ডেথ ট্র্যাপ ২.১

মাসুদ রানা ৪২৬ – ডেথ ট্র্যাপ ২ (দ্বিতীয় খণ্ড) – কাজী আনোয়ার হোসেন – সেবা প্রকাশনী

০১.

বলছে সবাইকে মেরে ফেলবে, বিড়বিড় করে বলল কর্পোরাল নাজমুল।

স্যর, ওরা কখন পৌঁছবে? জানতে চাইল সার্জেন্ট হোসেন আরাফাত দবির।

জবাব দিল না রানা। ওর সন্দেহ নেই, ওই কণ্ঠ এসএএসের কমাণ্ডার, মেজর জেনারেল জুলিয়াস বি. গুণ্ডারসনের! পোর্টেবল ভিউস্ক্রিনে আঠার মত সেঁটে আছে ওর চোখ। স্ক্রিনের নীচের দিকে চাইল। ছোট বক্সের ভিতর সরু রেখা দিয়ে তৈরি হোভারক্রাফট, একটু একটু নড়ছে। নীচে লেখা: বেল টেক্সট্রন সিরিয়াল নং-এন৭-এস–ল্যাণ্ডিং ক্রাফট এয়ার কুশণ্ড (ইউকে)।

এসএএস…অবিশ্বাস নিয়ে বলল নাজমুল। ওরা কেন?

আমরা এখনও মরিনি, গম্ভীর স্বরে বলল হোসেন আরাফাত দবির।

কিন্তু প্রায় মরেই গেছি, মনে মনে বলল রানা। দবিরের দিকে চাইল। ওরা চৌত্রিশ মাইল দূরে। আশি মাইল বেগে আসছে।

সাহায্য করতে যে আসছে না, তা বুঝতে পারছি, বলল দবির।

রানা হিসাব কষতে শুরু করেছে: চৌত্রিশ মাইল দূরে, আশি মাইল বেগে…

তার মানে ছাব্বিশ মিনিট, চট করে বলে দিল রাফায়লা।

শালার কপাল, বিড়বিড় করল দবির।

নীরব হয়ে গেছে ঘর। কেউ কিছু বলছে না।

কানের কাছে নাজমুলের দম ফেলবার আওয়াজ পাচ্ছে রানা। সবাই চেয়ে আছে ওর দিকে।

বড় করে শ্বাস নিল রানা, শান্ত করতে চাইছে মনকে। নতুন করে হিসাব কষতে শুরু করেছে। এসএএস–ব্রিটিশ স্পেশাল এয়ার সার্ভিস, দুনিয়ার সবচেয়ে বিপজ্জনক স্পেশাল ফোর্স! ওই দলের লোক আসছে উইলকক্স আইস স্টেশন লক্ষ্য করে।

নেতৃত্বে মেজর জেনারেল জুলিয়াস বি. গুণ্ডারসন, উনিই নিজে ওকে শিখিয়েছেন কেমন হওয়া উচিত কভার্ট ইনকারশনারি ওয়ারফেয়ার। বছরের পর বছর এসএএসের চিফ, আজ পর্যন্ত কখনও কোনও মিশনে ব্যর্থ হননি।

তার চেয়ে ঢের খারাপ কথা: উনি জ্যাম করে দিয়েছেন ওর রেডিয়ো, চাইলেও ম্যাকমার্জোয় খবর পাঠাতে পারবে না। তার মানেই, ফ্রেঞ্চ রণতরীকে ঠেকাবার কেউ নেই। স্টেশনের উপর নামবে নিউক্লিয়ার টিপড মিসাইল!

স্টপওয়াচ দেখল রানা।

২:০২:৩৫
        ২:০২:৩৬
        ২:০২:৩৭

এক ঘণ্টাও নেই, তার আগেই মিসাইল লঞ্চ করবে ফ্রেঞ্চরা।

বড় জলদি সব ঘটছে। আবারও রেঞ্জফাইণ্ডার ভিউস্ক্রিন দেখল রানা। ওদের দিকে ভোমরার মত আসছে ব্রিটিশ হোভারক্রাফট।

কমপক্ষে বিশটা!

প্রতিটার ভিতর দুই থেকে তিনজন।

তার মানেই, কম করে হলেও পঞ্চাশজন কমাণ্ডো!

ওর দলে কজন?

রানার মনে হলো: শুধুমাত্র লেংটি পরে বিশাল জনসভায় বক্তৃতা দিতে উঠেছে ও! শুধু তা-ই নয়, ও আসলে জনম বোবা!

আবার হিসাব কষতে শুরু করেছে রানা: স্টেশনের ভিতর ওর দলে তিনজন, পাতাল-গুহায় আরও তিনজন। গুদাম-ঘরে আহত নিশাত সুলতানা। আর ই-ডেকে খুঁটিত আটকে রেখেছে বিশ্বাসঘাতক পল সিংগারকে।

ভীষণ শুকিয়ে গেল রানার গলা।

এখন আত্মহত্যা করবার জন্য লড়বে, না পালাতে শুরু করবে?

একবার ম্যাকমার্ডো পৌঁছুতে পারলে…

ওদের হাতে অন্য কোনও উপায় আছে?

না, নেই।

চুপ করে আছে সবাই।

ঠিক আছে, আমরা খুব শীঘি রওনা হব, বলল রানা।

.

ই-ডেকের বরফ-ঠাণ্ডা প্ল্যাটফর্মে রানা নামতেই ধপ আওয়াজ হলো। ডেক পেরিয়ে দক্ষিণ টানেলের দিকে চলেছে।

হঠাৎ কী হলো? একপাশ থেকে জানতে চাইল পল সিংগার। কোনও সমস্যা?

হ্যাণ্ডকাফ পরা সৈনিকের সামনে থামল রানা। খুঁটির নীচে পা ছড়িয়ে বসেছে দুই ফ্রেঞ্চ বিজ্ঞানী। ক্লান্ত চোখে রানাকে দেখছে।

আগেই নিজের লোক মেরে সাফ করতে গিয়ে মস্ত ভুল করেছ, ভাইপারকে বলল রানা। আগে নিশ্চিত হওয়া উচিত ছিল স্টেশন দখলে রাখতে পারবে। ব্রিটিশদের বিশটা হোভারক্রাফট আসছে, পৌঁছবে তেইশ মিনিট পর।

কোনও বিকার দেখা গেল না লোকটার চোখে।

ওরা যখন আসবে, সম্বর্ধনার জন্য তুমি থাকছু, হাঁটতে শুরু করেছে রানা।

আমাকে ফেলে য়াবেন? অবিশ্বাস নিয়ে বলল সিংগার।

হ্যাঁ।

কেন? আমার সাহায্য আপনার দরকার।

চট করে ঘড়ি দেখে নিল রানা। বাইশ মিনিট পর হাজির হবে এসএএস প্লাটুন।

দক্ষিণ টানেলের মুখে পৌঁছে বলল রানা, জুলিয়াস বি. গুণ্ডারসনকে অভ্যর্থনা দিয়ো। হনহন করে হেঁটে চলেছে, টানেল ধরে সামনে বেড়ে পৌঁছে গেল নিশাতের গুদাম-ঘরের দরজায়।

চেয়ারে পিঠ ঠেকিয়ে বসেছে নিশাত সুলতানা। মুখ তুলে রানাকে দেখল, কোনও সমস্যা, স্যর?

আপনাকে সরিয়ে নিতে হবে।

কী হয়েছে?

আমেরিকার সেরা মিত্র চোখ উল্টে নিয়েছে। স্টেশন দখল করতে আসছে এসএএস।

কতজন, স্যর?

বিশটা হোভারক্রাফট।

কপাল! বিড়বিড় করল নিশাত।

আপা, নড়তে পারবেন? নিশাতের পাশে পৌঁছে গেছে রানা, গুছিয়ে তুলছে ফ্লুইড ব্যাগ ও ইন্ট্রাভেনাস ড্রিপ।

কখন আসবে, স্যর?

চট করে ঘড়ি দেখে নিল রানা। আর বিশ মিনিট পর।

বিশ মিনিট, ভোতা শোনাল নিশাতের কণ্ঠ।

ওর পিছন থেকে দুই ফ্লুইড লাইন তুলে নিল রানা।

স্যর, একমিনিট।

কাজ থামিয়ে ওর দিকে চাইল রানা।

বাদ দিন, নরম স্বরে বলল নিশাত।

বুঝলাম না।

স্টেশন ছেড়ে বেরিয়ে যান, বলল নিশাত। দেরি করবেন। আমরা দলে বিশজন থাকলেও এসএএস কমাণ্ডোদের প্লাটুন ঠেকাতে পারতাম না।

আপা…

ওরা রেগুলার ট্রপ নয়, প্রশিক্ষিত খুনি। খুন করাই কাজ। শত্রু এলাকায় কাউকে দেখামাত্র হত্যা করে, কাউকে বন্দি করে না। কোনও প্রশ্নও করে না। চুপ হয়ে গেল নিশাত। কয়েক সেকেণ্ড পর বলল, আপনি এসব জানেন, স্যর। স্টেশন থেকে বেরিয়ে যান।

যাব।

আমার মত লেংড়ি আপনার গতি কমিয়ে দেবে। ওদের ব্লকেড পেরুতে হলে দ্রুত চলতে পারে এমন লোক লাগবে।

আপনাকে ফেলে যাব না, আপা।

যেভাবে হোক আপনাকে ম্যাকমাৰ্ডোয় পৌঁছুতে হবে, নইলে আমেরিকান ফোর্স পাশে পাবেন না।

পেয়েই বা কী হবে?

তারপর ফিরবেন, উদোম ন্যাঙটো করে ছাড়বেন ব্রিটিশের বাচ্চাগুলোকে।

নিশাতের চোখে চাইল রানা।

পাল্টা নিস্পলক চেয়ে আছে নিশাত। যান, স্যর, নরম স্বরে বলল, ফাঁদ থেকে বেরিয়ে যান। আমি ঠিকই থাকব।

চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে রানা।

বড় আপার কথা শুনতে হয়! গম্ভীর স্বরে বলল নিশাত।

দেরি করা ঠিক হচ্ছে না, রানা। আমি লুকিয়ে থাকব। 

আস্তে করে মাথা উঁচু-নিচু করল রানা। আমি আবারও ফিরব, আপা। আমার জন্য অপেক্ষা করবেন।

নিশ্চয়ই, ভাই।

ঘুরে দাঁড়িয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল রানা।

০২.

ওয়াশিংটন ডি.সি.।

দৈনিক পত্রিকা অফিসের কমপিউটার ল্যাবে বসে আছে সন্থা ক্যাসেডিন, সামনে সর্বাধুনিক কমপিউটারের মনিটর। ঘরের কোণে মাইক্রোফিল্ম ভিউয়িং মেশিন। চারদেয়ালে ফাইলিং কেবিনেট। একের পর এক কমপিউটার।

যে সাইটে ঢুকেছে সান্থা, তা অল-স্টেটস্ লাইব্রেরির ডেটাবেস। অনেকে বলেন, যারা এসব লাইব্রেরি থেকে লয়েলের বই ধার করে, তাদেরকে চোখে চোখে রাখে এফবিআই। এর মাধ্যমে সিরিয়াল কিলারদের খুঁজে বের করা সহজ হয়। এই জনশ্রুতি আসলে অর্ধ-সত্য। কিন্তু, একটা সিস্টেম প্রতিটি লাইব্রেরি কমপিউটারে ক্রসলিঙ্ক করা। এই সিডি-রম সার্ভিস আপডেটেবল। দেশের কোথায় কোন বই আছে, তা বের করা যায়। অবশ্য, বই কে নিল, তার হিসাব থাকে না। কয়েকটা উপায়ে বই পাওয়া যায়। আপনি লেখকের নাম লিখে সার্চ করতে পারেন। বা, বইয়ের নাম, অথবা বইয়ের নির্দিষ্ট কোনও লাইন লিখে সার্চ দিতে পারেন। এ ধরনের সুবিধা দেয় অল-স্টেটস্ লাইব্রেরি ডেটাবেস।

মনিটরে চেয়ে আছে সান্থা ক্যাসেডিন। ক্লিক করে সার্চ বাই কি-ওঅর্ড বাটন টিপল ও। টাইপ করল: অ্যান্টার্কটিকা।

তিন সেকেণ্ড পর সার্চের রেজাল্ট এল মনিটরে:

৫৪,৬০০ এন্ট্রি ফাউণ্ড। উড ইউ লাইক টু সি এ লিস্ট?

খুব খুশি হলাম, বাপ, মনে মনে বলল সান্থা। মাত্র কয়েক হাজার বই পড়লেই দুনিয়ার সব জ্ঞান আমার! …এতগুলো বইয়ে লেখা হয়েছে অ্যান্টার্কটিকা শব্দটা?

না, এতে চলবে না। কিছুক্ষণ চুপ করে কী যেন ভাবল সান্থা, তারপর ঠিক করল, আরও সংক্ষিপ্ত কোনও কি-ওঅর্ড দরকার ওর। একটা ধারণা তৈরি হয়েছে মনে, কাজটা করলে সুবিধা পেতে পারে। অন্তত চেষ্টা করে দেখা যাক, ভাবল সান্থা। কিবোর্ডে লিখতে শুরু করেছে, কাজটা শেষে এণ্টার টিপল।

ল্যাটিচুড–৬৬, লংগিচ্যুড ১১৫° ২০ ১২,

সার্চ শুরু করেছে কমপিউটার। এক সেকেণ্ড পর মনিটরে ভেসে উঠল রেজাল্ট:

সিক্স এন্ট্রি ফাউণ্ড। উড ইউ লাইক টু সি এ লিস্ট?

আবার জিগায়! বিড়বিড় করল সান্থা। ওয়াই কি-তে বোঝানো হয়েছে ইয়েস। ওটা টিপে দিতেই মনিটরে ভেসে উঠল একটা লিস্ট। বইয়ের নাম এবং ওগুলো কোথায় রয়েছে পরিষ্কার ভাবে জানিয়ে দেয়া হয়েছে:

অল-স্টেটস লাইব্রেরি ডেটাবেস
        সার্চ বাই কি-ওঅর্ড সার্চ স্ট্রিং ইউজড
        ল্যাটিচুড–৬৬,৫
        লংগিচ্যুড ১১৫ ২০ ১২

নং, অতু এন্ট্রিজ ফাউণ্ড: সিক্স

টাইটেল: দ্য আইস ক্রুসেড: রিফ্লেকশন্স অন
এ ইয়ার স্পেন্ট ইন অ্যান্টার্কটিকা। অথার:
এ ভিসার, হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি, ২০০৯।

টাইটেল: ডক্টরাল থিসিস। অথার: রবার্ট
হিগিন্স, স্ট্যানফর, ১৯৯৯।

টাইটেল: ডক্টরাল থিসিস। অথার: জর্জ
হিউবার্ট, স্ট্যানফর, ১৯৯৮।

টাইটেল: পোস্ট-ডক্টরাল থিসিস। অথার:
এম ভিসার, ইউএসসি, সিটি, ১৯৯৭।

টাইটেল: ফেলোশিপ গ্র্যান্ট রিসার্চ পেপার।
এম ভিসার, হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি, ১৯৯৪

টাইটেল: প্রিলিমিনারি সার্ভে। অথার: শ্যারন
স্টোন, লাইকং, ১৯৭৮।

        লিস্টের দিকে চেয়ে আছে সান্থা। প্রতিটি এন্ট্রিতে বলা হয়েছে এসব বই বা থিসিসে আছে ল্যাটিচুড–৬৬.৫° এবং লংগিচ্যুড ১১৫° ২০ ১২।

বেশিরভাগই ইউনিভার্সিটির থিসিস। লেখকদের কারও নাম থেকে কিছুই বুঝবার নেই সান্থার। দুইজন ভিসার, রবার্ট হিগিন্স, জর্জ হিউবার্ট ও শ্যারন স্টোন।

       দুই হাজার নয় সালে অ্যান্টার্কটিকার উপর নতুন বই লিখেছে এন ভিসার। এই বইয়ের লোকেশন রেফারেন্স দেখল সান্থা। হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি থেকে প্রকাশ করা হয়েছে। প্রতিটি বড় লাইব্রেরিতে পাওয়া যায়।

        অন্য এন্ট্রি থেকে আঁচ করা যায়, লেখক নিজ পয়সায় বই প্রকাশ করেছেন। কিন্তু ওই এন ভিসারের বই প্রচুর চলেছে, ধারণা করল সান্থা। ঠিক করল, পরে এই বিষয়ে আরও খোঁজ নেবে।

আরেকটা এন্ট্রির উপর চোখ আটকে গেল ওর:

টাইটেল: প্রিলিমিনারি সার্ভে। অথার: শ্যারন
        স্টোন, লাইকং, ১৯৭৮।

এটাই শেষ এন্ট্রি। চট করে মনিটরে রেফারেন্স লিস্ট দেখে নিল সান্থা। ওখানে ডেটাবেসের প্রতিটি অ্যাব্রেভিয়েশনের ব্যাখ্যা লেখা। ওখানেই পেয়ে গেল লাইকং।

আচ্ছা, বিড়বিড় করে বলল।

লাইবকং মানে লাইব্রেরি অভ কংগ্রেস। ক্যাপিটল বিল্ডিঙের ওপাশের রাস্তায় লাইব্রেরি অভ কংগ্রেস, এখান থেকে বেশি দূরেও নয়।

শেষ এন্ট্রি আরেকবার দেখল সান্তা ক্যাসেডিন, বুঝছে না কেন প্রিলিমিনারি সার্ভে করা হলো। এন্ট্রির তারিখ দেখে নিল।

১৯৭৮

মানে তিরিশ বছরেরও আগে। একবার দেখে আসতে হয়? মৃদু হেসে প্রিন্ট স্ক্রিন লেখা বাটন টিপল সান্তা ক্যাসেডিন।

.

অ্যাডোনিস ক্যাসেডিনের টয়োটা গাড়ি এসে থেমেছে নিউ মেক্সিকোর রবিন এন কার্বির ষোলো নিউম্যান স্ট্রিট, লেক আর্থারের বাড়ির সামনে।

ষোলো নিউম্যান স্ট্রিটের কটেজটা বেশ সুন্দর, সাদা রঙের। সামনে ছোট্ট বাগান। ফুটে আছে অসংখ্য পাহাড়ি গোলাপ। বাগানের মাঝে ছোট্ট একটা পুকুর। অবসর নেয়া কোনও লোকের বাড়ি মনে হলো। সব কিছুর ভিতর যত্নের ছাপ।

আরেকবার বিজনেস কার্ড দেখে নিল অ্যাডোনিস। ঠিক আছে, রবিন এন কাৰ্বি, দেখা যাক আপনার কী বলার আছে।

গাড়ি থেকে বেরিয়ে বাগান পেরিয়ে বারান্দায় উঠল ও, নক করল স্ক্রিন দরজায়। আধ মিনিট পর ভিতরের কোনও দরজা খুলল, তার পনেরো সেকেণ্ড পর স্ক্রিন দরজার ওপাশে থামল এক লোক। বয়স হবে তার তিরিশের মত। সুঠামদেহী। ক্লিনশেভ করা। মৃদু হাসছে লোকটা।

মর্নিং, কী সাহায্য করতে পারি? দক্ষিণের উচ্চারণে টেনে টেনে কথা বলে।

আমি এসেছি রবিন এন কার্বির সঙ্গে দেখা করতে, তিনি কি আছেন? বিজনেস কার্ড বাড়িয়ে দিল অ্যাডোনিস। আমার নাম অ্যাডোনিস ক্যাসেডিন, কাজ করি দ্য ওয়াশিংটন পোস্টে। মিস্টার কার্বি এই কার্ড পাঠিয়েছিলেন।

হঠাৎ করেই মিলিয়ে গেল লোকটার হাসি। তীক্ষ্ণ হয়ে উঠেছে দুই চোখ। যেন সামনের লোকটার ওজন নিচ্ছে। চোখ চলে গেল সামনের রাস্তায়। বোধহয় বুঝতে চাইছে কেউ পিছু নিয়েছে কি না।

তারপর হঠাৎ করেই ক্যাসেডিনের উপর ফিরে এল দুইচোখ।

মিস্টার ক্যাসেডিন, দয়া করে ভিতরে আসুন, দরজা খুলে দিল সে। ধারণা করেছি যোগাযোগ করবেন, কিন্তু ভাবিনি এত দ্রুত আসবেন। প্লিয, ভিতরে আসুন।

চৌকাঠ পেরুল ক্যাসেডিন, বাড়ির ভিতর ঢুকবার পর টের পেল লোকটার দক্ষিণা টানের কথা মিলিয়ে গেছে, এখন ইস্ট কোস্টের পশ ইংরেজি বলছে! সন্দেহ নেই শিক্ষিত লোক।

পথ দেখিয়ে ওকে ছোট্ট ড্রয়িং রুমে নিয়ে এল লোকটা। দুজন মুখোমুখি দুটো সোফায় বসবার পর বলল, মিস্টার ক্যাসেডিন, রবিন এন কার্বি আমার সঠিক নাম নয়।

পকেট থেকে পেন্সিল ও প্যাড বের করল ক্যাসেডিন। আস্তে করে জানতে চাইল, আমি কি আপনার সত্যিকারের নাম জানতে পারি?

কী যেন ভাবছে যুবক, এই সুযোগে তাকে ভাল করে দেখে নিল ক্যাসেডিন। দীর্ঘাকায় লোক, সুর্দশন, কাঁধদুটো অস্বাভাবিক চওড়া, অ্যাথলেটদের মত। কিন্তু তার ভিতর কী যেন বড় অস্বাভাবিক।

চোখদুটো, এক সেকেণ্ড পর বুঝল ক্যাসেডিন।

একটু লাল হয়ে আছে। চোখের নীচে ঝুলছে ছোট থলি। এই লোক সর্বক্ষণ দুশ্চিন্তা করে, ভাবল ক্যাসেডিন। দিনের পর দিন ঘুমাতে পারে না।

আমার আসল নাম, ধীরে ধীরে বলল যুবক, রবিন কার্লটন।

কী কাজ করেন?

আগে ছিলাম মেরিন ফোর্সের মেজর। আটলান্টিক বেসড় রিকনিসেন্স ইউনিটে। কিন্তু অফিশিয়াল ইউএসএমসি রেকর্ডে দেখবেন, আমি মারা গেছি পেরুতে, এগারো সালে।

নিচু স্বরে কথা বলে যুবক, তিক্ত তার কণ্ঠ।

তা হলে আপনি একজন মৃত লোক, বলল ক্যাসেডিন। ভাল কথা। তা হলে আমার প্রথম প্রশ্ন: কেন আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে চাইলেন?

আমি আপনার লেখা পড়েছি, বলল রবিন। এবং পছন্দ করি। গ্র্যাণ্ড মাদার মিশেলে লিখতেন। তারপর পোস্টে। যা লেখার সরাসরি লেখেন আপনি। এটা আমার পছন্দ। অন্য অনেকের মত যা খুশি লেখেন না। আগে ভাল করে সব যাচাই করেন। আর আমার তাই দরকার। যা বলব, সেটা যেন মানুষ উড়িয়ে না দেয়।

যদি বিশ্বাসযোগ্য হয়, তো উড়িয়ে দেবে না, বলল ক্যাসৈডিন। ঠিক আছে, এবার খুলে বলুন কেন ইউনাইটেড স্টেট গভার্নমেন্ট আপনাকে মৃত ঘোষণা করেছে।

হাসল রবিন কার্লটন, তাতে শুধু তিক্ততা ও কষ্ট। যদি এসবের বিশ্বাসযোগ্যতা থাকে, বলল। মিস্টার ক্যাসেডিন, আমি যদি বলি, ইউনাইটেড স্টেটস অভ আমেরিকার সরকার নির্দেশ দিয়েছে, যাতে আমার গোটা ইউনিটকে মেরে ফেলা হয়?

চুপ করে আছে অ্যাডোনিস।

যদি বলি, আমাদের সরকার আপনার আমার সরকারআমার ইউনিটের ভিতর নিজেদের খুনি রেখেছিল? আমরা মিশনে অস্বাভাবিক কিছু খুঁজে পেলে যেন আমাদেরকে মেরে ফেলা হয়।

এগারো সালে পেরুর আন্দেজ পাহাড়ে তাই করা হয়েছে। মিস্টার ক্যাসেডিন, আপনার কি মনে হয় এই কাহিনি উপযুক্ত?

হ্যাঁ, নড়েচড়ে বসল অ্যাডোনিস।

এবার বলতে শুরু করল রবিন। ওরা ছিল পাহাড়ের অনেক উপরে এক ইনকা মন্দিরের ভিতর। তার আগে ওখানে মন্দিরের ভিতর কাজ করছিল ইউনিভার্সিটি রিসার্চারদের একটি টিম। এরা কয়েকটি দেয়ালে গভীর তাক খুঁজে পেল। সেখানে ছিল অতীত ইনকাদের সমাজের দৃশ্য।

কিন্তু একটি পাথুরে তাকে অন্য কিছু পেল তারা। আগে কখনও এ ধরনের ছবি পাওয়া যায়নি। বিখ্যাত ইনকা সম্রাট আতাহুয়ালপা সাক্ষাৎ করছেন স্প্যানিশ বিজয়ীদের সঙ্গে।

একপাশে দাঁড়িয়েছেন সম্রাট, পরনে রাজকীয় পোশাক, তাঁকে ঘিরে রেখেছে সভাসদ-বৃন্দ। সম্রাটের হাতে সোনার পাত্র, বাড়িয়ে ধরেছেন। ওটা দিয়ে বোঝানো হয়েছে উপহার-সামগ্রী।

ছবির বামদিকে অদ্ভুত চেহারার পাঁচজন লোক। এরা একেবারেই ইনকাদের মত নয়, হাড়ের মত সাদা। খুব চিকন ও লম্বা, যেন বছরের পর বছর খেতে দেয়া হয়নি। বড় গোল গোল চোখ, বাটির মত ফোলা কপাল! সরু ও দীর্ঘ থুতনি, কোনও মুখ নেই।

পাথরে খোদাই করা চিত্রে এই সাদা দলের নেতা দুই হাতে কী যেন বাড়িয়ে দিয়েছে সম্রাটের দিকে।

বোধহয় দুজন দুজনকে উপহার দেবে।

এসব পেতে কত দিন লাগে? শুকননা স্বরে জানতে চাইল অ্যাডোনিস।

বেশি দিন নয়, বলল কার্লটন।

বলতে শুরু করল সে: রিসার্চাররা যেটার জন্য গিয়েছিল, সেটা পেয়ে গেল মন্দিরের এক কলামের গায়ের তাকে। ওখানে ছিল ছোট একটা জিনিস। বড়জোর জুতোর বাক্সের সমান হবে, রুপালি।

প্রস্তর চিত্রের ঠিক সেই জিনিসই ওটা।

খুব খুশি হয়ে ওঠেন বিজ্ঞানীরা, বলল রবিন কার্লটন। দেরি করে স্টেটসে নিজেদের ইউনিভার্সিটিতে যোগাযোগ করলেন, জানিয়ে দিলেন জিনিসটা পেয়ে গেছেন। ওটা সম্ভবত কোনও এলিয়েন দলের কাছ থেকে পাওয়া উপহার।

আস্তে করে মাথা নাড়ল কার্লটন। গাধা ছিলেন ওঁরা! সাধারণ মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করেন। আজকাল যেকোনও সরকার যে-কারও ফোনে আড়ি পাততে পারে। অন্য কোনও দল তাঁদের কাছ থেকে জিনিসটা ডাকাতি করতে পারে, কাজেই আমার ইউনিটকে ব্রাজিল থেকে পাঠানো হলো।

সোফায় ঝুঁকে বসল সে। কিন্তু সমস্যা, ওই ইউনিট তখন আর আমার নয়।

এরপর মেরিন ইউনিট মন্দিরে পৌঁছবার পর কী হলো, বলতে শুরু করল সে। যখন একটা সিল টিম তাদের সঙ্গে মিলিত হলো, এরপর ওর নিজের লোকই মেরে ফেলতে চাইল ওকে।

মিস্টার ক্যাসেডিন, আমার ইউনিটের ভিতর নিজেদের লোক খুঁজে দিয়েছিল সরকার। এ-কাজ করার জন্য কমিটি করেছে তারা। নাম দিয়েছে ইন্টেলিজেন্স কনভার্জেন্স গ্রুপ। ওটা নিয়ন্ত্রণ করে জয়েন্ট চিফস অভ স্টাফের ন্যাশনাল রিকনিসেন্স অফিস। সোজা কথায়, ওটার প্রাথমিক কাজ আমেরিকার টেকনোলজিক্যাল শ্রেষ্ঠত্ব নিশ্চিত করা।

এরা আমার ইউনিটের সবাইকে মেরে ফেলল, মিস্টার ক্যাসেডিন। পুরো ইউনিট। খুঁজতে থাকল আমাকে মেরে ফেলার জন্য। বারোদিন আমাকে খুঁজল। তারা আমেরিকার সৈনিক। ছোট একটা ফাটলের ভিতর লুকিয়ে ছিলাম। পাথুরে দেয়াল থেকে নেমে আসা লবণাক্ত পানি দিয়ে পেট ভরিয়েছি। এরপর চলে গেল তারা।

আর ইউনিভার্সিটি রিসার্চারদের কী হলো? জানতে চাইল অ্যাডোনিস।

আস্তে করে মাথা নাড়ল রবিন। সিল টিম সবাইকে সরিয়ে নিয়ে গেল। আর কখনও তাদেরকে দেখা যায়নি।

চুপ হয়ে গেছে অ্যাডোনিস ক্যাসেডিন।

বারো দিন পর মন্দির থেকে বের হই, বলল রবিন। সময় লেগেছিল, কিন্তু ফিরে এলাম গোপনে নিজ দেশে। বাবা-মার বাড়িতে গেলাম। কিন্তু ভিতরে ঢুকতে পারলাম না। সামনে এবং পিছনের রাস্তায় দুটো ভ্যান ছিল। ওই বাড়ির উপর নজর রাখছিল চারজন লোক। ফিরে এলেই আমাকে শেষ করবে।

তিক্ত হাসল রবিন কার্লটন। তখন বুঝলাম, আমাকে জানতে হবে এসবের পিছনে কারা। এরপর একজনকে অনুসরণ করলাম। . জানলাম সে আসলে আইসিজি।

অবাক হয়ে সুদর্শন লোকটার দিকে চেয়ে আছে অ্যাডোনিস। কয়েক সেকেণ্ড পর বলল, ঠিক আছে, এই লোক আইসিজি। ওটা জয়েন্ট কমিটি, ঠিক? জয়েন্ট অভ স্টাফ ও দ্য ন্যাশনাল রিকনিসেন্স অফিসের লোক?

হ্যাঁ।

দ্য জয়েন্ট চিফস অভ স্টাফ সম্পর্কে জানে অ্যাডোনিস, সামান্য শুনেছে ন্যাশনাল রিকনিসেন্স অফিসের কথাও। ওটা আমেরিকার প্রতিটি স্পাই স্যাটালাইট নিয়ন্ত্রণ করে। ওই অফিসের গোপনীয়তা কিংবদন্তীর মত। সামান্য কয়েকটি এজেন্সি ব্ল্যাক বাজেটে চলে, এই অফিস সেগুলোরই একটা খুব প্রতিক্রিয়াশীল বিষয় নিয়ে কাজ করে। সিনেট ফিন্যান্স কমিটি এই আঁফিসের বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে পারে না। কোল্ড ওঅরের সময় ইউএস সরকার বারবার বলেছে, তাদের দেশে এনআরও নেই। অবশ্য, উনিশ শ একানব্বই সালে প্রচুর প্রমাণ ছড়িয়ে গেলে সুরকার বাধ্য হয়ে স্বীকার করে, আসলেই এই অফিস আছে।

আইসিজি আসলে দেশের সবচেয়ে বড় দু পক্ষের বিয়ের মত, বলল রবিন কার্লটন। একপক্ষে প্রতিটি আর্মড ফোর্সের সুপ্রিম কমাণ্ডিং বডি, অন্য দিকে আমাদের দেশের ইন্টেলিজেন্সের হর্তাকর্তারা।

আর আপনি বলছেন, ওটার কাজ দুনিয়ার আর সব দেশকে পিছনে ফেলে আমেরিকার টেকনোলজিক্যাল সুপিয়াৱিটি অর্জন করা।

হ্যাঁ, বলল কার্লটন। প্রথম কাজ: বড় টেকনোলজিক্যাল ব্রেকথ্রু দখল করে নেয়া। তা কমপ্যাক্ট ডিস্ক হোক, কমপিউটার চিপস বা স্টেলথ টেকনোলজি যেভাবে হোক এসব পেতে হবে ইউনাইটেড স্টেটস অভ আমেরিকাকে।

বড় করে শ্বাস ফেলল রবিন কার্লটন। মিস্টার ক্যাসেডিন, আমি বোধহয় আপনাকে ভাল করে বুঝিয়ে বলতে পারিনি। অন্য ভাবে চেষ্টা করে দেখা যাক। আইসিজির কাজ ইন্টেলিজেন্স জোগাড় করা, বা সরকারের কথা অনুযায়ী ইন্টেলিজেন্স কনভার্জেন্স করা।

এই অফিসের কাজ মূল্যবান তথ্য জোগাড় করা। নিশ্চিত করা যে, ওটার ব্যাপারে অন্য কোনও দেশ জানবে না। এ কাজ করতে গিয়ে বিনা দ্বিধায় মানুষ খুন করে আইসিজি। এদের কাজ অন্যদের মুখ বুজে দেয়া। জিনিসটা যেন শুধু আমেরিকার থাকে। আইসিজির প্রধান কাজ: আমেরিকা যেন দুনিয়ার নেতৃত্বে থাকে।

আচ্ছা, মৃদু মাথা দোলাল অ্যাডোনিস। আর আপনি বলছেন, এসব করতে গিয়ে এলিট মিলিটারি ইউনিটের ভিতর নিজেদের লোক ঢুকিয়ে দিচ্ছে তারা।

প্রয়োজনে মিলিটারি ইউনিটের যোদ্ধাদেরকে মেরে ফেলা আইসিজির মাত্র একটা কাজ, মিস্টার ক্যাসেডিন। এটা তাদের সহজ কাজ। এবার এভাবে দেখুন, বলল রবিন কার্লটন, দ্য জয়েন্ট চিফস অভ স্টাফ আইসিজির ছোট একটি অংশ। তারা নিজেদের বিশ্বস্ত লোক দিয়ে সংগঠনকে সাহায্য করছে। বয়স্ক যোদ্ধা, সিনিয়র সার্জেন্ট, গানারি সার্জেন্ট, ক্যারিয়ার, সোলজারএরা বসে আছে ভাল সব ইউনিটের ভিতর। প্রথমেই ঘটনাস্থলে হাজির হতে হয় র্যাপিড-রেসপন্স ইউনিটগুলোকে। যেমন মেরিন রিকনিসেন্স, সিল টিম বা আর্মি রেঞ্জার।

তাদের ভিতর ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে আইসিজির লোক। ধরুন, হঠাৎ এক শুক্র গুপ্তচর স্যাটালাইট বা কোনও গ্রহাণু পড়েছে কোথাও…

এবার ভেবে দেখুন, গ্রহাণু বা স্যাটালাইট পড়েছে ব্রাজিলের জঙ্গলে, তারা চারপাশ ঘিরে ফেলতে পাঠাবে মেরিনদেরকে। যদি ওই গ্রহাণুর ভিতর মূল্যবান কিছু পাওয়া যায়, প্রথমেই খুন করা হবে মেরিনদেরকে।

খুন করা হবে?

হ্যাঁ, তিক্ত স্বরে বলল কার্লটন। আপনি তো হাই-স্কুল পাশ করা সাধারণ সৈনিকদেরকে বিশ্বাস করবেন না। এরা যদি মুখ খোলে? জিনিসটা যদি হয় দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, এই লোকগুলোকে তো মেরে ফেলতেই হবে। হয়তো ওই জিনিসের মাধ্যমে কমপক্ষে বিশ বছর এগিয়ে যাবে ইউনাইটেড স্টেটস।

আসলে সাধারণ কোনও সৈনিকের পেট থেকে কথা বের করতে আপনার সোডিয়াম নাইট্রেট লাগবে না। কয়েকটা বিয়ার গিলিয়ে দেবেন, সঙ্গে মিষ্টি একটা মেয়ে, আশা দেবেন ভাল চাকরি মিলে যেতে পারে; ব্যস, মস্ত স্তনওয়ালী মেয়েটাকে সবই বলে দেবে সাধারণ মেরিন সৈনিক–ব্রাজিলের জঙ্গলে সে পেয়েছিল নীল গ্রহাণু।

এই তথ্যগুলোর মূল্য ভুলবেন না, মিস্টার ক্যাসেডিন, বলল রবিন কার্লটন। কয়েকজন সাধারণ সৈনিক বা অফিসার মরলে কী হবে দেশের? হয়তো এই দেশ অন্য দেশকে বিশ বছরের জন্য পিছনে ফেলবে। বা…।

হাত তুলে বাধা দিল অ্যাডোনিস ক্যাসেডিন। ঠিক আছে, এবার বলুন এমনটা কতদিন পর পর ঘটে? যেমন পুরো এক ইউনিটের সবাইকে মেরে ফেলা হলো–এমন তো খুব কম হওয়ার কথা।

আস্তে করে মাথা দোলাল কার্লটন। এটা ঠিকই বলেছেন। গত পনেরো বছরে মাত্র চারবার হয়েছে।

সন্দেহ নিয়ে রবিন কার্লটনের দিকে চাইল সাংবাদিক। মিস্টার কার্লটন, বুঝতে পারছি কী বলতে চান। কিন্তু এসব কাজ করতে হলে একদল ট্রেই লোকের নেটওঅর্ক থাকতে হবে। তাদের হাতে থাকতে হবে সঠিক অনুগত লোক। হাই র্যাঙ্কিং সৈনিকরা দ্য জয়েন্ট চিফস্ নয়, তারা সরকারের ভিতর চাইলেই…

মিস্টার ক্যাসেডিন, আপনি অ্যাণ্ড লিলিওয়েলেনের নাম শুনেছেন?

আবছা মনে পড়ছে…

সার্জেন্ট মেজর অ্যাণ্ড লিলিওয়েলেন মেরিন কর্পসের সার্জেন্ট মেজর। আপনি কি জানেন মেরিন কর্পসের সার্জেন্ট মেজর মানে কী, মিস্টার ক্যাসেডিন?

না, খুলে বলুন।

মেরিন কর্পসের নন-কমিশণ্ড অফিসার সার্জেন্ট মেজর মানেই মস্ত এক লোক। যদিও এনলিস্টেড, মিস্টার ক্যাসেডিন, সে নীচের সবার প্রধান। সার্জেন্ট মেজর অ্যাণ্ড লিলিওয়েলেন তেত্রিশ বছর মেরিন কর্পসের সঙ্গে কাটিয়েছে। দেশের সবচেয়ে বেশি পদক পাওয়া লোক সে।

আস্তে করে মাথা দোলাল কার্লটন। সে আইসিজি।

দীর্ঘ মুহূর্ত চুপ করে চেয়ে রইল অ্যাডোনিস। তারপর প্যাডে নামটা টুকে নিল।

কর্পসের প্রতিটি বদমাস সৈনিকের অভিভাবক সে। পেরু থেকে ফিরবার পর কার কাছে যেন শুনেছিলাম, ওই ঘটনার পর জীবিত মেরিনদেরকে সরিয়ে নেয় সে, তারা বিশ্বাসঘাতক। তাদের কাজের জন্য মেডেল দেয়ার জন্য আবেদনও করেছে। বেশিরভাগ সিনিয়র এনলিস্টেড সৈনিক বিশ্বাসঘাতক।

বিড়বিড় করে কী যেন বলল অ্যাডোনিস ক্যাসেডিন।

ওটাই হচ্ছে নেটওঅর্ক, মিস্টার ক্যাসেডিন। মেরিন ফোর্সের নীচ থেকে শুরু করে একেবারে মাথা পর্যন্ত আছে এরা। তারাই ঠিক করে কোন্ ইউনিটকে পাঠানো হবে। তারপর আর ফিরে আসতে পারে না সৈনিকরা। কোনও এলিট মিলিটারি ইউনিট শেষ করে দেয়া আইসিজির সামান্য কাজ। আইসিজি শুধু মিলিটারির ভিতর লোক রেখেছে তা নয়, তার চেয়ে অনেক বেশি ছড়িয়ে পড়েছে সরকারের নানা জায়গায়।

যেমন?

যেমন যেসব সংগঠন ব্রেকথ্র টেকনোলজি আবিষ্কার করছে, সেখানে।

একটা উদাহরণ দিন।

যেমন ব্যবসা।

বলতে চাইছেন প্রাইভেট কোম্পানির কথা?

আস্তে করে মাথা দোলাল রবিন কার্লটন।

আপনি বলতে চাইছেন ইউনাইটেড স্টেটসের সরকার নিজেদের লোক ঢুকিয়ে দিয়েছে প্রাইভেট কর্পোরেশনে? চোখ রাখছে তাদের উপর?

যেমন মাইক্রোসফট। আইবিএম। বোয়িং। লকহিড। রবিন কার্লটন গম্ভীর। শুধু তাই নয়, এ ছাড়া নেভি, আর্মি ও এয়ার ফোর্সের কন্ট্রাক্টারদের উপর নজর রাখা হয়। বিশেষ করে যারা এ দেশের সরকারের কাজ করে।

কী করে সম্ভব? মাথা নাড়ল অ্যাডোনিস ক্যাসেডিন।

এ ছাড়া আরও অনেক জায়গায় এরা আছে।

যেমন?

যেমন ধরুন ইউনিভার্সিটি, বলল কার্লটন। আইসিজির লিস্টে সবচেয়ে আগে ইউনিভার্সিটিগুলোর নাম। বহু শিক্ষক বিক্রি হয়ে গেছেন। যেমন ধরুন, আইসিজি জানত উনিশ শ তিরানব্বই সালেই ভেড়া ক্লোন করা হয়েছে। গত বছর আইসিজি জেনেছে, ইচ্ছে করলে মানুষ ক্লোন করতে পারবে। ক্লান্ত ভঙ্গিতে কাঁধ ঝাঁকাল কার্লটন। এমনই হওয়ার কথা ছিল। যদি জানতে হয় পাইপলাইনের ভিতর কী, আপনার নিজের লোক রাখতে হবে পাইপের ভিতর।

মৃত মেজর থেমে যাওয়ার পর পুরো একমিনিট চুপ করে বসে রইল অ্যাডোনিস ক্যাসেডিন।

আমেরিকান বিস্তৃত ইন্টেলিজেন্স গ্যাদারিং ষড়যন্ত্রের চিন্তাটা কাঁপিয়ে দিয়েছে ওকে। এই নেটওঅর্ক থেকে থাকলে ওটা একটা অক্টোপাস, চারপাশে ছড়িয়ে দিয়েছে গঁড়। পেন্টাগনের ছোট কমিটির বোর্ডরুম থেকে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসা ও ইউনিভার্সিটি। কিন্তু এসব নিয়ে কিছু লিখবার আগে আরও অনেক তথ্য দৱকার ক্যাসেডিনের।

মিস্টার ক্যাসেডিন, গম্ভীর স্বরে বলল রনি কার্লটন। ভয়ঙ্কর একটা সংগঠন আইসিজি। খুবই বিপজ্জনক। মাত্র একটা বিষয়ে তারা মন দিয়েছে: উন্নতি করতে হবে দ্য ইউনাইটেড স্টেটস অভ আমেরিকার। আমেরিকা যেন সবসময় জিতে যেতে পারে, সেজন্য যা করবার করবে তারা। যদি একদল লোক মেরে ফেলতে হয়, তো তাই করবে। আপনাকে খুন করবে, আমাকেও। মিস্টার ক্যাসেডিন, দেশপ্রেম আসলে হিংস্র লোকের গর্ব। ওই সংগঠন নিজেদের আর্মড ফোর্সের ভিতর ঢুকে পড়েছে, নিজেদের লোক মেরে ফেলছে। এসব করছে নিজেদের দেশের গোপন তথ্য লুকিয়ে রাখতে। আমরা কেউ ওই সংগঠন থেকে নিরাপদ নই।

আস্তে করে মাথা দোলাল অ্যাডোনিস। কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, মিস্টার কার্লটন, আপনার কাছে কোনও তথ্য আছে? ধরুন কোনও নাম, বা এমন কিছু যেটা থেকে প্রমাণ করা যাবে…

পাশের টেবিল থেকে এ-ফোর সাইজের একটা কাগজ নিল রবিন। বাড়িয়ে দিল সাংবাদিকের দিকে। এখানে আমার সংগ্রহ করা কিছু নাম, তাদের চাকরি অবস্থান ও র্যাঙ্ক টুকে দিয়েছি।

কাগজটা নিল ক্যাসেডিন। দ্রুত পড়তে শুরু করল:

ট্রান্সমিট নং. ৫৯৭-৯৭১৭-০৮১০১
রেফারেন্স নং. ৪৫৩১
বিষয়: সেনাবাহিনী কর্তৃপক্ষের কাছের কয়েকজন ব্যক্তির নাম।

নাম:                        চাকরিস্থল:               ফিল্ড/র‍্যাঙ্ক:

উইলিয়াম বীব।            লিঙ্কন ল্যাব।              নিউক্লিয়ার ফিফিলিস্ট।
জর্জ লোবো লার্সেন।       বার্কলি।                   অ্যারোনটিকাল ইঞ্জিনিয়ার।
মাইক গোউন্ড।             নেভি সিল।               লেফটেন্যান্ট কমাণ্ডার।
ন্যাট লেদারউড            আর্মি রেঞ্জার্স।            কর্নেল।
মার্লা হেয়ে।                 কলাম্বিয়া।                কমপিউটার সায়েন্টিস্ট।
সামান্থা রিভ।               হার্ভার্ড।                   ইণ্ডাস্ট্রিয়াল কেমিস্ট।
রাস্টি ফেরিস।              মাইক্রোসফট।            সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার।
উইলিয়াম ফেল্পস।         আইবিএম।                হার্ডওয়ার ইঞ্জিনিয়ার।
লেস্টার গ্রিম।               ক্রে।                       হার্ডওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার।
ভ্যালেনি ফার্গো।            ইউ এসএমসি।           কর্পোরাল।
ক্রিস হার্ট।                  বোয়িং।                    টেকনিশিয়ান
প্রস্টন স্টোন।               ইউএসসি।               জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ার।
রিপলি জেনড্রন।            জেপিএল।                অ্যারোনটিকাল ইঞ্জিনিয়ার।
অ্যামি কার্ভেল।              লকহিড।                 অ্যারোনটিকাল ইঞ্জিনিয়ার।
জ্যাক বোল্ট।                আর্মি রেঞ্জার্স।            সিনিয়র সর্জেন্ট।
সুয়েড নিলসেন।             ইয়েল।                   নিউক্লিয়ার ফিস্টি।
নৰ্মা হবসন।                 অ্যারিয।                 বয়েটরিন।
মাইক গ্যানন।               ইউএসএমসি।          গানরি সার্জেন্ট।
নিনা অস্টিন।                হার্ভার্ড।                  ক্যাপ্টেন।
জাড হর্সফল।                জন্স হপকিন্স।    
কলিন সিম্পসন র‍্যানডলফ। ইউএনএসসি।          সার্জেন্ট মেজর।
জিম বেলিংগার।              আর্মালাইট।             ব্যালেস্টিক্স।
এনিস কনরাড।                   ইউ.টেক্স।               ইনসেক্টস
জনি ওয়াকার।                ইউএসএমসি।          সার্জেন্ট।
অ্যাণ্ড্রু লিলিওয়েলেন।         আইসিজি               সার্জেন্ট মেজর।
লি মন্ট্যানা।                          ইউ কলোরাডো।        কেমিকেল এজেন্ট।
ম্যাক্স ডাব্লিউ কেইন।          টেক্সাস ল্যাব।           কেমিস্ট।
ফ্রেডারিক সিম্পসন।              প্রিন্সটন।                 ?
জেনি ফেয়ারওয়েল।           থার্ড মেরিন কর্পস       ?
পল সিংগার।                         ইউএসএমসি।          গানারি সার্জেন্ট।
গুয়েন রাসেল।                  ইউএসসি।                   ?
পার্কস আর, শর্ট।              নেভি সিল।              কমোডর।
পল মর্গান।                            ইউএসএমসি।          সার্জেন্ট।
চাক হ্যালুম।                    সিসিএ সিএলএও।     সায়েন্টিস্ট।
পলি রিগস।                     উকলা।                        জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ার।
অলিভার টার্নার।                ইউএসএমসি।           মেজর।
জন সিমন।                      ইউএসএএফ।          ক্যাপ্টেন।
—————————————————————————-

রবিন কার্লটনের দিকে মুখ তুলে চাইল অ্যাডোনিস। কোথেকে পেলেন?

মৃদু হাসল মেজর। প্রথমবারের মত আন্তরিক হাসি।

আপনার মনে পড়ে, আমার বাবা-মার বাড়ির উপর নজর রেখেছিল একদল লোক?

হ্যাঁ।

তাদের একজনের পিছু নিই। অ্যাপার্টমেন্টে ঢুকবে, এমন সময় তাকে থামাই। কয়েকটা প্রশ্ন করি। খুব আন্তরিকতার সঙ্গেই জবাব দিয়েছিল।

তারপর তার কী হয়েছে? ক্লান্ত স্বরে জানতে চাইল ক্যাসেডিন।

কোনও আবেগ থাকল না রবিন কার্লটনের হিমশীতল কণ্ঠে: লোকটা মারা যায়।

০৩.

গর্জে উঠেছে হোভারক্রাফটের ইঞ্জিন। ড্রাইভিং সিটে বসে মেঝের সঙ্গে অ্যাক্সেলারেটার টিপে ধরেছে নাজমুল। টেকোমিটারের কাঁটা ছুঁই-ছুঁই করছে ৬,০০০ আরপিএম।

এক সেকেণ্ড পর নাজমুলের পাশে, জমাট তুষারে থামতে শুরু করল দ্বিতীয় মেরিন হোভারক্রাফট, এখনও পিছলে চলেছে।

নাজমুলের রেডিয়োতে শোনা গেল হোসেন আরাফাত দবিরের কণ্ঠ: আর পনেরো মিনিট, বাছা। চলো মেইন বিল্ডিঙের কাছে, সবাইকে তুলে নিতে হবে।

.

বি-ডেকের ভিতর দিকের টানেলে হেঁটে চলেছে রানা, চট করে দেখে নিল হাতঘড়ি। আর মাত্র পনেরো মিনিট!

তিশা, শুনছ? হেলমেট মাইকে বলল রানা। মাইক্রোফোনের উপর হাত রেখে গলা ছাড়ল: এবার সবাই চলুন।

উইলকক্স আইস স্টেশনের বাসিন্দা বলতে তিন বিজ্ঞানী হ্যাভেনপোর্ট, টমসন ও হ্যারি। যে যার ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে তারা।

রানাকে এক ছুটে পাশ কাটাল হ্যাভেনপোর্ট ও হ্যারি, পরনে কালো, পুরু উইণ্ডব্রেকার। চলেছে সেন্ট্রাল শাফটের দিকে।

রানা হঠাৎ করেই শুনল তিশার কণ্ঠ: স্যর, তিশা। আপনি বিশ্বাস করবেন না নীচে কী ঘটেছে।

তুমিও বিশ্বাস করবে না উপরে কী ঘটছে, বলল রানা। আপাতত শুনবার সময় নেই, তিশা। সামনে বিরাট ঝামেলা। এই স্টেশনে আসছে এক প্লাটুন এসএএস কমাণ্ডে। চোদ্দ মিনিট পর পৌঁছবে।

হায় আল্লা! আপনি কী করবেন, স্যর?

এখান থেকে বেরিয়ে যাব। এ ছাড়া কোনও উপায়ও নেই। যেভাবে হোক যেতে হবে ম্যাকমার্ডোতে, ওখান থেকে সৈনিক নিয়ে ফিরব।

নীচে আমরা কী করব, স্যর?

ওখানেই থাকবে। পুলের ধারে। কেউ উঠে এলে গুলি করে ফেলে দেবে। চারপাশ দেখে নিল রানা। কোথাও নেই মেরি। পরে তোমার সঙ্গে কথা হবে, তিশা, বিমর্ষ শোনাল রানার কণ্ঠ।

সাবধান থাকবেন, স্যর।

তোমরাও সতর্ক থেকো। আউট। চরকির মত ঘুরে দাঁড়াল রানা। মেয়েটা গেল কোথায়!

কেউ জবাব দিল না। এইমাত্র যার যার ঘর থেকে ফিরেছে রাফায়লা ও টমসন, ব্যস্ত হয়ে পারকা পরছে। পকেটে গুজছে দরকারী কাগজ।

রাফায়লা, মেরি ভিসার কোথায়? জানতে চাইল রানা।

মনে হয় ঘরে ফিরেছে।

ওর ঘর কোনটা?

সুড়ঙ্গের আরেক দিকে, সামনের বামদিকের দরজা, বলল রাফায়লা।

তীরের মত ছুটতে শুরু করেছে রানা।

আর মাত্র বারো মিনিট!

বামদিকের দরজা পেয়েই ঝট করে খুলল ও।

শোবার ঘর। কেউ নেই।

দ্বিতীয় দরজা। ওটা তালা বদ্ধ। দরজার উপর তিনটে রিঙের মাঝে বায়োহাযার্ড সাইন। বায়োটক্সিন ল্যাব। এর ভিতর মেরি থাকবে না।

তৃতীয় দরজা। দড়াম করে কবাট খুলল রানা। ওখানেই থমকে গেল।

আগে এ ঘরে আসেনি। জায়গাটা ওয়ার্ক-ইন ফ্রিযার, খাবার রাখা হয় এসব ফ্রিযে। কিন্তু এখন ওই কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে না। ফ্রিযার রুমের ভিতর অন্য কিছু।

মেঝেতে। তিনটে দেহ।

কেভিন হাক্সলে, জর্জ মারফি এবং হলিডে স্যাম্পসন। চিত হয়ে পড়ে আছে। মুখ রক্তাক্ত।

লড়াই শেষে দলের সবাইকে বলেছে রানা, কোনও ফ্রিযারে ওদের সহযোদ্ধাদের লাশ রাখতে হবে। পরে সুযোগ পেলে কবর দিতে হবে। এটাই সেই ফ্রিযার রুম।

কিন্তু ফ্রিযার রুমে চতুর্থ এক মৃতদেহ। হলিডের পাশে। বস্তা দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে তার মুখ।

ভুরু কুঁচকে গেল রানার।

চতুর্থ মৃতদেহ?

ফ্রেঞ্চ কমাণ্ডো হতে পারে না। যেখানে মরেছে, এখনও সেখানেই পড়ে আছে তারা। তা হলে এ…

হঠাৎ মনে পড়ল রানার।

চার্লস মুন।

ডক্টর চার্লস মুন।

ওরা এই স্টেশনের এসে শুনেছে, কয়েক দিন আগে এই লোককে খুন করেছে বাঙালি বিজ্ঞানী রাশেদ হাবিব। অন্য বিজ্ঞানীরা এর লাশ রেখে গেছে এই ঘরে।

ঘড়ি দেখল রানা।

আর মাত্র এগারো মিনিট।

ওর মনে পড়ল, রাশেদ হাবিবের ঘরে জ্ঞান ফিরবার পর, লোকটা ওকে অদ্ভুত এক অনুরোধ করেছিল। বলেছিল, যদি সুযোগ হয়, মুনের লাশ দেখবেন। বিশেষ করে জিভ ও চোখ।

কেন দেখতে হবে মৃতের জিভ ও চোখ, তখন ভাবেনি রানা। কিন্তু জোর দিয়ে বলেছিল হাবিব, এ থেকে প্রমাণ হবে সে খুন করেনি।

আর মাত্র সাড়ে দশ মিনিট।

হাতে সময় নেই।

স্টেশন থেকে বেরিয়ে যেতে হবে।

কিন্তু রাশেদ হাবিব ওর প্রাণ বাঁচিয়েছে

দেরি না করে ফ্রিযার রুমে ঢুকে পড়ল রানা, এক হাঁটু গেড়ে বসল বস্তার পাশে। সরিয়ে দিল বস্তা।

ঠাণ্ডা অপলক চোখে রানার দিকে চেয়ে আছে চার্লস মুন। কচ্ছপের চোখের মত অস্বচ্ছ চাহনি, প্রাণ নেই তাতে। বিশ্রী চেহারার লোক ছিল সে। মোটা, মাথা ভরা টাক ফুলে ওঠা থলথলে মুখ। ত্বক হাড়ের মত সাদা।

সময় নষ্ট করল না রানা, চট করে পরীক্ষা করল চোখ।

টকটকে লাল, যেন চোখ থেকে ছিটকে বেরুচ্ছে রক্তিম আগুন। কোনও ড্রাগনের চোখ এমন হতে পারে।

লাশের মুখে মনোযোগ দিল রানা। চোয়াল খুলবার চেষ্টা করল, খুব শক্ত করে বন্ধ মুখ।

আরেকটু ঝুঁকে গেল রানা, দুহাতে খুলতে চাইল চোয়াল। চাপ দিতে খুব ধীরে খুলল মুখ।

এহহে, মুখ কুঁচকে ফেলল রানা। বমি পেয়ে গেছে।

চার্লস মুন দাঁত দিয়ে কেটে দুই টুকরো করে ফেলেছে জিভ।

মরবার আগে যে কারণেই হোক, ভয়ঙ্কর কামড় দিয়েছে জিভের উপর। চোয়াল খুলবার আগে দাঁতে দাঁত খিচে ছিল।

আর মাত্র দশ মিনিট!

যথেষ্ট হয়েছে, আর সময় নেই।

লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল রানা, বেরুবে দরজা দিয়ে, কিন্তু তার আগে মৃত মেরিন জর্জ মারফির হেলমেট তুলে নিল মেঝে থেকে, বেরিয়ে এল টানেলে।

ওদিক থেকে ছুটে আসছে মেরি ভিসার।

পারকা আনতে দেরি হলো, দুঃখপ্রকাশ করল। অন্যটা ভিজে গেছে তো…

জলদি চলো, মেয়েটির হাত ধরল রানা, হালকা পায়ে ছুটতে শুরু করেছে।

সুড়ঙ্গে বাঁক নিতেই দূরে দেখা গেল সেন্ট্রাল শাফট। পিছন থেকে কে যেন চেঁচিয়ে উঠল: ওরে ভাই, আমাকে ফেলে যাবেন না!

ঘুরে চাইল রানা। রাশেদ হাবিব। খাটো–পাদুটো উড়িয়ে আনছে তাকে। পরনে নীল, ভারী পারকা। বগলের নীচে মোটা বই।

ওটা দিয়ে কী করবেন? জলদি!

এই বই না থাকলে মরব রে, ভাই, বামহাতে বগলের বই দেখাল সে। পাঁচ সেকেণ্ড পেরুবার আগেই রানাকে পাশ কাটাল সে, মেরির কথা ভুলে উড়ে চলেছে।

দেরি না করে তার পিছু নিল রানা ও মেরি।

বই দিয়ে কী করবেন? জানতে চাইল রানা।

এটাই আমার প্রমাণ, আমি আসলে নিরপরাধ!

উইলকক্স আইস স্টেশনের বাইরে দিগন্ত থেকে আরেক দিগন্তে কাত হয়ে শোঁ-শোঁ আওয়াজে ছুটছে ধবল তুষার।

মেইন বিল্ডিং থেকে বেরিয়ে সমতলে ঝড়ের ভিতর উঠে এল রানা। সঙ্গে পিচ্চি মেরি ভিসার ও বিজ্ঞানী রাশেদ হাবিব।

আর মাত্র আট মিনিট, তারপর হাজির হবে এসএএস ফোর্স।

মেইন বিল্ডিঙের সামনে মেরিনদের দুই হোভারক্রাফট। বিশাল দুই যানের পাশে কর্পোরাল নাজমুল ও সার্জেন্ট হোসেন আরাফাত দবির, প্রায় ধাক্কা দিয়ে সবাইকে তুলছে নাজমুলের হোভারক্রাফটে।

সহজ প্ল্যান করেছে রানা।

নাজমুলের হোভারক্রাফট হবে যাত্রীবাহী। ওটাতে উঠবে ছয়জন। অর্থাৎ, উইলকক্স আইস স্টেশনের প্রত্যেকে। রাফায়লা ম্যাকানটায়ার, হ্যাভেনপোর্ট, টমসন, হ্যারি, মেরি ভিসার এবং ড্রাইভার নাজমুল।

সার্জেন্ট দবির ও রানার সঙ্গে থাকবে শটগান, ওরা পাহারা দেবে যাত্রীবাহী হোভারক্রাফটকে। সোজা পুবে ছুটবে, দৌড়ে হারাতে চাইবে এসএএসের হোভারক্রাফটকে।

দ্বিতীয় মেরিন হোভারক্রাফট ড্রাইভ করবে দবির, এদিকে ফ্রেঞ্চ কমলা হোভারক্রাফট চালাবে রানা। ঠিক করেছে, ওর সঙ্গে নেবে বাঙালি বিজ্ঞানী রাশেদ হাবিবকে।

নাজমুলকে হোভারক্রাফটের স্লাইডিং দরজা বন্ধ করতে দেখল রানা। লাফ দিয়ে নিজের হোভারক্রাফটের স্কার্টে উঠল দবির, হারিয়ে গেল কেবিনের ভিতর। তিন সেকেণ্ড পর আবারও বেরুল কালো এক মস্ত স্যামসোনাইট ট্রাঙ্ক নিয়ে, তুষারের ভিতর দিয়ে টেনে আনছে রানার দিকে। ধপ করে পাশে ফেলল। . এই যে আপনার পোকা মারার ওষুধ, স্যর! বলেই ছুট দিয়েছে নিজ হোভারক্রাফটের উদ্দেশে।

এই যে, হাবিব! তাড়া দিল রানা, জলদি!

লোকটার হাতে ফ্রিযার রুম থেকে আনা হেলমেট ধরিয়ে দিল ও। নিজে ধরল স্যামসোনাইট ট্রাঙ্কের টানা হাতল, টেনে নিয়ে চলেছে ওটা হোভারক্রাফট লক্ষ্য করে।

তুষারের ভিতর মেইন এন্ট্রান্সের সামনে নিথর ফ্রেঞ্চ যান।

আর মাত্র সাত মিনিট, এরপর পৌঁছুবে এসএএস ফোর্স।

ট্রাঙ্ক রেখে লাফ দিয়ে কমলা হোভারক্রাফটের স্কার্টে উঠল রানা, টান দিয়ে খুলে ফেলল স্লাইডিং ডোের। তুলে ধরুন আমার দিকে!

প্রাণপণ চেষ্টায় স্যামসোনাইট উঁচু করেছে বিজ্ঞানী, তার হাত থেকে ভারী জিনিসটা নিল রানা, ছুঁড়ে ফেলল ভিতরে। দেরি না করে কেবিন পেরিয়ে ধপ করে বসল ড্রাইভিং সিটে। গাড়িতে উঠে স্লাইডিং ডোর বন্ধ করে দিয়েছে হাবিব।

রানা ইগনিশনে চাবির কান মুচড়ে দিতেই গর্জন ছাড়ল ইঞ্জিন। হোভারক্রাফটের পিছনে ঘুরতে শুরু করেছে সাত ফুটি বিশাল ফ্যান। গতি আরও বাড়ছে, কয়েক সেকেণ্ড পর হয়ে উঠল পুরনো কোনও বাইপ্লেনের প্রপেলারের মত। তিন সেকেণ্ড পর ওভারড্রাইভ করল, দেখা গেল না পাখা, রইল শুধু আবছা ঘুরন্ত কী যেন।

হোভারক্রাফটের কালো রাবারের স্কার্টের নীচে চালু হয়েছে চারটে টার্বোফ্যান। ধীরে তুষার থেকে উঠে এল মস্ত ওই হোভারক্রাফট, বেলুনের মত ফুলে উঠল স্কার্ট।

কমলা যন্ত্রদানব ঘুরিয়ে নিল রানা, চলে গেল মেরিনদের সাদা দুই হোভারক্রাফটের পাশে। ড্রাইভাররা একইদিকে তাক করেছে। সব কটার মুখ, সাগরকে পাশে রেখে ছুটবে ম্যাকমার্ডো স্টেশন লক্ষ্য করে।

রিইনফোর্সড উইণ্ডস্ক্রিনের ভিতর দিয়ে দক্ষিণ-পশ্চিম দিগন্তে চাইল রানা। ওদিকে জ্বলজ্বলে ভুতুড়ে কমলা আলো। তার ভিতর কালো সব ছায়া। কালো সব বাক্স, নীচের দিকে গোলাকৃতি কী যেন। নীচ থেকে উড়ছে ধুলোর মত কিছু।

ব্রিটিশ হোভারক্রাফট। উইলকক্স আইস স্টেশনের কাছে পৌঁছে গেছে।

এবার রওনা দাও, হেলমেট মাইকে বলল রানা।

একইসঙ্গে ছুটতে শুরু করল তিন হোভারক্রাফট। খুব দ্রুত গতিবেগ উঠল আশি মাইলে।

পিছনে পড়ছে বরফ-জমিন। তীব্র গতি তুলে চলেছে রানাদের হোভারক্রাফট। নাজমুলের দুপাশে রানা ও দবির। লক্ষ্য পুবের ম্যাকমার্ডো স্টেশন। পাশেই আকাশ-ছোঁয়া ক্লিফ, ওপাশে অনেক নীচে উথাল-পাতাল উপসাগর। দুপাশে বরফ ছাওয়া প্রান্তর। কিন্তু মাঝের এই এক মাইল, সাগর পেরুনো অসম্ভব। ওদিকের জমিতে যেতে হলে পেরুতে হবে কমপক্ষে আট মাইল। ক্লিফের গোড়ায় আছড়ে পড়ছে দক্ষিণ সাগরীয় দানবীয় ঢেউ।

প্রচণ্ড গতি তুলে ছুটছে তিন হোভারক্রাফট, চট করে পিছন দিক দেখে নিল রানা। পশ্চিম-দক্ষিণ থেকে উইলকক্স আইস স্টেশনের কাছে পৌঁছে গেছে ব্রিটিশ হোভারক্রাফট বহর।

এরা অস্ট্রেলিয়ানদের কোনও স্টেশনে নেমেছে, হেলমেট ইন্টারকমে বলল রানা। ধারণা করছে, কেইসি স্টেশন থেকেই এসেছে। ওটা সবচেয়ে কাছে, উইলকক্স স্টেশন থেকে সাত শ মাইল দূরে।

চুতিয়া অস্ট্রেলিয়ান, মুখ ফস্কে বলে ফেলল দবির। পরক্ষণে তার খুকখুক কাশির আওয়াজ পাওয়া গেল।

.

মাত্র পাঁচ মাইল দূরে নীরব এক আমেরিকান বেল টেক্সট্রন সিরিয়াল নং. ৭-এস হোভারক্রাফটের রিইনফোর্সড উইণ্ডশিল্ডের ওপাশ থেকে চেয়ে আছে এসএএস কমাণ্ডার, মেজর জেনারেল জুলিয়াস বি. গুণ্ডারসন।

দীর্ঘদেহী লোক সে, যেন লোহা পেটা শরীর, পুরো মাথা কামানো, থুতনিতে ছোরার মত দাড়ি। বয়স মাত্র ছাপান্ন। ঠাণ্ডা চোখে চেয়ে আছে সে দূরে, তা হলে ভাগছে, মাসুদ রানা, আনমনে বলল। বাহ্, নিজেকে চালাক ভাবছে?

পুবে চলেছে, স্যর, গুণ্ডারসনের পাশের রেডিয়ো কপোল থেকে বলল তরুণ এসএএস কর্পোরাল। উপকূল ঘেঁষে।

ওদের পিছনে আটটা ক্রাফট পাঠাও, নির্দেশ দিল গুণ্ডারসন। ওদের একজনও যেন বাঁচতে না পারে। অন্যরা প্ল্যান অনুযায়ী স্টেশনে ঢুকবে।

জী, স্যর।

০৪.

রানার হোভারক্রাফটের স্পিডোমিটার জানান দিচ্ছে: গতিবেগ নব্বই মাইল। উইণ্ডশিল্ডের উপর আছড়ে পড়ছে ক্ষ্যাপা তুষার।

হেলমেট ইন্টারকমে নাজমুলের কণ্ঠ শুনল রানা: স্যর, ওরা আসছে!

ডানদিকে মুখ ঘোরাল রানা, আরও গম্ভীর হয়ে গেল। তীব্র গতি তুলে ওদের দিকে আসছে শযান।

ব্রিটিশ বহর থেকে সরে এসেছে কয়েকটা হোভারক্রাফট, ধাওয়া শুরু করেছে ওদের পিছনে।

অন্যরা স্টেশনে যাচ্ছে, জানাল দবির।

ড্রাইভিং সিটে ঘুরে চাইল রানা, কেবিনের পিছনে রাশেদ হাবিব। জর্জ মারফির বড় হেলমেট পরেছে বলে তাকে দেখতে কাকতাড়ুয়ার মত অদ্ভুত লাগছে।

মিস্টার হাবিব, বলল রানা।

জী, ভাই?

এবার আপনার কাজ দেখাবার সময় হয়েছে। দেখুন দেখি ট্রাঙ্ক খুলতে পারেন কি না।

মেঝেতে স্যামসোনাইট ট্রাঙ্কের পাশে হাঁটু গেড়ে বসল রাশেদ হাবিব, খুলতে শুরু করেছে ল্যাচ।

তুমুল গতি তুলে ড্রাইভ করছে রানা, একটু পর পর ঘুরে চাইছে।

ঢাকনি খুলে ফেলেছে হাবিব, ভিতরের জিনিস দেখে বলল, সর্বনাশ! বন্দুক!

তখনই বাইরে উঠল বিকট আওয়াজ। আবারও ড্রাইভিঙে মন দিল রানা। বুঝে ফেলেছে, ওটা কী। পরক্ষণে দেখল।

ওর হোভারক্রাফটের সামনে পড়েছুে মিসাইল। তুষারের বুকে দশ ফুট ব্যাসের গর্ত তৈরি করেছে। পরক্ষণে গহ্বরের কিনারা পেরুল ওর হোভারক্রাফট। বিকট বিস্ফোরণে ছিটকে উঠেছে বরফের কুচি ও তুষার।

আরও আসছে! নাজমুলের চিৎকার শুনল।

তীর থেকে সরে যাও! নির্দেশ দিল রানা। বামপাশে এক শ গজ দুরে ক্লিফ। ওদিক থেকে সরো!

কথার ফাঁকে চট করে মুখ সরাল। ওর পিছনে হাজির হয়েছে কয়েকটা ব্রিটিশ হোভারক্রাফট। দ্বিতীয় মিসাইল আসতে দেখল রানা।

সিলিণ্ডারের মত জিনিসটা সাদা রঙের, সামনের ব্রিটিশ হোভারক্রাফটের নাকের কাছ থেকে রওনা হয়েছে। লেজে ধোঁয়া নিয়ে ঘুরতে ঘুরতে আসছে।

ওটা মিলান অ্যান্টি-ট্যাঙ্ক মিসাইল!

মরেছি! গুঙিয়ে উঠল রাশেদ হাবিব।

মেঝের সঙ্গে অ্যাক্সেলারেটার টিপে ধরেছে রানা।

কিন্তু কাছে চলে এসেছে মিসাইল।

বাঁকা পথে আসছে রানার হোভারক্রাফট লক্ষ্য করে।

অনেক বেশি গতি ওটার।

একেবারে শেষ মুহূর্তে স্টিয়ারিং ইয়কে হ্যাঁচকা টান দিল রানা, দ্রুত বামে সরতে শুরু করেছে হোভারক্রাফট। ছুটছে ক্লিফের কিনারা লক্ষ্য করে।

ওদের নাকের সামনে দিয়ে পেল রকেট। পাগল হয়ে উঠেছে রানা, সরছে ডানদিকে। বিশ ফুট বাম বিস্ফোরিত হলো রকেট, চারপাশে ছড়িয়ে গেল পেঁজা তুষার।

আবারও বামে সরছে রানা, মাত্র দুই সেকেণ্ড পর ডানদিকে ছিটকে উঠল বিপুল তুষার। আধ সেকেণ্ড পর এল কান ফাটানো আওয়াজ।

এঁকেবেঁকে! হেলমেট মাইকে চেঁচাল রানা। কেউ টার্গেট লক করতে দিয়ো না!

প্রায় একইসঙ্গে বাঁক নিয়েছে তিন হোভারক্রাফট, যেন ভয়ঙ্কর ঝড়ের ভিতর দুলছে তিন জাহাজ। ওদের চারদিকের তুষার জমিতে নামছে ব্রিটিশদের আনগাইডেড মিসাইল। বিকট বিস্ফোরণের আওয়াজে ঝনঝন করছে কানের তালা। জমি থেকে ছিটকে উঠছে তুষার।

স্টিয়ারিং ইয়োকের সঙ্গে লড়ছে রানা, বরফের উপর বিশ্রী আওয়াজ তুলে পিছলে চলেছে হোভারক্রাফট। কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই বললেই চলে। একবার এদিকে সরতে চাইছে রানা, পরক্ষণে অন্য দিকে। পিছন থেকে ধাওয়া করে আসছে একের পর এক মিসাইল।

ট্রাঙ্ক, হাবিব! গলা ছাড়ল রানা। ট্রাঙ্ক!

এই তো আপনার ট্রাঙ্ক! স্যামসোনাইট খুলে কালো একটা টিউব বের করেছে সে। দৈর্ঘ্যে ওটা পাঁচ ফুট।

ঠিক আছে, আরেকটা ব্রিটিশ মিসাইল এড়াতে আরেক দিকে সরছে রানা। হড়কে চলেছে হোভারক্রাফট, ভারসাম্য রাখতে না পেরে দেয়ালে হুমড়ি খেয়ে পড়ল হাবিব, ওখান থেকে মেঝেতে।

টিউবের সঙ্গে গ্রিপষ্টক লক করুন, নির্দেশ দিল রানা।

কয়েক সেকেণ্ড পর ট্রাঙ্কের ভিতর গ্রিপস্টক পেল হাবিব। জিনিসটা ব্যারেলহীন অস্ত্রের বাঁটের মত। সামনের দিকে নীচে ট্রিগার। টিউবের শেষে ক্লিক করে আটকে গেল গ্রিপস্টক।

ঠিক আছে, হাবিব, আপনি একটা স্টিংগার মিসাইল লঞ্চার তৈরি করেছেন! এবার ওটা ব্যবহার করুন!

কীভাবে ব্যবহার করব, ভাই?

দরজাটা খুলুন! জিনিসটা কাঁধের সঙ্গে লাগান! দুষ্ট লোকের দিকে তাক করুন! যেই কানের কাছে ঝন শুনবেন, ট্রিগার টিপে দেবেন! বাকি কাজ ওটাই করবে!

জী, ভাই, কিন্তু… সন্দেহ নিয়ে বলল হাবিব। কথা শেষ করল না, খুলে ফেলল ডানদিকের স্লাইডিং দরজা। ভিতরে ঢুকল অ্যান্টার্কটিকার হিম-শীত। ওরে বাপরে মরেছি! শী…ত! ঝোড়ো হাওয়ার বিরুদ্ধে লড়ে দরজার কাছে পৌঁছে গেল হাবিব।

কাঁধে তুলে ফেলেছে স্টিংগার লঞ্চার, চোখ পাকিয়ে চাইল সাইটে। নাইট-ভিশনের ভিতর জ্বলজ্বলে সবুজ হোভারক্রাফট। ওটার উপর স্থির হলো ক্রস-হেয়ারপরের সেকেণ্ডে একটা গুঞ্জন শুনল হাবিব।

আমি শুনেছি! উত্তেজিত হয়ে চেঁচিয়ে উঠল, যেন ওহী শুনেছে, কিন্তু এবার কীভাবে ব্রিটিশগুলোকে শেষ করি?

ট্রিগার টিপে দিন। আঁড়ের মত পাল্টা চেঁচাল রানা।

পরক্ষণে ট্রিগার টিপল হাবিব। তখনই পিছনে উড়াল দিল। সে, ছিটকে গিয়ে পড়েছে কেবিনের ভিতর।

ওদিকে লঞ্চার থেকে বেরিয়ে গেছে মিসাইল। কালো ধোঁয়া ছিটকাল লঞ্চার। ছোট বিস্ফোরণ তৈরি করেছে, চুরচুর হয়ে ভেঙে পড়েছে হাবিবের পিছনে জানালার কাঁচ।

চোখ রেখেছে রানা, ঘুরতে ঘুরতে ব্রিটিশদের সামনের হোভারক্রাফটের দিকে চলেছে স্টিংগার। পিছনে পাক খাওয়া ধোঁয়া। ওটাই বুঝিয়ে দিল ফ্লাইট-পাথ।

ব্রিটিশ হোভারক্রাফটের নাকে লাগল স্টিংগার, পরক্ষণে বিস্ফোরিত হলো। মুহূর্তে হাজার টুকরো হলো ক্রাফট।

অন্যরা মোটেও হাল ছাড়ল না, পাত্তাই দিল না কিছু। পিছনের একটি হোভারক্রাফট এল সরাসরি জ্বলন্ত টুকরোগুলোর ভিতর দিয়ে।

দারুণ লক্ষ্যভেদ, হাবিব! উৎসাহ দিল রানা। ভাল করেই জানে, লোকটা আসলে ট্রিগার টেপা ছাড়া কিছুই করেনি। ব্রিটিশরা ব্যবহার করছে মিলান অ্যান্টি-ট্যাঙ্ক মিসাইল। ওই জিনিস ট্যাঙ্ক বা আর্মার্ড ভেহিকেল উড়িয়ে দেবে, অবশ্য শত্রুর গতি বড়জোর হতে হবে চল্লিশ মাইল। এবং সে কারণেই দ্রুতগতি হোভারক্রাফটের বিরুদ্ধে হিমশিম খাচ্ছে এসএএস কমাণ্ডেরা।

হিউয়েস এমআইএম-৯২ সারফেস-টু-এয়ার স্টিংগার মিসাইল একেবারেই অন্য জিনিস ব্যবহার করা হয় সুপারসনিক ফাইটার বিমানকে ফেলে দিতে। খুব সহজেই নব্বই মাইল বেগের হোভারক্রাফটকে গেঁথে ফেলেছে ওটা।

রানা এ-ও জানে, শোন্ডার-লঞ্চডু অ্যাসল্ট ওয়েপন্সের ভিতর সবচেয়ে সহজে ব্যবহার করা যায় স্টিগার। শুধু তাক করতে হবে অস্ত্র, গুনতে হবে গুঞ্জন, তারপর টিপে দিতে হবে ট্রিগার। বাকি কাজ করবে মিসাইল।

 রানার পিছনে মেঝে থেকে উঠেছে রাশেদ হাবিব, উকি দিল সাইড দরজা দিয়ে। ওই যে দেখা যায় বিধ্বস্ত হোভারক্রাফট, নানাদিকে ছিটকে পড়ে এখন জ্বলছে।

কী বুঝলেন? খুশি হয়ে জানতে চাইল সে।

আপনি পারেনও, বলল রানা। আবারও গলা শুকিয়ে গেছে ওর।

ঠিক পিছনে জোট বেঁধেছে সাতটা ব্রিটিশ হোভারক্রাফট!

.

সার্জেন্ট, স্যর। চেঁচিয়ে উঠল নাজমুল।

আসছি! পাল্টা চেঁচাল দবির। স্টিয়ারিং ইয়কে টান দিয়েছে সে। ডানদিকে বাঁক নিল ওর হোভারক্রাফট, চলে গেল নাজমুলের পাশে। আড়াল দেবে ব্রিটিশ হোভারক্রাফট থেকে।

ডানদিক দেখে নিল দবির, এইমাত্র ওর পাশের জানালায় লেগেছে অজস্র বুলেট। আঁচড় কাটার দাগ পড়েছে কাচে, অবশ্য  তৈরি হয়নি ফাটল। বুলেট-রেস্ট্যিান্ট লেকসান গ্লাস।

ব্রিটিশ হোভারক্রাফটগুলো বড়জোর বিশ গজ দূরে। সীমাহীন বরফ প্রান্তরে পিছলে চলেছে। যেন এক পাল হাঙর, ছুটে আসছে তিন হোভারক্রাফট লক্ষ্য করে।

সার্জেন্ট!

নাজমুলের পিছনে চলে এল দবির। ডানদিক থেকে আসছে চারটে ব্রিটিশ হোভারক্রাফট। এমপি-৫ দিয়ে পাশের জানালার কাচ নিচু করে নিল দবির, পরক্ষণে টিপে ধরল ট্রিগার। সবচেয়ে কাছের ব্রিটিশ হোভারক্রাফটের গায়ে বিশটা গর্ত তৈরি হলো।

হঠাৎ করেই বাঁক নিল ওই হোভারক্রাফট। দড়াম করে ধাক্কা দিল দবিরের হোভারক্রাফটে। অপ্রস্তুত ছিল দবির, জোর ঝাঁকি খেয়ে সিট থেকে পড়ে গেল মেঝেতে। বিরক্ত হয়ে জানতে চাইল, স্যর, আপনি কোথায়?

কোনও সাড়া নেই।

স্যর আর স্টিংগার গেল কই? আবারও সিটে উঠল ও। পাশের জানালা দিয়ে উঁকি দিল। একটু দূরে ছুটছে ব্রিটিশ হোভারক্রাফট। এতই কাছে, ড্রাইভারকে দেখতে পেল। পরনে কালো পোশাক, কপালে এসএএসের কালো নেটের ব্যালাক্লাভা। পিছনে দুজন, পরনে কালো ইউনিফর্ম। হোভারক্রাফটের পাশের দরজা খুলে ফেলেছে তাদের একজন।

ওরা উঠতে চায় এই হোভারক্রাফটে, ভাবল দবির।

কিন্তু এক সেকেণ্ড পর উজ্জ্বল আলোয় ভরে উঠল ব্রিটিশ হোভারক্রাফট। জানালার ফ্রেম থেকে ছিটকে বেরুল রিইনফোর্সড কাচ। বিক্ষেরিত হয়েছে সব।

অবাক হয়ে দেখছে দবির, এইমাত্র পাশে ছুটছিল লোকগুলো, এক সেকেন্ড পর পিছনে পড়ে গেল জ্বলন্ত জঞ্জাল। কাঁধের উপর দিয়ে চাইল দবির। পিছনে হাজির হয়েছে মাসুদ রানার কমলা হোভারক্রাফট। ওটা থেকে বেরুচ্ছে স্টিংগার মিসাইলের ধোঁয়া।

ধন্যবাদ, স্যর, বলল দবির।

বামে দেখুন। সতর্ক করল রানা।

প্রচণ্ড ধাক্কা খেয়ে সিট থেকে আবারও উড়াল দিল দবির, চোখের সামনে উন্টে গেল পৃথিবী। একপাশ থেকে এসেছে ভয়ঙ্কর গুতো। ধপ করে আবারও বরফ-সমতলে নামল ওর হোভারক্রাফট, বিন্দুমাত্র কমেনি গতি।

কোথায় আছে বুঝল না দবির। এক সেকেণ্ড পর হাঁচড়েপাঁচড়ে উঠতে চাইল ড্রাইভিং সিটে। আর ঠিক তখনই আবারও জোর ধাক্কা লাগল। এবার এসেছে ডানদিক থেকে।

স্যর! চেঁচিয়ে উঠল দবির।

.

জানি, দবির! তুষারের ভিতর উইণ্ডশিল্ডের এপাশ থেকে দেখছে। রানা। আরও গতি বাড়ছে ওর হোভারক্রাফটের।

ধবল বরফের মাঠে রেসের গাড়ির মত ছুটছে দবিরের হোভারক্রাফট। দুই পাশে দুটো কালো ব্রিটিশ ভোরক্রাফট, পালা করে গুতো মারছে।

হাবিব! হাঁক ছাড়ল রানা। স্টিংগার!

লঞ্চারে প্রায় বসিয়ে নিয়েছি…পিছন থেকে বলল হাবিব। নতুন করে গ্রিপস্টকে নতুন টিউব বসাতে চাইছে।

এক সেকেণ্ড, দবির! জানাল রানা।

গর্জে উঠল ওর হোভারক্রাফটের ইঞ্জিন। আরও বাড়ছে গতি। সামনে তিনটে হোভারক্রাফট। মাঝেরটা দবিরের। দুপাশ থেকে ধাক্কা দিচ্ছে দুই এসএএস হোভারক্রাফট।

ইঞ্চি ইঞ্চি করে তাদের কাছে পৌঁছে গেল রানা। ওভারটেক করছে। বামদিকের হোভারক্রাফটকে পিছনে ফেলল, কয়েক মুহূর্ত পর চলে এল তিন হোভারক্রাফটের সামনে। একটু দূরে নাজমুলের হোভারক্রাফট। বামে মাত্র বিশ গজ দূরে।

নাজমুল? ডাকল রানা।

জী, স্যর?

দবিরকে তুলে নেয়ার জন্য তৈরি থাকো!

জী?

তৈরি থাকো!

চুপ হয়ে গেছে নাজমুল।

এমপি-৫ তুলে নিয়েছে রানা। ঘুরে চাইল রাশেদ হাবিবের দিকে। হাবিব…

জী, ভাই?

কিছু ধরে থাকুন!

হোভারক্রাফটের গিয়ার নিউট্রাল করে দিল রানা, পরক্ষণে গায়ের জোরে ডানদিকে ঘোরাল স্টিয়ারিং ইয়োক।

দুই টনি বুলেটের মত ঘুরতে শুরু করেছে হোভারক্রাফট। এক শ আশি ডিগ্রি চরকির মত ঘুরল। দবির ও অন্য দুই ব্রিটিশ হোভারক্রাটের মুখোমুখি হয়েছে।

কেবিনের ভিতর চট করে ইয়োকে রিভার্স দিল রানা, উল্টো ঘুরছে টার্বোফ্যান। তীব্র গতি তুলে পিছু হটছে হোভারক্রাফট।

গতিবেগ কমপক্ষে আশি মাইল।

দবিরের মেরিন হোভারক্রাফট ও ব্রিটিশ দুই হোভারক্রাফট রানার নাকের সামনে! ড্রাইভিং জানালা দিয়ে এমপি-৫ বের করল রানা, গুলি করল এক পশলা।

বিস্ফোরিত হয়েছে বামের ব্রিটিশ হোভারক্রাফটের উইণ্ডশিল্ড। ড্রাইভিং সিটে লোকটাকে ঝাঁকি খেতে দেখল রানা। এক সেকেণ্ড পর পিছাতে শুরু করল হোভারক্রাফট। হারিয়ে গেল আঁধারে।

.

নরকের ভিতর আছে সার্জেন্ট হোসেন আরাফাত দবির।

বামপাশের ব্রিটিশ হোভারক্রাফট নেই, কিন্তু ডানদিকের হোভারক্রাফট নতুন উদ্যমে ধাক্কা দিচ্ছে। শুভ্র বরফের মাঠে পাশাপাশি ছুটছে দুই হোভারক্রাফট। গর্জন ছাড়ছে ইঞ্জিন। হঠাৎ দবির দেখল, খুলে গেছে ব্রিটিশ হোভারক্রাফটের সাইড দরজা। ওখান থেকে বেরুল কালো, মোটা ব্যারেল।

ব্রিটিশ কুকুরগুলো মারবে আমাকে, ভাবল দবির।

ব্যারেলের মুখ থেকে বেরুল কী যেন। ওটা, এম-৬০ গ্রেনেড লঞ্চার! মুহূর্ত পর দবিরের হোভারক্রাফটের দরজা রিস্ফোরিত হলো। কেবিনে এসে ঢুকল হিম-শীতল হাওয়া।

ওর হোভারক্রাফটের পাশের দেয়াল উড়িয়ে দিয়েছে!

একইসময়ে হোভারক্রাফটের ভিতর ঠং করে মেঝেতে পড়েছে কালো কী যেন!

বুঝতে দেরি হলো না দবিরের, ওটা কালো সিলিণ্ডার। গায়ে নীল অক্ষরে কী যেন লেখা। কেবিনের মেঝেতে গড়িয়ে ড্রাইভিং সিটের দিকেই আসছে। মনে হলো সাধারণ গ্রেনেড, কিন্তু দবির জানে, ওটা অনেক বেশি বিপজ্জনক।

ওটা নাইট্রোজেন চার্জ।

এসএএস ছাড়া অন্য কেউ ব্যবহার করে না।

দুনিয়ার সবচেয়ে বিপজ্জনক গ্রেনেড। ট্যাম্পার মেকানিজম আছে, যে ছুঁড়ে মারবে, চাইলে উল্টো তার দিকে ছুঁড়ে দেওয়া যায় না। স্ট্যাণ্ডার্ড টাইম ডিলে: পাঁচ সেকেণ্ড।

এখনই হোভারক্রাফট থেকে নামতে হবে। পরক্ষণে কেবিনের দক্ষিণ দিকে ডাইভ দিল দবির। ওদিকটা ব্রিটিশ হোভারক্রাফট থেকে দূরে। লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়েই খুলে ফেলল দরজা, পিছলে নেমে যেতে শুরু করেছে।

পাঁচ… চার…।

অ্যান্টার্কটিকার বরফ-শীতল হাওয়া লাগছে। দিগন্ত থেকে সাঁই-সাই করে চোখে-মুখে এসে পড়ছে তুষার। পাত্তা দিল না দবির। তুষার ওকে শেষ করবে না, হোভারক্রাফট থেকে পড়লেও হয়তো মরবে না; কিন্তু নাইট্রোজেন চার্জ মুহূর্তে খুন করবে ওকে!

তিন… দুই…।

জমাট ঠাণ্ডা হাওয়ার ভিতর প্রায় ঝাপিয়ে বেরিয়েছে দবির, তার আগে পিছনে বন্ধ করে দিয়েছে স্লাইডিং ডোর। দ্রুতগতি হোভারক্রাফটের ফুলে ওঠা কালো স্কার্টে শুয়ে পড়েছে। কেবিনের বেরিয়ে থাকা অংশে হাওয়ার বিরুদ্ধে লড়ছে। কানে শোঁ-শো আওয়াজ। তুমুল বেগে ছুটছে হোভারক্রাফট।

দুই… এক…

প্রার্থনা করছে দবির: যেন জানালার রিইনফোর্সড লেকসান গ্লাস…

হোভারক্রাফটের ভিতর বিস্ফোরিত হলো নাইট্রোজেন চার্জ।

থ্যাক! আওয়াজ হলো। দবিরের মুখের পাশে, কাচের ওপাশে লেগেছে তরল নাইট্রোজেন। ঝট করে মুখ সরিয়ে নিল ও।

দুই সেকেণ্ড পর ভিতর অংশে চোখ বোলাল। কেবিনের চারপাশে লেগেছে সুপারকুল্ড লিকুইড নাইট্রোজেন। পাশের জানালার ওপাশে থকথকে নীল কী যেন। আস্তে করে শ্বাস ফেলল দবির। যাক, টিকে গেছে গ্লাস!

কিন্তু এক সেকেণ্ড পর কী যেন কড়াৎ করে উঠল!

ঝট করে মুখ সরিয়ে নিল দবির। বরফ-ঠাণ্ডা জানালাকে চুরচুর করে দিয়েছে তরল নাইট্রোজেন, এখন খসে পড়ছে সব। এক হাজার টুকরো হলো কাঁচ।

সার্জেন্ট, স্যর?

ঘুরে চাইল দবির, পাশেই ছুটছে নাজমুলের হোভারক্রাফট। উইণ্ডস্ক্রিনের ওপাশে ড্রাইভিং সিটে তরুণ হেলেটা।

উঠে পড়ুন, স্যর!

দবিরের যানকে ঘেঁষে ছুটছে নাজমুলের হোভারক্রাফট। সড়াৎ করে সরে গেল চাইডিং দরজা। মুহূর্তের জন্য পরস্পরকে ছুঁয়ে গেল দুটো স্কার্ট। আবারও সরে গেল।

লাফ দিন! চেঁচিয়ে উঠেছে নাজমুল।

দবিরের ইয়ারপিসে জোরালো শোনাল কথাটা। উঠে দাঁড়াতে, শুরু করেছে ও।

আসুন! তাড়া দিল নাজমুল।

পাশের হোভারক্রাফটের কালো স্কার্টের দিকে চাইল দবির। চোখ পড়ল নীচে। দুই যন্ত্রদানবের মাঝে আশি মাইল বেগে পিছিয়ে চলেছে সাদা বরফ। তখনই চোখের কোণে কী যেন দেখল।

আধ সেকেণ্ড পর বুঝল, নাজমুলের যানের পিছনে ওটা একটা কালো হোভারক্রাফট।

মাইকে চিৎকার করল নাজমুল, স্যর, আপনি কোথায়!

খুলে গেছে কালো হোভারক্রাফটের সাইড ডোর। দবির আবছা দেখল, ভিতরে মিলান অ্যান্টি-ট্যাঙ্ক মিসাইল লঞ্চার।

পরক্ষণে ভুস করে উঠল পরিচিত ধোঁয়া, লঞ্চারের মুখ থেকে ছিটকে বেরুল মিসাইল, আসছে ঠিক ওর দিকেই! পিছনে ঘুরতে ঘুরতে আসছে পাগলাটে ধোঁয়া। ঠিক তখনই বুঝল দবির, বড় দেরি করে ফেলেছে।

স্যর! সার্জেন্ট! লাফ দিন! লাফ দিন!

ঝাঁপ দিল হোসেন আরাফাত দবির।

০৫.

তুমুল ঝোড়ো হাওয়ার ভিতর ডানা ভাঙা কাকের মত পড়তে শুরু করেছে দবির, চোখের কোণে দেখল বিস্ফোরিত হলো ব্রিটিশ হোভারক্রাফট। ওটাকে উড়িয়ে দিয়েছে স্টিংগার মিসাইল। কিন্তু তার আগেই মিলান অ্যান্টি-ট্যাঙ্ক মিসাইল ছুঁড়েছে এসএএস ক্রাফট। সাদা জিনিসটাকে ঘুরতে ঘুরতে আসতে দেখছে ও।

এর এক সেকেণ্ড পর নাজমুলের হোভারক্রাফটের কালো স্কার্টে পড়ল ওর দুই হাত। ভুলে গেল ব্রিটিশ মিসাইলের কথা, প্রাণপণে খামচে ধরতে চাইল কিছু। পাদুটো পড়তে শুরু করেছে ছুটন্ত জমির দিকে। এবার ছিটকে পড়বে নীচে। কিন্তু হাতে কী। যেন ঠেকল। নাজমুলের হোভারক্রাফটের স্কার্ট স্টাড। ওটা শক্ত করে ধরল দবির। তখনই দেখল, ব্রিটিশ মিসাইল গিয়ে লাগল ওর পরিত্যক্ত হোভারক্রাফটের পিছনে। এক সেকেণ্ডে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল সব।

.

দবিরকে তুলেছ? হেলমেট মাইকে বলল রানা।

এখনও রেসের বোটের মত ছুটছে ওর হোভারক্রাফট, তীর গতি তুলে পিছিয়ে চলেছে,। নাজমুলের হোভারক্রাফট দেখছে।

জী, স্যর, জবাব দিল কর্পোরাল। গাড়িতে উঠে পড়েছেন।

গুড। স্বস্তির শ্বাস ফেলল রানা, আর তখনই শুনতে পেল গোলাগুলির আওয়াজ। ঝট করে বামদিকে চাইল।

চিনতে পারল ওই হোভারক্রাফট। ওটাই উড়িয়ে দিয়েছে দরিরের হোভারক্রাফটের এক পাশ। এখন একদিকের দরজা খুলে গেছে, ওখান থেকে বেরিয়ে এসেছে মেশিনগানের নল! ওটা গিমপি নামে পরিচিত, বড় ক্যালিবারের হেভি-ডিউটি অস্ত্র, বসে আছে একটা ট্রাইপডের উপর। মাযলের মুখ থেকে বেরুল তিন ফুটি লেলিহান আগুনের জিভ। কান ফাটা গর্জন ছাড়ছে অস্ত্রটা।

নাজমুলের হোভারক্রাফটের উপর মনের ঝাল ঝাড়ছে এসএএস কমান্ডো! ছিটকে উঠছে ফুলকি, হোভারক্রাফটের শরীর ফুটো করছে অজস্র বুলেট, ফেটে গেল নানা জায়গায়।

নাজমুলের যানের পিছন থেকে বেরুতে লাগল কালো ধোঁয়া। পরিষ্কার দেখা গেল, গতি কমতে শুরু করেছে।

স্যর! ব্যস্ত হয়ে জানাল নাজমুল, মস্ত সমস্যা!

আমি তোমার দিকেই আসছি, অপেক্ষা করো, বলল রানা।

গতি কমে আসছে, স্যর! ওজন কমাতে হবে, নইলে গতি রাখতে পারব না!

ঝড়ের গতিতে ভাবতে চাইছে রানা। ধু-ধু বরফ প্রান্তরে এখনও পিছিয়ে চলেছে। ওর ডানে নাজমুলের হোভারক্রাফট, বামদিকে ব্রিটিশ হোভারক্রাফট।

কয়েক সেকেণ্ড পর বলল রানা, মিস্টার হাবিব…

জী, ভাই?

স্টিয়ারিং নিন।

জী, ভাই? চমকে গেছে হাবিব।

এই জিনিস গাড়ির মতই, তফাৎ শুধু চট করে এদিক ওদিক নেয়া যায় না, বলল রানা। ড্রাইভিং সিট থেকে সরে এসেছে।

ওই সিটে বসে পড়ল রাশেদ হাবিব। দুই হাতে শক্ত করে ধরল স্টিয়ারিং ইয়োক।

এবার চোখ বন্ধ করুন,নরম স্বরে বলল রানা।

কেন, ভাই?

বন্ধ তো করুন চোখ, আরও শান্ত হয়ে গেছে রানার কণ্ঠ। ডানহাতে তুলে ধরেছে এমপি-৫, ওর একপশলা গুলি উড়িয়ে দিল হোভারক্রাফটের উইণ্ডশিল্ড!

দুই হাতে চোখ ঢেকে ফেলেছে হাবিব, চারপাশে ঝরঝর করে পড়ছে কাঁচ। কয়েক সেকেণ্ড পর চোখ খুলে দেখল তুষারের মাঠের উপর দিয়ে আসছে দুটো হোভারক্রাফট।

ঠিক আছে, বলল রানা, হাবিব, এবার আমাকে নিয়ে চলুন কালো হোভারক্রাফটের সামনে।

স্টিয়ারিং ইয়োকে সামান্য চাপ দিল হাবিব। মসৃণভাবে বামে সরল হোভারক্রাফট, চলে গেল ব্রিটিশ হোভারক্রাফটের সামনে। ওখান থেকেই মেশিনগান চালানো হচ্ছে নাজমুলের যানের উপর।

ঠিক আছে, এখানেই রাখুন, বলল রানা।

এমপি-৫-র শোল্ডার স্ট্র্যাপ গলা দিয়ে ঘুরিয়ে আনল ও, হোলস্টার থেকে বের করল ডেযার্ট ঈগল অটোমেটিক পিস্তল, কক করে নিল।

এবার, হাবিব, ব্রেক টিপে ধরুন।

বিস্ময় নিয়ে ওর দিকে চাইল বিজ্ঞানী। কী বললেন?

যা বলছি করুন!

এবার সে বুঝল রানা কী করতে চাইছে।

হায় আল্লা! আপনি কি পাগল, ভাই?

আপনার মতই। যা বলছি করুন।

ঠিক আছে, মরলে আপনি মরবেন, আমি কিন্তু এসবে নেই।

দেরি করলে দুজনই মরব।

হতাশ হয়ে আস্তে করে মাথা দোলাল রাশেদ হাবিব, বড় করে শ্বাস নিল, তারপর দুই পায়ে প্রাণপণে টিপে ধরল ব্রেক প্যাডেল।

রানার হোভারক্রাফটের পিছিয়ে যাওয়া থেমে গেছে। নাক সামনে দিয়ে আছাড় খেল ব্রিটিশ হোভারক্রাফট। মুখোমুখি সংঘর্ষ হলো দুই হোভারক্রাফটের।

আগেই তৈরি ছিল রাশেদ হাবিব, শক্ত করে ধরেছে সিটের দুপাশ। প্রবল ঝকিটা সিটের ভিতর গেঁথে দিল তাকে। চোখ খুলে রেখেছে, নিজ চোখ বিশ্বাস করতে পারল না। ভাঙা উইণ্ডশিল্ডের ফাঁকা জায়গা দিয়ে বেরিয়ে গেছে মাসুদ রানা, চার পা সামনে বেড়ে উঠে পড়েছে শত্রু হোভারক্রাফটের নাকে!

দুই হোভারক্রাফটের নাক পরস্পরকে ছুঁয়ে আছে। তুমুল গতি তুলে ব্রিটিশদের হোভারক্রাফট সামনে বাড়ছে। পিছিয়ে চলেছে হাবিবেরটা। 

কালো হোভারক্রাফটের হুড়ে সামনে বাড়ছে রানা। দিগন্ত থেকে পিঠে এসে লাগছে তুষার-কণা। এমপি-৫ দিয়ে এক পশলা গুলিবর্ষণ করল রানা ব্রিটিশ হোভারক্রাফটের উইণ্ডশিল্ডে। চুরচুর হয়ে ভেঙে পড়ল কাচ। রানা পরিষ্কার দেখল, ড্রাইভারের বুক থেকে ফোয়ারার মত বেরুচ্ছে রক্ত।

 কেবিনের ভিতর আরও দুজন। যে-কোনও সময়ে অস্ত্র তাক করবে ওর উপর। লাফ দিয়ে হোভারক্রাফটের ছাতে উঠল রানা, এক সেকেণ্ড পর কেবিনের ভিতর থেকে এল কমপক্ষে পঞ্চাশটা গুলি।

কালো হোভারক্রাফটের ছাতে পা পিছলে যেতে দিয়েছে রানা, চলে এসেছে বাম পাশে। ওদিকে খোলা স্লাইডিং দরজা। ছাতে পেট রেখেই ঝুঁকে গেল, খোলা দরজার ফোকরে ভরে দিয়েছে এমপি-৫-এর মাযল। অন্ধের মত এদিক-ওদিক মাযল ঘুরিয়ে ট্রিগার টিপল।

এক মুহূর্তে শেষ হয়ে গেল অস্ত্রের ম্যাগাষিন। কান পেতে অপেক্ষা করছে রানা, মনে হলো না গুলির তোড়ে কেউ বাঁচতে পেরেছে। যদি বেঁচেও থাকে, যে-কোনও সময়ে পাল্টা গুলি শুরু করবে।

হোভারক্রাফটের ভিতর কোনও আওয়াজ নেই। থেমে গেছে ট্রাইপডে বসা মেশিনগান। আওয়াজ বলতে শুধু কানের পাশে হাওয়ার শোঁ-শোঁও মাতম।

ছাত থেকে নেমে এল রানা, খোলা স্লাইডিং দরজার জায়গাটা দিয়ে ঢুকে পড়ল হোভারক্রাফটের ভিতর। গুলিবর্ষণে মরেছে তিন এসএএস কমাণ্ডো। নিথর পড়ে আছে কেবিনের মেঝেতে, চারপাশ ভেসে যাচ্ছে রক্তে।

গা গুলিয়ে উঠল আঁশটে গন্ধে। ড্রাইভিং সিটে বসে পড়ল রানা, মাইকে বলল, মিস্টার হাবিব, আমার কথা শুনছেন?

.

কমলা ফ্রেঞ্চ হোভারক্রাফটের ভিতর স্টিয়ারিং ইয়োক শক্ত করে ধরেছে রাশেদ হাবিব, সাদা হয়ে গেছে নখগুলো। তুমুল গতি তুলে পিছিয়ে চলেছে হোভারক্রাফট।

বড়সড় হেলমেটের মাইক্রোফোনে বলল হাবিব, শুনছি।

এবার ঘুরিয়ে নিন হোভারক্রাফট, জানাল রানা। আপনি নাজমুলকে সাহায্য করবেন। কয়েকজনকে নামিয়ে দেবে ও, নইলে গতি হারাবে। দুই বা তিনজনকে নিজের হোভারক্রাফটে নেবেন।

আপনি ভাল করেই জানেন, ওই কাজ আমি পারব না, বলল হাবিব।

মিস্টার হাবিব…

ঠিক আছে, ঠিক আছে…

আমি কি খুলে বলব কীভাবে…

না, লাগবে না, অভিমান ভরে বলল হাবিব। আমিই পারব।

তা হলে তাই করুন। আমাকে অন্য কাজে যেতে হবে।

দখল করা কালো, হোভারক্রাফট বামে বাঁক নিতে শুরু করেছে। চলেছে নাজমুলের ক্ষতিগ্রস্ত যানের দিকে।

ঠিক আছে, নিজেকে বলল হাবিব। আগের চেয়ে শক্ত করে ধরেছে স্টিয়ারিং ইয়োক। হ্যাঁ, আমি পারি। নিজ চোখে দেখেছি মিস্টার রানা এমন করেছেন। উনি পারলে আমি কেন পারব না?

এবার হোভারক্রাফটের গিয়ার নিউট্রাল করল সে। টের পেল, একটু একটু করে গতি কমছে।

হা… এবার, বলল হাবিব, এইবার দেখি…

হ্যাঁচকা টানে ডানদিকে ইয়োক সরিয়ে নিল সে।

চরকির মত ঘুরতে শুরু করেছে হোভারক্রাফট।

ওরেব্বাবা! চিকন গলা বিকটভাবে ছাড়ল হাবিব। আল্লারসুলের দোহাই!

পরক্ষণে এক শ আশি ডিগ্রি ঘুরে গেল হোভারক্রাফট, সরাসরি সামনে চলেছে। মস্ত শ্বাস ফেলে স্টিয়ারিং ইয়োক সঠিক দিকে ঠেলে দিল হাবিব। হঠাই যেন স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে ভেহিকেল। বিড়বিড় করে বলল হাবিব, গুলিস্তানে গোলাপ শাহর মাজার যিয়ারত করতে হবে!

দুই সেকেণ্ড পর দরুদ পড়ে বুকে ফুঁ দিয়ে উঁচু গিয়ার ফেলল সে। জোরে জোরে বলল, আমি পারি! আমি সত্যিই পারি!

কংগ্রাচুলেশন্স, কানের ভিতর রানার কণ্ঠ শুনল সে। হ্যাঁ, আপনি পারেন। চালিয়ে যান। কিন্তু এবার চলে আসুন। আপনার সাহায্য নাজমুলের দরকার।

.

নাজমুলের হোভারক্রাফটের পাশে পৌঁছে গেছে রানা। প্রায় বিধ্বস্ত ওদের দুই যান, বডিতে অসংখ্য বুলেটের গর্ত। উইণ্ডশিল্ড নেই রানার হোভারক্রাফটের।

ওদের ঘিরে ঘুরছে অবশিষ্ট তিন ব্রিটিশ হোভারক্রাফট। কখনও চলে আসছে সামনে, কখনও পিছনে।

নাজমুলের হোভারক্রাফটের ডানে রানা, পাশাপাশি দুই দরজা। নাজমুলের ডানদিকের দরজা খোলা।

ঠিক আছে, দুজন পাঠিয়ে দাও আমার হোভারক্রাফটে! জানিয়ে দিল রানা। চলে আসছেন হাবিব। উনি নেবেন আরও দুজনকে।

জী, স্যর, জবাব দিল নাজমুল।

ড্যাশবোর্ডের ক্রজ কন্ট্রোল বাটন টিপল রানা, দেরি না করে বেরিয়ে এল কেবিনে, থামল খোলা দরজার সামনে। পাশাপাশি ছুটছে দুই হোভারক্রাফট। ওদিকের দরজায় দাঁড়িয়েছে হোসেন আরাফাত দবির। দুজনের মাঝে আট ফুট দূরত্ব। দবিরের সঙ্গে পিচ্চি মেরি ভিসার।

এবার, নাজমুল! হেলমেট মাইকে বলল রানা। সরে আসতে শুরু করেছে কর্পোরাল। আগে মেরিকে পাঠাও!

নাজমুলের হোভারক্রাফটের স্কার্ট ঘেঁষে দাঁড়াল দবির। শক্ত করে ধরেছে মেরিকে। ভয়ে ফ্যাকাসে হয়ে গেছে বেচারি। বরফঠাণ্ডা হাওয়ার ভিতর থরথর করে কাঁপছে।

নিজের স্কার্টে এসে দাঁড়াল রানা। বাড়িয়ে দিয়েছে দুহাত। নরম স্বরে বলল, এসো, মেরি! আমি জানি তুমি পারবে।

অনিশ্চিত ভাবে এক পা সামনে বাড়ল, মেরি।

হাত বাড়িয়ে দাও! হাত বাড়িয়ে লাফ দাও! ভয় নেই, আমি তোমাকে ধরে ফেলব

এবার লাফ দিল মেরি ভিসার।

ওটাকে লাফ না বলাই ভাল, যেন সামান্য লাফিয়ে একই জায়গায় থেমে গেছে।

ঝট করে সামনে বাড়ল রানা, খপ করে ধরে ফেলল মেয়েটির পারকা। ওকে নিয়ে এল কালো হোভারক্রাফটের কেবিনের ভিতর।

ঠিক আছ তো? জানতে চাইল রানা।

জবাব দেয়ার জন্য মুখ খুলল মেরি, আর ঠিক তখনই প্রচণ্ড ঝাঁকি খেল ওরা। তাল সামলাতে পারল না রানা ও মেরি, হুমড়ি খেয়ে পড়ল ডোরওয়ের উপর। চিকন স্বরে চিৎকার করে উঠেছে মেরি, খোলা দরজা দিয়ে পড়ে যেতে শুরু করেছে। কিন্তু শেষ সময়ে খপ করে মেয়েটির গ্লাভস পরা হাত ধরে ফেলল রানা।

ডানদিক থেকে ওদেরকে ধাক্কা দেয়া হয়েছে। ঝট করে ওদিকে চাইল রানা।

আরেকটা ব্রিটিশ হোভারক্রাফট।

প্রায় ধাক্কা দিয়ে মেরিকে কেবিনের ভিতর পাঠিয়ে দিল রানা। নিজে তৈরি হয়ে গেছে পরবর্তী ধাক্কার জন্য।

কিন্তু নতুন কোনও গুতো এল না।

বদলে হোভারক্রাফটের কেবিনের ডানদিকটা তুবড়ে ভিতরের দিকে ঢুকে গেল। ওদিকে বিস্ফোরিত হয়েছে কিছু।

মেঝের উপর টানা চিৎকার শুরু করেছে মেরি। ওর উপর ডাইভ দিল রানা, উড়ন্ত জঞ্জাল থেকে আড়াল দিতে চাইছে। ধোঁয়া ও ভাঙা টুকরোর ভিতর দিয়ে ওদিকে চোখ বোলাল।

কিন্তু ওখানে কোনও হোভারক্রাফট নেই। শুধু ধোঁয়া ও তাপপ্রবাহ।

তারপর ধপ্ করে আওয়াজ শুনল রানা। বুট পরা একজোড়া পা নেমেছে ওর হোভারক্রাফটের স্কার্টে। আবারও একই আওয়াজ। গলা শুকিয়ে গেল রানার। ধোঁয়া ও তাপ-প্রবাহের ভিতর হাজির হয়েছে একাধিক লোক।

অস্ত্র বাগিয়ে ঢুকে পড়েছে কেবিনের ভিতর!

০৬.

কটু ধোঁয়া ও তাপ-প্রবাহের ভিতর দুই এসএএস কমাণ্ডো সামনে বাড়ছে। রানা পড়ে আছে মেঝেতে। ঢেকে রেখেছে মেরির্কে। এবার ওকে গেঁথে ফেলবে তারা।

স্যর! মাথা নিচু করুন! রানার ইয়ারপিসে জোরালো শোনাল দবিরের কণ্ঠ।

মেরির মাথার পাশে মুখ গুজল রানা। কানের কাছে শুনল দুটো বুলেটের হুউস-হুউস আওয়াজ। ওর মাথার একটু উপর দিয়ে গেছে। ভারী পাথরের মত ধুপ করে পড়ল প্রথম এসএএস কমাণ্ডো। তার হৃৎপিণ্ড ফুটো করে দিয়েছে দবির।

দ্বিতীয় এসএএস কমাণ্ডে দ্বিধা করল। আর ওই এক সেকেণ্ড বড় দরকার ছিল রানার। ক্ষিপ্র বিড়ালের মত লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল ও, পরক্ষণে ঝাঁপিয়ে পড়ল লোকটার উপর। একইসঙ্গে হোভারক্রাফটের ড্যাশবোর্ডের উপর আছড়ে পড়ল ওরা।

শুরু হয়ে গেল হ্যাণ্ড-টু-হ্যাণ্ড কমব্যাট।

কয়েক সেকেণ্ড পর রানা টের পেল, বেদম মার খেতে শুরু করেছে। লোকটার ঘুষি পড়েছে ওর আহত ঘাড়ে, আরেকটা লেগেছে পাঁজরের খাঁচার উপর। মট আওয়াজ শুনেছে রানা, সকেট থেকে খুলে গেছে হাড়। ওকে কুঁজো করে দিয়েছে তীক্ষ্ণ ব্যথা। কলার ধরে ওকে টেনে তুলল এসএএস কমাণ্ডো, অন্য হাতে ধরেছে বেল্ট, দুই হাতে ছুঁড়ে ফেলে দিল ভাঙা উইণ্ডশিল্ডের ভিতর দিয়ে।

ধপ করে হোভারক্রাফটের হুডের উপর পড়ল রানা। সারা শরীরে টনটনে ব্যথা। শ্বাস নিতে পারছে না। কাশির সঙ্গে উঠে এসেছে তাজা রক্ত। এক সেকেণ্ড পর কেবিনের ভিতর অংশে চোখ গেল, লোকটা হোলস্টার থেকে বের করেছে সার্ভিস পিস্তল। ওটার দিকে চেয়ে হঠাৎ করে শ্বাস নিতে পারল রানা। মনে পড়ে গেল সব।

প্রচণ্ড গতিতে চলেছে হোভারক্রাফট।

ওকে খুন করতে চাইছে লোকটা।

যে-কোনও সময়ে মারা পড়বে ও।

যন্ত্রণায় ঝনঝন করছে সারা শরীর, কিন্তু দেহ গড়িয়ে দিল, নেমে যেতে চাইছে হোভারক্রাফটের নাক দিয়ে। চোখে পড়েছে, সামান্য দূরে নেমে গেছে কালো রাবারের স্কার্ট। নীচে সই-সাঁই করে সত্তর মাইল বেগে পিছিয়ে চলেছে বরফের মাঠ।

এবার মৃত্যু অনিবার্য।

পড়ে যেতে যেতে হোভারক্রাফটের নাকের কাছে কী যেন খপ করে ধরতে চাইল রানা। কোম্পানির ইস্পাতের মনোগ্রাম। তুমুল গতিতে পিছিয়ে যাওয়া জমিটা স্পর্শ করছে ওর দুই পায়ের ডগা।

বিস্মিত এসএএস কমাণ্ডে চেয়ে আছে পড়ন্ত রানার দিকে। দুই সেকেণ্ড পর পিস্তল তুলল সে, মাযল তাক করল শর্কর মাথার উপর।

মার খেয়ে, বিশ্রীভাবে ফুলতে শুরু করেছে রানার মুখ, দাঁতের গোড়া থেকে বেরুচ্ছে রক্ত। হোভারক্রাফটের বেড়ে থাকা স্কার্টে ঝুঁকে আছে, চোখ তুলে চাইল এসএএস কমাণ্ডোর চোখে। রানার ঠোঁটে ঝুলছে মৃদু হাসি। দাঁত বের করে পাল্টা হাসল লোকটা, আরেকটু উঁচু করল পিস্তলের নল। এবার বাগে পেয়ে গেছে। শক্রকে।

ঠিক তখনই স্কার্টের নীচে মাথা সরিয়ে নিল রানা। বুম করে উঠল পিস্তল। স্কার্টের উপরে লেগে বিঈং! শব্দে বেরিয়ে গেল বুলেট। হোভারক্রাফটের নাক থেকে ঝুলছে রানা; ভর দিয়েছে। ফুলে থাকা রাবার স্কার্টের উপর। তীব্র গতি তুলে সরসর করে পিছিয়ে চলেছে তুষার-জমিন।

হঠাৎ ধপ আওয়াজ পেল রানা। মুখ তুলে দেখল হুডের উপর উঠে এসেছে এসএএস কমাণ্ডো। অনেক ঝুঁকে এসেছে, হাসছে পিস্তল হাতে।

গুলি করবার জন্য অস্ত্র তাক করল লোকটা। রানা এখন মাত্র একটা কাজই করতে পারে। সেটাই করল। ফলে থাকা রাবার স্কার্ট থেকে সরিয়ে নিল হাত। হারিয়ে গেল হোভারক্রাফটের নীচে।

টার্বোফ্যানের আওয়াজ ঝালাপালা করে দিল ওর কান। ঠং করে বরফের উপর পড়েছে হেলমেটের পিছন অংশ। মাথার উপর শো-শো মাতম তুলছে চারটে টার্বোফ্যান। রানা যেন আছে কোনও উই টানেলে। বাতাস ভরা স্কার্টের পেট দেখল। ওখানে বনবন করে ঘুরছে টার্বোফ্যান। এক সেকেণ্ড পর হোভারক্রাফটের নীচ থেকে বেরিয়ে এল। কান ফাটানো আওয়াজ আর নেই। হিম বরফের মাঠে চিত হয়ে পড়ে আছে, সামনে মেরিকে নিয়ে ছুটে যাচ্ছে ওর দখল করা হোভারক্রাফট।

রানা ঝট করে গড়ান দিয়ে উপুড় হলো, বেল্ট থেকে খুলে নিয়েছে ম্যাগহুক। তাক করেছে ছুটন্ত হোভারক্রাফটের লেজ লক্ষ্য করে। পরক্ষণে টিপে দিল ট্রিগার।

বাতাস চিরে ছুটছে ম্যাকহুকের বালবের মত ম্যাগনেটিক হেড। পিছনে মহাব্যস্ত হয়ে ছুটছে দড়ি। হোভারক্রাফটের স্কার্টের একটু উপরে কেবিনের ধাতব গায়ে টং করে আটকে গেল হেড। ভয়ঙ্কর জোর টান খেল রানা, পরক্ষণে সরসর করে রওনা হয়ে গেল সত্তর মাইল স্পিডে।

হোভারক্রাফট টেনে হেঁচড়ে নিয়ে চলেছে ওকে। যেন পানিতে পড়া স্কিয়ার ও, প্রাণপণ চাইছে উঠে দাঁড়াতে। আর ঠিক তখনই চারপাশের জমিতে নাক জল একের পর এক বুলেট।

কাঁধের উপর দিয়ে পিছনে চাইল রানা।

পিছনে হাজির হয়েছে দ্বিতীয় ব্রিটিশ হোভারক্রাফট।

দ্রুত আসছে পিষে দেয়ার জন্য।

গড়ান দিয়ে চিত হলো রানা, বজ্র মুষ্ঠিতে ধরেছে ম্যাকহুক। ওকে টেনে নিয়ে চলেছে প্রথম হোভারক্রাফট। অন্য হাতে ডের্ট ঈগল বের করল, গুলি করল ধেয়ে আসা হোভারক্রাফট লক্ষ্য করে। বুম বুম! আওয়াজ তুলছে ডেযার্ট ঈগল। হোভারক্রাফটের স্কার্টে বড় কয়েকটা গর্ত তৈরি করল।

তাতে কমছে না গতি।

প্রায় বুকের কাছে চলে এসেছে।

এবার পেটের ভিতর ভরবে, ধীরেসুস্থে কমাবে গতি। নীচের ধারালো টার্বোফ্যান কুচি করবে ওকে।

টার্বোফ্যান… দ্রুত ভাবতে চাইছে রানা। এমন কিছু দরকার, যেটা… এমন কিছু যা… 

হেলমেট!

প্রথম হোভারক্রাফট টেনে নিচ্ছে ওকে, ঝট করে হোলস্টারে পিস্তল জল রানা, টান দিয়ে খুলে ফেলল হেলমেট।

যা করবার প্রথমবারে! ছিটকে উপরে উঠতে হবে হেলমেট, ঠিকভাবে লাগাতে হবে সামনের হোভারক্রাফটের ফ্যানের ব্লেডে।

হেলমেট ছুড়ে মারল রানা।

বাতাসে ভেসে উঠল ওটা, যেন চিরকাল ধরেই ভাসছে, তারপর বরফে পড়েই আবারও লাফিয়ে উঠল, আর ঠিক তখনই ওটার উপর দিয়ে পেরুল হোভারক্রাফট।.

সামনের ফ্যানে লেগেছে হেলমেট, ভাবল রানা। ঠিক তখনই ভয়ঙ্কর ঝাঁকি খেল হোভারক্রাফট। চোখের পলকে উল্টে গেল, ডিগবাজি শুরু করেছে সত্তর মাইল বেগে। কয়েক সেকেণ্ড পর ধুম করে পড়ল মেঝে হয়েছে ছাত, বরফ ছাওয়া প্রান্তরের উপর দিয়ে মসৃণভাবে চলেছে। পায়ের উপর দিয়ে চেয়ে আছে রানা। ওকে পঞ্চাশ গজ ধাওয়া করে থামল বিধ্বস্ত হোভারক্রাফট। দেখতে না দেখতে পিছনে পড়ে গেল জঞ্জাল।

আবারও উপুড় হলো রানা, শক্ত বরফ জমির উপর জোর ঝাঁকি খেয়ে ছুটে চলেছে। গতি আরও অনেক বেড়েছে সামনের হোভারক্রাফটের। চোখে-মুখে এসে পড়ছে অসংখ্য বরফ-কণা।

ম্যাকহুকের কালো বাটন টিপল রানা, ওটাই টেনে নেবে দড়ি। এখন উল্টো ওকে টানছে হোভারক্রাফটের দিকে ম্যাগনেটিক হুক। একমিনিট পেরুবার আগেই কালো রাবারের স্কার্টের কাছে পৌঁছে গেল রানা। পিছনের টার্বোফ্যান থেকে প্রচণ্ড হাওয়া মুখে এসে লাগছে। এসব পাত্তা দিল না রানা, স্কার্টের উপরে দড়ি বাঁধবার স্টাড আঁকড়ে ধরল, হোভারক্রাফটের উপর টেনে তুলল নিজেকে।

পরের পাঁচ সেকেণ্ডে পৌঁছে গেল বামদিকের সাইড ডোরওয়ের সামনে, ঢুকে পড়ল কেবিনের ভিতর। এইমাত্র মুখে চড় খেয়ে মেঝের উপর ছিটকে পড়েছে মেরি। বেচারির পেটের উপর নামিয়ে আনবার জন্য পা তুলেছে এসএএস কমাণ্ডো।

অ্যাই! গর্জে উঠল রানা।

ঝট্‌ করে ঘুরে চাইল কমাণ্ডা, মুহূর্তে খিচিয়ে ফেলল মুখ।

মেরি, নরম স্বরে বলল রানা, চোখ সরাল না লোকটার উপর থেকে, চোখ বুজে ফেলল।

দুই হাতে চোখ ঢাকল মেয়েটি।

দীর্ঘ কয়েক মুহূর্ত শত্রুর দিকে চাইল এসএএস কমাণ্ডো। পরস্পরকে দেখছে ওরা। তুমুল গতি তুলে ছুটছে কালো হোভারক্রাফট। ওরা যেন বুনো পশ্চিমের দুই দুধর্ষ গানম্যান, মুখখামুখি হয়েছে কোনও সেলুনের সামনে।

তারপর হঠাৎ করেই পিস্তলে ছোঁ দিল ব্রিটিশ লোকটা।

একই কাজ করেছে রানাও।

ঝটকা খেয়ে বেরিয়ে এল দুই পিস্তল, কিন্তু মাত্র একটা গুলির আওয়াজ হলো।

০৭.

এবার চোখ খুলতে পারো, মেরি, নরম স্বরে বলল কে যেন।

মৃত এসএএস কমাণ্ডোর লাশ এড়িয়ে সামনে বাড়ল রানা, এক হাঁটু গেড়ে বসল মেরির পাশে।

খুব ধীরে চোখ মেলল মেয়েটা।

ওর বাম গালে রক্ত জমে গেছে চড়ের কারণে। রানা আস্তে করে জানতে চাইল, ঠিক আছ?

না, দুই চোখ থেকে টপটপ করে বেরুল অঞ। পকেট থেকে বের করল অ্যাজমার পাফার, ওটার ভিতর দুবার ফুপিয়ে উঠে শ্বাস নিল।

আমার অবস্থাও ভাল না, হতাশ হয়ে বলল রানা। মেরির হাত থেকে পাফার নিল, কয়েকবার দম নিয়ে আনমনে ওটা রেখে দিল পকেটে।

চুপ করে পড়ে আছে মেরি। উঠে দাঁড়িয়ে স্টিয়ারিং হুইল ধরল রানা, বসে পড়েছে ড্রাইভিং সিটে। ডেযার্ট ঈগলের পেট থেকে খালি ম্যাগাষিন বের করল, নতুন ক্লিপ আটকে নিল।

ওর পাশে এসে থেমেছে মেরি, কাপা স্বরে বলল, আপনি যখন… চলে গেলেন হোভারক্রাফটের নীচে… আমি ভাবলাম… ভাবলাম আপনি মরে গেছেন!

হোলস্টারে রেখে দিল রানা পিস্তল। মুখ তুলে চাইল মেরির দিকে। গাল বেয়ে দরদর করে নামছে মেয়েটির অশ্রু।

আমি কি মরতে পারি, বলো? হাসল রানা। আমিই তো এই সিনেমার নায়ক!

নিঃশব্দে কাদছে মেরি, অবশ্য এক মুহূর্ত পর হেসে ফেলল। ওর হাসি দেখে রানাও হাসল।

ওকে অবাক করে বুকে মুখ গুজল মেরি। বোঝা গেল না, হাসছে না কাঁদছে। ওর পিঠে আদরের চাপড় দিল রানা। এক সেকেণ্ড পর বিস্মিত হয়ে ভাবল, ওই আওয়াজ কীসের!

আগে ছিল না। জোর আওয়াজ। ছন্দবদ্ধ। আছড়ে পড়বার মত।

বুম!

বুম!

বুম!

আওয়াজটা যেন ঠিক… মস্ত ঢেউ আছড়ে পড়বার মত!

চমকে গেছে রানা, বুঝে গেছে ওরা কোথায়। খুব কাছে ক্লিফ। হোভারক্রাফট নিয়ে নানা দিকে ছুটতে গিয়ে চলে এসেছে ওরা তিন শ ফুটি ক্লিফের পাশে।

তিন শ ফুট নীচে উপসাগর!

দানবীয় সব ঢেউ আছড়ে পড়ছে বরফের ক্লিফের উপর!

ওর বুকে মুখ গুজে আছে মেরি, কিন্তু, চোখের কোণে কী যেন দেখল রানা। ব্রিটিশ হোভারক্রাফটের ড্যাশবোর্ডের দেয়ালে ছোট এক কমপার্টমেন্ট, খুলে গেছে দরজা। ভিতরে দুটো রুপালি ক্যানিস্টার। একেকটা ক্যানিস্টার প্রায় এক ফুটি। মাঝে সবুজ ফিতার মত রঙে স্ট্যানসিল করা অক্ষর:

ট্রাইটোনাল ৮০/২০।

ট্রাইটোনাল ৮০/২০? অবাক হয়ে ভাবল রানা। এই জিনিস উইলকক্স আইস স্টেশনে কেন এনেছে ব্রিটিশরা?

ট্রাইটোনাল ৮০/২০ হাইলি কনসেন্ট্রেটেড এক্সপ্লোসিভ। খুবই দাহ্য বিস্ফোরক, আকাশ থেকে বোমার মত করে ফেলা হয়। ট্রাইটোনাল নিউক্লিয়ার বোমা নয়, কিন্তু ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণ তৈরি করে, চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে বিপুল তাপ। রানা যে ক্যানিস্টার দেখছে, তার ভিতর আছে এক কিলোগ্রাম বিস্ফোরক। মাঝারি কোনও বাড়ি মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেয়ার জন্য যথেষ্ট।

আরেকবার মেরির পিঠ চাপড়ে দিয়ে উঠে দাঁড়াল রানা, চলে গেল ড্যাশবোর্ডের কমপার্টমেন্টের সামনে। বের করে নিল রুপালি-সবুজ একটা ক্যানিস্টার। আবারও ফিরল মেরির পাশে। এখন ঠিক আছ তো?

তাই তো মনে হয়, হাসতে চাইল মেরি।

গুড। দেড় হাতি থাই পকেটে ট্রাইটোনাল ভরে রাখল রানা। তা হলে এবার ফিরতে হবে…

কোথা থেকে এমন জোর ধাক্কা এল রানা জানে না। আরেকটু হলে পা ফস্কে পড়েই যেত মেঝেতে।

বামদিকে হড়কে সরে গেছে ওদের হোভারক্রাফট।

ডানদিকে চাইতেই চমকে গেল রানা,। খোলা দরজার ওপাশে অবশিষ্ট দুই ব্রিটিশ হোভারক্রাফটের একটা!

আবারও গুঁতো দিল ওটা।

এতই জোরে, বামে সরে গেল ওর হোভারক্রাফট।

চট করে বামে চাইল রানা, চমকে গেছে। বুঝতে দেরি হয়নি এরা কী কাজে ব্যস্ত।

সর্বনাশ! বিড়বিড় করে বলল।

আবারও ধাক্কা দিয়েছে ব্রিটিশ হোভারক্রাফট। এবার আরও জোরে। পিছলে বামে সরছে রানার হোভারক্রাফট।

বিধ্বস্ত উইণ্ডশিল্ডের ভিতর দিয়ে দূরে চোখ গেল রানার। তীব্র গতিতে পিছিয়ে চলেছে বরফের প্রান্তর। কিন্তু বামে হঠাৎ করেই হারিয়ে গেছে তুষার-জমি। ওপাশে আর কিছুই নেই।

ক্লিফের শেষ প্রান্তে পৌঁছে গেছে ওরা।

একেক ধাক্কা ওদেরকে নিয়ে যাচ্ছে খাতের পাশে।

ওদিকে তিন শ ফুট নীচে…

স্টিয়ারিং হুইল নিয়ে কুস্তি শুরু করল রানা, উল্টো তো মেরে সরে যেতে চাইছে। কিন্তু অপেক্ষাকৃত ভারী ব্রিটিশ হোভারক্রাফট মোটেও সরছে না।

কোথাও যাওয়ার নেই রানার।

ডানদিকের পথ বন্ধ। আবারও সামনের দিকে চাইল রানা। মাত্র দশ গজ বামে পিছিয়ে চলেছে ক্লিফের কিনারা। নীচে ঢেউয়ের মাথায় সাদা ফেনা। একবার পড়লে…

হঠাৎ আরেকটা জোরালো ধাক্কা ওদেরকে সরিয়ে দিল আরও বামে। আট গজ দূরে কিনারা!

আরও কয়েক ধাক্কা খেলে… ভাবল রানা। দ্রুত মগজ চালাতে চাইছে। চট করে মনে পড়ে গেল হেলমেট মাইকের কথা, সাহায্য চাইতে হবে।

কিন্তু হেলমেটই তো নেই!

কারও সঙ্গে কথা বলতে পারবে না ও!

আরেকটা ধাক্কা লাগল। এবার আগের চেয়েও জোরে।

বামে সরে গেল হোভারক্রাফট।

মাত্র পাঁচ গজ দূরে কিনারা।

ডানদিকে চাইল রানা। ওদিকে হোভারক্রাফটের পাশে বড় গর্ত। ওদিক দিয়ে দেখা গেল, বরফের উপর দিয়ে ছুটে চলেছে কালো হোভারক্রাফট। দুই যানের মাঝে দূরত্ব তৈরি করছে। কিন্তু এক সেকেণ্ড পর দ্রুত সরে এল ধাক্কা দেয়ার জন্য।

সংঘর্ষ হলো দুই হোভারক্রাফটের। রানা টের পেল, ভীষণ দুলে উঠেছে ওর হোভারক্রাফট। আরও কয়েক ফুট সরে গেছে। কিনারার দিকে।

মাত্র দুই গজ দূরে খাড়া পতন।

উঁচু ক্লিফের মাথায় তীব্র গতি তুলে ছুটছে দুই হোভারক্রাফট। তিন শ ফুট নীচে দক্ষিণ সাগরের দানবীয় কালো ঢেউ।

ডানে চাইল রানা। পাশে ছুটছে ব্রিটিশ হোভারক্রাফট।

আবারও সরে গেছে, নতুন করে ধাক্কা দেবে। এই সুযোগে ডানে সরতে চাইল রানা। তারই ফাঁকে দেখল পিছন থেকে আসছে আরেকটা হোভারক্রাফট।

স্টিয়ারিং হুইল ঘোরাবার ফাঁকে চেয়ে রইল রানা। একটা কমলা হোভারক্রাফট। কিন্তু কমলা রঙের কেন?

তার মানেই ফ্রেঞ্চ… ওটার ভিতর থাকবার কথা…

রাশেদ হাবিবের!

দেখতে না দেখতে নাটকীয়ভাবে হাজির হলো বাঙালি বিজ্ঞানী, ব্রিটিশ হোভারক্রাফটের পাশে পৌঁছে গেছে। এখন তিন হোভারক্রাফট পাশাপাশি ছুটছে ক্লিফের কিনারে।

হঠাৎ করেই সরে এসে রানার যানকে ধাক্কা দিল ব্রিটিশ হোভারক্রাফট।

রানার স্কার্ট বেরিয়ে গেল কিনারা থেকে। ঝরঝর করে পড়তে শুরু করেছে আলগা সব বড় তুষার খণ্ড। চোখের সামনে ওগুলো ছোট হয়ে গেল, কয়েক সেকেণ্ড পর হারিয়ে গেল তিন শ ফুট নীচের দানবীয় ঢেউয়ের ভিতর।

মেরি, এসো! খপ করে মেয়েটির হাত ধরল রানা।

আমরা এবার কী করব? আবারও কাঁদতে শুরু করেছে। মেরি।

কোনও ভয় নেই, হোভারক্রাফট থেকে নামব, বলল রানা।

হোভারক্রাফটের ডানদিকের গর্তের দিকে ঠেলল মেরিকে। আবারও সরে গেছে ব্রিটিশ হোভারক্রাফট, শেষ ধাক্কা দেয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে।

অজান্তেই বড় করে ঢোক গিলল রানা। ওকে একেবারে সঠিক সময়ে…

ডেযার্ট ঈগল পিস্তল বের করল ও।

পাশ থেকে ওদের দিকে সরে আসছে ব্রিটিশ হোভারক্রাফট।

জোর ধাক্কা লাগল দুই হোভারক্রাফটে, আর ঠিক তখনই এক লাফে ব্রিটিশ হোভারক্রাফটের স্কার্টে উঠল রানা, বামহাতে জড়িয়ে এনেছে মেরিকে।

ঝট করে ঘুরে চাইল রানা, কিনারা পেরুল ওদের পরিত্যক্ত হোভারক্রাফট। মনে হলো দীর্ঘক্ষণ ঝুলে রইল আকাশে, তারপর হঠাৎ করেই গতি পেল–রওনা হয়ে গেল নীচে! কয়েক মুহূর্ত পর আছড়ে পড়ল সাগরের বুকে, হাজার টুকরো হলো সব।

ওদিকে দেখবার সময় নেই রানার, মেরিকে নিয়ে সরছে। পাঁচ সেকেণ্ডে উঠে পড়ল ব্রিটিশ হোভারক্রাফটের ছাতে। পিস্তল তাক করল ছাতের উপর, দেরি না করে তিনবার গুলি করল। জানের ভয়ে একদিকে সরছে ব্রিটিশ কমাণ্ডারা। হোভারক্রাফট নিয়ে সামনে চলে এসেছে রাশেদ হাবিব।

রানা ও মেরি ব্রিটিশ হোভারক্রাফটের স্কার্টে উঠতেই কাছে চলে এসেছে সে। এবার সরে এল পাশে। মেরিকে নিয়ে সাবধানে হাবিবের হোভারক্রাফটের স্কার্টে নামল রানা। কয়েক সেকেণ্ড পর ব্রিটিশ যান থেকে সরে যেতে লাগল কমলা হোভারক্রাফট।

ঘুরে চাইল রানা, ব্রিটিশ হোভারক্রাফটের উইণ্ডশিল্ডে নক্ষত্রের মত লাল দাগ। মারা পড়েছে ড্রাইভার। কিন্তু কেবিনের ভিতর কে যেন নড়ছে। বোধহয় ধরতে চাইছে স্টিয়ারিং হুইল।

কিন্তু অনেক দেরি করে ফেলেছে সে।

রানার মনে হলো, র‍্যাম্প বেয়ে উড়াল দিল স্টান্ট গাড়ি, ছিটকে কিনারা পেরুল ব্রিটিশ হোভারক্রাফট। উপরের দিকে উঠছে, তারপর মাধ্যাকর্ষণ টেনে ধরল ওটাকে! সঁই-সাই করে নীচে রওনা হলো। তার আগে কিনারা পেরুনোর সময় হোভারক্রাফটে একটা ভীত মুখ দেখেছে রানা।

ঘুরে দাঁড়াল ও, কমলা হোভারক্রাফটের সাইড ডোর খুলে গেছে। উদয় হয়েছে রাশেদ হাবিবের উদ্ভাসিত হাসিমুখ।

আপনার কী মনে হয়, ভালই চালাই? গর্ব ভরে জানতে চাইল।

আর মাত্র একটা ব্রিটিশ হোভারক্রাফট রয়ে গেছে। ওটার বিরুদ্ধে রানাদের হোভারক্রাফট দুটো। বাধ্য হয়ে বেশ দূরত্ব বজায় রাখছে এসএএস কমাণ্ডোরা।

খপ করে হাবিবের মাথার হেলমেট দখল করল রানা, নিজে পরে নিল মাথায়। মাইক চালু করল, নাজমুল, শুনছ?

জী, স্যর।

সবাই ঠিক?

কমবেশি সবাই ভাল, স্যর।

হোভারক্রাফটের কী অবস্থা? জানতে চাইল রানা।

বেদম মার খেয়েছে, স্যর, অবশ্য এখনও ঠিকভাবেই চলছে। আবারও পুরো পাওয়ার পেয়েছি।

গুড, বলল রানা। এবার শোনো, শেষ হোভারক্রাফট বাধা দিলে ম্যাকমার্ডোর দিকে যেতে পারবে?

জী, স্যর। ঠিক আছে, মেরির দিকে চাইল রানা। অপেক্ষা করো। আরেকজন যাত্রী পাবে।

রাশেদ হাবিবের দিকে চাইল রানা।

বুঝে গেল বিজ্ঞানী, আবারও হোভারক্রাফট নিয়ে তাকে যেতে হবে নাজমুলের যানের পাশে। যাত্রীবাহী হোভারক্রাফট রওনা হবে ম্যাকমার্ডো লক্ষ্য করে। আর এদিকে মাসুদ রানা আর ও লড়বে শেষ ব্রিটিশ হোভারক্রাফটের বিরুদ্ধে।

দু মিনিট পর পাশাপাশি ছুটতে লাগল দুই হোভারক্রাফট। সাইড দরজা খুলে গেছে দুটোরই।

নাজমুলের হোভারক্রাফটের দরজায় এসে দাড়াল হোসেন আরাফাত দবির। কমলা যানের দরজায় মেরিকে নিয়ে দাঁড়াল রানা। যেন দুই দেশের সীমান্তে বন্দি বিনিময় হবে।

ওদের শদুয়েক গজ পিছনে শেষ ব্রিটিশ হোভারক্রাফট।

ঠিক আছে, স্যর, রানার ইয়ারপিসে বলল দবির।

তুমি তৈরি তো? মেরির কাছে জানতে চাইল রানা।

হা… আচ্ছা।

পাশাপাশি স্কার্টে পা রাখল রানা ও মেরি। যাত্রীবাহী হোভারক্রাফটের কেবিন থেকে ব্রিটিশ যানের উপর চোখ রেখেছে কর্পোরাল নাজমুল। ওটা থেকে তীক্ষ্ণ নজর রাখছে এসএএস কমাণ্ডারা, অবশ্য চুপ করে সরে আছে দূরে।

হারামজাদারা কী করছে? আনমনে বলল নাজমুল।

.

ঠিক আছে, স্যর, এবার ওকে এদিকে পা রাখতে বলুন! চেঁচাল দবির।

মেরিকে নিয়ে সামনে বাড়ল রানা, হু-হু হাওয়া উড়িয়ে নিতে চাইছে ওদেরকে।

পাশের হোভারক্রাফটের স্কার্টে পা রেখেছে দবির। হাত বাড়িয়ে দিয়েছে মেরিকে টেনে নিতে। পিছন থেকে মেয়েটির দুই হাত ধরেছে রানা। সামনের স্কার্টে পা রাখতে চাইল মেরি, এবার উঠে পড়বে যাত্রীবাহী হোভারক্রাফটে।

কিন্তু ঠিক তখনই হেলমেট ইন্টারকমে রানা শুনল নাজমুলের চিৎকার:

কুকুরের বাচ্চা ব্রিটিশগুলো… রকেট মারছে!

একইসঙ্গে ওদিকে ঘুরে চাইল রানা ও দবির।

প্রথমে ধোঁয়ার লেজ দেখল ওরা।

ঘুরতে ঘুরতে আসছে ধোঁয়া। সরু, সাদা, বাস্পের মত।

ওটার সামনে উড়ে আসছে রকেট।

শেষ হোভারক্রাফট থেকে আসছে ওটা।

মিলান অ্যান্টি-ট্যাঙ্ক মিসাইল। নিচু হয়ে উড়ে আসছে। বরফ মাঠ থেকে তিন ফুট উপরে। দেখতে না দেখতে সব দূরত্ব গিলে নিয়ে পৌঁছে গেল, নাক খুঁজল কমলা হোভারক্রাফটের পিছনে, সঙ্গে সঙ্গে ডেটোনেট হলো।

ভয়ঙ্কর ভাবে ঝাঁকি খেয়েছে ফ্রেঞ্চ হোভারক্রাফট, রানার হাত, থেকে ছুটে গেছে মেরি। কেবিনের ভিতর চিত হয়ে পড়ল রানা। তার আগে দেখেছে দবিরকে, সে লাফ দিয়ে সামনে বেড়েছে, নিজে পড়তে শুরু করেছে তাও পাগলের মত চাইছে মেরির হাত ধরতে।

তারপর দুই হোভারক্রাফটের মাঝে পড়ে গেল ওরা দুজন!

 .

পা পিছলে পড়ছে মেরি ও দবির।

এক পলকের জন্য কালো স্কার্ট দেখল দবির, তারপর পড়ে গেল দুই হোভারক্রাফটের মাঝের সরু ফাঁকে।

তার আগে মেরির হাত খপ করে ধরেছে, বুকের উপর তুলে নিয়েছে বেচারিকে। আছড়ে পড়বার বেদম ব্যথা শুধু নিজের জন্য রেখেছে।

মাত্র এক সেকেণ্ড পর বুকে মেরিকে নিয়ে ধড়াস্ করে পড়ল পিছিয়ে যাওয়া জমাট বরফের উপর।

.

সার্জেন্ট দবির পড়ে গেছেন! রানার ইয়ারপিসে চেঁচিয়ে উঠল নাজুমল। সঙ্গে গেছে ছোট মেয়েটাও!।

বরফের মাঠে দিগ্বিদিক হারিয়ে ছুটছে কমলা হোভারক্রাফট। কারও নিয়ন্ত্রণ নেই ওটার উপর।

মিসাইল লাগতে উড়ে গেছে পিছনের ফ্যান ও অর্ধেক রাডার। মাছের লেজের মত নড়ছে হোভারক্রাফট, আবারও রওনা হয়েছে বামের ক্লিফের দিকে!

স্টিয়ারিং ইয়োক নিয়ে নাড়ছে রাশেদ হাবিব। কিন্তু অর্ধেক হাল নষ্ট হওয়ায় এখন শুধু বামদিকে সরছে হোভারক্রাফট। গায়ের জোরে ইয়োক ঠেলছে হাবিব। কয়েক সেকেণ্ড পর খুব ধীরে সাড়া দিল হোভারক্রাফট। সরছে ক্লিফের কিনারা থেকে। আবার রওনা দিয়েছে উইলকক্স আইস স্টেশনের দিকে।

নাজমুল! হেলমেট মাইকে বলল রানা। হাবিব প্রায় নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেয়েছে হোভারক্রাফটের, সেদিকে ওর খেয়াল নেই।

জী, স্যর?

ভাগো!

কী বললেন, স্যর?

আমাদের হোভারক্রাফট এখন বাতিল মাল, বলল রানা। আর কিছু করার নেই। রওনা হয়ে যাও! সোজা ম্যাকমাড়ো স্টেশনে যাবে। সাহায্য নিয়ে ফিরবে। তুমি আমাদের একমাত্র ভরসা।

কিন্তু আপনাদের কী হবে, স্যর?

যাও!

জী, স্যর।

এক সেকেণ্ড পর রাশেদ হাবিব বলল, ইয়ে, মেজর…

শুনছে না রানা। চেয়ে আছে নাজমুলের হোভারক্রাফটের দিকে। উল্টো দিকে চলেছে ওটা তুষার ঝড়ের ভিতর। কয়েক সেকেণ্ড পর পাশের জানালা দিয়ে চাইল রানা। দূরে বরফের ভিতর কালো ছোট একটি স্তৃপ।

ওটা দবির ও মেরি।

মেজর…

ঘুরে চাইল রানা। দবির ও মেরির দিকে চলেছে ব্রিটিশ হোভারক্রাফট। কিছুক্ষণ পর থেমে গেল। নেমে পড়েছে কালো পোশাক পরা লোক।

আর কিছু করার নেই, বিড়বিড় করে বলল রানা।

ওর পাশে স্টিয়ারিং ইয়োকের সঙ্গে কুস্তি লড়ছে হাবিব। মেজর! কিছু ধরুন!

ইয়োক আরও শক্ত করে ধরেছে হাবিব। আর ঠিক তখনই মট করে ভেঙে গেল ওটা। চরকির মত বামে ঘুরল হোভারক্রাফট। পিছন দিকে ছুটছে।

এসব কী করছেন? বেশরাগ নিয়ে জানতে চাইল রানা।

আমি সামলাতে চাইছিলাম, চেঁচাল হাবিব। আঙুল তুলে দেখিয়ে দিল হোভারক্রাফটের ভেঙে পড়া পিছন দিক।

হাবিবের আঙুল অনুসরণ করল রানা। বিস্ফারিত হলো দুই চোখ।

রিভার্সে ছুটছে হোভারক্রাফট, আবারও পৌঁছে গেছে ক্লিফের কিনারায়!

আজকের দিন শেষ হবে না? হতাশ হয়ে বলল রানা।

নিশ্চই, এই তো এখন মজা করে মরব, শুকনো স্বরে জানাল হাবিব।

তাকে ধাক্কা দিয়ে ড্রাইভিং সিট থেকে সরিয়ে দিল রানা, নিজে বসল ওখানে। পাম্প করতে শুরু করেছে ব্রেক পেডেল।

কিন্তু ভচ করে বডির সঙ্গে বসে গেল পেডেল! আর কখনও ব্রেক কষবে না।

তুমুল গতি তুলে পিছিয়ে চলেছে হোভারক্রাফট।

ওই কাজ তো আমিও করেছি, ভাই! বলল হাবিব, ব্রেক নেই!

ক্লিফের কিনারার দিকে ফিরছে ওরা। কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই হোভারক্রাফটের উপর।

ভাঙা স্টিয়ারিং ইয়োক খপ করে ধরল রানা। এদিক-ওদিক নাড়ছে, কিন্তু কোনও ইতিবাচক সাড়া নেই।

এত উপর থেকে নীচের সাগরে গিয়ে পড়লে,..

দেখতে না দেখতে চলে আসছে কিনারা!

তারপর হঠাৎ করেই নীচে কোনও জমিই থাকল না, পেটের ভিতর বেদম জোরালো মোড় টের পেল রানা। ক্লিফ ছেড়ে আকাশে উড়াল দিয়েছে ওদের হোভারক্রাফট!

পিছন অংশ সামনে রেখে আকাশে ভেসে উঠেছে ওটার নাক, পেরিয়ে গেছে কিনারা।

কেবিনের ভিতর ঝট করে ড্রাইভিং সিট ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে রানা, উঁকি দিয়েছে ভাঙা উইণ্ডশিল্ড দিয়ে। শিরিষ কাগজের মত শুকিয়ে গেছে গলা, ক্লিফের কিনারা দেখতে না দেখতে দূরে সরছে!

ওর পাশের সিটে রাশেদ হাবিব, ফুপিয়ে চলেছে। আমরা মরে যাচ্ছি, মেজর রানা! আমরা সত্যিই মরে যাব!

শুনবার সময় কই রানার, খাড়া হয়ে উঠেছে হোভারক্রাফট, সামনের দিক নাক তুলেছে উপরের দিকে। আকাশ ছাড়া কিছুই দেখা গেল না।

পাথরের মত নেমে চলেছে হোভারক্রাফট।

পাশের জানালা দিয়ে বাইরে চাইল রানা, সঁই-সাই করে ওদেরকে পাশ কাটাচ্ছে খাড়া ক্লিফের দেয়ালটা!

খপ্‌ করে ম্যাগহুক তুলে নিল রানা, নাক নামিয়ে আনল হাবিবের নাকের আধ ইঞ্চি দূরে, ধমকে উঠল, কোমর জড়িয়ে ধরুন! ছাড়বেন না!

ফুপিয়ে ওঠা বাদ দিয়ে অবাক হয়ে চাইল হাবিব, এক সেকেণ্ড পরমোটা অজগরের মত ভয়ঙ্কর ভাবে পেঁচিয়ে ধরল কোমর। ওদিকে খেয়াল নেই রানার, মাথার উপর ম্যাগহুক তুলেছে, ফায়ার করল ভাঙা উইণ্ডশিল্ডের ভিতর দিয়ে। খুব দ্রুত নীচে পড়ছে হোভারক্রাফট।

আকাশে ছিটকে উঠেছে ম্যাগকের আঁকশি, অর্ধেক পথ গিয়ে খুলে গেল ইস্পাতের গ্যাপলিং হুক। পিছনে সরসর করে ছুটছে দড়ি। এক সেকেণ্ড পর ক্লিফের কিনারা পেরুল এ্যাপলিং হুক, ওদিকে পড়েই আবারও ফিরতে লাগল। আঁচড়ে আনছে তুষার।

ক্লিফের পাশে নামছে হোভারক্রাফট, পিছন দিক নীচের দিকে তাক করা।

ক্লিফের কিনারার বরফে আটকে গেছে এ্যাপলিং হুক, আর খুলে এল না, হঠাৎ করেই টানটান হয়ে উঠল দড়ি। আর দড়ির শেষে ঝটকা খেয়ে পড়ন্ত হোভারক্রাফটের নাক দিয়ে বেরুল রানা ও রাশেদ হাবিব। ,

ওদের দেড় শ ফুট নীচে বিকট আওয়াজে সাদা ফেনার ভিতর আছড়ে পড়ল হোভারক্রাফট। হাজারখানেক টুকরো হলো।

মস্ত দোল খেয়ে ক্লিফের দিকে চলল রানা ও হাবিব। কমপক্ষে তিরিশ ফুট সরে পড়েছে হোভারক্রাফট, এখন দুলতে দুলতে ক্লিফের দিকে চলেছে ওরা। কয়েক সেকেণ্ড পর আছড়ে পড়ল খাড়া দেয়ালে।

ব্যথা ও ঝাঁকি ফস্কে দিল হাবিবের হাত, পড়তে শুরু করেছে সে। একেবারে শেষসময়ে খপ করে ধরল রানার ডানপায়ের বুট।

পুরো একমিনিট চুপ করে ঝুলে রইল ওরা। দেয়ালের মত খাড়া ক্লিফে কেউ নড়ছে না ভয়ে।

এখনও আছেন? একটু পর জানতে চাইল রানা।

তাই তো মনে হয়, ভয়ে ভয়ে বলল হাবিব।

ঠিক আছে, এবার রিল করে উঠব, বলল রানা। ডানহাত সামান্য সরাল ম্যাকহুক থেকে, টিপে দেবে কালো বাটন। ম্যাকহুক ওদেরকে টেনে তুলবে ক্লিফের মাথায়। অবশ্য, যদি টেকে ওই এ্যাপলিং হুক।

মুখ তুলে চাইল রানা। ওদের থেকে কমপক্ষে দেড় শ ফুট উপরে কিনারা। আঁচ করল, ম্যাগহুকের দড়ির শেষে ঝুলছে ওরা।

আর ঠিক তখনই দেখল।

এক লোক। ক্লিফের কিনারায়। উঁকি দিয়েছে নীচে।

বরফের মূর্তি হয়ে গেল রানা।

লোকটার মাথায় কালো ব্যালাক্লাভা!

হাতে মেশিন পিস্তল!

কী, উঠতে পারবেন? রানার বুটের নীচ থেকে জানতে চাইল হাবিব। তা হলে দেরি করছেন কেন? রানার কারণে ক্লিফের মাথায় এসএএস কমাণ্ডোকে দেখছে না সে।

আমরা আর উঠছি না, শুকনো স্বরে বলল রানা। চেয়ে আছে কালো পোশাক পরা কমাত্তোর দিকে।

উঠছি না? অবাক হলো হাবিব। এসব আবার কী বলেন?

সরাসরি নীচে, রানার দিকে চেয়ে আছে এসএএস কমাণ্ডে।

আস্তে করে ঢোক গিলল রানা। নীচের দিকে চাইল। দূরত্ব দেড় শ ফুট, ওখানে আছড়ে পড়ছে বিশাল সব ঢেউ। আবারও উপরে চাইল। খাপ থেকে চকচকে দীর্ঘ ছোরা বের করেছে এসএএস কমাণ্ডো, উবু হয়েছে ম্যাকহুকের দড়ি কাটতে।

ধূশশালা! বলল রানা।

আমার তো বোনই নেই, আমাকে শালা বলছেন? জানতে চাইল হাবিব।

না, দীর্ঘ যাত্রার জন্য তৈরি থাকুন।

কোথায় যেতে হবে?

সোজা পাতালে! শেষ সময়ে বড় করে দম নেবেন। ছুটন্ত হেলিকপ্টার থেকে পানিতে ঝাঁপ দেয়ার আগে এই কথাই শিখিয়ে দেয়া হয় কমাণ্ডো ট্রেইনিঙে। রানার ধারণা: এখন কাজে লাগবে এই বিদ্যা।

আবারও উপরে চাইল রানা। আরও ঝুঁকে এসেছে কমাণ্ডো, এবার ঘ্যাচঘ্যাচ করে দড়ি কাটবে।

ঠিক আছে, বলল রানা। শালাকে দড়ি কাটতে দেব না। হাবিব, আপনি তৈরি তো?

এক সেকেণ্ড অপেক্ষা করল রানা, তারপর দুইবার টিপে দিল ম্যাকহুকের ট্রিগার।

একইসময়ে ক্লিফের মাথায় ছড়িয়ে থাকা এ্যাপলিং হুক স্ন্যাপ আওয়াজ তুলে বুজুে গেল, বেরিয়ে এল তুষারের বুক থেকে। ক্লিফের উপর থেকে ছিটকে নীচের দিকে রওনা হলো আঁকশি ও দড়ি।

বিস্মিত এসএএস কমান্তো চেয়ে রইল। একইসঙ্গে নীচে রওনা হয়েছে রানা, হাবিব ও ম্যাকহুক।

অনেক নীচে দক্ষিণ সাগরের বিশাল কালো ঢেউ!

০৮.

পাতাল-গুহার থমথমে নীরবতায় অর্ধেক খেয়ে ফেলা মানবদেহের দিকে চেয়ে আছে লেফটেন্যান্ট তিশা করিম। মস্ত সব বরফখত্রে এদিক ওদিক ছিটিয়ে রয়েছে দেহাবশিষ্ট।

গুহার ভিতর ঢুকবার পর পেরিয়েছে চল্লিশ মিনিট। জনি ওয়াকার, গোলাম মোরশেদ ও নিনা ভিসার ভুলেও লাশের দিকে চাইছে না। সবার চোখ বিশাল কালো স্পেসশিপের উপর। ওটার চারপাশে ঘুরেছে ওরা, কালো ধাতব ডানা স্পর্শ করেছে, উঁকি দিয়েছে ককপিট ক্যানোপির ধোঁয়াটে কাচের ভিতর দিয়ে।

উপর থেকে মাসুদ রানা জানিয়েছে, স্টেশনে আসছে ব্রিটিশ এসএএস কমাণ্ডো প্লাটুন। বাধ্য হয়ে সরে যেতে হচ্ছে ওদেরকে। এই খবর পাওয়ার পর দুটো ট্রাইপডে এমপি-৫ বসিয়েছে তিশা। অস্ত্রগুলো পুকুরের উপর তাক করা। এসএএস কমাণ্ডোরা উঠে এলে তাদেরকে অনায়াসেই শেষ করতে পারবে ওরা।

এসব কাজ শেষ হয়েছে আধ ঘণ্টা আগে।

উইলকক্স আইস স্টেশনে এলেও, এখানে আসতে দেরি হবে এসএএস কমাণ্ডোদের। ডাইভিং বেল নামাতে একঘণ্টা, আবার বরফের সুড়ঙ্গ দিয়ে উঠতে আরও একঘণ্টা।

এখন চুপচাপ অপেক্ষা। শুরু হয়েছে ধৈর্যের খেলা।

তিশা ট্রাইপড বসাবার পর আবারও স্পেসশিপ দেখতে গেছে ওয়াকার ও নিনা। তিশার সঙ্গে রয়ে গেছে মোরশেদ। কিন্তু কিছুক্ষণ পর সে-ও বিদায় নিয়েছে। অদ্ভুত সুন্দর, নিষ্ঠুর, কালো স্পেসশিপ ছুঁয়ে দেখবে।

অস্ত্রের পাশে রয়ে গেছে তিশা।

গুহার শীতল বরফ মেঝেতে বসে আছে, চোখ পুকুরের ওপাশে লাশগুলোর উপর। অবাক লাগছে ওর। কারা এভাবে খেয়ে ফেলল মানুষগুলোকে! ছিড়ে নিয়েছে মাথা-হাত-পা। কোথাও চিবিয়ে গুড়ো করেছে হাড়। চারপাশে চুলকে পড়েছে রক্ত।

কী এমন প্রাণী যেটা এদেরকে এভাবে মেরে ফেলল?

পুকুরের উপর দিয়ে লাশের দিকে চেয়ে আছে তিশা। পানির সামান্য উপরে বরফ-দেয়ালে গোল গর্ত, বিশাল। ব্যাসে হবে কমপক্ষে দশ ফুট। উঠে আসবার সময় পানির নীচে এমন আরও গর্ত দেখেছে। _ ওই মস্ত গর্তগুলো বা ক্ষতবিক্ষত লাশের দিকে চাইলে অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে তিশার। এই পাতাল-গুহা যেন ভীষণ অশুভ।

এককথায় অকল্পনীয়, বলল নিনা ভিসার। এইমাত্র তিশার পাশে এসে থেমেছে। ব্যস্ত হয়ে চোখের উপর থেকে সরিয়ে দিল। এক গোছা চুল। স্পেসশিপ নিয়ে খুব উত্তেজিত। 

কোথাও কোনও মার্কিং নেই, বলল। গোটা স্পেসশিপ কুচকুচে কালো।

নিনা ভিসারের কথা বা স্পেসশিপ নিয়ে ভাবছে না তিশা। এই পাতাল-গুহা নয়টি আধ-খাওয়া লাশ, স্টেশনে এসএএস প্লাটুন–এসব নিয়েই ওর চিন্তা। বারবার মন বলছে, আর কখনও উইলকক্স আইস স্টেশন থেকে জীবিত বেরুতে পারবে না ওরা।

এককথায় অকল্পনীয়! আবারও বলল নিনা ভিসার।

.

তুষার-ঝড়ের ভিতর আরেকটি ঝড়ের মতই উইলকক্স আইস স্টেশনে ঢুকে পড়েছে এসএএস কমাণ্ডে দল, দক্ষ, নির্মম।

অস্ত্র হাতে ঢুকেছে স্টেশনের ভিতর, জোড়া তৈরি করে ছড়িয়ে পড়েছে চারপাশে। প্রতিটি দরজা খুলে দেখছে, একটা ঘরও বাদ পড়ছে না।

এ-ডেক পরিষ্কার, একজন জানিয়ে দিল।

বি-ডেকও, জানাল আরেকজন।

এ-ডেকের ক্যাটওয়াকে থামল জুলিয়াস বি, গুণ্ডারসন। এখানে দাঁড়িয়ে পরিত্যক্ত স্টেশনে চোখ বোলাল। যেন কোনও রাজা, এইমাত্র দখল নিয়েছে নতুন রাজ্যের। শীতল চোখে স্টেশন দেখছে গুণ্ডারসন, সরু ঠোঁটে হাসি।

এসএএস ট্রুপ নেমে গেল ই-ডেকে। ওখানে খুঁটির সঙ্গে আটকে আছে পল সিংগার ও দুই ফ্রেঞ্চ বিজ্ঞানী। দুই এসএএস কমাণ্ডে এদেরকে কাভার করল। কালো পোশাক পরনে আরও কয়েকজন নামল রাং-ল্যাড়ার বেয়ে, ঢুকে পড়ল সুড়ঙ্গগুলোতে।

দক্ষিণ টানেলে ছুটে গেল চার এসএএস কমাণ্ডো। কিছু দূর গিয়ে বামের দরজা কাভার করল দুজন। অন্য দুজন ডানদিকের দরজা।–ডানদিকের দুজন লাথি দিয়ে খুলল দরজা, ভিতরে উঁকি দিল।

এটা গুদাম-ঘর। লড়বড়ে কাঠের শেলফ। মেঝেতে কয়েকটা স্কুবা ট্যাঙ্ক।

আর কিছুই নেই।

উদ্যত অস্ত্র হাতে টানেল ধরে সামনে বাড়ল তারা। কিছুটা যেতেই দেখল লিফট। টানেলের শীতল সাদা আলোয় চকচক করছে স্টিলের দুই কবাট।

সংক্ষিপ্ত শিস বাজাল এসএএস কমাণ্ডা নেতা, মনোযোগ আকর্ষণ করছে অন্যদের।

থমকে গেছে সবাই লিফটের কাছে। ওটার দিকে দুই আঙুল তাক করল দলনেতা।

পাশের দুজন সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পেরেছে। লিফটের দুপাশে সরে গেল তারা, নেতা এবং চতুর্থ লোকটা অস্ত্র তাক করেছে স্টেইনলেস স্টিলের দরজার উপর।

আস্তে করে মাথা দোলাল দলনেতা। দুপাশের দুজন ঝটকা দিয়ে খুলল লিফটের কবাট। ভিতরে ব্রাশ ফায়ার করল দলনেতা।

খালি লিফটের চারদেয়াল ছিড়েখুঁড়ে গেল।

.

এসএএস কমাণ্ডোরা গুলিবর্ষণ শুরু করতেই চোখ বুজে ফেলেছে নিশাত সুলতানা। ওর মাথার এক ফুট দূরে বিকট আওয়াজে গুলি চলছে।

লিফটের শাফটের নীচে একেবারে ঘুটঘুটে অন্ধকার। গুটিসুটি মেরে বসে আছে নিশাত। মাথার উপর লিফটের মেঝে।

এসএএস কমাণ্ডোদের গুলি থরথর করে কাঁপিয়ে দিচ্ছে ছোট্ট লিফট। ছিড়ছে দেয়াল, নানা দিকে তৈরি হচ্ছে গর্ত। ঝরঝর করে মাথার উপর পড়ছে ধুলো ও কাঠের চল্টা। চোখ বুজে চুপ করে রইল নিশাত।

গুলির বিকট আওয়াজে ঝনঝন করছে কান। হঠাৎ অন্য একটা চিন্তা এল ওর মনে।

এরা আবারও গুলি করছে স্টেশনের ভিতর।

তার মানে উধাও হয়েছে দাহ্য গ্যাস।

হঠাৎ করেই থেমে গেল গুলির আওয়াজ। ঘটাং করে বন্ধ হলো লিফটের দরজা! আবারও নীরবতা।

পাক্কা তিন মিনিট পর আবারও শ্বাস নিল নিশাত।

.

খাড়া ক্লিফের পাশ দিয়ে সঁই-সাই করে পড়ছে মাসুদ রানা ও রাশেদ হাবিব, কয়েক সেকেণ্ড পর ঝপাস্ করে নামল ক্ষ্যাপা সাগরে।

শরীরে কনকনে ঠাণ্ডা হাতুড়ির বাড়ি, কিন্তু পাত্তা দিল না রানা। শিরা-উপশিরার ভিতর প্রচুর অ্যাড্রেনালিন, কাজেই ওর শরীর যথেষ্ট উত্তপ্ত। বেশিরভাগ এক্সপার্ট বলেন: অ্যান্টার্কটিকার বরফ-ঠাণ্ডা এই পরিবেশে বড়জোর আট মিনিট বাঁচবে যে-কেউ। অবশ্য অ্যাড্রেনালিন ও থারমাল ওয়েটসুটের কারণে রানা ধরে নিয়েছে: ও বাঁচবে কমপক্ষে আধ ঘণ্টা।

পানির উপর ভেসে উঠতে চাইছে এখন। আঁকুপাঁকু করছে ফুসফুস, খুব জরুরি হয়ে উঠেছে বাতাস নেয়া। হঠাৎ করেই সাগর-সমতলে ভেসেও উঠল, এবং চমকে গেল ভীষণভাবে। আগে এত বড় ঢেউ দেখেনি। সোজা নেমে আসছে ওর উপর। প্রচণ্ড ধাক্কা খেয়ে আবারও ডুবে গেল রানা। ছিটকে পড়েছে পিছনের বরফ দেয়ালের উপর।

ফুসফুসের সব বাতাস ভুস করে বেরিয়ে গেছে, এখন আঁকড়ে আসতে চাইছে বুকের ভিতর।

কয়েক মুহূর্ত পর সরে গেল ঢেউ, রানা টের পেল, ও আছে বিশাল দুই ঢেউয়ের মাঝের খোড়লে। আবারও নীচে টেনে নেয়া হচেছ ওকে। এক সেকেণ্ড পর সাঁতরাতে লাগল। বড় করে শ্বাস নিল, দেখে নিতে চাইল চারপাশ।

সাগরে দানবীয় সব ঢেউ। একেকটা কমপক্ষে চল্লিশ ফুট উঁচু। ওর বিশ গজ ডানে ক্লিফের হাঁটুতে ভেঙে পড়ল প্রকাণ্ড এক ঢেউ। চারদিকে ভাসছে আইসবার্গ। কোনও কোনোটা উচ্চতা ও চওড়ায় বিশাল সব স্কাইস্ক্র্যাপারের বাড়া। বেশ কিছু আইসবার্গ দীর্ঘ ও চ্যাপ্টা, যেন ফুটবল মাঠ–উপকূল থেকে এক শ গজ দূরে। যেন নীরব প্রহরী, বরফের ক্লিফকে পালাতে দেবে না।

হঠাৎ করেই ওর পাশে ভুস্ করে ভেসে উঠল রাশেদ হাবিব। হাঁ করে দম নিচ্ছে বেঁটে বিজ্ঞানী। রানা ভাবতে শুরু করেছে, এই যম-শীতে কী হবে লোকটার! পরক্ষণে ওর মনে পড়ল, হাবিবের পরনে নিয়োপ্রেন বডিসুট। সে বোধহয় ওর চেয়ে অনেক আরামে আছে। আর বোঝাই যাচ্ছে, ভালই সাঁতার জানে হাজার হোক বাংলাদেশের গ্রামের ছেলে, মায়ের পেট থেকেই সাঁতার শিখে আসে।

প্রকাণ্ড এক ঢেউ আসছে ওদের দিকে।

ডুব দিন! সতর্ক করল রানা। বড় করে শ্বাস নিয়েই তলিয়ে গেল নিজেও। মুহূর্তে নীরব হয়ে গেল চারপাশ।

নীচের দিকে নামতে শুরু করেছে ও, একটু পর দেখল ওর পাশে সাঁতরে চলেছে হাবিব। ওদের মাথার উপরে বিস্ফোরণের আওয়াজ হলো, ক্লিফের উপর আছড়ে পড়েছে ঢেউ, চারপাশে ছড়িয়ে গেল সাদা ফেনা।

আবারও ভেসে উঠল রানা ও হাবিব।

উত্তাল সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছে ওরা, তারই ভিতর রানা দেখল পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে হোভারক্রাফটের আস্ত এক দরজা।

তীর থেকে সরে যেতে হবে, বলল রানা, নইলে বরফের দেয়ালে আছড়ে পড়ে মরব।

কিন্তু যাব কোথায়? জানতে চাইল হাবিব।

ওই যে, ওখানে, ক্লিফ থেকে দুই শ গজ দূরে মস্ত এক খণ্ড আইসবার্গ দেখাল রানা। ওটা কাত হয়ে যাওয়া বিশাল পিয়ানোর মত।

হ্যাঁ, দেখেছি।

ওখানেই যাব, বলল রানা।

ঠিক আছে।

এক থেকে তিন পর্যন্ত গুনব, তারপর রওনা হব।

তিন বলা শেষে বড় করে দম নিল ওরা, তারপর তলিয়ে গেল। ক্লিফ পিছনে ফেলে ব্রেস্টস্ট্রোক দিয়ে খোলা সাগরে চলেছে। ওদের মাথার উপর সসস্ আওয়াজ তুলছে সাদা ফেনা।

দশ গজ পেরিয়ে গেল। তারপর বিশ গজ।

বুক আঁকড়ে আসছে হাবিবের, ভেসে উঠল। বড় করে দম নিয়ে আবারও তলিয়ে গেল। একই কাজ করল রানা, দাঁতে দাঁত খিচে আবারও ডুবে গেল ঢেউয়ের নীচে। পাঁজরের ভাঙা হাড়ে ব্যথা শুরু হয়েছে, সেই সঙ্গে একটু পর পর তীক্ষ্ণ খোঁচা।

পঞ্চাশ গজ যাওয়ার পর আবারও ভেসে উঠল ওরা। পিছনে ফেলে এসেছে ক্লিফে আছড়ে পড়া ঢেউ। এবার নিশ্চিন্তে ফ্রিস্টাইলে এগুতে পারল। অবশ্য, বেয়ে উঠতে হচ্ছে কমপক্ষে চল্লিশ ফুট উঁচু ঢেউয়ের উপর।

আরও কিছুক্ষণ পর আইসবার্গের পায়ের কাছে পৌঁছে গেল ওরা। কাছ থেকে দেখে মনে হলো পাহাড়ের মত উঁচু, সাদা কোনও দেয়াল। কোথাও কোথাও নানা খাজ ও সুড়ঙ্গ! সব গেছে বরফের বুকে।

বিশাল আইসবার্গের পাশে তাক দেখা গেল। ওটা নেমে এসেছে সাগর-সমতলে। ওই, কার্নিসের দিকে চলল রানা ও হাবিব। কিন্তু কাছে পৌঁছে দেখল ওই তাক ওদের চেয়ে কমপক্ষে তিন ফুট উপরে।

বাঁদরের মত উঠে পড়ুন আমার কাঁধে, বলল রানা।

কথাটা মনে ধরেছে বেঁটে বিজ্ঞানীর, সঙ্গীর কাঁধে বাম পা রাখল, তারপর উঠে যেতে চাইল।

বরফের তাকের কিনারা ধরে ফেলল। বেকায়দাভাবে হাঁচড়েপাঁচড়ে উঠে গেল। তাকের পাশে শুয়ে পড়েছে, হাত বাড়িয়ে দিল রানাকে তুলে নেওয়ার জন্য।

পানির ভিতর লাফিয়ে উঠল রানা, খপ করে ধরে ফেলল হাবিবের কবজি। উঠে আসতে শুরু করেছে। প্রায় পৌঁছেই গেল তাকের কাছে, কিন্তু ঠিক তখনই পিছলে গেল বিজ্ঞানীর ভেজা কবজি। ঝপাস্ করে পড়ল রানা সাগরে।

তলিয়ে গেছে, চারপাশে শুধু নৈঃশব্দ্য। এখন বরফের ক্লিফের উপর দানব ঢেউয়ের আছড়ানোর আওয়াজ নেই। চোখে পড়ল সাদা আইসবার্গের পেট। সাগরের ধোঁয়াটে পরিবেশে অনেক নীচে নেমে হারিয়ে গেছে।

উঠে আসতে শুরু করেছে রানা, আর ঠিক তখনই শুনল আওয়াজটা। ঝট করে ঘুরে চাইল। জানে, পানির ভিতর খুব দ্রুত চলে আওয়াজ। ওর ভুল হওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই।

ভ-ম-ম-ম-ম-ম-ম-ম-ম-ম!

নিচু আওয়াজ। গুঞ্জনের মত। ভিমরুল এমন আওয়াজ করে।

ভ-ম-ম-ম-ম-ম-ম-ম-ম-ম!

ভুরু কুঁচকে ফেলল রানা। ওর মনে হয়েছে আওয়াজটা যান্ত্রিক। কোনও মোটোরাইড় দরজা খুললে এমন হয়। খুব কাছেই আওয়াজ হয়েছে।

ওর পিছনে।

চরকির মত ঘুরল রানা।

এবার দেখতে পেল।

প্রকাণ্ড! এতই বড়, লাফ দিল ওর হৃৎপিণ্ড। দ্রুত হয়ে উঠেছে হৃৎস্পন্দন

পানির ভিতর খাপ পেতে বসে আছে।

নীরব। বিশাল।

রানার একটু উপরে আইসবার্গের পাশে।

দৈর্ঘ্যে কমপক্ষে তিন শ ফুট। কালো আর গোল। কনিং টাওয়ারের দুপাশে দুটো স্ট্যাবিলাইজিং ফিন। সিলিণ্ডারের মত শরীরের শেষে গোলাকার নাক।

দৃশ্যটা দেখে দপদপ করতে শুরু করেছে রানার মাথা।

নিজের চোখ বিশ্বাস করতে দ্বিধা হচ্ছে।

চেয়ে আছে সাবমেরিনের দিকে।

দ্রুত হাত-পা নেড়ে উঠতে শুরু করেছে রানা। দশ সেকেণ্ড পর ভুস করে ভেসে উঠল। পাঠাগার ডট নেট থেকে ডাউনলোডকৃত। 

আইসবার্গের তাক থেকে জানতে চাইল হাবিব, আপনি ঠিক আছেন তো, ভাই?

না, ভাল নেই, বলল রানা। আবারও বড় করে দম নিয়ে তলিয়ে গেল।

খুব নীরব চারপাশ।

আগের চেয়ে নেমে এসেছে রানা, অবাক হয়ে দেখল সাবমেরিনটাকে। ওর থেকে তিরিশ গজ দূরে। স্বচ্ছ পানির ভিতর নিথর প্রকাণ্ড সাবমেরিন। যেন বিশাল কোনও শিকারী জানোয়ার।

কাদের, ভাবছে রানা। মন দিল সিগনেচার ফিচার খুঁজবার জন্য।

সরু কনিং টাওয়ার, বো-তে চারটে টর্পেডো পোর্ট। খুলতে শুরু করেছে একটা।

আবারও শোনা গেল: ভ-ম-ম-ম-ম-ম-ম-ম-ম-ম!

এবার বোর বামে কী যেন লেখা দেখল। তিনটি ভার্টিকাল, শাফট, তাতে ব্যবহার করা হয়েছে তিনটি রং। নীল-সাদা-লাল।

রানা চেয়ে আছে ফ্রেঞ্চ পতাকার দিকে!

দম ফুরিয়ে যেতেই উঠে যেতে লাগল ও, একটু পর ভেসে উঠল।

তাক থেকে চেয়ে ছিল রাশেদ হাবিব, রানাক দেখেই বল, আপনি ওখানে কী করছেন, ভাই?

জবাব দিল না রানা, বদলে হাত তুলে ঘড়ি দেখে নিল।

স্টপওয়াচ জানিয়ে চলেছে:

২:৫৭:৫৯

২:৫৮:০০

২:৫৮:০১

সর্বনাশ! বিড়বিড় করল রানা। হোভারক্রাফট নিয়ে নানা দিকে ছুটবার সময় একদম ভুলে গিয়েছিল উপকূলের কাছেই থাকবে ফ্রেঞ্চ রণতরী। ওখান থেকে মিসাইল ফেলা হবে উইলকক্স আইস স্টেশনের উপর। এই সাবমেরিনের কোডনেম: কিলার ওয়েইল!

রানা ভুল ভেবেছে। ধরেই নিয়েছিল কিলার ওয়েইল কোনও ফ্রেঞ্চ রণতরী। কিন্তু তা নয়, কিলার ওয়েইল আসলে ফ্রেঞ্চদের সাবমেরিন!

আমাকে টেনে তুলুন, বলল রানা।

তাক থেকে হাত বাড়িয়ে দিল রাশেদ হাবিব। এবার শক্ত করে তার কবজি ধরল রানা, দ্রুত উঠবার চেষ্টা করল। দেড় ফুট উঠবার পর বামহাতে খপ করে ধরল তাকের কিনারা। কয়েক সেকেণ্ড পর উঠে এল কার্নিসে।

রাশেদ হাবিব ভেবেছিল ওর মতই চুপ করে শুয়ে থাকবে রানা, কিন্তু তা না করে লাফিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে।

অবাক হয়ে চেয়ে রইল হাবিব। পাগলাটে লোকটা ঝেড়ে দৌড় শুরু করেছে। ছুটছে আইসবার্গের আরও চ্যাপ্টা দিকে।

খুবই বিরক্ত হলো হাবিব, কিন্তু উঠে দাঁড়িয়ে পিছু নিল। বরফের স্তৃপ টপকে গেছে রানা, চলেছে তিরিশ গজ দূরের কিনারা লক্ষ্য করে। ওদিকের মেঝে ধীরে ধীরে উপরে উঠেছে। ওপাশে আর কিছু দেখল না হাবিব।

খাড়াই বেয়ে ছুটছে মাসুদ রানা। পিছনে ছুটে চলেছে হাবিব। ওদিকে চেয়ে ভাল লাগছে না ওর। ওখানে বরফের খাড়া দেয়াল নেমেছে তিরিশ ফুট নীচের সাগরে। আর উন্মাদ লোকটা আইসবার্গে উঠেও আবার ঝাপিয়ে পড়েছে হিমশীতল সাগরে!

.

ছুটর ফাঁকে স্টপওয়াচ দেখেছে রানা। টিপটিপ করে তিন ঘণ্টার দিকে চলছে ডিজিটাল ঘড়ি।

একটু পরই মিসাইল ছোঁড়া হবে!

২:৫৮:৩১

২:৫৮:৩২

২:৫৮:৩৩

ঝেড়ে দৌড় দেয়ার সময় ভাবতে শুরু করেছে রানা: এরা উড়িয়ে দেবে উইলকক্স আইস স্টেশন! মেরে ফেলবে ওর দলের সবাইকে! ছোট্ট মেয়েটাও মরবে! থামাতে হবে এদেরকে!

কিন্তু কীভাবে?

একজন মাত্র লোক কীভাবে ধ্বংস করবে সাবমেরিন?

তারপর হঠাৎ করেই বুঝতে পারল একটা বিষয়।

দৌড়ের উপর হোলস্টার থেকে তুলে নিয়েছে ম্যাগহুক, এম লেখা বাটনে চাপ দিয়েছে। ম্যাগহুকের ম্যাগনেটিক্যালি চার্জড় হেড-এ জ্বলে উঠেছে লাল বাতি।

থাই পকেট থেকে বের করেছে রুপালি ক্যানিস্টার। সবুজের ব্যাণ্ডে লেখা: ট্রাইটোনাল ৮০/২০। একবার ওটা দেখে নিয়েছে রানা। সামান্য ঘুরিয়ে নিয়েছে স্টেইনলেস স্টিলের ঢাকনি। হুশ আওয়াজ হয়েছে। খুলে গেছে ঢাকনি, ভিতরে পরিচিত ডিজিটাল টাইমার ডিসপ্লে। পাশেই আর্ম-ডিযআর্ম সুইচ। ট্রাইটোনাল ডেমোলিশন ডিভাইস, যে-কোনও সময়ে ডিআর্ম করা যায়।

বিশ সেকেণ্ড, ভেবেছে রানা। এরই ভিতর সরতে হবে ওকে।

ট্রাইটোনাল চার্জে বিশ সেকেণ্ডের জন্য টাইমার স্থির করেছে, তারপর ক্যানিস্টার বসিয়ে নিয়েছে ম্যাগহুর্কের মুখে বাবের মত ম্যাগনেটিক হেডে। শক্তিশালী চুম্বকে ঠক্ শব্দে আটকে গেছে ক্যানিস্টার।

এবড়োখেবড়ো জমি, প্রাণপণে দৌড়েছে রানা, তারপর পৌঁছে গেছে কিনারার কাছে, কোনও দ্বিধা না করেই উড়াল দিয়েছে। আকাশে ভেসে ছিল তিন সেকেণ্ড, তারপর ঝুপ করে পড়েছে সাগরে। পা নীচে রেখে নেমেছে। থরথর করে কেঁপে উঠেছে শীতে।

এই মুহূর্তে ওর চারপাশে অসংখ্য বুদ্বুদ। কয়েক সেকেণ্ড কিছুই দেখল না রানা, তারপর হঠাৎ সরে গেল সব বুদ্বুদ। টের পেল, ইস্পাতের বিশাল সাবমেরিনের নাকের সামনে হাজির হয়েছে।

চট করে ঘড়ি দেখল রানা।

২:৫৮:৫৯.

২:৫৯:০০

২:৫৯:০১

আর মাত্র একমিনিট!

পুরোপুরি খুলে গেছে টর্পেডো টিউবের দরজা। ওটার দিকে রওনা হয়ে গেল রানা। দশ গজ দূরে হাঁ হয়েছে টর্পেডো টিউব।

আশা করা যায় কাজ হবে, ভাবল, রানা। তুলে ধরেছে ম্যাগহুক। ওটার নাকে ট্রাইটোনাল চার্জ। আর্ম সুইচ টিপে দিল।

বিশ সেকেণ্ড পর ফাটবে বোমা।

দেরি না করে ম্যাগহুক ফায়ার করল রানা।

লঞ্চার থেকে ছিটকে বেরুল ম্যাগহুক, ওটার পিছনে ছুটল সাদা বুদ্বুদ। খোলা, টর্পেডোর দরজা লক্ষ্য করে পানির ভিতর মসৃণভাবে চলেছে হুক।

এক সেকেণ্ড পেরুবার আগেই টর্পেডো পোর্ট থেকে সামান্য নীচে স্টিলের হালে ঠং করে লাগল ম্যাগনেটিক হেড। ওটার সঙ্গে তাজা ট্রাইটোনাল চার্জ। কিন্তু পুরু ইস্পাতের খোল থেকে ছিটকে গেল ম্যাগনেটিক হেড। খুব ধীরে তলিয়ে যাচ্ছে।

হতভম্ব হয়ে গেল রানা। টার্গেটে লাগাতে পারেনি।

ওর মন চাইল, পানির নীচে চিকার করে নিজেকে গালি দিতে। এক সেকেণ্ড পর অন্য চিন্তা এল।

সাবমেরিনের ভিতরের লোকগুলো শুনেছে ধাতব আওয়াজ।

আধ সেকেণ্ড পর গ্রিপের কালো বাটন টিপল রানা, রিল করে আনছে ম্যাগনেটিক হেড। আশা করল, ওটা দ্রুত ফিরবে, নইলে ফুরাবে সময়… বিস্ফোরিত হবে ট্রাইটোনাল!

আরেকবার ম্যাগহুক ছুড়তে পারবে?

আর মাত্র একবার!

এক সেকেণ্ড পর শব্দটা পেল রানা।

ভূ—-ম!

ওর বামে সাবমেরিনের বো-র পাশে খুলে যাচ্ছে আরেকটা টর্পেডো ডোর!

আগে যেটার দিকে তাক করেছিল, তার চেয়ে এটা ছোট।

ছোট টর্পেডো, ভাবল রানা। এগুলো দিয়ে উড়িয়ে দেয় শত্রু সাবমেরিন।

মাত্র কথাটা ভেবেছে রানা, এমন সময় হঠাৎ জোরালো হুউইস! আওয়াজ পেল। নতুন পোর্ট থেকে বেরিয়েছে টর্পেডো! ঘুরতে ঘুরতে আসছে ঠিক ওর দিকেই!

অবাক হলো রানা, ওকে মারতে টর্পেডো ছেড়েছে ফ্রেঞ্চরা!

লঞ্চারে ফিরে এসেছে ম্যাগহুক, চট করে ট্রাইটোনালের আর্মডিআর্ম সুইচ টিপে দিল রানা। বাকি ছিল মাত্র চার সেকেণ্ড। ঠিক তখনই ওর কোমর পাশ কাটিয়ে চলে গেল টর্পেডো। ওটার জোরালো ঢেউ ওকে একবার ডিগবাজি করিয়ে দিয়ে গেছে।

আস্তে করে বুদ্বুদ ছাড়ল রানা। টর্পেডো এতই কাছে, ওর উপর লক করতে পারেনি। পরক্ষণে ওর পিছনে আইসবার্গে গিয়ে লাগল টর্পেডো, সঙ্গে সঙ্গে ডেটোনেট হলো।

.

আইসবার্গের কিনারে দাঁড়িয়েছে রাশেদ হাবিব, চোখ রেখেছে পানির দিকে, আর ঠিক তখনই বিশ গজ দূরে বিস্ফোরিত হলো টর্পেডো।

এক সেকেণ্ড আগে আইসবার্গের ওদিকটা জমাট ছিল, কিন্তু পর মুহূর্তে সাদা ভূমিধসের মত ঝরঝর করে নামল সাগরে বরফ। যেন খামচি দিয়ে নিয়ে গেছে আইসবার্গের বড় এক অংশ।

খাইসে! বড় করে শ্বাস নিল রাশেদ হাবিব।

তখনই আইসবার্গ থেকে বিশ গজ দূরে রানাকে দেখল। বড় করে দুবার শ্বাস নিল উন্মাদ লোকটা, আবারও তলিয়ে গেল।

.

টর্পেডো বিস্ফোরিত হওয়ার আওয়াজ এখনও মিলিয়ে যায়নি, বড় একটুকরো আইসবার্গ ঝরে পড়েছে পিছন সাগরে। ওদিকে ফিরেও চাইল না রানা, আবারও তাক করেছে ম্যাগহুক। এবার ভুল করলে চলবে না।

২:৫৯:৩৭

২:৫৯:৩৮

২:৫৯:৩৯

নতুন করে আর্ম সুইচ টিপল রানা, আবারও বিশ সেকেণ্ডের জন্য ট্রাইটোনাল চার্জ তৈরি হয়ে গেল।

পানির ভিতর দিয়ে ছুটে গেল ম্যাগহুক।

মনে হলো দীর্ঘ সময় ধরে ছুটে চলেছে।

তারপর হঠাৎ করেই ঢুকে গেল টর্পেডো পোর্টের ভিতর।

হ্যাঁ!

গ্রিপে এম বাটন টিপল রানা, টর্পেডো পোর্টের ভিতর সাড়া দিল ম্যাগনেটিক হেড। খসে পড়ল রুপালি ট্রাইটোনাল চার্জ। ম্যাকহুক রিল করতে শুরু করেছে রানা, তারই ফাঁকে ঘুরে গেল। মনে মনে বলল, এবার পালাও, বাপু!

প্রাণপণে সাতরাতে শুরু করেছে।

.

ফ্রেঞ্চ সাবমেরিনের টর্পেডো রুমে থমথমে নীরবতা। তরুণ এক এনসাইন কাউন্টডাউন করছে।

প্রাইমারি লঞ্চ আর বিশ সেকেণ্ড, বলল। ইরেজার হিসাবে রাখা হয়েছে নেপচুন-ক্লাস নিউক্লিয়ার টিপড টর্পেডো।

উনিশ… আঠারো… সতেরো…

.

আইসবার্গের কোলে রাশেদ হাবিব দেখল, এইমাত্র ভেসে উঠেছে মাসুদ রানা, অলিম্পিকের সেরা সাঁতারু মাইকেল ফেলপসের গতি তুলে তীরবেগে সাঁতরে আসছে হিমশৈলর দিকে। একহাতে উঁচু করে রেখেছে ম্যাগহুক।

.

ফ্রেঞ্চ নাবিক কাউন্টডাউন করছে: দশ… নয়… আট… সাত…

.

রানা বোধহয় ডলফিনদেরও হারিয়ে দেবার প্রতিযোগিতায় নেমেছে। ঝপাঝপ পড়ছে হাত। প্রবলভাবে নড়ছে পাদুটো। সাবমেরিন থেকে সরতে হবে! ট্রাইটোনাল চার্জ থেকে অনেক দূরে। ইমপ্লোশন ওকে টেনে নেবে নিজের দিকে। দশ গজ দূর থেকে ট্রাইটোনাল ফায়ার করেছে, এখন সরে এসেছে বিশ গজ দূরে। আঁচ করছে, আরও পাঁচ গজ গেলে নিরাপদ দূরত্বে সরে আসতে পারবে।

আইসবার্গ থেকে চিৎকার করল হাবিব, ভাইরে, কী হয়েছে আপনার? পাগল হয়ে গেলেন কেন!  

কিনারা থেকে সরুন! পাল্টা চেঁচাল রানা। পালান!

.

পাঁচ… চার… তিন…

কিন্তু দুই আর বলতে পারল না ফ্রেঞ্চ এনসাইন।

কারণ, ঠিক তখনই টর্পেডো টিউবের ভিতর বিস্ফোরিত হলো ট্রাইটোনাল চার্জ।

.

রাশেদ হাবিব যেখানে দাঁড়িয়েছে, ওখান থেকে দেখবার মত হলো। বিস্ফোরণটা। তার চেয়ে বড় কথা, এমন কিছুর জন্য সে তৈরি ছিল না।

পানির নীচে কালো কী যেন। ওখান থেকে হঠাৎ করেই ছিটকে উঠল সাদা মুস্ত মেঘ। কমপক্ষে পঞ্চাশ ফুট উপরে উঠল বিপুল পানি, দুই শ ফুট উপরে উঠেছে সাদা ফোয়ারা, ধীরে ধীরে পড়তে লাগল নীচে।

.

পানি-সমতলে রানা দেখল নীচ থেকে উঠে আসছে বিশাল সব নীল বুদ্বুদ। ওসব এসেছে সাবমেরিনের বো-র মস্ত গর্ত থেকে। অসংখ্য শুড় তৈরি হলো, যেন টেনে নেবে ওকে। তারপর হঠাৎ করেই তীব্র গতি তুলে বুদ্বুদগুলো ফিরতে লাগল সাবমেরিনের বুকে। রানার মনে হলো হ্যাঁচকা টান দিয়ে ওকে পিছিয়ে নিয়ে চলেছে কিছু।

ইমপ্লোশন।

ঠিক তখন বিশাল অ্যালিউমিনিয়ামের ক্যানের মত চুপসে গেল প্রকাণ্ড ফ্রেঞ্চ সাবমেরিন। মুহূর্তে চিড়ে-চ্যাপ্টা হলো সব। হঠাৎ রানা টের পেল, ওকে আর টানছে না পিছনের পানি। শিথিল করল হাত-পা, চুপ করে ভেসে রইল। নীচে আর কোনও সাবমেরিন নেই।

এর দুই মিনিট পর রানাকে টেনে তুলল রাশেদ হাবিব আইস বার্গের উপর।

বরফে সটান হয়ে শুয়ে পড়ল রানা, রেসের ঘোড়ার মত ফেস-ফেঁস শ্বাস ফেলছে।. ভিজে চুপচুপে, থরথর করে কাঁপছে শীতে। পরিশ্রমে ঘুমিয়ে পড়তে ইচ্ছা হলো ওর। তখনই মনে পড়ল: ফ্রেঞ্চ সাবমেরিন নেই, কিন্তু ওরা আছে আইসবার্গে। একটু পর হাইপোথারমিয়া ধরবে। এখন বিশ্রাম নেয়ার উপায় নেই।

০৯.

ওয়াশিংটন ডি.সি.।

ক্যাপিটল বিল্ডিং। নতুন করে আবারও শুরু হয়েছে ন্যাটো কনফারেন্স।

ইউএস রিপ্রেসেন্টেটিভ জ্যাক মার্টিন হেলান দিলেন চেয়ারে। মনোযোগ দিয়ে দেখছেন ফ্রেঞ্চ ডেলিগেশনের নেতা জঁ পিয়েরে কুই-কে। বক্তৃতা দিতে উঠে দাঁড়িয়েছে লোকটা।

সহ ডেলিগেটস, লেডিজ অ্যাণ্ড জেন্টলমেন, শুরু করল কুই, দ্য রিপাবলিক অভ ফ্রান্স আপনাদেরকে জানিয়ে দিতে চায়, সে তার পূর্ণ সমর্থন নিয়ে নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজেশনের পাশেই থাকবে। এই মহৎ সংগঠন প্রায় ষাট বছর ধরে পশ্চিমকে রক্ষা করছে। মহান ফ্রান্স আরও জানাতে চায়…

বকবক করছে লোকটা: সংগঠন হিসাবে ন্যাটোর তুলনা নেই, আর এই সংঘের সদস্য হতে পেরে ফ্রান্স গর্বিত। আস্তে করে মাথা নাড়লেন মার্টিন। সারা সকাল ধরে বিরতি নিয়েছে ফ্রেঞ্চ ডেলিগেটরা, বারবার সময় নিয়েছে, আর এখন হঠাৎ করেই বলতে শুরু করেছে, ন্যাটোর অসাধারণ সুকীর্তির জন্য ওরা কৃতজ্ঞ।…এর কোনও অর্থ হয়?

বক্তৃতা শেষে বসে পড়ল জ্যাঁ পিয়েরে কুই। এরিক হোমসের দিকে ঘুরে চাইলেন মার্টিন, কোনও মন্তব্য করবেন, তার আগেই চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়ালেন ব্রিটিশ ডেলিগেশনের নেতা সত্যিকারের ভদ্রলোক জর্জ মানরো, পরিশিলিত কণ্ঠে বললেন, লেডিজ অ্যাণ্ড জেন্টলমেন, আপনাদেরকে বিরক্ত করবার জন্য দুঃখিত, কিন্তু ব্রিটিশ ডেলিগেশনের তরফ থেকে আমি কিছুটা বিরতি প্রার্থনা করছি।

.

ক্যাপিটল বিল্ডিং থেকে সামান্য দূরে, উল্টো দিকে লাইব্রেরি অভ কংগ্রেস দালানের এইট্রিয়ামে ঢুকেছে সান্তা ক্যাসেডিন। তিনটি দালান নিয়ে তৈরি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় গ্রন্থাগার এটা। এর একমাত্র কাজ সব ধরনের বই সংগ্রহ করা, এবং তা বিপুল পাঠককে পড়তে দেয়া।

এখন বই পড়তেই এসেছে সান্থা। ওর দরকার রহস্যময় প্রিলিমিনারি সার্ভে নামের বইটি। ওটা প্রকাশ করা হয় ঊনিশ শ আটাত্তর সালে। লেখক ছিলেন শ্যারন স্টোন। আশা করা যায় বইটি এখানে পাওয়া যাবে।

এনকোয়ারি ডেস্কে অপেক্ষা করছে সান্থা। একটু আগে লাইব্রেরির এক অ্যাটেণ্ড্যান্ট গেছে বইটি খুঁজে আনতে।

লাইব্রেরি অভ কংগ্রেস ক্লোজড়-স্ট্যাক গ্রন্থাগার। এখানে বই খুঁজবার উপায় নেই, আপনাকে নির্দিষ্ট বই এনে দেবে কর্মচারী। এটা নন-সারকুলেটিং লাইব্রেরি, আপনি চাইলে বই বাড়িতে নিয়ে যেতে পারবেন না, গ্রন্থাগারের ভিতর বসে পড়তে হবে।

দশ মিনিটের বেশি পেরিয়ে গেছে, এখনও ফিরে আসেনি অ্যাটেণ্ড্যান্ট। লাইব্রেরিতে আসবার পথে একটা বই কিনেছে সান্থা, এখন ওটা নাড়াচাড়া করছে।

আবারও কাভারের দিকে চাইল:

দ্য আইস ক্রুসেড:

রিফ্লেকশন অন এ ইয়ার স্পেন্ট ইন
অ্যান্টার্কটিকা

ডক্টর, নিনা ভিসার
এসোশিয়েট প্রফেসর অভ জিয়োফিক্সি,
হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি

সূচনা পড়তে শুরু করেছে সান্থা ক্যাসেডিন।

শুরুতেই লেখিকা প্রশংসা করেছেন হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির জিয়োফিযিক্স ফ্যাকালটির হেড মরিস ভিসারের। আইস কোরের উপর বিপুল রিসার্চ করেছেন উনি।

এপর্যন্ত পড়ে ভুরু কুঁচকে ফেলল সান্থা। মরিস ভিসার বোধহয় লেখিকার বাৰা অথবা স্বামী! আবার পড়তে লাগল সান্থা।

মরিস ভিসারই প্রথম অ্যান্টার্কটিকার আইস শেলফ থেকে সিলিখ্রিক্যাল আইস কোর তুলে আনার উপর জোর দেন। তিনি বলেন, আইস কোরের ভিতর আমরা পেতে পারি লক্ষ লক্ষ বছর আগের আটকা পড়া বাতাস।

প্রথম অধ্যায়ে চলে গেল সান্থা:

বলা হয়েছে, আইস কোর বিষয়ে গবেষণা করলে বৈশ্বিক উষ্ণতা, গ্রিনহাউস এফেক্ট ও দ্রুত মিলিয়ে যাওয়া ওজন লেয়ারের ব্যাখ্যা মিলতে পারে।

লেখিকার কলমে আবারও এসেছে মরিস ভিসারের কথা। উনি উনিশ শ চুরানব্বই সালে পুরো বছর কাটান অ্যান্টার্কটিকায়, এক দুর্গম এলাকা থেকে সংগ্রহ করেন আইস কোর।

ওই রিসার্চ স্টেশনের নাম: উইলকক্স আইস স্টেশন।

স্টেশনের ল্যাটিচুড–৬৬.৫° এবং লংগিচুড ১১৫° ২০ ১২।

কেউ সামনে হাজির হয়েছে টের পেয়ে বই থেকে মুখ তুলল সান্থা। অ্যাটেণ্ড্যান্ট চলে এসেছে।

কিন্তু তার হাত খালি।

ওখানে বইটা নেই, আস্তে করে মাথা নাড়ল মেয়েটি।

নেই?

তিনবার দেখেছি, বলল অ্যাটেণ্ড্যান্ট। ওই তাকে নেই। প্রিলিমিনারি সার্ভে। লেখিকা শ্যারন স্টোন। বই বের হয়েছে ১৯৭৮ সালে। সরিয়ে ফেলেছে কেউ।

ভুরু কুঁচকে গেল সান্থার। এমন হওয়ার কথা নয়।

অ্যাটেণ্ড্যান্ট তরুণী মেয়েটির ব্যাজে ওর নাম লেখা: ক্যারল কনোরি। আস্তে করে কাঁধ ঝাঁকাল সে। নেই তো নেই! মেরে দিয়েছে কেউ।

একটা কথা মনে পড়তেই উত্তেজিত হয়ে উঠল সান্থা।

এমন কি হতে পারে এই মুহূর্তে বইটা পড়ছে কেউ? জানতে চাইল।

মাথা নাড়ল মেয়েটা। না। কমপিউটার বলছে: শেষবার ওটা ধার নেয়া হয়েছে ঊনিশ শ উনআশির নভেম্বরে।

উনিশ শ ঊনআশির নভেম্বরে, বিড়বিড় করল সান্থা।

একেবারে ভুতুড়ে কাণ্ড, বলল ক্যারল। ওর বয়স হবে বড়জোর বিশ। কলেজে পড়ে। যে লোক বই নিয়েছে, তার নাম টুকে এনেছি। ভাবলাম আপনার লাগতে পারে। কাগজের স্লিপ বাড়িয়ে দিল সে।

ওটা রিকোয়েস্ট ফর্মের ফটোকপি। ঠিক এমনই একটা ফর্ম পূরণ করে জমা দিয়েছে সান্থা, নইলে প্রিলিমিনারি সার্ভের বইটা দেয়া হবে না। লাইব্রেরি অভ কংগ্রেসের প্রতিটি ফর্ম রাখা হয় ফাইলে। এধরনের পরিস্থিতি হতে পারে ভেবেই বোধহয় এই ব্যবস্থা।

রিকোয়েস্ট ফর্মে নেম ভি পার্সন রিকোয়েস্টিং আইটেম-এ

ট্রেভল রয়েস।

মাঝে মাঝে এমন হয়, আস্তে করে মাথা নাড়ল অ্যাটেণ্ড্যান্ট মেয়েটি। ওই ট্রেভলের বোধহয় বইটা এতই পছন্দ, চুরি না করে পারেনি। কোটের পকেটে রেখে বেরিয়ে গেছে। আগে আমাদের বইয়ে ম্যাগনেটিক ট্যাগ থাকত না। গার্ডদের ফাঁকি দিয়েছে সহজেই।

মেয়েটার কথায় মন নেই সান্থার।

চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। হাতে রিকোয়েস্ট ফর্ম। তিরিশ বছরের বেশি ধরে এই কাগজ পড়ে ছিল লাইব্রেরি অভ কংগ্রেসের কোনও কেবিনেটে। প্রমাণ হিসাবে রয়ে গেছে।

জ্বলজ্বল করে উঠল সান্তা ক্যাসেডিনের দুই চোখ। মনে মনে বলল, আমি আপনাকে খুঁজে বের করব, ট্রেভল রয়েস!

ও জানে না, কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে সাপ বের করবে।

অফিসে ফিরে পরবর্তী দেড় ঘণ্টা পুরনো ফোন ডিরেক্টরি ঘাটাঘাটি করল সান্থা। বেশ কয়েকজন ট্রেভল রয়েসকে পেল। এদের প্রায় সবাই সাধারণ লোক। এক এক করে খোঁজ নিতে। শুরু করল ও। একজনকে উপযুক্ত মনে হলো ওর।

সান্থার জানা নেই, ১৯৮০ সালে নিউ ইয়র্ক থেকে ফকম্যান পাবলিকেশন প্রকাশিত উইলিয়াম সিলভারম্যানের দ্য পেন্টাগন অ্যাণ্ড অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বইয়ে রয়েছে এক ট্রেভল রয়েস, ইনিই ফোন ডিরেক্টরির গুরুত্বপূর্ণ সেই সরকারি কর্মকর্তা।

পরের পনেরো মিনিটে কয়েক জায়গায় ফোন করল সান্থা, কোনও তথ্য পেল না। এবার ওর এক পাগলি বান্ধবীকে ফোন দিল। এই মেয়ে আমেরিকান পলিটিক্স-এ এম.এ. করেছে হার্ভার্ড থেকে। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে সে জানাল, সান্থা যে ট্রেভল রয়েস সম্পর্কে তথ্য চাইছে, তা পাবে ইয়া মোটা এক বইয়ে।

বান্ধবীকে ধন্যবাদ দিয়ে ফোন রেখে অল স্টেটস লাইব্রেরির সাইটে গিয়ে দ্য পেন্টাগন অ্যাও অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বইটি বের করল সান্থা। পড়তে শুরু করে একটু পর বিরক্ত হয়ে সার্চ দিল–ট্রেভল রয়েস নাম খুঁজে নেয়ার জন্য।

তিন সেকেণ্ড পর স্ক্রিনে ভেসে উঠল ওই বইয়ের ষষ্ঠ অধ্যায়: দ্য পেন্টাগন!

শুরুতেই দেখা গেল ট্রেভল রয়েসের বিষয়ে লেখা:

..কেউ তাদের কোনও বইয়ে উল্লেখ করেননি, তাঁর মিলিটারি অ্যাডভাইজারদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল রিচার্ড নিক্সনের। বিশেষ করে এয়ার ফোর্সের কর্নেল ট্রেভল রয়েস… (পৃষ্ঠা–একাশি)।

 …ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারি শেষে কেউ বলতে পারেনি কর্নেল ট্রেভল রয়েস এসবের সঙ্গে জড়িত ছিল। উনি জয়েন্ট চিফস অভ স্টাফের সঙ্গে নিক্সনের লিয়াজো রক্ষা করতেন। নিক্সন যখন বাধ্য হয়ে অবসর নিলেন, ততদিনে ট্রেভল পূর্ণ কর্নেল। তিনিই ছিলেন রিচার্ড নিক্সনের দুই কান।

এটা অবিশ্বাস্য মনে হয়, নিক্সন ১৯৭৪ সালে অবসর নেয়ার পর ট্রেভল রয়েসকে আইনী সমস্যার ভিতর পড়তে হয়নি। এরপর প্রেসিডেন্ট ফোর্ড ও কার্টারের আমলে জয়েন্ট অভ স্টাফের সঙ্গে প্রেসিডেন্টের লিয়াজো অফিসার ছিলেন। খুব ঠাণ্ডা মগজের লোক, সবসময় নিজেকে গুটিয়ে রাখতেন। ১৯৭৯ সালে হঠাৎ করেই তার পদ খালি হয়ে যায়।

কার্টার অ্যাডমিনিস্ট্রেশন থেকে এর কোনও ব্যাখ্যা দেয়া হয়নি। ট্রেভল রয়েস অবিবাহিত, অনেকের ধারণা সমকামী ছিলেন। আরলিংটনে মিলিটারি অ্যাকাডেমিতে একা বাস করতেন। এমন কেউ নেই যে বলবে ট্রেভল রয়েস ছিলেন তার বন্ধু। প্রায়ই আমেরিকা ছেড়ে চলে যেতেন। কখনও জানা যায়নি গন্তব্য। এরপর ১৯৭৯ সালের ডিসেম্বরে হঠাৎ করেই সহকর্মীরা টের পেলেন, উনি তাঁদের সঙ্গে অফিস করছেন না।

তার খোঁজ পড়ল, কিন্তু আর কখনও ফিরলেন না ট্রেভল রয়েস… (পৃষ্ঠা–৮৬)

.

ব্রিটিশ কমাণ্ডার মেজর জেনারেল জুলিয়াস বি. গুণ্ডারসন এসে দাঁড়িয়েছেন উইলকক্স আইস স্টেশনের পুল ডেকে। একঘণ্টার একটু বেশি হলো দখল করে নিয়েছেন এই স্টেশন। পুরোপুরি আত্মবিশ্বাসী একজন মানুষ।

বিশ মিনিট আগে স্টেশনের ডাইভিং বেল করে পুরো সশস্ত্র কয়েকজন ডুবুরিকে পাঠিয়ে দিয়েছেন নীচে। অবশ্য, আরও নব্বই মিনিট পর পাতাল-গুহায় পৌঁছবে তারা। এখনও পুলের ভিতর সরসর করে নেমে চলেছে কেবল।

গুণ্ডারসন নিজেও কালো থারমাল ওয়েটসুট পরেছেন। ঠিক করেছেন, দ্বিতীয় দলের সঙ্গে পাতাল-গুহায় নামবেন, নিজ চোখে দেখবেন ওখানে কী আছে।

গানারি সার্জেন্ট ভাইপার ও দুই বিজ্ঞানীকে দেখে বললো, বেশ, তো এঁরা কারা? হাসি-হাসি হয়ে গেল মুখ। বাহ্, খুব খুশি হলাম, গানারি সার্জেন্ট পল সিংগার দেখছি!

অবাক হয়েছে ভাইপার। ভাবতে পারেনি ব্রিটিশ কমাণ্ডার ওকে চিনতে পারবে।

গানারি সার্জেন্ট পল সিংগার, বললেন গুণ্ডারসন। জন্ম বস্টনে, উনিশ শ তেয়াত্তর সালে। একানব্বই সালে ইউনাইটেড স্টেটস মেরিন কর্পসে যোগ দাও আঠারো বছর বয়সে; স্মল আর্মস এক্সপার্ট; হ্যাণ্ড টু হ্যাণ্ড কমব্যাট এক্সপার্ট; স্নাইপার। দুই হাজার দুই সালে ব্রিটিশ ইন্টেলিজেন্স প্রথম সন্দেহ করে, তুমি আমেরিকান স্পাই এজেন্সি ইন্টেলিজেন্স কনভার্জেন্স গ্রুপের সঙ্গে জড়িত।

মনে নেই আমার, কী নামে যেন ডাকে তোমাকে? …ভাইপার, তাই না? আমাকে বলল দেখি, বিষাক্ত সাপ, মাঝে মাঝেই এ ধরনের বিপদে পড়ো? দেখা যাচ্ছে, তোমার কমাণ্ডিং অফিসার তোমাকে খুঁটির সঙ্গে আটকে রেখে গেছে। কেন? কেন সে শত্রুর মুখে তোমাকে এভাবে ফেলে গেল?

কোনও জবাব দিল না ভাইপার।

আমার মনে হয়নি মাসুদ রানা এমন লোক, বিশ্বস্ত অনুচরকে ফেলে পালাবে, বললেন গুণ্ডারসন। নিশ্চয়ই এর কোনও ব্যাখ্যা আছে? আবারও হেসে ফেললেন তিনি। এবার বলো দেখি কারণটা।

কোনও জবাব দিল না সিংগার।

বারবার গুণ্ডারসনের পিছনে ডাইভিং বেলের কেবলের উপর চলে যাচ্ছে ওর চোখ।

ফ্রেঞ্চ বিজ্ঞানীদের দিকে মনোযোগ দিলেন গুণ্ডারসন। আর আপনারা যেন কারা?

মেজাজি ভঙ্গি নিয়ে বলল ম্যাথিউ ফ্যনুয়্যা, আমরা রিসার্চ স্টেশন ডুমো ডিখ-ঈলেখের বিজ্ঞানী। ইচ্ছার বিরুদ্ধে আমাদেরকে আটকে রেখেছে কোথাকার কে এক মেজর মাসুদ রানা। আমি দাবি করছি আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী…

মিস্টার বোউলস্…।

কথাটা শেষ হলো না, তার আগেই বিশালদেহী বোউলস পিস্তল উঁচু করল, পরক্ষণে পয়েন্ট-ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জে গুলি করল ম্যাথিউ ফ্যানুয়্যাকে।

ফ্রেঞ্চ বিজ্ঞানীর মাথা বিস্ফোরিত হয়েছে। রক্ত ও মগজ ছিটকে লেগেছে সিংগারের গালে।

স্যাঁ ডেনি পেঁয়েমি ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করেছে।

তার দিকে ঘুরে চাইল গুণ্ডারসন। তুমিও ফ্রেঞ্চ?

ফুপিয়ে ওঠা বেড়ে গেল।

মিস্টার বোউলস, বলল গুণ্ডারসন।

পেয়েযি বুঝে গেছে কী হবে। না! চেঁচিয়ে উঠল। আবারও পিস্তল তুলল পার্কার বোউলস, এক সেকেণ্ড পর সিংগারের অপর গালে লাগল টকটকে রক্ত ও কাঁচা মগজ।

.

অপ্রশস্ত এলিভেটার শাফটের নীচে ঘুটঘুটে অন্ধকার, গুলির বিকট আওয়াজে চটকা ভেঙেছে নিশাত সুলতানার।

ধুৎ! আনমনে ভাবল। আবারও বোধহয় জ্ঞান হারিয়েছিল।

আমাকে সচেতন থাকতে হবে, ভাবল।

যেভাবে হোক….

সঙ্গে আনা স্বচ্ছ প্লাস্টিকের ফ্লুইড ব্যাগের দিকে চাইল। ওটার সঙ্গে সংযুক্ত ওর বাহুর ইন্ট্রাভেনাস ড্রিপ।

ফুরিয়ে গেছে ফ্লুইড ব্যাগ।

সেটাও বিশ মিনিট আগের কথা।

শিউরে উঠল নিশাত। বড় ঠাণ্ডা। দুর্বল লাগছে। বুজে আসছে দুই চোখ।

দাঁত দিয়ে জিভ কামড়ে ধরল নিশাত। ব্যথা পেয়ে আবারও চোখ মেলল।

কয়েক মিনিট এভাবে জেগে থাকল, তারপর আবারও বুজে, এল চোখ।

এলিভেটার শাফটের নীচে জ্ঞান হারিয়ে পড়ে রইল নিশাত সুলতানা। একা।

.

ই-ডেকে পা বাড়াল জুলিয়াস বি. গুণ্ডারসন, সরু হয়ে গেছে দুই চোখ! গানারি সার্জেন্ট পল সিংগার। বড় দুষ্ট লোক ছিলে তুমি, ঠিক কি না?

নীরব থাকল পল সিংগার।

তুমি কি সত্যিই আইসিজি, বিষাক্ত সাপ? …সত্যিই বিশ্বাসঘাতক? ….নিজের ইউনিটের বিরুদ্ধে কাজ করেছ? …আসলে কী করেছ তুমি? অনেক আগেই নিজের কাভার হারিয়েছ, খুন করতে শুরু করেছ নিজ লোক? …অথচ, স্টেশন তখনও সিকিউর করা হয়নি। বুঝতে পারছি মাসুদ রানা ভীষণ খেপেছে। আর তাই তোমাকে ফেলে গেছে। যাতে আমি ওর কাজটা শেষ করি।

ঢোক গিলল ভাইপার।

শীতল চোখে লোকটার দিকে চাইল গুণ্ডারসন। আমি হলেও এই একই কাজ করতাম, সার্জেন্ট।

মেজর জেনারেলের পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে এক তরুণ এসএএস কর্পোরাল। স্যর।

বলো, কর্পোরাল? চার্জগুলো এবার স্টেশনের সীমানায় বসানো হবে।

রেঞ্জ কত?

পাঁচ শ গজ, স্যর। আপনার নির্দেশ মত, ঘিরে ফেলা হবে স্টেশন।

গুড, মাথা দোলাল গুণ্ডারসন। উইলকক্স স্টেশনে পৌঁছেই আঠারোটা ট্রাইটোনাল চার্জ বসাতে বলেছে সে। প্রায় বৃত্তাকারে ঘিরে নেয়া হবে স্টেশন। ওগুলোর বিশেষ কাজ আছে।

কর্পোরাল, কতক্ষণের ভিতর বিস্ফোরক বসাতে পারবে? জানতে চাইল গুণ্ডারসন।

ড্রিলিঙের জন্য আরও এক ঘণ্টা নেব, স্যর।

ঠিক আছে, বলল গুণ্ডারসন। তারপর সব বসিয়ে দেয়ার পর, আমার কাছে নিয়ে আসবে ডেটোনেশন ইউনিট।

ইয়েস স্যর, বলল কর্পোরাল। ও, আরেকটা কথা, স্যর…

হ্যাঁ, বলো?

স্যর, আমেরিকান হোভারক্রাফট থেকে যে দুই বন্দি পেয়েছি, তাদেরকে কী করব?

আগেই রেডিয়ো করেছে গুণ্ডারসন, ছোট মেয়েটি এবং ওই লোককে নিয়ে আসতে হবে স্টেশনে।..

ওই মেয়েকে ওর কোয়ার্টারে নিয়ে আটকে রাখো, বলল গুণ্ডারসন। আর লোকটাকে নিয়ে এসো এখানে।

.

পাতাল-গুহার আঁধার এক কোণে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে তিশা করিম। ওর হাতের ফ্লাশলাইটের আলো পড়েছে বরফ-দেয়ালে ছোট এক ফিসারের উপর।

বরফের দেয়াল যেখানে নেমে এসেছে, মেঝে ছুঁয়ে ওই ফাটল–বড়জোর দুই ফুট উঁচু, পাশে ছয় ফুটের বেশি হবে না। হামাগুড়ির ভঙ্গিতে বসে ফাটলের ভিতর চোখ চালাল তিশা। আঁধারে কিছুই দেখা গেল না। অবশ্য, আঁচ করা গেল ওদিকে ফাঁকা জায়গা।

এই যে!

ঘুরে চাইল তিশা।

গুহার আরেক প্রান্তে স্পেসশিপের নীচে দাঁড়িয়ে আছে নিনা ভিসার। বারকয়েক হাত নাড়ল। উত্তেজিত স্বরে বলল, এই যে! আসুন! একবার দেখে যান!

উঠে দাঁড়িয়ে রওনা হয়ে গেল তিশা, একমিনিট, পেরুবার আগেই পৌঁছে গেল বিশাল কালো স্পেসশিপের পাশে। একই সময়ে হাজির হয়েছে সার্জেন্ট জনি ওয়াকার। পুকুরের পাশে পাহারা দিচ্ছে, লেফটেন্যান্ট গোলাম মোরশেদ।

এটা আপনাদের কাছে কী মনে হয়? বিমানের পেটের কাছে। কী যেন দেখাল নিনা ভিসার।

তার পাশে চলে গেল তিশা, জিনিসটা দেখে ভুরু কুঁচকে গেল। মনে হলো, ওটা কোনও কিপ্যাড ধরনের কিছু।

বারোটা বাটন, তিনটি সারিতে চারটে করে বাটন। বাটনের উপরে চারকোনা কালো স্ক্রিন।

অবশ্য, এই কিপ্যাডে একটা বিষয় বড় অবাক করা।

এসব কি-র উপর কোনও লেখা বা চিহ্ন নেই।

স্পেসশিপের অন্য সব কিছুর মতই কিপ্যাড ও ব্যাকগ্রাউণ্ড কুচকুচে কালো। জিনিসটা ক্যালকুলেটারের মত।

তিশা খেয়াল করেছে, একটা বাটনে চিহ্ন আছে। মাঝের কলামে দ্বিতীয় বাটনে ছোট্ট একটা লাল বৃত্ত।

জিনিসটা কী হতে পারে? বলল সার্জেন্ট ওয়াকার।

কে জানে! বলল নিনা ভিসার।

হয়তো এটা দিয়ে বিমান চালু করা যায়, বলল তিশা।

মনে হয় না, মাথা নাড়ল নিনা ভিসার। কখনও কোনও এলিয়েনকে কিপ্যাড ব্যবহার করতে দেখেছেন?

আমি কোনও এলিয়েনকে চিনি না, বলল তিশা। আপনি চেনেন?

কথাটা পাত্তা দিল না নিনা ভিসার। কেউ জানে না এটা কী? হয়তো ইগনিশন কি, বা ওয়েপন্স সিস্টেম…

অথবা সেলফ-ডেসট্রাক্ট মেকানিজম, শুকনো স্বরে বলল তিশা।

আমি কি একটা বাটন টিপে দেখব? বলল নিনা।

কিন্তু কোন বাটন টিপবেন? আপত্তি জানাল ওয়াকার।

আর কোনটা, যেটার ভিতর বৃত্ত আঁকা।

ওয়াকারের দুই ঠোঁট পরস্পরকে টিপে ধরল। সরার ভিতর সে সবচেয়ে বয়স্ক। সবাই আশা করছে, ও কিছু বলবে। তিশার দিকে চাইল ওয়াকার।

আস্তে করে মাথা নাড়ল তিশা। এই জিনিস কী কাজ করে তা দেখবার জন্য আমাদেরকে পাঠানো হয়নি। বলে দেয়া হয়েছে পাহারা দিয়ে রাখতে হবে। আমেরিকান সৈনিকরা এলে আমাদের ছুটি।

গোলাম মোরশেদের দিকে চাইল ওয়াকার। সে পুল ছেড়ে চলে এসেছে স্পেসশিপের পাশে।

দিন টিপে, তিশা, বলল মোরশেদ। দেখা যাক কী হয়… নইলে খামোকা কিনব কেন?

তিশা চুপ করে আছে।

নিনা ভিসারের দিকে চাইল ওয়াকার। মেয়েটা আস্তে করে মাথা দোলাল। দেখা যাক কী হয়?

বাটন টিপুন, বলল ওয়াকার।

বড় করে শ্বাস নিল নিনা ভিসার, তারপর লাল বৃত্ত আঁকা বাটন টিপে দেয়ার জন্য হাত বাড়িয়ে দিল। স্পর্শ করল বাটন।

এতে কিছুই হলো না।

চাপ দেয়া শেষে আস্তে করে কিপ্যাড থেকে আঙুল সরিয়ে নিল নিনা ভিসার। মুখ তুলে চাইল স্পেসশিপের দিকে। ভাব দেখে মনে হলো, আশা করেছিল বিমান ভেসে উঠবে, বা কিছু হবে। না, কিচ্ছু হলো না।

তারপর হঠাৎ করেই সুরেলা মৃদু আওয়াজ হলো। কিপ্যাডের উপর জ্বলজ্বল করে উঠল স্ক্রিন।

এক সেকেণ্ড পর স্ক্রিনে দেখা দিল এক সারিতে কী যেন।

আরে, বিড়বিড় করল জনি ওয়াকার।

এটা কী? কাপা স্বরে বলল নিনা ভিসার।

স্ক্রিনে লেখা ভেসে উঠেছে:

২৪১৫৭৮১৭——–
        এণ্টার অথারাইযড এন্ট্রি কোড

নম্বর? অবাক হয়ে বলল জনি ওয়াকার।

তাও আবার ইংরেজিতে? বলল নিনা ভিসার। এই জিনিস আসলে কী?

আস্তে করে মাথা নাড়ল তিশা, রওনা হয়ে গেল ওদিকের ফাটল লক্ষ্য করে, ঠোঁটে মৃদু হাসি।

১০.

বরফ-ঠাণ্ডা আইসবার্গের উপর চিত হয়ে শুয়ে আছে মাসুদ রানা ও রাশেদ হাবিব, শুনছে নিয়মিত বিরতিতে মস্ত সব ঢেউ আছড়ে পড়ছে দুই শ গজ দূরে ক্লিফের গায়ে।

ওরা ঠিক করেছে, একটু বিশ্রাম নেবে, তারপর দম ফিরে–পেলে স্থির করবে কী করা যায়।

কয়েক মিনিট পেরুবার পর কোমরে হাত নিল রানা, কালো ছোট্ট ইউনিটের বাটন টিপে দিল।

বিপ!শব্দ তুলল যন্ত্রটা।

কী করছেন, ভাই? ওদিকে না চেয়েই জানতে চাইল হাবিব।

জিপিএস ইউনিট ইনিশিয়ালাইয করলাম, বলল রানা। এখনও চিত হয়ে পড়ে আছে। এটা স্যাটালাইট লোকেশন সিস্টেম, ন্যাভিস্টার গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেমে চলে। মেরিনদের কাছ থেকে পেয়েছি। সবাইকে একটা করে দিয়েছে, ইমার্জেন্সি হলে ব্যবহার করতে।

তাতে কী হবে, ভাই?

খুঁজে বের করা সোজা হবে। ধরুন আমরা সাগরের মাঝে থাকলেও

তা হলে আমাদেরকে উদ্ধার করতে কেউ আসবে? জানতে চাইল হাবিব।

হ্যাঁ, আসবে, বলল রানা। কিন্তু ততক্ষণে আমরা শীতে জমে.লাশ। ওরা এসে আমাদের মৃতদেহ নিয়ে যাবে।

এই জগতে আমার আপন কেউ নেই, ভাই। বিজ্ঞানী মানুষ, বিজ্ঞানের কিছুটা ক্ষতি হলেও হতে পারে, আর কারও কিছুই এসে যাবে না। নরম গলায় বলল হাবিব। আর মরেই যদি যাই, লাশের কী হবে তা নিয়ে ভাবি না।

মারা যাওয়ার আগে কাজ আছে না? নোট লিখব, উইলকক্স আইস স্টেশনে কী ঘটেছে সব জানাব। ফ্রেঞ্চ হামলা, বা গুণ্ডারসনের গুণ্ডামি…

ব্যাটাদের শাস্তি হবে তাতে?

হতেও পারে।

এটা শুনে একটু ভাল লাগছে।

কনুইয়ে ভর দিয়ে আধ-শোওয়া হলো রানা, ঘুরে চাইল ক্লিফের দিকে। দক্ষিণ সাগরের প্রকাণ্ড সব ঢেউ গিয়ে পড়ছে ওখানে। বিস্ফোরণের বিকট আওয়াজ, তারপর ফিরছে সাদা ফেনা সসস্ আওয়াজ তুলে।

প্রথমবারের মত এই আইসবার্গের উপর মন দিল রানা। প্রকাণ্ড বরফের চাই এটা। এতই ভারী, উন্মত্ত সাগরের মস্ত সব ঢেউ চাইলেও নাচাতে পারছে না একে। দৈর্ঘ্যে কমপক্ষে একমাইল। পানির নীচে কত বড়, কে জানে!

চারকোনা আইসবার্গ, একপাশে বিশাল এক চূড়া। এ ছাড়া অন্যদিক এবড়োখেবড়ো, ফাটল ধরা! রানার মনে হলো, ওরা আছে বরফের তৈরি কোনও চাদের জমিতে।

উঠে দাঁড়াল ও।

কোথা চললেন, ভাই? জানতে চাইল হাবিব। আরাম করে শুয়ে আছে। মরেই যদি যাই, এই জায়গাটা খারাপ কোন হিসাবে? আপনি তো আর হেঁটে বাড়ি ফিরতে পারবেন না।

দেখি না, হাঁটতে থাকি চলুন, বলল রানা। হাঁটলে শরীর তো অন্তত গরম হবে। হয়তো মাথা থেকে বুদ্ধি বেরিয়ে যাবে, কীভাবে তীরে ওঠা যায়।

হতাশ হয়ে আস্তে করে মাথা নাড়ল রাশেদ হাবিব, অবশ্য উঠে দাঁড়াল। রানার পাশে হাঁটতে শুরু করেছে। প্রায় বিশ মিনিট হাঁটল ওরা, তারপর টের পেল, ভুল দিকে এসেছে।

এদিকে হঠাৎ করেই শেষ হয়েছে আইসবার্গ। ওপাশে শুধু পশ্চিম দিগন্ত ও নীচে সাগর। সবচেয়ে কাছে তিন মাইল দূরে আইসবার্গ। রানা আশা করেছিল, এক হিমশৈল থেকে আরেকটায় উঠবে, এভাবে পৌঁছুবে তীরে। সে সম্ভাবনা নেই। ..

ফিরতি পথ ধরল ওরা। এবার গতি হলো অনেক মন্থর। হাবিবের ভুরু ও ঠোঁটে জমতে শুরু করেছে মিহি তুষার।

আইসবার্গ সম্বন্ধে কিছু জানেন? জানতে চাইল রানা।

সামান্য।

শুনে দেখি, কিছু শেখা যায় কি না।

পত্রিকায় পড়েছি, ইদানীং বড়লোকদের ভিতর খুব চালু হয়েছে আইসবার্গ ক্লাইম্বিং। পাহাড়ে না উঠে বরফের চাইয়ের উপর… কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, একদিন আপনার পাহাড় গলবে

এসর নয়, বৈজ্ঞানিক কিছু আশা করেছিলাম, বলল রানা। যেমন ধরুন, এসব হিমশৈল কখনও তীরে গিয়ে ভেড়ে?

না, কক্ষনো না, মাথা নাড়ল হাবিব। এগুলো অ্যান্টার্কটিকার ঠিক মাঝখান থেকে বাইরের দিকে আসে। উল্টো রাস্তায় যায় না। মেইন আইস শেলফ থেকে ভেঙে পড়েছে আমাদের এই আইসবার্গ। তাই এদিকটা এত খাড়া দেখতে পাচ্ছেন। ঝুলতে ঝুলতে বেশি ভারী হয়ে, নিজের ওজন সামলাতে না পেরে ভেঙে পড়ে এরা সাগরে, হাত দিয়ে চারপাশ দেখাল, হাবিব, হয়ে যায় এরকম এক-একটা আইসবার্গ।

বুঝলাম। বরফ জমিনের উপর দিয়ে হেঁটে চলেছে রানা!

কোনও কোনোটা সত্যিই বিশাল হয়। এতই বড় যে ভাবতে পারবেন না। ধরুন আস্ত একটা দেশের চেয়েও বড়। এই হিমশৈলের দিকেই দেখুন। এটা বিরাট। বেশিরভাগ আইসবার্গ দশ থেকে বারো বছর টেকে, তারপর গলে মিশে যায় সাগরে। কিন্তু পরিবেশ ঠিক থাকলে, আর আইসবার্গ প্রকাণ্ড হলে এটার মত একটা হিমশৈল টিকবে তিরিশ থেকে চল্লিশ বছর।

বলতে থাকুন, বলল রানা।

হাবিব যেখান থেকে ওকে তুলে নিয়েছিল, সেখানে পৌঁছে গেছে ওরা। একটু দূরেই ডুবে গেছে ফ্রেঞ্চ সাবমেরিন।

হেঁটে কী লাভ, বলুন? বলল হাবিব। আবার ফিরে এসেছি আগের জায়গায়।

মৃদু এক চড়াইয়ে উঠছে ওরা। ওদিকে এসে লেগেছিল ফ্রেঞ্চ সাবমেরিনের টর্পেডো।

মনে হলো ওখানে আইসবার্গে মস্ত কামড় বসিয়েছে দৈত্য। ওই টর্পেডো বিস্ফোরণের ফলে প্রচুর বরফ নেমেছে সাগরে। আইসবার্গের গায়ে প্রায় বৃত্তাকার বিশাল এক গর্ত তৈরি হয়েছে। ওখানে খাড়া বরফের দেয়াল নেমে গেছে তিরিশ ফুট নীচের সাগরে।

গর্তের ভিতর চোখ বোলাল রানা। দানব হিমশৈলের পায়ের কাছে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে সাগরের ঢেউ,

আমরা এখানেই মরব, তাই না? রানার পিছন থেকে বলল হাবিব।

আমি মরব না, বলল রানা।

মরবেন না?

না। আবারও ফিরব, দখল করে নেব উইলকক্স আইস স্টেশন। এ ছাড়া আর কোনও পথ নেই।

তাই করবেন ভাবছেন? সাগরের দিকে চাইল হাবিব। তো বলুন কীভাবে ওখানে যাবেন?

জবাব দিল না রানা।

আপনি দারুণ একটা খোয়াব দেখছেন, মেজর রানা, বলল হাবিব। হাইপোথারমিয়া হলে এমন হয়। এবার ধীরে ধীরে…

হাবিবের কথায় মন নেই রানার হাঁটু গেড়ে বসে পড়েছে। টর্পেডোর আঘাত লাগা প্রায়-বৃত্তাকার গর্তের ভিতর চেয়ে আছে।

ওর পাশে এসে দাড়াল হাবিক। কী দেখছেন, ভাই?

মুক্তির পথ, বলল রানা, হাল ছাড়ব কেন?

রানার দৃষ্টি লক্ষ্য করে চাদের মত গোল গর্তে চোখ বোলাল, হাবিব। এবার চট করে দেখতে পেল।

বরফের খাড়া দেয়ালের দুই গজ নীচে একটা ফ্রোয়েন গ্লাসের জানালা!

এবার আপনার পারকা খুলে ফেলুন, বলল রানা। নিজেরটা খুলতে শুরু করেছে।

হতবাক হয়ে গেছে রাশেদ হাবিব, কিন্তু ফিরে পেয়েছে আশা। দ্রুত হাতে খুলে ফেলল পারকা।

ব্যস্ত হয়ে উঠল রানা। দুই পারকা ও দুই জ্যাকেট গিঠ দিতেই হয়ে গেল বিশ্রী একটা দড়ি।

আপনি পিছিয়ে শুয়ে পড়বেন, কোমরে এই দড়ি, বলল রানা। আর অন্য প্রান্তে ঝুলব আমি। নামব বরফের ক্লিফ বেয়ে।

কোনও আপত্তি থাকল না হাবিবের।

দুই মিনিট পর জ্যাকেটের দড়ি কোমরে নিয়ে নেমে পড়ল রানা। চব্বিশ ফুট নীচে বরফ ধুয়ে ফিরছে সাগরের ঢেউ। ফ্রোযেন গ্লাসের জানালার সামনে পৌঁছে গেছে রানা। মনোযোগ দিল ওদিকে।

সন্দেহ নেই, মানুষই তৈরি করেছে এই জিনিস।

অনেক বয়স। জানালার কাঠের চৌকাঠ এবড়োখেবড়ো ও ক্ষত-বিক্ষত। ফ্যাকাসে ধূসর রং ধরেছে। এই জানালা কত আগের, আঁচ করতে পারল না রানা। বোঝা গেল না জানালার ওপাশে কী ছিল। হয়তো মস্ত কোনও দালান ছিল। এখন নেই। সব হারিয়ে গেছে প্রকাণ্ড আইসবার্গের পেটের ভিতর।

রানা ধারণা করছে, জানালার সামনে কমপক্ষে দশ গজ বরফ ধসিয়ে দিয়েছে সাবমেরিনের টর্পেডো, নইলে এদিকটা বেরিয়ে আসত না। হিমশৈলের ভিতর রয়ে গেছে দালানের অন্য অংশ।

বড় করে শ্বাস নিল ও, তারপর একটা পেনাল্টি কিক হাঁকাল, ঝনঝন করে ভেঙে পড়ল জানালার কাঁচ।

ওদিকে ছোট গুহামত। হিপ পকেট থেকে ফ্লাশলাইট নিল, সুইচ টিপে দাঁতে চেপে ধরে চৌকাঠ ধরে ঢুকে পড়ল ভিতরে।

ওর ফ্লাশলাইটের বাতি গিয়ে পড়েছে ঝুলন্ত কয়েকটি অক্ষরের উপর:

হ্যাপি নিউ ইয়ার ১৯৬৯!
     ওয়েলকাম টু লিটল আমেরিকা-৪!

এসব লেখা হয়েছে একটা ব্যানারে। গুহার ওদিকে শিথিলভাবে ঝুলছে।

না, এটা কোনও গুহা নয়।

কোনও ধরনের ঘর। চারদেয়াল কাঠ দিয়ে তৈরি। বরফের ভিতর চাপা পড়েছে।

সব উল্টো হয়ে ঝুলছে। পুরো ঘর উল্টে গেছে।

বিদ্ঘুটে লাগল রানার। ও দাঁড়িয়ে আছে এই ঘরের ছাতে। এটাই এখন হয়ে দাঁড়িয়েছে মেঝে।

ডানদিকে চাইল রানা। ওদিকে বোধহয় আরও ঘর আছে। কারা ছিল…

মেজর, বাইরে থেকে ভেসে এল হাবিবের কণ্ঠ।

জানালা দিয়ে মাথা বের করে উপরে চাইল রানা।

কী পেলেন? আমি তো শীতে মরে গেলাম, বলল হাবিব।

আগে কখনও লিটল আমেরিকা চার-এর নাম শুনেছেন? জানতে চাইল রানা।

হ্যাঁ, বলল বিজ্ঞানী। আমেরিকানদের ছোট স্টেশন। ষাট দশকের। উনিশ শ ঊনসত্তরে রসু আইস শেলফ থেকে ভেঙে পড়েছিল বড় এক আইসবার্গ। ওটার সঙ্গে সাগরে ভেসে যায় ওই দালান। নয় হাজার বর্গ কিলোমিটারের হিমশৈল ছিল। নেভি তিন মাস ধরে ওটাকে খুঁজেছে। তবে আর পায়নি। 

আমরা পেয়েছি, বলল রানা।

তা হলে কি নামব আমি? জানতে চাইল হাবিব।

দাঁড়ান, আগে তৈরি হয়ে নিই, বলল রানা। কয়েক পা পিছনে সরল। এবার আস্তে করে স্কুলে পড়ুন। আমি টেনে নেব।

.

লিটল আমেরিকা-৪-এর প্রধান ঘরের ছাতে গাট মেরে বসে আছে রাশেদ হাবিব, গায়ে জড়িয়ে নিয়েছে পুরু তিনটে উলের কম্বল। নতুন উদ্যমে দুই হাত ঘষছে, ফুঁ দিয়ে চলেছে তালুতে। রানা অন্য কাজে ব্যস্ত। পরনে এখনও ভেজা ফেটিগ। অন্ধকার উল্টানো ঘরগুলোয় ঘুরে বেড়াচ্ছে। ওদের দুজনের অত সাহস হয়নি যে চল্লিশ বছরের বেশি পুরনো খাবার পেটে পুরবে। সব ছড়িয়ে আছে ছাতে। কোক থেকে শুরু করে নানা খাবারের ক্যান।

যা শুনেছি, লিটল আমেরিকা-৪ ছিল অনেকটা উইলকক্স আইস স্টেশনের মতই, বলল হাবিব। রিসোর্স এক্সপ্লোরেশন স্টেশন, তৈরি করা হয় উপকূলীয় বরফের শেলফে। লোকগুলোর কাজ ছিল কন্টিনেন্টাল শেলফ থেকে অফ শোর অয়েল ডিপোযিট খুঁজে বের করা। ওরা কালেক্টার নামিয়ে দিত নীচের মাটি থেকে নমুনা সংগ্রহ…।

বলতে থাকুন, পাশের ঘর থেকে বলল রানা।

আপনি কি জানেন কীভাবে উল্টে গেল দালান? আইসবার্গ যখন খসে পড়তে থাকে, কখনও কখনও সবকিছু উল্টে যায়। এটা খুবই যৌক্তিক। আইসবার্গ বেশি ভারী হলে মেইনল্যাণ্ড থেকে ভেঙে পড়ে। নীচের বরফ এতদিন ছিল পানির ভিতর, গরম পানিতে আস্তে আস্তে সরু হয়ে এসেছে, বরফ। কাজেই হিমশৈল ভেঙে পড়লে, খুবই ব্যালেন্সড় না হলে, পুরো ডিগবাজি খায়।

পরের ঘরে নানান জং ধরা জঞ্জালের ভিতর হাঁটছে রানা। মস্ত এক সিলিণ্ডারের মত কেবল-সুলার একপাশে কাত হয়ে আছে। ওখানে আরও একটা জিনিস দেখতে পেল রানা।,

নেভি কতদিন ধরে এই স্টেশনটাকে খুঁজেছে? জানতে চাইল রানা। আগে খেয়াল করে শোনেনি।

প্রায় তিন মাস।

সেটা যথেষ্ট সময় মনে করেন?

ওই ঘর থেকে জবাব দিল হাবিব, যথেষ্টর বেশি। কেন, আপনার কী মনে হয়?

আস্তে করে দরজা দিয়ে প্রধান ঘরে নামল রানা, সঙ্গে কী যেন এনেছে। হাতে ধাতব কিছু।

আমেরিকান অভিযাত্রীদের কাছে এই জিনিস থাকার কথা নয়। মৃদু হাসছে। সাদা কর্ড তুলে ধরেছে। ওটার দিকে চাইল হাবিব। দড়ির মতই, কিন্তু সাদা পাউডার মাখা।

ডেটোনেটার কর্ড, বলল রানা। পঁাচাতে শুরু করেছে কোমরে। ক্লোজ কোয়ার্টার এক্সপ্লোসিভের ফিউজ। এটার সঙ্গে যে, পাউডার দেখছেন, সবই ম্যাগনেযিয়াম-সালফাইড। ম্যাগনেযিয়াম-বেযড ডেটোনেটার কর্ড খুব দ্রুত জ্বলে, ভয়ঙ্কর তাপ ছাড়ে–এতই বেশি যে, ধাতু পর্যন্ত কেটে ফেলে। আজকাল এটা অন্য কাজে ব্যবহার হয়।

আর, এটা দেখুন, জং ধরা প্রেশারাইড় ক্যানিস্টার তুলে ধরেছে রানা। ভিএক্স পয়জন গ্যাস। আর এটা… আরেকটা টিউব দেখাল। স্যারিন।

স্যারিন গ্যাস? চমকে গেছে হাবিব। জানে ওটা কী। স্যারিন গ্যাস ভয়ঙ্কর কেমিকেল অস্ত্র,। উনিশ শ পঁচানব্বই সালে জাপানে, টোকিও সাবওয়েতে এক ক্যানিস্টার স্যারিন গ্যাস ফাটিয়ে দেয় এক টেরোরিস্ট গ্রুপ। মারা পড়ে বেশ কয়েকজন। ষাটের দশকে এদের হাতে এই জিনিস ছিল? জানতে চাইল হাবিব।

হ্যাঁ, ছিল।

আর আপনি ভাবছেন কেমিকেল ওয়েপন্স ফ্যাসিলিটি ছিল এই স্টেশন? জানতে চাইল হাবিব।

সন্দেহ নেই।

কিন্তু… এরা অ্যান্টার্কটিকায় কেমিকেল ওয়েপন্স টেস্ট করছিল কেন?

দুটো কারণে, বলল রানা। প্রথম কথা: নিজ দেশে আমেরিকানরা বিষাক্ত গ্যাস ফিরে রাখে। তা ছাড়া, গ্যাসের টক্সিসিটি কমে উত্তপ্ত পরিবেশে। পরীক্ষার জন্য এমন জায়গা চাই, যেখানে সারা বছর শীত থাকে।

আর দ্বিতীয় কারণ?

দ্বিতীয় কারণ সোজা, হাবিবের দিকে চাইল রানা। এখানে কেউ দেখছে না এরা কী করছে।

আবারও পাশের ঘরে চলে গেল রানা। ওখান থেকে বলল, এসব গ্যাস এখন আমাদের কাজে আসবে না। কিন্তু অন্য একটা জিনিস আছে, ওটা আমাদের লাগতে পারে। হয়তো ফিরে যেতে পারব স্টেশনে।

জিনিসটা কী, ভাই?

এই যে, দরজা দিয়ে আবারও বেরিয়ে এসেছে রানা। হাতে ধুলো ভরা স্কুবা ট্যাঙ্ক।

এতদিন আগের জিনিস কী…

হাবিবের কথা শেষ হওয়ার আগেই বলল রানা, দেখা যাক কাজ করে কি না।

ঠিক আছে। আমাকে কী করতে হবে?

ব্রিদিং অ্যাপারেটাস পরিষ্কার করুন। আমি ক্যালিব্রেটিং নিয়ে কাজ করি।

রানার হাত থেকে ব্রিদিং অ্যাপারেটাস নিয়ে ব্যস্ত হয়ে উঠল হাবিব। ঝাড়ফুঁক শুরু করেছে মাউথপিস, ভালভ ও এয়ার হোসের উপর।

রানার ভয় অন্যখানে। এতদিনে বিষাক্ত হয়ে উঠতে পারে কমপ্রেসড এয়ার।

বিষাক্ত হয়েছে কি না বুঝবার একটাই মাত্র উপায়।

ওই বাতাসে বড় করে দম নিল রানা, অপলক চেয়ে রইল হাবিবের দিকে। যখন দেখল ধুপ করে পড়ে মরল না, বলল, বাতাস ঠিকই আছে।

পরবর্তী বিশ মিনিট স্কুবা গিয়ার নিয়ে কাজ করল ওরা। প্রায় তৈরি হয়ে গেল সব। কাজের ফাঁকে হাবিব বলল, আপনি কি চার্লস মুনের লাশ দেখেছেন?

কাজ থেকে মুখ তুলে হাবিবের দিকে চাইল রানা। সাগরের পানি দিয়ে দুই মাউথপিস পরিষ্কার করছে বেঁটে বিজ্ঞানী।

হ্যাঁ, দেখেছি, নিচু স্বরে বলল রানা।

কী দেখলেন? হাবিবের কণ্ঠে জোরালো আগ্রহ প্রকাশ পেল।

দ্বিধা করল রানা। দাঁত দিয়ে জিভ কেটে ফেলেছেন উনি।

হুম্।

খুব শক্ত ভাবে আটকে ছিল চোয়াল। চোখদুটো রক্তলাল।

আস্তে করে মাথা দোলাল হাবিব। আপনাকে কী বলেছে ওরা?

নিনা ভিসার জানিয়েছে, আপনি মুনের গলায় হাইপোডারমিক নিডল গেঁথে দেন। লিকুইড ড্রেইন ক্লিনার ঢুকে পড়ে রক্তে। সঙ্গে সঙ্গে মারা যান ভদ্রলোক।

বোদ্ধার মত মাথা দোলাল হাবিব। এবার একবার এটা দেখুন, ভাই। পারকার বুক পকেট থেকে মোটা বই বের করেছে সে। ওটা পানিতে চুপচুপে ভেজা। রানার দিকে বাড়িয়ে দিল।

ওটা নিল রানা। বইয়ের কাভারে লেখা: বায়োটক্সিকোলজি অ্যাণ্ড টক্সিন রিলেটেড ইলনেস।

কেউ যদি আপনাকে ড্রেইন ক্লিনার দিয়ে মারতে চায়, প্রথমে আপনার হৃৎপিণ্ড বন্ধ হবে, বলল হাবিব। বেকায়দা ভাবে ঠাস করে পড়েই মরবেন। দ্বিতীয় অধ্যায় দেখুন।

ভেজা পাতা উল্টে দ্বিতীয় চ্যাপ্টারে গেল রানা। শিরোনামে লেখা: টক্সিন-রিলেটেড ইন্সট্যান্টেনিয়াস ফিজিওলজিক্যাল ডেথ।

লেখক পরিচিত সব বিষের নামের তালিকা দিয়েছেন। মাঝে রয়েছে ইণ্ডাস্ট্রিয়াল ক্লিনিং ফ্লুইড, ইনসেকটিসাইড।

মূল কথা, বলল হাবিব, ওই ধরনের বিষ প্রয়োগ করলে বাইরে থেকে লাশের কোনও পরিবর্তন দেখা যায় না। আপনার হৃৎপিণ্ড হঠাৎ করেই বন্ধ হবে। চুটকি বাজাল সে। কিন্তু অন্য কোনও বিষে অন্য প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে। যেমন সাগরের সাপের বিষ।

সি স্নেক ভেনম? বলল রানা।

চ্যাপ্টার নাইন, বলল হাবিব।

ওই অধ্যায় খুঁজে নিল রানা। ন্যাচারালি অকারিং টক্সিন সি ফোনা।

সি স্নেক খুঁজে নিন, বলল হাবিব।

পাতা ওল্টাতে শুরু করেছে রানা। পেয়ে গেল: সি স্নেস্টক্সিন্স, সিমটমস্ অ্যাণ্ড ট্রিটমেন্ট।

এবার একটু পড়ুন, বলল হাবিব।

পড়তে শুরু করেছে রানা।

জোরে পড়ুন, ভাই, বলল হাবিব।

উচ্চারণ করে পড়তে শুরু করেছে রানা: দ্য কমন সি স্নেক–(এনহাইড্রিনা সিসেস্টোসা) হ্যায আ ভেনম উইদ এ টক্সিসিটি লেভেল থ্রি টাইমস্ দ্যাট অভ দ্য কিং কোবরা, দ্য মোস্ট লিথাল ল্যাণ্ড-বেযড স্নেক। ওয়ান ড্রপ (০:০৩ এমএল) ইয এনাফ টু কিল থ্রি মেন। কমন সিমটপস্ অভ সি স্নেক এনভেনোমেশন ইনক্লড একিং অ্যাণ্ড স্টিফনেস অভ মাসলস, থিকেনিং অভ দ্য টাং, প্যারালাইসিস, ভিযুয়াল লস, সিভিয়ার ইনফ্লেমেশন অভ দ্য আই এরিয়া অ্যাণ্ড ডাইলেশন অভ দ্য পিউলস, অ্যাণ্ড মোস্ট নোটেবলি অভ অল, লক-জ। ইনডিড, সো সিভিয়ার ইয,লক-জ ইন কেস, দ্যাট ইট ইয নট আননৌন ফর, ভিক্টিমস অভ দ্য সি স্নেক এনভেননামেশন টু…

রানাকে থামিয়ে দিল হাবিব। নরম স্বরে বলল, এবার ওখান থেকেই পড়ুন।

…টু সিভিয়ার দেয়ার ওউন টাংস্ উইদ দেয়ার টিথ, পড়া থেকে চোখ তুলে বেঁটে বিজ্ঞানীর দিকে চাইল রানা।

আস্তে করে মাথা দোলাল হাবিব। এখন আমাকে খুনি মনে হচ্ছে আপনার, মেজর?

আপনি হয়তো হাইপোডারমিক সিরিঞ্জের ভেতর সি স্নেক ভেনম ভরেছেন, বলল রানা।

না, ভাই, উইলকক্স আইস স্টেশনে সি স্নেক ভেনম রাখা হয় বায়োটক্সিন্স ল্যাবে, সে ঘর সবসময় তালা দিয়ে রাখা হয়, বলল। হাবিব। মাত্র দুই একজন ওই ঘরে যেত। তাদের ভিতর আমি ছিলাম না।

রানার মনে পড়ল বায়োটক্সিন্স ল্যাবরেটরি বি-ডেকে। ওখানে তিনটে বৃত্ত দিয়ে বায়ো-হ্যায়ার্ড সাইন ছিল দরজার উপর।

অন্য চিন্তা এল ওর। নিনা ভিসার বলেছিল: এসব শুরু হওয়ার আগে বি-ডেকে জন প্রাইসের সঙ্গে বায়ো ল্যাবে ছিল সে। ভদ্রলোক এনহাইড্রিনা সিসেস্টোসার নতুন অ্যান্টিভেনম নিয়ে কাজ করছিলেন।

মন থেকে চিন্তাটা সরিয়ে দিতে চাইল রানা।

না, নিনা ভিসার…

হাবিবের দিকে ঘুরে চাইল রানা। আপনার কী মনে হয়, কে চার্লস মুনকে খুন করতে পারে?

এমন কেউ, যার পক্ষে বায়োটক্সিন ল্যাবে যাওয়া সোজা ছিল, বলল হাবিব। তার মানেই জন প্রাইস, টমসন, অথবা নিনা ভিসার।

নিনা ভিসার… চিন্তার মোড় ঘুরিয়ে নিল রানা, জানতে চাইল, কেন এদের কেউ চার্লস মুনকে খুন করবে?

তা আমি জানি না, ভাই, বলল হাবিব।

এদের খুন করার মোটিভ কী হতে পারে? আপনার কিছুই জানা নেই?

জী-না, ভাই। কিছুই জানি না।

কিন্তু আপনার মোটিভ ছিল, বলল রানা। মুন আপনার রিসার্চের তথ্য চুরি করছিল।

তাইতে মনে হয় আমিই খুন করেছি, নাকি, ভাই? বলল হাবিব।

কিন্তু কেউ আপনাকে ফাঁসিয়ে দিয়ে থাকলে, সে সহজেই ড্রেইন ক্লিনার দিয়ে মুনকে খুন করতে পারত। সেক্ষেত্রে কেন এত ঝামেলা করে সি স্নেকের ভেনম ব্যবহার করল?

কথা তো এটাই, বলল, হাবিব। কিন্তু বই পড়ে দেখুন। ড্রেইন ক্লিনার ব্যবহার করলে ৫৯% মানুষ মরবে। আর সাগরের সাপের বিষ ব্যবহার করলে ৯৮% মানুষ সঙ্গে সঙ্গে মরবে। আসলে চার্লস মুনকে কোন সুযোগই দেয়নি খুনি, নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে। বাঁচার উপায় ছিল না তার।

নীচের ঠোঁট কামড়ে ধরল রানা, কয়েক সেকেণ্ড পর বলল, নিনা ভিসার সম্পর্কে কী জানেন?

কী জানব?

আপনাদের দুজনের সম্পর্ক কেমন? তাকে পছন্দ করতেন? বা আপনাকে পছন্দ করত সে?

না, আমরা কেউ কাউকে পছন্দ করতাম না।

আপনারা কেন পরস্পরকে পছন্দ করতেন না? জানতে চাইল রানা।

সত্যিই জানতে চান? বড় করে শ্বাস ফেলল হাবিব। অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে। কারণ, সে আমার খুব ঘনিষ্ঠ এক বন্ধুকে বিয়ে করে। উনি আমার বসও ছিলেন। আর তাঁকে কখনও ভালবাসেনি নিনা।

কেন ভালবাসেনি? জানতে চাইল রানা।

মারা যাওয়ার আগে মরিস ভিসার হার্ভার্ডের জিয়োফিক্সি ফ্যাকাল্টির প্রধান ছিলেন।

রানার মনে পড়ল, মেরি ওর বাবার কথা বলেছিল ওকে। উনি জটিল সব অঙ্ক শেখাতেন মেয়েকে। কিছু দিন হলো মারা গেছেন ভদ্রলোক।

একটা গাড়ি দুর্ঘটনায় মারা যান, তাই না?

হ্যাঁ, মাথা দোলাল হাবিব। এক মাতাল ড্রাইভার তার গাড়ি চালিয়ে দেয় মরিসের উপর। সঙ্গে সঙ্গে মারা যান। রানার দিকে চাইল সে। আপনি জানলেন কী করে?

মেরি বলেছে।

মেরি বলেছে… আস্তে করে বলল হাবিব। বড় ভাল মেয়ে। আপনাকে কি বলেছে, ও আমার গডডটার?

না, বলেনি।

মেরি যখন জন্ম নিল, ওর বাবা আমাকে বললেন, আমি যেন মেরির গডফাদার হই, বলল হাবিব। মরিসের কিছু হলে আমি মেরিকে আগলে রাখব। এরপর সাত বছর বয়সে মা মারা গেলেন ওর। লিভার ক্যান্সার ছিল।

এক সেকেণ্ড, বলল রানা, সাত বছর বয়সে ওর মা মারা গেছে?

হ্যাঁ।

তার মানে নিনা ভিসার ওর আপন মা নয়?

না, মরিসের দ্বিতীয় স্ত্রী নিনা, বলল হাবিব। নিনা ভিসার মেরির সৎ-মা।

রানার কাছে হঠাৎ করেই সব পরিষ্কার হতে শুরু করেছে। এ কারণেই নিনা ভিসারের সঙ্গে পারতপক্ষে কথা বলে না মেরি। গুটিয়ে রাখে নিজেকে। বাচ্চারা এমনই হয়, মোটেই পছন্দ করে না সৎ-মাকে। 

জানি না কেন নিনাকে বিয়ে করলেন মরিস, বলল হাবিব। জানতাম উনি বড় একা। তা ছাড়া, নিনা ভিসার আকর্ষণীয় তরুণী, সহজেই নিজের দিকে তাকে টেনে নিয়েছে। এত ক্যারিয়ারিস্ট বা উচ্চাকাঙ্ক্ষী মেয়ে আর দেখিনি। চোখ দেখলেই বুঝবেন। নিজের জন্য নাম চাই তার। মিশতে চায় মস্ত সব লোকের সঙ্গে। মরিসের চেনা নামকরা সব লোকের সঙ্গে মিশত। স্বামীকে মোটেও ভালবাসত না, জীবনেও মরিসের বাচ্চা নিত না।

দুঃখের হাসি হাসল হাবিব। তারপর মাতাল ড্রাইভার পিষে দিল মরিসকে, আর তখনই নিনার ঘাড়ে এসে পড়ল পিচ্চি মেরি।

এই বাচ্চার দায়িত্ব নেয়ার কোনও ইচ্ছা ছিল না ওর।

আপনাকে পছন্দ করে না কেন? জানতে চাইল রানা।

আবারও হাসল হাবিব। কারণ মরিসকে আমি বলেছিলাম, এই মেয়েকে বিয়ে করতে যাবেন না।

আস্তে করে শ্বাস ফেলল রানা। বুঝতে পারছে, ওরা উইলকক্স আইস স্টেশনে আসবার আগে বহু কিছু ঘটেছে ওখানে।

মাউথপিস দুটো তৈরি? জানতে চাইল ও।

হ্যাঁ।

আমাদের এই আলাপ চলবে, উঠে দাঁড়াল রানা। কাঁধে ঝুলিয়ে নিচ্ছে স্কুবা ট্যাঙ্ক।

এক সেকেণ্ড ভাই, ধড়মড় করে উঠে দাঁড়াল হাবিব। আপনি আবারও ফিরবেন ওখানে? ফিরতে গিয়ে যদি মারা পড়েন? তা হলে তো আর কেউ বিশ্বাস করবে না আমার কথা।

কে বলল আপনার কথা বিশ্বাস করেছি? বলল রানা।

আপনি বিশ্বাস করেছেন। আমি জানি।

সেক্ষেত্রে আমার সঙ্গে চলুন, খুব খেয়াল রাখুন যেন বেমক্কা না মারা পড়ি, জানালার দিকে রওনা হয়ে গেছে রানা। চৌকাঠের সামনে গিয়ে সাগরের দিকে চাইল।

ফ্যাকাসে হয়ে গেছে রাশেদ হাবিবের মুখ। ঠিক আছে, ভাই, রওনা হওয়ার গতি একটু কমান। আপনার মনে আছে, স্টেশনের পুলের ভিতর ঘুরছে কিলার ওয়েইল? তা ছাড়া, ভয়ঙ্কর এক জাতের সিল আছে ওখানে। ওগুলো কিলার ওয়েইলকেও মেরে ফেলে…।

কান দিচ্ছে না রানা, জানালা দিয়ে চেয়ে আছে দূরে। দক্ষিণপশ্চিমে অনেক উঁচু ক্লিফের ওদিকে সামান্য ঝিলিক। ওই বাতি একটু পর পর জ্বলছে। উইলকক্স আইস স্টেশনের রেডিয়ো অ্যান্টেনা থেকেই আসছে ওই সবুজ আলো।

মিস্টার হাবিব, আপনি সঙ্গে আসতে পারেন, আবার রয়েও যেতে পারেন, কিন্তু আমি ফিরছি, ঘুরে চাইল রানা। উইলকক্স আইস স্টেশন আবারও দখল করে নেব।

১১.

উনিশ শ ষাট সালের বিশাল দুই ওয়েটসুট পরে বরফ-ঠাণ্ডা সাগরে পাশাপাশি সাঁতরে চলেছে মাসুদ রানা ও রাশেদ হাবিব। চারপাশে থমথমে নীরবতা। চল্লিশ বছরের বেশি পুরানো স্কুবা গিয়ার কাজ করছে ভাল ভাবেই।

ওদের দুজনের কোমরে সরু স্টিলের কেবল। উত্তর-পুবের উইলকক্স আইস স্টেশনের এক মাইল দূরের লিটল আমেরিকা৪-র সিলিখ্রিক্যাল স্কুলার থেকে এসেছে ওই দুটো তার। সতর্ক থাকবার জন্য এই ব্যবস্থা। ওদের কেউ হারিয়ে গেলে, বা আলাদা হয়ে গেলে, আবারও ফিরতে পারবে পরিত্যক্ত স্টেশনে।

লিটল আমেরিকা-৪ স্টেশনে পাওয়া হার্টুন গান এনেছে রানা।এখন সামনে তাক করে রেখেছে।

নীল ক্রিস্টালের মত পরিষ্কার চারপাশের পানি। বরফের উপকূলীয় তাকের নীচ দিয়ে চলেছে ওরা। এদিক-ওদিক বরফের তৈরি স্ট্যালাকটাইটের জঙ্গল।

রানার পরিকল্পনা হচ্ছে: আইস শেলফের নীচ দিয়ে সাঁতরে চলবে ওরা, হাজির হবে উইলকক্স আইস স্টেশনের নীচে। পানির উপর থেকে সবুজ বাতি দেখে এসেছে রানা, তখনই ঠিক করেছে, ওদের পজিশন কী হতে পারে। ওরা সাঁতার কাটবে ওই বাতি লক্ষ্য করে। একবার বরফের তাকের নীচে পৌঁছে গেলে নিজেরাই খুঁজে নিতে পারবে স্টেশনের নীচের পুল।

আপাতত সফেদ বরফের রাজ্যে এগিয়ে চলেছে রানা ও হাবিব। বিদঘুটে সব আকৃতি চারপাশে। একেকটা যেন উল্টো পাহাড়ের চূড়া। সব নেমে গেছে চার শ ফুট নীচে।

ডাইভিং মুখোশের ভিতর ভুরু কুঁচকে ফেলল রানা। ওদেরকে আরও অনেক নামতে হবে, তা হলেই পৌঁছতে পারবে স্টেশনের পুলের নীচে।

বিশাল এবড়োখেবড়ো এক বরফ-পাহাড়ের পাশ দিয়ে নামতে শুরু করেছে ওরা। মুখোশের ভিতর থেকে ধবল বরফের পোক্ত দেয়াল দেখছে রানা। বেশ কিছুক্ষণ পর সাদা বরফের উল্টো চূড়ার পাশে পৌঁছে গেল। চূড়ার নীচ দিয়ে চলেছে, উপরে এবং চারপাশে বরফ-শৃঙ্গ। আধ মিনিট যাওয়ার পর হঠাৎ করেই ধক করে উঠল রানার বুক।

ওটা পানিতে ঝুলছে, একটু দূরেই। উইঞ্চ কেবলের শেষে। খুব ধীরে ফিরছে।

ডাইভিং বেল।

আবারও স্টেশনে চলেছে ওটা।

এর মানে কী, বুঝে গেছে রানা। নীচে নিজের দলকে নামিয়ে দিয়েছে ব্রিটিশ কমাণ্ডার–গুণ্ডারসন। এখন এসএএস কমাণ্ডোরা উপরে উঠছে পাতাল-গুহার দিকে।

তিশা ও মোরশেদের কথা চট করে মনে পড়ল রানার। সতর্ক থাকলে ওরা ঠেকাতে পারবে এসএএস কমাণ্ডোদের হামলা।

আর এদিকে হাবিব আর ও চেপে বসবে ডাইভিং বেলে।. বিনা পয়সায় বিনা টিকিটে ফিরবে উইলকক্স আইস স্টেশনের পুলে। এ সুযোগ ছাড়া যায় না।

পানির ভিতর চরকির মত ঘুরল রানা, হাতের ইশারা করল হাবিবকে। পিছনেই ছিল বিজ্ঞানী, একটু আগে উল্টো পাহাড়ের চূড়ার নীচ দিয়ে এসেছে। গতি বাড়াবার ইঙ্গিত করল রানা, নিজে দ্রুত নাড়ছে দুই পা। ডাইভিং বেলের দিকে চলেছে ওরা।

.

নীচে ওরা কজন? নরম স্বরে বলল জুলিয়াস বি, গুণ্ডারসন।

চুপ করে থাকল হোসেন আরাফাত দবির।

হাঁটু গেড়ে বসে আছে ও। পিছনে দুই হাত আটকে দেয়া হয়েছে হ্যাণ্ডকাফে। পুলের পাশে ই-ডেকে নামিয়ে আনা হয়েছে ওকে। মুখ থেকে গলগল করে বেরুচ্ছে রক্ত। প্রায় বুজে এসেছে ফোলা বাম চোখ। মেরিকে নিয়ে দ্রুতগতি হোভারক্রাফট থেকে পড়বার পর ওকে আবারও উইলকক্স আইস স্টেশনে ফিরিয়ে এনেছে ব্রিটিশরা। স্টেশনে পৌঁছতেই ওকে হাজির করেছে ইডেকে গুণ্ডারসনের সামনে।

মিস্টার বোউলস্, বলল গুণ্ডারসন।

বিশালদেহী এসএএস কমাণ্ডো প্রচণ্ড ঘুষি বসিয়ে দিল দবিরের। চোয়ালে। ছিটকে গিয়ে মেঝের উপর ধুপ করে পড়ল দবির।

নীচে ওরা কজন? বলল গুণ্ডারসন। একহাতে দবিরের ম্যাগহুক।

কেউ না! রক্তাক্ত ও ভাঙা দাঁতের ভিতর থেকে বেরুল কথাগুলো। নীচে আমাদের কেউ নেই। লোক নামানোর সময় পাইনি আমরা।

তাই নাকি? হাসল গুণ্ডারসন। চিন্তিত চোখে ম্যাগহুক দেখছে। মিস্টার দবির, তুমি বড় মিথ্যা বলো। মাসুদ রানার মত সুযোগ্য কমাণ্ডার এত বড় ভুল করবে? তার প্রথম কাজই তো হওয়ার কথা এক স্কোয়াড সৈনিককে, পাতাল-গুহায় পাঠিয়ে দেয়া। উইলকক্স আইস স্টেশনে এসেই এই কাজ করেছে সে।

তা হলে তাকেই জিজ্ঞেস করুন।

সত্যি কথা বলো, মিস্টার দবির, নইলে হঠাৎ করেই রেগে উঠতে পারি। আর সেক্ষেত্রে সিংহের মুখে ফেলে দেব তোমাকে।

নীচে কেউ নেই, জোর দিয়ে বলল দবির।

ঠিক আছে, হাসল গুণ্ডারসন, ঝট করে পল সিংগারের দিকে ফিরল। মিস্টার সিংগার, মিস্টার দবির কি সত্যি বলছে?

মুখ তুলে ভাইপারের দিকে চাইল দবির।

সিংগারকে বলল গুণ্ডারসন, মিস্টার সিংগার, মিস্টার দবির মিথ্যা বললে ওকে মেরে ফেলব। আর তুমি যদি মিথ্যা বলো, তোমাকেও ছাড়ব না।

চোখে আকুতি নিয়ে সিংগারের দিকে চাইল দবির।

ভাইপার বলল, ও মিথ্যা বলেছে। নীচে চারজন। তিনজন সৈনিক, চতুর্থজন সিভিলিয়ান।

তোর মা বেশ্যা ছিল, শুয়োরের বাচ্চা! সিংগারের দিকে চেয়ে রইল দবির।

মিস্টার বোউলস, প্রকাণ্ডদেহী লোকটার দিকে ম্যাগহুক ছুঁড়ে দিল গুণ্ডারসন। এই হারামজাদাকে ঝুলিয়ে দাও।

.

খুব ধীরে উঠছে ডাইভিং বেল। ঘণ্টির ভিতর অংশে ঢুকে পড়েছে রানা ও হাবিব। ডাইভিং বেলের ভিতর পানির পুল দিয়ে উঠে এসেছে ওরা, পা রেখেছে ভিতর অংশে। ভিতরে ছোট্ট একটা পুল, এটাকে ঘিরে ইস্পাতের ডেক।

মাউথপিস সরিয়ে দিল হাবিব, হাঁ করে বাতাস নিতে শুরু করেছে। ফাঁকা ডাইভিং বেলের চারপাশ দেখে নিল রানা। এখন ওর অস্ত্র দরকার। এমন কিছু, যেটা পরে কাজে লাগবে।

ওদিকের দেয়ালে ডিজিটাল ডেপথ কাউন্টার। টিকটিক করে উল্টো ঘুরছে। ডাইভিং বেল উঠছে, কাজেই দেখিয়ে চলেছে ৩৬০ ফুট। কয়েক সেকেণ্ড পর দেখাল ৩৫৯ ফুট। তারপর ৩৫৮ ফুট।

হ্যা! বেলের আরেক পাশ থেকে বলে উঠল হাবিব।

ঘুরে চাইল রানা। ছোট এক টিভি মনিটরের সামনে দাড়িয়েছে হাবিব। ছাত থেকে ঝুলছে ওটা। একটা সুইচ টিপে দিয়ে বলল, এটার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম।

কী ওটা? জানতে চাইল রানা।

পাগলা আর্লিং কর্গানের আরেকটা খেলনা। মনে নেই বুড়ো লোকটার কথা বলেছিলাম? ওই যে, যে সারাদিন ধরে কিলার ওয়েইল দেখত? বলিনি? কৰ্গ্যান পানির নীচে ডাইভিং বেলের ভিতর থেকে ওগুলোকে গুনত।

সাদা-কালো মনিটর আগ্রহ নিয়ে দেখল রানা। হাবিবের ঘরে ই-ডেকের যে দৃশ্য দেখেছে, এখনও তাই। রিট্রাক্টেবল সেতুর নীচ থেকে ছবি পাঠাচ্ছে ক্যামেরা।

থমকে গেল রানা। মনিটরে লোকজনের নড়াচড়া!

এসএএস ট্রুপের হাতে উদ্যত অস্ত্র। খুঁটির সঙ্গে পল সিংগার। ধীরে ধীরে ই-ডেকে পায়চারি করছে জুলিয়াস বি. গুণ্ডারসন।

কিন্তু স্ক্রিনে আরেকজনকে দেখে চমকে গেল রানা।

ওই লোক গুণ্ডারসনের পায়ের সামনে পড়ে আছে। পরিষ্কার দেখা গেল মুখটা সার্জেন্ট হোসেন আরাফাত দবির!

.

ঠিক আছে, ওকে ঝুলিয়ে দাও, মিস্টার বোউলস্, বলল গুণ্ডারসন। এইমাত্র ম্যাগহুকের কেবল পেঁচিয়ে দেয়া হয়েছে দবিরের দুই গোড়ালিতে।

এরই ভিতর সি-ডেকের সেতুর ওপাশ থেকে ম্যাগহুকের দড়ি ঘুরিয়ে এনেছে আরেক লোক। একটা পুলি তৈরি করা হয়েছে।

আরেক ব্রিটিশ কমাণ্ডোর হাত থেকে লঞ্চার নিল বোউলস্, ই-ডেক ও ডি-ডেকের মাঝের মইয়ের ধাপে আটকে দিল। এবার কালো বোতাম টিপে দিল। দড়ি টেনে নিতে শুরু করেছে লঞ্চার।

সি-ডেকের সেতুর উপর কাজ শুরু করেছে পুলি। ই-ডেক, থেকে উপরে উঠছে হোসেন আরাফাত দবির। উল্টো হয়ে ঝুলছে সে। হ্যাণ্ডকাফে পিছমোড়া করে আটকে দেয়া হয়েছে দুই হাত। অসহায় ভাবে পুলের উপর ঝুলে গেল বেচারা, পানির দিকে তাক করা মাথা।

.

ওরা কী করছে? জানতে চাইল হাবিব। সাদা-কালো মনিটরে চেয়ে আছে অসহায় রানা।

ওদের অনেক দূরে হোসেন আরাফাত দবির, পুলের উপর নিজ ম্যাগহুক দিয়ে ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে তাকে।

হঠাৎ চমকে গেল রানা ও হাবিব। দুলে উঠেছে ডাইভিং বেল। দেয়ালে হাত রেখে সামলে নিতে চাইল ওরা।

কী হলো? চট করে জানতে চাইল হাবিব।

জবাব দিতে হলো না রানাকে।

উত্তর আছে জানালার ওপাশে।

ডাইভিং বেল ঘিরে উঠছে কালো-সাদা, বিশাল কী সব। বুঝতে দেরি হলো না ওদের, আবারও পুলের ভিতর হাজির হয়েছে কিলার ওয়েইল!

.

প্রথম ডরসাল ফিন পানি কেটে ভেসে উঠতেই গুঞ্জন উঠল এসএএস কমাণ্ডোদের ভিতর। তারা সংখ্যায় বিশজনের বেশি, উপস্থিত হয়েছে ই-ডেকের চারপাশে।

মাথা নিচু করে পুলের উপর ঝুলছে হোসেন আরাফাত দবির। সে-ও দেখেছে, প্রকাণ্ড কালো সব কিলার ওয়েইল। পানির নীচে পুলের কিনারা দিয়ে ঘুরছে। একবার ছটফট করে উঠল দবির, কিন্তু বুঝে গেল, মুক্তি নেই ওর। দুই হাত ও দুই পা ভালভাবেই আটকানো।

গলা থেকে খুলে আসছে চেইন ও লকেট। ওটা লকেট, নয়, খুব ছোট একটি কোরআন শরীফ। সৌদি আরব থেকে এনে দিয়েছিল ওর শালা। কয়েক সেকেণ্ড পর চেইন ও কোরআন শরীফ টুপ করে নামল পুলৈর ভিতর, রওনা হয়ে গেল অতল কূপে।

পুলের প্ল্যাটফর্ম থেকে কিলার ওয়েইলের দিকে চেয়ে আছে জুলিয়াস বি. গুণ্ডারসন। এবার দারুণ জমবে, মন্তব্য করল।

হঠাৎ তার সামনে এসে দাঁড়াল এক কর্পোরাল। এই লোকই আগে রিপোর্ট দিতে এসেছিল। স্যর, ট্রাইটোনাল চার্জ বসানো শেষ। পুরু ক্যালকুলেটারের মত ছোট কালো ইউনিট বাড়িয়ে দিল সে। কিপ্যাডে কয়েকটি নম্বর। ডেটোনেশন ইউনিট, স্যর।

ওটা নিল গুণ্ডারসন। বাইরের মার্কার দেখে কী মনে হলো?

পেরিমিটারে পাঁচজন কর্পোরাল, স্যর। লেসার রেঞ্জফাইণ্ডার নিয়ে পাহারা দিচ্ছে। শেষবার চেক করা হয়েছে একটু আগে। পঞ্চাশ মাইলের ভেতর কেউ নেই, স্যর।

গুড, বলল গুণ্ডারসন। ভেরি গুড।

আবারও পুলের দিকে চাইল সে। পানির বিশ ফুট উপরে ঝুলছে বাংলাদেশ আর্মির সার্জেন্ট হোসেন আরাফাত দবির।

এবার একটু মজা করার সময় হয়েছে, বলল গুণ্ডারসন।

.

যদি আরও জোরে উঠত, ডেপথ কাউন্টারের দিকে চেয়ে আছে রানা। .

কাউন্টার খুব ধীরে নীচে নামছে। অনেক ধীরে উঠছে ডাইভিং বেল। এখনও পুরো এক শ নব্বই ফুট উঠতে হবে। সারফেসে পৌঁছুতে কমপক্ষে সাত মিনিট বাকি।

মনিটরে হোসেন আরাফাত দবিরের দিকে চেয়ে রইল রানা। বিড়বিড় করে কাউকে গালি দিচ্ছে।

.

মিস্টার বোউলস, ডাক দিল গুণ্ডারসন।

ম্যাগহুকের নির্দিষ্ট বাটন টিপে দিল বোউলস, সঙ্গে সঙ্গে দড়ি ছাড়তে শুরু করল ম্যাগহুক। মাথা নিচু করে পুলের দিকে নামছে হোসেন আরাফাত দবির।

পুলের ভিতর ছলকে উঠছে পানি। নানান দিকে ঘুরছে কিলার ওয়েইল। হঠাৎ ওগুলোর একটা ভেসে উঠল সারফেসে। যেন চেয়ে আছে দবিরের চোখে! ব্লোয়োল দিয়ে পানি ছুঁড়ল উপরে।

পানির দিকে নেমে আসছে দবির। পুলের একফুট আগে থেমে গেল ওর মাথা। হঠাৎ করেই ঝাঁকি খেয়ে থেমে গেছে ম্যাকক।

এই যে, মিস্টার দবির! ডেকের নিরাপদ দূরত্ব থেকে গলা ছাড়ল গুণ্ডারসন।

কী? জানতে চাইল দবির।

রুল ব্রিটানিয়া, মিস্টার দবির!

আবারও বাটন টিপল বোউলস, পানির নীচে তলিয়ে গেল দবিরের মাথা ও বুক।

.

পানির নীচে সাদা এক সারি দাঁত দেখল দবির। এইমাত্র ওকে পাশ কাটিয়েছে কিলার ওয়েইলটা!

বিস্ফারিত হয়ে গেল ওর দুই চোখ।

এতগুলো কিলার ওয়েইল!

যেন কালো-সাদা একদল দানবের ভিতর আটকা পড়েছে ও!

চারপাশে ঘুরছে ওই বিভীষিকাগুলো!–

হঠাৎ করেই একটা তিমি লক্ষ করল দবিরকে। একই সময়ে তাকে দেখেছে দবিরও। পানির ভিতর ঘুরে গেছে ওটা, অনেক গতি তুলে আসছে।

মাথা নিচু করে পানির ভিতর ঝুলছে দবিরের শরীর। কোথাও যাওয়ার নেই, কিছু করার নেই, নড়তে পারবে না চাইলেও।

ছুটে আসছে খুনি তিমি!

পানির ভিতর থেকে দবির শুনতে পেল, না, হই-হই করে উঠেছে এসএএস কমাণ্ডো ইউনিট। বিশাল ডরসাল ফিন ছুটে আসছে দবিরের দিকে।

.

ডাইভিং বেলের সাদা-কালো মনিটরে চোখ আটকে গেছে রানার।

দবির, বিড়বিড় করল রানা। কোনও কৌশল… চুপ হয়ে গেল। বুঝতে পারছে, মানুষটার কিছুই করবার নেই। ওর-ও কিছু করবার নেই!

.

পিছমোড়া হাতদুটো খুলে নিতে চাইল দবির। কাফ খুলল না।

ওর দিকে তেড়ে আসছে কিলার ওয়েইল।

গতি অনেক বেড়েছে।

এক পাশে কাত হয়ে গেল, হাঁ করল মস্ত চোয়াল।

সাৎ করে দবিরকে পাশ কাটাল খুনি তিমি। খসখসে চামড়ার স্পর্শ পেল দবির। শুনতে পেল না, বু, বু, বু বলে আপত্তি তুলছে এসএএস কমাণ্ডোরা।

.

ডাইভিং বেলের ভিতর স্বস্তির শ্বাস ফেলল রানা।

এবার আর বাঁচবে না মানুষটা, রানার পিছন থেকে বলল হাবিব।

কী বলতে চান?

আগেও বলেছি, ওই তিমি পাশ কাটাবার সময় অন্যদেরকে বুঝিয়ে দিয়েছে, এটা আমার শিকার। এবার খেয়ে ফেলবে আপনার সার্জেন্টকে।

.

রাগে-ক্ষোভে থরথর করে কাঁপছে দবির। কিছুই কি করবার নেই ওর?

ছটফট করছে, কিন্তু হাত ছুটিয়ে নিতে পারছে না।

হ্যাণ্ডকাফ খুলতে পারলে…

আবারও সেই খুনি তিমিকে দেখল দবির। দ্বিতীয়বারের মত আসছে!

বিক্ষিপ্ত পানির ভিতর অনেক গতি তুলেছে ওটা, গতি আরও বাড়ছে। বিশেষ কোনও উদ্দেশ্য নিয়ে ছুটে আসছে ওর দিকে। উঁচু ডরসাল ফিন থৈকে দুপাশে ছুটছে স্রোত।

আবারও কিলার হোয়েলের চোয়াল হাঁ হয়ে গেছে। সাদা দাঁত ও লালচে জিভ দেখল দবির।

ওটা যত কাছে আসছে, ভয় বাড়ছে দবিরের।

এবার একপাশে কাত হয়নি এই তিমি!

আগের মত পাশ কাটিয়েও গেল না।

ভয়ঙ্কর গতি তুলে সাত টন ওজনের তিমি গুঁতো দিল দবিরকে।

কী ওকে আঘাত হানল, বুঝবার আগেই দবিরের মাথা ঢুকে গেল মস্ত তিমির চোয়ালের ভিতর।

.

ডাইভিং বেলের ভিতর, মনিটরে চোখ রেখে হতবাক হয়ে গেছে রানা।

হায় আল্লা, ওর পিছনে মস্ত শ্বাস ফেলল হাবিব।

মনিটরে ভয়ঙ্কর দৃশ্য,

ঝরঝর করে ছিটিয়ে পড়ছে তাজা রক্ত, মিশে যাচ্ছে নীল পানিতে। ঝুলন্ত দবিরের উর্ধ্বাঙ্গ চিবাতে শুরু করেছে তিমি। বুক পর্যন্ত খাওয়া শেষে লাশের উরুতে কামড় বসাল। দড়ি থেকে ছুটিয়ে আনতে চাইছে দেহাবশিষ্ট। পানির ভিতর শুরু হয়েছে ভয়ঙ্কর সব ঝাঁকুনি। যেন বোটের বাইরে কেউ গ্র্যাপলিং হুক দিয়ে ধরেছে মাংস, আর তা ছুটিয়ে নিতে চাইছে শ্বেত-হাঙর।

কিছুই ভাবতে পারছে না রানা। মাথা নিচু হয়ে মিশে গেছে বুকে।

ওর পিছনে ছোট পুলের ভিতর হড়হড় করে বমি করল রাশেদ হাবিব।

.

একটু আগে চলে গেছে তিশা, আবারও ফিরেছে গুহার আরেক প্রান্তে, ফাটলের সামনে। পাতাল-গুহায় বিমানের কিপ্যাডের স্ক্রিনে চেয়ে আছে নিনা ভিসার ও সার্জেন্ট জনি ওয়াকার।

২৪১৫৭৮১৭——–

এন্টার অথারাইযড এন্ট্রি কোড

এটার মাধ্যমে বিমানে ঢুকতে হবে, বলল নিনা ভিসার।

স্ক্রিনে আপাতত আট ডিজিট দেখা যাচ্ছে: ২৪১৫৭৮১৭। তারপর রয়েছে ষোলোটি ফাঁকা ঘর, এগুলো পূরণ করলে মিলবে এন্ট্রি কোড।

যোলোটা অক্ষর বা সংখ্যা পূরণ করতে হবে, বলল জনি ওয়াকার। কিন্তু বুঝব কী করে এন্ট্রি কোড কী?

আরও সংখ্যা বসাতে হবে, চিন্তিত সুরে বলল নিনা ভিসার। সম্ভাবনা বেশি, ওটা কোনও নিউমেরিক্যাল কোড। স্ক্রিনের এই আট সংখ্যা শেষে ওগুলো বসালে কোড পূরণ হবে।

আমরা যদি বের করতেও পারি কোড, ফাঁকা জায়গায় সেটা বসাব কী করে? বলল ওয়াকার।

সামনে ঝুঁকে গেল নিনা ভিসার, কালো কিপ্যাডের প্রথম বাটন টিপে দিল।

এক সেকেণ্ড পর স্ক্রিনে প্রথম শূন্যস্থানে ভেসে উঠল ১ সংখ্যা

ভুরু কুঁচকাল ওয়াকার। আপনি বুঝলেন কী করে?

কাঁধ ঝাঁকাল নিনা। সহজ। ইট্রাকশন যখন ইংরেজি, তো ধরে নিতে পারি এই জিনিস তৈরি করেছে কোনও মানুষ। তার মানে, কিপ্যাডও মানুষেরই তৈরি। কাজেই বুঝেছি, এটা সাধারণ কিপ্যাড। ক্যালকুলেটার বা টেলিফোনের ডায়ালের মতই সংখ্যা বসাতে হবে। এমনও হতে পারে, এটা যে তৈরি করেছে, সে আর এখানে সংখ্যা বসাতে পারেনি।

দ্বিতীয় বাটন টিপল নিনা।

২ সংখ্যা দেখা দিল প্রথম সংখ্যার পরে।

হেসে ফেলল নিনা। আপন মনে বলল, ষোলো সংখ্যার কোড, সবমিলে আছে দশটা ডিজিট, এ থেকে বাছাই করে নিতে হবে। …সর্বনাশ! তার মানে, কমবিনেশন হতে পারে কয়েক ট্রিলিয়ন।

আপনি কোড ভাঙতে পারবেন? জানতে চাইল ওয়াকার।

জানি না, বলল নিনা। আগে বুঝতে হবে প্রথম আট সংখ্যা দিয়ে কী বুঝিয়েছে। সেক্ষেত্রে হয়তো বেরুবে কোড কী হতে পারে।

সামনে ঝুঁকল ওয়াকার, প্রথম বাটন একে একে চোদ্দবার টিপতে শুরু করেছে। দ্রুত কমে আসছে শূন্যস্থান।

হঠাৎ বিপ আওয়াজ হলো স্ক্রিনে। এবার স্ক্রিনের নীচে নতুন তথ্য ভেসে উঠল;

২৪১৫৭৮১৭১২১১১১১১১১১১১১১১
        ইনকারেক্ট কোড এন্টার্ড

এন্ট্রি ডিনাইড

এন্টার অথারাইযড এন্ট্রি কোড

আবারও স্ক্রিনে দেখা দিল আগের সেই আট সংখ্যা। তার শেষে ষোলোটি শূন্যস্থান।

হতবাক হয়ে জনি ওয়াকারের দিকে চেয়ে আছে নিনা ভিসার। কয়েক সেকেণ্ড পর বলল, আপনি কীভাবে জানলেন এমন হবে?

হাসল ওয়াকার। প্রথমবারে এন্ট্রি কোড বসাতে ভুল হতেই পারে। এটা বেশির ভাগ মিলিটারি এন্ট্রি-কোড সিস্টেমের মত।

.

গুহার আরেক প্রান্তে লেফটেন্যান্ট তিশা করিম। বরফের দেয়ালের নীচে, ফাটলের সামনে ঝুঁকে বসেছে, ভিতরে তাক করেছে ফ্লাশলাইট!

এই পাতাল-গুহার বিষয়ে আরও তথ্য চাইছে, তিশা। এই গুহা এবং মানুষের তৈরি ওই বিমান স্পেসশিপ ওকে সত্যি খুব আগ্রহী করে তুলেছে। অনেক কথাই মনে আসছে ওর।

ফাটলের ভিতর উঁকি দিল তিশা। উজ্জ্বল আলোয় ওদিকে দেখা গেল আরেকটা গুহা। গোলাকার সুড়ঙ্গ, দেয়াল বরফের, ডানদিকে চলে গেছে। ফাটলের ওপাশে পাঁচ ফুট নীচে মেঝে।

চিত হয়ে শুয়ে পড়ল তিশা, ছেড়ে চলে গেল ফাটলের ভিতর। নতুন এই গুহার মেঝেতে নামতে শুরু করেছে। কিন্তু হঠাৎ করেই পিঠের নীচ থেকে ধসে গেল বরফের মেঝে, বেকায়দা ভাবে ধুপ করে পড়ে গেল তিশা।

মেঝেতে পড়বার সময় ধুম! আওয়াজ হয়েছে। ছোট গুহার ভিতর বারবার ফিরছে ওই অওয়াজ! শুনলে মনে হয় বড় হাতুড়ি দিয়ে লোহার উপর ঘা দেয়া হয়েছে।

ধড়মড় করে উঠে দাঁড়াল তিশা।

পায়ের নীচে কি স্টিল?

মেঝের দিকে মনোযোগ দিল তিশা। মেঝের উপর পাতলা বরফের আস্তরণ। তার ভিতর দিয়ে পরিষ্কার চোখে পড়ল রিভেট।

বিস্ফারিত হলো ওর দুই চোখ। এখানে গোল মাথাওয়ালা রিভেট কোত্থেকে আসে?

জিনিসটা ধাতুর তৈরি।

পুরু মেঝে! রিইনফোর্সড ধাতু!

ছোট গুহার ভিতর ফ্লাশলাইটের আলো ঘুরিয়ে আনল তিশা। জায়গাটা সিলিণ্ডারের মত। অনেকটা রেলগাড়ির সুড়ঙ্গের সঙ্গে মিল আছে। গোলচে ছাত, যে ফাটল দিয়ে নেমে এসেছে, সেটা ছাড়িয়ে অনেক উপরে উঠেছে দেয়াল। ফাটলের উপরে খুব পাতলা বরফের দেয়াল, আলো পড়ে ওদিকটা স্বচ্ছ কাচের মত দেখাচ্ছে।

ফ্লাশলাইটের আলোয় আরেকবার চারপাশ দেখে নিল তিশা। সামনের দিকে গেছে গুহা। তারপর ওর চোখে পড়ল ওটা।

কোনও ধরনের দরজা। ধূসর রঙের, ভারী ইস্পাতের। বরফের দেয়ালে বসিয়ে দেয়া। পুরু কবাট ঢাকা পড়েছে বরফের পাতলা আস্তরণে। দরজাটা জাহাজ বা সাবমেরিনের মস্ত কোনও হ্যাচের মত। কবজাসহ শক্তপোক্ত ধাতব বালকহেডের ভিতর, বসানো।

এটা এখানে কেন! বিড়বিড় করল তিশা।

১২.

ওয়াশিংটন ডি.সি.তে তৃতীয়বারের মত ফোন করেছে অ্যাডোনিস ক্যাসেডিন, বসে আছে রবিন কার্লটনের ড্রইংরুমে।

দ্য ওয়াশিংটন পোস্টের অফিসে এবার ঠিকই কল রিসিভ করল তার স্ত্রী। সরি, ডারলিং।

ছিলে কোথায়? ভুরু কুঁচকে ফেলল ক্যাসেডিন। সারা দুপুর ধরে তোমাকে কল করছি!

খুব ব্যস্ত ছিলাম, খেয়াল করিনি কল আসছে। সামান্য বিরতি নিয়ে বলল সান্থা, বললেও বিশ্বাস করবে না, কী পেয়েছি।

এবার খুলে বলল, অল স্টেটস লাইব্রেরির ডেটাবেসে কী দেখেছে। সেটি অফিস থেকে পাওয়া ল্যাটিচুড ও লংগিচুড ব্যবহার করে খুঁজে বের করেছে অ্যান্টার্কটিকার উইলকক্স আইস স্টেশন।

ক্যাসেডিন বের করল সেটি থেকে পাওয়া মূল নোট, কথা শুনতে শুনতে চোখ বোলাতে শুরু করেছে ওটার উপর।

সান্থা আগ্রহ নিয়ে বলছে, ওই আইস স্টেশনে কোন ধরনের অ্যাকাডেমিকরা বাস করেছেন। তাঁরা বেশ কিছু পেপার্স বা বই লিখেছেন স্টেশনে থাকাকালীন। লাইব্রেরি অভ কংগ্রেসে গিয়ে শ্যারন স্টোনের বই প্রিলিমিনারি সার্ভে পায়নি, সেটাও জানাল।

ট্ৰেভল রয়েস নামের এক লোক উনিশ শ ঊনআশি সালে বইটা হাপিস করে দেন, বলল সান্থা।

ভুরু কুঁচকে গেল ক্যাসেডিনের। রয়েস? ট্রেভল রয়েস? উনি জয়েন্ট চিফস অভ স্টাফের অধীনে নিক্সন আমলে…

প্রেসিডেন্ট কার্টারের সময়েও, বলল সান্থা।

ড্রইংরুমে ফিরে এসেছে রবিন কার্লটন। ট্রেভল রয়েস। . সম্পর্কে কিছু বললেন আপনি?

হ্যাঁ, বলল ক্যাসেডিন। মোবাইল ফোনে স্পিকার বাটন টিপল ও। এবার মোবাইল ফোনে ওর স্ত্রী আলাপে যোগ দিতে পারবে। ট্রেভল রয়েস! চেনেন বা শুনেছেন এই নাম?

শুনেছি, বলল রবিন কার্লটন। উনি এয়ার ফোর্সে ছিলেন। পুরো কর্নেল হন। উনিশ শ ঊনআশি সালে একটা বিমান নিয়ে উধাও হন। আর ফেরেননি। 

হ্যাঁ, ওই লোকই, ফোনে বলল সান্থা। ক্যাসি, তোমার সঙ্গে কে?

ইনি রবিন কার্লটন, বলল ক্যাসেডিন। যার সঙ্গে দেখা করতে আসার কথা ছিল।

আপনার সঙ্গে পরিচিত হয়ে খুশি হলাম, মিস্টার কার্লটন, বলল সান্থা। হ্যাঁ, আপনি ঠিকই বলেছেন, ট্রেভল রয়েস রুপালি রঙের এক এয়ার ফোর্স বোয়িং সেভেন-টু-সেভেন নিয়ে উড়াল দেন। উনিশ শ ঊনআশি সালের তিরিশে ডিসেম্বরের রাত ছিল ওটা { কোথায় চলেছেন কাউকে বলা হয়নি। আর কখনও ফিরেও আসেননি।

কোথায় চলেছেন তার কোনও রেকর্ড নেই? জানতে চাইল ক্যাসেডিন।

ওটা ক্লাসিফায়েড, বেইবে, বলল সান্থা। অবশ্য, আমি ভদ্রলোকের ইতিহাস ঘেঁটেছি। ভিয়েতনামে ফ্যান্টম বিমান চালাতেন। ঊনিশ শ পঁয়ষট্টি সালে মেকং ডেল্টায় গুলি খেয়ে পড়ে যায় তাঁর বিমান। পুরো এক বছর বন্দি ছিলেন। দুই পা ভেঙে দেয়া হয়। ছিষট্টিতে উদ্ধার পান। এরপর পেন্টাগনে ডেস্কের কাজে বসিয়ে দেয়া হয়। আটষট্টি থেকে শুরু করে চুয়াত্তর পর্যন্ত প্রকিউরমেন্ট ডিভিশনে কাজ করেন। উনিশ শ বাহাত্তর সালে জয়েন্ট অভ স্টাফের জন্য তাকে নিয়োগ দেন নিক্সন। ওই একই কাজ করেন কার্টারের অধীনেও।

উনিশ শ সাতাত্তর সালে স্টেলথ প্রজেক্টের সঙ্গে জড়িত হন। এয়ার ফোর্স সিলেকশন কমিটিতে ছিলেন। এঁরাই নজ্রপ-বোয়িং কোম্পানির বি-২ স্টেলথ বম্বার বেছে নেন। অফিশিয়াল রেকর্ড অনুযায়ী: ট্রেভল রয়েস টেণ্ডারের অন্য প্রতিযোগী জেনারেল অ্যারোনটিক্স ও ক্যালিফোর্নিয়ার ছোট এক ইলেক্ট্রনিক্স কোম্পানি হাইটেক লিমিটেডের পক্ষে ভোট দেন এবং হেরেও যান।

তো বলো দেখি, ভদ্রলোক একটা প্রিলিমিনারি ল্যাণ্ড সার্ভে চুরি করতে গেলেন কেন? বলল ক্যাসেডিন। কোথাকার এক ইউনিভার্সিটির বই, সেটা আবার অ্যান্টার্কটিকার কোনও রিসার্চ স্টেশনের উপর লেখা! কারণটা কী?

ব্যাপার তো এখানেই, বলল সান্থা। আমার ধারণা বর্তমানের স্টেশন নয় ওটা।

এ থেকে কী বুঝব?

আমি এখন একটা বইয়ের দিকে চেয়ে আছি, বলল সান্থা। এই বইয়ের লেখিকা লিখেছেন, উইলকক্স আইস স্টেশন তৈরি করা হয়েছে উনিশ শ একানব্বই সালে।

আচ্ছা?

কিন্তু ট্রেভল রয়েস উধাও হন ঊনিশ শ ঊনআশি সালের ডিসেম্বরে।

তো?

আমার মনে হচ্ছে, ট্রেভল এর অনেক বছর আগে অন্য কোনও স্টেশনে গেছেন। উইলকক্স আইস স্টেশন তখনও তৈরিই হয়নি।

নীরব হয়ে গেল লাইন। তারপর আবারও বলল সান্থা, আমার ধারণা, ওখানে ওগুলো দুটো আলাদা স্টেশন। একই জায়গায় তৈরি করা হয়েছিল। একটা ঊনিশ শ আটাত্তর সালে, ওটার কথা লিখেছেন শ্যারন স্টোন। আর দ্বিতীয়টা তৈরি করা হয়েছে উনিশ শ একানব্বই সালে।

তার মানে, প্রথমটার উপরে তৈরি হয়েছে পরের স্টেশন? বলল ক্যাসেডিন।

পরে যারা স্টেশন তৈরি করেছে, তারা বোধহয় জানেও না নীচে আরেকটা স্টেশন আছে, বলল সান্থা। নিনা ভিসার তার বইয়ে আগের স্টেশনের কথা একবারও উল্লেখ করেননি।

আগেরটার নাম কী? বলল ক্যাসেডিন। রয়েস স্টেশন?

কে জানে, কী নাম ছিল ওই স্টেশনের; বলল সান্থা।

‘সেটি’ থেকে পাওয়া নোট টেবিলে রেখেছে ক্যাসেডিন, আর কার্লটনের চোখ পড়েছে ওটার উপর। তুলে নিয়ে পড়তে শুরু করেছে।

আমার অবস্থা তো বুঝতেই পারছ, বলল সান্থা। তোমার কী অবস্থা? জরুরি কোনও তথ্য পেলে?

তা বলতে পারো, বলল ক্যাসেডিন। মনে পড়ে গেছে, কী শুনেছে। রবিন কালটনের ইউনিটকে মেরে সাফ করে দিয়েছে দ্য ইন্টেলিজেন্স কনভার্জেন্স গ্রুপ।

আরে! হঠাৎ টেবিলের ওপাশ থেকে বলে উঠল রবিন কার্লটন। তুলে ধরেছে নোট। আপনি এটা কোথেকে পেলেন?

কাগজে লেখা:

..কপি, ওয়ান-টু-ফাইভ-সিক্স-ওয়ান-সিক্স…
..আয়োনোস্কেরিক সমস্যায় যোগাযোগ হারিয়ে…
..সামনের দল…
..মাসুদ রানা…
.. সিক্সটি-সিক্স পয়েন্ট ফাইভ…
.সোলার ফ্লেয়ার বারোটা বাজাচ্ছে রেডিয়োর…
..ওয়ান-ফিফটিন, টোয়েন্টি মিনিটস, টুয়েলভ সেকেণ্ড ইস্ট…
..কী করে… কড়কড় করছে। …চলে যাও, যাতে…
..রওনা হয়েছে দ্বিতীয় টিম…।

           ‘সেটি’ অফিসে কেন গিয়েছিল, রবিন কালর্টনকে খুলে বলল ক্যাসেডিন।

আর এই কোঅর্ডিনেটস, বলল কার্লটন, মাইনাস সিক্সটিসিক্স পয়েন্ট ফাইভ বা ওয়ান-ফিফটিন, টোয়েন্টি মিনিটস, টুয়েলভ সেকেণ্ড ইস্ট–এগুলো অ্যান্টার্কটিকার একটা রিসার্চ স্টেশনের?

হ্যাঁ, বলল ক্যাসেডিন।

শীতল চোখে তার দিকে চাইল কার্লটন। মিস্টার ক্যাসেডিন, মেরিন ফোর্সের রিকনিস্যান্স ইউনিট সম্পর্কে আপনি কতটা–জানেন?

তেমন কিছুই না। শুধু আপনার কাছ থেকে যা শুনেছি।

সামনে একটা দল আছে, আনমনে বলল রবিন কার্লটন।

হ্যাঁ, তাই তো বলেছে, কাগজের দিকে চাইল ক্যাসেডিন। রওনা হয়েছে দ্বিতীয় টিমও।

তার চেয়ে বড় কথা, মাসুদ রানা… চোখ তুলে চাইল রবিন কার্লটন।

ক্যাসেডিন জানতে চাইল, মাসুদ রানা কী? কোনও অপারেশনের নাম?

না, বলল কার্লটন। মাসুদ রানা একজন লোকের নাম। সে আগে বাংলাদেশ আর্মির মেজর ছিল। আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। আমাকে যখন পেরুর, ওই মন্দিরে খুন করার চেষ্টা চলছিল, তখন কাছাকাছিই ছিল না। পরে জেনেছি, কীভাবে যেন খবর পেয়ে ও সাহায্য করতে গিয়েছিল। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও ভেতরে ঢুকতে পারেনি। ওকে আটকে দিয়েছিল ইন্টেলিজেন্স কনভার্জেন্স গ্রুপের দালালরা।

সে আরও কিছু বলবে, সেজন্য অপেক্ষা করছে ক্যাসেডিন। কিন্তু কিছুই বলছে না কার্লটন।

তারপর হঠাৎ করেই ক্যাসেডিনের চোখে সরাসরি চাইল কার্লটন। আমার বন্ধু এখন ওখানে, নিচু স্বরে বলল। ওখানে!

তাতে কী? জানতে চাইল ক্যাসেডিন।

ওখানে দ্বিতীয় দল পাঠানো হয়েছে। তার মানে… চুপ করে গেছে।

অপেক্ষা করছে ক্যাসেডিন এবং তার স্ত্রী।

আবারও কাগজের দিকে চাইল কার্লটন। হায় যিশু! এবার চট করে বলল, একটু অপেক্ষা করুন। আমাকে এখনই একটা ফোন করতে হবে।

অপেক্ষা করছে ক্যাসেডিন ও সান্থা। বুক-পকেট থেকে মোবাইল ফোন নিয়ে দ্রুত ডায়াল করল কার্লটন।

হ্যাঁ, পার্সোনেল ডিপার্টমেন্ট, প্লিয, ফোনে বলল। কয়েক সেকেণ্ড পর বলল, হ্যাঁ, অ্যান্টার্কটিকা। মেরিন কর্পস। এদের সঙ্গে বাংলাদেশ আর্মির মেজর মাসুদ রানা আছেন। …তার পারিবারিক সমস্যার কথা… হ্যাঁ, আমি ফোনে অপেক্ষা করছি।

পুরো একমিনিট পেরুল, তারপর আবারও লাইনে এল কেউ।

হ্যাঁ, বলুন, বলল রবিন কার্লটন। হ্যাঁ, আমি ওঁর শালা, জর্জ, চুপ করে শুনছে সে। হায় যিশু, নরম স্বরে বলল, হায় ঈশ্বর, ঠিক আছে। ধন্যবাদ।

পকেটে ফোন রেখে দিল কার্লটন। বিড়বিড় করে গালি দিল কাকে যেন।

কী শুনলেন? জানতে চাইল ক্যাসেডিন।

ইউনাইটেড স্টেটস মেরিন কর্পসের পার্সোনেল ডিপার্টমেন্ট থেকে জানাল, কয়েকজন মেরিনের সঙ্গে দক্ষিণ সাগরে ট্রেইনিঙে গিয়ে মারা পড়েছেন মেজর মাসুদ রানা। গতকাল সকাল সাড়ে নটায় মারা যান। দুঃখজনক দুর্ঘটনার বিষয়টি বাংলাদেশ সরকারকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে।

ভদ্রলোক মারা গেছেন? ভুরু কুঁচকে ফেলেছে ক্যাসেডিন।

এদের কথা অনুযায়ী, বলল কার্লটন। কিন্তু বাস্তবের সঙ্গে তাদের কথা মিলবে, এমন না-ও হতে পারে। ওদের খাতাপত্রে আমিও তো মৃত। এক মুহূর্ত ভাবল সে, তারপর বলল, দ্বিতীয় দল…।

তাদের ব্যাপারে কী?

এখন উইলকক্স আইস স্টেশনে চলেছে দ্বিতীয় দল।

হ্যাঁ, তো?

ইউনাইটেড স্টেটস মেরিন কর্পসের তরফ থেকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে, মাসুদ রানা অনেক আগেই মরেছে। দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মনে হলো কার্লটনকে। তার মানে, ওই স্টেশনে অস্বাভাবিক কিছু পেয়েছে রানা। এখন ওকে মেরে ফেলা হচ্ছে বা হবে।

.

আবারও স্ত্রীকে ফোন করল ক্যাসেডিন। হাই-হ্যালোর ভিতর গেল না, সরাসরি বলল, ঠিক আছে, এবার দেরি না করে পাঠিয়ে দাও।

দাড়াও, এক সেকেণ্ড, বলল সান্থা। ক্যাসেডিন শুনতে পেল, ওপাশে কমপিউটারের কি-বোর্ড টেপা হচ্ছে।

এবার সেণ্ড করে দিলাম, বলল সান্থা।

এদিকে ড্রইংরুমের আরেক পাশে কমপিউটারের সামনে বসেছে রবিন কার্লটন। কয়েকটা স্ক্রিনে ক্লিক করল, এক সেকেণ্ড পর বেরিয়ে এল ই-মেইল স্ক্রিন।

পাতার নীচে ইনফর্মেশন বার-এ টিপটিপ করছে আলো:

ইউ হ্যাভ নিউ মেইল।

ওপেন আইকনে ক্লিক করল কার্লটন।

এক সেকেণ্ড পর মনিটরে বড় একটা পাতা খুলে গেল।

অল-স্টেটস্ লাইব্রেরি ডেটাবেস
        সার্চ বাই কি-ওঅর্ড
        সার্চ স্ট্রিং ইউজড
        ল্যাটিচ্যুড–৬৬.৫* লংগিচ্যুড ১১৫* ২০’ ১২”

নং অভ এন্ট্রিজ ফাউণ্ড: সিক্স।

টাইটেল: দ্য আইস ক্রুসেড: রিফ্লেকশন্স অন।
এ ইয়ার স্পেন্ট ইন অ্যান্টার্কটিকা। অথার:
এন ভিসার, হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি, ২০০৯।

টাইটেল: ডক্টরাল থিসিস। অথার: রবার্ট
হিগিন্স, স্ট্যানফর, ১৯৯৯।

টাইটেল: ডক্টরাল থিসিস। অথার: জর্জ
হিউবার্ট, স্ট্যানফর, ১৯৯৮।

টাইটেল: পোস্ট-ডক্টরাল থিসিস। অথার:
এম ভিসার, ইউএসসি, সিটি, ১৯৯৭।

টাইটেল: ফেলোশিপ গ্র্যান্ট রিসার্চ পেপার।
এম ভিসার, হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি, ১৯৯৪।

টাইটেল: প্রলিমিনারি সার্ভে। অথার: শ্যারন
স্টোন, লাইকং, ১৯৭৮।

        কার্লটন ও ক্যাসেভিনের জন্য অল স্টেটস্ ডেটাবেস থেকে পাওয়া লিস্ট পাঠিয়ে দিয়েছে সান্থা ক্যাসেডিন।

কাজের কাজ করেছ, স্ত্রীকে বলল ক্যাসেডিন।

তা তো আমি জানিই, কিন্তু ওটা দিয়ে কী করবে তোমরা? স্পিকার ফোনে জানতে চাইল সান্থা। 

এই লিস্ট থেকে ঠিকানা বের করব, বলল রবিন কার্লটন। দ্রুত কি-বোর্ডে আঙুল চলছে। অ্যান্টার্কটিকায় আমেরিকান যেসব অ্যাকাডেমিক আছেন, তাঁদের ই-মেইল ঠিকানা বের করতে পারলে রানার কাছে ই-মেইল করতে পারব।

বেশিরভাগ ইউনিভার্সিটি প্রফেসরদের ই-মেইল থাকে, স্ত্রীকে বলল ক্যাসেডিন। আর উইলকক্স আইস স্টেশনে স্যাটালাইট ফোন না থেকেই পারে না, কাজেই মেসেজ ঠিকই পৌঁছবে।

হঠাৎ বলে উঠল কার্লটন, হ্যাঁ, একটা ঠিকানা পেয়েছি। নিনা ভিসার, হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির ই-মেইল। এক্সটারনাল অ্যাড্রেসও দিয়েছে: নিনাভিসার @ উইলকক্স.এডু.ইউএস.। এবার এতেই চলবে। ওই স্টেশনে যে-কারও কমপিউটারে মেসেজ পাঠাতে পারব।

কাজটা শেষ করুন,বলল ক্যাসেডিন।

মেসেজ টাইপ করল কার্লটন, তারপর দেরি না করে কাট করে পেস্ট করে দিল। কাজ শেষে খটাস করে টিপে দিল সেও বাটন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *