প্রত্যাবর্তন

প্রত্যাবর্তন

কেউ মারা যাওয়ার পর তার ভূত হাজির হওয়ার রেকর্ড আছে আকছার। এসব ক্ষেত্রে বেশিরভাগ সময় ঘনিষ্ঠ আত্মীয়-স্বজন বা বন্ধু-বান্ধবদেরই দেখা দেয় মৃত ব্যক্তির আত্মা। এমন ঘটনাগুলো পাবেন ‘প্রত্যাবর্তন’ শিরোনামে।

১. সাগর থেকে ফিরে

সাগর থেকে ফিরে

টম পটারকে সে অর্থে দুষ্ট ছেলে বলতে পারবেন না আপনি। কিন্তু সে দারুণ অস্থির, যেখানেই থাকবে একটা একটা না গোলমাল, ঠিক পাকাবে। কখনও কোনো পড়শির জানালা ভাঙতে চায় না সে। কিন্তু যখনই একটা বলে লাথি মারে কীভাবে না কীভাবে ওটা কাঁচের জানালার দিকেই ছুটে যায়।

ওহ, টম পটার! তোমাকে নিয়ে আমরা কী করব? লোকেরা বলে। টম কেবল দুষ্টুমি মাখা ঝকঝকে একটা হাসি দেয়। আর এটাই মন জয় করে নেয় সবার, মাফ পেতেও সময় লাগে না তার।

১৮৬০ সালের কথা। টমের বাবা নেই। কাজেই মা-ছেলে দুজনের ভরণপোষণের জন্য চাকরি করতে হয় টমের মাকে। এসময়ই হাওয়ার্ড নামের এক ভদ্রলোকের বাড়িতে চাকরি হলো তাঁর। ইংল্যাণ্ডের গ্রিনউইচে বিশাল এক বাড়িতে পরিবার নিয়ে থাকেন মি. হাওয়ার্ড।

বাড়ির ওপরের তলার একটা কামরায় আপনি থাকতে পারেন, নতুন মালিক বললেন মিসেস পটারকে। আর টম যদি কাছের কোনো স্কুলে ভর্তি হয়, তবে সম্ভবত সে একটু স্থির হবে।

ধন্যবাদ, স্যর, খুশি হয়ে বললেন মিসেস পটার। টম আসলে চমৎকার একটা ছেলে। আমার মনে হয় স্কুলে সে ভাল করবে, আর আপনার অনুগ্রহের মর্যাদা দেবে।

টমের মাথা ভাল। সে দারুণ চটপটে আর বুদ্ধিমানও। স্কুলে তার দিনগুলো ভালই কাটতে লাগল। কখনও কখনও যে সে দুষ্টুমি করে না তা না, তবে ওই আগের মতই মাফও পেয়ে যায়।

টম যে স্কুলটাতে পড়ে সেটা চালায় একটা রোমান ক্যাথলিক এতিমখানা। এই এতিমখানাটার দায়িত্বে আছেন নরম মনের একজন পাদ্রী, ফাদার টড। শুরুতেই টমের সঙ্গে পাদ্রীর দারুণ ভাব হয়ে গেল। কয়েকটা বছর বেশ শান্তিতেই কাটল। টম পড়ালেখাও করছে মনোযোগ দিয়ে। কিন্তু কৈশোরে পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গে আবার দুরন্তপনা পেয়ে বসল তাকে। টমকে বাগ মানানো রীতিমত অসম্ভব হয়ে পড়ল তার মার পক্ষে।

টম পটারকে নিয়ে আমরা কী করব? একদিন ফাদার টডের কাছে জানতে চাইলেন মি. হাওয়ার্ড।

টমের বয়স এখন চোদ্দ, পাদ্রী জবাব দিলেন। তাকে ভাল একটা কাজে লাগিয়ে দেওয়ার এটা চমৎকার সময়। দেখি কী করতে পারি।

অতএব কাজ করতে গেল টম। সুতির কাপড় বানায় ম্যনচেস্টারের এমন একটা বড় খামারে পাঠানো হলো তাকে। এখানে কিছু দিন আরামেই থাকল। তারপরই আবার অস্থিরতা পেয়ে বসল তাকে। মা আর ফাদার টডকে লিখে জানাল তার খুব ইচ্ছা সাগরে যাবে। এতটাই আবেগের সঙ্গে আর গুছিয়ে লিখল কথাগুলো, মনে-মনে আশঙ্কা চেপে বসলেও তাকে যাওয়ার অনুমতি দিলেন তার মা আর ফাদার টড।

১৮৬৪ সালে উলউইচের একটা প্রশিক্ষণ জাহাজে চাকরি পেল টম। এখান থেকে তাকে পাঠানো হলো রাণীর একটা যুদ্ধ জাহাজে। প্রথম কিছু অভিযান দারুণ উপভোগ করল টম। তারপর আবার সক্রিয় হয়ে উঠল তার সেই অস্থির মন। নৌ বাহিনীর কড়া নিয়মের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করল সে। কয়েকজন বন্ধুসহ জাহাজ ছেড়ে পালাল। কঠিন পরিশ্রম আর নিয়মের বেড়াজাল থেকে মুক্ত হয়ে যেন হাতে চাঁদ পেল ছেলেরা। দুষ্টু বুদ্ধি মাথা চাড়া দিয়ে উঠল তাদের। বোকার মত কিছু অঘটন ঘটাল। আর এগুলোই তাদের ঝামেলায় ফেলল।

একদিন টম হাজির হলো গ্রিনউইচে মি. হাওয়ার্ডের বাসায়। ক্ষুধার্ত, ক্লান্ত, পরনে শতচ্ছিন্ন কাপড়। প্রচণ্ড অসুস্থ সে। মার সেবায় যখন সুস্থ হয়ে উঠল তখনই জানা গেল জাহাজ থেকে পালানোর অপরাধে তার নামে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা আছে।

মন ভেঙে গেল হতভাগী মার। টম, তোমাকে নিয়ে আমরা কী করব? হতাশায় কাঁদতে-কাঁদতে বললেন তিনি।

এদিকে এবার মি, হাওয়ার্ডেরও ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেছে। টমকে আর এখানে জায়গা দিতে নারাজ তিনি। মিসেস পটারকে বললেন, আমার মনে হয় ফাদার টডের পরমর্শ নেওয়া উচিত আপনার।

দয়ালু পাদ্রী কথা দিলেন এই বিপদ থেকে টমকে উদ্ধার করার জন্য তাঁর পক্ষে যতটুকু সম্ভব করবেন। জাহাজের ক্যাপ্টেন আর নৌ বাহিনীর কর্মকর্তাদের টমের, পক্ষ নিয়ে বুঝালেন তিনি। টম মন থেকে খারাপ ছেলে নয় মোটেই, বললেন পাদ্রী। আমি তাকে ভালমত চিনি। সে দুষ্ট স্বভাবের আর একটু স্বেচ্ছাচারী। কিন্তু আমার মনে হয় শেষ পর্যন্ত ভালই করবে টম।

পাদ্রীর কথায় মন গলল নৌ কর্তাদের। টমকে আবার জাহাজে ফিরিয়ে নিতে আর তার শাস্তি হালকা করে দিতে রাজি হলেন তারা। এবার টমকে পাঠানো হলো পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জগামী রণতরী ডরিসে।

তার চাকুরিদাতা আর পাদ্রী দুজনের প্রতিই কৃতজ্ঞতায় ভরে উঠল মিসেস পটারের মন। যখন খবর পলেন সব ঠিক আছে আর টম আবার সাগরে বেরিয়ে পড়েছে, সম্পূর্ণ বদলে যাওয়া এক মহিলায় রূপান্তরিত হলেন। এদিকে জন কুপার নামের এক লোক মি. হাওয়ার্ডের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে কাজ করে। একদিন তিনি টমের মাকে বিয়ের প্রস্তাব দিলেন, ভদ্রমহিলাও রজি হয়ে গেলেন। যেদিন চাকরি ছাড়লেন, মি. হাওয়ার্ড করমর্দন করে বললেন, আপনি চাকরিটা ছেড়ে দেওয়ায় এক দিক থেকে ভালই হলো। আপনাকে মিসেস কুপার বলে ডাকার অভ্যাস কখনওই করতে পারতাম না আমি। আশা করি সুখী হবেন। ওই দুরন্ত ছেলেও আর কখনও দুশ্চিন্তার কারণ হবে না আপনার।

টমের মার জায়গায় নতুন একটা মেয়ে কাজ নিল মি. হাওয়ার্ডের বাসায়, নাম মেরি স্নেইক।

কয়েক মাস পরের ঘটনা। তারিখটা ১৮৬৬ সালের ৮ সেপ্টেম্বর। কেউ একজন মি. হাওয়ার্ডের বাড়ির সদর দরজার বেল বাজাল। মেরি স্লেইক গেল দরজা খুলতে। মিসেস হাওয়ার্ড ছিলেন উপরে তার বেডরুমে। দরজা খোলার শব্দ পেলেন, তারপরই কণ্ঠ শুনতে পেলেন। কথাবার্তা চলল অল্প কিছুক্ষণ, কিন্তু আগন্তুকের কণ্ঠটা কানে আসতেই কেমন যেন পরিচিত ঠেকল মিসেস হওয়ার্ডের।

আমি এটা চিনি, নিজেকে বললেন তিনি, হঁা, সন্দেহ নেই এটা টম পটারের কণ্ঠ।

দরজা বন্ধ হয়ে যেতে নীচে হলে দাঁড়ানো মেয়েটাকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, কে এসেছিল, মেরি?

ওপরে তার বেডরুমে উঠে এল মেরি। জাহাজে কাজ করা একটা ছেলে, ম্যাম। তার মাকে খুঁজছিল। আমি বলেছি তাঁকে আমি চিনি না, তারপর ছেলেটাকে চলে যেতে বলি।

সে দেখতে কেমন ছিল? চিন্তিত স্বরে জিজ্ঞেস করলেন মিসেস হাওয়ার্ড।

পোশাক-আশাকে খুব ফিটফাট। তবে খালি পায়ে ছিল। আমি তাকে দেখলে আবার চিনতে পারব। তার মুখটা ফ্যাকাসে দেখাচ্ছিল, চোখে-মুখে হতাশার একটা ছাপ ফুটে উঠেছিল।

সে কি কিছু বলেছে?

তেমন কিছু না, ম্যাম। যখন আমি তাকে বললাম তার মা এখানে নেই তখন কেবল মাথায় হাত রেখে বলল, এখন আমি কী করব?

ধন্যবাদ, মেরি। আবার ও আসলে আমাকে ডাক দিতে ভুল করবে না।

মি. হাওয়ার্ড বাড়ি ফিরলে দেরি না করে তাঁকে ঘটনাটা খুলে বললেন তাঁর স্ত্রী। তারপর যোগ করলেন, আমার মনে হয় আবার জাহাজ থেকে পালিয়েছে সে।

মাথা ঝাঁকিয়ে মি.হাওয়ার্ড বললেন, টম পটারকে নিয়ে আমরা কী করব! কখনওই ঝামেলা ছাড়া থাকতে পারল না ছেলেটা।

ছেলেটা এভাবে বাড়ির দুয়ার থেকে ফিরে যাওয়াতে অপরাধবোধে ভুগছিলেন হাওয়ার্ডরা। তারা তাই টমের মার সঙ্গে যোগাযোগ করলেন ভদ্রমহিলার সঙ্গে টমের দেখা হয়েছে কিনা জানতে। যখন তিনি জানালেন টমের সঙ্গে অনেকদিন কোনো যোগাযোগ নেই, আরও হতাশ হয়ে পড়লেন তারা। সম্ভবত ছেলেটার কোনো ধারণাই নেই তার মা কোথায় আছে। আর এখন নিশ্চয় লণ্ডনের পথে-পথে ঘুরছে।

মি. হাওয়ার্ড ফাদার টডের সঙ্গে দেখা করলেন। ঘটনাটা শুনে অবাক হলেন তিনিও। টম আবার জাহাজ ছেড়ে পালিয়েছে এটা বিশ্বাস হয় না আমার, ঘোষণা দিলেন তিনি। মাত্র মাস দুয়েক আগে ওর একটা চিঠি পেয়েছি। তখনও সেখানে চমৎকার ছিল সে। আমার মনে হয় আপনাদের বাড়িতে কাজ করা সেই মেয়েটা, মেরির সঙ্গে একটু কথা বলা দরকার আমার। তাহলে নিশ্চিত হওয়া যেত আসলেই ছেলেটা টম পটারই ছিল কিনা।

আমি এখনই ওকে নিয়ে আসছি। বলে বেরিয়ে গেলেন মি. হাওয়ার্ড।

মেরি এসে পৌঁছতেই পাদ্রী তাকে ডজন খানেক ছেলের ছবি দেখালেন, যাদের মধ্যে টমও ছিল। তারপর বললেন, আমি দেখতে চাই সেদিন যে ছেলেটা এসেছিল তাকে তুমি এদের মধ্যে থেকে খুঁজে বের করতে পার কিনা।

একটু সময় তাকিয়েই একটা ছবি তুলে নিয়ে মেয়েটা বলল, এটাই সেই ছেলেটা। দিব্যি দিয়ে বলতে পারি আমি।

আর ছবিটা টম পটারেরই। অর্থাৎ এখন আর কোনো সন্দেহ রইল না সেদিনের সেই রহস্যময় আগন্তুক আর কেউ না টম পটার। তাহলে কোথায় গেল সে? কেন আর ফিরে এল না? আর যদি কেউ তাকে তার মায়ের ঠিকানা দিয়ে থাকে, তবে সে কেন সেখানে গেল না? এর কোনো ব্যাখ্যা নেই। আর এখন অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোনো উপায়ও নেই।

বেশ কয়েক সপ্তাহ পেরিয়ে গেল। তারপর অক্টোবরের এক দিনে নৌ সদরদপ্তর থেকে একটা চিঠি এল ফাদার টডের কাছে। খাম ছেড়ার সময় পাদ্রী মনে-মনে বললেন, সন্দেহ নেই টম পটারের খবর আছে। ছেলেটা এখন কোথায় আছে?

চিঠিটা পড়তে-পড়তে হাঁফাতে লাগলেন পাদ্রী, চেহারাটা ফ্যাকাসে হয়ে উঠেছে তাঁর। তড়িঘড়ি করে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেলেন।

ভাগ্য ভাল তিনি যখন পৌঁছলেন তখনও বেরিয়ে পড়েননি মি. হাওয়ার্ড। মিসেস হাওয়ার্ড আর মেরিকে ডেকে আনা হলো। তারপর চারজন জড় হলেন বাড়ির স্টাডিতে।

আপনারা কি প্রেতাত্মায় বিশ্বাস করেন? হঠাৎই জানতে চাইলেন পাদ্রী।

চমকে উঠলেন তাঁরা। তারপরই মি. হাওয়ার্ড বলে উঠলেন, না, প্রশ্নই ওঠে না। আপনি কেন এটা জিজ্ঞেস করছেন?

তাঁর কথায় কান না দিয়ে পাদ্রী জিজ্ঞেস করলেন, মিসেস হাওয়ার্ড, আপনি?

স্বামীর দিকে একবার দৃষ্টি দিয়ে জবাব দিলেন ভদ্রমহিলা, আমি কখনও এমন কিছু দেখিনি। তবে তবে ওরা থাকতেই পারে।

সবশেষে মেরির দিকে তাকালেন পাদ্রী, আর তুমি, মেরি? হ্যাঁ। সোজাসাপ্টা জবাব দিল মেয়েটা।

তাহলে তুমি নিশ্চয়ই অবাক হবে না, যদি আমি বলি একটা প্রেতাত্মার সঙ্গে তোমার দেখা হয়েছে।

স্তম্ভিত হয়ে বসে রইল মেয়েটা। মি. হাওয়ার্ড এবার পাদ্রীর দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলেন, আপনি কী বলতে চাচ্ছেন?

টম পটার কবে এসেছিল এখানে? জিজ্ঞেস করলেন পাদ্রী।

ওটা ছিল সেপ্টেম্বরের আট তারিখ। জবাব দিলেন মিসেস হওয়ার্ড।

এর দু-দিন আগেই জ্যামাইকায় মারা গেছে টম।

মি. হাওয়ার্ড চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। তাঁর স্ত্রী মাথায় হাত দিয়ে বসে রইলেন, আর মেরি কাঁদতে শুরু করল।

পাদ্রী নৌ দপ্তরের চিঠিটা নাড়িয়ে বললেন, চিঠিতে বলা হয়েছে, রণতরী ডরিসে বড় রকমের একটা দুর্ঘটনায় পড়ে টম। সেটা ছিল ১৮৬৬ সালের ২৪ জুলাই। এতে ভয়ঙ্করভাবে আহত হয় ছেলেটা। কয়েকটা সপ্তাহ যমে-মানুষে টানাটানি হয় তাকে নিয়ে। শেষ পর্যন্ত সেপ্টেম্বরের ৬ তারিখ মারা যায়। মারা যাওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তেও মাকে দেখতে চাচ্ছিল সে। তারপর সবাইকে এটা হজম করার একটু সময় দিয়ে ফাদার টম আবার বলতে শুরু করলেন, এই বাড়িতেই টম তার মাকে শেষ দেখেছে। আর এই কারণেই টমের প্রেতাত্মা এখানে আসার আকর্ষণ অনুভব করেছে। একটা আত্মা কেবল সেসব ঘটনা জানে যা সে জীবদ্দশায় জানত। বেঁচে থাকা অবস্থায় সে কখনওই জানত না তার মা বাসা বদল করেছে। আর তাই এখানে ফিরে এসেছে, প্রিয় মাকে শেষবারের মত দেখবার জন্য…

ফাদার টম কথা বলা বন্ধ করতেই নিস্তব্ধ হয়ে গেল গোটা কামরাটা। তারপর শোনা গেল মেরির কান্নার শব্দ। চোখের জল গড়িয়ে পড়ছে তার গাল বেয়ে। কাঁদতে-কাঁদতেই সে বলল, আমিই নাবিক ছেলেটার হতভাগ্য আত্মাকে ফিরিয়ে দিয়েছিলাম। সে কেবল তার মাকে খুঁজছিল। ইস, আমি যদি জানতাম…

২. ব্রাউন লেডি

ব্রাউন লেডি

গত দেড়শো বছরে ইংল্যাণ্ডের নরফোকের রেইনহ্যাম পার্কে ব্রাউন লেডি বা বাদামি বসনাকে দেখা গিয়েছে অনেকবার।

সিঁড়ি বেয়ে নিঃশব্দে ওঠা-নামা করে সে, কখনও করিডর ধরে হেঁটে বেড়ায়। তার পরনে থাকে বাদামি-হলুদ একটা পোশাক আর গলায় পশমের গলাবন্ধ। তার চোখের জায়গায় থাকে অন্ধকার গর্ত, মুখটা মোমের মত সাদা। এমনিতে কোনো কথা বলে না, কারও ক্ষতি করে না, এমনকী কিছু চায়ও না। তবে কখনও কখনও তার ঘুরে বেড়াবার মধ্যে অশুভ, ভয়ঙ্কর কী যেন একটা থাকে, এমনকী তাকে দেখে সবচেয়ে দুঃসাহসী মানুষটিরও গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে।

রেইনহ্যাম ছিল মারকুইজ অব টাউনশেদের বাড়ি। খুব প্রাচীন একটা বাড়ি এটি। ১৮৩৫ সালের দিকে এটা কিনে সংস্কার করান টাউনশেন্ডরা। এ উপলক্ষে বেশ কিছু বন্ধু-বান্ধবকে দাওয়াত দেন লর্ড এবং লেডি চার্লস টাউনশেণ্ড। এদের একজন ক্যাপ্টেন ফ্রেডেরিক মারিয়াট। ছোটদের জন্য গল্প লিখে তখন খুব নাম কামিয়েছেন ভদ্রলোক। ফ্রেডেরিক পৌঁছার পরপরই লর্ড চার্লস তাঁকে এক পাশে টেনে এনে নিজের স্টাডির দিকে নিয়ে চললেন।

দুজনের জন্য গ্লাসে মদ ঢেলে কথা বলা শুরু করলেন. লর্ড চার্লস। মুখে চিন্তার ছাপ। ফ্রেডেরিক, এখানে কিছু একটা সমস্যা তৈরি করছে। তোমার সাহায্য দরকার আমার। বাড়িতে একটা ভূত আছে এই গুজব ছড়িয়ে পড়েছে। আমি এটাকে পাত্তা দিতে চাইনি। কিন্তু কোনো চাকর-বাকর কিংবা অতিথিই দু-চার রাতের বেশি থাকতে পারে না এখানে। তারা ব্রাউন লেডি নামে পরিচিত একজন মহিলাকে দেখেছে। এই তথাকথিত ভূত নাকি বারান্দা এমনকি শোবার ঘরগুলোর ভিতরে আর আশপাশে ঘুরে বেড়ায়।

চার্লস, তিরস্কার করলেন ক্যাপ্টেন, এ ধরনের আজগুবি গল্পে তুমি কেন বিচলিত হচ্ছ এটা মাথায় আসছে না আমার। আমি ওসব ভূত, প্রেতাত্মায় বিশ্বাস করি না। যদি আসলেই কাউকে দেখা যায়, তবে ধরে নিতে পার কেউ তোমার সঙ্গে চালাকি করছে। তুমি কিনে নেওয়ার আগে কিছুদিন বাড়িটা খালি পড়ে ছিল। ঠিক না?

হ্যাঁ।

এই এলাকার একজন ম্যাজিস্ট্রেট হিসাবে আমি জানি, আবার কথা বলা শুরু করলেন ক্যাপ্টেন ম্যারিয়াট, এদিকটায় বেশ ভাল পরিমাণ চোরাচালানি আর চোরাশিকার হয়। এসব চোরাচালানির লুকানোর জায়গা হিসাবে যে বাড়ি আর আস্তাবলগুলো ব্যবহার করা হত এটি সম্ভবত তার একটা। এখন তোমাদের উপস্থিতির কারণে একটা নিরাপদ আত্মগোপনের জায়গা হাতছাড়া হওয়ার অবস্থা হয়েছে তাদের। তারাই গ্রামে ভূতের গল্প ছড়িয়ে তোমাকে তাড়াতে চাইছে।

লর্ড চার্লস উঠে দাঁড়ালেন চেয়ার ছেড়ে। উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে তার চোখ। আমার ধারণা তুমি আসল জায়গায় হাত দিয়েছ। তুমি জান আমার কুকুর আছে। আর এদের চেঁচামেচিতে রাতে এই বাড়ি কিংবা আস্তাবলের ধারে-কাছে ঘেঁষা কঠিন কারও কারও জন্য। তারাই আমাকে তাড়াতে চাচ্ছে। সন্দেহ নেই চোরাচালানি কিংবা চোরাশিকারীদের বানানো চরিত্র এই বাদামি বসনা নারী।

কোন্ কামরাটায় এই মহিলাকে দেখেছে লোকেরা? হালকা চালে জিজ্ঞেস করলেন ক্যাপ্টেন। তার বুদ্ধির প্রতি বন্ধুর আস্থা দেখে মনে-মনে খুশি হয়ে উঠেছেন।

আস্তাবলের দিকে মুখ করা দ্বিতীয় তলার একটা কামরা ওটা, জবাব দিলেন লর্ড চার্লস। বেশ বড়সড়, চমৎকার একটা কামরা এটা। চারপাশে সিডার কাঠের প্যানেল দেওয়া। দেয়ালে একজন মহিলার প্রতিকৃতি আছে। তার পরনে একটা বাদামিহলুদ পোশাক, গলায় একটা গলা বন্ধনী। সম্ভবত এটাই সেই ব্রাউন লেডি, যার কথা লোকে বলে।

তাহলে তোমার অনুমতি পেলে আমি সেখানে রাতে ঘুমাতে চাই, ঘোষণা করলেন ক্যাপ্টেন। এখান থেকে আস্তাবলের দিকে চোখ রাখতে পারব। আর তোমার ওই ব্রাউন লেডি যদি চেহারা দেখায় তার কুশলও জিজ্ঞেস করতে পারব, যদিও সে আসবে কিনা এ বিষয়ে সন্দেহ আছে আমার।

কোনো সমস্যা নেই। তোমার জন্য কামরাটা ঠিক করে দিতে বলছি। মনে হয় না রাতে কোনো অনাহূত অতিথি ব্যাঘাত ঘটাবে তোমার ঘুমে।

বালিশের নীচে গুলি ভরা একটা রিভলভার রেখে. পর পর দুরাত ভুতুড়ে কামরাটায় কাটালেন ক্যাপ্টেন ম্যারিয়াট। কিন্তু অস্বাভাবিক কিছুই নজরে এল না। তৃতীয় রাতটাই এখানে তাঁর শেষ রাত। ক্যাপ্টেনের ধারণা এ রাতটাও কাটবে ঘটনাবিহীনভাবে।

মাঝরাতের ঠিক আগে। হাতে মোমবাতি নিয়ে, বাদামী সিল্কের পোশাক পরা তরুণী মহিলার প্রতিকৃতিটা পর্যবেক্ষণ করছেন ক্যাপ্টেন। মহিলার চেহারায় কোনো অস্বাভাবিকতা নেই। মাথাটা একবার ঝাকিয়ে ভূতের চিন্তা-ভাবনা মন থেকে বিদায় করে এক পা পিছিয়ে এলেন। মোমবাতির শিখাটা কেঁপে উঠল। এখান থেকে মোমবাতির আলো যে ছায়া তৈরি করছে তাতে বদলে গেল চেহারাটা। ওটাকে এখন সাধারণ আর নিস্পাপ মনে হচ্ছে না। বরং ভীতিপ্রদ আর পৈশাচিক লাগছে। চোখ দুটো কোটরের ভিতরে ঢুকে গেছে, চামড়ার ভেতর থেকে হাড় ফুটে বেরোচ্ছে। ক্যাপ্টেনের কেন যেন মনে হলো তিনি একটা খুলির দিকে তাকিয়ে আছেন।

আবার সামনে এগুলেন, আগের সেই শান্ত, সুন্দর চেহারাটা ফিরে এল। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে, পাশের টেবিলে রাখলেন ম্যারিয়ট মোমবাতিটা। এবার ঘুমাতে যাবেন। ঠিক এমন সময় দরজায় ধাক্কা দিল কেউ। ভিতরে আসুন, বলার সময় মহিলার ছবিটার দিকে দৃষ্টি দেওয়া এড়াতে পারলেন না।

তবে কোনো ভূত কিংবা প্রেতাত্মা ঢুকল না ঘরে। লর্ড চার্লসের দুই ভাতিজা দাঁড়িয়ে আছে দরজার সামনে, করিডোরের শেষ মাথার একটা কামরা ভাগাভাগি করছে তারা। সন্ধ্যায় তাদের সঙ্গে দেখা হয়েছে ক্যাপ্টেনের, তখন শিকারী কুকুর আর বন্দুক নিয়ে আলাপ করছিল তারা।

যাক বাবা! আপনি ঘুমিয়ে পড়েননি। বলল কিশোরদের একজন। আপনি কি আমাদের রুমে একবার আসবেন? লণ্ডন থেকে কেনা একটা বন্দুক এই মাত্র খুলেছি। ওটা সম্পর্কে আপনার মতামত জানতে চাচ্ছিলাম।

মোমবাতিটা তুলে নিয়ে দরজার দিকে এগুলেন ক্যাপ্টেন। মনে হলো যেন ছবির মহিলাটি তাঁর দিকে তাকিয়ে ভেংচি কাটছে। তারপর জোর করে মুখে একটু হাসি ফুটিয়ে রিভলভারটা তুলে নিয়ে বললেন, এটা নেব আমি। ব্রাউন লেডির সঙ্গে যদি দেখা হয়ে যায়!

তিনজন করিডোর ধরে হেঁটে ছেলেদের কামরায় চলে এলেন। ক্যাপ্টেন অস্ত্রটার প্রশংসা করে বললেন, আগামীবার লণ্ডনে গেলে নিজেও এমন একটা কিনবেন। আরও কয়েক মিনিট আলাপের পর ক্যাপ্টেন হাই তুলতে তুলতে বললেন, এখন বিছানায় যেতে হবে আমাকে। আগামীকাল আবার লম্বা পথ পাড়ি দিতে হবে।

আপনাকে বরং আমরা পৌঁছে দিয়ে আসি, হাসতে-হাসতে বলল চার্লসের এক ভাতিজা, ব্রাউন লেডি যদি আবার আপনাকে অপহরণ করে ফেলে।

একসঙ্গে কামরা থেকে বের হয়ে লম্বা, অন্ধকার করিডোরটা ধরে হাঁটা ধরলেন তাঁরা। গোটা বাড়িটাই অন্ধকারে ঢেকে আছে, তাদের পায়ের আওয়াজ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই কোথাও। মাত্র কয়েক গজ এগিয়েছেন এমন সময় হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেলেন ক্যাপ্টেন।

দেখো! ফিসফিস করে বললেন তিনি।

করিডোরের অপর পাশ থেকে একটা কাঠামো এগিয়ে আসছে, হাতে লণ্ঠন। একজন মহিলা, হাঁটার সময় তার পোশাকটা খসখস শব্দ করছে। তবে ছায়ায় ঢাকা পড়ায় চেহারাটা দেখা যাচ্ছে না।

তিনি নিশ্চয় মহিলা অতিথিদের একজন, সম্ভবত পথ হারিয়েছেন। ম্যারিয়াট বিড়বিড় করলেন, কিংবা কেউ বাগানের দিকে যাচ্ছেন।

কিন্তু মহিলাটি কে? ছেলেদের একজন বলল, তাকে অতিথিদের কারও মত লাগছে না আমার।

কাঠামোটা তাঁদের দিকে এগিয়ে আসতে লাগল। তাপমাত্রাটা হঠাৎ করেই বেশ কয়েক ডিগ্রী নেমে গেল, মনে হচ্ছে যেন হঠাৎ করেই শীতকাল চলে এসেছে। তিনজন শীতে ঠকঠক করে কাঁপতে শুরু করলেন। হঠাই সামনের একটা খালি কামরার খোলা দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকে ছেলেদেরও টেনে নিলেন ম্যারিয়াট। তারপর একটু ফাঁক রেখে দোর টেনে দিলেন। এবার এই ফাঁকে চোখ রাখলেন সবাই, হৃৎপিণ্ডে দ্রিম দ্রিম বাড়ি খাচ্ছে।

মহিলাটি এখন দরজার কাছাকাছি চলে এসেছেন। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন ক্যাপ্টেন। লণ্ঠনের আলোয় চেহারাটা ধরা দিল তাঁর সামনে, পরনে সেই সিল্কের বাদামি পোশাক। সন্দেহ নেই ছবির সেই মহিলা আর ইনি একই ব্যক্তি। করিডোর ধরে আস্তেআস্তে হেঁটে চলেছেন। পোশাক খস খস শব্দ তুললেও পা ফেলার কোনো আওয়াজ হচ্ছে না। লণ্ঠনের আলোয় তার চোখে, মুখে অশুভ কিছু নজর পড়ল না।

দরজার ঠিক উল্টো পাশে যখন চলে এলেন তখন দাঁড়িয়ে পড়লেন। বাতিটা মুখের সামনে ধরলেন। আর তখনই চেহারাটা পাল্টে গেল। চামড়া-মাংস ভেদ করে স্পষ্ট হয়ে উঠল হাড়গুলো। মনে হলো যেন একটা কংকাল হেঁটে যাচ্ছে সামনে দিয়ে। গর্তের মধ্যে অদৃশ্য হয়েছে চোখ জোড়া, ঠোটহীন মুখটাকে লাগছে যেন একটা গোরস্থানের প্রবেশদ্বারের মত।

ধীরে-ধীরে দরজাটা মেললেন ক্যাপ্টেন। ব্রাউন লেডির ভয়ঙ্কর মুখটা আরও পরিষ্কার হয়ে উঠল তাঁদের চোখের সামনে। জোর খাটিয়ে নিজের মনটাকে স্থির করলেন কাপ্টেন। তারপর একেবারে কাছ থেকে গুলি করলেন প্রেতাত্মাটার দিকে।

বদ্ধ জায়গায় শব্দটা কানে তালা লাগিয়ে দিল। যখন ধোঁয়া অদৃশ্য হলো মেঝের দিকে তাকালেন ক্যাপ্টেন। আশা করছেন মাটিতে একটা দেহ পড়ে থাকতে দেখবেন। কিন্তু এখানে কিছুই নেই। এমনকী কিছু ছিল তা প্রমাণ করার মত কোনো চিহ্নও না। তিনজন পুরুষ আর বাতাসে ভেসে চলা হালকা ধোঁয়ার রেখা ছাড়া করিডোরে আর কিছুর অস্তিত্ব নেই।

পাগলের মত একজন আরেকজনের দিকে তাকাতে লাগলেন তারা। এখানে কিছু একটা ছিল, তাই না? আমার চোখ নিশ্চয় বেঈমানি করেনি? বললেন ক্যাপ্টেন। ছেলেদের একজন কাঁপতে-কাপতে বলল, আমি যা দেখেছি আপনিও যদি তা দেখে থাকেন তবে তা ভয়ঙ্কর। তারপর উল্টো পাশের দরজার দিকে ইশারা করে বলল, দেখুন, বুলেটের গর্ত। এখানে যা ছিল বুলেটটা তাকে ভেদ করে গেছে।

এবার ক্যাপ্টেন গম্ভীরকণ্ঠে বললেন, আমরা যাকে দেখেছি সে কোনো চোরাচালানী বা পোচার নয়, রেইনহ্যামের ব্রাউন লেডি, ছবির থেকে যে জীবন পেয়ে গেছে। তারপরই হঠাৎ একটা চিন্তা মাথা চাড়া দিয়ে উঠল তার। আমার সঙ্গে চলো। বলে দ্রুত নিজের কামরার দিকে হাঁটতে শুরু করলেন।

দেয়ালের যেখানে বাদামি বর্সনার ছবি ঝুলছে সেখানে চলে এলেন ক্যাপ্টেন। মোমটা উঁচু করে ধরলেন। ব্রাউন লেডি যেন এক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। তার মুখটাতে কোনো অস্বাভাবিকতা নেই। আলো পড়ে ঝিকিয়ে উঠছে বাদামি পোশাকটা। হঠাৎই ক্যাপ্টেনের শ্বাস বন্ধ হওয়ার উপক্রম হলো। মহিলার হৃৎপিণ্ডের কাছটায় কি একটু রক্তের চিহ্ন দেখা যাচ্ছে? আলো পড়ে চিক চিক করছে? নাকি তার উর্বর মস্তিষ্কের কল্পনা এটা?

ব্রাউন লেডিকে নিয়ে ক্যাপ্টেনের এই অভিজ্ঞতার বর্ণনা পাওয়া যায় তাঁর মেয়ে ফ্লোরেন্সের লেখা একটি বইয়ে। ১৮৯৯ সালে মারা যান ভদ্রমহিলা। তবে ক্যাপ্টেন ছাড়াও আরও অনেকেই বাদামি বসনাকে দেখেছেন। ধারণা করা হয় তিনি ছিলেন ডরোথি ওয়ালপল, ১৭২২ সালে ইংল্যাণ্ডের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করা রবার্ট ওয়ালপলের বোন। লোকে বলে ব্রাউন লেডি তার বাচ্চাদের খুঁজে ফিরছেন। ভদ্রমহিলা জীবিত থাকার সময় স্বামী দ্বিতীয় ভিসকন্ট টাউনশেণ্ডের সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হওয়ার পর বাচ্চাদের তাদের দাদির হেফাজতে রাখা হয়েছিল।

১৯৩৬ সালে বাদামি বসনার একটা ছবি তোলার চেষ্টা করেন একজন আলোকচিত্রী। তবে যে ছবিটি একটা ম্যাগাজিনে ছাপা হয় সেটা খুব স্পষ্ট।

৩. বিমানে ভূত

বিমানে ভূত

আকাশে উড়ছে ইস্টার্ন এয়ারলাইন্স কোম্পানির ট্রিস্টার-৩১৮ বিমানটি। বিমানকর্মীরা ছাড়াও ১৮০ জন যাত্রী আছেন বিমানে। নিউইয়র্ক থেকে ফ্লোরিডা যাচ্ছে বিমানটি। এয়ার হোস্টেস ফে মেরিওয়েদার তার সিট ছেড়ে উঠে স্টোরের দিকে রওয়ানা হলেন। যাত্রীদের জন্য সকালের নাস্তার তদ্বির করতে হবে তাঁকে। জায়গামত পৌঁছে খাবার গরম করার ওভেনটার দিকে হাত বাড়ালেন ফে। এ সময়ই একটা জিনিস দেখে আপনা আপনি চিৎকার বেরিয়ে এল তার মুখ থেকে। ওভেনের দরজার ওপাশ থেকে একটা মুখ উঁকি দিচ্ছে। এটা কী করে সম্ভব-ভাবলেন ফে। আতঙ্কে চোখ বুজলেন। যখন আবার চোখ খুললেন ওভেনের ভেতর কাউকে পেলেন না। যেই নাস্তা ভরা ট্রেটা বের করার জন্য দরজা খুলবেন, এমন সময় আবার মুখটা দেখা দিল ওভেনের ভিতর। মুখটা ঠোট নাড়ছে, মনে হয় যেন কিছু একটা বলছে সে। কিন্তু কথাগুলো বুঝতে পারলেন না তিনি।

কোনো মতে দৌড়ে ফ্লাইট এঞ্জিনিয়ার মুরে যেখানে বসেন সেখানে পৌঁছতে পারলেন। বিমানবালার সঙ্গে ওভেনের কাছে এলেন তিনি। মুখটা এখনও আছে। এবার মুরে আর ফে বুঝলেন সে কী বলছে। বলছে, সাবধান! বিমানে আগুন লাগতে চলেছে। এবার মুরে মুখটাকে চিনতে পারলেন। এটা আগের ফ্লাইট এঞ্জিনিয়ার ডন রেপোর মুখ, একটা দুর্ঘটনায় যিনি মারা গেছেন।

এসময় কেউই ডন রেপোর ভূতের কথাগুলো বিশ্বাস করল। তবে ঘণ্টা দুয়েক পর ওড়ার সময় কিছু সমস্যা দেখা দিল বিমানটায়। কাজেই মেরামতের জন্য নিউইয়র্কে ফিরিয়ে আনা হলো ওটাকে। ত্রুটি সারাবার পর পরীক্ষামূলকভাবে আকাশে উড়ানো হয় বিমানটা। এসময়ই আকাশে বিস্ফোরিত হয় বিমানটার জেট এঞ্জিন।

ডন রেপোর ভূতের সাবধানবাণী সত্যি ছিল। আমেরিকান বিমান পরিচালনা কর্তৃপক্ষের তদন্তে বেরিয়ে আসল যদি বিমানটিকে ত্রুটি সারানোর জন্য নিউইয়র্ক ফিরিয়ে আনা না হত, তবে সম্ভবত পৌনে দুশোর বেশি যাত্রী নিয়ে ফ্লোরিডা পৌঁছবার আগেই ভয়াবহ দুর্ঘটনায় পড়ত ট্রিস্টার-৩১৮।

১৯৭২ সালে ইস্টার্ন এয়ারলাইন্স-এর ফ্লাইট নম্বর ৪০১ বিধ্বস্ত হয়। ভয়াবহ সেই দুর্ঘটনায় ডন রেপোর সঙ্গে পাইলট বব লফট এবং ৯৭ জন যাত্রী নিহত হন। মৃত্যুর পর অনেকবার পাইলট বব লফটকেও দেখা গেছে বিভিন্ন ফ্লাইটে।

মর্মান্তিক এই দুর্ঘটনা কবলিত বিমানটির যেসব অংশ উদ্ধার করা সম্ভব হয় সেগুলো পরবর্তীতে নতুন তৈরি করা কয়েকটি বিমানে ব্যবহার করা হয়। ট্রিস্টার-৩১৮ বিমানটার কিচেনসহ আরও কিছু অংশ ছিল দুর্ঘটনা কবলিত সে বিমানটার অংশ।

এই ভৌতিক ঘটনার শুরু ১৯৭৩ সালে। এসময় ইস্টার্ন এয়ারলাইন্সের ভাইস-প্রেসিডেন্ট ট্রিস্টার-৩১৮ বিমানটায় ভ্রমণ করছিলেন। দস্তুরমত ইস্টার্ন এয়ারলাইন্সের পোশাক পরা একজন ক্যাপ্টেন বসেছিলেন তাঁর পাশে। হঠাৎ ক্যাপ্টেনের চেহারার দিকে ভালভাবে তাকালেন ভাইস-প্রেসিডেন্ট। আঁতকে উঠলেন তিনি। এটা কীভাবে সম্ভব? এক বছর আগে পাইলট বব লফট মারা গেছেন, তাহলে কীভাবে তাঁর পাশে বসে আছেন এখন। দৌড়ে ককপিটে চলে এলেন ভদ্রলোক। বিষয়টা কী? খতিয়ে দেখতে বিমানের অন্যান্য কর্মীরা দৌড়ে এল। তবে ততক্ষণে বব লফটের ভূত অদৃশ্য হয়েছে।

আরেকবার ট্রিস্টার-৩১৮ এর ফ্লাইট এঞ্জিনিয়ার ককপিটে ঢোকেন আকাশে ওড়ার আগে সব কিছু ঠিক আছে কিনা দেখে নেয়ার জন্য। এসময়ই চমকে উঠে দেখেন ডন রেপোর ভূত সিটে বসে আছে ইউনিফর্ম পরে। যন্ত্রপাতিগুলো পরীক্ষা করছে সে। অপর ফ্লাইট এঞ্জিনিয়ারকে সব যন্ত্রপাতি ঠিক আছে জানিয়ে অদৃশ্য হয় সে।

বিমানটির আরেক অফিসার ডন রেপোর যন্ত্রপাতি পরীক্ষা করার এই গল্প শুনেছিলেন। মায়ামি থেকে আটলান্টার দিকে ফিরতি ফ্লাইটের আগে যন্ত্রপাতিগুলো ব্যক্তিগতভাবে পরীক্ষা করে দেখার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। আর কাজটা করতে ককপিটে ঢুকতেই দেখেন ডন রেপোর ভূত খুব মনোযোগের সঙ্গে বিমানের সব যন্ত্রপাতি পরীক্ষা করছে।

১৯৭৪ সালে ইস্টার্ন এয়ারলাইন্স-এর পাইলটদের নিরাপত্তার কিছু নির্দেশনা দেয়। এতে বিমানে ডন রেপো আর বব লফটের উপস্থিতির কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়। এটা করা হয় কারণ বিমানের কর্মীরা যেন তাদের দেখে চমকে না ওঠেন সেজন্য। তবে এই ভূতেরা কখনও কারও ক্ষতি করেনি। বরং নিজেদের মত করে সাহায্য করার চেষ্টাই করেছে। তবে যত যাই হোক ভূত বলে কথা। ক্ষতি করে না জানার পরও মনে-মনে ঠিকই এদের প্রতি একটা আতংক ঠিকই থাকত সবার।

ডন রেপো এবং বব লফটের মারা যাওয়ার আঠারো মাস পর তাদের আত্মার শান্তি কামনা করে বিশেষ প্রার্থনার আয়োজন করা হয় ট্রিস্টার-৩১৮তে। এরপর থেকে আর তাদের ভূতকে দেখা যায়নি বিমানে। অবশ্য বিমান সংস্থাটির কর্তৃপক্ষ এমনকী বিমানের কর্মীরাও এই বন্ধুভাবাপন্ন কর্মকর্তাদের আত্মার থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য এই প্রার্থনা আয়োজন করতে চাননি। কিন্তু যাত্রীরা আতঙ্কে বিমানে চড়া বন্ধ করে দেওয়া শুরু করলে এটা করতে বাধ্য হন তারা।

আশ্চর্য ঘটনা, ১৯৭২ সালের সেই দুর্ঘটনায় রেপো আর লফটের সঙ্গে ৯৭ জন যাত্রীও মারা যান। কিন্তু ট্রিস্টার-৩১৮ বিমানে কেবল তাদের দুজনের ভূতেরই আনাগোনা ছিল। তাহলে বাকি যাত্রীদের ভূত কেন দেখা দিত না এটা একটা রহস্য। অবশ্য কে না জানে এ ধরনের ভৌতিক ঘটনা কোনো নিয়ম মেনে চলে না। তবে এমন হতে পারে রেপো আর লফট কোনোভাবেই তাদের পুরানো বিমান আর পেশার মায়া কাটাতে পারছিলেন না। বাকি যাত্রীদের তো আর এর প্রতি এত দরদ থাকার কথা নয়।

৪. রাঁধুনির ভূত

রাঁধুনির ভূত

একজন যাজক এই কাহিনিটি জানান। তবে কারও নাম প্রকাশ না করার শর্ত ছিল তার। আর আমরা যে সূত্র থেকে লেখাটি পেয়েছি তাতেও কারও নাম ছিল না। এটা এখন শুনব যাজকের জবানীতে।

আমার স্ত্রীর বাবার বাড়িতে বেশ কয়েকজন মহিলা চাকরবাকর ছিল। বিয়ের আগে এদের সব কিছু দেখভালের দায়িত্ব ছিল আমার স্ত্রীর। একবার বাড়ির মহিলা রাঁধুনির অ্যাপেণ্ডিসাইটিসে ব্যথা শুরু হয়। এসময় একটা হাসপাতালের গির্জার যাজকের দায়িত্ব পালন করছি আমি। মহিলাটিকে ওই হাসপাতালে ভর্তি করে দিই। সেখানে অপারেশন করা হলেও বাঁচানো যায়নি তাকে। তার বন্ধুরা মহিলাকে কবর দিয়ে দেয়।

অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার কয়েক দিন পরের ঘটনা। আমার স্ত্রী রান্নাঘরের একটা টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে কাজ করছে। এখান থেকে দরজা খোলা থাকলে সামনের বারান্দা দিয়ে যে-ই যাবে নজরে পড়বে তার। তখন সকাল এগারোটার মত বাজে। মাসটা ফেব্রুয়ারির শেষ কি মার্চের শুরু। একটা কেকের ওপর চিনির প্রলেপ দিচ্ছে তখন সে। এসময়ই কাজ থেকে চোখ তুলে খোলা দরজা পথে বারান্দাটার দিকে তাকাল সে। বাড়ির ভৃত্যদের বসবার ঘরের পাশ দিয়ে অন্য একটা কামরার দিকে গেছে বারান্দাটা। এসময়ই পরিষ্কার দেখল কিছুদিন আগে মারা যাওয়া সেই রাঁধুনিটিকে। বারান্দা ধরে ওই কামরাটার দিকে যাচ্ছে। সকালের দিকে সাধারণত যে ধরনের পোশাক পরে তাই পরনে। পরিস্থিতিটা এতটাই স্বাভাবিক মনে হলো যে শুরুতে আমার স্ত্রীও খুব একটা ভয় পেল না। তবে মহিলাটির পিছু নিল সে। বারান্দা থেকে কামরাটায় তার স্কার্টের ঝুলটা অদৃশ্য হতে দেখল। কিন্তু ভিতরে ঢুকে কাউকেই দেখতে পেল না সেখানে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *