অথৈ সাগর ২

ভলিউম ১০ – অথৈ সাগর ২ (দ্বিতীয় খণ্ড) – তিন গোয়েন্দা – রকিব হাসান – সেবা প্রকাশনী

কাপড় খুলল কুমালো। লম্বা, শক্ত, বাদামী শরীর, যেন নারকেলের কাণ্ড। দেয়ালের গা থেকে উপসাগরের ওপর বেরিয়ে থাকা একটা পাথরে গিয়ে দাঁড়াল। পরনে সাঁতারের পোশাক বলতে কিছু নেই, হাতে শুধু দস্তানা। ধারাল প্রবাল থেকে তার আঙুল বাঁচাবে ওগুলো। খসখসে খোসাওয়ালা ঝিনুক খামচে ধরে তুলতে সুবিধে হবে।

ডুব দেয়ার জন্যে তৈরি হতে লাগল সে। ডুবুরিরা এই পদ্ধতিটাকে বলে টেকিং দ্য উইণ্ড বা বাতাস নেয়া। দম নিতে আরম্ভ করল সে, একটা থেকে আরেকটা আরও ভারি, আরও লম্বা। ঠেলে, জোর করে বাতাস ঢোকাচ্ছে ফুসফুসে। সেই বাতাস আটকে রাখতে বাধ্য করল ফুসফুসকে।

তারপর আস্তে করে ঝাঁপ দিয়ে পড়ল পানিতে। ঝাঁপ দিল না বলে আলগোছে শরীরটাকে ছেড়ে দিল বলা ভাল। মাথা নিচু করে ডাইভ দেয়নি। সোজা হয়ে পড়েছে। পা নিচের দিকে দিয়ে নেমে যাচ্ছে খাড়া।

এভাবে নেমে গেল দশ ফুট। তারপর ডিগবাজি খেয়ে ঘুরিয়ে ফেলল শরীরটা, এবার মাথা নিচে পা ওপরে। একই সঙ্গে হাত পা নাড়ছে, কাছিমের মত।

পানির নিচে সাঁতারের অনেক দৃশ্য দেখছে মুসা, সে নিজেও ভাল সাঁতারু। কিন্তু এরকম দৃশ্য কখনও দেখেনি। ডুবুরির পোশাক ছাড়া তিরিশ ফুট নিচে নামতে পারলেই ধন্য হয়ে যায় ইউরোপিয়ান কিংবা আমেরিকান সাঁতারুরা। চ্যাম্পিয়ন হয়ে যায়। ওই গভীরতায়ই পানির প্রচণ্ড চাপ পড়ে শরীরের ওপর। নিচের পানি ওপরের দিকে ঠেলতে থাকে, পারলে গ্যাসভর্তি বোতলের মুখের কর্কের মত ফটাস করে ছুঁড়ে মারতে চায়।

কিন্তু কুমালো পরোয়াই করল না চাপের। নেমে যাচ্ছে…চল্লিশ ফুট…পঞ্চাশ …ষাট।

আমার বিশ্বাস, এর ডবল নিচে নামতে পারবে ও, কিশোর বলল। সাঁতার জানে বটে পলিনেশিয়ানরা।

হ্যাঁ, যোগ করল রবিন। বয়েস দুবছর হওয়ার আগেই সাঁতার শিখে ফেলে। হাঁটা শেখার আগে সাঁতার শেখে অনেক পলিনেশিয়ান শিশু। ডাঙা আর পানি ওদের কাছে সমান। উভচর। সীল, কাছিম, ব্যাঙ, বীবরের মত।

আবছা দেখতে পাচ্ছে তিন গোয়েন্দা, থেমেছে কুমালো। প্রবাল আঁকড়ে ধরে যেন ঝুলে রয়েছে, পা ওপরের দিকে। হাতের জোরে টেনে শরীরটাকে নামাল খানিকটা, ছেড়ে দিল, তারপর ধরল আরেক জায়গার প্রবাল। এরকম করল কয়েক বার। মনে হচ্ছে, হাতের ওপর ভর দিয়ে সাগরের তলায় হেঁটে বেড়াচ্ছে সে।

তারপর কালো কিছু একটা আঁকড়ে ধরে মাথা ঘোরাল, তীব্র গতিতে উঠতে শুরু করল ওপরে। ভুস করে ভেসে উঠল তার মাথা, শরীর, কোমর পর্যন্ত, আবার ডুবল, ভাসল, ডুবল, ভাসল, পরিষ্কার করে নিল মাথার ভেতরটা। হাত বাড়িয়ে ধরল পাথরের কিনার, যেটা থেকে লাফ দিয়েছিল।

হিসহিস করে তার ফুসফুস থেকে বেরোচ্ছে চেপে রাখা বাতাস। ব্যবহৃত বাতাস বেরিয়ে যাওয়ার পর বুক ভরে টেনে নিল বিশুদ্ধ বাতাস। চেহারায় যন্ত্রণার ছাপ, ছেলেদের কথা যেন কানে ঢুকছে না।

ধীরে ধীরে ঢিল হয়ে এল শরীর। স্বভাবিক হল চেহারা। ওপরের দিকে তাকিয়ে হাসল সে। তার বাড়ানো হাতটা চেপে ধরে তাকে টেনে ওপরে তুলল ছেলেরা।

হাতের কালো বস্তুটা পাথরে রাখল কুমালো।

আনন্দে চিৎকার করে উঠল মুসা। মনে মনে ভাগ্যকে ধন্যবাদ জানাল কিশোর, সঠিক দ্বীপটা খুঁজে পাওয়ায়। উপসাগরটা খুঁজে পেয়েছে ওরা, পেয়েছে প্রফেসর ইস্টউডের মুক্তার খামার। নিশ্চিত হওয়ার কারণ আছে। এসব অঞ্চলের ঝিনুক সাধারণত এতবড় হয় না, বাইরে থেকে বীজ আনার ফলেই হয়েছে।

এরকম আর আছে? জিজ্ঞেস করল কিশোর।

মাথা ঝাঁকাল কুমালো। বিছিয়ে আছে তলায়। সেজন্যেই ওপর থেকে কালো লাগে। একটার গায়ে আরেকটা লেগে রয়েছে। শয়ে শয়ে।

উত্তেজনায় প্রায় নাচতে শুরু করল মুসা। তারমানে শত শত মুক্তা!

না, শান্তকণ্ঠে বলল কুমালো। সব ঝিনুকে মুক্তা থাকে না। একটা মুক্তার জন্যেই হয়ত একশো ঝিনুক খুলতে হবে।

হ্যাঁ, সে-রকমই হবার কথা, একমত হল রবিন। তবে এখানে একটু অন্য রকম হতে পারে। বিশেষ ব্যবস্থায় ঝিনুকের চাষ করেছেন প্রফেসর।

দেখা যাক তাহলে এটাতে কিছু আছে কিনা, বলতে বলতে কোমর থেকে ছুরি খুলল মুসা। ঝিনুকটা নিয়ে চাড় মেরে খোলা দুটো খোলার চেষ্টা করতে। লাগল। অনেক চেষ্টা করল, ঘামতে শুরু করল সে, কিন্তু ঝিনুক আর খুলতে পারল না।

এভাবে পারবে না, কায়দা আছে,কুমালো হাত বাড়াল। দেখি, দাও আমার কাছে। চাড় দিয়ে ডালা খোলার বদলে ছুরির ফলাটা সে ঢুকিয়ে দিল দুই ডালার মাঝের ফাঁক দিয়ে, যতখানি যায়, কেটে ফেলল খোলাকে চাপ দিয়ে বন্ধ করে রাখে যে মাংসপেশি, সেটা। পেশি কেটে যেতেই ঝটকা দিয়ে খুলে গেল ডানা দুটো।

মুসার হাতে ঝিনুকটা দিল কুমালো। নাও, এবার খুঁজে দেখ। থাকলে কিনারের মাংসের ভেতরেই থাকবে।

ভীষণ উত্তেজিত হয়ে, কাঁপা হাতে মুক্তা খুঁজল মুসা। পেল না। হতাশ হল খুব। কিন্তু হাল ছাড়ল না। আরও ভেতরেও থাকতে পারে, কে জানে। অনেক খুঁজল সে। ঝিনুকের আঠাল পিচ্ছিল মাংস আর দেহযন্ত্রের কোনা কিছুই বাদ দিল না। কিন্তু মুক্তা মিলল না।

ধুত্তোর, খামোকা ঘাটলাম! বিরক্ত হয়ে প্রবালের একটা স্তপের ওপাশে ঝিনুকটা ছুঁড়ে মারল মুসা। অন্য পাশে গিয়ে শক্ত কিছুতে লাগার বদলে লাগল নরম কিছুতে, বিচিত্র একটা শব্দ শোনা গেল। লাফ দিয়ে উঠে স্কুপের কাছে দৌড়ে এল মুসা। আবিষ্কার করল রেভারেণ্ড হেনরি রাইডার ভিশনকে। মুখ থেকে ঝিনুকের রস আর মাংস মুছছে লোকটা।

গর্জে উঠে কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল ভিশন। মনে পড়ল, মিশনারির ওরকম রাগ করা উচিত না, মুখ খারাপ তো দূরের কথা। মুখের ভাব স্বাভাবিক রেখে হাসার চেষ্টা করল।

আপনি এখানে কি করছেন? মুসা জানতে চাইল।

প্রশ্নের জবাব দিতে পারল না ভিশন। বেরিয়ে এল স্তুপের ওপাশ থেকে। কিশোর, রবিন আর কুমালোও এসে দাঁড়িয়েছে। ওদের দিকে চেয়ে হাসল। কান। থেকে গড়িয়ে পড়ছে ঝিনুকের রস।

তোমাদের জন্যে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছিলাম, বলল সে। তাই আর থাকতে না পেরে দেখতে এসেছি কি করছ।

আপনি আমাদের ওপর স্পাইগিরি করছিলেন! গরম হয়ে বলল মুসা।

শান্ত দৃষ্টিতে মুসার দিকে তাকাল ভিশন। মাই বয়, তোমার মনে রাখা উচিত, দ্র আচরণ ঈশ্বর পছন্দ করেন।

পাক-পবিত্র থাকাও ঈশ্বর পছন্দ করেন, মুসা বলল। যান, মুখ ধুয়ে পাকসাফ হোন।

কিশোরের দিকে চেয়ে অভিযোগের সুরে বলল ভিশন, দেখ, তোমার বন্ধু দুর্ব্যবহার করছে। তোমার কিছু বলা উচিত।

নিশ্চয় বলব, তবে আপনাকে। ও ভূল বলেনি, আপনি সত্যি স্পাইগিরি করছিলেন আমাদের ওপর। আড়ালে থেকে চোখ রাখছিলেন।

ভুল করছ, মাই সান, ভুল করছ। আর তোমাদেরই বা দোষ দিই কিভাবে? রক্ত গরম, মাথা গরম করার বয়েস তো এটাই। যাকগে, আমি কিছু মনে করিনি তোমাদের কথায়। মিশনারি যখন হয়েছি, মাপ করতেই হবে মানুষকে, বলতে বলতে কিশোরের কাঁধে হাত রাখল ভিশন।

ঝাড়া দিয়ে হাতটা কাঁধ থেকে ফেলে দিল কিশোর। হয়েছে, ওসব ভণিতা রাখুন। আপনি মিশনারি নন। বেঈমান, দুমুখো সাপ।

বুঝতে পারছি, রেগেছ,ধৈর্য হারাল না মিশনারি। কিন্তু কেন এই ক্ষোভ জানতে পারি? সব খুলে বল আমাকে, বুঝে দেখি ভুল বোঝাবুঝিটা কোত্থেকে হল?

ক্ষণিকের জন্যে দ্বিধায় পড়ে গেল কিশোর। ভুল করেনি তো? লোকটা কি সত্যিই মিশনারি? ধৈর্য তো সে-রকমই, শান্তও রয়েছে। রেগে না গিয়ে বরং বোঝানর চেষ্টা করছে।

ফাঁদে ফেলার জন্যে হঠাৎ বলল কিশোর, প্রফেসর ইস্টউডের নাম নিশ্চয় শুনেছেন?

সামান্যতম চমকাল না ভিশন। মনে করার চেষ্টা চালাচ্ছে যেন। ইস্টউড… মাথা নাড়ল। না, মনে পড়ছে না। বোধহয় শুনিনি।

অ, তাহলে তো তাঁর ল্যাবরেটরিতে বাগও আপনি লুকাননি। তার সঙ্গে আমাদের কি কি কথা হয়েছে শোনেননি। জানেন না আমাদের এই দ্বীপে আসার কারণ। কালো সেডানে করে আমাদের পিছু নেননি। স্যালভিজ ইয়ার্ডটাও চেনেন।

না, তাই না?

কি বলছ কিছুই বুঝতে পারছি না, গলার জোর কিছুটা হারিয়েছে ভিশন। ঝিনুকের একটুকরো মাংস খসে পড়ল লম্বা নাক থেকে।

বুঝিয়ে দিচ্ছি। জামবুকে আপনিই শুকতারায় তুলে দিয়েছিলেন পার্ল ল্যাগুনের অবস্থান জানার জন্যে। আপনার নির্দেশেই আমার কাগজপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করেছে সে। মিশনারির ছদ্মবেশে আমাদের ভুলিয়ে বোটে উঠেছেন জামবু যে কাজ করতে পারেনি, সেটা করার জন্যে। লগবুক থেকে রিডিং নকল করেছেন। পথে এত দ্বীপ পড়ল কোনটাতেই নামেননি, পছন্দ হয়নি আপনার। হবে কি ভাবে? নামার উদ্দেশ্যে তো আসেননি। মানুষের ভালবাসা না ছাই, আসলে এসেছেন মুক্তোর খোঁজে।

ধপ করে একটা নারকেলের গুড়ির ওপর বসে পড়ল মিশনারি। হতাশ ভঙ্গিতে দুহাত ছড়াল। সামনে ঝুঁকল চওড়া কাঁধ। রাগে কালো হয়ে গেছে মুখ। তবে সামলে নিল।

বেশ, বলল সে। বুঝতে পারছি, খেলা খতম। অতিরিক্ত চালাক তুমি। ফাঁকি দিয়ে আর লাভ হবে না, গিলবে না তুমি।

ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে রইল কিশোর।

হ্যাঁ, আবার বলল ভিশন। তোমাকে ফাঁকি দেয়া যাবে না। বড় বেশি চালাক। তোমার বিরুদ্ধে না গিয়ে পক্ষেই থাকতে চাই।

সেটা সম্ভব নয়।

কেন নয়? স্বীকার করছি, আমি মিশনারি নই। ছদ্মবেশ নিয়েছি, অভিনয় করেছি। তার মানে এই নয় যে তোমাদের ক্ষতি করতে চেয়েছি।

কি চেয়েছেন তাহলে? মুক্তো চুরি করতে?

চুরি বলছ কেন? শব্দটা পছন্দ হল না ভিশনের। এই মুক্তোর খেত কারও ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়, এই দ্বীপটার মালিকও প্রফেসর নয়। এমনকি আমেরিকান সরকারও এটার মালিকানা দাবি করতে পারবে না। এটা কারও জায়গা নয়, তারমানে সবার। আমি সেই সবার একজন। তোমরাও। এই ল্যাগুন, যা যা আছে এখানে, সব কিছুর মালিক সবাই। আমাদের সবারই অধিকার রয়েছে এতে।

তারমানে আপনি বলতে চাইছেন, এত খাটাখাটনি করে, টাকা খরচ করে, প্রফেসর যে মুক্তোর খামার করেছেন…

প্রফেসরটা একটা গাধা। মানুষকে অতিরিক্ত বিশ্বাস করে। নিজের ভাল বোঝার অধিকার রয়েছে মানুষের এটা যেন জানেই না। আমি তার মত বোকা নই। কাজেই নিজের ভালমন্দ অবশ্যই বুঝব। তোমাদের কাছে আর লুকিয়ে লাভ নেই, আমার নাম ভিশন নয়, ডেংগু পারভি। আমি মুক্তা ব্যবসায়ী। দক্ষিণ সাগরে খুচরা মুক্তা ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে কিনে নিয়ে যাই নিউ ইয়র্ক, লণ্ডন, প্যারিসে। বিক্রি করি। মুক্তা চিনি আমি। আমার সাহায্য নিলে লাভ ছাড়া ক্ষতি হবে না তোমাদের। আমি যে দামে বিক্রি করতে পারব, তার চার ভাগের এক ভাগ দামেও তোমরা পারবে না। একটা রফায় আসতে পারি আমরা, ফিফটি-ফিফটি শেয়ার। কি, রাজি?

আপনার কথা শেষ হয়েছে? তাহলে যেতে পারেন।

হাসি ফুটল ডেংগুর ঠোঁটে। কাঁধের হোলস্টার থেকে রিভলভার বের করল। আমার সম্পর্কে অনেক কিছুই জেনেছ তোমরা, ভারি গলায় বলল সে। আরও একটা কথা জেনে রাখতে পার, মুক্তো অনেক দামি জিনিস। এরচে অনেক কম দামি জিনিসের জন্যে মানুষ খুন করেছি আমি।

কিশোর, মুসা বলে উঠল, ভয় দেখাচ্ছে ব্যাটা। রাজি হয়ো না। কচুটাও করতে পারবে না।

জ্বলে উঠল ডেংগুর চোখ। এই নিগ্রোর বাচ্চা, চুপ! আরেকটা কথা বললে জিভ টেনে ছিঁড়ে ফেলব। তোকে কথা বলতে কে বলেছে? চুপ করে বোস ওখানে। জলদি! এই, তোমরাও বস।

শুনো না, কিশোর, ওর কথা শুনো না, চেঁচিয়ে উঠল মুসা। দেখি হারামজাদা কি করে…

গর্জে উঠল রিভলভার। দুবার গুলি করল ডেংগু। একটা বুলেট মুসার প্রায় কান ছুঁয়ে গেল। আরেকটা গেল কিশোরের মাথার ওপর দিয়ে। পাথরে লেগে পিছলে গেল বুলেট, শিস কেটে চলে গেল পানির ওপর দিয়ে। প্রতিধ্বনি তুলল ল্যাগুনের অন্যপাশে প্রবালের দেয়ালে। চিৎকার করে নারকেলের কাণ্ড থেকে উড়ে গেল একটা নিঃসঙ্গ গাংচিল।

মিথ্যে হুমকি দিচ্ছে না লোকটা, বুঝতে পারল কিশোর। যেখানে বসতে বলা হয়েছে, বসে পড়ল। হাত ধরে টেনে বসাল মুসাকে। রবিনকে কিছু বলতে হল না, আপনাআপনি বসে পড়ল।

নিরস্ত্র কয়েকজন মানুষকে রিভলভারের ভয় দেখাচ্ছেন, রবিন বলল। লজ্জা করে না আপনার?

মানুষ কোথায়? কয়েকটা পুঁচকে বাঁচাল ছোঁড়া, হাহ হা। আর তোমাদের কাবু করতে অস্ত্র লাগে নাকি? খালি হাতেই টেনে টেনে ছিড়তে পারি ইচ্ছে করলে। কিন্তু কে কষ্ট করতে যায়? আর রিভলভার তোমাদের ভয়ে বের করিনি, করেছি ওই দানবটার জন্যে। এই দানব, কানাকার বাচ্চা কানাকা, এদিকে আয়। বোস। রিভলভার নেড়ে কুমালোকে ডাকল ডেংগু।

কুমালোকে দলে টানার কথা ভাবছেন নাকি? কিশোর বলল। অযথা মুখ খরচ করবেন। লাভ হবে না।

টেনে টেনে হাসল ডেংগু। এমন কোন কানাকা দেখিনি আমি, টাকা দিয়ে যাকে গোলাম বানানো যায় না। কুমালো, আমার চাকরি করবি তুই। ডুবুরি। অনেক টাকা দেব তোকে। জীবনে, এত টাকা চোখেও দেখিসনি। যা, কাজ শুরু করে দে। পানিতে নাম।

ধীরে ধীরে হাসি ফুটল কুমালোর সুন্দর মুখে। ভুল করছেন, মিস্টার ডেংগু, মোলায়েম স্বরে বলল সে। নাম শুনেই বুঝতে পারছি অস্ট্রেলিয়া, কিংবা নিউ গিনির কোন জঙ্গলে আপনার বাড়ি। টাকা দিয়ে স্বদেশী কোন জংলী ভাইকে গিয়ে কিনুন। রায়াটিয়ার মানুষ গোলাম হয় না।

যা বলছি কর! বেঁকিয়ে উঠল ডেংগু। নইলে মগজ বের করে দেব!

কিশোরের দিকে তাকাল কুমালো। আবার ফিরল ডেংগুর দিকে। বেশ। কত দেবেন?

এই তো পথে আসছিস। গোলাম আবার হবি না। তোদের চিনি না আমি? যা তুলবি তার পাঁচ ভাগের একভাগ।

চিন্তিত ভঙ্গিতে মাথা দোলাল কুমালো। আমার দস্তানা। আপনার পেছনের ওই পাথরের কাছে…

পেছন ফিরল ডেংগু।

বসা থেকে উঠে পড়ল মুসা।

ঝট করে আবার এদিকে ফিরল ডেংগু। কুমালোর দিকে রিভলভার নেড়ে বলল, যা, তুই নিয়ে আয়।

পাশ দিয়ে চলে গেল কুমালো। সামান্য পাশে ঘুরে একসঙ্গে তিন কিশোর আর তার ওপর নজর রাখল ডেংগু।

নড়ে উঠল কিশোর। মুহূর্তের জন্যে শুধু নজর ফেরাল ডেংগু, এটুকুই যথেষ্ট। বাঘের মত লাফিয়ে এসে তার ওপর পড়ল কুমালো। বাহু দিয়ে পেঁচিয়ে ধরল গলা। আরেক হাতে কজি চেপে ধরে রিভলভারটা হাত থেকে ফেলে দেয়ার চেষ্টা করল।

এগিয়ে এল তিন গোয়েন্দা।

ডেংগুর গায়ে মোষের জোর। হাত থেকে রিভলভার ছাড়ল না। কিশোরকে নিশানা করল।

সর, সরে যাও! চিৎকার করে বলল কুমালো। কিছুতেই পিস্তলের নল যোরাতে পারছে না।

গর্জে উঠল রিভলভার। আগেরবার গুলি করেছিল মারধান করার জন্যে। এবার করেছে মারার জন্যে। শেষ মুহূর্তে কুমালোর হ্যাঁচকা টানে লক্ষ্যভ্রষ্ট হল গুলি।

সামনে চলে এল মুসা। ঘুসি মারল ডেংগুর মুখে।

ভীষণ শক্তিশালী বার ভেতর থেকে রিভলভারটা বের করার প্রাণপণ চেষ্টা চালাচ্ছে কুমালো। পারছে না। নলের মুখ আস্তে আস্তে ঘুরে যাচ্ছে মুসার পেটের দিকে। এখন একটাই কাজ করার আছে কুমালোর, মুসাকে বাঁচাতে হলে। সামনে চলে আসা। নিজের শরীর দিয়ে মুসাকে আড়াল করা। ঠিক তা-ই করল সে। ডেংগুও ট্রিগারে চাপ দিল, সে-ও চলে এল নলের সামনে। গুলি খেয়ে পড়ে গেল মাটিতে।

হাঁটু গেড়ে বন্ধুর পাশে বসে পড়ল মুসা। মনে পড়ল বিকিনির সেই রাতের কথা। সৈকতে বসে কথা দিয়েছিল ওরা, একে অন্যের জন্যে জীবন দিয়ে দেবে। নাম বদল করেছিল। কুমালো বন্ধুত্বের মান রেখেছে।

ডেংগুর সোলার প্রেক্সাসে ঘুসি মারছিল কিশোর। কিছুই হয়নি দানবটার। বরং কিশোরই হাতে ব্যথা পেয়েছে। তার মনে হয়েছে, ঘুসি মেরেছে একতাল রবারের ওপর। ঘুসাঘুসি বাদ দিয়ে বসল কুমালোর পাশে।

এই সুযোগে ছুটে চলে গেল ডেংগু।

পিছু নিতে যাচ্ছিল মুসা, হাত ধরে তাকে থামাল কিশোর। পরে। ওর কথা। পরে ভাবা যাবে। আগে কুমালোর ব্যবস্থা করা দরকার।

কি করব?নাড়ি দেখছে রবিন। চলছে এখনও। কুমালোর ডান হাঁটুর ইঞ্চি দশেক ওপর থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে।

চোখ বুজে পড়ে আছে কুমালো।

ক্ষতটা পরীক্ষা করল কিশোর। দুটো গর্ত। বুলেট ঢোকার একটা, অন্যটা বেরোনোর। যেটা দিয়ে ঢুকেছে, ওটার মুখের চারপাশে পুড়ে গেছে চামড়া। খুব কাছে থেকে গুলি করলে হয় এরকম, বারুদের আগুনে পুড়ে যায়।

বুলেটটা বোধহয় হাড়ে লাগেনি, মাংস ফুঁড়ে বেরিয়ে গেছে। ভাগ্য ভাল, শিরা হেঁড়েনি। রক্ত বেরোচ্ছে, তবে কম।

শার্টের কাপড় ছিঁড়ে ল্যাণ্ডন থেকে ভিজিয়ে আনল রবিন। মুছে দিতে লাগল ক্ষত।

পেনিসিলিন দরকার, কিশোর বলল। কিংবা সালফা পাউডার।

দুটোই আছে বোটে, বলল রবিন। নিয়ে আসব গিয়ে?

না। ওকেই নিয়ে যেতে হবে বোটে। বাংকে শুইয়ে দিতে হবে। কিন্তু, নেয়াই হয়ে যাবে মুশকিল। মুসা, তুমি বরং গিয়ে বোটটা কাছে নিয়ে এস। দাঁড়াও দাঁড়াও, ইঞ্জিনের শব্দ…

ঠিকই শুনেছে সে। চালু হয়েছে বোটের ইঞ্জিন। ডেংগুই বোধহয় নিয়ে আসছে, রবিন বলল। অনুশোচনা হয়েছে তাহলে।

প্রাচীরের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল বোটটা। ল্যাগুন পেরিয়ে এসে ঢুকল উপসাগরে। ইতিমধ্যে নিজের শার্ট দিয়ে পেঁচিয়ে কুমাােের জখমের ওপরে টর্নিকেট বেঁধে ফেলেছে কিশোর। তার জানা আছে পনেরো মিনিট পর পর ঢিল দিয়ে আবার বাঁধতে হবে।

ডেংগু বোটটা নিয়ে আসছে বলে তার ওপর থেকে রাগ অনেকখানি কমল কিশোরের। মুসা, ওকে দেখিয়ে দাও কোন জায়গায় বোট রাখবে।

ইঞ্জিন থেমে গেছে। মুখ তুলে তাকাল কিশোর। অবাক হল। তীর থেকে এখনও একশো ফুট দূরে রয়েছে বোটটা।

এই-ই, আরেকটু সামনে আনতে হবে, চেঁচিয়ে হাত নেড়ে বলল মুসা।

জবাবে খিকখিক হাসি শোনা গেল। হুইল মোরাল ডেংগু। বোটের নাক ঘুরে গেল আরেক দিকে।

ভুল করছ, বাবা, হেসে বলল ডেংগু। তীরে ভেড়ানর জন্যে আনিনি। যাবার আগে শুধু কয়েকটা কথা বলতে এলাম তোমাদের সঙ্গে।

বোকা হয়ে গেল কিশোর।

হাঁ করে ডেংগুর দিকে তাকিয়ে আছে তিনজনে।

যাবার আগে মানে? কিশোর বলল। কি বলতে চাইছেন? গলা কাঁপছে তার।

বুঝলে না? একটা প্রস্তাব দিয়েছিলাম, মানতে পারনি। কাজেই একাই যেতে হচ্ছে আমাকে। সোজা পোনাপেতে চলে যাব। একটা জাহাজ আর ডুবুরি ভাড়া করে নিয়ে ফিরে আসব।

পারবেন না। নেভিগেশনের কিছু জানেন না।

তাতে কি? পোনালে অনেক বড় দ্বীপ। সোজা দক্ষিণে চলতে থাকব। এক সময় না এক সময় পেয়েই যাব দ্বীপটা।

কিন্তু কুমালোকে ডাক্তার দেখানো দরকার। এখানে থাকলে ও মরে যাবে। এভাবে একজন মানুষ মরবে, ভাবছেন না সে কথা?

কেন ভাবব? ও তো একটা কানাকা।

বলেন কি! এরকম একটা জায়গায়…,হারিক্যানে ধ্বংস হয়ে যাওয়া দ্বীপটার ওপর চোখ বুলিয়ে আতঙ্কিত হল কিশোর। এখানে ফেলে যেতে পারেন না আমাদেরকে। আপনি ফেরা পর্যন্ত বাচব না। কোন খাবার নেই। একটা কাঁকড়াও দেখিনি এতক্ষণে। ছায়া নেই, উড়ে যে বানাব তারও উপায় দেখি না। পানি নেই। পিপাসায়ইরে যাব। আর এতগুলো খুনের দায়ে সারা জীবন জল খাটতে হবে আপনাকে।

একবার খেটেছি, ডেংগু বলল। আর ঢাকার ইচ্ছে নেই ওখানে। এজন্যেই গুলি করে মারলাম না তোমাদের। যদি কেউ তোমাদের কথা জিজ্ঞেস করে-করবে বলে মনে হয় না—যদি করেই, বলব আমি না ফেরাতক দ্বীপে থাকবে ঠিক করেছিলে তোমরা। বাঁচতে পারনি, কোন কারণে মরে গেহ, তার আমি কি করব?

থ্রটলের দিকে হাত বাড়াল ডেংগু।

দাঁড়ান! মরিয়া হয়ে বলল কিশোর। একটা কথা অত রাখুন। ফার্স্ট এইড কিট থেকে পেনিসিলিনের টিউব আর সালফার কৌটাটা দিয়ে যান। কাছে আসার দরকার নেই। ছুঁড়ে মারুন।

হেসে উঠল ডেংগু। ওগুলো আমারও দরকার হতে পারে, খোকা। দূর যাত্রায় যাচ্ছি তো। কখন কি ঘটে যায়, বলা যায় না। তখন পাব কোথায়? চলি। গুড় বাই।

হালকা বাতাস ঠেলে বোটটাকে অনেকটা কাছে নিয়ে এসেছে। হঠাৎ দৌড়ে গিয়ে পানিতে ঝাঁপ দিল মুসা। জোরে সাঁতরে চল বোটের দিকে। দেখাদেখি কিশোরও গিয়ে পানিতে পড়ল। প্রথমবারের চেষ্টায় ইঞ্জিন স্টার্ট না নিলে হয়ত বোটটাকে ধরে ফেলতে পারবে ওরা। খালি হাতে পারবে না ডেংগুর সঙ্গে, পারেনি চারজনে মিলেও, তার ওপর ওর কাছে রয়েছে রিভলভার। কি করে কাবু করবে এত শক্তিশালী শত্রুকে, একবারও ভাবল না ওরা।

চালু হয়ে গেল ইঞ্জিন। ঘুরতে শুরু করে প্রপেলার। খুব ধীরে গতি নিতে লাগল ভারি বোটটা। একসময় আশা হল ছেলেদের, ধরে ফেলতে পারবে। কিন্তু পরক্ষণেই গতি বাড়ল, ওদের চেয়ে দ্রুত চলতে শুরু করল ওটা।

আর চেষ্টা করে লাভ নেই, থেমে গেল কিশোর আর মুসা। তাকিয়ে রয়েছে বোটের দিকে।

ল্যাগুনের প্রবেশমুখের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে ওটা। দেয়ালের কাঁধের ওপাশে হারিয়ে যাবার আগের মুহূর্তে ওদের দিকে ফিরে হাত নাড়ল ডেংগু।

আর কিছু দেখার নেই। শুধু বোটের রেখে যাওয়া ঢেউ ছাড়া। চিৎকার করে উঠল সেই গাংচিলটা। ওই একটা পাখি ছাড়া জীবন্ত আর কোন প্রাণী যেন রেখে যায়নি রিক্যান।

আর কি করব! চল, বলে তীরের দিকে সাঁতরাতে শুরু করল কিশোর।

আস্তে আস্তে সাঁতরে তীরে ফিরে এল ওরা। ডাঙায় উঠে এসে ধপ করে প্রায় গড়িয়ে পড়ল কুমালোর পাশে।

দীর্ঘ একটা মুহূর্ত নীরবে একে অন্যের দিকে তাকিয়ে রইল তিন গোয়েন্দা। যা ঘটে গেছে, বিশ্বাস করতে পারছে না এখনও। রুক্ষ প্রবালের স্কুপের ওপর ঘুরে এল ওদের দৃষ্টি।

হঠাৎ হাসতে শুরু করল মুসা। হতাশার দুর্বল হাসি। রবিনসন ক্রুসসা পড়ার পর কতবার ভেবেছি, ইস, ওরকম কোন দ্বীপে গিয়ে যদি থাকতে পারতাম, কি মজা হত। কিন্তু মরুভূমির চেয়ে খারাপ এরকম একটা জাগায় আটকা পড়ব, কল্পনাও করিনি কোনদিন!

নড়েচড়ে গুঙিয়ে উঠল কুমালো। যন্ত্রণার ছাপ চেহারায়, ভাঁজ পড়ল কপালে। চোখ মেলল সে। একে একে দেখল কিশোর, রবিন আর মুসার মুখ। কি ঘটেছিল, মনে পড়ল সব।

সরি, বেহুশ হয়ে গিয়েছিলাম, উঠে বসার চেষ্টা করল কুমালো। পারল না। চিত হয়ে শুয়ে পড়ল আবার। বিকৃত করে ফেলেছে চেহারা।

চুপচাপ শুয়ে থাক, কিশোর বলল।

জোর করে মুখে হাসি ফোঁটাল কুমালো। কি কি ঘটেছে আমি ঘুমানোর সময়? দারুণ কিছু মিস করেছি?

না, তেমন কিছু না। শুধু ডেংগুকে বিদায় জানাতে বাধ্য হয়েছি আমরা। বিদায়? চলে গেছে, বোট নিয়ে। পোনাপে থেকে জাহাজ আর ডুবুরি নিয়ে আসবে।

বড় বড় হয়ে গেল কুমালের চোখ। বিশ্বাস করেছ ওর কথা? ফাঁকি দিয়েছে সে, ধাপ্পা দিয়েছে। ভয় দেখিয়ে তোমাদেরকে দিয়ে কাজ আদায় করতে চেয়েছে। দেখ, রাতের আগেই ফিরে আসবে আবার। আমাদেরকে এই অবস্থায় এখানে ফেলে যেতে পারে না সে।

আল্লাহ করুক, তাই যেন হয়, আশা করল মুসা।

কিন্তু যদি সত্যিই চলে গিয়ে থাকে, তাহলে পোনাপেতে পৌঁছতে অন্তত তিন দিন লেগে যাবে তার। জাহাজ আর ডুবুরি জোগাড় করতে কম করে হলেও এক হপ্তা। ভাল ডুবুরি মেলানো খুব কঠিন। দুই তিন হপ্তাও লাগতে পারে। তারপর আরও তিন-চার দিন লাগবে এখানে আসতে। তিন হপ্তায় এখানে আমাদের কি হবে বুঝতে পারছে না সে?

না পারার কোন কারণ নেই, কিশোর বলল। তবে ও-ব্যাপারে মাথাব্যথা নেই তার।

এক হপ্তাও যদি লাগে আসতে, নিঃসঙ্গ পাথরগুলোর দিকে তাকাল কুমালো, কড়া রোদে যেন ঝলসাচ্ছে ওগুলো। গেছি আমরা। জানো কেন মানুষ নেই এটাতে?

না। কেন?

কারণ এখানে মানুষ বাস কতে পারবে না। কেউ কখনও চেষ্টা করেছে বলেও মনে হয় না। জীবন ধারণের জন্যে প্রয়োজনীয় জিনিস এখানে নেই। যা-ও বা কিছু ছিল, সব ধ্বংস হয়ে গেছে হারিক্যানে। এমনকি এখন পাখি পর্যন্ত থাকতে পারবে না এখানে। ল্যানে মাছ দেখিনি। মুসা যে নাম রেখেছে, মরা দ্বীপ, ঠিকই রেখেছে। এখানে থাকলে ক্ষুধায় ধুকে ধুকে মরতে হবে।

চোখ বুজে চুপচাপ যন্ত্রণা সহ্য করল কিছুক্ষণ কুমালো। তারপর আবার চেয়ে, হাসল। ওভাবে বলা উচিত হয়নি আমার। আসলে দুর্বল হয়ে পড়েছি তো, আবোলতাবোল…ভেব না, উপায় বের করেই ফেলব আমরা। বেঁচে যাব। কষ্ট করতে হবে আরকি, অনেক খাটতে হবে। এভাবে এখন শুয়ে থাকলে চলবে না আমার, জোর করে উঠে বসল কুমালো।

শুয়ে থাক! তীক্ষ্ণ হল কিশোরের কণ্ঠ। এই দেখ, কি কাণ্ড করেছ! আবার রক্ত বেরোতে শুরু করেছে। কোন ওষুধ নেই আমাদের কাছে।

কে বলল নেই? দুর্বল কণ্ঠে বলল কুমালো। ওষুধের বাক্সের ওপরই তো শুয়ে আছি। একটা নারকেলের কাণ্ডে মাথা রেখেছে সে।

এটা দিয়ে কি হবে?

দুরি দিয়ে বাকলটা চাছো। পাউডারের মত বেরোবে। ওগুলো জখমে লাগিয়ে। দাও। অ্যাসট্রিনজেন্ট, রক্ত পড়া বন্ধ করবে।

পচন ধরাবে না তো আবার?

আরে না না, যে কড়া রোদ। টেরিলাইজ করে দিয়েছে। একেবারে জীবাণুমুক্ত।

পলিনেশিয়ানদের ভেষজ জ্ঞানের কথা শুনেছে কিশোর। লতাপাতা, ঘাস, শেকড়, আর গাছপালা থেকে ওষুধ তৈরি করতে নাকি ওরা ওস্তাদ। অনেক জটিল রোগের সার্থক চিকিৎসা করে ফেলে। কিন্তু শুকনো নারকেলের কাণ্ডও যে ওষুধ হিসেবে ব্যবহার হয়, ভাবতে পারেনি।

তর্ক করল না সে। ছুরি দিয়ে চাছতে আরম্ভ করল। পাউডার জমল। ওগুলো নিয়ে জখমে রেখে শার্ট ছিঁড়ে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিল।

কুমালোর কপালে হাত দিয়ে দেখল রবিন। গরম। জ্বর উঠছে। অল্পক্ষণেই অস্থির হয়ে গেল কুমালো।

ছায়া দরকার, মুসাকে বলল কিশোর। ছায়ায় নিয়ে রাখতে হবে এখন ওকে।

যতদূর চোখ যায়, পুরো চীফটায় চোখ বোলাল ওরা। ছায়া নেই কোথাও। ওদের দিকে তাকিয়ে ব্যঙ্গ করছে যেন শুধু রুক্ষ পাথর।

এক জায়গায় কাছাকাছি হয়ে জন্মেছিল কিছু নারকেল গাছ, কাণ্ডগুলো দাঁড়িয়ে রয়েছে এখন। সামান্য ছায়া আছে ওখানে। সেখানেই কুমালোকে শুইয়ে দিল। ওরা। এমন কিছু ছায়া নয়, রোদের আঁচ ঠেকাতে পারছে না, তবু নেই মামার চেয়ে কানা মামা ভাল। সূর্য সরার সাথে সাথে ছায়া সরছে, কুমালোকেও সরাতে হচ্ছে।

এভাবে হবে না, কিশোর বলল। ছাউনি-টাউনি একটা কিছু তৈরি করতেই হবে।

তিক্ত হাসল মুসা। কোন ভরসা নেই।

কিন্তু নেই বলে বসে থাকল না। পুরো দ্বীপটায় খুঁজে দেখতে চলল ছাউনি বানান মত কিছু পাওয়া যায় কিনা।

বিড়বিড় করে কথা বলতে লাগল কুমালো। শোনার জন্যে প্রায় তার মুখের কাছে কান নিয়ে যেতে হল কিশোর আর রবিনকে।

কুমালো বলছে, কিশোর, আমার কথায় দুশ্চিন্তা কোরো না। বাড়িয়েই বলেছি। কোন না কোনভাবে টিকে যাবই আমরা। বেশিদিন তো নয়। এক কি দুহপ্তা, বড়জোর তিন। ডেংগু আসবে। আসতেই হবে তাকে। মুক্তার লোতে। সে

এলে অবশ্য আশা নেই আমাদের, কোন জাহাজ আসে না এদিকে। অসুবিধে নেই। ডেংগুই আসবে। আর আসতে কষ্ট হবে না তার, দ্বীপটার অবস্থান তো জানাই আছে।

া, কুমালো, কিশোর বলল। এখন ঘুমানর চেষ্টা কর তো একটু।

ওদেরকে ভয় পাওয়াতে চাইল না কিশোর। সে কেবল একলা জানে, ডেংগু কখনও ফিরে আসবে না। আসতে পারবে না।

বোটে লগবুক আছে। সেটার রীডিং অনুসরণ করবে ডেংগু। তাকে ফকি দিতে চেয়েছিল কিশোর। কিন্তু নিজের পাতা ফাঁদে নিজেই পড়েছে এখন। শুধু সে

একা নয়, আরও তিনজনকে নিয়ে পড়েছে।

লগবুকের রীডিং অনুসরণ করে একশো মাইল দূরে চলে যাবে ডেংগু। কিছুতেই বুঝতে পারবে না পার্ল ল্যাগুন কোথায় আছে। হয়ত খুঁজবে। যথাসাধ্য চেষ্টা করবে দ্বীপটা খুঁজে বের করার। পাওয়ার সম্ভাবনা হাজারে এক, হয়ত বা লাখে। মাসের পর মাস, সারা বছর ধরে খুঁজলেও হয়ত বের করতে পারবে না। কয়েক মাইলের মধ্যে চলে এলেও চোখে পড়বে না, কারণ দ্বীপটা সমুদ্র সমতল থেকে মাত্র দশ ফুট উঁচু, তা-ও যেখানটায় সবচেয়ে বেশি। গাছপালা নেই। পানি থেকে আলাদা করে দ্বীপটাকে চেনা খুব কঠিন। সঠিক রীডিং জানা থাকলেই শুধু খুঁজে বের করা সম্ভব।

আর যদিও বা অলৌকিক ভাবে বছরখানেক পরে ডেংগু খুঁজে পায় দ্বীপটা, ওদের লাভ কি তাতে? সে এসে দেখবে, চারটে ঝকঝকে কঙ্কাল পড়ে রয়েছে প্রবাল পাথরের মাঝে, অবশ্যই যদি ঝড়ের সময় পানিতে ভাসিয়ে না নিয়ে যায় লাশগুলো।

ডেংগু হয়ত ওদেরকে মরার জন্যে রেখে যায়নি। খানিকটা শাস্তি দিতে চেয়েছে। এটা ভেবেই ফেলে গেছে, আবার তে; আসছেই, ততদিন মরবে না ওরা। কিন্তু কিশোর যা করে রেখেছে, সময় মত কিছুতেই আসতে পারবে না ডেংগু।

রবিন আর মুসা জানলে কি বলবে? কুমালোও কি তাকেই দোষারোপ করবে তাদের মৃত্যুর জন্যে? মুখে হয়ত কেউই কিছু বলবে না, কিশোরের মানসি যন্ত্রণা বাড়াতে চাইবে না, কিন্তু মনে মনে? না খেয়ে মরার জন্যে কি দোষ দেবে না তাকে? আচ্ছা, না খেয়ে, পিপাসায় ধুকে ধুকে মরতে কতটা কষ্ট হবে? খুব বেশি?

আপাতত কাউকে কিছু না বলার সিদ্ধান্ত নিল কিশোর ! শুনলে মনমরা হয়ে পড়বে মুসা আর রবিন, একেবারে নিরাশ হয়ে যাবে। কুমালোর সেবাযতের দিকে আর মন দেয়ার প্রয়োজন বোধ করবে না।

ভয়ঙ্কর ভাবনাগুলো জোর করে মন থেকে বিদেয় করল কিশোর কুমালোর সেবায় মন দিল। রক্তপাত বন্ধ হয়েছে। কাজ করেছে টোটকা ওষুধ। সাবধানে টর্নিকেটটা খুলতে লাগল কিশোর। বেশিক্ষণ বেঁধে রাখা ঠিক না, গ্যাংগ্রিন হয়ে যেতে পারে। টনিকেটটা খোলার পরেও রক্ত বেরোল না। নারকেল-বাকলের পাউডারের ওপর শ্রদ্ধা জন্মাল কিশোরের। এত ভাল অ্যাসট্রিনজেন্ট এই জিনিস, কনাই করতে পারবে না অনেকে।

হেঁড়া শার্টটা নিয়ে গিয়ে পানিতে ভেজাল কিশোর। চিপে বাতাসে ছড়িয়ে নাড়ল, যাতে ঠাণ্ডা হয়। তারপর এনে রাখল কুমালোর কপালে। ভীষণ জ্বর। কি হচ্ছে না হচ্ছে জানতেই পারল না বেচারা।

রবিন সাহায্য করছে কিশোরকে।

মুসা বিশেষ সুবিধে করতে পারছে না। এসব দ্বীপে ছাউনির চালা বলতে একমাত্র নারকেল পাতা। একসময় অনেকই ছিল, এখন একটাও নেই। ঝড়ে ছিঁড়ে যেগুলো পড়েছিল, সেগুলোকেও ভাসিয়ে নিয়ে গেছে ঢেউ।

পাথরের খাঁজে খুঁজে আটকে রয়েছে কিছু ভাঙা কাণ্ড। কয়েকটা মাথা আছে। তাতে ডালও রয়েছে, তবে একটাও পাতা মেই। যেন ছুরি দিয়ে চেঁছে নিয়ে গেছে। বাতাস। হারিকানের এই প্রচণ্ড ক্ষমতা না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন।

নারকেল পাতা পাওয়া যাবে না, নিশ্চিত হয়ে গেল সে। তাহলে আর কি আছে? কি দিয়ে ছাউনি হবে? চোখ বন্ধ করে ভাবতে লাগল। ভাবনার একাগ্রতার জন্যে চোখের পাতা বোজেনি, বুজেছে রোদের মধ্যে চোখ মেলে রাখতে কষ্ট হচ্ছে বলে। প্যানডানাস পাতা দিয়ে ছাউনি বানায় দ্বীপবাসীরা, ট্যারো পাতা দিয়েও হয়। কলাপাতা পেলেও সাময়িক কাজ চালানো যায়। জাহাজডুবি হয়ে নির্জন দ্বীপে উঠে খুব আরামে থাকে নাবিকেরা, এরকম অনেক গল্প পড়েছে সে। তবে ওদের কেউই কোন মরা দ্বীপে ওঠে না। নানারকম রসাল ফলের গাছ থাকে, সুন্দর পাখি থাকে, হরিণ থাকে, মিষ্টি পানির ঝর্না থাকে ওসব দ্বীপে। বাঁচতে অসুবিধে হয় না মানুষের।

ওরকম একটা দ্বীপে আটকে গেলে কিছুই মনে করত না মুসা। হাত বাড়ালেই পেয়ে যেত পাকা কলা, ছিঁড়ে নিতে পারত রুটিফল, বুনো কমলা, আম, পেঁপে, পেয়ারা, আঙর। ল্যাগুন থাকত মাছে বোঝাই। সৈকত থাকত সাদা বালির, জোয়ারের পানি তাতে এনে ফেলত মোটা মোটা চিংড়ি। আর এত বেশি পাখি থাকত, খালি হাতেই ধরে ফেলা যেত ওগুলো, কারণ মানুষকে ভয় পায় না ওরা, আগে মানুষ দেখেনি তো কখনও। দ্বীপের কিনারে পাহাড়ে থাকত অগণিত পাখির বাসা, তাতে ডিম। পাহাড়ি ঝর্নায় আশ মিটিয়ে গোসল করত, নারকেলের মিষ্টি পানি খেত, থাকত বাঁশের তৈরি সুন্দর কুঁড়েতে। রাতে ফুটফুটে জ্যোৎস্নায় মাথা দোলাত নারকেল গাছ, রহস্যময় সরসর শব্দ তুলত বাঁশের কঞ্চি, সবুজ বন থেকে ভেসে আসত নিশাচর পাখির ঘুমপাড়ানি ডাক…

চোখ মেলতে বাধ্য, হল মুসা। ঘাড়ের চামড়া যেন পুড়ে যাচ্ছে রোদে। সাদা পাথরে রোদ প্রতিফলিত হয়ে চোখে এসে লাগতে গুঙিয়ে উঠল সে। তাকানই যায় না।

পাথরের দিক থেকে চোখ সরাতেই চোখে পড়ল ওটা। মস্ত দুটো পাথরের খাঁজে কি যেন একটা পড়ে আছে, পানির, কিনারে। ধড়াস করে উঠল তার বুক। নৌকা না তো! দেখে তো মনে হয় নৌকাই উল্টে পড়ে আছে। হয়ত ঝড়ে ভেসে এসে ঠেকেছে ওখানে!

উত্তেজনায় বুকের খাঁচায় দাপাদাপি শুরু করে দিল হৃৎপিণ্ডটা। আশার আলো জ্বলল মনে। নৌকা হলে এই মৃত্যুদ্বীপ থেকে বেরোতে পারবে। প্রবালের চোখা, ধারাল বাধা অমান্য করে দৌড় দিল সে।

নাহ্, নৌকা নয়! বিশাল এক মাছ। পেট আকাশের দিকে, মরে ঠাণ্ডা হয়ে আছে। পুরো তিরিশ ফুট লম্বা।

চামড়ার রঙ বাদামী, তাতে সাদা ফুটকি। কুৎসিত মুখ, ব্যাঙের মুখের মত অনেকটা। মুখের তুলনায় ছোট দুটো চোখ।

তিরিশ ফুট শরীরের তুলনায়ও মুখের হাঁ বিশাল। চার ফুট চওড়া। দুই কশ বেয়ে লালা গড়িয়ে পড়ছে এখনও, যেন শ্যাওলা লেগে আছে।

এত বড় আর কুৎসিত মাছ দেখলে প্রথমেই মনে হবে ওটা মানুষখেকো ভয়ঙ্কর হিংস্রজীব। কিন্তু মুসা জানে, এই মাছ একেবারেই নিরীহ, যদিও হিংস্রতম প্রজাতিরই বংশধর এটা। মাছের মধ্যে সব চেয়ে বড় মাছ, নাম হোয়েল শার্ক বা তিমি-হাঙর। এখানে যেটা পড়ে আছে সেটা ছোট, এর দ্বিগুণ বড়ও হয় এ মাছ। হাঙর গোষ্ঠির প্রাণী, অথচ ছোট জাতভাইদের মত রক্তলোলুপ নয়। খুব ছোট ছোট জলজ জীব খেয়ে বেঁচে থাকে। ওসব জীবের কোন কোনটা এত ছোট, খালি চোখে দেখা যায় না, অণুবীক্ষণ যন্ত্র লাগে।

নিরাশ হয়ে ফিরে এল মুসা। বন্ধুদের জানাল, ঘর বানানর মত কিছুই পাওয়া যায়নি। মাছটার কথাও বলল।

দাঁড়াও দাঁড়াও, হাত তুলল রবিন। বইয়ে পড়েছি, সাইবেরিয়ার আমুর নদীর ধারেও মানুষ বাস করে। এমন কোন গাছপালা নেই ওখানে, যা দিয়ে ঘর বানানো যায়। তাই মাছের চামড়া দিয়ে ঘর বানায় লোকে।

হেসে উঠল মুসা। ওসব সীল-টীলের চামড়া দিয়ে বানায় আরকি। হাঙরের চামড়া দিয়ে কে বানাতে যাবে?

দোষ কি? বলল কিশোর। চল তো দেখি। আমার মনে হয় ব্যবস্থা একটা হয়ে গেল।

দানব মাছটাকে দেখতে এল ওরা।

আহা, কি সুন্দর মুখ, মুখ বাঁকিয়ে কিশোর বলল। সারা প্রশান্ত মহাসাগরে এত সরল মুখ আর নেই। মাছটার চামড়ায় হাত বোলাল সে। সিরিসের মত খসখসে। কাটা সহজ হবে না। তবে ছুরিটুরি ভালই আছে আমাদের। পেটের চামড়াটা তুলে নেব আমরা। মুসা, তুমি গলার কাছ থেকে শুরু কর। রবিন, তুমি লেজের কাছে, পাখনার ওপর থেকে। আমি পেটের দুই পাশ থেকে চিরছি।

ভীষণ শক্ত চামড়া। এমন সব জায়গা আছে, ছুরিই বসতে চায় না। সেসব জায়গায় প্রবাল পাথর দিয়ে ছুরির বাটে বাড়ি মেরে ফলা ঢোকাতে হচ্ছে।

দরদর করে ঘামছে কিশোর। হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বলল, কেটে ছাড়াতে পারলে ভালই হবে। যা শক্ত, নারকেল পাতার চেয়ে অনেক বেশি টেকসই হবে, একেবারে ক্যানভাস। অ্যাসবেসটসের চেয়েও বেশি টেকসই হবে।

অত টেকার দরকার নেই আমাদের, রবিন বলল। আরও অনেক কম টিকলেও চলবে। দুতিন হপ্তার বেশি তো থাকছি না আমরা এই দ্বীপে।

খচ করে কাটা বিঁধল যেন কিশোরের মনে। ওরা এখনও জানে না, কোনদিনই আর ফিরবে না ডেংগু। বলে দেবে? জানাতেই যখন হবে, দেরি করে লাভ কি? শুনে আগে থেকেই মনকে শক্ত করুক।

নিশ্চয়! হালকা গলায় বলল কিশোর। কিন্তু ধর, আর ফিরল না। তাহলে?

থেমে গেল মুসার ছুরি। আমাদের তাহলে কি হবে ভেবেছ?

কি আর হবে, বলল রবিন। মরব।

না, এত সহজে মরছি না, কিশোর বলল। বেঁচে যাবই। কোন না কোন উপায় নিশ্চয় হয়ে যাবে। চুপ করে না থেকে এখন যা করছি করি। এই, মুসা, ওই কোনাটা ভালমত ছাড়াও। বাপরে বাপ, কি মোটা চামড়া!

হাসল মুসা। গণ্ডারেরও এত মোটা কিনা সন্দেহ।

দুই ঘন্টা কঠোর পরিশ্রমের পর দম নেয়ার জন্যে থামল ওরা। চামড়া অর্ধেক ছাড়িয়েছে। এমনিতেই সাংঘাতিক দুর্গন্ধ ছিল, চামড়া ছাড়ার পর অসহ্য হয়ে উঠেছে। মাথায় যেন গরম হাতুড়ি পিটছে সূর্য। রোদের তেজ এড়ানর জন্যে চোখের পাতা প্রায় বুজে রেখেছে ওরা। শার্টের হাতা দিয়ে মুখ মুছল মুসা। টর্নিকেট, ব্যাণ্ডেজ, আর কপালে পট্টি দিতেই শেষ হয়েছে কিশোরের শার্ট। মুসারটার না দিয়েই মুখ মুছল।

এক গ্লাস পানি যদি পেতাম, মুসা বলল।

তাই তো! চমকে উঠল কিশোর। একবারও মনে হয়নি ও-কথা! ছাউনির চেয়েও বেশি দরকার পানি, খাবারের চেয়েও। থাক, কাজকর্ম এখন বাদ। বাকিটা কালও সারতে পারব। এখন চল, কুমালো কেমন আছে, দেখে, পানির খোঁজ করি।

ঘুমিয়ে আছে কুমালো। গায়ের ওপর থেকে সরে গেছে গাছের ছায়া। ধরাধরি করে তাকে সরাল কিশোর আর মুসা। পট্টি শুকিয়ে গেছে, ভিজিয়ে এনে আবার ওটা কপালে রাখল রবিন।

তারপর শুরু হল পানির খোঁজ। পানি পাওয়া যাবেই, জোর গলায় একথা একে অন্যকে শুনিয়ে রওনা হল ওরা। কিন্তু মনে মনে প্রত্যেকেই জানে, পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। রুক্ষ এই রোদেপোড়া প্রবালদ্বীপে কোথায় থাকবে মিষ্টি পানি?

হারিক্যানের সময় প্রচুর বৃষ্টি হয়েছে, কিশোর বলল। পাথরের মাঝে বড় গর্তটৰ্ত থাকলে আটকে থাকার কথা। রোদে নিশ্চয় সব শুকিয়ে যায়নি এখনও।

তীরের কাছে পাওয়া গেল একটা গর্ত, বেশ বড় গামলার মত। তাতে কিছু পানি আটকে রয়েছে। তাড়াতাড়ি ছুটে গিয়ে আঁজলা ভরে তুলে মুখে দিল মুসা। থু থু করে ফেলে দিল পরক্ষণেই।

দূর! লবণ!

বৃষ্টির পানি নয়, ঝড়ের সময় সাগরের পানিই উঠেছিল এখানে। আরও কিছু গর্ত পাওয়া গেল, তাতে পানির দাগ আছে, পানি নেই। শুকিয়ে গেছে অনেক আগেই।

নারকেল গাছের গোড়াগুলোয় খুঁজে দেখল কিশোর।

নিশ্চয় ফল ছিল গাছে, রবিন বলল।

এক আধটা নারকেল পেলেও আপাতত চলত, বলল মুসা।

হ্যাঁ, কিশোর বলল। পানি তো হতই। খাবারও।

নারকেলের মিষ্টি পানি আর শাঁসের কথা ভেবে জিভে জল এল তিনজনেরই।

অনেক খুঁজল ওরা। কিন্তু একটা নারকেলও মিলল না।

মুশকিল হয়েছে কি, কিশোর বলল। নারকেল পানিতে ভাসে। ঝড়ের সময় যা পড়েছিল সব ভাসিয়ে নিয়ে গেছে ঢেউ।

তাহলে? ভুরু নাচাল মুসা। এবার কি করব?

খুঁড়ব, বলে সৈকতের দিকে রওনা হল কিশোর। ভাটার সময় ল্যাগুনের পানি নেমে গেলে নাকি অনেক সময় কিনারে মাটির তলায় মিষ্টি পানি পাওয়া যায়। আচ্ছা, এই জায়গাটা কেমন মনে হয় তোমাদের? পা দিয়ে দেখাল সে, ঠিক এই পর্যন্ত ওঠে পানি। পা আরেকটু নিচের দিকে সরাল, এখানটায়?

আমার কাছে পাগলামি মনে হচ্ছে, বলল মুসা। নোনা পানির নিচে আবার মিষ্টি পানি থাকে কি করে?

কি করে থাকে, জানি না, রবিন বলল। তবে আমিও পড়েছি। আমার মনে হয় বিচিত্র কোন প্রাকৃতিক কারণে বৃষ্টির পানি জমেটমে থাকে আরকি।

বেশ, খুঁড়ি তাহলে, বলে চ্যাপ্টা একটা পাথর তুলে নিয়ে ওটাকে বেলচা বানিয়ে বালি খুঁড়তে শুরু করল মুসা।

তিন ফুট খোঁড়ার পর কিশোর বলল, এবার থাম। দেখা যাক কি ঘটে?

চুইয়ে পানি উঠতে শুরু করল গর্তে। দেখতে দেখতে ভরে গেল তিন চার ইঞ্চি।

মিষ্টি পানি? মুসার জিজ্ঞাসা।

কি জানি, বলল কিশোর। আশা করছি। অনেক অ্যাটলেই ঘটে এটা। জাহাজডুবি হয়ে নাবিকেরা দ্বীপে ওঠার পর এমনি করে পানি বের করেই খেয়ে বেঁচেছে, শুনেছি।

দীর্ঘদিন বৃষ্টি না হলেও?

তা বলতে পারব না।

আমি পড়েছি, রবিন বলল। বষ্টি না হলেও পাওয়া যায়। সাগরের পানিই বালির স্তর ভেদ করে ওঠার সময় ফিলটার হয়ে যায়। লবণ অনেকখানি নষ্ট হয়ে যায় তাতে। আর বৃষ্টি হলে তো কথাই নেই। পাথর আর বালির ফাঁকফোকর দিয়ে চলে যায় তলায়, জমা হয়ে থাকে।…হ্যাঁ, যথেষ্ট উঠেছে। এবার খেয়ে দেখ। সাবধান, বেশি নেড় না। নোনা পানির চেয়ে মিষ্টি পানি হালকা, থাকলে ওপরেই থাকবে।

খানিকটা পানি তুলে মুখে দিল মুসা। তারপর আরও দুই আঁজলা তুলে গিলে ফেলল। মাথা দুলিয়ে বলল, লবণ আছে, তবে ততটা নয়। সাগরের পানির চেয়ে কম।

খানিকটা তুলে কিশোরও মুখে দিল। হতাশ মনে হল তাকে। মুখ থেকে ফেলে দিয়ে বলল, খেয়ো না আর, ভাল না। পেটে সহ্য হবে না।

কিশোরের না বললেও চলত। কপাল টিপে ধরল মুসা। ওয়াক ওয়াক শুরু করল। মোচড় দিচ্ছে পেট। হড়হড় করে বমি করে ফেলল। সকালে নাস্তা যা খেয়েছিল বেরিয়ে গেল সব।

রাগ করে কিশোর আর রবিনের দিকে তাকাল। ধেত্তের তোমাদের মিষ্টি পানি! বইয়ে কি সত্যি কথা লেখে নাকি? ব্যাটারা জানে না শোনে না…মরা দ্বীপে কখনও আটকা পড়েছিল ওরা যে জানবে?

তা হয়ত পড়েনি, স্বীকার করল কিশোর। কিন্তু ইউ এস নেভির সারভাইভাল বুক-এও একথাই লিখেছে, আমরা যা করলাম ওরকম করেই পানি বের করতে বলেছে।

তাহলে বেরোল না কেন?

হয়ত এখানকার বালি মোটা বেশি, লবণ ঠিকমত ফিল্টার করতে পারে না। কিংবা হয়ত খুব বেশি বৃষ্টি হয়নি এখানে। আর হলেও হয়ত ফাঁকফোকর দিয়ে অনেক নিচে নেমে গেছে।

অত সব হয়ত হয়ত শুনে তো লাভ নেই। সত্যি সত্যি হয় ওরকম কিছু কর।

মুসা, শান্তকণ্ঠে বলল কিশোর। তোমার মনের অবস্থা বুঝতে পারছি। কিন্তু ভুলে যাচ্ছ, এই দ্বীপে তুমি শুধু একাই তৃষ্ণার্ত নও।

চুপ হয়ে গেল মুসা।

থেমে থাকল না ওরা। চলল পানির ক্লান্তিকর খোঁজে। হাঁটতে হাঁটতে চলে এল প্রাচীরের সব চেয়ে সরু জায়গাটায়, এক দ্বীপ থেকে আরেক দ্বীপে যাবার সেতু তৈরি করেছে যেটা। দেয়ালের একপাশে সারাক্ষণ আছড়ে পড়ে সাদা ফেনা সৃষ্টি করছে সাগরের ঢেউ, আরেক পাশে নীল ল্যাগুনের সাদা সৈকত ঢালু হয়ে নেমে গেছে পানিতে। কাঁচের মত মসৃণ ল্যাগুনের পানি। এখানটায় গভীরতা বারো ফুটের বেশি নয়। নিচে যেন গজিয়ে উঠেছে এক পরীর, শহর, তাতে গাঢ় লাল প্রাসাদ, স্তম্ভ, প্যাগোডা, মিনার, সবই রয়েছে, তৈরি করেছে খুদে প্রবাল-কীট।

অতি চমৎকার দৃশ্য, মন ভরে যেত যদি গরম, ক্লান্তি, চোখ জ্বলা, এবং খাবার আর পানির ভাবনা ভুলে থাকা যেত। কিন্তু তা থাকা সম্ভব নয়।

সেতুর ওপাশেই আবার চওড়া হতে শুরু করেছে দেয়াল। ঘন্টাখানেক ধরে অন্য দ্বীপটায় খোঁজাখুঁজি করল ওরা। পানি পাওয়া গেল না। পাথরের খাঁজে, গর্তে পানি জমে রয়েছে, সবই নোনা। নারকেলের গোড়া আছে, কাণ্ড আছে, কোনটারই মাথা নেই, ফলে পাতা বা ফলও নেই। কোন কোন গুঁড়ির মাঝে গর্ত হয়ে আছে, ওগুলোতেও জমে-থাকা পানির খোঁজ করল ওরা। পেল না। শুকিয়ে গেছে।

অবশেষে পাওয়া গেল একটা নারকেল! আটকে রয়েছে পাথরের খাঁজে। ঢেউও ভাসিয়ে নিতে ব্যর্থ হয়েছে।

উত্তেজনায় কাঁপতে কাঁপতে ছোবড়া ছাড়াল ওরা। মাথার ওপরের দিকে ফাটা। ফাঁকের ভেতরে ছুরি ঢুকিয়ে চাড় দিয়ে ওপরের অংশটা তুলে ফেলল কিশোর। ভেতরের জিনিস দেখে গুঙিয়ে উঠল তিনজনেই।

খাইছে! বিলাপ শুরু করবে যেন মুসা। এক্কেবারে পচা!

ফাটা দিয়ে মালার ভেতরে নোনা পানি ঢুকে নারকেলের পানি আর শাঁসের সর্বনাশ করে দিয়েছে।

ছুরি দিয়ে খুঁচিয়ে শাস ফেলে মালা পরিষ্কার করতে করতে কিশোর বলল, যাক, একটা কাপ পাওয়া গেল।

লাভ কি? বলল রবিন, কি রাখব এটাতে?

দেখা যাক। কিছু না কিছু পাওয়া যাবেই।

খোঁজ চালিয়েই গেল ওরা। পশ্চিম দিগন্তে হেলে পড়েছে সূর্য। খাবার লাগবে, জানান দিল ওদের পেট, পানির তাগাদা দিতে শুরু করল।

এই যে পানি! হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল কিশোর।

কি পেয়েছে দেখার জন্যে তাড়াতাড়ি কুঁকে এল রবিন আর মুসা। পাথরের ফাঁকে মাটিতে শেকড় গেড়ে আছে চ্যাপ্টা এক ধরনের উদ্ভিদ।

হুঁহ, পানি! হতাশ হল মুসা।

মুসার কথায় কান দিল না কিশোর। নরম একটা পাতা ছিঁড়ে নিয়ে মুখে পুরে চিবাতে শুরু করল। ঠাণ্ডা রসে ভরা পাতাটা। শুকনো মুখ আর খসখসে জিভে ভিজে পরশ বোলাল। হাসি ফুটল তার মুখে।

একটা পাতা ছিঁড়ে মুসাও মুখে পুরল। বলল, হুঁ, ভালই। কিন্তু আর হেঁড়ার জন্যে হাত বাড়াল না।

রবিনও ছিঁড়ল একটা। বেশি না। তিনজনের মনেই এক ভাবনা। গাছটা তুলে নিয়ে যেতে হবে তাদের দ্বীপে। ওদেরই যখন এত পিপাসা, আহত কুমালোর নিশ্চয় আরও অনেক বেশি।

ভীষণ অস্থির হয়ে পড়েছে কুমালো। চোখ মেলল। জ্বরে লাল টকটকে।

সামান্য পানি নিয়ে এসেছি, কুমালো, কিশোর বলল। তবে এই পানি গিলতে পারবে না, চিবাতে হবে। তোমরা একে কি বল, জানি না, বইয়ে এর নাম পড়েছি পিগউইড।

পার্সলেইনও বলে অনেকে, রবিন বলল।

নাম যা-ই হোক খুব আগ্রহের সঙ্গে গাছটা নিল কুমালো। পাতাগুলো চিবিয়ে শেষ করল। তারপর একে একে শেষ করল কাণ্ড আর শেকড়ের রস।

দারুণ, বলল সে। নিশ্চয় আরও অনেক আছে। খেয়েছ তো?

মাথা কাত করল মুসা।

সরি, কিশোর বলল। আর কোন খাবার-টাবার দিতে পারব না তোমাকে।

কুমালো হাসল। পানিই দরকার ছিল আমার। পেয়েছি। এখন ঘুমাতে পারব, বলেই চোখ মুদল সে।

আরও পিগউইডের সন্ধান করল কিশোর। পেল না। পাতার দুএক ফোঁটা রস পিপাসা না কমিয়ে বরং বাড়িয়েই দিয়েছে। খুনী সূর্যটাকে দিগন্তের ওপাশে হারিয়ে যেতে দেখে আন্তরিক খুশি হল সে। স্বাগত জানাল রাতকে। ভেবে শঙ্কিত হল, ভয়ঙ্কর দিন আসবে কয়েক ঘন্টা পরেই, আরেকটা, তারপর আরেকটা…আসতেই থাকবে একের পর এক, যতক্ষণ না ক্ষুধায় পিপাসায় মারা যাচ্ছে ওরা…

এভাবে মরতে চায় না কিশোর। কিন্তু বাঁচতে হলে পানি চাই। এক নম্বর সমস্যা এখন পানি। কোথায় পাওয়া যাবে? ভাবতে বসল সে। নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটছে ঘন ঘন। হঠাৎ পাথরে হাত পড়তে চমকে উঠল। ভেজা ভেজা!

শিশির! শিশির পড়ছে। সন্ধ্যার ছায়া নামতেই হালকা বাষ্প জমেছে ল্যাগুনের ওপরে। যদি কোনভাবে ধরা যেত ওই শিশির…

শুনেছে, পলিনেশিয়ানরা শিশির ধরার কায়দা জানে। মনে করতে পারছে না কিভাবে। কুমালো হয়ত জানে, কিন্তু ও ঘুমাচ্ছে, এখন জাগানো উচিত হবে না।

ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়েছে রবিন আর মুসা। কিন্তু কিশোরের চোখে ঘুম এল। শুয়ে গড়াগড়ি করল কিছুক্ষণ। তারপর উঠে পড়ল। একটা ব্যবস্থা করতেই হবে।

ল্যাগুনের সৈকতে চলে এল সে। বালিতে একটা ছোেট গর্ত করল। তলায় রাখল নারকেলের মালাটা। গর্তের মুখ ঢেকে দিল কাপড় দিয়ে, শার্ট ঘেঁড়া কাপড়, যেটা দিয়ে কুমালোর মাথায় পট্টি দিয়েছিল। ঠাণ্ডা এখন বাতাস, পট্টির আর দরকার নেই। নারকেলের মালার মুখে কাপড়টার যে গোল অংশটুকু পড়েছে, তার ঠিক মাঝখানে একটা ফুটো করল। তারপর গর্তটা ঢেকে দিতে লাগল পাথর দিয়ে। ছোট ছোট পাথরের তিন ফুট উঁচু একটা পিরামিড তৈরি করে ফেলল গর্তের ওপরে।

উদ্দেশ্যঃ পাথরে ধরা পড়বে শিশির। ভিজবে। তারপর আরও শিশির পড়ে পাথরের ফাঁক দিয়ে চুঁইয়ে চুঁইয়ে নামবে নিচে, শার্টের কাপড়ে জমা হবে, সেখান থেকে ফোঁটা ফোঁটা পড়বে মালায়। সকাল নাগাদ একমালা পরিষ্কার পানি পাওয়ার সম্ভাবনা আছে।

ফিরে এসে দেখল সে, রবিন আর মুসা কুমালোর পাশে মড়ার মত ঘুমোচ্ছে। কিশোরও শুয়ে পড়ল আবার, মাথার নিচে দিল প্রবালের বালিশ।

কিন্তু ঘুমাতে পারল না। জীবন বাঁচানোর জন্যে অতি প্রয়োজনীয় তিনটে শব্দ শুধু ঘুরছে মাথায়—পানি, খাবার, ছাউনি।

বাড়িতে নিঝঝাট জীবন জাপনের কথা ভাবল সে। নরম বিছানা, মাথার ওপরে ছাত। পানির ভাবনা নেই। বিছানা থেকে নেমে কয়েক পা গিয়ে ট্যাপের মুখ ঘোরালেই হল। খিদে পেলে শুধু ফ্রিজের ডালা খোলা, ব্যস…।

বাড়িতে জীবন এত সহজ, যারা থাকে ধরে নেয় এত সহজেই কাটে জীবন, সব জায়গায়। কষ্ট যে করতে হয় অনেক জায়গায়, বোঝেই না যেন। তাই অচেনা সঙ্কটময় কোন জায়গায় গিয়ে পড়লে ভাবে, এই বুঝি মরলাম! ওখানেও যে বাঁচা সম্ভব, বিশ্বাসই করতে চায় না।

ওর গলা শুকিয়ে খসখসে সিরিশ কাগজ হয়ে গেছে। পেট যেন শূন্য একটা ড্রাম। তন্দ্রা নামল চোখে। স্বপ্নে দেখল বৃষ্টি। চমকে জেগে গেল সে। তাকাল আকাশের দিকে।

মেঘশূন্য আকাশ। বড়বড় একেকটা উজ্জ্বল তারা যেন খুদে খুদে সূর্য, কিশোরের মনে হল ওগুলোর তাপ এসে লাগছে তার গায়ে। ছায়াপথটাকে দেখে মনে হচ্ছে লম্বা পথের ওপর ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে কাচের গুঁড়ো।

এরকম রাত বিকিনিতেও কাটিয়েছে। রাতের বেলা ছোট জীবের হুটোপুটি শুনেছে ঝোপের ভেতরে। এখানে এই মৃত্যুদ্বীপে ওরকম কিছু নেই, একেবারে নীরব, শুধু দেয়ালে আছড়ে পড়া ঢেউয়ের বিচিত্র গুমরানি ছাড়া। বাতাসে ভেসে আসছে মৃত্যুর গন্ধ, দ্বীপের ওপাশ থেকে, পচা হাঙরের।

আবার অস্থির ঘুম নামল কিশোরের চোখে।

কাক-ভোরের ফ্যাকাসে আলোয় ঘুম ভাঙল তার। পিঠে আর শরীরের এখানে ওখানে ব্যথা। চোখা প্রবালের খোঁচা যেখানে যেখানে লেগেছে সবখানে। বাতাস খুব ঠাণ্ডা, পরিস্কার। ঘুমানর আগে যতটা ক্ষুধা আর তৃষ্ণা ছিল, ততটা নেই। খারাপ লক্ষণ। তারমানে দেহের যন্ত্রপাতিগুলো অবশ হয়ে আসছে।

তবে তাজা বাতাস নতুন উদ্দীপনা সঞ্চার করল তার মধ্যে। যেভাবেই হোক, যে-কোন উপায়েই হোক, এই মৃত্যুদ্বীপকে পরাজিত করবে ওরা, সেই সাথে পরাজিত করবে ডেংগু পারভিকে। মনে পড়ল একটা কবিতার দুটো চরণঃ

দি মরনিংস ডিউ পার্লড,
অলস রাইট উইথ দ্য ওয়ার্ল্ড।

খুশি মনে উঠে সৈকতে চলল সে। দেখার জন্যে, তার শিশির-ধরা-ফাঁদে কতখানি শিশির আটকা পড়েছে।

পানি জমেছে মালার অর্ধেকের কম। আরও বেশি পড়বে আশা করেছিল সে। শিশির বোধহয় হালকা ছিল। যাকগে, যা পড়েছে তাই লাভ। অতি মূল্যবান তরলটুকু নিয়ে ক্যাম্পে ফিরল সে।

কুমালো নড়াচড়া করছে। চোখ মেলে তাকাচ্ছে ও, তবে কেমন যেন হতবুদ্ধি একটা ভাব। তার মাথাটা তুলে ধরে অর্ধেকটা পানি গলায় ঢেলে দিল কিশোর। বাকি অর্ধেক মুসার হাতে দিয়ে বলল, তোমরা দুজনে ভাগাভাগি করে খেয়ে ফেল।

হাই তুলতে তুলতে উঠে বসেছে রবিন।

মালাটা মুসার হাতে ধরিয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়াল কিশোর। চলে এল মরা হাঙরটার কাছে। চামড়া ছিলতে শুরু করল। আর খামিক পরেই উঠবে মারাত্মক রোদ, তার আগেই যদি একটা ছাউনির ব্যবস্থা করা যায়, বেঁচে যাবে।

মালার তলায় জমা পানিটুকুর দিকে তাকিয়ে আছে মুসা। মুখ বাড়িয়ে রবিনও দেখল। চোখে চোখে কথা হয়ে গেল দুজনের। ওই দুই চুমুক পানিই এখন ওদের কাছে লক্ষ টাকার চেয়ে দামি। মুসা ভাবছে কুমালোর কথা, রবিনও।

গোঙাচ্ছে কুমালো। বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে কপালে। রোদ ওঠার আগেই যদি এই অবস্থা হয়, উঠলে পরে কি হবে? পানি খেল না মুসা। রবিনের দিকে বাড়িয়ে ধরল। মাথা নাড়ল রবিন। হাসল দুজনেই। কুমালোর মাথাটা উঁচু করে বাকি পানিটুকু তার মুখে ঢেলে দিল মুসা।

কিশোরকে সাহায্য করতে চলল দুই সহকারী গোয়েন্দা।

চামড়া পুরোপুরি ছাড়ার আগেই উঠল লাল সূর্য, দিগন্তে উঁকি দিয়েই যেন আগুন ছড়াতে শুরু করল।

চামড়া ছাড়ানো শেষ হল অবশেষে। বিশ ফুট লম্বা আট ফুট চওড়া বেশ চমৎকার একটা টুকরো। ভেতরের দিকে লেগে থাকা মাংসের টুকরোগুলো সযতে, সাফ করে ফেলল ওরা। চামড়াটা টান টান করে মাটিতে বিছিয়ে দেখল কাজ কেমন হয়েছে।

ভাল বুদ্ধি বের করেছিলে, রবিন, কিশোর বলল।

ঘর তো বানায় বললে মাছের চামড়া দিয়ে, মুসা বলল রবিনকে। কি করে বানায়? সাইবেরিয়ায় বললে, না?

হ্যাঁ। মাছ-তাতার বলে ওদেরকে। মাছ খায়, মাছের চামড়া দিয়ে জুতা আর পোশাক বানায়, ঘর বানায়। মাটিতে খুঁটি গেড়ে তার ওপর চামড়া ছড়িয়ে দেয়। যদি দেখতে যাও, বহুদূর থেকেই ওদের গ্রামের গন্ধ নাকে আসবে তোমার।

জানি, কি বলতে চাইছ, নাক কুঁচকাল মুসা।

হাঙরের চামড়ার অবশ্য এতটা গন্ধ বেরোবে না, কিশোর বলল। রোদে শুকিয়ে যাবার পর। তবে মাছটার গন্ধ আর সইতে পারছি না। এটাকে গড়িয়ে নামিয়ে দিতে পারলে হয়। জোয়ারে ভেসে চলে যাবে।

প্রচণ্ড পরিশ্রমের পর ভারি লাশটাকে পানির কিনারে নিয়ে যেতে পারল ওরা।

মাংসের পাহাড়, পচা দেহটার দিকে তাকিয়ে বলল মুসা।

অথচ এমনি কপাল আমাদের, একটা টুকরো মুখে দিতে পারব না।

বেশি পচে গেছে, কিশোর বলল। খেলে পেটে অসুখ করে মরবে।

সুতরাং, সাগরের নাস্তার আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করে বিষাক্ত খাবারের দিকে পিঠ ফেরাল ওরা। হাঙরের চামড়াটা টানতে টানতে নিয়ে ফিরে এল ক্যাম্পে।

ঘর বানানয় মনোযোগ দিল ওরা। কি করে বানানো যায়? পেরেক নেই, বল্ট নেই, স্কু নেই, নেই কড়িকাঠ, তক্তা, খুঁটি। ঘর বানাতে যা যা জিনিস প্রয়োজন, তার কোনটাই নেই।

শুধু আছে একটা চামড়া, মুসা বলল। চালা বানানো যাবে। দেয়াল হবে কি দিয়ে? পাথর জড়ো করব?

প্রথমে দরকার লগি, বলল কিশোর। আর গোটা দুই খুঁটি। ওই নারকেলের কাণ্ডটা দিয়ে লগির কাজ চলবে।

আরেকটা কাণ্ড কেটেই তো দুটো খুঁটি বানানো যাবে, রবিন বলল। কিংবা আরও এক কাজ করা যায়। নারকেলের অনেক কাণ্ড দাঁড়িয়ে আছে। পাশাপাশি দুটোকে পালা হিসেবে ব্যবহার করতে পারি।

নারকেল কাণ্ডের অভাব নেই। আট ফুট উঁচু দুটো কাণ্ড বেছে নিল ওরা, একটা থেকে আরেকটার দূরত্ব বারো ফুট। ছুরি দিয়ে ওগুলোর মাথায় গভীর খাঁজ কাটল। তার পর ফেঁড়ে যাওয়া আরেকটা কাণ্ডকে কেটে এনে তুলে দিল ওই দুটোর ওপর, কড়িকাঠ হয়ে গেল।

বাবা, দারুণ চালা, মুসা বলল। তাবু হয়ে গেল একেবারে।

হ্যাঁ, মাথা ঝাঁকাল রবিন। অনেক পলিনেশিয়ানই এরকম কুঁড়েতে থাকে। দ্বীপে থাকার সময় জাপানীরাও হরদম বানাত।

কড়িকাঠের ওপর চামড়াটা ঝুলিয়ে দিল ওরা, দড়িতে চাদর ঝোলানর মত করে। দশ ফুট করে হল একেকদিকে। এরপর দেয়াল তৈরির পালা। প্রবালের চ্যাপ্টা টুকরো এনে একটার ওপর আরেকটা রেখে দুই পাশে চার ফুট উঁচু দুটো দেয়াল তুলল। চামড়ার দুই প্রান্ত বিছিয়ে দিল ওগুলোর ওপর। তার ওপর আরও পাথর রেখে আটকে দিল, যাতে ছুটতে না পারে। ব্যস, হয়ে গেল ঢালু ছাউনি। রোদ তো আটকাবেই, বৃষ্টি হলেও গড়িয়ে পড়ে যাবে ঢাল বেয়ে।

পাথর দিয়ে অন্য দুপাশের দেয়ালও তুলে দিল ওরা। চারটে বড় বড় ফোকর রাখল, ওগুলো দরজা।

শেষ হল ঘর তৈরি। এমন কুঁড়ে আর কেউ কখনও দেখেছে কিনা সন্দেহ। মুসার দৃঢ় বিশ্বাস, মাছ-তাতারেরাও দেখেনি এই জিনিস।

কুমালোকে ঘরের ভেতর নিয়ে আসা হল। শোয়ানো হল প্রবালের মেঝেতে সব চেয়ে কম খসখসে জায়গায়। নিঃশ্বাস ফেলা দেখেই বোঝা গেল অন্ধকার। ঠাণ্ডায় এসে আরাম লাগছে তার। তিন ফুট চওড়া প্রবালের দেয়াল পুরোপুরি ঠেকিয়ে দিয়েছে রোদ। চালাটাও চমৎকার, অন্তত নারকেল পাতার ছাউনি আর ক্যানভাসের চেয়ে ভাল। কুঁড়ে কিছুটা নিচু হয়ে গেল, তবে একদিক দিয়ে সেটা বরং ভালই, ঝড়ের সময় বাতাসে উড়িয়ে নেয়ার সম্ভাবনা কম।

লম্বা হয়েছে যথেষ্ট। চারজনের জন্যে বেশ বড়। গা ঘেঁষাঘেঁষি করে থাকতে হবে না।

বৃষ্টির দিনে রান্নাও করতে পারব এর ভেতর, কিশোর বলল।

যদি বৃষ্টি হয়, বলল মুসা। রান্না করার মত কিছু পাওয়া যায়। আর যদি আগুন জ্বালাতে পারি।

ঠোঁটে চিমটি কাটল একবার কিশোর। এইসব যদির সমাধান করতে হবে আমাদের। বৃষ্টি ঝরাতে পারব না, কাজেই পানি জোগাড়ের অন্য ব্যবস্থা করতে হবে। হয়ে যাবে। ভাবতে হবে আর কি। গুইজি লতা থেকে পানি পাওয়া যায়, কিন্তু এই দ্বীপে ওই গাছ নেই। ব্যারেল ক্যাকটাসে পানি পাওয়া যায়, এখানে তাও নেই।প্যানডানাসের খোঁজ করলে কেমন হয়? এখানকার মত খারাপ জায়গায়ও জন্মায় ওগুলো। পানি থাকে ওতে। চল, খুঁজে দেখি।

খুব উৎসাহের সঙ্গে রওনা হল ওরা, যদিও জানে, প্যানভানাস পাওয়ার আশা তেমন নেই।

একটা পাথর তুলে মুসার হাতে দিতে দিতে কিশোর বলল, এটা চোষ। লালা গড়াতে থাকবে। মনে হবে পানি খাচ্ছ।

বাকি দিনটা খুঁজে বেড়াল ওরা। প্যানডানাসও পেল না, পানি আছে ওরকম কিছুই না। চাঁদের পিঠের মতই মরা যেন এই দ্বীপ।

সেরাতে আবার শিশির ধরা ফাঁদ পাতল কিশোর। কিন্তু পাতার খানিক পরেই এল জোরাল বাতাস, বাষ্প জমতেই পারল না। সকালে শূন্য পাওয়া গেল মালাটা। এমনকি রোগীর জন্যেও এক ফোঁটা পানি মিলল না।

কুমালোর বিহ্বল ভাব কেটে গেছে। ফলে পায়ের অসহ্য ব্যথা টের পাচ্ছে। প্রচণ্ড পিপাসা। তবে জ্বর চলে গেছে। গাল আর কপালে হাত দিলে এখন আগের মত গরম লাগে না। তার সঙ্গে পানির সমস্যা নিয়ে আলোচনা করল কিশোর। পানির জন্যে কি কি করেছে, সব জানাল। তারপর বলল, তুমি নিশ্চয় কোন উপায় বাতলাতে পারবে?

না, কুমালো বলল। এর বেশি আমিও কিছু করতে পারতাম না। ওই পিগউইড খুঁজে বের করা, তারপর মালা পেতে শিশির ধরা…।

জীবনে এতটা বোকা মনে হয়নি নিজেকে, বিড়বিড় করল কিশোর। অসহায়…

কিশোরের বিধ্বস্ত চেহারার দিকে তাকাল কুমালো। দুশ্চিন্তা কাবু করে ফেলেছে তোমাকে। একটা কথা বললে শুনবে?

কী?

সাঁতার কাটতে চলে যাও তোমরা। আমার দেশের লোকের বিশ্বাস, কোন ব্যাপার যখন খুব জটিল হয়ে যায়, কিছুতেই কিনারা না হয়, ওটার দিক থেকে তখন মুখ ফিরিয়ে নেয়া উচিত। গিয়ে খেলাধুলা করা উচিত কিছুক্ষণ। এতে শরীরের অস্থিরতা কমে, চিন্তার ক্ষমতা বাড়ে।

বেশ, ডাক্তার কুমালো, তুমি যখন বলছ, যাচ্ছি, শুকনো হাসল কিশোর।

তবে আমার মনে হয় সময়ই নষ্ট হবে অযথা।

আমার কাছে পরামর্শটা ভালই লাগছে, মুসা বলল। বাতাস আছে। পানিও বেশ ঠাণ্ডা। আরামই লাগবে।

রবিন কিছু বলল না। তবে কিশোর আর মুসা উঠতেই সে-ও পিছে পিছে চলল।

সাগরের কিনারে চলে এল ওরা। ল্যাগুনের চেয়ে এদিকটায় ঠাণ্ডা বেশি। ঝাঁপিয়ে পড়ল ঢেউয়ের ওপর। ধীরে ধীরে ঢালু হয়ে যায়নি দেয়ালটা, সৈকত নেই, একবারেই ঝপ করে নেমে গেছে গভীর পানিতে। তিনটে সীল মাছের মত খেলতে শুরু করল ওরা। ডুব দিচ্ছে, সাঁতার কাটছে, দাপাদাপি করছে। কচুপাতার পানির মত পিছলৈ ধুয়ে চলে গেল যেন তাদের সমস্ত উদ্বেগ।

ধরতে পারবে না আমাকে, মুসাকে চ্যালেঞ্জ করল কিশোর।

পারলে কি দেবে?

এই দ্বীপটা।

এই মরা দ্বীপ কে নেয়? তবু আমি ধরছি তোমাকে। কয়েক গজও যেতে পারল না কিশোর, তার আগেই তাকে ধরে ফেলল মুসা। ভেসে উঠে হাসতে হাসতে বলল, কি, রবিন মিয়া, তুমি চ্যালেঞ্জ করবে নাকি?

মাথা নাড়ল রবিন, না বাবা, পারব না, খামোকা মুখ খরচ করে লাভ নেই।

ডুব দাও,মুসাকে বলল কিশোর। আমি ধরব।

পারবে না জানে, তবু মুসার দ্রুত নেমে যাওয়া ছায়াটাকে লক্ষ্য করে ডুবে চলল কিশোর।

বিশ ফুট মত নেমে থামল মুসা। দেয়ালের ধার ধরে ডুব-সাঁতার দিয়ে চল। তার পিছে তেড়ে এল কিশোর।

দেয়ালের বোতলের মুখের মত জায়গাটায় এসে, যেখানে চওড়া হতে আরম্ভ করেছে দেয়াল, হঠাৎ মুখে ঠাণ্ডা পানি লাগল মুসার। বেশি ঠাণ্ডা।

মনে হল, ঠাণ্ডা পানির একটা ডুবো-প্রবাহ দেয়ালের গা থেকে বেরিয়ে এসে সাগরে পড়ছে। সামনে এগোতেই আবার গরম পানিতে পড়ল সে।

ঠাণ্ডা পানি কিশোরের শরীরেও লাগল। সঙ্গে সঙ্গে ভেসে উঠতে শুরু করল সে। দম প্রায় ফুরিয়ে এসেছে মুসার, সে-ও উঠতে লাগল।

রবিন দেখল, ভুস জুস করে ভেসে উঠল দুটো মাথা। সাঁতরে কাছে আসতে লাগল সে।

ঝাড়া দিয়ে চুল আর মুখ থেকে পানি ফেলে কিশোর বলল, মুসা, কিছু টের পেয়েছি। ঠাণ্ডা পানি। মনে হল দ্বীপের ভেতর থেকেই আসছে।

এর মানে বুঝতে পারছ?

না তো!

এর মানে পরিষ্কার পানি! বাজি ধরে বলতে পারি আমি।

ধরলে হারবে, আরকি।

কাছে চলে এল রবিন। জিজ্ঞেস করল, কি হয়েছে। তাকে বলল কিশোর। শুনে তার সঙ্গে একমত হল রবিন। নিশ্চয় মিষ্টি পানি! ইস, একটা বোতল পেলে হত! চল, ডুব দিয়ে হাঁ করে মুখে নিই।

ডুব দিল কিশোর। ঠাণ্ডা পানিতে মাথা ঢুকতেই স্রোতের দিকে ফিরে মুখ হাঁ করল। সঙ্গে সঙ্গে মুখে ঢুকল পানি। পরিষ্কার, মিষ্টি! গিলে নিয়ে আবার হাঁ করল। আবার গিলে আবার হাঁ। পানি মুখে নিয়ে ভেসে উঠল ওপরে। তার পাশে ভাসল মুসা।

রবিইন, চেঁচিয়ে উঠল গোয়েন্দা সহকারী। সত্যি মিষ্টি!

খুশিতে দাঁত বেরিয়ে পড়ল কিশোরের। বলল, যাক, অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে। রবিন, মুসার সঙ্গে গিয়ে তুমিও খেয়ে এস।

ওরা দুজনে আবার ভাসলে বলল কিশোর, তোমরা এখানে থাক। নিশানা রাখ। আমি গিয়ে মালাটা নিয়ে আসি।

দশ মিনিটের মধ্যেই নারকেলের মালা নিয়ে ফিরে এল সে।  কিন্তু মুখ তো নেই, মুসা বলল। ডোবালেই নোনা পানিতে ভরে যাবে। মিষ্টি পানি ভরবে কিভাবে?

পরা যাবে, বলল রবিন। কায়দা আছে।

হ্যাঁ, বলে ডুব দিল কিশোর। নোনা পানিতে ভরে গল মালা। ঠাণ্ডা পানিতে পৌঁছে মালাটা উপুড় করল সে। ভেতরে হাত ঢুকিয়ে পাম্প করার মত কয়েকবার ওপরে নিচে করল আঙুলগুলো। চাপ লেগে বেরিয়ে গেল নোনাপানি, আর ঢুকতে পারল না, কারণ মিষ্টি পানির চেয়ে ভারি। সেই জায়গা দখল করল মিষ্টি পানি। মালাটাকে কয়েকবার ওপরে-নিচে করে, পানি ঢুকিয়ে, বের করে নিশ্চিত হয়ে নিল। সে, যে আর এক ফোঁটা নোনা পানিও নেই। তারপর মালা ভর্তি মিষ্টি পানি নিয়ে, মালার মুখ হাত দিয়ে চেপে ধরে ভেসে উঠতে শুরু করল ওপরে।

দেয়ালের ওপরে উঠে পা দোলাচ্ছে রবিন। পাশে বসে আছে মুসা। হাত বাড়িয়ে মালাটা নিল কিশোরের হাত থেকে। ঠোঁটে লাগাতে গেল। বাধা দিল কিশোর, না না, আর খেয়ো না। দুতিন দিনের শুকনো পেট, বেশি সইতে পারবে না। যা খেয়েছ খেয়েছ। আবার পরে। এটা কুমালোর জন্যে নিয়ে যাই।

পানির নিচের ঝর্না থেকে কুমালোর জন্যে পানি নিয়ে এল ছেলেরা। দেখে, পানি এসে গেল আহত রোগীর চোখে। দুহাতে মালাটা ধরে একচুমুক খেয়ে নামিয়ে রাখল পাশে, ধরে রাখল যাতে গড়িয়ে না পড়ে যায়। বলল, জীবনে আর কোন জিনিস এত মজা লাগেনি।

যাক, দুটো দরকারি জিনিস পাওয়া গেল, বলল কিশোর। ঘর এবং পানি। কিন্তু পেট বলছে খাবার ছাড়া আর বেশিক্ষণ থাকতে পারবে না।

গুঙিয়ে উঠল মুসা, ঠিক বলেছ! আহারে, দুদিন ধরে যে কি কষ্টে রয়েছে বেচারা, পেটে হাত বোলাল সে।

হেসে উঠল সবাই।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে কুমালো বলল, এসব কাজ আমারই করার কথা। অথচ আমি একটা মরা কাঠ হয়ে পড়ে আছি এখানে, তোমরা কষ্ট করে মরছ।

হাত নাড়ল কিশোর। বাদ দাও এসব কথা।

হ্যাঁ, তোমারও এখন খাবার দরকার, মুসা বলল। আমাদের চেয়ে বেশি দরকার তোমার। কিশোর, দেরি করে লাভ কি? চল, যাই।

পানি খেয়ে শরীর কিছুটা ঠাণ্ডা হয়েছে। ছাউনির ছায়া ছেড়ে রোদে বেরোতে ইচ্ছে হচ্ছে না কিশোরের। কিন্তু বসে থাকলে চলবে না।

রবিন বলল, খোঁজাখুঁজি তো দুদিন ধরেই করলাম। কিছু থাকলে চোখে পড়ত না? কি পাওয়া যাবে এই হতচ্ছাড়া দ্বীপে?

একটা ব্যাপার চোখ এড়িয়ে গেছে তোমাদের, কুমালো বলল। একটা ভাল লক্ষণ। ওই পাখিটা, গাংচিল। রয়ে গেছে দ্বীপে। খাবার না থাকলে কিছুতেই থাকত না।

প্রথমে আমিও তাই ভেবেছি, কুমালো, কিশোর বলল। শুনে নিরাশ হবে হয়ত। চলে গেছে ওটা। কাল রাতে।

দীর্ঘ একটা নীরব মুহূর্ত, কেউ কথা বলল না। প্রচণ্ড হতাশা যেন চেপে ধরেছে সবাইকে। পানি শক্তি জুগিয়েছে বটে, অন্য দিকে পেটকেও চাঙা করেছে। খাবার চাইছে এখন ওটা।

হঠাৎ লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল কিলোর। বলল, এভাবে বসে থাকলে কিছুই হত না। পানি আর ঘর তো পেয়েছি। খাবারও পাব। ওঠ, এস তোমরা। প্রমাণ করে দেব, পাখি ব্যাটা ভুল করেছে।

ক্ষুধা তীক্ষ্ণ করে দিয়েছে ওদের চোখ। মিহি দাঁতের চিরুনি দিয়ে উকুন বাছার মত করে দ্বীপটায় খুঁজতে লাগল খাবার। অতি ছোট বস্তুও এখন চোখ এড়াবে না।

ওল্টানো যায় এরকম আলগা পাথর যে কটা পেল, সব উল্টে উল্টে দেখল তলায় কি আছে। প্রায় চষে ফেলল বালির সৈকত।

কিন্তু নিরাশ হতে হল।

তিন ঘন্টা খোঁজার পর ক্লান্ত হয়ে বসে পড়ল মুসা। শেষে একটা নারকেলের, কাণ্ডে মাথা রেখে একেবারে শুয়েই পড়ল। একটা আঙুল নাড়তে ইচ্ছে করছে না আর।

খুব মৃদু একটা শব্দ কানে এল, নড়াচড়ার। মনে হল কাটার ভেতরে। কিশোর আর রবিনকে ডাকল সে। কাছে এলে কিশোরকে বলল, কান রেখে দেখ।…কিছু শুনছ?।

কান ঠেকিয়ে রেখেই বলল কিশোর, ভেতরে জ্যান্ত কিছু আছে। ছুরি দিয়ে কেটে বের করা যাবে।

কাটা কাটতে শুরু করল ওরা। পচে নরম হয়ে গেছে। ভেতরের জিনিস দেখে মুখ বিকৃত করে ফেলল রবিন। মোটা মোটা শুয়ালোকার মত কতগুলো জীব।

পোকা! কিশোর বলল। সাদা গোবরেপোকার শুককীট। মুসা, ভর পকেটে। আর আছে কিনা দেখি।

খাবে ওগুলো! রবিনের প্রশ্ন।

প্রাণ তো বাঁচাতে হবে, জবাব দিল কিশোর। নাক টিপে ধরে তেতো ওষুধ খায় না রোগী?

মোট চোদ্দটা পোকা পেল ওরা। সেগুলো দেখাতে নিয়ে গেল কমালোকে।

বিষাক্ত? সন্দেহের চোখে পোকাগুলোর দিকে তাকাচ্ছে রবিন।

মোটেই না, মাথা নাড়ল কুমালো। ভিটামিনে ভরা।

রাঁধা যায় না?

যায়। আগুন তো নেই, রোদে ঝলসেই কাজটা সেরে নিতে হবে। অন্ধকারে থাকে এগুলো, শরীর খুব নরম। গরম পাথরে রেখে রোদে দাও, সেদ্ধ হয়ে যাবে।

ঘিনঘিনে লাগলেও ঝলসানো পুঁয়াপোকার স্বাদ খুব একটা খারাপ লাগল না ছেলেদের কাছে। দুই দিনের খিদে পেটে, যা খাবে এখন তাই ভাল লাগার কথা!

এগুলো যেখানে পেয়েছ, কুমালো বলল। সেখানে উইপোকাও থাকতে পারে। পচা কাঠে বাসা বানায় ওরা।

কুমানোর অনুমান সত্যি। ওই কাণ্ডটারই আরেক প্রান্তে একটা উইয়ের বাসা খুঁজে পেল ছেলেরা। এই পোকার আরেক নাম সাদা পিপড়ে। বেশ মোটা, নরম। রোদ সইতে পারে না। তাড়াহুড়ো করে গাছের ভেতরের সুড়ঙ্গে ঢুকে বাঁচতে চাইল। কিন্তু যেতে দেয়া হল না। রবিনও হাত লাগাল এখন। পোকাগুলোকে বের করে করে রাখল গরম পাথরে। চোখের পলকে কুঁকড়ে, মরে গেল ওগুলো। ধীরে ধীরে সেদ্ধ হল।

আবার কিছু খাওয়া জুটল অভিযাত্রীদের।

হেসে বলল মুসা, বাড়ি গিয়ে মাকে যদি বলি শুঁয়াপোকা আর উই বেঁধে দাও, কি করবে আল্লাই জানে।

আবার খুঁজল ওরা। আর কিছু বেরোল না।

সূর্য ডোবার আগে ডুব দিয়ে গিয়ে পানি তুলে আনল মুসা। মনে হল, আগের মত জোর আর নেই স্রোতের। কিশোরকে জানাল সেকথা।

নিশ্চয় বৃষ্টি, আন্দাজ করল গোয়েন্দাপ্রধান। কয়েক দিন আগে ঝড়ের সময় যে বৃষ্টি পড়েছিল, সেটাই মাটির তলায় জমা হয়েছিল, ফাঁক দিয়ে বেরোতে শুরু করেছে। পানি কমে আসছে, তাই স্রোতের জোরও কমছে। আবার বৃষ্টি না হলে শেষ হয়ে যাবে একসময়। মনে মনে উদ্বিগ্ন হলেও আশঙ্কার কথা কাউকে জানাল, না সে।

পানিতে মাছ নিশ্চয় আছে, কিশোর বলল। ধরি কিভাবে?

জোর আলোচনা চলল। মাছ ধরা যায় কি উপায়ে? সুতো নেই, বড়শি নেই, ছিপ নেই, টোপ নেই, জাল নেই, বর্শা নেই। কি দিয়ে ধরবে?

কুমালো সুস্থ স্বাভাবিক থাকলে একটা জবাব বের করা যেত। কিন্তু রোগে ভুগে ভীষণ ক্লান্ত সে, ঘুমোচ্ছে। সমস্যাটা নিয়ে প্রায় ধস্তাধস্তি শুরু করে দিল তিন গোয়েন্দা। হাই তুলল মুসা। ঘুম পেয়েছে।

একটা ফাদ বানানো যায়, কিশোর প্রস্তাব দিল। অবশ্য যদি একটা বাক্স বা ঝুড়িটুড়ি পাওয়া যায়।  কিন্তু নেই, আবার হাই তুলল মুসা, হাত চাপা দিল মুখে। কাজেই ফাঁদ তৈরি হচ্ছে না। আর কোন উপায়ও নেই…

নিশ্চয় আছে! চেঁচিয়ে বলে, একলাফে উঠে কুঁড়ে থেকে বেরিয়ে গেল কিশোর। রবিনও বেরোল। ঘুমজড়িত চোখে তাদের পিছু নিল মুসা, কি করে কিশোর দেখার জন্যে কৌতূহল হচ্ছে।

সূর্য ডুবে গেছে। যাই যাই করে এখনও রয়ে গেছে গোধূলির কিছু আলো। সাগরের পারে এসে পাথর জড়ো করতে শুরু করল কিশোর।

দয়া করে বলবে, কি করছ? আর থাকতে না পেরে জিজ্ঞেস করল মুসা।

ফাঁদ তৈরি করছি, পাথরের ফাঁদ। এটাই উপযুক্ত সময়, জোয়ার এখন সবে আসতে শুরু করেছে। পাথর গায়ে গায়ে লাগিয়ে একটা গোল দেয়াল তৈরি করব। জোয়ারে ডুবে যাবে ওটা। যখন পানি নেমে যাবে, হয়ত একআধটা মাছ আটকে থাকতেও পারে ওর ভেতর।

খাইছে। ঠিকই তো বলেছ! তুড়ি বাজাল মুসা। ঘুম দূর হয়ে গেছে। কিশোর আর রবিনের সঙ্গে সে-ও দেয়াল তৈরিতে হাত লাগাল। দেয়ালটা ছড়িয়ে নিয়ে গেল পানি পর্যন্ত, যাতে জোয়ার চলে যাওয়ার পরেও তাতে চিকচিকে পানি থাকে।

শেষ হল দেয়াল। তিন ফুট উঁচু, বিশ ফুট চওড়া।

হিসেব করে বের করল কিশোর, মাঝরাতের দিকে ডুবে যাবে দেয়াল, ভোরে সূর্য ওঠার আগে আবার বেরিয়ে আসবে। ভেতরে পানি থাকবে তখনও।

পরদিন সকালে রোদের বর্শাগুলো যখন সবে ছড়াতে শুরু করেছে সূর্য, দুএকটা ঢুকে পড়েছে মাছের চামড়ার তাঁবুতে, ঘুম ভাঙল মুসার। শুয়াপোকা আর উই হজম করে ফেলেছে পেট, নতুন খাবার চাইছে। কিশোর আর রবিনকে ডাকল, এই ওঠ ওঠ! আলসে হয়ে গেছে সব। চল, গিয়ে দেখি কি মাছ পড়ল।

ফাঁদের তলায় নেমে গেছে পানি। অল্প পানিতে ছোটাছুটি করছে কয়েকটা বিচিত্র ছোট জীব, বেরোনর পথ খুঁজছে। খুব সুন্দর একটা মাছ দেখা গেল, গায়ের রঙ সবুজে সোনালিতে মেশানো, তার ওপর লাল আর নীলের হালকা ভোরা। তিনজনেই চিনতে পারল ওটাকে, অ্যাঞ্জেল ফিশ। আরও দুটো মাছ আছে, অ্যাঞ্জেলের মত এত সুন্দর নয়, তবে খেতে চমৎকার। একটা বাচ্চা ব্যারাকুড়া, আরেকটা মুলেট। বিষাক্ত একটা স্করপিয়ন ফিশও আছে। ওটার কাছেও গেল না তিন গোয়েন্দা। পানিতেই রইল ওটা। পরের বার জোয়ার এলে বেরিয়ে যেতে পারবে, যদি ততোক্ষণ বেঁচে থাকে।

মোচার মত দেখতে একটা তারা মাছ দেখে ধরতে গেল মুসা, থামাল রবিন। খবরদার! মারাত্মক বিষ ওগুলোর কাঁটায়। হাতে ফুটলে প্রথমে হাত ফুলে যাবে। তারপর ফুলবে শরীর। শেষে হৃৎপিণ্ড থেমে গিয়ে মারা যাবে।

সরে এল মুসা। তারা মাছের ধারেকাছে গেল না আর।

খাবার উপযোগী মাছগুলো ধরে নিয়ে মহানন্দে ঘরে ফিরল তিন গোয়েন্দা। ওগুলো দেখে কুমালোও খুশি হল।

কাঁচাই খেতে হবে, সে বলল। খারাপ লাগবে না। তবে বেঁধে নিতে পারলে ভাল হত। কিন্তু কি করব? গায়ে তো জোর নেই, মলে আগুন জ্বালাতে পারতাম।

দেখি, আমি চেষ্টা করে, বলল কিশোর। তবে বিশেষ ভরসা পেল না। আমাজনের জঙ্গলে ভাসমান দ্বীপে আগুন জ্বালাতে গিয়ে বুঝেছে কাজটা কত কঠিন।

প্রথমেই দরকার শুকনো খড়কুটো। সেটা জোগাড় করা যাবে, নারকেলের কাণ্ড থেকে। ভেতরের কিছু ছোবড়া কেটে নিলেই হবে। তারপর লাগবে কাঠের গুঁড়ো। আর শক্ত শক্ত কয়েকটা কাঠি।

ছোবড়া জোগাড় হল। গুড়োও পাওয়া গেল বাকল চেঁছে। বাকি রইল কাঠি।

কাঠি লাগবে, কিশোর বলল। শক্ত এবং হালকা।

আগের দিন সৈকতে একটা গাছের ডাল পড়ে থাকতে দেখেছিল রবিন। ঢেউয়ে ভেসে এসে আটকা পড়েছে। ছুটে গিয়ে কাঠি কেটে নিয়ে এল সে।

বেশ হালকা কাঠি। খটখটে শুকনো। কিভাবে কি করবে? মুসা জানতে চাইল।

সোজা একটা কাঠিকে সুন্দর করে কেটে ঘোট করল কিশোর। এক মাথা, চোখা করল। বাকলের একটা টুকরো কেটে মাঝখানে ছোট একটা গোল খাঁজ করল। তারমধ্যে রাখল বাকলের গুড়ো। চারপাশে ছড়িয়ে দিল ছোবড়া। তারপর ছোট কাঠির চোখা মাথাটা খাঁজে রেখে দুহাতের তালুতে চেপে ধরে ডলতে শুরু করল, ডাল ঘুটনি দিয়ে ডাল ঘোটা হয় যেভাবে।

দ্রুত থেকে দ্রুততর হল হাত। হাতের জোর ঠিক রাখতে হবে, বাড়াতে হবে গতি, তাহলেই কেবল আসবে সাফল্য। টপ টপ করে ঘাম ঝরতে লাগল তার কপাল থেকে। বাকলের খাঁজটাকে গভীর করে বসে যাচ্ছে কাঠির চোখা মাথা। চারপাশে ছিটকে পড়ছে বাকলের গুড়ো।

আরও জোরে ডলতে লাগল কিশোর। ধোঁয়া বেরোতে শুরু করল ছোবড়া থেকে। তারপর দপ করে জ্বলে উঠল আগুনের একটা শিখা।

পেটের ওপর ভর দিয়ে শুয়ে পড়েছে মুসা। মুখ নামিয়ে আস্তে আস্তে ফু দিল। আগুনে। তার ওপর আরও কিছু ছোড়া আর শুকনোবার্কলের কুটো রাখল মুসা। উজ্জ্বল হয়ে জ্বলতে লাগল আগুন।

কাঠিটা সরিয়ে এনেছে কিশোর। হউফ! করে জোরে নিঃশ্বাস ফেলে হাতের। উল্টো পিঠ দিয়ে ঘাম মুছল কপালের। বলল, ইস, এভাবে কষ্ট করে আগুন ধরানো..ম্যাচ থাকলে কত সহজ হত।

দ্রুত মাছগুলোর চামড়া পরিষ্কার করে টুকরো টুকরো করে কেটে ফেলল ওরা। লম্বা লম্বা কাঠিতে গেঁথে ধরল আগুনের ওপর।

মাছের কাবাব দিয়ে চমৎকার নাস্তা হল সেদিন। কিছুই অবশিষ্ট রাখল না। কাঁটায় লেগে থাকা, মাংসগুলো পর্যন্ত চেটেপুটে সাফ করে ফেলল। সেই সঙ্গে রয়েছে ডুবো ঝর্নার মিষ্টি পানি। আয়েশ করে ঢেকুর তুলল সবাই। ভুলে গেল। প্রথম তিন দিনের আতঙ্ককর পরিস্থিতির কথা। মৃত্যুদ্বীপকে জয় করেছে ওরা।

আশা করা যাচ্ছে, রবিন বলল। ডেংগু আসাতক বেঁচে থাকতে পারব আমরা। একটা কাঠিতে ছুরি দিয়ে গোল গোল খাজ কাটছে সে, তিনটা কেটে ফেলেছে, আরেকটা কাটছে।

কি করছ? মুসা জিজ্ঞেস করল।

দিনের হিসেব রাখছি। কাঠিটা যেরকম লম্বা, তাতে চোদ্দটা খাজ কাটা যাবে। আমার বিশ্বাস, ততদিনে মোটর বোটটাকে দেখতে পাব। ইস, কি যে আনন্দের দিন হবে সেদিনটা!

রবিন, কিশোর বলল। কয়েকটা কথা বলার সময় এসেছে। তোমাদের জানিয়ে রাখা উচিত মনে করছি। একদিন খুব ঝামেলা গেছে, দুশ্চিন্তায় ছিলাম, আরও বেশি চিন্তায় পড়ে যাবে বলে বলিনি। ডেংগুর আশা ছাড়তে হবে আমাদের। দ্বীপ থেকে বেরোতে হলে ভেলা তৈরি করতে হবে।

রবিন, মুসা, কুমালো, তিনজনেই অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে কিশোরের দিকে।

ভেলা? মুসা বলল। ভেলা কি দরকার? বোটই যখন পাব?

না, বোট আসছে না, ভুল রীডিং লিখে ডেংগুকে কিভাবে ফাঁকি দিয়েছে, খুলে বলল কিশোর। কাজেই বুঝতেই পারছ, নিজের পায়ে কিভাবে কুড়োল মেরেছি।

তা মেরেছ, মাথা দোলাল মুসা।

না, ঠিকই করেছ তুমি, কুমালো বলল। এছাড়া আর কি করতে পারতে? তুমি তো আর জানতে না এখানে এনে আমাদেরকে আটকাৰে ডেংগু। তুমি করেছ, যাতে মুক্তা চুরি করতে না পারে সে। প্রফেসরের সম্পদ রক্ষা করেছ। এটা তোমার দায়িত্ব ছিল। আর এত ভাবনার কিছু নেই। খাবার আর পানি যখন পাওয়া গেছে, বেরিয়েও যেতে পারব আমরা। ভেলা বানাতে পারবে। নারকেলের অনেক কাণ্ড আছে।

কিন্তু শুধু কাণ্ড দিয়েই হবে না, রবিন বল। বাধব কি দিয়ে ওগুলোকে? পেরেক নেই, স্কু, বন্টু, দড়ি কিচ্ছু নেই। কুমালোর জবাবের জন্যে অপেক্ষা করল

সে। তাছাড়া আসল কাজই এখনও বাকি রয়ে গেছে, যে জন্যে আমরা এলাম এখানে, আটকা পড়লাম। মুক্তো ভোলা। কিছু নমুনা নিয়ে গিয়ে তাঁকে দেখাতে হবে। মুক্তো তোলার জন্যে এত নিচে ডুব দেবে কে? তুমি তো অসুস্থ।

কাজটা আমাদেরকেই করতে হবে আরকি, কিশোর বলল।

হাঁ হয়ে গেল রবিন। ষাট ফুট! তিরিশের বেশি আমি পারব না। পঁয়তাল্লিশের বেশি মুসাও পারবে কিনা সন্দেহ।

হাসল মুসা। ওর এই হাসির অর্থ বুঝল কিশোর। ব্যাপারটাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়ে ফেলেছে গোয়েন্দা সহকারী। আর একবার যখন নিয়েছে, সহজে ক্ষান্ত হবে না।

খানিক পরেই তাঁবু থেকে বেরিয়ে গেল মুসা। পিছে পিছে রওনা হল কিশোর আর রবিন।

ল্যাগুনের পাড়ে এসে কাপড় খুলে পানিতে নামল মুসা। ডাইভিং প্র্যাকটিস শুরু করল।

ডুব দিয়ে নেমে গেল অনেক নিচে। কিছুক্ষণ পর ভেসে উঠে ফোঁস্‌স্‌ করে বাতাস ছাড়ল মুখ দিয়ে।

দম নেয়ার পর বলল, তিরিশ ফুটের বেশি নেমেছি। পানি খালি ঠেলে রাখে। পায়ে দুটো লোহার জুতো পরতে পারলে কাজ হত। টেনে নামাত।

বিকেলে দোকান থেকে এনে দেবখন, হেসে বলল রবিন। আপাতত একটা পাথর দিয়ে কাজ চালাও।

হ্যাঁ, তাই করতে হবে।

একটা পাথর বেছে নিল মুসা, তার মাথার দ্বিগুণ। ওটা দুহাতে ধরে মাথা নিচু করে ডুব দিল। ভারের কারণে প্রথমে বেশ দ্রুত নেমে চলল, আস্তে আস্তে কমে এল গতি। কিন্তু তলায় নামতে পারল। এক হাতে পাথরটাকে বুকের সঙ্গে আঁকড়ে ধরে আরেক হাতে একটা ঝিনুক তুলে নিল। তারপর ছেড়ে দিল পাথরটা। সঙ্গে সঙ্গে তীরবেগে তাকে ঠেলে তুলতে লাগল পানি।

বিশাল বাদামী ঝিনুকটা তীরে ছুঁড়ে মারল সে।

পানির তলায় বেশিক্ষণ থাকেনি, বিশ সেকেণ্ড। ফলে পানির চাপ তেমন প্রতিক্রিয়া করল না শরীরে।

বাপরে বাপ, পিষে মেরে ফেলতে চায়! শ্বাস নিতে নিতে বলল সে। এভাবে একটা একটা করে ঝিনুক তুলতে হলে এক মুক্তা পেতেই এক বচ্ছর লাগবে।

একটা ঝুড়ি হলে…। কিশোরের কথায় বাধা দিল মুসা, কোথায় পাবে?

জানি না। চল, কুমালোকে জিজ্ঞেস করি।

কুমালোকে সমস্যাটার কথা বলতে পড়ে থাকা নারকেল কাণ্ডের মাথার দিকে তাকাল সে। বলল, নারকেল গাছের মাথায় শক্ত আঁশে তৈরি এক ধরনের জাল থাকে। চেষ্টা করলে ওগুলো দিয়ে একটা থলে বানানো যায়।

দূর! বলে মাথা নাড়ল মুসা।

তবে নারকেলের জাল বা কাপড় পাওয়া গেল। গাছের মাথার কাছে ডালের গোড়ায় জড়িয়ে থাকে এই জাল। বেশ শক্ত। ডালের গোড়ার ফুটখানেক ওপর থেকে ডালপাতা সব মুড়িয়ে নিয়ে গেছে ঝড়। তবে গোড়া যেটুকু আছে, তাতে পাওয়া গেল ওই জাল। ছুরি দিয়ে কয়েক টুকরো কেটে নিয়ে ওই জালের সুতো দিয়েই সেলাই করে থলে তৈরি হয়ে গেল।

আচ্ছা, এই জিনিস দিয়ে কাপড় হয় না? রবিন বলল।

হয়ত হয়, আনমনে বলল কিশোর চামড়ায় ঘষা লাগবে। আরাম পাব না। তবে দিনের বেলা গায়ে দিয়ে রাখলে রোদ বাঁচবে কিছুটা।

কড়া রোদ সাদা প্রবালে প্রতিফলিত হয়ে এসে গায়ে লেগে চামড়ায় যেন ছ্যাকা দেয়। ফোঁসকা পড়ে যাওয়ার অবস্থা।

নারকেলের কাপড় দিয়ে শার্ট, কিংবা বলা ভাল গায়ের কিশোর। গায়ে দিয়ে দেখল, ভালই, রোদ অনেকখানি ঠেকায়।

সানগ্লাস দরকার আমার, মুসা বলল। চোখের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে রোদ। এভাবে রোদের দিকে সারাক্ষণ চেয়ে থাকতে হলে অন্ধ হয়ে যাব।

ঠিকই বলেছে ও। এসব ছায়াশূন্য দ্বীপে আটকা পড়া অনেক নাবিকই অন্ধ হয়ে গেছে রোদের কারণে।

জালের বুনন কোথাও মোটা, কোথাও মিহি। ওরকম মিহি কাপড়ের ফালি কেটে চোখে বেঁধে নিল সে। খুদে ফাঁক দিয়ে তাকাল। আরে! কাজ হচ্ছে। রোদ আর ততটা লাগে না চোখে। যদিও দেখা যায় কম। তাতে কি? কাজ চললেই হল।

যাক, আরামই লাগছে, কিশোর বলল।

তা তো লাগছে, বলল মুসা। কিন্তু আমাকেও কি তোমার মতই কিত লাগছে?

হ্যাঁ, লাগছে, হেসে বলল রবিন। একেবারে নারকেল গাছের ভূত। হাসতে শুরু করল তিনজনেই।

চল, কুমালোকে দেখাই, প্রস্তাব দিল মুসা।

পা টিপে টিপে ঘরে ঢুকল ওরা। তবু সামান্য শব্দ হয়ে গেল। তন্দ্রায় দুলছিল কুমালো, হঠাৎ জেগে তিনটে কিম্ভুত মুখোশ পরা মূর্তিকে দেখে চমকে চিৎকার করে উঠল। তারপর চিনতে পারল ওদেরকে। কাপড়, চশমা, আর থলের প্রশংসা করল।

কি জানি, মাথা চুলকাল সে। সন্দেহ হচ্ছে, তোমাদের গায়েও পলিনেশিয়ান রক্ত বইছে কিনা। নইলে এভাবে নকল কর কিভাবে? যা-ই পাচ্ছ, ঠিক কাজে লাগিয়ে ফেলছ।

খুশি হয়ে আবার উপসাগরের ধারে ফিরে এল ওরা। কুমালোর প্রশংসা অনেক উৎসাহ জোগাল ওদের।

এখন, পলিনেশিয়ানদের মত ডুব দিতে পারলেই হয়, বলল কিশোর। তাহলে কিছু মুক্তো তুলতে পারব।

কিন্তু কাজটা মোটেই সহজ নয়। পাথর নিয়ে কয়েকবার চেষ্টা করে দেখল কিশোর, তলায় পৌঁছতে পারল না। তবে প্রতিবারেই আগের চেয়ে বেশি নিচে নামতে পারছে। বুঝল, আস্তে আস্তে অভ্যাস হয়ে যাবে। পুরো ব্যাপারটাই অভ্যাসের।

ব্যাগ কোমরে বেঁধে নিচে নেমে গেল মুসা। ঝিনুক কুড়িয়ে থলেতে ভরে উঠে আসার সময় খেয়াল করল, ভারি হয়ে গেছে। টেনে রাখছে নিচের দিকে। বেশি, জোরাজুরি করলে থলে ফেটে সব পড়ে যাওয়ারও ভয় রয়েছে। শেষে মাত্র তিনটে ঝিনুক নিয়ে উঠে আসতে হল তাকে।

আসলে একটা দাড়ি দরকার আমাদের, মুসা বলল। ব্যাগ বেঁধে দেব। টেনে তোলা যাবে।

ঠিকই বলেছ, একমত হল কিশোর। ভেলা তৈরির জন্যেও দড়ি দরকার। কিন্তু এই পাথরের রাজ্যে পাই কোথায়?

দড়ি খুঁজে অনেকটা সময় কাটাল ওরা। কুমালোর কাছে জেনেছে, ছোবড়া দিয়ে দড়ি তৈরি করে পলিনেশিয়ানরা। কিন্তু পেয়েছে মাত্র একটা নারকেল, ওটা দিয়ে আর কত লম্বা দড়ি হবে।

লিয়ান লতা দিয়ে দড়ির কাজ চালানো যায়। কিন্তু এই দ্বীপে তেমন কোন লতাই নেই।

আমাজানের জঙ্গলে ওরা দেখেছে, বোয়া সাপের চামড়া দিয়ে দড়ি বানায় ওখানকার জংলীরা। অ্যানকোণ্ডা সাপের চামড়া দিয়েও হয়। কিন্তু প্রবাল অ্যাটলে সাপ থাকে না, না ছোট, না বড়। সাগরের সাপ অবশ্য আছে, তবে এই ল্যাগুনে একটাও দেখতে পেল না ওরা।

দড়ি না পেলেও খাবার পেল। একটা শসা নিয়ে ঘরে ফিরল বিকেলে।

কুমালো চমকে যাবে, হাসতে হাসতে বলল মুসা। কে ভাবতে পেরেছিল প্রবালের বাগানে শসা পেয়ে যাব?

এই বিশেষ শসাটা কোন সজি নয়, কোন বাগানেও জননি। এটা একটা জলজ প্রাণী, নাম সী কিউকামবার বা সাগরের শসা। চীনাদের খুব প্রিয় খাবার।

ল্যাগুনের প্রবালের একটা তাকে ওটাকে পড়ে থাকতে দেখেছে ছেলেরা। বিশাল এক শসার মতই দেখতে, গায়ে শসার মতই শুয়া রয়েছে, চামড়ায় চাকা চাকা দাগ। বেশ মোটা, আর ফুটখানেক লম্বা। তবে পানির ওপরে তোলার পর চুপসে অর্ধেক হয়ে গেল।

এই জীবটাও বিষ ছড়াতে পারে, সেই বিষ চোখে লাগলে অন্ধ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা। কাজেই ছুরি দিয়ে গেঁথে সাবধানে তুলেছে ওটাকে মুসা। রেখে দিয়েছে গরম পাথরের ওপর। মরে যাওয়ার পর ক্যাম্পে এনেছে।

কুমালোর নির্দেশ মত লম্বালম্বি চিরে পাঁচটা ফালি করল ওটাকে কিশোর। ঝলসে নিল আগুনে। চেহারাটা কুৎসিত, কিন্তু খেতে চমৎকার লাগল সাগর-শসার মাংস।

সেরাতে দুঃস্বপ্ন দেখল মুসা। ঘুমের মধ্যেই চেঁচাতে শুরু করল, ওরে বাবারে! কানা হয়ে গেলামরে! সাগর-শসার বিষ লেগেছে!

ঠেলা দিয়ে তাকে জাগাল কিশোর। এই মুসা, চেঁচানি থামাও। দুঃস্বপ্ন দেখছ।

আর ঘুম এল না মুসার। হামাগুড়ি দিয়ে বেরিয়ে এল ছাউনি থেকে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। দেখতে পাচ্ছে সবাই, তারমানে অন্ধ হয়নি। আসলেই দুঃস্বপ্ন ছিল ওটা।

কালো কালো মূর্তির মত তার চারপাশে দাঁড়িয়ে আছে নারকেলের কাণ্ডগুলো।

তারার ঘড়ি দেখে অনুমান করল, ভোর তিনটে বাজে। ল্যাগুনের শান্ত পানিতে সাদার্ন ক্রসের উজ্জ্বল প্রতিবিধ ঝিলমিল করছে।

ল্যাগুনের ধারে পায়চারি শুরু করল সে, উত্তেজনা কমানোর উদ্দেশ্যে। তারপর সরে এল সাগরের ধারে। সাগরও নীরব। ঢেউ নেই। জোয়ার নামছে।

অলস ভঙ্গিতে হেঁটে এগোল সে ফাঁদে কি পড়েছে দেখার জন্যে। কিনারে। এসে ভেতরে তাকাল। ভীষণ চমকে উঠল সে। জীবনে এরকম দৃশ্য দেখেনি। বিশাল দুটো চোখ তাকিয়ে রয়েছে তার দিকে।

বাসনের সমান বড় একেকটা। তার মনে হল, কোন জীবন্ত প্রাণী নয়, প্রাণীর ওরকম চোখ থাকতে পারে না। সত্যি সত্যি দেখছে, না সে এখনও ঘুমিয়েই রয়েছে? আরেকটা দুঃস্বপ্ন দেখছে।

কেমন যেন ভূতুড়ে সবুজ রঙ চোখগুলোর, জ্বলছে। মনে হয় কাচের ওপাশে বৈদ্যুতিক বাতি বসানো। ট্রাফিকের সিগন্যাল বাতি যেন বলছে যাও। যাওয়ার ইহেও হল মুসার। কিন্তু পা কথা শুনতে চাইছে না।

হঠাৎ প্রচণ্ড আলোড়ন উঠল পানিতে, বিরাট কিছু একটা রয়েছে। দুটো সবুজ গোলক ধীরে ধীরে এগিয়ে আসতে লাগল মুসার দিকে।

চিৎকার করে উঠল সে। তবু দৌড় দিতে পারল না। চোখ দুটো যেন সম্মােহিত করে ফেলেছে তাকে, মাটির সঙ্গে আঠা দিয়ে জুড়ে দিয়েছে পা। স্বপ্নে যেরকম হয়, ইচ্ছে থাকলেও দৌড় দিতে পারে না মানুষ। সে-কারণেই তার মনে হচ্ছে, আবারও দুঃস্বপ্ন দেখছে।

পায়ের শব্দ শোনা গেল। পাশে এসে দাঁড়াল কিশোর। জিজ্ঞেস করল, কি হয়েছে? চিৎকার করছ

কেন?

তারপর সে-ও দেখল ওগুলো। মুসার মতই বিশ্বাস করতে পারছে না।

চোখের মতই তো লাগছে, রবিন বলল।

কিন্তু এত বড়? বলল মুসা। নাকি প্ল্যাঙ্কটন জমে আছে কে জানে!

পাগল নাকি? কিশোর বলল। প্ল্যাঙ্কটন কখনও ওভাবে গোল হয়ে জমে সাঁতরাতে পারে না। ওগুলো চোখই। আরিব্বাপরে, কত বড় একেকটা!

যেন ম্যানহোলের ঢাকনা! ভূত না তো! বলতে বলতে পিছিয়ে গেল মুসা। ফাদের ভেতর পড়ে যাবার ভয়েই বুঝি। হুঁশিয়ার! ব্যাটা আসছে!

ঝটকা দিয়ে সামনে এগোল ওটা।

চমকে পিছিয়ে গেল তিন গোয়েন্দা।

ওটার নড়াচড়ায় কয়েক টন পানি বেরিয়ে গেল ফাদের ভেতর থেকে। কালো কালো বিশাল কয়েকটি সাপ কিলবিক করে শূন্যে উঠল, আবার ঝপাত করে পড়ল পানিতে।

জায়ান্ট স্কুইড! আচমকা চেঁচিয়ে উঠল রবিন। ভাল করে দেখার জন্যে আগে বাড়ল। একটা সাপ তার দিকে এগোতেই তাড়াতাড়ি পিছিয়ে এল আবার।

ফোয়ারার মত ছিটকে এল তরল পদার্থ। ভিজে গেল তিন গোয়েন্দা।

পানি ছিটিয়ে ভেজাচ্ছে, মুসা বলল। ব্যাটা খেলছে আমাদের সঙ্গে।

পানি না, কালি,রবিন বলল। সাবধান, চোখে যেন না লাগে।

আরও দূরে সরে এল ওরা।

এ-জন্যেই ওদেরকে বলে কালি-কলম মাছ, বিড়বিড় করল কিশোর।

হ্যাঁ, বিদ্যে ঝাড়ার সুযোগ পেয়ে গেছে রবিন। খুব ঘন কালি, লেখা যায়। একজন অভিযাত্রী একবার ওই কালি দিয়ে লগবুক লিখেছিল।

দাপাদাপি তো করছে খুব, মুসা বলল। ঘাড়ের ওপর এসে না পড়ে।

মনে হয় না। ডাঙায় উঠতে পারে না ওরা।

সাগরে তো নামতে পারে?

কিভাবে নামতে হবে জানলে তো সহজেই পারত। কিন্তু যেমন বড় তেমনি বোকা। এরকম ফাঁদে নিশ্চয় আর কখনও পড়েনি। বেরোতে পারবে না।

ধরে নিয়ে যেতে পারলে হত, চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল কিশোর। এরকম একটা স্কুইডই চেয়েছেন মিস্টার লিসটার।

কিন্তু এই জীবটা তিনি পাচ্ছেন না, বলল রবিন। আশা করা যায়, স্কুনার নিয়ে ফেরার পথে ধরতে পারব একটা। হামবোল্ড কারেন্টে অনেক পাওয়া যায় এগুলো?

দক্ষিণ আমেরিকার উপকূল ঘেঁষে যে স্রোতটা এসেছে, তার কথা বলছ?

হ্যাঁ। মনে আছে তোমার ওই বইটার কথা, ছয়জন তরুণ বিজ্ঞানী বালসা গাছের ভেলায় চড়ে পাড়ি জমিয়েছিলেন সাগরে? পেরু থেকে রওনা হয়েছিলেন তারা, ওই স্রোতে ভেলা ভাসিয়ে দক্ষিণসাগরের দ্বীপে এসেছিলেন। অসংখ্য স্কুইড দেখেছিলেন তাঁরা। রাতের বেলা ভেসে উঠত ওগুলো, দিনে তলিয়ে যেত গভীর পানিতে।

সবুজ আলো দুটোর উজ্জ্বলতা এখন কমছে বাড়ছে, যেন ভেতরের বিদ্যুৎ উৎপাদক যন্ত্র ভোল্টেজ একবার বাড়াচ্ছে একবার কমাচ্ছে।

গায়ে কাঁটা দিল মুসার। খাইছে! ব্যাটা চোখের পাতা ফেলে না কেন একবারও? গুহার ভেতরে অষ্টাপদী জীবটার সঙ্গে লড়াইয়ের কথা মনে পড়ল তার। ওটার চোখেও এরকম শয়তানী ছিল, তবে আরও ছোট চোখ, আর দেখতে মানুষের চোখের মত। এটার মত উজ্জ্বলতাও ছিল না ওগুলোয় মাথা দোলাল সে, হুঁ, অক্টোপাস আর স্কুইডের মাঝে ফারাকটা এখন বুঝতে পারছি। মাঝে মাঝেই ভাবতাম তফাৎটা কোথায়?

অনেক তফাৎ, রবিন বলল। এটার চোখ বাসনের মত, অক্টোপাসের চোখ থিমবলের মত। অক্টোপাসের শরীর একটা আস্ত ফোলা ব্যাগ, আর এটার হল টরপেডোর মত। চলেও ওরকম ভাবেই। শুঁড় দশটা। দুটো শুঁড় আরগুলোর চেয়ে অনেক বেশি লম্বা। ওঁড়ে কাপের মত বসানো রয়েছে, তবে অক্টোপাসের মত সাকশন কাপ নয়, এগুলোতে রয়েছে ধারাল দাঁত। মারাত্মক। ইস্পাতের তার কেটে ফেলতে পারে।

যাহ্, বাড়িয়ে বলছ।

এক বর্ণও না। আমেরিকান মিউজিয়ম অভ নেচারাল হিস্টরির কয়েকজন বিজ্ঞানী একবার এক অভিযানে বেরিয়েছিলেন। বড় মাছ ধরার জন্যে তাঁরা ব্যবহার করছিলেন ইস্পাতের তার। সেই তার কেটে দিয়েছে স্কুইডের সাত। কাজেই সাবধান। অবশ্য যদি নিজেকে ইস্পাতের চেয়ে শক্ত মনে কর, তাহলে আলাদা কথা।

ভোর এল। অন্ধকার তাড়ানর জন্যে উঠেপড়ে লাগল ধূসর আলো। দানবটাকে স্পষ্ট দেখা গেল এখন। পুরো ফাঁদটা জুড়ে রয়েছে। শরীরের জন্য, শুড়ের জায়গা হচ্ছে না ভেতরে। পাথরের ওপর দিয়ে এসে শুকনোয় বিছিয়ে আছে ওগুলো।

ক্ষণে ক্ষণে রঙ বদলাচ্ছে টর্পেডোর মত শরীরটা। কালো থেকে বাদামী, বাদামী থেকে তামাটে, তামাটে থেকে ফ্যাকাসে সাদা।

গোল চোখের ব্যাস একফুট। রাতের চেয়ে এখন আরও ভয়ঙ্কর লাগছে। ফসফরাসের সবুজ আলো মিলিয়ে গেছে এখন, চোখ দুটোকে লাগছে এখন কালো, দুটো গর্তের মত, যেন যে কোন মুহূর্তে ভেতর থেকে বেরিয়ে আসবে আতঙ্ককর কিছু। তীব্র ঘৃণা নিয়ে তাকিয়ে আছে ছেলেদের দিকে। স্থির ওই চোখের দিকে

তাকিয়ে নিজেদেরকে বড় ক্ষুদ্র আর অসহায় মনে হল তিন গোয়েন্দার।

প্রশান্ত মহাসাগরের দুঃস্বপ্ন! বিড়বিড় করল কিশোর। একেবারে মানানসই।

জোয়ার এখনও পুরোপুরি নামেনি। ফাঁদের মধ্যে পানি রয়েছে। আবার জোয়ার এলে সহজেই বেরিয়ে যেতে পারবে স্কুইডটা। ততক্ষণ টিকতে পারলে হয়। আটকা পড়েছে পাথরের ফাদে। একেবারে নেমে যাবে পানি। রোদ উঠবে।

তখন কি করবে? ভাবসাবে মনে হচ্ছে বিপদ এখনও বুঝতে পারেনি ওটা।

ফাঁদের ভেতরে পানি কুচকুচে কালো, স্কুইডের কালি মেশানো। শরীরের ভেতরের থলে বোঝাই করে পানি টানছে, তীব্র গতিতে ছুঁড়ে মারছে আবার, উল্টোদিকে ছুটে যেতে চাইছে রকেটের মত, পারছে না পাথরের দেয়ালের জন্যে। ঠেকে রয়েছে।

আরিব্বাবারে, কত্তো বড়! গাল ফুলিয়ে বলল মুসা। শরীরটাই বিশ ফুট হবে।ড় আরও বিশ ফুট।

তু এটাকে ছোটই বলা চলে, রবিন বলল। বেয়াল্লিশ ফুট লম্বা উড়ওয়ালা স্কুইডও ধরা পড়েছে। শার্ম তিমির সঙ্গে অনেক সময় লড়াই বাধে স্কুইডের। একবার ওরকম এক লড়াই দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল একদল বৈজ্ঞানিক অভিযাত্রীর। লড়াইয়ে তিমিটা হেরে গিয়েছিল।

কিশোর ঠিকই বলেছে, মুসা বলল। এটাকে ধরে নিয়ে যেতে পারলে ভাল পয়সা মিলত। কিন্তু পারব না। হাতে পেয়েও ছেড়ে দিতে হচ্ছে।

জীবটার দিকে তাকিয়ে চুপচাপ ভাবছিল আর নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটছিল কিশোর। বলল, এটাকে কাজে লাগাতে পারি আমরা। দড়ি বানাতে পারি।

দড়ি? হাহ, পাগল হয়ে গেছ তুমি। এটা দিয়ে দড়ি বানাবে কি করে?

ড়গুলো দিয়ে। ফালি করে কেটে নিলে খুব শক্ত দড়ি হবে, চামড়ার ফালির মত।

ঘোঁৎ করে উঠল মুসা, বিশ্বাস করতে পারছে না।

কেন পারব না? কিশোরের কণ্ঠে দৃঢ় আত্মবিশ্বাস। বোয়াকনসট্রিকটর আর অ্যানাকোন্ডার চামড়া দিয়ে যদি দড়ি হয় স্কুইডের বঁড় দিয়ে কেন হবে না? মালয়েশিয়ায় অজগর দিয়েও দড়ি বানায় লোকে। ওগুলো এত টেকসই, আসবাবপত্র মোড়ানর কাজে ব্যবহার করে, লস অ্যাঞ্জেলেসের বড় বড় অনেক দোকানে দেখতে পাবে। আমার তো বিশ্বাস, এই ঔড় দিয়ে সাপের দড়ির চেয়ে শক্ত দড়ি হবে।

…বেশ, তা নাহয় হল, কিন্তু কাটতে যাচ্ছে কে? বললেই তো খসিয়ে দিয়ে দেবে না স্কুইড। আমি ওই শুড়ের ধারেকাছে যেতে চাই না। রেগে আগুন হয়ে শেষে আমাকে দিয়েই নাস্তাটা সেরে ফেলবেন মহামান্য কালির মহাজন।

সূর্য উঠল। রোদ চড়তে লাগল। গরম সইতে না পেরে অস্থির হয়ে উঠল দানবটা, রাগ বাড়ছে। মেরু অঞ্চলের ঠাণ্ডা পানি ওদের পছন্দ, হামরোল্ড স্রোতের কনকনে ঠাণ্ডা পানিতে ভেসে চলে আসে বলে নিরক্ষীয় অঞ্চলের গরম টের পায় না। দিনের বেলা ওই স্রোতের মধ্যেই থাকে। রাতে আবহাওয়া খুব ঠাণ্ডা হলে স্রোত ছেড়ে উঠে আসে ওপরে, আলো ফোঁটার আগেই ডুবে যায় আবার। রোদ ভীষণ অপছন্দ।

কড়া রোদে অস্থির হয়ে অল্প পানিতে সাংঘাতিক দাপাদাপি শুরু করল ওটা। শুঁড় দিয়ে চাবুকের মত বাড়ি মারতে লাগল দেয়ালের বাইরে মাটিতে, ধারাল দাঁতের আঁচড়ে গভীর ক্ষত হয়ে গেল শক্ত প্রবাল পাথরে।

হঠাৎ এক লাফ দিয়ে উঠে গেল ছয় ফুট। চাবুকের মতই শাঁই শাঁই শুঁড় চালাল বাতাসে। লাফিয়ে সরে এল রবিন আর মুসা। কিশোর সরে সারতে পারল না। পাথরে হোঁচট খেয়ে গেল পড়ে।

শাঁ করে এসে তার কোমর জড়িয়ে ধরল একটা ভয়াবহ ভঁড়। নারকেল কাপড়ের পোশাক কেটে চামড়ায় বসে যেতে লাগল তীক্ষ্ণধার দাঁত।

বড় একটা পাথর দিয়ে উঁড়টায় পাগলের মত বাড়ি মারতে শুরু করল মুসা। কুমালো! কুমালো! বলে গলা ফাটিয়ে চেঁচাতে লাগল রবিন।

ধীরে ধীরে কিশোরকে মুখের কাছে টেনে নিচ্ছে প্রকাণ্ড শুঁড়টা। ঈগল-চঞ্চর, মত ঠোঁটটা ফাঁক হয়ে বেরিয়ে পড়ল একসারি করাতে-দাঁত। দুই হাতে একটা পাথর আঁকড়ে ধরে রাখার চেষ্টা করছে কিশোর। পারছে না। টানের চোটে হাত ছুটে গেল পাথর থেকে। ধরল আরেকটা পাথর। হ্যাঁচকা টানে ওটা থেকেও তার হাত ছুটিয়ে নিল স্কুইডের গুঁড়।

তিন-হাতে পায়ে ভর দিয়ে আহত পা-টা টানতে টানতে তাঁবু থেকে বেরোল কুমালো।

কুমালে, জলদি! চেঁচিয়ে বলল রবিন। তার ধারণা, স্কুইডকে ঠেকার নিশ্চয় কোন উপায় জানে পলিনেশিয়ানরা।

পাথর দিয়ে বাড়ির পর বাড়ি মারছে মুসা। যেন রবারে লাগছে পাথর, কিছুই হচ্ছে না গুঁড়টার। শেষে পাথরটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে কিশোরের দুহাত চেপে ধরল। শুরু হল যেন স্কুইডে আর মানুষের দড়ি টানাটানি।

দুজনে মিলেও থামাতে পারল না খুঁড়টাকে। হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে চলেছে স্কুইড। আর মাত্র কয়েক ফুট তফাতে রয়েছে অপেক্ষমাণ ঠোঁট।

মুসা, খবরদার! সাবধান করল রবিন। আরেকটা ঔড় এগিয়ে আসছে মুসাকে ধরার জন্যে, সে দেখতে পায়নি। রবিনের চিৎকার শুনে লাফ দিয়ে সরে গেল একপাশে।

অবশেষে পৌঁছে গেল কুমালো। বড় একটা পাথর তুলে নিয়ে ভাল পা-টায় ভর দিয়ে দাঁড়াল। গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে ছুঁড়ে মারল পাথরটা। পাথর আর বর্শা ছুঁড়ে মাছ মারায় ওস্তাদ পলিনেশিয়ানরা। হাতের নিশানা খুব ভাল। আহত, অসুস্থ অবস্থায়ও কুমালোর লক্ষ্য ফসকাল না। দুর্বল অবশ্যই, কিন্তু এই জরুরি মুহূর্তে কোথা থেকে যেন অসুরের বল এসে গেছে তার গায়ে।

উড়ে এসে পাথরটা ঢুকল দানবের ঠোঁটে, চোয়ালে এমন শক্ত হয়ে আটকে গেল, কিছুতেই খুলতে পারল না স্কুইড।

একমুখ পাথর নিয়ে মানুষ খাওয়ার আশা ছাড়তে বাধ্য হল কালির মহাজন। কিন্তু ওঁড়ের বাঁধন আলগা করল না। যেন প্রতিজ্ঞা করেছে, আচ্ছামত শান্তি দিয়ে ছাড়বে ব্যাটাদের।

জলদি কর, রবিন, ওই লাকড়িটা দাও আমার হাতে! চিৎকার করে বলল কুমালো।

ছুটে গিয়ে নারকেল কাণ্ডের একটা ফাড়া লাকড়ি এনে কুমালোর হাতে দিল রবিন।

ধর আমাকে নিয়ে যাও ওটার কাছে!

কুমালোকে স্কুইডটার কাছে আসতে সাহায্য করল রবিন। পায়ের ব্যথার পরোয়াই করল না পলিনেশিয়ান। ধা করে বাড়ি মারল স্কুইডের মাথায়, মগজ ভর্তা করে দেয়ার জন্যে।

যন্ত্রণায় ভীষণ ভাবে কেঁপে উঠল স্কুইডের শরীর। লাফ দিয়ে উড়টা উঠে গেল ওপরে, ঢিল হয়ে গেল বাঁধন। ধপ করে মাটিতে খসে পড়ল কিশোর। ঝাড়া লেগে চিত হয়ে পড়েছে মুসা, আগেই।

মাটিতে আছড়াতে শুরু করল গুঁড়গুলো, মুমূর্ষ সাপের মত মোচড় খাচ্ছে। ধীরে ধীরে কমে এল নড়াচড়া, নিথর হয়ে গেল।

কিশোরকে তুলে বসাল রবিন আর মুসা। তার জখম পরীক্ষা করল। রক্তাক্ত শরীর। অনেক জায়গায় কেটেছে, রক্ত ঝরছে ওগুলো থেকে।

ঠিকই, আছি আমি, বলল কিশোর। হাত-পা ভাঙেনি। কাটাও তেমন বেশি নয়, শুধু আঁচড় লেগেছে। কুমালোকে তোল। ওর অবস্থা কাহিল।

কুমালোর দুই বগলের তলায় ক্রাচ হয়ে তাকে ধরে ধরে তাঁবুতে নিয়ে এল মুসা আর রবিন। একেবারে নেতিয়ে পড়ল বেচারা। সারাদিন পায়ের অসহ্য যন্ত্রণায় কষ্ট পেল।

কুমালোকে ঘরে রেখে মরা দানবটার কাছে ফিরে এল তিন গোয়েন্দা। পাথরটা আটকে রয়েছে স্কুইডের ঠোঁটে। যে ঔড়টা তাকে ধরেছিল সেটার দিকে চেয়ে শিউরে উঠল কিশোর। আতঙ্ক উত্তেজনায় দুর্বল হয়ে পড়েছে শরীর, মাথা ঘুরছে, ঘোলা দেখছে চোখে।

এরকম একটা প্রাণীকে মেরে ফেললাম, আফসোস করে বলল কিশোর। জ্যান্ত নিতে পারলে কাজ হত।

না মারলে তুমি বাঁচতে না এতক্ষণ, মুসা বলল। তাছাড়া ভেলা বানাতে দড়ি দরকার। ভেলা না হলে বেঁচে ফিরতে পারব না আমরা এখান থেকে।

তা ঠিক। বসে থাকলে চলবে না। জোয়ার আসার আগে কাজ শেষ করে ফেলতে হবে। নইলে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে এটাকে।

চামড়া খুবই শক্ত। কয়েক ঘন্টা কঠোর পরিশ্রম করে বঁড়গুলো আলাদা করল ওরা। টেনে নিয়ে গিয়ে পাথরের ওপর বিছিয়ে দিল রোদে শুকানর জন্যে।

কাল কাটব, কিশোর বলল। জোয়ার এসেছে। ভেসে ওঠা লাশটাকে টানতে শুরু করেছে পানি।

নিয়ে যাক, নাকি? জিজ্ঞেস করল মুসা। না স্কুইডের মাংসও খাওয়া যায়? কেটে রাখব খানিকটা?

আমার মনে হয় না সুবিধে হবে, রবিন বলল। পুবদেশীর অবশ্য বাচ্চা স্কুইডের মাংস খুবই পছন্দ করে। তবে এই বুড়ো দাদাকে ওরাও গিলতে পারবে কিনা সন্দেহ। চিবানই যাবে না রবারের মত মাংস।

ভেসে যাওয়ার আগে আরেকটা জিনিস রাখতে হবে আমাদের, বলল কিশোর। কাজে লাগবে।

একটা পাথর তুলে নিয়ে গিয়ে স্কুইডের ঠোঁটে বাড়ি মারতে শুরু করল সে। পিটিয়ে ভেঙে ফেলল একটা অংশ। শক্ত এই জিনিসটা দেখতে অনেকটা কুড়ালের মত, কুড়ালের ফলার মতই ধার। নারকেল কাণ্ডের একটা খাটো লাকড়ি নিয়ে হাতল বানাল কিশোর। শুঁড় থেকে সরু চামড়ার একটা ফালি কেটে হাতলের সঙ্গে বাঁধল ভাঙা ঠোঁটটা।

দেখতে হয়ত তেমন সুন্দর না, হাত ঘুরিয়ে বাতাসে কোপ মারল সে। তবে চমৎকার একটা কুড়াল পেয়ে গেলাম। ভেলা বানাতে খুব কাজ দেবে।

পরদিন জায়ান্ট স্কুইডের শুঁড় কেটে লম্বা লম্বা ফালি করল ওরা। চেঁছে ফেলে দিল চামড়ার ভেতরের মাংস। কড়া রোদে খুব তাড়াতাড়ি শুকিয়ে গেল চামড়া।

ট্যান করার দরকার আছে? মুসা জিজ্ঞেস করল।

কয়েক বছর যদি রাখতে চাইতাম, তাহলে করতাম, জবাব দিল কিশার। আমাদের এত বেশি দিন রাখার দরকার নেই। কয়েক হপ্তায় নষ্ট না হলেই হল।

অদ্ভুত, না? সুইডের চামড়া দিয়ে দড়ি…হাহ, হাই।

অদ্ভুত হবে কেন? ভুরু নাচাল রবিন। অন্য জীবের মত এটাও তো জীব। কিসের চামড়া ব্যবহার করে না লোকে? ক্যাঙারু, ওয়ালাবি, মোষ, উটপাখি, হরিণ, গুইসাপ, অ্যালিগেটর, হাঙর, সীল, ওয়ালরাস, কোনটা বাদ দেয়? বিশ্বাস করবে, জংলী নরখাদকরা আজও মানুষের চামড়া দিয়ে তাদের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র বানায়?.

বিশ ফুট লম্বা চারটে ফালি জোড়া দিয়ে বড় একটা দড়ি হল, উপসাগরের তলায় পৌঁছেও আরও থাকে। দড়ির এক মাথায় নারকেল কাপড়ের থলে বেঁধে ডুব দেয়ার জন্যে প্রস্তুত হল ওরা।

আমিই আগে যাই, মুসা বলল।

একহাতে পাথর আঁকড়ে আরেক হাতে ব্যাগ নিয়ে পানিতে নামল সে। ওপর থেকে কিশোর আর রবিন দেখল কঁপা কাঁপা একটা ছায়া নেমে যাচ্ছে, নামার সময় পানিতে ঢেউ উঠেছে, সে জন্যেই ওরকম দেখা যাচ্ছে মুসাকে।

পা নিচের দিকে রাখতে কষ্ট হচ্ছে মুসার। ঠেলে উল্টে ফেলতে চাইছে পানি। শেষে দুপা দিয়ে পাথরটা চেপে ধরল। এবার আর মাথা ওপরের দিকে রাখতে অসুবিধে হল না।

ভয়ঙ্কর চাপ পড়ছে দেহের ওপর। জড়িয়ে ধরে চেপে চ্যাপ্টা করে দিতে চাইছে যেন বিশাল কোন দৈত্য। এই চাপের মধ্যে ফুসফুসের বাতাস আটকে রাখতেই হিমশিম খাচ্ছে।

নিচে নেমে খামচি দিয়ে দিয়ে ঝিনুক তুলে ব্যাগে ভরতে লাগল। ঝিনুকের খোলা খসখসে, কাঁটা কাঁটাও রয়েছে কোন কোনটাতে। কুমালোর দস্তানা দুটো পরে আসা উচিত ছিল, ভাবল সে। খোঁচা লেগে রক্তাক্ত হয়ে যাচ্ছে আঙুল। যদি কাছাকাছি হাঙর থাকে, তাহলে বিপদ হবে। তবে ল্যানের ভেতর এ-পর্যন্ত কোন হাঙর দেখেনি। কিন্তু বাইরে থেকে আসতে কতক্ষণ?

থলেতে অন্তত পনেরোটা ঝিনুক জায়গা হবে। একের পর এক তুলে ভরতে লাগল সে। গোনার অবকাশ নেই। প্রচণ্ড এই চাপের মধ্যে কতক্ষণ থাকতে পারবে? এখনই মনে হচ্ছে, আধ ঘন্টা পেরিয়ে গেছে।

থলেটা ভরে ফেলে রেখে ওপরে উঠতে শুরু করল সে।

ওপরে ভাসলে হাত বাড়িয়ে তাকে টেনে তুলল কিশোর আর রবিন। জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলছে মুসা, শিস দেয়ার মত শব্দ বেরোচ্ছে নাকের ফুটো থেকে। শরীর মোচড়াচ্ছে যন্ত্রণায়। খি ধরেছে মাংসপেশিতে। ফুলে উঠেছে গলা আর হাতের রগ। থরথর করে কাঁপছে ম্যালেরিয়া রোগীর মত। এই কড়া রোদের মাঝেও শীত করছে।

উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ল রবিন আর কিশোর।

অনেক বেশি থেকে নিচে, কিশোর বলল। প্রায় দুই মিনিট। পলিনেশিয়ানদের কাছাকাছি। ওদের ওস্তাদ ডুবুরিরাও তিন মিনিটের বেশি পারে না।

উঠে বসল মুসা। আমার কিছু হয়নি, খসখসে কণ্ঠে বলল সে। ব্যাগটা তোল। দেখি, কি আছে।

দড়ি টেনে থলেটা তুলে আনা হল। পানির ওপরে তোলার আগে ওটার তলা দুহাত দিয়ে ধরল রবিন, যাতে ফেটে না যায়। সৈকতে ঢালা হল ঝিনুকগুলো। পনেরোটা। বড় বড়, কালো।

ভেতরে কি আছে দেখার জন্যে তর সইছে না ওদের। একের পর এক ঝিনুক খুলে মুক্তা খুঁজল! একটাও পেল না।

নিরাশ দৃষ্টিতে উপসাগরের, কালো পানির দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল মুসা। আবার যেতে হবে, তাই না!

হবে। কতবার যে যাওয়া লাগে, কে জানে! ঠিক আছে, আমি এবার চেষ্টা করে দেখি, বলল কিশোর।

দস্তানা পরে নাও,হাতের আঙুল দেখাল মুসা। দেখ, কি অবস্থা হয়েছে।

কুমালোর দস্তানা জোড়া নিয়ে এল কিশোর। তারপর থলে আর পাথর নিয়ে নেমে পড়ল পানিতে। পা নিচে রাখার চেষ্টা করল না সে। মাথা নিচের দিকে করে ঝিনুক তুলতে শুরু করল, পা দুটো ওপরে দুলছে সাগরের শ্যাওলার মত।

ঝিনুক ভরা শেষ করে ওপরে উঠতে লাগল। ধীরে ধীরে, সময় নিয়ে, চাপের সঙ্গে শরীর সইয়ে। কিন্তু তারপরেও তাকে যখন ডাঙায় টেনে তোলা হল, সটান চিত হয়ে শুয়ে পড়ল। ফোঁটা ফোঁটা রক্ত বেরোতে শুরু করল নাক-কান-মুখ দিয়ে। হাপরের মত ওঠানামা করছে বুক।

আ-আমি…তোমার মত… হাঁপাতে হাঁপাতে বলল সে। তোমার মত উভচর নই…

আবার টেনে তোলা হল থলেটা।

ঝিনুক খুলতে শুরু করল তিনজনে। এক এক করে খুলে ফেলল বারোটা, কিছু নেই।

তেরো নম্বরটা খুলতে খুলতে মুসা বলল, আনলাকি থারটিন। এটাতে তো থাকবেই না। বলেই দিল ছুরি ঢুকিয়ে। ডালা খুলে মাংসের ভেতরে আঙুল ঢুকিয়েই স্থির হয়ে গেল। গোল গোল হয়ে গেছে চোখ, ঝুলে পড়েছে নিচের চোয়াল। দ্রুত হয়ে গেল নিঃশ্বাস।

খাইছে! পেয়েছি!

দুআঙুলে টিপে ধরে জিনিসটা বের করে আনল মুসা। দীর্ঘ একটা মুহূর্ত কারও মুখে কথা ফুটল না। স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রয়েছে ওটার দিকে।

ইয়া আল্লাহ! অবশেষে ফিসফিসিয়ে বলল মুসা। এত দেখি ফুটবলের সমান!

ফুটবলের সমান অবশ্যই নয়, তবে মারবেলের সমান। মিউজিয়মে মুক্তা দেখেছে ওরা, ওগুলোর কোনটাই এর অর্ধেক বড় নয়। চমৎকার আকৃতি। একদিকে কাত করে ধরলে হয়ে যায় সাদা, আরেক দিকে ধরলে মনে হয় স্বচ্ছ, আকাশ আর ল্যাগুনের রঙে রঞ্জিত হয়ে যায়। পাথর নয়, যেন জীবন্ত।

কিশোরের হাতের তালুতে মুক্তাটা ফেলে দিল মুসা। আরও অবাক হল কিশোর। এত ভারি! তারমানে খুব ভাল জাতের মুক্তা। দুআঙুলে ধরে ঘুরিয়ে

ফিরিয়ে দেখতে লাগল। সূক্ষ্মতম দাগও নেই।

আরেক হাত দিয়ে রোদ আড়াল করল কিশোর। তার পরেও জ্বলছে মুক্তাটা, তবে এখন আর সূর্যের মত নয়, চাঁদের মত।

আনমনে বিড়বিড় করল বিস্মিত রবিন, প্রফেসর দেখলেও চমকে যাবেন!

তারমানে তার পরীক্ষা সফল হয়েছে, মুসা বলল।

নিশ্চয় হয়েছে। তবে তাঁকে দেখাতে নিয়ে যাওয়াটাই মুশকিল। হারিয়ে যেতে পারে। চুরি হতে পারে। পোনাপেতে গেলে ডেংগু ব্যাটা আমাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিতে পারে, অবশ্য যদি কোনদিন যেতে পারি।

যা, ঝুঁকি আছে, হাসি ফুটল কিশোরের মুখে। রতের মালিক হওয়ার এই এক অসুবিধে। সব সময় চিন্তা, কখন কি হয়ে যায়। চল, কুমালোকে দেখাই।

তাবুর অন্ধকারেও মুক্তার আগুন নিভল না। কুমালোর চোখের সামনে জিনিসটা তুলে ধরল কিশোর। শিস দিয়ে উঠল পলিনেশিয়ান। এত সুন্দর জিন্দেগিতে দেখিনি। আমাদের এদিকে এতবড় মুক্ত পাওয়া যায় না। তবে অন্যখান থেকে এনে বীজ ছড়ালে যে হয়, এটা প্রমাণ করে দিলেন তোমাদের প্রফেসর। দেখি, মালাটা দাও তো। পানি আছে না?

মালার পানিতে মুক্তাটা ফেলে দিল কুমালো। খুব দ্রুত তলিয়ে গেল ওটা। ভাল ওজন।

তোমার কাছেই থাক, কিশোর বলল। আমরা নানারকম কাজ করি, হারিয়ে ফেলতে পারি। ওটা সঙ্গে রাখলে কোন কাজই করতে পারব না।

মাপ চাই ভাই! আমি পারব না। ওটার ভাবনায় ঘুমাতে পারব না সারারাত। তুমিই রাখ।

অনিচ্ছা সত্তেও মুক্তাটা নিয়ে প্যান্টের পকেটে রাখল কিশোর। তবে রাখার আগে নারকেলের ছোবড়ায় ভালমত জড়িয়ে নিল, যাতে পকেট থেকে ফসকে পড়তে না পারে। মুক্তার উত্তাপ নেই, তবু তার মনে হল জ্বলন্ত একটা কয়লার টুকরো রয়েছে পকেটে, চামড়ায় হ্যাঁকা দিচ্ছে। মুক্তা তো পেল না, রাতদিন সব সময়ের জন্যে একটা দুর্ভাবনার ডিপো জোগাড় করল যেন।

যা হবার হবে, জোরে নিঃশ্বাস ফেলে বলল সে। চল, কাজে যাই। একটায় সন্তুষ্ট হবেন না প্রফেসর। আরও কয়েকটা লাগবে।

দিনটা শেষ হওয়ার আগেই সেদিন আরও দুটো মুক্তা যোগ হল প্রথমটার সঙ্গে। দ্বিতীয়টা কিছু ছোট, তৃতীয়টা আরও বড়।

তোমাদের আসা সার্থক হল, বলল কুমালো। মুক্তা পেলে। নিশ্চিন্ত হলে এতদিনে।

নিশ্চিন্ত? মুখ বাঁকাল কিশোর। দুশ্চিন্তার কারখানা তৈরি করলাম বরং। এগুলো প্রফেসরের হাতে তুলে দেয়ার আগে আর স্বস্তি নেই আমার কপালে।

সে-রাতে কিশোর দেখল দুঃস্বপ্ন। দেখল, ওদের ভেলা উল্টে গেছে। গভীর পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে সে। তার প্যান্টটা কামড়ে ছিঁড়ে খুলে নিয়ে যাচ্ছে একটা হাঙর। হাঙরের মুখটা ডেংগুর মত। মুখে শয়তানী হাসি। হাঙরের আবার হাতও আছে, সেই হাতে তিনটে মুক্তা।

জেগে গেল সে। ঘামে ভিজে গেছে শরীর। চট করে হাত চলে গেল প্যান্টের পকেটে। না, হারায়নি, আছে মুক্তাগুলো।

ভেলা তৈরি শুরু হল। ল্যাগুনের দিকে ঢালু হয়ে আছে জায়গাটা। ইচ্ছে করেই এই স্থান নির্বাচন করেছে ওরা। চারজনকে বয়ে নেয়ার উপযোগী ভেলা বেশ ভারি হবে, বয়ে নিয়ে গিয়ে পানিতে নামাতে পারবে না। জায়গা ঢালু হলে ঠেলে নামাতে সুবিধে হবে।

তারপরেও বাড়িতে সতর্কতা গ্রহণ করল কিশোর। কয়েকটা কাণ্ডকে পানির সঙ্গে আড়াআড়ি করে রাখল ডাঙায়। এগুলোর ওপর ভেলাটা তৈরি করে গড়িয়ে নিয়ে গিয়ে ফেলবে পানিতে। খুঁটি গেড়ে আটকে দিল রোলারগুলোকে, যাতে আপনাআপনি গড়িয়ে যেতে না পারে।

পনেরো থেকে বিশ ফুট লম্বা সাতটা কাও এনে রাখা হল রোলারের ওপর। লম্বাগুলো রাখা হল মাঝখানে, বেড়ে থাকা অংশটা গলুইয়ের কাজ করবে। পাশেরগুলোর মধ্যে যে কটা মাপে বড় হয়ে গেল, ছোট করে কেটে সমান করে ফেলা হল। খুব কাজ দিল কুড়ালটা, ওটা ছাড়া কাটতে পারত না।

চামড়ার ফিতে দিয়ে একটার সঙ্গে আরেকটা বাঁধা হল কাণ্ডগুলো।

বাঁধা শেষ করে সব দিক থেকে খুঁটিয়ে দেখল কতটা কি হয়েছে।

জাহাজের মতই আকার, বলল কিশোল রোদ থেকে বাঁচার জন্যে একটা কেবিন লাগবে। পালও দরকার।

হেসে উঠল মুসা। কি দিয়ে বানাবে? প্রবাল পাথর?

হেস না হেস না, মাথা নাড়ল রবিন। হাঙরের চামড়া দিয়েই ঘরের চাল হয়ে যাবে। পালও। হতাশ হয়ে পড়ল পরক্ষণে। কিন্তু পাল তুলতে হলে মাস্তুল চাই। কি দিয়ে বানাব? নারকেলের কাণ্ড বেশি ভারি। দাঁড় করানো যাবে না।

যাবে, কিশোর বলল। পরিশ্রম করতে হবে আরকি।

স্কুইডের ঠোঁটের কুড়াল আর ধারাল প্রবালের সাহায্যে কাণ্ড ফাড়তে লেগে গেল ওরা। অনেক ঘাম ঝরানর পর কাণ্ড কেটে বের করল আঠারো ফুট লম্বা একটা দণ্ড। ছুরি দিয়ে টেছে মসৃণ করতে লাগল।

তার পরেও খসখসে রয়েই গেল, সোজা হয়নি ঠিকমত। কিন্তু এটা পেয়েই খুশিতে নাচতে বাকি রাখল ছেলেরা।

ভেলার গলুইয়ের কাছে গর্ত করে ফেলল একটা। তাতে বসিয়ে দিল মাল।

কেবিন আর পাল বানানো যাবে পরেও। এখনই দ্বীপ ছাড়তে তৈরি নয় ওরা, কাজেই ঘরটার প্রয়োজন আছে।

ভেলা বানাতে লেগেছে তিন দিন। রসদ জোগাড় করতে আরও সময় লাগল।

প্রথমেই জরুরি হল পানি। ডুবোঝনাটা প্রায় ফুরিয়ে এসেছে, স্রোতের জোর নেই বললেই চলে। ঝিরঝির করে বেরোয় এখন। যত তাড়াতাড়ি পারা যায় এখন ওগুলো তুলে জমিয়ে ফেলা উচিত। দিনের মধ্যে অসংখ্য বার পালা করে ডুব দিল তিনজনে। প্রতিবারেই তুলে আনল একমালা করে পানি। আগের মত মিষ্টি নেই আঁর, নোনা পানি মিশে যাচ্ছে, যদিও খুব সামান্য।

কুমানোর সঙ্গে পরামর্শ করল কিশোর। পানি বয়ে নিই কি করে? এখন তো পাথরের গর্তে জমিয়েছি। গর্তটা তো আর তুলে নেয়া যাবে না। আর মালাও মোটে একটা। একমালা পানিতে কিছুই হবে না।

ভুরু কোঁচকাল কুমালো। হা, সমস্যাই। আমাদের জেলেরা ছাগলের চামড়া দিয়ে ব্যাগ বানিয়ে নেয়। একটা ডলফিন-টলফিন পেলেও চলত।

দেখা যাক ফাঁদে পড়ে কিনা। কিন্তু আপাতত সমস্যার সমাধান করি কিভাবে? পাথরের গর্তে পানি বেশিক্ষণ থাকবে না, রোদে উড়ে যাবে। ঢাকনা দিয়ে রাখলে থাকবে?।

থাকবে। নারকেলের লাকড়ি গর্তের ওপরে সাজিয়ে তার ওপর পাথর চাপা দিয়ে রাখগে। বলে ছুরি নিয়ে কাজ করতে লাগল কুমালো। ছেলেরা কাজ করেছে একদিন, সে-ও বসে থাকেনি। দুটো ক্রাচ বানিয়ে ফেলেছে। এখন বানাচ্ছে ভেলার জন্যে দাঁড়। বলল, নারকেল দিয়ে কত কিছুই করলাম। ঘর বানালাম, কাপড় বানালাম, ভেলা বানালাম…পানি রাখার পাত্রও বানানো যায়। তবে খুব কঠিন হবে। একটা টুকরো কেটে খোড়ল করে নিতে হবে…

পারব! তুড়ি বাজিয়ে চেঁচিয়ে বলল কিশোর। খোড়ল হুয়ে আছে ওরকম কিছু একটা বেছে নিলেই তো পারি আমরা।

অবাক হয়ে কিশোরের দিকে তাকাল কুমালো।

অন্য দ্বীপটায়, বলল কিশোর। কাল কয়েকটা বাঁশের টুকরো দেখে এলাম। নিশ্চয় ঝড়ে উপড়ে গিয়েছিল, অন্য দ্বীপ থেকে ঢেউয়ে ভেসে এসে ঠেকেছে…

তাহলে তো আর কোন ভাবনাই নেই।

কতটা লম্বা?

আট-দশ ফুট।

ছয় ফুট করে কেটে নাওগে।

কাটতে অসুবিধে হল না। তবে আরেকটা সমস্যা দেখা দিল। ফুটখানেক পর পরই বাশে একটা করে গাঁট, ওগুলো বন্ধ। ছিদ্র না করতে পারলে লাভ হবে না। করবে কি দিয়ে?

সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিল একটা তলোয়ার মাছ। নিজের জীবন দিয়ে বাঁচিয়ে দিল চারজন মানুষকে। ফাদে ধরা পড়ল ওটা। চমৎকার মাংস, কয়েক দিনের খাবারের ব্যবস্থা হয়ে গেল। ওটার তলোয়ার তিন ফুট লম্বা। একটা বাঁশের লাঠির মাথায় তলোয়ারটা বেঁধে লম্বা করে নিয়ে বর্শা বানিয়ে ফেলল মুসা। বাঁশের গাঁট ছিদ্র করার কাজে লাগল সেটা।

সাংঘাতিক শক্ত তলোয়ার মাছের তলোয়ার। একবার একটা মাছ তলোয়ার দিয়ে পালাউ ল্যাণ্ডনে একটা মোটর বোটের তলা ফুড়ে দিয়েছিল। শুধু তাই না, বোটের তলা ফুটো করে ধাতব পেট্রল ট্যাঙ্কে ঢুকে গিয়েছিল ওটার চোখা তলোয়ারের মাথা।

ছয় ফুট লম্বা তিনটে বাঁশের বোতল তৈরি হয়ে গেল। পানি বয়ে নেয়ার আর ভাবনা নেই। বোতলগুলোতে পানি ভরে নিয়ে কাণ্ড-কাটা ছিপি দিয়ে বন্ধ করে দেয়া হল ওগুলোর মুখ।

যাক, পানির অভাবে আর মরছি না, বলল কিশোর।

ঢেউয়ে ভেসে এসে যে শুধু পাকা বাশ ঠেকেছে তাই না, চারাও জল বাঁশের। আগে থেকেই ছিল ওগুলো দ্বীপে। ঝড়ে উপড়ে নষ্ট হয়ে গিয়েছিল ঝাড়টা। কিছু শেকড়-বাকড় রয়ে গিয়েছিল, হয়ত ওগুলো থেকেই চারা গজিয়েছে। দিনে প্রায় এক ফুট করে বাড়ছে ওগুলো। বাঁশের কেঁাড় খুব ভাল তরকারি। নরম থাকতে থাকতেই ওগুলো কেটে নেয়া হল। ভেলায় করে পাড়ি জমানর সময় খাওয়া যাবে।

বাহ, এখন আমাদের সুদিন, হাসতে হাসতে বলল মুসা। যখন নামলাম, ছিল মরুভূমি। এখন দেখি সব রকমের খাবার জোগাতে আরম্ভ করেছে দ্বীপটা।

রান্নার পাত্রও জোগাল ওদেরকে বাঁশ। ভেতরে পানি ভরে ফুটানো যায়। বাঁশটা পোড়ে না। শুধু তাই না, বাঁশের ভেতর ভরে খাবারও নেয়া যাবে।

তলোয়ার মাছের মাংস ফালি করে কেটে রোদে শুকাল ওরা। নোনাও করা যায়, কিন্তু পদ্ধতিটা জানে না ছেলেরা। কুমালো বলে দিল। সাগরের নোনা পানি এনে রেখে দিতে হবে পাথরের গর্তে। রোদে বাম্প হয়ে উড়ে যাবে পানি। নিচে জমে থাকবে লবণের হালকা আন্তর। লবণও পাওয়া গেল, নোনাও করা গেল মাছের মাংস।

মুক্তার জন্যে ঝিনুক তুলেছে ওরা। কুমালোর দেখাদেখি ঝিনুকের মাংস খেতে আরম্ভ করেছে। স্বাদ না থাকুক, প্রােটিন তো পাওয়া যায়, জীবন বাঁচে। কিন্তু বড় বেশি পচনশীল। একটু রোদেই পচতে শুরু করে। অনেক কায়দা-টায়দা করে শুকিয়ে নিল কিছু ঝিনুকের মাংস। বাঁশে ভরে রাখল। সাগর পাড়ির সময় নেহায়েত ঠেকায় না পড়লে খাবে না।

সাগরের শ্যাওলা তুলেও শুকিয়ে সংরক্ষণ করা হল খাবার হিসেবে।

এই জিনিস কে খায়? নাক কুঁচকাল রবিন। একেবারে শুকনো খড়।

কুমালো জানাল, স্বাদ যা-ই হোক, ভিটামিন আছে। প্রাচ্যের লোকেরা নাকি বেশ পছন্দ করে।

ফিরে আসতে শুরু করেছে পাখিরা। ইতিমধ্যেই চলে এসেছে কিছু। তার মধ্যে রয়েছে ভাড় নামে পরিচিত মেগাপড় পাখি। ওড়ার গতি খুবই সুখ, পাথরের ওপর দিয়ে হাঁটতেও পারে না ভালমত। মানুষকেও ভয় করতে শেখেনি। দুটো পাথর নিয়ে ঠুকতে শুরু করল কুমালো। আজব কোন কারণে ওই শব্দ শুনে লাফাতে লাফাতে দৌড়ে এল পাখিটা।

সহজেই ওটাকে ধরে ফেলল সে। পালক ছাড়িয়ে, কেটে, আগুনে ঝলসে

ওটাকে রেখে দেয়া হল ভেলায় খাবার জন্যে।

আঁচড়ানর শব্দে একরাতে ঘুম ভেঙে গেল মুসার। কী, দেখার জন্যে হামাগুড়ি দিয়ে তাঁবু থেকে বেরিয়ে এল সে। বিরাট একটা গোল পাথর বুকে হেঁটে চলেছে। পানির দিকে। চমকে উঠল সে। প্রথমেই মনে হল, ভূত! চেঁচিয়ে উঠতে যাবে, এই সময় চিনে ফেলল, কচ্ছপ। সাগরের কাছিম। বিশাল। দুশো পাউণ্ড খুব ভাল মাংসের ভাঁড়ার। নিশ্চয় ডিম পাড়ার জন্যে তীরে উঠেছিল, আঁচড়ের শব্দের ব্যাখ্যা এটাই।

এতগুলো মাংস ল্যানে হারিয়ে যেতে দেয়া যায় না। দৌড় দিল মুসা। আঁপিয়ে এসে পড়ল কাছিমের পিঠে। পাত্তাই দিল না জীবটা। আগের মতই গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে চলেছে। পাথরের খাঁজে পা ঢুকিয়ে দিয়ে ওটাকে আটকানর চেষ্টা করল সে। টেনে সহজেই তার পা ছাড়িয়ে নিল ওটা।

লাফিয়ে পিঠ থেকে নেমে পড়ল মুসা। উল্টে ফেলার চেষ্টা করল ওটাকে। বেজায় ভারি। একার সাধ্যে কুলাল না। সাহায্যের জন্যে চিৎকার শুরু করল।

কিশোর আর রবিন বেরিয়ে এসে সাহায্য করার আগেই ল্যাগুনের পানিতে নেমে পড়ল কাছিমটা।

কিন্তু এত সহজে ছাড়ার পাত্র নয় মুসা। কাছিমের পিঠে চড়ে বসল। টেলিভিশনে দেখেছে, কিভাবে পলিনেশিয়ান ছেলেরা কাছিমের পিঠে চড়ে পানিতে ঘুরে বেড়ায়।

গলাটা যেন রাবারের তৈরি। তার ঠিক নিচে শক্ত খোলার কিনার আঁকড়ে ধরল সে। চিত হয়ে গিয়ে শরীরের ভার দিয়ে উল্টে ফেলার চেষ্টা করল ওটাকে।

ওল্টাল না কাছিমটা, তবে ডুবও দিতে পারল না। সাঁতরে চলল ওপর দিয়ে।

সোজা এগিয়ে চলেছে সরু চ্যানেলের দিকে, যেখান দিয়ে সাগরে বেরোনো যায়। দ্রুত ভাবনা চলেছে মুসার মাথায়। সাগরে বেরিয়ে গেলে আর কিছু করতে পারবে না। যা করার এখনই করতে হবে। কি করবে? পেছনের একটা পা চেপে ধরবে? তাহলে হয়ত সাঁতরাতে অসুবিধে হবে কাছিমের।

পাশে কাত হয়ে হাত বাড়িয়ে পেছনের ডান পা-টা চেপে ধরল সে। ধরে রাখল শক্ত করে যাতে নাড়তে না পারে কাছিমটা।

অন্য তিনটা পা ব্যবহার করছে ওটা। ফলে সামনের দিকে না এগিয়ে এক জায়গায় ঘুরতে শুরু করল কাছিম। মুখটা সৈকতের দিকে ফিরতেই পা ছেড়ে দিল মুসা। সঙ্গে সঙ্গে ওই পা ব্যবহার শুরু করল জীবটা। এগিয়ে চলেছে এখন সৈকতের দিকে।

রবিন আর কিশোরকে দেখতে পাচ্ছে মুসা, কুমালোকেও। হৈ চৈ শুনে। বেরিয়েছে।

দাঁড়াও, মাংস নিয়ে আসছি, চেঁচিয়ে বলল গোয়েন্দা সহকারী।

কিন্তু সাগরের কাছিমও, সহজে পরাস্ত হতে চাইল না। মুসাকে পিঠ থেকে ফেলে দেয়ার সব রকম চেষ্টা চালাল। একবার এদিকে ঘুরে যাচ্ছে, আরেকবার ওদিকে। বার বার পেছনের পা চেপে ধরে ওটাকে সঠিক দিকে এগোতে বাধ্য করছে মুসা। এরকম করতে গিয়ে একসময় হাত ছুটে গেল গলার কাছ থেকে। ব্যস, চোখের পলকে ডুব দিল কাছিম। এক ডুবে নেমে এল ছয়-সাত ফুট। গলা চেপে ধরে টেনে আবার ওটাকে ওপরে উঠতে বাধ্য করল মুসা।

সৈকতের ধারে চলে এল কাছিমটা। পানিতে নেমে মুসাকে সাহায্য করল রবিন আর কিশোর কুমালোও করল, যতটা পারল। আরেকটু হলেই তার ভাল পা-টায় কামড়ে দিয়েছিল কাছিম। দাঁত বসাতে পারলে এক কামড়ে অনেকখানি মাংস তুলে ফেলত।

রাখ, করছি ব্যবস্থা, ছুরি বের করল কিশোর।

মাথা ঝাঁকাতে শুরু করল কাছিমটা। অনেক বয়েস হয়েছে। রবারের মত চামড়ায় ভাঁজ। মনে হচ্ছে যেন রেগে গিয়ে মাথা নাড়ছে একজন বুড়ো মানুষ।

মের না, দাদাকে মের না। বাধা দিল রবিন। জ্যান্ত রাখব ওটাকে। ভেলায় করে আমাদের সঙ্গে নিয়ে যাব। তাজা মাংসের দরকার হলে তখন জবাই করতে পারব।

ঠিক, একমত হল কুমালো। একটা কাঠি দিয়ে বালিতে খোঁচা মারছে। তবে ওটা দাদা নয়, দাদী। এই যে দেখ, ডিম পেড়ে রেখে গেছে।

ফুটখানেক গভীর একটা গর্তে প্রায় একশো ডিম পেড়েছে কাছিমটা।

সবাই মিলে টেনেটুনে কাছিমটাকে ডাঙায় তুলল। তারপর ঠেলে চিত করে ফেলল। আর সোজাও হতে পারবে না, পালাতেও পারবে না।

হাসিমুখে ডিমগুলোর দিকে এগিয়ে গেল মুসা। একটা ডিম তুলে নিল। ড্রারে, অবাক কাণ্ড! ভেবেছিল, মুরগী কিংবা হাঁসের ডিমের খোসার মতই শক্ত হবে, তা নয়। নরম, রবারের বলের মত।

ভাঙব কিভাবে? কুমালোক জিজ্ঞেস করল সে।

দাঁত দিয়ে এক জায়গায় কেটে ফেল। কাটা জায়গা মুখে লাগিয়ে চাপ দাও, ভেতরের জিনিস মুখে ঢুকে যাবে। কাঁচা খাওয়া যায়। তবে সিদ্ধ করে নিলে বেশি মজা লাগবে। এগুলোও নিয়ে যেতে পারব ভেলায় করে।

দাদীমাকে তুলে এনে একটা নারকেল কাণ্ডের সঙ্গে গলায় দড়ি দিয়ে বাঁধল ছেলেরা।

ভোর হল। আলোচনা করে একমত হল অভিযাত্রীরা, যথেষ্ট খাবার জোগাড় করা গেছে। এবার রওনা হওয়া যায়।

তাঁবুর ওপর থেকে হাঙরের চামড়াটা নামিয়ে দুই টকুরো করল ওরা। একটা দিয়ে পাল হবে, আরেকটা দিয়ে কুঁড়ের চালা।

পাল তোলার কাছি হিসেবে ব্যবহার করা হল স্কুইডের চামড়া। বাঁশ পেয়েছে, কাজেই পাল বানাতে অসুবিধে হল না।

কেবিনটা অতি সাধারণ। তিনটে বাঁশের টুকরো কেড়ে ধনুকের মত বাঁকা করে আটকে দেয়া হল ভেলায়। ফাঁক ফাঁক করে বসানো হয়েছে ধনুক তিনটে। তার ওপর ছড়িয়ে দেয়া হল চামড়াটা। কোণাগুলো বেঁধে দেয়া হল চামড়ার দড়ি দিয়ে, যাতে বাতাসে উড়ে যেতে না পারে। নৌকার ছইয়ের মতই দেখতে হল জিনিসটা। পাঁচ ফুট চওড়া, তিন ফুট উঁচু। নিচু হওয়ায় সুবিধে, ঝড়ো বাতাসেও উড়িয়ে নেবে না সহজে। লম্বায় হয়েছে আট ফুট। চারজনের জায়গা হয়ে যাবে। আর যেহেতু সামনে পেছনে খোলা, গলুইয়ে চোখ রাখতেও অসুবিধে নেই।

ডিমগুলো সিদ্ধ করে নেয়া হল। তারপর দাদীমাকে ভেলায় তুলে মাস্তুলের সঙ্গে বাঁধা হল শক্ত করে, ছুটতে পারবে না।

যাবার জন্যে তৈরি সবাই। বিষণ্ণ চোখে পরিত্যক্ত ঘরটার দিকে তাকাল ওরা, পুরো দুটো হপ্তা কাটিয়েছে এখানে। ফেলে যেতে এখন মায়া লাগছে। ভেলায় চড়ে সাগরে পাড়ি দেয়ার অনিশ্চয়তায় কাঁপছে বুক।

ঢেউ আর বাতাসের করুণার ওপর নির্ভর করতে হবে ওদের। যাওয়ার চেষ্টা করবে দক্ষিণে। কিন্তু সহজেই পথ ভুল করতে পারে। ঘুরে যেতে পারে উত্তর, পুব কিংবা পশ্চিমে। বাতাসের চাপ কতক্ষণ সহ্য করতে পারবে ওদের পলকা পাল কে জানে! আর দাঁড়ও তেমন মজবুত নয়। স্রোতের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে টিকবে?

চেঁচামেচি করে আর গান গেয়ে ভয় ভুলে থাকার চেষ্টা করল ওরা।

ভেলাটার একটা নাম রাখা দরকার, রবিন বলল। কি নাম, বলত?

কিশোর, তুমি বল, মুসা বলল।

আশা। কারণ এখন আশা ছাড়া আর কি করতে পারি আমরা।

ল্যাগুনে ভেলা ভাসাল চার নাবিক। চড়ে বসল তাতে। দাঁড় বেয়ে এগিয়ে চলল চ্যানেলের দিকে।

বাহ, ভালই তো ভাসছে,মন্দব্য করল কুমালো।

নাকও সোজা রাখছে, বলল কিশোর। নারকেল গাছের সরল মসৃণ কাণ্ডকে আরেকবার ধন্যবাদ জানাল সে। বেশ সোজা হয়েছে। কাত হয়ে যাবার প্রবণতা নেই।

নাহ, সত্যিই ভাল হয়েছে, দাঁড় বাইতে বাইতে বলল মুসা।

পাল নামিয়ে রাখা হয়েছে। চ্যানেল পেরোনর পর তারপর তোলা হবে। দাঁড় বেয়ে ভারি ভেলাটাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে যথেষ্ট পরিশ্রম হল চারজনের।

পনেরো মিনিট পর অবশেষে বের করে আনা হল ওটাকে। ভোলা সাগরে বেরোনর আনন্দেই যেন ঢেউয়ের বুকে দুলে দুলে নাচতে আরম্ভ করল আশা।

যাত্রার প্রথম দুদিন এত নির্বিঘ্নে কাটল, যাত্রা শুরুর আশঙ্কার আর বিন্দুমাত্র অবশিষ্ট রইল না অভিযাত্রীদের মাঝে।

বাতাসের গতি অপরিবর্তিত রইল, উত্তর-পুব দিক থেকে বইছে, ওরা চলেছে সোজা দক্ষিণে। এই গতি অব্যাহত রাখতে পারলে দিন কয়েকই পোনাপেতে পৌঁছে যাবে ওরা। আর কোন কারণে যদি দ্বীপটার কাছ থেকে সরে আসে, তাহলেও ভাবনা নেই, সীমার রুটে গিয়ে পড়বে। মারশাল আইল্যাণ্ড থেকে কুসাই, ট্রাক, পোনাপে আর ইয়্যাপেতে জাহাজ চলাচল করে। কোন না কোন জাহাজের দেখা পাবেই। কারণ ওই পথ ধরে অনেক মাছধরা জাহাজও চলাচল করে।

দিনের বেলা সূর্য ওদের কম্পাস, রাতে তারা। দাঁড় দিয়ে হলের কৃাজ চালায়। পালা করে ডিউটি দেয়। ক্রোনোমিটার নেই, সময়ও নির্ধারণ করে সূর্য আর তারা দেখে।

প্রতিটি কাণ্ডের ফাঁক দিয়েই ছলকে ওঠে পানি, ফলে সারাক্ষণই কিছুটা ভেজা থাকতে হচ্ছে ওদেরকে। তবে গরমের মধ্যে ওই ভিজে থাকাটা বরং আরামদায়ক। দিনের বেলা কড়া রোদ। অসুবিধে হয় না ওদের। সহ্য না হলে ঢুকে বসে থাকে ছইয়ের ভেতর।

বাঁশের বোতলে পানি ভরা আছে। নিচ থেকে ছলকে ওঠা, সাগরের পানি সারাক্ষণ ভিজিয়ে রাখছে বাঁশগুলোকে, ফলে ভেতরের পানি বেশ ঠাণ্ডা থাকছে। খাবার দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। তবে ভাবনা নেই, দাদীমা আছে। আর তেমন ঠেকায় পড়লে মাছও ধরতে পারবে।

ভেলার আশেপাশে খেলে বেড়ায় ডলফিনের দল। শরীরের রঙ উজ্জ্বল নীল কিংবা সবুজ, পাখনার রঙ হলুদ-রোদ লাগলে সোনালিই মনে হয়। ক্যামেলিয়ন। আর অক্টোপাসের মতই রঙ বদলাতে পারে ওরা। মাঝে মাঝেই হয়ে যায় চকচকে তামাটে। লাফালাফি করতে গিয়ে সেদিন ভেলায় এসে পড়ল একটা। আর নামতে পারল না। মৃত্যুর পর রঙ বদলে ধূসর-রূপালি হয়ে গেল, তার ওপর কালো কালো। দাগ।

তিন দিনের দিন আশাকে পরীক্ষা করতে এল মস্ত এক তিমি। সোজা এগিয়ে এল ভেলার দিকে, থেকে থেকেই ফোঁস ফোঁস করে পানির ফোয়ারা ছিটাল মাথার ওপরের ফুটো দিয়ে। ভয়ে প্রায় দম আটকে বসে রইল অভিযাত্রীরা। ইচ্ছে করলেই ভেলার বারোটা বাজিয়ে দিতে পারে ষাটফুটি দানবটা।

লেজের মাত্র একটা ঝাপটা, বলল উদ্বিগ্ন ররিন। ব্যস, তারপরেই আশা একেবারে নিরাশা।

ভেলাটাকে ঘিরে দুবার চক্কর মারল তিমি। তারপর লেজটাকে খাড়া ওপরের দিকে তুলে দিল ডুব। লেজ ডুবে যাওয়ার সময় এত বেশি পানি ছিটাল, অভিযাত্রীদের মনে হল এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেল তাদের ওপর।

প্রচণ্ড আলোড়ন উঠল পানিতে। ভীষণ কেঁপে উঠল ভেলা, দুলতে শুরু করল।

সর্বনাশ! চেঁচিয়ে উঠল মুসা। গোড়ালির ওপরে পানি উঠে গেছে। এই গেলাম!

তবে নৌকার তুলনায় একটা বিশেষ সুবিধে রয়েছে ভেলার। তলা নেই, কাজেই পানি জমা হয় না, ওপর দিয়ে গড়িয়ে চলে গেল, কিছু নেমে গেল ফাঁক দিয়ে।

ভেলার নিচ দিয়ে পেরিয়ে গিয়ে আবার ভউস করে আসল তিমি, আরেকবার নাকানি-চোবানি খাওয়াল ভেলাটাকে। কাঁধের ধাক্কায় আরেকটু হলেই ছিঁড়ে ফেলেছিল পাশের একটা কাণ্ডের বাঁধন।

আরও কিছুক্ষণ অভিযাত্রীদের আশঙ্কার মধ্যে রেখে অবশেষে ভু আর ভাসল না। দেখা দিল না আর একবারও।

তিমির কাঁধের ধাক্কায় ঢিল হয়ে গেছে কাণ্ডটার বাঁধন। তাড়াতাড়ি আবার সেটাকে শক্ত করল ওরা।

সেদিন সকাল থেকেই বাতাস পড়ে গেছে। ঝিরঝিরে বাতাসে পালের কোনা দুপাত ছপাত করে বাড়ি খাচ্ছে মাস্তুলের সঙ্গে। ঢেউ নেই। বাতাস না থাকায় দশগুণ বেশি হয়ে গেছে রোদের তেজ। সাগর যেন একটা মসৃণ চকচকে আয়না।

আনমনে মাথা নেড়ে বিড়বিড় করল কুমালো, ব্যাপার সুবিধের মনে হচ্ছে। হঠাৎ এরকম বাতাস পড়ে যাওয়ার মানে বিপদ।

কিন্তু আকাশে মেঘ নেই। শুধু পুবদিকে বহুদূরে কালো একটা স্তম্ভের মত দেখা যাচ্ছে, পানিতে দাঁড়িয়ে আছে যেন আকাশে মাথা তুলে।

খানিক পরে উত্তরে দেখা দিল ওরকম আরেকটা।

জলস্তম্ভ, কুমালো বলল। প্রশান্ত মহাসাগরের এদিকটায় খুব বেশি দেখা যায় ওগুলো।

বিপজ্জনক? মুসা জানতে চাইল।

কখনও কখনও, জবাবটা দিল রবিন। ডাঙায় যেমন বালির ঘূর্ণি ওঠে, অনেকটা ওরকম। তবে পানিরগুলো অনেক বড়, উদ্বিগ্ন চোখে দিগন্তের দিকে তাকিয়ে আছে সে। এই ছোট ছোটগুলো আগাম সঙ্কেত, বুঝিয়ে দিচ্ছে বড়টাও আসবে। টর্নেডোর মতই। বলা যায়, সাগরের টর্নেডো।

ডাঙার টর্নেডো তো ঘরবাড়িই উড়িয়ে নিয়ে যায়, কিশোর বলল।

যায়, বলল কুমালো। সাগরেরগুলোও কম না। একটু পরেই দেখতে পাবে। উত্তর-পূর্ব দিকে তাকিয়ে আছে সে।

তার দৃষ্টি অনুসরণ করে অন্যরাও তাকাল।

তাদের চোখের সামনেই জমে উঠল কালো মেঘ, তিন হাজার ফুট উঁচুতে। এমন ভাবে দোমড়াচ্ছে মোড়াচ্ছে, যেন জীবন্ত এক দানব। ওটা থেকে স্কুলে রয়েছে লম্বা একটা লেজের মত।

পলিনেশিয়ানরা এর নাম দিয়েছে আকাশের দানব। এ-সম্পর্কে অনেক কুসংস্কার আছে ওদের।

কালো জমাট বাঁধা মেঘটার মাঝে ঝিলিক দিচ্ছে বিদ্যুৎ।

হ্যারিক্যানের মত খারাপ নয় নিশ্চয়, আশা করল মুসা।

আরও বেশি খারাপও হতে পারে, কুমালো বলল। তবে থাকে না বেশিক্ষণ। আর হারিনের মত এত জায়গা জুড়ে আসে না। হারিক্যান আসে পাচ-ছয়শো মাইল জুড়ে, আর এটা বড়জোড় দুতিন হাজার ফুট। তবে ছোট হলে হবে কি, ভয়ঙ্কর আঘাত হানতে পারে। আমাকে জিজ্ঞেস করলে বলব এরচে হারিক্যান ভাল।

কিছু একটা করার জন্যে অস্থির হয়ে উঠেছে কিশোর। সরে যেতে পারি না, আমরা? এখানে থেকে কি ওটার খাবলা খেয়ে মরব? বলেই ছপাত করে দাঁড় ফেলল পানিতে।

অযথা শক্তি খরচ কোরো না। কোন দিক দিয়ে যে যাবে কিছুই বলা যায় না। দাঁড় বেয়ে সরে বাঁচতে গিয়ে হয়ত আরও ভেতরেই পড়ব। চুপচাপ এখন বসে বসে শুধু আশা করা ছাড়া আর কিছু করার নেই।

প্রতিমুহূর্তে লম্বা হচ্ছে দানবটার লেজ। এখন দেখে মনে হচ্ছে লম্বা ঔড় বাড়িয়ে দিয়ে সাগর ছোঁয়ার চেষ্টা করছে কোন অতিকায় অক্টোপাস।

আশ্চর্য রকম স্তব্ধ হয়ে আছে বাতাস। নড়ে না চড়ে না, একদম স্থির। অথচ কানে আসছে ছুটন্ত বাতাসের ভয়ঙ্কর গর্জন।

শুঁড়টা সাগর ছুঁয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে আলোড়ন উঠল ওখানকার পানিতে। শাঁ শাঁ করে শূন্যে উঠে যেতে লাগল পানি, ফোয়ারার মত।

ঘূর্ণি জেগেছে পানিতে। বাতাসের পাকের টানে ওপরের দিকে উঠে যাচ্ছে পানি, মনে হচ্ছে, পানির মোটা একটা স্তম্ভ রচনা করছে। প্রচণ্ড বাতাস বইছে ওখানে, অথচ ভেলার কাছে একরত্তি নেই। একটা নিঃশ্বাস পর্যন্ত ফেলছে না, এখানে বাতাস।

ডাঙার টর্নেভোরও এই একই ধর্ম। একটা বাড়ি হয়ত উড়িয়ে নিয়ে গেল খড়কুটোর মত, ঠিক দশ ফুট দূরেই আরেকটা ঘর রইল একেবারে অক্ষত।

আমাদের কাছে আসবে না, বলল সে।

হয়ত, বলল বটে, তবে ততটা আশাবাদী হতে পারল না কুমালো।

পাল নামিয়ে ফেলব?

লাভ হবে না। নিতে চাইলে নিয়ে যাবেই। নামিয়ে রাখলেও নেবে, উঠিয়ে রাখলেও নেবে।

দানবটার দয়ার ওপর পুরোপুরি নির্ভর করতে হবে, এই ভাবনাটাই অস্বস্তিকর। কিছু একটা করতে পারলে এতটা খারাপ লাগত না। হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকতে হবে। কিছুই করার নেই।

দেখার মত দৃশ্য। তিন হাজার ফুট উঁচু এক পানির স্তম্ভ। মাথাটা গোল হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে মেঘের মত, নিচটা শ আকৃতির। মাঝখানে সরু একটা স্তম্ভ যোগাযোগ রক্ষা করেছে দুটোর।

গতিবেগ দুশো মাইলের কম, না! চেঁচিয়ে বলল কিশোর। কিন্তু বাতাসের প্রচণ্ড গর্জনে ঢাকা পড়ে গেল তার কথা।

ঘুরে ঘুরে ছুটে আসছে শুটা। একবার এদিকে সরে যাচ্ছে, একবার ওদিকে। কোনদিকে যাবে যেন মনস্থির করতে পারছে না।

রোদের মধ্যে উড়ছিল একটা গাংচিল। হঠাৎ হ্যাঁচকা টানে ওটাকে ভেতরে নিয়ে গেল পানির স্তম্ভ, চোখের পলকে কোথায় যে হারিয়ে গেল ওটা, বোঝাই গেল না।

সরে যেতে যেতেও হঠাৎ গতিপথ বদল করে কাছে চলে এল দানবটা। একটানে যেন ছোঁ মেরে তুলে নিয়ে গেল ভেলার ছাউনি আর পাল। ডেকে উপুড় হয়ে পড়ে কাণ্ড আঁকড়ে ধরে রইল অভিযাত্রীরা।

মলিন হয়ে এল দিবালোক। চোখের সামনে শুধু পানি আর পানি। কানফাটা গর্জন। কানে আঙুল ঢোকাতে বাধ্য হল ওরা। বনবন করে ঘুরতে শুরু করেছে ভেলাটা।

হ্যাঁচকা টানে ছিঁড়ে গেল দাদীমার বাঁধন। চোখের পলকে সাগরে পড়ে অদৃশ্য হয়ে গেল কাছিমটা।

চোখ বন্ধ করে পড়ে রইল অভিযাত্রীরা।

তারপর কোথা দিয়ে যে কি ঘটে গেল, বুঝতেই পারল না ওরা। হঠাৎ নিজেদেরকে আবিষ্কার করল পানির মাঝে। চারপাশে পানি, ওপরে পানি, নিচে পানি। মাথার ওপরে একটা হাঙরকে দেখতে পেল খাবি খাচ্ছে। তবে কি ডুবে গেছে ওরা?

হঠাৎ কাত হয়ে গেল ভেলাটা। মুহূর্ত পরে কিশোর দেখল, সে একা একটা কাণ্ড আঁকড়ে ধরে আছে, অন্যেরা নেই। ভেলাটাও নেই।

আরও কয়েক সেকেণ্ড পর দেখল, সাগরে ভাসছে সে। সরে যাচ্ছে দানবটা। কি ঘটেছিল বুঝতে পারল। ওদের ওপর সরাসরি এসে পড়েনি জলস্তম্ভ, পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। যাবার সময় টান দিয়ে তুলে নিয়েছিল ভেলাটাকে। হাঙরটাকে আসলে সাগরের তলায় নয়, পানির স্তম্ভের মাঝে দেখতে পেয়েছে সে। :

সাগরের পানি স্থির। দূরে সরে গেছে পানির স্তম্ভটা। একশো ফুট দূরে একটা বাদামী মাথা ভেসে উঠতে দেখা গেল। খানিক দূরে আরেকটা মাথা।

কুমালোও! রবিইন! চেঁচিয়ে ডাকল কিশোর। মুসা কোথায়?

তোমার পেছনে, জবাব দিল রবিন।

পেছনে ফিরে তাকাল কিশোর। চল্লিশ ফুট দূরে ভাসছে মুসা। আরেকটা কাণ্ড আঁকড়ে ধরে রেখেছে।

কাছাকাছি হল চারজনে। দুটো কাণ্ডকে একসঙ্গে করে হেঁড়া দড়ির টুকরো যে কটা পাওয়া গেল, সেগুলো দিয়ে পেঁচিয়ে বাঁধল।

তারপর, বাকি কাণ্ডগুলো পাওয়া যায় কিনা খোঁজাখুঁজি শুরু করল।

তিন গোয়েন্দার সঙ্গে কুমালোও যোগ দিল। ভেলাটা যে জায়গায় ধ্বংস হয়েছে, সে জায়গাটা আন্দাজ করে নিয়ে চারপাশে তল্লাশি চালাল ওরা। কিন্তু আর একটা কাণ্ডও পাওয়া গেল না। কে জানে, হয়ত টেনে ওগুলোকে মাথার ওপরে তুলে নিয়ে চলে গেছে জলস্তম্ভ। দূরে কোথাও নিয়ে গিয়ে ফেলবে। মোট কথা, ওগুলো পাওয়ার আর কোন আশা নেই। যে দুটো পাওয়া গেছে, ওগুলোতেই সন্তুষ্ট থাকতে হবে।

রোদ নেই আর এখন। মাথার ওপরে কালো মেঘ। থেকে থেকে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। ঘন ঘন বাজ পড়তে শুরু করল। আকাশের দানব চলে গেছে, এবার আসবে বোধহয় ঝড়।

মেঘের মধ্যে যেন বোমা ফাটাতে শুরু করল বজ। নামল বৃষ্টি, মুষলধারে। তবে বেশিক্ষণ রইল না। জোরাল হল ওপরের বাতাস, উড়িয়ে নিয়ে গেল মেঘ।

বৃষ্টি থামলে আরও কিছুক্ষণ কাণ্ডগুলো খুঁজল অভিযাত্রীরা। পেল না। শেষে দুটো কাণ্ডের ওপর উঠেই কোনমতে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। চারজনের ভার বাইতে পারল না দুটো কাণ্ড, ডুবতে শুরু করল।

নেমে গেল মুসা। কাণ্ড ধরে ঝুলে রইল পানিতে। অন্যেরাও নেমে পড়ল। তার মত একই ভাবে ধরে ভেসে রইল। ঢেউ ভাঙছে মাথার ওপর। শ্বাস নিতে অসুবিধে হচ্ছে। পানি ঢুকে যেতে চায় নাকের ভেতর।

আশা এখন নিরাশায় পরিণত হয়েছে। বাঁশের বোতল আর খাবারগুলো গেছে ! পাল নেই, দাঁড় নেই, ছাউনি নেই, এমনকি নারকেল কাপড়ের পোশাকগুলোও নেই যে রোদ থেকে গায়ের চামড়া আর চোখ বাঁচাবে। দুটো মাত্র কাণ্ড, চারজনের ভর রাখতে পারে না, উঠে বসারও উপায় নেই। অন্ত্র বলতে আছে শুধু একটা করে ছুরি।

বার বার মুখ নামিয়ে পানির তলায় দেখছে রবিন। হাঙরের ভয় করছে। যেকোন মুহূর্তে হাজির হয়ে যেতে পারে ওগুলো। মুখ তুলে পানির ওপরেও খুঁজছে হাঙরের পিঠের পাখা, দূর থেকে পানি কেটে আসছে কিনা দেখছে।

তোমাদের কেমন লাগছে, জানি না, বলল সে। আমার অবস্থা কাহিল।

আহত পায়ের যন্ত্রণা অগ্রাহ্য করে হাসল কুমালো। বলল, এক কাজ কর। ভেলায় উঠে জিরিয়ে নাও খানিকক্ষণ। একজনের ভার সহজেই রাখতে পারবে এটা।

কুমালোর কথামত দুই কাণ্ডের ভেলায় উঠে চিত হয়ে শুয়ে পড়ল রবিন। খুবই বেকায়দা অবস্থা, কিন্তু এটাকেই মনে হল এখন গদির বিছানা।

অত ভাবনার কিছু নেই, শান্তকণ্ঠে বলল কুমালো। এখনও বেঁচে রয়েছি, আমরা! দুটো কাণ্ড আছে। চারটে প্যান্ট আছে। তিনটে ছুরি আছে। আর আছে তিনটে মুক্তো…..

চট করে পকেটের ওপর হাত বোলাল কিশোর। বলল, আছে।

বেশ। তাহলে ওগুলো জায়গামত পৌঁছে দেয়া এখন আমাদের দায়িত্ব। এক কাজ করতে হবে। ভেলায় উঠে একজন করে জিরাব আমরা। অন্য তিনজনে পেছন থেকে ঠেলে নিয়ে এগোব। সোজা দক্ষিণে। ঠিক আছে?

এতে খুব একটা লার্জ হবে বলে মনে হল না কারও কাছেই। তবু, চুপচাপ একজায়গায় ভেসে থেকে মরার চেয়ে কিছু করা ভাল। কুমালোর কথা মতই কাজ শুরু করল ওরা।

খুবই ধীর গতিতে আবার দক্ষিণে এগিয়ে চলল দুই কাণ্ডের আশা।

পালা করে ভেলায় উঠে বিশ্রাম নেয় ওরা। শক্ত কাণ্ডের ওপর শুয়ে থাকা, মুখের ওপর ঢেউ ভেঙে পড়া, মোটেই আরামদায়ক নয়। ঘন্টাখানেক পর সাগরে নেমে বরং আরামই লাগে।

আবার অনেকক্ষণ ধরে সাঁতার কেটে ভেলায় উঠতে পারলে সেটাও খানিকটা স্বস্তি।

তবে যতই সময় কাটতে লাগল এই আরাম আর স্বস্তি কোনটাই থাকল না।

দিনটা তো কাটল যেমন তেমন, রাতটা বড় বেশি দীর্ঘ মনে হল। ঘুমানো অসম্ভব! সারাক্ষণ জেগে থাকা, সতর্ক থাকা, ঢেউ এসে নাকে ঢোকে কিনা সে। খেয়াল রাখা, এক মহা বিরক্তিকর ব্যাপার। তন্দ্রা এলে, সামান্য অসতর্ক হলেই নাকেমুখে ঢুকে প্রায় শ্বাসরুদ্ধ করে দিতে চায় পানি।

তার ওপর রয়েছে জলজ জীবের ভয়। আতঙ্কিত করে রেখেছে ওদের। চেনাঅচেনা অদ্ভুত সব প্রাণী নিচ থেকে উঠে আসছে আজব ভেলাটাকে পরীক্ষা করে দেখতে। সাগরে এত প্রাণী আর কখনও দেখেনি ওরা।

সাগরে অবশ্য এত প্রাণীরই বাস। কিন্তু জাহাজে কিংবা নৌকায় থেকে সেগুলো খুব কমই দেখা যায়। ওপর থেকে বড়জোড় কিছু ডলফিন আর উড়ুক্কু মাছ, ব্যস। গভীর পানির জীবেরা দানবীয় জলযানের কাছে আসতেই ভয় পায়।

এমনকি দুই কাণ্ডের প্রায় ডুবো ডুবো ভেলার চেয়ে সাত কাণ্ডের ভাসমান। ভেলাটাও অনেক বেশি ভয়াল ছিল ওগুলোর কাছে। এ দুটোকে নিজেদের মতই কোন প্রাণী ভাবল বোধহয় মাছেরা, তাই দেখতে এল।

নিচে তাকালেই দেখা যায় অসংখ্য আলো। যেন ওপরের তারাজ্বলা আকাশের মতই নিচেও আরেকটা আকাশ রয়েছে।

বেশি দেখছে মুসা। ওই যে গেল একটা লণ্ঠন মাছ।…একটা তারাখেকো।…খাইছে! ওটা কি?

বিশাল দুটো চোখ অলস ভঙ্গিতে অনুসরণ করে চলেছে ভেলাটাকে। প্রায় এক ফুট ব্যাস, জ্বলছে, হলদে-সবুজ আলো।

ওটা আমাদের পুরানো দোস্ত, কিশোর বলল। জায়ান্ট স্কুইড।

কেঁপে উঠল রবিন। ও দোন্ত হতে যাবে কেন! শুঁড় বাড়িয়ে ধরবে না তো ব্যাটা?

ধরতেই পারে,মুসা বলল। থাক, এসব অলক্ষুণে কথা বল না। বল, ও খুব ভাল মানুষ, এখুনি চলে যাবে। বলে ভেলায় ঠেলার জোর কিছুটা বাড়াল সে।

পেছনে পড়ল চোখ দুটো।

উদয় হল আরও বিচিত্র একটা জীব। স্কুইডের চোখের মতই অনেকটা, জ্বলন্ত, আরও অনেক বড়। ওটার ব্যাস আট ফুটের কম না। রূপালি আলো বিচ্ছুরিত হচ্ছে। ভেলার একেবারে নিচে চলে এল ওটা। ছয় ফুট নিচ দিয়ে অনুসরণ করে চলল। মস্ত এক পূর্ণিমার চাঁদ যেন।

বোবা হয়ে গেছে যেন ছেলেরা। মুসার বাহুতে হাত রাখল কুমালো। কাপছে মুসা। অন্য দুজনের অবস্থাও ভাল নয়। চোখই যার এতবড়, সেই দানবটা কত বড়!

চোখ নয় ওটা, কুমালো বলল। ওটা চন্দ্র মাছ। চাঁদের মতই গোল আর জ্বলে তো, সেজন্যে ওই নাম।

গোল মাছ? মুসা বলল। যাহ, বানিয়ে বলছ, আমরা যাতে ভয় পাই।

না, বানিয়ে বলছি না। মাথাটা দেখতে পাচ্ছি আমরা।

তাহলে বাকি শরীরটা কোথায়?

বাকি কোন শরীর নেই। মাথা ছাড়া আর কিছু নেই ওটার। সেজন্যেই অনেকে বলে মাথা মাছ। আরও একটা নাম আছে ওটার, সূর্য মাছ। দিনের বেলা, প্রায়ই ভেসে থেকে রোদ পোয়ায় তো।

মাথা ছাড়া আর কিছু নেই? বিশ্বাস করতে পারছে না মুসা।

থাকে, ছোট বেলায়। লেজ। ধীরে ধীরে খসে যায় ব্যাঙের পোনার মত। আসলে মাথা ঠিক নয় ওটা, পুরো শরীরটাই। ওটার ভেতরেই রয়েছে ওর পেট আর শরীরের অন্যান্য যন্ত্রপাতি। সাঁতার কাটার জন্যে পাখনাও আছে।

বেশ বড়। ওজন নিশ্চয় টনখানেকের কম না।

হ্যাঁ। আরও বড় হয়। মাঝে মাঝে ক্যানুর তলা ঠেকে যায় পানির নিচে ভেসে থাকা মাথা মাছের গায়ে। মনে হয় ডুবো চরায় লেগেছে।

কয়েক মিনিট ধরে ভেলাটাকে অনুসরণ করল সাগরের চাঁদ। ওটা থাকতে থাকতেই এল চারটে সাপের মত জীব। রক্ত ঠাণ্ডা করে দেয়া চেহারা। ওগুলোর আলো নেই, চাঁদ মাছের আলোয় দেখা গেল কুৎসিত ভঙ্গিতে শরীর মোচড়াচ্ছে। আট-দশ ফুট লম্বা, মানুষের উরুর সমান মোটা।

সাপ নাকিরে বাবা? মুসা বলল।

না, মোরে, ছুরি বের করল কুমালো। এক ধরনের বান মাছ। এ-ব্যাটাদের ব্যাপারে হুঁশিয়ার। সব খায়। মানুষের মাংসেও অরুচি নেই।

হারামী জীব! বিড়বিড় করে বলল কিশোর।

হ্যাঁ, রবিন বলল। বইয়ে পড়েছি, প্রাচীন রোমানরা নাকি মোরে ইল পুষত, এক পুকুরে অনেকগুলো। রোজ সকালে ওগুলোর নাস্তার জন্যে জ্যান্ত মানুষ ফেলে দিত পুকুরে। যুদ্ধবন্দী কিংবা গোলামদের।

হাতে ছুরি নিয়ে সতর্ক দৃষ্টিতে পানির নিচে তাকিয়ে আছে কুমালো। আমরা ওদেরকে বলি ক্যামিচিক। অর্থাৎ ভয়ানক জীব। ব্যাটারা উভচর। গাছ বেয়ে ওপরে উঠে সাপের মত ওত পেতে থাকে। নিচে দিয়ে শিকার গেলে ঝাঁপিয়ে পড়ে তার ওপর। পোনাপৈতে একবার একজনকে কামড়ে দিয়েছিল একটা মোরে। সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে নেয়ার পরেও বাঁচেনি লোকটা, দুদিন পর মারা যায়।

ভেলার নিচ দিয়ে কয়েকবার আসা-যাওয়া করল ওগুলো। কুমালাৈর মত মুসাও ছুরি বের করে তৈরি হয়ে আছে।

ভেলায় এসে উঠবে না তো? জিজ্ঞেস করল সে।

উঠতেও পারে। অনেক সময় নৌকায়ই উঠে পড়ে চুরি করে। ওঠার সময় লেজটাকে কাজে লাগায় ওরা। দুনিয়ার বেশির ভাগ প্রাণীই আক্রান্ত না হলে হামলা করে না। কিন্তু মোরের ওসব দ্রতা নেই। অযথাই লাগতে আসে। এক ইঞ্চি লম্বা দাঁতের সারি, ছুরির মাথার মত চোখা আর ধারাল।

ছুরির বাঁট শক্ত করে চেপে ধরল মুসা। আসুক। প্রথম যে ব্যাটা আসবে, মুণ্ড কেটে ফেলব।

তাতে আরও খারাপ হবে। রক্তের গন্ধে হাজির হয়ে যাবে হাঙর। তাছাড়া ঘাড়ের চামড়া সাংঘাতিক শক্ত ওগুলোর। সহজে কাটবে না। তবে লেজের চামড়া নরম।

চলে গেল একটা বান। খানিক পরেই আলতো ছোঁয়া লাগল মুসার পিঠে। সে ঘাড় ফেরার আগেই ছুরির বাঁট দিয়ে গায়ের জোরে বাড়ি মারল কুমালো।

যাক, বলল সে। এই একটা আর জ্বালাতে আসবে না।

মুহূর্ত পরেই এল আরেকটা। মুসার প্রায় মুখে লেজ বুলিয়ে গেল। তার দিকেই বানগুলোর নজর কেন, বোঝা গেল না। পিঁপড়েরাও তার প্রতিই বেশি আকৃষ্ট হয়। আমাজানের জঙ্গল আর আফ্রিকাতেও সেই প্রমাণ পাওয়া গেছে। এখন শুরু করেছে। বান মাছগুলো। কাণ্ডের ওপর দিয়ে সাপের মত গড়িয়ে এল লেজ, আলতো ছোঁয়া লাগল মুসার মুখে। তারপরই উঠে এল মোটা শরীরটা, কুৎসিত মুখটা এগিয়ে আসছে নিঃশব্দে। হাঁ করা চোয়ালে তীক্ষ্ণ দত। তারার আলোয় অস্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। কুমালোর মতই ছুরি দিয়ে লেজে বাড়ি মারল মুসা। যন্ত্রণায় মোচড় দিয়ে উঠল বানের শরীর, লাফ দিয়ে নেমে গেল পানিতে।

চন্দ্র মাছের কাছে আর কোন সর্পিল ছায়াকে চোখে পড়ল না।

দুর্বল লাগছে মুসার। বান মাছগুলো আতঙ্কিত করে দিয়েছে তাকে, কাহিল। লাগছে সে-জন্যেই। ভেলায় উঠে শুয়ে পড়ল। ঘুম এসে গেল সঙ্গে সঙ্গে, কিন্তু পরমুহূর্তেই জেগে উঠল নাকে-মুখে পানি ঢুকে যাওয়ায়।

সবাই বুঝল, এখন ঘুমাতে না পারলে হয়ত মাথাই খারাপ হয়ে যাবে মুসার।

ওঠ, উঠে বস, কুমালো বলল। ঘোর। আমার কাঁধে মাথা রাখ…হ্যাঁ, ঘুমাও এবার।

তর্ক করতেও ইচ্ছে হল না মুসার। কুমালোর কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ল। ঢেউ এখন আর তার নাক ছুঁতে পারছে না।

বাতাস বাড়ছে। শীত করতে লাগল ওদের। ভোরের দিকে অসহ্য হয়ে উঠল ঠাণ্ডা। দিগন্তে সূর্যের আগমনে তাই খুশি হল খুব। তরে ঘন্টাখানেকও লাগল না, দূর হয়ে গেল খুশি। ভাবল, এর চেয়ে ঠাণ্ডা রাতই আরামের ছিল।

ঘুমিয়ে বেশ ঝরঝরে হয়েছে মুসার শরীর। ফলে ক্ষুধাও লেগেছে, পিপাসাও। অনন্যরা ঘুমাতে পারেনি, ফলে এই অসুবিধেটা দেখা দেয়নি এখনও।

তবে ক্ষুধার কথাটা কাউকে বলল না সে।

নিজের হাতের তালু দেখল, অন্যদেরগুলোও দেখল। নোনা পানিতে ভিজে কুঁচকে গেছে চামড়া।

।মরেছি, বলল মুসা। চামড়ার যা অবস্থা, আর বেশিক্ষণ এই অবস্থা চললে খসে যাবে। রসিকতা করল, দাও দাও, কোল্ড ক্রীমের কৌটাটা দাও।

অন্যেরা ক্লান্ত। কাজেই ভেলার বড় মোটরটা হল এখন মুসা। জোরে জোরে ঠেলতে লাগল। আশা তাদেরকে নিরাশ করবে বলেই মনে হচ্ছে।

বেলা যতই বাড়ল, বাড়ল ক্ষুধা আর পিপাসা, সবারই। পানিতে থাকায় একটা উপকার হয়েছে, রোমকূপ দিয়ে আর্দ্রতা ঢুকছে, ফলে দ্রুত পানিশূন্যতার হাত থেকে রেহাই পেয়েছে শরীর। ডাঙায়থাকলে আরও অনেক আগেই প্রচণ্ড পিপাসা পেত। এখানে ধীরে ধীরে আসছে পিপাসা, কিন্তু আসছে তো। রাত নাগাদ এত বেড়ে গেল, এখন যদি কেউ বলে এক গেলাস পরিষ্কার পানি দেবে, বিনিময়ে মুক্তা তিনটে দিয়ে দিতে হবে, সামান্যতম দ্বিধা করবে না কিশোর।

এই রাতে নিজেকে বালিস বানানর প্রস্তাব দিল মুসা। সবাই তার কাঁধে পালা করে মাথা রেখে ঘুমিয়ে নিক। প্রথমে ঘুমাল রবিন। তারপর কুমালো। সব শেষে কিশোর। শেষ দিকে নিজের চোখও আর খুলে রাখতে পারল না মুসা। কুমালে আর রবিন ভেলা ঠেলছে। কাণ্ড ধরে ভেসে রয়েছে সে। কাঁধের ওপর কিশোরের মাথা।

ঘুমিয়ে পড়ল মুসা। প্রায় একই সঙ্গে চমকে জেগে উঠল সে আর কিশোর। দুজনেই নাকেমুখে পানি ঢুকে গেছে। কাশতে আরম্ভ করল।

পরদিন সকালে কোথা থেকে এসে হাজির হল একঝাঁক বোনিটো। ভেলার সঙ্গে সঙ্গে চলল। বার বার ছোঁ মারল অভিযাত্রীরা, কিন্তু একটাকেও ধরতে পারল না।

বড়শির সুতো বানাতে পারলে কাজ হত, কাণ্ডের দিকে তাকিয়ে বলল। কুমালো। নারকেলের ছোবড়া দিয়ে তো বানানো যায়। কাণ্ডের আঁশ দিয়েও বোধহয় হবে।

দিনের অনেকটা সময় ব্যয় করল ওরা আঁশ বার করতে। জোড়া দিয়ে, পাকিয়ে তৈরি করে ফেলল একটা সুতো, যদিও মাত্র পাঁচ ফুট লম্বা। তবে শক্ত। বাকল কেটে একটা বড়শি বানাল কুমালো। সুতোর মাথায় বাঁধল সেটা। কিন্তু টোপ নেই।

টোপ ছাড়াই বড়শিটাকে পানিতে ঝুলিয়ে রাখল ওরা। আশা করছে, যদি কোন একটা বোকা বোনিটো খাবার মনে করে গিলে ফেলে?

চলে গেল বোনিটোর ঝক। অন্যান্য মাছ এল গেল, বড়শির দিকে নজর দিল কেউ।

আরেকটা ভয়ঙ্কর রাত পেরোল, কাটল দুঃসহ দিন। নোনা পানিতে ভিজে আর কাণ্ডের সঙ্গে ঘষা লেগে ঘা দেখা দিতে লাগল শরীরে। পা ফুলে যাচ্ছে। একধরনের ঝিনঝিনে অনুভূতি। লাল লাল দাগ পড়ছে, কোথাও কোথাও ফোসকা।

এই অবস্থাকে বলে ইমারসন ফুট, কিশোর বলল। এরপর দেখা দেবে ফোঁড়া। নোনা পানির ফোঁড়া।

রোদে পুড়ে গেছে চামড়া। টকটকে লাল হয়ে উঠেছে চোখ, ভীষণ জ্বালা করছে।

পানির অভাবে শুকিয়ে ঠোঁট ফেটে গেছে। ফুলে উঠেছে জিভ, মুখগহুর ভরে দিয়েছে যেন। কথা বলতে অসুবিধে হয়। নোনাপানি দিয়েই গরগরা করল মুসা, গিলেও ফেলল খানিকটা।

সাবধান, হুঁশিয়ার করল কিশোর। পেটে খুব সামান্য গেলে ক্ষতি নেই। কিন্তু একবার খাওয়া শুরু করলে আর লোভ সামলাতে পারবে না।

শরীরের লবণ দরকার হয়, প্রতিবাদের সুরে বলল মুসা। খেলে ক্ষতিটা কি বুঝি না।

বেশি খেলে প্রথমে জ্ঞান হারাবে, রবিন বলল। তারপর দুটো ব্যাপার ঘটতে পারে। হুঁশ ফিরে পাবে, তবে মাথায় গণ্ডগোল হয়ে যাবে। কিংবা একেবারেই আর ফিরবে না।

তাতেই বা কি? তিক্তকণ্ঠে বলল মুসা। এমনিতেই পাগল হব, কিংবা মরব। তারচে খেয়েই মরি। কপালে হাত রেখে সামনে তাকাল সে। পাগল বোধহয় হতেই শুরু করেছি। নানারকম গোলমেলে জিনিস দেখছি।

কি দেখছ? মেঘ করেছে। মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছে। ওই তো, দক্ষিণ-পশ্চিমে দেখাল সে। আমি জানি, চোখের ভুল…

ভুল নয়! চেঁচিয়ে উঠল রবিন। সত্যি বৃষ্টি হচ্ছে, আধ মাইল দূরেও হবে না। চল চল, জলদি চল!

চারজনে মিলে ঠেলতে শুরু করল ভেলাটাকে। দ্রুত সাঁতরে চলল মেঘের দিকে।

কিন্তু হতাশ হতে হল ওদেরকে। ওরাও পৌঁছে সারল, বৃষ্টি থেমে গেল। হেসে উঠল রোদ, যেন ব্যঙ্গ করল অভিযাত্রীদের।

দেখ দেখ, ওই যে আরেকখানে হচ্ছে? রবিন দেখাল এবার। সিকি মাইল পশ্চিমে। কাছেই, ওটাতে সময়মত পৌঁছানো যাবে এই আশায় ভেলা ঠেলে নিয়ে চলল ওরা। হালকা বাতাসে ভেসে এসেছে একটুকরো কালো মেঘ, ওটা থেকেই। বৃষ্টি পড়ছে।

সাঁতরে চলেছে ওরা। মেঘটাকেও ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে বাতাস। ওরা যতই জোরে সাঁতরায়, বাতাসও ততই জোরে বয়। যেন খেলা জুড়েছে ওদের সঙ্গে। ওরা ক্লান্ত হয়ে পড়ছে, কিন্তু বাতাসের ক্লান্তি নেই। তবু আশা ছাড়তে পারল না ওরা। : অবশেষে ঝরে ঝরে শেষ হয়ে গেল মেঘটা। রোদ দেখে বিশ্বাস করার উপায় নেই কয়েক মিনিট আগেও কেঁপে বৃষ্টি হচ্ছিল ওখানে।

কি মনে হয়? মুসা জিজ্ঞেস করল। সবই কি আমাদের কল্পনা?

নিশ্চয় না, বলল কিশোর। আমরা সবাই দেখেছি, তাই না? কেউ জবাব দিল না দেখে কুমালোকে বলল, কথা বলছ না কেন? দেখিনি?

মনে তো হল…, দ্বিধা করছে কুমালো। আসলে, কোন কিছুকেই আর বিশ্বাস করতে পারছি না।

এই যে আরেক কাণ্ড, এটাকেও বিশ্বাস করতে পারছি না! চেঁচিয়ে উঠল মুসা। অথচ হাতে লাগছে। ধরতেও পারছি। বড়শিটা বেঁধে রাখা হয়েছে কাণ্ডের সঙ্গে, তাতে আটকা পড়েছে একটা অ্যালবাকোর মাছ। মাছটা তুলে দেখাল সে। কালো, চকচকে শরীর। বেশি বড় না, মাত্র দেড় ফুট। তবে বেশ মোটাসোটা, ভাল মাংস।

ছুরি নিয়ে ক্ষুধার্ত হায়েনার মত মাছটাকে আক্রমণ করল ওরা। দেখতে দেখতে কাঁটাগুলো ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট থাকল না। ছোট একটা টুকরো সরিয়ে রাখল কুমালো, বড়শির টোপের জন্যে।

অনেকটা সুস্থ বোধ করল ওরা, পিপাসাও কমল সামান্য। অ্যালবাকোরের রসাল মাংসে পানি আছে। তবে একেকজনের ভাগে যেটুকু পানি পড়ল, বড় এক চামচের বেশি না।

বড়শিতে টোপ দেয়ায় তাড়াতাড়িই আকৃষ্ট হল শিকার, একটা বাচ্চা করাত মাছ। ধরা পড়ার পর আর রেহাই নেই, তুলে ওটাকে যত দ্রুত পারল সাবাড় করে দেয়া হল, টোপের জন্যে খানিকটা মাংস রেখে।

শিশু করাত যেখানে আছে, ধাড়িও থাকতে পারে। একটু পরেই দেখা গেল। ওটাকে। আলোড়ন তুলল পানিতে।

ওই দে! কুমালোকে দেখাল মুসা।

ছোট মাছের ঝাঁককে আক্রমণ করেছে বিশাল এক করাত মাছ। যোলো ফুটের কম হবে না। করাত দিয়ে দুটুকরো করে ফেলছে মাছগুলোকে, তারপর গপাগপ গিলছে। মারাত্মক ওদের করাত। তিমিকেও ছেড়ে কথা কয় না। অনেক সময় হারেও তিমি।

বিশাল করাতের কাছ থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করল ওরা। কাটা মাছের টুকরো ভেসে উঠছে পানিতে। নিয়ে আসছে ওগুলো মুসা আর কুমালো। জমাচ্ছে জেলার ওপর।

রক্তের গন্ধে এসে হাজির হল মস্ত এক টাইগার শার্ক। কাটা মাছগুলো খেতে শুরু করল।

এটা মোটেই পছন্দ হল না করাত মাছের। সোজা গিয়ে করাত চালিয়ে দিল হাঙরের গায়ে। ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরোল হাঙরের। পালাবে না পাল্টা আক্রমণ করবে ঠিক করতে পারছে না যেন।

দশ মিনিটের মধ্যে হাজির হয়ে যাবে হাঙরের পাল, শঙ্কিত হয়ে বলল কুমালো। চল, এখানে থাকা আর নিরাপদ না।

ভেলা ঠেলে তাড়াতাড়ি ওখান থেকে সরে এল ওরা। পেছনে তাকিয়ে দেখল, খানিক আগে যেখানে ছিল ওরা সেখানকার পানি যেন টগবগ করে ফুটছে। অসংখ্য হাঙর এসে হাজির হয়েছে। রক্তাক্ত হয়ে গেছে পানি।

আরও দূরে সরে এল ওরা। তারপর কাঁচা মাছ খাওয়ায় মন দিল।

বড় উপকার করল করাতটা, চিবাতে চিবাতে বলল মুসা। নাহ, ততটা দুর্ভাগা নই আমরা। কপাল মাঝে মাঝেই ভাল হয়ে যায়।

কিন্তু তারপর যতই সময় গেল কপাল আবার খারাপ হতে লাগল। মাছ আর চোখেই পড়ে না এখন। শুধু জেলিফিশ। ঘন হয়ে ছড়িয়ে আছে মাইলের পর মাইল জুড়ে। খুব সাবধানে চলতে হচ্ছে ওগুলোর ভেতর দিয়ে। জেলিফিশের শুড়ে মারাত্মক বিষ। বড় বড় মাছকেও অবশ করে ফেলে।

জেলিফিশের সব চেয়ে খারাপ প্রজাতিগুলোর একটা সী ব্লাবার। লাল রঙ, সাত ফুট পুরু, একেকটা শুঁড় একশো ফুট লম্বা। সাঁতার কাটার সময় সাঁতারুর শরীরে অনেক সময় জড়িয়ে যায় ওই শুঁড়, বিষাক্ত হুল ফুটতে থাকে চামড়ায়। তখন অন্যের সাহায্য ছাড়া ওই শুঁড় খোলা তার পক্ষে প্রায় অসম্ভব।

কম-বেশি হুল অভিযাত্রীদের সবার শরীরেই ফুটল। জেলিফিশের এলাকা থেকে সরে আসার পরেও অনেকক্ষণ থাকল ওই হুলের জ্বালা। আশার গায়ে লেগে আছে থিকথিকে জেলির মত জিনিস, জেলিফিশের গা থেকে লেগেছে, ওগুলোও বিষাক্ত।

পরদিন দেখা গেল একটা পাখি। মৃত্যুদ্বীপ থেকে আসার পর এই প্রথম পাখি চোখে পড়ল ওদের। কিছুক্ষণ পর উড়ে এল আরও অনেক পাখি, নডি, বুবি। পাক খেয়ে খেয়ে উড়তে লাগল ভেলাটাকে ঘিরে।

এরমানে, কুমালো বলল। ডাঙা দূরে নয়।

রক্তলাল উৎসুক চোখ মেলে ডাঙা খুঁজল চারজোড়া চোখ। কিন্তু দিগন্তের কোথাও নারকেল গাছের একটা মাথাও চোখে পড়ল না।

কোন কিছুই আর ভাল লাগছে না এখন ওদের। সব কিছুতেই বিরক্তি। এমন কি নিজেদের সান্নিধ্যও খারাপ লাগছে, সইতে পারছে না একে অন্যকে। বুঝতে পারছে কিশোর, এই অবস্থা আর দুদিন চললেই পাগল হয়ে যাবে সবাই।

মুসা বলল, রবিনকে একই ভেলায় আর সইতে পারছে না সে। রবিন ঘোষণা করে দিল, হাতের কাছে কিছু একটা পেলেই মুসার মুখে ছুঁড়ে মারবে ওটা।

প্রত্যেকেই ভাবছে, সে ছাড়া বাকি তিনজন পাগল। আবোল-তাবোল কথা বলছে। দেশী ভাষায় অনর্গল বকবক করে যাচ্ছে কুমালো। কিশোর বলল, আর পানিতে থাকছি না আমি। এবার সৈকতে উঠব।

হেসে উঠল মুসা। ডুব দিয়ে কিশোরের পা টেনে ধরে তাকে ডুবিয়ে রাখল কিছুক্ষণ। ভেসে উঠে হা হা করে হেসে বলল, কেমন উঠলে সৈকতে? দিলাম তো ঠেকিয়ে।

মেঘ দেখতে পেল কিশোর। অথচ মেঘের চিহ্নও নেই কোথাও। তারপর দেখল নারকেল গাছের মাথা। সবুজ গাছপালায় ছাওয়া দ্বীপ। পাহাড়ের ওপর থেকে বনের মাথায় ঝরে পড়ছে জলপ্রপাত।

খেয়ালই করল না ওরা, কখন বাতাসের বেগ বাড়ল, কালো মেঘ জমল, ফুCে উঠল সাগর। বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টি শুরু হল। ওপরের দিকে হা করে পানি খাওয়ার কথাও মনে এল না কারও। তবু করল, শরীরের স্বাভাবিক তাগিদেই বোধহয়। অনেক দিন পর পাকস্থলীতে ঢুকল মিষ্টি পানি।

কুঁসে উঠল সাগর। ছোট্ট ভেলাটাকে ঠেলে নিয়ে চলল দক্ষিণ-পশ্চিমে। নিজেদের অজান্তেই অনেকটা, কাণ্ডগুলো আঁকড়ে ধরে রইল ওরা।

ঝড়ের অন্ধকার মিশে গেল রাতের অন্ধকারের সঙ্গে। ঘোরের মধ্যে থেকে যেন কিশোরের কানে আসছে বাতাসের গর্জন, অনুভব করছে ঢেউয়ের দোলা।

তারপর শুনতে পেল আরেকটা গর্জন। বাতাসের নয়। তীরে ঢেউ আছড়ে পড়ার।

বিচিত্র কাণ্ড শুরু করেছে ভেলাটা। কিসের টানে যেন দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে, ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসছে আবার, আবার এগোচ্ছে…

কয়েকবার এরকম করে হঠাৎ টান লেগে ছিঁড়ে গেল বাঁধন। আলাদা হয়ে গেল দুটো কাণ্ড। আর আঁকড়ে ধরে রাখতে পারল না কিশোর। ডুবতে শুরু করল। পায়ের তলায় ঠেকল মাটি!

ধাক্কা দিয়ে আবার তাকে ভাসিয়ে ফেলল ঢেউ। আবার ভোবাল। আবার ভাসাল। অবশেষে দেখল, কোমর পানিতে দাঁড়িয়ে আছে সে।

হ্যাঁচকা টানে তাকে চিত করে ফেলল আবার পানি। টেনে নিয়ে গিয়ে ছুঁড়ে ফেলল বালিতে।

হাঁচড়ে-পাঁচড়ে আরও কিছুদূর উঠে গেল কিশোর। ঢেউ পৌঁছতে পারছে না এখানে। চিত হয়ে শুয়ে পড়ল বালিতে।

তারপর শুধুই অন্ধকার।

১০

চোখ মেলে একটা বাদামী মুখ দেখতে পেল কিশোর। কালো খোঁপায় লাল হিবিসকাস গোঁজা। হাতে একটা কচি ডাব। কাত করে ধরল তার ঠোঁটের কাছে।

ঠাণ্ডা মিষ্টি পানি পড়ল হাঁ করা মুখের ভেতর। ফোলা জিভের জন্যে গিলতে কষ্ট হল তার। কোনমতে গিলে নিল কয়েক ঢোক।

সূর্য উঠেছে, কিন্তু রোদ লাগছে না তার গায়ে। সে শুয়ে আছে ঘুন নারকেল

কুঞ্জের ছায়ায়। ফলে বোঝাই গাছগুলো। বাতাসে ভেসে আসছে ফুলের সুবাস।

তার পাশেই শুয়ে আছে রবিন, মুসা আর কুমালো। তাদের সেবাযত্ন করছে আরও কয়েকটা মেয়ে। গাছপালার ভেতরে কয়েকজন পুরুষকে দেখা যাচ্ছে।  এতই দুর্বল হয়ে পড়েছে কিশোর, আবার চোখ বুজে ফেলল। বয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তাকে, টের পাচ্ছে। আস্তে শুইয়ে দেয়া হল। কানে আসছে অনেক কণ্ঠস্বর। কাঠের ধোঁয়া আর খাবারের জিভে-পানি-আসা গন্ধ নাকে এল।

চোখ মেলল আবার কিশোর। গাঁয়ের একটা কুঁড়ের বারান্দায় শুইয়ে দেয়া হয়েছে তাকে। বেড়া বেয়ে ছাতে উঠে গেছে লতা, নানা রঙের ফুল ফুটে আছে। বড় বড় আম গাছে আম ধরে আছে, ফলের ভারে নুয়ে পড়েছে ডাল।

বারান্দায় ভিড় করে আছে অনেকগুলো বাদামী মুখ। কৌতূহলী দৃষ্টিতে, তাকিয়ে আছে অভিযাত্রীদের দিকে।

তার ওপর ঝুঁকল একটা মুখ, সেই মেয়েটা। হাসল কিশোর। কাঠের একটা পাত্র থেকে কাঠের চামচ দিয়ে খাবার নিয়ে বাড়িয়ে ধরল। কিশোর হাঁ করতেই ঢেলে দিল তার মুখে। রুটিফল, কলা আর নারকেল দিয়ে বানানো এক ধরনের মণ্ডের মত খাবার।

খুব ধীরে ধীরে গিলতে লাগল কিশোর।

পাশে এসে তার মাদুরের ওপর বসল এক বৃদ্ধ। তাকে অবাক করে দিয়ে ইংরেজিতে কথা বলে উঠল, আমি নুলামা। এ-গাঁয়ের মোড়ল। অনেক ভুগেছ তোমরা। আমাদের এখানে যখন আসতে পেরেছ, আর ভাবনা নেই। খেয়েদেয়ে ঘুম দাও। সব ঠিক হয়ে যাবে।

আবার যখন চোখ মেলল কিশোর, দেখল গাছপালার লম্বা ছায়া পড়েছে। নিশ্চয় শেষ বিকেল। শান্ত স্নিগ্ধ গাঁয়ের দিকে চোখ বোলাল সে। নির্দিষ্ট কোন রাস্তা নেই। গাছপালার ফাঁকে ফাঁকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে কুঁড়েগুলো।

গাছে গাছে ছেয়ে রয়েছে! আম তো আছেই। আছে রুটিফল, কলা, কমলা, লেবু, নারকেল, ডুমুর, পেঁপে, তুঁত। ফলে ফলে বোঝাই।

আর আছে ফুল। নানা জাতের অর্কিড আঁকড়ে রয়েছে গাছের ডাল, কাণ্ড। বুগেনভিলিয়া, হিবিসকাস আর কনভলভুলাসের বাগানে যেন বসন্ত এসেছে।

সচল রঙেরও অভাব নেই এখানে। গাছে গাছে উড়ছে আর কর্কশ চিল্কার করছে লাল-সবুজ কাকাতুয়া। ঝিম মেরে বসে রয়েছে ঘন নীল মাছরাঙা। পড়ন্ত রোদে চিকচিক করছে ঘুঘুর পালক। আরও অনেক পাখি আছে, বেশির ভাগের নামই জানে না সে। বিচিত্র ওগুলোর রঙঃ লাল, সবুজ, কালো, সাদা, নীল, হলুদ।

পাখির ডাকে মুখরিত হয়ে আছে গ্রামটা। তার সঙ্গে তাল মিলিয়েছে যেন লোকের মৃদু আলাপ। কাছেই কোথাও গিটার বাজিয়ে গান গাইছে কারা যেন।

ফিরে তাকাল কিশোর কুমালো, মুসা আঃ রবিনেরও ঘুম ভেঙেছে। উঠে বসেছে। অবাক হয়ে দেখছে, কান পেতে শুনছে।

স্বপ্ন দেখছি, তাই না? মুসা বলল।

হয়ত, বলল কিশোর। ঘুম ভাঙলে হয়ত দেখব এসব কিছুই নেই। নারকেলের কাণ্ড আঁকড়ে ধরে সাগরে ভাসছি…

ঘরের ভেতরে কথা শোনা গেল। কয়েকটা মেয়ে আর একজন বয়স্ক মহিলা বেরিয়ে এল পানি আর খাবারের পাত্র নিয়ে। সেগুলো রাখল অভিযাত্রীদের সামনে। নানারকমের মাছ, কবুতরের রোস্ট, মিষ্টি আলু সেদ্ধ আর একঝুড়ি ফল।

ওরা খাবার সময় কাছে এসে বসল বৃদ্ধ মোড়ল। হাসি হাসি মুখ।

এ-জায়গাটার নাম কি? খেতে খেতে জিজ্ঞেস করল কিশোর। জিভের ফোলা আর এখন নেই।

কুয়াক ট্রাক দ্বীপপুঞ্জের একটা দ্বীপ।

ট্রাক, যাকে দক্ষিণ সাগরের স্বর্গ বলা হয়। এর নাম অনেক শুনেছে কিশোর। বিশাল এক ল্যানকে ঘিরে রেখেছে একশো চল্লিশ মাইল লম্বা প্রবালের দেয়াল।

দেয়ালের ভেতরে ল্যাণ্ডনের বুকে গজিয়ে উঠেছে দুশো পঁয়তাল্লিশটা দ্বীপ।

এই দ্বীপটা কি ল্যাগুনের মধ্যে?

না। দেয়ালের ওপর। ওই যে, ওদিকে সাগর। আর এদিকে ল্যাগুন।

আমেরিকান নেভির লোক আছে এখানে?

মূল দ্বীপটাতে আছে। সকালে গিয়েছিলাম তোমাদের খবর জানাতে। সঙ্গে সঙ্গেই আসতে চাইছিল ওরা, আমি বারণ করেছি। বলেছি কাল সকালে যেন আসে, ততক্ষণ আমার মেহমান হয়ে থাকবে তোমরা। ওরা বলল, পোনাপে থেকে নাকি বোট নিয়ে বেরিয়েছিলে তোমরা, তারপর নিখোঁজ হয়েছ। কাল নেভির একটা হসপিটাল শিপ যাবে পোনাপে আর মার্শাল দ্বীপে, ইচ্ছে করলে ওটায় করে যেতে পার। হাসল বৃদ্ধ। কিংবা থেকেও যেতে পার এখানে, যতদিন ইচ্ছে। আমরা খুর খুশি হব।

চোখে পানি এসে গেল কিশোরের। আপনাদের দয়ার কথা কোনদিন ভুলব না। থাকতে পারলে খুশিই হতাম। কিন্তু পোনাপেতে জরুরি কাজ আছে। আমাদের।

পরদিন সকালে ক্যানুতে করে ট্রাকের মূল দ্বীপে পৌঁছে দেয়া হল অভিযাত্রীদের।

হসপিটাল শিপটা আধুনিক যন্ত্রপাতি সজ্জিত একটা সত্যিকারের হাসপাতাল। এক্স-রে মেশিন আছে, চিকিৎসার জন্যে প্রয়োজনীয় অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি আছে, আছে ফার্মেসী, ল্যাবরেটরি। দ্বীপ থেকে দ্বীপে ঘুরে বেড়ায়, অসুস্থের সেবা করে, দেশী মেয়েদেরকে নার্সের ট্রেনিং দেয়।

ধবধবে সাদা বিছানায় শোয়ানো হল অভিযাত্রীদের। চিকিৎসা শুরু হয়ে গেল সাথে সাথেই। কুমালোর জখম দেখে ডাক্তার বললেন, ঘা প্রায় শুকিয়ে এসেছে।

তিন দিন পর পোনাপেতে পৌঁছল জাহাজটা। রেডিওতে আগেই খবর পাঠানো হয়েছে। তৈরিই হয়ে ছিল কমাণ্ডার ফেলিকস ম্যাকগয়ার। জাহাজের নোঙর পড়তে

পড়তেই ওটার গায়ে এসে ঘেঁষল তার বোট।

অভিযাত্রীদের সঙ্গে দেখা হতেই প্রশ্ন শুরু করল, কোথায় ছিলে তোমরা? কি হয়েছিল? অ্যাটলে থেকে গেলে কেন? কেন ফিরলে না বোটে করে?

হেসে উঠল কিশোর। আহা, একটা করে প্রশ্ন করুন। নইলে জবাব দিই কি করে? আচ্ছা, আগে বলুন, ডেংগু ফিরেছে?

ডেংগু? ডেংগুটা আবার কে?

ওহহো, ভুলেই গিয়েছিলাম। আপনি তো আবার তাকে চেনেন রেভারেণ্ড হেনরি রাইডার ভিশন নামে।

ওঁকে উদ্ধার করেছে একটা মাছধরা নৌকো। বদ্ধ উন্মাদ হয়ে গেছেন। খাবার পানি সব ফুরিয়ে গিয়েছিল, পরে সাগরের পানি খেয়েছেন। তাতেই মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। একটু সুস্থ হলে তোমাদের কথা জিজ্ঞেস করেছিলাম। বললেন, তোমরা নাকি ইচ্ছে করেই অ্যাটলে থেকে গেছ। তিনি আবার ফিরে গেলে তারপর আসবে।

সব মিথ্যে কথা, কিশোর বলল। কুমালোকে গুলি করেছে। আমাদের ওখানে ফেলে রেখে এসেছে মরার জন্যে। ওই লোক মিশনারি নয়, মুক্তো ব্যবসায়ী। আর তার নামও রাইডার ভিশন নয়, ডেংগু পারভি। ওই অ্যাটলে একটা মুক্তোর খামার আছে। ওটাই লুট করতে চেয়েছিল সে।

হাঁ করে তাকিয়ে রইল ম্যাকগয়ার। তাই নাকি? আশ্চর্য!

এখন কোথায় সে? এখানেই?

না। বড় একটা বোট ভাড়া করে, মাঝিমাল্লা নিয়ে আবার বেরিয়েছে। আমরা তো ভাবলাম তোমাদের আনতে গেছে। পরে যখন শুনলাম, তোমরা প্রায় মরতে মরতে, এসে ট্রাক দ্বীপে উঠেছ, শুনে তো চমকে গেলাম।

গেছে কতদিন হল?

এই হপ্তাখানেক। কখন ফিরবে বলেনি। আবোলতাবোল কথা বলছিল। সে নাকি রামধনুর দেশ থেকে সোনার সিন্দুক তুলে আনতে যাচ্ছে। এখনও নব্বই ভাগ পাগল। একটা লগবুক সারাক্ষণ বগল তলায় চেপে রাখত, কাউকে ছুঁতেও দিত। না। কেউ দেখার কথা বললেই খেপে যেত। কোন জায়গায় যাচ্ছে, অবস্থান জানতে চেয়েছিলাম আমরা, বলেনি। ভাল নেভিগেশন জানে, এরকম একজন পলিনেশিয়ানকে নিয়ে গেছে। এক মুহূর্ত থেমে বলল ম্যাকগয়ার, এখন বুঝতে পারছি কোথায় গেছে। অ্যাটলেই যাবে।

ওখানে কোনদিনই পৌঁছতে পারবে না। হাসল কিশোর। আমি চাইছি, আমরা থাকতে থাকতেই ফিরে আসুক। গরুর হাডিড কোপানর কুড়াল নিয়ে ওর জন্যে তৈরি থাকব আমি।

হেসে বলল ম্যাকগয়ার, তোমাকে আর কিছুই করতে হবে না। এবার ফিরলেই জেলে ঢুকতে হবে তাকে।

কিন্তু কিশোর আর ম্যাকগয়ার দুজনেরই হিসেবে ভুল হয়েছে। কুড়ালের কোপও খেতে হল না ডেংগুকে, জেলেও ঢুকতে হল না।

১১

সেই বাড়িটাতেই উঠল অভিযাত্রীরা, পোনাপেতে, এসে প্রথম যেটায় উঠেছিল। ক্যাপ্টেন ইজরা কলিগ জানাল, মেরামত হয়ে গেছে শুকতারা।

একেবারে আগের মত, বলল সে।

মাছটাছগুলো কেমন আছে? জানতে চাইল কিশোর।

ভাল। তবে অক্টোপাসটা বেশ জ্বালায়। একদিন তো বেরিয়ে পড়েছিল ট্যাঙ্ক থেকে। মাকড়সার মত হেঁটে হেঁটে উঠে চলে এসেছিল ডেকে, আরেকটু হলেই সাগরে নেমে যেত। লোকজন ডেকে অনেক কষ্টে তারপর ধরেছি।

বাড়িতে একটা লম্বা রেডিওগ্রাম পাঠাল কিশোর। আর অনেক টাকার বীমা করে ছোট একটা প্যাকেট পার্সেল করে পাঠাল প্রফেসর এনথনি ইস্টউডের নামে।

মুক্তাগুলো হাত বদল করে অবশেষে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল।

জামবুর ব্যাপারে খোঁজখবর নিল তিন গোয়েন্দা। জেলেই রয়েছে এখনও। কিশোরের মনে হল, যথেষ্ট সাজা হয়েছে বেচারার। ম্যাকগয়ারকে অনুরোধ করল, তাকে মুক্তি দিতে।

মুক্তি পেল জামবু। একেবারেই অকৃতজ্ঞ লোকটা। কিশোরকে একটি বারও ধন্যবাদ জানাল না। দ্বীপেও থাকল না আর। আমেরিকাগামী যে জাহাজটা প্রথম ধরতে পারল, তাতেই মালা হিসেবে নাম লিখিয়ে পাড়ি জমাল দেশের উদ্দেশে।

ডেংগুর ফেরার অপেক্ষায় উদ্বিগ্ন হয়ে অপেক্ষা করতে লাগল তিন গোয়েন্দা। রিডিঙে ভূল রয়েছে, পার্ল ল্যাগুন খুঁজে বের করতে পারবে না সে। কিন্তু সত্যিই কি পারবে না? খুঁজতে খুঁজতে যদি পেয়ে যায়! কে জানে, হয়ত এখন ল্যাণ্ডনে মুক্তো ভোলায় ব্যস্ত তার লোকেরা। একবার ওখানে গিয়ে পৌঁছতে পারলে একটা, ঝিনুকও রাখবে না ডেংগু, সব তুলে ফেলবে, তাতে কোন সন্দেহ নেই কিশোরের। তারপর ওগুলো থেকে মুক্তা বের করে নিয়ে চলে যাবে। পোনাপেতে আর কোনদিনই ফিরবে না।

কারণ, দ্বীপে ছেলেদেরকে না পেয়ে তাদের লাশ না দেখে, সন্দেহ হবেই ডেংগুর। ভাববে, যে ভাবেই হোক পোনাপেতে ফিরে এসেছে ওরা। স্বভাবতই

এদিকে ঘেঁষতে চাইবে না সে সমস্ত মুক্তা নিয়ে একেবারে নিখোঁজ হয়ে যাবে।

প্রফেসরকে তখন কি জবাব দেবে কিশোর? স্বীকার করতেই হবে দোষটা তার। ডেংগুর ফাঁকিবাজি ধরতে পারেনি। তাকে বোটে তুলে সঙ্গে করে নিয়ে গেছে। নিয়ে গিয়ে একেবারে দেখিয়ে দিয়েছে আসল জায়গা।

আমি একটা গর্দভ! আস্ত গাধা! কথাটা মনে পড়লেই নিজেকে গাল দেয়। কিশোর। এই যেমন এখন দিচ্ছে। অস্থির হয়ে গড়াগড়ি শুরু করল মাদুরে। ঘুম পালিয়েছে। আর এভাবে বসে থাকা যায় না। কিছু একটা করা দরকার। অন্তত গিয়ে দেখা দরকার, অ্যাটলে সত্যি সত্যি যেতে পেরেছে কিনা ডেংগু।

পরদিন ভোরে ঘুম ভাঙতেই বন্দরে রওনা হল কিশোর, ক্যাপ্টেন কলিগকে। বলার জন্যে, ওরা আবার পার্ল ল্যাগুনে যাবে। পুব দিগন্তে তখন সবে উঁকি দিয়েছে সূর্য। বন্দরে এসে দেখল সে, একটা বোট এসে নোঙর করেছে ডকের

শখানেক গজ দূরে। নৌকা নামিয়ে তাতে নামল কয়েকজন পলিনেশিয়ান আর একজন শ্বেতাঙ্গ।

ধক করে উঠল কিশোরের বুক। দৃষ্টি তীক্ষ্ণ করল। কে লোকটা? ডেংগু? সত্যি দেখছে, না কল্পনা।

নৌকাটা আরও কাছে এলে ভালমত দেখা গেল নোকটাকে। ডেংগুই।

দুরুদুরু করছে কিশোরের বুক। ডেংগু নিশ্চয় অ্যাটলটা খুঁজে পায়নি। তাহলে ফিরত না। কিশোরকে দেখলে কি কররে এখন? রাগের মাথায় গুলি করে বসবে?

পালাবে নাকি? গিয়ে ম্যাকগয়ারকে খবর দেবে?

কিন্তু কোনটাই করল না কিশোর। দাঁড়িয়ে রইল স্থাণুর মত।

তীরে পৌঁছে গেল নৌকা। ডকে উঠল ডেংগু। মাতালের মত টলছে। চোখে বন্য দৃষ্টি। খোঁচা খোঁচা দাড়ি। উসকো খুসকো চুল এসে পড়েছে কানের ওপর। পিঠের কুঁজটা আরও প্রকট। ঝুলে পড়ছে কাঁধ, ফলে হাত দুটো অস্বাভাবিক লম্বা লাগছে।

তার সামনে গিয়ে দাঁড়াল কিশোর, চমকে দেয়ার জন্যে।

ডেংগু দাঁড়াল।

এই যে, ডেংগু, কিশোর বলল। চিনতে পারছ আমাকে?

এক মুহূর্ত চেয়ে রইল ডেংগু। তারপর ঘুরে হাঁটতে শুরু করল। যেন চিনতেই পারেনি।

পলিনেশিয়ান একটা লোকের হাতে সেক্সট্যান্ট, বোধহয় সে-ই নেভিগেটর। বলল, পুরোপুরি মাথা খারাপ হয়ে গেছে।

কি হয়েছিল? জিজ্ঞেস করল কিশোর।

লগবুকের রীডিং দেখে একটা দ্বীপ খুঁজেছে। তার ধারণা, ওই দ্বীপে অনেক মুক্তা আছে। রীডিং মত ওখানে গিয়ে দেখা গেল, কোন দ্বীপ নেই, শুধু পানি। আশেপাশে কয়েক মাইলের মধ্যে কোন দ্বীপ পাওয়া গেল না। মাথায় আগেই গোলমাল হয়ে ছিল, এই ঘটনার পর একেবারে পাগল হয়ে গেল। কি আর করা। বাধ্য হয়ে ফিরে এসেছি।

ডকের শেষপ্রান্তে হৈ-হট্টগোল শোনা গেল। কি হয়েছে দেখার জন্যে ফিরে। তাকাল কিশোর। দুজন মিলিটারি পুলিশের সঙ্গে ধস্তাধস্তি শুরু করেছে ডেংগু। হাত ছাড়াতে পারল না। টেনেহিঁচড়ে তাকে নিয়ে গেল ওরা।

লোকটার জন্যে এখন দুঃখই হল কিশোরের।

জেলে নয়, শেষ পর্যন্ত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হল ডেংগুকে। এখানে রোগ না সারলে পাঠিয়ে দেয়া হবে স্যান ফ্রানসিসকোর কোন মেনটাল ইন্সটিটিউশনে।

রেডিওতে সেদিনই একটা মেসেজ এল কিশোরের নামে। ম্যাকগয়ারের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল ক্যাপ্টেন কলিগ, মেসেজটা নিয়ে এসেছে।

কেবিনে রবিন, মুসা, কুমালো সবাই আছে।

খামটা ছিঁড়ল কিশোর। জোরে জোরে পড়ল :

ভাল কাজ দেখিয়েছ তোমরা। জানোয়ারগুলো পেয়েছি, চমৎকার। খুব খুশি হয়েছে লিসটার। বাকি যা আছে কারগো স্টীমারে তুলে দাও। পার্সেল পেয়েছেন ইস্টউড, তোমাদের অনেক প্রশংসা করেছেন। আর দেরি কর না। যত তাড়াতাড়ি পার, বাড়ি ফিরে এস।
তোমার চাচা, রাশেদ পাশা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *