একটা কম্বল জড়িয়ে দিল। গম্ভীর মুখে ওকে দেখল এলিনা, তবে কিছু বলল না।

নিজের সেটীতে ফিরে এসে বুকলেটটা তুলে নিল রানা। কিন্তু সেটা না খুলে চিন্তা করতে লাগল ওর অনুপস্থিতিতে কে কে ঢুকতে পারে ওর কেবিনে। এলিনা ঢুকেছিল, তবে ও নিজেই তা স্বীকার করেছে। এখানে তার উপস্থিতিই ব্যাখ্যা করে ঢোকার কারণটা। ওর ভয় করছে, নিঃসঙ্গ এবং অসহায় বোধ করছে, কোনও একজনের সঙ্গ দরকার। কিন্তু ওর সঙ্গ কেন? কেন…ধরা যাক, ডগলাস হিউমের নয়? কিংবা সমশ্রেণীর অভিনেতা হ্যানস ব্রাখটম্যান বা ব্রাড ফাগুসনের সঙ্গ নয় কেন? এমন কি হতে পারে, আমার সঙ্গ চাওয়ার পিছনে বিশেষ কারণ। আছে? মেয়েটা কি নজর রাখছে আমার ওপর? হয়তো অন্য কাউকে আমার কেবিনে ঢোকার সুযোগ করে দিচ্ছে। হঠাৎ বিচলিত হয়ে উঠল রানা-ওর কেবিনে এমন সব জিনিস আছে যা কাউকে দেখতে দেয়া যায় না।

বুকলেটটা রেখে দিয়ে লী ডোর-এর দিকে এগোল রানা। চোখ খুলে মাথা তুলল এলিনা। আবার যাচ্ছেন কোথায়?

বাইরে।

দুঃখিত। আমি আসলে…আবার ফিরে আসছেন তো?

দুঃখিত আমিও। আপনাকে বলে যাওয়া উচিত ছিল। নিচে যাচ্ছি, এখুনি। ফিরব।

মাথা ঝাঁকাল এলিনা, তার দৃষ্টি দরজা বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত অনুসরণ করল রানাকে। বাইরে বেরিয়ে এসে স্থির দাঁড়িয়ে থাকল রানা বিশ সেকেণ্ড, তারপর দ্রুত হেঁটে চলে এল জানালার সামনে। প্লেট গ্লাসে চোখ রেখে দেখল এলিনাকে যেমন বসে থাকতে দেখে এসেছে ঠিক তেমনি বসে আছে সে-এখন শুধু হাঁটুর ওপর কনুই রেখেছে, মুখটা দুই হাতের তালুতে, ধীরে ধীরে এদিক ওদিক মাথা নাড়ছে। একবার ইচ্ছে হলো সেলুনে ঢুকে আদর করে মেয়েটাকে, অভয় দিয়ে বলে ও থাকতে তার ভয়ের কোন কারণ নেই। তবে না, নিজেকে শক্ত করল ও। জানালার সামনে থেকে চলে এল প্যাসেঞ্জারদের কেবিন এলাকায়।

মাঝরাত পেরিয়ে গেছে, তবে লাউঞ্জ বার এখনও বন্ধ হয়নি। কাঁচমোড়া দরজা খুলে ফন গোলডার হুইস্কি চুরি করছেন জক মুর। চোখাচোখি হতে এক গাল হাসলেন। শুধু একবার মাথা ঝাঁকাল রানা, থামল না, লাউঞ্জ থেকে বেরিয়ে নেমে এল নিচে।

কেবিনে ঢুকে রানার মনে হলো যেখানে যা থাকার কথা সব এখনও ঠিকঠাকই আছে। তবে দক্ষ কোন লোক চিহ্ন রেখে যাবে না। নিজের দুটো সুটকেস খুলে ভেতরে একটা করে চুল রাখল ও, কেউ হাত দিলে ওটা ওখানে থাকবে না। ঢাকনি বন্ধ করে দুটো সুটকেসেই তালা লাগাল। সবশেষে তালা দিল মেডিকেল ব্যাগে-সাধারণ মেডিকেল ব্যাগের চেয়ে আকারে অনেক বড় আর ভারি এটা, ভেতরে অনেক ইকুইপমেন্ট আছে। ব্যাগটা নিয়ে প্যাসেজে বেরিয়ে এল, কবাট বন্ধ করার আগে কজার দুইঞ্চি ওপরে খালি একটা দেশলাইয়ের বাক্স গুঁজে দিল। কবাট খুললে পড়ে যাবে ওটা।

লাউঞ্জে এসে দেখল জক মুর এখনও রয়েছেন সেখানে। জাদুর বাক্স নিয়ে আবার কোথায় চললেন আমাদের দয়ালু হিলার! নতুন কোন মহামারী দেখা দিয়েছে নাকি? আপনার বুড়ো আংকেল মুর আপনাকে নিয়ে গর্বিত। আমার সঙ্গে যোগ দেবেন নাকি? হাতের বোতলটা উঁচু করে দেখালেন রানাকে।

ধন্যবাদ, মি. মুর, না। আপনি শুতে যাচ্ছেন না কেন? কাল সকালে উঠবেন কিভাবে?

আরে, ভাতিজা, গোটা ব্যাপারটাই তো তাই নিয়ে-কাল আমি উঠতে চাই না। আমি মুখোমুখি হব কাল বাদে পরশু দিনটার। আগামীকাল আমি পছন্দ করি না, ওগুলো সবসময় আজকের মত হয়। একটা আজ সম্পর্কে একমাত্র ভাল কথা। হলো, তার কিছুটা অন্তত অতীত-প্রতি মুহূর্তে সেটা দীর্ঘ হয়। কিন্তু আগামীকাল মানেই ভবিষ্যৎ-পুরোটা। হাতের বোতলটা উঁচু করে দেখালেন আবার। অন্যরা অতীতকে ভোলার জন্যে মদ খায়। কিন্তু আমি, অন্যদের চেয়ে অনেক বেশি ইন্টেলিজেন্ট আর সচেতন, মদ খাই ভবিষ্যৎ ভোলার জন্যে। আপনি জিজ্ঞেস করতে পারেন, ভবিষ্যৎকে কিভাবে ভোলা সম্ভব? আসলে প্র্যাকটিস দরকার। সেই সঙ্গে, কারণ বারির খানিকটা সহযোগিতাও। বোতলে চুমুক দিলেন তিনি।

মি. মুর, বলল রানা, আমার ধারণা আপনি ম্যাকবেথের ভগ্নাংশও নন।

একটা করুণ মূর্তি, বিষণ্ণ এক মানুষ, ধ্বংসই যার আসন্ন নিয়তি ম্যাকবেথ। না, আমার সঙ্গে কোনই মিল নেই। মুরদের আছে দুর্দমনীয় প্রাণশক্তি, অজেয় আড্ডা। আপনাদের শেকসপীয়ারকে যত খুশি ভাল বলতে পারেন, আমার প্রিয় হলো ওয়াল্টা দে লা ম্যারে। বোতলটা তুলে ভেতরে আর কতটুকু হুইস্কি আছে চোখ কুঁচকে দেখে নিলেন। উনি বলেছেন, লুক ইওর লাস্ট অন অল থিংস লাভলি এভরি আওয়ার।

আপনি যেভাবে বুঝছেন তিনি সম্ভবত সেভাবে বোঝাতে চাননি, মি. মুর, বলল রানা। একজন ডাক্তার হিসেবে বলছি, এবার আপনি নিজের কেবিনে গিয়ে। শুয়ে পড়ুন। মি. গোলড়া জানতে পারলে বিপদে পড়বেন।

গোলডা? তাহলে একটা কথা বলব? রানার দিকে ঝুঁকলেন মুর, যেন গোপন কিছু বলতে যাচ্ছেন। গোলডা আসলে অত্যন্ত দয়ালু লোক। আমি তাকে পছন্দ করি। সে আমার সঙ্গে সব সময় ভাল ব্যবহার করে। আসলে বেশিরভাগ মানুষই তো ভাল, তাই না? বেশিরভাগই দয়ালু। তবে গোলডার মত নরম কেউ না। তাহলে শুনুন, মনে পড়ছে…

তার হাত থেকে বোতলটা কেড়ে নিয়ে শেলফে রেখে দিল রানা, দরজা বন্ধ। করে চাবিটা রাখল নিজের ড্রেসিং গাউনের পকেটে। আপনি যখন বুঝতে পারবেন যে মি. গোলডা সম্পর্কে আপনার ধারণা একশো ভাগই ভুল, তখন আপনার কাছাকাছি আমি থাকতে চাই না। রানার সঙ্গে এগোচ্ছেন মুর, কোন প্রতিবাদ না করেই। কম্প্যানিয়নওয়ে বেয়ে নিচে নামল ওরা, মুরকে তার কেবিনের ভেতর ঠেলে দিল রানা।

কেবিনে ঢুকে নিজের বাঙ্কে বসলেন তিনি, তারপর হাত বাড়িয়ে বিছানার তলা থেকে একটা বোতল বের করলেন। আমাকে বলতে পারেন, স্বর্গেও কি বার আছে? প্রচুর মদ পাওয়া যায়?

তথ্যটা আমার জানা নেই, মি. মুর।

তারমানে আপনি শুধু একজন ডাক্তার, সর্বজ্ঞানের উৎস নন? এবার আপনি ফিরে যেতে পারেন, মাই গুড ফেলো।

ঘুমন্ত রবার্ট হ্যামারহেডের দিকে তাকাল রানা, তারপর কাঁধ ঝাঁকিয়ে সরে এল ওখান থেকে।

.

যেখানে বসিয়ে রেখে গিয়েছিল সেখানেই এলিনাকে দেখতে পেল রানা, হাত দুটো শরীরের দুপাশে, সেটীর কিনারা আকড়ে ধরে জাহাজের ঝাঁকি আর দোল সামলাচ্ছে। ক্লান্ত মুখের তুলনায় তার ব্রাউন, চোখ দুটো এখন অনেক বড় দেখাচ্ছে, রানার দিকে একবার তাকিয়ে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল।

দুঃখিত, বলল রানা। প্রোডাকশন ম্যানেজারের সঙ্গে ক্লাসিকস নিয়ে আলাপ করছিলাম। কোণার সেটীতে বসল ও। তাকে আপনি চেনেন তো?

জক মুরকে সবাই চেনে। হাসতে চেষ্টা করল এলিনা। গত ছবিটায়ও তাঁর সঙ্গে কাজ করেছি আমি। আপনি বোধহয় দেখেননি।

না। তবে ছবিটার কথা শুনেছে রানা, শুনেই ওটা থেকে মাইল পাঁচেক দূরে থাকার তাগিদ অনুভব করেছে।

জঘন্য একটা ব্যাপার। আমার কাজ এত খারাপ হয়েছে যে বলার নয়। তারপরও যে কেন আবার আমাকে সুযোগ দিল, বুঝি না।

আপনি অত্যন্ত সুন্দরী, বলল রানা। আপনার অভিনয় করতে না জানলেও চলে। তবে, আপনার দ্বারা ভাল অভিনয় হতেও পারে, আমি জানি না। আমরা মি. মুর সম্পর্কে কথা বলছিলাম।

হ্যাঁ, তার সঙ্গে কাজ করেছি আমি। শুধু তাঁর সঙ্গে না, মি. গোলডা আর মি. কার্লসনের সঙ্গেও। ওঁদের সঙ্গে এটা আমার তৃতীয় ছবি। মানে, মি. কার্লসন…মানে, মি. কার্লসন…।

জানি, মি. কার্লসন কিছুদিন অনুপস্থিত ছিলেন। তাহলে মি. মুরকে আপনি পছন্দ করেন?

বড় অদ্ভুত মানুষ তিনি। খুব মজার মানুষও। সবাই তাকে পছন্দ করে, তিনিও সবাইকে পছন্দ করেন। এমন কি মি. গোলডারও খুব পছন্দের মানুষ তিনি। খুব ঘনিষ্ঠ ওঁরা। সম্পর্কটাও তো অনেক দিনের।

তা তো জানতাম না। মি. মুর কি বিবাহিত?

তা বলতে পারব না। বোধহয়, কিংবা হয়তো ডিভোর্স হয়ে গেছে। কিন্তু তার সম্পর্কে এত কথা জিজ্ঞেস করছেন কেন?

রোগী বা সম্ভাব্য রোগী সম্পর্কে জানার সুযোগ পেলে ছাড়ি না কখনও।

মৃদু হেসে চোখ বুজল এলিনা। তার মানে আলোচনার এখানেই সমাপ্তি। সেলুনের তাপমাত্রা কমছে, সেটীর নিচ থেকে আরেকটা কম্বল নিয়ে গায়ে জড়াল রানা, তারপর বিশপের দেয়া বুকলেটটা তুলে নিল। পাতা ওল্টাল, প্রথম পৃষ্ঠায় বড় বড় অক্ষরে লেখা রয়েছে বেয়ার অ্যাইল্যাণ্ড। ওটাই একমাত্র শিরোনাম। তার নিচ থেকে শুরু হয়েছে বিষয়-বস্তু।

চারদিকে ব্যাপকভাবে আলোচনা হচ্ছে, মার্ভেলাস প্রডাকশন তাদের সর্বশেষ ছবিটা সম্পর্কে চরম ও রহস্যময় গোপনীয়তা অবলম্বন করছে। এ-ব্যাপারে সিনে। ম্যাগাজিনগুলো বিশেষভাবে সোচ্চার। তারা বলছে, বিনা খরচে প্রচারের সুযোগ থেকে কোন ফিল্ম কোম্পানী নিজেকে বঞ্চিত করবে, এমন ঘটনা আগে কখনও ঘটেনি। রানাও মনে মনে স্বীকার করল, অদ্ভুত ঘটনাই বটে। কিন্তু যে যাই বলুক, প্রচার সত্যি আমরা চাই না। চাই না আলোচ্য ছবির গল্পের কারণে। গল্পটাই এমন, ফাস হয়ে গেলে সারা দুনিয়ায় একটা আলোড়ন সৃষ্টি হবে। সেক্ষেত্রে এমন সব বাধা আসতে পারে যে ছবিটা শেষ পর্যন্ত আমরা হয়তো বানাতেই পারব না।

এলিনার কাশি রানার পড়ায় বিঘ্ন সৃষ্টি করল। কাশতে কাশতে নীল হয়ে গেল তার চেহারা। বুকলেটটা রেখে দিয়ে সেটী থেকে নামল রানা, এগিয়ে এসে এলিনার একটা হাত ধরল। আরে, আপনি তো দেখছি জমে যাচ্ছেন।

কই। আসলে খুব ক্লান্ত, এমনিতে ঠিকই আছি।

আপনার কেবিন কিন্তু এখানের চেয়ে অন্তত বিশ ডিগ্রী বেশি গরম।

কিন্তু কেবিনেও তো ঘুম আসবে না। কখন থেকে ঘুমাচ্ছি না জানেন…? এখানেই আমি ভাল আছি। প্লীজ।

রানা বলল, তাহলে আমার কোণার সেটীতে উঠুন, ওখানে একটু বেশি আরাম পাবেন।

হাতটা ছাড়িয়ে নিল এলিনা। প্লীজ।

তার দিকে পিছন ফিরে দুপা এগোল রানা নিজের সেটীর দিকে, তারপর ঘুরল। এগিয়ে এসে দুহাতে ধরে বুকে তুলে নিল তাকে। কথা না বলে ওর দিকে শুধু তাকিয়ে থাকল মেয়েটা, বাধাও দিল না। নিজের সেটীর ওপর বসাল রানা তাকে, নিজেও তার পাশে বসল। রানার দিকে তাকিয়ে থাকল সে, পালা করে একবার ওর ডান চোখে, তারপর আবার বা চোখে। কিছুক্ষণ পর বরফ ঠাণ্ডা একটা হাত রানার জ্যাকেটের ভেতর গলিয়ে দিল। এত সব ঘটছে, একবারও কোন কথা বলল না এলিনা, চেহারাতেও কোন ভাব ফুটল না। জ্যাকেটের ভেতর হাত গলিয়ে এভাবে ওকে স্পর্শ করায় মুগ্ধ হত রানা, যদি না শুধু সন্দেহটা থাকত মনে-কেউ হয়তো এলিনাকে নির্দেশ দিয়ে রেখেছে, ওর ওপর কড়া নজর রাখতে হবে। মেয়েটা তার দায়িত্ব নিষ্ঠার সঙ্গেই পালন করে যাচ্ছে, এত কাছ থেকে নজর রাখছে যে রানা নিঃশ্বাস ফেললেও জানতে পারবে।

নিজের কম্বলটা গায়ে জড়িয়ে মার্ভেলাস প্রোডাকশন-এর বুকলেটটা আবার তুলে নিল রানা। পরবর্তী দুপৃষ্ঠাতে গোপনীয়তা বজায় রাখার যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করা হয়েছে, যদিও ব্যাখ্যাটা রানাকে সন্তুষ্ট করতে পারল না। এরপর বলা হয়েছে, গল্পটা দাঁড় করাতে লেখকের ওপর দিয়ে কী ধকলটাই না গেছে। লেখক মানে সম্ভবত এরিক কার্লসন। এক পর্যায়ে লেখা হয়েছে, অনেকগুলো সম্ভাব্য বিকল্প বাদ দিয়ে শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত হয়, আমাদের প্রজেক্টের লোকেশন হবে বেয়ার আইল্যাণ্ড হ্যাঁ, আমরা সচেতন যে রওনা হবার আগে আপনারা সবাই জানতেন উত্তর নরওয়ের কাছাকাছি একটা দ্বীপ হবে আমাদের গন্তব্য। আসলে এটা একটা গুজব ছিল, আমরাই ছড়াই। কারণ আমরা চাইনি আমাদের আসল গন্তব্য কেউ জানুক। এই কৌশল অবলম্বন করায় আমরা ক্ষমা চাইব না, কারণ ব্যাপারটা গোপন রাখা আমাদের প্রজেক্টের জন্যে অত্যন্ত জরুরী ছিল।

এবার বেয়ার আইল্যাণ্ড সম্পর্কে একটা ধারণা দেয়ার চেষ্টা করা যাক। নিচে যে বিবরণ দেয়া হলো তা আমরা অসলোর রয়্যাল জিয়োগ্রাফিক সোসাইটি থেকে পেয়েছি, বিবরণের অনুবাদটাও ওঁরা করে দেন। এটা সংগ্রহ করে তৃতীয় একটা পক্ষ, যারা মার্ভেলাস প্রোডাকশন-এর সঙ্গে কোনভাবেই যুক্ত নয়। সেই তৃতীয় পক্ষের পরিচয় কখনই প্রকাশ করা হবে না। এখানে বলে রাখা দরকার যে নরওয়ে সরকার দ্বীপটায় আমাদেরকে ছবি তোলার অনুমতি দিয়েছেন। তাদেরকে জানানো হয়েছে, ওয়াইল্ডলাইফের ওপর একটা ডকুমেন্টারি করব আমরা। রানা। এরিক কার্লর্সনের লেখা পরিচ্ছেদটা পড়ছে, ওর মাথায় ঢুকছে না এ-সব কথা কি উদ্দেশ্যে লিখতে গেলেন ভদ্রলোক।

এক সময় বেয়ার আইল্যাণ্ড দাবিদারবিহীন একটা দ্বীপ ছিল। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে খনিজ সম্পদ আহরণের পিছনে ও হোয়েলিং অপারেশন খাতে প্রচুর পুঁজি খাটাবার পর নরওয়ে দ্বীপটার মালিকানা চেয়ে আবেদন জানায়। কনফারেন্সের (কোন কনফারেন্স তা উল্লেখ করা হয়নি) সামনে পেশ করা হয় আবেদনটা ১৯১০, ১৯১২ ও ১৯১৪ সালে। প্রতিবারই রাশিয়া বাধা দেয়ার কারণে প্রস্তাবটা বিবেচনা করা হয়নি। তবে ১৯১৯ সালে অ্যালাইড সুপ্রীম কাউন্সিল নরওয়েকে বেয়ার আইল্যাণ্ডের সার্বভৌম স্বত্ব দান করে, আনুষ্ঠানিকভাবে হস্তান্তর করা হয়। ১৯২৫ সালে ১৪ আগস্টে।

এরপর বেয়ার আইল্যাণ্ড সম্পর্কে জানা তথ্যগুলোই পড়ে গেল রানা। নরওয়ের নর্থ কেপ থেকে দুশো ষাট মাইল উত্তর-উত্তর-পশ্চিমে দ্বীপটা, আর স্পিজবার্জেন থেকে প্রায় একশো চল্লিশ মাইল দক্ষিণে। নিকটতম দ্বীপের কাছ থেকে দূরত্বের হিসেবে, আর্কটিকের সবচেয়ে বিচ্ছিন্ন দ্বীপ বেয়ার আইল্যাণ্ড।

এরপর দ্বীপটার ইতিহাস বর্ণনা করা হয়েছে, বিবরণ দেয়া হয়েছে খনিজ ও অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদের। তারপর বলা হয়েছে জলবায়ু সম্পর্কে। প্রাকৃতিক বিপদ বা দুর্যোগ বেয়ার আইল্যাণ্ডের স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য। কারণটাও স্পষ্ট-গালফ স্ট্রীম আর পোলার ড্রিফট একসঙ্গে মিশেছে এখানে। প্রায় সারাক্ষণই ঘন কুয়াশায় ঢাকা থাকে দ্বীপটা। গরম কালেই তাপমাত্রা ফ্রিজিং পয়েন্ট থেকে পাঁচ ডিগ্রীর বেশি ওপরে ওঠে না। মধ্য জুনের দিকে লেকগুলো বরফ মুক্ত হয়, গলতে শুরু করে তুষার। এপ্রিলের ত্রিশ তারিখ থেকে আগস্টের তেরো তারিখ পর্যন্ত, মোট এই একশো ছদিন মাঝরাতে সূর্য দেখা যায়। নভেম্বরের সাত থেকে ফেব্রুয়ারির চার পর্যন্ত দিগন্তরেখার নিচে থাকবে মামা।

রানা ভাবল, তাহলে বছরের এই সময়টায় ছবি করতে যাবার কি কারণ? দিনের আলো তো ঘণ্টা কয়েকের বেশি পাওয়াই যাবে না। আর আলো না থাকলে শূটিং হবে কি করে? নাকি গোটা ছবিই রাতে তোলা হবে?

বুকলেটে বলা হয়েছে বেয়ার আইল্যাণ্ডের আকৃতি একটা ত্রিভূজের মত। উত্তর-দক্ষিণে, সবচেয়ে লম্বা অংশটা বারো মাইল, চওড়া অংশটা মাইল দশেক। উত্তর আর পশ্চিম দিকটা সমতলই বলা যায়, পাহাড়ী এলাকা দক্ষিণ আর পুব দিকটা। কোন গ্লেসিয়ার নেই, তবে অসংখ্য লেক আছে, যদিও কোনটাই কয়েক গজের বেশি চওড়া নয়। বেয়ার আইল্যাণ্ডের উপকূল রেখাকে দুনিয়ার অন্যতম বৈরী একটা জায়গা বলে অভিহিত করা হয়। কথাটা বিশেষ করে দক্ষিণ দিক সম্পর্কে সত্যি, দ্বীপটা সেখানে শেষ হয়েছে খাড়া পাহাড় প্রাচীরে, জলপ্রপাত হয়ে সাগরে পড়ছে পাহাড়ী নদী। পাহাড়-প্রাচীরের নিচে, সাগরের পানিতে ছড়িয়ে রয়েছে বিশাল আকৃতির সব পাথর। পাহাড়-প্রাচীরের গায়ে নানা জাতের পাখি বাস করে, আঁকেঝকে হরেক রকম অতিথি পাখি এসে ডিম পাড়ে।

লী সাইডের দরজা খুলে গেল হঠাৎ, হোঁচট খেয়ে ভেতরে ঢুকল স্টিল ফটোগ্রাফার ল্যারি আর্চার। সে আমেরিকান, কথা বলে কম, হাসে আরও কম। সেলুনে ওদেরকে দেখে দাঁড়িয়ে পড়ল সে, চেহারায় অনিশ্চিত একটা ভাব। দুঃখিত…, ফিরে যাবার জন্যে ঘুরতে শুরু করল।

যাবেন না, যাবার দরকার নেই, বলল রানা। দেখে যা মনে হচ্ছে আসল ব্যাপারটা সেরকম নয়। এখানে আমরা ডাক্তার রোগীর সম্পর্কটাই ধরে রেখেছি, অবনতি ঘটতে দিইনি।

দরজা বন্ধ করে সেটীতে বসল আর্চার, খানিক আগে যেটায় একা বসেছিল এলিনা।

অনিদ্রার শিকার? জিজ্ঞেস করল রানা।

সব সময় তামাক পাতা চিবায় আর্চার, এখনও চিবাচ্ছে। হ্যাঁ। আর আমার ঘুম না আসার কারণ হলো মরগান। সে অসুস্থবোধ করছে।

মরগান তার কেবিন-মেট, জানে রানা। গ্যালিতে তাকে যখন শেষবার দেখেছে রানা, ঠিক সুস্থ ছিল বলা চলে না। তবে সে অসুস্থতার কারণ ছিল মরিসনের হুমকি। একটা প্রশ্নের উত্তর অবশ্য পাওয়া যাচ্ছে, গ্যালি থেকে বেরিয়ে কেন সে ব্যারনের সঙ্গে দেখা করেনি। কি রকম অসুস্থ সে? জিজ্ঞেস করল রানা।

চেহারা সবুজ হয়ে গেছে। গোটা কার্পেট ভিজিয়ে ফেলেছে। নাক কোঁচকাল আর্চার।

এলিনা। মৃদু ধাক্কা দিল রানা। দুঃখিত, আমাকে একবার ঘুরে আসতে হয়। এলিনা কথা বলল না, তবে রানার সাহায্য পেয়ে উঠে বসল। আর্চারের দিকে একবার তাকাল সে, তারপর আবার চোখ বুজল।

মরগান সেরকম অসুস্থ বলে মনে হয় না…মানে বিষ-টিস বোধহয় নয়… রানাকে যেতে বাধা দিচ্ছে আর্চার।

দেখে আসায় দোষ নেই। রানা ভাবছে, মরিসনের হাতে ধরা পড়ার আগে গ্যালিতে কিছুক্ষণ একা ছিল মরগান, কি খেয়েছে না খেয়েছে কে জানে।

আর্চারের কথাই ঠিক, আশ্চর্য সবুজ হয়ে গেছে মরগানের চেহারা। নিজের বাঙ্কে বসে আছে সে, দুই বাহু দিয়ে পেটটা যেন আড়াল করে রেখেছে। রানাকে দেখে কাতর গলায় বলল, গড, আমি মারা যাচ্ছি। তারপর কোম্পানীর কর্তাব্যক্তিদের গালাগাল শুরু করল সে। রানা তাকে দুটো ঘুমের বড়ি দিয়ে বেরিয়ে এল। অ্যাকোনাইট পয়জনে আক্রান্ত রোগী কথা বলতে পারে না, চিৎকার করার তো প্রশ্নই ওঠে না।

সেলুনে সেই আগের মত বসে রয়েছে এলিনা, জাহাজের সঙ্গে এদিক ওদিক দুলছে। আর আপনমনে তামাক পাতা চিবিয়ে যাচ্ছে আর্চার। আপনার কথাই ঠিক, সী-সিকনেস, বলল রানা। এলিনার কাছ থেকে সামান্য দূরে বসল ও। বন্ধ চোখের পাতা শুধু একবার নড়ে উঠল এলিনার, রানার ফিরে আসায় আর কোন প্রতিক্রিয়া হলো না। মি. আর্চার, সেলুনে ঠাণ্ডা খুব বেশি, আপনি বরং এখান। থেকে একটা কম্বল নিয়ে গায়ে জড়ান।

না, ধন্যবাদ। এখানে যে এত ঠাণ্ডা, আমার ধারণা ছিল না। লেপ আর বালিশ ছাড়া আমি ঘুমাতে পারি না, ওগুলো নিয়ে লাউঞ্জে চলে যাব। ক্ষীণ হাসল আর্চার। ভয় শুধু একজনকেই, গিয়ে হয়তো দেখব নিশাচর মি. মুর এখনও চৌর্যকর্মে রত। জক মুর যে লাউঞ্জের পানীয় চুরি করেন, সবারই তা জানা। আরও কিছুক্ষণ তামাক পাতা চিবাল সে, ক্যাপটেন ডানহিলের লোহার ট্রলিটা ইঙ্গিতে দেখাল রানাকে। খুব বেশি ঠাণ্ডা লাগলে ওই বোতলটা থেকে দুঢোক খেতে পারেন, ডক্টর রানা।

তা পারি। তবে হুইস্কি বিশেষ পছন্দ নয় আমার। কি ওটা?

 ভাল করে তাকাল আর্চার। ব্ল্যাক লেবেল।

একদমই চলবে না। ইচ্ছে হলে আপনি খেতে পারেন। খাওয়াই উচিত, আপনার ঠাণ্ডা কমবে। ইতস্তত করার কোন কারণ নেই, মি. গোলডার মউজুদ থেকে চুরি করা হয়েছে ওটা।

স্কচ আমার প্রথম পছন্দ নয়, বলল আর্চার।

আরে তাতে কি, শরীর গরম করা নিয়ে কথা। অন্তত অল্প একটু খেতে পারেন।

বোতলটার দিকে অনিশ্চিত ভঙ্গিতে তাকাল আর্চার।

এলিনাকে বলল রানা, আপনি? উপকারী জিনিস, সত্যি বলছি। খাবেন নাকি?

চোখ খুলে তাকাল এলিনা, চেহারায় আশ্চর্য নির্লিপ্ত ভাব। না, ধন্যবাদ। ও সব আমি খাই না বললেই চলে। আবার চোখ বন্ধ করল সে।

হঠাৎ অন্যমনস্ক হয়ে উঠল রানা। ওই বোতল থেকে আর্চার হুইস্কি খাবে না, খাবে না এলিনাও, অথচ আর্চারের ধারণা রানার খাওয়া উচিত। ওর অনুপস্থিতিতে আর্চার আর এলিনা কি সীটে ছিল, নাকি ব্যস্ত মৌমাছির মত আচরণ করেছে একজন পাহারায় ছিল, অপরজন বোতলটায় কিছু মিশিয়েছে? সেলুনে ঢুকে এমন একটা কথা বলল আর্চার, মরগানকে না দেখতে গিয়ে উপায় ছিল না রানার। হয়তো সেলুন থেকে ওকে বিদায় করার জন্যেই মরগানের অসুস্থতার কথা তোলে সে। এলিনা সেলুনে আসার আগে হয়তো আর্চারের সঙ্গে কথা বলে এসেছিল, বলে এসেছিল বুদ্ধি করে সেলুন থেকে ওকে কিছুক্ষণের জন্যে সরাতে হবে। মরগানের অসুস্থতা কাকতালীয় ঘটনা হতে পারে না, কেন, আর্চার তাকে হয়তো অল্প একটু বিষ খাইয়ে দিয়ে এসেছে।

হঠাৎ সচেতন হলো রানা। টলমল করতে করতে ওর দিকেই এগিয়ে আসছে আর্চার, হাতে ব্ল্যাক লেবেলের বোতলটা। বোতলে হুইস্কি আছে তিন ভাগের এক ভাগ। রানার সামনে দাঁড়িয়ে টলতে লাগল সে, ওই অবস্থাতেই গ্লাসে হুইস্কি ঢালল। আমরা দুজনই বোধহয় শুধু শুধু লজ্জা পাচ্ছি, ডক্টর। নিন, প্রথমে আপনি। উত্তম না খেলে অধম খায় কি করে বলুন!

আর্চারকে হাসতে দেখে রানাও হাসল। পরীক্ষা করার ইচ্ছেটা প্রশংসাযোগ্য। কিন্তু না, ধন্যবাদ। চেখে একবার দেখা হয়েছে, আমার ভাল লাগেনি। আপনি?

না, আমি চাখিনি, কিন্তু…

তাহলে ভাল কি খারাপ বলেন কিভাবে?

আমার মনে হয় না।

আপনি তো অধম হিসেবে চাখতে যাচ্ছিলেনই। গো অ্যাহেড। খান।

চোখ মেলল এলিনা। উনি খেতে চাইছেন না, তারপরও খেতে বলার মানে কি? ডাক্তাররা কি জোর করে রোগীদের অ্যালকোহল খাওয়ান?

খেঁকিয়ে উঠে রানার বলতে ইচ্ছে করল, তুমি চুপ করো! কিন্তু তা না বলে মৃদু হেসে বলল, টীটোটাল অবজেকশনস ওভাররুলড।

আরে খেলে ক্ষতি কি? বলল আর্চার, গ্লাসটা তুলে ঠোঁটে ঠেকাল সে।

এলিনার দিকে তাকাল রানা, তার চোখে সামান্য অসন্তোষ ছাড়া অন্য কোন প্রতিক্রিয়া নেই। তাড়াতাড়ি আবার আর্চারের দিকে ফিরল ও, দেখল গ্লাসটা ঠোঁট থেকে নামাচ্ছে সে, ইতিমধ্যে সেটা অর্ধেক খালি হয়ে গেছে।

মন্দ নয়, মন্তব্য করল আর্চার। তবে কেমন যেন অদ্ভুত লাগল স্বাদটা।

এ-কথা বলার দায়ে স্কটল্যাণ্ডে আপনাকে গ্রেফতার করা হত, বিড়বিড় করে বলল রানা। নিজেকে বোকা বোকা লাগছে ওর। ভিলেন বিনা দ্বিধায় হেমলক পান। করেছে, সহযোগিনী তাকিয়েছিল নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে।

আপনাকে ধন্যবাদ দিতে হয়, ডক্টর বলে গ্লাসটা আবার ভরে নিল আর্চার। গাটা সত্যি গরম হয়ে উঠছে। বোতলটা লোহার ট্রলিতে রেখে এসে আবার বসল নিজের সেটীতে। সম্ভবত আধ মিনিটের মত ওখানে বসে থাকল সে, তিন চার চুমুকে শেষ করল হুইস্কিটুকু, তারপর হঠাৎ দাঁড়াল। শরীর এখন এতটাই গরম আমার, মি. মুরকে অগ্রাহ্য করা কোন ব্যাপার না। কামরা থেকে দ্রুত বেরিয়ে গেল সে।

দরজাটার দিকে তাকিয়ে থাকল রানা। বুঝতে পারছে না কেন এসেছিল আর্চার, হঠাৎ এভাবে চলেই বা গেল কেন। এলিনার দিকে তাকাল ও, তাকে খুনী। ভেবেছিল বলে সামান্য লজ্জা পেল। যেন ও তাকিয়ে আছে বুঝতে পেরেই চোখ মেলল এলিনা, চেহারায় সেই নির্ভেজাল নির্লিপ্ততা, তবে রানার মনে হলো এই ভাবটার পিছনে রয়েছে নিরঙ্কুশ অসহায়তা। কোন কথা না বলে উঠে বসল সে, কম্বলটা ভাল করে গায়ে জড়িয়ে নিয়ে ওর গায়ের কাছে সরে এল। সাড়া দেয়ার একটা তাগাদা অনুভব করল রানা, একটা হাত তুলে এলিনার কাঁধের ওপর রাখল। কিন্তু হাতটা সেখানে বেশিক্ষণ থাকল না, কারণ ওর কব্জি ধরে হাতটা তার মাথার ওপর দিয়ে নিজের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দিল এলিনা। ডাক্তাররা সর্বংসহা, এটা বোঝাবার জন্যে হাসল রানা। এলিনাও ক্ষীণ হাসল, তবে তার চোখ দুটো কি কারণে কে জানে ভরে উঠল পানিতে। তারপর হঠাৎ সেটী থেকে নেমে পড়ল মেয়েটা, মুখোমুখি হলো রানার, তাকিয়ে থাকল রানার বোতাম লাগানো শার্টের দিকে, কোমল হাত দুটো দিয়ে আগেই জড়িয়ে ধরেছে ওকে। এলিনার বাহুবন্ধনে আটকা পড়ল রানা, মনে মনে জানে ওকে এভাবে বন্দী। করাটাই তার আসল কাজ, কারণ সে চায় না তাকে ফেলে কোথাও চলে যায় ও। গর্বিত ও নিঃসঙ্গ একটা মেয়ে, এই স্বভাববিরুদ্ধ আচরণ করতে তাকে কতটুকু মূল্য দিতে হচ্ছে জানা নেই রানার। ঘুম পাচ্ছে ওর, মাথাটাকে সচল রাখা কঠিন। হয়ে উঠল। তাছাড়া, ওকে যেন সম্মোহিত করে রেখেছে ব্ল্যাক লেবেলের বোতলটা। ইভনিং স্টারের দোলার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বোতলের ভেতর পানীয়টুকুও দুলছে। রানা ডাকল, এলিনা?

বলুন। মুখ তুলে রানার দিকে তাকাল না সে। এখন আর শার্টের দিকেও তাকিয়ে নেই এলিনা, শার্টে মুখ ঠেকিয়ে রেখেছে। শার্টটা ভিজেও গেছে ইতিমধ্যে।

আপনাকে বিরক্ত করতে চাই না, কিন্তু গলাটা এমন শুকিয়ে গেছে যে এক ঢোক না খেলেই নয় আর।

হুইস্কি?

ঠিক ধরেছেন।

না। রানাকে আরও জোরে জড়িয়ে ধরল এলিনা।

না?

হুইস্কির গন্ধ আমার একদম পছন্দ নয়।

তবে কি ধরে নেব আমাকে আপনার চুমো খাবার ইচ্ছে আছে?

জানি না। ইচ্ছেটা জাগতেও পারে।

আপনি আমার স্ত্রী নন বলে আমি সত্যিই আনন্দিত।

আরও পাঁচ মিনিট পেরিয়ে গেল, রানা উপলব্ধি করল রাতের মত অচল হয়ে গেছে ওর মাথা। অলস হাতে মার্ভেলাস প্রোডাকশনের বুকলেটটা আবার তুলে নিল ও। লণ্ডনের একটা ব্যাংকের ভল্টে জমা রাখা হয়েছে স্বয়ংসম্পূর্ণ স্ক্রীন-প্রে… এইসব ছাইপাশ পড়ল কিছুক্ষণ, তারপর রেখে দিল আবার। ইতিমধ্যে ওর পাশে আবার বসেছে এলিনা, ওর গায়ে হেলান দিয়ে চোখ বুজে রয়েছে, বোধহয়। ঘুমিয়ে পড়েছে। তার শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক ও নিয়মিত। পরীক্ষা করার জন্যে সামান্য একটু নড়ল রানা, নিঃশ্বাসের পতনে কোন পরিবর্তন ঘটল না। তারপর মেয়েটার বন্ধ চোখে ফুঁ দিল একবার, পাতার ভেতর মণিটা নড়ল না, তবে রানাকে জড়িয়ে থাকা হাত দুটো আরও একটু শক্ত হলো। বোঝা গেল, ঘুমাবার আগে অবচেতন মনকে সাবধান করে দিয়েছে এলিনা।

তারপরও রানা সিদ্ধান্ত নিল, ওর ঘুমানো চলবে না। যত কষ্টই হোক, ভোর না হওয়া পর্যন্ত জেগে বসে কাটিয়ে দেবে সময়টা। এই সিদ্ধান্ত নেয়ার দুমিনিটের মাথায় ঘুমিয়ে পড়ল।

০৭.

ঘুম ভাঙল রানার, তারপরও ওর বাম হাতটা জাগল না, সম্পূর্ণ অবশ আর প্রায় অকেজো হয়ে থাকল। ডান হাত দিয়ে ধরতে হলো কব্জিটা, হাতঘড়ির আলোকিত ডায়াল দেখার জন্য। চারটে বেজে পনেরো মিনিট।

দশ সেকেণ্ড পর প্রশ্ন জাগল মনে, ঘড়ি দেখার কথা মনে হলো কেন ওর? কারণ, সেলুনের ভেতরটা এই মুহূর্তে অন্ধকার। কিন্তু সেলুন অন্ধকার কেন? ঘুমোবার আগে দেখেছে সবগুলো আলো জ্বলছিল। পরবর্তী প্রশ্ন, ওর ঘুম ভাঙল কেন? গায়ে ধাক্কা লেগেছে, নাকি কানে কোন শব্দ ঢুকেছে? যে কারণেই ঘুম ভেঙে থাকুক, রানার ঘাড়ের পিছনে লোমগুলো দাঁড়িয়ে গিয়ে জানিয়ে দিল সেলুনে একা নয় ও।

আলতোভাবে এলিনার কব্জি ধরে হাতটা সরিয়ে দিল রানা। অবচেতন মনকে বলা আছে, মৃদু বাধা দিল এলিনা। বাধা অগ্রাহ্য করে নিজেকে মুক্ত করল ও, নেমে পড়ল সেটী থেকে, সাবধানে পা ফেলে সেলুনের মাঝামাঝি জায়গায় সরে এল।

টেবিলের কিনারা ধরে স্থির দাঁড়িয়ে আছে ও। অনুভব করতে পারছে, আবহাওয়ার অবস্থা খানিকটা ভাল হয়েছে। ওর মনে পড়ল, লী সাইডের দরজার পাশে আলোর সুইচ, ডুপ্লিকেট আরেক সেট সুইচ আছে স্টুয়ার্ডস প্যানট্রিতে। আন্দাজের ওপর ভর করে দরজার দিকে এক পা এগোল রানা, তারপর আবার স্থির হয়ে গেল। কামরার ভেতর যে-ই থাক, সে কি জানে ওর ঘুম ভেঙেছে, এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে আছে মেঝেতে? ওর চোখ সদ্য খোলা, আগন্তুকের চোখ তা নয়, ফলে অন্ধকারে ওর চেয়ে বেশি দেখতে পাচ্ছে সে। সে কি ধরে নেবে ওর প্রথম। কাজ সুইচের দিকে এগোনো? এই মুহূর্তে বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে পথের মাঝখানে? তার সঙ্গে কি কোন অস্ত্র আছে? ওর নিজের কাছে আছে মাত্র একটা হাত, অপর হাতটা এখনও প্রায় অবশ, ঝিন ঝিন করছে।

ধাতব শব্দ হলো, দরজার হাতল ঘোরানোর আওয়াজ। হিম বাতাস স্পর্শ করল রানাকে। লী ডোর দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে আগন্তুক। দ্রুত পা ফেলে দরজার কাছে পৌঁছে গেল রানা, দরজা পেরিয়ে বেরিয়ে এল ডেকে ঝট করে ডান হাতটা উঠে এল চোখের সামনে, অনুরক্ষার ভঙ্গিতে, কারণ অকস্মাৎ চোখ ধাঁধানো উজ্জ্বল আলো আঘাত করেছে ওর মুখে। হাত তোলার পর রানা বুঝল, ওর উচিত ছিল বাম হাতটা তোলা। ডান হাতটা রিজার্ভ রাখা উচিত ছিল আঘাত ঠেকানোর জন্যে। আঘাতটা লাগল ওর ঘাড়ের এক পাশে। ভোতা ও ভারি কিছু দিয়ে মারা হয়েছে। দরজার বাইরের কিনারা আঁকড়ে ধরে দাঁড়িয়ে থাকার ব্যর্থ চেষ্টা করল। ও। জ্ঞান হারায়নি, ধীরে ধীরে পড়ে গেল ডেকের ওপর। পা দুটো আসলে কিছুক্ষণের জন্যে অবশ হয়ে গিয়েছিল, একটু পরই আবার সিধে হয়ে দাঁড়াতে পারল ও।

ডেকে রানা একা। আততায়ী এখন কোথায়, কোন দিকে গেছে, কিছুই। বলতে পারবে না। টলতে টলতে সেলুনে ফিরে এল ও, দেয়াল হাতড়ে আলো জ্বালল, বন্ধ করল লী সাইডের দরজাটা। কনুইয়ের ওপর ভর দিয়ে সেটীতে শুয়ে রয়েছে এলিনা, একটা হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে চোখ রগড়াচ্ছে, যেন গভীর ঘুম থেকে এইমাত্র জাগল। চোখ ফিরিয়ে নিল রানা, এলোমেলো পা ফেলে ক্যাপটেন ডানহিলের টেবিলের দিকে এগোল, ধপাস করে বসে পড়ল তাঁর। চেয়ারটায়।

বোতলটার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকল রানা। তারপর গ্লাসটার খোঁজে চোখ ফেরাল, যেটা থেকে পান করেছিল আর্চার। গ্লাসটা কোথাও দেখা যাচ্ছে না। ডেকে পড়ে যেতে পারে, গড়িয়ে চলে যেতে পারে যে-কোন দিকে। টেবিল র‍্যাক থেকে অন্য একটা গ্লাস তুলে নিল রানা, খানিকটা হুইস্কি ঢালল সেটায়, চুমুক দিয়ে খেয়ে ফেলল, তারপর ফিরে এল নিজের সীটে। ঘাড়টা অসম্ভব ব্যথা করছে। মাথাটা জোরে একবার ঝাঁকালে ধড় থেকে খসে পড়বে বলে মনে হলো।

নাক দিয়ে শ্বাস নেবেন না, বলল রানা। তাহলেই হুইস্কির বাজে গন্ধটা আর পাবেন না। এলিনাকে ধরে বসিয়ে দিল ও, নিজে বসল তার পাশে, গায়ে কম্বল জড়াল, তারপর এলিনার কাঁধে একটা হাত রাখল। এবার হয়েছে।

কি ব্যাপার? কি ঘটেছে? নিচু গলা এলিনার, একটু বোধহয় কাঁপা কাঁপা।

কিছু না, দরজা। বাতাসে খুলে গিয়েছিল। বন্ধ করতে হলো।

কিন্তু আলো নেভানো ছিল কেন?

আমিই নিভিয়ে রেখেছিলাম, আপনি ঘুমোবার পর।

কম্বল থেকে একটা হাত বের করে রানার ঘাড়ের পাশটা স্পর্শ করল। এলিনা। জায়গাটা লাল হয়ে উঠেছে, ফিসফিস করে বলল সে। বেশ বড় একটা ক্ষত হতে যাচ্ছে, যদিও গভীর নয়। তবে রক্ত বেরুচ্ছে। পকেট থেকে রুমাল বের করে ঘাড়ের পাশটা চেপে ধরল রানা। কি করে ঘটল বলবেন?

কি বলব, অসতর্কতা। তুষারে পা পিছলে গেল, ঘাড়টা ঘষা খেল দরজার স্ট্রম-সিল-এ। বেশ ব্যথা করছে।

আর কিছু বলল না এলিনা। ধীরে তার অপর হাতটাও মুক্ত করল, রানার জ্যাকেটের কলার চেপে ধরল দুই হাতে, পূর্ণদৃষ্টিতে কিছুক্ষণ ওর চোখে তাকিয়ে থাকার পর কপাল ঠেকাল ওর কাঁধে। এবার রানার কলার ভেজার পালা। বিনিময়ে এলিনার এলোমেলো হলুদ চুলে হাত বুলাল ও।

কিছুক্ষণ পর হঠাৎ সিধে হলো এলিনা, ঠেলে সরিয়ে দিল রানাকে, মুঠো পাকানো হাত দিয়ে হালকা ঘুসি মারল ওর কাঁধে। ওরকম করবেন না, বলল সে। প্লীজ।

ঠিক আছে, করব না। দুঃখিত।

না, না, প্লীজ। দুঃখিত আমি। জানি না কি কারণে আমি…সত্যি জানি …। এলিনার গলা থেকে আওয়াজ বেরুনো বন্ধ হলো, তবে ঠোঁট জোড়া নড়ছে, পানি ভরা চোখে তাকিয়ে থাকল ওর দিকে, চেহারায় অসহায় ভাবটুকু এবার স্পষ্ট হয়ে উঠল। কিছুক্ষণ ফোঁস ফোঁস করে নাক টানল মেয়েটা, তারপর হঠাৎ দুহাত দিয়ে রানার গলাটা জড়িয়ে ধরল, এত জোরে যে দম বন্ধ হয়ে এল ওর। নিঃশব্দে কাঁদছে সে, মাঝে মধ্যে কেঁপে উঠছে শরীর। নিজেকে এরকম অসহায় প্রমাণ করে কি পেতে চাইছে মেয়েটা? কার জন্যে কাঁদছে সে? নিশ্চয়ই ওর জন্যে নয়, জানা কথা। পরস্পরকে ওরা ভাল করে চেনেই তো না। অবশ্য অনেক রোগী ডাক্তারদের কাধকে কান্নার উপযুক্ত স্থান বলে জ্ঞান করে। কিন্তু এলিনা মানুষ হয়েছে কঠিন একটা পরিবেশে, কিভাবে নিজেকে শক্ত রাখতে হয় জানা আছে তার। তাহলে সে কাঁদছে কেন? কার জন্যে কাঁদছে?

এলিনা কাঁদছে আর রানা ক্যাপটেন ডানহিলের টেবিলের পাশে রাখা বোতলটার দিকে তাকাচ্ছে ঘন ঘন। রানার অনুরোধে আর্চার যখন ওটা থেকে হুইস্কি খেলো, খাবার পর বোতলে হুইস্কি ছিল চার ভাগের এক ভাগ। কিন্তু এই মুহূর্তে সেটা অর্ধেক ভর্তি দেখা যাচ্ছে। নীরব ও বিপজ্জনক আগন্তুক শুধু আলোই। নেভায়নি, বোতলটাও বদলে দিয়ে গেছে। সেই সঙ্গে আর্চারের ব্যবহার করা। গ্লাসটা সঙ্গে করে নিয়ে যেতে ভোলেনি।

কি যেন বলল এলিনা, এত নিচু গলায় যে শুনতে পেল না রানা। জিজ্ঞেস করল, কি?

মুখটা একটু তুলল এলিনা, যাতে কথা বলতে সুবিধে হয়, তবে তারপরও তার মুখ দেখতে পেল না রানা। আমি দুঃখিত। দুঃখিত বোকার মত আচরণ করছি বলে। আপনি আমাকে ক্ষমা করবেন তো?

এলিনার কাঁধে মৃদু চাপ দিল রানা, প্রায় অন্যমনস্কভাবে, ওর মন ও চোখ এখনও বোতলটার ওপর। তবে কাঁধে মৃদু চাপটুকুই যথেষ্ট সাড়া দেয়া হয়েছে। বলে মনে করল মেয়েটা।

সে বলল, আপনি কি আবার ঘুমাবেন? বোকার মত কথা বলা এখনও তার বন্ধ হয়নি। কিংবা সে হয়তো বোকা নয়ই।

না, এলিনা ডিয়ার, আজ আর আমি ঘুমাব না।

বেশ, তাহলে ঠিক আছে।

আসলে উল্টোটা, ভাবল রানা। কিছুই ঠিক নেই। শারীরিক অর্থে এর চেয়ে কাছাকাছি হওয়া ওদের দুজনের পক্ষে সম্ভব নয়, কিন্তু মানসিক অর্থে এলিনার সঙ্গে এখন নেই রানা। ও রয়েছে ল্যারি আর্চারের সঙ্গে। ও ভেবেছিল, সে ওকে খুন করতে এসেছে। রানা তাকে প্রায় জোর করে হুইস্কি খাইয়েছে। যে হুইস্কিটুকু খাওয়াতে চাওয়া হয়েছিল ওকে।

রানা জানে, ল্যারি আর্চারকে আর কোনদিন দেখতে পাবে না ও। অন্তত জীবিত অবস্থায় নয়।

.

সাড়ে দশটার আগে দিনের আলো পাওয়া গেল না, কাজেই এগারোটার দিকে। সাগরের কোলে তুলে দেয়া হলো লাশগুলোকে। বাতাসের গতি আগের চেয়ে সামান্য কমলেও, ঝড় থামেনি। তুষারও চারদিক প্রায় ঢেকে রেখেছে। বাইবেল থেকে পাঠ করলেন স্বয়ং ক্যাপটেন ডানহিল। তিনটে লাশ ভাসাবার সময় তিনবার ইউনিয়ন ফ্ল্যাগ তোলা হলো। সাগর লাশ গ্রহণ করার সময় পানির ছলকে ওঠার আওয়াজ পেল ওরা, তবে ছলকে ওঠাটা দেখতে পেল না। কাজটা শেষ হতেই নিরাপদ উষ্ণ আশ্রয়ে ফিরে এল সবাই, শুধু রানা বাদে।

সবাইকে নিয়ে তাড়াহুড়ো করে ফিরে গেছেন ক্যাপটেন, তাড়াহুড়ো করার। কারণ হলো মৎস্যশিকারীদের নিয়ম নাকি কাউকে কবর দেয়ার পরপরই মদ্য পান করতে হয়। রানা যায়নি, কারণ ভিড়ের মধ্যে দেখতে পাওয়া কঠিন কে কার গ্লাসে কি ভরছে। কাল রাতে দুই কি আড়াই ঘণ্টা ঘুমিয়েছে ও, মনে হচ্ছে মাথার ভেতর জট পাকিয়ে গেছে সমস্ত চিন্তা-ভাবনা। হিম ঝড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকলে হয়তো জট কিছুটা খুলবে।

ল্যারি আর্চার মারা গেছে। যদিও অনেক খুঁজেও তার লাশ পায়নি রানা। কাউকে কিছু বুঝতে না দিয়ে একা একা ইভনিং স্টারের সম্ভব অসম্ভব সব। জায়গায় খুঁজেছে। কোথাও নেই, ভোজবাজির মত অদৃশ্য হয়ে গেছে লোকটা। আর্চার, রানা জানে, শুয়ে আছে ব্যারেন্ট সাগরে। কিভাবে সাগরে পড়ল ওর জানা নেই, তবে সেটা তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। কেউ হয়তো কিনারা থেকে পড়ে যেতে সাহায্য করেছে তাকে, কিংবা এমনও হতে পারে কারও সাহায্য পাবার তার দরকার ছিল না। রাতে অকস্মাৎ সেলুন ছেড়ে তার চলে যাবার কারণ, তার স্কচে রানার স্কুচে-বিষটা খুব দ্রুত সক্রিয় হয়ে ওঠে। ঝট করে সেলুন থেকে বেরিয়ে আসে বমি করার জন্যে, আর বমি করার জন্যে মানুষ সব সময় জাহাজের কিনারা লক্ষ্য করেই ছোটে। বরফ বা তুষারে একবার পা পিছলালেই হলো। জাহাজ যেভাবে প্রতি মুহূর্ত ঝাঁকি খাচ্ছিল, পা না পিছলানোটাই অস্বাভাবিক। কিনারার কাছে পৌঁছুবার পর নিঃসন্দেহে আরও অসুস্থ হয়ে পড়েছিল বেচারা।

রানা জানে, আর্চারের অনুপস্থিতি এখন পর্যন্ত কেউ লক্ষ করেনি, ও আর খুনী ছাড়া। এমন কি, হয়তো খুনীও কিছু জানে না। ওকে জীবিত দেখে খুনী বোধহয় হতভম্ব বোধ করছে। সে হয়তো জানেই না যে সেলুনে ঢুকেছিল আর্চার, বোতলটা থেকে রানার বদলে সে-ই খেয়েছিল স্কচ। আর সবাই ইতিমধ্যে ব্রেকফাস্ট সেরে গেছে, কিন্তু সেলুনে আর্চারকে দেখা না গেলেও কেউ তার খোঁজ করেনি। তার কেবিন-মেট মরগান এখনও সী-সিকনেসে ভুগছে, সম্ভবত অসুস্থ বলেই আর্চারের কথা মনে পড়ছে না তার।

ক্যাপটেন ডানহিলের সঙ্গে করা চুক্তিটার কথা মনে পড়ল রানার। চুক্তিতে অবশ্য বলা হয়নি কেউ নিখোঁজ হলে কি করা হবে। তা না বলা হলেও, আর্চারকে পাওয়া যাচ্ছে না শুনলে নির্ঘাত তিনি হ্যামারফেস্টে ফিরে যাবার সিদ্ধান্ত নেবেন।

আজ সকালে নিজের কেবিনে ঢোকার সময় খালি ম্যাচ বক্সটা ডেকে পড়ে থাকতে দেখেছে রানা। শুধু তাই নয়, ওর সুটকেস দুটোও খোলা হয়েছিল চুলগুলো জায়গামত পায়নি ও। চমকে ওঠার মত কোন ব্যাপার নয় অবশ্য। জাহাজের একজন অন্তত জানে যে অ্যাকোনাইট সম্পর্কে একটা আর্টিকেল পড়েছে। ও, অর্থাৎ পয়জনিং-এর ঘটনাগুলোকে অ্যাক্সিডেন্ট বলে বিশ্বাস করছে না ও। কাজেই ডাক্তারের লাগেজ পরীক্ষা করাটা স্বাভাবিক।

তারমানে এখন থেকে মাথার পিছন দিকেও এক জোড়া চোখ রাখতে হবে ওকে।

পিছনে শব্দ হলো। অলস ভঙ্গিতে ঘুরে দাঁড়াল রানা। অন্য কেউ নয়, ডগলাস হিউম। লী সাইডে ডেক কার্গো থাকায় সামান্য যে আড়াল রয়েছে, সেখানে এসে দাঁড়াল। কি ব্যাপার? সকালে হাঁটাহাঁটি না করলে কোষ্ঠকাঠিন্যের অভিশাপ থেকে মুক্ত হওয়া যায় না? নাকি ক্যাপটেন ডানহিলের স্কচ আপনার পছন্দ নয়?

দুটোই ভুল অনুমান। হাসল হিউম। আসল কারণ কৌতূহল। রানার পাশে তারপুলিন ঢাকা ডেক কার্গোর ফোলা অংশটায় টোকা মারল সে। দশ ফুটের মত উঁচু হবে জিনিসটা, সেমি-সিলিণ্ডিক্যাল, গোড়াটা চ্যাপ্টা, অন্তত এক ডজন ইস্পাতের তার দিয়ে পজিশনে বেঁধে রাখা হয়েছে। এটা কি, আপনি জানেন?

এটা কি বুদ্ধিমানের মত কোন প্রশ্ন হলো?

হলো।

প্রিফ্যাব্রিকেটেড হাট। অন্তত উইকে থাকতে আমাদেরকে তাই জানানো। হয়েছে। মোট ছটা, এমনভাবে ডিজাইন করা হয়েছে একটার ভেতর আরেকটা ঢুকিয়ে রাখা যায়-সহজে যাতে পরিবহন করা সম্ভব হয়।

ঠিক বলেছেন। বণ্ডেড প্লই, ইনসুলেশন, অ্যাসবেসটস আর অ্যালুমিনিয়াম দিয়ে তৈরি। ডেক কার্গোর আরও একটা আইটেমের দিকে হাত তুলল হিউম, ওরা যেটার আড়ালে দাঁড়িয়ে রয়েছে সেটার ঠিক পিছনে। জিনিসটার আকুতি একটু অদ্ভুতই বলা যায়-প্রায় গোল, ছফুটের মত উঁচু। আর ওটা?

আরও একটা চালাকি?

জী।

আর এবারও আমার জবাব ভুল হবে?

উইকে কি বলা হয়েছে তা যদি বিশ্বাস করেন, হবে। ওগুলো কুঁড়েঘর নয়, কারণ কুঁড়েঘর আমাদের দরকার নেই। আমরা যাচ্ছি সোর-হামনা নামে একটা জায়গায়। সোর-হামনা মানে সাউথ হেভেন। ওখানে আগে থেকেই ঘর আছে, রীতিমত ব্যবহারযোগ্য। সত্তর বছর আগে লার্নার নামে এক লোক ওখানে পৌঁছেছিল কয়লার খোঁজে। প্রসঙ্গক্রমে, পেয়েওছিল কয়লা। পাগলই বলা যায়, সৈকতের পাথরগুলো রঙ করে সে, ব্যক্তিগত সম্পত্তি বোঝাবার জন্যে। তারপর শুধু ঘর নয়, রাস্তাও তৈরি করে সে, হেডল্যাণ্ডের ওপর দিয়ে কাছাকাছি সৈকত পর্যন্ত। তার গল্প এখানেই শেষ। পরে একটা জার্মান ফিশিং কোম্পানী ঘাঁটি গেড়েছিল ওখানে, তারাও ঘর তৈরি করে। আরও আছে। বেশিদিন আগের কথা নয়, নরওয়ের একদল বিজ্ঞানী ওখানে নয় মাস ছিল, তারাও ঘর বানায়। সাউথ হেভেনে আর যা কিছুর অভাব থাকুক, থাকার জায়গার কোন অভাব নেই।

আপনি দেখছি অনেক কিছু জানেন।

মাত্র আধ ঘণ্টা আগে পড়া জিনিস ভুলি কি করে? মি. বিশপ আজ সকালে সবাইকে একটা করে বুকলেট বিলি করেছেন। আপনি পাননি?

পেয়েছি। তবে বুকলেটের সঙ্গে একটা অভিধান দিতে ভুলে গেছেন ভদ্রলোক।

তা যা বলেছেন, ভাষাটা ইংরেজদের বোঝার জন্যেও কঠিন হয়ে গেছে। পাশের তারপুলিনে টোকা দিল হিউম। এটা আসলে একটা সাবমেরিনের। মাঝখানের অংশ-স্রেফ একটা শেল, ভেতরে কিছু নেই। জিনিসটা ইস্পাতের তৈরি, দশ টন ওজন, চারটন কাস্ট-আয়রনের ব্লাস্ট সহ। দ্বিতীয় অংশটা হলো কনিং-টাওয়ার, পানিতে নামানোর পর এটার সঙ্গে জোড়া লাগানো হবে।

আচ্ছা! আর আফটার ডেকে ফুয়েলের ড্রামগুলো আসলে অ্যান্টি-ট্যাঙ্ক আর অ্যান্টি-এয়ারক্রাফট গান?

আপনি জানেন, স্ক্রীনপ্লের কপি মাত্র একটা, আর সেটা ব্যাংক অভ ইংল্যাণ্ড বা ওই রকম কোথাও তালা দিয়ে রাখা হয়েছে?

ওই জায়গায় এসে আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, বলল রানা।

দ্বীপটায় কাজ করার জন্যে ওদের সঙ্গে এমনকি একটা শূটিং স্ক্রীপ্টও নেই। আছে শুধু পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কহীন কিছু ঘটনার বিবরণ, যার কোন অর্থ খুঁজে পাবেন না। মানলাম, ওগুলো ওদের খেয়াল-খুশি মত জোড়া লাগালে বোধগম্য কিছু একটা দাঁড়ালেও দাঁড়াতে পারে। কিন্তু আসল জিনিস সঙ্গে করে আনা হয়নি। ভেবে দেখুন কেমন বিদঘুঁটে।

গোপনীয়তা রক্ষা করার সঙ্গত কারণ হয়তো আছে, বলল রানা। অনুভব করছে, ওর পা দুটো নিরেট বরফ হয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া এমন অনেক প্রডিউসার আছেন না, পরিচালককে নিজের মর্জি মাফিক কাজ করার অনুমতি দেন, পরিচালকের মুডের ওপর নির্ভর করেন?

রবার্ট হ্যামারহেড সেরকম নন, জীবনে কখনও তিনি মুডের ওপর নির্ভর করে কোন দৃশ্য চিত্রায়িত করেননি। হিউমের চুল তুষারে সাদা হয়ে গেছে। আর মি. গোলডার কথা যদি বলেন, অত্যন্ত গুছানো স্বভাবের লোক তিনি দেশলাইয়ের প্রতিটি কাঠি আর প্রতিটি পেনি হিসাব করে তবে কাজে নামেন। বিশেষ করে শেষ পেনিটা।

হ্যাঁ, সাবধানী মানুষ হিসেবে খ্যাতি আছে তাঁর।

সাবধানী! শিউরে উঠল হিউম। গোটা সেট-আপটা আপনার কাজে স্রেফ পাগলামি বলে মনে হচ্ছে না?

সে-কথা যদি বলেন, গোটা চলচ্চিত্র জগই তো একটা পাগলাগারদ। তবে একজন লেম্যান হিসেবে আমি ঠিক জানি না চলতি পাগলামিটা প্রচলিত পাগলামির সঙ্গে মিলছে কিনা। আপনার সঙ্গী অভিনেতা-অভিনেত্রীরা কে কি ভাবছেন?

কিসের ভাবাভাবি! গম্ভীর সুরে বলল হিউম। মোনাকা তো তার কুকুর দুটোকে নিয়েই ব্যস্ত। এলিনা তার কেবিনে বসে চিঠি লিখছে-সে অন্তত তাই ভান করছে। আমার ধারণা চিঠি নয়, উইল রচনা করছে। আর ব্রাড ফার্গুসন ও হ্যানস ব্ৰাখটম্যানের কথা আর কি বলব, কখনোই ওরা কোন কিছু সম্পর্কে মন্তব্য করে না। এক জোড়া আজব চরিত্র।

মানে, অভিনেতা হিসেবে?

জোর করে হাসল হিউম। ফিল্ম জগৎ সম্পর্কে খুব কম জানে তারা। মানে ব্রিটিশ ফিল্ম জগৎ সম্পর্কে। ব্রাখটম্যান অভিনয় করেছে শুধু ক্যালিফোর্নিয়ায়, আর ফার্গুসন শুধু জার্মানীতে। আজব চরিত্র বলছি এই জন্যে যে এমন কোন বিষয় নেই যা নিয়ে কথা বলা যায় ওদের সঙ্গে। বিষয় মেলে না।

কিন্তু আপনি নিশ্চয়ই ওদের সম্পর্কে জানেন?

এমনকি তা-ও না, তবে সেটা অস্বাভাবিক নয়। অভিনয় আমি পছন্দ করি, তবে চলচ্চিত্র জগৎ আমার একঘেয়ে লাগে, কাজেই সামাজিক অর্থে এই জগতের কারও সঙ্গে আমি মেলামেশা করি না। এদিক থেকে আমাকেও আপনি আজব চরিত্র বলতে পারেন। তবে মি. গোলডা ওদের দুজনের পক্ষে সুপারিশ করেছেন। সত্যি কথা বলতে কি, উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন। অভিনয়ের সময় ওরা সম্ভবত আমাকে স্নান করে দেবে। আবার একবার শিউরে মত উঠল। সে। ডগলাস হিউমের কৌতূহল নিবৃত্ত হলো না, তবে ডগলাস হিউম আর ধকল সহ্য করতে রাজি নয়। একজন ডাক্তার হিসেবে আপনি আমাকে খানিকটা স্কচ প্রেসক্রাইব করবেন না? বিশেষ করে ক্যাপটেন ডানহিল যখন উদারহস্তে দান। করছেন?

সেলুনে অন্তত বিশজন লোক রয়েছে, জাহাজের ক্রু ও প্যাসেঞ্জার মিলিয়ে, সবার হাতে একটা করে পানপাত্র। ফন গোলডা গায়ে বহুরঙা একটা কম্বল জড়িয়ে আরাম করে বসে আছেন। সবার সঙ্গে মোকাকে দেখে একটু অবাকই হলো রানা। মোনাকা রয়েছে তার তথাকথিত স্বামী মিখায়েল ট্যাকারের সঙ্গে। আরও রয়েছে পামেলা ও হুপার, পরস্পরের হাত মুহূর্তের জন্যেও তারা ছাড়ছে না। এলিনাকে অনুপস্থিত দেখে রানা অবাক হলো না। অনুপস্থিত রয়েছে মরগান ও এরিক কার্লসন। দুজন অভিনেতা, যাদের সঙ্গে হিউমের বিষয় মেলে না, ব্রখটম্যান আর ফার্গুসন এককোণে একসঙ্গে বসে আছে। এই প্রথম সত্যিকার আগ্রহের সঙ্গে তাদের দিকে তাকাল রানা। দেখে তাদেরকে অভিনেতা বলেই মনে হয়, কোন সন্দেহ নেই। ব্রাখটম্যান লম্বা, ফর্সা, সুদর্শন, বয়েস খুব বেশি নয়। তার চেহারায় চঞ্চল, সজীব একটা ভাব আছে। তার চেয়ে অন্তত পনেরো বছরের সিনিয়র হবে ব্রাড ফার্গুসন-শক্ত-সমর্থ কাঠামো, চওড়া কাঁধ, কোঁকড়ানো কালো চুল, সবেমাত্র সাদা হতে শুরু করেছে। তার চেহারায় সারাক্ষণ হাসি হাসি ভাব লেগে রয়েছে, অথচ রানার জানা মতে মার্ভেলাস প্রোডাকশনের ছবিটায় তার ভূমিকা ভিলেনের। শক্ত-সমর্থ কাঠামো ছাড়া তাকে। ভিলেন ভাবা কষ্টকর।

সেলুনের ভেতর কেউ শব্দ করছে না, একা শুধু ক্যাপটেন কথা বলছেন। ওদেরকে ঢুকতে দেখে নিঃশব্দে হুইস্কি অফার করলেন তিনি, সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান। করল রানা। তারপর আবার শুরু করলেন ক্যাপটেন।

আমরা দুঃখিত, কারণ তারা চলে গেলেন। আমরা আরও বেশি মর্মাহত, কারণ তারা তিনজন ছিলেন ব্রিটেনের সন্তান। না, আমরা কেডিপাসের কথাও ভুলতে পারি না। তবে এ-ও ঠিক যে মৃত্যুর এই ছোবল সবার কপালেই আছে, আগে হোক বা পরে। আরও একটা কথা, বেয়ার আইল্যাণ্ডে মৃত্যুবরণ করা সবার। ভাগ্যে থাকে না।

ভাবছি বেয়ার আইল্যাণ্ড সম্পর্কে আপনাদের কার কি ধারণা। বিশেষ কোন ধারণা থাকার কথা নয়। কেন থাকবে? ওটা তো স্রেফ একটা দ্বীপ। বেয়ার আইল্যাণ্ড, শুধু তো একটা নাম। কিন্তু না, আমার আর মি. জেংকিনসের কাছে, আমাদের মত আরও অনেকের কাছে বেয়ার আইল্যাণ্ড শুধু একটা দ্বীপ না, শুধু একটা নাম না। বেয়ার আইল্যাণ্ড আসলে একটা টার্নিং পয়েন্ট। একটা রেখা, যা আমাদের জীবনকে ভাগ করে দিয়েছে। বেয়ার আইল্যাণ্ড এমন এক দ্বীপ যেখানে। একটা কিশোর রাতারাতি পরিণত হয়ে ওঠে, যেখানে মধ্যবয়স্ক লোক হঠাৎ আমার মত বদ্ধ হয়ে ওঠে।

আমরা নাম দিয়েছিলাম-দাগেট। ব্যারেন্ট সাগর আর হোয়াইট সাগরের প্রবেশপথ। যুদ্ধের সময় রাশিয়ার বিভিন্ন জায়গায় ওই প্রবেশপথ দিয়ে কনভয় নিয়ে গিয়েছিলাম আমরা, সে আজ কত বছর আগের কথা। আপনি যদি গেট দিয়ে ভেতরে ঢোকার পর আবার প্রাণ নিয়ে ফিরে আসতে পারেন, আপনাকে অত্যন্ত ভাগ্যবান বলতে হবে। এরকম যদি ছবার করতে পারেন, মনে করতে হবে সারা জীবনের সমস্ত ভাগ্য আপনার ব্যবহার করা হয়ে গেছে। ওই গেট দিয়ে কবার গেছি আমরা, মি. জেংকিনস?

বাইশ বার, বললেন জেংকিনস।

বাইশ বার। গল্পটা এজন্যে বলছি না যে ওখানে আমি ছিলাম। বলছি এজন্যে যে মারমানস্ক অভিমুখে ওই কনভয়ে যারা ছিল, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে তারাই সবচেয়ে বেশি ভুগেছে। এই গেটেরই কাহিনী সেটা, যেখানে রাতদিন চব্বিশ ঘণ্টা ওত পেতে থাকত শত্রুরা, যেখানে আমাদের ওপর আক্রমণ চালানো হয়। অত্যন্ত কাজের জাহাজ ছিল সেগুলো, আর মানুষগুলো ছিল সুন্দর। শুধু ব্রিটেনের সন্তানরা নয়, জার্মানীর সন্তানেরাও। ওদিকের পানিতে যত সুন্দর মানুষ শুয়ে আছে তত আর পৃথিবীর কোথাও নেই। ওখানকার পানি এখন পরিষ্কার হয়ে গেছে, ধুয়ে মুছে গেছে সমস্ত রক্ত। তবে আমাদের মন থেকে নয়। পঁয়ত্রিশ বছর পার হয়ে গেছে, তারপরও বেয়ার আইল্যাণ্ড নামটা শুনলেই আমার শরীরের রক্ত ঠাণ্ডা হয়ে যায়। বড় করে শ্বাস টানলেন ক্যাপটেন ডানহিল। বুড়োরা বেশি কথা বলেন, কাজেই আপনারা এখন জানেন একজন বুড়োর হাতে পড়লে কি যাতনায় ভুগতে হয়। আমি আসলে শুধু বলতে চেয়েছিলাম, আমাদের শিপমেটরা সৎ সংসর্গেই থাকবেন। হাতের গ্লাসটা উঁচু করলেন তিনি। বন ভয়েজ।

বন ভয়েজ, ভাবল রানা, তবে এটাই শেষ শুভেচ্ছা নয়। শেষ শুভেচ্ছা যে নয়, অন্তরের গভীরে উপলব্ধি করছে ও। ওর ধারণা, ক্যাপটেন ডানহিলও তা উপলব্ধি করতে পারছেন।

ও যে ভয় পাচ্ছে, সেই একই ভয় কি আরও অনেকে পাচ্ছে? পৃথিবীর নির্জনতম ও দুর্গমতম প্রান্তে ভয়ঙ্কর একটা বিপদ ঝুলে রয়েছে মাথার ওপর, মানুষের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় কি তা টের পাবে না?

বলা কঠিন। ক্যাপটেন ডানহিল তাঁর চীফ এঞ্জিনিয়ারকে নিয়ে এক কোণে চলে গেছেন, নিঃশব্দে তাকিয়ে আছেন যে যার গ্লাসে, যদিও কিছু দেখতে পাচ্ছেন বলে মনে হলো না রানার। রবার্ট হ্যামারহেডের চোয়ালের হাড় আরও যেন উঁচু হয়ে উঠেছে, তবে গত সন্ধের চেয়ে এখন অনেক সুস্থ লাগছে ভদ্রলোককে, বসে আছেন একা, হাতে ধরা খালি গ্লাসে আঙুল বুলাচ্ছেন অনবরত–এটা তার নার্ভাসনেসের লক্ষণ বলে মনে হলো রানার। তবে কি ভাবছেন বলা মুশকিল।

 টেবিলের মাথায় ফন গোলডার সঙ্গে বসে আছেন ক্লার্ক বিশপ, তাঁরা দুজনও চুপচাপ। রানা ভাবল, ওঁদের দুজনের সম্পর্কটা আসলে কি? পরস্পরের প্রতি যথেষ্ট আন্তরিক বলে মনে হয়, বিশেষ করে ব্যবসা প্রসঙ্গে আলোচনা করার সময় পরস্পরকে সমর্থন করেন বিনা দ্বিধায়। রানার মনে পড়ল, সম্প্রতি মার্ভেলাস প্রোডাকশনের ভাইস-প্রেসিডেন্ট করা হয়েছে ক্লার্ক বিশপকে। তাঁরা এই মুহূর্তে কথা বলছেন না দেখে ধারণা করা যায়, রানা আর ক্যাপটেনের মত তারাও বিশেষ। একটা ভীতিকর সমস্যা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করছেন।

কথা বলছে না তিন দেবতাও, তবে কথা তারা প্রায় বলেই না। মিখায়েল ট্যাকার তার তথাকথিত স্ত্রীর মনোরঞ্জনে ব্যস্ত, তবে মাঝে মধ্যে নিচু গলায় পাশে। বসা কাউন্টের সঙ্গে কথা বলছে। ব্যারন অর্থাৎ মুনফেস তার রূম-মেট এডির সঙ্গে বাক্য বিনিময় করছে না, এমনিতেও পরস্পরের সঙ্গে কথা প্রায় বলেই না তারা। এক সময় সচেতন হয়ে উঠল রানা, ওর কনুইয়ের কাছে জক মুরের উপস্থিতি সম্পর্কে। ক্যাপটেন ডানহিলের বক্তৃতা ভদ্রলোককে বিচলিত করতে পেরেছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না। গ্লাস ভর্তি হুইস্কি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি, চেহারায় সামান্য হলেও মান একটা ভাব-অপরাধবোধ নয় তো?

মি. মুর, তার হাতে ধরা গ্লাসটার দিকে তাকাল রানা, আজ সকালে কখন থেকে শুরু করেছেন আপনি?

শুরু করেছি? শুরু করেছি মানে? মাই ডিয়ার ফেলো, যে বন্ধই করে না তার আবার শুরু করা কি?

রানার দৃষ্টি অনুসরণ করে তিনি দেখলেন, পামেলার হাত ধরে সেলুন থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে হুপার। মোনাকার চেয়ারের সামনে এক সেকেণ্ড ইতস্তত করল পামেলা, নিঃশব্দে হেসে বলল, গুড মর্নিং, মিস মোনাকা। আশা করি আজ আপনি সুস্থ বোধ করছেন?

নিখুঁত আকৃতির মুক্তো অর্থাৎ দাঁত দেখিয়ে হাসল মোনাকা, তারপর অন্যদিকে তাকাল-নকল হাসি হাসা হলো নকল হাসি বোঝাবার জন্যে, সঙ্গে থাকল আপোসহীন প্রত্যাখ্যান। পামেলার মুখ রাঙা হয়ে উঠতে দেখল রানা। কিছু বলতে গেল সে, কিন্তু চেহারা গম্ভীর করে তার হাত ধরে টান দিল হুপার, শান্ত ভাবে নিয়ে যাচ্ছে লী দরজার দিকে।

ব্যাপারটা কি ঘটল আসলে? দেখে মনে হলো আহত হয়েছেন মোনাকা। কিন্তু পামেলা তো কাউকে আহত করার মেয়ে নন।

করেছে, আহত করেছে। আমাদের মোনাকা হলো সেই জাতের মেয়ে, যে কিনা অল্পবয়েসী কোন মেয়েকে একেবারেই সহ্য করতে পারে না। অল্পবয়েসী আর সুন্দরী। পামেলার দোষ, তার বয়েস কম, সুন্দরীও।

মোনাকার যে ছবি আমি আঁকতে চাই, আপনি তার উল্টোটা আঁকতে বলছেন আমাকে! রানার গলায় অভিযোগ।

জক মুর হাসলেন। মোনাকাকে আপনি বিচ বলতে পারবেন না। প্রতিদ্বন্দ্বী নয় এমন যে-কোন প্রাণীর প্রতি অত্যন্ত সদয় সে-যেমন পোষা কুকুর ও অবোধ। শিশু ওদেরকে ছাড়া মোনাকা আর কাউকে ভালবাসতে সমর্থ নয়। ইচ্ছে করলে তাকে আপনি করুণা করতে পারেন-হৃদয়ে ভালবাসা নেই এমন যে কোন মানুষকেই তা করতে হয়। মোনাকাকে করুণা করার আরও কারণ হলো, বাস্তব জগতের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে না পেরে সবার কাছ থেকে পালিয়ে পালিয়ে থাকে সে, বাস করে ফ্যান্টাসীর জগতে।

বাইরের ডেকে কাকে যেন মুহূর্তের জন্যে দেখতে পেল রানা, মনে হলো এরিক কার্লসন। অত্যন্ত ধীরস্থির প্রকৃতির মানুষ তিনি, অথচ খুবই ব্যস্তভাবে কোথায় যাচ্ছেন? তাছাড়া, আপার ডেকে কি করছেন তিনি, ঠাণ্ডাকে যার যমের মত ভয়? জক মুরের কাঁধে একটা হাত রাখল রানা। একটু পরই ফিরে আসছি, মি. মুর। রোগী দেখতে যেতে হবে।

শান্ত ভাবে লী ডোর দিয়ে বেরিয়ে এল রানা। বেরিয়ে এসে দাঁড়াল, দেখতে চায় ওকে কেউ অনুসরণ করে বেরোয় কিনা। ঠিকই একজন পিছু নিয়েছে, প্রায় সঙ্গে সঙ্গে, তবে ওর ব্যাপারে কৌতূহলী হলেও ওকে সেটা বুঝতে দিতে চায় না। চোখাচোখি হতে ব্রাড ফার্গুসন সামান্য একটু হাসল, পা চালিয়ে চলে গেল। প্যাসেঞ্জার কেবিনগুলোর দিকে। আরও কয়েক সেকেণ্ড অপেক্ষা করল রানা, তারপর ইস্পাতের খাড়া মই বেয়ে চলে এল বোট ডেকে, ব্রিজ আর রেডিও ঘরের ঠিক সামনে।

ফানেল আর এঞ্জিন ইনটেক ফ্যান কেসিংটা চক্কর দিল রানা, কিন্তু কাউকে দেখল না। দেখতে পাবে বলে আশাও করেনি, কারণ এরকম অসহ্য ঠাণ্ডায় খোলা বোট ডেকে জরুরী কোন কারণ ছাড়া কেউ আসবে না। সামনে এগিয়ে মোটর লাগানো একজোড়া লাইফবোটের কাছে চলে এল ও, একটা ভেন্টিলেটারের পাশে আড়াল নিয়ে দাঁড়াল, তারপর উঁকি দিয়ে তাকাল আফটার ডেকে।

প্রথম কয়েক মুহূর্ত কিছুই দেখতে পেল না। তারপর তুষারের ভেতর আকৃতিগুলো পরিষ্কার হয়ে উঠল। আফটার ডেকে বহু জিনিস পড়ে আছে-ফুয়েল ড্রাম থেকে শুরু করে ষোলো ফুটী ওঅর্কবোট পর্যন্ত। সবগুলোর আকৃতি পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে না। তবে নড়াচড়া করলে আলাদা কথা।

বেঢপ একটা আকৃতির আড়াল থেকে বেরিয়ে এল কি যেন। আকৃতিটা একটু পর চিনতে পারল রানা-একটা সো-ক্যাটের কেবিন। বেরিয়ে এসেছে একজন মানুষ। খানিকটা ফিরল রানার দিকে, যদিও হাত দুটো মুখের সামনে থাকায় চেনা গেল না। হাত দুটো দিয়ে একটা পারকা হুড ধরে আছে সে। তবে চুলগুলো ঠিক যেন খড়। এই রঙের চুল গোটা জাহাজে মাত্র একজনেরই আছে, জানে রানা। প্রায় একই মুহূর্তে চোখের কোণ দিয়ে ও দেখতে পেল অপর একটা মূর্তি বোট ডেকের পিছন থেকে বেরিয়ে এসেছে, এগিয়ে আসছে প্রথম মূর্তিটার দিকে। দ্বিতীয় মূর্তির সরু মুখ দেখে চিনতে অসুবিধে হলো না। এরিক কার্লসন।

সরাসরি এগিয়ে এলেন কার্লসন, সরাসরি এলিনার একটা হাত ধরলেন। কার্লসন কোন বাধার সম্মুখীন হলেন না। মেয়েটার সঙ্গে কথা বলছেন তিনি। ডেকের ওপর হাঁটু গাড়ল রানা, কেউ দেখে ফেলার ভয়ে, সেই সঙ্গে কার্লসনের কথা শোনার আশায়। কিন্তু না, কিছুই শোনা গেল না। আংশিক কারণ বাতাস উল্টোদিকে বইছে, আংশিক কারণ ওরা কথা বলছে প্রায় কানে কানে।

তারপর এলিনার কোমরটা এক হাতে জড়িয়ে ধরলেন কার্লসন। তাঁর ঘনিষ্ঠ আলিঙ্গনে সাড়া দিল এলিনা, সে-ও একটা হাত তুলল কার্লসনের ঘাড়ে, তারপর মাথাটা রাখল তাঁর কাঁধে। এখনও কথা বলছে দুজন। এভাবে প্রায় দুমিনিট কাটল। তারপর ধীর পায়ে প্যাসেঞ্জার কেবিনের দিকে হেঁটে গেল ওরা, কার্লসনের একটা হাত এখনও এলিনার কাঁধে। ওদেরকে অনুসরণ করার কোন চেষ্টাই রানা। করল না, কারণ ওদের চোখে ধরা পড়ে যাবার ভয় তো আছেই, তাছাড়া ব্যক্তিগত কথা যা বলার ছিল তা বলাও হয়ে গেছে।

ধ্যান করার আর জায়গা পেলেন না? রানার পিছন থেকে কে যেন বলল।

ধ্যান করছি নাকি শিকার করছি, কি করে বুঝলেন? ধীরে ধীরে দাঁড়াল রানা, তারপর অলস ভঙ্গিতে ঘুরল, কারণ জানে চ্যাং ওয়েনের কাছ থেকে বিপদের কোন ভয় নেই। ভারি একটা পশমের কোট পরে রয়েছে সে, কাল মাঝরাতের তুলনায় এখন তাকে অনেক সুস্থ লাগছে দেখতে।

জানি না, সত্যি। রানাকে পাশ কাটিয়ে সামনে এগোল ওয়েন, বোট ডেকের রেইলিং ধরে ঝুঁকে নিচের দিকে তাকাল। আফটার ডেকে তুষার জমেছে, তুষারের ওপর এলিনা আর কার্লসনের পায়ের ছাপ স্পষ্ট ফুটে আছে। বার্ড ওয়াচিং?।

চখা-চখী।

জোড়াটা অদ্ভুত, স্বীকার করেন? 

ফিল্মী জগক্টাই অদ্ভুত, মি. ওয়েন। এখানে সব পাখিই…।

ওখানে, হাত তুলে চার্টহাউজটা দেখাল ওয়েন। গল্প করতে হলে গরম জায়গা দরকার।

চার্টহাউজ গরম নয়, কারণ দরজা খোলা রেখেই বেরিয়েছিল ওয়েন। এই দরজা দিয়েই এলিনা আর কার্লসনকে দেখেছে সে। ভেতরে ঢুকে কাবার্ড থেকে একটা বোতল বের করল। পরীক্ষা করার জন্যে আমাদের কি একজন টেস্টার। দরকার?

 লীড সীলটা দেখল রানা, ভাঙা নয়। যদি মনে করেন জাহাজে কেউ বটলিং প্ল্যান্ট সঙ্গে করে এনেছে, তাহলে দরকার।

চেক করে দেখেছি আমি। সীলটা ভাঙল ওয়েন। কাল রাতে আমাদের মধ্যে কথা হয়েছে। অন্তত বলা যায়, আমি কথা বলেছি। আপনি শুনে থাকতে পারেন আবার না-ও শুনে থাকতে পারেন। কাল রাতে আমি খুব উদ্বিগ্ন ছিলাম। ভেবেছিলাম আপনি আমাকে বিশ্বাস করতে পারবেন না। এখন উদ্বেগে আমার হাত-পা ঠাণ্ডা বরফ হয়ে যাচ্ছে। কারণ বুঝতে পারছি আপনি আমার সঙ্গে মন খুলে কথা বলবেন না।

যেহেতু বার্ড-ওয়াচিং-এর নেশায় পেয়েছে আমাকে? হালকা কৌতুকের সুরে জিজ্ঞেস করল রানা।

অনেক কারণের মধ্যে ওটাও একটা। পাইকারী পয়জনিং-এর প্রসঙ্গ এবার। চিন্তা-ভাবনা করার সময় পেয়েছি খানিকটা। বোঝাই যাচ্ছে কে পয়জনার তা। আপনি জানেন না, কারণ জানলে কেডিপাসের পর আর কেউ বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হত না, আপনি তাকে বাধা দিতেন–অথচ তারপরও ছজন আক্রান্ত হয়েছে, তার মধ্যে মারাও গেছে দুজন। আপনি এখনও হয়তো ভাবছেন যে গোটা ব্যাপারটা। দুর্ঘটনা কিনা, কারণ বিষক্রিয়ার ঘটনাগুলো দেখে মনে হবে কেমন যেন এলোমেলো, যেন কোন প্যাটার্ন নেই।

দেখে মনে হবে নয়, সত্যি এলোমেলো।

সেটা কাল রাতের কথা, যখন কোন ধারণা পাওয়া যাচ্ছিল না। এখন পাওয়া যাচ্ছে। কারণ ইতিমধ্যে অনেক ঘটনা ঘটেছে, তাই না?

কি ঘটেছে?

অনেক কিছু, বলল ওয়েন। সব যে কাল রাতে বা পরে ঘটেছে তা নয়, ঘটেছে হয়তো আগেই, তবে জানা গেছে পরে। আচ্ছা, বলুন তো, তরুণদের কাউকে না নিয়ে এই অভিযানের জন্যে ক্যাপটেন ডানহিল আর চীফ এঞ্জিনিয়ার জেংকিনসের মত বৃদ্ধদের কেন বাছাই করা হলো? কারণ হলো, এই বয়েসে অনেক কিছু দেখেও ওঁরা দেখতে পান না। তাছাড়া, সারাক্ষণ মদ খেয়ে একটা ঘোরের মধ্যে থাকেন।

মনে মনে চীনা তরুণের প্রশংসা করল রানা। ছোকরার বুদ্ধি আছে বলতে

কাল রাতে আমি বলেছিলাম, বছরের এই সময় ফন গোলডার এদিকে আসার সিদ্ধান্তটা অদ্ভুত। এখন আর আমি তা মনে করি না। এর একটা কারণ। আছে, এবং কারণটা কি তা আপনার বন্ধু ফন গোলডাকে জিজ্ঞেস করা দরকার। যদিও জিজ্ঞেস করলে যে উত্তর পাব এমন নয়।

তিনি আমার বন্ধু নন।

আর এটা কি? মার্ভেলাস প্রোডাকশনের বুকলেটটা বের করে দেখাল ওয়েন। পিচ্ছিল চরিত্র ক্লার্ক বিশপ সবাইকে একটা করে গছাচ্ছেন?।

ক্লার্ক বিশপ? পিচ্ছিল?

অবিশ্বস্ত, খয়ের খা, টাকার লোভী, মহা পিচ্ছিল এক চরিত্র।

তাহলে তিনিও আমার বন্ধু না হলে ভাল হয়।

স্ক্রীন-প্লের গুরুত্ব বোঝানোর জন্যে এই বুকলেট ছাপা হয়েছে। সন্দেহ হতে পারে, স্ক্রীন প্লে নয়, আরও গুরুত্বপূর্ণ কিছু গোপন করার জন্যে এটা একটা আড়াল বিশেষ। আরও সন্দেহ হতে পারে, কোন ব্যাংকে কোন স্ক্রীন-প্লে নেই, কারণ কোথাও কোন স্ক্রীন-প্লের অস্তিত্বই নেই। বেয়ার আইল্যাণ্ডে ওদের শূটিং শিডিউল দেখেছেন? পরস্পর সম্পর্কহীন কিছু ঘটনা শুধু। রহস্যময় মোটরবোট থাকবে, থাকবে ডামি সাবমেরিন, পাহাড়ে ওঠার দৃশ্য, পাহাড় থেকে সাগরে পড়ে যাবার দৃশ্য, আর্কটিক বরফে মারা পড়বে মানুষ। কিন্তু এ-সবের জন্যে বেয়ার আইল্যাণ্ডে যাবার দরকার কি? ইউরোপের যে-কোন জায়গায় গেলেই তো হত।

আপনার মন খুব সন্দেহপ্রবণ, মি. ওয়েন।

তারপর পোলিশ মেয়েটার কথা ধরুন…।

ল্যাটভিয়ান। এলিনা স্টুয়ার্ট। হ্যাঁ, বলুন?

আশ্চর্য একটা মেয়ে। একা এবং নির্লিপ্ত। কারও সঙ্গে মেশে না। কিন্তু ব্রিজে যখন কেউ অসুস্থ হয়, কিংবা ফন গোলডা বা ব্যারনের কেবিনে, সব সময়। কাকে দেখা যায়? এলিনা স্টুয়ার্টকে। কেন?

কারণ মেয়েটার মন খুব নরম।

তাহলে এরিক কার্লসনের সঙ্গে তার কি সম্পর্ক, ব্যাখ্যা করুন।

 আপনি কি কাউকে প্রেম করতেও দেবেন না?

প্রেম? মি. কার্লসনের সঙ্গে?

আপনি সম্ভবত মেয়ে নন, ওয়েন।

নিঃশব্দে হাসল ওয়েন। না, তবে ওদেরকে চিনি আমি। তারপর ধরুন, ম্যানেজমেন্টের রুই-কাতলারা ফন গোলডার সামনে এক রকম পিছনে আরেক রকম কেন? একজন ক্যামেরাম্যান কিভাবে ডিরেক্টর হয়? বলতে পারেন…?

আপনি তা জানলেন কিভাবে?

আরে, তারমানে আপনিও জানেন! আমি জেনেছি, কারণ আপনি আর মার্ভেলাস প্রোডাকশনের ডিরেক্টররা যে চুক্তিপত্রে সই করেছেন সেটা আমাকে দেখিয়েছেন ক্যাপটেন ডানহিল-কাউন্ট বট্রিউলার সই আছে তাতে। তারপর, বলতে পারেন, একজন ডিরেক্টর, নিজের কাজে অত্যন্ত যোগ্য হিসেবে বিবেচিত হওয়া সত্ত্বেও, ফন গোলডাকে অসম্ভব ভয় পান কেন? আমি রবার্ট হ্যামারহেডের কথা বলছি। অথচ জক মুর, যিনি শুধু মদ্যপ নন, ফন গোলডার ব্যক্তিগত রিজার্ভ সারাক্ষণ ধ্বংস করছেন, তিনি কেন ফন গোলডাকে দুচোখে দেখতে পারেন না?

আচ্ছা, মি. ওয়েন, বলুন তো, ইদানীং আপনি জাহাজ চালানোর কাজে কতটুকু নিবেদিত?

বলা কঠিন। বোধহয় আপনি যতটা ডাক্তারীর প্রতি।

অ্যাকোনাইট-মুক্ত পানীয় হাতে জানালা দিয়ে দুর্যোগ কবলিত সাগরের দিকে তাকাল রানা। মনে মনে বলছে, কি এবং কেন ধরনের প্রশ্নগুলো সংখ্যায় অনেক বেশি, মি. ওয়েন। সত্যি ভাবা যায় না, এরিক কার্লসনের সঙ্গে গোপনে দেখা করবে এলিনা স্টুয়ার্ট। গত রাতে ভারি অসুস্থ ছিলেন কার্লসন, তারপরও ভীতিকর একটা সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না-জীবনকে অত্যন্ত হালকাভাবে দেখেন এমন দুজন বা ততোধিক লোকের মধ্যে তিনিও একজন হতে পারেন, বা তিনিই প্রধান ব্যক্তি, কিংবা তাদের মধ্যে সংযোগ রক্ষাকারীদের একজন। ফন গোলডা, নিজেও তিনি বিষক্রিয়ার শিকার, কিন্তু কেডিপাস আক্রান্ত হয়েছে শুনে এত বেশি আঘাত পেলেন কেন? মিকি মুনফেস ওরফে ব্যারণ গ্যালিতে খাবারের খোঁজে হানা দিয়েছিল, নাকি অন্য কোন উদ্দেশ্যে? কিংবা মরগান নিজের কাজের যে ব্যাখ্যা দিল, তা কি সত্যি? কে ঢুকেছিল রানার কেবিনে, অ্যাকোনাইটের ওপর লেখা আর্টিকেলটা কে চেক করল, অবশিষ্ট হর্সর্যাডিশ কে ফেলে দিল, কে সার্চ করল। ওর সুটকেসগুলো? সুটকেসগুলো সেই লোকই সার্চ করেছে যে মদের বোতলটা বদলে দেয়, ওর ঘাড়ে আঘাত করে, এবং ল্যারি আর্চারের মৃত্যুর জন্যে দায়ী? নাকি এখানেও একাধিক লোক সক্রিয়? আর আর্চার যদি দুর্ঘটনাবশত মারা গিয়ে থাকে, তাই গেছে বলে ওর ধারণা, তাহলে সেলুনে সে এসেছিল কেন? জক মুর মোনাকার এমন তীব্র সমালোচনা করলেন কেন? এ-কথা কি সত্যি, মানুষকে সহ্য করতে পারে না মোনাকা, বিশেষ করে মেয়েমানুষকে? টাকা, সাফল্য, সুখ্যাতি, পজিশন, সবই তার যথেষ্ট পরিমাণে আছে, তারপরও পামেলার সঙ্গে অমন ঠাণ্ডা ব্যবহার করার কি কারণ? ব্ৰাখটম্যান আর ফার্গুসনকে কি সন্দেহের তালিকায় রাখতে হবে, যেহেতু তাদের একজন ওর পিছু নিয়েছিল? অভিনেতা হিসেবে ওরা অদ্ভুত, ডগলাস হিউম আভাসে সে-কথাই বলতে চেয়েছে, তার মানে কি হিউম নিজেকে আড়াল করার জন্যে ওদের ওপর সন্দেহ আরোপের চেষ্টা করেছে? ধ্যেত, এভাবে চিন্তা করলে মাথাটাই খারাপ হয়ে যাবে, এক সময় হয়তো চার্লস হুপারকেই মনে হবে বিষ প্রয়োগের হোতা, কারণ যেহেতু সে ওকে জানিয়েছে। ইউনিভার্সিটিতে কেমিস্ট্রি পড়ত সে।

আ পেনি ফর ইওর থটস, মি. রানা।

টাকা-পয়সা এভাবে পানিতে ফেলবেন না, ওয়েনকে পরামর্শ দিল রানা। কিসের চিন্তা?

চিন্তা আসলে দুটো। মানে, দুধরনের। যাবতীয় সমস্ত বিষয়ে আপনি যা ভাবছেন, আমাকে তার কিছুই বলছেন না। আর আপনার মনে যে-সব সন্দেহ রয়েছে সেগুলো প্রকাশ করছেন না।

আপনাকে যা বলিনি তা আসলে বলার উপযুক্ত নয়। আমার কাছে যদি কোন ফ্যাক্টস থাকত…

তাহলে আপনি স্বীকার করেন, মাত্মক একটা গোলমাল সত্যিই আছে?

অবশ্যই।

আর আপনি যা জানেন তার সবই আমাকে বলেছেন?

অবশ্যই।

মেডিকেল প্রফেশনের ওপর আমার বোধহয় আর শ্রদ্ধা থাকল না, বলল ওয়েন। হাত বাড়িয়ে রানার পার্কার ভেতর হাত গলিয়ে দিল সে, টেনে নামিয়ে ফেলল স্কার্ফটা। ওর ঘাড়ের বহুরঙা ক্ষতটা উন্মোচিত হয়ে পড়ল। জেসাস! কী সাংঘাতিক! কি করে হলো বলুন তো!

পড়ে গিয়ে।

ডাক্তাররা পড়ে যান না, তাদেরকে ফেলে দেয়া হয়। কিভাবে?

আপার ডেকে, পোর্ট সাইডে, সেলুন ডোরের স্টর্ম-সিলের ওপর।

কিন্তু আমি বলব, ক্রিমিনলজিস্টদের মত, আঘাতটা করা হয়েছে নিরেট কোন বস্তুর সাহায্যে। চওড়ায় জিনিসটা হবে আধ ইঞ্চি, ডগাটা ধারালো। সেলুনের ডোর সিল তিন ইঞ্চি চওড়া, আর রাবারের তৈরি। সব দরজার সিলই তাই। নাকি আপনি লক্ষ করেননি? যেমন লক্ষ করেননি ল্যারি আর্চার, স্টিল ফটোগ্রাফার, নিখোঁজ রয়েছেন?

রানা ভাবল, ছোকরার দেখা যাচ্ছে চোখ আছে। আপনি জানলেন কিভাবে?

তারমানে ব্যাপারটা আপনি অস্বীকার করছেন না?

আমার জানা নেই। আপনি কিভাবে জানলেন?

আমি আসলে মরগানকে দেখতে গিয়েছিলাম। শুনলাম সে নাকি অসুস্থ…।

সে অসুস্থ শুনে আপনি তাকে দেখতে গেলেন? কিন্তু অসুস্থ তো আরও অনেকে…

ওয়েন বলল, আমার জানা আছে, মরগানকে কেউ বিশেষ পছন্দ করে না। বুঝতে পারি, অসুস্থ হলেও কেউ তাকে দেখতে যাবে না। সে-কথা ভেবেই যেতে ইচ্ছে করে আমার।

বেশ, তারপর?

ব্রেকফাস্টের সময় সেলুনে আমি আর্চারকে দেখিনি, বলল ওয়েন। তাই মরগানকে জিজ্ঞেস করলাম, আর্চার কোথায়? সে বলল, ব্রেকফাস্টের জন্যে বেরিয়েছে। আমি আর তাকে কিছু বললাম না। তবে কৌতূহল হলো। প্রথমে গেলাম রিক্রিয়েশন রূমে। নেই সেখানে। তারপর এক এক করে জাহাজের প্রতিটি ইঞ্চি খুঁজে দেখলাম। নেই।

ক্যাপটেনকে ব্যাপারটা রিপোর্ট করা হয়েছে?

বাহ্, আপনার প্রতিক্রিয়া বিস্ময়কর। না, রিপোর্ট করিনি।

কেন?

ঠিক যে কারণে আপনি রিপোর্ট করেননি। সদ্য সই করা চুক্তিতে থাকুক বা থাকুক, কেউ নিখোঁজ হয়েছে শুনলেই জাহাজ ঘুরিয়ে নেবেন তিনি, রওনা হবেন হ্যামারফেস্টের উদ্দেশ্যে। আমি তা চাই না।

আপনি তা চান না?

না। কারণ আমি দেখতে চাই বেয়ার আইল্যাণ্ডে কি ঘটে।

ইন্টারেস্টিং কিছু ঘটতে পারে।

আমি জানি, আপনিও দেখতে চান বেয়ার আইল্যাণ্ডে কি ঘটে। ক্ষীণ হাসল ওয়েন। আপনার মনে আছে, আজ খুব ভোরে ব্রিজে দাঁড়িয়ে কি বলেছিলাম আমি? বলেছিলাম, আমাদের সাহায্য দরকার হতে পারে। আরও বলেছিলাম, এখানে আমাদের একটা ট্রান্সমিটার আছে, উত্তর গোলার্ধের যে-কোন জায়গার সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব। মনে আছে আপনার?

আছে। মনে মনে শঙ্কিত বোধ করল রানা। এরপর কি বলবে ওয়েন, আন্দাজ করতে পারছে। ওর শিরদাঁড়া বেয়ে ভয়ের একটা স্রোত নেমে এল।

যত ইচ্ছে সাহায্য চাইতে পারি আমরা, কিন্তু আমাদের চিৎকার এই জাহাজের গ্যালি পর্যন্তও পৌঁছুবে না। এই প্রথম ওয়েনের চেহারায় কৌতুকের বদলে উদ্বেগ ফুটে উঠতে দেখল রানা। পকেট থেকে একটা স্কুড্রাইভার বের করল সে, ইনার বাল্কহেডে সেট করা ইস্পাত-নীল রিসিভার-ট্রান্সমিটারের দিকে ঘুরল।

স্ক্রুড্রাইভার কি সব সময় সঙ্গেই রাখেন?

শুধু যখন বেয়ার আইল্যাণ্ডের উত্তর-পুবের রেডিও স্টেশন টানহেইম-এর সঙ্গে যোগাযোগ করতে ব্যর্থ হই। ভুলে গেলে চলবে না, ওটা সাধারণ কোন রেডিও স্টেশন নয়-নরওয়ে সরকারের একটা অফিশিয়াল বেস। ফেস-প্লেটের স্কুগুলো খুলতে শুরু করেছে ওয়েন। ঘণ্টাখানেক আগে একবার খুলেছিলাম। দেখলেই বুঝতে পারবেন আবার কেন লাগিয়ে রেখেছি।

আজ ভোরে ওয়েনের সঙ্গে কি কথা হয়েছিল মনে আছে রানার। ন্যাটোর আটলান্টিক ফোর্স-এর প্রসঙ্গও ওঠে। তার ঠিক পরপরই স্টারবোর্ড স্ক্রীন ডোর দিয়ে তুষারের ওপর তাজা পায়ের ছাপ দেখতে পায় ও। প্রথমে মনে হয়েছিল, ওখানে দাঁড়িয়ে আড়ি পেতে কেউ শুনে গেছে ওদের কথা। তারপর খেয়াল করে, পায়ের ছাপ মাত্র একজোড়া, ওর নিজেরই তৈরি। কথাটা সে সময় ওর নিরেট মাথায় ঢোকেনি যে যে-লোক ইভনিং স্টারে একের পর এক খুন করে যাচ্ছে তার উপস্থিত বুদ্ধি ক্ষুরধার হবারই কথা, এক সেট পায়ের দাগ দেখার পর সেই দাগের ওপরই পা ফেলবে সে, নতুন ছাপ তৈরি করবে না।

ফেস প্লেট খুলে ফেলল ওয়েন। উন্মোচিত ট্রান্সমিটারের দিকে দশ সেকেণ্ড তাকিয়ে থাকল রানা, তারপর বলল, হ্যাঁ, বুঝতে পারছি আবার কেন ফেস-প্লেট লাগিয়ে রেখেছিলেন। কিন্তু কেবিনটা এত ছোট, চোদ্দ পাউণ্ড পেজ-হ্যামার নিয়ে একটা লোক ভেতরে ঢুকল কিভাবে?

হ্যাঁ, দেখে তাই মনে হচ্ছে, পেজ-হ্যামার দিয়ে ভেঙে চুরমার করা হয়েছে। কাজটা যে-ই করে থাকুক, কোন খুঁত রাখেনি। রিসিভার-ট্রান্সমিটারটা কোনদিনই আর মেরামত করা সম্ভব নয়।

কিন্তু লাইফবোটের রেডিওগুলো? জিজ্ঞেস করল রানা।

ওগুলোর অবস্থা শুনবেন? ওগুলোও গ্যালি পর্যন্ত পৌঁছুবে কিনা সন্দেহ, তারচেয়ে মেগাফোন ভাল কাজ করবে।

ব্যাপারটা আপনার ক্যাপটেনকে রিপোর্ট করা দরকার, বলল রানা।

অবশ্যই।

তারপর হ্যামারফেস্টের দিকে ঘুরে যাবে জাহাজ?

ফেস-প্লেটের স্ক্রু আঁটছে ওয়েন। ক্যাপটেনকে জানাব চব্বিশ ঘণ্টা পর। চব্বিশ কি ছাব্বিশ ঘণ্টা পর, তার আগে নয়।

রানা জানতে চাইল, তারমানে সাউথ হেভেনের কাছাকাছি নোঙর ফেলার দূরত্বে পৌঁছুনোর পর?

নোঙর ফেলা সম্ভব কিনা জানি না। ইভনিং স্টারকে সম্ভবত বাঁধতে হবে। হ্যাঁ।

আপনি খুব কৌশলী মানুষ, মি. ওয়েন।

সঙ্গ দোষ বলতে পারেন। দায়ী যে-জীবন বেছে নিয়েছি।

প্লীজ, জীবনকে দায়ী করবেন না, বলল রানা। আমরা একটা দুঃসময়ের ভেতর বসবাস করছি, মি. ওয়েন।

.

প্রায় কালো রঙের আকাশ অনেক নিচে নেমে এসেছে, আকাশ থেকে সাগর পর্যন্ত শুধু তুষার দেখা যাচ্ছে। সময়টা সকাল, দেখে মনে হচ্ছে সন্ধে। বেয়ার আইল্যাণ্ডে বছরের এই সময়টা সারা দিনকেই সন্ধে বলে মনে হয়। এই দ্বীপ আর এদিককার পানি সম্পর্কে যার ধারণা আছে, ভয়ে তার বুক কাপবেই। সার্বক্ষণিক দুর্যোগ কবলিত দুর্গম এলাকা বলেই নয় শুধু, শক্তি প্রদর্শনের যুদ্ধে আর দ্বীপ দখলের লড়াইয়ে যে বিপুল রক্তপাত ঘটানো হয়েছে সে-কথা স্মরণ করেও। বেয়ার আইল্যাণ্ডকে কালো একটা ছায়ার মত, দেখতে পেল ওরা। কালো বলেই ভীতিকর লাগল। কারণ এক বছরে জমে ওঠা বরফ আর তুষার চারদিক সাদা করে রেখেছে, এমনকি ব্যারেন্ট সাগরের পানি পর্যন্ত দুধের মত, তার মাঝখানে এক হাজার পাঁচশো ফুট খাড়া একটা অতিকায় কালো আকৃতি মাথা তুলে আছে বেয়ার আইল্যাণ্ড। দ্বীপটার সর্বদক্ষিণ প্রান্তের দক্ষিণ-পশ্চিমে রয়েছে ওরা, ইভনিং স্টার এগোচ্ছে পুব দিকে। উইক ছাড়ার পর এই প্রথম প্রায় শান্ত সাগর পেয়েছে। ওরা, যদিও শান্ত বলাটা আসলে আপেক্ষিকডেকে দাঁড়াতে হলে এখনও রেইলিং বা অন্য কিছু ধরতে হচ্ছে ওদের। সব মিলিয়ে বলতে হবে, আবহাওয়ার এখনও তেমন কোন পরিবর্তন ঘটেনি। সাগরকে খানিকটা শান্ত লাগছে, তার কারণ বাতাস এখন সরাসরি উত্তর দিক থেকে বইছে, আর ইভনিং স্টার রয়েছে। পাহাড়-প্রাচীরের আড়ালে।

ব্রিজে ওরা প্রায় দশজন লোক রয়েছে। হেলমসম্যানের সামনে, ফরওয়ার্ড স্ক্রীন উইণ্ডোয় একটা হাই-স্পীড কেন্ট ক্লিয়ার-ভিউ স্ক্রীন লাগানো হয়েছে। হেলমসম্যান এই মুহূর্তে ওয়েন। জানালার অপর দিকে কাজ করছে বড় আকারের এক জোড়া উইণ্ডস্ক্রীন-ওয়াইপার।

পোর্ট ওয়াইপারের সামনে জক মুর, ডগলাস হিউম আর এলিনা স্টুয়ার্টের সঙ্গে দাঁড়িয়ে রয়েছে রানা। হিউমের চেহারাই শুধু নায়ক সুলভ নয়, বাস্তব জীবনেও নায়কের মত চলাফেরা করে সে-যেভাবেই হোক এলিনার সঙ্গে একটা বন্ধুতুপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি করে নিয়েছে। কি কারণে কে জানে, অন্তত রানার জানা নেই, গতকাল সকাল থেকে ওর সঙ্গে কোন কথাই বলেনি এলিনা। গত চব্বিশ ঘণ্টা ওকে যে সে এড়িয়ে গেছে তা নয়, তবে ওর খোঁজে একবারও আসেনি। কে জানে, তার মনে হয়তো অপরাধবোধ কাজ করছে। রানাও অবশ্য তার খোঁজ করেনি। কারণ ওর মনও দুএকটা বিষয়ে ব্যস্ত ছিল-তার মধ্যে একটা এলিনা।

এলিনার প্রতি খানিকটা কৃতজ্ঞও বটে ও। কারণ নিজের অজান্তে ওর প্রাণ বাঁচিয়েছে মেয়েটা। সেদিন রাতে স্কচ খাবার ইচ্ছে ছিল ওর, এলিনা বাধা দেয়ায়। তা আর খাওয়া হয়নি। খেলে তখুনি মারা যেত ও। শুধু তাই নয়, এলিনা তাকে। সেলুনেও আটকে রেখেছিল। আটকে না রাখলে অবশ্যই রানা জাহাজের এখানে সেখানে ঘুরে বেড়াত, ফলে পেজ-হ্যামারধারী আততায়ী আড়াল থেকে ওর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার একটা সুযোগ পেয়ে যেত। এলিনা যার বা যাদের পক্ষেই কাজ করুক, সচেতনভাবে না হলেও, রানার উপকারই করেছে। আর এলিনা যাদের পক্ষে কাজ করছে তাদের একজন যে এরিক কার্লসন, সে-ব্যাপারেও রানার মনে কোন সন্দেহ নেই। ক্লার্ক, রানা ও বিশপ ছাড়া গোটা জাহাজে আর শুধু একজনই একা একটা কেবিন ব্যবহার করছেন, তিনি হলেন এরিক কার্লসন। কাজেই কেবিন থেকে বেরুনোর সময় বা ঢোকার সময় কেউ তাকে দেখার নেই। তাছাড়া, তার রহস্যময় সাইবেরিয়ান ব্যাকগ্রাউণ্ড তো আছেই। তারপর কি ঘটল? এলিনার সঙ্গে গোপনে দেখা করলেন তিনি।

রানার হাত স্পর্শ করলেন জক মুর। ঘুরল রানা, হুইস্কির গন্ধ পেল নাকে। মনে আছে, কি নিয়ে আলাপ করছিলাম আমরা? দুই রাত আগে?

আলাপ তো আমরা অনেক বিষয়েই করেছি।

বার।

মি. মুর, আপনি শুধু এই একটা বিষয়েই মাথা ঘামান? বার? কিসের বার?

পরকালে, চেহারায় গাম্ভীর্য ফোঁটাবার চেষ্টা করলেন মুর। আপনার কি মনে হয়, স্বর্গে বার আছে? বার না থাকলে ওটা স্বর্গ হয় কি করে, আপনিই বলুন? খুব কড়াকড়ি আছে, এমন জায়গায় একটা বুড়োকে পাঠাবার কোন মানে হয় না। নিষ্ঠুর মনে হবে।

ঠিক বলতে পারছি না, মি. মুর। আমাদের বলা হয়েছে, পুণ্যবানরা ওই জিনিস অঢেল পাবেন। বাইবেলেও বোধহয় এ-ধরনের একটা আশ্বাস দেয়া হয়েছে। অন্তত মদবিহীন স্বর্গ বাইবেলেও কল্পনা করা হয়নি। তবে দুধ আর মধুর কোন কমতি নেই। মুরের চেহারায় আহত ভাব ফুটে উঠল। কেন আপনার মনে হচ্ছে, স্বর্গে যাবার পর এ-ধরনের একটা সমস্যার মুখোমুখি হতে হবে আপনাকে?

আমি পরম দয়ায় বিশ্বাস করি, মি. রানা, বললেন মুর, মদের নেশায় টলছেন। স্রষ্টা আর তার পুত্রের দয়া ছাড়া উদ্ধারের পথ নেই।

সারাটা জীবন নোংরা ফিল্ম জগতে কাটিয়ে আপনি দয়া বা ক্ষমা পাবার আশা করেন?

অবশ্যই। দয়া ছাড়া আর আছেটা কি? সব ধর্মেই তো বলা হয়েছে, শেষ পর্যন্ত মাফ করে দেয়া হবে।

এমনকি যাদের প্রাপ্য নয় তাদেরকেও?

ওদেরই তো সবচেয়ে বেশি দরকার, মি, রানা।

এমনকি মোনাকারও?

চেহারা দেখে মনে হলো, রানা যেন ভদ্রলোককে ঘুসি মেরেছেন। মুখ ঘুরিয়ে অন্য দিকে তাকালেন তিনি, তার চেহারায় বিষণ্ণ একটা ভাব ফুটে উঠল। কথা না বলে বেরিয়ে গেলেন ব্রিজ থেকে।

অসম্ভবকে সম্ভব হতে দেখলাম, রানার আরেক পাশ থেকে বলে উঠল। হিউম। অবশেষে মি. মুরকে কেউ আহত করতে পেরেছেন।

মি. মুরের বোধহয় ধারণা হয়েছে, আমার ভেতর দয়া বলে কিছু নেই।

রানার রেইলিং ধরা হাতটায় হাত রাখল এলিনা। আপনি নির্দয়? রানা দেখল, ছত্রিশ ঘণ্টা আগে মেয়েটার চোখের নিচে যে কালি জমেছিল তা আরও গাঢ় হয়েছে, একটু যেন ফোলা ফোলাও লাগল। আরও কি যেন বলতে গিয়ে ইতস্তত করছে সে, তারপর রানার কাঁধের ওপর দিয়ে দূরে তাকাল। তার দৃষ্টি অনুসরণ করার জন্যে ঘুরল রানা।

স্টারবোর্ডের হুইল হাউজ ডোরটা বন্ধ করে দিয়েছেন ক্যাপটেন ডানহিল। চেহারা দেখে বিচলিত মনে হলো তাকে। সরাসরি এগিয়ে গিয়ে ওয়েনের সামনে দাঁড়ালেন, কথা বললেন নিচু গলায়। ওয়েনের চেহারায় বিস্ময় ফুটে উঠল, তারপর মাথা নাড়ল সে। আবার কি যেন বললেন ক্যাপটেন। কাঁধ ঝাঁকাল ওয়েন, উত্তরে সে-ও কি যেন বলল। তারপর দুজনেই তাকাল রানার দিকে।

কিছু একটা ঘটেছে, বুঝতে পারছে রানা। ক্যাপটেন ওর দিকে তাকিয়ে আছেন অন্তর্ভেদী দৃষ্টিতে, মাথা ঝাঁকিয়ে চার্ট রূমটা দেখালেন, তারপর হাঁটা দিলেন সেদিকে। কাঁধ ঝাঁকিয়ে এলিনা ও হিউমের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিল রানা, পিছু নিল ক্যাপটেনের।

 রানা ঢোকার পর চার্ট রূমের দরজা বন্ধ করে দিলেন ক্যাপটেন। আরও দুঃসংবাদ, মি. রানা, বললেন তিনি। ফিল্ম কোম্পানীর একজন ক্রু, ল্যারি আর্চার, নিখোঁজ হয়েছেন।

নিখোঁজ হয়েছেন? কিভাবে?

সেটাই আমি জানতে চাইছি। রানার দিকে কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন ক্যাপটেন।

তিনি স্রেফ গায়েব তো আর হয়ে যেতে পারেন না। সব জায়গায় খুঁজে দেখা হয়েছে?

হ্যাঁ, সব জায়গায় দেখা হয়েছে। ইভনিং স্টারে নেই তিনি।

মাই গড! বলল রানা। অদ্ভুত ব্যাপার। কিন্তু কথাটা আমাকে আপনি বলছেন কেন?

কারণ আমার ধারণা আপনি আমাদেরকে সাহায্য করতে পারবেন।

সাহায্য করতে পারব? সাহায্য করতে চাই, কিন্তু কিভাবে? একজন ডাক্তার হিসেবে আমি বলতে পারি মি. আর্চারকে আমার কখনোই তেমন অসুস্থ মনে হয়নি…

ডাক্তার হিসেবে নয়! কঠিন সুরে বললেন ক্যাপটেন। আমি জানি, আপনি অন্যভাবে সাহায্য করতে পারেন।

আপনি জানেন…?

অদ্ভুত নয়, ব্যাপারটা, মি. রানা, যখন যা কিছু ঘটছে সব সময় তার মাঝখানে দেখা যাচ্ছে আপনাকে?

মানে? ব্যাখ্যা করবেন, প্লীজ?

কেডিপাস মারা গেছেন, এ-কথা কে প্রথম জানল? আপনি। মি. ওয়েন আর মি. গ্যাবন যখন অসুস্থ হলেন, কে তখন প্রথম ব্রিজে গেলেন? আপনি। ক্রু কোয়ার্টারে, স্টুয়ার্ডদের কেবিনেও আপনাকে প্রথম দেখা গেল। এরপর, আমার ধারণা, মি. গোলডার কেবিনেও যেতেন, আপনি, গিয়ে দেখতেন তিনি মারা গেছেন, কিন্তু আপনার আগে সেখানে হাজির হন মি. বিশপ-ফলে মি. গোলডা বেঁচে যান। আরও একটু বলি, এই অসুস্থ লোকগুলোর চিকিৎসা একজন ডাক্তারই করতে পারেন, কিন্তু তা তিনি না পারায়, স্বভাবতই মনে প্রশ্ন জাগে লোকগুলোকে অসুস্থ করে তোলার মেডিকেল নলেজ গোটা জাহাজে একজনেরই আছে-তিনি। কে? আপনি!

নিজের দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে যা বুঝছেন তাই বলছেন ক্যাপটেন, তাঁর কথায় যথেষ্ট যুক্তিও আছে। ভদ্রলোককে ছোট করে দেখায় নিজেকে তিরস্কারই করল রানা।

গত পরশু রাতে গ্যালিতে অনেকক্ষণ ছিলেন আপনি, আমি যখন ঘুমিয়ে। কেন? ওই জায়গা থেকেই তো বিষটা এসেছে। আমাকে বলেছে মরিসন। বলেছে, আপনি শুধু শুধু নাক গলাচ্ছিলেন, এমনকি কিছুক্ষণের জন্যে তাকে সরিয়েও দেন। যা খুঁজছিলেন তা আপনি পাননি। তবে পরে আবার ফিরে আসেন, তাই না? খাবারের অবশিষ্ট কোথায় আছে, খুঁজছিলেন, তাই না? ওগুলো নেই দেখে বিস্মিত হবার ভান করেন। কোর্টে দাঁড়িয়ে এ-সবের ব্যাখ্যা দিতে হবে যখন, তখন বুঝবেন…

আপনি, মি. ডানহিল, প্রলাপ বকছেন…।

সেই রাতে প্রায় সারারাতই কেবিনের বাইরে ছিলেন আপনি, তাই না, মি. রানা? জ্বী, আমি খোঁজ নিয়ে জেনেছি। সেলুনে ছিলেন, মি. বিশপ আমাকে জানিয়েছেন। ব্রিজে ছিলেন, মি. গ্যাবন জানিয়েছেন। ছিলেন লাউঞ্জে, মি. মুর জানিয়েছেন। আর ছিলেন…, নাটকীয় ভঙ্গিতে থামলেন তিনি, হাঁপাচ্ছেন, তারপর শেষ করলেন, …মি. আর্চারের কেবিনে, তাঁর কেবিন-মেট আমাকে জানিয়েছেন। আমি ভুলছি না, আপনিই আমাকে একটা গুরুত্বহীন চুক্তিপত্র গুছিয়ে দিয়ে হ্যামারফেস্টে ফিরে যেতে বাধা দেন।

হুইল-হাউজের দরজাটা খুলল রানা, ইঙ্গিতে চৌকাঠ টপকাতে বলল। ক্যাপটেনকে। এই মাত্র কোর্ট-এর কথা বলেছেন আপনি। আমার বিরুদ্ধে আপনার অভিযোগগুলো সবাইকে সাক্ষী রেখে বলুন, তারপর দেখা যাবে কোর্টে দাঁড়িয়ে কাকে বিপদে পড়তে হয়।

থতমত খেয়ে গেলেন ক্যাপটেন ডানহিল।

দরজাটা বন্ধ করল রানা, চিন্তা করছে কিভাবে শুরু করবে।

কিন্তু শুরু করার সময় ওকে দেয়া হলো না। নক হলো দরজায়, পরমুহূর্তে খুলে গেল সেটা। ব্যাকুল চেহারা, ভেতরে ঢুকল গ্যাবন। আপনাকে, স্যার, এখুনি একবার সেলুনে যেতে হবে, বলল সে। আপনাকেও, মি. রানা। ওখানে সাংঘাতিক একটা মারপিট হয়ে গেছে।

গ্রেট গড অলমাইটি! আঁতকে উঠে দ্রুত চার্টরূম থেকে নিষ্ক্রান্ত হলেন ক্যাপটেন, তাঁর পিছু নিয়ে রানাও।

০৮.

রিক্রিয়েশন রূম থেকে তিন দেবতার সম্মিলিত চিৎকার ভেসে আসছে। সেলুনে সব মিলিয়ে মাত্র ছজন লোককে দেখতে পেল ওরা। ছজনের মধ্যে তিনজন। দাঁড়িয়ে আছে, বসে আছে একজন, একজনকে দেখা গেল ডেকে হাঁটু গাড়া অবস্থায়, অপরজন শুয়ে আছে। দাঁড়িয়ে আছে হেনেরিক ব্রায়ান, এডি আর জক মুর-সবার চেহারায় উদ্বেগ, তবে ইতস্তত ও অসহায় একটা ভাবও আছে। ক্যাপটেনের টেবিলে একটা চেয়ারে বসে রয়েছে মিখায়েল ট্যাকার, রক্তের দাগ লাগা একটা রুমাল দিয়ে ডান গালের ক্ষত মুছছে। তার রুমাল ধরা হাতের গিটগুলোর চামড়া ছড়ে গেছে। ডেকে হাঁটু গেড়ে রয়েছে পামেলা। রানা তার পিঠটাই শুধু দেখতে পাচ্ছে, লম্বা চুল কোমর ছাড়িয়ে লুটিয়ে পড়েছে ডেকের ওপর, আর তার শিঙের তৈরি চশমাটা পড়ে রয়েছে দুফুট দূরে। পামেলা কাঁদছে, তবে নিঃশব্দে, মাঝে মধ্যে কেঁপে কেঁপে উঠছে তার সুগঠিত কাঁধ জোড়া। তাকে ধরে সিধে করল রানা, এখনও ডেকে হাঁটু গেড়ে বসে রয়েছে সে। চোখ ভরা পানি, রানার দিকে তাকাল মেয়েটা, চোখে চশমা না থাকায় চিনতে পারছে না ওকে।

সব ঠিক হয়ে যাবে, পামেলা, বলল রানা। আমি, আপনাদের ডাক্তার। ডেকে পড়ে থাকা মূর্তিটার দিকে তাকাল ও। তরুণ হুপারকে চিনতে অসুবিধে হলো না। লক্ষ্মী মেয়ে, শান্ত হোন এবার, ওকে একটু পরীক্ষা করি।

ওর আঘাত খুব মারক, মি. রানা, সাংঘাতিক আহত হয়েছে ও! ফুঁপিয়ে। উঠে বলল পামেলা। দেখুন না, এমন মার মেরেছে…এমন মার মেরেছে, আবার কেঁদে ফেলল সে।

মি. ব্রায়ান, মুখ তুলে তাকিয়ে বলল রানা, গ্যালিতে গিয়ে মি. মরিসনের কাছ থেকে খানিকটা ব্র্যাণ্ডি চেয়ে আনবেন? বলবেন আমি পাঠিয়েছি। মাথা ঝাঁকিয়ে সেলুন থেকে বেরিয়ে গেল ব্রায়ান। ক্যাপটেনের দিকে ফিরল রানা। দুঃখিত, আপনার অনুমতি চাওয়া উচিত ছিল।

ও কিছু না, ডক্টর রানা, বললেন ক্যাপটেন, তাকিয়ে আছেন মিখায়েল ট্যাকারের দিকে।

পামেলাকে রানা বলল, উঠুন, ওই সেটীতে গিয়ে বসুন। ব্র্যাণ্ডি এলে দুঢোক খাবেন, কেমন?

না…না

ডাক্তারের নির্দেশ, বলে এডি আর জক মুরের দিকে তাকাল রানা। কথা না বলে পামেলাকে নিয়ে সেটীর দিকে এগোল তারা।

এরপর হুপারকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে উঠল রানা। এখন একটু একটু নড়ছে সে। ট্যাকার তাকে ভালই মেরেছে-কপালটা কেটে গেছে, ফুলে উঠেছে একটা চোখ, একটা দাঁত নেই, নাকের দুই ফুটো থেকেই রক্ত বেরিয়ে আসছে, থেঁতলানো ঠোঁট থেকেও রক্ত গড়াচ্ছে। ট্যাকারের দিকে তাকাল ও। আপনার কীর্তি, মি. ট্যাকার?

বুঝতেই তো পারছেন, তারপরও জিজ্ঞেস করছেন কেন?

জিজ্ঞেস করছি এই জন্যে যে আপনার তুলনায় হুপারকে একদম বাচ্চাই বলা যায়। মারামারি করার জন্যে নিজের সমান কাউকে খুঁজে পেলেন না?

অর্থাৎ আপনার মত কাউকে?

মাই গড! বিড়বিড় করল রানা। ট্যাকারের সভ্য-ভব্য চেহারার আড়ালে। অত্যন্ত কর্কশ ও হিংস্র কি যেন একটা আছে। তাকে অগ্রাহ্য করে জক মুরকে গরম পানি আনতে বলল ও, যতটা সম্ভব পরিষ্কার করল হুপারের ক্ষতগুলো। তারপর কপালে প্লাস্টার লাগাল, নাকে তুলো গুঁজে দিল, সেলাই করল ঠোঁট। ও সিধে হলো, এই সময় ট্যাকারকে প্রশ্ন করলেন ক্যাপটেন।

কি ঘটেছিল, মি. ট্যাকার?

ঝগড়া।

ঝগড়া? কি থেকে ঝগড়া হলো? গলা শুনে মনে হলো ক্যাপটেন ডানহিল বিদ্রূপ করছেন।

অপমান থেকে। ও আমাকে অপমান করে।

ও? আপনাকে? ও তো একটা বাচ্চা ছেলে, মি. ট্যাকার! ক্যাপটেন আর রানার অনুভূতি একই রকম। একটা বাচ্চা ছেলে কি এমন বলল যে অপমান বোধ করলেন আপনি?

ব্যক্তিগত বিষয়ে অপমানকর কথা বলেছে। গালের ক্ষতে রুমাল চাপল ট্যাকার। কেউ আমাকে অপমান করলে তাকে আমি ছাড়ি না।

এই জাহাজের ক্যাপটেন হিসেবে আমি…

আমি আপনার ক্রু নই, ক্যাপটেন, কর্কশ গলায় বলল টাকার। ওই বোকা ছোকরা যদি কোন অভিযোগ না করে–আমি জানি করবে না-আপনি নিজের চরকায় তেল দিতে পারেন। দাঁড়াল সে, সেলুন ছেড়ে চলে গেল। ক্যাপটেন ডানহিলকে দেখে মনে হলো অনুসরণ করবেন তিনি, তারপর সিদ্ধান্ত পাল্টে নিজের টেবিলের মাথায় বসলেন, হাত বাড়ালেন নিজের বোতলের দিকে। ইতিমধ্যে পামেলাকে ঘিরে দাঁড়িয়েছে তিনজন, তাদের দিকে মুখ তুলে জিজ্ঞেস করলেন, কি ঘটেছে আপনারা কেউ দেখেছেন?

না, স্যার, জবাব দিল ব্রায়ান। ওখানে, জানালার সামনে একা দাঁড়িয়ে ছিলেন মি. ট্যাকার, এই সময় মি. হুপার তার সঙ্গে কথা বলার জন্যে এগিয়ে যান। কি কথা, বলতে পারব না। পরমুহূর্তে দেখি দুজনই মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছেন। কয়েক সেকেণ্ড পরই অবশ্য থেমে যায় ব্যাপারটা।

সতর্ক ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকালেন ক্যাপটেন, তারপর নিজের গ্লাসে হুইস্কি ঢাললেন। তার মধ্যে সেলুন ছেড়ে বেরুবার কোন লক্ষণ না দেখে রানা ধরে নিল, অ্যাংকারিজ-এ পৌঁছুনোর জন্যে ওয়েনের ওপর নির্ভর করছেন তিনি। হুপারকে দাঁড় করাল ও, দরজার দিকে হটিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।

ক্যাপটেন বললেন, আপনি কি ওঁকে নিচে নিয়ে যাচ্ছেন, মি. রানা?

মাথা ঝাঁকাল রানা। ফিরে এসে বলব আপনাকে, কিভাবে ব্যাপারটা শুরু করেছিলাম। এমনভাবে মুখ কোচকালেন ক্যাপটেন, দেখে মনে হতে পারে। ভেঙুচালেন, তারপর গ্লাস তুলে আড়াল করলেন মুখটা। দরজার দিকে এগোবার সময় রানা লক্ষ করল, সেটীতে বসে ব্র্যাণ্ডির গ্লাসে চুমুক দিচ্ছে পামেলা, প্রতিবার চুমুক দেয়ার সময় শিউরে উঠছে সে। তার চশমাটা রয়েছে জক মুরের হাতে, তিনি সেটা পামেলাকে ফিরিয়ে দেয়ার আগেই হুপারকে নিয়ে সেলুন থেকে বেরিয়ে এল রানা।

হুপারকে তার বাঙ্কে শুইয়ে, গায়ে একটা কম্বল চাপিয়ে দিল ও। খানিকটা রঙ ফিরে এসেছে তার চেহারায়, তবে এখনও কোন কথা বলেনি। রানা জিজ্ঞেস করল, ব্যাপারটা আসলে কি নিয়ে ঘটল?

ইতস্তত করল হুপার। দুঃখিত, মি. রানা। আমার বরং মুখ না খোলাই ভাল।

কেন?

সত্যি দুঃখিত। খানিকটা ব্যক্তিগত ব্যাপারই বলতে পারেন।

কারও কোন ক্ষতি হয়ে যেতে পারে?

হ্যাঁ, আমি…, চুপ করে গেল হুপার।

ঠিক আছে, থাক। মেয়েটাকে সত্যি আপনি ভালবাসেন। রানার দিকে নিঃশব্দে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকল হুপার, তারপর সায় দেয়ার ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকাল। আপনি চান, তাকে আমি এখানে পাঠিয়ে দিই?

নো, ডক্টর, নো! আমি চাই না…মানে, এই চেহারা নিয়ে… না, আমি তাকে মুখ দেখাতে পারব না!

মাত্র পাঁচ মিনিট আগে আপনার চেহারা আরও খারাপ ছিল। তখনও আপনার জন্যে কেঁদে বুক ভাসাচ্ছিল মেয়েটা।

তাই কি? হাসতে গিয়ে ব্যথা পেল হুপার, বিকৃত করল চেহারা। তাহলে…ঠিক আছে।

এরপর ট্যাকারের কেবিনের সামনে চলে এল রানা। নক করায় সাড়া দিল ট্যাকার, তবে রানাকে দেখে খুশি হয়েছে বলে মনে হলো না। তার ক্ষতটার দিকে তাকাল ও, জিজ্ঞেস করল, আপনি চান, ওটা আমি পরিষ্কার করে দিই?

কেবিনের একমাত্র চেয়ারটায় ট্রাউজার আর ফার পারকা পরে বসে রয়েছে। মোনাকা, দেখতে লাগছে লালচুলো এস্কিমোদের মত। কুকুর দুটো কোলের ওপর আদর খাচ্ছে। রানাকে দেখে মহিলার চোখ-ধাঁধানো হাসি পলকের জন্যে ম্লান হলো।

না।

এমনি ফেলে রাখলে দাগটা থেকে যেতে পারে, বলল রানা। থাক বা না থাক, ওর কিছু আসে যায় না।

সর্বনাশ! আঁতকে উঠল ট্যাকার।

কেবিনের ভেতর ঢুকল রানা, বন্ধ করল দরজা, ক্ষতটা পরীক্ষা করল, ধুয়ে এক টুকরো প্লাস্টার লাগিয়ে দিয়ে বলল, শুনুন, মি. ট্যাকার, আমি ক্যাপটেন ডানহিল নই। ছেলেটাকে কি ওভাবে আঘাত করা উচিত হয়েছে আপনার? মৃদু একটা টোকা দিলেই তো পারতেন, মেঝে থেকে উঠতে পারত না।

ক্যাপটেন ডানহিলকে কি বলেছি আপনি তা শুনেছেন-এটা একান্তই ব্যক্তিগত ব্যাপার, রুক্ষসুরে বলল ট্যাকার। রানা ভাবল, ওর সাইকোলজিক্যাল ট্রিটমেন্টে কোন কাজ হয়নি-স্বেচ্ছায় চিকিৎসা সেবা দান বা যুক্তির পথে আসার সকৌতুক আমন্ত্রণ প্রভাবিত করতে পারেনি তাকে। আপনি ডাক্তার বলে অন্যায় কৌতূহল দেখাতে পারেন না। আপনার মনে আছে, আর কি বলেছি আমি। ক্যাপটেনকে?

তিনি যেন নিজের চরকায় তেল দেন।

 ঠিক তাই।

আমার ধারণা, হুপারও সম্ভবত তাই বলবেন।

ছোকরাকে উচিত শাস্তি দেয়া হয়েছে, এবার কথা বলল মোনাকা, তার গলাও ট্যাকারের মত কর্কশ। তার কথা দুটো কারণে মজার বলে মনে হলো রানার। শোনা যায় সে তার স্বামীকে ঘৃণা করে, কিন্তু এখানে তার কোন প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে না-কাজেই সত্যি ঘৃণা করে কিনা ভাল করে খোঁজ নিয়ে দেখা দরকার। আরেকটা ব্যাপার হলো, সে তার স্বামীর মত জিভ আর ভাবাবেগকে সামলে রাখতে জানে না।

আপনি কিভাবে তা জানলেন, মিস মোনাকা? আপনি তো ওখানে ছিলেন।

থাকার দরকার কি। আমি…।

ডার্লিং! অকস্মাৎ বাধা দিল ট্যাকার, সতর্ক হবার জরুরী তাগাদা তার সুরে।

স্ত্রীকে কথা বলতে দিতে ভয় পান নাকি? জিজ্ঞেস করল রানা। শুনে শক্ত মুঠো হয়ে গেল ট্যাকারের হাত। গ্রাহ্য না করে মোনাকার দিকে তাকাল রানা। আপনি জানেন, হুপারের কি অবস্থা করেছেন আপনার বীরপুরুষ স্বামী? জানেন, ওখানে বসে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে বাচ্চা একটা মেয়ে? এ-সব আপনাকে স্পর্শ করে না?

আপনি কি ডাইনী কনটিনিউইটি মেয়েটার কথা বলছেন? হিস হিস করে উঠল মোনাকা। আমি বলব, তারও উচিত শাস্তি হচ্ছে।

ডার্লিং! অস্থির হয়ে উঠল ট্যাকার।

চোখে অবিশ্বাস, মোনাকার দিকে তাকিয়ে থাকল রানা। তবে সে যা বলেছে। তা যে তার অন্তরের কথা, বুঝতে অসুবিধে হলো না। না, শুধু রাগের মাথায় বলেনি। ঘৃণায় ও আক্রোশে চোখ দুটো জ্বলছে তার। ওই ভালমানুষ লক্ষ্মী মেয়েটা? তাকে আপনি ডাইনী বলবেন?

শুধু ডাইনী? খানকি, বেশ্যা, ছেনাল, নর্দমার কীট, স-ব বলব!

স্টপ ইট! চাবুকের মত সপাং করে উঠল ট্যাকারের গর্জন। তার চেহারা দেখে মনে হলো, বাধ্য হয়ে বেপরোয়া হতে হচ্ছে তাকে, স্ত্রীর সঙ্গে এই সুরে কথা না বলে উপায় দেখছে না।

ইয়েস, স্টপ ইট, বলল রানা। জানি না কি ছাইপাশ প্রলাপ বকছেন আপনি, মিস মোনাকা। আমার দৃঢ় বিশ্বাস আপনিও তা জানেন না। আমি শুধু জানি, আপনি অসুস্থ একটা মেয়েমানুষ।

ফেরার জন্যে ঘুরল রানা। ওর পথ আটকাল ট্যাকার। তার মুখের রঙ ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। আমার স্ত্রীর সঙ্গে এভাবে কেউ কথা বলে না, বলল সে, বলার সময় খুব সামান্যই নড়ল তার ঠোঁট।

হঠাৎ ট্যাকারকে একঘেয়ে লাগল রানার। আমি আপনার স্ত্রীকে অপমান করেছি?

এমন অপমান করেছেন যার কোন ক্ষমা নেই।

আর তাতে আপনি নিজেও অপমানবোধ করেছেন?

এতক্ষণে ব্যাপারটা আপনি বুঝতে শুরু করেছেন।

এবং কেউ আপনাকে অপমান করলে তাকে আপনি ছাড়েন না। ক্যাপটেন ডানহিলকে এই কথাই বলেছেন আপনি।

এই কথাই বলেছি।

আই সী।

আই থট ইউ মাইট। ট্যাকার এখনও রানার পথ আগলে রেখেছে।

আর যদি আমি ক্ষমা চাই?

ক্ষমা চাইবেন? ঠাণ্ডা হাসি ফুটল ট্যাকারের মুখে। আগে দেখা যাক ক্ষমার ধরনটা কি।

মোনাকার দিকে ফিরল রানা। বলল, জানি না কি ছাইপাঁশ প্রলাপ বকছেন আপনি, মিস মোনাকা। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আপনিও তা জানেন না। আমি শুধু জানি, আপনি অসুস্থ একটা মেয়েমানুষ।

চেহারার পরিবর্তন দেখে মনে হলো, অদৃশ্য দুটো থাবা তার মুখের দুই পাশেই অনেক গভীরে সেঁধিয়ে গেল, কপাল থেকে চিবুক পর্যন্ত, তারপর হাড়ের ওপর টান টান হলো চামড়া। ট্যাকারের দিকে ফিরল রানা, তার মুখের চামড়া মোটেও টান টান নয়। সুন্দর একটা চেহারা এত অল্প সময়ের ব্যবধানে এমন কুৎসিত হয়ে উঠতে পারে, ওর কোন ধারণা ছিল না। মুখে কোন রঙ নেই, যেন একটা মড়া। চোয়াল ঝুলে পড়েছে। তাকে ধাক্কা দিয়ে এগোল রানা, দরজা খুলে ঘাড় ফিরিয়ে পিছন দিকে তাকিয়ে বলল, ইউ পুওর বাস্টার্ড। চিন্তা করবেন না। ডাক্তাররা কখনও কাউকে কিছু বলে না।

আপার ডেকের পরিষ্কার হিম ঠাণ্ডা বাতাসে বেরিয়ে আসতে পেরে খুশি হলো রানা। অসুস্থ, অস্বাস্থ্যকর ও নোংরা একটা পরিবেশ পিছনে ফেলে এসেছে ও; অসুস্থতা কি বা কোথায় তা জানার জন্যে কারও ডাক্তার হবার দরকার নেই।

ইতিমধ্যে তুষারপাত কমেছে। পোর্ট সাইডে দাঁড়িয়ে দূরে তাকাল রানা। বেয়ার আইল্যাণ্ডের একটা পাহাড়কে আধ মাইল পিছনে ফেলে এসেছে ইভনিং স্টার, পোর্ট বোর দিকে সমান দূরত্বে অপর একটা পাহাড় দেখা যাচ্ছে। কাপ কলথপ আর কাপ মালমাগ্ৰেম, চার্ট দেখে নাম দুটো জেনেছে ও। ধারণা করল, আরও মাইল তিনেক এগোতে হবে ওদেরকে।

ব্রিজের দিকে তাকাল রানা। আবহাওয়ার অবস্থা নিশ্চয়ই আগের চেয়ে ভাল, তা না হলে ধরে নিতে হবে গন্তব্যের কাছাকাছি এসে পড়ায় আরোহীদের মধ্যে আগ্রহ আর কৌতূহল মাথাচাড়া দিয়েছে-ব্রিজের দুই উইং-এই ছোটখাট ভিড দেখা যাচ্ছে, তবে হুডগুলো দিয়ে মুখ প্রায় ঢাকা থাকায় চেনা যাচ্ছে না কাউকেই। হঠাৎ ওর কাছাকাছি একজনের উপস্থিতি সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠল রানা। ব্রিজের সামনের সুপারস্ট্রাকচারের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে রয়েছে সে। লম্বা চুল উড়ছে বাতাসে, পামেলাকে চিনতে পারল ও। তার দিকে এগোল, ডাক্তারের পাওয়া সুবিধে কাজে লাগিয়ে এক হাতে জড়িয়ে ধরল তাকে, অপর হাতে ধরে উঁচু করল মুখটা। পামেলার চোখ লাল হয়ে আছে, নাকের দুপাশ চোখের পানিতে এখনও ভেজা ভেজা। চমশাটা নাকে বাঁকা হয়ে রয়েছে। ডাইনী… ইত্যাদি?

পামেলা, বলল রানা। এখানে আপনি কি করছেন? এই ঠাণ্ডায় তো স্রেফ মারা পড়বেন। নিচে বা ভেতরে থাকা উচিত ছিল আপনার।

আমি একা হতে চেয়েছিলাম। মেয়েটার গলায় এখনও কান্নার সুর রয়ে গেছে। কিন্তু মি. মুর বারবার শুধু ব্র্যাণ্ডি সাধছিলেন। আর… মানে… শিউরে উঠল সে।

তারমানে মি. মুরকে ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে এসেছেন আপনি। তাহলে ভালই করেছেন…

ডক্টর রানা! হঠাই খেয়াল করল পামেলা রানা তাকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে রেখেছে। নিজেকে ছাড়াবার চেষ্টা করল সে, তবে জোর নেই তেমন। লোকজন আমাদের দেখে ফেলবে!

আমি গ্রাহ্য করি না, বলল রানা। আমি চাই আমাদের ভালবাসার কথা দুনিয়ার সবাই জানুক।

আপনি চান দুনিয়ার সবাই…, পামেলার চোখে গভীর মনোযোগ, একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকল রানার দিকে। কাঁচের পিছনে তার বিশাল চোখ দুটো আরও বড় হয়ে উঠল, তারপর সেই চোখের তারায় ফুটতে শুরু করল হাসির আভাস। ওহ, মি. রানা!

তরুণ এক ভদ্রলোক নিচে এখুনি আপনার সঙ্গে দেখা করতে চাইছেন, বলল রানা।

ওহ্! হাসিটা অদৃশ্য হলো পামেলার চোখ থেকে। সে কি…আমি বলতে চাইছি, তাকে তো হাসপাতালে যেতে হবে, তাই না?

বিকেলের মধ্যে তাকে আমরা হাঁটাচলা করতে দেখতে পাব।

সত্যি? সত্যি এবং সত্যি? ব্যাকুল আগ্রহে রানাকে ধরে ঝাঁকাল পামেলা।

আপনি যদি আমার পেশাগত যোগ্যতায় সন্দেহ পোষণ করেন…

ওহ, ডক্টর রানা! তাহলে কি জন্যে, কেন…?

আমার ধারণা, তিনি আপনার হাত ধরতে চান। নিজেকে আমি তিনি ধরে নিয়ে বলছি আর কি।

ওহ্, ডক্টর রানা! তারমানে কি…বলতে চাইছি, তার কেবিনে গেলে…?

ওখানে কি আপনাকে আমার টেনে নিয়ে যেতে হবে?

না। হাসল পামেলা। আমার মনে হয় না তার কোন প্রয়োজন আছে। ইতস্তত করল সে। ডক্টর রানা?

ইয়েস?

আপনি খুব সুন্দর মানুষ। সত্যি তাই।

এবার ভাগুন।

আবার হাসল পামেলা, এবারের হাসিতে প্রায় সুখী দেখাল তাকে, তারপর ভাগল। একটা ব্যাপারে মনে মনে খুশি হলো রানা। ওর ভয় ছিল পামেলার মনে আঘাত দিয়ে ফেলে, কিন্তু তা দিতে হয়নি। ট্যাকারের কেবিন থেকে বেরুবার সময় যে প্রশ্নগুলো জেগেছিল ওর মনে সেগুলো জিজ্ঞেস করার প্রয়োজনই হয়নি। মোনাকা যে অভিযোগগুলো করল সে-সবে মোনাকার ছবিই ফোটে, পামেলার নয়। পামেলার বিরুদ্ধে মোনাকার অভিযোগ সত্যি হলে চলচ্চিত্র জগতে আজও সামান্য কনটিনিউইটি গার্ল হিসেবে পরিচিত হত না পামেলা, বর্তমান যুগের অন্যতম ধনী ও তারকা শিল্পীদের একজন হত সে।

যেখানে ছিল সেখানেই কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল রানা। এইমাত্র কয়েকজন ক্রু এসেছে ফোরডেকে, ডেক কার্গোয় জড়িয়ে থাকা বাধনগুলো এখন আর প্রয়োজন নেই বলে খুলে নিচ্ছে, গুটিয়ে নিচ্ছে তারপুলিন। আরও দুদল ক্রু ডেরিক ও উইঞ্চ পরীক্ষা করছে। বোঝা গেল, গন্তব্যে পৌঁছুনোর পর সময় নষ্ট করার কোন ইচ্ছে ক্যাপটেন ডানহিলের নেই।

সেলুনে চলে এল রানা। জক মুর ছাড়া কাউকে দেখল না। তিনি একা, তবে ঠিক নিঃসঙ্গ নন, তাকে সঙ্গ দিচ্ছে হুইস্কির একটা বোতল। তার পাশে রানা বসতে হাতের গ্লাসটা নিচু করলেন। ব্যস্ততার নাম ডক্টর রানা, মৃদু হেসে বললেন তিনি। টোকা দিলেন বোতলে। চলবে নাকি?

বোতলটা প্যানট্রির, মি. মুর।

প্রকৃতির ফুল ও ফলে সমস্ত মানবজাতির অধিকার আছে। দেব নাকি সামান্য?

শুধু এই জন্যে দিন, তা না হলে আপনি সবটুকু খেয়ে ফেলবেন। আমার একটা ভুল হয়েছে, সেটা সংশোধন করা দরকার, মি. মুর। আমাদের মূল নারী চরিত্র অর্থাৎ নায়িকা সম্পর্কে। এখন আমার মনে হচ্ছে, দয়া-ধর্মের এমনিতেই আকাল, এই অবস্থায় তার জন্যে ও-সব বরাদ্দ করা মানে স্রেফ অপচয়।

অনুর্বর ভূমি, বলতে চান? পাথুরে জমি?

বলতে চাই।

তারমানে আমাদের সুন্দরী মোনাকার কোন উদ্ধার নেই?

তা আমি বলতে পারব না। শুধু বলতে পারব, তাকে উদ্ধার করা আমার। সাধ্যের বাইরে।

আমেন। আরও খানিকটা হুইস্কি খেলেন মুর।

বাকি দুজন সম্পর্কে আপনার কি ধারণা? জিজ্ঞেস করল রানা।

বাকি দুজন-এলিনা আর পামেলা? পামেলা তো লক্ষ্মী মেয়ে। এমনকি আমার এই বয়েসেও ওদেরকে আমি ভালবাসি। ভাল মেয়ে বলেই তো উন্নতি করতে পারছে না। এলিনাও খুব ভাল মেয়ে। ওদের দুজনকেই আমি ভালবাসি।

ওদের পক্ষে খারাপ কিছু করা সম্ভব নয়?

 অসম্ভব!

বলা সহজ। কিন্তু যদি অ্যালকোহলের প্রভাব থাকে?

কি? জক মুরকে হতচকিত দেখাল। কি বলছেন আপনি! অচিন্তনীয় ব্যাপার, মি. রানা, অচিন্তনীয় ব্যাপার।

ধরুন যদি দুগ্লাস করে জিন খায়?

এ কি ধরনের প্রলাপ বকছেন আপনি!

ওরা যদি আপনার কাছে দুএক ঢোক মদ চায় আপনি কি সেটাকে ক্ষতিকর ভাববেন?

কেন ভাবব! চেহারা দেখে মনে হলো জক মুরের বিস্ময় নির্ভেজাল।

তাহলে অনেক দিন আগের একটা ঘটনার কথা মনে করিয়ে দিই আপনাকে, বলল রানা। সেদিন একটানা অনেকক্ষণ কাজ হয়েছে সেটে, সবাই খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছে, শুনেছি এই সময় মাত্র এক ঢোক মদ খেতে চাওয়ায় এলিনার ওপর সাংঘাতিক খেপে যান আপনি।

অদ্ভুত এক মন্থরগতিতে বোতল আর গ্লাস টেবিলের ওপর নামিয়ে রেখে টলতে টলতে চেয়ার ছাড়লেন জক মুর। তাঁকে ক্লান্ত, অথর্ব আর অসহায় দেখাচ্ছে। আপনি এখানে ঢোকার পর থেকে…এখন আমি বুঝতে পারছি। প্রায় বিষণ্ণ সুরে ফিসফিস করছেন, আপনি এখানে ঢোকার পর থেকে এই প্রশ্নটাই করতে চাইছিলেন।

মাথা নাড়লেন মুর, চোখ ফিরিয়ে রানার দিকে তাকাচ্ছেন না। আমি ভেবেছিলাম আপনি আমার বন্ধু, শান্ত সুরে আবার বললেন, তারপর এলোমেলো পা ফেলে বেরিয়ে গেলেন সেলুন থেকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *