চারিদিকে শক্র ১

মাসুদ রানা ১৩৩ – চারিদিকে শক্র ১ (প্রথম খণ্ড) – কাজী আনোয়ার হোসেন – সেবা প্রকাশনী

প্রথম প্রকাশ : ডিসেম্বর, ১৯৮৫

এক কাঁচা-পাকা ভুরু কুঁচকে আছে। কপালের পাশে একটা রগ তিরতির করে কেঁপে উঠল। গভীর মনোযোগের সাথে একটা ফাইল দেখছেন বাংলাদেশ কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের সুযোগ্য। কর্ণধার মেজর জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) রাহাত খান।

কনফিডেনশিয়াল রিপোর্ট পার্ট ওয়ান
মিকোয়ান প্রজেক্ট

মস্কো থেকে ছয়শো মাইল দূরে বিলিয়ারস্ক-এ মিকোয়ান প্রজেক্টের কাজ এখন প্রায় শেষ পর্যায়ে। প্রজেক্ট হাতে নেয়া হয়। পাঁচ বছর আগে। এটা মিগ-৩১ তৈরির একটা মহা পরিকল্পনা। পরীক্ষামূলকভাবে মাত্র একজোড়া বিমান তৈরি করা হয়েছে।

মিগ-৩১ সোভিয়েত সমর-বিজ্ঞানীদের এক বিস্ময়কর আবিষ্কার। এর ব্যাপক উৎপাদন শুরু হলে পৃথিবীর গোটা আকাশ রাশিয়ান পাইলটদের হাতের মুঠোয় চলে যাবে। আকাশ-যুদ্ধে। সোভিয়েত এয়ারফোর্স হয়ে উঠবে অপরাজেয় একটা শক্তি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা তার পশ্চিমা মিত্রদের কাছে এ-ধরনের কিছু নেই, তারমানেই এক্ষেত্রে রাশিয়ার চেয়ে দশ বছর পিছিয়ে পড়বে তারা। ন্যাটো আর সি.আই.এ. মিগ-৩১-এর সার্থক নামকরণ করেছে-এয়ারকিং।

দুটো অতুলনীয় বৈশিষ্ট্য রয়েছে এয়ারকিং (মিগ-৩১)-এর। একটা হলো থট-গাইডেড উইপনস সিস্টেম, অপরটি অ্যান্টি রাডার।

ইনভ্যালিড চেয়ার কিভাবে কাজ করে জানা থাকলে থটগাইডেন্স সম্পর্কে পরিষ্কার একটা ধারণা পাওয়া সম্ভব। ইনভ্যালিড চেয়ার বেসামরিক পর্যায়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি হতে যাচ্ছে। এই চেয়ারের পরিকল্পনা এমনভাবে করা হয়েছে যাতে একজন পঙ্গু বা অচল ব্যক্তি তার কোন হাত, পা বা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নাড়াচাড়া না করে শুধু পজিটিভ থট অ্যাকটিভিটির সাহায্যে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় অনায়াসে যাওয়া-আসা করতে পারবে। চেয়ারটা তৈরি করা হবে অত্যাধুনিক ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতির সাহায্যে, ব্রেন-এর সাথে সংযুক্ত (একটা ক্যাপ বা হেডরেস্টের মাধ্যমে) সেনসরগুলো ব্রেন থেকে পাওয়া নির্দেশ হুইলচেয়ার বা ইনভ্যালিড ক্যারিজের মেকানিক্সের কাছে ট্রান্সমিট করবে-ইলেকট্রনিক ইমপালসের মত। মনের নির্দেশগুলো-সামনে এগোও, উল্টো দিকে ঘোরো, ডানে বা বাঁয়ে বাঁক নাও-সরাসরি ব্রেন থেকে আসবে। এই নির্দেশ সরাসরি হুইলচেয়ারের অন্তরে গিয়ে পৌঁছুবে।

পরীক্ষামূলকভাবে এই চেয়ার তৈরি করা সম্ভব হলেও, সামরিক প্রয়োজনে এই পদ্ধতি এখনও ব্যবহার করা শুরু হয়নি। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন এ-ধরনের একটা পদ্ধতি আরও নিখুঁত করে নিয়ে সামরিক কাজে ব্যবহার করার যোগ্যতা অর্জন করেছে। (পশ্চিম ইউরোপ এমনকি ইনভ্যালিড চেয়ার পর্যন্ত তৈরি করছে না।)

ডিটেকশন আর গাইডেন্সের জন্যে আধুনিক একটা এয়ারক্রাফটে রাডার আর ইনফ্রা-রেড সিস্টেম থাকতেই হবে, এয়ারকিং-এ এ-সবের সাথে রাশিয়ানরা যোগ করেছে চিন্তাপরিচালিত এবং চিন্তা নিয়ন্ত্রিত (থট-গাইডেড অ্যান্ড থটকন্ট্রোলড়) অস্ত্রাগার। রাডারের সিগন্যাল নিরেট একটা জিনিসে। বাড়ি খায়, স্ক্রীনে দেখা যায় আসলে ওখানে জিনিসটা কি রয়েছে। আর ইনফ্রারেড স্ক্রীনে দেখায় ডিটেকশন ইকুইপমেন্টের। চারদিকে হিট-সোর্স কোথায় রয়েছে। মিসাইল পরিচালনা বা লক্ষ্যস্থির করার জন্যে দুটোর যে-কোন একটা বা দুটো সিস্টেমই ব্যবহার করা যেতে পারে। মিসাইলেও দুটো সিস্টেমের যে-কোন। একটা অথবা দুটোই থাকে। তবে থট-গাইডেড সিস্টেমের সুবিধে হলো এই যে মিসাইল ছোড়ার পরও পাইলটের হাতে ওটাকে পরিচালনা করার ক্ষমতা থেকে যায়। পাইলট আরও একটা সুবিধে পাচ্ছে, এরও কোন তুলনা হয় না, বোতাম টিপলেই মিসাইল বেরোয়, কিন্তু বোতাম টেপা থেকে শুরু করে মিসাইল বেরুনো পর্যন্ত কিছুটা সময় লেগে যায়। থট-গাইডেড সিস্টেমে মিসাইল রিলিজ হতে প্রায় কোন সময়ই লাগবে না, কারণ পাইলটের মনের নির্দেশ সরাসরি ফায়ারিং সিস্টেমে চলে যাবে, কোন রকম শারীরিক তৎপরতার দরকার হবে না।

এই সফিসটিকেটেড সিস্টেমের কাছ থেকে পুরোমাত্রায় সুফল পেতে হলে নতুন ধরনের সফিসটিকেটেড কামান আর মিসাইলও দরকার। যুক্তরাষ্ট্র আর তার মিত্রদের তো প্রশ্নই ওঠে না, এমনকি সম্ভবত সোভিয়েত রাশিয়াও এখনও ওগুলো তৈরি করতে পারেনি। এয়ারকিং-এ তারা নিশ্চই প্রচলিত মিসাইল আর রকেটই ব্যবহার করবে। তবু, রাশিয়ার যা প্রোগ্রাম, এই মুহূর্তে যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উঠে পড়ে না লাগে, নতুন ধরনের মিসাইল আর কামান টেকনোলজিতেও পিছিয়ে পড়বে তারা।

এয়ারকিং-এর অ্যান্টি-রাডার কৌশল সম্পর্কে কিছুই জানা সম্ভব হয়নি। ওটার প্রাথমিক উড্ডয়নের সময় স্যাটেলাইট রাডারে ওটাকে ধরার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে সি.আই.এ.। কিভাবে জানা না গেলেও, এতে কোন সন্দেহ নেই যে এয়ারকিং যে-কোন ধরনের রাডারকে ফাঁকি দিতে সক্ষম।

এ-সব তথ্য পাবার পর, সঙ্গত কারণেই, ন্যাটো, সি.আই.এ. আর পেন্টাগনের ওরা সবাই হতভম্ব হয়ে পড়ে।

এই বিস্ময়কর হানাদার বিমান ব্যাপক হারে তৈরি করার জন্যে কয়েকশো বিলিয়ন রুবল আলাদা করে রেখেছে সোভিয়েত সরকার। মিগ-২৫ (ন্যাটো আর সি.আই.এ-র দেয়া নাম-এয়ারউলফ)-কে আরও উন্নত করার দুটো প্রজেক্ট এরইমধ্যে বাতিল করে দেয়া হয়েছে বা হবে। সোভিয়েত সমরবিদরা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, মিগ-৩১ (এয়ারকিং) ব্যাপক হারে তৈরি না হওয়া পর্যন্ত সোভিয়েত এয়ারফোর্সের পয়লা নম্বর হানাদার বিমান হিসেবে মিগ-২৫-ই বহাল থাকবে। ব্যাপক হারে মিগ-৩১ উৎপাদনে সহায়তা করার জন্যে রাশিয়ার ইউরোপীয় অংশে অন্তত তিনটে ফ্যাক্টরি-কমপ্লেক্স তৈরির কাজ হাতে নেয়া হয়েছে। একই সাথে এয়ারকিং-এর দুধরনের সংস্করণ তৈরি করা হবে-ইনটারসেপটর আর স্ট্রাইকার। এগুলোর উৎপাদন শুরু হলে ক্ষমতার ভারসাম্যে গুরুতর পরিবর্তন দেখা দেবে, তার পরিণতি কারও জন্যেই ভাল হবে বলে আশা করা যায় না।

এই হুমকি মোকাবিলার জন্যে প্রেসিডেন্টের কাছে দুটো গোপন প্রস্তাব পাঠায় সি.আই.এ.। তাদের প্রস্তাব ন্যাটো আর পেন্টাগন সমর্থন করে। এক নম্বর প্রস্তাব-কমান্ডো বাহিনী পাঠিয়ে গোটা মিকোয়ান প্রজেক্ট ধ্বংস করে দেয়া হোক। দুনম্বর প্রস্ত বি-একটা এয়ারকিং বিলিয়ারস্ক থেকে ছিনিয়ে নিয়ে আসা হোক।

তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বেধে যেতে পারে, এই কথা বলে প্রেসিডেন্ট দুটো প্রস্তাবই বাতিল করে দিয়েছেন। এটা প্রায় দুবছর আগের কথা।

.

কনফিডেনশিয়াল রিপোর্ট পার্ট টু

সি.আই. এ. এবং জিওনিস্ট ইন্টেলিজেন্সের গোপন প্ল্যান।

মিকোয়ান প্রজেক্টে একজন প্রথমশ্রেণীর ইহুদি বিজ্ঞানী কাজ করছে। তার নাম নেসতর কোইভিসতু। কোইভিসতু শুধু একজন বিজ্ঞানী নয়, সেইসাথে একজন স্পাইও। জন্মসূত্রে সোভিয়েত রাশিয়ার নাগরিক এবং সেখানেই মানুষ হলেও, ইহুদি রাষ্ট্র। ইসরায়েলের স্বার্থ তার কাছে সব সময় বড়।

রাশিয়ার সাথে ইসরায়েলের কূটনৈতিক সম্পর্ক না থাকলেও মিকোয়ান প্রজেক্ট সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাচার করতে কোইভিসতুর কোন অসুবিধে হয় না। মস্কোর মার্কিন দূতাবাসের ট্রেড অ্যাটাশে টিম ওয়াইজম্যান সি.আই.এ-র লোক, তার বিশ্বস্ত এজেন্ট হলো চাইম জসেস্কু। জসেস্কুও একজন রাশিয়ান ইহুদি। বিলিয়ারস্ক থেকে কোইভিসতুর পাঠানো তথ্য মস্কোয় রিসিভ করে এই জসেস্কু, তথ্যগুলো নিয়ে আসে মোলায়েভ নামে এক মুদি। সেগুলো টিম ওয়াইজম্যানের হাত ঘুরে যুক্তরাষ্ট্র হয়ে পৌঁছে যায় তেল আবিবে। কোইভিসতুর দুই ইহুদি বন্ধু আছে বিলিয়ারস্কে, তারাও বিজ্ঞানী এবং মিকোয়ান প্রজেক্টে কাজ করে। এদের। দুজনকেও দলে ভিড়িয়েছে সে। এদের একজন ড. ইসরাফিলভ, অপরজন ড. করনিচয়।

এই খুদে স্পাই রিঙে রাশিয়ান ইহুদি যারা রয়েছে তারা কেউ পেশাদার স্পাই নয়, কিন্ত সবাই ইসরায়েলের প্রতি নিবেদিতপ্রাণ। ইসরায়েল বা ইহুদিবাদের বড় কোন উপকারের বিনিময়ে মৃত্যুবরণ করতেও কুণ্ঠিত নয় তারা। কাজেই এদের।

শক্তিকে খাটো করে দেখা চলে না।

প্রেসিডেন্ট প্রস্তাব দুটো বাতিল করে দিলেও, সি.আই.এ.. কিন্তু হাল ছাড়ে না। নাসা আর পেন্টাগনের সাথে পরামর্শ করে। নেসতর কোইভিসতুর কাছে একটা প্রস্তাব পাঠায় তারা। উত্তরে কোইভিসতু জানায় সে রাশিয়া থেকে পালিয়ে আমেরিকায় পৌঁছুলেও সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। এয়ারকিং-এর উইপনস সিস্টেমের ডিজাইন তার তৈরি, সিস্টেমটার উন্নতিও তার হাতে হয়েছে, কিন্তু বিমানের আর সব অংশ নিয়ে কাজ করছে অন্যান্য বিজ্ঞানীরা, সেখানে তার নাক গলাবার কোন উপায় নেই। মিকোয়ান প্রজেক্টে সিকিউরিটি অত্যন্ত কড়া, তার ওপর ইহুদি বিজ্ঞানীদের, সামান্য হলেও, কিছুটা সন্দেহ আর অবিশ্বাসের চোখে দেখা হয়। বিমানের সমস্ত গোপন তথ্য হাত করা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। কাজেই আমেরিকা তাকে নিরাপদে রাশিয়া থেকে বের করে নিয়ে যেতে পারলেও এয়ারকিং-এর মার্কিন সংস্করণ তৈরির কাজে তেমন কোন সাহায্য সে করতে পারবে না।

এই উত্তরের সাথেই পাল্টা একটা প্রস্তাব পাঠায় কোইভিসতু। তাতে বলা হয়, সি.আই.এ-র সহায়তায় জিওনিস্ট ইন্টেলিজেন্স যদি রাশিয়ার একটা এয়ারকিং চুরি করতে চায়, বিলিয়ারস্কের ইহুদি বিজ্ঞানীরা তাহলে সম্ভাব্য সব রকম সাহায্য করবে।

প্রস্তাবটা লুফে নেয় সি.আই.এ. চীফ রবার্ট মরগ্যান। জিওনিস্ট ইন্টেলিজেন্সের ডিরেক্টর আইজ্যাক ময়নিহানের সাথে গোপন বৈঠকে বসে সে। দীর্ঘ আলোচনার পর সিদ্ধান্ত হয়, অপারেশনটা ইসরায়েলের নামে পরিচালিত হবে। সি.আই.এ. তার সমস্ত শক্তি দিয়ে সাহায্য করবে বটে, কিন্তু গোপনে। শেষ পর্যন্ত যখন সব জানাজানি হয়ে যাবে, এর সাথে যে সি.আই.এ. জড়িত ছিল, সেটা প্রকাশ পাওয়া চলবে না। চুরি করা এয়ারকিং ইসরায়েলে নিয়ে যাওয়া হবে, কাজেই পাইলটকে হতে হবে একজন ইসরায়েলি ইহুদি। সি.আই.এ. হেডকোয়ার্টার ল্যাংলি, ভার্জিনিয়াতে ট্রেনিং দেয়া হবে তাকে। রিফুয়েলিং পয়েন্ট কোথায় হবে, নির্ধারণ করার দায়িত্ব সি.আই. এ-র। রিফুয়েলিং পয়েন্ট খুঁজে পাবার জন্যে পাইলটের কাছে কোন এক ধরনের হোমিং ডিভাইস থাকতে হবে, রাশিয়ানরা দেখেও সেটার অস্তিত্ব যেন টের না পায়। চুরি করা এয়ারকিং তেল আবিবেই থেকে যাবে, তবে যখন বা যতক্ষণ খুশি সেটা মার্কিন বিজ্ঞানীদের দেখতে। দিতে বাধ্য থাকবে ইসরায়েল। এয়ারকিং-এর মার্কিন সংস্করণ তৈরি হলে এক স্কোয়াড্রন বিমান উপহার হিসেবে চাইবে ইসরায়েল, সি.আই.এ. ইসরায়েলের এই দাবি সমর্থন করবে। মিকোয়ান প্রজেক্টের কাজ শেষ হতে দুবছর বাকি, কাজেই সময় নষ্ট না করে একটা প্ল্যান তৈরি করে ফেলা দরকার। ইসরায়েল পাইলট নির্বাচন করে পাঠালেই তাকে ট্রেনিং দেয়ার কাজ শুরু। করা হবে।

দুই ইন্টেলিজেন্স চীফের মধ্যে এই সমঝোতা হওয়ার পর। প্রায় দুবছর পেরিয়ে গেছে। ইসরায়েলি পাইলট পিটি ডাভ-এর। ট্রেনিং শেষ, সিগন্যাল পাওয়ার অপেক্ষায় লন্ডনে রয়েছে সে। মিকোয়ান প্রজেক্টের কাজও প্রায় শেষ, তিন-চার মাসের মধ্যেই আনুষ্ঠানিকভাবে উড়বে এয়ারকিং। সে-অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি থাকবেন সোভিয়েত কম্যুনিস্ট পার্টির ফার্স্ট সেক্রেটারি। এই অনুষ্ঠানের মাত্র দুচার দিন আগে সিগন্যাল দেয়া হবে পিটি ডাভকে। সিগন্যাল পেয়ে লন্ডন থেকে মস্কোর পথে রওন হয়ে যাবে সে।

কনফিডেনশিয়াল রিপোর্ট/পার্ট থ্রী (ডিটেলস্)।
বি.সি.আই-এর কর্তব্য।

কেনেথ রবসন একজন ডাবল এজেন্ট, তার সাথে রানা ইনভেস্টিগেশনের যোগাযোগ বহুদিনের। ইসরায়েলি পাইলট পিটি ডাভ সি.আই.এ. হেডকোয়ার্টারে ট্রেনিং নিচ্ছে, এই তথ্য মাসুদ রানার কাছে মাত্র পাঁচশো ডলারে বিক্রি করে সে। দুদিন পর নিউ ইয়র্কের একটা পাব-এ অজ্ঞাতনামা একজন আততায়ীর গুলিতে রবসন মারা যায়। রবসন মারা যাওয়াতেই তার দেয়া তথ্যটা বিশেষ গুরুত্ব লাভ করে। তদন্ত শুরু করে রানা। কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে বেরিয়ে পড়ে সাপ। সি.আই.এ. আর জিওনিস্ট ইন্টেলিজেন্সের গোপন প্ল্যানের অনেকটাই জেনে ফেলে ও।

বি.সি.আই. হেডকোয়ার্টারে রিপোর্ট করে রানা, সেই সাথে নুমার ডিরেক্টর অ্যাডমিরাল জর্জ হ্যামিলটনকেও ব্যাপারটা জানায়। মার্কিন প্রেসিডেন্টের ঘনিষ্ঠ বন্ধু তিনি, একটা ইন্টেলিজেন্স এজেন্সীর চীফও বটেন। এই এজেন্সীর অস্তিত্ব। সম্পর্কে সি.আই.এ, এফ.বি.আই. সহ অনেক প্রতিষ্ঠানই ধরতে গেলে কিছুই জানে না, জর্জ হ্যামিলটন একমাত্র মার্কিন প্রেসিডেন্টের কাছে সরাসরি তার কাজের রিপোর্ট দেন। এদিকে আবার, বি.সি.আই. চীফ মেজর জেনারেল রাহাত খানের সাথেও তাঁর ব্যক্তিগত বন্ধুত্ব রয়েছে। রানাকে অত্যন্ত স্নেহ করেন ভদ্রলোক, ঠেকায়-বেঠেকায় সাহায্য নেন এবং করেন। মার্কিন প্রশাসনে অল্প যে দুএকজন ইসরায়েল-বিরোধী ব্যক্তি আছেন, তিনি তাদের অন্যতম।

রানার কাছ থেকে ব্যাপারটা জানার পর প্রথমে হেসেই উড়িয়ে দেন তিনি। তার ধারণা, প্রেসিডেন্টকে গোপন করে। সি.আই.এ. এ-ধরনের কোন প্ল্যান করতে পারে না। কিন্তু রানা সিরিয়াস বুঝতে পেরে তিনি সিদ্ধান্ত নেন ব্যাপারটা খোঁজ নিয়ে দেখবেন।

দিন পনেরো পর ওয়াশিংটনে আবার তার সাথে দেখা করে রানা। প্রথমদিকে প্রসঙ্গটা এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করেন। অ্যাডমিরাল। কিন্তু রানা নাছোড়বান্দা বুঝতে পেরে স্বীকার করেন, হ্যাঁ, সি.আই.এ. আর জিওনিস্ট ইন্টেলিজেন্সের গোপন প্ল্যান সম্পর্কে বিস্তারিত সবই জানতে পেরেছেন তিনি। মিকোয়ান প্রজেক্ট সম্পর্কেও সব কথা তার মুখ থেকে শোনে রানা। কিন্তু সবশেষে অ্যাডমিরাল জানান, ওরা দুপক্ষই সাংঘাতিক সতর্ক, এর সাথে যে সি.আই.এ. জড়িত সেটা প্রমাণ করা এক কথায় অসম্ভব। আর প্রমাণ ছাড়া সি.আই.এ-র বিরুদ্ধে তিনি প্রেসিডেন্টের কাছে রিপোর্ট করতে পারেন না।

অথচ রাশিয়াকে সাবধান করা দরকার।

অ্যাডমিরাল জানিয়ে দিলেন, সে দায়িত্বও তিনি নিতে পারেন না। বাংলাদেশ কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স ইচ্ছে করলে কে.জি.বি-র। সাথে যোগাযোগ করতে পারে।

কিন্তু প্রমাণ ছাড়া কে.জি.বি-ই বা বি.সি.আই-এর কথা। বিশ্বাস করবে কেন?

প্রমাণ সংগ্রহের চেষ্টা চলল। ইসরায়েলি পাইলটের নাম-ধাম, চেহারা, তার ট্রেনিং, টাইম শিডিউল ইত্যাদি নিশ্চই কোন ফাইলে লেখা আছে। সেই ফাইলটা বি. সি. আই-এর দরকার।

ওয়াশিংটন গিয়ে জর্জ হ্যামিলটনের সাথে দেখা করলেন মেজর জেনারেল রাহাত খান। তিন দিন আলোচনার পর অ্যাডমিরাল বি.সি.আই-কে সাহায্য করতে রাজি হলেন। বললেন, তিনি চান ইসরায়েলের এই অপারেশন ব্যর্থ হোক, কিন্তু। সি.আই.এ-র বিরুদ্ধে সরাসরি কিছু করা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। তিনি গোপনে বি.সি.আই-কে সাহায্য করবেন-তবে প্রেসিডেন্টের। কাছে ব্যাপারটা গোপন রাখবেন না। সি.আই.এ. যে এর সাথে জড়িত, সেটা প্রেসিডেন্টকে জানানো হবে না। শুধু জিওনিস্ট ইন্টেলিজেন্সের কথা বলা হবে।

এ-সবের আগে বি.সি.আই. হেডকোয়ার্টারের নির্দেশ পেয়ে। ইউরোপে এসে কে.জি.বি-র একজন গুরুত্বপূর্ণ এজেন্টের সাথে দেখা করল রানা। জিওনিস্ট ইন্টেলিজেন্স আর সি.আই.এ-র। ষড়যন্ত্র সম্পর্কে সব কথা খুলে বলা হলো তাকে। রানা অনুরোধ। করল, ব্যাপারটা এখুনি তুমি তোমার হেডকোয়ার্টারকে জানাও। কিন্তু কে.জি.বি. এজেন্ট হেসেই অস্থির। তার ধারণা রাশিয়া থেকে মিগ-৩১ চুরি করে আনা দুনিয়ার কারও পক্ষেই সম্ভব নয়। এ-ধরনের একটা ভুয়া তথ্য নিয়ে তার কাছে আসার জন্যে রানাকে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করতেও ছাড়ল না সে।

এরপর মেজর জেনারেল রাহাত খান নিজেই রাশিয়াকে সাবধান করার দায়িত্ব নিলেন। অনেক চেষ্টা-তদবির করার পর একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট হলো। রুমানিয়ার রাজধানীতে দুই ইন্টেলিজেন্স চীফ মুখোমুখি বসলেন। আগাগোড়া সব ব্যাখ্যা করে বললেন মেজর জেনারেল রাহাত খান। শুধু জর্জ হ্যামিলটনকে বাদ রাখলেন প্রসঙ্গ থেকে।

গভীর মনোযোগের সাথে সব শুনলেন কে.জি.বি. চীফ উলরিখ বিয়েগলেভ। রাহাত খান যতক্ষণ কথা বললেন, এক চুল নড়লেন না পর্যন্ত। রাহাত খান থামার পরও অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন ভদ্রলোক। মনে হলো, কার ওপর যেন রাগ হয়েছে তার। তারপর, ধীরে ধীরে তার চেহারা থেকে রাগের ভাব দূর হয়ে গেল। রাহাত খানকে তিনি হাভানা চুরুট অফার করলেন। ধন্যবাদ বলে পাইপ ধরালেন রাহাত খান। প্রতিক্রিয়ার জন্যে অপেক্ষা করছেন তিনি।

চুরুট ধরালেন কে.জি.বি. চীফ। তারপর রাহাত খানের ব্যক্তিগত কুশলাদি জানতে চাইলেন। বৈঠক এরপরও পনেরো মিনিট চলল বটে, কিন্তু প্রসঙ্গে আর ফিরে এলেন না উলরিখ বিয়েগলেভ। অপমানিত বোধ করলেন রাহাত খান। হোটেল থেকে সরাসরি এয়ারপোর্টে চলে এলেন। যান্ত্রিক গোলযোগের কারণে প্লেন আধঘণ্টা লেট হবে শুনে লাউঞ্জে অপেক্ষা করছেন। তিনি। পনেরো মিনিট পর একজন মেসেঞ্জার এল, রাহাত খানের হাতে একটা এনভেলাপ ধরিয়ে দিয়ে চলে গেল সে। এনভেলাপের ভেতর থেকে কে.জি.বি. চীফের নিজের হাতে লেখা একটা চিরকুট বেরুল-সংশ্লিষ্ট সবার জন্যে চ্যালেঞ্জ রইল, মিকোয়ান প্রজেক্টে একটা পিঁপড়েও ঢুকতে পারবে না। গোটা প্রজেক্ট দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ ইন্টেলিজেন্স কে.জি.বি. পাহারা দিচ্ছে, আমাদের চোখ ফাঁকি দেয়া খোদ শয়তানের পক্ষেও সম্ভব নয়। সিংহকে ইঁদুরের ভয় দেখানো, হাস্যকর নয় কি?

এতকিছুর পরও আবার বাংলাদেশ মন্ত্রী পর্যায়ে সোভিয়েত প্রশাসনের সাথে যোগাযোগ করে। কিন্তু এবারও কোন লাভ হয়। না। বাংলাদেশকে জানিয়ে দেয়া হয়, বি.সি.আই. যে তথ্য দিতে। চাইছে সেটা ভুয়া। তাছাড়া, রাশিয়ায় ঢুকে মিগ-৩১ চুরি করা, এ শুধু বদ্ধ পাগলই চিন্তা করতে পারে। ইত্যাদি ইত্যাদি।

উপকার করতে চাইছে, বিনিময়ে একটা ধন্যবাদ পর্যন্ত পেল। বি.সি.আই.।

ইতোমধ্যে জিওনিস্ট ইন্টেলিজেন্স হেডকোয়ার্টার থেকে সেই গুরুত্বপূর্ণ ফাইলের ফটো কপি বের করা গেছে। ওদের প্ল্যান। সম্পর্কে বিস্তারিত সবই এখন জানে বি.সি.আই.। ব্যাপারটা কাকতালীয় সন্দেহ নেই, কিন্তু ইসরায়েলি পাইলট পিটি ডাভের বয়স, গায়ের রঙ, চুলের ধরন, চোখের রঙ, দৈর্ঘ্য ইত্যাদি হুবহু। প্রায় মাসুদ রানার মত। এই মিল আশীর্বাদ হয়ে দেখা দিতে পারে। বিষয়টা নিয়ে জর্জ হ্যামিলটনের সাথে বিস্তারিত আলাপ করেছে রানা।

.

পরিস্থিতি পর্যালোচনা।

ইসরায়েল এক অশুভ শক্তি। এই রাষ্ট্রের হাতে এয়ারকিং থাকলে মুসলিম বিশ্ব, বিশেষ করে মধ্য প্রাচ্যের দেশগুলো ভয়ঙ্করভাবে কোণঠাসা হয়ে পড়বে। যা-খুশি তাই করবে তখন ইসরায়েল, টু শব্দটি করার সাধ্য থাকবে না কারও।

কে.জি.বি-র গোয়ার্তুমি অসহ্য। ওরা ভাবছে ওদের বিরুদ্ধে। ষড়যন্ত্র সম্ভব, এটা স্বীকার করলেও ওদের মান যাবে। কারও কোন কথায় কান দিতে তারা নারাজ।

কেউ চ্যালেঞ্জ করলে সেটা গ্রহণ করা অন্যায় নয়। কে.জি.বি-র চ্যালেঞ্জ ইচ্ছে করলে বি.সি.আই. গ্রহণ করতে পারে।

পিটি ডাভের জায়গায় রানাকে বিলিয়ারস্ক-এ পাঠানো সম্ভব বলে মনে হয়। কিন্তু মিগ চালাবার অভিজ্ঞতা থাকতে হবে রানার।

জর্জ হ্যামিলটন কথা দিয়েছেন, ওর ট্রেনিঙের ব্যবস্থা করা তেমন কঠিন হবে না।

.

সিদ্ধান্ত।

এখনও কোন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি, কাজেই ফাইলে এব্যাপারে কিছু লেখাও হয়নি।

ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চেয়ারে হেলান দিলেন রাহাত খান। কপালের পাশে রগটা আবার একবার লাফিয়ে উঠল। চোখ বুজে ধ্যানমগ্ন হলেন তিনি। এবার নিয়ে পর পর তিনবার গোটা ফাইলটা প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত পড়েছেন, কিন্তু তবু মনস্থির করতে পারছেন না।

তিন মিনিট পর চেয়ার ছেড়ে দাঁড়ালেন রাহাত খান, নিভে যাওয়া চুরুট ধরিয়ে কার্পেটের ওপর পায়চারি শুরু করলেন। মনে মনে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়ে গেছে, তার জিওনিস্ট ইন্টেলিজেন্স আর

সি.আই. এ-র অপারেশন ব্যর্থ করে দিতে হবে। কিভাবে ব্যর্থ করা সম্ভব, তা-ও তিনি জানেন। দ্বিধায় ভুগছেন সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত একটা কারণে।

কারণটা হলো মাসুদ রানা।

ওকে তিনি ভালবাসেন বললেও সবটা বলা হয় না। হে করেন বললেও কোথায় যেন অসম্পূর্ণ থেকে যায়। তাঁর নিজের সন্তান নেই, বোধহয় সেজন্যেই মাঝেমধ্যে এই প্রশ্নটা নিজেকে করেন তিনি, আমার সন্তান থাকলে আমি কি তাকে রানার চেয়ে বেশি ভালবাসতাম?

কিন্তু রানাকে তিনি যতটা ভালবাসেন তারচেয়ে বেশি। ভালবাসা কোথায় ধরে, তার জানা নেই।

ওকে কি তিনি ভুল করে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছেন? যে দায়িত্ব সি.আই.এ-র মত একটা প্রতিষ্ঠানকে দিতে সাহস পাননি মার্কিন প্রেসিডেন্ট, সেই দায়িত্ব একা রানার ওপর চাপিয়ে দেয়া কি ওকে খুন করারই নামান্তর নয়?

আজ তিন দিন ধরে এই দ্বিধায় ভুগছেন রাহাত খান। ফলে সিদ্ধান্ত লিখতে দেরি হচ্ছে।

বি.সি.আই-এ আরও অনেক এজেন্ট রয়েছে, তাদের অনেকেই রানার চেয়ে কম যোগ্য নয়। কিন্তু বাঘের খাঁচায় কাউকে পাঠাতে হলে রানার কথাই মনে পড়ে সবার আগে। কঠিন কাজ? তাহলে রানাকে ডাকো, ও-ই পারবে। এটা স্রেফ একটা অনুভূতি, আর কিছু নয়। নাকি আরও কিছু?

এই অনুভূতি তার মনের শক্তি আর সাহস শতগুণ বাড়িয়ে দেয়। মাঝেমধ্যে হাতে এমন এক-আধটা কাজ আসে যখন এই অতিরিক্ত শক্তি আর সাহস তাঁর দরকার হয়ে পড়ে।

এবারকার কাজটা সেরকম। কাজেই, পাঠালে মাসুদ। রানাকেই।

দ্বিধা? পায়চারি থামিয়ে আপনমনে হাসলেন মেজর জেনারেল। দ্বিধা কেন! পিটি ডাভ তার কাজে সফল হবে এব্যাপারে শতকরা একশো ভাগ নিশ্চিত হয়েছেন তিনি। সেই ভয়েই তো তিনি জিওনিস্ট ইন্টেলিজেন্সকে বাধা দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। পিটি ডাভকে সি.আই.এ-ও সাহায্য করছে। এখন যদি ডাভের জায়গায় রানা যায়, আর কেউ যদি সেটা টের না পায়, কেন রানা ব্যর্থ হবে?

সন্দেহ নেই রানাকে তিনি বাঘের খাঁচায় পাঠাচ্ছেন, কিন্তু বাঘের চোখে ধুলো দেয়ার ব্যবস্থাও তো করাই আছে।

রিভলভিং চেয়ারে এসে বসলেন রাহাত খান। খোলা ফাইলটা টেনে নিলেন সামনে। তুলে নিলেন কলম। সিদ্ধান্ত-এর নিচে লিখলেন

পিটি ডাভের জায়গায় মাসুদ রানা। একই অ্যাসাইনমেন্ট। মিগট্রেনিং নেয়ার জন্যে কালই ভার্জিনিয়ার পথে রওনা হোক ও।

তিন মাস পর।

চেরেমেতেইভো এয়ারপোর্ট। মস্কো।

ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের যাত্রীবাহী বিএসি-ওয়ান ওয়ান ওয়ানএর আরোহীরা টারমাক ধরে এগোল। মেঘলা আকাশ, ঝড়ো বাতাস বইছে। লৌহযবনিকার অভ্যন্তরে কিসের যেন ভয়ভয় রহস্য। এক লাইনে এগোচ্ছে আরোহীরা, সবার পিছু পিছু আসছে। অস্থির প্রকৃতির এক যুবক। বাতাস উড়িয়ে নিয়ে যাবে, তাই এক হাতে চেপে রেখেছে হ্যাট। অপর হাতে ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ লেখা একটা ট্র্যাভেল ব্যাগ। তার চেহারা বা পোশাক-আশাকে তেমন কোন বৈশিষ্ট্য নেই, সব মিলিয়ে অতি সাধারণ একজন মানুষ। চোখে খুব মোটা ফ্রেমের চশমা। চিকন গোঁফ। ঠাণ্ডা বাতাস লেগে লাল হয়ে উঠেছে নাক। পরনে কালো টপকোট আর কালো ট্রাউজার, পায়ের জুতো জোড়াও কালো। মাঝে মাঝেই জিভের ডগা দিয়ে নিচের ঠোঁটটা ভিজিয়ে নিচ্ছে, আড়চোখে ঘন ঘন তাকাচ্ছে ডানে-বাঁয়ে। নার্ভাস, তাতে কোন সন্দেহ নেই। যেন

চুরি করতে এসে ধরা পড়ার ভয়ে তটস্থ।

কে.জি.বি. তার ফটো তুলবে। চেরেমেতেইভো মস্কোর প্রধান। এয়ারপোর্ট, ফরেন ফ্লাইটের প্রত্যেক আরোহীর ফটো তোলা হয়। এখানে। টেলিফটো লেন্সের সাহায্যে দূর থেকে করা হয় কাজটা, আরোহীরা কেউ টেরও পায় না। কখন তোলা হবে ফটো, নাকি। এরই মধ্যে তোলা হয়ে গেছে, বলতে পারবে না যুবক, তবু টারমাকের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত মাথা নিচু করে রাখল সে, ভাবটা যেন ধুলো থেকে চোখ বাঁচাবার চেষ্টা করছে।

ডিজএমবারকেশন লাউঞ্জের আকস্মিক উত্তাপ একটা ধাক্কার মত লাগল। কোটের কলার আর হ্যাট নামিয়ে চুল ব্রাশ করার। একটা ঝোক চাপল তার। কপাল থেকে চুলগুলো সরাল সে, হ্যাটটা একটু সরে যাওয়ায় সিঁথির কাছে একগোছা সাদা চুল বেরিয়ে পড়ল-এ থেকে বোঝা যায় নিজের চেহারা নিয়ে মোটেও মাথা ঘামায় না যুবক। ঠিক এই মুহূর্তে আবার তার ফটো তোলা। হলো। চঞ্চল চোখে আরেকবার নিজের চারদিকে তাকাল সে। তারপর কাস্টমস ডেস্কের দিকে এগোল। যে-কোন আন্তর্জাতিক। টার্মিনালে যা দেখা যায়, চারদিকে মানুষের অনর্গল স্রোত। উজ্জ্বল লাল-হলুদ আর কালো সিল্ক ঝলমল করে উঠল চোখের। সামনে, দশ সদস্যের আফ্রিকান এক ডেলিগেশন তার আগে আগে লাইন দিয়ে এগোচ্ছে। এশিয়ান, ইউরোপিয়ান, ওরিয়েন্টাল-কত বিচিত্র চেহারার মানুষ। জনস্রোতের একটা অংশ হয়ে গেল সে। এয়ারপোর্ট লাউঞ্জের এই পরিচিত পরিবেশ একটু যেন সুস্থির হতে সাহায্য করল তাকে। যদিও চেহারায় ক্লান্তির ভাব থেকেই গেল।

জানে, কাস্টমস অফিশিয়ালদের পিছনে যারা দাঁড়িয়ে রয়েছে ওরা সবাই সিকিউরিটির লোক-নির্ঘাত কে.জি.বি.। ডিটেকটরের। দুই স্ক্রীনের মাঝখানে হাতের ব্যাগটা রাখল সে, কনভেয়ার  বেল্টের সাথে তার অন্যান্য লাগেজও চলে এল। এক চুল নড়ল না সে, এরপর কি হবে জানা আছে। কাস্টমস্ অফিসারদের পিছন থেকে একজন লোক, চেহারায় নির্লিপ্ত ভাব, এগিয়ে এসে বেল্ট থেকে সুটকেস দুটো হ্যাঁচকা টান দিয়ে তুলে নিল। এই হ্যাঁচকা টান, এর কোন দরকার ছিল না। মনে মনে শঙ্কিত হলো যুবক।

কে.জি.বি. এজেন্টের দিকে দ্বিতীয়বার আর তাকালই না সে। চেয়ে আছে কাস্টমস অফিসারের দিকে। কিন্তু না দেখেও বুঝতে পারছে, কে.জি.বি-র লোক দুজন অত্যন্ত ব্যস্ততা ও উত্তেজনার সাথে তল্লাশী চালাচ্ছে তার সুটকেসে। এলোমেলো করা হচ্ছে। কাপড়চোপড়, অযত্নের সাথে হাতড়ে কি যেন খুঁজছে তারা।

কাস্টমস্ অফিসার তার কাগজ পত্র চেক করল। কাউন্টারের শেষ মাথায় রয়েছে কন্ট্রোলার, এবার তার কাছে চলে গেল ওগুলো। ওদিকে সুটকেস হাতড়ানো আরও দ্রুতগতিতে চলছে, কে.জি.বি. এজেন্টদের চেহারা থেকে নির্লিপ্ত ভাব অদৃশ্য হয়েছে, এখন সেখানে রাগ আর বিস্ময়-কেউ যেন মস্ত একটা ঠক দিয়েছে তাদের।

অফিসার জানতে চাইল, মি. লিরয় পামার? মস্কোয় আপনার কি কাজ?

খুক করে কাশি দিল যুবক, বলল, আমার কাগজেই তো রয়েছে, আমি গোল্ডেন প্লাস্টিক কোম্পানীর এক্সপোর্ট এজেন্ট। হেড অফিস, গার্ডেন সিটি…।

হ্যাঁ, তা তো দেখতেই পাচ্ছি, বলল কাস্টমস অফিসার। আহাম্মক বনে গিয়ে বিড়বিড় করছে কে.জি.বি. এজেন্টদের একজন, ঘন ঘন তার দিকে তাকাল অফিসার। আপনি…দেখতে পাচ্ছি, গত দুবছরে, আপনি বেশ কয়েকবার সোভিয়েত ইউনিয়নে এসেছেন, মি. পামার?

হ্যাঁ, একটু ক্ষোভের সাথে বলল যুবক। কিন্তু কোনবারই এই ঝামেলায় পড়তে হয়নি আমাকে। সন্ত্রস্ত নয়, বিস্মিত দেখাল। তাকে।

সেজন্যে আমি দুঃখিত, মি. পামার, বলল অফিসার। কে.জি.বি. এজেন্ট দুজন নিচু গলায় নিজেদের মধ্যে কথা বলছে, কিছুই শুনতে পেল না যুবক। ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের আর সব আরোহীরা ইতোমধ্যে গেট পেরিয়েছে, প্যাসেঞ্জার লাউঞ্জে ছড়িয়ে পড়ছে তারা। এখানে শুধু একা আটকা পড়েছে যুবক।

আমার কাগজ-পত্র সব ঠিক আছে, বলল সে। লন্ডনে সোভিয়েত দূতাবাসের ট্রেড অ্যাটাশে নিজে ওগুলোয় সই করেছেন। ক্ষীণ একটু অস্বস্তি ধরা পড়ল তার কণ্ঠস্বরে, যেন এই ঠাট্টার কোন অর্থ বুঝতে পারছে না সে। এর কোন মানে হয়? কাপড়-চোপড় এভাবে তছনছ করার? জানতে পারি, কি খুঁজছেন ওঁরা?

একজন কে.জি.বি. এজেন্ট এগিয়ে এল। লালচে চুল কপাল থেকে সরিয়ে তার দিকে সরাসরি তাকাল যুবক, হাসি হাসি করল। মুখের চেহারা। বিশালদেহী রাশিয়ান সে, চ্যাপ্টা মঙ্গোল অবয়ব, শরীরের প্রতিটি অংশ থেকে ক্ষমতা আর শক্তি ঠিকরে বেরুচ্ছে যেন। অফিসারের কাছ থেকে পাসপোর্ট আর ভিসা চেয়ে নিয়ে। পরীক্ষা করল সে। তারপর চোখ তুলে যুবকের দিকে কঠিন দৃষ্টিতে তাকাল। জানতে চাইল, কেন? মস্কোয় আবার আপনার। আসার দরকার পড়ল কেন, মি.-পামার?

পামার, হা। আমি একজন ব্যবসায়ী-এক্সপোর্টার।

কে.জি.বি. এজেন্টের ঠোঁট বেঁকে গেল, যেন নিঃশব্দে ব্যঙ্গ করছে? সোভিয়েত ইউনিয়নে কি এক্সপোর্ট করতে চান আপনি?

প্লাস্টিক গুডস-খেলনা, কাপপিরিচ, এইসব।

যে-সব আবর্জনা আপনি বিক্রি করেন, তার নমুনা কোথায়?

আবর্জনা! দেখুন…

আপনি ইংরেজ, মি. পামার? কিন্তু আপনার কথার সুর…ওটা ইংলিশ নয়। কেন?

আমার জন্ম জ্যামাইকায়…

আপনাকে দেখে তো মনে হয় না আপনি একজন জ্যামাইকান।

যতটা সম্ভব ইংরেজ সাজতে চেষ্টা করি আমি, বলল যুবক। বিদেশে ব্যবসা করতে তাতে সুবিধে হয়।

বুঝলাম না।

আপনারা আমার লাগেজ সার্চ করছেন কেন?

কে.জি.বি. এজেন্টকে মুহূর্তের জন্যে বিমূঢ় দেখাল, এধরনের কোন প্রশ্ন আশা করেনি সে। সেটা জানার আপনার কোন দরকার নেই, রাগের সাথে বলল সে। মনে রাখবেন, সোভিয়েত ইউনিয়নে আপনি একজন ভিজিটর। ছো দিয়ে সুটকেস থেকে একটা ট্রানজিস্টর রেডিও তুলে নিল সে, যুবকের নাকের সামনে তুলে ঘড়ির পেন্ডুলামের মত দোলাল দুবার, কর্কশ সুরে জানতে চাইল, এটা কেন? মস্কোয় বসে আপনার দেশের উদ্ভট প্রোগ্রাম এটায় তো শোনা যাবে না!

আহত বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকল যুবক।

হঠাৎ রেডিওর পিছনের ঢাকনিটা খুলে ফেলল এজেন্ট।

পকেটে ঢোকানো যুবকের হাত দুটো শক্ত মুঠো হয়ে গেল।

রেডিওর ভেতরটা পরীক্ষা করে দেখল এজেন্ট। হতাশ দেখাল তাকে। রেডিও আর পাসপোর্ট কাউন্টারের ওপর রাখল সে, স্পষ্ট হুমকির সুরে বলল, ঠিক আছে!

চোয়াল উঁচু হয়ে উঠল যুবকের। কাউন্টার থেকে পাসপোর্ট তুলে নিয়ে কোটের ব্রেস্ট পকেটে রাখল, রেডিওটা ঢুকল সাইড পকেটে। অপর এজেন্ট তার সুটকেস দুটো বন্ধ করল, কাউন্টার থেকে ফেলে দিল তার পায়ের কাছে। একটা সুটকেসের তালা খুলে গেল, ছিটকে বেরিয়ে এল কয়েক জোড়া শার্ট আর মোজা। হাঁটু মুড়ে বসে ওগুলো আবার সুটকেসে ভরল যুবক। এজেন্ট দুজন নিজেদের মধ্যে হাসাহাসি করছে। সুটকেস বন্ধ করে সিধে হলো যুবক, লম্বা চুল নেমে এসে দৃষ্টিপথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। নাকের ডগায় নেমে আসা চশমাটা ঠিক জায়গায় বসাল সে। সুটকেস দুটো দুই হাতে নিয়ে, ব্যাগটা বগলে, ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াল। তাকে অপমান করা হয়েছে, সেজন্যে সে ক্ষুন্ন-অন্তত। চেহারায় সে-ভাবটুকুই ফুটে আছে। এই অভিনেতা আসলে মাসুদ রানা।

কাউন্টারের পিছনে, দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ছিল আরেকজন লোক। এ-ও কে.জি.বি, কিন্তু ওদের দুজনের চেয়ে বড় পদের। অফিসার। যুবক যতক্ষণ কাউন্টারের সামনে ছিল, মুহূর্তের জন্যেও তার ওপর থেকে চোখ সরায়নি সে। যুবক পিছন ফিরতেই তিনজন জড়ো হয়ে উত্তেজিতভাবে ফিসফাস শুরু করল।

রানা জানে, ওরা নিশ্চই সেকেন্ড চীফ ডাইরেক্টরেট পার্সোনেল-সম্ভবত ফার্স্ট সেকশন, সেভেনথ ডিপার্টমেন্ট। অ্যামেরিকান, ব্রিটিশ আর ক্যানাডিয়ান ট্যুরিস্টদের ওপর কড়া নজর রাখাই ওদের কাজ।

প্যাসেঞ্জার লাউঞ্জ থেকে বেরিয়ে এল রানা। হাতের সুটকেস আর বগলের ব্যাগ ফুটপাথে নামিয়ে রাখল। লাইন থেকে বেরিয়ে এসে ওর সামনে থামল কালো একটা ট্যাক্সি। মস্কোভা হোটেল, বলল ও।

মাথা ঝাঁকাল ড্রাইভার। বাতাসে উড়ে যাবার ভয়ে হ্যাটে হাত চাপা দিয়ে রেখেছে রানা, তাড়াতাড়ি উঠে বসল ট্যাক্সিতে। লক্ষ। করল গাড়িতে লাগেজ তুলতে অযথা বেশি সময় নিচ্ছে ড্রাইভার। আপনমনে হাসল ও।

হ্যাট খুলে ট্যাক্সির এক কোণে হেলান দিয়ে বসল রানা। ভিউ মিররে তাকিয়ে দেখল, সেই প্রকাণ্ডদেহী কে.জি.বি. এজেন্ট কালো একটা সিডান-এ চড়ছে। ট্যাক্সি ছেড়ে দিল ড্রাইভার। পিছু নিল সিডান।

এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে মটরওয়েতে চলে এল ট্যাক্সি। এই মটরওয়ে দক্ষিণ-পুব দিক ধরে এগিয়ে মস্কোর মাঝখানে লেনিনগ্রাদ এভিনিউ-এ মিশেছে। একবারও পিছন ফিরে তাকাল না রানা। জানে, কালো সিডান আসছে পিছু পিছু।

খানিকটা স্বস্তি বোধ করছে রানা। লিরয় পামার তার প্রথম পরীক্ষায় উতরে গেছে। ঘামছে ও, কারণ ট্যাক্সির ভেতর হিটার রয়েছে। অপরাধী, অস্থির একজন লোকের অভিনয় করতে হয়েছে ওকে-কিন্তু মনে মনে স্বীকার করল, কিছুটা সত্যি নার্ভাস হয়ে পড়েছিল ও। ওর জন্যে ওটা একটা পরীক্ষা ছিল, ফেল মারলে সব ভেস্তে যেত। কে.জি.বি. এজেন্ট আর কাস্টমস অফিসাররা আগে থেকেই যাকে ভাল করে চেনে, তার ভূমিকায় অভিনয় করতে হয়েছে ওকে। কোথাও একটু অমিল দেখলেই ট্র্যাক করে ধরত। শুধু পামারের পোশাক, চশমা, চুল আর গোঁফ নয়, তার হাত-পা আর মুখ নাড়ার ভঙ্গি, উচ্চারণ বৈশিষ্ট্য অনুকরণ করতে হয়েছে ওকে। কটুগন্ধী আফটারশেভ লোশন মাখতে হয়েছে, কারণ পামার মাখে। দুদিন দাঁত না মেজে অপরিষ্কার রাখতে হয়েছে, কারণ পামার তার দাঁত মাজে না। চেহারায় চাপা একটা অস্থিরতা দেখাতে হয়েছে, পামারও তাই দেখিয়ে থাকে।

লিরয় পামার হিসেবে মস্কোয় আসার কথা পিটি ডাভের। ডাভ এখন রানা এজেন্সীর লন্ডন শাখার ছেলেদের হাতে। ওরা। তাকে জামাই আদরে রাখবে, কিন্তু চারদেয়ালের ভেতর থেকে। বাইরে যেতে দেবে না একবারও, যতদিন না রাশিয়া থেকে বেরিয়ে যায় রানা।

পিটি ডাভ যাতে নির্বিঘ্নে রাশিয়ায় ঢুকতে পারে তার জন্যে। জিওনিস্ট ইন্টেলিজেন্স চমৎকার একটা পরিকল্পনা করেছিল। তাদের এই পরিকল্পনার বয়স প্রায় দুবছর। দুবছর ধরে বার। কয়েক রাশিয়ায় আসা-যাওয়া করে একটা কাভার তৈরি করছিল পামার, যে কাভার ব্যবহার করার কথা পিটির। পিটির সাথে পামারের দৈহিক গড়নের অমিল প্রায় নেই বললেই চলে। এব্যাপারে পিটির সাথে রানারও কোন অমিল সহজে চোখে পড়ার নয়।

লিরয় পামার একজন স্মাগলার। অদূর ভবিষ্যতে ড্রাগস্মাগলিঙের সাথে জড়িয়ে পড়তে পারে সে, অত্যন্ত সতর্কতার সাথে কে.জি.বি. অফিসারদের মনে এই সন্দেহ ঢুকিয়ে দেয়া হয় বছরখানেক আগে। সেই থেকে পামারের ওপর সতর্ক নজর রাখা হয়-তবে এবারের মত এত প্রকাশ্যে তাকে বিরক্ত করা হয়নি। কখনও। কে জানে, রানা ভাবল, জিওনিস্ট ইন্টেলিজেন্স হয়তো কৌশলে কে.জি.বি-কে জানিয়ে দিয়েছিল, পামারের সুটকেসে কিছু পাওয়া যাবে। গবেট লোকটা যেভাবে ওর সুটকেস দুটো হাতড়াল, দেখে মনে হলো কিছু পাওয়া যাবে এ যেন সে জানত।

কিন্তু পায়নি। আর পায়নি বলেই তাকে অনুসরণ করা হচ্ছে।

মিলছে না, ভাবল রানা। পিটি ডাভ নিরাপদে মস্কোভা হোটেলে পৌঁছুবে, এটাই চাইবে জিওনিস্ট ইন্টেলিজেন্স। কে.জি.বি. এজেন্ট তাকে অনুসরণ করবে, এটা তারা চাইতে পারে না। তাহলে? পামারের সুটকেসে কিছু পাওয়া যাবে, এই খবর কোত্থেকে পেল কে.জি.বি.?

মস্কোয় পা দেয়ার পর কি হবে না হবে, তার প্রায় কিছুই জানানো হয়নি পিটি ডাভকে। কাজেই রানাও কিছু জানে না। কে। জানে, ভাবল ও, হয়তো জিওনিস্ট ইন্টেলিজেন্স চেয়েছে পিটির পেছনে কে.জি.বি. লাগুক। এর পেছনে তাদের হয়তো অন্য কোন উদ্দেশ্য আছে।

অস্বস্তি আর সেইসাথে খানিকটা অসহায় বোধ করল রানা। নিরাপত্তার জন্যে কি ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে তা না জানা, এরচেয়ে বিপজ্জনক আর কিছু নেই। কিন্তু করার কিছু নেইও, জিওনিস্ট ইন্টেলিজেন্সের হাতের পুতুল সে, যেমন নাচাবে তেমনি নাচতে হবে ওকে। নিরাপত্তার আয়োজন আর পরিকল্পনায় ওরা যদি কোন ভুল করে থাকে, সেটা সংশোধনের কোন সুযোগ পাবে না ও।

দুতরফের চোখে ধরা পড়ার ভয় রয়েছে ওর। কে.জি.বি-কে

সতর্ক করে দেয়া হয়েছে, বিলিয়ারস্ক থেকে মিগ-৩১ চুরি করার জন্যে একজন ইসরায়েলি পাইলট রাশিয়ায় ঢুকবে। এই পাইলটকে ধরার জন্যে কে.জি.বি. চেষ্টার কোন ত্রুটি করবে না। আরেক পক্ষ হলো, সি.আই.এ. আর জেড. ই-র মিলিত স্পাই রিঙ। ও যে পিটি ডাভ নয় তা যদি ওরা বুঝতে পারে, স্রেফ খুন হয়ে যাবে ও। ভরসা এইটুকু যে স্পাই রিঙের রাশিয়ান ইহুদি বা সি.আই.এ. এজেন্টরা কেউ কোনদিন পিটি ডাভকে দেখেনি। তবে পিটি ডাভের চেহারার বর্ণনা, অভ্যেস, চরিত্র, স্বভাব, আচরণ ইত্যাদি সম্পর্কে সব জানিয়ে সাবধান করা আছে তাদেরকে। কাজেই, বিপদ যে কোন দিক থেকে আসবে বলা কঠিন।

ট্যাক্সি ছুটছে, ডান দিকে খিমকি রিজারভয়ার। দ্রুতগতি কালো মেঘের নিচে বিপুল জলরাশি, দেখে মনে হলো অমঙ্গলের হিম-শীতল ছায়া। খানিক পরই সাজানো গোছানো শহুরে পরিবেশের ভেতর ঢুকে পড়ল ওরা। জানালা দিয়ে বাঁ দিকে তাকাল রানা, ডায়নামো স্টেডিয়ামকে পাশ কাটাল ট্যাক্সি।

পিটি ডাভ একজন পাইলট, স্মরণ করল রানা, স্পাই নয়। সি.আই.এ. হেডকোয়ার্টারে মিগ-২৫ চালাবার ট্রেনিং পেয়েছে সে, এসপিওনাজ সম্পর্কেও কিছু কিছু জ্ঞানদান করা হয়েছে তাকে, কিন্তু একজন স্পাইয়ের নির্লিপ্ত, ঠাণ্ডা ভাব তার মধ্যে আনা যায়নি। এ-সব তথ্য তেল আবিব থেকে চুরি করা ফাইলে পেয়েছে রানা। পিটির দুর্বলতা সম্পর্কে তাতে বিশদ লেখা। আছে। ও জানে পিটির দুর্বলতাগুলো ওর আচরণেও প্রকাশ পাওয়া চাই। তা না হলে বিপদে পড়বে ও।

মেজর জেনারেলের কথা মনে পড়ল ওর। ওকে এই যমের। বাড়ি পাঠাবার ব্যাপারে তাঁর দ্বিধাদ্বন্দ্ব আঁচ করতে পেরেছিল ও। আলোচনার মাঝখানে, এক সময়, ওর নিজের মনেও ক্ষীণ একটু সংশয় দেখা দিয়েছিল-এ কি সম্ভব? খোদ রাশিয়া থেকে ওদের একটা সাত রাজার ধন চুরি করে নিয়ে বেরিয়ে আসা?

আরও মনে হয়েছিল, বুড়ো কি আমাকে জেনেশুনে মরতে পাঠাচ্ছে?

কিন্তু তারপর সমস্ত সংশয় আর দ্বিধা কোথায় ভেসে গেল, রোমাঞ্চের হাতছানি পাগল করে তুলল ওকে। খাঁচায় ঢুকে হিংস্র। বাঘকে খুঁচিয়ে উত্তেজিত করে তুলতে হবে, কেড়ে আনতে হবে। তার আহার। এত বড় চ্যালেঞ্জ খুব কমই এসেছে তার জীবনে।

এয়ারকিং। মিকোয়ান মিগ-৩১। সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ যুদ্ধবিমান। চুরি করে নিয়ে যাবে ও বাংলাদেশে।

রানার গায়ে কাঁটা দিল।

.

দযেরঝিনস্কি স্ট্রীট। কে.জি.বি. হেডকোয়ার্টার।

কর্নেল সাসকিন তার অফিসে পায়চারি করছে। এম ডিপার্টমেন্টের হেড সে, মিকোয়ান প্রজেক্টের সিকিউরিটি চীফ। পাঁচ বছর আগে এই দায়িত্ব নেয়ার সময় তার মাথায় ছিল ঘন। কালো ঝাকড়া চুল, এখন সেখানে মস্ত এক টাক পড়েছে, চুল যা আছে বেশিরভাগ সাদা। তার বয়স বিয়াল্লিশ, ছয় ফিটের মত লম্বা, চওড়া হাড়, কোথাও এক ছটাক মেদ জমেনি। অত্যন্ত খুঁতখুঁতে লোক, কিন্তু শান্ত প্রকৃতির। কৌশলী আর তীক্ষ্ণ বুদ্ধির অধিকারী বলে সুনাম আছে ডিপার্টমেন্টে।

পায়চারি করছে কর্নেল, আর ভাবছে। মিগ-৩১-এর টেস্টফ্লাইটের সময় ঘনিয়ে এসেছে। একেবারে শেষ পর্যায়ে পৌঁছে সন্দেহ জাগছে মনে। তার সিদ্ধান্তগুলো কি সঠিক ছিল?

বিলিয়ারস্কে ফুটো আছে, অনেক দিন থেকেই জানে সে। কোইভিসতু, করনিচয় আর ইসরাফিলভ, এরা বেঈমান, ঘরের শত্রু বিভীষণ। মুদি মোলায়েভ সম্পর্কেও জানে সে। এই লোকটাই তথ্য আনা-নেয়া করে। এত লম্বা সময় ধরে এই মিগ ৩১ তৈরি হচ্ছে, কে.জি.বি-র চোখে ওদের ধরা না পড়ে উপায় ছিল না।

কিন্তু ওদের ব্যাপারে সে বা তার ডিপার্টমেন্ট কিছুই করেনি। শুধু সিকিউরিটি সিস্টেম আরও জোরদার করা হয়েছে, বাড়ানো হয়েছে কড়াকড়ির মাত্রা-যাতে তথ্য পাচার প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে আসে, পালানো হয়ে ওঠে অসম্ভব, আর যাতে গোপন আলোচনার সুযোগ না থাকে।

এটা এক ধরনের জুয়া খেলা, প্রথম থেকেই জানত কর্নেল সাসকিন কোইভিসতু, করনিচয় আর ইসরাফিলভ মিকোয়ান প্রজেক্টের তিন অমূল্য রত্ন, এদেরকে সরাবার পরামর্শ দিতে সাহস হয়নি তার। তার পরামর্শ গ্রহণ করা হত বলেও মনে হয় না। আরও একটা ভয় ছিল, ওদেরকে সরিয়ে দিলে জিওনিস্ট ইন্টেলিজেন্স বা সি.আই.এ. মিকোয়ান প্রজেক্টের অন্য আরেক দল লোককে স্পাই হিসাবে কাজে লাগাবে। এদেরকে তবু তো চেনে, তাদের অস্তিত্ব সম্পর্কে কিছু জানারও হয়তো সুযোগ হবে না তার। অচেনা শত্রুর চেয়ে চেনা শত্রু ভাল, তখন অন্তত তাই মনে হয়েছিল। তার সহকারী, মেজর রোমানভও তার এই ধারণা সমর্থন করে।

কিন্তু এখন সন্দেহ হচ্ছে, সিদ্ধান্তটা কি ভুল ছিল? শত্রু পুষে রাখা কি ঠিক হয়েছে?

ব্যর্থতার মূল্য তাদের সবাইকে দিতে হবে, টেকো মাথায় হাত। বুলাতে বুলাতে ভাবল কর্নেল। সেটা যে কি রকম মূল্য, ভাবতেও বুক কাঁপে। মর্যাদা তো খোয়াতেই হবে, স্ত্রী-পুত্র-পরিবার সবার পেটে লাথি পড়বে, সেই সাথে প্রাণটাও হারাতে হতে পারে। কে.জি.বি-তে ব্যর্থতার কোন ক্ষমা নেই।

তথ্য যাই পাচার হয়ে থাকুক, মিগ-৩১-এর মার্কিন সংস্করণ তৈরির জন্যে যথেষ্ট তথ্য সি.আই.এ.পায়নি।-কথাটা ভেবে একটু। সান্ত্বনা পাবার চেষ্টা করল কর্নেল। কিন্তু তারপরই ভাবল, যদি কোন বিপদ ঘটে, তাকে জিজ্ঞেস করা হবে, জেনেশুনে একদল স্পাইকে কেন তুমি প্রজেক্টের মধ্যে থেকে কাজ করবার সুযোগ দিলে?

এই প্রশ্নের কোন জবাব দিতে পারবে না সে। দিলেও সেটা। গ্রাহ্য হবে না।

কে.জি.বি. চীফ উলরিখ বিয়েগলেভ প্রায় বছর দুয়েক আগে। তাকে বলেছিলেন, তার কাছে খবর আছে, জিওনিস্ট ইন্টেলিজেন্স। আর সি.আই.এ. নাকি বিলিয়ারস্ক থেকে একটা মিগ-৩১ চুরি করার প্ল্যান করছে। কথাটা শুনে প্রাণ খুলে হেসেছিল সে। তার হাসিতে যোগ দিয়েছিলেন চীফও। তারপর বলেছিলেন, এটা একটা ভুয়া খবর সন্দেহ নেই, তবে বিলিয়ারস্কে স্যাবোটাজের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না।

খবরটা সত্যিই কি ভুয়া ছিল? গুরুত্ব না দিয়ে কি বোকামি করা হয়েছে? স্যাবোটাজ যদি সম্ভব হয়, চুরি করা সম্ভব হবে না কেন? আর বেশি সময় নেই, সিকিউরিটি আরও কড়া করতে হবে। শেষ মুহূর্তে কোন রকম ঝুঁকি নেয়া চলে না।  

ঝনঝন শব্দে টেলিফোন বেজে উঠল। নিজের ডেস্কের দিকে এগোল কর্নেল সাসকিন।

চেয়ারে বসে পা দোলাচ্ছে, আর বসের দিকে তাকিয়ে আছে। মেজর রোমানভ। শক্ত-সমর্থ শরীর, বুকের ছাতি বিয়াল্লিশ ইঞ্চি, বলার চেয়ে শোনাতেই তার আগ্রহ বেশি, ফলে কর্মকর্তাদের প্রিয়পাত্র হতে পেরেছে। কিন্তু এই মুহূর্তে ভুরু কুঁচকে আছে তার, ভাবছে, কর্নেলকে তো এত অস্থির দেখাবার কথা নয়!

মাত্র আজ সকালেই বিলিয়ারস্কের কে.জি.বি. ইউনিটের কাছ থেকে রিপোর্ট পেয়েছে কর্নেল সাসকিন। আন্ডারগ্রাউন্ড সেলের ওপর নজর রাখার জন্যে লোকসংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। গত আটচল্লিশ ঘণ্টায় গোণার বাইরে বিলিয়ারস্কে কেউ ঢোকেনি। ছোট্ট শহরটা থেকে বেরিয়েছে শুধু মুদি ব্যাটা, মোলায়েভ। মস্কো থেকে বিলিয়ারস্কে তার ভ্যান পৌঁছুনোর সাথে সাথে সার্চ করা হয়েছে। কর্নেল নির্দেশ দিয়েছে, শহরে ঢোকা মাত্র প্রতিটি গাড়ি সার্চ করতে হবে। আর সিকিউরিটি ফেন্স পেরিয়ে ফ্যাক্টরিতে যে লাট সাহেবই ঢুকতে চাক, প্রত্যেকের পরিচয় সম্পর্কে সম্পূর্ণ নিশ্চিত হতে হবে, পরিচিত হলেও পরীক্ষা করতে হবে তার কাগজ-পত্র, সার্চ করতে হবে শরীর আর কাপড়-চোপড়। কুকুরের সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে, যাতে পেরিমিটার ফেন্সের চারদিক আরও ঘন ঘন পেট্রল দিতে পারে। হ্যাঙ্গারে সশস্ত্র গার্ডের সংখ্যাও বাড়িয়ে তিনগুণ করা হয়েছে।

আজ রাতেই কে.জি.বি. হেলিকপ্টারে চড়ে বিলিয়ারস্কে যাচ্ছে রোমানভ, বর্তমান অফিসারের কাছ থেকে সিকিউরিটি ফোর্সের দায়িত্ব বুঝে নেবে সে। বিলিয়ারস্ককে নিচ্ছিদ্র করে তুলতে মাত্র কয়েক ঘণ্টা সময় লাগবে তার। কর্নেল সাসকিন ঠিক করেছে, ফার্স্ট সেক্রেটারি আর তাঁর দলের সাথে নয়, টেস্ট-ফ্লাইটের চব্বিশ ঘণ্টা আগে বিলিয়ারস্কে পৌঁছুবে সে। চীফ উলরিখ বিয়েগলেভ সম্ভবত ফার্স্ট সেক্রেটারির সাথে ওখানে পৌঁছুবেন। টেস্ট-ফ্লাইট কয়েক ঘণ্টা বাকি থাকতে আন্ডারগ্রাউন্ড সেলের সব কজনকে গ্রেফতার করবে তারা। ফার্স্ট সেক্রেটারি পৌঁছুনোর আগেই ওদেরকে ইন্টারোগেট করা শুরু হয়ে যাবে। সন্দেহ নেই, সব দেখে পুলকিত হবেন ফাস্ট সেক্রেটারি। আর গর্বিত হাসি। দেখা যাবে চীফ উলরিখ বিয়েগলেভের মুখে। কর্নেলের সাথে পরামর্শ করে রোমানভ ঠিক করেছে, কোইভিসতু, করনিচয়, ইসরাফিলভ, মোলায়েভ আর তার স্ত্রীকে একই সময়ে গ্রেফতার করা হবে, যেখানেই তারা থাকুক না কেন। ওদের মিথ্যে নিরাপত্তাবোধ মুহূর্তে উবে যাবে কপূরের মত। কে.জি.বি-র নারকীয় নিষ্ঠুরতা কাকে বলে হাড়ে হাড়ে টের পাবে বাছাধনরা।

ক্রেডলে রিসিভার নামিয়ে রেখে তার দ্বিতীয় সহকারী মেজর বাস্কির দিকে তাকাল কর্নেল। মেজর বাস্কির মস্ত একটা গুণ, কর্মকর্তাদের মেজাজ বুঝে কথা বলতে পারে সে। অনুকরণে তার। জুড়ি মেলা ভার-বস্ হাসলে সে-ও হাসে, বস্ উদ্বিগ্ন হলে সে-ও গম্ভীর হয়, কর্তার ধমক খেলে সে-ও অধস্তনদের ধমকায়। একহারা গড়ন, চোখ দুটো সদা সতর্ক। বিলিয়ারস্কে অ্যাসিস্ট্যান্ট কে.জি.বি. সিকিউরিটি চীফ সে। প্লেনে করে আজই মস্কোয়। এসেছে, কর্নেল সাসকিনকে একটা রিপোর্ট দেয়ার জন্যে। তার মৌখিক রিপোর্ট পেয়ে খুশি হয়েছে কর্নেল, কিন্তু আরও বেশি খুশি হয়েছে মিখাইল রাভিকের লিখিত রিপোর্ট পড়ে। রাভিক। মিকোয়ান প্রজেক্টের চীফ সিকিউরিটি অফিসার।

মিকোয়ান প্রজেক্টের সিকিউরিটি ব্যবস্থা যেমন সুচারু তেমনি কড়া। শুধু পরীক্ষিত কৌশলগুলোই কাজে লাগানো হয়েছে, কারও। উর্বর মস্তিষ্কপ্রসূত কোন চমকপ্রদ আইডিয়া নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষার কোন ঝুঁকি নেয়া হয়নি। ঘর-বাড়ি বানিয়ে দেয়া হয়েছে, সপরিবারে একদল কে.জি.বি. অফিসার প্রকাশ্যে বসবাস করছে ওখানে, তাদের অধীনে রয়েছে সেকেন্ড ডাইরেক্টরি থেকে বাছাই করা স্কোয়াড। সহায়তাকারী দল হিসেবে রয়েছে বেশ কিছু জি.আর.ইউ, সোভিয়েত মিলিটারি ইন্টেলিজেন্সের সদস্য। তারা এয়ারস্ট্রিপ আর শহরে গার্ড ও পেট্রল হিসেবে দায়িত্ব পালন করে। তৃতীয় আরও একটা দল রয়েছে, এরা কে.জি.বি-র আনঅফিশিয়াল সদস্য। সাদা পোশাকে ইনফরমার আর সিভিলিয়ান স্পাই হিসেবে রিসার্চ আর ডেভেলপমেন্ট টীমের সবচেয়ে কাছে থেকে দায়িত্ব পালন করছে ওরা। তিনটে দলই আসলে চারজন লোকের ওপর নজর রাখছে। এই চারজন সম্পর্কে সব তাদের মুখস্থ।

খুক করে কাশল কর্নেল সাসকিন, অর্থাৎ সহকারীদের মনোযোগ দাবি করছে সে। প্রায় একই ভঙ্গিতে যে যার চেয়ারে নড়েচড়ে বসল মেজর রোমানভ আর মেজর বাস্কি।

শেষ মুহূর্তে আমি কোন ঝুঁকি নিতে চাই না, বলল কর্নেল। চীফ এই নিয়ে দুবার ফোন করলেন, তিনিও খুব উদ্বেগের মধ্যে আছেন। ভাবছি, ফিফথ চীফ ডাইরেক্টরেট থেকে স্পেশাল একটা ডিটাচমেন্ট ডেকে নেব কিনা। তোমরা কি বলো? ওদের সিকিউরিটি সাপোর্ট ইউনিটকে যদি ডাকি, কেমন হয়?

বিলিয়ারস্কে সশরীরে থেকে দায়িত্ব পালন করে মেজর বাস্কি, প্রস্তাবটা অপমানকর লাগল তার কাছে। বসের মেজাজ বুঝে কথা বলতে অভ্যস্ত হলেও, এই মুহূর্তে তার ব্যতিক্রম ঘটল। সে বলল, তার কোন দরকার আছে বলে আমি মনে করি না, কমরেড কর্নেল।

দরকার নেই! বিস্মিত দেখাল কর্নেল সাসকিনকে। তুমি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারো, ওখানে কোন বিপদ হবে না?

চুপ করে থাকল মেজর বাস্কি। কিন্তু কর্নেল তার দিকে চোখে প্রশ্ন নিয়ে তাকিয়েই থাকল। অগত্যা ধীরে ধীরে মাথা নাড়তে হলো বাস্কিকে। বলল, না, গ্যারান্টি দিতে পারি না।

কেউ তোমাকে তা দিতে বলছেও না, আশ্বস্ত করল কর্নেল। অধস্তনকে সহজেই নত করা গেছে, সন্তুষ্টির ক্ষীণ হাসি দেখা গেল। তার ঠোঁটে।

কতজন লোক, কর্নেল?

শখানেক। গোপনে, অবশ্যই। তবে একশোর কম নয়। ওদের যদি কোন প্ল্যান থাকে, এত লোক দেখে ভয়েই হয়তো। তাতে হাত দেবে না ওরা।

কর্নেলের মেজাজ বুঝে নিয়েছে মেজর বাস্কি, অভিযোগের সুরে বলল সে, মেজর রাভিক তো বিশ্বাসই করে না ওদের কোন প্ল্যান আছে।

হুম। হয়তো নেই। কিন্তু আমাদের ধরে নিতে হবে টেস্টফ্লাইট স্যাবোটাজ করা হবে-মিসাইল বা কামানে কারসাজি থাকতে পারে, মাঝ-আকাশে বিস্ফোরিত হতে পারে প্লেন। পরিণতি সম্পর্কে তোমাদের বলার দরকার করে না। মিগ-৩১এর প্রোডাকশন পিছিয়ে যাবে, আদৌ প্রোডাকশনে যাওয়া হবে। কিনা তাও নতুন করে বিবেচনা করা হতে পারে। আমাদের কি হবে, সেটা নাই বা ভাবলাম।

মেজর রোমানভ একটা চুরুট ধরাল। কোন ভাব নেই। চেহারায়। শুধু শুনে যাচ্ছে সে, কিছু জিজ্ঞেস না করলে মুখ খুলবে না।

টেলিফোনে পলিটিক্যাল সিকিউরিটি সার্ভিসের সাথে কথা বলো, নির্দেশ দিল কর্নেল। ওদের যারা বিলিয়ারস্কে কাজ করছে। তাদের মধ্যে থেকে সবচেয়ে বিশ্বস্ত কয়েকজনকে বাছাই করো-ফ্যাক্টরি কমপ্লেক্সের ভেতর ডিউটি দেবে তারা, বেঈমানগুলোর কাছাকাছি থাকবে। তোমার অধীনে কাজ করবে। ওরা, বাস্কি। বাস্কি মাথা ঝাঁকাল। প্রত্যেকের কাছে অস্ত্র থাকবে, কমিউনিকেটর থাকবে। এবার বলো, টেস্ট-ফ্লাইটের আগে, প্লেনে যখন অস্ত্র তোলা হবে, কোথায় থাকবে তিন বেঈমান?

নোট বুকে চোখ বুলাল মেজর বাস্কি। ওরা তিনজনই হ্যাঙ্গারের ভেতর থাকবে, কমরেড কর্নেল।

বাকি চুলগুলোও দেখছি সাদা হয়ে যাবে! হ্যাঙ্গারের ভেতর ওদের থাকা মানে বিপদের সম্ভাবনা তিনগুণ বাড়ল। খুলে বলো, মেজর।

কোইভিসতু উইপনস সিস্টেমের দায়িত্বে রয়েছে, কমরেড কর্নেল…

সে কি রাতেও এয়ারক্রাফটে কাজ করবে, টেক অফ না করা পর্যন্ত?

জ্বী, কমরেড কর্নেল।

তার কাজ আর কাউকে দিয়ে হয় না? হয় যে না তা কর্নেলও জানে।

জ্বী না।

বেশ। আর সবাই?

করনিচয় আর ইসরাফিলভ, দুজনেই নাকি মেকানিক্স হিসেবে দুর্লভ প্রতিভা, বলল মেজর বাস্কি। ফুয়েলিং সিস্টেমে, মিসাইল আর অন্যান্য অস্ত্র লোডিঙে ওরা বিশেষজ্ঞ। রিয়ারওয়ার্ড ডিফেন্স পড-এও ওদের কাজ আছে। এতদিন ওরাই সব দেখাশোনা করেছে, ওদের কাজ আর কাউকে দিয়ে করানো যাবে না।

হুঁ। নজর রাখার ব্যাপারটা?

একেবারে কাছ থেকে নজর রাখা হবে। আমাদের ইনফরমাররা সারারাত ছায়া হয়ে লেগে থাকবে ওদের সাথে।

কিন্তু স্যাবোটাজের ব্যবস্থা করা হচ্ছে কিনা বুঝতে পারবে কি? সে টেকনিক্যাল জ্ঞান তাদের আছে?

আছে, কমরেড কর্নেল।

গুড। এ-ব্যাপারে তোমার কথায় আস্থা রাখতে পারি। আর মোলায়েভ?

মুদি ব্যাটা আর তার বউ নিজেদের বাড়িতেই থাকবে…

বুঝলাম, মেজর বাস্কিকে বাধা দিল কর্নেল সাসকিন। ব্যাপারটা তাহলে এই রকম দাঁড়াল। আমাদের মিলিটারি ইন্টেলিজেন্স বিলিয়ারস্কের চারদিকে একটা বৃত্ত তৈরি করবে, সেটা টপকে ভেতরে ঢোকা কারও পক্ষে সম্ভব নয়। সিকিউরিটি। সাপোর্ট ইউনিট কাল পৌঁছুবে ওখানে। পেরিমিটার ফেন্সের কাছে গার্ডদের, হ্যাঙ্গারে ইনফরমারদের, ফ্যাক্টরিতে এজেন্টদের আর শহরে পেট্রল পার্টিদের সাহায্য করবে ওরা। তিন বেঈমানকে চোখে চোখে রাখা হবে, বিশেষ করে কোইভিসতুকে। কিছু কি বাদ দিলাম, রোমানভ?

আমার নোটবুকে সব লেখা আছে, কমরেড কর্নেল, মুখ। খুলল রোমানভ।

চেয়ারে হেলান দিল কর্নেল, হাত দুটো পরস্পরের সাথে। বাধল মাথার পিছনে। আরও সতর্কতার জন্যে, আমার মনে হয়, মস্কোয় রশির অপর প্রান্তটাও মুঠোয় নেয়া দরকার। না, আজ রাতে নয়। আটচল্লিশ ঘণ্টা আগেই যদি ওরা গায়েব হয়ে যায়, ফ্লেমিং ব্যাপারটা জেনে ফেলতে পারে, বিলিয়ারস্কের তিন বেঈমানকে সাবধান করে দেবে সে। না! কাল হলেই চলবে, তাতে করে ওরা যা জানে সব আদায় করতে অন্তত চব্বিশ ঘণ্টা। সময় পাব আমরা। এদিকটা তুমি দেখবে, রোমানভ।

দেখব, কমরেড কর্নেল। ওরা কাভার হিসেবে যে ওয়্যারহাউসটা ব্যবহার করছে, ওটার ওপর নজর রাখার জন্যে আজ রাতেই লোক পাঠাব। আপনি হুকুম করলেই ভেতরে ঢুকবে ওরা।

গুড। কাল বিলিয়ারস্কে যাবার আগে ওদের আমি দেখতে চাই। ওয়্যারহাউসের ওপর নজর রাখার জন্যে নিজেদের লোককে পাঠিয়ো না। সেভেনথ ডাইরেক্টরেটকে বলো, ওরা লোক দিয়ে সাহায্য করবে। সময় হলে আমি বলব, তখন আমাদের লোক ওদের কাছ থেকে দায়িত্ব বুঝে নেবে। তাই হবে, কমরেড কর্নেল।

.

মস্কোভা হোটেলের ঠিক উল্টোদিকে একটা পার্কিং এরিয়া, কালো সিডান থামল সেখানে।

পোর্টিকো পেরিয়ে হোটেল ফয়েই-এ ঢুকল রানা, অন্যমনস্কতার ভান করে কালো সিডানের ওপর চোখ বুলাল। সিডানের লোক দুজন ওর পিছু নিয়ে হোটেলে ঢোকেনি। আরোহী লোকটা এরইমধ্যে একটা খবরের কাগজ মেলে ধরেছে, আর সিগারেট ধরিয়েছে ড্রাইভার। ওদের এই আচরণ সতর্ক করে তুলল রানাকে, রিসেপশন ডেস্কের গায়ে ঠেস দিয়ে ফয়েই-এর চারদিকে তাকাল ও। ওর জন্যে যে লোকটা অপেক্ষা করছে, সাত সেকেন্ডের মধ্যে তাকে চিনে ফেলল রানা। চেরেমেতেইভো এয়ারপোর্ট থেকে নিশ্চই ওর ফটো দুযেরঝিনস্কি স্ট্রীটে ওয়্যারপ্রিন্টের মাধ্যমে ট্রান্সমিট করা হয়েছে, একটা কপি নিয়ে এই লোক সোজা চলে এসেছে এখানে। কে.জি.বি-র দক্ষতা সম্পর্কে জানে ও, তাই আশ্চর্য হলো না। সামান্য একজন ক্রিমিনাল হিসেবে ওকে সন্দেহ করা হচ্ছে, অথচ চোখের আড়াল না করার জন্যে কি বিপুল আয়োজন! মনে মনে ভাবল, যদি আসল পরিচয়টা টের পায় রে…!

লোকটার কোলের ওপর খোলা একটা প্রাভদা, কিন্তু চোখ দুটো ঘুমে ঢুলু ঢুলু! কারও ওপর নজর রাখার জন্যে এটা একটা ভাল কৌশল-ঘুমের ভান করা। ফয়েই-এর মাঝামাঝি জায়গায় অনেকগুলো উঁচু আসনের একটায় বসে আছে সে, ওভারকোটটা ফেলে রেখেছে সোফার হাতায়। রানা হোটেল থেকে বেরুলে এই লোক পিছু নেবে। ততক্ষণে হয়তো বাইরের গাড়ি আর এজেন্টদেরও পালাবদল ঘটবে।

কামরাটা বারোতলায়। পোর্টারকে বিদায় করে দিয়ে চশমা খুলল রানা। হ্যাটটা নামিয়ে ছুঁড়ে দিল বিছানার ওপর। মাথার চুল হাত দিয়ে এলোমেলো করল। খুলে ফেলল টাই। ছোট একটা সুইট, লম্বা জানালার সামনে দাঁড়ালে ধূলি-ঝড় আর রেড স্কয়ার দেখা যাবে। সুটকেস খুলে স্লিপার বের করল। কামরার এক কোণে একটা ড্রিঙ্কস ট্রলি, সেটা থেকে স্কচের একটা বোতল আর গ্লাস নিয়ে চলে এল সোফায়। আড়াই কি তিন পেগ হুইস্কি খেলো। ও। নিচু তেপয়ে পা তুলে ঢিল করে দিল পেশীগুলো।

পিটি ডাভ একজন ভীতু লোক। কাজেই সন্ত্রস্ত হয়ে আছে, এই ভাব দেখাতে হবে ওকে। ভয় নয়, অস্বস্তি বোধ করছে রানা। ওকে নিয়ে কি করা হবে, কিছুই ও জানে না। জানে না পিটি ডাভের নিরাপত্তা পরিকল্পনায় জেড.ই. আর সি.আই.এ. কোন ভুল করে বসে আছে কিনা।

এই পরিস্থিতি অত্যন্ত বিপজ্জনক।

কামরার চারদিকে চোখ বুলাল রানা। মস্কোভা বিলাসবহুল হোটেল, সেন্ট্রালি-হিটেড। ফরেন ডেলিগেশনগুলো বেশিরভাগ এখানেই ওঠে। আড়িপাতা যন্ত্র আছে কিনা খুঁজতে নিষেধ করা আছে। দুমুখো আয়নার উল্টোদিক থেকে কেউ ওর ওপর নজর। রাখছে কিনা জানার কোন উপায় নেই।

নিজের অজান্তেই বিশাল আয়নার দিকে চোখ চলে গেল, তারপর ধীরে ধীরে চোখ বুজল ও। অনুভূতিটা অস্বস্তি কর-সরাসরি কেউ ওর দিকে তাকিয়ে আছে ভাবতে বড় বিশ্রী লাগে।

ঘুরেফিরে বারবার সোভিয়েত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার কথা ভাবতে চাইছে ও। এয়ারকিং নিয়ে যতক্ষণ আকাশে থাকবে ও, ওর সাথে সোভিয়েত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করবে। সি.আই.এ. হেডকোয়ার্টারে মাত্র তিনমাসের ট্রেনিং পেয়েছে ও। মিগ-২৫ (এয়ারউলফ) চালাতে শিখেছে। ওকে একা ট্রেনিং নিতে দেখলে সি.আই.এ. সন্দেহ করবে, তাই ছয়টা দেশের ছয়জন পাইলটকে ট্রেনিং দেয়া হয়। অ্যাডমিরাল জর্জ হ্যামিলটনই সব ব্যবস্থা করে দেন। সি.আই.এ-কে জানানো হয়, বন্ধু কয়েকটা দেশের প্রতি শুভেচ্ছার নিদর্শন হিসেবে এই প্রোগ্রামের পরিকল্পনা করা হয়েছে। সি.আই.এ-র ওই এয়ারস্ট্রিপে মিগ-৩১ অর্থাৎ এয়ারকিঙেরও একটা ডামি তৈরি করা হয়। কোইভিসতুর পাঠানো ফটো আর বর্ণনার সাহায্যে তৈরি হয় ডামিটা। পিটি ডাভের ট্রেনিং শেষ হয়ে গিয়েছিল আগেই, তাই ডামির ওপর সি.আই.এ-র বিশেষ নজর ছিল না। এই সুযোগটাও পুরোপুরি নিয়েছে রানা। এয়ারকিঙে যখন চড়বে ও, সে-ভাগ্য যদি কখনও হয়, কন্ট্রোল-প্যানেল ওর কাছে অপরিচিত লাগবে না।

ঠাণ্ডা মাথায়, যুক্তি দিয়ে ভাবতে গেলে মানুষের অনেক কাজই অঘাতি বা পাগলামি বলে মনে হয়। বিলিয়ারস্ক থেকে এয়ারকিং নিয়ে আকাশে ওঠার পর পুব-পশ্চিম-উত্তর-দক্ষিণ যেদিকেই যাক রানা, রাশিয়ান সীমান্ত পেরোতে হলে হাজার মাইলের ওপর পাড়ি দিতে হবে ওকে। এই এক হাজার মাইল ধরে ওর পিছনে লেগে থাকবে গোটা সোভিয়েত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা।

মাথাটা হঠাৎ ঘুরে উঠল। গলা শুকিয়ে কাঠ। গ্লাসে খানিকটা হুইস্কি ঢেলে এক চুমুকে গিলে ফেলল ও। মাথা ঠাণ্ডা করে কিছুই চিন্তা করতে পারছে না। উঠে দাঁড়িয়ে চলে এল জানালার

সামনে। সব ভুলে থাকতে চায়।

বারোতলা থেকে নিচে, রেড স্কয়ারে তাকাল। সার সার পার্ক করা কয়েকশো গাড়ি। হাজার হাজার মানুষ। বৃষ্টির দেখা নেই, আকাশ ভরা মেঘ, বিরতিহীন ধূলিঝড়-শেষ বিকেলেই সন্ধে ঘনিয়ে এসেছে। হিস্টরী মিউজিয়মের ওপর দিয়ে অনেকক্ষণ ক্রেমলিনের দিকে তাকিয়ে থাকল ও। লেনিনের সমাধিও দেখা গেল, ব্রোঞ্জ-এর দরজার সামনে খুদে আকৃতির গার্ডরা পায়চারি করছে। স্কয়ারের শেষ মাথায় বিশাল সেন্ট ব্যাসিলস ক্যাথেড্রাল।

সব ভুলে থাকতে চাইলেও তা সম্ভব না। আর খানিক পরই মস্কোভা নদীর কিনারায় তিনজন লোকের সাথে দেখা করতে হবে ওকে। এদের কাউকেই ও চেনে না, পরিচয়ও জানা নেই। শুধু জানে জ্বাসনোখোলমস্কি ব্রিজে যেতে হবে ওকে, ওখানে তিনজন। লোক ওর জন্যে অপেক্ষা করবে। ডিনার সেরে তারপর হোটেল থেকে বেরুতে হবে ওকে। বাইরে বেরিয়ে ভাব দেখাতে হবে সে যেন একজন ট্যুরিস্ট, শহর দেখতে বেরিয়েছে, যে বা যারাই তার। পিছু নিক। শুধু একটা ব্যাপারে ওর কোন ভুল হলে চলবে না, নির্দিষ্ট জায়গায় ঠিক সাড়ে দশটায় পৌঁছুতে হবে ওকে। হ্যাট আর কোট সাথে নিতে হবে…না, শুধু সাথে নিলে চলবে না, পরে থাকতে হবে ওগুলো। ট্রানজিস্টর রেডিওটাও সাথে থাকবে। এথেকেই বোঝা যায়, হোটেলে আর ফিরে আসছে না ও। অর্থাৎ ক্সাসনোখোলমস্কি ব্রিজ থেকেই বিলিয়ারস্কের দিকে ওর যাত্রা হবে। শুরু।

দশটা বাজার কয়েক মিনিট বাকি থাকতে মস্কোভা হোটেলের বার থেকে লিরয় পামার বেরিয়ে এল। তার আগে, হোটেলের ডাইনিং হলে ডিনার সেরেছে ও। ডিনার খাওয়ার সময় তার ওপর নজর ছিল কে.জি.বি-র। ডাইনিং হলের এক কোণে একা একটা টেবিল আগে থেকেই দখল করে বসেছিল লোকটা। তেমন লম্বা না, তবে মোটাসোটা। ডিনার সেরে বার-এ এল সে, লোকটাও পিছু নিয়ে ঢুকল। লুকোচুরি নেই, প্রকাশ্যে তার ওপর নজর রাখছে, টেবিলে ভদকার গ্লাস। ডিনার খাওয়ার জন্যে নিচে নামার সাথে সাথে কে.জি.বি এজেন্টরা সার্চ করার জন্যে তার কামরায় ঢুকবে, ধরে নিয়েছিল রানা। সুযোগ পেলে ওর বডি সার্চ করতেও ছাড়বে না। ডিনারের সময় ওভারকোটটা খুলে রাখতে হয়েছে, কিন্তু এমন জায়গায় রেখেছিল বসার জায়গা থেকে দেখতে পাচ্ছিল পরিষ্কার। ওটার ধারেকাছেও যায়নি কেউ। ছোট্ট রেডিওটা ওভারকোটের পকেটেই রেখেছে ও।

ডিনারের সময় শহরের ম্যাপ আর একটা গাইড বুকে চোখ বুলিয়ে নিয়েছে রানা। কোলের ওপর ফেলে ভাজ খুলেছিল ম্যাপের, মোটাসোটা লোকটা দেখতে পায়নি। বার-এ ঘণ্টাখানেক ছিল, ওখানে বসেও আরেকবার দেখে নিয়েছে ম্যাপ আর গাইড বুক। বার থেকে বেরুল ও, সাথে সাথে টিকটিকিও পিছু নিল।

হোটেলের পোর্টিকো থেকে ধাপ বেয়ে রেড স্কয়ারে নামল রানা। ফয়েই-এ দাঁড়িয়ে গ্যাস লাইটার জ্বেলে একটা সিগারেট ধরাল লোকটা। সঙ্কেতটা দেখল না রানা, কিন্তু রাস্তার উল্টোদিকে পার্ক করা বিরাট একটা গাড়ি থেকে কালো একটা মূর্তিকে বেরিয়ে আসতে দেখতে পেল। কালো সিডানটাকে কোথাও দেখা গেল না। রাস্তার ওপরে মাত্র একজন লোক। ধাপ বেয়ে নেমে আসছে মোটু।

দুজন।

গাড়িটার হেডলাইট জ্বলল, চিরে দিল কালো অন্ধকার। ইঞ্জিনের গর্জনের সাথে আরও উজ্জ্বল হলো জোড়া আলো। একটু ভয় পেল রানা, হোটেল ছেড়ে যাচ্ছে দেখে ওকে গ্রেফতার করা হবে না তো!

কয়েক গজ এগিয়ে ইচ্ছে করেই থামল রানা। এদিক ওদিক তাকাল, যেন কোন দিকে যাবে ঠিক করতে চাইছে। ঝড়ো। হাওয়ায় হ্যাটটা বার বার উড়ে যেতে চায়, দাড়িয়ে থেকে সেটাকে। ভাল করে বসাল মাথায়। ওভারকোটের কলার তুলে ঘাড় ঢাকল। কিন্তু না, ওর কাছাকাছি এল না কেউ।

মানেঝনায়া স্কয়ার থেকে রেড স্কয়ার প্রপারে বেরিয়ে এসে। বাঁহাতি পেভমেন্টটা বেছে নিল রানা। জি.ইউ.এম-এর সামনেটা ওর চলার পথেই পড়বে। স্কয়ারে প্রচুর লোকজন, লেনিনের সমাধি দেখার জন্যে এত রাতেও কিছু লোক লাইন দিয়ে। এগোচ্ছে। হাতে সময় নেই, তা না হলে সত্যিই শ্রদ্ধা জানাবার জন্যে লাইনে দাঁড়িয়ে পড়ত ও। রাস্তার দুধারেই ঝলমলে দোকান-পাট, কাচ-ঘেরা জানালার সামনে খদ্দেরদের ভিড়। রাশিয়ানরা নির্লিপ্ত আর ঠাণ্ডা, নিয়নের সাদা আলোয় আরও বেশি নিশ্রুভ আর নিস্তেজ দেখাল ওদের। ক্যুনিজম কি ওদেরকে বড়। বেশি বাস্তববাদী করে তুলেছে, কেড়ে নিয়েছে স্বতঃস্ফূর্ত প্রাণচাঞ্চল্য? কে জানে!

ফেউ দুজন কি করছে দেখার কোন চেষ্টাই করল না রানা। জানে, ওরা তাকে হারাবে না। বলা হয়েছে, কেউ যদি পিছু নেয়, খসাবার দরকার নেই। কাজেই তারা যাতে ওকে না হারায়, তার ব্যবস্থা করা দরকার। হাঁটার গতি আরও শ্লথ করল রানা। দোকানগুলোর ফ্যাশন প্রদর্শনীতে কিছু সময় কাটাল। দুমিনিটের জন্যে জি.ইউ.এম-এ ঢুকল, দুনিয়ার সবচেয়ে বড় ডিপার্টমেন্টাল স্টোর এটা।

রেড স্কয়ার থেকে বেরিয়ে এল রানা। আস্তে-ধীরে হাঁটছে, যেন কোন তাড়া নেই। দূরে ক্রেমলিনের আকাশছোঁয়া টাওয়ার। দেখা গেল। মস্কোভা নদীর কাছে পৌঁছুবার আগেই ঠাণ্ডায় হি হি। করতে শুরু করল ও। মস্কোভোরেতস্কি ব্রিজে উঠে মাথা নিচু করে। রাখল, বাতাসের চাপে যাতে খুলির সাথে সেঁটে থাকে হ্যাট। খুলে ওটা হাতে নেয়া চলবে না-ও কোথায়, হ্যাট দেখে জানতে পারছে টিকটিকিরা। হাত দুটো ওর কজি পর্যন্ত ওভারকোটের পকেটে ঢোকানো।

রোড ব্রিজের কিনারায় চলে এল রানা। প্যারাপেটের ওপর দিয়ে ঝুঁকে নিচে তাকাল। কালচে পানিতে স্ট্রীট ল্যাম্পের আলো পড়েছে, অনবরত ছোবল দিয়ে নদীর গা ফেনায় সাদা করে তুলছে বাতাস।

রানার পিছন দিকে কেউ একজন দাঁড়িয়ে পড়ল। অল্প কয়েকজন লোক ব্রিজে, হয় বাতাসের ধাক্কায় নয়তো টানে। এগোচ্ছে। সচল ছায়াদের মধ্যে থেকে একটা ছায়া দাঁড়িয়ে পড়লে নজর কাড়বেই।

ঘুরে দাঁড়াল রানা, প্যারাপেটের দিকে পিছন ফিরল। কলারটা ঘাড়ের ওপর ভাল করে বসিয়ে নেয়ার ফাঁকে ব্রিজের ওপর রাস্তাটুকু জরিপ করল। গাড়িটা দাঁড়িয়ে পড়েছে, হেডলাইট নেভানো,

ভেতরে কেউ আছে বলে মনে হলো না। স্ট্রীট ল্যাম্প থেকে যতটা দূরে সম্ভব পার্ক করা হয়েছে ওটাকে। রাস্তার উল্টো দিকে, রানার দিকে পিছন ফিরে একজন লোক দাঁড়িয়ে রয়েছে, ঝুঁকে পড়ে নদী দেখছে সে।

আবার হাঁটা ধরল রানা। সম্পূর্ণ নিরস্ত্র ও। ভাবল, একটা অস্ত্র থাকলে কি ভাল হত, নাকি বিপদ বাড়ত তাতে? মন খুঁত খুঁত করার একটাই কারণ, ক্সাসনোখোলমস্কি ব্রিজে পৌঁছুবার পর কি ঘটবে ও জানে না।

মস্কোভা নদীর পাশ ঘেঁষে এগিয়েছে ড্রেনেজ ক্যানেল। সেটা পেরিয়ে ওযারকোভস্কায়া কোয়েতে উঠে এল রানা। তারপর পাথুরে সিঁড়ির ধাপ বেয়ে বাঁধের ওপর নেমে এল। বাঁধ ধরে হাঁটছে, পিছনে পায়ের আওয়াজ পেল। শান্ত, দৃঢ় পদক্ষেপ, সিড়ি বেয়ে নেমে আসছে।

গাড়ি আর তার আরোহীর কথা ভাবল রানা। সংখ্যায় ওরা কজন জানার জন্যে এখন আর ফিরে যেতে পারে না ও। তিনজন। আছে বলে জানে, চারজন হওয়াও বিচিত্র নয়। আর গাড়িটা নিশ্চই ও্যারকোভস্কায়া কোয়ের ওপর দিয়ে আসবে, আবার কখন। রাস্তায় উঠবে ও সেই অপেক্ষায় থাকবে ড্রাইভার।

উসতিনস্কি ব্রিজ পেরিয়ে এসে হাতঘড়ি দেখল রানা। দশটা বিশ। পরের ব্রিজটাই ক্লাসনোখোলমস্কি, পৌঁছুতে দশ মিনিটের বেশি লাগবে না ওর। ওখানেই ওর সাথে দেখা হবে…কাদের?

ব্রিজের ঘন কালো ছায়ায় ভৌতিক একটা নিস্তব্ধতা। সাদোভিশিস্কায়া বাঁধের ওপর দাঁড়িয়ে রয়েছে ও, এক-আধটা দম্পতি ছাড়া গোটা বা খালি। একটা তরুণ দম্পতি বা হয়তো। প্রেমিক-প্রেমিকা, বাঁধের ও-পাশ ঘেঁষে এদিকেই এগিয়ে আসছে। পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে আছে দুজন, থেমে থেমে পা ফেলছে, একজন আরেকজনের গালে গাল, ঠোঁট, কপাল ঘষছে-আর কোনদিকে কোন খেয়াল নেই তাদের। দৃশ্যটা চোখে পড়ার পর অন্তত পাঁচ সেকেন্ড বিপদের কথা ভুলে থাকল রানা। ওর মনে। হলো প্রেমের চেহারা সবখানে এক, কোথাও বদলায় না।

এগোল রানা। তরুণ-তরুণীকে পাশ কাটাবার সময় ঘাড় ফিরিয়ে দেখল ওদের, মেয়েটার কানে ফিসফিস করছে ছেলেটা, চোখ বুজে হাসছে মেয়ে। রানার অস্তিত্ব সম্পর্কে ওরা কেউ বোধহয় কিছু জানতেই পারল না। অত্যন্ত সাবধানে এগোচ্ছে। রানা, প্রতিটি পদক্ষেপ গুনছে। পিছনে পায়ের আওয়াজ এখনও। পাচ্ছে ও, বাঁধের ওপর ছড়িয়ে থাকা কাকর আর নুড়ি পাথরের। ওপর জুতো ঘষে এগিয়ে আসছে লোকটা। তরুণ-তরুণীর পায়ের আওয়াজ একটু পরই মিলিয়ে গেল। তারপরই আরও একজোড়া পায়ের শব্দ পেল রানা। তিন জোড়া পা। দ্রুত এগিয়ে আসছে।

ইচ্ছে হলো দৌড় দেয়। মনে হলো ওরা বোধহয় ব্রিজে উঠতে দেবে না ওকে। এখন যদি ওকে গ্রেফতার করা হয়, লোকগুলোর সাথে দেখা হবে না ওর।

ওই সামনে ব্রিজে ওঠার সিঁড়ি। শান্ত ভাবেই ধাপগুলো টপকে ক্সাসনোখোলমস্কি ব্রিজে উঠে এল ও। ক্যানেল পেরিয়ে মস্কোভার সরু বাধে নামার জন্যে আবার এক প্রস্থ সিঁড়ির ধাপ ভাঙল। নদীর এটা দক্ষিণ দিক। ওপারে কোটেলনিচেস্কায়া কোয়ে, সার সার আলো জ্বলছে। মাঝখানে কালো নদীতে সাদা ফেনা। সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামার পর পিছনে কোন আওয়াজ নেই। কিন্তু ওপরের ব্রিজ থেকে ইঞ্জিনের ভোতা আওয়াজ পেল ও। আবার হাতঘড়ি দেখল। দশটা ত্রিশ।

খুব সাবধানে পা ফেলে আসছে ওরা। রানা এখানে দাঁড়িয়ে পড়ায় কিছু একটা ঘটবে বলে সন্দেহ করেছে হয়তো। দুজোড়া পায়ের আওয়াজ সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসছে। এক জোড়া দাঁড়িয়ে পড়ল।

ব্রিজের নিচে অন্ধকার, সেদিকে তাকাল রানা। ছায়া থেকে কোন মূর্তি বেরিয়ে এল না। পিছন ফিরল ও, বাঁধ ধরে ধীরে ধীরে হাঁটতে শুরু করল আবার।

কেউ যদি না আসে? হোটেলে ফিরে যাবে আবার? কিন্তু হোটেলে যদি কেউ ওর সাথে যোগাযোগ না করে? একাই বিলিয়ারস্কের দিকে রওনা হয়ে যাবে ও? প্রশ্নই ওঠে না।

কে.জি.বি. দুর্ভেদ্য প্রাচীর তৈরি করে রেখেছে, প্রজেক্ট এরিয়ায় ঢোকা যাবে না। তার আগেই, শহরে ঢোকা মাত্র অ্যারেস্ট হয়ে যাবে ও, কিংবা গুলি খেয়ে খুন হয়ে যাবে।

গোরোভস্কায়া কোয়ে থেকে আরেক প্রস্থ সিঁড়ি নেমে এসেছে। বাধের ওপর। কাছাকাছি চলে এসেছে রানা, এই সময় সিঁড়ির গোড়া থেকে তিনটে ছায়ামূর্তি বেরিয়ে এসে ওর দিকে এগোল। কারা ওরা? কে.জি.বি. নয় তো? দাঁড়িয়ে পড়বে কিনা ভাবছে রানা, ওদের একজন ইংরেজিতে জানতে চাইল, মি. পামার?

হ্যাঁ।

তিনজন লোক ঘিরে ফেলল রানাকে, ওর মুখের ওপর চোখ ধাধানো আলো পড়ল টর্চের। ইংলিশ কণ্ঠস্বর আবার শোনা গেল, হ্যাঁ, ইনিই।

রানা ভাবল, এর মানে কি পিটি ডাভ হিসেবে মেনে নিল আমাকে? উতরে গেলাম আমি?

তিনজনের মধ্যে সবচেয়ে যে লম্বা, বয়সে তরুণ, চৌকো মুখ, সোনালি চুল, সে-ই কথাবার্তা শুরু করল। ওরা কজন আপনার পিছু নিয়েছে? ইংরেজিতে বলল, তবে উচ্চারণ-ভঙ্গি রাশিয়ান।

রুশ ভাষায় উত্তর দিল রানা, একটু ঝালিয়ে নিতে চাইছে। পায়ে হেঁটে, সম্ভবত তিনজন। আর একটা গাড়ি। সেটা এখন। ব্রিজের ওপর।

গুড, রাশিয়ান লোকটা বলল। প্রথম লোকটাকে লক্ষ করছে। রানা। এ একজন ইংরেজ, সম্ভবত ব্রিটিশ এমব্যাসির সিকিউরিটি

স্টাফ। জিওনিস্ট ইন্টেলিজেন্স আর সি.আই.এ.কে ব্রিটিশ সিক্রেট সার্ভিসও সাহায্য করছে, সে আভাস ও আগেই পেয়েছে। অন্তত একটা প্রমাণও পেয়েছে ও। স্মাগলার লিরয় পামার একজন। ব্রিটিশ। পিটির কাভার তৈরি করার জন্যে ব্রিটিশদের কাছ থেকেই। পামারকে ধার করেছে ইসরায়েলিরা। কিন্তু এই লোকটার কাজ কি এখানে? এ-ই কি ওকে বিলিয়ারস্কে নিয়ে যাবে? একজন ইংরেজ? অসম্ভব! তাহলে?

রানা লক্ষ করল, ওর মতই বয়স হবে লোকটার। একই গড়ন, একই চোখের রঙ, দৈর্ঘ্য-প্রস্থেও কোন অমিল নেই। এমনকি দুজনে একই পোশাক পরে আছে। কেন যেন গায়ের রোম খাড়া হয়ে গেল রানার। মন বলছে, ভয়ানক কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে।

লোকটা ওর দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসল, যেন উৎসাহ দিতে চাইল ওকে। উত্তরে জোর করে রানাও হাসল একটু।

কি করছে ওরা, জসেস্কু? রানার ওপর চোখ রেখে ইংরেজ লোকটা জিজ্ঞেস করল।

সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে ছিল একজন, সে এখন গাড়ির কাছে ফিরে যাচ্ছে। মোটা লোকটা ইতস্তত করছে, ভেবে পাচ্ছে না কি করবে-কারণ এখানে আমরা চারজন রয়েছি। রাশিয়ান জসেস্কু হেসে উঠল। ব্যাটা ভয় পেয়েছে।

তারমানে আরও লোকজন আসবে ওদের। চলো, মি. পামারকে নিয়ে কেটে পড়া যাক।

চারজন ওরা দাঁড়িয়ে আছে গায়ে গা ঠেকিয়ে, ছোট্ট একটা বৃত্ত রচনা করে। যে-কোন পরিস্থিতির জন্যে তৈরি হয়ে আছে। রানা। হঠাৎ পালাতে হতে পারে। ঠেকাতে হতে পারে আকস্মিক হামলা। ইংরেজ লোকটা ওর ডান দিকে, দুজনের ওভারকোট একই রঙ আর কাপড়ের, পরস্পরের সাথে চেপে রয়েছে। রাশিয়ান ইহুদি জসেস্কু তার কালো ওভারকোটের ভেতর থেকে। মোটা একটা কাঠের ভারী মুগুর বের করল।

এত থাকতে মুগুর! শরীরের পেশী লোহা হয়ে গেল রানার।

ইংরেজ লোকটার নাম ন্যাট ফরহ্যান্স। গত দুবছর ধরে বার কয়েক রাশিয়ায় আসার সময় যে পাসপোর্টটা ব্যবহার করেছে সে তাতে তার নাম উল্লেখ করা হয়েছে লিরয় পামার। এই শেষবার রাশিয়ায় ঢুকেছে সে, এবার ব্যবহার করেছে আরেক নামে অন্য একটা পাসপোর্ট। প্রথমে অবিশ্বাস আর বিস্ময়ে চিৎকার করে উঠল ন্যাট ফরহ্যান্স। ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটল কপাল থেকে। সোনালি চুল জসেস্কু কনুই দিয়ে ধাক্কা দিল রানাকে, একই সাথে আবার ফরহ্যান্সের কপালে ঘা মারল মুগুরের।

ওদের পায়ের কাছে হুমড়ি খেয়ে পড়ল ফরহ্যান্স। ভোতা গোঙানির আওয়াজ বেরুচ্ছে গলা থেকে। তার মাথার কাছে বসে। পড়ল জসেস্কু, ঘন ঘন মুগুর তুলল আর ফরহ্যান্সের মুখের ওপর নামাল। থ্যাচ থ্যাচ করে শব্দ হতে লাগল।

ঘেমে গেছে রানা। বুঝতে পারছে, ইংরেজের চেহারা বিগড়ে দিচ্ছে জসেস্কু, কেউ যাতে চিনতে না পারে।

হুইসেলের আওয়াজ। সিঁড়ির কাছে দাঁড়িয়ে থাকা কে.জি.বি. এজেন্ট তার সঙ্গী-সাথীদের সাহায্য চাইছে।

আপনার কাগজ-পত্র-জলদি! চাপা গলায় দ্রুত বলল জসেস্কু। লাশের দিকে ঝুঁকে রয়েছে সে। দেরি করলে সবাই মারা পড়ব!

ব্রেস্ট পকেট থেকে জসেস্কুর হাতে তিনটে কাগজ ধরিয়ে দিল রানা। পাসপোর্ট, মুভমেন্ট ভিসা, সোভিয়েত দূতাবাস থেকে দেয়া আইডেনটিফিকেশন। এখনও একটা ঘোরের মধ্যে রয়েছে রানা। জিওনিস্ট ইন্টেলিজেন্স, ব্রিটিশ সিক্রেট সার্ভিস আর সি.আই.এ-র এই আকস্মিক নিষ্ঠুরতা ওকে হতভম্ব করে দিয়েছে। লোকটাকে দিয়ে দুবছর ধরে নিজেদের একটা কাজ করিয়ে নিয়েছে ওরা, দুবছর আগে কাজে লাগাবার সময়ই ওকে এভাবে মেরে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছিল। লোকটা কে, কি তার পরিচয়, কিছুই জানে না ও। হয়তো মৃত্যুদণ্ড পাবার মত কোন অপরাধ করেছিল, তবু লোকটার জন্যে দুঃখ বোধ করল রানা। বেচারা শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত টের পায়নি এভাবে তাকে মেরে ফেলা হবে।

সম্মোহিতের মত ওদের কাজ দেখছে রানা। ওর কাগজ-পত্র। সব লাশের ওভারকোটের পকেটে ঢুকিয়ে দেয়া হলো। তৃতীয় লোকটা ছো দিয়ে রানার মাথা থেকে তুলে নিল হ্যাটটা। জসেস্কু লাশের ওভারকোটের পকেট থেকে আগেই পাসপোর্ট ভিসা ইত্যাদি বের করে নিয়েছে। ওরা দুজন ধরাধরি করে লাশটাকে। বাঁধের কিনারায় নিয়ে এল। শূন্যে তোলা হলো মৃতদেহ, তারপর কয়েকবার দোলা দিয়ে ছুঁড়ে দেয়া হলো পানিতে। বাঁধের কিনারা থেকে কয়েক গজ দূরে ঝপাৎ করে পড়ল সেটা। সাথে সাথে ডুবে গেল, কিন্তু একটু পর ভেসে উঠল আবার, ওভারকোটটা বেটপভাবে ফুলে আছে, স্রোতের টানে একটু একটু করে দূরে সরে যাচ্ছে।

জলদি! রানার কনুই ধরে হ্যাঁচকা টান দিল জসেস্কু। আমাদের সাথে আসুন। পাভোলেতস মেট্রো স্টেশনে যেতে হবে।

এক সাথে কয়েকটা হুইসেলের আওয়াজ শোনা গেল। মোটা কে.জি.বি. এজেন্ট ওদের কাছ থেকে মাত্র পঞ্চাশ গজ দূরে। ঘাড় ফিরিয়ে একবার নদীর দিকে তাকাল রানা, তারপর ছুটল। জসেস্কু আর অপর লোকটা ওকে ফেলে পনেরো বিশ গজ এগিয়ে গেছে এরইমধ্যে।

ওদের পিছু নিয়ে এক প্রস্থ সিঁড়ি ভাঙল রানা, উঠে এল গোরোভস্কায়া কোয়েতে। পিছনে হুইসেলের আওয়াজ দ্রুত কাছে চলে আসছে। বার বার ঘাড় ফিরিয়ে ওকে দেখে নিচ্ছে জসেস্কু, আধো অন্ধকারে সাদা ঝলকের মত তার দাঁত দেখতে পাচ্ছে রানা। ঘন ঘন তাগাদা দিচ্ছে লোকটা, আরও জোরে ছুটুন, আরও জোরে!

.

লাশটা বাঁধের ওপর তুলতে গলদঘর্ম হয়ে উঠল ওরা চারজন। ওদের বয়স কম, কিন্তু চারজনই মোটাসোটা। এইটুকু পরিশ্রমে রীতিমত হাঁপাতে লাগল সবাই। সবচেয়ে মোটা লোকটাই ওদের লীডার, সে-ই লাশের পকেট থেকে কাগজ-পত্র বের করল। টর্চের আলোয় সেগুলোর ওপর অনেকক্ষণ ধরে চোখ বুলাল সে, তারপর আলো ফেলল লাশের মুখে। হুম, বলল সে। এব্যাপারে সেন্টারকে আমি আগেই সাবধান করে দিয়েছিলাম। তার গলার সুরে অসন্তুষ্টির ভাব। চেরেমেতেইভোয় ওর কাছে। কোন ড্রাগস পাওয়া যায়নি। যে-কোন কারণেই হোক, চাহিদা। মেটাতে পারেনি সে। তাই ওরা তাকে খুন করেছে, লুদভিক। বন্ধুদের হাতেই খুন হয়েছে স্মাগলার পামার।

পাভোলেতস মেট্রো স্টেশন মুগ্ধ করল রানাকে। এত সুন্দর স্টেশন ইউরোপ বা আমেরিকাতেও দেখেনি ও। এটার নক্সা করা হয়েছে মিউজিয়ামের ঢঙে, আর্কিটেক্টরা আধুনিক স্থাপত্যশিল্পের। সমস্ত কৌশল আর উৎকর্ষ যেন অকুণ্ঠচিত্তে ব্যবহার করেছে। প্রায় গোটা স্টেশনই কাঁচ দিয়ে ঘেরা, প্ল্যাটফর্মের ধারে ফুল বাগান। বিশাল থামগুলো আসলে থাম নয়, একেকটা স্ট্যাচু, সংখ্যায় এত বেশি যে গুনে শেষ করা মুশকিল। মাথার ওপর একশো গজ উঁচুতে সিলিং, সার সার ঝাড়বাতি ঝুলছে সেখানে। চারদিক ঝকঝক তকতক করছে, একটা ছেঁড়া কাগজ বা সিগারেটের টুকরোও চোখে পড়ল না। দীর্ঘশ্বাস ফেলতে ফেলতে কালো টানেল থেকে বেরিয়ে আসা ট্রেনগুলোকে এই পরিবেশে একেবারেই বেমানান লাগল।

প্ল্যাটফর্মে লোকজন প্রচুর। একসাথে বেশি লোক ভিড় করে নেই, ছাড়া ছাড়া ভাবে দাঁড়িয়ে ট্রেনের অপেক্ষা করছে সবাই। রানার পাশে থামল জসেস্কু, কিন্তু বেশিক্ষণ থাকল না। চারদিকে। একবার ভাল করে চোখ বুলিয়ে নিয়ে রানার হাতে একটা নীল রঙের ব্রিটিশ পাসপোর্ট ধরিয়ে দিল সে। পাসপোর্টের ভেতর আরও কিছু কাগজ-পত্র আছে। বিড়বিড় করে বলল, ট্রেন থেকে নামার আগে সব ভাল করে পড়ে নেবেন। আপনার নাম চার্লস ডিকেনস। টুরিস্ট, স্পুতনিক হোটেলে উঠেছেন। যাই ঘটুক, ভয় পাবেন না। মনে রাখবেন, ওরা কোন ইংরেজকে খুঁজছে না। শুধু যদি শান্ত থাকতে পারেন, তাতেই বিপদ কেটে যাবে।

প্ল্যাটফর্মের আরেক প্রান্তে চলে গেল জসেস্কু। পাসপোর্টের ভাঁজ খুলে ফটোটা ভাল করে দেখল রানা। পামারের ছদ্মবেশ নিয়ে আছে ও, কাজেই তার ফটোর সাথে ওর চেহারা না মেলার কোন কারণ নেই। ক্যাপ খুলে ভঁজ করল ও, চশমার সাথে সেটা রেখে দিল ওভারকোটের পকেটে। ওভারকোট খুলে ঝুলিয়ে নিল ভাজ করা হাতে। ফরমাল গাঢ় রঙের স্যুটটা অস্বস্তির কারণ হয়ে থাকল, কারণ দেখলেই বোঝা যায় বিদেশে তৈরি। কথাটা মনে হতেই চারদিকে চোখ বুলাল একবার। যা ভেবেছিল, দুএকজন রাশিয়ান ওর দিকে তাকিয়ে আছে।

সামনের লাইনে একটা ট্রেন এসে থামল। ওভারকোটটা কাঁধের ওপর ফেলে এগোল ও। ট্রেন ছাড়ার পর সীটের ওপর নড়েচড়ে বসে ঘাড় ফেরাল ও, দেখল নির্লিপ্ত চেহারা নিয়ে জসেস্কু একটা খবরের কাগজ পড়ছে, লম্বা করে দেয়া পা দুটো দুই সারি সীটের মাঝখানের প্যাসেজে বেরিয়ে আছে। অপর লোকটা এই কমপার্টমেন্টে ওঠেনি।

কিছুটা অস্বস্তিবোধের অভিনয় করতে হবে ওকে। এক এক করে আরোহীদের দিকে তাকাল রানা। নারী পুরুষ মিলিয়ে মোট পঁচিশ জন। সারা দুনিয়ার ট্রেন যাত্রীদের যেমন দেখায়, এদেরকেও তেমনি দেখাল-ক্লান্ত, একঘেয়েমির শিকার, কেন্দ্রিক, সরাসরি কেউ কারও চোখে না তাকাবার ব্যাপারে সতর্ক। তবু ওদের সামনে নিজেকে উলঙ্গ উলঙ্গ লাগল রানার। ওর পরনের কাপড়চোপড় আর কারও সাথে মিলছে না। আলো। ঝলমলে আরেক প্ল্যাটফর্মে থামল ট্রেন, কালো বোর্ডের ওপর। সাদা অক্ষরে স্টেশনের নাম লেখা-তাগানস্কায়া। মস্কোর মাঝখান থেকে উত্তর-পুব দিকে সরে যাচ্ছে ওরা।

হুসস-কমপার্টমেন্টের দরজা খোলার সময় আওয়াজটা হয়। নতুন যারা আসে, আর পুরানো যারা নেমে যায়, সবাইকে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করে রানা। কেউ ওর দিকে ফিরেও তাকায় না। আরেকবার জসেস্কুর দিকে তাকাবার ঝুঁকি নেয় ও। সেটা টের। পায় দীর্ঘদেহী রাশিয়ান, ধীরে ধীরে ঘাড় ফিরিয়ে ওর দিকে সে-ও। নিঃশব্দে তাকায়। তার দৃষ্টি, দেহ আর মুখভঙ্গি থেকে একটাই নির্দেশ বিচ্ছুরিত হয়-শান্ত থাকো।

চোখ ফিরিয়ে নেয় রানা। কোথায় যাচ্ছে ও, জানে না। রাশিয়ান ইহুদিদের কতটুকু বিশ্বাস করা যায়, তাও বুঝতে পারছে না। ওরা যে তাকে সন্দেহ করেনি, এটুকু পরিষ্কার। পিটি ডাভ হিসেবেও উতরে গেছে ও।

মনটা অস্থির হয়ে আছে। মস্কোর মাঝখানে একজন লোক। খুন হয়েছে, আর তারা ট্রেনে করে পালাচ্ছে। আইনের লোকেরা। দূর থেকে লক্ষ করেছে এই হত্যাকাণ্ড, খুনীরা কোন পথে পালাবে আন্দাজ করে নেবে তারা।

জিওনিস্ট ইন্টেলিজেন্সের ফাইলে লেখা আছে, পিটি ডাভকে মস্কো থেকে কিভাবে বের করে নিয়ে যাওয়া হবে, বা কিভাবে বিলিয়ারস্কে হাজির করা হবে, এসব তার জানার দরকার নেই। সে ভীতু লোক, তাকে কিছু না জানালেই বিপদের সম্ভাবনা কম। সারাটা পথ তাকে লাগেজ বা কার্গো হিসেবে ট্রিট করা হবে।

কুরস্কায়া স্টেশনে থামল ট্রেন। দুজন লোক নেমে গেল। ট্রেন ছাড়ার আগের মুহূর্তে একজন লোক উঠল। তাগড়া এক। যোয়ান, চেহারায় রগচটা ভাব, কিন্তু রানার দিকে তাকাল না।

ট্রেন ছেড়ে দিল, রানা দেখল জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে জসেস্কু। রানাও তাকাল।

ট্রেন থেকে যারা নেমেছে, কেউ প্ল্যাটফর্ম থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে পারেনি। ওভারকোট আর হ্যাট পরা দুজন লোক তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে।

প্ল্যাটফর্ম ছাড়িয়ে এল ট্রেন। রানার সাথে চোখাচোখি হলো জসেস্কুর। ছোট্ট করে একবার মাথা ঝাঁকাল জসেস্কু। এর অর্থ বুঝতে পারল রানা। কে.জি.বি.। খুনীর খোঁজে স্টেশনে পৌঁছে গেছে ওরা। প্রতিটি মেট্রো ট্রেনে এখুনি হয়তো উঠছে না, তবে নিঃসন্দেহে ধরে নেয়া যায় সবগুলো স্টেশন থেকে বেরুবার প্রতিটি পথ সীল করে দিচ্ছে ওরা। মেট্রো যে পালাবার জন্যে আদর্শ একটা রুট, ভাল করেই জানে ওরা। ওদের কাছে ম্যাপ আছে, আছে টাইমটেবল। খুনটা হয়েছেও পাভেলেস স্টেশনের কাছাকাছি।

তাগড়া যোয়ান লোকটা সুন্দরী এক মেয়ের দিকে অপলক তাকিয়ে আছে। এক কোণে, সীটে হেলান দিয়ে ঘুমাচ্ছে যুবতী।

জসেস্কুর দেয়া কাগজ-পত্র বের করে পড়ে নিল রানা। তারপর আবার জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল। অন্ধকার টানেলের ভেতর দিয়ে ছুটছে ট্রেন।

পরের স্টেশন কমসোমলস্কায়া। না তাকিয়েই বুঝল রানা, উঠে দাঁড়িয়ে দরজার দিকে এগোল জসেস্কু। স্লাইডিং ডোরের সামনে গিয়ে দাঁড়াল সে, রেলিঙের ওপর হাত।

উঠল রানা। এগিয়ে এসে দুনম্বর দরজার সামনে দাঁড়াল। ট্রেন থামল, সরে গেল দরজার কবাট। নামার আগেই কে.জি.বির কয়েকজন লোককে দেখতে পেল ও। বেশ অনেক লোক নেমেছে, ভিড়টার মাঝখানে থাকল ওরা দুজন। এগজিট গেটের দিকে এগোচ্ছে সবাই, ক্লান্ত পায়ে। রানা উপলব্ধি করল, পিছিয়ে পড়েছে জসেস্কু। কিন্তু ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল না। গেটের গোড়ায় কয়েকজন লোক, ট্রেন থেকে সদ্য নামা আরোহীদের কাগজ-পত্র পরীক্ষা করছে তারা। পকেটে হাত ভরে চার্লস ডিকেনস-এর কাগজ-পত্র বের করল রানা-পাসপোর্ট, এন্ট্রি ভিসা, হোটেল। রিজারভেশন, ইনটুরিস্ট ইনফরমেশন বুকলেট।

একজন কে.জি.বি. এজেন্টের সামনে দাঁড়াতে হলো রানাকে। লোকটার মুখে মাংস নেই, শুধুই যেন হাড়। গর্তে ঢোকা চোখে। অন্তর্ভেদী দৃষ্টি। আর সবাইকে বেশ খানিকক্ষণ দাঁড় করিয়ে রেখে। রানার কাগজ-পত্র খুঁটিয়ে পরীক্ষা করল সে। ফটোর সাথে রানার চেহারা আট-দশ বার মিলিয়ে দেখল। চার্লস ডিকেনস মস্কোয় আসার পর, তিন দিন আগে, তার নামে যে-সব কাগজ-পত্র ইস্যু করা হয়েছে সেগুলোও ভাল করে দেখল। মনে মনে ভাবছে রানা, স্পুতনিক হোটেলে সত্যি কি এই নামে কোন লোক উঠেছে সেদিন?

আপনাকে স্নান দেখাচ্ছে, মি. ডিকেনস, ইংরেজিতে মন্তব্য। করল এজেন্ট। হাসছে, মনে হলো কিছু সন্দেহ করেনি।

খাওয়াদাওয়ায় অনিয়ম, পেটটা ভাল যাচ্ছে না, বলল রানা। হাসল ও।

ফটোয় আপনি চশমা পরে রয়েছেন, মি. ডিকেনস।

পকেটে হাত চাপড়াল রানা। আছে।

আপনি বলছেন, স্পুতনিকের খাবার ভাল না?

ঠিক উল্টোটা-আমার জন্যে একটু বেশি রিচ।

ধন্যবাদ, মি. ডিকেনস, ধন্যবাদ। পাসপোর্ট সহ অন্যান্য। ডকুমেন্টের নম্বর একটা নোটবুকে টুকে নিল লোকটা, তারপর সব ফিরিয়ে দিল। গেট পেরিয়ে সিঁড়িতে উঠল রানা। পিছন ফিরে। একবারও তাকাল না।

সিঁড়ির মাথায় উঠে বিশাল একটা রেলওয়ে ম্যাপের সামনে দাঁড়াল রানা। মস্কোর মেট্রো সিস্টেমের খুঁটিনাটি সবই এই ম্যাপ দেখে জানা যাবে। ম্যাপে চোখ, কিন্তু মনটা খুঁত খুঁত করছে। সিঁড়ির মাথায় উঠতে জসেস্কু এত দেরি করছে কেন? ওদের কি আটকানো হয়েছে? সিঁড়ির নিচে তাকাবার একটা ঝোক চাপল, কিন্তু তাকাল না। মনোযোগ চলে গেল অন্য আরেক দিকে। কোনদিকে তাকায়নি রানা, কিছু তাই দেখেওনি। শুধু কিছু শব্দ ওকে সতর্ক করে তুলল। জুতোর আওয়াজ, কর্কশ কণ্ঠস্বর-সবই খুব অস্পষ্ট। কিন্তু হার্টবিট বাড়ছে।

সাবধানে, ধীরে ধীরে ঘাড় ফেরাল রানা, হঁাৎ করে উঠল বুক। স্টেশনের মেইন গেট দিয়ে কখন ওরা ঢুকেছে, বলতে পারবে না ও। এরই মধ্যে চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে ওরা। অসংখ্য লোক স্টেশন থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিল, তাদের সবাইকে ফেরত পাঠানো হচ্ছে। ইতোমধ্যে লোকজন লাইন দিতে শুরু করেছে, সবার কাগজ-পত্র আবার নতুন করে পরীক্ষা করা হবে।

সিঁড়ির নিচে, প্ল্যাটফর্মের ডান দিকে কে.জি.বি-র এজেন্টরা আগের মতই আরোহীদের কাগজ-পত্র চেক করছে। সিড়ির আরেক দিকে, বায়ে, নতুন যারা এসেছে ওদের সম্পর্কে এখনও কিছু জানে না তারা।

ওরাও কে.জি.বি, কিন্তু অন্য ডিপার্টমেন্টের, সম্ভবত সেকেন্ড চীফ ডাইরেক্টরেট থেকে পাঠানো হয়েছে। পঞ্চাশ থেকে ষাটজনের একটা বাহিনী ঢুকে পড়েছে স্টেশনের ভেতর, কয়েক দলে ভাগ হয়ে আরোহীদের কাগজ-পত্র চেক করছে ওরা। একজন লোককে কয়েকবার পড়তে হচ্ছে চেকিঙের সামনে। মৃদু প্রতিবাদের আওয়াজ উঠল এদিক ওদিক থেকে, উত্তরে শোনা গেল কর্কশ ধমক।

রানার কাঁধে একটা হাত পড়ল। বুঝল, জসেস্কু। কিন্তু তাকাল না। ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে সিঁড়ির বাঁ দিকে ফিরল জসেস্কু। আঁতকে উঠল সে, নিঃশ্বাসের সাথে একটা শব্দ বেরিয়ে এল, সর্বনাশ?

কেন? দ্রুত জানতে চাইল রানা। আমাদের কাগজ-পত্র। নিখুঁত নয়?

সম্পূর্ণ নিখুঁত বলে কোন জিনিস নেই, জবাব এল। এভাবে ওরা স্টেশনে ঢুকেছে দেখে ভাবছি…

কি ভাবছেন? তাগাদা দিল রানা। মন খারাপ হয়ে গেছে। ওর। ভয় লাগছে। নিরাপত্তার নিশ্চিদ্র কোন ব্যবস্থা এরা করতে পারেনি তাহলে।

আপনি বরং টয়লেটে চলে যান, চাপা সুরে বলল জসেস্কু। তাছাড়া আর তো কোন উপায় দেখছি না।

এটা কোন সমাধান নয়, বিরক্তির সাথে বলল রানা। টয়লেটেও যাবে ওরা। তাছাড়া, আমাকে বেরুতে হবে না?

গেটের দিকে তাকিয়ে আছে জসেস্কু। ওই দেখুন, আরও লোক আসছে ওদের। গেটের দিকে তাকিয়ে রানাও দেখল, কে.জি.বি. এজেন্টদের আরও একটা দল ভেতরে ঢুকছে। সবাই এসে পৌঁছুলে ওদের বিশ্বাস বেড়ে যাবে, নিজের প্রস্তাবের। পক্ষে যুক্তি দেখাতে শুরু করল জসেস্কু, তখন ওরা ভাববে ওদের চোখকে ফাঁকি দিয়ে কারও পক্ষে স্টেশনের বাইরে বেরিয়ে যাওয়া সম্ভব না। ঠিক সেই সময় আপনি টয়লেট থেকে বেরিয়ে এসে ওদের সামনে দিয়ে এগোবেন। বলা যায় না, ওরা হয়তো আপনাকে চেকই করবে না।

রানা বুঝল, ওকে নয়, নিজেকে অভয় দেয়ার চেষ্টা করছে। জসেস্কু। আনাড়ি নাকি ব্যাটা! পিটি ডাভের বিপদ নিজের মাথায় তুলে নেয়াটা হয়তো বোকামিই হয়ে গেছে।

যান! এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে ওদের চোখে পড়ে যাবেন! অস্থির দেখাল জসেস্কুকে।

আমার মনে হয়, তারচেয়ে চলুন স্টেশন থেকে বেরিয়ে যাবার চেষ্টা করি…।

আমি আপনাকে আদেশ করছি! কঠিন সুরে বলল জসেস্কু। আগেই বলা আছে, আমি যা বলব তাই হবে। এখানকার হালচাল আপনার চেয়ে আমি ভাল বুঝি। যান!

জসেস্কুর দিকে তাকিয়ে থাকল রানা। ভাবল, লোকটার নির্দেশ অমান্য করলেও এখন আর কোন লাভ হবে না। বিপদ এসে গেছে, নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করা বোকামি হবে। দেখা যাক শেষ পর্যন্ত কি হয়।

শান্তভাবে ঘুরে দাঁড়াল রানা। নামতে শুরু করল সিঁড়ি বেয়ে। সিঁড়ির বাঁ দিকেই টয়লেট। সেখানে যেতে হলে একদল কে.জি.বি. এজেন্টের পিঠ ঘেঁষে এগোতে হবে ওকে।

সিঁড়ির মাথা থেকে রানার দিকে তাকিয়ে থাকল জসেস্কু। ওদের তিনজনের কাগজপত্রে কোন খুঁত নেই, জানে সে। কিন্তু হাজার হোক সবই তো নকল, ফাঁস হয়ে যেতে কতক্ষণ। অপ্রত্যাশিতভাবে দলে দলে কে.জি.বি. এজেন্টদের ঢুকতে দেখে সেই ভয়টাই করছে ও। একজন কে.জি.বি. এজেন্ট রানার দিকে ঘাড় ফিরিয়ে তাকিয়ে

আছে দেখে বুকটা ধড়াস করে উঠল জসেস্কুর। রানা টেরও পাচ্ছে না, ওর দিকে কেউ তাকিয়ে আছে। কে.জি.বি. এজেন্ট একজন মেজর। জসেস্কুর মনে হলো, ডিকেনসের মাথার দিকে নয়, মেজর তাকিয়ে রয়েছে ওর পায়ের দিকে। যেন ওর হাঁটার ধরনটা গভীর মনোযোগের সাথে লক্ষ করছে সে।

.

মস্কোভা হোটেলের বার-এ বসে পাইপ টানছে মার্কিন দূতাবাসের ট্রেড অ্যাটাশে টিম ওয়াইজম্যান। দরজার কাছাকাছি এমন। জায়গায় বসেছে, হোটেল ফয়েই-এর সবটুকু দেখতে পাচ্ছে সে। অনেকেই তাকে চেনে-জানে মাঝে-মধ্যে এখানে বসে এই সময় বই পড়ে আর মদ খায় লোকটা।

কে.জি.বি-র লোকজন হোটেলে ঢুকতেই তাদের দেখতে পেল ওয়াইজম্যান। ওদের সাথে পলিটিক্যাল সিকিউরিটি। সার্ভিসেরও অন্তত দুজন লোক রয়েছে। তার হিসেবে যদি ভুল না থাকে, বেচারা ন্যাট ফরহ্যান্সের মৃত্যু তাহলে বৃথা যায়নি। চোখে বিষাদ নিয়ে আপনমনে মাথা নাড়ল সে, শেষ চুমুক দিয়ে। খালি করে ফেলল স্কচের গ্লাস। এই হোটেলে কে.জি.বি.. অফিসারদের উপস্থিতি প্রমাণ করছে, ফরহ্যান্স মারা গিয়ে যে গল্পটা তৈরি করে গেছে সেটা গিলেছে ওরা, বিশ্বাস করেছে। এখন ওরা জানে, লিরয় পামার ড্রাগ ব্যবসায়ীদের চাহিদা পূরণ করতে না পারায় তাদের হাতে খুন হয়েছে সে। পামার মৃত-পিটি ডাভ দীর্ঘজীবী হোক।

স্মিত হেসে ওয়েটারকে ডাকল সে। আবার তাকে স্কচ হুইস্কি দিয়ে গেল ওয়েটার। বিল মিটিয়ে দিয়ে বইয়ের পাতায় চোখ রাখল ওয়াইজম্যান। আড়চোখে তাকিয়ে কে.জি.বি. অফিসারদের তৎপরতা লক্ষ করছে। এলিভেটর থেকে পিটির লাগেজ নিয়ে নেমে এল তারা। রহস্যময় চরিত্র লিরয় পামার, নিরীহদর্শন, কিন্তু মস্কোর সরলমতি তরুণ-তরুণীকে মাদকদ্রব্যে আসক্ত করে তুলেছিল। তার কাছ থেকে কারা ড্রাগস কিনত, ব্যবহার করত কারা, জোর তদন্ত চালিয়ে জানার চেষ্টা করবে কে.জি.বি.। আপনমনে হাসল ওয়াইজম্যান। আজ রাতে জিওনিস্ট। ইন্টেলিজেন্সের চীফ আইজ্যাক ময়নিহানকে সিগন্যাল পাঠাবে। সে-অগ্রগতি সন্তোষজনক। ড্রাগ-ব্যবসায়ীদের ধরার চেষ্টা করছে। কে.জি.বি, পামারকে যারা খুন করেছে। স্টেশনে কে.জি.বি-র প্রথম দলটাকে যে-সব কাগজ-পত্র দেখিয়েছে জসেস্কু ওগুলো। ছাড়াও আরও একটা কাগজ আছে তার কাছে। একান্ত ইমার্জেন্সী দেখা দিলে, শেষ অস্ত্র হিসেবে এই কাগজটা ব্যবহার করবে সে। ওটা একটা রেড কার্ড, শুধু একজন কে.জি.বি. এজেন্টের কাছে থাকতে পারে। নকল, তাই ওটা ব্যবহার করার কোন ইচ্ছে নেই তার, কিন্তু স্টেশন থেকে বেরুনো যদি অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায় তখন ব্যবহার না করে উপায়ও থাকবে না।

যা আশঙ্কা করেছিল জসে, তাই ঘটল। স্টেশনের গেট দিয়ে পিল পিল করে আরও কে.জি.বি. এজেন্ট ঢুকল। গত পাঁচ-সাত মিনিটে চার-পাঁচ বার জায়গা বদল করেছে সে, হাবভাবে ফুটিয়ে তুলেছে ভালমানুষের ছাপ। মেইন গেটে একটা ব্যারিয়ার খাড়া করেছে এজেন্টরা, স্টেশন থেকে বেরিয়ে অন্ধকার রাস্তায় পা দিতে হলে ওই ব্যারিয়ার টপকাতে হবে। স্টেশনে যারা ঢুকছে বা বেরিয়ে যাচ্ছে, সবার কাগজ-পত্র কয়েক জায়গায় কয়েকবার করে পরীক্ষা করা হচ্ছে। দুএকটা মুখ চিনতে পারল জসেস্কু, এরা সবাই পলিটিক্যাল সিকিউরিটি সার্ভিসের লোক। টিম ওয়াইজম্যানের ফাইলে এদের চেহারা দেখেছে সে। বোধহয় এর মধ্যে আর কিছু নেই, পামারের খুনীকেই শুধু খুঁজছে ওরা।

কাগজ-পত্র ঠিক নেই, এই অজুহাতে বেশ কিছু লোককে গ্রেফতার করা হয়েছে। এক কোণে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে। তাদের, গাড়িতে তুলে হেডকোয়ার্টারে নিয়ে যাওয়া হবে ইন্টারোগেট করার জন্যে।

পরচয়কে একটা রেস্তোরায় বসে প্যাটিস আর কেক খেতে দেখল ও। ওর দলের তিন নম্বর লোক সে। পরচয়ের ধরা পড়ার ভয় কম, কারণ তার কাছে নাইট ওয়াচম্যানের কাগজ যেটা রয়েছে সেটা নকল নয়। কে.জি.বি. এজেন্টরা ওকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা জেরা করলেও কিছু এসে যায় না। সমস্যা শুধু পিটি ডাভকে নিয়ে।

ব্যাজ দেখে বোঝা যায়, লোকটা কে.জি.বি-র একজন মেজর। রানার পায়ের দিকে তাকিয়েছিল, রানাকে ঢুকতে দেখেছে টয়লেটে। সেই থেকে টয়লেটের দরজার দিকে তাকিয়ে। আছে সে, অপেক্ষা করছে রানা কখন বেরিয়ে আসে।

কিছু একটা সন্দেহ করেছে মেজর, বুঝতে পারছে জসেস্কু। পিটির সাথে কথা বলেছে সে, মেজর নিশ্চই সেটা দেখেনি। দেখলে তার দিকেও এক-আধবার তাকাত।

পিটির আচরণে একটু অবাকই হয়েছে জসেস্কু। ওয়াইজম্যান তাকে সাবধান করে দিয়ে বলেছিল, পিটি লোকটা ভীতুর ডিম, বিপদ দেখলে ঘাবড়ে যাবে। কিন্তু ঘটল ঠিক উল্টোটা। চারপাশে হঠাৎ এত কে.জি.বি. দেখেও গা ঢাকা দিতে চায়নি সে। এখন। যদি সাহস করে বেরিয়ে আসে, আর ভয় না পায়, শেষ রক্ষা হতেও পারে। ওর কাগজ-পত্র নকল হলেও এত তাড়াতাড়ি ফাঁস হয়ে যাবার কথা নয়।

ছ্যাঁৎ করে উঠল বুক। কে.জি.বি. মেজর অধৈর্য হয়ে উঠেছে। টয়লেটের দিকে এগোচ্ছে সে। ওকে বাধা দেয়া দরকার, উপলব্ধি। করল জসেস্কু। কিন্তু কিভাবে? টয়লেটের দিকে পা বাড়াল সে।

পথরোধ করে দাঁড়াল একজন অফিসার। মুখে বিনয় আর। ভদ্রতার মুখোশ আঁটা। আপনার পরিচয়-পত্র, কমরেড?

মর শালা! মনে মনে অভিশাপ দিল জসেস্কু। পিটি ডাভের ভাগ্য এখন তার নিজের হাতে। ইচ্ছে হলো, কে.জি.বি. অফিসারকে অগ্রাহ্য করে, তাকে পাশ কাটিয়ে টয়লেটের দিকে এগোয়। না, চরম বোকামি হয়ে যাবে। অফিসারের চোখে চোখ। রেখে হাসল সে। ব্রেস্ট পকেটে হাত ভরে বের করে আনল আইডেনটিটি কার্ড।

.

ক্লজিট থেকে বেরুতে যাচ্ছিল রানা, বাইরে পায়ের আওয়াজ পেয়ে পাথর হয়ে গেল। বুট, তারমানে কে.জি.বি.। আওয়াজটা এগিয়ে এসে ওর ক্লজিটের সামনেই থামল। নক হলো দরজায়।

এই যে, কে আছেন ভেতরে, রূঢ় কণ্ঠস্বর, ইংরেজিতে জানতে চাইল। কাগজ দেখান! তাড়াতাড়ি!

আমি…মানে, অসুবিধে আছে, ভেতর থেকে বলল রানা।

ইংরেজ? জানতে চাইল মেজর। স্টেট সিকিউরিটি। আপনার কাগজ দেখতে চাই, প্লীজ।

আপনি কি…একটু অপেক্ষা করতে পারেন না?

ঠিক আছে, বলল মেজর। বেশি দেরি করবেন না।

রোল থেকে কাগজ ছিড়ল রানা, চেইন টেনে ল্যাবরেটরিতে পানি ঢালল। কোমরের বেল্ট খুলে বাকল নাড়াচাড়া করল, আবার লাগাল ওটা। তারপর বোল্ট খুলে বেরিয়ে এল ক্লজিট থেকে।

লোকটাকে চিনতে পারল না রানা, কিন্তু চেনা চেনা লাগল। তার মুখের ভাব আর চোখের কৌতূহল দেখে বুঝল, কে.জি.বি. মেজরও সন্দেহে ভুগছে, তারও চেনা চেনা লাগছে ওকে। একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে রানার মুখে।

আপনার কাগজ, প্লীজ। রানার সামনে হাত পাতল মেজর। টান টান হয়ে আছে পেশী, সতর্ক চোখে রানার প্রতিটি নড়াচড়া লক্ষ করছে। আপনি কি অসুস্থ? নাকি ভয় পেয়েছেন?

আমাকে চিনে ফেললে এই লোককে খুন করতে হবে আমার, ভাবল রানা। না-পেটের ট্রাবল।

রানার হাত থেকে ছো দিয়ে কাগজগুলো নিল মেজর। বারবার পাসপোর্টের ফটো আর রানার মুখ দেখল।

হঠাৎ লোকটাকে চিনতে পারল রানা। বছর তিনেক আগে পোল্যান্ডের এক অখ্যাত শহরে এই লোকের সাথে হাতাহাতি হয়েছিল ওর। স্রেফ সন্দেহের বশে সারাটা দিন পিছু লেগে ছিল মেজর, বিরক্ত হয়ে এক সময় ঘুরে দাঁড়ায় রানা। প্রথমে তর্ক, তারপর হাতাহাতি। নাকে ঘুসি খেয়ে জ্ঞান হারিয়েছিল মেজর।

আপনার কাগজ-পত্র ঠিক নেই!

এটা একটা ফাঁদও হতে পারে, ভাবল রানা।

হাসল রানা। বলল, তা হতেই পারে না… কিন্তু মুখের কথা শেষ করতে পারল না ও, দেখল, কাগজগুলো কোটের পকেটে। ভরছে মেজর। এর মানে কি? কঠিন সুরে জিজ্ঞেস করল ও।

পকেট থেকে হাত বের করল মেজর। রিভলভার দেখে মনে মনে প্রমাদ গুণল রানা। আপনাকে গ্রেফতার করা হলো, মেজর। মাসুদ রানা।

এরপর আর কিছু বলার থাকে না। রানাকে চিনে ফেলেছে মেজর। শুধু গ্রেফতার করেই ক্ষান্ত হবে না, কে.জি.বি. হেডকোয়ার্টারে নিয়ে গিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ইন্টারোগেট করা হবে ওকে। তারপর পাঠিয়ে দেয়া হবে সেন্ট্রাল জেলে। মিথ্যে পরিচয় দিয়ে সোভিয়েত রাশিয়ায় ঢোকার অপরাধে ছমাস থেকে ছয় বছরের জেল হতে পারে ওর। আর যদি প্রমাণ করতে পারে। সোভিয়েত রাশিয়ার ক্ষতি করার প্ল্যান ছিল ওর, মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত। হতে পারে।

বি.সি.আই, বিদায়! মাতৃভূমি, বিদায়। এয়ারকিং,… কাঁধ ঝাঁকাল রানা, চেহারায় অসহায় ভাব ফুটিয়ে তুলল, বলল, চিনে। ফেলেছ, তাই না? কিসে ধরা পড়লাম বলো তো?

সবচেয়ে যেটা বেশি চিনি, তোমার হাঁটার ধরন, বলল। মেজর। সারা মুখে অতৃপ্তির হাসি। তারপর গলার সুর। সবশেষে চোখ-এই চোখ একবার দেখলে ভোলা যায়? হাসছে। বটে, কিন্তু রিভলভারটা তাক করে আছে রানার বুকে। চলো, হেডকোয়ার্টারে বসে গল্প করা যাবে। নাকে একটা আঙুল ঘষল সে। এই নাকেই ঘুসিটা মেরেছিল রানা। আবারও মারল ও।

চোখে অন্ধকার দেখল মেজর, কিন্তু ট্রিগার টেনে দিতে দেরি করল না। খালি চেম্বারে হ্যামার পড়ল। ছিটকে রোলার টাওয়েল কেবিনেটের গায়ে বাড়ি খেলো সে, তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল রানা। সেফটি ক্যাচ অফ করার চেষ্টা করছে মেজর, নাগালের মধ্যে তার রিভলভার ধরা হাতের কব্দিটা শুধু পেল রানা। অপর হাত দিয়ে উন্মাদের মত টান দিল টাওয়েল।

মেজরের চওড়া কজি পিছলে বেরিয়ে যাচ্ছে রানার মুঠো থেকে। হাঁটু দিয়ে তার পেটে একটা গুতো মারল ও। হুস করে বাতাস বেরুল মেজরের মুখ থেকে, কেবিনেটের দেয়ালে ঢলে পড়ল সে। বিশাল একটা টাওয়েলের লুপ রানার হাতে চলে এল, মেজরের মাথায় সেটা গলিয়ে দিয়ে টানল রানা। মেজরের মুক্ত হাতটা টাওয়েল ধরে টানাটানি শুরু করল। চোখ দুটো বিস্ফারিত হয়ে গেল তার, মনে হলো কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসবে। টাওয়েলটা মোচড়াচ্ছে রানা, সেই সাথে টানছে। দূর থেকে একটা আওয়াজ ভেসে এল। পরমুহূর্তে ঘাড়ে প্রচণ্ড এক রদ্দা খেলো রানা।

ঘুরল রানা। চোখে আগুন নিয়ে তাকিয়ে আছে জসেস্কু।

মাই গড, কাকে পাঠিয়েছে ওরা! নিজের কপালে চাপড় মারল জসেস্কু। ও কে.জি.বি.! আপনি একজন কে.জি.বি. মেজরকে খুন করে ফেলেছেন!

জসেস্কুর উত্তেজনা আর ভয় রানাকে যেন স্পর্শও করল না। মেজরের দিকে তাকাল ও। আধ হাত জিভ বেরিয়ে পড়েছে। লোকটার, চোখ দুটো কোটরের বাইরে বেরিয়ে এসে কিনারায় ঝুলছে যেন। ও আমাকে চিনে ফেলেছিল, শান্ত সুরে বলল রানা। এছাড়া কোন উপায় ছিল না। লাশটা তাড়াতাড়ি সরিয়ে ফেলার ব্যবস্থা করুন।

হাঁ করে তাকিয়ে থাকল জসেস্কু। এই লোককে ভীতুর ডিম বলার মানে কি? কে.জি.বি. অফিসারকে মেরে ফেলেও বিচলিত হয় না। আবার তাকে হুকুম করে!

লাশটা টেনে একটা ক্লজিটে ঢোকাল জসেস্কু। নিজেও ঢুকল, ভেতর থেকে বন্ধ করে দিল দরজা। খানিক পর জানতে চাইল, . নিরাপদ?

হ্যাঁ, বলল রানা।

ক্লজিট থেকে বেরিয়ে এল জসেস্কু। ওর পকেট থেকে টাকাপয়সা সব বের করে নিয়েছি। দেখে যেন মনে হয়, ডাকাতি করার উদ্দেশ্যেই মারা হয়েছে ওকে।

ধন্যবাদ।

ঘন ঘন ঢোক গিলল জসেস্কু। এখানে আর এক মুহূর্তও নয়। হয়তো এরইমধ্যে মেজরের খোঁজ পড়ে গেছে। এখনি বেরিয়ে সোজা ব্যারিয়ারের দিকে এগোবেন আপনি। দুতিন। জায়গায় দাঁড় করানো হতে পারে আপনাকে, ভয়…জানি, ভয় পাবেন না আপনি।

কচু জানেন, বলে ঘুরে দাঁড়াল রানা, শান্ত পায়ে বেরিয়ে এল টয়লেট থেকে।

ব্যারিয়ারের কাছে পৌঁছুবার আগে দুবার থামানো হলো। ওকে। কাগজ-পত্রে চোখ বুলিয়ে, গতিবিধি সম্পর্কে দুএকটা প্রশ্ন। করে ছেড়ে দিল। ধীর পায়ে ব্যারিয়ারের দিকে এগোল রানা।

জসেস্কু কতটা পিছনে, ওর কোন ধারণা নেই। তার জন্যে ওকে অপেক্ষা করতে হবে-ব্যারিয়ার টপকানো যদি সম্ভব হয়।

ব্যারিয়ারের সামনে যারা দাঁড়িয়ে রয়েছে কেউ মেজর পদের নিচে নয়। গলায় লুপ জড়িয়ে যাকে মেরেছে রানা, তার চেয়ে এদের চেহারায় ক্ষমতা আর কর্তৃত্বের ভাব অনেক বেশি। এদের একজন ছয় ফিটের মত লম্বা, মাথায় খয়েরী চুল, মুখে কাঁচা হাতের প্লাস্টিক সার্জারি, রানা দূরে থাকতেই ওকে খুঁটিয়ে দেখতে শুরু করল। লোকটার পাশে এক তরুণ অফিসার, তার হাতেই নিজের কাগজ-পত্র ধরিয়ে দিল রানা। খয়েরী চুল ঠাণ্ডা চোখে সারাক্ষণ তাকিয়ে থাকল রানার দিকে। চোখাচোখি হতে হাসল লোকটা, মনে হলো রাবারের ঠোঁট একটু প্রসারিত হলো মাত্র। কৃত্রিম গালে অস্বাভাবিক লম্বা আঙুল ঘষল সে।

ইংরেজ? তরুণ অফিসার জানতে চাইল।

কি…ও, হ্যাঁ।

হুম। মি. ডিকেনস, টেবিলের ওদিকে আপনাকে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে। আমরা আপনার হোটেলের সাথে যোগাযোগ করব।

কেন? হাসছে রানা, চোখে কৌতুক। আমার কাগজ কি ঠিক নেই?

ঠিক তো আছেই, আপনার পাসপোর্ট আর অন্যান্য কাগজে সিকিউরিটি সার্ভিসের স্ট্যাম্পও রয়েছে। তবু, অপেক্ষা আপনাকে করতে হবে।

স্রেফ কৌতুহল, বলল রানা। ব্যাপারটা কি বলবেন? কি হয়েছে? কাকে ধরার চেষ্টা করছেন আপনারা?

ড্রাগ ব্যবসায়ীদের, বলল তরুণ অফিসার। আপনার সাথে নিশ্চয়ই হিরোইন বা আর কিছু নেই, মি. ডিকেনস?

মুখ টিপে হাসল রানা। আছে।

সিনিয়র অফিসার, খয়েরী চুল, ঠাণ্ডা গলায় বলল, আপনি খুব রসিক, মি. ডিকেনস।

কিন্তু তাই বলে এই বিপুল আয়োজন? ভুরু কুঁচকে জানতে চাইল রানা।

আপনি সোভিয়েত ইউনিয়নের মাটিতে দাঁড়িয়ে রয়েছেন, মি. ডিকেনস, জবাব দিল সিনিয়র অফিসার। এখানে ক্রাইমের হার খুব কম। ক্রাইম যাতে মাথাচাড়া দিতে না পারে, তাই এমনকি সামান্য একটা ছিচকে চোরের পিছনেও গোটা পুলিস আর গোয়েন্দা বিভাগকে লেলিয়ে দেয়া হয়।

গাম্ভীর্যের সাথে এমন একটা মুখভঙ্গি করল রানা, যেন সাংঘাতিক প্রভাবিত হয়েছে। তরুণ অফিসার ব্যারিয়ারের একটা। প্রান্ত উঁচু করে ধরল, তারপর ইঙ্গিত করল রানাকে। ব্যারিয়ারের তলা দিয়ে একটা টেবিলের পাশে গিয়ে দাঁড়াল রানা। অনেকগুলো ফোল্ডিং চেয়ার, কিন্তু একটাও খালি নেই। যারা বসে আছে তাদের মধ্যে রাশিয়ান ছাড়াও বিদেশী কিছু লোককে দেখা। গেল। একজন আমেরিকানকে বলতে শুনল ও, দেখো, সোনা, আমার পাসপোর্টকে চ্যালেঞ্জ করার কোন অধিকার তোমার নেই।

রগচটা চেহারার এক কে.জি.বি. অফিসার তার মন্তব্যে কান না দিয়ে ফোনের রিসিভার তুলে ডায়াল করতে শুরু করল।

বসার জায়গা না পেয়ে টেবিলের এক কোণে বসে পড়ল রানা। লালমুখো এক অফিসার হিংস্র ভঙ্গিতে তাকাল ওর দিকে, কিন্তু কিছু বলতে গিয়েও বলল না। আয়োজন দেখে দুশ্চিন্তাই হলো রানার। টেবিল-চেয়ার দেয়ার মানে এখানে বসিয়েই প্রথম দফা ইন্টারোগেট করা হবে। সময় এই মুহূর্তে প্রাণের মতই মূল্যবান। দেরি হলে ফেঁসে যাবে ও। যে কোন মুহূর্তে মেজরের খোঁজ পড়তে পারে। তারপর তার লাশ খুঁজে পাওয়া মাত্র কয়েক মিনিটের ব্যাপার।

একটা ঢোক গিলে ব্যারিয়ারের দিকে তাকাল ও। একজন অফিসারের কাছ থেকে কাগজ-পত্র ফিরিয়ে নিয়ে ব্যারিয়ার। টপকাল জসেস্কু, গেট দিয়ে বেরিয়ে স্টেশনের বাইরের অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে গেল। একা একা লাগলেও, স্বস্তি অনুভব করল রানা।

তরুণ অফিসার এগিয়ে এল এতক্ষণে, টেবিলের পিছনের। চেয়ারে বসে হাত বাড়াল টেলিফোনের দিকে। রানার চোখে তাকিয়ে অভয় দিয়ে হাসল সে। আপনি কোন বিপদে পড়বেন না, আশা করতে দোষ কি?

.

স্পুতনিক হোটেলের নাম্বারে ডায়াল করল অফিসার। মনের ভেতর ঝড় বয়ে যাচ্ছে রানার। দুনিয়ার সবচেয়ে বড়, সবচেয়ে নিষ্ঠুর আর পরিশ্রমী সিকিউরিটি সার্ভিসের পাল্লায় পড়েছে সে। সি.আই.এ. কর্মকর্তাদের ধারণা, এত বড় বলেই কে.জি.বি. হাস্যকরভাবে অযোগ্য-কথাটা স্মরণ করেও স্বস্তি পেল না রানা।

হোটেল স্পুতনিক? রুশ ভাষায় জানতে চাইল তরুণ অফিসার। চোখে কৌতুক আর ঠোঁটে মৃদু হাসি নিয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে থাকল রানা, যেন টেলিফোন আলাপের ব্যাপারে তার কোন মাথাব্যথা নেই। হা-স্টেট সিকিউরিটি। বুদায়েভের সাথে কথা বলতে দিন, প্লীজ। বুদায়েভ নিশ্চই কে.জি.বি-র ইনফরমার ডেস্ক ক্লার্ক হতে পারে, ওয়েটার হতে পারে, কিংবা হয়তো থালাবাসন ধোয়। হলে হবে কি, ম্যানেজারের চেয়ে তার ক্ষমতা অনেক বেশি।

বেশ অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পর অপরপ্রান্তে বুদায়েভকে পেল তরুণ অফিসার। বুদায়েভ-এখানে একজন ট্যুরিস্ট রয়েছেন, মি. চার্লস ডিকেনস। তিনশো আট নম্বর রূম বুক করেছেন উনি…হ্যাঁ, ওঁকে তুমি জানো। বলো তাহলে, ভদ্রলোক কেমন দেখতে? মি. ডিকেনস, প্লীজ, আমার দিকে তাকান। ধন্যবাদ। হ্যাঁ, বলো, বুদায়েভ, হুম। হা…হা-আচ্ছা। উনি ওখানে নেই বলছ? এরপর আবার বেশ খানিকক্ষণ অপেক্ষা। অফিসারের দিকে তাকিয়ে আছে রানা, জিওনিস্ট ইন্টেলিজেন্স আর সি.আই.এ-কে ধন্যবাদ দিচ্ছে মনে মনে। গুড, টেলিফোনে বলল অফিসার। ধন্যবাদ, বুদায়েভ, গুড্রাই।

পাসপোর্ট সহ অন্যান্য কাগজ ফিরে পেল রানা। ধন্যবাদ, মি. ডিকেনস। আপনাকে যদি দেরি করিয়ে দিয়ে থাকি, সেজন্যে আমরা দুঃখিত। আপনি যেতে পারেন।

সিনিয়র অফিসারকে পাশ কাটাবার সময় লোকটাকে হাসতে দেখল রানা। প্লাস্টিক সার্জারির কারণে তার মুখের একটা পাশ নড়েচড়ে না। বীভৎস লাগল হাসিটা।

বাইরে বেরিয়ে আসতেই চারদিক থেকে হেঁকে ধরল কনকনে ঠাণ্ডা। গায়ে বাতাস লাগতে টের পেল রানা, শরীরটা ঘামে ভিজে রয়েছে ওর। চারদিকে তাকাল ও, একটা গাঢ় ছায়া থেকে বেরিয়ে আসতে দেখল জসেস্কুকে। খুব যে একটা খুশি হলো রানা তা নয়। এদের ওপর কতটা ভরসা করা যায় এখনও বুঝতে পারছে না ও। চমৎকার, সামনে এসে বলল জসেস্কু। আপনার সাহসের আমি তারিফ করি। কিন্তু অনেক সময় নষ্ট হয়েছে, খানিক পর রাস্তায় থাকাটাই বিপজ্জনক হয়ে উঠবে-যত নিখুঁত কাগজই থাক সাথে। আপনি আমার আগে আগে যান, কিরভ স্ট্রীট ধরে। স্টেশন এলাকা পেরিয়ে যাবার পর আবার আমরা একা হব, কোনদিকে যাচ্ছি দেখাব আপনাকে। ঠিক আছে তো?

.

ভোর অন্ধকারে ওদের দুজনকে গ্রেফতার করা হলো।

দুজনেই সংসারী মানুষ, মিরা প্রসপেক্ট এলাকায় শ্রমিকদের। বহুতল ভবনের সতেরো আর উনিশতলায় দুটো ফ্ল্যাটে থাকে। জসেস্কু আর পরচয়ের সহকারী এরা, কে.জি.বি-র খাতায় অনেক। দিন হলো এদের নাম টোকা আছে।

ওদেরকে গ্রেফতার করতে এল মেজর রোমানভ। কাঁচা ঘুম থেকে তুলে নিচে নামানো হলো দুজনকে। গাড়িতে তোলা হলে। দযেরঝিনস্কি স্ট্রীট, কে.জি.বি. হেডকোয়ার্টারের দিকে রওনা হয়ে গেল গাড়ি।

নিজের গাড়িতে উঠে মেজর রোমানভ তার লোকদের নির্দেশ। দিল, কাজে যখন হাত দিয়েছি, এসো শেষ করি। সার্ভেইলেন্স টীমকে অর্ডার দাও, ওয়্যারহাউসে ঢুকে পড়ক। জসেস্কুকে চাই আমি। ধরে হেডকোয়ার্টারে নিয়ে যেতে বলো ওকে।

ঘটাং করে ভ্যানের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল জসেস্কু, ঘুম ভেঙে গেল রানার। ক্যাব-এর ঠিক পিছনে, একটা মোটা কম্বলের ওপর শুয়ে আছে ও। উঠে বসে হাই তুলল, আড়মোড়া ভাঙল, তারপর হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে খুব করে রগড়াল চোখ দুটো। ভ্যানটা রয়েছে একটা ওয়্যারহাউসের ভেতর, এটা মস্কোর স্যানিটারী ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানীর নিজস্ব গুদামঘর। চোখ থেকে হাত সরিয়েও জসেস্কুকে দেখতে পেল না রানা। ভ্যানের ওপর ল্যাভেটরি বাউল আর সিস্টার্ন-এর স্থূপ উঁচু হয়ে রয়েছে, তার আড়ালে কি যেন করছে জসেস্কু। জিনিসগুলো আজ কুইবিশেষে নিয়ে যাবে সে, ওখানে একটা নতুন হোটেল তৈরি হচ্ছে, এই টয়লেট সামগ্রী তারাই অর্ডার দিয়েছে। কুইবিশেভ বিলিয়ারস্ক থেকে একশো মাইল দক্ষিণে ছোট একটা শহর, মস্কো থেকে কুইবিশেভের দূরত্ব সাতশো মাইলের কিছু বেশিই হবে।

মি. ডাভ, জেগে আছেন?

হ্যাঁ। কটা বাজে?

সাড়ে পাঁচটা। ছটায় বিলিয়ারস্কের পথে রওনা হয়ে যাব আমরা, বলল জসেস্কু। বুড়ো চাচা কফি বানিয়েছে, যদি চান এক মগ খেয়ে নিতে পারেন।

ভ্যান থেকে জসেস্কুর নেমে যাবার শব্দ পেল রানা। কংক্রিটের মেঝে ধরে খানিক দূর এগোবার পর সিঁড়ির কয়েকটা ধাপ বেয়ে মিলিয়ে গেল আওয়াজটা। একটা দরজা খোলার শব্দ হলো।

রাতে ভাল ঘুম হয়নি রানার। কিরভ স্ট্রীট থেকে এই ওয়্যারহাউস বেশি দূরে নয়। কমসোমলস্কায়া মেট্রো স্টেশন থেকে মাত্র সিকি মাইল হবে। জসেস্কু ওকে এখানে নিয়ে আসে। রাত একটার পর। তার কাছ থেকে নতুন কাগজ-পত্র বুঝে নেয়। রানা। এবার ও রাশিয়ান সাজে, নাম আলেক্সি অরলভ, ঠিকানা মিরা প্রসপেক্টস-এর সাতাশ নম্বর বহুতল ভবনের একটা ফ্ল্যাট। ড্রাইভার জসেস্কুর সহকারী সে। অরলভ বিবাহিত, দুই সন্তানের। জনক। বাস্তবেও ওই ঠিকানায় আছে লোকটা, জসেস্কুর হুকুম না পেলে ঘরের বাইরে বের হবে না।

কাগজ-পত্র যা ছিল তা তো মুখস্থ করতেই হলো, তার। বাইরেও অরলভ সম্পর্কে প্রচুর তথ্য জসেস্কুর কাছ থেকে জেনে নিল রানা। ফলে শুতে সাড়ে তিনটে বেজে গিয়েছিল।

ভ্যানের পিছন থেকে নেমে এল ও। কাল রাতে জসেস্কুর সাথে কথা বলার পর তার সম্পর্কে আগের ধারণা একটু পাল্টেছে ওর। পিটি ডাভের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে চেষ্টার কোন ত্রুটি করেনি লোকটা। মস্কোর মত একটা শহরে থেকে এ-ধরনের কাজ করা, প্রতি মুহূর্তে প্রাণের ওপর ঝুঁকি নিতে হয়। কে.জি.বির চোখ ফাঁকি দিয়ে গা চুলকাবারও উপায় নেই। এই পরিস্থিতিতে কয়েক সেট পরিচয়-পত্র যোগাড় করা অসাধ্য সাধনই বলতে হয়। লোকটার সাথে কথা বলে আরও একটা ব্যাপার উপলব্ধি করেছে রানা। রাশিয়ানদের প্রতি তার বিজাতীয় একটা ঘৃণা রয়েছে। লোকটার ব্যক্তিগত দুএকটা কথাও জেনে ফেলেছে রানা। বিড় বিড় করে বলে ফেলেছে ওয়্যারহাউসের নাইটগার্ড-বুড়ো চাচা। জসেস্কুর স্ত্রীও ইহুদি, বছর সাতেক হলো জেল খাটছে। ইহুদি সম্প্রদায়ের ওপর অত্যাচার চালানো হচ্ছে, তার বিরুদ্ধে শ্লোগান লেখা পোস্টার দেয়ালে সাঁটার সময় গ্রেফতার করা হয় তাকে। স্ত্রীর সাথে দেখা করার অনেক চেষ্টা করেছে। জসেস্কু, কিন্তু অনুমতি মেলেনি। নানা গুজব কানে আসে তার। কেউ বলে সে নেই। কেউ বলে তাকে সাইবেরিয়ায় পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে।

ওয়্যারহাউসের ডিসপ্যাচ-অফিসে বসে রয়েছে জসেস্কু আর বুড়ো চাচা। মাত্র সকাল হচ্ছে, স্টাফরা এখুনি কেউ আসবে না। ভেজানো দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকল রানা, মুখ তুলে তাকাল জসেস্কু। তাকাল, তাকিয়েই থাকল। ভাবল, এই নোক পারবে তো? তাদের আশা পূরণ হবে? ইসরায়েলের মাটিতে পৌঁছুবে দুনিয়ার সেরা যুদ্ধবিমান?

সিলিং থেকে ঝুলছে নগ্ন একটা বালব। রানা একটা চেয়ার টেনে টেবিলের সামনে বসার পরও একদৃষ্টে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল জসেস্কু। বুড়ো চাচা এক মগ ধূমায়িত কফি রাখল রানার সামনে। চুমুক দিয়ে মুখ বাঁকাল রানা। চিনি দুধ ছাড়া কফি। তবে আগুনের মত গরম। জসেস্কুর ইঙ্গিত পেয়ে অফিস কামরা থেকে বেরিয়ে গেল বুড়ো চাচা।

ও দেখতে গেল, এখানে আমাদের ওপর চোখ রাখা হয়েছে কিনা, বলল জসেস্কু।

তারমানে… দ্রুত শুরু করল রানা।

না-আপনি এখানে আছেন তা ওরা জানে না। কাল রাতে যারা পিছু নিয়েছিল বা স্টেশনে যারা কাগজ-পত্র চেক করল, আমি তাদের কথা বলছি না। কে.জি.বি-র যে ডিপার্টমেন্ট এয়ারকিঙের সিকিউরিটির দায়িত্বে রয়েছে, তারা আমার পরিচয় জানে। অনেকদিন থেকেই আমাদের ওপর নজর আছে ওদের। এখন যখন টেস্ট-ফ্লাইটের আর দেরি নেই… হাতঘড়ি দেখল সে, আর ত্রিশ ঘণ্টা পর এয়ারকিং নিয়ে আকাশে উঠবেন। আপনি… স্বাভাবিকভাবেই আমাদের ওপর খুব কড়া নজর রাখবে ওরা।

তাহলে এখানে দেরি করার মানে কি? জিজ্ঞেস করল রানা। আমরা রওনা হয়ে গেলেই তো পারি।

ওরা পিছু নিলে বিপদে পড়ব, সন্দেহ নেই, বলল জসেস্কু, কিন্তু টাইম শিডিউল ভাঙি কি করে? ভাঙলে আরও জটিল সব অসুবিধের মধ্যে পড়ে যাব।

আমি বিলিয়ারস্কের পথে রওনা হয়ে গেছি ওরা জানবে?

নাও জানতে পারে। ওরা হয়তো স্রেফ লক্ষ রাখছে আমাদের। ওপর, পিছু নাও নিতে পারে।

কিন্তু পথে যদি থামায়? জানতে চাইল রানা।

তার জন্যে অন্যরকম আয়োজন করা আছে, বলল জসেস্কু। গম্ভীর দেখাল তাকে।

আমাকে জানতে হবে।

জসেস্কু চুপ করে থাকল। যেন রানার কথা শুনতে পায়নি সে।

আজ আমাকে ছশো মাইল পেরোতে হবে, জসেস্কু, শন্ত গলায় বলল রানা। পথে কত রকম বিপদ হতে পারে। সব কথা আমার জানা উচিত না?

দুঃখিত, মি. ডাভ, প্রায় অস্ফুটে বলল জসেস্কু। শুধু একটা কথা জেনে রাখুন, যেভাবে হোক আপনাকে আমি বিলিয়ারস্কে পৌঁছুবার সুযোগ করে দেব। ধীরে ধীরে তার চেহারায় দৃঢ় প্রতিজ্ঞার একটা ভাব ফুটে উঠল। আমার ওপর অর্ডার আছে। দরকার হলে চাইম জসেস্কু এই দুনিয়ায় থাকবে না।

স্তব্ধ হয়ে গেল রানা।

আমাকে ফ্যানাটিক ভাববেন না, বলল জসেস্কু। ভাববেন না, মরার নেশায় মরতে চাইছি। এটা আমার রাশিয়ার ওপর প্রতিশোধ, ইসরায়েলের প্রতি ভালবাসা, স্ত্রীর কাছে ওয়াদা-একটা এয়ারকিং হারালে ওদের আঁতে ঘা লাগবে, ওই ঘা দিতে পারলে মরতেও আমার আপত্তি নেই।

রানার মুখে কথা যোগাল না।

নড়েচড়ে বসল জসেস্কু, মুখ তুলে বলল, এখান থেকে নিরাপদে একবার বেরিয়ে যেতে পারলে, সেই সার্কুলার মটরওয়েতে না পৌছানো পর্যন্ত আমাদেরকে আর থামানো হবে না। যদি কোন বিপদ দেখা দেয়, ওখানে আমাদের জন্যে আরেকটা গাড়ি অপেক্ষা করবে, তাতে উঠে চলে যাবেন আপনি। আর যদি বিপদ না হয়, আমিই আপনাকে নিয়ে যাব।

মাথা ঝাঁকাল রানা।

পাশের কামরায় শেভ করার সরঞ্জাম আছে। ইচ্ছে করলে আপনি গোসলও করে নিতে পারেন। তবে তাড়াতাড়ি।

কামরা থেকে বেরিয়ে আসবে রানা পিছন থেকে জসেস্কুর গলা শুনল। মি. ডাভ সত্যি আপনি প্লেনটা চালাতে পারবেন? ইসরায়েলের মাটিতে ওটা পৌঁছুবে?

ধীরে ধীরে ঘাড় ফেরাল রানা। জসেস্কু তার কফির খালি মগের ভেতর তাকিয়ে আছে, দুহাত দিয়ে আঁকড়ে ধরে আছে।

মগটা, কনুই দুটো কাঠের টেবিলে। নীল ওভারঅল পরা প্রকাণ্ড শরীরটা কেমন যেন সিঁটকে আছে বলে মনে হলো।

পারব, বলল রানা। তবে ইসরায়েলে নিয়ে যেতে পারব কিনা আমাকে জিজ্ঞেস করবেন না।

জানি, গোটা সোভিয়েত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়তে হবে আপনাকে, ফেঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল জসেস্কু। তারপর ক্ষীণ একটু হাসি দেখা গেল তার ঠোঁটের কোণে। কিন্তু আমি তবু আশাবাদী। কারণ জানি, এয়ারকিংকে বাধা দেয়ার মত কিছু নেই ওদের হাতে।

পাশের কামরায় চলে এল রানা। কাল রাতে জসেস্কু ওর চুল কেটে দিয়েছে, মাথাটা ধুয়ে নিল ও। তারপর দাড়ি কামাল। তৈরি হয়ে অফিস কামরায় ফিরে দেখল বেরিয়ে পড়ার জন্যে এক পা হয়ে আছে জসেস্কু। বুড়ো চাচা উঁকি দিল একবার, বিড়বিড় করে কিছু বলে আবার চলে গেল।

বাইরে এসে গেছে ওরা, বলল জসেস্কু। তার চেহারায় চাপা। উত্তেজনা।

কজন ওরা?

একটা গাড়িতে-তিনজন। বুড়ো চাচা আগেও ওদের দেখেছে। বিলিয়ারস্ক সিকিউরিটি টীমেরই অংশ এরা। মস্কোয়। এরা মি. ফ্লেমিঙের পিছনে ঘুর ঘুর করে, বিলিয়ারস্ক থেকে পিছু। নেয় মোলায়েভের-মোলায়েভ মুদি…।

বাধা দিয়ে রানা জানতে চাইল, মাত্র তিনজন?

হ্যাঁ। বুড়ো চাচারও ধারণা অন্য কোন উদ্দেশ্য থাকলে দল ভারী করে আসত ওরা। ওভারঅলের পকেট থেকে একটা। আটোমেটিক বের করল জসেস্কু। চালাতে জানেন?

অটোমেটিকটা হাতে নিয়ে উল্টেপাল্টে দেখল রানা। একটা ম্যাকারভ, আগে কখনও দেখেনি ও। ওয়ালথার পি-টোয়েনটি এইটের সাথে অনেক মিল আছে, কিন্তু রেঞ্জের ব্যাপারে কিছু বলা। কঠিন। মাথা ঝাঁকাল ও।

গুড। তবে একেবারে চরম বিপদ না দেখলে এটা ব্যবহার। করবেন না।

ঠিক আছে।

আপনি রেডি? হাতঘড়ি দেখল জসেস্কু। ছটা বেজে কয়েক মিনিট।

ভেন্টিলেটরের দিকে তাকাল রানা। হ্যাঁ। বাইরে এখনও ভাল করে আলো ফোটেনি।

বিশাল ভ্যানের ক্যাব-এ এসে উঠল ওরা। ওয়্যারহাউসের জোড়া দরজার দিকে মুখ করে রয়েছে ওটা। স্টার্ট দিল জসেস্কু, হেডলাইট জ্বালল। দরজার পাশে বুড়ো চাচাকে দেখল রানা। দরজা খুলে যেতে শুরু করল। গিয়ার দিল জসেস্কু, ভ্যানের চাকা গড়াতে শুরু করল। দিনের আবছা আলোয় বেরিয়ে এল ওরা। রাস্তার প্রায় শেষ মাথায় কালো একটা সিডান দেখল রানা।

সরু রাস্তা। দক্ষ হাতে বন বন করে হুইল ঘুরিয়ে ভ্যান সিধে করল জসেস্কু। কালো সিডান ওদের পিছনে দাঁড়িয়ে থাকল। কিরভ স্ট্রীটে পড়ল ভ্যান। একটু একটু দিনের আলো ফুটছে, সেই সাথে ম্লান হয়ে আসছে স্ট্রীট ল্যাম্পের আলো। নির্জন রাস্তা, কালো সিডান পিছু নেয়নি। বাঁক নিয়ে চোখের আড়ালে চলে গেল ভ্যান। কালো সিডানের ভেতর ওরা কেউ অস্থির হলো না। তিনজনের মধ্যে যার বয়স বেশি, অলস ভঙ্গিতে হাত বাড়িয়ে ফোনের রিসিভার তুলে নিল। ডায়াল করতে হলো না, রিসিভার তোলার মুহূর্তেই কে.জি.বি. কর্নেল সাসকিনের সাথে সরাসরি যোগাযোগ ঘটে গেছে। এইমাত্র রওনা হলো ওরা-দুজন। হ্যাঁ, স্যানিটারী ওয়্যার ডেলিভারি ভ্যানে করে। এখন আমরা কি করব, কমরেড কর্নেল?

কয়েক সেকেন্ড চুপচাপ, তারপর নির্দেশ এল, মেজর রোমানভ মিরা প্রসপেক্ট-এ রয়েছে, ওর সাথে কথা বলে নিই। আপাতত শুধু পিছু লেগে থাকো, তবে খুব বেশি কাছে যাবার দরকার নেই, কুজভ।

ধন্যবাদ, কর্নেল, ক্যাপ্টেন কুজভ ড্রাইভারের উদ্দেশে মাথা ঝাঁকাল। স্টার্ট নিল সিডান। ওয়্যারহাউসের জোড়া দরজার সামনে দিয়ে তীর বেগে ছুটে চলে এল কিরভ স্ট্রীটের মুখে। রাস্ত রি শেষ মাথায় কালো একটা ছায়ার মত দেখাল ভ্যানটাকে, শহরের ইনার রিঙ রোড সাদোরভায়া-র দিকে এগোচ্ছে।

একেবারে কাছে যাবার দরকার নেই, কুজভ বলল, কিন্তু চোখের আড়াল করা চলবে না।

দেঁতো হাসি দেখা গেল ড্রাইভারের মুখে। জ্বে-আজ্ঞে, কমরেড। কয়েক মিনিটের মধ্যে ভ্যান আর সিডানের মাঝখানের। দূরত্ব কমিয়ে একশো গজের মধ্যে আনল সে। সাদোভায়ায় ঢোকার মুখে গতি মন্থর হলো ভ্যানের। তারপর বাঁক নিল ডান দিকে।

কর্নেল, কর্নেল, রিসিভারে দ্রুত কথা বলছে ক্যাপ্টেন, ওরা এখন সাদোভায়া-তে, দক্ষিণ-পুব দিকে যাচ্ছে।

হেডকোয়ার্টার থেকে কর্নেল সাসকিন বলল, চাইম জসেস্কুকে গ্রেফতার করো। অরলভ আর মুন্তাকিভকে গ্রেফতার করে এইমাত্র। হেডকোয়ার্টারে নিয়ে আসা হয়েছে। জসেস্কুর সাথে অপর লোকটা কে বলতে পারো?

ঠিক জানি না, কমরেড কর্নেল। তবে মনে হয়…

তাই। অপর লোকটা হওয়া উচিত অরলভ। জসেস্কু যদি সত্যি মাল ডেলিভারি দেয়ার জন্যে রওনা হয়ে থাকে, তার সাথে তো সহকারী অরলভেরই থাকার কথা।

চেক করলে দেখা যাবে অরলভের কাগজই লোকটার কাছে। রয়েছে, বলল অফিসার। কার্ল মার্ক্স স্ট্রীটে ঢুকল ভ্যান। মনে হচ্ছে শহর থেকে বেরিয়ে যেতে চাইছে ওরা…

জসেস্কু কোথায় মাল ডেলিভারি দেবে জানো?

খোঁজ নিয়ে দেখতে হবে, কমরেড কর্নেল।

যদি মটরওয়ে ধরে, ট্রাভেল কন্ট্রোলে রিপোর্ট করতে হবে ওদের, বলল কর্নেল। তখন জানা যাবে, কোথায় ডেলিভারি। দেবে। চেক পয়েন্ট পর্যন্ত পিছনে থাকো, কুজভ। ইতিমধ্যে এখানে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলব কি করা হবে। মেজর রোমানভ জেরা করছে অরলভ আর মুন্তাকিভকে। হয়তো ওদের কাছ থেকে কিছু জানা যেতে পারে। যোগাযোগ বিছিন্ন হয়ে গেল।

বাকুনিস্কায়া স্ট্রীটে পড়ল ভ্যান। শহর থেকে বেরিয়ে এসে উত্তর-পুব দিকে তাড়া খাওয়া ইঁদুরের মত ছুটছে। গোর্কি রোডের দিকে যাচ্ছে ওরা।

বাঁ দিকে বাঁক নিচ্ছে ভ্যান, কমরেড, বলল ড্রাইভার। মস্কোভার শাখা নদী আউজা পেরিয়ে এল সিডান। আউজা এখানটায় দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হচ্ছে, আরও খানিক দূর এগিয়ে উসতিনস্কি ব্রিজের কাছে মূল নদীর সাথে মিলিত হবে। ব্রিজ পেরিয়ে এসে বাঁ দিকে ঘুরল ভ্যান। পিছু লেগে থাকল সিডান। ওরা কি আমাদের চিনতে পেরেছে, কমরেড?

সম্ভব, বলল কুজভ। গোর্কি রোডে ঢুকছে, তাই না? ওই তো, যা ভেবেছি, খৃচলকোভস্কোয়ে ওয়ে ধরল-পুব দিকে যাচ্ছে।

হ্যাঁ, গোর্কির দিকে যাচ্ছে সন্দেহ নেই, সায় দিল ড্রাইভার। এবং তারপর কাজান। সবশেষে…?

জানি, জানি। সেটা কর্নেলের মাথাব্যথা।

কর্নেল শুধু শুধু খেলাচ্ছে, তৃতীয় লোকটা এই প্রথম কথা বলল। প্যাসেঞ্জার সীটের এক কোণে জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে। সে, চোখ দুটো বন্ধ। আমি হলে জসেস্কু ব্যাটাকে হেডকোয়ার্টারে ধরে নিয়ে গিয়ে অ্যায়সা পাদানি দিতাম…

তুমি জেগে আছ? বিদ্রুপের সুরে জানতে চাইল কুজভ।

যা চেঁচামেচি শুরু করেছ, ঘুম কি আর আসে!

*

এই চেক-পয়েন্টে ওরা আপনার ফটো তুলবে। রাস্তার ধারে, ভারী মালবাহী ট্রাকগুলোর পিছনে ভ্যান দাঁড় করাল জসেস্কু।

উইন্ডস্ক্রীন দিয়ে সামনে তাকিয়ে রানা দেখল, চেক-পয়েন্টের লোকজন সবাই খুব ব্যস্ত। ভ্যানটাকে থামতে দেখল অনেকেই, কিন্তু কেউই বিশেষ মনোযোগ দিয়ে তাকাল না। আঁটসাঁট ব্রাউন রঙের ইউনিফর্ম পরা একজন সৈনিক ক্যাব-এর জানালা ঘেঁষে হেঁটে গেল। এরা কি কে.জি.বি-র লোক?

না-রেড আর্মি। তবে এদের লীডার একজন কে.জি.বি.. অফিসার। ওদিকে, ওই যে একচালা ঘরটা দেখছেন, ওখানে বসে সে। জসেস্কুর দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকাল রানা। কাঠের একটা। ঘর, দরজার সামনে চেয়ারে বসে একজন লোক সিগারেট টানছে, পরনে সাদা পোশাক।

কি হয় এখানে-শুধু কাগজ-পত্র চেক করে, নাকি আরও ঝামেলা আছে?

সাধারণত কাগজ-পত্র দেখে ছেড়ে দেয়া হয়, বলল। জসেস্কু। আর ফটো তোলা হয় অফিসের পাশে ওই যে ছোট্ট ঘরটা দেখছেন, ওখান থেকে। হাসবেন না, ওরা ধরে নেবে নিশ্চই কিছু গোপন করার আছে আমাদের। একটা চুরুট ধরাল সে। আসুন, নামি।

দরজা খুলে নেমে পড়ল রানা। ওর হাতের তালু ঘামছে। পিছন দিকে তাকাতে ইচ্ছে হলো, কিন্তু তাকাল না। সারাটা পথ পিছু নিয়ে এসেছে কালো সিডান। আরোহীদের চেহারা দেখতে পেলে ভাল হত।

ভ্যানের সামনে তিনটে ট্রাক ছিল, এক এক করে ব্যারিয়ার পেরিয়ে চলে গেল ওগুলো। ক্যাবে উঠতে যাবে জসেস্কু, একজন সৈনিক হন হন করে এগিয়ে এল ওদের দিকে। এক মিনিট, কমরেড, বলল সে। ভ্যান এখানেই থাকুক, কগজগুলো আমাকে। দিন।

চেহারায় বিস্ময় ফুটিয়ে তুলল জসেস্কু, দেখাদেখি রানাও। সৈনিক কোন ব্যাখ্যা দিল না, ওরাও কিছু জানতে চাইল না। কিন্তু। মনের অবস্থা দুজনেরই কাহিল। সামনে গাড়ি না থাকলে। ব্যারিয়ারের সামনে থামতে হয়, এটাই নিয়ম। ওদের বেলা সে নিয়ম বাতিল করা হলো কেন?

কাগজগুলো নিয়ে অফিস কামরায় ঢুকল সৈনিক। চেহারায় জোর করা নির্লিপ্ত ভাব নিয়ে চুরুট ফুকে চলেছে জসেস্কু, যেন কিছুতেই তার কিছু এসে যায় না। নিজের চারদিকে ভাল করে তাকাবার ঝোঁকটা চেপে রাখল রানা। জানে, নজর রাখা হচ্ছে। ওদের দিকে।

তিনটে লাইন ধরে ব্যারিয়ারের সামনে থামছে গাড়িগুলো। ভ্যানের পিছনে কয়েকটা ট্রাক এসে থামল। একজন সৈনিকের নির্দেশে ভ্যানকে পাশ কাটিয়ে ব্যারিয়ারের দিকে এগোল ট্রাক ড্রাইভাররা। বিশাল কংক্রিটের পিলারের মাথায় চওড়া মটরওয়ে-ওদের মাথার ওপর। ট্রাফিকের একটানা গমগমে আওয়াজ আসছে।

সিডানের একজন লোক এইমাত্র অফিসে ঢুকল, বিড়বিড় করে বলল জসেস্কু। গাড়িটা কোথায়, দেখেছেন?

আপনার ধারণা, পালাতে হতে পারে? জানতে চাইল রানা।

মাথা নাড়াল জসেস্কু। মনে হয় না। এখনও ওদের কাছে আপনার কোন গুরুত্ব নেই। গ্রেফতার করলে আমাকে করবে…ওই, আমাদের কাগজ ফিরে আসছে!

কংক্রিটের ওপর দিয়ে গট গট করে হেঁটে এল সৈনিক। তার হাত থেকে কাগজ নিয়ে চোখ বুলাল জসেস্কু। সেই গোর্কি পর্যন্ত মেইন রোড ধরে ভ্রমণ করতে পারবে ওরা-লিখিত অনুমতিসহ সীল মেরে দিয়েছে। গোর্কিতে পৌঁছে নতুন পারমিট দরকার হবে ওদের, পুব দিকে কাজান পর্যন্ত যাবার জন্যে। তারপর কাজান থেকে কুইবিশেভ যেতে হলে আরেকটা পারমিট লাগবে।

কাগজগুলো ধরিয়ে দিয়ে ফিরে যাচ্ছে সৈনিক। চুরুট ফেলে জুতো দিয়ে মাড়াল জসেস্কু। উঠে পড়ল ক্যাব-এ। অফিস দরজার দিকে একবারও না তাকিয়ে তার পিছু পিছু রানাও ভ্যানে চড়ল। স্টার্ট দিল জসেস্কু। হেলেদুলে এগোল ভ্যান। লাল আর। সাদা রঙের ব্যারিয়ার উঠে গেল আকাশের দিকে। ব্যারিয়ারের পর রাস্তাটা ঢালু হয়ে নেমে গোর্কি যাবার মটরওয়েতে পড়েছে।

লাঞ্চ খাব গোর্কিতে, আর চা খাব কাজানে। নাকি। ইসরায়েলিরা চা খায় না? মুচকি মুচকি হাসছে জসেস্কু।

পিছনে আছে ওরা?

উইং-মিররে তাকাল জসেস্কু। নেই। এবার হয়তো অন্য। কোন গাড়ি পাঠাবে। কিছু এসে যায় না-কে.জি.বি. আতঙ্কিত নয়, পিছু নিয়েছে স্রেফ কৌতূহলে। তবে, আপনার পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হবার চেষ্টা করবে ওরা।

আমি অরলভ, ওরা বিশ্বাস করছে না?

এখনও হয়তো করছে, বলল জসেস্কু। কিন্তু আপনার ফটো স্টেট হাইওয়ে মিলিশিয়ার রেকর্ড অফিসে পৌঁছুলেই। গোলমাল বেধে যাবে। অরলভের ফটোর সাথে মিলবে না ওটা।

কখন পৌঁছুবে?

আজ বিকেলে। তখন ওরা জানতে চাইবে আসলে আপনি কে।

রাস্তা থেকে গ্রেফতার করে হেডকোয়ার্টারে নিয়ে যাবে, স্বগতোক্তি করল রানা।

হয়তো। কিন্তু বিলিয়ারস্কের ওরা ভারি অবিশ্বাসী। আশা করতে দোষ কি আমাদের নিয়ে অপেক্ষার খেলা খেলবে ওরা? চিন্তার। কিছু নেই, যখন যেখানে থামছি বা থামব, সবখানে আপনার। নিরাপত্তার জন্যে বিকল্প ব্যবস্থা করা আছে। ওরা যদি রাস্তার কোথাও থামায় আমাদের, নিজেদের জন্যেও বিপদ ডেকে আনবে। তৃপ্তির হাসি দেখা গেল জসেস্কুর মুখে।

.

রবার্ট হিউমকে গম্ভীর, শোকার্ত এবং বিষন্ন দেখাল। ন্যাট ফরহ্যান্স ওরফে লিরয় পামার ওরফে চার্লস ডিকেনসের লাশ সনাক্ত করার পর রুমাল বের করে শুকনো চোখ মুছল সে। ব্রিটিশ দূতাবাসের ট্রেড অ্যাটাশে হিউম, মস্কো পুলিসের অনুরোধে এই মর্গে লাশটা সনাক্ত করতে এসেছে সে।

ক্ষতবিক্ষত নাকমুখ, চেহারা চেনা যায় না। মস্কো পুলিসের ইন্সপেক্টর বাজারনিক হিউমের পাশেই দাঁড়িয়ে রয়েছে। অনেকক্ষণ একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকার পর হিউম মাথা ঝাঁকাল। লাশ চিনতে তার কোন অসুবিধে হলো না, চার্লস ডিকেনসের পরিচয় নিয়ে রাশিয়ায় ঢুকেছিল এই লোক, আসল নাম ন্যাট ফরহ্যান্স, বছর দুয়েক ধরে বার কয়েক লন্ডন-মস্কো আসা যাওয়া করেছে লিরয় পামার নামে।

কে এই লোক, চিনতে পারছেন, মি. হিউম? ঠাণ্ডা সুরে জানতে চাইল ইন্সপেক্টর বাজারনিক।

হ্যাঁ, বলে দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁট কামড়াল হিউম, যেন শোক সামলাবার চেষ্টা করছে। যতদূর বুঝতে পারছি, এ মি. লিরয় পামারের লাশ। ইন্সপেক্টরের দিকে ফিরল সে। লাশের গায়ে-মাথায় একটা কম্বল চাপা দিল ইন্সপেক্টর।

আপনার কোন ভুল হচ্ছে না তো, মি. হিউম?

শ্রাগ করল হিউম। কি করে! মি. পামার একজন ব্যবসায়ী ছিলেন, আর আমি আপনার দেশে ব্রিটিশ ট্রেড অ্যাটাশে-মস্কোয় এলে আমার সাথে দেখা না করে ফিরতেন না উনি। চেহারাটা ক্ষতবিক্ষত, তার কারণ আমি আন্দাজ করতে অপারগ…কিন্তু ভদ্রলোককে চিনতে না পারার কোন কারণ নেই।

ধন্যবাদ। চেহারা…তার ব্যবসায়ী বন্ধুরা নিশ্চই চেয়েছে ওকে যেন কেউ চিনতে না পারে কিন্তু কেন?

আমারও তো সেই প্রশ্ন-কেন? বিমূঢ় দেখাল হিউমকে। কিন্তু ইন্সপেক্টর বাজারনিকের হাবভাব খুঁটিয়ে লক্ষ করছে সে। এই লোককে সে চেনে না, কিন্তু হলপ করে বলতে পারে, কাপড়ে-চোপড়ে যাই হোক, আসলে লোকটা কে.জি.বি.। ইউনিভার্সিটি থেকে সদ্য পাস করা মেধাবী গ্রাজুয়েটরা ইদানীং। কে.জি.বি-তে ঢুকতে শুরু করেছে, বাজারনিক তাদেরই একজন।

এ নিয়ে আলোচনা করে লাভ নেই, হাসি মুখে বলল বাজারনিক। আমাদের পেশার ধর্মই এই, অনেক কিছু জেনেও না জানার ভান করতে হয়। আপনার আমি নিন্দা করছি না, মি. হিউম, শুধু বাস্তব পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করছি।

দুঃখিত, ইন্সপেক্টর। আপনাকে আমি সাহায্য করতে পারলাম। দেশে ব্যাপারটা নিয়ে দারুণ হৈ-চৈ হবে।

মস্কোর পানিও যথেষ্ট ঘোলা হবে, বলল ইন্সপেক্টর। বাদ দিন, যা হবার তা তো হয়েছেই। আসুন, এরপর আপনাকে ভদকা অফার করা না হলে অন্যায় করা হবে।

বিজয়ের হাসি গোপন করে মর্গ থেকে বেরিয়ে এল হিউম।

.

তাহলে কে এই লোক? ঠাণ্ডা গলায় জানতে চাইল কর্নেল সাসকিন। তার হাতে রানার একটা ফটো, চেক-পয়েন্টে ভ্যানের পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে রানা। ফটোটা মেজর রোমানভ আর ক্যাপ্টেন কুজভের নাকের সামনে নাড়ল কর্নেল। তোমরা কেউ কিছু বলতে পারছ না!

এপ্রিল মাসের চমৎকার একটা দিন, জানালার বাইরে দিনের। আলো ফুরিয়ে আসছে। অধস্তনদের ওপর ঠিক রাগান্বিত নয়, অসন্তুষ্ট হয়েছে সে। জসেস্কুর সহকারী লোকটার পরিচয় জানা সম্ভব হয়নি সেজন্য উদ্বিগ্ন নয় সে, কিন্তু বিরক্ত বোধ করছে। জসেস্কুর সহকারীকে এম ডিপার্টমেন্ট চেনে না বলে জানিয়ে দিয়েছে। ভ্যানটাকে এখনও চোখে চোখে রাখছে কালো সিডানের আরোহীরা, শুধু ক্যাপ্টেন কুজভ ফিরে এসেছে মস্কোয়। কর্নেলের সহকারী, মেজর বাস্কি বিলিয়ারস্কে ফিরে গেছে, বিলিয়ারস্কের চীফ সিকিউরিটি অফিসার মিখাইল রাভিকের জন্যে নিয়ে গেছে নতুন একটা তথ্য-জসেস্কু আর তার অজ্ঞাতনামা সহকারী বিলিয়ারস্কের দিকেই এগোচ্ছে।

আমরা জানি না, কমরেড কর্নেল, বলল রোমানভ।

অধস্তনদের ওপর চোটপাট করা কর্নেলের স্বভাব নয়। কিন্তু কেন? এই ফটো তো আমরা ঘণ্টা কয়েক আগেই পেয়েছি।

আমরা চেক করছি, কমরেড কর্নেল। কমপিউটর আর রেকর্ডস ডাইরেক্টরেট এটাকে টপ প্রায়োরিটি দিয়ে কাজ করছে।

কেন? ওরা কেন? বিস্মিত দেখাল কর্নেলকে।

আমরা সন্দেহ করছি, বলল ক্যাপ্টেন কুজভ, লোকটা বিদেশী এজেন্ট, কমরেড কর্নেল।

হুম। তাহলে এ-ও আমাকে বিশ্বাস করতে হবে! ভ্যান থামিয়ে ওদের আমরা ধরে আনছি না কেন, কমরেড কর্নেল? হঠাৎ জানতে চাইল কুজভ। এখানে নিয়ে এসে ইন্টারোগেট করলেই তো জানা যায়…

রাগের সাথে ক্যাপ্টেনের দিকে তাকাল কর্নেল সাসকিন। বেকুব!

কর্নেলের উদ্দেশ্য আর চিন্তা-ভাবনা আন্দাজ করার চেষ্টা করল রোমানভ। তাক লাগানো একটা বিজয়ের অপেক্ষায় রয়েছে। সে। কর্নেল উপলব্ধি করছে, জসেস্কুর সাথে ওই লোক নিশ্চই গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু বিলিয়ারস্ক দুর্ভেদ্য এই বিশ্বাস তার আচরণকে বড় বেশি প্রভাবিত করছে। বিলিয়ারস্ক যে দুর্ভেদ্য, তা রোমানভও বিশ্বাস করে। এই বিশ্বাসের জন্যেই জসেস্কুর সহকারী বিপদ হয়ে দেখা দিতে পারে জেনেও তাকে নিয়ে খেলায় মেতেছে কর্নেল, আশা করছে এই লোক তাকে আরও অনেক লোকের কাছে নিয়ে যাবে! তারা হয়তো সি.আই.এ-র ছদ্মবেশী এজেন্ট, একসাথে সবাইকে ধরতে পারলে গোটা কে.জি.বি. তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। হয়ে উঠবে।

রোমানভের মন খুঁত খুঁত করছে বটে, কিন্তু সেই সাথে একথাও ভাবছে সে-যাক বিলিয়ারস্কের দিকে, একা একজন লোক। কি আর হুমকি হয়ে দেখা দেবে?

তোমার ইন্টারোগেশনের ফলাফল কি? জানতে চাইল কর্নেল।

শূন্য। কিছুই জানতে পারিনি।

কি বলছ, রোমানভ?

রোমানভ চুপ করে থাকল।

অরলভকে ফটোটা দেখিয়েছ? প্রশ্ন করল কর্নেল। তার পরিচয় নিয়ে অন্য একটা লোক জসেস্কুর সাথে যাচ্ছে, এ-কথা। শোনার পর রাগে ফেটে পড়েনি সে?

অরলভ, আমার বিশ্বাস, লোকটার পরিচয় জানে না, কমরেড। কর্নেল।

ভ্যানটা যে বিলিয়ারস্কের দিকে যাচ্ছে, আমার সাথে তুমি এক মত?

হ্যাঁ, কমরেড কর্নেল। তাতে কোন সন্দেহ নেই।

তাহলে এই লোক, যে-ই হোক সে, বিলিয়ারস্কের জন্যে একটা হুমকি? তার উদ্দেশ্য নিশ্চই স্যাবোটাজ করা?

হয়তো, কমরেড কর্নেল।

হয়তো নয়, রোমানভ, নিশ্চই তাই। কিন্তু স্যাবোটাজ করার। জন্যে কোইভিসতু আর তার সাঙ্গপাঙ্গরাই তো রয়েছে ওখানে। কি সেই কাজ যা ওরা করতে পারবে না, অথচ এই লোক একা তা পারবে? কিছুক্ষণ গভীর চিন্তা-মগ্ন দেখাল কর্নেলকে। কি ধরনের অপারেশন হতে পারে এটা? লোকটার পরিচয় জানতে পারলে… কথা শেষ না করে আপন মনে হাসল সে।

কর্নেলের উদ্দেশ্য সঠিক বোঝা যাচ্ছে না, ভাবল রোমানভ। সময় আর বিষয়টা উপভোগ করছে সে, সন্দেহ নেই। বড় ধরনের অতিরিক্ত কোন বিজয় আশা করছে? কিন্তু কি হতে পারে সেটা? কর্নেলের জায়গায় সে হলে এতক্ষণে গ্রেফতার করে হেডকোয়ার্টারে নিয়ে আসত লোকটাকে।

কর্নেল বলল, আমার ফ্লাইট কয়েক ঘণ্টা পিছিয়ে দাও, বিলিয়ারস্কে আমি আরও দেরি করে যাব। ভ্যানের কথা বলে বিলিয়ারস্ক সিকিউরিটিকে সাবধান করে দাও। কুজভ, রেকর্ডসএর কর্নেল গ্যাগারিনের সাথে আমার যোগাযোগ করিয়ে দাও-যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই লোকের পরিচয় জানতে চাই আমি। আর তুমি, রোমানভ, অরলভ আর মুন্তাকিভকে আবার ইন্টারোগেট করো। জানতে চেষ্টা করো লোকটা কে।

কামরা থেকে বেরিয়ে গেল রোমানভ। ফোনের রিসিভার তুলে ডায়াল করতে শুরু করল কুজভ। রানার ফটোর দিকে তাকিয়ে আছে কর্নেল, বিড়বিড় করছে, যেই হও, বাছাধন, তোমার নিস্তার নেই।

.

প্রায় বারো ঘণ্টা একনাগাড়ে ঝাঁকি খেয়ে থেঁতলে গেছে শরীর। বাতাস আর ইঞ্জিনের একটানা গর্জন অস্থির করে তুলেছে ওকে। মন আর চোখ একঘেয়েমির শিকার-চারদিকে বৃক্ষহীন রাশিয়ান স্তেপ, বৈচিত্র্যহীন, নিঃস্ব, ধূসর খা-খা প্রান্তর, সেই উরাল পর্যন্ত

এর বিস্তৃতি, বিলিয়ারস্ক ছাড়িয়ে আরও দুশো মাইল।

রানা ক্লান্ত।

খানিক আগে রাত নেমেছে। ভ্যানের হেডলাইট অন করা। পিছনের সিডান বরাবর দুশো গজ পিছনে ছিল। ভ্যান কাজান ছাড়িয়ে আসার পর আবার সিডানকে পিছনে আবিষ্কার করে ওরা। ভোলগার ওপর নতুন তৈরি লেনিন ব্রিজ পেরোবার সময় রানাই ওটাকে প্রথম উইং-মিররে দেখে। জসেস্কুকে একটু বিশ্রাম দেয়ার জন্যে তখন সে-ই ভ্যান ড্রাইভ করছিল। পিছনে আবার কে.জি.বি. লেগেছে দেখে সাথে সাথে ড্রাইভিং হুইল রানার কাছ থেকে নিয়ে নেয় জসেস্কু।

হেডলাইট জ্বালেনি সিডান। কিন্তু দুজনেই ওরা জানে, পিছনে আছে ওটা।

আর কত দূর? দীর্ঘ নীরবতা ভেঙে জানতে চাইল রানা।

বাঁকটা, আর চার মাইল, ওই রাস্তার চোদ্দ মাইলের মাথায় বিলিয়ারস্ক।

এই রাস্তাতেই দ্বিতীয় গাড়িটা তুলে নেবে আমাকে? জসেস্কুর দেয়া ম্যাপটা খুলল রানা। ঠিক কোথায় গাড়ি বদল করবে ও, দেখে নিল।

হ্যাঁ।

তাহলে তো আর বেশি দেরি নেই।

উত্তরে একটা দীর্ঘশ্বাস চাপল জসেস্কু।

বাঁক নেয়ার পর প্রথম যে ঝোপটা পাব, তাতেই লাফিয়ে পড়ব, বলল রানা।

মুহূর্তের জন্যে চোখ বুজল জসেস্কু, বিড়বিড় করে কিছু বলল, বোধহয় প্রার্থনা করল-সম্ভবত রানার জন্যেই। তারপর চোখ খুলে তাকাল রানার দিকে। গাড়িতে আপনি নেই দেখলে ওদের মাথায় আগুন ধরে যাবে।

হ্যাঁ। কিন্তু শুধু ওভারটেক করার সময় জানতে পারবে ওরা।

সেটি ওরা পারছে না, বিড়বিড় করে বলল জসেস্কু। জান। যায় তাও রাজি।

দেখবেন, ধরা পড়ে যাবেন না যেন।

কে চায়, বলুন, জবাব দিল জসেস্কু। অন্য প্রসঙ্গে চলে গেল

সে, মি. ইসরাফিলভ মিনিট পনেরো আগে গার্ড-পোস্ট পেরিয়েছেন।

কিভাবে জানলেন?

কাজানে দেখেছি তাঁকে, গ্যাসোলিন স্টেশনে।

বিলিয়ারস্ক থেকে উনি বেরুলেন কিভাবে? শুনেছি টেস্টফ্লাইটের জন্যে গোটা প্রজেক্ট এলাকা সীল করে দেয়া হয়েছে।

তা হয়েছে, উনি কাজান থেকে বিলিয়ারস্কে ফিরছেন। বিজ্ঞানীর মা অসুস্থ, যখন তখন অবস্থা, তাই তাঁকে বেরুতে দিয়েছে ওরা। সাথে অবশ্য একজন কে.জি.বি. এজেন্টকে গছিয়ে দিয়েছিল।

ভুরু কুঁচকে জসেস্কুর দিকে তাকাল রানা।

না, চিন্তার কিছু নেই, বলল জসেস্কু। বিজ্ঞানীকে কাজানে, মায়ের কাছে পৌঁছে দিয়ে ফিরে গেছে এজেন্ট লোকটা। কে.জি.বি. তাঁকে নিয়ে আতঙ্কিত নয়। ওরা জানে, উনি আমাদের লোক। জানে, বিলিয়ারস্কে তাঁকে ফিরতেই হবে।

তাঁর মা কি সত্যি অসুস্থ? মারা যাচ্ছেন?

অন্তত ডাক্তার ভদ্রলোক সে-কথাই বলবেন। মুচকি একটু হাসল জসেস্কু। এমনিতে ভদ্রমহিলা সত্তরেও সাংঘাতিক সঁটো। রাস্তায় মি. ইসরাফিলভই আপনাকে তুলে নেবেন।

ইসরায়েলকে রাশিয়ান ইহুদি যারা যাহায্য করছে রানা উপলব্ধি করল, সবাই তারা বিসর্জন দেয়ার জন্যে প্রস্তুত। এদের উদ্দেশ্য যাই হোক এই আত্মত্যাগের প্রবণতা দেখে মনে শ্রদ্ধা জাগে। মাতৃভূমি, জন্মস্থানের সাথে বেঈমানী করছে এরা-কে জানে, হয়তো পরিস্থিতিই ওদেরকে বাধ্য করেছে এই পথে আসতে। ইসরায়েল যে একটা অশুভ শক্তি তা হয়তো এরা বোঝেই না।

এই মুহূর্তে কোন স্বার্থবোধ বা চাতুরী কাজ করছে না রানার মনে-সান্ত্বনা, সহানুভূতি আর অভয় দেয়ার জন্যে জসেস্কুকে কিছু বলতে চাইল ও।

কিভাবে যেন সেটা বুঝে ফেলল জসেস্কু। কর্কশ শোনাল তার কণ্ঠস্বর, গাছ, দেখতে পাচ্ছেন? ওগুলোর মাঝখান দিয়ে এরপর। এঁকেবেঁকে এগিয়েছে রাস্তা, ড্রাইভারদের ঘুম তাড়াবার জন্যে তৈরিই করা হয়েছে ওভাবে। প্রথম বড় ঝোপটা আর বেশি দূরে নয়। রানার দিকে তাকাল সে। আমাকে কিছু বলবেন না, প্লীজ। আমার অসম্মানে ঘা লাগতে পারে, আমি অপমান বোধ। করতে পারি। দোহাই আপনার, আপনি শুধু প্লেনটা নিয়ে রাশিয়া থেকে বেরিয়ে যান!

টেবিলের ওপর দুটো জুতো। চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে অনেকক্ষণ ধরে সেগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে তরুণ পুলিস। ইন্সপেক্টর বাজারনিক, তবলায় মৃদু টোকা দেয়ার ঢঙে চেয়ারের হাতলে আঙুলের বাড়ি মারছে সে।

আবার টেবিলের দিকে ঝুঁকল বাজারনিক, একটা জুতো তুলে নিয়ে সাদা লেবেলটার ওপর চোখ রাখল। লেবেলে লেখা রয়েছে, এই জুতোর মালিক লিরয় পামার। বাজারনিকের ঠোঁটে এক চিলতে আড়ষ্ট হাসি দেখা গেল, যেন এই ধাঁধা তাকে একাধারে। বিমূঢ় এবং কৌতুহলী করে তুলেছে। জুতো দুটো পাশাপাশি রাখল ও, ডান পাটি আর বাঁ পাটি, কিন্তু জোড়া মিলছে না-একটা কালো, অপরটা খয়েরী। ডান পাটির চেয়ে বা পাটি দেড় সাইজ। বড়। মস্কোভা নদী থেকে উদ্ধার করা লিরয় পামারের এক পাটি। জুতো এখনও ঠাণ্ডা আর ভিজে। অন্যটা পালিশ করা চকচকে। গোড়ালির ক্ষয় দেখে বোঝা যায় অল্প কদিন ব্যবহার করা হয়েছে। এটা আনা হয়েছে মস্কোভা হোটেল, পামারের কামরা থেকে।

আর সব কিছুই মিলেছে, মেলেনি শুধু এই জুতো। হ্যাটের সাইজ সমান, কলার সাইজ এক, হোটেলে পাওয়া ওভারকোটও লাশের গায়ে ফিট করেছে, ফিট করেছে স্যুট, মোজা…শুধু জুতো বাদে। কেন? কি এর রহস্য? একজন মানুষের জুতো এত ছোটবড় হয়? কেন?

আবার চেয়ারে হেলান দিল বাজারনিক। এটা একটা রহস্য সন্দেহ নেই। কিভাবে এই রহস্য উদ্ঘাটন করা যায়! অনেকক্ষণ ধরেই একটা প্রশ্ন জাগছে মনে: নদীতে যার লাশ পাওয়া গেছে আর মস্কোভা হোটেলে যে লোক উঠেছিল, দুজন আলাদা মানুষ, একজন নয়?

মানুষ যদি দুজন হয়, কেন দুজন? আবিষ্কারের চেয়ে প্রশ্নটা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ, এর উত্তরেই নিহত রয়েছে জুতো রহস্যের সমাধান। মস্কোভা হোটেল থেকে বেরিয়ে তিনজন লোকের সাথে দেখা করেছিল পামার, পামারের বদলে এই তিনজনের একজনকে খুন করে নদীতে ফেলে দেয়া হয়? কেন, কেন?

সাধারণ একজন পুলিস হয়তো রহস্যটা নিয়ে এত বেশি মাথা ঘামাত না। কিন্তু বাজারনিক সাধারণ পুলিস নয়। মস্কো পুলিসের ইন্সপেক্টর বটে সে, কিন্তু তাকে পুলিস বিভাগে পাঠানো হয়েছে। কে.জি.বি-র সেকেন্ড চীফ ডাইরেক্টরেট থেকে। পুলিস বিভাগের কাউকে নয়, শুধু কে.জি.বি-র পলিটিক্যাল সিকিউরিটি সার্ভিসের সিনিয়র অফিসারদের কাছে জবাবদিহি করে সে।

মস্কোয় ড্রাগস বেচাকেনা শুরু হয়েছে, পুলিস বিভাগ এই তথ্য জানতে পারার পরই বাজারনিককে ইন্সপেক্টর করে পাঠানো হয় পুলিস হেডকোয়ার্টারে। এই ড্রাগ রিঙ ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়ার জন্যে প্রচুর ক্ষমতা দেয়া হয়েছে তাকে। প্রশাসনের কাছ থেকে। যে-কোন ধরনের সাহায্য চাইলেই সে পাবে। লিরয় পামার যে একজন ড্রাগ স্মাগলার, এই তথ্যটা বেশ কিছুদিন আগে পুলিস বিভাগ জানতে পারে। সেই থেকে পামারকে হাতেনাতে ধরার অপেক্ষায় ছিল বাজারনিক। গরচয়েভ-এর কাছ থেকে ইংরেজ লোকটার মৃত্যু সংবাদ শুনে খুশি হয়েছিল বটে, কিন্তু সেই সাথে শাস্তি এড়িয়ে লোকটা বেরিয়ে গেল ভেবে হতাশও কম হয়নি। যদিও তার মৃত্যুতে কিছু এসে যায় না, কারণ তার কাছ থেকে যারা ড্রাগস কিনত তাদের সবাইকে সে চেনে।

আর এখন জানা যাচ্ছে, পামার আসলে মরেইনি।

হাত বাড়িয়ে ক্রেডল থেকে রিসিভার তুলল বাজারনিক। একজন অপারেটরের সাড়া পাওয়া গেল। অপারেটর যে সুইচবোর্ড সামনে নিয়ে বসে আছে সেটার সাথে পুলিস বিভাগের কোন ফোনের কোন যোগাযোগ নেই। সেভেনথ ডাইরেক্টরেট-এ দাও, কর্নেল লেভিন-এর সাথে কথা বলব। ইংলিশ ট্যুরিস্টদের ওপর নজর রাখার জন্যে আলাদা একটা ডিপার্টমেন্ট আছে কে.জি.বি-তে। কর্নেল লেভিন তার হেড। কর্নেলের সাথে অনেকক্ষণ ধরে আলাপ করল বাজারনিক। তারপর আবার হেলান দিল চেয়ারে, চোখ দুটো ফিরে এল জুতো দুটোর ওপর।

কর্নেলের কাছ থেকে আরও লোক চেয়েছে বাজারনিক। এবার মস্কোয় আসার পর পামার কি করেছে না করেছে সব তারা চেক করবে। লুদভিক, গরচয়েভ আর সার্জেন্ট রাসকিনকে। দরকার হবে তার। এর আগে বেশ কয়েকবার রাশিয়ায় এসেছে। পামার, মস্কোয় তার অতীত গতিবিধি সম্পর্কে তদন্ত চালাবে ওরা। পামারের স্বভাব, অভ্যেস, যোগাযোগ ইত্যাদি সম্পর্কে রেকর্ড-পত্র থেকে যা পাওয়া যায় সব ওরা উদ্ধার করবে। সার্জেন্ট। রাসকিন লোকটা ইহুদি, ওকে বাদ দেবে কিনা ভাবল বাজারনিক। না, থাক, লোকটা খুব কাজের। ইন্টারকমের বোতাম টিপে গরচয়েভের সাথে কথা বলল সে, ওদেরকে নিয়ে চলে এসো; তাড়াতাড়ি।

আবার জুতোর দিকে তাকাতেই বিদ্যুৎ চমকের মত কথাটা মনে পড়ল। এয়ারপোর্টে পামারের কাছে একটা ট্রানজিসটর রেডিও ছিল, ড্রাগস থাকতে পারে মনে করে সেটা চেকও করা হয়। কিন্তু হোটেল কামরা বা লাশের সাথে ওটা পাওয়া যায়নি। নদীতে রয়ে গেছে?

অস্থির দেখাল বাজারনিককে। একটা সিগারেট ধরাল সে। রেডিওটা কোথায়?

.

ওর জন্যে অপেক্ষা করছিল ইসরাফিলভ।

সরু রাস্তার এক ধারে ছোট মস্কোভিচ সিডান দাঁড়িয়ে আছে, হুডটা খোলা। একজন লোকের অস্পষ্ট একটা কাঠামো দেখল রানা, গাড়ির হাঁ করা চোয়ালের ভেতর ঝুঁকে রয়েছে। রাস্তার ধারে উঁচু মাটি, তার কিনারায় বসে অপেক্ষা করছে রানা। গাড়ির ইঞ্জিনে কাজ করছে লোকটা, কিংবা কাজ করার ভান করছে। সে একা, রাস্তায়ও কেউ নেই, তবু নিঃসন্দেহ হবার জন্যে দশ মিনিট ধৈর্য ধরল রানা। ইতোমধ্যে লোকটা একবার যখন সিধে হলো, ধুস শালা বলে গাল দিল-বোধহয় ইঞ্জিনকে-হাত বুলাল আড়ষ্ট পিঠে, তখন চট করে গাছের আড়ালে লুকিয়ে পড়ল রানা। আড়াল থেকে দেখল, লোকটার মুখে এক জোড়া চাদ ঝলমল করছে। বুঝল, চশমা পরে আছে লোকটা। নিজের চারদিকে তাকাল সে, রাস্তার দুটো দিক বেশ সময় নিয়ে দেখল, তারপর আবার ঝুঁকল ইঞ্জিনের ওপর।

এবার আড়াল থেকে বেরিয়ে রাস্তায় নেমে পড়ল রানা। লোকটা পিছন ফিরে রয়েছে। ও যদি ইসরাফিলভ না হয়…

কতক্ষণ ধরে দেখছেন আমাকে? রুশ ভাষায় জিজ্ঞেস করল। লোকটা, বিরক্তি চেপে রাখার গরজ নেই। এখনও ঝুঁকে আছে। ইঞ্জিনের ওপর।

মি. ইসরাফিলভ? জিজ্ঞেস করল রানা। অবাক হয়েছে ও। কোন কোন লোকের মাথার পিছনেও একজোড়া করে চোখ থাকে, এ সেই দলের।

হুডের নিচ থেকে মাথা বের করল ইসরাফিলভ, একটা নোংরা ন্যাকড়ায় হাতের তেল মুছছে। চাঁদ দিগন্তরেখা থেকে খুব বেশি। ওপরে ওঠেনি এখনও, তার আলোয় খুঁটিয়ে দেখল রানাকে। রানার কাঠামো, দাঁড়াবার ভঙ্গি, তাকাবার ভঙ্গি, সব এক মুহূর্তে দেখে নিল সে, সন্তুষ্টচিত্তে মাথা ঝাঁকাল আপনমনে, যেন এই নির্বাচন তার পছন্দ হয়েছে। ঘটাং করে বন্ধ করল হুড। কাছ থেকে লোকটাকে দেখে তার বয়স আন্দাজ করল রানা-পঁয়তাল্লিশ, পঞ্চাশও হতে পারে। কানের দুপাশে পাক। ধরেছে চুলে। মানুষটা ছোটখাট, টেনেটুনে যদি পাঁচ ফিট হয়। পরনে ঢোলা একটা স্যুট, তার ওপর রেনকোট। রানার দিকে। ফিরে বলল, আপনি দেরি করে ফেলেছেন।

দুঃখিত, বলল রানা। লোকটা কেমন যেন অস্বস্তির মধ্যে। ফেলে দিয়েছে ওকে।

সমস্যা গার্ডদের নিয়ে, হঠাৎ একেবারে নরম সুরে শুরু করল ইসরাফিলভ। আমার দেরি দেখে, হয় জংশন না হয় রাস্ত। র শেষ মাথার গার্ড-পোস্ট থেকে কাউকে পাঠাতে পারে ওরা। প্রথম গার্ড-পোস্ট পেরিয়ে এসেছি প্রায় এক ঘণ্টা হয়ে এল। যেকোন মুহূর্তে আমি কোথায় দেখার জন্যে কেউ চলে আসতে পারে। সেজন্যেই তো ইঞ্জিনে হাত দিতে হলো।

ছোট্ট করে মাথা ঝাঁকাল রানা, তারপর জিজ্ঞেস করল, বিলিয়ারস্কে আমি ঢুকব কিভাবে?

গাড়ির ট্রাঙ্কে করে।

ওরা সার্চ করবে না?

মনে হয় না। ইতিমধ্যে একবার ভাল মত সার্চ করা হয়েছে। প্রায়-সময় কে.জি.বি. অতশত চিন্তা করে না।

সার্চ করার নির্দিষ্ট কোন প্যাটার্ন আছে?

একটা গার্ড-পোস্ট আউটগোয়িং সবগুলো গাড়ি সার্চ করে, বলল ইসরাফিলভ। আরেক গার্ড-পোস্ট সার্চ করে ইনকামিং সবগুলো গাড়ি। দায়িত্বের অতিরিক্ত কাজ করতে অভ্যস্ত নয় এরা। তবে শহরে নতুন গার্ডদের বড় একটা বাহিনী আনা হয়েছে, তারা কি করবে জানা নেই আমার।

নতুন…কারা এরা?

সম্ভবত মিলিটারি ইন্টেলিজেন্সের লোক, বলল ইসরাফিলভ। হাইওয়ে জংশনে বারো-তেরো জনকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি আমি। সন্দেহ নেই, বিপদের আশঙ্কা করছে ওরা। হেসে উঠল ইসরাফিলভ। রানাকে পাশ কাটিয়ে গাড়ির পিছনে এসে দাঁড়াল।

মস্কোভিচের ট্রাঙ্ক খুলল ইসরাফিলভ। দ্রুত মাথা ঝাঁকিয়ে ইঙ্গিত করল রানাকে, যেন সময় নষ্ট হচ্ছে বলে বিরক্ত হচ্ছে সে। তার পাশে এসে দাঁড়াল রানা। ট্রাঙ্কটা ছোট আর খালি। ঝুঁকে ভেতরে ঢুকল রানা, কোন কথা বলল না, ঘাড় আর মাথা নিচু করে বসল কোনমতে। কয়েক সেকেন্ড ওকে দেখল ইসরাফিলভ, তারপর সন্তুষ্টচিত্তে মাথা ঝাঁকিয়ে বন্ধ করে দিল ট্রাঙ্ক।

ভেতরটা অন্ধকার হয়ে গেল। কোথাও নিশ্চই বাতাস ঢোকার ব্যবস্থা করা আছে, ভাবল রানা। ইঞ্জিনের শব্দ হলো, তবে কানে তালা লাগল না-মাত্র তিনটে সিলিন্ডার ফায়ার করছে। হঠাৎ গাড়িটা লাফিয়ে ওঠায়, ট্রাঙ্কের শক্ত গায়ে মাথা ঠুকে গেল। ভুরু কুঁচকে উঠল রানার। ৮৮

বিলিয়ারস্কে যাবার বাকি পথটুকু পেরোবার সময় আরোহীর সুবিধে-অসুবিধের কথা একবারও ভাবল না ইসরাফিলভ। রাস্তাটা সরু, প্রজেক্ট সাইটে ইকুইপমেন্ট নিয়ে আসতে গিয়ে ভারী ট্রাকগুলো এর বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে। এখানে সেখানে বড় বড় গর্ত, কোথাও ঢালু হয়ে গেছে। দেরি হয়ে গেছে, সেটা পুষিয়ে নেয়ার জন্যে বিধ্বস্ত রাস্তার ওপর দিয়ে ঝড়ের বেগে গাড়ি চালাল সে। তার একমাত্র চিন্তা, পিটি ডাভকে যেভাবে হোক প্রজেক্ট। এলাকার ভেতর বিজ্ঞানীদের কোয়ার্টারে পৌঁছে দিতে হবে। পিটির আরাম-আয়েশের ব্যাপারে তার কোন মাথাব্যথা নেই। তার গুরু কোইভিসতু এখন চোখে না দেখেই পিটি বলতে অজ্ঞান, কিন্তু পিটির ওপর তার নিজের কোন মোহ বা শ্রদ্ধাবোধ নেই। থাকলে বরং একটু ঈর্ষা আছে।

রাশিয়ার ক্ষতি করার এই ষড়যন্ত্রে ইসরাফিলভ গুরুর সাথে হাত মিলিয়েছে শুধু একটা কারণে, বিশ বছর সাধনা করার পর। অস্ত্র বিজ্ঞানে যা কিছু আবিষ্কার করেছে সে, সব নিজেদের আবিষ্কার বলে সমস্ত কৃতিত্ব লুঠ করেছে তরুণ কমুনিস্ট। বিজ্ঞানীরা। এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে লাভ হয়েছে এই যে তার একমাত্র ছেলেকে মিথ্যে অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করে সাইবেরিয়ায় নির্বাসনে পাঠানো হয়েছে। ইসরাফিলভ জানে, কোইভিসতু সহ সবাইকে ওদের ধরা পড়তে হবে, জেনেশুনেই এ-পথে পা বাড়িয়েছে সে। সবাই মরবে তারা, শুধু একজন বাদে।

অপারেশন যদি সফল হয়, মিগ-৩১ যদি ইসরায়েলের মাটিতে পৌঁছোয়, পিটি ডাভকে নিয়ে সারা দুনিয়ায় মহা হৈ চৈ পড়ে যাবে। প্রতিটি ইহুদি বাড়িতে ফুলের মালা দিয়ে সাজানো হবে তার ছবি। যারা তাকে সাহায্য করতে গিয়ে বিসর্জন দেবে তাদের নামও শ্রদ্ধার সাথে লোকে স্মরণ করবে বটে, কিন্তু দুদিন যেতে না যেতে সবাই ভুলে যাবে তাদের কথা। কিন্তু পিটি ডাভ নিজের কৃতিত্বের কথা শোনার আর বলার জন্যে বেঁচে থাকবে এই সুন্দর পৃথিবীতে। কাজেই তার প্রতি একটু ঈর্ষা যদি হয়ই, সেটা কি খুব অন্যায়?

এয়ারস্ট্রিপ সহ গোটা প্রজেক্ট এলাকার চারদিকে কাঁটাতারের উঁচু বেড়া। বেড়ার এক জায়গায় একটা ফাঁক, এই ফাঁকে বসানো হয়েছে দ্বিতীয় গার্ড-পোস্ট। বিলিয়ারস্ক গ্রামটা পড়েছে বেড়ার বাইরে। গ্রাম বলতে কয়েকশো কাঠের ঘর, অনুর্বর জমিতে কমিউন প্রথায় চাষাবাদ, আর অভাব। গ্রামের মাঝখানে বেড়ার ভেতর, গজিয়ে উঠেছে প্রজেক্ট-টাউন-গাছপালা, নির্দেশ নিষেধাজ্ঞা আর গোপনীয়তা দিয়ে ঘেরা।

দূর থেকেই গার্ড-পোস্ট দেখতে পেল ইসরাফিলভ, গাড়ির গতি কমিয়ে আনল সে। যাবার সময় দেখে গিয়েছিল ছয়সাত জন গার্ডকে, বেড়ে তিনগুণ বা তারও বেশি হয়েছে। পিছনের গার্ডপোস্টেও ওদের বাড়তি সংখ্যা দেখে এসেছে সে। গাড়ি ফাঁকের মাঝখানে থামতেই দুজন গার্ড গটগট করে এগিয়ে এল। হঠাৎ চোখ-ধাঁধানো আলোয় প্রায় অন্ধ হয়ে গেল ইসরাফিলভ। এটা নতুন একটা সার্চলাইট, গজ পঞ্চাশেক দূরে একটা ট্রাকের মাথায় বসানো হয়েছে। হাতল ঘুরিয়ে জানালার কাঁচ নামাল সে, মাথাটা বের করল বাইরে। একজন গার্ডকে চিনতে পারা গেল।

কেমন আছ হে? সহাস্যে, সকৌতুকে জানতে চাইল ইসরাফিলভ। লোকটার নাম আসিমভ।

ড. ইসরাফিলভ, কোথায় ছিলেন আপনি? এক ঘণ্টার বেশি হয়ে গেল এক নম্বর গার্ড-পোস্ট পেরিয়েছেন আপনি, এতক্ষণ ছিলেন কোথায়? আসিমভের গলায় ঝঝ, ভুরু কোঁচকানো। কতটা রাগ বা সন্দেহ হয়েছে বলা কঠিন, হতে পারে সিনিয়র অফিসারকে নিজের যোগ্যতা দেখাতে চাইছে সে। অফিস ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে রয়েছে একজন মেজর।

জানালা দিয়ে হাত দুটো বের করে নাড়ল ইসরাফিলভ, এখনও তেল আর কালি লেগে রয়েছে তার আঙুলে। আর বোলো না, হতচ্ছাড়া গাড়িটা এমন ভোগাল! হঠাৎ তার চোখে কৌতুক ঝিক্ করে উঠল। আমাদের পাঁচসালা পরিকল্পনার সব। ভাল, কিন্তু মস্কোভিচের কোন উন্নতি করতে পারেনি, কি বলো? হো হো করে হেসে উঠল সে, এটা আসলে আসিমভকে তার হাসিতে যোগ দেয়ার একটা আমন্ত্রণ। এমন প্রাণখোলা হাসি শুনে। আসিমভও না হেসে পারল না, তবে, তার ঠোঁট দুটো সামান্য একটু প্রসারিত হলো মাত্র।

ইঞ্জিন স্টার্ট দিন, কঠিন শোনাল গলাটা। আসিমভ নয়, হুকুমের সুরে নির্দেশটা এল পাশে দাঁড়ানো গার্ডের কাছ থেকে। একে ইসরাফিলভ চেনে না।

আসিমভের দিকে তাকাল সে। প্রথম গার্ডের চেহারায়, কোন ভাব নেই। অগত্যা কাঁধ ঝাঁকাল ইসরাফিলভ, স্টার্ট দিল ইঞ্জিনে। আওয়াজ শুনেই বোঝা গেল, একটা সিলিন্ডার কাজ করছে না। দ্বিতীয় গার্ড ইশারা করল, হুড-ক্যাচ রিলিজ করতে বলছে। নির্দেশ পালন করল ইসরাফিলভ। আসিমভ নিজের জায়গা ছেড়ে। নড়ল না, তার সঙ্গী হুড তুলে ঝুঁকে পড়ল ইঞ্জিনের ওপর।

আড়চোখে একবার সিনিয়র অফিসারের দিকে তাকাল। ইসরাফিলভ। দরজায় কাঁধ ঠেকিয়ে এদিকেই তাকিয়ে আছে সে, নিরাসক্ত ভাব নিয়ে রুটিন চেক দেখছে, ঠোঁটে সিগারেট।

আবার জানালা দিয়ে মাথা বের করল ইসরাফিলভ। ঘটনাটা। কি, কিছু বুঝতে পারলে?

হঠাৎ করেই সশব্দে হুড বন্ধ করে গাড়ির জানালার দিকে দ্রুত। এগিয়ে এল দ্বিতীয় গার্ড। ইঞ্জিনের এই অবস্থা হলো কি করে! জানালার সামনে থেমে ইসরাফিলভের চোখে কটমট করে তাকাল সে। আপনি একজন বিজ্ঞানী-ওটার আরও যত্ন নেয়া উচিত ছিল! আরও কিছু বলতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিল গার্ড, হঠাৎ উপলব্ধি হয়েছে একজন বিজ্ঞানীর সাথে এই সুরে কথা বলে নিজের আসল পরিচয় প্রকাশ করে ফেলেছে সে।

ইসরাফিলভও বুঝল, এই লোক মিলিটারি ইন্টেলিজেন্স না হয়েই যায় না। শান্ত গলায় বলল সে, বিজ্ঞানী বলেই এসব বিষয়ে নজর দেয়ার সময় নেই আমাদের।

দ্বিতীয় গার্ড ঘুরে দাঁড়াল। অফিসারের দিকে ফিরে মাথা নাড়ল সে। একটা হাত নাড়ল অফিসার, গেট খুলে গেল। আসিমভ মাথা ঝাঁকিয়ে গাড়ি নিয়ে এগোবার অনুমতি দিল।

গিয়ার দিল ইসরাফিলভ, গাড়ি চলতে শুরু করল। গেট পেরিয়ে এল ওরা, সাথে সাথে পিছনে বন্ধ হয়ে গেল সেটা। এতক্ষণে মেরুদণ্ডে ভয়ের একটা শীতল প্রবাহ অনুভব করল ইসরাফিলভ, তার হাত আর পা কাপতে শুরু করল। পিটি ডাভকে কমপ্লেক্সের ভেতর নিয়ে এসেছে সে! এই সাফল্য তাকে উল্লসিত করতে পারল না, কারণ এখনও ব্যাপারটা তার কাছে অবিশ্বাস্য লাগছে।

দুপাশে কোয়ার্টার, মাঝখানে সোজা রাস্তা। প্রতিটি কোয়ার্টার একতলা, কাঠের তৈরি, সবগুলো একই ধাচের। রাস্তা আর কোয়ার্টারের মাঝখানে ঘাস মোড়া চওড়া লন। শহর না বলে এটাকে ক্যাম্প বলাই ভাল। কঠোর নিয়ম আর নির্দেশ মেনে চলতে হয় সবাইকে।

টুপোলেভ এভিনিউ ধরে খানিক দূর এগিয়ে, সামান্য ঢালু ড্রাইভওয়ে দিয়ে সোজা খোলা গ্যারেজে ঢুকে পড়ল মস্কোভিচ। এই রাস্তায় দোকানপাট, সিনেমা হল, বার বা ড্যান্স হল নেই, কাজেই লোকজনও না থাকার মত। রাস্তার উল্টোদিকে শুধু একটা গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। গ্যারেজে ঢোকার আগে আড়চোখে সেদিকে একবার তাকিয়ে নিল ইসরাফিলভ, কিন্তু কাউকে দেখতে পেল না। এই গাড়ির আরোহীরাই তার বাড়ির ওপর নজর রাখে। গ্যারেজের ভেতর গাড়ি থামাবার পর নিঃসাড় হয়ে গেল ইসরাফিলভ, চোখ বুজে বসে থাকল, যেন তার আর কিছু করার নেই। ভয়টা আবার ফিরে এসেছে মনে। তার গুরু কোইভিসতু অবশ্য বারবার আশ্বাস দিয়ে বলেছে, উইপনস-ট্রায়ালের আগে ওদেরকে গ্রেফতার করা হবে না, কিন্তু এখন হঠাৎ মনে হচ্ছে, গাড়ির আরোহীরা যদি সার্চ করতে চায় তার বাড়ি? পিটি ডাভকে যদি আবিষ্কার করে ফেলে? প্লেনে উইপনস ফিট করার জন্যে ওকে তাদের দরকার আছে, কিন্তু ওর কাজটা যদি কোইভিসতু আর করনিচয়কে দিয়ে করাতে চায়, কার কি বলার থাকবে? মনে মনে নিজেকে ধিক্কার দিল ইসরাফিলভ। প্রাণ যদি নাও যায়, জীবনের বাকিটা সময় সাইবেরিয়ায় যন্ত্রণা ভোগ করতে হবে, এসব জেনেই তো এ-পথে এসেছে সে। এখন তাহলে ভয় পাচ্ছে। কেন! থমথমে চেহারা নিয়ে গাড়ি থেকে নামল সে। ট্রাঙ্ক খোলার আগে বন্ধ করল গ্যারেজের দরজা।

.

আশ্চর্য, একজনের কাছ থেকেও কিছুই জানতে পারলে না তুমি! কর্নেল সাসকিনকে বিরক্ত দেখাল, কণ্ঠস্বর ঝগড়াটে। নিজের। অফিস কামরায় পায়চারি করছে সে। মেজর রোমানভ একটা চেয়ারে ম্লান মুখে বসে আছে। টেবিল ঘড়িতে সাতটা বেজে দশ, এইমাত্র বন্দীদের সেল থেকে ক্লান্ত আর হতাশ হয়ে বেরিয়ে এসেছে মেজর, দেখে এসেছে অরলভ আর মুস্তাকিভের জ্ঞান ফেরেনি।

ওদের কাছ থেকে কথা আদায়ের জন্যে চেষ্টার কোন ত্রুটি করেনি রোমানভ। কে.জি.বি. টরচারের যতগুলো কৌশল চর্চা। করে, একে একে সবগুলো ওদের ওপর প্রয়োগ করা হয়েছে, ফলাফল শূন্য। বারবার জ্ঞান হারিয়েছে ওরা, জ্ঞান ফিরিয়ে আনার পর বারবার সেই একই কথা বলেছে-তারা কিছু জানে না। তার এখন বিশ্বাস, অরলভ সত্যি কিছু জানে না। মুন্তাকিভের কিছু জানার প্রশ্ন আরও অবান্তর।

কিন্তু কর্নেলের বিশ্বাস, ওরা মিথ্যে কথা বলছে।

ওদের বিরুদ্ধে অভিযোগ হলো, জসেস্কুকে চেনে ওরা, এবং অরলভ জসেস্কুর সহকারী হিসেবে ভ্যানে কাজ করে। অরলভ বলতে চায়, জসেস্কু তাকে বাড়ি থেকে কোথাও বেরুতে নিষেধ করেছে, কিন্তু কারণটা বলেনি। তবে মাল ডেলিভারি দেয়ার জন্যে সেদিন জসেস্কুর কুইবিশভ যাবার কথা জানত সে। কথাগুলো অরলভ বলল তার ওপর ড্রাগ ব্যবহার করার পর।

ভ্যানের দ্বিতীয় লোকটার গুরুত্ব প্রতি মুহূর্তে বাড়ছে, এটুকু পরিষ্কার বুঝতে পারছে রোমানভ। কিন্তু বোঝা যাচ্ছে না ইহুদি বেঈমানরা একজন মাত্র এজেন্টকে বিলিয়ারস্কে ডেকে নিয়ে কি অর্জন করার আশায় রয়েছে। কোইভিসতু, ইসরাফিলভ আর করনিচয়, এরা তিনজনই রাতের বেলা মিগ-৩১ নিয়ে কাজ করবে-এদের পক্ষে সম্ভব নয় অথচ এই লোক পারবে, কি ধরনের স্যাবোটাজ হতে পারে সেটা? তাছাড়া, বিলিয়ারস্কের দিকে লোকটা যাচ্ছে বটে, কিন্তু প্রজেক্ট এরিয়ার ভেতর ঢুকবে কিভাবে? একজন আগন্তুকের পক্ষে কোনভাবেই মিগ-৩১-এর ধারেকাছে যাওয়া সম্ভব নয়। লোকটা শুধু ফটো তুলতে এসেছে, স্রেফ তথ্য সংগ্রহই তার উদ্দেশ্য, এ-ধরনের কিছু চিন্তা করাও হাস্যকর। তবে?

রোমানভের সামনে থামল কর্নেল। মুখ তুলে কর্তার উদ্বিগ্ন চেহারার দিকে তাকাল রোমানভ। এরই মধ্যে বিলিয়ারস্কের পথে রওনা হতে ঘণ্টা কয়েক দেরি হয়ে গেছে কর্নেলের। জসেস্কুর সহকারী সম্পর্কে নিশ্চিতভাবে কিছু না জেনে মস্কো ছাড়বে না সে। শহরতলিতে তার জন্যে একটা হেলিকপ্টার অপেক্ষা করছে সেই বিকেল থেকে।

ঠিক আছে, কর্নেলের গলার সুর শুনে মনে হলো একটা। সিদ্ধান্তে পৌচেছে সে। ফোন করো, রোমানভ। আমাদের। গাড়িকে বলো জসেস্কু আর তার সহকারীকে গ্রেফতার করতে হবে। এই মুহূর্তে!

ইয়েস, কমরেড কর্নেল। ফোনের রিসিভার তুলে নিল রোমানভ। রেডিওতে নির্দেশটা পৌঁছে যাবে কে.জি.বি. অফিস কাজানে, সেখান থেকে পাঠানো হবে কালো গাড়িতে।

ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করো, বিলিয়ারস্ক জংশন থেকে কি ধরনের সাহায্য দরকার হবে ওদের, বলল কর্নেল। তারপর। জানতে চাইল, গাড়িতে ওরা কজন, জানো?

তিনজন, জবাব দিল রোমানভ। আবার পায়চারি শুরু করল। কর্নেল সাসকিন। অপরপ্রান্তের কথা মন দিয়ে শুনল মেজর। রিপোর্ট, কর্নেল। বিলিয়ারস্ক জংশন থেকে ওরা জানাচ্ছে ভ্যানটাকে শেষবার ওরাই দেখেছে। জংশন পেরোবার সময় নির্দেশ মানেনি জসেস্কু, ব্যারিয়ার ভেঙে বেরিয়ে গেছে। ফোনের রিসিভার ধরা হাতটা শরীরের পাশে ঝুলে পড়ল রোমানভের।

পায়চারি থামিয়ে বিদ্যুৎবেগে ঘুরল সাসকিন। তাহলে কোন। দেরি নয়। যেভাবে হোক, যে-কোন মূল্যে থামাতে বলো ওটাকে। আমি জানতে চাই দ্বিতীয় লোকটা এখনও ভ্যানে আছে কিনা!

রানাকে যতই দেখছে নেসতর কোইভিসতু ততই অবাক হচ্ছে। এক আধবার খুঁত খুঁত করছে মনটা। পিটি ডাভ সম্পর্কে যা বলা হয়েছে তাকে, তার অনেক কিছুই মিলছে না। টুপোলেভ এভিনিউয়ে তার বাড়িতে রানার আসার পর থেকেই ওর ওপর সারাক্ষণ চোখ রাখছে কোইভিসতু।

গোসল সেরে খানিক বিশ্রাম, তারপর খেতে বসল রানা, পরিবেশন করল কোইভিসতুর সেক্রেটারি এবং একমাত্র মেয়ে সলভিনা। টেবিলে কোইভিসতুও বসল, কিন্তু খেলো না, সন্ধের পর এক গ্লাস দুধ ছাড়া আর কিছু খায় না সে।

বয়স পঞ্চান্ন, চেহারায় ধ্যানমগ্ন সন্ন্যাসীর জ্যোতি আর কমনীয়তা। কথা বলে মৃদু গলায়, ভারী কণ্ঠস্বর। চোখ দুটো সব সময় আধবোজা, দৃষ্টি যেন বহু দূরে নিবদ্ধ। বিশ বছর লেবার ক্যাম্পে থাকার পরও তার মানসিক বৈকল্য দেখা দেয়নি বলে তার বন্ধু-বান্ধব আর সহযোগীরা বিস্মিত না হয়ে পারেনি।

ত্রিশ বছর বয়সে ক্যুনিস্ট পার্টির এক প্রভাবশালী সদস্যের মেয়েকে বিয়ে করে কোইভিসতু। বিয়ের এক বছর পরই বিদেশে গুরুত্বপূর্ণ সামরিক তথ্য পাচার করার অভিযোগ এনে তাকে গ্রেফতার করা হয়। একজন ইহুদিকে জামাই করায় কম নিন্দিত হয়নি শ্বশুর, তারপর জামাইয়ের বিরুদ্ধে এই গুরুতর অভিযোগ আনার খবর শুনে হার্টফেল করে মারা যায় সে। স্বামীকে বিপদ থেকে মুক্ত করার জন্যে সাধ্যমত সব কিছু করে অভেদলিনা। তার দৌড়াদৌড়ি আর ধরাধরিতে কাজ হয়, মৃত্যুদণ্ডের বদলে লেবার ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেয়া হয় কোইভিসতুকে। সলভিনার বয়স তখন। দুমাস।

সেই মেয়ের বয়স এখন চব্বিশ। চাপা স্বভাবের মেয়ে, বাপ বলতে অজ্ঞান। বাপের বুকে যে প্রতিশোধের প্রতিজ্ঞা তুষের আগুনের মত জ্বলছে, সলভিনার চেয়ে ভাল করে আর কেউ তা জানে না। কোইভিসতুর একটা ভয় ছিল, প্রতিশোধ নিতে গেলে তার একমাত্র মেয়ের জীবনে বিপদ নেমে আসবে। কিন্তু মেয়েই বাপকে বুঝিয়েছে, তোমার ওপর অন্যায় করা হয়েছে, প্রতিশোধ তোমাকে নিতেই হবে। তাছাড়া, আমার বাবা কাপুরুষ এই বোধ। নিয়ে আমি বেঁচে থাকতে চাই না। আজ মা বেঁচে নেই, কিন্তু মায়ের দেয়া শিক্ষা আমি ভুলিনি। এ-দেশে ইহুদিদের ওপর যে অত্যাচার চলছে তার বিরুদ্ধে কাউকে না কাউকে তো প্রতিবাদ জানাতেই হবে। তুমি যদি ভয় পাও, সুযোগের অপেক্ষায় থাকব। আমি, আমিই একদিন প্রতিশোধ নেব।

মেয়েকে তো বটেই, এমন কি স্ত্রীকেও ঘুণাক্ষরে টের পেতে দেয়নি কোইভিসতু যে তার বিরুদ্ধে অভিযোগটা সত্যি ছিল। অত্যন্ত সতর্কতার সাথে তথ্য পাচার করত সে, ফলে অভিযোগ তোলা হলেও তার বিরুদ্ধে নিঃসন্দেহে কিছু প্রমাণ করা যায়নি।

খাবার টেবিলে কথা হলো ওদের মধ্যে। রানাকে সম্পূর্ণ শান্ত, নিরুদ্বিগ্ন আর স্বাভাবিক দেখে বিস্মিত না হয়ে পারল না কোইভিসতু। মস্কো থেকে কিভাবে বিলিয়ারস্কে পৌঁছুল রানা, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে প্রশ্ন করে সব জেনে নিল সে। জসেস্কুর জন্যে দুঃখ। প্রকাশ করল-এখনও সে কুইবিশেভের রাস্তা ধরে পালাচ্ছে, নাকি এরইমধ্যে ধরা পড়েছে কে.জি.বি-র হাতে, কে জানে। জসেস্কুর পরিণতির কথা ভেবে রানা কাতর হলো না দেখে কোইভিসতুর বিস্ময় আরও একটু বাড়ল। জিওনিস্ট ইন্টেলিজেন্সকে সে অনুরোধ করেছিল, পাইলট হিসেবে এমন একজনকে পাঠাও যার বুকে দেশপ্রেম, জাতি-প্রেম আর ভ্রাতৃত্ব বোধের অভাব নেই। এই অনুরোধের সাথে ভাবাবেগের কোন সম্পর্ক ছিল না, কোইভিসতুর বিশ্বাস এই গুণগুলো না থাকলে রাশিয়া থেকে মিগ-৩১ নিয়ে পালিয়ে যাওয়া কারও পক্ষে সম্ভব নয়। এই অ্যাসাইনমেন্টে এমন সব বিপদের মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে, শুধু টেকনিক্যাল জ্ঞান আর ক্ষুরধার বুদ্ধির সাহায্যে সেগুলো থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে না, রক্ষা পেতে হলে চাই জেদ, লোভ, আক্রোশ, স্বদেশবাসী আর স্বজাতির প্রতি মমত্ববোধ। তার অনুরোধ রক্ষা করা হবে, কথা দিয়েছিল জিওনিস্ট ইন্টেলিজেন্স। কিন্তু এ কাকে পাঠিয়েছে তারা?

কথা খুব কম বলে, যেন দূরত্ব রেখে চলতে চায়। ব্যক্তিগত ব্যাপারে কোন কৌতূহল দেখায় না, যেন ওদের ভাগ্যে কি আছে আছে সে-ব্যাপারে ওর কোন মাথাব্যথা নেই। পাষাণ নাকি?

বলা হয়েছিল, পিটি ডাভ সাহসী নয়, কিন্তু পাইলট হিসেবে তার জুড়ি মেলা ভার। কিন্তু এখানেও উল্টোটা দেখা যাচ্ছে, সাহসী না হলে শত্রু এলাকার ভেতর এমন নিশ্চিন্তে বসে খাচ্ছে কিভাবে? এই লোককে ভীতু বলার কোন মানে হয়?

কিন্তু আসল কথা হলো, পাইলট হিসেবে কেমন ও? এব্যাপারেও যদি উল্টোটা সত্যি হয়, তাহলেই সর্বনাশ। এতগুলো লোক শুধু-শুধু মারা পড়বে, ইসরায়েলের মাটিতে কোনদিনই মিগ-৩১ পৌঁছুবে না।

খাওয়াদাওয়া শেষ হওয়ার অপেক্ষায় থাকল কোইভিসতু। পিটি ডাভের পরীক্ষা নেবে সে।

রানাকে কোইভিসতুর হাতে তুলে দিয়েই নিজের কোয়ার্টারে ফিরে গেছে ইসরাফিলভ। কাল এয়ারকিঙের উইপনস ট্রায়াল, তার আগে ইসরাফিলভের সাথে আর দেখা হবে না কোইভিসতুর। তার অপর সহকারী করনিচয়কে নিয়ে রাত দুটোয় সিকিউরিটি নেট পেরোবে ইসরাফিলভ, ফ্যাক্টরি কমপ্লেক্সে ঢুকে রিপোর্ট করবে।

কোইভিসতু জানে, ওদের তিনজনের ওপর সারাটা রাত কড়া নজর রাখবে কে.জি.বি.। সন্দেহ নেই, ফ্লাইটের ঘণ্টা কয়েক আগেই ওদেরকে গ্রেফতার করতে চাইবে তারা, কিন্তু ইচ্ছে থাকলেও উইপনস-সিস্টেমে বাকি কাজটুকু শেষ হবার আগে ওদেরকে তারা ছোঁবে না। রাত দুটো পর্যন্ত তারা শুধু এই একটা। কাজই করতে পারে-রাস্তায় গাড়ি দাঁড় করিয়ে কোয়ার্টারের ওপর নজর রাখা। সেজন্যেই পিটি ডাভকে বাড়িতে নিয়ে এসে তোলা সাংঘাতিক ঝুঁকির কাজ বলে মনে হলেও, সব দিক থেকে। সবচেয়ে নিরাপদ হয়েছে। বিলিয়ারস্কের অন্য যে-কোন জায়গার চেয়ে এই কোয়ার্টার নিরাপদ, এখানে ওরা কাউকে খোঁজার জন্যে আসবে না-এলেও একেবারে শেষে আসবে।

পাঁচ বছর আগের কথা মনে পড়ল কোইভিসতুর। লেবার। ক্যাম্পে ছিল সে, নিজের সাবজেক্ট নিয়ে কাজও করছিল, কিন্তু মনে মনে জানত, জীবনে আর ওখান থেকে বেরুনো হবে না। প্রস্তাবটা এল হঠাৎ করে। প্রস্তাব না বলে আদেশ বলাই ভাল। তাকে জানানো হলো, তোমাকে লেবার ক্যাম্প থেকে ছেড়ে দেয়া হচ্ছে, বিলিয়ারস্কের একটা প্রজেক্টে তুমি কাজ করবে।

বিলিয়ারস্কে আসার পর সে জানল থট-গাইডেড উইপনসসিস্টেম নিয়ে কাজ করতে হবে তাকে। লেবার ক্যাম্পে যাবার আগে এ-বিষয়ে প্র্যাকটিকাল কাজের অভিজ্ঞতা ছিল তার, কিন্তু তার গবেষণা বেশিদূর এগোয়নি। ইতোমধ্যে বিশ বছর পার হয়ে গেছে। একজন ক্যুনিস্ট সমর-বিজ্ঞানী থট-কন্ট্রোলড উইপনসসিস্টেম আবিষ্কার করে ফেলেছে। কোইভিসতুর ভাগ্যই বলতে হবে, ক্যুনিস্ট বিজ্ঞানীর আবিষ্কার ছিল সম্পূর্ণ থিওরিটিক্যাল, সেটাকে বাস্তবে রূপ দিতে হলে কোইভিসতুর অভিজ্ঞতা, মেধা আর জ্ঞান একান্ত দরকার। বিলিয়ারস্কে পৌঁছুবার পর আরও একটা তথ্য পেল কোইভিসতু, কম্যুনিস্ট বিজ্ঞানী নিউমোনিয়ায়। মারা গেছে। বুঝল, ও ছাড়া কোন গতি নেই ওদের।

তোমার ট্রেনিং সম্পর্কে বলো, পিটি, জিজ্ঞেস করল। কোইভিসতু।

করনিচয়ের লিভিংরূমে সামনাসামনি দুটো সোফায় বসে রয়েছে ওরা, তেপয়ে ধূমায়িত কফির কাপ। করনিচয় তার সেক্রেটারিকে নিয়ে খানিক আগে বেডরূমে গিয়ে ঢুকেছে। পরস্পরকে ভালবাসে ওরা, ওদের মানসিক অবস্থা বুঝতে পারে। কোইভিসতু। কে জানে, আজই হয়তো ওদের জীবনের শেষ দিন। সে কথা ভুলে থাকার জন্যেই হয়তো প্রেম করছে ওরা।

নিজের ট্রেনিং সম্পর্কে আগাগোড়া মিথ্যে কথা বলে গেল রানা। মিগ-২৫ চালিয়েছে ও, চালিয়েছে মিগ-৩১-এর ডামি, তবে ওর ট্রেনিঙের মেয়াদ দুবছর ছিল না, ছিল মাত্র তিন মাস। কোইভিসতু গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনল রানার কথা। রানা থামতে সন্তুষ্টচিত্তে মাথা ঝাঁকাল সে। আর যাই হোক, ছোকরার ট্রেনিংটা নিখুঁতই হয়েছে, ভাবল সে।

কোন রকম ভুমিকা না করে সরাসরি জানতে চাইল রানা, উইপনস-সিস্টেম সম্পর্কে সব খুলে বলুন আমাকে, মি. কোইভিসতু।

রানার আগ্রহ দেখে খুশি হলো প্রৌঢ় বিজ্ঞানী। এই সময় ঘরে ঢুকল সলভিনা। স্বাস্থ্য, সৌন্দর্য, কোমলতা আর ব্যক্তিত্বের আশ্চর্য একটা সমাবেশ ঘটেছে মেয়েটার মধ্যে। সাড়ে পাঁচ ফিটের কাছাকাছি লম্বা। নড়াচড়া না করলে মনে হবে কোন প্রতিভাবান ভাস্করের সারা জীবনের সাধনার ফল। মেয়েটার একমাত্র খুঁত ওর চোখ ছোট ছোট। ফর্সা, লালচে মুখের তিন দিকে কাঁধ পর্যন্ত লম্বা সোনালি চুলের ফ্রেম। তোমাকে আর কফি দেব, বাবা? জানতে চাইল সে। কোইভিসতু মাথা নাড়তে রানার দিকে তাকাল সে। আপনাকে আরও কিছুক্ষণ জেগে থাকতে হবে, মি. ডাভ, তার ঠোঁটে ক্ষীণ একটু হাসি ফুটে উঠেই মিলিয়ে গেল, কাজেই আরও এক কাপ খেলে ভাল করবেন।

হাসিমুখে তাকাল রানা। জেগে থাকতে হবে কেন?

আমি আপনাকে জাগিয়ে রাখব, বলল সলভিনা।

কোইভিসতুর দিকে তাকাল রানা। কোইভিসতু হেসে উঠল। রানার কাপে কফি দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল সলভিনা। মেয়ের গমনপথের দিকে তাকিয়ে থেকে কোইভিসতু বলল, আমরা ইসরায়েল বলতে অজ্ঞান। সলভিনা আগেই আমার। অনুমতি চেয়ে নিয়েছে, তোমার কাছে ইসরায়েলের গল্প শুনতে চাইবে ও।

তারমানে একটা পরীক্ষা দিতে হবে আমাকে, ভাবল রানা।

হঠাৎ করেই কাজের কথায় ফিরে এল কোইভিসতু। উইপনস-সিস্টেম, হঁা। আগেই বলে রাখি, মূল ব্যাপারটা কিন্তু আমার আবিষ্কার নয়। আমি সিস্টেমটার ইলেকট্রনিক্সের দিকটা নিয়ে কাজ করেছি শুধু। মিনিয়েচারাইজেশন, ইত্যাদি। নিভে যাওয়া পাইপটা ধরিয়ে নিল সে। পাইলট উইপসন সিস্টেম দুটো আলাদা কোন ব্যাপার নয়, একটাই জিনিসের দুটো অংশমাত্র। ইউ আর লিটারেলি প্লাগড ইনটু দ্য উইপনস্ সিস্টেম। সেনসরগুলো তোমার থট-প্রসেস আর আই মুভমেন্টে সাড়া দেবে, ওগুলো তোমার হেলমেটের ভেতর তৈরি করা হয়েছে, সেল আর ভাইজর-এ। একটা মাত্র তার তোমার ব্রেন-ইমপালস ফায়ারিং মেকানিজমে বয়ে নিয়ে যাবে, ওটা তুমি ম্যানুয়ালি কনসোলের সাথে জুড়ে দেবে-কনসোলটা কোথায় জানো তো? মাথা ঝাঁকাল রানা। গুড। যা ঘটে, প্রসেস হিসেবে সেটা তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়, তোমার জন্যে গুরুত্বপূর্ণ শুধু ফলাফলটা। মিগ-৩১-এর রাডার সিস্টেম বিশেষভাবে তৈরি করা হয়েছে যাতে উইপনস্-কন্ট্রোলের। সাথে তাল মিলিয়ে কাজ করতে পারে-লাভ, ফায়ারিং টাইম অবিশ্বাস্য রকম কমে গেছে। তোমার চোখ যত দ্রুতই সাড়া দিতে পারুক, তারচেয়ে অনেক দ্রুত সাড়া দেয় রাডার। রাডার সাড়া দিলেই তোমার ব্রেনে রিয়্যাকশন হবে, সেই রিয়্যাকশনে রিয়্যাক্ট। করবে উইপনস্-সিস্টেম। এবং গোটা ব্যাপারটা ঘটতে প্রায় কোন সময়ই লাগবে না। এয়ার-টু-এয়ার মিসাইল ঘেঁড়ো বা কামান ফায়ার করো, লক্ষ্যবস্তুকে তোমার না দেখতে পেলেও কোন ক্ষতি নেই, কারণ রাডার দেখতে পেয়ে তোমার ব্রেনে ইমপালস সৃষ্টি করেছে, আর সেই ইমপালসে রিয়্যাক্ট করে বসেছে উইপনস-সিস্টেম। চোখের দেখা আর রাডারের দেখা, সময়ের ব্যবধান মাত্র কয়েক সেকেন্ডের। অন্য যে-কোন প্লেন বা পাইলটের চেয়ে এই কসেকেন্ড এগিয়ে থাকবে তুমি।

কথা বলায় মশগুল, পাইপটা আবার নিভে গেছে। সেটা ধরাল কোইভিসতু।

রানা ভাবল, কিন্তু আমি তো যুদ্ধ করতে আসিনি। পিছু নেয়া রাশিয়ান ফাইটারগুলো একের পর এক মাঝ আকাশে বিস্ফোরিত হতে থাকবে, এই যদি অবস্থা হয়, যুদ্ধ ঘোষণার বাকি থাকে কি? রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা, হাসব না কাঁদব!

আবার শুরু করেছে কোইভিসতু। তোমার চোখ টার্গেট দেখতে পাবার সাথে সাথে, তোমার ব্রেন থেকে ইমপালস ট্রান্সমিট হয়ে যাবে উইপনস-কন্ট্রোলে-আর যে মারণাস্ত্রই তুমি ছুঁড়তে চাও, তা ছোড়া হয়ে যাবে। শুধু তাই নয়, তোমার ব্রেন ইমপালস টার্গেটের দিকে মিসাইলের যাত্রা-পথও নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে।

একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে রানা, কোইভিসতুর কথাগুলো যেন গোগ্রাসে গিলছে। সেটা লক্ষ করে অভয় দিয়ে হাসল কোইভিসতু। ভয় পেয়ো না, পিটি-আমাদের কিছু রেড এয়ারফোর্স পাইলট তেমন বুদ্ধিমান নয়। এই সিস্টেম কাজ করবে শুধু যখন তুমি হেলমেট পরে থাকবে। এর বেশি, মুচকি হাসল সে, তোমাকে কিছু জানাতে পারছি না-টপ সিক্রেট ইনফরমেশন! অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল বিজ্ঞানী। থেমে, পাইপ টানল সে। তারপর আবার বলল, ওখানে একটা মাস্টার লক আউট সুইচ আছে, তোমার কুচিন্তা যদি মাঝ আকাশে বন্ধুদের ধ্বংস করতে চায়, ওটা ঠেকাবে।

কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল কোইভিসতু, আধবোজা চোখে যেন। নিজের গভীরে তাকিয়ে আছে। এরপর যখন কথা বলল, মনে। হলো, শুধু নিজের সন্তুষ্টির জন্যে একটা সমস্যা নিয়ে ভাবছে সে। মিগ-৩১ ইসরায়েল পেলেও, ওটা থেকে পুরোপুরি ফায়দা আদায়। করা তোমাদের পক্ষে সম্ভব না। তবে আশার কথা এই যে মার্কিন। সরকার, অন্তত পেন্টাগন আর সি.আই.এ, উইপনস-সিস্টেমের গুরুত্ব বোঝে। যুক্তির বিচারে এটাই পরবর্তী পদক্ষেপ, আর এর সম্ভাবনারও কোন শেষ নেই। আমাকে ওরা নিয়ে যেতে চেয়েছিল, আমি রাজি হইনি…তারচেয়ে একটা মিগ-৩১ চুরি করা সহজ, আমার চেয়ে অনেক বেশি কাজও দেবে। ঘন ঘন পাইপে টান দিল সে, কিন্তু ধোঁয়া বেরুল না। আমেরিকানরা এখনও কাজে হাত দেয়নি, তাড়াতাড়ি না দিলে বোকামি করবে ওরা। সিস্টেমটা এখনও এখানে নিখুঁত নয়, কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে রিফাইনমেন্ট। আর অ্যাপ্লিকেশনের বন্যা বয়ে যাবে, তখন আর এদের সাথে পাল্লা দেয়া আমেরিকানদের পক্ষে সম্ভব হবে না। কাজেই একটা মিগ-৩১ ওদের সত্যিই দরকার। হঠাৎ আড়ষ্ট একটু হাসি দেখা গেল কোইভিসতুর মুখে। তুমি বোধহয় বোর ফিল করছ। জানি, তুমি একজন পাইলট হিসেবে ইন্টারেস্টেড, বিজ্ঞানী হিসেবে। নও।

রানা জিজ্ঞেস করল, এবার আপনি আমাকে অ্যান্টি-রাডার সম্পর্কে বলুন।

হতাশ দেখাল কোইভিসতুকে, এদিক ওদিক মাথা নাড়ল। অ্যান্টি-রাডার সম্পর্কে…কিছুই আমি জানি না। গোটা প্রজেক্টে এটাই সবচেয়ে গোপন ব্যাপার।

আমাকে জানতে হবে, বলল রানা, আমি আকাশে থাকার সময় রিমোট-কন্ট্রোলের সাহায্যে রাশিয়ানরা ওটার সুইচ অফ করে দিতে পারবে কিনা-কিংবা না বুঝে আমিও ওটা অফ করে দিতে পারি কিনা।

চিন্তিত দেখাল কোইভিসতুকে। ধোঁয়া বেরুচ্ছে না, কিন্তু জেদের বশে পাইপটা টেনেই চলেছে। এক সময় মুখ তুলল সে। না। তর্জনী দিয়ে নাক ঘষল। গুজব থেকে যা উদ্ধার করতে পেরেছি-এসব গুজব কদাচ শোনা যায়, কোন ভিত্তি আছে কিনা তাও বলা মুশকিল-অ্যান্টি-রাডার ক্যাপাসিটি আসলে মেকানিক্যাল কোন ব্যাপারই নয়।

সে কি! বিমূঢ় দেখাল রানাকে।

আমি অন্তত তাই বুঝেছি, বলল কোইভিসতু। জিনিসটা হয়তো এক ধরনের পর্দা, কিংবা আজব কোন রঙও হতে পারে। কিভাবে কাজ করে, এ-ব্যাপারে আমি শুধু আমার ধারণাটুকু তোমাকে জানাতে পারি। রাডার বিম এয়ারক্রাফটের গায়ে গিয়ে ধাক্কা খায় না, পিছলে বা যেভাবে হোক বেরিয়ে যায়, ফলে স্ক্রীনে। কিছুই দেখা যায় না। তবে এটা জানি যে নিরাপত্তার প্রয়োজনে সিস্টেমটা নিউট্রালাইজ করা যায়-ধরো, বিপজ্জনক আবহাওয়ায় নিজেদের এয়ারপোর্টে ল্যান্ড করার সময়। পাইলটই সেটা পারে। কিন্তু কিভাবে কাজটা করা হয়, আমি জানি না। তার চেহারা ম্লান হয়ে গেল। ওটা তুমি ব্যবহার করতে পারবে না। মাথা নাড়ল সে। আমার নিজেরই সন্দেহ আছে, পিটি। যা শুনেছি তাই তোমাকে বললাম। তবে, সিস্টেমটা যে কাজ করে, তা সত্যি। এয়ারক্রাফটের এই অংশের উন্নতি করা হয়েছে অন্য জায়গায়, বিলিয়ারস্কে নয়।

কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর রানা জানতে চাইল, ককপিটে ওঠার পর কতটা সময় পাব আমি?

সময় পাবে বলে মনে হয় না। সিকিউরিটি এত কড়া…তোমার অনুপ্রবেশ ঠিকই টের পাবে ওরা, হয়তো কয়েক সেকেন্ড দেরিতে। এই কয়েক সেকেন্ড সময় তুমি পেলেও পেতে। পারো। তুমি জানো, ফার্স্ট সেক্রেটারি কাল আসছেন এখানে? সোভিয়েত টেকনোলজির এই সাফল্য নিজের চোখে দেখতে চেয়েছেন তিনি। কে.জি.বি. চীফ উলরিখ বিয়েগলেও তার সাথে আসছেন। পার্টির হোমড়াচোমড়া নেতারা তো থাকবেনই।

আপনাদের কি হবে?

এক মুহূর্ত চুপ করে থাকল কোইভিসতু। আমাদের তিনজনের কথা ভেবেই তো এত কড়াকড়ি। রানার প্রশ্ন আসলে এড়িয়ে গেল সে। কাল মিলিটারি ইন্টেলিজেন্স থেকে ট্রুপারদের একটা স্পেশাল ডিটাচমেন্ট এসে পৌঁচেছে। ওরা কে.জি.বি-র অধীনে থেকে কাজ করবে, সংখ্যায় একশোরও বেশি। সব মিলিয়ে একটা গ্যারিসন। কোইভিসতুর চোখের তারা ঝিক করে। উঠল, মৃদু হাসি দেখা গেল তার ঠোঁটে। আরও ছোট করতে হবে তোমাকে চুল, হেলমেট আর সেনসরগুলো যাতে এফিশিয়েন্টলি কাজ করতে পারে। কয়েক সেট কাগজ তৈরি করা হয়েছে, সেগুলোয় তোমার ফটো লাগবে-সলভিনা তোমার জন্যে অপেক্ষা। করছে, ও-ই সব ব্যবস্থা করবে। রানাকে আরেকবার খুঁটিয়ে দেখল সে। না, আর কিছুর দরকার নেই।

এবার আবার রুট সম্পর্কে বলুন। হ্যাঙ্গার এরিয়ার লেআউট জানতে চাই আমি।

নিঃশব্দে ইঙ্গিত করে সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল কোইভিসতু। তার পিছু পিছু ডাইনিং রূমে বেরিয়ে এল রানা। ছোট ডাইনিং টেবিলে বড় টেবিল-ক্লথের মত ঝুলছে একটা লার্জ-স্কেল ড্রইং। বেডরূমে ঢোকার আগে এখানে এটা রেখে গেছে করনিচয়।

পেন্সিলে আঁকা একটা নক্সা। নক্সার এক জায়গায় আঙুল। রাখল কোইভিসতু। এখানে রয়েছি আমরা, আবাসিক এলাকার প্রায় মাঝখানে। এই যে গেটটা দেখছ, এটা দিয়ে টেকনিক্যাল

আর সায়েন্টিফিক স্টাফরা হ্যাঙ্গার আর ফ্যাক্টরি কমপ্লেক্সে ঢোকে… রাস্তাগুলোর ওপর দিয়ে এগোল তার আঙুল, থামল লাল একটা রেখার ওপর। রেখাটার গায়ে খানিক পর পর লাল রঙেরই ক্রসচিহ্ন। হ্যাঁ, বলে চলেছে কোইভিসতু, এখানে রয়েছে আরও একটা কাঁটাতারের বেড়া, ইলেকট্রিফায়েড। ক্রসচিগুলো ওয়াচটাওয়ার, বেড়ার ওপর নজর রাখা হয় ওগুলো থেকে। এই বেড়ায় আর মাত্র একটা গেট আছে, সেটা দিয়ে এয়ারস্ট্রিপে যাওয়া যায়। এই গেট শুধুমাত্র সিকিউরিটির লোকজন ব্যবহার করে, আর তুমি ব্যবহার করবে।

কিভাবে?

কোইভিসতু হাসল। সাহসে বুক বেঁধে, বলল সে। অবশ্য আমরাও তোমাকে যতটা পারি সাহায্য করব। এ-ব্যাপারে কিছু ভেবো না। পাইপে তামাক ভরল সে। আগুন ধরিয়ে গল গল করে ধোঁয়া ছাড়ল। তুমি সিগারেট খাও তো?

পিটি ডাভ যা বলত তাই বলল রানা, খুব একটা না।

মাথা ঝাঁকাল প্রৌঢ়, যেন এই উত্তরই আশা করেছিল সে। পকেট থেকে সিগারেটের একটা প্যাকেট বের করে রানার হাতে ধরিয়ে দিল। ধরাও একটা।

কেন?

অভ্যস্ত হও, বলল কোইভিসতু। দরকার আছে।

প্যাকেটটার ওপর একবার চোখ বুলাল রানা। কিন্তু এ যে দেখছি আমেরিকান সিগারেট।

মুচকি হাসল কোইভিসতু। হ্যাঁ, এখানকার স্ট্যাটাস-সিম্বল। ছদ্মবেশ নেয়ার পর তোমার মুখে এই সিগারেট থাকলে সেটা হবে সবচেয়ে কনভিন্সিং-কাগজগুলোর চেয়েও। ম্যাপের দিকে আবার তাকাল সে। একটা আঙুল রাখল গেটের ওপর। এই গেট পেরিয়ে এখানে চলে আসবে তুমি, রানওয়ের একেবারে শেষ। প্রান্তে। এখানে এই যে চৌকো ঘরটা দেখছ, এই বিল্ডিংটাই মেইন হ্যাঙ্গার, দুটো প্রোটোটাইপই এখানে রাখা আছে। সারারাত এই হ্যাঙ্গারে থাকব আমরা, ট্রায়ালে অংশ নেয়ার জন্যে প্লেনটাকে সাজাব।

ট্রায়ালের জন্যে তাহলে মাত্র একটা প্লেনকেই সাজানো। হবে?

হ্যাঁ। দেখতেই পাচ্ছ, সিকিউরিটি অফিসগুলো হ্যাঙ্গারের সাথেই। পাইলটদের কামরাও এখানে, এই যে। মাথা ঝাঁকাল রানা। গুড। দোতলায় উঠতে হবে তোমাকে, করিডর ধরে… বিশাল মেইন হ্যাঙ্গারের পাশেই আরেকটা বিল্ডিং, সেটার প্ল্যানের ওপর আঙুল রয়েছে কোইভিসতুর। আর যে-সব বিল্ডিং দেখছ ওগুলো ল্যাবরেটরি, উইন্ড-টানেল, টেস্ট-হাউস, এই সব। ওদিকে যাবার কোন দরকারই নেই তোমার, অযথা সময় নষ্ট হবে। যত তাড়াতাড়ি পারো পাইলটদের ড্রেসিং-রূমে ঢুকে পড়বে তুমি। রেড এয়ারফোর্সের লেফটেন্যান্ট-কর্নেল ইউরি বেনিন। ফ্লাইটের ঘণ্টা কয়েক আগেই হ্যাঙ্গারে পৌঁছুবে। ওর জন্যে তৈরি। থাকবে তুমি।

কিন্তু পরে যদি আর কেউ যায় ওখানে? আমাকে হয়তো ওখানে তিন-চার ঘণ্টা থাকতে হবে।

পায়চারি শুরু করল কোইভিসতু। লাশটা লুকিয়ে ফেলবে তুমি। অনেকগুলো লকার আছে, সবগুলোর তালা ভাল। তারপরও হাতে তোমার প্রচুর সময় থাকবে। আমার পরামর্শ, শাওয়ারের নিচে দাড়িয়ে…।

কাউকে খুন করার জন্যে আসিনি আমি, ভাবল রানা। জিজ্ঞেস করল, তিন ঘণ্টা ধরে গোসল করতে বলছেন?

দেখে মনে হবে তুমি গোসল করছ, সত্যি সত্যি করবে কেন। সময় যখন হয়ে আসবে, হ্যাঙ্গারে আমরা একটা গোলমাল বাধিয়ে দেব। তখন তুমি ড্রেস পরবে, হেলমেটের ভাইজর (মুখোশ) লুকিয়ে রাখবে তোমার চেহারা। উইপনস্-সিস্টেমে আমরা যারা কাজ করছি তারা বারবার পাইলটদের অনুরোধ করি, ল্যাবরেটরি ছাড়া আর কোথাও যেন হেলমেট না খোলে। ফ্লাইটের এক দুঘন্টা আগে যদি তোমাকে ওটা পরে থাকতে দেখে, কারও মনে প্রশ্ন জাগবে না।

গোলমালটা কি?

স্রেফ একটা ডাইভারশন, বলল কোইভিসতু। ওদের দৃষ্টি অন্য দিকে ফেরাবার জন্যে। এ-ব্যাপারে তোমাকে চিন্তা করতে হবে না। আমার কাছে খুদে একটা রেডিও ডিভাইস থাকবে, সেটার মাধ্যমে তুমি জানতে পারবে কখন তোমাকে নিজের কামরা থেকে হ্যাঙ্গারে আসতে হবে। হ্যাঙ্গারের কাছে এসে যা-ই দেখো, সময় নষ্ট কোরো না। মিগ-৩১-এর ককপিটে ওঠার ওটাই হবে তোমার শেষ আর একমাত্র সুযোগ। ককপিটে উঠেও দেরি করবে না।

সেই প্রশ্নটা আবার করল রানা, আমি চলে যাবার পর কি হবে?

যাই হোক, কিছু এসে যায় না, মৃদু কণ্ঠে বলল কোইভিসতু। এই ঝুঁকি সবাই আমরা স্বেচ্ছায় নিয়েছি, কেউ বাধ্য করেনি। এখানে আমাদের কাজ শেষ হলে এমনিতেও মরতাম, এখন না হয় স্বজাতির একটা উপকার করে মরব-দুটোর মধ্যে তুমি কোন পার্থক্য দেখো?

চুপ করে থাকল রানা। এসো, প্লেনের আর্মামেন্ট নিয়ে আরেকবার আলোচনা করি। ভাগ্যই বলতে হবে, অন্তত তোমার জন্যে, প্রথম ট্রায়ালে ওরা শুধু এয়ার-টু-এয়ার মিসাইল পরীক্ষা করবে, গ্রাউন্ড-অ্যাটাক উইপনস ব্যবহার করা হবে না। আমার তো মনে হয়, যদিও তোমাকে গোটা সোভিয়েত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে একা লড়তে হবে, তবু…

চাঁদনি রাতে আকাশের গায়ে প্রকাণ্ড কালো বাদুড়ের মত লাগছে। এমআইএল এমআই-এইট হেলিকপ্টারকে। মস্কো থেকে রওনা হয়ে বিলিয়ারস্কের পথে অর্ধেক দূরত্ব পেরিয়ে এসেছে কর্নেল সাসকিন। নিচে কখনও ঘুমিয়ে থাকা দুএকটা গ্রাম, কখনও গোর্কি আর কাজানের মাঝখানের রাস্তায় দুএকটা গাড়ির আলো দেখা যায়। পাইলট আর কো-পাইলটের পিছনে বসে রয়েছে কর্নেল, তার পিছনে বসেছে একজন বডিগার্ড, একজন পুরুষ সেক্রেটারি, একজন রেডিও অপারেটর, তারপরও চব্বিশটা সীট খালি পড়ে আছে।

জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে কর্নেল, ঠোঁটে সিগারেট। কে? কে? নিজেকে জিজ্ঞেস করছে সে। কে ওই লোক? অরলভের পরিচয় নিয়ে মস্কো, গোর্কি আর কাজান চেকপোস্ট পেরিয়ে গেছে। কি তার উদ্দেশ্য? রোমানভের তদন্ত সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে, কিছুই জানতে পারেনি সে। জসেস্কুর ভ্যান অবশ্য পাওয়া। গেছে, কুইবিশেভের দশ মাইল উত্তরে। খাদে পড়ার আগে ক্যাব থেকে ছিটকে পড়ে গিয়েছিল জসেস্কুর লাশ। না, দুর্ঘটনা নয়, জুলফির নিচে ছোট্ট, গোল একটা গর্ত দেখা গেছে। অহত্যা করেছে জসেস্কু? নাকি খুন করা হয়েছে তাকে? রিভলভারটা। পাওয়া গেছে লাশের হাতেই। বোধহয় অহত্যা। ধরা পড়লে। টরচার করে তথ্য আদায় করা হবে, সেই ভয়ে মরল লোকটা?

তার সহকারী লোকটাকে ভ্যানে পাওয়া যায়নি। রোমানভের সাথে আলোচনা করে কর্নেল সিদ্ধান্তে পৌচেছে, পায়ে হেঁটে বা। বিকল্প কোন গাড়ি নিয়ে বিলিয়ারস্কের দিকেই রওনা হয়েছে সে। ওয়্যারহাউসের বুড়ো দারোয়ানকে গ্রেফতার করেও কোন লাভ হয়নি। ইন্টারোগেশন শুরু হবার সাথে সাথে মারা গেছে সে। দুর্বল, হার্টের অবস্থা ভাল ছিল না।

কে ওই লোক? একা সে কি করতে পারে?

আরেকটা সিগারেট ধরাল কর্নেল। লোকটার ফটো বিলিয়ারস্কে ট্রান্সমিট করা হয়েছে, সেই সাথে সতর্ক করে দেয়া হয়েছে সিকিউরিটিকে। এক সময় রীতিমত আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিল কর্নেল-বিলিয়ারস্কে পৌঁছুতে বোধহয় বড় বেশি দেরি করে ফেলছে সে। এই মুহূর্তে প্রজেক্ট এলাকায় পৌঁছে ব্যক্তিগতভাবে সমস্ত দায়িত্ব নিজের হাতে তুলে নেয়ার প্রচণ্ড একটা তাগিদ তাকে অস্থির করে তুলছে।

ঘাড় ফিরিয়ে রেডিও অপারেটরের দিকে তাকাল সাসকিন। সামনে কনসোল নিয়ে বসে আছে অপারেটর। কনসোল থেকে মুখ না তুলেই কর্নেলের দৃষ্টি অনুভব করল সে, হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল। একটা দীর্ঘশ্বাস চেপে ঘাড় সোজা করে সামনে তাকাল কর্নেল। তার গলার কাছে ভয়ের একটা অনুভূতি, বড়সড় কিছু একটা যেন গিলতে গিয়ে আটকে গেছে ওখানে। হাত দিয়ে কপালের একটা পাশ টিপে ধরল সে। ভালয় ভালয় ট্রায়াল শেষ হওয়া পর্যন্ত এই টেনশনে ভুগতে হবে তাকে।

সাসকিন জানে, এই মুহূর্তে দযেরঝিনস্কি স্ট্রীটের কমপিউটর রূমে কাজ করছে মেজর রোমানভ। একজন লোককে খুঁজে বের করার জন্যে কমপিউটরের সাহায্য নিচ্ছে সে। লোকটা ব্রিটিশ বা আমেরিকান হতে পারে। সম্প্রতি রাশিয়ায় ঢুকেছে, ভুয়া পরিচয় আর পাসপোর্ট নিয়ে। এসপিওনাজ এজেন্ট হওয়ারই সম্ভাবনা বেশি। ভ্যানের দ্বিতীয় লোকটার পরিচয় উদ্ধার করার জন্যে রাশিয়ার সবচেয়ে বড় কমপিউটরের সাহায্য নিচ্ছে কে.জি.বি.।

বড় ধরনের কৃতিত্বের লোভে লোকটাকে সময় থাকতে গ্রেফতার করেনি কর্নেল সাসকিন, সেজন্যে এখন তার ইচ্ছে হলো নিজের মাথার চুল ঘেঁড়ে। আরও একটা ভুল করছে সে, জানে। কিন্তু এই ভুল তাকে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত করে যেতে হবে।

চীফ উলরিখ বিয়েগলেভকে এই লোক সম্পর্কে কিছুই জানায়নি সাসকিন। ব্যর্থতা সম্পূর্ণ হলে প্রাপ্য শাস্তি মাথা পেতে নেবে সে, কিন্তু টেনশনে ভোগার সময় অপমান আর অসম্মান। সইতে পারবে না।

বিপদ এখনও ঘটেনি, ঘটতে যাচ্ছে। এই মুহূর্তে যুক্তিসিদ্ধ। কল্পনাশক্তির পরিচয় দেয়া উচিত কর্নেলের, উচিত সম্ভাব্য হামলা ঠেকাবার জন্যে একটা পরিকল্পনা তৈরি করা। কিন্তু তা না করে নিজেকে তিরস্কার করছে সে, অপমান হওয়া থেকে বাচার কথা। ভাবছে। শুধু একটা ব্যাপারে সিদ্ধান্তে আসতে পেরেছে কর্নেল, ফার্স্ট সেক্রেটারি আর কে.জি.বি. চীফ বিলিয়ারস্কে পৌঁছুবার অন্ত ত দুঘণ্টা আগে তিন বেঈমানকে ইন্টারোগেট করবে সে।

ওখানে পৌঁছুবার জন্যে অস্থির হয়ে আছে সে। আরেকটা সিগারেট ধরিয়ে হাতঘড়ি দেখল, দশটা পনেরো।

.

পুলিস ইন্সপেক্টর বাজারনিকের ডেস্কে লিরয় পামারের অনেকগুলো। ফটো। একটা করে তুলছে সে, নমুনার সাথে মিল খুঁজছে, তারপর নামিয়ে রাখছে।

লিরয় পামারের সম্পূর্ণ ডোসিয়ে সংগ্রহ করতে তিন ঘণ্টা। সময় নিয়েছে তার সহকারীরা। তথ্যগুলো উদ্ধার করা হয়েছে। কে.জি.বি-র সেকেন্ড চীফ ডাইরেক্টরেট-এর বিভিন্ন শাখা থেকে। কাজটা আরও অনেক কম সময়ে সারা যেত, কিন্তু তার সহকারীরা কমপিউটর ব্যবহার করার অনুমতি চেয়ে পায়নি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অতীব গুরুত্বপূর্ণ, টপ সিক্রেট একটা কাজে ব্যস্ত রয়েছে দযেরঝিনস্কি স্ট্রীটের কমপিউটর।

দুই পাটি জুতোর মধ্যে যেমন অমিল খুঁজে পেয়েছিল বাজারনিক, ফটোগুলোর মধ্যেও তেমনি অমিল তার চোখে ধরা পড়ল। তার হাতে এই মুহূর্তে পামারের দুটো ফটো রয়েছে। একটা তোলা হয়েছে দুদিন আগে চেরেমেতেইভো এয়ারপোর্টে, অপরটা আঠারো মাস আগে মস্কোর একটা রাস্তায়। দ্বিতীয় ছবিটা তোলা হয়েছিল রুটিন সার্ভেইলেন্সের অংশ হিসেবে, এই ব্রিটিশ ব্যবসায়ী সম্পর্কে তখনও বাজারনিক আগ্রহী হয়ে ওঠেনি। ফটো দুটো আরও খানিকক্ষণ দেখে নিয়ে সহকারীদের দিকে বাড়িয়ে ধরল সে, বলল, তোমাদের কি মনে হয়?

গরচয়েভ আর রাসকিন পাশাপাশি দুটো চেয়ারে বসে আছে। হাত বাড়িয়ে ফটো দুটো ইন্সপেক্টরের কাছ থেকে নিল গরচয়েভ। খুঁটিয়ে দেখল। আমার মনে হয়, কমরেড ইন্সপেক্টর, এরা দুজন আলাদা মানুষ।

তুমি কি বলো, রাসকিন? জানতে চাইল ইন্সপেক্টর।

গরচয়েভের হাত থেকে ফটো দুটো নিয়ে রাসকিনও ভাল করে দেখল। নিঃশব্দে কাঁধ ঝাঁকাল সে, তারপর বলল, ঠিক বুঝতে পারছি না, কমরেড ইন্সপেক্টর।

গরচয়েভ আর আমি একমত, ফটো দুটো একই লোকের নয়, বলল বাজারনিক। তাহলে প্রশ্ন ওঠে-এদের মধ্যে মারা গেল কে?

কি করে বুঝবেন! দুজনেই তো একরকম দেখতে, কমরেড ইন্সপেক্টর।

উঁহু, দেখতে ওরা এক নয়, একই ধরনের ছদ্মবেশে ওদেরকে একরকম দেখাচ্ছে, বলল বাজারনিক। লোকটাকে মেরে ফেলার পর ইচ্ছে করে তার চেহারা নষ্ট করা হয়েছে, যাতে আমরা বুঝতে না পারি যে মানুষ আসলে দুজন ছিল। এখন প্রশ্ন হলো, দুজন। কেন?

গরচয়েভকে শুধু বিমূঢ় নয়, কৌতুহলীও দেখাল, যেন মজার। একটা ধাঁধা উপভোগ করছে সে। রাসকিনের চেহারায় কোন ভাব নেই, কথা বলতেও যেন উৎসাহী নয় সে। চেয়ার ছেড়ে পায়চারি শুরু করল বাজারনিক। সময় নেই, দেরি করলে বিপদ ঠেকানো যাবে না, হঠাৎ করেই এই রকম একটা উপলব্ধি জন্ম নিল তার মনে, অথচ এর কোন কারণ খুঁজে পেল না সে। তার মনে হলো, বোকার মত চারদেয়ালের ভেতর নিজেকে বন্দী করে রেখেছে সে। মুখ তুলে ওয়ালক্লকের দিকে তাকাল। দশটা ত্রিশ। পায়চারি থামিয়ে গরচয়েভের দিকে ফিরল সে। কমসোমলস্কায়া মেট্রো স্টেশনে একজন কে.জি.বি. মেজর খুন হয়েছেন, কাল সন্ধ্যায়।

কে তাকে খুন করল?

পামারের কোন সহকারী?

পামার হতে পারে না? এখন তো জানা গেল, সে মরেনি। গরচয়েভের দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আছে ইন্সপেক্টর। জবাব না দিয়ে শুধু কাঁধ ঝাঁকাল গরচয়েভ।

মস্কোয় আসার পর পামার যাদের সাথে মেলামেশা করত, বলল বাজারনিক, তাদের সবাইকে চিনি আমরা। এদের সবার। পরিচয় পামারের ফাইলেও রয়েছে। ধরে এনে জেরা করেছ তোমরা, টরচার করেছ, কিন্তু কোন তথ্য আদায় করতে পেরেছ। কি?

সহকারীরা চুপ।

আবার পায়চারি শুরু করল বাজারনিক। কোথায় সে? কোথায় পামার? কারা তাকে লুকাল? কেন তাকে লুকাল? তাকে। মেরে ফেলা হয়েছে, এটা প্রমাণ করার দরকার পড়ল কেন? বা হাতের তালুতে ডান হাত দিয়ে ঘুসি মারছে বাজারনিক, আপনমনে বিড়বিড় করছে, আমরা যাতে তার গন্ধটা হারিয়ে ফেলি, সেজন্যে? তাই যদি হয়, লন্ডনে কেন এই অভিনয় করল না? খবরটা ঠিকই আমাদের কানে তোলা যেত, কিন্তু চাইলেও সত্যি-মিথ্যে যাচাই করার তেমন সুযোগ পেতাম না। এখানে তো আমরা লাশ পর্যন্ত যাচাই করার সুযোগ পেয়েছি। থামল সে, ঘুরল, তারপর আবার এগোল। উঁহু, না। এই চাতুরীর পিছনে অন্য কোন উদ্দেশ্য আছে, আমাদেরকে ফাঁকি দেয়ার জন্যে এটা করা হয়নি। রাশিয়ার ভেতর, মস্কোয়, পামারকে গায়েব করে দেয়া জরুরী দরকার ছিল ওদের। কেন?

গরচয়েভ আর রাসকিন পরস্পরের দিকে বোবাদৃষ্টিতে তাকাল।

ধরো, পামার যে একজন ড্রাগ-স্মাগলার তা আমরা জানি না, বলল বাজারনিক। কেউ আমাদেরকে এই ইনফরমেশন দেয়নি। এরপর যা ঘটেছে-কে.জি.বি-র একজন মেজর খুন। হয়েছে সেটা ভুলো না-দুটো খুন, ভুয়া একজন পামার…লোকটা সম্পর্কে তাহলে কি ভাবতে পারি আমরা? দাঁড়িয়ে পড়ল ইন্সপেক্টর, সহকারীদের দিকে অন্তর্ভেদী দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল।

দুবার খুক খুক করে কাশল গরচয়েভ, যেন কোন বোকামি। করে ফেললে তাকে ক্ষমা করা হয়। আমরা ভাবব, লোকটা নিশ্চই একজন এজেন্ট।

ঠিক তাই! হাসি ফুটল বাজারনিকের মুখে। সে স্পাই। হয় আমেরিকান, না হয় ব্রিটিশ। সে ড্রাগ-স্মাগলার এই কথা বলে আমাদেরকে আসলে বোকা বানানো হয়েছে। খানিক বিরতি দিয়ে চিন্তা করল সে। লোকটা অদৃশ্য হয়ে গেছে। কেন? কি। করছে সে? কি করতে চায়?

সহকারীরা কোন উত্তর যোগাতে পারল না। ফটোগুলো এনভেলাপে ভরে ফাইলে রাখল বাজারনিক, ফাইলটা বগলদাবা করে এগোল দরজার দিকে। গরচয়েভ, এসো আমার সাথে। লোকটার ফটো সেন্ট্রাল কমপিউটরে ঢুকিয়ে দিয়ে জানতে হবে কে এই লোক। দরজার কাছে পৌঁছে ঘাড় ফেরাল সে। রাসকিন, ব্রিটিশ এমব্যাসিতে আমাদের লোকের সাথে যোগাযোগ। করো। বলো, এটা জরুরী। পামারের কন্ট্যাক্ট কে ছিল আমি জানতে চাই। এখুনি! গরচয়েভকে নিয়ে কামরা থেকে বেরিয়ে। গেল সে।

প্রথমে খোলা দরজা তারপর ডেস্কে রয়ে যাওয়া ফটোটার। দিকে আড়চোখে তাকাল রাসকিন। ব্লটিং পেপারের আড়ালে চাপা পড়েছিল এটা, বাজারনিকের দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে। দরজার দিকে চোখ রেখে ফটোটা তুলল সে। দেখল ভাল করে। ফটোর এই লোক পিটি ডাভ, রাসকিন জানে, লিরয় পামারের ছদ্মবেশ নিয়ে আছে।

রাসকিনের বড়সড় লাল মুখে দুশ্চিন্তার ভাঁজ পড়ল। মস্কোর ব্রিটিশ দূতাবাসে কে.জি.বি-র লোক আছে, তারা দূতাবাসের। কিচেন, বাগান, করিডর আর সুইমিং পুলে কাজ করে। বাজারনিক এদেরকে প্রশ্ন করতে শুরু করলেই মার্কিন দূতাবাসের টিম ওয়াইজম্যান আর ফ্লেমিং-এর সাথে লিরয় পামারের ছদ্মবেশধারী। ন্যাট ফরহ্যান্স-এর যোগাযোগ আবিষ্কার করে ফেলবে সে। ন্যাট ফরহ্যান্স আসলে ব্রিটিশ সিক্রেট সার্ভিসের লোক, বছর কয়েক আগে জীবনে একবারই সে টাকার লোভে দেশের সাথে বেঈমানী করেছিল। ব্যাপারটা ফাঁস হয়ে যায়, কিন্তু ফরহ্যান্সকে জানানো হয় যে তাকে ক্ষমা করা হয়েছে। আসলে পরে তাকে বলি দেয়া হবে বলে বাচিয়ে রাখা হয়। এই শেষবার মস্কোয় এসেছিল সে। কোন ছদ্মবেশ ছাড়াই, প্যাকেজ ট্যুরের আওতায় সাধারণ একজন। টুরিস্ট হিসেবে। এয়ারপোর্ট থেকে সোজা দূতাবাসে চলে আসে। সে, নিজের মৃত্যুর দুএক ঘণ্টা আগে গা ঢাকা দেয়-অল্প সময়ের জন্যে প্রকাশ করে আবার লিরয় পামার হিসেবে। বলা যায় না, কেউ হয়তো তাকে লক্ষ করেছে, হয়তো এমন কি এ-ও জানে যে ফরহ্যান্সের পরিচয় আর ছদ্মবেশ নিয়ে অন্য একজন লোক লেনিনগ্রাদে চলে গেছে। তাহলে লন্ডন থেকে চেরেমেতেইভো এয়ারপোর্টে যে লোকটা পৌচেছে আর ফরহ্যান্সের বিকল্প, দুজন এক লোক নয় এটা আবিষ্কার করতে কতক্ষণ সময় নেবে ওরা?

মনে মনে অস্থির হয়ে উঠল রাসকিন। খবরটা যেভাবে হোক। ব্রিটিশ দূতাবাসকে জানাতে হয়। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল সে। বাজারনিকের অফিস থেকে ফোন করা সম্ভব না, সমস্ত কল মনিটর করা হয়। অথচ এই বিল্ডিং ছেড়ে বেরুতেও পারছে না। সে-বাজারনিক মিনিট কয়েকের মধ্যে ফিরে আসবে। দোতলার রেস্ট-রূমে সোশ্যাল ফোন-লাইন আছে, রাতের এই সময়টায় লাইনটা মনিটর করা হয় না বলেই সে জানে। বাজারনিক তার নিজের ইনফরমারদের থেকে কোন তথ্য পাবার আগেই ব্রিটিশ দূতাবাসকে সতর্ক করে দেবে সে। কামরা থেকে বেরিয়ে সিঁড়ির দিকে হন হন করে এগোল রাসকিন।

.

ল্যাংলি, ভার্জিনিয়া। সি.আই.এ. হেডকোয়ার্টার।

গোপনীয়তা রক্ষার জন্যে হেডকোয়ার্টারের ভেতর আলাদা একটা অফিসই তৈরি করে ফেলা হয়েছে। মোট তিনটে কামরা-অপারেশন রূম, রিসেপশন রূম আর রেস্টরুম। অপারেশন রূমে রয়েছে সর্বাধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থাসহ খুদে কমপিউটর। রিসেপশনে আছে অয়্যারলেস, টেলিফোন, টিভি আর ইন্টারকম। রেস্টরূমে সোফা আর নরম বিছানা। এই অফিসে যারা কাজ করবে, বাইরের কেউ তাদের চেহারা দেখার সুযোগ পাবে না-কাজের ফাঁকে এখানেই তারা বিশ্রাম নেবে।

সি.আই.এ. চীফ রবার্ট মরগ্যান অপারেশন রূমে ঢুকল, পিছনে প্রাইভেট সেক্রেটারি লিলিয়ান গ্রে। রবার্ট মরগ্যান যেন নিরেট সোনা দিয়ে তৈরি ভিন গ্রহের কোন প্রাণী, পঁয়ষট্টি বছর বয়েসেও চেহারায় বার্ধক্যের ছাপ পড়েনি। তাঁর চুল, ভুরু, গায়ের রঙ ইত্যাদি সবই সোনালি, শুধু চোখের তারায় ঘোলাটে একটা ভাব আছে, আর সাদা অংশটায় চিকন টকটকে লাল কিছু রেখা। তার এই চোখজোড়াই ফাঁস করে দেয় যে তিনি অশুভ আর। অমঙ্গলের সান্নিধ্যে সময় কাটান, চক্রান্ত আর ষড়যন্ত্রের জাল পাতাই তার পেশা। বিনয়ী সদালাপী, মিশুক আর খোশমেজাজী বলে সুনাম রয়েছে দ্রলোকের। পৃথিবীর বুক থেকে কাউকে সরিয়ে ফেলার নির্দেশ দেয়ার সময়ও তার মুখে মিষ্টি একটুকরো। হাসি লেগে থাকে। রাষ্ট্রের যাবতীয় গোপন ব্যাপার যাতে ফাস না হয় সেদিকটাও দেখতে হয় সি.আই.এ-কে, তাই এমনকি খোদ প্রেসিডেন্টের কাছেও অনেক বিষয় চেপে যান রবার্ট মরগ্যান। জিওনিস্ট ইন্টেলিজেন্সের চীফ আইজ্যাক ময়নিহান-এর কথাই ধরা যাক। ময়নিহান যে যুক্তরাষ্ট্র, ভার্জিনিয়াতে এসেছেন, প্রেসিডেন্টকে তা জানানো হয়নি।

লিলিয়ান গ্রে-র বয়স পঁয়ত্রিশ, পাটখড়ির মত রোগা আর। তালগাছের মত লম্বা। রক্ত মাংসের কমপিউটর বলা যায় তাকে, একবার যা শেখে তা আর কখনও ভোলে না। রবার্ট মরগ্যান চিরকুমার, লিলিয়ানও চিরকুমারী। ওরা নাকি পরস্পরকে ভালবাসে-বলাই বাহুল্য, এটা একটা টপ সিক্রেট ইনফরমেশন।

অপারেশন রূমের দেয়ালগুলো ম্যাপ দিয়ে ঢাকা-ইউরোপিয়ান রাশিয়া, ব্যারেন্ট সী, আর্কটিক ওশেন, মস্কো মেট্রো সিস্টেম আর একটা মস্কো স্ট্রীট প্ল্যান। ইসরায়েলি পাইলট। পিটি ডাভ যেখানে আছে, যে পথ দিয়ে পালিয়ে আসবে, সবই। দেখানো হয়েছে ম্যাপে।

ম্যাপগুলোর সামনে দাঁড়িয়ে পড়লেন রবার্ট মরগ্যান। দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরেছেন লম্বা পাইপ। একটু পরই পিছনে পায়ের আওয়াজ পেলেন তিনি।  

অপারেশন রূমে ঢুকলেন জিওনিস্ট ইন্টেলিজেন্সের চীফ আইজ্যাক ময়নিহান। পিছু পিছু এল তাঁর প্রাইভেট সেক্রেটারি ফিদি আইরিন। ময়নিহানকে তরুণই বলা যায়, মাত্র বিয়াল্লিশ বছর বয়স। সিনেমার নায়কদের মত চেহারা, অভিনয়ের ঢঙে কথা বলেন, দেখলে মনে হয় তার সবকিছুই যেন কৃত্রিম। কালো চুল, স্বাস্থ্য ভাল, দেখে বোঝার উপায় নেই ভদ্রলোক হার্টের রুগী। দুবার অ্যাটাক হয়ে গেছে, আরেকবার হলে বাঁচবেন না। ভদ্রলোক অত্যন্ত দাম্ভিক, ঘনিষ্ঠ বন্ধুকেও সন্দেহের চোখে দেখেন।

ফিদি আইরিন সুন্দরী, মাত্র ছাব্বিশ বছর বয়স তার। মিশরে জন্ম, সেখানেই বড় হয়েছে। ইসরায়েলের পক্ষে বছর পাঁচেক গুপ্তচর হিসেবে কাজ করার পর তেল আবিবে পালিয়ে যায়। মিশরীয় জেনারেলরা, আইরিন যাদের রক্ষিতা ছিল, এখনও তাকে ভুলতে পারেনি।

অপারেশন রূমে আরও দুজন লোক রয়েছে, দুজনেই সি.আই.এ. এজেন্ট। একজনের নাম হ্যারিসন, ইউ.এস. এয়ারফোর্সের প্রাক্তন অফিসার সে। হ্যারিসনের অধীনেই মিগ চালাবার ট্রেনিং পেয়েছে পিটি ডাভ। দ্বিতীয় এজেন্টের নাম টল ব্যাট, ইউ.এস. নেভীর প্রাক্তন অফিসার। যে যার ডেস্কে বসে টেলিফোনে কথা বলছে তারা।

কফি চলবে? ময়নিহানের সাথে করমর্দন সেরে জানতে চাইলেন মরগ্যান। নাকি…

ধন্যবাদ, হ্যাঁ, কফি, বললেন জিওনিস্ট ইন্টেলিজেন্স চীফ।

অপারেশন রূমের লাগোয়া খুদে একটা কিচেনও আছে, সেদিকে পা বাড়াল লিলিয়ান, স্মিত হেসে তাকাল আইরিনের দিকে।এসো না, গল্প করি।

বস্ ময়নিহানের দিকে চট করে একবার তাকাল আইরিন। ময়নিহান সবার চোখকে ফাঁকি দিয়ে একটা চোখ টিপলেন। ইঙ্গিতটা কিসের তা অবশ্য আন্দাজ করা কঠিন, তবে এটাকে প্রেমের স্থূল বহিঃপ্রকাশ বলা যাবে না। লিলিয়ানের পিছু পিছু। কিচেনে গিয়ে ঢুকল আইরিন।

ফোনের রিসিভার নামিয়ে রেখে প্রাক্তন এয়ারফোর্স অফিসার। হ্যারিসন চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। তার হাতে একটা ওয়েদার ফটোগ্রাফ। এটা আর্কটিক এলাকার আবহাওয়ার ছবি, উপগ্রহ থেকে তোলা হয়েছে। একটা মই বেয়ে দেয়ালের বেশ অনেকটা। ওপরে উঠে গেল হ্যারিসন, পিন দিয়ে আর্কটিক ম্যাপের পাশেই ফটোটা আটকাল। প্রতিটি ম্যাপের পাশে সেই এলাকার ওয়েদার ফটোগ্রাফ সাটা রয়েছে।

ময়নিহান আর মরগ্যান, দুই ইন্টেলিজেন্স চীফ, রাশিয়ার ম্যাপের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। ম্যাপে শুধু রাশিয়ার ইউরোপিয়ান অংশটুকু দেখানো হয়েছে। দুজনেই একদৃষ্টে তাকিয়ে আছেন, খুঁটিয়ে দেখছেন সোভিয়েত রাশিয়ার ডিফেন্স সিস্টেম। রাশিয়ানদের এই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভেদ করতে হবে পিটি ডাভকে। অবশ্য সে যদি বিলিয়ারস্ক থেকে এয়ারকিং নিয়ে আকাশে উঠতে পারে।

ম্যাপের গায়ে অসংখ্য রঙিন পিন আর রিবন দেখা যাচ্ছে। এই পিন আর রিবনের তাৎপর্য যারা জানে, হার্টবিট তাদের বাড়বেই বাড়বে।

ম্যাপের মাথার কাছে পোলার প্যাক, ওখানে একটা রিবন। রয়েছে। বিরাট আকৃতির অনেকগুলো লুপ তৈরি করে ওপর দিকে। উঠে গেছে রিবনটা। এই রিবন রাশিয়ান ঊঋঘ-লাইন চিতি করছে। রাশিয়ান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার এই অংশটাকে নিয়ে উদ্বিগ্ন। হবার তেমন কোন কারণ নেই পিটি ডাভের। কিন্তু দুই। ইন্টেলিজেন্স চীফের দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে এক ঝাঁক খুদে পিন। নীল পিনগুলো প্রত্যেকটি এক একটা বিমান ঘাঁটি, আর লাল রিং বা বৃত্তগুলো প্রত্যেকটি একটা করে মিসাইল ঘাঁটি। প্রতিটি ফাইটার স্টেশনকে চব্বিশ ঘণ্টা সতর্কাবস্থায় রাখা হয়, মাত্র কয়েক মিনিটের নোটিশে কম করেও বারোটা ফাইটার আকাশে উঠে আসতে পারে। বিমানঘাঁটিগুলো মারমানস্ক থেকে সোভিয়েত ইউনিয়নের উত্তর উপকূল ধরে পশ্চিম দিকে আরচ্যানজেলস্ক আর পুব দিকে পনেরোশো মাইল সেই তাইমির পেনিনসুলা পর্যন্ত ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। প্রতি জোড়া ঘাঁটির মাঝখানে একশো মাইলের মত দূরত্ব।

পিনগুলোর নিচে লাল বৃত্তের দুটো রেখা। একজোড়া বৃত্তের মাঝখানের দূরত্ব একশো মাইলের কিছু কম হবে, রেখা দুটো পিনগুলোর মতই একই পথ ধরে এগিয়ে একই এলাকায় শেষ হয়েছে। প্রতিটি মিসাইল ঘাঁটিতে সম্ভবত বারোটা বা তারও বেশি সারফেস-টু-এয়ার আর ইনফ্রা-রেড মিসাইল আছে, নিক্ষেপ করা হয় কংক্রিটের তৈরি প্যাড থেকে। দুটো মিসাইল ঘাঁটির মাঝখানে, এখানে তার উল্লেখ না থাকলেও, মিসাইলবাহী ট্রাক রয়েছে, প্রতিটি কনভয়ে অন্তত ছটা মিসাইল থাকবেই। প্রতিটি মিসাইল ঘাঁটিতে রাডার সিস্টেম আছে, সেগুলো সেন্ট্রাল রাডার কন্ট্রোলের সাথে সংযুক্ত। উঋঘ-লাইন থেকে পাওয়া ডাটা আর ইনফরমেশন সেন্ট্রাল রাডার কন্ট্রোলে প্রসেস করা হয়।

লাল বৃত্ত দিয়ে তৈরি রেখা দুটোর দিকে সম্মোহিতের মত তাকিয়ে আছেন সি.আই.এ. চীফ। একটা রেখা উপকূল ধরে এগিয়ে গেছে, অপরটা তিনশো মাইল ভেতর দিকে, প্রথমটার সাথে সমান্তরাল ভাবে এগিয়েছে। মিসাইল ঘাঁটির এই লাইন দুটো এমন একটা রাডার ব্যবস্থার সাথে সংযুক্ত যে ব্যবস্থায় সোভিয়েত রাশিয়ার প্রতি ইঞ্চি আকাশে সর্বক্ষণ তীক্ষ্ণ নজর রাখা যায়। পিটি ডাভকে এয়ারকিং নিয়ে প্রতিটি রেখা পেরোতে হবে, এড়িয়ে যেতে হবে বিমানঘাঁটির ফাইটার স্কোয়াড্রন আর মিসাইলগুলোকে। এরপরও আছে সোভিয়েত স্পাই ট্রলার, রেড। ব্যানার নর্দার্ন ফ্লিট-এর মিসাইল ক্রুজার আর সাবমেরিন। ম্যাপে এখনও এগুলোর পজিশন চিক্তি করার কাজ শেষ করেনি। টলব্যাট।

জিওনিস্ট ইন্টেলিজেন্স চীফ ময়নিহান লক্ষ করলেন, মরগ্যান তার দিকে তাকিয়ে আছেন। কি বুঝছেন? জানতে চাইলেন। তিনি।

সংখ্যায় খুব বেশি ওগুলো, বললেন মরগ্যান।

হ্যাঁ, ভুরু জোড়া কপালে তুললেন ময়নিহান। কিন্তু তার মানে কি আপনি বলতে চাইছেন পিটির কোন সুযোগ নেই?

সরাসরি কোন উত্তর না দিয়ে সি.আই.এ. চীফ বিড়বিড় করে বললেন, বেচারা! ওর জন্যে আমরা শুধু প্রার্থনা করতে পারি।

পিটি ডাভকে জীবনে এই প্রথম আর শেষবার দেখছে সলভিনা। তার চোখে পিটি একজন অসমসাহসী বীর, দেশকে ভালবেসে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়তে এসেছে। বাবার অত্যাগের সাথে। পিটির অত্যাগের পার্থক্যটুকু পরিষ্কার দেখতে পায় সে-বাবা প্রতিশোধ নিতে চাইছেন বলে অত্যাগের জন্যে প্রস্তুত হয়েছেন, কিন্তু পিটি কারও ওপর প্রতিশোধ নেয়ার জন্যে এখানে আসেনি, নিখাঁদ দেশপ্রেমই তাকে এই ঝুঁকি নিতে উদ্বুদ্ধ করেছে। পিটির। প্রতি শ্রদ্ধায় ছেয়ে যায় তার অন্তর।

একটা ছেলেকে ভালবাসে সলভিনা। সে ক্যুনিস্ট পার্টির প্রভাবশালী এক সদস্যের একমাত্র ছেলে। সলভিনাকে বিয়ে করার জন্যে ছেলেটা পাগল। বছর কয়েক ধরে চেষ্টার পর মাবাবাকে এই বিয়েতে রাজিও করিয়েছে সে। সলভিনার মনে। একটা আশা, বাবার সাথে সে-ও যদি বিপদে পড়ে, তার প্রেমিক তাকে যেভাবে হোক রক্ষা করবে। একটু আভাসও দিয়ে রেখেছে সলভিনা, বলেছে, আমরা ইহুদি, কাজেই বিনা দোষে শাস্তি ভোগ করা আমাদের কপালের লিখন। তেমন যদি কিছু ঘটে…

সলভিনাকে আশ্বাস দিয়ে ছেলেটা বলেছে, কেউ তোমার কোন ক্ষতি করতে পারবে না, অন্তত আমি বেঁচে থাকতে নয়।

ভালবাসে বটে, কিন্তু সব কিছু বিলিয়ে দেয়নি সলভিনা। জানে, বেশি ঘনিষ্ঠ হলে তার ওপর ওর আর অতটা আকর্ষণ থাকবে না।

কিন্তু পিটি ডাভের ব্যাপারটা আলাদা। বীর পুরুষের দেখা পাওয়া ভাগ্যের কথা, এই দুর্লভ সুযোগ বার বার আসে না জীবনে। কি চায় ইহুদি বীর, কি পেলে খুশি হয় সে? কি আমি দিতে পারি তাকে? কি আছে আমার যা দিয়ে তাকে শ্রদ্ধা জানাই?

ড্রেসিং রূমে পায়চারি করছে সলভিনা, আর ভাবছে। পিটি ডাভকে দেয়ার মত কিছুই নেই তার। এই উপলব্ধি তাকে অস্থির করে তুলল। তারপরই দুষ্টামিমাখা, লাজুক এক চিলতে হাসি ফুটল তার ঠোঁটে। নেই, সত্যি, আবার আছেও। একটা মেয়ের সবচেয়ে বড় যে সম্পদ, যা পেলে বীরপুরুষরাও কৃতজ্ঞ বোধ করে, আত্মহারা হয়ে ওঠে আনন্দে, পিটি ডাভ আমার সেই সম্পদ  দুহাত ভরে নিক না তুলে। যদি নেয়, আমি তাহলে ধন্য হই। কিন্তু নেবে কি? নাকি আমার দান ফিরিয়ে দেবে অবহেলার সাথে?

এই সময় খুলে গেল দরজা। ঘরে ঢুকল পিটি ডাভ ওরফে মাসুদ রানা। তুমিই আমাকে সাজাবে, তাই না? জানতে চাইল ও।

কিন্তু শর্ত আছে, আড়ষ্ট হাসি দেখা গেল সলভিনার ঠোঁটে। আমাকে আপনি গল্প শোনাবেন।

কাজ শুরু করো, বলল রানা। আমিও গল্প শুরু করি। ঠিক আছে? পিছন ফিরল রানা, দরজাটা বন্ধ করে দিল। শিরশিরে একটা আনন্দঘন অনুভূতি ছড়িয়ে পড়ল সলভিনার সারা শরীরে।

তার দিকে ফিরল রানা। কি করতে হবে আমাকে?

একটা সুটকেসের দিকে তাকাল সলভিনা। ওতে আপনার ইউনিফর্ম আছে, পরতে হবে। তার আগে আপনার শরীরের কয়েক জায়গায় প্যাড লাগাতে হবে। যে লোকের ছদ্মবেশ নেবেন, আপনার চেয়ে একটু মোটা সে।

জুলফির নিচেটা চুলকাল রানা। চেহারায় একটু ইতস্তত ভাব।

হ্যাঁ, নিস্তব্ধতা ভেঙে বলল সলভিনা, যা পরে আছেন সব। খুলে ফেলতে হবে।

শার্টের বোতাম খুলতে শুরু করে রানা বলল, সেই পুরানো। গল্প। অপরাধী মনে হলো রানার নিজেকে। কিন্তু এছাড়া…

মানে? চোখ বড় বড় করে তাকাল সলভিনা।

বারে, গল্প শুনতে চাইলে না? একটা ছেলে, আর একটা মেয়ে। কেউ তারা কাউকে ভাল করে চেনে না। বন্ধ একটা ঘরে একদিন তারা আটকা পড়ল। পিটি ডাভের অভিনয় করছে রানা।

মেঝেতে হাঁটু গেড়ে বসে সুটকেস খুলছিল সলভিনা, ঘাড়। ফিরিয়ে রানার দিকে তাকাল। কৌতুহলে ঝিক্ করে উঠল তার। চোখের তারা, জানতে চাইল, তারপর?

তারপর যা হয়। শুনতে চেয়ো না, তারচেয়ে এসো হাতেকলমে… নিজেকে কিল মারতে ইচ্ছে করল রানার।

ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল সলভিনা, থরথর করে কাঁপছে ওর সারা শরীর।

.

এই ছদ্মবেশই মিগ-৩১-এর কাছে পৌঁছুবার সবচেয়ে বিশ্বস্ত পাসপোর্ট। কড়া নিরাপত্তার জালকে ফাঁকি দিতে হলে একটাই উপায়, ওই জালের একটা অংশ হয়ে যাওয়া। একঘণ্টা পর আবার যখন দরজা খুলল রানা, আসছি বলে বেরিয়ে গেল সলভিনা, ফিরল কোইভিসতু আর করনিচয়কে সাথে নিয়ে। ইতোমধ্যে ইউনিফর্ম পরে নিয়েছে রানা, শুধু চেহারা বদল করার কাজটা বাকি আছে। সলভিনা কাজ শুরু করল, তাকে পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করল কোইভিসতু আর করনিচয়। প্রথমে ওর চুল আরও ছোট করা হলো। কোইভিসতু মন্তব্য করল, এতে করে তোমার ফ্লাইং হেলমেটের ভেতর যে কন্ট্যাক্টগুলো আছে সেগুলো তোমার ব্রেন-ওয়েভ ভালভাবে রিসিভ করতে পারবে। রানা জানে, হেলমেটের ভেতর ওই কন্ট্যাক্টগুলোই উইপনস্-সিস্টেম কন্ট্রোল করবে, ওর ব্রেন-ওয়েভ পাঠিয়ে দেবে রাডার, মিসাইল বা কামানে।

সবশেষে আয়নার সামনে দাঁড়াল রানা। অচেনা মুখ, জীবনে কখনও দেখেনি। পরনে খয়েরী শার্ট, গাঢ় রঙের টাই, ইউনিফর্ম। বুকের কাছে উজ্জ্বল ব্যাজ।

ভেরি গুড, বলল কোইভিসতু। সোফায় বসে রয়েছে সে, একই সোফার হাতলে বসেছে সলভিনা। ক্যাপ্টেন দিমিত্রি অদরিক, মিলিটারি ইন্টেলিজেন্সের সিকিউরিটি সাপোর্ট ইউনিট, বর্তমানে দায়িত্ব পালন করছ…?

মেজর রাভিকের অধীনে, বলল রানা। রাভিক একজন কে.জি.বি. মেজর। বিলিয়ারস্ক, মিকোয়ান প্রজেক্টের সিকিউরিটি তার দায়িত্ব।

গুড, ভেরি গুড। সন্তুষ্ট দেখাল কোইভিসতুকে। তোমার অপারেশনাল ব্যাকগ্রাউন্ড সব মনে আছে তো? মাথা ঝাঁকাল রানা। ওয়ান্ডারফুল। এবার একটু হাঁটাহাঁটি করো, ইউনিফর্মের সাথে মানিয়ে নাও নিজেকে। ঠোঁটে মৃদু হাসি নিয়ে পায়চারি শুরু করল রানা। কয়েক মুহূর্ত তীক্ষ্ণ চোখে ওকে দেখল কোইভিসতু, তারপর বলল, না, ওভাবে না। তোমার দুই হাতের দুটো আঙুল। বেল্টে গোজা থাকবে, এভাবে… দেখিয়ে দিল সে। তাকে অনুকরণ করল রানা। হ্যাঁ, হয়েছে। শুধু একটা কথা মনে রাখতে হবে তোমাকে, পিটি। গার্ডরা মিলিটারি ইন্টেলিজেন্সের একজন। ক্যাপ্টেনের কাছ থেকে ঠিক যে আচরণ আশা করে, তা যদি না করতে পারো, তুমি ধরা পড়ে যাবে। গার্ডরা জানে মিলিটারি। ইন্টেলিজেন্সের লোক মানেই গোয়ার, রগচটা, দাম্ভিক আর। নিষ্ঠুর। সুযোগ পেলে অন্তত দুচারজনকে ধমক দিতে ছাড়বে না। কারও বোতাম ভাঙা, কারও ক্যাপ বাঁকা হয়ে আছে, কেউ হয়তো হাই তুলছে—এ ধরনের কিছু না কিছু তোমার চোখে পড়বেই। কাউকে সিগারেট ফুকতে দেখলে কষে একটা চড় মেরে বসবে। দেখবে, তোমাকে ওরা সন্দেহ করা তো দূরের কথা, শ্রদ্ধা করতে শুরু করেছে। আবার মাথা ঝাঁকাল রানা। কোইভিসতুর পরামর্শগুলো গুরুত্বের সাথে নিচ্ছে ও, এসব তার দীর্ঘদিনের। অভিজ্ঞতার ফসল। এবার তুমি বসো, পিটি।

বসার আগে হাত দিয়ে চেয়ারটা মুছল রানা, আঙুলে ধুলো লেগেছে কিনা পরীক্ষা করল। বসার পর পায়ের ওপর পা তুলে দিল ও, সারা শরীর সম্পূর্ণ শিথিল। কারও দিকে না তাকিয়ে পকেট থেকে বের করল রূপালি একটা সিগারেট কেস আর লাইটার। এ-দুটো শুধু নির্দিষ্ট কয়েকটা দোকানে কিনতে পাওয়া যায়, কিনতে হলে খদ্দেরকে কে.জি.বি. বা মিলিটারি ইন্টেলিজেন্সের লোক হতে হবে। ভুরু বা মুখের কোন রেখা না কাঁপিয়ে সিগারেট ধরাল রানা।

হাততালি দিল করনিচয়। নিখুঁত, একেবারে নিখুঁত।

কে বলবে তুমি স্পাই নও? এত সহজে আরেকজনের আচরণ রপ্ত করা, এটা তোমার একটা জন্মগত গুণ-কাজে লাগানো উচিত।

বিনয়ের মৃদু হাসি দেখা গেল রানার ঠোঁটে।

তোমার কাগজ-পত্র সব পেয়েছ তো? জানতে চাইল কোইভিসতু।

মাথা ঝাঁকাল রানা। ক্যাপ্টেন অদরিকের জিআরইউ (মিলিটারি ইন্টেলিজেন্স) আইডি কার্ড, ট্রানজিট পেপার সহ বাকি সবই সলভিনার কাছ থেকে নিয়ে পকেটে ভরেছে ও। নকল ডগট্যাগস মোটা চেইনে গলার সাথে ঝুলছে।

করনিচয়, এবার তোমার পালা, বলল কোইভিসতু। পথ বাতলাও।

শিরদাঁড়া খাড়া করে বসল করনিচয়। গেটে গার্ডের সংখ্যা আরও অনেক বেড়েছে, বলল সে। কে.জি.বি-র সাধারণ ট্রপস ওরা, সিকিউরিটি সাপোর্ট গ্রুপের কাউকে ওখানে দায়িত্ব দেয়া হয়নি।

কেন? জানতে চাইল রানা।

কাঁধ ঝাঁকাল করনিচয়। ঠিক জানি না, তবে মনে হয়, গেটেও মিলিটারি ইন্টেলিজেন্সকে দায়িত্ব দিলে মেজর রাভিক অপমান বোধ করবেন…দুই ডিপার্টমেন্টের মধ্যে সম্মানের লড়াই তো লেগেই আছে।

পেরিমিটার ফেন্স সম্পর্কে বলুন, জানতে চাইল রানা।

ওয়াচটাওয়ারে প্রচুর গার্ড, উপচে পড়ার মত অবস্থা, বলল করনিচয়। বেড়ার ভেতর দিকে শিকারী কুকুর টহল দিচ্ছে, প্রতি দশ মিনিটে একবার। কাঁটাতারের এই বেড়া আসলে একটা নয়, পাশাপাশি দুটো, তাছাড়া আপনি যখন ওখানে পৌঁছুবেন কুকুরগুলোকে তার আগেই ছেড়ে দেয়া হবে-আমি বলতে চাইছি, বেড়া কেটে ভেতরে ঢোকার কথা কোন পাগলও ভাববে না। একজোড়া ওয়াচটাওয়ারের মাঝখানে একশো গজ দূরত্ব-আপনাকে অন্তত চারটে ওয়াচটাওয়ার পাশ কাটাতে হবে।

ভাব দেখাবে যেন তুমি বেড়া পরীক্ষা করছ, রানাকে পরামর্শ দিল কোইভিসতু। আর হ্যাঁ, টাওয়ারের গার্ডদের ধমকাবে, জিজ্ঞেস করবে ওরা কেউ ঘুমাচ্ছে কিনা। বলে যাও, করনিচয়।

গেটের কাছটা দিন হয়ে আছে আলোয়-দূর থেকেই আপনাকে ওরা দেখতে পাবে। আউটার গেট আসলে একটা। ব্যারিয়ার, তারপরই গার্ড-পোস্ট। এখানে ওরা আপনার কাগজপত্র দেখতে চাইবে। আপনাকে দেখে ভারি অবাক হবে ওরা, কারণ চিনতে পারবে না, তবে মিলিটারি ইন্টেলিজেন্সের ব্যাচ দেখে পিলে চমকে যাবে ওদের। এরপর আবার আপনাকে। থামতে হবে মেস-গেটে। গেটে তালা মারা থাকবে, গার্ডরা থাকবে ভেতর দিকে। গেট খোলার আগে ওরা আপনার কাগজ দেখতে চাইবে।

কোইভিসতুর দিকে তাকাল রানা।

চিন্তার কিছু নেই, বলল কোইভিসতু। স্পেশ্যাল গ্রুপের চলতি হপ্তার কাগজ আর আইডেনটিফিকেশন চেক করে দেখেছি আমরা, তোমারগুলো সব ঠিক আছে। করনিচয় হেলান দিল সোফায়, তার বদলে কোইভিসতু কথা বলে গেল, মেস-গেট পেরিয়ে ভেতরে ঢোকার পর আর দেরি কোরো না, সরাসরি এয়ারফিল্ডের দিকে চলে যাবে। তোমার মাথার ওপর হয়তো  হেলিকপ্টার চক্কর দেবে, কিন্তু ভয় পাবার কোন কারণ নেই। ইউনিফর্ম দেখে সরে যাবে ওরা। এরপর অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ বিল্ডিং। আগেই বলেছি, এই বিল্ডিঙের লাগোয়া হ্যাঙ্গারে মিগ-৩১ রয়েছে। বিল্ডিঙের বাইরে সিকিউরিটি গার্ড আছে, এখানেও তোমাকে কাগজ-পত্র দেখাতে হবে। কিন্তু যেহেতু তুমি বিলিয়ারস্কের কে. জি. বি. হেডকোয়ার্টারে ঢুকতে যাচ্ছ, কেউ ভুলেও ধারণা করবে না যে তুমি ওখানের লোক নও। কোইভিসতু হাসল। ভেতরে ঢুকে সোজা ওপরতলায় উঠে যাবে, ঢুকে পড়বে পাইলটদের রেস্ট-রূমে। তখন ওখানে কেউ থাকবে না।

পাইলট…কর্নেল বেনিন কোথায়? জানতে চাইল রানা।

এখন? জিজ্ঞেস করল করনিচয়, হাতঘড়ির দিকে চোখ। বিছানায়, ঘুমাচ্ছে।

এই প্রজেক্ট এলাকার ভেতর বিশেষ একটা জায়গা আলাদা। করা আছে, বলল কোইভিসতু, তার চেহারায় তিক্ততার ছাপ। সেখানে শুধু কয়েকজন বিজ্ঞানী আর কে.জি.বি. অফিসাররা থাকে। তাদের সাথেই একটা কোয়ার্টার নিয়ে থাকে বেনিন। অ্যান্টি-রাডার নিয়ে যারা কাজ করছে, তারাও এখানে থাকে। সেজন্যেই অ্যান্টি-রাডার সম্পর্কে বহু চেষ্টা করেও আমরা তেমন কিছু জানতে পারিনি।

বেনিন রেস্ট-রূমে আসবে তো? জিজ্ঞেস করল রানা।

আসবে বৈকি। ওখানেই তো সে কাপড় বদলাবে। হয়তো ওখানে বসে খাওয়াদাওয়াও সারবে সে…যদিও এ-ধরনের ফ্লাইটের আগে তার খিদে থাকে না…তোমার, পিটি? সকৌতুকে তাকাল কোইভিসতু।

খিদে-টিদে আমার কয়েক দিন থেকেই নেই, সত্যি কথাই বলল রানা। ঘুমও হচ্ছে না।

হাতঘড়ি দেখল কোইভিসতু। আড়াইটায় বেরিয়ে যাচ্ছি। আমরা, ঘুমাবার জন্যে ঘণ্টা দুয়েক সময় পাবে তুমি।

বাদ দিন, বলে মুখের সামনে হাত এনে হাই তুলল রানা, হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখ রগড়াল। লক্ষ করল, ঠোঁটে মিটিমিটি হাসি নিয়ে সারাক্ষণ ওকে দেখছে সলভিনা। কোইভিসতুর দিকে তাকাল ও। আবার আমাকে সব বলুন।

সিকিউরিটি…?

মিগ-৩১, উইপনস-সিস্টেম, রিয়্যারওয়ার্ড ডিফেন্স পড,। সিকিউরিটি। প্রথম থেকে সব আবার আমি শুনতে চাই।

.

রোমানভ আর বাজারনিক পরস্পরকে চেনে, কে.জি.বি. ট্রেনিং স্কুল থেকে একই সাথে পাস করে বেরিয়েছে তারা। মেধার নাকি সুপারিশের অভাবে, কে জানে, বাজারনিককে পুলিস বিভাগে বদলি করা হয়, আর রোমানভ থেকে যায় কে.জি.বি. হেডকোয়ার্টারে। অনেক দিন পর দযেরঝিনস্কি স্ট্রীটের। কমপিউটর রূমে আবার ওদের দেখা হয়ে গেল। বাজারনিককে দেখে একগাল হাসল রোমানভ, আর বাজারনিক মনে মনে গাল দিল, শালা! খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে অনেক প্রশ্ন করল রোমানভ, তার আচরণে একটু তাচ্ছিল্যের ভাবও প্রকাশ পেল, বাজারনিক কোন অভিযোগ না করা সত্ত্বেও মন্তব্য করল, পুলিসে চাকরি করা, তাও কে.জি.বি-তে ট্রেনিং পাবার পর-দুঃখজনক। স্বভাবতই এরপর আর গল্প-গুজবে উৎসাহ পাবার কথা নয় বাজারনিকের।

সাদা কোট পরা একজন অপারেটর এগিয়ে এল। ফটো ভরা এনভেলাপটা তার হাতে ধরিয়ে দিল বাজারনিক।

অপারেটর চলে যাবার পর রোমানভ জানতে চাইল, কিজন্যে আসা হলো এখানে?

বিদেশী একজন এজেন্টের পরিচয় জানতে চাইছি আমি, বলল বাজারনিক। তুমি?

আমিও।

ভুরু কুঁচকে তাকাল বাজারনিক।  

সেই বিকেল থেকে এখানে বসে আছে রোমানভ। সন্ধে পেরিয়ে রাত হয়ে গেছে, কিন্তু তার প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেনি কমপিউটর। জসেস্কুর সাথে ভ্যানে কে তার সহকারী ছিল, জানা যায়নি। অপারেটরের বক্তব্য, এটাকে কোনমতেই কমপিউটরের ব্যর্থতা বলা যাবে না। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি সম্পর্কে প্রয়োজনীয় তথ্য দিতে না পারলে কমপিউটর কি করতে পারে। শুধু চেহারার বর্ণনাই যথেষ্ট নয়-সম্ভাব্য কি ধরনের ছদ্মবেশ নিতে পারে সে, কোন দেশের নাগরিক, একাধিক দেশের নাগরিক কিনা, এর আগে রাশিয়ায় ঢুকেছিল কিনা, সি.আই.এ. অথবা ব্রিটিশ সিক্রেট সার্ভিস কিংবা অন্য কোন ইন্টেলিজেন্সের সাথে তার কোন সম্পর্ক থাকলে সেটা কি, কি কি ভাষা জানে, এই রকম আরও অসংখ্য প্রশ্নের উত্তর দরকার কমপিউটরের, তবেই লোকটার আসল পরিচয় ওটার কাছ থেকে বের করা সম্ভব। কিন্তু বেশিরভাগ তথ্যই রোমানভ সরবরাহ করতে ব্যর্থ হয়েছে। দুএকটা প্রশ্নের যা-ও বা উত্তর দিয়েছে সে, সেগুলো ভুল। যেমন, জসেস্কুর সহকারীকে বিদেশী এজেন্ট বলে উল্লেখ করেছে সে, বলেছে, লোকটা ব্রিটিশ সিক্রেট সার্ভিস বা সি. আই. এ-র স্পাই হতে পারে।

সিগারেট ফুঁকছে আর চিন্তা করছে রোমানভ। কি যেন বলল বাজারনিক? মস্কোভা নদীতে একটা লাশ পাওয়া গেছে, চেহারা চেনা যায় না? কাকে তুমি খুঁজছ বললে? জিজ্ঞেস করল সে। বাজারনিক সিগারেট ধরাল, উত্তর দেয়ার তেমন গরজ অনুভব করছে না।

প্রশ্নটা আবার করল রোমানভ।

কাকে খুঁজছি? তাকে আমি পামার হিসেবে চিনি…

ধীরে ধীরে ঘাড় ফেরাল রোমানভ। নির্লিপ্ত চেহারা। কেন? কি করেছে সে?

আমাকে জানানো হয়েছিল, সে একজন ড্রাগ-স্মাগলার, বলল বাজারনিক। মেঝের দিকে তাকিয়ে সিগারেট টানছে। রোমানভ, যেন আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে সে। কিন্তু মজার ব্যাপার। হলো, বলে চলল বাজারনিক, মস্কোভা নদীতে আমরা যার লাশ পেলাম তার পকেটে পামারের কাগজ-পত্র ঠিকই ছিল, কিন্তু দুদিন আগে চেরেমেতেইভো এয়ারপোর্টে যে লোক পামার হিসেবে নেমেছে এ লাশ তার নয়।

শিরদাঁড়া খাড়া হয়ে গেল রোমানভের। কবে?

দুদিন আগে…

মারা গেল কখন? দ্রুত জিজ্ঞেস করল রোমানভ, উত্তেজনায় কেঁপে গেল তার গলা।

সেই রাতেই।

ধরা পড়েছে কেউ?

মাথা নাড়ল বাজারনিক। পামারের পরিচিত সবাইকে আমরা জেরা করেছি, কিন্তু খুনের সাথে তাদের কোন সম্পর্ক পাইনি।

তাহলে তাকে মারল কে?

তিক্ত একটু হাসি দেখা গেল বাজারনিকের ঠোঁটে। কয়েকজন লোক। কিন্তু তাদের পরিচয় জানি না। শুধু তাই নয়, কে যে মারা গেছে তা-ও আমরা বুঝতে পারছি না।

কি!

বললাম না, যে লোক মারা গেছে সে পামার নয়, অন্তত যে পামার দুদিন আগে লন্ডন থেকে চেরেমেতেইভো এয়ারপোর্টে এসেছিল সে নয়।

তাহলে কে সে? কারা ওরা? ঘেউ ঘেউ করে উঠল রোমানভ।

অসহায় ভঙ্গি করে কাঁধ ঝাঁকাল বাজারনিক। তোমাদের কমপিউটরকে সেই কথাটা জিজ্ঞেস করার জন্যেই তো এসেছি।

নিজেকে শান্ত করল রোমানভ। ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করতে হবে। ঠিক আছে। তোমার ধারণা বিকল্প একজন লোক ছিল?

মাথা ঝাঁকাল বাজারনিক।

কেন?

কেন আবার, সম্ভাব্য কারণ তো একটাই-দুদিন আগে যে মস্কোয় পৌঁচেছে সে একজন এসপিওনাজ এজেন্ট, নিজের আসল পরিচয় মুছে ফেলার জন্যে লাশটাকে ব্যবহার করেছে।

সটান উঠে দাঁড়াল রোমানভ, উত্তেজিতভাবে পায়চারি শুরু করল। লাশ রেখে যারা চলে গেল, তাদের সম্পর্কে কিছু জানা যায়নি?

না। তারা পালিয়ে গেছে।

কোথায়?

মেট্রো স্টেশনেপাভোলেতস।

তারপর?

তারপর আবার কি। আমাদের পুলিসের আর তোমাদের কে. জি. বি-র লোক তাদেরকে হারিয়ে ফেলে। সেই থেকে পামারকে।

আর খোঁজাও হচ্ছে না।

আমরাও একজন এজেন্টের পরিচয় জানতে চাইছি, উত্তেজনায় হাঁপাতে শুরু করেছে রোমানভ। কাল খুব ভোরে মস্কো থেকে একটা ভ্যান নিয়ে রওনা হয় সে… তার চেহারা রক্তশূন্য দেখাল। থামো… ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলল, এতক্ষণে যেন উপলব্ধি করতে পারছে কিসের সাথে হোঁচট খেয়েছে সে। থামো…

একই খাতে বইছে বাজারনিকের চিন্তাধারা। তুমি কি মনে করো…?

এই চেহারার কোন লোক দুহপ্তার মধ্যে সোভিয়েত ইউনিয়নে ঢোকেনি। হয়তো আরও আগে থেকে মস্কোয় রয়েছে সে, কিন্তু ঢুকল কিভাবে? কমপিউটরকে আমি তার ফটো দিয়েছি, সন্দেহজনক আমেরিকান বা ব্রিটিশ স্পাইদের চেহারার সাথে মিলিয়ে দেখার জন্যে…

আর আমি খুঁজছি পামারকে, বলল বাজারনিক। তোমার এজেন্ট এখন কোথায়? জানতে চাইল সে।

বিলিয়ারস্কে।

কি! আঁতকে উঠল বাজারনিক। তারমানে…

হয়তো এরই মধ্যে কমপ্লেক্সের ভেতর ঢুকে পড়েছে সে, আরেক ছদ্মবেশ নিয়ে।

উদ্দেশ্য?

মাথার চুলে আঙুল চালাচ্ছে রোমানভ, এলোমেলো পা ফেলে। পায়চারি করছে। কি করে বলব! একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে। অনেক কিছুই হতে পারে-হয়তো প্লেনটাই উড়িয়ে দেবে।

রোমানভের চোখে ভয়ের ছায়া দেখতে পেল বাজারনিক।

নক হলো দরজায়। এসো, বলল রোমানভ।

মাঝবয়েসী একজন অপারেটর ঢুকল ভেতরে, হাতে একগাদা ফটো। দুঃখিত, কমরেড মেজর। আপনার লোককে আমরা খুঁজে বের করতে পারিনি।

কিছুই জানা গেল না?

না। আমেরিকান বা ব্রিটিশ স্পাইদের ফাইলে এই লোক সম্পর্কে কিছু নেই। ফটোগুলো টেবিলে রেখে কামরা থেকে।

বেরিয়ে গেল অপারেটর।

কয়েক মুহূর্ত ওরা দুজন কেউ কথা বলল না। তারপর ধৈর্য। হারিয়ে বাজারনিক বলল, কি হলো!

মুখ তুলল রোমানভ। মানে? ছবিগুলো আমাকে দেখাও! কিছুটা রাগ, কিছুটা নির্দেশের সুরে বলল বাজারনিক।

কয়েক সেকেন্ড একদৃষ্টে বাজারনিকের দিকে তাকিয়ে থাকল রোমানভ। পরিবেশটা বদলে গেছে, অনুভব করল সে। বাজারনিক এখন করুণা করছে তাকে। টেবিল থেকে ফটোগুলো নিয়ে বাজারনিকের কোলের ওপর ফেলল।

দ্রুত হাতে এক এক করে ছবিগুলো দেখল বাজারনিক। দুএকবার স্থির হলো তার হাত, ইতোমধ্যে দেখা ফটোগুলো থেকে দুএকটা তুলে নিয়ে আবার ভাল করে পরীক্ষা করল। শেষ ছবিটা হাতে নিয়ে সোফা ছাড়ল বাজারনিক। এই লোকই তো-পামার! ফিস ফিস করে বলল সে।

তার মুখের দিকে নিঃশব্দে তাকিয়ে থাকল রোমানভ।

নক হলো দরজায়, ঝট করে সেদিকে ফিরল বাজারনিক। ঘরে ঢুকল গরচয়েভ। সহকারীকে হাঁপাতে দেখে ভুরু জোড়া কুঁচকে উঠল বাজারনিকের। কি ব্যাপার? ওপরতলার রেস্তোরাঁয় চা খেতে গিয়েছিল গরচয়েভ, সাথে করে তার প্রমাণও নিয়ে এসেছে-সাদা টাই-এ চায়ের দাগ।

লুদভিক… হাঁপাতে হাঁপাতে বলল গরচয়েভ, হেডকোয়ার্টার থেকে ফোন করেছে। শালার ব্যাটা ইহুদি…

কে? রাসকিন? কি করেছে সে? গরচয়েভের দিকে এগোল বাজারনিক।

সাপ! সাপ! চিৎকার করে উঠল গরচয়েভ। বেঈমান! ব্রিটিশ দূতাবাসে ফোন করেছে ব্যাটা…।

থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল বাজারনিক। কি বললে!

ঠিকই বলছি, কমরেড মেজর। রেস্ট-রূমের ফোন লাইন মনিটর করা হচ্ছিল, ওখান থেকেই ব্রিটিশ দূতাবাসে ফোন করে সে। লুদভিক তাকে আপনার অফিসে আটকে রেখেছে…

শব্দ করে হেসে উঠল রোমানভ। কি আশ্চর্য, এই রকম ভুল মানুষ করে! তুমি দেখছি ডোবাবে!

ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল বাজারনিক। বলার কিছু নেই তার।

তবে হঠাৎ করে আমাদের দুজনের সমস্যাই সমাধান হয়ে গেছে, বলল রোমানভ। তোমার বিশ্বস্ত লোকটা…কি যেন নাম? হ্যাঁ, রাসকিন। পামার কে, নিশ্চই জানে সে। জানে, কেন সে। বিলিয়ারস্কে গেছে।

ধীরে ধীরে উজ্জ্বল হয়ে উঠল বাজারনিকের চেহারা। হ্যাঁ, তাই মনে হচ্ছে বটে।

তাহলে চলো, বলল রোমানভ। তোমার অফিসেই যাওয়া যাক।

.

কানে ফোনের রিসিভার নিয়ে বাজারনিকের ডেস্কের সামনে দাঁড়িয়ে আছে রোমানভ, সেন্টার কোড-রূম থেকে সাড়া পাবার অপেক্ষায় রয়েছে সে। অফিস কামরার এক কোণে পড়ে রয়েছে আধমরা রাসকিন, তার হাতে আর পায়ে রশি বাঁধা। লোকটার মুখ ফুলে ঢোল হয়ে গেছে, রক্ত বেরিয়ে আসছে ভাঙা নাক, ফাটা ঠোঁট আর তেলানো জিভ থেকে। চোখ দুটো বন্ধ, কপালের। মাঝখানটা বেটপভাবে ফুলে কালচে হয়ে গেছে। অচেতন রাসকিনের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে লুদভিক আর গরচয়েভ, এখনও হাঁপাচ্ছে তারা। দুজনেই চোখে প্রত্যাশা নিয়ে। বাজারনিকের দিকে ঘন ঘন তাকাচ্ছে, আশা রাসকিনের ওপর আবার হাত চালাবার অনুমতি পাবে তারা।

মেঝের ওপর পায়চারি করছে বাজারনিক। হাতঘড়ি দেখল সে, রাত একটা।

বাজারনিকের অফিসে ঢুকেই বসকে ফোন করেছিল রোমানভ। সে তার রিপোর্টে কর্নেল সাসকিনকে জানিয়েছে, ভ্যানের দ্বিতীয় লোকটা যে একজন এজেন্ট এখন আর তাতে কোন সন্দেহ নেই। জানিয়েছে, রাসকিনের মুখ থেকে কথা আদায় করা হচ্ছে, একটু পর আবার রিপোর্ট করবে সে। রাত সাড়ে বারোটায় আবার ফোন করে রোমানভ। রিপোর্টে বলে, রাসকিনের কাছ থেকে কোন তথ্য পাওয়া যায়নি। লোকটা স্বীকার করেছে বটে যে সে নিজেও একজন ব্রিটিশ এজেন্ট, মার্কিন দূতাবাসের ট্রেড অ্যাটাশে টিম ওয়াইজম্যান আর কালচারাল অ্যাটাশে ফ্রেমিং-এর সাথেও তার যোগাযোগ আছে, কিন্তু ভ্যানের দ্বিতীয় লোকটা সম্পর্কে তার কাছ থেকে কোন তথ্যই আদায় করা যায়নি।

পামারের কিছু ছবি ওয়্যার-প্রিন্টের সাহায্যে বিলিয়ারস্কে পাঠিয়ে দিয়েছে রোমানভ। মস্কো, গোর্কি আর কাজানের সিকিউরিটি চেকপোস্টে তোলা ভ্যানের দ্বিতীয় লোকটার ছবিও পেয়েছে কর্নেল। রোমানভকে নির্দেশ দিয়েছে সে, সম্ভাব্য যত রকম ছদ্মবেশ নিতে পারে পামার, কমপিউটরের কাছ থেকে তার একটা করে নমুনা চাইতে হবে। সেগুলো পাবার সাথে সাথে পাঠিয়ে দিতে হবে বিলিয়ারস্কে।

রোমানভ এখন লন্ডন আর ওয়াশিংটনে সোভিয়েত দূতাবাসে ফোন করছে। কোড করা নির্দেশ দিচ্ছে সে-কে.জি.বি. এজেন্টরা যেন হাতের সব কাজ ফেলে সি.আই.এ. আর ব্রিটিশ সিক্রেট সার্ভিসের প্রথম শ্রেণীর এজেন্টরা কে কোথায় আছে তার একটা তালিকা তৈরি করে। কে.জি.বি. এজেন্টদের জানতে হবে, দুদিন আগে লন্ডন থেকে মস্কোয় যারা এসেছে তাদের মধ্যে কোন এজেন্ট ছিল কিনা, থাকলে তার পরিচয় কি।

রিসিভার নামিয়ে রেখে ঘুরল রোমানভ। দেখল, গরচয়েভ আর লুদভিক অত্যন্ত আগ্রহের সাথে রাসকিনের জ্ঞান ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছে। বাজারনিক, আমার মাথায় একটা আইডিয়া এসেছে, বলল রোমানভ।

পায়চারি থামিয়ে নিজের চেয়ারে ফিরে এল বাজারনিক। রোমানভও ডেস্কের সামনে একটা চেয়ারে বসল। আইডিয়া?

তার আগে, এসো, এ পর্যন্ত আমরা কি করেছি তার একটা হিসেব কষি, বলল রোমানভ। রাশিয়ার শত্রু কারা আমরা তা জানি। আমরা জানি রাশিয়ায় ঢুকে স্যাবোটাজ করার যোগ্যতা তাদের মধ্যে কার কার আছে। আমেরিকা আর পশ্চিমা দুনিয়ার। সবগুলো ইন্টেলিজেন্স সার্ভিস সম্পর্কে খোঁজ নিয়েছি আমরা, যারা। এ-ধরনের একটা অপারেশনে হাত দিতে সাহস পাবে। এই এজেন্ট লোকটা অত্যন্ত বুদ্ধিমান, প্রমাণ-এখনও সে ধরা পড়েনি। নিশ্চই সে প্রথম শ্রেণীর একজন এজেন্ট। তারমানে এতক্ষণে তার পরিচয় আমাদের জানা উচিত ছিল, ঠিক?

ঠিক, বলল বাজারনিক। বোঝাই যাচ্ছে, এ নতুন একজন লোক। কিংবা, শুধু এই একটা কাজের জন্যে লুকিয়ে রাখা। হয়েছিল তাকে।

ঠিক আমি যা ভাবছি।

তাহলে কোথায় তাকে খুঁজব আমরা? কোথায় খোঁজ নিলে তার পরিচয় জানতে পারব?

আমার ধারণা, হয় সে একজন টপ এজেন্ট, না হয় সে। আসলে এজেন্টই নয়।

বাজারনিক বলল, এজেন্ট তো তাকে হতেই হবে, তা না হলে এ-ধরনের একটা অপারেশনে তাকে পাঠানো হবে কেন? তার যোগ্যতা দেখে টের পাচ্ছ না? কে.জি.বি-র চোখে ধুলো। দিয়ে মস্কো থেকে কিভাবে বেরিয়ে গেল! এতক্ষণে হয়তো। পৌঁছেও গেছে বিলিয়ারস্কে। হাত তুলে রাসকিনকে দেখাল সে। ওরা রাসকিনকে ব্যবহার করেছে, জানত ও ব্যাটা খরচ হয়ে যাবে। আরও একজন টপ ম্যানকে হারিয়েছে ওরা-ভ্যানের ড্রাইভার জসেস্কু, এত কাঠখড় পুড়িয়ে সাধারণ একজন লোককে বিলিয়ারস্কে পাঠাবার কি দরকার? উঁহু, লোকটা অবশ্যই একজন এজেন্ট, আমার মনে হয় পৃথিবীর সেরা এজেন্টদের একজন সে।

কিন্তু, ধরো, লোকটার উদ্দেশ্য যদি প্রজেক্ট ধ্বংস করা না হয়? ভেবে দেখো, প্রজেক্ট স্যাবোটাজ করে ওদের লাভই বা কি? বেলেনকো মিগ-২৫ ওদের হাতে তুলে দিয়েছে বটে, কিন্তু তবু আমেরিকানরা এত পিছিয়ে আছে যে মিগ-৩১-এর মত কিছু বানাতে আরও দশ বছর সময় লাগবে ওদের। মিকোয়ান প্রজেক্ট ধ্বংস করে সময়টা কমিয়ে আনা যাবে না। আমাদেরকে অবশ্য দেরি করিয়ে দেবে, তা ঠিক, কিন্তু তাও দুএক বছরের বেশি নয়।

ঠিক কি বলতে চাইছ তুমি? ভুরু কুঁচকে জানতে চাইল বাজারনিক।

মিকোয়ান প্রজেক্ট সম্পর্কে ইতিমধ্যে কি ধরনের তথ্য পেয়েছে ওরা আমরা তা জানি, বলল রোমানভ। সেগুলো যথেষ্ট নয়। তাই ওরা হয়তো আরও তথ্য সংগ্রহ করার জন্যে এই লোকটাকে পাঠিয়েছে। এখানে ঠিক কি ঘটছে, একজন প্রত্যক্ষদর্শীর রিপোর্ট থেকে সেটা জানতে চায়।

তারমানে তুমি বলতে চাইছ এই লোক এজেন্ট নয়, একজন এক্সপার্ট?

হতে পারে না?

চিন্তিত দেখাল বাজারনিককে। তারপর ধীরে ধীরে মাথা ঝাঁকাল সে। সম্ভব। রাসকিনের দিকে তাকাল সে। লুদভিক আর গরচয়েভ এখনও তার জ্ঞান ফেরাবার চেষ্টা করছে।

উঁহু, বলল রোমানভ। আমার ধারণা ও কিছু জানে না।

তবু, ওর মুখ খোলার শেষ একটা চেষ্টা আমি করব, যেন প্রতিজ্ঞা করল বাজারনিক।

কাঁধ ঝাঁকাল রোমানভ। যা ভাল বোঝে। কিন্তু আগে আমি একটা ফোন করে নিই। কমপিউটরকে বললেই ব্রিটিশ আর

মার্কিন অ্যারোস্পেস ইন্ডাস্ট্রিজ চেক করে দেখবে…

কিন্তু উত্তর পেতে তো কয়েক ঘণ্টা সময় লেগে যাবে হে, প্রতিবাদ করল বাজারনিক।

ইহুদি ইঁদুরটার মুখ খোলাতে তারচেয়েও বেশি সময় নেবে। তোমরা, বলে ফোনের রিসিভার তুলে নিল রোমানভ।

পঞ্চাশ গজ বাকি থাকতেই সার্চলাইট খুঁজে নিল ওকে, স্থির হলো ওর ওপর। সাদা, চোখ ধাধানো আলোর একটা টানেল, তার ভেতর দিয়ে হাঁটতে হলো ওকে। গেটের কাছে এক দল গার্ড, অটোমেটিক রাইফেলগুলো ওর দিকে তাক করা। ওয়াচটাওয়ার থেকেও গার্ডরা অপলক চোখে দেখছে ওকে। স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করল রানা, বুকের ভেতর হাতুড়ির বাড়ি পড়ছে। এখন আর চাইলেও ফিরে যেতে পারবে না ও। ঘুরে উল্টো দিকে হাঁটা দিলেই ওরা ভাববে ও পালাচ্ছে, এক সাথে গর্জে উঠবে ডজন খানেক রাইফেল। হাঁটু জোড়া কেমন যেন দুর্বল লাগল, মনে হলো ভাজ হয়ে যাবে। পা চলতে চায় না। শুধু মনের জোরে এগিয়ে চলল ও। কপালে ঠাণ্ডা লাগছে, তারমানে ঘাম জমেছে ওখানে। চোখের ওপর একটা হাত তুলে বিরক্তি ফুটিয়ে তুলল চেহারায়। চোখের কাছে হাতটা একটু একটু কাঁপছে।

হল্ট!

দাঁড়িয়ে পড়ল রানা। এই উপলব্ধি ধাক্কার মত লাগল-গেটের। কাছে এসে পড়েছে ও। একজন গার্ড এগিয়ে এল ওর দিকে, তাকে কাভার দিচ্ছে আরও আট-দশজন গার্ড।

পরিচয় দিন, কমরেড।

শক্ত কংক্রিটের ওপর বুট ঠুকল রানা, প্রচণ্ড রাগে হাত দুটো শরীরের পাশে ঝাঁকাল, সেই সাথে কর্কশ সুরে বলল, দয়া করে পরিচয় দিন, কমরেড ক্যাপ্টেন!

গার্ড একটও ঘাবড়াল না। একজন মিলিটারি ইন্টেলিজেন্স অফিসারের কাছ থেকে ঠিক এই আচরণই আশা করে সে। বলল, দয়া করে পরিচয় দিন, কমরেড ক্যাপ্টেন।

পকেট থেকে কাগজ-পত্র বের করে বাড়িয়ে দিল রানা, ওপরে থাকল হলুদ আইডি কার্ড। ওগুলো নেয়ার সময় রানার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকল গার্ড-এই অফিসারকে আগে কখনও দেখেনি সে।

কাগজগুলো পরীক্ষা করছে গার্ড, একটা সিগারেট ধরিয়ে গেটের চারদিকে তাকাল রানা। উজ্জ্বল আলোয় আরও নয়জন। গার্ড দাড়িয়ে আছে, সবার দৃষ্টি ওর ওপর। যত দূর চলে গেছে কাঁটাতারের বেড়া, সাদা আলোয় পরিষ্কার দেখা যায়। বেড়ার ওপারে ফাঁকা একটা মাঠ, অনেক দূর পর্যন্ত আলোকিত। গেটের কাছ থেকে সামান্য দূরে একটা ব্যারিয়ার, সাদা আর লাল রঙের, নিচু হয়ে পথ আটকে রেখেছে। ব্যারিয়ারের ওপারে ইউনিফর্ম পরা আরও দুজন গার্ড। এদের রাইফেল সরাসরি রানার দিকে তাক করা নয়, কিন্তু ধরে আছে শক্তভাবে, সতর্কতার সাথে, মুহূর্তের নোটিসে লক্ষ্য ভেদ করতে পারবে। ব্যারিয়ারের দুদিকেই একটা করে গার্ড-রূম, দুটো দরজায় একজন করে গার্ড দাঁড়িয়ে আছে। গার্ডদের সবার কর্ড আর ব্যাজ পরীক্ষা করল রানা। এরা সবাই কে.জি.বি-র লোক, মিলিটারি ইন্টেলিজেন্সের একজনও নেই। মনে মনে একটু স্বস্তি অনুভব করল ও, ওকে চিনতে না পারায় এরা কেউ অবাক হবে না।

বেড়ার বাইরে কেন গিয়েছিলেন আপনি, কমরেড ক্যাপ্টেন?

উত্তর দিতে এক মুহূর্ত দেরি করল রানা। প্রথমে হাত বাড়িয়ে গার্ডের কলারে টোকা দিল। সাথে সাথে চোখ বাঁকা করে নিজের কলার দেখল গার্ড। সাদা কলারে কালো একটা চুল আটকে আছে। চোখে ঘুম নিয়ে দাড়ি কামাতে গেলে এই হয়। তোমার ওপর হুকুম আছে, বলল রানা, তেমনি আমার ওপরও হুকুম আছে। খবর রাখো, প্রজেক্ট এলাকার আশপাশে একজন বিদেশী এজেন্ট ঘুর ঘুর করছে? সামনের দিকে একটু ঝুঁকল রানা, যেন। গার্ডের চোখ দুটো ভাল করে দেখতে চায়। নাকি এ-সব খবর রাখার প্রয়োজন বোধ করো না?

উত্তর দিতে সৈনিকও একটু দেরি করল। তারপর বলল, জ্বী, কমরেড ক্যাপ্টেন, আমাদের সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে।

আর এই তোমাদের সতর্ক থাকার নমুনা? বাঁ হাতের তর্জনী কাঁধের ওপর ফেলল রানা। ওদিকে ঝোপ আর জঙ্গল, কেউ যদি লুকিয়ে থাকে? একটা কুকুর নিয়ে আধঘণ্টা পর পর একবার করে টহল দাও ওদিকে।

থমথমে চেহারা নিয়ে রানার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল। গার্ড। রানার চোখেও পলক পড়ল না। এক সময় গার্ডের চোখের পাতা কাঁপল। খটাস করে বুট ঠুকে স্যালুট করল সে, মাথা ঝাঁকাল। জ্বী, কমরেড ক্যাপ্টেন। ভাল পরামর্শ দিয়েছেন।

ঠোঁটে ক্ষীণ হাসি নিয়ে ক্যাপ ছুঁলো রানা। গার্ডের কাছ থেকে ইঙ্গিত পেয়ে ইউনিফর্ম পরা কে.জি.বি-র একজন লোক ব্যারিয়ার তুলে দিল। রানা লক্ষ করল, গার্ড-রূমের একটা দরজা থেকে। একজন লোক ভেতরে ঢুকে অদৃশ্য হয়ে গেল। সম্ভবত দ্বিতীয়। গেটে ফোন করে জানাবে সে, অফিসারকে ভেতরে ঢোকার অনুমতি দেয়া হয়েছে।

এগোল রানা। বুক আর পা এখনও কাঁপছে ওর। মনে হলো, . শরীর থেকে ওর পা দুটো হাজার মাইল দূরে।  

যতই এগোল রানা, ম্লান হয়ে এল আলো। হঠাৎ ঘঁাৎ করে উঠল বুক। সার্চলাইটের আলো ঘুরে গেছে, সরাসরি খুঁজে নিয়েছে ওকে। পিছন থেকে কর্কশ আদেশ পাবার অপেক্ষায় উৎকর্ণ হয়ে থাকল ও। ঘাড় ফিরিয়ে পিছন দিকে তাকাবার ইচ্ছেটা অনেক কষ্টে দমন করল। জানে, ওয়াচটাওয়ার আর গেটের গার্ডরা তাকিয়ে আছে ওর দিকে। তারপর হঠাৎ করেই অন্ধকার হয়ে গেল সামনেটা, সার্চলাইট নিভে গেছে। পাঁচ সেকেন্ডে পাঁচ পা এগোল রানা, তারপর আবার জ্বলে উঠল সার্চলাইট। দ্বিতীয় গেটের কাছাকাছি চলে এসেছে ও, গেটের পাশে একটা ট্রাক, ট্রাকের মাথায় সার্চলাইট বসানো রয়েছে। একটা আওয়াজ শুনে আকাশের দিকে তাকাল রানা, অন্ধকার আকাশে কিছুই দেখা গেল না। দূরে কোথাও রয়েছে হেলিকপ্টারটা, কে জানে কি মনে করে নিভিয়ে রেখেছে সব আলো।

বন্ধ গেটের সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল রানা। একজন মাত্র গার্ডকে দেখল ও। এগিয়ে এসে গেটের ওপারে থামল। এই সময় আরও একজন লোক বেরিয়ে এল গার্ড রূম থেকে, রাইফেল উঁচিয়ে কাভার দিচ্ছে প্রথম গার্ডকে। তার কাছ থেকে ইঙ্গিত পেয়ে প্রথম গার্ড মাথা ঝাঁকাল। পকেট থেকে আইডি কার্ড বের করল রানা, লোহার গেটের ফাঁক দিয়ে গলিয়ে দিল হাত। সিগারেটটা ফেলে দিল ও, বুটের তলায় পিষে চ্যাপ্টা করল, কোমরে হাত রেখে অপেক্ষা করছে ও, দেরি করিয়ে দেয়ায় চেহারায় রাগ আর বিরক্তির ছাপ।

কার্ড থেকে মুখ তুলে স্যালুট ঠুকল গার্ড। এক মুহূর্ত পর খুলে গেল গেটের গায়ে বসানো ছোট্ট দরজা। ঢোকার সময় একটু নিচু হতে হলো রানাকে, পিছনে ঘটাং করে শব্দ হতে বুঝল আবার বন্ধ করা হলো দরজা। ভেতরে ঢুকে বেড়ার এদিক ওদিক ভাল করে দেখল ও, চিন্তিত ভাবে গাল চুলকাল, তারপর হাঁটা ধরল রানওয়ে ঘিরে থাকা পথটা ধরে। ট্রাকের মাথার ওপর ঘুরে গেল সার্চলাইট। সামনে নিজের গাঢ় আর লম্বা ছায়া নিয়ে এগোল। রানা।

আধ মিনিট পর আবার অন্ধকার। হ্যাঙ্গারের দিকে আলো। দেখা যাচ্ছে, অনেকটা দূর এখনও। গেটের গার্ডরা ওর কথা হয়তো ভুলেই গেছে, তবু অন্ধকারেও পিঠে তাদের দৃষ্টি অনুভব করল ও। শার্টটা ভিজে গেছে ঘামে, বুক কাঁপছে এখনও। রাস্তা থেকে রানওয়ের ওপর উঠে এল ও।

ত্রিশ গজের মত এগিয়েছে রানা, হুট করে কোত্থেকে যেন মাথার ওপর চলে এল একটা হেলিকপ্টার। বাতাসের ঝাপটায়। ক্যাপটা উড়ে যাবার আগেই হাত দিয়ে সেটা ধরে ফেলল ও। ট্রাউজার আর জ্যাকেট শরীরের সাথে সেঁটে গেল। মুখ তুলে ওপর দিকে তাকাল ও। কপ্টারের খোলা দরজায় একটা লালচে মুখ। লোকটাকে উদ্দেশ্য করে একটা হাত নাড়ল ও। লোকটা। হাসল তারপর ঘাড় ফিরিয়ে পাইলটকে কি যেন বলল। বিরাট একটা ইউ টার্ন নিয়ে চলে গেল কপ্টার। ক্যাপটা মাথায় ভাল। করে বসিয়ে নিয়ে হ্যাঙ্গারের দিকে এগোল রানা।

সামনেই হ্যাঙ্গার, একশো গজও হবে না। দরজায় গার্ড, কংক্রিটের মেঝেতে সাদা আলো। আরও সামনে এসে অস্পষ্ট। যান্ত্রিক আওয়াজ পেল রানা, হ্যাঙ্গারের ভেতর মেশিন চলছে। ধনুকের মত বেঁকে গিয়ে আবার সোজা হয়েছে ট্যাক্সি-ওয়ে, বাঁকটা ঘুরে আসতেই হ্যাঙ্গারের খোলা দরজা সরাসরি রানার সামনে পড়ল। উত্তেজনার শিরশিরে একটা অনুভূতি ছড়িয়ে পড়ল সারা শরীরে। দাঁড়িয়ে পড়ে হ্যাঙ্গারের ভেতরটা ভাল করে দেখা। উচিত হবে না। প্রচণ্ড একটা কৌতূহল অনুভব করল ও, এগজিবিশনের সামনে দিয়ে যাবার সময় বাচ্চা ছেলেরা যেমন। অনুভব করে। হ্যাঙ্গারের ভেতর থেকে একটা গুঞ্জনের আওয়াজ ভেসে এল। ভেতরে লোকজনের জটলা, বেশিরভাগই ইউনিফর্ম পরা গার্ড। মিগ-৩১ মাত্র মুহূর্তের জন্যে ধরা পড়ল ওর চোখে, আশ্চর্য লম্বাটে আর ছুঁচালো নাক ক্রমশ ওপর দিকে বেড়ে আকাশের দিকে তাক করা। রূপালি ফিউজিলাজের কাছে খুদে আকৃতির মানুষগুলো কিলবিল করছে। দেখার সুযোগ আরও দুএক সেকেন্ড ছিল কিন্তু মুখ ফিরিয়ে নিল রানা। এভাবে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকলে কেউ সন্দেহ করতে পারে।

পাশেই কে.জি.বি. সিকিউরিটি হেডকোয়ার্টার। এখানেও ইউনিফর্ম পরা গার্ডদের ব্যস্ততা লক্ষ করল রানা। লম্বা লম্বা পা ফেলে, কারও দিকে না তাকিয়ে সোজা গেটের কাছে পৌঁছুল ও। দরজায় দুজন গার্ড, দুজনেই শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অপেক্ষা করল, তারপর একই সাথে স্যালুট ঠুকল তারা। কিন্তু হঠাৎ করে দরজাটা খুলে গেল ভেতর থেকে। ভেতরেও একজন গার্ডকে দেখল রানা, এক পাশে সরে গেল সে। ঢুকতে যাবে রানা, দরজায় উদয় হলো একজন অফিসার। আগেই এর ফটো দেখেছে রানা, সাথে সাথে চিনতে পারল। কর্নেল সাসকিন মিকোয়ান প্রজেক্টের সিকিউরিটি চীফ। দ্রুত স্যালুট করল রানা, আঙুল দিয়ে ক্যাপ স্পর্শ করল। কর্নেলকে ক্লান্ত আর উদ্বিগ্ন দেখল ও।

দোরগোড়ায় থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছে কর্নেল সাসকিন। তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রানার অন্তর ভেদ করে গেল যেন। কঠিন সুরে জানতে চাইল সে, কি চাই, ক্যাপ্টেন?

কোথায় ভুল হয়েছে বুঝতে পারল রানা। তার আচরণ দেখে কর্নেলের ধারণা হয়েছে, ও রিপোর্ট করতে চায়। কর্নেলের পিছনেই দাঁড়িয়ে রয়েছে মেজর রাভিক, রানার দিকে চেয়ে রয়েছে। অবাক চোখে। সর্বনাশ, ভাবল রানা। মিলিটারি ইন্টেলিজেন্সের সমস্ত লোক এখানে মেজর রাভিকের অধীনে দায়িত্ব পালন করছে। তাদের প্রত্যেককে চেনার কথা মেজরের। সবাইকে। সামনাসামনি যদি নাও দেখে থাকে, ফটো নিশ্চই দেখেছে। কিন্তু ক্যাপ্টেন অদরিকের কোন অস্তিত্বই নেই মিলিটারি ইন্টেলিজেন্সে। কাজেই তাকে দেখার কোন প্রশ্নও ওঠে না। তুমি কে হে? এখন। যদি জানতে চায়?

হাতের তালু ঘামছে। ধড়াস ধড়াস করছে বুকের ভেতরটা। মিগ-৩১ এখান থেকে একশো গজও দূরে নয়, মনে পড়ল, ওটা। নিয়ে পালাবার জন্যেই এসেছে ও অথচ সোজা হেঁটে এসে ধরা। দিল খোদ সিকিউরিটি চীফের হাতে। সরাসরি না তাকিয়েও। গার্ডদের রাইফেল আর কর্নেলের হোলস্টারে গোঁজা রিভলভারটা দেখে নিল রানা। এখন এখানে গ্রেফতার হওয়ার অর্থ জানা আছে ওর, প্রাণ থাকতে সেটা মেনে নেবে না ও।

কটমট করে তাকিয়ে আছে কর্নেল সাসকিন, তার কাঁধের ওপর দিয়ে রানার দিকে তাকিয়ে আছে মেজর রাভিক। কমরেড কর্নেল, আপনার অনুমতি ছাড়াই গার্ডদের আমি নির্দেশ দিয়েছি, ওরা যেন কুকুর নিয়ে বাইরের ঝোপগুলো দেখে আসে, রুশ ভাষায়, স্পষ্ট উচ্চারণে বলল রানা।

চেহারা দেখে মনে হলো কথাগুলোর মর্ম বুঝতে এক সেকেন্ড দেরি হলো কর্নেলের, যেন রানার চোখে চোখ রেখে অন্য কিছু। ভাবছিল সে। দ্রুত, ছোট্ট করে মাথা ঝাঁকাল, বলল, বুদ্ধিটা ভাল। ধন্যবাদ, ক্যাপ্টেন। দস্তানা পরা হাত দিয়ে ক্যাপ স্পর্শ করল কর্নেল, রানাকে পাশ কাটাল।

হাত নামাল রানা, তারপর আবার তুলল মেজর রাভিক ওকে পাশ কাটাতে শুরু করায়। পরম স্বস্তির সাথে একটু একটু করে। গরম নিঃশ্বাস ছাড়ল রানা, ওর রিপোর্ট সেকেন্ড-ইন-কমান্ডও অনুমোদন করেছে। মেজর রাভিক ক্যাপ ছুঁলো না, ছোট্ট করে শুধু। মাথা ঝাঁকাল, এখন আর তাকে বিস্মিতও দেখাল না। রানা শুনল, ওর পিছন থেকে কর্নেল সাসকিন বলছে, এদিকে এরা তিনজন ভেতরে ঢুকেছে, এদের আর বেরুতে দেয়া হবে না। এবার তাহলে মুদি ব্যাটা মোলায়েভকে ধরতে হয়।

হ্যাঁ, আর দেরি করার মানে হয় না। ওকে…ওর বউকেও।

কোন কারণ ছাড়া দাঁড়িয়ে থাকা যায় না, কাজেই দরজা টপকে এগোল রানা, ওদের কথা আর শোনা হলো না। ও ভেতরে ঢুকতেই তৃতীয় গার্ড বাইরে বেরিয়ে গিয়ে বন্ধ করে দিল। দরজা। সরু করিডর, ফাঁকা। হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে ঘাম মুছল রানা, কাঁধ কঁকিয়ে জ্যাকেটটা ঠিকমত বসিয়ে নিল ঘাড়ে, ক্যাপটা সোজা করল। খানিক দূর এগিয়ে একটা সিঁড়ির সামনে থামল ও। ওপরে অফিসার্স মেস আর পাইলটদের রেস্ট-রূম। সিঁড়ি বেয়ে ওপরে ওঠার সময় মোলায়েভের কথা ভাবল ও। পিটি ডাভের ফটো পাঠানো হয়েছিল মস্কো আর বিলিয়ারস্কে, সেটা কি দেখেছে মোলায়েভ? ওর এখনকার ছদ্মবেশ আর পরিচয় সম্পর্কে তার কোন ধারণা আছে? সিঁড়ির মাথায় উঠে হাতঘড়ি দেখল ও। এখনও তিনটে বাজেনি। তারমানে তিন ঘণ্টারও বেশি অপেক্ষা করতে হবে।

তিন ঘণ্টায় কত কি ঘটতে পারে! তারপর ভাবল, মুদি লোকটা কি রকম সাহসী?

.

রাত সাড়ে তিনটের সময় ওপরতলায়, পাইলটদের রেস্ট-রূমে উঠে এল লেফটেন্যান্ট কর্নেল বেনিন। ভেতরে ঢুকে ঘুরল সে, হাত বাড়াল সুইচের দিকে। সুইচে নয়, আরেকজনের হাতে তার হাত ঠেকল। চমকে ওঠার সময় পেল বেনিন, সতর্ক হওয়ার সুযোগ মিলল না। দেড় মন ওজনের একটা ঘুসি পড়ল তার কানের পাশে। আততায়ীকে চাক্ষুষ করার কোন সুযোগ হলো না তার, করিডরের আবছা আলোয় দেখল ঘরের মেঝে বিদ্যুৎগতিতে উঠে আসছে-মুহূর্তে ধরাশায়ী হলো সে।

খুট করে একটা আওয়াজ হলো, উজ্জ্বল আলোয় ভরে উঠল। ঘর। মেঝেতে ছিটকে পড়া নিঃসাড় শরীরটার দিকে তাকিয়ে এক সেকেন্ড স্থির হয়ে থাকল রানা। তারপর দরজা বন্ধ করল, মুঠো করা হাতটায় ফুঁ দিল কয়েকবার, এগিয়ে এসে দাঁড়াল বেনিনের। অচেতন শরীরের পাশে।

পকেট থেকে হাইপোডারমিক সিরিঞ্জ আর মেডিসিনের একটা খুদে শিশি বের করল রানা, বেনিনের পাশে হাঁটু গেড়ে বসল। প্রথমে পালস দেখল, তারপর পুশ করল ইঞ্জেকশন। বেলা বারোটার আগে বেচারার ঘুম ভাঙবে না।

বেনিনকে চিৎ করল রানা। চেহারা দেখে মনে হলো ওর চেয়ে বছর কয়েকের বড়ই হবে। তবে শরীরের কাঠামো দুজনের প্রায় একই রকম। মেঝের ওপর দিয়ে টেনে খাড়া। দাঁড়িয়ে থাকা লকারগুলোর সামনে বেনিনকে নিয়ে এল ও। পকেট থেকে কোইভিসতুর দেয়া মাস্টার কী বের করে খুলে ফেলল একটা লকার।

ভেতরে কিছু নেই, খালি। একটা পা ঠেকিয়ে দরজার কবাট। খুলে রাখল ও। প্রথমে বেনিনের মাথা আর কাঁধ লকারের ভেতর ঢোকাল, তারপর তার দুই বগলের নিচে হাত গলিয়ে টেনে খাড়া করল তাকে। লকারের ভেতর দাঁড়িয়ে থাকল বেনিন, কিন্তু রানা তাকে ছেড়ে দিলেই সে পড়ে যাবে। ছাড়ল রানা, সেই সাথে বন্ধও করে দিল দরজার কবাট, শরীরটা আর বেরিয়ে আসার সুযোগ পেল না। চাবি ঘুরিয়ে লকারের তালা বন্ধ করল রানা।

আরেকটা লকার খুলে প্রেশার স্যুটটা পরীক্ষা করল ও। এটা বেনিনের প্রেশার স্যুট, ওর গায়েও ফিট করবে। ভাগ্য ভালই বলতে হবে যে সাধারণ এয়ারক্রাফট প্রেশার স্যুটের উন্নত। সংস্করণ এটা, দর্জিকে দিয়ে তৈরি করানো নাসার স্পেস স্যুটের মত কিছু নয়। তা যদি হত, দুজনের কাঠামোয় সামান্যতম হেরফের হলেও রানার গায়ে ফিট করত না স্যুটটা। নাসার স্পেস-স্যুট যার জন্যে তৈরি সে ছাড়া আর কেউ পরতে চাইলে গায়ে ফিট করবে না, এমন নিখুঁতভাবে তৈরি করা হয়।

স্যুট পরীক্ষা শেষ করে মিলিটারি ইন্টেলিজেন্সের ইউনিফর্ম খুলে ফেলল রানা। তিনটে পঁয়তাল্লিশ। তলপেটের কাছে একটা সুড়সুড়ি অনুভব করল ও। সময় যেন কাটছে না। গা থেকে শার্ট খোলার সময় কজির খানিক ওপরে টেপ দিয়ে আটকানো ব্লিপার ডিভাইসটা দেখে নিল ও। এটার মাধ্যমেই ডাক আসবে হ্যাঙ্গারে যাবার।

আরও আড়াই ঘণ্টা!

.

নয় চোখের সামনে সোনালি রিস্ট-ওয়াচ তুলল কর্নেল সাসকিন। রাত চারটে। মেইন হ্যাঙ্গারের খোলা দরজার ওপর দাঁড়িয়ে রয়েছে। সে, নিরাপত্তা প্রহরী, বিজ্ঞানী আর টেকনিশিয়ানদের কর্মব্যস্ততা লক্ষ করছে। খানিক আগেও গার্ডরা হাসাহাসি আর গল্প করছিল, ঘুরে বেড়াচ্ছিল এদিক ওদিক। কিন্তু তাকে দেখার পর আর কারও মুখে টু-শব্দটি নেই, যে যার নির্দিষ্ট জায়গায় পাথর হয়ে আছে। হ্যাঙ্গারের দরজায় পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ওরা একটা প্রাচীর তৈরি করেছে, পরিচিত কেউ ঢুকতে চাইলেও তার কাগজ-পত্র চেক করবে। হ্যাঙ্গারের ভেতর, মিগ-৩১-কে ঘিরে দাঁড়িয়ে রয়েছে যারা, তারাও সিকিউরিটি চীফের উপস্থিতি টের পেয়ে সতর্ক হয়ে উঠেছে। বিজ্ঞানীদের ওপর তীক্ষ্ণ নজর রাখছে তারা।

বিজ্ঞানী আর টেকনিশিয়ানদের অনেকেই তাকে লক্ষ করেনি কারণ মুখ তুলে তাকাবার মত সময় নেই তাদের। তবে করনিচয়কে একবার মুখ তুলতে দেখেছে সে, ওকে দেখে পাশে। দাঁড়ানো ইসরাফিলভকে কি যেন বলেওছে ফিসফিস করে।

কোইভিসতুকেও দেখতে পাচ্ছে কর্নেল। মিগ-৩১-এর খোলা। ককপিটের ভেতর তার শরীরের অর্ধেক ঢুকে আছে, পাইলটের সীটে বসা একজন টেকনিশিয়ানকে কি পরামর্শ দিচ্ছে সে।

মিগ-৩১-কে নিয়ে তেমন কোন গর্ববোধ নেই কর্নেল সাসকিনের। তার বিশ্বাস, সোভিয়েত ইউনিয়ন দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ। শক্তি, বিজ্ঞান থেকে শুরু করে পার্থিব সমস্ত ব্যাপারে এই শক্তির জয়যাত্রা অব্যাহত থাকবে। আর যেখানেই কিছু অর্জনের আয়োজন আছে সেখানেই থাকবে গোপনীয়তা রক্ষা আর নিরাপত্তা বিধানের প্রয়োজন। কাজেই সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রায় সমস্ত কর্মকাণ্ডে কে.জি.বি-র একটা বিশেষ ভূমিকা থাকতে বাধ্য। দেশের উন্নয়নে কে.জি.বি-র অবদান আছে, এটাই তার গর্ব।

তার দায়িত্ব মিগ-৩১-কে রক্ষা করা। সম্ভাব্য সবরকম সাবধানতা অবলম্বন করেছে সে, প্রয়োজনে নিজের প্রাণ পর্যন্ত বিলিয়ে দেবে। সাফল্য আর ব্যর্থতার কথা অবশ্য কেউ বলতে পারে না, ভাগ্য যদি বিমুখ হয় তাহলে আর কি করা-প্রাপ্য শাস্তি মাথা পেতে নেবে সে।

আজ রাতে তেমন ঠাণ্ডা পড়েনি, অথচ শীত শীত করছে। তার। পেটে অ্যাসিড জমেছে, ট্যাবলেট চুষেও লাভ হচ্ছে না। অসহায় ভঙ্গিতে কাঁধ ঝাঁকাল সে, ভাবল, টেনশনে ভোগাই আমার কপালের লিখন।

প্রোডাকশন প্রোটোটাইপ ওয়ান তার কাছ থেকে মাত্র একশো। ফিট দূরে। ওটার পিছনে, টেকনিশিয়ানদের অবহেলা গায়ে না মেখে দাঁড়িয়ে রয়েছে দ্বিতীয় আরেকটা এয়ারক্রাফট-পিপি টু। বিশাল হ্যাঙ্গারের পিছন দিকে।

পিপি ওয়ান-কে ঘিরে যারা দাঁড়িয়ে আছে তাদের সাথে কথা বলবে নাকি? চিন্তাটা বাতিল করে দিল কর্নেল। ওরা সবাই বাছাই করা লোক, ডিউটিতে পাঠাবার আগে সে নিজে ওদেরকে ব্রিফিং করেছে। কাজের মধ্যে রয়েছে ওরা, এখন ওদেরকে কিছু বলতে গেলে নেতৃত্বের দুর্বলতা প্রকাশ পায়, প্রমাণ হয়ে যায় আত্মবিশ্বাসের অভাব। ধীর, দৃঢ় পদক্ষেপে দরজার অপর দিকে এগোল সে। গার্ডদের একজনের সাথে তার পার্সোনাল বডিগার্ড কথা বলছে। চোখ-ইশারায় তাকে পিছু নিতে বলে দ্বিতীয় হ্যাঙ্গারের দিকে এগোল কর্নেল।

এই দ্বিতীয় হ্যাঙ্গারেই তৈরি করা হয়েছে মিগ-৩১। ভেতরটা এখন অন্ধকার আর বাইরে থেকে তালা দেয়া। গোটা হ্যাঙ্গারটাকে ঘিরে আছে একদল গার্ড। ওদেরকে বলতে হবে ভেতরে ঢুকে আরেকবার সার্চ করো।

সময় বয়ে যাচ্ছে, বিপদ আসি আসি করেও আসছে না, একটু একটু করে ভয় কেটে গিয়ে বিশ্বাস বাড়ছে তার। সহকারী মেজর রোমানভের ধারণাই বোধহয় ঠিক, ভাবল সে। জসেস্কুর সহকারী লোকটা বিদেশী বটে, কিন্তু এসপিওনাজ এজেন্ট নাও হতে পারে-সম্ভবত টেকনিক্যাল এক্সপার্ট। তাকে পাঠানো হয়েছে। কোইভিসতু আর অন্যান্যদের সাথে কথা বলার জন্যে। এক জোড়া চোখ ছাড়া আর কি অস্ত্র সাথে আনতে পারে লোকটা? দুই হ্যাঙ্গারের মাঝখানের আলোকিত জায়গাটা পেরোবার সময় কাঁটাতারের বেড়ার ওপারে তাকাল কর্নেল। ওদিকে কোথাও পাহাড়, উঁচু ঢিবি বা বালিয়াড়ি নেই, যেখানে দাঁড়িয়ে রানওয়ের ওপর ভালভাবে নজর রাখা যায়। প্রোডাকশন হ্যাঙ্গার সার্চ করা হয়ে গেলে, নিজেকে সে স্মরণ করিয়ে দিল, বেড়ার ওপারেও ডগ পেট্রল পাঠাতে হবে।

কিন্তু মনের খুঁতখুঁতে ভাব তবু যায় না। কেন যেন সন্দেহ হচ্ছে, কমপ্লেক্সের ভেতর ঢুকে পড়েছে লোকটা। না, এই শেষ। সময়ে কোন ঝুঁকি নেবে না সে। গোটা প্রজেক্ট এলাকা আরেকবার তন্ন তন্ন করে সার্চ করতে হবে।

এক নম্বর হ্যাঙ্গার থেকে কর্নেল সাসকিনকে বেরিয়ে যেতে। দেখল কোইভিসতু। মইয়ের নিচে তাকাল সে, দেখল তার দিকে তাকিয়ে দুজন মেকানিক নিজেদের মধ্যে কি যেন বলাবলি করছে। আর হাসছে। ওদের মুখের ওপর, দুজনকেই অবাক করে দিয়ে, কোইভিসতুও একগাল হাসল। তাকে ওরা আতঙ্কিত আর ভয়ে কাঁপতে দেখবে বলে আশা করেছিল, ওদের মুখের ওপর হাসতে পেরে অদ্ভুত একটা তৃপ্তি অনুভব করল কোইভিসতু।

কমরেড ডিরেক্টর, মিগ-৩১-এর পাইলটের সীটে বসা টেকনিশিয়ান বলল, বেশি সময় নেই, তাড়াতাড়ি শেষ করুন।

উইপনস-গাইডেন্স সিস্টেমের সার্কিটগুলো শেষবারের মত চেক করে নিচ্ছে কোইভিসতু। ইট্রুমেন্ট প্যানেলের বাঁ দিকের একটা অংশ খুলে ফেলা হয়েছে, ভেতরে দেখা যাচ্ছে জটিল ওয়্যারিং আর মিনিয়েচার সার্কিট। কোইভিসতুর নির্দেশে। ফাইন্যাল চেকিঙের কাজ এগিয়ে চলেছে।

সে জানে, মেকানিক আর টেকনিশিয়ানদের অনেকেই কে.জি.বি-র লোক। লেবার ক্যাম্পে থাকার সময়, তারপর একটানা গত পাঁচ বছর ধরে বাধ্য করা হয়েছে তাকে এই উইপনস-গাইডেন্স সিস্টেমের ওপর কাজ করতে। পাইলটের আসনে বসা টেকনিশিয়ান ফচ আজ প্রায় সাত বছর ধরে তার। সহকারী হিসেবে কাজ করছে। কোইভিসতু জানে, ফচ কে.জি.বির একজন চর, তার ওপর নজর রাখার দায়িত্ব পালন করছে। ফচের বাবা ছিল একজন নাৎসী, রেড আর্মির হাতে উনিশশো পঁয়তাল্লিশ সালে গ্রেফতার হয়। টেকনিশিয়ান হিসেবে ফচ একটা প্রতিভা। শত্রু হলেও প্রতিভার প্রতি একটা শ্রদ্ধাবোধ আছে। কোইভিসতুর। ফচ কে.জি.বি. এজেন্ট, সেজন্যে তার ওপর ওর কোন বিদ্বেষ নেই। ওরা যে যার দায়িত্ব পালন করছে মাত্র, নিয়তির বিধান খণ্ডায় কে!

হাতঘড়ি দেখল কোইভিসতু। চারটে চার। প্রিন্টেড একটা সার্কিট চেক করছে ফচ, এই ফাঁকে হ্যাঙ্গারের ভেতর নিরাপত্তা ব্যবস্থা জরিপ করে নিল সে।

মিগ-৩১-এর টেইল ইউনিট ছাড়িয়ে আরও সামনে চলে গেল তার দৃষ্টি, ওদিকে এককোণে দ্বিতীয় প্রোটোটাইপটা রয়েছে। প্রথমটার তুলনায় নিশ্চভ দেখাল ওটাকে। কিন্তু সে জানে, ওটারও ফুয়েল ট্যাংক সম্পূর্ণ ভরা আছে। ফ্যাক্টরির ওপর কোন ধরনের বিমান হামলা হলে মুহূর্তের নোটিসে আকাশে উঠে যেতে পারবে। সোভিয়েত ইউনিয়নের সমস্ত এয়ারক্রাফটই, হোক সেটা

প্রোটোটাইপ, প্রোডাকশন মডেল বা সার্ভিস এয়ারক্রাফট, সামরিক বিমান হলেই হলো, সর্বক্ষণ হামলা ঠেকাবার জন্যে প্রস্তত হয়ে থাকে।

কাজেই, পিটি ডাভ প্রথম প্রোটোটাইপ নিয়ে আকাশে ওঠার সাথে সাথে কি ঘটবে আন্দাজ করা কঠিন নয়। প্রথমটার পিছনে দ্বিতীয়টাকে লেলিয়ে দেবে ওরা। অস্ত্রসজ্জার জন্যে খানিক দেরি হবে বটে, তাও খুব বেশি হলে ঘণ্টাখানেক। সিস্টেম্স আর কন্ট্রোলস্ চেকিং হয়তো বাদই দেবে। দ্বিতীয় মিগ-৩১ আকাশে থেকেই রিফুয়েলিঙের সুবিধে ভোগ করবে, কিন্তু পিটিকে রিফুয়েলিঙের জন্যে নিচে কোথাও নামতে হবে। ইসরাফিলভ আর করনিচয়ের সাহায্য নিয়ে দ্বিতীয় প্লেনটাকে অচল করে দেবে। সে, তা না হলে ধরা পড়ে যাবে পিটি।

আকাশে ওঠার পর পিপি টু-ই পিটির একমাত্র বিপদ। অন্তত আর কোন বিমান পিটির মিগ-৩১-এর সাথে পাল্লা দিয়ে পারবে না।

আগুন।

এটাই একমাত্র সমাধান, ভাবল কোইভিসতু। হ্যাঙ্গারের ভেতর দাউ দাউ আগুন জ্বলে উঠলে আতঙ্কিত হয়ে পড়বে সবাই, সেই সুযোগে প্লেনের ককপিটে উঠে বসবে পিটি, প্লেনটাকে গড়িয়ে নিয়ে বাইরে, ট্যাক্সি-ওয়েতে চলে যাবে। কেউ কিছু সন্দেহ করবে না, সবাই ধরে নেবে প্রোটোটাইপ ওয়ানকে আগুন। থেকে বাঁচাবার চেষ্টা করছে পাইলট। এক ঢিলে দুই পাখি। পিটিও পালাবার সুযোগ পাবে, ওর পিছু ধাওয়া করার উপায়ও থাকবে না।

আগুন ধরানো কোন সমস্যা না। হ্যাঙ্গারের ভেতর প্রচুর তেল, কাঠ ছাড়াও দাহ্য পদার্থের কোন অভাব নেই। সহকারীদের আগেই এ-ব্যাপারে পরামর্শ দিয়ে রেখেছে সে। ওদের সাথে আরও একবার কথা বলা দরকার।

শেষ পর্যন্ত পিটি সত্যি পালাতে পারবে কিনা, এই প্রশ্নে কোন উদ্বেগ নেই কোইভিসতুর। পিটির মিগ-৩১ কোন রাডারে ধরা পড়বে না। তারমানেই রাশিয়ানরা ইনফ্রা-রেড বা প্রক্সিমিটি মিসাইল ছুঁড়তে চাইলে প্রথমে ওদেরকে প্লেনটা দেখতে পেতে হবে। ঝক ঝক এয়ারক্রাফট পিটিকে ধাওয়া করতে পারে, কিন্তু তাতে কোন লাভ হবে না।

এয়ারকিঙের টেইল সেকশনের দিকে তাকাল কোইভিসতু। স্পেশ্যাল টেইল ইউনিটে কাজ করছে ইসরাফিলভ, প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত এটা তার নিজের প্রজেক্ট, তার সহকারী হিসেবে এই প্রজেক্টে কাজ করছে করনিচয়। টেইল-অ্যাসেম্বলিতে রয়েছে। অ্যান্টি-মিসাইল সিস্টেম আর ইসিএম গিয়ার, এ-দুটো কাজে লাগবে পিটির। কোইভিসতুর ধারণা, পরীক্ষামূলক হলেও সিস্টেমটা কাজ করবে। এর আগে মাত্র একবার একটা আরপিভিতে ব্যবহার করা হয়েছে। আজ অবশ্য উইপনসট্রায়ালের এটাও একটা অংশ, পাইলট সিস্টেমটার কার্যকারিতা পরখ করবে।

সময় নিয়ে একটু উদ্বেগ বোধ করল কোইভিসতু। ফার্স্ট সেক্রেটারি আসবেন সকাল নটায়। তার আগেই ওদের তিনজনকে গ্রেফতার করা হবে, জানে সে। খুব বেশি হলে সাড়ে ছটার মধ্যে শেষ হয়ে যাবে তাদের কাজ। তারমানে ওদের দৃষ্টি অন্য দিকে ফেরাবার শেষ সময় ওই সাড়ে ছটা-পিটির জন্যেও টেক-অফ করার আদর্শ সময় হতে পারে ওটা। পাঁচটায় বিরতি, ওরা কফি খাবে। তখনই সহকারীদের সাথে কথা বলবে সে।

কড়া নজর রাখা হচ্ছে তার ওপর। ঘণ্টাখানেক আগে টয়লেটে গিয়েছিল সে, যেন দেয়াল ফুড়ে বেরিয়ে এল একজন গার্ড, পিছু নিয়ে টয়লেটের দরজা পর্যন্ত গেল সে।

নষ্ট পাওয়ার ট্রানজিসটর খুঁজে বের করছে ফচ, আর মিনিট কয়েকের মধ্যে পেয়ে যাবে। ফাইনাল চেক শেষ করতে তারপর আর বেশি সময় লাগার কথা নয়।

পেয়েছি, কমরেড ডাইরেক্টর, মুখ তুলে কোইভিসতুর দিকে তাকাল ফচ। তার ঠোঁটে তেরছা একটু হাসি লেগে রয়েছে, যেন বুঝতে পেরেছে নষ্ট ট্রানজিসটরটা কোইভিসতুই ওখানে ফিট করে রেখেছিল, কাজ শেষ করতে যাতে দেরি হয়।

কোইভিসতুও হাসল। কিন্তু ম্লান।

ফচের হাত থেকে চৌকো প্লাস্টিকটা নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখল কোইভিসতু। ঠিক আছে, তুলে ফেলো ওটা। আর একটা আনছি আমি।

টেকনিক্যাল স্টোর থেকে? কিন্তু আপনি কেন যাবেন…

কুঁজো হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে কোমরে ব্যথা ধরে গেছে, বলল কোইভিসতু। ওটা নিয়ে আসি, তাহলে সিধে হয়েএকটু হাঁটাও হবে। ফচকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে মই বেয়ে নেমে এল সে।

.

 হারামখোর, বুন্ধু কাঁহিকে! ও মরে গেছে, ওকে তোমরা মেরে ফেলেছ! বিস্ফোরিত হলো ইন্সপেক্টর বাজারনিক। ভয় পেয়ে এক পা পিছিয়ে গেল লুদভিক আর গরচয়েভ, দুজনকেই বোকা বোকা, হতভম্ব দেখাল।

রাসকিনের লাশের সামনে থেকে উঠে দাঁড়াল বাজারনিক, রাগে ফুঁসছে।

ওদের দিকে পিছন ফিরে ফোনের রিসিভার তুলে ডায়াল করল মেজর রোমানভ। বাজারনিকের মুখ থেকে আবার গালাগালির তুবড়ি ছুটল, তার দিকে ফিরে রোমানভ শান্ত গলায় বলল, মরে গেছে তো কি হয়েছে? ও কিছু জানত না।

জানত না!

না, বলল রোমানভ।

তাহলে? এখন কি হবে? তোমার মহামূল্যবান মিগ-৩১ যে…

ম্লান একটু হাসল রোমানভ। জানি। মিগ-৩১-এর বিপদ। কাটেনি। সেজন্যেই তো এখনও মস্কোয় রয়েছি আমি, সেজন্যেই। তো কথা বলতে চাইছি কমপিউটর রূমের সাথে।

হাতঘড়ি দেখল বাজারনিক। সাড়ে চারটে। কটা বাজে খেয়াল আছে?

হ্যালো? রিসিভার থেকে হাত সরিয়ে কথা বলল রোমানভ। রোমানভ। খবর কি? এত দেরি হচ্ছে কেন? ঠিক আছে, যত। তাড়াতাড়ি সম্ভব তালিকাটা চাই আমি। ক্রেডলে রিসিভার। নামিয়ে রাখল সে, বাজারনিকের দিকে ফিরল। অপারেটর বলল, এটা একটা জটিল কাজ, আরও সময় লাগবে। ওহে, লাশটাকে নিয়ে যাও তোমরা-আমার ঘেন্না লাগছে।

লাশ নিয়ে কামরা থেকে বেরিয়ে গেল লুদভিক আর গরচয়েভ। বাজারনিক জানতে চাইল, কি চেক করছে ওরা?

একটা তালিকা এরইমধ্যে তৈরি করেছে, বলল রোমানভ, কিন্তু তাতে মাত্র সাত-আট জন অ্যারোনটিকস এক্সপার্টের নাম রয়েছে-আমেরিকা আর ইউরোপের। বয়স আর যোগ্যতার বিচারে, আমরা যাকে এখানে খুঁজছি তার সমান। এখন ওরা কে কোথায় আছে সেটা জানার চেষ্টা চলছে।

চেষ্টা করতে করতেই যদি সময় পেরিয়ে যায় তাহলে আর লাভ…

পায়চারি শুরু করল রোমানভ।। কিন্তু করারও তো কিছু নেই। হয় আমরা সময় মত তথ্যটা পাব, না-হয় পাব না। এ নিয়ে চিন্তা-ভাবনা না করাই ভাল। এসো, কমপিউটরকে আর কি জিজ্ঞেস করা যেতে পারে, একটু ভেবে দেখি।

এক মুহূর্ত পর বাজারনিক বলল, এয়ারক্রাফট সম্পর্কে সম্ভাব্য সব কিছু চেক করে দেখতে বলতে পারো। সব পদের লোক সম্পর্কে…

কিভাবে?

আমেরিকান বা ইউরোপিয়ান অ্যারোস্পেস প্রোগ্রামের সাথে যারা জড়িত তাদের সবার ফাইল চেক করা যেতে পারে, বলল বাজারনিক। ওরা আমাদের এখানে একজন যোগ্য, সমর্থ, বুদ্ধিমান লোককে পাঠিয়েছে। একজন অ্যাস্ট্রনট হতে অসুবিধে কোথায়? আমাদের একজন কসমোন-এর কথা ধরো-কি দেখতে হবে, কি প্রশ্ন করতে হবে, ইনফরমেশন অ্যানালাইজ করার নিয়ম ইত্যাদি সবই তার জানা।

রোমানভকে চিন্তিত দেখাল। পায়চারি থামিয়ে বাজারনিকের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল সে।

আমরা যাকে খুঁজছি তার বয়স পঁচিশ থেকে আটাশ, শক্তসমর্থ, বুদ্ধিমান-প্রথমে তাকে তুমি একজন এজেন্ট বলে সন্দেহ করেছিলে। হতে পারে তার কমান্ডো ট্রেনিং আছে, নিঃসন্দেহে সে ভাল একজন পাইলট। নাসার অ্যাস্ট্রটরা সবচেয়ে সেরা ট্রেনিং। পাওয়া…

পাইলট? ভাল একজন পাইলট? চোখ দুটো বিস্ফারিত হয়ে উঠেছে রোমানভের। হতে পারে! ওরা হয়তো মিগ-৩১। হাইজ্যাক…

এই তো, ঠিক লাইনে চিন্তা করছ! কমপিউটরকে বলো…

না, দ্রুত মাথা নাড়াল রোমানভ। টেলিফোনে কাজ হবে। চলো, আমরা নিজেরাই যাই। কমপিউটর ইনডেক্স দেখে। অপারেটরকে পরামর্শ দিতে পারব ঠিক কি চাই আমরা। দুনিয়ার সেরা পাইলটদের একটা তালিকা হাতে পেলে…

আর তারা কে কোথায় আছে জানতে পারলে…

বুঝতে পারব কাকে পাঠিয়েছে ওরা!

তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে পড়ল ওরা। ঘড়িতে তখন চারটে চল্লিশ।

*

শাওয়ার-কিউবিকল-এ একটা চেয়ার নিয়ে এসেছে রানা, মেঝেতে লুটিয়ে থাকা ভারী পর্দা ভাঁজ করে চেয়ারের পিঠে ঝুলিয়ে দিয়েছে-যাতে পানির ছিটে গায়ে না লাগে। শাওয়ারটা অন করা, কিউবিকল-এর ভেতর ঘন কুয়াশার মত বাশ্চ ভেসে। বেড়াচ্ছে।

এখনও কোন বিপদ হয়নি, কিন্তু মনে মনে জানে, জসেস্কু নির্ঘাত ধরা পড়বে, আর ধরা পড়লে তার মুখ থেকে ঠিকই কথা আদায় করবে কে.জি.বি। শারীরিক অত্যাচার কতক্ষণ সইতে পারবে জসেস্কু, সেটাই হলো প্রশ্ন। সে মুখ খুললে ওকে খুঁজে বের করা কে.জি.বি-র জন্যে কোন সমস্যাই নয়।

এসো, মনে মনে আহ্বান জানাল রানা, আমিও তৈরি হয়ে আছি। যাই ঘটুক না কেন, এয়ারকিঙের একেবারে কাছে পৌঁছে। ধরা পড়তে রাজি নই বাপু। ককপিটে যদি চড়তে না পারি, লাশ হয়ে ফেরত যাব, হেরে গিয়ে প্রাণে বাঁচতে রাজি নই।

কোইভিসতু আর তার সহকারীদের কথা মনে পড়ল ওর। ওদের সাহসের সত্যিই তুলনা হয় না।

ইউনিফর্ম খুলে শুধু শর্টস পরে চেয়ারে বসে আছে রানা। বেনিনের সাথে একই লকারে মিলিটারি ইন্টেলিজেন্সের ইউনিফর্মটা রেখেছে ও। লকারটা আরেকবার খুলতে হয়েছিল ওকে। এক হাত দিয়ে অচেতন শরীরটাকে ধরে রেখে আরেক হাতে ইউনিফর্মটা ভেতরে গুঁজে দিতে হিমশিম খেয়ে গিয়েছিল ও।

গরম বাতাস, শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। তবে গরম থাকছে শরীরটা। চোখে ঘুম, কিন্তু জানে এখন ঘুমানো মানে মৃত্যুকে একটা সুবর্ণ সুযোগ করে দেয়া।

প্রথমে সামনের রূম থেকে ভেসে আসা আওয়াজটা ওর কানে ঢুকল না। দ্বিতীয়বার ডাকল লোকটা, সাথে সাথে শিরদাঁড়া খাড়া হয়ে গেল ওর। রেস্ট-রূমে কেউ ঢুকেছে।

সাবধানে, ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল রানা, চেয়ারটা যাতে কোন শব্দ না করে। কে?

সিকিউরিটি চেক, কর্নেল-জরুরী।

সন্দেহ নেই, কে.জি.বি.। কর্নেল সাসকিন তাহলে সন্দেহ করছে বিদেশী এজেন্ট প্রজেক্ট এলাকার ভেতর ঢুকে পড়েছে?

কি চাই তোমার? কর্কশ সুরে জানতে চাইল রানা। আরও একটা লাশ? নাকি শুধু আহত করার সুযোগ পাওয়া যাবে?

আপনার আইডেনটিফিকেশন।

মাথায় যেন বাজ পড়ল রানার। কয়েক সেকেন্ড অসাড় হয়ে থাকল ওর চিন্তাশক্তি, ওর দ্বারা এ-ধরনের একটা ভুল হতে পারে বিশ্বাসই করতে পারল না। ছি, ধিক্কার দিল নিজেকে। এই ভুলের ক্ষমা হয় না। বেনিনের কাগজ-পত্র বেনিনের পকেটেই রয়ে গেছে সব, বের করে নেয়ার কথা মনেই পড়েনি ওর। ইচ্ছে হলো। চড়িয়ে নিজের গাল দুটো ফাটিয়ে দেয়। আইডি কার্ড চাইছে ওরা, দেখাতে না পারলে,..

এরপর আর কিছু ভাবা যায় না।

দ্রুত চিন্তা করছে রানা। বিপদ থেকে বাঁচতে হবে। গলা। চড়িয়ে বলল, জাহান্নামে যাও, আমি এখন গোসল করছি। বিরক্ত করার আর লোক পাওনি, না?

রেস্ট-রূম থেকে মাত্র পাঁচ গজ দূরে দাঁড়িয়ে রয়েছে রানা। গার্ড আর ওর মাঝখানে শুধু একটা ভারী পর্দা। ও কি একা এসেছে, নাকি সাথে আরও কেউ আছে?

দুঃখিত, কমরেড কর্নেল, কিন্তু…।

বুদ্ধিটা নিশ্চই তোমার মাথা থেকে বেরিয়েছে, সোলজার? বুঝতে পারছি, রেস্ট-রূম সার্চ করতে এসেছ তুমি, সামান্য একজন গার্ড হয়েও কতটা ক্ষমতা রাখো দেখাতে এসেছ আমাকে। কর্নেল সাসকিন কোথায়? সে জানে?

না, মানে…

ক্ষীণ একটু হাসি ফুটল রানার ঠোঁটে। কিন্তু আর কিছু বলল না ও। আধ মিনিট পেরিয়ে গেল। তারপর হুঙ্কার ছাড়ল ও, এখনও তুমি ওখানে দাঁড়িয়ে আছ! তোমার স্পর্ধা তো কম নয়। দেখছি!

আবার অপেক্ষা। সন্দেহ নেই, পর্দার তলা দিয়ে ওর ছায়া। দেখতে পেয়েছে গার্ড। কিন্তু লোকটা যে চলে যায়নি, বুঝতে পারল রানা। যাবার আগে ক্ষমা চাইবে। যদি না চায়, ধরে নিতে হবে সরাসরি কর্নেল সাসকিনকে গিয়ে রিপোর্ট করবে সে। নাকি এগিয়ে এসে পর্দা সরাবে, দেখতে চাইবে ওকে?

অটোমেটিকটা বেনিনের বাথরোবে, বাথরোব ঝুলছে বাথরুমের দরজার পিছনে। ওদিকে যাওয়ার কোন উপায় নেই, দেখে ফেলবে। মারতে হলে খালি হাতেই মারতে হবে। কিন্তু লোকটা যদি গুলি করে? গুলির আওয়াজ হলে…

দুঃখিত, কমরেড কর্নেল, প্রায় আধ মিনিট পর নিস্তব্ধতা ভাঙল গার্ড। কিন্তু…সাবধানে থাকবেন, কমরেড কর্নেল। কমরেড কর্নেল সাসকিন অর্ডার দিয়েছেন, সন্দেহজনক কাউকে দেখলেই গুলি করতে হবে-এজেন্ট লোকটা নাকি ভারী বিপজ্জনক।

কান পেতে থাকল রানা। বুটের অস্পষ্ট আওয়াজ পাওয়া গেল। দূরে সরে যাচ্ছে। তারপর আরও একটা শব্দ, দরজা বন্ধ হলো।

হাঁফ ছাড়ল রানা।

দরজা বন্ধ দেখলে কেউ সন্দেহ করতে পারে, তাই খুলে রেখেছিল ও। লকার থেকে আইডি কার্ড বের করে দ্বিতীয়বার চিন্তা করে দেখল-না, খোলাই থাকুক। অটোমেটিকটা বাথরোব থেকে নিয়ে এসে নিজের কাছে রাখল এবার।

হাতঘড়ি দেখল ও। এখনও অনেক দেরি। এই মুহূর্তে কি করছে ওরা তিনজন-কোইভিসতু, ইসরাফিলভ আর করনিচয়?

.

আর সবাই ক্যান্টিনে গেছে, কিন্তু ওদের তিনজনকে হ্যাঙ্গার থেকে বেরুতে দেয়া হয়নি। এয়ারক্রাফটের পাশেই মেঝের ওপর বসে কফি খাচ্ছে ওরা। টেকনিশিয়ানরা সবাই একসাথে যায়নি, পালা করে হ্যাঙ্গার থেকে বেরিয়েছে। একদল ফিরে এলে আরেক দল গেছে। আর গার্ডরা কেউই হ্যাঙ্গার ছেড়ে মুহূর্তের জন্যে নড়েনি। টেকনিশিয়ানদের একটা দল ফিসফিস করে আলাপ করছে।

গার্ডদের সাথে, আড়চোখে ওদের তিনজনের দিকে তাকাচ্ছে, হাসছে লুকিয়ে লুকিয়ে।

কোইভিসতু লক্ষ করল কফির কাপে চুমুক দেয়ার সময় করনিচয়ের ঠোঁট কাপল। অভয় বা আশ্বাস দেয়ার কোন মানে হয় না, হাস্যকর শোনাবে। সহানুভূতি প্রকাশ করার কোন ইচ্ছেও জাগল না। এ-পথে তারা স্বেচ্ছায় এসেছে।

তবু, জীবনের মায়া বড় মায়া। খারাপ বা ভয় তো একটু। লাগবেই। নিজের কথা নয়, কোইভিসতু মেয়েটার কথা ভাবছে। আগেই ব্যবস্থা করা ছিল, পিটি ডাভ তাদের কোয়ার্টার থেকে বেরিয়ে আসার পরপরই সলভিনার প্রেমিক এসে সলভিনাকে বিলিয়ারস্ক থেকে বের করে নিয়ে গেছে। মেয়েটার কপালে শেষ পর্যন্ত কি আছে, কোইভিসতু জানে না। তাকে গ্রেফতার করা হবে, জানে সে। হয়তো ষড়যন্ত্রে সলভিনারও হাত আছে বলে ওকেও ওরা গ্রেফতার করতে পারে। ছেলেটার সাথে আজ সকালেই বিয়ে হয়ে যাবে সলভিনার, স্ত্রীকে রক্ষার জন্যে চেষ্টার কোন ত্রুটি করবে না সে। তার বাপ অত্যন্ত প্রভাবশালী লোক, ছেলের মুখ চেয়ে সে-ও হয়তো পুত্রবধূকে নির্দোষ প্রমাণ করার চেষ্টা করবে। বাকি সলভিনার ভাগ্য।

ইসরাফিলভকে খুব অস্থির দেখাল। দায়িত্বের ব্যাপারে অত্যন্ত সচেতন সে। নিচু গলায় জিজ্ঞেস করল, সময় তো আর বেশি নেই, তাই না? কি করতে হবে বলে ফেলুন।

আমি আর আধ ঘণ্টা সময় নষ্ট করতে পারব, বলল কোইভিসতু। কাজ শেষ করতে তার বেশি দেরি হলে ফচ সন্দেহ। করবে।

আমাদেরও সেই একই অবস্থা, বলল ইসরাফিলভ। টেইলঅ্যাসেম্বলির কাজ শেষ করতে প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বেশি সময় নিয়েছি আমরা দুজন। আর বড়জোর আধ ঘণ্টা, এর মধ্যেই কাজ শেষ করতে হবে।

ওরা আমাদের সাথে এ-ধরনের আচরণ না করলেও পারত, বিড়বিড় করে বলল করনিচয়। চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে, খেলা শেষ।

ওরা চাইছে আমরা ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে থাকি, বলল কোইভিসতু। ওদেরকে খুশি হতে দিই কেন? এসো, এমন ভাব দেখাই যেন কিছুই আমরা বুঝতে পারছি না-ভয় পাইনি আমরা।

কাজের কথা বলুন!

ইসরাফিলভের দিকে তাকাল কোইভিসতু। যা বলেছিলাম, আগুন। না, ওদিকে তাকিয়ো না। দ্বিতীয় প্রোটোটাইপের কাছে। কোন একটা অজুহাত দেখিয়ে ওদিকে আমাদের একজনকে যেতে হবে। এখন নির্দিষ্ট একটা সময় ঠিক করে ফেলা দরকার।

সাড়ে ছটা, তার বেশি দেরি করা যাবে না।

বেশ, তাই, বলল কোইভিসতু।

ধরাবার দায়িত্ব আমার, বলল ইসরাফিলভ। ছটা দশে আমি টয়লেটে যাবার নাম করে টেইল-সেকশন ছেড়ে যাব, গার্ডদের কেউ যদি সাথে যেতে চায়, ব্যাটাকে মরতে হবে।

শুধু যদি আর কোন উপায় না দেখো তাহলেই কারও সাথে লাগবে, সাবধান করে দিল কোইভিসতু। আমি চাই না তুমি আহত হও। অটোমেটিকটা সাথে আছে তো? মাথা ঝাঁকাল ইসরাফিলভ। গুড। টয়লেট থেকে বেরিয়ে এসে আগুন লাগাবার জন্যে যা যা দরকার সব তুমি দ্বিতীয় প্রোটোটাইপের পিছনে পাবে। কয়েক ড্রাম পেট্রল আর…

কিভাবে আগুন ধরাতে হয়, আমি জানি, হিস হিস করে বলল ইসরাফিলভ।

তাহলে এসো, পিটি ডাভের সাফল্যের জন্যে শেষবার প্রার্থনা করি আমরা…

১০

সোনালি হাতঘড়ি দেখল কর্নেল সাসকিন। ছটা সাত। এইমাত্র একটা খবর পেয়েছে সে-এক ধরনের দুঃসংবাদই বলা যায়-একটা টপোলেভ টিইউ-ওয়ানফোরফোর এয়ারলাইনার ফার্স্ট সেক্রেটারি, কে.জি.বি. চীফ, সোভিয়েত প্রতিরক্ষা মন্ত্রী, সোভিয়েত এয়ারফোর্স মার্শাল এবং অন্যান্য উচ্চপদস্থ অফিসারকে নিয়ে মস্কো থেকে রওনা হয়ে গেছে। আশা করা হচ্ছে ছটা তিরিশ মিনিটে বিলিয়ারস্ক এয়ারস্ট্রিপে ল্যান্ড করবে ওটা। খবরটা হতভম্ব করে দিয়েছে কর্নেলকে, রীতিমত ঘাবড়ে গেছে সে। কথা ছিল নটায় এসে পৌঁছুবেন ওঁরা, সময়টা হঠাৎ এভাবে এগিয়ে নিয়ে আসার কারণ বোধগম্য হলো না তার। কয়েকটা জরুরী কাজ বাকি রয়েছে এখনও, সেগুলো শেষ করার আগেই ওঁরা যদি এসে পড়েন, সব ওলটপালট হয়ে যাবে।

রাগে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকতে ইচ্ছে হলো তার। মরুকগে।

কন্ট্রোল টাওয়ারকে সতর্ক করে দেয়া হয়েছে, এয়ারলাইনারের জন্যে অপেক্ষা করছে ওরা। রানওয়ের পাশে কয়েকটা টেবিল পাতা হয়েছে, কয়েকজন অফিসার সেখানে বসে একগাদা রিপোর্ট পরীক্ষা করছে। সর্বশেষ সার্চ সম্পন্ন হওয়ার পর। তৈরি করা হয়েছে রিপোর্টগুলো। কোন রিপোর্টেই সন্দেহজনক কিছু পাওয়া গেল না।

মুদি মোলায়েভ আর তার বউকে ধরে নিয়ে এসে বেঁধে রাখা হয়েছে বেসমেন্টের একটা সেলে। মারধর করে প্রায় শেষ করে ফেলা হয়েছে লোকটাকে, কিন্তু তবু একটা কথাও তার মুখ থেকে বের করা যায়নি এখনও। প্রথমে বউটার ওপর নির্যাতন চালানো হয়েছে স্বামীর চোখের সামনে। কোন লাভ হয়নি। আক্ষরিক অর্থেই মোলায়েভের গায়ের ছাল তুলে ফেলা হয়েছে। কয়েকজন অফিসারের শুধু শুধু সময় নষ্ট।

চেয়ার ছেড়ে উঠল সাসকিন। টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে ফোনের রিসিভার তুলল সে। দযেরঝিনস্কি স্ট্রীটের কমপিউটর রূমে পাওয়া গেল মেজর রোমানভকে।

রোমানভ উত্তেজিত। তার গলা কাপছে। কমরেড কর্নেল, তাকে আমরা পেয়েছি! কমরেড কর্নেল, আমার কথা শুনতে পাচ্ছেন?

জলদি, রোমানভ, চেঁচিয়ে উঠল সাসকিন। তাড়াতাড়ি, সংক্ষেপে বলো। কয়েকজন অফিসার ঘাড় ফিরিয়ে তার দিকে তাকাল।

সে একজন পাইলট…পিটি ডাভ, একজন ইসরায়েলি…

ইসরায়েলি? হাঁপাচ্ছে কর্নেল, চেহারায় অবিশ্বাস।

কিন্তু ট্রেনিং পেয়েছে সি.আই.এ. হেডকোয়ার্টারে। মিগ-২৫ চালাতে জানে…

কিন্তু একজন পাইলট কেন, রোমানভ? সে কি করবে…?

মিগ-৩১ সম্পর্কে কিছুই তার অজানা নেই, কমরেড কর্নেল। আমার মনে হয়…

বলছ, মিগ-৩১ হাইজ্যাক করে নিয়ে যেতে এসেছে?

না, তা সম্ভব না…

ধন্যবাদ, রোমানভ, অসংখ্য ধন্যবাদ… রিসিভারটা ছুঁড়ে ফেলে দিল সাসকিন। হুঙ্কার ছাড়ল, বাস্কি, কোথায় তুমি?

মেজর বাস্কি ছুটে এল।

গ্রেফতার করো ওদের, এখুনি! গর্জে উঠল কর্নেল। সারা শরীর কাঁপছে তার। কোইভিসতু, ইসরাফিলভ আর। করনিচয়।-হাতকড়া পরিয়ে বেসমেন্টে নিয়ে যাও। কুইক।

খারাপ খবর, কর্নেল? জানতে চাইল বাস্কি।

লোকটা পাইলট! ওরা একজন পাইলটকে পাঠিয়েছে। নিশ্চই। প্রজেক্ট এলাকার ভেতর ঢুকে পড়েছে সে। হ্যাঙ্গারে খোজো! তোমরা সবাই…না, অর্ধেক লোক গোটা বিল্ডিং সার্চ করো। যাও!

.

টয়লেটটা হ্যাঙ্গারের শেষ মাথায়। দরজা খুলে গেল, ভেতর থেকে। ইসরাফিলভকে বেরিয়ে আসতে দেখল কোইভিসতু। দূর থেকে। ছোট্ট দেখাল ইসরাফিলভকে-নিরীহ ভালমানুষ, কারও কোন ক্ষতি করতে জানে না। হ্যাঙ্গারের একদিক থেকে আরেক দিকে হেঁটে যাচ্ছে সে-অলসভঙ্গি, যেন কোন তাড়া নেই। ওর সাথে একজন গার্ডও ঢুকেছিল টয়লেটে, কিন্তু তাকে বেরুতে দেখা গেল না।

পিপি টু-র ছায়ায় পৌঁছুল ইসরাফিলভ। এখনও টয়লেট থেকে বেরুচ্ছে না গার্ড। মৃদু একটা হাসি ফুটল কোইভিসতুর ঠোঁটে। নিপাট ভদ্রলোক ইসরাফিলভ, মানুষ খুন করতে পারে, ভাবা যায় না।

ওভারঅলের ওপর সাদা কোট পরে আছে কোইভিসতু। ভাল করে গায়ে জড়িয়ে নিল সেটা। ঠাণ্ডা লাগছে না, কোমরে গোঁজা অটোমেটিকটা আড়াল করার দরকার ছিল। করনিচয়ের দিকে তাকাল না, শুধু ছোট্ট করে মাথা ঝাঁকাল সে। জানে, ইঙ্গিত পাবার অপেক্ষায় তাকিয়ে আছে করনিচয়।

ছটার খানিক পর এয়ারক্রাফটের সমস্ত কাজ শেষ হয়ে যায়। কোইভিসতু কাজে দেরি করছে সেটা বুঝতে পেরেছিল ফচ, কিন্তু  তার ধারণা হয় ভয়ে হাত চলছে না বলে দেরি হচ্ছে। কাজ শেষ হতে ক্যান্টিনে চলে গেছে সে, বন্ধুদের সাথে আড্ডা মারবে। যাবার সময় তার ঠোঁটে বাঁকা হাসি লেগে ছিল। শুধু একজন, পিভৎ, কোইভিসতুর মতই সে-ও একজন ইলেকট্রনিক এক্সপার্ট, হ্যাঙ্গার থেকে বেরিয়ে যাবার সময় কোইভিসতুর সামনে দাঁড়িয়ে অসহায় ভঙ্গিতে কাঁধ ঝাঁকিয়েছিল।

পিভৎ-এর প্রতি কৃতজ্ঞ বোধ করল কোইভিসতু। কোটের পকেটে হাত ঢুকিয়ে দিয়ে খুদে ট্রান্সমিটারটা ছুঁলো সে। বোতামে চাপ দিয়ে ছেড়ে দিলেই পিটি ডাভের বাহুতে আটকানো ব্লিপার প্রতি সেকেন্ডে একবার পিপ পিপ শব্দ করবে। পিটি ছাড়া আর কেউ সে-শব্দ শুনতে পাবে না। শব্দ পেলেই পিটি বুঝবে, হ্যাঙ্গারে আসার সময় হয়েছে তার।

ঘাড় ফিরিয়ে দরজার দিকে তাকাল কোইভিসতু। তার আর সবচেয়ে কাছের গার্ডের মাঝখানে পঁচিশ গজের মত ফারাক। ত্রিশ গজের মধ্যে ওরা চারজন দাঁড়িয়ে রয়েছে। সারারাত জাগার

পরও কারও চেহারায় ক্লান্তির ছাপ নেই।

হ্যাঙ্গারের শেষ মাথার দিকে তাকাল কোইভিসতু। লাল কি যেন একটা লাফিয়ে উঠল। আগুন? শিখা? পরমুহূর্তে সমস্ত সংশয় দূর হয়ে গেল। হঠাৎ লাফ দিয়ে উঠল বিশাল আগুন। ইসরাফিলভের ছোট্ট কাঠামোটা ঝুঁকে ছিল, হঠাৎ সেটা অদৃশ্য হয়ে গেল চোখের সামনে থেকে। আগুনে পড়ল নাকি?

দরজার দিকে ফিরছে কোইভিসতু, সেই সাথে কোমর থেকে বের করছে অটোমেটিকটা। প্রথমে একজন গার্ড চিৎকার করে উঠল। কয়েক সেকেন্ড আর কোন শব্দ নেই। তারপর একসাথে চিৎকার জুড়ে দিল সবাই।

পুলক অনুভব করল কোইভিসতু। লাগ ভেলকি!

সময় নিয়ে লক্ষ্য স্থির করল কোইভিসতু। সবচেয়ে কাছের লোকটার বুকে গুলি করল সে। লোকটা পড়ল কিনা দেখার ধৈর্য বা আগ্রহ নেই, হ্যাঙ্গারের পিছন দিকে ফিরল আবার। করনিচয় তাকে পাশ কাটিয়ে ছুটল। তার মাথার ওপর দিয়ে বাতাসে শিস কেটে বেরিয়ে গেল একটা বুলেট। একটা হেঁড়ে গলা থেকে নির্দেশ এল, গুলি কোরো না! প্লেনের ক্ষতি হবে! গুলি কোরো না!

এতক্ষণে তীক্ষ্ণ শব্দে বেজে উঠল অ্যালার্ম। কিন্তু গার্ডরা এখনও সবাই হতভম্ব, শুধু চেঁচাচ্ছে আর ছুটোছুটি করছে। বাইরে। থেকে নতুন একদল গার্ড ঢুকল হ্যাঙ্গারে, সরাসরি আগুন লক্ষ্য করে ছুটল তারা।

আগুনের সামনে এখন বেশ অনেক লোক। একজন লোককে দেখেই চিনতে পারল কোইভিসতু। ইসরাফিলভ। তার সাদা কোট লাল হয়ে গেছে। সারা শরীরে আগুন নিয়ে গার্ডদের ভিড়ের। মধ্যে ঢুকে পড়েছে সে, হাত দুটো সামনে বাড়িয়ে দিয়ে।

অটোমেটিকটা পকেটে ভরে করনিচয়ের পিছু পিছু দৌড়ে আগুনের কাছাকাছি চলে এল কোইভিসতু। খুদে ট্রান্সমিটারের বোতাম আগেই টিপে দিয়েছে। জানে, রওনা হয়ে গেছে পিটি ডাভ, যেকোন মুহূর্তে হ্যাঙ্গারে পৌঁছে যাবে সে। একটা ধাক্কা খেলো কোইভিসতু, হোস পাইপ টেনে নিয়ে যাচ্ছে একজন গার্ড। দেখতে না পেয়ে সেই তার পায়ের ওপর পা ফেলেছিল। রিভলভারটা বের করে সরাসরি লোকটার মাথায় গুলি করল কোইভিসতু।

ভিড়। ছুটোছুটি। চেঁচামেচি। তার সাথে যোগ হয়েছে আগুনের শোঁ শোঁ একটানা আওয়াজ। তেলের একটা ড্রাম। বিস্ফোরিত হলো। চোখের পলকে পঞ্চাশ হাত পিছিয়ে এল সবাই।

কেউ তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে, অপেক্ষা করছে কোইভিসতু। কিন্তু তেমন কিছু ঘটল না। লোকটাকে গুলি করেছে। সে, কেউ দেখেনি।

সময় দেখল সে। সাড়ে ছটা। ঘাড় ফিরিয়ে পিছন দিকে তাকাল। মিগ-৩১-কে ঘিরে ফেলা হয়েছে। অসংখ্য গার্ড, পরস্পরের হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে সবাই। হতাশায় কান্না পেল কোইভিসতুর। একটা পিঁপড়েকেও প্লেনের কাছে ঘেঁষতে দেবে না ওরা।

কিন্তু পিটি ডাভকে কি বাধা দেবে ওরা?

আগুন ধরাবার পিছনে কি মতলব কাজ করছে, ওরা টের পেয়ে গেছে। কোইভিসতু যা আশা করেছিল তা হবার নয়। তার ধারণা ছিল হ্যাঙ্গারে আগুন লাগলে গার্ডরা সবাই আগুন নেভাতে ছুটবে। কিন্তু না! শত গোলযোগের মধ্যেও কারও না কারও মাথা ঠিকই কাজ করে। সেই রকম কেউ একজন গার্ডদের নির্দেশ দিয়েছে, পিপি ওয়ান-কে ঘিরে ফেলো। রক্তমাংসের দেয়ালের সামনে মেজর বাস্কিকে দেখতে পেল কোইভিসতু। হাত নেড়ে গার্ডদের নির্দেশ দিচ্ছে। ভারী একটা যান্ত্রিক কণ্ঠস্বর গমগম করে উঠল লাউডস্পীকারে। আগুনের শিখা দ্বিতীয় মিগ-৩১-এর দিকে দ্রুত এগোচ্ছে, সচল লাভার মত। ধোঁয়ায় ঢাকা পড়ে যাচ্ছে। হ্যাঙ্গারের পিছন দিকটা।

একই নির্দেশ বারবার আসছে লাউডস্পীকার থেকে। আগুনের কাছে শুধু ফায়ারব্রিগেডের লোকজন থাকবে, বাকি সবাই সরে আসুন। ভিড় কমান। গার্ডরা যে যার জায়গায় থাকুন।

হ্যাঙ্গারের ভেতর একটা ফায়ার টেন্ডার ঢুকল। সোজা পিছন দিকে ছুটল সেটা।

একদল ইউনিফর্ম পরা গার্ড ঢুকল হ্যাঙ্গারে। ওদের দেখেই কোইভিসতু বুঝল, তাকে নিয়ে যেতে এসেছে ওরা। তাকে আর তার সহকারী করনিচয়কে। ইসরাফিলভ ওদের নাগালের বাইরে চলে গেছে।

পিটিকে নিরাপদে হ্যাঙ্গারে ঢুকতে দেয়ার এই সুযোগ, ভাবল। কোইভিসতু। ধরা দেবে না সে। লড়বে। ওকে কোণঠাসা করার। জন্যে এগিয়ে আসবে ওরা। হ্যাঙ্গারের মুখ থেকে সরে আসতে হবে ওদেরকে।

আরও পিছিয়ে যেতে শুরু করল কোইভিসতু। করনিচয়কে কাছে ডেকে বলল, মরব। কিন্তু ধরা দেব না। তুমি?

নিঃশব্দে কোটের পকেট থেকে নিজের অটোমেটিকটা বের করল করনিচয়।

হ্যাঙ্গারের দিকে তাকাল ওরা। কোথায় পিটি? কোথায় সে? এখনও আসছে না কেন?

কোথায় রানা?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *