ডেথ ট্র্যাপ ১.২

১৫.

জ্বলজ্বলে সবুজ আলোয় ভরে উঠেছে চারপাশ। নাইট-ভিশন গগলস্ পরে ই-ডেক ও ডি-ডেকের মাঝের রাং-ল্যাডার বেয়ে খুব ধীরে, সাবধানে উঠছে মাসুদ রানা। প্রশিক্ষকের কথা মনে পড়ছে ওর। ভদ্রলোক বলেছিলেন: মনে রাখবেন, চোখে নাইট-ভিশন গগলস্ মানেই কম পাওয়ারের বিনকিউলার ব্যবহার করা। আপনি হয়তো দূরের কিছু ছুঁতে চান, কিন্তু একটু এগুলৈই টের পাবেন, ওটা আছে আসলে অনেক কাছে।

গোটা স্টেশন ডুবে আছে ঘুটঘুটে অন্ধকারে।

থমথম করছে চারপাশ।

বড় ঠাণ্ডা পরিবেশ। কোথাও কোনও আওয়াজও নেই।

স্টেশনে দাহ্য গ্যাস ছড়িয়ে পড়তে থেমে গেছে সব গোলাগুলি। পা টিপে টিপে চলেছে সবাই। ফিসফিস করে কথা হচ্ছে হেলমেটের মাইক্রোফোনে। নিস্তব্ধ আঁধারে একটু আওয়াজও কানে আসছে।

উজ্জ্বল সবুজ রঙের স্টেশনে চারপাশে চোখ রাখছে রানা।

নতুন জটিল এক পর্যায়ে পৌঁছেছে এই লড়াই।

যেভাবেই হোক, স্টেশনের ফিউজ-বক্স পেয়েছে ফ্রেঞ্চ কমাণ্ডোরা, এবং নিভিয়েও দিয়েছে সব বাতি। সন্দেহ নেই, আর কোনও উপায় না পেয়ে এই ঝুঁকি নিয়েছে। বড় কোনও ভুলও করেনি।

ছোট দলের বন্ধু গাঢ় অন্ধকার। যতই আবিষ্কার করা হোক অ্যাম্বিয়েন্ট লাইট টেকনোলজি, নাইট-ভিশন গগলস বা গানসাইট যতই কাজের, হোক, সাধারণ মিলিটারি ট্যাকটিশিয়ানরা মনে করেন: ছোট কোনও দল নিয়ে হামলা করলে, সবচেয়ে ভাল কাজ হয় অন্ধকারের সুযোগ নিলে। নেভি-এয়ারফোর্স-আর্মি, এই তিন সংগঠনের কোনও যোদ্ধা লড়তে চায় না অন্ধকারে।

সবাই সতর্ক থেকো, ফিসফিস করল রানা। ফ্ল্যাশার ফেলতে পারে। নাইট-ভিশন লড়াইয়ে মস্ত ঝুঁকি স্টান গ্রেনেড। ওটার আরেকটা নাম ফ্ল্যাশার। ওই গ্রেনেড হঠাৎ করেই তৈরি করে চোখ ধাঁধানো আলো। এর উদ্দেশ্য কিছুক্ষণের জন্য শত্রুকে হতচকিত করে দেয়া। নাইট-ভিশন গগলস সামান্য আলো অনেক উজ্জ্বল করে, ফলে ফ্ল্যাশার জ্বলে উঠলে নাইট-ভিশন গগলস পরা যোদ্ধার চোখ শুধু ধাধিয়ে যাবে তা নয়, চিরকালের জন্য অন্ধও হয়ে যেতে পারে সে।

স্টেশনের সেন্ট্রাল শাফটে উঁকি দিল রানা। উপরের ফ্রস্টেড গ্লাস গম্বুজ দিয়ে বাইরের কোনও আলো আসছে না। জুলাই চলছে, বেশি দিন হয়নি শুরু হয়েছে অ্যান্টার্কটিকার শীতকাল। আরও দুই মাস রাতের মত অন্ধকার থাকবে।

পিছনে তিশা আসছে, টের পেল রানা। চট করে দেখে নিল। ওরা ঠিক করেছিল শাফটের দিকে যাবে।

বাতি নিভে যেতেই দলের সবাইকে নির্দেশ দিয়েছে রানা: নাইট ভিশন চালু করে। এর পর খুলে বলেছে ওর পরিকল্পনা।

অন্ধকারে আত্মরক্ষামূলক পরিকল্পনা করলে চলবে না। হামলা ওদেরই করতে হবে। এ ছাড়া কোনও উপায় নেই। দুই দলের ভিতর সেই দল জিতবে, যারা অন্ধকারকে নিজেদের কাজে ভালভাবে লাগাতে পারবে! মূল কথা: রানার দলকে আক্রমণাত্মক। হতে হবে।

আসলে তাড়িয়ে নিয়ে যেতে হবে ফ্রেঞ্চদেরকে। কোথায়? যেখানে কোণঠাসা হয় তারা!

সংখ্যায় তারা কম। বারোজনের ভিতর আছে মাত্র চারজন। একটু আগে মোরশেদ বলেছে, তাদের দুজন .এ-ডেক ছেড়ে। গেছে। ধারণা করা যায়, দুই দলে ভাগ হয়ে গেছে তারা।

এরচেয়ে বড় কথা, ধাওয়া খেয়ে পিছাতে শুরু করেছে তারা। রানার নির্দেশে ওর দলও ভাগ হয়ে গেছে। এ থেকে অনেক সুবিধা পাবে ওরা।

এ-ডেকে আছে গানারি সার্জেন্ট ভাইপার, সার্জেন্ট জনি। ওয়াকার ও লেফটেন্যান্ট মোরশেদ। এদিকে ই-ডেকে তিশা, নাজমুল ও নিজে রানা।

এখন মোরশেদরা যদি এ-ডেক থেকে ফ্রেঞ্চ কমাণ্ডোদেরকে নীচে তাড়িয়ে আনতে পারে, ওই চারজন ফাদে পড়বে। উপরে শর্ক, নীচেও তাই। ওরা সহজেই কোণঠাসা করবে ফ্রেঞ্চদেরকে।

বাড়তি কোনও কৌশল করতে যায়নি বা বেশি ভাবতে যায়নি রানা। অবস্থা বুঝে এগুতে হবে। এটা সাধারণ কোনও লড়াই নয়। এক পক্ষে দুনিয়া-সেরা মিলিটারি ইউনিট। ফ্রেঞ্চদের ছোট করবার কোনও সুযোগ নেই। অন্যদিকে দুজন আমেরিকান মেরিন এবং ওরা বাংলাদেশ আর্মির কজন।

এই লড়াই হবে ভয়ঙ্কর।

দাহ্য গ্যাসের কারণে কোনও দল আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করবে। পুরনো আমলের লড়াইয়ের মত হাতাহাতি করতে হবে।

এবং সেটা হবে নিকষ অন্ধকারে।

তার মানেই লড়াই চলবে ছোরা দিয়ে।

হঠাৎ ওর পরিকল্পনায় বড় একটা খুঁত টের পেল রানা।

ফ্রেঞ্চদের সঙ্গে রয়েছে ক্রসবো।

মৃত ফ্রেঞ্চ কমাণ্ডার কাছ থেকে সংগ্রহ করা ক্রসবোটা দেখল রানা। ওই জিনিস আগ্নেয়াস্ত্রের মত আগুনের ফুলকি তৈরি করবে না। নিরাপদে দূর থেকে ব্যবহার করবে ফ্রেঞ্চরা। স্যাণ্ডহাস্টে ক্রসবো সম্বন্ধে কী শিখেছিল, ভাবতে চাইল রানা। ছোট ক্রসবোর রেঞ্জ বেশি নয়। বড়জোর রিভলভারের মত। একটু দূরের টার্গেটে লাগানো প্রায় অসম্ভব।

রেঞ্জ বড়জোর বিশ ফুট।

নিঃশব্দে কপালকে দোষ দিল রানা। ওরা ছোরা দিয়ে কিছুই করতে পারবে না। বিশ ফুট দূর থেকে পাখির মত ওদেরকে ফেলবে ফ্রেঞ্চরা। গ্যাসীয় পরিবেশে ওদের কাছে এমন কোনও অস্ত্র নেই, যেটা দূর থেকে ছুঁড়তে পারবে।

এক সেকেণ্ড পর ভাবল রানা, ওদের সঙ্গে রয়েছে…

নিচু স্বরে হেলমেট মাইকে নির্দেশ দিতে শুরু করল ও। দু মিনিট পর তিশাকে নিয়ে উঠে এল ডি-ডেকে।

কাঁধের উচ্চতায় ম্যাগহুক রেখে সামনে বাড়ছে রানা, মুহূর্তে ছুঁড়তে পারবে অস্ত্রটা। অন্য হাতে মৃত ফ্রেঞ্চের ক্রসবো। .

যদিও নিখুঁত লক্ষ্যভেদের জন্য তৈরি হয়নি আমালাইট এমএইচ-১২ ম্যাগহুক লঞ্চার, কিন্তু ওটার ম্যাগনেটিক এ্যাপলিং হুক ছিটকে যায় কমপক্ষে এক শ ফুট। প্রথমে এমএইচ-১২ ম্যাগহুক তৈরি করা হয় আর্বান ওয়ারফেয়ার ও অ্যান্টি-টেরোরিস্ট অপারেশনের জন্য আশা করা হয়েছে, ওটার দড়ি ও গ্যাপলিং হুক ব্যবহার করে বাড়ি বা, ওয়্যারহাউসের দেয়াল অনায়াসে পেরুবে অ্যান্টি-টেরোরিস্ট ইউনিট, ঝট করে ঢুকে পড়বে শত্রু এলাকায়।

এসব মাথায় রেখেই ছোট করা হয়েছে ম্যাগক। হাতের লঞ্চার কমপক্ষে এক শ ফুট দড়ি ও হুক ছুঁড়বে। জিনিসটা স্টেট অভ আর্ট। ওটার হাইড্রলিক লঞ্চিং সিস্টেম আকাশের দিকে ছুঁড়লে প্রতি বর্গ ইঞ্চিতে চার হাজার পাউণ্ড চাপ তৈরি করে। আর সে-কারণে রানার বুঝতে দেরি হয়নি, বিশ ফুট দূরের শত্রুর দিকে ম্যাগহুক ছুঁড়লে, ওটা ঠিকভাবে বুকে-পেটে লাগলে, ওয় লোককে কষ্ট করে আর লড়তে হবে না।

পুলের পানিতে রানা নিজেই দেখেছে, কাছ থেকে সাত টনি কিলার ওয়েইলকে থামিয়ে দিয়েছে ম্যাগহুক। কাছ থেকে হুক ব্যবহার করলে এক শ আশি পাউণ্ডের যে-কারও করোটি ফাটিয়ে দিতে পারবে।

রানার কারণে আবারও আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেছে ওর দলের সবাই। থাকুক ফ্রেঞ্চদের হাতে ক্রসবো, ওদের আছে ম্যাগহুক, ওটা দিয়ে দূর থেকে হামলা করবে।

আপাতত লেফটেন্যান্ট মোরশেদ, গানারি সার্জেন্ট ভাইপার ও সার্জেন্ট জনি ওয়াকার স্টেশনের এ-ডেক থেকে তাড়িয়ে নীচে আনছে ফ্রেঞ্চদেরকে। এদিকে ই-ডেক থেকে উপরের দিকে রওনা হবে লেফটেন্যান্ট তিশা করিম ও কর্পোরাল নাজমুল। এই দুই দল মিলিত হবে সি-ডেকে। তারপর দেখা যাক কী ঘটে।

আপাতত রানার সঙ্গে রয়েছে তিশা করিম। নিশাত সুলতানার পা থেকে রক্ত পড়া থামলে, একটু পর ওদের সঙ্গে যোগ দেবে নাজমুল। একটু আগে নিশাতের ধমণীতে মেথাড়ন দিয়েছে ওরা। এ-ডেকে পাল্টা হামলা শুরু করেছে দুই মেরিন ও বাংলাদেশ আর্মির লেফটেন্যান্ট গোলাম মোরশেদ। দ্রুত সামনে বাড়ছে ওরা। টেক্সট বুক থ্রি-গিং ফ্লাশিং ফর্মেশন ব্যবহার করছে। লিপ ফ্লগিং করে সামনে বাড়ছে একজন, ছুঁড়ছে ম্যাগহুক। দড়ি ও হুক গুটিয়ে নিয়ে সে রিলোড করবার আগেই দ্বিতীয়জন তাকে ছাড়িয়ে সামনে বাড়ছে। তার ম্যাগহুক শত্রুদের দিকে ছুঁড়বার পর পিছনের তৃতীয়জন আবার তাকে ছাড়িয়ে সামনে বাড়ছে। ব্যবহার করছে ম্যাগহুক, ততক্ষণে তৈরি হয়ে যাচ্ছে প্রথমজন।

এ-ডেকে ওরা যা ভেবেছে, তাই করছে দুই ফ্রেঞ্চ কমাণ্ডো। ম্যাগহুকের হামলার মুখে পিছাতে শুরু করেছে। মই বেয়ে নেমে যাচ্ছে নীচের তলায়।

অবশ্য, গোলাম মোরশেদের রিপোর্ট পাওয়ার পর চিন্তিত হয়ে পড়েছে রানা। অন্য একটা বিষয় খেয়াল করেছে। ফ্রেঞ্চরা বড় জলদি সরছে। বিধ্বস্ত বি-ডেক এড়িয়ে গেছে তারা। সোজা নামছে সি-ডেকে।

এরা দক্ষতার সঙ্গে টু বাই টু কাভার ফর্মেশন ব্যবহার করছে। সামনের দুজন চারপাশ কাভার করছে, এদিকে পিছনের দুজন কাভার করছে পিছন দিক। দুই দলের মাঝে থাকছে দশ গজ দূরত্ব।

মোরশেদ আগেই জানিয়েছে, নাইট-ভিশন গগলস ব্যবহার করছে ফ্রেঞ্চা। প্রস্তুতি নিয়েই এসেছে। এখন তাড়াহুড়া করে নামছে শাফট দিয়ে।

রানা ভেবেছিল লোকগুলো টানেলে সময় নষ্ট করবে, কিন্তু অন্য কোনও পরিকল্পনা আছে তাদের। সি-ডেকের টানেলে অল্প সময় ছিল। যেন অপেক্ষা করেছে, উপর থেকে নেমে আসবে শক্ররা। তারপর হঠাৎ করেই আবারও ক্যাটওয়াকে বেরিয়ে এসেছে, রাং-ল্যাডার বেয়ে নেমে আসছে ডি-ডেকে।

হঠাৎ স্ট্র্যাটেজির বিষয়ে জুলিয়াস বি. গুণ্ডারসনের একটা কথা মনে পড়ল রানার। উনি বলেছিলেন, ভাল স্ট্রাটেজি একটা জাদুর মত। শত্রুকে একটা হাত দেখতে দিন, কিন্তু অন্য হাতে কী করছেন তা যেন বুঝতে না পারে।

মাসুদ ভাই, ওরা দক্ষিণ-পশ্চিমের মই বেয়ে নামছে,, ইয়ারপিসে মোরশেদের কণ্ঠ শুনল রানা। আপনি কি নীচে?

ডি-ডেকের ক্যাটওয়াকে বেরিয়ে এসেছে রানা। চারপাশ সবুজ। কাজ শুরু করেছি।

ডি-ডেকের দক্ষিণ-পশ্চিম কোনা কাভার করছে রানা ও তিশা। রাং-ল্যাডার দেখতে পেল, ওটা গেছে সি-ডেকের দিকে। মাইকে বলল রানা, নাজমুল, তুমি কোথায়?

কাজ প্রায় শেষ, ই-ডেকের গুদাম থেকে জানাল নাজমুল।

পশ্চিম দিক কাভার করুন, সার্জেন্ট, ইন্টারকমে শোনা গেল মোরশেদের কণ্ঠ।

জনি ওয়াকার বলল, ওদের আসতে দিন, লেফটেন্যান্ট। তারপর পাঠিয়ে দেয়া যাবে মেজর রানার দিকে।

ডি-ডেকে রাং-ল্যাডারের সামনে পৌঁছে গেছে রানা ও তিশা। কুঁজো হয়ে দাঁড়িয়েছে, ফাঁকা মইয়ের দিকে তাক করেছে ম্যাগহুক। ধাতব ক্যাটওয়াকে বুটের ধুপধাপ আওয়াজ শুরু হয়েছে। তারপর শুনতে পেল তুঙ্ক আওয়াজ। ক্রসবো ব্যবহার করা হয়েছে।

মইয়ের দিকেই আসছে, মোরশেদের কণ্ঠ।

ক্যাটওয়ার্কের গ্রিলে আরও পায়ের শব্দ।

এখন যে-কোনও সময়ে হাজির হবে লোকগুলো।

কিন্তু হঠাৎ করেই ঠং-ঠাৎ আওয়াজ তুলে কী যেন পড়ল।

মোরশেদের বিকট চিৎকার এল, সাবধান! চোখ বন্ধ! ফ্ল্যাশার গ্রেনেড ফেলেছে।

চট করে চোখ বুজে ফেলেছে রানা। উপরের ডেকে পড়েছে গ্রেনেড। এক সেকেণ্ড পর ফাটল ওটা। এক পলকের জন্য উজ্জ্বল সাদা হয়ে উঠল উইলকক্স আইস স্টেশন।

রানা চোখ খুলবে, এমন সময় অন্য আওয়াজ পেল ডানদিক থেকে। মনে হলো কেউ খুব দ্রুত খুলছে প্যান্টের চেইন।

চোখ মেলেই চরকির মত ঘুরল রানা, সামনে সবুজ আলো। কোথাও কেউ নেই। কোনও নড়াচড়াও নেই।

কপাল! বলে উঠল মোরশেদ, মাসুদ ভাই, একজন রেলিং থেকে নেমে পড়েছে।

এইমাত্র চেইন খুলবার যে আওয়াজ পেয়েছে, এখন এক পলকে বুঝল রানা। মূল শাফট দিয়ে দড়ি বেয়ে নামছে কেউ! ওর বুঝতে দেরি হয়নি; ওটা কোনও ডিভেন্সিভ মুভ নয়।

কোঅর্ডিনেটেড মুভ। পরিকল্পনা নিয়েই করেছে। এবং হামলা করবার জন্যই।

আসলে পালাতে শুরু করেমি ফ্রেঞ্চ কমাণ্ডোরা

ওদের পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করছে! .

জুলিয়াস বি. গুপ্তারসন বলেছিলেন, ভাল স্ট্রাটেজি একটা জাদুর মত। শত্রুকে এক হাত দেখতে দিন, কিন্তু অন্য হাতে কী করছেন তা যেন বুঝতে না পারে।

রাজাকে চেক দিলে যেভাবে পাল্টা হামলা করতে চায় দাবাড়, এই মুহূর্তে তেমনি করেই ভাবতে শুরু করেছে রানা।

ওরা কী করতে চায়?

এখন কী ভাবছে?

ভাবলে অনেক কিছুই বেরুতে পারে, কিন্তু এখন ওর হাতে একদম সময় নেই। এক সেকেণ্ড পর ওর পাশের বরফ-দেয়ালে এসে লাগল অন্তত চারটে তীর।

মস্ত কুঁজওয়ালা হদ্দ বুড়োর মত উবু হয়ে গেল রানা, অবশ্য ঘুরল চালু চরকির মত, দেখতে পেল ওর পিছনের মেঝেতে ঝাপিয়ে পড়েছে তিশা। পরক্ষণে আবারও ঘুরল রানা, কী ঘটছে বুঝবার আগেই রাং-ল্যাডার বেয়ে সরসর করে নেমে এল এক লোক। মুখোমুখি হয়ে গেছে রানা ও লোকটা। তাকে চিনল রানা,. ফ্রেঞ্চ কমাণ্ডোদের নেতা: জ্যাকুস ফিউভিল!

.

ই-ডেকে গুদাম-ঘরে নিশাত সুলতানার পাশে বসে আছে নাজমুল। নিশাতের হাতের শিরা শক্ত রাবারের মত, ফলে সুঁই গাঁথা কঠিন। নাইট-ভিশন গগলস পরে পরিষ্কার দেখছেও না। চারবার সুঁই বিধিয়েছে, প্রতিবার আইভি লাইন থেকে ফ্লুইড গড়িয়ে পড়েছে নিশাতের হাতে।

ঠিক ভাবে আইভি দেয়ার পর উঠে দাঁড়াল নাজমুল, দরজার দিকে রওনা হবে, এমন সময় শুনল অদ্ভুত কিছু আওয়াজ। আঁধার গুদামের বাইরে সুড়ঙ্গে আলতো পায়ে হাঁটছে কেউ!

ঘুরেই বরফের মূর্তি হয়ে গেল নাজমুল।

কান পেতে অপেক্ষা করছে।

বাইরে দক্ষিণ টানেল ধরে হালকা পায়ে গেল সে বা তারা।

সামনে বেড়ে দরজার নব ধরল নাজমুল, খুব ধীরে নিঃশব্দে খুলল কবাট, উঁকি দিল সাবধানে। নাইট-ভিশন গগলসের কারণে সবুজ লাগছে টানেল। বামে চাইতেই দেখল পুল। মৃদু সব ঢেউ এসে লাগছে ডেকের পাশে।

ডানে চাইতেই দেখল, দীর্ঘ টানেল গেছে দূরের অন্ধকারে। নাজমুলের মনে পড়ল, স্টেশনের ওদিকেই ই-ডেকে ড্রিলিং রুম।

উইলকক্স আইস স্টেশনের এই অংশ সবচেয়ে নিচু, সে কারণেই এদিকে রাখা হয়েছে ড্রিলিং রুম। ওখান থেকেই বরফের কোরে বিজ্ঞানীরা নামিয়ে দেন ড্রিল। স্টেশন থেকে বেশ দূরে ওই রুম, মাঝে চল্লিশ গজ দীর্ঘ সরু টানেল।

ডানদিকের টানেল ধরেই গেছে সে বা তারা। এক মুহূর্ত দ্বিধা করল নাজমুল, তারপর ম্যাগহুক হাতে রওনা হলো পিছনে।

.

জ্যাকুস ফিউভিলকে লক্ষ্য করে ম্যাগহুক ফায়ার করেছে রানা। কিন্তু বিদ্বেগে দু ভঁজ হয়ে গেছে লোকটা। তার মাথার উপর দিয়ে রাং-ল্যাডারে ঝটাং করে লাগল হুক, পেঁচিয়ে গেল মইয়ের ধাপে।

হাত থেকে ম্যাগহুক ছেড়ে দিল রানা, তাক করল ক্রসবো। ওই একই সময়ে রানার বুকে ক্রসবো তাক করেছে ফিউভিল।

একইসঙ্গে অস্ত্রদুটো ব্যবহার করল ওরা। শিস তুলে পরস্পরকে পাশ কাটাল দুই তীর।

রানার আর্মার্ড শোল্ডারপ্লেটে লাগল ফিউভিলের তীর। ওদিকে রানার তীর গিয়ে লেগেছে লোকটার বাহুতে। হাত তুলে মুখ ঢেকেছে বিশালদেহী কমাণ্ডো। ব্যথা পেয়ে গর্জন ছাড়ল সে, সুস্থ হাতে তাড়াহুড়া করে ক্রসবো রিলোড করতে চাইছে। ওখানে বৃত্তাকার পাঁচটি রাবার স্লট থাকে, দ্রুত রিলোড করবার জন্য ওখান থেকে তীর নেয়া হয়। কিন্তু এখন রানার ক্রসবোর স্লটে কোনও তীর নেই!

যে কমাণ্ডোকে শেষ করে ক্রসরো পেয়েছে রানা, সে আগেই শেষ করে ফেলেছে সব তীর! ছিল শুধু শেষ তীরটা!

দেরি করল না রানা, ওই তীরের মতই ছুটে সামনে বাড়ল। পরক্ষণে ঝাপিয়ে পড়ল ফ্রেঞ্চ কমাণ্ডোর উপর। একইসঙ্গে ধড়াস্ করে পড়ল ওরা মইয়ের পিছনের ক্যাটওয়াকে।

পাঁচ গজ দূরে ক্যাটওয়ার্কে মুখ ঢেকে পড়ে আছে তিশা, দেখতে পেয়েছে ফ্রেঞ্চ কমাণ্ডের উপর ঝাপিয়ে পড়েছে রানা। লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল তিশা, রানাকে সাহায্য করতে ছুটতে শুরু করবে, এমন সময় রাং-ল্যাডার বেয়ে নেমে এল আরেক ফ্রেঞ্চ কমাণ্ডো!

কালো নাইট-ভিশন গগলসের ভিতর দিয়ে ওর দিকে চাইল লোকটা!

.

ধীর পায়ে সরু, টানেল বেয়ে চলেছে নাজমুল। শেষমাথায় একটা দরজা। ওদিক দিয়েই ঢুকতে হয় ড্রিলিং রুমে দরজা এখন আধ খোলা।

পা টিপে টিপে সামনে বাড়ছে নাজমুল, খাড়া করে রেখেছে কান। ঘরের ভিতর খসখস আওয়াজ। নড়াচড়া করছে কেউ। গুদাম পাশ কাটিয়ে এখানে এসে হাজির হয়েছে লোকটা?

কী যেন করছে।

নিচু স্বরে মাইক্রোফোনে কী যেন বলল। ইংরেজি না।

লে পেইজ এস্ত তেন্দু।

পাথরের মূর্তি হয়ে গেল নাজমুল। লোকটা ফ্রেঞ্চ কমাণ্ডো।

দরজার পাশে পৌঁছে দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়াল, ও, চোখে এখনও নাইট-ভিশন গগলস— আধ খোলা দরজা দিয়ে উঁকি দিল।

ওর মনে হলো ভিডিয়ো ক্যামেরার ভিতর দিয়ে চেয়ে আছে। প্রথমে চোখে পড়ল দরজার চৌকাঠ, ওটা ওর সবুজ ভিউস্ক্রিনের ডানে। তারপর দেখা গেল ঘরের ভিতর অংশ।

এক সেকেণ্ড পর দেখল লোকটাকে। তার চোখেও নাইটভিশন গগলস, একেবারে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। হাতের ক্রসবো তাক করেছে ওর মুখ লক্ষ্য করে!

.

সামনে নাইট-ভিশন গগলস পরা ফ্রেঞ্চ কমাণ্ডো, কিন্তু এক পলকে তিশা চিনল এই লোক ভিভাদিয়েখ।

গ্যাসোয়া ভিভাদিয়েখ। এই লোকই হামলার শুরুতে ক্রসবো দিয়ে ওর কপালে তীর মেরেছিল। হেলমেটের সামনের দিকে এখনও সেই তীর ঝুলছে। হারামজাদা হাসছে আবার! ..

বুঝতে পেরেছে, আগে এই মেয়েকেই তীর মেরেছিল।

সবজেটে আলোর ভিতর ক্রসবো উপরে তুলল সে, পরক্ষণে ছুঁড়ল তীর।

তিশা আছে বিশ ফুট দূরে, এক সেকেন্দ্রে বিশ ভাগ সময়ে হঠাৎ করেই দেখল তীরের ডগা আসছে ওর দিকেই। ঝট করে সরে গেল তিশা, ডান হাত তখনও পিছনে রয়ে গেছে। হঠাৎ খটাং আওয়াজ শুনল। ভীষণ ঝাঁকি খেল ওর হাত। তীর গিয়ে লেগেছে ওর ম্যাগহুকের উপর, ঝটকা দিয়ে দূরে গিয়ে পড়ল অস্ত্রটা।

একটু সামলে নেয়ার আগেই তিশা দেখল, ছুটে আসছে ভিভাদিয়েখ, হাতে বেরিয়ে এসেছে বাউয়ি ছোরা। মনে হলো মুহূর্তে হাজির হয়েছে লোকটা, তিশার গলা লক্ষ্য করে নামিয়ে। আনল হান্টিং নাইফ।

হঠাৎ জোরালো ঠং আওয়াজ তুলল বাউয়ি, প্রচণ্ড ঝাঁকি খেয়ে থেমে গেছে চওড়া ফলা।

নিজের ছোরা দিয়ে হামলা ঠেকিয়ে দিয়েছে তিশা।

পিছিয়ে গেল দুই যোদ্ধা, বৃত্তাকারে ঘুরতে শুরু করেছে, হামলা, করবে পরস্পরের উপর। ভিভাদিয়েখ উল্টো করে ধরেছে ছোরা, একই কাজ করছে তিশাও। এখনও দুজনের চোখে নাইট-ভিশন গগলস।

হঠাৎ করেই লাফিয়ে সামনে বাড়ল ভিভাদিয়েখ, কিন্তু নিজেরটা দিয়ে তার ছোরা সরিয়ে দিল তিশা। কিন্তু ফ্রেঞ্চ কমাণ্ডোর হাত ওর চেয়ে দীর্ঘ, তিশা সরে গেলেও সুইপ করল। চোখ থেকে আলগা হয়ে গেল তিশার গগলস।

এক মুহূর্ত কিছুই দেখল না তিশা। চারপাশ শুধু ঘুটঘুটে অন্ধকার।

মুহূর্তে বুঝল, গগলস না থাকলে ও সম্পূর্ণ অন্ধ!

পিছনের ক্যাটওয়াকে কম্পন টের পেল তিশা। লাফিয়ে সামনে বেড়েছে ভিভাদিয়ে।

পুরোপুরি অন্ধ তিশা, কিন্তু ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের নির্দেশে ঝট করে বসে পড়ল। ঠিক করছে কি না এখনও জানে না।

এক সেকেণ্ড পর টের পেল, ঠিকই করেছে। ওর হেলমেটের উপর দিয়ে শ-শ আওয়াজ তুলে বেরিয়ে গেল ছোরার ফলা।

অন্ধকারে সামনের ক্যাটওয়াকে ডিগবাজি শুরু করল তিশা, সরে যাচ্ছে ভিভাদিয়েখের কাছ থেকে। তিনবার ডিগবাজি দিয়ে উঠে দাঁড়াল, চাপড় দিল হেলমেটের পাশের বাটনে। সঙ্গে সঙ্গে চোখের সামনে বসে গেল ইনফ্রারেড ভাইজার।

ওটা নাইট-ভিশন নয়, কিন্তু প্রায় সমানই কাজ করে।

চারপাশের ক্যাটওয়াক ধরা পড়ছে ইলেকট্রনিক নীল-কালো ইমেজে। ক্যাটওয়াক ও রাং-ল্যাডার নীল রঙের। মইয়ের কাছে নানা রঙের দুটো আকৃতি দেখল তিশা। তারা ক্যাটওয়াকে জাপ্টাজাল্টি করে গড়িয়ে সরছে। মাসুদ রানা ও জ্যাকুস ফিউভিল, বোধহয় কুস্তি চলছে তাদের ভিতর।

চট করে ঘুরল তিশা, ওর দিকে ছুটে আসছে লাল-সবুজ-হলুদ আরেকটা আকৃতি।

ওটা গ্যার্সেয়া ভিদিয়েখ।

অথবা, লোকটার শরীরের ভিতরের হিট প্যাটার্ন।

পাশ থেকে ছোরা চালাল গ্যাসেঁয়া ভিদিয়েখ। আবারও নিজের ছোরা দিয়ে হামলা ঠেকিয়ে দিল তিশা। পরক্ষণে জোরালো সাইড কিক করল ফ্রেঞ্চের সোলার প্লেক্সাস লক্ষ্য করে। লাথিটা জায়গামতই লেগেছে, হুমড়ি খেয়ে পড়ল ভিভাসিয়েখ। কিন্তু পড়বার আগে খপ করে ধরেছে তিশার ছোরা ধরা ডান কবজি। জোর টান খেয়ে পড়ে গেল তিশাও।

একই সঙ্গে ক্যাটওয়াকে পড়েছে ওরা। নীচে ভিভাদিয়েখ, উপরে তিশা।. গড়িয়ে সরল ও, পিঠ দিয়ে পড়ল ক্যাটওয়াকের পাশের বরফ-দেয়ালে। মেঝেতে উঠে বসতে গিয়ে হাতে কী যেন ঠেকল। মুহূর্তে বুঝে গেল ওটা কী।

ম্যাগহুক!

আর ঠিক তখনই চোখের সামনে হাজির হলো রঙিন ঝলমলে আকৃতি… ওর উপর ঝাপিয়ে পড়ছে গ্যাসোয়া ভিভাদিয়েখ! হাত বাড়িয়ে রেখেছে, এবার কচ করে কেটে দেবে তিশার কণ্ঠনালী!

হাত থেকে ছোরা ছেড়ে দিল তিশা, দুই হাতে লোকটাকে ঠেকাতে চাইল। দুই হাতে শক্ত করে ধরে ফেলল লোকটার ছোরা ধরা কবজি। ওর গলা থেকে মাত্র এক ইঞ্চি দূরে তীক্ষ্ণধার ফলা, কিন্তু ওখানেই থামাতে পারল।

অবশ্য, তা মাত্র কয়েক সেকেণ্ডের জন্য।

লোকটা অনেক বেশি শক্তিশালী।

তিশার কণ্ঠনালী থেকে আধ ইঞ্চি দূরে থামল ছোরা।

চোখের সামনে গ্যাসেয়া ভিভাদিয়েখের মুখ দেখল তিশা। ইনফ্রারেড ভাইজারে লোকটার করোটি ও দাঁতগুলো পরিষ্কার দেখছে। থরথর করে কাঁপছে রং। মাংস ও রক্ত ওগুলো। তিশার মনে হলো নরক থেকে উঠে এসেছে ভয়ঙ্কর পৈশাচিক কঙ্কাল।

লোকটা এত কাছে, তার নাইট-ভিশন গগলস ঘষা লাগছে ওর হেলমেটে।

গগলস্, চট করে ভাবল তিশা।

পর মুহূর্তে সামান্য দ্বিধা করে গ্যাসোয়ার ছোরা ধরা হাত থেকে বাম হাত সরিয়ে নিল, খামচি দিয়ে খুলে দিল লোকটার নাইট-ভিশন গগলস।

ঘোঁৎ করে উঠল গ্যাসোয়া ভিভাদিয়েখ। ক্যাটওয়াকের পাশ থেকে গগলসটা নীচে ফেলে দিল তিশা। ভাবছে, অন্ধ হয়ে গেছে হারামজাদা!

কিন্তু গলার উপর ছোরা নামিয়ে আনছে ভিভাদিয়েখ.। হঠাৎ করেই গ্যাসোয়ার নীচে পিছলে সরল তিশা, এখন ওর হেলমেট লোকটার চোখের সামনে।

মনে পড়ে? এটা দিয়েছিলে, নিচু স্বরে বলল তিশা, চোখের সামনে দেখছে হেলমেটে গাঁথা তীর। ওটা নীল রঙের। এবার ফিরিয়ে নাও!

পরক্ষণে ঝটকা দিয়ে সামনে মাথা বাড়াল তিশা। হেলমেটের তীর খছ করে বিঁধল গ্যাসেয়া ভিভাদিয়েখের ডান চোখে। বিকট চিল্কার ছাড়ল লোকটা, মনে হলো ভয়ঙ্কর কোনও হিংস্র প্রাণী গর্জে উঠেছে। তিশা টের পেল, ছলাৎ করে ওর চোখেমুখে এসে পড়েছে একগাদা উষ্ণ রক্ত।

নীচ থেকে লাথি মেরে লোকটাকে ছিটকে ফেলে দিল তিশা। ইনফ্রারেড ভাইজারে দেখল, লোকটার ডান চোখ থেকে বেরুচ্ছে তরল হলুদ-লাল কী যেন।

চিত হয়ে ক্যাটওয়াকে আছড়ে পড়েছে ভিভাদিয়েখ, একের পর এক চিৎকার ছাড়ছে। একহাতে ঢেকে ফেলেছে শূন্য কোটর। তিশার খোঁচা খেয়ে বেরিয়ে এসেছে তার চোখ। এরপরও মেঝের উপর বসে দু দিকে থাবা ছুঁড়ল সে, তিশাকে নাগালে পেলে–হামলা করবে।

ক্যাটওয়াকে পড়ে থাকা ম্যাগহুক তুলে নিল তিশা, ফ্রেঞ্চ কমাণ্ডোর রক্তাক্ত করোটি তাক করল। দাপাদাপি করছে লোকটা, কিন্তু তিশার হাতে সময় আছে। সাবধানে ম্যাকহুকের ট্রিগার টিপে দিল ও।

ভিভাদিয়েখের মুখের উপর আঘাত হানল হুক। আধ সেকেণ্ড। পর ধপ্ করে ক্যাটওয়াকের উপর পড়ল লোকটা। দু টুকরো হয়ে গেছে তার করোটি। গোটা ক্যাটওয়াক জুড়ে গড়াগড়ি করছে রানা ও ফিউভিল। নানান আওয়াজ শুনছে রানা হেলমেট ইন্টারকমে।

… ওরা আরেক দিকে যাচ্ছে!

অন্য মই বেয়ে…

উপরের ক্যাটওয়াকে ধপধপ আওয়াজ।

খুব কাছেই কোথাও ব্যবহার করা হলো ক্রসবো। স্ন্যাপ আওয়াজ। ক্রসবোর বোল্টে আরেকটা তীর বসিয়ে নিয়েছে ফিউভিল। বিশালদেহী ফ্রেঞ্চের নাইট-ভিশনের নীচে, মুখের উপর কনুই নামিয়ে আনল রানা। ভ করে বসে গেল লোকটার নাকের হাড়। রানার হাতের চারপাশে ছিটকে লাগল রক্ত। ঝাপসা হলো ফ্রেঞ্চ কমাণ্ডোর গগলস।

রাগে গরগর করছে ফিউভিল, গায়ের জোরে ধাক্কা দিয়ে রানাকে ক্যাটওয়াকের কিনারায় পাঠিয়ে দিল সে। দুজনের মাঝে দেড় ফুট দূরত্ব। এখনও ক্যাটওয়াকে পড়ে আছে সে, গগলসের উপর রক্ত পড়ায় প্রায় অন্ধ হয়ে উঠেছে। গনগনে রাগ নিয়ে ঘুরল সে, ক্রসবো তাক করল রানার মাথা লক্ষ্য করে।

ক্যাটওয়াকের কিনারায় রেলিঙের পাশে পড়েছে রানা, বিদ্যুদ্বেগে চলছে মগজ। ঝটকা খেয়ে ফিউভিলের হাত ঘুরতেই খপ করে ক্রসবো ধরল ও, আধ সেকেণ্ড পর শরীর গড়িয়ে দিয়ে নেমে গেল ক্যাটওয়াক থেকে!

শত্রু এমন করবে ভাবতেও পারেনি ফিউভিল।

ক্রসবো ছাড়ছে না রানা, নিজে পড়তে শুরু করেছে গভীর শাফটে। মুহূর্ত পর থেমে গেল পতন, এখনও ঝুলছে লোকটার ক্রসবো ধরে। একবার শরীর দুলিয়ে নেমে পড়ল নীচের ডেকে, সঙ্গে এনেছে লোকটার ক্রসবো। এখনও দুই পায়ে দাঁড়িয়ে আছে, এবার ডি-ডেকের ক্যাটওয়াকের দিকে তাক করল ক্রসবো, পরক্ষণে টিপে দিল ট্রিগার।

এখনও ক্যাটওয়াকে মুখ দিয়ে পড়ে আছে ফিউভিল, বেকায়দা ভাবে ডান হাত ঝুলছে বাইরে। ক্রসবো ডিসচার্জ হতেই পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জে ইস্পাতের গ্রিলের ভিতর দিয়ে ঢুকল তীরফিউভিলের নাইট-ভিশন গগলসের ভিতর কাত হয়ে ঢুকল, গাঁথল গিয়ে ফরাসি সৈনিকের কপালের পাশে।

.

ড্রিলিং রুমে ফ্রেঞ্চ কমাণ্ডোর ক্রসবোর মুখে থমকে গেছে নাজমুল।

ফ্রেঞ্চ লোকটা ভাবছে সে সুবিধাজনক অবস্থানে আছে। বলতে গেলে মরেই গেছে শত্রু। কিন্তু একটা কথা একদম ভুলে গেছে সে।

নাইট-ভিশন ব্যবহার করলে খুব খারাপ হয় পেরিফেরাল, ভিশন।

লোকটা অনেক বেশি কাছে। এবং সে-কারণে দেখতেই পায়নি কোমরের কাছে ম্যাকহুক ধরে আছে শত্রু।

বিন্দুমাত্র দেরি না করে ফায়ার করল নাজমুল। লঞ্চার থেকে ছিটকে বেরুল ম্যাগহুক, মাত্র তিন ফুট পেরিয়ে বিঁধল ফরাসি সৈনিকের বুকে। বিশ্রী মটমট আওয়াজ উঠল। ভিতর দিকে ডেবে গেল কমাণ্ডোর পাঁজরের খাঁচা, ভাঙা কয়েকটা হাড় ঢুকে গেল হৃৎপিণ্ডে। মেঝেতে পড়বার আগেই মারা গেল লোকটা।

বড় করে শ্বাস নিল নাজমুল, আস্তে করে দম ফেলল। যাক, বাঁচা গেছে! ড্রিলিং রুমের ভিতর অংশে চোখ গেল। ফ্রেঞ্চ কমাণ্ডো কী করছিল দেখে হা হয়ে গেল ওর মুখ। মনে পড়ল, একটু আগে কী বলছিল লোকটা–লে পেইজ এস্ত তেন্দু।

দ্বিতীয়বার ঘরে চোখ বোলাল নাজমুল, তারপর হেসে ফেলল।

.

দক্ষিণ টানেল, মাসুদ ভাই, রানার হেলমেট ইন্টারকমে এল মোরশেদের কণ্ঠ।

ফিউভিলের হাত বেয়ে আবারও ই-ডেকে নেমে এসেছে রানা। তখনই কালো পোশাক পরা এক লোককে পুলের ওপাশে দক্ষিণ টানেলে ঢুকতে দেখেছে। ওই লোক শেষ ফ্রেঞ্চ কমাণ্ডো। দড়ি দিয়ে শাফট বেয়ে নেমেছে সে।

আমি ওকে দেখেছি, ছুটতে শুরু করেছে রানা।

স্যর, আমি নাজমুল, হঠাৎ শোনা গেল কর্পোরাল নাজমুলের কণ্ঠ। আপনি কি এইমাত্র দক্ষিণ সুড়ঙ্গের কথা বললেন?

হ্যাঁ।

তাকে আসতে দিন, স্যর। দৃঢ় শোনাল নাজমুলের কণ্ঠ। তার পিছনে আসেন।

ব্যাপার কী, নাজমুল? মৃদু কুঁচকে গেল রানার ভুরু।

তার পিছনে আসেন, স্যর, এবার ফিসফিস করে বলল নাজমুল। সে চায় আপনি ওর পিছন পিছন আসেন।

এক পলক থামল রানা, তারপর জিজ্ঞেস করল, নাজমুল তুমি বোধহয় এমন কিছু জানো, সেটা আমি জানি না?

জী, স্যর।

সার্জেন্ট জনি ওয়াকার, গানারি সার্জেন্ট ভাইপার ও তিশা ইডেকে রানার : পাশে দক্ষিণ সুড়ঙ্গের মুখে পৌঁছেছে। সবাই হেলমেট ইন্টারকমে নাজমুলের বক্তব্য শুনতে পেয়েছে।

এদের সবাইকে দেখে নিল রানা, তারপর হেলমেট মাইকে বলল, ঠিক আছে, নাজমুল, দেখা যাক কী করো।

ই-ডেকের দক্ষিণ টানেলে ঢুকে পড়ল ওরা। বেশ কিছুক্ষণ হেঁটে যাওয়ার পর সুড়ঙ্গের শেষমাথায় দেখল একটা দরজা। এইমাত্র সবজেটে আলোয় দরজা পেরিয়ে ঘরে ঢুকে পড়েছে কালো এক মূর্তি।

নাজমুল ঠিকই বলেছে। লোকটা খুব ধীরে হাঁটছিল। যেন বোঝাতে চেয়েছে, সে ড্রিলিং রুমে ঢুকবে।

এগিয়ে চলেছে রানা ও অন্যান্যরা। ড্রিলিং রুমের দরজার দশ গজ দূরে পৌঁছে গেছে, এমন সময় হঠাৎ করেই অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এল একুটি হাত, টান দিল রানার বাহু ধরে। চরকির মত ঘুরল রানা, ঘুষি মারবার আগেই দেখল দেয়ালে বসানো কাবার্ড থেকে উদয় হয়েছে নাজমুল। ওর পিছনে কাবার্ডের ভিতর আরেকটা দেহ। নিজের ঠোঁটের উপর আঙুল রাখল নাজমুল, তারপর সবাইকে এগুতে ইশারা করে রওনা হলো ড্রিলিং রুমের দরজার দিকে।

ফাঁদ পেতে বসে আছি, দরজার কাছে গিয়ে নিচু স্বরে বলল নাজমুল। টান দিয়ে দরজা খুলল। জোরালো কটকট আওয়াজ তুলে বাইরের দিকে খুলে গেছে দরজা।

ঘরের দূর-দেয়ালের কাছে ফ্রেঞ্চ কমাণ্ডোকে দেখল ওরা। লোকটা ফ্রেঞ্চ দলের নেতা জ্যাকুস ফিউভিল। লোকটা বুঝে গেছে। ফাদে পড়েছে।

আমি… আমি… সারেণ্ডার করছি, দুর্বল স্বরে বলল সে।

লোকটার দিকে চেয়ে আছে রানা। পাশ ফিরে নাজমুল ও অন্যদের দিকে চাইল। পরামর্শ আশা করছে। এক সেকেন্ড পর পা রাখল ড্রিলিং রুমের ভিতর।

মনে হলো স্বস্তির হাসি হাসল ফিউভিল।

ঠিক তখন পিছন থেকে হাত বাড়িয়ে রানার বাহু ধরল নাজমুল। থেমে গেছে রানা, ঘুরে চাইল। ফিউভিলের দিকে চেয়ে আছে নাজমুল।

ভুরু কুঁচকে ফেলল ফিউভিল।

এক সেকেণ্ড পর নাজমুল বলল, …লে পেইজ এস্ত তেন্দু।

মাথা কাত করে চাইল ফিউভিল।

তাই বলেছে? বলল রানা। তার মানে, ফাঁদ পাতা হয়েছে।

 হঠাৎ করেই অন্য কীসের দিকে যেন চোখ চলে গেল ফিউভিলের। জিনিসটা তার সামনে, মেঝের উপর। হঠাৎ করেই লোকটার হাসি ম্লান হয়ে গেল। আতঙ্কিত চোখে চাইল নাজমুলের দিকে।

নাজমুল জানে, কী দেখেছে জ্যাকুস ফিউভিল।

পাঁচটা ফ্রেঞ্চ শব্দ পড়তে পারল ফিউভিল, বুঝে গেল মস্ত ভুল করেছে মৃত্যু এবার অনিবার্য!

ওই পাঁচ শব্দ হচ্ছে: ব্যাখায়েখ সে কোসে সুখ লেনেমি।

অর্থাৎ, শক্রর এপাশে চলে আসুন!

হাসি-হাসি চেহারা করে সামনে বাড়ল নাজমুল, একই সময়ে না! বলে উঠল ফিউভিল। কিন্তু দেরি করে ফেলেছে। দরজার সামনে ট্রিপ-ওয়ায়ারে পা ফেলল নাজমুল।

ড্রিলিং রুমের ভিতর প্রচণ্ড শব্দে বিস্ফোরিত হলো দুটো কংকেভ মাইন!

১৬.

ইউনাইটেড স্টেটস অভ আমেরিকা।

নিউ মেক্সিকো।

রুক্ষ মরুভূমির বুক চিরে এঁকেবেঁকে গেছে সুদীর্ঘ এক হাইওয়ে। চারপাশে সোনালী-বাদামি বালির বিস্তৃতি। তারই মাঝে কালো একটি স্তর। নীচে এই কালো মাটি-পাথর, মাথার উপর মেঘহীন সুনীল আকাশ। দুপুর। দাউদাউ আগুন ঢালছে সূর্য।

মরুভূমির হাইওয়েতে তীর বেগে ছুটছে একটিমাত্র গাড়ি। দরদর করে ঘামছে চালক অ্যাডোনিস ক্যাসেডিন। তার ভাড়া নেয়া ঊনিশ শ আশি সালের টয়োটা গাড়ির এসি বহু আগেই মহাপ্রয়াণে গেছেন। এখন গাড়ির ভিতরের অংশ হয়ে উঠেছে উত্তপ্ত আভেন। অ্যাডোনিসের ধারণা: বাইরের চেয়ে কমপক্ষে দশ ডিগ্রি বেশি গরম ভিতরে।

দ্য ওয়াশিংটন পোস্টের রিপোর্টার অ্যাডোনিস ক্যাসেডিন এই পত্রিকার সঙ্গে রয়েছে বিগত তিনবছর। আগে ইনভেস্টিগেটিভ রিপোর্টিং জার্নাল গ্র্যাণ্ডমাদার মিশেল-এ ফিচার লিখত। তখনই নাম ফাটতে শুরু করে। আসতে শুরু করে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা।

গ্র্যাণ্ডৰ্মাদার মিশেল পত্রিকার সঙ্গে বেশ খাপ খাইয়ে নিয়েছিল ক্যাসেডিন। ওই পত্রিকার মূল উদ্দেশ্য: সরকারের ভুল বক্তব্য বা রিপোর্ট সাধারণ মানুষের চোখের সামনে তুলে ধরা। জটিল সব বিষয়কে খুব সহজভাবে লেখা হয় পত্রিকাটিতে। খুশি মনেই কাজ করছিল অ্যাডোনিস, ওর একটা আর্টিকেল উঁচু পর্যায়ের দুটো পুরস্কার পেল। সে আর্টিকালে তুলে ধরেছিল, কীভাবে আটলান্টিক, মহাসাগরে হারিয়ে গেছে ক্র্যাশ করা বি-২ স্টেলথ বম্বারের পাঁচটি নিউক্লিয়ার বোমা। ওই বিমান পড়ে ব্রাজিলের উপকূলে। আমেরিকান সরকার প্রেস রিলিজে বলেপ্রতিটা ওয়ারহেড খুঁজে বের করে নিরাপদে সরিয়ে আনা হয়েছে।।

এরপর তদন্ত শুরু করল ক্যাসেডিন, বের করে আনল আসল সত্য কীভাবে ওসব বোমা খোঁজা হয়েছে।

কয়েক দিনের ভিতর উন্মোচিত হলো কঠিন সত্য। আসলে রেসকিউ মিশনে জোর দিয়ে খোঁজাই হয়নি ওয়ারহেড। অফিশিয়ালদের ওপর নির্দেশ ছিল, বম্বারের সব প্রমাণ নষ্ট করে। ফেলতে হবে। এরপর সম্ভব হলে খুঁজতে হবে ওয়ারহেড। জানা–গেল, আদতে ওই ওয়ারহেডগুলো খুঁজেই পাওয়া যায়নি।

পুরস্কারপ্রাপ্ত ওই আর্টিকেল প্রকাশের পর বিপুল সাড়া পড়ে যাওয়ায় ক্যাসেডিনকে প্রথমবারের মত চিনলেন দ্য ওয়াশিংটন পোস্টের সম্পাদক। উনি ওকে চাকরি দিতে চাইলেন। এরপর দেরি করেনি ক্যাসেডিন, এ্যাণ্ডমাদার মিশেল পত্রিকাটির অনুমতি নিয়েই যোগ দিয়েছে দ্য ওয়াশিংটন পোস্টে।

অ্যাডোনিস ক্যাসেডিনের বয়স তিরিশ, লম্বা লোক সে, উচ্চতা ঝাড়া সাড়ে ছয় ফুট। বালির মত বাদামি রঙের চুল, এলোমেলো। চোখে ওয়ায়ার-ফ্রেম চশমা। এখন তার ভাড়া নেয়া গাড়ির মেঝে দেখলে মনে হবে, ওখানে বোমা পড়েছে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে খালি কোকের ক্যান, মুচড়ে যাওয়া চিযবার্গারের র্যাপার। প্রতিটি কম্পার্টমেন্টে গুজে রাখা হয়েছে প্যাড ও কলম। অ্যাশট্রের ভিতর হেঁড়া খাম।

মরুভূমির মাঝ দিয়ে চলেছে অ্যাডোনিস ক্যাসেডিন।

বেজে উঠল তার সেলুলার ফোন। কল করেছে ক্যাসেডিনের স্ত্রী সান্থা।

ওয়াশিংটনের সাংবাদিক সমাজে বেশ জনপ্রিয় এই আন্তরিক দম্পতি। দুজনই দ্য ওয়াশিংটন পোস্টে চাকরি করে। ওদের কাছে কেউ সাহায্য চাইলে তাকে খালি হাতে ফিরতে হয় না। তিনবছর আগে ক্যাসেডিন গ্র্যাণ্ডমাদার মিশেল ছেড়ে পোস্টে চাকরি নেয়ার পর ওকে তরুণী এক রিপোর্টার সান্থা জোন্সের সঙ্গে কাজ করতে বলা হয়। এর মাত্র এক সপ্তাহের ভিতর ওদের দুজনের মনের মধ্যে কী যেন হয়ে গেল। তার দুই সপ্তাহ পর ওরা বিয়ে করল। প্রায় তিনবছর হলো ওরা আনন্দে আছে। অবশ্য, এখনও ওদের সন্তান আসেনি। একই বিষয়ের উপর কাজ করে ওরা।

পৌঁছে গেছ? স্পিকার ফোনে বলল সান্থা। ওর বয়স মাত্র। পঁচিশ, কাঁধে . লুটিয়ে পড়েছে লালচে-বাদামি চুল, বড় বড় চোখদুটো আকাশের মতই নীল, হাসলে ঝলমল করে ওঠে মুখ। খুব সুন্দরী নয় ও, কিন্তু ওই হাসি দেখলে তৃতীয়বার ফিরে চাইতে হয়। আপাতত সান্থা আছে ওয়াশিংটন ডি.সি.তে, জরুরি কিছু কাগজপত্র খুঁজছে।

প্রায় চলে এলাম, জবাব দিল অ্যাডোনিস।

নিউ মেক্সিকোর মরুভূমির মাঝে একটা অভযারভেটরির দিকে চলেছে। আজ (SETI) সেটি ইন্সটিটিউটের এক টেকনিশিয়ান ফোন করেছে পত্রিকা অফিসে, জানিয়েছে, পুরনো এক স্পাই স্যাটালাইট নেটওয়ার্কে বেশ কিছু জরুরী কথা শুনতে পেয়েছে। তদন্ত করতে পাঠানো হয়েছে অ্যাডোনিস ক্যাসেডিনকে।

প্রায়ই এমন হয়, সার্চ ফর এক্সট্রাটেরেস্ট্রিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইন্সটিটিউট বা সেটি নানা শব্দ খুঁজে পায়। তাদের রেডিয়ো স্যাটালাইট অ্যারে খুবই শক্তিশালী ও অস্বাভাবিক সেনসিটিভ। সেটির টেকটিশিয়ানরা এক্সট্রাটেরেস্ট্রিয়াল ইন্টেলিজেন্স ট্রান্সমিশন খুঁজতে গিয়ে কখনও মিলিটারি ট্র্যান্সমিশনও শুনতে পায়। নানা দিকে ছড়িয়ে থাকা গুপ্তচর স্যাটালাইটের টুকটাক আওয়াজ বা শব্দ ধরে ফেলা খুব অস্বাভাবিক নয়।

ওগুলো দ্য ওয়াশিংটন পোস্টের কলামে লেখা হয়: সেটি সাইটিং শিরোনামে। বেশিরভাগ সময় দেখা যায়, ওগুলো সাধারণ, গুরুত্বহীন সব শব্দ, কোনও আগামাথা নেই। আসলে ধরে নেয়া হয়েছে: সত্যিই একদিন এসব ফালতু শব্দের মধ্যেই মিলবে ভাল কোনও কাহিনি। হয়তো সেদিন ওই কাহিনি লেখা হলে মিলে যেতে পারে পুলিত্যার!

ইন্সটিটিউটে তোমার কাজ শেষে আমার সঙ্গে যোগাযোগ কোরো, বলল সান্থা। সৈক্সি ভঙ্গিতে এবার বলল, আমার কাছে একটা জিনিস আছে, ওটা সেটি সাইটিঙের চেয়ে খারাপ হবে না।

মুচকি হাসল অ্যাডোনিস। লোভ লাগিয়ে দিচ্ছ?

হুঁ।

কাজ শেষে সোজা বাড়ি ফিরছি, বলল অ্যাডোনিস।

আমি অপেক্ষায় থাকলাম। ওপাশে ফোন রেখে দিল সান্থা।

একঘণ্টা পর সেটি ইন্সটিটিউটের ধুলো ভরা পার্কিং লটে গাড়ি রাখল অ্যাডোনিস। লটে আরও তিনটে গাড়ি দেখল। লাফ দিয়ে, গাড়ি থেকে বেরিয়ে দরজায় তালা না মেরেই রওনা হয়ে গেল। দোতলা বাড়িটার দিকে। তিন শ ফুট উঁচু রেডিয়ো টেলিস্কোপের নীচে ছায়ার ভিতর বাড়িটা। চারপাশের মরুভূমিতে আরও সাতাশটা রেডিয়ো টেলিস্কোপ, দেখলে মনে হয় বিশাল সব স্যাটালাইট ডিশ।

বাড়ির ভিতর ঢুকতেই ছোটখাটো এক লোকের সঙ্গে দেখা হলো অ্যাডোনিসের। লোকটার পরনে সাদা ল্যাব কোট, নিজের নাম বলল বার্নি ওলসন। জানাল, ওই সিগনাল ধরেছে সে-ই।

বেশ কয়েক ধাপ নেমে অ্যাডোনিসকে একটা পাতাল-ঘরে নিয়ে এল সে। নীরবে লোকটার পিছনে চলেছে অ্যাডোনিস। চারপাশের দেয়ালে একের পর এক ইলেকট্রনিক রেডিয়ো ইকুইপমেন্ট।

হাঁটতে হাঁটতে বলল ওলসন, দুপুর আড়াইটার সময় শুনতে পেলাম। বুঝতে দেরি হলো না, ইংলিশ বলছে। তখনই বুঝলাম, এরা এলিয়েন হতে পারে না।

ভাগ্যিস বুঝেছেন, চেহারা ভীষণ গম্ভীর রাখল অ্যাডোনিস।

উচ্চারণ থেকে বুঝলাম, এরা আমেরিকান। তখনই পেন্টাগনে যোগাযোগ করলাম। হাঁটতে হাঁটতে অ্যাডোনিসের দিকে চাইল সে। ওখানে আমাদের একটা ডিরেক্ট লাইন আছে।

মনে হলো এজন্যে খুব গর্বিত সে। যেন নীরবে বুঝিয়ে দিল: সরকার মনে করে আমাদের কাজ খুব গুরুত্বপূর্ণ।

অ্যাডোনিস আন্দাজ করল, ওলসন যোগাযোগ করেছে কোনও রিসেপশনিস্টের দপ্তরে। ডিপার্টমেন্ট অভ ডিফেন্সের ফোন-বুকে যে-কেউ পাবে ওই নম্বর। অ্যাডোনিসের মোবাইল ফোনের স্পিডডায়ালেও ওই নম্বর আছে। 

তা যাই হোক, তারা যখন বলল, ওই ট্র্যান্সমিশন ওদের না, তখন ভাবলাম, খবরের কাগজের সঙ্গে যোগাযোগ করা যেতে পারে, বলল ওলসন।

খবরটা দিয়েছেন বলে অনেক ধন্যবাদ, বলল অ্যাডোনিস।

প্রকাণ্ড ঘরের কোণে একটা কন্সেলের সামনে পৌঁছে গেছে ওরা। ডেস্কের উপর দুটো স্ক্রিন, নীচে একটা কি-বোর্ড। স্ক্রিনের পাশে ব্রডকাস্ট কোয়ালিটি রিল-টু-রিল রেকর্ডিং মেশিন।

শুনতে চান ওই বার্তা? বলল ওলসন, রিল-টু-রিল রেকর্ডিং মেশিনের প্লে বাটনে বুড়ো আঙুল রেখেছে।

নিশ্চয়ই।

সুইচ টিপে দিল ওলসন, ঘুরতে শুরু করল রিল।

প্রথমে কিছুই শুনল না অ্যাডোনিস, চলছে শুধু স্ট্যাটিক। দুই মিনিট পর ওলসনের দিকে চাইল। গাধাটা ভুল রিল চালু করল?

আসবে আসবে, ধৈর্য ধরুন, বলল ওলসন।

আরও কিছুক্ষণ স্ট্যাটিক হওয়ার পর হঠাৎ শুরু হলো কথা:

…কপি, ওয়ান-টু-ফাইভ-সিক্স-ওয়ান-সিক্স…।

…আয়োনোস্ফেরিক সমস্যায় যোগাযোগ হারিয়ে…

…সামনের দল…

…মাসুদ রানা…।

…মাইনাস সিক্সটি-সিক্স পয়েন্ট ফাইভ…

…সোলার ফ্লেয়ার বারোটা বাজাচ্ছে রেডিয়োর…

..ওয়ান-ফিফটিন, টোয়েন্টি মিনিটস্, টুয়েলভ সেকেণ্ড ইস্ট;

…কী করে…কড়কড় করছে।…চলে যাও, যাতে…

..রওনা হয়েছে দ্বিতীয় টিম…

বিরক্তির চোটে চোখ বুজে ফেলল অ্যাডোনিস ক্যাসেডিন। খামোকা ওকে ডেকেছে গাধাটা। মিলিটারিদের অসম্পূর্ণ কিছু বার্তা দিয়ে ও কী করবে?

বার্তা থেমে গেছে। চোখ খুলল অ্যাডোনিস, দেখল ওর মুখের দিকে আগ্রহ নিয়ে চেয়ে আছে লোকটা। আশা করছে, তার আবিষ্কার থেকে দারুণ কিছু বেরিয়ে আসবে। লোকটা আছে মরা মরুভূমির ভিতর, মানুষ হিসাবে আসলে তেমন কেউ নয়। এমন অনেক মানুষ আছে, এদের কারও কোনও দাম নেই। সে বোধহয় আশা করছে, দ্য ওয়াশিংটন পোস্টে তার নাম ছাপা হবে। মানুষটার জন্য খারাপই লাগল অ্যাডোনিসের। আস্তে করে শ্বাস ফেলল সে। অনিচ্ছাসত্ত্বেও শার্ট পকেট থেকে কাগজ-কলম বের করল।

আরেকবার শোনাতে পারেন রিলটা?

প্রায় ঝাপিয়ে পড়ে রিওয়াইণ্ড বাটন টিপল ওলসন। একটু পর। রিল প্লে করল।

চুপচাপ নোট নিতে শুরু করল অ্যাডোনিস।

.

রানা ভাবছে, কপাল খুবই মন্দ জ্যাকুস ফিউভিলের। নিজেদের আনা বোমার আঘাতে মরেছে লোকটা। ফ্রেঞ্চরা ওই বোমা পেয়েছিল ইউনাইটেড স্টেটস্ থেকেই। দু দেশের গভীর বন্ধুত্বের প্রমাণ হিসাবে ন্যাটো থেকে ফ্রান্সকে দেয়া হয় ওই মাইন।

এম১৮এ১ মাইনকে সাধারণত দুনিয়াজুড়ে বলা হয় ক্রেমোর। ফুলে থাকা পোর্সেলিন বাসনের ভিতর থাকে এক শর বেশি বলবেয়ারিং। সঙ্গে থাকে ছয় শ গ্রাম সি-৪ এক্সপ্লোসিভ। ক্লোের আসলে ডিটেকটেবল ফ্র্যাগমেন্টেশন গ্রেনেড,। যতই বিস্ফোরণ হোক, এটার পিছনে থাকলে কোনও ভয় নেই। কিন্তু সামনে থাকলে… কয়েক শ টুকরো টুকবে শরীরে।

ক্লেমোরের বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, মাইনের সামনের দিকে লেখা থাকে: এদিকটা শত্রুর দিকে দিন।

ফ্রেঞ্চ ভাষায় লেখা ছিল: BRAQUEZ CE CÖTE SUR LENNEMI. অর্থাৎ ব্যাখায়েখ সে কোতে সুখ লেনেমি।

ইংরেজিতে ওই কথা দেখলে বুঝে নিতে হবে, আপনি আছেন ক্লেমোর মাইনের ভীষণ খারাপ দিকে।

শেষ কৌশল হিসাবে ড্রিলিং রুমে দুটো ক্লেমোর মাইন পেতেছে ফ্রেঞ্চ কমাণ্ডেরা। তাদের আশা ছিল, রানার দলের সবাই অক্কা, পাবে। লোকগুলো মরবার পর তাদের পরিকল্পনার টুকরোগুলো একে একে মিলিয়েছে রানা।

ফ্রেঞ্চ কমাণ্ডো দলের নেতা নীচে এক লোককে আগেই পাঠিয়েছে। সেই লোক দরজার সামনে পেতেছে দুটো ক্লেমোর মাইন। ওই দুটোর ভিতর ট্রিপ-ওয়ায়ার সংযোগ করা ছিল। এরপর বাধ্য হয়ে পিছাতে শুরু করেছে, এমন এক ভঙ্গি নিয়ে ড্রিলিং রুমে ঢুকে পড়ত কমাণ্ডো দল। রানার দল আগেই জানে, ড্রিলিং রুম থেকে বেরুতে পারবে না তারা। কোণঠাসা হয়ে গেছে শত্রুরা। চেঁচিয়ে সারেণ্ডার করবে।

তাদের পিছনে ছুটে যাবে রানার দলের সবাই।

আর ট্রিপ-ওয়ায়ারে পা পড়তেই ব্যস, ভিঢ়িম!

খুব সহজ ফাঁদ পেতেছে ফ্রেঞ্চরা। ওই এক চালেই সব গুটি উল্টে যেত। চতুরতার সঙ্গে কাজটা করেছে তারা, পিছাতে শুরু করেছে। যে-কেউ বুঝবে, তাদেরকে হার মানতেই হবে। কারও মনে হবে না, আসলে ফ্রেঞ্চ দুর্দান্ত কাউন্টার-অ্যাটাক করছে।

কিন্তু একটা কথা জ্যাকুস ফিউভিল বোঝেনি, কংকেভ মাইনের ফাঁদ পাতার সময় রানার দলের কেউ ঢুকে পড়তে পারে ঘরে। সে। যদি ফ্রেঞ্চ কমাণ্ডোকে ঠেকিয়ে দেয়, সেক্ষেত্রে তাদের আর কোনও ভরসা থাকে না।

নাজমুলের কাজ দেখে খুশি হয়ে সবাই মিলে ওর পিঠ চাপড়ে লাল করে দিয়েছে।

কর্পোরাল কোনও হাতাহাতির ভিতর যায়নি, এক ঢিলে দুটো পাখি ঝোলার ভিতর পুরেছে। ফ্রেঞ্চ কমাণ্ডো মারা যাওয়ার পর মাত্র একটা জিনিস পাল্টে দিয়েছে নাজমুল।

ক্লেমোর মাইনের মুখ ঘুরিয়ে দিয়েছে।

জ্যাকুস ফিউভিল যখন ড্রিল রুমের ভিতর থেকে নাজমুলকে দেখল, এরপর তার চোখ পড়ল ভয়ঙ্কর এক দৃশ্যের উপর। ক্লেমোর মাইন চেয়ে আছে তার দিকেই!

আর ঠিক তখন ট্রিপ-ওয়ায়ারে পা রাখল নাজমুল। এরপর কী হয়েছে জ্যাকুস ফিউভিল জানে না।

এর ফলে শেষ হয়েছে দীর্ঘ একটা লড়াই।

.

একঘণ্টার ভিতর বেশিরভাগ মৃতদেহ খুঁজে বের করা হলো।

জ্যাকুস ফিউভিল শেষ। এ ছাড়া তিমির হামলায় মরেছে চার ফ্রেঞ্চ কমাণ্ডো। আমেরিকান মেরিনের কর্পোরাল টনি কেলগ ও জর্জ মারফি মারা গেছে। হলিডের লাশ পাওয়া গেল না, ওটা নিয়ে গেছে তিমি। সব মিলে আট ফ্রেঞ্চ কমাণ্ডোর লাশ পড়ে ছিল আইস স্টেশনের নানান জায়গায়।

আমেরিকান মেরিন ও বাংলাদেশ আর্মির সব মিলে দুজন গুরুতর ভাবে আহত। নিশাত সুলতানার এক হাঁটু কেটে নিয়ে গেছে খুনি তিমি। সবাই ভেবেছিল লড়াই শুরু হওয়ার সময় মরেছে কেভিন হাক্সলে, পরে দেখা গেল এখনও বেঁচে আছে সে।

কেভিন হাক্সলের চেয়ে অনেক সুস্থ নিশাত, এখনও জ্ঞান আছে ওর অন্য হাত-পা ঠিকভাবেই নাড়ছে। থেমে গেছে রক্ত পড়া, ব্যথাও নেই মেথডনের গুণে। এখন ওর শেষ শত্রু হয়ে উঠতে পারে শক। ঠিক করা হয়েছে, আপাতত পর্যবেক্ষণের জন্য ই-ডেকে, গুদাম-ঘরেই রাখা হবে নিশাতকে। এখন সরাতে গেলে জ্ঞান হারাতে পারে।

এদিকে কমবয়সী মেরিন ডুবে গেছে ট্রমার ভিতর, কোনও জ্ঞান নেই। রানা এবং ওর দল যখন কেভিনকে সরাতে চাইল, তখন বুঝেছে, এখনও বেঁচে আছে বেচারা। আসলে অমন গুরুতর আহত হলে মানুষের মগজ সমস্ত নিয়ন্ত্রণ নিজ হাতে তুলে নেয়। যতই মেথডন বা মর্ফিন দেয়া হোক, এত বুলেট শরীরে নিয়ে সেব্যথা কেউ সহ্য করতে পারবে না। সেরা কাজটা করেছে মগজ,। হাক্সলের সেনসারি অ্যাপারেটাস অফ করে দিয়েছে, আশা করছে, বাইরে থেকে কেউ সাহায্য করবে।

এখন জরুরি হয়ে উঠেছে একজন ডাক্তার পাওয়া।

নার্সের কাজ জানে নিশাত, কিন্তু নিজেই তো পা হারিয়ে পঙ্গু হতে বসেছে। মেরিনদের সঙ্গে মেডিক হিসাবে ছিল হলিডে সিম্পসন, সে-ও চলে গেছে সবার ধরাছোঁয়ার বাইরে।

এইমাত্র ই-ডেকে নিশাতকে দেখে এসেছে রানা, এখন হাঁটছে এ-ডেকের ক্যাটওয়াকে। ডাইনিং রুমের দরজায় থামল, জিজ্ঞেস করল, কী করছ, নাজমুল?

ঘরের ভিতর কেভিন হাক্সলের উপর ঝুঁকে পড়েছে নাজমুল। টেবিলের উপর চিত হয়ে পড়ে আছে আমেরিকান ছেলেটা। মেঝের উপর গড়িয়ে পড়ছে রক্ত, দেখতে না দেখতে জমাট বরফ হয়ে উঠছে।

কাজ থেকে চোখ তুলে চাইল নাজমুল। হতাশ হয়ে মাথা, নাড়ল। বড় করে শ্বাস ফেলে বলল, রক্ত পড়া থামাতে পারছি না। শরীরের ভিতর অনেক জখম। গোটা পেট ছিড়েখুড়ে গেছে। কপাল থেকে ঘাম মুছল ও। চোখের উপর দেখা দিল রক্তের সরু রেখা। আস্তে করে বলল, আমি আর কিছু করতে পারব না, স্যর। এখনই ওর ডাক্তার দরকার।

নিথর ছেলেটির দিকে চাইল রানা। কয়েক মুহূর্ত পর বলল, যতটা পারো করো। ঘর থেকে বেরিয়ে এল ও।

.

ঠিক আছে, এবার মন দিয়ে শোনো সবাই, বলল রানা। আমাদের হাতে খুব বেশি সময় নেই। কাজেই সংক্ষেপে বলছি।

ই-ডেকে পুলের পাশে রানাসহ হাজির হয়েছে সুস্থ ছয়জন যোদ্ধা। ফাঁকা উইলকক্স আইস স্টেশনের ভিতর গমগম করে উঠল রানার কণ্ঠ, মনে রেখো, ফ্রেঞ্চরা যখন হামলা করেছে, ধরে নিতে পারো, অন্যরাও আসবে। তারা এতক্ষণে যথেষ্ট সময় পেয়েছে। এবার আসতে পারে ফুল স্কেল অ্যাটাক। এখন যে দলই আসুক, তারা ফ্রেঞ্চদের চেয়ে অনেক বেশি প্রস্তুতি নিয়ে। আসবে। আরও অনেক অস্ত্র থাকবে তাদের কাছে।…কারও কিছু বলার আছে?

আমার কিছু বলার নেই, স্যর, বলল সার্জেন্ট হোসেন আরাফাত দবির।

একই কথা আমার, বলল গানারি সার্জেন্ট ভাইপার।

বাংলাদেশ আর্মির সার্জেন্ট দবির এবং মেরিনদের গানারি সার্জেন্ট পল সিংগার দলে সবচেয়ে বয়স্ক। ওরা বুঝেছে, ঠিকই বলছে মেজর মাসুদ রানা।

আর কেউ কিছু বলছে না। রানা বলল, ঠিক আছে, এবার শুনুন, সার্জেন্ট জনি ওয়াকার…

জী, মেজর।

আপনি গিয়ে হোভারক্রাফট দুটোর রেফাইণ্ডার ঘুরিয়ে দিন স্টেশনের বাইরের দিকে। দুটোর মধ্যে যেন গ্যাপ না পড়ে। শুধু ট্রিপ-ওয়ায়ার দিয়ে কিছুই হবে না। এখন থেকে রেঞ্জফাইণ্ডার কাজে লাগবে। স্টেশনের পঞ্চাশ মাইলের ভিতর কেউ এলেই জানতে চাই।

বুঝতে পেরেছি, বলল সার্জেন্ট ওয়াকার।

আপনি যখন উপরে থাকবেন, চেষ্টা করবেন রেডিয়ো দিয়ে ম্যাকমার্ডোর সঙ্গে যোগাযোগ করতে, বলল রানা। জানতে হবে কখন আসবে রিইনফোর্সমেন্ট। এতক্ষণে ম্যাকমাড়োয় পৌঁছে যাওয়ার কথা আমেরিকান সৈনিকদের!

বুঝেছি, রওনা হয়ে গেল ওয়াকার।

মোরশেদ… বলল রানা।

বলুন, মাসুদ ভাই।

তোমার কাজ ইরেজার বা ডিলে সুইচ খুঁজে বের করা। এই স্টেশনের উপর থেকে শুরু করে নীচ পর্যন্ত সবখানে খুঁজবে। ওটার ভিতর কোনও সুইচ থাকবে। ফ্রেঞ্চদের কোনও না কোনও চালাকি থাকতেই পারে, খুঁজে বের করো সেটা।

জী, মাসুদ ভাই, কাছের রাং-ল্যাডারের দিকে চলল লেফটেন্যান্ট গোলাম মোরশেদ।

গানারি সার্জেন্ট ভাইপার…

স্যর।

ডাইভিং বেল উঁচু করা বা নামানোর উইঞ্চের কাছে চলে যান। ওটার কন্ট্রোল প্যানেল সি-ডেকের অ্যালকোভে। লড়াইয়ের সময় গ্রেনেডের আঘাতে কন্ট্রোল প্যানেল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যত দ্রুত সম্ভব উইঞ্চ চালু করতে হবে। …আপনি ওটা মেরামত করতে পারবেন?

আশা তো করি পারব, স্যর। বিদায় নিল গানারি সার্জেন্ট ভাইপার।

রানার সামনে রয়ে গেল মাত্র দুজন সার্জেন্ট হোসেন আরাফাত দবির ও লেফটেন্যান্ট তিশা করিম।

দবির, তিশা, আপনারা ডাইভ গিয়ার তৈরি রাখুন। তিনজন ডাইভার নামবে পুলে। কাজেই চার ঘণ্টা ডাইভ কমপ্রেশন চাই। লো-অডিবিলিটি গিয়ার ব্যবহার করবেন। পরে লাগতে পারে, সেজন্য অগযিলারি রাখবেন।

এয়ার মিক্স? জানতে চাইল সার্জেন্ট দবির।

স্যাচিউরেটেড, হিলিয়াম-অক্সিজেন, নাইনটি-এইট টু টু, বলল রানা।

কয়েক মুহূর্ত চুপ রইল হোসেন আরাফাত দবির ও তিশা করিম। ৯৮%, হিলিয়াম ও ২% অক্সিজেনের মিশ্রণ খুব কমই করা হয়। অক্সিজেনের এত কম ব্যবহার থেকে বোঝা যায়, অনেক গভীরে ডাইভ দেয়া হবে।

তিশা ও দবিরের হাতে এক মুঠো নীল ক্যাপসুল দিল রানা। জিনিসটা এন-৬৭ডি অ্যান্টি-নাইট্রোজেন ব্লাড-প্রেশার ক্যাপসুল। আমেরিকান নেভি ওটা ব্যবহার করে ডিপ-ডাইভ মিশনে। রওনা হওয়ার আগে ম্যাকমার্ডো স্টেশন চিফের কাছ থেকে পেয়েছে রানা এ-জিনিস। মিলিটারি ডাইভাররা আদর করে এই ক্যাপসুলের নাম দিয়েছে পিল

গভীর পানিতে নামবার সময় রক্তের বাড়তি নাইট্রোজেন দূর করে, ঠেকিয়ে দেয় ডুবুরিদের ডিকমপ্রেশন সিকনেস বা বেণ্ড। রক্তের ভিতর নাইট্রোজেন দূর করে বলে নেভি এবং মেরিন কর্পস ডুবুরিরা অনেক সহজে নেমে যেতে পারে, তাদের নাইট্রোজেন নারকোসিসের ভয় থাকে না। আবার উঠতে গিয়ে ডিকমপ্রেশন স্টপ বা বাড়তি সময়ও দিতে হয় না। আমেরিকা ও অন্যান্য উন্নত দেশ এই বিপ্লবী পিল মিলিটারি ডিপ-ডাইভে ব্যবহার করে।

ডিপ ডাইভিং? নীল ক্যাপসুল থেকে চোখ তুলে রানার দিকে চাইল তিশা।

আস্তে করে মাথা দোলাল রানা। আমাদের জানতে হবে ওই। গুহার ভেতর কী আছে।

১৭.

বি-ডেকের বাইরের সুড়ঙ্গ ধরে হাঁটছে মাসুদ রানা, ডুবে আছে গভীর ভাবনায়। ওর মনে হচ্ছে, খুব দ্রুত সব ঘটতে শুরু করেছে।

উইলকক্স আইস স্টেশনে ফ্রেঞ্চ হামলা জোর কঁকি দিয়েছে ওকে। ভাল করেই বুঝেছে, এই স্টেশনের নীচে কী আছে, ওর জানতেই হবে। কী লুকিয়ে আছে এই স্টেশনের নীচে? যাই থাক, সেজন্য নিরপরাধ মানুষ মারতে একটুও দ্বিধা করেনি ফরাসি সরকার। 

ফ্রেঞ্চ কমাণ্ডোরা জিনিসটা কেড়ে নিতে এসেছে এবং হেরে গেছে। কিন্তু সেজন্য নিশ্চিন্ত হওয়ার কোনও কারণ নেই। এবার অন্য কোনও দেশ তাদের কমাণ্ডো পাঠাতে পারে। তা যদি হয়, ফুল স্ট্রেংথ ইউএস ফোর্স পৌঁছবার আগেই উইলকক্স আইস স্টেশনের ওপর আবারও হামলা আসবে।

আগামী কয়েকটা ঘণ্টা খুবই বিপজ্জনক সময়।

ওর ভুল না হয়ে থাকলে, একাধিক দেশের মিলিটারি আসছে, উইলকক্সআইস স্টেশনের দিকে।

এখন প্রশ্ন: আমেরিকান রিইনফোর্সমেন্ট আগে আসবে, না তার আগেই হাজির হবে অন্য কোনও দেশের সশস্ত্র বাহিনী?

সেক্ষেত্রে মাত্র এই কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে কী করতে পারবে মাসুদ রানা?

এ নিয়ে বেশি ভাবতে চাইছে না। এমনিতেই অনেক কাজ পড়ে আছে। অবশ্য অন্যসব কাজের ভিতর এখন খুব দ্রুত একটা কাজ সারতে হবে।

ফ্রেঞ্চদের সঙ্গে লড়াইয়ের পর উইলকক্স আইস স্টেশনে রয়ে গেছে পাঁচ বিজ্ঞানী। তাদের তিনজন পুরুষ, দুজন মহিলা— এরা সবাই আশ্রয় নিয়েছে বি-ডেকের লিভিং কোয়ার্টারে। এখন ওদিকেই চলেছে রানা, মনে আশা: ওই পাঁচজনের ভিতর হয়তো ডাক্তার থাকতে পারে। সে চিকিৎসা ও শুশ্রুষা দিতে পারবে কেভিন হাক্সলেকে।

বাঁকা টানেলে হেঁটে চলেছে রানা, এখনও পোশাক থেকে টপটপ করে পানি পড়ছে। ভীষণ শীত লাগছে, কিন্তু পাত্তা দিচ্ছে না। মেরিনদের সঙ্গে এসেছে বলে ওদের সবাইকে ফেটিগের নীচে থারমাল ওয়েটসুট দেয়া হয়েছে। আর্কটিক পরিবেশে প্রতিটি দেশের রিকন ইউনিটের সদস্যরা ওই পোশাক ব্যবহার করে। লংজনের চেয়ে অনেক গরম ওয়েটসুট, তা ছাড়া, ভিজে গেলেও ভারী হয়ে ওঠে না। কম ওজন বহন করা রিকন ইউনিটের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, ওয়েটসুট বয়ে নেয়ার চেয়ে পরে থাকাই অনেক সোজা।

হঠাৎ রানার ডানদিকে খুলে গেল একটা দরজা, ওদিক থেকে ভাসতে ভাসতে আসছে বাষ্প। পিচ্ছিল কালো কী যেন বেরিয়ে এল করিডোরে, থামল রানার সামনে।

লিলি।

পানিতে ভিজে চুপচুপ করছে ওটা। হাসি-হাসি ভঙ্গি করে রানার দিকে চাইল। ওদিকটা শাওয়ার রুম, বাস্পের ভিতর থেকে

বেরিয়ে এল মেরি ভিসারও। রানাকে দেখেই মিষ্টি করে হাসল। . হাই, বলল। এখন ওর পরনে শুকনো পোশাক। একটু

এলোমেলো মাথার চুলগুলো। রানা আঁচ করল, গরম শাওয়ার নিয়েছে মেরি।

হাই, মৃদু হাসল রানা।

শাওয়ার রুম খুব ভালবাসে লিলি, সিলটার দিকে ইশারা করল মেরি। বাষ্পের ভিতর পিছলে গেলে খুব ফুর্তি ওর।

কুচকুচে কালো, ছোট্ট গেযেলা সিলের দিকে চাইল রানা, ওটা থেমেছে ওর পায়ের সামনে। দেখতেই মনে হলো একটু আদর করে দেয়া উচিত। তা ছাড়া, এই সিল ওর প্রাণ বাঁচিয়েছে। নরম চাহনির বাদামি চোখে বুদ্ধির পরিষ্কার ছাপ।

মেরির দিকে চাইল রানা। এখন সুস্থ বোধ করছ?

শুকনো পোশাক পরার পর এখন আর খারাপ লাগছে না, বলল মেরি।

আস্তে করে মাথা দোলাল রানা। পুলের ভিতর ভীষণ ভয় পেয়েছিল মেয়েটা, সেই ভয় কাটিয়ে খুব দ্রুতই সামলে নিয়েছে। বাচ্চারা এমনই হয়, দ্রুত শিখতে যেমন পারে, ভুলতেও পারে। অত উপর থেকে পুলের ভিতর পড়েছে! ওর মত করে তিমির তাড়া খেলে মানসিক রোগী হয়ে উঠত বয়স্ক কেউ।

মেরি যে হাসি-খুশি আছে সেজন্য মনে মনে সার্জেন্ট দবিরের প্রশংসা করল রানা। ও নিজে যখন পুলের ভিতর মেরির হাতে ম্যাগহুক ধরিয়ে দিল, আর মেয়েটি উঠে গেল উপরের দিকে, তারপর থেকে বাকি লড়াইয়ের সময় সর্বক্ষণ ওকে নিজের পাশে রেখেছে দবির। মেরির কোনও ক্ষতি হতে দেয়নি।

গুড, বলল রানা। তুমি আসলে কিছুই ভয় পাও না, তাই না? বড় হলে মেরিন হতে পারো।

আপনি কি মেরিন? জানতে চাইল মেরি, চিকচিক করছে চোখদুটো।

না। মাথা নাড়ল রানা। আমি অন্য দেশের সৈনিক।

কিন্তু সোলজার।

তা ঠিক।

আমি ঠিক আপনার মত মানুষ হতে চাই।

তুমি ওদিকে যাবে? সামনের দিক ইশারা করল রানা।

হ্যাঁ, যাব, রানার পাশে হাঁটতে শুরু করল মেরি। টানেলের মেঝেতে থপথপ করে পিছু নিয়েছে লিলি।

আপনি কোথায় চলেছেন? জানতে চাইল মেরি।

তোমার মাকে খুঁজছি।

ওহ্, একটু মিইয়ে যাওয়া স্বরে বলল মেরি।

পরিবর্তনটা খেয়াল করেছে রানা, ওর পাশে মেঝের দিকে। চেয়ে হাঁটছে মেরি। হঠাৎ করে মেয়েটার মন খারাপ হলো কেন?

অস্বস্তিকর নীরবতা নেমেছে দুজনের মাঝে। রানা ভাবতে শুরু করেছে কী বলা যায়। কয়েক সেকেণ্ড পর বলর, হ্যাঁ, কত যেন বলেছিলে তোমার বয়স? বারো?

হ্যাঁ।

তা হলে সেভেনে পড়ো?

হ্যাঁ।

আচ্ছা, সেভেন, আর কিছুই মাথায় আসছে না, নিজের উপর রেগেই গেল রানা। এক মুহূর্ত পর বলল, তা হলে তো ক্যারিয়ার নিয়ে ভাবার সময় হয়ে গেছে।

রানার কথা শুনে গভীর ভাবে ভাবতে শুরু করেছে মেরি, হাঁটতে হাঁটতে রানার দিকে চাইল। হ্যাঁ, বলল গম্ভীর সুরে। যেন সত্যি ওর বারো বছর বয়সী মনে এ নিয়ে অনেক চিন্তা জড় হয়েছে। আমি ঠিক করেছি শিক্ষক হব, বলল। আমার বাবার মত। আবার আপনার মত ভাল মানুষও হতে চাই।

তোমার বাবা কী পড়ান?

বস্টনের বড় একটা কলেজে জিয়োলজি, বলল মেরি। এবার গম্ভীর ভাবে বলল, কলেজের নাম হার্ভার্ড।

তুমি নিজে কি পড়াতে চাও? জানতে চাইল রানা।

অঙ্ক।

অঙ্ক?

আমি অঙ্কে ভাল, বলল মেরি। শ্রাগ করল, একইসঙ্গে বিব্রত ও গর্বিতা।। আমার বাবা হোমওঅর্কের সময় সাহায্য করতেন, বলল মেরি। উনি বলতেন, বয়সের তুলনায় অনেক বেশি অঙ্ক বুঝি আমি। তাই আমাকে অঙ্ক পড়াতেন, সমবয়সীরা এখনও ওসব অঙ্ক চোখেও দেখেনি। দারুণ ইন্টারেস্টিংসব অঙ্ক। আরও কয়েক বছর পর ওগুলো শেখার কথা। বাবা এমন সব অঙ্ক শিখিয়েছেন, যেগুলো কোনও স্কুলে পড়ানোই হয় না।

তাই? আগ্রহী হয়ে বলল রানা, কী ধরনের অঙ্ক সেগুলো?

আপনি মনে হয় জানেন–পলিনেমিয়াল, নাম্বার সিকিউয়েন্স, কিছু ক্যালকুলাস। 

ক্যালকুলাস… নাম্বার সিকিউয়েন্স… অবাক হয়ে গেল রানা।

যেমন ধরুন ট্রায়াঙ্গুলার নাম্বার ও ফিবোনাচি নাম্বার, এইসব আর কী।

অবাক বিস্ময় নিয়ে মাথা নাড়ল রানা, বাব্বা, অনেক শিখেছে পিচ্চি মেয়ে। ওর বয়স মাত্র বারো, অন্যদের তুলনায় একটু খাটো, কিন্তু দারুণ চালু ওর মগজ। আবারও মেরির দিকে চাইল রানা, পায়ের আঙুলে ভর দিয়ে প্রায় নাচতে নাচতে চলেছে ও। মনেই হয় না সাধারণ কোনও বাচ্চা মেয়ে নয়।

আমরা দুজন একসঙ্গে অনেক অঙ্ক করতাম, বলল মেরি। আরও কত কিছু সফটবল, হাইকিং, এমন কী, একবার আমাকে স্কুবা ডাইভিঙে নিয়ে গিয়েছিল বাবা। অথচ, তখনও ওই কোর্স আমি করিইনি।

তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে, তোমার বাবা এখন আর এসব করেন না, বলল রানা। .

জবাব দিচ্ছে না মেরি, নীরব হয়ে গেছে। কিছুক্ষণ পর বলল, না আর করেন না।

কেন করেন না? আস্তে করে জানতে চাইল রানা। ভাবছে, এবার শুনতে পাবে মেরির বাবা-মা সর্বক্ষণ ঝগড়া করতেন, শেষে ডিভোর্সই হয়ে গেল। আজকাল এসব: খুব চলে। এমন কী বাংলাদেশেও।

গতবছর গাড়ি দুর্ঘটনায় মারা গেছেন বাবা, মৃদু স্বরে বলল মেরি।

কথাটা শুনে হঠাৎ করেই থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল রানা। চাইল মেরির দিকে। বাচ্চা মেয়েটির চোখ জুতোর ফিতার উপর।

আমি সত্যিই দুঃখিত, মেরি, নরম স্বরে বলল রানা।

মাথা কাত করল মেরি। না, ঠিক আছে। আবার হাঁটতে শুরু করেছে।

বাইরের দিকের টানেলে দেয়ালের ভিতর অংশে একটা দরজা বসানো, ওখানে পৌঁছে গেছে রানা ও মেরি।

আমি এখানেই থামব, বলল রানা।

আমিও, বলল মেরি।

নব মুচড়ে দরজা খুলে ফেলল রানা, আগে ঢুকতে. দিল মেরিকে। ওর পর লিলি। ওদের পিছনে ঘরে ঢুকল রানা।

যে ঘরে ঢুকেছে, সেটা কোনও কমন-রুম। বিশ্রী কটকটে কমলা রঙের কয়েকটা সোফা, একপাশে স্টেরিয়ো, টেলিভিশন ও ডিভিডি। রানা বুঝতে পারছে, এরা নিয়মিত টিভি সিগনাল পায় না। বাধ্য হয়ে টিভিতে ডিভিডির সিনেমা বা অন্য অনুষ্ঠান দেখে।

কমলা এক কাউচে বসেছে নিনা ভিসার ও রাফায়লা ম্যাকানটায়ার। দুজনের পরনে এখন শুকনো পোশাক। অন্যদিকের কাউচে তিনজন তোক। এরা সবাই উইলকক্স আইস স্টেশনের বিজ্ঞানী। আগেই লোকগুলোর নাম জেনে নিয়েছে রানা। তারা: হ্যাভেনপোর্ট, টমসন ও হ্যারি। ফ্র্যাগমেন্টেশন গ্রেনেডের আঘাতে কর্পোরাল টনি কেলগের কী হয়েছে, তা দেখবার পর কেউ ঘূর থেকে বেরুবার সাহস করেনি। সবাইকে ক্লান্ত ও হতাশ মনে হলো।

কাউচের কাছে গিয়ে নিনা ভিসারের পাশে বসল মেরি। নীরব হয়ে গেছে, মাকে কিছুই বলল না। রানার মনে পড়ল, ফ্রেঞ্চ হামলা শুরু হওয়ার আগে প্রথমবার এই মা-মেয়েকে একসঙ্গে দেখেছিল। তখনও তেমন কোনও কথা বলেনি মেরি। দুজনের ভিতর কোনও রাগারাগি ছিল, তাও মনে হয়নি। কিন্তু এখন টের পেল, আড়ষ্ট হয়ে উঠেছে তারা। মন থেকে চিন্তাটা দূর করতে চাইল রানা, নিনা ভিসারের সামনে গিয়ে দাঁড়াল।

আপনাদের ভিতর কোনও চিকিৎসক আছেন? জানতে চাইল রানা।

মাথা নাড়ল নিনা ভিসার। না। বব থর্নিক্রাফট ছিল স্টেশনের একমাত্র ডাক্তার। কিন্তু সে তো… চুপ হয়ে গেল সে।

কী? .

বড় করে শ্বাস ফেলল নিনা। সে ছিল হোভারক্রাফটে। কথাছিল ওই গাড়ি যাবে ডুমো ডিখ-ঈলেখে।

ধীরে মাথা দোলাল রানা। টের পেল, আবারও রেগে গেছে। পাঁচ বিজ্ঞানীকে উদ্ধারের নাম করে নিয়ে গিয়ে মেরে ফেলেছে ফ্রেঞ্চ কমাণ্ডোরা।

ওর হেলমেট ইন্টারকমে কণ্ঠ শুনল: মেজর রানা, সার্জেন্ট জনি ওয়াকার বলছি।

বলুন।

আপনার কথামত স্টেশনের বাইরের দিকে রেঞ্জফাইন্ডার তাক করেছি। আপনি কি এসে দেখবেন?

হ্যাঁ, আসব, বলল রানা। কয়েক মিনিট পর। আপনি কোথায়?

দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে।

ওখানেই অপেক্ষা করুন। ম্যাকমার্জোয় রেডিয়ো করতে পেরেছেন?

এখনও চেষ্টা চালাচ্ছি। কিন্তু প্রতিটা ফ্রিকোয়েন্সির ভিতর জট পাকিয়ে গেছে। যোগাযোগ করতে পারছি না।

চেষ্টা করতে থাকুন, বলল রানা, একটু পর আসছি।

কমন রুম থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য ঘুরে দাঁড়াল রানা, দরজার কাছে চলে গেছে, এমন সময় কে যেন, ওর কাঁধে টোকা দিল! ঘুরে দাঁড়াল রানা। নিনা ভিসার। হাসছে মহিলা।

এইমাত্র মনে পড়ল, বলল। স্টেশনে মেডিকেল ডাক্তার আছে।

.

লড়াই শেষ হওয়ার পর দুই ফ্রেঞ্চ বিজ্ঞানী ম্যাথিউ ফেনুয়্যা ও স্যা ডেনি পেয়েযিকে পাওয়া গেছে। ডাইনিংরুমের এক কাবার্ডে। প্রাণের ভয়ে লুকিয়ে ছিল লোকদুটো। তারা কোনও বাধা দেয়ারও চেষ্টা করেনি। অনানুষ্ঠানিক ভাবে ঘাড় ধরে কাবার্ড থেকে বের করা হয়েছে, ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়া হয়েছে মেঝের উপর। লোকদুটোর মুখে ফুটে উঠেছিল ভীষণ ভয়। ভুল দলের হয়ে কাজ করেছে তারা। যাদেরকে মেরে ফেলতে চেয়েছে, তারাই এখন বন্দি করেছে ওদেরকে। কাজেই ধরে নিয়েছে, এবার যে-কোনও সময়ে বিশ্বাসঘাতকার জন্য চরম শাস্তি পাবে। মেরে ফেলা হবে তাদেরকে।

তারপর যখন দেখল, তাদের দুই হাতে হ্যাণ্ডকাফ আটকে দেয়া হয়েছে, তাতে একটু স্বস্তি পেয়েছে। ঘাড় ধরে আবারও দাঁড় করানো হয়েছে, ধাক্কা দিয়ে বের করা হয়েছে ডাইনিংরুম থেকে। এরপর তাদেরকে নামিয়ে আনা হয়েছে ই-ডেকে। একটা খুঁটির সঙ্গে তাদের হ্যাণ্ডকাফ আটকে দেয়া হয়েছে। অনেক কাজ পড়ে আছে, কাজেই রানা চায়নি ওর কোনও লোক এদেরকে পাহারা দিতে বাধ্য হোক। সময় নেই ওদের হাতে। ফ্রেঞ্চ বিজ্ঞানীদের প্ল্যাটফর্মে যেখানে দাঁড় করিয়ে দেয়া হয়েছে, সেটা চারপাশ থেকে দেখা যায়। কাজের ফাঁকে তাদের উপর চোখ রাখতে পারবে সবাই।

বি-ডেকের ভাঙা ক্যাটওয়াকে বেরিয়ে এসেছে রানা, হেলমেট মাইকে কিছু বলবে, এমন সময় ক্যাটওয়াকে ওর পিছনে এসে দাঁড়াল নিনা ভিসার। একটু ইতস্তত করে বলল, একটা কথা বলতে চাই আপনাকে। কমন রুমে জিজ্ঞেস করতে পারিনি।

হাতের ইশারায় একটু অপেক্ষা করতে বলে হেলমেট মাইকে বলল রানা, নাজমুল। রানা। হাক্সলে কেমন আছে?

ইয়ারপিসে ভেসে এল নাজমুলের কণ্ঠ: আপাতত রক্ত থামাতে পেরেছি। কিন্তু স্যর, আর কিছুই করতে পারব না। যেকোনও সময়ে মরবে।

এখন কি স্টেবল?

মনে তো হয়, স্যর।

ঠিক আছে, শোনো। তুমি ই-ডেকে নামবে, ওখানে আটকে রাখা হয়েছে দুই ফ্রেঞ্চ বিজ্ঞানীকে। তাদের একজন ম্যাথিউ ফেনুয়্যা, তাকে ছুটিয়ে আনবে। কথার ফাঁকে নিনা ভিসারের দিকে চাইল রানা। জানতে পারলাম, মেসিউ ফেনুয়্যা আসলে, দক্ষ সার্জেন।

ঠিক আছে, স্যর, তাড়াতাড়ি করে বলল নাজমুল। হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে। এবার সত্যিকারের কোনও ডাক্তার চিকিৎসা করতে পারবে হাক্সলের। এক মুহূর্ত চুপ করে থাকল সে, তারপর বলল, কিন্তু… স্যর…

কী, নাজমুল?

আমরা কি ওই লোককে বিশ্বাস করতে পারি?

না, পারি না, দৃঢ় ভাবেই বলল রানা। রাং-ল্যাডারের দিকে চলেছে। উঠবে এ-ডেকে। নিনা ভিসারকে আসতে ইশারা করল। ফুটো পয়সা দিয়েও বিশ্বাস করবে না। নাজমুল, ওই লোককে বলবে, কেভিন হাক্সলে মরলে তাকেও মেরে ফেলা হবে।

ঠিক আছে, স্যর।

রাং-ল্যাডারের উপরের ধাপে গিয়ে থামল রানা, পা রাখল এডেকের ক্যাটওয়াকে। ঘুরে দাঁড়িয়ে দু হাত ধরে নিনা ভিসারকে তুলে নিল। তখনই দেখতে পেল ডাইনিংরুম থেকে বেরিয়ে এসেছে নাজমুল, উল্টো দিকের রাং-ল্যাডারের দিকে ছুটতে শুরু করেছে। ই-ডেকে নেমে তুলে আনবে ফ্যেনুয়্যাকে।

স্টেশনের প্রধান প্রবেশ পথের দিকে চলেছে রানা ও নিনা। একবার ঘাড় ফিরিয়ে স্টেশনের ভিতর অংশ দেখে নিল রানা। চারপাশে ছড়িয়ে পড়েছে ওর দলের আর সবাই।

সার্জেন্ট জনি ওয়াকার আছে বাইরে ঝড়ের ভিতর। ই-ডেকে সার্জেন্ট দবির ও লেফটেন্যান্ট তিশা, ওরা ডাইভিঙের জন্য স্কুবা গিয়ার প্রস্তুত করছে। গানারি সার্জেন্ট আছে মাঝের সি-ডেকে, অ্যালকোভে। উইঞ্চ কন্ট্রোল ঠিক করছে। লেফটেন্যান্ট গোলাম মোরশেদকে কোথাও দেখা গেল না। সে স্টেশন ঘুরে ইরেজার খুঁজছে।

সবাই যে যার কাজে ব্যস্ত।

রানার হেলমেট ইন্টারকম খড়মড় করে উঠল। এক মুহূর্ত পর বলে উঠল গোলাম মোরশেদ।

কিছু পেলে, মোরশেদ?

না, মাসুদ ভাই। স্টেশনে কোনও ইরেজার ডিভাইস নেই।

নেই? ভুরু কুঁচকে গেল রানার। তা হয় কী করে?

কিছু নেই। ফ্রেঞ্চরা বোধহয় বুঝতে পারেনি এত তাড়াতাড়ি লড়তে হবে। তাই ইরেজার বসাতে পারেনি।

রানা ভাবল, বোধহয় ঠিকই বলেছে মোরশেদ। সার্জেন্ট আরাফাত দবির খুব দ্রুত ফিরে আসতেই জানা গেল ফ্রেঞ্চরা গুলি করে মেরে ফেলেছে বিজ্ঞানীদেরকে। বিধ্বস্ত হয়েছে তাদের হোভারক্রাফট। ফ্রেঞ্চ কমান্ডোরা চেয়েছিল ওদের সবার বিশ্বাস অর্জন করবে, তারপর পিঠে গুলি করে মারবে! যখন তাদের সে পরিকল্পনা বিফল হলো, চট করে আর ইরেজার বসাতে পারেনি।

কিন্তু একটা জিনিস পেয়েছি, মাসুদ ভাই, বলল মোরশেদ।

সেটা কী?

একটা রেডিয়ো।

রেডিয়ো? শুকনো স্বরে বলল রানা। ওই জিনিস দিয়ে কী করত লোকগুলো?

সাধারণ কোনও রেডিয়ো নয়, মাসুদ ভাই। এটা ভিএলএফ। পোর্টেবল ভিএলএফ ট্রান্সমিটার।

মোরশেদের কথায় পুরো মনোযোগ দিল রানা। ভিএলএফ খুবই লো ফ্রিকোয়েন্সি ট্রান্সমিটার। ওটার দীর্ঘ তরঙ্গ হয় তিন কিলো হার্ট থেকে তিরিশ কিলো হার্ট। ওয়েভলেংথু অনেক টানা হয়। এতই দীর্ঘ, ওই রেডিয়োর সিগনালকে বলা হয়–খুব ভারী রেডিয়ো সিগনাল। মাটি ছুঁয়ে চলে ওই তরঙ্গ। খুব শক্তিশালী ট্রান্সমিটার থেকে পাঠানো হয় ওই সিগনাল। সাধারণত এসব ট্র্যান্সমিটার হয় বিশাল এবং তাতে নানা ঝামেলা পোহাতে হয়। এসব কারণে আর্মি এই রেডিয়ো ব্যবহার করে না। অবশ্য, নতুন এক টেকনোলজির কারণে ছোট ভিএলএফ তৈরি করা যায়। কিন্তু ওটা হয় অনেক ভারী। শক্তিশালী লোক পিঠে নিতে পারে ওই। রেডিয়ো।

এখন, উইলকক্স আইস স্টেশনে ফ্রেঞ্চরা এনেছে অমন একটা ট্রান্সমিটার।

কিন্তু কেন?

ভিএলএফ রেডিয়ো সিগনাল পাঠানো হয় শুধু…

তাই বা কীভাবে হয়, ভাবল রানা। ফ্রেঞ্চরা আসলে কী চেয়েছে!

আচ্ছা, মোরশেদ, ওটা কোথায় পেয়েছ?

ড্রিলিং রুমে।

তুমি কি এখন ওখানে?

জী, মাসুদ ভাই।

ওটা নিয়ে এসো পুল ডেকে, বলল রানা। সার্জেন্ট ওয়াকারের কাজ দেখে এসে নীচে নেমে দেখব ওটা।

ঠিক আছে।

ইন্টারকম অফ করে দিল রানা। ওরসঙ্গে এন্ট্রান্স টানেলে ঢুকে পড়েছে নিনা ভিসার। জানতে চাইল, আপনি বললেন ইরেজার, ওটা কী?

আস্তে করে শ্বাস ফেলল রানা। ইরেজার বলতে এক ধরনের বোমা বোঝানো হয়। ছোট কভার্ট ফোর্স লড়াইয়ে হেরে গেলে ওটা ব্যবহার করে। সঙ্গে থাকে ডিলে সুইচ। ওটা সাধারণ টাইমারের মতই কাজ করে।

দাঁড়ান-দাঁড়ান, আমি তো কিছুই বুঝছি না, বলল নিনা।

বুঝিয়ে বলতে শুরু করল রানা: ওই ফ্রেঞ্চাদের মত ছোট ক্র্যাক ইউনিট গোপনে কোনও মিশনে যেতেই পারে। কিন্তু যদি ধরা পড়ে, তাদের কারণে আন্তর্জাতিক জটিলতা তৈরি হবে। ধরুন, যদি ফ্রেঞ্চ ইউএস রিসার্চ স্টেশনে এসে সবাইকে খুন করতে গিয়ে ধরা পড়ে যেত, তখন?

আমি বোধহয় বুঝতে শুরু করেছি। রানার দিকে চেয়ে আছে মহিলা।

কেউ নিশ্চিত হয়ে বলতে পারে না, ক্র্যাক ইউনিট সফল হবে। হয়তো তাদের চেয়ে অনেক দক্ষ একদল সৈনিক তাদেরকে মেরে ফেলল। দেয়ালের হুক থেকে একটা পারকা নিয়ে পরতে শুরু করেছে রানা। আজকাল প্রায় প্রতিটি এলিট টিম–ধরুন ফ্রেঞ্চ প্যারাশুট রেজিমেন্ট, ব্রিটেনের এসএএস, ইউএসের নেভি সিল–এরা কন্টিনজেন্সি প্ল্যানে ইরেজার রাখে। ওই জিনিসের কাজ তাদের দলের সবাইকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া। এর ফলে মনে হবে, কখনও ওদিকে যায়নি ওই দল। কোনও দল ব্যবহার করে সায়ানাইড পিল, আবার অন্যরা অন্যকিছু কিন্তু মূল কাজ আত্মহত্যা করা।

তো আপনি বলছিলেন এক্সপ্লোসিভের কথা, বলল নিনা।

বিশেষ বিস্ফোরকের কথা, বলল রানা। বেশির ভাগ সময় ইরেজার হয় ক্লোরিন-বেজড এক্সপ্লোসিভ। বা হাই-টেম্পারেচার লিকুইড ডেটোনেটার। ওগুলোর কাজ হয় সৈনিকের মুখ উড়িয়ে দেয়া, বাষ্প করে দেয়া শরীর, নষ্ট করে ফেলা ইউনিফর্ম ও ডগট্যাগ। মোট কথা, ইরেজারের মূল কাজ শত্রুপক্ষকে বুঝিয়ে দেয়া যে ওখানে কেউ ছিল না।

কবে থেকে এসব শুরু হয়েছে? জানতে চাইল নিনা।

এই তো কিছু দিন ধরে। মন্টানার পাতাল মিসাইল সাইলো স্যাবোটাজ করতে গিয়েছিল একদল জার্মান সৈনিক। তার পর থেকে।

ওরা কী করতে গিয়েছিল?

ব্যালাস্টিক নিউক্লিয়ার মিসাইলগুলো–যেগুলোর অস্তিত্ব তারস্বরে অস্বীকার করছিল আমেরিকা সেগুলো ধ্বংস করতে। যখন বুঝল ধরা পড়তে যাচ্ছে, তিনটা লিকুইড-ক্লোরিন গ্রেনেডের পিন খুলে ফেলল। ওগুলো যখন বিস্ফোরিত হলো, ওদের কিছুই থাকল না। ওখানে কোনও জার্মান সৈনিক যায়নি, দোষও পড়ল না কোনও দেশের উপর।

জার্মান স্যাবোটাজ ইউনিট, মন্ট্যানা, অবিশ্বাস নিয়ে বলল নিনা। আমার যদি কোনও ভুল হয়ে থাকে, তো ধরিয়ে দেবেন–জার্মানরা না এখন আমেরিকার মিত্রপক্ষ?

ফ্রেঞ্চরাও তো আপনাদের বন্ধু রাষ্ট্র, ভুরু নাচাল রানা, ওরা কি দোস্তি করতে এসেছিল? আসলে বেশিরভাগ সময় দেখা যায় শত্রুর চেয়ে মিত্র দেশই বেশি ক্ষতি করে। শুনেছি পেন্টাগন এর নাম দিয়েছে ক্যাসিয়াস অপারেশন্স। জুলিয়াস সিজারের খুনি ক্যাসিয়াসের নামে।

নামও দিয়েছে আবার?

পারকা পরা শেষ, সদর দরজার দিকে রওনা হয়ে গেল রানা, আগে আমেরিকা ছিল দুই মহাপরাশক্তির একটা। তখন দুই সুপারপাওয়ারের ভিতর একটা ভারসাম্য ছিল। একে অপরকে সমঝে চলত। একদল খারাপ কিছু করতে গেলে, অন্যদল সেটা ঠেকাত। কিন্তু, সোভিয়েত ইউনিয়ন শেষ হয়ে গেল, থাকল শুধু আমেরিকা পৃথিবীর সত্যিকারের একমাত্র সুপারপাওয়ার। আপনাদের হাতে আছে অন্য সবার চেয়ে অনেক বেশি অস্ত্র। আপনারা অস্ত্রের জন্য বিপুল অঙ্কের ডলার খরচ করছেন। অন্য কোনও দেশ এভাবে খরচ করলে ফতুর হয়ে যেত। সোভিয়েতরা প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে নিজেদেরকে ফকির, করেছে। এরপর হালুয়া-রুটির আশায় আমেরিকার অনেক বন্ধু রাষ্ট্র জুটে গেছে। কিন্তু তারা জানে, আমেরিকা অনেক বেশি শক্তিশালী, নিষ্ঠুর এবং নৃশংস। একের পর এক দেশে হামলা করছে সে। কাজেই প্রায়সবাই চায় আমেরিকার মস্ত পতন হোক। মহাচিন তো চায়ই, পরম মিত্র ফ্রান্স, জার্মানি, এমন কী গ্রেট ব্রিটেনও চায় আমেরিকাকে হঠিয়ে ক্ষমতার স্বাদ পেতে।

আমি কখনও এসব ভাবিনি, বলল নিনা।

আসলে ভাবার প্রয়োজন পড়েনি আপনার, বলল রানা। আমাকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে এই স্টেশনের বিজ্ঞানীদেরকে ম্যাকমার্জোয় নিরাপদে পৌঁছে দেয়া। ওখান থেকে রওনা হওয়ার আগে ওই স্টেশনের চিফ অনুরোধ করেন, তাঁদের সেনাবাহিনী পৌঁছে যাওয়া পর্যন্ত যেন আমি উইলকক্স আইস স্টেশন পাহারা দিই। আমি তাকে কোনও কথা দিইনি। এটা আমার কর্তব্যও নয়। আমি এখানে যুদ্ধ করতে বা প্রাণ দিতে আসিনি। কিন্তু এখন যদি ফ্রেঞ্চ কমাণ্ডোদের মত করে অন্য দেশের আর্মি হাজির হয়, হয়তো বাধ্য হয়ে লড়তে হবে আমাকে।

সদর দরজার সামনে পৌঁছে গেছে রানা, হাত রাখল হ্যাণ্ডেলের উপর। পাশ ফিরে চাইল। আপনি কী যেন, জানতে চেয়েছিলেন। হাঁটতে হাঁটতে বললে অসুবিধে হবে?

দরজার পাশের হুক থেকে পারকা নিল নিনা, তারপর পরতে শুরু করল। কোনও সমস্যা নেই।

মহিলা গরম কাপড় পরে নিতেই দরজা খুলে বেরিয়ে এল রানা। আসুন।

.

ই-ডেকে ডেপথ গজ ভালভাবে দেখে নিচ্ছে তিশা করিম। হোসেন আরাফাত দবিরও সঙ্গে রয়েছে, ওরা আছে পুল থেকে দূরে প্ল্যাটফর্মের উপর। শেষ কিলার ওয়েইল চলে যাওয়ার পর পৌনে একঘণ্টা পেরিয়ে গেছে। কিন্তু যখন-তখন আবার আসতে পারে। কাজেই ওরা সতর্ক।

ইউনিটের স্কুবা গিয়ারগুলো পরীক্ষা করছে ওরা। ঠিক হয়েছে। ডাইভিং বেল নিয়ে নামবে ডুবুরিরা। আপাতত ই-ডেকে ওরা দুজন ছাড়া কেউ নেই। মাঝে মাঝে বিদায় নিচ্ছে দবির ও তিশা, চলে যাচ্ছে দক্ষিণের টানেলে, গুদাম-ঘরে। ওখানেই রাখা হয়েছে ক্যাপ্টেন নিশাত সুলতানাকে।

হাতের ডেপথ গজ নামিয়ে রাখল তিশা, আরেকটা তুলে নিল। কী সুন্দর কালো চোখ মানুষটার! খুব নিচু স্বরে বলল, কাজ থেকে চোখ তুলল না।

নিজের কাজ বন্ধ করে তিশার দিকে চাইল দবির। ও যখন কোনও কথা বলল না, চোখ তুলল তিশা।

ওর মনে হলো সার্জেন্ট লোকটা লেফটেন্যান্টের ওজন বুঝতে চাইছে। তারপর হঠাৎ করেই অন্য দিকে চোখ সরিয়ে নিল।

শুনেছি আগেও সুন্দর ছিল ওঁর চোখ, কিন্তু পরে আরও সুন্দর হয়েছে, বলল দবির। অনেকেই জানে না কী হয়েছিল।

নীরবতা নেমে এসেছে দুজনের মাঝে। পাকা একমিনিট পর জানতে চাইল তিশা, কী হয়েছিল?

জবাব দিল না দবির, তারপর আস্তে করে মাথা দোলাল।

কী হয়েছিল?

বড় করে শ্বাস ফেলল দবির। হিলিয়াম কমপ্রেসার নামিয়ে রাখল, চাইল তিশার দিকে। উনি ফাইটার বিমানের খুব ভাল পাইলট। অনুচ্চ স্বরে বলতে শুরু করল দবির: মেজর মাসুদ রানা একটা মিশনে গিয়েছিলেন, বসনিয়ায়। তখন সার্বদের সঙ্গে মহা যুদ্ধ চলছিল। চলছে গণ হারে মুসলিম নিধন। এই মিশনে আমাদের কাছে সাহায্য চেয়েছেন যিনি, সেই নুমার চিফ অ্যাডমিরাল জর্জ হ্যামিলটন অনেক আগে ছিলেন মেরিন কর্পসের চিফ। তাকে অনুরোধ করে মেরিন কর্পসের একটা এভি-৮বি হ্যারিয়ার বিমান চেয়ে নেন মেজর রানা। আলাপ করে ঠিক হয়, মেরিনদের সঙ্গে বসনিয়ায় বিপজ্জনক মিশনে যোগ দেবেন তিনি।

এখানে বলে রাখি, ওই হ্যারিয়ার যুদ্ধ বিমানকে এক কথায় অনেকে চেনে জাম্পজেট বলে। ওটা একমাত্র অ্যাটাক বিমান যেটা সরাসরি আকাশে উঠে যেতে পারে। অন্য পাইলটদের সঙ্গে মেজর রানার দায়িত্ব ছিল নো-ফ্লাইং-যোন পাহারা দেয়া। কিন্তু তার চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ কাজে মন দিলেন তিনি।

চুপ করে দবিরের দিকে চেয়ে আছে তিশা। লোকটা যেন হারিয়ে গেছে বহু দূরে।

একদিন সার্বিয়ানদের মিসাইল ব্যাটারি তাঁর বিমান ফেলে দিল। অনেক পরে জানা গেছে, সার্বিয়ানদের কাছে আমেরিকার তৈরি স্টিংগার মিসাইল ছিল।

তা যাই হোক, বিমানটাকে স্টিংগার মিসাইল ফেলে দেয়ার আগেই ইজেক্ট করেন মেজর রানা। বিধ্বস্ত হয়েছিল বিমান। উনি নেমে এলেন সার্বদের এলাকায়, চারপাশে ঘন জঙ্গল।

তিশার দিকে চাইল দবির।

মেজর রানা এরপর ঊনিশ দিন লুকিয়ে ছিলেন সার্বদের জঙ্গলে। একা। কোনও অস্ত্র নেই। কয়েক শ সার্বিয়ান সৈনিক গোটা জঙ্গলে খুঁজছে তাকে। তারপর যখন ধরে ফেলল, তখন আট দিন ধরে উনি অভুক্ত।

একটা পোড়ো ফার্মহাউসে নিয়ে গেল তাঁকে। একটা চেয়ারে বসিয়ে বেঁধে রাখল। নিয়মিত অত্যাচার শুরু হলো। পেরেক গাঁথা তক্তা দিয়ে সারাদেহে আঘাত করা হতো। সঙ্গে একের পর এক প্রশ্ন। মাসুদ রানা কেন ওই এলাকার উপর দিয়ে বিমান চালিয়েছে? তার ওটা কি গুপ্তচর বিমান ছিল? সে কি তাদের বর্তমানের অবস্থান জানে? আমেরিকান সেনাবাহিনী সার্ব এলাকায় ঢুকে পড়েছে?

সত্যিই কি সার্বিয়ান এলাকায় ঢুকে পড়ে আমেরিকান সেনাবাহিনী? জানতে চাইল তিশা।

আস্তে করে মাথা নাড়ল দবির। অনেক পরে দুটো সিল টিম গিয়েছিল। কিন্তু তার আগে বাংলাদেশের কয়েকজন ঢুকে পড়ে সার্বিয়ান এলাকায়। শুনেছি বিসিআই নামের একটা বাংলাদেশি সংগঠনের সদস্য তারা। তাদের কারণে স্থানীয় সার্বরা বলতে শুরু করল, গভীর জঙ্গলে ভয়ঙ্কর সব ভূত হাজির হয়েছে। ওরা নিজেরা যদি নিরীহ মুসলিমদের উপর এভাবে গণহত্যা না চালাত, তা হলে হয়তো এভাবে মরতে হতো না তাদেরকেও।

মেজর কি জানতেন বাংলাদেশি সৈনিক বা গুপ্তচররা সার্বদের, এলাকায় ঢুকে পড়েছে? বলল তিশা।

আস্তে করে মাথা দোলাল দবির। হ্যাঁ। অফিশিয়ালি মেজরের কাজ ছিল নো-ফ্লাইং-যোন পাহারা দেয়া। কিন্তু আসলে সার্বদের নেতাদের ফার্মহাউসে হামলা করার জন্য তথ্য জোগাড় করতেন।

পরে সে-তথ্য অনুযায়ী হামলা করত বাংলাদেশি সংগঠনের ইউনিট। তা যাই হোক, মেজর রানার মুখ থেকে একটা কথাও বের করতে পারল না সার্বরা।

মনোযোগ দিয়ে দবিরকে দেখছে তিশা। কী যেন বলবার আগে একটু ইতস্তত করছে সার্জেন্ট।

যাই হোক, সার্বরা ধরে নিল অদ্ভুত যে দল হামলা করছে, তাদের সঙ্গে মেজর রানার যোগাযোগ আছে। সার্বদের স্ট্র্যাটেজিক টার্গেটগুলো একের পর এক বিধ্বস্ত হচ্ছিল। এটা সম্ভব শুধু আকাশ থেকে কো-অর্ডিনেটস জানিয়ে দিলে। সারা ঠিক করল, এই লোককে চরম শাস্তি দিতে হবে। তারা মেজর রানার চোখ দুটো উপড়ে নিল।

কী করল? চমকে গেছে তিশা।

ছয়জন মিলে মেঝের উপর ফেলে গেঁথে রাখল মেজরকে, আরেকজন সার্ব খুব ধীরে কেটে বের করে নিল ওঁর দুই চোখ। কাজটা করার সময় লোকটা বাইবেল থেকে উদ্ধৃতি দিল: তোমার হাত যদি পাপ করে, ওটা কেটে ফেলো! যদি পাপ করে চোখ, উপড়ে ফেলো!

অসুস্থ বোধ করছে তিশা। অন্তরের গভীরে বুঝতে পারছে, অসহায় অন্ধ মাসুদ রানার কেমন লেগেছিল। তারপর কী করল তারা? জানতে চাইল।

কোটর থেকে বেরিয়ে রগের শেষে ঝুলতে থাকল দুটো চোখ। এরপর একটা কাবার্ডের ভিতর আটকে রাখল ওঁকে। দুই চোখ থেকে দরদর করে পড়ছে রক্ত।

তারপর? ঢোক গিলল তিশা। মেজর বেরুলেন কীভাবে?

উনি যে সংগঠনের সঙ্গে জড়িত, শুনেছি সেটার চিফ কয়েকজন লোক পাঠিয়ে দিয়েছিলেন আগেই। জুনের এক তারিখে মেজরকে খুঁজে পেল তারা। আমেরিকান বেসে আগেই অপেক্ষা করছিল একটা চার্টার বিমান। ওটাতে তুলে গোপনে লণ্ডনে নিয়ে যাওয়া হলো তাকে। কুইন এলিজাবেথ হসপিটালে ভর্তি করা হলো। কোনও পত্রিকার সাংবাদিক বা টিভি রিপোর্টার কিছুই জানল না।

মেজরকে উদ্ধার করতে গিয়ে ফার্মহাউসে প্রচণ্ড লড়াই হয় সার্বদের সঙ্গে বাংলাদেশি ওই দলের। পশুগুলোকে শেষ করে আমাদের দেশের যুবকরা, কিন্তু তাদেরও দুজন গুরুতর আহত হয়। এরা যখন লণ্ডনে হাসপাতালে ভর্তি হলো, তখনও মেজর রানার চোখ থেকে টপটপ করে রক্ত বেরুচ্ছে।

তারপর কী হলো? চোখ বড় বড় করে দবিরের দিকে চেয়ে আছে তিশা।

বাংলাদেশ সরকার-প্রধান কৈফিয়ত চাইলেন মেজরের সংগঠনের চিফের কাছে। তাদের লোক সার্বিয়ায় থাকবার কথা নয়। জবাবে উনি শুধু জানিয়ে দেন, আপনারা চাইলে আমি পদত্যাগ করতে পারি। শেষপর্যন্ত পিছিয়ে যান সরকার-প্রধান। উনি অন্যান্য সংগঠন থেকে জানতে পারেন, ওই ভদ্রলোককে সরিয়ে দিলে তাঁর হাতে তৈরি সোনার টুকরো ছেলেরা সব কজন তার সাথেই পদত্যাগ করবে।

আর মেজর রানার কী হলো?

অন্ধ হয়ে গেলেন মেজর। চোখ যদি কাজই না করে, দেখবেন কী করে? বিরতি নিল দবির। একটু পর বলল, কিন্তু তাঁর চিফ মেজর জেনারেল (অব.) রাহাত খান আর মেরিন কর্পসের প্রাক্তন চিফ, বর্তমানের নুমা চিফ অ্যাডমিরাল জর্জ হ্যামিলটন ম্যারিল্যাণ্ডের জন্স হপকিন্স ইউনিভার্সিটি হাসপাতালে নিয়ে গেলেন মেজরকে। ওখানেই আছেন দুনিয়ার সবচেয়ে দক্ষ চোখের সার্জারি ইউনিট।

তারপর?

চোখ ঠিক করল তারা। …আর কিছু জানি না, জানবই বা কী করে, আমি তো চিকিৎসার কিছুই বুঝি না। তবে মেজরের চোখ দুটো আরও সুন্দর হয়ে উঠল। কী করে যেন রেটিনা নষ্ট হয়নি তাঁর। ডাক্তাররা বললেন, যা ক্ষতি হয়েছে সেটা চোখের বাইরের দিকে। আসল অংশ ঠিক ছিল। সামান্য বিরতি নিয়ে দবির বলল, আমরা আবার মার্ভেলে ফিরলে মেজর রানার বন্ধু ব্রিগেডিয়ার সোহেল আহমেদের কাছে জিজ্ঞেস করতে পারেন। তিনি আমার চেয়ে অনেক ভাল ভাবে বুঝিয়ে বলতে পারবেন।

আস্তে করে মাথা দোলাল তিশা। বুঝতে পারছে, কেন হোসেন আরাফাত দবির মাসুদ রানাকে এত ভক্তি করে। কেন কোনও কথা বললেই সেটা পালন করতে ব্যস্ত হয়ে ওঠে। আসলে মানুষটাকে পুরো বিশ্বাস করে সে। মাসুদ রানা বললে বোধহয় নরকে যেতেও রাজি হবে এই লোক।

আমারও তো একই অবস্থা, মনে মনে বলল তিশা। শ্রদ্ধা করে ও মাসুদ রানাকে। মানুষটা সত্যিকারের নেতা। নিজের জন্য কিছুই চান না উনি। কাজ করেন দলের সবার ভালর জন্যে।

আপনি ওঁকে খুব পছন্দ করেন, তাই না? চাপা স্বরে জানতে চাইল দবির।

আমি ওঁকে বিশ্বাস করি।

নীরবতা নেমে এসেছে দুজনের মাঝে।

দীর্ঘশ্বাস ফেলল তিশা। আমার বয়স কম হয়নি, দবির।

চুপ করে আছে সার্জেন্ট।

আপনি কি জানেন, একবার আমার বিয়ে হয়েছিল?

না, লেফটেন্যান্ট জানতাম না।

উনিশ বছর বয়সে প্রেম করে বিয়ে করি। সে ছিল দুনিয়ার সেরা মিষ্টি মানুষ। সরকারী এক স্কুলের টিচার ছিল। আর আমি তখন অনার্সে পড়ছি। কী সুন্দর করেই না ইংরেজি কবিতা বলত। কী ভদ্র, শান্ত, হাসিখুশি! উনিশ পেরুনোর আগেই প্রেগনেন্ট হলাম।

চুপ করে ওর দিকে চেয়ে আছে দবির।

তারপর একদিন, ছলছল করে উঠল তিশার চোখ। তখন আমার পেটে বাচ্চাটা আড়াই মাসের। সেদিন কলেজ থেকে আগেই চলে এসেছি। বাড়িতে ফিরেই দেখলাম সোফার উপর। শুয়ে সতেরো বছরের এক ছাত্রীর সঙ্গে… সেই মেয়ে এসেছিল ইংরেজি পড়তে।

মুখ কুঁচকে অন্য দিকে চাইল দবির।..

এরপর তিন সপ্তাহ পর মিসক্যারেজ হয়ে গেল। জানি না কেন হলো। মনের চাপ, রাগ, ঘৃণা জানি না কেন। এরপর থেকে সব পুরুষকে ঘৃণা করতে লাগলাম। পশুটাকে তালাক দিয়ে যোগ দিলাম বাংলাদেশ আর্মিতে। ঘৃণা হয়তো মানুষকে ভাল যোদ্ধা করে। অন্তর থেকে প্রতিটা গুলি করি, যেন শত্রুর মগজ বা বুকে বেঁধে। এরপর থেকে কখনও কাউকে বিশ্বাস করিনি। …তারপর ট্ৰেইনিঙ এসে দেখা হলো মেজর মাসুদ রানার সঙ্গে।

বহু দূরে চেয়ে আছে তিশা করিম। চোখ থেকে টপটপ করে পড়ছে অশ্রু। আমি খেয়াল করতে শুরু করলাম ওঁকে। জাহাজের সবাই কত কথা বলে, কিন্তু মনে হলো ওই মানুষটা যেন অনেক একা। এতই একা, যেন নীরবে চলে গেছে বহু দূরের কোনও নিঝুম দ্বীপে। আমি জানি না আমার কী হলো, নতুন করে বিশ্বাস ফিরল মনে। অন্তরটা বলল, এই মানুষটা কখনও তোকে ঠকাবে না।

সার্জেন্ট, আমার অন্তর বলল, সর্বক্ষণ কী যেন খুঁজছে তার মন। সে যদি হয় কোনও মেয়ে… আমি যদি হতাম সেই মেয়ে, আমি প্রতিদিন ফুলের মালা গেঁথে ওর পায়ে নামিয়ে রাখতাম। ..আসলে ওর ভিতর কী যেন আছে। আগে কোনও পুরুষের ভিতর এমন কিছু দেখিনি।

কিছুই বলছে না দবির, শুধু চেয়ে আছে তিশার দিকে।

তিশা বুঝতে পেরেছে লোকটা অবাক হয়ে ওকে দেখছে, চট করে চোখ মুছে ফেলল ও। .

দুঃখিত, আসলে আপনাকে এসব বলতে চাইনি। কাকেই বা বলব? কেন বলব?

আপনি মেজর রানাকে বলতে পারেন আপনার মনের কথা, খুব নরম স্বরে বলল দবির।

হ্যাঁ, তাই বলি আর কী, কান্নার মত শোনাল তিশার হাসি। সহকারীরা পিছনে হাসতে শুরু করবে। এমনিতেই কোনও মেয়ে আর্মির ফ্রন্ট লাইন ইউনিটে যোগ দিলে সবাই হাসে। দবির, তার চেয়ে অনেক ভাল, যতদিন পারি আমি ওর কাছাকাছি থাকব, কখনও ওকে ছুঁয়েও দেখতে চাইব না। এটা অনেক দূরে চলে যাওয়ার চেয়ে তো ভাল?

বড় করে শ্বাস ফেলল, সার্জেন্ট দবির। মনে মনে মেয়েটির প্রশংসা না করে পারছে না। আপনি ঠিকই বলেছেন, একটু পর বলল।

আপনি বুঝেছেন, সেজন্য ধন্যবাদ, হঠাৎ আরও বিমর্ষ হয়ে উঠল তিশার মুখ। সার্জেন্টের চোখে চোখ রাখল। আর মাত্র একটা প্রশ্ন।

সেটা কী, আপা?

মাথা কাত করল তিশা। আপনি বললেন ব্রিগেডিয়ার সোহেল আহমেদ সবই জানেন। আপনি তাঁর কাছ থেকে এসব শুনেছেন তা মনে করি না। বসনিয়ার সব ঘটনা কোথা থেকে জানলেন?

মৃদু হাসল হোসেন আরাফাত দবির। কয়েক মুহূর্ত পর নিচু গলায় বলল, আমি ওই উদ্ধার টিমে ছিলাম।

.

যে-কোনও ধরনের প্যালিয়োন্টোলজি মানেই ধৈর্যের খেলা, বলল নিনা ভিসার, তুষারের মাঝে হাঁটছে রানার পাশে। কিন্তু এখন নতুন টেকনোলজি এসেছে, আপনি চাইলে কমপিউটারকে কাজে লাগাতে পারেন। হয়তো কোনও কাজে চলে গেলেন, ফিরে এসে দেখলেন দারুণ কিছু আবিষ্কার করে বসেছে কমপিউটার।

যে নতুন টেকনোলজির কথা বলছে নিনা, আসলে তা অতি দীর্ঘ সনিক তরঙ্গের স্পন্দন। উইলকক্স আইস স্টেশনের প্যালিয়োন্টোলজিস্টরা ওটার কারণেই বরফের তলায় খুঁজে পান ফসিল হওয়া হাড়। এখন আর বরফ খুঁড়ে বের করতে হয় না, ফলে ক্ষতিও হয় না ফসিলের।

সেক্ষেত্রে পরের ফসিল পাওয়া পর্যন্ত কী করেন আপনারা? জানতে চাইল রানা।

মেজর, আপনি হয়তো জানেন না, আমি সাধারণ কোনও প্যালিয়োন্টোলজিস্ট নই, ভুরু কুঁচকে আবার মৃদু হেসে ফেলল নিনা। প্যালিয়োন্টোলজিস্ট হওয়ার আগে মেরিন বায়োলজিস্ট ছিলাম। আর এসব ঘটার আগে স্টেশনের কর্তা জন প্রাইসের সঙ্গে ছিলাম বায়ো ল্যাবে, বি-ডেকে। উনি, এনহাইড্রিনা সিসেস্টোসা থেকে নতুন অ্যান্টিভেনম তৈরি করছিলেন।

মৃদু মাথা দোলাল রানা। সাগরের সাপ।

অবাক হয়ে রানাকে দেখল নিনা। আপনি তো অনেক কিছু জানেন, মেজর!

এখানে আসার আগে আমিও আলাদা পেশায় ছিলাম; মৃদু হাসল রানা।

স্টেশনের সীমানার কাছে চলে এসেছে ওরা। একটু দূরে সার্জেন্ট জনি ওয়াকার, দাঁড়িয়ে আছে মেরিনদের একটি হোভারক্রাফটের পাশে। স্টেশনের দিক থেকে বাইরের দিকে তাক করা হয়েছে হোভারক্রাফট।

চারপাশ প্রায় অন্ধকার। টানা বইছে তুমুল তুষার-ঝড়। বহু, দূরে চাইলে শুধু মাইলের পর মাইল বরফ-মোড়া জমি। দিগন্তে গাঢ় কমলা প্রভা। ওয়াকারের পিছনে হোভারক্রাফটের ছাতে নীরবে ঘুরছে রেঞ্জফাইণ্ডার। দেখলে মনে হয় রিভলভিং টারেট থেকে তাক করেছে বিশাল কামানের নাক। ধীরে ধীরে পুরো এক শ আশি ডিগ্রি ঘুরছে। আধ মিনিট পর পর একপাশ থেকে শুরু করে আরেক পাশে গিয়ে থামছে, তারপর আবার ফিরছে।

আপনার কথা মত সেট করেছি, রানার সামনে থামল ওয়াকার। অন্য এলসিএসি দক্ষিণ-পূর্ব কোণে। মেরিনদের হোভারক্রাফটের নাম এলসিএসি। অর্থাৎ, ল্যাণ্ডিং ক্রাফট-এয়ার কুশও।

গুড, বলল রানা।

যেভাবে উইলকক্স স্টেশনের বাইরের দিকে চেয়ে আছে হোভারক্রাফটের রেঞ্জফাইণ্ডার, সামনের বিস্তৃত এলাকা পাহারা দিতে পারবে। ওই দুই রেফাইণ্ডার কমপক্ষে পঞ্চাশ মাইল কাভার করবে। ওদের দিকে কেউ এলে অনেক আগেই জানবে ওরা।

আপনার সঙ্গের পোর্টেবল স্ক্রিন? ওয়াকারের কাছে জানতে চাইল রানা।

এই যে, পোর্টেবল ভিউনি বাড়িয়ে দিল ওয়াকার। পর্দায় দেখা গেল তথ্য পাঠিয়ে চলেছে দুই রেঞ্জফাইণ্ডার।

পোর্টেবল স্ক্রিন খুদে টেলিভিশনের মত, বামদিকে একটা হাতল। পর্দায় দুটো সরু সবুজ রেখা খুব ধীরে সরছে। ঠিক যেন গাড়ির উইণ্ডস্ক্রিনের ওয়াইপার। রেঞ্জফাইণ্ডার সামনে কিছু পেলে এই স্ক্রিনে জ্বলে উঠবে দপদপে লাল বিন্দু। সঙ্গে নীচে ফুটে উঠবে ভাইটাল স্ট্যাটিস্টিক্স।

বেশ চলুন, এবার দেখা যাক স্টেশনের নীচে গুহার ভিতরে কী, বলল রানা।

পাঁচ মিনিট পেরুবার আগেই প্রধান দালানের কাছে ফিরে এল ওরা। ঝরঝর করে কালো আকাশ থেকে পড়ছে সাদা তুষার, তার ভিতর দিয়ে দ্রুত হাঁটছে। রানা জানাল, কীভাবে পাতাল-গুহার ভিতর নামবে ওরা।

প্রথমে নিশ্চিত হতে হবে ওখানে স্পেসশিপ আছে কি না। সত্যিই ওই ধরনের কিছু আছে, এর কোনও প্রমাণ এখনও পাওয়া যায়নি। শুধু জানা গেছে, উইলকক্স আইস স্টেশনের এক বিজ্ঞানী জানিয়েছে, গুহার ভিতর স্পেসশিপ দেখেছে। এবং সে-লোক সম্ভবত মারা গেছে। কেউ জানে না সে কী দেখেছে। ঠিক তখনই তার উপর হামলা হয়। জানা যায়নি শত্রু কারা। এটা জানাও খুব জরুরি।

ছোট কোনও দলকে পাতাল-গুহায় পাঠাবার আরেকটা তৃতীয় কারণ আছে রানার। অবশ্য, নিনা বা ওয়াকার তা জানে না।

নতুন করে কোনও কমাণ্ডো দলের হামলা হলে, এবং ওরা নিজেরা পরাজিত হলে, তবুওঁ পাতাল-গুহার ভিতর নিজেদের লোক থাকলে তারা পাল্টা হামলা করতে পারবে।

এই গুহার ভিতর ঢুকতে হলে যেতে হবে পানির নীচের এক সুড়ঙ্গ দিয়ে। কিন্তু কভার্ট ইনকাশানারি ফোর্স কখনোই পানির নীচ দিয়ে হামলা করতে চায় না। এর বড় কারণ: কেউ জানে না ভেসে উঠবার পর তাদের জন্য কী অপেক্ষা করছে। এখন, আগেই যদি রানার কোনও ছছাট দল ঢুকে পড়ে ওই গুহার ভিতর, শত্রুরা ভেসে উঠতেই অনায়াসে তাদেরকে শেষ করতে পারবে ওরা।

রানা, জনি ওয়াকার ও নিনা পৌঁছে গেছে স্টেশনের মেইন এন্ট্রান্সে। র‍্যাম্প বেয়ে নেমে ঢুকে পড়ল সুড়ঙ্গের ভিতর। পিছনে বন্ধ করে দেয়া হলো দরজা। দুমিনিট পেরুর আগেই এডেকের ক্যাটওয়াকে বেরিয়ে এল ওরা। ওখানে অন্য দুজনের কাছ থেকে বিদায় নিল রানা, দ্রুত চলেছে ডাইনিংরুম লক্ষ্য করে।

এতক্ষণে ফিরবার কথা নাজমুলের, সঙ্গে থাকবে ফ্যেনুয়্যা। লোকটা বলতে পারবে এখন কী অবস্থায় আছে হাক্সলে।

ডাইনিংরুমের দরজা পেরিয়ে ঢুকে পড়ল রানা, একটু দূরে দেখল নাজমুল ও ফ্যেনুয়্যাকে। তারা দাঁড়িয়ে আছে একটা টেবিলের পাশে। ওখানে চিত হয়ে পড়ে আছে কেভিন হাক্সলে।

রানা ভিতরে ঢুকতেই চট করে ওর দিকে চেয়েছে নাজমুল ও ফ্যেনুয়্যা, বিস্ফারিত হয়ে গেছে চোখ। কেন যেন রানার মনে হলো, হাতে-নাতে ধরা পড়েছে দুই চোর।

অস্বস্তিকর কয়েকটা মুহূর্ত পেরুল, তারপর বলে উঠল নাজমুল, স্যর, হাক্সলে মারা গেছে।

ভুরু কুঁচকে গেল রানার। জানত, কেভিন হাক্সলে গুরুতর আহত, যে-কোনও সময়ে মরতে পারে, কিন্তু নাজমুল যেভাবে বলল…।

এক পা সামনে বাড়ল নাজমুল, গম্ভীর গলায় বলল, স্যর, আমরা যখন ফিরলাম, তার আগেই মরেছে। ডাক্তার বলছে জখমের কারণে নয়।

১৮.

সেটি অভযারভেটরির পার্কিং লটে ভাড়া করা গাড়িতে বসে আছে অ্যাডোনিস ক্যাসেডিন, দম আটকে আসতে চাইছে গরমে। দরদর করে ঘামছে সে। পকেট থেকে সেলুলার ফোন বের করে কল দিল, স্ত্রী সান্থাকে। সে আছে ওয়াশিংটন ডি.সি.তে।

কী বুঝলে? ওদিক থেকে জানতে চাইল সান্থা।

মহাবিরক্তিকর, সেটি রেকর্ডিং থেকে নোট নিয়েছে, এখন দেখছে।

কিছুই পেলে না?

নাহ্, কিছু না। কোনও স্পাই স্যাটালাইট থেকে কয়েকটা বিচ্ছিন্ন শব্দ, আর কিছুই না।

যা বলেছে সেটা লিখে নিয়েছ?

নোট বুকের উপর চোখ বোলাল ক্যাসেনি।

হ্যাঁ, তা করেছি। কিন্তু এ থেকে কিছুই পাব না।

তা-ও বলো দেখি, বলল সাহা।

ঠিক আছে, দীর্ঘশ্বাস ফেলল ক্যাসেডিন। এবার গড়গড় করে বলে গেল সে।

..কপি, ওয়ান-টু-ফাইভ-সিক্স-ওয়ান-সিক্স…

..আয়োনোস্ফেরিক সমস্যায় যোগাযোগ হারিয়ে…

…সামনের দল…

…মাসুদ রানা….

…মাইনাস সিক্সটি-সিক্স পয়েন্ট ফাইভ…।

..সোঁলার ফ্লেয়ার বারোটা বাজাচ্ছে রেডিয়োর…

…ওয়ান-ফিফটিন, টোয়েন্টি মিনিটস, টুয়েলভ, সেকেণ্ড ইস্ট…

..কী করে… কড়কড় করছে। …চলে যাও, যাতে…

.রওনা হয়েছে দ্বিতীয় টিম…।

ওদিক থেকে শ্বাস ফেলল সান্থা। ব্যস? আর কিছুই নেই?

ফাঁপা হাসল ক্যাসেডিন। আবার কী চাও? এবার তো বুঝলে কী বলেছে?

এসবের নিশ্চয়ই কোনও মানে আছে।

আমারও মনে হয়েছিল, নইলে এই নরকে আসি?

ওই কাজ আমার উপর ছেড়ে দাও, তোমাকে ওখানে পৌঁছে দেব। হাসতে শুরু করেছে সাহা। কয়েক মুহূর্ত পর বলল, এবার কোথায় যাবে?

ড্যাশবোর্ড থেকে ছোট সাদা একটা কার্ড নিল ক্যাসেডিন। ওটা ভিজিটিং কার্ড। ঝকঝকে ছাপা:

রবিন এন কার্বি
        গানস্মিথ
        ১৬ নিউম্যান স্ট্রিট, লেক আর্থার, এনএম

ভাবছি এই টাম্বলউইড ভরা নরকে যখন চলেই এলাম, তো, একবার ওই রহস্যময় রবিন এন কার্বির সঙ্গে দেখা করেই যাই, বলল ক্যাসেডিন।

যে লোক মেইল-বক্সে ভিজিটিং কার্ড রেখে গেছে? জানতে চাইল সান্থা।

হ্যাঁ, সে-ই।

দুই সপ্তাহ আগে ওই কার্ড পাওয়া যায় ক্যাসেডিনের মেইল বক্সে। সঙ্গে কোনও চিঠিও ছিল না। কিছুই লেখা হয়নি কার্ডে। ক্যাসেডিন প্রথমে ভেবেছিল ফেলে দেবে কার্ড, পরে কী মনে করে রেখে দিয়েছে।

পরদিন এল টেলিফোন। ভারী পুরুষালী কণ্ঠ। জানতে চাইল কাসেডিন কার্ড পেয়েছে কি না।

ক্যাসেডিন জানাল, সে কার্ড পেয়েছে।

এবার লোকটা বলল, তার কাছে জরুরি কিছু তথ্য আছে, আগ্রহী হয়ে উঠতে পারে ক্যাসেডিন।

ক্যাসেডিন জানতে চাইল, সে কি ওয়াশিংটনে এসে. ওর সঙ্গে কথা বলতে পারবে?

লোকটা জানিয়ে দিল, তার পক্ষে কোথাও যাওয়া সম্ভব নয়। যদি আসতে হয় তো আসতে হবে ক্যাসেডিনকেই। লোকটাকে ভীত বলে মনে হয়েছে ক্যাসেডিনের। ও নাকি আগে নেভিতে ছিল।

আমাদের কোনও ফ্যান না তো? জানতে চাইল সান্থা।

গ্র্যাণ্ডমাদার মিশেল জার্নালে কাজ করবার সময় বেশ কিছু ভক্ত জুটে গিয়েছিল ক্যাসেডিনের। মাঝে মাঝে এখনও বিরক্ত করে তারা { কেউ কেউ বলে, তার কাছে ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারির চেয়ে জটিল রহস্য আছে। বদলে বেশি কিছু দিতে হবে না, জমজমাট কাহিনি বুঝে একহাজার ডলার বা দুই হাজার ডলার দিলেই সে সন্তুষ্ট থাকবে।

কিন্তু রবিন এন কার্বি লোকটা একবারও টাকা চায়নি। আর এখন ক্যাসেডিন চলে এসেছে তার এলাকার কাছেই, সুতরাং…

এমনও হতে পারে লোকটা গুরুত্বপূর্ণ কিছু বলবে, বলল ক্যাসেডিন। তার বাড়ির কাছে চলে এসেছি, তাই ভাবছি ঘুরেই আসি।

পরে আবার বোলো না তোমাকে সাবধান করিনি, বলল সান্থা, ঠিক আছে, ঘুরে এসো।

 ফোন রেখে দড়াম করে গাড়ির দরজা বন্ধ করল ক্যাসেডিন।

.

দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকা অফিসে ফোন রেখে ছাতের দিকে চাইল সান্তা ক্যাসেডিন, উদাস হয়ে উঠছে। অবশ্য কিছুক্ষণ পর সচেতন হলো।

মাঝ সকাল। নিচু ছাতের বিশাল এই ঘরে বুক-সমান সব পার্টিশনের ওপাশে এক শর বেশি কলিগ ব্যস্ত হয়ে যে যার কাজ করছে। একের পর এক ফোন আসছে। খটখট করছে কি-বোর্ড। কাগজ বা ফাইল নিয়ে নানা দিকে ছুটছে অনেকে।

নীল জিন্স প্যান্ট ও সাদা শার্ট পরেছে সান্থা, গলা থেকে ঝুলছে কালো টাই। চুলগুলোকে পনিটেইল করা।

আরও কয়েক সেকেণ্ড পর হাতের দিকে চাইল। স্বামীর কাছ থেকে পাওয়া তথ্যগুলো টুকে নিয়েছে নোট বুকে। সাবধানে প্রতিটি লাইন পড়ল সান্থা। বেশিরভাগ অংশ ফালতু মনে হলো। মাসুদ রানা নামের এক লোক, আয়োনোস্ফেরিক সমস্যা, সামনের দল ও দ্বিতীয় দলের কথা বলেছে।

কিন্তু, তিনটে লাইন গুরুত্বপূর্ণ মনে হলো সান্থার:

মাইনাস সিক্সটি-সিক্স পয়েন্ট ফাইভ
     আয়োনোস্ফেরিক সমস্যায় যোগাযোগ হারিয়ে
        ওয়ান-ফিফটিন, টোয়েন্টি মিনিটস, টুয়েলভ সেকেণ্ড ইস্ট

ভুরু কুঁচকে এই তিনটি লাইনে চোখ বোলাল সান্থা, কিছুক্ষণ পর উঠে দাঁড়াল, চলে এল পাশের ডেস্কে। ওদিকের শেলফ থেকে তুলে নিল বাদামি ফোলিও আকৃতির বই। কাভারে চোখ বুলিয়ে নিল: বার্থেলেমিউস অ্যাডভান্সড় অ্যাটলাস অভ ওয়ার্ল্ড জিয়োগ্রাফি। কয়েকটা পৃষ্ঠা উল্টেই চট করে পেয়ে গেল যা খুঁজছে।

পাতার একটা লাইন অনুসরণ করছে ওর আঙুল।

আরিহ্! উচ্চারণ করে বলল। কাছের ডেস্কে অন্য এক রিপোর্টার তার কাজ থেকে মুখ তুলে চাইল।

খেয়াল করল না সান্থা ক্যাসেডিন। সামনের পৃষ্ঠার উপর আটকে গেছে ওর চোখ।

আঙুল থেমেছে ম্যাপের ল্যাটিচ্যুড ৬৬.৫ ডিগ্রি দক্ষিণে ও লংগিচ্যুড ১১৫ ডিগ্রি, ২০ মিনিট বারো সেকেণ্ড পুবে।

ভুরু কুঁচকে গেল সান্থার। ওর আঙুল থেমেছে অ্যান্টার্কটিকার উপকূলে।

.

ই-ডেকে পুলের পারে জড় হয়েছে রানার দলের সবাই।

একটু পর সার্জেন্ট জনি ওয়াকার, লেফটেন্যান্ট তিশা করিম ও লেফটেন্যান্ট গোলাম মোরশেদ পিঠে ঝুলিয়ে নেবে স্কুবা ট্যাঙ্ক। পরতে শুরু করেছে কালো থারমাল ইলেকট্রিক ওয়েসুট।

চুপ করে ওদেরকে দেখছে রান ও গানার সার্জেন্ট ভাইপার। তাদের পিছনে দাঁড়িয়েছে কর্পোরাল নাজমুল। নিঃশব্দে ই-ডেকে গুদামঘরের দিকে রওনা হলো সার্জেন্ট হোসেন আরাফাত দবির। আরেকবার দেখে আসবে আহত নিশাত সুলতানাকে।

গোলাম মোরশেদের ড্রিল রুম খুঁজে পাওয়া কালো ব্যাকপ্যাক কাছেই পড়ে আছে। ওটার ভিতর থেকে বের করা হয়েছে ফ্রেঞ্চদের আনা ভিএলএফ ট্রান্সমিটার, রাখা হয়েছে রানার পায়ের সামনে।

কেভিন হাক্সলের মৃত্যু ওদের সবাইকে প্রবলভানে আঁকি দিয়েছে। ফ্রেঞ্চ ডাক্তার ম্যাথিউ ফ্যোনুয়্যা রানাকে বলেছে, কেভিনের গলার ভিতর অংশে ল্যাকটিক অ্যাসিড ছিল। ল্যাকটিক অ্যাসিড মানেই অন্য কোনও ক্ষতের কারণে মরণ হয়নি কেভিন হাক্সলের।

কণ্ঠনালীতে ওই অ্যাসিডের অর্থ: হঠাৎ করেই ফুসফুসে অক্সিজেন যাওয়া থেমে গেছে। তখন চালু থাকবার জন্য বাধ্য হয়ে ফুসফুস চিনি পোড়াতে শুরু করেছে। তৈরি হয়েছে ল্যাকটিক অ্যাডোসিস। অন্য কথায়: কণ্ঠনালীর ভিতর ল্যাকটিক অ্যাসিড মানেই হঠাৎ করেই ফুসফুস অক্সিজেন পায়নি। অর্থাৎ, কেভিনের অ্যাজফিক্সিয়েশন বা সাফোকেশন হয়েছে।

গুলির কারণে মারা যায়নি কেভিন। মরেছে, কারণ ফুসফুসে অক্সিজেন যায়নি। কেউ একজন গলা টিপে মেরে ফেলেছে ওকে।

খুন হয়েছে কেভিন হাক্সলে।

সেই সময়ে বাইরে জনি ওয়াকারের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল রানা ও নিনা ভিসার। ওই একই সময়ে ই-ডেকে নেমে আসে কর্পোরাল নাজমুল, ফেনুয়্যার হ্যাণ্ডকাফ খুলে দিয়ে তাকে নিয়ে উপরে রওনা হয়। আর সে সময়ে এ-ডেকের ডাইনিংরুমে ঢোকে কেউ, গলা টিপে মেরে ফেলে মুমূর্ষ কেভিন হাক্সলেকে।

খুব চিন্তিত হয়ে পড়েছে রানা।

ওদের সঙ্গেই আছে ঠাণ্ডা মাথার কোনও খুনি।

অন্যদেরকে সব খুলে বলেনি রানা, শুধু জানিয়েছে কেভিন হাক্সলে আর নেই। কীভাবে মরল, তা এড়িয়ে গেছে। ওর মনে হয়েছে, খুনিকে আরও সতর্ক হওয়ার সুযোগ না দেয়াই ভাল। লোকটা এখনও জানে না রানা টের পেয়েছে। নাজমুল ও ফেনুয়্যা শপথ করেছে, তারা এ বিষয়ে একটা কথাও বলবে না।.

চুপচাপ অন্যদেরকে পোশাক পরতে দেখছে রানা, দ্রুত চলছে। ওর মগজ।

খুনি যে-ই হোক, সে ভেবেছে অন্যরা মনে করবে গুরুতর জখমের কারণেই মরেছে হাক্সলে। রানাকে যদি তাই বলা হতো, ওই একই কথা ও-ও ভাবত। গুরুতর আহত ছেলেটা নিঃশব্দে বিদায় নিয়েছে। সবাই ঠিক তা-ই ভাববে, এটা ধরে নিয়েছে খুনিও। গলা টিপে মেরে ফেললে রক্ত বেরোয় না। কোনও ক্ষতও তৈরি হয় না। এটা স্বাভাবিক যে সবাই ভেবে নেবে শেষ যুদ্ধে হেরে গেছে আহত কেভিন।

কিন্তু খুনি জানত না গলা টিপে মারলে একটা প্রমাণ রয়ে যায়, গলার ভিতর অংশে থাকে ল্যাকটিক অ্যাসিড।

রানা বুঝতে পারছে, উইলকক্স আইস স্টেশনে কোনও ডাক্তার না থাকলে, কেউ জানত না কীভাবে মরেছে কেভিন।

নানা চিন্তা আসছে রানার মনে।

এমনও হতে পারে, স্টেশনের ভিতর রয়ে গেছে কোনও ফ্রেঞ্চ সৈনিক! এমন কেউ, যাকে খুঁজেই পায়নি ওরা। একাকী কোনও কমাণ্ডো, যে ঠিক করেছে একে একে শেষ করবে ওদের। সবচেয়ে দুর্বল, মুমূর্ষ মানুষটাকে দিয়ে শুরু করেছে নিজের কাজ।

মন থেকে চিন্তাটা দূর করে দিল রানা। গোটা স্টেশন, এর চারপাশ, বাইরে রয়ে যাওয়া অবশিষ্ট ফ্রেঞ্চ হোভারক্রাফট–সব জায়গা ভালভাবে খুঁজে দেখেছে ওর লোক। না, উইলকক্স আইস স্টেশনের বাইরে বা ভিতরে কোথাও শত্রু-সেনা নেই।

তার মানেই আরেকটা বড় সমস্যা চেপেছে ঘাড়ে।

কেভিন হাক্সলেকে যে খুন করেছে, সে ওর পরিচিত কেউ। এমন কেউ, যাকে বিশ্বাস করে ও।

দুই ফ্রেঞ্চ বিজ্ঞানী খুনি হতে পারে না। লড়াই শেষে তাদেরকে হ্যাণ্ডকাফ দিয়ে আটকে রাখা হয়েছে লোহার খুঁটির সঙ্গে।

হতে পারে উইলকক্স আইস স্টেশনের বিজ্ঞানীদের কেউ খুনি। রানার সঙ্গে ছিল নিনা ভিসার ও জনি ওয়াকার, অন্য বিজ্ঞানীরা ছিল বি-ডেকের কমন রুমে। বলতে গেলে, তাদেরকে ঘিরে ছিল মেরিন সৈনিক ও রানার দলের সবাই। কোন্ কারণে কোনও বিজ্ঞানী একজন মেরিন সৈনিককে খুন করবে? খুন করেই বা কী পাবে? বিজ্ঞানীদেরকে উদ্ধার করে সরিয়ে নেয়ার জন্যেই এসেছে ওরা।

অবশ্য, অন্য কিছুও হতে পারে।

কোনও মেরিন খুন করেছে কেভিন হাক্সলেকে।

এমন হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম, কিন্তু হতেও তো পারে?

সেক্ষেত্রে আঙুল তুলতে হয় সার্জেন্ট ভাইপারের দিকে। সে ছাড়া স্টেশনের ভিতর অংশে দ্বিতীয় কোনও মেরিন ছিল না।

রানা ও নিনা ভিসার গিয়েছিল সার্জেন্ট জনি ওয়াকারের সঙ্গে দেখা করতে। এই দুজন খুনি হতে পারে না। অন্য মেরিন অর্থাৎ সার্জেন্ট ভাইপারের ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া অসম্ভব। সে ছিল স্টেশনে, এমন সময় খুন হয় হাক্সলে।

অবশ্য, যে-কেউ কাজটা করে থাকতে পারে।

এক এক করে সবাইকে হিসাবের ভিতর আনছে রানা।

গানারি সার্জেন্ট পল সিংগার, ওরফে ভাইপার। সে ছিল সিডেকে, ব্যস্ত, ছিল বিধ্বস্ত উইঞ্চ কন্ট্রোল ঠিক করবার কাজে। একা ছিল সে।

ভাবতে শুরু করে মনটা খুব তেতো হয়ে গেল রানার।

আর কোনও মেরিন নেই যাকে সন্দেহ করবে। অন্যরা মারা গেছে। তার মানে, সার্জেন্ট ভাইপার বা অন্য চার বিজ্ঞানী ছাড়া  তেমন কেউ নেই যাকে সন্দেহ করবে।

নাকি আছে?

ওর নিজের দলের বেশ কয়েকজন?

তাদের কেউ ওই খুন করে থাকলে?

চুপ করে ভাবছে রানা।

কৃষ্ণাঙ্গদের মত কুচকুচে কালো লেফটেন্যান্ট গোলাম মোরশেদ। স্টেশনের উপর থেকে শুরু করে, নীচ পর্যন্ত ফ্রেঞ্চদের ইরেজার খুঁজেছে সে। পেয়েছে ভিএলএফ ট্রান্সমিটার। ওটা এখন ওর পায়ের কাছে। মোরশেদও একা ছিল।

এবার নাজমুল। তরুণ সৈনিক, ওকে কিশোরও বলা যায়। ওর উপর সবচেয়ে আগে সন্দেহ পড়ে। সে বলেছিল, আপাতত কেভিনের রক্ত থামাতে পেরেছে। তার মানেই ওই ছেলেটা আগের চেয়ে স্টেবল ছিল। নইলে নাজমুল ই-ডেকে নেমে আসত না। লড়াই শেষে ডাইনিংরুমে হাক্সলের সঙ্গে একা ছিল নাজমুল। ভাবতে ভাল লাগছে না, কিন্তু এমন হতেই পারে, কেভিনকে খুন করেছে সে একঘণ্টা আগেই।

কিন্তু কেন করবে কাজটা? কোনও ধরনের যুক্তি তো নেই! ম্যাকমার্ডো থেকে আসবার পথে নাজমুল ও কেভিন হাক্সলে আলাদা হোভারক্রাফটে এসেছে। ওদের দুজনের ভিতর ঝগড়া হওয়ারও কোনও সুযোগ ছিল না। নাজমুলের বয়স মাত্র একুশ বছর। কোনও কাজ দিলে বযস্ত হয়ে শেষ করে। কোনও নির্দেশ দিলে ঝাঁপিয়ে পড়ে সোৎসাহে। ওর এত বয়স হয়নি যে কাজে ফাঁকি দেবে বা কোনও প্রতিহিংসা পুষবে। সরল একটা ছেলে। নিজের দেশ বা মার কথা বলতে গিয়ে আবেগ তাড়িত হয়ে ছলছল করে ওঠে ওর দুই চোখ।

নাজমুলকে খুনি ভাবতে গিয়ে বিদ্রোহী হয়ে উঠল রানার মন। হঠাৎ অন্য একটা স্মৃতি মনে পড়ল। ওই তিক্ত অতীত স্মৃতি ভুলে .. যেতে চেয়েছে, কিন্তু পারেনি।

রবিন কার্লটন!

পেরু। এপ্রিল, দু হাজার এগারো সাল।

মানুষটা ছিল আমেরিকান। দক্ষ সেনা। পদ ছিল মেজরের। নুমা অফিসে পরিচিত হয় ওরা। দশ মিনিট পেরুবার আগেই বুঝতে পারে, পরস্পর পরস্পরকে পছন্দ করে ফেলেছে। দারুণ মিলে যায় দুজনের রুচি। দূর-সাগরকে মন থেকে ভালবাসে ওরা। দ্রুত চালাতে পছন্দ করে গাড়ি। এমন অসংখ্য মিল পেয়েছে ওরা নিজেদের ভিতর।

কার্লটন ওকে দাওয়াত দিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। অবিবাহিত মানুষের বাড়ির মত অগোছালো ছিল না, তার কটেজ। দারুণ চমৎকার রাধে কার্লটন। কিচেনে রান্নার কাজে সাহায্য করবার সময় রানা টের পেল, খুবই বুদ্ধিমান লোক ওর এই নতুন বন্ধু। স্ট্র্যাটেজির উপর দারুণ সব আইডিয়া আসে তার মগজে।

এরপর বহুবার ওদের দেখা হয়েছে নুমা অফিসে বা অন্য কোথাও। যোগাযোগ ছিল ফোনে। রানার জন্মদিনে বা ঈদে পৌঁছে যেত কার্লটনের দামি উপহার। একইভাবে ক্রিসমাস বা কার্লটনের জন্মদিনে পৌঁছে যেত রানার সুন্দর কোনও উপহার।

তারপর, দুহাজার এগারো সালের এপ্রিলে রানা ছিল পেরুর আকাশছোঁয়া আন্দেজ পর্বতে, বাংলাদেশ আর্মির একটা কমাণ্ডো ইউনিট নিয়ে ট্রেনিঙে ছিল। সেসময় গুজব শুনল, আন্দেজ পর্বতের অনেক উপরে প্রাচীন এক ইনকা মন্দিরের ভিতর আবিষ্কৃত হয়েছে খুব গুরুত্বপূর্ণ এক আর্টিফ্যাক্ট। দামি আর্টিফ্যাক্ট কেড়ে নিতে ইউনিভার্সিটি রিসার্চারদেরকে খুন করেছে একদল ট্রেজার-হান্টার। তাদের সঙ্গে আধুনিক সব অস্ত্র। পেরুভিয়ান প্রেসিডেন্ট সহায়তা চেয়েছেন ইউনাইটেড স্টেটসের কাছে।

রানা তখন ঠিক করল, পর্বতের ওই মন্দিরে ওর দল নিয়ে যাবে, তাতে ট্রেইনি অফিসাররা বাস্তব সমস্যা কেমন হয় তা বুঝবে। জায়গাটা খুব দূরেও নয়, সেদিনই রওনা দিল ওরা।

পাহাড়ের ওই এলাকায় পৌঁছে রানা দেখল, ওখানে আগেই হাজির হয়েছে ইউএস আর্মি রেঞ্জারের পুরো এক প্লাটুন সৈনিক। সবুজ একটা পাহাড় ঘিরে রেখেছে তারা। চারপাশের দুই মাইলের ভিতর কাউকে ঢুকতে দিচ্ছে না। পাহাড়ের চূড়ায় প্রায় ধসে পড়া পিরামিড আকৃতির ইনকা মন্দির দূর থেকেই চোখে পড়ছিল।

রেঞ্জারদের কর্নেলের কাছ থেকে রানা শুনল, ওই মন্দিরের ভিতর ঢুকেছে মেরিনদের একটি রিকনিসেন্স ইউনিট। মেরিনদের আরেকটি দল এসেছে। কিন্তু তাদেরকে মন্দিরের দিকে যেতে দেয়া হয়নি। রানা আরও জানল, মন্দিরের ভিতর যে ইউনিট চুকেছে, সেটার নেতৃত্বে আছে মেজর রবিন কার্লটন।

সবার আগে পৌঁছেছে সে। ওর দল নিয়ে ব্রাজিলের জঙ্গলে ট্রেইনিঙে ছিল। আমেরিকান সামরিক বাহিনীর উঁচু পদ থেকে নির্দেশ আসতেই এখানে চলে এসেছে।

আর্মি রেঞ্জার কর্নেল জানেন না, কী ঘটছে পোডড়া মন্দিরের ভিতর। অন্য ইউনিটগুলোকে বলে দেয়া হয়েছে, এই এলাকার দুই মাইলের ভিতর কেউ যেন ঢুকতে না পারে। ওই সীমানা পেরুবার উপায় ছিল না রানার, ওখানেই থামতে হয় বাংলাদেশ আর্মির দলটিকে। অবশ্য, দ্বিতীয় মেরিন ইউনিটের পরিচিত একজনের কাছ থেকে একটা হেলমেট চেয়ে নিয়েছিল রানা।

এর কিছুক্ষণ পর হাজির হলো নতুন আরেকটা মিলিটারি ইউনিট।

এদেরকে অবশ্য ভিতরে ঢুকতে দিল রেঞ্জারদের কর্নেল। ওই দলটি ছিল সিল টিম। তখন মেরিনদের কে যেন বলল, এরা এসেছে মাইন সরিয়ে নিতে। মেজর রবিন কার্লটন নাকি মন্দিরের। চারপাশে মাইন পেতে রেখেছে।

একঘণ্টা পর মন্দিরের ভিতর শুরু হলো তুমুল গোলাগুলি।

নীচ থেকে দেখা গেল, মন্দিরের ভিতর ঢুকে পড়েছে সিল ইউনিট। এরপর মেরিনদের কাছ থেকে ধার নেয়া হেলমেটের ইয়ারপিসে রানা শুনল চিৎকার। বেশ স্ট্যাটিক চলছে, তার ভিতর দিয়ে চিৎকার করে বলা হলো:

আমি মেজর রবিন কার্লটন, ইউনাইটেড স্টেটস মেরিন ফোর্স রিকনিসেন্স ইউনিট ফোর। রিপিট করছি: আমি ইউএস মেরিন ফোর্স রিকনিসেন্স ইউনিটের মেজর রবিন কার্লটন। বাইরে কি মেরিন ইউনিট আছ? থাকলে দয়া করে সাড়া দাও।

দ্বিতীয় মেরিন ইউনিটের মেজর জবাব দিল না, অন্য কাজে ব্যস্ত।

কিন্তু রানা সাড়া দিল। বলল, আমি মাসুদ রানা। ছোট একটা ইউনিট নিয়ে পাহাড়ের গোড়াতেই আছি। এরা আমাদের ঢুকতে দিচ্ছে না। রবিন, তুমি অনুমতি আদায় করে দিতে পারবে?

কিন্তু ওর মনে হলো, কার্লটন ট্র্যান্সমিট করলেও এদিকের কোনও কথা শুনছে না।

আবারও বলল কার্লটন: মন্দিরের বাইরে আছ কোনও মেরিন? দয়া করে এখনই রেইড করো! আমার ইউনিটের ভিতর বিশ্বাসঘাতক ঢুকিয়ে দিয়েছে ওরা! মেরিনস, সিল টিম বলেছিল আমাদেরকে সাহায্য করতে এসেছে। বলেছিল, ওরা স্পেশাল ইউনিট! মন্দির পাহারা দেয়ার জন্য ওয়াশিংটন থেকে এসেছে! তারপর পিস্তল বের করে একে একে আমাদেরকে খুন করতে শুরু করেছে। এখন আমাকেও খুন করতে চাইছে! আমার নিজের লোক রয়েছে তাদের সঙ্গে! হারামজাদারা বিক্রি হয়ে গেছে। আমার ইউনিটের ভিতর বিষ ঢুকিয়ে দিয়েছে ওরা! আমার নিজের লোকই এখন হামলা করছে…

এরপর কেটে গেল সিগনাল। চট করে মেরিনদের দিকে চাইল রানা। একটু আগে মেরিনদের মেজর খুলে রেখেছে হেলমেট। টুলে বসে ওটা দিয়ে হাঁটুর উপর টোকা দিচ্ছে। গাজরের মত লালচে চেহারায় মহাবিরক্তি। লোকটা বোধহয় কার্লটনের কথা শুনতে পায়নি। না কি ব্যাপারটা ইচ্ছাকৃত? দুশ্চিন্তার কোনও ছাপ নেই তার মুখে। একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে তরুণ লেফটেন্যান্ট। তার মাথায় হেলমেট নেই, তারটা দিয়ে দিয়েছে রানাকে। বুঝতে দেরি হলো না রানার, কার্লটন ট্রান্সমিট করেছে অফিসার্স-ওনলি ফ্রিকোয়েন্সিতে। তার মানে, ও নিজে ছাড়া কেউ শুনতে পাচ্ছে না কিছু।

নিজের দলকে তৈরি হতে বলল রানা, পাঁচ মিনিট পেরুনোর আগেই রওনা হলো মন্দির লক্ষ্য করে। কিন্তু বিশ ফুট যাওয়ার আগেই ওদেরকে ঘিরে ফেলল রেঞ্জারদের বড় একটা সশস্ত্র দল। সংখ্যায় তারা ষাটজন, ওদিকে রানা সহ ওর দলে মাত্র চোদ্দজন।

রেঞ্জার কর্নেল কঠোর স্বরে বলল, মেজর রানা, আমাকে স্পষ্ট নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কেউ ওদিকে যাবে না। কেউ না। কেউ বা কোনও দল মন্দিরে ঢুকতে চাইলে, তাকে বা তাদেরকে গুলি করা হবে। আপনারা বিদেশি… আমি চাই না আপনাদের উপর গুলি, চালাতে হোক। এরপর আরও শীতল হয়ে উঠল তার কণ্ঠ, আপনার কি মনে হয় আমরা গুলি করব. না? …আমি কিন্তু দ্বিতীয়বার মুখে কিছু বলব না।

চুপ করে রেঞ্জার কর্নেলের দিকে চেয়ে ছিল রানা।

লোকটার উচ্চতা সাড়ে ছয়ফুট মত। বয়স হবে পঁয়তাল্লিশ। ঢাল আকৃতির বুক। লালচে চেহারা। কু-কাট চুল। চোখদুটো মৃত মাছের চোখের মত। রানার এখনও মনে আছে লোকটার নাম। রোবটের মত করে বলেছিল; শুনে রাখুন, আমি ইউনাইটেড স্টেটস আর্মির কর্নেল ন্যাট লেদারউড।

মন্দিরের কাছে যাওয়া আর হয়নি রানা বা ওর দলের কারও। মেরিন লেফটেন্যান্টের দিকে এগোতে পারেনি, তার হেলমেটও ফিরিয়ে দেয়া সম্ভব হয়নি। তখনও হেলমেট ইন্টারকমে রবিন কার্লটনের আর্তি শুনছে রানা: মেরিনদের কেউ কি নেই তোমরা? আমাদের খুন করছে ওরা!।।

বারবার যোগাযোগ করেছে কার্লটন। তখন প্রচণ্ড রাগে থরথর করে কাঁপছে রানা। সিল টিম এরই ভিতর কার্লটনের বেশিরভাগ লোককে মেরে ফেলেছে। কার্লটন হতাশ হয়ে বলেছিল: আমার নিজের লোক যোগ দিয়েছে ওদের সঙ্গে! আমাদেরকে মেরে ফেলছে! আমি বুঝতে পারছি না কী ঘটছে!

কিছুক্ষণ পর রবিন কার্লটন বলেছে, হায় ঈশ্বর! আমি ছাড়া কেউ নেই আমার দলের!

মন্দির থেকে আর বেরোয়নি সে।

বাংলাদেশ আর্মির কমান্ডোদের ট্রেইনিং শেষে সোজা ইউএসএ ফেরে রানা। মেরিন অফিসে খোঁজ নিতেই ওখান থেকে জানানো হলো: ওই মন্দিরের ভিতর কোনও শত্রু পায়নি মেজর রবিন কার্লটন। ওখানে কোনও লড়াইও হয়নি। আসলে মন্দিরের ভিতর রহস্যজনক কোনও আর্টিফ্যাক্ট ছিল না। ফাঁকা পড়ে ছিল ভাঙা, মন্দির চারপাশ খুঁজতে শুরু করবার পর তার দলের কয়েকজন, তাদের ভিতর কার্লটন নিজেও, পড়ে যায় গোপন এক কূপের ভিতর। ওটা ছিল কমপক্ষে এক শ ফুট গভীর। চারদিকে ছিল পাথরের দেয়াল। অত উপর থেকে পড়ে একজনও বাঁচেনি। পরে উদ্ধার করা হয়েছে মৃতদেহগুলো।

অবশ্য, মেজর রবিন কার্লটনের লাশ পাওয়া যায়নি।

মেরিন অফিসের রিপোর্ট অনুযায়ী: ওই মন্দিরে অস্বাভাবিক কিছুই ঘটেনি। সতর্ক না হলে এমন মর্মান্তিক দুর্ঘটনা তো ঘটতেই পারে!

সেদিন মারা পড়ে বারোজন মেরিন।

রানা জানে, ও একমাত্র মানুষ যে কার্লটনের কথা শুনেছিল। কাউকে বললেও বিশ্বাস করবে না, কার্লটনের নিজ লোক ওদেরকে খুন করেছে। এরপর আমেরিকার সেনাবাহিনীর ব্যাপারে খোঁজ-খবর নিতে শুরু করে রান!। কিন্তু জরুরি তথ্য না পাওয়ায় বেশি দূর এগোতে পারেনি।

এখন বরফের নীচে অ্যান্টার্কটিকার উইলকক্স আইস স্টেশনে কথাটা মনে পড়ে কেমন যেন কু ডাকছে ওর মন। কার্লটনের কণ্ঠ বাজছে কানে: আমার ইউনিটের ভেতর বিশ্বাসঘাতক ঢুকিয়ে দিয়েছে ওরা!

বিজ্ঞানীদের ভিতর কেউ হাক্সলেকে খুন করে থাকতে পারে। কার্লটনের বলা সেই ওরা কারা? ইউএস সরকার? ইউএস মিলিটারি?

হতে পারে।

প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ইউনাইটেড স্টেটসের মিলিটারিতে বিশেষ কিছু লোক ঢুকিয়ে দিত সরকার। আসলে তাই করে প্রায় প্রতিটি দেশ। সাধারণ অফিসার বা সৈনিকা এদেরকে ছুঁচোর চেয়ে বেশি ঘৃণা করে।

নিজের দলের ভিতর বিশ্বাসঘাতক থাকতে পারে, ঠাণ্ডা একটা শিরশিরে অনুভূতি নেমে গেল রানার মেরুদণ্ড বেয়ে। মনে মনে আবার হিসাব কষতে শুরু করেছে,

তিশা করিম। মিষ্টি একটা মেয়ে। তরুণ এবং আহত কেভিন হাক্সলেকে খুন করবে কেন? কোনও কারণ তো নেই। কারও সঙ্গে কোনও রাগারাগি নেই তিশার। স্কুবা গিয়ার তৈরি রাখতে ই-ডেকে নেমে এসেছে। তার সঙ্গে এখনও আছে সার্জেন্ট হোসেন আরাফাত দবির। তিশা কি কোনওসময়ে একেবারে একা ছিল? সেই সময়ে উঠে যায় এ-ডেকে? খুন করে কেভিন হাক্সলেকে?

সার্জেন্ট হোসেন আরাফাত দবির সত্যিকারের দক্ষ সৈনিক, যার উপর ভরসা করা যায়। একটু পর পর গিয়ে নিশাত সুলতানাকে দেখে আসছে। সে ই-ডেক ছেড়ে এ-ডেকে গিয়েছিল? উপরে উঠে যাওয়ার কোনও কারণ নেই। কিন্তু পারে তো যেতে?

একমাত্র নিশাত সুলতানাকে বিশ্বাস করতে পারবে রানা। সে নিজেই আহত, চাইলেও কেভিন হাক্সলেকে খুন করতে পারত না।

থমথমে চেহারা নিয়ে সাগরের পুলের দিকে চেয়ে রইল রানা। ওদের ভিতর বরফ-ঠাণ্ডা মগজের খুনি আছে! ওয়াকার, নিশাত, নিনা ভিসার এবং ও নিজে ছাড়া অন্যরা যে-কেউ খুনি হতে পারে!

দুই লেফটেন্যান্ট গোলাম মোরশেদ ও তিশা করিম এবং সার্জেন্ট জনি ওয়াকার ডাইভ দেয়ার জন্য প্রস্তুত। ওদের পিঠে নেভির লো-অডিবিলিটি এয়ার ট্যাঙ্ক। আজকাল ওই জিনিসকে স্টেলথ ট্যাঙ্ক বলে।

পানির ভিতর খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে আওয়াজ, আর সাধারণ স্কুবা ট্যাঙ্ক নানা শব্দ তৈরি করে। মাউথ পিস থেকে কমপ্রেসড় বাতাস বেরুবার সময় বেশ জোরালো বগ-বগ শব্দ তোলে। কমার্শিয়াল আণ্ডারওয়াটার মাইক্রোফোন চট করে ধরতে পারে ডুবুরির ব্রিদিং গিয়ারের হিসহিস আওয়াজ। এটা মাথায় রেখে ইউএস নেভি কোটি ডলার খরচ করে নিঃশব্দ আণ্ডারওয়াটার ব্রিদিং অ্যাপারেটাস তৈরি করিয়েছে। লাবা, বা লো-অডিবিলিটি ব্রিদিং অ্যাপারেটাস তাদের চাহিদা ভালভাবেই পুরণ করেছে। কোনও আওয়াজ করে না ওই জিনিস। সাধারণ অডিও ডিটেকশন সিস্টেম। যেমন স্টেলথ এয়ারক্রাফট ধরতে পারে না, ঠিক তেমনই বর্তমানের স্টেলথ ট্যাঙ্ক। .

ওর দলের দিকে চাইল রানা। যে যার মুখে মুখোশ বসিয়ে নিয়েছে। এবার আঁপিয়ে পড়বে রক্ত মিশ্রিত লালচে পানিতে। আরেকবার পুলের দিকে চাইল রানা। মাঝে ভাসছে ডাইভিং বেল, এ ছাড়া পানিতে কিছুই নেই। কমপক্ষে চল্লিশ মিনিট আগে বিদায় নিয়েছে খুনি তিমিগুলো। চট করে আবার ফিরবে বলে মনে হয় না। কাঁধে টোকা পড়তেই ঘুরে চাইল রানা।

কখন যেন এসেছে নিনা ভিসার। পরনে নীল-কালো থারমালইলেকট্রিক ওয়েটসুট। একটু চমকে গেল রানা। টানটান হয়ে আছে নিনার পোশাক। এখানে পৌঁছে তাকে ভাল করে দেখেনি ও। অপূর্ব সৌষ্ঠবের কারণে বড় মাপের মডেল হতে পারত নিনা ভিসার।

একটু আগেও আপনার সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছি, বলল নিনা। ব্যস্ততার কারণে সময় হয়নি আপনার। …আমি অন্যদের সঙ্গে নামতে চাই।

চুপ করে আছে রানা।

ওই গুহায় নামতে গিয়ে মরেছে এই স্টেশনের নয়জন। আমি জানতে চাই, ওখানে আসলে কী আছে।

নিনা ভিসারের দিক থেকে চোখ সরিয়ে বামে দাঁড়িয়ে থাকা তিন যোদ্ধাকে দেখল রানা। একটু কুঁচকে গেছে ওর ভুরু।

আমি ওদেরকে সাহায্য করতে পারব, বলল নিনা। বিশেষ করে গুহার বিষয়ে।

খুলে বলুন, কীভাবে।

জন প্রাইস বলেছিলেন ওই গুহা পানির নীচে, বলল নিনা। উনি আরও বলেন, গুহার বরফ-দেয়াল কয়েক শ ফুট চওড়া। …এখন, গুহার দেয়াল যদি খাড়া হয়, ধরে নিতে পারেন ওটা। তৈরি হয়েছে ভূমিকম্পের কারণে। বা সাগরের নীচের লাভার চাপে। শুধু নীচ থেকে পাথরের প্রচণ্ড ঠেলা খেলে তৈরি হয় এমন দেয়াল।

আমার লোক সতর্ক থাকবে, ডক্টর ভিসার। ঠিক আছে। কিন্তু আমি বলতে পারব ওখানে কী আছে।

এবার পুরো মনোযোগ দিল রানা। পানির পুলের কিনারে চলে গেছে তিন ডুবুরি। ওয়াকার-তিশা-যোরশেদ, একমিনিট অপেক্ষা, করো। ঘুরে নিনা ভিসারের দিকে চাইল রানা। তা হলে বলুন, ডক্টর ভিসার, নীচে কী আছে।

বলছি, কথা গুছিয়ে নেয়ার জন্য থামল নিনা। রানা বুঝতে পারছে, এ ব্যাপারে অনেক ভেরেছে সে।

এক নম্বর থিয়োরি। ওটা এলিয়েনদের। অন্য গ্রহ থেকে এসেছে স্পেসশিপ। অন্য সভ্যতা থেকে। এই বিষয়ে খুব বেশি জানি না। কিন্তু স্পেসশিপ যদি এলিয়েনদের হয়, ওটা একবার দেখারজন্য নিজের হাত কেটে দিতেও গররাজি হব না।

আপনার হাত-পা কাটতে হবে না, এমনিতেই আমাদের একজন পা হারিয়েছে, শুকনো শোনাল রানার কণ্ঠ।

আর কিছু বলবেন?

দুই নম্বর থিয়োরি, বলল নিনা। ওটা আসলে এলিয়েন নয়।

তাই? ভুরু নাচাল রানা।

হতেই পারে, বলল নিনা, ওটা এলিয়েন বিমান নয়। আর এ। থিয়োরি আমার পরিচিত। সত্যিকারের প্যালিয়োন্টোলজি। এটা অনেক পুরোনো থিয়োরি। কিন্তু আজ পর্যন্ত কেউ প্রমাণ করতে পারেনি।

কী ধরনের প্রমাণ?

চাপা শ্বাস ফেলল নিনা ভিসার। এই থিয়োরিতে বলা হয়েছে, বহুকাল আগে পৃথিবীতে সভ্য কোনও জাতি ছিল। থামল সে, চেয়ে আছে রানার চোখে। বুঝতে চাইছে মনের কথা।

কিছুক্ষণ পর বলল রানা, বলতে থাকুন।

সে বহু হাজার বছর আগের কথা। মিটিমিটি হাসল নিনা। আমি বলছি ডাইনোসর আসার আগের কথা। ধরুন, চার শ মিলিয়ন বছর আগে? …আপনি যদি ভাবতে শুরু করেন, ঠিক বুঝবেন এমন হতেই পারে–সে আমলে অতি সভ্য কোনও জাতি ছিল। নিশ্চয়ই জানেন, আমাদের মানব-সভ্যতার উত্থান মাত্র এক মিলিয়ন বছরের কম সময়ের।

পৃথিবীর ইতিহাসে আমাদের উদ্ভব অল্প কদিনের। যদি ধরে নিই পৃথিবীর বয়স চবিবশ ঘণ্টা, তো প্রথম মানব জন্ম নিয়েছে মাত্র তিন সেকেণ্ড আগে। তার মানে, মানব-সভ্যতা এসেছে আরও অনেক পরে। নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, আমি হোমমা সেপিয়েন্সদের কথা বলছি। মাত্র বিশ হাজার বছর ধরে সভ্য হচ্ছি আমরা। অর্থাৎ, পৃথিবীর চব্বিশ ঘণ্টার জীবনে মাত্র এক সেকেণ্ড সময় ধরে সভ্য হচ্ছি আমরা।

চুপ করে আছে রানা। বলতে গিয়ে উত্তেজিত হয়ে উঠেছে নিনা ভিসার, পছন্দের বিষয় পেয়ে চকচক করছে দুই চোখ।

প্যালিয়োন্টোলজি আমাদেরকে জানিয়েছে, ঢের পরে এসেছে স্তন্যপায়ী প্রাণী। তারও অনেক পরে এসেছে মানুষ। সূর্য থেকে পৃথিবীর সঠিক দূরত্ব, ঠিক তাপমাত্রা, উপযুক্ত পরিবেশ, পরিবেশে পর্যাপ্ত অক্সিজেন, সবচেয়ে বড় কথা— ডাইনোসর বিলুপ্ত হওয়া, এর ফলে পৃথিবীতে উদ্ভব হয়েছে মানব জাতির। আমরা সবাই জানি অ্যালভেরেজ থিয়োরি, একটা প্রকাণ্ড গ্রহাণু আকাশ থেকে পড়ে শেষ করে দিল সমস্ত ডাইনোসর, তারপর রাজত্ব শুরু করল স্তন্যপায়ী প্রাণী। কিন্তু একটা কথা বোধহয় জানেন না, গত সাত শ মিলিয়ন বছরে কমপক্ষে চারটে গ্রহাণু এই গ্রহের বুকে পড়েছে।

অল্পস্বল্প পড়েছি, বলল রানা।

হা। জানার তো কথা, আপনি শিক্ষিত মানুষ। স্যর এডমুণ্ড হ্যালি মন্তব্য করেছেন, গোটা কৃষ্ণ সাগর তৈরি হয়েছে বিশাল একখণ্ড গ্রহাণুর আঘাতে। এমনটি ঘটে কয়েক শ মিলিয়ন বছর আগে। নিউ যিল্যাণ্ডের বিখ্যাত ফিজিসিস্ট আলেকণ্ডার বিকারটন রাদারফোর্ডে পড়াতেন, তিনি বলেন: গোটা দক্ষিণ আটলান্টিক সাগর, অর্থাৎ দক্ষিণ আফ্রিকা এবং দক্ষিণ আমেরিকা আগে প্রকাণ্ড একটা গামলার মত ছিল। তিন শ মিলিয়ন বছর আগে ওখানে এসে পড়ে বিশাল এক গ্রহাণু।

এখন, আমরা যদি ধরে নিই, প্রকাণ্ড সব ডাইনোসরদের মত করেই অন্য সব সভ্যতা হারিয়ে গেছে প্রকাণ্ড গ্রহাণুর আঘাতে…এবার নিজেদেরকে জিজ্ঞেস করতে পারি–কেমন ছিল সেই সভ্যতা? আর কেন এভাবে বিলুপ্ত হলো ডাইনোসরদের মত? গত কয়েক বছরে নামকরা কজন বিজ্ঞানী এই একই কথা বলেছেন।

স্ট্যানফোর্ডের জোসেফ সরেনসন তাঁদের ভিতর বেশি প্রখ্যাত তিনি বলেন, বহু আগের সেই সমাজ বোধহয় অন্য কোনও প্রাণীর ছিল না, ছিল মানব-সভ্যতার।

অন্যদের দিকে চাইল রানা। ওরা অপেক্ষা করছে। মনোযোগ দিয়ে শুনছে নিনা ভিসারের প্রতিটা কথা।

খেই ধরল নিনা ভিসার: হয়তো জানেন, প্রতি বাইশ হাজার বছরে আধ ডিগ্রি কাত হয় পৃথিবী। সরেনসন বলতে চেয়েছেন, চার শ মিলিয়ন বছর আগে এমন করেই কাত হয়েছিল পৃথিবী। তখন এই গ্রহ ঠিক এতটা দূরেই ছিল সূর্য থেকে। তার মানে, তাপমাত্রা ছিল এখনকার মতই। আমরা এই স্টেশন থেকে যে আইস কোর স্যাম্পল, পেয়েছি, তাতে দেখা গেছে আমাদের বর্তমানের পরিবেশের মতই ছিল সেই বাতাস। তাতে ছিল একই পরিমাণ অক্সিজেন, নাইট্রোজেন ও হাইড্রোজেন। …আপনি কি এর মানে বোঝেন? আগেও ঠিক এমনই অবস্থানে ছিল পৃথিবী।

রানা মনে মনে বলল, তাই?

ওই পাতাল-গুহা সাগরের পনেরো শ ফুট নীচে, বলল নিনা। অর্থাৎ, অ্যান্টার্কটিকার সাধারণ সমতল থেকে কমপক্ষে আড়াই হাজার ফুট নীচে। হতে পারে ওখানে রয়েছে চার শ মিলিয়ন বছরের বরফ। ওটা যদি নীচ থেকে ঠেলা খেয়ে উঠে, আসে, তো ওই বরফ আসলে আরও অনেক আগের হতে পারে।

ওখানে যা-ই থাক্‌, সেটা লক্ষ লক্ষ বছর ধরে জমাট বেঁধে আছে। তার মানেই বহু আগেকালের কথা। হতে পারে ওই স্পেসশিপ এলিয়েনদের। অথবা অতীতের মানুষের। লক্ষ লক্ষ বছর ধরে টিকে আছে মানুষ। যাই হোক, মেজর, এটা পৃথিবীর সবচেয়ে বড় প্যালিয়োন্টোলজিকাল আবিষ্কার, আর আমি সেমুহূর্তে উপস্থিত থাকতে চাই।

প্রচুর কথা বলে হাঁপিয়ে উঠেছে নিনা ভিসার, বড় করে শ্বাস নিতে শুরু করেছে।

চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে রানা, ভাবছে।

নরম স্বরে বলল নিনা, মেজর, আমি জীবনের সামান্যতম তোয়াক্কাও করি না। এমন আবিষ্কারের জন্য মরতেও দ্বিধা করব না। এটা হতে পারে মানব-সভ্যতার সবচেয়ে বড় আবিষ্কার। আমার সারাজীবন ধরে…।

কৌতূহল নিয়ে নিনার দিকে চেয়ে আছে রানা। ও নিজে কিছু বলবে, সেটা টের পেয়ে থেমে গেল নিনা।

আপনার মেয়ের কী হবে? জানতে চাইল রানা।

আস্তে করে মাথা কাত করল নিনা। এ ধরনের প্রশ্নের জন্য তৈরি ছিল না।

আপনি মেরিকে রেখে নীচে নামতে চান? বলল রানা।

ও নিরাপদেই থাকবে, হেসে ফেলল নিনা। ওর জন্য তো আপনি থাকছেন।

আগে কখনও নিনা ভিসারকে হাসতে দেখেনি রানা। ঝলমল করে উঠেছে গোটা মুখ। . যেন নীল-সাগরে বইছে ঝিরঝিরে হাওয়া, চারপাশে সোনালী রোদ, দূরে দারুণ সুন্দর কোনও সবুজ দ্বীপ।

তা ছাড়া, নীচে গেলে আমাদের হারিয়ে যাওয়া ডুবুরিদের পরিচয় জানিয়ে দিতে পারব আপনাদেরকে। আর…

হাত তুলে বাধা দিল রানা। ঠিক আছে, আপনি যেতে পারেন। কিন্তু ব্যবহার করবেন আমাদের স্কুবা ডাইভিং গিয়ার। কারও জানা নেই পাতাল-গুহায় ডুবুরিদের কী হয়েছে। কিন্তু সন্দেহ করছি, ওখানে যা আছে, সেটা ব্রিদিং গিয়ারের আওয়াজ পেয়েই হাজির হয়েছিল। চাই না আপনারও করুণ পরিণতি হোক।

আমার জন্য ভেবেছেন, তাই অসংখ্য ধন্যবাদ, মেজর, বলল নিনা ভিসার। গলা থেকে চেইন ও লকেট খুলল সে, রানার দিকে বাড়িয়ে দিল। ডাইভ দেয়ার সময় এটা সঙ্গে রাখতে চাই না। এটা রাখুন। ফিরে এসে নেব।

বেশ, জিনিসটা নিল রানা, রেখে দিল প্যান্টের পকেটে।

ঠিক তখন পুলের বামে জোরালো গোঙানির আওয়াজ উঠল। চট করে ঘুরে চাইল রানা, গভীর থেকে বিশাল কালো কী যেন উঠে আসছে। চারপাশ ভরে গেছে সাদা বুদ্বুদ ও ফেনায়। রানা প্রথমে ভেবেছিল, আবার দেখা দিয়েছে কিলার ওয়েইল, বোধহয় পেট ভরেনি ওদের। কিন্তু এক মুহূর্ত পর টের পেল, ওটা বিন্দুমাত্র সাঁতার কাটছে না। হুইশ আওয়াজ তুলে মসৃণভাবে উঠে এল পুলের সমতলে। চারপাশে ছড়িয়ে গেল ঢেউ ও ফেনা। সেই ফেনার ভিতর মিশছে সরু রেখার রক্ত। প্রকাণ্ড কালো জিনিসটা প্রায় ডুবু-ডুবু। প্ল্যাটফর্মে কয়েক পা পিছিয়ে গেছে সবাই।

এক মুহূর্ত পর ওটাকে চিনল রানা। কিলার ওয়েইলই। মৃত। পানিতে শিথিলভাবে ভাসছে কালো-সাদা লাশ। পাশেই প্ল্যাটফর্ম। ওখান থেকে ছুঁয়ে দিতে পারবে যে-কেউ। বোধহয় পালের সবচেয়ে বড়টা এটা, পুরুষ তিমি। দৈর্ঘ্যে কমপক্ষে তিরিশ ফুট। ওজন হবে সাত টন।

রানা ভেবেছিল, এই তিমির মাথায় গুলি করেছে নিশাত সুলতানা। ওটা ছাড়া অন্য কোনও তিমি মরেনি; কিন্তু এক সেকেণ্ড পর সিদ্ধান্ত পাল্টে নিল ও।

নিশাতের গুলিতে ক্রিকেট বলের মত গর্ত হওয়ার কথা। কিন্তু এই তিমির মাথায় কোনও ক্ষত নেই।

তা ছাড়া, আরেকটি বিষয় লক্ষ্য করবার মত।

এটা পানির ভিতর ভেসে উঠেছে।

কোনও স্তন্যপায়ী প্রাণী মরলে প্রথমে পানিতে ভাসতে থাকে, তারপর পেট ভরে গেলে টুপ করে ডুবে যায়। নিশাত যে তিমিকে মেরেছে, এতক্ষণে ওটা সাগরের মেঝেতে গিয়ে ঠেকেছে।

কিন্তু এই তিমিকে খুন করা হয়েছে একটু আগে।

অবাক চোখে মৃত তিমির দিকে চেয়ে আছে সবাই।

পানির ভিতর অল্প অল্প করে গড়িয়ে চুলেছে লাশ। একটু পর চিত হলো। প্রকাণ্ড তিমির সাদা পেটে চোখ পড়তেই ঢোক গিলল রানা।

নিনা ভিসারের মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেল।

বিড়বিড় করে কী যেন বলল তিশা।

চিরে দেয়ার দীর্ঘ দুটো রক্তাক্ত ক্ষত তিমির তলপেটে। পাশাপাশি উঠে গেছে গলা পর্যন্ত। ছিড়ে দেওয়া হয়েছে পেট-বুক ও গলা। পেট থেকে বেরিয়ে এসেছে কুণ্ডলি পাকানো সাদাটেখয়েরি নাড়িভূঁড়ি, পরিধি মানুষের হাতের চেয়ে বেশি।

ছুরি দিয়ে কাটা হয়নি সমান্তরাল দুই ক্ষত, যেন পেট ফুটো করেছে মস্ত দুটো দাঁত, তারপর চিরচির করে কেটে থেমেছে গিয়ে গলার গোড়ায়। চামড়া-মাংস উপড়ে ছিড়ে নেয়া হয়েছে।

চুপ করে লাশের দিকে চেয়ে আছে ওরা, প্রায় সবার চোখে চিন্তা ও ভয়ের ছাপ। বুঝতে পারছে, নীচে এমন কিছু আছে যেটা মেরে ফেলতে পারে এই বিশাল কিলার ওয়েইলকে!

আস্তে করে শ্বাস ফেলল রানা, তারপর ঘুরল নিনা ভিসারের দিকে। এখনও যেতে চান?

আরও কয়েক সেকেণ্ড তিমির লাশের দিকে চেয়ে রইল নিনা, তারপর ফিরে চাইল রানার দিকে। না, নিচু স্বরে বলল, যাব না, এ-কথা বলব না।

১৯.

পুল ডেকে থম মেরে বসে আছে কর্পোরাল নাজমুল, খুব চিন্তিত হয়ে পড়েছে। কিছুক্ষণ পর চাইল পুলের মাঝে। উপর থেকে নেমে এসেছে উইঞ্চের কেবল, চলে গেছে পানির অনেক গভীরে। কেবলের শেষে ডাইভিং বেল। ওদের দলের ডুবুরিদের সঙ্গে গেছে নিনা ভিসার। যত দ্রুত সম্ভব গতি তুলে নামছে কেবল।

একঘণ্টার বেশি হলো, পানির নীচে ডুবুরিরা। থামবে গিয়ে তিন হাজার ফুট গভীরে। অর্থাৎ, প্রায় এক কিলোমিটার। সেজন্য বেশ সময় লাগবে। বিশ মিনিট আগে সার্জেন্ট হোসেন আরাফাত দবির, গানারি সার্জেন্ট ভাইপার ও মেজর স্যর উপরে উঠেছেন। পোর্টেবল রেডিয়ো দিয়ে ম্যাকমার্ডো স্টেশনের সঙ্গে যোগাযোগ করবার চেষ্টা করবে সার্জেন্ট দবির ও ভাইপার। স্যর গেছেন। উপরের ডেকগুলো ঘুরে দেখতে। তার আগে ওদেরকে বলেছেন, জেনে নিতে হবে কখন আসবে আমেরিকান সেনাবাহিনী। যখনতখন অন্য দেশের সেনাবাহিনীর হামলা হতে পারে। বাইরে যেভাবে তুষার-ঝড় হচ্ছে, চাইলেও ওরা সবাইকে নিয়ে রওনা দিতে পারবে না।

ই-ডেকে চুপ করে বসে আছে নাজমুল। শব্দ বলতে শুধু সিডেকের উইঞ্চ মোটরের একঘেয়ে ঘং-ঘং আওয়াজ। ওই আওয়াজ ভাল লাগছে না ওর।

হঠাৎ একটা আওয়াজ পেয়ে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল নাজমুল। শব্দটা হঠাৎ করেই শুরু হয়ে আবারও থেমে গেছে। কারও গলার আওয়াজ। পুরুষ কণ্ঠ। বলে উঠেছে ফ্রেঞ্চ ভাষায়!

ডিএলএফ ট্রান্সমিটারের উপর চোখ পড়ল ওর। ওটা কয়েক ফুট দূরে।

হঠাৎ করেই শিসের মত তীক্ষ্ণ আওয়াজ তুলল যন্ত্রটা। তারপর আবারও শোনা গেল কণ্ঠ। ধীর গতিতে বলছে। একই কথা দুবার বলল।.বোধহয় রিপোর্ট করতে বলছে।

স্যর ফ্রেঞ্চ ভাষা জানেন? কখন ছুটতে শুরু করেছে, নাজমুল জানে না। ভুলেই গেছে হেলমেট মাইকে কথা বলতে পারবে। রাং-ল্যাডারে বেয়ে দ্রুত উঠছে, দেড় মিনিট পর পৌঁছে গেল বিডেকে। ভাঙা ক্যাটওয়াকে রানাকে দেখেই দৌড়ে গিয়ে থামল সামনে। স্যর! ফরাসিদের রেডিয়ো থেকে কী যেন বলছে!

নীচে থেকে জানালে তাড়াতাড়ি নামতে পারতাম, রাংল্যাডারের দিকে ছুটতে শুরু করেছে রানা। তুমি গিয়ে দবির আর ভাইপারের কাজে সাহায্য করো।

মই বেয়ে দ্রুত নামছে রানা, মিনিট পেরুবার আগেই পৌঁছে গেল ই-ডেকে। থমথম করছে চারপাশ। কোথাও কোনও আওয়াজ নেই। বোধহয় ট্রান্সমিট শেষ করে চুপ হয়ে গেছে রেডিয়ো। হতাশ লাগছে রানার। হেলমেট মাইক চালু করে ঝুঁকে দাড়িয়েছে রেডিয়োর সামনে। কোনও কথা এলে অন্যরাও শুনবে।

আর মাত্র একবার বল, মনে মনে বলল রানা।

ঠিক তখনই আবারও বলে উঠল বার্তা প্রেরক: হায়েনার পাল, তিনঘণ্টার ভিতর রিপোর্ট দিতে হবে। আবারও বলছি, তিনঘণ্টার ভিতর রিপোর্ট চাই। এর ভিতর যোগাযোগ না করলে ধরে নেয়া হবে সময় শেষ। সেক্ষেত্রে ইঞ্জিন চালু করব আমরা। আবারও বলছি, তিনঘণ্টার ভিতর যোগাযোগ না করলে ইঞ্জিন চালু করা হবে। আউট, কিলার ওয়েইল।

চুপ হয়ে গেছে ভিএলএফ ট্রান্সমিটার।

ইরেজার ডিভাইস, বিড়বিড় করে বলল রানা। চট করে ক্যাসিয়ো ডিজিটাল ঘড়িতে কাউন্ট-ডাউন চালু করল। হেলমেট মাইকে বলল, ফ্রেঞ্চদের কাছে ইরেজার ছিল। মন দিয়ে শোনো, ফ্রেঞ্চদের সঙ্গে ইরেজার ছিল। তিনঘণ্টার আগেই ওটা খুঁজে বের করতে হবে, নইলে উড়ে যাবে এই স্টেশন।

স্যর, স্টেশনের বাইরে থেকে বলল নাজমুল। ওটা কোথায় রেখেছে আমরা খুঁজে দেখেছি, পাইনি।

নাজুমলের কথায় মন নেই রানার, দ্রুত ভাবছে। ফ্রেঞ্চ বার্তায় বলা হয়েছে, তারা কিলার ওয়েইল। আর হায়েনা ফ্রেঞ্চ কমাণ্ডোরা, হামলা করেছে এই স্টেশনে। ওদিকের লোকটা নিজেকে কিলার ওয়েইল বলেছে কেন?

কারণ, তারা আছে পানিতে। উপকূলের কাছে। বোধহয় অ্যান্টার্কটিকার তীরের কাছে থেমেছে কোনও ফ্রেঞ্চ রণতরী!

সাধারণত দীর্ঘ ওয়েভলেন্থের জন্য ভিএলএফ ট্রান্সমিটার ব্যবহার করে জাহাজ বা সাবমেরিন। কমাণ্ডোরা ট্রান্সমিটার সঙ্গে এনেছে জাহাজের সঙ্গে যোগাযোগ করবে বলে!

ওই জাহাজ কোনও ফ্রিগেট বা ডেস্ট্রয়ার, হয়তো আছে তীর, থেকে এক শ মাইল দূরে। এখন উইলকক্স আইস স্টেশনের উপর তাক করেছে অস্ত্র। বোধহয় এক ব্যাটারি নিউক্লিয়ার টিপড় ক্রুজ মিসাইল!

আগে রানার সন্দেহ হয়নি যে কেন ফ্রেঞ্চ কমাণ্ডোরা সঙ্গে ইরেজার আনেনি, কিন্তু এখন বুঝতে পারছে, বাইরে রয়ে গেছে তাদের ইরেজার উপকূল থেকে অনেক দূরে জাহাজ ও অস্ত্র। এবং তিনঘণ্টা পর কোনও ডেস্ট্রয়ার থেকে স্টেশনের উপর ফেলবে মিসাইল, সব মিশিয়ে দেবে বরফে।

এখন মাত্র দুটো জিনিস ইরেজার ডিভাইস থামাতে পারে। প্রথমত: বারো মৃত ফ্রেঞ্চ কমাপ্তোদের কেউ রিপোর্ট করলে ছোড়া হবে না মিসাইল। কিন্তু, তা হওয়ার নয়। রানার সামনে এখন একমাত্র উপায়: ম্যাকমার্ডো স্টেশনে যোগাযোগ করা। জানতে হবে কখন উইলকক্স আইস স্টেশনে পৌঁছবে আমেরিকান সৈনিকরা। একইসঙ্গে ম্যাকমাৰ্ডোর মেরিনদেরকে জানাতে হবে, এদিকে এক ব্যাটারি মিসাইল তাক করেছে ফ্রেঞ্চ কোনও রণতরী। হাতে মাত্র তিনঘণ্টা, তার আগেই যেভাবে হোক ঠেকাতে হবে ফ্রেঞ্চদেরকে।

মাইকে বলে উঠল রানা, দবি, কথা শুনতে পাচ্ছেন?

জী, স্যর, জবাব দিল সার্জেন্ট আরাফাত।

আপনারা ম্যাকমার্ডোর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পেরেছেন?

জী-না, স্যর।

বারবার চেষ্টা করুন, বলল রানা। ওদেরকে লাইনে পেতে হবে। হাতে তিনঘণ্টার চেয়ে কম সময়, তারপর এই স্টেশন গুঁড়িয়ে দেয়া হবে।

আমরা চেষ্টা করছি, জানাল গানারি সার্জেন্ট ভাইপার।

ক্রুজ মিসাইলের কথা ভাবতে গিয়ে শীতল শিরশিরে অনুভূতি নামছে রানার মেরুদণ্ড বেয়ে। চেয়ে আছে ও উইঞ্চের কেবলের দিকে। একটু পর পায়চারি শুরু করল। আসলে হাতে বড়জোর দুই ঘণ্টা, তারপর তুষার-ঝড়ের ভিতর স্টেশন থেকে অনেক দূরে সরে যেতে হবে। কিন্তু সাগরের অনেক নীচে রয়ে গেছে তিশা, মোরশেদ, ওয়াকার ও নিনা ভিসার। ওদেরকে আবার তুলে আনতে অনেক সময় বেরিয়ে যাবে।

স্যর, হঠাৎ শুনতে পেল তিশার কণ্ঠ, আমি তিশা। রিপিট করছি। আমি লেফটেন্যান্ট তিশা। শুনতে পাচ্ছেন, স্যর?

হেলমেট মাইক চালু করল রানা। হ্যাঁ, শুনছি, তিশা। নীচে তোমাদের কী অবস্থা?

প্রায় তিন হাজার ফুট গভীরতায় পৌঁছে গেছি। এবার কেবল বন্ধ করব। চুপ হয়ে গেছে মেয়েটি। সামান্য বিরতি নিয়ে বলল, ঠিক আছে, কেবল নেমে যাওয়া থেমে গেছে।

ওর কথা শেষ হতেই হঠাৎ ঝটকা খেল ই-ডেকের উপরের কেবল। অনেক নীচে আচমকা থেমে গেছে ডাইভিং বেল।

স্যর, আমাদের সময় অনুযায়ী দুটো দশ মিনিট, বলল তিশা। কনফার্ম করুন।

তিশা, কনফার্ম করছি, সময় দুপুর দুটো দশ মিনিট, বলল রানা। ডিপ-ডাইভিং করবার সময় কখন রওনা হয়েছে, তা ভালভাবেই মনে রাখা হয়। গত কয়েক দিন আগে তিশার মত করেই উইলকক্স আইস স্টেশনের বিজ্ঞানীরা এই নিয়ম মেনে ডাইভ দিয়েছে। এবং এরপর একজনও ফিরে আসেনি।

আবার বলছি, সময় দুপুর দুটো দশ মিনিট। নিজেদের বাতাস ব্যবহার করছি। এবার বেরুব ডাইভিং বেল থেকে।

হাঁটবার ফাঁকে একবার প্যান্টের পকেটে চাপড় দিল রানা, ওর মনে পড়ল নিনা ভিসার দিয়ে গেছে একটা লকেট ও চেইন। জিনিসটা বোধহয় হোয়াইট গোল্ডের। একবার ভাবল বের করে দেখবে, পরক্ষণে বাতিল করে দিল চিন্তাটা।

প্রতি মিনিটে একবার হলেও যোগাযোগ করছে তিশা।

কোনও দুর্ঘটনা ছাড়াই ডাইভিং বেল থেকে বেরিয়ে গেছে ওরা চারজন তিশা, ওয়াকার, মোরশেদ ও নিনা ভিসার। কয়েক মিনিট পর তিশা জানাল, ওরা পাতাল-সুড়ঙ্গের মুখ খুঁজে পেয়েছে। এখন ওটার ভিতর দিয়ে উপরের দিকে উঠছে।

ধীরে ধীরে পায়চারি করছে রানা, ডুবে গেছে গভীর চিন্তার ভিতর।

অনেক নীচের ওই গুহায় কী আছে? ওটার জন্য প্রাণ বাজি ধরেছিল ফ্রেঞ্চ কমাণ্ডোরা, সঙ্গে ইরেজার আনেনি। ভেবেছিল জিনিসটা নিয়ে চট করে সরে পড়বে। তাদের ইরেজার আছে সাগরে, ওখান থেকে মিসাইল এসে পড়বে এই স্টেশনের উপর। হাতে বড়জোর দুই ঘণ্টা। এদিকে ওর দলে আছে ঠাণ্ডা-মাথার খুনি। সে যে কখন কী করে বসবে, কেউ জানে না।

হেলমেট ইন্টারকম জ্যান্ত হয়ে উঠল: স্যর, দবির।

যোগাযোগ করতে পেরেছেন?

না, স্যর।

রানাদের সঙ্গে আনা পোর্টেবল রেডিয়ো দিয়ে বহুক্ষণ হলো ম্যাকমার্ডো স্টেশনে বার্তা পাঠাতে চাইছে হোসেন আরাফাত দবির, ভাইপার ও নাজমুল। স্টেশনের মেইন এন্ট্রান্স দিয়ে বেরিয়ে ফাঁকা জায়গায় থেমেছে ওরা। মনে আশা ছিল, এতে সিগনাল পাবে।

ইন্টারফেয়ারেন্স কেমন? জানতে চাইল রানা।

অনেক বেশি, স্যর, বিষন্ন স্বরে বলল দবির।

একমুহূর্ত কী যেন ভাবল রানা, তারপর বলল, দবির, আপনারা সিগনাল পাঠাবার চেষ্টা বাদ দিন। ভিতরে চলে আসুন। আপনি বি-ডেকে বিজ্ঞানীদের সঙ্গে কথা বলবেন। তারা আছেন কমন-রুমে। হয়তো তাদের কেউ স্টেশনের রেডিয়ো ব্যবহার করে ম্যাকমাৰ্ডোয় খবর পাঠাতে পারবেন।

জী, স্যর।

নীরব হয়ে গেল ইন্টারকম। পুলের পানির দিকে চেয়ে রইল রানা। একটু পর আবারও ওকে পেয়ে বসল দুশ্চিন্তা।

চোখের সামনে ভাসছে কেভিন হাক্সলের ক্ষত-বিক্ষত মৃতদেহ। ওকে খুন করল কে? আপাতত বিশ্বাস করতে পারবে শুধুমাত্র জনি ওয়াকার ও নিনা ভিসারকে। তারা ওর সঙ্গেই ছিল। অন্যরা যে-কেউ খুন করে থাকতে পারে।

সে-কারণে হোসেন আরাফাত দবির, ভাইপার ও নাজমুলকে কাছাকাছি রাখতে চাইছে। ওদের কেউ খুনি হয়ে থাকলে অন্য দুজনের সামনে খুন করতে পারবে না।

হঠাৎ আরেকটা চিন্তা এল, মাইকে বলল রানা, সার্জেন্ট দবির, আপনি এখনও বাইরে?

জী, স্যর।

আপনি যখন বি-ডেকে নামবেন, বিজ্ঞানীদের কাছে জিজ্ঞেস করবেন, তাঁদের কেউ আবহাওয়ার ব্যাপারে কিছু জানে কি না, বলল রানা।

.

উইলকক্স আইস স্টেশনে এ-ডেকের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে রেডিয়ো রুম। ডাইনিংরুমের ঠিক উল্টো পাশে। মাঝে বিশাল শাফট। রেডিয়ো রুমের ভিতর স্যাটালাইট টেলিকমিউনিকেশন গিয়ার ও শর্ট রেডিয়ো ট্রান্সমিটার। ঘরের দুপাশে চারটে রেডিয়ে কপোল, প্রতিটির সঙ্গে মাইক্রোফোন, একটা করে কমপিউটার স্ক্রিন, কিবোর্ড এবং কয়েকটি ফ্রিকোয়েন্সি ডায়াল।

একটা রেডিয়ো কন্সেলের সামনে বসেছে রাফায়লা ম্যাকানটায়ার, রানা ঘরে ঢুকতেই ঘাড় কাত করে চাই সে।

মেয়েটির বয়স পঁচিশ, আন্দাজ করল রানা। খুব দুশ্চিন্তা করছে। গোল মুখকে ঘিরে বাদামি চুলগুলো। বড় দুই বাদামি চোখে ভয়। কালির মত মাসকারা লেপ্টে আছে গালে! মেয়েটির পাশে দাঁড়িয়েছে হোসেন আরাফাত দবির, নাজমুল ও ভাইপার। ঘরে রাফায়লা একমাত্র বিজ্ঞানী।

হোসেন আরাফাত দবিরের দিকে চাইল রানা। আবহাওয়ার ব্যাপারে কিছুই জানে না আর কেউ?

তা নয়, স্যর, বলল দবির। আমাদের কপাল ভাল। ইনি মিস রাফায়লা ম্যাকানটায়ার, স্টেশনের রেডিয়ো বিশেষজ্ঞ ও রেসিডেন্ট মিটিয়োরোলজিস্ট।

আমি আসলে রেডিয়ো এক্সপার্ট নই, বলল মেয়েটি। বব হিউবার্ট ছিল… কিন্তু পাতাল-গুহার ভিতর হারিয়ে গেছে সে। তাকে কাজে সাহায্য করতাম। এখন আমাকেই এসব দেখতে… কথা শেষ না করে থেমে গেল সে।

ভরসা দেয়ার ভঙ্গিতে হাসল রানা। আপনাকে দিয়েই চলবে, মিস ম্যাকানটায়ার।

আমাকে রাফায়লা বলে ডাকতে পারেন।

ঠিক আছে রাফায়লা, এবার অন্য একটা আলাপ সেরে নেয়া যাক। এখন আমাদের সামনে দুটো সমস্যা। আপনি হয়তো দুটোর ব্যাপারেই সাহায্য করতে পারবেন। প্রথম: আমাদেরকে খুব দ্রুত ম্যাকমার্ডোর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। তাদেরকে খুলে বলতে হবে এখানে কী ঘটছে। তারা এখনও সেনাবাহিনী না পাঠিয়ে থাকলে, এখনই যেন পাঠায়। একটু আগে পর্যন্ত আমরা আমাদের পোর্টেবল রেডিয়ো দিয়ে ম্যাকমাৰ্ডোয় . যোগাযোগ করতে চেয়েছি, কিন্তু সম্ভব হয়নি। এখন প্রথম প্রশ্ন: আপনাদের রেডিয়ো কাজ করবে?

দুর্বল হাসি দিল রাফায়লা। আগে তো কাজ করত। মানে, এসব শুরু হওয়ার আগে। কিন্তু তারপর শুরু হলো সোলার ফ্লেয়ার। আমাদের সবার ট্রান্সমিশন নষ্ট হলো। শেষদিকে আমাদের অ্যান্টেনা ভেঙে পড়ল ঝড়ে। ওটা এখনও ঠিক করতে পারিনি আমরা।

ঠিক আছে, আমরা ওটা ঠিক করব, বলল রানা।

মহিলার অন্য একটা কথা শুনে চিন্তিত হয়ে পড়েছে। আগেও অ্যান্টার্কটিকায় এসে সোলার ফ্লেয়ারের খপ্পরে পড়েছে, কিন্তু এটা নিয়ে বেশি ভাবতে যায়নি। জিনিসটা আসলে বিকল করে দেয় ইলেকট্রোম্যাগনেটিক স্পেকট্রাম। সব রেডিয়ো কমিউনিকেশন বাধাগ্রস্ত হয়।

সোলার ফ্লেয়ার সম্পর্কে খুব বেশি জানি না, বলল রানা। একটু খুলে বলবেন?

বেশি কিছু বলার তো নেই, বলল রাফায়লা। আমরা বিজ্ঞানীরাও ওটা সম্বন্ধে খুব বেশি জানি না। সংক্ষেপে সোলার ফ্লেয়ার হচ্ছে: সূর্যের গায়ে প্রচণ্ড তাপের বিস্ফোরণ। বেশিরভাগ লোক বলে সানস্পট। ওই সানস্পট যখন দেখা দেবে, আমাদের গ্রহে এসে পড়বে বিপুল পরিমাণ আলট্রাভায়োলেট রেডিয়েশন। এতই বেশি, চিন্তা করা যায় না। এমনিতে সূর্য থেকে যে তাপ আসে, ঠিক সেভাবেই পৃথিবীর বুকে নামে এই রেডিয়েশন। বিষাক্ত করে ফেলে আয়োনোস্ফেয়ার। তৈরি হয় একটা পুরু চাদর, ওটা ভেদ করে বেরুতে পারে না ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ওয়েভ। বিকল হয় রেডিয়ো সিগনাল। উপর থেকে সিগনাল পাঠাতে পারে স্যাটালাইটও।

হঠাৎ রাফায়লার চোখ পড়েছে একটি কমপিউটারের স্ক্রিনের উপর। ক্লান্ত স্বরে বলল, আসলে, আমাদের কাছে ওয়েদারমনিটরিং গিয়ার আছে। একমিনিট সময় দিলে দেখাতে পারব সোলার ফ্লেয়ার কেমন দেখতে।

বেশ, বলল রানা।

পাশের কমপিউটার চালু করল রাফায়লা। ফ্যানের গুঞ্জন শুরু হয়েছে। কিছুক্ষণ পর স্ক্রিনে প্রোগ্রামগুলোর আইকন, দেখা গেল। একটা প্রোগ্রামের উপর ক্লিক করল রাফায়লা। কয়েক সেকেণ্ড পর ঝড়াৎ করে স্ক্রিনে দেখা দিল দক্ষিণ-পুব অ্যান্টার্কটিকার স্যাটালাইট ম্যাপ। তার ভিতর বেশ কয়েকটি রঙের খেলা। রানা খেয়াল করল, ওটা ব্যারোমেট্রিক ওয়েদার ম্যাপ। সারা দিন ধরে এই জিনিস দেখায় বিবিসি বা সিএনএন।

এটা অ্যান্টার্কটিকার পুর্বের ওয়েদার সিস্টেম, স্ক্রিনের কোণে তারিখ দেখে নিল রাফায়লা। দুদিন আগের। রানার দিকে ঘুরে চাইল। সোলার ফ্লেয়ার শুরু হওয়ার আগে এটা পাই। এরপর ঢাকা পড়ে ওয়েদার স্যাটালাইট।

মাউসে ক্লিক করল রাফায়লা। আরেকটা স্ক্রিন ভেসে উঠল। ওহ্, একমিনিট। পরে আরেকটা পাওয়া গেছে। এটাই এখন নতুন।

পর্দার অর্ধেক জুড়ে ম্যাপ, তার ভিতর হলদে-সাদা বিশাল বিস্ফোরণ। বামের বেশিরভাগ স্ক্রিন জুড়ে অ্যাটমোস্ফিয়ার ডিসটার্বেন্স, প্রায় ঢাকা পড়েছে অ্যান্টার্কটিকার উপকূল।

প্রকাণ্ড সোলার ফ্লেয়ার, ভাবল রানা।

এটা আমাদের সোলার ফ্লেয়ার, মেজর, আবারও রানার দিকে চাইল রাফায়লা। এই ছবি তোলার পর আরও পুবে সরে এসেছে, ঢেকে দিয়েছে আমাদেরকে।

বিস্ফোরণের ভিতর কয়েকটা রঙের খেলা। কোথাও কোথাও লাল ও কমলা রং, কয়েক জায়গায় কালো দেখা গেল।

সাধারণত সূর্যে বিস্ফোরণ হলে পৃথিবীর নির্দিষ্ট জায়গায় ফ্লেয়ার হয়, বলল রাফায়লা। হয়তো একটা স্টেশনে চলছে রেডিয়ো ব্ল্যাকআউট, কিন্তু মাত্র দুই শ মাইল দূরের স্টেশনে কোনও সমস্যা নেই।

স্ক্রিনের দিকে চেয়ে আছে রানা। এবারেরটা কতদিন ধরে চলবে বলে মনে করছেন?

শ্রাগ করল মেয়েটি। হয়তো একদিন, বা দুই দিন। কতক্ষণ ধরে সূর্য থেকে রেডিয়েশন আসবে, তার উপর নির্ভর করে। বড় সানস্পট কয়েক দিন ধরেও চলে।

আবারও কমপিউটারের স্ক্রিনে চাইল রাফায়লা। ডুবে গেছে চিন্তার ভিতর। নীচের ঠোঁট কামড়ে আঁচ করতে চাইছে কী যেন। তারপর দ্বিধান্বিত স্বরে বলল, আসলে জানি না। এবারেরটা অনেক বড়। মনে হয়, আরও পাঁচ দিন ধরে চলবে।

মেয়েটি চুপ হয়ে যাওয়ায় নীরবতা নেমেছে ঘরে। সবাই টের পেল, রেডিয়ো সুবিধা পাবে না।

রানার পিছন থেকে বলে উঠল নাজমুল, পা…আঁচ দিন?

পিছনে আছে বলে দেখতে পেল না, ভুরু কুঁচকে গেছে তার স্যরের। রাফায়লা, আপনি বলেছেন আয়োনোস্ফেয়ারে নানা বিঘ্ন তৈরি করে ফ্লেয়ার, ঠিক?

হ্যাঁ।

আর আয়োনোস্ফেয়ার হচ্ছে…।

বড় একটা স্তর, মেজর, এটা পৃথিবীর পরিবেশে পঞ্চাশ থেকে শুরু করে উপরের আড়াই শ মাইল জুড়ে ছড়িয়ে থাকে, বলল রাফায়লা। আয়োনোস্কেয়ার বলা হয় কারণ, বাতাসে মিশে থাকে আয়োনাইযড মলিকিউল।

বুঝলাম, বলল রানা। তার মানে, সূর্যে বিস্ফোরণের ফলে পৃথিবীতে এসে পড়ছে বিপুল শক্তি, তখন আয়োনোস্কেয়ারে নানা সমস্যা দেখা দিচ্ছে। আমাদের অনেক উপরে একটা বর্ম তৈরি হচ্ছে, আর তাই রেডিয়ো সিগনাল পাঠাতে পারছি না। ঠিক বলেছি?

হ্যাঁ।

আবার স্ক্রিনের দিকে চাইল রানা। হলদে-সাদা বিস্ফোরণের ভিতর কালো দাগগুলোকে দেখছে। সাদা-হলুদের মাঝে ওরকম বেশ বড় একটা কালো দাগ, তার উপর চোখ ওর। এটা কি ইউনিফর্ম? জানতে চাইল।

ইউনিফর্ম? চোখ পিটপিট করে চাইল রাফায়লা। বুঝতে পারেনি।

ওই রেডিয়েশনের বর্ম কি সব জায়গায় সমান শক্তিশালী? আসলে জানতে চাইছি, এর কোনও দুর্বল জায়গা আছে? এমন কোনও জায়গা, যেখানে বর্ম ভেদ করা যায়? যেমন ধরুন, ওই কালো দাগগুলো, ওদিক দিয়ে রেডিয়ো সিগনাল পাঠাতে পারব?

এটা সম্ভব, বলল রাফায়লা ম্যাকানটায়ার। খুব জটিল কাজ, কিন্তু অসম্ভব নয়। কিন্তু ঠিক স্টেশনের উপরে থাকতে হবে ফ্লেয়ারের ফাটল।

বেশ, বলল রানা, এবার বলুন, আপনি হিসাব কষে বের করতে পারবেন কখন এই স্টেশনের উপর কালো দাগ আসবে? যেমন ধরুন, ওদিকের ওই বড় কালো গর্তটা।

হলদে-সাদা বিস্ফোরণের মাঝে কালো গর্ত দেখিয়ে দিল ও।

মনিটরের দিকে চেয়ে ভাবতে শুরু করেছে রাফায়লা। দুমিনিট পর বলল, একটা উপায় আছে। যদি ফ্লেয়ারের আগের কয়েকটা ইমেজ বের করি, হিসাব কষে বের করতে পারব ফ্লেয়ার কী গতিতে এই মহাদেশের উপর দিয়ে যাচ্ছে। ওটার গতি ও লক্ষ্য যদি বের করে নিই, মোটামুটি একটা কোর্স বুঝতে পারব।

তা হলে কাজটা করুন, বলল রানা। কিছু পেলে আমাকে জানাবেন। আমাদের জানতে হবে স্টেশনের উপর কখন আসবে কালো গর্ত। খুব জরুরি ম্যাকমার্ডো স্টেশনে মেসেজ পাঠানো।

তার আগে অ্যান্টেনা ঠিক করতে হবে, নইলে…।

ওই কাজে হাত দিচ্ছি, বলল রানা, আপনি ফ্লেয়ারের মাঝে গর্ত খুঁজে বের করুন। আমরা অ্যান্টেনা ঠিক করছি।

০১.

ঠিক আছে! এইবার তুইল্লা ধরু! চেঁচিয়ে উঠল সার্জেন্ট হোসেন আরাফাত দবির।

স্ট্যাবিলাইয়িং কেবল দিয়ে উইলকক্স আইস স্টেশনের তুবড়ে যাওয়া রেডিয়ো অ্যান্টেনা তুলে আনতে চেষ্টা করছে নাজমুল ও ভাইপার। অ্যান্টেনা বলতে তিরিশ ফুট উঁচু একটা কালো খুঁটি। মাথার উপর দপদপ করছে সবুজ বাতি। আস্তে আস্তে উপরের। দিকে উঠছে খুঁটি। কয়েক সেকেণ্ড পর পর জ্বলে উঠছে সবুজ বাতি, সে আলোয় ভূতের মত লাগছে তিনজনকে।

আর কতক্ষণ লাগবে? নীচে দাঁড়িয়ে ঝোড়ো হাওয়ার উপর দিয়ে জানতে চাইল রানা।

তুলে ধরতে বেশিক্ষণ না, স্যর, কিন্তু এটা হচ্ছে সবচেয়ে সোজা কাজ, জানাল দবির। আসল কঠিন কাজ রেডিয়োর সবকটা তার ঠিকভাবে লাগানো। বিদ্যুৎ চালু হয়ে গেছে। কিন্তু আরও পনেরো-বিশটা তার ঝালাই দিতে হবে।

আন্দাজ কতক্ষণ?

তিরিশ মিনিট, স্যর।

কাজ করতে থাকুন।

র‍্যাম্প বেয়ে আবারও স্টেশনের সুড়ঙ্গের দিকে নামতে শুরু করেছে রানা। ভিতরে ঢুকবে দুটো কারণে। নিশাত সুলতানাকে দেখে আসা উচিত। তা ছাড়া, দেখা করতে হবে রাফায়লা ম্যাকানটায়ারের সঙ্গে।

এ-ডেকের ক্যাটওয়াকে ওর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল মেয়েটির। রানা বাইরে গিয়েছিল অন্যদের কাজ দেখতে। আর এ সময়ে রেডিয়ো রুমে কমপিউটারের মনিটরে ওয়েদার ম্যাপ দেখেছে রাফায়লা। খুঁজে বের করতে চেয়েছে সোলার ফ্লেয়ারের দুর্বলতা।

কপাল খুলল? জানতে চাইল রানা।

নির্ভর করে আপনি কী আশা করছেন, বলল রাফায়লা। রেডিয়োতে কখন যোগাযোগ করতে চান?

যত দ্রুত সম্ভব।

সেক্ষেত্রে ভাল সংবাদ নেই আমার কাছে, বলল রাফায়লা। আমার হিসাব অনুযায়ী, এই স্টেশনের উপর দিয়ে সোলার ফ্লেয়ারের একটা গর্ত পেরুবে পঁয়ষট্টি মিনিট পর।

পঁয়ষট্টি মিনিট, বিড়বিড় করল রানা, পরক্ষণে জানতে চাইল, ওটা কতক্ষণ চলবে?

কাঁধ ঝাঁকাল রাফায়লা। বড়জোর দশ বা পনেরো মিনিট। এরই ভিতর সিগনাল পাঠিয়ে দেয়া কঠিন হবে না।

আরও অনেক আগেই রেডিয়ো ব্যবহার করতে পারলে ভাল হতো, খুব জরুরি হয়ে উঠেছে ম্যাকমার্ডোর সঙ্গে যোগাযোগ করা। তাদেরকে জানাতে হবে, অ্যান্টার্কটিকার কাছে হাজির হয়েছে ফ্রেঞ্চ রণতরী, এক ব্যাটারি মিসাইল তাক করেছে উইলকক্স আইস স্টেশনের উপর।

রানা জানতে চাইল, এরপর স্টেশনের আকাশে আবারও কোনও গর্ত আসবে না?

মৃদু হাসল রাফায়লা। জানতাম আপনি জানতে চাইবেন। তাই আগেই জেনে নিয়েছি। প্রথমটা পেরিয়ে গেলে আরও দুটো আসবে। কিন্তু সেজন্য অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে। …এখন দুপুর দুটো ছেচল্লিশ মিনিট। তার মানে, প্রথম সুযোগ আসবে পঁয়ষট্টি মিনিট পর। এরপর আরও অনেক পরে আসবে অন্য দুই সুযোগ। দ্বিতীয়টা আজ সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার সময়। তারপর আবারও একটা সুযোগ মিলবে রাত দশটায়।

চাপা শ্বাস ফেলল রানা। প্রথমবারে ম্যাকমার্ডোর সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পারলে এই স্টেশন থাকবে না।

গুড ওঅর্ক, রাফায়লা, বলল। অনেক ধন্যবাদ। আরেকটা কাজ করে দিলে খুশি হব–আমার লোক যখন অ্যান্টেনা ঠিক করবে, তখন রেডিয়ো রুমে থাকলে ভাল হয়। কোনও মেসেজ আসতে পারে।

মৃদু মাথা দোলাল মেয়েটি। কোনও অসুবিধে নেই।

থ্যাঙ্কস, বলল রানা। টের পেল, গত কয়েক ঘণ্টার লড়াইখুন-গোলাগুলি দেখে হাঁপিয়ে গেছে মেয়েটি। মন সরিয়ে নেয়ার জন্য কোনও কাজ খুঁজছিল।

রাফায়লার দিকে চেয়ে মৃদু হাসল রানা, রাং-ল্যাডারের দিকে পা বাড়াল। তিন মিনিট পর নেমে এল ই-ডেকে। গুদাম-ঘরের দিকে চলেছে। টানেলের মাঝে পৌঁছে নির্দিষ্ট দূরজার সামনে থামল, এক সেকেণ্ড পর নিঃশব্দে খুলল কবাট।

মেঝেতে বসে আছে নিশাত সুলতানা, পিঠ ঠেকিয়ে রেখেছে ররফ-দেয়ালে। চোখ দুটো বোজা। অবশ্য রানার পায়ের অস্পষ্ট আওয়াজ পেয়েছে। চোখ মেলল না। জানতে চাইল: কে?

আস্তে করে নিশাতের সামনে বসল রানা। এখন কেমন লাগছে, আপা?

চোখ মেলল না নিশাত। মেথাডনের কাজ শেষ।

ছিড়ে যাওয়া হাঁটুর দিকে চাইল রানা। এবড়োখেবড়ো হাড় বেরিয়ে ছিল, পরে ভালভাবে ব্যাণ্ডেজ করে দিয়েছে হোসেন আরাফাত দবির। অবশ্য, এখন রক্তে চুপচুপে ভেজা ব্যাণ্ডেজ।

মনে হয় না আর কখনও ম্যারাডোনার মত ফুটবল খেলতে পারব, বলল নিশাত।

ওঁর মুখের দিকে চেয়ে আছে রানা। বুঝতে পারছে, কতটা কষ্ট সহ্য করছে বেচারি। 

চোখ মেলল নিশাত। ওই হারামজাদা মাছ আমার পা নিয়ে গেছে, রাগ নিয়ে বলল।

পরে দেখেছি।

ঠেকানোর কোনও উপায় ছিল না, নাক দিয়ে ঘোৎ আওয়াজ করল নিশাত। চুপ করে চেয়ে আছে রানা। হাসবার চেষ্টা করল। নিশাত। ভাই, আপনি কি জানেন আপনি কত সুন্দর?

মেথাডন ঠিকই কাজ করছে, মন্তব্য করল রানা।

ভাল মানুষ চিনতে আমার ভুল হয় না, দেয়ালে আরও ঠেস দিয়ে বসল নিশাত। ওই চোখদুটো দেখেই প্রেমে পড়ে মেয়েরা। আর সব গুণ তো আছেই।

চুপ করে আছে রানা।

ঠিক আছে, ফালতু কথা বাদই দিই, বলল নিশাত। কী কাজে এসেছেন? শুধু আমাকে দেখে যাওয়ার জন্য?

না।

তা হলে কী?

কেভিন হাক্সলে মারা গেছে।

কী? চমকে গেল নিশাত। ওরা তো বলেছিল ছেলেটা বাঁচবে।

ওকে খুন করা হয়েছে।

ফ্রেঞ্চরা?

না, পরে। অনেক পরে। ততক্ষণে ফ্রেঞ্চরা মারা পড়েছে।

কোনও বিজ্ঞানী?

এখনও জানি না, বলল রানা। এ থেকে কার উদ্দেশ্য পূরণ হবে তা-ও জানি না।

নীরবতা নামল দুজনের মাঝে।

একটু পর বলল নিশাত, যে বিজ্ঞানীকে আটকে রাখা হয়েছে? ওই যে বাঙালি বিজ্ঞানী? কী যেন নাম? …হ্যাঁ, রাশেদ হাবিব।

চমকে গেছে রানা। নানা কাজে ভুলেই গিয়েছিল। বাঙালি এক বিজ্ঞানী খুন করেছে এক আমেরিকান বিজ্ঞানীকে। ওরা স্টেশনে আসবার একটু পর নিনা ভিসার তার কথা বলেছিল। রাশেদ হাবিবকে বি-ডেকে তার ঘরে আটকে রাখা হয়েছে। কিন্তু সত্যি লোকটা ঘরে আছে কি না, পরে আর পরখ করে দেখেনি রানা। সে যদি ছাড়া পেয়ে থাকে, তা হলে হয়তো সে-ই…

দিনে দিনে গাধা হচ্ছি, বলল রানা। হেলমেট মাইকে বলল, আরাফাত, ভাইপার, নাজমুল, আপনারা বাইরে?

হ্যাঁ, বাইরে, জবাব দিল সার্জেন্ট ভাইপার।

আপনাদের একজনকে বি-ডেকে যেতে হবে, দেখবেন ওই বন্দি বিজ্ঞানী এখনও তার ঘরে আছে কি না।

ঠিক আছে, যাচ্ছি, বলল ভাইপার।

হাসতে চাইল নিশাত। স্যর, আপনার উপর খুব কাজের চাপ পড়ছে।

আপন মনে কী যেন ভাবতে শুরু করেছে রানা।

কী ভাবছেন, স্যর? জানতে চাইল নিশাত।

মুখ নিচু করে নিয়েছে রানা, আস্তে করে মাথা নাড়ল।

আমার আগেই বোঝা উচিত ছিল ওরা সৈনিক, আপা।

কী যে বলেন, স্যর।

হ্যাঁ, আগেই ওদেরকে বন্দি করা উচিত ছিল।

কিছুই না জেনে বন্দি করা কি ঠিক হতো, স্যর?

আমাদের কয়েকজনকে হারিয়েছি।

কিন্তু জিতেছি আমরাই।

আমাদের কপাল ভাল যে মরিনি, বলল রানা, ওরা ক্যাটওয়াকে আমাদের পাঁচজনকে পেয়ে গেল, সবাই মরত, কিন্তু তখন ক্যাটওয়াক ধসে পড়ল পুলের ভিতর। তারপর ভাবুন ড্রিলিং রুমে কী ঘটল। ওদের পরিকল্পনা ছিল নিখুঁত। নাজমুল যদি না বুঝত, আমাদেরকে সহজেই মেরে ফেলা হতো। ওরা সবসময়েই এগিয়ে ছিল আমাদের চেয়ে; পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়েছে, অথচ পরিকল্পনা বলতে আমার কিছুই ছিল না।

শুনুন, স্যর, একটু জোর দিয়ে বলল নিশাত, একটা কথা শুনতে চান?

কী, আপা?

স্যর, আপনি কি জানেন, ছয় মাস আগে আর্মি থেকে আমাকে স্যাণ্ডহার্সটে কমান্ডো ট্রেইনিং নিতে পাঠাতে চেয়েছিল?

না, জানি না।

সেই চিঠি এখনও আমার কাছে আছে, বলল নিশাত। আর্মি চিফের সই ছিল ওটাতে। আমি সেই চিঠি পড়ে কী করেছি আপনি জানেন, স্যর?

কী করেছেন?

চিফকে ধন্যবাদ জানিয়ে চিঠি পাঠিয়েছি, তাতে লিখেছি: এত বড় সুযোগ দেয়ার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। কিন্তু আমি বর্তমান পোস্টে সন্তুষ্ট। আমি মেজর মাসুদ রানার সঙ্গে দ্য মার্ভেল অভ গ্রিস জাহাজের মিশনে কাজ করতে চাই।

অবাক হয়ে গেছে রানা। নিশাত সুলতানা এ-কাজ করবে ভাবতে পারেনি।

রানার চোখে নিস্পলক চাইল নিশাত। কারণটা জানতে চান, স্যর? আপনি একজন সত্যিকারের নেতা। বুদ্ধিমান, সাহসী, তার চেয়ে বড় কথা, সত্যিকারের মানুষ। মানুষের মধ্যে এ গুণ খুব কমই পাওয়া যায়। …আর তাই আপনার সঙ্গে থাকতে চেয়েছি। কয়েকজন বড় অফিসারের সঙ্গেও কাজ করেছি, কিন্তু আপনার মত কাউকে পাইনি। সেই যে গরিলার দ্বীপে গিয়েছিলাম আপনার সঙ্গে, তার পর থেকে আপনার সঙ্গে কাজ করার সুযোগ খুঁজেছি। এরপর আপনার মার্ভেলে যোগ দেয়ার পর বুঝলাম সত্যি সত্যিই আপনি কেমন মানুষ। এরপর থেকে আপনার পাশে দাঁড়িয়ে জীবনের ঝুঁকি নিতে দ্বিধা করিনি। যেমন এখন, আপনি আমার কথা ভেবে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন। …আসলে বেশিরভাগ সামরিক অফিসার চিন্তা করেন শুধু নিজেদের মহৎ কীর্তি ও পদোন্নতি নিয়ে। তাদের কিছুই যায় আসে না অধীনস্থ অফিসার বা সৈনিক মরল, না বাঁচল। এখানেই আপনি আলাদা, স্যর, আপনি সবার কথা ভাবেন, তাদের আপদে বিপদে হাজির থাকেন। আর সেটা আমাদের সবার মন ছুঁয়ে যায়।

অস্বস্তি বোধ করছে রানা। বিব্রত ভঙ্গিতে হাত তুলল, আপা, প্লিজ! লজ্জা দেবেন না। এসব কথা…।

বলছি, কারণ আর কখনও বলার সুযোগ না-ও পেতে পারি। …আপনি আসলে নিজের উপর রেগে আছেন, কারণটা হচ্ছে: আমরা মরতে বসেছিলাম। কিন্তু মনে রাখবেন, স্যর, আপনি দুর্দান্ত কৌশলী ও বুদ্ধিমান। তার চেয়ে বড় কথা, আপনি সত্যিকারের একজন মানুষ। কাজেই নিজের উপর বিশ্বাস রাখুন। যে ধরনের বিপদই আসুক না কেন, আপনি উতরে যাবেন। আমরা আপনার পাশে থাকব।

রানা চুপ করে চেয়ে রইল নিশাতের চোখে। কয়েক সেকেণ্ড পর বলল, আমার সাধ্যমত দায়িত্ব পালনের চেষ্টা করব, আপা।

একটু বেসুরো স্বরে জানতে চাইল নিশাত, রাফায়লা। ম্যাকানটায়ার নতুন কিছু জানাতে পারল, স্যর?

তেমন কিছু না। উঠে দাঁড়াল রানা। ঠিক আছে, যাই গিয়ে দেখি, রাশেদ হাবিব তার ঘরে আছে কি না। দরজার কাছে চলে গিয়েও আবার ঘুরে চাইল। নরম স্বরে বলল, আপা, আপনি কখনও শুনেছেন যে আর্মি ইউনিটের ভেতর গুপ্তচর ঢুকিয়ে দেয় সরকার?

ঠিক কী বোঝাতে চাইছেন, স্যর?

এক মুহূর্ত দ্বিধা করল রানা, তারপর বলল, আমি যখন কেভিন হাক্সলের লাশ পেলাম, তখন একজনের একটা কথা মনে পড়ল। সে ছিল আমেরিকান মেরিন কর্পসের একজন মেজর, আমার খুব ভাল বন্ধু। মারা যাওয়ার আগে বলেছিল, ওর ইউনিটের ভিতর বিশ্বাসঘাতক ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে।

চুপ করে চেয়ে আছে নিশাত, আস্তে করে ঠোঁট চাটল। কী যেন ভাবছে। কয়েক মুহূর্ত পর বলল, শুনেছি অনেক দেশের আর্মিতেই এই কাজ করা হয়।

কী শুনেছেন, আপা?

এদের কাজ এলিমিনেট করা। সরকারের উঁচু পদের কেউ যদি কিছু গোপন রাখতে চায়, এদেরকে নির্দেশ দিলেই এরা খুন করে সহযোদ্ধাদের সবাইকে।

নিরাপত্তার স্বার্থে যেকোনও দেশের আর্মির ভিতর সরকারের নিজস্ব লোক থাকতেই পারে, বলল রানা। তারা ডিপ-কভার এজেন্ট, তাদের কাজই প্রতিরক্ষা ইউনিটের নাড়ির ভিতর ঢুকে যাওয়া। সবার উপর চোখ রাখা।

মাথা ঝাঁকাল নিশাত।

সেই যে একবার তিন মাসের জন্যে ইউ.এস. মেরিনদের রেমালপাগো রোহো, বা আর-সেভেন ট্রেইনিং এক্সারসাইজে গিয়েছিলাম আপনার সঙ্গে, ওখানেই প্রশিক্ষণের সময় কানাঘুষা শুনেছি মেরিন কর্পসেও আছে ডিপ কাভার এজেন্ট অফিসাররা বলেছে, তাদের ভিতর ডিপ-কভার এজেন্ট ঢুকিয়ে রেখেছে সিআইএ। কেউ কেউ বলেছে, তাদের উপর নজর রাখছে ন্যাশনাল রেকনিসেন্স অফিস ও জয়েন্ট চিফস্ অভ স্টাফদের সাবকমিটি। ওটার নাম নাকি ইন্টেলিজেন্স কনভার্জেন্স গ্রুপ। এদের কাজ আমেরিকান মিলিটারি ইউনিটগুলোর ভেতর ইনফিলট্রেট করা।

এক অফিসার আমাকে বলেছিল, আইসিজি আসলে কয়েকটি ইন্টেলিজেন্স এজেন্সির আল্টা-সিক্রেট কমিটি। ঠিক জায়গায় নিজ লোক রাখে তারা। কোনও ইউনিট মিশনে গিয়ে যা পাওয়ার কথা নয় এমন কিছু পেলে যেমন ধরুন স্পেসশিপ বা এলিয়েন কিছু বা মূল্যবান ধাতুসেক্ষেত্রে আইসিজির লোকের কাজ হয় গ্রুপের সৈনিক আর অফিসারদেরকে সবাইকে মেরে ফেলা, যাতে খবরটা লিক-আউট না হয়, এরা কাউকে কিছু বলতে না পারে।

আস্তে করে শ্বাস ফেলল রানা। এই একই কথা ও নিজেও শুনেছে। সাধারণ ইউনিটের ভিতর ভরে দেয়া হয় ডাবল-এজেন্ট। রবিন কার্লটনের কথা আবারও মনে পড়ে গেছে ওর। মারা যাওয়ার আগে হেলমেট মাইকে বলেছিল সে আমার দলের ভিতর বিশ্বাসঘাতক ঢুকিয়ে দিয়েছে ওরা!

ওটা কোনও ফালতু কথা ছিল না। রানার সঙ্গে আসা বাঙালি সৈনিক বা অফিসারদের বিষয়ে এভাবে ভাবতে চাইছে না। ওদের কারও সঙ্গে আমেরিকার আইসিজির যোগাযোগ থাকবারও কথা নয়। কিন্তু বিজ্ঞানী বা মেরিনদের ভিতর আমেরিকান সরকারের লোক থাকতেই পারে।

ঠিক আছে, আপা, পরে আবার আপনাকে দেখে যাব, বলল রানা।

কাজ তো গুছিয়ে আনতেই হবে, বলল নিশাত। কিন্তু একটু অন্যদিকেও মন দেয়া দরকার। যেমন, কোনও মেয়ে হয়তো পাগলের মত ভালবাসে আপনাকে, সেদিকটাও…

ভুরু উঁচু করল রানা। তাই নাকি?

হ্যাঁ, স্যর। সত্যি ভালবেসে ফেলেছে।

মাথা নেড়ে হাসল রানা। আপনার মেথাডন ঠিকই কাজ করছে, আপা। চমৎকার গল্প বানাচ্ছেন।

বিশ্বাস করুন বা না করুন, এটা বাস্তব সত্য। ঠিক আছে, স্যর, পরে কথা হবে। দেয়ালে ভাল করে ঠেস দিয়ে বসল নিশাত।

গুদাম-ঘর থেকে বেরিয়ে গেল রানা। আবারও চোখ বুজল নিশাত, নরম স্বরে বলল, জানেন, স্যর, কার চোখ পড়েছে আপনার উপর? যদি বুঝতেন কীভাবে চেয়ে থাকে ওর দুই চোখ! পুল ডেকে বেরিয়ে এসেছে রানা, ওর মনে হচ্ছে পরিত্যক্ত হয়েছে গোটা স্টেশন। পুলের মাঝে নেমে গেছে ডাইভিং বেলের অনড় কেবল।

স্যর, তিশা বলছি, ইয়ারপিসে শুনতে পেল রানা। আপনি কি এখনও উপরে?

এখন পুল ডেকে। তুমি কোথায়?

পঞ্চান্ন মিনিট হলো ডাইভের। বরফের সুড়ঙ্গ বেয়ে উঠছি।

কোনও সমস্যা? এখনও না। …একমিনিট। আরে, এ কে?

কী দেখেছ, তিশা? সতর্ক হয়ে উঠেছে রানা।

না, কিছু নয়, স্যর, একটু লজ্জিত কণ্ঠ তিশার। কোনও সমস্যা নেই। আপনার সঙ্গে ছোট্ট মেয়েটা আছে যে, ওর বন্ধু এখানে নেমে এসেছে।

কার কথা বলছ? পরক্ষণে বুঝতে পারল রানা।

ওই যে আপনার বন্ধু সিল লিলি। এইমাত্র টানেলে ঢুকেছে। আমাদের পিছু নিয়ে।

মনের চোখে রানা দেখল, ডাইভারদের সঙ্গে বরফের সুড়ঙ্গ ধরে খুশি মনে চলেছে লিলি, অবাক হয়ে দেখছে, মেকানিকাল ব্রিদিং অ্যাপারেটাস পরা লোকগুলো কী কষ্টই না করছে। ওর তো কোনও সমস্যাই হচ্ছে না!

তোমাদেরকে আর কতটা উপরে উঠতে হবে? জানতে চাইল রানা।

বলা কঠিন। খুব সাবধানে উঠতে হচ্ছে। গতি কম। আন্দাজ পাঁচ মিনিট পর উপরে পৌঁছব।

আমার সঙ্গে যোগাযোগ রেখো, বলল রানা। আরেকটা কথা, খুব সতর্ক থাকবে।

জী, স্যর। আউট তিশা।

ক্লিক আওয়াজ তুলে কেটে গেল রেডিয়ো লিঙ্ক। পুলের দিকে চেয়ে রইল রানা। পানি এখনও লালচে। আপাতত একদম স্থির, কাচের মত। পুলের সামনে গিয়ে দাঁড়াবে বলে এক পা এগোলো রানা, পরক্ষণে থেমে গেল। পায়ের নীচে মুড়মুড় করে কী যেন ভেঙেছে।

মাথা নিচু করে বুটের দিকে চাইল রানা। পা সরিয়ে নিতেই দেখা গেল ধাতব ডেকে গুড়ো হয়ে গেছে কাঁচ। জিনিসটা সাদা, ফ্রস্টেড গ্লাস।

ভুরু কুঁচকে গেছে রানার। ঠিক তখন হঠাৎ করেই হেলমেট ইন্টারকমে একটা কণ্ঠ শুনল।

মেজর, আমি ভাইপার। বি-ডেকে। এইমাত্র রাশেদ হাবিবের রুম থেকে ফিরেছি। দরজায় চাপড় দিয়ে সাড়া পাইনি। তারপর দরজা ভেঙে ভিতরে ঢুকে দেখি কেউ নেই। রাশেদ হাবিব উধাও। আবারও বলছি, হাবিব তার ঘরে নেই।

রানার মেরুদণ্ড বেয়ে নেমে গেল শিরশিরে অনুভূতি।

লোকটা কোথায় যেতে পারে?

ঘুরে বেড়াচ্ছে স্টেশন জুড়ে!

সবাইকে একত্র করে খুঁজে বের করতে হবে লোকটাকে। ঘুরে দাঁড়াবে, তার আগে হালকা মৃদু শিসের আওয়াজ পেল। বাতাস চিরে কী যেন আসছে!

তারপর হঠাৎ ঠক করে আওয়াজ হলো। তীক্ষ্ণ ব্যথা পেল রানা, ভীষণ জ্বলছে ঘাড়ের পিছনে। এক সেকেণ্ডের দশ ভাগ সময়ে বুঝল, ঘাড়ে এসে লেগেছে তীব্র গতির কিছু!

ভাঁজ হয়ে যেতে চাইল দুই হাঁটু, নিজেকে বড় দুর্বল মনে হলো রানার। ডানহাতটা চলে গেল ঘাড়ের পিছনে, হাত ফিরিয়ে এনে চোখের সামনে ধরল।

ওর হাতে তাজা রক্ত!

খুব ধীরে চোখের সামনে নামছে কালো চাদর। জানে না, কখন হাঁটু গেড়ে বসে পড়েছে। বরফ-ঠাণ্ডা প্ল্যাটফর্মের উপর ঠাস করে পড়ল রানার কপাল। খুব দুশ্চিন্তা হলো–গুলি লেগেছে ঘাড়ে!

তারপর হঠাৎ করেই ঝাপসা হয়ে হারিয়ে গেল সব দুশ্চিন্তা, চারপাশে নেমে এল গাঢ় অন্ধকার।

থেমে গেল ওর হৃৎপিণ্ড! মারা গেছে কিংবদন্তির নায়ক, মেজর জেনারেল রাহাত খানের অতি আদরের প্রিয় শিষ্য, ব্রিগেডিয়ার সোহেল আহমেদের প্রাণের বন্ধু মাসুদ রানা।

২১.

খাড়া বরফ-টানেল ধরে উঠছে তিশা করিম।

কোথাও আওয়াজ নেই। বড় শান্তিময় পরিবেশ। চারপাশে শুধু আকাশের মত সাগরের নীল জল।

সাবলীলভাবে সাঁতরে চলেছে তিশা, লো-অডিবিলিটি ব্রিদিং গিয়ারের কারণে সামান্য হিসহিস আওয়াজ, এ ছাড়া সব চুপচাপ। সঙ্গের তিন ডাইভার ও লিলি ছাড়া কোথাও কিছু নড়ছে না। কোনও শিসের আওয়াজ নেই, গান গাইছে না কোনও তিমি।

বড়সড় ফুল-ফেস ডাইভিং মাস্কের ভিতর দিয়ে চেয়ে আছে তিশা। ওর হ্যালোজেন ডাইভ ল্যান্টার্ন আলো ফেলেছে বরফের দেয়ালে, সব লাগছে নীল ও সাদা।

অন্য ডাইভাররা জনি ওয়াকার, গোলাম মোরশেদ ও বিজ্ঞানী মহিলা নিনা ভিসার ওর পাশে নিঃশব্দে সাঁতরে চলেছে।

একটু পর হঠাৎ করেই অনেক চওড়া হয়ে গেল সুড়ঙ্গ, উপরে উঠবার সময় দুপাশের দেয়ালে বেশ কয়েকটা গোল গর্ত দেখল তিশা।

গর্তগুলো কীসের বুঝতে পারল না। একেকটা ব্যাসে দশ ফুটের মত হবে। মস্ত কোনও ফুটবল ঢুকিয়ে দেয়া যাবে তার ভিতর দিয়ে। মোটমাট আটটা গর্ত গুনল তিশা, ভাবতে শুরু করেছে কী ধরনের প্রাণী ওগুলো তৈরি করেছে।

কয়েক মুহূর্ত পর হঠাৎ করেই গর্তের কথা একেবারে ভুলে গেল ও। অনেক বেশি মনোেযোগ দিতে হয়েছে ঢের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে।

উপরে আর কোনও সুড়ঙ্গ নেই!

প্রায় উঠে এসেছে ওরা গুহার ভিতর!

ইন্টারকমে বলল তিশা, স্যর, তিশা বলছি। ওদিক থেকে কোনও জবাব নেই। স্যর, আপনি কি আমার কথা শুনছেন?

না, কোনও সাড়া নেই।

এমনটা হওয়ার কথা নয়, ভাবল তিশা। স্যর জবাব দিলেন না কেন? মাত্র কয়েক মিনিট আগে যোগাযোগ করেছে ও।

হঠাৎ ইয়ারপিসে খড়খড় করে উঠল একটা কণ্ঠ। সে মাসুদ রানার কণ্ঠ নয়।

লেফটেন্যান্ট তিশা, আমি কর্পোরাল নাজমুল। তিশার মনে, হলো শোঁ-শোঁ ঝড়ের ভিতর কথা বলছে নাজমুল। বোধহয় স্টেশনের বাইরে সে। আপনার কথা শুনতে পেলাম। কী হয়েছে আপনার?

আমরা পানির উপরে উঠে আসছি, বলল তিশা। স্যরের কী হয়েছে? উনি জবাব দিলেন না, বিচলিত হয়ে জানতে চাইল ও।

উনি স্টেশনের কোথাও আছেন। বোধহয় আপার ওখানে। হয়তো কোনও কারণে হেলমেট খুলেছেন।

ওঁকে খুঁজে বের করো, নাজমুল। ওঁকে না পেলে আমাকে জানাবে। আমরা গুহার কাছে পৌঁছে গেছি।

যাচ্ছি, লেফটেন্যান্ট।

রেডিয়ো বন্ধ করে দিল তিশা, আবার উঠতে শুরু করেছে উপরের দিকে।

পানির নীচ থেকে উপরের দিকে চাইলে কেমন যেন অদ্ভুত–লাগে। ঠিক যেন কাঁচের মত। বিকৃত হয়ে যায় একটু দূরের সব কিছু।

সারফেসের দিকে উঠছে তিশা, ওর পাশে অন্যরা। প্রায় একইসঙ্গে পানির উপর মাথা তুলল ওরা।

চারপাশে চাইছে। ওরা আছে মস্ত এক নোনা পানির পুকুরের মাঝে। একদিকে বিশাল এক পাতাল-গুহা। তিশার পাশে ভাসছে জনি ওয়াকার ও গোলাম মোরশেদ। ওদের পিছনে নিনা ভিসার।

আগে কখনও এত বড় গুহা দেখেনি ওরা কেউ। ছাত হবে কমপক্ষে এক শ ফুট উপরে। চারদেয়াল এতই দূরে, মেরিনদের আনা শক্তিশালী হ্যালোজেন ল্যান্টার্ন দিয়েও দেখা গেল না গুহার শেষমাথা।

তারপর দেখতে পেল তিশা। মোরশেদের বিড়বিড় শুনতে পেল ও, আরেশশালা!

পুরো একমিনিট একটা কথাও বলতে পারল না তিশা, চেয়ে রইল বিস্ফারিত, চোখে। তারপর পুকুরের পাড়ে উঠবে বলে সাঁতরাতে শুরু করল। একটু পর পায়ের নীচে কঠিন জমিন পেয়ে গেল। পুরোপুরি চমকিত ও। একটা জিনিসের উপর থেকে চোখ সরাতে পারছে না।

আগে কখনও এমন কিছু দেখেনি তিশা। এসব দেখা যায় সিনেমার পর্দায়। টের পেল, শ্বাস আটকে রেখেছে।

ওটা কোনও ধরনের উড়োজাহাজ।

কুচকুচে কালো। নাক থেকে শুরু করে লেজ পর্যন্ত নিকষ কালো। আকার হবে সাধারণ ফাইটার জেট বিমানের মতই। বরফ-দেয়ালের ভিতর গেঁথে আছে বিশাল দুটো টেইল ফিন। যেন বহু বছর ধরে ধীরে ধীরে গিলে নিতে চেয়েছে বরফের দেয়াল বিমানটাকে।

বিশাল কালো স্পেসশিপ ঠাণ্ডা-সাদা গুহার বিপরীতে দেখতে কর্কশ লাগছে। উঁচু তিনটে শক্তিশালী হাইড্রলিক ল্যাণ্ডিং স্ট্রাটের উপর দাঁড়িয়ে আছে।

মনে হলো না পৃথিবীর কোনও মানুষের তৈরি হতে পারে ওই স্পেসশিপ।

খুবই নীচ চেহারা ওটার।

চকচকে কালো নাক কুঁকে এসেছে, ঠিক যেন বাজপাখির ঠোঁট। ওটার দিকে চাইলে কনকর্ডের কথা মনে আসে। ফিউজেলাজের দুপাশে নেমে এসেছে কালো দুটো ডানা, দেখলে মনে হয় যে-কোনও সময়ে উড়াল দেবে হিংস্র কোনও পাখি। রিইনফোর্সড় টিন্টেড গ্লাস ক্যানোপি ঠিক নাকের উপর বসানো।

বিশাল ঈগল, ভাবল তিশা। আজ পর্যন্ত সর্বকালের সবচেয়ে দ্রুত, ভয়ঙ্কর, এবং মন্তু পাখি!

তিশা টের পেল, অন্যরা ওর পাশে উঠে এসেছে বরফের মেঝেতে। চুপ করে দেখছে অদ্ভুত সুন্দর স্পেসশিপটাকে। সবার মুখের উপর থেকে ঘুরে এল তিশার চোখ।

হাঁ হয়ে গেছে গোলাম মোরশেদ।

বিস্ফারিত জনি ওয়াকারের দুই চোখ।

অবশ্য, নিনা ভিসারের প্রতিক্রিয়া অস্বাভাবিক মনে হলো তিশার। চোখ সরু করে স্পেসশিপের দিকে চেয়ে আছে মেয়েটা। কেন যেন শিউরে উঠল তিশা। নিনা ভিসারের চোখে কীসের যেন নেশা দেখেছে ও। বিপজ্জনক কোনও চিন্তা করছে সে। হয়তো ভাবছে এ থেকে কী ধরনের সুবিধা আদায় করতে পারবে।

এক সেকেণ্ড পর মাথা থেকে চিন্তাটা দূর করে দিল তিশা। স্পেসশিপের মোহ কেটে গেছে ওর, বিশাল গুহা ভালভাবে, দেখবার জন্যে চারপাশে চাইল।

দৃশ্যটা চোখে পড়তে লাগল দশ সেকেণ্ড।

দেখেই চমকে গেল তিশা। নিচু স্বরে বলল, হায় আল্লাহ!

ওরা নয়জন! বা বলা উচিত, নয়টা মৃতদেহ।

বুঝতে দেরি হয়েছে যে ওগুলো মানুষের শরীর। পুকুরের ওদিকে, কোনোটা চিত হয়ে, অন্যগুলো বড় বড় পাথরের এখানে ওখানে গুজে রাখা। চারপাশে শুধু রক্ত মেঝের উপর পুরু রক্তের স্তর, ছলকে লেগেছে দেয়ালে, মেখে আছে শরীরগুলোতে।

যেন কসাইখানা!

হাত-পা ছিড়ে নিয়েছে। কাঁধ থেকে উপড়ে নেয়া হয়েছে মাথা। কারও বুক থেকে খুবলে তুলেছে মাংস। মেঝের উপর ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ভাঙা হাড়। বেশিরভাগে ফাটল ধরা। এখনও জড়িয়ে আছে শুকনো মাংস।।

বড় করে ঢোক গিলল তিশা, ঠেকাতে চাইছে উথলে ওঠা বমি। বুঝতে পারছে, ওরা আইস স্টেশনের নয় ডুবুরি।

তিশার পাশে থমকে গেছে মোরশেদ, ড্যাবড্যাব করে দেখছে। পুকুরের ওদিকে ছিড়েখুঁড়ে খাওয়া শরীরগুলো।

.

ভাঙা ভাঙা স্বপ্ন দেখছে মাসুদ রানা।

প্রথমে কোনও স্বপ্ন ছিল না। শুধু গাঢ় অন্ধকার। যেন ও ভাসছিল মহাশূন্যে। তারপর হঠাৎ করেই এল উজ্জ্বল সাদা আলো। ওটা ওর আত্মা। তখন ভীষণ বৈদ্যুতিক শক লাগল। আগে কখনও ভাবতে পারেনি এমন তীব্র ব্যথা লাগতে পারে। তারপর আবার ফিরে এল সব স্মৃতি। মনে হলো, ও আছে মেঝের মত কোনও জায়গায়। খুব ঠাণ্ডা, বড় একা ও, ঘুমিয়ে আছে, কিন্তু জেগেও আছে।

এটা আবার কী করে হয়?

ঘুটঘুটে অন্ধকার। চারপাশে কোনও দেয়াল নেই।

কী যেন চেটে চলেছে ওর গাল।

বোধহয় কোনও কুকুর। বড় কোনও কুকুর। কী জাতের, কে জানে! রানা শুধু বুঝতে পারছে, ওটা মস্ত। এত বড় হয় না কুকুর।

ওর গালে নাক ঠেকিয়ে শুকছে, কৌতূহলী। ওটার ভেজা নাক লাগছে মুখে। গোঁফগুলো সুড়সুড়ি দিচ্ছে ওর নাক-মুখে।

খুবই কৌতূহলী কুকুর, একইসঙ্গে ওটাকে হিংস্রও মনে হচ্ছে। তারপর হঠাৎ করেই গর্জে উঠল কুকুরটা। গলা এত জোরালো, মনে হলো নরক থেকে আসছে গর্জন!

ভীষণ চমকে গেছে রানা। অজানা কোনও শত্রুর বিরুদ্ধে গর্জে চলেছে কুকুর। ভীষণ খেপেছে। উন্মাদ হয়ে উঠেছে রাগে। লাফঝাঁপ দিচ্ছে। শত্রুর দিকে ফিরে বের করেছে হিংস্র দাঁত।

দেয়াল বিহীন বিশাল ঘরে চুপ করে পড়ে আছে রানা। বুঝতে পারছে না, কেন নড়তে পারছে না। নাকি নড়তে ইচ্ছাই করছে না? তারপর ধীরে ধীরে চোখের সামনে দেখল দেয়াল। কয়েক মুহূর্ত পর টের পেল, আছে ই-ডেকের ধাতব প্ল্যাটফর্মে।

এখনও ওর উপর ঝুঁকে আছে মস্ত কুকুরটা। ক্ষুরধার দাঁত বেরিয়ে এসেছে, ভয়ঙ্কর ঘড়ঘড় আওয়াজ করছে। এই কুকুর যেন ওকে আড়াল দিতে চাইছে।

কিন্তু কী থেকে? কুকুরটা কী দেখছে, যেটা নিজে ও দেখতে পাচ্ছে না?

তারপর হঠাৎ করেই ঘুরল কুকুরটা, দৌড়ে চলে গেল। স্টিলের ডেকে পড়ে রইল একা রানা।

ঘুমন্ত অথচ জাগ্রত। নড়তে পারছে না। হঠাৎ ওর মনে হলো, ও খুব অসহায়।

পায়ের দিক থেকে কী যেন আসছে ওর দিকে। দেখতে পেল রানা, কিন্তু শুনতে পেল পায়ের আওয়াজ। খুব ধীরে, স্টিলের প্ল্যাটফর্মে এক পা এক পা করে আসছে।

তারপর হঠাৎ ওর চোখের সামনে ঝুঁকে এল পৈশাচিক এক মুখ! দেখল রানা, হাসছে সে।

জ্যাকুস ফিউভিল!

চটচটে রক্তে মাখা বিকৃত মুখ। ঠোঁটে বাঁকাচোরা হাসি। কপালের ক্ষত থেকে ছিড়ে ঝুলছে মাংস। জ্বলজ্বল করছে দুই চোখ, তাতে তীব্র ঘৃণা। ছোরা উপরে তুলল ফ্রেঞ্চ কমাণ্ডো, ওটা দেখাল।

তারপর ঝাঁকি খেল ছোরা, নামতে শুরু করেছে রানার গলা লক্ষ্য করে…

এই যে, নরম স্বরে বলল কে যেন।

চট করে চোখ মেলল রানা। ভেঙে গেছে দুঃস্বপ্ন টের পেল, চিত হয়ে শুয়ে আছে। এটা কোনও বিছানা হতে পারে। ঘরে উজ্জ্বল ফুরোসেন্ট বাতি। দেয়ালের রং সাদা। আসলে বরফের দেয়াল।

ওর পাশে দাড়িয়ে আছে এক লোক।

তার উচ্চতা হবে বড়জোর সোয়া পাঁচ ফুট। আগে কখনও একে দেখেনি রানা।।

বেশ খাটো, কিন্তু গিটারের ছয় নম্বর তারের মত টানটান শরীর। মস্ত দুটো খয়েরি চোখ। মাথা ছোট বলে লোকটার দুই চোখ আরও বড় লাগছে। কাঁধে সাদা-কালো চুল। মনে হলো, এক মাসের ভিতর চিরুনি পড়েনি ওখানে। সামনের উপরের দুটো দাঁত অনেক বড়, সেগুলোর মাঝের ফাঁক দিয়ে ম্যাচের দুটো কাঠি ঢুকিয়ে দেয়া যাবে। পরনে লোকটার সাদা শার্ট ও পলিয়েস্টার প্যান্ট। উইলকক্স আইস স্টেশনের বরফ-ঠাণ্ডা পরিবেশে তাকে বেমানান লাগছে।

লোকটার হাতে কী যেন।

দীর্ঘ একটা স্ক্যালপেল।

ওটার দিকে দ্বিতীয়বার চাইল রানা।

স্ক্যালপেলে তাজা রক্ত।

চিকন স্বর বলল, হ্যাঁ। আপনি জেগে আছেন।

উজ্জ্বল আলোয় ভুরু কুঁচকে ফেলল রানা, উঠে বসতে চাইল। সম্ভব হলো না। কী যেন ওকে বাধা দিয়েছে। এবার বুঝতে পারল, কেন উঠে বসতে পারেনি।

বিছানার দুপাশে দুটো চামড়ার ফিতা আটকে রেখেছে ওর দুই হাত। আরও দুটো আটকে দিয়েছে ওর দুই পা। উঁচু হয়ে চারপাশ দেখতে চাইল রানা, সেটাও পারা গেল না। কপালেও সমস্যা। ফিতা দিয়ে আটকানো ওর মাথা। বিছানা থেকে উঠবার উপায় নেই ওর।

বিদঘুটে লোকটার দিকে চেয়ে রইল রানা।

ভালভাবেই ওকে আটকে রেখেছে সে।

একমিনিট, বলল খাটো লোকটা। আর বড়জোর… দুই সেকেণ্ড… তারপর…।

উঁচু করে ধরল রক্তাক্ত স্ক্যালপেল, তারপর সরে গেল। আর তাকে দেখতে পেল মা রানা, তাড়াতাড়ি করে বলল, দাড়ান!

পরের সেকেণ্ডে আবারও লোকটাকে দেখা গেল। ভুরু কুঁচকে চাইল রানার দিকে। কী ব্যাপার?

আপনি… কী করতে চাইছেন? ব্যাঙের ডাকের মত আওয়াজ বেরুল রানার কণ্ঠ থেকে। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে।

হাসল লোকটা। বেরিয়ে এল এবড়োখেবড়ো দাতগুলো। ভয় নেই, মেজর। আপনি এখনও উইলকক্স আইস স্টেশনেই আছেন …আপনাকে দেখে মনে হয় যেন বাঙালি।

বাংলায় জানতে চাইল রানা, আপনি কে?

কেন, মেজর, বলল সে, খুনি বিজ্ঞানী রাশেদ হাবিব।

বড় করে ঢোক গিলল রানা।

লোকটা আবার চলে গেছে ওর মাথার পিছনে। কী যেন করছে। আবার গুনগুন করে নাকি সুরে গানও গাইছে। ব্যথা লাগছে ঘাড়ে। ওদিক দিয়ে স্ক্যালপেল ঢুকিয়ে দেবে নাকি?

কাচির খচখচ আওয়াজ, তারপর ঠক করে কী যেন ফেলল। আবার পাশে চলে এল লোকটা, এখন হাতে স্ক্যালপেল নেই। রানার কপাল আটকে রাখা ফিতা খুলতে শুরু করেছে। তার মূল কাজ শেষ, বের করে নিয়েছে বুলেটের চারটে টুকরো। বাধন খুলবার ফাঁকে বলল, আপনি-কবর থেকে ফিরে এলেন, মেজর।

কবর থেকে?

হ্যাঁ, মাথা দোলাল বিজ্ঞানী। আপনার কপাল খুব ভাল। কলারের ভিতর কেভলার কলার না থাকলে… এতক্ষণে হুরপরীদের সঙ্গে… বুলেটের সমস্ত শক্তি খেয়ে ফেলেছে ওই কেভলার।

গলা ও ঘাড় থেকে গোলাকার কলার সরিয়ে নিল সে, রানার চোখের সামনে ধরল। স্নাইপারদের বুলেট ঠেকাতে অফিসারদের ওই জিনিস দেয়া হয় মেরিন ফোর্স থেকে। সার্জেন্ট বা কর্পোরালদেরকে দেয়া হয় না, কারণ স্নাইপাররা সাধারণ কাউকে গুলি করবে না।

কপালের ফিতা খুলে দিল রাশেদ হাবিব। আরও মনোযোগ দিয়ে কেভলার কলার দেখল রানা। জিনিসটা দেখতে যাজকের সাদা কলারের মত, টার্টল-নেক গেঞ্জির কলারের ভিতর অংশে ছিল। ঘাড়ের কাছে এবড়োখেবড়ো গর্ত। ওদিক দিয়ে ঢুকেছে বুলেট।

এটা না থাকলে মরতেন, বলল বিজ্ঞানী। বুলেট ছিড়ে দিত ক্যারোটিড। তারপর আপনাকে বাঁচায় কার বাপের সাধ্যি। কলারে লেগে থেমেছে বুলেট, ঘাড়ে লেগেছে সামান্য কয়েকটা টুকরো। তাতেও নিশ্চিন্তে মরা যেত। এবং মরেও ছিলেন। অন্তত কিছুক্ষণের জন্যে।

বকবক করছে লোকটা। হতাশ হয়ে মনোযোগ হারাল রানা। ঘরের চারপাশে চোখ বোলাতে শুরু করেছে। এই ঘর কারও লিভিং কোয়ার্টার। একপাশে একটা খাট, একটা ডেস্ক, তার উপর কমপিউটার ও দুটো সাদা-কালো টিভি মনিটর। শেষের দুটো রাখা হয়েছে প্রাচীন এক ডিভিডি রেকর্ডারের উপর।

ঘুরে চাইল রানা। কী যেন বলছিলেন?

আপনার ঘাড়ে বুলেটের কয়েকটা টুকরো গেঁথেছিল, মেজর। ধরুন একমিনিটের জন্য থেমে গেছিল হৃৎস্পন্দন। আপনি ছিলেন তখন ক্লিনিক্যালি ডেড।

তাই? মাথা উঁচু করে ঘাড় নাড়ল রানা। কিন্তু দুই হাত নাড়তে পারল না। এখনও ওর হাত-পায়ের ফিতা খুলে দেয়া হয়নি।

ভয় পাবেন না, সব ফিতাই খুলে দেব, বলল রাশেদ হাবিব। বুলেটের টুকরোগুলো সরিয়ে নিয়েছি, পরিষ্কারও করেছি ক্ষত। ওখানে কেভলার কলারের কয়েক টুকরোও ছিল। সরিয়ে নিতে কষ্ট হয়নি। আপনি যখন জেগে গেলেন, তার আগে এই কাজই করছিলাম। বিছানার পাশে রুপালি একটি ট্রেতে রেখেছে রক্তাক্ত স্ক্যালপেল। পাশে রক্তে ভেজা ধাতুর সাতটা টুকরো।

কোনও ভয় পাবেন না, হয়তো ভাবছেন আমি ডাক্তার নই, বড় বড় দাঁত দুটো বেরিয়ে এল হাসিতে। এমবিবিএস পাশ করে মনে হলো কাজটা আমার নয়, তাই জিয়োফিক্সি পড়তে শুরু করি।

আমার বাঁধন তো খুলবেন? বলল রানা।

হ্যাঁ, তা তো খুলে দেবই। ভুলেই গিয়েছিলাম। নার্ভাস মনে হলো লোকটাকে। প্রথমে আপনার মাথা স্থির রাখতে হয়েছে, নইলে বুলেট আর কেভলারের টুকরো ঘাড় থেকে বের করতে পারতাম না। আপনি কি জানেন ঘুমের ভিতর খুব নড়চড়া করেন? জানবেন কোত্থেকে? ঘুমে কাদা! তা যাই হোক, আমি বুঝলাম এই মালকে ধরে রাখতে পারব না, আর তখন আচ্ছামত বেঁধে নিতে হলো। দুর্বল হাসি দিল হাবিব। ছাড়া পেয়ে আমাকে আবার আটকে রাখবেন না তো?

গম্ভীর মুখে রাশেদ হাবিবকে দেখল রানা। লোকটা আসলেই খুব নার্ভাস। কিছুদিন আগে খুন করেছে এক সহকর্মীকে। এখন ভাবছে, তার উপর প্রতিশোধ নেয়া হতে পারে। কিন্তু আমার কী হবে, ভাবল রানা। আমি আর এখানে আটকা থাকতে চাই না। পাগলাটে লোক, কখন কী করে বসবে তার কোনও ঠিকও নেই।

আরও কিছু বলবেন? জানতে চাইল রানা। কথার ফাঁকে ঘরের ভিতর চোখ বোলাল। দূর দেয়ালে দরজা। ভালভাবেই আটকে রাখা। সব, দেয়াল বরফের।

মেজর, আমি বলতে চাই: আমি কোনও খুনি নই। আমি কক্ষনো চার্লস মুনকে খুন করিনি।

কোনও কথা বলল না রানা। চট করে মনে পড়ে গেল নিনা ভিসারের কথাগুলো এই লোকই চার্লস মুনকে খুন করেছে। যে রাতে খুন হয় লোকটা, খুব ঝগড়া করেছিল রাশেদ হাবিব। তারপর মুনের কণ্ঠে গেঁথে দেয়া হয় হাইপোডারমিক সিরিঞ্জ। তার ভিতর ছিল, লিকুইড ড্রেন ক্লিনার। রক্তে মিশে যায় বিষ। পরে যখন লাশ পাওয়া যায়, ঘাড় থেকে ঝুলছিল সিরিঞ্জ।

আমার কথা বিশ্বাস করতে পারছেন না? নিচু স্বরে বলল হাবিব। সন্দেহ নিয়ে চেয়ে আছে রানার দিকে।

কোনও জবাব দিল না রানা।

মেজর, আমার কথা আপনাকে বিশ্বাস করতেই হবে। বুঝতে পারছি ওরা কী বুলেছে। কী ভয়ঙ্কর খুনি আমি। কিন্তু আমার কথা শুনতে হবে আপনাকে। আমি খুন করিনি। আল্লার কসম! ওই কাজ আমি করিনি।

বড় করে শ্বাস ফেলল সে, ধীর গতিতে বলতে শুরু করল।

মেজর, এটা সাধারণ কোন ইস্টিশন না। এখানে অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটছিল। আপনি এখানে আসার আগে অনেক কিছুই ঘটেছে। কাউকে বিশ্বাস করতে পারবেন না।

কিন্তু আপনাকে বিশ্বাস করতে পারব, তা-ই না? জানতে চাইল রানা।

হ্যাঁ। ঠিক তা-ই। ঘন ঘন মাথা দোলাল বিজ্ঞানী। কিন্তু আপনি আমাকে বিশ্বাস করতে পারছেন না, ঠিক? আপনাকে বলা হয়েছে, মাত্র চার-পাঁচ দিন আগে এক লোককে খুন করেছি, তার ঘাড়ে গেঁথে দিয়েছি ইণ্ডাস্ট্রিয়াল-স্ট্রেংথ ড্রেইনো। ঠিক? হ্যাঁ, বেশ, এবার বুঝতে হবে আপনাকে… রানার দিকে এক পা সামনে বাড়ল সে।

কী করতে চান? সাবধানী চোখে চেয়ে রইল রানা। আপনি এবার বুঝবেন… বন্দির বুকের কাছে ঝুঁকে এল রাশেদ হাবিব। ওকে পাহাড়ের মত উঁচু মনে হলো রানার। ঠাণ্ডা দুই চোখ চেয়ে আছে ওর দিকে।

আরও আড়ষ্ট হয়ে গেল রানা। হৃৎস্পন্দন বাড়তে শুরু করেছে। পুরোপুরি অসহায়। লোকটা যে কী করে বসবে…

খস্! হঠাৎ করেই খুলে গেল রানার বামহাতের ফিতা, লুটিয়ে পড়েছে মেঝের উপর। এক সেকেণ্ড পর ডানহাত খুলে গেল।

দুই হাত খুলে গেছে রানার। এবার ওর বুক আটকে রাখা ফিতা খুলে দিল বেঁটে বিজ্ঞানী। চট করে উঠে বসল রানা। সরে গেছে লোকটা, দুই পায়ের ফিতা খুলছে ব্যস্ত হয়ে।

দীর্ঘ কয়েক মুহূর্ত রাশেদ হাবিবের দিকে চেয়ে রইল রানা, তারপর নরম স্বরে বলল, ধন্যবাদ।

আমাকে ধন্যবাদ দেবেন না, মেজর, বলল হাবিব। আমাকে বিশ্বাস করুন। …কথা দিন: সব ঝামেলা শেষ হলে চার্লস মুনের লাশ পরখ করে দেখবেন। তার চোখ আর জিভ দেখলেই হবে। তা হলেই সব বুঝবেন। আপনি আমার একমাত্র ভরসা, মেজর। আপনি একমাত্র লোক যে প্রমাণ করতে পারবেন আমি আসলে নিরপরাধ।

রানাকে মুক্ত করে দিয়েছে রাশেদ হাবিব। উঠে বসল রানা, আস্তে করে ধরল ঘাড়ের পিছন অংশ। ব্যথায় দপদপ করছে জায়গাটা। কাছের এক আয়না দিয়ে ঘাড়ের পিছন দিক দেখল। ভালভাবেই ক্ষত বুজে দিয়েছে হাবিব। সেলাইয়ে কোনও খুঁত নেই। 

লোকটার হাত থেকে অ্যাডহেসিভ গজ নিল রানা, ক্ষতের উপর শক্ত করে বসিয়ে দিল। নিজের দেহের দিকে চাইল। ওর বেশিরভাগ আর্মার সরিয়ে নিয়েছে বিজ্ঞানী। এখনও পরে আছে ক্যামোফ্লেজ ফেটিগ। তার নীচে টার্টল-নেক গেঞ্জি। পায়ে এখনও বুট, তুবড়ে গেছে গোড়ালি ও হাঁটুর গার্ডগুলো। দূরের দেয়ালের কাছে একটা টেবিল, তার উপর রাখা পিস্তল, ছোরা, এমপি-৫ মেশিন পিস্তল ও ম্যাগহুক।

বন্ধ ঘরের দরজা আবারও দেখল রানা। কী যেন মনে পড়তে চাইছে। ও, হ্যাঁ, রিভেট মেরে বন্ধ করে দেয়া হয় রাশেদ হাবিবের রুমের দরজা। কিন্তু মন বলছে, ও যেন দেখেছে ভেঙে ফেলা হয়েছে দরজা।

হঠাৎ জানতে চাইল রানা, কীভাবে এখানে আনলেন?

সোজা কাজ। আপনার শরীরটা ভরে দিলাম লিফটে, তারপর তুলে আনলাম এই লেভেলে, বলল হাবিব।

কিন্তু আপনার ঘরের দরজা বন্ধ করে দেয়া হয়। কীভাবে বেরুলেন বা ঢুকলেন?

চতুর হাসল বিজ্ঞানী। আপনি আমাকে জাদুকর হ্যারি হুডিনি বলতে পারেন।

ঘরের আরেক প্রান্তে চলে গেল সে, থমকে দাঁড়িয়ে গেল দুই টিভি মনিটরের সামনে। চিন্তা করবেন না, মেজর, সবই বলব। অবশ্য তার আগে, আপনাকে একটা দৃশ্য দেখাতে চাই।

সেটা কীসের?

আবারও হাসল হাবিব। সেই চতুর হাসি। মেজর, আপনি নিশ্চয়ই দেখতে চান কে আপনাকে গুলি করেছে?

কয়েক পলক হাবিবের দিকে চেয়ে রইল রানা, তারপর বিছানা থেকে নেমে এল। টনটন করছে ঘাড়, শুরু হয়ে গেছে বেদম মাথাব্যথা। তিক্ত মনে ঘরের আরেক প্রান্তে পৌঁছে গেল ও, হাবিবের পাশে দুই টেলিভিশন মনিটরের সামনে থামল।

আপনার ঠাণ্ডা লাগছে না? লোকটার নিশ্চিন্তভাব দেখে জানতে চাইল।

শার্টের দুটো বোম খুলে ফেলল হাৰিব, দেখা গেল সুপারম্যানের মত নীল ওয়েটসুটের আণ্ডারগার্মেন্ট। নিয়োপ্রেন বডিসুট, গর্ব করে বলল। আসলে স্পেসওয়াকের জন্য এই জিনিস ব্যবহার করে। এখানে হিমাঙ্কের এক শ ডিগ্রি নীচে নেমে গেলেও টের পাব না।

ডানপাশের মনিটর চালু করল বিজ্ঞানী, সাদা-কালো স্ক্রিনে কিছুই দেখা গেল না। অবশ্য দশ সেকেণ্ড পর দৃশ্য ফুটল। আইস স্টেশনের নীচের ডেক দেখতে পেল রানা। ওই যে কালো পুল।

ছবিটা একটু অদ্ভুত। অনেক উপর থেকে ক্যামেরা দিয়ে তোলা হয়েছে। পুল ও চারপাশের দৃশ্য।

লাইভ ফিড, মন্তব্য করল হাবিব। সি-ডেকের সেতুর নীচ থেকে এই দৃশ্য তুলছে ক্যামেরা। একেবারে নীচে নীল পানির পুল।

স্ক্রিনে সাদা-কালো ছবি দেখছে রানা ভুরু কুঁচকে।

ছয় মাসে একবার করে বিজ্ঞানীদের পালা করে সরিয়ে নেয়া হয় অন্য ঘরে, বলল হাবিব। আমার আগে এ ঘরে যে লোক ছিল, সে এক পাগল মেরিন বায়োলজিস্ট। এসেছিল নিউ যিল্যাণ্ড থেকে। কিলার ওয়েইল খুব পছন্দ করত সে। সারাদিন ধরে খুনি তিমি দেখত। ঘণ্টার পর ঘণ্টা শুধু এ-ই। কিলার ওয়েইলগুলো। বাতাস নেয়ার জন্য আসত স্টেশনে। ওগুলোর প্রতিটার নাম দিয়েছিল। লোকটার নাম ছিল… কী যেন! কার্কাস? না… মাথা নাড়ল হাবিব। তা যাই হোক। বুড়ো কার্কাস সেতুর নীচে একটা ক্যামেরা বসাল। ঘরে বসে পুলের ভিতর খুনি তিমি দেখবে। ওরা এলেই দৌড়ে এসে ঘরে মনিটর চালু করত। কখনও গিয়ে ঢুকত ডাইভিং বেলের ভিতর। কাছ থেকে কিলার ওয়েইল দেখবে বলে। পাগল না?

রানার দিকে চেয়ে ফিক করে হেসে ফেলল হাবিব। আর রানার মনে হলো, সামনেই তো আস্ত পাগল দেখছি! ..

যাই হোক, কিলার–ওয়েইল নিয়ে আমরা কথা বলছি না। আবার মনিটরের দিকে চাইল হাবিব।

আপনি কিলার ওয়েইলের সঙ্গে আমাদের লড়াই দেখেছেন? জানতে চাইল রানা।

ভয়ঙ্কর, তা-ই না? বলল হাবিব। দেখিনি মানে! ডিভিডি করে রেখেছি! কাছ থেকে দেখেছেন? একেকটা দানব। আপনি কি জানেন কীভাবে শিকার করে? শিকারের আগের অভ্যেস খেয়াল করেছেন? শিকার ধরার আগে একবার পাশ দিয়ে যায়, তারপর ফিরে এসে হামলা শুরু করে।

আগে খেয়াল করিনি, বলল রানা।

আমার কথা বিশ্বাস করতে পারেন। প্রতিবার একই কাজ করে। আগেই বইয়ে পড়েছিলাম। আমার কী মনে হয় জানেন, ওরা আগেই কোনোভাবে অন্যদেরকে বুঝিয়ে দেয় এই শিকারটা আমার। আপনি চাইলে দেখাতে পারি যে কীভাবে…

অন্য কিছু দেখাতে চেয়েছিলেন, তাড়াতাড়ি করে বলল রানা। এক লোক গুলি করছে আমাকে।

ও, হ্যাঁ। ঠিক কথাই তো বলেছেন। ভুলে গিয়েছিলাম। রানা ভুরু কুঁচকে চেয়ে আছে দেখে টেবিলের উপর থেকে একটা ডিভিডি ডিস্ক নিল সে, ভরে দিল প্লেয়ারে। লোকটা বোধহয় পাগল, ধারণা করল রানা। খুব নার্ভাস, সর্বক্ষণ তিরতির করছে চোখের তারা। অবশ্য বোঝা যায় তুখোড় বুদ্ধিমান লোক। অনেক বেশি কথা বলে। একবার শুরু করলে চট করে থামতে পারে না। রানা আঁচ করতে চাইল কত হবে তার বয়স। কয়েক সেকেণ্ড পর সিদ্ধান্ত নিল, পঁয়তাল্লিশ থেকে পঞ্চাশ।

এই তো পেয়েছি! হঠাৎ বলে উঠল রাশেদ হাবিব।

কী? জানতে চাইল রানা।

আর্লিং কর্গ্যান! ওই মেরিন বায়োলজিস্টের নাম…

ডিভিডি চালু করুন, বিরক্ত হয়ে বলল রানা।

ও, হ্যাঁ, ঠিকই তো বলেছেন, প্লে বাটন টিপল হাবিব।

কয়েক সেকেন্ড পর দ্বিতীয় মনিটরে দৃশ্য ফুটল। প্রথম মনিটরের মতই, অনেক উপর থেকে ছবি তোলা হয়েছে। পুল ও চারপাশের প্ল্যাটফর্ম।

অবশ্য, একটা ব্যতিক্রম আছে।

দ্বিতীয় মনিটরে দেখা গেল এক লোক দাঁড়িয়ে আছে নীচের ডেকে। মেরিনদের মত পোশাক। একা।

বোঝা গেল না সে কে হতে পারে। ক্যামেরা ঠিক তার মাথার উপর থেকে ছবি তুলেছে। চকচক করছে লোকটার হেলমেটের উপর অংশ এবং শোল্ডারপ্লেট।

তারপর হঠাৎ করেই মুখ তুলে চাইল লোকটা। বিশাল কূপের উপর দিকে চেয়েছে। নিজের মুখ দেখতে পেল রানা। ভুরু কুঁচকে নিজের ভুরু কোঁচকানো মুখ দেখছে ও। হাবিবের দিকে চাইল রানা, এটা কখন রেকর্ড করেছেন?

দেখতে থাকুন।

আবার মনিটরে মন দিল রানা। পুলের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছে ও, হেলমেটে কী যেন বলল। কোনও আওয়াজ নেই। মুখ নড়ছে।

কথা শেষ হলে ডেকের উপর এক পা সামনে বাড়ল।

ওখানেই থেমে গেল। কীসের উপর যেন পা পড়েছে।

রানা নিজের ছবি দেখছে, সামনের দিকে ঝুঁকে গেছে ও। ডেকের উপর ভাঙা কাঁচ। চারপাশ দেখে নিল। তারপর যেন-কান পাতল। কিছু শুনতে হলে অনেকে এভাবে মুখ কাত করে। বোধহয় হেলমেট মাইক্রোফোনে কিছু বলছে কেউ।

ছবির রানা আবার সোজা হয়ে দাঁড়াল, ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে। হঠাৎ করেই ভীষণ ঝাঁকি খেল ওর দেহ। ঘাড় থেকে ছিটকে বেরুল সরু রেখার রক্ত; থমকে দাঁড়িয়ে গেছে রানা, টলমল করছে দুদিকে। ঘাড়ের উপর রাখল হাত, আবার মুখের সামনে নিয়ে এল ওটা। বোধহয় তাজা রক্ত।

হঠাৎ করেই ভাঁজ হয়ে গেল দুই হাঁটু। ডেকের উপর ধপ্ করে পড়ল। আর একটুও নড়ছে না।

নিজেকে টেলিভিশনের পর্দায় দেখছে রানা, কিন্তু খুশি হতে পারছে না।

এইমাত্র ওকে গুলি করা হয়েছে।

রাশেদ হাবিবের দিকে চাইল রানা।

আরও আছে, মনিটরে মনোযোগ দিল হাবিব। অনেক কিছু আছে।

টেলিভিশনের পর্দায় মন দিল রানা। পুলের পাশে পড়ে আছে ওর দেই। কিছুক্ষণ পেরিয়ে গেল, কিছুই ঘটছে না। তারপর হঠাৎ করেই দৃশ্যপটের এক পাশে কী যেন নড়ে উঠল।

রানার শিরার ভিতর বান নামল অ্যাড্রেনালিনের, এবার দেখবে কে ওকে গুলি করেছে।

প্রথমে একটা হেলমেট দেখা গেল। ওরই মত মেরিনদের পোশাক পরা।

হাঁটবার ভঙ্গি দেখে বোঝা গেল সে পুরুষ। কিন্তু মুখ দেখা গেল না।

ওর নিথর দেহের দিকে খুব ধীর ভঙ্গিতে আসছে সে। কোনও ব্যস্ততা নেই। হোলস্টার থেকে বের করে ফেলেছে পিস্তল। স্লাইড টেনে নিল। কক করেছে। এবার গুলি করবে।

টেলিভিশনের দৃশ্যে পুরো মনোযোগ দিয়েছে রানা।

হেলমেটের কারণে লোকটার মুখ দেখা যাচ্ছে না। অচেতন রানার পাশে বসল সে, দুই আঙুল দিয়ে রক্তাক্ত গলা স্পর্শ করল।

পালস্ পরখ করে দেখছে, বিড়বিড় করল রাশেদ হাবিব।

কয়েক সেকেণ্ড পর উঠে দাঁড়াল খুনি, সন্তুষ্ট হয়েছে যে রানার হৃৎস্পন্দন থেমে গেছে। আনকক করল পিস্তল, হোলস্টারে রেখে, দিল।

এবার মন দিয়ে দেখুন, বলল হাবিব। রানার দিকে ফিরে চাইল। মেজর, সত্যিই আপনার হার্ট থেমে যায়।

লোকটার দিকে চেয়ে নেই রানা, সমস্ত মনোযোগ মনিটরে। আঠার মত আটকে গেছে স্ক্রিনে ওর দৃষ্টি।

এবার দেখুন কী করে, বলল হাবিব। আর এখানেই মস্ত ভুল করল সে, নইলে…

দৃশ্যের লোকটার দিকে চেয়ে আছে রানা। হেলমেটের জন্য এখনও দেখা যাচ্ছে না মুখ। প্রচণ্ড লাথি দিয়ে রানার দেহ গড়িয়ে নিচ্ছে লোকটা। নিয়ে চলেছে পুলের ধারে। জোরালো তিনটে লাথি খেয়ে পুলের পাশে পৌঁছে গেল রানা। পরের লাথিতে ঝুপ করে পানিতে পড়ল ওর শিথিল দেহ।

লোকটা জানে না, বলল হাবিব, ব্যাটা লাখিয়ে আপনার হার্ট চালু করে দিয়েছে।

বলতে পারেন কীভাবে কী হলো?

ধারণা করেছি, পানি এতই ঠাণ্ডা, ওটা ডেফিব্রিলেটরের কাজ করেছে। আপনি তো জানেন, টেলিভিশনে দেখেননি? প্যাডেল দিয়ে ইলেকট্রিক-শক মেরে লোকের হার্ট চালু করে? ঠিক ওভাবে আপনার দেহে ঝাঁকি দিয়েছে বরফ-ঠাণ্ডা পানি। এবার বুঝুন? আপনার কোনও প্রস্তুতি নেই, এখন ওই ঠাণ্ডা সহ্য করতে পারে কোনও শরীর? ওই ঝাঁকি খেয়ে চালু হয়ে গেল আপনার হৃৎপিণ্ড।

মনিটরে চেয়ে আছে রানা।

পুলের কিনারায় দাঁড়িয়েছে লোকটা, চেয়ে আছে পানির দিকে। বুদ্বুদ ও ঢেউ নীচে। আধ মিনিট পর ঘুরে দাঁড়াল লোকটা, দেখে নিল চারপাশ। কিন্তু তার পিছনে পুলের ভিতর কী যেন! বিড়বিড় করল রানা, ওটা আবার কী!

দ্রুত হেঁটে দৃশ্যপট থেকে বিদায় নিল লোকটা।

এবার রাশেদ হাবিবের দিকে চাইল রানা।

সব শেষ হয়নি তো, ভাই, আপত্তির সুরে বলল লোকটা। ভাল করে দেখুন।

আবারও মনিটরে মন দিল রানা।

পুল ডেক ফাঁকা। কেউ নেই। দীর্ঘ কয়েক সেকেণ্ড পেরিয়ে গেল। কিছুই ঘটছে না। ধীরে ধীরে একমিনিট পেরুল, তারপর হঠাৎ করেই ওটা দেখতে পেল রানা।

কী হতে পারে? বিড়বিড় করে বলল।

ঠিক তখনই হঠাৎ করে আপনা-আপনি পুলের পানি সরে যেতে লাগল। সরছে বুদ্বুদ ও ফেনা, তারপর ভেসে উঠল অচেতন রানার দেহ।

অবাক হয়ে দেখছে রানা। শিরার ভিতর ঠাণ্ডা হয়ে আসতে চাইল ওর রক্ত।

জিনিসটা যাই হোক, আসলেই প্রকাণ্ড। আকারে কিলার ওয়েইলের চেয়ে খুব বেশি ছোট নয়।

কিন্তু কোনও কিলার ওয়েইল নয়।

পানি থেকে তুলে ফেলল রানার অচেতন দেহ, আস্তে করে নামিয়ে রাখল ডেকের উপর। চারপাশে গড়িয়ে গেল হালকা ঢেউ। এবার ডেকের উপর উঠে এল গণ্ডারের চেয়ে অনেক বড় প্রাণীটা। ওটার বিপুল ওজনে থরথর করে কেঁপে উঠল ডেক।

হতবাক হয়ে দেখছে রানা। ওটা কোনও ধরনের সিল।

কিন্তু ওর জানা ছিল না, এত বড় সিল পৃথিবীতে আছে।

বিপুল চর্বির কারণে থলথল করছে বিশাল দেহ, পিছনের দুই ফ্লিপারের উপর ভর করেছে। রানা আঁচ করল, ওটা ভয়ঙ্কর শক্তিশালী। অমন শরীরের ভর রাখতে হলে পেশিও হতে হবে প্রকাণ্ড। ওই প্রাণীর ওজন কমপক্ষে আট টন।

অবাক করা ওটার দাঁত। বিশাল সিলের দুই শ্বদন্ত উপর থেকে নীচের দিকে নামেনি, শুরু হয়েছে নীচের মাড়ি থেকে উঠে গেছে নাকের দুপাশে।

কী ওটা? নিচু স্বরে বলল রানা।

আমি জানি না, বলল হাবিব। নাক, চোখ, মাথার আকৃতি দেখে মনে হয় এলিফ্যান্ট সিল। কিন্তু এত বড় হয় না ওই জিনিস। বা অমন দাঁতও কোনোদিন বাপের জন্মে দেখিনি। এলিফ্যান্ট সিলের নীচের ক্যানাইন বড়, কিন্তু এমন বিশাল হয় না।

ডেকের উপর প্রায় দাঁড়িয়ে পড়েছে সিল, তারপর নিচু হয়ে রানার দেহ দেখল। মনে হচ্ছে শুকছে ওকে। দীর্ঘ গোঁফ ঘষা লাগছে রানার নাকে-গালে। অনড় পড়ে আছে রানা।

তারপর খুব ধীরে মস্ত একটা হাঁ করল সিল। আরও ঝুঁকে এল, কোদালের মত দাঁতগুলো দেখা গেল পরিষ্কার। ওই জন্তুর চোয়ালের ভিতর সহজেই ঢুকে যাবে রানার মাথা।

চোখ বিস্ফারিত করে দেখছে রানা।

এবার গেল আমার মাথা!

তো বাঁচলাম কী করে?

ডিনার সারতে আরও নেমে এল সিল। হাঁটা আরও বড় করেছে, তারপর হঠাৎ করেই চরকির মত ঘুরে গেল ওটা। এতই দ্রুত যে, চমকে গেল রানা। এই সাইজের মাল এমন দ্রুত নড়লে… থরথর করে কেঁপে উঠল ডেক।

দূরের কিছু দেখছে ওটা। কিন্তু অন্য কাউকে দেখা গেল না।

কুকুরের মত ঘেউ-ঘেউ শুরু করেছে সিল।

দৃশ্যের সঙ্গে আওয়াজ নেই, কিন্তু চোখের সামনে দেখা যাচ্ছে কুকুরের মত ডাক ছাড়ছে। সরে গেছে দুই ঠোঁট, বেরিয়ে এসেছে ক্ষুরধার দাঁতগুলো। খেপে গিয়ে চরকির মত ঘুরছে, সেইসঙ্গে ঘেউ ঘেউ। ভঙ্গি দেখে মনে হলো ছুটে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে শত্রুর উপর। পিছনের দুই ফ্লিপারের পেশি থরথর করে কাঁপছে।

তারপর হঠাৎ করেই ঘুরে দাঁড়াল দানবীয় সিল, ঝপাস করে আঁপিয়ে পড়ল পুলের ভিতর। তৈরি হলো বিশাল ঢেউ। ডেকের উপর দিয়ে বয়ে গেল পানির স্রোত। তার ভিতর পড়ে থাকল রানা।

দাঁড়ান-দাঁড়ান, নাটকীয় ভাবে বলল রাশেদ হাবিব। এবার আসছেন ত্রাতা হাবিব।

দৃশ্যপটে পা রাখল এক বেঁটে লোক, এর মাথায় মেরিনদের হেলমেট নেই। পরিষ্কার দেখা গেল তাকে, বিজ্ঞানী রাশেদ হাবিব। ছুটে চলে গেল রানার দেহের পাশে, তারপর দুহাত ভরে দিল বগলের ভিতর, টেনে নিয়ে চলেছে। কয়েক সেকেণ্ড পর কাউকে দেখা গেল না। ফাঁকা পুল ডেক দেখাচ্ছে ক্যামেরা।

স্টপ বাটন টিপল বিজ্ঞানী। আর কিছু নেই।

কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল রানা। এখনও হজম করতে পারেনি সব।

প্রথমে ওকে গুলি করেছে এক লোক, ওর পালস দেখেছে, তারপর নিশ্চিত হয়ে লাথি মেরে ওকে ফেলে দিয়েছে পানির ভিতর। ওকে আর খুঁজে পাওয়া যেত না।

এরপর এল এলিফ্যান্ট সিল। ওটা পানি থেকে তুলে আনল ওকে, আস্তে করে নামিয়ে দিল প্ল্যাটফর্মে। তারপর খেতে চেয়েও ফিরতে হলো কালো পানিতে হাজির হলো রাশেদ হাবিব।

এবার কী বুঝলেন? বলল বিজ্ঞানী। আমি না বলেছি আপনি ক্লিনিক্যালি ডেড ছিলেন? ওই লোক নিশ্চিত ছিল যে আপনি আর ফিরছেন না।

নিশ্চিত না হলে আর একটা গুলি পাঠিয়ে দিত মগজে, বলল রানা। আস্তে করে মাথা নাড়ল। ওর মনে হলো, মৃত্যুই ওকে রক্ষা করেছে আরেক মৃত্যু থেকে। কয়েক মুহূর্ত পর বলল, এই ডিভিডি আরেকবার দেখতে চাই। তখন ওই লোককে ভাল করে দেখতে পাইনি।

আবারও প্লে বাটন টিপল রাশেদ হাবিব।

নিজেকে পুল ডেকে দেখল রানা। বলল, এবার জলদি করে সামনে বাড়ুন।

ফাস্ট ফরওয়ার্ড করছে হাবিব।

হাসির সিনেমার চার্লি চ্যাপলিনের মত করে নড়ছে রানা। তারপর হঠাৎ করেই ধুপ করে পড়ে গেল।

হাজির হলো খুনি লোকটা। দেখতে না দেখতে পরীক্ষা করল হৃৎস্পন্দন। হাস্যকর ভাবে উঠে দাঁড়িয়ে লাথি মারতে শুরু করেছে রানার নিথর দেহে।

এবার স্বাভাবিক ভাবে চলতে দিন, বলল রানা।

শেষবারের মত লাথি মারল লোকটা, পানির ভিতর গিয়ে পড়ল মৃত রানা।

ঠিক আছে, এবার স্টপ করার জন্য তৈরি থাকুন, বলল রানা। খুব মনোযোগ দিয়ে দৃশ্যটা দেখছে।

লোকটা আছে পানির ধারে, চেয়ে আছে পুলের ভিতর। ডুবে গেছে রানা।

ঘুরে দাঁড়াল লোকটা, চারপাশ দেখে নিল।

ব্যস! থামুন! বলল রানা।

পয বাটন টিপল রাশেদ হাবিব। দৃশ্য আটকে গেছে।

লোকটার হেলমেটের উপর অংশ দেখা যাচ্ছে। ঘুরে চারপাশ দেখতে চেষ্টা করেছে বলে সামান্য উঁচু হয়েছে কাঁধ।

আপনি আসলে কী চান? বলল হাবিব। আপনি তো চেহারা দেখছেন না।

আমি ওর মুখ দেখতে চাই না, বলল রানা।

আসলেই চেহারা নিয়ে মাথাব্যথা নেই ওর। চোখ পড়ে আছে লোকটার কাঁধে। বা বলা উচিত ডান কাঁধের আর্মার্ড প্লেটের উপর।

থরথর করে কাঁপছে দৃশ্য, কিন্তু পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে।

প্লেটের উপর একটা ছবি।

শিরশির করছে রানার মেরুদণ্ড, ওই লোকের কাঁধের প্লেটে একটা টাট্টু। ছবিটা একটা ভাইপার সাপের, ছোবল দেয়ার জন্য বেরিয়ে এসেছে দুই শ্বদন্ত!

২২.

ই-ডেকের গুদাম-ঘরে ঠাণ্ডা বরফ-দেয়ালে মাথা রেখে বসে আছে নিশাত সুলতানা, বুজে রেখেছে চোখ দুটো। আধ ঘণ্টা হলো কেউ ওকে দেখতে আসেনি। ওর মন বলছে: একটু পর চলে আসবে হোসেন আরাফাত দবির। কনকনে ব্যথা শুরু হয়েছে ছেড়া হাঁটুতে, আরেক ডোজ মেথাডন দেয়া দরকার।

বড় করে শ্বাস ফেলল নিশাত, ব্যথা থেকে সরিয়ে রাখতে চাইছে মনকে। কিন্তু কিছুক্ষণ পর কেমন যেন করে উঠল মন। এই ঘরে অন্য কেউ আছে।

আস্তে করে চোখ মেলল নিশাত। দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে কে যেন।

একটা লোক। মেরিনদের পোশাক পরা।

চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। যেন পাথরের মূর্তি। ছায়ার কারণে মুখ দেখা গেল না। একটা কথাও বলছে না।

দবির? আস্তে করে সোজা হয়ে বসল নিশাত। দেখতে চাইছে কে এসেছে।

এক মুহূর্ত পর চমকে গেল। দবির না।

যে এসেছে সে দবিরের চেয়ে লম্বা, আরও পোক্ত শরীর।

লোকটা একটা কথাও বলছে না। চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। অন্ধকার থেকে চেয়ে আছে নিশাতের দিকে। কয়েক সেকেণ্ড পর নিশাত বুঝল, এই লোক কে হতে পারে।

ভাইপার, বলল। কী হয়েছে? কথা বলছেন না কেন?

দরজা থেকে সরল না পল সিংগার। নিষ্কল্প চোখে দেখছে নিশাতকে। কয়েক মুহূর্ত পর বলে উঠল, কিন্তু ঠোঁট নাড়া দেখা গেল না। নিচু কণ্ঠ, কর্কশ, আমি দবিরের বদলে এসেছি। আপনার ব্যবস্থা করছি।

ভাল হলো, বলল নিশাত, আরও সোজা হয়ে বসল। সত্যি আরেক ডোজ মেথাডন খুব দরকার।

দরজা থেকে নড়ল না ভাইপার।

ভুরু কুঁচকে গেল নিশাতের। কী হলো? জানতে চাইল। দেরি করছেন কেন? আপনাকে সাদর আমন্ত্রণ জানাতে হবে?

না, ঠাণ্ডা স্বরে বলল লোকটা। গুদাম-ঘরে এসে ঢুকল।

বিস্ফারিত হয়ে গেল নিশাতের দুই চোখ। করিডোরের আলো এসে পড়েছে লোকটার উপর। হাতে একটা ছোরা!

বরফ-দেয়ালে ঢুকে যেতে চাইল নিশাত। ভাইপারের হাতের ছোরা মেরিনদের বাউয়ি নাইফ। কী করতে চান, ভাইপার?

আমি দুঃখিত, ম্যাডাম, শীতল কণ্ঠে বলল লোকটা। আপনি ভাল সৈনিক, কিন্তু ভুল যুদ্ধে এসেছেন।

তার মানে কী?

কাছে চলে এসেছে ভাইপার। তার ছোরার উপর আঠার মত আটকে গেছে নিশাতের চোখ।

ন্যাশনাল সিকিউরিটি, ম্যাডাম, বলল সিংগার। জাতীয় স্বার্থে…

ন্যাশনাল সিকিউরিটি? ঢোক গিলল নিশাত। এসব আবার কী বলছেন?

সরু ঠোঁটে দেখা দিল হাসি, পৈশাচিকভাবে হাসছে সিংগার। আরে ম্যাডাম, বুঝলেন না? এসব তো আপনাদের আর্মতেও থাকার কথা। অনেক কাহিনি তো শুনবার কথা। আপনি বুঝতে পারছেন না আমি কে?

একটা পিশাচ, একটা রক্তপিশাচ, বলল নিশাত। এক চোখ রেখেছে নিজের হেলমেটের উপর। ওটা আছে ওর এবং ভাইপারের মাঝে। উল্টো হয়ে পড়ে আছে। মাইক্রোফোন তাক করা উপরের দিকে।

আস্তে করে বেল্টের দিকে ডানহাত নামিয়ে দিল নিশাত।

যা করতেই হবে, তাতে আমরা দেরি করি না, বলল ভাইপার।

আপনি কী করতে চান? বেল্টের বাটন টিপে চালু করে দিল নিশাত হেলমেট মাইক।

.

বি-ডেকে রাশেদ হাবিবের ঘরে বডি আর্মার পরে নিয়েছে রানা, দ্রুত হাতে তুলে নিচ্ছে অস্ত্র। পিস্তল চলে গেছে কোমরের হোলস্টারে, গোড়ালির খাপের ভিতর ছোরা, কাঁধের হোলস্টারে এমপি-৫। এবার পিঠে ঝুলিয়ে নিল ম্যাগহুক। মাথার উপর চাপিয়ে নিল হেলমেট। আর তখনই শুনতে পেল:

..জাতীয় স্বার্থে।

ভাইপার, নামিয়ে রাখুন ওই…

হঠাৎ স্ট্যাটিকের আওয়াজ শুরু হলো, আর শোনা গেল না কিছুই।

কিন্তু যা বুঝবার বুঝে গেছে রানা।

নিশাত সুলতানা আছে গুদাম-ঘরে, আর ওখানে গিয়ে ঢুকেছে পল সিংগার, ওরফে ভাইপার! ঝট করে রাশেদ হাবিবের দিকে চাইল রানা। জাদুকর হ্যারি হুডিনি, দেখিয়ে দিন কীভাবে বেরুতে হবে। পাঁচ সেকেণ্ড পাবেন, তারপর গুলি করব ঠ্যাঙে!

ওরে বাপরে! দরজার দিকে ছুট দিয়েছে বিজ্ঞানী। এত তাড়া কীসের?

পাশে ছুটতে শুরু করেছে রানাও। আমার এক অফিসারকে খুন করতে চাইছে এক আমেরিকান সৈনিক।

.

গুদাম-ঘরে নিশাতের ভাঙা হেলমেটের উপর পা রেখেছে ভাইপার। চুরমার করে দিয়েছে মাইক। ম্যাডাম, কী হয় মরলে? নরম স্বরে বলল। আমি আপনাকে বুদ্ধিমতি মনে করেছিলাম। ওই সিগনাল তো আমিও শুনতে পেয়েছি।

আপনি কেভিন হাক্সলেকে খুন করেছেন? জানতে চাইল নিশাত।

নিশ্চয়ই!

চট করে পাল্টে গেল নিশাতের সম্বোধন: তুমি কি জানো তোমার বাবার পশ্চাদ্দেশ দিয়ে বেরিয়েছ?

নিশাতের সামনে পাহাড়ের মত দাঁড়িয়ে পড়েছে সিংগার। দেয়ালে একটু সরে গেল নিশাত।

এবার মরতে হয়, ম্যাডাম, হাসি-হাসি সুরে বলল ভাইপার।

ঘোঁৎ করে উঠল নিশাত। ভাইপার, একটা কথা জানতে খুব ইচ্ছে আমার তোমার বাবার কতটা কষ্ট হয়েছিল?

কাঠ-কাঠ হাসি দিল পল সিংগার। আপনার মনে রাখতে হবে আমি অন্য জাতের। আমি আইসিজি।

.

পুরু কাঠের দরজার সামনে থেমে গেছে বিজ্ঞানী রাশেদ হাবিব, এইমাত্র রানা খেয়াল করেছে দশটি সমান্তরাল তক্তা দিয়ে তৈরি ওই দরজা।

একটা তক্তার উপর হাত রেখেছে হাবিব। বাইরের দিকে বিম, আর তাই ওদিক থেকে কেউ দেখেনি ভিতরে দরজার তক্তা কেটেছি।

সরু হয়ে গেল রানার চোখ। পরক্ষণে বুঝতে পারল। ভারী দরজার পুরু তক্তা সমান্তরাল করে কেটেছে হাবিব। বাইরের দিকে খাড়া বিম ঠিকই আছে, কিন্তু সেটাও খানিকটা কেটে ফেলা হয়েছে। ওদিক থেকে কেউ দেখলে বুঝবে না ফোপড়া করেছে দরজা।

ব্যাটার বুদ্ধি আছে, স্বীকার করে নিল রানা।

করাতের কাজ চালাতে হয়েছে স্টেক নাইফ দিয়ে, বলল হাবিব। আসলে তিনটে ছুরির বারোটা বাজিয়েছি। কঠিন তক্তা, সহজে নষ্ট হয় ছুরির ধার। ডানপাশের টেবিল থেকে একটা স্টেক ছুরি তুলে, নিল সে, খাড়া বিমের সরু ফাটলে চাড় দিল। ক্রোবারের কাজ করছে জিনিসটা। এক মুহূর্ত পর টাস্ করে খুলে এল সমান্তরাল একটা তক্তা।

ওটা আস্তে করে মেঝেতে নামিয়ে রাখল হাবিব। দরজার বুকে চৌকো একটা বাইরের বাকা টানেল দেখল রানা।

দ্রুত কাজ করছে রাশেদ হাবিব, দুই হাতে সরিয়ে নিল দ্বিতীয় তক্তা। আরও বড় হলো গর্ত। দরজার বুকে মাঝারি একটা ফোকড় তৈরি হয়েছে। পাশের খাড়া বিম সরাতে শুরু করেছে রানা, তিন সেকেণ্ড পর বেশ বড় হলো গর্ত। রাশেদ হাবিবের মত চিকন লোক বেরিয়ে যেতে পারবে।

এবার তিন পা পিছিয়ে যান, বলল রানা। নিজেও কয়েক পা পিছিয়েছে। এক পলক হাবিবকে দেখে নিয়েই দৌড় শুরু করল, ঝাপিয়ে পড়ল দরজার উপর।

জোর মড়াৎ আওয়াজ তুলে ভেঙে পড়ল কয়েকটা তক্তা। সব চারদিকে ছিটকে দিয়ে সুড়ঙ্গের মেঝেতে পড়েছে রানা। পরক্ষণে লাফ দিয়ে উঠেই ঝেড়ে দৌড় দিল। কেউ দেখলে ভাৰবে, বেচারা আমাশা রোগীর লোটা-কম্বল নিয়ে ভাগছে ছিচকে চোর!

পিছন থেকে চেঁচাল হাবিব, ভাই রে, আমার জন্য একটু অপেক্ষা করেন। আমি কী করে একা থাকব?

টানেলে বাঁক নিল রানা। কোনও ভয় নেই!

উড়ে চলেছে রানা, ওর পিছু নিল হাবিব, বিড়বিড় করে বলল, ওভাবে ঝাঁপ দিলে আমার সব কটা হাড় মুড়মুড় করে ভাঙত!

পাখির মত উড়ে চলেছে সে, বাঁক নিয়েই দূরে রানাকে দেখতে পেল।

চিতার মত ছুটছে রানা, ধুপধুপ করে লাফিয়ে চলেছে হৃৎপিণ্ড। মাথার ভিতর দপদপে ব্যথা। বামে মোড় নিল সেন্ট্রাল শাফটের দিকে। একহাজার একটা চিন্তা মনের ভিতর। যে-লোক ওকে গুলি করেছে, তার শোল্ডারপ্লেটে ভাইপারের টাটু।

ওই লোক গানারি সার্জেন্ট পল সিংগার, ওরফে ভাইপার! খুবই সম্মানিত সৈনিক, বহু বছর কাজ করেছে মেরিন কর্পসে। এ ধরনের জঘন্য কাজ কেন করছে সে? নিজ দলের আহত যোদ্ধাকে মেরে ফেলছে!

নিশাত সুলতানা এখন ই-ডেকের গুদাম-ঘরে। মেরে ফেলা হচ্ছে তাকে।

ভাইপার এরই ভিতর কেভিন হাক্সলেকে খুন করেছে। আহত তরুণ ছিল সবার ভিতর সবচেয়ে দুর্বল। আর এখন নিশাত সুলতানাকে খুন করতে গেছে ঠাণ্ডা মাথার খুনিটা। এক পা নেই নিশাতের, তার উপর মেথডন দেয়া হয়েছে, ঝিমিয়ে পড়ে থাকবার কথা। সহজেই ওকে মেরে ফেলবে সিংগার।

প্রায় উড়তে উড়তে বি-ডেকের ক্যাটওয়াকে বেরিয়ে এল রানা। ছুটতে শুরু করেছে কাছের রাং-ল্যাডারের উদ্দেশে। পাঁচ সেকেণ্ড পর পিছলে নেমে যেতে লাগল সি-ডেকে। তার দশ সেকেণ্ড পর রাং-ল্যাডার বেয়ে নেমে গেল ডি-ডেকে। পরের লেভেলে নামতে শুরু করেছে।

কয়েক মুহূর্ত পর পৌঁছে গেল ই-ডেকে। পুলের পাশ কেটে ছুটছে, চোখের কোণে দেখল ছোট সব ঢেউ এসে লাগছে ডেকের পাশে। পরক্ষণে ঢুকে পড়ল দক্ষিণ টানেলে। একটু দূরে নিশাতের গুদাম-ঘরের দরজা।

দৌড়ের গতি কমাল রানা, প্রায় নিঃশব্দে চলেছে। কাঁধের পিছন থেকে তুলে নিয়েছে ম্যাগহুক। স্টেশনের গ্যাসীয় পরিবেশে ব্যবহার করতে পারবে না পিস্তল। অস্ত্রের মত করে সামনে বাড়িয়ে ধরল ম্যাকহুক।

পৌঁছে গেল খোলা দরজার সামনে। ঘরের ভিতর দুই পা ঢুকে থমকে দাঁড়িয়ে গেল। কোমর থেকে বাগিয়ে ধরেছে ম্যাকহুক, কিন্তু ভিতরের দৃশ্য দেখে ওখানেই থমকে গেছে। অবাক হয়ে চেয়ে রইল। বিড়বিড় করে বলল, কী করে সম্ভব!

গুদামের মেঝেতে নিশাত সুলতানা ও পল সিংগার।

টানটান হয়ে বসা নিশাত সুলতানা। পিঠ ঠেকিয়ে দিয়েছে একদিকের দেয়ালে। ওর ভাল পা কাজে ব্যস্ত। পায়ের পাতা দিয়ে টিপে ধরে আছে ভাইপারের গলা। লোকটা গেঁথে আছে কাঠের শেলফের ভিতর। তাক থেকে মেঝেতে গড়িয়ে পড়েছে কয়েকটা স্কুবা ট্যাঙ্ক। নিশাতের বিশাল পায়ের পাতা চেপে ধরেছে ভাইপারের গলা, কাঠের শেলফে মাথা গুঁজে দিতে হয়েছে লোকটাকে। নিজের হোলস্টার থেকে কোল্ট অটোমেটিক পিস্তল বের করেছে নিশাত, দুই হাতে ধরেছে। অস্ত্রের নল তাক করেছে সিংগারের কপাল লক্ষ্য করে।

স্টেশনের বাতাসে গ্যাস ভাসছে বলে গুলি হলে বিস্ফোরণ হবে, কিন্তু মনে হলো এসব নিয়ে ভাবছে না নিশাত। বাম ভুরুতে দুটো কাটা চিহ্ন, নষ্ট কলের পানির মত গাল বেয়ে ফোঁটা ফোঁটা পড়ছে রক্ত। ওদিকে খেয়াল নেই নিশাতের, কঠোর চোখে চেয়ে আছে পল সিংগারের চোখে। মনে হলো চিবিয়ে খেয়ে ফেলবে লোকটাকে।

বাতিল কাগজের মত তাকের ভিতর খুঁজে আছে ভাইপার, বারকয়েক সরে যাওয়ার চেষ্টা করে থেমে গেছে। নিশাতের শারীরিক শক্তি সম্পর্কে কিছুই জানে না সে। যতবার সরতে চেয়েছে, তার কণ্ঠার উপর বেকায়দা চাপ দিয়েছে বারো নম্বরি বুট। পা দিয়ে গলা টিপে মেরে ফেলছে নিশাত লোকটাকে।

ঘরের ভিতর যেন ঝড় বয়ে গেছে। মেঝের উপর পড়ে আছে দুটো শেলফ। স্কুবা ট্যাঙ্কগুলোর মাঝে ভাইপারের বাউয়ি ছোরা দেখল রানা। রক্ত মেখে আছে ফলায়।

খুব ধীরে রানার দিকে চাইল নিশাত। দরজার কাছে থমকে গেছে রানা।

একটু আগের লড়াইয়ের ফলে ঘনঘন শ্বাস ফেলছে নিশাত, বড় করে একবার দম নিয়ে বলল, কী ব্যাপার, স্যর? আপনি কি চুপ করে দাঁড়িয়েই থাকবেন?

২৩.

ম্যাথিউ ফ্যেনুয়্যা ও স্যাঁ ডেনি পেয়েযিকে ই-ডেকে যেখানে রাখা হয়েছিল, সেখানেই খুঁটির সঙ্গে আটকে রাখা হয়েছে পল সিংগার বা ভাইপারকে। চাইলেও হ্যাণ্ডকাফ খুলতে পারবে না। সব বডি আর্মার সরিয়ে নেয়া হয়েছে। চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। এখনও পরনে ক্যামোফ্লেজ পোশাক, অর্থাৎ কমব্যাট ফেটিগ।

লোকটার সামনে দাঁড়িয়েছে মাসুদ রানা, হোসেন আরাফাত দবির ও নাজমুল, ওদের সবার চোখ থেকে তীব্র ঘৃণা ঝরছে। পুল ডেকে বয়ে আনা হয়েছে নিশাত সুলতানাকে, বসে আছে একটা চেয়ারে রাণী ক্লিয়োপেট্রার মত।

রানার পিছনে দাঁড়িয়েছে বিজ্ঞানী রাশেদ হাবিব, শুকনো মুখ

পরিবেশে টানটান উত্তেজনা। কেউ কথা বলছে না।

হাতঘড়ি দেখল রানা। বিকেল তিনটা বেয়াল্লিশ মিনিট। সোলার ফ্লেয়ারের বিষয়ে রাফায়লা ম্যাকানটায়ার কী বলেছিল, মনে আছে রানার। উইলকক্স আইস স্টেশনের উপরের আকাশ পরিষ্কার হবে তিনটা একান্ন মিনিটে।

আর মাত্র নয় মিনিট।

তার আগেই যা করবার করতে হবে। তিশা এবং অন্যরা এখনও পাতাল-গুহার ভিতর। আগে তাদের সঙ্গে কথা বলবে, তারপর যোগাযোগ করবে ম্যাকমার্ডো স্টেশনে? হাতঘড়ির পাশের একটি নব টিপে দিল রানা। বদলে গেল ডিসপ্লে। স্টপওয়াচ স্ক্রিন। টিকটিক করে বাড়ছে সময়।

১:৫২:৫৮
        ১:৫২:৫৯
        ১:৫৩:০০

হাতে সময় নেই। তিনটে একান্ন মিনিটে ম্যাকমার্ডোর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করবার পর, হাতে সময় থাকবে এক ঘণ্টারও কম। এর ভিতর ফ্রেঞ্চ রণতরীকে ঠেকাতে না পারলে উইলকক্স আইস স্টেশনের উপর এসে পড়বে মিসাইল।

ঠিক আছে, চারপাশে জড় হওয়া প্রত্যেকের উদ্দেশে বলল রানা, দবির ও নাজমুণ, যা বলার তাড়াতাড়ি।

ওদের কাহিনি সংক্ষেপে বলল ওরা। দুজন ছিল বাইরে, স্টেশনের অ্যান্টেনা ঠিক করছিল।

তারপর, স্যর, আপনি বললেন আমাদের একজন যেন মিস্টার হাবিবের ঘর দেখে আসি, বলল দবির। কাজটা, নিল ভাইপার। দেরি না করে চলে গেল। এরপর পনেরো মিনিট পর ফিরে এল। বলল, সব ঠিক। এখনও ঘরের ভিতর আছেন রাশেদ হাবিব। খামোকা চিন্তা করেছেন স্যর।

আস্তে করে মাথা দোলাল রানা। ওই সময়ের আগেই গুলি করা হয়েছে ওকে।

এর একটু পর, আমি উঠে পড়লাম, আপাকে দেখে আসব, বলল দবির। কিন্তু বাধা দিল ভাইপার, জানাল সে-ই দেখে আসবে। তখন কোনও সন্দেহ করিনি। ভাবলাম, লোকটার একটা নরম সুন্দর মন আছে।

আবারও মাথা দোলাল রানা। ওই সময়ে হামলা হয় নিশাতের উপর। দুপা সামনে বাড়ল রানা, বিশ্বাসঘাতকের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে। গানারি সার্জেন্ট, তোমার কিছু বলার আছে?

চুপ করে থাকল পল সিংগার।

গানারি সার্জেন্ট, তোমার কোর্ট-মার্শাল হবে, বলল রানা।

বিন্দুমাত্র চিন্তা নেই লোকটার, টিটকারির ভঙ্গিতে হাসছে।

তীব্র ঘৃণা বোধ করছে রানা। এই লোক তরুণ এক সৈনিককে খুন করেছে। ওকে গুলি করেছে। তারপর খুন করতে গেছে আহত নিশাত সুলতানাকে।

পরে ই-ডেকে ঝাপসা কাঁচ কোত্থেকে এল, খুঁজে বের করেছে রানা। এ-ও বোঝা গেছে, কীভাবে স্টেশনে গ্যাসের বলয়ের ভিতর গুলি করেছে ভাইপার।

কাজটা খুবই সোজা ছিল।

স্টেশনের ভিতর স্নাইপার রাইফেল ব্যবহার করেনি ভাইপার। বাইরে থেকে গুলি করেছে। গম্বুজের সাদা ঝাপসা কাঁচে ছোট গর্ত তৈরি করে শাফটের অনেক উপর থেকে গুলি করেছে। ওই ছোট্ট গোল কাঁচ ই-ডেকের মেঝেতে দেখেছে রানা।

ঠাণ্ডা চোখে পল সিংগারের চোখে চাইল রানা।

আমাকে বলেছে ও আইসিজি, বলল নিশাত।

একটু অবাক হয়ে চাইল দবির-নাজমুল, বুঝতে পারছে না।

পরে তোমাদেরকে বলব, বলল নিশাত।

গানারি সার্জেন্ট? গুড়গুড় করে উঠল রানার কণ্ঠ।

কোনও কথা বলছে না লোকটা।

তোমার কিছুই বলার নেই?বলল রানা।

কিন্তু স্যর, আমাকে যখন শেষ করতে এল, অনেক কথা বলছিল, বলল নিশাত। আমার মনে হয়, ওর দুটো বলই কেটে নেয়া উচিত, পরে তিমি মাছকে খেতে দেয়া যেতে পারে।

সিংগারের দিকে চেয়ে আছে রানা। খুশি খুশি একটা ভাব ভাইপারের মুখে।

প্রচণ্ড রাগে মেজাজ বিগড়ে গেল রানার। যদি পারত, দুই হাতে ছিড়ে ফেলত লোকটাকে।

সামরিক নেতার উচিত নয় রেগে ওঠা মাথার ভিতর জুলিয়াস বি, গুণ্ডারসনের কণ্ঠ শুনল রানা। মনে মনে বলল: কখনও আপনার দলের ভিতর বিশ্বাসঘাতক ঢুকেছে?

নিজেকে জিজ্ঞেস করল, এই পরিস্থিতিতে বিখ্যাত এসএএস কমাণ্ডার কী করতেন?

আপনাদের কারও কোনও মতামত–দবির? জানতে চাইল রানা।

আস্তে করে মাথা নাড়ল সার্জেন্ট। দুঃখিত চেহারা। ভাবতে পারেনি এতক্ষণ ভয়ঙ্কর এক সাপের সঙ্গে ওঠবস করেছে। আস্তে করে বলল, ভাবতে পারিনি তুমি মীর জাফর। ঘুরে চাইল রানার দিকে। স্যর, একে খুন করা আমাদের কাজ না, বাধ্য না হলে। আমেরিকান অফিসার এলে তার হাতে তুলে দেয়া যেতে পারে।

ভাইপারের দিকে চেয়ে আছে রানা। পাল্টা জ্বলন্ত চোখে চেয়ে আছে লোকটা।

দীর্ঘ একটা মুহূর্ত পেরিয়ে গেল, তারপর রানা বলল, ভাইপার, সংক্ষেপে বলো ইন্টালিজেন্স কনভার্জেন্স গ্রুপ কী।

সুন্দর ক্ষত, নরম স্বরে বলল লোকটা, চেয়ে আছে রানার ঘাড়ের দিকে। ওখানে সেলাই ও ব্যাণ্ডেজ। আপনার তো মরবার কথা ছিল।

সময় হলে মরব, বলল রানা। আইসিজি সম্পর্কে বলো।

সরু ঠোঁট টিপে হাসল লোকটা। দুলছে হাসতে গিয়ে। কয়েক মুহূর্ত পর বলল, আপনি মারা পড়বেন, মেজর। অন্যদের দিকে চাইল সে। তোমরাও কেউ বাঁচবে না।

কেন? তুমি মেরে ফেলবে আমাদেরকে? বলল রানা।

আপনি তো আইসিজির বিষয়ে জানতে চান, বলল ভাইপার। আমি তো আইসিজি সম্পর্কে সবই বলেছি।

আইসিজি আমাদেরকে মেরে ফেলবে?

বাঁচবেন না, বলল সিংগার। আপনাদের কারও বাঁচবার উপায় নেই। এখানে যা দেখে ফেলেছেন, তার ফলে কুকুরের মত গুলি করে মারা হবে। আমেরিকান সরকার যখন স্পেসশিপ হাতে পাবে, চাইবে না কয়েকটা ফালতু লোক ওটা নিয়ে কথা বলুক। সবাই মরবেন। আমার কথা ফলবে, আপনারা আসলে সবাই জিন্দা লাশ।

কথাগুলোর রণন মিলিয়ে গেল। থমথম করছে ই-ডেক।

রানা ওর দল নিয়ে উইলকক্স আইস স্টেশনে এসেছিল বাঙালি ও আমেরিকান বিজ্ঞানীদেরকে সরিয়ে নেবে ম্যাকমার্ডো স্টেশনে, বদলে জড়িয়ে গেছে ফ্রেঞ্চ কমাণ্ডোদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে। আর এখন টের পাচ্ছে, আমেরিকান সরকার ওদেরকে দাবার খুঁটির মত ব্যবহার করছে। প্রয়োজন শেষে মেরে ফেলা হবে ওদেরকে।

নিজেকে নিয়ে তোমার খুব গর্ব হচ্ছে, তা-ই না? ভাইপারের চোখে চেয়ে আছে রানা।

আমি দেশের কাজ করেছি, আমার দেশ উপকৃত হলেই হবে, বলল সিংগার।

লোকটাকে পিটিয়ে মারবে ঠিক করেছে রানা, হয়তো তাই করত, কিন্তু অনেকটা উপর থেকে এল এক নারী কণ্ঠ: মেজর!

মুখ তুলে চাইল রানা।

এ-ডেকের রেলিং থেকে ঝুঁকে আছে রাফায়লা ম্যাকানটায়ার। আবারও বলল, সময় হয়ে গেছে, মেজর!

একে পাহারা দিতে হবে না, বলল রানা, রওনা হয়ে গেল রাং-ল্যাডারের দিকে।

তিন মিনিট পর এ-ডেকে রেডিয়ো রুমে ঢুকল রানা। ওর সঙ্গে এসেছে দবির ও বিজ্ঞানী হাবিব। ই-ডেকে রয়ে গেছে নাজমুল, মেথডন দেবে নিশাত সুলতানাকে।

রেডিয়ো কন্সেলের সামনে বসে পড়েছে রাফায়লা। রাশেদ হাবিবকে দেখে মস্ত ঢোক গিলল।

কী খবর, ডারলিং রাফায়লা? খুশি-খুশি স্বরে বলল হাবিব।

এই তো, খুব সাবধানী সুরে বলল মেয়েটা। রানার দিকে চাইল। এখন যে-কোনও সময়ে ফ্লেয়ার সরে যাবে। কয়েকটা বাটন টিপল সে। ছাতের কাছে ঝুলন্ত দুটো স্পিকারে শুরু হয়েছে স্ট্যাটিক।

সসসসসস।

এটা ফ্লেয়ারের আওয়াজ, বলল রাফায়লা। কিন্তু কয়েক সেকেণ্ড অপেক্ষা করলে…

হঠাৎ থেমে গেল সব আওয়াজ, নেমে এসেছে নীরবতা।

আকাশ পেয়ে গেছি, বলল রাফায়লা। এই সুযোগ। মেজর, যোগাযোগ করুন।

কগোলের সামনে বসে পড়ল রানা, তুলে নিল মাইক্রোফোন। টক বাটন টিপে যোগাযোগ করতে চাইতেই খুব তীক্ষ্ণ শিসের আওয়াজ শুরু হলো। যেন সিগনালকে বাধা দিচ্ছে কিছু। মাইক্রোফোন নামিয়ে রাখল রানা। চাইল রাফায়লার দিকে। এবার কী? কোনও বাটন টিপতে হবে?

কয়েকটা সুইচ টিপল মেয়েটি। না, আপনাকে কিছু করতে হবে না।

সোলার ফ্লেয়ার? ঠিক সময় বের করতে পারেননি?

তা নয়, আপত্তি নিয়ে বলল রাফায়লা।

কিছুই ঘটছে না। শুধু কানে কনকনে আওয়াজ।

মেয়েটা যা-ই করুক, রেডিয়ো ঠিক হচ্ছে না। উঁচু পর্দার আওয়াজ থামছে না। কিছুক্ষণ পর রাফায়লা বলল, কী যেন হয়েছে। এটা ফ্লেয়ারের কারণে হচ্ছে না। অন্য কিছু। মনে হচ্ছে ইলেকট্রনিক। কেউ গলা টিপে ধরছে জ্যামার দিয়ে…

কথাটা শুনে চমকে গেছে রানা।

জ্যামিং করছে?

ম্যাকমার্ডো আর আমাদের মাঝে কেউ তা-ই করছে। সিগনাল পাঠাতে দিচ্ছে না।

স্যর… কোথেকে যেন ভেসে এল একটি কণ্ঠ।

ঘুরে চাইল রানা। দরজার কাছে নাজমুল।

কী?

স্যর, এটা দেখুন, বামহাত বাড়িয়ে দিয়েছে তরুণ।

হোভারক্রাফটের পোর্টেবল ভিউনি, কিছুক্ষণ আগে ওটা দেখেছে রানা। ছোট টিভি পর্দার মত। তথ্য পাঠিয়ে চলেছে হোভারক্রাফটের রেঞ্জফাইণ্ডার।

রেডিয়ো রুমের শেষপ্রান্তে রানার সামনে পৌঁছে গেল নাজমুল। মনিটর নিয়ে চোখ বোলাল রানা, পরক্ষণে চমকে গেল। সর্বনাশ!

স্ক্রিনে বেশ কয়েকটা লাল বিন্দু। বিশটার কম হবে না।

বিশটা শত্রুযান এলে…

সব আসছে উইলকক্স আইস স্টেশনের দিকে!

থমকে গেছে রানা, আর ঠিক তখনই শুনল ওই কণ্ঠ। শুকনো কাঠের মত শুকিয়ে গেল ওর গলা। গমগম করছে রেডিয়ো রুম। ওই কথা যেন আসছে স্বয়ং স্রষ্টার তরফ থেকে।

উইলকক্স আইস স্টেশন, শোনো… নাটকীয় চর্চিত কণ্ঠ: উইলকক্স আইস স্টেশনের তোমরা ভালভাবে মন দিয়ে শোনো: এরই ভিতর জেনেছ, তোমাদেরকে ম্যাকমার্ডো স্টেশনে সিগনাল পাঠাতে দেয়া হচ্ছে না। কাজেই সে চেষ্টা করে লাভ নেই। এখন ভাল করবে যার যার অস্ত্র নামিয়ে রাখলে। কারণ আমরা যখন আসব, কারও সঙ্গে অস্ত্র থাকলে, বাধ্য হয়ে তাকে বা তাদেরকে মেরে ফেলব। লেডিজ অ্যাণ্ড জেন্টলমেন, তোমাদেরকে মেরে ফেলতে আমার ভীষণ কষ্ট হবে।

বিস্ফারিত হয়েছে রানার দুই চোখ। ওই কণ্ঠ ওর খুব চেনা। আর ওই ইংরেজি উচ্চারণ!

এই কিছুদিন আগেও ট্রেইনিং নিয়েছে ওই মস্ত গুরুর কাছ থেকে!

ওই কণ্ঠ এসএএসের কমাণ্ডার, মেজর জেনারেল জুলিয়াস বি. গুণ্ডারসনের!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *