ডেথ ট্র্যাপ ১.১

মাসুদ রানা ৪২৫ – ডেথ ট্র্যাপ ১ (প্রথম খণ্ড) – কাজী আনোয়ার হোসেন – সেবা প্রকাশনী

০১.

যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, রাশা ও অস্ট্রেলিয়ার মত কয়েকটি দেশ মিলে ভাগ করে নিয়েছে ওই বিরান-বিশাল-শীতল-ধবল প্রান্তর। বছরের এক তৃতীয়াংশ সময়ে হয়ে ওঠে আকারে দ্বিগুণ। দিনের পর দিন বয় ওখানে তুমুল তুষার-ঝড়। তাপমাত্রা শূন্যের অনেক নীচে। বরফমোড়া কোনও সাধারণ দেশ নয় ওটি, বরং প্রকাণ্ড একটি জীবিত, জাগ্রত মহাদেশ। এবং সেখানেই শুরু হতে চলেছে মহা জটিল এক নাটকের প্রথম অংক।

উইলকক্স আইস স্টেশন, অ্যান্টার্কটিকা।

১৩ই জুলাই।

তিনঘণ্টা হলো স্টেশনের সঙ্গে রেডিয়ো যোগাযোগ বিচ্ছিন হয়ে গেছে দুই ডুবুরির।

গভীরে নামবার সময় ডাইভিং ছিল নিখুঁত। নেমেছে তারা অনেক নীচে। স্টেশনের দুই সেরা ডুবুরি স্টোন ও অ্যাডামস মাঝে মাঝেই আলাপ করেছে ইন্টারকমে।

আধাআধি নামবার পর রিপ্রেশারাইয করেছে, এরপর পুরো তিন হাজার ফুট নীচে গিয়ে থেমেছে। বেরিয়ে এসেছে ডাইভিং বেল থেকে, একপাশে সরু এক বরফের টানেল ধরে আবারও উঠে গেছে বিশাল এক গুহার দিকে।

পানির তাপমাত্রা ছিল এক দশমিক নয় ডিগ্রি সেলসিয়াস। দুবছর আগেও অ্যান্টার্কটিকায় ডাইভিং ছিল প্রায় অসম্ভব, দশ মিনিট পানিতে থাকলে হাইপোথারমিয়ায় মরতে হতো। কিন্তু এখন নেভির জন্য তৈরি থার্মাল-ইলেকট্রিক সুটের কারণে প্রায়জমে যাওয়া পানিতে তিন ঘণ্টারও বেশি ডুবে থাকা যায়।

গভীর পানির ভিতর সরু, খাড়া বরফের সুড়ঙ্গ দিয়ে উঠবার সময় রেডিয়োতে আলাপ করেছে ডুবুরিরা। বরফের দেয়ালের ফাটল ও রুক্ষতা নিয়ে মন্তব্য করেছে। তাদের কাছে স্বর্গীয় মনে হয়েছে চারপাশের বরফের দেয়াল, যেন গভীর সুনীল আকাশ।

তারপর হঠাৎ করেই থেমে গেছে সব কথা। উপরে দেখতে পেয়েছে স্থির পানি। ওখানে শুধু কালো কাঁচের মত নিথর, গাঢ় অন্ধকার। সাধারণত এত শান্ত হয় না পানি। চারপাশে আলো ফেলেছে ওদের, মিলিটারি-স্পেক হ্যালোজেন ফ্লাশলাইট। স্ফটিকের মত জ্বলজ্বল করেছে নীলচে বরফ। এরপর উপরের। দিকে উঠতে শুরু করেছে ডুবুরিরা।

আর ঠিক তখনই শুনতে পেয়েছে আওয়াজটা।

থেমে গেছে দুই ডুবুরি।

স্বচ্ছ ও বরফ-ঠাণ্ডা পানির ভিতর প্রথমে ওটা ছিল একটি মাত্র হুইসল। ওরা ভেবেছে, গান গাইছে কোনও তিমি।।

খুব সম্ভব ওটা কিলার ওয়েইল। কয়েক দিন হলো স্টেশনের ভিতর দেখা দিয়েছে একজোড়া তরুণ কিলার ওয়েইল। খুবই ছোট ঝক, বারবার উইলকক্স আইস স্টেশনের ভিতরের পুলে দম নিতে উঠছে ওগুলো।

অবশ্য, কিলার ওয়েইল না-ও হতে পারে, হয়তো ওই শিসের মালিক কোনও নীল তিমি, সঙ্গী জোগাড় করবার জন্য গান গাইছে পাঁচ কি ছয় মাইল দূরে। তিমির গান নিয়ে এই এক বড় সমস্যা। পানি এত ভাল কণ্ডাক্টার, কেউ বোঝে না তিমি এক মাইল দূরে, না দশ মাইল।

কয়েক সেকেণ্ড স্থির থেকে আবারও উপরে উঠতে শুরু করল দুই ডুবুরি।

আর ঠিক তখনই প্রথম শিসের জবাব দেয়া হলো।

এরপর বেজে উঠল আরও কমপক্ষে এক ডজন শিস। দুই। ডুবুরিকে ঘিরে চলেছে আওয়াজ। প্রথম শিসের চেয়ে অনেক কাছে পরের শিসগুলো।

গাঢ় নীল পানির ভিতর চরকির মত ঘুরে চারপাশে চোখ বুলালো দুই ডুবুরি।

কোথা থেকে আসছে এসব আওয়াজ?

কাঁধ থেকে হারপুন গান নামিয়ে নিয়েছে ডুবুরিদের একজন, দেরি হয়নি হ্যামার কক করতে। হঠাৎ থেমে গেছে তীক্ষ্ণ শিস, শুরু হয়েছে বেশ কিছু করুণ আর্তচিৎকার ও কুকুরের মত ঘেউঘেউ গর্জন।

তারপর হঠাৎ করেই জোরালো ধুপ-ধড়াস্ আওয়াজ হয়েছে। ঝট করে উপরে চেয়েছে দুই ডুবুরি। চারপাশ ছিল আয়নার মত পরিষ্কার, কোথাও কোনও কম্পন ছিল না, কিন্তু সেই নিথর পানি এখন বিস্ফোরিত হয়েছে হাজার টুকরোয়–উপর থেকে নেমে আসছে বিশাল কিছু!

.

জোর ছলাৎ আওয়াজ তুলে সারফেসে ভেসে উঠল প্রকাণ্ড ডাইভিং বেল।

গোলাকার পুলের ধারে পায়চারি করছে জন প্রাইস, ধমকের সুরে নির্দেশ দিয়ে চলেছে। সুঠাম দেহে পরনে তার কালো ইনসুলেটেড় ওয়েট সুট। প্রাইস মেরিন বায়োলজিস্ট, পাশ করেছে স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটি থেকে। এই উইলকক্স আইস স্টেশনের কর্ণধার সে।

সি-ডেকে উইঞ্চ কন্ট্রোল নিয়ে কাজ করছে তরুণ এক টেকনিশিয়ান, তাকে বলল সে, ঠিক আছে, ওখানেই রাখো! ওকে, লেডিজ অ্যাণ্ড জেন্টলমেন, হাতে সময় নেই। সবাই উঠে পড়ন।

পুলের ধারে হাজির হয়েছে ছজন ওয়েট সুট পরা ডাইভার, একে একে বরফ-ঠাণ্ডা পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ল তারা। এক মিনিট পেরুনোর আগেই উঠে পড়ল ডাইভিং বেলে। পুলের মাঝে জিনিসটা গম্বুজ আকৃতির, অর্ধেক অংশ পানির নীচে।

বিশাল পুলের ধারে, পানির কাছে এসে দাঁড়িয়েছে প্রাইস। এই গোল পুল ঘিরে তৈরি হয়েছে উইলকক্স আইস স্টেশন। কঠিন বরফ খুঁড়ে তৈরি সিলিণ্ডারের মত পাঁচতলা গভীর ফ্যাসিলিটি, বহু দূরের উপকূলীয় রিসার্চ স্টেশন হিসাবে কাজ করছে। প্রকাণ্ড ব্যারেলের মত ফাঁকা জায়গার চারপাশে সরু ক্যাটওয়াক ও মই, সবই মিশেছে একেকটা করে দরজায় ওপাশে বরফের তৈরি দালান। আগে আসা বহু মানুষের মতই উইলকক্স আইস স্টেশনের বাসিন্দারা ভাল করেই জানে, পোলার ওয়েদারে বেঁচে থাকতে হলে বরফের প্রান্তরের নীচে বাস করতে হবে। 

দুই কাঁধে স্কুবা গিয়ার ঝুলিয়ে নিল জন প্রাইস, শতবারের মত হিসাব কষতে শুরু করেছে।

ডাইভারদের সঙ্গে তিনঘণ্টার বেশি রেডিয়ো লিঙ্ক বিচ্ছিন্ন। একঘণ্টা বরফের সুড়ঙ্গের ভিতর দিয়ে উপরের দিকে উঠেছে স্টোন ও অ্যাডামস। তার আগে, একঘণ্টা ধরে ডাইভিং বেল চেপে নীচে নেমেছে।

নামবার সময় ফ্রি এয়ার পেয়েছে ওরা। উপর থেকে ডাইভিং বেলের ভিতর তাজা বাতাসের ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু বেল থেকে বেরিয়ে আসবার পর থেকেই স্কুবা ট্যাঙ্কের অক্সিজেন ব্যবহার করেছে। ওই প্রথম মুহূর্ত থেকে প্রতিটি সেকেণ্ড হিসাব করতে হবে।

তার মানে, চারঘণ্টা হলো ওরা স্কুবা ট্যাঙ্কের অক্সিজেন ব্যবহার করছে..

কিন্তু সমস্যা: ওদের স্কুবা ট্যাঙ্কে আছে মাত্র তিনঘণ্টা চলবার বাতাস!

এ থেকে অনেক কিছুই আঁচ করে নেয়া যায়।

দুই ডুবুরির কাছ থেকে শেষ যে কথা ওরা শুনেছে, তার পর থেকে পাওয়া গেছে শুধু স্ট্যাটিকের আওয়াজ। সেই সঙ্গে অদ্ভুত কিছু শিসের শব্দ।

ওই শিস তৈরি করতে পারে নীল, মিঙ্কস বা অন্য কোনও নিরীহ তিমি। অথবা, আধ মাইল বরফ ও পানির কারণে তৈরি হয়েছে রেডিয়ো ইন্টারফেয়ারেন্স। প্রাইস আন্দাজ করছে, রেডিয়ো যোগাযোগে ছেদ পড়তেই ফিরতি পথ ধরেছে স্টোন ও অ্যাডামস, রওনা হয়েছে, ডাইভিং বেলের দিকে। তখন নির্দিষ্ট সময়ের আগেই বেল টেনে তুললে সুড়ঙ্গের ভিতর আটকা পড়ত দুই ডুবুরি। তাদের কাছে যথেষ্ট অক্সিজেনও ছিল না।

কিন্তু, সত্যি যদি দুই ডুবুরি বিপদে পড়ে কিলার ওয়েইল বা লেপার্ড সিল হামলা করে প্রাইসের প্রথম কাজ হওয়া উচিত ছিল ডাইভিং বেল তুলে একদল ডাইভারকে পাঠানো।

শেষে প্রাইস ঠিক করেছে, ডাইভিং বেল টেনে তুলে ওটাতে করে আবারও কাউকে নীচে নামানোর সময় নেই। স্টোন ও অ্যাডামস্ যদি বেঁচে থাকে, হয়তো ওটাতে নিরাপদে উঠতে পারবে ওরা। এখন উচিত নীচেই রেখে দেয়া ডাইভিং বেল।

কিন্তু সেটা তিন ঘণ্টা আগের কথা। এই সময়টা ডুবুরিদের দিয়েছে প্রাইস। এরপর একঘণ্টা ধরে টেনে তুলেছে ডাইভিং বেল। আর এখন নতুন করে নামবার জন্য তৈরি হয়ে গেছে, দ্বিতীয় দলটি।

শুনুন।

ঘুরে চাইল জন প্রাইস। ওর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে স্টেশনের প্যালিয়োন্টোলজিস্ট, নিনা ভিসার। 

মহিলাকে পছন্দ করে প্রাইস। নিনা ভিসার বুদ্ধিমতী ও প্র্যাকটিক্যাল; প্রয়োজনে কঠোর হতে জানে, হাত নোংরা হবে ভেবে কাজ ফেলে রাখে না। মহিলার বারো বছরের একটা মেয়েও আছে জেনে খুব অবাক হয়নি প্রাইস। গত এক সপ্তাহ হলো এই স্টেশনে বেড়াতে এসেছে কিশোরী মেরি ভিসার।

কিছু বলবে? জানতে চাইল প্রাইস।

ঝড়ে ভেঙে পড়েছে উপরের অ্যান্টেনা, সিগনাল পাঠানো যাচ্ছে না, বলল নিনা ভিসার। আরও সমস্যা আছে, খুব কাছে চলে এসেছে একটা সোলার ফ্লেয়ার।

মুশকিল।

আমি রাফায়লাকে প্রতিটা মিলিটারি ফ্রিকোয়েন্সি স্ক্যান করতে বলেছি, কিন্তু আপনাকে আশাব্যঞ্জক কিছু শোনাতে পারছি না।

বাইরের অবস্থা কী?

খুবই খারাপ। সাগর-তীরের ক্লিফের উপর আছড়ে পড়ছে আশি ফুটি ঢেউ। সমতলের বরফ ছুঁয়ে বইছে এক শ নট গতিবেগের ঝড়। কেউ যদি আহত হয়, তাকে বাইরে নিয়ে, যেতে পারব না আমরা।

ডাইভিং বেলের দিকে ঘুরে চাইল প্রাইস। আর রাশেদ হাবিব?

তাকে তার ঘরে আটকে রাখা হয়েছে, নার্ভাস চোখে বিডেকের দিকে চাইল নিনা ভিসার।

আর দেরি করতে পারছি না, বলল প্রাইস। এবার যেতে হয়।

তার দিকে চাইল নিনা ভিসার। জন…

ভুলেও অনুরোধ করতে যেয়ো না, নিনা, মহিলার পাশ থেকে রওনা হয়ে গেল প্রাইস, চলেছে ডাইভিং বেলের দিকে। পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়বার আগে বলল, আমি চাই তুমি উপরেই থাকো। তোমার মেয়ের তোমাকে দরকার পড়তে পারে। চেষ্টা করো সিগনাল পাঠাতে। আমরা স্টোন আর অ্যাডামসকে নিয়েই ফিরব।

আমরা তিন হাজার ফুট গভীরতায় পৌঁছে গেছি, দেয়ালের আটকে রাখা স্পিকারে কড়-কড় করে উঠল জন প্রাইসের কর্কশ কণ্ঠ।

উইলকক্স আইস স্টেশনের অন্ধকার রেডিয়ো রুমে বসে আছে নিনা ভিসার। রজার দ্যাট, জন, সামনের মাইক্রোফোনে বলল সে।

বাইরে কোনও নড়াচড়া নেই, কন্ট্রোল। কোথাও কোনও অস্বাভাবিকতা দেখছি না। ঠিক আছে, লেডিজ অ্যাণ্ড জেন্টলমেন, আমরা উইঞ্চ বন্ধ করছি। এবার ডাইভিং বেল থেকে বের হওয়ার প্রস্তুতি নিন।

সাগরের এক কিলোমিটার নীচে একটা ঝাঁকি খেয়ে থামল ডাইভিং বেল। ওটার পেটের ভিতর ইন্টারকম ব্যবহার করল জন প্রাইস: কন্ট্রোল, প্লিয ২১৩২ আওয়ার্স কনফার্ম করো।

ডগলাস মওসন বেলের বদ্ধ পরিবেশে পরস্পরের দিকে চাইল সাত ডুবুরি, ধুকপুক করছে সবার বুক।

স্পিকারে ভেসে এল নিনা ভিসারের কণ্ঠ: আই কপি, ডাইভিং বেল। সময় কনফার্ম করা হলো, এখন রাত নয়টা বত্রিশ মিনিট।

কন্ট্রোল, মার্ক করতে হবে আমরা ২১৩২ আওয়ার্সে নিজেদের অক্সিজেন ব্যবহার করতে শুরু করছি।

মার্কড।

দেয়ালের হুক থেকে ভারী ফেস মাস্ক নিল সাত ডুবুরি, এক মিনিট পেরুনোর আগেই সুটের কলারবোনের গোলাকার বাকসে আটকে নিল মুখোশ।

কন্ট্রোল, আমরা এখন বেল থেকে বেরিয়ে পড়ছি।

সামনে বাড়ল জন প্রাইস, মুহূর্তের জন্য ডাইভিং বেলের অভ্যন্তরের পুলের কালো পানি দেখল, তারপর দুই কদম বেড়ে ঝপাস্ করে নেমে পড়ল গাঢ় অন্ধকারে।

    .

মাইক্রোফোনে বলে উঠল নিনা ভিসার, ডাইভার্স, ২২২০ আওয়ার্স, ডাইভ টাইম ফরটি-এইট মিনিটস্। রিপোর্ট।

রেডিয়ো রুমে নিনা ভিসারের পিছনে বসেছে রাফায়লা ম্যাকানটায়ার, সে স্টেশনের রেসিডেন্ট মিটিয়োরোলজিস্ট। গত দুই ঘণ্টা ধরে স্যাটালাইট রেডিয়ো কল্লোলের সামনে বসে আছে, কিন্তু বাইরে কোথাও একচুল ফ্রিকোয়েন্সি নেই।

খড়খড় আওয়াজ করে উঠল ইন্টারকম। এক সেকেণ্ড পর যোগাযোগ করল জন প্রাইস: কন্ট্রোল, আমরা এখনও বরফের সুড়ঙ্গ ধরে উপরের দিকে উঠছি। অস্বাভাবিক কিছু দেখিনি।

রজার, ডাইভার্স, বলল নিনা। আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখবেন।

ওর পিছনে আবারও টক বাটন টিপল রাফায়লা। কলিং অল ফ্রিকোয়েন্সি, দিস ইয় ফোর-ওয়ান-এইট স্টেশন। আই রিপিট, দিস ইয় ফোর-ওয়ান-এইট, রিকোয়েস্টিং ইমিডিয়েট অ্যাসিস্ট্যান্স। আমাদের এখানে দুজন আহত, সম্ভবত গুরুতর ভাবে। আমাদের ইমিডিয়েট সাপোর্ট দরকার। দয়া করে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন। আবারও বলছি, দয়া করে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন। বাটনের উপর থেকে আঙুলের চাপ সরিয়ে নিয়ে বিড়বিড় করে বলল রাফায়লা, যে-কেউ, সাড়া দিন!

    .

বরফের সুড়ঙ্গের উপরের অংশ চওড়া হতে শুরু করেছে।

সবাইকে নিয়ে ধীরে ধীরে উপরের দিকে উঠছে জন প্রাইস, পানির নীচে প্রত্যেকের চোখে পড়েছে চার দেয়ালে মস্ত সব গর্ত।

প্রতিটা গর্ত একেবারেই গোল, ব্যাসে কমপক্ষে দশ ফুট। সব শেষ হয়েছে বরফের সুড়ঙ্গের ভিতর। একটা গর্তের ভিতর আলো ফেলল এক ডুবুরি। নিকষ কালো অন্ধকার ছাড়া কিছুই দেখা গেল না।

হঠাৎ ইন্টারকমে বলে উঠল জন প্রাইস, ঠিক আছে, সবাই কাছাকাছি থাকুন। আমরা সারফেসের কাছে চলে এসেছি।

ওদিকে স্টেশনের রেডিয়ো রুমে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসল নিনা ভিসার। মনোযোগ দিয়ে শুনছে জন প্রাইসের কথা।

সারফেস খুব শান্ত মনে হচ্ছে। এখনও অ্যাডামস বা স্টোনের হদিশ মেলেনি।

পরস্পরের দিকে চাইল রাফায়লা ও নিনা। ইন্টারকমের বাটন টিপল নিনা। ডাইভার্স, কন্ট্রোল থেকে বলছি! ওসব আওয়াজ কীসের ছিল? এখন কি কোনও আওয়াজ পাচ্ছেন? বন্ধ হয়ে গেছে তিমি মাছের গান?

কোথাও কোনও আওয়াজ নেই। এক মিনিট, কন্ট্রোল। আমি সারফেসে উঠে আসছি।

মাত্র আধ মিনিট পর কাঁচের মত সারফেস ভেদ করে উঠে এল প্রাইসের হেলমেট। ফেসপ্লেট থেকে গড়িয়ে নামল বরফঠাণ্ডা পানি। পানির উপর প্রিন্সটন-টেক ডাইভ লাইট তুলল প্রাইস। চারপাশে ছড়িয়ে পড়ল হ্যালোজেন বালবের আলো, গুহার দূরের কোণ আবছা ভাবে দেখা গেল।

চারপাশ দেখতে শুরু করেছে প্রাইস। বড়সড় এক পুকুরের মাঝে ভেসে উঠেছে সে। একটু দূরে বিশাল পাতাল গুহা।

একবার ঘুরে চারদিক দেখে নিল প্রাইস। এই বিশাল গুহার চার দেয়াল বরফ দিয়ে তৈরি, সত্যিকারের দেয়ালেরমতই খাড়া।

 চতুর্থ দেয়ালে চোখ আটকে গেল প্রাইসের, চমকে গেল। ইন্টারকমে বলে উঠল, কন্ট্রোল, আমি কী দেখছি তোমরা কেউ বিশ্বাস করবে না!

কী দেখেছেন, জন? মাইক্রোফোনে বলল নিনা ভিসার।

বিশাল গুহা। চারপাশে বরফের খাড়া দেয়াল। কোনও একসময়ে সাইসমিক অ্যাক্টিভিটির কারণে তৈরি হয়েছে। বলতে পারি না এই গুহা কোথায়। কিন্তু সমতল থেকে কমপক্ষে কয়েক শ ফুট নীচে হবে।

আচ্ছা!

আর হ্যা… ওদিকে কিছু একটা দেখতে পাচ্ছি, নিনা!

ভুরু কুঁচকে রাফায়লার দিকে চাইল নিনা ভিসার, ইন্টারকমের বাটন টিপল, বলুন কী ওটা, জন।

নিনা… দীর্ঘ বিরতি নিয়ে বলল প্রাইস, নিনা, আমার ভুল না হয়ে থাকলে, ওটা একটা স্পেসশিপ!

     .

বরফের দেয়ালের নীচে প্রায় চাপা পড়েছে ওটা। পুরো কালো রঙের। উইংস্প্যান নব্বই ফুট। অনেকটা উপরে উঠেছে। চকচকে ডর্সাল টেইল ফিন। আকাশযানের পিছনের অংশ ঢাকা পড়েছে বরফের প্রাচীরের নীচে। খুব পোক্ত তিনটে ল্যাণ্ডিং স্ট্রাট দেখা গেল। দারুণ সুন্দর কালো একটা আকাশযান। সাধারণ। বিমান এত অ্যারোডাইন্যামিক হয় না। জাহাজটা এতই অপূর্ব, দেখলে মনে হয় ওটার মালিক হতে পারলে আর কিছু চাওয়ার থাকত না।

পিছনে ঝপাৎ আওয়াজ হতেই চরকির মত ঘুরল জন প্রাইস। ডুবুরিরা ভেসে উঠেছে। সবার চোখ আটকে গেছে স্পেসশিপের উপর। কিন্তু তাদের পিছনের পানিতে যেন ঢিল পড়েছে, তৈরি হচ্ছে বড় একটা বৃত্ত। পানিতে ভারী কিছু পড়লে ওরকম গোলাকার ঢেউ হয়!

ঢেউ কীসের, উপর থেকে কী পড়ল? জানতে চাইল প্রাইস, হ্যানলন?

জানি না, মিস্টার প্রাইস। কিন্তু মনে হলো পাশ দিয়ে কী যেন গেল।

তার দিকে চেয়ে আছে প্রাইস, দুই সেকেণ্ড পর দেখল চোখের সামনে টুপ করে ডুবে গেল হ্যানলন।

হ্যানলন?

পরক্ষণে আরেকজন আর্তচিৎকার করে উঠল। লোকটার নাম টম সামার।

পানির ভিতর ঘুরে গেল প্রাইস, আর ঠিক তখনই এক পলকের জন্য দেখতে পেল চকচকে কালো একটা পিঠ। বিশাল কোনও প্রাণী, সারফেস ভেদ করে উঠে এসেছে, তারপর বিপুল ওজন নিয়ে ঝপাস করে পড়ল পানিতে। টম সামারের বুকের উপর চেপে বসেছে ওটা, পরক্ষণে তাকে নিয়ে তলিয়ে গেল।

এক সেকেণ্ড পর উন্মাদ হয়ে উঠল জন প্রাইস, যে করে হোক তীরে গিয়ে উঠতে হবে! পুলের সারফেসের নীচে মাথা তলিয়ে যেতেই অদ্ভুত কিছু আওয়াজ পেল। খুব জোরে শব্দ হচ্ছে। শুরু হয়েছে তীক্ষ্ণ চিৎকার। কর্কশ ধ্বনি ছাড়ছে কী যেন। সেই সঙ্গে কুকুরের ডাকের মত ঘেউ-ঘেউ গর্জন!

দ্বিতীয়বার যখন সারফেসে ভেসে উঠল প্রাইস, পুকুরের হিম-শীতল দেয়াল দেখতে পেল। সারফেস থেকে একটু উপরে, সামনে বিশাল এক গর্ত। ওই জিনিস আগেও দেখেছে সে, বরফের সুড়ঙ্গে, পানির নীচে।

তারপর হঠাৎ করেই একটা গর্ত থেকে কী যেন বেরিয়ে এল!

হায় যিশু! ফিসফিস করে বলল প্রাইস।

    .

ইণ্টাকমে ভেসে এল একের পর এক আর্তচিৎকার। আইস স্টেশনের রেডিয়ো রুমে ভীষণ চমকে গেছে নিনা ভিসার, চোখ পড়ে আছে কঙ্গোলের উপর। ওর পাশে বসে আছে রাফায়লা, এক হাতে চেপে ধরেছে মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেছে চেহারা। দেয়ালের স্পিকারে ভেসে আসছে একের পর এক করুণ আর্তনাদ ও ভয়ার্ত চেঁচামেচি।

জনসন!

ওকে নিয়ে গেছে!

হায় ঈশ্বর! নাহ!

যিশু, ওই দেয়াল থেকে… ওই দেয়াল থেকেই আসছে ওগুলো!

তারপর হঠাৎ জন প্রাইসের কণ্ঠ শোনা গেল; সবাই পানি থেকে উঠে যাও! পানি থেকে উঠে যাও!

আরেকটা আর্তচিৎকার ভেসে এল। পরক্ষণে আরেকটা। মাইক্রোফোন চেপে ধরল নিনা। মিস্টার প্রাইস! প্রাইস! কথা বলুন!

ইন্টারকমে কর্কশ কণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠল প্রাইস, দ্রুত বলে চলেছে, তার ফাঁকে হাঁসফাস করছে: নিনা… শালার কপাল… আমি ওগুলোকে দেখছি না। আমাদের কেউ নেই। ওদের টেনে নিয়ে গেছে… বিরতি দিল প্রাইস, কয়েক সেকেণ্ড পর বলল, হায় যিশু। নিনা… সাহায্য চেয়ে রেডিয়ো করো। সবাইকে জানাও আমাদের সাহায্য দরকার…

পরক্ষণে ইন্টারকমে ভেসে এল কাঁচ ভাঙবার আওয়াজ। দীর্ঘ কয়েক মুহূর্ত পেরিয়ে গেল, আর যোগাযোগ করল না জন প্রাইস।

নতুন করে রেডিয়োর মাইক্রোফোনে বলতে শুরু করল রাফায়লা: গডস সেক, কেউ সাড়া দিন! দিস ইয ফোর-ওয়ানএইট স্টেশন, রিকোয়েস্টিং ইমিডিয়েট অ্যাস্টিস্ট্যান্স! আবারও বলছি, এটা ফোর-ওয়ান-এইট স্টেশন! আমাদের বেশ কয়েকজন পাতাল গুহার ভিতর মারা পড়েছে। আপনারা কেউ কি শুনতে পাচ্ছেন? দয়া করে সাড়া দিন! আমাদের ডাইভাররা… হায় যিশু… আমাদের ডাইভাররা বলেছে পাতাল গুহার ভিতর ওটা একটা স্পেসশিপ! ওদের উপর হামলা করেছে কারা যেন! আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন! পানির নীচে মেরে ফেলছে ওদেরকে!

কারও কাছ থেকে কোনও সাড়া পেল না উইলকক্স আইস স্টেশনের কেউ। বৃথা হলো ডিসট্রেস সিগনাল পাঠানো। কেউ কোনও জবাব দিল না।

কিন্তু আসলে অন্তত তিনটি রেডিয়ো ইন্সটলেশন থেকে শোনা গেছে রাফায়লার জরুরি বার্তা।

০২.

১৬ই জুলাই।

ভোর সাড়ে ছয়টা।

তুষারের উপর দিয়ে তীব্র গতি তুলে ছুটছে হোভারক্রাফট। ওটা ধবধবে সাদা, কিন্তু অ্যান্টার্কটিকায় ওই রঙের যান ব্যবহার করা হয় না। চট করে চিনবার জন্য বেশির ভাগ যানের রং হয় গাঢ় কমলা। খুব দ্রুত চলেছে সাদা হোভারক্রাফট। অনেকেই জানে, অ্যান্টার্কটিকায় যারা আসে, তাদের সত্যিকারের ব্যস্ততা বলতে কিছুই থাকে না। কিন্তু মনে হচ্ছে এই হোভারক্রাফটের আরোহীদের খুবই তাড়া আছে।

রিইনফোর্সড় ফাইবার গ্লাস উইণ্ডস্ক্রিনের ভিতর দিয়ে সামনে চেয়ে আছে মাসুদ রানা। ওর হোভারক্রাফটের স্টারবোর্ডে এক শ গজ দূরে দ্বিতীয় হোভারক্রাফট দেখতে পেল। ওটাও সাদা, বরফে ছাওয়া সমতলের উপর দিয়ে ছুটে চলেছে পাশাপাশি।

থমথম করছে রানার মুখ। হঠাৎ করেই অ্যান্টার্কটিকায় আসতে হয়েছে ওকে। গতকাল মাঝসকালে আমেরিকান স্টেশন ম্যাকমাৰ্ডোয় পৌঁছে পরিস্থিতি ওর কাছে সুবিধাজনক মনে হয়নি।

ফ্রেইটার দ্য মার্ভেল অভ গ্রিস নিয়ে তাসমানিয়ার দক্ষিণ সাগরে ছিল রানা, ওর কাজ ছিল বাংলাদেশ আর্মির ছোট একটা দলকে এ.ও.এস অর্থাৎ অ্যাসল্ট অন সির উপর ট্রেইনিং দেয়া। চলছে ট্রেইনিং, সকাল নটা। এমনসময় হঠাৎ করেই বাংলাদেশ কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের চিফ মেজর জেনারেল (অব.) রাহাত খানের কল এল ওর স্যাটালাইট মোবাইল ফোনে।

রানার বুকের ভিতর ছলাৎ করে উঠল ঊষ্ণ রক্ত। নিশ্চয়ই কিছু একটা ইমার্জেন্সি দেখা দিয়েছে নিশ্চয়ই নতুন কোনও অ্যাসাইনমেন্ট দেবে বুড়ো?

কল রিসিভ করে জী, স্যর, বলতেই গুরুগম্ভীর স্বরে জানালেন রাহাত খান, রানা, আপাতত তোমাদের ট্রেইনিং বন্ধ রাখতে হবে। জরুরি একটা কাজে তোমাদেরকে দরকার।

চুপ করে অপেক্ষা করেছে রানা।

কয়েক মুহূর্ত পর বললেন রাহাত খান, অ্যাডমিরাল জর্জ হ্যামিলটন যোগাযোগ করেছিল। আমার মাধ্যমে তোমার কাছে সাহায্য চাইছে। এর সঙ্গে আমাদের দেশের স্বার্থও জড়িত।

অ্যাডমিরাল আমাদের কাছে কী চাইছেন, স্যর? জানতে চেয়েছে রানা।

খুকখুক করে কাশলেন চিফ, তারপর বললেন, ওর নুমার কয়েকজন বিজ্ঞানী আটকা পড়েছেন উইলকক্স আইস স্টেশনে। তাঁদের তিনজন মারা পড়েছেন গভীর পানিতে নেমে। এ মুহূর্তে আমেরিকান সেনাবাহিনী বলতে ম্যাকমাৰ্ডোয় মেরিন কর্পসের মাত্র কয়েকজন সৈনিক। ওই স্টেশন পাহারা দিতেই তাদের বেশির ভাগকে লাগবে। অবশ্য, তাদের কাছ থেকে সব ধরনের সহায়তা পাবে। হ্যামিলটন জানে, মার্ভেল নিয়ে তাসমানিয়ার কাছেই আছ। বাংলাদেশ আর্মির ট্রেইনি অফিসার, সার্জেন্ট এবং কর্পোরালদের নিয়ে সাহায্যে যেতে পারো। …আমাদের প্রধানমন্ত্রী ও আর্মি চিফের সঙ্গে কথা বলার পর হ্যামিলটনকে জানিয়ে দিয়েছি, তুমি তোমার দল নিয়ে যাবে। বিরতি দিলেন রাহাত খান।

তুই বললেই যেখানে-সেখানে আমাকে যেতে হবে, শালা? ধমকের সুরে জানতে চাইল রানা, মনে মনে। মুখে বলল, জী, স্যর।

ওখানে কয়েকজন বিখ্যাত বাংলাদেশি ও আমেরিকান বিজ্ঞানী কাজ করছিলেন। তোমাদের কাজ হবে তাদেরকে উদ্ধার করে নিরাপদে ম্যাকমাৰ্ডোয় পৌঁছে দেয়া। চুপ হয়ে গেলেন রাহাত খান। কয়েক মুহূর্ত পর বললেন, গতরাতে উইলকক্স আইস স্টেশন থেকে রেডিয়ো বার্তা পাওয়া গেছে। ওরা আকুল হয়ে সাহায্য চেয়েছে। বলেছে, ওদের ওখানে নাকি একটা স্পেসশিপ আছে। অবিশ্বাস্য! …তোমার যদি সুযোগ হয়, সরেজমিনে দেখবে ওখানে আসলে কী ঘটছে।

জী, স্যর।

এবং ধরে নিতে পারো, ক্ষমতাশালী বেশ কিছু দেশ এরই ভিতর আগ্রহী হয়ে উঠেছে।

তার মানে, স্যর, ওখানে পৌঁছবার পর আমাদের উপর হামলা আসতে পারে?

হ্যাঁ, আমি ভয়ানক বিপদের আশঙ্কা করছি। খুব সতর্ক থাকতে হবে তোমাদের।

রানাকে কথা বলবার সুযোগ দিয়েছেন রাহাত খান, তারপরও প্রাণপ্রিয় শিষ্য চুপ করে আছে দেখে সাত সেকেণ্ড অপেক্ষার পর কেটে দিয়েছেন লাইন।

উইণ্ডস্ক্রিনের ভিতর দিয়ে আবারও সামনের ধূসরতার দিকে চাইল রানা।

ফিসফিস এক, শুনছেন, স্যর?

রেডিয়োতে বলল রানা, ফিসফিস দুই, ফিসফিস এক বলছি। …কী?

স্যর… সার্জেন্ট হোসেন আরাফাত দবিরের গম্ভীর, মোটা কণ্ঠ হঠাৎ করেই হারিয়ে গেল। গত বিশ ঘণ্টায় অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশের আয়োনোস্ফেরিক পরিস্থিতি খুব মন্দ হয়ে উঠেছে। শুরু হয়েছে প্রচণ্ড একটা সোলার ফ্লেয়ার। ওটার কারণে ব্যাহত হচ্ছে সব ধরনের ইলেকট্রোম্যাগনেটিক স্পেকট্রাম। এমন কী বন্ধ হয়েছে সাধারণ শর্ট-রেঞ্জ ইউএইচএফ ট্রান্সমিশনও। মাত্র এক শ গজ দূরের হোভারক্রাফটে যোগাযোগ করা কঠিন হয়ে উঠেছে। উইলকক্স আইস স্টেশনে বার্তা পাঠানো তো পুরোপুরি অসম্ভব।

স্ট্যাটিক আবারও কমে এসেছে, স্পিকারে আরাফাতের কণ্ঠ ফিরল, স্যর, আপনার মনে পড়ে একঘন্টা আগে মুভিং কন্ট্যাক্ট ধরা পড়ে?

হ্যাঁ।

গত একঘণ্টা ধরে ফিসফিস দুইয়ের ইলেকট্রনিক ইকুইপমেন্ট উল্টো দিক থেকে আসা এমিশন ধরেছে। ওই হোভারক্রাফট দ্রুত চলেছে ফ্রেঞ্চ উপকূলীয় রিসার্চ স্টেশন ডুমো ডিখ-ঈলেখের দিকে।

তাতে কী, সার্জেন্ট?

স্যর, এখন আমি আর ওটাকে খুঁজে পাচ্ছি না।

দূরে চাইল রানা। আপনি শিয়োর?

এখন আর আমাদের স্কোপে কোনও রিডিং নেই, স্যর। হয় ইঞ্জিন বন্ধ করেছে, নয়তো হঠাৎ করেই অদৃশ্য হয়েছে।

এক মুহূর্ত ভাবল রানা, চট করে পিছনে দেখে নিল পারসোনেল কম্পার্টমেন্টের ভিতরটা। দুই পাশে বসেছে চারজন। মাঝে একজন। তাদের দুজন আমেরিকান মেরিন কর্পসের সদস্য। অন্য তিনজন বাংলাদেশ আর্মির। প্রত্যেকের পরনে স্লো ফেটিগ। কোলের উপর সাদা-ধূসর কেভলার হেলমেট, বুকে একই রঙা বডি আর্মার। পাশে ঠেস দিয়ে রাখা ধূসর-সাদা অটোমেটিক রাইফেল। রানা, বাংলাদেশ আর্মির অফিসার ও সৈনিকদের জন্য ওই একই জিনিস দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া, প্রত্যেককে সরবরাহ করা হয়েছে অন্যান্য আরও অস্ত্র ও যন্ত্রপাতি।

উইলকক্স আইস স্টেশন থেকে ডিসট্রেস সিগনাল পাওয়ার পর এরইমধ্যে কেটে গেছে দুই দিনেরও বেশি। আদেশ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রওনা হয়ে প্রায় তিন হাজার কিলোমিটার পেরিয়ে পৌঁছেছে রস সাগরে। ওই সাগরের তীরে উত্তর আমেরিকা, সারাবছর এক শ চারজন লোক রাখে স্টেশন ম্যাকমাৰ্ডোয়। ঊনিশ শ বাহাত্তর সালে ওখানেই ইউএস নেভি তাদের নিউক্লিয়ার বোমা পরীক্ষা করেছিল। ছি-ছি করেছিল পৃথিবীর মানুষ। এরপর নতুন করে ওখানে বোমা ফাটানো হয়নি, দক্ষিণ পোল যেতে হলে ওই পথেই যেতে হয় ইউএসএকে। গত বিকেলে ম্যাকমার্ডো থেকে রওনা হয়েছে রানার দল ও কয়েকজন মেরিন সৈনিক। ওদের গন্তব্য: নয় শ মাইল। তুষার ছাওয়া প্রান্তর পাড়ি দিয়ে ইউএস রিসার্চ ফ্যাসিলিটি উইলকক্স আইস স্টেশন।

নির্জন এলাকায় খুব ছোট একটা স্টেশন। অ্যান্টার্কটিকায় এ ধরনের খুদে স্টেশনও খুব কম। সবচেয়ে কাছের প্রতিবেশী ছয় শ মাইল দূরে। উইলকক্স স্টেশন একটা আমেরিকান পোস্ট, ডাল্টন আইসবার্গ থেকে একটু দূরে কোস্টাল আইস শেলফের উপর। শত শত মাইল বিরান ভূমিতে, বরফের ধূ-ধূ প্রান্তরের উপর বইছে ঝোড়ো হাওয়া। সাগরের দিকে তিন শ ফুট উঁচু পাথুরে ক্লিফ, ওখানে সারা বছরই ষাট ফুট উঁচু ঢেউ আছড়ে পড়ে।

আকাশ পথে উইলকক্স স্টেশনে যাওয়া অসম্ভব কাজ। এই শীতে বইছে মাইনাস তিরিশ ডিগ্রি ব্লির্ড, পর পর তিন সপ্তাহ ধরে চলছে। বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন: কমপক্ষে আরও একমাস চলবে এই চরম পরিবেশ। হেলিকপ্টারের রোটর বা জেট ইঞ্জিন মাঝ আকাশে জমে গিয়ে বিধ্বস্ত হবে নির্ঘাত।

সাগরের দিক দিয়ে যেতে হলে ডিঙিয়ে আসতে হবে তিন শ ফুট উঁচু বরফের ক্লিফ। ইউএস নেভি এককথায় বলে দিয়েছে: ওদিক দিয়ে উঠতে যাওয়া মানেই আত্মহত্যা করা।

অর্থাৎ, তুষার ছাওয়া জমির উপর দিয়েই আসতে-যেতে হবে। তার মানেই, ব্যবহার করতে হবে হোভারক্রাফট। বাংলাদেশ আর্মির পাঁচজন অফিসার ও সৈনিক ও রানা, মোট ছয়জন চলেছে। ওদিকে আমেরিকান কর্তৃপক্ষ থেকে দেয়া হয়েছে মেরিন কর্পস-এর ছয়জন সৈনিক। এদের সবার নেতৃত্বে রয়েছে মাসুদ রানা।

হোভারক্রাফটের ওই সিগনাল নিয়ে আবারও ভাবল রানা। মানচিত্রে ম্যাকমার্ডো, ডিখ-ঈলেখ ও উইলকক্স আইস স্টেশন প্রকাণ্ড এক ত্রিকোণ তৈরি করেছে। উপকূলে দুটো বাহু ডিখঈলেখ ও উইলকক্স স্টেশন, ওদিকে বহু দূরের জমিতে রস সাগরের তীরে ম্যাকমার্ডো শেষ বাহু।

দ্বিতীয় ফিসফিস যে সিগনাল পেয়েছে, ওটা গেছে উপকূলে ডুমো ডিখ-ঈলেখের দিকে। হোভারক্রাফটের গতিবেগ ছিল কমবেশি চল্লিশ মাইল। এ থেকে আঁচ করা যায়, ওটা সাধারণ হোভারক্রাফট। অবশ্য এমনও হতে পারে, উইলকক্স স্টেশনের ডিসট্রেস সিগনাল ধরতে পেরেছে ডিখ-ঈলেখের ফ্রেঞ্চরা, এবং সে কারণেই সাহায্য করতে ছুটে এসেছে। এখন ফিরছে নিজ স্টেশনের দিকে।

আবারও রেডিয়ো চালু করল রানা, সার্জেন্ট, শেষ কখন সিগনাল পেয়েছেন?

খড়মড় করে উঠল রেডিয়ো। আট মিনিট আগে, স্যর। রেঞ্জফাইণ্ডার কন্ট্যাক্ট। আগের ইলেকট্রনিক সিগনেচারের মতই। একইদিকে গেছে। একই সিগনাল, স্যর। আট মিনিট আগে ওখান থেকেই হারিয়ে গেছে।

যেন নরক হয়ে উঠেছে পরিবেশ, দিগন্ত থেকে কাত হয়ে আসছে আশি মাইল গতিবেগের তুমুল ঝড়। সাদা তুষার ছাড়া কিছুই দেখা যায় না। সাধারণ রেইডার স্ক্যানিং কোনও কাজে আসবে না। আয়োনোস্ফেয়ারে সোলার ফ্লেয়ারের কারণে বিকল হয়েছে রেডিয়ো কমিউনিকেশন। তার উপর লো প্রেশার সিস্টেম কানা করে দিয়েছে সবার রেইডার।

এমন জটিল পরিস্থিতি হতে পারে ভেবেই হোভারক্রাফটের ছাতে বসানো হয়েছে রেঞ্জফাইণ্ডার। প্রতিটি রিভলভিং টারেটে এক শ আশি ডিগ্রি নজরে রাখছে রেঞ্জফাইণ্ডার; নিডল নামে পরিচিত হাই-পাওয়ার্ড ফোকাল বিম ছুঁড়ছে। ওটা সাধারণ রেইডার নয় যে পৃথিবীর বাঁকে গিয়ে ক্ষমতা হারাবে। নিডল পৃথিবীর মাটি ছুঁয়ে চলে, দিগন্ত পেরিয়ে পৌঁছে যায় প্রায় পঞ্চাশ মাইল দূরে। কোনও লাইভ অবুজেক্ট, সেটা কেমিকেল, জন্তু বা ইলেকট্রনিক হোক, ঠিকই ওটাকে রেকর্ড করবে নিডল। ম্যাকমার্ডো থেকে রওনা হওয়ার পর রেঞ্জফাইণ্ডার অপারেটার কর্পোরাল নাজমুল বলেছে, স্যর, পরীক্ষা করেছি, কোনও জিনিস যদি বলকে ওঠে, শ্বাস নেয়, বা বিপবিপ আওয়াজ করে, এই রেঞ্জফাইণ্ডার ঠিকই তাকে ধরে ফেলে।

রেডিয়ো চালু করল রানা, সার্জেন্ট, সিগনাল কোথায় বন্ধ হয়েছে? আমরা ওটা থেকে কত দূরে?

আমরা কমবেশি নব্বই মাইল দূরে, স্যর, জবাব দিল সার্জেন্ট হোসেন আরাফাত দবির।

ধবধবে সাদা দিগন্তের দিকে চাইল রানা। এক মুহূর্ত পর বলল, ঠিক আছে। যান, চেক করে দেখে আসুন।

জী, স্যর।

এবারের ট্রেইনিঙে গত একমাস ধরে সার্জেন্ট হোসেন আরাফাত দবিরকে নতুন করে চিনছে রানা। পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সী শক্তপোক্ত লোক সে, মুষ্টিযোদ্ধার মত কঠোর চেহারা, কমপক্ষে তিনবার ভেঙেছে নাক। চোখদুটো গভীর গর্তে বসানো, মোটা বিছার মত ভুরু। কাজে কোনও খুঁত রাখে না সে। কাজের সময় গম্ভীর, কিন্তু কাজ না থাকলে সবসময় হাসির কথা বলে। কেন যেন প্রথম থেকেই রানাকে খুব শ্রদ্ধার সঙ্গে নিয়েছে সে, প্রায় প্রতিটা কথা স্যর না বলে শুরু বা শেষ করে না।

আমরা উইলকক্স আইস স্টেশনের দিকে চলেছি, বলল রানা। আপনারা দেখে আসুন কোথায় গেছে ওই সিগনাল। কাজ শেষে সোজা স্টেশনে চলে আসবেন।

জী, স্যর।

দুই ঘণ্টার ভিতর ফিরবেন। রেঞ্জফাইণ্ডার পিছন দিকে চালু করুন। পিছনে কেউ থাকলে আমি আগেই জানতে চাই।

জী, স্যর।

ও, আরেকটা কথা, বলল রানা।

সেটা কী, স্যর?

কাউকে বেশি খাটাবেন না।

জী, স্যর।

ফিসফিস এক, আউট।

ফিসফিস দুই, আউট।

পাঁচ সেকেণ্ড পর ডানদিকে বাঁক নিল দ্বিতীয় হোভারক্রাফট, সোজা ঢুকে পড়ল তুষার-ঝড়ের ভিতর।

 ০৩.

একঘণ্টা পর উপকূল চোখে পড়ল, হাই-পাওয়ার্ড ফিল্ডগ্লাসের ভিতর দিয়ে প্রথমবারের মত উইলকক্স আইস স্টেশন দেখল মাসুদ রানা।

বরফে ছাওয়া জমিতে প্রথমে ওটাকে কোনও স্টেশন মনে হলো না। বড়জোর বলা যেতে পারে পেটমোটা গম্বুজওয়ালা কয়েকটা দালান। সবই তুষারের ভিতর ডুবে আছে আধাআধি।

কমপ্লেক্সের ঠিক মাঝে মেইন বিল্ডিং। চারকোনা ভিত্তি উপর প্রকাণ্ড গোল গম্বুজ। দালানের ভিত্তি দৈর্ঘ্য ও প্রস্থে এব শ ফুটের বেশি হবে না। উচ্চতা বড়জোর দশ ফুট।

প্রধান গম্বুজের একটু দূরে অপেক্ষাকৃত ছোট আরেকটা দালান। ওটার ছাতের উপর এক পায়ে দাঁড়িয়ে আছে বিধ্বস্ত রেডিয়ো অ্যান্টেনা। উপরের অর্ধেক কোমর ভেঙে নীচের দিকে নেমে এসেছে। নীচের অংশ এখনও দাঁড়িয়ে আছে শুধু কয়েকটা টানটান কেবলের জোরে। নানা জায়গা থেকে ঝুলছে বরফ। চারপাশে বাতি বলতে শুধু মেইন ডোম, ওটার ভিতর থেকে আসছে সাদা আলো।

স্টেশন থেকে আধ মাইল দূরে হোভারক্রাফট রাখতে বলেছে রানা। যানটা থেমে যেতেই খুলে গেল পোর্ট-সাইড দরজা, একইসঙ্গে হোভারক্রাফটের ফুলে ওঠা স্কার্টে পা রাখল সবাই, তারপর লাফ দিয়ে নেমে পড়ল শক্ত জমাট তুষারে। একপলক চারপাশ দেখে নিয়ে স্টেশনের দিকে ডাবল-মার্চ শুরু করল দলটি। হৌউউ-হৌউউ করুণ আওয়াজ তুলছে ঝোড় হাওয়া, সাগরের দিক থেকে ক্লিফের উপর ঢেউ আছড়ে পড়বার বুম বুম আওয়াজ আসছে।

তোমরা সবাই জানো কী করতে হবে, হেলমেট মাইকে বলল রানা।

বরফ-সাদা ক্লিয়ার্ডের ভিতর ছড়িয়ে পড়ল দলটি। ছুটে চলেছে স্টেশনের দিকে।

    .

সার্জেন্ট হোসেন আরাফাত দবির তুবড়ে যাওয়া হোভারক্রাফট দেখবার অনেক আগেই সামনের বরফে দেখতে পেয়েছে চওড়া ফাটল।

তুষারের মাঝে মানুষের হাস্যরত দুই ঠোঁট যেন ওটা, কমপক্ষে চল্লিশ গজ বিস্তৃত, অনেক গভীর।

মস্ত ফাটল থেকে এক শ গজ দূরে হোভারক্রাফট রেখেছে সার্জেন্ট। সে নামবার পর তুষারযান থেকে নেমে এল কয়েকজন মেরিন এবং বাঙালি সৈনিক। পিচ্ছিল বরফের ভিতর সাবধানে সামনে বাড়ল সবাই, পৌঁছে গেল ফাটলের কাছে।

এই দলের ক্লাইম্বার কর্পোরাল নাজমুল, তাকে হার্নেসে আটকে দিল সার্জেন্ট হোসেন আরাফাত দবির। নাজমুল বিড়ালের মতই সাবলীল, চটপটে, ওজনেও কম, বয়স মাত্র তেইশ। ওর আরেক নাম: প্রফেসর শঙ্কু। ছেলেমি চেহারা। পাগলের মত পড়ে সায়েন্স ফিকশন।

হার্নেসে দড়ি আটকে দিতেই উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল নাজমুল, পেটের উপর ভর করে ক্রল শুরু করল। দেখতে না দেখতে চলে গেল ফাটলের কিনারায়, গলা বাড়িয়ে দেখে নিল নীচের দিক।

হায় আল্লা…।

দশ গজ পিছনে হেলমেট মাইকে সার্জেন্ট হোসেন আরাফাত দবির জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে, নাজমুল?

ওরা সব নীচে, স্যর, চাপা শ্বাস ফেলল কর্পোরাল। কনভেশনাল ক্রাফট। গায়ে ফ্রেঞ্চ ভাষায় কী যেন লেখা। ক্রাফটের তলা থেকে খসে পড়েছে পাতলা বরফের মেঝে। তুষারের ব্রিজ পেরুতে গিয়েই এই অ্যাক্সিডেন্ট। ..

সার্জেন্ট দবিরের দিকে মাথা ঘোরাল সে, থমথম করছে মুখ। শর্ট-রেঞ্জ রেডিয়ো ফ্রিকোয়েন্সিতে হালকা শোনাল ওর কণ্ঠ: সবাই মরে ভূত, স্যর!

নেমে পড়ো, বাছা।

আড়াই মিনিট পর খাতের তলদেশের কাছে পৌঁছে গেল নাজমুল।

চল্লিশ ফুট উপর থেকে পড়ে ভচকে গেছে হোভারক্রাফটের নাক, ফাটল ধরেছে প্রতিটি জানালার কাঁচে ওখানে তৈরি হয়েছে অসংখ্য মাকড়সার জাল। এরই ভিতর সবকিছুকে ছেয়ে ফেলেছে হালকা, তুষার, ইতিহাস থেকে মুছে দিতে শুরু করেছে ওদের অস্তিত্ব।

হোভারক্রাফটের সামনের উইন্ডস্ক্রিন ভেদ করে ছিটকে পড়েছে দুই আরোহী, ফাটলের দূর-প্রান্তে মৃতদেহ, মরেছে ঘাড় মটকে। বরফ হয়ে যাওয়া রক্তের পুকুরের ভিতর নিথর।

ভুতুড়ে পরিবেশ, বার কয়েক শিউরে উঠল নাজমুল।

হোভারক্রাফটে আরও লাশ আছে, আবছা দেখা গেল। ফাটা কাঁচের ওপাশে নক্ষত্র আকৃতির জমাট রক্তের দাগ।

নাজমুল? হেলমেট ইন্টারকমে শুনল কর্পোরাল। নীচে কেউ বেঁচে আছে?

মনে হয় না, স্যর, বলল নাজমুল।

ইনফ্রা-রেড দিয়ে পরীক্ষা করে দেখো, পরামর্শ দিল দবির। হাতে বিশ মিনিট, তারপর রওনা হব। কেউ বেঁচে থাকলে তাকে ফেলে যেতে চাই না।

আমেরিকান মেরিনদের হেলমেটের ইনফ্রা-রেড ভাইযার চালু করল নাজমুল, এখন দেখলে কেউ ভাববে ও ফাইটার বিমানের পাইলট।

বিধ্বস্ত হোভারক্রাফটের উপর মনোযোগ দিল, দেখতে পেল–ইলেকট্রনিক নীল ইমেজারি। হোভারক্রাফটের ইঞ্জিন শীতল, কোথাও হলুদ রং নেই। ভাইযারের কারণে কালোর উপর নীল রঙা দেখাল ক্র্যাশ সাইট! তার চেয়ে বড় কথা, হোভারক্রাফটের ভিতর কমলা বা হলুদ রঙের কোনও দেখা নেই। বরফের মতই ঠাণ্ডা হয়ে গেছে লাশগুলো।

নাজমুল বলতে শুরু করল, স্যর, ইনফ্রারেড থেকে যা বুঝলাম…

ঠিক তখনই ওর নীচ থেকে সরে গেল জমিন। সাবধান হওয়ার কোনও সুযোগই পেল না নামজুল, ওজন নিতে গিয়ে মটমট করে ওঠেনি বরফের মেঝে, স্রেফ খসে পড়ল সব।

এতই দ্রুত ঘটল, আরেকটু হলে বুঝত না সার্জেন্ট দবির। ফাটলের কিনারায় শুয়ে নীচে চেয়েছে সে, পরমুহূর্তে দেখল এক সেকেণ্ডে উধাও হয়েছে কর্পোরাল। ছেলেটির পিছু নিয়ে সরসর করে ছুটছে কালো দড়ি!

নাজমুল পড়ল! দড়ি ধরো! হুঙ্কার ছাড়ল সার্জেন্ট দবির। আলগা হাতে দড়ি ধরেছে দুই মেরিন, কিন্তু কথাটা শুনে দেরি করল না, দুই হাতে খ করে ধরল লাইন। তারা দুজন অপেক্ষা করছে জোর ঝুঁকির জন্য।

ফাটলের কিনারা থেকে সরসর করে নামছে দড়ি, কিন্তু দুই সেকেণ্ড পর ঝটাং করে টানটান হয়ে গেল।

উঠে দাঁড়িয়েছে সার্জেন্ট দবির, কিনারা থেকে এক পা পিছাল, তারপর উঁকি দিল খাতের ভিতর।

পড়ে আছে বিধ্বস্ত হোভারক্রাফট, বরফের দেয়ালের কাছে দুই মৃতদেহ। তারপর নাজমুলকে দেখল দবির, হোভারক্রাফটের স্টারবোর্ড দরজা থেকে দুই ফুট উপরে দড়ি থেকে ঝুলছে সে।

বাছা, ঠিক আছ তো? হেলমেট মাইকে জানতে চাইল দবির।

জানতাম, স্যর, আমাকে মরতে দেবেন না, বলল নাজমুল।

একমিনিট ঝুলে থাকো, তুলে আনছি।

জী, স্যর। হোভারক্রাফটের স্টারবোর্ড দরজার দিকে চাইল নাজমুল, পরক্ষণে আঁৎকে উঠল। হায় আল্লা! স্য–র!

    .

কাঠের প্রকাণ্ড দরজার উপর করাঘাত করল মাসুদ রানা।

উইলকক্স আইস স্টেশনের চারকোনা ভিত্তির মাঝে দরজা। ওখানে যেতে হলে সরু এক র‍্যাম্প বেয়ে আট ফুট নামতে হয়।

আবারও করাঘাত করল রানা। মূল ভিত্তির প্যারাপেটে আছে ও, উপর থেকে দরজার উপর টোকা দিচ্ছে।

দশ গজ পিছনে, র‍্যাম্পের মুখে দুই পা ছড়িয়ে উপুড় হয়ে শুয়েছে গানারি সার্জেন্ট পল সিংগার, ম্যাকমার্ডো থেকে রওনা হওয়ার আগে নিজেকে সার্জেন্ট ভাইপার বলে পরিচয় দিয়েছে। এখন তার হাতে এম-সিক্সটিন ই অ্যাসল্ট রাইফেল, তাক করেছে বদ্ধ দরজার উপর।

কয়েক মুহূর্ত পর কর্কশ কটকট আওয়াজ তুলল কাঠের দরজা, শ্বাস আটকে ফেলল রানা। তুষারের মেঝেতে এসে পড়ল সরু রুপালি আলো। ধীরে ধীরে খুলে যাচ্ছে দরজা।

রানার নীচে র‍্যাম্পে এসে দাঁড়াল এক লোক। পরনে তার কমপক্ষে সাত পরত পোশাক। হাতে কোনও অস্ত্র নেই।

হঠাৎ সতর্ক হয়ে উঠল লোকটা, বোধহয় সামনের র‍্যাম্পে সার্জেন্ট ভাইপারকে শুয়ে থাকতে দেখেছে। তার নাকের উপর তাক করা হয়েছে এম-১৬ ই অ্যাসল্ট রাইফেল।

এক পা নড়বেন না, লোকটার পিছন থেকে বলল রানা। আমরা বাংলাদেশ আর্মির সদস্য, সঙ্গে ইউনাইটেড স্টেটসের মেরিন। .

জমাট বরফের মূর্তি হয়ে গেল লোকটা।

রানার ইয়ারপিসে এক নারী কণ্ঠ বলল, দুই নম্বর ইউনিট, হাজির। সব সিকিউর করা হয়েছে।

তিন নম্বর ইউনিট, সব সিকিউর।

ঠিক আছে, আমরা সদর-দরজায় পৌঁছে গেছি। বরফের শেলফ থেকে লোকটার পাশে নেমে এল রানা, দ্রুত হাতে সার্চ করল।

র‍্যাম্প বেয়ে নামল গানারি সার্জেন্ট, হাতের রাইফেল তাক করেছে দরজার উপর।

বরফের মূর্তিকে বলল রানা, আপনি আমেরিকান? নাম কী?

নন, জে সুই ফ্রাঁসোয়া, আড়ষ্ট স্বরে বলল সে। এবার ইংরেজিতে জানাল, আমার নাম ম্যাথিউ ফ্যেনুয়্যা।

০৪.

অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশকে বিশ্বের শেষ নিরপেক্ষ এলাকা মনে করেন বহু অ্যাকাডেমিক পর্যবেক্ষক। এই মহাদেশে প্রথাগত কোনও পবিত্র-ভূমি নেই যে সেজন্য ধর্ম-যুদ্ধ হবে, এখানে কোনও সীমানা নিয়ে লড়তে হয় না। সবার কাছে চাঁদের ভূমির মত এই সুদূর মহাদেশ, বিশাল-বিরান প্রান্তরে সবাই মিলেমিশে বাস করতে পারবে। অবশ্য, যদি এই চরম পরিবেশে টিকে থাকতে পারে!

ঊনিশ শ একষট্টি সালের অ্যান্টার্কটিকা চুক্তি দেখলে মনে হতে পারে, বিশাল এক পিঠা ভাগ করা হয়েছে। এক অংশ করে পেয়েছে প্রতিটি পক্ষ। এর ভিতর চিলি, আর্জেন্টিনা ও ব্রিটেন মিলে ভোগ করবে একই এলাকা। অন্যরাও বিশাল এলাকা পেয়েছে। অস্ট্রেলিয়া পেয়েছে একাই অ্যান্টার্কটিকার চার ভাগের এক ভাগ জমি। মহাদেশের এক অংশ অ্যামুসেন সাগর ও বায়ার্ড ল্যাণ্ড, এসব এলাকার কর্তৃত্ব কারও হাতেই নেই।

সাধারণ বুদ্ধি থেকে মনে হতে পারে: এই মহাদেশ আসলে সত্যিকারের আন্তর্জাতিক এলাকা। কিন্তু বাস্তবে বিষয়টি অত সহজ নয়। অনেকে বলবেন: অ্যান্টার্কটিকায় সবার রাজনৈতিক সম অধিকার আছে। কিন্তু তারা কথা দিয়ে যতই উড়িয়ে দিতে চান, : বাস্তব হচ্ছে: অ্যান্টার্কটিকার জমি নিয়ে প্রচণ্ড বিরোধ রয়েছে আর্জেন্টিনা ও গ্রেট ব্রিটেনের ভিতর। শক্তিশালী বেশ কয়েকটি দেশ মেনেও নেয়নি ঊনিশ শ পঁচাশি সালের ইউএন রেযোলিউশন, তারা কখনও মানবে না অ্যান্টার্কটিকার গোটা এলাকা হওয়া উচিত সমস্ত মানব-সভ্যতার জন্য মুক্ত। চুক্তিবদ্ধ দেশগুলো বেশ কিছু বিষয়ে একদম চুপ থেকেছে। ঊনিশ শ পঁচানব্বই সালে গ্রিনপিসের রিপোর্টে বলা হয়েছে: ফ্রেঞ্চ সরকার, ভিক্টোরিয়া ল্যাণ্ডের উপকূলে গোপনে নিউক্লিয়ার বোমার পরীক্ষা চালিয়েছে। বড়রা কেউ এ নিয়ে কোনও উচ্চবাচ্য করেনি। আসল কথা হচ্ছে: সাধারণ সব দেশকে শক্তিশালী সব দেশের আঙুল শাসানি মেনেই চলতে হবে।

তার চেয়ে বড় কথা: সীমান্ত-বিহীন এই এলাকায় শত্রু হামলা হলে কীভাবে তা ঠেকানো হবে, সে বিষয়ে কোনও আইন বা নীতি প্রণয়ন করা হয়নি।

 হাজার মাইল দূরে একেকটা রিসার্চ স্টেশন, কিন্তু সেসব এলাকায় মাঝে মাঝেই আবিষ্কার হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ, দুস্প্রাপ্য ও মূল্যবান বস্তু–যেমন ইউরেনিয়াম, পুটোনিয়াম, সোনা ইত্যাদি। এমনও তো হতে পারে, ভিন কোনও দেশ বাধ্য হয়ে কাঁচা-রসদ বা মূল্যবান কিছুর খোঁজ পেলে দখল করতে সেনাবাহিনী: পাঠাবে। হয়তো সে জিনিস সম্বন্ধে সাধারণ মানুষ এখনও জানে না।

আগে কখনও দেশগুলোর ভিতর এমন ধরনের লড়াই শুরু হয়নি অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশে।

কিন্তু প্রথমবার বলে একটা কথা আছে।

উইলকক্স আইস স্টেশনের ভিতর ফ্রেঞ্চম্যান ম্যাথিউ ফ্যেনুয়্যার পাশে হাঁটতে গিয়ে এই কথাগুলোই ভাবছে মাসুদ রানা।

ম্যাকমার্ডোতে পৌঁছে রেকর্ড করা রাফায়লা ম্যাকানটায়ারের ডিসট্রেস সিগনাল শুনেছে. ও। মহিলা জানিয়েছে, উইলকক্স আইস স্টেশনের নীচে চাপা পড়ে আছে একটা স্পেসক্রাফট। এখন সত্যিই যদি ওই স্টেশনের বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করে থাকেন এক্সট্রা-টেরেস্ট্রিয়াল স্পেসশিপ, সন্দেহ নেই অন্য দেশও ওই জিনিস দখল করতে আগ্রহী হয়ে উঠবে। কিন্তু তারা আমেরিকান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে স্ট্রাইক টিম পাঠাতে সাহস পাবে কি না, সেটা সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়।

চিফ আমাকে সব ঘুরে দেখতে বলেছেন, মনে মনে বলল রানা। এখনও খচূ-খচ্‌ করছে ওর মন। আমেরিকান রিসার্চ স্টেশনের দরজায় ফ্রেঞ্চ লোক দেখে কু ডাকতে শুরু করেছে মন। বরফের টানেলের ভিতর হেঁটে চলেছে এখন। এক পা পিছনে আসছে ম্যাথিউ ফ্যেনুয়্যা। আগের চেয়ে একটু বেশি শক্ত করে অটোমেটিক পিস্তলের বাঁট ধরল রানা।

আঁধার টানেল ফুরিয়ে এল, সামনে আলোকিত ফাঁকা এক জায়গায় পৌঁছে গেল ওরা। দাঁড়িয়ে পড়ল রানা, পায়ের নীচে সরু, কালো, ধাতব ক্যাটওয়াক। চোখ ফেলল চারপাশে। জায়গাটা মস্ত এক ড্রামের মত। নীচে ফাঁকা শূন্যতা।

মাটির নীচে, থুক্ক, বরফের নীচে এটা বিশাল এক ব্যারেল, মনে মনে বলল রানা। ব্যারেলের চারদিকে গেছে কালো রঙের সরু সব ক্যাটওয়াক। মাঝে বিশাল শাফট। ওপাশে বোধহয় সায়েন্টিস্টদের ল্যাব ও কোয়ার্টার। এই ব্যারেলের অনেক নীচে গোলাকার পানির প্রকাও এক নীল পুল। তার মাঝখানে স্টেশনের ডাইভিং বেল ভাসছে।

এই পথে আসুন, হাতের ইশারা করে ডানদিক দেখাল ফ্যেনুয়্যা। সবাই ডাইনিংরুমে।

ফ্রেঞ্চ লোকটাকে এক ফুট পিছনে নিয়ে বিশ কদম যাওয়ার পর আলোকিত ঘরে পৌঁছে গেল রানা। ওর মনে হলো প্লে গ্রুপের ক্লাসরুমে ঢুকে পড়েছে। ও এমন এক আগন্তুক, যাকে দেখে ভয় পেতে পারে বাচ্চারা।

গোলাকার এক টেবিল ঘিরে বসা পাঁচজন পুরুষ ও নারী। পুরুষদের গালে খোঁচা-খোঁচা দাড়ি, ময়লা হয়ে গেছে মহিলার পোশাক। সবাইকে হতক্লান্ত মনে হলো। রানা দরজা দিয়ে ঢুকতেই ওর দিকে চাইল বিষন্ন চোখগুলো।

এরা কেউ বাঙালি নয়, বুঝল রানা। বাঙালি বিজ্ঞানীদের বোধহয় আগেই হোভারক্রাফট করে সরিয়ে নেয়া হয়েছে।

ঘরে আরও দুজন লোক, টেবিলের পিছনে। এরা আলাদা, পরনে নতুন পোশাক, চেহারায় কোনও ক্লান্তি নেই। বোধহয় ম্যাথিউ ফ্যেনুয়্যার সঙ্গে এসেছে। ডানদিকের লোকটার হাতে ধোঁয়া ওঠা কফি, সুপ বা চায়ের ট্রে। টেবিল ঘুরে এগুতে শুরু করেছিল, কিন্তু রানা ঘরে ঢুকতেই থমকে দাঁড়িয়েছে সে।

ডিসট্রেস সিগনাল পেয়ে এসেছে ডিখ-ঈলেখের ফ্রেঞ্চ বিজ্ঞানীরা, ভাবল রানা। অবশ্য, তা না-ও হতে পারে।

চুপ সবাই। চোখ রানার উপর। ওকে ভিনগ্রহের মানুষ মনে হচ্ছে তাদের কাছে। হেলমেট, বডি আর্মার, তুষারের ফেটিগ, কাঁধে এমপি-৫ মেশিন পিস্তল, হাতে .৪৪ অটোমেটিক পিস্তল।

রানা ও ফ্যেনুয়্যার পর ঘরে ঢুকেছে সার্জেন্ট পল সিংগার। এবার তার উপর স্থির হলো সবার চোখ। অন্য গ্রহের প্রাণী আরেকটা বেড়েছে। হেলমেটের ভাইযারের কারণে রানা ও ভাইপারকে মনে হচ্ছে যেন দুই যমজ ভাই। কিন্তু একজনের চামড়া বাদামি, অাজনের ত্বক ফকফকে সাদা।

আপনাদের কোনও ভয় নেই, নরম সুরে বলল ম্যাথিউ ফেয়্যা। এঁরা আমেরিকান মেরিন, সঙ্গে বাংলাদেশ আর্মির ইউনিট। এঁরা আপনাদেরকে সরিয়ে নেবেন।

ফোস করে দম ফেলল মহিলা। ওহ, যিশু, অস্পষ্ট সুরে বলল। কাঁদতে শুরু করেছে। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ!

আমেরিকান উচ্চারণ, খেয়াল করেছে রানা! চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়াল মহিলা, ওর দিকে এগিয়ে এল। গাল বেয়ে দরদর করে গড়াচ্ছে অশ্রু। ভেজা স্বরে বলল, জানতাম, আপনারা ঠিকই আসবেন।

রানার শোল্ডারপ্লেট আঁকড়ে ধরল মহিলা, ভিনদেশি সৈনিকের বুকে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করেছে। কোনও সান্ত্বনা দিতে গেল না রানা। মহিলা থেকে একটু দূরে রেখেছে পিস্তল। প্রয়োজন পড়লে দেরি না করে ব্যবহার করবে।

ঠিক আছে, ম্যাম, নিচু স্বরে বলল রানা। তাকে পথ দেখিয়ে কাছের এক সিটের পাশে চলে গেল, হাতের ইশারা করল বসতে। চিন্তা করবেন না, ম্যাম। এখান থেকে আপনাদেরকে সরিয়ে নেয়া হবে।

মহিলা চেয়ারে বসবার পর সবাইকে দেখে নিল রানা। লেডিজ অ্যাণ্ড জেন্টলমেন, আমরা কজন বাংলাদেশ থেকে এসেছি, সঙ্গে ইউনাইটেড স্টেটসের মেরিন কর্পসের সাত নম্বর ইউনিটের কয়েকজন। হাতের ইশারায় সার্জেন্টকে দেখাল রানা। ও ইউএস মেরিন কর্পস্-এর গানারি সার্জেন্ট পল সিংগার। আমি বাংলাদেশের, মেজর মাসুদ রানা। আমরা ডিসট্রেস সিগনাল পেয়ে এসেছি। আপনাদেরকে এখান থেকে সরিয়ে নেব। তার আগে, সিকিউর করা হবে এই স্টেশন। আমাদের কাজ আপনাদেরকে নিরাপদ রাখা, এবং ম্যাকমার্জোয় পৌঁছে দেয়া।

টেবিলের ওপাশে স্বস্তির বড় শ্বাস ফেলল এক লোক।

আশা করি কোনও ভুল ধারণা করবেন না, বলল রানা, আমাদের সঙ্গী মেরিন সৈনিকরা রিকনিস্যান্স ইউনিট, তারা আপনাদেরকে এখান থেকে সরিয়ে নেবে না। তাদের কাজ স্টেশন পাহারা দেয়া। এদিকে বাংলাদেশ আর্মির দায়িত্ব আপনাদেরকে নিরাপদে ম্যাকমাৰ্ডোয় পৌঁছে দেয়া। ঝড় কমে এলেই এ কাজে হাত দেব আমরা। অবশ্য, ধারণা করছি তার আগেই পুরো ইকুইপৃড় এক্সট্রাকশন টিম পৌঁছে যাবে।

ম্যাথিউ ফ্যেনুয়্যা এবং টেবিলের পিছনে দাঁড়ানো দুই লোকের পকে চাইল রানা। আপনারা বিজ্ঞানী, এসেছেন ডিখ-ঈলেখ, থেকে। …ভুল ধারণা করেছি?

ট্রে হাতে লোকটা মস্ত ঢোক গিলল। বিস্ফারিত হয়ে উঠেছে দুই চোখ।

না, ঠিকই বলেছেন, বলল ফ্যেনুয়্যা। আমরা রেডিয়ো মেসেজ পেয়ে যত দ্রুত সম্ভব এখানে এসেছি। এঁদের সাহায্য করতে।

এক নারী-কণ্ঠ বলে উঠল রানার ইয়ারপিসে, ইউনিট টু। চারপাশ ঘুরে দেখেছি, সব ঠিক আছে, স্যর।

ইউনিট থ্রি। আমরা তিনটা… না, চারটে কন্ট্যাক্ট পেয়েছি ড্রিলিং রুমে। আমরা এখন তাদের নিয়ে উঠে আসছি।

ফ্যেনুয়্যার দিকে চাইল রানা। আপনাদের সবার নাম?

আমি প্রফেসর ম্যাথিউ ফ্যেনুয়্যা, বলল ফ্রেঞ্চম্যান। ইনি গ্যাসোয়া ভিভাদিয়েখ, আর ট্রে হাতে উনি ডক্টর স্যাঁ ডেনি পেঁয়েযি।

এদের নাম মিলে গেছে। ম্যাকমার্ডো থেকে দ্য মার্ভেল অভ গ্রিসে ফ্রেঞ্চ বিজ্ঞানীদের নামের লিস্ট পাঠানো হয়েছে, তার সঙ্গে মিলছে সব। সন্দেহ নেই, এঁরা ফেনুয়্যা, ভিভাদিয়েখ এবং পেয়েযি, এসেছেন ডিখ-ঈলেখ থেকেই।

দরজার উপর টোকা পড়তেই ঘুরে চাইল রানা।

খোলা দরজার উপর এসে দাঁড়িয়েছে সার্জেন্ট জনি ওয়াকার। গাঁট্টাগোট্টা লোক সে, বয়স ছিচল্লিশ, মেরিন দলে সবচেয়ে বয়স্ক। বেশিরভাগ সময় কুঁচকে রাখে নাক, দেখায় কুকুরের মত। বহুবছরের অভিজ্ঞতার ছাপ চেহারায়। তার দশ গজ পিছনে তার পার্টনার কর্পোরাল টনি কেলগ। স্বাভাবিকের চেয়ে দীর্ঘ সে, চিকন-চাকন, কুচকুচে কালো চেহারা, বয়স মাত্র একুশ বছর।

দুই মেরিনের মাঝে তাদের খাটুনির ফসল: এক রূপবতী মহিলা, এক লোক, এক কিশোরী আর একটা সিল মাছ অবশ্য মাছ বলা হলেও আসলে এরা তিমির মতই স্তন্যপায়ী জন্তু, ম্যামাল।

০৫.

ওঁরা চারঘণ্টা আগে এসেছেন, বলল নিনা ভিসার।

এ-ডেকের ক্যাটওয়াকে দাঁড়িয়েছে নিনা ভিসার ও রানা, এখান থেকে আইস স্টেশনের মূল অংশ চোখে পড়ছে।

নিনা এরই ভিতর রানাকে জানিয়েছে, উইলকক্স আইস স্টেশনটা: বরফের শেলফের ভিতর খাড়া করে গাঁথা বিশাল একটা ব্যারেলের মত। এই ফ্যাসিলিটি পুরো পাঁচতলা। একেবারে নীচতলা সাগর-সমতলে।

সিলিন্ডারের প্রতি তলায় রয়েছে কিছু ধাতব ক্যাটওয়াক; দুপাশের দেয়ালে খাড়া, সরু রাং ল্যাডার; ওগুলো দিয়েই ওঠা-। নামা করতে হয়। এই ফ্যাসিলিটি ফাঁকা ফায়ার এস্কেপের মতই। চারপাশে বরফের দালান। প্রতিটি তলায় ক্যাটওয়াক মিশেছে চারটে সমতল মেঝের টানেলে। মাঝের মস্ত শাফট ঘিরে এসব টানেল। কমপাসের চার কাটার মতই উত্তর-দক্ষিণ পুব ও পশ্চিমে গেছে।

একেকটি লেভেলকে একতলা ধরে নেয়া হয়েছে। এ থেকে শুরু করে ই লেভেল নাম দেয়া হয়েছে। ফ্যাসিলিটির সবচেয়ে উপরে এ-ডেক। আর ই-ডেক একদম নীচে, ওখানে। রয়েছে ধাতব একটি প্ল্যাটফর্ম। তার ভিতর সাগরের পানির মস্ত পুল। নিনা জানিয়েছে, ব্যারেলের মাঝে সি-ডেক, ওখানে রিট্রাক্টেবল একটা সেতু বাড়িয়ে দেয়া যায় স্টেশনের শাফটের উপর।

এরা কজন এসেছে? জানতে চাইল রানা।

প্রথমে তিনজন, তারপর আরও দুজন, বলল নিনা। আমাদের সঙ্গে রয়ে গেছে চারজৰ। শেষজন আমেরিকান ও বাঙালি বিজ্ঞানীদেরকে নিয়ে হোভারক্রাফটে করে ডিখ, ঈলেখের দিকে রওনা হয়েছে।

আপনি এদের চেনেন?

সা ডেনি পেয়েযি ও ম্যাথিউ ফ্যোনুয়্যাকে চিনি, বলল নিনা। আমার ধারণা, ভীষণ ভয় পেয়ে প্রস্রাব করে ফেলেছে পেয়েযি, আপনারা যেভাবে অস্ত্র নিয়ে এসে ঢুকলেন! …আর চতুর্থ লোকটাকেও চিনি, তার নাম দু লা বোয়াবার্থেলিউ।

সার্জেন্ট জনি ওয়াকার একটু আগে নিনা ভিসারকে নিয়ে। ডাইনিংরুমে ঢুকবার দু মিনিটের ভিতর রানা বুঝে গেছে, কিছু জানতে চাইলৈ এই মহিলার কাছেই প্রশ্ন করতে হবে। ম্যাকমার্ডো থেকে রওনা হওয়ার আগে ওকে বলা হয়েছে, গত এক সপ্তাহের পরিস্থিতি কেমন ছিল তা জেনে নিলে ওর সুবিধে হবে।

অন্যরা ক্লান্ত এবং ভীত, কিন্তু নিনা ভিসার শক্ত রয়েছে। মনে হচ্ছে সবার দায়িত্বে আছে সে-ই। ওয়াকার ও কেলগ রানাকে বলেছে, ফ্যাসিলিটি সিকিউর করতে গিয়ে ই-ডেকে মহিলাকে পেয়েছে। আধহাত কালো দাড়িওয়ালা এক ফ্রেঞ্চ বিজ্ঞানীকে ড্রিল রুম ঘুরিয়ে দেখাচ্ছিল সে।

স্টেশনের বিশাল শাফটের দিকে চেয়ে আছে নিনা ভিসার, আপাতত গভীর চিন্তার ভিতর ডুবে গেছে। তার দিকে চাইল রানা। নিনা ভিসারের চেহারাটা খুবই আকর্ষণীয়, দেখলে মনে হয়। বয়স পঁচিশের বেশি। গাঢ় বাদামি চোখ, কাঁধে ফুলে ওঠা কালো চুলের মেঘ। একটু উঁচু চোয়াল, কিন্তু বেমানান লাগে না। ঠোঁট দুটো মায়াবী কবিতার মত। মহিলার কণ্ঠে চকচক করছে রুপালি চেইনে ঝোলানো একটা লকেট।

হঠাৎ করেই ক্যাটওয়াকে এসে দাঁড়াল ছোট্ট একটি মেয়ে। রানা আঁচ করল, ওর বয়স বড়জোর দশ! খাটো করে ছাঁটা সোনালি চুল, বোতামের মত ছোট্ট নাক, চোখে ভারী কাচের চশমা। কমিকের চরিত্রের মত লাগছে মেয়েটিকে, ফুলে ওঠা বড় একটা পারকা পরেছে–উলের হুড ঝুলছে ওর মাথার পিছন অংশে।

মেয়েটির পিছনে ক্যাটওয়াকে এসে থেমেছে সিল মাছটি।

ওর নাম কী? নিনা ভিসারের কাছে জানতে চাইল রানা।

ও আমার মেয়ে, মেরি, মেয়েটির কাঁধ চাপড়ে দিল নিনা। মেরি, ইনি মেজর রানা।

হাই, মেরি, বলল রানা।

কয়েক সেকেণ্ড চুপ রইল মেয়েটি, নিস্পলক দেখছে রানাকে। চোখ আটকে গেছে মেরিনদের দেয়া আমার, হেলমেট ও অস্ত্রের উপর।

দেখতে দারুণ লাগছে আপনাকে, শেষ পর্যন্ত বলল।

তা-ই? মৃদু হাসল রানা।

চোখদুটো যেন কালো সাগরের মত গভীর।

তোমার বয়স কত, মেরি?

বারো, প্রায় তেরো হতে চলেছে।

আচ্ছা?

হা। বয়সের তুলনায় একটু খাটো আমি।

আমিও, বলল রানা। পায়ের দিকে চাইল। থপথপ করে এগিয়ে এসেছে সিল, শুকে দেখছে ওর হাঁটু। আর তোমার বন্ধু? ওর নাম কী?

ও একটা মিষ্টি মেয়ে, নাম লিলি।

উবু হলো রানা, হাত বাড়িয়ে দিতেই ওটা শুকল সিল মাছ। খুব বড় নয় লিলি, আকারে মাঝারি কুকুরের সমান। গলা থেকে ঝুলছে সুন্দর একটা লাল কলার।

লিলি কী ধরনের সিল? জানতে চাইল রানা। আলতো চাপড় দিল ওটার মাথায়। 

আর্কটাসেফালাস গেযেলা, বলল মেরি। আর্কটিকের ফার সিল।

রানার হাতের চারপাশে মাথা দিয়ে গুঁতো দিতে শুরু করেছে লিলি, বুঝিয়ে দিচ্ছে ওর কানের পিছন দিকটা চুলকে দিতে হবে। নীরব নির্দেশ পালন করল রানা, তারপর হঠাৎ করেই কাত হয়ে পড়ে গেল সিল, চিত হয়ে গিয়ে ধরল পেট।

ও বুলছে ওর পেট চুলকে দিতে হবে, হেসে ফেলল মেরি। খুব খুশি হয়। 

ক্যাটওয়াকে শুয়ে অপেক্ষা করছে লিলি। ফ্লিপারগুলো উঁচু করে দৈহ থেকে সরিয়ে রেখেছে। আরও নিচু হলো রানা, ব্যস্ত হাতে চুলকে দিল মসৃণ পেট।

আপনি সারাজীবনের জন্যে একজন বন্ধু পেলেন, মন্তব্য করল নিনা ভিসার। মনোযোগ দিয়ে রানাকে দেখছে সে।

ভাল বন্ধু পেলে সব সময়েই ভাল লাগে, সোজা হয়ে দাঁড়াল রানা।

জানতাম না যারা যুদ্ধ করে, তারা বন্ধুত্বও করে, হঠাৎ করেই বলল নিনা। অস্বস্তির ভিতর ফেলে দিয়েছে রানাকে।

এক মুহূর্ত পর বলল রানা, সবাই তো আর পাষণ্ড হয় না।

কিন্তু আপনারা এখানে এসেছেন একটা জিনিস নিতে।

সুন্দরী মহিলার চোখে চোখ রাখল রানা। কয়েক সেকেণ্ড পর চোখ সরিয়ে নিল নিনা। রানা বুঝে গেল, বোকা নয় মহিলা।

আগের প্রসঙ্গে ফেরা যাক, বলল ও। আপনি ওঁদের দুজনকে ভাল করেই চেনেন। আর তৃতীয়জনের সঙ্গেও পরিচয়, হয়েছে, ঠিক?

হা।

আর চতুর্থজন… গ্যাসেয়া ভিভাদিয়েখ?

তার সঙ্গে আগে কখনও দেখা হয়নি।

রানা জানতে চাইল, ওঁরা মোট কজনকে ডিখ-ঈলেখ-এ নিয়ে গেছেন?

হোভারক্রাফটে বড়জোর ছয়জন আঁটে, কাজেই পাঁচজন বিজ্ঞানীকে নিয়েছেন।

আর নিজেদের চারজনকে এখানে রেখে গেছেন।

ঠিকই ধরেছেন।

মহিলার দিকে চেয়ে আছে রানা। এবার কয়েকটা বিষয় পরিষ্কার করে নেয়া যাক। যেমন, বরফের নীচে আপনারা কী পেয়েছেন; বা রাশেদ হাবিব… স্টেশনে যে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটেছে… থেমে গেল রানা।

কী ইঙ্গিত করা হয়েছে, বুঝতে পেরেছে মহিলা। বাঙালি মেজর চাইছে না, বাচ্চা মেয়ের সামনে খুন নিয়ে আলাপ হোক।

হ্যাঁ, আলাপটা সেরে নেয়াই ভাল, আড়ষ্ট মুখে বলল নিনা ভিসার।

উইলকক্স আইস স্টেশনের চারপাশে নজর বোলাল রানা। অনেক নীচে সুনীল পানির পুল। একতলা উপর থেকে শুরু হয়েছে ক্যাটওয়াক। তারপর টানেলের ওপাশে বরফের দালান। সেসব অবশ্য দেখা যাচ্ছে না। রানার চোখ ভাসা ভাসা ভাবে সবই দেখছে, কিন্তু মন অন্যখানে। অন্তর বলছে, এখানে বড় ধরনের কোনও গোলমাল চলছে। কিন্তু আঙুল তুলে নির্দিষ্ট কিছু দেখাতে পারবে না।

কয়েক সেকেণ্ড পর জানতে চাইল রানা, আমি যদি ভুল বলি, আমাকে শুধরে দেবেন। এই স্টেশন তো বরফের শেলফ খুঁড়ে তৈরি? প্রতিটি দেয়াল বরফের, সেক্ষেত্রে বরফ গলছে না কেন? আপনারা নানান মেশিনারি ব্যবহার করছেন, এতে প্রচুর তাপ হওয়ার কথা।

আগেও অ্যান্টার্কটিকায় এশিয়ানদের দুএকটা স্টেশনে বিসিআইয়ের কাজে এসেছে রানা। শেষবার মস্ত বিপদে পড়েছিল, সেবার ঠেকাতে হয় শ্বেতাঙ্গদের ভয়ঙ্কর চক্রান্ত এবং হামলা।

এখন নিনা ভিসারের কাছ থেকে এই আমেরিকান স্টেশনের বিষয়ে প্রয়োজনীয় তথ্য চাইছে ও। কখন-কী-কোন্ তথ্যের প্রয়োজন পড়বে, বলা যায় না।।

আপনি খুবই ভাল প্রশ্ন করেছেন, বলল নিনা ভিসার। আমরা আমেরিকানরা যখন এখানে এলাম, দেখা গেল কোর ড্রিলিং মেশিন থেকে প্রচণ্ড তাপ তৈরি হচ্ছে। ফলে বরফের দেয়াল গলতে শুরু করল। তখন সি-ডেকে কুলিং সিস্টেম বসানো হলো। তারপর থেকে একটা থার্মোস্ট্যাট সারাক্ষণ স্টেশনের তাপমাত্রা মাইনাস এক ডিগ্রিতে রাখে। মজার ব্যাপার, উপরে হয়তো হিমাঙ্কের তিরিশ ডিগ্রি নীচে আবহাওয়া, কাজেই কুলিং সিস্টেম ভিতরের পরিবেশ উষ্ণ করে। এতে আমরা সবাই খুশি।

খুশি হওয়ারই কথা, চারদিক দেখছে রানা। আবার ডাইনিংরুমের দরজার উপর চোখ পড়ল ওর। ম্যাথিউ ফ্যেনুয়্যা এবং অন্য তিন ফ্রেঞ্চ ভিতরে, উইলকক্স আইস স্টেশনের বাসিন্দাদের সঙ্গে একই টেবিলে বসেছে। ক্যাটওয়াক থেকে তাদেরকে চোখে পড়ছে।

আপনি আমাদের সবাইকে ফিরিয়ে নিতে এসেছেন? হঠাৎ রানার পিছন থেকে জানতে চাইল মেরি।

চিন্তিত চোখে চার ফ্রেঞ্চকে দেখছে রানা, কয়েক সেকেণ্ড পর মেয়েটির দিকে ফিরল! এখনই নয়, মেরি। তার আগে কিছু কাজ শেষ করতে হবে।

০৬.

চওড়া বরফের টানেলের ভিতর হেঁটে চলেছে নিনা ভিসার ও রানা। ওদের পিছনে কর্পোরাল কেলগ ও সার্জেন্ট ওয়াকার।

ওরা চারজন রয়েছে বি-ডেকে, প্রধান লিভিং এরিয়ায়। বড় একটা মোড় ঘুরতেই বরফের দেয়ালের ভিতর দুপাশে শুরু হয়েছে দরজা, ওপাশে রয়েছে বেডরুম, কমনরুম, নানা ল্যাবোরেটরি ও স্টাডিরুম। একটা দরজা মনোযোগ কেড়ে নিল রানার। ওটার উপর বায়োহ্যায়ার্ড সাইন আঁকা। ত্রিকোণ প্লেটে লেখা:

বায়োটক্সিন ল্যাবোরেটরি।

ম্যাকমার্ডো পৌঁছবার পর জানতে পারলাম, বাঙালি এক বিজ্ঞানী অন্য আরেক বিজ্ঞানীকে খুন করেছেন, বলল রানা। তাঁর অভিযোগ ছিল, চুরি করা হচ্ছে তাঁর রিসার্চের তথ্য।

রানার দিকে চাইল নিনা ভিসার। পাগলামি ছাড়া আর কী! তাঁর রিসার্চের তথ্য অন্য কেউ চুরি করবে কেন!

টানেলের শেষে পৌঁছে গেছে সবাই, সামনে বরফের ভিতর বড় একটা দরজা। তার উপর পেরেক ঠুকে কাঠের তক্তা আড়াআড়ি ভাবে আটকে দেয়া হয়েছে।

রাশেদ হাবিব, বিড়বিড় করে বলল রানা, পরক্ষণে নিনার দিকে চাইল। উনিই না প্রথম স্পেসশিপ আবিষ্কার করেন?

ভুল শুনেছেন। ওটা প্রথম দেখতে পেয়েছিলেন জন প্রাইস। রাশেদ হাবিব খুন করেছেন চার্লস মুনকে। আসলে রিসার্চ পেপার নিয়ে দুজনের এমন কোনও বিবাদ হয়নি যে একেবারে খুনই করে ফেলতে হবে। নিশ্চয়ই এর ভিতর কোনও জটিলতা ছিল।

রানা এবং ওর দল ম্যাকমার্ডো পৌঁছে উইলকক্স আইস স্টেশনের উপর সংক্ষিপ্ত ব্রিফিং পেয়েছে। তাতে মনে হয়েছে খুবই সাধারণ ফ্যাসিলিটি ওটা। ওখানে কাজ করেন কয়েক পেশার লোক। যেমন: সাগরের প্রাণী নিয়ে গবেষণা করছেন মেরিন বায়োলজিস্টরা; বরফের ভিতর আটকা পড়া ফসিল পরীক্ষা করছেন প্যালিয়েনটোলজিস্টরা; খনিজ সম্পদ খুঁজছেন জিয়োলজিস্টরা; বরফের ভিতর গভীর গর্ত খুঁড়ে হাজার বছরের কার্বন মনোক্সাইড ও অন্যান্য গ্যাস খুঁজছেন রাশেদ হাবিবের মত জিয়োফিযিসিস্টরা।

কদিন আগে উইলকক্স আইস স্টেশনে অত্যন্ত অস্বাভাবিক একটা ঘটনা ঘটেছে। রাফায়লা ম্যাকানটায়ার ডিসট্রেস সিগনাল পাঠানোর দু এক দিন আগে আরেকটি হাই-প্রায়োরিটি সিগনাল পাঠানো হয়েছে এই স্টেশন থেকেই। তাতে বলা হয়েছে, যত দ্রুত সম্ভব যেন এক স্কোয়াড় মিলিটারি পুলিশ পাঠানো হয়।

ওই সিগনালের বক্তব্য অস্পষ্ট ছিল, কিন্তু আঁচ করা যায়, এক ঝঙালি বিজ্ঞানী খুন করে ফেলেছেন তাঁর এক কলিগকে।

তক্তা দিয়ে আটকানো দরজা দেখছে রানা, একবার চারপাশের টানেল দেখে নিল। ভাবছে, আপাতত জানবার উপায় নেই আসলে এখানে কী ঘটেছে। মেজর জেনারেল (অব.) রাহাত খানের কথা মনে পড়ল। ওকে আবছা কিছু নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। ওর বুঝতে দেরি হয়নি, উনি আসলে কী চান।

মেরিন দলের সঙ্গে উইলকক্স আইস স্টেশনে পৌঁছবে, বাঙালি বিজ্ঞানী ও নুমার রিসার্চারদের পৌঁছে দেবে ম্যাকমার্ডো স্টেশনে। কিন্তু তার আগে, সুযোগ হলে দেখবে ওই স্টেশনে এটা সত্যিই স্পেসশিপ কি না। যদি পারো, ওটা সম্বন্ধে তথ্য জোগাড় করবে।

এদিকে ম্যাকমার্ডোর ব্রিফিং রুমে আমেরিকার আণ্ডারসেক্রেটারি অভ ডিফেন্স স্পিকারফোনে বলেছেন: সন্দেহ নেই ওই ডিসট্রেস সিগনাল অন্য দেশের কর্তৃপক্ষও শুনতে পেয়েছে। মিস্টার রানা, সত্যি যদি ওখানে এক্সট্রা-টেরেস্ট্রিয়াল ভেহিকেল থাকে, আপনাদের উপর যে-কোনও রকম হামলা আসতে পারে। আমেরিকান সরকার চাইছে না এমন নাজুক পরিস্থিতি হোক। এবং সেজন্য মেরিনদের পাঠানো হচ্ছে। অবশ্য, এই মুহূর্তে আমাদের সেনাবাহিনীর বড় কোনও দল ম্যাকমাৰ্ডোয় নেই। আর সেকারণেই অ্যাডমিরাল হ্যামিলটনের মাধ্যমে আপনার কাছে সাহায্য চেয়েছি আমরা। মেরিন সৈনিকরা ওই স্পেসশিপের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে। …এখন আমরা চাই, আপনি তাদের নেতা হিসাবে থাকুন। শুনেছি আপনার সঙ্গে বাংলাদেশ আর্মির কয়েকজন অফিসার ও নন-কমিশণ্ড অফিসার রয়েছে। তাদেরকে পাশে পেলে আমরা খুবই খুশি হব। পরে আমাদের সেনাবাহিনী ওখানে পৌঁছে গেলে আপনারা বিজ্ঞানীদের ম্যাকমাৰ্ডোয় পৌঁছে দেবেন। মিস্টার রানা, দয়া করে মনে রাখবেন, যে ভাবেই হোক, ওই স্পেসশিপ আমাদের হাতে আসতে হবে। অন্য কারও হাতে ওই জিনিস পড়লে গোটা পৃথিবী জুড়ে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হতে পারে। আবারও বলছি, ওই স্পেসশিপের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। অন্য সব বিষয় এখন গৌণ হয়ে উঠেছে।

ভদ্রলোক তাঁর বক্তব্যে, বাঙালি বা আমেরিকান বিজ্ঞানীদের নিরাপত্তা বা তাদের ভালমন্দের বিষয় একটিবারও উল্লেখ করেননি। আবার একটু আগে নিনা ভিসার একই কথা বলেছে: সরকার আমাদের নিরাপত্তা নিয়ে ভাবছে না, তাদের প্রথম এবং শেষ কথা, বিজ্ঞানীরা মরলে মরুক, স্পেসশিপ হাতে পেতে হবে।

রানা স্থির করেছে, পাতাল বরফের টানেলে স্পেসশিপ দেখতে এখনই ডুবুরি পাঠাবে না। ওর মন বলছে, এই স্টেশনে বড় ধরনের সমস্যা চলছে। তার উপর পরিস্থিতি একদম বদলে গেছে ফ্রেঞ্চ লোকগুলো আসবার পর। এখন নিজের ইউনিট ও মেরিনদের ছাড়া কারও উপর বিশ্বাস রাখা মস্ত ভুল হবে।

দরজার দিক থেকে চোখ সরাল না রানা, নিনা ভিসারকে বলল, সংক্ষেপে বলুন কী ঘটেছে।

রাশেদ হাবিব স্ট্যানফোর্ডের জিয়োফিযিসিস্ট, দ্বিতীয়বার পিএইচ.ডি.-র জন্য কাজ করছিল। তার রিসার্চ ছিল আইস কোরের উপর। তার সুপারভাইযার ছিলেন ডক্টর চার্লস মুন। আইস কোরের বিষয়ে অদ্ভুত সব তথ্য পাচ্ছিল রাশেদ হাবিব। অন্য কেউ বরফের এত গভীরে গর্ত করতে পারেনি। সে পৌঁছে যায় এক কিলোমিটারের বেশি নীচে।

আইস কোর বিষয়ে সামান্য ধারণা আছে রানার। সাধারণত বরফের শেলফে তিরিশ সেন্টিমিটার চওড়া গর্ত করা হয়, অনেক গভীর থেকে তুলে আনা হয় সিলিণ্ডারের মত কোর। সেই বরফের কোরের ভিতর বদ্ধ গ্যাসগুলো পরীক্ষা করা হয়। পাওয়া যায় হাজার বছর আগের বাতাস, বোঝা যায় সে আমলে কেমন ছিল পরিবেশ।

তা যাই হোক, বলল নিনা, সপ্তাহখানেক আগে দুর্দান্ত একটা আবিষ্কার করল রাশেদ হাবিব। উপরের দিকে উঠে আসা বরফ ভেদ করল তার ড্রিল। সেই বরফ ছিল প্রিহিস্টোরিক। কোনও এককালে বড় কোনও ভূমিকম্পে ওই বরফ উঠে আসে নীচ থেকে। রাশেদ হাবিব কোরের পকেটে তিন শ মিলিয়ন বছর আগের বাতাস পেয়ে গেল। যে-কোনও জিয়োফিযিসিস্টের জন্য এটা সারাজীবনের সবচেয়ে বড় অসামান্য সুযোগ। আগে কখনও কেউ ওই সময়ের পরিবেশ সম্পর্কে জানতে পারেনি। চিন্তা করুন, তখনও পৃথিবীতে ডাইনোসর আসেনি। শ্রাগ করল নিনা ভিসার। কোনও অ্যাকাডেমিকের জন্য ওটা রংধনুর শেষ প্রান্তে সোনার কলস বলতে পারেন। খ্যাতি ছাড়াও শুধু লেকচার সার্কিটেই লক্ষ লক্ষ ডলার উপার্জন করতে পারবেন তিনি। …তারপর দুএক দিন পর আর ড্রিলিং ভেক্টর সামান্য বদলে নিল রাশেদ হাবিব–ভেক্টর বলতে বরফের ভিতর ড্রিলের অ্যাঙ্গেল বদল করা এবং, কপাল কাকে বলে, পনেরো শ ফুট নীচে পেয়ে গেল বরফের ভিতর চার শ মিলিয়ন বছর আগের ধাতু।

রানাকে এর গুরুত্ব বুঝতে দেয়ার জন্য একটু থামল নিনা ভিসার।

চুপ রইল রানা।

এরপর আমরা ডাইভিং বেল নীচে পাঠালাম, বলল নিনা। বরফের শেলফের ভিতর কিছু সনিক-রেসোন্যান্স টেস্ট করা হলো। আর ওখানেই একটা গুহার ভিতর আবিষ্কার করা হলো প্রাগৈতিহাসিক সেই ধাতু। আরও পরীক্ষা করতে গিয়ে দেখা গেল, ওই গুহা থেকে একেবারে তিন হাজার ফুট নীচে নেমে গেছে এক বরফের সুড়ঙ্গ। তখন সাগরে নেমে ওই সুড়ঙ্গ দিয়ে ডুবুরিদের উপরে উঠতে বলা হলো। সেখানেই জন প্রাইস খুঁজে পেলেন ওই স্পেসশিপ। আর এর পর হারিয়ে গেল সব কজন, ডুবুরি।

রানা জানতে চাইল, এসবের সঙ্গে ডক্টর চার্লস মুন হত্যাকাণ্ডের কী সম্পর্ক?

মুন ছিলেন রাশেদ হাবিবের সুপারভাইর, বলল নিনা। সবসময় রাশেদ হাবিবের কাঁধের উপর দিয়ে অদ্ভুত সব আবিষ্কার দেখছিলেন তিনি। ক্রমে প্যারানয়ার ভিতর চলে যায় হাবির। বলতে শুরু করে মুন তার রিসার্চ চুরি করছেন। তার আবিষ্কার নিয়ে গোপনে আর্টিকেল লিখছেন।

আসলে রাশেদ হাবিবের ভয় পাওয়ারই কথা, বহির্বিশ্বে। অনেক বেশি যোগাযোগ ছিল ডক্টর মুনের। জার্নালে লিখলে তার কথাই বিশ্বাস করবে সবাই। এডিটররা তাকে ভাল করেই চিনতেন। একমাসের ভিতর তার আর্টিকেল ছাপা হবে, কিন্তু হাবিব চাইলেও ছয় মাসের মধ্যে নিজের আর্টিকেল প্রকাশ করতে পারত না। এর পর, ধাতু আবিষ্কার হওয়ার পর হাবিব মনে করল, তার হীরার খনি চুরি করছেন মুন।

এ কারণে ডক্টর মুনকে খুন করে ফেললেন হাবিব?

হ্যাঁ। গত শুক্রবার রাতে। ডক্টর মুনের ঘরে গেল রাশেদ হাবিব, তারপর শুরু হলো চেঁচামেচি। আমরা সবাই শুনতে পেয়েছি সেই চিৎকার। ভীষণ খেপে গেল হাবিব। আগেও এমন করেছে, তাই আমরা বেশি গা করিনি। কিন্তু, এবার ডক্টর মুনকে খুনই করে ফেলল সে।

কীভাবে খুন করল? দরজার উপর চোখ রানার।

সে… একপলক দ্বিধা করল নিনা ভিসার। ডক্টর মুনের ঘাড়ে হাইপোডারমিক নিডল গেঁথে দিল। ভিতরে ছিল বিষাক্ত ইণ্ডাস্ট্রিয়াল-স্ট্রেংথ ড্রেন-ক্লিনিং ফ্লুইড।

আচ্ছা। দরজার দিকে ইশারা করল রানা। ঘরে আছেন উনি?

ওই ঘটনার পর নিজেই নিজেকে আটকে রেখেছে, বলল নিনা। এক সপ্তাহের খাবার নিয়ে ঘরে ঢুকে বলেছে, আমরা যদি তাকে ধরতে চাই, সে আমাদেরকেও খুন করবে। ভীষণ ভয় পেয়েছি আমরা। পুরো পাগল হয়ে গেছে লোকটা। তারপর একরাতে… নীচের গুহায় ডুবুরি নামাবার আগের রাত ছিল সেটা… আমরা সবাই মিলে বাইরে থেকে তক্তা দিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলাম। দরজার দুপাশে রানার লাগালেন জন প্রাইস, আর আমরা ঠিক জায়গায় ধরলাম আড়া। তারপর একটা রিভেট গান দিয়ে দরজা আটকে দিলেন প্রাইস।

ভদ্রলোক এখনও বেঁচে আছেন? জানতে চাইল রানা।

হ্যাঁ। তার নড়াচড়ার আওয়াজ পাবেন। এখন বোধহয় ঘুমিয়ে আছে। নইলে নানান আওয়াজ তৈরি করত।

দরজার কিনারা দেখতে শুরু করল রানা। শক্ত ভাবেই। দরজায় রিভেট লাগানো হয়েছে। আপনাদের বন্ধু পোক্ত কাজই করেছেন, বলল রানা। ঘুরে দাঁড়াল। অবশ্য উনি ভিতরে থেকে থাকলে। আপাতত তাঁকে নিয়ে ভাবছি না। …আপনারা তো নিশ্চিত ওই ঘর থেকে কোনও পথে বেরুনো যায় না?

এটাই একমাত্র দরজা।

অন্য কোনও পথে বেরুনো যায় না? যদি বরফের দেয়াল, মেঝে বা ছাত খুঁড়ে বের হন?

ইস্পাতের পাত দিয়ে মোড়া সিলিং এবং মেঝে, খুঁড়ে, বেরুতে পারবে না। আর এই ঘর করিডোরের শেষমাথায়। পিছনে বা দুপাশে কোনও ঘরও নেই। জমাট বরফ দিয়ে তৈরি দেয়াল। বেরুনোর কোনও উপায় নেই তার।

সেক্ষেত্রে আপাতত ওখানেই থাকুন, বলল রানা, বরফের টানেলে ফিরতি পথ ধরল, আমাদের হাতে এখন অন্য কাজ আছে।

কী করবেন ভাবছেন?

প্রথমে জানতে হবে গুহার ভিতর ডুবুরিদের কী হয়েছে।

০৭.

ওয়াশিংটন ডি.সি.-র আকাশে ঘন কালো মেঘ জমেছে, থমথম করছে পরিবেশ। এঁকেবেঁকে ঝলসে উঠছে নীলচে বিদ্যুৎ। যেকোনও সময়ে ঝমঝম করে নামবে বৃষ্টি। অথচ, মাত্র ঘণ্টা দুয়েক আগে নীল আকাশে ঝলমল করছিল সোনালী সূর্য।

বিলাসবহুল লাল কার্পেট মোড়া ক্যাপিটল বিল্ডিঙের এক প্রান্তে এইমাত্র মিটিং হল-এ বিরতি নিয়েছেন ডেলিগেটরা। সবার ফোল্ডার বন্ধ হয়ে গেছে। চেয়ার পিছনে ঠেলে উঠে। দাঁড়িয়েছেন সবাই, কোটের পকেটে চলে গেছে রিডিং গ্লাস। বিরতি ঘোষণা হতেই যার যার বসের পাশে চলে গেছে এইডরা, হাতে সেলুলার ফোন, ফোল্ডার ও ফ্যাক্সের বার্তা।

কী বুঝলে, এরিক? নিজ এইডকে বললেন স্থায়ী ইউএস রিপ্ৰেযেন্টেটিভ, জ্যাক মার্টিন। এইমাত্র নেগোশিয়েটিং রুম ত্যাগ করেছেন গোটা ডেলিগেশনের বারোজন ফ্রেঞ্চ। আজ এই নিয়ে চারবার বিরতি নিল ওরা।

ফ্রেঞ্চ মিশনের নেতা মোটা এক লোক, নাম জঁ পিয়েরে কুই। তার চাহনি দেখলে মনে হতে পারে, অন্যদেরকে অনেক নিচু শ্রেণীর মানুষ মনে করেন তিনি। এইমাত্র দলের সবাইকে নিয়ে বেরিয়ে গেছেন। আপনমনে আরেকবার মাথা নাড়লেন জ্যাক মার্টিন।

তিনি সারাটা জীবন ধরেই কূটনীতিক, বয়স চলছে ছাপ্পান্ন, বছর, বেশ বেঁটে মানুষ; কখনও স্বীকার করবেন না, কিন্তু গত দুবছরে একটু মোটাও হয়ে গেছেন। পূর্ণিমার চাঁদের মত গোল মুখ, ঘোড়ার ক্ষুরের আকৃতির ধূসর চুলগুলো খুলি কামড়ে আরও পিছাতে শুরু করেছে। হাড়ের ফ্রেমের চশমা ব্যবহার করেন, পুরু কাঁচের কারণে স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বড় দেখায় নীল চোখদুটো।

উঠে দাঁড়ালেন তিনি, আড়মোড়া ভাঙলেন। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে চোখ রাখলেন বিশাল হলরুমে। ঘরের মাঝে প্রকাণ্ড গোলাকার টেবিল ঘিরে নির্দিষ্ট জায়গা ছেড়ে যোলোটি আরামদায়ক, নরম চামড়া মোড়া চেয়ার।

এই সভার মূল এজেণ্ডা: নতুন করে নিজেদের ভিতর সব। ধরনের বিরোধের নিষ্পত্তি করে নেবে মিত্রশক্তির দেশগুলো।

টিভির খবরে আন্তর্জাতিক মিত্রপক্ষীয় নেতারা হাতে-হাত মিলিয়ে যে হাসিখুশি ভাব দেখান, বেশির ভাগ সময়ই তা নকল হয়; প্রায়ই দেখা যায় বানোয়াট হাসি দিয়ে নিজেদের দুশ্চিন্তা লুকিয়ে রাখছেন। হয়তো দেখা গেল হোয়াইট হাউস থেকে বেরিয়ে এলেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ও অন্য দেশের প্রধানমন্ত্রী দুই দেশের পতাকার পাশে ক্যামেরার সামনে করমর্দন করলেন, কিন্তু বাস্তব হচ্ছে: কোনও চুক্তি সম্পাদন, প্রতিজ্ঞা ভাঙা, পরস্পরের উপর এসপিয়োনাজ, কূটনীতিকদের কামড়া-কামড়ি–এসবই গোপনে চলে মিটিংরুমে, ক্যামেরার আড়ালে। আজ সে-কাজেই ব্যস্ত ইউএস রিপ্রেযেক্টেটিভ জ্যাক মার্টিন। কূটনীতিকদের হাসি ও করমর্দন আসলে জটিল এক প্রক্রিয়ার কেকের বড়জোর আইসিং। কূটনীতিকরা একে অপরের কাছ থেকে কী সুবিধা আদায় করবেন, সেটাই একমাত্র উদ্দেশ্য।

আন্তর্জাতিক মিত্রপক্ষীয় দেশ মানেই সত্যিকারের মিত্র দেশ–নয়। এটা আসলে একে অপরকে ল্যাং মেরে পিছনে ফেলে এগিয়ে যাওয়ার প্রতিযোগিতা। বন্ধুত্ব যদি সুবিধা এনে দেয়, তো খুবই ভাল। সুবিধা যদি না পাওয়া যায়, সেক্ষেত্রে সাধারণ সম্পর্ক বজায় রাখাই যথেষ্ট। আন্তর্জাতিক বন্ধুত্ব মানেই বৈদেশিক সাহায্য, অন্য দেশের সামরিক ক্ষমতাকে মেনে নেয়া এবং ব্যবসায়িক সহায়তা পাওয়া। এতে প্রয়োজন পড়ে হাজার হাজার কোটি ডলার। এ বিষয়কে হালকা ভাবে উড়িয়ে দেয়া যায় না।

সেকারণেই ওয়াশিংটন ডি.সি.-র গ্রীষ্মের এই মেঘলা দিনে ক্যাপিটল বিল্ডিঙে হাজির হয়েছেন জ্যাক মার্টিন। তিনি একজন নেগোশিয়েটার। তার চেয়েও বড় কথা: তিনি একজন দক্ষ কূটনীতিক। আজ তাঁর সমস্ত কূটনৈতিক দক্ষতা কাজে লাগছে।

মিত্রপক্ষীয় দেশ আমেরিকা ও ফ্রান্সের ভিতর আজকের বিশেষ এই সভা শুধু নিজ বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য নয়, তার চেয়েও জটিল কিছু বিষয় স্থির করবার জন্য।

একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকের পর মিত্রপক্ষীয় দেশগুলো আগে কখনও এমন গুরুত্বপূর্ণ সভায় বসেনি।

আজ কূটনীতিক বা নেগোশিয়েটাররা বসেছেন দ্য নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইযেশন বা ন্যাটোর জন্য নিজেদের দরদাম কষতে।

এরিক, তুমি কি জাননা গত চল্লিশ বছর ধরে ফ্রান্সের বৈদেশিক নীতি হচ্ছে পশ্চিমা বিশ্বে ইউনাইটেড স্টেটসের ক্ষমতা হ্রাস করা? জানতে চাইলেন জ্যাক মার্টিন। বুঝে গেছেন ফ্রেঞ্চ ডেলিগেশন ফিরতে দেরি করবে।

তাঁর এইড এরিক হোমসের বয়স পঁচিশ বছর। ছেলেটি হারভার্ড থেকে ব্যাচেলার ডিগ্রি নিয়েছে আইনের উপর। কোনও জবাব দেয়ার আগে দ্বিধা করল সে। বুঝতে পারছে না কেন তাজা বোমার মত কথা বলছেন মার্টিন। সুইভেলিং চেয়ারে ঘুরে এরিকের দিকে চাইলেন কূটনীতিক। পুরু কাচের ওপাশ থেকে তরুণকে দেখছেন।

না, স্যর, আমি এ বিষয়ে তেমন কিছুই জানি না, বলল। . এরিক।

চিন্তিত ভঙ্গিতে মাথা দোলালেন মার্টিন। ওরা আমাদেরকে বুনো ষাঁড় মনে করে। আমরা যেন কোনও মানুষই নই, বিয়ার গিলতে থাকা লাল ঘাড়ওয়ালা বেবুন। তাদের মনের দুঃখ: দুর্ঘটনাবশত আমাদের হাতে এসে পড়েছে পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র। আর সে কারণেই আমরা হয়ে উঠেছি। পৃথিবীর হর্তাকর্তা। এ কারণে বড় কষ্ট ওদের মনে। ওরা তো এখন ন্যাটোর পূর্ণ সদস্য পদেও নেই। ওদের ধারণা, ইউএসএ শুধু অস্ত্রের জোরে ইউরোপের ঘাড়ে চেপে বসেছে। এটা ইউরোপিয়ান দেশগুলোর জন্য ভয়ঙ্কর অপমানজনক।

হাসি চাপলেন মার্টিন। তাঁর মনে পড়েছে, ঊনিশ শ ছিষট্টি সালে ন্যাটোর সম্মিলিত সামরিক কমাণ্ড থেকে পদত্যাগ করে ফ্রান্স, তার মূল কারণ ছিল, তারা চায়নি ন্যাটোর অধীনে থাকুক তাদের নিউক্লিয়ার ওয়েপন্স। তারা ধরেই নেয়, যে-কোনও সময়ে ওসব বোমা চলে, যেতে পারে আমেরিকার হাতে। সে সময়ের ফ্রেঞ্চ প্রেসিডেন্ট চার্লস দ্য গল পরিষ্কারভাবে বলে দেন, ন্যাটো আসলে আমেরিকানদের একটা সংগঠন। ফ্রান্স এখন ন্যাটোর নর্থ আটলান্টিক কাউন্সিলে সাধারণ পদ নিয়েছে, এবং সেটা করেছে সবার উপর চোখ রাখতেই।

এরিক বলল, স্যর, অনেকে ফ্রেঞ্চদের সঙ্গে একমত। তাঁরা অ্যাকাডেমিক ও ইকোনমিস্ট। তাঁরা বলেন ন্যাটো আসলেই আমেরিকানদের সংগঠন। আমরা ইউরোপের উপর নিজেদের অস্ত্রের ক্ষমতা দেখাচ্ছি।

হাসলেন জ্যাক মার্টিন। তিনি জানেন, ভাল ছেলে এরিক, কলেজে লেখাপড়াও করেছে, কোনও মৌলবাদী নয়, কিন্তু কফির আসরে বসে ফিলোসফিক্যাল তর্ক করতে বসা ছেলেমেয়েদের মতই বোকা। এই ধরনের তরুণ বা তরুণীরা আরও ভাল কোনও দুনিয়া আশা করে। সেজন্য অনেক কথাই বলে; কিন্তু বাস্তব কথা হচ্ছে: দুনিয়া সম্পর্কে এদের কোনও ধারণাই নেই। এরিকের কথায় রাগ করেননি মার্টিন। বরং এরিকের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে ভাল লাগছে তার। কিন্তু মিটিং থেকে কী বুঝলে, এরিক? আবারও জানতে চাইলেন তিনি।

কয়েক মুহূর্ত চুপ রইল এরিক। তারপর বলল, আমেরিকা ন্যাটোর মাধ্যমে ইউরোপিয়ান দেশগুলোকে অর্থনৈতিক এবং টেকননালজির দিক থেকে পঙ্গু করে রেখেছে। বিশেষ করে নিরাপত্তার দিক থেকে। এমন কী উন্নত দেশ ইংল্যাণ্ড বা ফ্রান্সও জানে, তাদের যদি সেরা অস্ত্রের সিস্টেম পেতে হয়, তা হলে হাত পাততে হবে আমাদের কাছে। এ ধরনের অবস্থায় অদের সামনে মাত্র দুটো পথ খোলা হয় হাতে হ্যাট নিয়ে আমাদের দরজায় টোকা দেবে, নইলে যোগ দিতে হবে ন্যাটোতে! যতটা জানি, আমেরিকা কখনও ন্যাটোর বাইরের কোনও দেশকে প্যাট্রিয়ট মিসাইল সরবরাহ করেনি। জী, স্যর, আমি মনে করি ন্যাটোর মাধ্যমে ইউরোপের উপর ছড়ি ঘোরাচ্ছি আমরা।

মন্দ বলোনি, এরিক। কিন্তু একটা কথা মন দিয়ে শুনে নাও, গোটা পরিস্থিতি আরও অনেক জটিল, বললেন মার্টিন। হোয়াইট হাউস প্রথম থেকেই আমেরিকার জাতীয় নিরাপত্তা দেখছে। সেখান থেকেই নির্দেশ আসছে, দুনিয়ার উপর ছড়ি ঘোরাতে হবে। আমরা ইউরোপের উপর নিজেদের কর্তৃত্ব হারাতে চাই না, এরিক। বিশেষ করে অর্থনৈতিক ও প্রকৌশলের দিক থেকে। এদিকে ফ্রান্স চাইছে আমরা যেন আমাদের কর্তৃত্ব হারাই। এবং সে কারণেই গত দশ বছরেরও বেশি হলো ফ্রেঞ্চ সরকার চাইছে ইউরোপে যেন দাপট কমে আসে আমেরিকার।

কোনও উদাহরণ দেবেন, স্যর? বলল এরিক।

তুমি কি জানো, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠার পিছনে সবচেয়ে বড় শক্তি ছিল ফ্রান্স?

তাই? জানতাম না, স্যর। আমি তো জানতাম…

তুমি কি জানো, ফ্রান্স প্রথম ইউরোপিয়ান দেশ যেটা প্রথম থেকেই ইউরোপিয়ান ডিফেন্স চার্টার চেয়েছে?

চুপ হয়ে গেলেন জ্যাক মার্টিন।

জী, না, স্যর, জানতাম না।

এটা কি জানো, ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সিকে সাবসিডি দিয়ে অনেক কম দামে কক্ষপথে কমার্শিয়াল স্যাটালাইট ছাড়তে সাহায্য করছে ফ্রান্স? তারা নাসার চেয়ে অনেক কম দামে এসব দিচ্ছে।

জী-না, জানতাম না।

বাছা, গত দশ বছর ধরে গোটা ইউরোপকে একত্রিত করতে চাইছে ফ্রান্স। তারা তাদের সাধারণ সব পণ্য গোটা পৃথিবীর মানুষের কাছে বিক্রি করতে চায়। ফ্রান্স এর নাম দিয়েছে রিজিওনাল প্রাইড। আমরা আমেরিকান কূটনীতিকরা বুঝতে পারছি: এসব করে ইউরোপিয়ান দেশগুলো বোঝাতে চাইছে, তারা এখন আর আমেরিকাকে তাদের পাশে চায় না।

ইউরোপের কি আসলেই আমেরিকাকে দরকার? চট করে জানতে চাইল এরিক হোস্। ভুরু কুঁচকে গেছে ওর।

দুষ্ট হাসি ফুটে উঠল মার্টিনের ঠোঁটে। যতদিন ইউরোপ আমাদের ওয়েপন্স টেকনোলজির সমান হতে না পারে–হ্যাঁ, আমাদেরকে ওদের খুবই দরকার। আমাদের ডিফেন্স টেকনোলজি অনেক আধুনিক বলে বড় কষ্ট ফ্রেঞ্চদের মনে। ওদের আজও এমন সাধ্য হয়নি যে আমাদের ধারেকাছে আসতে পারবে। এই কারণে নিজেদের ছোট মনে হয় ওদের।

আমরা যত দিন এগিয়ে থাকব, ওরা জানবে ওদের সামনে কোনও পথ নেই, বাধ্য হয়ে পিছু পিছু চলতে হবে। কিন্তু… ডানহাতের তর্জনী তুললেন মার্টিন। একবার যদি নতুন কিছু পেয়ে যায় ওরা, সেই জিনিস যদি আমাদের অস্ত্রের চেয়ে আধুনিক হয়, সেক্ষেত্রে পরিস্থিতি হঠাৎ করেই পাল্টে যেতে পারে।

মনে রাখতে হবে উনিশ শ ছেষট্টি নয় এটা। রাজনৈতিক পরিবেশ অনেক বদলে গেছে। এখন যদি ন্যাটো থেকে বেরিয়ে যায় ফ্রান্স, ধরে নিতে পারো, তার সঙ্গে ওই সংগঠন থেকে বেরিয়ে যাবে অর্ধেকের বেশি ইউরোপিয়ান দেশ। নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ যে…

ঠিক তখনই প্রকাণ্ড ঘরের দরজা খুলে গেল, পিছনে ফ্রেঞ্চ ডেলিগেশন নিয়ে টেবিলের দিকে এগিয়ে এলেন দলের নেতা জঁ পিয়েরে কুই।

সবাই যে যার সিটে বসে পড়তেই এরিকের কানে বললেন মার্টিন, আমার দুশ্চিন্তা হচ্ছে। এমনও হতে পারে, খুব আধুনিক কোনও আবিষ্কারের খুব কাছে পৌঁছে গেছে ফ্রেঞ্চরা। আজকে ওদের আচরণ খেয়াল করেছ? এরই ভিতর চারবার মিটিঙে বিরতি নিয়েছে। পুরো চারবার! তার মানে বোঝো?

তেমন কিছুই বুঝিনি, স্যর।

ওরা মিটিঙে বসে খামোকা সময় নষ্ট করছে। এমনটা করা হয় শুধু জরুরি তথ্য পাওয়ার অপেক্ষায়, কোনও খবরের আশায় থাকলে। বারবার বিরতি নিচ্ছে, যাতে ফ্রেঞ্চ ইন্টেলিজেন্সের লোক তাদেরকে বর্তমান অবস্থা জানাতে পারে। আর নেগোশিয়েটারদের চেহারা দেখে মনে হচ্ছে, জিনিসটা যাই হোক, ওটা পাল্টে দিতে পারে ন্যাটোর বর্তমান অবস্থান। …হয়তো ধ্বংসই হয়ে যাবে সংগঠনটা।

০৮.

সামান্যতম আওয়াজ না করে পানির উপর ভেসে উঠল মসৃণ, কালো মাথা। আকারে বেশ বড়, দেখলে অস্বস্তি হয়। মাথার দুপাশে নিপ্রাণ কুচকুচে কালো দুটো চোখ, একটু সামনে ভোঁতা নাক। প্রাণীটা পুলের ভিতর কিছুক্ষণ স্থির থাকল, একটু পর তার পাশে দেখা দিল আরেকটা কালো মাথা। কৌতূহল নিয়ে ই-ডেকের ব্যস্ততা দেখছে দুই দানব।

উইলকক্স আইস স্টেশনের পুলে এই দুই কিলার ওয়েইল আসলে ছোট স্পেসিমেন। যদিও, প্রতিটির ওজন কমপক্ষে পাঁচ টন। দৈর্ঘ্যে লেজ থেকে শুরু করে মাথা পর্যন্ত কমবেশি পনেরো ফুট।

একটু দূরে ধাতব ডেকে কী যেন করছে দু পেয়ে প্রাণীগুলো, কৌতূহল মিটে যেতেই, নিস্পৃহ চোখে চারপাশ দেখল দুই তিমি। গোলাকার পুলের কিনারা ধরে ঘুরতে শুরু করল। একটু পর পর পুলের মাঝে ডাইভিং বেল ঘিরে চক্কর কাটছে।

রানার নির্দেশে ডাইভিং সুট পরছে ডুবুরিরা।

তিমি দুটোর নড়াচড়া খুবই নিয়ন্ত্রিত, পুলের কিনারা ধরে ঘুরছে। একটা এক দিকে চাইলে, অন্যটা উল্টো দিক দেখছে। ভাব দেখে মনে হয় কী যেন খুঁজছে তারা।

ওরা খাপ পেতে আছে লিলির জন্য, সি-ডেকের ক্যাটওয়াক থেকে দুই তিমি দেখছে মেরি। নির্বিকার এবং ঠাণ্ডা কণ্ঠ শুনে মনেই হয় না আসলে ও বারো বছরের কিশোরী।

প্রায় দুঘণ্টা হলো ওর দল নিয়ে উইলকক্স আইস স্টেশনে এসেছে রানা। আপাতত আছে ই-ডেকে, ওর দলের ডুবুরিরা ডগলাস মওসন ডাইভিং বেল নিয়ে ডুব দেবে জন প্রাইস ও অন্যদের খোঁজে।

সি-ডেক থেকে রানা ও ডুবুরিদের দিকে চেয়ে ছিল মেরি, এমন সময় পুলের ভিতর দেখা দিয়েছে দুই কিলার ওয়েইল। মেরির পাশে উইঞ্চ কন্ট্রোলে কাজ করছে দুজন।

এদেরকে পছন্দ করে মেরি। অন্যদের মত বয়স্ক নয়, কিছু জানতে চাইলে হুঁ-হাঁ করে না, সব ভাল করে বুঝিয়ে দেয়। মেরি খুশি যে এদের দুজনের একজন মেয়ে।

লেফটেন্যান্ট তিশা করিম ছিপছিপে, সুন্দরী, দেখলে মনে হয় এমপি-৫ অস্ত্রটা ওর হাতের বাড়তি অংশ হয়ে উঠেছে। হেলমেটের নীচে চকচকে কালো দীর্ঘ চুল। মিষ্টি মুখটা দেখলে মনেই হয় না কঠোর হতে জানে। বয়স মাত্র তেইশ বছর। বাংলাদেশ আর্মির যুবক অফিসাররা ওর নাম দিয়েছে: বিদুষী। কোনও প্রেমাকাতক্ষী অফিসার এক পা সামনে বাড়লে তাকে ভাল ব্যবহারে দশ গজ পিছিয়ে দেয় তিশা। আপাতত নীচের পুলে দুই তিমির চক্কর কাটা দেখছে ও।

ওরা লিলির জন্য অপেক্ষা করছে? চট করে ক্যাটওয়াকে চোখ ফেলল তিশা। ওর পাশেই আছে গেযেলা সিল। অস্বস্তি বোধ করে ক্যাটওয়াকের কিনারা থেকে সরে গেল ওটা। মনে হলো ভয় পাচ্ছে: চল্লিশ ফুট নীচ থেকে উঠে আসবে দুই খুনি তিমি।

ওরা লিলিকে পছন্দ করে না, বলল মেরি।

কারণটা কী? জানতে চাইল তিশা।

ওরা একাকী, তার উপর তরুণ বয়সী, বলল মেরি। ওরা কাউকে পছন্দ করে না। ওদের যেন প্রমাণ দিতে হবে ওরা অন্যদের চেয়ে আকারে অনেক বড়। ছেলেরা এমনই তো হয়। কিলার ওয়েইলগুলো এমনিতেই কমবয়সী কাঁকড়া-খেকোদের ধরে খায়। কিন্তু এই দুটো কয়েকদিন আগে পুলের ভিতর লিলিকে সাঁতার কাটতে দেখেছে, তারপর থেকে বারবার ঘুরে ঘুরে আসছে।

কাঁকড়া-খেকো বলতে কী বোঝাচ্ছ? উইঞ্চ কন্ট্রোল থেকে জানতে চাইল টনিকেলগ।

এক ধরনের সিল, বলল মেরি। বেশ বড় আর মোটা। ওদেরকে তিন কামড়ে খেয়ে ফেলে কিলার ওয়েইলরা।

আস্ত সিল মাছ খেয়ে ফেলে? অবাক হয়ে জানতে চাইল টনি।

হ্যাঁ, মাথা দোলাল মেরি।

বাপরে! আগে হাইস্কুলের ছাত্র ছিল টনি, কোনও দিন ওর মনে হয়নি বই পড়া উচিত। স্কুল জীবনটা খুব কষ্টে কেটেছে। আর্মিতে যোগ দেয়ার পর ওর মনে হয়েছে কাজের কাজ করেছে, আর কখনও পড়াশোনা করতে হবে না। লিলির উপর চোখ রাখল টনি, আঁচ করছে সিলের আকার ও বয়স। তুমি এত কিছু জানলে কী করে, মেরি?

সচেতন ভাবে শ্রাগ করল মেরি। আমি অনেক বই পড়ি।

ও।

টনির দিকে চেয়ে হাসছে তিশা।

ভুরু কুঁচকে ওকে দেখল টনি। অত হাসছেন কেন?

ভাবছি তুমি মোট কয়টা বই পড়েছ।

অনেক, মাথা দোলাল টনি।

তাই? হ্যাঁ।

কমিকের বই, টনি?

আমি শুধু কমিকের বই পড়ি না, মাঝে মাঝে প্রেমের বইও পড়ি।

হাসতে শুরু করেছে মেরিও।

কুচকুচে কালো টনি খেয়াল করেছে মেরির হাসি, ভুরু আরও কুঁচকে ফেলল সে। হা-হা করার কিছু নেই। জানি কখনও কলেজের প্রফেসর হব না, তা হলে বেশি বই পড়তে যাব কেন! তিশা এখনও হাসছে, ওর দিকে চেয়ে ডান ভুরু নাচাল টনি। আপনি বুঝি খুব বই পড়েন?

না, কিন্তু তোমার চেয়ে বেশি।

আমিও পড়ি, বলল টনি। বইয়ের মতই মানুষের মন পড়তে পারি। আপনি যার জন্য জান দিতে চান, সে যে কে, তা-ও বুঝে ফেলেছি। 

তিশার চোখের পাতা বার কয়েক কাপল! চোখের ভাষা হয়ে উঠল বিমর্ষ। ঘুরে তিমিগুলোর দিকে চাইল।

একবার ওকে দেখে নিল মেরি। ইতস্তত করে জানতে চাইল, আমি কি জানতে পারি আপনার সেই মানুষটা কে?

না, আসলে কেউ নেই, পুলের দিকে চেয়ে রইল তিশা।

আমাদের দলে দেখতে সবচেয়ে সুন্দর যে পুরুষ, তাকে খুঁজে পেলেই বুঝবে সে কে, বলল টনি।

রেলিঙে কনুই রেখে কিলার ওয়েইল দেখছে তিশা, ঠিক করেছে পাত্তা দেবে না এদেরকে। স্টেশনের ভিতর চক্কর কাটছে দুই তিমি, এখনও খুঁজে চলেছে লিলিকে। একবার থমকে গেল একটা তিমি, মনে হলো দেখছে তিশাকে। তারপর এক পাশে মাথা সরাল ওটা, আরও মনোেযোগ দিয়ে চাইল।

ওরা এত দূর থেকে পরিষ্কার দেখে? মেরির কাছে জানতে চাইল তিশা। আমি তো জানতাম পানি থেকে চোখ তুললে তিমির দৃষ্টি অস্বচ্ছ হয়ে ওঠে।

অন্য সব তিমির চেয়ে কিলার ওয়েইলের চোখ অনেক বড় আর পরিষ্কার, বলল মেরি। পানি থেকে উঠলেও ভাল দেখে। …আপনি ওদের সম্পর্কে আর কিছু জানেন?

কিছু বই পড়েছি, অল্প-স্বল্প জানি ওদের বিষয়ে, কিলার ওয়েইলের দিকে চেয়ে আছে তিশা।

পুলের কিনারা দিয়ে ঘুরছে দুই তিমি। ওরা যেন পানির ভিতর টর্পেডো। ধৈর্যের অভাব নেই, শান্ত-শিষ্ট ভঙ্গি। নীচের ডেকে রানা ও অন্যদেরকে দেখছে তিশা। আবার চাইল পুলের দিকে, সাঁতার কেটে চলেছে দুই তিমি। মেরির কাছে জানতে চাইল, ভিতরে কীভাবে ঢুকল? বরফের শেলফের নীচ দিয়ে?

উপর-নীচ মাথা দোলাল মেরি। হ্যাঁ। এই স্টেশন তো সাগর থেকে মাত্র এক শ গজ দূরে। আর বরফের শেলফ খুব গভীরও নয়, বড়জোর পাঁচ শ ফুট। শেলফের নীচ দিয়ে আসে ওরা, এখানে এসে ভেসে ওঠে স্টেশনের ভেতর।

পুলের আরেক দিকে চলে গেছে দুই তিমি, ওগুলোর দিকে আবারও চাইল তিশা। ওগুলোর ভঙ্গি খুব শান্ত, যেন দুই কুমির অপেক্ষা করছে শিকার ধরবার জন্য।

চারপাশ দেখা শেষে খুব ধীরে ডুবে গেল তিমি দুটো। পানিতে তৈরি হলো ছোট দুটো ঢেউ। চোখ খুলে রেখেছে তিমিদুটো, চেয়ে আছে উপরের দিকে।

ওরা হঠাৎ করেই বিদায় নিচ্ছে, মন্তব্য করল তিশা।

ডাইভিং প্ল্যাটফর্মের পাশে পুল এখন খালি। দক্ষিণের সুড়ঙ্গ থেকে সার্জেন্ট জনি ওয়াকারকে বেরিয়ে আসতে দেখল তিশা। লোকটার কাঁধের উপর কয়েকটা স্কুবা : ট্যাঙ্ক। নিনা ভিসার ওদেরকে জানিয়েছে, দক্ষিণ সুড়ঙ্গে ছোট একটা মালবাহী এলিভেটার আছে, ওটা দিয়ে ই-ডেকে নামানো যায় ডাইভিং গিয়ার। ওই লিফট ব্যবহার করেছে ওয়াকার।

প্ল্যাটফর্মের আরেক দিকে চোখ গেল তিশার। ওখানে মাথা ঝুঁকিয়ে কী যেন করছে মাসুদ রানা। ডান হাত রেখেছে কানের উপর। যেন হেলমেট ইন্টারকমে কিছু শুনছে। তারপর হঠাৎ করেই কাছের একটা রাং-মইয়ের দিকে রওনা হলো সে। হাঁটতে হাঁটতে হেলমেট মাইকে কী যেন বলছে।

স্টেশনের আরেক প্রান্তে রাং-ল্যাডারের কাছে থেমে চট করে তিশার দিকে চাইল। খড়খড় আওয়াজের ভিতর দিয়ে মানুষটার কণ্ঠ শুনল তিশা: তিশা, টনি, এ-ডেকে ওঠো। জলদি।

কাছের রাং-ল্যাডারের দিকে রওনা হলো তিশা, হেলমেট মাইকে বলল, কী হয়েছে, স্যর?

খুব গম্ভীর কণ্ঠে রানা বলল, বাইরে ট্রিপ-ওয়ায়ারে ছেদ পড়েছে। সার্জেন্ট ভাইপার ওখানে আছে। এইমাত্র বলল, ওটা একটা ফ্রেঞ্চ হোভারক্রাফট।

.

হোভারক্রাফটের দিকে রাইফেলের মাযল ঘোরাল সার্জেন্ট ভাইপার?

নাইট-ভিশন গান সাইটে উজ্জ্বল সবুজ আলোয় দেখা গেল ভেহিকেলের এক পাশে লেখা: ডুমো ডিখ-ঈলেখ – ০২।

স্টেশনের কমপ্লেক্সের বাইরে তুষারের উপর শুয়ে আছে পল সিংগার। শাশা হাওয়া বইছে, সেই সঙ্গে ঝড়ের ভিতর উড়ছে সাদা তুষার। সার্জেন্ট তার ব্যারেট এম৮২১এ স্নাইপার রাইফেলের নল তাক করেছে হোভারক্রাফটের উপর।

গানারি সার্জেন্ট বয়স্ক লোক, বেশ লম্বা-চওড়া, কালো চোখদুটোর চাহনি খুবই গম্ভীর। .তার ইউনিটের মেরিনদের মত নয় সে, নিজ ইউনিফর্মে পরিবর্তন এনেছে। শোল্ডারপ্লেটের উপর ভয়ঙ্কর হিংস্র এক ভাইপার সাপের উল্কি আঁকা। নীচে লেখা: যদি পারো তো চুমু দাও।

পল সিংগার ক্যারিয়ার সোলজার, বাইশ বছর মেরিন কর্পসের সঙ্গে আছে। সাধে গানারি সার্জেন্ট হয়নি। মেরিনদের নন-কমিশন্ড অফিসারদের এই র্যাঙ্ক খুব অল্প লোক অর্জন  করেছে। সিংগারের পক্ষে সহজেই উচ্চ পদে যাওয়া সম্ভব ছিল, কিন্তু সে ঠিক করেছে, তার জন্য গানারি সার্জেন্ট পদ যথেষ্ট। নিজ ইচ্ছাতেই মেরিন ফোর্সের রিকনিসেন্স ইউনিটে রয়ে গেছে।  রিকনিসেন্স ইউনিটগুলোর ভিতর র্যাঙ্ক নিয়ে বাড়াবাড়ি নেই। এই দলে যোগ দেয়া খুব কঠিন, এসব যোদ্ধাদের সমান সম্মান পায় না বহু অফিসার। অনেক সময়েই দেখা যায় চারতারা জেনারেল সিনিয়র রিকন সদস্যদের সঙ্গে আলাপ করছেন যুদ্ধের কৌশল ও অস্ত্রের বিষয়ে। বেশ কয়েকবার সিংগারের কাছেও এসব বিষয়ে জানতে চেয়েছেন জেনারেলরা। রিকনিসেন্সের বেশির ভাগ যোদ্ধা সার্জেন্ট বা কর্পোরাল, কিন্তু। এই দলে পদ নিয়ে মাতামাতি নেই। এটাই যথেষ্ট যে তারা : রিকন, ইউনাইটেড স্টেটসের মেরিন কর্পস–এলিট ফোর্স। ওটাই পদ হিসাবে যথেষ্ট।

উইলকক্স আইস স্টেশনে পৌঁছবার পর স্টেশনের ওদিকে তুষার-প্রান্তরে দুই শ গজ দূরে সার্জেন্ট ভাইপারকে লেসার ট্রিপ-ওয়ায়ার বসানোর দায়িত্ব দিয়েছে রানা। আসলে হোভারক্রাফটের রেঞ্জফাইণ্ডারের মত করেই কাজ করে ট্রিপওয়ায়ার। বাক্সের মত কয়েকটা ইউনিট, সেসবের ভিতর দিয়ে চলে সরু অদৃশ্য লেসার বিম। কোনও কিছু ওই বিম ভেদ করে এলে সিংগারের বাহুর গার্ডে জ্বলে উঠবার কথা লাল বাতি।

এ ক্ষেত্রে তাই হয়েছে।

এরপর দেরি না করে এ-ডেকে মাসুদ রানাকে রেডিয়ো করেছে সিংগার। তখনই দেখে আসতে বলেছে রানা। এমনও হতে পারে, দলবল নিয়ে ফিরছে সার্জেন্ট হোসেন আরাফাত দবির। তাকে দুঘণ্টার ভিতর ফিরতে বলেছে রানা। আর সে সময়ও প্রায় ফুরিয়ে এল। দুঘণ্টা হলো উইলকক্ট আইস স্টেশনে পৌঁছেছে রানা ওর দল নিয়ে। এখন যে-কোনও সময়ে এসে যাবে সার্জেন্ট দবির।

কিন্তু যে বা যারা আসছে, তারা দবির নয়।

সার্জেন্টের হেলমেট ইন্টারকমে শোনা গেল রানার কণ্ঠ: সার্জেন্ট সিংগার, ওটা কোথায়?

দক্ষিণ-পূর্ব কোণে। বাইরের দালানগুলোর পাশ দিয়ে আসছে। সিংগার দেখছে, তুষারে ছাওয়া ঘোট সব দালানের মাঝ দিয়ে খুব ধীরে সামনে বাড়ছে হোভারক্রাফট।

আপনি কোথায়? তুষার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে জানতে চাইল সে। রাইফেল হাতে মূল গম্বুজের দিকে ছুটতে শুরু করেছে।

সদর দরজার আগে, বলল রানা। পিছন থেকে কাভার পজিশনে থাকুন।

আমি প্রায় পৌঁছে গেছি ওখানে।

আকাশ থেকে কাত হয়ে পড়ছে ঘন তুষার, চোখ চলে না বেশি দূর। খুব সাবধানে আসছে হোভারক্রাফট। এক শ গজ তফাৎ রেখে ওটার সঙ্গে ছুটছে ভাইপার। প্রধান গম্বুজের কাছে থামল ভেহিকেল। বেশিরভাগ বাতাস বেরিয়ে যেতেই নিচু হয়ে গেল হোভারক্রাফট। চল্লিশ গজ দূরে তুষারের ভিতর শুয়ে পড়ল সার্জেন্ট সিংগার, গাড়ির দরজার উপর স্নাইপার রাইফেল তাক করেছে।

টেলিস্কোপে চোখ রেখেছে, এমনি সময় হোভারক্রাফটের স্লাইডিং দরজা খুলে গেল, টপাটপ চারজন লোক নেমে পড়ল তুষার-ঝড়ের ভিতর।

০৯.

গুড মর্নিং, হাসি-হাসি সুরে ফ্রেঞ্চে বলল রানা।

চার বিজ্ঞানী দাঁড়িয়ে পড়েছে দরজার সামনে। চেহারা বোকা-বোকা। সামনে ও পিছনে দুজন করে পাশাপাশি দাঁড়িয়েছে, মাঝে বড় একটা করে কন্টেইনার।

তাদের সামনে গিয়ে দাঁড়াল রানা, হাতে আলগা ভাবে ঝুলছে এমপি-৫। ওর পিছনে এমপি-৫ কাঁধে তুলে ফেলেছে কর্পোরাল টনি কেলগ ও সার্জেন্ট জনি ওয়াকার। অস্ত্রের নলের উপর দিয়ে সামনের লোকগুলোকে দেখছে তারা।

ভিতরে ঢুকে পড়ন, আমন্ত্রণ জানাল রানা।

লোকগুলো এক মুহূর্ত ইতস্তত করল, তারপর সামনে বাড়ল। একপাশে সরে গেল রানা। সবাই দরজা দিয়ে ঢুকতেই পিছনে রওনা হলো। আড়ষ্ট পায়ে চলেছে ফ্রেঞ্চরা। বোঝা গেল ভারী কন্টেইনার বইতে কষ্ট হচ্ছে তাদের।

একমিনিট হাঁটতেই ফুরিয়ে গেল সুড়ঙ্গ, ক্যাটওয়াকে বেরিয়ে এল ওরা। একটু দূরে ডাইনিংরুমে উজ্জ্বল আলো জ্বলছে। ওদিকে হাতের ইশারা করল রানা। ওর পিছনে দুপাশ থেকে কাভার করছে টনি কেলগ ও জনি ওয়াকার।

আপনারা ইংরেজি জানেন? সবাই ডাইনিংরুমে ঢুকতেই জানতে চাইল রানা।

নতুন এই দলের নেতা বললেন, জী। তবে একটু আগে আপনি যেমন সাবলীল ফ্রেঞ্চ বললেন, তেমনি করে ইংরেজি জানি না আমরা।

দুই কন্টেইনার মেঝের উপর রেখে চারপাশ দেখছেন। তারা। চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে সতীর্থদের দেখে।

কাঁধে অস্ত্র ঝুলিয়ে তাদের পাশে চলে গেল কেলগ, ভাল ভাবে সার্চ করে দেখল। কারও সঙ্গে অস্ত্র নেই। মাথা নাড়ল রানার দিকে চেয়ে।

ইংরেজিতে জানতে চাইল রানা, এখানকার সব সায়েন্টিস্ট ফ্রেঞ্চ স্টেশনে পৌঁছেছেন? সবাইকে একটা টেবিলের পিছনে বসতে ইশারা করল।

হ্যাঁ, নিরাপদে ডুমো ডিখ-ঈলেখ পৌঁছেছেন, প্রথম ভদ্রলোক জানালেন।

তাঁর চেহারা দেখে মনে হয় নিয়মিত খেতে পান না। দুই গালে বড় দুটো গর্ত, উঁচু চোয়ালের হাড়ের কারণে দেখতে খারাপ লাগে, চোখদুটোও খোড়লের ভিতর বসা। সুড়ঙ্গ দিয়ে আসবার সময় নিজের নাম বলেছেন জ্যাকুস ফিউভিল। লিস্টে এই নাম আছে, জানে রানা। এঁর নামের নীচে সংক্ষিপ্ত বায়োডেটায় লেখা: জ্যাকুস ফিউভিল, জিয়োলজিস্ট, কন্টিনেন্টাল শেলফের প্রাকৃতিক গ্যাসের উপর গবেষণা করছেন।

সুড়ঙ্গ ধরে আসবার পথে অন্য তিন ফ্রেঞ্চের নামও জেনে নিয়েছে রানা। এঁদের সবার নাম আছে ওই লিস্টে।

অন্য চার ফ্রেঞ্চ বিজ্ঞানী এখনও ডাইনিংরুমেই আছেন। তারা ম্যাথিউ ফ্যেনুয়্যা, গ্যাসেয়া ভিভাদিয়েখ, সঁা ডেনি পেয়েযি ও দু লা বোয়াবার্থেলিউ। এদিকে উইলকক্স আইস স্টেশনের আসল বাসিন্দারা চলে গেছেন নিজেদের কোয়ার্টারে। আগেই রানা বলে দিয়েছে, আপাতত তাদেরকে ওখানেই থাকতে হবে। আর এ দিকে ওর দলের কয়েকজনকে নিয়ে নতুন আগন্তুকদের সঙ্গে দেখা করতে গেছে রানা। সে-সময়ে ওর দলের মেরিন ল্যান্স-কর্পোরাল কেভিন হাক্সলে ডাইনিংরুমের দরজা পাহারা দিয়েছে।

আমরা যতটা সম্ভব দ্রুত ফিরেছি, বললেন জ্যাকুস ফিউভিল। সঙ্গে টাটকা খাবার আর ফিরতি পথের জন্য ব্যাটারি চালিত কম্বল এনেছি।

তিশা করিমের দিকে চাইল রানা। ডাইনিংরুমের আরেক দেয়ালের কাছে মেয়েটি। ওখানে ফ্রেঞ্চদের আনা সাদা রঙের কন্টেইনার দুটো পরীক্ষা করে দেখছে।

এসব আনার জন্য ধন্যবাদ, ঘুরে জ্যাকুস ফিউভিলের দিকে চাইল রানা। অনেক করেছেন। আমরা এসেছি কয়েক ঘণ্টা পর, এখানে পৌঁছে দেখলাম ইতিমধ্যেই ফ্রেঞ্চরা সাহায্য করছে।

তা তো করবেই, বললেন জ্যাকুস ফিউভিল। প্রতিবেশীর খোঁজ নেয়া তো সবারই দায়িত্ব। ক্লান্ত হাসলেন তিনি। অ্যান্টার্কটিকায় কেউ জানে না কখন কার কী সাহায্য লাগবে।

ঠিকই বলেছেন, তাঁর এক সঙ্গী বললেন।

রানার ইয়ারপিসে বলে উঠল, সার্জেন্ট সিংগার: মেজর, আরেকটা কন্ট্যাক্ট। এইমাত্র ট্রিপ-ওয়ায়ার পেরুল।

ভুরু সামান্য কুঁচকে গেল রানার। বড় দ্রুত ঘটছে সব। আট বিজ্ঞানীকে সামলাতে পারবে ওরা, কিন্তু এখন উইলকক্স আইস স্টেশনে আরও লোক এলে…

একমিনিট, মেজর, সব ঠিক। ওটা আমাদের হোভারক্রাফট। সার্জেন্ট দবির ফিরছে।

আস্তে করে শ্বাস ফেলল রানা। ঘুরে দাঁড়িয়ে দরজার দিকে পা বাড়াল। ক্যাটওয়াকে পৌঁছে রওনা হলো সদর-দরজার দিকে।

ওদিকে ডাইনিংরুমের দেয়ালের কাছে দুই কন্টেইনারের একটার ভিতর হাত ভরে দিয়েছে তিশা করিম। উপর থেকে সরিয়ে ফেলেছে কয়েকটা কম্বল ও টাটকা পাউরুটি। বাক্সের নীচে। বেশ অনেকগুলো–ক্যান। বেশির ভাগই মাংসের গরুর, শুয়োরের ও মুরগির। প্রতিটি ক্যান সিল করা। মাথার উপর রিং, ওটা ধরে টান দিলে ছাতের সরু পাত উঠে আসবে।

কয়েকটা ক্যান সরিয়ে বাক্সের নীচে মনোযোগ দিল তিশা। আঁর ঠিক তখনই কী যেন চোখে পড়ল।

কী যেন বড় অস্বাভাবিক!

বেশিরভাগ ক্যানের চেয়ে বড় ওই ক্যানটা। আকারে মাঝারি, ত্রিকোণাকৃতির। প্রথমে তিশা নিশ্চিত হতে পারল না, কেন ওর সন্দেহ জেগেছে। কিন্তু আকারটা বড় বেঢপ।

পরক্ষণে বুঝে গেল।

এই ক্যানের সিল ভাঙা। পাত উঠিয়ে নিয়ে আবারও ঠিক ভাবে রাখতে চেয়েছে। খুঁতটা প্রায় চোখেই পড়ছে না। ভাল করে খেয়াল করলে বোঝা যায়, ক্যানের মুখে সরু একটা কালো রেখা।

চট করে ঘুরে চাইল তিশা, ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেছে মাসুদ রানা। চোখ পড়ল ফ্রেঞ্চ বিজ্ঞানীদের উপর। ওকেই দেখছেন জ্যাকুস ফিউভিল, চকিতে চাইলেন বোয়াবার্থেলিউয়ের দিকে।

.

রানার সঙ্গে সার্জেন্ট হোসেন আরাফাত দবিরের দেখা হলো এন্ট্রান্স টানেলের কাছেই, ডাইনিংরুক্ষ থেকে তিরিশ ফুট দূরের ক্যাটওয়াকে।

কী অবস্থা? জানতে চাইল রানা।

থমথম করছে সার্জেন্টের মুখ। খুব খারাপ খবর, স্যর।

খুলে বলুন।

সিগনাল হারিয়ে যায়। ওটা একটা ফ্রেঞ্চ হোভারক্রাফট। ডুমো ডিখ-ঈলেখের। একটা গভীর খাদের ভিতর পড়ে।

তারপর? চট করে ডাইনিংরুমের দরজার দিকে চাইল রানা। ওখানে রয়েছে ফ্রেঞ্চরা। কয়েক মিনিট আগে জ্যাকুস ফিউভিল বলেছে দ্বিতীয় হোভারক্রাফট নিরাপদে ডুমো ডিখঈলেখ পৌঁছে গেছে। কী হয়েছিল? পাতলা বরফের কারণে দুর্ঘটনা?

না, স্যর। আমরা প্রথমে তা-ই ভেবেছি। পরে কাছ থেকে দেখল কর্পোরাল নাজমুল।

কী দেখল? চট করে জানতে চাইল রানা।

মাথা নাড়ল দবির। হোভারক্রাফটের ভিতর পাঁচটা লাশ, স্যর। সবার মাথার পিছনে গুলি করা হয়েছে।

রানার হেলমেট ইন্টারকমে শোনা গেল তিশার কণ্ঠ: স্যর, মস্ত কোনও গোলমাল। খাবারের ক্যান আগেই খোলা হয়েছে।

ঝট করে ঘুরে দাঁড়াল রানা। ডাইনিংরুম থেকে বেরিয়ে এসেছে তিশা করিম। দ্রুত হেঁটে আসছে। হাতে তিনকোনা একটা ক্যান। ওটার মুখ খোলা।

মেয়েটির পিছনে ডাইনিংরুমে জ্যাকুস ফিউভিলকে দেখতে পেল রানা। লোকটা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। চেয়ে আছে তিশার দিকে, তারপর তার চোখ পড়ল রানার চোখে ওদের চোখ আটকে গেছে পরস্পরের উপর।

এর এক সেকেণ্ড পর যা বোঝার বুঝে গেল দুজনেই।

তিশা এগিয়ে আসছে বলে ফিউভিলকে আর দেখতে পেল না রানা। ক্যানের মুখ খুলে ফেলেছে মেয়েটি, ভিতর থেকে কী যেন বের করছে। জিনিসটা ছোট এবং কালো। যেন কোনও ক্রুশ। তফাৎ হচ্ছে ওটা খুদে আকারের, হাতলের জায়গাটা পিছন দিকে বেঁকে গেছে।

জিনিসটার উপর চোখ পড়তেই বিস্ফারিত হলো রানার চোখ। সতর্ক করতে মুখ হাঁ করল ও, কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে।

ডাইনিংরুমে সাদা দুই কন্টেইনার লক্ষ্য করে ঝাঁপ দিয়েছে ফিউভিল। একইসঙ্গে উঠে দাঁড়িয়েছে দু লা বোয়াবার্থেলিউ। স্টেশনে পৌঁছে. তাকে সার্চ করেনি রানারা। ঝটকা দিয়ে পারকা সরিয়ে দিয়েছে সে, দুই হাতে বেরিয়ে এসেছে ফ্রেঞ্চদের তৈরি খাটো ব্যারেলের ফ্যামাস অ্যাসল্ট রাইফেল। ওই একই সময়ে ফ্রেঞ্চ বিজ্ঞানী গ্যাসোয়া ভিভাদিয়েখ দুই পকেট থেকে বের করেছে দুটো ক্রুশ। ওই একই জিনিস তিশার হাতে। ভিভাদিয়েখের ডান হাতের ক্রুশ থেকে ছিটকে বেরুল কী যেন। তিশাও ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে, ওই মুহূর্তে রানা দেখল হঠাৎ করেই মেয়েটির মাথা পিছনে ঝটকা খেল। পরক্ষণে মেঝের উপর ধড়াস্ করে পড়ল তিশা।

এক সেকেণ্ড পর ব্রাশ ফায়ারের আওয়াজে খানখান হলো নীরবতা। অ্যাসল্ট রাইফেলের ট্রিগার পেঁচিয়ে ধরেছে দু লা বোয়াবার্থেলিউ, ডাইনিংরুম থেকে বেরুল একপশলা গুলি। দরজার সামনে দু টুকরো হয়ে গেল কর্পোরাল কেভিন হাক্সলে।

দশ সেকেণ্ডে কয়েক দফায় গুলিবর্ষণ করল বোয়াবার্থেলিউ, ততক্ষণে মেঝের উপর ঝাপিয়ে পড়েছে তার শত্রুপক্ষের প্রত্যেকে। সবাই বুঝে গেছে, উইলকক্স আইস স্টেশন হয়ে উঠেছে যুদ্ধক্ষেত্র।

মাসুদ রানা বলছি! হেলমেট মাইকে শান্ত কণ্ঠে বলল রানা, দুই লাফে চলে গেছে কাছের টানেলের দরজার আড়ালে। ওরা আটজন! আবার বলছি, ওরা আটজন! ছয়জন মিলিটারি পারসোনেল! দুজন সায়েন্টিস্ট। এরা কমাণ্ডোদের জন্যে অস্ত্র লুকিয়ে এনেছে। কাউকে কোনও ছাড় দিতে যেয়ো না!

রানার চারপাশে ছিটকে পড়ছে বরফ-কুঁচি, দু লা বোয়াবার্থেলিউয়ের গুলি লাগছে মাথার উপরের বরফ-দেয়ালে।

ক্রসবো দেখে ফেলেছে বুঝেই কাজে নেমে পড়েছে ফ্রেঞ্চ কমাণ্ডোরা।

পৃথিবীর প্রতিটি এলিট মিলিটারি ইউনিটের বিশেষ কিছু চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য থাকে। ইউনাইটেড স্টেটসের নেভি সিল মুখোমুখি লড়াই-এ বারো গেজ পাম্প-অ্যাকশন শটগান ব্যবহার করে। ব্রিটিশ স্পেশাল এয়ার সার্ভিস, বা এসএএস ব্যবহার করে নাইট্রোজেন চার্জ। ইউএস মেরিন ফোর্স রিকনিসেন্স ইউনিট বা রেগুলার ইউনাইটেড স্টেটস্ মেরিন কর্পস ব্যবহার করে আমালাইট এমএইচ-১২ ম্যাগহুক। ওটা এ্যাপলিং হুকসহ লঞ্চার। ধাতব দেয়াল বেয়ে উঠবার সময় ব্যবহার করা হয় হাই-পাওয়ার্ড ম্যাগনেট। ম্যাকমার্ডো স্টেশনে রানার দলের সবার জন্য এই একই জিনিস দেয়া হয়েছে।

মাত্র একটি এলিট ফোর্স ব্যবহার করে ক্রসবো।

দো খমিয়েখ খেযিমন্ত প্যাখাশুতিস্ট দোইনফেন্তেখিয়্য দে মেখিন হচ্ছে ফ্রেঞ্চদের ক্র্যাক কমান্ডো ইউনিট–অন্য দেশে এরা ফাস্ট মেরিন প্যারাশুট রেজিমেন্ট নামে পরিচিত। এদের কাজ ব্রিটিশ এসএএস বা ইউএসএ-র সিলের মতই।

এই রেজিমেন্ট ইউএস মেরিন বা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর রেগুলার ফোর্সের মত নয়। এদের কাজ এক ধাপ উঁচু স্তরের। অফেন্সিভ ইউনিট বা অ্যাটাক টিম, এলিট কভার্ট ফোর্স–এদের একমাত্র কাজ শত্রুপক্ষের এলাকায় ঢুকে পড়া এবং দেখামাত্র সবাইকে হত্যা করা।

রানা যখন তিশাকে ক্যানের ভিতর থেকে খুদে ক্রসবো বের করতে দেখেছে, ও বুঝে গেছে ওই লোকগুলো ডুমো ডিখঈলেখের বিজ্ঞানী নয়।

ফ্রেঞ্চ এলিট ফোর্সের কমাণ্ডোরা ধরেই নিয়েছে রানা ডুমো ডিখ-ঈলেখের বিজ্ঞানীদের নাম জেনে আসবে, কাজেই তাদের নাম ধার করে এসেছে উইলকক্স আইস স্টেশনে। নিজেদেরকে আরও বিশ্বাসযোগ্য করবার জন্য সঙ্গে এনেছে সত্যিকারের দুজন বিজ্ঞানীকে।

ডুমো ডিখ-ঈলেখের ম্যাথিউ ফ্যেনুয়্যা ও স্যা ডেনি পেয়েযিকে আগে থেকেই উইলকক্স আইস স্টেশনের বাসিন্দারা চিনত।

নিষ্ঠুর ধোকাবাজি করেছে এরা।

রানা যখন ওর দল দিয়ে স্টেশনে এল, ওরা দেখল এই দলের নেতা ম্যাউি ফ্যেনুয়্যা, যাকে এখানকার বাসিন্দারা ভাল করেই চেনে। কাজেই ওরা ধরে নিয়েছে এরা সবাই বিজ্ঞানী। এদের একজন উইলকক্স আইস স্টেশনের পাঁচ বিজ্ঞানীকে সরিয়ে নিয়েছে, ভঙ্গি করেছে নিরাপদে পৌঁছে দেবে ফ্রেঞ্চ স্টেশনে। অথচ নির্দ্বিধায় ওরা নিরীহ সিভিলিয়ান মানুষগুলোকে বিনা অপরাধে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে তুষারের প্রান্তরে। ভাবতে গিয়ে এখন রাগে ফুঁসছে রানা, মনের চোখে দেখছে: বাঙালি ও আমেরিকান বিজ্ঞানী–নারী-পুরুষ, সবাই কাঁদছে, করুণ সুরে প্রাণভিক্ষা চাইছে: আমাদেরকে মারবেন না, দয়া করুন, বাঁচতে দিন! তাদের পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে ফ্রেঞ্চ কমাণ্ডোরা, তারপর মাথার পিছনে পিস্তলের নল ঠেকিয়ে গুলি করল। হোভারক্রাফটের ভিতর ছিটকে পড়ছে ধূসর মগজ ও রক্ত।

ম্যাথিউ ফ্যোনুয়্যা ও স্যাঁ ডেনি পেয়েযি আসলে বিজ্ঞানী?

ভাবতে গিয়ে ঘৃণায় মুখ কুঁচকে ফেলল রানা। নিরীহ অসহায় বিজ্ঞানীদের হত্যার সঙ্গে নিজেদের জড়াতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেনি, এদেরকে কী লোভ দেখিয়েছে ফ্রেঞ্চ সরকার?

অবশ্য, জবাবটা পাওয়া খুবই সোজা।

ফ্রেঞ্চদের হাতে স্পেসশিপ এলে পরীক্ষা করবার প্রথম সুযোগ দেয়া হবে এদেরকে।

হেলমেট ইন্টারকমে একের পর এক চিৎকার শুনল রানা।

পাল্টা গুলি করো!

সরে এসো!

হাক্সলে মারা গেছে। তিশাও!

শালার কপাল! ওই হারামজাদাকে গুলি করতে…

দরজার কৰাটের আড়াল থেকে সামনের দিক দেখল রানা। ডাইনিংরুম এবং মেইন এন্ট্রান্স প্যাসেজওয়ের মাঝে ক্যাটওয়াকে পড়ে আছে তিশা।

রানার চোখ স্থির হলো কেভিন হাক্সলের উপর। ডাইনিংরুম ও ক্যাটওয়াকের মাঝে সে। বড় বড় দুই চোখ ভোলা, মুখটা ভেসে গেছে রক্তে, হেঁড়াখোঁড়া, পেট থেকে এসেছে ওই রক্ত। ওকে পয়েন্ট-ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জে গুলি করেছে দু লা বোয়াবার্থেলিউ।

একটু দূরে স্টেশনের মেইন এন্ট্রান্সের মুখে কর্পোরাল নাজমুল আছে, ঝট করে বেরিয়ে এসেই গুলি করে আবার আড়াল নিচ্ছে। ফ্রেঞ্চদের ফ্যামাস রাইফেল দুর্বল র্যাট-ট্যাট আওয়াজ তুলছে, তার জবাবে জার্মানদের তৈরি এমপি-৫ যেন বাতাস ভরা টিউব ফুটো হওয়ার আওয়াজ করছে। কর্পোরাল নাজমুলের পাশে যোগ দিয়েছে কর্পোরাল টনি কেলগ।

চারপাশ দেখে নিতে চাইল রানা। পশ্চিম টানেলের মুখে জবুথবু হয়ে বসেছে সার্জেন্ট জনি ওয়াকার। ওয়াকার, ঠিক আছেন? জানতে চাইল রানা।

দু লা বোয়াবার্থেলিউ যখন গুলি শুরু করল, ডাইনিংরুমের সবচেয়ে কাছে ছিল সার্জেন্ট জনি ওয়াকার ও কর্পোরাল কেভিন হাক্সলে। গুলি শুরু হতেই, ঝট করে কবাটের আড়ালে সরে গেছে ওয়াকার। ওদিকে সরাসরি গুলির তোড়ে পড়েছে কেভিন। দ্রুত পছিয়েছে ওয়াকার, ঝেড়ে দৌড় দিয়ে পৌঁছে গেছে পশ্চিম টানেলের আপাত নিরাপদ আড়ালে।

পঞ্চাশ ফুট দূরে তাকে হেলমেট মাইকে কথা বলতে দেখল রানা। ওর হেডসেটে বলে উঠল ঘড়ঘড়ে কণ্ঠ: ঠিক আছি, স্যর। একটু চমকে গেছি, তবে কিছু হয়নি।

গুড।

রানার মাথা থেকে একফুট উপরে বরফের দেয়ালে লাগল একপশলা গুলি। আবারও দরজার কবাটের আড়ালে চলে গেল ও। পরক্ষণে কবাটের পাশ থেকে উঁকি দিল। অবশ্য, এবার শিসের মত একটা আওয়াজও পেল।

এক সেকেণ্ড পর কানের কাছে ধাতব খট আওয়াজ শুনে চমকে গেল। চার ইঞ্চি দৈর্ঘ্যের একটা তীর এসে বিঁধেছে ওর ডান চোখের দুই ইঞ্চি দূরের বরফ-দেয়ালে। ডাইনিংরুমে জ্যাকুস ফিউভিলকে দেখতে পেল রানা। লোকটার হাতে উদ্যত ক্ৰসবো। তীর মারা হতেই তার দিকে খাটো ব্যারেলের সাবমেশিনগান বাড়িয়ে দিল বিজ্ঞানী ম্যাথিউ ফ্যেনুয়্যা। এক সেকেণ্ড পর গোলাগুলিতে যোগ দিল ফিউভিল।

চৌকাঠের আড়াল থেকে আবারও উঁকি দিল রানা, তিশাকে দেখতে পেল। ডাইনিংরুম এবং মেইন এন্ট্রান্সের মাঝে ক্যাটওয়াকের উপর পড়ে আছে মেয়েটা, নিথর।

তারপর হঠাৎ করেই নড়ে উঠল ওর হাত।

জ্ঞান ফিরছে বলেই বোধহয় ওটা স্বাভাবিক রিফ্লেক্স।

হাত নাড়া দেখেছে রানা, হেলমেট মাইকে বলল, রানা বলছি, তিশা বেঁচে আছে। কিন্তু একদম খোলা জায়গায়। আমাকে কাভার দিতে হবে। আমি ওকে নিয়ে আসব। তোমরা কনফার্ম করো।

একের পর এক বক্তব্য এল:

কেলগ, চেক।

নাজমুল আছি। 

জনি ওয়াকার, চেক।

দবির আছি, বলল সার্জেন্ট। আপনি যেতে পারেন, স্যর। কাভার দিচ্ছি। …এবার, স্যর!

ঠিক আছে! আড়াল থেকে ছিটকে বেরুল রানা, চলে এসেছে। ক্যাটওয়াকে।

বাঙালি সৈনিক ও আমেরিকান মেরিনরা একইসঙ্গে বেরিয়ে এসেছে কাভার পজিশন থেকে, গুলি শুরু করেছে ডাইনিংরুমের দরজা লক্ষ্য করে। কানে তালা লেগে গেল রানার! ডাইনিংরুমের দেয়াল থেকে চারপাশে ছিটকে পড়ছে বরফের কুঁচি। শ খানেক বুলেট কয়েক সেকেণ্ডে দেয়াল খুবলে তৈরি করল অসংখ্য গর্ত। সবার গুলিবর্ষণে পিছিয়ে গেছে জ্যাকুস ফিউভিল, ডাইভ দিয়ে কাভার নিয়েছে।

এদিকে বাইরে ক্যাটওয়াকে তিশার পাশে হাঁটু গেড়ে বসেছে রানা। চট করে দেখে নিল মেয়েটির মাথা। কেভলার হেলমেটের ফোরহেড গার্ড থেকে রক্তের সরু রেখা নামছে কপালবেয়ে। এক ইঞ্চি পুরু কেভলার বর্ম ভেদ করে কপালে এসে থেমেছে রুপালি তীর, চিকচিক করছে উজ্জ্বল আলোয়। ত্বক ফুটো করে করোটির এক মিলিমিটার আগে থেমে গেছে তীর।

ঠিক আছে, এবার উঠে পড়ো, মেয়ে! তাড়া দিল রানা, নিশ্চিত নয় তিশা শুনতে পেয়েছে। চারপাশ থেকে কাভার ফায়ার দিচ্ছে ওর দলের সবাই। হ্যাঁচকা টানে তিশাকে কোলে তুলে নিল রানা, পরক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েই ছুটতে শুরু করল মেইন এন্ট্রান্স টানেলের প্যাসেজওয়ে লক্ষ্য করে।

হঠাৎ কোথা থেকে উদয় হলো এক ফ্রেঞ্চ কমাণ্ডো। লোকটা আছে ডাইনিংরুমের বরফের দেয়ালের ওপাশে। এইমাত্র বুলেটে তৈরি গর্তের ভিতর দিয়ে রাইফেল বের করছে-সে।

মুহূর্ত দেরি না করে তিশাকে কোল থেকে বাম কাঁধে নিল। রানা, পরক্ষণে হোলস্টার থেকে ছোঁ দিয়ে তুলে নিল পিস্তল, পরপর দুবার গুলি করল। দুর্বল আওয়াজ তোলে ফ্যামাস রাইফেল, এমপি-৫ করে চাকার টিউব ফুটো হওয়ার আওয়াজ, কিন্তু মেরিনদের আই.এম.আই ডোের্ড ঈগল অটোমেটিক পিস্তল সত্যিকারের বজ্রপাত। রানার দুটো গুলিই ঠিক জায়গায় লেগেছে–বিস্ফোরিত হলো ফ্রেঞ্চ কমাণ্ডোর মাথা, ওখানে একটা লাল বাষ্পের বল তৈরি হলো। রানা দেখেছে দুবার লোকটার মাথা ঝাঁকি খেয়েছে, তারপর ধপ্ করে পড়ে গেছে সে।

জুলদি ভাগুন, স্যর! ইয়ারপিসে হোসেন-আরাফাত দবিরের কণ্ঠ শুনল রানা।

প্রায় পৌঁছে গেছি! গুলির আওয়াজের উপর দিয়ে বলল ও ইণ্টারকমে আরেকটা কণ্ঠ শুনল। খুব ঠাণ্ডা গলা এর। ওদিকে কোনও গোলাগুলি নেই।

মেরিন ফোর্স, ভাইপার বলছি। আমি এখনও বাইরের পোস্টে। আরও ছয়জন ফ্রেঞ্চ কমাণ্ডো বেরুচ্ছে দ্বিতীয় হোভারক্রাফট থেকে। আবারও বলছি, পরের হোভারক্রাফট থেকে নেমেছে ছয়জন কমাণ্ডো। স্টেশনের এন্ট্রান্স টানেলের দিকে যাচ্ছে।

এক সেকেণ্ড পর ইন্টারকমে গুলির আওয়াজ শুনল রানা। ওটা ভাইপারের স্নাইপার রাইফেল।

ভাইপার বলছি, মেরিন ফোর্স। ওরা এখন পাঁচজন। মেইন এন্ট্রান্সের দিকে ছুটছে।

কাঁধের উপর দিয়ে মেইন এন্ট্রান্স টানেলের দিকে চাইল রানা। তিশাকে নিয়ে ওদিকেই ছুটবে ভেবেছিল। এই মুহূর্তে ওখানে আছে হোসেন আরাফাত দবির ও টনি কেলগ, ডাইনিংরুমের দিকে গুলি পাঠাচ্ছে। ওখানে ওই একই কাজ করছে সার্জেন্ট জর্জ মারফি।

এর এক সেকেণ্ড পর বিস্ফোরিত হলো যুবকের বুক। শক্তিশালী কোনও অস্ত্র থেকে গুলি করে ছিন্নভিন্ন করে দেয়া হয়েছে ওর পিঠ-বুক। প্রচণ্ড ঝাঁকি খেয়েছে মারফি, পাজরের খাঁচা থেকে ছিটকে বেরিয়েছে রক্ত। কোমর থেকে শুরু করে ঘাড় পর্যন্ত ভয়ঙ্কর আঘাতে এক ঝটকায় পিছিয়ে গেছে, তরুণ সৈনিকের মেরুদণ্ড ভাঙবার মড়াৎ আওয়াজটা স্পষ্ট শুনল রানা।

এক সেকেণ্ডের দশ ভাগের এক ভাগ সময়ে এন্ট্রান্স প্যাসেজওয়ে থেকে ছিটকে বেরুল হোসেন আরাফাত দবির ও টনি কেলগ। ঘুরেই পিছন-টানেলের শত্রুদল লক্ষ্য করে গুলি পাঠাল ওরা। এক মুহূর্ত ওখানে থামল না, কয়েক কদম সরে চলে গেল সবচেয়ে কাছের রাং-ল্যাডারের সামনে, দেরি না করে নামতে শুরু করেছে বি-ডেকের দিকে।…

রানা এবং ওর দলের সবার কপাল মন্দ, এইমাত্র ফিরেছে হোসেন আরাফাত দবির ও ওর দলের সবাই। হঠাৎ করেই গুলি শুরু হতে ভাল কোনও অবস্থান বেছে নিতে পারেনি কেউ। ওরা মেইন এন্ট্রান্সের কাছে দুই দল ফ্রেঞ্চের মাঝে আটকা পড়েছে। পিছনে ডাইনিংরুমে একদল কমাণ্ডো, ওদিকে মেইন এন্ট্রান্স দিয়ে ঢুকে পড়েছে তাদের দ্বিতীয় দল।…

পরিস্থিতি বুঝতে সময় লাগেনি রানার, মাইকে বলল, দবির! নীচে নামুন! সবাইকে নিয়ে বি-ডেকে!

এখন তা-ই করছি, স্যর!

এর চেয়ে ঢের খারাপ পজিশনে রানা ও তিশা। ওরা আছে ক্যাটওয়াকে। একপাশে ডাইনিং হল, আরেক পাশে এন্ট্রান্স প্যাসেজওয়ে। কোথাও যাওয়ার নেই। কোনও দরজা নেই আড়াল নেবে। লুকাতে পারবে না কোনও প্যাসেজওয়েতে। মাত্র তিন ফুট চওড়া ধাতব ক্যাটওয়াক একদিকে জমাট বরফের দেয়াল, অন্য দিক শুধু শূন্য, সত্তর ফুট নীচে নীল পানির পুল।

যে-কোনও সময়ে মেইন এন্ট্রান্স প্যাসেজওয়ে দিয়ে ভিতরে ঢুকবে দ্বিতীয় ফ্রেঞ্চ কমাণ্ডো দল, এবং একদম সামনে পাবে রানা ও তিশাকে।

মাথার পাশে বরফ-দেয়াল বিস্ফোরিত হতেই চরকির মত ঘুরল রানা। ডাইনিংরুমে উঠে দাঁড়িয়েছে জ্যাকুস ফিউভিল, একের পর এক গুলি শুরু করেছে অ্যাসল্ট রাইফেল থেকে। ডেযার্ট ঈগল পিস্তল দিয়ে ডাইনিংরুমে ফিউভিলের দিকে পর পর ছয়বার গুলি ছুঁড়ল রানা। চট করে দেখে নিল মেইন এন্ট্রান্স। আর বড়জোর দশটা সেকেণ্ড পাবে।

মনে মনে বলল রানা, কপাল মন্দ। ওর কাঁধের উপর এলিয়ে পড়ে আছে তিশা।

ক্যাটওয়াকের রেলিঙে ঝুঁকল রানা। অন্তত সত্তর ফুট নীচে স্টেশনের পুল। ওদের বাঁচবারই কথা। কিন্তু কিলার ওয়েইল…

অন্য কোনও উপায় নেই?

পায়ের নীচের ক্যাটওয়াক দেখল রানা, তারপর চাইল পিছনের বরফ-দেয়ালের দিকে।

মেজর, ওখান থেকে সরে যান, নইলে মরবেন? বলে উঠেছে সার্জেন্ট জনি ওয়াকার। স্টেশনের দক্ষিণ ক্যাটওয়াকে বেরিয়ে এসেছে সে। ওখান থেকে পরিষ্কার দেখছে উত্তর এন্ট্রান্স টানেল। যা দেখছে, তাতে খুশি হওয়ার কিছু নেই।

সরে যেতেই চেষ্টা করছি, বলল রানা।

ডাইনিংরুমে ফিউভিলের দিকে আরও দুটো গুলি পাঠাল ও, তারপর হোলস্টারে রেখে দিল পিস্তল। কাঁধে ঝুলন্ত হোলস্টার থেকে বের করে নিল ম্যাগহুক। আর্মালাইট এমএইচ-১২ দেখতে পুরনো আমলের টমি গানের মত। দুটো পিস্তল গ্রিপ; একটা সাধারণ গ্রিপ, সঙ্গে ট্রিগার, আরেক দিকে মাযলের নীচে সাপোর্ট গ্রিপ। আসলে ম্যাগহুক একটা কমপ্যাক্ট পিস্তল, দু হাতলওয়ালা লঞ্চার, নল দিয়ে প্রচণ্ড গতিতে ছুঁড়ে দেয় এ্যাপলিং হুক।

কাঁধের উপর গুঙিয়ে উঠেছে তিশা। বরফ-দেয়ালের দিকে লঞ্চার তাক করল রানা, টিপে দিল ট্রিগার। জোরালো ধাতব ঘটাং আওয়াজ তুলেমাযল থেকে ছিটকে বেরুল এ্যাপলিং হুক, তীব্র গতি তুলে ঢুকেছে জমাট বরফের দেয়ালে, চারপাশ বিস্ফোরিত করে পৌঁছে গেছে ডাইনিংরুমে। ওদিকে পৌঁছে যেতেই খুলে গেছে ওটার আঁকশি।

মেজর! সরে যান!

ভাল করেই জ্ঞান ফিরেছে তিশার। প্রায় জোর করেই কাঁধ থেকে নেমে পড়ল।

আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরো! নির্দেশ দিল রানা।

কেন? এক পলকে লালচে হয়ে গেল তিশার গাল।

জলদি! সময় নেই! মেয়েটির কাঁধে দুই হাত রাখল রানা, কাছে টেনে নিল। দুজনের ঠোঁট খুব কাছাকাছি। কেউ দেখলে ভাববে: দুই প্রেমিক-প্রেমিকা পরস্পরকে জড়িয়ে ধরেছে, এবার চুমু দেবে একে অপরকে। বামহাতে আরও শক্ত করে তিশাকে জাপ্টে ধরল রানা, ঘুরেই নিতম্ব রাখল রেলিঙে। একবার দেখে নিল মেইন এন্ট্রান্স টানেল, ওখানে প্যাসেজওয়ের বরফ-দেয়ালে কালো ছায়া। এক সেকেণ্ড পর ওখান থেকে এল গুলির আওয়াজ।

শক্ত করে ধরো, তিশার কানে বলল রানা। 

মেয়েটির পিছনে দুই হাতে লঞ্চার শক্ত করে ধরেছে ও। গলা জড়িয়ে ধরেছে তিশা। হঠাৎ করেই পিছনে ভর দিল রানা, তারপর তিশাকে নিয়ে রেলিং টপকে নীচের দিকে পড়তে লাগল।

মুহূর্ত পর একপশলা গুলি রেলিঙে লেগে নানা দিকে ছুটে গেল। পড়তে শুরু করে কয়েক ফুট উপরে সাদা-কমলা আগুন ছিটকাতে দেখল রানা। কানের কাছে বাতাসের শোঁ-শোঁ আওয়াজ।

ওদের উপরে সরসর করে বেরুচ্ছে ম্যাগহুকের কেবল। বিডেক ছাড়িয়ে নেমে চলেছে ওরা, একপলক দবির ও কেলগকে দেখল, অবাক বিস্ময় নিয়ে ওদেরকে পড়তে দেখছে তারা।

তারপর লঞ্চারের সামনের গ্রিপে কালো বাটনে চাপ দিল রানা। মাযলের ভিতর দ্রুত খুলে যাওয়া কেবলকে আঁকড়ে ধরল ক্ল্যাম্পিং মেকানিজম।

প্রচণ্ড ঝটকা খেয়ে থামল রানা ও তিশা। একটু উপরে বিডেক। ক্যাটওয়াকের দিকে ওদেরকে দুলিয়ে নিয়ে চলেছে কেবল। কয়েক ফুট নীচে সি-ডেকের ক্যাটওয়াক, দু সেকেণ্ড অপেক্ষা করল রানা, তারপর তিশাকে নিয়ে নেমে পড়ল ধাতব গ্যাংওয়েতে।

সি-ডেকের ক্যাটওয়াকে পা রাখতেই লঞ্চারের ট্রিগারে দুবার চাপ দিল রানা। এ-ডেকে স্ন্যাপ আওয়াজ তুলে সঙ্কুচিত হলো গ্যাপলিং হুকের আঁকশি, ডাইনিংরুমের দেয়ালে নিজের তৈরি গর্তের ভিতর দিয়ে বেরিয়ে এল। আইস স্টেশনের বিশাল শাফটে পড়তে শুরু করেছে। ওটাকে নিজের পেটে টেনে নিচ্ছে লঞ্চার। পাঁচ সেকেণ্ড পর আবারও ছুঁড়বার অবস্থায় পৌঁছে গেল যন্ত্রটা।

তিশাকে নিয়ে সবচেয়ে কাছের ডোরওয়ের দিকে রওনা হলো রানা।

১০.

গ্রেনেড!

বি-ডেকের উত্তর টানেল ধরে ছুটছে হোসেন আরাফাত দবির ও টনি কেলগ, বাঁক ঘুরেই ঝাপিয়ে পড়ল সামনের মেঝেতে।

পিছনে বিকট আওয়াজে বিস্ফোরিত হলো গ্রেনেড, থরথর করে কেঁপে উঠেছে গোটা টানেল। বিস্ফোরণের এক মুহূর্ত পর এল জোরালো কংকাশন, ওয়েভ। সঙ্গে এল তীব্র গতিতে সুইয়ের মত কালো-কী যেন, ছিটকে গেল দুই সৈনিকের উপর দিয়ে, লাগল উল্টো দিকের দেয়ালে।

হতবাক বিস্ময় নিয়ে পরস্পরের দিকে চাইল দুই সৈনিক।

এইমাত্র ফ্র্যাগমেন্টেশন গ্রেনেড ফেটেছে।

ওটা সাধারণ বিস্ফোরকই, কিন্তু পেটের ভিতর থাকে অসংখ্য ছোট ধাতব টুকরো, প্রতিটি ছোরার মত ধারালো, একবার গায়ে বিধলে খুঁটে বের করা ডাক্তারদের পক্ষে প্রায় অসম্ভব। বিস্ফোরিত হলে চারদিকে ছিটকে পড়ে টুকরোগুলো। 

আমি আগেই ভেবেছি, শুকনো স্বরে বলল টনি কেলগ, এমপি-৫-এর রিসিভারে নতুন ম্যাগাজিন ভরল সে। অনেককে বলেওছি, ওই চুতিয়া ফ্রেঞ্চদের বিশ্বাস করা যায় না। ওদের ভিতর কী যেন আছে। ওই খুদে চোখ,সাপের মত চাহনি… আর কুত্তার বাচ্চারা নাকি আমেরিকার মিত্র!

আরেকটু হলে শেষ করে দিয়েছিল, বলল দবির।

উঠে দাঁড়িয়ে আবার বাঁকের কাছে চলে গেছে কেলগ, খুব সাবধানে ওদিকে উঁকি দিল। আড়ষ্ট হয়ে গেল ওর চেহারা। হায় যিশু…

কী হয়েছে? জিজ্ঞেস করল দবির।

আর কিছু জানতে হলো না তাকে। নিজেই বুঝে গেল। ঠক্‌ঠকাস আওয়াজ তুলে বাঁক পেরিয়ে এসেছে দ্বিতীয় গ্রেনেড। ওদের দুজনের মাঝে পাঁচ ফুট দূরে এসে থেমেছে! 

ওরা দুজন খোলা টানেলে। কোথাও যাওয়ার নেই। পালাবে কোথায়? ঝেড়ে দৌড় দিলেও করিডোের পেরুতে পারবে না। তার অনেক আগেই ফাটবে গ্রেনেড।

ওটা দেখেই দুহাতের জোরে সরসর করে পিছলে এগিয়েছে দবির। দেখলে কেউ বলবে পাকা ডিফেণ্ডার, স্লাইডিং ট্যাকল করে শক্রর পা থেকে সরিয়ে দিতে চাইছে ফুটবল। কিন্তু আওতার ভিতর গ্রেনেড পেয়ে যেতেই স্লাইডিং ট্যাকল করল না সে, জীবনের সেরা কিক দিল বাম পায়ে, খট-খটাং আওয়াজ তুলে উত্তর টানেলে ফিরল গ্রেনেড, ছুটে চলেছে সেন্ট্রাল শাফট লক্ষ্য করে। পিছলে বাঁক পেরিয়ে গেল দবিরও।

সামনে বেড়ে খপ করে তার কাঁধ ধরল কেলগ, বাকের এপাশে টেনে এনে দাঁড় করিয়ে দিল। আধ সেকেণ্ড পর বিকট আওয়াজে ফাটল গ্রেনেড। দ্বিতীয়বারের মত সামনের দেয়ালে লাগল অসংখ্য ধাতুর ধারালো টুকরো।

শালার ফ্রেঞ্চ চুতিয়ারা… ঢোক গিলল কেলগ। আমরা–এবার ফেঁসে গেছি!

বাছা, ছুটতে শুরু করো, ভাগতে হবে, পরামর্শ দিল দবির। চট করে চাইল উত্তর টানেলের দিকে। ওখানে দেখতে পেল ক্যাপ্টেন নিশাত সুলতানাকে। এইমাত্র বাঁক ঘুরেছে সে। তার সঙ্গে দুই কর্পোরাল নাজমুল ও হলিডে স্যাম্পসন। বি-ডেকের পশ্চিম দিক দিয়ে ঘুরে এসেছে তারা।

সামনে দলের দুজনকে দেখে থমকে গেছে নিশাত, ক্ষণে–চড়া কণ্ঠে বলল, সবাই শুনে নাও, চারদিকে ছড়িয়ে পড়তে হবে। নইলে একসঙ্গে মোরব্বা হব। কর্পোরাল নাজমুল, কর্পোরাল হলিডে আর আমি আবারও পশ্চিমে ফিরব, ঘুরে চলে যাব বাইরের দিকের টানেলে। কেলগ আর আপনি সার্জেন্ট দবির যাবেন পুবে। আমরা যখন নিশ্চিত হবো ভাল পজিশনে পৌঁছেছি, তখন ভাবতে শুরু করব কীভাবে সবার সঙ্গে যোগ দেয়া যায়। এরপর হারামজাদার দুলকে কোণঠাসা করব। সবাই আমার কথা বুঝতে পেরেছে?

কেউ কোনও কথা বলল না, আপত্তি নেই যোগ্য ক্যাপ্টেনের কথা মেনে নিতে। নিশাতের সঙ্গে উল্টো দিকের বরফ টানেলে ঢুকে পড়ল দুই কর্পোরাল।

বাইরের দিকের টানেল ক্রমেই বেঁকে গেছে, পুব দিকে ছুটে চলেছে দবির ও কেলগ। দৌড়ের ফাঁকে বলল দবির, ঠিক আছে… এটা কী? বি-ডেক, তাই না? এখানে কী আছে?

আমি জানি না… আরও কিছু বলতে গিয়ে থেমে গেল কেলগ, টানেলের বাঁকে পৌঁছে গেছে।

দুজনই থমকে দাঁড়িয়েছে ওরা, পরস্পরের দিকে চাইল। আরও কালো হয়ে গেছে কেলগের মুখ।

.

উইলকক্স আইস স্টেশনের মাঝের শাফট লক্ষ্য করে গুলি পাঠাল মাসুদ রানা।

লেফটেন্যান্ট তিশা করিম এবং ও আছে সি-ডেকে, একটা ঘরের ভিতর। খোলা দরজার ওপাশে মাঝের ক্যাটওয়াক। চৌকাঠে এসে দাঁড়িয়েছে রানা, হাতে উদ্যত পিস্তল, মূল শাফট দিয়ে দেখা যায় উপরের এ-ডেক।

রানার পিছনে ঘরের ভিতর হাঁটু গেড়ে বসেছে তিশা, ধীরে ধীরে মাথা নেড়ে সচেতন হয়ে উঠতে চাইছে। হেলমেট খুলে ফেলেছে, পিঠে এলিয়ে পড়েছে কালো চুলের দীর্ঘ দুটো বেণী। কৌতূহল নিয়ে হেলমেট ও তীর দেখল তিশা। আস্তে করে মাথা নাড়ল। হেলমেট থেকে তীর খুলল না, আবার পরে নিল। কপালে ও গালে রয়ে গেল শুকনো রক্তের দাগ। গম্ভীর চেহারায় শক্ত করে ধরল এমপি-৫, উঠে দাঁড়িয়ে চলে গেল রানার পাশে।

ঠিক আছ? কাঁধের উপর দিয়ে জানতে চাইল রানা। পিস্তল তাক করেছে এ-ডেকের দিকে।

আমি কিছু মিস করেছি, স্যর?

তোমার কি মনে আছে একদল ফ্রেঞ্চ ভাব করছে তারা বিজ্ঞানী, তারপর আমাদের উপর গুলি শুরু করল? এ-ডেকের দিকে এক রাউণ্ড গুলি পাঠাল রানা।

তা মনে আছে।

আমরা তখন জানলাম, হোভারক্রাফট নিয়ে স্টেশনে ঢুকেছে ওদের আরও ছয়জন কমাণ্ডে।

এটা জানতাম না।

আর কিছু বলার… আরেকটা গুলি পাঠাল রানা, নেই।

পাশ থেকে রানার চোখের দিকে চাইল তিশা।

ওই দুই মায়াবী কালো চোখে নিজের উপর বিরক্তি। নিজেকে দোষ দিয়ে চলেছে। ফ্রেঞ্চ কমান্ডোরা সত্যিকারের রূপ দেখিয়েছে, কিন্তু সেজন্য তাদের উপর রাগ নেই। রাগ ওর নিজের উপর। আগেই বোঝা উচিত ছিল এরা বিজ্ঞানী নয়, খুনে সৈনিক।

আনমনে মাথা দোলাল তিশা।

রানা মানতে পারছে না, এরা উইলকক্স আইস স্টেশনে আগে এসেছে, সঙ্গে এনেছে সত্যিকারের দুজন বিজ্ঞানীকে, কাউকে সন্দেহ করবার কোনও সুযোগই দেয়নি।

মানুষটা নিজের উপর আরও খেপেছে, কারণ লড়াইয়ের শুরুতে কোনও পরিকল্পনা করতে পারেনি। ওদেরকে প্রথম থেকেই বোকা বানিয়েছে ফ্রেঞ্চ, বেকায়দা অবস্থায় ফেলেছে। আর এখন তো লড়াই কীভাবে চলবে সেটা তারাই ঠিক করছে।

কিন্তু আসলে কিছুই করবার ছিল না মাসুদ রানার।

তিশার মন চাইল ওকে সান্ত্বনা দিতে। কিন্তু চুপ রইল।

এদিকে নিজেকে দোষ দেয়া বন্ধ করেছে রানা, পরিষ্কার টের পেয়েছে মগজে ক্রোধ জমলে একের পর এক ভুল করবে। ওর মনে পড়ছে তিন বছর আগে লণ্ডনে ছিল, বিসিআইয়ের চিফ ওকে যোগ দিতে বলেন একটা সেমিনারে। উনি বলে দেন, ওখানে অনেক কিছু শিখতে পারবে। ওই সেমিনারে বক্তৃতা দেন লিজেণ্ডারি ব্রিটিশ কমাণ্ডার, মেজর জেনারেল জুলিয়াস বি. গুণ্ডারসন।

শক্তিশালী দেহের লোক, বাদামি দুই চোখে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি, গোটা মাথা কামানো, থুতনির নীচে কুচকুচে কালো ছোরার মত দাড়ি। জুলিয়াস বি, গুণ্ডারসন দু হাজার সাল থেকে এখনও এসএএস-র প্রধান। ধারণা করা হয় তিনি বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে প্রতিভাবান ফ্রন্ট-লাইন মিলিটারি ট্যাকটিশিয়ান। ওই সেমিনার শেষে রানা মেনে নিয়েছে, ছছাট দল নিয়ে শত্রু এলাকায় ঢুকে বিজয়ী হওয়ার স্ট্র্যাটেজি সত্যিই তাঁর তুলনাহীন। অবশ্য সঙ্গে থাকতে হবে। এসএএস-র মত এলিট যোদ্ধা ইউনিট। গুণ্ডারসন কালে কালে হয়ে উঠেছেন ব্রিটিশ মিলিটারির গর্ব। শোনা যায় তাঁর অধীনে আজ পর্যন্ত এসএএস কোনও মিশনে ব্যর্থ হয়নি।

দুবছর আগে আবারও লণ্ডনে ওকে, দু দিনের একটি সেমিনারে যোগ দিতে বলেন বিসিআই চিফ মেজর জেনারেল (অব.) রাহাত খান। কমনওয়েলথ দেশগুলোর সেনাবাহিনী থেকে সেরা অফিসারদের পাঠানো হয় ওই সেমিনারে। তবে বক্তৃতা দেওয়ার জন্য নয়, কভার্ট ওয়ারফেয়ার সম্বন্ধে জ্ঞান নিতে।

ওই সেমিনারে শেষ বক্তা ছিলেন এসএএস-এর চিফ মেজর জেনারেল গুণ্ডারসন। তাঁর গভীর জ্ঞান ও সন্দেহাতীত যোগ্যতার পরিচয় পেয়ে মুগ্ধ হয় রানা। অনেকেই তাকে একের পর এক প্রশ্ন করে কাবু করতে চেয়েছে, কিন্তু খুব সহজ ভঙ্গিতে উত্তর দেন তিনি। প্রতিটা কথার ভিতর ছিল তীক্ষ্ণ সব যুক্তি।

রানার এখনও মনে পড়ে, তিনি বলেছিলেন, লড়াই শুরু হলে আপনার মনে প্রথম প্রশ্ন জেগে ওঠা উচিত: শত্রু আসলে কী চায়? যদি এই প্রশ্নের জবাব মেলে, মনকে দ্বিতীয় প্রশ্ন করুন: শত্রু কীভাবে পেতে চাইছে জিনিসটা?

নিজেই বুঝবেন; প্রথম প্রশ্নের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ দ্বিতীয় প্রশ্ন। বলতে পারেন, তা কীভাবে? ধরুন, জিনিসটা যদি তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ না-ই হয়, তো কী কারণে চাইছে? আপনাকে বুঝতে হবে, কারণ যাই হোক, ওটা পাবার জন্য জান বাজি ধরেছে সে। এটা বোঝা খুব জরুরি। এ থেকেই বুঝবেন, শুরু হয়ে গেছে লড়াই। আর সে লড়াই আপনার শেষ করতে হবে।

একবার দ্বিতীয় প্রশ্নের জবাব মিললে তৃতীয় প্রশ্ন আসে: কীভাবে এদেরকে ঠেকাবেন?

এরপর নেতৃত্বের উপর বক্তৃতা দেন গুণ্ডারসন, বারবার বলেন মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হবে, যৌক্তিক পথে ভাবতে হবে। রাগী নেতা মানেই বোকা নেতা, সে একের পর এক ভুল করে খতম করবে তার দলকে।

আপনারা সামরিক নেতা, বলেছেন, গুণ্ডারসন, আপনাদের পক্ষে রেগে ওঠা বা বোকা বনার সুযোগ নেই।

কোনও নেতা, রাগ বা ভুল থেকে মুক্ত নয়, কাজেই এরপর গুণ্ডারসন। তাঁর তিন ধাপের ট্যাকটিক্যাল অ্যানালিসিস পেশ করেন।

আপনি যখন রেগে গেলেন, এই তিন ধাপের অ্যানালিসিস ব্যবহার করুন। রাগের বিষয়টি থেকে নিজের মন সরিয়ে নিন, শেষ করুন হাতের কাজ। তা হলে ভুলতে পারবেন কী রাগিয়ে দিয়েছিল। এরপর যে কাজে আপনাকে বেতন দেয়া হয়, সেটা শুরু করুন।

ওই সেমিনার শেষে মেজর জেনারেল গুণ্ডারসনের অধীনে ট্রেইনিং নেয় কয়েকজন সেরা অফিসার, তাদের ভিতর রানাও ছিল। অনেক কিছুই শিখতে পেরেছে তার কাছ থেকে।

এখন বরফ-ঠাণ্ডা উইলকক্স আইস স্টেশনের সি-ডেকে একটা দরজার চৌকাঠে দাঁড়িয়ে ভাবছে রানা, মনের ভিতর কথা বলে চলেছেন মেজর জেনারেল জুলিয়াস বি. গুণ্ডারসন।

বড় করে শ্বাস ফেলল রানা।

এরা কী চায়?

একটা স্পেসশিপ।

ওটা পাবে কীভাবে?

ওদের সবাইকে খুন করবে, তারপর তুলে আনবে স্পেসশিপ, কোনও দেশ বুঝবার আগেই ওটাকে সরিয়ে ফেলবে এই মহাদেশ থেকেই।

কিন্তু এই অ্যানালিসিসে একটা সমস্যা আছে। খুঁতটা ধরতে পেরেছে রানা।

বড় দ্রুত এখানে হাজির হয়েছে ফ্রেঞ্চরা।

এবং এতই দ্রুত, ইউনাইটেড স্টেটস কোনও দল পাঠাবার আগেই পৌঁছে গেছে তারা। এ থেকে বোেঝা যায় উইলকক্স আইস স্টেশন থেকে ডিসট্রেস সিগনাল ছড়িয়ে পড়বার সময় কাছেই ছিল তারা। অর্থাৎ, রাফায়লা ম্যাকানটায়ার যখন সিগনাল পাঠাল, তার আগেই ডুমো ডিখ-ঈলেখে ছিল ফ্রেঞ্চ কমাণ্ডোরা।

আগে থেকে কারও বুঝবার উপায় ছিল না ওই সিগনাল পাঠানো হবে। কাজেই, ওটা হঠাৎ করেই ঘটে।

আর এই অ্যানালিসিসের সমস্যা এখানেই।

ফ্রেঞ্চরা সামনে মস্ত একটা সুযোগ দেখতে পেয়েছে, এবং সুযোগটা নেয়ার জন্য মুহূর্তের নোটিসেই হামলে পড়েছে।

ডুমো ডিখ-ঈলেখে নিশ্চয়ই আর্কটিক ওয়ারফেয়ার বা এ ধরনের কোনও এক্সারসাইজে ব্যস্ত ছিল ফ্রেঞ্চ কমান্ডোরা।

তারপর উইলকক্স আইস স্টেশন থেকে ডিসট্রেস সিগনাল ধরল ডুমো ডিখ-ঈলেখ স্টেশন। খবর পাওয়ামাত্র ফ্রেঞ্চ সরকার বুঝে নিল, উইলকক্স আইস স্টেশনে রয়েছে এক্সট্রাটেরেস্ট্রিয়াল স্পেসশিপ, এবং তাদের এলিট মিলিটারি ইউনিট আছে মাত্র ছয় শ মাইল দূরে।

এ সুযোগ ছাড়া যায়?

ফ্রান্স মুঠোর মধ্যে পেয়ে যাবে অকল্পনীয় প্রকৌশলগত। উন্নতির সম্ভাবনা। এক পলকে পাল্টে যেতে পারে তাদের প্রপালশান সিস্টেম, হয়তো বদলে যাবে বিমানের আকৃতিও। তারা পেয়ে যেতে পারে অত্যন্ত আধুনিক, ঈর্ষণীয় অস্ত্র সম্ভার।

আসলে এর আগে কোনও জাতির সামনে এমন মোক্ষম সুযোগ আর আসেনি।

আরও ভাল দিক: ফ্রেঞ্চরা যদি উইলকক্স আইস স্টেশন থেকে স্পেসশিপ সরিয়ে ফেলতে পারে, চাইলেও আমেরিকান সরকার ইউএন বা ফ্রেঞ্চ সরকারের কাছে কেঁদে পড়তে পারবে না, কাউকে বলতে পারবে না আমেরিকার হাতে স্পেসশিপ ছিল। যা কখনও তাদের কাছে ছিলই না, তা চুরি হয়েছে, এমন কথা কী করে বলবে!

দুটো সমস্যা তৈরি হয়েছে ফ্রেঞ্চ কমাণ্ডোদের সামনে।

প্রথম সমস্যা: উইলকক্স আইস স্টেশনের বাঙালি ও আমেরিকান বিজ্ঞানী, তাদেরকে মেরে ফেলতে হবে। কোনও সাক্ষী রাখা চলবে না।

দ্বিতীয় সমস্যা গুরুতর: সন্দেহ নেই ইউনাইটেড স্টেট উইলকক্স স্টেশনে রিকনিস্যান্স ইউনিট পাঠাবে। এদিকে টিকটিক করে এগিয়ে চলেছে সেকেণ্ডের কাঁটা। ফ্রেঞ্চরা বুঝতে পেরেছে, যত দ্রুত সম্ভব ইউএস টুপ হাজির হবে, এবং তা ঘটবে স্পেসশিপ সরিয়ে নেয়ার আগেই।

তার মানেই: তুমুল গোলাগুলি।

কপালের জোরে ঠিক সময়ে নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছেছে ফ্রেঞ্চ কমাণ্ডো দল। কিন্তু তাদের পক্ষে উইলকক্স আইস স্টেশনে ফুল-স্ট্রেংথ অ্যাসল্ট চালানো সম্ভব নয়। হতে পারে, তারা স্পেসশিপ সরিয়ে নেয়ার আগেই তাদের টুপ হয়ে উঠবে অসহায়, অনেক বড় কোনও দল পাঠাবে ইউএসএ।

কাজেই তাদেরকে অন্য পরিকল্পনা করতে হয়েছে।

কমাণ্ডোরা ভান করেছে, তারা বিজ্ঞানী, প্রতিবেশীদের সাহায্য করতে এসেছে। তারা ধারণা করেছে, ছোট কোনও দল এলে বোকা বানাতে পারবে, এবং প্রথম সুযোগেই সবাইকে খুন করতে পারবে। অপেক্ষাকৃত দুর্বল ও ছোট দলের জন্য এটা মন্দ পরিকল্পনা নয়।

সেক্ষেত্রে মাত্র একটি প্রশ্ন থাকে: অ্যান্টার্কটিকা থেকে কীভাবে স্পেসশিপ সরাবে?

আপাতত ওই প্রশ্নের জবাব না পেলেও চলবে, ভাবল, রানা। এখন লড়াইয়ে মন দেয়া উচিত। আবারও প্রথম প্রশ্ন ফিরল মনে: ওরা কী চাইছে?

বিজ্ঞানী এবং ওদেরকে খুন করতে চাইছে, যত দ্রুত সম্ভব।

তা কীভাবে করবে?

মন থেকে কোনও জবাব পেল না রানা। নিজেকে জিজ্ঞেস করল, আমি হলে কী করতাম?

মুহূর্ত পর ওর মন বলে দিল: তুমি সবাইকে তাড়িয়ে এক জায়গায় নেবার চেষ্টা করতে। সেক্ষেত্রে গোটা স্টেশন খুঁজে সবাইকে খুন করতে হতো না।

গ্রেনেড! চেঁচিয়ে উঠল তিশা।

কাঁধে মৃদু ঝাঁকি খেয়ে বাস্তবে ফিরল রানা। এ-ডেক থেকে উড়ে নামছে কালো গ্রেনেড, আসছে ঠিক ওদের দিকেই। উপর থেকে পড়ছে আরও ছয়টা গ্রেনেড। ওগুলো ঢুকে গেল বিডেকের তিন টানেলের ভিতর।

সরে আসুন, স্যর!

তিশার ডাক শুনে পিছিয়ে ঘরে ঢুকে পড়ল রানা, চট করে বন্ধ করে দিল কবাট। কয়েক লাফে পৌঁছে গেল ওরা ঘরের আরেক প্রান্তে। পুরু কাঠের দরজার উপর ঠকাস্ আওয়াজ তুলল গ্রেনেড!

একমুহূর্ত পর বোমা বিস্ফোরিত হলো বিকট আওয়াজে। দরজার ভিতর অংশ থেকে নানা দিকে ছুটল সাদা কাঠের চল্টা। সে জায়গায় দেখা গেল কয়েক শ তীক্ষ্ণধার ধাতুর টুকরো, একেকটা পেরেকের ডগার মত।

চমকিত রানা দেখল দরজার একেবারে নীচ থেকে শুরু করে উপর অংশ ঝাঁঝরা হয়েছে। একটু আগে কাঠের কবাট ছিল মসৃণ, এখন মনে হচ্ছে ওটা ভয়ঙ্কর কোনও মেডিইভেল টর্চার ডিভাইস। গোটা দরজা জুড়ে খুদে বর্শার ফলা, প্রায় বেরিয়ে এসেছে পুরু কবাট ভেদ করে।

উপরে বি-ডেকে বিস্ফোরণের আওয়াজ। বি-ডেক, ভাবল রানা, ওখানে সবাইকে জড় করতে চাইছে ফ্রেঞ্চরা।

ওর শুকনো মুখ দেখে জানতে চাইল তিশা, কী ভাবছেন, স্যর?

কোনও জবাব দিল না রানা, সামনে এগিয়ে খুলে ফেলল দরজা, উঁকি দিল আইস স্টেশনের সেন্ট্রাল শাফটে। মুহূর্ত পর মাথার পাশে, খট-খট আওয়াজে দরজার চৌকাঠে লাগল দুটো বুলেট। পাত্তা দিল না রানা, সামান্য আড়াল নিয়ে উপরের এডেকের দিকে চাইল।

ক্যাটওয়াকের উপর দফায় দফায় গুলি ছুঁড়ছে পাঁচ ফ্রেঞ্চ কমাণ্ডো, উদ্দেশ্য কাভার ফায়ার দেয়া।

সেই সুযোগে নেমে আসছে বাকি পাঁচ কমাণ্ডো। মাত্র কয়েক সেকেণ্ডে মই বেয়ে নেমে এল তারা, বি-ডেকের ক্যাটওয়াকে পৌঁছে গেল। হাতে উদ্যত অস্ত্র নিয়ে ঢুকে পড়ল টানেলগুলোর ভিতর।

ওদিকে চেয়ে অস্বস্তি বোধ করল রানা। উপর থেকে ফ্রেঞ্চ কমাণ্ডোরা তাড়া দেয়ায় ওর দলের প্রায় সবাই আছে ওই বিডেকে।

এ ছাড়া আরেকটা বিষয় খুব জরুরি।

উইলকক্স আইস স্টেশনে প্রধান লিভিং এরিয়া বি-ডেক, ওখানে যার যার কোয়ার্টারে আমেরিকান বিজ্ঞানীদেরকে পাঠিয়ে দিয়েছে ও। এরপর ওরা দেখতে গেছে ফ্রেঞ্চ হোভারক্রাফট নিয়ে কারা এল।

চিন্তিত রানা চেয়ে আছে বি-ডেকের দিকে। ওদেরকে ওইখানে জড়ো করতে চাইবে ফ্রেঞ্চ কমাণ্ডোরা!

.

হঠাৎ করেই বদলে যেতে শুরু করেছে বি-ডেকের পরিস্থিতি।

বরফের টানেলের বাঁকে পৌঁছেই চমকে গেছে হোসেন আরাফাত দবির ও টনি কেলগ। ওদিক থেকে আসছে উইলকক্স আইস স্টেশনের বাসিন্দারা।

চট করে হোসেন আরাফাত দবিরের মনে পড়ল বি-ডেক হচ্ছে এদের লিভিং এরিয়া।

পিছনে সাবমেশিনগানের গর্জন শুরু হয়েছে।

হেলমেট ইন্টারকমে মাসুদ রানার কণ্ঠ শুনল দবির, প্রত্যেক ইউনিট, আমি মেজর মাসুদ রানা। এইমাত্র পাঁচ ফ্রেঞ্চ কমাণ্ডে নেমেছে ক্যাটওয়াকে। আবার বলছি, ওরা পাঁচজন। তোমরা বি-ডেকে সতর্ক হও।

দ্রুত ভাবতে শুরু করেছে দবির, কী যেন বি-ডেকের ফ্লোর প্ল্যান! ওর মনে পড়ল, অন্য লেভেলের সঙ্গে সামান্য, তফাৎ আছে বি-ডেকের। অন্য সব ফ্লোরে সেন্ট্রাল শাফট থেকে এসেছে চারটে টানেল, তারপর রয়েছে বাইরের গোলাকার টানেল, কিন্তু বি-ডেক তা নয়। পাথরের মস্ত একটি স্তরের, কারণে দক্ষিণে কোনও সুড়ঙ্গ খোড়া যায়নি বি-ডেকে।

অন্য সব লেভেলের মত নয়, বি-ডেকে প্রধান শাফট থেকে এসেছে মাত্র তিনটি টানেল, বাইরের দিকের টানেল কোনও বৃত্ত তৈরি করেনি। এর ফলে দক্ষিণ টানেল হঠাৎ করেই বুজে গেছে। দবিরের মনে পড়ল, আগেও ওদিকটা দেখেছে: টানেলের শেষে একটি ঘর, আর ওখানেই আটকে রাখা হয়েছে বাঙালি বিজ্ঞানী রাশেদ হাবিবকে।

আপাতত বাইরের দিকের টানেলে রয়েছে দবির ও কেলগ, পুব টানেলের বাঁক পেরুলে পা রাখবে উত্তর টানেলে। গোলাগুলির বিকট আওয়াজ শুনে বেরিয়ে এসেছে বিজ্ঞানীরা, অবশ্য বেশি দূর যাওয়ার সাহস হয়নি। ফ্যাকাসে হয়ে গেছে সবার মুখ, তাদের ভিতর ছোট্ট এক মেয়েকে দেখতে পেল দবির।

হায় আল্লা, বিড়বিড় করে বলল সে। পরক্ষণে কেলগকে বলল, পিছনে টানেল কাভার দাও। বোঝাতে চেয়েছে কেউ যেন বাইরের এই টানেল থেকে উত্তর টানেলে ঢুকতে না পারে।

নিজে বিজ্ঞানীদের পেরিয়ে গেল দবির, নজর রাখল পুব টানেলে। পিছন না ফিরেই বলল, লেডিজ অ্যাণ্ড জেন্টলম্যান, আপনারা যার যার ঘরে ফিরে যান। জলদি!

এখানে কী হচ্ছে? রাগত কণ্ঠে জানতে চাইল একজন বিজ্ঞানী।

আপনাদের বন্ধুরা মোটেই বন্ধু ছিল না, বলল সার্জেন্ট দবির। আপনাদের স্টেশনের ভিতর একদল ফ্রেঞ্চ প্যারাট্রুপার নিয়ে ঢুকেছে ওরা। সামনে পেলে খুন করবে আপনাদেরকে। এবার নিজের ঘরে ফিরে যান।

সার্জেন্ট, গ্রেনেড! করিডোরের দূর-প্রান্তে চেঁচাল কেলগ।

চোখের কোণে দবির দেখল এইমাত্র বাঁক পেরুল কেলগ, তীরের মত আসছে ওর দিকেই। আরও চোখে পড়ল বিশ ফুট পিছনে ড্রপ খেয়েছে ফ্র্যাগমেন্টেশন গ্রেনেড।

শালার কপাল! চরকির মত ঘুরল দবির, পুব টানেলের বাক কমপক্ষে দশ গজ দূরে!

ঠিক তখনই পুব টানেল থেকে এল আরও দুটো গ্রেনেড। বাইরের দিকের টানেলের দুই মুখে পড়েছে সব মিলে তিনটে গ্রেনেড!

ফ্রেঞ্চ কুত্তার-বাচ্চারা! বিস্ফারিত হলো দবিরের দুই চোখ। কাছের দরজার কবাট খুলতে শুরু করেছে ও, ধমকে উঠল বিজ্ঞানীদেরকে, শালারপো, শালারা, ঘরে ঢোক! এক্ষুনি! যে যার ঘরে!

এক সেকেণ্ড পর বিজ্ঞানীরা বুঝল সে কী বলছে, পরক্ষণে যে যার দরজার দিকে ঝেড়ে দৌড় দিল।

সামনের দরজা দিয়ে ঢুকে পড়ল দবির, পরক্ষণে উকি দিল কেলগ কী করছে দেখতে। বাঁকা টানেল ধরে সিক্স মিলিয়ন ডলার ম্যানের গতি তুলে ছুটে আসছে তরুণ কর্পোরাল।

তারপর পা পিছলে গেল তার।

বেকায়দা ভাবে হুমড়ি খেয়ে পড়ে সরসর করে পিছলে চলেছে বরফের মেঝেতে।

অসহায় চোখে কেলগের দিকে চেয়ে রইল দবির। লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াতে গেল কালো ছেলেটা, তারই ফাঁকে চাইল পিছনের ফ্র্যাগমেন্টেশন গ্রেনেডের দিকে।

আর বড়জোর দুই সেকেণ্ড বাকি।

দুশ্চিন্তা করতে গিয়ে দবিরের পেটের পেশি জট পাকিয়ে গেল।

বাঁচবে না টনি কেলগ। ছেলেটাকে ভাল লেগেছিল ওর।

সবচেয়ে কাছের দরজা দিয়ে ঢুকতে চাইছে দুই বিজ্ঞানী। পিছনের জন গুঁতো দিচ্ছে সঙ্গীর পিঠে। যেভাবে হোক ঘরে ঢুকতে হবে।

মহা আতঙ্ক নিয়ে কেলগের দিকে চেয়ে আছে দবির। দুই বিজ্ঞানীকে ঠেলাঠেলি করতে দেখেছে কেলগ, বুঝে গেছে ওই ঘরে আর ঢুকতে পারবে না। বাইন মাছের মত গা মুচড়ে ঘুরে চাইল, তিরিশ ফুট দূরে টানেলের বাঁকে ফ্র্যাগমেন্টেশন গ্রেনেড!

উন্মাদ হয়ে উঠল কেলগ, ঘুরেই চাইল দবিরের চোখে। দুজনের চোখ আটকে গেছে পরস্পরের উপর। ভীষণ ভয় কেলগের চোখে, বুঝে গেছে মরতে যাচ্ছে ও এখুনি।

কোথাও যাওয়ার নেই। কোথাও না!

তারপর বিকট আওয়াজে ফাটল তিন গ্রেনেড উত্তর টানেলে একটা, পুব টানেলে দুটো পেটের সব বিষ ঝাড়ল। চৌকাঠ ছেড়ে পিছিয়ে গেল দবির, চোখের সামনে দেখল দুদিকে ছুটছে চকচকে ধাতুর টুকরো!

১১.

পুরু কাঠের ওপাশে থরথর করে কেঁপে উঠল মেঝে, আবারও দরজায় বিঁধল শ্যাপনেল। সি-ডেকে সামনের দিকের একটা ঘরে অ্যালুমিনিয়ামের, টেবিল কাত করে তার পিছনে আড়াল নিয়েছে রানা ও তিশা।

দলের সবাই, তোমরা কোথায়? ইন্টারকমে জানতে চাইল রানা।

শুনতে পেল কয়েকটি কণ্ঠ, ওপাশে গুলির আওয়াজ।

ক্যাপ্টেন নিশাত সুলতানা বলছি, আমার সঙ্গে কর্পোরাল নাজমুল ও হলিডে সিম্পসন, বি-ডেকের উত্তর-পশ্চিম থেকে তুমুল গুলির মুখে পড়েছি!

জোরালো স্ট্যাটিক শুরু হলো রানার ইয়ারপিসে।

.. দবির… কেলগ পড়ে গেছে। পুব টানেলে… হঠাৎ বন্ধ হলো হোসেন আরাফাত দবিরের কণ্ঠ, পরক্ষণে হারিয়ে গেল সিগনাল।

ওয়াকার বলছি… সঙ্গে লেফটেন্যান্ট গোলাম মোরশেদ, এখনও এ-ডেকে। কিন্তু গুলির মুখে বেরুতে পারছি না।

সার্জেন্ট পল সিংগার জানাল, ভাইপার… আমি বাইরে, মেইন এন্ট্রান্সের দিকে আসছি।

কেলগের কাছ থেকে কোনও সাড়া নেই। এরই ভিতর মারা পড়েছে জর্জ মারফি ও কেভিন হাক্কলে। মনে মনে হিসাব কষছে রানা, ওরা তিনজন মারা গেছে, তার মানে ওকে নিয়ে দলে আছে মাত্র নয়জন। এদিকে ফ্রেঞ্চরা ছিল বারোজন, সঙ্গে হেলপার দুই বিজ্ঞানী। পল সিংগার আগেই বলেছে, বাইরে একজনকে মেরেছে সে। রানা নিজে ডাইনিংরুমে একজনকে শেষ করেছে। তার মানে ফ্রেঞ্চ কমাণ্ডোরা এখন দশজন। সঙ্গে দুই বিজ্ঞানী, তারা কোথায়। কে জানে!

বর্তমানে ফিরল ওর মন। চোখ পড়ল কাঠের প্রকাণ্ড দরজার উপর। কবাটে গেঁথে আছে অসংখ্য চকচকে রুপালি খুদে বর্শার ফলা। তিশার দিকে চাইল রানা। আমরা এখানে থাকতে পারব না।

আমারও তাই মনে হয়, স্যর, শুকনো গলায় বলল তিশা।

দ্বিতীয়বার তিশার দিকে চাইল রানা। মেয়েটা আসলে কী বোঝাতে চাইছে? আর কোনও কথাও বলছে না। তারপর ওর কাঁধের উপর দিয়ে ওদিকটা দেখিয়ে দিল।

প্রথমবারের মত ঘরে চোখ বোলাল রানা। এর আগে খেয়াল করবার সময় ছিল না।

মনে হলো এটা কোনও বয়লার রুম। ছাত জুড়ে অসংখ্য কালো পাইপ। ঘরের ডানপাশ জুড়ে একটার উপর আরেকটা সাদা রঙের বিশাল দুটো সিলিণ্ডার। ওই দুই সিলিণ্ডার দৈর্ঘ্যে কমপক্ষে বারো ফুট, উচ্চতা হবে ছয় ফুট।

দুই সিলিণ্ডারের মাঝে বড় হীরক আকৃতির লাল স্টিকার। বোঝানো হয়েছে সিলিণ্ডারের ভিতর দাহ্য পদার্থ। নীচে বড় বড় অক্ষরে লেখা:

ডেনজার
     ফ্লামেবল প্রপেল্যান্ট
        এল-৫ 
     হাইলি ফ্ল্যামেবল

প্রকাণ্ড দুই সাদা সিলিণ্ডারের দিকে চেয়ে রইল রানা। ওগুলোর সঙ্গে সংযুক্ত একটা কমপিউটার? ওটা আছে ঘরের পিছনে। কমপিউটার চলছে, কিন্তু স্ক্রিন-সেভারে দেখা গেল বিশালবক্ষা এক নির্লজ্জ মেয়ে সৈকতে শুয়ে নানান ইঙ্গিত করছে।

ঘরের পিছনে চলে গেল রানা, থামল কমপিউটারের সামনে। ওর দিকে চেয়ে ঠোঁট গোল করে ইশারা করল মেয়েটি।

পরে, ডারলিং, স্ক্রিনের দিকে চাইল রানা, কি-বোর্ডে টোকা দিল। সঙ্গে সঙ্গে উধাও হলো মেয়েটি।

সেখানে উদয় হয়েছে নানা রঙের উইলকক্স আইস স্টেশনের পাঁচতলা ডায়াগ্রাম। স্ক্রিনে পাঁচটা বৃত্ত। বামে তিনটে, ডানদিকে দুটো মাঝে মস্ত শাফট, ওটাকে ঘিরেছে প্রতিটি সার্কেল। এই সার্কেলের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে চারটে সোজা টানেল।

বাইরের টানেল ও ভিতরের কূপের মাঝে বেশ কিছু ঘর। প্রতিটি রুমকে আলাদা রঙে দেখানো হয়েছে। স্ক্রিনের এক পাশে কালার চার্ট দিয়ে বুঝিয়েছে তাপমাত্রা। হিমাঙ্কের–৫.৪ ডিগ্রি থেকে শুরু করে হিমাঙ্কের-১.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত দেখিয়েছে।

দরজার কাছ থেকে মন্তব্য করল তিশা, এয়ার কণ্ডিশনিং সিস্টেম, স্যর?

হ্যাঁ। এল-৫, মানে প্রপেল্যান্ট হিসাবে ক্লোরোফ্লিউরোকার্বন ব্যবহার করে। অনেক পুরনো আমলের।

আছে তাই তো বেশি, মন্তব্য করল তিশা।

ওর পাশে পৌঁছে গেল রানা, হ্যাণ্ডেল ধরে সামান্য ফাঁক করল দরজা। পরক্ষণে চমকে গেল। বেসবল আকৃতির কালো কী যেন ছুটে আসছে ওরই দিকে!

পিছনে বেরুচ্ছে সাদা ঘন ধোঁয়া! জ্যাকুস ফিউভিলকে এডেকের ক্যাটওয়াকে দেখা গেল, হাতে ফ্যামাস অ্যাসল্ট রাইফেল। মাযলের নীচে ৪০এমএম গ্রেনেড লঞ্চার।

ঝট করে উবু হয়ে গেল রানা, চৌকাঠ এবং ওর মাথার উপরের ফাঁক দিয়ে ভিতরে ঢুকল গ্যাস-প্রপেল্ড গ্রেনেড, তখনও একটু একটু করে উপরে উঠছে, আধ সেকেণ্ড পর ঘরের পিছনে গিয়ে লাগল ওটা।

বেরোও! এক্ষুণি! চেঁচিয়ে উঠল রানা।

তিশাকে দ্বিতীয়বার বলতে হলো না, তীরের মত দরজা দিয়ে বেরুল ও। হাতের এমপি-৫, গুলি ছুঁড়ছে এ-ডেকের দিকে।

ডাইভ দিয়ে চৌকাঠ পেরুল রানা, এবং ঠিক তখনই ওর পিছনে এয়ার-কণ্ডিশনিং রুমে বিস্ফোরিত হলো গ্রেনেড। প্রায় উড়ে গেল দরজা, মজবুত কজা না থাকলে শলার মত ছিটকে পড়ত। বাইরের দিকে পুরো এক শ আশি ডিগ্রি খুলে গেছে দরজা, দড়াম করে লাগল ক্যাটওয়াকের বরফ-দেয়ালে। খোলা চৌকাঠ দিয়ে বেরুল আগুনের বিশাল এক গোলক, রানাকে স্পর্শ করেই চলে গেল স্টেশনের মাঝে।

স্যর, আসুন! ডাকছে তিশা, ক্যাটওয়াক থেকে এ-ডেক লক্ষ্য করে গুলি করছে।

মেঝেতে পড়েই এক গড়ান দিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে রানা, ঘুরেই এমপি-৫ থেকে এক পশলা গুলি পাঠাল। এইমাত্র উপরের ক্যাটওয়াকে ছিল জ্যাকুস ফিউভিল, কিন্তু ওখান থেকে সরে গেছে সে।

ছুটতে শুরু করেছে তিশা, দীর্ঘ পায়ে ওর পাশে চলে গেল রানা। সি-ডেকের ক্যাটওয়াক ধরে এগিয়ে চলেছে ওরা, বেরিয়ে এসেছে খোলা জায়গায়। মদিক কাভার করছে রানা, ডানদিক দেখছে তিশা। ওদের এমপি-৫-এর মাযল থেকে ছিটকে বেরুচ্ছে, উজ্জ্বল হলুদ ঝলকানি। ফ্রেঞ্চদের পাল্টা গুলি ওদের আশপাশের বরফ-দেয়ালে এসে লাগছে।

দশ গজ দূরের দেয়ালে ছোট অ্যালকোভ দেখতে পেয়েছে রানা।

তিশা! ওদিকে!

জী!

কয়েক মুহূর্ত পর খুদে অ্যালকোতে ঝাঁপিয়ে ঢুকল রানা ও তিশা। এক পলক পর এয়ার-কণ্ডিশনিং রুমের ভিতর বিকট আওয়াজে বিস্ফোরণ ঘটল।

রানা বুঝে গেছে, এই বিস্ফোরণ অন্যগুলোর মত নয়, একেবারেই ভিন্ন ধাচের। এটা গ্রেনেড ফাটবার শব্দ নয়, অনেক গুরুগম্ভীর গর্জন। অনেক বড় কিছু ফেটে পড়ছে।

এয়ার-কণ্ডিশনিং সিলিণ্ডার!

ওই ঘরের চার-দেয়াল চুরচুর হলো ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণে। ঠিক যেন তাসের প্রাসাদ, মুহূর্তে ছিটকে গেল চারপাশে। কেউ শ্যাম্পেনের বোতলের কর্ক খুলেছে, এমন ভাবে প্রচণ্ড গতি তুলে ছিটকে বেরুল কালো পাইপগুলো, স্টেশনের শাফটের মাঝের একশ ফুট পেরিয়ে গাঁথল গিয়ে ওদিকের দেয়ালে।

পাশের দেয়ালে গুলি লাগতেই অ্যালকোভের দেয়ালে সেটে গেল রানা, চট করে চারপাশ দেখে নিল।

দেয়ালের গভীরে জায়গাটা ক্লজিটের মত, ব্যবহার করা হয় ডাইভিং বেল উপরে তোলা ও নামাবার বিশাল উইঞ্চের কন্ট্রোল কঙ্গেল রুম হিসাবে। কন্সেল বলতে ছোট কিছু লিভার, ডায়াল ও প্যানেল ভরা বোতাম।

কন্সোলের সামনে স্টিল-প্লেটেড বিশাল এক চেয়ার। চট করে ওটা চিনল রানা। এফ-১৪ ফাইটার বিমানের পাইলট ইজেকশন সিট। নীচে বুস্টারের কালো পোড়া দাগ, উপরে গভীর ট্যাপ খাওয়া স্টিলের মস্ত হেডরেস্ট। বুঝতে দেরি হলো না, বিগত জীবনে নিজ দায়িত্ব ভাল ভাবেই পালন করেছে এই জিনিস। উইলকক্স আইস স্টেশনের কেউ বুদ্ধি করে বিরাট চেয়ার বসিয়ে নিয়েছে রোটেটিং এক স্ট্যাণ্ডে, তারপর গোটা জিনিসটা মেঝের সঙ্গে বন্টু মেরে আটকে দিয়েছে। চার শ পাউণ্ড ওজনের মিলিটারি জঞ্জাল এখন হয়ে উঠেছে হেভি ডিউটি ফার্নিচার।

হঠাৎ করেই তুমুল গুলি শুরু হলো এ-ডেকের উত্তর-পশ্চিম কোনা থেকে। চমকে গিয়ে ইজেকশন সিটের উপর উঠে পড়ল তিশা, পরক্ষণে সরে গেল হেডসেটের ওপাশে। গুটিসুটি মেরে বসেছে। বিশাল সিটের ইস্পাতের পাত ওকে ভাল ভাবেই আড়াল দিয়েছে।

পুরো দশ সেকেণ্ড গুলিবর্ষণ চলল ইজেকশন সিটের উপর। হেডসেটে মাথা রেখে বসে রইল তিশা, চোখ বন্ধ। ইস্পাতের পাতে লেগে চারপাশে ছিটকে পড়ছে গুলি। কয়েক মুহূর্ত পর আবারও চোখ খুলে এদিক-ওদিক চাইল।

এক পাশে কী যেন নড়ছে।

ওর বামদিকে, নীচে।

ওদিকে স্টেশনের পুল।

ওখানে পানির নীচে ওটা কী? কালো-সাদা, বিশাল আকারের, ধীর ভঙ্গিতে চলছে, যেন হুমকি দিচ্ছে কাউকে। পানির বেশ কিছুটা নীচে রয়েছে ওটা, উঁচু ডরসাল ফিন সারফেস ভেদ করে উপরে উঠছে না।

প্রথমটার সঙ্গে যোগ দিল দ্বিতীয়, তারপর তৃতীয়, শেষে চতুর্থ কিলার ওয়েইল। দলের নেতা বিশাল আকারের, দৈর্ঘ্যে কমপক্ষে চল্লিশ ফুট। অন্যগুলো একটু ছোট।

ওগুলো মেয়ে, ভাবল তিশা। বইয়ে পড়েছে, একটা পুরুষের সঙ্গে থাকে কমবেশি আট-নয়টা মেয়ে।

অস্থির হয়ে উঠেছে পুলের পানি, ভাঙাচোরা দৃশ্য–এ কারণে কালো-সাদা দানবগুলোকে আরও ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছে। পুরুষটা কাত হতেই দেখা গেল ওটার সাদা পেট আর বিকট খোলা মুখ। তিশার : ভয় লেগে গেল দুই সারি ক্ষুরধার দাঁত দেখে।

নেতার পিছনে সেই দুই তরুণ খুনি। ফ্রেঞ্চ কমাণ্ডো দলের হামলা শুরু হওয়ার আগে এদেরকে পুলে দেখেছে তিশা, তখন সিলমাছ লিলিকে খুঁজছিল তারা।

আবারও ফিরেছে… সঙ্গে এনেছে গোটা দলের সবাইকে।

পুলের কিনারা ধরে ঘুরতে শুরু করেছে গোটা পাল, ওদিকে চেয়ে শিরশির করছে তিশার বুক। মনে পড়ছে বইয়ে পড়া ভয়ঙ্কর সব বর্ণনা। বহু লোক মরেছে কিলার ওয়েইলের কবলে পড়ে!

.

বিন্দুমাত্র সুযোগ ছিল না কর্পোরাল টনি কেলগের।

তিন ফ্র্যাগমেন্টেশন গ্রেনেডের তীব্র গতির এ্যাপনেল দুপাশ থেকে আঁঝরা করেছে তাকে। অসহায় চোখে তরুণ সৈনিকের দিকে চেয়েছিল আরাফাত দবির। বিস্ফোরণের আগে মেঝেতে হাঁটু গেড়ে বসে দুহাতে মুখ ঢেকে ফেলেছিল কেলগ, তারপর পেরেকের ডগার মত অসংখ্য এ্যাপনেল বিঁধল ওর সারা দেহে।

কাছের দরজা দিয়ে সামনের বিজ্ঞানীকে ঠেলে ভিতরে ঢুকতে চেষ্টা করছিল তার সঙ্গী, কিন্তু যথেষ্ট সময় পায়নি বেচারা। কেলগের মতই, চাওয়া যায় না তার দিকে। যেখানে দাঁড়িয়েছিল, ওখানেই ধপ করে পড়েছে লাশ। কেলগের বুক ও কাঁধের বডি আর্মার বহু এ্যাপনেল ঠেকিয়েছে, কিন্তু বিজ্ঞানী ছিল একেবারেই অনাবৃত ও অসহায়। এখনও তার গোটা দেহ থেকে দরদর করে রক্ত ঝরছে। দেখতে ভয়ঙ্কর হয়েছে লাশটা।

এ ধরনের বিস্ফোরণ হলে কোনও পেশি রক্ষা পায় না। এখানেও তাই হয়েছে। দেহে এক ইঞ্চি ত্বক নেই যা অক্ষত।

পুরু ভুরুজোড়া কুঁচকে মৃত সঙ্গীর দিকে চেয়ে রইল সার্জেন্ট আরাফাত দবির, জানে না কী করবে। বি-ডেকের আরেক পাশে বাইরের বাঁকা টানেল ধরে ছুটে চলেছে নিশাত সুলতানা। পিছনে কর্পোরাল নাজমুল ও হলিডে সিম্পসন, মাঝে মাঝে থমকে দাঁড়িয়ে গুলি করছে। টানেল ধরে ধেয়ে আসছে তিনটে কালো ছায়া।

কর্পোরাল হলিডে সিম্পসনের বয়স একত্রিশ বছর, ব্রোঞ্জের মত চকচকে ত্বক, চৌকো চোয়াল, আসলে তার পরিবার এসেছে ইতালি থেকে। মন যেমনই থাক, সবার সঙ্গে ভাল ব্যবহার করে।

এই উপদলের নেত্রী ক্যাপ্টেন নিশাত সুলতানা, রানার গোটা দলে সে সেকেণ্ড ইন কমাণ্ড? তিশা করিমের সঙ্গে ওর অনেক তফাৎ। দলের এই দুই মহিলা একজন দক্ষিণ মেরু হলে অপরজন উত্তর মেরু।

তিশার বয়স মাত্র তেইশ, দেখতে রাণী পুতুলের মত সুন্দর, মিষ্টি করে কথা বলে, অবশ্য সবার সঙ্গে একটু দূরত্ব বজায় রেখে চলে। এদিকে নিশাতের বয়স একত্রিশ, ঝাড়া ছয় ফুট উঁচু, ওজন প্রায় দুই শ পাউণ্ড। সবার দেখাদেখি রানাও ওকে আপা বলেই ডাকে। বদলে সবাই ওর কাছ থেকে পায় বড়বোনের আদর। দলের কেউ আহত হলে বা অসুস্থ হলে তার ভাবতে হয় না, সুস্থ হওয়া পর্যন্ত নার্সিঙের কাজ নিজেই নেয় সে।

হেলমেট মাইকে বলল নিশাত, স্যর, নিশাত বলছি। বিডেকে গোলাগুলি চলছে। আবারও বলছি, বি-ডেকে তুমুল গুলি চলছে। পিছন থেকে শত্রুরা আসছে। তাদের সঙ্গে ফ্র্যাগমেন্টেশন গ্রেনেড। চারপাশে এসে পড়ছে। পশ্চিম টানেলের দিকে যাচ্ছি, ওখানে বাঁক নিলে সামনে পড়বে মাঝের কূপ। আপনি বা আপনার কেউ শাফট দেখে থাকলে, আমাদের জানান ওখানে কী ঘটছে।

সবার হেলমেট ইন্টারকমে ভেসে এল রানার কণ্ঠ: রানা বলছি। মাঝের শাফট দেখছি। ক্যাটওয়াকে কেউ নেই। আপনার লেভেলে রয়েছে পাঁচজন শত্রু। সবাই এখন টানেলের ভিতর।

এ-ডেকে আরও পাঁচজন শক্র। তাদের অন্তত একজনের কাছে ৪০এমএম গ্রেনেড লঞ্চার। আপনারা যদি ক্যাটওয়াকে বেরিয়ে আসেন, নীচ থেকে আমরা কাভার দিতে পারব। …সার্জেন্ট জনি ওয়াকার, লেফটেন্যান্ট গোলাম মোরশেদ? আপনারা কোথায়?

আমরা এখনও এখানে, জবাব দিল জনি ওয়াকার।

এ-ডেকে?

জী, এবার বলল গোলাম মোরশেদ।

এখনও আটকে রেখেছে?

সরে আসবার চেষ্টা করছি, মাসুদ ভাই।

আপাতত সে-চেষ্টা বাদ থাকুক, কাজে মন দাও, তোমাদের দিকে যেন বেশি মনোযোগ দেয়। দশ সেকেণ্ড পর বি-ডেকে খোলা জায়গায় বেরিয়ে আসবে আমাদের তিনজন।

ঠিক আছে, মাসুদ ভাই।

নিশাত বলল, আমরা এখন পশ্চিম টানেল ধরে আসছি, স্যর। যে-কোনও সময়ে পৌঁছে যাব সেন্ট্রাল শাফটে।

এদিকে সি-ডেকের অ্যালকোভে হেলমেট মাইকে আবারও বলল রানা, সার্জেন্ট আরাফাত দবির! সাড়া দিন!

ওপাশ থেকে কোনও জবাব নেই।

সার্জেন্ট দবির, আপনি কোথায়?

.

বি-ডেকে মেয়েদের শাওয়ার রুমে চমকে গেছে নিনা ভিসার। এইমাত্র লাথি মেরে দড়াম করে দরজা খোলা হয়েছে। এক পলকের জন্য ভীষণ ভয় পেল সে। মেয়েদের শাওয়ার রুমে ঢুকেছে ফ্রেঞ্চ সৈনিকরা? না বোধহয়। তা হলে পাশের রুমে কে? ওটা পুরুষদের শাওয়ার রুম।

ধড়াস্ ধড়াস্ করছে নিনার হৃৎপিণ্ড। মহিলা শাওয়ার ব্লকের ভিতর আছে সে, তার মেয়ে মেরি, রাফায়লা ম্যাকানটায়ার ও জিয়োলজিস্ট ম্যাক্স জে. রলিন্স। সার্জেন্ট দবির সবাইকে ঘরে ফিরতে বললে এখানে এসে ঢুকেছে মেয়েরা। এর এক সেকেণ্ড পর দরজা খুলে মেঝের উপর ঝাপিয়ে পড়েছে রলিন্স লোকটা। এরপর দরজা বন্ধ হতে না হতেই বাইরের টানেলে ফাটল ফ্র্যাগমেন্টেশন গ্রেনেড।

সেন্ট্রাল শাফট ও বাইরের টানেলের মাঝে মেয়েদের শাওয়ার ব্লক। জায়গাটা বি-ডেকের উত্তর-পুর্ব কোণে। এখান থেকে বেরুতে হলে তিনটে দরজা: একটা গেছে উত্তর টানেলে, একটা বাইরের টানেলে, এবং অন্যটা সোজা গেছে পুরুষদের শাওয়ার রুমের পাশে।

এখন পুরুষদের শাওয়ার রুমে ধুপধাপ আওয়াজ হচ্ছে।

কিউবিকল দরজাগুলো লাথি মেরে খুলছে। তার মানেই ফ্রেঞ্চ কমাণ্ডোরা!

কেউ লুকিয়ে থাকলে মরবে।

মেরিকে দরজার দিকে ঠেলে নিয়ে গেল নিনা, ওদিক দিয়ে বেরুনো যায় উত্তর টানেলে। চলো, মেরি, এখান থেকে বেরুতে হবে।

একবার কাঁধের উপর দিয়ে পিছনে চাইল নিনা ভিসার।

ছয়টা শাওয়ারের ওপাশে পুরুষ শাওয়ার রুমের দরজা।

ওটা এখনও বন্ধ।

কিন্তু যে-কোনও সময়ে দরজা খুলবে কমাণ্ডোরা।

উত্তর টানেলের দরজার সামনে পৌঁছল নিনা, শক্ত করে ধরল হ্যালে। দ্বিধা করছে। জানার উপায় নেই ওদিকে কী অপেক্ষা করছে।

নিনা! কী করছ! চলে এসো! সাপের মত ফোঁস করে উঠল ম্যাক্স জে. রলিন্স। লম্বা ও চিকন লোক সে, কোনও কারণ ছাড়াই সারাক্ষণ ভীষণ নার্ভাস থাকে। এখন খুবই আতঙ্কিত।

ঠিক আছে, ভয় পাবেন না, বলল নিনা। হ্যাণ্ডেল মুচড়ে দরজা খুলতে শুরু করেছে।

হঠাৎ পুরুষদের শাওয়ার রুমের দরজায় ধুম করে কী যেন লাগল। পরক্ষণে সবার পিছনে খুলে গেল ওই দরজা।

পালাও! চিকন স্বরে চেঁচিয়ে উঠল রলিন্স।

ঝট করে দরজা খুলল নিনা, মেরিকে নিয়ে বেরিয়ে এল উত্তর টানেলে।

কিন্তু তিন পা যেতে না যেতেই থামতে হলো। হাঁ হয়ে গেল ওর মুখ। সামনে ভয়ঙ্কর চেহারার এক লোক, ভুরু কুঁচকে ওর মাথার উপর তাক করেছে অস্ত্র!

তারপর মাথা নাড়ল লোকটা, অস্ত্র নামিয়ে বলল, দুঃখিত।.

নিনা ও মেরির সামনে এসে দাঁড়াল সার্জেন্ট দবির। আমি নিজেই ঘাবড়ে গেছি। ভয় পাবেন না।

টানেলে বেরিয়ে এসেছে রাফায়লা ও রলিন্স, পিছনে দড়াম করে বন্ধ করে দিল দরজা। পাঠাগার ডট নেটের সৌজন্যে প্রাপ্ত।

মেয়েদের শাওয়ার রুমের দিকে ইঙ্গিত করল দবির, ওরা ওখানে?

হ্যাঁ, বলল নিনা।

অন্যরা ঠিক আছে? বোকার মত জানতে চাইল রলিন্স।

এখন আর চট করে ঘর থেকে বেরুবে না, পিছনের টানেল দেখে নিল দবির। বাইরের টানেল থেকে গুলির আওয়াজ আসছে। ওর ডান কান বেয়ে রক্ত পড়ছে, খেয়াল করেছে নিনা। বেশ বড় জখম। মনে হলো না লোকটা কিছু টের পেয়েছে। তার ইয়ারপিসে রুপালি ধাতুর টুকরো গেঁথে আছে।

আমরা সমস্যার ভিতর পড়ে গেলাম, চারপাশের টানেল। দেখছে দবির। সবার সঙ্গে কন্ট্যাক্ট হারিয়ে গেছে। এ্যাপনেলের টুকরো লেগে বিকল হয়েছে রেডিয়ো। চাইলেও যোগাযোগ করতে পারব না। অন্যদের কথাও শুনছি না।

ঘুরে দাঁড়াল দবির, নিনার উপর দিয়ে টানেলের শেষমাথা দেখল। ওদিকে গেলে স্টেশনের বিশাল শাফট ও ক্যাটওয়াক।

আমার সঙ্গে আসুন, নিনার পাশ ঘেঁষে রওনা হয়ে গেল দবির, চলেছে উইলকক্স আইস স্টেশনের মাঝের কূপ লক্ষ্য করে।

১২.

সার্জেন্ট দবির! হেলমেট মাইকে নিচু স্বরে বলল রানা। ওর চোখ বি-ডেকের পশ্চিম টানেলের উপর। দবির! আপনি কোথায়, সাড়া দিন!

সার্জেন্ট নেই? জানতে চাইল তিশা।

যোগাযোগ বন্ধ, বলল রানা।

ওরা স্টেশনের পুবে, সি-ডেকে অ্যালকোভের ভিতর, অপেক্ষা করছে নিশাত, কর্পোরাল নাজুমল ও হলিডের জন্য, যে-কোনও সময়ে বি-ডেকের পশ্চিম টানেল থেকে বেরিয়ে আসবে ওরা।

প্রথমে বেরুল নিশাত সুলতানা। দ্রুত পিছনে হাঁটছে, হাতে উদ্যত অস্ত্র। এক শ আশি ডিগ্রি ঘুরছে ওটা। শত্রু দেখলেই গুলি করবে।

নিশাতকে দেখেই এ-ডেকের দিকে গুলি পাঠাতে শুরু করেছে রানা। কেউ ওখানে কাভার নিলে তাকে পিছাতে হবে। পাঁচ সেকেণ্ড পর গুলি শুরু করল তিশা, একই দিকে ওর চোখ।

অ্যালকোভের পিছন-দেয়ালের পাশে সরে এল রানা, অস্ত্র রিলোড করতে লাগল। তিন রাউণ্ড করে গুলি ছুঁড়ছে তিশা।

হঠাৎ খুব অস্বাভাবিক একটা ঘটনা দেখল রানা।

তিশার অস্ত্রের মাযল থেকে ছিটকে বেরুচ্ছে ছয় ফুটি হলুদ আগুন। মাত্র এক সেকেণ্ড পর আর শিখা দেখা গেল না। কিন্তু ওই আগুন থাকবার কথা নয়। রানার এক পলকের জন্য মনে হয়েছে তিশার এমপি-৫ মেশিন পিস্তল যেন ফ্লেম-থ্রোয়ার!

আসলে কী ঘটছে? পরক্ষণে বুঝে গেল রানা। ঝট করে ঘুরে চাইল এয়ার-কণ্ডিশনিং রুমের দিকে।

হঠাৎ করেই বলল তিশা, আমার গুলি শেষ!

ঘুরেই এ-ডেকে গুলি পাঠাল রানা। এই সুযোগে রিলোড করতে পারবে তিশা।

এ-ডেকের ক্যাটওয়াকের উপর দিয়ে ছুটছে রানার গুলি। এদিকে বি-ডেকে নিশাতের পিছু নিয়ে ক্যাটওয়াকে বেরিয়ে এসেছে নাজমুল ও হলিডে। দ্রুত পিছু হটছে ওরা। যে টানেল থেকে বেরিয়েছে, সেদিকে গুলি পাঠাচ্ছে।

হলিডের অস্ত্রের গুলি শেষ। রানা দেখল, চট করে ম্যাগাযিন খুলেছে সে, ওটা ফেলে দিল ক্যাটওয়াকের উপর। নতুন ম্যাগাযিন রিলোড করে নিল অস্ত্রের রিসিভারে। আর ঠিক তখনই পশ্চিম টানেল থেকে এল গুলি, গলার চামড়া ও সামান্য মাংস চেঁছে নিয়ে বেরিয়ে গেল ওটা।

ছিটকে পিছিয়ে গেছে হলিডে, ভারসাম্য হারিয়েছে পুরোপুরি। কয়েক মুহূর্ত পর অস্ত্র ঘুরিয়ে নিতে পারল, অজানা শত্রু লক্ষ্য করে খালি করল ম্যাগাযিন। ওই আওয়াজে মৃত লোকও জেগে উঠবে। দুই দশমিক দুই সেকেণ্ডে বেরিয়েছে তিরিশটা গুলি। আবারও খালি হয়ে গেছে ম্যাগাযিন। খপ করে হলিডের হাত ধরল নিশাত, টানেলের দিক থেকে ঘুরিয়ে নিয়ে তাড়া দিল, ক্যাটওয়াক ধরে ছুটতে শুরু করুন!

নতুন ম্যাগাযিন হাতড়াতে গিয়ে দেরি করছে আহত হলিডে, গলা বেয়ে দরদর করে পড়ছে রক্ত। ম্যাগাযিন সে পেল, কিন্তু রক্তে ভেজা হাত থেকে পড়ে গেল ওটা। রেলিঙের পাশ দিয়ে পঞ্চাশ ফুট নীচের পুলে নামল। ছলাৎ আওয়াজ তুলে হারিয়ে গেল পানির ভিতর। হলিডের কাছে বাড়তি ম্যাগাযিন নেই। হাত থেকে এমপি-৫ ছেড়ে দিল সে, হোলস্টার থেকে বের করে নিল কোল্ট .৪৫ সিঙ্গল শট রিভলভার।

থেমে থেমে এ-ডেকের উপর গুলি পাঠাচ্ছে তিশা ও রানা। হলিডের ম্যাগাযিন পুলের ভিতর পড়তে দেখেছে তিশা। ওখানে উঠে এসেছিল কিলার ওয়েইলের পালের একটা, জিনিসটা খাবার কিছু নয় দেখে আবারও ডুব দিয়েছে।

নিশাত সুলতানার অস্ত্রের গুলি শেষ। খালি ম্যাগাযিন ফেলে দ্রুত হাতে ভরে নিল নতুন ক্লিপ।

দুশ্চিন্তা নিয়ে তাদের দিকে চেয়ে রইল রানা। বি-ডেকে আপা, নাজমুল ও হলিডে ক্যাটওয়াক ধরে পশ্চিম থেকে উত্তর সুড়ঙ্গের দিকে ছুটছে।

ওরা প্রায় পৌঁছে গেছে, এমন সময় উত্তর সুড়ঙ্গ থেকে ছিটকে বেরুল সার্জেন্ট দবির, পিছনে কয়েকজন সিভিলিয়ান।

মুখোমুখি দাঁড়িয়ে পড়েছে নিশাত-নাজমুল-হলিডে ও দবির।

দৃশ্যটা দেখে শ্বাস আটকে ফেলল রানা।

খোলা জায়গায় মস্ত বিপদে পড়েছে ওরা চার যোদ্ধা। সঙ্গে চার সিভিলিয়ান! যে-কোনও সময়ে হাজির হবে ফ্রেঞ্চ কমাণ্ডো দল, ঝাঁঝরা করে দেবে ওদেরকে।

সার্জেন্ট দবির! হেলমেট মাইকে চেঁচাল রানা। ওখান থেকে সরে যান! ক্যাটওয়াক থেকে…

চোখের সামনে প্রলয় দেখতে শুরু করেছে রানা।

একইসঙ্গে বি-ডেকের ক্যাটওয়াকে ছিটকে বেরিয়েছে পাঁচজন ফ্রেঞ্চ কমাণ্ডো!

পশ্চিম টানেল থেকে এসেছে তিনজন। দুজন পুব টানেল থেকে। বিন্দুমাত্র দ্বিধা করল না তারা, গুলি শুরু করেছে।

এবার যা ঘটল, তাড়াহুড়ার ভিতর ঠিক বুঝল না রানা।

বি-ডেকে পিনসার ম্যানুভার করেছে পাঁচ কমাণ্ডা, নিশাতনাজমুল ও হলিডেকে ক্যাটওয়াকে তাড়িয়ে এনেছে এবার দু পাশ থেকে গুলি করে ঝাঁঝরা করবে।

সার্জেন্ট দবির ও চার সিভিলিয়ান বাড়তি বোনাস। এদেরকে আশা করেনি ফ্রেঞ্চরা। সবাই ক্যাটওয়াকে উঠতেই ওদের উপর অস্ত্র তাক করেছে।

কিন্তু দ্বিতীয় দফা গুলি করবার কোনও সুযোগ পেল না তারা।

পশ্চিম টানেল থেকে যে তিন ফ্রেঞ্চ এসেছে, তারাই আগে গুলি করেছে। তাদের অস্ত্রের মাযল থেকে ছিটকে বেরুল অতি উত্তপ্ত সাদা আগুন।

পয়েন্ট-ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জে গুলি খেল নিশাত, নাজমুল ও হলিডে। নিশাত পায়ে, নাজমুল কাঁধে, দুর্ভাগ্য যে পরপর দুটো গুলি খেল হলিডে মাথায়, চারটে বুকে বুক-মাথা থেকে ফোয়ারার মত ছিটকে বেরুল রক্ত। মেঝের উপর পড়ার আগেই মারা গেছে সে।

আর বিশেষ কিছু বুঝবার সুযোগ পেল না বিস্মিত রানা।

কারণ ঠিক তখনই ব্যাপারটা ঘটল।

হতবাক হয়ে রানা দেখল, স্টেশনের পশ্চিমে ফ্রেঞ্চদের রাইফেলের মাযল ও বাঁটের পিছন থেকে বেরিয়েছে দ্বি-মুখী বিশাল দুই আগুনের চাবুক। যেন ভয়ঙ্কর দুই উল্কা, সাত ফুট উঁচু আগুনের গোলকের ভিতর আটকা পড়ল তিন ফ্রেঞ্চ ক্যাটওয়াক ধরে নানা দিকে নাচতে নাচতে চলেছে সাদা আগুনের গোলক, সামনে-পিছনে যা পড়ছে হজম করে ফেলছে।

বি-ডেকের ক্যাটওয়াক অদৃশ্য হলো আগুনের ভিতর, চার পাশে শুধু সাদা শিখা। কাউকে আর দেখা গেল না।

পুরো পাঁচ সেকেণ্ড চেয়ে রইল রানা, জানে না কী করবে। সব এত দ্রুত ঘটছে, যেন বি-ডেকের ক্যাটওয়াকে প্রচুর গ্যাসোলিন ঢেলে ম্যাচ দিয়ে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে কেউ।

দ্বিতীয়বার ওদিকে না চেয়ে চরকির মত ঘুরল রানা। ওই এয়ার-কণ্ডিশনিং রুম…বুঝতে দেরি হয়নি ওর।

রকেট-গ্রেনেড ক্ষতিগ্রস্ত করেছে এয়ার-কণ্ডিশনিং সিলিণ্ডারকে, ওই দুটো ফুটো হওয়ায় বেরুচ্ছে হাইলি ফ্ল্যামেবল ক্লোরোফ্রিউরোকার্বন!

এই কারণেই তখন তিশার অস্ত্রের নল থেকে বেরিয়েছে ছয় ফুটি আগুন। ওটা মস্ত সতর্কবাণী, অনেক আগেই খেয়াল দেয়া উচিত ছিল। অবশ্য তখনও স্টেশনে ছড়িয়ে পড়েনি সিএফসি।

কিন্তু এখন… বদ্ধ স্টেশনে ছড়িয়ে পড়ছে গ্যাস। ফ্রেঞ্চরা গুলি করতেই সাদা আগুন গিলে ফেলেছে বি-ডেক।

আস্তে করে শ্বাস ফেলল রানা।

এয়ার-কণ্ডিশনিং সিলিণ্ডার থেকে এখনও সিএফসি বেরুচ্ছে। ছড়িয়ে পড়বে গোটা স্টেশনে। সামান্য আগুন পেলেই…

গ্যাসের আভেন হয়ে উঠছে উইলকক্স আইস স্টেশন!

এখন শুধু সামান্য ফুলকি… বা একটা গুলি পরক্ষণে বিশাল বোমার মত ফাটবে গোটা স্টেশন!

বি-ডেকের সকেট থেকে ফট-ফটাস্ আওয়াজ তুলে খুলছে . রিভেট ক্যাটওয়াকের উপর এখানে-ওখানে আগুন। ফোস্কা পড়া মানুষগুলো প্রাণপণে চেঁচিয়ে চলেছে। যোদ্ধা হোক বা সিভিলিয়ান, ক্যাটওয়াকে পড়ে ছটফট করছে সবাই। পোশাকে আগুন, পুড়তে শুরু করেছে চামড়া, মাংস।

যেন নরকের দৃশ্য!

স্টেশনের পশ্চিমের ফ্রেঞ্চ কমাণ্ডারা গুলি চালিয়েছে নিশাতনাজমুল-হলিডের উপর, তাদের অস্ত্রের মাযলের ফুলকি থেকেই ধরেছে গ্যাসের নারকীয় সাদা আগুন, এখন তাদেরকেই আগে পোড়াতে শুরু করেছে।

প্রতিটি মাযল তৈরি করেছে দুটো করে আগুনের গোলক। একটা গেছে সামনে, অন্যটা পিছনে। অস্ত্রের মালিকের মুখ পুড়িয়ে দিতে চেয়েছে।

এখন ডেকের উপর পড়ে আছে দুই ফ্রেঞ্চ কমাণ্ডো, ছাড়ছে বিকট চিৎকার। তৃতীয়জন বারবার আছড়ে পড়ছে বরফের মেঝের উপর, নেভাতে চাইছে ফেটিগের আগুন।

ক্যাপ্টেন নিশাত ও কর্পোরাল নাজমুলের পোশাক পুড়ছে। ওদের পাশে লাশ হয়ে পড়ে আছে হলিডে। ক্যাটওয়াকের উপর চড়-চড়াৎ আওয়াজ তুলে নিথর শরীরটাকে ঝলসাচ্ছে হলুদ আগুন।

উত্তর টানেলের কাছে রাফায়লা ম্যাকানটায়ারের প্যান্ট থেকে কমলা শিখা চাপড়ে নেভাতে চাইছে দবির, ধাতুর ক্যাটওয়াকের উপর দাপাদাপি করছে মেয়েটি। দবিরের পাশে একই কাজ করছে নিনা ভিসার, পিচ্চি মেরির পারকা থেকে নেভাতে চাইছে আগুন। চিকন স্বরে চেঁচিয়ে চলেছে রলিন্স, ফসফস্ করে পুড়ছে তার মাথার সব চুল।

তারপর অসুস্থকর মড়মড় আওয়াজ শুরু হলো। মুচড়ে যেতে শুরু করেছে ইস্পাত।

মেয়েটার পোশাকের আগুন নেভানো বাদ দিয়ে মুখ তুলে চাইল দবির। বিড়বিড় করে বলল, হায় আল্লা!

অস্বস্তিকর আওয়াজটা চমকে দিয়েছে রানাকে।

কয়েক সেকেণ্ড পর বুঝল কী ঘটছে। ক্যাটওয়াকের স্টিলের ক্রিকোণ সাপোর্ট গেছে সরাসরি বরফের দেয়ালের ভিতর। এখন দেয়াল থেকে পিছলে বেরিয়ে আসছে সব। ..

বি-ডেকের আগুন উত্তপ্ত করে তুলেছে সব রিভেট, ফলে গরম হয়ে উঠছে সাপোর্ট। গলিয়ে দিচ্ছে চারপাশের বরফ। বরফের দেয়াল থেকে খুলে আসছে বি-ডেকের গোটা কাঠামো!

ঠক-ঠক-ঠকাস্ আওয়াজ তুলে খুলছে একের পর এক রিভেট। বরফ-দেয়ালে বড় গর্ত তৈরি করে বেরুচ্ছে ইস্পাতের আড়া, ধাতব ঠং আওয়াজ তুলে সি-ডেকের ক্যাটওয়াকে পড়ল একটা রিভেট।

কয়েক সেকেণ্ড পর পড়ল দ্বিতীয় রিভেট।

নামল তৃতীয়টা।

এরপর প্রায় একই সঙ্গে পনেরোটা রিভেট খসল।

সি-ডেকের ক্যাটওয়াকে শুরু হয়েছে ধাতব বৃষ্টি। কয়েক মুহূর্ত পর হঠাৎ করেই আবারও শুরু হলো উইলকক্স আইস, স্টেশনে গা শিউরানো আওয়াজ।

ভেঙেচুরে পড়ছে স্টিলের পাত।

বি-ডেক পড়বে, বিড়বিড় করে বলল রানা।

পর মুহূর্তে হঠাৎ করেই নামতে শুরু করল সব।

গোটা ক্যাটওয়াক, গোলাকার জ্বলন্ত ফ্লোর… সবই পড়ছে সিডেকের দিকে! চারপাশে শুধু মড়মড় আওয়াজ!

বরফ-দেয়ালে ছিড়ে রইল ক্যাটওয়াকের ইস্পাতের সামান্য। অংশ। অন্য সমস্ত কিছু হঠাৎ করেই আছাড় খেল। সি-ডেকের একটু উপরে স্থির হলো বি-ডেক। আপাতত পতন থেমেছে, কিন্তু পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রি ঢালু হয়ে গেছে মেঝে।

এবার বরফ-দেয়াল থেকে পিছলে বেরুল ওই ফ্লোরের বেশির ভাগ সাপোর্ট, সোজা নেমে গেল স্টেশনের শাফট ধরে।

বি-ডেকে যারা উঠে দাঁড়িয়েছিল, ক্যাটওয়াক নিয়ে নামল সিডেকের দিকে।

তারা এগারোজন!

সাধারণ নাগরিক ও যোদ্ধারা ভাঙা ক্যাটওয়াক নিয়ে সরাসরি পড়ল উইলকক্স আইস স্টেশনের মূল শাফটে।

সোজা পঞ্চাশ ফুট নীচে নীল পানিতে ঝপাস্ করে নামল তারা!

১৩.

পানিতে পড়েই তলিয়ে গেল নিনা ভিসার। মুখের সামনে অজস্র বুদ্বুদ। এক পলকে নীরব হয়েছে চারপাশ। ..

শিউরে উঠল নিনা। উহ্, কী ঠাণ্ডা! থরথর করে কাঁপতে শুরু করেছে সারাশরীর।

তারপর হঠাৎ করেই আওয়াজগুলো শুনল।

ভুতুড়ে পানির ভিতর চাপা ধুপ ধুপ। তারপর থেমেও গেল আওয়াজ। উপর থেকে পড়েছে অন্যরা।

অলস ভঙ্গিতে উপরে উঠছে বুদ্বুদ, সেগুলোর ভিতর দিয়ে দেখল একটু দূরে প্রকাণ্ড আকারের জিনিসটা।

মসৃণ ভঙ্গিতে চলেছে, ওগুলো কী?

বিশাল, কালো রঙের।

বরফ-ঠাণ্ডা পানির ভিতর নিঃশব্দে চলছে, ঠিক ওভাবে ভাসে আকাশের চিল। প্রস্থে গাড়ির চেয়ে চওড়া কালো দেহগুলো। হঠাৎ বড় একটা ঢেউ দুলিয়ে দিল নিনাকে। প্রথমে কিছুই বুঝল না, তারপর হঠাৎ করেই দেখল সামনে হাঁ করা বিশাল এক মুখ। অসংখ্য গিজগিজে দাঁত, সব ক্ষুরের মত ধারালো।

ভীষণ ভাবে চমকে গেল নিনা।

কিলার ওয়েইল!

দ্রুত হাত-পা নাড়তে শুরু করেছে সে, কয়েক সেকেণ্ড পর হঠাৎ করেই উঠে এল পানি-সমতলে, বড় করে দম নিল। এখন আর বরফ-ঠাণ্ডা পানি নিয়ে ভাবছে না। পুলের ভিতর একের পর এক কালো ডরসাল ফিন উঠে আসছে!

পুলের কোথায় আছে বুঝবার আগেই নিনার পাশে ভেসে, উঠল কী যেন! চমকে গিয়ে চরকির মত ঘুরল ও।

না, কোনও খুনি তিমি নয়।

রাফায়লা ম্যাকানটায়ার।

নিনা টের পেল, নতুন করে চালু হয়েছে ওর হৃৎপিণ্ড। এক সেকেণ্ড পর আরেক পাশে ভেসে উঠল জিয়োলজিস্ট ম্যাক্স জে. রলিন্স।

আবার ঘুরে চাইল নিনা। বিধ্বস্ত বি-ডেক থেকে পুলের নানা দিকে পড়েছে পাঁচ ফ্রেঞ্চ কমাণ্ডে। খেয়াল করল, তাদের একজন পানির উপর উপুড় হয়ে ভাসছে।

শাফটের উপর থেকে এল তীক্ষ্ণ চিঙ্কার।

ছোট্ট কোনও মেয়ে চেঁচিয়ে চলেছে।

উপরে চাইল নিনা ভিসার।

ওই যে অনেক উপরে মেরি, বি-ডেকে ক্যাটওয়াকের উল্টে যাওয়া রেলিং থেকে ঝুলছে। যে বাঙালি সার্জেন্ট ওদেরকে এদিকে এনেছে, ভাঙা ক্যাটওয়াকে উপুড় হয়ে সামনে বাড়ছে সে, বোধহয় মেরির হাত ধরতে চায়।

মেরির দিকে চেয়ে আছে নিনা, এক মুহূর্ত পর টের পেল, ওর এবং রলিন্সের মাঝ দিয়ে গেল বিশাল এক কিলার ওয়েইল। ওর পায়ে গা ঘষে গেছে জল্পটা।

এক সেকেণ্ড পর চিৎকার শুনল নিনা।

লোকটা পুলের আরেক দিকে। দ্রুত ঘুরেছে নিনা, দেখল এক ফ্রেঞ্চ কমাণ্ডোকে সাদা আগুনে অসংখ্য ফোস্কা মুখে, পুড়ে গেছে কপাল-গাল–পাগলের মত পুলের কিনারায় পৌঁছুতে চাইছে সে। চোখে বেদম ভয়, ফোপাচ্ছে বাচ্চার মত, ফোঁস-ফোঁস করে শ্বাস ফেলছে।

এ ছাড়া কোথাও কোনও নড়াচড়া নেই।

ভয়ে জমে গেছে সবাই।

মুহূর্ত পর দেখা গেল ব্যস্ত সাঁতারুর পাশে হাজির হয়েছে কালো, বিশাল এক ডরসাল ফিন। হঠাৎ গতি কমাল তিমি, . আক্রমণাত্মক ভঙ্গি নিয়ে লোকটার পিছনে ডুব দিল।

এর ফলে ভয়ঙ্কর পরিণতি হলো লোকটার।

হঠাৎ করেই জোরালো কড়াৎ, আওয়াজ তুলল তার মেরুদণ্ড, পিছনে বেঁকে গেল পিঠ। ধাক্কা খেয়ে ঘুরে গেছে সে, চিৎকার করতে মস্ত হাঁ করেছে, কিন্তু গলা থেকে কোনও শব্দ বেরুল না। বিস্ফারিত হলো, দুই চোখের তারা। সে বোধহয় দেখেছে খুনি তিমি কেটে নিয়েছে, তার কোমর থেকে নীচের অংশ! ওই অংশ এখন তিমির প্রকাণ্ড চোয়ালের ভিতর!

পরের কামড় আরও অনেক ভয়ঙ্কর। প্রচণ্ড হ্যাঁচকা টান খেল কমাণ্ডো, পানির উপর ঠাস্ করে পড়ল মাথা, পরক্ষণে চিরদিনের জন্য হারিয়ে গেল সে।

যিশু! চোয়াল ঝুলে পড়েছে নিনার। হায় যিশু…

.

সার্জেন্ট আরাফাত দবির ক্যাটওয়াকের যে অংশে, সেটা বরফের দেয়ালের ভিতর গেঁথে থাকা। আপাতত পড়বার কথা নয়। বেশ খাড়া ভাবে ঢালু হয়ে নেমেছে ক্যাটওয়াক, নীচে সেন্ট্রাল শাফট বা গভীর কূপ।

দবির তিন বিজ্ঞানীর নাম জানে না, অবশ্য এটা জানে, ওরা ক্যাটওয়াকে অনেক সুথ ছিল। চট করে কিছু ধরতে পারেনি। সবাই পড়ে গেছে কূপের ভিতর।

কিন্তু ওর রিফ্লেক্স ছিল বিদ্যুতের ঝিলিকের মত। নীচ থেকে ক্যাটওয়াক সরতেই ডেকের উপর ঝাপিয়ে পড়েছে, একহাতে খপ করে ধরেছে ক্যাটওয়াকের গ্রিল।

পিচ্চি মেয়েটাও দারুণ চালু।

পায়ের নীচে মেঝে সরে যেতেই ক্যাটওয়াকের উপর আছাড় . খেয়েছে সে, ঢালু মেঝেতে গড়িয়ে চলে গেছে শেষ প্রান্তে। এরপর খাদের ভিতর পা-কোমর-বুক পড়তেই রেলিং পেরুল মাথাটাও। আর ঠিক তখনই শেষ চেষ্টা করেছে ওর কপাল ভাল, একহাতে ধরে ফেলেছে হ্যাণ্ড রেলিং।

গ্যাস বিস্ফোরণে দুর্বল রেলিং এক পলক স্থির থেকেছে, পরক্ষণে লচকে গেছে। এখন ঝুলছে ভাঙা ক্যাটওয়াকের শেষে। উপর অংশ উল্টে নীচে নেমে এসেছে।

ওখানে ঝুলছে ছছাট্ট মেয়েটি। ক্যাটওয়াকের মুচড়ে যাওয়া উল্টো রেলিং মাত্র একহাতে ধরতে পেরেছে। পঞ্চাশ ফুট নীচে পুলের ভিতর অপেক্ষা করছে বুভুক্ষু খুনে তিমির পাল!

ভুলেও নীচে তাকাবে না! গম্ভীর স্বরে বলল, দবির। মেয়েটির হাত ধরবার জন্য উপুড় হয়ে পিছলে সামনে বাড়ছে সে। এরই ভিতর নীল পানির পুলে দেখেছে কিলার ওয়েইল। এ-ও দেখেছে, এক কমাণ্ডোকে নিয়ে গেছে একটা দানব। সে-কারণেই চাইছে না বাচ্চা মেয়েটা ওদিকটা দেখুক।

মেয়েটা অঝোরে কাঁদছে, বারবার ফুঁপিয়ে বলছে, আমাকে পড়ে যেতে দেবেন না, স্যর, প্লিয!

কক্ষনো দেব না, পেটের উপর ভর করে হাত বাড়িয়ে দিল দবির। একবার মেয়েটার কবজি ধরতে পারলেই…

এখনও দবিরের আশপাশে বেশ কিছু ছোট আগুন জ্বলছে ক্যাটওয়াকে। মেয়েটার কবজি থেকে কমপক্ষে একফুট দূরে ওর হাত। দবির দেখল চারপাশ দেখতে শুরু করেছে মেয়েটি।

তোমার নাম কী? হঠাৎ করেই বলল দবির। সরিয়ে নিতে চাইছে মেয়েটার মনোযোগ।

আমার হাত পুড়ে যাচ্ছে, ফুপিয়ে উঠল মেরি।

রেলিঙের ওদিকটা দেখে নিল দবির। বামে পনেরো ফুট দূরে প্ল্যাটফর্মের এক অংশে জ্বলছে খুদে আগুন। রেলিং যেখানে মচকে গেছে, জায়গাটা ওখানে।

হ্যাঁ, সোনা-পাখি, জানি হাতে গরম লাগছে। এই এখনই তোমাকে সরিয়ে নেব। শুধু একটু অপেক্ষা করো। কী যেন বললে তোমার নাম?

মেরি।

বাহ্, খুব সুন্দর নাম। আমার নাম দবির। কিন্তু আমার বন্ধুদের মত তুমিও আমাকে লেখক বলতে পারো।

ওঁরা আপনাকে ওই নামে কেন ডাকেন?

মাথা কাত করে চাইল দবির। ওখানে রেলিং চাটছে আগুন।

অবস্থা ভাল না।

বিস্ফোরণের ফলে তাপ তৈরি হয়েছে, রেলিঙের কালো রং শুকিয়ে চড়চড় করছে, যেন শুকনো কাগজ। এখন যদি ওখানে আগুন লাগে; জ্বলতে শুরু করবে গোটা রেলিং।

পিছলে সামনে বাড়ছে দবির। মেয়েটার হাত ধরতে চাইছে। কিন্তু তা করতে হলে এখনও ছয় ইঞ্চি এগুতে হবে। প্রায় পৌঁছেই গেছে।

তুমি কি সবসময় এত কথা জানতে চাও? প্রাণ খুলে হাসার ভঙ্গি নিতে চাইল দবির, গলা দিয়ে বেরুল দুর্বল হাসি। শরীর টানটান করতে গিয়ে কুঁচকে গেল গাল। আসলে জানো… খুব সাবধানে এক ইঞ্চি এক ইঞ্চি করে নীচে নামছে। বড় করে শ্বাস ফেলল। হয়েছে কী, একবার… শ্বাস নিল। আমার এক বন্ধু একবার ধরে ফেলল একটা বই লিখছি…

বুঝতে পেরেছি… আবারও নীচে চলে গেছে মেরির চোখ।

মেরি, সোনা-পাখি, এবার শোনো। …হ্যাঁ, তুমি শুধু আমার দিকে তাকিয়ে থাকো। ঠিক আমার দিকে। কারও দিকে না।

ঠিক আছে, সায় দিল মেরি। পরক্ষণে নীচে চাইল। মনে হলো এক্ষুনি হাত ছেড়ে দেবে।

শালার কপাল আমার… বিড়বিড় করল দবির।

.

ফ্রেঞ্চ কমাণ্ডোকে যেখান থেকে নিয়ে গেছে, তার মাত্র তিন ফুট দূরে কর্পোরাল নাজমুল। লোকটাকে ওভাবে মরতে দেখে আত্মা খাঁচা ছাড়া হয়ে গেছে ওর।

এখন থমথম করছে গোটা পুল।

কেউ কোনও আওয়াজ করছে না।

প্রায় নাড়াচাড়া না করেই ভেসে থাকতে চাইছে নাজমুল। চারপাশে নজর রেখেছে। নোনা পানি বরফের মত ঠাণ্ডা। ভীষণ জ্বলছে কাঁধের ক্ষতটা। ওটার কথা ভুলে থাকতে চাইছে।

ওর পাশে ভাসছে নিশাত সুলতানা, অপেক্ষা করছে কখন কী ঘটে। পাশে উপুড় হয়ে ভাসছে মৃত হলিডে। মাথা থেকে সরু রেখায় রক্ত বেরুচ্ছে, মিশে যাচ্ছে নীল পানিতে।

পুলের ভিতর স্থির হয়ে আছে অবশিষ্ট চার ফ্রেঞ্চ কমাণ্ডো। নাজমুল বা নিশাতের দিকে ঘুরেও চাইছে না। আপাতত দুই পক্ষ ভুলে গেছে লড়াই।

চোখ সরিয়ে বিজ্ঞানীদেরকে দেখল নাজমুল।

পানিতে পাথরের মূর্তি হয়ে গেছে দুই মহিলা আর ওই ছিচকাদুনে লোকটা।

পুলের ভিতর ওরা দশজন।

বাধ্য না হলে নড়ছে না।

কারও সাহস নেই যে সাঁতার কাটবে।

কয়েক সেকেণ্ড আগে দেখেছে কীভাবে তলিয়ে গেছে ফ্রেঞ্চ কমাণ্ডো।

এ থেকে শিক্ষা নিয়েছে সবাই যদি না নড়ো, তোমাকে না-ও দেখতে পারে।

শ্বাস আটকে ফেলল নাজমুল! নীচে মসৃণ ভাবে সরছে বিশাল, সব আকারের তিমি।

ক্লিক আওয়াজ পেয়ে ঘুরল নাজমুল। পানির উপর এমপি-৫ তুলে ধরেছেন আপা!

উনি খেপা মানুষ, ভাবল নাজমুল। এটা সম্ভব শুধু ওঁর পক্ষেই। পিস্তল দিয়ে লড়বেন খুনে তিমির বিরুদ্ধে!

থমথম করছে চারপাশ।

কেউ নড়লেই…. .

হঠাৎ পানি-সমতলের একটু নীচে নিশাতের ডানে বিকট গর্জন ছাড়ল এক তিমি। পরক্ষণে তুলে ফেলল শরীরের উপর অংশ, বাতাসে ভেসে কাত হয়ে গেল, গুঁতো দিল গিয়ে নিথর হলিডের দেহে। বিশাল চোয়ালে নিল লাশ, ক্ষুরধার দাঁতগুলো গা গুলানো খচখচ আওয়াজ তুলে মাংস কাটছে। মুড়মুড় করে ভাঙছে বেশির ভাগ হাড়। লাশ নিয়ে ডুবে গেল তিমির মাথা, পরক্ষণে তলিয়ে গেল লেজটাও। ওখানে রইল শুধু ঘোলাটে লালচে ফেনা।

হলিডে এক ফোঁটা নড়ছিল না।

পুলের সবাই একইসঙ্গে জ্ঞান অর্জন করল।

ওরা নড়ছে কি নড়ছে না, তা নিয়ে কিলার ওয়েইলের কোনও মাথা-ব্যথা নেই! .

এবার একইসঙ্গে নড়ে উঠল নয়জন। পুলের কিনারায় যেতে পাগল হয়ে উঠেছে সবাই। সবার পিছনে ভেসে উঠেছে. খুনে তিমিগুলো, তারাও ব্যস্ত হয়ে উঠেছে পেট-পূর্তি করতে।

.

বি-ডেকের ভাঙা ক্যাটওয়াকে কাকে যেন অভিশাপ দিচ্ছে সার্জেন্ট হোসেন আরাফাত দবির।

মেরি যখন পুলের দিকে চেয়েছে, ও দেখতে পেয়েছে বিশাল কালো-সাদা কী যেন। নীচে ওসব কী তা বুঝতে পেরেই থিরথির করে কাঁপতে শুরু করেছে ওর নীচের চোয়াল। তারপর যখন দেখেছে পানির নীচ থেকে লাফ দিয়ে উঠেছে একটা, কচমচ করে চিবিয়ে খাচ্ছে হলিডের শরীর, কেঁপে উঠল ওর সারা শরীর।

হায় খোদা, হায় যিশু! ফুঁপিয়ে চলেছে এখন। 

বাধ্য হয়ে তাড়াহুড়া করতে হচ্ছে দবিরকে। ক্যাটওয়াকের শেষপ্রান্তে পৌঁছে বুক পর্যন্ত নামিয়ে দিয়েছে খাতে। কোমর থেকে পা ক্যাটওয়াকের উপরে, মাথা তাক করেছে অনেক নীচের পুলের দিকে। একবার নীচে খসে পড়লে…।

মুক্ত ডানহাত মেরির দিকে বাড়িয়ে দিয়েছে দবির।

দুজনের হাত মাত্র দুই ইঞ্চি দূরে।

বলতে গেলে কবজি প্রায় পেয়েই গেছে দবির।

এমন সময় হঠাৎ করেই বামদিকে নরম একটা ফস্ আওয়াজ শুনল। ঝট করে ঘুরে চাইল। শালার কপাল…।

রেলিঙে ধরেছে ছছাট্ট কমলা আগুন, দ্রুত পোড়াতে শুরু করেছে শুকনো কালো রং। তার ভিতর দিয়ে খুব সরু রেখার একটা শিখা আসছে।

বিস্ফারিত হলো দবিরের দুই চোখ।

রেলিং বেয়ে রকেটের মত আসছে শিখা!

ঠিক মেরির হাতের দিকেই!

এখনও পুলে খুনি তিমির দিকে চেয়ে আছে মেরি। মাথা তুলে দবিরের দিকে চাইল। দুজনের চোখ মিলিত হতেই দবির বুঝল, আতঙ্কে জড়পদার্থ হয়ে গেছে মেয়েটা।

ওর পক্ষে যতটা নামা সম্ভব, নেমে গেছে দবির। টানটান হয়ে উঠেছে সমস্ত পেশি, ক্যাটওয়াক থেকে নীচে ঝুলছে দেহের উপরের অংশ। শেষ চেষ্টা হিসাবে খপ করে মেরির কবজি ধরতে চাইল।

কালো, হ্যাণ্ড রেলিঙের উপর দিয়ে ছুটে আসছে কমলা শিখা, পিছনে লম্বা লেজ।

মেরির কবজি থেকে মাত্র এক ইঞ্চি দূরে দবিরের হাত।

আরও একটু নামতে চাইল সে। ওর আঙুলের ডগা স্পর্শ করল মেয়েটার হাতের উপর অংশ।

আর এক ইঞ্চি। মাত্র এক ইঞ্চি…

ঠিক তখনই উজ্জ্বল কমলা শিখা চোখের কাছে দেখল দবির। প্রচণ্ড হতাশা নিয়ে চেঁচিয়ে উঠল ও: না!

চোখের সামনে দিয়ে তরতর করে চলে গেল শিখা, গিয়ে ঢুকল মেরির হাতের নীচে।

অসহায় আতঙ্ক নিয়ে চেয়ে রইল দবির, তীব্র যন্ত্রণায় চেঁচিয়ে উঠেছে মেরি। শরীরে আগুন লাগলে কারও পক্ষেই নিয়ন্ত্রণ রাখা অসম্ভব।

রেলিং ছেড়ে দিল মেরি।

এমনই হবে, বুঝেছে দবির, আর সেজন্যই ক্যাটওয়াকের উপর অংশ থেকে বামহাত সরিয়ে নিয়েছে হোঁচট খেয়ে নেমে। এসেছে সে মেয়েটির দিকে। সরাসরি তিন ফুট পতন হলো তার। একটা হাত নীচের দিকে, অন্য হাত উপরের দিকে তাক করা।

নীচের হাত খপ করে ধরল মেরির পিঙ্ক পারকার উলের হুড। বাম হাতে ধরে ফেলেছে জ্বলন্ত রেলিং।

জোর ঝাঁকি খেয়ে থামল দুজন। চরকির মত এক শ আশি, ডিগ্রি ঘুরে গেল দবির। আরেকটু হলে সর্কেট থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিল কাঁধের হাড়। এখন ওর মাথা উপরের দিকে, ঝুলছে জ্বলন্ত রেলিং ধরে। ঠিক করেছে, কিছুতেই রেলিং ছাড়রে না।

ওর হাতে পুরু চামড়ার গ্লাভস্, কিন্তু মনে হলো মাথার ভিতর আগুন ধরে গেছে। ব্যথাটা সামলে নিয়ে এক সেকেণ্ড পর মেরির দিকে চেয়ে স্বস্তির হাসি হাসল।

সোনা-পাখি, তোমাকে ধরেছি, বড় করে দম নিল দবির, পাখিটা ঠিকই খপ করে ধরেছি!

নীচে ঝুলছে মেরি, বেকায়দা ভাবে দুদিকে প্রসারিত দুই হাত। দবিরের শক্তিশালী পাঞ্জা ধরে রেখেছে উলের হুড।

ঠিক আছে, খুশি হয়ে বলল দবির। এবার দেখা যাক কীভাবে উঠে যাওয়া…।

হঠাৎ পুট করে একটা আওয়াজ হলো। আর সঙ্গে সঙ্গে একটু নীচে নামল মেরি। দবির প্রথমে বুঝল না কী ঘটেছে। তারপর দেখতে পেল। চোখ পড়েছে মেরির পারকা এবং ওটার উলের হুডের উপর।

চোখ বিস্ফারিত হলো দবিরের।

আসলে পারকার অংশ না ওই হুড!

আজকাল এসব পারকা ও হুড বিক্রি হয়। দরকার হলে একটা থেকে আরেকটাকে খুলে নেয়া যায়। মেরির  পারকার সঙ্গে হুডে রয়েছে সব মিলে ছয়টা বোতাম।

তারই একটা খুলে যাওয়ার আওয়াজ পেয়েছে দবির। অসুস্থ বোধ করল ও। মনে মনে বলল, এটা ঠিক না! আল্লা, এত কষ্ট করার পরে…

পুট! আরেকটা বোতাম খুলেছে। ~

কার উপর যেন ভীষণ অভিমান হলো দবিরের। বুঝতে পারছে না কী করবে। আসলে কিছু করবারও নেই। রেলিঙের সবচেয়ে নীচের অংশে ঝুলছে। নিজেকে আর নামাতে পারবে না। অন্য হাতে ধরেছে মেরির হুড

পুট! পুট! .

খুলে গেল আরও দুটো বোতাম। ভীষণ ভয়ে চেঁচিয়ে উঠল মেরি। ছোট ছোট ঝাঁকি খেয়ে নীচে নামছে। তারপর হঠাৎ করেই আবারও স্থির হচ্ছে।

টানটান হয়ে উঠেছে হুড। পারকার কলারে এখন মাত্র দুটো, বোতাম বাকি!

মেরিকে দুলিয়ে সি-ডেকের ক্যাটওয়াকে ফেলবে, ভাবতে শুরু করেছে দবির। ওটা আছে বারো ফুট দূরে। চিন্তাটা বাতিল করে দিল। উলের হুড ফট করে খুলে যাবে। মাত্র ওই দুটো বোতাম ধরে রেখেছে মেরির ওজন।

দুশশালার কপাল! প্রায় চেঁচিয়ে উঠল দবির। কোনও শালা সাহায্য করবে না!

নিশ্চয়ই করবে, অপেক্ষা করো, কাছ থেকেই বলে উঠল কে যেন। আমি আসছি!

মাথা কাত করে চাইল দবির, মুখ চুন হয়ে গেল। সি-ডেকের ক্যাটওয়াকের কাছে মাসুদ স্যর, বেরিয়ে আসছেন এক অ্যালকোভ থেকে। ওঁর পাশে তিশা করিম। তাকে কী যেন বলছেন স্যর। দেখিয়ে দিলেন কাছের রাং-ল্যাডার। মেয়েটা নামছে পুল ডেকের দিকে। এদিকে সাহায্য করতে আসবেন স্যর।

পুট! .

অবশিষ্ট দুই বোতামের একটা খুলে গেছে। বিকৃত চেহারা করে মেরির দিকে চাইল দবির। ভয়ঙ্কর ভয় পেয়েছে বাচ্চা মেয়েটা, তারচেয়ে দ্বিগুণ ভয় পেয়েছে ও নিজে। কাঁদতে গিয়ে লালচে হয়ে উঠেছে মেয়েটির দুই চোখ। টপটপ করে গাল বেয়ে পড়ছে অশ্রু। দবিরের চোখে চোখ রাখল। ফেঁপাতে শুরু করেছে আবার, বলল, আমি মরতে চাই না! ঈশ্বর, আমি মরতে চাই না!

আর মাত্র একটা বোতাম বাকি।

মেরির ওজন নিতে গিয়ে ভীষণ টানটান হয়ে উঠেছে হুড।

বোতাম টিকবে না।

দবির বুঝে গেছে, কিছুই করতে পারবে না। ফ্যাসফ্যাসে স্বরে বলল ও, পারলাম না, সোনা-পাখি!

এর এক সেকেণ্ড পর পুট আওয়াজ তুলল বোতাম খুলে গেল হুড। অসহায় দবির চেয়ে রইল। ওর মনে হলো খুব ধীরে নীচে রওনা হলো মেরি। বিস্ফারিত দৃষ্টিতে চেয়ে রইল ওর চোখে, মুখে ভীষণ কষ্টের ছাপ। মিষ্টি মেয়েটা নীচে গিয়ে পড়ছে, মুচড়ে উঠল দবিরের বুকের ভিতরটা।

পঞ্চাশ ফুট নীচে বরফ-ঠাণ্ডা পানিতে ঝপাস্ করে পড়ল ছোট্ট মেরি!

১৪.

কসাইখানা হয়ে উঠেছে উইলকক্স আইস স্টেশনের পুল। সিডেকের অ্যালকোভে হতবাক হয়ে গেছে মাসুদ রানা।

বরফ-ঠাণ্ডা পানিতে ধোঁয়া বা মেঘের মত ছড়িয়ে পড়ছে তাজা রক্ত। কোথাও কোথাও অনেক বেশি পরিমাণে, ওদিকটায় কিলার ওয়েইলগুলোকেও স্পষ্ট দেখা গেল না।

পুলের একদিকে ফ্রেঞ্চ কমাণ্ডোরা, বেশির ভাগ হামলা হচ্ছে তাদেরই উপর। এরই ভিতর দুজন লোক হারিয়েছে তারা। পুলের কিনারে ধাতব ডেকে উঠবার জন্যে উন্মাদের মত সাঁতরে, চলেছে নাজমুল, নিশাত ও তিন বিজ্ঞানী।

পুরো পথ তীক্ষ্ণ চিৎকার ছেড়েছে পিঙ্ক পারকা পরা মেরি, ঝপাস্ করে চিত হয়ে নেমেছে পুলে, এবং সঙ্গে সঙ্গেই টুপ করে ডুবে গেছে।

ঝট করে দবিরের দিকে চাইল রানা, বি-ডেকের উল্টো রেলিং থেকে ঝুলছে সার্জেন্ট।..

পলকের জন্য চোখে চোখ পড়ল দুজনের। একদম হেরে যাওয়া চেহারা দবিরের, ভীষণ বিরক্ত ও ক্লান্ত, লালচে দুই চোখ বলে দিল পরাজয় মেনে নিয়েছে। আর কিছুই করবার নেই ওর।

কিন্তু রানার কিছু করবার আছে। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে বসেছে ওর, বর্তমান পরিস্থিতি বুঝে নিয়েছে।

পুলের আরেক দিকে ডাইভিং বেলের ওপাশে পড়েছে মেরি, ওদিকের পানি এখনও ফাঁকা। অন্যরা পৌঁছে গেছে, পুলের কিনারায়, মহাব্যস্ত হয়ে পানি ছেড়ে উঠতে চাইছে। কেউ খেয়াল করেনি ছোট্ট মেয়েটা পুলের ভিতর পড়েছে।

পুলের দিকে চেয়ে আছে রানা, শুনতে পেল সার্জেন্ট জনি ওয়াকারের কণ্ঠ। সার্জেন্ট ভাইপার ওরফে পল সিংগার ও বাংলাদেশ আর্মির লেফটেন্যান্ট গোলাম মোরশেদের সঙ্গে দ্রুত কথা বলছে সে। ফ্রেঞ্চ কমাণ্ডোদের বিরুদ্ধে এ-ডেকে তুমুল গোলাগুলি চলছে ওয়াকার ও মোরশেদের।

… ওদের নিয়ে যাও দক্ষিণে….

ওরাও অস্ত্র ব্যবহার করতে পারবে না…

ঘুরে দাঁড়াল রানা, কাজে লাগবে এমন জরুরি কিছু খুঁজছে দুই চোখ।

একটু দূরে নির্জন অ্যালকোভ। কয়েক মুহূর্ত হলো তিশাকে পুল ডেকে পাঠিয়েছে। ভেবেছিল নিজে দবিরকে সাহায্য করতে যাবে। কিন্তু তার আগেই পড়ে গেল মেয়েটা। বেচারি আছে এখন পুলের ভিতর কিলার ওয়েইলদের সঙ্গে।

পিছনে কন্সেলের বোতামগুলো দেখল রানা, ওখানে একটা লিভারের নীচে লেখা: ডাইভিং বেল উইঞ্চ।

ওটা দিয়ে কিছু হবে না।

ওর চোখ আটকে গেল বড় চৌকো এক বোতামের উপর। তার নীচে লেখা: ব্রিজ।

নীচের পুলের দিকে আবারও চাইল রানা, ওর মনে পড়েছে নিনা ভিসারের কথা: এখান থেকেই স্টেশনের মাঝে বাড়িয়ে দেয়া যায় রিট্রাক্টেবল ব্রিজ।

এক লাফে অ্যালকোভে পৌঁছে গেল রানা, বড় চৌকো বোতামটা টিপে দিল, সঙ্গে সঙ্গে শুনল পায়ের নীচে জোরালো গুঞ্জন।

কী যেন পাশের দেয়ালের ওদিক থেকে গুনগুন করছে। মেঝের তলা থেকে বেরিয়ে পুলের উপর যাচ্ছে সরু এক প্ল্যাটফর্ম। ওদিক থেকেও একটা আসছে। দুটো মিলিত হবে ক্যাটওয়াকের নীচে।

এবার আর এক সেকেণ্ডও নষ্ট করল না রানা, ব্রিজের উপর দিয়ে দৌড়াতে শুরু করল। ওর চেয়ে অনেক দ্রুত সামনে বাড়ছে সেতু। ওটা বেশি চওড়া নয়, বড়জোর দুই ফুট, দুদিকে কোনও রেলিংও নেই। ওদিক থেকে আসছে অন্য অংশ, মাঝে মিলিত হবে; বড় করে শ্বাস নিল রানা, দৌড়ের গতি আরও বাড়িয়েছে, হঠাৎ করেই কোনাকুণি ভাবে লাফ দিল সেতুর উপর থেকে।

ওদিকে অবাক হয়ে চেয়ে আছে সার্জেন্ট হোসেন আরাফাত দবির। বিশাল কূপের মাঝে তীরের মত ছুটছে মাসুদ স্যর, ডাইভিং বেলের উপর দিয়ে পেরিয়ে গেল, তারপর পড়তে লাগল বরফ-ঠাণ্ডা পুলের ভিতর।

ভারী ইটের মত পড়ছে রানা, তবে অদ্ভুত একটা কাজ করল। ঝট করে ডানহাত উপরে তুলল, কী যেন নিল কাঁধের পিছন থেকে।

যতটা পারে ছড়িয়ে দিয়েছে দুই পা, এখন আর পানির গভীরে তলিয়ে যাবে না। দুই হাতে শক্ত করে ধরেছে কাঁধের পিছন থেকে নেয়া জিনিসটা।

.

ভয় পেয়ে পুলের ভিতর ঘুরে দাঁড়িয়েছে মেরি ভিসার। ওর পাশে বিস্ফোরিত হয়েছে পানি।

মেরি ভেবেছিল ওটা কোনও কিলার ওয়েইল, কূপের অনেক গভীর থেকে উঠে এসেছে। কিন্তু মাথা ও মুখে লেগেছে কয়েক বালতি পানি। চোখ পরিষ্কার হতেই আবারও দেখল, ওর পাশেই পানির ভিতর নেমেছে এক লোক।

যোদ্ধাদেরই কেউ। এক মুহূর্ত পর টের পেল, এই লোককে আগেও দেখেছে, কথাও বলেছে। এই লোকটা বেশ ভাল। নামটা মনে করবার চেষ্টা করল মেরি। মাশুক, ভাবল। বা মাটুশ। ওই রকমই নাম।

ঠিক আছ তো, মেরি? জানতে চাইল লোকটা।

বোকা-বোকা চেহারায় উপর-নীচ মাথা দোলাল মেরি।

উপর থেকে পানিতে পড়েছে লোকটা, কান থেকে খুলে গেছে ইয়ারপিস। ওটা ঠিক করে নিল সে। লোকটার দুই চোখের মণি–কুচকুচে কালো। অন্য কারণে হঠাৎ করেই চমকে গেল মেরি, কী যেন হুশ করে পাশ কাটিয়ে গেছে। পরক্ষণে বুঝল ওটা একটা কিলার ওয়েইল।

দুজনের মুখের পাশ দিয়ে চলে গেল ওটার কালো, উঁচু ডরসাল ফিন। তারপর খুব ধীরে তলিয়ে গেল।

তীব্র আতঙ্কে হাঁপাতে শুরু করেছে মেরি।

ওর পাশে পানির গভীরে চোখ রেখেছে লোকটা। ওরা পুলের যেখানে আছে, সেখানে রক্ত ছড়িয়ে পড়েনি। নীচে শুধু স্ফটিকের মত স্বচ্ছ নীল পানি।

লোকটার চোখ লক্ষ্য করে পানির নীচে চাইল মেরি। এক সেকেণ্ড পর ভীষণ চমকে উঠল। মস্ত হাঁ করে ওর পায়ের দিকে ছুটে আসছে এক কিলার ওয়েইল!

টানা চিৎকার শুরু করেছে মেরি, কিন্তু ওর পাশের লোকটা চুপ করে আছে। ভঙ্গি দেখে মনে হলো ভয়ডর বলে কিছু নেই, সম্পূর্ণ নির্বিকার। এক সেকেণ্ড পর পানির দিকে দুই হাতে তাক করল সাবমেশিন-গানের মত জিনিসটা। পেরিয়ে গেল একটা সেকেণ্ড, তারপর খুনি তিমির দিকে চেয়ে টিপে দিল ট্রিগার।

কিন্তু গুলির আওয়াজ হলো না।

জোরালো ঘটাং আওয়াজ করে কী যেন বের হয়েছে।

রানার লঞ্চারের মাযল থেকে ছিটকে বেরিয়েছে গেল, ম্যাগনেটিক এ্যাপলিং হুক। পানির ভিতর সোজা গিয়ে গেঁথেছে তিমির নাকে। প্রচণ্ড ব্যথা পেয়ে চমকে উঠেছে তিমি, থমকে গেছে স্থানুর মত।

মেরিনদের এই লঞ্চার প্রতি বর্গ ইঞ্চিতে চার হাজার পাউণ্ড ধাক্কা তৈরি করে, গন্তব্যে পৌঁছে দেয়, এ্যাপলিং হুককে। রানা নিশ্চিত ছিল না এই জিনিস থামাবে সাত টনি কিলার ওয়েইলকে। জল্পটাও চমকে গেছে তার সঙ্গে কেউ লড়তে এসেছে দেখে।

পর পর দুবার লঞ্চারের ট্রিগারে চাপ দিল রানা, সঙ্গে সঙ্গে ফিরতে লাগল গ্র্যাপলিং হুক।

পুরো আস্ত আছ তো? মেরির দিকে চাইল রানা, হাত পায়ের সব আঙুল আছে?

হাসি-হাসি দুই চোখের দিকে চাইল মেরি, বোকার মত মাথা দোলাল।

তা হলে চলো লেজ তুলে পালাই, মেরির হাত ধরে সঁতরাতে শুরু করল রানা।

.

পুলের ধারে পৌঁছেছে নিনা ভিসার, হাঁকুপাঁকু করে উঠে গেল ইস্পাতের ডেকে, ঘুরে চাইল। একটু দূরে প্রাণপণে সাঁতরাচ্ছে রলিন্স ও রাফায়লা।

তাড়াতাড়ি! চেঁচিয়ে উঠল নিনা। তাড়াতাড়ি!

আগে পৌঁছুল রাফায়লা, দুই হাতে তার হাত ধরল নিনা, টান দিয়ে তুলে নিল, ডেকে।

হাঁপাতে হাঁপাতে আসছে রলিন্স, এখনও দুই গজ দূরে।

আরও জলদি, রলিন্স!

আর মাত্র এক গজ পেরুতে পারলেই…

রলিন্স ক্লান্ত ও হতাশ চোখে চাইল, ডেকের কিনারে হাঁটু গেড়ে অপেক্ষা করছে নিনা ভিসার।

তারপর পৌঁছে গেল রলিন্স, অলিম্পিকের চ্যাম্পিয়ন সাঁতারুর মত বুক দিয়ে ধপ করে বাড়ি দিল ডেকের পাশে। বিজয়ীর মত হাত বাড়িয়ে দিয়েছে, সামনে ঝুঁকে খপ করে তার হাত ধরল নিনা। ডেকের উপর টেনে তুলছে, এমন সময় লোকটার পিছনের পানি চিরে দেখা দিল খুনি তিমি। মস্ত হাঁ করেছে ওটা, মুহূর্তে রলিন্সের পা থেকে শুরু করে বুক পর্যন্ত চোয়ালের ভিতর পুরে নিল।

ক্ষুরের মত দাঁতগুলো পাজরে বসতেই জিওলজিস্টের দুই চোখ বিস্ফারিত হলো। এখনও তার দুই হাত ধরে প্রাণপণে টানছে নিনা। কিন্তু ওদিক থেকে এল অনেক বেশি জোরালো টান। এক সেকেণ্ড পর পানির নীচে নামল কিলার ওয়েইলের বিশাল মাথা, সরিয়ে নিতে শুরু করেছে শিকারকে। নিনা টের পেল, আতঙ্কিত বিজ্ঞানীর দুই হাতের নখ চিরে দিচ্ছে ওর হাতের চামড়া, বেরিয়ে আসছে রক্ত। এক মুহূর্ত পর ওর হাত থেকে ছুটে গেল লোকটা। ডেকের উপর ধপ করে পড়ে গেল ও। ভীত দৃষ্টিতে দেখল, মুহূর্তে তলিয়ে গেল রলিন্স।

.

এখনও ডেকের কয়েক গজ দূরে নিশাত ও নাজমুল। গায়ের সমস্ত শক্তি ব্যবহার করে আসছে ওরা। কোনওদিকে চাওয়ার সময় নেই নাজমুলের, কিন্তু এমপি-৫-র নল পানির নীচে ডুবিয়ে গুলি করছে নিশাত। বাংলাদেশ আর্মি কলেজে শিখেছে: পানির নীচে গুলি ভাল কোনও ফলাফল এনে দেয় না। পানিতে মাত্র ছয় গজ গেলেই সাধারণ বুলেটের ভেলোসিটি প্রায় ফুরিয়ে যায়। এরপর একটু গিয়েই টুপ করে ডুবে যায়।

এই কঠিন বাস্তব যেন মানতে চাইছে না নিশাত। ও অপেক্ষা। করছে, তারপর খুনি তিমি কাছে আসতেই গুলি শুরু করছে। বুঝতে পারছে, ওই দানবগুলোর পুরু চামড়া ভেদ করছে বুলেট। অবশ্য তাতে বড় কোনও ক্ষতি হচ্ছে না। নিশাতের গুলির তোড়ে বাঁক নিয়ে অন্য দিকে সরছে কিলার ওয়েইল, কিন্তু তা কয়েক মুহূর্তের জন্য, তারপর আবারও ফিরছে, যেন এরকম সামান্য চিমটিতে কিছুই যায় আসে না তাদের।

ডেকের পাশে পৌঁছেছে নাজমুল, এবার উঠে পড়বে, চট করে কাঁধের উপর দিয়ে চাইল। একটু পিছনে আসছে নিশাত আপা।

বামদিকে চেয়ে আছে নিশাত; পানির নীচে গুলি পাঠাতে শুরু করেছে। তারপর হঠাৎ করেই হাতের ঝাঁকুনি থেমে গেল। মনে হলো খুব দ্বিধান্বিত হয়ে উঠেছে সে।

অস্ত্রটা আর গুলি ছুঁড়ছে না।

চেম্বারে ফেঁসে গেছে একটা বুলেট।

হতবাক নাজমুল দেখল, মহা-বিরক্তি নিয়ে এমপি-৫ ঝাঁকাতে শুরু করেছে আপা, মনে হলো ঝাঁকি দিয়েই অস্ত্র চালু করবে।

আর ঠিক তখনই নাজমুল টের পেল, পানির নীচ দিয়ে কালো কী যেন উঠে আসছে নিশাতের ডানদিকে।

আপা! গলা ফাটিয়ে চেঁচিয়ে উঠল নাজমুল, ডানদিকে!

শুনতে পেয়েছে নিশাত, ঝট করে ঘুরে গেছে ওদিকে। এবং দেখেও ফেলেছে, পিছনে উঠে আসছে খুনি তিমি। এখন আর কোনও কাজে আসবে না অস্ত্র। পানির ভিতর সরে যেতে চাইল নিশাত, দুই পা ভাঁজ করে তুলে নিল বুকের কাছে। এক সেকেণ্ড পর কয়েক ইঞ্চির ব্যবধানে ওর পিছন দিয়ে চলে গেল কিলার ওয়েইল।

নাজমুল মাত্র ভাবতে শুরু করেছে, নিশাতকে পাশ কাটিয়ে চলে গেছে খুনি, কিন্তু ঠিক তখনই টের পেল, গতিপথ পাল্টে নিয়েছে ওটা, ভেসে উঠেছে পানির উপর, চোয়ালের ভিতর খপ করে পুরে নিয়েছে অস্ত্র সহ নিশাতের হাত।

তীব্র ব্যথা পেয়ে এমপি-৫ ছেড়ে হ্যাঁচকা টান দিয়ে ছাড়িয়ে নিল সে হাতটা। অস্ত্রের উপর কামড় পড়তেই চিবাতে শুরু করেছে তিমি।

কবজি থেকে রক্ত বেরুচ্ছে নিশাতের। আশপাশের পানি লাল হয়ে উঠছে।

পাত্তা দিল না নিশাত, হাত যে আছে এই তো বেশি! অস্ত্রটা অবশ্য হারিয়েছে। ডেকের কাছে পৌঁছতে ব্যস্ত হয়ে উঠল।

নাজমুলের মনে হলো, খোদ শয়তানের তাড়া খেয়েছে আপা। নিজে দুই হাতে ভর দিয়ে উঠে এল প্ল্যাটফর্মে, তাড়া দিল: জলদি আপা! আরও জলদি!

টর্পেডোর মত অবসছে নিশাত সুলতানা।

প্ল্যাটফর্মের কিনারায় হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল নাজমুল। নিশাতের পিছনে আবার দেখা দিয়েছে কালো ছায়া।

ওরকম কালো ছায়া পুলের চারপাশে। অনেক।

তারপর হঠাৎ করেই বুঝল নাজমুল, কোনওভাবেই ডেকে পৌঁছবে না আপা!

যেন ওর ভাবনা বাস্তব করতেই হঠাৎ নিশাতের ছুটন্ত দুই পায়ের পিছনে হাজির হলো বিশাল এক কালো দানব।

হতবাক নাজমুল দেখল, ওখানে মৃদু কাপছে সুবোধ-শান্ত পানি, তার ভিতর দিয়ে খুব ধীরে এল ওটা, বিশাল সাদা-কালো চোয়ালের ভিতর দেখা দিল লালচে কী যেন।

চওড়া মুখ খুলছে খুনি তিমি!

করাতের মত দাঁতগুলো বেরিয়ে আসতেই রক্ত হিম হয়ে এল নাজমুলের। স্বচ্ছ পানির ভিতর দেখল, নিশাতের পিছনে বিশাল কালো ডরসাল ফিন খুব ধীরে উঠছে আর উঠছে, তারপর বেচারি আপার পাদুটো ঢুকে গেল তিমির চোয়ালের ভিতর।

তখনও পা ছুঁড়ছে নিশাত।

এক মুহূর্ত পর তিমি নিশ্চিত হলো শিকার ধরা পড়েছে, আস্তে করে চোয়াল বন্ধ করল নিশাতের হাঁটুর একটু উপরে।

.

মানসিক ও শারীরিক প্রচণ্ড ঝাঁকি খেয়েছে নিশাত, ওর জানা ছিল না কোনও হামলা এমন ভয়ঙ্কর হতে পারে।

হতচকিত নাজমুল দেখল, নিশাতকে অনায়াসে নীচে নিয়ে যাচ্ছে তিমি। চারপাশের পানি ভরে উঠছে ফেনা ও বুদ্বুদে, তার ভিতর ফিনকি দিয়ে পড়ছে রক্ত। উন্মাদিনীর মত ছটফট করছে নিশাত, চোয়ালের কারাগার থেকে বেরুতে চাইছে।

হঠাৎ ভেসে উঠল নিশাত, একইসঙ্গে উঠে এসেছে তিমিটাও। পানির নীচে ঝটকা-ঝটকি করতে গিয়ে কীভাবে যেন চোয়ালের থেকে এক পা ছুটিয়ে নিতে পেরেছে নিশাত, তিমির নাকের সামনে আবারও সাঁতরাতে শুরু করেছে।

শুয়োরের বাচ্চা! চিল্কার করে গালি দিল।

কিন্তু ওর অন্য পা কোনওভাবেই ছাড়ছে না তিমি।

হোঁচট খেয়ে সামনে বাড়ল নিশাত, মুখের কাছে দেখা দিল সাদা স্রোত। ওকে ঠেলে নিচ্ছে তিমি। একটু সামনে নাজমুল ও প্ল্যাটফর্ম!

তারপর দড়াম করে ডেকের সঙ্গে বাড়ি খেল নিশাত। কী করে যেন শক্ত করে ধরে ফেলেছে ধাতব প্ল্যাটফর্মের গ্রিল।

খুন করে ফেলব, হারামজাদা! দাঁতে দাঁত চিপে চিৎকার ছাড়ল নিশাত। শালা, শুয়োরের বাচ্চা!

দুই হাতে শক্ত করে প্ল্যাটফর্ম ধরেছে নিশাত। ঝটকা দিয়ে। সামনে বাড়ল নাজমুল, খপ করে ধরে ফেলল নিশাতের দুই হাত, প্রাণপণে টানছে পিছন দিকে। এবার শুরু হলো তিমির সঙ্গে টাগঅভ-ওয়ার। মাঝে বেকায়দা ভাবে আটকা পড়েছে নিশাত।

তারপর নাজমুল দেখল হোলস্টার থেকে কোল্ট অটোমেটিক রিভলভার বের করল নিশাত, কিলার ওয়েইলের মাথা তাক করেই গুলি ছুঁড়ল।

মর শালা! বলল নাজমুল।

কী? খাবি? তিমির উদ্দেশ্যে চিৎকার করল নিশাত, এটা খেয়ে দ্যাখ!

ওর অস্ত্রের মাযলের মুখ থেকে ঝলকে উঠল হলুদ আগুন, সঙ্গে সঙ্গে জ্বলে উঠল চারপাশের গ্যাসীয় বাতাস। বিকট বিস্ফোরণটা নিশাত ও নাজমুলকে কমপক্ষে পাঁচ গজ পিছনে ছিটকে ফেলল ডেকের উপর।

তিমির কপাল এত ভাল নয়। ঠিক মগজে ঢুকেছে বুলেট। সঙ্গে সঙ্গে একের পর এক ঝাঁকি খেতে শুরু করেছে ওটা। পিছিয়ে চলেছে, আরও উপরের দিকে উঠছে মাথা। তারপর নিজের তৈরি রক্তের ধোঁয়ার ভিতর আস্তে করে নেমে গেল পানিতে। মুখে রয়ে গেল তার পুরস্কার–মারা যাওয়ার মাত্র পাঁচ সেকেণ্ড আগে নিশাতের বাম পায়ের হাঁটু কেটে নিয়েছে।

.

পুলের ঠিক মাঝে আছে মেরি ও রানা, একদিকে ডাইভিং বেল, ওদিকে পঁচিশ ফুট দূরে প্ল্যাটফর্ম। পরস্পরের দিকে পিঠ রেখে চারপাশ দেখছে। হতবাক হয়ে গেছে। চারপাশে কিছুই নড়ছে না। বড় বেশি শান্ত পানি, কোথাও কোনও আওয়াজও নেই।

স্যর, প্রায় ফিসফিস করে বলল মেরি। তিরতির করে কাঁপছে চোয়াল। ভয় এবং ঠাণ্ডায়।

কী, মেরি? চারপাশের পানিতে চোখ রেখেছে রানা।

আমার খুব ভয় লাগছে।

ভয়? কীসের জন্য? রানার নিজের কণ্ঠ একটু কেঁপে গেল। আজকাল তো বাচ্চারা কিছুই ভয় পায় না। এসব অনেক দেখে সি ওয়ার্ল্ডে।

কথাটা মাত্র বলেছে রানা, দুই চোখ বিস্ফারিত হলো, দেখল ঠিক সামনেই একটা কিলার ওয়েইল। পানির উপর নাক উঁচু করে তেড়ে আসছে মেরি এবং ওর দিকে!

মেরি, ডুব দাও! চেঁচিয়ে উঠল রানা। তেড়ে আসা তিমির চওড়া মুখ খুলে যেতেই দেখা দিয়েছে ছুরির মত দুই সারি সাদা দাত।

বড় করে দম নিয়েই ডুব দিল রানা, সঙ্গে হঁচকা টান দিয়েছে মেরিকে।

পানির ভিতর হঠাৎ করেই চারপাশ হয়ে উঠল নীরব, নিঃশব্দ। ওদের উপর দিয়ে তীব্র গতি তুলে পেরুল বিশাল সাদা পেট, খ্যা আওয়াজ তুলে ঘষা দিল রানার হেলমেটের উপর অংশে। আবারও জোর ঝপাস্ আওয়াজ তুলে পানির উপর পড়ল তিমির মাথা, এখনও এগিয়ে যাওয়ার গতি কমেনি।

এই সুযোগে মাথা তুলল রানা ও মেরি, হাঁ করে দম নিতে চাইছে।

চট করে বামদিকে চাইল রানা, ওদিকে প্ল্যাটফর্মের উপর নাজমুল ও নিশাত। ডানদিক দেখল, নিরাপদেই ওই ডেকে উঠেছে নিনা ভিসার ও. রাফায়লা ম্যাকানটায়ার। দ্রুত সরছে কিনারা থেকে।

চরকির মত ঘুরল রানা, জোরালো টান খেয়ে এইমাত্র তলিয়ে গেল আরেক ফ্রেঞ্চ কমাণ্ডো! লোকটা প্রায় পৌঁছে গিয়েছিল ডেকের কাছে। চাপা শ্বাস ফেলল রানা, অন্যদের চেয়ে অনেক বেশি দূর পেরুতে হবে ওদেরকে। উপর থেকে ওরা পড়েছে পুলের ঠিক মাঝে।

মরুক শালার ফ্রেঞ্চগুলো, ভাবল। উপরের দিকে চাইতেই দেখল সি-ডেকের মাঝে কূপের উপর রিট্র্যাক্টেবল ব্রিজ। পরক্ষণে কান ফাটানো আওয়াজে চমকে গেল। সি-ডেকের অ্যালকোভের ভিতুর বিকট বিস্ফোরণ হয়েছে। সাদা আগুনের বিশাল লকলকে জিভ চেটে দিল সেন্ট্রাল শাফটের বাতাসকে।

রানা বুঝে গেছে কী হয়েছে। এ-ডেকের ফ্রেঞ্চরা ভাল করেই। জানে গোলাগুলি অসম্ভব, কাজেই শাফটের ভিতর গ্রেনেড ফেলছে। বুদ্ধি আছে কুকুরগুলোর! গ্যাস মিশ্রিত বাতাসে গ্রেনেড ফাটলে ক্ষতি হবে দ্বিগুণ। লোকগুলোর প্রথম টর্গেট ছিল উপরের ওই অ্যালকোভ। একটু আগে তিশা আর রানা ওখান থেকে গুলি করছিল। করছিল।

 হঠাৎ আগুনের গোলকের ভিতর থেকে বেরিয়ে এল কী যেন।

ওটা বেশ বড় ও ধূসর, চৌকো আকৃতির, গড়িয়ে পড়ে গেল মাঝের কূপে। বড় দ্রুত পড়ছে পুলের দিকে। শোঁ-শোঁ আওয়াজ তুলে বাতাস কেটে নামছে বিপুল ওজন নিয়ে। এক সেকেণ্ড পর বজ্রের মত জোর আওয়াজ তুলে নীচের প্ল্যাটফর্মে নামল চার শ পাউণ্ডের ইজেকশন সিট। একটু আগে সি-ডেকের অ্যালকোভে, কসোলের সামনে ছিল। ধাতুর ডেকের বুকে গভীর ট্যাপ ফেলল ওটার নিখাঁদ ইস্পাতের শরীর।

চারপাশে নানা হৈ-চৈ ও আওয়াজ, কিন্তু রানার চোখ আটকে গেছে তিনতলা উপরের রিট্রাক্টেবল ব্রিজের উপর। দূরত্বটা মেপে নিচ্ছে।

তিরিশ ফুট। বড়জোর পঁয়ত্রিশ ফুট?

সময় নষ্ট করল না রানা, তুলে ধরল ম্যাগহুক, বুড়ো আঙুলে এম লেখা বোতাম টিপে দিল। জ্বলে উঠেছে লাল বাতি, এ্যাপলিং হুক অ্যাকটিভেট হয়েছে। এবার কাজ করবে ম্যাগনেট।

ট্রিগার টিপতেই ম্যাগহুক থেকে ছিটকে বেরুল ম্যাগনেটিক হেড, খটাং শব্দে আটকে গেল রিট্রাক্টেবল ব্রিজের নীচে।

মনে মনে অংক কষল রানা: হিসাব শেষে বিড়বিড় করে বলল, ধূর!

মেরির হাতে ম্যাগহুক ধরিয়ে দিল, দ্রুত স্বরে বলল, মিষ্টি মেয়ে, একটা কথাই বলব: ভুলেও এটা ছাড়বে না!

দুই হাতে লঞ্চার ধরেছে মেরি, অবাক হয়ে রানার দিকে চাইল।

আশ্বাস দেয়ার ভঙ্গিতে হাসল রানা, বলল, শুধু শক্ত করে ধরো।

এবার ম্যাগহুকের গ্রিপে কালো বোম চাপ দিল রানা। হঠাৎ পানি ছেড়ে আকাশে উড়াল দিল মেরি, উঠছে ম্যাগহুকের টানে। ওটা যেন অদ্ভুত কোনও ছিপ, উল্টো টেনে নিচ্ছে শিকারিকে।

মেরির ওজন কম, কোনও সমস্যা হচ্ছে না ম্যাগহুকের, যেন পাখির বাচ্চা তুলছে ব্রিজের দিকে। রানা জানত, ও নিজে ম্যাগহুকে ওজন চাপালে অনেক ধীরে উঠবে।

মেরিকে নাগালে পাওয়ার জন্য পানি থেকে লাফিয়ে উঠল এক কিলার ওয়েইল।

চমকে গেল রানা, বিশাল ওই তিমি পানি থেকে তুলে ফেলেছে গোটা দেহ, তীরের মত উঠছে শূন্যে।

ম্যাগহুকের টানে এখনও উপরে উঠছে মেরি, নীচে চেয়ে দেখল পানি থেকে ছিটকে উঠে আসছে তিমি। যেন স্রেফ নরক থেকেই উঠে আসছে ওটা, মুখ থেকে বেরুচ্ছে বিকট গর্জন!

ঠিক তখন উপরে ঠক আওয়াজ হলো।

ওর দিকে উঠে আসছে তিমি।

বিস্মিত হয়ে ফুঁপিয়ে উঠল মেরি, উপরে চাইল।

ও আটকে গেছে ব্রিজের নীচে।

আর উঠতে পারবে না!

বিশাল চওড়া হাঁ খুলেছে তিমি, পৌঁছে গেছে লাফের শেষে…

প্রাণপণে ম্যাগহুক আঁকড়ে ধরেছে মেরি, বুকের কাছে তুলে ফেলল দুই পা। ঠিক তখনই ওর নিতম্ব থেকে ছয় ইঞ্চি নীচে বিশ্রী খটাৎ আওয়াজ তুলল তিমির দাঁতগুলো, বন্ধ হয়ে গেছে চোয়াল।

চেয়ে রইল মেরি, কালো-সাদায় মেশানো তিমি আবারও নীচে পড়ছে। খুব দ্রুত ছোট হচ্ছে ওটা, তারপর ঝপাস্ করে নামল পুলে, তলিয়ে গেল। দানবটা কমপক্ষে তিরিশ ফুট লম্বা ছিল, পানির গভীর থেকে সোজা উঠে এসেছিল ওপরে।

হঠাৎ মেরির মুখের সামনে হাজির হয়েছে একটা হাত, ভয়ের চোটে আরেকটু হলে হার্ট অ্যাটাক করত, ছেড়েই দিত ম্যাগহুক।

ভয় নেই, সোনা-পাখি, বলে উঠল একটি কণ্ঠ, আমি।

মুখ তুলে হাসি-হাসি মুখটা দেখল, মেরি। এই মানুষটাকে খুব বিশ্বাস করি, ভাবল। নাম তো মনে নেই, কিন্তু ইনিই বই লিখতে গিয়ে লেখক নাম পেয়েছেন বন্ধুদের কাছ থেকে।

সার্জেন্ট হোসেন আরাফাত দবিরের হাতটা ধরল মেরি।

তিন সেকেণ্ড পর ওকে রিট্রাক্টেবল ব্রিজে নামিয়ে দিল মানুষটা। প্রথম কিছুক্ষণ হাঁপাল মেরি, তারপর খুশিতে কেঁদে ফেলল। ওর কাঁধে আস্তে করে হাত রাখল দবির, অবাক হয়েছে। এক সেকেণ্ড পর পারকার পকেটে হাত ভরল মেরি, বের করল হাঁপানি রোগের প্লাস্টিকের পাফার।

ওটা ব্যবহার করে বড় দুটো দম নিল মেরি, তারপর দবিরের চোখে চোখ রেখে বলল, সি ওয়ার্ল্ডে ওই জিনিস নেই!

.

পুলের মাঝে রানা খেয়াল করছে, ওকে ঘিরে অনবরত চক্কর কাটছে দুটো কিলার ওয়েইল। গালের সবচেয়ে ছোট এই দুটো। বোধহয় তরুণ বয়সী।

উপরের দিকে মুখ তুলে চেঁচিয়ে উঠল রানা, দবির, আমার ম্যাগহুক ফেলুন!

দেরি না করে সেতুর উপর শুয়ে পড়ল সার্জেন্ট, সরু প্ল্যাটফর্মের নীচে হাত বাড়িয়ে ডি-অ্যাকটিভেট করতে চাইছে গ্যাপলিং হুকের ম্যাগনেট।

জলদি, দবির! পুলের ভিতর থেকে এল রানার ব্যস্ত কণ্ঠ।

চেষ্টা করছি, স্যর! বলল সার্জেন্ট, এক মিনিট!

সেই সময় আমার কই!

সেতুর নীচে পুরো কাঁধ ঢুকিয়ে দিয়েছে দবির, গ্রিপের এম লেখা সুইচ পেতে চাইছে। ওটাই শক্তিশালী ম্যাগনেটকে অ্যাক্টিভেট ও ডি-অ্যাক্টিভেট করে

এ কাজ করতে গিয়ে হঠাৎ চমকে গেল দবির। আবছা শুনল, সেতুর উপর কার সঙ্গে যেন কথা বলছে মেরি!

ফ্রেঞ্চ কোনও কমাণ্ডো?

এবার যেন স্পষ্ট শুনল, লিলি, সাহায্য কর! ডাইভারকে সাহায্য কর!

পিটপিট করে চাইল দবির। ভাবতে শুরু করেছে, কাজের চাপে শেষে খারাপ হয়েই গেল মাথা।

.

পুলের ভিতর রানা বুঝে গেছে, মৃত্যু এবার অনিবার্য। চক্কর কাটছে দুই তিমি। একটা সামনে, অন্যটা পিছনে। এই ফাঁদ থেকে বেরুনোর কোনও উপায়ও নেই। 

হঠাৎ করেই চক্কর থামিয়ে আরেক দিকে রওনা হলো একটা তিমি। অজান্তে ঢোক গিলল রানা।

এবার খেলা খতম করতে আসবে ওটা।

খুব ধীরে ঘুরল, মাথা তাক করেছে রানার দিকে, পানির মাত্র একফুট নীচে আছে। ডরসাল ফিন আরও উপরে উঠল খুনি তিমির, তারপর হঠাৎ করেই মিসাইলের তীব্র গতি পেল। কালোসাদা মাথার ধাক্কা খেয়ে উপরে তৈরি হলো বড় ঢেউ। সরাসরি রানার দিকে আসছে খুনি তিমি।

চট করে ঘুরে চাইল রানা। না, কোথাও যাওয়ার নেই। এমন কোনও অস্ত্রও নেই যেটা ওটাকে ঠেকাবে।

তাই বলে হার মেনে নেব? ভাবল রানা। হ্যাঁচকা টানে হোলস্টার থেকে বের করে নিল ডেযার্ট পিস্তল, তুলে ধরেছে পানির উপর।

মনে মনে বলল, এভাবে যদি মরতে হয়, তো লড়েই মরব!

তীব্র বেগে আসছে তরুণ তিমি।

কিন্তু হঠাৎ করেই কালো কী যেন ঝপাৎ করে পড়ল রানার মুখের সামনে। ওর এবং তিমির মাঝে আছে ওটা।

এতই পিছলা, পানির ভিতর কোনও আওয়াজই করেনি, স্যাৎ করে সরে গেল রানার সামনে থেকে, প্রচণ্ড গতি তুলে আরেক দিকে রওনা হয়েছে।

ভাল করেই ওটা দেখেছে দুই তিমি, মুহূর্তে মনোযোগ হারিয়ে ফেলেছে রানার উপর থেকে। যে তিমিটা ছুটে আসছিল, সেটা রানার একফুট আগে বাঁক নিল, নতুন উদ্যমে ছুটল নতুন শিকার ধরতে।

হতভম্ব হয়ে গেছে রানা। ওটা আসলে কী? এক পলকের জন্য মনে হয়েছে, কোনও ধরনের সিল!

ঠিক তখনই সামনে পড়ল ম্যাগহুক। ওটা ডুবে যাওয়ার আগেই খপ করে ধরল রানা, উপরের দিকে চাইল। সেতুর উপর উপুড় হয়ে শুয়ে আছে সার্জেন্ট দবির, এক হাত সেতুর নীচে।

একবার ম্যাগহুক দেখে নিল রানা, বুঝল নতুন করে জীবন পেতে চলেছে।

আধ সেকেণ্ড পর হঠাৎ করেই ওর মুখের কাছে দেখা দিল ছোট্ট কালো একটা সুঁচালো মাথা। ভীষণ চমকে পানিতে চিত হয়ে পড়ল রানা। তবে বুঝেছে, ওটা মেরির লিলি— অ্যান্টার্কটিক গেযেলা সিল।

ভিজে যাওয়ায় ছোট্ট লাল কলার চকচক করছে, জন্তুটা কোমল চাহনি ফেলল রানার চোখে। তারপর রওনা হয়ে গেল আরেক দিকে। রানা শপথ করে বলতে পারবে, নিঃশব্দে হাসছিল ছোট্ট সিল। পুলের ভিতর অনায়াসে দুই তিমিকে ফাঁকি দিয়ে নানা দিকে ছুটছে।. .

হঠাৎ করেই বামদিকে মাথা ঘোরালো। বোধহয় শুনতে পেয়েছে অস্বাভাবিক কোনও শব্দ, হয়তো দেখেছে অন্য কিছু। একবার খুশি-খুশি ভঙ্গি করে রানার দিকে চাইল, তারপর পানির নীচ দিয়ে রওনা হয়ে গেল পুলের আরেক দিকে।

পানির সামান্য নীচ দিয়ে তীব্র গতি তুলে ছুটছে, যেন, সত্যিকারের কোনও টর্পেডো। তিমিগুলোকে বোকা বানাতে মুহূর্তে মুহূর্তে সরছে বামে বা ডানে, তারপর হঠাৎ করেই খাড়া ডাইভ দিয়ে নেমে গেল গভীর পানির ভিতর। এক সেকেণ্ড পর তিমিগুলো টের পেল, পালাতে শুরু করেছে তাদের শিকার। ঝন্টু করে বাক নিল তিনটে কালো ডরসাল ফিন, ব্যস্ত হয়ে ধাওয়া শুরু করল।

সুযোগটা আগেই নিয়েছে রানা, চলে এসেছে তীরের কাছে। আর মাত্র তিন ফুট পেরুলেই…

এমন সময় বড় ঢেউ ভীষণ দুলিয়ে দিল ওকে, পুরো এক পাক ঘুরে গেল ও–এইমাত্র প্রচণ্ড গতি তুলে ওকে পাশ কাটাল বিশাল এক তিমি। এইবার কামড়ে ধরবে, ভাবল রানা। কিন্তু তা নয়, ওটা পিছু নিয়েছে মায়াবী ফার সিলের।

ফোঁস করে শ্বাস ফেলল রানা, সামনে বেড়ে ধরে ফেলল ডেকের গ্রিল। দেরি না করে উঠে এল পানি থেকে, চোখ পড়ল তুবড়ে যাওয়া ইজেকশন সিটের উপর। একটু সামনে কাত হয়ে পড়ে আছে ওটা। ঘুরে চাইল রানা, চারপাশে হৈ-চৈ চলছে।

অনেক আগেই পানি থেকে উঠেছে নিনা ভিসার ও রাফায়লা ম্যাকানটায়ার, এখন দ্রুত চলেছে ই-ডেকের টানেল লক্ষ্য করে। একটু দূরে ক্যাপ্টেন নিশাত ও কর্পোরাল নাজমুল। নিশাতের উপর ঝুঁকে পড়েছে ছেলেটা, মনে হলো আপার পায়ের কোনও ক্ষত থেকে রক্ত থামাতে চাইছে।

পুলের উল্টো দিকে অবশিষ্ট দুই ফ্রেঞ্চ কমাণ্ডোকে দেখল রানা, তারাও নিরাপদ। চুপচুপে ভেজা, এইমাত্র ডেকে উঠেছে। তাদের একজন ওকে দেখেছে, দেখামাত্র হাত বাড়িয়ে দিয়েছে ক্রসবো বের করতে।

ঠিক তখনই চোখের কোণে নড়াচড়া দেখে ঘুরে দাঁড়াল রানা। পানির নীচ দিয়ে আসছে পরিচিতি কালো ছায়া।

মিষ্টি মেয়ে লিলি।

তার পিছনে তেড়ে আসছে বিশাল কালো-সাদা তিনটি দেহ। মনে হলো, কখনও হাল ছাড়বে না।

পানির সামান্য নীচে প্রচণ্ড গতি তুলছে লিলি। কয়েক মুহূর্ত পর পর পিছনে ঝটকা দিচ্ছে ফ্লিপারগুলোতে। হঠাৎ করেই কাত হয়ে গেল লিলি, পরক্ষণে বুলেটের মত এল পানির ভিতর দিয়ে। রক্ত ভরা পানিতে কখনও দেখা যাচ্ছে, আবার পরক্ষণে দেখা যাচ্ছে না ওকে।

ওদিকের ডেকে দুই ফ্রেঞ্চ কমাণ্ডো, মোটেই কমল না লিলির গতি। রানার মনে হলো রকেট হয়ে গেছে ওটা, পিছনে তেড়ে আসছে তিনটে কালো-সাদা শয়তান দানব।

অবাক হয়ে দেখছে রানা, ডেক থেকে তিন ফুট দূরে থাকতে হঠাৎ করেই ঝাপ দিল লিলি। পানি থেকে উঠে এল দেহ, সাবলীল ভঙ্গিতে পেট দিয়ে নামল ডেকের উপর, দুই হতবাক ফ্রেঞ্চকে পিছনে ফেলে সরসর করে চলে গেল নয় ফুট দূরে। ওখানেই থামল না, পিছলে যাওয়া থামতেই কাজে লাগাল চার ফ্লিপার, পানির ধার থেকে আরও দূরে সরে যেতে ছুটতে লাগল।।

এক সেকেণ্ড রানা ভাবল, লিলি অমন করছে কেন? দ্বিতীয় সেকেণ্ডে অতীত মনে পড়ল। পানির ধার থেকে সরে না গেলে কিলার ওয়েইল থেকে কেউ নিরাপদ নয়।

তবু চেয়ে আছে রানা।

পুলের ওদিকে হাজির হয়েছে বিশাল এক কালো-সাদা দানব, ভয়ঙ্কর গর্জন ছাড়তে ছাড়তে গভীর পানি থেকে উঠে এসেছে, প্রকাণ্ড শরীর নিয়ে আছড়ে পড়ল পুরু ধাতব প্ল্যাটফর্মে। তখনও পিছলে চলেছে নিজ বিপুল ওজনে। মসৃণ ভাবে কাত হলো, খুলে . গেল মস্ত চোয়ালের হাঁ, মনে হলো কোনও কষ্ট ছাড়াই ধরে ফেলল এক ফ্রেঞ্চ কমাণ্ডোকে। পরক্ষণে নরম দেহ পেয়ে বসাল জোরালো কামড়। টানা চিৎকার শুরু করেছে কমাণ্ডো। এদিকে বেকায়দা ভঙ্গিতে বিশাল শরীর নিয়ে ডেকে পিছাতে শুরু করেছে কিলার ওয়েইল, কয়েক সেকেণ্ড পর ঝপাস্ করে নেমে পড়ল পুলে। হারিয়ে গেল হতভাগ্য লোকটাকে নিয়ে।

ডেকের সবাই এবার বুঝল: কিনারা থেকে সরতে হবে!

তিশাকে দেখতে পেল রানা, নাজমুলের সঙ্গে যোগ দিয়েছে সে। দুজন মিলে কাঁধে তুলে নিয়েছে নিশাতকে, পুলের কিনারা থেকে সরছে। তারই ফাঁকে নিশাতের কোমর থেকে নীচের অংশ দেখতে পেল রানা। ওখানে হাঁটু থেকে কাটা পড়েছে একটা পা।

ঠিক তখন পিছনে ঝপাৎ জোরালো আওয়াজ পেল রানা। থরথর করে কেঁপে উঠেছে প্ল্যাটফর্ম! চরকির মত ঘুরল ও, দেখল, উঠে এসেছে আরেক দানব। ওখান থেকে হাসি-হাসি মুখ করে গড়িয়ে আসছে ওর দিকে!

যেন সাপের মত পিছলে চলছে!

এখনও হাঁটুর উপর ভর করে বসে আছে রানা।

একপাশে কাত হয়ে গেল তিমি, বিরাট হাঁ মেলেছে!

বিশাল দানবের উল্টো দিকে প্রাণ হাতে নিয়ে ডাইভ দিল রানা, ঝাপ দিয়ে মনে মনে বলছে: রানা রে, পালা এবার!

ওর চোখ পড়েছে তুবড়ে যাওয়া ইজেকশন সিটের উপর। চার ফুট দূরে কাত হয়ে পড়ে আছে ওটা। হয়তো ওই পর্যন্ত পৌঁছুতে পারবে। যদি লাফ দিয়ে ওটা টপকে যেতে পারে, আর কোনও বিপদ নেই। ডাইভ শেষে ডেকে পড়ে ধড়মড় করে উঠে বসল রানা, দেরি না করে হামাগুড়ি দিয়ে রওনা হয়ে গেল ইজেকশন সিট লক্ষ্য করে।

কিন্তু অনেক দ্রুত আসছে খুনি তিমি!

পিচ্ছিল ডেকের উপর থ্যাপ-থ্যাপ করে থাবা পড়ছে রানার, কিন্তু তা যথেষ্ট নয়। ঠিক সময়ে ইজেকশন সিটের ওপাশে যেতে পারবে না। চারপাশে ঝরঝর করে পড়ছে পানি। পিছলে আসা কিলার ওয়েইলের তৈরি বৃষ্টি!

রানার ঠিক পিছনে পৌঁছে গেছে ওটা।

রক্তে প্রচুর অ্যাড্রেনালিন নিয়ে আবার সামনে ঝাপিয়ে পড়ল রানা। স্পষ্ট বুঝে গেছে, চেয়ারের ওপাশে যেতে পারবে না, কাজেই ঝাঁপ দিয়েই পিঠ ঘুরিয়ে নিয়েছে।

এক সেকেণ্ড পর টের পেল, আছে ইজেকশন সিটের ভিতর!

কাত হওয়া সিটে আসীন হয়েছে, বা বলা উচিত শুয়ে আছে। পুলের দিকে ওর মুখ, চট করে চোখ তুলে চাইল। কিন্তু কিছুই দেখবার নেই, সামনে শুধু বিশাল কিলার ওয়েইল।

বুকের উপর হাজির হয়েছে ওটা! এখনও গর্জাতে গর্জাতে আসছে!

আর মাত্র তিন ফুট! মোটেও কমছে না গতি!

এখন আর থামবে না!

একবার শ্বাস ফেলেই চোখ বুজে ফেলল রানা। ঠিক তখনই ওর মাথার চারপাশে বন্ধ হলো খুনি তিমির বিরাট চোয়াল!

ভয়ঙ্কর জোরালো ঘঠাং! আওয়াজ পেল রানা। আগে কখনও এমন বিকট আওয়াজ জীবনেও শোনেনি। ভেবেছিল তীব্র, টনটনে ব্যথা লাগবে, ওর মাথা চিবাতে শুরু করেছে কিলার ওয়েইল!

কিন্তু কই, কোথাও কোনও ব্যথা নেই যে!

অবাক হয়ে চোখ মেলল, পরক্ষণে চমকে গেল সামনে ছোরার মত গিজগিজে এসব কী! এক সেকেণ্ড পর টের পেল, এদিক-ওদিকে, উপরে-নীচে শুধু দাঁত আর দাঁত! তার ওদিকটা প্রায়ান্ধকার। দুই সারি দাঁতের মাঝে লালচে থলথলে জিভ!

আরও এক সেকেণ্ড পর কাজ শুরু করল রানার মগজ।

ওর মাথা আছে খুনি তিমির মুখের ভিতর!

অজানা কোনও কারণে, যে ভাবেই হোক, যদিও বোঝা যাচ্ছে

বিষয়টা কী… তবে এখনও আস্ত আছে ও।

এটা কোনও ভাবেই হওয়ার কথা নয়। উপরের দিকে মুখ তুলে চাইল রানা। তুবড়ে যাওয়া ইজেকশন সিটের স্টিলের হেডসেট ওর মাথার তিন দিকে।

রানার মাথার দুপাশে হেডরেস্টে প্রচণ্ড কামড় বসিয়েছে কিলার ওয়েইল। কিন্তু খুব পোক্ত জিনিস এই স্টিলের হেডরেস্ট, ঠেকিয়ে দিয়েছে ভয়ঙ্কর কামড়। রানার কান থেকে মাত্র এক মিলিমিটার দূরে তিমির দাঁত। দুপাশে ডেবে গেছে হেডরেস্টের ইস্পাত। একদিকের ইস্পাত এবড়োখেবড়ো, সামান্য খোঁচা দিয়ে

এক ফোটা রক্ত বের করেছে রানার বাম কান থেকে।

রানার বুক ও মাথার দিক আছে তিমির বিশাল মুখের ভিতর।

হঠাৎ করেই ওর নীচে ঝাঁকি খেল ইজেকশন সিট।

ধাতব প্ল্যাটফর্মে শুরু হলো ঘষ্টে যাওয়ার আওয়াজ। সিটের ভিতর অংশে সরে গেল রানা। মনে হলো লেংচে লেংচে সামনে বাড়ছে সিট!

হঠাৎ করে থেমে গেছে নড়াচড়া 1 ঝাঁকি খেয়ে সামনে বেড়েছে রানা, আবার থমকে গেছে সিট। হঠাৎ করেই ও বুঝে গেল কী ঘটছে।

চেয়ার সহ ওকে পুলের দিকে টেনে নিয়ে চলেছে তিমি!

আবারও জোরালো আঁকি খেল ইজেকশন সিট। রানা বুঝল, ডেকের উপর কমপক্ষে তিন ফুট টেনে নেয়া হয়েছে ওটাকে।

মনের চোখে বিশাল তিমির নড়াচড়া দেখছে রানা। পিছলে পিছিয়ে চলেছে। আগের তিমি এভাবেই ফ্রেঞ্চ-কমার্তোকে নিয়ে উধাও হয়েছে পুলের ভিতর। আর এটা টেনে নিয়ে চলেছে চার শ পাউণ্ড ওজনের ইজেকশন সিট।

আবারও হোঁচট খেয়ে সামনে বাড়ল প্রকাণ্ড সিট। গরম বাতাসের হলকা লাগল রানার মুখের উপর। ওই বাতাস এসেছে তিমির পেট থেকে।

তিক্ত হাসল রানা। খুব হাঁসফাঁস লাগছে ওটার, রূপকথার বইয়ের দুষ্ট নেকড়ের মত বড় করে শ্বাস ফেলছে। কে জানে, মনে মনে হয়তো বলছে: এইবার হাঁপ দেব, কাঁপ দেব, তারপর উড়িয়ে দেব তোর ছোট্ট বাড়ি!

সিট চোয়ালে নিয়ে ছেঁচড়ে পিছাচ্ছে তিমি। একবার পানিতে নামতে পারলেই…।

গরম হাওয়া মুখে লাগতেই সিটের ভিতর গা মুচড়ে সরে যেতে চাইল রানা। আবারও হোঁচট খেয়ে সামনে বাড়ছে সিট। পানিতে গিয়ে পড়বার আগেই তিমির কাছ থেকে ভাগতে হবে।

ইজেকশন সিটের নীচ অংশ দিয়ে বেরিয়ে আছে রানার পা, পাশেই হাস্যরত তিমির খোলা ঠোঁট। রানা ভাবছে, ওই পথে যদি নামি, পিছলে বেরুতে পারব সিট থেকে, তারপর তিমির মুখের পাশ থেকে উঠেই দে ভোঁ দৌড়!

খুব তিক্ত মনে ধীরে ধীরে সিট থেকে নীচের দিকে নামতে শুরু করেছে রানা। খুব সতর্ক, ব্যাটা তিমি যদি টের পায় ও ভাগতে, চায়, তো…

হঠাৎ করেই একপাশে আরও কাত হয়ে গেল ইজেকশন সিট, ধাতব ডেকের উপর ভয়ানক ঘষটে যাওয়ার আওয়াজ শুরু হয়েছে। দাঁতগুলো থেকে আসছে বিশ্রী বাজে দুর্গন্ধ। দুই হাতে খপ করে আর্মরেস্ট ধরল রানা, কোনওভাবেই দানবটার মুখের ভিতর গিয়ে ঢুকতে চায় না।

নিজেকে একটু সামলে নিয়ে আবারও নীচের দিকে নামতে লাগল রানা। চেয়ারের হাঁটুর কাছে নেমে এল। ওর দুই চোখ চেয়ে আছে খোঁচা-খোঁচা দাঁতগুলোর উপর। আবারও নড়ে উঠল চেয়ার, ভীষণ ভারী জিনিস বইতে গিয়ে ঘড়ঘড় শব্দ করছে তিমি।

খুব সাবধানে আরও এক ইঞ্চি নামল রানা।

সমস্যার মুখে পড়ে ওখানেই থামতে হলো।

সিটের যেখানে নেমেছে, আর ধরতে পারবে না দুই দিকের আর্মরেস্ট। কিন্তু ধরবার মত কিছু লাগবেই, নইলে নিজেকে সিট থেকে বের করবে কী করে? ব্যস্ত হয়ে সামনের পাশ দেখল রানা।

না, কিছুই তো নেই! 

তারপর ওর চোখ পড়ল কিল্লার ওয়েইলের দাঁতের উপর।

দুই হাতে খুনি তিমির মস্ত দুটো সাদা দাঁত খপ করে ধরল রানা। আর তখনই আচমকা ঝাঁকি খেয়ে আবারও সামনে বাড়ল ইজেকশন সিট। রানা টের পেল, এবার ডেক থেকে সামান্য উঁচু হয়ে উঠেছে ওটা!

ভয়ে পেয়ে গেল ও। চেয়ার পৌঁছে গেছে ডেকের কিনারে। এবার উল্টে পড়বে পুলে। তারপর…

আরও শক্ত ভাবে দুই দাঁত ধরল রানা, তারপর জোর ঠেলা দিল। সরসর করে নীচে নামল ওর শরীর, পরক্ষণে ইজেকশন সিট থেকে বেরিয়ে এল। বিশাল,তিমির মুখের পাশেই ডেকে পড়েছে। চোখের সামনে দেখতে পেল, পুলের ভিতর নেমে গেছে দানবের লেজ। পানিতে ঝাপটা দিতেই উপরে উঠল মাথা। ডেক থেকে তুলে ফেলেছে গোটা ইজেকশন সিট। পিছলে পানিতে নেমে গেল কালো-সাদা শরীর, সঙ্গে নিয়ে চলেছে ভারী পুরস্কার।

এক সেকেণ্ড দেরি করেনি রানা, লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়েই ঝেড়ে দৌড় দিয়েছে নাজমুল, তিশা ও নিশাতকে লক্ষ্য করে। দৌড়ের ফাঁকে হেলমেট মাইকে বলল, সার্জেন্ট জনি ওয়াকার, রিপোর্ট পাঠান!

এখনও এ-ডেকে, মেজর। ভাইপার আর লেফটেন্যান্ট মোরশেদ আমার সঙ্গেই।

উপরে ওরা কজন? জানতে চাইল রানা।

মাসুদ ভাই, পাঁচজন মিলিটারি, দুজন সিভিলিয়ান, জবাব দিল মোরশেদ। কিন্তু এইমাত্র দুজন কমাণ্ডো মই বেয়ে নীচের লেভেলে যাচ্ছে। …কী বললেন? আরেশশালা…

কানেশন কেটে গেছে। খস-মস্ আওয়াজ শুনতে পেল রানা।

মোরশেদ…

কিন্তু হঠাৎ করেই রানার একটু সামনে হাজির হয়েছে এক ফ্রেঞ্চ কমাণ্ডো!

পুলের ভিতর পড়া পাঁচ ফ্রেঞ্চ কমাণ্ডার শেষজন। শুধু এই লোকই বেঁচে আছে। বরফ-ঠাণ্ডা পানিতে ভিজে চুপচুপে, কিন্তু আগুন হয়ে আছে রাগে, ভয়ঙ্কর ভাবে ভুরু কুঁচকে রানাকে দেখল। যেন নরক থেকে এসেছে, শত্রুর বুকে তাক করল ক্রসবোরা

দৌড় থামাল না রানা, ঝট করে হাঁটুর পাশের খাপ থেকে বের করে নিল থােয়িং নাইফ, এবং দৌড়ের উপরই হাতের ঝটকায় ছুঁড়ে মারল পিছন দিকে। ফলাটা বাতাসে শিস তুলে গাঁথল ফ্রেঞ্চ শত্রুর বুকে। ধুপ করে পড়ল লোকটা। বড় জোর দুই সেকেণ্ড ব্যয় হলো এতে। লাশের পাশে ফিরে এল রানা, এক টানে বের করে নিল ছোরা, বাদ পড়ল না ক্রসবোও, দেরি না করে হাঁটতে শুরু করেছে। হেলমেট মাইকে বলল, মোরশেদ, তোমাদের কী খবর? ঠিক আছ?

জী, মাসুদ ভাই। সরি। আমার আগের হিসাব ভুল ছিল। একটা কমেছে। এখন আছে চারজন আর দুই বিজ্ঞানী।

নীচের পাঁচটা শেষ, বলল রানা। দক্ষিণ টানেলের মুখে পৌঁছে গেছে ও। ওখানেই নিশাতকে নিয়ে টানেল ধরে চলেছে তিশা ও নাজমুল।

নিশাতের উপর চোখ পড়ল রানার। বাম হাঁটু রক্তাক্ত। এবড়োখেবড়ো হাড় বেরিয়ে আছে, পায়ের নীচের অংশ নেই।

ওঁকে নিরাপদ কোথাও নিয়ে চলো, বলল রানা। রক্ত পড়া বন্ধ করতে হবে। মেথাডন লাগবে।

জী, বলল তিশা।

নিশাতকে বয়ে নিতে সাহায্য করছে রানা। নরম স্বরে বলল, কেমন বোধ করছেন, আপা?

আপার গালে একটা চুমু দিলে… দেখবে ঠিক হয়ে গেছি, দাঁত দাঁত চেপে বলল নিশাত। নীরবে সহ্য করছে ভয়ঙ্কর ব্যথা।

তাই দেব আমরা, আগে কাজ শেষ করি, সামনের টানেলে দরজা দেখেছে রানা। তিশা ও নাজমুলকে বলল, ওখানে নিয়ে চলো।

সামনে বেড়ে দরজা খুলল রানা, আহত নিশাতকে সাবধানে ঘরে ঢোকাল ওরা। পোশাক থেকে টপটপ করে পড়ছে পানি। এটা কোনও গুদাম-ঘর। নিশাতকে মেঝের উপর শুইয়ে দিতেই জখম পা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে উঠল নাজমুল।

হেলমেট মাইকে বলল রানা, সবাই তোমরা কোথায়?

ইন্টারকমে এল একের পর এক নাম ও তাদের পরিস্থিতি।

সার্জেন্ট ভাইপার, সার্জেন্ট জনি ওয়াকার ও লেফটেন্যান্ট গোলাম মোরশেদ এ-ডেকে।

লেফটেন্যান্ট তিশা করিম ও কর্পোরাল, নাজমুল ই-ডেকে। রানার সামনেই, তবুও হেলমেট ইন্টারকমে নাম ও অবস্থান জানাল ওরা সবাই। এমন কী বাদ পড়ল না ক্যাপ্টেন নিশাতও, নিজের নাম জানাল।

টনি কেলগ, হলিডে স্যাম্পসন, জর্জ মারফি মারা গেছে, কোনও সাড়া এল না সার্জেন্ট হোসেন আরাফাত দবিরের তরফ . থেকেও।

ঠিক আছে, সবাই মন দিয়ে শোনো, বলল রানা। আমার ভুল না হলে ফ্রেঞ্চ কমাণ্ডারা এখন চারজন। এ ছাড়া আছে দুই বিজ্ঞানী। তারা যে নিরীহ এমন কথা বলছি না। …এবার শোনো, শেষ করতে হবে এই লড়াই। সংখ্যার দিক থেকে এখন আমরা বেশি। আমি চাই গোটা ফ্যাসিলিটির উপর থেকে শুরু করে নীচ পর্যন্ত তল্লাসী করা হোক। ওদেরকে কোণঠাসা করব আমরা। সতর্ক থাকতে হবে, যেন আমাদের আর কাউকে হারাতে না হয়। …ঠিক আছে, এবার শোনো আমরা কী করব। প্রথমে…

হঠাৎ থেমে গেল রানা, ওদের মাথার উপরের ছাতে, ধপ ধপ আওয়াজ শুরু হয়েছে। মুখ তুলে ছাতের দিকে চাইল ওরা।

আর কোনও আওয়াজ নেই।

ডানদিকের সুড়ঙ্গের ছাতে নির্দিষ্ট বিরতি দিয়ে দুটো করে ফ্লুরোসেন্ট বাতি জ্বলছে।

কিন্তু হঠাৎ করেই নিভে গেল সব বাতি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *