ড্রাকুলা (পর্ব ২)

ড্রাকুলা ২
প্রথম প্রকাশ : অক্টোবর, ১৯৭৯

২.০১ লুসি ওয়েস্টেনরার ডায়েরী থেকে

লুসি ওয়েস্টেনরার ডায়েরী থেকে

১৭ সেপ্টেম্বর, সকাল।

একে একে শান্তিতেই কেটে গেল চারটে দিন আর রাত। আগের চেয়ে অনেক বেশি সুস্থ মনে হচ্ছে আজ নিজেকে। ভোর হয়েছে একটু আগে। জানালা দিয়ে ঘরে এসে পড়েছে ভোরের সোনালী রোদ। ঝিরঝিরে বাতাসে জুড়িয়ে যাচ্ছে শরীর মন। গত চারদিন সমানে রাত জেগে আমাকে পাহারা দিয়েছেন ডা. ভ্যান হেলসিং। আজ রাত থেকে আমাকে আর কারও পাহারা দেবার দরকার নেই ভেবেই বোধহয় আমস্টারডামে ফিরে গেছেন তিনি। ধীরে ধীরে সাহস ফিরে পাচ্ছি আমিও। বুঝতে পারছি রাতের বেলা একা থাকতে আর ভয় করবে না আমার। রসুনের উগ্র গন্ধটার সাথেও অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি। বিশেষভাবে জন্মানো এই রসুনের আর একটা নতুন মোড়কও গতকাল হারলেম থেকে এসে গেছে, অতএব চিন্তা কি?

গভীর রাত।

আজ রাতের প্রত্যেকটি ঘটনা হুবহু লিখে রাখছি। ঈশ্বর, চরম দুর্ঘটনা ঘটার আগেই যেন শেষ করতে পারি লেখাটা। আশা করছি, আমি বলে না দিলেও লেখাটা চোখে পড়বে সবার। ভীষণ দুর্বল আর অসহায় বোধ করছি। বুঝতে পারছি ধীর পায়ে আমাকে গ্রাস করতে এগিয়ে আসছে মৃত্যু। ঈশ্বর, শক্তি দাওযেন মরার আগেই শেষ করে যেতে পারি লেখাটা।

যথারীতি রসুনের কোয়াগুলো জানালা আর দরজার চৌকাঠে রেখে মালটা গলায় পরে শুয়ে পড়লাম। কতক্ষণ ঘুমিয়ে ছিলাম জনি না, হঠাৎ অদ্ভুত একটা শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। এরকম শব্দ শুনেই প্রথমবার ঘুমের ঘোরে বাইরে বেরিয়ে গিয়েছিলাম, আর মিনা ধরে নিয়ে এসেছিল আমাকে। আশ্চর্য, এখন সব মনে পড়ছে আমার। হঠাৎ করেই জনের কথা মনে পড়লো, কেন যেন মনে হচ্ছে এখন পাশের ঘরে ওর থাকা উচিত ছিল। পাশ ফিরে কোল বালিশটা আঁকড়ে ধরে ঘুমোবার চেষ্টা করলাম, কিন্তু ঘুম এল না কিছুতেই। অকারণেই ভয় ভয় করছে, অথচ সকালে ভেবেছিলাম বিন্দুমাত্র ভয় পাব না আজ রাতে। মনে ভয় ঢুকতেই আর ঘুমোবার চেষ্টা করলাম না। এবং তা করতে গিয়েই প্রচণ্ড বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে পড়লাম। এতক্ষণ ঘুমোবার চেষ্টা করেও ঘুমোতে পারিনি। অথচ এখন জেগে থাকতে গিয়ে টেনে খুলে রাখতে পারছি না দুচোখের পাতা। হঠাৎ বারান্দায় একটা অদ্ভুত শব্দ হতেই লাফ দিয়ে বিছানা থেকে উঠে গিয়ে দরজা খুলে চেঁচিয়ে উঠলাম, কে, কে ওখানে? সাড়া দিল না কেউ, কিন্তু হলপ করে বলতে পারি ওখান থেকেই এসেছে ওই অদ্ভুত শব্দটা।

মনে মনে একটু অস্বস্তি নিয়েই ফিরে এলাম বিছানায়। হঠাৎ বাগানের দিক থেকে ভেসে এল নেকড়ের ভয়ঙ্কর হিংস্র গর্জন। অবাক কাণ্ড! শহরের এই এখানটায় নেকড়ে এল কোত্থেকে! উঠে গিয়ে জানালার বদ্ধ কাঁচের শার্সি দিয়ে বাইরে উঁকি দিলাম। আবছা চাঁদের আলোয় চোখে পড়ল বাগানের ওপরের আকাশে চক্কর মারছে একটা বাদুড়। কিন্তু নেকড়ে বা ওই জাতীয় কিছুর ছায়াও চোখে পড়ল না বাগানের কোথাও। আমি জানালার কাছে এসে দাঁড়াতেই সাঁই করে একপাক ঘুরে জানালার ধারে উড়ে এল বাদুড়টা। ওটার জ্বলজ্বলে লাল দুটো চোখের দিকে চাইতেই পুরনো ভয়টা ফিরে এলো আবার আমার মনে। বাদুড়টার দিকে চাইতে আর সাহস হল না, ফিরে এলাম বিছানায়। প্রতিজ্ঞা করলাম কিছুতেই ঘুমোবো না আজ রাতে।

এমন সময় দরজা খুলে ঘরে এসে ঢুকলেন মা। আমাকে স্তব্ধ হয়ে বিছানায় বসে থাকতে দেখে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন তিনি, কি রে, অমন করে বসে বসে কি ভাবছিস? ঘুম আসছে না?

কি জানি কেন ভয় করছে, মা।

ঠিক আছে, বাকি রাতটা আজ তোর কাছেই কাটাব। এগিয়ে এসে আমার বিছানায় বসে ডাকলেন মা, আয় শুয়ে পড়।

আমি শুতেই আমার পাশে শুয়ে পড়লেন মা। হঠাৎ জানালার কাঁচের শার্সিতে ডানা ঝাঁপটানোর শব্দ হতেই চমকে উঠে নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করলেন, এই রাতের বেলা আবার মরতে এল কোন পাখি? বলেই কয়েক মুহূর্ত সেদিকে

তাকিয়ে থেকে আবার পাশ ফিরে শুলেন মা।

ঠিক তার পর পরই ঘটল ভয়ঙ্কর ঘটনাটা। বাগানের লতা ঝোপের ওপার থেকে ভেসে এল হাজার হাজার নেকড়ের ক্রুদ্ধ চাপা গর্জন। ঝন ঝন শব্দে টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে ঘরের মেঝেতে ছড়িয়ে পড়ল কঁচের শার্সিগুলো। ভাঙা শার্সির মধ্যে দিয়ে প্রঃ জোরে বইতে শুরু করল দমকা হাওয়া, থর থর করে কেঁপে উঠল খড়খড়িগুলো। একলাফে বিছানার ওপর উঠে বসলাম আমি আর মা।

জানালার দিকে চোখ পড়তেই প্রচণ্ড আতঙ্কে শিউরে উঠলাম। ভাঙা শার্সির মধ্যে দিয়ে আমাদের দিকেই ভয়ঙ্কর হিংস্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে একটা বিশাল নেকড়ে। আশ্চর্যবাড়া দেয়াল বেয়ে দোতলার জানালার কাছে নেকড়ে উঠল কি করে বুঝতে পারলাম না। চেঁচিয়ে উঠে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন মা। আর তার হাতের ঝটকা লেগে আমার গলা থেকে ছিঁড়ে পড়ে গেল প্রফেসর হেলসিং-এর পরিয়ে দেয়া রসুনের মালাটা। মালাটা ছিঁড়ে যেতেই হা হা শব্দে কুৎসিত হাসি হেসে উঠল কেউ। সেই হাসির শব্দের সাথে তাল মিলিয়ে ঝিক করে জ্বলে উঠল একটা চোখ-ধাধান তীব্র নীল আলো। সাথে সাথে বুক ভাঙা আর্তনাদ করে মেঝেয় লুটিয়ে পড়লেন মা। বাহতের মত স্তব্ধ হয়ে বিছানায় বসে দেখতে লাগলাম অবিশ্বাস্য ঘটনাগুলো।

মা মেঝেতে পড়ে যেতেই জানালা হতে অদৃশ্য হয়ে গেল নেকড়েটা। তার বদলে হু হু করে তীব্র বাতাস ঢুকতে শুরু করল ঘরে। সেই বাতাসে ভর করে ভেসে আসছে অজস্র চকচকে রূপালী ধূলিকণা। ঘরে ঢুকেই পাক খেয়ে ঘুরতে লাগল কণাগুলো। চোখের সামনে ওই ধূলিকণার ভেতর থেকে রূপ নিচ্ছে একটা বিশাল কালো মূর্তি। ওদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই ঘুমে জড়িয়ে এল দুচোখ। কিছুতেই খুলে রাখতে পারছি না চোখের পাতা। বহু চেষ্টা করেও আর বসে থাকতে না পেরে লুটিয়ে পড়লাম বিছানায়।

ঠিক কতক্ষণ পরে জানি না, আস্তে আস্তে চোখ মেলে চাইলাম। দূরের গির্জার ঢং ঢং ঘণ্টাধ্বনি কানে এসে বাজছে। বাগানের ওপাশে এসে একসাথে জড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে চেঁচাচ্ছে পাড়ার কুকুরগুলো। আর বাগানেরই কোন ঝোপের ভেতর বসে সমানে গান গেয়ে চলেছে একটা পাপিয়া।

উঠে বসার চেষ্টা করলাম, কিন্তু পারলাম না। বিন্দুমাত্র জোর পাচ্ছি না শরীরে। চেঁচিয়ে চাকরদের ডাকার চেষ্টা করলাম, ভালমত স্বর ফুটল না গলায়। বার কয়েক ডেকেও কারও সাড়া না পেয়ে অসহায়ভাবে চুপচাপ বিছানায় পড়ে থাকলাম। আরও কিছুক্ষণ পর বাইরের বারান্দায় কার পায়ের শব্দ পাওয়া গেল, তাহলে আমার ডাক কানে গিয়েছে কারও। কয়েক মুহূর্ত পরেই দরজা খুলে ঘরের ভেতর উঁকি দিল একটা চাকর। এবং দিয়েই চেঁচিয়ে উঠল ভয়ে।

জানালার ভাঙা কাঁচের শার্সি দিয়ে ঘরে ঢুকছে দমকা হাওয়া। বার বার একটার সাথে আরেকটা বাড়ি খেয়ে বিশ্রী শব্দ করছে খড়খড়িগুলো। কুৎসিত ভঙ্গিতে মেঝেতে পড়ে আছেন মা, মড়ার মত বিছানায় শুয়ে আছি আমি, এতসব দেখে ভয় পাবারই কথা চাকরটার।

চাকরটার চেঁচামেচিতে আরও একটা চাকর এসে হাজির হল। ঘরের অবস্থা দেখে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল সে-ও। ওদের সাহায্যে বিছানার ওপর উঠে বসলাম। মাকেও মেঝে থেকে তুলে পাশের বিছানায় শুইয়ে চাদর দিয়ে ঢেকে দিল ওরা। কাজ ঠিকই করছে কিন্তু আতঙ্ক দূর হচ্ছে না ওদের মন থেকে। অগত্যা নিচে থেকে খানিকটা করে ব্র্যাণ্ডি খেয়ে আসতে বললাম ওদেরকে, ভাবলাম তাহলে কিছুটা ধাতস্থ হবে। নিচে চলে গেল ওরা। কিন্তু আর ফিরে এল না। ব্যাপার কি? গায়ের জোর দিয়ে গলা ফাটিয়ে বার কয়েক ডেকে কোন সাড়া পেলাম না চাকর দুটোর কাছ থেকে। কোনমতে বিছানা থেকে নেমে দেখতে চললাম। নিচে গিয়েই পাওয়া গেল ওদেরকে, তবে অজ্ঞান হয়ে মেঝেতে পড়ে থাকা অবস্থায়। ভুল করে ব্র্যাণ্ডির বদলে মার ঘুমের ওষুধের বোতল থেকে ওষুধ খেয়ে ফেলেছে ওরা। বুঝতে পারছি এসবই ভয়ঙ্কর কোন দুর্যোগের পূর্বাভাস।

নিজের ঘরে ফিরে এলাম। মায়ের জ্ঞান ফিরেছে কিনা পরীক্ষা করতে গিয়েই টের পেলাম দুর্যোগটা কি। বুকের ভেতর থেকে একসাথে ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইছে চাপ চাপ কান্না। শেষ পর্যন্ত আর সইতে না পেরে ডুকরে কেঁদে উঠলাম। আমাকে ছেড়ে চিরদিনের মত চলে গেছেন মা।

ঠিক সেই মুহূর্তে আবার শোনা গেল বিশ্রী অট্টহাসির শব্দ। আবার বাগানের দিক থেকে একসাথে গর্জন করে উঠল হাজারো নেকড়ের দল। আবার জানালা দিয়ে ঘরে ঢুকতে শুরু করল সেই আশ্চর্য রূপালী ধূলিকণা। পরিষ্কার বুঝতে পারলাম, সময় শেষ হয়ে আসছে আমারও। কিন্তু তা বাইরের পৃথিবীটাকে জানিয়ে যাওয়া দরকার। তাড়াতাড়ি ড্রয়ার হাতড়ে ডায়েরী, খাতা আর কলম বের করে লিখতে বসলাম।

চোখের সামনে আবার কাল মূর্তির রূপ নিচ্ছে ধূলিকণাগুলো এখন থেকে যে কোন মুহূর্তে ঘটে যেতে পারে যা খুশি। ঈশ্বর, মৃত্যুর পর তোমার পায়ে ঠাই দিও আমাকে।

২.০২ রাতের খাওয়ার পর

ডাক্তার জন সেওয়ার্ডের ডায়েরী থেকে

১৭ সেপ্টেম্বর।

রাতের খাওয়ার পর পড়ার ঘরে বসে কয়েকদিনের জমান চিঠিপত্রগুলো দেখছিলাম। গত কয়েকদিনের কাজের চাপে ওগুলোর কথা প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম। এক মনে চিঠি পড়ছি, হঠাৎ ঝটকা মেরে দরজা খুলে ঝড়ের বেগে ঘরে এসে ঢুকল রেনফিল্ড। তরকারি কাটার ধারাল একটা ছুরি ওর হাতে। চোখের দৃষ্টি উদভ্রান্ত। ভয়ঙ্কর কোন উদ্দেশ্য নিয়েই এ ঘরে এসে ঢুকল সে। এক মুহূর্ত থমকে দাঁড়াল রেনফিল্ড, তারপর ছুরি বাগিয়ে ধরে সোজা ছুটে এল আমার দিকে। লাফ দিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াতে গেলাম। কিন্তু তার আগেই এসে পড়ল রেনফিল্ড। প্রচণ্ড জোরে ছুরিটা ঢুকিয়ে দিতে গেল সে আমার পেটে। হাত দিয়ে ঠেকাবার চেষ্টা করলাম। পেটটা বেঁচে গেল ঠিকই, কিন্তু এফোঁড় ওফোড় হয়ে ঢুকে গেল ওটা আমার কনুইয়ের কাছে মাংসে। টান মেরে ওখান থেকে ছুরি বের করে নিল রেনফিল্ড। সাথে সাথেই ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরিয়ে এল ক্ষতস্থান থেকে। আবার ছুরি মারার চেষ্টা করল রেনফিল্ড, কিন্তু আর সুযোগ দিলাম না ওকে। গায়ের জোর দিয়ে একটা ঘুসি মারলাম ওর চোয়ালে। ঘুসি খেয়ে ছিটকে মেঝেতে পড়ে গেল রেনফিল্ড, উঠে বসল পরমুহূর্তে। মেঝেতে পড়ে যাওয়া ছুরিটা দুলতে গিয়েই আমার হাত থেকে গড়িয়ে পড়া রক্তের দিকে চোখ পড়ল ওর। সাথে সাথেই পৈশাচিক উল্লাসে, চিক চিক করে উঠল ওর দুই চোখ! হামাগুড়ি দিয়ে মেঝেতে পড়ে থাকা রক্তটুকুর দিকে এগিয়ে এল সে, তারপর উবু হয়ে বসে জিভ বের করে চাটতে লাগল সেই রক্ত। ব্যাপার দেখে রি রি করে উঠল আমার সারা শরীর।

ততক্ষণে এক এক করে দারোয়ানগুলোও এসে পড়েছে। রেনফিল্ডকে চিৎ করে মেঝেতে ফেলে ওর হাত পা বেঁধে ফেলল। নিয়ে যাবার সময় বিড় বিড় করতে করতে গেল সে, কি শান্তি, কি শান্তি। আসলে রক্তই জীবন, রক্তেই প্রাণ।

আর দেরি না করে ক্ষতস্থানটা ব্যান্ডেজ করে নিলাম। ক্লান্তিতে ভেঙে আসছে সারা শরীর। ঘুমোতে যেতে হবে এখন।

১৮ সেপ্টেম্বর।

আজ সকালে প্রফেসর ভ্যান হেলসিং-এর পাঠান তারবার্তা পেলাম। তারবার্তার কথাগুলো অবশ্যই ক্রিসেন্টে থাকবে আজ রাতে। লক্ষ্য রাখবে রসুনের কোয়াগুলো যেন ঠিক জায়গায় থাকে। যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি পৌঁছানর চেষ্টা করছি আমি।

লুসিদের বাড়ি পৌঁছে গাড়ির ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে সদর দরজার কড়া নাড়লাম। কেউ সাড়া দিল না। বার কয়েক কড়া নেড়েও কেউ সাড়া না দেয়ায় অগত্যা ঘণ্টা বাজালাম। কিন্তু তবু কারও সাড়া নেই। এত বেলায় চাকরগুলো পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছ নাকি? আরও কিছুক্ষণ ডাকাডাকি করেও কারও সাড়া পেলাম না। একটু শঙ্কিত হলাম মনে মনে। কিছু ঘটেনি তো? অন্য কোন পথে বাড়িতে ঢোকা যায় কিনা খুঁজে দেখলাম, কিন্তু পেলাম না। বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবছি কি করা যায়, এমন সময় একটা গাড়ি এসে থামল সেখানে। লাফ দিয়ে গাড়ির ভেতর থেকে নামলেন প্রফেসর ভ্যান হেলসিং।

নেমেই আমাকে প্রশ্ন করলেন প্রফেসর, জন, এখন এলে নাকি? কেবল পাওনি ঠিকমত?

পেয়েছি। আজ সকালে। পেয়েই ছুটে এসেছি এখানে। আসার পর কি ঘটেছে বললাম ওকে। একবারও বাধা না দিয়ে আমার কথা শুনলেন প্রফেসর। তারপর মাথা থেকে হ্যাটটা খুলে দোলাতে দোলাতে বললেন, যেভাবেই হোক বাড়ির ভেতর ঢুকতেই হবে আমাদের। এসো তো দেখি।

একচক্কর বাড়িটা ঘুরে রান্নাঘরের জানালার সামনে এসে দাঁড়ালাম। ব্যাগ থেকে ছোট্ট একটা লোহা কাটা করাত বের করে আমার হাতে দিয়ে বললেন প্রফেসর, জানালার শিক কটা কেটে ফেলো তো।

প্রফেসরের হাত থেকে করাতটা নিয়ে কাজ শুরু করে দিলাম। জানালার পাল্লাগুলো ভেতর দিকে, কাজেই বাইরে থেকে শিক কাটতে কোন অসুবিধে হল না। অল্পক্ষণেই গোটা তিনেক শিক কেটে ফেললাম। শিক কাটা হলে একটা পাতলা ছুরির সাহায্যে দরজার খিল খুলে ফেললেন প্রফেসর। জানালা গলে ঘরের ভেতর ঢুকলাম আমরা। ঘরের মেঝেতে পড়ে নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছে একটা চাকর। বেশ কয়েকবার জোরে ধাক্কা দেবার পর আস্তে করে চোখ মেলল সে, যেন খুলতে পারছে না চোখের পাতা। আমাদেরকে দেখেই বার কয়েক চোখ মিট মিট করে উঠে বসল সে। এত বেলায়ও এমনভাবে ঘুমোচ্ছে কেন জিজ্ঞেস করেও কোন সন্তোষজনক উত্তর পেলাম না ওর কাছ থেকে। শুধু বলল, কি জানি, কখনোই তো এত বেলা পর্যন্ত ঘুমাই না। আজ যে কি হলো। ওকে আর কিছু না বলে খাবার ঘরের দিকে পা বাড়ালাম।

খাবার ঘরে ঢুকেই থমকে দাঁড়ালাম। আফিমের আরকের গন্ধে ভুর ভুর করছে সারাটা ঘর, আর জ্ঞান হারিয়ে মেঝেতে পড়ে আছে পরিচারক দুজন। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে প্রফেসরের মুখের দিকে চাইতেই দেখলাম থমথম করছে তার মুখ। গম্ভীর ভাবে বললেন তিনি, জলদি ওপরে চল। বলেই ছুটতে শুরু করলেন। তার পিছু পিছু এসে ঢুকলাম দোতলায় লুসির ঘরে।

চিৎ হয়ে মড়ার মত বিছানায় পড়ে আছে লুসি। পাশের খাটে আপাদমস্তক সাদা চাদরে মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে কে যেন, বোধহয় লুসির মা। একপাশে বিছানার ওপর ছিঁড়ে পড়ে আছে লুসির গলার রসুনের মালাটা। শয্যার পাশে কয়েক সেকেণ্ড পাথরের মূর্তির মত অনড় দাঁড়িয়ে থাকলেন প্রফেসর। তারপর আর একটু এগিয়ে গিয়ে শয্যায় শায়িত চাদরে মোড়া দেহের ওপর থেকে টান মেরে চাদরটা সরিয়ে ফেললেন। যা ভেবেছিলাম। চাদরের তলায় শুয়ে আছেন লুসির মা-ই। একনজর দেখলেই বোঝা যায়-মৃত। তবু সন্দেহ নিরসনের জন্যে একবার লুসির মার নাড়ী পরীক্ষা করে নিয়ে লুসির দিকে মন দিলেন প্রফেসর। ভুরু কুঁচকে কিছুক্ষণ লুসির হাতের নাড়ীটা টিপে ধরে রেখে হঠাৎ আমার দিকে চেয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন তিনি, নিচ থেকে একটা ব্র্যাণ্ডির বোতল নিয়ে এসো, জলদি!

বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে ছুটলাম। ব্র্যাণ্ডির বোতল এনে প্রফেসরের হাতে দিতেই বললেন, এক কাজ করো তো। ঠাণ্ডা পানির ছিটে দিয়ে জ্ঞান ফেরাবার ব্যবস্থা করাগে চাকর দুটোর। আর তাড়াতাড়ি একটু পানি গরম করে নিয়ে আসতে বলো রান্নাঘরের চাকরটাকে।

প্রায় ঘণ্টাখানেক চেষ্টা করে রীতিমত গলদঘর্ম হয়ে জ্ঞান ফেরালাম চাকর দুটোর। গরম পানি নিয়ে আগেই লুসির ঘরে চলে গেছে তৃতীয় চাকরটা। সদ্য জ্ঞান ফিরে পাওয়া চাকর দুটোকে আমার পেছন পেছন আসতে বলে ওপরে চলে এলাম। ঘরে ঢুকে দেখলাম গরম পানিতে কাপড় ভিজিয়ে সারা গায়ে ঘষে ঘষে লুসির শরীরের উত্তাপ ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছেন প্রফেসর।

তখনও জ্ঞান ফিরে আসেনি লুসির, হঠাৎ সদর দরজায় ঘণ্টা বাজার শব্দ শুনলাম। খানিকক্ষণ পরই চাকর এসে জানাল, আর্থার হোমউডের কাছ থেকে খবর নিয়ে এসেছে একজন লোক। লোকটাকে নিচের হলঘরে বসাবার জন্যে নির্দেশ দিলাম চাকরকে। বেরিয়ে যাচ্ছিল চাকরটা, ওকে ডেকে বললেন প্রফেসর, পাশের ঘরের বিছানাটা ঠিক করতে বলো তো কাউকে। আর লুসিকে পরাবার জন্যে শুকনো কাপড় নিয়ে এস।

চাকরটা পোশাক এনে দিতেই চাদরের তলায় রেখে কোনমতে লুসির পোশাক পালটে দিলেন প্রফেসর। তারপর দুজনে মিলে ধরাধরি করে পাশের ঘরে নিয়ে এলাম তাকে। চাকরটাকে লুসির কাছে থাকতে আদেশ দিয়ে আমাকে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলেন প্রফেসর। নিচে নামতে নামতে বললেন, কি যে করব এখন বুঝতে পারছি না। চল, দুজনে মিলে ভেবেচিন্তে যাহোক একটা কিছু উপায় বের করা যায় কিনা দেখি।

বলতে বলতেই খাবার ঘর থেকে ড্রইংরুমে এসে ঢুকলাম। ঘরের সবকটা জানালা বন্ধ। আবছা আলোয় ঘরের কিছুই ঠিকমত দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না। চিন্তিত ভাবে বললেন প্রফেসর, আমাদের দুজনের শরীর থেকেই রক্ত দেয়া হয়ে গেছে। অথচ এই মুহূর্তে রক্ত না পেলে লুসিকে বাঁচান যাবে না। এখন রক্ত কোথায় পাই…

প্রফেসরের কথা শেষ হবার আগেই ঘরের কোণের সোফা থেকে ভেসে এল একটা ভারি কণ্ঠস্বর, অত ভাবনা কিসের, প্রফেসর, আমি তো এসে গেছিই। একটু আগে হোমউডের খবর নিয়ে এসেছিল লোকটা, অথচ ওর কথা বেমালুম ভুলে বসে আছি আমরা। ওর কণ্ঠস্বর শুনে আশায় আনন্দে দুলে উঠল বুকটা। কারণ, ওই কণ্ঠস্বরের মালিককে ভাল মতই চিনি আমি। আমার প্রিয় বন্ধুকুইনসে মরিস।

ছুটে গিয়ে সোফা থেকে উঠে দাঁড়ান মরিসের হাতটা চেপে ধরে বললাম, খবর কি, মরিস? আর্থারের বাবা কেমন আছেন?

ভাল না। অবস্থা খুবই খারাপ। তা লুসি কেমন আছে, জন? গত তিন দিন নাকি ওর কোন খবরই জানে না আর্থার।

কথার উত্তর দিলেন প্রফেসর, লুসির অবস্থাও খুবই খারাপ, মরিস। তুমি সময় মত এসে না পড়লে বোধহয় বাঁচানই যেত না ওকে।

চিরদিনই সাধ্যমত বিপন্নকে সাহায্য করে এসেছি, প্রফেসর। আজও না হয় আর একজনকে করলাম। তা এখন কি করতে হবে আমাকে?

এস আমার সাথে, বলে দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন প্রফেসর, তার পিছু পিছু মরিস। দরজার কাছে গিয়ে ঘুরে দাঁড়ালেন প্রফেসর। আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ভাল কথা, জন, লুসির সাংঘাতিক অসুস্থতা আর ওর মায়ের মৃত্যুর সংবাদ জানিয়ে একটা তার করে দাও আর্থারকে। একটা গাড়ি নিয়ে যেয়ে পোস্টাফিসে, তাহলে তাড়াতাড়ি যেতে পারবে, বলেই মরিসকে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন তিনি। সময় নষ্ট না করে পোস্ট অফিসের দিকে চললাম আমি।

১৯ সেপ্টেম্বর।

অত্যন্ত ছটফট করে কাটিয়েছে লুসি গত রাতটা। কিছুক্ষণ পর পরই বোধহয় সাংঘাতিক কোন দুঃস্বপ্ন দেখে চমকে জেগে উঠেছে। সারাটা রাত পালা করে লুসিকে পাহারা দিয়েছি আমি আর প্রফেসর। ঘুরে ঘুরে বাড়ি পাহারা দিয়েছে কুইনসে মরিস। একটা জিনিস ভাল করে খেয়াল করেছি আমরা, জেগে থাকার চাইতে ঘুমিয়ে থাকলেই যেন অনেকটা স্বাভাবিক মনে হয় লুসিকে। আর ঘুমের মধ্যে কোন কারণে লুসির ঠোঁট দুটো ফাঁক হলেই ঠোঁটের দুপাশের ঝকঝকে সাদা তীক্ষ্ণ ধার দুটো দাঁত স্পষ্ট নজরে পড়েছে, অথচ হলপ করে বলতে পারি ওই দাঁত দুটো এর আগে কখনও দেখিনি।

সারারাত ছটফট করে বোধহয় অত্যন্ত ক্লান্ত হয়েই ভোরের দিকে গভীর ভাবে ঘুমিয়ে পড়ল লুসি। তার সেই ঘুম ভাঙল একেবারে বিকেল বেলা। ঘুম ভাঙলে প্রথমেই আর্থারের কথা জিজ্ঞেস করল সে। সকালবেলাই আর্থারকে আনতে মরিসকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন প্রফেসর, সে কথাই এখন জানালেন লুসিকে।

বিকেলের অস্তগামী সূর্যের সোনালী আলো জানালার কাঁচের শার্সি ভেদ করে ঘরে এসে পড়েছে। সে আলো লুসির স্নান চিবুকে এসে পড়ায় আরো রোগাটে দেখাচ্ছে তাকে। অল্প পরেই গির্জা থেকে ভেসে এল ছটা বাজার সময় সঙ্কেত, আর ঠিক এই সময় ঘরে এসে ঢুকল আর্থার। আমাদের কারও দিকে একটি বারের জন্যেও না তাকিয়ে আশ্চর্য শান্ত পায়ে লুসির বিছানার কাছে এগিয়ে গেল সে। ওকে লুসির কাছে একটু একলা থাকতে দিয়ে ঘর থেকে সবাই বেরিয়ে এলাম আমরা।

.

মিনা আরকারের ডায়েরী থেকে

১৭ সেপ্টেম্বর।

গতকাল হঠাৎ করেই রহস্যজনক ভাবে মারা গেলেন মিস্টার হকিন্স। মোটামুটি সেরে উঠলেও এখনও অত্যন্ত দুর্বল জোনাথন। মাত্র দিন কয়েক আগে ওকে নিয়ে মিস্টার হকিমের বাড়ি এসে উঠেছি। অসংখ্য এলম গাছ দিয়ে ঘেরা তার গির্জা সংলগ্ন বাড়িটা সত্যিই চমৎকার। আমরা এসে তাঁর বাড়িতে ওঠায় দারুণ খুশি হয়েছিলেন নিঃসন্তান আর একেবারে নিরাত্মীয় মিস্টার হকিন্স। জোনাথন কাউন্ট ড্রাকুলার প্রাসাদ দুর্গ থেকে ফিরে আসার পর পরই তাকে নিজের ব্যবসার অংশীদার করে নিয়েছিলেন মিস্টার হকিন্স, অবশ্য জোনাথন অসুস্থ থাকায় ওর হয়ে সবটা ব্যবসা একাই দেখাশোনা করেছিলেন তিনি। এহেন পিতৃস্থানীয় লোকের মৃত্যুতে সত্যিই ব্যথা পেয়েছে জোনাথন। আর সত্যি বলতে কি, ওই স্নেহময় লোকটার কথা মনে হলেই চোখ ফেটে পানি বেরিয়ে আসছে আমারও।

কি করে যে মারা গেলেন মিস্টার হকিন্স তা বুঝতে পারছি না। গত রাতেও খাওয়ার সময় তাঁকে দিব্যি সুস্থ মনে হয়েছে, অথচ আজ সকালবেলা নিজের ঘরের বিছানায় মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে তাকে।

আর কেন জানি আজ বার বার সুসির কথা মনে পড়ছে। অনেকদিন তার খোঁজখবর নেয়া হয়নি। ডায়েরীটা লেখা শেষ করেই তার কাছে চিঠি লিখতে হবে একটা।

.

ডাক্তার জন সেওয়ার্ডের ডায়েরী থেকে

২০ সেপ্টেম্বর।

চাকরটার ডাকাডাকিতে ঘুম ভেঙে গেল। উঠে বসে হাতঘড়িতে দেখলাম ভোর ছটা বাজে। আমি উঠে বসতেই চাকরটা জানাল আমাকে ডাকছেন প্রফেসর। ব্যাপার কি দেখার জন্যে তাড়াতাড়ি সুসির ঘরে এসে ঢুকলাম। ঘরের সব কটা জানালা বন্ধ। পর্দাগুলো পর্যন্ত টাঙান থাকায় ভোরের আলো ঢুকতে পারছে না সে ঘরে। রসুনের অসহ্য তীব্র গন্ধে ভারি হয়ে আছে ঘরের আবহাওয়া।

আমি ঘরে ঢুকতেই জানালাগুলো খুলে দিতে বললেন আমাকে প্রফেসর। এগিয়ে গিয়ে জানালাগুলো খুলে দিতেই ঘরে এসে পড়ল ভোরের সোনালী রোদ। খোলা জানালা দিয়ে আসা নির্মল হাওয়ার ঝাঁপটা কয়েক মুহূর্তেই ঘর থেকে ঝেটিয়ে বের করে নিয়ে গেল রসুনের অসহ্য গন্ধ।

এতক্ষণ ঘর অন্ধকার থাকায় প্রফেসরকে ভালমত দেখতে পাইনি, এখন ওঁর দিকে তাকাতেই দেখলাম, লুসির বিছানার পাশে পাথরের মূর্তির মত নিশ্চল দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। ওঁর চেহারা দেখেই অনুমান করা যায় খবর ভাল না। সুসির দিকে চেয়ে বুঝলাম ঠিকই অনুমান করেছি। আরো ফ্যাকাসে হয়ে গেছে ওর গায়ের রঙ। চোয়াল বসে গিয়ে ঠেলে বেরিয়ে এসেছে চিবুকের হাড়। শ্বাস নিতে অত্যন্ত কষ্ট হচ্ছে ওর। আর একটা আশ্চর্য ব্যাপার, গতকাল কথা বলার সময়ই শুধু তীক্ষ্ণ দাত দুটো দেখা গিয়েছিল। কিন্তু আজ বদ্ধ ঠোঁটের দুকোণ থেকে ঠেলে বাইরে বেরিয়ে এসেছে দাঁত দুটো। গলার দগদগে ক্ষতচিহ্ন দুটোও যেন রাতারাতি মিলিয়ে গেছে। দেখে আদৌ বোঝা যাবে না মাত্র গতকালও ক্ষত ছিল ওর গলার ওই জায়গায়।

স্তব্ধ বিস্ময়ে তাকিয়ে ছিলাম লুসির দিকে, চমক ভাঙল প্রফেসরের কথায়। আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন তিনি, লুসির সময় ঘনিয়ে এসেছে, জন। আর্থারকে জলদি ডেকে নিয়ে এস।

মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিয়ে নিঃশব্দে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলাম। আর্থারের কাঁধে মদু ঝাকুনি দিয়ে ঘুম ভাঙালাম ওর। শুয়ে শুয়েই বার কয়েক চোখ রগড়াল সে, তারপর চাইল আমার মুখের দিকে। সেখানে কি দেখল কে জানে, তড়াক করে উঠে বসল বিছানার ওপর। বসে থেকেই আমার হাত দুটো চেপে ধরে থর থর করে কেঁপে উঠল একবার। আমার মুখ দেখেই যা বোঝার বুঝে নিয়েছে সে।

আস্তে করে ওর হাত দুটো ছাড়িয়ে নিয়ে সান্ত্বনা দেবার সুরে বললাম, নিয়তির ওপর তো মানুষের কোন হাত নেই, আধার। তুই, আমি, আমরা পুরুষ মানুষ। যত দুঃখই আসুক না কেন ভেঙে পড়লে চলবে না আমাদের। আয়, ওঠ, দেরি করলে হয়ত সুসির সাথে শেষ দেখাটাও করতে পারবি না।

প্রায় জোর করে ওকে বিছানা থেকে তুলে নিয়ে চললাম। লুসির সামনে গিয়ে স্থির থাকতে পারবে না ভেবেই বোধহয় যেতে চাইছে না ও। লুসির ঘরে ঢুকে দেখলাম, নিজেকে অনেকটা সামলে নিয়েছেন প্রফেসর। যদূর সম্ভব ঘরটাকেও গোছগাছ করে ফেলেছেন। শুধু তাই নয়, লুসির অগোছালো চুলগুলোকে পর্যন্ত হাত দিয়ে একটু ঠিকঠাক করে দিয়েছেন। আর্থারকে দেখেই স্নান কণ্ঠে বলে উঠল লুসি, এস আর্থার। এ সময়ে তোমাকেই কামনা করছিলাম মনে মনে। তুমিও বোধহয় বুঝতে পারছ, সময় শেষ হয়ে এসেছে আমার।

ধীরে ধীরে বিছানার পাশে এগিয়ে গিয়ে ধপ করে বসে পড়ল আর্থার। দুহাতে তুলে নিল লুসির রোগজীর্ণ দুটো হাত। রক্তশূন্য ফ্যাকাসে কপালের নিচে বসে যাওয়া কোটর থেকে স্থির দৃষ্টিতে আর্থারের দিকে চেয়ে আছে লুসির গভীর প্রেমপূর্ণ কিন্তু বেদনার্ত বড় বড় চোখ। কয়েক সেকেণ্ড একভাবে তাকিয়ে থেকে একটুক্ষণের জন্যে চোখের পাতা মুদে বার কয়েক জোরে জোরে শ্বাস নিল লুসি। ধীরে ধীরে আশ্চর্য একটা পরিবর্তন আসতে থাকল লুসির চেহারায়। কেমন যেন একটু কঠোর মনে হচ্ছে এখন ওর চেহারা। ঠোঁটের কোণ থেকে আরও বেরিয়ে এসেছে সেই দাঁত দুটো। একটু পরই আবার চোখ মেলল সে। কিন্তু প্রেম আর বেদনার পরিবর্তে সে চোখে এসে ভর করেছে এখন রাজ্যের লালসা। আবার কথা বলল লুসি, এস আর্থার, শুধু একবার, একবার চুমো খাও তোমার লুসিকে। কামনা মদির সে কষ্ঠে আশ্চর্য ব্যাকুলতা। এমন তো হবার কথা নয়। লুসির মত মৃত্যু পথ যাত্রিণীর মুখে কথাটা, আর তার বলার ধরন কেমন যেন বেমানান মনে হল আমার কাছে।

আমার মতই লুসির কথা শুনে চমকে উঠলেন প্রফেসরও। ধীরে ধীরে লুসির মুখের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে আর্থারের মুখ। অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে লুসি। উত্তেজনায় ফাঁক হয়ে গেছে ওর দুটো ঠোঁট, আর সে ঠোঁটের ফাঁক থেকে হিংস্র ভঙ্গিতে সম্পূর্ণ বেরিয়ে এসেছে অমানবিক তীক্ষ্ণ দাঁত দুটো।

আর্থারের মুখের সাথে মুসির মুখ লাগে লাগে এমন সময় বাঘের মত লাফ দিয়ে সামনে এগিয়ে গেলেন প্রফেসর। খপ করে আর্থারের চুলের মুঠি ধরে টেনে ওর মাথাটা সরিয়ে আনলেন পেছনে, যেন লুসিকে চুমো খেতে না পারে।

প্রফেসরের ব্যবহারে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম আমি। আর্থারও। ওর বেদনাহত মুখের দিকে তাকিয়ে কোমল স্বরে বললেন প্রফেসর, দুঃখ পেয়ো না, আর্থার। তোমার ভালর জন্যেই করলাম কাজটা। এখনকার লুসি আর তোমার সেই আগের প্রেমিকা নেই। শয়তানের ছোঁয়ায় এখন একটা ডাইনীতে রূপান্তরিত হয়েছে সে। এই মুহূর্তে ওকে চুমো খেলে তোমাকেও হারাতে হবে আমাদের।

প্রফেসরের কথা শুনে একবারের জন্যে দপ করে জ্বলে উঠল লুসির দুই চোখ। যেন চোখের দৃষ্টি দিয়ে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ভস্মীভূত করে দিতে চাইছে সে প্রফেসরকে। তারপরই আস্তে করে দ্বিতীয়বারের জন্যে চোখ মুদলো লুসি। শ্বাস টানার তালে তালে বার কয়েক জোরে জোরে দুলে উঠেই একেবারে থেমে গেল বুকের ওঠানামা। উবু হয়ে লুসিকে একবার পরীক্ষা করেই বিড়বিড় করে রায় দিলেন প্রফেসর, সব শেষ।

সঙ্গে সঙ্গেই ছেলে মানুষের মত-ডুকরে কেঁদে উঠল আর্থার। জোর করে ঠেলে ওকে ঘর থেকে বের করে নিয়ে চলে এলাম পাশের ঘরে একটা সোফায় বসে পড়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল সে। অসহ্য বেদনায় টন টন করে উঠল আমারও বুকের ভেতরটা। আমিও তো ভালবেসেছিলাম লুসিকে।

বেশ কিছুক্ষণ পর লুসির ঘরে ফিরে এসে দেখলাম শয্যার ওপর ঝুঁকে পড়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে লুসিকে পরীক্ষা করছেন প্রফেসর। মৃত্যু যেন লুসির দেহের সমস্ত লাবণ্য আবার অকৃপণ হাতে ফিরিয়ে দিয়েছে।

আমার উপস্থিতি টের পেয়ে ঘুরে দাঁড়ালেন প্রফেসর। এগিয়ে এসে সয়েহে আমার কাধে একটা হাত রেখে বললেন, ব্যথা হয়ত পেয়েছ, জন, কিন্তু যদি জানতে কত বড় দুঃসহ যন্ত্রণা আর বীভৎসতার হাত থেকে ও মুক্তি পেয়েছে আজ তাহলে ও মারা গেছে ভেবে দুঃখ না করে বরং খুশিই হতে।

কিন্তু, স্যার, এভাবে হঠাৎ করে আমাদের মাঝ থেকে সে চলে যাবে ভাবতেই পারিনি।

চলে গেছে? কে বলল চলে গেছে?

প্রফেসরের কথার ধরনে আশ্চর্য হলাম। বুঝতে না পেরে প্রশ্ন করলাম, যায়নি?

না যায়নি। গেছে শুধু তার কোমল রূপটা। আবার সে আমাদের মাঝে ফিরে আসবে, কিন্তু অতি ভয়ঙ্কর সাংঘাতিক হিংস্ররূপে।

কি বলছেন, স্যার, কিছু বুঝতে পারছি না।

পারবে, সময় হলে ঠিকই বুঝতে পারবে সব। কিন্তু তার আগেই আমাদের তৈরি হতে হবে, জন। না হলে আরো বড় সর্বনাশ ঘটে যাবার আশঙ্কা আছে।

২১ সেপ্টেম্বর।

একটু আগে ওঁর বাবার মৃত্যু সংবাদ পেয়ে বাড়ি চলে গেছে আধার। অতএব লুসির কোন আত্মীয়স্বজন না থাকায় স্বাভাবিক ভাবেই ওর আর ওর মার শেষকৃত্যের দায়িত্বটা এসে পড়ল আমার ঘাড়ে। সারাক্ষণ পাশে পাশে থেকে আমাকে সাহায্য করছেন প্রফেসর। ওদের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় কাকে কাকে আমন্ত্রণ জানাব, কোথায় কবর দেব ভেবে ঠিক করতে পারছিলাম না, উদ্ধার করলেন প্রফেসর। তিনি বললেন, এত ভাবাভাবির কি আছে। লুসিদের পারিবারিক চিঠিপত্র দেখলেই ওসব অনুমান করা যাবে। ওদের উকিলকেও খবর দেয়া দরকার। তার আগে চল তো ঘরগুলো একবার খুঁজে দেখি।

ওদিকে, আমস্টারডামে আপনার কোন জরুরী কাজ পড়ে নেই তো?

না, নেই। আর থাকলেই বা কি? এখানকার এই ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিতে শত কাজ থাকলেও আমি ফিরে যেতে পারব না।

লুসির ঘরে খুঁজতে খুঁজতে হঠাৎ অস্ফুট শব্দ করে উঠলেন প্রফেসর। উদ্বিগ্ন ভাবে জিজ্ঞেস করলাম আমি, কি হল, স্যার?

প্রফেসরের মুখে হালকা হাসির ছাপ। আমাকে একটা খাতা দেখিয়ে বললেন তিনি, এটা পেয়ে যাওয়ায় ভালই হল, আমাদের অনেক উপকারে লাগবে।

কি ওটা? অবাক হয়ে জানতে চাইলাম।

লুসির ডায়েরী।

কোথায় পেলেন ওটা?

লুসির বালিশের তলায়। বলে একটুক্ষণ কি যেন ভাবলেন তিনি। তারপর বললেন, একটা কথা, জন, আমরা যদি এভাবে লুসিদের বাড়ি তল্লাশি করতে থাকি কারও কিছু বলার নেই তো?

না, না, কার কি বলার থাকবে? আর আপনি বোধহয় জানেন না, প্রফেসর, বিয়ের কথাবার্তা পাকাঁপাকি হরার পর পরই তার স্থাবর অস্থাবর সমস্ত সম্পত্তি আর্থারের নামে উইল করে দিয়েছিল লুসি। অবশ্য লুসির মৃত্যুর পরই সমস্ত সম্পত্তির অধিকার পাবে আর্থার, দলিলে একথাই লেখা ছিল। এখন আইনতঃ লুসির সমস্ত সম্পত্তির মালিক আর্থার। আমাদেরকে কিছু বলার অধিকার একমাত্র আর্থারেরই আছে। আর প্রাণ গেলেও আমাদের কাজে বাধা দেবে না সে, একথা হলপ করে বলতে পারি আমি।

আমার কথায় আশ্বস্ত হয়ে আবার খোঁজাখুঁজি শুরু করলেন প্রফেসর। খুব একটা কষ্ট করতে হল না। অল্প পরেই মিসেস ওয়েস্টেনরার ঘরের একটা আলমারির ভেতর পেয়ে গেলাম যা খুঁজছিলাম। কাজ সেরে ঘর থেকে বেরোবার সময় বললেন প্রফেসর, উহুঁ, কি ধকলটাই না গেল! এবার একটু বিশ্রাম দরকার আমাদের। কাল ভোরে উঠেই তো আবার খাটুনি শুরু হবে। ফেরার আগে আর একবার লুসিকে দেখতে গেলেন প্রফেসর, তার সাথে সাথে আমিও। চামেলির মিষ্টি গন্ধ ঘরের বাতাসে। তার সাথে এসে যোগ হয়েছে ধূপের সুবাস। অর্থাৎ এক কথায় যদূর সম্ভব শুচিশুদ্ধ করে তোলা হয়েছে লাশ রাখা ঘরটাকে। ধবধবে সাদা চাদরে ঢাকা লুসির সর্বাঙ্গ। এগিয়ে গিয়ে আস্তে করে চাদরের এক প্রান্ত উন্মোচিত করলেন প্রফেসর। স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলাম লুসির মুখের অপূর্ব সৌন্দর্য। যেন মরেনি সি, দীর্ঘদিন একটানা রোগভোগের পর শান্তিতে ঘুমোচ্ছ। ওর মুখের লাবণ্য কঠোর হাতে ছিনিয়ে নেয়নি মৃত্যু। বরং দুহাতে মুঠো ভরে দিয়েছে। এমন আজব কথা দেখা তো দূরের কথা, কখনো কারও মুখে শুনিনি পর্যন্ত।

কিন্তু ওই রূপকথার ঘুমন্ত রাজকন্যার মত চেহারার দিকে তাকিয়ে কিন্তু খুশি হতে পারলেন না প্রফেসর। থমথমে গভীর ওঁর মুখের চেহারা। পাথরের মত রুক্ষ কঠিন। তাহলে আর সব সাধারণ লাশের মত লুসির লাশ পচতে গলতে শুরু করলেই খুশি হতেন তিনি? বেশ কিছুক্ষণ একভাবে লুসির দিকে তাকিয়ে থাকার পর মুখ খুললেন প্রফেসর। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, এখানে একটু অপেক্ষা কর তুমি, আমি এক্ষুণি আসছি, বলে দ্রুত ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন তিনি।

অল্পক্ষণ পরেই ফিরে এলেন প্রফেসর। হাতে এক মুঠো রসুন। রসুনগুলো লুসির বিছানার চারপাশে ছড়িয়ে দিলেন তিনি। নিজের গলা থেকে ছোট্ট একটা সোনার কুশ খুলে নিয়ে রাখলেন লুসির বুকের ওপর। একটা অদ্ভুত জিনিস পলকের জন্যে চোখে পড়ল তখনই, কিংবা আমার চোখের ভুলও হতে পারে। কুশটা সুসির বুক স্পর্শ করতেই মনে হল চকিতের জন্যে একবার কুঞ্চিত হয়েই সোজা হয়ে গেল লুসির কপালের চামড়া। ব্যাপারটা প্রফেসরের চোখে পড়েছে কিনা তা তার মুখ দেখে আন্দাজ করতে পারলাম না। কাজ শেষ করে ধীরে ধীরে চাদরটা দিয়ে আবার লুসির মুখ ঢেকে দিলেন প্রফেসর। তারপর আমার দিকে ফিরে বললেন, চল, এখনকার মত কাজ শেষ। তবে কাল রাতের বেলা আবার একবার লুসিকে পরীক্ষা করে দেখতে হবে আমার।

কাল রাতে! অত্যন্ত আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করলাম।

ঘরে চল, বলছি।

ঘরে এসে জামা কাপড় বদলে দুটো চেয়ারে সামনাসামনি বসার পর বললেন প্রফেসর, আগামীকাল রাতের আগে অস্ত্রোপচারের এক সেট যন্ত্রপাতি জোগাড় করে দিতে পার আমাকে?

আরও অবাক হয়ে প্রশ্ন করলাম, যন্ত্রপাতি দিয়ে কি হবে? কার শরীরে অস্ত্রোপচার করবেন আপনি?

লুসির শরীরে।

যা ভাবা উচিত নয় তাই ভেবে বসলাম। পাগল হয়ে গেলেন নাকি প্রফেসর? বোধহয় আমার মনের ভাব টের পেয়েই মৃদু হাসলেন তিনি। বললেন, এতে অবাক হবার কিছু নেই, জন। অস্ত্রোপচার ঠিকই করব, কিন্তু প্রচলিত ডাক্তারী পদ্ধতিতে নয়। এ জন্য বিদ্যে। একটু থেমে আবার বললেন, ঠিক আছে, তোমার সাহায্য যখন দরকার, তোমাকে খুলেই বলি ব্যাপারটা। কিন্তু, খবরদার ঘুণাক্ষরেও যেন কেউ কথাটা জানতে না পারে। প্রথমে লুসির মাথাটা কেটে শরীর থেকে আলাদা করে ফেলব আমি। এরপর বুক চিরে ছিঁড়ে বের করে আনব হৃৎপিণ্ড। ওকি, ওরকম শিউরে উঠলে কেন? তুমি না ডাক্তার? মানুষ কাটার বিদ্যে না তুমি রীতিমত সাধনা করে শিখে এসেছ? তাছাড়া এর আগে একাধিক জীবন্ত মানুষের শরীরে কি তুমি স্থির নিষ্কম্প হাতে ছুরি চালাওনি? মরা মানুষের বেলায় তোমার এত ভয় কেন?

চালিয়েছি, স্যার, তবে সে জীবন বাঁচাবার জন্যে। কিন্তু আপনি যা করতে বলছেন, এ যে রীতিমত পৈশাচিকতা।

পিশাচের হাত থেকে বাঁচতে হলে পৈশাচিকতার দরকার আছে, জন। হ্যাঁ, এখন মন দিয়ে শোন আমার কথা। তোমার ভয় পাওয়ার বা মন খারাপ করার কিছু নেই। কারণ কাজটা করব আমি। নিজের হাতে। তুমি শুধু সাহায্য করে যাবে আমাকে। সম্ভব হলে আজই করতাম। কিন্তু কাল সমাধি অনুষ্ঠানের আগে এসে নিশ্চয়ই লুসিকে দেখতে চাইবে আর্থার। তখন তাকে ব্যাপারটার গুরুত্ব বোঝান সম্ভব নাও হতে পারে। তোমাকে যা বলেছি, যেভাবেই হোক এক সেট যন্ত্রপাতি জোগাড় কর তুমি। কাল লুসির সমাধি অনুষ্ঠান শেষ হয়ে গেলে রাতের বেলায় চুপি চুপি তুমি আর আমি কবরখানায় ঢুকে আমাদের কাজ শেষ করে আসব। বুঝেছ?

না, একটু ক্ষুন্ন হয়েই জবাব দিলাম। আসলে কি করতে চাইছেন আপনি, স্যার? লুসির ওই সুন্দর মৃতদেহটাকে শুধু শুধু কাটাছেঁড়া করে কি লাভ? বিজ্ঞান বা মানুষের কোন উপকারেই তো এটা লাগবে না।

লাগবে, স্থির শান্ত গলায় জবাব দিলেন প্রফেসর। তারপর আমার কাঁধে একটা হাত রেখে ধীরে ধীরে বলতে লাগলেন তিনি, কিন্তু তা বোঝার সময় তোমার হয়নি এখনও। ব্যথা পেয়ো না, জন। বুঝতে পারছি তোমার এককালের ভালবাসার পাত্রীর শরীরটা পৈশাচিক ভাবে ছিন্নভিন্ন করতে যাচ্ছি জেনে ব্যাপারটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছ না তুমি। কাজটা করতে আমারও যে কতটা খারাপ লাগবে তা তোমাকে বলে বোঝাতে পারব না আমি। আমাকে তো তুমি ভালমতই জান, জন। অকারণে একটা কুটোও এদিক থেকে ওদিকে সরাই না আমি। তাছাড়া অতীতে যখনই তোমার কোন চরম দুর্যোগ উপস্থিত হয়েছে, প্রথমেই কি আমাকে মনে পড়েনি তোমার? সেসব দিনেও তো আমাকে অনেক খাপছাড়া কাজ করতে দেখেছ তুমি। তাহলে? তাহলে আমার কথা মেনে নিতে পারছ না কেন? মনে পড়ছে কি, লুসির মৃত্যু সময়ে লুসির ঠোঁটে চুমু খেতে যাবার আগে আর্থারকে জোর করে টেনে সরিয়ে নিয়েছিলাম আমি? অবাক হয়ে গিয়েছিলে তোমরা, হয়ত কিছুটা বিরক্তও। কিন্তু জান না সেদিন কত বড় সর্বনাশের হাত থেকে আর্থারকে টেনে সরিয়ে এনেছি আমি। সে সময়কার লুসির চোখের ভাষা কি পড়তে পেরেছিলে তোমরা? পারনি। কারণ সে-চোখ তোমাদের নেই। কারও রহস্যময় অঙ্গুলি হেলনে আর্থারকে চুমো খেতে বাধ্য করছিল লুসি, নিজের অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও। কিন্তু আর্থারকে যখন টেনে সরিয়ে নিলাম, লুসির চোখের নীরব ভাষা আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানিয়েছিল আমাকে। কারণ আমি তার প্রিয়তমকে শয়তানের ক্লেদাক্ত অশুচি স্পর্শ থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছিলাম। আমি জানি, শীঘ্রই আবার আঘাত হানবে সে শয়তান, আর তার জন্যেই আমার এ প্রচেষ্টা। যে করেই হোক আর্থারকে বাঁচাতেই হবে আমাকে।

একটু জিরিয়ে নিয়ে আবার বলতে শুরু করলেন প্রফেসর, গত কয়েক সপ্তাহ ধরেই ঘটে চলেছে নানারকম বিদঘুটে অস্বাভাবিক ঘটনা। এ কয়দিন যদি আমার ওপর বিশ্বাস রাখতে পারলে তাহলে আজ পারছ না কেন? জোর করলে হয়ত প্রয়োজনের খাতিরে সব বলতে হবে তোমাকে আমার, কিন্তু তার ফল খারাপ ছাড়া ভাল হবে না। শুধু তোমার সাহায্য আমার দরকার বলেই এত কথা বলতে হচ্ছে আমাকে। যদি শেষ পর্যন্ত তোমার সাহায্য না পাই তাহলে একাই এগোব আমি। দুনিয়ার কোন শক্তিই আমাকে রুখতে পারবে না, দৃঢ় আত্মপ্রত্যয়ে গম গম করে উঠল প্রফেসরের কণ্ঠ। কয়েক সেকেন্ড আমার মুখের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে কোমল গলায় বললেন তিনি, আগেও বলেছি, এখনো বলছি, আমাদের সামনে অপেক্ষা করছে ভয়ঙ্কর এক পৈশাচিক ভবিষ্যৎ। আর তার জন্য আগে থেকেই কোমর বেঁধে তৈরি হতে হবে আমাদের। সামান্য ভুলের জন্যে বা সময়ের হেরফেরে সর্বনাশ হয়ে যেতে পারে। অতএব, এখন থেকেই আমাদের অন্ততঃ নিজেদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি ঘটতে দেয়া চলবে না। এর পর আর কোন কথা আহে তোমার?

এরপর আর কথা থাকতে পারে না। একটু আগে এই লোককেই মনে মনে পাগল ঠাউরেছি ভেবে অনুশোচনায় ভরে গেল মন। এতদিন ঘনিষ্ঠ ভাবে থেকেও ওই অসাধারণ প্রতিভাবান লোকটাকে চিনতে ভুল করেছি আমি? ছিঃ ছিঃ! চেয়ার থেকে উঠে গিয়ে সোজা প্রফেসরের পায়ে হাত দিয়ে মাফ চাইলাম, প্রতিজ্ঞা করলাম, জীবনে আর তার কোন কাজেরই কৈফিয়ত চাইব না আমি।

আমার কথায় অত্যন্ত খুশি হলেন প্রফেসর। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বিদায় নিয়ে চলে গেলেন নিজের ঘরে বসে বসে চুপচাপ আকাশ পাতাল ভাবতে থাকলাম আমি।

২২ সেপ্টেম্বর।

ভোরবেলা প্রফেসরের ডাকে ঘুম ভেঙে উঠে বসলাম বিছানার ওপর। আমি উঠে বসলে এগিয়ে এসে একটা চেয়ারে বসলেন প্রফেসর। তাড়াতাড়ি বাথরূম সেরে এসে ওর সামনে বসতেই বললেন তিনি, তোমাকে অস্ত্রোপচারের যন্ত্রপাতি যোগাড় করতে বলেছিলাম না, তার আর দরকার নেই।

নেই! কেন? অবাক হয়েই প্রশ্ন করলাম।

কারণ, দেরি হয়ে গেছে অনেক, বলে পকেট থেকে একটা ছোট্ট সোনার কুশ বের করে আমাকে দেখালেন প্রফেসর। এটা চিনতে পার?

এটা তো কাল লুসির বুকে রেখে দিয়েছিলেন!

হ্যাঁ, দিয়েছিলাম। কিন্তু তারপর চুরি হয়ে যায়। চুরি করেছিল ওদের বাড়িরই একজন চাকর। আর তার শাস্তিও সে পেয়েছে।

শাস্তি পেয়েছে?

নিচের তলায় রান্নাঘরের মেঝেতে মরে পড়ে আছে চাকরটা। সারা শরীর ক্ষতবিক্ষত। দেখলে মনে হয় একাধিক কুকুর জাতীয় হিংস্র পশুর দাঁত-নখের আঘাতে মৃত্যু হয়েছে ওর। আর তার পাশেই পড়ে ছিল এই ক্রুশটা।

তাহলে! এখন কি করব আমরা? বিমূঢ়ের মত প্রশ্ন করলাম।

আপাততঃ অপেক্ষা করা ছাড়া আর কিছু করার নেই। তবে খুব বেশিদিন আমাদের অপেক্ষা করতে হবে বলে মনে হয় না, বলে উঠে দাঁড়ালেন তিনি। এখন তৈরি হয়ে নাও তো। ওদিকে আবার অনেক কাজ পড়ে আছে। নতুন আর এক প্রহেলিকার মধ্যে আমাকে ফেলে রেখে নিঃশব্দে ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে গেলেন প্রফেসর।

অত্যন্ত ব্যস্ততার মাঝে কাটল সারাটা দিন। হ্যাম্পস্টেড কবর-খানায়লুসিদের ব্যক্তিগত কবর তৈরি করে রেখে গেছেন সুসির পূর্বপুরুষরা। মিসেস ওয়েস্টেনরার আলমারিতে পাওয়া নথিপত্রেই একথা জানতে পেরেছেন প্রফেসর। সেই কবরখানায় কফিন বয়ে নেবার সময় ধার্য করা হল বিকেল সাড়ে পাঁচটায়। আর্থারের জন্যেই এ সময়টা ঠিক করা হল। কারণ পাঁচটার আগে কিছুতেই এসে পৌঁছতে পারবে না সে। আর তাকে ফেলে লুসিকে সমাধিস্থ করার কথায় মন সায় দিল না কিছুতেই।

কাঁটায় কঁটায় বিকেল পাচটায় এসে পৌঁছল আর্থার। ওর দিকে আর তাকানই যায় না। একদিকে প্রেমিকা, অন্যদিকে বাবার মৃত্যুতে একেবারে ভেঙে পড়েছে বেচারা। ওকে আমার সাথে আসতে বলে লাশ রাখা ঘরের দিকে রওনা দিলাম আমি। নিঃশব্দে আমার পেছন পেছন হেঁটে এসে লাশঘরে ঢুকল আর্থার। ঘরে ঢুকেই শিশুর মত কেঁদে উঠল সে। কাঁদতে কাঁদতেই বলল, এ বিশাল পৃথিবীতে আপনার বলতে আমার আর কেউই রইল না, জন। বলতে পারিস এখন কি করব আমি?

কি বলে সান্ত্বনা দেব ওকে? আস্তে করে ওর দুকাঁধে আমার দুহাত রেখে ওকে টেনে আনলাম নিজের দিকে। নিবিড় ভাবে আমাকে জড়িয়ে ধরে আবার হু হু করে কেঁদে উঠল আর্থার। আমার নিজের চোখও আর শুকনো রইল না। নিঃশব্দে টপ টপ করে অশ্রু ঝরে পড়তে লাগল আমার দুগাল বেয়ে।

বেশ খানিকক্ষণ পর আর্থারের আলিঙ্গন মুক্ত হয়ে আস্তে করে বললাম, কেঁদে আর কি হবে, আর্থার, এখন শেষবারের মত একবার লুসিকে দেখবি, চল।

নিঃশব্দে লুসির শয্যা পাশে এসে দাঁড়ালাম দুজনে। আস্তে করে লুসির মুখের ওপর থেকে চাদরটা সরিয়ে দিলাম আমি। আগের চেয়ে হাজার গুণ বেড়ে গেছে সুসির রূপ। দেখে মনে হচ্ছে ছত্রিশ হাজার রাক্ষসের দেশের সেই মায়াবী যাদুকর সোনার কাঠির ছোঁয়ায় ঘুম পাড়িয়ে রেখেছে অপূর্ব সুন্দরী রাজকুমারীকে। যে কোন মুহূর্তে ওর কাঠির ছোঁয়ায় আবার ঘুম ভেঙে উঠে বসবে রাজার দুলালী। আহ, তাই যদি হতো! শেষ পর্যন্ত আমার কানের কাছে মুখ রেখে ফিসফিস করে বলেই ফেলল আর্থার, জন, সত্যিই কি মরে গেছে লুসি? তুই তো ডাক্তার। আর একবার ভালমত পরীক্ষা করে দেখ না ওকে।

না, আর্থার, সত্যিই মারা গেছে ও। কিন্তু এমন মৃত্যুর কথা আমি কখনও শুনিনি। ও আবার ভুল বুঝে বসবে ভেবে বললাম, তবে কদাচিৎ হলেও মৃত্যুর পর কোন কোন মানুষের মধ্যে আবার উল্টো প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। তারা পচে তো যায়ই না, বরং জীবিতাবস্থা থেকেও সুন্দর হয়ে ওঠে। আসলে তাদের দেহের ভেতরই সুপ্ত থেকে যায় তাদের আত্মা। লুসির মৃত্যুটাও ঠিক তেমনি। এমন সময় দরজার বাইরে করাঘাতের শব্দ হতেই জিজ্ঞেস করলাম, কে?

সময় পেরিয়ে যাচ্ছে, জন, বাইরে থেকে বললেন প্রফেসর। শব বাহকেরা অপেক্ষা করছে।

নে, চল, আর্থার, বলে লুসির মুখটা ঢেকে দিতে গেলাম আমি। কিন্তু আমাকে বাধা দিল আর্থার। এগিয়ে এসে আলতো করে লুসির কপালে ঠোঁট ছোঁয়াল সে। তারপর পরম যত্নে ধীরে ধীরে চাদর দিয়ে ঢেকে দিল লুসির মুখটা।

বিকেলের পড়ন্ত রোদে মিছিল করে কফিন নিয়ে কবরখানার দিকে রওনা দিলাম আমরা। বিকেল যে এত বিষণ্ণ লাগতে পারে ভাবিনি কখনও। রাস্তার পাশের ওক গাছগুলো পর্যন্ত যেন আমাদের শোকে অংশগ্রহণ করে দাঁড়িয়ে আছে নিথর হয়ে। আর গির্জার ঘণ্টার প্রতিটা ধ্বনি যেন শেলের মত হৃদয়ে এসে বাজছে।

কাজ শেষ হতে হতে বেশ রাত হয়ে গেল। রাতে খাবার টেবিলে বসে প্রায় কিছুই খেতে পারলাম না। কোনমতে খাওয়ার পালা সাঙ্গ হলে ড্রইংরুমে এসে বসলাম। মোটা একটা চুরুট ধরিয়ে একটানা টানতে লাগলেন প্রফেসর। কুণ্ডলী পাকিয়ে ওপরে উঠে যাচ্ছে নীলচে সাদা ধোঁয়া। আর ওই ধোঁয়ার কুণ্ডলীর ভেতর কেবলই যেন ভেসে বেড়াতে লাগল লুসির অপূর্ব সুন্দর মুখ।

কতক্ষণ কেটে গেল জানি না, প্রফেসরের কাশির শব্দে চমক ভাঙল। খুক খুরু করে কেশে গলা পরিষ্কার করছেন প্রফেসর, বোধহয় কথা বলার জন্যেই। আর্থারের কিন্তু খেয়াল নেই। একভাবেই চুপ করে বসে ঘরের কোণের ফায়ারপ্লেসটার দিকে তাকিয়ে আছে সে। ওর মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে, ওই আগুনের মতই ব্যথার আগুন জ্বলছে তার মনে।

আরো বার দুয়েক কেশে গলাটা পরিষ্কার করে নিয়ে বললেন তিনি, যদি কিছু মনে না কর, তোমাকে দুএকটা কথা জিজ্ঞেস করব, আর্থার।

যেন স্বপ্নের জগৎ থেকে উঠে এসেছে এমনি ভাবে ধীরে ধীরে মাথা ঘুরিয়ে প্রফেসরের দিকে চেয়ে আস্তে করে বলল সে, বলুন।

লুসি কি তার সমস্ত সম্পত্তি তোমার নামে উইল করে দিয়ে গেছে?

হ্যাঁ।

বেশ। ওর সম্পত্তির একমাত্র উত্তরাধিকারী হিসেবে তোমার কাছ থেকে লুসির যাবতীয় ব্যক্তিগত চিঠিপত্র এবং ডায়েরীটা দেখার অনুমতি চাইছি। একটু থেমে আবার বললেন, অবশ্য, কাজ শেষ হলেই আবার তা তোমাকে ফিরিয়ে দেব আমি শুধুমাত্র কৌতূহলের বশে ওগুলো দেখতে চাইছি না আমি, এর বিশেষ কারণ আছে। পাছে বেহাত হয়ে যায় এজন্যে তোমাকে জিজ্ঞেস না করেই ওগুলো সরিয়ে রেখেছিলাম, কিন্তু বিশ্বাস কর একটা কাগজও এ পর্যন্ত খুলে দেখিনি আমি।

মিছেই লজ্জা দিচ্ছেন আমাকে, প্রফেসর। আমি জানি, আপনি চাইলে লুসি একান্ত ব্যক্তিগত ডায়েরীটাও আপনার হাতে তুলে দিতে বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ করত না। যার জিনিস সে-ই করত না, আর আমি করব এটা ভাবলেন কি করে আপনি?

ভেরি গুড, আর্থার। অসংখ্য ধন্যবাদ তোমাকে। অবশ্য তোমার কাছ থেকে এ উত্তরই আমি আশা করেছিলাম, চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন প্রফেসর। লুসির মৃত্যুর পর এই প্রথম আর্থারকে সান্ত্বনা দেবার জন্যে বললেন তিনি, আমাদের সবার জীবনেই কোন না কোন সময়ে ঘনিয়ে আসে প্রচণ্ড অশান্তি আর দুঃখ। কিন্তু সেই অশান্তি আর দুঃখকে অতিক্রম করে শান্তি সুখের দুয়ারে পৌঁছতে হলে চাই অসাধারণ আত্মত্যাগ আর দুর্জয় সাহস। এবং তা হলেই, যত বড় দুঃখই আসুক না কেন, তাকে জয় করা যায়, বলে দৃঢ় পদক্ষেপে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন প্রফেসর। আর আর্থারকে জোর করে সোফা থেকে তুলে শুতে চললাম আমরা।

ওপরের তলার একটা ঘরে একই শয্যায় আর্থারের সাথে শুয়ে পড়লাম আমি। কয়েক মিনিট পরই সে ঘরে এসে ঢুকলেন প্রফেসর। আমি উঠে বসতে গেলে ইশারায় আমাকে শুয়ে থাকতে বললেন তিনি। সারাটা রাত ঘরের কোণে একটা চেয়ারে বসে, কেন, কে জানে, আমাদের বিশেষ করে আর্থারকে পাহারা দিলেন প্রফেসর। আর সারারাতই বাতাসে ভর করে বাগান থেকে ভেসে এলো হাস্নাহেনা আর রজনী গন্ধার স্নিগ্ধ সুবাস।

২.০৩ ঝড়ের গতিতে এগজিটারের দিকে

মিনা হরকারের ডায়েরী থেকে

২২ সেপ্টেম্বর।

ঝড়ের গতিতে এগজিটারের দিকে ছুটে চলেছে ট্রেন। জানালার পাশে বসে বাইরের দৃশ্য দেখতে দেখতে অতীতের কথা ভাবছি। এই তো ক দিন আগে হুইটবিতে ছিলাম। সেদিন আমার কাছ থেকে অনেক, অনেক দূরে ছিল জোনাথন। আর আজ? আজ সে আমার স্বামী, সুপ্রতিষ্ঠিত একজন আইনজীবী। এই তো আমার কোলে মাথা রেখে ঘুমোচ্ছ সে। কত ঘটনই না ঘটে গেল এর মধ্যে, কত পরিবর্তন হয়ে গেল পারিপার্শ্বিক অবস্থার।

সুচারু রূপেই মিস্টার হকিন্সের শেষকৃত্য সমাধা হয়েছে। আমি আর জোনাথন ছাড়াও ওঁর কয়েকজন বিশিষ্ট বন্ধু, যাঁরা এগজিটারেই থাকেন এবং তার লণ্ডনস্থ একজন মক্কেল স্যার জন প্যাটনও কবর দেবার সময় উপস্থিত ছিলেন। পৌরহিত্য করালেন স্যার প্যাক্সটনই। ভারাক্রান্ত চোখে সারাক্ষণ পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আমাদের পিতৃস্থানীয় মিস্টার হকিন্সের কবর দেয়া দেখলাম আমি আর জন।

কাজ শেষ হলে ঘোড়া গাড়িতে চেপে শহরে ফিরে এসেছিলাম আমরা। গাড়ি থেকে নেমে অনিশ্চিত ভাবে এদিক ওদিক ঘুরতে শুরু করলাম দুজনে। শেষ পর্যন্ত জনের ইচ্ছায়ই হাইড পার্কের এক নির্জন কোণে একটা ভাল জায়গা বেছে নিয়ে বসে পড়লাম আমরা। একটু পরই সাঝ ঘনিয়ে এল। খানিকক্ষণ পরই ভীষণ নিস্তব্ধ হয়ে এল জায়গাটা, মেন যেন বিষণ্ণও। আর বসে থাকতে ভাল লাগল না, তাই উঠে পড়লাম। পিকাডিলির পথ ধরে পাশাপাশি হাটছি। সেই পুরনো দিনের মত আমার হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিড়ি করে ধরে রেখেছে জোনাথন।

চারদিকে তাকাতে তাকাতে যাচ্ছি, হঠাৎ রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একটা বিরাট ঘোড়ার গাড়িতে একটা মেয়েকে বসে থাকতে দেখেই ভীষণভাবে চমকে উঠলাম। চমকে ওঠার কারণ হল গুচ্ছ গুচ্ছ সোনালী চুলের ওপর একটা সুন্দর সাদা হ্যাট পরে একজন লোকের পাশে বসে আছে আমার প্রিয় বান্ধবী লুসি। এপাশ থেকে লোকটার চেহারা দেখা যাচ্ছে না ভালমত। এক ঝটকায় জোনাথনের মুঠো থেকে আমার হাত ছাড়িয়ে নিয়ে গাড়িটার দিকে দৌড়ে গেলাম। আমার পেছন পেছন ছুটে এল জন। গাড়ির কাছে পৌঁছে নাম ধরে চেঁচিয়ে ডাকলাম সিকে। ধীরে ধীরে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল লুসি, সঙ্গে সঙ্গে লোকটাও। এতক্ষণে লোকটার চেহারা ভালমত নজরে পড়ল আমার। ওর ঈগলের মত বাকানো নাকের নিচে ছুঁচালো এক জোড়া গোঁফ, আর অদ্ভুত লাল দুটো চোখ। গাড়ির ভেতরের আবছা আলোয় আঙ্গারের মত ধ্বক ধক করে জ্বলছে সে চোখ। ঠিক এই সময় অফুটে আর্তনাদ করে উঠল জোনান।

কি হলো? বলে উৎকণ্ঠিত ভাবে জোনাথনের দিকে ফিরে চাইলাম আমি।

আঙুল তুলে ঘোড়াগাড়িটার দিকে নির্দেশ করে বলল জোনাথন, এ সে-ই! ওকে চিনতে পারছ না তুমি, মিনা?

জোনাথনের কথার অর্থ ঠিক বুঝতে না পেরে ঘাড় ঘুরিয়ে আবার চাইলাম গাড়িতে বসা লোকটার দিকে। সামনের দিকে এখন একটু ঝুঁকে বসায় রাস্তার পাশের একটা দোকানের আলো তেরছা ভাবে এসে পড়েছে লোকটার মুখে। সে আলোয় লোকটার চেহারা ভালমত নজরে পড়ল আমার। সঙ্গে সঙ্গেই শিউরে উঠলাম আতঙ্কে। কারণ এ মুখের সাথে আমার চাক্ষুষ পরিচয় না থাকলেও বার বার শুনে শুনে আর পড়ে ও-চেহারা এখন আমার মুখস্থ। পাথরের মত রুক্ষ কঠিন লোকটার মুখ। টুকটুকে লাল ঠোঁটের কোণ থেকে উঁকি মারছে ককে সাদা দুটো তীক্ষ্ণ দাঁত। চোখের দৃষ্টিতে ওর রাজ্যের লালসা, দেখলেই ঘিন ঘিন করে ওঠে সারা গা। ঠিকই বলেছে জোনাথন। এ সে-ই! কিন্তু ওর পাশে লুসি কেন? তবে কি…

একটা অজানা আতঙ্কে ধ্বক করে উঠল হৃৎপিণ্ডটা।

এই সময় হঠাৎ চলতে শুরু করল গাড়িটা। ওটা আমার সামনে দিয়ে বেরিয়ে যেতেই ঘুরে দাঁড়ালাম। এক জায়গায় ঠায় দাঁড়িয়ে চলমান গাড়িটার দিকে তাকিয়ে আছে জোনাথন! আমি ফিরে দাঁড়াতেও কোন কথা বলল না সে। চলতে চলতে মোড় নিয়ে একসময় চোখের আড়ালে চলে গেল গাড়িটা।

গাড়িটা চলে যাবার পর জোনাথন আমার দিকে চাইতেই জিজ্ঞেস করলাম, লোকট কাউন্ট ড্রাকুলা না?

হ্যাঁ, কাউন্ট ড্রাকুলাই। কিন্তু এরই মাঝে এত তরুণ হয়ে গেল কি করে ও? আর ওর পাশের মেয়েটাই বা কে?

হঠাৎ হাসপাতালের ডাক্তারের কথা মনে পড়ে গেল আমার। এসব ব্যাপার নিয়ে জোনাথনের স্নায়ুতে চাপ পড়লে ক্ষতি হতে পারে ওর, বলেছিল ডাক্তার, তাই আর কোন কথা না বলে তাড়াতাড়ি ওকে নিয়ে সে-জায়গা থেকে সরে পড়লাম। কিন্তু বাড়ি ফিরে যেতে মন চাইছে না। অগত্যা গ্রীন পার্কের একটা বেঞ্চিতে এসে বসলাম দুজনে, পাশাপাশি। কিন্তু সেখানেও বেশিক্ষণ ভাল লাগল না। শেষ পর্যন্ত দুত্তোর বলে উঠেই পড়ল জোনাথন, সাথে সাথে আমিও।

আবার পাশাপাশি হাঁটতে লাগলাম আমরা। মন জুড়ে ভিড় করে আছে আমার ড্রাকুলার চিন্তা। শুধু ড্রাকুলা হলেও না হয় কথা ছিল, কিন্তু তার সাথে লুসি কেন? হাঁটতে হাঁটতেই একসময় বাড়ির কাছে এসে পড়লাম। কিন্তু বাড়িতেও মন টিকবে না। মিস্টার হকিন্সের অনুপস্থিতি অসহ্য পীড়া দেবে মনকে। তবুও জোনাথনের বিশ্রামের কথা ভেবে ঢুকে পড়লাম বাড়িতে।

নিজের ঘরে এসে ঢুকতেই একটা টেলিগ্রাম দিয়ে গেল চাকরটা। বোবার টেলিগ্রাম করতে গেল আমার কাছে? সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে খুললাম খামটা। লেখাটা পড়েই কেঁপে উঠলাম থর থর করে। ধপ করে বসে পড়লাম বিছানার ওপর।

কি হলো, কি হলো? উদ্বিগ্ন ভাবে জিজ্ঞেস করল জোনাথন। নিঃশব্দে ওর হাতে তুলে দিলাম টেলিগ্রামটা। শব্দ করে পড়ল জোনাথন, অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি, পাচদিন আগে মারা গেছেন মিসেস ওয়েস্টেনরা, লুসিও মারা গেছে গত পরশু। আজই অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে ওদের-প্রফেসর ভ্যান হেলসিং।

জোনাথনের পড়া শেষ হতেই বললাম, জানো, আজ কাউন্ট ড্রাকুলার পাশে বসে থাকা মেয়েটা কে ছিল? স্বয়ং লুসি। এখন বুঝতে পারছি লুসির মৃত্যুটা অস্বাভাবিক। যে-কোন রহস্যময় উপায়েই হোক সুসিকে নিজের দলে টেনে নিয়েছে শয়তান, পিশাচ কাউন্ট ড্রাকুলা। আর আজ সন্ধ্যার পর ঘোড়া গাড়িতে বোধহয় কাউন্ট ড্রাকুলার সাথে নৈশ অভিসারেই বেরিয়েছিল লুসি। ঈশ্বর, এ-ও দেখতে হলো আমাকে।

.

ডাক্তার জন সেওয়ার্ডের ডায়েরী থেকে

২২ সেপ্টেম্বর।

সমস্ত কাজ শেষ হয়ে যাবার পর রিং-এ ফিরে গেছে আর্থার, সাথে করে নিয়ে গেছে কুইনসে মরিসকে। এ কদিন ছায়ার মত আমাদের সাথে সাথে থেকে সব কাজে সাহায্য করেছে মরিস। আশ্চর্য! ওর মুখ দেখে একবারও মনে হয়নি লুসির মৃত্যুতে সামান্যতম ব্যথা পেয়েছে সে। আসলে ব্যথা সে ঠিকই পেয়েছে, ও-ও তো ভালবাসত লুসিকে, কিন্তু প্রচণ্ড সহনশীলতা ওর। অন্তরে সারাক্ষণ জ্বলে পুড়ে মরেছে, কিন্তু বিন্দুমাত্র বহিঃপ্রকাশ ঘটেনি তার।

আজ রাতের গাড়িতে আমস্টারডামে ফিরে যাবেন প্রফেসর ভ্যান হেলসিং, তবে আগামীকালই আবার ফিরে আসবেন তিনি। ওখানে নাকি কয়েকটা ব্যক্তিগত কাজ শেষ করতে হবে তাকে।

জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছি। হ্যাম্পস্টেড গির্জার চূড়াটা পরিষ্কার চোখে পড়ছে এখান থেকে। নির্জন পাহাড়ী উপত্যকার ওই রকম এক গির্জা সংলগ্ন উন্মুক্ত আঙিনার কাছের কবরখানায় নিজের আত্মীয় স্বজনের পাশে এখন চিরদ্রিায় নিদ্রিত লুসি। ভোরের সোনালী আলোয় ঝলমল করছে সারাটা উপত্যকা। ওদিক থেকে বয়ে আসা ঝিরঝিরে দখিনা হাওয়ায় ভর করে ভেসে আসছে নাম না জানা বুনো ফুলের গন্ধ।

আগামীকাল প্রফেসর ফিরে না আসা পর্যন্ত করার কিছুই নেই। এ সময়টা কি করে কাটাব ভাবছি। দারুণ উত্তেজনায় কি করে কেটে গেছে গত কটা দিন টেরই পাইনি। এখন সমস্ত উত্তেজনার শেষে দিন রাতের প্রতিটা মুহূর্তকে অসম্ভব দীর্ঘ বলে মনে হচ্ছে।

হঠাৎ মনে হল, তাই তো, এমন সুন্দর একটা দিন, কাটানর অসুবিধে কোথায়? সুসির কবরখানায় চলে গেলেই হয়। ঘুরে বেড়িয়ে সময় কাটানর এক বিচিত্র জায়গা ওটা। কথাটা মনে হতেই উঠে পড়লাম।

এক কথায় অপূর্ব হ্যাম্পস্টেডের ওই পাহাড়ী উপত্যকাটা। চারদিকে গাছে গাছে ফুটে আছে অসংখ্য মাম না জানা বুনো ফুল, ওগুলোর গন্ধে ভুরভুর করছে এলাকাটা। আর ওসব ফুলের আশেপাশে উড়ে বেড়াচ্ছে হাজার হাজার প্রজাপতি। বিচিত্র ওদের রঙ, কোনটা গাঢ় নীল, লাল বা হলুদ, কোনটার কাল পাখার ওপর সাদা ছাপ, কোনটা মাখন রঙা আর কোনটা রামধনুর সাত রঙ গায়ে নিয়ে উড়ছে বিচিত্র কায়দায়।

পায়ের নিচের লম্বা সবুজ ঘাসের ভেতর ছুটোছুটি করছে অসংখ্য মেঠো ইঁদুর। প্রায়ই একটা বাদাম বা ওই জাতীয় কিছুতে ভাগ বসাতে গিয়ে তুমুল মারপিট বাধাচ্ছে ওরা। প্রকৃতির এতসব আশ্চর্য জিনিস দেখতে দেখতে ভুলেই গেলাম লুসির কথা।

দুপুর পর্যন্ত একটানা ঘুরে বেড়িয়ে ক্লান্ত হয়ে এসে শুয়ে পড়লাম একটা বিশাল ওকের ছায়ায়। আমি শোয়র মাত্র মিনিটখানেক পরই ছোট ছোট প্রাণীর আনাগোনায় জ্যান্ত হয়ে উঠল আমার আশপাশটা। ঝোপের ভেতর থেকে সুড়ুৎ করে বেরিয়ে আসছে খরগোশ। গাছ থেকে অতি সাবধানে নেমে আসছে কাঠবিড়ালী। সারাক্ষণ কান খাড়া হয়ে আছে ওদের। সামান্যতম বিপদের আভাস পেলেই ছুটে পালিয়ে যাবে নিরাপদ আশ্রয়ে। পরিষ্কার নীল আকাশের কোথাও একরত্তি মেঘ নেই। বই ওপরে, স্থির শান্ত ভঙ্গিতে ডানা মেলে দিয়ে ভাসছে একটা চিল। দেখতে দেখতে দুচোখ জড়িয়ে এল ঘুমে।

ঘুম ভাঙল গির্জার সান্ধ্য ঘণ্টাধ্বনিতে। ওরে বাবা, এতক্ষণ ঘুমিয়েছি। ধড়মড় করে উঠে বসলাম। পশ্চিমাকাশে অস্ত যাচ্ছে সূর্য। তার টকটকে লাল আভায় রঙিন হয়ে গেছে ওদিককার আকাশ। আর দেরি করা যায় না। উঠে দাঁড়িয়ে রওনা হলাম বাড়ির দিকে। পেছনে বিষঃ একঘেয়ে ঢং ঢং শব্দে বেজেই চলল হ্যাম্পস্টেড গির্জার ঘণ্টা।

২.০৪ অদ্ভুত কয়েকটা খবর

অদ্ভুত কয়েকটা খবর বেরোল ২৫ সেপ্টেম্বর, দি ওয়েস্ট মিনিস্টার গেজেট পত্রিকায়। সকালের সাধারণ সংখ্যায় বেরোল নিচের খবরটাঃ হ্যাম্পস্টেড রহস্য। গত দুই তিন দিন ধরিয়া কতকগুলি ভয়াবহ কাণ্ডকারখানা ঘটিয়া চলিয়াছে হ্যাম্পস্টেড এবং তাহার আশেপাশের এলাকায়। ঘটনা-গুলিকে বিভিন্ন নাম আখ্যায়িত করিতেছে লোকেরা। কেউ কেনসিংটনের আতঙ্ক, কেউ আততায়ী রমণী, আবার কেউ বা বলে শ্বেতবসনা সুন্দরী। উক্ত কয়েকদিন ধরিয়া বেশ কিছু সংখ্যক শিশু খেলার মাঠ বা অন্য কোন জায়গা হইতে বাড়ি ফিরিবার পথে রহস্যজনক ভাবে নিখোঁজ হইয়া যায়। এবং এই নিরুদ্দিষ্ট হওয়ার ঘটনাগুলি ঘটে সন্ধ্যার পর। এই শিশুদের কেউ কেউ গভীর রাত্রে বাড়ি ফিরিয়া আসে, আর কেউবা ফেরেই না। পরে কোন গোপঝাড়ে বা কোন নির্জন জায়গায় অচেতন অবস্থায় পাওয়া যায় উহাদের। তাহাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করিয়া বিশেষ কিছুই জানা যায় নাই। সব কয়জন শিশুই একই উত্তর দিয়াছে। তাহারা বলে, কে একজন রহস্যময়ী নারী তাহাদিগকে ভুলাইয়া লইয়া যায়, তারপর কি ঘটে আর তাহারা বলিতে পারে না।

একটা ব্যাপার লক্ষ্য করা গিয়াছে, এইসব ঘটনায় পতিত প্রতিটি শিশুর গলায় সূক্ষ্ম দুটি ক্ষতের সৃষ্টি হয়। সাধারণতঃ ইঁদুর বা ছোট আকারের কুকুরের দাঁতের কামড়ের সহিত ইহার বেশ সাদৃশ্য আছে। হ্যাম্পাস্টেডের চতুর্দিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখিবার জন্য অত্যন্ত জরুরী নির্দেশ দেওয়া হইয়াছে স্থানীয় শান্তিরক্ষা বাহিনীকে।

সেই দিনই দি ওয়েস্ট মিনিস্টার গেজেট পত্রিকার বিশেষ সংস্করণে বেরোল নিম্নোক্ত খবরটিঃ

হ্যাম্পস্টেডের আতঙ্ক!
আর একটি শিশু আহত!!
আবার সেই রহস্যময়ী নারী!!!

এইমাত্র গোয়েন্দা বিভাগের সূত্র হইতে জানা গেল যে গত রাত্রে নিখোঁজ একটি শিশুকে আজ সকালে হ্যাম্পস্টেডের কাছাকাছি সুটার পাহাড়ের নির্জন জঙ্গল হইতে খুঁজিয়া বাহির করা হইয়াছে। সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। শিশুটির গলায় সূক্ষ্ম ক্ষতচিহ্ন এবং তাহাকে ভুলাইয়া লইয়া গিয়াছিল এক রহস্যময়ী নারী। তবে অন্যান্য শিশুর তুলনায় এ শিশুটি অত্যন্ত দুর্বল হইয়া পড়িয়াছে, এবং তাহার শরীর প্রায় রক্তশূন্য।

২.০৫ দুচোখের পাতা এক করতে পারিনি

মিনা হারকারের ডায়েরী থেকে

২৪ সেপ্টেম্বর।

দুচোখের পাতা এক করতে পারিনি গত দুটো রাত। বার বারই ঘুরেফিরে মনে হয়েছে লুসি আর কাউন্ট ড্রাকুলার কথা। আমার স্বামীকে শেষ করতে বসেছিল কাউন্ট ড্রাকুলা, কেবল দুর্জয় সাহস আর কপাল গুণে বেঁচে গেছে জোনাথন। কিন্তু তার পৈশাচিকতা থেকে বাঁচতে পারেনি লুসি, আমার প্রিয় বান্ধবী। কাউন্ট ড্রাকুলা, লুসির এ সর্বনাশের জন্যে কিছুতেই ক্ষমা করব না আমি তোমাকে। যে কোন উপায়ে যে কোন মূল্যে তোমার ধ্বংস আমি দেখবই। না হলে আরও কত মূল্যবান প্রাণকে পিশাচে পরিণত করবে তুমি কে জানে? ওই শয়তানটাকে ধ্বংস করতে হলে প্রফেসর ভ্যান হেলসিং-এর সাহায্য আমার একান্ত প্রয়োজন। জোনাথনের ডায়েরীতে বর্ণিত কাহিনী প্রফেসরকে জানাব ভাবছি, তাহলে তাঁর কাজে হয়ত অনেক সুবিধে হবে। হ্যাঁ, তাই জানাব। তবে তার আগে। ডায়েরীতে বর্ণিত কাহিনীর প্রতিটা লাইন টাইপ করে ফেলতে হবে আমাকে।

২৫ সেপ্টেম্বর সকালে মিনা হারকারের কাছ থেকে একটা ছোট্ট টেলিগ্রাম পেলেন প্রফেসর ভ্যান হেলসিং :

সম্ভব হলে আজ সকাল সোয়া দশটার ট্রেনেই চলে আসুন-উইনহেল মিনা হারকার।

.

মিনা আরকারের ডায়েরী থেকে

২৫ সেপ্টেম্বর।

প্রফেসরের এখানে এসে পৌঁছানোর সময় যতই এগিয়ে আসছে ততই উত্তেজনা বোধ করছি মনে মনে। কেন যেন কেবলই মনে হচ্ছে জোনাথনের সেই ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার ওপর নতুন কোন আলোকপাত করতে পারেন তিনি। তাছাড়া লুসির অন্তিম মুহূর্তেও একেবারে সামনে উপস্থিত ছিলেন তিনি, তাঁর মুখ থেকে সব কথা শুনতে পাব, সেটাও কম উত্তেজনার ব্যাপার নয়। আজ মনে হচ্ছে লুসির নিশিতে পাওয়া, ঘুমের ঘোরে হাঁটার মধ্যে সত্যিই অলৌকিক কিছু একটা ছিল। হুইটবির সেই ঘটনাগুলো পরিষ্কার ভেসে উঠল মনের পর্দায়। তন্ময় হয়ে সেসব কথা ভাবছি, এমন সময় দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ হল। চমকে উঠে হাতঘড়ির দিকে চাইতে চাইতে দরজা খুলতে এগিয়ে গেলাম। আড়াইটা বাজে ঘড়িতে।

দরজা খুলতেই দেখলাম দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে আছেন একজন ভদ্রলোক। মাঝামাঝি উচ্চতার, চমৎকার স্বাস্থ্য, পৌরুষদীপ্ত বলিষ্ঠ শরীর, পরিষ্কার করে কামান চিবুক, আর গভীর নীল দুটো চোখ ভদ্রলোকের। দেখলেই বোঝা যায় যথেষ্ট বয়েস হয়েছে ভদ্রলোকের, অথচ এখনও মুখের কোথাও উঁাজ পড়েনি। একটা। প্রফেসর ভ্যান হেলসিংকে চোখে দেখিনি কখনও, কিন্তু এখন এই ভদ্রলোককে দেখেই বুঝলাম ইনিই সেই বিখ্যাত প্রফেসর। দেখলেই ওঁর প্রতি শ্রদ্ধায় মাথা নুয়ে আসবে যে কোন লোকের।

অভিবাদন জানিয়ে বললাম, আসুন, প্রফেসর।

মাথা থেকে হ্যাটটা খুলে প্রত্যাভিবাদন জানালেন প্রফেসর, তারপর ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললেন, তুমিই বোধহয় মিনা, লুসির বান্ধবী?

হ্যাঁ, প্রফেসর।

তোমাকে তুমি করে বলছি বলে কিছু মনে করনি তো?

কি যে বলেন, প্রফেসর। আপনি করে বললেই বরং লজ্জায় পড়ে যেতাম আমি। বসুন, একটা সোফা দেখিয়ে বসতে বললাম প্রফেসরকে।

একটা সোফায় বসে পড়ে মৃদু হেসে বললেন প্রফেসর, আমাকে তুমি নিরাশ করনি, মিনা। সারাটা পথ ভাবতে ভাবতে এসেছিলাম। লুসির বান্ধবী লুসির মতই হবে। আসলেও তুমি তাই। লুসির মতই নম্র ব্যবহার, আর লুসির মতই রূপ তোমার। প্রফেসরের কথায় লজ্জা পেলাম। বললাম, আসলে আপনি বাড়িয়ে বলছেন, প্রফেসর।

এক বিন্দুও না, বলেই আসল কথায় এলেন প্রফেসর। হ্যাঁ, এবার কাজের কথায় আসা যাক। কি কারণে আমাকে এখানে ডেকেছ তুমি?

সবই বলব, বলে উঠে গিয়ে দেরাজ থেকে জোনাথনের ডায়েরীতে বর্ণিত কাহিনীর একটা টাইপ করা কপি বের করে এনে প্রফেসরের হাতে দিতে দিতে বললাম, তবে তার আগে এটায় একবার চোখ বুলিয়ে নিন।

কি ওটা? আমার হাত থেকে কাগজন্তুগুলো নিতে নিতে জিজ্ঞেস করলেন প্রফেসর।

আমার স্বামীর লেখা ডায়েরীর একটা কপি।

কাগজন্তুগুলো হাতে নিয়েই পড়তে শুরু করলেন প্রফেসর। এই সুযোগে খাবার ব্যবস্থা দেখতে নিচে নেমে এলাম আমি। সব কিছু গোছগাছ করে ওপরে এসে দেখলাম, ঘরের ভেতর পায়চারি করছেন প্রফেসর, সারা মুখ থমথমে গম্ভীর। আমাকে দেখেই মৃদু হাসলেন প্রফেসর, যেন মেঘ কেটে গিয়ে সূর্য উঁকি দিল। বললেন, অসংখ্য ধন্যবাদ তোমাকে, মিনা। বুদ্ধি করে আমাকে ডেকে এনে ঠিকই করেছ তুমি। তোমার স্বামীর লেখা ওই কাহিনী সবটা পড়িনি এখনো, তবে যেটুকু পড়েছি তাতেই অনেক কিছু পরিষ্কার হয়ে গেছে আমার কাছে। কিন্তু কথা কি জান, আমাদের মাথার ওপর ঘনিয়ে আসছে গাঢ় মেঘ, প্রচণ্ড তুফান উঠতে যাচ্ছে, এ সময়ে অত্যন্ত সতর্ক থাকতে হবে আমাদের। এ সময়ে তোমার মত বুদ্ধিমতী মেয়ে আর জোনাথনের মত দুঃসাহসী ছেলে আমার একান্তই দরকার। আশা করি আমাকে সাহায্য করবে তোমরা।

সাহায্য করতে এবং আপনার সাহায্য নিতেই তো আপনাকে ডেকে এনেছি এখানে। কিন্তু এখন পর্যন্ত হয়ত অনেক কিছুই আপনি জানেন না, প্রফেসর।

কি কথা, মিনা?

সে কথা বললেও বিশ্বাস করা কঠিন। সেদিন মিস্টার হকিন্সকে সমাধিস্থ করার পর বাড়ি ফিরতে ভাল লাগছিল না বলে পিকাডিলির ফুটপাত ধরে হাঁটছিলাম আমি আর জোনাথন। সে সময়েই ঘটে ঘটনাটা।

কি সে ঘটনা?

লুসিকে কাউন্ট ড্রাকুলার পাশে বসে থাকতে দেখেছি আমি, একটা বিশাল ঘোড়া গাড়ির ভেতর।

কি বললে?

হ্যাঁ, তাই, বলেই হঠাৎ খেয়াল হল আমার; এখনো খাওয়া দাওয়া হয়নি প্রফেসরের। তাড়াতাড়ি বললাম, সে কথা পরে বলা যাবে, সব বলার জন্যেই তো ডেকে এনেছি আপনাকে। তার আগে চলুন তো, হাত মুখ ধুয়ে খেয়ে নেবেন। খেতে খেতেই না হয় বলা যাবে সব।

প্রফেসরকে সাথে নিয়ে নিচের ডাইনিং রূমে নেমে এলাম। খেতে খেতেই সেদিনের সমস্ত ঘটনা খুঁটিয়ে বললাম ওকে। একটাও প্রশ্ন না করে আমার সব কথা শুনলেন তিনি। তারপর বললেন, পৃথিবীতে প্রতিদিন কত বিচিত্র ঘটনা যে ঘটছে আমরা তার কটার হিসেব রাখি, মিনা। তোমার দেখা ঘটনাটাও তেমনি অনেক ঘটনার একটা। যথেষ্ট বয়স হয়েছে আমার, দেখেছিও কম না। যথেষ্ট অভিজ্ঞতা হয়েছে বলেই বলছি, তোমার কথা শুনে হাসা তো দূরের কথা, বরং আমার ভাবনা আরও বেড়ে গেছে। ভেবেছিলাম আরও কদিন অপেক্ষা করতে হবে, কিন্তু এত তাড়াতাড়িই যে কাজ শুরু করে দেবে পিশাচটা ভাবিনি। তা তোমার স্বামী কেমন আছে এখন? দেখছি না যে ওকে?

কোর্টে গেছে। ফিরতে আরও দেরি হবে। সেদিন কাউন্ট ড্রাকুলাকে দেখার পর থেকে কেমন যেন হয়ে গেছে ও। মনে হচ্ছে আবার নার্ভাস ব্রেক ডাউন ঘটতে যাচ্ছে ওর।

ঘটবে না। কিছু ভেব না তুমি। এসে যখন একবার পড়েছি, নার্ভাস ব্রেকডাউন আর হতে দেব না ওর। আমার ওপর বিশ্বাস রাখতে পারবে না, মিনা?

না পারলে কখনোই আপনাকে ডেকে আনতাম না এখানে।

ভেরি গুড! তা এখন আমার একটু কাজ আছে। উঠি।

রাতের বেলা ফিরবেন তো?

না। যদিও এগজিটারেই থাকছি আজ রাতে, তোমার এখানে ফিরতে পারব। কাজ শেষ করতে করতে হয়ত অনেক রাত হয়ে যেতে পারে। হোটেলেই কোনমতে কাটিয়ে দেবোখন। বলে উঠে দাঁড়ালেন প্রফেসর। তারপর কি মনে হতেই বললেন, হ্যাঁ, ভাল কথা, টাইপ করা কাগজন্তুগুলো নিয়ে যেতে পারি আমি? সবটা তো পড়তে পারিনি তখন, সময়মত পড়ে দেখব।

নিশ্চয়ই আসলে আপনার জন্যেই টাইপ করে রেখেছিলাম ওগুলো।

আমার কথায় দারুণ খুশি হলেন প্রফেসর। বললেন, সত্যিই, তোমার মত বুদ্ধিমতী মেয়েদের নিয়ে কাক্ত করে আরাম আছে। ঠিক আছে, এখন চলি। কাল যদূর সম্ভব সকাল সকাল এখানে এসে পড়ব আমি, ঘুরে দাঁড়িয়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন তিনি। দরজার কাছে গিয়ে ফিরে দাঁড়িয়ে বললেন, আবার বলছি তোমাকে, জোনাথনের জন্যে একটুও চিন্তা করো না। সব ঠিক হয়ে যাবে, বলেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন প্রফেসর।

আশায় আনন্দে দুলে উঠল বুকটা। পরিষ্কার বুঝতে পারছি, ওই লোকের ওপর যে কোন গুরুদায়িত্ব চাপিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্তে বসে থাকা যায়।

আস্তে করে এগিয়ে গেলাম জানালাটার কাছে। শিকের গায়ে কপাল ঠেকিয়ে চেয়ে থাকলাম বাগানের দিকে। আমার নিজ হাতে লাগান সাদা গোলাপ গাছটায় একটা ইয়া বড় ফুল ফুটেছে। কোত্থেকে তার ওপর উড়ে এসে বসেছে একটা কাল ভ্রমর। ওটা দেখেই লুসির পাশে কাউন্ট ড্রাকুলার কথা মনে হল আমার। লুসি যেন ওই সাদা গোলাপ, আর ড্রাকুলা কাল ভ্রমর। দাউ দাউ করে প্রতিশোধের আগুন জ্বলে উঠল আমার মনে। অস্কুট বললাম, কাউন্ট ড্রাকুলা, তৈরি থেকো। আবারো বলছি, লুসির মৃত্যুর প্রতিশোধ আমি নেবোই। কিন্তু তখনো কি জানতাম কাজটা কতটা কঠিন আর বিপজ্জনক?

২.০৬ আবার নতুন করে শুরু

জোনাথন হারকারের ডায়েরী থেকে

২৬ সেপ্টেম্বর।

আবার নতুন করে শুরু করতে হবে ভাবিনি, উপায়ও নেই না করে। এত আনন্দ কেমন করে চেপে রাখব আমি? গত রাতে খাবার টেবিলে প্রফেসর ভ্যান হেলসিং-এর সাথে সাক্ষাৎকারের কথা আমাকে বিস্তারিত বলেছে মিনা। প্রফেসরের আশ্বাসবাণীতে যেন নতুন করে জীবন ফিরে পেয়েছি আমি। স্বপ্ন আর বাস্তবতার এক গভীর সন্দেহ এতদিন কুরে কুরে খেয়েছে আর মনকে, তা থেকে কাল মুক্তি পেয়েছি। এখন থেকে আর কোন কিছুতেই ভয় পাব না, ভয় পাব না বয়ং কাউন্ট ড্রাকুলাকে দেখেও।

একটা জিনিস কিছুতেই বুতে পারছি না আমি। লণ্ডনে এসেই কি করে যৌবন ফিরে পে কাউন্ট ড্রাকুলা? যেভাবেই পাক, তা নিয়ে আর ভাবব না। প্রফেসর হেলসিং ওর বিরুদ্ধে লেগেছেন যখন, এর কারণ একদিন জানতে পাই।

আমরা আজ সকালে নাস্তা করতে বলার আগেই এসে হাজির হয়েছেন প্রফেসর। বলতে কি, আমার জীবনের এ এক স্মরণীয় মুহূর্ত। আমাকে দেখে যতটা খুশি হলেন প্রকেন, তাকে দেখে তার চেয়ে অনেক বেশি খুশি হলাম আমি। ঘরে ঢুকেই এগিয়ে এসে আমার কাঁধে হাত রেখে চিবুকটা ধরে আলোর দিকে ফিরি বললে প্রফেসর, মিনা বলছিল তুমি অসুস্থ, কিন্তু কই, তার কোন লক্ষণ দেখছি না তো?

মিছে কথা বলেনি, মিনা, ওঁকে বসতে বলে মৃদু হেসে বললাম, আসলে গতকাল আপনার আগমন বার্তা শোনার আগে পর্যন্ত সত্যিই অসুস্থ ছিলাম আমি, প্রফেসর। আপনার আশ্বাসবাণী মিনার মুখ থেকে শোনার পর পরই সম্পূর্ণ ভাল হয়ে গেছি আমি।

ভেরি গুড। এরকম রোগী না হলে চিকিৎসা করে মজা কোথায়? হো হো করে হেসে উঠে বললেন প্রফেসর। ওঁর হাসির শব্দে প্রায় ছুটতে ছুটতে ঘরে এসে ঢুকল মিনা, আমার জন্যে ডিমের ওমলেট করে আনতে কিচেনে গিয়েছিল সে। মিনাকে ঢুকতে দেখেই ওর উদ্দেশ্যে বললেন প্রফেসর, কেমন মিনা, বলিনি, ভাবনার কোন কারণ নেই, ভাল হয়ে যাবে জোনাথন?

এর আগে অনেকের মুখেই শুনেছিলাম, প্রফেসর ভ্যান হেলসিং-এর চেহারা দেখেই রোগীর দেহ ছেড়ে রোগ পালায়, কথাটা দেখছি মিথ্যে নয়, হেসে জবাব দিল মিনা। তা এখন তাড়াতাড়ি বসে পড়ুন তো, প্রফেসর। আর একটা প্লেট নিয়ে আসছি আমি।

খাওয়া শেষ করে মোটা একটা চুরুট ধরালেন প্রফেসর। চুরুটে গোটা কয়েক টান দিয়ে বললেন, তোমার ডায়েরীতে বর্ণিত কাহিনীটা আমি পড়েছি, জোনাথন। কিন্তু সবটা ব্যাপার আবার এখন তোমার মুখ থেকে শুনতে চাই আমি। কাহিনীর কোন কোন জায়গা এখনও দুর্বোধ্য ঠেকছে। সে সব জায়গাগুলো নিয়ে আলোচনা করলেই পরিষ্কার হয়ে যাবে অনেক কিছু।

সব বলব, প্রফেসর। তবে তার আগে আমার ছোট্ট একটা প্রশ্নের জবাব দিন তো। কাউন্ট ড্রাকুলার অস্তিত্ব সম্পর্কে বিশ্বাস করেন আপনি?

অবশ্যই। লুসিই তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ।

প্রফেসরের কথা শুনে খুশিতে চেয়ার ছেড়ে প্রায় লাফিয়ে উঠলাম। সভ্য জগতের একজন অসাধারণ প্রতিভা সম্পন্ন মানুষ আমার এই অবিশ্বাস্য অদ্ভুত কাহিনী বিশ্বাস করবে, স্বপ্নেও ভাবিনি। একথা কাউকে বলে বিশ্বাস করাতে পারব, এ চিন্তাটাই আসলে এতদিন আমাকে কুরে কুরে খেয়েছে। বললাম, তাহলে শুনুন, প্রফেসর। নড়ে চড়ে চেয়ারে আরাম করে বসলেন প্রফেসর। আর আমি বলে যেতে থাকলাম আমার জীবনের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর এক অভিজ্ঞতার কথা, একটুও না বাড়িয়ে, একটুও না কমিয়ে।

বসে বসে আমার সব কথা শুনলেন প্রফেসর। মাঝেমধ্যে প্রশ্ন করে জেনে নিচ্ছিলেন এটা ওটা। আমার কথা শেষ হবার পরও কয়েক মিনিট চুপচাপ কিছু ভাবলেন প্রফেসর। তারপর হাতঘড়ির দিকে একবার চেয়েই উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, অনেক, অনেকখানি এগিয়ে দিয়েই আমাকে তুমি, জোনাথন। সেজন্যে অসংখ্য ধন্যবাদ। কিন্তু এখন আমাকে আবার হুইটবিতে ফিরে যেতে হচ্ছে। সাড়ে দশটার ট্রেন ধরতে হলে আর দেরি করা যায় না।

আমার জীবনের ওই ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা যদি আপনার সামান্যতম কাজেও লাগে তাহলে নিজেকে আমি ধন্য মনে করব, প্রফেসর। চলুন আপনাকে গাড়িতে তুলে দিয়ে আসি।

স্টেশনে যাবার পথে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন প্রফেসর, তোমাকে যদি ইতিমধ্যে কখনো হুইটবিতে গিয়ে আমার সাথে দেখা করতে বলি, তাহলে তোমার কোন অসুবিধে নেই তো, জোনাথন?।

অসুবিধে? কিছুমাত্র না। যখনই খবর পাঠাবেন, দেখবেন, উড়ে গিয়ে হাজির হয়েছি।

সম্ভব হলে মিনাকেও নিয়ে যেয়ো।

সে অনুমতিই তো আপনার কাছে চাইতে যাচ্ছিলাম আমি।

স্টেশনে পৌঁছে ট্রেনের জন্যে অপেক্ষা করতে হল না। জানালার কাছেই সীট পেলেন প্রফেসর। ওঁর জানালার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছি, এমন সময় একজন খবরের কাগজের হকার দেখে সেদিনকার এক কপি দি ওয়েস্ট মিনিস্টার গেজেট কিনলেন প্রফেসর। আমার সাথে কথা বলার ফাঁকে ফাঁকেই কাগজটা উল্টে পাল্টে দেখছিলেন, হঠাৎ কাগজের এক জায়গায় চোখ পড়তেই স্তব্ধ হয়ে গেলেন তিনি, থমথমে কঠিন হয়ে গেল মুখ চোখ। আর একবার মনোযোগ দিয়ে সংবাদটা পড়লেন তিনি। তারপর বিড়বিড় করে বললেন, এত কুৎসিত আর ভয়ঙ্কর পথ বেছে নেবে পিশাচটা, ভাবিনি। কি খবর পড়ে অমন চমকে উঠলেন প্রফেসর, উঁকি দিয়ে দেখতে গেলাম। ওদিকে হুইসল দিয়ে চলতে শুরু করেছে গাড়ি। কাজেই খবরটা পড়তে পারলাম না, কিন্তু হেডিংটা ঠিকই পড়লাম, হ্যাম্পস্টেড রহস্য। ঠিক করলাম এখুনি একটা কাগজ কিনে নিয়ে খবরটা পড়তে হবে।

ক্রমশঃ গতি বাড়ছে ট্রেনের। জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে চেঁচিয়ে বললেন প্রফেসর, খুব শিগগিরই বোধহয় হ্যাম্পস্টেডে আসতে হতে পারে তোমাদের। তৈরি থেকো।

গাড়িটা স্টেশন ছেড়ে চলে যেতেই একটা দি ওয়েস্ট মিনিস্টার গেজেট কিনে খবরটা পড়লাম। পড়ে প্রফেসরের মতই চমকে উঠলাম আমিও। বিদ্যুৎ চমকের মত মনে পড়ে গেল কাউন্ট ড্রাকুলার প্রাসাদ দুর্গের তিন ডাইনীর কথা। এখনও পরিষ্কার কানে এসে বাজছে যেন ওই ডাইনীদের দিকে বাড়িয়ে ধরা কাউন্টের কাপড়ের পুটলির ভেতর মানব শিশুর কান্না!

২.০৭ লুসিকে নিয়ে ব্যস্ত থাকায়

ডাক্তার জন সেওয়ার্ডের ডায়েরী থেকে

২৬ সেপ্টেম্বর।

লুসিকে নিয়ে ব্যস্ত থাকায় রেনফিল্ডের দিকে নজর দিতে পারিনি গত কয়েকদিন। আজ খোঁজ নিয়ে জানলাম মোটামুটি ভালই আছে সে। আর কোন ঝামেলায় পড়তে হয়নি ওকে নিয়ে।

আর্থারের একটা চিঠি পেয়েছি গতকাল। একই খামে ভরে মরিসও চিঠি দিয়েছে একটা। তাতে জেনেছি ভালই আছে ওরা। মানসিক প্রফুল্লতা অনেকটা ফিরে আসছে আর্থারের।

এদিকে নিজেকে কাজের মাঝে ডুবিয়ে রেখেছি আমি। লুসির স্মৃতি থেকে মুক্তি পেতে হলে এছাড়া আর কোন পথ নেই। বেশ ভালই ছিলাম, কিন্তু হঠাৎ করেই ঘটতে শুরু করেছে আবার নতুন ঘটনা। এসব অদ্ভুত কাণ্ডকারখানার কোথায় যে শেষ, ঈশ্বরই জানেন। আর প্রফেসর ভ্যান হেলসিং কিছু কিছু জানলেও এখন বলবেন না কিছুতেই। এগজিটার থেকে ফিরেছেন আজ প্রফেসর। আমি তখন শুয়ে শুয়ে বিশ্রাম নিচ্ছিলাম। গম্ভীর মুখে ঘরে ঢুকে কোন কথা না বলে আমার দিকে দি ওয়েস্ট মিনিস্টার গেজেট পত্রিকাটা এগিয়ে দিয়ে একটা বিশেষ খবরের উল্লেখ করে বললেন, পড়েছ এটা?।

পড়েছি সকালবেলাই। কিন্তু মাথামুণ্ড কিছুই বুঝিনি। আর ও নিয়ে আমার অত মাথা ঘামাবার দরকারই বা কি? ওটা পুলিশের কাজ। কিন্তু সেটা নিয়ে প্রফেসরের ভাবনা দেখে অবাক হলাম। না বুঝেই প্রশ্ন করলাম, ব্যাপারটা নিয়ে আপনি ভাবছেন কেন, স্যার?

যেটার বিরুদ্ধে আহার দ্রিা ত্যাগ করে লড়ছি গত কয়েকদিন ধরে, সেটা নিয়ে ভাবব না?

প্রফেসরের কথার অর্থ বুঝতে না পেরে বোকার মত হুঁ করে বসে রইলাম। খেপে গেলেন প্রফেসর, আসলে তোমাকে চালাক মনে করতাম, জন। কিন্তু এখন দেখছি আমার ধারণা মিথ্যে। একটু থেমে আবার বললেন, রহস্যময় ভাবে হারিয়ে যাওয়া শিশুগুলোকে ফেরত পাবর পর ওদের গলায় দাঁতের সূক্ষ্ম ক্ষত দেখা যায়। এর সঙ্গে লুসির গলার ক্ষত দুটার মিল এত সকালেই ভুলে বসে আছ?

তাই তো। দুটো ব্যাপারে বেশ সাদৃশ্য আছে দেখছি! বললাম, বুঝতে পেরেছি। যে দুর্ঘটনায় লুসির মৃত্যু হয়েছে, সেই একই জাতীয় দুর্ঘটনার কবলে পড়েছিল শিশুগুলো।

হ্যাঁ, এতক্ষণে অনেকটা বুঝতে পেরেছ, বলতে বলতে একটা চেয়ার টেনে আমার মুখোমুখি বসলেন প্রফেসর। কিন্তু লুসির দুর্ঘটনা আর শিশুগুলোর দুর্ঘটনার জন্যে আলাদা আলাদা শক্তি দায়ী।

বুঝতে না পেরে চুপ করে রইলাম। একটু সামনের দিকে ঝুঁকে বললেন প্রফেসর, একটা কথার জবাব দাও তো। এ পর্যন্ত লুসির মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে যথেষ্ট ইঙ্গিত দিয়েছি আমি। তার একটুও কি তোমার মাথায় ঢোকেনি?

টুকবে না কেন? অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের ফলে স্নায়বিক দুর্বলতাই লুসিকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছে।

গুড। কিন্তু সে-রক্তক্ষরণের কারণ কি? কোথায় গেল ওই রক্ত?

প্রফেসরের প্রশ্নে চমকে উঠলাম। তাই তো! এমন করে তো ভেবে দেখিনি কখনো। রক্তক্ষরণের কোন কারণই তো ঘটেনি লুসির শরীরের কোথাও। তাহলে? প্রফেসরের প্রশ্নের কোন জবাব খুঁজে পেলাম না।

আমার বিছানার একেবারে পাশে চেয়ারটাকে টেনে নিয়ে এলেন প্রফেসর। তারপর যেন ক্লাসে লেকচার দিচ্ছেন, এমন ভাবে বলতে শুরু করলেন তিনি, আসলে তুমি যথেষ্ট বুদ্ধিমান, সাহসী এবং যুক্তিবাদী হলেও কোনকিছু আচ্ছন্ন করে রেখেছে তোমার মন। ফলে দৈনন্দিন জীবনের বাইরের কোনকিছুর সাথে সম্পর্ক নেই তোমার, সেদিকে ফিরেও তাকাও না তুমি। জানা-অজানার মাঝে এমন অনেক কিছু আছে এই পুরনো পৃথিবীতে, বুদ্ধিতে যার ব্যাখ্যা চলে না, নেই ওগুলোর কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তি। অথচ অস্বীকার করতে পারা যায় না ওগুলোকে। যেমন, সম্মোহন-একে অস্বীকার করতে পার কি তুমি? এই সম্মোহন জিনিসটা কি, এর যথাযথ উত্তর কি বিজ্ঞান দিতে পেরেছে?

কিন্তু বিজ্ঞানীরা তো একে অস্বীকার করে না।

বেশির ভাগই করে। আর যারা করে না, তারাও এ সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে পরিষ্কার করে বলতে পারে না কিছু।

বুঝলাম তর্ক করে লাভ নেই। আমি নিজেও এ সম্পর্কে প্রায় কিছুই জানি না। অতএব চুপ থাকাই বুদ্ধিমানের কাজ মনে করলাম। আমাকে নিরুত্তর দেখে আবার বলে চললেন প্রফেসর, অতীতে হাজার হাজার রহস্যময় কাণ্ড ঘটেছে এই পৃথিবীতে, আজও ঘটছে, ভবিষ্যতেও ঘটবে। তার কিছু কিছু সমাধান হয়ত করতে পেরেছে বা পারবে মানুষ, কিন্তু বেশির ভাগই মানুষের ক্ষমতার বাইরে।  বল তো দেখি, যেখানে বড় জোর দেড়শো বছর বাঁচে মানুষ, তাও কচিত কদাচিৎ, সেখানে নশো বছর বেঁচে ছিল কি করে মেথুসেলা? ছোট বড় সব জাতের মাকড়সাই অল্প কদিনের বেশি বাঁচতে পারে না, অথচ স্পেনের এক পুরনো গির্জায় শুধুমাত্র প্রদীপের জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত চর্বি খেয়ে কি করে শতাব্দীর পর শতাব্দী বেঁচে ছিল সেই বিখ্যাত বিশাল মাকড়সাটা? এসব প্রশ্নের কি জবাব দেবে তুমি? একটু থেমে আবার বলতে শুরু করলেন প্রফেসর, জান, দক্ষিণ আমেরিকার কোন কোন অংশে এবং পশ্চিম সাগরের কোন কোন দ্বীপে এক জাতের ছোট আকারের বাদুড় আছে, যার নাম ভ্যাম্পায়ার। দিনের বেলা গাছের ডালে মড়ার মত ঝুলে থাকে, আর রাতের বেলা মানুষ বা অন্যান্য প্রাণীর দেহ থেকে চুরি করে রক্ত খেয়ে যায় ওরা। একটা মশা কামড়ালে মশার বাপ-মা চোদ পুরুষ উদ্ধার করে থাপ্পড় মেরে শরীর থেকে তাড়াবার চেষ্টা করি ওটাকে আমরা। অথচ মশার চেয়ে লাখগুণ বড় ওই ভ্যাম্পায়ারেরা এই আমাদের মত মানুষের দেহ থেকেই রক্ত খেয়ে চলে যায়, অথচ টেরও পায় না মানুষ। কেন? কোন্ কৌশলে গায়ের চামড়া ফুটো করে রক্ত খায় ওরা, তা আজও বলতে পারে না বিজ্ঞানীরা। জান, অনেক সময় ভ্যাম্পায়ার আছে এমন সব দ্বীপের কাছ দিয়ে যাবার সময় প্রাণ দিতে হয় অনেক নাবিককে? দিনের বেলায় কিছু না, কিন্তু রাতে জাহাজের ডেকে পাহারারত নাবিকের গায়ের রক্ত খেয়ে চলে যায় ভ্যাম্পায়ার। চলতে থাকে রাতের পর রাত এই ঘটনা। প্রথম প্রথম কিছুই বুঝতে পারে না নাবিকেরা কিন্তু ক্রমাগত শরীরের রক্ত বেরিয়ে যাবার ফলে ফ্যাকাসে হতে শুরু করে ওই নাবিকদের শরীর। আস্তে আস্তে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে ওরা। লুসির কেসটাও অনেকটা এই রকম। না হলে, চার চারজন সুস্থ সবল পুরুষের শরীরের রক্ত দেয়ার পরও রক্তশূন্যতায় ভুগে সে মারা যায় কি করে?

তাহলে, তাহলে স্যার, আপনি কি বলতে চান লুসির মৃত্যুর জন্যে ভ্যাম্পায়ারই দায়ী?

হ্যাঁ। তবে ওটা সত্যিকারের ভ্যাম্পায়ার নয়, যদিও অনেকটা ভ্যাম্পায়ারের পদ্ধতিতেই কাজ করে। ইণ্ডিয়ায় অনেক তান্ত্রিক সাধক-ফকির আছেন, যারা ইচ্ছে করলেই স্বেচ্ছায় মারা যেতে পারেন, আবার বেঁচেও থাকতে পারেন যতদিন খুশি। কবরের মত জায়গায় ওদেরকে বন্দী করে রাখলেও বেরিয়ে চলে আসতে পারেন ওঁরা। আমাদের এই ভ্যাম্পায়ারটা অনেকটা ওই ধরনের।

একি শুনছি আমি? এই ঊনবিংশ শতাব্দিতে লণ্ডনের মত সভ্য উন্নত নগরীর বুকেও কি এ ধরনের কাও ঘটতে পারে? বেশ কয়েক মিনিট স্তব্ধ হয়ে বসে থাকার পর হঠাৎ লাফ দিয়ে নেমে পড়লাম বিছানা থেকে। ওই অসাধারণ প্রতিভাবান লোকটার পায়ের কাছে হাঁটু গেড়ে বসে হাত দুটো জোড় করে মিনতি জানালাম, স্যার, চিরদিনই আপনার প্রিয় ছাত্র ছিলাম আমি। জীবনে বহু শিক্ষা পেয়েছি আপনার কাছে। আজও কিছু শেখান আমাকে, এভাবে অন্ধের মত হাতড়ে হাতড়ে আর কতদিন চলবে?

সব কথা অবশ্যই তোমাকে বলব, জন। কিন্তু সময় আসেনি। এখন বললে হয়ত বিশ্বাসই করবে না সব কথা।

এমন কি কথা, স্যার, যে আপনি বললেও বিশ্বাস করব না?

করবে না। যেমন ধর শিশুদের গলার ছোট ছোট ক্ষতচিহ্নগুলোর কথা। তোমার মতে লুসির গলা আর শিশুদের গলার ক্ষতের জন্যে একই শক্তি দায়ী।

হ্যাঁ, আমার তো তাই ধারণা…।

না, তা নয়, জন, উঠে দাঁড়ালেন প্রফেসর। আসল ব্যাপারটা সত্যিই অবিশ্বাস্য।

দোহাই আপনার, স্যার। আর হেঁয়ালি সইতে পারছি না আমি। যা বলার বলে ফেলুন, প্রায় চেঁচিয়ে উঠলাম আমি।

সোজা আমার চোখে চোখ রাখলেন প্রফেসর। ভরাট গম্ভীর গলায় বললেন, যদি বলি শিশুদের গলায় ওগুলো লুসির দাঁতের চিহ্ন?

স্তব্ধ হয়ে গেলাম প্রফেসরের কথা শুনে। ধীরে ধীরে একটা অন্ধ ক্রোধ মাথা চাড়া দিয়ে উঠল আমার মনে। যেন আমার সামনে বিনা দোষে লুসির গালে একটা প্রচও থাপ্পড় মেরে বসেছেন প্রফেসর। কয়েক মুহূর্ত কথা ফুটল না আমার মুখে। শেষে ফিসফিস করে বলেই বসলাম, আসলে, আসলে আপনি পাগল হয়ে গেছেন, স্যার?

আমার কথায় বিন্দুমাত্র রাগ করলেন না প্রফেসর, যেন এই উত্তরই আশা করেছিলেন তিনি। মৃদু হেসে শান্ত কণ্ঠে বললেন, হলে সত্যিই খুশি হতাম, জন। এরকম নির্মম সত্যকে সহ্য করতে পারবে না বলেই আসল কথা সহজে বলতে চাইনি আমি।

প্রফেসরের কণ্ঠস্বর আর বলার ভঙ্গি যেন চাবুক মেরে বাস্তবে ফিরিয়ে আনল আমাকে। পরিষ্কার বুঝতে পারলাম সম্পূর্ণ সুস্থ মস্তিষ্কে আছেন প্রফেসর। আসলে ওই নির্মম সত্যকে সহ্য করতে না পেরেই হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়েছিলাম আমি। একটু আগে প্রফেসরকে অমন একটা কটু কথা বলে বসেছি ভেবে লজ্জায় চোখ তুলে চাইতে পারলাম না তার দিকে। মাথা নিচু করে বললাম, গর্দভের মত কথা বলে ফেলেছি, স্যার। দয়া করে মাপ করবেন।

এতে লজ্জার কিছু নেই, জন। তোমার বয়সে, তোমার অবস্থায় থাকলে আমিও এর চেয়ে ভাল কিছু বলতাম না। তাছাড়া লুসিকে ভালবাসতে তুমি। ওর সম্পর্কে এধরনের কথা শুনলে মাথা ঠিক না থাকারই কথা তোমার। তবু, আমার মুখের কথা শুনে তোমাকে ব্যাপারটা বিশ্বাস করতে বলব না। সাহস থাকলে চল, আজ রাতেই প্রমাণ করে দেব আমি।

এবার সত্যিই বিপদে পড়লাম। যত সহজ মনে হচ্ছে ব্যাপারটা চোখের সামনে ঘটতে দেখে সহ্য করা তত সহজ নয়। ইতস্তত করতে লাগলাম বুঝতে পেরে প্রফেসর বললেন, তোমাকে ব্যাপারটা চাক্ষুষ না দেখিয়ে আর এক পা-ও এগোব না আমি। কারণ তোমার সাহায্য যখন আমার দরকার, তোমাকে আগে পুরোপুরি বিশ্বাস করাতে হবে। তা নাহলে বার বারই নিজের অজ্ঞাতে হলেও আমার কাজে বাধার সৃষ্টি করবে তুমি।

ঠিক আছে, স্যার। যা ভাল বোঝেন, করুন। তা আপাততঃ আমাদের কাজ কি?

প্রথমেই নর্থ হসপিটালে গিয়ে সবচেয়ে শেষের শিশুটাকে পরীক্ষা করে দেখব আমি, একা। ওর চার্জে থাকা ডাক্তার ভিনসেন্টের সাথে আগেই কথা বলে রেখেছি।

তারপর?

তারপর আরো কিছু টুকিটাকি কাজ সেরে সন্ধ্যার পর চলে যাব হ্যাম্পস্টেডের কবরখানায়। রাতটা ওখানেই কাটাব দুজনে, বলে পকেট হাতড়ে কি যেন একটা বের করলেন প্রফেসর। আর এই যে দেখ, লুসিদের পারিবারিক কবরখানার চাবি। ইচ্ছে করেই আর্থারকে দিইনি আমি এটা। চাবিটা আবার পকেটে রেখে দিয়ে বললেন প্রফেসর, খেয়ে দেয়ে একটু ঘুমিয়ে নাও তুমি। নাহলে রাত জাগতে কষ্ট হবে। আমি চললাম, বলেই ঘুরে দাঁড়িয়ে রওনা হয়ে গেলেন।

প্রফেসর চলে যাবার পর সটান শুয়ে পড়লাম বিছানায়। খেতে বসেও লাভ নেই, সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গেছে খাবার রুচি। বিছানায় শুয়েও বহুক্ষণ ঘুম এল না চোখে। কেবলই ঘুরে ফিরে মনে আসছে এক চিন্তা ভাবতে ভাবতেই কখন যে ঘুমিয়ে পড়লাম জানি না।

.

সন্ধ্যার পর পরই রাতের খাওয়াটা সেরে নিলাম আমি আর প্রফেসর। তারপর বেরিয়ে পড়লাম দুজনে। কৃষ্ণপক্ষের রাত কাজেই ঘুটঘুটে অন্ধকার। এখানে ওখানে ঘরের ফাঁক ফোকর দিয়ে বেরিয়ে আসা আলোর রেখা যাও চোখে পড়ছে দুএকটা, তাতে অন্ধকার তো কাটছেই না বরং আরো যেন বাড়িয়ে তুলেছে। এলোমেলো বয়ে চলেছে হিমেল হাওয়া। দূর থেকে ভেসে আসছে টহলদারী পুলিশের ঘোড়ার খুরের শব্দ। কর্কশ শব্দে একবার ডাকছে, একবার থামছে ঝিঝিগুলো। ঝিঝির ডাক থেমে গেলেই নিস্তব্ধ নিঝুম হয়ে পড়েছে চারদিক। মাঝে মধ্যে ডানা ঝটপট করে মাথার ওপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে দুএকটা নিশাচর পাখি।

হাঁটতে হাঁটতে সংকীর্ণ ঢালু পথ বেয়ে পাহাড়ী উপত্যকায় এসে পৌঁছলাম। এলাকাটা আমার সম্পূর্ণ চেনা হলেও এখন কেমন যেন রহস্যময় লাগছে আশপাশটা। অন্ধকারে আবছামত ঠাহর হচ্ছে হ্যাম্পস্টেডগির্জার উঁচু চূড়া।

কারখানার কাছে পৌঁছে গেট খুলে ভেতরে ঢুকলাম। দুপাশের বিশাল সব ওক আর বার্চের সারির মাঝখান দিয়ে চলে গেছে পাথর বা ধান চওড়া পথ। এ পথটা থেকে আবার ডাইনে বাঁয়ে বেরিয়ে গেছে বহু শাখা পথ। কুঞ্জবিতানের মত লতায় পাতায় ঢাকা এই সরু পথগুলো। এরকম একটা শাখা ধরেই লুসিদের পারিবারিক কবরখানার সামনে এসে পৌঁছলাম আমরা। আমাকে কারখানার দরজার তালা খুলতে বলে একটা ছোট্ট মোমবাতি জ্বাললেন প্রফেসর। দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে লুসির কফিনের সামনে এসে দাঁড়ালাম। আমার হাতে মোমবাতিটা দিয়ে একটা স্কু-ড্রাইভার বের করে কফিনের কজার স্কু খুলতে শুরু করলেন প্রফেসর। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কফিন খুলছেন কেন, স্যার?

হলে বিশ্বাস করা কি করে, তোমাকে? কথা বলতে বলতেই স্কু খুলে কফিনের ডালাটা তুলে ধরে আমাকে ভেতরে তাকাতে বললেন প্রফেসর। কফিনের ভেতর একবার উঁকি দিয়েই স্তব্ধ হয়ে গেলাম। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হলো না আমার। এ-ও কি সম্ভব? খা

খাঁ করছে কফিনের ভেতরটা। লুসির মৃতদেহের চিহ্নমাত্র নেই ওতে। অথচ স্থির নিশ্চিত আমি, এটাই লুসির কফিন। উত্তেজনায় ঝিমঝিম্ করতে লাগল সারা শরীর, ঝাঁ ঝাঁ করছে দুকান। মনে হচ্ছে মাথার ভেতর করাত চালাচ্ছে কেউ। আমার ভাবান্তর লক্ষ্য করে স্থির শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করলেন প্রফেসর, সন্দেহ ঘুচেছে?

না। লুসির লাশটা কফিনে নেই বলেই কোন কিছু প্রমাণ হয় না।

কেন?

কেন? এমনও তো হতে পারে কেউ চুরি করে নিয়ে গেছে ওর লাশটা, বলেই বুঝলাম গর্দভের মত কথা বলে ফেলেছি। এটা কোন যুক্তিই নয়। কারণ কফিন থেকে লাশ চুরি করতে যাবে কে? তাতে লাভই বা কি?

বোকার মত কথা বলো না। ঠিক আছে, আরো দেখতে চাও? এসো, দেখাচ্ছি, বলে কফিনের ডালাটা বন্ধ করে দিলেন প্রফেসর। ফুঁ দিয়ে বাতিটা নিভিয়ে স্কু-ড্রাইভারটাসহ ব্যাগে ভরে রাখলেন। বাইরে বেরিয়ে এসে আবার তালা মেরে দিলাম দূরজায়। তারপর আমাকে গির্জার এদিকটায় নজর রাখতে বলে অন্য দিকটায় এগিয়ে গেলেন তিনি। বিশাল একটা দেবদারুর আড়ালে লুকিয়ে থাকলাম আমি। প্রফেসর অদৃশ্য হয়ে গেলেন ওদিককার একটা গাছের আড়ালে। গা ছমছমে নিস্তব্ধতা চারদিকে। সেই অখণ্ড নীরবতাকে ভেঙে খান খান করে দিয়ে মাঝে মধ্যেই কর্কশ শব্দে ডেকে উঠছে ঝিঝিগুলো, কিছুক্ষণ একটানা ডেকেই

থেমে যাচ্ছে আবার। আরো জমাট বাঁধছে নিস্তব্ধতা। আরও কিছুক্ষণ কেটে যাবার পর চাঁদ উঠলো। কৃষ্ণপক্ষের আবছা কমলারঙা একফালি ভৌতিক চাদ। ফ্যাকাসে জ্যোৎস্নায় পরিষ্কার হয়নি আশপাশের কোন কিছুই, বরং আরো অদ্ভুত রহস্যময় দেখাচ্ছে ঝোপঝাড়গুলোকে। হিমেল হাওয়ার ঝাঁপটায় মজ্জা পর্যন্ত ভেদ করতে চাইছে প্রচণ্ড ঠাণ্ডা, এতো ঠাণ্ডায়ও ভয়ে দরদর করে ঘামছি আমি। লুসির শূন্য কফিনটার কথা মনে পড়লেই, আতঙ্কে খাড়া হয়ে যাচ্ছে গায়ের লোম। বাতাসে পাতা নড়ার সামান্যতম শব্দেও চমকে উঠছি, মনে হচ্ছে এই বুঝি ঘটলো ভয়ঙ্কর একটা কিছু। একনাগাড়ে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে পা ব্যথা করতে শুরু করেছে। গড়িয়ে চললো সময়। বারটা বাজলো, তারপর একটা, দুটো, আর কতক্ষণ অপেক্ষা করব? ঠিক এই সময় চোখে পড়লো ওটা। দেবদারুর ছায়ায় ছায়ায় কবরখানার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে আগাগোড়া সাদা কাপড়ে ঢাকা একটা মূর্তি। সাদা মূর্তিটা আরও একটু এগিয়ে আসতেই দেখলাম ওটার পেছন পেছন অনুসরণ করে আসছে একটা কালো মূর্তি। হাঁটার ধরন দেখেই বুঝলাম প্রফেসর। দেবদারুর আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে ছুটলাম সেদিকে। কয়েক পা গিয়েই একটা পাথরে হোঁচট খেয়ে মাটিতে পড়ে গেলাম, কপালটা দারুণভাবে ঠুকে গেল একটা পাথরে। ঝিঝিম্ করতে লাগল মাথাটা। কয়েক সেকেণ্ড পর ঝিঝিম্ ভাবটা একটু কমতেই দেখলাম ঠিক আমার সামনে এসে পড়েছে সাদা মূর্তি। কিছুই না বুঝে চেঁচিয়ে উঠলাম। আমার চিৎকার শুনে থমকে দাঁড়ালো সাদা মূর্তিটা, পরক্ষণেই জুনিপার ঝোপের ওপর দিয়ে উড়ে গিয়ে লুসিদের কবরখানার সামনে পৌঁছেই কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেল।

কতক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে ছিলাম জানি না, চমক ভাঙলো প্রফেসরের ডাকে, কি ব্যাপার, জন, পড়ে গেলে কি করে?

উঁ! না, এমনি, হঠাৎ একটা পাথরে হোঁচট লেগে পড়ে গিয়েছিলাম, বলতে বলতে উঠে দাঁড়ালাম আমি।

লাগেনি তো কোথাও?

না, বলেই প্রফেসরের বুকের কাছে জড়ানো ছোট্ট পুঁটলিটা নজরে পড়লো। ওটা কি, স্যার?

এটা মানব শিশু। তা সাদা মূর্তিটাকে দেখেছ তো ঠিকমত?

চেহারাটা দেখিনি।

তোমার জবাব পেয়েছ?

চেহারা যখন দেখিনি, লুসি কিনা কি করে বলব? কিন্তু, স্যার, ওই শিশুটাকে আপনি কোথায় পেলেন?

একটা দেবদারুর গোড়ায়। ডাইনীটাও ছিলো ওখানে, আমার সাড়া পেয়ে পালিয়েছে।

কোন ক্ষতি হয়নি তো শিশুটার?

না দেখে কি করে বলি? এসো আমার সাথে, ঘুরে দাঁড়িয়ে হাঁটতে শুরু করলেন প্রফেসর, আমিও তার পিছু পিছু চললাম। গির্জার কাছাকাছি পৌঁছে বসে পড়ে মাটিতে নামিয়ে রাখলেন তিনি শিশুটাকে। পকেট থেকে দেশলাই বের করে জ্বালিয়ে ভালমত পরীক্ষা করলেন শিশুর গলার কাছটা। খুশি হয়ে বললেন, না, কোন দাগ নেই। ঠিক সময়ই পৌঁছে গিয়েছিলাম আমি।

তা এখন এটাকে নিয়ে কি করবেন, স্যার?

সেটাই সমস্যা, এত রাতে ওকে নিয়ে কোন পুলিশ ফাঁড়িতে গেলে প্রশ্নের ঠেলায় জান বেরিয়ে যাবে। কে জানে উল্টো আমাদেরকে শিশু অপহরণের সাথে জড়িত ভেবে সন্দেহ করে হাজতেও পুরে দিতে পারে পুলিস। তাহলে আমাদের বারটা না বাজিয়ে ছাড়বে না ওরা। তারচেয়ে এক কাজ করা যাক। পথের ধারে পুলিশ বা সাধারণ লোকের নজরে পড়তে পারে এমন কোন জায়গায় শুইয়ে রাখি শিশুটাকে। ভোর হয়ে গেছে। নিরাপদেই থাকবে শিশুটা।

আবার যদি ডাইনী এসে তুলে নিয়ে যায় শিশুটাকে?

নেবে না। আর আসতেই পারবে না ও এখন। শুনছো না মোরগ ডাকছে?

মোরগ ডাকলে আর বেরোতে পারে না বুঝি ডাইনীরা?

না।

জায়গামত পৌঁছে শিশুটাকে মাটিতে শুইয়ে রেখে অদূরেই একটা ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে পড়লাম আমরা। একটু পরই টহলদারী পুলিশের ঘোড়ার পায়ের শব্দ শোনা গেল। ঠিক সেই সময়ই হয়ত জেগে গিয়ে বা অন্য কোন কারণে চেঁচিয়ে কেঁদে উঠলো শিশুটা। সঙ্গে সঙ্গে থেমে গেল ঘোড়ার খুরের শব্দ। মুহূর্ত পরই আবার এগিয়ে আসতে লাগল দুটো ঘোড়া, এবার দ্বিগুণ জোরে। কয়েক সেকেণ্ড পরই দেখলাম লণ্ঠন হতে এগিয়ে আসছে দুজন ঘোড়সওয়ার। শিশুটাকে খুঁজে পেয়ে ওটাকে নিয়ে চলে গেল পুলিশ দুজন। ওরা চলে যাবার পরও আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলাম আমরা, তারপর ঝোপের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে বাড়ির দিকে রওনা দিলাম।

পথ চলতে চলতেই প্রফেসর বললেন, বাড়িতে গিয়ে ঘুমিয়ে নিতে হবে খানিকটা। আজ দুপুরে আবার হানা দেব হ্যাম্পস্টেডের কবরখানায়।

২৭ সেপ্টেম্বর।

গত রাতের ঘটনার পর ওই অভিশপ্ত কবরখানায় যেতে আর আমার ইচ্ছে হল, কিন্তু ছাড়লেন না প্রফেসর। নির্জন ওই সমাধি ভূমিতে পৌঁছতে পৌঁছতে মাথার ওপর উঠে এল সূর্য। আশ্চর্য, গত রাতে দেখা সেই কবরখানার সঙ্গে এর যেন কোন মিল নেই। উজ্জ্বল রোদে ঝলমল করছে সারাটা উপত্যকা।

লুসিদের কবরখানার গেট খুলে ভেতরে ঢুকে গতরাতের মতই লুসির কফিনের ডালা খুলে তুলে ধরলেন প্রফেসর। আছে। ঠিকমতই কফিনের ভেতর শুয়ে আছে লুসি। এ কি অদ্ভুত কাণ্ড-কারখানার মধ্যে পড়লাম! রাতের বেলা ছিলো না, এখন আবার সে এলো কোত্থেকে? সবচেয়ে আশ্চর্য ব্যাপার, লুসি মারা যাবার পর সাতদিন পেরিয়ে গেছে, কিন্তু একটুও বিকৃত হয়নি ওর শরীর। অথচ এতদিনে পচে গলে যাবার কথা ছিল লাশটার।

আগের চেয়েও অনেক, অনেক বেশি সুন্দরী মনে হচ্ছে লুসিকে। আশ্চর্য রকম টুকটুকে লাল হয়ে গেছে ওর ঠোঁট দুটো, যেন কাঁচা রক্ত লেপে দেয়া হয়েছে ওখানে। অবাক কণ্ঠে নিজেই নিজেকে শুধালাম, এ কি স্বপ্ন, না সত্যি?

আমার হয়ে জবাব দিলেন প্রফেসর, দিনের আলোর মত সত্যি। বলে উবু হয়ে আঙুল দিয়ে লুসির ঠোঁট দুটো একটু ফাঁক করে সেদিকে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললেন তিনি, দেখেছ, কেমন তীক্ষ্ণ হয়ে উঠেছে দাত দুটো? আমার কথাকে অস্বীকার করার আর কোন যুক্তি আছে তোমার?

নেই। এত কিছু অবিশ্বাস্য কাজ কারবার দেখার পর থাকতেও পারে না। একসময় যাকে ভালবেসেছিলাম তার এমন কদর্য ডাইনী রূপ চোখের সামনে দেখতে পাব এ কি স্বপ্নেও ভেবেছি কখনো? পরস্পর বিরোধী একটা ভাব মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে চাইল মনের মধ্যে। এ ধরনের একটা অলৌকিক ঘটনাকে কিছুতেই সত্যি বলে মেনে নিতে পারছি না, অথচ খণ্ডন করার মত যুক্তিই বা

কোথায়? তবু মিনমিন করে বললাম, যে চুরি করেছিল, ভোর রাতে হয়তো আবার সুসির লাশটাকে যথাস্থানে ফিরিয়ে দিয়ে গেছে সে-ই।

ঠিক। কিন্তু কে চুরি করেছিল লাশটা?

তা তো জানি না।

হো হো করে হেসে উঠলেন প্রফেসর, ওরকম কথা যদি তোমার হাসপাতালের কারও কাছে কখনও বল, হয় ঘাড় ধরে হাসাতাল থেকে বের করে দেবে তোমাকে, নাহয় তোমার রোগীদের সাথেই জায়গা করে দেবে। এখন আবোলতাবোল চিন্তা বাদ দিয়ে আমার কথা শোন। একটা জিনিস বল তো, কখনও কোন মানুষের ওই দুটো দাঁত অমন তীক্ষ্ণ আর লম্বা হয়ে উঠতে দেখেছ? তাও আবার মৃত্যুর পর? মেডিকেল সায়েন্সে আছে এ কথার উল্লেখ? আর মৃত্যুর পরও দীর্ঘদিন ধরে মানুষের স্বাস্থ্য অটুট থাকে, বেড়ে যায় রূপ-লাবণ্য এটা কোন কেতাবে লেখা আছে?

জবাব দিতে পারলাম না। নেই তো, দেবো কি করে? কয়েক সেকেণ্ড চুপ করে থেকে আমাকে কিছুটা ধাতস্থ হবার সময় দিলেন প্রফেসর। তারপর আবার বলতে থাকলেন, আজ তোমাকে সব খুলে বলছি, জন। এক দ্বৈত জীবনযাপন করছে এখন লুসি। আমাদের সমাজে থাকাকালীন এক ভয়ঙ্কর জঘন্য পিশাচ ওর রক্ত পান করতে আসত। ওকে সম্মোহিত করে নিজের পৈশাচিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করত শয়তানটা। শেষ পর্যন্ত সম্মোহিত অবস্থায়ই মৃত্যু ঘটে লুসির। এতে ওর ওপর পিশাচটার প্রভাব পুরোপুরিই থেকে যায়। তাই ও আজ আমাদের কাছ থেকে মরে গিয়েও অমৃতা থেকে গেছে। একটা কথা হয়ত জানো না তুমি, সম্মোহিত অবস্থায় মারা গেলে লাশের শরীরে সুপ্ত থেকে যায় আত্মা। আর পিশাচটার প্রভাব লুসির ওপর থেকে যাওয়ায় ওটার মতই রক্তচোষা হয়ে গেছে সে-ও। এখন আমাদের হাতে একটাই মাত্র পথ খোলা আছে, সত্যিকার মৃত্যুর জগতে পাঠিয়ে দিতে হবে লুসিকে।

বুঝতে পারছি এধরনের কথাবার্তা আর বেশিদিন শুনতে থাকলে আমার পরিচালিত পাগলা গারদেরই রোগী হতে হবে আমাকে। মাথার ভেতর তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে সবকিছু, তবু জিজ্ঞেস করলাম, একটা মরা মানুষকে দ্বিতীয় বার মারবেন কি করে আপনি, স্যার?

সহজেই। এসব ক্ষেত্রে প্রথমে লাশের মাথা কেটে ফেলতে হয়। তারপর মুখের ভেতর বুনো রসুনের কোয়া পুরে দিয়ে হৃদপিণ্ড বরাবর ঢুকিয়ে দিতে হয় কাঠের দুচাল কীলক।

লুসির অপূর্ব সুন্দর দেহটা ছিন্ন ভিন্ন হচ্ছে, কল্পনার চোখে দেখতে পেয়ে শিউরে উঠলাম। কিন্তু আশ্চর্য, মনে যতটা, ব্যথা পাওয়া উচিত ছিল ততটা পেলাম না। পেলাম না এই কারণে যে, মানুষ লুসিকে ভালবাসতাম আমি, ডাইনী লুসিকে নয়। আসলে প্রফেসরের কথা একটু একটু করে বিশ্বাস করতে শুরু করেছি আমি।

ভেবেছিলাম আজই কাজ শুরু করে দেবেন প্রফেসর, কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে কফিনের ডালাটা বন্ধ করে ফেললেন প্রফেসর। তারপর আমার হাত ধরে টানলেন, এসো। বাড়ি ফিরে যাই।

থমথমে গম্ভীর মুখে পাহাড়ী উপত্যকার ঢাল বেয়ে নামছেন প্রফেসর, পেছনে পেছনে নামছি আমি। দেখে মনে হচ্ছে গভীর চিন্তায় ডুবে আছেন প্রফেসর। আর থাকতে না পেরে শেষ পর্যন্ত জিজ্ঞেসই করে ফেললাম, কিছু ভাবছেন, স্যার?

অ্যাঁ, হ্যাঁ। ভাবছি বৈকি, জন। ভাবছি যত শীঘ্র সম্ভব এই পৈশাচিক জীবন থেকে মুক্তি দিতে হবে সুসিকে। তবে তার আগে আর্থারকে জানান দরকার। কিন্তু বুঝতে পারছি না কেমন করে বোঝাব তাকে। নিজের চোখে অনেক অবিশ্বাস্য ঘটনা দেখেছ তুমি। মৃত্যুর আগে লুসির গলার ক্ষতচিহ্ন, আর হাসপাতালে ভর্তি হওয়া দুএকটা আঁহত শিশুর গলার দাগের সামঞ্জস্য নিজের চোখে দেখেছ তুমি। লুসির কফিন রাতে খালি আর দিনে ভরা দেখেছ। হ্যাম্পস্টেডের কবরখানায় এক দেবদারুর গোড়ায় একটা শিশুকে কুড়িয়ে পাবার সাক্ষী তুমি। গভীর রাতে জুনিপার ঝোপের ওপর দিয়ে উড়ে যাওয়া সাদা মূর্তিটাও মিথ্যে দেখনি। অথচ এতকিছু দেখার পরও তোমাকে বোঝাতে যা বেগ পেতে হয়েছে, তাতে ভয় হয় আদৌ বোঝাতে পারবো কিনা আর্থারকে। একটু থেমে দম নিয়ে আবার বলতে শুরু করলেন তিনি, মৃত্যুর আগে লুসির ঠোঁটে চুমো খেতে দিইনি আর্থারকে, তাতেই মনঃক্ষুন্ন না হবার ভান করলেও সে যে তা হয়েছিল এটা নিশ্চিত। এখন আবার ভুল করে বলে বসে লুসিকে জীবন্ত কবর দিয়েছি আমরা। কারণ লুসির মৃত্যুর রায় দিয়েছি আমরা দুই ডাক্তার। এতে আরেকটা সম্ভাবনা তার মাথায় জাগতে পারে, জীবিতাবস্থায় লুসিকে কবর দেবার পর কফিনের ভেতর আমরা খুন করেছি তাকে। আর এ ধারণায় যদি একবার পেয়ে বসে আর্থারকে তাহলে তার পরিণতি একবার চিন্তা করে দেখ তো। অতএব ভেবেচিন্তে অতি সাবধানে এগোতে হবে আমাকে। পরিষ্কারভাবে আর্থারকে বোঝাতে হবে, দেখাতে হবে সবকিছু। আর তারপর, শুধুমাত্র তারপরই লুসিকে ওই অভিশপ্ত জীবন থেকে মুক্তি দেয়া সম্ভব।

কথা বলতে বলতেই বাড়ি পৌঁছে গেলাম। এখান থেকে বিদায় নেবেন প্রফেসর। কিছু টুকিটাকি কাজ সারতে শহরে যেতে হবে তাকে। যাবার আগে বার বার আমাকে হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলে গেলেন, একটু সাবধানে থেকো, জন। একসময় ভালবাসতে তুমি লুসিকে, সুতরাং এখন তোমার ওপর ওর নজর পড়াও বিচিত্র কিছু নয়। আর কাল রাত দশটায় আমার সাথে বার্কলে হোটেলে দেখা কর। আর্থার আর মরিসকে আসার জন্যেও টেলিগ্রাম করে দেবো আজই। মরিসকে দরকার আছে আমার। এ ধরনের ভয়ঙ্কর কাজে ওর মত শক্তিমান, দুর্ধর্ষ, সাহসী পুরুষের দরকার আছে আমাদের। ওরা এসে পৌঁছুলে সবাই মিলে ঠিক করব আমাদের পরবর্তী কাজ কি, বলেই ঘুরে দাঁড়ালেন প্রফেসর। তারপর লম্বা লম্বা পা ফেলে এগিয়ে গিয়ে একটা বাঁক ঘুরে অদৃশ্য হয়ে গেলেন।

২.০৮ বার্কলে গিয়ে হোটেলে

২৯ সেপ্টেম্বর, ভোর।

সাড়ে নটা নাগাদ বার্কলে গিয়ে হোটেলে পৌঁছেছিলাম গত রাতে। দশটার একটু আগে এসে পৌঁছুল আর্থার আর মরিস। ওদেরকে অভ্যর্থনা জানিয়ে বসাতে বসাতে জিজ্ঞেস করলেন প্রফেসর, তাহলে ঠিকমতই আমার টেলিগ্রাম পেয়েছিলে তোমরা?

হ্যাঁ। এবং পেয়েই ছুটে চলে এসেছি। ভাবলাম, আবার কি ঘটল কে জানে।

ঘটেনি, তবে ঘটবে। আর এজন্যেই ডেকে এনেছি তোমাদের।

ঘটবে? কি ঘটবে, প্রফেসর? জিজ্ঞেস করল মরিস।

ঘটবে ঠিক না, তবে ঘটাব? একটু গুছিয়ে বসলেন প্রফেসর। তারপর আবার বললেন, আর সেজন্যে তোমাদের সবার অনুমতি প্রয়োজন। হয়ত আমার প্রস্তাব শোনা মাত্র তোমরা বিরক্ত, এমনকি রেগেও যেতে পার। কিন্তু তার আগে আমার প্রস্তাবটা অন্তত বিবেচনা করে দেখবে।

কি করতে হবে কিছুই জানা নেই আমার, প্রফেসর, বলতে বলতে, হাতটা বাড়িয়ে দিল মরিস। জানার প্রয়োজনও বোধ করছি না। কারণ কাজটা করতে যাচ্ছেন আপনি। এবং আমি জানি, আর যাই করুন, অন্যায় কিছু করবেন না আপনি। অতএব আমি আপনার দলে।

আর আমার আত্মমর্যাদা বা ধর্মীয় বিশ্বাস ক্ষুন্ন না হলে জীবন দিয়ে হলেও আপনার কাজে সাহায্য করব আমি, প্রফেসর, বলল আর্থার।

ভেরি গুড। তোমাকে কথা দিচ্ছি, আর্থার, তোমার আত্মমর্যাদা বা ধর্মীয় বিশ্বাসের কিছুমাত্র অবমাননা হবে না।

তাহলে এখন আমাদের কি করতে হবে বলে ফেলুন, সমস্বরে বলল আর্থার আর মরিস।

তোমাদের সবাইকে হ্যাম্পস্টেডের কবরখানায় যেতে হবে আমার সাথে। এবং আজ রাতে।

দপ করে মুখের হাসি নিভে গেল আর্থারের। অর্থাৎ, লুসির কবরে?

হ্যাঁ।

কেন?

লুসির কফিনের ডালাটা খুলব আমি। তোমাদের সবার সামনে।

কিন্তু কেন, প্রফেসর, কেন? আপনার কি এমন উদ্দেশ্য পূরণ হবে তাতে?

হবে। কিন্তু আগেভাগে সেকথা বলতে চাই না তোমাদের। বললেও বিশ্বস করবে না, ভরাট গম্ভীর গলায় বললেন প্রফেসর। যদি আজ রাতের মধ্যে তোমাদেরকে বোঝাতে না পারি, তাহলে আর কোনদিন বোঝাতে পারব কিনা সন্দেহ।

অর্থাৎ? আপনি কি বোঝাতে চাইছেন, প্রফেসর?

এক কথায় তা বলে বোঝান অসম্ভব, আর্থার। তবু যখন জানতেই চাইছ, বলছি, একবার কেশে গলাটা পরিষ্কার করে নিলেন প্রফেসর। তারপর ধীর শান্ত গলায় বললেন, তোমরা সবাই জান, মারা গেছে লুসি, তাই না? কিন্তু আমি যদি বলি মরেনি ও…

প্রফেসরের কথার মাঝেই চেঁচিয়ে উঠলো আর্থার; কি সব আবোলতাবোল বকছেন, প্রফেসর? আপনি বলতে চান জীবন্ত অবস্থায়ই লুসিকে কবর…

না, তা বলতে চাই না। এবং লুসি জীবন্ত একথাও বলিনি কখনো। তবে ও জীবন-মৃতা হতে বাধা কোথায়?

জীবন-মৃতা! এ-ও কি সম্ভব?

এ পৃথিবীতে কি যে সম্ভব আর কি অসম্ভব, সঠিকভাবে কেউই বলতে পারে, আর্থার। এমন অনেক রহস্য আছে, শতাব্দীর পর শতাব্দী চেষ্টা করেও তার বিন্দুমাত্র উদ্ঘাটন করতে পারেনি মানুষ। আর তেমনি একটা রহস্যের সম্মুখীন হয়েছি আমরা। এবং এর হাত থেকে মুক্তি পাবার একমাত্র উপায় মাথা কেটে ফেলতে হবে লুসির।

প্র-ফে-স-র! প্রায় ককিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে পড়লো আর্থার। এ আপনি কি বলছেন? কেন করতে যাচ্ছেন কাজটা? আর আমার চোখের সামনে আমার প্রেমিকার লাশটা ছিন্ন ভিন্ন করবেন, আর আমি তাতে সায় দেব ভাবলেন কি করে? হয় আমি ভুল শুনেছি, না হয় পাগল হয়ে গেছেন আপনি।

হাত ধরে আর্থারকে আবার চেয়ারে বসিয়ে বলল মরিস, না, আর্থার, প্রফেসর পাগল হয়ে যাননি। আমি জানি, সময় বিশেষে এ ধরনের নিষ্ঠুর কাজ করতে হয় মানুষকে এবং তা করতে হয় সমাজের আরো দশজন মানুষের কল্যাণার্থে। জীবনে বহু দেশ ঘুরেছি আমি, দেখেছিও অনেক। সেজন্যেই প্রফেসরের কথায় বিন্দুমাত্র অবাক হচ্ছি না আমি। আপনি বলে যান, প্রফেসর, আমরা শুনছি।

তোমাকে ধন্যবাদ, মরিস, একটু থেমে আবার বলতে শুরু করলেন প্রফেসর, দৃঢ় আত্মবিশ্বাস তার কণ্ঠে। আর্থার অন্যের প্রতি, তোমার প্রতি, মৃতের প্রতি মানুষ হিসেবে আমারও একটা পবিত্র কর্তব্য আছে এবং যত বাধাই আসুক, ঈশ্বরের নামে শপথ করে বলছি আমি তা পালন করবই। কিন্তু তার আগে তোমাদেরকে যথাসম্ভব বোঝাতে চেষ্টা করব আমি। শেষ পর্যন্তও যদি তোমাদেরকে পথে আনতে না পারি, আমার কাজ আমি করবই। তবে আমার মনে হয় সব মিজের চোখে দেখলে অনেক কিছুই পরিষ্কার হয়ে যাবে তোমাদের কাছে। আমার একান্ত অনুরোধ, আগে থেকে না বুঝেশুনে ঝট করে কিছু করে বসো না। তার ফল আদৌ শুভ হবে না। এই বৃদ্ধ বয়সেও কেন ওই ভয়ঙ্কর পথে পা বাড়াচ্ছি আমি বলতে পার? বাড়াচ্ছি নিষ্ঠুর পৈশাচিক পরিণতির হাত থেকে তোমাদের বাঁচাতে আজ যদি আমি সরে দাঁড়াই এই পৈশাচিকতার হাত থেকে কেউ পরিত্রাণ পাবে না তোমরা; তুমি, জন, মরিস কেউ না, কারণ তোমরা তিনজনই লুসির বন্ধু। এবং তোমাদের পরও এই পরিণতির শিকার হবে হ্যাম্পস্টেড এবং তার আশেপাশের এলাকার অসংখ্য যুবক যুবতী। তুমি কি তাই চাও আর্থার? তোমাদেরকে ভাল না বাসলে কখনও ওই ভয়ঙ্কর পথে পা বাড়াতে যেতাম না আমি।–লুসি অসুস্থ, জনের কাছ থেকে এ খবর পেয়ে পাগলের মত ছুটেও আসতাম না, নিজের দেহের রক্ত দিয়ে লুসিকে বাঁচানোর চেষ্টাও করতাম না। জীবন-মৃতা লুসির গলা কাটতে কি আমার হাত বিন্দুমাত্র কাঁপবে না বলতে চাও? কাঁপবে। হয়ত তোমাদের চেয়ে একটু বেশিই কাপবে। কারণ ও আমার মেয়ের মত। তবু কেন করতে যাচ্ছি কাজটা? করতে যাচ্ছি এক অভিশপ্ত পৈশাচিক জীবন থেকে ওর আত্মাকে মুক্তি দিতে। ওকে স্বাভাবিক মৃত্যুর দেশে পাঠাতে। তাতে শান্তি পাবে লুসির আত্মা। শান্তি পাব আমরা সবাই।

প্রফেসরের কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে উঠে এসে তার হাত দুটো চেপে ধরল আর্থার, বলল, না বুঝে আপনাকে ব্যথা দিয়েছি। প্রফেসর, আমাকে মাফ করুন।

উত্তরে শুধু হাসলেন প্রফেসর, সে-হাসিতে উপচে পড়ল স্নেহ আর ভালবাসা।

হ্যাম্পস্টেডের কবরখানায় এসে পৌঁছলাম রাত বারটায়। কখনো ঘন কালো মেঘের ফাঁক থেকে বেরিয়ে এসে চারদিকে ধূসর আলো ছড়িয়ে দিচ্ছে চাঁদ, কখনো গাঢ় অন্ধকারে ঢেকে দিয়ে ঢুকে পড়ছে ভেতরে। এদিকে ওদিকে টিপটিপ করে জ্বলছে জোনাকির দীপ। একটানা কর্কশ শব্দে ডেকে চলেছে ঝিঝিগুলো। কবরখানার গেট খুলে ভেতরে ঢুকলেন প্রফেসর পেছন পেছন আমরা তিনজন। লুসির কফিনের কাছে বসে মোমবাতি জ্বাললেন প্রফেসর। তারপর আমার দিকে ফিরে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, গতকাল যখন আমার সাথে এখানে এসেছিলে তুমি, লুসির লাশটা ছিলো কফিনে?

 আর্থার আর মরিসকে উদ্দেশ্য করে বললেন প্রফেসর, শুনলে তো তোমরা? এখন দেখ…

বলেই কফিনের ডালাটা তুলে ধরলেন প্রফেসর। খালি কফিন। স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল আর্থার আর মরিস। কয়েক সেকেণ্ড পর নীরবতা ভাঙল আর্থার, কাজটা কে করল প্রফেসর, আপনি?

আমি করিনি। আজ থেকে দুদিন আগেও রাতের বেলা এখানে এসেছিলাম আমি আর জন। সেদিনও কফিন খুলে দেখেছিলাম লুসি নেই। অবশ্য কিছুক্ষণ পর আবার ফিরে এসেছিল সে।

ফিরে এসেছিল?

হ্যাঁ। কি, ঠিক বলিনি, জন?

হ্যাঁ।

কিন্তু এখন কফিন খালি। কেন বালি, কোথায় গেল লুসি সব আজ তোমরা চাক্ষুষ দেখতে পাবে। কোন সন্দেহই আজ তোমাদের মনে রাখব না আমি। চল, বাইরে গিয়ে অপেক্ষা করি।

কফিনের ডালাটা বন্ধ করে বাতি নিভিয়ে দিলো প্রফেসর। তারপর সবাই বাইরে বেরিয়ে এলাম। সামাধিকক্ষের রুদ্ধ বাতাসে দম বন্ধ হয়ে আসছিল এতক্ষণ, এখন বাইরে বেরিয়ে এসে খোলা হাওয়ায় হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। মেঘের ফাঁক থেকে আবার বেরিয়ে এসেছে চাদ। কৃষ্ণপক্ষের ঘোলাটে চাঁদের আলোয় কেমন যেন ভৌতিক লাগছে চারপাশের সবকিছু। অস্বাভাবিক নিঝুম মনে হচ্ছে আশপাশটা। কেন? এতটা নীরব মনে হয়নি তো একটু আগেও? হঠাৎ বুঝলাম কারণটা। চুপ করে গেছে ঝিঝি পোকাগুলো।

একটা সিগারেটের জন্য আনচান করে উঠল বুকটা। কিন্তু প্রফেসরের সামনে ধরাই কি করে? বাইরে বেরিয়েই ব্যাগ হাতড়ে বিস্কুটের মত কি যেন একটা বের করলেন প্রফেসর। একটা সাদা রুমালে জড়িয়ে চাপ দিয়ে ভেঙে গুঁড়ো করলেন তিনি জিনিসটাকে, তারপর ময়দার তালের মত কিসের সাথে সেই গুড়ো মিশিয়ে দুহাতের চেটো দিয়ে ঘষে ঘষে সরু সরু ফালি বানিয়ে, সমাধিকক্ষের বন্ধ কপাটের ফাঁকে ঠেসে ঠেসে গুঁজে দিলেন ওগুলো। অবাক লাগল ব্যাপারটা। কৌতূহলী হয়ে উঠল আর্থার আর মরিসও। শেষ পর্যন্ত আর থাকতে না পেরে জিজ্ঞেসই করে ফেললাম, ওটা কি করলেন, স্যার?।

জীবন-মৃতা ডাইনীটার ভেতরে ঢোকার পথ রুদ্ধ করে দিলাম।

ওই সামান্য ময়দার লেচি আটকে রাখতে পারবে ডাইনীটাকে? মরিসের কণ্ঠে অবিশ্বাস।

অবশ্যই, দৃঢ় আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে জবাব দিলেন প্রফেসর।

ময়দার তালের সাথে ওটা কি মেশালেন, স্যার? জিজ্ঞেস করলাম আমি।

ধুনো। ছোট্ট এক কথায় জবাব দিয়ে মাথা থেকে হ্যাটটা খুলে ফেলে আমাদেরকে ওখান থেকে সরে যেতে বললেন প্রফেসর। তাড়াতাড়ি তিনটা সমাধিস্তম্ভের আড়ালে গিয়ে লুকালাম আমি, আর্থার আর মরিস। প্রফেসরও গিয়ে লুকালেন একটার আড়ালে। অপেক্ষাকৃত হালকা মেঘের আড়ালে গিয়ে ঢুকেছে এখন চাঁদ। তাই নিকষ কালো অন্ধকারে ঢেকে যেতে পারেনি পৃথিবী। কিন্তু দেখা যাচ্ছে না কিছুই। প্রত্যেকটা জিনিসের হালকা একটা অবয়ব চোখে পড়ছে কেবল। পূর্ব অভিজ্ঞতা সত্ত্বেও অন্যদের কাছ থেকে আলাদা হয়ে কি এক অজানা আতঙ্কে শিরশির করে উঠল শরীরটা।

মাটির সমান্তরালে উবু হয়ে থেকেও দেখলাম ধোঁয়াটে অন্ধকার আকাশের পটভূমিকায় সারি সারি কবরগুলো আশ্চর্য রকম সাদা দেখাচ্ছে, আর ঠিক তেমনি আশ্চর্য রকমের কালো দেখাচ্ছে সাইপ্রেস, জুনিপার, ইউক্যালিপটাস গাছগুলোকে। মাঝে মধ্যে লোকালয় থেকে ভেসে আসছে দুএকটা রাত জাগা কুকুরের ডাক। ওই দূরাগত ডাক আর আশপাশের গাছের শুকনো পাতার হালকা মর্মর ধ্বনি মিশে এত ভয়াবহ শব্দের সৃষ্টি করতে পারে, না শুনলে ভাবতে পারবে না কেউ। এই বিশাল কবরখানায় নিথর নিঝুম হয়ে আছে পৃথিবী, স্তব্ধ হয়ে গেছে যেন সময়ের গতি। ঠিক এই সময় কাছেই একটা কবরের পাশে লুকিয়ে থাকা প্রফেসরের চাপা অস্ফুট ডাকে চমকে উঠলাম। তেমনি চাপা গলায় দিক নির্দেশ করে আমাদেরকে তাকাতে বললেন প্রফেসর।

প্রফেসরের নির্দেশিত দিকে তাকিয়ে দেখলাম, দূর থেকে ইউক্যালিপটাস-এর ছায়া মাড়িয়ে ধীরে ধীরে এদিকে এগিয়ে আসছে একটা সাদা ছায়ামূর্তি। চলতে চলতেই হঠাৎ করে থমকে দাঁড়ালো মূর্তিটা। ঠিক সেই মুহূর্তে মেঘের ভেতর থেকে বেরিয়ে এল চাঁদ। ঘোলাটে চাদের আলোয় দেখলাম ধবধবে সাদা লাশ ঢাকার পোশাক পরে দাঁড়িয়ে আছে এক তরুণী। বুকের কাছে ধরা কি একটা জিনিসের ওপর ঝুঁকে থাকায় তরুণীর মুখটা ভালমত দেখা যাচ্ছে না। হঠাৎ শব্দ করে ককিয়ে কেঁদে উঠল তরুণীর বুকের কাছে ধরা প্রাণীটা। মানব শিশুর উচ্চকিত কান্না। শিশুটা কেঁদে উঠতেই সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আবার এগিয়ে আসতে শুরু করল তরুণী। পরিষ্কার চিনতে পারলাম এবার লুসিকে। আমাদের তিন নায়কের গভীর ভালবাসার পাত্রী মিস্ লুসি ওয়েস্টেনরা। এই মুহূর্তে আশ্চর্য রকম বদলে গেছে লুসি। তার চেহারায় সমস্ত কোমলতা আর মাধুর্য মুছে গিয়ে সেখানে ফুটে উঠেছে এক ভয়াবহ নিষ্ঠুরতা।  

চোখের কোণ দিয়ে লক্ষ্য করলাম সমাধিস্তম্ভের আড়াল থেকে অতি ধীরে বেরিয়ে আসছেন প্রফেসর। ফিসফিস করে আমাদেরকেও আড়াল থেকে বেরিয়ে আসতে বললেন তিনি। ততক্ষণে আরও এগিয়ে এসেছে লুসি। ওর ঠোঁটের কষা বেয়ে গড়িয়ে পড়েছে কালচে মত কি যেন। সে-গাঢ় তরল পদার্থ ফোটায় ফোঁটায় ওর সাদা পোশাকে ঝরে পড়ে কালো করে দিয়েছে বুকের কাছটায়। কেউ বলে না দিলেও বুঝতে পারলাম ঝরে পড়া তরল পদার্থটা রক্ত, মানুষের রক্ত। চাঁদের আলোয় রক্তের স্বাভাবিক রঙ বদলে গিয়ে কালো দেখাচ্ছে। প্রফেসরের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, পাথরের মূর্তির মত স্থির দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। আমার পাশেই এসে দাঁড়িয়েছে আর্থার। টলছে ও। হাত বাড়িয়ে আমি ওকে ধরে না ফেললে পড়েই যেত হয়ত।

অত্যধিক নড়াচড়া করাতেই বোধহয় আমাদেরকে দেখতে পেয়ে তীব্র আক্রোশে ফুসে উঠল লুসি। সরাসরি চাইল সে আমার চোখের দিকে। চমকে উঠলাম। কোথায় ওর সেই গভীর নীল চোখ? তার বদলে সেখানে জ্বলজ্বল করছে যেন দুটো জ্বলন্ত অঙ্গার। গভীর বিতৃষ্ণায় ভরে গেল আমার বুকের ভেতরটা। লুসির জন্যে সামান্য ভালবাসা যা তখনও আমার মধ্যে অবিশিষ্ট ছিল ওই ভয়ঙ্কর চোখ দুটো দেখার পর তা একেবারে শেষ হয়ে গেল। হঠাৎ খিলখিল করে হেসে উঠে শিশুটার ঠ্যাং ধরে তাকে দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিল লুসি। নরম ঘাসের ওপর আছড়ে পড়ে প্রচণ্ড শব্দে চেঁচিয়ে উঠল শিশুটা। কচি গলার তীক্ষ্ণ আর্তনাদে ভারি হয়ে উঠল নৈশ বাতাস। সেদিকে বিন্দুমাত্র কান না দিয়ে আর্থারের দিকে কামার্ত দৃষ্টি হেনে মদালসা ভঙ্গিতে এগিয়ে আসতে থাকল লুসি। আর্থারের কাছ থেকে মাত্র দুগজ দূরে দাঁড়িয়ে হাত দুটো সামনে বাড়িয়ে আহ্বান করল সে, তুমি ওদের সাথে কেন, প্রিয়তম? এসো, আমার কাছে এসো। কতদিন থেকে তোমার বাহুপাশে ধরা দেবার জন্যে ব্যাকুল হয়ে আছি আমি। জলতরঙ্গের মত সুরেলা আওয়াজের মত বেজে উঠল যেন লুসির কণ্ঠর। ঝড় তুলল শরীরের প্রতিটি স্নায়ুতন্ত্রীতে। সে মায়াবী আহ্বানে সাড়া না দিয়ে পারা যায় না কিছুতেই। মন্ত্রমুগ্ধের মত সামনে এগিয়ে যাচ্ছিল আর্থার। ঠিক সেই মুহূর্তে ঝড়ের বেগে ছুটে এলেন প্রফেসর। লুসি আর আর্থারের মাঝখানে দাঁড়িয়ে পড়ে একটা ছোট্ট সোনার কুশ তুলে ধরলেন লুসির দিকে। যেন জীবন্ত বৈদ্যুতিক তারে পা দিয়েছে এমন ভাবে আর্তনাদ করে পেছনে ছিটকে পড়ল লুসি। পরমুহূর্তে ঘুরে দাঁড়িয়ে নিজেদের কবরখানার দিকে ছুটল। কিন্তু কবরখানার গেটের সামনে গিয়েই আবার থমকে দাঁড়াল, ভাব দেখে বোঝা যাচ্ছে ভেতরে ঢোকার পথ খুঁজে পাচ্ছে না। গেটের ফাঁক ছিল যেখানে, সেখানে ধুনো মেশান ময়দার ফালি দিয়ে বন্ধ করে দিয়েছেন প্রফেসর, সেখানে বার কয়েক উঁকি ঝুঁকি মেরে ঢোকার পথ না পেয়ে ঘুরে দাঁড়াল লুসি। ক্রুদ্ধ সংহার মূর্তি এখন ওর। কোন রূপসী তরুণীর মুখ এতটা বীভৎস হতে পারে কল্পনাও করবে না কেউ। কোটর থেকে ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চাইছে জ্বলজ্বলে লাল দুটো চোখ, আধ-খোলা ঠোঁটের ফাঁকে দেখা যাচ্ছে ঝকঝকে সাদা দাঁত, চুলগুলো এলোমেলো ভাবে ছড়িয়ে পড়েছে পিঠে, মুখে, বুকে। ছবিতে দেখা যাচ্ছে মেডুসার মত লাগছে এখন ওকে। আতঙ্কে থর থর করে কেঁপে উঠলাম আমি। তীব্র ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিলাম সেদিক থেকে। ঠিক এই মুহূর্তে ওই হিংস্র ডাইনীটাকে হত্যা করতে পারলে বোধহয় অনেকটা স্বস্তি পেতাম।

সমাধিকক্ষের বদ্ধ দরজা আর মাথার ওপর কুশ তুলে ধরা প্রফেসরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে প্রচণ্ড রাগে ফুঁসতে থাকল লুসি। কিন্তু এগোতে পারল না কিছুতেই। প্রফেসরের হাতের ওই পবিত্র কুশের কাছে সে সম্পূর্ণ অসহায়, প্রায় আধ মিনিট চুপচাপ ওই অবস্থায়ই দাঁড়িয়ে থাকলেন প্রফেসর, তারপর বললেন, আধার, আর কোন সন্দেহ নেই তো তোমার? আমার কাজে এরপর আর বাধা দেবে না তুমি?

দুহাতে মুখ ঢেকে অস্ফুট কান্নায় ভেঙে পড়ল আর্থার।

মেয়েমানুষের মত কাঁদলে তো চলবে না, আর্থার। কিছু একটা বল। আমাকে অপেক্ষা করিয়ে রেখো না শুধু শুধু।

আপনার যা খুশি করুন, প্রফেসর। আমাকে আর কিছু জিজ্ঞেস করবেন না। শুধু ওই ডাইনীটাকে চলে যেতে বলুন আমার সামনে থেকে। আমি আর সইতে পারছি না ওকে। অবস্থা দেখে মনে হল যে-কোন মুহূর্তে জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যেতে পারে আর্থার। এগিয়ে গিয়ে দুপাশ থেকে ওকে চেপে ধরে রাখলাম আমি আর মরিস। আশ্চর্য! আমাদের তিনজনের মাঝে কোন ভাবান্তর নেই একমাত্র মরিসের। বরং এই ভয়ঙ্কর ঘটনা দেখে যেন মজা পাচ্ছে ও। ওর দুর্ধর্ষতা আর সাহসিকতার কথা কেবল শুনে এসেছিলাম এতদিন, আজ স্বচক্ষে দেখলাম।

কুশটা দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরে রেখে মোমবাতি জ্বাললেন প্রফেসর। তারপর এগিয়ে গিয়ে দুআঙুলে চিমটি দিয়ে দিয়ে গেটের ফাঁক ফোকরে লাগান ধুনো মেশান ময়দার ফালিগুলো তুলে ফেলতে লাগলেন। সবগুলো ফালি তোলা হয়ে গেলে গেটের কাছ থেকে সরে এলেন তিনি। সঙ্গে সঙ্গেই গেটের দিকে ছুটে গেল ডাইনীটা। চোখের সামনে অবস্থা হতে হতে একেবারে মিলিয়ে গেল ওর অবয়ব। এক মুহূর্ত আগে যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল লুসি, সেখানে দেখা গেল এখন রূপোর মত চিকচিকে একটা ধুলোর ঘূর্ণি। ঘুরতে ঘুরতেই গেটের ফাঁক দিয়ে ভেতরে ঢুকে অদৃশ্য হয়ে গেল ঘূর্ণিটা। হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম আমরা।

লুসি সমাধিকক্ষের ভেতর ঢুকে যেতেই ঘুরে দাঁড়িয়ে বললেন প্রফেসর, এখানে আর দাঁড়িয়ে থেকে লাভ নেই। চলো তো দেখি, শিশুটার কি অবস্থা।

এগিয়ে গিয়ে ঘাসের ওপর থেকে বাচ্চাটাকে তুলে নিলেন প্রফেসর। মোমের আলোয় বাচ্চাটার গলার সূক্ষ্ম ক্ষত দুটো পরীক্ষা করে দেখলেন তিনি, নাড়ীও দেখলেন। তারপর বললেন, বাচবে বলেই মনে হয়।

আগের কায়দায়ই বাচ্চাটাকে টহলদারী পুলিশের হাতে তুলে দিয়ে বাড়ির পথ ধরলাম আমরা। চলতে চলতেই বললেন প্রফেসর, বুঝলে আর্থার, আজ যে মর্মান্তিক অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হলে, ভবিষ্যতে কখনও যদি পেছন ফিরে তাকাও তাহলে বুঝতে পারবে কত প্রয়োজন ছিল এ অভিজ্ঞতার।

বাড়িতে পৌঁছে আমাদের সবাইকে নির্দেশ দিলেন প্রফেসর, এখন একটু ঘুমিয়ে নাও সবাই। দুপুর বারটার পর আবার কাজে নামতে হবে সবাইকে।

২৯ সেপ্টেম্বর, রাত।

চং ঢং করে গির্জার পেটা ঘড়িতে বেলা বারটা বাজতেই আবার হাম্পস্টেডের কবরখানার দিকে রওনা দিলাম আমরা। ইচ্ছে করেই সবাই শোক প্রকাশের কালো পোশাক পরেছি। তাতে দল বেঁধে কবরে ঢুকতে দেখলেও কিছু টের পাবে না লোকে। দেড়টা নাগাদ উপত্যকাটায় এসে পৌঁছলাম আমরা। কবরখানার দারোয়ানের চোখকে ফাঁকি দেবার উদ্দেশ্যে অনির্দিষ্টভাবে খানিকক্ষণ এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি করে একসময় টুক করে রেলিং টপকে ঢুকে পড়লাম কবরখানার ভেতর।

ঝোপঝাড়ের আড়ালে আড়ালে হেঁটে এসে পৌঁছুলাম লুসিদের কবরখানায়। পকেট থেকে চাবি বের করে গেটের তালা খুললেন প্রফেসর। একে একে সমাধিকক্ষের ভেতর ঢুকলাম আমরা সবাই। হাতে করে আজ একটা নতুন ব্যাগ নিয়ে এসেছেন প্রফেসর। বেশ বড়সড় ব্যাগটা, বোধহয় অনেক জিনিসপত্র আজ নিয়ে এসেছেন তিনি এতে করে। ব্যাগ থেকে তিনটা বড় বড় মোমবাতি বের করে জ্বালিয়ে দুটো বসিয়ে দিলেন দুটো কফিনের ওপর, তৃতীয়টা আমার হাতে দিয়ে এগিয়ে গিয়ে লুসির কফিনের ডালাটা তুলে ধরলেন প্রফেসর। প্রায় একসাথে কফিনের ওপর ঝুঁকে দাঁড়ালাম আমি, আর্থার আর মরিস। সাথে সাথেই বাতাসে দোলানো বেতস লতার মত থর থর করে কেঁপে উঠল আর্থার। বুক ভেঙে বেরিয়ে এল একটা দীর্ঘশ্বাস। মাত্র দিন দুয়েক আগে দেখে গেছি আমি লুসিকে। এই দুদিনেই সৌন্দর্য আরো বৃদ্ধি পেয়েছে ওর। কিন্তু আজ আর ওর জন্যে বিন্দুমাত্র ভালবাসা নেই আমার বুকে। গতরাতের কথা মনে পড়তেই আবার বিষিয়ে উঠল মনটা। চোখের কোণ দিয়ে দেখলাম, সামলে নিয়েছে আর্থার। ক্রমশঃ রুক্ষ কঠিন হয়ে উঠছে ওর মুখ চোখ। কুঁচকে ছোট হয়ে আসছে ভূ দুটো। কঠিন গলায় প্রফেসরকে জিজ্ঞেস করল সে, প্রফেসর, একি আমার প্রেমিকা, লুসি, না গতরাতের ডাইনী লুসি?

দুটোই। দিনেরবেলা ও তোমার প্রেমিকা, রাতে হয়ে ওঠে নরকের ঘৃণ্য কীট।

কফিনের ভেতর শায়িত লুসিকে ভয়ঙ্কর একটা দুঃস্বপ্নের মত মনে হচ্ছে এখন আমার কাছে। ওর রূপ লাবণ্য আর বিন্দুমাত্র স্পর্শ করতে পারছে না আমার মনকে। কেবলই ভেসে উঠছে মনের পর্দায়, ওর ঝকঝকে তীক্ষ্ণ ধারাল দাঁত, রক্তমাথা কামার্ত মুখ, আর অসংখ্য বিষাক্ত নাগিনীর মত জট পাকান কালো চুল।

ওদিকে ব্যাগ খুলে প্রয়োজনীয় সমস্ত জিনিসপত্র সাজিয়ে ফেলেছেন প্রফেসর। তার মধ্যে আছে ছোট একটা মাটির প্রদীপ, মাথা মোটা কয়েকটা পেরেক, একটা লোহার হাতুড়ি, একটা মাংস কাটার বড় ধারাল ছুরি আর ফুট তিনেক লম্বা একটা একমুখ চোখা কাঠের গজাল।

জিনিসগুলো একে একে মাটিতে সাজিয়ে রেখে প্রদীপটা ধরিয়ে নিলেন প্রফেসর। ওতে কিসের তেল ব্যবহার করেছেন প্রফেসর বলতে পারব না, কিন্তু স্নিগ্ধ নীলাভ একটা আভা ছড়িয়ে পড়ল সমাধিকক্ষের ভেতর। রীতিমত অবাক হলেও অসীম ধৈর্যের সাথে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকল আর্থার আর মরিস। প্রস্তুতি পর্ব শেষ করে মুখ তুলে তাকালেন প্রফেসর। বললেন, কাজ শুরু করার আগে দুএকটা কথা বলে নিতে চাই তোমাদের। জীবন-মৃত আত্মাদের নিয়ে দীর্ঘদিন যারা চর্চা করেছেন, সেইসব প্রাচীন বিশেষজ্ঞদের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা অনুসরণ করেই একাজে হাত দিয়েছি আমি। কারও আত্মা জীবন-মৃততে পরিণত হবার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় তার অমরত্ব পাবার এক তীব্র লালসা। সম্পূর্ণ ভাবে কেউই মরে না এরা, অমরত্বও পায় না, অথচ শতাব্দীর পর শতাব্দী মৃতদের সংখ্যা কেবল বাড়িয়েই চলে। কোন সুস্থ মানুষ এরকম জীবন-মৃতদের হাতে মারা যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সে-ও হয়ে ওঠে জীবন-মৃত, শিকারের জন্যে হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়াতে শুরু করে নতুন জীবন-মৃত আত্মাও। এমনি ভাবেই সে আদিমকাল থেকে আজ পর্যন্ত পৃথিবীতে কেবল বেড়েই চলেছে জীবন-মৃতদের সংখ্যা। আর্থার, লুসির মৃত্যু শয্যায় তুমি লুসিকে চুমু খেতে যাচ্ছিলে না, যদি তা করতে তাহলে তোমার বিরুদ্ধেও আজ আমাদের এমনি করেই দল পাকাতে হতো। আজ যদি লুসিকে আমরা হত্যা না করি, আজ হোক, কাল হোক বা কদিন পরে হোক তোমাদের জীবন-মৃততে পরিণত করে ছাড়বেই সে। এ থেকে কিছুতেই নিষ্কৃতি নেই তোমাদের। কারণ লুসি জানে তোমরা তিনজনই ওকে ভালবাস। তাই বলছিলাম…

প্রফেসরের কথার মাঝখানেই কথা বলে উঠলো আর্থার, আর আমাদেরকে বোঝনোর দরকার নেই, প্রফেসর কাল রাতেই সব বুঝে গেছি আমরা। এখন শুধু কি করতে হবে তাই বলুন।

ভেরি গুড, খুশি হয়ে আর্থারের কাঁধ চেপে ধরে প্রচণ্ড এক ঝাকুনি দিলেন প্রফেসর। একটা অত্যন্ত কঠিন কাজ করতে হবে তোমাকে, আর্থার। আমি লুসির মাথা কেটে মুখে রসুনের কোয়া পুরে দেবার সঙ্গে সঙ্গে ঈশ্বরের নাম নিয়ে এই কাঠের গজালটা সম্পূর্ণ বিধিয়ে দিতে হবে লুসির হৃৎপিণ্ডে। পারবে?

পারব, আশ্চর্য শান্ত আর্থারের গলা। যেন লোহার শিক দিয়ে গেঁথে একটা ট্রাউট মাছ মারতে যাচ্ছে সে।

হ্যাঁ তুমি পারবে, আর্থার, বলে গজালটা এগিয়ে দিলেন প্রফেসর, নাও, ধরো। গজালের চোখা অংশটা ঠিক লুসির হৃৎপিণ্ড বরাবর ধরে আমি বলার সাথে সাথে এই হাতুড়ি দিয়ে প্রচণ্ড জোরে আঘাত হানবে গজালের ভোতা অংশে। খবরদার, এক আঘাতেই যেন গজালটা লুসির হৃৎপিণ্ড ভেদ করে। আর মনে রেখো তোমার প্রেমিকাকে খুন করতে যাচ্ছ না তুমি, ওকে পাঠাতে যাচ্ছ স্বাভাবিক মৃত্যুর দেশে।

দৃঢ় হাতে গজাল আর হাতুড়িটা তুলে নিল আর্থার। বিন্দুমাত্র কাঁপছে না এখন ওর হাত। চোখে মুখে ফুটে উঠেছে দৃঢ় প্রতিজ্ঞার ছাপ।

ডান হাতে মাংস কাটার ছুরিটা তুলে নিয়ে শান্ত পায়ে কফিনের কাছে এগিয়ে গেলেন প্রফেসর। বাঁ হাতে ওর কতগুলো রসুনের কোয়া। কফিনের ডালাটা তুলে শক্ত করে ধরে রাখল মরিস। মাটি থেকে প্রদীপটা তুলে নিয়ে লুসির মাথার দিকটায় দাঁড়ালাম আমি। গম্ভীর গলায় জোরে জোরে বাইবেলের স্তোত্রপাঠ শুরু করলেন প্রফেসর। তার সাথে গলা মেলালাম আমরা তিনজন। স্তোত্রপাঠ করতে করতেই বাঁ হাতের রসুনের কোয়াগুলো ঘুমন্ত রোগীর মুখে ট্যাবলেট গুঁজে দেয়ার মত করে গুঁজে দিলেন প্রফেসর লাশের মুখে, পরমুহূর্তে মাংস কাটা ছুরিটা দিয়ে গায়ের জোরে কোপ বসালেন লুসির গলায়। ব্যাস, শুরু হয়ে গেল প্রলয় কাও। জীবন্ত মানুষের ধড় থেকে মাথাটা কেটে আলাদা হয়ে যাবার পর যা করে ধড়টা তেমনি ভাবে মোচড় খেতে শুরু করল লুসির ধড়। কাটা গলা দিয়ে ঝলকে ঝলকে বেরিয়ে এল তাজা রক্ত। কফিনের ভেতর রক্তের নদী বয়ে যাচ্ছে যেন। সেই রক্তের নদীতে ক্রমাগত মোচড় খাচ্ছে লুসির ধড়টা। হাত দুটো থাবা মারছে কফিনের গায়ে। যেন ঘুম ভেঙে গিয়ে অঙ্গারের মত টকটকে লাল চোখ মেলে চেয়ে আছে কাটা মাথাটা। ধীরে ধীরে নিষ্প্রভ হয়ে আসছে চোখের লালচে জ্যোতি। আর্থারকে তৈরি হতে নির্দেশ দিলেন প্রফেসর। নির্ধিধায় গজালটা লুসির হৃৎপিণ্ড বরাবর ধরে হাতুড়ি হাতে তৈরি হয়ে দাঁড়াল আর্থার। ক্রমশঃ নিভে আসছে চোখের জ্যোতি, তার সাথে তাল মিলিয়ে কমে আসছে ধড়টার নড়াচড়া। চোখের জ্যোতি একেবারে নিডে যেতেই ধড়টার নড়াচড়াও বন্ধ হয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে চেঁচিয়ে উঠলেন প্রফেসর, এইবার, আর্থার। চোখের পলকে হাতুড়ির এক আঘাতে জায়গামত গজালটা বসিয়ে দিল আর্থার। সবচেয়ে আশ্চর্য কাণ্ডটা ঘটল তখুনি। গজার মাছের মত বার দুয়েক শূন্যে লাফিয়ে উঠল কাটা মুণ্ডটা। তারপরই গলতে শুরু করল মুণ্ড আর ধড়। কয়েকদিনের গলিত শবে পরিণত হল ওগুলো। অসহ্য দুর্গন্ধে ভরে গেল সমাধিকক্ষটা। তাড়াতাড়ি কফিনের ডালা নামিয়ে দিতে বললেন প্রফেসর মরিসকে। তারপর গজালটা ছাড়া বাকি জিনিসপত্রগুলো ব্যাগে ভরে আমাদেরকে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলেন তিনি। সমাধিকক্ষের দরজায় তালা লাগিয়ে দিয়ে চাবিটা আর্থারের হাতে তুলে দিতে দিতে বললেন প্রফেসর, তোমার জিনিস তুমি নিয়ে নাও, আর্থার। আর, না জানিয়ে তোমার জিনিস রেখে দিয়েছিলাম বলে ক্ষমা চাইছি।

সাথে সাথে আঁটু গেড়ে প্রফেসরের পায়ের কাছে বসে পড়ে হাত জোড় করে বলল আর্থার, দয়া করে আর আমাকে লজ্জা দেবেন না, প্রফেসর। আমাকে আর লুসিকে নরক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দেবার জন্যে চিরঋণী হয়ে থাকলাম আপনার কাছে।

হাত ধরে টেনে আর্থারকে দাঁড় করিয়ে বললেন প্রফেসর, তোমরা ছেলেমানুষ। তবুও আমাকে সাহায্য করতে গিয়ে যা করেছ, তোমাদের বয়সে আমি হলে কিন্তু তা পারতাম না।

এতক্ষণে মুখ খুলল মরিস, এই বয়সেই পৃথিবীর বহু দেশে ঘুরেছি আমি, বহু বিপদে পড়েছি, বহু অদ্ভুত জিনিস দেখেছি। কিন্তু আজ আপনি যা দেখালেন, প্রফেসর, তার তুলনা হয় না।

হয়েছে। চলো এখন যাওয়া যাক। ওদিকে বেলাও বেশি নেই, তাড়া লাগালেন প্রফেসর।

এতক্ষণে খেয়াল করলাম অস্ত যাচ্ছে সূর্য। গোধূলির আলোয় রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে পশ্চিমাকাশ। আমার মনে হল লুসির রক্ত ছড়িয়ে দিয়েছে কেউ ওখানে। নতুন করে আবার লুসির মৃত্যুর শোকটা অনুভব করতে শুরু করলাম এখন।

অস্তগামী সূর্যের হালকা নরম আলো ছড়িয়ে পড়েছে উপত্যকা জুড়ে। জানা অজানা অসংখ্য পাখির কলকাকলিতে মুখর হয়ে আছে জুনিপারের ঝোপ। মনের আনন্দে লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে এদিক ওদিক খেলে বেড়াচ্ছে খরগোশ। মনে হচ্ছে রাতের আঁধারে বিপদসংকুল দূর্গম পথ পাড়ি দিয়ে যেন স্বর্গের নন্দন কাননে এসে হাজির হয়েছি আমরা।

এসব দৃশ্য দেখতে দেখতে পাহাড়ী উপত্যকা বেয়ে নামতে লাগলাম আমরা। একসময় প্রফেসর বললেন, সহজ কাজটা শেষ করলাম আমরা, কিন্তু সবচেয়ে কঠিন কাজটাই বাকি রয়ে গেছে এখনো। এই সমস্ত দুর্ভাগ্যের মূল যে, সেই নাটের গুরুকে খুঁজে বার করতে হবে আমাদের, তাকেও লুসির মতই কফিনে ফেলে হত্যা করতে হবে। কিন্তু আগে খুঁজে বের করতে হবে পিশাচটাকে। এবং সেইটাই হবে সবচেয়ে দীর্ঘ সময়সাপেক্ষ এবং বিপজ্জনক কাজ। অবশ্য সূত্র একটা খুঁজে পেয়েছি আমি, এগোতে হবে সে-পথ ধরে। একা আমার পক্ষে তা করা একেবারেই অসম্ভব। আশা করি আমাকে সাহায্য করবে তোমরা?

করব মানে? এই অদ্ভুত ভয়ঙ্কর ব্যাপার চাক্ষুষ দেখার চেয়ে রোমাঞ্চকর আর কিছু আছে নাকি পৃথিবীতে। আমি একপায়ে খাড়া, প্রফেসর, সবার আগে বলল মরিস।

আর কিছুর জন্যে না হলেও, একটু আগে চাপিয়ে দেয়া ঋণের বোঝা কিছুটা হালকা করার জন্যে অন্তত আপনার সাথে এগিয়ে যাব আমি, প্রফেসর, গভীর আবেগের সঙ্গে বলল আর্থার।

আমি এখনও আপনার ছাত্র, স্যার, আপনার কাছ থেকে এখনও অনেক কিছু শেখার বাকি আছে আমার। যত বিপজ্জনক পথেই পা বাড়ান না কেন আপনি, শিখতে হলে তো আপনার সাথে থাকতেই হবে আমার, বললাম আমি।

আমাদের কথায় অত্যন্ত খুশি হয়ে বললেন প্রফেসর, তোমাদেরকে সাথী হিসেবে পেয়ে কি খুশি হয়েছি আমি বলে বোঝাতে পারব না। তাহলে এক কাজ কর, আর্থার, মরিস আগামী কাল সন্ধে সাতটায় জনের বাড়িতে আমার সাথে দেখা কর তোমরা। আজই একটা বিশেষ কাজে আমস্টারডামে যাচ্ছি আমি, অবশ্য কালই ফিরে আসব আবার। আর জন, তুমি এসো আমার সাথে। কথা আছে।

বিদায় নিয়ে লুসিদের বাড়িতে চলে গেল আর্থার আর মরিস। প্রফেসরের সাথে হোটেলে চললাম আমি। কামরায় ঢুকে টেবিলে রাখা একটা খাম পেলেন প্রফেসর। মিনার টেলিগ্রামঃ

আজ রাতের ট্রেনেই হুইটবি থেকে আপনার সাথে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে রওনা দিচ্ছি আমরা। জরুরী কথা আছে।

মিনা হারকার।

সত্যি এই মহিলাটি একটি রত্ন, টেলিগ্রামটা পড়ে খুশি হয়ে উঠলেন প্রফেসর। কিন্তু ওরা তো ছিল এগজিটারে, হুইটবিতে এল কখন? আর এলই বা কেন?

 বোধহয় কোন কাজ ছিল হুইটবিতে। যাকগে, ওসব নিয়ে ভেবে লাভ নেই এখন, ওরা এলেই সব প্রশ্নের জবাব জানতে পারব, বললাম আমি।

ওরা তো আসছে, কিন্তু এখন ওদের রাখি কোথায়?

আমার বাড়িটার কথা ভুলে গেলেন, স্যার? ওখানেই তো স্বচ্ছন্দে থাকতে পারবে ওরা।

হঠাৎ কি মনে হতেই ঘড়ি দেখলেন প্রফেসর। তারপর উদ্বিগ্ন ভাবে বললেন, রাতের ট্রেন আসতে তো আর বেশি দেরি নেই। তোমাকে তো তাহলে এখুনি স্টেশনে রওনা হতে হয়।

তাই যাচ্ছি, স্যার। আর আপনি?

আমিও আজ রাতের ট্রেনই ধরছি। হঁ্যা, ভাল কথা, যেজন্যে তোমাকে সাথে করে এনেছি, বলে টেবিলের ড্রয়ার খুলে একটা খাম বের করলেন প্রফেসর। ওটা আমার দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বললেন, নাও, এটার ভেতর মিনার স্বামী জোনাথনের ট্রানসিলভেনিয়া ভ্রমণের এক অদ্ভুত কাহিনী লেখা আছে। জোনাথনের ডায়েরীর কপি এটা। অবসর সময়ে পড়ে দেখ, অজানা অনেক প্রশ্নের জবাব পাবে। হারিয়ে ফেলো না কিন্তু আবার। আমার কাছে এটা সোনার খনির চেয়েও মূল্যবান।

না, না, স্যার। সে ব্যাপারে নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন আপনি। তাহলে, আমি এখন যাচ্ছি, স্যার?

এসো।

খামটা হাতে করে বাইরে বেরিয়ে এলাম। হাতঘড়িতে দেখলাম ট্রেন এসে পড়ার সময় প্রায় হয়ে গেছে। হাতে সময় অল্প, যেভাবেই হোক এই অল্প সময়ের মধ্যেই স্টেশনে পৌঁছতে হবে আমাকে।

২.০৯ হারকার দম্পতি

ডাক্তার জন সেওয়ার্ডের ডায়েরী থেকে

৩০ সেপ্টেম্বর।

গত রাতে হারকার দম্পতিকে নিয়ে ফিরতে ফিরতে অনেক রাত হয়ে গিয়েছিল। সদ্য ঘুম থেকে উঠে মুখ হাত ধুয়ে অপেক্ষা করছি এমন সময় ঘরের দরজায় টোকা পড়ল, আসতে পারি? মিসেস হরকারের কণ্ঠস্বর।

নিশ্চয়ই! আসুন! সানন্দে অভ্যর্থনা জানালাম।

হাসিমুখে ঘরে এসে ঢুকলেন হারকার দম্পতি। আপনার সাথে একটু গল্প করার লোভ সামলাতে পারলাম না। তা খুব ব্যস্ত নাকি? জিজ্ঞেস করলেন মিসেস হারকার।

আরে না-না। আসলে আপনাদের জন্যেই অপেক্ষা করছিলাম আমি। গতকাল রাতেই আলাপ করতে চেয়েছিলাম কিন্তু রাত বেশি হয়ে যাওয়ায় সে ইচ্ছে ত্যাগ করতে হল। আরে, দাঁড়িয়ে রইলেন যে, বসুন না?

চেয়ারটা টেনে নিয়ে এসে ঠিক আমার মুখোমুখি বসলেন মিসেস হারকার। পরিচ্ছন্ন ঘরোয়া পোশাকে অপূর্ব লাগছে ওকে। কোণের দিকের একটা চেয়ারে, বসলেন মিস্টার হরকার।

এর আগে আপনাকে না দেখলেও আপনার অনেক প্রশংসা শুনেছি লুসির মুখে, বললেন মিনা হারকার। রোগের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত লুসির শয্যাপার্শ্বে ছিলেন আপনি। কিছু মনে না করলে আপনার মুখ থেকেই সে-সম্পর্কে সব কথা শুনতে চাই।

না, না, মনে করার কি আছে। তবে… মিসেস হরকারের চোখের দিকে তাকিয়ে থেমে গেলাম হঠাৎ।

মিষ্টি করে হাসলেন মিসেস হারকার, থামলেন কেন? বলুন।

বলতে বাধা নেই, মিসেস হারকার, কিন্তু সব কথা বিশ্বাস করবেন কিনা সন্দেহ।

নিঃসংকোচে বলতে পারেন, ডাক্তার সেওয়ার্ড।

তাহলে নিন, টেবিলের ড্রয়ার থেকে আমার ডায়েরীটা বের করে মিসেস হারকারের দিকে এগিয়ে দিলাম। সময় মতো পড়ে দেখবেন এটা। সব কথা জানতে পারবেন।

অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে, ডাক্তার, ডায়েরীটা পেয়ে অত্যন্ত খুশি হলেন মিসেস হারকার।

এই সময় চাকর এসে জানাল, টেবিলে খাবার দেয়া হয়েছে। উঠে দাঁড়িয়ে ডাইনিং রুমের দিকে পা বাড়ালাম আমরা।

খেতে খেতেই আলাপ জমে উঠল মিস্টার হরকারের সঙ্গে। কথায় কথায় জানা গেল স্যামুয়েল এফ বিলিংটন অ্যাণ্ড সন-কে লেখা চিঠির জবাব পেয়েই কাঠের বাক্সগুলো পাঠানোর তদন্ত করতে হইটবিতে গিয়েছিলেন ওঁরা।

ওখানকার কাজ শেষ হয়েছে আপনার?

হয়েছে, পাইপে তামাক ঠাসতে ঠাসতে বললেন মিস্টার হারকার। শুধু বিলিংটনই নয়, কিংস ক্রস রেলস্টেশন, এমনকি মেসার্স কার্টার অ্যাণ্ড প্যাটারসন কোম্পানীতেও হানা দিয়েছি আমি। এতে একটা জিনিস পরিষ্কার হয়ে গেছে, কাউন্ট ড্রাকুলার পাঠানো মাটি ভর্তি পঞ্চাশটা কাঠের বাক্স ডিমেটার জাহাজে করে ঠিকমতই ভার্না থেকে হুইটবিতে গিয়ে পৌঁছেছিল। অবশ্য বাক্সগুলো এখন কোথায় জানি না আমি।

চকিতে একটা সম্ভাবনার কথা মনে পড়ে গেল আমার। আমার হাসপাতালের নার্সের কাছে শুনেছিলাম, গত পরশু কারফাক্সের পুরানো গির্জা থেকে কয়েকটা বাক্স ঠেলাগাড়ি করে সরিয়ে নেয়ার সময় ঠেলাঅলা দুজনকে খুন করে ফেলতে যায় রেনফিল্ড। তাহলে বাক্সগুলো কোথায় সরিয়ে নেয়া হচ্ছে জানে কি নার্স?

আমার বাড়ির আশপাশের জায়গাটা একটু ঘুরে দেখবেন বলে উঠে পড়লেন হারকার দম্পতি। পড়ার ঘরে ফিরে এসে প্রফেসরের দেয়া মিস্টার হরকারের ডায়েরীর টাইপ করা কপিটা পড়তে বসলাম, প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই অদ্ভুত এক জগতে প্রবেশ করলাম আমি। পড়তে পড়তে কোন্ দিক দিয়ে যে সময় কেটে গেল টেরই পেলাম না। পড়া শেষ হলেও অনেকক্ষণ গুম মেরে বসে বসে ভাবতে থাকলাম। কাউন্ট ড্রাকুলার আশ্চর্য কাহিনী পড়ার পর কতগুলো অদ্ভুত চিন্তায় পেয়ে বসল আমাকে। পুরানো গির্জায় গিয়ে কার সাথে কথা বলে রেনফিল্ড? স্বাভাবিক বাদুড়ের মত ওড়ে না, জ্যোৎস্না রাতে দেখা ওই বাদুড়টার সাথে কোন সম্পর্ক আছে কি কাউন্ট ড্রাকুলার? লুসির মৃত্যুর জন্য দায়ী কি ওই রক্তলোভী পিশাচটাই? হঠাৎ মিসেস হারকারের দরজায় টোকা দেবার শব্দে চমক ভাঙল আমার, ফিরে এসেছেন ওঁরা।

বিকেলের দিকে আমাকে ধরলেন মিসেস হারকার, ডাক্তার সেওয়ার্ড, দুপুরের খাওয়া দাওয়ার পর আপনার ডায়েরীটা পড়ে জানতে পারলাম অনেক কিছুই। কিন্তু এখন আমার একটা অনুরোধ রাখতে হবে আপনাকে। রেনফিল্ড সম্পর্কে দারুণ কৌতূহল বোধ করছি আমি। চলুন না, দয়া করে পাগলটাকে একবার দেখাবেন আমাকে।

আপত্তি নেই, চলুন।

মিসেস হারকারকে নিয়ে ঢাকার আগে মজা করার জন্যে আমি একা একবার রেনফিন্ডের কাছ থেকে অনুমতি নিতে ঢুকলাম ওর ঘরে। বিছানায় চিৎ হয়ে সটান শুয়ে আছে রেনফিল্ড। আমাকে ঢুকতে দেখে গম্ভীর ভাবে ঘাড় ফিরিয়ে চাইল। ওকে বললাম, একজন মহিলা দেখা করতে চান তোমার সাথে, রেনফিল্ড।

ভুরু কুঁচকে জানতে চাইল সে, কেন?

এমনি, হাসপাতাল পরিদর্শন করতে এসেছেন উনি। হাসপাতালের জ্ঞানী লোকদের সাথে পরিচিত হবার তার ভারি ইচ্ছে।

ঠিক আছে, নিয়ে আসুন, অনুমতি দিল রেনফিল্ড। হঠাৎ তড়াক করে উঠে পড়ল সে বিছানা থেকে। না, দাঁড়ান, ঘরটা পরিষ্কার করে নিই একটু। বলেই অদ্ভুত কায়দায় ঘর গোছাতে শুরু করল রেনফিল্ড। কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই ওর বাক্স খুলে সবকটা মাছি আর মাকড়সা মুখে পুরে গিলে ফেলল সে। ঘরের এখানে ওখানে ভালমত খুঁজে পেতে দেখল আর কোন মাছি, মাকড়সা বা ওই জাতীয় কোন জীবন্ত প্রাণী আছে কিনা। নেই, এ ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে বিছানার ওপর থেকে একটা বালিশ এনে ওর বাক্সটার ওপর বিছিয়ে গম্ভীর ভারিক্কি চালে ওটার ওপর গিয়ে আরাম করে বসল রেনফিল্ড। তারপর অনেকটা হুকুমের মত করে বলল আমাকে, যান নিয়ে আসুন ওকে। রেনফিল্ডের রকমসকম দেখে ভীষণ হাসি পেল কিন্তু ও আবার দুঃখ পাবে মনে করে হাসলাম না।

আমার সাথে রেনফিল্ডের ঘরে ঢুকেই অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে রেনফিন্ডের দিকে হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে হেসে বললেন মিসেস হারকার, আপনার সাথে

পরিচিত হয়ে দারুণ খুশি হলাম, মিস্টার রেনফিল্ড।

সঙ্গে সঙ্গে মিসেস হারকারের কথার জবাব দিল না রেনফিল্ড, বাড়িয়ে ধরা হাতের দিকেও হাত বাড়িয়ে দিল না। বরং গভীর পর্যবেক্ষকের দৃষ্টিতে মিসেস হারকারের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আপন মনেই বলল সে, হ, ভয়ঙ্কর বিপদ এগিয়ে আসছে দেখতে পাচ্ছি।

কিসের বিপদ, কার বিপদ, রেনফিল্ড? জিজ্ঞেস করলাম আমি।

বিজ্ঞের মত মাথা দোলাল রেনফিল্ড। কিন্তু আমার কথার জবাব দিল না। মিসেস হারকারের দিকে চেয়ে বলল, এখানে এসেছেন কেন?

আপনাকে দেখতে, মিষ্টি হেসে জবাব দিলেন মিসেস হারকার।

মস্ত ভুল করেছেন আপনি, মিসেস হারকার। আজ রাতেই উনি আসবেন আমার এখানে। আপনার গায়ের গন্ধও পেয়ে যাবেন। তারপর, তারপর আপনাকে খুঁজে বের করতে কিছুমাত্র বেগ পেতে হবে না তাকে।

কে আসবেন, কেন আসবেন, রেনফিল্ড? আর মিসেস হারকারের নামই বা জানলে কিভাবে তুমি? বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম আমি।

হে হে করে সেঁতো হাসি হেসে বলল রেনফিল্ড, কে আসবেন? বললে চিনবেন নাকি তাকে? আর মিসেস হরকারের নাম জানলাম কিভাবে জিজ্ঞেস করছেন? এ সাধারণ কথাটা জানতে না পারলে মিছিমিছিই এতদিন সাধনা করলাম?

রেনফিন্ডের কথার মাথামুও কিছুই বুঝতে পারলাম না। বুঝলাম ওর পাগলামিটা আবার রড়তির দিকে। ওর সাথে আর কথা বলে লাভ নেই ভেবে বেরিয়ে আসতে ইশারা করলাম মিসেস হারকারকে। হাসিমুখে রেনফিন্ডের দিকে তাকিয়ে বললেন তিনি, আচ্ছা, চলি মিস্টার রেফিন্ড, সময় করে আবার দেখা করব আপনার সাথে।

যেন আঁতকে উঠল রেনফিল্ড, না, না, ভুলেও আর এখানে আসবেন না আপনি। আজ যদি ভালোয় ভালোয় ওঁর অসাধারণ ঘ্রাণশক্তি থেকে রক্ষা পেয়ে যেতে পারেন তাহলেই মনে করবেন মস্ত ফাঁড়া কেটে গেছে। অবশ্য সে সম্ভাবনা খুবই কম। অত্যন্ত সাবধানে থাকবেন, মিসেস হারকার। তারপর আমার দিকে ফিরে বলল, ওঁর ব্যাপারে আপনারাও একটু হুঁশিয়ার থাকবেন, ডার।

রেনফিন্ডের কথায় মনটা খারাপ হয়ে গেল। কি বোঝাতে চাইছে রেনফিল্ড? অবশ্য বেশিক্ষণ ভাবলাম না সেকথা। পাগলের প্রলাপ ভেবে দূর করে দিলাম চিন্তাটা মন থেকে।

.

মিনা হারকারের ডায়েরী থেকে

৩০ সেপ্টেম্বর, গভীর রাত।

সন্ধ্যার পর ডাক্তার সেওয়ার্ডের পড়ার ঘরে জরুরী বৈঠক বসল আমাদের। গোল টেবিলটা ঘিরে বসেছি আমি, জোনাথন, লর্ড গোডালমিং, মিস্টার মরিস, ডাক্তার সেওয়ার্ড আর প্রফেসর ভ্যান হেলসিং। একবার কেশে গলাটা পরিষ্কার করে নিয়ে কথা শুরু করলেন প্রফেসর, আজ এক বিশেষ প্রয়োজনে সবাই এখানে জমায়েত হয়েছি আমরা। এক ভয়ঙ্কর অদৃশ্য শত্রু প্রতিনিয়ত আমাদের পাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে, তাকে কোথায়, কখন, কিভাবে ঘায়েল করব সে বিষয়েই আজ আলোচনা করব। কিন্তু তার আগে শক্রর চরিত্র সম্পর্কে কিছু বলে নেয়া প্রয়োজন তোমাদের। আমাদের মধ্যে কেউই ভ্যাম্পায়ার বা রক্তচোষা বাদুড়ের অস্তিত্বকে অস্বীকার করতে পারবে না। এই রক্তচোষা বাদুড়ের সাথে তুলনা করা যায় আমাদের শত্রুকে। জীবনের বহু বিচিত্র অভিজ্ঞতা সত্ত্বেও ব্যাপারটা সম্পর্কে প্রথমে নিশ্চিন্ত হতে পারিনি আমি। অশরীরী এক পিশাচ লুসির রক্ত খেয়ে দিন দিন শক্তিশালী হচ্ছে, এটা প্রথমেই ধরতে পেরেছিলাম, কিন্তু কোন আকৃতিতে সে আসে যায় সেটা বুঝতে যথেষ্ট সময় অপেক্ষা করতে হয়েছে আমাকে।

ভয়ঙ্কর এই পিশাচেরা যে-কোন মুহূর্তে যে-কোন প্রাণীর আকৃতি ধারণ করতে পারে। ঝড়, বৃষ্টি, বজের মত যে-কোন প্রাকৃতিক শক্তিকেও ব্যবহার করতে পারে চোখের পলকে। হতে পারে ছোট বড় যা খুশি। সাধারণতঃ নেকড়ে বা বাদুড়ের রূপ নিতেই বেশি ভালবাসে ওরা। ড্রাকুলার প্রাসাদ দুর্গে জ্যোৎস্না প্রাবিত গভীর রাতে ধূলিকণা থেকে তাদের মানুষে রূপ নিতেও দেখেছে জোনাথন। নিজেদের চারপাশে ঘন কুয়াশা বা ঝড়ের পরিমণ্ডল সৃষ্টি করতে পারে এই অশুভ শক্তিরা, ডিমেটার জাহাজের ঘটনা এর জ্বলন্ত প্রমাণ। শুধু তাই নয়, যখন যেখানে খুশি অবাধে যাতায়াত করতে পারে এরা, এমন কি ডারি ডালাবন্ধ কফিনের মধ্যে থেকেও এই পিশাচদের ভীষণ অমানুষিক শক্তি যে কতটা হতে পারে তা আমাদের কল্পনারও বাইরে।

কিন্তু, এত ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও এরা স্বাধীন নয়! সুনির্দিষ্ট কতগুলো প্রাকৃতিক নিয়মের আওতার ভেতরে এদেরকে থাকতে হয়। কেউ যেচে তাকে না ডাকলে বা অনুকূল পরিবেশ না পেলে কখনও কোথাও অনুপ্রবেশ করতে পারে না এরা। কফিনে বা এরকম কোন জায়গায়, নির্দিষ্ট একটা আধারের কেন্দ্রে এদেরকে বাস করতে হয়। সূর্যাস্তের পর থেকে ভোরে মোরগ ডাকার আগ পর্যন্ত বাইরের পৃথিবীতে চলাফেরা করে বেড়াতে পারে এরা, তারপরই সুড়সুড় করে ফিরে যেতে হয় নিজেদের বাসস্থানে। রসুন, ধুনো এবং পবিত্র কুশকে যমের মত ভয় করে এরা। এমন কি কফিনের ওপর বুনো গোলাপের ডাল বিছিয়ে রাখলেও তার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে না পিশাচেরা।

আর বয়স? দিন কালের পরিধি দিয়ে এই শয়তানদের বয়স মাপা যায় না। জীবন্ত প্রাণীদেহ থেকে রক্ত পান করে করে শতাব্দীর পর শতাব্দী বেঁচে থাকতে পারে এরা। মাসের পর মাস কিছু না খেয়েও থাকতে পারে। তখন মনে হয় বয়স বেড়ে গেছে এদের, আবার রক্ত খেয়ে নিলেই আগের মত তরুণ হয়ে যায়। ঘোড়াগাড়িতে লুসির পাশে তরুণ ড্রাকুলাকে দেখে চমকে যায় জোনাথন, আসলে অবাক হওয়ার কিছু ছিল না। লুসির রক্ত, সেই সাথে লুসির ধমনীতে প্রবেশ করানো আমাদের কয়েকজনেরও রক্ত খেয়ে খেয়ে ওরকম তরুণ হয়ে গিয়েছিল ড্রাকুলা।

এই ভয়ঙ্কর শক্তিশালী শত্রুর বিরুদ্ধে কিভাবে সংগ্রাম করতে পারি আমরা, কোথায় খুঁজে পাওয়া যাবে তাকে, এ সম্পর্কে ভালমত ভেবে দেখতে হবে আমাদের। কাজটা অত্যন্ত দুরূহ এবং বিপজ্জনক। একবার হেরে গেলে তার পরিণতি-নিশ্চিত মৃত্যু। এবং এই মৃত্যুই এর শেষ নয়। শয়তানের শিকার হয়ে মৃত্যুর পর তারই মত এক ভয়ঙ্কর প্রেতাত্মা হয়ে রাতের অন্ধকারে আত্মগোপন করে বেড়াতে হবে, আর অতি প্রিয়জনদের শরীরের রক্ত পান করতেও তখন বিন্দুমাত্র দ্বিধা হবে না আমাদের।

তবু নিজের জীবন তুচ্ছ করেও আত্মীয়স্বজন এবং পৃথিবীর অগুণতি মানুষের মুখ চেয়ে এই শয়তানের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে আমাদের। এ পবিত্র কর্তব্য থেকে কিছুতেই সরে দাঁড়াতে পারি না আমরা। কারণ এ না করলে মুত্যুর পর একদিন যখন সৃষ্টিকর্তার সামনে গিয়ে দাঁড়াব, তখন তার কাছে কি জবাব দেব আমরা? দিনের পর দিন মানুষের জীবন থেকে তার দেয়া আলো, গান, ভালবাসাকে ছিনিয়ে নেবে এক অন্ধকারের পিশাচ, সব জেনেশুনেও আমরা তার প্রতিকার না করে গেলে কি আমাদের ঘৃণার চোখে দেখবেন না ঈশ্বর? আমি বৃদ্ধ হয়েও যদি এই ভয়ঙ্করের বিরোধিতা করতে এগিয়ে যাই, তোমরা তরুণ হয়ে কি বসে থাকবে? বল? জবাব দাও, আবেগে, উত্তেজনায় গমগম করে উঠল প্রফেসরের ভরাট কণ্ঠস্বর।

ধীরে ধীরে টেবিলের ওপর হাত বিছিয়ে দিল জোনাথন। তার হাতের ওপর হাত রাখলাম আমি। দুজনের হয়ে জোনাথন বলল, আমাদের দুজনকে আপনার বিশ্বস্ত সহযোগী ধরতে পারেন, প্রফেসর।

তিনজনের দিকেই তিনজনে নীরব দৃষ্টি বিনিময় করলেন ডাক্তার সেওয়ার্ড, লর্ড গোডালমিং আর মিস্টার মরিস। তারপর একে একে আমাদের হাতের ওপর হাত রাখলেন ওঁরা তিন বন্ধু। তিনজনের হয়ে বললেন মিস্টার মরিস, আমাদের কথা তো আগেই আপনাকে জানিয়েছি, প্রফেসর।

ভেরি গুড! ভেরি গুড! তোমাদের সাহস আর আমার ওপর বিশ্বাস দেখে ভারি খুশি হলাম, বলতে বলতে উঠে দাঁড়িয়ে একটু সামনে ঝুঁকে আমাদের পাঁচজনের হাতগুলো দুহাতে চেপে ধরলেন প্রফেসর। তারপর হাত ছেড়ে দিয়ে আবার বসে পড়লেন চেয়ারে। আমরাও টেবিলের ওপর থেকে আমাদের হাত তুলে আনলাম। সবার মুখের দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে আবার বলতে শুরু করলেন প্রফেসর, আমাদের এই সম্মিলিত শক্তি নিয়ে এবার কাজে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। কিভাবে? প্রথমেই খুঁজে বার করতে হবে নাটের গুরু কাউন্ট ড্রাকুলার বাসস্থানটা। জোনাথন আর মিনার ডায়েরী পড়ে এবং অন্যান্য জায়গায় খোঁজখবর করে আমি জানতে পেরেছি, ড্রাকুলার প্রাসাদ দুর্গ থেকে পঞ্চাশটা কাঠের বাক্স কারফাক্সের পুরানো গির্জায় পৌঁছানর পর কয়েকটা কাঠের বাক্স আবার ঠেলাগাড়িতে করে কোথাও সরিয়ে নেয়া…।

প্রফেসরের কথার মাঝেই হঠাৎ লাফিয়ে উঠে ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন মিস্টার মরিস। ব্যাপার কি ভাবছি, এমন সময় বাইরে থেকে ভেসে আসা পিস্তলের গুলির শব্দে চমকে উঠলাম সবাই। সঙ্গে সঙ্গে আমাদের ঘরের একপাশের জানালার কাচের শার্সি ভেঙে ঝন ঝন শব্দে ছড়িয়ে পড়ল মেঝেতে। দারুণ ভয় পেয়ে গিয়ে চেঁচিয়ে উঠলাম আমি। একলাফে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল সবাই। এই সময় পিস্তল হাতে ঘরে ঢুকলেন মিস্টার মরিস। উত্তেজিত ভাবে বললেন, আপনার কথা শুনতে শুনতে হঠাৎ ওই জানালাটার দিকে চোখ পড়ে যায় আমার, প্রফেসর।  দেখলাম কালো মত কি একটা উড়ে বেড়াচ্ছে জানালার কাছে। ব্যাপারটা দেখার জন্যে বাইরে বেরোতেই দেখি জানালার কাঁচের শার্সির গায়ে এসে বসার চেষ্টা করছে একটা প্রকাণ্ড বাদুড়। সাথে সাথেই কোমর থেকে পিস্তল তুলে গুলি করলাম…।

ওটার গায়ে গুলি লেগেছে? মৃদু হেসে জানতে চাইলেন প্রফেসর।

এটাই আশ্চর্য, প্রফেসর। লক্ষ্যভ্রষ্ট হয় না আমার নিশানা, হলপ করে বলতে পারি আজও হয়নি। অথচ গুলি খেয়েও দিব্যি উড়ে চলে গেল বাদুড়টা, যেন গুলিটা লাগেইনি ওটার গায়ে। আর বাদুড়টার ওড়ার কায়দাও অদ্ভুত।

ওটা বাদুড় নয়, মরিস। কাজেই তোমার গুলি লাগলেও মরবে কেন ওটা? আসলে রাতের বেলা মারা যায় না ওদের, গুলি ছুঁড়ে তো নয়ই। শয়তানটাকে মারতে হলে সবার আগে ওটার আস্তানা খুঁজে বার করতে হবে আমাদের। এবং সেজন্যে ভোর হলেই কারফাক্সের পুরানো গির্জায় হানা দিতে চাই আমি। প্রথমে গুণে দেখতে হবে পঞ্চাশটার ভেতর কটা কফিন অবশিষ্ট আছে ওই গির্জায়, তারপর জানতে হবে কোথায় সরিয়ে নেয়া হয়েছে বাকিগুলো। তারপর সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত, এই সময়ের মধ্যে কফিনের ভেতরই হত্যা করতে হবে হারামীটাকে।

ঠিক, অত্যন্ত উৎসাহের সাথে বলে উঠলেন মিস্টার মরিস। অযথা সময় নষ্ট করা উচিত হবে না। তা মিসেস হারকারও কি যাবেন আমাদের সাথে?

দরকার নেই, নিষেধ করলেন প্রফেসর। এই অজানা বিপদের মধ্যে ওকে টেনে নিয়ে গিয়ে লাভ কি?

ওদের সাথে যাবার প্রচণ্ড ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও প্রতিবাদ করতে পারলাম না।

হাতঘড়ির দিকে চেয়ে বললেন মিস্টার মরিস, যথেষ্ট রাত হয়েছে, এখন একটু জিরিয়ে নিলে হয় না? সেই ভোরে উঠে তো আবার বেরিয়ে পড়তে হবে আমাদের।

হ্যাঁ, যার যার ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ো সবাই, আদেশ দিলেন প্রফেসর।

ঘরে এসে বিছানায় শুয়ে পড়লাম আমি আর জোনাথন। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়ল জোনাথন। কিন্তু আমার চোখে ঘুম এলো না কিছুতেই। কেবলই মনে হতে লাগল রেনফিল্ডের কথা। আমাকে বার বার হুঁশিয়ার করছিল কেন সে? ওই পাগলটার কথার ভেতর কি সত্যতা কিছু আছে?

কতক্ষণ জেগে শুয়ে ছিলাম জানি না। হঠাৎ জানালার দিকে চোখ পড়তেই চমকে উঠে বসলাম। হালকা জ্যোৎস্নায় চোখে পড়ল জানালার কাছে বার বার উড়ে আসছে বাদুড়টা, লাল জ্বলজ্বলে দুটো চোখ ওটার। আশ্চর্য! বেশ কিছুদিন আগে লুসির ঘরের জানালায় বসে থাকতে দেখেছিলাম আমি এটাকেই। হাতের কাছে আর কিছু না পেয়ে একটা বালিশ তুলে নিয়েই ওটার দিকে ছুঁড়ে মারলাম আমি। জানালার গায়ে চাপা থ্যাপ শব্দ করে গড়িয়ে মাটিতে পড়ে গেল বালিশটা। সে-শব্দে ঘুম ভেঙে গেল জোনাথনের।

কি হল? বলে একলাফে বিছানার ওপর উঠে বসল জোনাথন।

ওই বাদুড়টা! আঙুল দিয়ে জানালার দিকে নির্দেশ করতে গিয়েই দেখলাম নেই ওটা ওখানে। চলে গেছে।

চিন্তিত ভাবে জানালার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকল জোনাথন, তারপর আমাকে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়তে বলে নিজেও শুয়ে পড়ল আবার। কিন্তু জানি বাকি রাতটা আর কিছুতেই ঘুম আসবে না আমার। অগত্যা বাতি জ্বেলে ডায়েরী লিখতে বসলাম।

২.১০ কারফাক্সের গির্জা

জোনাথন হারারের ডায়েরী থেকে

১ অক্টোবর।

সারাটা দিন কারফাক্সের গির্জার আশেপাশে ঘুরে বেড়িয়েও ভেতরে ঢুকতে পারলাম না। কারণ সদর দরজা ছাড়া ভেতরে ঢোকার আর কোন পথ নেই। দরজাটা তালা মারা, চাবি গির্জার দারোয়ানের কাছে। গির্জা সংলগ্ন আলাদা একটা ছোট্ট ঘরে থাকে দারোয়ান। ওই চাবি ছাড়া গির্জার ভেতর ঢোকা অসম্ভব।

যেভাবেই হোক ওই চাবিটা দরকার আমাদের, একসময় বললেন প্রফেসর।

কিন্তু কি করে যোগাড় করা যায় চাবি? শেষ পর্যন্ত দারোয়ানের সাথে ভাব জমিয়ে ঘরে ঢুকে এক ফাকে ওর বিছানার তলা থেকে একজোড়া চাবির একটা চুরি করে নিয়ে এলেন মিস্টার মরিস। ভারি পেতলের চাবিটা প্রফেসরের হাতে তুলে দিতেই খুশিতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল তার মুখ। বললেন, দিনের বেলায় দারোয়ানের চোখ এড়িয়ে গির্জার ভেতরে ঢোকা যাবে না কিছুতেই। অতএব রাতেই চেষ্টা করে দেখতে হবে। অবশ্য হাজার গুণ বিপজ্জনক হয়ে পড়বে তাহলে কাজটা, কারণ তখন জেগে উঠবে রক্তচোষা পিশাচটা। তবে ভাবনা নেই, তৈরি হয়েই ভেতরে ঢুকব আমরা। শুধু বিপদের সময় সাহস হারিয়ে না ফেললেই হল। এখন চলল, কোথাও বসে খেয়ে নেয়া যাক।

গির্জা থেকে বেশ কিছুটা দূরে এক জায়গায় বসে খাওয়া সেরে নিলাম আমরা। জায়গাটা চমৎকার। খাওয়া দাওয়ার পর গাছের ছায়ায় শুয়ে জিরিয়ে নিচ্ছিল সবাই, কিন্তু আমার শুতে ভাল লাগছিল না। বার বারই মিনার কথা মনে পড়ছিল। গতরাতের কথাও ভাবলাম। সত্যিই কি জানালার কাছে বাদুড় দেখেছিল মিনা? সত্যিই হবে। কারণ মিস্টার মরিসও তো দেখেছিলেন ওটাকে। লুসির অসুখের সময় ওর ঘরের জানালায়ও দেখা গিয়েছিল ওটাকে, মিনাই বলেছে আমাকে কথাটা। তারপর থেকেই লুসির অসুখ বেড়ে যায়। পাগল রেনফিল্ডও নাকি বার বার কোন অজানা বিপদের হুঁশিয়ারি জানিয়েছে মিনাকে। একথাটাও মিনার মুখেই শুনেছি। হঠাৎ একটা অশুভ চিন্তা ছেয়ে ফেলল মনটাকে। তাহলে, তাহলে কি মিনার ওপর দৃষ্টি পড়েছে…। না, থাক। এমন একটা অশুভ চিন্তা কিছুতেই স্থান দেব না মনে। চিন্তাটা তাড়াবার জন্যেই পকেট থেকে কলম আর ডায়েরী বুকটা বের করে ডায়েরী লিখতে বসলাম।

২ অক্টোবর।

রাত দশটার দিকে আরও কিছু খেয়ে নিয়ে আমাদের বিশ্রামের জায়গা ছেড়ে উঠে কারফাক্সের পুরানো গির্জার দিকে আবার রওনা দিয়েছিলাম আমরা গতকাল। বার বার নানা ভাবে মিনার চিন্তাটা তাড়াতে চেষ্টা করেছি মন থেকে, কিন্তু বার বারই ঘুরে ফিরে মনে আসছিল অশুভ চিন্তাটা। প্রফেসরকে বলি বলি করেও শেষ পর্যন্ত বলতে পারলাম না।

নিঃশব্দে গির্জাটার দিকে চলতে লাগলাম আমরা। চাদের আলোয় ঘাসে ঢাকা সরু পথের ওপর ভৌতিক ছায়া ফেলে দাঁড়িয়ে আছে দুপাশের বিশাল গাছগুলো। গির্জার কাছাকাছি পৌঁছেই হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে আমাদেরকেও থামতে বললেন প্রফেসর। ব্যাগ হাতড়ে বের করলেন চারটে রসুনের মালা আর চারটে কুশ। আমাদের প্রত্যেকের হাতে একটা করে কুশ আর মালা দিয়ে বললেন, যার যার গলায় পরে নাও মালাগুলো। ক্রুশগুলো রেখে দাও কোটের বুক পকেটে। তাহলে আর কোনো পিশাচ প্রেতাত্মা তোমাদের স্পর্শ করতে পারবে না, অবশ্য চেষ্টার ত্রুটি করবে না কোনমতেই! জন, একটা করে মোমবাতি দিয়ে দাও সবাইকে। একটু থেমে আবার বললেন প্রফেসর, কিন্তু মুশকিল হবে দরজাটা নিয়ে। অত ভারি আর পুরানো দরজা খুলতে গেলে শব্দ হবেই। আর সেই শব্দে দারোয়ানটা জেগে উঠলেই আমাদের সব উদ্দেশ্য ভেস্তে যাবে।

অত কেয়ার করি না। বেশি গোলমাল পাকালে ব্যাটাকে ওর ঘরেই বেঁধে রেখে গির্জার ভেতরে ঢুকে পড়ব আমরা। মুখে রুমাল বেঁধে নিলেই আর আমাদেরকে চিনতে পারবে না সে, গোয়ারের মত বললেন মিস্টার মরিস। সত্যিই লোকটা দুঃসাহসী।

গোলমাল যত এড়ানো যায় ভাল। অগত্যা এড়াতে না পারলে তোমার কথাই কাজে লাগাতে হবে। এখন একছুটে ওর ঘরে গিয়ে উঁকি মেরে দেখে এসো তো, কি করছে দারোয়ানটা? মিস্টার মরিসকে উদ্দেশ্য করে বললেন প্রফেসর।

পকেট থেকে একটা রুমাল বের করে মুখে বেঁধে নিলেন মিস্টার মরিস। তারপর একছুটে অদৃশ্য হয়ে গেলেন ওক আর বার্চের আড়ালে। অল্পক্ষণ পরই আবার ফিরে এলেন তিনি। মুখেবাঁধা রুমালটা খুলে বললেন, মদ খেয়ে মাতাল হয়ে পড়ে আছে ব্যাটা। কানের কাছে বোম ফাটলেও টের পাবে না এখন কিছু।

যাক, ভালই হল, খুশি হয়ে বললেন প্রফেসর।

আবার চলতে শুরু করলাম আমরা। গির্জার কাছে পৌঁছে সিঁড়ি ভেঙে উঠে এলাম চাতালের ওপর। পকেট থেকে চাবি বের করে তালা খুললেন প্রফেসর। সবাই মিলে কাঁধ লাগিয়ে ঠেলা দিলাম ভারি দরজাটায়। উকট যান্ত্রিক শব্দ তুলে খুলে গেল ভারি পাল্লা দুটো। আমার মনে হল যেন যক্ষপুরীর দ্বার উন্মুক্ত হয়ে গেল চোখের সামনে। সবার আগে ভেতরে ঢুকলেন প্রফেসর। তারপর এক এক করে আমরা সবাই ঢুকে পড়ে ভেতর থেকে ভিড়িয়ে দিলাম দরজাটা। যে যার মোমবাতি জ্বালিয়ে নিতেই চোখে পড়ল ধাপে ধাপে সিঁড়ি নেমে গেছে নিচের দিকে। দল বেঁধে সেই সিঁড়ি ভেঙে নিচে নামতে লাগলাম আমরা। সবার আগে নামছেন প্রফেসর।

সেই সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতে কাউন্ট ড্রাকুলার প্রাসাদ দুর্গে একা অন্ধকার সিঁড়ি বেয়ে নামার কথা মনে পড়ে গেল আমার। মোমের আলোয় সিঁড়ির

একপাশের দেয়ালে আমাদের ছায়াগুলো পড়ে তির তির করে কাঁপছে অপরাধী প্রেতের মত। আশেপাশে যেন টের পাচ্ছি কার অদৃশ্য উপস্থিতি। সিঁড়িতে আর একপাশের রেলিংয়ে পুরু হয়ে জমে আছে ধুলোর বর। থেকে থেকেই ভ্যাপসা পচা একটা গন্ধ নাকে এসে লাগছে। কাউন্ট ড্রাকুলার গায়ের সেই পচা গন্ধ যেন এটা। কথাটা মনে হতেই আতঙ্কে গায়ের লোম খাড়া হয়ে উঠল আমার।

একসময় শেষ হল সিঁড়ির ধাপ। পুরু ধুলো বিছান একটা মেঝেতে এসে নামলাম আমরা। সামনেই পড়ে আছে মাটি ভর্তি বারগুলো। গুণে দেখলাম, মোট উনত্রিশটা অর্থাৎ বাকি একুশটা বাক্স সরিয়ে ফেলা হয়েছে কোথাও। কোথায়? তাই নিয়ে আলাপ আলোচনা করছি, হঠাৎ ফিসফিস করে বলে উঠলেন লর্ড গোডালমিং, কে? ও কে?

কোথায়? জিজ্ঞেস করলাম আমি।

আঙ্গুল তুলে ওপাশের দরজাটা দেখিয়ে দিলেন তিনি। লর্ড গোডালমিং-এর নির্দেশিত দিকে চেয়েই চমকে উঠলাম। শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে গেল ঠাও শিহরণ। স্তব্ধ হয়ে দেখলাম আবছা অন্ধকারে দরজার গোড়ায় দাঁড়িয়ে রয়েছে কাউন্ট ড্রাকুলা স্বয়ং। সেই ঈগলের মত বাঁকান নাক, পাথরে খোদাই মুখ আর টকটকে লাল একজোড়া চোখ। এক পলকের জন্যে দেখলাম পিশাচটাকে। অন্য সবাই ঘুরে দাঁড়াবার আগেই আবার অদৃশ্য হয়ে গেল সে।

চলো দরজার ওপাশে কি আছে দেখে আসি। আমার মনে হয় পুরানো সমাধিকক্ষ ওটা, বলে মোমবাতি হাতে এগিয়ে চললেন প্রফেসর।

দরজার ওপাশে পৌঁছে দেখলাম প্রফেসরের কথাই ঠিক। সমাধিকক্ষই ওটা। ঘরটার তিনদিকে ঘেরা পাথরের নিরেট দেয়ালে কোন দরজা জানালা নেই, এই ভূগর্ভস্থ সমাধিকক্ষে থাকা সম্ভবও নয়।

গেল কোথায় ও? এখানে তো লুকোবার জায়গা দেখছি না, বললেন লর্ড গোডালমিং।

কে লুকোবে? জিজ্ঞেস করলেন প্রফেসর।

কেন, একটু আগে দেখা লোকটা?

ওদের লুকোবার জায়গার অভাব হয় না। হয়ত আমাদের আশেপাশেই কোথাও অদৃশ্য হয়ে আছে।

হঠাৎ মিস্টার মরিসের বিস্মিত কণ্ঠ শুনে সবাই ঘুরে তাকালাম ওর দিকে। কথা

বলে আঙুল দিয়ে ঘরের এক কোণে আমাদের দেখিয়ে দিলেন তিনি। নির্দেশিত দিকে চেয়ে দেখলাম চকচকে ধূলিকণার এক ঘূর্ণি উঠেছে সেখানে। কণাগুলোর আভায় অনেকখানি কেটে গেছে ওদিককার অন্ধকার। ফসফরাসের মত ঝিকমিক করে জ্বলছে নিভছে অসংখ্য ধূলিকণা। আশ্চর্য! এ জিনিসই দেখেছিলাম আমি কাউন্ট ড্রাকুলার প্রাসাদ দুর্গে। ডাইনীতে রূপ নিয়েছিল ওই ধূলিকণা। এখন কিসে রূপ নেবে?

দেখতে দেখতে বীভৎস চিৎকারে কান ঝালাপালা করে দিয়ে কোত্থেকে বেরিয়ে এল হাজার হাজার ইঁদুর। ইঁদুরের লুটোপুটি আর চিৎকারের মাঝেই ক্রমশঃ বড় হতে শুরু করল ধূলিকণাগুলো। জোনাকির সমান বড় হয়েই ঝাক বেঁধে উড়ে এসে আমাদের চারপাশে নির্দিষ্ট একটা দূরত্ব বজায় রেখে ঘুরতে শুরু করলো ওগুলো। বুঝতে পারছি রসুনের মালা আর পবিত্র কুশ সঙ্গে থাকাতেই কাছে ঘেঁষতে পারছে মা পিশাচটা। তবু যদূর সম্ভব ভয় দেখাবার চেষ্টা করছে। আস্তে আস্তে রূপ বদলাতে শুরু করেছে জোনাকিগুলো। হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে গেল জোনাকিরা। তার পরিবর্তে আমাদেরকে ঘিরে ধপ করে শূন্য থেকে পড়ল একটা প্রকাণ্ড পাইথন। বিশাল মাথাটা তুলে টকটকে লাল চোখ মেলে আমাদেরকে দেখতে থাকল সাপটা।

এক ঝটকায় কোমর থেকে পিস্তলটা বের করে এনে ওটার দিকে নিশানা করলেন মিস্টার মরিস। কিন্তু ট্রিগার টেপার আগেই তার হাত চেপে ধরে বললেন প্রফেসর, গুলি করে কোন লাভ হবে না, মরিস। মরবে না ওটা।

যেন প্রফেসরের কথায় সায় দিতেই খল খল করে বীভৎস হাসি হেসে উঠল সাপটা। বদ্ধ কামরায় সেই শব্দ প্রতিধ্বনিত হয়ে চতুগুণ ভয়ঙ্কর শোনাল। মরিসের হাত ছেড়ে দিয়ে পকেট থেকে একটা বিস্কুটের মত জিনিস বের করলেন প্রফেসর। ওটার কিছুটা ভেঙে ছুঁড়ে দিলেন সাপটার মাথায়। অবাক কাণ্ড! একটা প্রচণ্ড আর্তচিৎকার করে চোখের পলকে অদৃশ্য হয়ে গেল সাপটা। ওদিকে বেড়েই চলেছে ইঁদুরের চিৎকার। যেন পাগল হয়ে গেছে ওগুলো। আর বেশিক্ষণ এখানে থাকলে ওগুলোর কিচকিচ শব্দে পাগল হয়ে যাব আমরাও।

আমাদের এখানকার কাজ আপাতত শেষ, বলে ভাড়া লাগালেন আমাদের প্রফেসর। চলো বেরোই এ নরক থেকে।

ডারি দরজাটা খুলে বাইরে বেরিয়ে এলাম আমরা। দরজার পা দুটো আবার নাগাবার পর তালা দিয়ে দিলেন প্রফেসর। পুবের আকাশে রঙের ছোপ লাগতে শুরু করেছে তখন। ক্লান্ত পায়ে ডাক্তার সেওয়ার্ডের বাড়ির দিকে রওনা দিলাম আমরা।

ঘরে ফিরে দেখলাম তখনও গভীর ঘুমে অচেতন হয়ে আছে মিনা। কেমন যেন একটু মান দেখাচ্ছে ওকে। হয়তো সারারাত আমাদের চিন্তায় ঘুমাতে পারেনি, ভোরের দিকে ঘুমিয়ে পড়েছে। ওকে বিরক্ত না করে ঘরের কোণের সোফাটায় এসে গা এলিয়ে দিলাম। মনে মনে ঠিক করলাম একুশটা বাক্সের খোঁজে আজই একবার টমাস মেলিং এর সঙ্গে দেখা করতে হবে। ক্যারীং কনট্রাক্টর সে। পঞ্চাশটা বাক্স কারফারে পুরানো গির্জায় পৌঁছে দেবার দায়িত্ব নিয়েছিল সেই।

.

মিনা হারকারের ডায়েরী থেকে

২ অক্টোবর।

বই পড়ে আর ঘুমিয়ে কেটেছে গতকাল সারাটা দিন। সন্ধ্যার পর থেকেই জোনাথনদের ফিরে আসার অপেক্ষা করতে লাগলাম, কিন্তু রাত এগারোটা বেজে যাবার পরও যখন ওরা ফিরল না, রীতিমত অস্বস্তি বোধ করতে লাগলাম। কি জানি, কোন বিপদে পড়ল নাকি ওরা! কিন্তু প্রফেসরের মত অসমসাহসী আর প্রতিভাবান লোক রয়েছেন ওদের সাথে, ভেবে সান্ত্বনা পেলাম একটু।

বারটা বাজার পরও ফিরল না ওরা। চুপচাপ বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়া ছাড়া আর কিছু করার নেই। কিন্তু বিছানায় শুয়েও ঘুম এলো না। চারদিক নিস্তব্ধ নিলুম। ফুটফুটে জ্যোৎস্নায় বাইরের সবকিছুই কেমন ফ্যাকাসে রহস্যময় মনে হচ্ছে। ঠিক এই সময় চোখে পড়ল জিনিসটা। ছেড়া মেঘের মত ছোট্ট এক টুকরো হালকা কুয়াশা ভাসতে ভাসতে এদিকেই এগিয়ে আসছে। বিচিত্র রূপ নিতে নিতে এগিয়ে আসা কুয়াশাটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কেমন যেন নেশাচ্ছন্ন হয়ে পড়লাম। জানালার বদ্ধ কাঁচের শার্সির কাছে এসে একমুহূর্তের জন্যে থমকে দাঁড়াল কুয়াশাটা, তারপর জানালার বদ্ধ পাল্লার মাঝখানের সামান্য ফাঁক দিয়ে চুইয়ে চুইয়ে ভেতরে ঢুকতে শুরু করল। ঘরের ভেতর ঢুকেই একবার আমার মাথার ওপর পাক খেল কুয়াশার স্তর, তারপর অন্য একটা স্তম্ভের রূপ নিতে শুরু করল। লাল টকটকে দুটো ভয়ঙ্কর চোখ ওই কুয়াশার ভেতর থেকে সরাসরি চেয়ে আছে আমার দিকে। সেই চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কেমন যেন মোগ্রস্তের মত হয়ে পড়লাম। ধীরে ধীরে বুজে এল চোখের পাতা। বোধহয় ঘুমিয়েই পড়েছিলাম। অনেক বেলা করে ঘুম ভেঙেছে আজ। ঘুম ভাঙার পর ভীষণ ক্লান্ত আর অবসন্ন লাগছিল নিজেকে। এখনও কেমন যেন ম্যাজম্যাজ করছে শরীরটা। কথাটা জানাতে হবে প্রফেসরকে।

২.১১ কেনফিন্ডের পাগলামি

ডাজার জন সেওয়ার্ডের ডায়েরী থেকে

২ অক্টোবর।

কেনফিন্ডের পাগলামি বেড়ে গিয়ে কোন অঘটন ঘটে যেতে পারে ভেবে সারাক্ষণ একজন লোককে ওর ঘরের বাইরে রেখে ওকে পাহারা দেয়ার নির্দেশ দিয়ে রেখেছিলাম নার্সকে। তার সামান্যতম পরিবর্তন দেখলেও আমাকে খবর দেবে নার্স। কাজেই সেদিক থেকে নিশ্চিন্ত ভেবে হাসপাতালে যাওয়া বাদই দিয়েছি আজ। তাছাড়া গত রাতের অভিযানের পর হাসপাতালে যাবার মত শারীরিক বা মানসিক অবস্থাও ছিল না। কাজেই সারাটা দিন সেঁটে ঘুষ দিয়ে বিকেলের দিকে উঠেছি ঘুম থেকে।

সন্ধ্যার পর ড্রইং রুমে বসে চা খেতে খেতে আমাদের ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নিয়ে, আলাপ আলোচনা করতে লাগলাম। সকালে সামান্য কিছু মুখে দিয়ে সেই যে কোথায় বেরিয়েছিলেন মিশর হারকার সারাদিন পর একটু আগে বাড়ি ফিরে এসেছেন। তার মুখ দেখে বোঝা গেল যে কাজে বেরিয়েছিলেন তাতে পুরোপুরি সফল না হলেও একেবারে ব্যর্থ হননি। ঘরে ঢুকেই ক্লান্তভাবে ধপাস করে একটা সোফায় বসে পড়লেন তিনি।

কি ব্যাপার, কাউকে কিছু না জানিয়ে কোথায় টো টো করে এলেন? জিজ্ঞেস করলাম আমি।

বলব সবই, কিন্তু আগে কিছু খেয়ে নেয়া দরকার। বলে মিসেস হরকারের দিকে তাকিয়ে হালকা রসিকতার সুরে বললেন তিনি, আপনি কি দয়া করে কৃতার্থ করবেন এ অধমকে?

অবশ্যই, অবশ্য, সেই কখন থেকেই তো হুজুরের ডোগ সাজিয়ে বসে আছি। কিন্তু পাত্তাই নেই হুজুরের। তা দয়া করে এবার গাত্রোখান করা হোক, কপট গাম্ভীর্যের সাথে জবাব দিলেন মিসেস হারকার।

ওদের দুজনের কথার ধরনে হো হো করে হেসে ফেললাম আমরা সবাই, হাসতে হাসতেই উঠে দাঁড়ালেন মিস্টার হারকারও। একটু পর খাওয়া সেরে ফিরে এলেন তিনি। মিসেস হারারের শরীরটা বিশেষ ভাল নেই বলে তাকে জোর করে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে এসেছেন। একটা সোফায় বসে পড়ে পকেট থেকে পাইপ বের করে তাতে তামাক পরে ধরিয়ে নিলেন মিস্টার হারকার।

আমি আর কৌতূহল চেপে রাখতে না পেরে বলেই ফেললাম, ভাবসাব দেখে তো মনে হচ্ছে কাউন্ট ড্রাকুলার সাক্ষাৎ পেয়ে গেছেন আপনি।

সাক্ষাৎ না পেলেও খোঁজ পেয়ে গেছি, মুখ থেকে পাইপটা সরিয়ে বললেন মিস্টার হারকার।

তাহলে তো কাজই করে এসেছ একটা। কোথায় পেলে তার বোজ? এতক্ষণে মুখ খুললেন প্রফেসর।

আসলে সেই একুশটা বাক্সের খোঁজে বেরিয়েছিলাম আমি। কার্টার, প্যাটারসন কোম্পানীর কাছ থেকে পাওয়া সামান্য একটা সূত্র ছিল আমার হাতে। সেই সূত্র ধরেই ক্যারীং কন্ট্রাক্টর টমাস মেলিং-এর খোঁজ করি। সেখান থেকে খোঁজখবর করতে করতে শেষ পর্যন্ত একুশটা বাক্সের হদিস পেয়ে যাই আমি। প্রথম কিস্তিতে ঠেলাগাড়িতে করে টা বাক্স নিয়ে যাওয়া হয়েছিল মাইল অ্যাণ্ড নিউ টাউনের একশো সাতানব্বই নম্বর চিকস্যাও স্ট্রীটে। দ্বিতীয় কিস্তিতে আরও হটা নিয়ে যাওয়া হয় ব্রেমওসের জ্যামাইকা লেনে। তৃতীয় ও চতুর্থ কিস্তিতে বাকি নটা বাক্স নিয়ে যাওয়া হয় পিকাডিলি সার্কাসের কাছের পুরানো গির্জাটায়। আমার মনে হয় তিনশো সাতচল্লিশ নম্বর পিকাডিলির সেই বিশাল পুরানো গির্জাটাতেই এখন ঠাঁই নিয়েছে কাউন্ট ড্রাকুলা।

দারুণ আবিষ্কার করে এসেছে দেখছি। তা, তিনশো সাতাশি নম্বর বাড়িটা চেনো তুমি, নিজ চোখে দেখেছ?

দেখেছি। বুঝতে পারছি কেন প্রশ্নটা করছেন। অর্থাৎ কার-ফাক্সের গির্জার মত প্রহরা আছে কিনা, ঢুকতে অসুবিধে হবে কিনা, এই তো? মৃদু হেসে বললেন মিস্টার হারকার, না, প্রফেসর, হবে না।

গুড।

আগামী দিনের পরিকল্পনা নিয়ে এরপর দীর্ঘক্ষণ আলোচনা করলাম আমরা। রাতে শুতে যাবার আগে হাসপাতালটা একবার পরিদর্শন করে এলাম আমি। রেনফিডের ঘরেও উঁকি দিয়ে দেখলাম। পরম নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে ও।

.

৩ অক্টোবর

ভোরে কতক্ষণ ঘুমিয়েছি বলতে পারব না, হঠাৎ নার্সের উত্তেজিত ডাকে ঘুম ভেঙে গেল আমার। আমি চোখ মেলতেই বলল সে, সাংঘাতিক কাণ্ড ঘটে গেছে, স্যার, রেনফিন্ডের অবস্থা শোচনীয়। রক্তাক্ত অবস্থায় ঘরের মেঝেতে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে সে।

স্যাণ্ডেল জোড়া কোনমতে পায়ে পালিয়ে নিয়ে রাত্রিবাস পরেই ছুটলাম। নার্সের মুখে আগে থেকে শোনার পরও রেনফিন্ডের ঘরে উঁকি দিয়েই আঁতকে উঠলাম। বাঁ পাশে কাত হয়ে মেঝেতে পড়ে আছে রেনফিল্ড। রক্তে ভেসে যাচ্ছে ঘরের মেঝে। আন্দাজেই বুঝলাম ভয়ঙ্কর কোন দুর্ঘটনা ঘটেছে। এগিয়ে গিয়ে ওর পাশে বসে পড়লাম। আস্তে করে ওর মুখটা আমার দিকে ঘুরিয়ে দিয়েই থমকে গেলাম। মনে হল, প্রচণ্ড আক্রোশে মেঝেতে ঠুকে ঠুকে ওর মুখটাকে তেলে দিয়েছে কেউ। চুইয়ে চুইয়ে এখনও রক্ত ঝরছে ক্ষতস্থান থেকে। ওর অচেতন দেহের পাশে উবু হয়ে বসে ভালমত পরীক্ষা করে দেখলাম, যেভাবে বাঁকাচোরা হয়ে পড়ে আছে দেহটা তাতে আন্দাজ করলাম কোমরটাও ভেঙে গেছে। কেমন করে ঘটেছে ব্যাপারটা বুঝতে না পেরে নার্সকে জিজ্ঞেস করলাম, কিন্তু সে-ও বলতে পারল না কিছু।

রেনফিন্ডের ঘরের সামনে সারাক্ষণ পাহারা দেয় একজন দারোয়ান, সুতরাং সামনে দিয়ে কেউ তার ঘরে ঢুকে তাকে এভাবে মারপিট করে যেতে পারবে না। আর পেছনের বন্ধ জানালা দিয়ে রেফিন্ডের অজান্তে কেউ তার ঘরে ঢোকার প্রশ্নই ওঠে না। মারা তো দূরের কথা। বিছানা থেকে পড়ে গিয়েও ওরকম ঘটা অস্বাভাবিক। তাহলে?

ব্যাপারটার মাথামুণ্ড কিছুই বুঝতে না পেরে প্রফেসরকে খবর পাঠালাম। কয়েক মিনিটের মধ্যেই রাতের পোশাক পরা অবস্থায়ই ছুটে চলে এলেন প্রফেসর। কয়েক মুহূর্ত রেনফিডের তেলানো মুখের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে আমার দিকে ঘুরে দাঁড়ালেন তিনি। আস্তে করে বললেন, অত্যন্ত গুরুতর মনে হচ্ছে আঘাতটা। ভালমত পরীক্ষা করে দেখতে হবে ওকে। ওর ওপর নজর রেখো, এখুনি আসছি আমি।

টেনে টেনে শ্বাস নিচ্ছে রেনফিল্ড। দেখেই বোঝা যাচ্ছে খুবই খারাপ ওর অবস্থা। অল্পক্ষণেই ফিরে এলেন প্রফেসর, হাতে অপারেশনের ইট্রুমেন্টস বক্স। ওর থমথমে গম্ভীর মুখ দেখে অনুমান করলাম গভীর ভাবে ভাবছেন কিছু তিনি। ঘরে ঢুকেই নার্সের দিকে চেয়ে বললেন তিনি, তুমি একটু বাইরে যাও তো। দরকার হলে ডাকব।

মাথা ঝাঁকিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল নার্স। আর বিন্দুমাত্র দেরি না করে রেনফিডের পাশে উবু হয়ে বসে পড়ে তাকে পরীক্ষা করতে শুরু করলেন প্রফেসর। বেশ কয়েক মিনিট ধরে গভীর ভাবে পরীক্ষা করার পর উঠে দাঁড়িয়ে বললেন প্রফেসর, মুখের আঘাতটা তেমন কিছু না, আসলে আঘাত লেগেছে করোটিতে। ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে মাথার তালু। যন্ত্রণার অভিব্যক্তি দেখেই বোঝা যাচ্ছে আঘাতটা মারাত্মক। এখন যত শীঘ্র সম্ভব স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে হবে রক্তের চাপ। যেভাবে রক্তক্ষরণ বাড়ছে তাতে শীঘ্রিই অস্বাভাবিক ভাবে বেড়ে যাবে যন্ত্রণা। ওর মাথার ভেতরের জমাট বাঁধা রক্ত অপসারণের জন্যে এখুনি অপারেশন করতে হবে।

দরজায় টোকা দেবার মৃদু শব্দ হতেই এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলে দিলাম। দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে আর্থার, মরিস আর মিস্টার হারকার। চেহারা আর পোশাক পরিচ্ছদ দেখেই বোঝা যায় সদ্য ঘুম থেকে উঠে এসেছে ওরা। আর্থার বলল, কি হয়েছে জন? শুনলাম, মারাত্মক দুর্ঘটনা নাকি ঘটে গেছে এখানে?

ঠিকই শুনেছিস। আয়, ভেতরে আয়, ডাকলাম আমি।

ওরা ঘরে ঢুকতেই আবার দরজা বন্ধ করে দিলাম আমি। রেনফিল্ডকে ওভাবে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে প্রায় আঁতকে উঠে বলল আর্ধার, কি হয়েছে লোকটার?

সংক্ষেপে ঘটনাটা জানালাম ওদের। সব শেষে বললাম, অপারেশনের পর সামান্য সময়ের জন্যে হয়ত জ্ঞান ফিরতে পারে ওর। তাহলে ওর এ অবস্থার জন্য কে দায়ী জানা যাবে হয়ত।

আস্তে আস্তে এগিয়ে গিয়ে রেনফিডের বিছানাটায় বসে পড়ল ওরা তিনজন। ততক্ষণে অপারেশনের কাজ শুরু করে দিয়েছেন প্রফেসর। গভীর উৎকণ্ঠার সাথে, প্রতীক্ষা করতে থাকলাম আমরা। সময় যেন কাটতেই চাইছে না। যেন অনড় হয়ে দাঁড়িয়ে গেছে আশঙ্কা আর উদ্বেগ ভরা মুহূর্তগুলো। জ্ঞান ফিরে আসবে, তো রেনফিডের? যদি আসে, কি শুনতে পাব ওর মুখ থেকে?

ধীরে, অতি ধীরে শ্বাস ফেলছে রেনফিল্ড। যে-কোন মুহূর্তে থেমে যেতে পারে বুকের ওই মৃদু উত্থান পতন। এক সময় শেষ হল অপারেশন। অত্যন্ত নিপুণভাবে কাজ শেষ করেছেন প্রফেসর। কয়েক মুহূর্তের জন্যে বেশ জোরে জোরে বাস ফেলল রেনফিল্ড, তারপরই ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে আসতে থাকল ওর শ্বাসপ্রশ্বাস। বার কয়েক চোখের পাতা মিট মিট করে আস্তে করে চোখ মেলল রেনফিল্ড। কাঁপা কাঁপা গলায় প্রায় অস্ফুট স্বরে জিজ্ঞেস করল, এক ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্ন থেকে জেগে উঠেছি আমি, প্রফেসর। বুঝতে পারছি নির্মম বাস্তবে পরিণত হয়েছে স্বপ্ন। তা আমার আয়ু আর কতক্ষণ আছে, প্রফেসর?

সে প্রশ্নের জবাব না দিয়ে শান্ত ভাবে বললেন প্রফেসর, দুঃস্বরে কথাটা আমাকে খুলে বলবে কি, রেনফিল্ড?

বলব। আগে আমাকে একটু পানি খাওয়ান। তৃষ্ণায় শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে গলা।

আমি মরিসের দিকে চাইতেই আমার ইঙ্গিত বুঝতে পেরে একছুটে গিয়ে একটা ব্রাপ্তির বোতল জোগাড় করে আনল সে। একটা গ্লাসে পানি ঢেলে তাতে খানিকটা ব্র্যাণ্ডি মিশিয়ে রেনফিল্ডের হাঁ করা দুঠোঁটের ফাঁক দিয়ে একটু একটু করে ঢেলে দিলাম। ওটুকু খাওয়ার পর সামান্য একটু যেন চাঙ্গা মনে হল রেনফিল্ডকে। বার দুয়েক ঢোক গিলে মৃদু স্বরে কথা বলতে শুরু করল সে, আসলে স্বপ্ন দেখিনি প্রফেসর, এক ভয়াবহ বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি আমি একটু আগে। আমি জানি, সময় ফুরিয়ে এসেছে আমার। কিন্তু সব বলে যাব আপনাদের। এ পর্যন্ত বলে আর একবার পানি খেতে চাইল রেনফিল্ড। পানি খেয়ে আবার বলতে শুরু করল সে, ঘুমিয়ে ছিলাম, হঠাৎ নেকড়ের কুদ্ধ গর্জনে ঘুম ভেঙে গেল। জেগে উঠে ঠাহর করার চেষ্টা করলাম কোন্ দিক থেকে আসছে ওই গর্জন, বলেই একটু থামল রেনফিল্ড। কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে ওর।

গভীর আগ্রহের সাথে রেফিন্ডের কথা শুনছিলেন প্রফেসর। রেনফিল্ড চুপ করতেই ওর হাতে মৃদু চাপ দিয়ে বললেন তিনি, বলে যাও, তারপর?

কি যেন বলছিলাম?

নেকড়ের গর্জন।

হ্যাঁ, নেকড়ের গর্জন। প্রথমে অবাক হলেও কয়েক মুহূর্ত পরেই বুঝে ফেললাম ব্যাপারটা। জানালার দিকে অকিয়ে দেখলাম, গাঢ় কুয়াশায় নিজেকে ঢেকে নিয়ে আমার জানালার ওপাশে এসে দাঁড়িয়েছেন তিনি। এর আগেও বহুবার বহুরূপে আমার সামনে এসেছেন তিনি, কিন্তু আজ একেবারে স্বরূপে আত্মপ্রকাশ করলেন। জ্বলন্ত অঙ্গারের মত জ্বলছে তার চোখ দুটো। আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলেন তিনি। চাঁদের আলোয় ঝিকিয়ে উঠল তার ঝকঝকে সাদা তী দাঁতের সারি। আমার ঘরে ঢুকতে চাইছেন তিনি। কিন্তু কেন যেন মনে হচ্ছিল আজ জানালা না খোলাই উচিত। খুললেই হয়ত ভয়ঙ্কর কিছু ঘটে যাবে। আবার থামল রেনফিল্ড। কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে একটু জিরিয়ে নিয়ে আবার বলতে শুরু করল সে, প্রায়ই আমার জন্যে খাবার পাঠাতেন তিনি। বড় বড় নীল রঙের মাছি পাঠাতেন, নীলকান্ত মণির মত ঝিকমিক করত ওদের ডানা আর পিঠ। আর পাঠাতেন সুপুষ্ট মাকড়সা, পতঙ্গ। যাদের পিঠে আঁকা থাকত করোটির চিহ্ন। আজ তিনি জানালার বাইরে দাঁড়িয়ে মৃদু হেসে বললেন, আজ তোমার জন্যে কি পাঠাব জানো? ইঁদুর। হাজার হাজার জ্যান্ত ইঁদুর। টকটকে লাল তাজা রক্ত বইছে ওগুলোর ধমনীতে।

তাঁর কথায় হাসলাম আমি, কিন্তু জানালা খুললাম না। আসলে দেখতে চাইছিলাম তার ক্ষমতা কতটুকু। ঠিক এই সময় আবার একসঙ্গে ডেকে উঠল হাজার হাজার নেকড়ে। ধীরে ধীরে একরাশ জমাট কুয়াশা ছড়িয়ে পড়তে লাগল সামনের মাঠটায়। সেই কুয়াশার ভেতর বিদ্যুৎ চমকের মত ছুটে বেড়াতে লাগল একটা আলোর শিখা। একসময় সরে গেল কুয়াশা। তখনই চোখে পড়ল ওগুলো। হাজার হাজার ইঁদুর। মাঠ পেরিয়ে পিলপিল করে এগিয়ে আসছে আমার জানালার দিকে। আবার এসে দাঁড়ালেন তিনি জানালার সামনে। হেসে বললেন, সব তোমার জন্যে। আর শুধু আজ নয়, আমার উপাসনা করলে হাজার হাজার বছর ধরে এভাবে তোমাকে কৃতার্থ করে যাব আমি।

ধীরে, অতি ধীরে জানালার কাছে এগিয়ে গেলাম আমি, কিন্তু জানালা খুললাম না। শুধু তার জ্বলজ্বল লাল চোখের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। কতক্ষণ তাকিয়ে ছিলাম জানি না, হঠাৎ মনে হল, তাইতো, জানালা খুলছি না কেন? এতদিন ধরে কি শুধু এই দিনটির জন্য অপেক্ষা করিনি আমি? কথাটা মনে হতেই আস্তে করে হাত বাড়িয়ে খুলে দিলাম জানালা। পরম শ্রদ্ধা ভরে মাথা নিচু করে তাকে আহ্বান জানালাম, আসুন, প্রভু, ভেতরে আসুন।

চোখের পলকে অদৃশ্য হয়ে গেল ইঁদুরগুলো। একটা দমকা হাওয়ার মত ঘরে এসে ঢুকলেন তিনি, আবার চুপ করে গেল রেনফিল্ড। বার কয়েক জোরে জোরে খাস নিয়ে মৃদু কণ্ঠে পানি চাইল সে। তাড়াতাড়ি তার দুঠোঁটের ফাঁকে ব্র্যাণ্ডি মেশান পানি ঢেলে দিলাম আমি। তার অবস্থা দেখে মনে হল যে-কোন মুহূর্তে আবার জ্ঞান হারাতে পারে সে। এখন জ্ঞান হারিয়ে ফেললে ওর কথা আর শোনা হবে না, এই ভয়ে আগের কথার খেই ধরিয়ে দিতে গেলাম আমি। বাধা দিয়ে আমাকে ফিসফিস করে বললেন প্রফেসর, না, না, জন, জোর করে এখন কিছু বলিও না ওকে দিয়ে। তাহলে হয়ত স্মৃতি শক্তিই গোলমাল হয়ে যেতে পারে ওর।

বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকেই একটু সামলে নিয়ে আবার বলতে শুরু করল রেনফিল্ড, আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন তিনি। হিংস্র পদের মত জ্বলজ্বল চোখে আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, সঙ্গী চাও, রেনফিও, মেয়ে সঙ্গী? কে না চায়? ঘাড় কাত করে সম্মতি জানালাম আমি।

হঠাৎ কিসের গন্ধ পেয়েই বোধহয় কুকুরের মত সারা ঘরে ওকে বেড়াতে লাগলেন তিনি। তারপর আমার কাছে এগিয়ে এসে বললেন, আরে, এ ঘরে তো ঘুরে গেছে দেখছি তোমার সঙ্গিনী।

তার কথা শুনে বিদ্যুৎ চমকের মত বুঝে ফেললাম ব্যাপারটা। গত কয়েক মাসে মাত্র একজন মেয়ে মানুষ একবার এ ঘরে প্রবেশ করেছেন, মিসেস হারকার। বুঝলাম মিনা হারকারকে আমার সঙ্গিনী রূপে পাঠাতে চান তিনি। কি করে পাঠাবেন তাও বুঝে ফেললাম। মিসেস হারকারকে আগে জীবন-মৃতাতে পরিণত করবেন তিনি, কারণ সম্পূর্ণ জীবিতাবস্থায় স্বামী ফেলে আমার কাছে মিসেস হারকার আসবেন এটা গাধার শিং গজানোর মতই অসম্ভব। তারপর মিসেস হারকারকে দিয়ে জীবন-মৃত করাবেন আমাকে। এবং শুধু এভাবেই মিসেস হারকার আর আমার মিলন হতে পারে। চোখের সামনে মিসেস হরকারের সুন্দর নিস্পাপ মুখটা ভেসে উঠল। মনে পড়ল কেমন মমতা ডরে আমার সাথে আলাপ করে গেছেন তিনি।

শয়তানের সাধনা করেছিলাম শুধু ক্ষমতার লোভে, নিস্পাপ মানুষের চরম সর্বনাশের কারণ হবার জন্যে নয়। আস্তে করে জিজ্ঞেস করলাম তাকে, আপনি কি মিসেস হরকারের কথা বলছেন?

চমৎকার, বুঝতে পেরেছ দেখছি। হ্যাঁ, আমার সহকারী হবার যোগ্যতা তোমার আছে, খুশি হলেন তিনি।

কিন্তু মিসেস হারকারকে সঙ্গিনী হিসেবে পেতে চাই না আমি, নিজেকে জীবন-মৃততে পরিণত করতেও আপত্তি আছে আমার।

কি বললে? মুহূর্তে হাসি হাসি ভাবটা মুছে গেল তার মুখ থেকে। দ্বিগুণ হিংস্রতায় জ্বলজ্বল করে জ্বলে উঠল তার চোখ দুটো, আবার চুপ করল রেনফিল্ড। ঘড় ঘড় আওয়াজ হচ্ছে ওর বুকের ভেতর। বুঝলাম, সময় শেষ হয়ে এসেছে রেফিরে।

আর একটু ব্র্যাঙি মেশান পানি ঢেলে দিলাম রেনফিল্ডের হাঁ করা মুখে। যেভাবেই হোক আর একটুক্ষণ টিকিয়ে রাখতে হবে ওকে। শুনতে হবে ওর কাহিনী। মিসেস হারারের নাম শোনা মাত্র ধক্ করে উঠেছিল আমার বুকের ভেতর। বুঝতে পারছি চরম দুর্যোগ ঘনিয়ে আসছে ওঁর মাথার ওপর। রেনফিডের কাহিনীর শেষাংশ না শুনতে পারলে বোঝা যাবে না কিভাবে মিসেস হরকারের ওপর চড়াও হবে পিশাচ ড্রাকুলা।

আস্তে আস্তে আবার বলতে শুরু করল রেনফিল্ড, আমি তার কথায় প্রতিবাদ করায় দারুণ খেপে গিয়ে সারা ঘরে পায়চারি করে বেড়াতে লাগলেন তিনি। মাঝে মাকে আমার দিকে এমন ভাবে চাইতে লাগলেন যেন আমি একটা ঘৃণ্য কীট। উনি ক্ষমতাশালী ঠিক, কিন্তু আমিও তো একেবারে অকেজো নই। সাধনা করে করে আমিও তো মোটামুটি ক্ষমতা অর্জন করেছি। তাহলে, শুধু আমার স্বপক্ষে একটা কথা বলতেই তিনি অমন ভাব দেখাবেন কেন? আমি তার সাধনা করেছি, এক আধটা ভুল করে ফেললেও তো আমাকে তার ক্ষমা করা উচিত। আজ বুঝতে পারছি, ঈশ্বরকে বাদ দিয়ে শয়তানের পূজা করা কত বড় ভূল, কত বড় অপরাধ।

কথাটা বুঝতে পেরেই মনে মনে বার বার ডাকতে লাগলাম ঈশ্বরকে। আমার কৃত অপরাধের জন্য মাফ চাইলাম তার কাছে। ওদিকে শয়তানটার ঔদ্ধত্য ক্রমশঃ সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। দেশে আগুন ধরে গেল আমার মাথায়। আর সহ্য করতে না পেরে ঈশ্বরের নাম নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লাম ওর ওপর। দুহাতে জাপটে ধরলাম শয়তানটাকে। পারি আর না পারি, এতে আগের ভুলের কিছুটাও যদি প্রায়শ্চিত্ত হয় তো ক্ষতি কি?

আমার আলিঙ্গন থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেবার আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগল শয়তানটা। কিন্তু পারল না। বহু ভাবে চেষ্টা করেও আমার হাত থেকে ছাড়া না পেয়ে হঠাৎ স্থির হয়ে গেল সে। ভাবলাম বুঝি জয়ী হতে চলেছি আমি। আমার ওপর যে অবজ্ঞা সে দেখিয়েছে ঠিক সেটাই ফিরিয়ে দেবার জন্যে থুথু ছিটিয়ে দিলাম তার মুখে, এবং দিয়েই বুঝলাম চরম ভুল করেছি। থুথু ছিটাতে গিয়েই তার চোখের দিকে চোখ পড়ল আমার। সাথে সাথে পৈশাচিক ক্ষমতায় আমার মত অলৌকিক ক্ষমতার শক্তিধর লোককেও সম্মোহিত করে ফেলল সে। সম্মোহিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সাময়িক ভাবে ক্ষমতা হারালাম আমি। এই সুযোগে আমার বাইপাশ থেকে বেরিয়ে এল শয়তানটা। পরমুহূর্তে আমাকে দুহাতে চেপে ধরে এক ঝটকায় মাথার ওপর তুলে প্রচণ্ড এক আছাড় মারল সে। মনে হল একটা পাহাড় ভেঙে পড়ল আমার ওপর। জ্ঞান হারাবার আগের মুহূর্তে শুনলাম হাজারো নেকড়ের সম্মিলিত ক্রুদ্ধ গর্জন, বলে কয়েকবার খুব জোরে টেনে টেনে শ্বাস নিল রেনফিল্ড। খাস নেবার সময় সাংঘাতিক ভাবে বেড়ে গেল তার বুকের ঘড় ঘড় আওয়াজ। তারপর অতি কষ্টে ফিসফিসিয়ে বলল, আপনাকে মিসেস হরকারের সম্পর্কে আগেই হুঁশিয়ার করেছিলাম, ডাক্তার, কিন্তু আমার কথা শোনেননি… বলেই চুপ করে গেল সে। তাড়াতাড়ি তার দুঠোঁটের ফাঁকে একটু পানি ঢেলে দিলাম। কিন্তু সেটুকু গিলতে পারল না রেনফিল্ড, গড়িয়ে পড়ে গেল কষা বেয়ে।

রেনফিল্ড মারা যাবার সঙ্গে সঙ্গে কঠোর দৃষ্টিতে আমার দিকে চাইলেন প্রফেসর। বললেন, ও তোমাকে মিনা সম্পর্কে হুঁশিয়ার করেছিল, কথাটা বলনি কেন আমাকে?

আমি, আমি স্যার ওটাকে পাগলের প্রলাপ বলে ভেবেছিলাম, আমতা আমতা করে জবাব দিলাম।

হুঁহ! বলে একলাফে মেঝে থেকে উঠে দাঁড়ালেন প্রফেসর। আমাদের কারও দিকে আর একবারও না তাকিয়ে ছুটে বের হয়ে গেলেন ঘর থেকে। আমরাও ছুটলাম তার পিছু পিছু। বাড়ি পৌঁছে সোজা মিসেস হরকারের ঘরের দিকে এগিয়ে। গেলেন প্রফেসর। ঠেলা দিতেই খুলে গেল ঘরের দরজা। খিল দেয়া হয়নি, শুধু ভিড়িয়ে রাখা হয়েছিল দরজার কপাট। প্রায় একসাথেই ঘরে ঢুকলাম আমরা চারজনে। মিসেস হারকারের বিছানার দিকে চোখ পড়তেই স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম। আতঙ্কে খাড়া হয়ে উঠল গায়ের নোম, মেরুদণ্ড বেয়ে শিরশির করে নেমে গেল হিমেল শিহরণ।

চিৎ হয়ে বিছানায় শুয়ে আছেন মিসেস হারকার। জানালা দিয়ে জ্যোৎস্না এসে পড়েছে সেই বিছানার ওপর। বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে তার গলার ওপর ঝুঁকে আছে কালো আলখেল্লা পরা, ও কে? মিসেস হরকারের হাত দুটো বুকের ওপর জড়ো করে বা হাতে ধরে রেখেছে, আর নিজের মুখটা ভালমত মিসেস হারারের গলার কাছে ঠেকানোর জন্যে ডান হাত দিয়ে তার ঘাড় চেপে সামান্য একটু ওপরে তুলে ধরেছে মূর্তিটা।

আমাদের পায়ের শব্দে চমকে উঠে ঘুরে দাঁড়াল কালো আলখেলা পরা মূর্তিটা। সাথে সাথেই আতঙ্কিত গলায় ফিসফিস করে বললেন মিস্টার হারকার, কাউন্ট, কাউন্ট ড্রাকুলা!

ঘরের ভেতর আমাদেরকে দেখে রাগে আগুনের শিখার মত দপ করে জ্বলে উঠল কাউন্টের দুই চোখ। প্রচণ্ড আক্রোশে দুঠোঁটের কোণ থেকে বেরিয়ে এসেছে তার ঝকঝকে সাদা দাঁত দুটো। শিকার হাতছাড়া হয়ে যায় দেখে বাষের মত হার দিয়ে উঠল পিশাচ কাউন্ট, পরক্ষণেই তেড়ে এল আমাদের দিকে। সঙ্গে সঙ্গে কোটের দুই পকেট থেকে ঝটকা মেরে বেরিয়ে এল প্রফেসরের দুই হাত। বা হাতে ঝকঝক করে উঠল একটা ছোট্ট সোনার ক্রুশ, সেটা কান্টের দিকে উঁচিয়ে ধরলেন তিনি, যেন দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল কাউন্ট। সেখান থেকেই রুদ্ধ আক্রোশে দাঁত খিচাতে থাকল আমাদের উদ্দেশ্যে! বিড়বিড় করে কি যেন পড়লেন প্রফেসর-বোধহয় বাইবেলের পবিত্র শ্লোক, তারপরই ডান হাতের জিনিসটা ছুঁড়ে দিলেন কাউন্টের দিকে। বিস্কুটের মত জিনিসটা দেখেই বুঝলাম–ধুনো।

সঙ্গে সঙ্গে অমানুষিক আর্তনাদ করে উঠে পিছিয়ে গেল কাউন্ট। পরমুহূর্তেই কুয়াশায় রূপ নিতে শুরু করল সে। কয়েক সেকেণ্ডেই গাঢ় কুয়াশায় ঢেকে গেল একটু আগে কাউন্ট যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল সেখানটা। ওই গাঢ় কুয়াশার ভেতর ছুটে বেড়াচ্ছে দুটো জ্বলন্ত অঙ্গারের মত জ্বলজ্বলে শাল চোখ। এ বীভৎসতা ভয়। দুস্বপ্নেও কল্পনা করা যায় না। ধীরে ধীরে জানালা গলে বেরিয়ে যেতে লাগল কুয়াশার স্তর। কুয়াশার স্তরের পেছনের অংশে যেন ৰূলে থেকে বেরিয়ে গেল চোখ দুটোও। সঙ্গে সঙ্গে একবারের জন্যে শোনা গেল হাজার হাজার নেকড়ের সম্মিলিত ক্রু হিংস্র গর্জন।

চোখের সামনে থেকে বিভীষিকাটা দূর হয়ে যেতেই মিসেস হরকারের বিহানার কাছে ছুটে গেলেন প্রফেসর। ওর গলার ক্ষত দুটোতে হালকা ভাবে আঙুল বোলাতে বোলাতে আস্তে করে ডাকলেন মিসেস হারকারকে। ধীরে ধীরে চোখ মেলে চাইলেন মিসেস হারকার। আমাদের সবাইকে ওর বিছানার পাশে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অবাক কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, এত রাতে আপনারা এখানে কেন?

দুর্ঘটনায় মারা গেছে রেনকি। সবাই আমরা সেখান থেকেই আসছি। ভাবলাম, তুমি যখন রেনফিডের সম্পর্কে আগ্রহ, তোমাকে খবরটা এখনই জানাই,আসল কথা মিসেস হরকারের কাছে ভাঙলেন না প্রফেসর।

আ-হা-হা। তাই নাকি? মরে বেঁচেছে তাহলে লোকটা। আসলে পাগল হলেও সত্যিই ভাল ছিল রেফিন্ড। ওর অকস্মাৎ মৃত্যুতে আন্তরিক দুঃখ হচ্ছে আমার, বলতেই গলার কাছে হাত দিলেন মিসেস হারকার। ক্ষতস্থানে হাত দিয়ে ব্যথা লাগতেই বললেন, উহ! আমার এখানটায় এত ব্যথা করছে কেন? আজ শরীরটাও এত দুর্বল লাগছে কেন?

ও কিছু না। বোধহয় পিপড়ে কামড়েছে গলায়। আর বেশি রাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলে অমন দুর্বল লাগে সবারই। হয়েহে, ঘুমাও এখন। ভোর হতে দেরি আছে এখনও। বলে মিস্টার হরকারের দিকে ফিরে ফিসফিসিয়ে বললেন প্রফেসর, খবরদার, রাতের বেলা মিসেস হারকারকে একা ফেলে আর যাবে না কোথাও। যাও এখন ওর পাশে শুয়ে পড়গে। আর এই নাও, এটা ওর বালিশের নিচে রেখে দিও, বলে আর একটুকরো ধুনো মিস্টার হরকারের দিকে এগিয়ে দিলেন প্রফেসর।

আজ সকালেই মিনার চেহারা দেখে কেমন যেন সন্দেহ হয়েছিল আমার, প্রফেসর। কিন্তু তখন তেমন গুরুত্ব দিইনি, বললেন মিস্টার হারকার।

তোমাদের এই গুরুত্ব না দেয়াটা কতবড় ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায় বুঝতে পারছো তো এখন? তোমাদের সবাইকে বলহি, আমাদেরকে উদ্দেশ্য করে বললেন প্রফেসর। এখন থেকে যত সামান্যই হোক, কোন কিছু সন্দেহ হলেই আমাকে জানাবে। বুঝেছ?

ঘাড় কাঁত করে আমরা সাড়া দিলাম সবাই।

মিস্টার হারকারকে মিসেসের কাছে রেখে বেরিয়ে এলাম আমরা তিনজনে। বাইরে বেরিয়ে প্রফেসরকে জিজ্ঞেস করলাম, স্যার, মিসেস হারকারকে না জাগালেও তো পারতেন?

পারতাম, কিন্তু লুসির কথা ভুলে গেছ? পিশাচের দ্বারা সম্মোহিত হয়ে মারা গিয়ে পিশাচিনীতে পরিণত হয়েছিল সে। মিসেস হারকারের বেলায়ও তা ঘটতে পারত। তাই তার ঘুম ভাঙিয়ে তাকে সমোহনমুক্ত করে দিলাম। এখন ঈশ্বর না করুন, আরেকবার পিশাচের দ্বারা সমোহিত হবার আগে মারা গেলে আর পিশাচিনীতে পরিণত হবে না মিনা।

প্রফেসরের অসাধারণ সূক্ষ্ম দৃষ্টির তারিফ করলাম মনে মনে। আরেকবার ওই অসাধারণ প্রতিভাবান লোকটার প্রতি শ্রদ্ধায় মাথা নুয়ে এল আমার।

২.১২ জরুরী বৈঠক

জোনাথন হারকারের ডায়েরী থেকে

৩ অক্টোবর।

সকালবেলা আবার আমাদের জরুরী বৈঠক বসলো ডাক্তার সেওয়ার্ডের পড়ার ঘরে। আলোচ্য বিষয়-কাউন্ট ড্রাকুলা। প্রফেসর বললেন, আজ সূর্যাস্তের আগে যেভাবেই হোক খুঁজে বের করতে হবে শয়তানটাকে। পঞ্চাশটা বাক্সের সব কটা খুঁজে বের করে খুলে খুলে দেখতে হবে। এমন ভাবে প্রস্তুত রাখতে হবে নিজেদের যেন কাউন্ট ড্রাকুলাকে খুঁজে পাওয়া মাত্র হত্যা করতে পারি তাকে, একে একে সবার মুখের দিকে তাকালেন তিনি। কারও কোন আপত্তি আছে?

না, নেই, বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে বললেন মিস্টার মরিস। ওই কাউন্ট হারামজাদাকে খুন করা ছাড়া এই মুহূর্তে আর কোন ইচ্ছেই নেই আমার।

মৃদু হেসে বললেন প্রফেসর, আসলে তোমার মুখ থেকে এই জবাবই আশা করছিলাম আমি, মরিস।

চার-চারটে জায়গায় হানা দিয়ে আজকের মধ্যে পঞ্চাশটা বাক্স পরীক্ষা করা সব, স্যার? মৃদু প্রতিবাদ জানালাম আমি।

একেবারে অসম্ভব না হলেও সহজ নয় কাজটা। দুটো দলে ভাগ হয়ে যেতে হবে আমাদের। মরিস আর আর্থার থাকবে এক দলে, অন্য দলে থাকব আমি, তুমি আর জন। ওরা দুজন হানা দেবে মাইল অ্যাও নিউ টাউনের একশ সাতানব্বই নম্বর চিকস্যাও লেন আর মেসের জ্যামাইকা লেনে। আমরা খুঁজব কারফার আর পিকডিলির পুরানো গির্জায়। আর্থার আর মরিসের খোঁজার জায়গা দুটোর ওপর তেমন গুরুত্ব দিচ্ছি না আমি, কিন্তু তবু একবার দেখা উচিত। মরিস, তোমাদের কাজ হবে বাক্সের ডালাগুলো খুলে ভেতরটা দেখা। ভেতরে কাউন্ট না থাকলে সেখানে একটুকরো করে ধুনো রেখে আবার বন্ধ করে দেবে ডালা।

আর থাকলে? জিজ্ঞেস করলেন মিস্টার মরিস।

যেভাবে লুসির জীবন-মৃত আত্মাটাকে হত্যা করেছি, অবিকল তেমনি ভাবেই তাকে হত্যা করবে। এবং কাজটা করার ভার দিচ্ছি আমি তোমাকে, উত্তর দিলেন প্রফেসর।

তাহলে, এখুনি এই মুহূর্তে ঈশ্বরের নাম নিয়ে বেরিয়ে পড়তে চাই আমি।

এসো, ঈশ্বর সহায় থাকুন তোমাদের।

লর্ড গোডালমিং আর মিস্টার মরিস বেরিয়ে যাবার পর আমরাও বেরিয়ে পড়লাম। প্রথমেই হানা দিলাম কারফাক্সের বিশাল পুরানো গির্জাটায়। আজ আমরা তৈরি হয়েই এসেছি, কাজেই গির্জায় ঢুকতে বাধা দিতে পারল না আমাদের দারোয়ান। টমাস মেলিং-এর কাছ থেকে অনুমতিপত্র নিয়ে তার প্রতিনিধি হয়ে এসেছি আমি। অবশ্যই মিছে কথা বলে অনেক কষ্টে রাজি করান গেছে টমাস মেলিংকে।

বাক্সগুলো যেখানটায় পড়ে আছে সেখানে দিনরাতের কোনো ভেদাভেদ নেই। সেদিন রাতের মতই আজ দিনের বেলায়ও মোমবাতি জ্বেলেই কাজ করতে হল আমাদের। ব্যাগ থেকে বড় একটা স্কু-ড্রাইভার বের করে মাটি ভর্তি সেই বিশাল বাক্সের ডালাগুলো খুলে ফেললেন প্রফেসর। প্রত্যেকটা বাক্সের ভেতরই একবার করে উঁকি মেরে দেখে নিয়ে একটুকরো করে ধুনো ভেঙে ফেললেন ডেতরে, তারপর আবার বন্ধ করে দিলেন ডালাগুলো। ঊনত্রিশটা বাক্সই খুঁজে দেখলাম, কিন্তু পাওয়া গেল না পিশাচটাকে।

গির্জা থেকে বেরিয়ে এসে বললেন প্রফেসর, হারামজাদা টের পেয়ে গেছে আমরা পিছু লেগেছি ওর, তাই পালিয়েছে। চলো, দেরি না করে পিকাডিলির পরিত্যক্ত গির্জাটায় হানা দিই।

ফেনচার্চ স্ট্রীটে পৌঁছে হঠাৎ আমাকে বললেন প্রফেসর, গ্রীন পার্ক থেকে একজন চাবির কারিগর ডেকে নিলে কেমন হয়? বলা তো যায় না। গির্জার সদর দরজায় তালা মারাও থাকতে পারে।

লাগবে না, প্রফেসর, বললাম আমি। সেদিনই ওই গির্জার আশপাশটা ভালমত দেখে গেছি আমি। আস্তাবলের সামনের জানালাটায় গরাদ নেই। অনায়াসে ওই জানালা দিয়ে ভেতরে ঢুকে যেতে পারব আমরা।

বেশ, চলো তাহলে, লোক যত কম জানাজানি হয় ততই মঙ্গল, আমার কথায় সায় দিয়ে বললেন প্রফেসর।

এখান থেকে একটা ঘোড় গাড়ি নিয়ে পিকাডিলি সার্কাস পর্যন্ত এলাম আমরা, তারপর পায়ে হেঁটে দুপুরের একটু পর এসে দাঁড়ালাম পরিত্যক্ত গির্জাটার সামনে। আশপাশটা অত্যন্ত নির্জন। ঘুরে গিয়ে পেছনে আস্তাবলটার কাছে পৌঁছে জানালা টপকে একে একে ভেতরে ঢুকলাম আমরা। নিচের হল ঘরটায় পৌঁছতেই একটা ভ্যাপসা পচা দুর্গন্ধ এসে লাগল নাকে। ওই গন্ধের সাথে আমি ভালভাবেই পরিচিত, কাউন্ট ড্রাকুলার গায়ের গন্ধ ওটা। বুঝলাম, অতি সম্প্রতি এই হলঘরটা ব্যবহার করছে শয়তানটা। বিরাট হল ঘরের শেষ প্রান্তে পড়ে আছে কাঠের বাক্সগুলো। এক মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে এগিয়ে গিয়ে বাক্সের ডালা খোলায় মন দিলেন প্রফেসর। কিন্তু এখানেও পাওয়া গেল না কাউন্টকে। টমাস মেলিং-এর হিসেব মত এখানে মোট নটা বাক্স থাকার কথা, কিন্তু গুণে দেখলাম আটটা আছে, আর একটা কোথায় গেল? গির্জার সব কটা ঘর তন্ন তন্ন করে খুঁজেও পাওয়া গেল না বাটা। অর্থাৎ এখান থেকেও পালিয়েছে কাউন্ট ড্রাকুলা, একেবারে বার সহ।

কঠিন গলায় আমাদের সবার সামনে প্রতিজ্ঞা করলেন প্রফেসর, কাউন্ট ড্রাকুলা, আমার হাত থেকে পার পাবে না তুমি, শত শত নিরপরাধ প্রাণোচ্ছল যুবক যুবতী আর মিনার মুখ চেয়ে যেভাবে হোক তোমাকে খুঁজে বের করবই আমি।

সন্ধ্যার পর ডাক্তার সেওয়ার্ডের বাড়িতে ফিরে এসে দেখলাম আমাদের আগেই ফিরে এসেছেন মিস্টার মরিস আর শর্ড গোডালমিং। ভঁরাও খুঁজে পাননি কাউন্ট ড্রাকুলাকে। তবে জায়গা মতই পেয়েছেন বারটা বাক্স। অর্থাৎ সত্যিই একটা বার উধাও।

৪ অক্টোবর সকাল।

সারা দিনের খাটুনির পর গভীর ভাবে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, হঠাৎ মিনার ডাকে ঘুম ভেঙে গেল। ধড়মড় করে উঠে উদ্বিগ্ন গলায় জিজ্ঞেস করলাম, কি হয়েছে, মিনা?

প্রফেসরকে একবার ডেকে নিয়ে এসো না, জলদি, উত্তেজিত গলায় আমাকে অনুরোধ করল মিনা।

ব্যাপার কি? হঠাৎ প্রফেসরের দরকার পড়ল কেন? জানতে চাইলাম আমি।

একটু আগে এসেছিল ও। কিন্তু প্রফেসরের দেয়া কুশটার জন্যে আমার কাছে আসতে পারেনি। দূর থেকেই অবশ্য সম্মোহিত করার চেষ্টা করছিল আমাকে, কিন্তু খুব একটা কার্যকরী হতে পারছিল না। কাল বলে দিয়েছেন প্রাফেসর, যদি পিশাচটা এসে আমাকে সম্মোহিত করার চেষ্টা করে, আর আমি বুঝতে পারি, তাহলে সঙ্গে সঙ্গে যেন তার কাছে খবর পাঠাই। জলদি যাও না, প্লিজ।

যাচ্ছি, বলে তাড়াতাড়ি বিছানা থেকে নেমে স্যাণ্ডেল জোড়া পায়ে গলাতে গলাতে ছুটলাম। বারান্দায় বেরিয়েই প্রায় ধাক্কা খেতে যাচ্ছিলাম, আরে মিস্টার মরিস, আপনি এখানে? এই রাতের বেলা?

সারারাত বাড়ির আনাচে কানাচে পাহারা দেবার ভার পড়েছে আমার ওপর। অবশ্যই ভার দিয়েছেন প্রফেসর। কিন্তু আপনি এভাবে হন্তদন্ত হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছেন কোথায়?

প্রফেসরকে ডেকে আনতে।

কেন? মিসেসের কিছু হয়েছে নাকি? উদ্বিগ্ন কণ্ঠ মিস্টার মরিসের।

না, তেমন কিছু নয়। একটু আগে নাকি কাউন্ট ড্রাকুলা এসে তাকে সম্মোহিত করার চেষ্টা করেছিল।

তাই নাকি? কিন্তু মিসেসকে একা ফেলে যাওয়া ঠিক হবে না আপনার। আপনি ঘরে যান। এক্ষুণি ডেকে আনহি আমি প্রফেসরকে, বলেই ঘুরে দাঁড়িয়ে ছুটলেন মিস্টার মরিস।

ঘরে ফিরে এলাম। সারাটা রাত জেগে থেকে আমাদেরকে পাহারা দিয়েছেন মিস্টার মরিস। কথা ভাবতেই কেমন যেন লজ্জা লাগল আমার। আর আমাদের কথা এতটা ভাবেন প্রফেসর, ভেবে তার প্রতি জাগল গভীর শ্রদ্ধা। দুমিনিট পরেই মিস্টার মরিসকে নিয়ে এসে ঘরে ঢুকলেন প্রফেসর। হাসতে হাসতে মিনাকে জিজ্ঞেস করলেন, কি ব্যাপার? অসময়ে এ বুড়ো ছেলেকে এত জরুরী তলব কেন?

ড্রাকুলা এসেছিল, প্রফেসর। আমাকে সম্মোহিত করার চেষ্টাও করেছিল, কিন্তু সুবিধে করতে পারেনি। আমি টের পেয়ে গেছি সাথে সাথেই।

ভেরি গুড। হারামজাদাটাকে পেয়েছি এতদিনে। তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়তো মা! হ্যাঁ, আর আমার চোখের দিকে তাকাও। মিনা প্রফেসরের চোখে চোখ রাখতেই অদ্ভুত ভঙ্গিতে সেদিকে তাকিয়ে থেকে দুহাতের তালু মাথার দুপাশ থেকে একশ আশি ডিগ্রী কোণ করে কোমর পর্যন্ত ঘুরিয়ে আনলেন তিনি কয়েকবার। ধীরে ধীরে অর্ধমুদিত হয়ে এল মিনার চোখের পাতা, ভারি হয়ে উঠল শ্বাস-প্রশ্বাস। মিনার দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে ইঙ্গিতে মিস্টার মরিসকে কাছে ডাকলেন প্রফেসর। মিস্টার মরিস এগিয়ে যেতেই ফিসফিস করে তাকে লর্ড গোডালমিং আর ডাক্তার সেওয়ার্ডকে ডেকে নিয়ে আসতে বললেন। একটু পরই এসে হাজির হল ওরা।

মিনার বিছানার কাছে এগিয়ে গিয়ে অনেকটা ফিসফিসিয়ে অদ্ভুত কণ্ঠে ডাকলেন প্রফেসর, মিনা, শুনতে পাচ্ছি আমার কথা?

যেন স্বপ্নের ওপার থেকে জবাব এল, হ্যাঁ, প্রফেসর।

কোথায় এখন তুমি?

জানি না।

ধমকে উঠলেন প্রফেসর, বল কোথায়?

কি জানি, ঠিক বুঝতে পারছি না। অচেনা লাগছে সব কিছু।

কি দেখতে পাচ্ছ?

কিচ্ছু না। কেবল অন্ধকার, গাঢ় অন্ধকার চারদিকে।

আলো নেই কোথাও?

না।

কিছু শুনতে পাচ্ছ?

হ্যাঁ।

কি?

পানির অস্পষ্ট কলকল, কোন কিছুর গায়ে ঢেউয়ের চাপড় মারার মৃদু ছল ছলাৎ শব্দ।

সবই স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে?

হ্যাঁ।

অর্থাৎ কোন খোলের মধ্যে মাছ এখন তুমি?

হ্যাঁ।

স্তব্ধ বিস্ময়ে প্রফেসর ছাড়া একে অন্যের মুখের দিকে চাওয়াচাওয়ি করলাম আমরা সবাই। ওদিকে প্রশ্ন করেই চলেছেন প্রফেসর, আর কি শুনতে পাচ্ছ?

তেমন কিছু না।

তবু?

ব্যস্ত সব মানুষের পায়ের শব্দ, নোঙরের গায়ে লোহার শেকল জড়ানোর একটানা বিশ্রী ঘড় ঘড় আওয়াজ।

এ সমস্ত শব্দও অস্পষ্ট?

হ্যাঁ।

কি করছ তুমি এখন?

শুয়ে আছি। মৃত্যুর মত নিশ্চল নিস্পন্দ হয়ে শুয়ে আছি। মনে হচ্ছে করে… হঠাৎ এই সময় বাইরে কোথাও মোরগ ডেকে উঠল। সঙ্গে সঙ্গেই যেন অসহ্য যন্ত্রণায় ছটফট করে উঠল মিনা। মনে হচ্ছে শাস নিতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে ওর। চেঁচিয়ে উঠলেন প্রফেসর, জলদি, জলদি আমার চোখের দিকে তাকাও, মিন হ্যাঁ, হয়েছে। এবার ফিরে এস তুমি আমাদের পৃথিবীতে। হ্যাঁ, এস এস। শুধু তুমি, একা। এসো। এসো।

আস্তে করে চোখের পাতা সম্পূর্ণ খুলল মিনা। আমাদের সবাইকে ওর বিছানার কাছে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, প্রনের, আপনারা সব কি করছেন এখানে? আমার দিকে অবাক হয়ে অমন তাকিয়ে… বলতে গিয়েই হঠাৎ থেমে গিয়ে শব্দ করে হাসল মিনা। ওই হো, ভুলেই গিয়েছিলাম, আমাকে সম্মোহিত করেছিলেন আপনি। তা কিছু জানতে পারলেন, প্রফেসর?।

পেরেছি, আমরা সবাই, উত্তর দিলেন মিস্টার মসি। একটু আগে মিনার মুখ থেকে বেরোনো কথার সুর নকল করে বললেন তিনি, আপনি এখন খোলর মধ্যে।

মিস্টার মরিসের কথা শুনে হো হো করে হেসে উঠলাম আমরা সবাই। বুঝতে পেরে অবাক হয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকল,মিন। হাসির বেগ একটু প্রশমিত হয়ে এলে মিনাকে সব কথা বললেন প্রফেসর।

প্রফেসরের কথা শেষ হলে জিজ্ঞেস করলাম আমি, তাহলে কোন নৌকা বা জাহাজের খোলের মধ্যে আছে এখন কাউন্ট ড্রাকুলা?

হ্যাঁ। এবং উধাও হওয়া বাটার ভেতরে।

অর্থাৎ লণ্ডন ছেড়ে পালাচ্ছে সে?

হ্যাঁ, পালাচ্ছে।

তাহলে তো এখুনি বাক্সটা খুঁজতে বেরিয়ে পড়া উচিত আমাদের, উত্তেজিত ভাবে বললেন মিস্টার মরিস।

অত তাড়াহুড়োর কিছু নেই, মরিস, ওর তাড়াতাড়ি দেখে হেসে ফেলে বললেন প্রফেসর। যেটুকু বুঝতে পারছি-জাহাজটা এখনো কোনও বন্দরে নোঙর করা অবস্থাতেই আছে। এখন প্রথমে আমাদের জানতে হবে বিরাট মাটি ভর্তি বাক্স নিয়ে ট্রানসিলভেনিয়ার দিকে রওনা হচ্ছে কোন্ জাহাজটা।

ট্রানসিলভেনিয়ার নাম শুনেই ধক করে উঠল আমার হৃৎপিণ্ডটা। বললাম, তাহলে আবার নিজের দুর্গে ফিরে যাচ্ছে পিশাচ কাউন্ট ড্রাকুলা?

হ্যাঁ, উত্তর দিলেন প্রফেসর। এবং সেখানে পৌঁছতে পারার আগেই ওকে শেষ করতে হবে আমাদের। একবার নিজের প্রাসাদে পৌঁছে গেলে আর ওকে খুঁজে বের করা যাবে না সহজে।

.

মিনা হারারের ডায়েরী থেকে

৭ অক্টোবর।

আজ সকালে আবার জরুরী বৈঠক বসল আমাদের। কেমন করে, কোন্‌পথে কোন্ জাহাড়ে পালাচ্ছে কাউন্ট ড্রাকুলা, এক এক করে আমাদের র শোনালেন প্রফেসর। গত কয়েকদিন ধরেই এ সব খোঁজখবর নিয়েছেন তিনি। মিস্টার মরিসের এক প্রশ্নের জবাবে বললেন তিনি, ট্রানসিলভেনিয়ার দিকে রওনা দেয়া ছাড়া কোন উপায় ছিল না শয়তানটার। আন্দাজ করলাম যেপথে এসেছিল সেপথেই ফিরে যাবে সে। হয় দানিয়ুব মাউথ দিয়ে, নয় কৃষ্ণ সাগর পার হয়ে। এই আন্দাজের ওপর ভিত্তি করেই বন্দরে খোঁজ নিই কোন জাহাজ দানিয়ুব মাউথ কিংবা কৃষ্ণ সাগর পাড়ি দিচ্ছে কিন্তু এভাবে খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম না কিছু। শেষ পর্যন্ত আর্থারের একটা কথা বেশ মনে ধরল। সে বলল, গত কয়েক দিনের পুরানো দি টাইমস পত্রিকা ঘেঁটে দেখলেই কবে, কোন্ জাহাজ, কোত্থেকে যাত্রা করে কোথায় গিয়ে পৌঁছবে তা জানা যাবে। সাথে সাথেই গত বিশ দিনের দি টাইমস জোগাড় করে খুঁজে দেখতে শুরু করলাম। যা চাইছিলাম, পেয়েও গেলাম শেষ পর্যন্ত। জারিনা ক্যাথেরিন নামে রাশিয়ান জাহাজ ডোলিটিল ওয়ার্ক থেকে ছেড়ে জানা যাবে। জাহাজটা বন্দর ত্যাগ করে গেছে গতকাল। খোঁজ নিয়ে জেনেছি, মাটি বোঝাই একটা বাও বয়ে নিয়ে গেছে জাহজটা! ভার্না থেকে নিসটিকস নামে একজন লোক ছাড়িয়ে নিতে আসবে বাক্সটা।

তাহলে জারিনা ক্যাথেরিনকে কিভাবে ধরা যায় তাই এখন ভেবে দেখতে হবে আমাদের, বললেন মিস্টার মরিস।

ভার্না পৌঁছতে কম করেও তিন সপ্তাহ লাগবে জাহাজটার। স্থলপথে আজ থেকে দিন দশেক পরে রওনা দিলেও জাহাজটা পৌঁছার আগেই ডানা পৌঁছে যেতে পারব আমরা।

তারপর? জানতে চাইলেন লর্ড গোডালমিং।

সুযোগ পেলে সেখানেই হত্যা করব কাউন্টের জীবন-মৃত আত্মাকে। একান্তই যদি সে সুযোগ না পাই তাহলে যেভাবেই হোক অন্তত একটা বুনো গোলাপের ডাল ভরে দেব বাটায়, যেন বাক্স থেকে বেরিয়ে না আসতে পারে পিশাচটা। তারপর কোথায় নেয়া হয় বাক্সটা দেখব। সেটা জানা হয়ে গেলে একসময় না একসময় পিশাচটাকে হত্যার সুযোগ আমরা পাবই।

এরপর আলোচনা করে ঠিক করা হল কবে ভার্নার উদ্দেশে রওনা দেব। দশ দিন নয়, তার অর্ধেক, অর্থাৎ আজ থেকে ঠিক পাঁচ দিন পর, অর্থাৎ, ১২ অক্টোবর যাত্রা শুরু হবে আমাদের।

২.১৩ চ্যারিং ক্রস

জোনাথন হারকারের ডায়েরী থেকে

১৫ অক্টোবর, ভার্না।

চ্যারিং ক্রস অতিক্রম করলাম আমরা ১২ অক্টোবর সকালে, এবং প্যারীতে এসে পৌঁছুলাম সেদিনই রাতে। আগেই আসন সংরক্ষিত করা ছিল ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেসে, তাই বেশ আরামেই এসেছি সারাটা পথ। ট্রেন থেকে নেমেই তাঁর নামে কোন তারবার্তা এসেছে কিনা বাণিজ্য প্রতিনিধির দফতরে খোঁজ নিয়ে তা জানতে গেছেন লর্ড গোডালমিং। আমরা গিয়ে উঠলাম ওডেসাস হোটেলে।

সমস্ত শারীরিক দুর্বলতা কাটিয়ে আবার তার স্বাভাবিক উচ্ছলতায় ফিরে এসেছে মিনা। প্রায়ই ভোরের আগে ওকে সম্মোহন করে কাউন্ট ড্রাকুলার খোঁজ জেনে নেন প্রফেসর। তবে এ পর্যন্ত জাহাজের গায়ে ঢেউয়ের আছড়ে পড়ার শব্দ শুনতে পাচ্ছি ছাড়া আর কিছু বলছে না সে। অর্থাৎ এখনও মাঝ দরিয়ায় রয়েছে জারিনা ক্যাথেরিন।

১২ থেকে ১৫ অক্টোবর পর্যন্ত চারদিনে আসা চারটে টেলিগ্রাম নিয়ে একটু পরই হোটেলে ফিরে এলেন লর্ড গোডালমিং। লণ্ডন ছেড়ে আসার আগেই লয়ার্ড জাহাজ কোম্পানীর সাথে বন্দোবস্ত করে এসেছিলেন তিনি, জারিনা ক্যাথেরিনের খবরাখবর জানিয়ে যেন ওকে রোজ একটা করে টেলিগ্রাম করা হয়। কথা রেখেছে লয়ার্ড কোম্পানী। এ পর্যন্ত পাওয়া চারটে খবরই এক-ভার্নার বন্দরে পৌঁছতে এখনও দেরি আছে জারিনা ক্যাথেরিনের। জাহাজ বন্দরে না ভেড়া পর্যন্ত কিছুই করার নেই আমাদের। তবে এর ভেতর সহকারী বাণিজ্য দূতের সাথে দেখা করে যেভাবেই হোক তার কাছ থেকে বাক্সটা পরীক্ষা করে দেখার একটা অনুমতিপত্র নিতে হবে। লর্ড গোডালমিং আশ্বাস দিলেন, কাজটা করতে পারবেন তিনি।

১৬ অক্টোবর।

লয়ার্ড কোম্পানীর তারবার্তায় জানা গেল দারদানেলস অতিক্রম করেছে জারিনা ক্যাথেরিন।

১৭ অক্টোবর।

বাণিজ্য দূতের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বাক্সটা খুলে দেখার অনুমতিপত্র জোগাড় করে ফেলেছেন লর্ড গোডালমিং। এমনকি জাহাজটা বন্দরে ভেড়ার আগে আমাদেরকে খবর দেবার ব্যবস্থা করবেন বলেও প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন বাণিজ্য দূত। আমাদের মধ্যে আলোচনার পর ঠিক হয়েছে, বাক্স খোলর পর কাউন্ট ড্রাকুলাকে পাওয়া গেলেই তাকে হত্যার দায়িত্ব নেবেন প্রফেসর স্বয়ং, এবং ডাক্তার সেওয়ার্ড তাঁর সহকারী। মরিস, লর্ত গোডালমিং আর আমি থাকব পাহারায়। প্রয়োজন মনে করলে আমাদের কাজে বাইরের অনধিকার চর্চাকারীকে আগ্নেয়াস্ত্রের সাহায্যে ঠেকিয়ে রাখব। কারণ এবার সুযোগ হারালে শয়তানটাকে আবার হাতের মুঠোয় পাওয়া সহজ হবে না।

২৪ অক্টোবর।

পুরো এক সপ্তাহ পার হয়ে গেছে, এখনো জারিনা ক্যাথেরিনের কোন খবর নেই। অথচ দারদালেস থেকে ওটার ভার্না পৌঁছতে চব্বিশ ঘণ্টাও লাগার কথা নয়।

২৫ অক্টোবর।

আজও কোন খবর নেই। সম্মোহিত অবস্থায় মিনা জানাল, এখনো ঢেউয়ের শব্দ ছাড়া আর কিছুই শুনতে পাচ্ছে না সে। অর্থাৎ এখনো দূর সাগরেই রয়ে গেছে জারিনা ক্যাথেরিন।

২৬অক্টোবর।

লয়ার্ড কোম্পানীর তারবার্তায় জানা গেল জারিনা ক্যাথেরিনের সাথে ওদের সমস্ত যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে গেছে। প্রফেসরের ধারণা, প্রচণ্ড কুয়াশার জন্যে মাঝ সাগরের কোথাও আটকে পড়েছে জাহাজটা।

২৭ অক্টোবর।

খবর নেই আজও। উত্তেজনা আর হতাশায় মরিয়া হয়ে উঠেছি সবাই। সবচেয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছেন প্রফেসর। তার ধারণা, আমাদের চোখে ধুলো দিয়ে জারিনা ক্যাথেরিনকে নিয়ে অন্য কোথাও চলে যাচ্ছে ড্রাকুলা। এক রাতে বেশ কয়েকবার মিনাকে সম্মোহিত করেও তেমন কিছু জানা যায়নি।

২৮ অক্টোবর।

লয়ার্ড কোম্পানীর তারবার্তায় আজ খোঁজ পাওয়া গেছে জারিনা ক্যাথেরিনের। আজ দুপুর একটায় নাকি গালেজ-এ প্রবেশ করবে জাহাজটা। কিন্তু গালেজ-এ যাবার তো কথা ছিল না ওটার।

.

ডাক্তার জন সেওয়ার্ডের ডায়েরী থেকে

২৮ অক্টোবর।

জারিনা ক্যাথেরিন গালেজ-এ ঢাকায় খুব একটা অবাক হলাম না, যদিও গালেজ-এ যাবার কথা ছিল না ওটার। আসলে এমনি একটা অভাবনীয় কিছু ঘটার অপেক্ষাতেই ছিলাম আমরা। খবর শুনে শান্তভাবে মিনাকে বললেন প্রফেসর, দেখ তো মা, গালেজ-এ যাবার ট্রেন কটায়?

রেলওয়ে টাইম টেবল-এর পাতা উল্টে দেখে নিয়ে বলল মিনা, চব্বিশ ঘণ্টায় মাত্র একটা ট্রেন, রাত একটা ছত্রিশ মিনিটে।

ওতেই যাব, জিনিসপত্র গোছগাছ করে নাও তুমি। জোনাথন, টিকিট কাটার ভার তোমার ওপর। আর্থার, জাহাজ দপ্তরের প্রতিনিধির সাথে দেখা করে একটা অনুমতিপত্র নিয়ে আসবে, যাতে গালে-এ বাক্সটা পরীক্ষা করে দেখতে আমাদের কোন অসুবিধা না হয়। মরিস, সহকারী বাণিজ্য দূতের সাথে দেখা করে আর একটা অনুমতিপত্র সংগ্রহ করবে তুমি, তাহলে বাক্সটা খুলতে আর কেউ বাধা দিতে পারবে না আমাদের। জন আর আমি আগামীদিন কি করে কি করব তার একটা প্ল্যান তৈরি করে ফেলছি।

মিস্টার হারকার, আর্থার আর মসি ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার পর মিসেস হারকারকে বললেন প্রফেসর, মিনা, যাও তো মা, জোনাথনের ট্রানসিলভেনিয়া ভ্রমণ কাহিনী লেখা আসল ডায়েরীটা নিয়ে এসো। গলেজ থেকে কাউন্ট ড্রাকুলার প্রাসাদ পর্যন্ত যাবার একটা সংক্ষিপ্ত পথের নকশা বের করে ফেলতে চাই। আর… সরাসরি মিসেস হারকারের চোখের দিকে তাকিয়ে হাসলেন প্রফেসর, তার সঙ্গে যদি তোমার হাতের তৈরি একটু কফি হয়…।

এখুনি যাচ্ছি আমি, বলে দ্রুত ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন মিসেস হারকার।

উনি চলে যেতেই আমার দিকে ফিরে বললেন প্রফেসর, একটা কথা হয়ত তোমাকে পরে বলার সুযোগ নাও পেতে পারি, জন, আগে থেকেই বলে রাখছি, বার বার মিনাকে সম্মোহিত করেছি আমি এবং করেছি রাতের বেলা। ড্রাকুলা জেনে গেছে যে মিনাকে সম্মোহিত করে আমরা তার খোঁজ নেবার চেষ্টা করছি, আর জানাটা তার পক্ষে স্বাভাবিক। কারণ মিনার ওপর প্রভাব বিস্তার করেছে সে, আমরাও করছি। তোমার জানা আছে একই দেশে দুই রাজা রাজত্ব করতে পারে না, তেমনি একই জায়গায় দুটো শক্তি প্রয়োগ করলে দুর্বলটা হটে যেতে বাধ্য। কাউন্টের শক্তি আমাদের চাইতে দুর্বল হয়ে পড়েছে মিনার সঙ্গে সঙ্গে রাখা কুশ আর ধুনোর জন্যে। ও দুটোকে দারুণ ভয় পায় কাউন্ট, অথচ আমাদের শক্তির উৎসই হল জিনিস দুটো, সুতরাং ক্ষমতার যুদ্ধে হেরে গিয়ে বুঝে গেছে পিশাচটা আসল ব্যাপার, কি করে আমরা তার খোঁজখবর করছি। তাই নিজেকে বাঁচানোর জন্যে দারদানেলস-এ প্রবেশ করার পর প্রচণ্ড কুয়াশার সৃষ্টি করে জারিনা ক্যাথেরিনের গতিপথ ভুল করিয়ে গালেজ-এ নিয়ে ফেলেছে সে জাহাজটাকে। তাহলে তুরস্কের মধ্যে দিয়ে সহজেই তার এলাকায় ঢুকে যেতে পারবে সে। আর ওর এলাকায় একবার ঢুকে যেতে পারলে অনেক অনেক বেশি ক্ষমতার অধিকারী হয়ে পড়বে পিশাচটা।

এই সময় কফি আর ডায়েরী বুকটা নিয়ে এসে ঘরে ঢুকলেন মিসেস হারকার। কফি খেতে খেতে ভবিষ্যৎ প্ল্যান নিয়ে আলোচনা করতে লাগলাম আমরা।

২৯ অক্টোবর!

ট্রেনে করে ভার্না থেকে গালেজ-এর দিকে চলেছি আমরা। যার যার ওপর দায়িত্ব দেয়া কাজ সুচারুরূপে সম্পন্ন করে সন্ধ্যার দিকে আবার আমরা সবাই মিলিত হয়েছিলাম গতকাল, সেই সময়ই একবার মিসেস হারকারকে সম্মোহন করলেন প্রফেসর। মিসেস হারকার বললেন, ঢেউয়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে না আর। তার বদলে দূরে বহু মানুষের কাটা কাটা কথা শোনা যাচ্ছে। অস্পষ্ট আলোর রেখা চোখে পড়ছে…হঠাৎ এলোমেলো ঝড়ো বাতাস বইতে শুরু করেছে…দূর থেকে ভেসে আসছে এক আধটা নেকড়ের গর্জন…এই সময়ে বেশিক্ষণ মিসেস হারকারকে সম্মোহিত করে রাখলে নতুন কোন পদ্ধতিতে তার ওপর অশুভ প্রভাব ফেলে বসতে পারে কাউন্ট ড্রাকুলা, এই ভয়ে তাড়াতাড়িই তাকে সম্মোহন মুক্ত করে দিলেন প্রফেসর। মিসেস হরকারের ছাড়া ছাড়া কথাগুলোকে বিশ্লেষণ করে মন্তব্য করলেন তিনি, এখন নৈশ ভ্রমণে বেরিয়েছে কাউন্ট ড্রাকুলা।

৩০ অক্টোবর, সকাল।

গালেজ-এর খুব কাছাকাছি এসে পড়েছি। এখন সাতটা বাজে। প্রায় তিন ঘণ্টা লেট করেছে ট্রেন, নাহলে ভোর চারটায়ই গালেজ-এ পৌঁছে যাবার কথা। ভোরের আগে একবার মিসেস হারকারকে সমোহিত করে জানা গেল, আমার চারদিকে এখন গাঢ় অন্ধকার কিছু দেখতে পাচ্ছি না কেবল চাকার একটানা ঘড় ঘড় শব্দ…চাবুকের শন শন…হ্রেষাধ্বনি ছাড়া আর কিছুই শোনা যাচ্ছে না.. ভীষণ দুলছি…কে যেন জঘন্য ভাষায় গালাগাল দিল একটা… এর পরই মিসেস হারকারকে সম্মোহন মুক্ত করে দিয়েছিলেন প্রফেসর।

হঠাৎ ধীরে ধীরে কমতে লাগল ট্রেনের গতি। কুলিদের হাঁক-ডাকও আবছা ভাবে কানে এসে বাজছে। তাহলে গালেজ-এ পৌঁছে গেছে ট্রেন।

২.১৪ বাণিজ্য দূতের দফতরে

জোনাথন হারকারের ডায়েরী থেকে

৩০ অক্টোবর, সকাল।

মিনাকে মিস্টার মরিসের সাথে আগেই তারযোগে ঠিক করে রাখা হোটেলে পাঠিয়ে দিলাম। লর্ড গোডালমিং চলে গেলেন বাণিজ্য দূতের দফতরে। আর আমরা তিনজনে রওনা দিলাম জাহাজ ঘাটার উদ্দেশে।

সোজা গিয়ে জারিনা ক্যাথেরিনের ক্যাপ্টেনের সাথে দেখা করে বাটার কথা জিজ্ঞেস করলাম। তিনি জানালেন মাটি বোঝাই বিরাট ওই বাজটাই শুধু গলেজএ নামিয়ে দেয়া হয়েছে। এছাড়া আর কোন মাল খালাস হবে না এখানে। তিনি আরও জানালেন, গতকাল বিকেলে ১৬নং বার্গেন স্ট্রাসের ইমানুয়েল হিলডেসহিয়েম নামে একজন রুমানিয়ান কাউন্ট ড্রাকুলার উপযুক্ত নির্দেশপত্র দেখিয়ে ছাড়িয়ে নিয়ে গেছে বাক্সটা। প্রথমে নাকি আপত্তি জানিয়েছিলেন ক্যাপ্টেন, কিন্তু রুমানিয়ানটা জোর করতে থাকলে বললেন যে বাটা ভার্মায় খালাস করার নির্দেশ আছে ভর ওপর। তবুও নাছোড়বান্দা রুমানিয়ানা, শেষ পর্যন্ত বাক্সের গায়ে আটকান লেবেল পড়ে দেখতে অনুরোধ করল সে ক্যাপ্টেনকে। উপায়ান্তর না দেখে তাই করলেন ক্যাপ্টেন? অবাক কাণ্ড! লেবেলে নাকি লেখা আছে গালেজ ভায়া জিব্রাল্টার। লেবেলটা জাল কিনা তাও পরীক্ষা করে দেখলেন ক্যাপ্টেন। কিন্তু না, একেবারে জেনুইন লেবেল।

এর বেশি কিছু জানেন না ক্যাপ্টেন জাহাজ থেকে নেমে এসে ভাড়াটে টমটম রাখার জায়গায় খোঁজ নিয়েও তেমন কিছু জানা গেল না। একজন টমটমঅলা শুধু বলতে পারল গতকাল বিকেলে নাকি একটা টমটমে চাপিয়ে বিরাট একটা কাঠের বাক্স নিয়ে যাওয়া হয়েছে, কিন্তু কোথায় নেয়া হয়েছে বলতে পারল না সে।

হতাশ হয়ে ফিরে এলাম হোটেলে।  

*

আমরা হোটেলে পৌঁছানর একটু পরই লর্ড গোডালমিংও ফিরে এলেন। বিন্দুমাত্র সময় নষ্ট না করে জরুরী মিটিং-এ বসলাম আমরা। এখন আমাদের গন্তব্যস্থান সোজা কাউন্ট ড্রাকুলার প্রাসাদ দুর্গ। যেভাবেই হোক বিসট্রিজ থেকে বোর্গো গিরিপথ অতিক্রম করে কাউন্টির দুর্গের পথ ধরতে হবে আমাদের। গালেজ থেকে বিসট্রিজে তিন ভাবে যাওয়া যায়। প্রথমত জলপথে, সেরেথ নদী দিয়ে। দ্বিতীয়ত রেলপথে—এখান থেকে ভেরেস্তি পর্যন্ত গিয়ে ঘোড়া গাড়িতে চেপে। আর তৃতীয় ও শেষ পথটা শুধু ঘোড়া গাড়িতে। আন্দাজ করলাম। এই পথেই গেছে কাউন্ট ড্রাকুলা।

যদি প্রথম পথেই যায়, সেক্ষেত্রে কাউন্ট ড্রাকুলাকে ধরতে হলে একটা অসাধারণ দ্রুতগামী স্টীম লঞ্চ দরকার। আর দ্বিতীয় পথে যদি গিয়ে থাকে সে তাহলে তাকে ধরা যাবে না কোনমতেই। কিন্তু সেপথে বারবার বাহন বদলাতে হবে বলে আন্দাজ করলাম কিছুতেই সে পথটা বেছে নেয়নি ড্রাকুলা। আর তৃতীয় পথটা ধরে যদি সে গিয়ে থাকে, তাহলে এই মুহূর্তে আমরা রওনা দিলেও আমাদের থেকে পনর যোল এন্টা এগিয়ে থাকবে ড্রাকুলা। সুতরাং একটা অত্যন্ত দ্রুতগামী টমটম হলে একটানা আটচল্লিশ ঘণ্টা চলার পর হয়ত কাউন্ট ড্রাকুলাকে ধরা সম্ভব হলেও হতে পারে আমাদের পক্ষে। যদিও আমরা নিশ্চিত যে তৃতীয় পথটাই বেছে নিয়েছে সে, তবুও হুঁশিয়ার থাকতে হবে আমাদের। অন্য দুটো পথে তার যাওয়ার সম্ভাবনাটাও একেবারে বাদ দিলে চলবে না।

তাহলে কি করা যায়? সংক্ষিপ্ত আলোচনার পর ঠিক হল, যত টাকা লাগুক স্টীম লঞ্চ ভাড়া করে নদীপথে যাব আমি আর লর্ড গোলমিং। মিনা আর প্রফেসর এগারটা চল্লিশের ট্রেন ধরে রেলপথে যাবেন। আর ছঘোড়ায় টানা একটা গাড়ি নিয়ে তৃতীয় পথে রওনা দেবেন ডাক্তার সেওয়ার্ড আর মিস্টার মরিস। বোর্গো গিরিপথের মুখে গিয়ে মিলিত হবে তিনটে দল এবং শেষ কথা হল যে-কোন উপায়েই হোক কাউন্ট ড্রাকুলার আগে পৌঁছতে হবে তিনটে দলের।

পথে দস্যু তস্কর বা বুনো জানোয়ারের ভয় আছে, কাজেই তিনটে দলকেই সাথে করে আগ্নেয়াস্ত্র নিতে হবে। প্রয়োজনীয় ম্যাপও নিতে হবে। সমস্ত সম্ভাবনাগুলো সূক্ষ্মভাবে বিশ্লেষণ করে যার যার দায়িত্ব বুঝে নিয়ে হোটেল থেকেই তিনটে দলে ভাগ হয়ে তিন দিকে বেরিয়ে পড়লাম আমরা।

৩০ অক্টোবর, রাত।

প্রচুর টাকার বিনিয়ে একটা খুবই ভাল লঞ্চ জোগাড় করতে পেরেছি আমরা। চালককে বসে থাকতে বলে নিজের হাতেই স্টিয়ারিং হইল তুলে নিলেন লর্ড গোডালমিং। অসাধারণ দক্ষতায় প্রচণ্ড জোরে লঞ্চটাকে চালিয়ে নিয়ে চললেন তিনি। এত ভাল লঞ্চ চালনা তিনি কোথায় শিখলেন জিজ্ঞেস করে জানলাম, টেমস নদীতে তাঁর নিজেরই একটা স্টীম লঞ্চ আছে। নিরক্ষরেখা থেকে ৪৭ ডিগ্রী কৌণিক দূরত্ব রেখে উত্তর দিকে যাত্রা করেছিলাম আমরা, এখন দ্রুত গতিতে কারপাথিয়ানসের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে চলেছি। লর্ড গোডালমিং আমাকে আশ্বাস দিয়েছেন এ হারেই সারাটা রাত লঞ্চ চালিয়ে যেতে পারবেন তিনি।

অন্ধকার রাতে, অজানা পথে এক অজানা ভয়ঙ্করের দেশে পাড়ি জমিয়েছি আমরা। বাইরের পৃথিবীর সাথে এখন আমাদের সমস্ত যোগাযোগ ছিন্ন। গভীর অন্ধকারে নদীর দুতীরের বিশাল পাহাড়গুলোকে দেখলে কেন যেন ছমছম করে ওঠে গা। তার ওপর মাঝে মাঝেই হিমেল ঝড়ো বাতাসের প্রচণ্ড ঝাঁপটায় থর থর করে কেঁপে উঠছে আমাদের লঞ্চ।

৩১ অক্টোবর।

যতই সামনে এগোচ্ছি, বেড়ে চলেছে ঠাণ্ডা। লঞ্চের ভেতরে ফার্নেসের উত্তাপ মা থাকলে প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় বহু আগেই জমে যেতাম। সারারাত একটানা লঞ্চ চালিয়ে ক্লান্ত হয়ে চালকের হাতে হুইল তুলে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন লর্ড গোডালমিং। দুপুরের পর থেকে আবার লঞ্চ চালনার ভার নিয়েছেন তিনি।

১ নভেম্বর।

সাংঘাতিক উদ্বেগ সত্ত্বেও গভীর ভাবে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, ঘুম ভাঙল লর্ড গোড়ালমিং-এর ডাকে। ধড় মড় করে উঠে বসে দেখলাম সকাল হয়ে গেছে।

ফালুতে এসে পৌঁছার পরও ড্রাকুলার বাক্সের কোন খোঁজ পেলাম না। এখান থেকে বিসট্রিজের দিকে চলে গেছে ছোট্ট একটা শাখা নদী। ওই পথেই যেতে হবে আমাদের। শাখা নদী দিয়ে ভেতরে ঢুকেই একটা ফেরিঘাট চোখে পড়ল। ওখানে খোঁজ নিয়ে জানলাম। বড় আকারের নৌকা পাল তুলে দিয়ে বেশ দ্রুত গতিতেই বিসট্রজের দিকে এগিয়ে গেছে গতকাল রাতের বেলা। কে হ্রানে, ওই নৌকাটায় করেই যাচ্ছে কিনা কাউন্ট ড্রাকুলা? যাক বা না যাক, এ ভাবেই বিসট্রজে পৌঁছুতে হবে আমাদের। এ পর্যন্ত ভাল ভাবেই এসেছি আমরা। অন্য দুটো দল ও কি আমাদের মতই এগুচ্ছে? হঠাৎ মিনার কথা মনে পড়তেই মনটা খারাপ হয়ে গেল। ঈশ্বরের কাছে আর্জি জানাচ্ছি, ও যেন বিপদ মুক্ত থাকে।

২.১৫ উঁচু নিচু পাহাড়ী পথে

ডাক্তার জন সেওয়ার্ডের ডায়েরী থেকে

১ নভেম্বর।

কোন্ দিক দিয়ে যে গত দুটো দিন কেটে গেছে টেরই পাইনি। লিখতেও পারিনি, কারণ সে সময়ও নেই, সুযোগও নেই। উঁচু নিচু পাহাড়ী পথে চলতে গিয়ে টমটমের ক্রমাগত আঁকুনিতে স্থির হয়ে বসাই দুষ্কর, লিখব কি?

কোচোয়ান বাদেই টমটমটা ভাড়া নিয়েছিলাম, অবশ্য তাতে টাকা খরচ হয়েছে প্রচুর। টমটমের পুরো মূল্যও জামানত হিসেবে রেখে আসতে হয়েছে গাড়ির মালিকের কাছে।

পালা করে টমটম চালাচ্ছি আমি আর মরিস। মাঝে মাঝে অতি সামান্য সময়ের জন্যে আমাদের এবং ঘোড়াগুলোর খাওয়া আর বিশ্রাম চলছে। এই একটু বিশ্রামের সময়েই আজ লেখার জন্যে খাতা খুলে বসেছি। কয়েকটা লাইন অন্তত না লিখে রাখলে চলবে কেন?

যতই সামনে এগোচ্ছি বেড়ে চলেহে ঠাণ্ডা। অল্পঅল্প তুষারও পড়তে শুরু করেছে গতকাল রাত থেকে। এবড়োখেবড়ে উঁচু নিচু পাহাড়ী পথ এমনিতেই সাংঘাতিক বিপজ্জনক, তার ওপর তুষার পড়ে পিচ্ছিল হয়ে শতগুণ বেড়ে গেছে বিপদের আশঙ্কা। তবু, যেভাবেই হোক যত দ্রুত সম্ভব বোর্গো গিরিপথে গিয়ে পৌঁছতেই হবে আমাদের।

২.১৬ ভেরেস্তিতে এসে পৌঁছেছি

মিনা হারকারের ডায়েরী থেকে

৩১ অক্টোবর।

ভেরেস্তিতে এসে পৌঁছেছি আজ দুপুরে। রাতটা হোটেলে কাটিয়ে কাল খুব ডোরে আবার বোগো গিরিপথের দিকে রওনা দেব। যেভাবে শীত পড়তে শুরু করেছে, এখান থেকেই সবার জন্যে গরম জামা-কাপড় কিনে না নিয়ে গেলে বোর্গো গিরিপথে পৌঁছে বিপদে পড়তে হবে, ভেবে, দিনের বেলায়ই সমস্ত কেনাকাটা সেরে রেখেছিলাম। জোনাথনের জন্যে দারুণ ভাবনা হচ্ছে। কি জানি কোন বিপদে পড়ে বসে আবার।

১ নভেম্বর।

আজকের মত এত সুন্দর সকাল জীবনে দেখিনি আমি। চারদিকে ছবির মত সুন্দর সব প্রাকৃতিক দৃশ্য। ধূসর, সবুজ আর নীলের মেলা চারদিকে।

ভাল কথা, দুদিন পর আজ ভোররাতে আবার আমাকে সম্মোহিত করেছিলেন প্রফেসর। আর্য। আমার কথা শুনে প্রফেসরের ধারণা হয়েছে এখন নাকি আবার জলপথে চলেছে কাউন্ট ড্রাকুলা। প্রফেসর বলেছেন, গালেজ থেকে প্রথমে টমটমে করে তৃতীয় পথ ধরে খানিকটা এগিয়ে গেছে কাউন্ট আমাদের বোকা বানানোর জন্যে। তারপর ফিরে এসে জলপথে রওনা হয়েছে। ভাবতেও পারেনি পিশাচটা, তিনটে পথেই তার পিছু নেব আমরা। কাউন্ট জলপথে চলেছে শোনার পর থেকে জোনাথনের বিপদাশঙ্কায় সারাক্ষণ কেমন করছে আমার বুকের ভেতরটা।

বোধহয় আমার মনের কথা টের পেয়েই আমার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে প্রফেসর বললেন, ভেবো না মা, এই পিশাচটার সম্বন্ধে যথেষ্ট অভিজ্ঞ জোনাথন। বিপদ আসলে ঠিকই টের পাবে সে। তাছাড়া পবিত্র ক্রুশ আর ধুনো কাছে আছে ওর, ত্রিসীমানায় ঘেঁষতে পারবে না পিশাচ ড্রাকুলা।

একটা গ্রামের ভেতর এসে রাস্তার পাশে একটা চায়ের দোকান দেখে গাড়ি থামিয়ে চা খেতে নামলাম আমরা। বিচিত্র পোশাক পরা মেয়ে-পুরুষের দল আমাদেরকে ঘিরে ধরে এটা ওটা জিজ্ঞেস করতে লাগল। একজন বৃদ্ধা জিজ্ঞেস করল প্রফেসরকে, এ এলাকায় নতুন দেধূছি তোমাদেরকে, তা চলেছ কোথায়?

বোর্গো গিরিপথ পেরিয়ে কাউন্ট ড্রাকুলার মেহমান হতে চলেছি আমরা, উত্তর দিলেন প্রফেসর।

পাগল হয়ে তোমরা। ওই হতচ্ছাড়া প্রাসাদে মেহমান হতে গিয়ে প্রাণ নিয়ে ফিরতে পারে কেউ? বুকে ক্রুশ চিহ্ন আঁকতে আঁকতে বলল বৃক্কা।

ঈশ্বর সহায় থাকলে আমরা পারব। এই দেখুন না কি কি জিনিস আছে আমাদের সাথে, বলে পকেট থেকে শ, রসুন আর ধুনো বের করে দেখালেন প্রফেসর।

হুঁ! মনে হচ্ছে পারবে তোমরা। তবু হুঁশিয়ার করে দিচ্ছি, সাবধানে থেকো, কথা শুনে মনে হল প্রফেসরের দেখান জিনিসগুলোর গুণাগুণ জানা আছে বৃদ্ধার।

চা খাওয়া হয়ে গেলে আবার রওনা দিলাম আমরা। হিসেব মত দুপুরের আগেই বোর্গো গিরিপথের মুখে পৌঁছে যাবার কথা আমাদের।

২নভেম্বর, সকাল।

দুপুরে নয়, শেষ পর্যন্ত গতকাল বিকেলে এসে পৌঁছেছিলাম বোর্গো গিরিপথের প্রবেশ মুখে। তিনটে দলের মধ্যে আমরাই প্রথম এখানে এসে পৌঁছেছি। বোর্গো গিরিপথটার প্রবেশ মুখের কাছেই বুকোভিনা থেকে বিসট্রিজ হয়ে আসা চওড়া পথটার সাথে এসে মিশেছে পুব পশ্চিম উত্তর থেকে আসা তিনটে গাড়ি চলার উপযোগী অপেক্ষাকৃত ছোট পথ। পশ্চিমের পথটা চলে গেছে কাউন্ট ড্রাকুলার প্রাসাদ দুর্গ পর্যন্ত। ক্রমশঃ ঢালু হয়ে নেমে যাওয়া পথটার দুদিকে বাড়া পাহাড় আর ঘন বন জঙ্গল। ওদিকে তাকালেই কেমন যেন ছমছম করে ওঠে গা। অথচ এই পথ দিয়েই এক আঁধার রাতে একা একা কাউন্ট ড্রাকুলার প্রাসাদ দুর্গে পাড়ি জমাতে হয়েছিল জোনাথনকে, কথাটা ভাবুলেও খাড়া হয়ে ওঠে গায়ের রোম। সত্যিই সাহসী বলতে হবে জোনাথনকে।

ঠিক উপত্যকা নয়, বরং বলা যায় বিশাল একটা সমান্তরাল চত্বরের ওপর দাঁড়িয়ে আছে বোর্গো গিরিপথের মুখটা। দক্ষিণে খাড়া পাহাড়। উত্তর পুবের পথ দুটো অনেক দূর পর্যন্ত চোখে পড়ে এখান থেকে। এঁকেবেঁকে এগিয়ে গিয়ে হঠাৎ করেই পাহাড়ের আড়ালে হাড়িয়ে গেছে পথ দুটো।

চারদিকে যতদূর চোখ যায় লোক বসতির কোনো চিহ্নই নেই। অনেক খুঁজে পেতে পুবের পাহাড়ের গায়ে একটা খিলানঅলা গুহার মত জায়গা বের করে তাতে আমাদের রাত কাটানর বন্দোবস্ত করলেন প্রফেসর। গাড়ি থেকে খুলে নিয়ে কাছেই একটা গাছের সাথে বেঁধে খেতে দিলেন ঘোড়াগুলোকে। একটানা খাড়াই পাহাড়ী পথ বেয়ে এসে অত্যন্ত পরিশ্রান্ত হয়ে পড়ছিল ওরাও।

বেলা থাকতে থাকতেই আশপাশের বন থেকে কিছু কাঠ জোগাড় করে আনলেন প্রফেসর। অল্পক্ষণ পরেই পশ্চিমের বিশাল পাহাড়টার ওপারে অস্ত গেল সূর্য। অদ্ভুত লাগল আমার কাছে সূর্যাস্তটা। অস্ত যাবার আগে পাহাড়টার চূড়ায় যেন কয়েক মুহূর্ত চুপচাপ বসে থাকল সূর্যটা, তারপরই দ্রুত নেমে গেল ওপাশে। পশ্চিমাকাশের মেঘগুলোর ওপর কিছুক্ষণ ধরে রঙ ছিটাল পাহাড়ের ওপাশে হারিয়ে যাওয়া সূর্যটা। তয় হয়ে ওই বিচিত্র রঙে রাঙান মেঘমালার দিকে তাকিয়ে ছিলাম, টেরই পাইনি কখন এসে ঘিরে ধরেছে নিকষ কালো অন্ধকার। আর টর পাব কি, সন্ধ্যা তো আর নিয়ম মাফিক পায়ে পায়ে এগিয়ে আসেনি, হঠৎ করেই যেন ঝাঁপিয়ে পড়েছে আমাদের ওপর।

আঁধার হয়ে যেতেই গুহার ভেতর থেকে আমাকে ডাকলেন প্রফেসর। ফিরে দেখলাম, কাঠের পর কাঠ সাজিয়ে বিশাল এক অগ্নিকুণ্ড তৈরি করে ফেলেছেন তিনি। সেই অগ্নিকুণ্ডে ভালমত আগুন জ্বলে উঠতেই গুহার ভেতরটা ত্রার বাইরের বেশ কিছুটা জায়গা আলোকিত হয়ে গেল। এগিয়ে গিয়ে গুহার ভেতরে ঢুকতেই চোখে পড়ল গুহার মেঝেতে কাঠি দিয়ে এঁকে বিরাট একটা বৃত্ত তৈরি করেছেন প্রফেসর। হিজিবিজি করে আরও কি সব যেন আঁকা বৃত্তটার ভেতর। আমাকে বৃত্তটার ভেতর গিয়ে বসতে আদেশ দিলেন প্রফেসর। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, এটা কি প্রফেসর?

আগে থেকেই হুঁশিয়ার থাকলাম। কাউন্ট ড্রাকুলার এলাকা এটা। সে ছাড়াও আরও কত পিশাচ প্রেতাত্মা আছে এ এলাকায় কে জানে। ওই বৃত্তের ভেতর থাকলে আমাদের কিছুই করতে পারবে না পিশাচেরা। যদিও চেষ্টা করবে অনেকভাবে। আর একটা কথা, ওরা তোমাকে নানা ভাবে প্রলুব্ধ করে বাইরে বের করার চেষ্টা করবে, তোমারও ইচ্ছে করবে বেরোতে, কিন্তু খবরদার। এক চুল বাইরে যাবে না বৃত্তের।

বৃত্তের ভেতর বসেই খেয়ে নিলাম আমি আর প্রফেসর। হিম পড়তে শুরু করেছে। গায়ে কয়েকটা মোটা কম্বল জড়িয়ে নিয়ে গনগনে আগুনের পাশে বসে থাকা সত্ত্বেও কাঁপুনি গেল না শরীরের। আর অন্ধকার! এমন নিকষ কালো অন্ধকার জীবনে দেখিনি আমি। বনের ভেতর থেকে ভেসে আসছে অরণ্যচারী প্রাণীদের বিচিত্র ডাক। মাঝে মাঝেই কানে এসে বাজছে নেকড়ের কাজে কাঁপন বীভৎস গর্জন। সব কিছুকে ছাড়িয়ে গেছে কোটি কোটি ঝিঝির সম্মিলিত কর্কশ চিৎকার।

সারাদিনের ক্লান্তিতে ঘুমে চোখের পাতা বুজে আসছে আমার, কিন্তু কি জানি ঘুমিয়ে পড়লেই কি ঘটে এই ভয়ে জোর করে মেলে রাখছিলাম চোখের পাতা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর পারলাম না। একটা পাথরে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম।

ঠিক কতক্ষণ পর জানি না, হঠাৎ ঘোড়াগুলোর ভয়ার্ত চিৎকারে ঘুম ভেঙে গেল। চেয়ে দেখলাম বসে থেকেই থর থর করে কাঁপছে ঘোড়াগুলো। কোন কারণে প্রচণ্ড ভয় পেয়েছে ওরা।

ওদিকে শো-ওঁ-ওঁ শব্দে বয়ে চলেছে তুষার মেশান প্রচণ্ড ঝড়ো হাওয়া। হঠাৎ করেই থেমে গেল বাতাসের গর্জন। সাথে সাথেই লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে দড়ি ছেঁড়ার জন্যে আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগল ঘোড়াগুলো। পালাতে চাইছে। কেন? কি দেখতে পেয়েছে ওরা?

কয়েক সেকেণ্ড পরই বুঝতে পারলাম ব্যাপারটা, ঘোড়াগুলোর পেছনে বন থেকে যেন তালে তালে মার্চ করতে করতে এগিয়ে আসছে হাজার হাজার ধূসর লোমশ প্রাণী। ওদের হাঁ করা মুখের ফাঁকে দেখা যাচ্ছে ঝকঝকে সাদা ধারাল দাতের সারি। অগ্নিকুণ্ডের আলোয় ঝিকিয়ে উঠল দাঁতগুলো। প্রত্যেকটা মুখের ভেতর থেকে বেরিয়ে এসেছে একটা করে টকটকে লাল জিভ। ঘোড়াগুলোর কয়েক হাতের মধ্যে এসেই দাঁড়িয়ে পড়ল জানোয়ারগুলো, তারপর একসাথে হিংস্র গর্জন করে উঠে ঝাঁপিয়ে পড়ল ঘোড়াগুলোর ওপর। দেখতে দেখতে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ঘোড়াগুলোকে খেয়ে ফেলল ওরা।

ঘোড়াগুলোকে খাওয়ার পর আমাদের ওপর চোখ পড়ল নেকড়েগুলোর। ধীরেসুস্থে খুশি মনে আমাদের দিকে এগিয়ে আসতে থাকল ওরা। গুহা মুখটা থেকে হাতখানেক তফাতে থাকতেই আবার একসাথে বীভৎস গর্জন করে উঠল জানোয়ারগুলো। অর্থাৎ আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে যাচ্ছে ওরা, এটা তারই ইঙ্গিত।

আতঙ্কে চেঁচিয়ে উঠে দুহাতে জড়িয়ে ধরলাম প্রফেসরকে। সান্ত্বনা দিয়ে বললেন প্রফেসর, ভয় নেই মা, আমাদের বৃত্তের ভেতর ঢুকতে পারবে না হতচ্ছাড়া নেকড়েগুলো। ওরা সাধারণ জানোয়ার হতে পারতো, কিন্তু কাউন্ট ড্রাকুলার প্রভাব আছে ওদের ওপর। ওই পিশাচ কাউন্ট যে জিনিসকে ভয় পায়, ওই নেকড়েগুলোও ভয় পায় তাকে। প্রফেসরের কথাই ঠিক। বৃত্তটার ইঞ্চি দুয়েকের মধ্যে পা দিয়েই হিটকে পেছনে সরে গেল কয়েকটা নেকড়ে, যেন কষে চাবুক মেরেছে কেউ ওদের গায়ে! আর সামনে এগোতে সাহস করল না নেকড়ে, গুলো। বৃত্তটার কয়েক হাত দূরে বসে বসেই ক্রুদ্ধ গর্জন করে করে শাসতে লাগল আমাদের, যেন বলছে, সাহস থাকলে বাইরে আয়, তারপর দেখাচ্ছি মজা। কিন্তু ওদের মজা দেখার সাহস আমাদের নেই। তাই বৃত্তের ভেতর বসেই ভয়ে ঠক ঠক করে কাপতে থাকলাম।

কতক্ষণ পর জানি না, হঠাৎ করেই যেন কার আগমনে ভয় পেয়ে গিয়ে পেহনের জঙ্গলে ছুটে পালাল নেকড়েগুলো! কাঠগুলো পুড়ে যাওয়ায় নিবু নিবু হয়ে। এসেহে অগ্নিকুণ্ডের আগুন। কিছু নতুন ডালপালা ফেলে দিলেন তাতে প্রফেসর। আবার দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল আগুন। ঠিক এই সময় আগুনের আলোয় চোখে পড়ল জিনিসগুলো। তিনিটে ধুলোর ঘূর্ণি। আশ্চর্য রকমের উজ্জ্বল এক ধরনের দ্যুতি বিচ্ছুরিত হচ্ছে ধূলিকণাগুলো থেকে। আস্তে আস্তে সেই ঘূর্ণায়মান উজ্জ্বল ধূলিকণার ভেতর থেকে রূপ নিতে থাকল তিনটে মূর্তি। অল্পসময়েই ঝলমলে সাদা পোশাক পরা তিনজন অপূর্ব সুন্দরী তরুণীকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম গুহামুখটার সামনে। আশ্চর্য উজ্জ্বল দীর্ঘ টানাটানা চোখ, ঝকঝকে সাদা তীক্ষ্ণ দাত আর টুকটুকে লাল ঠোঁট ওদের। দুজনের রঙ একটু চাপা। পরিষ্কার বুঝলাম ওরা কারা। কাউন্ট ড্রাকুলার প্রাসাদ দুর্গে চাঁদনী রাতে এই তিন ডাইনীকেই দেখেছি জোনাথন।

আমাদের দিকে চেয়ে খিলখিল করে হেসে উঠল ওরা। আশেপাশের পাহাড়ের গায়ে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয়ে বেড়াতে লাগল। সেই হাসির শব্দ। মদির কণ্ঠে আমাকে ডাকল সবচেয়ে সুন্দরী ডাইনীটা, ওখানে ওই গুহার ভেতরে বসে কেন, বোন? চলো আমাদের সঙ্গে। আমরা সবাই মিলে হাসব, খেলব, গাইব। কি মজা হবে, না? এসো, চলে এসো।

মাথার ভেতরটা কেমন জানি করে উঠল আমার। মনে হল, তাইতো, এই হতচ্ছাড়া গুহায় বসে আছি কেন আমি? ওদের সাথে চলে গেলেই তো পারি। বেরিয়ে যাবার জন্যে আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াতে যেতেই কাঁধ চেপে ধরে জোর করে আমাকে বসিয়ে দিলেন প্রফেসর। পকেট থেকে একটা ক্রুশ বের করে আমার মাথায় হেয়ালেন। সঙ্গে সঙ্গে ওই তিন ডাইনীর সাথে হেসে খেলে বেড়ানোর চিন্তা

দূর হয়ে গেল আমার মাথা থেকে। বুঝতে পারলাম, চরম ভুল করতে যাচ্ছিলাম।

ক্রুশটা দেখেই একটু চমকে গেল ডাইনীরা। পকেট থেকে এক টুকরো ধুনো বের করলেন এবার প্রফেসর। তারপর ভেঙে তিন টুকরো করে ছুঁড়ে দিলেন তিন ডাইনীর দিকে। বুক ভাঙা আর্তনাদ করে চোখের পলকে কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেল ডাইনীরা।

যেমনি হঠাৎ করে থেমে গিয়েছিল, ডাইনীগুলো চলে যেতেই তেমনি হঠাৎ করেই আবার শুরু হল তুষার ঝড়। বুঝলাম, ঝড়কে থামিয়ে দিয়েছিল ওই তিন ডাইনী।

একসময় শেষ হল ওই ভয়ঙ্কর রাত। ঝড়ের বেগও কমতে কমতে থেমে গেল একসময়ে। সকাল যে এত আকাক্ষিত হতে পারে জীবনে প্রথমে টের পেলাম আজ।

.

প্রফেসর ভ্যান হেলসিং-এর মেমর‍্যাণ্ডাম

২ নভেম্বর।

নাস্তা খাওয়ার পরপরই গভীর ঘুমে ঢলে পড়েছে মিনা। ভীষণ ঘুম পাচ্ছে আমারও। কিন্তু ঘুমালে চলবে না, বহু কাজ পড়ে আছে। প্রথমেই খুঁজে বের করতে হবে ওই ডাইনী তিনটের কবর।

বৃত্তটার ভেতরই ঘুমিয়ে আছে মিনা। এই দিনের বেলা কোন ভয় নেই, কিন্তু ডাইনীদের অশুভ প্রভাব পড়তে পারে ওর ওপর, ভেবে, ওর মাথার কাছে রেখে দিলাম একটা কুশ। তারপর শরীরের ওপর কিছু ধুনোর গুঁড়ো ছিটিয়ে দিয়ে গুহা থেকে বাইরে বেরিয়ে এলাম।

কিন্তু কোন পথে যাবে? ভেবেচিন্তে পশ্চিমের পথটা ধরেই রওনা দিলাম। বেশ কিছুদূর এগিয়ে যাবার পর চোখে পড়ল পরিত্যক্ত কবরখানাটা। কবরখানাটার একপাশে একটা বড়সড় ঘর। কালের কশাঘাতে জীর্ণ হয়ে গেছে দেয়ালগুলো। প্লাস্টার খসে গিয়ে মুখ ব্যাদান করে আছে লাল ইট।

ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে ওই ঘরটাতেই ঢুকে পড়লাম। বেশ কয়েকটা পুরানো কফিন পড়ে আছে ঘরটার ভেতর। বুঝলাম আসলে এটা একটা সমাধিকক্ষ। কতদিনের পুরানো কফিন ওগুলো কে জানে? আন্দাজ করলাম, কয়েকশো বছর আগের তো হবেই। মলিন হয়ে যাওয়া কফিনগুলোর গায়ের বিচিত্র কারুকাজ দেখেই বোঝা যায় প্রাচীন আমলের কোন সম্রান্ত রাজা বা জমিদারের সমাধিকক্ষ এটা।

প্রত্যেকটা কফিন এখন খুলে দেখতে হবে আমাকে। সহজ নয় কাজটা, তবু কতেই হবে। এক এক করে খুলতে শুরু করলাম কফিনের ডালা। সব কটা কফিন খুলে দুটো ডাইনীকে পেলাম, সেই অপেক্ষাকৃত চাপা রঙের দুটো। কিন্তু সবচেয়ে সুন্দরীটা কোথায়? যেখানেই হোক, খুঁজে বের করতেই হবে ওকে। তার আগে যে দুটোকে পাওয়া গেছে ওদেরকেই শেষ করে নেয়া যাক। সেই আগের কায়দায় মাথা কেটে রসুনের কোয়া পুরে দিলাম ওদের মুখে। তারপর হৃৎপিণ্ডে বসিয়ে দিলাম কাঠের গজাল। সঙ্গে সঙ্গে কফিনের ধুলোর সাথে মিশে গেল ওরা। কোন চিহ্নই থাকল না আর ওদের। শত শত বৎসর আগে কেউ মারা গেলে তার চিহ্ন আজ পর্যন্ত থাকবেই বা কি?

ডাইনী দুটোকে শেষ করে আবার খুঁজতে শুরু করলাম। খুঁজতে খুঁজতে এ সমাধিকক্ষটার ঠিক পেছনে ছোট্ট আর একটা সমাধিক খুঁজে পেলাম। মাত্র দুটো কফিন আছে সেখানে। দুটোর গায়েই সোনার কারুকাজ করা। সোনার পাতে লাশের নাম লিখে আটকে দেয়া হয়েছে দুটো কফিনের মাথার দিকটায়। এত পুরু হয়ে ধুলো পড়ে আছে এগুলোর ওপর যে ভালমত পড়াই যায় না। পকেট থেকে রুমাল বের করে প্রথম কফিনটার গায়ে আটকান নাম লেখা পাতটার ওপরটা ভালমত মুছে নিয়ে নামটা পড়েই চমকে উঠলাম। পরিষ্কার জার্মান অক্ষরে বড় বড় করে লেখা নামটাকে বাংলা অক্ষরে লিখতে হয়, কাউন্ট ড্রাকুলা।

কফিনটার ডালার স্কুগুলো খুলে ধীরে ধীরে তুলে ধরলাম ডালাটা। শূন্য। কেউ নেই ওর ভেতর। অর্থাৎ কাউন্ট থাকে না এখানে। আর থাকে না যে তার প্রমাণ তো আমি নিজেই। নতুন নতুন কফিন বদলিয়ে এখান থেকে ওখানে ঘুরে বেড়ায় কাউন্ট। তেমনি একটা কফিনের পিছু নিয়েই তো সুদূর ইংল্যাণ্ড থেকে এই দুর্গম পার্বত্য এলাকায় এসে পৌঁছেছি আমরা। ডালাটা নামিয়ে রাখার আগে ধুনো আর রসুন ছড়িয়ে দিলাম কফিনটার ভেতরে। ভবিষ্যতে দরকার পড়লেও আর এটার ভেতর এসে আত্মগোপন করতে পারবে না কাউন্ট ড্রাকুলা।

দ্বিতীয় কফিনটার কাছে এগিয়ে গিয়ে এটার নেমপ্লেটটাও মুছে ফেললাম রুমাল দিয়ে। এটাতে লেখা নামটা হল, কাউন্টেস ফ্যানজিসকা। অর্থাৎ এই ফ্যানজিসকা নামের ভদ্রমহিলা ছিলেন কাউন্ট ড্রাকুলার সহধর্মিণী। স্কুগুলো খুলে এ কফিনটার ডালাটা তুলে ধরতেই চমকে উঠলাম। যদিও আগেই আন্দাজ করেছিলাম, তবু স্তব্ধ হয়ে সেদিকে চেয়ে থাকলাম কয়েক মুহূর্ত। কফিনের ভেতর শুয়ে আছে গতরাতের সেই রূপসী ডাইনী। গতরাতের চেয়েও অনেক, অনেক বেশি সুন্দরী মনে হচ্ছে এখন ওকে। বুঝলাম, জীবিত থাকাকালীন এই কাউন্টেসের পরিচারিকা ছিল চাপা রাঙা ডাইনী দুটো।

আর বেশিক্ষণ ভাবনা চিন্তা না করে শেষ করে দিলাম এটাকেও। কফিনের ডালা আটকে যখন বাইরে বেরিয়ে এলাম, রীতিমত কাঁপছে তখন আমার সর্বশরীর। তিন তিনটা ডাইনীকে একা শেষ করা সোজা কথা নয়।

বোগো গিরিপথের প্রবেশ মুখের ওহাটার কাছে ফিরে আসতে আসতে দুপুর গড়িয়ে গেল। এসে দেখলাম তখনও গভীর ঘুমে অচেতন হয়ে আছে মিনা।

.

মিনা আরকারের ডায়েরী থেকে

২ নভেম্বর, রাত।

ঘুম ভাঙল প্রফেসরের ডাকে। উঠে গুহা থেকে বেরিয়ে দেখলাম পশ্চিমাকাশের দিকে রওনা দিয়েছে সূর্য। প্রফেসর বললেন, এই যে মা, খাওয়া দাওয়া আজ কিছু হবে না?

একটু অপেক্ষা করুন, প্রফেসর, এখুনি আনছি, টিন খুলে শুকনো খাবার বের করতে বসলাম।

খাবারগুলো সবে সাজান শেষ করেছি, এমন সময় মাথার ওপরের পাহাড় চূড়া থেকে ভেসে এল প্রফেসরের উচ্চকিত চিৎকার, মিনা, জলদি এসো।

খাবার ফেলে ছুটলাম। চূড়ায় উঠতে উঠতে উদ্বিগ্ন গলায় জিজ্ঞেস করলাম, কি হল প্রফেসর?

চোখ থেকে বিনকিউলার নামাতে নামাতে উত্তেজিত কণ্ঠে বললেন প্রফেসর, একটা ঘোড়াগাড়ি। এদিকেই আসছে।

কই, কোথায়? প্রফেসরের পাশে এসে জিজ্ঞেস করলাম।

বিনকিউলার আমার হাতে দিতে দিতে বললেন প্রফেসর, উত্তরের পথ ধরে আসছে গাড়িটা।

বিনকিউলারটা চোখে লাগিয়ে প্রফেসরের নির্দেশিত দিকে তাকালাম। সত্যিই, উত্তরের পাহাড়ী পথ ধরে একটা দুঘোড়া টানা হুড খোলা বেশ বড় আকারের গাড়ি অত্যন্ত দ্রুতগতিতে ছুটে আসছে এদিকেই। গাড়িটায় রাখা বাক্সটাও দেখতে পাচ্ছি পরিষ্কার। কয়েকজন জিপসী বসে আছে বাক্সটার ওপর। গাড়িটার দিকে তাকিয়ে আছি, হঠাৎ বহু দূরের পাহাড়টার আড়াল থেকে বেরিয়ে এল আর একটা গাড়ি। ওটার দ্রুত আকৃতি বড় হওয়া দেখেই বোঝা যাচ্ছে ঝড়ের গতিতে এগিয়ে আসছে গাড়িটা। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে সামনেরটাকে ধরার জন্যে পাগল হয়ে উঠেছে পেছনের গাড়িটা। ওটা আরও এগিয়ে আসতেই লাগাম ধরে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটাকে চিনতে পারলাম আমি। জোনাথন। আনন্দে দুলে উঠল বুকটা। চোখ থেকে বিনকিউলারটা নামিয়ে প্রফেসরের হাতে দিতে দিতে বললাম, দেখুন, দেখুন, প্রফেসর, জোনাথনরাও পৌঁছে গেছে।

তাই নাকি? কই দেখি? আমার হাত থেকে বিনকিউলারটা প্রায় ছিনিয়ে নিয়ে চোখে লাগালেন প্রফেসর। কয়েক সেকেও দেখে নিয়েই যন্ত্রটা চোখ থেকে নামিয়ে কান পেতে কি যেন শোনার চেষ্টা করলেন। তারপর বললেন, পুব দিক থেকেও দ্রুত ছুটে আসা ঘোড়ার পুরের শব্দ শোনা যাচ্ছে।

প্রফেসরের কথা শুনে আমিও পুব দিকে কান পেতে শোনার চেষ্টা করলাম। আমারও যেন মনে হল শুনতে পাচ্ছি শব্দটা।

চলো, মিনা। আক্রমণের প্রস্তুতি নিইগে, বলে আমার হাত ধরে দ্রুত পাহাড় বেয়ে নামতে শুরু করলেন প্রফেসর।

নিচে নেমে এসে কি মনে হতেই পশ্চিম আকাশটা একবার দেখে নিয়ে ঘড়ির দিকে তাকালেন প্রফেসর। তারপর প্রায় আঁতকে উঠে বললেন, সর্বনাশ! বেলা তো প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। হাতে সময়ও অল্প। এই সময়ের ভেতরই ওই জিপসীগুলোর হাত থেকে বাক্সটা ছিনিয়ে নিয়ে ড্রাকুলাকে শেষ করতে না পারলে আবার হাতছাড়া হয়ে যাবে পিশাচটা। সূর্য ডুবে গেলেই কফিন থেকে বেরিয়ে পালাবে কাউন্ট। তখন এই এলাকায় উল্টো তার হাতেই মারা যাব আমরা। তুমি। এখানে দাঁড়াও মিনা, আমি আসছি। এক ছুটে গিয়ে গুহার ভেতর থেকে তার ব্যাগ ও পিস্তলটা নিয়ে এলেন প্রফেসর। ও দুটো আমার হাতে দিয়ে আমাদের ঘোড়াশূন্য গাড়িটা নিজেই টানতে টানতে নিয়ে চললেন গিরিপথের উত্তর প্রবেশ মুখের কাছে। সেখানে পৌঁছে গাড়িটা আড়াআড়ি ভাবে রেখে প্রবেশ পথটা বন্ধ করে দিলেন। তারপর ছুটে এসে আমার হাত থেকে ব্যাগ আর পিস্তলটা নিয়ে আমাকে সহ ছুটলেন গিরিমুখের কাছে। ফেলে রাখা গাড়িটার কাছাকাছিই একটা বিশাল পাথরের আড়ালে লুকিয়ে রইলাম আমরা।

এক এক করে কেটে যাচ্ছে প্রতীক্ষার উৎকণ্ঠিত মুহূর্তগুলো। প্রতি সেকেণ্ডে দুবার করে সূর্যের দিকে তাকাচ্ছেন প্রফেসর। কারণ ওটা অস্ত গেলেই আমাদের আশা ভরসা সব শেষ। এই নির্জন ভয়ঙ্কর পাহাড়ী এলাকা থেকে তখন প্রাণ নিয়ে বেরিয়ে যেতে পারব কিনা সন্দেহ। ফিসফিস করে প্রফেসরকে জিজ্ঞেস করলাম, এত ভয়ের কি আছে, প্রফেসর, আপনার বানান ওই বৃত্তের ভেতর বসে থাকলেই তো আর আমাদের কোন ক্ষতি করতে পারবে না ড্রাকুলা।

পারবে। এবং অতি সহজে। নেকড়েগুলোর কথা ভুলে গেলে?

কিন্তু ওরাও তো বৃত্তের ভেতর ঢুকতে পারে না?

আজ পারবে। ওগুলোর ওপর থেকে শুধু নিজের প্রভাব তুলে নেবে কাউন্ট ড্রাকুলা। সঙ্গে সঙ্গে সাধারণ নেকড়েতে পরিণত হবে ওগুলো। তখন ওই যাদুর বৃত্ত থাকা না থাকা নেকড়েগুলোর কাছে সমান। গোটা চারেক রাইফেল পিস্তল দিয়ে কি করে ঠেকাব ওই হাজার হাজার রক্তলোভী হিংস্র নেকড়েকে?

এতক্ষণে টের পেলাম কোন্ পথে আসবে বিপদ। মনে পড়ল নেকড়েগুলোর ঝকঝকে তীক্ষ্ণ দাত আর টকটকে লাল জিভের কথা। কি করে ঘোড়াগুলোকে নিমেষে টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলেছিল ওরা কল্পনা করে নিজের অজান্তেই শিউরে উঠলাম একবার। ওদিকে দ্রুত এগিয়ে আসছে ঘোড়ার পদশব্দ।

খবরদার! এক পা এগোবে না আর, হঠাৎ আমাদের দুপাশের পাহাড় চূড়া থেকে রুক্ষ কঠিন গলায় আদেশ দিল কেউ কাউকে। চমকে উঠে তাকালাম দুদিকেই। দেখলাম, রাইফেল উঁচিয়ে ধরে ডান দিকের পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে আছেন মিস্টার মরিস, বায়ে জোনাথন। আবার গর্জে উঠলেন মিস্টার মরিস, শেষবারের মত বলছি, এখুনি গাড়ি না থামালে গুলি করতে বাধ্য হব।

লাফ দিয়ে পাথরের আড়াল থেকে বেরিয়ে এলেন প্রফেসর, তার সাথে সাথে আমিও। দেখলাম দ্রুত ধাবমান ঘোড়াগুলোকে থামাবার জন্যে প্রাণপণ চেষ্টা করছে জিপসী সর্দার। মিস্টার মরিসের কথা সর্দার বুঝতে পেরেছে কিনা কে জানে। কিন্তু তার কণ্ঠস্বরের দৃঢ়তায় আর হাতের রাইফেল দেখে যে কেউই আন্দাজ করতে পারবে মিস্টার মরিসের উদ্দেশ্যটা কি। আমার মনে হল আন্দাজেই বুঝে নিয়েহে জিপসী সর্দার। অসাধারণ দক্ষতায় ঘোড়াগুলোকে থামিয়ে গাড়ি ঘুরিয়ে পালাবার চেষ্টা করল সে। সঙ্গে সঙ্গে গর্জে উঠল মিস্টার মরিসের হাতের রাইফেল। প্রাণ হারিয়ে লুটিয়ে পড়ল একটা ঘোড়া। গুলি করল জোনাথনও। দ্বিতীয় ঘোড়াটাও পড়ে গেল। বেগতিক দেখে গাড়ি থেকে নেমে ছুটল জিপসী সর্দার। পিছু পিছু তার সাঙ্গপাঙ্গরাও।

এক মুহূর্ত দেরি না করে ব্যাগ হাতে ছুটলেন প্রফেসর। আমি ছুটলাম তার পিছু পিছু। জিপসীদের গাড়ির কাছে পৌঁছেই এক মুহূর্তও দেরি না করে। পকেট থেকে স্কু-ড্রাইভার বের করে বাক্সের ডালা খোলায় মনোযোগ দিলেন তিনি। ওদিকে পশ্চিম পাহাড়ের আড়ালে চলে গেছে সূর্য। মেঘের গায়ে তার রঙ ছিটানর পালাও প্রায় শেষ। এমনি সময় টান মেরে বাক্সের ডালা তুলে ফেললেন প্রফেসর। একসাথে বাক্সের ভেতরে উঁকি দিলাম আমি, প্রফেসর, জোনাথন আর মিস্টার মরিস।

বোধহয় ঘুম ভাঙার সময় হয়ে এসেছে কাউন্ট ড্রাকুলার। কারণ জ্বলতে শুরু করেছে তার লাল টকটকে চোখ দুটো। যে-কোন মুহূর্তে এখন আড়মোড়া ভেঙে উঠে পড়তে পারে পিশাচটা।

দ্রুত ব্যাগ থেকে রসুনের কোয়া বের করে কাউন্টের মুখে পুরে দিলেন প্রফেসর। পরমুহূর্তেই মাংস কাটা ছুরির এক কোপে কাউন্টের মাথাটা গলা থেকে আলাদা করে দিল জোনাথন। ডান পায়ের হাঁটু পর্যন্ত লম্বা বুটের সাথে চামড়ার স্ট্র্যাপ দিয়ে আটকে বেঁধে রেখেছিল সে ছুরিটা, বোধহয় এমনি কোন প্রয়োজনীয় মুহূর্তের জন্যেই। কাউন্টের কাটা ধড়টা সাংঘাতিকভাবে দুমড়াতে মোচড়াতে শুরু করতেই ব্যাগ থেকে একটা কাঠের গজাল আর হাতুড়ি বের করে মিস্টার মরিসের হাতে তুলে দিলেন প্রফেসর। বললেন, পিশাচটার দেহটা স্থির হলেই এই গজালটা ওর হৃৎপিণ্ডে বসিয়ে দেবে।

হাতুড়ি আর গজাল হাতে অপেক্ষা করতে থাকলেন মিস্টার মরিস। হঠাৎ আমাদের পেছনে ঘোড়ার খুরের শব্দ হতেই চমকে পেছনে ফিরে চাইলাম। দেখলাম, গাড়ি নিয়ে গিরিমুখে প্রবেশ করছেন লর্ড গোডালমিং। প্রায় একই সময়ে পুবের মুখ দিয়ে এসে ঢুকলেন ডাক্তার সেওয়ার্ড। ওদের কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। লর্ড গোডালমিং আর ডাক্তার সেওয়ার্ডের হাতে গাড়ির ভার দিয়েই জিপসীদের আটকাতে রাইফেল হাতে দুদিক থেকে দুই পাহাড় চূড়ায় উঠে যান মিস্টার মরিস আর জোনাথন, পরে ওদের মুখেই কথাটা শুনেছি আমি। এতক্ষণ হয়ত কোন পাহাড়ের আড়ালে অপেক্ষা করছিলেন লর্ড গোডালমিং আর ডাক্তার সেওয়ার্ড, জিপসীরা পরাজিত হয়েছে টের পেয়েই এখন গিরিমুখে এসে ঢুকেছেন ওঁরা।

গিরিমুখে প্রবেশ করেই গাড়ি থেকে লাফিয়ে নেমে আমাদের দিকে ছুটে এলেন লর্ড গোডালমিং আর ডাক্তার সেওয়ার্ড। বাক্সের দিকে চোখ ফেরাতেই দেখলাম নড়াচড়া বন্ধ হয়ে গেছে কাউন্টের ধড়টার। ঠিক সেই মুহূর্তে হাতের গজালটা কাউন্টের হৃৎপিণ্ডে ঢুকিয়ে দিলেন মিস্টার মরিস।

সাথে সাথেই ঘটতে শুরু করল ঘটনা। দ্রুত গলতে শুরু করল কাউন্টের দেহটা, সবটা দেহ গলে যাওয়ার পর বাক্সের গায়ের ধুলোর সাথে মিশে যেতে শুরু করল গলিত পদার্থটুকু। দেখতে দেখতে আমাদের চোখের সামনে ধুলোয় মিলেমিশে অদৃশ্য হয়ে গেল কাউন্টের সমস্ত চিহ্ন। আজ থেকে কয়েকশো বছর আগে যদি মারা যেত কাউন্ট তাহলেও তার কফিন খুলে দেখলে এখন বাক্সের মধ্যে যেমন দেখছি তেমনি ধুলো ময়লা ছাড়া আর কিছুই দেখতাম না আমরা।

ওদিকে অকার হয়ে এসেছে। বনের ভেতর ডাকতে শুরু করেছে নেকড়েগুলো। উদ্বিগ্ন গলায় বললেন প্রফেসর, জলদি, গাড়ি দুটোতে উঠে পড় সবাই। নেকড়ের হাত থেকে বাঁচতে হলে এখুনি পালাতে হবে আমাদের। কাউন্টের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে স্বাভাবিক জানোয়ারে পরিণত হয়েছে ওরা। যাদুর বৃত্ত বা ওই ধরনের আর কিছুই এখন ওদের ঠেকাতে পারবে না।

কিন্তু পালিয়ে যাবে কোথায়? জিজ্ঞেস করলাম আমি।

কাউন্ট ড্রাকুলার প্রাসাদ দুর্গে।

প্রাসাদ দুর্গে, অবাক হয়ে গেলাম আমি। ওই অভিশপ্ত দুর্গে এই রাতের বেলা গিয়ে ঢুকতে চাইছেন আপনি?

হ্যাঁ, প্রাসাদ দুর্গে। ওটাই এখন আমাদের জন্যে সবচেয়ে নিরাপদ স্থান।

নিরাপদ হল কি করে? কাউন্ট ড্রাকুলা না হয় মরেছে, কিন্তু ওই তিন ডাইনী তো রয়ে গেছে।

না, নেই। আজ দুপুরে শেষ করে এসেছি আমি ওদের। তুমি তখন ঘুমিয়ে ছিলে।

প্রফেসরের প্রতি শ্রদ্ধায় আর একবার নুয়ে এল আমার মাথাটা।

কাউন্ট মারা যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে খুলে গিয়েছিল দুর্গের সমস্ত মায়াবী তালা, কাজেই সদর দরজা খুলে ভেতরে ঢুকতে বিন্দুমাত্র বেগ পেতে হয়নি আমাদের। ঘোড়াসুদ্ধ গাড়িগুলোকেও ভেতরে নিয়ে আসার পর ভেতর থেকে দরজায় খিল তুলে দিয়েছিলেন প্রফেসর।

সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে এসে যে কামরাটায় জোনাথনের ঘুমানোর বন্দোবস্ত করেছিল কাউন্ট ড্রাকুলা তা আমাদের দেখাচ্ছিল জোনাথন, এমন সময় কয়েকজন লোকের ভয়ার্ত চিৎকার শুনে চমকে উঠে ছুটে গেলাম জানালার কাছে। তারার আবছা আলোয় চোখে পড়ল দুর্গের সদর দরজার দিকে প্রাণপণে ছুটে আসছে কয়েকটা লোক। ওদের চুল আর পোশাকের আবছা, অবয়ব দেখে বুঝলাম সেই জিপসী কয়জন। কিন্তু ওরা এভাবে চেঁচাতে চেঁচাতে ছুটছে কেন? মনে হচ্ছে ভয়ঙ্কর কোন কিছু তাড়া করেছে ওদের। কয়েক সেকেও পরই বুঝতে পারলাম ব্যাপারটা। বন থেকে বেরিয়ে হিংস্র গর্জন করতে করতে জিপসীদের পেছন পেছন ছুটে আসছে লোমশ জানোয়ারগুলো। কাউন্টের পৈশাচিক প্রভাব মুক্ত হয়ে তারই পূজারীদের তাড়া করেছে ভয়াবহ নেকড়ের দল।

বন্ধ সদর দরজার কাছে এসে প্রাণপণে তাতে ধাক্কা দিতে শুরু করল জিপসীরা, আর বার বার পেছনে তাকাতে লাগল। ওদের কাছ থেকে আর মাত্র কয়েক গজ দূরে আছে সাক্ষাৎ মৃত্যু।

উদ্বিগ্নভাবে প্রফেসরকে বললাম, দরজার খিলটা খুলে দেয়া উচিত, প্রফেসর।

এখন আর কোন লাভ নেই, শান্ত গলায় বললেন প্রফেসর। দেরি হয়ে গেছে অনেক। নিচে নেমে গিয়ে আমরা খিল খোলার আগেই জিপসীরে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলবে নেকড়ের দল।

নাটকের শেষ অঞ্চ অভিনীত হবার আগেই আস্তে করে জানালার কাছ থেকে সরে এলাম আমি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *