প্রজাপতির খামার

ভলিউম ১১ – প্রজাপতির খামার – তিন গোয়েন্দা – রকিব হাসান – সেবা প্রকাশনী

এখানেই বিছাই, বলে, মেঝেতে ম্যাপ বিছিয়ে দেখতে বসে গেল কিশোর পাশা।

হ্যাঁ, এইই ভালো হয়েছে, বললো রবিন। টেবিলটা একটু সরাতে হয়েছে, এই যা। তবে বড় ম্যাপ দেখতে মাটিতেই সুবিধে।

বেশি আওয়াজ করো না, হুঁশিয়ার করলো জিনা। বাবা স্টাডিতে। শব্দ শুনলেই এসে চেঁচামেচি শুরু করবে।

না, করবো না, মাথা নেড়ে বললো মুসা।

এই রাফি, চুপ থাকবি, কুকুরটাকেও সাবধান করলো জিনা। নইলে বের করে দেবো। বুঝেছিস? বুঝতে পারলো রাফিয়ান। শুয়ে পড়লো একেবারে ম্যাপটার ওপরই।

আরে গাধা, সরা ধমক লাগালো কিশোর। তাড়া আছে আমাদের। বাটারফ্লাই হিল খুঁজে বের করতে হবে

বাটারফ্লাই হিল? জিনা বললো। দারুণ নাম তো!

হ্যাঁ, বাংলা করলে হয় প্রজাপতির পাহাড়। ওদিকেই ছুটি কাটাতে যাচ্ছি আমরা এবার। কয়েকটা গুহাও আছে কাছাকাছি। তাছাড়া রয়েছে একটা প্রজাপতির খামার…

প্রজাপতির খামার! জিনা অবাক। প্রজাপতির আবার খামার হয় নাকি!

হয়, মুসা জানালো। আমাদের ইস্কুলের এক বন্ধু, জনি, তার বাড়ি ওখানে। সে-ই আমাদের দাওয়াত দিয়েছে ওখানে যেতে…।

তা-ই বলো, মাথা দোলালো জিনা। এজন্যেই হুট করে চলে এসেছে আমাদের বাড়িতে। আমি তো ভাবলাম আমাদের এখানেই ছুটি কাটাতে এসেছে। তোমরা তাহলে বাটারফ্লাই হিলে যাচ্ছে প্রজাপতির খামার দেখতে!

যা, রবিন বললো। ভাবলাম, এদিক দিয়েই যখন যেতে হবে, তোমাকেও নিয়ে নেবো। তা যাবে তো?

যাবো না মানে? এরকম একটা চান্স ছাড়ে নাকি কেউ?

গভীর মনযোগে ম্যাপ দেখছে চারজনে। হঠাৎ ঝটকা দিয়ে খুলে গেল স্টাডিরুমের দরজা। বিড়বিড় করে আপনমনে কি বলতে বলতে এগিয়ে এলেন জিনার বাবা মিস্টার পারকার। ছেলেমেয়েদেরকে দেখতেই পেলেন না আত্মভোলা বিজ্ঞানী, এসে পড়লেন একেবারে ওদের গায়ের ওপর। হোঁচট খেয়ে মাটিতেই পড়ে গেলেন।

রাফি ভাবলো, ওদের সঙ্গে খেলতে এসেছেন মিস্টার পারকার, খুশিতে জোরে ঘেউ ঘেউ করে উঠে নাচানাচি শুরু করলো সে।

তুমি যে কি, বাবা, মিস্টার পারকারকে ধরে বললো জিনা। একটু দেখে হাঁটতে পারো না?

এই রাফি, চুপ! ধমক লাগালো কিশোর। এতো হাসির কি হলো? থাম!

তিন গোয়েন্দাও এসে হাত লাগালো। মিস্টার পারকারকে ধরে তুলে দাঁড় করিয়ে দিলো। তারপর কেউ তার কাপড় ঝেড়ে দিতে লাগলো, কেউ দেখতে লাগলো কোথাও ব্যথা-ট্যথা পেয়েছেন কিনা। কড়া চোখে ছেলেমেয়েদের দিকে তাকিয়ে আচমকা গর্জে উঠলেন তিনি, এটা একটা শোয়ার জায়গা হলো! এই জিনা, তোর মা কোথায়? জলদি যা, ডেকে নিয়ে আয়! ডেস্কটা যদি একটু গুছিয়ে রাখে! কাগজপত্র কিছু পাচ্ছি না। ডাক, জলদি ডাক!

মা তো বাড়ি নেই, বাবা। বাজারে গেছে।

নেই? সেকথা আগে বলবি তো! যত্তোসব! গজগজ করতে করতে গিয়ে আবার স্টাডিতে ঢুকলেন তিনি। দড়াম করে বন্ধ হয়ে গেল দরজা।

পরদিন সকালে সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়লো ওরা। তিন গোয়েন্দা আর জিনা সাইকেলে চলেছে, পাশে পাশে ছুটে চলেছে রাফি। সাগরের ধার দিয়ে গেছে পথ। রোদে ঝলমল করছে নীল সাগর।

গোবেল দ্বীপটা দেখা যেতেই হাত তুলে চেঁচিয়ে উঠলো জিনা, ওই যে, আমার দ্বীপ।

মুখ ফিরিয়ে তাকালো অন্যেরা। বহুবার দেখেছে ওরা ওই দ্বীপ, আর দ্বীপের পুরানো দুর্গের টাওয়ারটা। তবু যতোবারই দেখে নতুন মনে হয়। যতক্ষণ না চোখের আড়াল হলো, সাইকেল চালাতে চালাতে ফিরে ফিরে তাকালো ওরা ওটার দিকে।

সঙ্গে প্রচুর খাবার দিয়ে দিয়েছেন তিন গোয়েন্দার প্রিয় কেরিআন্টি, জিনার মা। কাজেই দুপুরে খাবার অসুবিধে হলো না ওদের। পথের পাশে গাছের ছায়ায় বসে খেয়ে নিলো, জিরিয়েও নেয়া হলো সেই সাথে। তারপর আবার চলা।

কটা নাগাদ পৌঁছবো? জিজ্ঞেস করলো জিনা।

এই চারটে, জবাব দিলো কিশোর।

বেলা গড়িয়ে আসছে। পথের দুধারে এখন ছড়ানো প্রান্তর। কোথাও মাঠ, কোথাও চাষের জমি। দূরে দেখা গেল পাহাড়।

ওটাই বোধহয়, বলে গলায় ঝোলানো ফীন্ডগ্লাস চোখে ঠেকালো কিশোর। যা, ওটাই। অদ্ভুত চ্যাপ্টা চূড়া। বুড়ো মানুষের দুমড়ে যাওয়া হ্যাটের চূড়ার মতো লাগছে দেখতে।

সাইকেল থেকে নামলো সবাই। এক এক করে ফান্ডগ্রাস চোখে লাগিয়ে পাহাড়টা দেখলো।

চারটের আগেই পৌঁছতে পারতো ওরা, রাফির কারণে পারলো না। ওরা সাইকেলে চড়ে চলেছে, আর কুকুরটা চলেছে দৌড়ে, তাড়াতাড়ি ক্লান্ত হয়ে পড়ছে। ওকে বিশ্রাম দেয়ার জন্যে মাঝে মাঝে থামতে হচ্ছে ওদের।

অবশেষে পৌঁছলো ওরা বাটারফ্লাই হিলের গোড়ায়। ঢালু উপত্যকায় ছড়িয়ে আছে তৃণভূমি, তাতে গরু চরছে। ঢালের আরও ওপরে, ঘাস যেখানে ছোট আর শক্ত, সেখানে চরছে ভেড়ার পাল। পাহাড়ের পায়ের কাছে যেন গুটিসুটি মেরে শুয়ে রয়েছে ফার্মহাউসটা।

ওটাই জনিদের বাড়ি, বললো কিশোর। ছবি দেখেছি। এই চলল, ওই ঝর্নাটায় হাতমুখ ধুয়ে চুল আঁচড়ে নিই। রাফি, সাংঘাতিক ঘেমেছিস। ইচ্ছে করলে গোসল করে নিতে পারিস।

মুখহাত ধুয়ে, পরিপাটি হয়ে বাড়িটার দিকে এগোলো ওরা। পায়েচলা মেঠোপথ পেরিয়ে এসে থামলো ফার্মের গেটের কাছে। ভেতরে বিরাট এলাকা। উঠনে মুরগী মাটিতে ঠুকরে ঠুকরে দানা খাচ্ছে। পুকুরে হাঁস সাঁতার কাটছে।

ভেতরে ঢুকলো ওরা। সামনে এগোলো। কোথায় যেন ঘেউ ঘেউ করে উঠলো একটা কুকুর। বাড়ির এককোণ ঘূরে ছুটে বেরিয়ে এলো একটা ছোট জীব। ধবধবে সাদা।

খাইছে! দারুণ সুন্দর ভেড়ার বাচ্চা তো! মুসা বললো।

এই রাফি, চুপ! ধমক দিয়ে বললো জিনা। কিছু বলবি না ওটাকে।

বাচ্চাটার পিছে পিছে বেরোলো একটা বাচ্চা ছেলে। বয়েস পাঁচের বেশি হবে। লালচে কোঁকড়া চুল, বড় বড় বাদামী চোখ। ওদেরকে দেখে থমকে দাঁড়ালো।

তোমরা কারা? জিজ্ঞেস করলো সে।

আমরা জনির বন্ধু, হেসে জবাব দিলো কিশোর। তুমি কে?

আমি ল্যারি। আর ও, ভেড়ার বাচ্চাটাকে দেখিয়ে বললো ছেলেটা, ও টোগো। খুব দুষ্টু।

তাই নাকি? রবিন বললো। খুব সুন্দর তোমার বাচ্চাটা।

সেজন্যেই তো ওকে আমি এতো ভালোবাসি। এই টোগো, আয় আয়, আমার কাছে আয়। বাচ্চাটা এগিয়ে এলে ওটাকে ধরে কোলে তুলে নিলো ল্যারি। তা তোমরা ভাইয়ার কাছে এসেছে বুঝি?।

জনি তোমার ভাই? মুসা বললো। হ্যাঁ, তার কাছেই এসেছি। কোথায় ও?।

ওখানে, হাত তুলে মস্ত গোলাঘরটা দেখালো ল্যারি। ডবিও আছে সাথে। যাও না, গেলেই দেখা হবে।

ভেড়ার বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে যেদিক থেকে এসেছিলো সেদিকে চলে গেল ল্যারি।

ভেড়াটার যেমন লেলাম, ছেলেটার তেমনি গাল। দেখলেই আদর করতে ইচ্ছে করে, জিনা বললো।

অন্য তিনজনেও মাথা ঝাঁকালো। এমনকি রাফিয়ানও বলে উঠলো, হুফ! গোলাঘরের কাছে এসে গলা চড়িয়ে ডাকলো কিশোর, জনি! জঅনি?

বেরিয়ে এলো ওদেরই বয়েসী একটা ছেলে। সাথে একটা কুকুর। ওদেরকে দেখেই দুহাত তুলে চিৎকার করতে করতে ছুটে এলো জনি, এই যে, তিন গোয়েন্দা, এসে পড়েছে! আরি, জিনাও! আবার রাফিও! এসো এসো। ছুটিটা ভালোই কাটবে এবার আমি তো সেই কখন থেকে অপেক্ষা করে আছি। ভাবছি এই আসছে, এই আসহো!…আরি আরি, ডবি, তুই আবার যাচ্ছিস কোথায়? আরে ও তো রাফি। তোরও বন্ধু।

ঘাড়ের নোম খাড়া হয়ে গেছে রাফিয়ানের। মৃদু গরগর করছে। তার মাথায় চাপড় দিয়ে জিনা বললো, হয়েছে, আর রাগতে হবে না। ও ডবি। ওদের এখানেই বেড়াতে এসেছি আমরা।

দুটো কুকুরের ভাব হতে সময় লাগলো না। জিনা বললো জনিকে, তোমার ভাইটা কিন্তু খুব সুন্দর। ভেড়ার বাচ্চাটাও।

হেসে উঠলো জনি। আর বলো না। টোগোকে নিয়ে সারাক্ষণ ব্যস্ত ও। কিছুতেই চোখের আড়াল করতে চায় না। এসো, বাড়িতে এসো।

মায়ের সঙ্গে বন্ধুদের পরিচয় করিয়ে দিলো জনি।

তোমাদের কথা রোজই বলে জনি, হেসে বললেন মহিলা। বলেছে এখানে নাকি ছুটি কাটাবে। এসেছো, ভালো করেছে। কোনো অসুবিধে হবে না। তবু, কম্বল সব রেডি করে রেখেছে তোমাদের জন্যে ও। খাওয়ারও অসুবিধে হবে না। দুধ, ডিম, রুটি, মাখন, সব পাবে। যখন যা দরকার, চাইবে, লজ্জা করবে না।

ঘরের ভেতরে ছোটাছুটির শব্দ শোনা গেল। ওই যে, আবার শুরু করেছে! দুটোর জ্বালায়… ঘরের দিকে ফিরে চিৎকার করে মহিলা বললেন, এই ল্যারি, চুপ করলি! ভেড়ার বাচ্চাটাকে নিয়ে আবার ঢুকেছিস ঘরে! কতোবার না মানা করেছি, ওসব নিয়ে ঘরে ঢুকবি না। আবার মেহমানদের দিকে ফিরলেন তিনি। বুঝলে, কুকুর-বেড়াল আমার খারাপ লাগে না। কিন্তু ছাগল-ভেড়া একটুও পছন্দ না। কত বলি ওকে, ওটা ফেলে দিয়ে একটা কুকুরের বাচ্চা পোষ, শোনেই না ছেলেটা। টোগো টোগো করে পাগল।

মা, জনি বললো, এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথাই বলবে শুধু? চা-টা খাওয়াতে হবে না ওদেরকে?

ও, নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই। এসো, এসো তোমরা। ভেতরে এসো।

খাবারের বহর দেখে আফসোস করলো মুসা, হায় হায়, এতো! এমন জানলে দুপুরে খেতামই না।

না না, এমন আর কি করতে পারলাম, জনির মা বললেন। তাড়াহুড়ো করে করেছি। জনি, তুই খাওয়া ওদের। দেখিস, কোনো কিছু যেন বাকি না থাকে। আমার কাজ পড়ে আছে…

ঠিক আছে, ঠিক আছে, ভদ্রতা করে বললো কিশোর। আমরা নিজেরাই নিয়ে খেতে পারবো।

হ্যাঁ, খাও। নিজের বাড়ি মনে করবে। কোনো লজ্জা করবে না। চলে গেলেন মহিলা।

টোগো আর ল্যারিও বসেছে ওদের সঙ্গে। পারলে ভেড়ার বাচ্চাটাকে টেবিলেই তুলে দিতো ল্যারি, বড় ভাইয়ের ভয়ে পারছে না। কোলে নিয়ে বসেছে।

মাংসের বড়াগুলো দেখিয়ে জনি বললো, ওগুলো কি দিয়ে তৈরি হয়েছে, জানতে পারলে মোটেও খুশি হবে না টোগো। হাসলো সে। ওর দাদার মাংস দিয়ে।

তাড়াতাড়ি টোগোকে মাটিতে নামিয়ে দিলো ল্যারি। ভয়, কি জানি কোনোভাবে দাদার মাংসের অবস্থা দেখে যদি ভয় পেয়ে যায় ভেড়ার বাচ্চাটা?

কুকুর দেখে অভ্যস্ত টোগো, রাফিয়ানকে দেখে মোটেও ভয় পেলো না। তার গা ঘেঁষে গিয়ে দাঁড়ালো। রাফিও আদর করে তার গা চেটে দিলো। ব্যস, ভাব হয়ে গেল দুটোতে।

খাওয়া শেষ হলো। এই সময় হাত মুছতে মুছতে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলেন জনির মা। একটা চেয়ার টেনে বসলেন। জিজ্ঞেস করলেন, তা কি ঠিক করলে? কোথায় থাকবে? ঘরে, না বাইরে?

বাইরেই থাকি, কিশোর বললো। মজা বেশি হবে।

থাকো, যেখানে ইচ্ছে। জনি, তবুটাবুগুলো কোথায় রেখেছিস? দিয়ে দে। ওরা নিজেরাই গিয়ে জায়গা পছন্দ করুক, কোথায় থাকবে।

এসো, বন্ধুদের ডাকলো জনি।

ল্যারি আর ডবিও চললো ওদের সাথে। আর ল্যারির কোলে অবশ্যই রইলো টোগো।

তাঁবু আর অন্যান্য জিনিসপত্র বয়ে নিতে মেহমানদেরকে জনি তত সাহায্য করলোই, ল্যারি আর ডবিও করলো।

পাহাড়ের দিকে যেতে যেতে জনি বললো, যা সুন্দর জায়গা! খুব পছন্দ হবে। তোমাদের। আমিও তোমাদের সঙ্গে ক্যাম্পে থাকতে পারতাম, কিন্তু বাড়িতে অনেক কাজ।

সমস্ত জিনিসপত্র নিয়ে গিয়ে গোলাঘরে রেখেছে জনি। দুটো তাঁবু, দুটোই ভালো। আবহাওয়া এখন যেরকম, তেমন থাকলে এই ভাবুরও দরকার নেই। খোলা আকাশের নিচেই ঘুমাতে পারবে অভিযাত্রীরা।

জিনিসগুলোর প্রশংসা করলো তিন গোয়েন্দা আর জিনা।

একটা ঠেলাগাড়ি বের করে তাতে জিনিসগুলো তুলতে আরম্ভ করলো জনি। তার সঙ্গে হাত লাগালো তিন গোয়েন্দা আর জিনা। ল্যারিও যতোটা পারলো সাহায্য করলো ওদেরকে। চামচ থেকে শুরু করে, ফ্রাইং-প্যান, কেটলি, মোটকথা ক্যাম্পিলের যতো জিনিস দরকার, সব জোগাড় করে রেখেছে জনি।

সে বললো, ঠেলাগাড়ি পরেও নিতে পারবে। আগে জায়গা পছন্দ করো।

তার চেয়ে আরেক কাজ করা যাক, কিশোর বললো। জিনা, তুমি আর রবিন চলে যাও। জায়গা পছন্দ করো গিয়ে আমরা মালপত্র নিয়ে আসছি।

জায়গা বাছতে বেশিক্ষণ লাগলো না। ঠেলে বেরিয়ে থাকা একটা পাথরের নিচ থেকে দেখা গেল ঝর্না বইছে। স্বচ্ছ টলটলে পানি। পানি যেখানে গিয়ে পড়ে ছোট একটা ডোবামতো তৈরি করেছে, সেখানে গজিয়ে উঠেছে ঘন সবুজ গাছপালা। ওই ঝর্নার পাড়েই ক্যাম্প করার সিদ্ধান্ত নিলো ওরা।

মালপত্র সব এনে রাখা হলো জায়গামতো। কিন্তু সেরাতে আর তাঁবু ফেলার ঝামেলায় যেতে চাইলো না কেউ। আকাশ ঝকঝকে পরিষ্কার। তারা থাকবে। বাতাসও বেশ উষ্ণ। রাতে খোলা আকাশের নিচে ঘুমালেও অসুবিধে হবে না।

খাবারের প্যাকেটগুলো খুলতে বসলো রবিন আর জিনা। রবিন ভাবছে, ভাঁড়ার করা যায় কোন জায়গাটাকে। মনে পড়লো, ঝর্নাটা যে পাথরের নিচ থেকে বেরিয়েছে, সেখানে একটা গুহা আছে। ভেতরটা বেশ ঠাণ্ডা। খাবার রাখলে সহজে নষ্ট হবে না। অন্যদেরকে বলতে তারাও একমত হলো তার সাথে।

ওদেরকে কাজেকর্মে সাহায্য করলো জনি। তার যাবার সময় হলো। বললো, রাতের খাবারের দেরি হয়ে গেছে এমনিতেই। আমি যাই। কাল দেখা হবে। ইস্, তোমাদের সঙ্গে থাকতে পারলে ভালোই হতো!…আচ্ছা, চলি।

ডবিকে নিয়ে রওনা হয়ে গেল সে। নেমে যাচ্ছে ঢাল বেয়ে। সেদিকে তাকিয়ে একবার নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটলো শুধু কিশোর। কিছু বললো না।

ও তোমাদের খুব ভালো বন্ধু, জিনা মন্তব্য করলো।

একমত হয়ে মাথা ঝাঁকালো তিন গোয়েন্দা।

কটা বাজে? বলে ঘড়ি দেখলো কিশোর। আরিব্বাপরে! আটটা বাজে! বুঝতেই পারিনি। তা ঘুমটুম পেয়েছে কারো?

পেয়েছে,হাই তুললো মুসা।

রবিন আর জিনা জানালো, তাদেরও ঘুম পেয়েছে। এমনকি কিছুই না বুঝে রাফিয়ানও হুফ বলে মাথা ঝাঁকালো।

ঘুমের আর দোষ কি? মুসা বললো। সারাটা দিন কি কম কষ্ট গেছে? তা ঘুমের আগে হালকা কিছু খেয়ে নিলে কেমন হয়?

আমিও একথাই ভাবছি, কিশোর বললো।

ভাঁড়ারের দায়িত্ব নিয়েছে রবিন। বললো, রুটি, মাখন আর সামান্য পনির হলেই চলবে। কি বলো? আর গোটা দুই টম্যাটো। কিছু জাম, আর, সেই সাথে এক গ্লাস করে বরফ দেয়া দুধ হলে…

চমৎকার হয়। রবিনের কথাটা শেষ করে দিলো মুসা। হাত তালি দিয়ে বললো, জবাব নেই!

বরফ পাবে কোথায়? কিশোর জিজ্ঞেস করলো।

তাই তো, একমুহূর্ত ভাবলো রবিন। চিন্তা নেই, তুড়ি বাজালো সে। ঝর্নার পানি যেরকম ঠাণ্ডা, তাতে বোতল চুবিয়ে রাখলেই বরফের মতো ঠাণ্ডা হয়ে যাবে দুধ। পানি এমন ঠাণ্ডার ঠাণ্ডা, মনে হয় ফ্রিজ থেকে বের করা হয়েছে।

হালকা খাওয়া। তাড়াতাড়িই সেরে ফেললো ওরা। তার পর হলুদ ফুল ফুটে থাকা একটা বড় ঝোপ বেছে নিয়ে তার পাশে কম্বল বিছিয়ে শুয়ে পড়লো।

শোয়র সাথে সাথে ঘুমিয়ে পড়লো মুসা। কিশোর ঘুমালো তারপর। রবিন আর জিনা শুয়ে শুয়ে কথা বললো কিছুক্ষণ, ওদেরকে সঙ্গ দিলো রাফিয়ান।

জিনা ঘুমালো। সারাদিন এতো পথ দৌড়ে এসে রাফিয়ান খুব ক্লান্ত। সেও ঘুমালো। রবিন জেগে রইলো আরও কিছুক্ষণ। অনেক তারাই ফুটেছে আকাশে। তবে তার মাঝে ঝকঝক করছে মস্ত একটা তারা, চট করে চোখে পড়ে। দেখছে আর ভাবছে রবিন, আহা, পৃথিবীটা কি সুন্দর এখানে! এরকম একটা জায়গায় যদি চিরটাকাল বাস করা যেতে

আকাশে তারার মেলা, নিচে নিঝুম ধরণী। সব কিছু নীরব, শুধু ঝর্নার একটানা বয়ে চলার কুলকুল ছাড়া। মাঝে মাঝে দূরের খামারবাড়ি থেকে ভেসে আসছে কুকুরের ডাক, বোধহয় ডবি। তারপর বাতাস যখন স্তব্ধ হয়ে গেল, সেই ডাকও শোনা গেল না আর।

কিছুক্ষণ ঘুমানোর পরই জেগে গেল রাফি। একটা কান খাড়া করলো। মৃদু একটা শব্দ শুনতে পাচ্ছে, মাথার ওপরে। একটা চোখ মেললো। কালো একটা বাদুড়। শূন্যে পাক খেয়ে খেয়ে নিশাচর পোকা খুঁজে বেড়াচ্ছে। আবার ঘুমিয়ে পড়লো সে।

হঠাৎ জোরালো একটা আওয়াজে সবারই ঘুম ভেঙে গেল। লাফিয়ে উঠে বসলো সবাই। নীরবতার মাঝে আওয়াজটা বড় বেশি হয়ে কানে বাজছে।

কী? জিনার প্রশ্ন।

এরোপ্লেন, জবাব দিলো কিশোর। তাকিয়ে রয়েছে পাহাড়ের ওপর দিয়ে উড়ে যাওয়া ছোট বিমানটার দিকে। নিশ্চয় ওদিকের এয়ারী থেকে এসেছে।…কটা বাজে? আরিব্বাবা, নটা পাচ! বারো ঘণ্টা ঘুমালাম।

বাজুকগে, বলে আবার শুটিসুটি হয়ে শুয়ে পড়লো মুসা। চোখ বন্ধ করে বললো, আমি আরো ঘুমাবো।

এই ওঠো, ওঠো, জোরে জোরে ঠেলা দিলো তাকে কিশোর। এলাকাটা ঘুরে দেখা দরকার। প্রজাপতির খামার দেখবে না?

ভুলেই গিয়েছিলাম, উঠে বসলো আবার মুসা।

ঝর্না থেকে হাতমুখ ধুয়ে এলো সবাই। নাস্তা তৈরি করতে বসলো রবিন। তাকে সাহায্য করলো জিনা।

পরিষ্কার নীল আকাশ, ঝলমলে রোদ। ফুরফুরে হাওয়া বইছে। ঝোপের পাশে বসে বাতাস বাঁচিয়ে আগুন জ্বাললো রবিন। ডিম সেদ্ধ করলো। রুটি কেটে তাতে মাখন মাথালো জিনা। টুকরো করে টম্যাটো কেটে তাতে লবণ আর মশলা মাথালো। ঝর্নার পানিতে চুবিয়ে রাখা কয়েকটা দুধের বোতল গিয়ে নিয়ে এলো কিশোর আর মুসা।

সাধারণ খাবার। কিন্তু এই পরিবেশে বসে এসবই অমৃতের মতো লাগলো ওদের।

খাওয়ার মাঝামাঝি সময়ে ঘেউ ঘেউ শুরু করলো রাফি। ঘনঘন লেজ নাড়ছে। সবাই আন্দাজ করলো, বোধহয় জনি আসছে। হ্যাঁ, সে-ই, কারণ রাফিয়ানের ডাকের জবাবে সাড়া দিলো ডবি। একটু পরেই দেখা গেল তাকে। পাহাড়ের মোড় ঘুরে বেরিয়ে এলো। কাছে এসে লম্বা জিভ বের করে বসলো।

স্বাগত জানাতে তার গা চেটে দিলো রাফিয়ান।

জনি এলো। ও, নাস্তা করছে। এতোক্ষণে? ওদিকে কতো কাজ করে এলাম আমি। সেই ছটা থেকে শুরু করেছি। গরু দোয়ালাম, গোয়াল সাফ করলাম, হাঁসমুরগীগুলোকে খাবার দিলাম, খুপরী থেকে ডিম বের করলাম।

এখানে এসেই পুরোদস্তুর খামারওয়ালা বনে গেছো দেখছি, হেসে ঠাট্টা করলো মুসা।

হাতের ঝুড়িটা নামিয়ে রাখলে জনি। দুধ, রুটি আর ডিম পাঠিয়ে দিলো মা। বাসায় বানানো কেকও দিয়েছে।

অনেক ধন্যবাদ তাকে। তোমাকেও। কিশোর বললো। কিন্তু জনি, তাঁবু আর জিনিসপত্র ধার দিয়ে এমনিতেই অনেক সাহায্য করেছে, ঋণী করে ফেলেছো। ভাই, কিছু মনে করো না, খাবারের দামটা অন্তত দিতে দাও।

মা নেবে না। বললেই রাগ করবে।

কিন্তু আমরাই বা তোমাদের কাছ থেকে পয়সা ছাড়া কতো নেবো? রবিন বললো।

নিতে খারাপ লাগবে, বললো মুসা। বুঝতে পারছে না…

পারছি। কিন্তু মাকে আমি বলতে পারবো না, জনি হাতজোড় করলো। আমি মাপ চাই। পারলে তোমরা দাও গিয়ে।

মুশকিলই হলো দেখছি, চিন্তিত ভঙ্গিতে বললো কিশোর।

এক কাজ করা যায়, প্রস্তাব দিলো জিনা। যতোবার খাবার আনবে, ততোবার কিছু কিছু করে পয়সা দেবো আমরা তোমার হাতে। তুমি সেগুলো নিয়ে রেখে দেবে একটা বাক্সে। তারপর আমরা চলে যাবার দিন, কিংবা পরে উপহার কিনে তাকে দেবে। আমাদের তরফ থেকে। তাহলে আর তিনি মাইন্ড করতে পারবেন না। কি, ঠিক আছে?

অনিচ্ছা সত্ত্বেও রাজি হলো জনি। হুঁ, তা দেয়া যায়। তবে তোমরা পয়সা না দিলেই আমরা খুশি হতাম। যাকগে, এখন এগুলো তোমাদের ভাঁড়ারে তুলে রাখো তো।

খাবার রেখে আসা হলে কিছু টাকা বের করে জনির হাতে দিয়ে কিশোর বললো, কালকের আর আজকের খাবারের দাম।

টাকাটা পকেটে রেখে দিয়ে জনি বললো, তা আজ কি করবে ঠিক করেছে কিছু? প্রজাপতির খামার দেখতে যাবে, না আমাদের খামার?

তোমাদের খামারে তো গেছিই কাল একবার, পরে যেতে পারবো যখন খুশি, কিশোর বললো। অন্যদের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, এই, আজ কি করা যায় বলো তো? এমন ঝলমলে রোদ ফেলে কালো গুহাগুলোতে ঢুকতে ইচ্ছে করছে না। গুহায় নাহয় আরেকদিন ঢোকা যাবে, কি বলো?

কেউ জবাব দেয়ার আগেই হঠাৎ সমস্বরে চেঁচাতে শুরু করলো রাফি আর ডবি। একই দিকে তাকিয়ে রয়েছে। বড় একটা ঝোপের দিকে।

কে এলো? জিনা বললো। এই রাফি, দেখ তো কে?

ছুটে গেল রাফিয়ান আর ডবি। একটা বিস্মিত কণ্ঠ কানে এলো। এই যে ডবি? এখানে এসে উঠেছিস কেন? তোর বন্ধুটি কে?

মিস্টার ডাউসন, জনি জানালো। প্রজাপতির খামারের এক মালিক। জাল নিয়ে প্রায়ই আসে এখানে, প্রজাপতি ধরতে।

ঝোপ ঘুরে বেরিয়ে এলেন একজন মানুষ। আলুথালু পোশাক, চশমাটা বারবার নাকের ওপর থেকে পিছলে পড়তে চায়। চুল-দাড়িতে কতোদিন নাপিতের কাঁচি লাগেনি কে জানে। হাতে একটা প্রজাপতি ধরার জাল। ছেলেমেয়েদের দেখে থমকে দাঁড়ালেন। হাল্লো! জনি, ওরা কারা?

আমার বন্ধু, মিস্টার ডাউসন। পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি, এ-হলো জর্জিনা পারকার, বিখ্যাত বিজ্ঞানী মিস্টার জোনাথন পারকারের মেয়ে। ও কিশোর পাশা, বাংলাদেশী। ওর চাছা রকি বীচের বিরাট এক স্যালভিজ ইয়ার্ডের মালিক। ওর নাম মুসা আমান, আফ্রিকান অরিজিন, এখন রকি বীচে থাকে। বাবা উঁচুদরের সিনেমা টেকনিশিয়ান। আর এ-হলোগে রবিন মিলফোর্ড, আইরিশ, বাবা বড় সাংবাদিক। আর এই মিয়া হলো আমাদের রাফিয়ান, ওরফে রাফি, জিনার প্রিয় কুকুর।

হ্যাঁ। বোঝা যাচ্ছে, আমাদেরও প্রিয় হয়ে উঠবে, মাথা নেড়ে এগিয়ে এলেন মিস্টার ডাউসন। কাঁধের ওপর তুলে রেখেছেন লাঠিতে বাঁধা প্রজাপতির জাল। চশমার কাঁচের ওপাশে চোখ দুটো উজ্জ্বল। তিন কিশোর, এক কিশোরী। চমৎকার। তা বাপুরা নোংরা করে দিয়ে যাবে না তো এলাকাটাকে? দাবানল লাগিয়ে দেবে না তো?

কল্পনাই করতে পারি না ওকথা, হেসে বললো জিনা। মিস্টার ডাউসন, আপনার প্রজাপতির খামারটা দেখাতে নিয়ে যাবেন আমাদের? খুব দেখতে ইচ্ছে করছে।

নিশ্চয়ই নেবো, আরও উজ্জ্বল হলো ডাউসনের চোখ। দেখানোর সুযোগই পাই না কাউকে। এদিকে বড় একটা আসে না কেউ। এসো, এদিক দিয়ে।

সরু একটা পাহাড়ী পথ ধরে ওদেরকে নিয়ে চললেন ডাউসন। এতো জঙ্গল হয়ে আছে, পথটা প্রায় চোখেই পড়ে না। মাঝামাঝি আসতেই শোনা গেল একটা ভেড়ার বাচ্চার ডাক, পরক্ষণেই কথা বলে উঠলো একটা কচিকণ্ঠ, ভাইয়া, ভাইয়া, আমি এখানে। আমাকে নিয়ে যাবি?

ল্যারি আর টোগো। প্রায় একই রকম করে লাফাতে লাফাতে এলো। ছুটে গিয়ে ভেড়ার বাচ্চাটার গা শুকলো রাফি, যেন ওটা কোনো ধরনের আজব কুকুরের বাচ্চা।

এখানে কি? কড়া গলায় বললো জনি। বাড়ি থেকে এতোদূর এসেছে! কতোদিন না মানা করা হয়েছে? দেখো, একদিন ঠিক হারিয়ে যাবে।

আমি আসতে চাইনি তো, বড় বড় বাদামী চোখ দুটো ভাইয়ের দিকে মেলে কৈফিয়তের সুরে বললো ল্যারি। টোগো আসতে চাইলো, তাই।

তুমিই এসেছে ওকে নিয়ে। আমি কোথায় যাই দেখার জন্যে।

না না, টোগোই আসতে চাইলো! কেঁদে ফেলবে যেন ল্যারি। আমি মানা করেছিলাম, পালিয়ে চলে এলো।

বেশি মিথ্যে কথা শিখে গেছে। কিছু হলেই টোগোর ওপর সব দোষ চাপিয়ে দিয়ে নিজে বেঁচে যেতে চাও। বাবা শুনলে দেখো কি করে। এখন এসেই যখন পড়েছে, চলো। প্রজাপতির খামারে যাচ্ছি আমরা। এরপর যদি কোথাও যেতে চায় টোগো, ওকে একাই যেতে দেবে। গিয়ে মরুকগে। জ্বালিয়ে মারলো ওই ভেড়ার বাচ্চাটা!

না না, আর যেতে চাইবে না, বলতে বলতে বাচ্চাটাকে কোলে তুলে নিলো ল্যারি। আর নামতেই দেবো না। কিন্তু খানিক পরেই আবার নামিয়ে দিতে বাধ্য হলো। এই মুহূর্তে কোল পছন্দ না হওয়ায় এতো জোরে আচমকা চেঁচিয়ে উঠলো, চমকে গিয়ে লাফ দিয়ে উঠলো রাফি আর ডবি। এরপর থেকে না নামানো পর্যন্ত চেঁচিয়েই চললো বাচ্চাটা।

হুঁমম, ফিরে চেয়ে বললেন ডাউসন, ভালো দর্শক জোগাড় হয়েছে আজকে।

ককুর-ভেড়া দেখলে কি ভয় পায় আপনার প্রজাপতিরা? তাড় পাশে চলে গেল শারি। বলেন তো ওগুলোকে এখানেই রেখে যাই?

গাধার মতো কথা বলে, পেছন থেকে বললো তার ভাই। প্রজাপতির কি…। কথা শেষ না করেই হঠাৎ চিৎকার করে উঠলো জনি। হ্যাঁচকা টান মারলো ডাউসনের হাত ধরে। ওই যে, স্যার, একটা প্রজাপতি! ধরবেন না!

না, শান্তকণ্ঠে বললো ডাউসন। ওটা মিডো-ব্রাউন। অতি সাধারণ। কি ব্যাপার, ইস্কুলে কিছু শেখায় না নাকি? এরকম একটা প্রজাপতিও চিনতে পারো না।

না, শেখায় তো না, হেসে বললো জনি। আপনি আমাদের ইস্কুলের টীচার হলে খুব ভালো হতো। অনেক কিছু শিখতে পারতাম। তবে জেনারেল নলেজ বইতে দেখেছি অনেক রকম প্রজাপতির নাম। ক্যাবেজ বাটারফ্লাই, কলিফ্লাওয়ার মথ, রেড অ্যাডমিরাল,বু ক্যাপটেন, অসট্রিচ মথ…

তাকে থামিয়ে দিয়ে কিশোর জিজ্ঞেস করলো, মিস্টার ডাউসন, এখানে দুর্লভ প্রজাপতি আছে কিছু?

নিশ্চয়ই আছে, বললেন প্রজাপতি বিশেষজ্ঞ। আর সাধারণ প্রজাপতিও আছে প্রচুর। যতো খুশি ধরে নিয়ে গিয়ে বংশ বাড়াই। একটা প্রজাপতি মানেই শত শত ডিম। ডিম থেকে বাচ্চা ফুটিয়ে বিক্রি করি আমরা।

হঠাৎ একদিকে ছুটলেন তিনি। আরেকটু হলেই ধাক্কা দিয়ে ফেলে। দিয়েছিলেন জিনাকে। সরি! বললেন বটে, কিন্তু ফিরেও তাকালেন না তার দিকে। ওই যে একটা ব্রাউন অ্যারগাস। চমৎকার নমুনা। এ-বছর এই প্রথম দেখলাম। সরো, সরো তোমরা, সরে যাও। কথা বলবে না।

চুপ করে আছে ছেলেমেয়েরা। এমনকি জানোয়ারগুলোও নীরব। পা টিপে টিপে এগিয়ে যাচ্ছেন ডাউসন একটা গাছের দিকে। ফুলের ওপর বসা ছোট কালচে বাদামী রঙের একটা প্রজাপতির ওপর চোখ। কাছে গিয়ে হঠাৎ ওপর থেকে নিচের দিকে নামিয়ে আনলেন জালটা। ধরা পড়লো ব্রাউন অ্যারগাস। ডানা নেড়ে ফড়ফড় করতে থাকা প্রজাপতিটার পাখা দুআঙুলে টিপে ধরে সবাইকে দেখিয়ে বললেন, এটা মাদী প্রজাপতি। গরমের সময় সচরাচর যেসব নীল প্রজাপতি দেখো, এটা তাদেরই একটা প্রজাপতি। অনেক ডিম পাড়বে এই প্রজাপতিটা, অনেক ঝুঁয়াপোকার জন্ম দেবে, নাদুস-নুদুস পোকা…

নীল প্রজাপতি বললেন, আগ্রহী চোখে ব্রাউন অ্যারগাসের দিকে তাকিয়ে আছে রবিন। কিন্তু এটা তো নীল নয়। কালচে বাদামী। ডানায় কমলা রঙের ফোঁটা…

তাতে কি? রঙে কি এসে যায়? আমি বলছি এটা নীল প্রজাপতির বংশধর। কাঁধে ঝোলানো একটা টিনের বাক্সে প্রজাপতিটা ভরে রাখলেন ডাউসন। বোধহয় ওদিক থেকে এসেছে, তৃণভূমির দিক থেকে, হাত তুলে উপত্যকা দেখালেন তিনি।

মিস্টার ডাউসন, জরুরী গলায় বললো মুসা। সামনের ডানা কালচে সবুজ, তাতে লাল ফোঁটা। আর পেছনের ডানা লাল, তাতে সবুজ বর্ডার। জলদি আসুন। ধরতে পারলে লাভ হবে আপনার।

ওটা প্রজাপতি নয়, রবিন বললো।

ঠিকই বলেছো, প্রশংসার দৃষ্টিতে রবিনের দিকে তাকালেন ডাউসন। জাল তুললেন পতঙ্গটাকে ধরার জন্যে। এটা মথ। আটকে ফেললেন ওটাকে।

কিন্তু মথ তো দিনের বেলা ওড়ে না, তর্ক শুরু করলো মুসা। শুধু রাতে ওড়ে।

কিছু জানে না! ভারি লেন্সের ভেতর দিয়ে মুসার দিকে তাকালেন ডাউসন। আজকালকার ছেলেমেয়েগুলোর হলো কি? অথচ আমাদের সময়ে প্রতিটি ছেলেমেয়েই জানতাম কোনটা দিনের মথ, আর কোনটা রাতের।

কিন্তু, বলতে গিয়ে ডাউসনের কড়া চাহনির দিকে তাকিয়ে থেমে গেল মুসা।

এটার নাম সিক্স-স্পট বারনেট ডে-ফ্লাইং মথ, বাচ্চা ছেলেকে যেন বোঝাচ্ছেন, এমনিভাবে ধীরে, থেমে থেমে প্রতিটি শব্দ উচ্চারণ করলেন ডাউসন। রোদের মধ্যে উড়ে বেড়াতে খুব ভালোবাসে এরা। আর তর্ক করবে না আমার সঙ্গে। মূখ ছেলেকে ভালো লাগে না আমার।

মুসার কাঁচুমাচু মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেললো অন্যেরা। তবে অবশ্যই নীরবে, এবং ডাউসনের অলক্ষ্যে।

তবে তাদের দিকে চোখ নেই তার। মথটাকে বাক্সে ভরতে ব্যস্ত। বললেন, এরকম মথ আরও দরকার আমার। দেখলেই বলবে। মনে রেখো, এগুলো আরও বড় হয়। বড় দেখলেও বলবে।

ব্যস, আর কিছু বলতে হলো না। সবাই মথ খুঁজতে আরম্ভ করলো ঝোপেঝাড়ে। প্রজাপতি ধরা খুব ভালো লাগছে ওদের। রাফি আর ডবিও বেশ আগ্রহী। এখানে ওখানে ওকে বেড়াতে লাগলো। কিছুই না পেয়ে আবার আগের জায়গায় এসে জমায়েত হলো সকলে। তারপর আবার এগোনোর পালা।

এমনি করে পথে পথে থেমে, প্রজাপতি ধরে এগোতে অনেক সময় লাগলো। যতোটা লাগার কথা, তার চেয়ে অনেক বেশি সময় লাগিয়ে, অনেক দেরিতে এসে প্রজাপতির খামারে পৌঁছলো দলটা।

এই কাচের ঘরেই আপনার প্রজাপতি রাখেন? জানতে চাইলো কিশোর।

হ্যাঁ, মাথা ঝাঁকালেন ডাউসন। এসো। সব দেখাচ্ছি। কিভাবে কি করি আমি আর আমার বন্ধু ডরি। আজ অবশ্য ওর দেখা পাবে না, নেই এখানে।

জায়গাটা অদ্ভুত লাগলো দর্শকদের কাছে। কটেজটা দেখে মনে হয় যে কোনো সময় ধসে পড়তে পারে। দুটো জানালা ভাঙা, ছাতের কয়েকটা টালি গায়েব। কিন্তু কাঁচের ঘরগুলো বেশ সুন্দর, সুরক্ষিত অবস্থায় রাখা হয়েছে। প্রতিটি কাঁচ ঝকঝকে পরিষ্কার। নিজেদের চেয়ে প্রজাপতি আর মথের যত্ন অনেক বেশি নেন প্রজাপতি মানবেরা, বোঝা গেল।

এখানে কি শুধু আপনারা দুজনই থাকেন? জিজ্ঞেস করলো রবিন। এরকম একটা জায়গায় দুজন মানুষ কি করে থাকে ভাবতে অবাক লাগছে তার। একা লাগে না?

না, একা লাগবে কেন? রবিনের প্রশ্নটাই যেন অবাক করলো ডাউনকে। তাছাড়া মিসেস ডেনভার আছে, আমাদের কাজকর্ম করে দেয়। তার ছেলে এসে মেরামত-টেরামত কিছু লাগলে করে দেয়। প্রজাপতির ঘরগুলো পরিষ্কার রাখে। মিসেস ডেনভার কীট-পতঙ্গ একদম পছন্দ করে না, ঘরগুলোর কাছেই আসে না সে। কাজেই তার ছেলেকেই সব করতে হয়।

কটেজের জানালা দিয়ে উঁকি দিলো এক বৃদ্ধা। জিনার মনে হলো, বুড়ি তো নয়, রূপকথার বইয়ের পাতা থেকে নেমে আসা ডাইনী। ভুরু কুঁচকে তার দিকে তাকালো মুসা। ভূত আর ডাইনী-পেত্নীকে যে সে ভয় পায়, একথা জানা আছে জনির। হেসে বললো, ভয় নেই, মানুষই, ভূতপ্রেত নয়। মহিলা ভালো। আমাদের রাঁধুনী মেয়েটা প্রায়ই দুধ আর ডিম দিতে আসে এখানে। সে গিয়ে সব বলে। একটা দাঁতও নেই মহিলার। ফলে চেহারাটা ওরকম বিকট লাগে। ডাইনী মনে হয়।

তোমার ভূতের ভয়টা আর দূর করতে পারলে না, রবিন বললো মুসাকে। তোমরা ডাইনীর আলোচনা নিয়েই থাকো, আমি প্রজাপতি দেখতে গেলাম।

ছোট ছোট কাচের বাক্সের ভেতরে শত শত প্রজাপতি উড়ছে। কাঁচের ঘরের মধ্যে নানা রকম গাছ লাগিয়ে ঝোপঝাড় তৈরি করা হয়েছে, বাইরে যেরকম ঝোপে ঝাড়ে থাকে প্রজাপতি, ঠিক সেরকম পরিবেশ।

খাইছে! বলে উঠলো মুসা। কতো খুঁয়াপোকা দেখেছো? পাতা খেয়ে তো সব সাফ করে ফেললো।

হ্যাঁ, রাক্ষসের মতো খায় ওরা, ডাউসন বললেন।

অনেক ধরনের শুঁয়াপোকা দেখা গেল। কোনোেটা ভীষণ কুৎসিত, দেখলেই গায়ে কাঁটা দেয়, কোনোটা খুব সুন্দর, সারা শরীরে রঙের বাহার। যেমন, গাঢ় সবুজ পোকা, লাল আর হলুদ ফোঁটা। আরেক ধরনের আছে, বেশ বড়, সবুজের ওপর লাল আর কালো ডোরা, লেজের কাছে বাঁকা শিঙের মতো। দেখতে যেন বিকট, তেমনি সুন্দর।

প্রাইভেট-হক মথের য়াপোকা, ডাউসন জানালেন।

এর নাম প্রাইভেট-হক কেন? রবিন জিজ্ঞেস করলো ভয়ে ভয়ে। কিছু জানো না বলে যদি আবার গাল দিয়ে ওঠেন ডাউসন?

কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে হাসলেন প্রজাপতি মানব। বোধহয় তিনি মনে করেছেন, খুব বুদ্ধিমান ছেলেটা। কেন, হক মথ উড়তে দেখোনি কখনও? ও, দেখোনি। অদ্ভুত ভঙ্গিতে ওড়ে। অনেকটা ওই হকহক চেনো তো?

চিনি। বাজপাখি।

গুড। ওই বাজপাখির মতো।

কিন্তু প্রাইভেট কেন? একা একা থাকতে পছন্দ করে বুঝি?

ঠিক ধরেছো। বুদ্ধিমান ছেলে। তবে এখানে একা থাকার সুযোগ পায় না। অন্যদের সঙ্গে একসাথেই বেড়ে উঠতে হয়।

প্রজাপতির খামার দেখতে ভালোই লাগছে ওদের।

গুটি কেটে প্রজাপতি বেরিয়ে আসতে দেখে বিস্ময়ে চোখ কপালে উঠলো মুসার। আশ্চর্য! এ-কি যাদু নাকি!

আমার কাছেও অনেক সময় যাদুই মনে হয়, হেসে বললেন ডাউসন। ডিম থেকে কিলবিলে ওয়াপোকা বেরোনো, সেই পোকার গুটিতে আশ্রয় নেয়া, তারপর সেই শুটি কেটে ডানাওয়ালা চমৎকার রঙিন প্রজাপতি বেরিয়ে আসতে দেখলে অবাক না হয়ে উপায় নেই।

কিন্তু ভীষণ গরম এখানে, মিস্টার ডাউসন, একজিনিস আর বেশিক্ষণ দেখতে ভালো লাগছে না কিশোরের। ওদিকে বোধহয় কিছুটা ঠাণ্ডা হবে। ওদিকে গিয়ে বসি।

হ্যাঁ হ্যাঁ, যাও, বললেন ডাউসন। আমার কাজ আছে। দেখতে ইচ্ছে করলে আবার এসো।

ওখান থেকে সরে একটা ছায়ামতো জায়গায় চলে এলো ওরা। হঠাৎ পেছনে ভাঙা গলায় কথা বলে উঠলো কেউ, যাও, এখানে কি? চলে যাও।

গরগর করে উঠলো রাফি আর ডবি। পাই করে ঘুরলো সবাই। ডাইনীর মতো দেখতে মহিলাটা দাঁড়িয়ে আছে। মুখের ওপর এসে পড়েছে তার পাটের আঁশের মতো ফিনফিনে চুল।

কি ব্যাপার, মিসেস ডেনভার? দ্রকণ্ঠে বললো কিশোর। আমরা খামার দেখতে এসেছি। কিছু নষ্ট করব না।

করো আর না করো, সেটা ব্যাপার না, দাঁত নেই বলে সমস্ত কথা জড়িয়ে যাচ্ছে মহিলার, স্পষ্ট বোঝা যায় না। বাইরের কেউ আসুক এটা আমার ছেলে পছন্দ করে না।

কিন্তু এটা নিশ্চয় আপনার ছেলের জায়গা নয়, অবাক হয়েছে মুসা। মিস্টার ডাউসন আর তার বন্ধু…

তোমাদেরকে চলে যেতে বলা হয়েছে, চলে যাও, ব্যস, ওদের দিকে মুঠো তুলে ঝাঁকালো বৃদ্ধা। আমার ছেলে পছন্দ করে না।

এভাবে কথা বলা রাফিরও পছন্দ হলো না। বৃদ্ধার দিকে তাকিয়ে বেঁকিয়ে উঠলো সে। তার দিকে আঙুল তুলে গড়গড় করে কি সব বললো মহিলা, প্রায় কিছুই বোঝা গেল না। জিনার মনে হলো, মন্ত্র পড়লো বুড়ি! তাকে আরও অবাক করে দিয়ে ফাটা বেলুনের মতো চুপসে গেল রাফি, বসে পড়লো তার পায়ের কাছে।

রেগে উঠতে যাচ্ছিলো জিনা, তার হাত ধরে ইশারায় কথা বলতে নিষেধ করলো জনি। বৃদ্ধার দিকে ফিরে নরম গলায় বললো, আপনার ছেলেই তো থাকে না এখানে। কে এলো, না এলো, তাতে তার কি? আপনাকে এভাবে লোক তাড়াতে বলে গিয়েছে কেন?

চোখে পানি টলমল করতে লাগলো মহিলার। হাড়সব এক হাতের আঙুল আরেক হাতের আঙুলের খাঁজে ঢুকিয়ে চুপ করে রইলো এক মুহূর্ত। ধরা গলায় বললো, ওর কথা না শুনলে ও যে আমাকে মারে! হাত মুচড়ে দেয়! আমার ছেলে লোক ভালো না, খুব খারাপ। চলে যাও। তোমাদেরকে দেখলে রেগে যাবে। তোমাদেরও মারবে।

মহিলার কাছ থেকে সরে এলো ওরা।

জনি বললো, বুড়িটা পাগল। আমাদের রাধুনী বলে ওর ছেলে খারাপ নয়, অথচ বুড়ি বলে বেড়ায় খারাপ। মেরামতের কাজ খুব ভালো পারে তার ছেলে। মাঝে মাঝে আমাদের বাড়িতে আসে তো, দেখি। হাত আর বাড়িঘরের অন্যান্য মেরামতি কাজে ওস্তাদ। আমার মনে হয় বুড়ি বাড়িয়ে বলছে, তবে তার ছেলে খুব একটা ভালো লোকও নয়।

মিস্টার ডাউসনের বন্ধুটি কেমন? জিজ্ঞেস করলো কিশোর। ডরি, যাকে দেখলাম না।

জানি না। কখনও দেখিনি। বেশির ভাগ সময়ই বাইরে বাইরে থাকে। ব্যবসার দিকটা বোধহয় ও দেখে। এই ডিম, ভঁয়াপোকা, প্রজাপতি বিক্রির ব্যাপারটা।

খামারটা আরেকবার দেখতে ইচ্ছে করছে আমার, মুসা বললো। কিন্তু মিস্টার ডাউসন যেরকম করে তাকান, বুকের মধ্যে কাপ ধরে যায়। এতো কড়া চোখে চশমার কি দরকার? এমনিই তো দেখতে পারার কথা।

মাঝে মাঝে তুমি যে কি ছেলেমানুষের মতো কথা বলো না, হেসে বললো রবিন। চোখের কড়া দৃষ্টির সঙ্গে পাওয়ারের কি সম্পর্ক?

না, নেই। এমনি বললাম আরকি।

আমি আর যেতে চাই না ওখানে, জিনা বললো। বুড়িটা আস্ত ডাইনী। রাফিকে কিভাবে বশ করে ফেললো দেখলে?…তো এখন কোথায় যাবো?

ক্যাম্পে, কিশোর বললো। খিদে লেগেছে। জনি, তুমি আমাদের সাথে যাবে, না বাড়িতে কাজ আছে?

না, সব সেরে এসেছি। চলো যাই। তোমাদের সঙ্গে বসে খেতে ভালোই লাগবে।

ভাইয়া, আমিও যাবো, বায়না ধরলো ল্যারি। তার কোলে এখন চুপচাপ রয়েছে ভেড়ার বাচ্চাটা।

না, জনি বললো। মা চিন্তা করবে। তুমি বাড়ি ফিরে যাবে। চলো, আরেকটু এগিয়ে রাস্তা চিনিয়ে দেবো।

হ্যাঁ-না আর কিছু বললো না ল্যারি। মুখ গোমড়া করে রাখলো।

যাওয়ার সময় যতোটা সময় লেগেছিলো, ফিরতে লাগলো তার চেয়ে অনেক কম। জিনিসপত্র যেখানে যা রেখে গিয়েছিলো, ঠিক তেমনি রয়েছে। ভাঁড়ারের খাবারেও কেউ হাত দেয়নি।

হাসি-ঠাট্টার মাঝে খাওয়া শেষ করলো ওরা।

হাত-পা ছড়িয়ে চিত হয়ে শুয়ে পড়লো মুসা। বললো, সারাটা বিকেলই তো পড়ে আছে। এরপর কি করবো?

গোসল করতে পারলে ভালো হতো, জিনা বললো। যা গরম। বাড়িতে হলে তো এতোক্ষণে সাগরে থাকতাম।

গোসল করতে চাইলে অবশ্য এক জায়গায় নিয়ে যেতে পারি, জনি বললো। বড় একটা পুকুর আছে।

পুকুর? আগ্রহে লাফিয়ে উঠে বসলো মুসা। কোথায়?

ওই যে এয়ারফী দেখছো, হাত তুলে দেখালো জনি, ওখানে। এই ঝর্নার পানি কোথায় গিয়ে পড়েছে ভেবেছো একবারও? পাহাড়ের মোড় ঘুরে, উপত্যকা ধরে এগিয়ে গেছে, পথে ঘোট ঘোট খাড়ি তৈরি করেছে কয়েকটা। শেষে গিয়ে পড়েছে ওই পুকুরে। পুকুরটা প্রাকৃতিক, এই ঝর্নার পানি পড়ে পড়েই সৃষ্টি হয়েছে। কিনা কে জানে! খুব ঠাণ্ডা পানি। প্রায়ই গিয়ে ওখানে গোসল করি আমি।

শুনে তো ভালোই মনে হচ্ছে, কিশোর বললো। চলো না এখনই যাই।

এখন? রবিন বললো। এখন তো কাজই সারিনি। খাবারের বাক্স, টিন গোছাচ্ছে সে আর জিনা। ঠিকঠাক মতো নিয়ে গিয়ে আবার ভাঁড়ারে ভরে রাখছে।

অসুবিধে কি? আমরা যাই। তোমরা কাজ সেরে এসো।

ঠিক আছে, জিনা বললো, যাও।

এয়ারফীন্ডের দিকে রওনা হলো কিশোর, মুসা আর জনি। সকালে একটা বিমান দেখেছিলো, তারপর আর একটাও দেখা যায়নি। খুব নীরব এয়ারফীল্ড, ভাবলো কিশোর। সেকথা বললো জনিকে।

নীরব বলছো তো, জনি বললো হেসে। দাঁড়াও, আগে নতুন ফাইটারগুলোর পরীক্ষা শুরু হোক, তারপর বুঝবে। শব্দের জ্বালায় টেকা যাবে না। আমার খালাতো ভাই বলেছে শীঘ্রি পরীক্ষা শুরু হবে।

ফাইটার এনে পরীক্ষা করবে? মুসা বললো। তাহলে তো কাম সারা। কান ঝালাপালা করে দেবে। যা আওয়াজ।

তোমার খালাতো ভাই আছে যখন, কিশোর বললো, তাকে ধরে একদিন গিয়ে এয়ারফীন্ডটাও দেখে আসতে পারবো। পুরানো বিমান ঘাঁটি দেখার খুব শখ আমার।

আমারও, পেছন থেকে বলে উঠলো জিনা। কাজ সেরে চলে এসেছে।

এক জায়গায় এসে জনি বললো, এখান থেকে আমাদের বাড়ি বেশি দূরে না। গিয়ে সুইমস্যুট নিয়ে আসি। যাবো আর আসবো। এই ডবি, দৌড় দে।

আমরা কোন পথে যাবো? মুসা জিজ্ঞেস করলো।

সোজা চলে যাও। ওই যে দূরে বড় পাইন গাছটা দেখছে, জনি বললো, ওটার দিকে হাঁটো। আমি এই এলাম বলে।

ডবিকে নিয়ে দৌড় দিলো জনি। অন্যেরা ধীরে ধীরে এগিয়ে চললো পাইন গাছটার কাছে। বেশ ভালোই দৌড়ায় জনি, তাড়াতাড়িই ফিরে এলো কাঁধে সুইমস্যুট নিয়ে। জোরে জোরে হাঁপাচ্ছে।

পাইন গাছটার কাছে পৌঁছলো ওরা।

ওই যে দেখো, জনি বললো, পুকুর।

পানির রঙ দেখেই বোঝা গেল পুকুরটা গভীর। ঘন নীল, ঠাণ্ডা, কাঁচের মতো মসৃণ পানির উপরিভাগ। একপাড়ে ঘন গাছের সারি। একেবারে পানির কিনারে নেমে গেছে একধরনের ছোট জাতের উদ্ভিদ।

এগিয়ে গেল দলটা। হঠাৎ থমকে দাঁড়ালো গাছের গায়ে লাগানো একটা নোটিশ দেখে। লেখা রয়েছেঃ

কীপ আউট
ডেনজার
গভার্নমেন্ট প্রোপার্টি

সরে থাকতে বলছে। বিপদ! সরকারি জায়গা! অবাক হয়ে বললো মুসা। এর মানে কি?

দূর, হাত নাড়লো জনি। ওই নোটিশকে পাত্তা দিও না। ও কিছু না।

কি বলো? কথাটা ধরলো কিশোর, কিছু না-ই যদি হবে, তাহলে লিখেছে কেন?

ওরকম নোটিশ এই এয়ারফীন্ডের আশেপাশে অনেক দেখতে পাবে, হালকা গলায় বললো জনি। বিপদ আছে বলে হুঁশিয়ার করে দিয়ে সরে থাকতে বলেছে। কিন্তু আজ পর্যন্ত একটা বিপদও দেখিনি আমি। শুধু প্লেন আছে, কামান-বন্দুকবোমা কিছু নেই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর নাকি অনেক এয়ারফীন্ডের পাশে মাইন পড়ে থাকতে দেখা গেছে, এখানে তা-ও দেখিনি।

তাহলে নোটিশ লিখেছে কেন? মুসাও ধরলো। তোমার খালাতো ভাইকে জিজ্ঞেস করলেই পারো। লিখেছে যখন, নিশ্চয় কোনো কারণ আছে।

বললাম তো, নেই, জোর দিয়ে বললো জনি। জন্মের পর থেকেই ওই নোটিশ দেখে আসছি। একসময় হয়তো লাগিয়েছিলো কোনো কারণে, এখন সেই কারণটা আর নেই। এখানে এসে গোসল করি, যা খুশি করি আমরা। কেউ কিছু বলে না।

বেশ মেনে নিলাম তোমার কথা, বললো বটে কিশোর, কিন্তু মানতে যে পারেনি সেটা তার স্বরই জানিয়ে দিলো। এখানে নোটিশ লাগানোর কোনো কারণ অবশ্য আমিও দেখছি না। কাঁটাতার নেই, বেড়া নেই, কিছুই নেই। শুধু নোটিশ লিখে রাখলেই কি আর লোকে মানবে?

ওসব কথা বাদ দিয়ে এখন এসো, পানিতে নামি।

সুইমস্যুট পরে ডাইভ দিয়ে পানিতে পড়লো ওরা। যতটা ভেবেছিলো, তার চেয়ে গভীর। চমৎকার ঠাণ্ডা, এই গরমে বেশ আরামদায়ক। কুকুরদুটোও তীরে থাকলো না, ঝাঁপিয়ে পড়লো পানিতে। মজা পেয়ে দাপাদাপি করতে লাগলো। রাফি তো উত্তেজনায় চেঁচাতেই শুরু করলো।

এই রাফি, চুপ! ধমক দিলো জনি।

কেন, চুপ করবে কেন? কিছুটা অবাক হয়েই জিজ্ঞেস করলো জিনা।

এয়ারফীন্ডে কেউ থাকলে শুনতে পাবে।

শুনুক না, অসুবিধে কি? তুমি তো বললে নোটিশ এমনি এমনিই লিখেছে।

আর কিছু বললো না জনি।

রাফির দেখাদেখি কিছুক্ষণ পর ডবিও চেঁচাতে শুরু করলো। আবার ধমক লাগালো জনি, এই ডবি, চুপ করলি। মারবো কষে এক থাপ্পড়!

কিন্তু ডবি চুপ করার আগেই ঘটে গেল আরেক ঘটনা। ধমক দিলো একটা কণ্ঠ, উঁচু গলায় কথা বলা স্বভাব লোকটার, এই, হচ্ছে কি! সরকারি এলাকায় অন্যায় ভাবে ঢুকেছে। নোটিশ দেখোনি?

চিৎকার থামিয়ে দিলো কুকুর দুটো। কে কথা বলে দেখার জন্যে ঘুরে তাকালো সবাই।

এয়ারফোর্সের ইউনিফর্ম পরা একজন লোক, বিশালদেহী, মোটা, লাল মুখ।

কি হয়েছে? লোকটার দিকে সঁতরে এগোলো কিশোর। আমরা গোসল করছি। কোনো ক্ষতি করছি না।

নোটিশ দেখোনি? গাহের দিকে হাত তুললে লোকটা।

দেখেছি। কিন্তু এখানে তো কোনো বিপদ দেখছি না, নিজেকে লাথি মারতে ইচ্ছে করলো কিশোরের, নোটিশ দেখেও জনির কথা বিশ্বাস করেছে বলে।

উঠে এসো! গর্জে উঠলো লোকটা। সব্বাই।

ধীরে ধীরে পানি থেকে উঠে এলো সবাই। কুকুর দুটো উঠে গা ঝাড়া দিয়ে তাকালো লোকটার দিকে।

এই কুত্তাদুটোকেই ঘেউ ঘেউ করতে শুনেছি তাহলে? তোমরা তো ছোট নও, নোটিশ বোঝার বয়েস হয়েছে। তারপরেও অমান্য করলে কেন? উপদেশ দিতে আরম্ভ করলো লোকটা, যা সব চেয়ে বেশি ঘৃণা করে কিশোর। চেঁচামেচি শুনে ভাবলাম, কেউ হয়তো বিপদে পড়েছে। তাই দেখতে এসেছি।

এখন তো দেখলেন পড়িনি, মুখ কালো করে বললো জনি।

পড়নি, কিন্তু পড়তে পারতে। এই ছেলে, তোমাকে আগেও দেখেছি মনে হয়? তুমি আর ওই কুত্তাটাকে? হ্যাঁ, মনে পড়েছে। হ্যাঙারের ওধার থেকে বেরিয়ে নিষিদ্ধ এলাকা দিয়ে চলেছিলে।

হ্যাঁ, গিয়েছিলাম, আমার খালাতো ভাই ফাইট-লেফটেন্যান্ট জ্যাক ম্যানরের সঙ্গে দেখা করতে, কিছুটা ঝাঁঝের সঙ্গেই বললো জনি। সেটা কি দোষের নাকি? সেদিনও বলেছি, আজও বলছি, শাইং করতে যাইনি। আর করার আছেই বা কি ওখানে? আমি শুধু আমার ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে গেছিলাম।

বেশ, আমিও দেখা করবো তার সাথে। দেখা করে বলবো, ভালোমতো ধোলাই দেয় যেন তোমাকে। বড় বেশি ফড়ফড় করো! চোখের মাথা খেয়েছো নাকি? চারদিকে নোটিশ ছড়িয়ে আছে দেখোনি?

তারমানে কি তলে তলে জরুরী কিছু ঘটছে? ফস করে জিজ্ঞেস করে বসলো জনি।

ঘটলে যেন বলবো তোমাকে! বিরক্ত কণ্ঠে বললো লোকটা। এখানে বিপদের কিছু নেই আমিও জানি। ঝর্নার পানি এসে জমা হয় এই পুকুরে, মাছটাছও জিয়ানো নেই যে নষ্ট হবে। তাছাড়া লোকে এখানে পিকনিক করতে এসে জায়গাটাকে সরগরম করে তুললে ভালোই লাগতো, যা নীরব হয়ে থাকে! কিন্তু সেটা করতে দিতে পারি না। আমার ওপর আদেশ রয়েছে কাউকে যেন ঢুকতে না দেয়া হয়।

লোকটা ঠিকই বলছে, ভাবলো কিশোর। জনি তর্ক করছে অযথা। নোটিশ অমান্য করে ওরাই বেআইনী কাজ করেছে। উচিত হয়নি। বললো, দেখুন, আমরা সত্যি অন্যায় করেছি। গরম লাগছিলো তো, ঠাণ্ডা পানির কথা শুনে লোভ সামলাতে পারিনি। গোসল করতে চলে এসেছি। ঠিক আছে, আর আসবো না।

কিশোরের দিকে প্রশংসার দৃষ্টিতে তাকালো বিমান বাহিনীর গার্ড। হাসি ফুটলো মুখে। বুদ্ধিমান ছেলে। এই গরমের দিনে তোমাদের গোসলটা নষ্ট করলাম বলে খারাপই লাগছে আমার। ওই ছেলেটার মাথায় গোলমাল আছে, জনির দিকে হাত তুললো সে। বেশি গোঁয়ার। এতোই যদি গোসলের শখ ছিলো, তোমার ভাইয়ের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে এলে না কেন? তাহলেই তো আমি আর কিছু বলতাম না। আমার জানা থাকতো, এই সময়ে কুকুরের চিৎকার শোনা যাবে, কিছু হৈ-হট্টগোল শুনতে পাবো। দেখতে আসতাম না।

থাক, কিছু মনে করবেন না, কিশোর বললো। আর আসব না। তাছাড়া এখানে থাকছিও না আমরা, যে জ্বালাতে আসবো। মাত্র কয়েকটা দিন, বেড়াতে এসেছি।

সো লং জানিয়ে, অনেকটা স্যালুটের ভঙ্গিতে হাত তুলে, মার্চ করে চলে গেল লোকটা।

ও ব্যাটা এখানে মরতে এলো কেন? এখনও মেনে নিতে পারছে না জনি। আমাদের গোসলটা নষ্ট করলো! গোপন কোনো ব্যাপার যদি না-ই থাকে…।

আই, চুপ করো! ওকে থামিয়ে দিলো মুসা। কিশোরের মতো সে-ও খুব লজ্জা পেয়েছে। দোষ তো ওদেরই। নোটিশ দেখার পরেও নামলো কেন পানিতে? ও কি বলে গেল শুনলে না? ওর ওপর আদেশ রয়েছে। আমাদের মতো তো আর ইস্কুলের ছাত্র নয় যে অফিসিয়াল আদেশকেও কিছু না বলে উড়িয়ে দেবে। সরকারি চাকরি করে। ইউনিফর্মের একটা দাম তো আছে।

যা, মাথা ঝাঁকালো কিশোর। আর কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। গা মুছে চলো এখন তোমাদের বাড়িতে। তোমার মার কাছ থেকে কিছু খাবার চেয়ে নেবো। সাঁতার কেটে সব হজম হয়ে গেছে। পরিস্থিতি সহজ করার জন্যে হাসলো সে।

কিন্তু হাসি ফোঁটানো গেল না জনির মুখে। একে তো লোকটার ব্যবহার ভালো লাগেনি, তার ওপর বন্ধুদের কাছে লজ্জা পেয়েছে। বড়মুখ করে এনেছিলো। রাগে, ক্ষোভে এখন মাথার চুল ছিড়তে ইচ্ছে করছে।

গা মুছে কাপড় বদলাতে বদলাতে জিজ্ঞেস করলো, আমার ভাইয়ের কাছ থেকে অনুমতি যদি নিই, আবার আসবে তো?

না, বললো কিশোর। তবে তার সাথে দেখা করতে পারলে খুশি হবো।

হুঁ! আবার চুপ হয়ে গেল জনি।

বাড়ির কাছাকাছি আসতে দেখা গেল, ভেড়ার বাচ্চা কোলে নিয়ে প্রায় ছুটে আসছে ল্যারি।

ওই যে আসছে, হেসে বললো জিনা। ছড়াকার ভুল করেছেন। ওকে নিয়েই বরং ছড়াটা লিখে ফেলা উচিত ছিলোঃ ল্যারি হ্যাড আ লিটল ল্যাম্ব…

হেসে উঠলো সবাই।

ছড়াটা আমিও জানি, হেসে বললো ল্যারি। ম্যারি হ্যাড আ লিটল ল্যাম্ব, ওটা তো? সুর করে দুলে দুলে ছড়া বলতে আরম্ভ করলো সে।

বাড়ি থেকে আবার বেরিয়েছো? জনি বললো।

বা-রে। মা-ই তো তোমাদের ডাকতে বললো। চায়ের সময় হয়েছে…

মোটেও ডাকতে পাঠায়নি মা। তুমি নিজেই এসেছে, মা জানে না…

না এসে কি করবো? টোখোটা পালালো। ওকে খুঁজতে খুঁজতেই না…

আমাদের কাছে চলে এসেছো? হেসে ফেললো রবিন।

আমাদের কি দোষ? বড় বড় মায়াবী চোখ মেলে রবিনের দিকে তাকালো ল্যারি। মা বললো চা হয়েছে। ভাবলাম বুঝি তোমাদের ডাকতে বলছে, তাই…

চলে এসেছে, এই তো? খুব ভালো করেছো, আদর করে তার গাল টিপে দিলো জিনা।

খুশি হয়ে উঠলো আবার ল্যারি। ভেড়ার বাচ্চাটাকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো, ওকে আদর করলে না? ও মন খারাপ করবে তো।

হাসতে বাচ্চাটার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো জিনা। বললো, জনি, তুমি খুব ভাগ্যবান। ইস, আমার যদি এমন একটা ভাই থাকতো!

হাসি ফুটলো জনির মুখে। খানিক আগের গোমড়া ভাবটা কেটে গেল। ল্যারির হাত ধরলো, চল, বাড়ি চল।

হাঁটতে হাঁটতে মুসা ঠাট্টা করলো, ল্যারি, তোমার বাচ্চাটা খালি পালায়, ওকে বেঁধে রাখতে পারো না?

সঙ্গে সঙ্গে জবাব এলো, রাখতাম তো। কিন্তু ও যে খুব কাঁদে। মা নেই তো, তাই।

একেবারে চুপ হয়ে গেল মুসা।

জানালা দিয়ে দলটাকে আসতে দেখে বেরিয়ে এলেন মা। এসেছো। ভালো করেছে। মেহমান এসেছে বাড়িতে। ভাবলাম, তোমরা এলে দেখা হতো। আলাপ করতে পারতে।

কে এসেছে, মা? ভুরু কোঁচকালো জনি।

জ্যাক।

জ্যাক ভাইয়া! এসেছে! খুব ভালো হয়েছে…!

কথা শুনে বেরিয়ে এলো এক সুদর্শন তরুণ। লম্বা। হাসি হাসি মুখ। দেখেই তাকে ভালো লেগে গেল তিন গোয়েন্দা আর জিনার।

হাল্লো! হেসে বললো জ্যাক। তোমাদের কথা খালার কাছে শুনলাম। দেখা হয়ে ভালো হলো। হাত মেলাতে এগিয়ে এলো সে।

এক এক করে তিন গোয়েন্দা আর জিনা হাত মেলালো। এগিয়ে এলো রাফিয়ান। জ্যাকের সামনে বসে একটা পা উঁচু করে দিলো। আরি, কুকুরটা কি করছে! অবাক হয়ে বললো সে।

হাত মেলাতে বলছে, হেসে বললো জিনা। আপনাকে পছন্দ হয়ে গেছে ওর।

খেতে খেতে অনেক কথাই হলো।

শেষে বিদায় নিয়ে যাওয়ার জন্যে উঠলো জ্যাক। তাকে গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিলো ছেলেমেয়েরা। টোগোকে নিয়ে ল্যারিও এলো তাদের সঙ্গে।

লম্বা লম্বা পায়ে পাহাড়ের মোড়ে হারিয়ে না যাওয়া পর্যন্ত গেটের কাছে দাঁড়িয়ে রইলো ওরা। তারপর আবার ফিরে এলো বাড়িতে।

ডিম, দুধ, রুটি, মাখন আর পনির ঝুড়িতে ভরে দিলেন মা। সেগুলো নিয়ে, তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে আবার ক্যাম্পে ফিরে চললো তিন গোয়েন্দা আর জিনা।

জনি রয়ে গেল খামারে, তার কাজ আছে। পরদিন আবার যাবে ক্যাম্পে, বলে দিলো সে।

ঢাল বেয়ে উঠছে ওরা। আগে আগে চলেছে রাফি। এই সময় কোথা থেকে যেন উড়ে এসে ফুলের ওপর বসলো বড় একটা প্রজাপতি। এরকম প্রজাপতি আর কখনও দেখেনি ওরা।

খাইছে! কতোবড়! বলে উঠলো মুসা। কি প্রজাপতি?

মাথা নাড়লো রবিন। বলতে পারবো না। কিশোর, তুমি জানো?

নাহ, কিশোর বললো। চেহারা-সুরতে তো দুর্লভ জিনিস বলেই মনে হচ্ছে। ধরে নিয়ে যাবো নাকি ডাউসনের কাছে?

কিশোরের কথা শেষ হতে না হতেই পা টিপে টিপে এগিয়ে গেল জিনা। হাত বাড়ালো প্রজাপতিটাকে ধরার জন্যে। শেষ মুহূর্তে উড়ে গেল ওটা। গিয়ে বসলো কাছেই আরেকটা ফুলে। আবার এগোলো জিনা। শেষ মুহূর্তে আবার উড়লো প্রজাপতি। গিয়ে বসলো আরেক ফলে।

রোখ চেপে গেল জিনার। ধরবেই ওটাকে। প্রজাপতিটাও চালাক। কিছুতেই ধরা পড়তে চাইলো না। গেলও না এলাকা ছেড়ে।

দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মজা দেখছে তিন গোয়েন্দা। কৌতূহলী চোখে তাকিয়ে আছে রাফিয়ান।জিনাকে সাহায্য করতে এগোবে কিনা ভাবছে বোধহয়।

শেষ পর্যন্ত অবশ্য ধরা পড়তে হলো প্রজাপতিটাকে। সাবধানে ওটার দুই পাখা টিপে ধরে রেখে জিনা বললো, একটা পনিরের টিন খালি করে ফেলো, জলদি!

তাড়াতাড়ি টিনের পনির বের করে, একটা প্যাকেটের কাগজ ছিঁড়ে মুড়ে রাখলো রবিন। টিনটা দিলো জিনাকে। সাবধানে ওটার মধ্যে প্রজাপতিটাকে ভরলো জিনা। চেপে রাখা নিঃশ্বাসটা ফোঁস করে ছেড়ে বললো, থাকো এবার আরামসে! বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে বললো, আমি শিওর, এটা দেখে খুব অবাক হবেন মিটার ডাউসন।

তখন না বললে আর যাবে না ওখানে? মুসা বললো। ডাইনী বুড়িটা আছে…

থাকুক। তবুও যাবো।

তোমার কখন যে কি মনে হয়, হাসতে হাসতে বললো কিশোর, ঠিকঠিকানা নেই।

কি বলছো, কিশোর? এতোবড় একটা প্রজাপতি ধরলাম। দুর্লভ কিনা, কি নাম, জানতে ইচ্ছে করছে না তোমার?

করছে। তবে তার চেয়েও বেশি ইচ্ছে করছে ডরি আর বুড়ির ছেলের সঙ্গে দেখা করতে। প্রজাপতিটা না ধরলেও ওদের সঙ্গে দেখা করতে যেতামই একবার।

ঝট করে কিশোরের দিকে তাকালো রবিন। তোমার কথায় রহস্যের গন্ধ পাচ্ছি! কি ব্যাপার, কিশোর?

নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটলো একবার গোয়েন্দাপ্রধান। এখনও জানি না। তবে এখানে আসার পর থেকেই কতগুলো ব্যাপার বেশ অবাক করেছে আমাকে। তদন্ত করে দেখা দরকার।

নিজে থেকে কিছু না বললে হাজার চাপাচাপি করেও কিশোরের মুখ থেকে কোনো কথা আদায় করা যাবে না, একথা জানা আছে তিনজনেরই। কাজেই আপাতত আর কোনো প্রশ্ন করলো না। সময় হলে আপনা থেকেই সব বলবে কিশোর।

কাঁচের ঘরগুলোর কাছে মিস্টার ডাউসনের দেখা মিললো না, নেই তিনি ওখানে।

বোধহয় কটেজে, কিশোর বললো। ডেকে দেখি।

কটেজের কাছে এসে ডাক দিলো সে, মিস্টার ডাউসন। মিস্টার ডাউসন!

সাড়া দিলেন না প্রজাপতি মানব, বেরিয়ে এলেন না। তবে দোতলার একটা জানালার পর্দা ফাঁক হলো, উঁকি দিলো কেউ। সেদিকে হাত নেড়ে আবার ডাউসনের নাম ধরে ডাকলো কিশোর।

মুসা বললো, মিস্টার ডাউসন, আপনার জন্যে একটা দুর্লভ প্রজাপতি নিয়ে এসেছি।

জানালা খুলে গেল। বেরিয়ে এলো মিসেস ডেনভারের মুখ। জিনার মনে হলো, একেবারে কার্টুন ছবির ডাইনী, কোনো ভুল নেই।

মিস্টার ডাউসন নেই, জবাব দিলো মিসেস ডেনভার।

তার বন্ধু মিস্টার ডরি কোথায়? জিজ্ঞেস করলো কিশোর। তিনি আছেন?

ওদের দিকে তাকিয়ে কি বললো মহিলা, বোঝা গেল না। জানালার ভেতরে ঢুকে গেল আবার তার মুখ।

অবাক হয়ে কিশোরের দিকে তাকালো মুসা। এরকম করলো কেন? হ্যাঁচকা টান দিয়ে কেউ সরিয়ে নিলো বলে মনে হলো না?

ঘরে তার ছেলেটা নেই তো? নিজেকেই যেন প্রশ্ন করলো রবিন।

কি জানি! গাল চুলকালো কিশোর। চলো, আশপাশটা ঘুরে দেখি ডাউসনকে পেয়েও যেতে পারি।

কটেজের একটা কোণ ঘুরে উঁকি দিতে একটা ছাউনি চোখে পড়লো। কেউ নেই। ঠিক ওই সময় পেছনে পদশব্দ শুনে ফিরে তাকালো ওরা। একজন লোক আসছে তাদের দিকে। খাটো, রোগাটে, লম্বা মুখ, নাকটা বাঁকা। চোখে কালো চশমা। হাতে একটা প্রজাপতি ধরার জাল। বললো, মিস্টার ডাউসন তো নেই। কি চাও তোমরা?

আপনি নিশ্চয় মিস্টার ডরি, কিশোর বললো। আমরা একটা দুর্লভ প্রজাপতি ধরে এনেছি। মিস্টার ডাউসনকে দেখাতে।

দেখি? হাত বাড়ালো ডরি।

টিনটা দিলো জিনা। সাবধানে টিনের ঢাকনা খুলে সামান্য ফাঁক করলো ডরি, যাতে প্রজাপতিটা উড়ে যেতে না পারে।

কালো কাঁচের ভেতর দিয়ে দেখতে দেখতে মাথা ঝাঁকালো ডরি। হুঁ, ভালো। এক ডলার দিতে পারি।

এক পয়সাও দিতে হবে না, এমনিই নিন, জিনা বললো। শুধু বলুন, এটার নাম কি? কি জাতের?

কোনো ধরনের ফ্রিটিল্যারি? রবিন জিজ্ঞেস করলো।

হতে পারে, বলে, পকেট থেকে একটা ডলার বের করে তাড়াতাড়ি তার হাতে গুঁজে দিলো লোকটা। এই নাও। প্রজাপতি পেয়ে খুশি হলাম। মিস্টার ডাউসন এলে বলবো।

আর কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে আচমকা ঘুরে দাঁড়ালো সে। এক হাতে টিন, আরেক হাতে জাল নিয়ে দ্রুত হাঁটতে শুরু করলো।

অবাক হয়ে হাতের টাকাটার দিকে তাকালো একবার রবিন। তারপর আবার তাকালো লোকটার দিকে।

ডরি চলে গেলে মুসা বললো, আজব লোক! এই লোকের সঙ্গে বনিবনা হয় কিভাবে মিস্টার ডাউসনের? টাকাটা কি করবে? এটা দরকার নেই আমাদের।

মিসেস ডেনভারকে দিয়ে দেবো, চিন্তিত ভঙ্গিতে বললো কিশোর। তার দরকার। ছেলে তাকে একটা পয়সাও দেয় বলে মনে হয় না।

আবার কটেজের সামনে এসে দাঁড়ালো ওরা। আশা করেছিলো মিসেস ডেনভারকে দেখতে পাবে। কিন্তু পেলো না। একমুহূর্ত দ্বিধা করে সামনের দরজায় গিয়ে টোকা দিলো রবিন।

দরজা খুলে গেল। বিড়বিড় করে কি বললো মহিলা, বোঝা গেল না। তারপর বললো, তোমরা চলে যাও। আমার ছেলে এসে দেখলে তোমাদের তো গালমন্দ করবেই, আমাকেও মারবে। চলে যাও তোমরা।

যাচ্ছি। এই নিন, বলে টাকাটা মহিলার হাতে গুঁজে দিলো রবিন।

হাতের তালুতে ডলারটা দেখে বিশ্বাসই করতে পারলো না মিসেস ডেনভার। তারপর হঠাৎ যেন সংবিৎ ফিরে পেয়ে তাড়াতাড়ি ছেড়া জুতোর ভেতরে ওটা লুকিয়ে ফেললো। আবার যখন সোজা হলো, দেখা গেল তার চোখে পানি টলমল করছে। তোমরা খুব ভালো! সে-জনন্যই বলছি, চলে যাও। আমার ছেলেটা মানুষ না! তোমাদেরকেও মেরে বসতে পারে। চলে যাও, প্লীজ!

নীরবে ওখান থেকে সরে এলো ওরা।

আজব এক জায়গা! হাঁটতে হাঁটতে বললো কিশোর। দুজন প্রজাপতি মানব, একসাথে থাকে, অথচ আচার ব্যবহারে একজনের সঙ্গে আরেকজনের আকাশ-পাতাল তফাৎ। একজন মহিলা, তার ব্যবহার আরও অদ্ভুত। ছেলের কথা যা শুনি, ওটা নিশ্চয় আরেক পাগল! বুঝতে পারছি, আবার আসতে হবে এখানে।

তারমানে রহস্যের ভূত ঘাড়ে চেপেছে তোমার, হেসে বললো মুসা।

কেন, তোমার কাছে রহস্যময় লাগছে না?

লাগছে।

আমি অবাক হচ্ছি, রবিন বললো, ডরি প্রজাপতিটা চিনতে পারলো না দেখে। প্রজাপতির ব্যবসা করে, অথচ…কি জানি, হয়তো খালি বেচাকেনা নিয়েই থাকে লোকটা। কোনটা কোন প্রজাপতি তার ধার ধারে না।

কিন্তু বেচাকেনা করতে গেলে জিনিস চিনতে হয় না? জিনা প্রশ্ন তুললো। লোকে যখন বলে এই জাতের প্রজাপতি দিন, ওই জাতের শুঁয়াপোকা দিন, না চিনলে কি করে দেয়?

তা-ও কথা ঠিক, মাথা দোলালো রবিন। নাহ, পুরো ব্যাপারটাই রহস্যময়!

ক্যাম্পে ফিরে এলো ওরা। এসেই সোজা ভাঁড়ারের দিকে রওনা হলো রাফিয়ান। হাত নেড়ে রবিন বললো, না না, রাফি, যাসনে। খাবার সময় হয়নি এখনও।

এখন কি করবো? শুয়ে পড়েছে মুসা। সুন্দর বিকেল।

তা ঠিক। কিন্তু রাতে আর সুন্দর থাকবে বলে মনে হয় না, কিশোর বললো পশ্চিম আকাশের দিকে তাকিয়ে। মেঘ জমছে। মনে হচ্ছে বৃষ্টি আসবে।

আমারও মনে হয়, জিনা বললো। সাগরের তীরে বাড়ি। কখন বৃষ্টি আসে না আসে মোটামুটি আঁচ করতে পারে। দূর! আর একটা হপ্তা অপেক্ষা করতে পারলো

আকাশ! এখন বৃষ্টি এলে উপায় আছে? সারাদিন তাবুতে বসে থাকতে হবে। ক্যাম্পিঙের আর কোনো মানে হবে না।

যখন আসে আসবে, রবিন বললো। এখন ওসব ভেবে লাভ নেই। বৃষ্টি এলে বসে থাকবো কেন? গুহাগুলো দেখতে চলে যাবো। এখন এসো, মিউজিক শুনি। আবহাওয়ার খবর খারাপ হলে তা-ও জানতে পারবো।

বেশ, চলো তাহলে মিউজিকই শুনি, জিনা বললো। আজ বিকেলে কোনো এক সময়ে প্যাসট্রোল সিমফনি বাজানোর কথা। ঘোষণা শুনেছি, তবে সময়টা ঠিক মনে নেই। এখানে, এই পাহাড়ী গাঁয়ে, ওই মিউজিক শুনতে দারুণ লাগবে। তবে অবশ্যই ভলিউম কমিয়ে শুনতে হবে। জোরে শুনতে ভালো লাগে না ওই বাজনা।

বাবারে, একেবারে কবি হয়ে যাচ্ছে দেখি আমাদের জিনা বেগম, হেসে ঠাট্টা করলো মুসা।

পানি-নিরোধক খাপ থেকে রেডিওটা বের করলো কিশোর। সুইচ টিপে স্টেশন টিউন করতেই শোনা গেল মোটা কণ্ঠ, সংবাদ এখনকার মতো শেষ হলো। ধন্যবাদ।

আহহা, শেষ হয়ে গেল, বললো কিশোর। আবহাওয়ার খবরটা শোনা উচিত ছিলো। যাকগে, পরের বার শুনবো।

শোনা গেল ঘোষকের গলা। হ্যাঁ, জিনা ঠিকই বলেছে, প্যাসট্রোল সিমফনিই শোনানো হবে। নরম, হালকা লয়ে শুরু হলো বাজনা। ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়তে লাগলো যেন পাহাড়ী প্রকৃতি জুড়ে। যেন এই পরিবেশে শোনার জন্যেই সৃষ্টি হয়েছে ওই মিউজিক। রেডিওটা সামনে রেখে আরাম করে জাঁকিয়ে বসলো চারজনে। কারো মুখে কথা নেই। তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে পশ্চিম আকাশে অপরূপ রঙের খেলা। ধীরে ধীরে দিগন্তে নামছে সূর্য।

ওদিকে একই দিগন্তের কোল থেকে উঠে আসছে মেঘের স্তর। সূর্যটা হারিয়ে গেল তার ওপাশে। মন খারাপ হয়ে গেল ওদের।

ঠিক এই সময়, বাজনা ছাপিয়ে সোনা গেল আরেকটা শব্দ। বিমান।

এতো আচমকা আর এতো জোরে হলো শব্দটা, চমকে গেল শ্রোতারা। ঘেউ ঘেউ শুরু করলো রাফিয়ান।

কোথায় ওটা? দেখতে না পেয়ে অবাক হয়েছে মুসা। কাছেই মনে হচ্ছে,

অথচ দেখছি না! জনির ভাই জ্যাক ওড়াচ্ছে না তো?

ওই যে, কিশোর হাত তুললো।

পাহাড় পেরিয়ে উড়ে আসতে দেখা গেল হোট বিমানটাকে। ওদের মাথার ওপর একবার চক্কর দিয়ে চলে গেল এয়ারফীন্ডের দিকে।

ছন্দপতন ঘটালো এই বিকট আওয়াজ। বাজনা শুনতে আর ভালো লাগলো না ওদের।

রাতের খাওয়ার জন্যে তৈরি হতে লাগলো ওরা। রবিন আর জিনা গিয়ে খাবার নিয়ে এলো ভাঁড়ার থেকে। রাফিয়ান গেছে সাথে, যদি কোনো সাহায্য করতে পারে এই আশায়। কিন্তু মুখে ঝুলিয়ে আনার মতো কিছু না থাকায় খালিমুখেই ফিরতে হয়েছে তাকে।

খেতে বসে বার বার অস্বস্তিভরে পশ্চিম আকাশের দিকে তাকাতে লাগলো কিশোর। নাহ, বৃষ্টিটা বোধহয় আসবেই। দেখো, ইতিমধ্যেই অর্ধেক আকাশ ছেয়ে ফেলেছে মেযে। সূর্য তো সেই যে ঢুকেছে মেঘের মধ্যে, আর বেরোচ্ছে না। মনে হয় আজ তাঁবু খাটাতেই হবে।

হ্যাঁ, একমত হয়ে মাথা দোলালো জিনা।

করলে তাড়াতাড়ি করতে হবে, মুসা বললো। বাতাস ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। রাতে আজ শীতই লাগবে।

চলো, তাড়াতাড়ি খেয়ে উঠে ঝোপের ভেতর থেকে বের করে ফেলি, রবিন বললো। চারজনে হাত লাগালে বেশিক্ষণ লাগবে না তাবু খাটাতে।

সত্যিই তাই। এক ঘণ্টাও লাগলো না। বিশাল ঝোপের ধারে খাঁটিয়ে ফেলা হলো তাঁবু।

ভালোই খাঁটিয়েছি, কি বললো, তাঁবু দেখতে দেখতে নিজেদের তারি করলো মুসা। সাধারণ বাতাস তো দুরের কথা, হারিকেন এলেও উড়িয়ে নিতে পারবে না। আরামেই থাকবো ভেতরে। এখন বিছানা করে ফেলা দরকার। কম্বল আজ গায়ে দিতে হবে, কাজেই বিছানো চলবে না। বড় আর পাতা দিয়েই বিছানা করতে হবে।

কাছেই গমের খেতের ফসল সবে কাটা হয়েছে। সেখান থেকে খড় তুলে আনলো ওরা। ঝোপের অভাব নেই, পাতারও অভাব হলো না। প্রচুর পাতা জোগাড় করে আনা হলো। সেসব বিছিয়ে তৈরি করে ফেলা হলো চমৎকার পুরু আর নরম গদির মতো বিছানা। তার ওপর যার যার অ্যানারাক বিছিয়ে দিয়ে চাঁদরের কাজ সারলো।

কাজ সেরে বাইরে এসে আরেকবার তাকালো আকাশের দিকে। নাহ, বৃষ্টি আসবেই, আর কোনো সন্দেহ নেই। সেই সাথে ঝড়ও আসতে পারে। তবে ওদের আশা-সকালে থেমে যাবে বৃষ্টি। আকাশ পরিষ্কার হয়ে যাবে। আবার বাইরে বেরোতে পারবে ওরা। আর যদি না-ই হয়, কি আর করা, চলে যাবে গুহা দেখতে।

মেঘ করায় স্বাভাবিক সময়ের আগেই অন্ধকার হয়ে গেছে। তাঁবু খাটানো হয়েছে দুটো, কিন্তু ঘুমানোর আগে এক তাবুতে বসে গল্প করবে ঠিক করলো ওরা। রেডিও শুনবে। তাবুতে ঢুকে চালু করে দিলো রেডিও। রাফিকে ডাকলো জিনা। কিন্তু ভেতরে এলো না কুকুরটা, বাইরেই শুয়ে থাকলো। বোধহয় আরাম লাগছে ওখানেই।

রেডিওটা সবে অন করেছে কিশোর, এই সময় ঘেউ ঘেউ করে উঠলো রাফিয়ান। সঙ্গে সঙ্গে সুইচ অফ করে দিলো সে।

নিশ্চয় কেউ আসছে, জিনা বললো। কে?

হয়তো জনি, আন্দাজ করলো মুসা। আকাশের অবস্থা খারাপ দেখে আমাদেরকে বাড়িতে নিয়ে যেতে আসছে।

নাকি আঁধার রাতে মথ খুঁজতে বেরোলেন মিস্টার ডাউসন, হেসে বললো রবিন।

হাসলো কিশোর। মুসার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে বললো, বলা যায় না, মিসেস ডেনভারও হতে পারে। ঝড়ের রাতে কাউকে যাদু করতে বেরিয়েছে হয়তো।

দূর, বাজে কথা বলো না তো, গায়ে কাঁটা দিল মুসার। আল্লাহ না করুক। মিসেস ডেনভার ভালো মানুষ, ডাইনী নয়। তাছাড়া পৃথিবীতে ডাইনী বলে কিছু নেই…

তা-ই নাকি? আরে, আমাদের মুসা আমান বলে কি? ভূতপ্রেতের ওপর থেকে বিশ্বাস তাহলে উঠে যাচ্ছে তোমার। আশ্চর্য!

ভূতের কথায় আরও কুঁকড়ে গেল মুসা।

কিশোরের সঙ্গে সঙ্গে রবিন আর জিনাও হাসতে আরু করলো।

ওদিকে ডেকেই চলেছে রাফিয়ান।

কে এলো, দেখতে হয়। বলে তাবুর দরজা দিয়ে মাথা বের করে জিজ্ঞেস করলো কিশোর, এই রাফি, কে-রে?

মুখও ফেরালো না রাফিয়ান। কিশোরের কথা যেন কানেই যায়নি। একই দিকে তাকিয়ে ঘেউ ঘেউ করে চলেছে। নিশ্চয় কিছু দেখতে পেয়েছে।

শজারু-টজারু হবে, ভেতর থেকে বললো জিনা।

কি জানি। তবে আমার মনে হয় ওকে নিয়ে গিয়ে দেখা উচিত কি দেখেছে। জানা দরকার। অন্য কিছুও হতে পারে।

তাঁবু থেকে বেরিয়ে পড়লো কিশোর। আয়, রাফি। কি দেখেছিস? দেখা তো আমাকে।

লেজ নাড়তে নাড়তে ছুটলো রাফিয়ান। পেছনে প্রায় দৌড়ে এগোলো কিশোর। অন্ধকারে কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। গাছের শেকড়ে কিংবা লতায় লেগে হোঁচট খাচ্ছে। টর্চ আনা উচিত ছিলো, ভাবলো সে। এখন আর আনার সময় নেই। অনেকখানি চলে এসেছে।

ঢাল বেয়ে দৌড়ে চললো কিছুক্ষণ রাফিয়ান, এয়ারফীন্ডের দিকে মুখ। তারপর বার্চ গাছের একটা জটলার পাশ কাটিয়ে এসে দাঁড়িয়ে গেল। আরও জোরে চিল্কার করতে লাগলো।

আবছামতো একটা ছায়া নড়তে দেখলো কিশোর। চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলো, এই, কে?

আমি…আমি…, জবাব দিলো একটা দ্বিধান্বিত কণ্ঠ। ডরি।

ছায়ার হাতে লম্বা লাঠির মাথায় জালের মতো দেখতে পেলো কিশোর।

আমাদের ফাঁদগুলো দেখতে এসেছি, আবার বললো ডরি। ঝড় আসছে তো। ভাবলাম, দেখেই যাই কোনো মথ-টথ পড়লো কিনা। বৃষ্টি এলে সব ধুয়ে চলে যাবে, পরে এসে কিছুই পাবে না।

ও, স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো কিশোর। আমি ভেবেছিলাম না জানি কি। তা মিস্টার ডাউসনও বেরিয়েছেন নাকি?

যা! রাতে প্রায়ই বেরোই আমরা, মথ শিকারে। কাজেই যদি তোমাদের কুকুরটা রাতে ডেকে ওঠে, যখনই ডাকুক, ধরে নেবে আমরা।…চেঁচিয়ে তো কান ঝালাপালা করে দিলো ওটা! থামাও না। বড় পাজি কুকুর মনে হচ্ছে।

এই রাফি, চুপ! ধমক দিয়ে বললো কিশোর। লোক চিনতে পারিস না?

চুপ হয়ে গেল বটে রাফি, কিন্তু তার অস্বস্তি দূর হলো না। শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলো ছায়াটাকে।

আরেকটা ফাঁদ দেখতে যাচ্ছি আমি, ডরি বললো। তোমরা যাও। কুকুরটার মুখ বন্ধ রাখতে বলবে।

টর্চ জ্বলে উঠলো ডরির হাতে। হাঁটার তালে নেচে নেচে এগিয়ে চললো আলোটা।

আমরা এই পাহাড়েই ক্যাম্প করেছি, কিশোর বললো। এই তো, বড় জোর শখানেক গজ হবে। ইস, টর্চ আনলে আপনার সঙ্গে যেতে পারতাম। রাতে মথ ধরা দেখতে ইচ্ছে করছে। নিশ্চয় খুব ভালো লাগতো।

জবাব দিলো না লোকটা। চলে যাচ্ছে। যতোই দূরে সরছে, ধীরে ধীরে স্নান হয়ে আসছে টর্চের আলো।

ফিরে চললো কিশোর। অন্ধকারে দিক ঠিক রাখাই মুশকিল। আরও নানারকম অসুবিধে তো রয়েছেই। একশো গজ যেতেই পথ হারালো সে। ক্যাম্পের কাছ থেকে অনেক ডানে সরে গেল। অবাক হলো রাফি। কিশোরের শার্টের হাতা কামড়ে ধরে আস্তে টান দিলো।

কি-রে। দাঁড়িয়ে গেল কিশোর। পথ ভুল করলাম নাকি? সর্বনাশ, তুই না থাকলে তো এই অন্ধকারে সারারাত ঘুরে মরতাম! তবু কিছুতে খুঁজে পেতাম না। যা, পথ দেখা।

পথ দেখিয়ে তাকে নিয়ে চললো রাফিয়ান। কিছুদূর এগিয়ে তিনটে টর্চের আলো চোখে পড়লো কিশোরের। তার দেরি দেখে বেরিয়ে পড়েছে রবিন, মুসা আর জিনা।

কিশোওর, তুমি? শোনা গেল রবিনের উদ্বিগ্ন কণ্ঠ। এতোক্ষণ কি করছিলে?

আর বলো না, পথ হারিয়েছিলাম। টর্চ ছাড়া বেরোনোই উচিত হয়নি। রাফি সাথে না থাকলে আজ আর তাঁবুতে ফিরতে পারতাম না।

কি দেখে চেঁচামেচি করল জানতে চাইলো জিনা। প্রজাপতি মানব, ডরি। ও বললো মিস্টার ডাউসনও নাকি বেরিয়েছেন।

কেন? মুসা বললো। ঝড় আসছে দেখছে না? মথ-টথ কি আর বেরোবে নাকি এখন। নিশ্চয় বাসায় ঢুকে বসে আছে।

মধু-ধরা ফাঁদ দেখতে বেরিয়েছে নাকি। যদি ধরা-টরা পড়ে থাকে? কিশোর জানালো। কোথায় যেন পড়েছি, হে ডালে মধু মাখিয়ে রাখা হয়। সেই মধুর গন্ধে ঝাঁকে ঝাঁকে মথ এসে সেখানে পড়ে। তখন ওগুলোকে ধরা মোটেই কঠিন না।

তাই নাকি? মজার ব্যাপার তো, মুসা বললো। দেখতে যেতে পারলে হতো।…এহহে, বৃষ্টির ফোঁটা পড়তে আরম্ভ করেছে। ডরি আর তার মথ, সবাই ভিজবে। চলো চলো, তাঁবুতে চলল।

এবার আর বাইরে থাকতে চাইলো না রাফিয়ান। পানির বড় বড় ফোঁটা ভালো লাগলো না মোটেও। সবার আগেই ঢুকে পড়লো তাঁবুর ভেতর। বসলো রবিন আর জিনার পাশে।

জায়গা তো সব তুইই দখল করে ফেললি, রাফি, হেসে বললো জিনা। আরেকটু ছোট হতে পারলি না।

জবাবে জিনার হাঁটুতে মাথা রেখে দীর্ঘশ্বাস ফেললো রাফি। যেন তার দুঃখ বুঝতে পেরেছে। _ তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে জিনা বললো, কাণ্ড দেখে। ওরকম বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলছিস কেন? তোর আবার কিসের দুঃখ? ও, বুঝেছি। বাইরে বসে শজারু দেখতে পারবি না, হাঁকডাক করতে পারবি না, এই জন্যে?

বসে বসে কি করি? ঘুমও তো আসছে না, কিশোর বললো। তার টর্চটা জেলে,শুইয়ে রেখেছে রেডিওর ওপর। রেডিওতেও বোধহয় শোনার মতো কিছু নেই।

গল্প করা ছাড়া আর কি করার আছে? জিনা বললো। এক কাজ করো, তোমাদের অথৈ সাগর ভ্রমণের গল্পটা আরেকবার বলো। অনেক মজা করে এসেছে।

মজা না ছাই, গজগজ করলো মুসা। ছাইভস্ম কতো কি যে খেলাম। শুঁয়াপোকাও বাদ দিইনি?

ওই শুঁয়াপোকাই বলতে গেলে জান বাঁচালো আমাদের, রবিন বললো। ওগুলো খেয়ে খানিকটা শক্তি পেয়েই না আবার খাবার খুঁজতে পেরেছি। নইলে তো মরেছিলাম। আরিব্বাপরে, যা রোদ আর গরম ছিলো, জিনা, কি বলবো? কুমালো ওদিকে গুলি খেয়ে বেহুশ, মরে মরে অবস্থা। পানি নেই। বড় বাঁচা বেঁচে এসেছি। জীবনে আর ওমুখো হচ্ছি না আমি।

আমার কিন্তু অতো খারাপ লাগেনি, কিশোর বললো। দ্বীপটা ছেড়ে আসতে শেষে কষ্টই হয়েছে।

বলোই না আরেকবার গল্পটা, অনুরোধ করলো জিনা।

গুছিয়ে গল্প বলায় ওস্তাদ রবিন। কেস-ফাইল লিখতে লিখতে এটা রপ্ত করেছে। সে-ই আরম্ভ করলো।

বাইরে ভালোমতোই শুরু হয়েছে ঝড়-বৃষ্টি। ছোই তাঁবুটাকে হ্যাঁচকা টানে উড়িয়ে নিয়ে যেতে চাইছে প্রবল বাতাস।

গল্প বলে চলেছে রবিন। মুসাকে অক্টোপাসে ধরে মারার উপক্রম করেছে, সেই জায়গাটায় এসেছে, তন্ময় হয়ে শুনছে সবাই, এই সময় নিতান্ত বেরসিকের মতো ঘেউ ঘেউ শুরু করে দিলো রাফিয়ান। চমকে দিলো সবাইকে। শুধু চেঁচিয়েই ক্ষান্ত হলো না। তাবুর ফাঁকে নাক ঢুকিয়ে ঠেলে মাথাটা বের করে দিলো বাইরে। আরও জোরে চেঁচাতে লাগলো।

মরেছে! আরেকটু হলেই হার্ট অ্যাটাক হয়ে যেতো আমার, বলে উঠলো মুসা। এই রাফি, তোর হলো কি?…আরে আরে দেখো, আবার বেরিয়ে গেল। এই, ভিজে ঠাণ্ডা লাগাবি তো। কি দেখতে গেছিস? দুটো পাগলকে? ওরা মথ ধরতে এসেছে…আয়, আয়।

কিন্তু ফিরেও এলো না রাই, চিৎকারও থামালো না। গলা ফাটিয়ে চেঁচিয়ে চলেছে। কিশোর গিয়ে টেনে আনার চেষ্টা করলে তার দিকে তাকিয়ে রেগে উঠলো। শেষে জিনা গিয়ে তাকে ধরে আনলো।

ব্যাপারটা কি? কিছুটা অবাকই হয়েছে কিশোর। এই রাফি, চুপ কর না। কানের পর্দা ফাটিয়ে দিলি তো।

কোনো কিছু উত্তেজিত করেছে তাকে, চিন্তিত ভঙ্গিতে বললো জিনা। অস্বাভাবিক কিছু!…এই শোনো, শোনো, একটা চিৎকার শুনলে?

কান পাতলো সবাই। কিন্তু ঝড়ো বাতাস আর তাঁবুর গায়ে আছড়ে পড়া বৃষ্টির শব্দ ছাপিয়ে আর কিছু শোনার উপায় নেই।

কিছু থাকলেও এখন যাওয়া সম্ভব না, মুসা বললো। ভিজে চুপচুপে হয়ে যাবো। আর এই বৃষ্টিতে খুঁজে বের করাও মুশকিল হবে। রাফি, চুপ কর। যেতে পারবো না।

তবু থামলো না রাফি।

শেষে রেগে গেল জিনা। ধমক লাগালো, এই, চুপ করলি! হতচ্ছাড়া কুত্তা কোথাকার!

রেগে এভাবে তাকে খুব কমই গালি দেয় জিনা। অবাক হয়ে চুপ করলো সে। ফ্যালফ্যাল করে তাকাতে লাগলো জিনার মুখের দিকে।

হয়েছে, আর ওরকম করে তাকাতে হবে না, পাজি কোথাকার! চুপ, একদম চুপ! ইঁদুর, ছুঁচো যা দেখবে চেঁচাতে শুরু করবে। আর একটা চিৎকার করলে চড়িয়ে দাঁত ফেলে দেবো…।

জিনার কথা শেষ হলো না। ঝড়ের গর্জন আর মুষলধারে বৃষ্টির ঝপঝপ ছাপিয়ে শোনা গেল আরেকটা ভারি গোঁ গোঁ আওয়াজ ইঞ্জিনের।

চট করে পরস্পরের দিকে তাকালো চারজনে।

খাইছে! এরোপ্লেন! ফিসফিস করে বললো মুসা, যেন বিমানটা শুনতে পাবে তার কথা। এই ঝড়বৃষ্টির মাঝে বেরোলোয় ব্যাপারটা কি?

অবাক হয়ে একে অন্যের দিকে তাকাতে লাগলো ওরা। এমন কি জরুরী ব্যাপার ঘটলো যে এই দুর্যোগের মাঝেওউড়তে হলো বিমানটাকে?

ঝড়ের মাঝে ওড়ার ট্রেনিং দিচ্ছে? নিজের কানেই বেখাপ্পা শোনালো যুক্তিটা। না, তা হতে পারে না।

এখান থেকে ওড়েনি, রবিন বললো। হয়তো অন্য কোনোখান থেকে এসেছে। কিংবা উড়ে যাচ্ছিলো এখান দিয়ে। আবহাওয়া বেশি খারাপ হয়ে যাওয়ায় ল্যান্ড করছে।

হ্যাঁ, তা হতে পারে, একমত হলো মুসা। আশ্রয় খুঁজছে।

মাথা নাড়লো কিশোর। না, আমার তা মনে হয় না। এয়াররুট থেকে অনেক দূরে এই এয়ারফীন্ড। তাছাড়া এটাকে ঠিক এয়ারপোর্টও বলা যায় না, অতি সাধারণ একটা এক্সপেরিমেন্টাল স্টেশন। আর যদি আবহাওয়া খারাপের কারণে নামতে বাধ্যই হয়, এখানে কেন? ধারেকাছেই প্রথম সারির বিমান বন্দর রয়েছে, ওখানে যাবে। আশ্রয়, সাহায্য সবই পাওয়া যাবে ওখানে।

তাহলে হয়তো মহড়াই দিচ্ছে, জিনা বললো। জনির ভাই। ঝড়ের মাঝে উড়ে হাত পাকিয়ে নিচ্ছে।

যা-ই হোক, এঞ্জিনের শব্দ হারিয়ে যেতেই ব্যাপারটা গুরুত্ব হারালো ওদের কাছে, আপাতত। হাই তুললো রবিন, শোয়া দরকার। ঘুম পাচ্ছে।

হ্যাঁ, মাথা ঝাঁকালো কিশোর। ঘড়ি দেখলো। রবিন, রাফিকে নিয়ে তুমি আর জিনা এটাতেই থাকো। আমি আর মুসা চলে যাচ্ছি ওটাতে। দড়ি দিয়ে শক্ত করে বেঁধে দরজার ফাঁক বন্ধ করে দেবে। কিছু দরকার হলে, কিংবা অসুবিধে হলে ডাকবে আমাদের।

আচ্ছা, মাথা কাত করলো রবিন।

বৃষ্টির মাঝে মাথা নিচু করে বেরিয়ে গেল কিশোর আর মুসা। দরজার ফাঁকটা শক্ত করে আটকে দিয়ে এসে কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লো রবিন।

জিনাও হলো। তার পাশ ঘেঁষে শুয়ে পড়লো রাফিয়ান। সারা রাতে একটা শব্দও করলো না আর।

পরদিন সকালেও মুখ গোমড়া করে রইলো আকাশ। তাঁবুর ফাঁক দিয়ে উঁকি দিয়ে মুসা বললো, আবহাওয়ার পূর্বাভাস শোনা উচিত ছিলো। আজও পরিষ্কার হবে কিনা সন্দেহ। কটা বাজে, কিশোর?

আটটা! আজকাল ঘুম খুব বেড়ে গেছে আমাদের। চলো দেখি, ওরা উঠলো কিনা। অ্যানারা পরে নাও, নইলে ভিজবে।

গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হচ্ছে তখনও। ঝর্না থেকে হাতমুখ ধুয়ে এলো ওরা। নাস্তা করতে বসলো। তাবুর মধ্যে গাদাগাদি করে খেতে ভালো লাগছে না। রোদ নেই, ফলে মনও বিষণ্ণ হয়ে যায়। ভাবছে, দিনটা যদি কিছু পরিষ্কার হতো, জনিদের ফার্মে অন্তত যাওয়া যেতো।

নাস্তার পরে মুসা বললো, যে-রকম অবস্থা, গুহায়ই বোধহয় ঢুকতে হবে আমাদের। বাইরে কোথাও যেতে পারবো না।

তা-ই চলো, জিনা বললো।

ম্যাপ দেখে নেয়া দরকার, পরামর্শ দিলো কিশোর। গুহার কোনো একটা মুখ নিচয় রাস্তা-টাস্তার কাছে বেরিয়েছে। পাহাড়ের গোড়ার দিকেই কোথাও হবে।

থাকলে থাক না থাকলে নেই,মুসা বললো, গেলেই দেখতে পাবো। আর না থাকলেই বা কি? আসল কথা, এখন বসে থাকতে ভাল্লাগছে না, একটু হাঁটাহাঁটি করতে চাই, ব্যস।

বাস, ঝোপঝাড়, সব ভেজা। ওগুলোর মধ্যে দিয়ে হাঁটতেই বিরক্ত লাগে। লাফিয়ে লাফিয়ে আগে আগে চলছে রাফিয়ান।

সবাই টর্চ নিয়েছে তো? মনে করিয়ে দিলো রবিন। গুহার ভেতরে কিন্তু দরকার হবে।

যা, রাফি ছাড়া সবাই নিয়েছে। তার অবশ্য দুটো প্রাকৃতিক টর্চই আছে, চোখ, গুহার অন্ধকারেও দেখতে পাবে। তাছাড়া রয়েছে প্রখর ঘ্রাণশক্তি আর শ্রবণশক্তি, মানুষের নাক-কানের চেয়ে অনেক বেশি উন্নত ওর যন্ত্রগুলো।

ঢাল বেয়ে কিছুক্ষণ নেমে উত্তরে মোড় নিলো ওরা। হঠাৎ করেই এসে পড়লো একটা চওড়া পথে, ঘাস আর আগাছা নেই ওখানে, কেটে সাফ করা।

দাঁড়িয়ে গেল কিশোর। নিশ্চয় কোথাও নিয়ে যাওয়া হয়েছে এই পথ।

তাই তো মনে হচ্ছে, রবিন বললো। চকের খনিটনি আছে বোধহয়। রাস্তায় পড়ে থাকা একটা খড়িমাটির ডেলায় লাথি মারলো সে।

চলো না এগিয়ে দেখি, বললো জিনা।

পথের একটা মোড় ঘুরতেই নোটিশ চোখে পড়লো। ওটার বাংলা করলে দাঁড়ায়ঃ গুহা এদিকে। দড়ি লাগানো পথগুলো ধরে গেলে ভালো। যেগুলোতে দড়ি নেই সেগুলোয় ঢুকলে পথ হারানোর ভয় আছে। সাবধান!

ভালোই তো মনে হচ্ছে, উত্তেজনা ফুটলো কিশোরের কণ্ঠে। জনিও বলেছিলো বটে, ওগুলোতে বিপদ আছে। চলো, ঢুকেই দেখা যাক।

হাজার হাজার বছরের পুরানো এগুলো, রবিন বললো। স্ট্যালামাইট আর স্ট্যালাকটাইট জমে থাকে এসব গুহায়।

শুনেছি, জিনা বললো, হাত থেকে নাকি ঝুলে থাকে জমাট বরফ। নিচে থেকেও বরফের স্তম্ভ উঠে যায় ওপর দিকে, ওপরেরগুলোকে ধরার জন্যে।

আমিও শুনেছি, মুসা বললো। নাকি ভূগোল বইয়ে পড়লাম, মনে নেই। ছাত থেকে যেগুলো নামে ওগুলোকে বলে স্ট্যালাকটাইট, আর মেঝে থেকে যেগুলো ওঠে ওগুলোকে স্ট্যালাগমাইট।

বইয়েই বোধহয় পড়েছি। হাত নাড়লো জিনা, কি জানি, কোনটাকে কি বলে।

গুহার কাছাকাছি এসে পথের চেহারা অন্যরকম হয়ে গেল। আলগা খড়িমাটি পড়ে নেই। রুক্ষও নয়, বেশ মসৃণ। প্রবেশপথটা মাত্র ছয় ফুট উচু, তার ওপরে একটা সাদা রঙ করা বোর্ডে বড় বড় কালো অক্ষরে লেখা রয়েছে মাত্র দুটো শব্দঃ বাটারফ্লাই কেভস।

রাস্তার মোড়ে যে হুঁশিয়ারিটা দেখেছিলো, সেরকমই আরেকটা নোটিশ দেখা গেল গুহা-মুখের ঠিক ভেতরে।

ওটার দিকে রাফিয়ানকে তাকিয়ে থাকতে দেখে হেসে জিনা বললো, পড়ে নে ভালোমতো। আমাদের কাছাকাছি থাকবি।

টর্চ জ্বেলে ঢুকে পড়লো ওরা। চারটে টর্চের আলোয় ঝলমল করে উঠলো চারপাশের দেয়াল। অবাক হয়ে চিৎকার শুরু করে দিলো রাফি। বদ্ধ গুহায়

প্রতিধ্বনি তুললো সেই ডাক, বিকট হয়ে এসে কানে বাজলো।

রাফির নিজেরই পছন্দ হলো না সেই শব্দ। চিৎকার থামিয়ে জিনার গা ঘেঁষে এলো। হাহ হাহ করে হাসলো জিনা। দূর, বোকা, এটা তো গুহা। জীবনে কম গুহা দেখেছিস, ভয় পাচ্ছিস যে এখন?…এই, সাংঘাতিক ঠাণ্ডা তো এখানে! ভাগ্যিস অ্যানারাক এনেছিলাম।

গোটা দুই ছোট আর সাধারণ গুহা পেরিয়ে বড় একটা গুহায় ঢুকলো ওরা। যেখানে সেখানে বরফ চমকাচ্ছে। কিছু ঝুলে রয়েছে হাত থেকে, কিছু উঠে গেছে মেঝে থেকে। ওপরের বরফের সঙ্গে নিচের কোনো কোনোটা মিলে গিয়ে তৈরি হয়েছে থাম, দেখে মনে হয় এখন গুহার ছাতের ভার রক্ষা করছে ওগুলো।

দারুণ। বিড়বিড় করলো রবিন। দেখার মতো জিনিস!

সুন্দর, কিন্তু কেমন যেন গা ছমছমে, কিশোর বললো। বলতে পারবো না কেন। এসো, পরের ওহাটা দেখি।

পরেরটা আবার ছোট। তবে বরফ আছে। টর্চের আলো ঠিকরে পড়ছে ওগুলোতে। সৃষ্টি করছে রামধনুর সাত রঙ। আরিব্বাবা! চোখ বড় বড় করে ফেললো জিনা। একেবারে পরীর রাজ্য!

পরের গুহাটায় কোনো রঙ নেই। দেয়াল, মেঝে, ছাত, থাম সবকিছু একধরনের ফ্যাকাসে সাদা, টর্চের আলো ঠিকরে এসে চোখে লাগে। আসলে স্ট্যালাকটাইট আর স্ট্যালাগমাইট এতো বেশি লেগে গেছে এখানে, থাম এত ঘন, মাঝের ফাঁক দিয়ে অন্যপাশ দেখাই কঠিন।

মোট তিনটে সুড়ঙ্গমুখ দেখা গেল এই গুহাটায়। একটাতে দড়ি আছে, দুটোতে নেই। যে দুটোতে নেই, ওগুলোর মুখের কাছে দাঁড়িয়ে ভেতরে উঁকি দিলো অভিযাত্রীরা। ভেতরটা অন্ধকার, নিস্তব্ধ। তাকিয়ে থাকতে থাকতে গায়ে কাঁটা দিলো ওদের। যদি ঢুকে পথ হারায়, আর কোনোদিন বেরোতে পারবে কিনা সন্দেহ!

দড়িওয়ালাটা দিয়েই ঢোকা যাক, জিনা প্রস্তাব দিলো। ওমাথায় কি আছে দেখে ফিরে আসবো। কি আর থাকবে, হয়তো আরও কিছু গুহা।

দড়ি ছাড়া একটা গুহামুখের ভেতরে ঢুকে ঝুঁকতে আরম্ভ করলো রাফিয়ান। তাড়াতাড়ি ডাক দিলো তাকে জিনা, এই, জলদি বেরিয়ে আয়! হারিয়ে যাবি?

কিন্তু ফিরলো না রাফি, ঢুকে গেল আরও ভেতরে। ঘন কালো অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে শঙ্কিত হলো সবাই।

খাইছে! বলে উঠলো মুসা। কি দেখে গেল ওখানে? রাফি, এইই রাফি! বিকট প্রতিধ্বনি উঠলো গুহার দেয়ালে দেয়ালে।

ঘেউ ঘেউ করে সাড়া দিলো রাফি। মনে হলো, মুহূর্তে ওই ডাকে ভরে গেল সমস্ত গুহা আর সুড়ঙ্গ। বিচিত্র আওয়াজ! সহ্য করতে না পেরে কানে আঙুল দিলো রবিন।

ঘাউ! ঘাউ! ঘাউ! ঘাউ। ডেকেই চলেছে যেন একাধিক কুকুর। অথচ রাফি ডেকেছে মাত্র দুবার। ছুটে বেরিয়ে এলো সে। সাংঘাতিক অবাক হয়েছে। বিশ্বাসই করতে পারছে না যেন এই শব্দের স্রষ্টা সে নিজে।

গলায় শেকল পরিয়ে আনা উচিত ছিলো তোকে, বকা দিলো জিনা। খবরদার, আর কাছ থেকে সরবি না।

কথা শুনলো এবার রাফি। কাছে কাছেই রইলো। গুহা থেকে গুহায়, সুড়ঙ্গ থেকে সুড়ঙ্গে ঘুরে বেড়াতে লাগলো দলটা। দড়ি লাগানো জায়গাগুলোতেই শুধু ঘুরছে ওরা। অনেক সুড়ঙ্গ দেখলো, যেগুলোতে দড়ি নেই। ভেতরে কি আছে। দেখার লোভও হলো, কিন্তু জোর করে দমন করলো কৌতূহল। অযথা বিপদে পড়ার কোনো মানে হয় না।

একটা গুহায় একটা ডোবামতো দেখা গেল। পানি জমে বরফ হয়ে আছে। আয়নার কাজ করছে ওটা। ছাতের সব কিছুর প্রতিবিম্ব দেখা যাচ্ছে ওর ভেতর। ঠিক এই সময় একটা অদ্ভুত শব্দ কানে এলো ওদের। চিনতে পারলো না কিসের শব্দ। সোজা হয়ে কান পাতলো সবাই।

কাঁপা কাঁপা, তীক্ষ্ণ শব্দটা যেন ক্রমান্বয়ে ভরে দিতে লাগলো সব গুহা, সুড়ঙ্গ। একবার বাড়ছে, আবার কমছে…বাড়ছে…কমছে…

বেশিক্ষণ চুপ থাকতে পারলো না রাফি। ঘেউ ঘেউ করে চেঁচিয়ে উঠলো সে। যেন তার ডাকের জবাবেই আরও জোরে হলো আগের বিচিত্র শব্দটা।

এ-কি ভূতুড়ে কাণ্ড! ভয়ে ভয়ে অন্ধকার সুড়ঙ্গের দিকে তাকিয়ে রইলো মুসা।

ব্যাপারটা কি! ফিসফিসিয়ে বললো জিনা, জোরে বলতে ভয় পাচ্ছে। চলো, এখানে আর এক মুহূর্তও না!

কানে আঙুল দিয়ে ছুটলো ওরা। দৌড়ে চললো প্রবেশপথের দিকে। যেন হাজারখানেক বুনো কুকুর একসঙ্গে তাড়া করেছে ওদেরকে।

প্রবেশপথের বাইরে দাঁড়িয়ে হাঁপাতে লাগলো দলটা। শব্দ শুনে ভয় পেয়ে পালিয়ে এসেছে বলে এখন গাধা মনে হচ্ছে নিজেদের।

বাবারে বাবা! কপালের ঘাম মুছে বললো মুসা। মনে হচ্ছিলো কানের ফুটো দিয়ে একেবারে মগজে ঢুকে যাচ্ছে।

ভয়ানক শব্দ! ফ্যাকাসে হয়ে গেছে জিনার মুখ। ওই গুহায় আর ঢুকছি না আমি! চলো, ক্যাম্পে যাই।

খড়িমাটি বিছানো রাস্তা ধরে তাঁবুতে ফিরে চললো ওরা। বৃষ্টি থেমেছে। মেঘও কাটতে শুরু করেছে।

ক্যাম্পে ফিরে একটা তাবুতে ঢুকে আলোচনায় বসলো ওরা।

ওরকম শব্দ প্রায়ই শোনা যায় কিনা, মুসা বললো, জিজ্ঞেস করতে হবে জনিকে। আশ্চর্য! দর্শকদের এভাবেই স্বাগত জানায় নাকি ওই গুহা!

সে যা-ই হোক, কিশোর বললো, বেশি ছেলেমানুষী করে ফেলেছি আমরা। রীতিমতো লজ্জা পাচ্ছে এখন সে।

এক কাজ করা যাক তাহলে, পরামর্শ দিলো জিনা, আবার ফিরে গিয়ে চিল্কারের জবাবে আমরাও চিৎকার শুরু করি। দেখবো কি হয়?

ওসব করে আর লাভ নেই, আরও বেশি ছেলেমানুষী করতে রাজি নয় কিশোর। চিৎকার-প্রতিযোগিতায় কিছু হবে না। কম্বলের তলা হাতড়ে ফীভগ্নাস বের করে গলায় ঝোলালো সে। এয়ারফীন্ডের অবস্থা দেখতে যাচ্ছি আমি।

বাইরে বেরিয়ে ফীগ্লাস চোখে লাগিয়ে, একবার দেখেই চিৎকার করে উঠলো কিশোর। ওরেব্বাবা, কতো লোক! হচ্ছেটা কি ওখানে? পেনও এসেছে অনেকগুলো। নিশ্চয় আজ সকালে আমরা যখন গুহায় ছিলাম তখন এসেছে।

এক এক করে কীভগ্নাস চোখে লাগিয়ে দেখলো সবাই। ঠিকই বলেছে কিশোর। কিছু একটা ঘটছে এয়ারফীন্ডে। তাড়াহুড়া আর উত্তেজনা দেখা যাচ্ছে মানুষগুলোর মাঝে। এই সময় শোনা গেল ইঞ্জিনের শব্দ।

আরেকটা প্লেন আসছে, মুসা বললো। জ্যাক ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে পারলে হতো, রবিন বললো। সে বলতে পারবে কি হচ্ছে।

লাঞ্চের পর ফার্মে গিয়ে জনিকে জিজ্ঞেস করতে পারি, মুসা প্রস্তাব দিলো। হয়তো সে কিছু জানে, ভাইয়ের কাছ থেকে শুনে থাকতে পারে।

যাক, বাঁচা গেল, আবার রোদ উঠছে, খুশি খুশি গলায় বললো জিনা। মেঘের ফাঁকে উঁকি দিয়েছে সূর্য, একঝলক সোনালি উষ্ণ বোদ ছড়িয়ে দিয়েছে বৃষ্টিভেজা প্রকৃতির ওপর। ইতিউতি ছুটে চলা হেঁড়া মেঘের ফাঁকে ফাঁকে চোখে পড়ছে এখন নীল আকাশ। এরকম কড়া রোদ থাকলে শীঘ্রি শুকিয়ে যাবে ঝোপঝাড়। চলো, রেডিও শুনি, আবহাওয়া অফিস কি বলে? অযথা অ্যানারাক বয়ে বেড়াতে রাজি না আমি।

রেডিও অন করলো ওরা। কিন্তু অল্পের জন্যে মিস করলো আবহাওয়ার খবর।

দূর! বলে বন্ধ করে দিতে গিয়েও থমকে গেল মুসা। দুটো শব্দ কানে এসেহে, বাটারফ্লাই হিল। বাড়ানো হাতটা মাঝপথেই ঝুলে রইলো তার, কান পেতে আছে আরও কথা শোনার জন্যে। ঘোযক বলছে, বাটারফ্লাই হিল থেকে চুরি যাওয়া প্লেন দুটো খুব দামী, ভেতরে অনেক টাকার যন্ত্রপাতি লাগানো। হয়তো ওগুলোর জন্যেই চুরি হয়েছে প্লেন। দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, ওগুলো উড়িয়ে নিয়ে গেছে আমাদের দুজন সেরা পাইলট। ওরা হচ্ছে ফ্লাইট-লেফটেন্যান্ট জ্যাক ম্যানর আর ফ্লাইট-লেফটেন্যান্ট রিড বেকার। দুটো প্লেনই একেবারে গায়েব, কোনো খোঁজ নেই। হারিয়েছে কাল রাতে ঝড়ের সময়।

এক মুহূর্ত থেমে আরেক খবরে চলে গেল ঘোষক। রেডিও বন্ধ করে দিয়ে শূন্য দৃষ্টিতে অন্যদের দিকে তাকালো মুসা।

জ্যাকের মতো মানুষ এরকম একটা কাণ্ড করলো! বিড়বিড় করলো কিশোর। আনমনে চিমটি কাটলো একবার নিচের ঠোঁটে। বিশ্বাস হচ্ছে না!

প্লেন উড়ে যেতে কিন্তু শুনেছি আমরা, মুসা বললো। দুটোই। পুলিশকে গিয়ে সব জানানো উচিত। ইস, জ্যাক একাজ করলো! হায়রে, দুনিয়ায় কাকে বিশ্বাস করবো?

ঠিক, মাথা দোলালো রবিন।

রাফিও কিন্তু বিশ্বাস করেছিলো ওকে, জিনা মনে করিয়ে দিলো। আর লোক চিনতে সাধারণত সে ভুল করে না।

জনি খুব দুঃখ পাবে, মুসা বললো। বেচারা ভাই বলতে অজ্ঞান…

হঠাৎ আবার চেঁচাতে শুরু করলো রাফি। এবার আনন্দের ডাক। কে আসছে দেখার জন্যে ফিরে তাকালো কিশোর। জনি।

কাছে এসে ওদের পাশে বসে পড়লে জনি। মুখচোখ শুকনো। হাসার চেষ্টা করলো। খুব খারাপ খবর আছে, কেমন ভাঙা ভাঙা কণ্ঠস্বর।

জানি,মুসা বললো। এইমাত্র শুনলাম রেডিওতে।

সবাইকে অবাক করে দিয়ে কাঁদতে শুরু করলো জনি। গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে পানি। মোছার চেষ্টা করলো না। পানি যে পড়ছে সেটাই যেন টের পাচ্ছে না। কে কিভাবে সান্ত্বনা দেবে বুঝতে পারলো না। শুধু রাফি গিয়ে চেটে দিতে লাগলো তার ভেজা গাল। বিচিত্র কুঁই কুঁই আওয়াজ বেরোচ্ছে গলা দিয়ে। কুকুরটার গলা জড়িয়ে ধরে অবশেষে বললো সে, জ্যাক ভাইয়া হতেই পারে না! সে এরকম কাজ করবে না! আমি বিশ্বাস করি না! তোমরা তো দেখেছো তাকে, তোমাদের কি মনে হয়?

আমিও বিশ্বাস করতে পারছি না, গলায় সহানুভূতি মিশিয়ে বললো কিশোর। মাত্র একবার দেখেছি, তা-ও অল্প সময়ের জন্যে। আমার মনে হয় না তোমার ভাই খারাপ লোক।

সে আমার কাছে হিরো, বলে ভেজা গাল মুছলো জনি। আজ সকালে যখন মিলিটারি পুলিশ প্রশ্ন করতে এসেছিলো বাবাকে, কি যে মনের অবস্থা হয়েছিলো আমার, বলে বোঝাতে পারবো না। জ্যাক ভাইয়াকে চোর বলায় এতো রেগে গিয়েছিলাম, ঘুসি তুলে মারতে গিয়েছিলাম পুলিশকে। শেষে জোর করে ধরে আমাকে ঘর থেকে বের করে দিলো মা।

শুধু ওই দুজন পাইলটই তো? জানতে চাইলো কিশোর। নাকি আরও কেউ নিখোঁজ হয়েছে?

না, ওই দুজনই। আজ সকালে রোলকলের সময় অন্য সবাই হাজির ছিলো। শুধু আমার ভাই আর রিড ভাইয়া বাদে। ওরা দুজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু।

কেসটা আরও খারাপ হয়েছে সেজন্যেই, মুসা বললো।

কিন্তু আমি বলছি ওরা চুরি করেনি! জোর দিয়ে বললো জনি। মুসার দিকে তাকালো ভুরু কুঁচকে। তুমিও ওদেরকে চোর ভাবছো নাকি?

প্রশ্নই ওঠে না। ওদেরকে…, রাফিয়ানকে দৌড় দিতে দেখে থেমে গেল মুসা। আবার কে আসছে?

প্রচণ্ড চিৎকার করতে লাগলো রাফি। মোটা, ভারি একটা কণ্ঠ আদেশ দিলো, চুপ! চুপ! এই, তোর বন্ধুরা কোথায়?

উঠে এগিয়ে গেল কিশোর।

ঢাল বেয়ে উঠে আসছে দুজন মোটাসোটা ইউনিফর্ম পরা লোক। মিলিটারি পুলিশ।

এই রাফি, চুপ কর, ডেকে বললো কিশোর। আসতে দে।

দৌড়ে তার কাছে ফিরে এলো রাফি। উঠে এলো লোক দুজন। এখানেই ক্যাম্প করেছে, না? বললো একজন। কয়েকটা প্রশ্ন করতে চাই। কাল রাতে

তো এখানেই ছিলে?।

হ্যাঁ, বললো কিশোর। আসুন। আপনারা কি জিজ্ঞেস করবেন, জানি। ভেরি গুড। বসো সবাই। এখানেই বসি, নাকি?

মাথা ঝাঁকালো কিশোর। গোল হয়ে বসলো সবাই। যা যা জানে, সব জানালো ওরা। বেশি কিছু বলতে পারলো না অবশ্য। শুধু দুটো প্লেন উড়ে যাওয়ার কথা ছাড়া।

সন্দেহজনক আর কিছুই শোনোনি কাল রাতে? জিজ্ঞেস করলো প্রথম লোকটা।

না, জবাব দিলো কিশোর।

কেউ আসেটাসেনি এদিকে? নোটবুক থেকে মুখ তুললো দ্বিতীয়জন।

আঁ…ও হ্যাঁ, একজনকে দেখেছি। মিস্টার ডরি। প্রজাপতি ধরে।

তুমি শিওর, মিস্টার ডরিকেই দেখেছো?

নাম তো তা-ই বললো। হাতে প্রজাপতি ধরার জাল ছিলো। চোখে কালো চশমা, আবছা অন্ধকারেও কাচ চকচক করতে দেখেছি। মিস্টার ডাউসনকে দেখিওনি, তাঁর কথাও শুনিনি। মিস্টার ডরি বললো, দুজনেই বেরিয়েছে, মথ শিকারে।

আর কিছু জানো না, না?

না, মাথা নাড়লো কিশোর।

হুঁ, বলে নোটবুক বন্ধ করলো লোকটা। অনেক ধন্যবাদ তোমাদেরকে। যাই, ওই দুজনের সঙ্গেও কথা বলা দরকার। রাতে বেরিয়েছিলো যখন, কিছু দেখলেও দেখতে পারে। কোথায় থাকে ওরা?

চলুন, দেখিয়ে দিচ্ছি, জনি উঠে দাঁড়ালো। তার সঙ্গে অন্যেরাও উঠলো। হাঁটতে হাঁটতে পুলিশদেরকে বললো, দেখুন, আপনারা হয়তো বিশ্বাস করতে চাইবেন না। তবু আমি বলছি, জ্যাক ম্যানর চোর নয়। হতে পারে না।

ও তোমার কে হয়? জিজ্ঞেস করলো একজন পুলিশ।

ভাই।

ও। দেখা যাক তদন্ত করে, কি বেরোয়।

প্রজাপতির খামারটা দেখা গেল। হাত তুলে ভাঙা কটেজটা দেখিয়ে জনি বললো, ওখানেই থাকেন মিস্টার ডাউসন আর ডরি। আমাদের কি আর আসার দরকার আছে?

না। তোমরা যাও। থ্যাংক ইউ।

একটা কথা, স্যার, অনুরোধ জানালো জনি। জ্যাক ম্যানর চুরি করেনি, একথাটা জানতে পারলে দয়া করে কি একটা খবর দেবেন আমাদেরকে? দেখবেন, যখনি সে জানবে তাকে সন্দেহ করা হচ্ছে, যোগাযোগ করবে আপনাদের সঙ্গে।

তোমার ভাই, না? দ্বিতীয় লোকটা বললো। কোনো আশা নেই, বুঝলে। কাল রাতে একটা প্লেন জ্যাক ম্যানরই উড়িয়ে নিয়ে গেছে। কোনো সন্দেহ নেই তাতে।

১০

পাহাড় বেয়ে নেমে খামারের দিকে এগিয়ে গেল দুজন পুলিশ। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলো ছেলেমেয়েরা। রাফিও দুপায়ের ফাঁকে লেজ ঢুকিয়ে দিয়ে চেয়ে রয়েছে। সে জানে না কি হয়েছে, কিন্তু বুঝতে পারছে খারাপ কিছু ঘটেছে।

এখানে দাঁড়িয়ে থেকে আর লাভ নেই, কিশোর বললো। প্রজাপতি মানবদের কাছে কিছু পাবে না। মথ ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়বে না ওদের। সামনে দিয়ে হাতি হেঁটে গেলেও না।

যাবার জন্যে সবে ঘুরেছে ওরা, এই সময় কানে এলো তীক্ষ্ণ চিত্তার। থমকে দাঁড়য়ে কান পাতলো সবাই। নিশ্চয় মিসেস ডেনভার, মুসা বললো। তার আবার কি হলো?

চলো তো দেখি, বলে এগোলো কিশোর। তার পেছনে সবাই এগিয়ে চললো কটেজের দিকে।

কাছে এসে শুনতে পেলো একজন পুলিশের গলা। বলছে, আহহা, এতো ভয় পাচ্ছেন কেন? আমরা শুধু কয়েকটা কথা জিজ্ঞেস করতে এসেছি।

যাও! ভাগো! তীক্ষ্ণ কন্ঠে চেঁচিয়ে উঠলো আবার বৃদ্ধা। কাঠির মতো সরু হাতটা নাড়ছে জোরে জোরে। তোমরা এখানে কিজন্যে এসেছো? যাও, যাও!

শুনুন, মা, শান্তকণ্ঠে বোঝানোর চেষ্টা করলো আরেকজন, আমরা মিস্টার ডাউসন আর মিস্টার ডরির সঙ্গে কথা বলতে এসেছি। তারা কি নেই?

কে? কার কথা বললে? ও, পাগল দুটো। বেরিয়ে গেছে, জাল নিয়ে, মহিলা বললো। আমি ছাড়া আর কেউ নেই এখন। অপরিচিত লোক দেখলে আমি ভয় পাই। যাও, যাও।

শুনুন, বললো আরেকজন, মিস্টার ডাউসন আর মিস্টার ডরি কাল রাতে পাহাড়ে কোথায় গিয়েছিলো বলতে পারবেন?

রাতে তো আমি ঘুমাচ্ছিলাম। কি করে বলবো? যাও। আমাকে একটু শান্তিতে থাকতে দাও?

পরস্পরের দিকে তাকিয়ে নিরাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়লো দুই পুলিশ। মহিলাকে প্রশ্ন করে লাভ নেই। কিছু জানা যাবে না।

বেশ, যাচ্ছি আমরা, একজন আলতোভাবে বৃদ্ধার কাঁধ চাপড়ে দিলো। অযথাই ভয় পেয়েছেন। ভয়ের কিছু নেই তো।

ওদের সঙ্গে আবার দেখা হয়ে গেল কিশোরদের। কিশোর বললো, মহিলার চিৎকার শুনে দেখতে এলাম কি হয়েছে।

জাল নিয়ে বেরিয়ে গেছে তোমাদের প্রজাপতি মানব, বললো একজন পুলিশ, দুজনেই। আজব লোক, আজব জীবন! এতোসব কিলবিলে খুঁয়াপোকার মাঝে যে কি করে বাস করে…করুক, যেভাবে খুশি। হ্যাঁ, যা বুঝতে পারছি, কাল রাতে বোধহয় ওরা কিছু দেখেনি। আর দেখার আছেই বা কি? দুজন পাইলট দুটো প্লেন উড়িয়ে নিয়ে চলে গেছে। এটা দেখলেই বা কার সন্দেহ হবে?

তবে ওই দুজনের একজন যে আমার ভাই জ্যাক নয়, এ-ব্যাপারে আমি শিওর, জনি বললো।

শ্রাগ করলো লোক দুজন। তারপর হাঁটতে হাঁটতে চলে গেল।

আবার পাহাড়ের ঢালে এসে উঠলো ছেলেমেয়েরা। নীরব। অবশেষে কথা বললো কিশোর, কিছু খাওয়া দরকার। লাঞ্চের সময় পেরিয়ে গেছে অনেকক্ষণ আগে। জনি, এসো, আমাদের সাথেই খাও।

না ভাই, আমি কিছুই মুখে দিতে পারবো না।

ক্যাম্পে ফিরে রবিন আর জিনাকে খাবার বের করতে বললো কিশোর। প্রচণ্ড খিদে পেয়েছে সবারই, জনি বাদে। জোর করে তার হাতে একটা স্যাণ্ডউইচ তুলে দিলো মুসা। সেটা চিবানোর চেষ্টা করতে লাগলো জনি।

অর্ধেক খাওয়া হয়েছে, এই সময় চিৎকার শুরু করলো রাফি। কে এলো দেখার জন্যে ফিরে তাকালো সবাই। কিশোরের মনে হলো, নিচে একটা ঝোপের ভেতরে কি যেন নড়লো। তাড়াতাড়ি ফীল্ডগ্নাস বের করে চোখে লাগালো সে।

মনে হয় মিস্টার ডাউসন, দেখতে দেখতে বললো কিশোর। জাল দেখতে পাচ্ছি। প্রজাপতি ধরছেন বোধহয়।

ডাকি, কি বলো? মুসা বললো। তাকে জানাই, মিলিটারি পুলিশেরা তাঁর সঙ্গে কথা বলতে গিয়েছিলো।

গলা চড়িয়ে ডাকলো কিশোর।

সাড়া এলো।

আসছেন, বললো মুসা।

মিস্টার ডাউসনকে এগিয়ে আনতে গেল রাফিয়ান। ঢাল বেয়ে উঠে এলেন প্রজাপতি মানব, পরিশ্রমে হাঁপ ধরে গেছে।

তোমাদের কাছেই আসছিলাম, ডাউসন বললেন। বনেবাদাড়ে ঘোরাঘুরি করো, হয়তো চোখে পড়ে যেতে পারে, সেকথা বলতে। সিনাবার মথ, দেখলেই আমাকে খবর দেবে। পারলে ধরে নিয়ে যাবে কটেজে। দেখতে কেমন বলে দিচ্ছি। পাখার নিচটা…।

চিনি, বাধা দিয়ে বললো কিশোর। একটু আগে দুজন মিলিটারি পুলিশ গিয়েছিলো আপনার সাথে কথা বলতে। কাল রাতে কোথায় ছিলেন, জিজ্ঞেস করার জন্যে। ভাবলাম, মিসেস ডেনভার তো বুঝিয়ে বলতে পারবে না, আমরাই বলি।

শূন্য দৃষ্টিতে ওদের দিকে তাকালেন ডাউসন। মিলিটারি পুলিশ গিয়েছিলো আমার বাড়িতে?

হ্যাঁ, কাল রাতে সন্দেহজনক কিছু চোখে পড়েছে কিনা আপনার জিজ্ঞেস করার জন্যে। মথ শিকারে বেরিয়েছিলেন তো তখন। দুটো এরোপ্লেন…

তাকে কথা শেষ করতে দিলেন না ডাউসন। মথ শিকারে। আমি বেরিয়েছিলাম? পাগল নাকি। ঝড় আসছিলো তখন। শুধু আমাদের এই এলাকা কেন, দুনিয়ার কোনো অঞ্চলেই ওরকম সময়ে মথ বেরোয় না। রাতের বেলা হলেও না। আবহাওয়া খারাপ হলে মানুষের অনেক আগেই বুঝতে পারে ওরা।

ডাউসনের কথা শুনে অবাক হলো কিশোর। কিন্তু আপনার বন্ধু ডরি যে বললো, দুজনেই মথ শিকারে বেরিয়েছেন?

এবার ডাউসনের অবাক হওয়ার পালা। ডরি? কাকে দেখতে কাকে দেখেছো! ও তো আমার সাথেই ছিলো বাড়িতে। দুজনে মিলে নোট লিখেছি।

চুপ হয়ে গেল কিশোর। ভাবছে। ব্যাপার কি? মিস্টার ডাউসন কি কিছু ধামাচাপা দিতে চাইছেন? কাল রাতে যে বেরিয়েছিলেন কোনো কারণে স্বীকার করতে চাইছেন না?

দেখুন, স্যার, শেষে বললো সে, কাল রাতে আমি মিস্টার ডরিকেই দেখেছিলাম। অন্ধকার ছিলো বটে, কিন্তু জাল আর চোখের চশমা লুকাতে পারেনি। কালো কাচের চশমা।

ডরি কালো কাচের চশমা পরে না, আরও অবাক হয়ে বললেন ডাউসন। কি সব আবল-তাবল বকছে!

না, স্যার, আবল-তাবল নয়, এবার কথা বললো মুসা। কাল নিজের চোখে দেখে এসেছি তাকে, কালো কাচের চশমা পরতে। একটা প্রজাপতি ধরে নিয়ে গিয়েছিলাম, বিকেলে। আমাদের কাছ থেকে ওটা নিয়ে একটা ডলার দিলো।

তোমাদের মাথা খারাপ! নাকি ইয়ার্কি মারছো আমার সঙ্গে! রেগে গেলেন ডাউসন। অযথা সময় নষ্ট! আমার বন্ধু, আমি জানি না? ডরি কালো কাঁচের চশমা পরে না। কাল বিকেলে বাড়িতেও ছিলো না সে। আমার সঙ্গে বেরিয়েছিলো। দুজনেই শহরে গিয়েছিলাম কিছু দরকারী জিনিস কিনতে। আর তোমরা বলছো কাল তার সাথে দেখা হয়েছে, প্রজাপতি নিয়ে এক ডলার দিয়েছে, রাতে পাহাড়েও আবার কথা বলেছো!

রাগ করবেন না, স্যার, মোলায়েম গলায় বললো কিশোর। কিন্তু আমরা সত্যিই…

আবার বলছে সত্যি! গর্জে উঠলেন প্রজাপতি মানব। চমকে গেল রাফিয়ান। গরগর করে উঠলো।

আর দাঁড়ালেন না ওখানে মিস্টার ডাউসন। গটমট করে নেমে যেতে লাগলেন ঢাল বেয়ে। রাগতঃ ভঙ্গিতে বিড়বিড় করছেন আপনমনে।

খুব অবাক হয়েছে সবাই। তাকালো একে অন্যের দিকে।

মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারছি না! দুহাত নাড়লো কিশোর। কাল রাতে কি তাহলে স্বপ্ন দেখলাম নাকি? একজনকে যে দেখেছি, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। রাফিও দেখেছে। হাতে জাল, চোখে চশমা। কথা বলেছি। মথ না ধরলে ওরকম ঝড়ের রাতে কি করতে বেরিয়েছিলো সে?

জবাবটা দিলো জনি, হয়তো পেন চুরির সঙ্গে ওই লোকের কোনো সম্পর্ক আছে।

কিশোরও একই কথা ভাবছে। চুপ করে তাকিয়ে রইলো জনির দিকে।

উঁহুঁ, মাথা নাড়লো মুসা, আমার তা মনে হয় না। কাল দেখলাম তো কটেজে। ওই লোক আর যা-ই করুক, প্লেন চুরি করতে পারবে না। দেখে ওরকম মনে হয় না।

কিন্তু আমাদেরকে যে টাকা দিয়েছে, সে যদি সত্যিই ডরি না হয়ে থাকে? প্রশ্ন তুললো রবিন।

নাকি ওই ব্যাটাই মিসেস ডেনভারের ছেলে? জিনা বললো।

দেখতে কেমন? জনি জানতে চাইলো। মিসেস ডেনভারের ছেলেকে আমি চিনি। বলেছি না, আমাদের ওখানে মাঝে মাঝে কাজ করতে যায়। ওর ওপর মোটই বিশ্বাস রাখা যায় না। বলো তো কেমন চেহারা, টেড কিনা বুঝতে পারবো।

খাটো, রোগাটে, চোখে কালো কাঁচের চশমা, বলে চেহারার বর্ণনা দিলো মুসা।

ও টেড ডেনভার নয়, মাথা নাড়লো জনি। টেড লম্বা, মোটা, ঘাড় এতো মোটা, নাড়তেই কষ্ট হয়। কোনো রকম চশমাই পরে না।

ব্যাটা তাহলে কে? নিজেকে ডরি বলে চালিয়ে দিলো? সবার দিকে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালো মুসা।

কেউ তার প্রশ্নের জবাব দিতে পারলো না। হঠাৎ তার চোখ পড়লো খাবারের দিকে। আরি, আরি, সব তো নষ্ট হয়ে গেল! অর্ধেক খাওয়াই এখনও বাকি!

নীরবে খেয়ে চললো সকলে।

ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেললে জনি। প্লেন চুরির সঙ্গে এ-সবের কোনো সম্পর্ক আছে কিনা বুঝতে পারছি না…

থাক বা না থাক, ঘোষণা করলো যেন কিশোর, ওই প্রজাপতির খামারের ওপর চোখ রাখতে হবে আমাদের। রহস্যময় কিছু একটা ঘটছে ওখানে, আমি এখন শিওর!

১১

প্রায় সারাটা বিকেল বিমান চুরি আর কালো চশমা পরা লোকটার কথা আলোচনা করেই কাটালো ওরা। একটা কথা কিছুতেই বুঝতে পারছে না, নিজেকে ভরি বলে চালাতে গেল কেন সে? এতো বড় বোকামি কেন করলো? তার বোঝা উচিত ছিলো, কারো সন্দেহ হলে, আর সামান্য খোঁজ করলেই ব্যাপারটা ফাঁস হয়ে যাবে।

হয়তো ব্যাটা পাগল, মুসা বললো। নিজেকে ডরি ভাবতে ভালোবাসে। এজন্যেই, ডরি নয় বলেই ব্যাটা আমাদের প্রজাপতিটা চিনতে পারেনি।

এক কাজ করলে কেমন হয়? জিনা প্রস্তাব দিলো, আজ রাতে গিয়ে লুকিয়ে থেকে চোখ রাখবো প্রজাপতির খামারের ওপর। নকল ডরি, আসল ডরি, ডাউসন, কে কি করে দেখে আসা যাবে।

আমিও এই কথাই ভাবছি, কিশোর বললো। যাবো, তবে সবাই নয়। আমি আর মুসা। তোমরা ক্যাম্পে থাকবে। সবার একসাথে যাওয়া ঠিক হবে না।

আমিও যাবো, জনি বললো।

না, দল ভারি করে লাভ নেই। ধরা পড়ার ভয় আছে। তাহলে রাফিকে নিয়ে যাও, জিনা বললো। তোমাদের বিপদটিপদ হলে…

ও গিয়ে ঝামেলা আরও বাড়াবে, মুসা বললো। কিছু দেখলেই চিৎকার শুরু করবে। অযথা শব্দ করবে। তারচে আমরা দুজনই যাই। ভয় নেই, আমাদের কিছু হবে না। যদি বুড়িটা সত্যি সত্যি ডাইনী না হয়ে থাকে…

হেসে উঠলো জনি। অন্যেরাও হেসে ফেললো মুসার কথা শুনে।

আমি তাহলে বাড়িতেই যাই, জনি উঠে দাঁড়ালো। অনেক কাজ। শোনো, আবারও বলছি, আমাকে নিয়ে যাও। এই এলাকা তোমাদের অচেনা, আমার চেনা। রাতের বেলা আমি সাথে থাকলে সুবিধে হবে…কি বলো?

চুপ করে এক মুহূর্ত ভাবলো কিশোর। তারপর মাথা কাত করলো। ঠিক আছে। তবে খুব সাবধানে থাকবে। এধরনের কাজ করে তোমার অভ্যাস নেই তো…

আমি কোনো বিপদে ফেলবো না তোমাদের, কথা দিলাম। তা কখন রওনা হতে চাও?

এই দশটা নাগাদ। নাকি এগারোটা? এগারোটা হলেই বোধহয় ভালো হয়। অন্ধকার থাকবে তখন।

ঠিক আছে। খামারের পেছনের ওক গাছটার কাছে দেখা হবে। দেখেছে তো, বড় গাছটা? ওটার নিচেই থাকবো আমি।

আচ্ছা।

জনিকে কিছুদূর এগিয়ে দিয়ে এলো রাফি।

চা-টা চলবে নাকি, মুসা? রবিন জিজ্ঞেস করলো। বানাবো?

বানাও,হাত ওল্টালো মুসা। তবে আর কিছু না। দুপুরের খাওয়াটা দেরিতে হয়ে গেছে। খিদে নেই। এখন আর নাস্তার ঝামেলা না করে রাতে একবারেই খাবো।

ও হা, কিশোর মনে করিয়ে দিল, ছটার খবর শোনা দরকার। চুরি যাওয়া প্লেনের কথা কিছু বলতে পারে।

ছ’টা বাজার মিনিটখানেক আগে রেডিও অন করলো সে। খবরের জন্যে কান পেতে রইলো। অবশেষে শুরু হলো খবর। নানারকম খবর পড়ছে সংবাদ পাঠক। ওরা যখন হতাশ হয়ে ভাবতে আরম্ভ করেছে প্লেনের কথা কিছু বলবেই না, তখনই বলা হলোঃ কাল রাতে বাটারফ্লাই হিল এয়ারপোর্ট থেকে চুরি যাওয়া বিমান দুটো পাওয়া গেছে। দুটোই সাগরে পড়েছে। ওগুলোকে পানির তলা থেকে টেনে তোলার ব্যবস্থা হচ্ছে। দুই পাইলটের একজনকেও পাওয়া যায়নি। ধারণা করা হচ্ছে, পানিতে ডুবে মারা গেছে ওরা।…

অন্য খবরে চলে গেল সংবাদ পাঠক।

রেডিও বন্ধ করে দিয়ে সবার মুখের দিকে তাকালো কিশোর। পড়লো কিভাবে? নিশ্চয় ঝড়ে। তাহলে চোরেরা আর যন্ত্র বিক্রি করতে পারলো না।

কিন্তু জনির ভাই তো মারা পড়লো? ফ্যাকাসে হয়ে গেছে জিনার চেহারা।

চোরই যদি হয়ে থাকে জ্যাক ম্যানর, রবিন বললো, তার জন্যে দুঃখ করে লাভ নেই।

কিন্তু সে চোর নয়, প্রতিবাদ করলো জিনা। চোরের মতো লাগেনি।

আমার কাছেও লাগেনি, মুসা বললো।

রবিন ঠিকই বলেছে, কিশোর বললো।চোর হলে দুঃখ করে লাভ নেই। আর চোর না হয়ে থাকলে তো প্লেনেও থাকবে না, মরেওনি, দুঃখ করা প্রয়োজনই হবে না আমাদের। তবে মারা গিয়ে থাকলে জনি বেচারা খুব কষ্ট পাবে। জ্যাক তার কাছে আর হিরো থাকবে না।

হ্যাঁ, মাথা দোলালো রবিন। জ্যাক সত্যি সত্যি মারা গিয়ে থাকলে আর আমাদের এখানে থাকা চলবে না। সারাক্ষণ মন খারাপ করে থাকবে জনি, আমাদের মজা নষ্ট হবে। আর কোনো আনন্দ পাবো না এখানে থেকে।

ভুল বললে, কিশোর বললো, মারা গিয়ে থাকলে আরও বেশিদিন এখানে থাকা উচিত আমাদের। জনিকে খুশি রাখার জন্যে। আমরা চলে গেলে সান্ত্বনা দেয়ার কেউ থাকবে না, ও আরও বেশি মনমরা হয়ে যাবে।

হ্যাঁ, ঠিকই বলেছো তুমি, একমত হলো মুসা। দুঃখের দিনে পাশেই যদি না থাকলো, বন্ধুবান্ধব কিসের জন্যে?

সে-ও নিশ্চয় খবরটা শুনেছে, জিনা বললো। কি মনে হয়, তোমাদের জন্যে ওক গাছের নিচে অপেক্ষা করবে আর?

জানি না, কিশোর বললো। না থাকলেও অসুবিধে নেই। আমাদের তো দুজনেরই যাবার কথা ছিলো। ও তো জোর করে ঢুকলো। যা খুশি ঘটুক, খামারের রহস্যের কিনারা না করে আমি যাচ্ছি না এখান থেকে।

বসে থাকলে সময় কাটতে চায় না, তাই পাহাড়ের ওদিকে ঘুরতে বেরোলো ওরা। ফিরে এলো কিছুক্ষণ পর। আটটায় রাতের খাওয়া শেষ করে আবার রেডিও অন করলো। নটার সংবাদ শুনবে।

কিন্তু নটার সংবাদে আর নতুন কিছু বললো না। ছটায় যা বলেছিলো, তা-ই বললো।

রেডিও বন্ধ করে দিয়ে ফীগ্লাস চোখে লাগিয়ে এয়ারফীল্ডে কি হচ্ছে না হচ্ছে দেখতে চললো কিশোর।

লোকজনের চলাফেরা আর খুব একটা দেখা যাচ্ছে না, বললো সে। শান্ত হয়ে আসছে সব। জ্যাক আর রিডের বন্ধুরা বোধহয় খুব শক পেয়েছে খবর শুনে।

আচ্ছা, আমরা শুনলাম, অথচ ওরা কেউ কাল রাতে প্লেন দুটো উড়তে শুনলো? প্রশ্ন তুললো জিনা।

না শোনার তো কথা নয়, রবিন বললো।

তাহলে বাধা দিলো না কেন?

ঝড়ের জন্যে হয়তো প্রথমে বুঝতে পারেনি কিছু। তারপর তো উড়েই চলে গেল। তখন আর কিছু করার ছিল না।

তা-ই হবে, মাথা ঝাঁকালো জিনা।

আমরা সাড়ে দশটায় রওনা হবো, কিশোর বললো। তোমরা শোয়ার ব্যবস্থা করছে না কেন?

সে করা যাবে, যাও না আগে তোমরা, জিনা বললো। রাফিকে নিয়েই যাও, বুঝেছো? ওই ডাইনী বুড়িটা কি করে বসে ঠিক নেই! তার ওপর রয়েছে কালো চশমাওয়ালা লোকটা। পাজি লোক।

তোমরা এই পাহাড়ে একা থাকবে, রাফিকে তোমাদেরই বেশি দরকার। আমাদের কিছু হবে না। বারোটার মধ্যেই ফিরে আসবো।

খোলা আকাশের নিচে বসে কথা বলছে ওরা। আজ আর মেঘ নেই, ফলে ভাবতে ঢোকারও দরকার নেই। ঝকঝকে তারাজলা আকাশের দিকে তাকিয়ে এখন কল্পনাই করা যায় না, গত রাতে এই সময় কি প্রচণ্ড ঝড়বৃষ্টি ছিলো।

ঘড়ি দেখলো কিশোর। যাবার সময় হয়েছে। মুসা, ওঠো।

রবিন আর জিনাকে সাবধানে থাকতে বলে রওনা হলো দুজনে। আকাশ পরিষ্কার বটে, কিন্তু অন্ধকার যথেষ্ট আছে। খোলা অঞ্চলে এমনিতেই অন্ধকার কিছুটা কম লাগে, কিন্তু তারপরেও যা আছে, অনেক।

তবু সাবধানে থাকতে হবে আমাদের, নিচু গলায় বললো কিশোর। কেউ যাতে দেখে না ফেলে।

সোজা চলে এলো ওরা খামারের পেছনের বড় ওক গাছটার কাছে। জনি নেই। তবে মিনিট দুয়েক পরেই খসখস শব্দ শোনা গেল। জনি এলো। হাঁপানো দেখেই অনুমান করা গেল ছুটে এসেছে।

সরি, দেরি হয়ে গেল, ফিসফিস করে বললো সে। ছটার খবর শুনেছো?

শুনেছি, জবাব দিলো কিশোর। খুব খারাপ লেগেছে আমাদের।

আমাদের লাগেনি, জনি বললো। আমি জানি, জ্যাক ভাইয়া আর রিড ওগুলোতে ছিলো না। যদি মরেই থাকে, দুটো চোর মরেছে। চোরের জন্যে দুঃখ করতে যাব কেন?

না, কোনো কারণ নেই, কিশোর বললো। মনে মনে অবশ্য সে জনির মতো নিশ্চিত হতে পারলো না যে বিমান দুটোতে ওই দুইজন ছিলো না।

তা এখন কি করবে, ভেবেছো কিছু? জনি জিজ্ঞেস করলো। কটেজের জানালায় আলো দেখছি, পর্দা টানেনি বোঝাই যায়। গিয়ে উঁকি দিয়ে দেখতে পারি ভেতরে কি হচ্ছে।

তা-ই করবো। এসো। সাবধান, একটু শব্দও যেন না হয়। আমার পেছনে, একসারিতে এসো।

পা টিপে টিপে কটেজের দিকে এগিয়ে চললো ওরা।

১২

নিঃশব্দে কটেজের কাছে চলে এলো তিনজনে।

জানালার বেশি কাছে যাবে না, সতর্ক করলো কিশোর, ফিসফিস করে কথা বলছে। যতোটা না গেলে নয় ঠিক ততোটা। আমরা দেখবো, কিন্তু আমাদের যেন দেখে না ফেলে।

ওটা বোধহয় রান্নাঘরের জানালা, মুসা বললো। মিসেস ডেনভার হয়তো ওখানেই থাকে। ঘুমিয়েছে কিনা কে জানে!

জানালার কাছে এসে দাঁড়ালো ওরা। পর্দা নেই। একটা মাত্র মোম জ্বলছে ঘরে। আলোর চেয়ে ছায়াই বেশি।

ঘুমায়নি মিসেস ডেনভার। বাদামী রঙের একটা রকিং চেয়ারে বসে ধীরে ধীরে দুলছে সামনে পেছনে। পরনে ময়লা ড্রেসিং গাউন। মুখ দেখা যাচ্ছে না স্পষ্ট, তবু কিশোরের মনে হলো, ভয় পাচ্ছে মহিলা। কোনো কারণে অস্বস্তিতে ভুগছে। বুকের ওপর ঝুলে পড়েছে মাথাটা। মাঝে মাঝে কাঁপা হাতে সরিয়ে দিচ্ছে মুখের ওপর এসে পড়া ধোঁয়াটে চুল।

না, ডাইনী নয়! ফিসফিসিয়ে বললো মুসা। এখন শিওর হলাম। ডাইনী হলে ওভাবে ভয় পেতো না। এখন বসে বসে তপজপ করতো। আসলে ও অতি সাধারণ এক বৃদ্ধা।

এত রাত পর্যন্ত জেগে রয়েছে কেন? নিজেকেই যেন প্রশ্নটা করলো কিশোর। কারো অপেক্ষা করছে নিশ্চয়।

আমারও সেরকমই মনে হচ্ছে, জনি বললো। আরও হুঁশিয়ার থাকতে হবে আমাদের। বলে চট করে একবার পেছনে তাকিয়ে নিলো সে, পেছন থেকে এসে ঘাড়ের ওপর কেউ পড়ছে কিনা দেখলো।

চলো, ঘুরে বাড়ির সামনের দিকে চলে যাই, মুসা বললো।

সামনের দিকেও একটা আলোকিত জানালা দেখা গেল। রান্নাঘরের চেয়ে অনেক বেশি আলো এখানে। কারও চোখে পড়ে যাওয়ার ভয়ে কাঁচের শার্সির কাছ থেকে দূরে রইলো ওরা। টেবিলের সামনে বসে থাকতে দেখা গেল দুজন লোককে, একগাদা কাগজ ঘাটাঘাটি করছে।

মিস্টার ডাউসন, নিচু গলায় বললো কিশোর। অন্য লোকটা নিশ্চয় তাঁর বন্ধু ডরি। চোখে চশমা তো সত্যিই নেই। এই লোকের সঙ্গে দেখা হয়নি আমাদের, টাকাও এই লোক দেয়নি। যে দিয়েছিলো তার সঙ্গে এর কোনো মিল নেই।

লোকটার দিকে তাকিয়ে রয়েছে তিনজনে। অতি সাধারণ চেহারা, আর দশজনের মাঝখান থেকে আলাদা করে চেনা যাবে না। ছোট গোঁফ, কালো চুল, বড় নাক।

কি করছে? জনির প্রশ্ন।

কোনো কিছু লিস্ট করছে, কিশোর বললো। বোধহয় কাস্টোমারদের। বিলটিল বানাবে আরকি। মিস্টার ডাউসন ঠিকই বলেছিলেন, আমাদেরকে যে টাকা দিয়েছে সে ডরি নয়। তারমানে কাল রাতে পাহাড়ে জাল হাতে এই লোককে দেখিনি।

তাহলে সে কে? বলে জানালার কাছ থেকে টেনে দুজনকে সরিয়ে আনলো মুসা, সহজভাবে কথা বলার জন্যে। আর কেনই বা জাল হাতে পাহাড়ে গেল সে? মথ শিকারের মিথ্যে গল্প শোনালো? আর যে রাতে প্লেনগুলো চুরি গেল, ঠিক সেই রাতেই কেন?

ঠিক, কেন? মুসার সুরে সুর মেলালো জনি। আরও আস্তে কথা বলার জন্যে তাকে কনুইয়ের গুতো লাগালো কিশোর। কাল রাতে নিশ্চয় রহস্যময় কিছু ঘটেছিলো পাহাড়ে, আস্তেই বললো সে। এমন কিছু, যে ব্যাপারে লোকে কিছুই জানে না। কিশোর, তোমরা তো গোয়েন্দা। ধরো না ওই লোকটাকে, যে নিজেকে ডরি বলে চালিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছে। খুঁজে বের করো তাকে। জিজ্ঞেস করো এসবের মানে কি?

করবো, কথা দিলো কিশোর। এখন দেখি, আর কোনো জানালায় আলো আছে কিনা?…আছে, ওই যে একটায়। ছাতের ঠিক নিচে। কে থাকে ওখানে?

হয়তো বুড়ির ছেলে, আন্দাজ করলো মুসা। থাকতেও পারে, জনি বললো। কিন্তু দেখবো কিভাবে?

উপায় আছে, কিশোর বললো, দিনের বেলায় দেখেছি। পলকের জন্যে টর্চ জ্বেলেই নিভিয়ে ফেললো সে, যাতে কাছেই ছাউনির বেড়ায় ঠেস দিয়ে রাখা মইটা ওরা দেখতে পারে।

যা, দেখা যাবে, মুসা বললো। তবে খুব আস্তে আস্তে আনতে হবে ওটা। শব্দ করা চলবে না। মই লেগে সামান্য ঘষার আওয়াজ হলেও ওঘরে যে আছে, উঁকি দিয়ে দেখতে আসবে।

তিনজনে মিলে বয়ে আনবো, শব্দ হবে কেন? জানালাটা বেশি ওপরে না, মইটাও লম্বা না যে বেশি ভারি হবে।

সত্যি বেশি ভারি না মইটা। বয়ে এনে আস্তে করে কটেজের দেয়ালে ঠেকাতে কোনো অসুবিধেই হলো না ওদের। শব্দ হলো না।

আমি আগে উঠি, কিশোর বললো। মইটা শক্ত করে ধরে রাখো। আর আশেপাশে নজর রাখবে। কারও সাড়া পেলে কিংবা কাউকে আসতে দেখলে সতর্ক করে দেবে আমাকে। মইয়ের ওপর আটকে থেকে বিপদে পড়তে চাই না।

দুদিক থেকে মইটাকে শক্ত করে ধরে রাখলো জনি আর মুসা। বেয়ে ওপরে উঠলো কিশোর। জানালার চৌকাঠের কাছে পৌঁছে সাবধানে মাথা তুললো।

এই ঘরেও মাত্র একটা মোম জ্বলছে। খুব ছোট ঘর। আসবাবপত্র নেই বললেই চলে। অগোছালো। বিছানায় বসে আছে একজন বিশালদেহী মানুষ। চওড়া কাধ, ভীষণ মোটা বাড়।

লোকটার দিকে একনজর তাকিয়েই নিশ্চিত হয়ে গেল কিশোর, হ্যাঁ, এই লোক মায়ের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করতেই পারে। ভয়ানক নিষ্ঠুর চেহারা। মনে পড়লো বৃদ্ধার কথাঃ আমাকে মারে সে! হাত মুচড়ে দেয়! খুব খারাপ লোক!

মোমের কাছে ধরে একটা খবরের কাগজ পড়ছে লোকটা।

কিছুক্ষণ পর পকেট থেকে একটা ঘড়ি বের করে সময় দেখলো। বিড়বিড় করে কি বললো, বোঝা গেল না। তারপর উঠে দাঁড়ালো লোকটা। ভয় পেয়ে গেল কিশোর, জানালার কাছে চলে আসবে না তো সে? আর এখানে থাকা যায় না। শব্দ না করে যতো তাড়াতাড়ি পারলো নেমে এলো মই বেয়ে।

মিসেস ডেনভারের ছেলে, বন্ধুদেরকে জানালো সে। ও জানালার কাছে আসবে এই ভয়ে তাড়াহুড়ো করে নেমেছি। জনি, তুমি গিয়ে একবার দেখে এসো। তাহলে পুরোপুরি শিওর হওয়া যাবে যে ওই লোকটাই টেড ডেনভার।

মই বেয়ে উঠে গেল জনি। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই নেমে এলো আবার। হ্যাঁ, টেডই। আশ্চর্য! এতোখানি বদলে গেল! শয়তানের মতো লাগছে আজ। অথচ কয়েক দিন আগেও এতোটা খারাপ লাগেনি। মা সন্দেহ করতো, খারাপ লোকের সঙ্গে ওঠাবসা আছে তার। অনেক বেশি মদ খায়। ওই করে করেই এরকম চেহারা হয়েছে।

এমনভাবে ঘড়ি দেখলো, কিশোর বললো, যেন কারো আসার অপেক্ষা করছে। আমাদেরকে যে টাকা দিলো, কাল রাতে পাহাড়ে গেল, সেই চশমা পরা লোকটার জন্যে নয় তো? নিশ্চয় কোনো খারাপ মতলব আছে ব্যাটাদের। নইলে মিথ্যে কথা বলবে কেন?

এসো, জনি বললো, কোথাও লুকিয়ে থাকি। দেখবো, কি করে?

হ্যাঁ। ওই গোলাঘটায় চলো।

নিঃশব্দে ভাঙা বাড়িটার কাছে চলে এলো ওরা। ছাতের অনেকখানি নেই। দেয়ালও বেশির ভাগই ধসে পড়েছে। পুরোপুরি ধসে পড়ার অপেক্ষাতেই যেন এখন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ধুকছে ভাঙা বাড়িটা। ভাপসা গন্ধ। নোংরা। বসার কোনো পরিষ্কার জায়গাই নেই। আশাও করেনি কিশোর। ধুলো লেগে থাকা কয়েকটা পুরানো বস্তা এককোণে টেনে নিয়ে গিয়ে বসে পড়লো তার ওপরেই।

খাইছে! কি গন্ধরে বাবা! নাক সিঁটকালো মুসা। আলু পচেছে। এখানে বসা যাবে না। চলো, আর কোথাও যাই।

শশশ! হুঁশিয়ার করলো কিশোর। একটা শব্দ শুনলাম!

চুপ করে বসে কান পাতলো ওরা। শব্দটা তিনজনেই শুনতে পাচ্ছে। খুব হালকা পায়ে এগিয়ে আসছে কেউ। পায়ে রবার সোলের জুতো, সেজন্যেই বেশি শব্দ হচ্ছে না। চলে গেল গোলাঘরের পাশ দিয়ে। তারপর শোনা গেল মৃদু শিস।

উঠে দাঁড়িয়ে ভাঙা জানালা দিয়ে উঁকি দিলো কিশোর। দুজন লোক, জানালো সে। টেডের জানালার নিচে দাঁড়িয়ে আছে। ওদের জন্যেই নিশ্চয় অপেক্ষা করছিলো টেড। ওই যে, টেড নামছে মনে হয়। এখানে না আবার কথা বলতে চলে আসে!

সরে যাওয়া উচিত। কিন্তু আর সময় নেই। কটেজের সামনের দরজা খোলার আওয়াজ হলো। বেরিয়ে এলো টেড। এখনও তাকিয়েই রয়েছে কিশোর। সামনের জানালা দিয়ে মিস্টার ডাউসনের ঘর থেকে এসে পড়া স্নান আলোয় আবছামতো দেখতে পাচ্ছে লোকগুলোকে।

গোলাঘরের দিকে এলো না ওরা। কটেজের কোণ ঘুরে নিঃশব্দে চলে গেল তিনজনেই।

এসো, জরুরী গলায় বললো কিশোর, পিছু নেবো। ব্যাটাদের কথা শুনতে হবে। তাহলে বোঝা যাবে কি করছে।

কটা বাজে? মুসা বললো। আমাদের দেরি দেখলে রবিনরা না আবার চিন্তা করে।

বারোটা বেজে গেছে, স্যুমিনাস ডায়াল ঘড়ি দেখে বললো কিশোর। ওরা বুঝবে, জরুরী কোনো কাজে জড়িয়ে গেছি আমরা।

পা টিপে টিপে কটেজের অন্যপাশে বেরিয়ে এলো ওরা। লোকগুলোকে দেখা গেল কাঁচের ঘরের ওপাশে কয়েকটা গাছের গোড়ায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে। কথা বলছে, কিন্তু এতো নিচু গলায়, কিছু বোঝা যায় না এখান থেকে।

তারপর গলা চড়ালো একজন লোক। জনি চিনতে পারলো, টেড ডেনভার। কোনো কারণে রেগে গেছে। খুব বদমেজাজী। যদি বোঝে তাকে ঠকানোর চেষ্টা হচ্ছে, তাহলে আর এক মুহূর্ত শান্ত থাকতে পারে না।

অন্য দুজন তাকে শান্ত করার চেষ্টা করলো। কিন্তু লাভ হলো না। চিৎকার করে বললো টেড, আমি কিছু শুনতে চাই না। আমি আমার টাকা চাই। তোমরা যা যা করতে বলেছে, তাই করেছি। তোমাদের সাহায্য করেছি, এখানে এনে লুকিয়ে রেখেছি। কাজ শেষ হয়ে গেছে, এখন আমার টাকা দাও।

এতো জোরে কথা বলছে সে, ভয় পেয়ে গেল অন্য দুজন। তারপর ঠিক কি ঘটলো, বুঝতে পারলো না ছেলেরা। কানে এলো, একটা ঘুসির শব্দের পর পড়ে গেল একজন। তারপর আরেকটা ঘুসি, আরেকজন পড়ে গেল। খিকখিক করে হেসে উঠলো টেড। কুৎসিত হাসি।

কয়েক সেকেণ্ড পরেই কটেজের জানালায় দেখা দিলো মিস্টার ডাউসন আর ডরির মুখ। শোনা গেল উদ্বিগ্ন কণ্ঠ, কে ওখানে? কি হয়েছে?

ঝনঝন করে কাঁচ ভাঙলো। বড় একটা পাথর কুড়িয়ে নিয়ে কাঁচের ঘর সই করে ছুঁড়েছে টেড। এতো জোরে হলো আওয়াজ চমকে গেল কিশোররা।

কিছু না, স্যার, চেঁচিয়ে জবাব দিলো টেড। কে যেন ঘোরাফেরা করছিলো এখানে। চোর মনে করে দেখতে বেরোলাম। ঠিকই আন্দাজ করেছি। আমার সাড়া পেয়েই বোধহয় দৌড়ে পালাতে গিয়ে কাঁচের ঘরের ওপর পড়ে কাচ ভেঙেছে।

ধরতে পারলে না?

চেষ্টা তো করলাম। পালালো। তারপর যেন ভাগ্য তার প্রতি সদয় হয়েই দেখিয়ে দিলো তিন কিশোরকে। টর্চ জ্বাললো সে। আর আলো এসে পড়লো একেবারে কিশোরদের ওপর। চেঁচিয়ে উঠলো সে, কে? এই তো, পেয়েছি। তোমরাই, অ্যাঁ? তাহলে তোমরাই এসেছো চুরি করতে? কাঁচের ঘরের দেয়াল ভেঙেছো? দাঁড়াও, দেখাচ্ছি মজা!

১৩

পালানোর চেষ্টা করলে অবশ্য সবাই ধরা পড়তো না, কিন্তু সে চেষ্টা করলো না ওরা। জনি আর মুসার কজি চেপে ধরলো টেড। অবাক হলো মুসা। সাংঘাতিক জোর লোকটার গায়ে। হাতই নাড়াতে পারছে না সে, এতো জোরে ধরেছে।

বেরিয়ে এলেন মিস্টার ডাউসন আর ডরি। কিশোরকে ধরলেন।

এখানে কি করছো? কাচের ঘর ভাঙলে কেন? রেগেমেগে বললো ডাউসন। ভাঙা ফোকর দিয়ে এখন আমাদের সমস্ত প্রজাপতি বেরিয়ে যাবে!

ছাড়ুন, হাত ছাড়ন, কণ্ঠস্বর স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করলো কিশোর। আমরা ভাঙিনি।

ও-ই ভেঙেছে! চিৎকার করে বললো টেড। আমি দেখেছি।

মোটেই দেখোনি, মিথ্যুক কোথাকার। ভাঙলে তো তুমি! এখন বলছো আমাদের নাম! পাল্লা দিয়ে চেঁচিয়ে উঠলো জনি। ছাড়ো আমাকে। আমি জোনার কলিউড। ভালো চাইলে ছাড়ো আমাকে, নইলে আমার বাবা তোমার মুণ্ডু চিবিয়ে বাবে!

ও জনি, দাঁত বের করে হাসলো টেড। জোনার কলিউড। যার বাবা টেডকে খারাপ লোক বলে ফার্মে চাকরি দিতে চায় না। অথচ দিনমজুরী করাতে বাধে না। দাঁড়াও, এইবার পেয়েছি সুযোগ। অপমানের প্রতিশোধ নেববা আমি। মুরগী চুরি করতে আসার অপরাধে পুলিশ যখন তার ছেলেকে কান ধরে টেনে নিয়ে যাবে, তখন টের পাবে কে খারাপ আর কে ভালো।

ডাউসনকে বোঝানোর চেষ্টা করলো কিশোর, কিন্তু তিনিও কিছুই শুনতে চাইলেন না।

মুসা আর জনিকে টানতে টানতে ছাউনির দিকে চললো টেড। ডাউসন আর ডরিকে বললো, ওদেরকেও নিয়ে আসুন। সারারাত অন্ধকার ঘরে বন্দী থাকলে সকালে আপনিই তেজ কমে যাবে।

হাত ছাড়ানোর কোনো চেষ্টাই করলো না কিশোর।

এই সময় শোনা গেল কুকুরের ঘেউ ঘেউ।

রাফিয়ান! শান্তকণ্ঠে কিশোর বললো, কামড় খেতে না চাইলে হাত ছাড়ন।

রাফি! রাফি! চেঁচিয়ে ডাকলো মুসা। এদিকে আয়! আমরা এখানে!

এমন বিকট গর্জন করে উঠলো রাফিয়ান, টেড পর্যন্ত ভয় পেয়ে গেল। লাফিয়ে কাছে চলে এলো। কামড় বসানোর আগে টেডের পায়ের কাছে মুখ এনে খটাস করে বন্ধ করলো হাঁ। ভয় দেখানোর জন্য। দাঁতে দাঁতে বাড়ি খেয়ে যে আওয়াজ হলো, তাতেই ভয়ে সিটিয়ে গেল টেড। কখন যে ছেড়ে দিলো মুসা আর জনিকে নিজেই বলতে পারবে না। ডাউসন আর ডরি কিশোরকে ছেড়ে দিয়ে আগেই দৌড় দিয়েছে দরজার দিকে।

টেডও তাদের পিছু নিলো। তেড়ে গেল রাফি।

চলো দেখি, কিশোর বললো, লোক দুটোর কি হলো?

কিন্তু নেই ওরা। ঘুসি খেয়ে পড়ে গিয়েছিল বটে, কিন্তু গোলমালের সুযোগে গা ঢাকা দিয়েছে।

পালিয়েছে! জনি বললো। তো, এখন? আর তো কিছু করার নেই এখানে?

না, কিশোর বললো। আমরা ক্যাম্পে ফিরে যাবো। খুব একটা কিছু জানতে পারলাম না। শুধু জানা গেল, ডাউসন সত্যি কথাই বলেছেন, চশমাওয়ালা লোকটা ডরি নয়। টেড ডেনভার খারাপ লোক, বাজে লোকের সঙ্গে তার মেলামেশা…

এবং ওদেরকে কোনোভাবে সাহায্য করেছে, কিশোরের কথাটা শেষ করলো মুসা। ওদেরকে এখানে এনে লুকিয়েছে। কাজের বিনিময়ে পয়সা পায়নি। কিন্তু কাজটা কি করেছিলো?

জানি না। মাথা আর কাজ করছে না এখন। চলো, গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ি। কাল এসব নিয়ে ভাববো। জনি, বাড়ি চলে যাও।

অধীর হয়ে অপেক্ষা করছে রবিন আর জিনা। কিশোরদেরকে দেখেই বলে উঠলো, কি ব্যাপার? কি হয়েছিলো? এতো রাত করলে? রাফি তাহলে ঠিকমতোই খুঁজে পেয়েছে তোমাদের?

এক্কেবারে সময়মতো, হেসে বললো মুসা। আমাদের দেরি দেখে পাঠিয়েছিলে, না?

হ্যাঁ, জিনা বললো। আমরাও যেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু রবিন বললো, আগে রাফিই যাক। ও যদি না ফেরে তাহলে আমরা যাবো। তা হয়েছিলো কি?

সব কথা ওদেরকে জানালো মুসা আর কিশোর।

অবাক কাণ্ড! রবিন বললো। হচ্ছেটা কি ওই প্রজাপতির খামারে! টেড ওই লোক দুটোকে কি সাহায্য করেছে? কিভাবে বের করা যায়, বলো তো?

হাজার চেষ্টা করেও টেডের কাছ থেকে জানা যাবে না, কিশোর বললো। দেখি, কাল আবার যাবো খামারে। টেড যদি তখন না থাকে, তার মাকে ফুসলেফাঁসলে কিছু কথা আদায়ের চেষ্টা করবো।

হ্যাঁ, ওই মহিলা নিশ্চয় অনেক কিছু জানে, রবিন বললো। দুজন লোককে কটেজে লুকিয়ে রেখেছিলো তার ছেলে। এর মানে ওদের খাওয়া মিসেস ডেনভারকেই জোগাতে হয়েছে। কিন্তু বলবে তো?

সেটা কাল দেখা যাবে। কথা বলতে আর ভাল্লাগছে না এখন। আমি ঘুমাতে যাচ্ছি।

পরদিন বেশ বেলা করে ঘুম ভাঙলো ওদের।

ভাঁড়ারে গিয়ে দেখা গেল, খাবার ফুরিয়েছে। কিশোর আশা করলো, জনি ওদের জন্যে খাবার নিয়ে আসবে। আর যদি না-ই আসে, ওরাই যাবে ফার্মে, খাবার আনতে। রুটি, মাখন আর সামান্য পনির দিয়ে নাস্তা সেরে বসে রইলো জনির অপেক্ষায়।

এখান থেকে সোজা প্রজাপতির খামারে যাবো আমরা, কিশোর বললো। রবিন, মিসেস ডেনভারের সঙ্গে কথাবার্তা তুমিই বলবে। তোমার কথার জবাব হয়তো দিতে পারে। কারণ টাকাটা তুমিই তার হাতে দিয়েছে। কাজেই চক্ষুলজ্জার খাতিরে হলেও কিছু বলে ফেলতে পারে।

ঠিক আছে, মাথা কাত করলো রবিন। তা যাবো কখন? এখনই?

দেখি আরেকটু। জনি আসে কিনা।

জনি এলো না। প্রজাপতির খামারে রওনা হলো গোয়েন্দারা।

কটেজের কাছে এসে সাবধান হলো ওরা। টেড-এর সামনে পড়তে চায় না। কিন্তু কটেজে সে আছে বলে মনে হলো না। এমনকি প্রজাপতি মানবদেরও দেখা

গেল না।

প্রজাপতি ধরতে বেরিয়েছে হয়তো, মুসা বললো। ওই যে, মিসেস ডেনভার। কতগুলো কাপড় ধুয়েছে দেখেছো? খুব পরিশ্রম হয়েছে বোধহয়। দড়িতে টানাতেই হাত কাঁপছে এখন। রবিন, যাও, ওকে সাহায্য করো।

মহিলার কাছে চলে এলো রবিন। মিষ্টি হেসে জিজ্ঞেস করলো, এই যে মিসেস ডেনভার, কেমন আছেন?…আহহা, অনেক কষ্ট হচ্ছে তো আপনার। দিন, আমি মেলে দিই। মহিলার মুখের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলো। ডান চোখের চারপাশ কালো হয়ে ফুলে উঠেছে। আরে, আপনার চোখে কি হলো?

মিসেস ডেনভারের কাছ থেকে কাপড়ের বালতিটা নিয়ে নিলো রবিন। বাধা দিলো না মহিলা। চুপচাপ দাঁড়িয়ে রবিনের কাজ দেখতে লাগলো।

মিস্টার ডাউসন আর মিস্টার ডরি কোথায়? জিজ্ঞেস করলো রবিন।

বিড়বিড় করে যা বললো মহিলা, বুঝতে বেশ অসুবিধে হলো রবিনের। কথার মর্মোদ্ধার করতে পারলো শুধু, দুজনে প্রজাপতি ধরতে বেরিয়েছে।

আপনার ছেলে টেড কোথায়? আবার প্রশ্ন করলো রবিন।

হঠাৎ ফোঁপাতে আরম্ভ করলো মহিলা। নোংরা অ্যাপ্রন তুলে মুখ ঢেকে এগোলো রান্নাঘরের দিকে।

আশ্চর্য! আনমনে বিড়বিড় করলো রবিন। হলো কি আজ মহিলার! কাপড় মেলা বাদ দিয়ে তাড়াতাড়ি তার পেছনে পেছনে গেল সে। ধরে বসিয়ে দিলো রকিং চেয়ারটায়।

মুখ থেকে কাপড় সরিয়ে রবিনের দিকে তাকালো মহিলা। তুমিই আমাকে ডলারটা দিয়েছিলে; না? রবিনের হাতে আলতো চাপড় দিয়ে বললো, খুব ভালো ছেলে তুমি। মনটা খুব নরম। জানো, কেউ ভালো ব্যবহার করে না আমার সঙ্গে। আর আমার ছেলেটা তো একেবারেই না। যখন তখন শুধু মারে।

আপনার চোখে ঘুসি মেরেছিলো, না? নরম গলায় সহানুভূতির সুরে বললো রবিন। কবে? কাল?

হ্যাঁ। টাকা চাইছিলো। ও সব সময় আমার কাছে টাকা চায়। আবার ফুপিয়ে উঠলো মহিলা। টাকা দিতে পারিনি বলে মেরেছে। তারপর পুলিশ এসে ধরে নিয়ে গেল ওকে।

কি বললেন! পুলিশ! নিশ্চয় আজ সকালে। অবাক হয়ে গেছে রবিন। পায়ে পায়ে অন্যেরাও এসে দাঁড়িয়েছে দরজার কাছে, তাদের কানেও গেছে কথাটা।

পুলিশ বললো, সে নাকি চোর, ফোঁপাতে ফোঁপাতে বললো মিসেস ডেনভার। মিস্টার হ্যারিসনের হাঁস চুরি করেছে। আগে এরকম ছিলো না আমার ছেলে। ওই শয়তান লোকগুলো এসেই তার সর্বনাশ করেছে, তাকে বদলে দিয়েছে।

কোন লোক? মহিলার হাড্ডি-সর্বস্ব হাতে হাত বুলিয়ে দিয়ে রবিন বললো, আমাদেরকে সব খুলে বলুন, সব ঠিক হয়ে যাবে। আমরা আপনাকে সাহায্য করবো।

ওই লোকগুলো তাকে নষ্ট করেছে!

কোন লোক? কোথায় থাকে ওরা? এখনও কি এখানে লুকিয়ে আছে?

ওরা চারজন, এতো নিচু গলায় বললো মহিলা, শোনার জন্যে মাথা নিচু করে কান পাততে হলো রবিনকে। আমার ছেলেকে এসে বললো, ওদেরকে যদি খামারে লুকিয়ে থাকার ব্যবস্থা করে দেয়, তাহলে অনেক টাকা দেবে। বদলোক ওরা, নিশ্চয় কোনো খারাপ মতলব আছে, তখনই বুঝেছি। ওপরে আমার শোবার ঘরে বসে কানাকানি, ফিসফাঁস করতো ওরা, দরজায় আড়ি পেতে সব শুনেছি।

মতলবটা কি ওদের, জানেন?হৃৎপিণ্ডের গতি দ্রুত হয়ে গেছে রবিনের।

কোনো কিছুর ওপর নজর রাখছিলো ওরা। পাহাড়ের ওদিকের কোনো কিছুর ওপর। কখনও দিনে, কখনও রাতে। আমার শোবার ঘরটাও দখল করেছিলো ওরা, এখানে ঘুমাতো। আমি ওদের খাবার বেঁধে দিতাম। কিন্তু এর জন্যে একটা পয়সাও দেয়নি আমাকে। জঘন্য লোক!

আবার কাঁদতে লাগলো মহিলা। সবাই এসে ঘরে ঢুকেছে। কোমল গলায় সান্ত্বনা দিলো কিশোর, কাঁদবেন না, মিসেস ডেনভার। এর একটা বিহিত আমরা করবোই।

বাইরে পায়ের আওয়াজ পাওয়া গেল এই সময়। জানালার কাছে এসে দাঁড়ালেন মিস্টার ডাউসন। তোমরা! আবার এসেছে! কিশোর আর মুসার ওপর চোখ পড়তে চেঁচিয়ে উঠলেন তিনি। তোমাদের শাস্তির ব্যবস্থাও হয়েছে। পুলিশকে সব বলে দিয়েছি। আজ সকালে টেডকে যখন নিতে এসেছিলো তখন। রাতের বেলা আমার প্রজাপতির ঘর ভাঙো! মজা টের পাবে। কত্তোবড় সাহস, আবার এসেছে এখানে!

১৪

চলো যাই, জিনা বললো। এখানে আর কথা বলা যাবে না। মিসেস ডেনভারও বোধহয় আর কিছু জানে না। ওর ছেলেটাকে ধরে নিয়ে যাওয়ায় খুব খুশি হয়েছি। আমি। আর এসে মাকে মারতে পারবে না। এমন বদমাশ ছেলে, মাকে মারে…

তোমরাও কি কম নাকি? জানালার বাইরে থেকে বললেন ডাউসন।

চুপ করুন! রেগে গেল জিনা। আপনার সঙ্গে কে কথা বলে? না বুঝে বক বক করেন…

এই মেয়ে, মুখ সামলে কথা বলবে। ধমকে উঠলেন ডাউসন।

জিনাকে আর কিছু বলতে হলো না। প্রচণ্ড ঘাউ করে উঠে লাফিয়ে গিয়ে জানালার কাছে পড়লো রাফি। পারলে জানালা দিয়ে মুখ বের করেই ডাউসনকে কামড়ায়। আর দাঁড়ালেন না ওখানে প্রজাপতি মানব। ঘুরেই দিলেন দৌড়।

রান্নাঘর থেকে বেরোতেই দেখা গেল কাঁচের ঘরগুলোর কাছে দাঁড়িয়ে আছেন ডাউসন।

আমরা যাচ্ছি, শীতল গলায় বললো কিশোর। পুলিশের সাথে দেখা হলে ভালোই হয়। আমাদেরও কথা আছে ওদের সঙ্গে। এখানে অনেক কিছু ঘটছে, আপনি এর কিছুই জানেন না। প্রজাপতি ছাড়া আপনার চোখে আর কিছু পড়ে না।

তাতে তোমার কি, বেয়াদব ছেলে!

আমার কিছু না, আপনারই ক্ষতি হচ্ছে। আপনি কি জানেন, এই বাড়িতে কি সব কাণ্ড ঘটছে? জানেন, টেড ডেনভার তার মাকে ধরে ধরে মারে? চোখে যে কালশিরা পড়েছে মহিলার, আজ সকালে তা-ও নিশ্চয় আপনার চোখে পড়েনি। পুলিশ আপনাকেও ধরবে। আপনার এখানে যে চার চারটে মানুষ লুকিয়ে থাকতো, দিনরাত আনাগোনা করতো, পুলিশ আপনাকে সেসব কথা জিজ্ঞেস করবে না ভেবেছেন?

কি বলছো তুমি, বদমাশ ছেলে? বিস্ময়ে হাঁ হয়ে গেল ডাউসনের মুখ। মানুষ? কেথেকে এলো? কারা?

জানি না। তবে জানতে পারলে ভালো হতো। আর কোনো কথা না বলে দলবল নিয়ে পাহাড়ের দিকে এগোলো কিশোর। পেছনে তাকালে দেখতে পেতো, এখনও হাঁ করে রয়েছেন বিস্মিত প্রজাপতি বিশেষজ্ঞ।

কি মানুষরে বাবা! ঝাঁঝালো কণ্ঠে জিনা বললো। একই বাড়িতে থাকে, অথচ কিছুই দেখে না, খেয়াল করে না! বিজ্ঞানীগুলো সব এক। আমার বাবাকে দেখোনা, খালি থাকে গবেষণা নিয়ে, বাইরের আর কিছু চোখে পড়ে না।

এখন কথা হলো, অন্য প্রসঙ্গে চলে গেল রবিন, লোকগুলো কে? পাহাড়ে উঠে কিসের ওপর চোখ রাখতো? কেন? কিশোর, ঝড়ের রাতে ওদেরই একজনকে দেখেছিলে। নিজেকে ডরি বলে চালিয়েছে। হাতে ছিলো প্রজাপতি ধরার জাল, যাতে তার এই রাতে ঘোরাঘুরির ব্যাপারে কু প্রশ্ন না তোলে।

হ্যাঁ, তুমি ঠিকই বলেছে, কিশোর বললো। চোখ রেখেছিলো ওরা এয়ারফীন্ডের ওপর। আমি একটা আস্ত গর্দভ! আগে কেন ভাবলাম না কথাটা? রাতদিন পাহারা দিয়েছে ওরা। দুজন রাতে, দুজন দিনে। দুজন করে লুকিয়ে থেকেছে মিসেস ডেনভারের শোবার ঘরে।

কিশোর, উত্তেজিত হয়ে উঠেছে জিনা, প্লেন চুরির সাথে এর কোনো সম্পর্ক নেই তো?

নিশ্চয় আছে। এছাড়া আর কি? কিন্তু এর সাথে রিড আর জ্যাককে কিভাবে জড়ালো, সেটাই বুঝতে পারছি না। পুলিশকে জানানো দরকার। তবে তার আগে জানানো দরকার, বড় কাউকে। পুলিশ আমাদের কথা বিশ্বাস না-ও করতে পারে। এখানে একমাত্র জনির বাবাকেই বলা যায়।

আমারও তাই মনে হয়, রবিন বললো।

চলো।

পাহাড়ী পথ ধরে প্রায় ছুটে চললো ওরা।

ফার্মের চত্বরে ঢুকেও কাউকে চোখে পড়লো না। একেবারে নির্জন।

জনির নাম ধরে ডাকলো মুসা।

গোলাঘরের দরজায় দেখা দিলে জনি। চেহারা ফ্যাকাসে। রাতে নিশ্চয় ভালো ঘুম হয়নি। উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো, কি ব্যাপার? খুব উত্তেজিত মনে হচ্ছে?

তোমার বাবা কোথায়? কিশোর জিজ্ঞেস করলো। জরুরী কথা আছে।

দীর্ঘ এক মহূর্ত কিশোরের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো জনি। আর কোনো প্রশ্ন করলো না। মাঠের দিকে তাকিয়ে-যেখানে লাল-সাদা গরুগুলো চরছেচেঁচিয়ে বাবাকে ডাকলো সে।

ডাক শুনে তাড়াহুড়ো করে এগিয়ে এলেন মিস্টার কলিউড। কি ব্যাপার? বাবা, কিশোর কি যেন বলবে তোমাকে।

এক এক করে ছেলেমেয়েদের মুখের দিকে তাকালেন কলিউড। বললেন, তোমরাই তাহলে জনির বন্ধু। গুড়। তা কি বলবে?

আপনি নিশ্চয় খুব ব্যস্ত, কিশোর বললো। বেশি দেরি করাবো না। সংক্ষেপে সব কথা বলতে লাগলো সে। প্রজাপতির খামারে কাকে কাকে দেখেছে, পাহাড়ের ওপর কাকে দেখেছে, খামারের বৃদ্ধা মহিলা আর তার ছেলের কথা…টেডের কথায় আসতেই মাথা ঝাঁকালেন কলিউড। অতো খারাপ ছিলো

আগে। বছরখানেক আগে থেকে শুরু হয়েছে, যখন অসৎ-সঙ্গে পড়লো।

ওর সঙ্গীদের কয়েকজনের সাথে দেখা হয়েছে কাল রাতে, গতরাতের অভিযানের কথা খুলে বললো কিশোর। সকালে খামারে গিয়েছিলো, মিসেস ডেনভারের সাথে কি কি কথা হয়েছে, তা-ও জানালো।

খারাপ কাজ করলে শাস্তি পেতেই হবে, আনমনে বললেন কলিউড। সব কথা বলতে হবে তাকে, কাকে কাকে জায়গা দিয়েছিলো, কেন দিয়েছিলো, ওরা কারা, সঅব। আমারও মনে হচ্ছে পেন চুরির সঙ্গে এসবের সম্পর্ক আছে।

উত্তেজনায় লাল হয়ে গেছে জনির মুখ। বাবা, আমার মনে হয় ওই লোকগুলোই প্লেন চুরি করেছে! চারজন তো। সহজেই জ্যাক ভাইয়া আর রিডকে ধরে, বেঁধে সরিয়ে ফেলতে পারে। তারপর দুজনে দুটো প্লেন উড়িয়ে নিয়ে যাওয়াটা কিছু না, প্লেন চালানো জানলেই হলো। সেটা তো আজকাল অনেকেই জানে। নিয়েছে ওই হারামজাদারা, মাঝখান থেকে দোষী হলো আমার ভাই।

হ্যাঁ, ঠিকই বলেছো, বাবাও একমত হলেন। এখন তাড়াতাড়ি পুলিশকে জানানো দরকার। টেডকে চাপ দিলেই গড়গড় করে সব বলে দেবে। জ্যাক আর রিডকে কোথায় রেখেছে, তা-ও জানা যাবে।

আনন্দ, উত্তেজনায় প্রায় লাফাতে শুরু করলো জনি। আমি জানতাম! তখনই বলেছিলাম, আমার ভাই হতেই পারে না! বাবা, বলেছি না তোমাকে! জলদি চলো, পুলিশকে জানাতে হবে।

দ্রুত ঘরের দিকে রওনা হলেন কলিউড। টেলিফোন করলেন থানায়। তারপর রিসিভার রেখে দিয়ে বললেন, ওরা খুব সিরিয়াসলি নিয়েছে। টেডকে জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছে। আধ ঘণ্টা পর এখানে ফোন করবে বললো।

ওই আধ ঘণ্টা যেন আর কাটতেই চাইলো না। বার বার ঘড়ি দেখছে কিশোর। স্থির হয়ে বসতে পারছে না কেউই। সব চেয়ে বেশি অস্থির হয়ে আছে জনি। ল্যারি আর তার ভেড়ার বাচ্চাটাকে এতোক্ষণে একবারও দেখা গেল না। গেল কোথায়?—অবাক হয়ে ভাবলো জিনা।

টেলিফোনের শব্দ যেন বোমা ফাটালো ঘরে, খুব জোরে বেজেছে বলে মনে হলো ওদের কাছে। প্রায় ছুটে গিয়ে রিসিভার তুললেন কলিউড। হ্যাঁ হ্যাঁ, বলছি…খবর কি?…ও, হ্যাঁ…হ্যাঁ… রিসিভার কানে ঠেসে ধরেছেন তিনি। তাই নকি?…থ্যাঙ্ক ইউ। গুড-বাই।

রিসিভার নামিয়ে রেখে ছেলেমেয়েদের দিকে ফিরলেন তিনি।

জ্যাক ভাইয়া চুরি করেনি, তাই বললো না? জনি জিজ্ঞেস করলো।

হ্যাঁ।

হাত তালি দিয়ে বাচ্চা ছেলের মতো লাফাতে শুরু করলো জনি। বলেছিলাম ! বলেছিলাম না! ও চোর হতেই পারে না, হতেই পারে না…

খারাপ খবরও আছে, বাবা বললেন।

কী? থমকে গেল জনি।

টেড স্বীকার করেছে, কলিউড বললেন, প্লেন চুরি করতেই এসেছিলো চারজন লোক। ওদের দুজন খুব ভালো পাইলট। বিদেশী। অন্য দুজন সাধারণ অপরাধী, ওদেরকে আনা হয়েছে ঝড়ের রাতে বিড় আর জ্যাককে কিডন্যাপ করার জন্যে। ওদেরকে বেহুশ করে ধরে এনে এয়ারফীন্ডের বাইরে লুকিয়ে রাখা হয়েছে কোথাও। ওদেরকে সরিয়ে ফেলার পর দুই পাইলট গিয়ে প্লেন নিয়ে উড়ে গেছে। এয়ারফীন্ডের লোকেরা টের পেলো যখন তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে।

তারমানে, সাগরে পড়ে যারা মারা গেছে, তারা রিড আর জ্যাক নয়, ওই দুজন বিদেশী পাইলট? কিশোর বললো।

হ্যাঁ। তবে ওদের জন্যে ভাবছি না আমি। আমার উদ্বেগ রিড আর জ্যাককে নিয়ে। ওদেরকে কোথায় লুকানো হয়েছে, টেড জানে না। তাকে বলা হয়নি। তাকে টাকা দেয়নি, কারণ প্লেন দুটো সাগরে পড়ে গেছে, তাদের উদ্দেশ্য সফল হয়নি।

পাইলট দুজন মরেছে, বাবার উদ্বেগের কারণ বুঝে উদ্বিগ্ন হলো জনিও, আর চোর দুটোও নিশ্চয় পালিয়েছে! এমন কোথাও রেখে গেছে বন্দিদেরকে, যেটা কোনোদিনই জানা যাবে না!

ঠিক তাই, বাবা বললেন। এখন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দুজনকে খুঁজে বের করতে হবে। এমনিতেই দেরি হয়ে গেছে অনেক, অনেক কষ্ট হচ্ছে নিশ্চয় ওদের। হাত-পা বাঁধা থাকলে, খাবার আর পানি না পেলে মরে যাবে। চোর দুটো যদি পালিয়ে থাকে কে ওদেরকে খাবার দিয়ে আসবে?

আতঙ্কিত হয়ে বললো জনি, ওদেরকে খুঁজে বের করতেই হবে, বাবা!

কিন্তু কোথায় খুঁজতে হবে জানি না আমরা। পুলিশও জানে না।

বিড়বিড় করে কি বললো কিশোর, বোঝা গেল না। নিচের ঠোঁটে ঘনঘন চিমটি কাটতে শুরু করলো সে।

১৫

থমথমে নীরবতা। কেউ জানে না কোথায় খুঁজতে হবে। কথাটা যেন প্রচণ্ড আঘাত করে স্তব্ধ করে দিয়েছে সবাইকে। সবার মনেই এক প্রশ্নঃ কোথায় আছে রিড আর জ্যাক?

এতো সহজে কজা হয়ে গেল দুজনে? মুসা মুখ খুললো। নিশ্চয় এয়ারফীল্ডে বিশ্বাসঘাতক রয়েছে, চোরগুলোকে সাহায্য করেছে যে।

থাকতে পারে, কলিউড বললেন। খুব ধীরেসুস্থে ঠাণ্ডা মাথায় পরিকল্পনা করে এই কাজ করেছে। নিশ্চয় নতুন ধরনের কিছু ছিলো প্লেনের ভেতর, যেগুলোর নকশার জন্যেই প্লেন চুরি করেছিলো বিদেশী ওই পাইলটেরা। পালিয়ে তো প্রায় গিয়েই ছিলো। ওদের কপাল খারাপ, পড়লো ঝড়ের মুখে।

ওরা ভেবেছিলো, জিনা বললো, ঝড়র সময় চুরি করাটাই ভালো। আন্দাজ ঠিকই করেছিলো। তখন ওদেরকে পেন চুরি করতে বাধা দিতে আসেনি কেউ। গার্ডেরা নিশ্চয় গিয়ে সবাই ঘরে ঢুকে বসেছিলো।

আমার অবাক লাগছে, কিশোর বললো, এতো কিছু ঘটে গেল ডাউসন আল ডরির নাকের ডগা দিয়ে, অথচ ওরা কিছুই জানলো না?

প্রজাপতি ছাড়া ওদের মাথায় আর কিছু নেই, বিরক্ত গলায় বললো জনি। পুলিশ সহজে ছাড়বে না ওদেরকে। এতো বেকুব যে মানুষ হয়, না দেখলে বিশ্বাসই করতাম না।

এখন কথা হলো, কুটি করলো কিশোর, আমরা কি করতে পারি? এভাবে হাত গুটিয়ে বসে থাকতে তো ইচ্ছে করছে না। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে কলিউডের দিকে তাকালো সে।

তোমরা আর কি করবে? তিনি বললেন। পুলিশের কাছে খবর এসেছে, দুজন লোক খুব দ্রুত একটা ভ্যান চালিয়ে চলে গেছে। ওদের গতিবিধি সন্দেহজনক ঠেকেছে দুচারজন পথচারীর কাছে। গাড়ির নম্বরও টুকে নিয়েছে ওরা। হতে পারে চোরদুটোই। ওদেরকে যদি পুলিশ ধরে ফেলে, জ্যাক আর রিড কোথায় আছে জানা যাবে। আর তো কোনো উপায় দেখি না।

হতাশায় গুঙিয়ে উঠলো কেউ কেউ। কিছুই করার নেই ওদের। এখানে মাইলের পর মাইল ছড়িয়ে থাকা আদিম প্রকৃতিতে কোথায় খুঁজবে দুজন বন্দি মানুষকে? খড়ের গাদায় সুচ খোঁজার চেয়েও কঠিন কাজ, প্রায় অসম্ভব।

এখানে বসে বসে ভাবলে তো আর সমস্যার সমাধান হবে না, উঠলেন মিস্টার কলিউড। আমি কাজে যাই। তোর মা কোথায়, জনি?

বাজার করতে গেছে, ঘড়ির দিকে তাকালো জনি। ডিনারের আগেই ফিরবে।

ল্যারিটাও কি ওর সঙ্গে গেল নাকি? ওর কোনো সাড়াশব্দই নেই। বাচ্চাটাকেও নিশ্চয় নিয়ে গেছে?

ও-কি ওটাকে ছাড়া নড়ে নাকি?

হুঁ! বেরিয়ে গেলেন কলিউড।

তিন গোয়েন্দা আর জিনার দিকে তাকিয়ে হঠাৎ মনে পড়লো জনির, আরে, ভুলেই গিয়েছিলাম! তোমাদের নিশ্চয় খাবারে টান পড়েছে?

হ্যাঁ, মাথা নাড়লো কিশোর। জনির মনের এই অবস্থা, এ-সময়ে তার কাছে খাবার চাইতে লজ্জাই লাগছে তার। ভাগ্যিস পয়সা দিয়ে কিনে নেয়ার ব্যবস্থা করে নিয়েছিলো, নইলে এখন আরও খারাপ লাগতো।

রবিন, তুমি আমার সাথে এসো, জনি বললো। যা যা লাগে, নিয়ে নাও।

রান্নাঘরের দিকে চলে গেল দুজনে।

খানিক পরে খাবারের ঝুড়ি নিয়ে ফিরে এলো।

জনি, কিশোর বললো, সকালটা আজ তোমার সাথেই থাকি আমরা, কি বলো? তোমার কাজে সাহায্য করবে।

তাহলে তো খুব ভালোই হয়, উজ্জ্বল হলো জনির মুখ। কাজে সাহায্যের চেয়ে এখন বেশি প্রয়োজন তার বন্ধুদের সঙ্গ। বাবাকে কথা দিয়েছিলাম আজ মুরগীর ঘরগুলো পরিষ্কার করবো। তোমরাও হাত লাগালে ডিনারের আগেই সেরে ফেলতে পারবো।

ঠিক আছে, চলো। তোমার কাজ শেষ হয়ে গেলে আমাদের সাথে বেরোতে পারবে। বিকেলে কোথাও একসাথে ঘুরতে যেতে পারবো আমরা।

মুরগীর খোয়াড়ের কাছে শুয়ে থাকতে দেখা গেল ডবিকে। সোজা তার দিকে এগিয়ে গেল রাফিয়ান। সাথী পেয়ে গিয়ে খেলা জুড়ে দিলো দুটোতে।

সারাটা সকাল কঠোর পরিশ্রম করলো ছেলেরা। জিনা ওদেরকে খোঁয়াড় পরিষ্কারের কাজে সাহায্য করতে পারলো না, ওর এসব নোংরা লাগে। সে গিয়ে জনিদের বাগানে ফুল দেখলো। কিছু গাছের মরা পাতা বাছলো। বেড়ে ওঠা পাতা কাঁচি দিয়ে হেঁটে দিলো। ফুল গাছের পরিচর্যা করতে খুব ভালো লাগে তার।

ওদের কাজও শেষ হয়েছে, এই সময় গাড়ির এঞ্জিনের শব্দ কানে এলো।

নিশ্চয় আন্টি আসছেন, কিশোর বললো। চলো, দেখি।

হাত ধুয়ে ছেলেরা এসে দেখলো, ইতিমধ্যেই যা বলার স্ত্রীকে বলে ফেলছেন মিস্টার কলিউড। শুনে জনির মা-ও উদ্বিগ্ন হলেন। বের করতে না পারলে মরবে তো! পায়ের আওয়াজ শুনে মুখ তুললেন। ও, তোমরা। আমি ভাবলাম ল্যারি।

ল্যারি? ভুরু কোঁচকালো জনি। গাড়িতেই বসিয়ে এসেছিলে নাকি?

গাড়িতে? অবাক হলেন মিসেস কলিউড। তাকে পাব কোথায় বসানোর জন্যে? আমার সঙ্গে যায়নি তো। বাড়িতেই আছে।

কই, বাড়িতে তো নেই। আমরা তো ডাবলাম তোমার সাথে গেছে।

বলিস কি! ভয় দেখা দিলো মায়ের চোখে। আমি তো ভেবেছি তোর কাছে। আছে!

আর আমরা ভেবেছি তোমার সাথে গেছে। গলা কাঁপছে জনির।

জনি, পুকুর! প্রায় কেঁদে ফেললেন মা। জলদি গিয়ে দেখ পানিতে পড়লো কিনা! ল্যারি, ল্যারি, বাপ আমার, কোথায় গেলি…! বলতে বলতে মা-ই ছুটে বেরোলেন ঘর থেকে।

মিস্টার কলিউড বললেন তিন গোয়েন্দাকে, তোমরা পাহাড়ের দিকে চলে যাও। হয়তো ভেড়ার বাচ্চাটা ছুটে গিয়েছিলো। ওটাকে খুঁজতে গিয়ে পথ হারিয়ে থাকতে পারে।

১৬

ল্যারির নাম ধরে ডাকতে ডাকতে পুকুরের দিকে চলে গেল জনি। মাঝখানটা বেশ গভীর ওটার, আর ল্যারি সাঁতার জানে না।

রাফিয়ানকে নিয়ে জিনা আর তিন গোয়েন্দা ছুটলো গেটের দিকে।

খাড়া ঢাল বেয়ে ওঠার সময় এদিক ওদিক তাকালো ওরা, বার বার ডাকতে লাগলো ল্যারির নাম ধরে। কিন্তু ছেলেটার ছায়াও নেই। কেন যেন কিশোরের মনে হচ্ছে, ফার্মে নেই ল্যারি। ভেড়ার বাচ্চাটাই হারিয়েছিলো, তাকে খুঁজতে খুঁজতে দূরে কোথাও চলে গেছে সে।

আমাদের ক্যাম্পে হয়তো গিয়ে বসে আছে, মুসা বললো। ওখানে যাবার খুব ইচ্ছে ওর, দেখলাম সেদিন।

গিয়ে থাকলে তো ভালোই, কিশোর বললো। আমার মনে হয় না। একা একা অতদূরে যায়নি সে কথনও। চেনার কথা নয়।

কি যে শুরু হলো আজ! খালি লোক হারানোর খবর শুনছি! জিনা বললো। প্রথমে গেল রিড আর জ্যাক, কোথায় আছে কেউ জানে না। এখন ল্যারি নিখোঁজ!

কোনো ছুটিই কি আরামে কাটাতে পারবো না আমরা? রবিনের প্রশ্ন। যেখানেই যাই, উত্তেজনা আর রহস্য যেন আমাদের পায়ে পায়ে গিয়ে হাজির।

খালি উত্তেজনা আর রহস্য হলে তো কোনো কথা ছিলো না, মুসা বললো। বিপদ আসে যে! সেটাই মাঝে মাঝে অসহ্য লাগে।

ক্যাম্পে এসে পৌঁছলো ওরা। ল্যারি আর টোগোর ছায়াও নেই।

এবার কোথায় যাই? জিনা বললো।

যাবো যেখানেই থোক, মুসা বললো। বলা যায় না কতোক্ষণ লাগবে খুঁজতে। এক কাজ করা যাক, কিছু মুখে দিয়ে নিই। খালি পেটে খুঁজতে বেরিয়ে আমরাও সুবিধে করতে পারবো না।

কথাটা মন্দ বলোনি। কিভাবে কোথায় খুঁজব, ইতিমধ্যে একটা প্ল্যানও করে ফেলা যাবে, একমত হলো কিশোর।

খাবার, অর্থাৎ শুধু স্যান্ডউইচ তৈরি করতে বসলো জিনা আর রবিন। হাত কাঁপছে জিনার। কোনো জিনিসই ঠিকমতো ধরে রাখতে পারছে না। বললো, গেল কোথায় ছেলেটা! কোনো ক্ষতি না হয়ে যায়, আল্লাহ না করুক! সারা সকাল ধরে নিখোঁজ!

স্যান্ডউইচ তৈরি হলো।

রবিন ডাকলো, এসো, বসে যাও। তা কি ঠিক করলে? কিভাবে কোথায় খুঁজবো?

আলাদা হয়ে ছড়িয়ে পড়বো আমরা, কিশোর একটা স্যান্ডউইচ হাতে তুলে নিলো। কিছু টম্যাটো আর গাজর নিয়ে পকেটে ভরলো। পাহাড়ের আশেপাশে খুঁজবো। একটু পর পরই ল্যারির নাম ধরে ডাকবো। তোমরা যাবে পাহাড়ের ওই দিকটায়, রবিন আর জিনাকে বললো সে। একজন খুঁজতে খুঁজতে ওপর দিকে উঠবে, আরেকজন নামবে। এই পাশটায় খুঁজবো আমি আর মুসা, একইভাবে। তারপর আমরা দুজন চলে যাবো প্রজাপতির খামারে। ওখানেও যেতে পারে।

স্যান্ডউইচ হাতে নিয়েই উঠে পড়লো ওরা। দুই দল চলে গেল দুদিকে। রাফি একবার গেল এদলের কাছে, আরেকবার দলের কাছে। এমনি করে সারা পাহাড়ময় ছুটে বেড়াতে লাগলো সে। একটা কাজ পাওয়া গেছে। সে-ও বুকে গেছে, ল্যারি হারিয়েছে। ছেলেটা আর টোগোর গন্ধ তার চেনা। বাতাস কে সেই গন্ধ বের করার চেষ্টা চালাচ্ছে।

প্রজাপতির খামারে গিয়ে দেখা গেল, সেখানে কেউ নেই। কারো চিহ্নই নেই খামারে। এমনকি মিসেস ডেনভারও কটেজে নেই, বাইরে কোথাও গেছে। আর দুই প্রজাপতি মানবের তো এ-সময় থাকারই কথা নয়। প্রজাপতি ধরতে বেরিয়েছে।

ওদের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল রবিন আর জিনার। দর থেকে চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলো, একটা পাঁচ বছরের ছেলে আর একটা ভেড়ার বাচ্চাকে দেখেছে কিনা।

জবাব এলো, দেখেনি।

রেগে রয়েছে এখনও, জিনা বললো রবিনকে। দেখেছো কেমন কাটা কাটা জবাব দিলো? প্রজাপতি না খুঁজে এখন ওরাও আমাদের সাহায্য করলে কাজ হতো।

আবার আগের জায়গায় জমায়েত হলো তিন গোয়েন্দা, জিনা আর রাফি। প্রায় হাল ছেড়ে দিয়েছে ওরা। ল্যারিকে পাওয়া যায়নি। এরপর কি করবে, এই নিয়ে আলোচনা করছে ওরা, এই সময় হঠাৎ কান খাড়া করে ফেললো রাফিয়ান। তারপর চেঁচিয়ে উঠলো উত্তেজিত হয়ে। যেন বোঝানোর চেষ্টা করছে, আমি একটা জিনিস বোধহয় পেয়েছি।

বুঝে ফেললো জিনা। চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলো, কি, কি পেয়েছিস রাফি?

কান আরও খাড়া করে ফেললো রাফিয়ান।

যা যা এগো, নির্দেশ দিলো জিনা। দেখ কি পেয়েছিস!

চলতে আরম্ভ করলো রাফিয়ান। মাঝে মাঝেই থেমে গিয়ে কান পাতে, শোনে, তারপর আবার চলে। ওরাও শোনার চেষ্টা করছে, কিন্তু কুকুরের মতো প্রখর নয় ওদের শ্রবণশক্তি। কিছুই শুনতে পেলো না।

আরি! কিশোর বললো। ও তো গুহার দিকে চলেছে! ওদিকে গেছে ল্যারি? ফার্ম থেকে অনেক দূরে, পথও খুব জটিল। কি করে এলো!

কি জানি! বুঝতে পারছি না, জিনা বললো। কিন্তু রাফির তো ভুল হওয়ার কথা নয়?

যেভাবেই যাক,মুসা বললো, সেটা পরেও জানা যাবে। এখন ছেলেটাকে খুঁজে পেলেই হয়।

মিনিটখানেক পরেই শোনা গেল একটা ক্লান্ত কণ্ঠ, টোগো টোগো! কোথায় তুই?

ল্যারিইইই! প্রায় একসঙ্গে চিৎকার করে উঠে ছুট লাগালো চারজনে।

অবশ্যই সবার আগে পৌঁছলো সেখানে রাফিয়ান। তিন গোয়েন্দা আর জিনা পৌঁছে দেখলো ছেলেটার মাথা চাটছে সে, তার গলা জড়িয়ে ধরে রেখেছে ল্যারি। গুহার ঠিক বাইরে বসে আছে। ভেড়ার বাচ্চাটা নেই সাথে।

ল্যারি! ল্যারি! বলে চিৎকার করে ছুটে গেল জিনা। কোলে তুলে নিলো তাকে।

বাদামী চোখ মেলে সকলের দিকে তাকালো ল্যারি। মোটেই অবাক হয়নি ওদেরকে দেখে। শান্ত কণ্ঠে ঘোষণা করলো যেন, টোগো পালিয়েছে। ওই ওখানে গিয়ে লুকিয়েছে। গুহাটা দেখালো সে।

গেছে, যাক, মুসা তার গাল টিপে দিয়ে বললো। তুমি যে যাওনি, এটাই বুদ্ধিমানের কাজ করেছে। ঢুকলে আর কোনোদিন পাওয়া যেতো না তোমাকে।

চলো ওকে বাড়ি নিয়ে যাই, রবিন বললো।

কিন্তু জিনার কোলে থেকেই লাথি মারতে শুরু করলো ল্যারি। চিৎকার করে বললো, না, না, আমি যাবো না! টোগোকে ফেলে যাবো না! টোগো! টোগো!

শোনো, ল্যারি, বোঝনোর চেষ্টা করলো কিশোর। গুহার ভেতরে থেকে থেকে শীঘ্রি বিরক্ত হয়ে যাবে টোগো। তখন আপনাআপনিই বেরিয়ে আসবে। তোমার মা তোমার জন্যে কাঁদছেন।

কাঁদুক, সাফ জবাব দিয়ে দিলো ল্যারি। আমি টোগোকে ছাড়া যাবে না।

তোমার খিদে পায়নি? মুসা জিজ্ঞেস করলো।

এই উত্তেজনার মুহূর্তেও মুসার কথায় হেসে ফেললো সবাই।

ল্যারি বললো, পেয়েছে। কিন্তু টোগোকে ছাড়া খাবো না। টোগো! টোগো! জলদি আয়। আমরা বাড়ি যাবো।

ওকে এখুনি নিয়ে যাওয়া দরকার, রবিন বললো। বাড়িতে নিশ্চয় সবার পাগল হওয়ার অবস্থা। টোগো ঢুকতে যখন পেরেছে, বেরিয়ে আসতে পারবে। জন্তুজানোয়ারের অনুভূতি খুব প্রখর। আর যদি বেরোতে না-ই পারে, দুঃখ করা ছাড়া আর কি করার আছে? দড়ি ছাড়া গুহাগুলোয় ঢোকা কোনোমতেই উচিত হবে না।

চলো, ল্যারি, জিনা বোঝালো ওকে। টোগো সময় হলেই আসবে। খেলতে গেছে তো ভেতরে। খেলা শেষ হলেই বেরিয়ে আসবে। ধীরে ধীরে গুহার কাছ থেকে সরে আসতে লাগলো সে। তোমার মা যে কাঁদছে, খারাপ লাগছে না তোমার?

লাগছে তো।

তাহলে চলো বাড়ি গিয়ে খেয়েদেয়ে টোগোকে নিতে আসবো আমরা আবার।

অবশেষে রাজি হলো ল্যারি।

খড়িমাটির পথ বেয়ে ফিরে চললো দলটা। সবাই খুশি। ল্যারিকে খুঁজে পাওয়ার উত্তেজনায় জ্যাক আর রিডের কথা ভুলেই গেছে ওরা।

ছেলেকে দেখে ছুটে এলেন মিসেস কলিউড। জিনার কোল থেকে নিয়ে নিলেন তাকে। জড়িয়ে ধরে চুমু খেয়ে কেঁদে বললেন, কোথায় চলে গিয়েছিলি তুই, ল্যারি? ওই ভেড়ার বাচ্চাটাই তোর সর্বনাশ করলো। গেল কই হতচ্ছাড়াটা!

ওকে গাল দিচ্ছো কেন? ওর খেলতে ইচ্ছে করে না? গুহার ভেতরে খেলতে গেছে।

সব শুনে শিউরে উঠলেন মিসেস কলিউড। ওই গুহায় ল্যারি ঢুকলে কি সর্বনাশ হতো সেকথা আর ভাবতে চাইলেন না তিনি।

বাবার দাও, মা, খিদে পেয়েছে, ল্যারি বললো।

সে বসলো খেতে, আর টেবিল ঘিরে সবাই বসলো তার খাওয়া দেখতে। আজ যেন ল্যারির খাওয়াটাই এক নতুন ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।

গপগপ করে খেতে লাগলো ল্যারি। তার খাওয়া দেখেই বোঝা গেল কি প্রচণ্ড খিদে পেয়েছে।

খাওয়া শেষ করেই চেয়ার থেকে নেমে পড়লো ল্যারি, আমি টোগোকে আনতে যাবো।

না না, তোমার যাবার দরকার নেই, তাড়াতাড়ি ছেলের হাত ধরলেন মা। আমি কেক বানাতে যাচ্ছি, তুমি আমার কাছে বসে থাকবে। সময় হলে আপনিই ফিরে আসবে টোগো।

সত্যিই ফিরে এলো টোগো। তিন গোয়েন্দা, জিনা আর জনি বসে কথা বলছে তখন পুকুর পাড়ে। নাচতে নাচতে চত্বরে ঢুকলো বাচ্চাটা। মানুষ দেখেই ব্যা ব্যা করে উঠলো।

টোগো, এসেছিস! আয়, আয়, এদিকে আয়! চিৎকার করে ডাকলো জনি।

আর, তোর পিঠে লিখলো কে?

ভুরু কোঁচকালো কিশোর।

লেখাটা পড়ার চেষ্টা করে পারলো না মুসা। বললো, শয়তান লোকের কাজ। বাচ্চাটাকে একা পেয়ে তার পিঠে কি লিখে দিয়েছিলো। মুছে গেছে।

ওর সাদা রঙটাই নষ্ট করে দিয়েছে, জিনা বললো জনিকে, ধুয়ে ফেলো। বিচ্ছিরি লাগছে দেখতে।

দাঁড়াও! তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলে উঠলো কিশোর। জে আর এম-এর মতো লাগছে আমার কাছে। আর ওই দুটো অক্ষর বোধহয় আর এবং পি, না না, বি! নিচের অংশটা মুছে যাওয়ায় পি-এর মতো লাগছে।

জে এম! আর বি! উত্তেজনায় দম বন্ধ হয়ে যাবে যেন জনির। কোটর থেকে চোখ প্রায় ঠিকরে বেরোনোর অবস্থা। তার মানে কি জ্যাক ম্যানর আর রিড বেকার! কে লিখলো?

আরও অক্ষর আছে ওর পিঠে, ছোট ছোট করে লেখা! কিশোর বললো, শক্ত করে ধরে রাখা ওকে। পড়ার চেষ্টা করি। আমার বিশ্বাস জ্যাক আর রিডই ওকে দিয়ে মেসেজ পাঠিয়েছে। ওদের কাছেই চলে গিয়েছিলো বাচ্চাটা!

প্রায় মুছে যাওয়া অক্ষরগুলো পড়ার চেষ্টা করতে লাগলো সবাই। মোট চারটা অক্ষর আছে বলে মনে হচ্ছে। ঝোপঝাড়ের ভেতর দিয়ে এসেছে বোধহয় বাচ্চাটা, পাতার ঘষায় ঝাপসা হয়ে গেছে অক্ষর।

শব্দটা কে! দেখতে দেখতে বললো কিশোর। প্রথম অক্ষরটাকে জি. ও. সি. যা খুশি ধরা যায়। কিন্তু তৃতীয় শব্দটা ভি, কোনো সন্দেহ নেই। আমি শিওর লেখাটা কেভ, মানে গুহা। আর গুহার ভেতরেই ঢুকেছিলো টোগো। মুখ তুললো সে। তাহলে ওখানেই নিয়ে গিয়ে আটকে রেখেছে জ্যাক আর রিডকে আর আমরা কিনা ভাবছিলাম…তোমার বাবা কোথায়, জনি?

গোলাঘরের পেছনে পাওয়া গেল কলিউডকে। কাজ করছেন। ভেড়ার বাচ্চা আর ওটার পিঠের লেখা দেখানো হলো তাকে।

কি করবো এখন? জিজ্ঞেস করলো কিশোর। গুহায় ঢুকবো? না পুলিশকে ফোন করবেন?

পুলিশকে অবশ্যই জানানো দরকার, কলিউড বললেন। তোমরা গুহায় চলে যাও। সাথে করে দড়ি নিয়ে যাও বেশি করে। দড়িওয়ালা গুহাগুলোয় ওদেরকে রাখার সম্ভাবনা কম, কারণ ওগুলোতে প্রায়ই লোক ঢোকে দেখার জন্যে। দড়ির একমাথা ধরে সুড়ঙ্গের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকবে একজন। আরেক মাথা ধরে অনন্যরা ভেতরে ঢুকবে। এতে হারানোর ভয় থাকবে না। বুঝতে পেরেছে আমার কথা?

মাথা কাত করলো কিশোর। আপনি না বললেও তা-ই করতাম। তাছাড়া রাফিকে তো নিয়েই যাচ্ছি। ও অনেক সাহায্য করতে পারবে।

মাথা ঝাঁকিয়ে পুলিশে ফোন করতে চলে গেলেন কলিউড।

জনি, কিশোর বললো, জলদি গিয়ে দড়ি নিয়ে এসো। আর টর্চ, যে কটা পারো। মোমবাতি আর দেশলাইও আনবে। গুহায় ঢুকে বিপদে পড়তে চাই না।

১৭

ঝাড়-জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে রুদ্ধশ্বাসে প্রায় দৌড়ে চলেছে দলটা। ভেড়ার বাচ্চাটা মুসার কোলে। ওটা বুঝতেই পারছে না ব্যাপারটা কি? মানুষগুলো এরকম করছে কেন? আর সেজন্যেই যেন থেকে থেকে চেঁচিয়ে উঠছে ব্যা ব্যা করে। শরীর মুচড়ে, লাথি মেরে নেমে পড়তে চাইছে কোল থেকে, কিন্তু কেউ তার আবেদন কানে তুলছে না। দরকার আছে বলেই নিয়েছে ওকে।

অবশেষে গুহায় যাবার খড়িমাটি বিছানো পথে এসে পড়লো ওরা। জুতোর ঘায়ে বিচিত্র শব্দ করে ছিটকে কিংবা গড়িয়ে পড়ছে আলগা খড়িমাটির টুকরো। ওরা এসে দাঁড়ালো প্রবেশপথের কাছে, যেটার কপালে লেখা রয়েছে সাবধানবাণী।

ভেড়ার বাচ্চাটাকে মাটিতে নামিয়ে শক্ত করে ধরে রাখলো মুসা। জিনা ডাকলো, রাফি, এদিকে আয়। শোক টোগোকে। গন্ধটা মনে রাখ। তারপর ওর পিছে পিছে যাবি, যেখানেই যায়। দেখতে না পেলে গন্ধ শুকে কে এগোবি।

অযথা এসব কথা বললো জিনা। কিভাবে অনুসরণ করতে হয় খুব ভালোই জানা আছে রাফিয়ানের। টোগোর গন্ধ তার পরিচিত, তবু জিনার কথায় আরেকবার ভেড়ার বাচ্চাটার আগা-পাশ-তলা কলো সে।

টোগোকে ছেড়ে দিলো মুসা। রাফিকে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে বললো জিনা। জানে পারবে, তবু নিশ্চিত হতে চায় টোগোর গন্ধ শুকে ঠিকমতো এগোতে পারে কিনা রাফি। মাটি আর বাতাস শুকতে শুকতে প্রায় ছুটে চললো কুকুরটা। প্রথম গুহাটায় এসে ঢুকলো। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ফিরে তাকালো জিনার দিকে।

যা যা, এগোরাফি, আদেশ দিলো জিনা। বুঝতে পারছি, টোগোর পিছু নিয়ে এই অত গুহায় তোকে ঢুকতে বলায় তোর অবাক লাগছে। কিন্তু ঢুকতে বলার কারণ আছে। আমরা জানতে চাই, বাচ্চাটা কোথায় যায়। এতো কথা বললো সে এই জন্যে, তার আশঙ্কা হচ্ছে বিরক্ত হয়ে না আবার এই মজার খেলাটা বন্ধ করে দেয় রাফি।

কিন্তু বন্ধ করলো না রাফিয়ান। আবার মাটি কলো।

সেই গুহাটায় এসে ঢুকলো সে, যেটাতে রঙের সৃষ্টি করেছে বরফের ঝাড় আর স্তম্ভ। চকচকে উজ্জ্বল রঙিন থামের মতো লাগছে কোনো কোনোটাকে। ওটা পেরিয়ে ঢুকলো আরেকটা গুহায়, যেটাতে সব চেয়ে বেশি রঙ। রামধনুর সাত রঙের বাহার দেখা যায় যেখানে। যেটাকে পরীর রাজ্য মনে হয়েছিলো জিনার। সেটা পেরিয়ে ঢুকলো আরেক গুহায়, যেখানে দড়ি ছাড়া সুড়ঙ্গ রয়েছে কয়েকটা।

এই যে, তিনটে সুড়ঙ্গ, জিনা বললো। আমার মনে হয় না, দড়িওয়ালা সুড়ঙ্গ ধরে ঢুকবে রাফি…।

তার কথা প্রমাণ করতেই যেন একটা দড়িছাড়া সুড়ঙ্গের মুখের কাছে মাটি শুঁকতে শুরু করলো রাফি। বাঁয়ের একটা পথ, যেটাতে সেদিন আচমকা ঢুকে গিয়েছিলো সে, তারপর অনেক ডাকাডাকি করে বের করে আনতে হয়েছে।

ঢুকে পড়লো সবাই। প্রত্যেকের হাতেই টর্চ জ্বলছে।

আমিও ভেবেছিলাম…, বলেই থেমে গেল জিনা। তার কথার প্রতিধ্বনি উঠলো সুড়ঙ্গের দেয়ালে বাড়ি খেয়েঃ আমিও ভেবেছিলাম, আমিও ভেবেছিলাম… ভেবেছিলাম…ছিলাম… ছিলাম…ইলাম…

সেদিনকার চিৎকারের মানে এখন বুঝতে পারছি, প্রতিধ্বনির ভয়ে কণ্ঠস্বর একেবারে খাদে নামিয়ে ফিসফিসিয়ে বললো কিশোর। ডাকাতগুলো চিৎকার করেছে, জোরে জোরে শিস দিয়েছে। সুড়ঙ্গে প্রতিধ্বনিত হয়ে ওই শব্দ হয়ে উঠেছিলো ভয়ঙ্কর। আমার বিশ্বাস রাফির ঘেউ ঘেউ ওরা শুনতে পেয়েছিলো। ঘাবড়ে গিয়েছিলো মানুষ আসছে ভেবে। কাজেই ভয় দেখিয়ে আমাদেরকে তাড়ানোর জন্যে ওরকম শব্দ করেছিলো।

আর সত্যি… বলেই প্রতিধ্বনি শুনে গলার স্বর নামিয়ে ফেললো রবিন, আমরা ভয় পেয়ে পালিয়েছিলাম। হ্যাঁ, তুমি ঠিকই বলেছে, ওই শয়তানগুলো ওরকম আওয়াজ করেছিলো। এছাড়া ওরকম অদ্ভুত আওয়াজের আর কোনো ব্যাখ্যা নেই।… আরিব্বাবারে, কি লম্বা সুড়ঙ্গ! আর কি রকম এঁকেবেঁকে ঘুরে ঘুরে গেছে!…আরে, সামনে দেখি আবার দুই মুখ! কোনটা দিয়ে যাবো?

সেটা রাফিই বলে দেবে, জিনা বললো। একটা সুড়ঙ্গের মুখের কাছের মাটি ইতিমধ্যেই শুকতে আরম্ভ করেছে রাফি, এবারও বাঁয়েরটা।

দড়ি আনার দরকারই ছিলো না, জনি বললো। রাফি যেভাবে পথ চিনে এগোচ্ছে, আমাদের অসুবিধে হতো না। ঠিক বের করে নিয়ে আসতো।

যা, মাথা ঝাঁকালো কিশোর। দড়ির চেয়ে অনেক ভালো পথপ্রদর্শক সে। তবে ও না থাকলে দড়ি অবশ্যই ব্যবহার করতে হতো। নইলে এই সুড়ঙ্গ আর গুহার গোলকধাঁধা থেকে বেরোনো মুশকিল হয়ে যেতো। মনে হয় পাহাড়ের একেবারে পেটের মধ্যে চলে এসেছি…।

এই সময় হঠাৎ থেমে গেল রাফি। মাথা তুলে পাশে কাত করে কান পেতে শুনছে। জ্যাক আর রিডের সন্ধান কি পেয়ে গেল? ঘেউ ঘেউ করে উঠলো একবার। বদ্ধ জায়গায় বিকট হয়ে কানে বাজলো সেই ডাক।

কাছেই কোনোখান থেকে শোনা গেল তার ডাকের জবাবঃ এইই। এইই! এই যে! এখানে! এখানে!

জ্যাক ভাইয়া! প্রতিধ্বনির কথা ভুলে গিয়ে চিৎকার করে উঠলো জনি। আনন্দে অন্ধকার সুড়ঙ্গের মধ্যেই লাফাতে শুরু করলো। জ্যাক ভাইয়া, শুনছো! আমিইইই, আমি জনিইই!

সাথে সাথে সাড়া এলো, জনি, এই যে এদিকে! বুঝতে পারছিস?

প্রায় ছুটে এগোলো রাফিয়ান। থমকে দাঁড়িয়ে পড়লে হঠাৎ। আগে আগে চলেছে কিশোর, আরেকটু হলে তার গায়ের ওপরই পড়তো। প্রথমে বুঝতে পারলো না কি ব্যাপার। তারপর টর্চের আলোয় স্পষ্ট হলো নিরেট দেয়াল, ওদের পথ আগলে যেন এক বিরাট চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেয়ালের কাছে দাঁড়িয়ে আছে টোগো। অবাক কাণ্ড। সামনে দেয়াল, অথচ জ্যাকের কণ্ঠ কানে আসছে!

এই যে, আমরা এখানে!

বোঝা গেল, কিভাবে আসছে। রাফিয়ান যেখানে দাঁড়িয়ে আছে ঠিক তার পাশেই মেঝেতে একটা ফোকর। কিশোরের টর্চের আলো পড়লো তার ওপর। বললো, ওই যে, ওখানেই আছে! ওই গর্তে! জ্যাকডাই, ওখানেই আছেন, না? জবাব দিন!

জবাব এলো।

আরেকটু সামনে এগিয়ে গর্তের ভেতর আলো ফেললো কিশোর। ওই তো, গুহার মেঝেতে পড়ে রয়েছে একজন মানুষ। পাশে দাঁড়িয়ে আরেকজন, জ্যাক ম্যানর। শুয়ে থাকা লোকটাই তাহলে রিড।

ঈশ্বরকে অনেক ধন্যবাদ, আমাদের খুঁজে পেয়েছে তোমরা, জ্যাক বললো। ওরা আমাদেরকে এখানে রেখে চলে গেল, আর এলো না। হঠাৎ পেছন থেকে ধাক্কা দিয়ে ঠেলে ফেলে দিয়েছে এই গর্তে। রিডের গোড়ালি মচকে গেছে। আমি ভালোই আছি, কিন্তু উঠবো কিভাবে? অনেক চেষ্টা করেছি, পারিনি। কারও সাহায্য ছাড়া পিরবোও না।

আর কোনো অসুবিধে নেই, জ্যাক ভাইয়া, আমরা এসে গেছি, কিশোরের পাশে দাঁড়িয়ে গর্তের ভেতরে উঁকি দিয়ে বললো জনি। কিভাবে তুললে সুবিধা হবে? গর্তের মুখটা তো বেশি বড় না।

প্রথমে আমাকে টেনে তোলো, জ্যাক বললো। তারপর দুজন গর্তে নেমে রিডকে তুলে ধরবে, তখন তাকে আমি টেনে তুলে নিতে পারবো। এমন বাজে জায়গা আর দেখিনি। ওই গর্তটা ছাড়া বেরোনোর আর কোনো জায়গাই নেই। কতো লাফালাফি যে করলাম। ছুঁতেই পারলাম না ওপরের ধার! আর রিড তো দাঁড়াতেই পারে না।

শুধু কিশোর আর জনিকে দিয়ে হলো না। মুসাকেও হাত লাগাতে হলো। তারপর অনেক কায়দা কসরৎ করে টেনে তোলা হলো জ্যাককে। সাথে দড়ি না আনলে বের করতে পারতো না। জিনা আর রবিনও হাত গুটিয়ে বসে নেই। টোগোকে আটকে রেখেছে জিনা, ওটা কেবলই ছুটে একদিকে চলে যেতে চায়। আর রবিন দুই হাতে দুটো টর্চ উচিয়ে রেখেছে।

অবশেষে উঠে এলো জ্যাক। দড়ি ধরে নেমে গেল কিশোর আর মুসা। ঘোরের মধ্যে রয়েছে যেন রিড। ঘোলাটে দৃষ্টি। জ্যাকের ধারণা, মাথায় আঘাত পেয়েছে রিড। দুদিক থেকে ধরে তাকে তুলে দাঁড় করালো কিশোর আর মুসা। এক পা বাকা করে বেকায়দা ভঙ্গিতে দাঁড়ালো সে, মুসার কাঁধে ভর রেখে। বের করা শক্ত।

তবে বেশি ভারি না রিড, এই যা সুবিধে। দুই হাতে ধরে তাকে মাথার ওপর তুলে ধরলো মুসা, অনেকটা টারজানের মতো। সুড়ঙ্গের মেঝেতে বিপজ্জনক ভঙ্গিতে শুয়ে পড়লো জ্যাক। মেঝে ঢালু, তাই মাথা পায়ের চেয়ে নিচুতে। পিছলে আবার গর্তে পড়ে যাওয়ার ভয় আছে। কিন্তু পরোয়া করলো না সে। পেছনে একই ভাবে শুয়ে পড়ে শক্ত করে তার পা জড়িয়ে ধরে রইলো জনি।, বুক পর্যন্ত গর্তের কিনারে বাড়িয়ে দিয়ে স্কুলে পড়লো জ্যাক। হাত বাড়ালো নিচের দিকে। রিডের হাতের নাগাল পেয়ে শক্ত করে ধরলো। তারপর ইঞ্চি ইঞ্চি করে টেনে তুলতে লাগলো। নিচ থেকে ঠেলে রেখেছে কিশোর আর মুসা।

অবশেষে তুলে আনা হলো রিড়কে। দড়ি বেয়ে উঠতে মুসা আর কিশোরের খুব একটা অসুবিধে হলো না, কারণ জনি আর জ্যাক তো রয়েছেই সাহায্য করার জন্যে।

খুব মজার একটা ব্যাপার ঘটে গেছে ভেবে আর চুপ থাকা সমীচীন মনে করলো না রাফি। ঘাউ ঘাউ করে হাঁক ছাড়লো কয়েক বার, বদ্ধ জায়গায় কানে তালা লাগিয়ে দিলো সকলের। ভয় পেয়ে ডেকে উঠলো ভেড়ার বাচ্চাটা, জিনার হাত থেকে ছুটে যাওয়ার জন্যে ছটফট করতে লাগলো।

হউফ! করে জোরে নিঃশ্বাস ফেললো জ্যাক। আর কোনোদিন বেরিয়ে আসতে পারবো ভাবিনি! বাপরে, কি জায়গা দম বন্ধ করে দেয়! চলো, এখানে আর এক মুহূর্তও না। বেরোই। আলোবাতাস দরকার। পানির অভাবে বুকটা শুকিয়ে যা খাঁ করছে। হারামজাদাগুলো সেই যে ফেলে চলে গেল, আর এলো না!

আবার পথ দেখিয়ে দলটাকে গুহার বাইরে বের করে নিয়ে এলো রাফিয়ান। স্বচ্ছন্দে। এবার আর মাটি কিংবা বাতাস শোকারও প্রয়োজন বোধ করেনি। ভুল করেনি একটিবারের জন্যেও। ভেড়ার বাচ্চাটা কিভাবে নিরাপদে বেরিয়ে গিয়েছিলো, এখন বোঝা গেল। অনুভূতি ওটারও যথেষ্ট প্রখর। ইন্দ্রিয়ের এই প্রখরতা কেবল মানুষেরই নেই।

উজ্জ্বল সূর্যালোকে বেরিয়ে এসে চোখ ধাধিয়ে গেল ওদের। বিশেষ করে রিড আর জ্যাকের। দীর্ঘ সময় গাঢ় অন্ধকারে বন্দী ছিলো ওরা। হাত দিয়ে চোখ ঢেকে ফেললো দুজনেই।

এখানে কিছুক্ষণ বসে আগে চোখের আলো সইয়ে নিন, কিশোর পরামর্শ দিলো, নইলে হাঁটতে পারবেন না। তারপর আমাদের বলুন, ভেড়ার বাচ্চাটার গায়ে মেসেজ লিখলেন কিভাবে? ওটাও কি গর্তে পড়ে গিয়েছিলো?

হ্যাঁ, মাথা ঝাঁকালো জ্যাক। আমাদের গর্তে ফেলে দিয়ে লোকগুলো চলে গেল। আমরা পড়েই আছি, পড়েই আছি। দিনরাত্রির প্রভেদ বোঝার উপায় নেই। সময় কতো, কি বার, কিছুই বুঝতে পারছি না। কোনো শব্দও নেই। তারপর হঠাৎ করেই কানে এলো মুদ খটখট আওয়াজ। কিসের, বুঝতে পারলাম না। তখনও জানি না পাথরে লেগে ভেড়ার বাচ্চাটার খুরের শব্দ হচ্ছিলো। অবাক হলাম। আমাদের আরও অবাক করে দিয়ে গর্তে পড়লো বাচ্চাটা। একেবারে আমার ওপরেই। পড়েই চেঁচাতে শুরু করলো গলা ফাটিয়ে। বের করে দিতে গিয়েও থেমে গেলাম। বুদ্ধিটা এলো মাথায়। মনে করলাম, বাইরে বেরোলে লোকের চোখে পড়বেই। যদিও বুঝতে পারছিলাম না কি করে ঢুকলো ওটা, আবার ঠিকমতো বাইরে বেরোতে পারবে কিনা এসব।

লিখে দিয়েছিলেন বটে, মুসা বললো, কিন্তু আরেকটু হলেই নষ্ট হয়ে যেতো আপনার মেসেজ। প্রায় মুছেই গিয়েছিলো।

তবু, শেষ পর্যন্ত বুঝতে তো পেরেছে, জোরে নিঃশ্বাস ফেললো জ্যাক। রিড হাত পা ছড়িয়ে চুপ করে বসে আছে, চোখ বন্ধ। তার দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে আবার বললো সে, সুড়ঙ্গে ঢোকানোর পর পরই আমাদের সমস্ত জিনিস কেড়ে নিয়েছে ডাকাতগুলো। ঘড়ি, টাকাপয়সা, এমনকি কলমটা পর্যন্ত।

তাহলে লিখলেন কি দিয়ে? জিনা জিজ্ঞেস করলো।

রিডের প্যান্টের পকেটে একটুকরো কালো চক ছিলো, জ্যাক জানালো। ওই চক আমাদের কাছে থাকে। চিহ্ন দেয়ার জন্যে ব্যবহার করি আমরা। বিশেষ করে বড় বড় ম্যাপে এয়াররুটগুলোর ওপর। বাচ্চাটাকে ধরে রাখলো রিড, আমি ওটার পিঠে লিখলাম। অন্ধকারে কি লিখছি, তা-ও বোঝার উপায় ছিলো না। পড়তে যে পেরেছো, এটাই আমাদের ভাগ্য। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে গর্তের বাইরে ছুঁড়ে দিয়েছি বাচ্চাটাকে। ভয় পেয়ে, কিংবা ব্যথা পেয়ে, যে কারণেই হোক, গলা ফাটিয়ে কয়েকবার চেঁচালো ওটা। তারপর দিলো দৌড়, যেদিক থেকে এসেছিলো সেদিকে। কি কাণ্ড, বলো তো? যেন আমাদের মেসেজ নেয়ার জন্যেই এসেছিলো ওটা! দুনিয়াতে অনেক রহস্যময় ব্যাপারই ঘটে, যার কোনো ব্যাখ্যা নেই। আবার কাকতালীয় ব্যাপার বলতেও ইচ্ছে করে না!

হুঁ, মাথা দোলালো জনি। নইলে ল্যারিই বা ওটার জন্য পাগল হবে কেন? আর ওটারই বা ঘুরে বেড়ানোর এতো শখ হবে কেন? যখন-তখন বাড়ি থেকে বেরিয়ে এদিক সেদিক চলে যায়। আর গেলেই ওটার পিছে পিছে ছোটে ল্যারি। এজন্যে সবাই মিলে কতো বকাবকি করি দুজনকে। অথচ আজ এটার এই বাড়িপালানো স্বভাবের কারণেই খুঁজে পাওয়া গেল তোমাদেরকে! নইলে কোনোদিনই ওই গর্ত থেকে…

আর বলিস না, বলিস না! তাড়াতাড়ি হাত নাড়লো জ্যাক। দম বন্ধ হয়ে আসছে!…আচ্ছা, এবার বল দেখি, আমরা গায়েব হয়ে যাওয়ায় এয়ারফীল্ডে শোরগোল ওঠেনি?

উঠেছে, রবিন বললো। আপনাদের দুজনের প্লেন দুটো যে চুরি হয়েছে জানেন? যে দুটো আপনারা চালাতেন?

আন্দাজ করেছি। ওরাও আমাদেরকে ধরে নিয়ে এলো, ওদিকে প্লেনও উড়লো দুটো।…একটা কুকুরের চিত্তার কানে আসছিলো, পাহাড়ের ওপর থেকে। বুঝতে পেরেছি, রাফিয়ান। ইস, যদি তোরা তখন বুঝতে পারতি আমাদের ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তাহলে ছুটে আসতে পারতি।

হ্যাঁ, ঝড়ের রাতে অনেক ঘেউ ঘেউ করেছে রাফি, জিনা বললো। আমি ওকে ধমক দিয়ে থামিয়েছি। যদি বুঝতে পারতাম ডাকাতদের দেখে চিৎকার করেছে ও…যাকগে, যা হবার হয়ে গেছে। এখন আর ওসব বলে লাভ নেই।

প্লেনগুলোর কি হয়েছে, জানো কিছু?

শুনেছি, ঝড়ের মধ্যে উড়তে গিয়ে সাগরে ভেঙে পড়েছে। পাইলটদের পাওয়া যায়নি, জনি জানালো।

ও, বিষণ্ণ হয়ে গেল জ্যাক। আমার খুব প্রিয় ছিলো প্লেনটা! আর ওড়াতে পারবো না! রিড, তোমারও নিশ্চয় খারাপ লাগছে?

হ্যাঁ, ক্লান্ত ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকালো রিড। গুহা থেকে বেরিয়ে খোলা বাতাসে আসার পর অনেকটা সুস্থ লাগছে তাকে, ঘোরের ভাবটা আর নেই! চল, যাওয়া যাক।

হাঁটতে জ্যাকের অসুবিধে হলো না, কিন্তু রিড একেবারেই পারলো না। পালা করে তাকে বয়ে নিয়ে চললো ছেলেরা। জিনার কোলে টোগো। ছাড়লেই সোজা পথে না গিয়ে ওটা আরেক দিকে চলে যেতে চায়।

মাঝপথে দেখা হলো পুলিশের সঙ্গে। কলিউডের ফোন পেয়ে গুহার দিকেই আসছিলো। রিডের দায়িত্ব নিলো ওরা।

ফার্মে ফিরে এলো ছেলেমেয়েরা। উদ্বিগ্ন হয়ে অপেক্ষা করছিলেন জনির বাবা, মা, আর ল্যারি। উষ্ণ সংবর্ধনা জানালেন সবাইকে। জিনার কোল থেকে টোগোকে প্রায় কেড়ে নিলো ল্যারি। জড়িয়ে ধরে আদর করতে করতে বললো, পালিয়ে যাওয়ার অভ্যাসটা তুই ছাড়, বুঝেছিস! বড়দের মতো করে বললো সে। বড় খারাপ অভ্যাস! ধরে একদিন এমন মার লাগাবো… কথা আর শেষ হলো না তার। যেন বুঝতে পেরেই মারের ভয়ে ঝটকা দিয়ে তার হাত থেকে ছুটে গিয়ে মাটিতে লাফিয়ে পড়লো বাচ্চাটা। তিড়িং বিড়িং করে খানিকটা লাফিয়ে নিয়ে দৌড় দিলো গোলাঘরের দিকে। ওটাকে ধরে আনতে ছুটলো ল্যারি।

বাচ্চা দুটোর কাণ্ড দেখে হাসতে আরম্ভ করলো সবাই। এমনকি রিডও পায়ের ব্যথা ভুলে গিয়ে হেসে উঠলো।

পাগল ছেলে! সস্নেহে সেদিকে তাকিয়ে বললেন মা। থাক, আর কিছু বলবো না টোগোকে। ওটার জন্যেই আজ ওদের ফিরে পাওয়া গেল..আরে, তোমরা সব দাঁড়িয়ে কেন? এসো এসো, ঘরে এসো। চা-নাস্তা রেডিই আছে।

ওসব নাস্তা-ফাস্তায় কাজ হবে না আমার, হেসে হাত নাড়লো জ্যাক। আমার আর রিডের ভুড়িভোজন দরকার। কখন যে শেষ খেয়েছি, ভুলেই গেছি।

ঠিক আমার কথাটা বলেছেন,তুড়ি বাজালো মুসা। কখন যে খেয়েছি মনেই নেই। এতো খাটাখাটনি করেছি, মনে হচ্ছে নাড়ি পর্যন্ত হজম হয়ে গেছে। আন্টি, দুটো বড় বড় কেক, আর অন্তত খানকুড়ি মাংসের বড়া না হলে চলবে না আমার।

পাগল ছেলে! মুসার দিকে তাকিয়ে দ্বিতীয়বার বললেন মিসেস কলিউড।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *