বড়দিনের ছুটি

ভলিউম ১১৭ – বড়দিনের ছুটি – তিন গোয়েন্দা – রকিব হাসান – সেবা প্রকাশনী

টেলিফোনে কথা বলছেন রবিনের আম্মা মিসেস মিলফোর্ড। কিশোরের চাচীর সঙ্গে। এবারকার বড়দিনে বড় করে একটা পার্টি দিতে চান কয়েক জন বান্ধবী মিলে।

হ্যাঁ হ্যাঁ, শখানেক মাংসের বড়া হলেই

চলবে, মেরিচাচীকে বললেন মিসেস মিলফোর্ড।মুসার আম্মাকে বলেছি অ্যাপল পাই আর কেক আনতে। মুরগী-টুরগী আর বাকি যা যা দরকার, আমি ব্যবস্থা করব।

ফোনে কথা বলতে বলতে অবচেতন ভোবই তার আঙুলগুলো খেলা করছে। বসার ঘরের কোণে বসানো ক্রিস্টমাস ট্রীর একটা ডেকোরেশন নিয়ে।

রবিন তো বলছে, গায়ের সব লোককে দাওয়াত করতে।

বিরাট ডেস্কটার ওপাশে বসে থাকা ছেলের দিকে তাকিয়ে স্নেহের হাসি হাসলেন তিনি। কিন্তু সেটা কি আর সম্ভব? যাই হোক, যত বেশি সম্ভব মানুষকে দাওয়াত করব। চেনাজানা কাউকে বাদ দেব না। ঠিক আছে, রাখি এখন। মুসার আম্মার সঙ্গে কথা বলতে হবে।

লাইন কেটে দিয়ে মুসাদের নম্বরে ডায়াল করলেন তিনি। কে, মিসেস আমান? …

লম্বা নিঃশ্বাস ফেলল রবিন। বসে আছে বাইরে বেরোনোর অপেক্ষায়। কিন্তু সেই যে তখন থেকে বলেই চলেছেন মা, চলেছেনই। থামাথামি আর নেই।

তারপর রবিনের মতে অনন্তকাল পার করে দিয়ে রিসিভার রেখে যেই সরে আসতে যাবেন, ওর দুর্ভাগ্য-আবার বাজল টেলিফোন। ছো মেরে তুলে নিলেন তিনি। কে? ও, মিসেস ডানকান হ্যাঁ হ্যাঁ, দিচ্ছি তো পার্টি..

আবার চলল কথা। রবিন অপেক্ষা করছে বাজারে যাওয়ার জন্যে। পার্টির জন্যে প্রচুর জিনিসপত্র কিনতে হবে। লম্বা লিস্ট করেছেন মা। টাকাও দিয়ে দিয়েছেন। টেবিলে পড়ে আছে ওগুলো। তালিকায় কিছু বাদ পড়ল কিনা শেষ মুহূর্তে আরেকবার চেক করতে হবে। মা না বললে আর বেরোতে পারছে না রবিন।

মিসেস ডানকানের সঙ্গে কথা বলা শেষ করে আসার জন্যে পা বাড়িয়েছেন।এই সময় আবার বাজল টেলিফোন। রিসিভার কানে ঠেকিয়ে হাতের ইশারায় রবিনকে অপেক্ষা করতে বললেন তিনি।

আর কোন কাজ না পেয়ে বিরক্ত হয়ে টেবিলে রাখা একটা কয়েন তুলে নিয়ে দাঁড় করিয়ে ঘোরানো শুরু করল রবিন। কতটা বেশি সময় ধরে ঘোরাতে পারে সেই চেষ্টা। অবসরপ্রাপ্ত বুড়ো-বুড়ি যারা দাওয়াতে আসবেন, তাদের কাকে কি উপহার দেয়া যায়, মা এখন সেই আলোচনা করছেন ফোনে।

আবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে ওজন মাপার ছোট যন্ত্রটার দিকে নজর দিল রবিন।

টেবিলের একপাশে রাখা আছে ওটা। বাবার জিনিস। পোস্ট করার আগে চিঠিপত্র কিংবা পার্সেল মেপে দেখে নেন ওজন কত। সময় কাটানোর জন্যে প্রথমে একটা পেন্সিল মাপল রবিন, অ্যাঢেসিভ টেপ মাপল, তারপর একের পর এক কয়েনের ওজন দেখতে শুরু করল বাজারে নেয়ার জন্যে যেগুলো দিয়েছেন তাকে মা ৷

সব ধরনের মুদ্ৰাই রয়েছে, দোকানদারকে ভাঙতি দেয়ার সুবিধের জন্যে।

পাঁচ, দশ, বিশ, পঞ্চাশ পেন্স-একেকটার ওজন একেক রকম। মাপতে মাপতে হঠাৎ থেমে গিয়ে স্কেলের দিকে তাকিয়ে রইল ভুরু কুঁচকে। দুটো পঞ্চাশ পেন্সের মুদ্রা মাপতে গিয়ে তফাতটা লক্ষ্য করেছে।

ঘটনাটা কি! আনমনে বিড়বিড় করল সে। এটার ওজন বাকিগুলোর চেয়ে কম কেন?

নিশ্চিত হবার জন্যে পঞ্চাশ পেন্সের অন্য মুদ্রাটা আবার মেপে দেখল সে। কোন সন্দেহ নেই। দুটোর ওজন দুই রকম ৷ প্রথমটার চেয়ে দ্বিতীয়টা চার গ্রাম কম। এ ছাড়া আর কোন পার্থক্য নেই। দুটোই অবিকল এক রকম দেখতে। একই রকম নতুন চকচকে।

বিস্মিত ভাবটা প্রকাশ পেতে দিল না মুখে। মার দিকে ফিরে তাকাল। আশা করল, যেখানে দাড়িয়ে আছেন, সেখান থেকে তার ছোট্ট এই পরীক্ষাটি নজরে পড়বে না তার। মিসেস ডানকানের সঙ্গে পার্টি নিয়ে আলোচনায় অতিশয় মশগুল।

তার দৃঢ় বিশ্বাস, অদ্ভুত কিছু রয়েছে মুদ্রা দুটোর মধ্যে। কোন রহস্য।

সেদিন বিকেলে কিশোরদের বাগানের ছাউনিতে জমায়েত হলো সবাই। কিশোর, মুসা, রবিন, ফারিহা টিটু তো রয়েছেই-দলে নতুন যুক্ত হয়েছে আরও তিনজন: বব, অনিতা ও ডলি। গ্ৰীনহিলস স্কুলে পড়ে। মুসা আর রবিনের বন্ধু।

গোয়েন্দাগিরির বেজায় শখ। বহুদিন ধরে চাপাচাপি করছে মুসা আর, রবিনকে।

ওদের অনুরোধে প্রথমবারের মত ওই তিনজনকে দলে নিতে রাজি হয়েছে কিশোর। তবে শর্ত আছে, ওদের আচরণ বা কাজকর্ম তার পছন্দ না হলে কোন রকম কৈফিয়ত ছাড়াই দল থেকে বাদ দিয়ে দেবে। বব, অনিতা আর ডলি শর্তে রাজি।

সকাল বেলা রবিনের আম্মা ফোন সেরে বাজারের লিস্টে শেষবারের মত

চোখ বুলিয়ে রবিনকে ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সে বেরিয়ে পড়েছিল কিশোরের সঙ্গে

দেখা করার জন্যে। মুদ্রা সম্পর্কে তার দুর্দান্ত আবিষ্কারের খবরটা জানাতে।

দলের সবাইকে খবরটা জানানোর দায়িত্ব নিয়েছে এরপর কিশোর, রবিন চলে গেছে বাজারে। খবর জানিয়ে বিকেল বেলা জরুরী মীটিং ডেকেছে কিশোর। সেই মিটিঙেই হাজির হয়েছে এখন ওরা।

শীতকালে ছাউনির মধ্যে আরাম নেই। ঠাণ্ডা থেকে বাঁচার জন্যে গরম কাপড়-চোপড় পরে জবরজং সেজে বসেছে একেকজন। সবাই এসে গেছে, একজন বাদে, নতুন সদস্য ডলি।

ডলি! মুখ বাকাল বব। জীবনে কোনদিন সময় ঠিক রেখেছে? বাকি সবার মতই অধৈর্য হয়ে উঠেছে সে। আলোচনা শুরু করার জন্যে তর সইছে না।

এই সময় থাবা পড়ল দরজায়।

কে? ডেকে জিজ্ঞেস করল বব।

ডলি! ফিসফিস করে এমন ভঙ্গিতে বলল, যেন সাংঘাতিক কিছু ঘটে গেছে।

অকারণে এমন করছে। হাত নাড়ল বব, দেখবে, কিছুই হয়নি।

হু! তার কথায় মনে হলো কান নেই কিশোরের। পঞ্চাশ যোগ পঞ্চাশ

সমান আটাশ! নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটল সে।

সেরেছে! শুরু হলো ল্যাটিন ভাষা! মুখ বাকাল মুসা। বলা যায় না, এখুনি হয়তো বলে বসবে পঞ্চাশ মিনিটে এক ঘণ্টা হয়।

কি বললে? মুসার মন্তব্য শুনে যেন বাস্তবে ফিরে এল কিশোর। আসলেই

তো তাই-পঞ্চাশে পঞ্চাশে আটাশই তো হওয়ার কথা।

অঙ্ক ভুলে গেলে নাকি তুমি?

দরজা খুলে দিয়েছে বব। ঘরে ঢুকল ডলি।

এত দেরি করলে যে? জিজ্ঞেস করল বব।

ইশারায় তাকে কথা বলতে নিষেধ করে ডলিকে বসতে ইশারা করল কিশোর।

হঠাৎ চিৎকার করে উঠল রবিন। কিশোরের কথা বুঝে ফেলেছে। ঠিকই

বলেছে ও! পঞ্চাশে পঞ্চাশে তো আটাশই হওয়ার কথা। কারণ পঞ্চাশ পেন্সের একটা মুদ্রার ওজন যদি চোদ্দ গ্ৰাম হয়, দুটোর হবে আটাশ। কিন্তু আজ সকালে একটা মুদ্রা পেয়েছি, যেটার ওজন চার গ্রাম কম, অর্থাৎ দশ গ্রাম। ওরকম দুটো হলে দশে আর দশে দাড়াবে বিশ। এতক্ষণে বুঝেছ নিশ্চয় সবাই?

খাইছে! কপাল চাপড়াল মুসা। এটার ভাষা তো আরও ভারী, প্রাচীন গ্রীক। কিছুই বুঝিনি আমি।

আমিও না! ফারিহা বলল। রবিন, একটা বর্ণও বুঝিনি আমি তোমার

কথা।

আমিও না, ফারিহার সঙ্গে সুর মেলাল অনিতা। আমার বিশ্বাস টিটুও কিছু বোঝেনি। কি রে, টিটু?

খোলসা করে বলো না সব, মুসা বলল, তাহলেই তো হয়ে যায়। এত কথা বলা লাগে না আর।

বলছি, বলছি, কিশোরের দিকে তাকাল রবিন। কিশোর, তুমিই বলো না।

ঠিক আছে নাটকীয় ভঙ্গিতে সবার দিকে তাকাল কিশোর। সকাল বেলা এক অদ্ভুত জিনিস রবিন লক্ষ করেছে।

সেটা কি? অধৈর্য হয়ে হাত নাড়ল মুসা। তাই তো জানতে চাচ্ছি। অত

ভূমিকা না করে বলে ফেলো না।

কিশোরের পায়ের কাছে বসেছে টিটু। মাথা চাপড়ে তাকে আদর করে দিল

সে। সবাই শোনার জন্যে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে।। ঘরে পিনপতন নীরবতা। সবাইকে একটা অস্থিরতায় রাখার জন্যে যেন ইচ্ছে করে সময় নিচ্ছে কিশোর।

হ্যাঁ, শোনো, অবশেষে মুখ খুলল সে। সকাল বেলা বাজারে যাওয়ার জন্যে রেডি হয়ে বসে ছিল রবিন। আন্টি তখন টেলিফোনে কথা বলছেন। ও শুনছে আর অপেক্ষা করছে। সময় কাটছে না দেখে শেষে কতগুলো মুদ্রা নিয়ে ওজন মাপতে শুরু করে ওজন মাপক যন্ত্রে। বুঝলে কিছু? মাথা নাড়ল সবাই।

গুড, বলল কিশোর। না বোঝাতে গুড-এর কি হলো বোঝা গেল না।

অনেকগুলো মুদ্রা মেপেছে সে। আন্টি ওকে বাজার করার জন্যে দিয়েছিলেন ওগুলো। তার মধ্যে পঞ্চাশ পেন্সের মুদ্রা ছিল দুটো। মজার ব্যাপারটা হলো, দুটোর ওজন এক রকম নয়।

বলো কি! এমন ভঙ্গি করে বলল ডলি, যেন কি ভয়ঙ্কর অঘটন ঘটে গেছে।

হ্যাঁ, তাই,! মাথা ঝাকাল রবিন।

সে-জন্যেই তোমাদেরকে এখানে ডাকলাম,  কিশোর বলল। জিজ্ঞেস করার জন্যে তোমাদের কার কাছে কয়টা পঞ্চাশ পেন্সের মুদ্রা আছে।

যাতে ওগুলো নিয়ে মেপে দেখতে পারি আমরা কিশোরের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলল রবিন।

এই যে আমার কাছে দুটো আছে, সঙ্গে সঙ্গে বের করে দিল ফারিহা। আর নেই। আমার মানি-বক্সে দুটোই ছিল।

আমার পাঁচটা আছে, গর্বের সঙ্গে বলল অনিতা।এখনও কাছে কাছে। ক্রিস্টমাসের বাজার করিনি তো, তাই রয়ে গেছে।

বাকি সবাইও তাদের যার কাছে যতগুলো পঞ্চাশ পেন্সের মুদ্রা আছে বের করতে লাগল। মহা হই-চই, হট্টগোল। একসঙ্গে কথা শুরু করে দিয়েছে সব।

আরে আস্তে, আস্তে! তাড়াতাড়ি সাবধান করল কিশোর। এত চেঁচামেচি, করলে চাচী চলে আসবে দেখতে..রবিন, তোমার গবেষণাটা আরেকবার চালাও তো দেখি আমাদের সামনে।

সঙ্গে সঙ্গে কাজে লেগে গেল রবিন। একটা কমলার বাক্সের ওপর ওজন

মাপক যন্ত্রটা রাখল সে। বাক্সটাকে টেবিল হিসেবে ব্যবহার করে ওরা। পকেট থেকে মুদ্রা দুটো বের করে দেখাল সে। মায়ের বাজারের পয়সা থেকে সরিয়ে ফেলেছি এ দুটো। অবশ্য মেরে দিইনি, এক ডলারের একটা নোট দিয়ে দিয়েছি  তাকে।

ছোট মাপক যন্ত্রটার থালায় একটা মুদ্ৰা রাখল সে। কাটার দিকে তাকিয়ে বলল, দেখো, ওজন ঠিক চোদ্দ গ্রাম। প্রথমটা তুলে নিয়ে দ্বিতীয়টা রাখল

থালায়। এবার এটা দেখো। দশ গ্রাম। চার গ্রামই কম।

হ্যাঁ, তাই তো দেখছি, কাটাটার দিকে তাকিয়ে আছে মুসা। এদিক ওদিক

কেঁপে কেঁপে আস্তে করে স্থির হলো এক জায়গায়।

এখন ফারিহারগুলোর অবস্থা দেখা যাক, রবিন বলল।

মুদ্রা দুটো তার হাতে তুলেদিল ফারিহা।

দুটোই দেখা হলো।

চোদ্দ গ্রাম এবং চোদ্দ গ্রাম, কাটার দিকে তাকিয়ে থেকে মুসা বলল।

দেখি, তোমারগুলো দাও তো এবার, বব, হাত বাড়াল কিশোর।

তিনটে মুদ্রা তার হাতে ফেলে দিল বব।

চোদ্দ, চোদ্দ, এবং চোদ্দ, ওজন দেখে ঘোষণা করল রবিন।

এরপর অনিতার পালা। তার কাছে আছে পাঁচটা মুদ্রা। সবগুলো চোদ্দ গ্রাম।

কিশোরের চারটে আর মুসার দুটোর একই ওজন।

কি ডলির তিনটে মুদ্রার শেষটাকে ওজন দিয়েই চিৎকার করে উঠল। রবিন,দেখো, ওজন কম। আমার দ্বিতীয়টার সমান!

কান পেতে শব্দ শুনল সবাই।

তারপর মুসা হঠাৎ তার একটা ভারী মুদ্রা আছড়ে ফেলে দিয়ে শুনে বলল,

শুনলে? এক রকম না কিন্তু।

একমত হয়ে মাথা নাড়াল সবাই।

ভেতরে কি আছে দেখা দরকার, মুসা বলল তখন।

কি করে? ডলির প্রশ্ন।

অবশ্যই একটাকে কেটে ফেলে। জবাব দিল রবিন।

ওহ, মাথা নাড়ল কিশোর, একটা নয়, দুটোকে। বেশির ভাগ মুদ্ৰাই যেহেতু

চোদ্দ গ্রাম ওগুলোকেই স্বাভাবিক ধরব আমরা। স্বাভাবিক একটাকে কাটব প্রথমে, তারপর হালকা একটাকে। দুটোর তুলনা করতে পারব তাহলে।

মুহূর্ত দেরি না করে দেয়ালের ছকে ঝোলানো একটা লোহাকাটা করাত খুলে নিয়ে এল সে। আরও বেশ কিছু প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ঝোলানো রয়েছে ওখানে।

ওগুলো রাখার সময় কিশোর বলেছিল, কোনটা যে কখন দরকার হয়ে যাবে, কেউ বলতে পারে না। সে-জন্যেই রাখলাম।

প্রথমে ভারীটা কেটে দেখা যাক, বব বলল।

ভাইসে আটকে নেয়া উচিত না? রবিন বলল। ধাতব জিনিস। হাত দিয়ে

ধরে কাটা বিপজ্জনক হয়ে যাবে।

ভাইসও একটা আছে। কোন অসুবিধে নেই। রীতিমত একটা ওঅর্কশপ এই ছাউনিটা। চোদ্দ গ্রামের একটা মুদ্রা ভাইসে আটকে নিয়ে কাটা শুরু করল কিশোর।

জোরাল ঘ্যাচর ঘ্যাচর আওয়াজ। ঘুমিয়ে পড়েছিল টিটু। চমকে একটা কান

খাড়া করে ফেলল। কিন্তু চোখ মেলল না সে। খাওয়ার আগে আর মেলবে বলেও মনে হয় না।

অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে বাকি সবাই। কিশোরের হাতের দিকে তাকিয়ে

আছে।

মিনিটের পর মিনিট পার হয়ে যাচ্ছে। কাটা আর শেষ হয় না।

করাতের দাতের ঘষায় ধোয়ার মত উড়ছে ধাতুর সূক্ষ্ম কণা।

শেষ হয়ে এসেছে, তাই না? তর সইছে না আর রবিনের।

হঠাৎ সবাইকে চমকে দিয়ে মুদ্রাটা দুই টুকরো হয়ে একটা টুকরো মাটিতে।

পড়ে ঠন করে উঠল।

যাক, হলো শেষ পর্যন্ত! উত্তেজিত ভঙ্গিতে মাটি থেকে টুকরোটা তুলে নিয়ে দেখতে লাগল কিশোর। তারপর বাড়িয়ে দিল রবিনের দিকে। হাতে হাতে ঘুরতে থাকল ওটা। সবাই দেখল। করাতে কাটা সমান, মসৃণ ধারটায় আভুল বোলাল ডলি।

কিশোর, কি বোঝা যাচ্ছে এতে? আমার তো মনে হচ্ছে খামোকা কাটা হলো, মাঝাখান থেকে পঞ্চাশ পেন্স গরীব হয়ে গেলাম আমি।

একটু ধৈর্য ধরো, মুসা বলল, বাকিটারও একই গতি করা যাক। তারপর বোঝা যাবে লাভটা কি হলো। কি বলো কিশোর?

মাথা ঝাকাল কেবল কিশোর।

নিজের দুটো মুদ্রার মধ্যে হালকা মুদ্রাটা বের করে ডলিকে দেখাল রবিন।

এই যে, তোমার মত আমিও পঞ্চাশ পেন্স গরীব হতে চলেছি। মুদ্রাটা নিজেই ভাইসে লাগিয়ে কাটা শুরু করে দিল সে।

এবার আর আগেরটা কাটার মত এত শব্দ হলো না, কাটাও অত কঠিন হলো না। যে রকম তাড়াতাড়ি কেটে ফেলছ, ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে আছে মুসা, মনে হচ্ছে ধাতুটাই নরম, তাই না?

মাথা ঝাকাল রবিন। কোন সন্দেহ নেই তাতে। আগেরটার চেয়ে অনেক

তাড়াতাড়ি এটা কেটে ফেলল রবিন। কিশোর যেটা কেটেছে তার অর্ধেক সময়

লাগল।

ভাইসে আটকানো টুকরোটার দিকে এক নজর তাকিয়েই চিৎকার করে উঠল,

দেখো, ধাতুর দুটো স্তর!

হাঁ, তাই তো, মাটিতে পড়ে যাওয়া টুকরোটা তুলে নিয়ে বলল অনিতা।

বাইরের আস্তরটা একেবারে পাতলা। ভেতরেরটা পুরু, তবে অন্য রকম, কালো

রঙের।

হালকা, সস্তা কোন ধাতু দিয়ে তৈরি, গম্ভীর মুখে কিশোর বলল।

কেন, সস্তা কেন? প্রশ্ন করল ফারিহা।

কারণ, এই মুদ্রাগুলো জাল! জবাব দিল কিশোর। আসল মুদ্রার মত দামী

ধাতু দিয়ে তৈরি করে জালিয়াতদের কোন লাভ নেই, সেজন্যে সস্তা ধাতু ব্যবহার করে।

জালিয়াত স্তদ্ধ হয়ে গেল ডলি। কিন্তু আমার কয়েনটা জাল হতেই পারে

না। নিজের হাতের হালকা মুদ্রাটার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল সে, আমার আপা এটা দিয়েছে আমাকে।

তোমার আপার কোন দোষ নেই, ডলি, তাকে বোঝাল রবিন। এটা তো

আর তিনি নিজে বানাননি। অন্য কেউ তাকে দিয়েছে। যে দিয়েছে সে আবার

কারও কাছ থেকে পেয়েছে, সেই জন আবার অন্য কারও কাছ থেকে-এ ভাবেই। হাত বদল হতে থাকে কয়েন। আমার প্রশ্ন, প্রথম কার হাত থেকে বেরোল এটা?

হ্যাঁ, ঠিক আমারও প্রশ্ন সেটা, উত্তজিত স্বরে কিশোর বলল। এবং

প্রশ্নটার জবাব খুঁজে বের করতে হবে আমাদের। রবিন আর ডলির প্রথম কাজ

হলো এখন মুদ্রা দুটো কার কার হাত ঘুরে এসেছে যতটা সম্ভব সেটা জানার চেষ্টা করা। আমরাও ঘুরে ঘুরে খোজ-খবর নিয়ে দেখব কিছু জানা যায় কিনা।

আপাতত এটাই আমাদের প্রথম কাজ।

মীটিং শেষ হলো। ছাউনি থেকে বাগানে বেরিয়ে এল সবাই। চারটেও

বাজেনি, কিন্তু এখনই দিনের আলো মুছে যেতে আরম্ভ করেছে। ধূসর আকাশটা যেন অনেক নিচে নেমে এসে খুলে রয়েছে। তুষার পড়া শুরু হবে মনে হচ্ছে।

হ্যাঁ, পড়বে, কিশোর বলল।

সাইকেলে চেপে সবার উদ্দেশে হাত নেড়ে চলে গেল বব।

একে একে সবাই চলে গেল বিদায় নিয়ে। বাগানের গেটটা লাগিয়ে দিল

কিশোর। রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আনমনে নিচের ঠোঁটে চিমটি

কাটল একবার সে। বিড়বিড় করে বলল, মনে হচ্ছে রহস্য আরেকটা পেয়ে গেলাম!

বাড়ি ফিরে সোজা মার দিকে এগিয়ে গেল রবিন। আগের দিন যে যুদ্রাটা তাকে দিয়েছেন তিনি, সেটার কথা জিজ্ঞেস করার জন্যে। কার কাছ থেকে নিয়েছেন, বলতে পারলেন না। তবে তার আগের দিন কোন কোন দোকানে জিনিস কিনতে গিয়েছিলেন, সেটা মনে করতে পারলেন। যত্ন করে নোটবুকে তালিকাটা লিখে নিল রবিন।

ডলিও একই কাজ করল। তার বড় বোনকে জিজ্ঞেস করে জেনে নিল গত

চব্বিশ ঘণ্টায় কোথায় কোথায় গিয়েছিল। ডলির বড় বোন জানাল, পাশের শহরটাতে হেয়ারড্রেসারের দোকানে গিয়েছিল চুল ঠিক করতে। তারপর গিয়েছিল একটা পোশাকের দোকান আর কেমিস্টের দোকানে। গায়ে ফিরে যায় পোস্ট অফিসে, সেখান থেকে মুদীর দোকান আর বেকারিতে।

পাঁচটার সময় ডলির সঙ্গে দেখা করল রবিন, তালিকা দুটো মিলিয়ে নেয়ার জন্যে। কিন্তু দুজনের তালিকায় একটা দোকানের নামও পেল না যেগুলো মিলে।

অর্থ্যাৎ,,রবিনের আম্মা যেখানে যেখানে গিয়েছেন, তার কোনটাতেই যায়নি ডলির বোন। এর দুটো মানে হতে পারে। হয় ভিন্ন ভিন্ন দিনে যে কোন এক জায়গা থেকে মুদ্রা দুটো তাদের হাতে এসেছে, নয়তো দুই জায়গা থেকে ওগুলো পেয়েছে তারা। কোখান থেকে এসেছে, বের করা অসম্ভব বলে মনে হলো ওদের কাছে।

বাকি গোয়েন্দারাও চুপ করে বসে রইল না। যার যার মানি-বক্স খালি করে

টাকা-পয়সা যা আছে সব নিয়ে বেরিয়ে পড়ল সেগুলো ভাঙিয়ে পঞ্চাশ পেলের

মুদ্রা জোগাড়ের জন্যে। ভাগ্যিস স্কুল এখন ছুটি, নইলে এসব করার সময়ই পেত না কেউ। রহস্যটা হাতছাড়া হয়ে যেত।

কিশোর, ফারিহা আর টিটু গেল পোস্ট অফিসে। কাউন্টারে বসা মেয়েটা

উৎসাহের সঙ্গেই ওদের টাকা-পয়সা ভাঙিয়ে পঞ্চাশ পেন্সের মুদ্রা দিয়ে দিল।

বব দাড়িয়ে রইল রাস্তায়। পথচারী দেখলেই একটা করে ডলার বাড়িয়ে ধরে অনুরোধ করতে লাগল পঞ্চাশ পেন্সের দুটো মুদ্রা দেয়ার জন্য।

মুসা করতে গেল বাজারে,টুকিটাকি জিনিষ কিনতে লাগল। এমন করে

কিনল, যাতে প্রচুর পঞ্চাশ পেলের মুদ্রা জোগাড় হয়। যেমন, এক টিউব পেপারমিট লজেন্স কিনলে দিতে হবে বিশ পেন্স, দোকানিকে এক ডলার দিলে খুশি হয়েই সে বাকি পয়সার সঙ্গে একটা পঞ্চাশ পেন্স দিয়ে দিল। প্রতি দোকান

থেকে একটার বেশি জিনিস কিনল। আর এই কাজটা করতে গিয়েই একটা মজার আবিষ্কার করে বসল সে।

মুদী দোকান থেকে এক প্যাকেট বিস্কুট কিনে, টাকা দিয়ে দোকানির বউকে

জিজ্ঞেস করল পঞ্চাশ পেন্সের মুদ্রা দিতে পারবে কিনা।

পারব। তারপর মাথা নাড়তে নাড়তে যোগ করল মহিলা, বুঝলাম না

লোকের কি হয়েছে আজ। সবাই এসে খালি পঞ্চাশ পেন্সের মুদ্রা চাইছে।

খানিক দূরে একটা বেকারিতে অনিতার বেলায়ও প্রায় একই ব্যাপার ঘটল।

একটা লোক কেক কিনে দাম মিটিয়ে দেয়ার পর মহিলাকে কয়েকটা ডলার দিয়ে জিজ্ঞেস করল, এগুলোর বিনিময়ে তাকে পঞ্চাশ পেলের মুদ্রা দিতে পারবে কিনা।

লোকটা অনেক লম্বা, উত্তেজিত কষ্ঠে বলল অনিতা। মাথার হ্যাটটা চোখের ওপর নামিয়ে রেখেছিল। কোটের কলার তুলে দিয়ে চিবুক ঢেকে দিয়েছিল এমন ভাবে, যাতে তার চেহারা বোঝা না যায়। কিন্তু তার বা গালের কাটা দাগটা ঠিকই দেখে ফেলেছি আমি।

বেকারিতে যা যা শুনে এসেছে, সবাইকে জানাচ্ছে সে। ছটা প্রায় বাজে। কে কি করে এসেছে, বলার জন্যে আবার জমায়েত হয়েছে গোয়েন্দারা। মুসা আর অনিতা জরুরী খবর জেনে এসেছে। বাকি সবাই তেমন কোন খবর আনতে না পারলেও পঞ্চাশ পেলের মুদ্রা নিয়ে এসেছে অনেকগুলো। তবে দুঃখের কথা, ওগুলোর কোনটার ওজনই চোদ্দ গ্রামের নিচে নয়।

খড়ের গাদায় সুচ খুঁজছি আমরা, মুখ কালো করে ডলি বলল।

জাল মুদ্রা পাইও যদি আরও, তার সঙ্গে, সুর মেলাল বব, তাহলেই বা

জালিয়াতদের খুঁজে বের করব আমরা কিভাবে? টাকা সর্বক্ষণ হাত থেকে হাতে ঘুরে বেড়াচ্ছে-কার কাছ থেকে কখন কি ভাবে কার কাছে গেল, কিছুই বলার উপায় নেই।

তা ঠিক, একমত হলো কিশোর। আজ, বিকেলে যে ভাবে গায়ের পথে

পথে ঘুরে বেড়ালাম আমরা, এ রকম করে ঘুরে কোন লাভ নেই।

তাহলে কি করব? রবিনের প্রশ্ন। রহস্যটার ব্যাপারে তার আগ্রহই যেন

সবচেয়ে বেশি। তার আশঙ্কা হচ্ছে বাকি সবাই ভোটাভুটি করে রহস্য উদ্ধারের চেষ্টাটাই না বাদ দিয়ে দেয়।

পুলিশকে জানাতে পারি আমরা, মুসা বলল।

পুলিশ জানে না কি করে বুঝলে,রবিন বলল। আমাদের আগেই হয়তো জেনে বসে আছে ওরা।

হ্যাঁ, তা ঠিক, বব বলল। বেকারিতে যে লোকটাকে দেখে এসেছে ডলি,

লোকও হতে পারে। সাদা কাপড়ে তদন্ত করে বেড়াচ্ছে হয়তো।

উঁহুঁ, ওকে আমার মোটেও ডিটেকটিভ বলে মনে হয়নি, মাথা নাড়ল ডলি। বরং কেমন রহস্যময় ভাবভঙ্গি। পুলিশ ওরকম করে না।

তারমানে তদন্তটা চালিয়েই যেতে হচ্ছে আমাদের, কিশোরের দিকে তাকাল

রবিন। তাই না?

কিশোর জবাব দেবার আগেই চিৎকার করে উঠল টিটু, খুফ। খুফ।

হেসে ফেলল কিশোর, আমি আর কি বলব? টিটুই তো যা বলার বলে দিল।

যাই হোক, গায়ে যা দেখার দেখে নিয়েছি আমরা। এখানে আর কিছু দেখার নেই। শহরে গিয়ে চেষ্টা করে দেখতে হবে। ভাগ্য ভাল হলে কিছু পেয়েও যেতে পারি ওখানে।

ওর কথা যে কতখানি সত্যি, তখন যদি সেটা জানত!

পরদিন সকালে পাশের শহরে যেতে তৈরি হলেন ববের আম্মা। ববকে বললেন সঙ্গে যেতে। ববের ছোট বোন জুলিয়াও সঙ্গে যেতে চাইল। আপত্তি করলেন না তিনি। গেলে ররং ভালই। বড়দিনের বাজার করবেন। জিনিসপত্র প্রচুর। বহন করার জন্যেও লোক দরকার।

শহরের বড় রাস্তা ধরে হেঁটে যাচ্ছে তিনজনে। ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের সামনে এসে দাড়িয়ে গেল জুলিয়া।

দেখো, দেখো, মা, উত্তেজিত স্বরে বলে উঠল সে। দুজন ফাদার দোকানের দরজায় দাড়িয়ে থাকতে দেখা গেল দুজন লাল কাপড় পরা লোককে। লম্বা, সাদা বড় বড় দাড়ি। ওদের সঙ্গে দাড়িয়ে ছবি তুলছে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা। ক্রেতা করার নতুন কায়দা। ভালই। দোকানের ভেতর ফাদার ক্রিস্টমাস সেজে মূর্তির মত দাড়িয়ে থাকাটা পুরানো হয়ে গেছে।

মা, আমি ফাদার ক্রিস্টমাস দেখব! ফাদার ক্রিস্টমাস দেখব! মার হাত

ধরে টানাটানি শুরু করল জুলিয়া।

শিকারীর চোখ মেলেই ছিল ফাদাররা। দেখে ফেলল একজন। এগিয়ে এসে বলল, আপনার মেয়েকে নিয়ে একটা ছবি তুললে কেমন হয়, ম্যাডাম মাত্র এক ডলার দশ পেন্স লাগবে। চমৎকার একটা বাঁধানো ছবি পেয়ে যাবেন। যখন ইচ্ছে দেখে স্মরণ করতে পারবেন এবারের বড় দিনটাকে। কি বলেন?

ববের আম্মা জবাব দেবার আগেই জুলিয়াকে টেনে নিয়ে গিয়ে পোজ দিয়ে

দাড়িয়ে গেল দ্বিতীয় ফাদারের সামনে।

অনুমতি না দিয়ে আর পারলেন না ববের আম্মা। ঠিক আছে, তুলুন, তবে

মাত্র একটা, তার বেশি না।

খুব খুশি জুলিয়া। পেছন থেকে তাকে জড়িয়ে ধয়ে পোজ দিয়ে। দাড়াল ফাদার। সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তুলল তার সঙ্গী। হেসে বলল জুলিয়াকে, হয়ে গেছে।

মা আর ভাইয়ের কাছে ফিরে এল জুলিয়া। ছবি ডেভেলপ হতে দেরি হলো

না। সেটা বাড়িয়ে ধরে প্রথম ফাদার ববের আম্মাকে বলল, এই যে ম্যাডাম

নিন। মাত্র এক ডলার দশ পেন্স।

ছবি দেখে খুশি হলেন ববের আমা। বাহ, ভাল হয়েছে তো! ছবিটা ববের

হাতে রাখতে দিয়ে ব্যাগ থেকে দুই ডলার বের করে দিলেন তিনি লোকটাকে।

দশ পেন্স রেখে নব্বই পেন্স ভাঙতি দিল তাকে লোকটা। তার মধ্যে একটা

পঞ্চাশ পেন্সের মুদ্রাও রয়েছে।

পঞ্চাশ পেন্স। আরেকটু হলে হাত থেকে ছবিটাই ফেলে দিচ্ছিল বব। শুরুটা চমৎকার! পঞ্চাশ পেন্সের মুদ্রাটা কি ভাবে মায়ের কাছ গেকে নেয়া যায় সেই চিন্তা করতে লাগল সে।

হঠাৎ করে নিতান্ত কাকতালীয় ভাবেই সমস্যাটার সমাধান হয়ে গেল। মিনিট দশেক পর বব আর জুলিয়া একটা খবরের কাগজের ট্যান্ডের সামনে অপেক্ষা করছে। মা গেছেন ভেতরে, কাগজ কিনতে। খানিক পর বেরিয়ে এসে ববকে জিজ্ঞেস করলেন, বব, তোর কাছে ভাঙতি পয়সা আছে? পঞ্চাশ পেন্স ভাঙিয়ে দিতে পারবি? তোর বাবার জন্যে একটা পত্রিকা কেনা দরকার। দোকানদার ভাঙতি দিতে পারছে না।

হাতে যেন চাঁদ পেয়ে গেল বব। তাড়াতাড়ি পকেট থেকে ভাঙতি পয়সা বের করে গুঁজে দিল মায়ের হাতে। তবে মায়ের পঞ্চাশ পেন্সের মুদ্রাটা নিয়ে নিজের পকেটে ভরতে ভুলল না। বাজিয়ে শোনার প্রবল ইচ্ছেটা চাপা দিল সে। শোনার জায়গা নয় এটা। লোকজনের অভাব নেই। কে কোনখান থেকে নজর রেখেছে বলা বাড়ি ফিরে আর একটা মুহূর্ত দেরি করল না সে। সিড়ির রেলিঙের ধাতব হাতলে বাড়ি মারল। উত্তেজনায় কেঁপে উঠল বুক, যখন শুনল শব্দটা আসল মুদ্রার মত মিষ্টি নয়। অন্য রকম। কেমন ভোঁতা ভোঁতা।

খোদা! কি কপাল আমার! ভাবল সে। গতকাল এ রকম একটা জিনিসের

জন্যে পুরো গ্রীনহিলস গ্রামটা চষে বেড়িয়েছে ওরা। কিন্তু পায়নি।

দশ গ্রাম। হুঁ, আরেকটা জাল মুদ্রা এটা, কোন সন্দেহ নেই তাতে, মাপক যন্ত্র দিয়ে মেপে দেখে বলল কিশোর।

কোথায় পেলে এটা? ববকে জিজ্ঞেস করল অনিতা। আজকেও সারাটা সকাল ঘুরে বেড়িয়েছি গায়ের মধ্যে, কিছুই পাইনি। আর তুমি শহরে একবার গিয়েই পেয়ে গেলে!

হেনরির ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের বাইরে পেয়েছি, বব বলল। ফাদার

ক্রিস্টমাস দুজনের কথাও ওদের জানাল সে।

দাঁড়াও, দাঁড়াও! হঠাৎ বলে উঠল রবিন। ফাদার ক্রিস্টমাস! সেদিন

আমাদের পাশের বাড়ির মিসেস ডগলাসও গিয়েছিলেন শহরে। সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন তার ছেলেকে। ওই ছেলেটাও নাকি ফাদার ক্রিস্টমাসের সঙ্গে ছবি তুলেছে। মিসেস ডগলাস মাকে বলছিলেন। আমার মুদ্রাটা যেদিন পেয়েছি তার আগের দিন।

মজার ব্যাপার তো! মুসা বলল। তারমানে খোঁজ-খবর পাওয়া যেতে শুরু করেছে।

কিন্তু আমি এ কথা মেনে নিতে পারছি না  ডলি বলল। আমার বড় বোন তো আর ওদের সঙ্গে পোজ দিয়ে ছবি তুলতে যায়নি।

তারমানে তুমি বলতে চাও, ফাদার ক্রিস্টমাসরা ওই কয়েন দেয়নি? এই

মুদ্রা রহস্য নিয়ে খুব উত্তেজিত হয়ে আছে সে।

হয়তো দিয়েছে, চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল কিশোর। পয়সা তো হাতে হাতেই

ঘোরে। স্বাভাবিক ভাবে চোখে না পড়লে কে আর গবেষণা করে দেখতে যায় কোনটা আসল কোনটা নকল। রবিন যদি ওভাবে হঠাৎ করে আবিষ্কার না করে ফেলত, ওটাও চলে যেত বাজারে, অন্য কারও কাছে। ডলির কয়েনটাও অন্য কারও কাছ থেকে ফাদার ক্রিস্টমাসের হাত ঘুরে, ডলির আপার হাত ঘুরে তার হাতে চলে এসেছে।

তা ঠিক, ফারিহা বলল। তাছাড়া ফাদার ক্রিস্টমাসরা পয়সা জাল করবে এটাও ভাবা যায় না।

তার দিকে তাকিয়ে হাসল কিশোর।

যদিও সবাই জানে, আবার বলল ফারিহা, দোকানের ফাদার ক্রিস্টমাসরা

আসল হয় না।

কিন্তু একটা কথা ভেবে দেখো, জাল কয়েন পাচারকারী যদি হয়ও ওরা, বব বলল, অত বড় বড় দাড়ির আড়ালে কেউ চিনতে পারবে না ওদের।

হ্যাঁ, তাই তো।দুজন ফাদার ক্রিস্টমাস বাচ্চাদের সঙ্গে এ ভাবে হেসে হেসে কথা বলে, কে সন্দেহ করবে তাদের! রবিন বলল।

আমরা করব! দৃঢ়কষ্ঠে জবাব দিল কিশোর। এবং সেটা পরীক্ষা করে দেখার জন্যে আজই শহরে যাব আমরা।

বাসে করে বিকেল চারটের সময় এসে ডগলাসের ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের সামনে নামল ওরা। বড় দিনের সময় এখন, সকালে যেমন ক্রেতার ভিড় ছিল, বিকেল বেলাও একই রকম ভিড়।

ওই যে ওরা!, উত্তেজিত ভঙ্গিতে দুই ফাদার ক্রিস্টমাসকে দেখাল বব।

এ ভাবে চেঁচিও না, সাবধান করল কিশোর। এসো আমার সঙ্গে।

সবাইকে নিয়ে চলে এল এক ক্রিস্টমাস ট্রী বিক্রেতার দোকানের কাছে। তৈরি

করা ক্রিস্টমাস গাছের ছোটখাট একটা জঙ্গল হয়ে আছে। তার আড়ালে এসে

দাড়াল ওরা কি করা যায় পরামর্শ করার জন্যে।

ওই যে ওই লোকটা জুলিয়ার ছবি তুলেছিল, গাছের ফাঁক দিয়ে হাত তুলে

দেখাল বব।

সাথে পিস্তল-টিস্তল নেই তো? অনিতা বলল।

হ্যাঁ, তা তো আছেই, মুসা বলল। দাড়ির মধ্যে লুকানো।

বাজে কথা একদম বলবে না আমার সঙ্গে! রেগে উঠল অনিতা। ছাগল

পেয়েছ নাকি আমাকে কিছু বুঝি না মনে করেছ?

চুপ করে থাকা কিংবা আস্তে কথা বলার কথা ভুলে গিয়ে চিৎকার করে উঠল সে।

চুপ! আস্তে। ধমক লাগাল কিশোর। কাজের কথা শোনো এখন, সমস্ত

বিকেল এখানে দাড়িয়ে থাকার জন্যে আসিনি আমরা। কিছু করতে হবে। ভাগ

ভাগ হয়ে যাব। তোমরা গিয়ে দাঁড়াও উল্টোদিকের ওই চত্বরটাতে। খবরের

কাগজের স্ট্যান্ডটার অাড়ালে দাড়াবে, ওরা যাতে দেখতে না পায়। সাথে করে

টিটুকে নিয়ে যাও। ফারিহা আর ডলিকে নিয়ে আমি যাচ্ছি দোকানের কাছে,

জানালা দিয়ে চোখ রাখব লোকগুলোর ওপর।

বলার পর আর এক মুহূর্তও দেরি করল না কেউ। ঘুরতে বেরোনো অতি

সাধারণ কয়েকটা ছেলের মত ভঙ্গি করে রইল ওরা। যার যার জায়গায় থেকে

নজর রাখতে লাগল ফাদার ক্রিস্টমাসদের ওপর।

অন্য দোকানের ফাদারদের মতই এই দুজনও স্বাভাবিক আচরণ করছে।

ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের দিকে তাকিয়ে হাসছে, তাদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছে। ছবি তোলার জন্যে অনুরোধ করছে তাদের বাবা-মাকে। বাচ্চাদের কোলে নিয়ে আদর করছে। চওড়া হাসি হাসছে তুলার তৈরি দাড়ি-গোঁফের আড়াল থেকে।

নাহ, কোন কিছুই সন্দেহ করার মত নয়, চাপা স্বরে মুসাকে বলল রবিন।

জোরে নিঃশ্বাস ফেলল মুসা। সে-রকমই তো লাগছে। আসার সঙ্গে সঙ্গে

এত তাড়াতাড়ি কিছু একটা দেখে ফেলব, সে-আশাও আমি অবশ্য করছি না। তা ছাড়া কিশোর তো বললোই ফাদারদের কোন দোষ না-ও থাকতে পারে; হতে পারে। ওদের অজান্তেই ওদের হাত দিয়ে হয়তো কেউ পাচার করে দিচ্ছে নকল মুদ্রাগুলো।

হ্যাঁ, তা পারে, কিছুটা হতাশ কণ্ঠেই জবাব দিল রবিন। আর ববের আম্মা

যে কয়েনটা ববকে দিয়েছেন, সেটাও ফাদারদের কাছ থেকেই পাওয়া, সেটাও

তো ঠিক না হতে পারে। বাজার করেছেন। আরও অনেকে পঞ্চাশ পেন্সের কয়েন তাকে দিয়ে থাকতে পারে।

কিশোররা তখন দোকানের বাইরে জানালার কাছে দাঁড়িয়ে উঁকি দিচ্ছে।

ভঙ্গিটা যেন দোকানের উইন্ডোতে সাজানো খেলনা আর অন্যান্য জিনিস দেখছে।

রাস্তার দিকে পেছন করে আছে, উইন্ডোর কাছে দাঁড়ানো অন্যান্য ছেলেমেয়েদের মত। উইভোর কাচে চত্বরের লোকজনকে দেখা যাচ্ছে। তীক্ষ দৃষ্টিতে তাদেরকে দেখছে ওরা। ফাদার ক্রিস্টমাসদেরও দেখা যাচ্ছে, কাজেই ওই দুজনকে দেখার জন্যেও সরাসরি তাকানো লাগছে না ওদের।

দুই ঘণ্টা ধরে একই জায়গায় দাড়িয়ে থাকল ফারিহা আর ডলি। বাজার

করতে আসা ছেলেমেয়েরা দোকানে ঢুকছে বেরোচ্ছে, উত্তেজিত কলরব করছে। অস্বাভাবিক কোন কিছুই চোখে পড়ল না ওদের। কিছুই করতে না পেরে বিরক্ত হয়ে গেল টিটু। লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল। ঘটনাটা ঘটল তখনই। তার থাবা মাড়িয়ে দিল একজন লোক। চিৎকার দিয়ে উঠল টিটু।

প্রায় একই সময়ে চিৎকার দিয়ে ববের হাত খামচে ধরল অনিতাও।

আরে কি করছ। হাতে নখ বসে যেতে চেচিয়ে উঠল বব।

স্বপ্ন দেখছি নাকি আমি! অনিতা বলল।

তা কি করে বলব? কিন্তু আমার হাতের চামড়া যে তুলে দিচ্ছ এটা ঠিক।

ওই যে লোকটা-কালো ওভারকোট পরা, ববের কথা যেন কানেই যায়নি

অনিতার, রাস্তা পার হয়ে গেল এইমাত্র-দেখলে না?

কাচের দিকে এমন করে তাকাতে লাগল বব, যেন পারলে কাচ থেকে খামচি দিয়ে বের করে আনে লোকটাকে। কালো কোট পরা একজন লোককে চত্বর থেকে নেমে যেতে দেখল সে-ও।

ওই লোকটাকেই দেখেছিলাম আমি বেকারিতে, গালে কাটা দাগ, উত্তেজিত

স্বরে বলল অনিতা। ও গিয়ে কথা বলেছিল ফাদার ক্রিস্টমাসদের সঙ্গে। বুঝতে পারছি না কি ঘটবে এখন!

উত্তেজনায় টানটান হয়ে কাচের দিকে তাকিয়ে রইল দুজনে। আশেপাশে

ঘোরাফেরা করছে ছেলেমেয়ের দল, হই-চই হাসাহাসি করছে: কোন কিছুই যেন

কানে ঢুকছে না বব বা অনিতার।

কই, কিছুই তো করছে না! হতাশ কষ্ঠে বলল বব। লোকটা থামছে না।

রাস্তার ধার দিয়ে সোজা এগিয়ে চলেছে।

আরে না না! হঠাৎ দম আটকে ফেলল অনিতা। দেখো, কি করছে–যুরে

গেল…এগিয়ে যাচ্ছে সিড়ির দিকে!.-আরে, কি কাণ্ড!

জোরে চিৎকার দিয়ে নিজের অজান্তেই ঘুরে সরাসরি তাকিয়ে ফেলল লোকটার দিকে। তার চিৎকার শুনে অন্য ছেলেমেয়েরাও ফিরে তাকাল। হাসির রোল উঠল। চত্বরে লম্বা হয়ে পড়ে গেছে কোটওয়ালা লোকটা। সঙ্গে নিয়ে পড়েছে একজন ফাদার ক্রিস্টমাসকে।

আরি দেখো না অবস্থা বব বলল। চত্বরে কয়েনের ছড়াছড়ি। ফাদারের

পকেট থেকে পড়েছে। কম করে হলেও দশটা পঞ্চাশ পেন্সের মুদ্রা আছে ওর

মধ্যে।

প্রায় ছোঁ দিয়ে দিয়ে পঞ্চাশ পেন্সের কয়েকটা মুদ্রা তুলে নিল কোটওয়ালা

লোকটা।

চার হাত-পায়ে ভর দিয়ে উঠে বসল ফাদার ক্রিস্টমাস। ছড়িয়ে থাকা পয়সাগুলো তুলে তুলে পকেটে ভরতে শুরু করল। তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে গেল ছেলেমেয়েরা। এই হট্টগোলের মধ্যে সবার অলক্ষে উধাও হয়ে গেল কোটওয়ালা লোকটা।

আপনাআপনি পড়েনি ফাদার, বব বলল। তাকে ফেলে দিয়েছে

কোটওয়ালা লোকটা। পঞ্চাশ পেন্সের কয়েনগুলো হাতানোর জন্যে।

আমারও তাই ধারণা, অনিতা বলল।

কিশোর, ফারিহা আর ডলি পুরো ঘটনাটাই ঘটতে দেখেছে। ওরাও পড়ে

যেতে দেখেছে কোটওয়ালা লোকটাকে, দেখেছে তার গালের কাটা দাগ।

গতকালের বেকারির সেই লোকটা বলেই তাকে চিহ্নিত করেছে ডলি।

কয়েকটা কয়েন তুলে নিয়ে গেছে সে! ঘন ঘন দম নিতে নিতে বলল ডলি। চট করে পঞ্চাশ পেন্সের কয়েনগুলো তুলে পকেটে ভরে ফেলেছে।

তারমানে আমাদের মত একই ব্যাপারে তারও আগ্রহ দেখা যাচ্ছে, কিশোর বলল। গুড। তারমানে সত্যি সত্যি এগোনো শুরু করেছি আমরা।

কিন্ত লোকটা গোয়েন্দা না জালিয়াত? ফিসফিস করে বলল ফারিহা।

জানি না, জবাব দিল কিশোর। তবে একটা ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই

আমার, ওই দুজন ফাদার ক্রিস্টমাসের মধ্যে গোলমেলে কিছু একটা রয়েছে।

আমি ভাবছি পড়ে যাওয়া পঞ্চাশ পেন্সের মুদ্রাগুলো আসল ছিল, না নকল, ডলির প্রশ্ন।

জেনে নিলেই তো পারি, কিশোর বলল। পকেট থেকে টাকা বের করে দিল ফারিহাকে। ফারিহা এই নাও দুই ডলার। একটা ছবি তুলে এসোগে ফাদার ক্রিস্টমাসদের সঙ্গে।

আমি! আঁতকে উঠল ফারিহা।

অসুবিধে কি? কিশোর বলল। ফাদারদের পয়সা দরকার। তোমার ছবি

তুললে পয়সা পাবে। তুলবে না কেন? তা ছাড়া তোমাকে মানাবেও। কারণ তুমি এখনও ছোট আছ। অামি তুলতে গেলে মানাবে না।

বাচ্চাদের মত করে কোলের কাছে জড়িয়ে ধরে রেখেছে একজন

ফাদার ক্রিস্টমাস, আরেকজন তার ছবি তুলছে-দৃশ্যটা কল্পনা করেই হেসে ফেলল ডলি। কিন্তু ফারিহা হাসল না। ফাদার ক্রিস্টমাসদের সঙ্গে ছবি তুলতে মোটেও ভাল লাগছে না তার। কিন্তু উপায় নেই। গোয়েন্দাগিরিতে অত বাছবিচার করলে চলে না। অনিচ্ছা সত্তেও মুখে হাসি ফুটিয়ে ছবি তুলতে গেল সে।

উল্টো দিকের উইনডোতে দাড়িয়ে ফারিহাকে ফাদার ক্রিস্টমাসদের দিকে

এগিয়ে যেতে দেখল বব আর অনিতা। টিটু ওকে দেখেই ছুটে যাওয়ার জন্যে

টানাটানি শুরু করল। এক জায়গায় বসে থেকে মহা বিরক্ত হয়ে উঠেছে সে।

ফারিহাকে ফাদারদের সঙ্গে ছবি তুলতে দেখে কাগজের স্ট্যাভের ওপাশে

দাড়িয়ে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারল না মুসা আর রবিন। কয়েক

মিনিটের মধ্যেই ফারিহার হাতে তার ছবিটা ধরিয়ে দেয়া হলো

টাকা বের করে দিল ফারিহা।

আড়ালে দাড়িয়ে একজন ফাদার ক্রিস্টমাসের হাত থেকে ফারিহাকে ভাঙতি পয়সা নিতে দেখল গোয়েন্দারা সবাই।

বেচারি ফারিহা!আষাঢ়ের আকাশের মত মুখ কালো করে তাকে ফিরে

আসতে দেখল ওরা। কাছে এসে কিশোরকে জানাল সে, একটা পঞ্চাশ পেন্সের কয়েনও দেয়নি।

হুঁ, মোটেও হতাশ মনে হলো না কিশোরকে। যাই, দেখি, আমার ভাগ্যটা

পরীক্ষা করে আসি।

দোকান থেকে বেরিয়ে গেল কিশোর। খানিক আগে পড়ে গিয়েছিল যে

লোকটা তার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। পকেট থেকে একটা ডলার বের করে বাড়িয়ে।দিয়ে অনুরোধ করল সে, আমাকে দুটো পঞ্চাশ পেন্সের কয়েন দিতে পারেন? আমার ছোট বোনকে পঞ্চাশটা পেন্স দিতে হবে কার্ড কেনার জন্যে। আমার কাছে

ভাঙতি নেই।

নিশ্চয়ই, হাসিমুখে জবাব দিল ফাদার ক্রিস্টমাস। পকেট থেকে খুচরা বের করে কিশোরকে দিয়ে দিল। কিশোর সে-দুটো পকেটে ভরে, লোকটাকে ধন্যবাদ জানিয়ে, ফিরে এল দোকানের ভেতর।

ডলি আর ফারিহার কাছে এসে মুদ্রা দুটো বের করে বাজিয়ে শোনাল ডলি আর ফারিহাকে। নিজেও শুনল। তারপর বলল, শুনলে তো? আরও দুটো নকল কয়েন।

মিনিট পনেরো পরে আবার ক্রিস্টমাস গাছগুলোর পেছনে জমায়েত হলো গোয়েন্দারা। সাবধান রইল যাতে কারও চোখে না পড়ে।

ওরা এখন নিশ্চিত, ফাদার ক্রিস্টমাসের ছদ্মবেশের আড়ালে লুকিয়ে আছে ভয়ানক দুজন অপরাধী। কিন্তু দুটো বড় প্রশ্নের উত্তর অজানা রয়ে গেল।এক, কি করে প্রমান করবে লোকগুলো অপরাধী। দুই, এদের সঙ্গে গালকাটা লোকটার সম্পর্ক কি?

কি করা যায় সেটা নিয়ে আলোচনা করছে ওরা, এই সময় ঘণ্টা বেজে উঠল। হেনরির ডিপার্টমেন্টাল স্টোর আর অন্য সব দোকানপাট বন্ধ করার সময় হয়েছে। বড়দিনের সময় বলে এখন অনেক দেরি করে বন্ধ হয়, যাতে অফিস ফেরতা লোকজন বাজার করে যেতে পারে। দোকানগুলো থেকে ঝাঁক বেঁধে বেরিয়ে আসতে শুরু করল ক্রেতার দল। চত্বর পেরিয়ে রাস্তায় নেমে যেতে লাগল। বিক্রি না হওয়া ক্রিস্টমাস গাছগুলো দোকানের ভেতর নিয়ে যেতে শুরু করল দোকানদার।

শেষবারের মত একটা বাচ্চার ছবি তুলল ফাদার ক্রিস্টমাসরা। তারপর যখন দেখল, আর একজন ক্রেতাও অপেক্ষা করছে না কোথাও, রাস্তা ধরে হটিতে শুরু করল দুজনে।

আজকের মত কাজ শেষ ওদের, মুসা বলল।

হ্যাঁ, কাজ মানে তো মুদ্রা পাচারী একদিনের জন্যে যথেষ্ট পাচার-টাচার করে এখন গোপন আস্তানায় ফিরে যাচ্ছে, বব বলল।

তাহলে ওদের পিছু নিলেই পারি, ফারিহা বলল।

চমৎকার প্রস্তাব! লুফে নিল রবিন।

কেউ আপত্তি করল না। লোকগুলোর পেছন পেছন রওনা হলো।

মোড় নিয়ে মিলরোডে ঢুকে অদৃশ্য হয়ে গেল লোকগুলো।

জলদি এসো? কিশোর বলল। কোন বাড়িটাড়িতে ঢুকে পড়লে আর দেখতে পাব না।

দৌড়াতে শুরু করল ওরা। আগে আগে ছুটছে টিটু। মাটিতে নাক নামিয়ে গন্ধ নিছে। এতক্ষণ পর একটা কাজের মত কাজ পেয়ে গিয়ে মহাখুশি।

কিন্তু মোড় নিয়ে অন্য পাশে এসে হতভম্ব হয়ে গেল ওরা।

লোকগুলো উধাও!

খাইছে। হাপাতে হাপাতে বিমূঢ়ের মত এদিক ওদিক তাকাচ্ছে মুসা।

আমরা যে পিছু নিয়েছি নিশ্চয় বুঝে ফেলেছে, অনিতা বলল।

কিংবা হয়তো গাড়িটাড়ি কিছু রাখা ছিল এখানে। তাতে উঠে চলে গেছে, ডলি বলল।

কিংবা হরিণে টানা স্লেজ, ব্যঙ্গ করে বলল রবিন। যে গাড়িতে চড়ে চলাফেরা করে ফাদার ক্রিস্টমাস।

কিন্তু এ মুহূর্তে এ রসিকতায় হাসতে পারল না কেউ। ভীষণ হতাশ হয়ে বব বলল, তারমানে ওদের সাক্ষাৎ পাওয়ার জন্যে কাল সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে আমাদের। হেনরির দোকান যখন খোলে।

কিন্তু হঠাৎ করেই জোরে হাত নেড়ে বন্ধুদের সাবধান করে দিল কিশোর। ঠেলে, ধাক্কা দিয়ে সবাইকে নিয়ে চলে এল একটা পার্ক করে রাখা গাড়ির আড়ালে। ওই যে ওরা! কয়েক মিনিটের জন্যে ওই অফিস বাড়িটায় ঢুকেছিল।

তাই তো মনে হচ্ছে নিচু স্বরে বলল বব। পোশাক খোলার জন্যে হবে। হয়তো।

দেখলে? চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে ফারিহা। মোটেও অপরাধী মনে হচ্ছে না এখন ওদেরকে।

অনিতাও হা হয়ে গেছে। বয়েসও তো আমাদের চেয়ে তেমন বেশি না।

খানিক দূরে একটা অফিস বিল্ডিঙের সদর দরজা দিয়ে বেরিয়ে এসেছে দুজন তরুণ। বগলে দুটো লাল-সাদা রঙুের পোশাক।

ওখানে ঢুকেছিল পরনের ফাদার ক্রিস্টমাসের আলখেল্লা খোলার জন্যে, মুসা বলল। নিচে তো একেবারে সাধারণ পোশাক।

কিন্ত ওই পোশাক এ ভাবে খোলাখুলি নিয়ে যাচ্ছে কেন? মানুষে দেখলে যে চিনে ফেলবে সেই পরোয়াও করছে না নাকি? আনমনে বিড়বিড় করল কিশোর। ব্যাপারটা মাথায় ঢুকছে না আমার।

পিছু নেব নাঁকি ওদের? জিজ্ঞেস করল রবিন। তাহলে হয়তো আরও কিছু জানা যাবে। কি, নেব?

অতএব রওনা হয়ে গেল ওরা। পার্ট করে রাখা গাড়িগুলোর আড়ালে আড়ালে বেশ কিছুটা দূরত্ব রেখে অনুসরণ করে চলল লোকগুলোকে।

একের পর এক রাস্তা পেরিয়ে যেতে লাগল ওরা। শহরের ভেতর দিয়ে চলে যাওয়া নদীটার পাড় ধরে এগোল খানিক। তারপর একটা বাগানওয়ালা চত্বরে চুকল। এক সারি সামনে গিয়ে কথা বলতে লাগল দুজনে।

বাগানে ঢুকে পড়া উচিত আমাদের, কিশোর বলল। পাতাবাহারের আড়ালে আড়ালে ওদের অনেক কাছে চলে যেতে পারব।

দ্রুত একটা ঝোপের আড়ালে এসে লুকাল ওরা, লোকগুলোর খুব কাছে।

দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলে বলেই রাত কাবার করবে নাকি? ফিসফিস করে বলল ডলি। উফ, ঠাণ্ডায় জমে যাচ্ছি আমি!

বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না ওকে। হাত মেলাল লোকগুলো, তারপর দুজন দুদিকে হাটতে শুরু করল।

সবে পা বাড়াতে যাবে ওরা, এই সময় বড় একটা কালো গাড়ি এসে ঘ্যাচ করে থামল ওদের পাশে। পাকা চত্বরে রবারের চাকা ঘষার শব্দ মিলানোর আগেই লাফ দিয়ে গাড়ি থেকে নেমে এল দুজন লোক।

আরে, সেই গালকাটা! দম বন্ধ করে ফেলল অনিতা।

এতটাই চমকে গেল দুই ফাদার ক্রিস্টমাস, বাধা দেয়ার কথাও যেন মাথায় এল না। সহজেই ওদের কাবু করে ফেলা হলো।

স্তব্ধ হয়ে গেছে গোয়েন্দারা। হা করে তাকিয়ে দেখছে পাতাবাহারের ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে থেকে।

এত দ্রুত ঘটে গেল ঘটনাটা, টু শব্দটি করার সুযোগ পেল না ফাদার ক্রিস্টমাসেরা। তাদের একজনকে ধাক্কা দিয়ে তুলে দেয়া হলো গাড়িতে। কিন্তু দ্বিতীয়জনকে তোলার আগেই হঠাৎ ঝাড়া দিয়ে হাত ছাড়িয়ে নিয়েই দৌড় মারল সে। পালিয়ে গেল। দোকানের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ফটো তোলে যে লোকটা, এ সে-ই।

এক দৌড়ে গিয়ে ফ্ল্যাটগুলোর মাঝে ঢুকে হারিয়ে গেল সে। ওর অাক্রমনকারীরা দ্বিধা করল। বুঝতে পারল, আর তাড়া করে লাভ নেই। গাড়িতে বসল দুজনে। ইঞ্জিন চালু করেই রেখেছে ড্রাইভার। ওরা উঠে বসতেই গাড়ি ছেড়ে দিল।

পুরো ঘটনাটা ঘটতে মিনিটখানেকের বেশি লাগল না। আশেপাশে আর দ্বিতীয় কোন লোক নেই যে দেখবে। গোয়েন্দাদের চোখের সামনে নির্বিবাদে একজন ফাদার ক্রিস্টমাসকে কিডন্যাপ করে নিয়ে চলে গেল ওরা।

দুই হাতে চেপে ধরে আছে কিশোর টিটুর চোয়াল।

চিৎকার করার জন্য পাগল হয়ে উঠেছে কুকুরটা।

গাড়ি চত্বর থেকে বেড়িয়প যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঝাড়া দিয়ে কিশোরের হাত থেকে মুখ ছুটিয়ে নিল টিটু।

হউ! হউ! হউ। হউ! টানাটানি করে শিকল ছুটানোর চেষ্টা করছে। পাকা চত্বরে তার নখ ঘষা লাগার শব্দ হচ্ছে।

থাম, টিটু! চুপ কর! শান্ত হ! তুই গিয়ে আর এখন কিছু করতে পারবিনে!

কোনমতেই ছাড়ল না ওকে কিশোর। তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে এল মুসা আর বব। অবশেষে শান্ত হলো টিটু।

ঘটনাটা নিয়ে আলোচনার সুযোগ পেল গোয়েন্দারা।

কোথায় নিয়ে গেল লোকটাকে? মুসার প্রশ্ন।

লোকটা কে? রবিন জানতে চাইল।

কিন্তু কেউ ওদের কথার জবাব দিতে পারল না।

অন্ধকার হয়ে আসছে। চত্বরটা এখনও নির্জন। দুটো ষ্ট্ৰীট ল্যাম্পের আলো পড়ছে রাস্তায়। দিনের আলো পুরোপুরি শেষ হয়ে যায়নি বলে উজ্জল হতে পারছে না আলোটা। অন্ধকারের সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে ঠাণ্ডা।

ধস্তাধস্তিটা হয়েছে যে জায়গায়, সেখানে এসে দাঁড়াল গোয়েন্দারা। ফাদার ক্রিস্টমাসের একটা লাল-সাদা পোশাক পড়ে থাকতে দেখল ফারিহা পানি নিষ্কাশনের ড্রেনের মধ্যে। বাতাসে উড়ছে তুলোর তৈরি সাদা লম্বা দাড়ি। তুলে নিল সে।

ডলির দাঁতে দাঁতে বাড়ি খাচ্ছে। শীতে না যতটা, তারচেয়ে বেশি ভয়ে।

আরেকজন ফাদার ক্রিস্টমাসের খোঁজে যেতে হবে এখন আমাদের, কিশোর বলল। বিল্ডিঙের দিকে পালিয়ে গেছে যে লোকটা। লাল-সাদা আলখেল্লাটা তুলে নিল সে।

কি ভাবে খুঁজে বের করব? ববের প্রশ্ন। দরজায় দরজায় গিয়ে তো আর নক করে জিজ্ঞেস করা যাবে না-এই ভাই, একজন নকল ফাদার ক্রিস্টমাস আছে নাকি এখানে।

তা ছাড়া লোকগুলোর আসল পরিচয়ও জানি না আমরা, ববের কথা সমৰ্থন করল মুসা।যারা ওদের আক্রমণ করল, তাদের সম্পর্কেও কিছুই জানি না। ওরা কি অপরাধী না পুলিশের লোক, তা-ও জানা নেই। রহস্যটা বড়ই জটিল মনে হচ্ছে আমার কাছে। অন্ধকারে ছায়া ঢাকা অপরিচিত বাড়িগুলোর দিকে তাকিয়ে বলল, সবচেয়ে ভাল হয় যদি এখন আমরা ..

বাড়ি না গিয়ে বরং লোকটাকে খুঁজতে যাই, মুসাকে বাধা দিয়ে বলে উঠল রবিন।

আমিও রবিনের সঙ্গে একমত, কিশোর বলল। সবে জমে উঠতে আরম্ভ করেছে রহস্যটা, এ সময়ে এটাকে বাদ দেয়ার প্রশ্নই ওঠে না আকাশের দিকে মুখ তুলে তাকাল ফারিহা। ঠাণ্ডা, মোলায়েম কি যেন গালে লেগেছে। চিৎকার করে উঠল, আরি! তুষার পড়ছে!

বলতে না বলতেই আরেক কণা তুষার উড়ে এসে পড়ল তার নাকে।

তুষারই তো! অনিতাও চিৎকার করে উঠল।

তুষার! তুষার! সমস্বরে কেঁচাতে শুরু করল সবাই। হঠাত করেই উত্তেজিত হয়ে পড়ল ওরা। আনন্দে অস্থির। মনে হচ্ছে এবারের বড় দিনটা প্রচুর তুষার-পড়া সাদা বড় দিন-এ পরিণত হবে। সেটা খুব মজার।

আকাশের দিকে জন্যে মুখ এটা উঁচু করে, হাত তুলে, উন্মাদ নৃত্য জুরে দিল ওরা।মুসা অার কিশোরের জন্য এটা ধর্মীয় উতসব নয়।কিন্তু সাময়িকভাবে তাতে আনন্দ করায় কোন বাধা নেই। সবার খুশি দেখে টিটুও চুপ করে থাকতে পারল না। প্রবল লাফালাফি জুড়ে দিল। পেঁজা তুলোর মত ভেসে ভেসে নেমে আসছে হালকা তুষার কণা। লাফিয়ে উঠে সেগুলেী ধরার চেষ্টা করতে লাগল সে।

কয়েকজন পথচারীকে দেখা গেল এতক্ষণে কাজ শেষে করে বাড়ি ফিরছে।

ছেলেমেয়েদের দিকে বিরক্ত চোখে তাকাল। তুষার ওদের কোন আনন্দ দিতে পারল না। থুতনির কাছে অল্প কিছু দাড়িওয়ালা একজন লোক তো দাঁড়িয়েই গেল জ্ঞান দেয়ার জন্যে, তোমাদের কাছে যতই ভাল লাগুক, তুষার জিনিসটা মোটেও ভাল নয়। ঠাণ্ডা, পিচ্ছিল, প্যাঁচপেঁচে! অতি জঘন্য।

ঠান্ডা দূর করাটা তো কঠিন কিছু না, জবাব দিল অনিতা। আমাদের মত নাচাকুঁদো করুন। দেখবেন গা গরম হয়ে গেছে।

যেন তার কথায় সমর্থন জানাতেই আরও জোরে লাফানো শুরু করে দিল টিটু।

ওপর দিকে চোখ পড়তেই থেমে গেল রবিন। কেঁচিয়ে উঠল, দেখো দেখো।

ওই বাড়িটার একেবারে ওপরতলার জানালাটা-ডান দিকের!

হাত তুলে একটা আলোকিত জানালা দেখাল সে কেন; তোমার কি মনে হচ্ছে ওই লোকটাই জানালাটার দিকে তাকিয়ে আছে কিশোর। জানালার কাছে দাড়িয়ে আছে কেউ। হঠাৎ করেই আলো নিভিয়ে দেয়া হলো। অন্ধকারে কোন কিছুই আর চোখে পড়ল না।

ওই লোকটাই, কোন সন্দেহ নেই আমার, রবিন বলল। ওকে চিনতে পেরেছি আমি। যে লোকটা ছবি তুলছিল। জানালার কাচে নাক ঠেকিয়ে মনে হয় দেখছিল সে।

তারমানে আমাদের ওপর নজর রাখছিল, ডলি বলল। উদ্দেশ্যটা কি তার?

কি করতে চায়? ভীত মনে হচ্ছে তাকে।

অত ভয় পাছ কেন? মুসা বলল। আমাদের চেঁচামেচি শুনে সাধারণ কৌতূহল হয়েছিল, দেখতে এসেছিল। অন্য কিছু না।

ছাড়া আরেকটা কথা ভুলে যাচ্ছ, বব বলল, ভয় পাওয়ার মত যথেষ্ট কারণ রয়েছে অারও।

অনিতা ভয় পায়নি। রহস্যময় এই ঘটনাগুলো সম্পর্কে জানার ইচ্ছে তার কৌতূহল সামলাতে পারছে না। বলল, ওপরে গিয়ে দেখা যায় না?সবার যাওয়া ঠিক হবে না।রবিন-মুসা তোমরা আমার সঙ্গে এসো। ববের সঙ্গে মেয়েরা সব এখানেই থাকো।

তারমানে এ ক্ষেত্রেও মেয়েদের বেলায় অন্য বিচার রেগে উঠল অনিতা তোমরা গিয়ে মজা করবে আর আমরা দাড়িয়ে দাঁড়িয়ে আঙুল চুষি। বড় অন্যায়।

আমি তো মেয়ে নই, নাকি? অনিতার কথার প্রতিবাদ করল বব। আমি তো থাকতে আপত্তি করছি না। অন্যায়ের কি দেখলে?

জবাব খুঁজে না পেয়ে চুপ হয়ে গেল অনিতা নাও, ধরো, টিটুর শিকলটা বাড়িয়ে দিল কিশোর। এর দায়িত্ব তোমার।

অনিতার কথায় কিছু মনে করেনি সে। দলে নতুন এসেছে অাস্তে অাস্তে শিখে যাবে। কিন্তু কোনমতেই হাসি ফুটল না অনিতার মুখে। মুখ গোমড়া করে রইল। কিশোরদের সঙ্গে যাওয়ার একান্ত ইচ্ছে তার।

বাড়িটায় ঢুকে লিফটে উঠল কিশোর। ড্রেনে পড়ে থাকা ফাদার ক্রিস্টমাসের পোশাকটা সাথে নিয়ে এসেছে।

বোতাম টিপে দিল মুসা। টপ ফ্লোরে লিফট থেকে নামল ওরা। এখন, কোনদিকে যাবে?

ডানে যেতে হবে, রবিন বলল। ভাল করে দেখে রেখেছি আমি।

তা তো বুঝলাম,  কিশোর বলল। কিন্তু দরজা তো দুটো। কোনটায় টোকা দেব?

প্রথম দরজাটায় গিয়ে কান পাতল মুসা। রেডিও বাজছে, জানাল সে।

পায়ের শব্দও শোনা যাচ্ছে।

হঠাৎ মেয়ে মানুষের কণ্ঠ শুনতে পেল। দরজার একেবারে কাছে। চমকে গিয়ে লাফ দিয়ে পিছিয়ে এল।

জন, তোমার ওষুধ রাখলে কোথায়? বৃদ্ধার কাপা কাঁপা কণ্ঠ। টেবিলেই রেখেছিলে? ঠিক মনে আছে?

এ ঘরে থাকবে না, ফিসফিস করে বলল কিশোর। সরে এসে দ্বিতীয় দরজাটায় গিয়ে কান রাখল মুসা। খানিকক্ষণ কান লাগিয়ে রেখে জানাল, কোন শব্দই আসছে না।

তারমানে আছে এটাতেই, মাথা দোলাল রবিন। হয়তো ভয় পাচ্ছে কিডন্যাপকারীরা ফিরে আসবে আবার। আলো নিভিয়ে চুপ করে আছে।

বেল বাজালেই বোঝা যাবে, কিশোর বলল। এমন করে হাতে নিল পোশাকটা, যাতে শুরুতেউ লোকটার চোখে পড়ে। তারপর টিপে দিলু বেলপুশ।

তীক্ষ্ণ স্বরে বেজে উঠল বেল।যেকোন মুহূর্তে খুলে যেতে পারে এখন।

কিন্তু ভেতর থেকে সাড়া বা কোন রকম শব্দ এল না।।

রবিন, এ তলাটাই তো? মুসার প্রশ্ন। ভুল হয়নি তোমার?

আবার বেল টিপল কিশোর। আবার শোনা গেল বেলের শব্দ।

বাজাতেই থাকো, রবিন বলল। থেমো না। দেখা যাক কতক্ষণ না খুলে থাকতে পারে। ঘণ্টা বাজানো থামাতে হলে দরজা তাকে খুলতেই হবে। ও এই ঘরেই আছে।

হাসল কিশোর। রবিনের পরামর্শটা পছন্দ হয়েছে তার। বাজাতেই থাকল।

অন্তত বিশবার বাজানোর পর দরজার ওপাশে হুক থেকে শিকল খোলার শব্দ পাওয়া গেল।

বললাম না আছে,উত্তেজিত স্বরে রবিন বলল। টিপতে থাকো।

অবশেষে, খুব ধীরে সামান্য ফাঁক হলো দরজা। দেখা গেল ওকে। কিশোর ভেবেছিল রেগে যাবে। কিন্তু শান্তকণ্ঠে জিজ্ঞেস করল তরুণ, কি ব্যাপার?

কিশোর জবাব দেবার আগেই তার হাতের ফাদার ক্রিস্টমাস পোশাকটা দেখে ফেলল সে। বিস্ময়ে বড় বড় হয়ে গেল চোখ। দ্রু নড়ে উঠল সে। এগিয়ে এসে একটানে পোশাকটা কিশোরের হাত থেকে কেড়ে নিয়ে মুহূর্তে লাগিয়ে দিতে গেল আবার দরজা।

কিন্তু তৈরি ছিল কিশোর। চোখের পলকে পাটা ঠেলে দিল দরজার ভেতরে।

পায়ে শক্ত জুতো ছিল বলে রক্ষা। নইলে পাল্লার চাপে প্রচন্ড ব্যথা পেত।

মরিয়া হয়ে আবার দরজা লাগানোর চেষ্টা করল ফাদার ক্রিস্টমাস।

সরো! চিৎকার করে উঠল সে। সরে যাও দরজার সামনে থেকে। ভাগো!

এর একটা ব্যাখ্যা না শুনে যাচ্ছি না আমরা, জবাব দিল কিশোর।

সব জানি আমরা, মুসা বলল।

কি জানো তোমরা? রেগে উঠল ফাদার ক্রিসমাস।ভাল চাও তো যাও বলে দিচ্ছি।

আমাদের আপনি ভয় দেখাতে পারবেন না, জবাব দিল কিশোর। নিচে আমাদের বন্ধুরা অপেক্ষা করছে। বলে দিয়ে এসেছি দশ মিনিটের মধ্যে আমরা ফিরে না গেলে ওরা যেন পুলিশের কাছে চলে যায়।

পুলিশ! চমকে গেল ফাদার ক্রিস্টমাস।

অসুবিধে কি? ভুরু নাচাল কিশোর। জাল মুদ্রা পাচার, কিডন্যাপিং-আরও কি কি করছেন সেটা আপনারাই ভাল জানেন। আমার ধারণা, বিশ বছরের কমে জেল থেকে বেরোতে পারবেন না।

হ্যাঁ, ঠিক, মাথা ঝাকাল রবিন, ততদিনে বুড়ো হয়ে যাবেন। চান সেটা?

ফ্যাকাসে হয়ে গেল ফাদার ক্রিস্টমাসের চেহারা। মনে মনে হাসল কিশোর।

ধাপ্পাতে কাজ হয়েছে।

এই সময় লিফটের শব্দ কানে এল। ওপরতলায় উঠে আসছে।

এসো। ভেতরে চলে এসো, জলদি! গোয়েন্দাদের বলে আবার দরজা ফাঁক করে দিল ফাদার ক্রিস্টমাস। বোঝা গেল, পড়শীদের দেখতে দিতে চায় না।

কিশোররা ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে দরজা লাগিয়ে দিল। তারপর জানতে চাইল ওরা কেন এসেছে। আধঘণ্টার মধ্যেই আমার বাবা-মা চলে আসবে। তোমাদের দেখলে খুশি হবে না।

ঠিক আছে কিশোর বলল, তার আগেই চলে যাব আমরা। অবশ্য যদি আমাদের বলেন, কেন করছেন এ কাজ।

কি কাজ করছি বলব? তোমাদের কথা কিছু বুঝতে পারছি না আমি, জবাব দিল ফাদার ক্রিস্টমাস।

সত্যি বলছে! না ভান?

পারছেন না মানে? রেগে উঠল মুসা। জাল কয়েন পাচার করে বেড়াচ্ছেন আর এখন বলছেন কিছু জানেন না? ওসব চালাকি বাদ দিন!

জাল কয়েন? কি বলছ? আমার কাছে কোন জাল কয়েন নেই।

তাহলে এগুলো কি? পকেট থেকে দুটো মুদ্ৰা বের করে দেখাল কিশোর আজ বিকেলে এগুলো আমাকে দিয়েছে আপনার দোস্ত।

আমি বিশ্বাস করি না।

তাহলে শুনুন কি ঘটেছে, কিশোর বলল, বিকেল বেলা তাকে গিয়ে একটা ডলার দিয়ে ভাঙতি চাইলাম। বানিয়ে বানিয়ে বললাম, আমার বোনকে পঞ্চাশ পেল দেব একটা কার্ড কেনার জন্যে। মাকে উপহার দেব। শুনতে পাননি? কাছেই তো ছিলেন

হ্যাঁ হ্যাঁ, এখন মনে পড়েছে, জবাব দিল লোকটা। কিন্তু ওগুলো জাল, কে বলল তোমাকে?

কয়েন দুটো লোকটার কানের কাছে নিয়ে গিয়ে একটার সঙ্গে আরেকটা বাড়ি দিয়ে শব্দ করল কিশোর। শুনুন শব্দটা। কি মনে হচ্ছে? স্বাভাবিক।

এখনও বিশ্বাস না হলে আরও ভালমত প্রমাণ করে দিতে পারি, রবিন বলল। একটা লোহাকাটা করাত নিয়ে আসুন। কাটলেই দেখতে পাবেন ভেতরে কি আছে।

ঠিক আছে, ঠিক আছে, বিশ্বাস করলাম, হাল ছেড়ে দিল লোকটা। করতাম না। কিন্তু যা সব কাও ঘটতে আরম্ভ করেছে, জাল কয়েন হলে আর অবাক হওয়ার কি আছে।

ধপ করে একটা চেয়ারে বসে পড়ল সে। হাতে রয়ে গেছে এখনও ফাদার ক্রিস্টমাসের পোশাকটা। হয়তো তোমাদের কথাই ঠিক, বলল সে। খানিক আগে আমাদের ওপর কেন হামলা চালিয়েছিল লোকগুলো, এতক্ষণে বোঝা যাচ্ছে। হঠাৎ এমন ভাবে আক্রমণ করে বসল…. ভাবতেই পারিনি….

আসলে কির্ডন্যাপ করতে চেয়েছিল আপনাদের, রবিন বললু। দুজনকেই।

আপনি পালিয়ে আসাতে বেঁচে গেছেন। আপনার বন্ধুকে কোথায় নিয়ে গেল ওরা, কিছু আন্দাজ করতে পারেন?

জানলে কি আর এখানে বসে থাকতাম মনে করেছ? জবাব দিল লোকটা।

টাকার ব্যাপারটা কি বলুন তো? পঞ্চাশ পেন্সের জাল মুদ্রা কোত্থেকে আসছে? জানতে চাইল কিশোর.

কাস্টোমারদের দেয়ার জন্যে প্রচুর ভাঙতি রাখতে হয় আমাদের, লোকটা জানাল। ছবি তুলে অনেকেই দুই ডলার দেয়। এক ডলার দশ পেন্স রেখে বাকিটা ভাঙতি দিতে হয়। কয়েন রাখা ছাড়া উপায় কি। কিন্তু আমরা জাল কয়েন পাচার করছি এ ধারণা হলো কি করে তোমাদের?

আপনি নাহয় রাখেন না, লোকটার প্রশ্নের জবাব দিল না কিশোর। কিন্তু আপনার বন্ধু?

তার কথা তাকেই জিজ্ঞেস কোরো, বিষন্ন কষ্ঠে জবাব দিল লোকটা।

প্রশ্ন খুঁজে পেল না আর কিশোর। রহস্যটা জটিল থেকে জটিলতর হয়ে উঠছে।

রবিন আর মুসাও বুঝতে পারছে না আর কি প্রশ্ন করা যায়। আগুপিছু বিবেচনা না করে হুট করে লোকটাকে অভিযুক্ত করে বসায় লজ্জা পাচ্ছে এখন তিনজনেই। মনে হচ্ছে, দুই ফাদার ক্রিস্টমাস-যাদেরকে ওরা সন্দেহ করেছে, দুজনেই নির্দোষ

বুঝতে পেরেছি! ওদেরকে চমকে দিয়ে হঠাৎ চিৎকার করে উঠল লোকটা।

চেয়ার থেকে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল। এতটাই উত্তেজিত হয়ে পড়েছে, একসঙ্গে সব বলতে গিয়ে কথাই বেরোতে চাইল না।

শান্ত থেকে ধীরেসুস্থে বলার অনুরোধ করল তাকে কিশোর।

পঞ্চাশ পেন্সের মুদ্রা, না? গত হপ্তায় বনের মধ্যে কি পেয়েছি, কল্পনাও করতে পারবে না। বনের মধ্যে দিয়ে একটা রাস্তা চলে গেছে ডগলাস ফার্মের দিকে। সেই রাস্তার এক জায়গায় দেখি অনেকগুলো কয়েন পড়ে আছে। রাস্তার ধারে ঘাসের মধ্যে। তুলে নিলাম ওগুলো। তারমানে ওগুলোই ছিল তোমাদের এই জাল মুদ্রা। আমরা কল্পনাই করতে পারিনি। কে হারিয়েছে সে-খোঁজ নেয়ারও প্রয়োজন মনে করিনি। পরের দিন হেনরির দোকানে কাজে গেলাম। কুড়িয়ে পাওয়া পয়সাগুলো দিয়ে লোকের ভাঙতি শোধ করতে লাগলাম।

আমরা মানে কে কে? জিজ্ঞেস করল রবিন।

আমি আর আমার বন্ধু টনি। একটু আগে যাকে কিডন্যাপ করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

দম নেয়ার জন্যে থামল সে। তারপর বলল, আমার নাম রোভার।….এখন বুঝতে পারছ তো, কোনও ধরনের অপরাধের সঙ্গে জড়িত নই আমরা?

পয়সাগুলো পুলিশকে দিয়ে আসা উচিত ছিল আপনাদের, গম্ভীর মুখে কিশোর বলল। তাহলে আজকে আর এই ঝামেলার মধ্যে পড়তে হত না।

জানি! কিন্তু নিজেকে আমাদের জায়গায় কল্পনা করলেই আমাদের সমস্যাটা বুঝতে পারবে। রোভার বলল। খুব কঠিন অবস্থার মধ্যে দিয়ে চলতে হচ্ছে আমাদের। আমরা ছাত্র। বড়দিনের এই ছুটিতে কাজ করছি কলেজে পড়ার টাকা রোজগারের জন্যে। খদ্দের আকৃষ্ট করার জন্যে আমাদের ভাড়া করেছে হেনরি।

ছবি তোলার টাকার লাভ সে নেয় না, সব আমরাই পাই। কাজেই সব খরচ খরচাও আমাদের। ফিল্মমের দাম, দামী ক্যামেরার ভাড়া ইত্যাদির খরচ মিটানোর পর লাভ খুব কমই থাকে আমাদের।

টাকার দরকার কার না আছে? রোভারের এ সব কৈফিয়তে মন ভিজল না মুসার। তাই বলে রাস্তায় পাওয়া টাকা তুলে নিতে হবে? ক্ষতি যা করার করে ফেলেছেন। এখন পস্তানো তো লাগবেই।

চুপ করে রইল রোভার।

কিশোর বলল, আমরা এখনও জানি না ওই মুদ্রাগুলো এল কোত্থেকে? ওগুলোর সঙ্গে গালকাটা লোকটার সম্পর্ক কি?

গালকাটা? বোকা হয়ে তাকিয়ে রইল রোভার।

যে লোকটা আপনার বন্ধু টনিকে কিডন্যাপ করেছে। যে তাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়েছিল হেনরির দোকানের সামনে যতই শুনছে, বিমূঢ় হয়ে যাচ্ছে রোভার। জিজ্ঞেস করল, রহস্যটার সন্ধান অনেক আগেই পেয়েছ মনে হচ্ছে?

মাত্র গতকাল, জবাব দিল কিশোর।

দেখো, একটা অনুরোধ করব, কাতর কণ্ঠে বলল রোভার, দয়া করে পুলিশের কাছে যেয়ো না। গেলে হয়তো টনির সাংঘাতিক ক্ষতি হয়ে যেতে পারে।

ঠিক আছে, যাব না, কথা দিল কিশোর। আমরা নিজেরাই এটা সমাধানের চেষ্টা করব।

কিন্তু বাড়ি ফিরে না গেলে টনির বাবা-মা যদি পুলিশে খবর দেন? প্রশ্ন তুলল মুসা।

তুলবে না, রোভার বলল। কারণ ওরা এখানে নেই। ছুটি কাটাতে চলে গেছে হলিডে কটেজে। হেনরির দোকানে আমাদের ক্রিস্টমাস ইভের কাজ শেষ হয়ে গেলে টনিও চলে যাবে।..তা তোমরা এখন কি করার কথা ভাবছ?

রীতিমত অসহায় বোধ করছে এখন রোভার। কাচুমাচু ভঙ্গিতেই বোঝা যায়।

কয়েনগুলো যেখানে পেয়েছেন আপনারা, প্রথমে সেখানে যাব, কিশোর বলল। আকাশ থেকে তো আর পড়েনি ওগুলো। কোন না কোন সূত্র পেয়েই যাব জায়গামত যেতে পারলে।

হুঁ, উদ্বিগ্ন ভঙ্গিতে চোয়াল ডলল রোভার। কাল যে কি হবে বুঝতে পারছি না।টনিকে ছাড়া হেনরির দোকানের কাজটা চালাব কি করে? হেনরির সঙ্গে আমাদের চুক্তি হয়েছে-বড় দিন শেষ না হওয়া পর্যন্ত তার ওখানে কাজ করব আমরা। কলি যদি দুজনের একজন হাজির হতে না পারি, কি বলবে সে?

সেটা নিয়ে ভাববেন না, সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিল কিশোর। টনির বদলে আমাদের কাউকে দিয়ে দেব। রবিন যেতে পারে।

রবিন। ভুরু কুঁচকে ফেলল রোভার।

কিশোরের কথা শুনে মুসা আর রবিনও চমকে গেল।

হ্যাঁ, আমার এই বন্ধুটি, রবিনকে দেখাল কিশোর। টনির চেয়ে সামান্য খাটো হবে। হাই হিল জুতো পরে নিলেই লম্বা হয়ে যাবে অনেকটা। বাকিটা পরণ করে নেবে ফাদার ক্রিসমাসের পোশাক দিয়ে।আলখেল্লা আর দাঁড়ি-গোঁফের আড়ালে কেউ চিনতে পারবে না ওকে।

সত্যিই পারবে না, মুসা বলল।

আমি কি তোমাদের তদন্তে কোন সাহায্য করতে পারি? জিজ্ঞেস করল রোভার।

আপাতত লাগবে না, কিশোর বলল। আপনি বরং খেয়েদেয়ে শান্তিতে একটা ঘুম দিন। তাজা না হয়ে কাল সকালে চাকরিতে যেতে পারবেন না।

রোভারের সঙ্গে হাত মিলিয়ে, তাকে গুড নাইট জানিয়ে রওনা হলো তিন গোয়েন্দা।

বেরোনোর আগে দরজার কাছ থেকে রবিন বলল, কাল সকালে দেখা হবে।

সকাল সাড়ে আটটায় আপনার এখানে চলে আসব আমি। ফাদার ক্রিস্টমাস সেজে আপনার সঙ্গে দোকানে যাব।

আহ, বাঁচালে আমাকে, ভাই! অসংখ্য ধন্যবাদ তোমাদেরকে, কৃতজ্ঞ স্বরে বলল রোভার। তোমরা না এলে কি যে করতাম!

কথা শেষ। ঘর থেকে বেরিয়ে এল তিন গোয়েন্দা। লিফটের কাছে ওদেরকে এগিয়ে দিয়ে গেল রোভার।

ভাবছি, লিফটে করে গ্রাউন্ড ফোরে নামতে নামতে বিড়বিড় করল কিশোর, আগামী কাল কি ঘটবে?

বাপরে, বহুত সময় লাগিয়ে দিলে! তিন গোয়েন্দাকে লিফট থেকে বেরোতে দেখেই বলে উঠল বব। আমরা আর পাঁচ মিনিট দেখেই দেখতে যেতাম কি হয়েছে তোমাদের এত দেরি করলে কেন?

কি বলল লোকটা জানতে চাইল ডলি।

জাল পয়সাগুলো কি ওরাই বানাচ্ছে? অনিতার প্রশ্ন।

অন্য লোকটার খবর কি? জিজ্ঞেস করল ফারিহা।কোথায় ধরে নিয়ে গেল ওকে?

সব প্রশ্নের জবাবই দিল কিশোর। জানাল আগামী দিনের পরিকল্পনা।

এখন আমাদের বাড়ি ফেরা দরকার, বলল সে। ভাগ্যিস বাড়িতে বলে এসেছিলাম দেরি হতে পারে

সবাই বাড়িতে বলে এসেছে, বড়দিনের বাজার দেখতে যাচ্ছে ওরা।

তুষারপাতের বিরাম নেই। রাস্তাঘাট, বাড়ির ছাত, সব তুষারে ঢেকে দিচ্ছে।

বাস স্টপে যাওয়ার পথে অনবরত তুষারকণাকে ধাওয়া করে যেতে লাগল টিটু।

পরদিন সকালে যখন ঘুম ভাঙল ওদের, সারা গ্রাম সাদা তুষারে ঢেকে গেছে।

গরম কাপড়-চোপড়ে গা মুড়ে, মাথা ঢেকে ঘর থেকে বেরোল সবাই।কিশোরদের বাগানের ছাউনিতে মিলিত হয়েছে সকাল সাড়ে আটটায়।রবিন বাদে।

সকালের বাসে শহরে চলে গেছে সে এত তুষার দেখে আনন্দে ফেটে পড়ার কথা ছিল ওদের। কিন্তু মগজে এখন

অন্য চিন্তা তুষারের বল বানিয়ে ছোঁড়াছুড়ি খেলা, কিংবা তুষারমানব বানানোর আগ্রহ নেই।

চিন্তিত ভঙ্গিতে কিশোর বলল, ভাবছি, এত তুষারের মধ্যে ডগলাস ফার্মটা খুঁজে পাওয়া না কঠিন হয়ে দাঁড়ায় আমাদের জন্যে।

কথা বলার সময় মুখ থেকে বেরোনো বাতাস সাদা ধোঁয়ার মত হয়ে যাচ্ছে।

তোমাকে আগুন বের করা ড্রাগনের মত লাগছে, কিশোর, হেসে বলল ফারিহা।

কিন্তু তার দিকে তাকিয়ে ভ্ৰকুটি করল কিশোর। হাসল না। কেউই হাসল না। রসিকতা করার মত মানসিক অবস্থা নেই এখন কারও।

কিশোর ঠিকই বলেছে ডলি একমত হলো তার সঙ্গে। ফার্মটা খুঁজে পাব

তো? তুমি বলার আগে ভাবিইনি। কি করে পাব? এই এত তুষারের মধ্যে রাস্তার মধ্যে আরও কয়েন যদি পড়ে থাকে, থাকবে তুষারের নিচে ঢাকা। খুঁজে পাওয়ার কোন সম্ভাবনাই নেই। তারমানে কোন সূত্রও চোখে পড়বে না।

আগেভাগেই অত চিন্তা করে লাভ নেই.মুসা বলল। আগে গিয়ে তো দেখি। পাওয়া না পাওয়া সে তো পরের ব্যাপার।

টিটুর চিৎকারে ফিরে তাকাল ওরা। ছাউনির দরজার বাইরে চলে এসেছে সে। দৌড়ে চলে এল ওদের কাছে।

টেনে-হিঁচড়ে তাকে নিয়ে গিয়ে আবার ঘরের ভেতর ঢোকানোর চেষ্টা শুরু করল ফারিহা।

ও বুঝে গেছে, আমরা অভিযানে বেরোচ্ছি। টিটুর দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়াল কিশোর,উঁহুঁ, নেয়া যাবে না রে তোকে, টিটু। তুষারে ভিজে সর্দি বাধাবি।মরবি তখন।

তা ছাড়া যাবি কি করে? অনিতা বলল। আমরা তো যাব সাইকেলে।

সাইকেলে যেতে পারব কিনা সন্দেহ আছে, বব বলল।

মেশিন যদি আসে, রাস্তা সাফ হয় তাহলে পারব; না হলে হাঁটা ছাড়া গতি নেই।

টিটুকে ভেতরে নেয়ার চেষ্টা করতে গিয়ে হিমসিম খেয়ে যাচ্ছে ফারিহা। কিন্তু নিতে আর পারে না।করুণ আর্তনাদ শুরু করে দিল টিটু।ওকে নিয়েই যাই না কেন, মুসা বলল। একটা টবোগান নিলে তাতে চড়ে দিব্যি চলে যেতে পারবে টিটু। ভিজবেও না। ঠাণ্ডাও লাগবে না।

হ্যাঁ, বুদ্ধিটা মন্দ না, ডলি বলল।

বেশ, রাজি হলো অবশেষে কিশোর। কিন্তু সারাক্ষণ একা তো আমার পক্ষে টেনে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয় ভারী জিনিসটা।

তোমার একা টানার দরকার কি? সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল বব। পালা করে টানব আমরা সবাই।

টিটুকে সবাই ভালবাসে ওরা। ওকে ফেলে যেতে মন চাইল না কারোরই।

কয়েক মিনিটের মধ্যেই রওনা হলো গোয়েন্দাদের বিচিত্র মিছিলটা। ছয়টা সাইকেল, আর কিশোরের সাইকেলের সঙ্গে বাধা ছোটখাট স্লেজের মত একটা টানা গাড়ি।তাতে চড়ে আরামছে চলেছে টিটু।

তুষার কাটার গাড়ি এসেছে। মেইন রোডটা পরিষ্কার করার পর গলিগুলো সাফ করছে এখন। আগে আগে গেছে গাড়িটা। সুতরাং রাস্তা সাফ। এগোতে অসুবিধে হচ্ছে না গোয়েন্দাদের।

বিশাল যন্ত্রটার দুই পাশে একনাগাড়ে ছিটকে পড়ে উঁচু হয়ে পাড়ের মত জমে যাচ্ছে তুষার।যতই গাঁয়ের ভেতর দিকে এগুচ্ছে, পুরু হচ্ছে তুষারের স্তর।

সবাই বেশ সতর্ক রয়েছে। কড়া নজর রেখেছে। কোনমতে ডগলাস ফার্মের রাস্তাটা চোখ এড়িয়ে যেতে দেবে না।

চিন্তা নেই একমাত্র টিটুর। টোবোগানে পা ছড়িয়ে বসে মহানন্দে ভ্রমণ করছে।

রবিন ততক্ষণে পৌঁছে গেছে রোভারদের ফ্ল্যাটের দরজায়।

হাতে দুটো ফাদার ক্রিস্টমাসের পোশাক, আর কাঁধে ঝোলানো ক্যামেরা নিয়ে বেরিয়ে এল রোভার।

কোন খবর নেই নিশ্চয়? জিজ্ঞেস করল সে।

না, মাথা নাড়ল রবিন। সবে তো সকাল হলো। তবে এতক্ষণে নিশ্চয় ডগলাস ফার্মের উদ্দেশে রওনা হয়ে গেছে সবাই।

রাস্তায় নেমে হেনরির দোকানের দিকে হাটতে শুরু করল দুজনে। মিল রোডের সেই অফিস বিল্ডিংটায় ঢুকে পোশাক পাল্টে ফাদার ক্রিস্টমাসের পোশাক নিল, আগের দিন যেখানে খুলেছিল টনি আর রোভার।

বেরিয়ে যখন এল, সম্পূর্ণ নতুন মানুষ। একেবারেই চেনা যাচ্ছে না। আর কে-ই বা খেয়াল করতে যাচ্ছে যে একজন ফাদার ক্রিস্টমাস আগের দিনের ফাদার ক্রিস্টমাসের চেয়ে সামান্য খাটো?

অবশেষে সেই জায়গাটায় পৌঁছে গেল গোয়েন্দারা, যেখানে ডগলাসের ফার্মটা পাওয়া যাওয়ার কথা। একপাশে খোলা মাঠ, আরেক পাশে বন। বন আর মাঠের মাঝখান দিয়ে রাস্তা চলে যাওয়ার চিহ্ন দেখা যাচ্ছে।

মেঘে ভারী হয়ে আছে আকাশ। সীসার মত রঙ। দিনের আলোটাও কেমন বিচিত্র। চারপাশে ছড়িয়ে থাকা তুষারের কারণে। শামুকের গতিতে তুষার সাফ করতে করতে চলেছে তুষার কাটার যন্ত্রটা। সোজা চলে যাচ্ছে। পাশের গলিপথে নামার কোন ইচ্ছে নেই।

খোলা মাঠে অনেক বেশি পুরু হয়ে পড়েছে তুষার। তার মধ্যে সাইকেল।

নামানোর চেষ্টা করল মুসা। মুহূর্তে অর্ধেক চাকা দেবে গেল। মজা করার জন্য তার মধ্যেই প্যাডাল করে সাইকেল চালানোর চেষ্টা করল সে। কিন্তু গেল কাত হয়ে তুষারের মধ্যে পড়ে। সবাই হাসতে লাগল। উঠে দাঁড়িয়ে কাপড় থেকে তুষার ঝেড়ে ফেলল মুসা।

সাইকেল থেকে নেমে পড়ল কিশোর। একটা গাছের নিচে রেখে, সৰাইকে রাখুতে বলল। মুসার অবস্থা দেখেই বোঝা গেছে, গলিপথে সাইকেল চালানো কঠিন ব্যাপার হবে।

গাছের নিচে থাকলে অন্তত ভিজবে না সাইকেলগুলো। আকাশের দিকে তাকাল কিশোর। চেহারা দেখেছ? আবার শুরু হবে তুষারপাত।

তার কথা শেষ হতে না হতেই এক কণা তুষার এসে পড়ল নাকের ডগায়।

চলো, যাওয়া যাক! হাটতে শুরু করল সে।তুষার মাড়িয়ে হাটতে লাগল ওরা। রাস্তার চিহ্নও চোখে পড়ছে না। গাছের ডালপালা সব নুয়ে পড়েছে তুষারের ভারে। নিচ দিয়ে যাওয়ার সময় ওদের মাথায় খসে পড়ে, শব্দ করে ভেঙে ছিটকে যাচ্ছে চতুর্দিকে। দেখতে দেখতে পা থেকে মাথা পর্যন্ত সাদা পাউডারের মত তুষারে সাদা হয়ে গেল ফারিহা।

আজকে আর কিছুই খুঁজে পাওয়া যাবে না। খড়ের গাদায় সুচ খোঁজার সামিল! ডলি বলল। সবার পেছনে পড়ে গেছে সে। ক্লান্তি আর ঠাণ্ডায় কাহিল।

আরে এত তাড়াতাড়িই হতাশ হয়ে যাচ্ছ কেন? বব বলল। কি ঘটবে।

আগে থেকে কেউ বলতে পারে না। ফার্মটা পাবই আমরা।

ডলিকে উৎসাহ জোগানোর চেষ্টা করলেও কথাটা নিজেই বিশ্বাস করতে পারল না বব।

কিন্তু কিশোর সহজে দমার পাত্র নয়। এগিয়েই চলল সে ঘন হয়ে পড়ছে এখন তুষার। সীমিত করে দিচ্ছে দৃষ্টিশক্তি। সামনে কয়েক হাতের বেশি নজরে আসছে না। সেজন্যেই গাড়িটাকে দেখার অনেক আগেই ওটার ইঞ্জিনের শব্দ কানে এল ওদের।

খাইছে! বলে উঠল মুসা। এ রাস্তা দিয়েই আসছে মনে হচ্ছে? মিছিলের আগে আগে হাটছে সে। আমাদের দিকেই আসছে!

জলদি লুকাও! সাবধান করে দিল কিশোর, গাড়িতে যে-ই থাক, আমাদেরকে তার দেখে ফেলা চলবে না।

সবাই একমত হলো তার সঙ্গে। ওদের মনে হতে লাগল গাড়িটার মধ্যে বিপদ রয়েছে। কিন্তু কেন, সে-প্রশ্নের জবাব দিতে পারল না কেউ। তুষারের মধ্যে দিয়ে যত দ্রুত পারল, দৌড়ে ঢুকে পড়ল আবার জঙ্গলে। গাছের নিচে ঘাপটি মেরে বসে রইল। বাড়ছে ইঞ্জিনের শব্দ।

অবাক কাণ্ড! মুসা বলল। আসার পথে চাকার দাগ তো কোথাও দেখলাম না।আর এ রাস্তাটা থেকে অন্য কোন দিকে কোন রাস্তা বেরোয়নি।সোজা চলে গেছে-ডগলাস ফার্মই হোক, বা অন্য যে কোনখানেই হোক।

নজরে এল গাড়িটা। বড় কাল একটা গাড়ি। একজন আরোহীকে দেখেই চিনে ফেলল অনিতা গাছের গোঁড়া আরও সেঁটে গেল। লোকটার চোখে পড়তে চায় না।

তুষারের জন্যে ধীরে চলতে বাধ্য হচ্ছে গাড়িটা। চলে গেল পাশ দিয়ে।

ধরা পড়ার ভয়ে তুষারের মধ্যে উপুড় হয়ে পড়ে থাকল গোয়েন্দারা। টিটুর মুখ চেপে ধরে রাখল কিশোর, যাতে শব্দ করতে না পারে। ইঞ্জিনের শব্দ পুরোপুরি মিলিয়ে যাবার পর খুব সাবধানে মাথা তুলল।

গেছে!উঠে দাঁড়াল সে। দেখলে? কাল যে তিনজনকে দেখেছিলাম, ওরাই গেল কোথায়? ফারিহার প্রশ্ন।

নিশ্চয় হেনরির দোকানে, একসঙ্গে বলে উঠল বব আর অনিতা।

সর্বনাশ! আঁতকে উঠল ডলি। রবিন আছে না ওখানে।

আছেই তো! অত ভয় পাবার কিছু নেই! কিশোর বলল। এ সব কাজে নতুন নয় সে। নিজেকে রক্ষা করার ক্ষমতা তার আছে। আমাদের কাজ আমরা করতে থাকি। ফার্মে গিয়ে জালিয়াতদের গোপন আস্তানা খুঁজে বের করা দরকার।

টনিকেও উদ্ধার করে আনতে হবে।

হ্যাঁ, একমত হয়ে মাথা দোলাল মুসা। ওদের এই শয়তানি খেলা যত তাড়াতাড়ি পারা যায় বন্ধ করা দরকার।

তারমানে বলতে চাইছ কিশোরের দিকে তাকাল বব, ডগলাস ফার্মের দিক থেকেই ওরা এসেছে?

মাথা ঝাকাল কিশোর।

এবং তারমানে, অনিতা বলল, গাড়ির চাকার দাগ অনুসরণ করে গেলেই পেয়ে যাব ফার্ম হাউসটা? কপালটা খুলতে আরম্ভ করেছে মনে হয়!

কিন্তু আমাদের পায়ের ছাপের কি হবে? মনে করিয়ে দিল ফারিহা। ওদের চোখে পড়ে যাবে না সেগুলো?

তা তো পড়তেই পারে, জবাব দিল মুসা। কিন্তু যে হারে তুষার পড়ছে, দেখতে দেখতে ঢেকে যাবে। তা ছাড়া গাড়ি চালানোর সময় সর্বক্ষণ ওয়াইপার চালাতে হয়। সামনে হাতি দাঁড়িয়ে থাকলেও এর মধ্যে দিয়ে দেখাটা কঠিন। তাছাড়া দাগ থাকতে পারে সন্দেহ করলে তবে তো দেখার চেষ্টা করবে।

হ্যাঁ, একমত হয়ে মাথা দোলাল কিশোর। হয়তো তোমার কথাই ঠিক। কিন্তু সাবধানের মার নেই। সুতরাং কোন রকম ঝুকি নিতে আমি নারাজ। রাস্তা ছেড়ে এখন থেকে বনের ভেতর দিয়েই এগোব।

যাত্রা শুরুর ইঙ্গিত পেয়ে লাফ দিয়ে গিয়ে আবার টবোগানে চড়ল টিটু। তাকে টেনে নেয়ার পালা এখন ববের। বনের ভেতর দিয়ে চলতে রাস্তার চেয়ে খাটনি কম লাগল। তুষার কম। গাছপালা থাকায় রাস্তার মত পুরু হয়ে পড়তে পারেনি। প্রায় মাইল দেড়েক এগোনোর পর খামারবাড়িটার চালা চোখে পড়ল ওদের।

ডগলাস ফার্ম। বুঝতে পারল, তার কারণ, রাস্তায় গাড়ির চাকার যে দাগ রয়েছে, সেটা শুরু হয়েছে বাড়িটার গেটের কাছ থেকে।

দাঁড়াও, হাত তুলে সবাইকে থামতে ইশারা করল কিশোর। শুনতে পাচ্ছ?

বনের কিনারে যে যেখানে ছিল, মূর্তির মত দাঁড়িয়ে গেল। কান পাতল।

ফার্মের ভেতর থেকে গুঞ্জনের মত একটা শব্দ কানে আসছে। অথচ বাড়িটা নির্জন মনে হচ্ছে। কাউকে চোখে পড়ছে না

তিনজন লোককে গাড়িতে করে চলে যেতে দেখেছে। তাহলে ভেতরে শব্দ হচ্ছে কিসের?

কোন ধরনের মেশিন-টেশিন হবে, বব বলল অবশেষে।

ফার্মের ভেতর থেকেই আসছে শব্দটা, অনিতা বলল।

আমি যাচ্ছি, কিশোর বলল। দেখে আসিগে। তোমরা সব এখানেই থাক।

আমি আসি, মুসা বলল।

না, তুমিও থাকো। লোক তো নিশ্চয় আছে। আমাকে ধরে ফেলতে পারে।

দুজন ধরা পড়ার চেয়ে একজন পড়া ভাল।কেঁপে উঠল ডলি।ঠান্ডায় না ভয়ে বুঝা গেল না। রবিনের কথা মনে পড়ল তার। টনিকে যে ভাবে কিডন্যাপ করা হয়েছে, রবিনকেও করবে না তো? বলা যায় না, কিশোরকেও আটকে ফেলতে পারে। তখন কি হবে?

কিশোর, সাবধানে থেকো, ফারিহা বলল।

টিটু কি বুঝল কে জানে, চাপা স্বরে গরগর করে উঠল। কিশোরের সঙ্গে যেতে চায় বোধহয় সে-ও তোর যাওয়ার দরকার নেই, হেসে বলল কিশোর। সবার সঙ্গে থাক।

আদর করে মাথা চাপড়ে দিল কুকুরটার।

পা বাড়াল সে। বনের ভেতর থেকে বেরিয়ে এল খোলা জায়গায়। দৌড় দিল খামারবাড়িটার দিকে। যত তাড়াতাড়ি পারল ছুটে এসে গা ঠেকিয়ে দাঁড়াল বাড়ির পাথরে দেয়ালে। কান পেতে শুনতে শুনতে অপেক্ষা করতে লাগল। কেউ দেখে ফেললে বেরিয়ে আসবে। কিন্তু এল না কেউ। কানে আসছে একটানা গুঞ্জনের মত শব্দ। কাছে থেকে জোরাল শোনাচ্ছে। মেশিনই।

কয়েক মুহূর্ত অপেক্ষা করে পা টিপে টিপে, দেয়াল ঘেষে জানালার দিকে রওনা দিল সে। তুষারে চাপা পড়ে যাচ্ছে জুতোর শব্দ। ভালই। মনে মনে তুষারকে ধন্যবাদ দিল সে কয়েক পা এগিয়ে আবার থেমে গেল। সতর্ক হয়ে উঠেছে প্রতিটি ইন্দ্ৰিয়।

সামান্যতম বিপদের গন্ধ দেখলেই দেবে দৌড়।

পার হয়ে গেল কয়েক সেকেন্ড। কিছুই ঘটল না।

আবার পা বাড়াল সে। জানালার কাছে এসে সাবধানে গলা বাড়িয়ে উঁকি দিল ভেতরে।

প্রথমেই চোখে পড়ল টনিকে। হাত-পা বাধা অবস্থায় পড়ে আছে মেঝেতে। একটা লোক বসে আছে তার কাছে। জানালার দিকে পেছন করে। কিশোরকে দেখতে পেল না।

ঠোঁট গোল করে শিস দেয়ার ভঙ্গি করল কিশোর। কিন্তু শব্দ বের করল না।

আরেকটু কাত হয়ে তাকাল ভাল করে দেখার জন্যে।

গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে স্থির দৃষ্টিতে এদিকে তাকিয়ে আছে বাকি সবাই।

কিশোরের প্রতিটি নড়চড়া লক্ষ্য করছে। বুকের মধ্যে প্রবল বেগে লাফাচ্ছে তাদের

হৃৎপিণ্ড।

নিশ্চয় কিছু দেখেছে! হঠাৎ বলে উঠল মূসা।

কি দেখল, উত্তেজনায় চিৎকার করে উঠল উলি। আস্তে কথা বলার কথা ভুলে গেছে।

তাকে সাবধান করে দিল মুসা।

কি দেখেছে, এখুনি জানা যাবে, অনিতা বলল। ওই যে, ফিরে আসছে।

দৌড়ে আসছে কিশোর।

সামান্য সময়ের জন্যে থেমেছিল, আবার পুরোদমে পড়তে আরম্ভ করেছে তুষার।

টনিকে দেখে এলাম! কাছে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল কিশোর। বেধে মেঝেয় ফেলে রেখেছে।

এই ঠাণ্ডার মধ্যে! ওরা মানুষ না! দত কিড়মিড় করল মুসা।

মাত্র একজন লোক আছে পাহারায়, জানাল কিশোর। ওকে সরিয়ে দিতে হবে, যাতে টনিকে মুক্ত করতে পারি বলা সহজ, করা কঠিন, বব বলল! গিয়ে বললেই তো আর সরে যাবে।

তা তো যাবেই না, হেসে বলল কিশোর। তবে আমার মাথায় একটা বুদ্ধি এসেছে। ছোট ছোট কিছু পাথর জোগাড় করা দরকার।

তুষারে ঢেকে আছে সব, পাব কোথায়? অনিতা বলল, আর কোন বুদ্ধি বের করতে পারো না?

না, পারি না। এটাই একমাত্র বুদ্ধি। সময় আছে আমাদের হাতে। পাথর জোগাড় করা অসম্ভব হবে না। কিছুটা কৰ্কশ কষ্ঠেই জবাব দিল কিশোর, তুমি পারলে অন্য কোন বুদ্ধি বের করোগে। আমি পাথর দিয়েই কাজ সারতে চাই।

এক মুহূর্ত দেরি না করে গাছের গোঁড়ার তুষার সরাতে শুরু করল সে।

নিচের মাটি পাথরের মত কঠিন। পাথর খুঁড়ে তোলার চেষ্টা করতে গিয়ে গলদঘর্ম হলো, কিন্তু বের আর করতে পারল না।

নাহ, খোঁড়ার জন্যে দিনটা আজ বড়ই প্রতিকূল! বিরক্ত কষ্ঠে বলে টিটুকে ডাকল। টিটু আয় তো এদিকে।

দুই লাফে কাছে চলে এল টিটু।

পাথুরে জায়গাটা দেখিয়ে দিয়ে হুকুম দিল কিশোর, খোড়।

কিশোর কি চায়, এক কথাতেই বুঝে ফেলল বুদ্ধিমান কুকুরটা। খোঁড়ার কাজে মানুষের আঙুলের চেয়ে তার নখ যে কত বেশি দক্ষ, বুঝিয়ে দিল পলকে।

একের পর এক পাথর খুঁড়ে তুলে ফেলতে লাগল সে।

পাথর তোলার পর তাকে থামতে বলল কিশোর। হয়েছে।

অনেক ধন্যবাদ তোকে। এনে ভালই করেছি। বাড়ি গিয়ে দুটো বড় বড় হাড় পাবি। হাড়ের কথা শুনে আনন্দে হাঁক ছাড়তে গেল টিটু। সঙ্গে সঙ্গে তার মুখ চেপে ধরল ফারিহা। না না, টিটু না! বব পাথরগুলো দেখিয়ে বলল কিশোর।তুমি পাথর ছুড়বে। ওই যে কুড়াঁটা দেখছ, লোকটাকে ওদিকে নিয়ে যাবার চেষ্টা করো। এই সুযোগে আমি আর মুসা গিয়ে টনির বাঁধন খুলে দেব।

ঠিক আছে।খুশি মনে রাজি হয়ে গেল বব। আশা করি মেয়েরাও আমাকে সাহায্য করতে পারবে। যত বেশি লোককে কাজে লাগানো যায়, তত ভাল। কি বলো? ডলি, ফারিহা আর অনিতা একেক জন একেক দিকে সরে যাক। সবাই মিলে ছুঁড়তে থাকলে বোকা হয়ে যাবে লোকটা। বুঝতে পারবে না কোনদিক থেকে আসছে।

বুদ্ধিটা মন্দ না, স্বীকার করল কিশোর। বেশ রসদ ভাগ করে নাও তোমরা। প্রথম পাথরটা ছোড়ার সঙ্গে সঙ্গে অ্যাকশনে যাব আমি আর মুসা।

খামারবাড়িটার চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলল ডলি, ফারিহা, অনিতা আর বব।

ঠকাস করে গিয়ে প্রথম পাথরটা পড়ল জানালার কাঠের ফ্রেমে।

বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না গোয়েন্দাদের। দরজায় দেখা দিল লোকটা। ডানে-বাঁয়ে তাকাতে লাগল। প্রবল তুষারপাতের মধ্যে কিসের শব্দ হলো, বোঝার চেষ্টা করছে।

আরেকটা পাথর গিয়ে পড়ল। লোকটার কাছাকাছি। চরকির মত পাক খেয়ে ঘুরে দাঁড়াল সে। এগিয়ে এল পাথরটার দিকে।

ঠকাস! গোলাঘরের ঘুণে ধরা দরজায় গিয়ে লাগল তৃতীয় পাথরটা।

ঠকাস! ঠকাস!

আরও দুটো পাথর।

অবাক হয়ে ঘুরতে থাকল লোকটা। কুকুরের লেজের গোড়ায় মাছি বসে বিরক্ত করলে সেটাকে ধরার জন্যে যেমন করে ঘুরতে থাকে কুকুর। হয়তো ভাবছে, তুষারপাতের সঙ্গে সঙ্গে পাথর-বৃষ্টিও শুরু হলো বুঝি! দেখতে যাচ্ছে না কেন? অধৈর্য হয়ে উঠল মুসা। যাবে না নাকি?

ওরা বেশি কাছাকাছি পাথর ফেলছে, বিরক্ত হয়ে বলল কিশোর। ওদের বলে এলাম কুয়াটার দিকে নিয়ে যেতে।

ঠকাস!

যষ্ঠ পাথরটা গিয়ে লাগল কুয়ার দেয়ালে।

এইবার পড়তে দেখল প্রহরী। সাধারণ পাথর। তারমানে আকাশ থেকে পড়ছে না। ভাল করে দেখার জন্যে এগিয়ে গেল।

চলো! ফিসফিস করে মুসাকে বলে দৌড় দিল কিশোর।

তুষারপাতের মধ্যে পুরু তুষারের আস্তরণ মাড়িয়ে তাড়াতাড়ি দৌড়ানো সহজ ব্যাপার নয়। তা ছাড়া শব্দ করা যাবে না। ভাগ্য ভাল, পাথরটার দিকে গভীর মনোযোগ রয়েছে লোকটার। তাই অন্য কিছু খেয়াল করল না।

খোলা দরজা দিয়ে ছুটে ভেতরে ঢুকে পড়ল দুই গোয়েন্দা। টনির কাছে চলে এল। কিছু বলার সময় নেই এখন, তাকে বলল কিশোর। আপনাকে ছাড়াতে এসেছি আমরা।

পকেট থেকে পেন্সিল কাটার ছুরি বের করে লোকটার বাঁধন কেটে দিল।

টনির চোখে সতর্কতা দেখে আবার বলল, আমরা আপনার বন্ধু রোভারের বন্ধু।

দড়ি কেটে বসা লাল হয়ে যাওয়া জায়গাগুলো উলতে শুরু করল টনি। বলল, এই লোকগুলো জালিয়াত। কয়েন জাল করে। খুব খারাপ লোক। সব করতে পারে। ওরা আমাকে বলেছে, ওদের কয়েন ছড়িয়ে বেড়াচ্ছি আমি। ওদেরই একজন কয়েনগুলো কোথাও দিয়ে আসতে যাচ্ছিল, রাস্তায় ব্যাগ ছিড়ে পড়ে যায়।

হাতড়ে হাতড়ে যা পারে তুলে নিয়েছিল। তখন সব খুঁজে পায়নি অন্ধকার ছিল বলে। গোণা ছিল বোধহয়। পরে গুনে দেখে কম। আবার যায় তুলে আনতে কিন্ত গিয়ে আর পায়নি একটাও। আমি আর রোভার তুলে নিয়ে গিয়েছিলাম।

সেগুলো খোঁজার জন্যে তখন লোক লাগাল ওরা। হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াতে লাগল। জানি আমরা, বাধা দিয়ে বলল কিশোর। গত হস্তায় রাস্তায় কুড়িয়ে পেয়েছিলেন আপনি আর রোভার।

ও, জানো! টনি অবাক।

গত তিনদিন ধরে এই জাল কয়েন নিয়ে তদন্ত করছি আমরা। কিন্তু একটা কথা বুঝতে পারছি না, কাল আপনাকে ধরে নিয়ে এল কেন ওরা?

বললামই তো, ওদের কয়েন মানুষকে দিয়ে ফেলেছি আমরা। সত্যি বলছি, একেবারে না জেনে। ওরা চায় না ব্যাপারটা জানাজানি হয়ে যাক। এখানে কয়েনগুলো বানাচ্ছে ওরা, কিন্তু বাজারে ছাড়বে দূরের কোন শহরে নিয়ে গিয়ে।

যাতে সূত্র ধরে ধরে পুলিশ ওদের খুঁজে না পায়।

তাই।

কেন, মেশিনের শব্দ শুনছ না? আঙুল তুলে মাটির দিকে দেখাল টনি।

সেলারে বসে বানাচ্ছে এতক্ষণে বোঝা গেল শব্দটা কম কেন। মেশিনটা রয়েছে মাটির নিচের ঘরে।

রক্ত চলাচল বন্ধ থাকায় উঠে দাড়াতে কষ্ট হলো টনির। তিনজন লোক আছে ওখানে। ওই যে দেখো, ট্র্যাপডোর। সেলারে নামার দরজা। এত লোকের কথা শুনে সতর্ক হয়ে উঠেছে কিশোর। সোজা থানায় গিয়ে পুলিশকে জানাতে হবে।

না না, আর যা-ই করো, পুলিশের কাছে যেয়ো না! কাতর অনুনয় শুরু করল টনি। লোকগুলো ভয়ঙ্কর। কাল ধরে এনেছে আমাকে। আজ আনতে গেছে টনিকে। এতক্ষণে হয়তো ধরে ফেলেছেও ওকে!

সর্বনাশ! চমকে গেল কিশোর। টনিকে ধরলে রবিনকেও ধরবে ওরা, ছাড়বে না।

ওদিকে সমস্ত রসদ শেষ করে ফেলেছে বব বাহিনী। খামারবাড়ির দরজার দিকে তাকিয়ে অস্থির হয়ে উঠল। বেরোচ্ছে না কেন এখনও কিশোররা? কুয়োর কাছে দাঁড়িয়ে আছে প্রহরী। এদিক ওদিক তাকাচ্ছে।

ঝট করে বুদ্ধিটা উদয় হল অনিতার মাথায়। বিপজ্জনক। কিন্তু কার্যকরী বলল, যে কোন ভাবেই হোক, লোকটাকে দরজার কাছ থেকে সরিয়ে রাখতে হবে, কিশোররা না বেরোনো পর্যন্ত।

বলে আর দেরি করল না। ঝোঁপ থেকে বেরিয়ে সোজা হাঁটা দিল লোকটার দিকে।

স্তব্ধ হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে বব, ডলি আর ফারিহা। কি করতে যাচেছ অনিতা!

তাজা বাতাস চাইছেন, তাই না? হেসে বলল অনিতা।

ভীষণ চমকে গিয়ে পাক খেয়ে ঘুরে গেল লোকটা। হা করে তাকিয়ে রইল দীর্ঘ একটা মুহূর্ত। ধমকে উঠল, এই মেয়ে, এখানে কি করছ।

না, কিছু করছি না। এমনি হাটতে বেরিয়েছি।

হাটতে বেরিয়েছে। এই তুষারপাতের মধ্যে! জবাব খুঁজে পেল না লোকটা।

আচমকা ফেটে পড়ল, মিথ্যে বলার আর জায়গা পাওনি। চাবকে তোমার চামড়া ছাড়াব।

কে ভয় পায় তোমাকে? বুড়ো আঙুল দেখাল অনিতা। ও কি করতে চায়, বুঝে গেছে এতক্ষণে বব। ঝোপের আড়াল থেকে বেরিয়ে বাড়িটার দিকে দৌড় মারল। লোকটার অলক্ষে বাড়ির পাশ ঘুরে এসে দাড়াল জানালার সামনে। চাপা স্বরে ডাক দিল, কিশোর, জলদি বেরোও! অনিতা লোকটাকে ব্যস্ত রেখেছে! বেশিক্ষণ পারবে না। জলদি করো।

ট্র্যাপডোরটা দেখিয়ে মুসা বলল, নিচে আরও তিনজন রয়েছে।

থাক, কিশোর বলল। ওদের ব্যবস্থা পরে করব। আগে গার্ডটাকে ঠেকানো দরকার।

জানালার কাছে এসে দাঁড়াল সে।পেছন পেছন এল মুসা আর টনি।

কুয়ার কাছ থেকে সরেনি লোকটা।জানালার দিকে পেছন করে দাঁড়িয়ে আছে।

তার সামনে খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে গোঁয়ারের মত তর্ক জুড়ে দিয়েছে অনিতা।

সুযোগটা কাজে লাগাল কিশোররা। টনিকে সহ বেরিয়ে এল দরজা দিয়ে।

ওদের বেরোতে দেখেছে অনিতা। বুঝতে পারছে, আরও কিছুক্ষণ ব্যস্ত রাখতে হবে লোকটাকে।

স্বর নরম করে বলল, এমন করছেন কেন আপনি? আমি তো ক্ষতি করিনি।

হাঁটতে বেরিয়েছিলাম…

এই তুষারপাতের মধ্যে নেকড়েরা হাঁটতে বেরোয় না, আর তুমি বেরিয়েছ, এ কথা বিশ্বাস করতে বলো আমাকে? নিশ্চয় কোন মতলব আছে তোমার।

সত্যি বলব? যেন কত গোপন কথা ফাঁস করে দিচ্ছে অনিতা, এমন ভঙ্গিতে বলল, তাহলে শুনুন কেন এসেছি। সেদিন হাটতে হাটতে চলে এসেছিলাম এদিকে।কুয়াটা দেখে কৌতূহল হলো। ঝুকে দেখতে গিয়ে আঙুল থেকে একটা আঙ্গটি খসে পড়ে গেল কুয়ার মধ্যে।মার আঙ্গটি। অনেক দামী হীরা বসানো।

লোভে চকচক করে উঠল লোকটার চোখ। মনে মনে হাসল অনিতা। টোপ গিলেছে হাদাটা। কুয়ার দেয়াল ঘেষে দাঁড়িয়ে ঝূকে নিচে তাকাল।

কাছে চলে এসেছে ততক্ষণে কিশোররা।

কই, কিছু তো দেখছি না, লোকটা বলল। টর্চ নিয়ে আসিগে।

তার আর দরকার হবে না, বলেই পেছন থেকে তাকে জোরে ধাক্কা মারল টনি। কুয়ার দিকে আরও ঝুকে গেল লোকটার দেহের ওপরের অংশ। দুই পা ধরে হ্যাচক টান মারল কিশোর আর মুসা।

কুয়ার মধ্যে উল্টে পড়ে গেল লোকটা। কুয়ার মুখ দিয়ে বেরোনো তার চিৎকারটা কেমন অপার্থিব শোনাল।

দারুণ দেখালে, অনিতা উচ্ছসিত প্রশংসা না করে পারল না কিশোর।

মাথা উঁচু করে একটা বিশেষ ভঙ্গিতে দাঁড়াল অনিতা। ভাবখানা, গোয়েন্দা হিসেবে তোমার চেয়ে কম নই আমি।

তাতে কিছু মনে করল না কিশোর। হাসল কেবল তার দিকে তাকিয়ে।

দৌড়ে এল ডলি আর ফারিহা। এ কি করলে? শঙ্কিত স্বরে বলল ডলি। যদি মরে যায়?

মরবে না, কুয়ার দেয়াল ঘেষে দাঁড়িয়ে নিচে উঁকি দিল কিশোর। পানি নেই। গভীরতাও কম। তবে সাহায্য ছাড়া উঠে আসতে পারবে না আর।

নিচ থেকে চিৎকার শুরু করল লোকটা। তুলে আনার জন্যে অনুনয় বিনয় করতে লাগল। বার বার কাতর কণ্ঠে জানাতে লাগল, তার পা ভেঙে গেছে।

তুলে অবশ্যই আনা হবে, কিশোর বলল। তবে আমরা নই। পুলিশে আনবে।

ওপরে উঠে আসার ব্যর্থ চেষ্টা করতে লাগল লোকটা। কিন্তু ভাঙা পা নিয়ে কিছুই করতে পারল না।

ঘুরে দাঁড়াল কিশোর। বাকি তিনটার ব্যবস্থা করতে হয় এখন। চলো যাই।

তিনজনকে নিয়ে বিশেষ বেগ পেতে হলো না। জানলই না ওরা আটকা পড়েছে। ওপর থেকে হুড়কো আটকে দেয়া হলো ভারী কাঠের ট্রাপডোরটার। তার ওপর চাপিয়ে দেয়া হলো ঘরের মধ্যে যত ভারী, ভারী জিনিসপত্র আছে, সব। কোনমতেই যাতে দরজা ভেঙ্গে উপরে উঠে আসতে না

পারে লোকগুলো।

হাত ঝাড়তে ঝাড়তে কিশোর বলল, এখানকার কাজ শেষ। বাকি তিনজনকে ধরতে হবে এবার। রবিন আর রোভার বিপদের মধ্যে রয়েছে। জলদি।

আবার তুষার মাড়িয়ে দল বেঁধে ফিরে চলল ওরা। বনের মধ্যে দিয়েই এগোল এবারও। দুটো কারণে। এক, তুষার এখানে কম। দুই, গাড়ি নিয়ে যদি ফিরে আসে গালকাটা লোকটা, তাহলে যাতে ওর চোখে না পড়ে।

রাস্তার মাথায় যেখানে সাইকেলগুলো রেখে গিয়েছিল, তার কাছাকাছি আসতে ইঞ্জিনের শব্দ কানে এল। তাড়াতাড়ি গাছের আড়ালে লুকিয়ে পড়ে ফাঁক দিয়ে তাকাল কালো গাড়িটাই। ফিরে যাচ্ছে খামারবাড়িতে। তুষারপাতের মধ্যে দূর থেকে গাড়ির আরোহীদের চোখে পড়ল না। তবে ওরা শিওর রবিন আর রোভারকে কিডন্যাপ করে নিয়ে ফিরে এসেছে গালকাটা আর তার দুই সহকারী। মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল কিশোর। জরুরী কষ্ঠে ববকে বলল, বব, সোজা থানায় চলে যাও। যত তাড়াতাড়ি পারো, পুলিশ নিয়ে ফিরবে। আমরা খামারবাড়িতে ফিরে যাচ্ছি আবার। রবিনদের উদ্ধার করতে হবে।

সময়মতই পুলিশ নিয়ে ফিরে এল বব। তার বন্ধুদের সবাইকে পেল ওখানে, কেবল রবিন বাদে। রোভারও নেই।

মাটির নিচ থেকে তিন জালিয়াতকে তুলে আনল পুলিশ। হাতকড়া লাগাল। কুয়া থেকেও তুলে নিল আহত লোকটাকে। আরও একজনকে পেল, হাত-পা বাঁধা অবস্থায়: টনিকে যেখানে ফেলে রাখা হয়েছিল, সেখানে। তাকে কাবু করতে বিন্দুমাত্র বেগ পেতে হয়নি কিশোরদের। এতজনের বিরুদ্ধে একা কিছুই করতে পারেনি লোকটা।

তার মুখেই জানা গেল সব ঘটনা। গালকাটা আর তার আরেক সঙ্গীকে নিয়ে হেনরির দোকানে গিয়েছিল সে। রোভারকে ধরে আনার জন্যে। কল্পনাই করেনি, ফাঁদ পেতে রাখা হবে ওদের জন্যে। তাতে পা দিয়ে বেমক্কা ভাবে ধরা পড়েছে গালকাটা আর তার সহকারী। গাড়িতে ছিল তৃতীয় লোকটা। দুজনকে বন্দি হতে দেখে গাড়ি নিয়ে পালাল। তবে শেষ রক্ষা করতে পারল না।

ঘটনাটা কি ঘটেছে পরে রবিনের মুখে জেনেছে কিশোররা। দোকানের দরজায় ফাদার ক্রিস্টমাস সেজে ছবি তুলে যাচ্ছিল ওরা। ভালই করছিল রবিন।

কিন্তু রোভারের চেয়ে খাটো দেখে সন্দেহ করে বসেন দোকানের মালিক মিস্টার হেনরি। অগত্যা সব কথা খুলে বলতে হয় তাকে। গালকাটারা এলে ওদের ধরার জন্যে তার সাহায্য চায় রবিন।

মিস্টার হেনরি আর কর্মচারীদের সহায়তায় ধরে ফেলা হয় দুই জালিয়াতকে।

পরদিন কিশোরদের ছাউনিতে আন্ডায় বসেছে সবাই। গ্ৰীনহিলসের পুলিশ কনষ্টেবল ফগর্যাম্পারকটের কথা উঠল। বড়দিনের ছুটি কাটাতে অন্য শহরে আত্মীয়ের বাড়িতে চলে গেছে ফগ।

বেচারা ফগ! জিভ করে আফসোস করল ফারিহা। দারুণ একটা রহস্য থেকে বঞ্চিত হল।এসে যখন শুনবে, আফসোসের আর সীমা থাকবে না তার।

ফগের নাম শুনেই কান খাড়া করে ফেলেছে টিটু। কাকতালীয় ভাবে ঠিক এই সময় গেটের কাছে সাইকেলের ঘণ্টার শব্দ শোনা গেল। টিটু ভাবল, ফগ। আর ঠেকায় কে তাকে। ফগের গোড়ালি কামড়ানোর লোভে ঘেউ ঘেউ করে গলা ফাটিয়ে চিৎকার দিতে দিতে বেরিয়ে চলে গেল।

হুড়মুড় করে তার পেছন পেছন ছুটে বেরিয়ে এল সবাই।

টিটুর মতই হতাশ হতে হলো ওদেরকেও। ফগ নয়, গায়ের মুদী দোকানের ছেলেটা এসেছে মেরিচাচীর কাছ থেকে জিনিসপত্রের অর্ডার নিতে।

*** সমাপ্ত ***

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *