অবাক কাণ্ড

ভলিউম ১৮অবাক কাণ্ডতিন গোয়েন্দা – রকিব হাসান – সেবা প্রকাশনী

ঘটনাটা কি…? গাড়ির ইঞ্জিনের ওপর থেকে মুখ তুলে তাকিয়েই বলে উঠল কিশোর পাশা। সোজা হতে গিয়ে মাথা বুকে গেল পুরানো সাদা রঙের শেভি ইমপালার হুডে।

মাল নিয়ে ফিরে এসেছেন রাশেদ পাশা। উদ্ভট সব জিনিস কেনায় জুড়ি নেই তার, কিন্তু এবার যেন সব কিছুকে ছাড়িয়ে গেছেন।

ইয়াডের বড় ট্রাকটার ড্রাইভিং হুইল ধরে বসে আছেন তিনি। মাথায় পুরানো একটা রোমশ টুপি, পেছনে ঝুলে রয়েছে র্যাকুনের লেজ। টুপি বটে একখানা! ট্রাকের পেছনে ইয়ার্ডের দুই কর্মচারী, ব্যাভারিয়ান ভাই বোরিস আর রোভার বিচিত্র সব জিনিসের মধ্যে বসে আছে।

বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে রয়েছে কিশোর। বিশ্বাস করতে পারছে না নিজের চোখকে। মাথাটাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি রাশেদ পাশার! সেদিকে তাকিয়ে সরে আসতে গিয়ে কনুই লেগে উল্টে পড়ল ইঞ্জিনের ওপর রাখা একটা মবিলের ক্যান। ক্র্যাংককেসের ভেতর দিয়ে গড়িয়ে ঢুকে যেতে শুরু করল ঘন তেল।

খাইছে! চিৎকার করে উঠল মুসা আমান। গাড়ির চেসিসের নিচ থেকে যেন ছিটকে বেরিয়ে এল। না বলতেই ঢেলে দিলে কেন?

দেখার মত চেহারা হয়েছে তার। চেসিসের নিচে কাজ করতে গিয়ে এমনিতেই কালিতে মাখামাখি হয়ে গিয়েছিল, তার ওপর পড়েছে মবিল। কোঁকড়া চুল বেয়ে গড়াচ্ছে। ইঞ্জিনের মবিল পাল্টাতে নিচে ঢুকেছিল সে। কিশোরকে বানিয়েছিল সহকারী। কিন্তু বলার আগেই তেল ঢেলে দিয়েছে কিশোর।

রেগে গিয়ে মুসা বলল, কি হয়েছে?

ক্যানটা আবার সোজা করে ফেলেছে কিশোর। কিন্তু দেরিতে। সমস্ত তেল পড়ে গেছে ততক্ষণে। বলল, সরি! চমকে গিয়েছিলাম!

কেন? তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ লেগেছে? বলেই চোখ পড়ল মেরিচাচীর ওপর। অফিসের বারান্দা থেকে নেমে গটমট করে এগিয়ে আসছেন ট্রাকের দিকে। রাশেদ পাশার দিকে তাকিয়ে মুসাও চমকে গেল কিশোরের মতই। খাইছে! এ কি কাণ্ড!

রাশেদ পাশা! ফেটে পড়লেন যেন মেরিচাচী। তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে। এসব কি এনেছ! মালগুলোর দিকে হাত নাড়লেন তিনি। এই জঞ্জাল দিয়ে কি হবে!

জঞ্জাল নয় এগুলো, শান্তকন্ঠে বলল রাশেদ পাশা। ইয়ার্ডের মাল, বিক্রির জন্যে। যারা চিনবে, তারা কিনবে।

তোমার মাথার ওই টুপিটাও? আয়নায় দেখেছ মুখটা?

পেছন থেকে লেজটা সামনে নিয়ে এলেন রাশেদ পাশা। লম্বা বেনিতে যেমন হাত বোলায় মেয়েরা, তেমনি করে বোলাতে বোলাতে বললেন, একেবারে আসল মাল। খাটি জিনিস। ব্যাকুনের চামড়ায় তৈরি ডেভি ক্ৰিকেট ক্যাপ।

দ্রুত ট্রাকের পেছন দিকে চলে এলেন মেরিচাচী। যারা চিনবে, তারা কিনবে! হতচ্ছাড়া সব জিনিস! ট্রাঙ্কটার মধ্যে কি?

নিজেই উঠে গিয়ে টান দিয়ে ডালা তুলে ফেললেন। এতগুলো কমিকের বই। এর জন্য টাকা নষ্ট করলে!

কয়েক লাফে ট্রাকের পেছনে পৌছে গেল কিশোর। কৌতূহলে ফাটছে। উঠে পড়ল ট্রাকে। ট্রাঙ্কের ভেতর গাদা গাদা কমিকের বই।

মারছে! মুসাও এসে দাঁড়িয়েছে ট্রাকের কাছে। লোকটা সাংঘাতিক কমিক ভালবাসত তো! যার কাছ থেকে এনেছে।

অনেক পুরানো, কিশোর বলল। নিশ্চয় অনেকদিন ফেলে রেখেছিল। মুসার দিকে ঝুঁকল। নিচু গলায় জিজ্ঞেস করল, কত টাকা আছে তোমার কাছে?

বেশি না, পকেটে হাত ঢুকিয়ে দিল মুসা।

অ্যাই, কি হয়েছে? রবিন জিজ্ঞেস করল। সবেমাত্র ইয়ার্ডে ঢুকেছে সে। গায়ে সাদা পোলো শার্ট। পরনে খাকি প্যান্ট। সুন্দর লাগছে ওকে।

দেখে খুশি হলো কিশোর, এই যে, ঠিক সময়ে এসে পড়েছ। দেখো তো পকেটে কত টাকা আছে?

পকেটে হাত ঢোকাল রবিন। বেশি নেই। টানাটানি। কেন?

হাসল কিশোর। কিছু কমিক কিনব।

বইগুলো ঘটছেন মেরিচাচী। আরও কিছু আছে কিনা দেখছেন ট্রাঙ্কের ভেতরে। কি কারণে যে এগুলো আনল। এখন কার কাছে বিক্রি করি? কাস্টোমার কোথায়?

এখানে। রবিনের হাত থেকে টাকাগুলো ছোঁ মেরে নিয়ে নিল কিশোর। নিজের পকেটে যা আছে বের করল। তিনজনেরটা একসাথে করে দ্রুত গুনে ফেলল। নাও, বাড়িয়ে দিয়ে বলল, একুশ ডলার সত্তর সেন্ট। তোমার সমস্ত যন্ত্রণা কিনে নিলাম আমরা। কি বলো, চাচী?

নিয়ে যা! জানে বাঁচলাম! টাকাটা নিতে গিয়েও দ্বিধা করলেন মেরিচাচী। কি করবি ওসব পচা কমিক দিয়ে?

কমিক নিয়ে কি করে মানুষ? পড়ব।

চোখে সন্দেহ দেখা দিল মেরিচাচীর। তোর মতলবটা কি বলো তো? কমিক নিয়ে ডুবে থেকে কাজে ফাঁকি দেয়ার ফন্দি না তো?

হেসে ফেললেন রাশেদ পাশা। টাকা দিচ্ছে নিয়ে নাও। এতক্ষণ তো কোথায় বেচবে কোথায় বেচবে করছিলে। কাস্টোমার পেয়েই দিধা কিসের?

তবু দ্বিধা করছেন মেরিচাণী। কোন উদ্দেশ্য না থাকলে কিশোর টাকা দিয়ে কিনত না। এমনিতেও অবশ্য বিক্রির জিনিস প্রয়োজন হলে কিনে নেয় সে, আর দশজন কাস্টোমারের মতই। আবার নিজে যখন কাজ করে দেয়, তখনও তার পারিশ্রমিক নিয়ে নেয়। কঠোর ভাবে মেনে চলে ব্যবসার নিয়ম কানুন! যদিও পুরো ব্যবসাটা একদিন তারই হবে, তবু নিজের মনে করে কিছু নিয়ে নেয় না। তার এই নিয়মনিষ্ঠায় খুবই খুশি মেরিচাচী। বলেন, সাংঘাতিক উন্নতি করবে একদিন তার ছেলে। কিশোরকে ছেলেই ভাবেন নিঃসন্তান মারিয়া পাশা।

আরে নাও না, টাকাটা চাচীর হাতে গুঁজে দিতে দিতে বলল কিশোর। একলা তো কিনিনি। তিনজনে মিলেই কিনেছি।

সেজন্যেই তো ভয়! কি ফন্দি করেছিস কে জানে!

আর কথা বাড়াল না কিশোর। মুসাকে নিয়ে মাল নামাতে শুরু করল। নিচে দাঁড়িয়ে সাহায্য করল রবিন। এগুলোর জন্যে টাকা নিয়েছ?

মাথা খারাপ হয়ে গেছে আজকে ওর, মুসা বলল। প্রথমে আমার মুখে তেল ঢালল। তারপর টাকা-পয়সা কেড়ে নিয়ে গিয়ে কতগুলো পুরানো কমিক…

মবিল? মুসার মাথা শুকে নাক কুঁচকাল রবিন। আমি তো ভেবেছিলাম, মাথায় তেল দেয়া আরম্ভ করেছ বুঝি।

এসব কথা বাদ দাও তো! অধৈর্য হয়ে হাত নাড়ল কিশোর। রবিনের দিকে তাকাল। বললে তো টাকা-পয়সা কেড়ে নিয়ে কতগুলো পুরানো কমিক কিনেছি। আসলে টাকা খাটালাম, মস্ত লাভের জন্যে।

টাকা খাটালে? ভুরু কুঁচকে গেল রবিনের। যা দিয়েছ তার বহুগুণ ফেরত পাবে।ট্রাঙ্কটায় টোকা দিল কিশোর।

এই আবর্জনা থেকে? মুসার কষ্ঠে অবিশ্বাস।

অত অবহেলা কোরো না। এর মধ্যে গুপ্তধন লুকানো আছে। জাননা, পুরানো কমিকের দাম মাঝে মাঝে কত বেড়ে যায়? কিছু তো হাজার হাজার ডলারে বিক্রি হয়।

হাজার হাজার…? ট্রাঙ্কটার দিকে তাকিয়ে রয়েছে রবিন।

নিশ্চয়ই। তবে কয়েকশো ডলার তো পাবই। দুই হাতের তালু এক করে জোরে জোরে ডলল কিশোর। বেশিও হতে পারে। তাতে আমার একটা গাড়ি কেনা হয়ে যাবে হয়তো। তবে যাই লাভ হবে, তিনজনে ভাগাভাগি করে নেব আমরা।

পরের শুক্রবারে মুসার ইমপালায় চড়ে শহরতলীতে রওনা হলো তিন গোয়েন্দা। তিনজনেরই অবসর। মুসার বাড়িতে কাজ নেই, রবিনের ছুটি, আর মেরিচাচীও কিশোরকে নতুন কাজ গছাতে ব্যর্থ হয়েছেন, কারণ সেদিন কোন কাজই নেই ইয়ার্ডে।

প্রচুর ধোঁয়া বেরোচ্ছে এগজস্ট পাইপ থেকে। রিয়ারভিউ মিররে সেই ধোঁয়ার দিকে তাকিয়ে মুখ বাঁকাল মুসা। তুমি একটা সর্বনাশ করেছ, কিশোর। সেই যে মবিল ফেললে তার জের এখনও চলছে। ইঞ্জিনের গা থেকে পুড়ে শেষ হয়নি।…আমার চুলে তো এখনও গন্ধ আছে!

তেল তো অনেক ভাল, রবিল ফোড়ন কাটল। পুরানো কমিক পড়তে পড়তে যে অন্ধ হয়ে যাইনি এটাই বেশি। বাপরে বাপ! লাইব্রেরিতে পুরানো বই মোছার চেয়ে বিরক্তিকর এটা।

তোমার মত বইয়ের পোকাও একথা বলছ? সামনের রাস্তার ওপর মুসার নজর। তবে যা-ই বলো, কিছু কিছু পড়তে কিন্তু ভালই লেগেছে। ছোটবেলার কথা মনে পড়ে গেছে, যখন ওসব পড়তাম। যেমন ধরো, ক্রিমসন ফ্যান্টমের কথাই। মাথা নেড়ে জোরে একটা নিঃশ্বাস ফেলল সে। ও তো সাংঘাতিক জিনিস। এখনও ভাল্লাগে।

তোমার লাগে, পেছনের সীটে বসেছে রবিন। মেঝেতে পায়ের কাছে পড়ে থাকা মলাটের বাক্সটার দিকে তাকিয়ে বিরক্ত মুখভঙ্গি করল। আমার লাগে না। বাক্সটায় একটা লাথি মেরে বলল, এগুলো আমার পড়তে হয়েছে, ভাল না মন্দ বোঝার জন্যে, ভাবলেই মেজাজ খিচড়ে যায়। কমিকের মধ্যে কিছু আছে নাকি!

সাবধান! ঘাড় ঘুরিয়ে রবিনের দিকে তাকিয়ে বলল কিশোর, এগুলো ব্যবসার মাল। নষ্ট করলে টাকা নষ্ট হবে। মালগুলো খুঁজে বের করতে হবে আগে আমাদের, সব চেয়ে দামিগুলো। ছিঁড়েটিড়ে নিয়ে গেলে হয়তো কিনতেই রাজি হবে না ইন্টারকমিকনের ওরা।

ওরাই যদি বাঁচায়। নইলে এসব আবর্জনা কিনবে কে গাঁটের পয়সা খরচ করে? ভাগ্যিস কাগজে কমিকস কনভেশনের খবরটা পড়েছিলে।

কিশোর হাসল। রবিন, এতটা কিপটে হয়ে গেলে কি করে তুমি? দাঁড়াও, আগে পেয়েনি টাকাটা। গোনার কাজে লাগিয়ে দেব। গুনতে গুনতে শেষে টাকার ওপরই ঘেন্না ধরে যাবে।

এসে গেছি, ঘোষণা করল মুসা। দ্য সেনচুরি গ্র্যান্ড প্লাজা।

কাচ আর ইস্পাতে তৈরি পরিষ্কার আকাশে মাথা তুলে দাঁড়ানো চকচকে টাওয়ারটার দিকে তাকাল রবিন। এরকম একটা জায়গায় কমিক বিক্রি হয়!

আগস্ট মাসের পঁচা গরম পড়ছে। ঘামছে কিশোর। বলল, এই মুসা, গাড়ি এখানেই রাখ কোথাও। গিয়ে দেখা যাক কি ধরনের সম্মেলন হচ্ছে।

ড্রাইভওয়ে দিয়ে হোটলের আন্ডারগ্রাউন্ড পার্কিং গ্যারেজে গাড়ি নিয়ে এল মুসা। আজব এক কংক্রীটে তৈরি জঙ্গলের মত লাগছে জায়গাটাকে। মোটা মোটা থাম ধরে রেখেছে ছাত এবং তার ওপরের বাড়িটাকে। উজ্জ্বল রঙ করে জায়গাটাকে মোটামুটি একটা সুন্দর রূপ দেয়ার চেষ্টা করেছে কর্তৃপক্ষ, কিন্তু কতটা সফল হয়েছে বলা মুশকিল। মুসার অন্তত ভাল লাগছে না। গাড়ির এগজস্টের ধোঁয়া, অল্প আলো, আর অসংখ্য থামের ছায়া কেমন যেন ভূতুড়ে করে তুলেছে পরিবেশ।

খালি একটা জায়গায় গাড়ি ঢুকিয়ে দিয়ে মুসা বলল, নাও, থামলাম। বেরোও সবাই।

বেরোও বললেই কি আর হয়, রবিন বলল। যা একখান বোঝা নিয়ে এলাম। লেখাগুলো যেমন বিচ্ছিরি, ওজনটাও তেমনি বাজে। দেখি, নাও তো।

আবার এটাতেও আমাকে টানছ কেন? প্রতিবাদ জানাল মুসা। তোমাদেরকে ড্রাইভ করে যে এখানে নিয়ে এলাম, সেটা কিছু না?

সেটা আমিও করতে পারতাম।

পারলে তো তোমার ফোক্স ওয়াগেনে করেই আসতাম। ওই গোবরে পোকার ভেতরে জায়গা হলো না বলেই তো…আসলে ওই বাক্সটার জন্যেই হলো না।

বিরক্ত চোখে দুই সহকারীর দিকে তাকাল কিশোর। তোমাদের যখন এতই কষ্ট লাগছে, ঠিক আছে, আমিই নিতে পারব। বাক্সটা ধরে টান দিল সে। আগের মত শুটকি ভাব নাকি আমাকে?

না, তা ভাবব কেন? মুসা বলল। জুডো ক্লাসের ব্যায়াম অনেক মেরামত করে দিয়েছে তোমাকে। শরীর আরও ভাল হয়ে যেত, যদি কারাতে শিখতে।

এমনিতেই যথেষ্ট হয়েছে। ভারি বোঝা নিয়ে এলিভেটরের কাছে পৌঁছতে পৌঁছতেই হাঁপিয়ে উঠল কিশোর।

কল বাটন টিপতেই খুলে গেল এলিভেটরের দরজা।

ঢুকল তিনজনে। পায়ের শব্দ কানে এল। দৌড়ে আসছে কেউ এলিভেটর ধরার জন্যে। ঝট করে একটা হাত ঢুকে গেল দরজার ফাঁকে, পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগেই। আবার ঝটকা দিয়ে খুলে গেল দরজা। একজন লোক। শরীরের মাংস খসে খসে পড়ছে তার।

ভয়ঙ্কর মানুষটাকে দেখে আরেকটু হলেই হাত থেকে কমিকের বাক্স খসে পড়ে যাচ্ছিল কিশোরের।

লাফিয়ে এলিভেটরে উঠে লোকটা বলল, সরি, চমকে দিলাম। গোয়েন্দাদেরকে একধারে সরে যেতে দেখে হাসল। কাঁধের গিঁটলি হয়ে যাওয়া একটুকরো মাংস দুই আঙুলে টিপে ধরল সে। ল্যাটেক্স সেজেছি আমি। কমিকের মাংস খসা ভূত। প্রতিযোগিতার সাজ। কেমন লাগছে?

একেবারে বা-বাবা, তোতলাতে লাগল কিশোর, বাস্তব!

লবিতে পৌঁছল এলিভেটর। যেমন তাড়াহুড়ো করে উঠেছিল, তেমনি করেই নেমে গেল মাংস খসা ভূত। জনতার ভিড়ে হারিয়ে গেল। লবির আরও অনেকেই নানা রকম সাজে সেজেছে। সবই কমিক বইয়ের চরিত্র। এলিভেটর থেকে নেমে মারবেলের মেঝেতে বিছানো কার্পেটের ওপর দিয়ে ক্রোমের ফ্রেম করা অ্যানাউন্সমেন্ট বোর্ডের দিকে এগোল তিন গোয়েন্দা। ইনটারকমিকন, পড়ল কিশোর, মেইন কনফারেন্স হল। তাকাল দুই সহকারীর দিকে। অনেক বড় মনে হচ্ছে।

সম্মেলন যেখানে হবে সেদিকে এগোল ওরা। সাধারণ একটা কাঠের টেবিলের সামনে একদল মানুষকে সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল। টেবিলের পেছনে বসে একটা মেয়ে। সোনালি রঙ করা চুল। মাঝখানে কালো রঙের একটা শিং গজিয়েছে, চুলগুলোকেই বাঁধা হয়েছে ওরকম করে। গায়ে কালো রঙের টি-শার্ট, তাতে সাদা অক্ষরে লেখা: ইনটারকমিকন স্টাফ। তিন গোয়েন্দা কাছে যেতেই বলল, দশ ডলার করে প্রতিটি।

ওদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে, কালো কালির বড় একটা ইঙ্ক প্যাড থেকে স্ট্যাম্পে কালি নিয়ে ছাপ দিয়ে দিল গোয়েন্দাদের ডান হাতের উল্টো পিঠে।

কিশোর লক্ষ করল, প্রয়োজনের অতিরিক্ত সময় রবিনের হাতটা ধরে রাখল মেয়েটা এবং এই প্রথম হাসল।

মুসাও ব্যাপরটা লক্ষ্য করেছে। কিশোরের দিকে মাথা কাত করে বলল, রবিনটা যে কি জাদু করে বুঝি না! মেয়েগুলো ওকে দেখলেই আরেক রকম হয়ে যায়…

যা খুশি করুকগে। হাতের ছাপটার দিকে তাকাল কিশোর। লেখা হয়েছেঃ ইন্টারকমিকন-ডে ১। বিড়বিড় করল সে, টিকেটের চেয়ে খরচ কম, ফাঁকিবাজিরও ভয় নেই। ইচ্ছে করলেই আমরা নিয়ে গিয়ে কোন বন্ধুকে দিয়ে দিতে পারব না এটা, টিকেট হলে যেমন পারা যায়। মোট কথা যাকে দেয়া হয়েছে শুধু তার জন্যেই এটা প্রযোজ্য।

রবিনের পেছন পেছন কনফারেন্স হলের দরজায় এসে দাঁড়াল দুজনে। দরজা জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে বিশালদেহী এক লোক। ষাঁড় যেন। এর গায়েও কালো টিশার্ট। হাত বাঁড়াল টিকেট চাওয়ার ভঙ্গিতে।

যার যার ডান হাত বাড়িয়ে দিল তিন গোয়েন্দা।

ছাপগুলো পরীক্ষা করল লোকটা। তারপর হাসল। বেরিয়ে পড়ল একটা ভাঙা দাঁত। সরে গেল একপাশে। পা বাড়াল তিন গোয়েন্দা। ঢুকল এসে যেন এক সাংঘাতিক পাগলখানার মধ্যে।

লবির শান্ত পরিবেশের তুলনায় এই জায়গাটাকে মনে হলো আরব্য রজনীর কোন সরগরম মেলা, কিংবা বাজার। বিশাল হলঘরে পাতা হয়েছে কাঠের শত শত ফোল্ডিং টেবিল। কিছু টেবিল ব্যবহার হচ্ছে কাউন্টার হিসেবে, রাশি রাশি কমিকের বই স্তূপ হয়ে আছে ওগুলোতে। কিছু টেবিলে গায়ে গায়ে লাগিয়ে স্টল তৈরি করা হয়েছে। প্রতিটি স্টলের পেছনে লাগানো হয়েছে তাক আর ডিসপ্লে বোর্ড, ওগুলোতে সাজিয়ে রাখা হয়েছে রঙচঙে কমিকের বই। বইগুলোকে যত্ন করে অয়েল পেপারে মোড়া হয়েছে। সংগ্রাহকের জিনিস। যার পছন্দ হবে অনেক দাম দিয়ে কিনবে।

অনেক মানুষ। যেখানে ফাঁক পেয়েছে গাদাগাদি করে রয়েছে। হাঁটার উপায় নেই। অনেক কষ্টে ঠেলেঠুলে এগোতে হয়। বুড়ো-বাচ্চা, সব বয়েসের মানুষই হুমড়ি খেয়ে পড়েছে কমিকের ওপর, দামদর করছে। পছন্দ হলে কিনছে, না হলে সরে যাচ্ছে আরেক কাউন্টারে। বিচিত্র সব পোশাক পরে রয়েছে অনেকে, ক্রেতাবিক্রেতা উভয় দলেই আছে এই সাজের বাহার। হট্টগোলে কান ঝালাপালা।

পাথর হয়ে যেন দরজায় দাঁড়িয়ে আছে তিন বন্ধু। লম্বা, পাতলা লাল চুলওয়ালা, ইনটারকমিকনের টি-শার্ট পরা একজন মানুষ সরে এলেন ভিড়ের ভেতর থেকে। তিন গোয়েন্দার দিকে তাকিয়ে হাসলেন।

প্রথম এলে বুঝি, বললেন তিনি। তোমাদের অবাক হওয়া দেখেই বুঝেছি। নাটকীয় ভঙ্গিতে বললেন, ইনটারকমিকনে স্বাগতম। আমি লুই মরগান। এই কনভেনশনের চীফ। হাসলেন। পাগলাগারদ মনে হচ্ছে তো? কিশোরের হাতের বাক্সটার দিকে তাকিয়ে বললেন, তো, কি নিয়ে এলে?

ওদের কথা শোনার পর হাসিটা বাড়ল তাঁর। অনেক পাইকার পাবে এখানে। হাত ছড়িয়ে স্টলগুলো দেখালেন তিনি। সব চেয়ে বড় গ্রুপটা হলো সুমাতো কমিকস। তাদের টাকা আছে, ভাল দাম দিতে পারবে। ওই যে, ওদিকটায় ওদের স্টল। লম্বা একটা আঙুল তুলে ঘরের একধারে দেখালেন।

নির্দেশ মত ঘরের ওই পাশটায় চলে এল তিন গোয়েন্দা। ছোট একটা স্ট্যান্ডের কাছে এসে থামল কিশোর, কমিকের সাথে সাথে টি-শার্টও বিক্রি হয় ওখানে। তিনজনের জন্যেই একটা করে শার্ট কিনল সে। ওগুলোতে ছাপ মারা রয়েছেঃ কমিক লাভারস ডু ইট উইথ পিকচারস।

সুমাতো কমিক লেখা স্টলটা চোখে পড়ল ওদের। অনেক বড়। ডান পাশের অর্ধেক জুড়ে দেয়াল ঘেঁষে বিরাট এক দোকান সাজানো হয়েছে। খরিদ্দারও প্রচুর।

টেবিলের কাছে যাওয়ার আগে দ্বিধা করল তিন গোয়েন্দা। সব কিছু দেখে নিয়ে তারপর যেতে চায়।

পাঁচজন অল্পবয়েসী লোক দাঁড়িয়ে টেবিলের ওপাশে। খরিদ্দার সামলাচ্ছে। একজনের এক কানে দুল। সে কথা বলছে একটা ছোট ছেলের সঙ্গে। একটা থান্ডারবীম কমিকের তিন নম্বর সিরিজটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, দিয়ে দিলাম চার ডলারেই। বইটার মলাটে নায়কের ছবি আঁকা। নিজের চোখ থেকে লেজার রশ্মি বের করে ট্যাঙ্ক ফুটো করে ফেলছে। তোমার ভাগ্য ভাল, খোকা। পেয়ে গেলে। এখানে আর কোন দোকানে এই কমিক পাবে না।

তাড়াতাড়ি টাকা বের করে দিল ছেলেটা, যেন দেরি করলেই হাতছাড়া হয়ে যাবে ওই অমূল্য সম্পদ।

নিচু গলায় দুই বন্ধুকে বলল রবিন, আসার সময় এইমাত্র দেখে এলাম আরেকটা স্টলে, এক ডলারের কমিকের স্কুপে ফেলে রেখেছে ওই একই জিনিস।

মুসা বলল, পঞ্চাশ সেন্ট দিয়ে আমি নতুন কিনে পড়েছি।

সুমাতো স্টলের আরও কাছাকাছি এসে তিন গোয়েন্দা দেখল এক জায়গায় একটা টেলিভিশনে ভিসিআর লাগিয়ে রেখেছে একজন সেলসম্যান। শজারুর কাটার মত খাড়া খাড়া চুল, গায়ে কালো টি-শার্ট। অ্যাসট্রোঅ্যাইসেস কমিকের কিছু দৃশ্য দেখাচ্ছে। ইদানীং টিভিতে বেশ গরম করে রেখেছে ওই নতুন সাইন্স ফিকশনটা। বিপুল সাড়া জাগিয়েছে। লোকটা বলছে, এই পার্টটা টিভিতে আসতে আরও দুএক হপ্তা লাগবে। চালাকি করে আগেই জোগাড় করে ফেলেছি আমরা। শহরের কেউ দেখার আগেই পেয়ে যাচ্ছেন। জলদি নিয়ে নিন, শেষ হওয়ার আগেই।

বলে খরিদ্দারদের দিকে কি-করে-ফেলেছিনু-রে এমন একটা ভঙ্গিতে তাকাল সে।

বছর বিশেক বয়েসের এক তরুণ টাকা বাড়িয়ে দিল।

ফিসফিস করে মুসা বলল, অযথা টাকা খরচ করছে। কয়েকদিন অপেক্ষা করলে বিনে পয়সায়ই দেখতে পারত। চাইলে ভিসিআরে রেকর্ডও করে নিতে পারত।

টাকা দিচ্ছে একটা জালিয়াতি করে আনা টেপের জন্যে, রবিন বলল।

নিশ্চয় ঘুষ দিয়ে নিয়ে এসেছে। নয়ত সিন্ডিকেট যখন টিভি কোম্পানিতে পাঠাচ্ছিল ছবিটা, তখন স্যাটেলাইট বীম দিয়ে ধরে রেকর্ড করে ফেলেছে। মহা শয়তান ব্যাটারা!

কত রকমের পাগল যে আছে দুনিয়ায়, কিশোর বলল। টাকাও আছে খরচও করছে। ওরা কিনছে বলেই ঠকানোরও সুযোগ পাচ্ছে। দেখি, আমরা কি করতে পারি?

এগিয়ে গেল কিশোর।

একজন সেলসম্যান মুখ তুলে ওদের দিকে তাকিয়ে বলল, বলো, কি করতে পারি?

দ্বিধা করছে তিন গোয়েন্দা।

ও, তোমরা কিনবে না? বেশ, না কিনলে সরে দাঁড়াও। যারা কিনবে তাদের জায়গা দাও।

না, কিশোর বলল, আমরা কিনব না।

স্টলের কাছ থেকে সরে এসে রবিনের দিকে তাকাল সে। বলল, এরা ডাকাত। বেচতে পারব না এদের কাছে। ওটা কোথায় দেখেছিলে? চার ডলারেরটা যেখানে এক ডলারে বিক্রি করে?

ওদিকে, রবিন বলল। ইমারজেন্সি একজিটের কাছে। কি যেন একটা নাম। পাগল না উন্মাদ, কি যেন।

স্টলের নামের সঙ্গে ম্যাড কথাটা জুড়ে দেয়া হয়েছে অবশ্য, তবে মালিক সত্যি পাগল কি-না কে জানে! যদিও তাঁকে দেখলে পাগল বলেই সন্দহ হবে। এলোমেলো কোঁকড়া কালো চুল, পুরু গোঁফ। দোকানের নাম ম্যাড ডিকসনস ওয়ার্ল্ড। তরুণ সহকারীকে ডেকে বললেন, জনি, চট করে ওপরে গিয়ে আরও কয়েক বাক্স কমিক নিয়ে এসো। তারপর ঘুরতেই চোখ পড়ল লম্বা, বিষন্ন চেহারার একজন মানুষের দিকে। চাঁদিতে টাক। তিনপাশে পাতলা চুল, ধূসর হয়ে এসেছে।

ধমকে উঠলেন ম্যাড, আবার এসেছেন?

ভদ্রলোক বললেন, ফ্যান ফানের কপিটার জন্যে সাড়ে তিনশো দিতে রাজি আছি।

মাথা নাড়লেন ডিকসন। পাঁচ।

আরও বিষন্ন হয়ে গেলেন ভদ্রলোক। দর কষাকষি শুরু করলেন, ঠিক আছে, সাড়ে চার।

ছয়।

কিন্তু লেখা তো রয়েছে মাত্র সাড়ে চারশো! মরিয়া হয়ে উঠলেন যেন ক্রেতা।

এখন আর ছয়ের কমে বেচব না। জনাব পাগলও কম যান না। বুনো দৃষ্টি ফুটেছে চোখে।

হাত মুঠো করে ফেললেন ক্রেতা। বেশ ছয়ই দেব। হাসি ফুটল পাগলের চোখে। বলতে বেশি দেরি করে ফেলেছেন। এখন সাত।

চোয়াল স্কুলে পড়ল লোকটার। সাত! বেচতে চান না নাকি কারও কাছে?

কারও কাছে বেচতে চাই না কথাটা ঠিক নয়। আপনার কাছে চাই না।

ঝটকা দিয়ে ঘুরে দাঁড়ালেন ক্রেতা। গটমট করে চলে গেলেন। সেদিকে তাকিয়ে রয়েছে কিশোর। মিস্টার ডিকসনের দিকে ফিরে বলল, কাস্টোমারদের সঙ্গে এরকম আচরণই করেন নাকি?

সবার সঙ্গে করি না। যারা বেশি বিরক্ত করে, ঘাড়ে এসে চাপতে চায়, তাদের সঙ্গে করি। বড় একটা কমিক পাবলিশিং কোম্পানিতে চাকরি করে। ভীষণ বিরক্ত করে এসে। কিশোরের বাক্সটার দিকে তাকালেন ডিকসন। তোমরা কি জন্যে এসেছ? কিনবে, না বেচবে?

বেচব। বাক্সটা টেবিলে রেখে ডালা খুলল কিশোর।

ভেতরের জিনিসগুলো দেখলেন ডিকসন। ভাল জিনিস কিছু আছে। চোখ চকচক করছে তার। সিলভার এজ-এর বই দুটো তো বেশ ভাল কন্ডিশনে আছে। তাছাড়া কিছু নাম্বার ওয়ানস…ঠিক আছে, যা আছে, আছে। পুরো বাক্সটাই বেচে দাও। চারশো ডলার দেব।

দাম শুনে কান গরম হয়ে যাচ্ছে টের পেল কিশোর। বুঝল, মুখেও রক্ত জমছে। শুরুতেই এত! তার পরেও বলল, মাত্র চার? অর্ধেকও তো বলেননি। দাম জানা আছে আমার…

বাধা দিয়ে ম্যাডম্যান বললেন, ওভারস্ট্রীট গাইডে দেখিয়েছ তো? ওরা বলবেই। আরও অনেক দাম হাঁকবে, কিন্তু কিনবে না। শয়তানি আরকি। কি লিখে রেখেছে দেখোনি? কেউ যাতে এসে কিছু বলতে না পারে। লিখেছে, আমাদের কাছে যা আছে, ওগুলো আরও অনেকের কাছেই থাকতে পারে। দামেরও তফাৎ হতে পারে। কাজেই কেনার আগে চিন্তা করে নেবেন। আমরা লাভ করার জন্যেই বসেছি, লাভ করব।

সেটা তো সততার পরিচয় দিয়েছে, কিশোর বলল। লাভ করবে বলেছে ডাকাতিও করছে না, ঠকাচ্ছেও না…এর বেশি আর বলতে পারল না সে। টেনে সরিয়ে নিয়ে গেল তাকে রবিন আর মুসা। নিচু গলায় বলল, কি যা-তা বকছ অনেক বেশি দিতে চাইছে, দিয়ে দাও। খরচ করেছি একুশ ডলার, পাচ্ছি চারশো আর কত!

বেশিই পাব, কিশোর বলল। এক কথায়ই যখন চারশো দিতে রাজি হয়েছে, জিনিসের দাম আরও অনেক বেশি। দরাদরি করতে অসুবিধে কী?

ম্যাডম্যানের দিকে ঘুরতে গেল কিশোর। কিন্তু ঘোরা আর হলো না। দৃষ্টি আটকে গেল নীল সোনালি রঙের ওপর।

ওদেরই বয়েসী একটা মেয়ে। বেশ লম্বা। সুন্দর সোনালি চুল প্রায় কোমরের কাছে নেমে এসেছে। নীল সিল্কের আলখেল্লা গায়ে। ভেতরে পরেছে হলুদ রঙের একটা বাদিং স্যুট, রঙটা এতই উজ্জ্বল, সোনালিই লাগছে। হাত আর পা পুরোপুরি বেরিয়ে আছে। পায়ে হলুদ বুট। হাঁটাও খুব সুন্দর। চোখ ফেরানো যায় না।

কিশোরও ফেরাতে পারছে না।

সেটা দেখে হাসলেন ম্যাড। চোখে লেগে যায়, না? কস্টিউম কনটেস্টে স্টেলারা স্টারগার্লের মত পোশাক পরেছে। কেন প্রতিযোগিতায় জিতে যায় এরা, বুঝি…

হ্যাঁ, দামের ব্যাপারটা, কমিক বিক্রির কথায় ফিরে এল কিশোর। বলেই আবার চোখ ফেরাল মেয়েটার দিকে।

দেখি তো আবার, বলে বাক্সে আবার হাত ঢোকালেন ডিকসন। দশটা কমিক টেনে বের করে বললেন, এগুলো আমি সহজেই বেচতে পারব। আসলে দামও এগুলোরই। ঠিক আছে, একটারই দামদর হোক। তিনশো দিতে রাজি আছি।

শুনছে না কিশোর।

তোমাকে দামের কথা বলছে, কিশোর, কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে বলল রবিন।

জোর করে যেন মেয়েটার ওপর থেকে চোখ সরাল গোয়েন্দাপ্রধান। মেয়েদের দিকে এভাবে সাধারণত তাকায় না সে। নিশ্চয় কোন কারণ আছে, বুঝতে পারছে, তার দুই সহকারী।

মোটামুটি ভালই দাম বলেছেন, বলেই আবার মেয়েটার দিকে ঘুরতে শুরু করল কিশোরের মুখ।

এক পলকের জন্যে যেন ঝিলিক দিয়ে উঠল হলুদ রঙ। পরক্ষণেই লাল কস্টিউম পরা একটা মূর্তির আড়ালে চলে গেল মেয়েটা। মঠবাসী ভিক্ষুর আলখেল্লার মতই লাগছে পোশাকটা, রঙ বাদে। মূর্তিটা আরও কাছে এলে কিশোর দেখল, মুখোশ পরেছে লোকটা। সাদা-কালো মড়ার মুখ। না না, কঙ্কালের মুখ।

আনমনেই মাথা নেড়ে আবার ম্যাডম্যানের দিকে ফিরল কিশোর। অন্যমনস্ক অবস্থাটা চলে গেছে। বলল, তিনশো ডলার বললেন, না? আমাদের সব চেয়ে দামি মাল এগুলোই। যে কেউই কিনতে চাইবে, কেবল এগুলোর জন্যেই…

আলখেল্লা পরা মড়াটা তার প্রায় গা ঘেঁষে চলে গেল। বাদুড়ের ডানার মত দুলে উঠল লাল আলখেল্লার প্রান্ত। বিরক্ত হয়ে ঘুরে তাকাল কিশোর।

নাটকীয় ভঙ্গিতে মূর্তিটাকে হাতে তুলতে দেখল সে। ছড়িয়ে দিয়েছে লম্বা লম্বা আঙুল। টান টান হয়ে গেছে হাতের ফ্যাকাসে চামড়া। চারটে ছোট ছোট বল পড়ল মেঝেতে।

ধোঁয়ায় ঢেকে গেল ম্যাড ডিকসনের স্টলটা।

হঠাৎ এই ধোঁয়া দেখে ভয়ে চিৎকার করে উঠল কিছু কমিক ক্রেতা। কিন্তু এই চিৎকার কিছুই না, আসল হট্টগোল শুরু হল ধোঁয়া সরে যাওয়ার পরে।

হায় হায়রে! গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে লাগলেন ম্যাড ডিকসন, আমার সর্বনাশ করে দিয়েছে! ডাকাতি! মাথা ঝাঁকাচ্ছেন বার বার, তাতে এলোমেলো চুল আরও ছড়িয়ে যাচ্ছে। বড় বড় গোঁফ কেমন যেন ফাঁক ফাঁক হয়ে বিকট করে তুলেছে মুখটাকে। গেল কোথায় ব্যাটা! লাল আলখেলা! ক্রিমসন ফ্যান্টম কস্টিউম! খুন করব আমি ওকে।

উধাও হয়েছে লাল পোশাক পরা লোকটা।

কিশোর বলল, ধোঁয়া দিয়ে ঢেকে ফেলেছিল, যাতে কেউ না দেখে ওকে। টেবিল টপকে গিয়ে দামি কমিকগুলো নিয়ে চলে গেছে।

পেছনের কাঠের ডিসপ্লে বোর্ডটার দিকে তাকিয়ে রয়েছে সে। সাজানো কমিক বইয়ের মাঝে বড় একটা ফোকর হয়ে আছে। ডিকসনও তাকিয়ে রয়েছেন সেদিকে। ফ্যান ফান নাম্বার ওয়ানের কপিটা নিয়ে গেছে…

সেই কমিকটাই, যেটার জন্যে চাপাচাপি করছিল টেকো লোকটা, নিতে পারেনি, ভাবছে কিশোর।

…আরও নিয়েছে, বলছেন ম্যাড। একগাদা! বিশ থেকে তিরিশ ডলার দাম ওগুলোর। হঠাৎ বদলে গেল বিক্রেতার কণ্ঠস্বর। কেন, দেখতে পেল কিশোর। একটা বই দেখা গেল, তাতে দামের ট্যাগ লাগানো রয়েছেঃ ৪,৫০০ ডলার।

ধোঁয়াটা তেমন স্মার্ট আইডিয়া নয়, কিশোর বলল। এগুলো পুরানো পদ্ধতি। এতে অসুবিধে হলো, চোর নিজেও কিছু দেখতে পায় না। অনেক সময় যেটা নিতে আসে সেটাই ফেলে যেতে হয়। ফেলে গেছে দেখতে পায়নি বলেই।

যা নিয়েছে তা-ই যথেষ্ট, ম্যাড বললেন। আমারগুলো যা পেয়েছে তা তো নিয়েছেই, তোমার যেগুলো আমার হাতে ছিল, সেগুলোও নিয়েছে।

পরস্পরের দিকে তাকাতে লাগল তিন গোয়েন্দা। ক্রিমসন ফ্যান্টম বা লাল ভূত ওদের কমিকগুলোও নিয়ে গেছে, সব চেয়ে দামিগুলো, যেগুলোর প্রাথমিক দামই উঠে গিয়েছিল তিনশো ডলার।

তার মানে সমাধান করার জন্যে একটা কেস পেয়ে গেলাম, বিড়বিড় করল মুসা।

কেস? সমাধান? ভুরু কুঁচকে তার দিকে তাকালেন ম্যাড।

হ্যাঁ, মাথা ঝাকাল কিশোর। পকেট থেকে কার্ড বের করে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, এটা দেখলেই এসব কথার মানে বুঝবেন।

তিন গোয়েন্দা!…দাড়াও, দাঁড়াও! টেবিলের নিচে হাত ঢুকিয়ে দিয়ে বের করলেন একটা ছোট বাক্স। তার ভেতর থেকে বের করলেন একটা ময়লা প্রায় দোমড়ানো কার্ড। কোণগুলো নষ্ট হয়ে গেছে।

আরি! এ কি কাণ্ড! রবিন বলল, আমাদের কার্ড!

নিশ্চয়, ডিকসন বললেন। অনেক পুরানো। তোমাদের এখনকারটার সঙ্গে মেলে না। এটা বোধহয় প্রথম দিককার ছাপা কার্ডগুলোর একটা। পঁচাত্তর ডলারে বিক্রি করতে পারব।

চোখ মিটমিট করল কিশোর। তার মানে আপনি এটা বিক্রি করবে?

শ্রাগ করলেন ডিকসন। কেন করব না? কিছু কিছু লোক যা পায় তা ই সংগ্রহে রাখে। দীর্ঘ একটা মুহূর্ত ওদের দিকে তাকিয়ে রইলেন তিনি। তাহলে তোমরাই সেই লোক, যারা যে-কোন রহস্যের সমাধান করে বলে ঘোষণা দাও। বেশ, তোমাদেরকেই আমার এখন সব চেয়ে বেশি প্রয়োজন কেন, বলছি আমার কমিকগুলো খুঁজে বের করে দাও। সেই সাথে তোমাদেরগুলোও করো। ওভারস্ট্রীট যা বলেছে, তখন আমি সেই দাম দিয়েই তোমাদের কমিকগুলো কিনব, যাও, কথা দিলাম।

আবার একে অন্যের দিকে তাকাতে লাগল তিন গোয়েন্দা। অবশেষে কিশোর বলন ডিকসনের দিকে তাকিয়ে, বেশ, আমরা রাজি। যে বইগুলো আছে এখনও সেগুলোসহ বাক্সটা তুলে এক হাতে নিয়ে আরেকটা হাত বাড়িয়ে দিল কমিক বিক্রেতার দিকে।

আমার নাম আসলে জেমস ডিকসন, হাসলেন বিক্রেতা। গোঁফের জন্যে হাসিটা অনেকখানিই ঢাকা পড়ে গেল। ওরকম একটা হাস্যকর নাম নিয়েছি স্রেফ প্রচারের জন্যে।

সেটা বুঝতে পেরেছি আমরা। কিশোরও হাসল। আমি কিশোর পাশা। ও মুসা আমান। আর ও রবিন মিলফোর্ড। তাহলে কাজ শুরু করা যাক। প্রথম প্রশ্ন, মিস্টার ডিকসন, বিশেষ কাউকে কি সন্দেহ হয় আপনার?

কাউকে? এখন তো মনে হচ্ছে সবাইকেই সন্দেহ করি। স্টলের আশপাশে ভিড় জমানো জনতাকে দেখালেন তিনি হাত তুলে। তারপর দেখালেন পুরো হলঘর। তুমি জানো না, কারা এসেছে। ক্যালিফোর্নিয়ার সব চেয়ে বড় পাগলগুলোই এখানে ভিড় জমায়। হাসলেন তিনি আবার। তোমাকে অবশ্য পাগল বলছি না, কারণ তুমি কিনতে আসোনি।

তার মানে, আপনি বলতে চাইছেন, এরা সবাই পাগল?

হাত ওল্টালেন ডিকসন। একটা কথা বলতে পারি, সংগ্রহের নেশায় যখন পেয়ে বসে মানুষকে, হিতাহিত জ্ঞান লোপ পায় অনেকের। বিগড়ে গিয়ে অন্য মানুষ হয়ে যায়। কি সংগ্রহ করল, কিভাবে করল, সেটা নিয়ে বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা থাকে না। আমার বিশ্বাস, অসুস্থই হয়ে পড়ে তখন ওরা।

চুরিও করে বলতে চাইছেন, কিশোর বলল। চোরটা কি বইগুলো বেচবে? কি মনে হয় আপনার?

অত সহজ হবে না। বিশেষ করে ফ্যান ফানের মত জিনিস। ভ্রূকুটি করলেন ডিকসন। যেখানেই বেচতে যাবে, প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে। দোকানদার জানতে চাইবেই, কোথেকে জোগাড় করা হয়েছে ওগুলো।

চোরটা তা বলতে চাইবে না, মুসা বলল।

মাথা  ঝাঁকালেন ডিকসন। মুশকিলটা হলো কি, সংগ্রাহকের ব্যাপারে তদন্ত করছ তোমরা। কি যে করবে লোকটা, বলা কঠিন। হয়তো সারাটা জীবনই মাটির তলার ঘরে লুকিয়ে রাখবে কমিকগুলো। বেরই করবে না।

ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করছে তিন গোয়েন্দা। কৌতূহলী দর্শক এসে ভিড় জমিয়েছে স্টলের কাছে, তাদেরকে সরিয়ে দিল হোটেলের কর্মচারীরা। আবার নিয়মিত বেচাকেনা শুরু হলো ঘরে। বারো বছরের একটা ছেলে এগিয়ে এল। হাতে একটা সাদা-কালো ছবি। ছবিটা মলাটে সাটা। একজন বন্ধুকে দেখিয়ে বেশ গর্বের সঙ্গে বলল, দেখ দেখ, কি পেয়েছি। পুরো পাতাটাতেই আইজাক হুফারের আর্ট। ক্রিমসন ক্রিস্টমাস থেকে এঁকেছে। মাত্র সত্তর ডলার দিয়ে নিয়ে ফেললাম।

লম্বা, পাতলা, ধূসর চুলওয়ালা একজন লোক এগিয়ে এল। চামড়ার রঙ বেশি ফ্যাকাসে। কোন সময়েই যেন বাইরে বেরোয় না, খালি ঘরে বসে থাকে। বলল, এই খোকা, আমার কাছে বেচে দাও ওটা। পঁচাত্তর দেব।

না, জবাব দিল ছেলেটা।

একটানে ছেলেটার হাত থেকে ছবিটা নিয়ে নিল লোকটা। ওর হাতে গুঁজে দিল কতগুলো নোট। নাও, একশোই দিলাম। অনেক কিছু কিনতে পারবে।

হাঁ করে তাকিয়ে রয়েছে ছেলেটা। ফড়াৎ ফড়াৎ করে টেনে ছবিটা ছিড়ে ফেলল লোকটা। বড় একটা অ্যাশট্রেতে গুঁজে লাইটার বের করে আগুন ধরিয়ে দিল টুকরোগুলোতে।

কে আপনি? চিৎকার করে উঠল ছেলেটা। আমার জিনিস কেন ছিড়লেন?

বেঁটে, মোটা, কালো চুল, কালো দাড়ি এক লোক এগিয়ে এল। ঠিকই করেছে ছিড়ে। ওর নাম আইজাক হুফার। ওটা তারই আঁকা ছিল।

চোয়াল স্কুলে পড়ল ছেলেটার। আপনিই আইজাক হুফার! একটা অটোগ্রাফ দেবেন?

ছেলেটার বাড়িয়ে ধরা নোটবুকে হেসে সই দিয়ে দিল পাতলা লোকটা।

ইস! দুঃখ করে বলল ছেলেটা, যদি ওই ছবিটাতে আপনার-সই নিতে পারতাম!

হুফারের মুখ থেকে হাসি চলে গেল। ক্রিমসন ফ্যান্টমে জীবনে সই দেব না আমি!

মোটা লোকটা ছেলেদের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ল। কেন রাগল জানো? তুমি নিশ্চয় জানেন না, ওই সিরিজ থেকে বের করে দেয়া হয়েছে হুফারকে। ঠকিয়েছে। হিরোয়িক কমিকস তার সমস্ত শিল্পকর্ম বিক্রি করে দিয়েছে, অথচ একটা পয়সা দেয়নি ওকে। তাই যেখানে যা পাচ্ছে নষ্ট করে ফেলছে সে, যাতে আরও দামি না হয়ে ওঠে, আরও বেশি রোজগার করতে না পারে হিরোয়িক কমিক।

হুফার! ডাক দিলেন ডিকসন। আপনাকেই আমার দরকার ছিল। একটা জিনিস দেখাতাম। সংগ্রহে রাখার মত। মুখ বাঁকালেন তিনি। কিন্তু এখন আর পারব না। চুরি হয়ে গেছে।

তাই! স্টলের কাছে এগিয়ে এল মোটা লোকটা। চোর বলছে তার দোকানে ডাকাতি হয়েছে। চমৎকার!

জ্বলন্ত চোখে লোকটার দিকে তাকালেন ডিকসন। দেখ এডগার, আমার ব্যাপারে নাক গলাতে এসো না!

তুমি চোর নও বলতে চাও? লোকে পছন্দ করে কিনতে আসে বলে তাদের গলা কাট তুমি। তোমাদের মত লোকেরাই এই কালেকটিং ব্যবসাটাকে মাটি করল! সুযোগ পেয়ে ছিলে ফেল মানুষকে।

স্টলের টেবিল, ঘুরে এডগারের দিকে এগোতে গেলেন ডিকসন। তাঁর হাত চেপে ধরল হুফার। তার হাতের উল্টো পিঠে কনভেনশন স্ট্যাম্প মারা দেখতে পেল কিশোর। ওখানেই থাকুন। এডগার ঠিকই বলেছে। ডাকাতিই চলছে এখানে। কমিক থেকে সবাই লাভবান হয়, কেবল আর্টিস্ট বাদে।

এই যে, ডিকসন! তাড়াহুড়ো করে এগিয়ে এলেন কনভেনশন চীফ ই মরগান। এইমাত্র পেলাম খবরটা। কি যে কাণ্ড! কারও কোন দায়-দায়িত্ব নেই। আমি এখান থেকে সরেও সরতে পারলাম না, ঘটে গেল…! দুঃখজনক। কি নিয়েছে চোর?

বেশি কিছু না। সব চেয়ে দামি যেটা নিয়েছে সেটা ফ্যান ফানের একটা কপি। তাতে হুফারের কিছু কাজ করা ছিল। হুফারের হাত থেকে হাত ছাড়িয়ে নিলেন ডিকসন। থাকলে এখন ওকে দেখাতে পারতাম।

কমিক বিক্রির ব্যাপারে নানা জনের নানা মত থাকতে পারে, বললেন মরগান। তবে চুরিদারিটা মানা যায় না। এর একটা ব্যবস্থা করতেই হবে।

তা তো হবেই। চোখ খোলা রাখব আমরা, এডগার বলল। হুফার, চলো, যাই। রক অ্যাস্টারয়েড বোধহয় শুরু হয়ে গেল। এখনও গেলে ধরা যায়।

রওনা হয়ে গেল দুজনে।

কয়েকজন ডিটেকটিভকে কাজে লাগিয়ে দিয়েছি আমি, ডিকসন বললেন। তিন গোয়েন্দার পরিচয় করিয়ে দিলেন মরগানের সঙ্গে।

কার্ডে চোখ বোলালেন মরগান। গোয়েন্দা, না? বেশ বেশ। সাহায্যের দরকার হলে জানিও। আমার এখন কাজ আছে, যেতে হবে। আরেক সমস্যা। গোল্ড রুমে রক অ্যাস্টারয়েডের সিরিয়াল দেখানো হবে, সব কটা, ষাট ঘণ্টা ধরে চলবে। অথচ চালানোর মানুষই এখনও আসেনি। প্রোজেকশনিস্ট। এডগারকে অপেক্ষা করতেই হচ্ছে।

জোরে নিঃশ্বাস ফেললেন তিনি। প্রোজেকটর সেট করেই রেখেছি। চালানোর একজন মানুষ পেলেই এখন হয়ে যেত। কস্টিউম প্রতিযোগিতাও শুরু হওয়ার সময় হয়েছে।

কিছুটা উদ্বিগ্ন হয়েই তাড়াহুড়া করে চলে গেলেন তিনি।

রক অ্যাস্টারয়েড? ঠিক বুঝতে পারছে না রবিন।

চল্লিশ দশকের শেষ দিকে একটা বেশ চালু সায়েন্স ফিকশন সিরিজ ছিল, বোধহয় সেটার কথাই বলছে, কিশোর বলল। হাতের বাক্সটা আবার টেবিলে নামিয়ে রেখে প্রায় দৌড় দিল লুই মরগানের পেছনে। রবিন আর মুসাও পিছু নিল।

মরগানকে ধরল কিশোর, স্যার, এক সেকেন্ড। একটা সাহায্য করবেন দয়া করে? ওই লোক দুটো কে, বলতে পারেন, একটু আগে যারা মিস্টার ডিকসনের স্টল থেকে গেল?

পাতলা, লম্বা লোকটার নাম আইজাক হুফার। ছবি আকিয়ে এবং লেখক। মোটা লোকটার নাম এডগার ডুফার। হুফারের হাতের লেখা ভাল না, তাই তার কামিকের কথাগুলো লিখে দিতে হয় ডুফারকে। চমৎকার মিলেছে দুজন হুফার এবং ডুফার। হাসলেন মরগান। ডুফারটা পাজি। নিজের সম্পর্কে অনেক উঁচু ধারণা। সবাইকে বলে বেড়ায়, তার অনেক বড় কিছু হওয়া উচিত ছিল, কিন্তু কমিক প্রকাশকদের জন্যে সেটা হতে পারেনি। খালি গোলমাল করার তালে থাকে এই লোক।

হুফারের সঙ্গে ভাবসাব তো বেশ ভালই দেখলাম, কিশোর বলল।

তা তো থাকবেই। বললাম না দুজনে একসাথে কাজ করে। মাসখানেক আগে হুফার থাকত ওহায়ওতে। আমার বিশ্বাস, লস অ্যাঞ্জেলেসে এসেছে এখানে তার কমিক কেমন চলে দেখতে। ভাল চললে থেকে যাবে। কিন্তু আসার পর থেকে কোন কমিক আঁকতে দেখিনি।

এক মুহূর্ত চুপ থেকে জোরে একটা নিঃশ্বাস ফেললেন তিনি। তারপর বললেন, আমি তাকে কনভেনশনে দাওয়াত করেছি। সম্মান দেখিয়ে একটা ঘরও দিয়েছি থাকার জন্যে। মনে হয় ভুলই করে ফেলেছি।

ঘড়ি দেখলেন মরগান। দেরি হয়ে যাচ্ছে। যেতে হবে।

তাড়াহুড়া করে তাকে চলে যেতে দেখল তিন গোয়েন্দা।

ভালই একটা কেস মিলল মনে হচ্ছে, মুসা বলল।

সন্দেহ করার মত একজনকে পেয়েও গেলাম, রবিন বলল।

কার কথা বলছ? জিজ্ঞেস করল কিশোর, ডুফার, না হুফার?

আইজাক হুফার। চুরিটাই সন্দেহজনক। হয়তো সে-ই করিয়েছে, ওই কমিকগুলো তার পছন্দ নয় বলে। ছেলেটার হাত থেকে নিয়ে কিভাবে নষ্ট করে ফেলল দেখলে না। ফ্যান ফানের ছবিগুলোও নিশ্চয় তার পছন্দ ছিল না।

কিন্তু কমিকগুলো চুরি হওয়ার পর পরই এসে উদয় হয়েছিল সে, মনে করিয়ে দিল মুসা। ধোঁয়াও সরে সারেনি তখনও।

হুঁ, মাথা দোলাল কিশোর। লোকটা কোথায় উঠেছে, জানি আমরা। তার ঘরে গিয়ে দেখলেই তো পারি কমিকগুলো আছে কি-না?

রাজি হয়ে গেল অন্য দুজন।

রিসিপশন ডেস্ক থেকে হুফারের রুম নম্বর নিল কিশোর। তিন মিনিট পরেই ৩১৮ নাম্বার ঘরের দরজার সামনে এসে দাঁড়াল তিন গোয়েন্দা।

একবার দেখেই মাথা নাড়ল কিশোর, এই তালা খুলে ঢোকা সহজ হবে না। বিশেষ যন্ত্রপাতি দরকার।

ভুরু কুঁচকে তালাটার দিকে তাকিয়ে রইল সে। পাশের ৩২০ নম্বর ঘরের খোলা দরজার ওপর চোখ পড়তেই উজ্জ্বল হলো চেহারা। ছোট একটা ঠেলাগাড়ি রাখা দরজার পাশে। তার মানে ঘর যে পরিষ্কার করে সে ওটা নিয়ে এসেছে।

দরজায় জোরে জোরে দুবার থাবা দিল কিশোর। ডাক দিয়ে জিজ্ঞেস করল, ভেতরে কেউ আছেন? এপাশ ওপাশ একবার তাকিয়েই ঢুকে পড়ল শূন্য ঘরের ভেতরে। পেছনে ঢুকল দুই সহকারী গোয়েন্দা।

এবার? জানতে চাইল মুসা, ওঘরে যাব কি করে? দেয়াল ফুটো করে?

তার দরকার হবে না, বলতে বলতে স্লাইডিং-গ্লাস ডোরের কাছে এসে দাঁড়াল কিশোর। বেরিয়ে এল ব্যালকনিতে। এখান থেকে হোটেলের ভেতর দিকে চত্বর আর সুইমিং পুল চোখে পড়ে। বাঁয়ে তাকাল সে। ৩১৮ নম্বর ঘরের ব্যালকনির দরজা রয়েছে চার ফুট দূরে। ছোট্ট একটা লাফ দিলেই পৌঁছে যাওয়া যায়, আনমনে বলল। তবে সেই লাফটা দেয়ার মত লোক প্রয়োজন, খেলাধুলায় যে পারদর্শী। বিশেষ করে ফুটবল প্লেয়ার।

না না, তাড়াতাড়ি হাত নাড়ল মুসা। আমি পারব না!

তাকে রাজি করাতে কয়েক সেকেন্ডের বেশি লাগল না কিশোরের। ২২০ নম্বর ঘরের ব্যালকনির রেলিডে চড়ে বসল মুসা। বিড়বিড় করে বলছে, জ্বালিয়ে মারল! কিছু বলতেও পারি না! গাধার মত রাজি হয়ে যাই! কিশোরের দিকে তাকাল না। জানে, কি দেখতে পাবে। দেখবে, মুচকি হাসছে গোয়েন্দাপ্রধান। চোখে চোখ পড়লে হা হা করে হেসে ফেলবে। ওকে সেই সুযোগটা দিতে চাইল না।

কিন্তু রবিনকে ঠেকানো গেল না। হেসে বলল, দেরি করছ কেন? লাফ দাও। মাত্র তো চার ফুট।

তা তো বটেই, গজগজ করল মুসা। মাত্র চার ফুটই যদি কোনভাবে মিস করি, পড়ব গিয়ে তিরিশ ফুট নিচে।

শক্ত করে রেলিঙ চেপে ধরে আছে সে। বুড়ো আঙুলের ওপর ভর রেখে আচমকা হাত ছেড়ে দিল। চোখ সামনের ব্যালকনির দিকে। নিচে তাকাচ্ছে না। লাফ দিল অনেকটা ব্যাঙের মত করে।

অন্য ব্যালকনিটা যেন উড়ে চলে এল তার কাছে। ডান পা-টা রেলিঙে জায়গামতই বসল, কিন্তু পিছলে গেল বা পা। দম বন্ধ করা ভয়াবহ একটা মুহূর্ত, উল্টে পড়ছে সে। দুহাতে থাবা দিয়ে ধরে ফেলেছে রেলিং। চেপে ধরার ফলে সাদা হয়ে গেছে হাতের পেছনটা। ধীরে ধীরে টেনে তুলতে লাগল শরীরটাকে।

অনেক কষ্টে পতন রোধ করে আবার শক্ত হয়ে বসল রেলিঙে। লাফিয়ে নামল ব্যালকনিতে। ফিরে তাকাল বন্ধুদের দিকে।

অধৈর্য ভঙ্গিতে হাত তুলে কাচ লাগানো দরজাটা দেখাল কিশোর। ঢোকার ইঙ্গিত করল।

বাহ্, চমৎকার, তিক্ত কণ্ঠে বলল মুসা, আমার জন্যে খুব তো চিন্তা করো দেখছি!

দরজার কাছে গিয়ে কাচের ভেতর দিয়ে উঁকি দিল সে। কাউকে দেখতে পেল। দরজা খোলার জন্যে নব ধরে টানতেই নিঃশব্দে খুলে গেল পাল্লা।

ভেতরে ঢুকল মুসা। ভাল মত দেখে নিল হুফার আছে কি-না ঘরে। নেই। অসংখ্য বোর্ডে আঁকা রয়েছে নানা রকম ড্রইং, সম্মেলনে বিক্রির জন্যেই নিশ্চয় একে রেখেছে হুফার। কিছু পত্রপত্রিকাও চোখে পড়ল। বেশির ভাগই কমিক ম্যাগাজিন। ওগুলোতে ফ্যান ফানের কপিটা দেখতে পেল না সে।

আলমারির দরজা খুলে দেখল ভেতরে আলখেল্লাটা আছে কি-না। তা-ও নেই। তারপর ড্রেসারে খুঁজতে এল মুসা। প্রথম ড্রয়ারটা সবে টান দিয়ে খুলেছে, এই সময় নড়াচড়া লক্ষ্য করল পেছনে।

ঝট করে সোজা হয়ে চরকির মত পাক খেয়ে ঘুরল সে। জমে গেল যেন বরফ হয়ে। বাথরুম থেকে লাফিয়ে বেরিয়ে এসেছে একটা কুৎসিত মূর্তি। শরীরটা মানুষের মত, বিশাল চওড়া বুকের হাতি, পরনে কালো জিনসের প্যান্ট। মুখটা ভয়ঙ্কর। সবুজ রঙের একটা গিরগিটির মুখকে যেন বিকৃত করে দেয়া-হয়েছে। কমিকের ফ্রগ মিউট্যান্ট।

জীবটা যে মানুষ, সেটা বুঝতে সময় বেশি লাগল না মুসার। তবে যতটুকুই লাগল, তাতেই দেরি হয়ে গেল। মানুষটা লাফ দিয়ে সরে এল তার কাছে, ধা করে চোয়ালে ঘুসি মেরে বসল।

টলে উঠল মুসা। ঝটকা দিয়ে পেছনে সরে গেল মাথাটা, বাড়ি লাগল ব্যালকনিতে বেরোনর দরজার ফ্রেমে।

প্রচন্ড ব্যথায় যেন অন্ধ হয়ে গেল মুসা। ওই অবস্থায়ই কারাতের কোপ বসানর চেষ্টা করল লোকটার ঘাড়ে। লাগাতে পারল না। মারটা সহজেই ঠেকিয়ে ফেলল ফ্রগ মিউট্যান্ট, আবার ঘুসি মারল। পেছনে যেন উড়ে গেল মুসার শরীরটা, বেরিয়ে গেল দরজার বাইরে।

ব্যালকনির রেলিঙে ধাক্কা খেল সে, তারপর উল্টে পড়তে শুরু করল। পাগলের মত হাত বাড়িয়ে রেলিং ধরার চেষ্টা করল, কিছুই ঠেকল না হাতে। চারিদিকে সব ফাঁকা, শুধুই শূন্যতা।

মাথা নিচু করে নিচের চত্বরে পড়তে যাচ্ছে মুসা। মরিয়া হয়ে শূন্যেই শরীরটাকে বাঁকাল সে। বান মাছের মত শরীর মুচড়ে সরাসরি চত্বরে পড়া থেকে বাঁচল কোনমতে। ডাইভিং বোর্ড থেকে ঝাঁপ দিতে দিতেই এই কায়দাটা রপ্ত করেছে। সুইমিং পুলের দিকে সরে চলে এসেছে। নামছে তীব্র গতিতে। এই ডাইভ তাকে অলিম্পিকের স্বর্ণপদক এনে দেবে না, কিন্তু পদকের চেয়ে অনেক অনেক দামি জীবনটা তো বাঁচল।

ঝপাং করে পানিতে পড়ল মুসা। যতটা ডোবার ডুবে ভেসে উঠতে শুরু করল। ভুস করে মাথা তুলল পানির ওপরে। জোরে জোরে শ্বাস নিতে লাগল। কাঁপছে এখনও। অল্পের জন্যে বেঁচেছে। পুলের কিনার থেকে ডজনখানেক হাত এগিয়ে এল তাকে টেনে তোলার জন্যে। কিন্তু যেখানে ছিল সেখানেই রইল সে, শকটা হজম করে নেয়ার জন্যে।

আরেক গ্রহে নামল নাকি, ভাবছে মুসা। তার সামনের লোক-গুলোকে মনে হচ্ছে স্টার ওঅরস ছবির এক্সট্রাদের মত। রোবট, সবুজ মানুষ, মূল মাথা ছাড়াও আর দুটো বাড়তি মাথাওয়ালা মানুষ, আর বিচিত্র সব জীব। ওরাও আসলে মানুষ, এই সাজে সেজেছে।

মুসার মনে পড়ল কস্টিউম কনটেস্টের কথা। সম্মেলনে যোগ দিতে এসেছে অনেকে। তাদের ঠিক মাঝখানেই পড়েছে সে। তীরে দাঁড়ানো অনেকের চোখেই বিরক্তি দেখতে পেল। কারণ আছে। আচমকা পানিতে পড়ে ওদেরকে ভিজিয়ে দিয়েছে সে।

তার পরেও কয়েকজন টেনেটুনে তুলল ওকে। ওদের মাঝে তার বন্ধু কিশোর আর রবিনও রয়েছে।

কি হয়েছে? জানতে চাইল রবিন।

ভিড় সরানোর চেষ্টা করছে কিশোর।

দেখলাম ঢুকলে, রবিন বলছে, একটু পরেই দেখি দরজা দিয়ে উড়ে বেরোলে। ব্যাপারটা কি?

উড়তে সাহায্য করা হয়েছিল আমাকে। এমন জোরে ঘুসি মারল…

তোমার মত মানুষও সামলাতে পারল না, কথাটা শেষ করে দিল রবিন। কে মারল? হুফার? না লাল আলখেল্লা পরা লোকটা?

মাথা নাড়ল মুসা। আমার মনে হয় না ভূতটা হুফার। ওর ঘরে কোন কস্টিউম দেখলাম না। আমাকে যে মেরেছে তার গায়ে মোষের জোর। সারা গায়ে পেশী আর পেশী। মুখ দেখতে পারিনি। ফ্রগ মিউট্যান্টের মুখোশ পরা ছিল।

হুঁ, আনমনে বিড়বিড় করল কিশোর। দুজন জুটল এখন। একজন কমিক লিখে হিরো হয়ে গেছে, আরেকজন মুখোশ পরে ভিলেন সেজেছে, চুরি করে ঢুকেছে হুফারের ঘরে। মুখ তুলল। দুজনের মাঝে সম্পর্ক নেই তো?

ওই যে, এসে গেছে, নিচু গলায় বলল রবিন।

হোটেলের ব্লেজার পরা একজন লোক এগিয়ে এলেন। পকেটের মনোগ্রাম দেখে বোঝা গেল, তিনি হোটেলের ম্যানেজার। চেহারাটা রুক্ষ, মোটেও আন্তরিক নয়। পেছনে দৌড়ে আসছেন আরেকজন, লুই মরগান।

কি হয়েছিল? কাছে এসে জিজ্ঞেস করলেন ম্যানেজার।

আমি-ইয়ে…পড়ে…গিয়েছিলাম, আমতা আমতা করে জবাব দিল মুসা। প্লাস্টিকের একটা পুল চেয়ারে বসেছে।

পড়ে গিয়েছিলে? কি করে? কোত্থেকে? মুসার ওপর ঝুঁকে দাঁড়ালেন ম্যানেজার।

আমি… মরিয়া হয়ে যেন চারপাশে তাকাল, মুসা। তাকে উদ্ধার করতে এগিয়ে এল কিশোর।

আপনাদের বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে দেয়া দরকার, ম্যানেজারের দিকে তাকিয়ে কড়া গলায় বলল কিশোর। ব্যালকনিতে ওগুলো কি রেলিং লাগিয়েছেন? এত নিচু! পড়ল তো সেজন্যেই। ভাগ্যিস ডাইভ দেয়ার অভ্যেস আছে ওর। নইলে তো… কেঁপে ওঠার অভিনয় করল গোয়েন্দপ্রধান। দরজার দিকে তাকিয়ে পিছিয়ে এসেছিল আমার বন্ধু। হঠাৎ দিল হাঁচি। তাল সামলাতে না পেরে উল্টে পড়ে গেল। আপনাদের রেলিংগুলো আরেকটু উচু হলে এই অবস্থা হত না। শুকনোয় পড়ে যদি মরত, পারতেন আর ফিরিয়ে দিতে?

কিশোরের এই ভাষণে থতমত খেয়ে গেছেন ম্যানেজার। সামলে নিয়ে শীতল দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি এই হোটেলের গেস্ট?

এগিয়ে এলেন লুই মরগান। হ্যাঁ। রুম নম্বর তিনশো ষোলো। আমার সঙ্গে উঠেছে।

প্রতিবাদ করল না কিশোর। তাকিয়ে রয়েছে মরগানের দিকে।

তাই! কনভেনশন চীফের দিকে ঘুরলেন ম্যানেজার। দিনটাই আজ খারাপ যাচ্ছে, কি বলেন মিস্টার মরগান? প্রথমে হলো ডাকাতি, তারপর এই কাণ্ড আশা করি আর কোন গোলমাল দেখতে হবে না আজ। বলে রওনা হয়ে গেলে।

গটমট করে হেঁটে যাচ্ছেন ম্যানেজার। সেদিক থেকে মুখ ফিরিয়ে কিশোরকে জিজ্ঞেস করলেন মরগান, তদন্ত করতে গিয়েই নিশ্চয় এটা ঘটল?

হ্যাঁ, স্বীকার করল কিশোর। তদন্ত করতে গেলে অনেক সময় মাথার ঠিক থাকে না মুসার, উল্টোপাল্টা কাজ করে বসে। বোধহয় পানিতে ঝাপ দেয়ার শখ হয়েছিল। যা-ই হোক, সাহায্যের জন্যে ধন্যবাদ। কিন্তু ম্যানেজার যদি তিনশো যোলোতে আমাদের খোঁজ নিতে যান…?

তাহলে তোমাদের পেয়ে যাবেন। ঘরটা তোমাদেরকে দিতে চাই। পাশের ঘরটাই আমার, দুশো আট নম্বর। আমি বুঝতে পারছি, এই কেসের তদন্ত করতে হলে হোটেলের একটা ঘর তোমাদের লাগবেই। চাবি বের করে দিলেন মরগান। তোমার বন্ধুর কাপড় বদলানোও দরকার। তবে, ভিজে কাপড় গায়ে লেপটে সগিম্যান সেজে থাকার ইচ্ছে যদি হয়ে থাকে আমার আপত্তি নেই। জোরে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, বিচারক মন্ডলীকে বলে দেব, এই কস্টিউম যেন শো করার ব্যবস্থা করা হয়।

এমন ভঙ্গিতে বললেন মরগান, সত্যি ভেবে বসল মুসা। তাড়াতাড়ি হাত তুলে নিষেধ করল, না না, ওকাজ করবেন না!

হাসলেন মরগান। এগিয়ে গেলেন বিচারকের মঞ্চের দিকে।

তিন গোয়েন্দা চলল ৩১৬ নম্বর কামরায়।

ঘরে দুটো ডাবল বেড আছে, একটা ড্রেসার আছে, আর আছে একটা তালা দেয়া দরজা, যেটা খুললে ৩১৪ নম্বরে ঢোকা যায়।

তোয়ালে নিয়ে বাথরুমের দিকে চলে গেল মুসা। এখানে রবিন আর কিশোরের আপাতত কিছু করার নেই। আবার নিচে রওনা দিল দুজনে।

সম্মেলনে যাওয়ার টিকেট চেক করছে এখন অন্য একজন। গোলগাল মুখ, যেন একটা কুমড়ো। এলোমেলো চুল। লোকের টিকেট দেখে হাতের উল্টো পিঠে সীল মেরে দিচ্ছে। দরজা পাহারা দিতে বসেছে এখন সেই মেয়েটা, যার চুল দুই রঙে ডাই করা, যে তিন গোয়েন্দার হাতে সীল মেরেছিল। কিশোরের দিকে একবার চেয়েই মুখ ফিরিয়ে নিল সে। কিন্তু রবিনের দিকে তাকিয়েই রইল। হাসল। বলল, হাই, আমার নাম ডোরা।

রবিন তার মধুরতম একটা হাসি উপহার দিল মেয়েটাকে। ডোরা! চমৎকার নাম! আমার খুব পছন্দ। আচ্ছা, ভোরা, ওই স্মােক বম্ব ফাটার পর কালো আলখেল্লা পরা কোন মানুষকে কি এখান দিয়ে যেতে দেখেছ?

রবিনের চোখের দিকে তাকিয়ে রইল মেয়েটা। মাথা নাড়ল।

এডগার ডুফারের বর্ণনা দিয়ে কিশোর জিজ্ঞেস করল ডোরাকে, ওরকম কাউকে যেতে দেখেছে কি-না।

ভ্রূকুটি করল মেয়েটা। ওরকম মোটকা কত লোক এখানে কমিক কিনতে আসে জানো? হাজার হাজার। ওদের নশো নব্বই জনই যায় এখান দিয়ে। সব দেখতে এক রকম। কতজনের কথা মনে রাখব?

এই লোকটা মোটামুটি পরিচিত, রবিন বলল। কমিকের লেখা লেখে। দাড়ি আছে…

ডুফারের কথা বলছ না তো? তোমার বন্ধু তাহলে ওকথা বললেই পারত, নামটা বললেই বুঝতে পারতাম। হ্যাঁ, দেখেছি। এই তো মিনিট দুই আগে বেরিয়ে রেস্টুরেন্টের দিকে গেল।

রেস্টুেরেন্টে এসে লোকটাকে পেল গোয়েন্দারা।

ওদেরকে লাঞ্চের দাওয়াত দিল ডুফার। চলো, বাইরের টেবিলে গিয়ে বসি। তাহলে খেতে খেতে সম্মেলন দেখতে পারব।

সোনালি চুলওয়ালা মেয়েটাকে আরেকবার দেখার আশায় রাজি হয়ে গেল কিশোর।

সুইমিং পুলের কিনারে একটা টেবিলে এসে বসল ওরা। ছাতার নিচে। সম্মেলন চলছে। একজন করে প্রতিযোগীর নাম ঘোষণা করা হচ্ছে, আর সেই ভিড় থেকে বেরিয়ে এসে হাঁটছে সুইমিং পুলের কিনার দিয়ে, চারপাশে এক চক্কর, দর্শক আর বিচারক মন্ডলীকে দেখাচ্ছে তার পোশাক।

দুটো করে চীজবার্গারের অর্ডার দিল ভুফার। একটা করে তুলে নিল কিশোর আর রবিন।

কামড় বসাল কিশোর। চিবিয়ে গিলে নিয়ে বলল, কমিকের ব্যাপারে আমাদের কিছু তথ্য দরকার। আপনি কি বলতে পারবেন?

ভুরু কুঁচকে গেল ডুফারের। দাড়িও যেন উঠে এল সামান্য ওপরে। বলো, কি জানতে চাও?

ওরা কথা বলছে, এই সময় পুলের কিনারে এসে দাঁড়াল আরেকজন প্রতিযোগী। অদ্ভুত এক পোশাক পরেছে। যেন বিশাল একটা টোস্টারের ভেতরে ঢুকিয়ে নিয়েছে শরীরটা। হাত, পা আর মুখ বেরিয়ে আছে শুধু।

কিশোরের প্রশ্নের জবাবে ডুফার বলল, আমি কমিক সংগ্রহ করি, তার কারণ, করতে আমার ভাল লাগে। পাতা উল্টাই ওগুলোর। কোন ছবি ভাল লেগে গেলে, সেগুলোর মাঝের ফাঁকা জায়গায় লিখি নিজের মত করে। লিখতে আমার ভাল লাগে। কমিক অনেকেই পছন্দ করে, তবে শুধু পড়তেই। আঁকাআঁকি কিংবা লেখার ঝোঁক নেই তাদের।

সবার নেই, রবিন বলল। একথা বলা যাবে না।

তা ঠিক। আমার আছে। হুফারেরও আছে। ও অবশ্য লিখতে পারে না, হাতের লেখা ভাল নয় তো। তবে তার ছবিগুলো দেখার মত, কি বলো?

মাথা ঝাঁকাল কিশোর। চোখ অন্যদিকে তাকিয়ে রয়েছে সেই মেয়েটার দিকে। সোনালি চুল।

বলে চলেছে ডুফার, হুফারের কাজগুলো একেকটা ক্ল্যাসিক। দশ বছর আগে, মাত্র আঠারো বছর বয়সেই দুর্দান্ত এক হিরো তৈরি করে বসেছিল সে। গল্প তৈরি করল, ছবি আঁকল, ছাপতে দিল এক কমিক ম্যাগাজিনে। সাংঘাতিক সাড়া জাগাল। রাতারাতি অংসখ্য ভক্ত জুটে গেল তার। কমিকের নায়কের নাম রেখেছিল সে, গ্রে ফ্যান্টম।

হাসল ডুফার। ফ্যানজাইন ম্যাগাজিনে ছাপার ব্যবস্থা হয়েছিল তার কমিক। রঙের ব্যাপারে একটা বাধা ছিল। চার রঙা ছাপার উপায় ছিল না, সাদা-কালোতে ছাপা হত ম্যাগাজিনটা। তৃতীয় আর একটামাত্র রঙে ছাপা যেত, তাহল ধূসর। আর তাই বাধ্য হয়ে নায়কের নাম দিতে হলো হুফারকে, গ্রে ফ্যান্টম বা ধূসর ভূত। ওই রঙেতেই ছাপল তার কমিক। যা-ই হোক, খুবই সাড়া জাগাল গ্রে ফ্যান্টম। হিরোয়িক কমিকস নামে একটা কোম্পানি কাজের অফার দিল হুফারকে, এবং তখন তার হিরোর নাম হয়ে গেল…

ক্রিমসন ফ্যান্টম! প্রায় চিৎকার করে বলল রবিন। টকটকে লাল ওই হিরোর গল্প আমি পড়েছি!

হুফারের এক সাংঘাতিক সৃষ্টি। শুধু যে কাহিনীই ভাল, তা-ই না, আঁকতেও পারে বটে লোকটা। আর সব কমিকের চেয়ে একেবারে আলাদা, গতানুগতিকার বেড়া ডিঙাল ক্রিমসন ফ্যান্টম। তারপরে রয়েছে একটা বিশেষ ব্যাপার…

মাথা ঝাঁকাল রবিন। ঠিকই বলেছেন। গোপন গোপন ভাব। একটা রহস্য। ক্রিমসন ফ্যান্টম যে আসলে কে, তা-ই জানে না লোকে। তার পরিচয় গোপন থাকে। ওভাবেই কাজ করে যায় সে। তিন-চার রূপ, একেক বার একেক রূপে উদয় হয়। কমিকের তিন-চারটে চরিত্রের যে কোন একটা হতে পারে সে, কোনটা আসল ফ্যান্টম, বোঝা মুশকিল। ওই ধাঁধার জবাব খুঁজতে খুঁজতে তো মাথাই খারাপ হয়ে যেত আমার।

এ যাবৎ হাতে গোনা যে কটা ভাল কমিক বেরিয়েছে, তার মধ্যে একটা ছিল ওই ক্রিমসন ফ্যান্টম, ভোঁতা গলায় বলল হুফার। অথচ ধ্বংস করে দেয়া হলো ওটাকে।

ধ্বংস? এতক্ষণে সতর্ক হলো কিশোর, কিভাবে?

নীল বোরাম নামে একজন লোকের সঙ্গে কাজ করত হুফার। লোকটা ছিল তার কমিকের এডিটর। বোরামকে বিশ্বাস করেছিল সে। কপিরাইটের ব্যাপারে কি জানি একটা ঘাপলা বাধিয়ে ক্রিমসন ফ্যান্টমের কপিরাইট নিজের নামে করিয়ে নিল বোরাম। টেবিলে চাপড় মারল ডুফার। মহা শয়তান। নিয়ে নেয়ার পর সিরিজটাকে আরও জনপ্রিয় করার জন্যে নানা রকম কায়দা করতে লাগল সে। একটা বিশেষ প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা করল। ক্রিমসন ফ্যান্টম আসলে কোন চরিত্রটা, বলতে পারলে পুরস্কার দেয়া হবে।

রবিন বলল, ওই প্রতিযোগিতার কথা জানি আমি।

তা তো জানবেই। অনেক ছেলেই জানে ক্রিমসন ফ্যান্টম প্রতিযোগিতার কথা। তারপর আরও দুটো নতুন ক্রিমসন ফ্যান্টম বই বের করল বোরাম। একটার নাম দিল সিক্রেটস অভ দি ক্রিমসন ফ্যান্টম, আরেকটা দ্য ব্যাটেলিং ক্রিমসন ফ্যান্টম। নতুন লেখক আর আর্টিস্ট নিয়োগ করল একাজে। ওরা খারাপ করেনি, তবে হুফারের তুলনায় একেবারেই সাধারণ।

রাগে ভুরু কোঁচকাল ডুফার। আসলে চরিত্রটার যা যা বিশেষত্ব ছিল, সব নষ্ট করল বোরাম, খুন করল চরিত্রটাকে। ক্রিমসন ফ্যান্টম এখনও আছে, ভালই বিক্রি হয়, তবে এটা একেবারেই অন্য কমিক। আসলটার ধারেকাছেও লাগে না। অবশ্য বিক্রি হয় প্রচুর। হিরোয়িক কমিকসকে তুলেছে ওটাই, বোরামকেও বড়লোক বানিয়েছে।

এডগার ডুফার কিছুই করতে পারল না? প্রশ্ন করল কিশোর। এই সময় ওদের টেবিলের পাশ দিয়ে গেল কস্টিউম পরা আরেকজন প্রতিযোগী। এই লোকটার পোশাক বিচিত্র। টমেটোর চারপাশে সাজিয়ে রাখা অনেকগুলা লেটুসপাতা যেন বিশাল আকার নিয়ে জীবন্ত হয়ে উঠেছে।

চেষ্টা অনেকই করেছে, জানাল ডুফার। ঠেকানর চেষ্টা করেছে বোরামকে। পারেনি। আর পারবেই বা কি করে? চালাকি করে ততদিনে ক্রিমসন ফ্যান্টমের কপিরাইট নিজের নামে করে ফেলেছে বোরাম। ডুফার ভাবল, সে কাজ না করলেই কমিকটা বন্ধ হয়ে যাবে, আর কেউ আঁকতে পারবে না। তাই হিরোয়িক কমিকস থেকে বেরিয়ে চলে আসে সে। কিন্তু বোরাম ধুরন্ধর লোক। অন্য লোক দিয়ে কমিক আঁকাতে শুরু করল। কিছুই করতে না পেরে নিজের সৃষ্টির ওপরই ভীষণ রেগে গেল ডুফার। যেখানেই পায় নষ্ট করে ফেলে। তোমাদের সামনেই তো নষ্ট করল। দেখলেই ওরকম করে পোড়ায়।

তার মানে, কিশোর বলল, আপনি বলতে চাইছেন কোম্পানিটা ক্রিমসন ফ্যান্টমের ভক্তদেরকে ঠকাচ্ছে?

ঠকাচ্ছে আসলে অনেকেই, এক বোরাম নয়, হাত ওল্টাল ডুফার। ঘুরে তাকাল পাশের টেবিলে বসা কালো-চুল এক তরুণের দিকে। তাকে বলল, অ্যাই, পিটার, তোমার কাছে ওভারস্ট্রীটের কপি আছে?

বার্গার খাচ্ছিল লোকটা। হাতের খাবার প্লেটে নামিয়ে রেখে কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ থেকে বের করে আনল একটা দোমড়ানো মোটা বই। এই নাও, বলে ছুড়ে দিল ডুফারের দিকে।

লুফে নিল ডুফার। টেবিলে বিছিয়ে পাতা ওল্টাতে শুরু করল। এই যে, পাওয়া গেছে। সেরিবাস। সাদা-কালো কমিক, প্রথম প্রকাশিত হয় উনিশশো সাতাত্তর সালে। আসল একেকটা কপি বিক্রি হবে এখন পাঁচশো ডলারে। এই যে, দেখ, নকলও রয়েছে। জালিয়াতি। যারা চেনে তারা ঠিকই বুঝতে পারবে এটা নকল। নকলগুলো বিক্রি হয় বিশ-তিরিশ ডলার দামে।

হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়তে নাড়তে গিয়ে বইটা ফেরত দিয়ে এল ডুফার। ছেলেদেরকে বলল, কমিক ভক্তদের ব্যাপারটা বুঝি না। অনেক সময় যারা ঠকায় তাদেরও লাভবান করে দেয়। জাল বলেই কিনে নেয় অনেকে অনেক দাম দিয়ে, সংগ্রহে রাখার জন্যে।

আবার ভ্রূকুটি করল ডুফার। ঠকিয়েও পয়সা কামায়। লোকে আসল ভেবে বেশি দাম দিয়ে কেনে। লাভটা যায় প্রকাশকের পকেটে। সেগুলো বিক্রি করারও মানুষ আছে। আসল বলে গছিয়ে দেয় ক্রেতাকে।

মুখ তুলল কিশোর, যেমন? কার মত বিক্রেতা?

ইঙ্গিতটা বুঝতে পারল ডুফার। লোকে তো প্রায়ই অভিযোগ করে জেমস ডিকসনের নামে। ওর কাছে কিছু কিনতে গেলে সাবধান। হাতে ঘড়ি থাকলে, হাত মেলানর পর ভালভাবে দেখে নেবে বদলে দিল কি-না। নিজের রসিকতায় নিজেই হাসল সে।

প্রতিযোগিতা শেষ হয়েছে। বিজেতার নাম ঘোষণা করার আগে বাঁশি বাজল। ঘোষণা করলেন বিচারক। প্রথম হয়েছে রোমশ পোশাক পরা একজন। ও সেজেছিল স্লোর্জ দ্য প্ল্যানেট ইটার।

পাশের টেবিলে বিরক্তি প্রকাশ করল পিটার। এটা একটা কাজ হলো? আমি তো ভেবেছিলাম ওই সোনালি চুল মেয়েটাই জিতবে!

মেয়েটার দিকে তাকিয়ে কিশোরও একই কথা ভাবছে, তবে সেটা প্রকাশ করল না।

উঠে দাঁড়াল ডুফার। এবার যেতে হয়। রকের জাহাজ ভাঙার তোড়জোড় করছে মাকৰ্মান। দ্রুত গিয়ে খাবারের বিল দেয়ার জন্যে কাউন্টারের সামনে দাঁড়াল সে।

হাঁ করে তাকিয়ে রয়েছে দুই গোয়েন্দা। হেসে উঠল পিটার। বুঝলে না? রক অ্যাসটারয়েড ছবির কথা বলল ডুফার। সিনেমার খুব ভক্ত, সাইন্স ফিকশন। অনেক কিছুই মনে রাখে। ভাল ভাল ডায়লগ মুখস্থ করে রাখে, জায়গা মত ঝাড়ে। হাহ হা।

উঠে দাঁড়াল রবিন। বিড়বিড় করে বলল, কি সব মানুষ! সবাই-ই পাগল নাকি এখানকার!

বেরোনোর জন্যে রওনা হল দুই গোয়েন্দা। চোখের কোণ দিয়ে কিশোর দেখতে পেল সোনালি ঝিলিক।

ঘুরে তাকাল সে। রেস্টুরেন্টে ঢোকার মুখের কাছে একটা টেবিলে বসেছে সোনালি চুল মেয়েটা। সঙ্গে আরেকজন বয়স্ক মহিলা, বোধহয় মেয়েটার মা। তৃতীয় আরও একজন রয়েছেন, যাকে চিনতে পারল কিশোর। সেই টাকমাথা লোকটা, ম্যাড ডিকসনের কাছ থেকে যে ফ্যান ফানের কপিটা কিনতে চেয়েছিলেন।

দরজার দিকে এগোনোর সময় কথা কানে এল কিশোরের। টাকমাথা লোকটার সঙ্গে কথা বলার সময় মেয়ের কাঁধে আলত চাপড় দিল বয়স্ক মহিলা। বলল, ফটোকভারের জন্যে আমাদের মিরার মত মেয়ে আর পাবেন না, মিস্টার বোরাম। ও আপনার পারফেক্ট মডেল।

ও, এ-ই তাহলে নীল বোরাম, ভাবল কিশোর, আইজাক হুফারের প্রথম দিককার কাগজগুলোর ব্যাপারে এত আগ্রহী কেন লোকটা?

হঠাৎ রাগী একটা জোরাল কণ্ঠ শুনে ঘুরে তাকাল সে। প্রবেশ পথের একটু দূরে চোখমুখ লাল করে দাঁড়িয়ে রয়েছে হুফার। চিকার করে বলল, হচ্ছেটা কি এখানে, মরগান! আমার ঘরে কে জানি ঢুকে সব তছনছ করে দিয়েছে!

হুফার, মরগান বললেন, এসব নিয়ে কি এখানেই কথা বলতে হবে? দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। অস্বস্তিতে পড়ে গেছেন, মুখ দেখেই অনুমান করা যায়। ইতিমধ্যেই লোক জমা আরম্ভ হয়েছে। কৌতূহলী চোখে তাকাচ্ছে দুজনের দিকে।

জনতার ভিড়ে সামিল হলো কিশোর আর রবিন।

চিৎকার করে বলছে তখন হুফার, কে জানি ঢুকেছিল আমার ঘরে! আমার কাপড় কেটেছে, চিরে ফালাফালা করেছে সমস্ত ছবি!

গুঞ্জন উঠল সম্মেলনে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে।

ও কাজ কে করতে যাবে? মরগানের প্রশ্ন।

সেটাই তো জানতে চাইছি আমিও। তোমার সিকিউরিটি কোথায়? এটা কি ধরনের সম্মেলন হলো?

আর্টিস্টকে শান্ত করার চেষ্টা করলেন মরগান, তোমার অবস্থা বুঝতে পারছি। যদি যেতে চাও…

যেতে চাইব? গলা আরও চড়ল হুফারের। আমি যেতে চাই না। আমি চাই ওই লোকটাকে। আপনি জানেন, কি করে আমার জিনিসগুলো নষ্ট করেছে সে! আমি এখানে টাকা রোজগারের জন্যে এসেছিলাম এবং সেটা করেই ছাড়ব আমি। তার জন্যে যা কিছু করতে হয় করব।

দুপদাপ পা ফেলে চলে যাওয়ার সময় ঘুরল সে। আমাকে প্রয়োজন হলে কনভেনশন ফ্লোরে খোঁজ করবেন।

ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল জনতা। গুঞ্জন করছে। মরগানের পাশে এসে দাঁড়াল কিশোর আর রবিন।

মাথা নাড়ছেন তিনি। দেখলেন কাণ্ডটা? কমিক বুকের আর্টিস্টেরও কত দাপট? শ্রাগ করলেন। হুফারের এখানে আসার উদ্দেশ্য ছবি বিক্রি করা। সেটা করতে না পারলে হোটেলের ভাড়া নিয়েই বিপদে পড়ে যাবে।

মাথা ঝাঁকাল কিশোর। টাকার প্রয়োজন অনেক সময় মানুষকে চুরি করতে বাধ্য করে। আরও কয়েকজনের ব্যাপারে আমার আগ্রহ আছে, প্রশ্ন করতে চাই। সোনালি পোশাক পরা মেয়েটা কে?

হাসলেন মরগান। ও, মিরিনা জরডানের কথা বলছ? মেয়েটা যথেষ্ট চালাক। সম্মেলনে এই প্রথম যোগ দিয়েছে। স্বীকার করতেই হবে, স্টেলারা স্টারগার্লের চমৎকার নকল ওই মেয়েটা। স্টার বানাতে চাইছে ওকে ওর মা।

টেবিলে বসা ওই লোকটা কে? জিজ্ঞেস করল কিশোর।

ওর নাম নীল বোরাম। হিরোয়িক কমিকসের সিনিয়র এডিটর। স্টেলারা স্টারগার্ল ছাপে ওরাই। মিসেস জরডান মেয়ের চেয়ে আরও চালাক, করিতকর্মা। কোন কাজে কাকে ধরতে হবে খুব ভাল জানে। দুই মাসের মধ্যেই কোন কমিক বইয়ের মলাটে যদি মিরিনার হাসি হাসি মুখ জ্বলজ্বল করে, অবাক হব না। কিছুটা হতাশ ভঙ্গিতেই মাথা নাড়লেন মরগান। সব মহলের লোকের সঙ্গে জানাশোনা আর খাতির মহিলার। আমার জন্যে যদি কাজ করত, ভাল হত।

পকেটে হাত দিলেন মরগান। ওদের সঙ্গে পরিচয় করতে চাইলে আজ রাতের পার্টিতে এসো, খাওয়া-দাওয়াও হবে। বাড়তি কয়েকটা টিকেট আছে। এই যে নাও, এটা তোমার… রবিনকে দিলেন তিনি। কিশোরকে একটা দিয়ে বললেন, এটা তোমার, আর এই এটা তোমাদের আরেক বন্ধুর জন্যে। হাসলেন। তোমাদের ভেজা বন্ধু।

একটু থেমে যোগ করলেন, পার্টিতে ভিড় হবে খুব। অনেক সময় ধরে চলবে, অনেক রাত পর্যন্ত। তবে অসুবিধে নেই। তোমাদের জন্যে ঘর রেখে দেব আমি, ঘুমাতে পারবে।

ঘড়ি দেখলেন তিনি। এবার যেতে হয়। সাংবাদিকদের কাছে ফ্যান গেস্ট অভ অনারদের পরিচয় করিয়ে দিতে হবে।

প্রায় ছুটে চলে গেলেন মরগান।

ফ্যান গেস্ট অভ অনারটা কি বলো তো? জিজ্ঞেস করল রবিন।

মাথা নাড়ল কিশোর। জানি না। বুঝতে পারছি না সাংবাদিক কেন দরকার মরগানের। নিজে নিজেই তো অনেক কিছু করে ফেলেছেন।

এখন আমাদের কাজটা কি?

চলো, ওপরে যাই। তারপর মুসাকে নিয়ে বাড়ি যাব। শুকনো কাপড় দরকার ওর। আর রাতে আমাদেরকেও অন্য পোশাক পরে আসতে হবে। ব্যাংকোয়েট পার্টিতে এই জিনস আর টি-শার্টে চলবে না।

এখনও শুকায়নি মুসার কাপড়, ভেজা রয়েছে। আর কোন উপায় নেই। ওগুলোই পরল সে। গাড়িতে এসে উঠল তিনজনে।

রকি বীচের দিকে চলতে চলতে কিশোর জিজ্ঞেস করল, বলো তো, কাকে বেশি সন্দেহ হয় তোমাদের?

অবশ্যই আইজাক হুফার, রবিন বলল।

কেন?

সামনের সীট থেকে কিশোরের দিকে ফিরে তাকাল রবিন। ওর নিজের ছবি নিজেই পোড়ানোর দৃশ্যটা মন থেকে তাড়াতে পারছি না আমি। মনে হল যেন জোর করে কিছু প্রমাণের চেষ্টা করছে। এবং আমরা জানি, ফ্যান ফান বইতে তার আঁকা ছবিগুলো চুরি গেছে।

এটা একটা পয়েন্ট, একমত হলো কিশোর।

তারপর রয়েছে আরেকটা ব্যাপার, টাকাপয়সার টানাটানি আছে ওর। কারণ ওর ছবিগুলো নষ্ট হয়ে গেছে দেখে সাংঘাতিক হতাশ হয়ে পড়েছে, আচরণেই বুঝিয়ে দিয়েছে সেটা। অথচ একশো ডলার দিয়ে ছবিটা কিনে নিয়ে পুড়িয়ে ফেলল! নষ্ট করল কেন অতগুলো টাকা? অদ্ভুত নয় এসব আচরণ?

বেশ, কিশোর বলল। ধরা যাক, হুফারই আমাদের চোর। কিন্তু তার ঘরের জিনিসপত্র তছনছের ব্যাপারটা কিসের সঙ্গে খাপ খাওয়ানো যায়?

বলতে পারছি না। অনেকগুলো ঘোরপ্যাচ রয়েছে পুরো ব্যাপারটাতে। একবার মনে হচ্ছে হুফারই সব কিছুর হোতা, আবার মনে হচ্ছে তা হতে পারে না। তাহলে তার ঘরে লোক ঢুকে জিনিস নষ্ট করে কেন? তাছাড়া সে চুরি করে থাকলে তার ঘরে চোরাই মালগুলো নেই কেন? প্রমাণ যাতে না থাকে সেজন্যে অবশ্য সরিয়ে রাখতে পারে অন্য কোথাও। আরও একটা কথা ভাবছি, লাল আলখেল্লা পরা জীবন্ত ক্রিমসন ফ্যান্টম আর মুসাকে যে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছে, ফ্রগ মিউট্যান্ট, একই লোক নয় তো? আর সেই লোকটা কি আইজাক হুফার?

তা হতে পারে না, ড্রাইভিং সিট থেকে বলল মুসা। হুফারের শরীরের গঠন  আর ব্যাঙটার গঠনে তফাত আছে। এক রকম নয়।

এই ক্রিমসন ফ্যান্টমের রহস্যটায় আরও লোক জড়িত রয়েছে, কিশোর বলল। এই যেমন, ডিকসন আর বোরাম। পেছনের সীটে হেলান দিল সে।

একটা ব্যাপার লক্ষ্য করেছ, একজন আরেকজনের ব্যাপারে কেমন পরস্পর বিরোধী কথাবার্তা বলছে? ডুফার ভাবে হুফার একজন জিনিয়াস। ডিকসন ভাবেন পাগল, আর মরগান দুঃখ করেন তার জন্যে। ডিকসন নিজেকে ব্যবসায়ী ভাবেন, অথচ হুফার আর ডুফার বলে লোকটা একটা শয়তান।

হেসে উঠল রবিন। হুফার ভাবে সে কমিকের সংস্কারক, দামি কমিকগুলো বাঁচার চেষ্টা করছে। কিন্তু ডিকসন আর মরগান ভাবছেন, সে কেবল একটা কাজেই পটু, গোলমাল বাধানো। এক সেকেন্ড ভাবল সে। বোরামের ব্যাপারটা কি? আমার তো মনে হয় না কেউ ওকে পছন্দ করে। ডুফার তাকে ঘৃণা করে, কারণ তাকে ঠকিয়েছে এডিটর। হুফারের বিশ্বাস, ক্রিমসন ফ্যান্টমের বারোটা বাজিয়েছে বোরাম। ডিকসনও দেখতে পারেন না। কমিক কেনার জন্যে এত চাপাচাপি করেও তাকে রাজি করাতে পারেনি লোকটা।

যে বইটা সে কেনার এত চেষ্টা করল, সেটাই চুরি হয়েছে, এতে কি কিছু প্রমাণিত হয়? মুসার প্রশ্ন।

হয়, জবাব দিল কিশোর। তাকে সন্দেহ হয়। তোমার ওপর হামলা চালিয়েছে বলেও সন্দেহ করতে পারতাম, যদি শরীরের গঠন মিলে যেত। বোরামকে দেখলে মনে হয় একটা বগা, ভুড়িওয়ালা বগা। আর তোমার ওপর যে হামলা চালিয়েছিল, সে স্বাস্থ্যবান লোক, পেশীবহুল শরীর।

গাড়ির ছাতের দিকে তাকিয়ে ভুরু কোঁচকাল কিশোর। তার সন্দেহের তালিকায় মিরিনা জরডানকেও যোগ করতে চাইছে। কিন্তু মেলাতে পারছে না। ডিকসনের সঙ্গে যখন দরাদরি করছে কিশোর, তখন স্টলের পাশ দিয়ে হেঁটে গিয়ে কি অপরাধ করেছে মিরিনা?

অপরাধ জগতের এটা একটা পুরানো কৌশল। সুন্দরী একটা মেয়েকে ঘটনাস্থলে পাঠিয়ে দিয়ে লোকের নজর সেদিকে আকৃষ্ট করা, এবং সেই সুযোগে ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের মত করে অপরাধটা ঘটিয়ে ফেলা।

কিন্তু মিরিনাকে এই অপরাধের সঙ্গে জড়াতে ভাল লাগছে না কিশোরের। ও এতে জড়িত না থাকলেই সে খুশি হয়।

কেসটা বড়ই অদ্ভুত, অবশেষে বলল কিশোর।

মাথা ঝাঁকাল কিশোর। ডিকসন একটা কথা ঠিকই বলেছেন, সংগ্রহ-টংগ্রহ যারা করে, ওই মানুষগুলোর মাথায় আসলেই কিছুটা ছিট আছে। নইলে কমিক বুক জোগাড়ের মত একটা ছেলেমানুষীতে এত আগ্রহ কেন?

ঠিক, শুকনো গলায় বলল রবিন। চালাক হলে তো ইলেকট্রনিক জিনিসপত্র জোগাড়ের মত বড়মানুষীই করত। কম্পিউটার নিয়ে পাগল হত। হাসিটা চওড়া হল তার। কিংবা পুরানো গাড়ি নিয়ে।

মুসা কিছু বলল না। তবে কিশোর টিটকারিটা হজম করল না। খোঁচা দিয়ে বলল, হ্যাঁ, কিছু কিছু মানুষের মেয়ে দেখলে পাগল হয়ে যাওয়ারও একটা বাতিক আছে।

কেসের ব্যাপারে আলোচনার আপাতত এখানেই ইতি ঘটল।

রকি বীচে পৌছে ইয়ার্ডের কাছে কিশোরকে নামিয়ে দিল মুসা।

ভেতরে ঢুকে অফিসের বারান্দায় চাচা-চাচীকে বসে থাকতে দেখল কিশোর। তাদেরকে জানাল, রাতে বাড়ি ফিরবে না। হোটেলে থাকবে। কাজ আছে। রাশেদ পাশা কিছুই বললেন না। মেরিচাচী জানতে চাইলেন, কাজটা কি। জানাল কিশোর, অবশ্যই অনেক কিছু গোপন করে, ঢেকেঢুকে। তারপর চলে এল নিজের ঘরে। পোশাক পাল্টানোর জন্যে।

আধ ঘণ্টা পরেই ইয়ার্ডে এসে পৌঁছল অন্য দুই গোয়েন্দা। পোশাক পাল্টে এসেছে। বাইরে রাত কাটাতে হবে, তাই ব্যাগে করে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে এসেছে। মুসার ইমপালাতে করেই চলল ওরা, কোস্ট হাইওয়ে ধরে। মুসাকে সান্তা মনিকা হয়ে যেতে বলল কিশোর।

কেন? জানতে চাইল মুসা।

ম্যাড ডিকসনের স্টলে লেখা রয়েছে, তার দোকানটা সান্তা মনিকায়, দেখনি? কিশোর বলল, ফোন বুক দেখে ঠিকানা জেনে নিয়েছি। পথেই পড়বে, বেশি ঘুরতে হবে না আমাদের। দেখেই যাই কি ধরনের বই বিক্রি হয় ওখানে।

ম্যাড ডিকসনের কমিক এমপারিয়ামটা রয়েছে পিকো বুলভারে। বাণিজ্যিক এলাকার একধারে একটা সাধারণ দোকান। দুপাশে আরও দুটো দোকান, দুটোরই করুণ চেহারা, ব্যবসা ভাল না বোঝাই যায়। একটাতে বেতের তৈরি আসবাব বিক্রি হয়, আরেকটাতে নানা ধরনের ভ্যাকিউয়াম ক্লিনার।

ডিকসনের দোকানটায় রঙের ছড়াছড়ি। ডিসপ্লে উইনডোগুলোর কাছে সঁটানো রয়েছে রঙ-বেরঙের ছবি, সবই কোন না কোন কমিকের বিচিত্র হিরোর। দরজার কাছে লাগানো রয়েছে স্টেলারা স্টারগার্লের বিশাল এক ছবি। দেখতে হুবহু মিরিনা জরডানের মত। কিংবা বলা যায় মিরিনাই দেখতে স্টেলারার মত।

বাহ, সবুজ একটা ভ্যানের পাশে গাড়ি রাখতে রাখতে বলল মূসা, দেখো, কে এসেছেন!

গাড়ির গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন ডিকসন। দরজার দিকে নজর। দুটো ছেলে কমিক বইয়ের দুটো ভারি বাক্স নিয়ে বেরোচ্ছে। বোঝার ভারে কুঁজো হয়ে গেছে।

গাড়ি থেকে বেরিয়ে ডাকল কিশোর, মিস্টার ডিকসন?

আরে, তোমরা, এলোমেলো চুলে আঙুল চালালেন ম্যাড। হাতে একগাদা কমিক।

স্টলে বিক্রির জন্যে নিয়ে যাচ্ছেন বুঝি, কিশোর বলল আলাপ জমানো ভঙ্গিতে। শূন্য জায়গা ভরবেন, চোরে যেগুলো খালি করে দিয়েছে?

হ্যাঁ, হাতের কমিকগুলোর দিকে তাকিয়ে জবাব সিন ডিকসন। তারপর মুখ তুলে হাসলেন। শুনলাম, বাতাসে ওড়ার কায়দা শিখে ফেলেছ? তিন তলা থেকে চত্বরে না পড়ে গিয়ে পড়েছ সুইমিং পুলে? মাথা দুলিয়ে বললেন, তোমরা গোয়েন্দাগিরির সঙ্গে সঙ্গে এসবও প্র্যাকটিস করো নাকি?

ডিকসনের হাতের দিকে তাকাল কিশোর। সবচেয়ে ওপরে কমিকের ছবি দেখল। ফ্যান ফান নাম্বার ওয়ানের আরেকটা কপি। প্রাইস স্টিকারটায় দৃষ্টি আটকে গেল তার। দাম লেখা রয়েছে দুশো পঞ্চাশ ডলার।

ঠিক এরকম একটা কমিকই চুরি হয়েছে দেখেছি, কিশোর বলল। এটার দাম তো অনেক কম। নীল বোরামের কাছে অনেক বেশি চেয়েছিলেন?

ওটা একটা বিশেষ বই ছিল… বলতে গিয়ে থেমে গেলেন ডিকসন। কিশোরের চোখের দিকে তাকালেন। আমাকে এসব প্রশ্ন কেন? বরং ওই চোরটাকে ধরার চেষ্টা করা উচিত তোমাদের।

তা-ই তো করছি। তদন্ত চালাচ্ছি আমরা। জানেন বোধহয়, তদন্ত করতে গেলে অনেক প্রশ্ন করতে হয়।

ভুল লোককে করছ। আমার লোক তোমাদেরকে রেস্টুরেন্টে হুফারের সঙ্গে দেখেছে। শোনো, ওই লোকটাকে পাত্তা দিও না। ওর কথাও শুনো না। হুফার আর ডুফারের মত মানুষের সঙ্গে কারও মেশাই উচিত না। বাজে স্বভাব। ওদের মতই কমিক সংগ্রহ দিয়ে জীবন শুরু করেছিলাম আমিও। কিন্তু আস্তে আস্তে পেশা হিসেবে নিয়ে নিলাম কাজটাকে, ব্যবসা শুরু করলাম। ভালই করছি এখন। ওদের মত শয়তানি করে কাটাচ্ছি না।

ভ্রূকুটি করলেন ম্যাড। এমন সব কাণ্ড করে ওরা, এমন সব ফালতু কারণে রাগ পুষে রাখে, যেগুলোর কোন মানেই হয় না। একবারও ভেবে দেখে না কমিক ডিলার আর কমিকের দোকানদাররাই ওদের বাঁচিয়ে রেখেছে। যেমন হুফার, তেমনি ডুফার। আমাদের মত ব্যবসায়ীদের কষ্ট দিতে পারলেই যেন ওদের যত আনন্দ।

আনমনে নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটল কিশোর। ম্যাডকে কষ্ট দেয়ার জন্যে কি চুরি করতেও পিছপা হবে না ওরা?

ডিকসনকে তাঁর দোকানের সামনে রেখে আবার রওনা হলো তিন গোয়েন্দা। সেঞ্চুরি যাও ধরে এগোল। ড্রাইভিং হুইল ধরে বসেছে মুসা, সামনের দিকে তাকিয়ে ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলল। ভাবসাবে মনে হলো, আমাদেরকে তিন গোয়েন্দা না ভেবে তিন ভাঁড় ভেবেছেন ম্যাড। থ্রী স্টুজেস।

এবং তাঁর সেই ভাবনাটারই অবসান ঘটাতে হবে আমাদের, গম্ভীর হয়ে বলল পেছনের সীটে বসা কিশোর। আর তা করতে হলে প্রচুর পরিশ্রম করতে হবে। জানতে হবে কমিক চুরির সময়টায় সন্দেহভাজনদের কে কোথায় কি করছিল।

ডিকসন কোথায় ছিলেন, জানি, রবিন বলল। আমাদের সামনেই দাঁড়িয়ে ছিলেন।

কিশোর ভাবছে, মিরিনা জরডান কোথায় ছিল, তা-ও জানি। ক্রিমসন, ফ্যান্টম যখন এগিয়ে আসছিল, আমাদের কাছ থেকে তখন সরে যাচ্ছিল মেয়েটা। হয়তো ওকে জিজ্ঞেস করা উচিত ছিল…ভাবনাটা ঠেলে সরিয়ে দিল সে। অন্যান্য সন্দেহভাজনদের কথা ভাবতে লাগল। আমি জানতে চাই, নীল বোরাম কোথায় ছিল তখন। আর এডগার ডুফার। বিশেষ করে, আইজাক হুফারের কথা তো জানতেই চাই। প্রশ্নগুলোর জবাব পেলে অনেক কিছু পরিষ্কার হয়ে যাবে।

মাটির নিচের গ্যারেজে গাড়ি রেখে, এলিভেটরে করে উঠে এসে নিজেদের ঘরে ঢুকল তিন গোয়েন্দা। ব্যাগ নামিয়ে রাখল। তারপর রওনা হলো মেইন কনফারেন্স রুমের দিকে। কনভেনশন ডোরের বাইরে অনেকটা পাতলা হয়ে এসেছে ভিড়, কিন্তু ভেতরে যেন আরও বেড়েছে। ঠাসাঠাসি গাদাগাদি হয়ে আছে। রুক্ষ চেহারার সিকিউরিটি গার্ড, সামনের দুটো দাঁত ভাঙা যার, সে আবার ফিরে এসে বসেছে নিজের জায়গায়। তিন গোয়েন্দাকে আটকাল। ভাল করে ওদের হাতের সিল দেখে তারপর ঢুকতে দিল।

সঙ্গীদের নিয়ে ভিড়ের ভেতর দিয়ে ঘরের একধারে চলে এল কিশোর। সারি সারি টেবিল পাতা হয়েছে। টেবিলের সামনে বসে ভক্তদের বাড়িয়ে দেয়া খাতায় অটোগ্রাফ দিচ্ছে কমিক আর্টিস্টরা। কেউ কেউ পেন্সিল দিয়ে কমিকের হিরোর স্কেচ এঁকে দিচ্ছে। কিছু টেবিলে কমিক বই, ম্যাগাজিন, আর ইলাসট্রেশন বোর্ডের সাথে সাথে উঁচু হয়ে আছে পোস্টারের স্তূপ। সেগুলোও বিক্রি হচ্ছে চড়া দামে।

চুটিয়ে ব্যবসা করে চলেছে আর্টিস্টেরা। শত শত লোক সারি দিয়ে দাঁড়িয়েছে টেবিলের সামনে। ছেলে-বুড়ো-মাঝবয়েসী সব বয়েসের সব ধরনের লোক। মানিব্যাগ ভরে টাকা নিয়ে এসেছে। অকাতরে সেগুলো খরচ করছে কমিকের পেছনে। অনেক ভক্তেরই চোখ চকচক করছে তাদের প্রিয় শিল্পীকে দেখতে পেয়ে, তাদের সঙ্গে কথা বলতে পেরে যেন ধন্য হচ্ছে। কিছু কিছু তো আছে, ওদের কাণ্ড দেখে মাথার স্থিরতা সম্পর্কেই সন্দেহ জাগে। খাতায় তো অটোগ্রাফ নিচ্ছেই, বই, পোস্টার যত পারছে কিনে সেগুলোতে নিচ্ছে, গায়ের শার্টে নিচ্ছে, কেউ কেউ কাগজের কফি কাপ বাড়িয়ে দিচ্ছে আর্টিস্টের দিকে, সই করে দেয়ার জন্যে।

অটোগ্রাফের অনুরোধের সঙ্গে সঙ্গে চলছে নানা রকম প্রশ্ন, ব্যতিব্যস্ত করে তুলছে আর্টিস্টদের। ধৈর্যের সাথে সই করে দিচ্ছে ওরা, প্রশ্নের জবাব দিয়ে চলেছে, ব্যবসার স্বার্থে। এত মানুষের সম্মিলিত কণ্ঠস্বর কোলাহলে পরিণত হয়েছে।

আপনি না থাকলে স্নাইম ম্যান আর স্নাইম ম্যান থাকত না, জ্যাক, বলল এক ভক্ত। ওকে কেউ আপনার মত করে আঁকতে পারত না।

আরেকজন তরুণ ভক্ত আরেক আর্টিস্টের সামনে এসে চেঁচিয়ে উঠল, রোবট অ্যাভেঞ্জারের বারোটা বাজিয়েছেন আপনি। একমাত্র স্টেবিনস জানত কি করে ওই রোবট আঁকতে হয়। আপনি তো ওটার মাথাকে ভলভো গাড়ির নাক বানিয়ে দিয়েছেন। কিছু হয়েছে ওটা? আপনাকে বের করে দেয় না কেন কোম্পানি? একটা বই বাড়িয়ে ধরে বলল সে, দিন, এখানে একটা সই করে দিন।

ছেলেটার দিকে তাকিয়ে রয়েছে আর্টিস্ট। আমার আঁকা ভাল না লাগলে অটোগ্রাফ নিতে এসেছ কেন? বইটাই বা কিনেছ কেন?

কিনেছি বিক্রি করার জন্যে। আপনার সই থাকলে ডবল দামে বেচতে পারব।

বিহ্বল ভঙ্গিতে মাথা নাড়তে নাড়তে বইটাতে সই করে দিল আটিস্ট।

এই কনভেনশন রুমটাকে কেন ম্যাডহাউস বলে বুঝতে পারছে কিশোর। পাগলখানা! বিড়বিড় করল সে, ঠিক নামই দিয়েছে! বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে বলল, চলো, আইজাক হুফারকে খুঁজে বের করি।

সব চেয়ে লম্বা লাইন পড়েছে হুফারের টেবিলের সামনে। অন্য আর্টিস্টদের মত তার টেবিলে বই, ম্যাগাজিন কিংবা পোস্টার নেই বিক্রির জন্যে। ভক্তদের বাড়িয়ে দেয়া খাতায় দ্রুত একে দিচ্ছে কমিকের বিভিন্ন চরিত্র। কোন কোন ভক্ত সহানুভূতির সুরে বলছে কি করে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে তার চিত্রকর্মকে, সান্ত্বনা দিচ্ছে। অনুরোধ করছে আরও ভাল কোন চরিত্র তৈরি করার জন্যে, যেটা আগেরটার চেয়ে অনেক বেশি জনপ্রিয় হয়ে উঠবে। শিল্পীর নিজের হাতে এঁকে দেয়া ছবি পেয়ে খুব খুশি ওরা।

কয়েকটা ছেলে এসে ধরল হুফারকে ক্রিমসন ফ্যান্টম এঁকে দিতে হবে, কিংবা ক্রিমসন ফ্যান্টমের বইতে সই করে দিতে হবে।

দেরি করছেন কেন! চিৎকার করে উঠল এক কিশোর, দিন, এঁকে দিন!

হুফারের নাকের কাছে ক্রিমসন ফ্যান্টমের একটা নতুন সংস্করণ দুলিয়ে বলল আরেকজন, এটাতে সই করুন।

ছেলেটার কব্জি চেপে ধরল হুফার। ক্রিমসন ফ্যান্টমে সই আমি করব না। করাতে হলে বোরামের কাছে নিয়ে যাও। আরও বিশটা চরিত্র তৈরি করেছি আমি। ওগুলোর কোনটা চাও তো বলো, এঁকে দিই।

না, ক্রিমসনেই দিতে হবে, গোঁয়ারের মত বলল অবুঝ ছেলেটা। আঁকতে পেরেছেন, সই দিতে পারবেন না কেন?

ওটা এখন বোরামের সম্পত্তি। তার কাছে যেতে বললাম তো।

না, আপনাকেই দিতে হবে।

আমি পারব না, মাথা নাড়ল হুফার। আর ওভাবে আমার নাকের সামনে ওটা নাড়তে থাকলে মেজাজ ঠিক থাকবে না বলে দিলাম। কালি ঢেলে নষ্ট করে দেব বইটা।

হাত ছেড়ে দিল হুফার।

তার নাকের কাছে বইটা নাড়তেই থাকল ছেলেটা।

ছিরে ফেলব কিন্তু, হুমকি দিল হুফার।

তার মুখের দিকে তাকিয়ে আর বিরক্ত করতে সাহস করল না ছেলেটা। হাত সরিয়ে নিয়ে হারিয়ে গেল ভিড়ের ভেতরে।

দাঁড়াও আমি একবার কথা বলে আসি হুফারের সঙ্গে, ফিসফিসিয়ে দুই বন্ধুকে বলল রবিন। কনুই দিয়ে তো মেরে ভিড় ঠেলে টেবিলের দিকে এগোতে শুরু করল সে। গুঁতো খেয়ে রেগে গিয়ে তার দিকে ঘুরে জ্বলন্ত চোখে তাকাতে লাগল লোকে। পাত্তাই দিল না সে। এগোতেই থাকল। কিন্তু যে হারে ঠেলাঠেলি করছে লোকে, হুফারের দৃষ্টি আকর্ষণ করবে কিভাবে? কাজেই, সরাসরি পথটাই বেছে নিল সে। নাম ধরে ডাক দিল, মিস্টার হুফার?

মুখ তুলে তাকাল হুফার। আবার কি? রবিনের শুন্য হাত দেখে বলল, ও, আলতুফালতু জিনিস অন্তত সই করতে আননি। তা কি চাই? স্কেচ? কার ছবি আঁকব? তোমাকে দেখে কিন্তু লাগছে তুমি কিলার ব্রেন-এর ভক্ত। ঠিক বলেছি না? ততক্ষণে ওর কলম, কাগজের ওপর ছোটাছুটি শুরু করেছে।

আপনাকে আমি ম্যাড ডিকসনের স্টলের সামনে দেখেছিলাম। দোকানটায় বোমা ফাটার আগে। ছেলেটার হাত থেকে কমিক নিয়ে পোড়ানোর দৃশ্যটা দারুণ লেগেছিল আমার কাছে।

আচমকা ব্রেক কষার পর পিছলে গিয়ে যেন থেমে গেল হুফারের কলম।

কমিকগুলো ডাকাতি হওয়ার সময় আপনি ওখানে থাকলে খুব ভাল হত, আবার বলল রবিন। লোকটাকে হয়তো ধরে ফেলতে পারতেন। কোথায় ছিলেন তখন? লোকটাকে দেখেননি?

নীরবে রবিনের দিকে তাকিয়ে রয়েছে হুফার। ভক্তরা বিরক্ত হতে আরম্ভ করেছে। একজন চেঁচিয়ে বলল, এই, আগেই এসে বকবক শুরু করলে কেন? লাইনে দাঁড়াও। তোমার পালা আসুক, তারপর জিজ্ঞেস করো।

হুফার, আরেকজন বলল, আমাদের দিকে নজর দিন। ওতো অনেক পরে এল। যেতে বলুন ওকে।

কোথায় ছিলাম? কারও দিকে না তাকিয়ে অবশেষে রবিনের কথার জবাব দিল হুফার। এই চিড়িয়াখানার ভেতরেই। তিক্ত কণ্ঠে কথাটা বলে আবার আঁকতে শুরু করল সে। মুখ না তুলেই বলল, যাও, ভাগ। আমি ব্যস্ত।

স্কেচটা তুলে ধরে বলল, কিলার ব্রেন কিনতে চান কেউ?

তাকিয়ে রয়েছে রবিন। এত তাড়াতাড়ি এভাবে ওর দিক থেকে নজর সরিয়ে নেবে হুফার, কল্পনাও করেনি। এরকম আচরণ করতে না পারলে যে ভক্তদের হাত থেকে রেহাই পেতে পারত না, এ কথাটা ভুলেই গিয়েছিল সে। কানের কাছে, অসংখ্য কন্ঠের চিৎকার শুনতে পেল, ছবিটা কিনতে চায় ওরা, একজন একটা দাম বললে আরেকজন তার চেয়ে বেশি আরেকটা বলছে। নীলামে চড়ানো হয়েছে যেন ওই সদ্য আঁকা ছবি। কোনমতে দুপাশের দুজনকে সরিয়ে আরেকটু আগে বাড়ল রবিন। তার একটা কার্ড বাড়িয়ে দিয়ে বলল, আশা করি আবার দেখা হবে আমাদের। এর বেশি আর বলতে পারল না। টেনে তাকে পেছনে নিয়ে গেল কয়েকটা হাত।

ঢুকতে যতটা কষ্ট হয়েছিল, বেরোতে তার চেয়ে কম হল না। সবাই হুড়াহুড়ি করছে টেবিলের কাছে যাওয়ার জন্যে।

ভিড়ের ঠিক বাইরেই অপেক্ষা করছে কিশোর আর মুসা। রবিন বেরোতেই মুসা জিজ্ঞেস করল, কি বলল?

কমিক ডাকাতির সময় সে নাকি এই ঘরেই ছিল, পেছনের জনতার দিকে তাকিয়ে জবাব দিল রবিন। এখন যারা আছে, তখনও হয়তো তাদের অনেকেই ছিল। তার মানে অনেকেই তাকে দেখেছে। সাক্ষ্য দিতে পারবে তারা। হাত দিয়ে ডলে পোলো শার্টটা সমান করার চেষ্টা করতে লাগল সে। ভিড়ের চাপে কুঁচকে লেহে জায়গায় জায়গায়।

হু। সরু হয়ে এল কিশোরের চোখের পাতা, তাহলে ডাকাতির পর পরই এত তাড়াতাড়ি স্টলের কাছে পৌছে গেল কি করে?

সে আর ডুফার একই সময়ে হাজির হয়েছে, রবিন বলল। হয়তো একই সাথে ছিল দুজনে।

মাথা ঝাকাল কিশোর। ভাল বলেছ। ডুফারকে পাওয়া যাবে কােথায়?

পরিচিত একটা মুখ দেখা দিল ভিড়ের ভেতরে। পিটার, যে লোকটা ওভারগ্রীপ কমিকের কপি ধার দিয়েছিল ডুফারকে। তিন গোয়েন্দাকে দেখে জানতে চাইল, কি করছে এখানে।

এমনি এসেছে, দেখতে, জানাল কিশোর। তারপর জিজ্ঞেস করল, ডুফারকে দেখেছে কিনা। মাথা নেড়ে পিটার জানাল, গত এক ঘণ্টা ওর সঙ্গে দেখা নেই। হাসল হঠাৎ করেই। গোল্ড রুমে গিয়ে দেখতে পারো। কি করে যেতে হবে পথ বলে দিয়ে বলল, না গেলেও অবশ্য পারো। যে কোন সময়ে এসে পড়তে পারে ডুফার।

কিশোর জিজ্ঞেস করল, নীল বোরামকে দেখেছেন কোথাও?

দেখেছি, হাত তুলে দেখাল পিটার। ওই যে ওখানে। হিরোয়িক কোম্পানির লোক নিয়ে সাংবাদিকদের সাক্ষাৎকার দিচ্ছে বোরাম। নতুন কোন হিরোয়িক ক্লাসিকের ঘোষণা দিচ্ছে মনে হয়।

সেদিকে তাকিয়ে ক্যামেরার আলো ঝিলিক দিতে দেখল কিশোর। আর সোনালি পোশাকের চমক। দ্রুত এগোল দুই সহকারীকে নিয়ে। জায়গাটার স্টল সব সরিয়ে দিয়ে পরিষ্কার করা হয়েছে বিশেষ কাজের জন্যে। হিরোয়িক কমিকের কয়েকজন আর্টিস্ট পোজ দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে লাইফ সাইজ কিছু কার্ডবোর্ডে আঁকা কমিকের বিভিন্ন চরিত্রের ছবির সামনে।

কিন্তু তাদের দিকে নজর নেই ক্যামেরার। আলো ফেলা হয়েছে স্টেলারা স্টারগার্লের ওপর, ক্যামেরার চোখও তারই ওপর আটকে আছে যেন। কারণটা বোঝা শক্ত নয়। ছবির পাশেই দাঁড়িয়ে আছে মিরিনা জরডান, এখনও সোনালি কসটিউম পরনে, সাংবাদিকের দিকে তাকিয়ে উজ্জ্বল হাসি হাসছে।

একটু দূরে তার মা কথা বলছে সাংবাদিকদের সঙ্গে। তার পেছনে নীল বোরাম।

সম্পাদকের কাছে এগিয়ে গেল কিশোর। মিস্টার বোরাম, আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করতে পারি?

কেন নয়? টাকে হাত বোলালেন বোরাম। করো, প্রশ্ন করো।

আমি আপনাকে ম্যাড ডিকসনের স্টলের সামনে দেখেছি, ডাকাতির একটু আগে, কিশোর বলল। আপনার কি মনে হয়, যে কমিকগুলো চুরি হয়েছে ওগুলো মূল্যবান?

ওর দিকে তাকিয়ে রয়েছেন বোরাম। এটা কি ধরনের প্রশ্ন হলো?

আমি আর আমার দুই বন্ধু এই কেসের তদন্ত করছি, ম্যাড ডিকসনের হয়ে। মুসা আর রবিনকে দেখাল কিশোর। তিন গোয়েন্দার একটা কার্ড বের করে দিল বোরামের হাতে। আপনার মতামত জানা দরকার…

বাধা দিয়ে বোরাম বললেন, শুধু মতামত নয়, আরও অনেক কিছুই জানতে চাও তুমি। কার্ডটার দিকে তাকিয়ে বললেন বোরাম। তারপর তাকালেন কিশোরের দিকে। ডাকাতি হওয়ার সময় কনভেনশন ফ্লোরেই ছিলাম না আমি, স্টলের কাছে থাকা তো দূরের কথা। গোন্ড রুমের বাইরে কমিকের এক মাথামোটা পুজারি আটকে ফেলেছিল আমাকে।

পুজারি?

এডগার ডুফার। ভ্রূকুটি করলেন বোরাম। যেন ডুফারের সঙ্গে সাক্ষাতের সেই স্মৃতিটাও বিরক্ত করছে তাঁকে। গোন্ড রুম থেকে বেরিয়ে এল, গাধাগুলো যেখানে সিনেমা দেখাচ্ছিল সেখানে। মনে হলো, প্রোজেকটরের কিছু একটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। মেরামতের চেষ্টা করছিল লুই মরগান। এই সময় ডুফার বেরিয়ে এসে বিরক্ত করতে শুরু করল আমাকে।

তারপর?

কে জানি এসে বলল, ম্যাড ডিকসনের স্টলে গন্ডগোল হয়েছে। দেখতে গেল ডুফার। ভাবলাম, মরগান বোধহয় জানে কিছু, তাই তাকে ধরলাম। সত্যি, বলছি, এভাবে ডুফারের হাত থেকে রেহাই পেয়ে খুশিই হয়েছিলাম। নিজের সম্পর্কে তার উঁচু ধারণা। কুৎসিত ভঙ্গিতে হাসলেন বোরাম। অনেক অনেক উঁচু।

একটু থেমে বললেন সম্পাদক, তোমার প্রশ্ন শেষ হয়েছে? কাজ আছে আমার, যেতে হবে।

লোকটা চলে যাচ্ছেন, তাকিয়ে রয়েছে সেদিকে কিশোর। কেসটার মাথামুন্ড কিছুই বুঝতে পারছে না এখনও।

কাঁধে হাত পড়তে ফিরে তাকাল সে। পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন লুই মরগান।

বোরামের সঙ্গে কথা বললে দেখলাম, জিজ্ঞেস করলেন তিনি, তোমাদের কেসে সে-ও জড়িয়েছে নাকি?

জড়াতেও পারে, অনিশ্চিত শোনাল কিশোরের কণ্ঠ। ডাকাতির আগের মুহূর্তেও ম্যাড ডিকসনের স্টলের সামনে ছিলেন তিনি। কিন্তু এখন অস্বীকার করছেন। অ্যালিবাই রয়েছে বলছেন। সেটাই তদন্ত করে দেখতে হবে আমাদের।

আর কার কার ব্যাপারে তদন্ত করবে?

এডগার ডুফার। আইজাক হারের সঙ্গে ইতিমধ্যেই কথা বলে এসেছি।

আগ্রহ ফুটল মরগানের চোখে। তারও কি অ্যালিবাই আছে নাকি?

বলল তো সেরকমই। আর্টিস্ট সেকশনে নাকি জিনিসপত্র বিক্রি করে বেড়াচ্ছিল। আমার তো বিশ্বাস, নয়শো অটোগ্রাফ শিকারি তার পক্ষে রায় দেবে।

আমার মনে হয় না, ভুরু কুঁচকে মাথা নাড়লেন মরগান। ঢোকার মুখে তোমাদের সঙ্গে যখন দেখা হলো, তখন কিন্তু আমি আটিস্ট এরিয়ার ভেতর দিয়েই এসেছি। একটা লোককেও তখন দেখিনি হুফারের টেবিলের সামনে। কারণ, হুফার তখন টেবিলেই ছিল না।

আজ রাতেই আলিবাইগুলো সব যাচাই করে দেখতে হবে, বলল কিশোর। ব্যাংকোয়েট রুমে ঢুকেছে দুই সহকারীকে নিয়ে। ডাকাতির সময় ম্যাড ডিকসনের স্টলের কাছাকাছি ছিল এরকম কয়েকজনের সঙ্গেও কথা বলব। টাইটা সমান করতে লাগল সে। অস্বস্থি ফুটেছে চোখে।

ভুরু কুঁচকে ফেলল মূসা। কাণ্ডটা কি হলো! এমন করছ কেন? সেই সোনালি চুল মেয়েটাই মাথা গরম করেছে তোমার। এরকম অবস্থা তো দেখিনি! রহস্য রেখে সুন্দরী মেয়ের দিকে ঝুঁকেছে আমাদের কিশোর পাশা! অবিশ্বাস্য!

ফালতু কথা রাখো তো! ঝাঁঝাল কণ্ঠে বলল কিশোর। গাল লাল হয়ে যাচ্ছে। এদিক ওদিক ঘুরছে চোখ, নিশ্চয় মিরিনা জরডানকেই খুঁজে বেড়াচ্ছে।

দেখা গেল মেয়েটাকে। স্টেলারা স্টারগার্লের অনুকরণে আরেকটা পোশাক পরেছে। এটা আগেরটার চেয়ে অনেক সহনীয়। উঁচু কলারওয়ালা আলখেল্লা। সোনালি চুলগুলোকে সোজা করে আঁচড়ে নিয়ে ঠিক চাঁদিতে বসিয়েছে একটা মুকুট। সোনালি রঙের সিঙ্কের কাপড়ে তৈরি হয়েছে পরনের স্কার্টটা। হাঁটতে গেলেই আলখেল্লা আর স্কার্টের ঝুলের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে পড়ে সুন্দর লম্বা পা। এই পোশাকে তাকে আগের চেয়েও বেশি আকর্ষণীয় লাগছে।

মিরিনার মা কয়েকজন কমিক ভক্তের সঙ্গে গভীর আলোচনায় ডুবে না যাওয়াতক অপেক্ষা করল কিশোর, তারপর এগিয়ে গেল মিরিনার দিকে, কথা বলার জন্যে।

পরিচয় দিল কিশোর।

ও, তুমি ওদেরই একজন, মিরিনা বলল, চোরাই কমিক খুঁজছে। বড় বড় চোখ জ্বলজ্বল করছে আগ্রহে। কনভেনশন ফ্লোরের সবাই তোমাদের কথা বলাবলি করছে। তোমার বন্ধু সুইমিং পুলে পড়ার পর থেকে।

তাই! ঢোক গিলল কিশোর। কিভাবে শুরু করবে ভাবছে। সোজাসুজি বলাই ভাল, তাই বলল, ডাকাতির সময় তুমি ঘটনাস্থলেই ছিলে।

অদ্ভুত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাল মিরিনা।

ম্যাড ডিকসনের স্টলের কাছে, আবার বলল কিশোর। আমি…ওখানে তোমাকে আমি নিজের চোখে দেখেছি।

হাসল মিরিনা। শুধু তুমি নও, অনেকেই আমাকে দেখেছে ওখানে। তাকিয়ে ছিল। এই সম্মেলনে ঢোকার সাহসটা যে কিভাবে করলাম, ভাবলে আমারই অবাক লাগে।

খুব সুন্দর লাগছিল কিন্তু তোমাকে।

এভাবেই কথা বলো নাকি তুমি? আড়চোখে কিশোরের দিকে তাকাল মিরিনা। এত সোজাসাপ্টা?

ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে লাভটা কি? বলল বটে কিশোর, কিন্তু মনে মনে স্বীকার করতে বাধ্য হলো, এভাবে বললে লোকে যেমন খুশি হয়, রেগেও যায়। প্রশংসা করছে বলে রাগছে না মেয়েটা, কিন্তু যদি সমালোচনা করত? সত্যি হলেও রেগে আগুন হয়ে যেত। বহুবার নিজেকে বুঝিয়েছে কিশোর, এভাবে আর বলবে না। কিছু বলার সময় ঠিক রাখতে পারে না। স্বভাব মাফিক সরাসরিই বলে ফেলে সব কথা। মিথ্যে করে বলল, তোমার মত একজন বিশিষ্ট চরিত্রের সঙ্গে এই প্রথম কথা বলছি।

বিশিষ্ট চরিত্র কথাটা কিভাবে নিল মিরিনা বোঝা গেল না। কারণ হাসতে দেরি করল সে। হয়তো বোঝার চেষ্টা করছে কিশোর ব্যাঙ্গ করল কি-না। হাসিটা ছড়িয়ে পড়ল সারা মুখে। ডাকাতটার কথা জিজ্ঞেস করবে তো? না, ভাই আমি ওকে দেখিনি।

অন্য কিছু তো দেখেছ? অস্বাভাবিক কিছু? পরিবেশের সঙ্গে মেলে না এমন?

শ্রাগ করল মিরিনা। নাহ, ওরকম কিছু দেখেছি বলেও মনে পড়ে না। আসলে, ভয়েই অস্থির হয়ে ছিলাম তখন। ওই যে, প্রথম স্টেজে উঠতে গেলে কিংবা বক্তৃতা দিতে গেলে এক ধরনের ভয় ভয় লাগে না। আসলে, ভয় না বলে অস্বস্তি বলাই উচিত। বুঝতেই পারছ, জীবনে প্রথম এতবড় সম্মেলনে যোগ দিতে এসেছি।

ভাবছে মেয়েটা। কপালে হালকা ভাঁজ পড়েছে। হঠাৎ হাত তুলল, দাঁড়াও দাঁড়াও, মনে পড়েছে। ম্যাড ডিকসনের স্টলটার দিকে তাকিয়েছিলাম বটে, নামটা আজব বলেই চোখ আটকে গিয়েছিল। কালো এলোমেলো চুলওয়ালা এক লোক দাঁড়িয়েছিল টেবিলের ওপাশে… কিশোরের দিকে তাকাল সে, তুমি কথা বলছিলে তার সাথে! আবার কি যেন ভাবল মেয়েটা। তোমার পাশে ছিল লম্বা একটা নিগ্রো ছেলে, আর একটা আমেরিকান ছেলে, চুলের রঙ…।

ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল কিশোর। মুসা আর রবিনের কথা বলছে। এসব শুনতে চায়নি সে। আর কিছু দেখনি? অস্বাভাবিক কিছু?

মাথা নাড়ল মিরিনা। নাহ। পোশাক প্রতিযোগিতায় যোগ দিতে চলেছি তখন, সেদিকেই খেয়াল ছিল, আর কোনদিকে নয়। পাশ দিয়ে ছুটে চলে গেল লাল আলখেল্লা পরা লোকটা, তার গায়ের বাতাস এসে লাগল। কমিকের চরিত্রের মতই উড়ছিল আলখেল্লার ঝুল। তবে স্নাইম ম্যান বলা যাবে না তাকে কোনমতেই। বিচ্ছিরি লেগেছে আমার, তার ওভাবে গা ঘেঁষে যাওয়াটা। নাক কুঁচকাল মিরিনা।

ওর কোন কিছু চোখে পড়ার মত ছিল? মানে, খটকা লাগে ওরকম কিছু?।

কি আর লাগবে? ওর পোশাকটাই তো অদ্ভুত, অবশ্য এই কনভেনশন রুমের বাইরে। এখানে কোন কিছুই অস্বাভাবকি নয়। নানা রকম বিচিত্র পোশাক পরে এসেছে মানুষ প্রতিযোগিতার জন্যে। ও-ও পরেছে। লাল আলখেল্লা। তাড়াহুড়া ছিল অনেক।

ভাব না ভাল করে। ছবিটা মনে গেঁথে নাও। কি কি করছিল মনে করার চেষ্টা কর।

চোখ বন্ধ করল মিরিনা। আলখেল্লার ভেতরে হাত ঢুকিয়েছিল। কি যেন বের করেছিল।

হতে পারে, মিরিনাকে মনে করায় সাহায্য করতে চাইল কিশোর, স্মােক বম্ব বের করছিল লোকটা। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে গোয়েন্দাপ্রধান, মেয়েটার মুখের দিকে। আলখেল্লার নিচে কি পরেছিল মনে আছে? দেখেছ?

না, মাথা নাড়ল মিরিনা। আসলে ওভাবে খেয়ালই করিনি। আমি তখন আমার চিন্তায়। কে কি করছে এত দেখার সময় ছিল নাকি। তাছাড়া কি করে জানব লোকটা বোমা বের করছে?

তা-ও তো বটে, ভাবল কিশোর। বলল, বোমা ফাটার পর অনেক চিৎকার চেঁচামেচি হয়েছে। এটাও কি খেয়াল করোনি?

সেটা তো করতেই হয়েছে। এত চিৎকার করলে কি আর কানে না ঢুকে যায়। তবে একবারই তাকিয়েছি। দেরি হওয়ার ভয়ে থাকতে পারিনি, তাড়াহুড়া করে চলে গেছি। ও, লাল আলখেল্লা পরা লোকটাকে ছুটে যেতে দেখেছি।

সামনে ঝুঁকল কিশোর। আরেকবার তোমার গা ঘেঁষে গেল?

না, দ্বিতীয়বার আর গা ঘেঁষে নয়। মনে হলো, লাল একটা ঝিলিক দেখলাম। ছুটে যাচ্ছে দরজার দিকে, বেরিয়ে যাওয়ার জন্যে।

তুমি কোন দিকে যাচ্ছিলে?

কেন, দেখোনি? আর্টিস্টরা সব যেখানে বসে ছিল সেদিকে। ঘরের একধারে, ঢোকার দরজা থেকে দূরে। ওখানেই তো প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা করা হয়েছে।

দরজার দিকেই যাচ্ছিল, তুমি শিওর?

আবার শ্রাগ করল মিরিনা। শিওর হওয়ার কোন উপায় ছিল না। ধোঁয়া দেখলাম, লাল রঙের ঝিলিক দেখলাম, এর পর আর দেখিনি লোকটাকে।

প্রবেশ পথের কাছে কেউই তাকে দেখেনি, কিশোর বলল। ওরকম লাল আলখেল্লা পরা একজন লোককে দেখেও মনে থাকবে না কারও, এটা হতে পারে। মিরিনার দিকে তাকাল সে। আরও কিছু জিজ্ঞেস করার কথা ভাবছে। কিন্তু আর কোন প্রশ্ন এল না মাথায়। আপাতত আর কিছু মনে পড়ছে না। আমার প্রশ্ন শেষ।

এবার যেতে পারি? হেসে জিজ্ঞেস করল মিরিনা। যেন গোয়েন্দার সঙ্গে কথা বলতে পেরে খুশিই হয়েছে।

নিশ্চয়ই। বলল কিশোর। মেয়েটা যেন কথা বলার জন্যে মুখিয়েই আছে। খটকা লাগল তার।

তোমার ওই যে আমেরিকান বন্ধুটি, অবশেষে বলেই ফেলল মেয়েটা, যেন এটা জিজ্ঞেস করার জন্যেই কিশোরের এত প্রশ্নের জবাব দিয়েছে। ও কি সোনালি চুল পছন্দ করে?

ও, এই ব্যাপার! দীর্ঘ একটা মুহূর্ত নীরবে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে রইল কিশোর। তারপর হাসল। কিছু বলতে যাবে এই সময় ডাক শোনা গেল, মিরিনা, অ্যাই মিরিনা!

ওই যে, তোমার আম্মা ডাকছেন, কিশোর বলল। পকেট থেকে তিন গোয়েন্দার একটা কার্ড বের করে চট করে গুঁজে দিল মিরিনার হাতে। আশা করি আবার দেখা হবে। পকেটে রেখে দাও। প্রয়োজন হতে পারে আমাদেরকে।

হাসল মিরিনা। হয়তো।

আলাদা হয়ে দুজনে দুদিকে এগোল ভিড়ের মধ্যে দিয়ে। কয়েক মিনিট পরেই এসে রবিন খামচে ধরল কিশোরের হাত। বলল, এডগার ডুফারকে পেয়েছি।

কি বলল?

বোরাম যা বলেছে। দুজনে নাকি গোল্ড রুমের বাইরে তর্ক করছিল।

কি নিয়ে? জানতে চাইল কিশোর।

ক্রিমসন ফ্যান্টমের লেটেস্ট বই নিয়ে। নতুন আর্টিস্ট জোগাড় করেছে বোরাম।

ডুফার বলল, ওই আর্টিস্ট কোন কাজেরই না। ছায়া তৈরি করতে পারবে না।

ছায়া?

ক্রিমসন ফ্যান্টমকে সৃষ্টি করে সেটাকে ফোটানর জন্যে নানা রকম বিচিত্র আলোআঁধারি তৈরি করেছিল হুফার। এই যেমন, চরিত্রটার মাথায় কালো ছায়া। এমনিতেই মড়ার খুলির মত মুখোশ পরানো ওটার, তার ওপর ওই ছায়া একটা দুর্দান্ত আবহ তৈরি করে দিল। নতুন আটিস্টরা ওগুলো সব বাদ দিয়ে দিয়েছে। ডুফার বলছে, চরিত্রটার কোন কিছুই রাখেনি ওরা। সব কিছু উড়িয়ে-ফুড়িয়ে একেবারে জলো করে দিয়েছে।

ইনটারেসটিং, কিশোর বলল। চোরের মুখোশটার কথা মনে আছে? মড়ার খুলির মত। তার ওপর হালকা কালো রঙ, যেন ছায়াই তৈরি করা হয়েছে। আশা করি ডুফার সেকথা স্বীকার করবে।

স্বীকার করবে মানে?

ফ্যান্টমের মাথায় কালো ছায়া যাদের পছন্দ, তাদেরই কেউ নিশ্চয় ওরকম মুখোশ পরবে, কিশোর বলল। আরেকটা ব্যাপার, আলখেল্লা অনেক কিছু ঢেকে দেয়। ছদ্মবেশীদের জন্যে এটা এক মহা প্রয়োজনীয় পোশাক। ভেতরে কে আছে, বোঝা মুশকিল হয়ে পড়ে। পেটে চাপড় দিল কিশোর। খিদে পেয়েছে। চলো, মুসাকে খুজে বের করি।

সীটের ব্যবস্থা হয়েই আছে, জানাল রবিন। ডুফার আমাদেরকে তার টেবিলে খাওয়ার দাওয়াত করেছে।

তাই নাকি? তাহলে তো খুবই ভাল। মুসা গেল কোথায়? ভিড়ের দিকে তাকাতে লাগল কিশোর। চোখে পড়ল নীল বোরামকে। আইজাক হুফারের বুকে হাত ঠেকিয়ে বললেন, তোমার মুখটা বড় বেশি পাজি, হুফার। আমার নামে যা-তা বলে বেড়াচ্ছ। কানে এসেছে আমার।

পাজি! তুমি আমাকে পাজি বলে গাল দিলে! রেগে আগুন হয়ে গেল বদমেজাজী আর্টিস্ট। দাঁড়াও, আমিও ছাড়ব না। বক্তৃতা যখন দেব, তখন বুঝবে।

ঘোড়ার ডিম করবে! জোরে এক ধাক্কা মারলেন হুফারকে বোরাম। ঘুসি মারার জন্যে হাত তুললেন।

ভিড়ের ওপর পড়ল হুফার। সামলে নিয়ে সোজা হলো। সে-ও ঘুসি তুলল।

ঘুসি চালালেন বোরাম। লাগাতে পারলেন না। রেঞ্জের বাইরে রয়েছে হুফার। হুফারও ঘুসি চালাল। সে-ও লাগাতে পারল না। বোঝা গেল, মারামারি করতে জানে না দুজনের একজনও।

দুজনের মাঝখানে এসে দাঁড়াল একজন লোক।

ঘরের দরজায় পাহারারত সেই ষাঁড়ের মত সিকিউরিটি গার্ড। হুফারের কাঁধ চেপে ধরে টেনে সরাতে গেল তাকে, এই সময় আবার ঘুসি মেরে বসলেন বোরাম।

হুফারের চোয়ালে লাগল। রেগে গাল দিয়ে উঠল হুফার। কিন্তু গার্ড ধরে রেখেছে বলে কিছু করতে পারল না। একপাশ থেকে এসে বোরামকে ধরে ফেললেন মরগান।

বোরামের দিকে তাকিয়ে দাঁত খিচাচ্ছে আর গালাগাল করছে হুফার। টেনেটুনে দুজনকেই মঞ্চে নিয়ে যাওয়া হলো। বসিয়ে দেয়া হলো সীটে। একজনের কাছ থেকে আরেকজনকে বহুদুরে, এমাথায় আর ওমাথায়। সম্মেলনে যোগ দিতে আসা অন্য সদস্যরাও বসে পড়তে লাগল চেয়ারে।

মুসাকে খুঁজে পেল রবিন আর কিশোর। কিশোর জিজ্ঞেস করল মুসাকে, হুফারের সম্পর্কে কি জানলে?

ডাকাতির সময় আর্টিস্টদের কোন টেবিলের কাছেই তাকে দেখা যায়নি, মুসা বলল।

সব কিছুই কেমন যেন গোলমাল হয়ে যাচ্ছে! মেলাতে পারছি না! পোশাক প্রতিযোগিতায় এরকমই হয় নাকি?

হাত ওল্টাল মুসা। কয়েকজন আর্টিস্টের সঙ্গে কথা বলেছি আমি। ওরা জানিয়েছে, ওখানে তখন ছিল না হুফার।

তাহলে হুফারকেও কিছু প্রশ্ন করা দরকার আমাদের, পরামর্শ দিল রবিন।

আগে খেয়ে নিই, চলো, কিশোর বলল।

চলো।

টেবিলে বসে গেছে ডুফার। তিন গোয়েন্দাকে দেখে হাত নেড়ে ডাকল। খাবারের চেহারা দেখেই মেজাজ খারাপ হয়ে গেল কিশোরের। সালাদটা তো সহ্য করা যায়, কিন্তু মুরগীর যা চেহারা-নিশ্চয় সেদ্ধ হয়নি ঠিকমত, রবার হয়ে আছে। আলুগুলোও পোড়া।

রবিনের কানে কানে বলল মুসা, কিছু বলো না। পয়সা তো আর দিতে হবে আমাদের। মুফতে পেয়েছি। যা পেলাম খেয়ে নেয়া ভাল।

খাওয়ার পরে হুফারের সঙ্গে কথা বলার পরিকল্পনা করেছিল তিন গোয়েন্দা, সেটা সম্ভব হলো না। দেখা গেল, ডিনার শেষের বক্তা হিসেবে তাকেই বেছে নেয়া হয়েছে।

উঠে দাঁড়াল হুফার। আমাকে কিছু বলতে বলা হয়েছে, সে জন্যে প্রথমেই মিস্টার মরগানকে ধন্যবাদ দিয়ে নিচ্ছি। হাসল সে। ক্যালিফোর্নিয়ায় আসার পর এই প্রথম আমাকে এতটা গুরুত্ব দিল কেউ।

তার উদ্দেশ্যে মৃদু হাসল শ্রোতারা।

আমি জানি, কিছু লোকের ধারণা, আমি এখানে এসে কমিক তৈরি একেবারে ছেড়ে দিয়েছি। মাথা নাড়ল হুফার। ভুল। তাদের উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ নেই। নতুন একটা হিরো তৈরির কাজে হাত দিয়েছি আমি। খুব তাড়াতাড়িই সেটাকে দেখতে পাবেন আপনারা।

কেউ হাততালি দিয়ে, কেউবা কথা বলে তার এই কাজকে স্বাগত জানাল।

কার হয়ে কাজ করছেন আপনি? জিজ্ঞেস করল একজন।

সেদিক ঘুরল হুফার। আমি আমার নিজের হয়ে ছাড়া আর কারও জন্যে কাজ করি না। অন্তত এখন। এবার আমার কমিক আমি নিজেই পাবলিশ করব। এতে অনেক ঝামেলা হয় বটে, কিন্তু মানসিক যন্ত্রণার হাত থেকে রেহাই পাওয়া যায়। আর, নীল বোরামের দিকে তাকাল সে। হাতছাড়া হওয়ার ভয়ও থাকে অনেক কম। ঠকিয়ে নেয়ার কেউ থাকে না তো।

জ্বলন্ত চোখে আর্টিস্টের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন সম্পাদক। তার চকচকে টাকের চামড়া লালচে হয়ে উঠেছে।

নিজে পাবলিশ করার সমস্যা নিয়ে আলোচনা করতে লাগল হুফার। বক্তৃতা শেষে উৎসাহী অনেক ভক্ত তুমুল করতালি আর চিৎকার-চেঁচামেচি করে আনন্দ প্রকাশ করল। জানাল, তার নতুন হিরোর আশায় উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করবে তারা।

তিন গোয়েন্দার সঙ্গে এক টেবিলে বসে মাথা দোলাল ডুফার। হুফার নতুন কমিক তৈরি করছে একথাটা আমার কানেও এসেছিল। যাক, সত্যিই করছে তাহলে। খুশি লাগছে। চিন্তিত ভঙ্গিতে দাড়িতে আঙুল চালাতে লাগল সে। ভাবছি, পাবলিশ করার টাকা পেল কোথায়?

আমার বিশ্বাস, কিশোর বলল। সেজন্যেই এখানে এসেছে সে। টাকা। জোগাড়ের জন্যে।

অনেক টাকা দরকার। পাবলিশিং মুখের কথা নয়।

আইজাক হুফারের ব্যাপারে আরেকটা প্রশ্ন জমা হলো! বিড়বিড় করল রবিন।

মাথা ঝাঁকাল কিশোর। ডাকাতির সময়কার কোন অ্যালিবাই নেই হুফারের। এখন মনে হচ্ছে, ডাকাতি করার একটা উদ্দেশ্য থাকলেও থাকতে পারে তার। মোটিভ? তা মোটিভটা হলো, টাকা।

মুসার দিকে তাকাল কিশোর। হাই তুলছে গোয়েন্দা সহকারী। কেমন লাগছে তোমার, বুঝতে পারছি, কিশোর বলল। আপাতত হুফারের সঙ্গে কথা বলা বাদ দিয়ে ঘুমোতে যাই চলো।

তা-ই চলো, রবিন বলল।

মুসা তো রাজি হয়েই আছে। আমিও চলে যাব এখুনি, ডুফার বলল।

তাকে গুড নাইট জানিয়ে রওনা হয়ে গেল তিন গোয়েন্দা।

পথে একটা টেবিলে আবার দেখা হলো মিরিনার সঙ্গে। সাথে তার মা রয়েছেন এবং বরাবরকার মতই টেবিলের অন্যান্য লোকদের সঙ্গে গভীর আলোচনায় মগ্ন হয়ে আছেন।

ওদের দিকে তাকিয়ে হাসল মিরিনা।

কিশোরের মনে হলো, হাসিটা বোধহয় রবিনের উদ্দেশেই। মনে মনে হাসল সে। রবিনকে বড় বেশি পছন্দ করে মেয়েরা।

তবে সেকথা মুহূর্তে ভুলে গেল কিশোর। তার মন জুড়ে রয়েছে কেসটার নানা প্রশ্ন, নানা রকম সমস্যা। বিছানায় শুয়েও ভাবতেই থাকল সে। ঘুম আসছে না। একটু পরেই কানে এল দুই সহকারীর নাক ডাকার শব্দ।

হোটেলের অন্ধকার ঘরে শুয়ে শুয়ে নানা কথা ভাবছে কিশোর। একসময় মনের পর্দায় ভেসে উঠল মিরিনা জরডানের মুখ। মনে হতে লাগল, মেয়েটা মেয়েটা সত্যিই এসবে জড়িত নেই তো? থাকতেও পারে…

ভাবনায় ছেদ পড়ল তার। খুট করে একটা শব্দ হলো দরজায়। লাফ দিয়ে বিছানায় উঠে বসল কিশোর।

কে যেন দরজা খুলে ঢোকার চেষ্টা করছে!

খুলে গেল দরজা।

একটা ছায়ামূর্তিকে দেখতে পেল কিশোর। আবছা আলোয় লোকটাকে চিনতে পারার আগেই পেছনে লেগে গেল পাল্লা। ঘরে ঢুকেছে লোকটা।

বিছানার পাশের টেবিলের দিকে ঝটকা দিয়ে চলে গেল কিশোরের হাত, টেবিল ল্যাম্পের সুইচ টেপার জন্যে। কিন্তু অপরিচিত ঘরে তাড়াহুড়া করতে গিয়ে সব ভন্ডুল করে দিল। নাড়া লেগে উল্টে পড়ে গেল ল্যাম্পটা।

কি! কি হয়েছে! চিৎকার শুরু করল রবিন আর মুসা, জেগে গেছে।

ঘরে লোক ঢুকেছে, মুসা টের পেল প্রথমে। লাফিয়ে বিছানা থেকে নেমে ধরতে গেল ওকে। অন্ধকারে শুরু হয়ে গেল জাপটাজাপটি।

কিশোরও নেমে পড়েছে। ঘুসি মারতে গিয়েও সামলে নিল। সরিয়ে আনল হাত। কার গায়ে লাগবে ঠিক নেই। রবিন কিংবা মুসার গায়েও লাগতে পারে। দ্বিধায় পড়ে গেল সেজন্যে।

কিন্তু লোকটার সেই অসুবিধে নেই। যাকেই মারবে, যার গায়েই লাগবে, সেই শত্রু। কাজেই এলোপাতাড়ি মেরে চলল সে, আর মারতে লাগল গায়ের জোরে।

আগে বাড়তে গিয়ে পেটে লাথি খেল কিশোর। হুঁক করে উঠে চেপে ধরল পেট। প্রচন্ড ব্যথায় হাঁসফাঁস করতে লাগল।

পেট চেপে ধরেই, দেয়ালের দিকে রওনা হলো। সুইচবোর্ডটা খুঁজে বের করতে হবে…

গাঁক করে উঠল একটা কণ্ঠ। তার পরেই শোনা গেল রবিনের চিৎকার, পালাচ্ছে! ব্যাটা পালাচ্ছে!

অন্ধকারে আরও কিছু বিচিত্র শব্দ শোনা গেল।

সুইচবোর্ডটায় হাত ঠেকল কিশোরের।

জ্বলে উঠল ছাতে ঝোলানো ঝাড়বাতি।

আলোয় ভেসে গেল ঘর। দরজা খুলে বেরিয়ে যাচ্ছে তখন লোকটা।

দরজার দিকে দৌড় দিল তিন গোয়েন্দা।

প্রথম মোড়টার কাছে পৌছে গেছে ততক্ষণে রহস্যময় লোকটা। মোড় ঘুরে অদৃশ্য হয়ে গেল।

মোড় পেরিয়ে এল ছেলেরাও। গেল কোথায় লোকটা? সামনে লম্বা বারান্দা, এত তাড়াতাড়ি দৌড়ে সেটা পেরোতে পারার কথা নয়।

নিশ্চয় কোন একটা ঘরে ঢুকে পড়েছে! হাঁপাতে হাঁপাতে বলল রবিন। কোমরের কাছটায় চেপে ধরে রেখেছে, লাথি খেয়েছে ওখানে।

মুসা দৌড়ে গেল একজিট সাইন লেখা একটা দরজার কাছে। একটানে পাল্লা খুলতেই কানে এল দ্রুত পদশব্দ।

ইমারজেন্সি সিঁড়ি দিয়ে নামছে ও! চিৎকার করে বলল সে, জলদি এসো!

দুপদাপ করে নামতে শুরু করল তিনজনে। পদভারে কাঁপছে লোহার সিড়ি। ওরা যে পিছু নিয়েছে বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে না নিশ্চয় লোকটার। বুঝুক। কি আর করা? নিঃশব্দে তো নামার উপায় নেই।

লোকটাকে যেভাবেই হোক, ধরতে চায় কিশোর। একটা বোঝাপড়া আছে। চোরাই কমিকগুলো উদ্ধারের ব্যাপারটা তো আছেই, এখন যোগ হয়ে হয়েছে পেটের লাথি। আপনা থেকেই হাত মুঠোবদ্ধ হয়ে গেল ওর।

মাটির নিচে প্যারেজের প্রবেশ মুখের কাছে শেষ হয়েছে সিঁড়ি।

প্রায় একযোগ এসে দরজার গায়ের প্যানিক বারে ঝাপিয়ে পড়ল ওরা। ঝটকা দিয়ে খুলে গেল পাল্লা। বড় বড় থামের জন্যে ছাতের আলো ঠিকমত পৌঁছতে পারে না ওখানে। দরজার ওপরের বাল্বটাও ভাঙা। কাজেই অন্ধকারই বলা চলে জায়গাটাকে।

দৌড় দিল মুসা। কংক্রীটের মেঝেতে জুতোর শব্দ হচ্ছে। কেয়ারই করল না সে। বাঁয়ে মোড় নিয়ে চিৎকার করে সঙ্গীদেরকে জানাল, এদিকে!

সামনে ছুটছে মূর্তিটা। গতি বাড়িয়ে দিল মুসা। দেখতে দেখতে পেছনে ফেলে এল রবিন আর কিশোরকে।লম্বা লম্বা পায়ে এগোল মুসা। লোকটার গায়ে গিয়ে পড়ার ইচ্ছে কিন্তু আচমকা ঘুরে দাঁড়াল লোকটা। ঘুসি চালাল।

একটা থামের আড়ালে চলে গেল মুসা।

মুসা! থমকে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে উঠল রবিন। এই মুসা, ঠিক আছ তুমি?

আমার দম বন্ধ করে দিয়েছে! হাঁপাতে হাঁপাতে থামের আড়াল থেকে উঠে দাঁড়াল মুসা। আরিব্বাপরে বাপ!

সবার পেছনে ছিল কিশোর। মুসা অদৃশ্য হওয়ার পর রবিনকে দাঁড়িয়ে যেতে দেখল। সাবধানে থাম ঘুরে এগোল সে। পাঁচ কদম এগোতেই জ্বলে উঠল গাড়ির হেডলাইট, চোখেমুখে পড়ে যেন অন্ধ করে দিল তাকে।

একটা মাত্র আলো, আরব্য রজনীর সিন্দাবাদের গল্পের একচোখো দানব সাইক্লপসের মত। আলোটার আকার দেখে অনুমান করল, ভ্যান জাতীয় গাড়ি।

একটা হেডলাইট কাজ না করলেও ইঞ্জিন ঠিকই কাজ করছে গাড়িটার। গ্যাস বাড়াতেই ভীষণ গর্জন করে খেপা ঘোড়ার মত লাফ দিয়ে ছুটে আসতে লাগল কিশোরের দিকে।

চিৎকার দিয়ে রবিন আর মুসাকে হুঁশিয়ার করেই পাশে লাফ দিল সে। থামের এপাশে বেরোতে গিয়ে হেডলাইট চোখে পড়ল, ওরাও আঁপিয়ে পড়ল মেঝেতে। টায়ারের তীক্ষ্ণ শব্দ করে পাশ দিয়ে চলে গেল গাড়িটা।

লাফিয়ে উঠেই ওটার পেছনে দৌড় দিল কিশোর। ততক্ষণে একজিট র্যাম্পে উঠে পড়েছে গাড়ি, দ্রুত ডানে ঘুরতে আরম্ভ করেছে। সে র্যাম্পের মাথায় উঠতে উঠতে যানবাহনের ভিড়ে ঢুকে গেল ওটা, হারিয়ে গেল দেখতে দেখতে।

হতাশ ভঙ্গিতে ঝুলে পড়ল তার কাঁধ। অন্য দুজন পৌঁছলে জিজ্ঞেস করল, লাইসেন্স প্লেট দেখেছ? নাম্বার?

ইয়ার্কি করছ নাকি! মুসার জবাব।

রবিন বলল, দেখার জন্যে থেমে থাকলে এতক্ষণে চ্যাপ্টা হয়ে যেতাম, চাকার নিচে পড়ে।

আমিও দেখতে পারিনি, কিশোর বলল। ড্রাইভারকেও না। তোমরা কিছু দেখেছ?

গাড়িটা গাঢ় রঙের ছিল, রবিন বলল। যতদুর মনে হলো, ধূসর।

না, কালো, মুসা বলল।

মাথা নাড়ল কিশোর। আমার কাছে লাগল কালচে সবুজ।

একটা হেডলাইট নষ্ট।

মুসার এই কথাটায় একমত হল কিশোর। ঠিক। তার মানে একটা সাইক্লপস ভ্যান পাওয়া গেল সূত্র হিসেবে। এরকম গাড়ি লস অ্যাঞ্জেলেসে খুব বেশি নেই। জোরে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, খুঁজে বের করতে তেমন সমস্যা হবে না।

সেই সমস্যার কথা পরেও ভাবা যাবে, রবিন বলল। উপস্থিত যে সমস্যা রয়েছে সেটার সমাধান করা দরকার আগে।

কিশোর আর মুসা দুজনেই তাকাল রবিনের দিকে। কি সমস্যা?

আমাদের ঘরের চাবি কেউ এনেছ? পাল্লা বন্ধ করলে তো আপনাআপনি তালা লেগে যায়।

নিজের পরনের পাজামার দিকে তাকাল কিশোর। তারপর মুসা আর রবিনের দিকে। একজন পরেছে দৌড়ের পোশাক, আরেকজন পাজামা। পকেট নেই। চাবি রাখার জায়গা নেই। হুম! মাথা দোলাল সে, রেজিস্ট্রেশন ডেস্কে গিয়ে আরেকটা চাবি চাইতে হবে আরকি। কিন্তু যা পোশাক পরে বেরিয়েছি! লোকে সত্যি সত্যি এবার থ্রী স্টুজেস ভাববে।

সাইডওয়াকে উঠে পড়ল সে। চলো, যাই। রাতের হাওয়া মন্দ লাগবে না।

একপাশে খাড়া হয়ে উঠেছে কংক্রিটের দেয়াল। কিছুদূর এগোতেই শেষ হয়ে এল, দেখা গেল সরু একটা প্রবেশ পথ, তার ওপাশে ছোট বাগান। এখান দিয়ে ঢুকে পড়া যাক, প্রস্তাব দিল মুসা।।

একটা রয়াল পাম গাছের কাছে আসতেই ছায়ার মধ্যে গুঙিয়ে উঠল কে যেন। মাটিতে পড়ে ছিল। উঠে বসল কোনমতে। পাতলা, রাগী চেহারা। চিনতে অসুবিধে হলো না। এডগার হুফার।

কি হয়েছে আপনার? জিজ্ঞেস করল কিশোর।

ঠোঁট ফুলে গেছে হুফারের। মুখের একপাশে কাটা দাগ। চোখের কোণে কালশিটে পড়ে গেছে। ভ্রূকুটি করে মুখ বাঁকাতে গেল সে, সাধারণত যা করে, উফ করে উঠল ঠোঁটে ব্যথা লাগতে।

কি হয়েছে বলতে পারব না। ওই হট্টগোল ভাল্লাগছিল না, তাই বেরিয়ে এসেছিলাম খোলা বাতাসে। কে জানি এসে পড়ল গায়ের ওপর। উঠে দাঁড়াল হুফার। ব্যথার ভয়ে আস্তে আস্তে খুব সাবধানে নড়াচড়া করছে। ভালমত পেটাল আমাকে সে। চেহারা দেখার সুযোগ পেলাম না। তবে কে, আন্দাজ করতে পেরেছি।

কে? জানতে চাইল রবিন।

কে আমাকে পেটাতে চেয়েছিল? ঘুসি মেরেছিল হলঘরে? হোটেলে ঢোকার গেটের দিকে পা বাড়াল হুফার। নীল বোরাম।

ভেতরে ঢুকল হুফার। পেছনে তিন গোয়েন্দা। ছেলেদের দিকে বার বার তাকাচ্ছে আর্টিস্ট, ওদের পোশাক অবাক করেছে তাকে।

রিসিপশন ডেস্কের দিকে ঘুরতে গেল রবিন। মাথা নেড়ে তাকে মানা করল কিশোর, আপাতত চাবির কথা ভুলে যাও।

হুফারকে অনুসরণ করে লৰি ধরে চলল ওরা। নজর সামনের দিকে। আশেপাশে কারও দিকে তাকাচ্ছে না। মুখ টিপে হাসছে লোকে, টিটকারি দিচ্ছে, মন্তব্য করছে ওদের উদ্দেশে। এলিভেটরের কাছে এসে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল ওরা।

চারজনেই এলিভেটরে উঠলে তিন নম্বর লেখা বোতামটা টিপল হুফার।

সম্মেলনের বেশির ভাগ অনুষ্ঠানই হচ্ছে দোতলার ঘরগুলোতে, হুফার বলল। আরও ওপরে উঠছে কেন, সেটা জানাল সে, নীল বোরামের ঘরের নম্বর তিনশো পঁয়তিরিশ। শুনে ফেলেছি। ওর সঙ্গে দেখা হওয়া প্রয়োজন এখন আমার। মুঠো হয়ে গেল তার আঙুল।

এলিভেটর থেকে নেমে বারান্দা ধরে এগোল সে। পেছনে ছায়ার মত লেগে রইল তিন গোয়েন্দা।

৩৩৫ নম্বর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাবা দিল হুফার।

ভেতর থেকে সাড়া দিলেন বোরাম। দরজা খুললেন। টাইয়ের নট ঢিলা করা। সুট এখনও পরাই রয়েছে।

সোজা কলার চেপে ধরল হুফার। ঝাঁকাতে শুরু করল। চিৎকার করে বলল, ভেবেছ পার পেয়ে যাবে! সেটি হচ্ছে না!

আরি, হুফার, করো কি! করো কি! চেঁচিয়ে উঠলেন বোরাম।

ভেতর থেকে ডাক শোনা গেল। দুজনকে ছাড়ার চেষ্টা করতে লাগল তিন গোয়েন্দা। দৌড়ে এলেন লুই মরগান। পেছনে কয়েকজন লোক, কমিকের কোন কোন কাজ করে সবাই, হাতে গেলাস।

কি করি! ব্যাঙ্গ ঝরল হুফারের কঠে। এখনই বুঝবে! তোমার চেহারাটাকে আরেক রকম করে না দিয়েছি তো আমার নাম হুফার না! আমারটাকে যেমন করেছ!

কি…কি বলছ তুমি…কিছুই তো বুঝতে পারছি না! গলায় চাপ, দম নেয়ার জন্যে হাঁসফাঁস করছে বোরাম, কলার ছাড়ানোর চেষ্টা করছে।

ন্যাকা! বুঝতে পারছ না! মুখ ভেঙচাল হুফার। আমার গায়ের ওপর এসে পড়েছিলে কেন? মারলে কেন?

বোরাম কিছু বলার আগেই মরগান জিজ্ঞেস করলেন, কখন মারল?

এই তো কয়েক মিনিট আগে! ওকেই জিজ্ঞেস করুন না!

মাথা নাড়তে লাগলেন মরগান। কি করে গেল? ওর ঘরে আমরা এসেছি বেশ কিছুক্ষণ হলো। বেরোয়নি। আমাদের দাওয়াত করে এনেছে।

পার্টি চলেছে, কিশোর মুখ খুলল এবার, কাজেই সবার চোখ এড়িয়ে চট করে বাইরে থেকে ঘুরে আসাটা অসম্ভব নয়।

হয়তো। জোর দিয়ে বললেন মরগান, কিন্তু গত আধ ঘণ্টায় যে বেরোয়নি এটা আমি বলতে পারি। ঘরের মাঝখানের বড় একটা কাউচ দেখিয়ে বললেন, ও আর আমি ওখানে বসে ছিলাম এতক্ষণ। কথা বলছিলাম।

সরাসরি কিশোরের চোখের দিকে তাকালেন তিনি। বাইরে বেরোলে আমার চোখ এড়িয়ে কিছুতেই যেতে পারত না।

পরদিন সকালে তাড়াতাড়ি বিছানা ছাড়ল কিশোর। ভারি নিঃশ্বাস পড়ছে তখনও রবিন আর মুসার, ঘুমোচ্ছে। শব্দ করল না সে, ওদের ঘুম ভাঙাল না। ব্যাগ থেকে সাঁতারের স্যুটের একটা পাজামা বের করে পরল। গায়ে দিল একটা ঢোলা শার্ট। চাবি নিয়ে পা টিপে টিপে এগোল দরজার দিকে।

পুলের কিনারে যাওয়ার জন্যে বেরোচ্ছে। তার ধারণা, ওখানে এই কেসটা নিয়ে ভাবলে জবাব মিলবে তাড়াতাড়ি। মগজটা ভালমত কাজ করবে ওখানে গেলে।

পুলের পানিতে নেমে পড়বে। চুপ করে ভাসতে ভাসতে মনটাকে ছেড়ে দেবে বল্গাহীন ভাবে-যেখানে খুশি ঘুরে বেড়াক। জট ছাড়াক রহস্যগুলোর। আজব এক জটিলতার মধ্যে পড়েছে। এক পা এগোলে দুপা পিছিয়ে আসতে হচ্ছে।

যেমন ধরা যাক আইজাক হুফারের কথা। লোকটাকে কাছে থেকে দেখলে তার সম্পর্কে অন্য একটা ধারণা হয়ে যায়। ওর রাগী রাগী ভাবটা আর ততখানি থাকে না। রাগী, সন্দেহ নেই, তবে হাস্যকর একটা ব্যাপারও রয়েছে ওর মাঝে, কিছুটা ভাঁড়ামি। ওকে চোর হিসেবে কিছুতেই ভাবতে পারছে না কিশোর।

শুধু তা-ই নয়, রাতে ওদের ঘরে ঢুকে পড়েছিল সে, এটাও মানতে পারছে না। একটা ব্যাপার আলোচনা করে তিনজনেই একমত হয়েছে, যতটা জাপটাজাপটি ওরা করেছে ধরার জন্যে, তাতে আর যা-ই হোক, হুফারের চেহারার ওই পরিবর্তন হতে পারে না, ওভাবে মারেইনি ওরা। তাহলে ওসব দাগ কার কাছ থেকে সংগ্রহ করল হুফার?

সন্দেহ অন্য দিকে ঘোরানর জন্যে নিজেই নিজেকে পেটায়নি তো? নাহ। ভ্যানে করে লোকটা পালিয়ে যাওয়া আর তিন গোয়েন্দার ওকে দেখে ফেলার মাঝে এতটা সময় পায়নি সে যে এরকম একটা কাণ্ড করতে পারবে।

আরেকটা কাজ করতে পারে। গাড়ির গায়ে বুকে বুকে মুখে দাগ করে ফেলে তারপর গাডিটাকে কোথাও রেখে দিয়ে চলে আসা। ভাবতে গিয়ে এতটাই হাস্যকর মনে হলো কিশোরের, হেসেই ফেলল। উঁহুঁ, এই যুক্তি ধোপে টেকে না। ওরকম কাণ্ড আর যে-ই করতে পেরে থাকুক, হুফার পারবে না। ওরকম লোকই নয় সে।

বেশ। তা যদি না হয় তাহলে কে পেটাল তাকে? কেন? কমিক চুরির সঙ্গে এর কি কোন সম্পর্ক আছে? ডাকাতির ব্যাপারে এখনও সন্দেহের বাইরে নয় সে। কিন্তু যেহেতু পিটুনি খেয়েছে, আরও কেউ যে এসবে জড়িত রয়েছে, এটা স্পষ্ট। আরেকটা নতুন রহস্য এসে যোগ হল আগের রহস্যগুলোর সাথে।

এলিভেটরে করে নিচে নেমে এল কিশোর। লবি পেরোতে যাবে, এই সময় নাম ধরে ডাক শুনতে পেল। ঘুরে তাকিয়ে দেখল তাড়াহুড়া করে আসছেন লুই মরগান।

এত সকালে উঠলে, বললেন কনভেনশন চীফ।

আপনিও তো উঠেছেন। কাল রাতে পাটির পর ঘুমোতে নিশ্চয় অনেক রাত হয়েছে।

বাধ্য হয়েই উঠতে হয়েছে, হাসলেন মরগান। সম্মেলনের কাজ। অনেক ঝামেলা। কত রকম গোলমাল হতে পারে। আগেই সেগুলো বুঝে নিয়ে সাবধান থাকা দরকার। পারলে মিটিয়ে ফেলা দরকার, যাতে না হয়। ভাগ্যটা বরং ভালই মনে হচ্ছে। কিছুটা তো ঘুমিয়ে নিতে পেরেছি। গোল্ড রুমে গিয়ে দেখ, লাল লাল চোখ হয়ে আছে কতজনার। বিশ ঘণ্টা ধরে শুধু তাকিয়েই রয়েছে, রক অ্যাসটারয়েডের দিকে। সম্মেলন করতে এলে ঘুম-নিদ্রা সব বাড়িতে রেখে আসতে হয়।

তবে, মরগানকে দেখে মনে হলো না ঘুমের বিশেষ অসুবিধে হয়েছে। ভালই বিশ্রাম নিয়েছেন। নতুন ধোঁয়া জিনস পরনে, গায়ে নতুন ইনটারকমিকন টি-শার্ট। বগলে চেপে রেখেছেন একটা ক্লিপবোর্ড। চকচকে চোখ। কাজ করার জন্যে পুরোপুরি তৈরি হয়ে এসেছেন।

নিজের চোহরা না দেখেও আন্দাজ করতে পারছে কিশোর, তার মুখে ক্লান্তির ছাপ ফুটে আছে।

তোমার কেসের খবর কি? জিজ্ঞেস করলেন মরগান, তদন্ত কতটা এগোল?

করছি। নতুন নতুন সব ব্যাপার বেরিয়ে আসছে, অবাক করার মত। নিশ্চয় বুঝতে পারছেন, হুফারকে সন্দেহ করছি আমরা। বিশেষ করে তার অ্যালিবাইটাকে আপনি যখন ফুটো করে দিলেন। কিন্তু একটা কথা, সে যদি চোরই হবে, তার ঘরের জিনিসপত্র তছনছ করতে গেল কে, কেন? তাকে মারলই বা কেন?

মাথা ঝাঁকালেন মরগান। কৌতূহলী মনে হচ্ছে। তোমার কি মনে হয়?

এখনও কিছু ভেবে ঠিক করতে পারিনি। তবে একটা ব্যাপার পরিষ্কার, হঠাৎ করেই কেউ মরিয়া হয়ে উঠেছে হুফারের জীবনটাকে হেল করে দেয়ার জন্যে। কোন একটা ঘাপলা কোথাও নিশ্চয় আছে, যেটা এখনও ধরা পড়েনি আমাদের চোখে। অবস্থা দেখে তো মনে হয় হুফার শিকারি নয়, শিকার।

ঘড়ি দেখলেন মরগান। দেরি হয়ে যাচ্ছে। যা-ই হোক, তোমার সঙ্গে আমিও একমত। রওনা হয়ে গেলেন তিনি। এক পা গিয়েই ঘুরে তাকালেন। আমার মনে হয়, হুফারকে নিয়ে যা ঘটছে তার অন্য ব্যাখ্যা আছে।

যেমন?

সেই যে পুরানো প্রবাদঃ চোরের সঙ্গে থাকতে থাকতে চোরই হয়ে যায়।

এই শেষ কথাগুলো নাড়িয়ে দিল কিশোরকে। পুলের কাছে পৌঁছল চিন্তা করতে করতে। ঝাপ দিয়ে পড়ে সাঁতার কাটতে শুরু করল।

পানি তার খুব ভাল লাগে। এর একটা কারণ, পানিতে নাক ডুবিয়ে চুপচাপ ভেসে থেকে কিংবা চিত হয়ে চোখ বন্ধ করে ধীরে ধীরে সাঁতরানো যায়, আর এই সময়ে মগজটাকে খাটানো যায় পুরোদমে। জটিল সমস্যার সমাধান করা সহজ হয়, কারণ ভাবনায় একাগ্রতা আসে।

কিছুক্ষণ দাপাদাপি করে শান্ত হলো কিশোর। চুপ করে নাক ডুবিয়ে ভাসতে লাগল। চালু হয়ে গেছে মগজ। ভাবছে। কেউ হামলা করেছিল হুফারকে। তার ঘরে মুসাকেও আক্রমণ করেছিল একটা লোক। তারপর গত রাতে তিনজনকেই এলোপাতাড়ি পিটিয়েছে কেউ। তিনটে ঘটনাই কি একই লোকের কাজ? সেই লাল আলখেল্লা পরা লোকটা করেছে এসব, যে কমিকগুলো ছিনতাই করেছে?

মুখোশের জন্যে লোকটার মুখ দেখতে পারেনি মুসা, তবে শরীরের অনেকটাই দেখেছে। পেশীবহুল শরীর লোকটার। ডাকাতির ব্যাপারে যাদেরকে সন্দেহ করা যায়, তাদের সঙ্গে এই লোকটার শরীরের মিল নেই। হুফার লম্বা, পাতলা; ডুফার মোটা, বোরাম ভুঁড়িওয়ালা। আর মিরিনা জরডানকে তো মেলানোই যায় না কোনমতে।

কাজেই চোরটা এমন কেউ, যাকে ওরা চেনেই না, কিংবা ওই ডাকাতির সঙ্গে একাধিক লোক জড়িত। জটগুলো ছাড়ার চেষ্টা করছে কিশোর, এই সময় পেছনে ঝপাং করে শব্দ হলো। ডাইভ দিয়ে পড়েছে কেউ।

মাথা তুলল মেয়েটা। পরনে লাল, সাঁতারের পোশাক। খাট বাদামী চুল মাথা এবং গালের সঙ্গে লেপ্টে গেছে। সাঁতরাতে শুরু করল সে। পিছু নিল কিশোর।

সে যখন পুলের প্রান্তে পৌঁছল, মেয়েটা তখন ফিরে সাঁতরাতে শুরু করেছে আরেক প্রান্তের দিকে।

যাবে নাকি আবার? ভাবল কিশোর। যাওয়াই ঠিক করল। জোরে জোরে সঁতরে চলে এল মেয়েটার পাশাপাশি। ভাল করে দেখার জন্যে মুখের দিকে ভাকাল। বেশ সুন্দরী। রোদে পোড়া চামড়া। তার দিকে একবার তাকিয়েই গতি বাড়িয়ে দিল মেয়েটা।

প্রতিযোগিতা করতে চাইছে মনে হলো। লেগে গেল কিশোর কিন্তু কয়েক সেকেন্ড পরই বুঝে গেল পারবে না, মেয়েটার সঙ্গে। অনেক আগেই আরেক প্রান্তে চলে গেল মেয়েটা, ঘুরে আবার আসতে শুরু করল। প্রায় মাঝপথে কিশোরকে পাশ কাটিয়ে উল্টো দিকে চলে গেল।

আর চেষ্টা করল না কিশোর। লাভ নেই। পারবে না। অহেতুক পরিশ্রমে ক্লান্ত হওয়ার কোন মানে হয় না। তাছাড়া ক্লান্ত হলে মগজও ঠিকমত কাজ করতে চায় না। ভেসে থেকে তাকিয়ে রইল মেয়েটার দিকে।

পানি থেকে উঠে পড়ল মেয়েটা। চুলে আঙুল চালিয়ে পানি ঝরাল, তারপর গিয়ে বসল একটা লাউঞ্জ চেয়ারে। তোয়ালে দিয়ে গা মুছতে লাগল। কয়েক ডলা দিয়ে তোয়ালেটা রেখে দিয়ে হেলান দিল চেয়ারে। আরাম হচ্ছে না বোধহয়। আবার উঠে চেয়ারটাকে ঘুরিয়ে রোদের দিকে মুখ করে বসল।

চেয়ারের হেলানে ঝোলানো ছিল ব্যাগটা। নাড়া লেগে মাটিতে পড়ে গেল। মুখ খুলে ছড়িয়ে পড়ল ভেতরের জিনিস। লক্ষ্যই করল না মেয়েটা। সে রোদ নিয়ে ব্যস্ত। কিভাবে ঠিকমত গায়ে লাগে সেটা দেখছে।

কিশোর তাকিয়ে রয়েছে ব্যাগ থেকে বেরোনো জিনিসগুলোর দিকে। কমিকের বই। অনেকগুলো।

খুবই অবাক হয়েছে সে। কি করবে ঠিক করতে পারল না একটা মুহূর্ত। ডুব দিয়ে মাথা ঠান্ডা করে নিল যেন। তারপর সাঁতরাতে শুরু করল তীরের দিকে। পানি থেকেই দেখতে পেল কমিকগুলোর ভেতর থেকে উঁকি দিয়ে আছে তিন গোয়েন্দার একটা কার্ড। না না, একটা নয়, আরও আছে! আশ্চর্য! ওদের কমিকের বই আর কার্ডগুলো তো থাকার কথা হোটেলের ঘরে, একটাও তো বিক্রি করেনি এখনও। তাহলে মেয়েটা পেল কোথায়?

এর একটাই মানে হতে পারে। এই কমিক ওদের ঘরেরগুলো নয়। ম্যাড ডিসনের স্টল থেকে যেগুলো ছিনতাই হয়েছে সেগুলো। বাক্সে অনেক কার্ড ছিল। কিছু ঢুকে গিয়েছিল হয়তো বইগুলোর মাঝে।

কিন্তু মেয়েটার কাছে এই জিনিস এল কোথা থেকে?

১০

ভূতে তাড়া করেছে যেন, এমন তাড়াহুড়ো করে পানি থেকে উঠে এল কিশোর। তার কাণ্ড দেখে অবাক হলো মেয়েটা। পিঠ সোজা করে বসে তাকিয়ে রইল।

পানিতে নড়াচড়া করছিল বলে ততটা ভাল করে মেয়েটাকে দেখতে পারেনি কিশোর। এবার দেখল। বড় বড় চোখ মেলে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে সে। রোদে শুকানোর পর চুলের রঙও আরেক রকম হয়ে গেছে। বাদামী নেই আর এখন, সোনালি।

মিরিনা! বলে উঠল কিশোর, তুমি এখানে কি করছ?

চারপাশে তাকাল মিরিনা। অপরাধী অপরাধী একটা ভাব। অনুনয়ের সুরে বলল, বলো না, প্লীজ। আমি ভেবেছিলাম কেউ দেখতে পাবে না…

চেয়ারের পায়ের কাছে পড়ে থাকা কমিকগুলোর দিকে তাকাল আবার কিশোর। কেন বলব না?

ওর হাত চেপে ধরল মিরিনা। প্লীজ! জানলে আম্মা আমাকে খুন করে ফেলবে!

এটা আশা করেনি কিশোর। চুপ করে রইল।

আবার বলল মিরিনা, এত সকালে কেউ আসবে এখানে কল্পনাও করিনি। কাজেই ভাবলাম, এই সুযোগে চট করে একবার সাঁতারটা দিয়েই আসি। আম্মা জানতে পারলে…

চোখ মিটমিট করল কিশোর। কিসের কথা বলছ?

ওর সোনালি পরচুলাটার কথা। বিচ্ছিরি জিনিস! খোলার সুযোগ পেলেই খুলে রাখি। এই ফালতু জিনিস কে মাথায় দিয়ে বেড়ায়! ভাবলাম, এভাবে কেউ চিনতে পারবে না আমাকে। ভুল করেছি।

আরও সোজা হয়ে বসতে গিয়ে চেয়ারের একেবারে কিনারে চলে এল সে। তুমি ডুবে ছিলে, তাই পানিতে নামার আগে দেখতেই পাইনি তোমাকে। আশা করি, কাউকে কিছু বলবে না, আমাকে বকা শোনাবে না। কি আর করব! কপালটাই খারাপ! পড়লাম তো পড়লাম, একেবারে গোয়েন্দার সামনে!

মুখ তুলে তাকাল মিরিনা। কিশোরের চোখে চোখ। দৃষ্টিতে অনুনয়। আম্মা যদি শোনে, আমি এই কাণ্ড করেছি, ভীষণ রেগে যাবে। স্টেলারা স্টারগার্লের মডেল হওয়া আর কোন দিনই হবে না হয়তো আমার। আম্মা সাহায্য না করলে…

বাধা দিয়ে কিশোর বলল, শোনো, আমি এসেছি জিজ্ঞেস করতে, এগুলোর ব্যাপারে।

মাটি থেকে ব্যাগ আর কমিকগুলো কুঁড়িয়ে নিয়ে মিরিনার দিকে বাড়িয়ে ধরল

সে।

এগুলো…! বইগুলোর দিকে তাকিয়ে রয়েছে মিরিনা, এগুলো এখানে এল কিভাবে!

আমিও সেটাই জানতে চাই, গম্ভীর হয়ে বলল কিশোর।

ওগুলো আমার নয়! আজব কমিকগুলো দেখে প্রথমে অবাক হলো মিরিনা। কার্ডগুলো দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল, এই ভেবে যে কমিকের মালিকের নাম লেখা রয়েছে। তারপর রেগে গেল যখন দেখল কার্ডে কিশোরের নাম লেখা রয়েছে। এগুলো তো তোমাদের! তোমাদের কার্ড এর মধ্যে গুজে দিয়েছে! আমাকে ভয় দেখালে কেন…!

থেমে গেল আচমকা। গোল গোল হয়ে গেল চোখ। সর্বনাশ! শুনেছি তোমাদের কমিকও চুরি হয়েছে। এগুলো নয় তো?

চিন্তিত ভঙ্গিতে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে রয়েছে কিশোর। এটা যদি অভিনয় হয়ে থাকে, তাহলে ভবিষ্যতে মিরিনার অসকার পাওয়া কেউ ঠেকাতে পারবে না। তবে এতটা বাস্তব অভিনয় করতে পেরেছে বলে মনে হলো না তার। সত্যি কথাই বলছে মেয়েটা।

হ্যাঁ, এগুলোই আমাদের চুরি যাওয়া কমিক, কিশোর বলল। তিনশো ডলার দাম উঠে গেছে। তোমার ব্যাগে এল কি করে?

হেলান দিল মিরিনা। বিস্ময় রয়ে গেছে চোখে। কোলের ওপর রাখা হাতের আঙুল মুঠো হয়ে গেছে। বলল, আমি জানি না। জোর নেই গলায়।

কি বিপদে পড়েছে বুঝতে পারছে মিরিনা। এখন আর কেবল মায়ের বকা শুনেই পার পাবে না, আরও দুর্গতি আছে কপালে। সে চোর, এটা জানাজানি হলে ক্যারিয়ার শেষ। মডেলিঙের এখানেই ইতি।

আবার মুখ তুলে তাকাল মিরিনা। বিধ্বস্ত চেহারা। মেকআপ নেই বলেই যে ওরকম লাগছে, তা নয়।

এটা তোমার ব্যাগ, তাই না? শান্তকণ্ঠে জিজ্ঞেস করল কিশোর।

চিরুনি বের করল মিরিনা। চুলে চালাতে চালাতে বলল, ব্যাগটা আমার, স্বীকার করছি। তবে ভেতরের জিনিসগুলোর খবর জানি না। কসম খেয়ে বলছি, কমিকগুলো আমি ঢোকাইনি।

আজ সকালে কারও সাথে দেখা হয়েছিল, এখানে আসার আগে? কিংবা ব্যাগটা কোথাও রেখে গিয়েছিলে?

মাথা নাড়ল মিরিনা। না। দেখা যাতে না হয় সেটাই চাইছিলাম। সাবধান ছিলাম। আমি চাইনি কেউ, আমাকে চিনে ফেলুক। ঘর থেকে বেরোনোর পর সারাক্ষণই আমার সঙ্গে ছিল ওটা। একটু থেমে বলল, একটা সময় বাদে। যখন আমি পানিতে ছিলাম।

হ্যাঁ, মাথা দোলাল কিশোর। যে কেউ চুরি করে কমিকগুলো মিরিনার ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখতে পারে। এটা এমন কোন কঠিন কাজ না। যেন দেখতে পাবে লোকটাকে, এমন ভঙ্গিতে পুলের চারপাশে নজর বোলাল সে। কেউ নেই। এমনকি লাইফগার্ডও না।

পানিতে মিরিনার তো বটেই, কিশোরেরও নজর ছিল না এদিকে। সে-ও ওর সঙ্গে সাঁতরাচ্ছিল। ওই সুযোগে যে কেউ এসে ওগুলো ব্যাগে ঢুকিয়ে রেখে যেতে পারে ওদের অলক্ষ্যে, এতটাই মগ্ন হয়ে ছিল ওরা। হয়ত তা-ই করেছে লোকটা।

মিরিনার কথায় চমক ভাঙল কিশোরের, তুমি নিশ্চয় এগুলো ফেরত চাও। কমিকগুলো কিশোরের দিকে তুলে ধরল মেয়েটা। জিনিসগুলো তোমার। কিন্তু আমার ব্যাগে রাখল কে?

বিস্মিত ভাবটা কেটে গিয়ে হাসি ফুটল মিরিনার মুখে। ওই পচা স্পাই স্টোরিগুলোর মত ঘটনা। যাকে ফাঁসাতে চায় তার অজান্তে শত্রুপক্ষের লোক এসে বেআইনী জিনিস ঢুকিয়ে রেখে যায়। পুলিশ এসে ধরে তখন লোকটাকে এবং ভুলটা করে।

মিরিনার তোয়ালেটা চেয়ে নিল কিশোর। গা মুছতে লাগল। ভাবছে, আসলেই কি এই ব্যাপার ঘটেছে? মিরিনাকে ফাঁসার জন্যেই একাজ করেছে কেউ?

কমিকগুলো হাতে নিয়ে এক এক করে দেখতে লাগল সে। হুঁ, এগুলোই চুরি হয়েছিল। হতে পারে, অন্যের ব্যাগে ঢুকিয়ে দিয়ে এগুলো সরিয়ে দিতে চেয়েছে চোরটা। হয়তো তার কাজে লাগবে না, কিংবা বিক্রি করার সাহস করতে পারেনি। কিন্তু সরানর জন্যে তোমাকে বেছে নিল কেন?

জবাব দিতে পারল না মিরিনা।

হঠাৎ মনে পড়ল কথাটা। মিরিনার মা! সাংঘাতিক চালাক মহিলা। বিজ্ঞাপনের জাদুকর বলা চলে। বর্ন পাবলিসিটি হাউন্ড। মিরিনার কাছে চোরাই কমিক পাওয়া গেছে, মেয়ের জন্যে এর চেয়ে বড় বিজ্ঞাপন আর কি হতে পারে?

সেটা করার জন্যেই হয়তো কমিকগুলো চুরি করেছেন মিসেস জর্ডান। নিজেও করে থাকতে পারেন।

মিরিনার দিকে তাকাল কিশোর। ওর দিকে তাকিয়ে রয়েছে সে। নিস্পাপ চাহনী। নাহ্, ওই মেয়ে একাজ করেনি। যা বলছে সত্যিই বলছে। মিরিনা আর লাল আলখেল্লাকে একসাথে দেখেছে ম্যাড ডিকসনের স্টলের সামনে। মিসেস জরডান কি ছিলেন তখন ওখানে? থাকলেও হয়ত মেয়ের অলক্ষ্যে। তাঁর পরিকল্পনার কথা কিছুই জানাননি মেয়েকে।

আরেকটা প্রশ্ন করতে যাবে কিশোর মিরিনাকে, এই সময় পেছনে হিসিয়ে উঠল রাগী কণ্ঠ, ও, তাহলে এখানে এসে বসে আছ!

ঘুরে তাকাল কিশোর। জ্বলন্ত চোখে মিরিনার দিকে তাকিয়ে রয়েছেন মিসেস জড়ান।

এভাবে গায়েব হয়ে যাওয়ার মানেটা কি? কড়া গলায় আবার শুধালেন মিসেস জরডান। আমি ওদিকে সারা হোটেল খুঁজে মরছি। কি করছ এখানে? এই পোশাকে, একটা সো-কলড ডিটেকটিভের সাথে?

নিজের জিনিসপত্র তুলে নিতে লাগল মিরিনা। এই সময়টায় তার মায়ের অগ্নিদৃষ্টি সহ্য করতে হল কিশোরকে। ইতিমধ্যে একবার মুখ তুলে মায়ের দিকে তাকিয়ে মিনমিন করে বলল মিরিনা, সরি, আম্মা, ভুল হয়ে গেছে…

হয়েছে! ধমক দিয়ে তাকে থামিয়ে দিলেন মা, জলদি যাও! নিজের মাথার হ্যাঁট খুলে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, পর এটা! কেউ দেখে ফেলার আগেই। সানগ্লাস পর। ইসসি রে, কেউ দেখেই ফেলল কি-না…।

মেয়ের হাত চেপে ধরলেন মিসেস জরডান। টান দিলেন হাঁটার জন্যে। মিরা, কি যে করিস, কিছু বুঝি না! ভূত চাপে নাকি তোর মাথায়! এত করে বললাম, টেলিভিশনে একটা সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা করেছি আজ। বুঝেসুঝে চলবি। সকালে উঠেই তৈরি হবি। তা না করে চলে এসেছিস এখানে! জানিস না, এভাবে ভিজিয়ে উঠে রোদে শুকালে চামড়ার সর্বনাশ হয়ে যায়? কত আর শেখাব! বিরক্ত হয়ে গেছি!

চরকির মত পাক খেয়ে হঠাৎ কিশোরের দিকে ঘুরলেন মহিলা। ইয়াং ম্যান, আমি আশা করব, আমার মেয়ে সম্পর্কে যেন কোন গুজব ছড়ানো না হয়। ওর ভাল হোক, এটাই তোমার চাওয়া উচিত। একটা কথা বিশেষ ভাবে বলে দিচ্ছি, সে রকম কিছু যদি ঘটে, তোমার সঙ্গে বোঝাপড়া হবে আমার। আমি তোমাকে ছাড়ব না। মনে রেখো কথাটা।

মায়ের পেছনে দাঁড়িয়ে আছে মিরিনা। সরমে মরে যাচ্ছে যেন। আবার তার হাত ধরে টানলেন মিসেস জরডান। কিশোরের দিকে তাকিয়ে জোর করে মুখে হাসি ফোটাল মিরিনা। অসহায়ের হাসি।

জোরে জোরে হাঁটছেন মিসেস জরডান। তাঁর পোশাকের দিকে তাকিয়ে রয়েছে কিশোর। পোশাকের ঝুলটুল সব মিলিয়ে বিচিত্রই লাগছে। আলখেল্লার সঙ্গে অনেক মিল রয়েছে। ওপরের পোশাকের নিচে আরেকটা পোশাক রয়েছে মহিলার। আলখেল্লার মত অনেকটা।

সেদিকে তাকিয়ে কিশোর ভাবছে, লাল আলখেল্লা পরে যে এসেছিল স্টলের কাছে, তাকে পুরুষ হতেই হবে, এমন কোন কথা নেই।

১১

হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকল কিশোর। মূসা আর রবিনের ঘুম তখনও পুরোপুরি ভাঙেনি। শব্দ শুনে দুজনেই চোখ মেলে তাকাল। কিশোরের হাতের কমিকগুলো দেখে পুরো সজাগ হয়ে গেল।

খাইছে! বিছানায় উঠে বসতে বসতে বলল মুসা, কোথায় পেলে?

পানির কাছে। খুলে বলতে যাচ্ছিল কিশোর, তার আগেই ফোন বাজল।

জ্বালাল! গিয়ে রিসিভার তুলল মুসা। কানে ঠেকিয়ে শুনে ভুরু উচু হয়ে গেল। রবিনের দিকে তাকিয়ে বলল, তোমার আব্বা।

উঠে এসে রিসিভার নিয়ে কানে ঠেকাল রবিন। বাবা, কি ব্যাপারও, তাই নাকি?..আচ্ছা, দেখি… রিসিভার নামিয়ে রেখে বন্ধুদের দিকে ফিরে বলল, মিস্টার বার্টলেট লজ। ভ্যান নুইজে একটা ব্যান্ড পার্টি হবে, একটা ক্যাসেট পাঠাবেন, সেজন্যেই বাড়িতে ফোন করেছিলেন আমাকে। যেতে হবে।

দিয়ে আসতে হবে নাকি আমাকে? মূসার প্রশ্ন।

যদি দয়া করো, হেসে বলল রবিন।

আমিও আসছি তোমাদের সঙ্গে, কিশোর বলল। যেতে যেতে বলব সব।

আচ্ছা। আবার রিসিভার তুলে ডায়াল শুরু করল রবিন। মিস্টার লজকে ফোন করে বলল, এক ঘণ্টার মধ্যেই আসছে সে।

কয়েক মিনিটেই তৈরি হয়ে ঘর থেকে বেরোল তিনজনে। নিচে নামার জন্যে রওনা হলো এলিভেটরের দিকে। ৩১৪ নম্বর ঘরের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় দরজা খুলে গেল। বেরিয়ে এল একজন লোক। শজারুর কাঁটার মত খাড়া খাড়া চুল। হাতে কার্ডবোর্ডের একটা বড় বাক্স। কাঁধের ওপর দিয়ে ফিরে ভেতরে তাকিয়ে বলল, আচ্ছা, চলি। নিচে নিয়ে যাচ্ছি এগুলো।

লোকটা ওদের পেছনে পড়ে গেল। এলিভেটর এল। উঠে পড়ল তিন গোয়েন্দা। ডেকে বলল লোকটা, অ্যাই, দাঁড়াও, চলে যেও না।

ওপেন লেখা বোতামটা টিপে দিল মুসা।

ভেতরে ঢুকল লোকটা। থ্যাংকস। এই জিনিস নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা যায় না। বাপরে বাপ, পাথর!

বাক্সটা পিছলে গেল। খসে পড়ে যাচ্ছিল। তাড়াতাড়ি হাত বাড়িয়ে ধরে ফেলল কিশোর। এই সুযোগে ভেতরে তাকানোর সুযোগ হয়ে গেল। ভিডিও টেপে বোঝাই।

আরেকবার ধন্যবাদ দিল লোকটা। জিজ্ঞেস করল, লবিটা একটু টিপবে, প্লীজ?

মাথা ঝাঁকাল কিশোর। টিপে দিল বোতামটা।

লবিতে এলিভেটর থামতেই আর যাতে পিছলাতে না পারে এমন ভাবে বাক্সটা শক্ত করে ধরে বেরিয়ে গেল লোকটা। তিন গোয়েন্দা রয়ে গেল। আন্ডারগ্রাউন্ড গ্যারেজে নামবে ওরা।

বেলা বেশি হয়নি। রাস্তায় যানবাহনের ভিড় কম। দ্রুত গাড়ি চালিয়ে চলে এল ওরা রকি বীচে বার্টলেট লজের অফিসে। বাড়িতেই অফিস করেছেন তিনি। ওরা থামতে না থামতেই ভেতর থেকে বেরিয়ে এলেন ট্যালেন্ট এজেন্ট, পরনে ফুটবল খেলোয়াড়ের জারসি, চোখে সানগ্লাস। ব্যায়াম করতে যাচ্ছিলেন। রবিনকে দেখে বললেন, এসেছ। এক মিনিট। আসছি। আবার ভেতরে চলে গেলেন তিনি। বেরিয়ে এলেন ছোট একটা প্যাকেট নিয়ে। সেটা রবিনের হাতে দিয়ে বললেন, ঘুম থেকে জাগিয়েছে আমাকে ক্লাবের মালিক। এটা চায়। দিয়ে আসতে পারবে? হাই তুললেন তিনি। বলো, সারা রাতে কাজ করে এত সকালে ওঠা যায়? ব্যবসাটাই নিশাচরদের।

যেন তার হাইয়ের জবাবেই হাই তুলল মুসা। রবিনও। দেখে হেসে ফেললেন তিনি। বাহ্, তোমাদেরও দেখি একই অবস্থা! জেগে ছিলে নাকি সারারাত? জবাবের অপেক্ষা না করেই রবিনকে বললেন, প্যাকেটের গায়ে ঠিকানা আছে। যেতে বেশিক্ষণ লাগবে না। কিছু মনে করে না। আর কাউকে…

বাধা দিয়ে মুসা বলল, না না, ঠিক আছে।

প্যাকেটে গানের টেপ রয়েছে, ক্লাবের মালিকের দরকার। পৌছে দিতে বেশিক্ষণ লাগল না ওদের। স্যান ডিয়েগো ফ্রিওয়ে ধরে আবার লজ অ্যাঞ্জেলেসে ফেরার সময় ট্রাফিকের ভিড় দেখতে পেল।

ফ্রিওয়ে থেকে সরে এল মুসা। বিকল্প রাস্তা হিসেবে বেছে নিল সেপুলভেড়া বুলভারকে। সান্তা মনিকার ভেতর দিয়ে যাওয়ার সময় আবার রাস্তা বদল করে পিকো ধরে চলল সে।

কি হলো? জিজ্ঞেস করল রবিন, যাচ্ছ নাকি কোথাও?

এলামই যখন, জবাব দিল মুসা। আরেকবার ম্যাড ডিকসনের দোকানটা ঘুরে যেতে চাই। কাল রাতের একটা ব্যাপার খচখচ করছে মনের মধ্যে।

পুরানো একটা সবুজ ভ্যানের কাছে এসে গাড়ি রাখল সে। সেই গাড়িটাই, আগের দিন যেটাতে করে কমিক নিয়ে গিয়েছিলেন ডিকসন।

কাল রাতে একটা ভ্যান আরেকটু হলেই চাপা দিয়ে মেরে ফেলেছিল আমাদেরকে, নিজেকেই যেন বলছে মুসা। আমার কাছে তখন অন্য রকম রঙ লেগেছে। কিন্তু কিশোর বলল সবুজ, তাই একবার দেখতে এলাম।

লস অ্যাঞ্জেলেসে সবুজ ভ্যান অনেক আছে, কিশোর বলল।

কিন্তু একটা সূত্র আছে আমাদের হাতে। গাড়ি থেকে নেমে ঘুরে গাড়ির সামনের দিকে চলে গেল মুসা। ফিরে এল একবার দেখেই। গম্ভীর হয়ে মাথা ঝাঁকাল, আমাদের সাইক্লপসকে পেয়েছি। একটা হেডলাইট ভাঙা।

বাকি পথটা আলোচনা করল ওরা ব্যাপারটা নিয়ে।

তার মানে, রবিন বলল, কাল রাতে আমাদের ঘরে ঢুকেছিলেন ডিকসনই। কেন? আমরা তো তাঁর হয়েই কাজ করছি, তাই না? তিনি আমাদের মক্কেল।

হতে পারে, কিশোর বলল, আমাদেরকে একটা কভার হিসেবে ব্যবহার করছেন তিনি।

ঝট করে তার দিকে ফিরল রবিন। তীক্ষ্ণ হয়ে উঠেছে দৃষ্টি। তুমি বলতে চাইছ, তিনিই কমিকগুলো চুরি করেছেন, আমাদের বোকা বানিয়েছেন, কাজে লাগিয়ে দিয়ে সবাইকে দেখাতে চেয়েছেন তিনি নিরপরাধ। যাতে কেউ সন্দেহ করতে না পারে! মাথা ঝাঁকাল সে। চমৎকার একটা মোটিভও রয়েছে তার। বিজ্ঞাপন।

ডিকসনের স্টলের ডাকাতির কথা কনভেনশনে আসা প্রতিটি মানুষ শুনেছে, কিশোর বলল। বাজি রেখে বলতে পারি, সবাই ওরা স্টলে গিয়েছে দেখার জন্য।

একমত হয়ে মুসাও মাথা ঝাঁকাল। হ্যাঁ। এবং এটাই চেয়েছিলেন ম্যাড। তৈরি থেকেছেন ওদের জন্যে। কাল আরও কত বই আনিয়েছেন, মনে আছে? ভ্রূকুটি করল সে। কিন্তু ডাকাতির সময় স্টলেই ছিলেন। তিনি ক্রিমসন ফ্যান্টম নন।

না। কিন্তু তাঁর সহকারী থাকতে বাধা কোথায়? কাজ শেষ করে লোকটাকে দ্রুত সরে পড়তে বলে রেখেছেন।

হ্যাঁ, এইবার মিলে যাচ্ছে খাপে খাপে, মাথা দোলাল মুসা। আর একটা প্রশ্ন। কোন্ লোকটাকে সহকারী বলে মনে হয় তোমার?

রবিন বলল, জেনেই যখন ফেলেছি, আর তাঁকে ব্যবসার সুযোগ দেব কেন? দুষ্ট হাসি ফুটল তার মুখে। চলো, তার ঘাম ছুটিয়ে দিই। হারিয়ে যাওয়া কমিকগুলো রহস্যময় ভাবে আবার আমাদের হাতে চলে এসেছে, সেটা জানলে ভিড়মি খেয়ে পড়বেন পাগল সাহেব।

হাসল কিশোর। কথাটা মন্দ বলোনি। তাঁর প্রতিক্রিয়া দেখেই অনুমান করতে পারব, কাজটা তিনিই করেছেন কি-না। আবার চোরের সন্ধানে বেরোতে হবে কি না আমাদেরকে। হোটেলের ঘর থেকে কমিকগুলো নিয়ে কনভেনশন ফ্লোরেই চলে যাব, চলো।

হোটেলে পৌছে নিজেদের ঘরে চলল ওরা। এই বার ৩১৪ নম্বর ঘরের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় লুই মরগান স্বয়ং বেরিয়ে এলেন। এই যে, তোমাদেরই খুঁজছিলাম! কথাটা কি সত্যি? মিরিনা জরডান নাকি চোরাই কমিকগুলো খুঁজে পেয়েছে?

সবগুলো নয়, কিছু, মরগানের কথায় হাসি চেপে রাখতে পারছে না কিশোর, কেবল আমাদেরগুলো। তাহলে যা আন্দাজ করেছিল, তা-ই ঠিক। মিসেস জরডান এভাবে বিজ্ঞাপনই করতে চেয়েছিলেন।

কিশোরের মনের কথা পড়তে পেরেই যেন মরগান বললেন, মিরিনার মা কিছুই বলছে না। তবে তার মেয়ের বিজ্ঞাপন হয়ে গেল ভালমত। যা-ই হোক, তোমাদের খুঁজছিল মহিলা। কমিকগুলোর জন্যে, ওগুলো হাতে নিয়ে ক্যামেরার সামনে দাঁড়াবে মিরিনা।

নাক ঘোঁত ঘোঁত করলেন তিনি। খবর পেয়ে ইতিমধ্যেই কয়েকজন সাংবাদিক হাজির হয়ে গেছে। মিসেস জরডানের ভাবসাব দেখে মনে হচ্ছে গন উইথ দ্য উইন্ডের মত আরেকটা ছবি তৈরি করতে যাচ্ছেন তিনি।

লোকের ভিড় জমে যাবে তো হোটেলে! কিশোর বলল। মিরিনাকে দেখার জন্যে…

এটাই চেয়েছেন মহিলা। কি করে কাজটা করলেন তিনি, জানি না, ম্যানেজারকে রাজি করিয়ে ফেলেছেন। তার মেয়ের জন্যে আলাদা এলিভেটরের ব্যবস্থা হয়েছে, সাথে থাকবে ইউনিফর্ম পরা আর্দালি।

এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বললেন তিনি, ভাব একবার অবস্থাটা! এই হোটেলে ঢুকেছিল স্টারগার্লের সাধারণ মডেল হয়ে, ফেরত যাবে রীতিমত স্টার হয়ে।

এই সময় দেখা গেল মিরিনাকে। এলিভেটরের দিকে চলেছে। পরনে আবার সেই স্টেলারা স্টারগার্লের পোশাক। কিশোরের ওপর চোখ পড়তে অস্বস্তি ভরা হাসি হাসল। বুঝতে পারল কিশোর, মঞ্চ-ভীতিতে ধরেছে মেয়েটাকে। আরেকটা ব্যাপার, মিরিনা একা।

আমার মনে হয়, ব্যাপারটা মরগানও লক্ষ্য করেছেন, আগেই নিচে চলে গেছেন মিসেস জরডান। রিপোর্টারদের সঙ্গে আলাপ জমিয়েছেন। একটা বিষয়ে অন্তত শিওর হলাম, আগাগোড়া মিথ্যে বলেননি মহিলা।

ঘরে ফিরে গেলেন মরগান।

অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে কিশোর। ভাবছে। ঘটনাটা কি? এরকম করলেন কেন কনভেনশন চীফ? এটা তো তার সম্মেলনের জন্যেও একটা বিরাট বিজ্ঞাপন।

মিরিনাকে কমিকগুলো দেয়া যায়, কি বল? দুই সহকারীর মতামত জানতে চাইল কিশোর।

শ্রাগ করল শুধু মুসা। রবিন বলল, অসুবিধে নেই।

ঘরে ঢুকল ওরা। কমিকগুলো নিয়ে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এসে রওনা দিল এলিভেটরের দিকে।

ব্যক্তিগত এলিভেটরের সামনে তখনও দাঁড়িয়ে রয়েছে মিরিনা। নিঃসঙ্গ। পরনে নীল আলখেল্লাটা শেষ বারের মত টেনেটুনে ঠিক করল। এলিভেটরের দরজার দিকে এমন ভঙ্গিতে তাকাল, যেন আলিবাবার ডাকাতের পাহাড়ের দরজা খুলতে যাচ্ছে। ভেতরে গিয়ে ধনরত্নও পেতে পারে, আবার ডাকাতের তলোয়ারে মুন্ডও কাটা যেতে পারে।

ওর কাছ থেকে দশ ফুট দূরে রয়েছে কিশোর, এই সময় এলিভেটর এল।

মিরিনা, ডাকল কিশোর। মেয়েটা ফিরে তাকাতেই হাতের কমিকগুলো তুলে দেখাল।

কিশোরকে দেখে খুশি হলো মিরিনা। একা যেতে ভয় করছিল যেন। পরিচিত একটা মুখ দেখে সাহস পেল।

এবং এদিকে তাকিয়ে ছিল বলেই এলিভেটরের গোলমালটা চোখে পড়ল না তার। দরজা খুলে গেছে। ভেতরে উজ্জ্বল আলো থাকার কথা। অথচ আলোই নেই। অন্ধকার।

বেরিয়ে এল একটা হাত। আর্দালির নয়। ধরে, এক হ্যাঁচকা টান দিয়ে ভেতরে নিয়ে গেল মিরিনাকে।

১২

এলিভেটরের দিকে ছুটে গেল কিশোর। পেছনে রবিন আর মুসা। ওরা এসে পৌঁছতে পৌঁছতে দরজা বন্ধ হয়ে গেল। মাঝপথে আটকে গেল মিরিনার চিৎকার।

হাতে কমিকগুলো ধরাই রয়েছে। পাই করে ঘুরল কিশোর। ফ্যাকাসে হয়ে গেছে মুখ। দুই সহকারীকে বলল, এসো!

ঘোরানো লোহার সিঁড়িটার দিকে দৌড় দিল সে। আগের রাতে এটা দিয়েই পালিয়েছিল ওদের ঘরের চোর। এক টানে দরজা খুলেই ভেতরে ঢুকে পড়ল কিশোর। একেক লাফে দুতিনটে করে ধাপ পেরিয়ে নামতে লাগল।

তার সাথে পাল্লা দিতে মুসার অসুবিধে হল না, তবে রবিন পেরে উঠল না। পিছিয়ে পড়তে লাগল।

পা ব্যথা শুরু হয়েছে কিশোরের। মাংসপেশীতে খিচ ধরছে এভাবে নামতে গিয়ে। কেয়ার করছে না। তার এক চিন্তা, মিরিনাকে ধরতে পারবে তো? নামতে পারবে এলিভেটরের আগে?

অসম্ভবই মনে হলো। তবু হাল ছাড়ল না। গতি কমাল না। নেমে চলল একই ভাবে।

লবিতে পৌঁছেও থামল না কিশোর। টিভির সাংবাদিক সহ অনেকেই রয়েছে এখানে। এতগুলো মানুষের সামনে কিছুতেই বেরোবে না লোকটা মিরিনাকে নিয়ে। অন্য কোন তলায় নামারও সাহস করবে না। এলিভেটরের জন্যে অপেক্ষা করতে পারে যে কেউ দেখে ফেলার ভয় আছে।

লোকটার জন্যে একমাত্র নিরাপদ জায়গা হলো গ্যারেজে নামা।

সিঁড়ির শেষ কয়েকটা ধাপ যেন উড়ে নেমে এল কিশোর। আগের রাতের মতই গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল প্যানিক বারের ওপর। লোকটা বেরিয়ে গিয়ে মিরিনাকে নিয়ে গাড়িতে উঠে পরার আগেই ধরতে না পারলে…

এলিভেটর ব্যাংকের দিকে দৌড় দিল সে। ধস্তাধস্তি আর চিৎকারের চাপা শব্দ যেন মধুবর্ষণ করল তার কানে। এর অর্থ এখনও এলিভেটরের ভেতরেই রয়েছে মিরিনা। মুক্তির চেষ্টা করছে।

তুমি থামবে! ধমক শোনা গেল। গায়ে হাত তুলতে চাই না আমি। আমার জিনিসগুলো কোথায় লুকিয়েছ বলে দাও, ছেড়ে দেব।

পরিচিত কণ্ঠস্বর। দরজা খুলে বেরিয়ে এলে কিশোর দেখল, তার অনুমান ঠিক। মিরিনাকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে বেরিয়ে এলেন ম্যাড ডিকসন।

কমিক হাতে কিশোরকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে চমকে গেলেন তিনি। আপনাআপনি ঢিল হয়ে গেল মিরিনার গলা পেঁচিয়ে ধরা হাতের বাঁধন।

এটাই চেয়েছিল কিশোর। টেনে সরিয়ে আনল মিরিনাকে। এক ধাক্কায় ডিকসনকে ফেলে দিল কংক্রিটের দেয়ালের ওপর। দেয়ালে দুপ করে বাড়ি খেলো কমিক বিক্রেতার শরীর। ক্ষণিকের জন্যে অসাড় হয়ে গেল যেন।

টলমল করছে মিরিনার পা। শরীরের ভার রাখতে পারছে না যেন। একবার দুলে উঠেই পড়তে শুরু করল কাটা কলাগাছের মত।

কমিকগুলো হাত থেকে ছেড়ে দিয়ে তাকে ধরতে গেল কিশোর। এই সময় ঝাঁপিয়ে এসে পড়লেন ডিকসন। জুডোর প্যাচ কষার সময় নেই। সরাসরি ঘুসি মারল তাঁর চোয়ালে কিশোর। আবার গিয়ে দেয়ালে ধাক্কা খেলেন কমিক বিক্রেতা।

রবিন আর মুসা পৌঁছে গেছে। মিরিনাকে ধরল রবিন। মুসা এগোল কিশোরকে সাহায্য করতে। এগিয়ে গিয়ে দেয়ালের সঙ্গে চেপে ধরল ডিকসনকে।

পাশে চলে এল কিশোর। কমিক বিক্রেতার প্রায় কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে বলল, মেয়েমানুষের সঙ্গে ধস্তাধস্তি করার চেয়ে পুরুষমানুষের সঙ্গে করা অনেক কঠিন, তাই না?

মিরিনাকে আবার সোজা হয়ে দাঁড়াতে সাহায্য করল রবিন। ডিকসনকে ধরে রেখেছে মুসা। মিরিনার কাছে এসে কিশোর সান্তনা দিয়ে বলল, আর ভয় নেই। সব ঠিক হয়ে যাবে। ও আর কিছু করতে পারবে না তোমার।

ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে এল মিরিনা। তারপর হঠাৎই যেন কথাটা মনে পড়তে চিৎকার করে বলল, হায় হায়, ওরা আমার জন্য অপেক্ষা করছে! আম্মা আমাকে মেরে ফেলবে…

বিদ্যুৎ খেলে গেল যেন ওর শরীরে। রবিনের হাত থেকে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে ঝট করে বসে পড়ে কমিকগুলো কুড়াতে লাগল। তুলতে তুলতেই কিশোরের দিকে তাকাল একবার। অনেক ধন্যবাদ তোমাদের।…বলো তো, আমাকে কেমন দেখাচ্ছে? ক্যামেরার সামনে যেতে পারব?

ঠিকই আছে সব, রবিন বলল। পারবে।

যা ঘটল সেটা সবার সামনে আম্মাকে বলা যাবে না। যাই। তোমাদের সঙ্গে পরে দেখা করব।

কমিকের বই হাতে এলিভেটরের দিকে এগোল মিরিনা।

ডিকসনের দিকে নজর দিল আবার কিশোর। অনেক কথা বের করতে হবে পেট থেকে।

এভাবে আমাদের দেখে নিশ্চয় চমকে গেছেন, হেসে বলল রবিন।

চমকাব কেন? আরেক দিকে তাকিয়ে রয়েছেন ডিকসন। চুলগুলো আগের চেয়ে এলোমেলো, সত্যি সত্যিই এখন পাগল মনে হচ্ছে তাঁকে। মাথা নাড়তে লাগলেন। ঝাঁকুনি দিয়ে হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করলেন। কিন্তু মুসা কি আর ছাড়ে।

ও, চমকাননি, ব্যাঙ্গ করে বলল কিশোর। তা চমকাবেন কেন? কাল রাতে তো আর আপনি আমাদের ঘরে ঢোকেননি। আমরা যখন পিছু নিয়ে এখানে, নামলাম, তখন আমাদেরকে মারেনওনি।

কি বলছ বুঝতে পারছি না।

তা তো পারবেনই না, মুসা বলল। পেরেছেন কেবল ভ্যানে করে পালাতে। হেডলাইট ভাঙা সবুজ গাড়িটাতে চড়ে। চমৎকার একটা নাম দিয়েছি আমরা ওটার, জানেন। সাইক্লপস।

আমি..মানে…আমি…

মানে মানে না করে ঝেড়ে ফেলুন না, কিশোর বলল। নাকি,আমরাই বলে দেব কি কি অকাজ করেছেন। চুরি, খুনের চেষ্টা, অপহরণের চেষ্টা…

অভিযোগগুলো সব সত্যি নয়! গলা কাঁপছে ডিকসনের। শুনলাম, স্টারগার্লের পোশক পরা মেয়েটা কমিকগুলো খুঁজে পেয়েছে। ভাবলাম, সবই বুঝি পেয়েছে। তারপর শুনলাম, না, শুধু তোমাদেরগুলো পেয়েছে। ব্যাপারটা অদ্ভুত লাগল আমার কাছে।

রাগত ভঙ্গিতে চোখ মিটমিট করছেন তিনি। কমিকগুলো চুরি যাওয়ার আগে আমার স্টলের সামনে তাকে দেখেছি। তারপর হঠাৎ করেই কয়েকটা কমিক পেয়ে গেল সে। ধরেই নিলাম, সবগুলোই আছে তার কাছে। অল্প কয়েকটা বের করেছে। কাজেই তাকে একা ধরার জন্যে ওত পাতলাম। কোথায় কমিকগুলো লুকিয়েছে বের করার জন্যে। টাকা খাইয়ে কয়েক মিনিটের জন্যে আর্দালিটার কাছ থেকে এলিভেটরটা চেয়ে নিয়েছি। বের করে দিয়েছি তাকে।

একটা মুহূর্তের জন্যে কিশোরের মনে হলো, মিরিনাকে একা ছেড়ে দিয়ে ভুল করল না তো? কমিকগুলো নিয়ে পালাল? হয়তো মিরিনাই আসল চোর। পরক্ষণেই দূর করে দিল সন্দেহটা। কমিকগুলো দেখার পর মিরিনার চমকে যাওয়াটা অভিনয় হতেই পারে না। বলল, ভুল মানুষকে ধরেছিলেন আপনি, মিস্টার ডিকসন। কমিকগুলো পাওয়ার সময় আমি ছিলাম মিরিনার সামনে। কে জানি তার ব্যাগের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছিল।

উদভ্রান্ত দৃষ্টি ফুটল ম্যাডের চোখে। পাগলই হয়ে যাচ্ছেন যেন। অনুনয়ের সুরে কিশোরকে বললেন, চুরি করে কমিকগুলো নিয়ে গিয়ে মাথা খারাপ করে দিল আমার লোকটা। তোমরাও সুবিধে করতে পারলে না। বের করতে পারলে না ওগুলো। তখন আমিই খুঁজতে শুরু করলাম। কাল রাতে তোমাদের ঘরে সেজন্যেই ঢুকেছিলাম।

কিন্তু আমাদের ঘরে কেন ঢুকলেন? মুসার প্রশ্ন।

তোমরা যে আছ ওখানে, তা-ই জানতাম না। শুধু জানি, ওটা দিয়ে তিনশো চোদ্দ নম্বরে ঢোকা যায়, তাই ঢুকেছিলাম…

লুই মরগানের ঘরে ঢোকার জন্যে? ভুরু তুলল রবিন।

লুই মরগান! নিজের কপালে চাপড় মারল কিশোর। আজ সকালে ভিডিও টেপের বাক্স নিয়ে বেরোতে দেখলাম একটা লোককে, তার ঘর থেকে। তখনই মনে পড়া উচিত ছিল আমার, কোথায় দেখেছি লোকটাকে। সুমাতো কমিকের স্টলে গরম গরম কার্টুনের ভিডিও ক্যাসেট বিক্রি করছিল।

ডিকসনের দিকে তাকাল সে। কিছুটা শান্ত হয়ে এসেছেন ম্যাড, যেন বুঝতে পেরেছেন জ্যান্ত পোড়ানো হবে না আর তাকে, রেহাই পেয়ে গেছেন।

মরগানের সঙ্গে সুমাতো কমিকের সম্পর্ক কি, বলুন তো? জিজ্ঞেস করল কিশোর।

জায়গাটার মালিক সে, জবাব দিলেন ডিকসন। কেন, তুমি জানো না? এজন্যেই তো কনভেনশনটা করতে পেরেছে এখানে। বহুদিন ধরে কমিকের ব্যবসা করে আসছে লোকটা।

কমিকের ব্যবসা, আমনে বিড়বিড় করল কিশোর। কয়েকটা ছিন্ন সুতো জোড়া দেয়ার চেষ্টা চালাল মনে মনে। একটা ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে গেছে, ম্যাড ডিকসন চুরিটা করেননি।

ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল কিশোর। একজন সন্দেহভাজন কমল। তবে রহস্য যেখানে ছিল, মোটামুটি সেখানেই রয়ে গেছে। সমাধান হয়নি।

আরেকটা প্রশ্ন করা দরকার ডিকসনকে। ফ্যান ফানের একটা কপি চুরি যাওয়ার পর আরেকটা যেটা এনে রাখা হল তার জায়গায়, সেটাতে প্রাইস ট্যাগ দেখলাম দুশো পঞ্চাশ ডলার। অথচ যেটা চুরি গেছে সেটা যখন কিনতে এলেন নীল বোরাম, দাম চাইলেন ছশো ডলার, এবং তাতেই তিনি কিনতে রাজি হয়ে গেলেন। কেন? ওটার এত বেশি দাম হওয়ার কারণ কি?

কালো ছায়া নামল ম্যাড ডিকসনের মুখে। ওটাতে আইজাক হুফারের সই ছিল। আসল আইজাক হুফার। সংগ্রাহকের জিনিস। কারও পছন্দ হলে যত দাম হকতাম, তত দিয়েই কিনে নিত।

১৩

অটোগ্রাফ দেয়া? কিশোর বলল, আমি কমিক সংগ্রহ করি না, তার পরেও আমি জানি আইজাক হুফার কোন ক্রিমসন ফ্যান্টম বইতে সই করেনি। এডগার ডুফার আমাকে সমস্ত গল্প বলেছে। আমি নিজের চোখে দেখেছি, হুফার সই করেনি।

তুমি ঠিকই বলেছ, ডিকসন বললেন। গোঁফের নিচে দেখা দিল এক চিলতে হাসি। তবে সে যাতে সই করেছে, তাতে ছিল ফ্যান ফান আর গ্রে ফ্যান্টম। ক্রিমসন ফ্যান্টমের অনেক আগে আঁকা হয়েছিল ওই কমিক। আমার মনে হয়, বোরামের সঙ্গে গন্ডগোলের আগে ওই অটোগ্রাফ দিয়েছিল হুফার। হঠাৎ করেই মিলিয়ে গেল হাসিটা। চুরি করে নিয়ে গেল শয়তান চোরটা।

চিন্তিত ভঙ্গিতে নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটল একবার কিশোর। হুফারকে ওটা দেখানোর সুযোগই আপনি পাননি, তাই না?

মাথা নাড়ল ডিকসন। বইটা চুরি হওয়ার আগে দেখাই হয়নি ওর সঙ্গে আমার। আর যখন হলো, তখনও তার সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পেলাম না। বরং জড়িয়ে গেলাম ডুফারের সঙ্গে।

কেশে গলা পরিষ্কার করলেন ডিকসন। তিন গোয়েন্দার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তো, আমাকে নিয়ে কি করবে?

কাল রাতের কথা জিজ্ঞেস করছেন তো? কিশোর বলল, ওই যে, যে সব ছোটখাট শয়তানিগুলো করলেনঃ জোর করে লোকের ঘরে ঢোকা, মারধর করা, গাড়ি চাপা দেয়ার চেষ্টা, এসব?

হ্যাঁ, ঘামতে শুরু করেছেন ডিকসন। ওগুলোর কথাই বলছি।

শ্রাগ করল কিশোর। আমরা অভিযোগ করব না। আপনি হেডলাইটটা ঠিক করে নিন। থানায় গিয়ে বড়জোর একটা এন্ট্রি করিয়ে নিতে পারেন, বাড়ি লেগে ওটা ভেঙেছে।

স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন ডিকসন।

কিন্তু রবিন আবার চিন্তায় ফেলে দিল তাঁকে। বলল, তবে মিরিনা যদি পুলিশকে রিপোর্ট করে, বিপদে পড়বেন। আমাদের না জানিয়ে হয়তো যাবে না। কিন্তু যদি যায়, কি বলবেন পুলিশকে, ভেবে ঠিক করে রাখবেন।

কিশোর আশা করল, পুলিশের কাছে না যাওয়ার জন্যে বোঝাতে পারবে মিরিনাকে। তবে সেকথা বলল না ডিকসনকে।

শুকনো হাসি হাসলেন কমিক বিক্রেতা। দেখা যাক, কি হয়। আমি স্টলে যাচ্ছি। প্রয়োজন পড়লে ওখানে দেখা কোরো আমার সঙ্গে। পারলে মিরিনাকেও নিয়ে এসো। সব কথা তাকে বুঝিয়ে বলে মাপটাপ চেয়ে নেব, যাতে পুলিশের কাছে না যায়।

সেটাই করবেন, মুসা বলল। এলিভেটরের বোতাম টিপে দিয়ে কিশোরকে জিজ্ঞেস করল, এরপর কি করছি আমরা?

চলো, হুফারকে খুঁজি। অটোগ্রাফের ব্যাপারটা আলোচনা করা দরকার।

লবিতে উঠে এল ওরা। মেইন কনফারেন্স রুমের দিকে চলল। প্রবেশ পথের কাছে, টেবিলের সামনে কমিক ক্রেতাদের ছোট একটা লাইন। ওদের হাতে সিল মেরে দিচ্ছে দুই রঙা চুলওয়ালা মেয়েটা।

দ্রুত স্টলের দিকে চলে গেলেন ডিকসন। তিন গোয়েন্দা গেট পেরোতে যেতেই ওদেরকে আটকাল বিশালদেহী সেই দারোয়ান। সরি। হবে না।

হাতের ছাপ দেখাল কিশোর।

এটা তো কালকের, দারোয়ান বলল। মুছে গেছে। যাই হোক, চেষ্টাটা ভালই করেছিলে। পারলে না আরকি। আমাকে ফাঁকি দেয়া অত সোজা না।

মানি ব্যাগের জন্যে পকেটে হাত ঢোকাল কিশোর। দেখুন, টিকেটের পয়সা মারার কোন ইচ্ছেই আমাদের নেই। জানতাম না। আমরা মনে করেছিলাম, একদিন টিকেট করে নিলেই হবে।

কয়েক মিনিট পরে, হাতের উল্টোপিঠে ইন্টারকমিকন-২ ছাপ মেরে কনভেনশন রুমের ভেতরে ঢুকল তিন গোয়েন্দা। ভিড়ের ভেতর দিয়ে পথ করে এগোল।

কোথায় পাওয়া যাবে হুফারকে? মুসার প্রশ্ন।

টেবিলের কাছে গিয়ে দেখি, কিশোর বলল। ওখানে না পেলে দোকানদারদের জিজ্ঞেস করব। কেউ হয়তো বলতে পারবে।

হুফারের সীট খালি।

অনেককেই জিজ্ঞেস করা হলো-দোকানদার, হুফারের ভক্ত, কিন্তু কেউ বলতে পারল না লোকটা কোথায় আছে। এমনকি অন্যান্য আর্টিটেরাও জানে না ও কোথায় আছে। পেন্সিল দিয়ে ওয়াকি উডেন্টের ছবি আঁকছেন একজন বৃদ্ধ আটিস্ট। প্রশ্ন শুনে বললেন, একটু আগে তো ছিল। কোথায় যে গেল…কিছুই বলে যায়নি।

এবার? কিশোরকে জিজ্ঞেস করল রবিন।

এসব ক্ষেত্রে, মাথা চুলকে জবাব দিল কিশোর, হোটেলের রিসিপশনিস্টকে জিজ্ঞেস করলে ফল পাওয়া যায়।

না, মাথা নেড়ে বলল রিসিপশন ক্লার্ক, এখন তার সঙ্গে দেখা করতে পারবে না। জরুরি একটা মীটিঙে রয়েছেন।

কখন দেখা করা যাবে, জানতে চাইল কিশোর। বলেছেন কিছু?

হয়তো আজ বিকেলে কোন এক সময়, জানাল রিসিপশনিস্ট।

তার জন্যে কি একটা মেসেজ রেখে যেতে পারব? রিসিপশনিস্ট সম্মতি জানালে তার কাছ থেকেই কাগজ আর কলম নিয়ে নোট লিখে ভাঁজ করে, সেটা দিয়ে বলল, মুখে বলবেন, আমরা তার সঙ্গে ম্যাড ডিকসনের স্টলে দেখা করব।

হুঁ, মাথা দুলিয়ে মুসা বলল, এখন আমরা জানি, বিকেলটা কোথায় কাটাতে হবে।

আবার কনভেনশন হলে ফিরে চলল ওরা। ওদেরকে দেখে অস্বস্তি ফুটল ডিকসনের চোখে। মেয়েটা এল না?

কথা বলিনি এখনও। কোথায় গিয়েছিল, জানাল কিশোর। ডিকসনকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল, ভাববেন না, ব্যবস্থা একটা হবেই।

এই সময় একটা ছেলেকে আসতে দেখা গেল। বিরাট একটা বাক্স হাতে, কিশোর যে বাক্সটা এনেছিল, তার চেয়ে অন্তত তিন গুণ বড়। ভারের চোটে বাঁকা হয়ে গেছে ছেলেটা, হাঁটতে পারছে না ঠিকমত। ওদেরকে বললেন ডিকসন, আমার ব্যবসা আসছে মনে হয়।

টেবিলের সামনে এসে বাক্সটা মেঝেতে নামিয়ে রাখল ছেলেটা। চোখে সন্দেহ নিয়ে তাকাল ডিকসনের দিকে। টেবিলে হেলান দিয়ে মৃদু হাঁপাতে লাগল ছেলেটা। স্লাইম ম্যান নম্বর ওয়ান আছে? দ্য আউরেজিয়াস ওজনের নম্বর ওয়ান এবং নম্বর টু পেয়ে গেছি। স্নাইম ম্যানটা দরকার।

মাথা ঝাকালেন ডিকসন, আছে।

পেছনের র্যাক থেকে স্নাইম ম্যানের একটা কপি নামাতে গেলেন তিনি। ছেলেটা বাক্সটা তুলে ধপাস করে ফেলল টেবিলের ওপর। এ কমিকটা ছেলেটার হাতে দিতে গিয়েই চিৎকার করে উঠলেন ডিকসন, ধর, ধর! তবে কিছু করার আগেই পড়ে গেল কোলপসিবল টেবিলটা।

দূর, কাণ্ডটা কি করলাম! দাঁড়ান, আমি ঠিক করে দিচ্ছি, বলে হাঁটু গেড়ে বসে বই তুলতে শুরু করল ছেলেটা।

ডিকসন আর তার সহকারী মিলে আবার টেবিলটা খাড়া করতে লাগলেন।

জমাতে জমাতে এক জায়গায় কমিকের স্তূপ করে ফেলল ছেলেটা। তারপর নিজের বাক্সটা ঠেলে সরাতে গেল।

পা দিয়ে আটকালেন ডিকসন। এক মিনিট। বলেই বাক্সের ডালা ফাঁক করে ভেতর থেকে বের করে আনলেন একটা স্লইম ম্যানের কপি। এটা আমার। ওখানে গেল কি করে? ছেলেটার মুখের কাছে বইটা নাড়তে নাড়তে বললেন, এবার ছেড়ে দিলাম, যাও। আর যদি এদিকে দেখি ঠ্যাঙ ভেঙে দেব।

বিরাট বোঝাটা তুলে নিয়ে দ্রুত সরে পড়ল ছেলেটা, বোঝার তুলনায় খুব তাড়াতাড়ি গেল।

সেদিকে তাকিয়ে আনমনে বিড়বিড় করে বললেন ডিকসন, ভাল করে দেখা উচিত ছিল। আমার আরও বই নিয়ে গেছে কি-না কে জানে! এই জন্যেই, বুঝলে, তিন গোয়েন্দার দিকে তাকিয়ে বললেন, দামি জিসিনগুলো পেছনে সরিয়ে রাখি, হাতের কাছ থেকে দূরে। চোরের অভাব নেই। তিক্ত হাসি হাসলেন। একটা চোরকেও কিছু না বলে ছেড়ে দিলাম। অথচ আমাকেই চোর ভাবে ডুফার, গলাকাটা ডাকাত ভাবে!

এডগার ডুফারের নাম শুনে ঝট করে একটা কথা মনে পড়ে গেল কিশোরের। লোকটার ওপর থেকে সন্দেহ দূর হয়ে গেল তার। টেবিলটা পড়ে যাওয়া থেকেই বুঝেছে। লাল আলখেল্লার আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে আসতে পারলেও বিশাল বপু নিয়ে ওই টেবিল ডিঙিয়ে যেতে পারবে না সে কোনমতেই। তাহলে অবশ্যই ধসে পড়ত টেবিলটা। তাহলে কে কাজটা করল? মিসেস জরডান?

অ্যাই যে, তোমরা এখানে।

ফিরে তাকাল কিশোর। হাতে একগাদা কমিক বুক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মিরিনা। বলল, এখানেই পাব জানতাম। ভাবলাম, ফেরত দিয়েই যাই।

থ্যাংকস। মিরিনার হাত থেকে কমিকগুলো নিল কিশোর। সাক্ষাৎকার কেমন হলো?

ভাল। আম্মা বলল, এতদিনে নাকি আমি কিছু শিখতে পেরেছি। সাংবাদিকদেরকে অপেক্ষা করিয়ে রেখে ভাল করেছি। এরকমই নাকি করতে হয়, তাতে দাম বাড়ে। আমার দেরি হওয়ার আসল কারণটা যদি জানত… ডিকসনের ওপর চোখ পড়তে থেমে গেল সে।

কমিক গোছাচ্ছেন ডিকসন। হাত কাঁপছে। তাকাতে পারছেন না মিরিনার দিকে। হঠাৎ কেন কথা থামিয়ে দিয়েছে বুঝতে অসুবিধে হয়নি। বললেন, মিরিনা, আমি দুঃখিত, সত্যিই দুঃখিত! বড় অন্যায় করে ফেলেছি!

নরম হয়ে গেল মিরিনা। না না, আমি কিছু মনে করছি না! ভুল হয়েই যায় মানুষের। কিশোরের দিকে তাকাল সে। কিশোর, তোমাকে ধন্যবাদ দেয়া হয়নি তখন। সাংঘাতিক ছেলে তুমি, বাব্বাহ! বলে ওর হাত চাপড়ে দিল সে।

লাল হয়ে গেল কিশোর। এরকম খোলাখুলি প্রশংসায় লজ্জা পায় সে তার ওপর করেছে একটা মেয়ে। ঢোক গিলে বলল, ও কিছু না…আমি…আমরা… চুপ হয়ে গেল সে। দেখল, ওর দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে রবিন আর মুসা। মেয়েদের ব্যাপারে কিশোরের অস্বস্তির কথাটা জানা আছে ওদের।

ওকে আরও অস্বস্তিতে ফেলে দিল মিরিনা। বলল, ফাইট করতে পারো বটে তুমি! কিশোরের হাত ধরে বলল, এসো না, আজ একসঙ্গেই লাঞ্চ খাই? কিশোরের নীরবতাকে সম্মতি ধরে নিয়ে বলল সে, তাহলে ওই কথাই রইল। হোটেলের সাইড গেটের কাছে বাগানে তোমার জন্যে অপেক্ষা করব আমি। বিশ মিনিটের মধ্যে।

চলে গেল মিরিনা।

দুই বন্ধুর দিকে তাকিয়ে মাথা চুলকে কিশোর বলল, কি করা যায়, বলো তো? ও আমাকে একা যেতে বলল!

কি আবার, রবিন বলল। যাবে। কথা বলার এটাই তো সুযোগ। দেখো না, কিছু বের করতে পারো কি-না।

ঠিক, মুসাও একমত। লাল আলখেল্লার সঙ্গে কোন যোগাযোগ থেকে থাকলে…

বেশ,… বিড়বিড় করে আরও কিছু বলল কিশোর, বুঝতে পারল না অন্য দুজন। রওনা হলো নিজেদের ঘরের দিকে, কমিকগুলো রেখে আসার জন্য।

পোশাক বদলে এল মিরিনা। পরনে শর্ট, গায়ে টি-শার্ট, মাথায় উইগ নেই, বেরিয়ে আছে খাট বাদামি চুল। স্বাভাবিক লাগছে তাকে এই পোশাকে, আরও বেশি সুন্দর।

বাহ্, দারুণ লাগছে তোমাকে, প্রশংসা করল কিশোর। এটাই কি তোমার আসল রূপ?

হাসল মিরিনা। কেন, আরও কিছু আছে ভাবছ নাকি? কিশোরের হাতের ভাঁজে হাত ঢুকিয়ে দিয়ে তাকে সাইডওয়াকের দিকে টেনে নিয়ে চলল সে। পোশাক তো না, পাগলামি! আহ, বাচলাম!

পাশাপাশি হাঁটছে দুজনে।

আবার বলল মিরিনা, কাছেই একটা রেস্টুরেন্ট আছে। বার্গার আর সালাদ খুব ভাল করে। ওখানে গিয়ে আরামে বসতে পারব আমরা, স্টেলারা স্টারগার্লের ব্যাপারে কেউ মাথা ঘামাবে না।

প্রচুর আলোবাতাস রয়েছে রেস্টুরেন্টটার ভেতরে। চারদিকে প্রচুর কাচ, ভেতরে অসংখ্য টবে গাছ। ভিড় কম। খাবারের অর্ডার দিল মিরিনা।

খাওয়ার ফাঁকে একসময় তিন গোয়েন্দার একটা কার্ড বের করে পড়ল। মুখ তুলে জিজ্ঞেস করল, তোমরা সত্যিই গোয়েন্দা? অপরাধী খুঁজে বেড়াও?

কিশোর বলল, বহু বছর ধরে একাজ করছি।

আর এর প্রতিষ্ঠাতা হলে গিয়ে তুমি। অন্য দুজন তোমার সহকারী।

মাথা ঝাঁকাল কিশোর। কাঁটা চামচের মাথায় গেঁথে তোলা মাংসের টুকরোটা খসে পড়ে গেল পিরিচে। আবার গেঁথে নিয়ে মুখে পুরে চিবাতে লাগল।

দারুণ একটা টিম তোমাদের, মিরিনা বলল। অনেক খোঁজখবর নিয়েছি তোমাদের ব্যাপারে। তুমি হলে দলটার মাথা। তোমার নিগ্রো বন্ধুটির গায়ে জোর বেশি, তাই তাকে দেয়া হয় সাধারণত বিপজ্জনক কাজের ভার। আর আমেরিকান বন্ধুটি বইয়ের পোকা, তাই বই ঘেঁটে তথ্য জোগাড় আর গবেষণার ভার পড়ে তার ওপর। ঠিক বলেছি না?

মাথা ঝাকাল কিশোর। হ্যাঁ, খোঁজখবর সত্যিই নিয়েছ।

তারপর কিছুক্ষণ প্রশ্ন করে গোয়েন্দাগিরির ব্যাপারে নানা কথা জেনে নিল মিরিনা। অবশেষে কাজের কথায় এল কিশোর, ওই অদ্ভুত পোশাক কেন পরো তুমি?

কঠিন প্রশ্ন করলে। চিবিয়ে মুখের খাবারটুকু গিলে নিল মিরিনা। এক ঢোক পানি খেলো। তারপর বলল, কমিক খুব পছন্দ আমার। কিন্তু আম্মা একদম দেখতে পারে না। হাতে দেখলেই বকাবকি করে। শেষে একদিন চোখ পড়ল স্টেলারা স্টারগার্লের ওপর। আমাকে দিয়ে মডেলিং করানর ভাবনাটা তখনই এল মাথায়।

তোমার কেমন লাগে মডেল হতে?

ভাল না। আমার ইচ্ছে কমিক আর্টিস্ট হওয়া।

হাসল কিশোর। স্নাইম ম্যানের ছবি আঁকবে?

আঁকলে ক্ষতি কি? তবে স্টেলারা স্টারগার্লকেই আমার বেশি পছন্দ।

আর কোন প্রশ্ন খুঁজে পেল না কিশোর। খাওয়া শেষ করে উঠল।

হোটেলের পাশের গেট দিয়ে আবার বাগানে ঢুকল দুজনে।

কিশোর বলল, ভাল খাবার খাইয়েছ। ধন্যবাদ।

আবার দেখা হবে, হাত বাড়িয়ে দিল মিরিনা। কাল পর্যন্ত থাকছ তো?

মিরিনার হাতটার দিকে তাকিয়ে রয়েছে কিশোর। কি যেন ভাবছে। তারপর ধীরে ধীরে হাত বাড়াল। বলল, কতদিন থাকব বলতে পারছি না। তবে এ কেসের সমাধান না হওয়াতক আছি, এটা বলতে পারি। চোখ আটকে গেল মিরিনার হাতের দিকে। আরি!

কী? হাতটা টেনে নেয়ার চেষ্টা করল মিরিনা। কিন্তু কিশোর ছাড়ল না। তাকিয়ে রয়েছে হাতের উল্টো পিঠের সিলটার দিকে।

কিশোর, কি হলো?

বিড়বিড় করছে কিশোর, আরও আগেই বোঝা উচিত ছিল! অনেক আগে!

ডাকাতির কথা বলছ?

আরেক হাতে মিরিনার হাতটা চাপড়ে দিয়ে কিশোর বলল, বলছি, ক্রিমসন ফ্যান্টমের কথা। শোক বম্বগুলো ফেলার সময় লোকটার দুটো হাতই আমি দেখেছি।

তাতে কি?

তাতে? অনেক কিছু। প্রথমেই বলা যায়, লোকটার কোন হাতেই সিল ছিল না।

১৪

মিরিনার হাত ধরে টানতে টানতে দরজার দিকে ছুটল কিশোর। রবিন আর মুসাকে একথা জানানো দরকার।

আহ, ছাড় না! হ্যাঁচকা টান দিয়ে হাতটা ছাড়িয়ে নিল মিরিনা। এই পোশাকে কনভেনশন ফ্লোরে যেতে পারব না আমি। কেউ আমাকে চিনে ফেলতে পারে। আর তাহলে আম্মা আমার…

ছাল ছাড়াবে, কথাটা শেষ করে দিল কিশোর। হাতে সিল না থাকাটা এমন কি জরুরি?

অনেক জরুরি। এতে প্রমাণ হয়, কাজটা করেছে ভেতরের কোন লোক। তুমি, আমি, দোকানদার, যে-ই ঢুকি না কেন, প্রবেশ মূল্য দিতে হয়, হাতে সিল মেরে নিতে হয়। নইলে দরজায় আটকে দেয় দারোয়ান। কিন্তু যে লোকটা বোমা ফেলল তার হাতে সিল না থাকলেও ঢুকতে পারল। কি করে? কেন তাকে আটকাল না দারোয়ান? একটাই কারণ, ও এখানকার লোক।

হুঁ, বুঝলাম, দ্বিধা করছে মিরিনা। লবিতে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে রয়েছে এলিভেটর ব্যাংকের দিকে। দেখ, এই কেসে তোমাদের আমি সাহায্য করতে চাই, যদি সম্ভব হয়। এখন ত আর আমাকে এড়াতে পারবে না, জড়িত হয়ে গেছি। ওপরে গিয়ে পোশাক বদলে আসি। ম্যাড় ডিকসনের দােকানের সামনে থেক, দেখা হবে।

তোমার সাথে আসব?

হাসল মিরিনা। দরকার নেই। এখন আর এলিভেটরে কিছু হবে বলে মনে হয় না। একাই যেতে পারব।

মেইন কনফারেন্স রুমের দিকে রওনা হলো কিশোর। কয়েকবার দেখা হয়েছে, ইতিমধ্যে তাকে চিনে ফেলেছে দারোয়ান, তার পরেও হাতের সিল না দেখে ছাড়ল না। ভিড়ের ভেতর দিয়ে সোজা ডিকসনের স্টলের দিকে এগোল সে। ওটার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে রবিন আর মুসা।

ওকে দেখেই বলে উঠল মুসা, কয়েক যুগ তো লাগল আসতে। লোরা স্টারগার্ল তোমাকে আরেক গ্যালাক্সিতে নিয়ে গিয়েছিল নাকি?

রবিন রসিকতা করল না। কিশোরের চেহারা দেখেই অনুমান করে ফেলেছে কিছু হয়েছে। কি ব্যাপার? ভুরু কোঁচকাল সে। ওখানেও রহস্য পেলে?

একটা সূত্র পেলাম, কিশোর বলল। শুনলে তোমাদেরও চোখ কপালে উঠবে। আইজাক হুফারের দেখা পেলে?

আমাকে কি দরকার? পেছন থেকে বলে উঠল হুফার। সময় মত এসে গেছি, তাই না? হাসল সে। এইমাত্র এলাম। একটা উৎসবের আয়োজন করব ভাবছি। জ্যাকেটের পকেটে চাপড় দিয়ে বলল, একটা কন্ট্রাক্ট আছে এখানে। নতুন একটা কমিকের জন্যে চুক্তি করে এলাম।

কে ছাপছে? সব কথাই কানে গেছে ডিকসনের।

হ্যাঁরিস ডিমলার। এ শহরেই আছেন। কনভেনশনে যোগ দিতে এসেছেন। দেখা হয়ে গেল। আমাকে নিয়ে গেলেন ঘরে। আলাপ-আলোচনা করে পছন্দ হলো, কাজ করতে রাজি হয়ে গেলাম। মীটিং থেকে চলে গিয়েছিলাম সে জন্যেই।

কাল ডাকাতির সময় কি সেখানেই ছিলেন? জিজ্ঞেস করল কিশোর।

মাথা ঝাকাল হুফার। হ্যাঁ। ওখান থেকে এসে কনভেনশন ফ্লোরে ঢুকে দেখি ধোঁয়া।

আপনার নতুন চুক্তির কথা কেউ জানে?

কেউ না। বকবক করে সবাইকে জানিয়ে দিয়ে মেজর মেহ্যামের বারোটা বাজাতে চাই না এখনই।

মেজর মেহ্যাম? ডিকসনের গোফ কাঁপছে। কি ধরনের হিরো হবে? মুষ্টিযোদ্ধা? ইনটেলিজেন্ট এজেন্ট? মারসেনারি? নাকি স্পেসম্যান?

তার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল হুফার। একটা কপি কিনে নিজেই পড়ে দেখবেন। আগে থেকেই বলতে যাব কেন? কিশোরের দিকে তাকাল সে। চুক্তির কথা কেউ জানে কি-না, এ প্রশ্ন করলে কেন?

কণ্ঠস্বর খাদে নামিয়ে কিশোর বলল, আপনার কি ক্ষতি করেছে, জানি আমি। সে কথাই ভাবছি- হবিগুলো নষ্ট করল, হামলা চালাল… যে করেছে, সে জানেই না, যে এখানে থাকার একটা জোরাল কারণ আছে আপনার।

সামনে ঝুকল রবিন। কিশোর, কেবল জটিল করে তুলছ সব কিছু। দয়া করে একটু সহজ করো। এমন ভাবে বলছ, যেন কেউ হুফারকে তাড়াতে চাই এখান থেকে।

ঠিক, তা-ই বলছি। হুফারের দিকে তাকাল কিশোর। এই চুক্তি না হলে কি এখনও এখানে থাকতেন আপনি?

না। এমনকি সেদিন বক্তৃতাও দিতাম না। আমি বুঝতে পেরেছি, ঘটনা কোনভাবে আঁচ করে ফেলেছে বোরাম, তাই তাকে আরেকটু খুঁচিয়ে  দিতে চেয়েছি। কিন্তু তুমি বললে…

কেউ জানে না আপনার চুক্তির কথা, কিশোর বলল। তাহলে মিস্টার ডিমলারের ওপরও হামলা চলত। বিরক্ত করা হত তাঁকেও। আঘাতটা শুধু আপনার ওপরই হয়েছে, হুফার। আমার বিশ্বাস এর সঙ্গে ফ্যান ফান চুরির ব্যাপারটার কোন সম্পর্ক আছে। থাকতেই হবে!

ভিকসনের দিকে তাকাল কিশোর। অটোগ্রাফের কথা জিজ্ঞেস করছেন না কেন?

অটোগ্রাফ? সতর্ক হয়ে উঠলেন হুফার। কোন কিছুতে সই করতে বলবেন তো…

সই করে দিয়েছেন, এমন কিছুর কথাই বলব, ডিকসন বললেন।

যদি হুফার করে থাকেন আরকি, মাঝখান থেকে বলল কিশোর।

মানে? হুফারের চোখে সংশয়।

আমি দেখেছি, আপনি ক্রিমসন ফ্যান্টমে সই করেননি। পুড়িয়ে ফেলতেও দেখেছি। আপনার হিরোয়িক কমিক আমলের কোন কিছুতেই সই আপনি আর করতে চান না।

ও, সবই দেখেছ তাহলে। কোন কিছুই চোখ এড়ায় না। খেপামি ভাবতেই পার। তবে কেন এই খেপামি করি কারণটা জানলে আর ওরকম ভাববে না। হিরোয়িক কমিক, বিশেষ করে নীল বোরাম আমার সর্বনাশ করে দিয়েছে।

জানি আমরা, কিশোর বলল। এডগার ডুফার সবই বলেছে আমাদের।

পকেটে দুই হাত ঢুকিয়ে দিল আটিস্ট। তার মানে কোন কথাই আর গোপন থাকে না। যা-ই হোক, বুঝতেই পারছ কেন আর আমি ওদের প্রকাশিত কোন কিছুতে সই করি না। আমি সই দিয়ে ওদের ব্যবসা কেন বাড়াব?

সব সময় তো ওদের ওপর খাপ্পা ছিলেন না, ডিকসন বললেন। সে সময় নিশ্চয় সই করতেন।

হেসে উঠল হুফার। সে সময় এত কাজ আমাকে দিত হিরোয়িক কমিক, করতে করতেই জানা বেরোত, সম্মেলনে যোগ দেয়ার আর সময় পেতাম না। সই করব কি?

তার আগে? ফ্যান ফানের আমলে?

গ্রে ফ্যান্টমের কথা বলছেন? মাথা নাড়ল হুফার, না, তখনও দিইনি। এতটা বিখ্যাত হইনি তখনও যে লোকে আমার অটোগ্রাফ চাইতে আসবে।

যা-ই হোক, আপনি নিশ্চয় কথাটা ভুলে গেছেন। একআধটা সই করেই থাকতে পারেন। কাউকে উপহার দেয়া কোন কপিতেঃ মাকে দিতে পারেন, বোনকে দিতে পারেন, বন্ধুকে…কিংবা যেখানে কাজ করতেন সেখানকার কাউকে…

মনে করতে পারছি না। ভুরু কোঁচকাল হুফার। কেন? এটা নিয়ে এত প্রশ্ন কেন?

আপনার সই দেয়া ফ্যান ফানের একটা কপি ছিল আমার কাছে, জোর দিয়ে বললেন ডিকসন।

থাকতেই পারে না, ঠিক একই রকম জোর দিয়ে বলল হুফার। আমি ফ্যান ফানের কোন কপিতে সই করিনি।

দেখুন, আপনার নামটাই ছিল। স্পষ্ট পড়া যায়। যে পৃষ্ঠা থেকে গল্প শুরু হয়েছে…

চোখের পাতা সরু হয়ে এল হুফারের। দেখলে বুঝতে পারতাম।

তা আর পারবেন না। কপিটা চুরি হয়ে গেছে। ডিকসনের দিকে তাকাল হুফার। সইটা দেখতে কেমন, বলতে পারবেন? এখন আমার সই অনেক বদলে গেছে, তখনকার সঙ্গে মিলবে না। ইদানীংকার কোন সই থেকে জাল করতে গেলে ধরা পড়ে যাবে, অন্তত আমি দেখলে বুঝে ফেলব। আমি সই করিনি ওরকম কোন কপিতে, এটা বলতে পারি। মনে থাকতই…

হয়তো মনে করতে চান না এটার কথা। আমি শিওর হচ্ছি, তার কারণ, যে লোকটা ওই কপি আমার কাছে বিক্রি করেছে, সে আপনার সই ভালমতই চেনে।

কে লোকটা? জানতে চাইল মুসা।

নীল বোরাম।

চোখে অবিশ্বাস নিয়ে ডিকসনের দিকে তাকাল তিন গোয়েন্দা।

ওই শয়তানটা! ফেটে পড়ল হুফার। তার কপিতে দেব আমি সই!

দিতেই পারেন। একটা সময় তো বন্ধুত্ব ছিল আপনাদের। যখন একসঙ্গে কাজ করতেন, ডিকসন বললেন।

কোন কালেই ওর সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব ছিল না, তিক্ত কণ্ঠে বলল হুফার। ওটা একটা ধাড়ি শয়তান, আর আমি ছিলাম অল্পবয়েসী, তার তুলনায় কচি খোকা, যাকে ঠকানোর সুযোগ পেয়েছিল সে। আমাকেই বরং একটা অটোগ্রাফ দিয়েছিল একবার। হিরোয়িক কমিক ছাড়ার পর সেটা পুড়িয়ে ফেলেছি।

তাহলে বইটা পেলেন কোথায় বোরাম? রবিনের প্রশ্ন।

নীল-সোনালি রঙের ঝিলিক তুলে এই সময় সেখানে এসে হাজির হলো মিরিনা।

কিছু মিস করলাম না তো?

না, কিশোর বলল, সময়মতই এসেছ। আলাপটা সবে গরম হলো। নীল বোরামের কথা বলছি আমরা।

ওই হারামজাদার মুখে একটা ঘুসি মারতে পারলে এখন খুশি হতাম আমি! মুঠো তুলে ঝাঁকাল হুফার।

পারলে মারুনগে, আমি আপনাকে আটকাব না, ডিকসন বললেন। লোকটা আপনাকে যদি ঠকিয়েই থাকে, রাগ হবেই। হাজার হোক, আপনারটা ভাঙিয়ে তো আর কম খাচ্ছে না। একটা খবর নিশ্চয় জানেন, পুরানো জনপ্রিয় কমিকগুলো আবার ক্ল্যাসিক হিসেবে ছাপছে হিরোয়িক কমিক।

তার মানে, মুসা বলল। আমরা যেগুলো পড়তাম, সেগুলোই রিপ্রিন্ট করছে?

হ্যাঁ। ক্রিমসন ফ্যান্টম ক্ল্যাসিক খুব চড়া দামে বিক্রি হবে। ব্যাপারটা ডিকসনেরও পছন্দ নয়। এতে আসল বইগুলোর দাম অনেক কমে যাবে। যেগুলো আগে প্রকাশিত হয়েছিল। আমার কাছে অনেক আছে, যেখানে যা পেয়েছি কিনে ফেলেছি। লস দিতে হবে আমাকে।

বোরামের কাছে ফ্যান ফান বিক্রি করেননি কি এই রাগেই? জিজ্ঞেস করল কিশোর।

হ্যাঁ, তিক্ত হাসি ফুটল ডিকসনের ঠোঁটে। অনেক দিন ধরেই কেনার জন্যে আমার পেছনে লেগে ছিল সে। দিইনি।

নীল বোরামের সঙ্গে কথা বলা দরকার, বলল কিশোর। দেখি, তাঁর কি বলার আছে?

হিরোয়িক কমিকের এলাকায় পৌঁছল ওরা। আরেকটা প্রেস কনফারেন্স দিতে তৈরি হচ্ছে কোম্পানি। মিরিনার দিকে তাকিয়ে হাসলেন বোরাম। পেছনে কারা আসছে, দেখেই হাসিটা মুছে গেল মুখ থেকে।

হুফার! জোর করে পাতলা একটা হাসি দিলেন বোরাম। অভিযোগ করতে এসেছ তো আমার নামে? গালাগাল করবে?

না, জবাবটা দিল কিশোর। কয়েকটা কথা জিজ্ঞেস করতে এসেছি। আপনি যে বইটা কিনতে চেয়েছিলেন ডিকসনের দোকান থেকে, সেটার ব্যাপারে। মনে আছে নিশ্চয়? ফ্যান ফানের কপি। সংগ্রাহকের জিনিস।

কি বলছ বুঝতে পারছি না! টাকের চামড়া লাল হয়ে যাচ্ছে সম্পাদকের। চোখে অস্বস্তি। বার বার তাকাচ্ছেন ডিকসনের দিকে।

ফ্যান ফান নাম্বার ওয়ানের কপিটা, যেটা সেদিন কিনতে চেয়েছিলেন, মনে করিয়ে দেয়ার ভঙ্গিতে বলল কিশোর। মিস্টার ডিকসন বললেন, আপনিই নাকি তাঁর কাছে ওটা বিক্রি করেছিলেন।

তাতে কি? সম্পাদকের গালে দুটো লাল রক্তবিন্দু জমল। এটা কোন অভিযোগ নয়। কমিক আমি বিক্রি করেই থাকতে পারি। ওটাই আমার ব্যবসা। কিশোরের দিকে সরাসরি তাকালেন তিনি। নাকি চোর ভাবছ আমাকেই?

আরে না না, কি যে বলেন, তাড়াতাড়ি বলল কিশোর। বোমা যখন ফাটল, তখন আপনি ছিলেন ডুফারের সঙ্গে, গোন্ড রুমের বাইরে। আমরা কেবল জানতে এলাম, কপিটার জন্যে এত আগ্রহ কেন আপনার?

শুনতে চাও? আরও বেশি দামের অফার পেয়েছিলাম আমি কপিটার জন্যে। লাভের এই সুযোগ ছাড়ব কেন? তাই কিনতে গিয়েছিলাম। অন্যায় হয়েছে?

তা হয়নি। মিস্টার ডিকসন যা চাইলেন, তা দিয়েই আনলেন না কেন তাহলে? লাভ তো হতই।

না, হত না। দাম বাড়াতে বাড়াতে এমন এক পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল, বেচে লাভ হত না। তাই আর কিনিনি।

কে কিনতে চেয়েছিল? জিজ্ঞেস করল মুসা।

ঠোঁটে জিভ বুলিয়ে ভিজিয়ে নিলেন বোরাম।

চাইলেও এখন আর লোকটার কাছে কপিটা বিক্রি করতে পারছেন না, মিস্টার বোরাম, রবিন বলল।

সে পাট ঘুচে গেছে। কাজেই এখন বলতে আর অসুবিধে কি?

সুমাতো কমিক, ফাঁদে আটকা পড়েছেন যেন বোরাম, ভাবভঙ্গিতে সে রকমই লাগছে।

বইটা পেলেন কোথায়? হুফার জানতে চাইল। আমি তো দিইনি।

হাল ছেড়ে দিলেন বোরাম। বুঝলেন, মিথ্যে বলে সুবিধে হবে না আর। বললেন, সুমাতোর কাছ থেকেই নিয়েছিলাম।

কিশোর বলল, মিটার বোরামকে আর বিরক্ত করার দরকার নেই। চলো।

সারি বেঁধে স্টলটার কাছ থেকে সরে এল ওরা সবাই।

ভেরি, ভেরি ইনটারেসটিং, কিশোর বলল, ঘরের ইঁদুরেই বেড়া কেটেছে। একটা কোম্পানি, যে কমিকটা বিক্রি করেছে, হঠাৎ করে তারাই আবার ফেরত চাইছে ওটা। অবশেষে জোড়া লাগতে আরম্ভ করেছে এক এক করে। আর মাত্র কয়েকটা প্রশ্নের জবাব, তাহলেই আমাদের চোরটাকে ধরে ফেলতে পারব। রহস্যময় কণ্ঠে বলল সে। আমি এখন জানি, কোথায় খুঁজতে হবে তাকে।

১৫

দাঁড়াও, কিশোরের হাত ধরে ফেলল মিরিনা। আসলে কোথায় যাচ্ছি আমরা?

যেখান থেকে সমস্ত গোলমালের উৎপত্তি, জবাব দিল কিশোর। সুমাতো কমিকসের খানিক দূরে এসে দাঁড়িয়ে গেল সে।

ভিড়ের জন্যে কাছে যাওয়ার উপায় নেই। গায়ে গায়ে লেগে যেন মানুষের প্রাচীর তৈরি হয়ে গেছে।

ঢোকা যাবে? ভিড়ের দিকে তাকিয়ে রয়েছে রবিন।

যাবে, এদিকে তাকিয়ে বলে উঠল একটা ছেলে, লাল হয়ে গেছে চোখ, ঠেলাঠেলি করার পরিশ্রমেই বোধহয়। কাল ছিল তিরিশ, আজ নিজে কিনেছি, আজ হয়ে গেছে দশ। এখনি সব বিক্রি শেষ হয়ে যাবে।

তারপরেও দাম অনেক বেশি, নিচু গলায় বলল কিশোর। টেপের কথা বলছে ছেলেটা। অন্যান্য জিনিসের দামও কমিয়ে দেয়া হয়েছে জানা গেল। কেন? অবাক লাগছে কিশোরের। হঠাৎ করে কেন এভাবে দাম কমাল?

কারণটা জানার জন্যে এগিয়ে গেল সে। ভিড় ঠেলে ঢোকার চেষ্টা করল। কয়েক মিনিট একটানা মানুষের শরীরের চাপ আর কনুইয়ের গুতো খাবার পর বেরিয়ে আসতে পারল প্রাচীরের অন্যপাশে, কাউন্টারের কাছাকাছি। কমিক আর ভিডিও টেপ বিক্রি করে কুল পাচ্ছে না সেলসম্যানেরা। দাম কমে যাওয়ায় যেন পাগল হয়ে উঠেছে ক্রেতারা। কিনেই চলেছে। সোনালি, শজারুর কাঁটার মত চুলওয়ালা লোকটা জিজ্ঞেস করল কিশোরকে, কি দেব?

ইয়ে…লোরা স্টারগার্ল! প্রথম যে নামটা মনে এল বলে দিল কিশোর।

ভাল জিনিস চেয়েছ। অনেকগুলো আছে আমাদের কাছে, স্পেশাল, এক থেকে পাঁচ পর্যন্ত। পাঁচ ডলার করে সবগুলোর দাম হয় পঁচিশ, কিশোরের দিকে তাকিয়ে হাসল লোকটা। তবে তোমার জন্যে পনেরো। দশই বাদ, যাও।

টাকা বের করে দেয়া ছাড়া উপায় নেই। দেয়ার সময় লোকটার হাতের দিকে তাকাল। না, এই লোক ক্রিমসন ফ্যান্টম নয়। আঙুলগুলো মোটা মোটা, খাটো, নখের মাথা কামড়ে কেটে ফেলেছে। হাতের উল্টো পিঠে স্পষ্ট ছাপ দেয়া।

টাকাটা নিয়ে আরেক জনের হাতে দিল সোনালি চুল, দাম রেখে বাকিটা ফেরত দেয়ার জন্যে। টাকা গুনছে দ্বিতীয় লোকটা, কিশোর তাকিয়ে রয়েছে তার হাতের দিকে। নাহ, ওর হাতেও ছাপ রয়েছে।

এই যে, নাও, থ্যাংকস, টাকাটা ফিরিয়ে দিতে দিতে বলল দ্বিতীয় লোকটা। তারপর তাকাল সহকারীদের দিকে। একজনকে ডেকে বলল, ডেড, স্পেশাল কিছু নিয়ে এসো তো।

আরেক প্যাকেট স্টেলারা স্টারগার্ল কমিক বের করল ডেভ। এগুলো? দামটা দেখতে পেল কিশোর। দশ ডলার লেখা রয়েছে।

না, গাধা, এগুলো কি স্পেশাল হলো নাকি? না থাকলে দোকান থেকে নিয়ে এসোগে। আজকেই দরকার।

আবার ভিড় ঠেলে ফিরে চলল কিশোর। ঢুকতে যতটা কষ্ট হয়েছিল, বেরোতে তার চেয়ে কিছুটা কম হলো। কি কিনে এনেছে সে, দেখেই হাসতে লাগল মিরিনা।

গম্ভীর হয়ে কিশোর বলল, পরে তোমার অটোগ্রাফ নিয়ে নেব এগুলোতে, যখন তুমি বিখ্যাত হয়ে যাবে স্টারগার্ল হিসেবে। এখন অন্য জায়গায় যেতে হবে।

অন্য জায়গায়?

এখানে সব ফালতু জিনিস বিক্রি করছে সুমাতোরা। হাতের প্যাকেটটা দেখাল কিশোর, এসব জঞ্জাল। তবে দোকানে স্পেশাল কিছু রয়েছে। ভাবছি, ওগুলো এতই স্পেশাল কিনা, যা চুরি করে জোগাড়ের দরকার পড়ে?

দেখতে চাও তো? চলো, ভ্যান আছে আমার, ম্যাড ডিকসন বললেন। কিছুক্ষণের জন্যে সেলসম্যানদের ওপর দোকানের ভার দিয়ে যেতে পারব।

আমিও যাব, মিরিনা বলল। সোনালি পোশাকের দিকে তাকাল। তবে এই কাপড়ে…

নাও, নিজের গায়ের জ্যাকেটটা খুলে দিল হুফার। এটা গায়ে চড়াও। অনেকখানিই ঢাকতে পারবে।

আন্ডারগ্রাউন্ড গ্যারেজে নেমে এল ওরা। হুফার, মিরিনা আর ডিকসন উঠলেন সবুজ ভ্যানে। তিন গোয়েন্দা উঠল মুসার ইমপালায়।

তা সত্যিই জানো তো দোকানটা কোথায়? গ্যারেজ থেকে বেরিয়ে এলে জিজ্ঞেস করল কিশোর।

জানি, মুসা বলল। ডিকসন কি বলল শুনলে না? ওয়েস্টার্নের কাছে, হলিউডে। বলল তো দেখতে পাবই। আমিও একবার দেখেছিলাম মনে পড়ে। বের করে ফেলতে পারব।

ঠিকই পারল সে। একবারেই। চার তলা একটা পুরানো বাড়ির গ্রাউন্ড ফ্লোরে রয়েছে সুমাতো কমিকস। সামনের দিকটায় উজ্জ্বল রঙে দোকানটার বিজ্ঞাপন লেখা হয়েছে। আর এঁকেছে প্রচুর ছবি। হলুদ পটভূমিতে ফুটে আছে কমিকের নানা রকম হিরোরা। জাপানী হিরোদের সঙ্গে আমেরিকান সুপারম্যানের লড়াইটা চমৎকার।

হেসে ফেলল রবিন। সুমাতো কমিকস যখন, এর চেয়ে ভাল আর কি দেখাতে পারত?

দুটো গাড়িই পার্ক করে নেমে এল সবাই।

ডিকসন বললেন, কমিক জোগাড় যখন শুরু করেছিলাম, তখন প্রায় সারাটা দিনই এখানে কাটাতাম। সব চেয়ে কম দামে বিক্রি করত এরা।

আর সব চেয়ে কম ভাড়ায় দোকান পাওয়া যেত তখন, পাশের মলিন ঘরগুলোর দিকে তাকাল হুফার।

ওই সময়, কথার পিঠে আবার বললেন ডিকসন, বাড়িটার মাটির তলার দোকানগুলোতে সেকেন্ডহ্যান্ড পেপারব্যাক বই বিক্রি হত। এখন আর দোকান নেই, গুদাম করে ফেলা হয়েছে। আমরা যেটার খোঁজে এসেছি, সেটা ওখানে পাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। সিড়িটা চিনি, কিন্তু নামতে গেলে ধরা পড়ে যেতে পারি।

হাসল মিরিনা। হুফারের জ্যাকেটটা খুলতে শুরু করল। আমার মনে হয়, ওদের নজর আরেক দিকে সরানোর ব্যবস্থা আমি করতে পারব।

কিভাবে কি করবে দ্রুত একটা ছক ঠিক করে ফেলল কিশোর। কাজ শুরু হলো সেই মত। পরের পাঁচটা মিনিট হুফার, ডিকসন আর কিশোর ঘুরে বেড়াতে লাগল, সাধারণ খরিদ্দারের মত। পাঁচ মিনিট পর পিছু নিল মিরিনা। বাইরে রয়ে গেল মূসা আর রবিন, কোন গন্ডগোল দেখা দিলে সেটা সামলানোর চেষ্টা করবে।

কনভেনশন হলের তুলনায় অর্ধেক বেচাকেনাও এখানে আশা করেনি কিশোর। তবে যা দেখল, সেটাও আশা করেনি। র্যাকে কমিক ঘাটাঘাটি করছে চারজন কাস্টোমার। উদাস, শূন্য দৃষ্টিতে তাদের দিকে তাকিয়ে রয়েছে দুজন সেলসম্যান।

দেয়াল ঘেঁষে প্রচুর বাক্স ছিল, দাগ দেখেই অনুমান করতে পারল কিশোর। মেঝেতে ধুলোর মাঝে মাঝে চারকোণ দাগ, ওসব জায়গায়ও বাক্স ছিল। র্যাকেও বই তেমন নেই। ব্যবসা খারাপ হয়ে এলে কিংবা দোকান বিক্রি করে দেয়ার সময় যে অবস্থা হয় সে রকম লাগছে। তবে বেশি তাড়াহুড়া যেন করেছে মালিক।

ঘুরে তাকিয়ে ডিকসনের ওপর চোখ পড়ল কিশোরের। দোকানের পেছনের অংশে একটা দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছেন। দোকান খালি হয়ে যাওয়ায় সুবিধেই হয়েছে ওদের। অনেক বাক্স সরিয়ে নিয়ে গিয়ে খোলা হয়েছে, বই বের করে নিয়ে বাক্সগুলো ওখানেই ফেলে রেখেছে। র্যাকের কমিক দেখার ভান করতে করতে ওখানে চলে এল কিশোর। হুফারও এল।

খুলে গেল সামনের দরজা, ভেতরে ঢুকল মিরিনা। পোশাকের মতই মুখেও হাসি ঝলমল করছে। কনভেনশন হলে যেভাবে আকৃষ্ট করেছে মানুষকে, এখানেও তার ব্যতিক্রম হলো না। সব কটা চোখ ঘুরে গেল তার দিকে।

এই-ই সুযোগ। মাটির নিচের ঘরে ঢোকার দরজাটা আস্তে করে খুলে ফেললেন ডিকসন। ঢুকে পড়ল তিনজনে। ধুলো পড়া চল্লিশ ওয়াটের একটা বাল্ব জ্বলছে সিঁড়িতে, আলো-আঁধারি তৈরি করেছে।

নিচে নেমে সুইচবোর্ডটা খুঁজল কিশোর। পেল না। সিঁড়ির আলো আবছা ভাবে আসছে এখানে, তাতে ভাল করে জিনিসপত্র চোখে পড়ে না। তবে দেখার তেমন কিছু আছে বলেও মনে হলো না। কয়েকটা ছোট ছোট বাক্স আর খুলে রাখা কোন মেশিনের কিছু যন্ত্রপাতি বাদে।

যন্ত্রাংশগুলোর দিকে তাকিয়ে রয়েছে কিশোর। এরকম জিনিস দেখেছে কোথাও আগেও। কোথায়? ধীরে ধীরে স্মৃতিতে স্পষ্ট হলো। দেখেছে ওদেরই স্যালভিজ ইয়ার্ডে। বন্ধ হয়ে যাওয়া একটা ছাপাখানা থেকে কিনে এনেছিলেন রাশেদ পাশা। কি মেশিনের জানেন? ফিসফিস করে বলল সে, পুরানো অফসেট প্রিন্টিং মেশিন। কিন্তু কি ছেপেছে ওরা এই মেশিন দিয়ে?

সামনে পা বাড়াতেই পায়ে লাগল দলামোচড়া করে ফেলে রাখা কাগজ। লাথি লেগে কাগজের বলটা ছুটে গেল হুফারের দিকে। তুলে নিল সে। টেনেটুনে সমান করল কাগজটা। দেখে বলল, এই ম্যাড, জানেন এটা কি?

সাদা-কালোয় ছাপা হয়েছে কাগজটাতে।

ডিকসনও দেখে চিনতে পারলেন। জানব না কেন? আগে খবরের কাগজে সাদা-কালোয় ছাপা হত কমিক। বইও ছাপত। এই পাতাটা নিশ্চয় পঞ্চাশ বছরের পুরানো।

আমার মনে হচ্ছে নতুন, পাতাটা দেখিয়ে বলল হুফার। পুরানো হলে হলুদ হয়ে যেত, কিনারগুলো হত ফাটা ফাটা। খোলার সময় মুড়মুড় করে ভেঙে যেত।

এখন বুঝতে পারছি, কিশোর বলল, স্পেশাল জিনিস বলতে কি বোঝাতে চেয়েছে।

ভাল কথা, বলে উঠল একটা কণ্ঠ। এখন বলো তো, তোমাদের নিয়ে কি করা যায়?

সিড়ির দিকে তাকাল ওরা। আবছা আলোয় তিনটে মূর্তিকে দেখা গেল। নেমে আসতে লাগল একজন। তাকে চিনতে পারল কিশোর। কনভেনশন ফোরের সেই বিশালদেহী দারোয়ান।

মনে করেছিলাম, লোকটা বলল, তোমার কালো বন্ধুটা উড়াল দিয়ে পুলে নামার পর থেকেই সাবধান হয়ে যাবে। হলে না। ঘুরঘুর করতেই থাকলে, যাকে পেলে তাকেই প্রশ্ন করলে, আরও সহকারী জোগাড় করলে, শেষমেষ এখানেও এসে হাজির হলে। আশা করি, চেঁচামেচি করার কথা ভাবছ না। লাভ হবে না। দোকানটা বন্ধ করে দিচ্ছি আমরা। দেয়ালগুলোও অনেক পুরু। বাইরে থেকে শোনা যাবে না।

নরিস, বলল একজন সেলসম্যান, কণ্ঠে অস্বস্তি, কি করব এদের?

হ্যাঁ, লোকটার সঙ্গে গলা মেলাল কিশোর, কি করা হবে আমাদের? নরিস, জানলেন কি করে আমরা এখানে আসছি?

ওই বোরাম ছাগলটা লাফাতে লাফাতে এল বসের কাছে, তোমরা নাকি নানা রকম কথা জিজ্ঞেস করেছ, এটা বলার জন্যে। সে আন্দাজ করে ফেলেছিল, তোমরা এখানে আসছ। হাসল নরিস। তারপর আর কি? আমাকে এখানে পাঠিয়ে দিল তোমাদের তিন গাধাকে ধরার জন্যে।

অন্ধকারে ভালমত আমাদের দেখতে পাচ্ছে না, ভাবল কিশোর। ডিকসন আর হুফারকে মুসা আর রবিন বলে ভুল করছে ব্যাটা। ও, লুই মরগানের হয়ে অনেককেই ধরতে যান তাহলে আপনি, বলতে বলতে তার দিকে এগোল সে। আলোয় বেরিয়ে এল। পেছনে হাত নিয়ে গিয়ে নেড়ে ইশারা করল ডিকসন আর হুফারকে, যাতে না এগোয়।

এখন আমার মনে পড়ছে, বলছে কিশোর, মুসা যখন ব্যালকনি থেকে পড়ে গিয়েছিল, তখন আপনি ছিলেন না গেটে পাহারায়। আপনার জায়গায় বসেছিল যে মেয়েটা হাতে সিল দেয় সে। ছুটি ছিল নাকি তখন আপনার? নাকি ছুটি দেয়া হয়েছিল আইজাক হুফারের ঘরে ঢোকার জন্যে?

ভয় পাচ্ছে কিশোর, তার কথা শুনে লোকটা মেজাজ না খারাপ করে বসে। সময় চাইছে সে। দেরি করিয়ে দিতে চাইছে। যাতে মুসা আর রবিন চলে আসার সময় পায়। ওপরে মিরিনারই বা কি হলো?

ডিনারের সময়ও আপনি ছিলেন ওখানে, কথা থামাল না কিশোর। বোরাম আর হুফার যখন হাতাহাতি শুরু করলেন, তাদের ছাড়াতে গেলেন। কেন? পরে সুযোগ করে গিয়ে হুফারকে শেষ করে দেয়ার জন্যে? নাকি বোরাম যে কাজটা করতে চেয়েছিলেন, সেটা করার জন্যে? বেচারা হুফারকে দুরমুজ করার জন্যে?

হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়তে লাগল নরিস। এতক্ষণে বুঝলাম, তোমাদের নিয়ে কেন এত দুশ্চিন্তায় পড়ে গিয়েছেন বস। মাথাটা বড় বেশি পরিষ্কার তোমাদের। অনেক কিছুই বুঝে ফেল।

তবে সব বুঝতে পারি নি। আমি ভেবেছিলাম, আপনিই বুঝি ক্রিমসন ফ্যান্টম সেজেছেন। পরে বুঝলাম, আপনি না। আপনার হাতের আঙুল বেশি মোটা, প্রায় চাঁপাকলার মত। সময় ফুরিয়ে আসছে, বুঝতে পারছে কিশোর। নরিস আর তার দুই সহকারী আর বেশিক্ষণ থাকবে না এখানে, কাজ সেরে সরে, পড়তে চাইবে।

চাঁপাকলা, না? রাগ প্রকাশ পেল নরিসের কণ্ঠে। চাঁপাকলার গাট্টা খাওনি তো মাথায়, খেলে বুঝতে পারবে!

বাধা দেয়ার জন্যে তৈরি হলো কিশোর। বেশি আত্মবিশ্বাস দেখাচ্ছেন না? আমি একা নই। আপনারাও তিনজন, আমরাও তিনজন।

আবার হাসল নরিস। বেরিয়ে পড়ল ভাঙা দাঁত, স্নান আলোতেও দেখতে পেল কিশোর। তাতে কোন অসুবিধে নেই। তোমাদের তিনজনকে একাই কাবু করে ফেলতে পারি…

কথা শেষ করল না সে। পেছন থেকে হাতটা সামনে নিয়ে এল। হাতে একটা বেসবল ব্যাট। ব্যাটের মোটা অংশটায় চাপড় দিল বাঁ হাতে।

ভয় পাচ্ছে তার দুই সহকারী। ওরাও হাত সামনে আনল। দুজনের হাতেই একটা করে ব্যাট।

নরিসের ইঙ্গিতে এগিয়ে আসতে লাগল তারাও।

১৬

মুঠো শক্ত করল কিশোর। লড়াই না করে কিছুতেই ধরা দেবে না। হেরে গেলে যাবে, সে পরে দেখা যাবে। কোনমতে নরিসকে কাবু করে ফেলতে পারলেই হলো, বাকি দুজন আর এগোবে না। লেজ তুলে দৌড় দেবে, বোঝাই যায়। নিজের ইচ্ছেয় আসেনি ওরা, নিশ্চয় জোর করে নিয়ে এসেছে নরিস।

তবে বিশালদেহী লোকটাকে কাবু করা অত সহজ নয়। গায়ে যে শুধু মোষের জোর তাই নয়, কি করে ব্যাট ব্যবহার করতে হয়, তা-ও জানে। ধরার কায়দা দেখেই অনুমান করা যায়। এক পা এক পা করে এগোচ্ছে, পেছনে গা ঘেঁষাঘেষি করে আছে তার দুই সহকারী।

সমস্ত দুশ্চিন্তা আর ভয় জোর করে মন থেকে সরিয়ে দিল কিশোর। জুডো ক্লাসে শেখানো হয়েছে এটা করতে। শত্রুর ওপর কড়া নজর, প্রতিটি নড়াচড়া লক্ষ্য করছে। ধীরে ধীরে ভারি দম নিতে লাগল।

কাছে আসতে নরিসদের আরও অর্ধেক পথ বাকি, এই সময় সিড়ির মাথায় আরও দুটো মূর্তি চোখে পড়ল কিশোরের। সঙ্গে সঙ্গে ডাক দিল সে, মুসা, এই সামনের লোকটাই তোমাকে ঘুসি মেরেছিল! পুলে ফেলে দিয়েছিল!

হেসে উঠল নরিস। ওসব পুরানো কৌশল অনেক দেখা আছে আমার। আমি তাকাচ্ছি না পেছনে।

ওরা কথা বলছে, এই সুযোগে নিঃশব্দে নেমে চলে এল রবিন আর মুসা। ঝাপিয়ে পড়ল দুই সেলসম্যানের ওপর। একটা লোকের কানের সামান্য নিচে ঘাড়ের ওপর কারাতে কোপ মারল রবিন। টু শব্দ করতে পারল না লোকটা। হাত থেকে ব্যাট খসে পড়ল। জ্ঞান হারিয়ে পড়ে গেল সে।

অন্য লোকটার ব্যাট ধরা হাতটা চেপে ধরে মুচড়ে পেছনে নিয়ে এল মুসা। হ্যাঁচকা টান দিয়ে ব্যাট কেড়ে নিল বিস্মিত লোকটার হাত থেকে। তারপর সেটা দিয়ে আক্রমণ করল নরিসকে।

বোঝাপড়াটা এই ব্যাটের সঙ্গেই হবে আমার, বলল সে।

চমকটা সামলে নিতে সময় লাগল না নরিসের। চিৎকার করে উঠে ব্যাট তুলল সে, বাড়ি মারল মুসার মাথা সই করে। সেটা ঠেকানোর জন্যে ব্যাট তুলল মুসা। ঠেকালও। তবে ব্যাটটা ধরে রাখতে পারল না, ছুটে গেল। সে যে লোকটার কাছ থেকে ব্যাট কেড়ে নিয়েছিল সে-ও এগিয়ে এল ওকে ধরার জন্যে। রবিন বাধা দিল তাকে।

মুসার দিকে যেই নজর দিয়েছে নরিস, অমনি লাফ দিয়ে আগে বাড়ল কিশোর। তবে টের পেয়ে গেল সেটা বিশালদেহী লোকটা। মুসাকে বাড়ি মেরে তার হাত থেকে ব্যাট ফেলে দিয়েই ঘুরল, সই করার সময় পেল না, কিশোরকে আসতে দেখেই বাড়ি মারল। ঠিকমত লাগাতে পারল না। ব্যাটের মাথা কিশোরের মুখ ছুঁয়ে গেল। তারপর গিয়ে লাগল পুরানো কাঠের রেলিংটাতে। মড়াৎ করে কাঠ ভাঙার আওয়াজ হলো। আরেক কদম এগোল কিশোর। এক হাতে ব্যাট আটকানোর চেষ্টা করতে করতে আরেক হাতে কব্জি চেপে ধরল নরিসের।

কিন্তু ভারি শরীর দিয়ে ধাক্কা মেরে কিশোরকে সিঁড়ি থেকে ফেলে দেয়ার চেষ্টা করল সে। রেলিঙে লেগে ব্যথা পেল কিশোর, উফ করে উঠল। কব্জি থেকে আঙুল ছুটে গেল। রেলিং আঁকড়ে ধরে পতন ঠেকাল।

ব্যাটটা টেনে ছাড়িয়ে নিয়ে হেসে উঠল নরিস। আবার ঘুরল মুসা আর রবিনকে বাড়ি মারার জন্যে। ওদের চিত করেই ঘুরবে কিশোরকে কাবু করার জন্যে।

ওদেরকে নাগালের মধ্যে না পেয়ে আবার ঘুরল কিশোরের দিকে। কিন্তু ওকে যেখানে আশা করেছিল, সেখানে পেল না। তার পরেও বাড়ি মারল। ব্যাটের নিচ দিয়ে ডাইভ দিল কিশোর। মাথা নিচু করে উড়ে এসে পড়ল নরিসের ওপর। মাথা দিয়ে ভীষণ জোরে গুতো মারল পেটে।

হুঁক করে উঠল লোকটা। সামনের দিকে বাঁকা হয়ে গেল শরীর। দুদিক থেকে তাকে ধরে ফেলল মুসা আর রবিন। সাংঘাতিক জোর লোকটার গায়ে। প্রচন্ড ব্যথা পেয়েছে, তবু দুজনের ধরার সঙ্গে সঙ্গে এক ঝাড়া দিয়ে মুক্ত করে নিল নিজেকে। শুধু মুক্ত করেই ক্ষান্ত দিল না, পাশে ঘুরে ঘুসি মারল রবিনের ঘাড়ে।

যথেষ্ট হয়েছে, বলেই ঝাপ দিল মুসা। গড়াতে গড়াতে পড়ল নরিসকে নিয়ে। গড়ানো থামল যখন, সে থাকল ওপরে।

কাহিল হয়ে পড়েছে নরিস। তাকে টেনে দাঁড় করাল মুসা। হেসে বলল, তোমার ঘুসিতে দারুণ শক্তি, জানা হয়ে গেছে আমার। এবার দেখ তো, আমারটা কেমন লাগে?

বলেই মেরে বসল।

ইতিমধ্যে দ্বিতীয় সেলসম্যানকে কাবু করে ফেলেছে কিশোর। দুজনেই বসে পড়েছে সিড়ির ওপর। হাঁপাচ্ছে পরাজিত কুকুরের মত। মারপিটের বিন্দুমাত্র ইচ্ছেও আর নেই ওদের।

দারুণ, বুঝলে! হাত ঝাড়তে ঝাড়তে কিশোরকে বলল রবিন, শেষ মারটা বড় চমৎকার দিলে। কি মার? জুডো?

মাথা ডলছে কিশোর। ছাই! একজায়গায় ফুলে উঠেছে, সেখানে আঙুলের চাপ দিয়েই উফ করে উঠল। ছাই হোক আর যা-ই হোক, কাজ হয়েছে, নরিসের ওপর প্রতিশোধ নিতে পেরে সন্তুষ্ট হয়েছে মুসা। তোমাদেরকে মারতে এল কেন?

সংক্ষেপে সব জানাল কিশোর। শুনেটুনে মুসা বলল, ভাল। পুলিশকে খবর দেব?

তাতে এই তিনটেকে জেলে ভরতে পারব বটে, কিশোর বলল, কিন্তু গভীর জলের মাছটা ফসকে যাবে। লুই মরগানকে আটকাতে পারব না আমরা।

কেন নয়? জালিয়াতি যে করেছে এটা তো ঠিক?

কমিক বুক জালিয়াতি, হুফার বলল, এই অপরাধে জেলে ঢোকানো যাবে বলে মনে হয় না। উকিলই ভাল বলতে পারবে।

কিন্তু আইন তো ভঙ্গ করেছে সে?

পাবলিশিং কপিরাইট অমান্য করেছে, এটা বলা যায়, কিশোর বলল। এধরনের অপরাধে লোকের শাস্তি হয় বটে, তবে জেলে যায় না। জরিমানা টরিমানা দিয়েই খালাস পেয়ে যায়।

শহর ছেড়ে চলে যাবে সে, ডিকসন বললেন।

দেশ ছেড়ে চলে যেতে পারে, বলল কিশোর। তাহলে জরিমানাও দিতে হবে না। দেখি, আগে জেনে নিই, কি ধরনের শয়তানি চলছিল এখানে। তারপর বুঝেশুনে কিছু একটা করা যাবে।

ধমক দিতেই যা জানে গড়গড় করে বলে দিল এক সেলসম্যান। এখানে, এই মাটির নিচের ঘরে কমিক বই ছেপে নকল জিনিসটা আসল বলে ধরিয়ে দেয়া হত সংগ্রাহকের হাতে।

ভাল আয় করেছে, হুফার বলল। শ খানেক কমিক ছাপতে ব্ল্যাক অ্যাও হোয়াইটে বড় জোর হাজার দুয়েক ডলার লাগে। প্রতিটি বই কম করে হলেও পঞ্চাশে গছাতে পারবে বোকা সংগ্রাহকগুলোকে। তাতে লাভ থেকে যাবে তিন হাজার। সোজা কথা নয়। লেখক কিংবা আর্টিস্টকে কমিশনের জন্যে একটা পয়সাও দিতে হবে না। লাভ সবটাই নিজের পকেটে পুরতে পারবে প্রকাশক।

কিন্তু সব কিছু বন্ধ করে দিচ্ছে মরগান, কিশোর বলল। প্রেসও বন্ধ করে দিয়ে এখানকার পাট চুকিয়ে চলে যাওয়ার মতলব। তারমানে আরও কোন ব্যাপার আছে। একজন সেলসম্যানের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, কি ব্যাপার, বল তো?

আরেক ফন্দি করেছে, লোকটা বলল। এবার কালারে ছাপবে।

কালার? ভুরু কোঁচকাল হুফার। তাতে তো অনেক গল্প। একশো ছাপথেই বেরিয়ে যাবে বারো হাজার! চুরি করে ছাপতে গেলে প্রেস থেকে তো আর পারবে না, নিজেকেই করতে হবে সব কিছু। এসটাবলিসমেন্ট কস্ট অনেক। টাকা পাবে কোথায়?

তাইওয়ান, সিঁড়ির গোঁড়া থেকে জবাব দিল নরিস। হাত-পা বাঁধা হয়ে বসে আছে। চারপাশে তাকাল বিরক্ত চোখে। ওরই মত আরেক শয়তান প্রিন্টারের সঙ্গে ওখানে যোগাযোগ হয়েছে মরগানের, চুক্তিও করেছে। এখানে ছেপে চোরাচালান হয়ে চলে আসবে আমেরিকায়। আপাতত চিনামাটির জিনিসের বাক্সে করে আনার সিদ্ধান্ত নিয়ে মরগান। পুরো উপকুলে ছড়িয়ে দেয়ার ইচ্ছে তার। আমাদের সবাইকে ব্যবসায় লাগাবে বলে লোভ দেখিয়েছিল। টাকার অঙ্ক হিসেব করে দেখিয়েছিল। রাজি না হয়ে পারিনি।

এখন আর কি, কিশোর বলল, জেলে গিয়ে পচুনগে। বেশি লোভ করলে এরকমই হয়।

সেলারেই তিনজনকে বেঁধে ফেলে রেখে বেরিয়ে এল ওরা। দোকানের দরজায় তালা লাগিয়ে দিল। গাড়িতে বসে আছে মিরিনা। এরকম একটা পরিবেশে এভাবে বসে থাকতে ভাল লাগছিল না ওর। ওদের দেখে অস্বস্তি দূর হলো। উদ্বিগ্ন কন্ঠে জিজ্ঞেস করল, খবর কি তোমাদের? সব ভাল? চিন্তায়ই পড়ে গিয়েছিলাম। আমাকে বের করে দিল সেলসম্যানগুলো। চুরি করে ঢুকতে হয়েছে তখন মুসা আর রবিনকে।

আমরা ভাল। কি কি ঘটেছে মিরিনাকে জানাল কিশোর। এখন গিয়ে মরগানকে ধরতে হবে, পালানোর আগেই।

কি করে আটকাব? মুসার প্রশ্ন।

ডাকাতির অভিযোগে, সমাধান দিল রবিন। যদি কোনভাবে ওটার সঙ্গে জড়িয়ে ফেলতে পারি ওকে, চোরাই কমিকগুলো খুঁজে বের করতে পারি, তাহলেই হবে।

সন্তুষ্ট হতে পারল না মিরিনা। বলল, অনেকগুলো  যদি এসে যাচ্ছে।

কনভেনশনে ফিরে কোলাহল আর লোকের হুড়াহুড়ি যেন জোর একটা ধাক্কা মারল ওদের। আশা করেছিল, সুমাতো কমিকের মতই এখানেও দেখবে ভাঙা মেলা, লোকজন কম, সবাই পোটলাপুঁটলি গোছগাছ করে বাড়ি ফেরার তোরজোর করছে।

দুই রঙা চুলওয়ালা মেয়েটার শোচনীয় অবস্থা। কুলিয়ে উঠতে পারছে না আর বেচারি। একই সাথে দুটো কাজ করতে হচ্ছে। হাতে সিলও মারতে হচ্ছে, দারোয়ানের কাজও করতে হচ্ছে। ফুরসত পেলেই তাকাচ্ছে এদিক ওদিক, নিশ্চয় নরিসকে দেখার আশায়। নরিস যে আর ফিরবে না, জানলেই মুষড়ে পড়বে মেয়েটা, তাই তাকে কিছু বলল না কিশোর।

এবার? কনভেনশন ফ্লোরে ঢুকেই জিজ্ঞেস করল রবিন।

আমাদেরকে দেখে ফেলার আগেই তাকে খুঁজে বের করতে হবে আমাদের, মুসা বলল। গরিলাটাকে পাঠিয়েছে আমাদেরকে বন্দি করার জন্যে। এখন আমাদেরকে ঘুরঘুর করতে দেখলেই সন্দেহ করে বসবে।

ঠিক, একমত হয়ে বলল কিশোর। মরগানকে খুঁজে বের করতে হবে, চোরাই কমিকগুলোও বের করতে হবে।

এই তো, পেলাম, শোনা গেল বাজখাই কণ্ঠ। মোটা শরীর দিয়ে ধাক্কা মেরে ভিড় সরাতে সরাতে এগিয়ে এল ডুফার। খুব উত্তেজিত লাগছে! ব্যাপারটা কি?

খপ করে তার হাত চেপে ধরল হুফার। এড, মরগানকে দেখেছ?

হাসিতে দাঁত বেরিয়ে পড়ল ডুফারের। দাড়ি নেড়ে বলল, ঠিকই আন্দাজ করেছি! খুব উত্তেজনা। হয়েছেটা কি? আবার কিছুতে হাত দিল নাকি?

সে হাসছে, আর কিশোর ভাবছে মরগানের হাতের কথা। ডাকাতির পর পর হাজির হয়েছে লোকটা, লম্বা আঙ্গুলওয়ালা পাতলা হাতজোড়া ডলতে ডলতে। ওই হাতের উল্টো পিঠে সিল ছিল না। কনভেনশন বস হিসেবে তার টিকেট লাগে না।

মরগানের হাত ডাকাতটার হাতের সঙ্গে মিলে যায়, কিশোর বলল, ওর হাতেও কোন সিল নেই। আমার বিশ্বাস, ডাকাতিটা সে-ই করেছে। কিন্তু দুজন লোক তাকে গোল্ড রুমে যেতে দেখেছে, ভাকাতির সময়। ভুরু কোচকাল কিশোর। নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটল একবার। ভাবছে।

আমি তাকে গোল্ড রুমে দেখেছি, ডুফার বলল। ঘরে ঢুকে ঘ্যান ঘ্যান করতে লাগল প্রোজেকশনিস্ট তখনও আসেনি বলে। সে নিজেই প্রোজেকটরটা চালানোর চেষ্টা করল, পারল না। যন্ত্রটা এমনকি পর্দায় দিকেও সেট করা ছিল না, যে ছবি ফেলা যাবে। মজার কাণ্ড করেছে। ওটাকে চালানোর জন্যে ব্যাগ ব্যবহার করেছে সে।

ব্যাগ? কিসের ব্যাগ? জানতে চাইল কিশোর।

শ্রাগ করল ডুফার। কাঁধে একটা ক্যানভাসের ব্যাগ ছিল। এই কনভেনশনের অর্ধেক লোকের কাঁধেই ওরকম ব্যাগ আছে।

মুসা বলল, কিন্তু আমাদের সাথে যখন দেখা হলো, তখন ছিল না।

রবিন যোগ করল, আর সেটা ডাকাতির বেশি আগেও নয়।

আসল কথা হলো, কিশোর বলল, কি ছিল ব্যাগটার ভেতর?

তোমার কি মনে হয়? মিরিনার প্রশ্ন। কসটিউম?

হতে পারে, ভ্রূকুটি করল কিশোর। কিন্তু সময়ের ব্যাপারটা মিলছে না। পোশাক খুলে এত তাড়াতাড়ি গোন্ড রুমে পৌঁছল কি করে?

ভাল প্রশ্ন, মুসা বলল। গোল্ড রুমে দেখা দরকার। এসো।

দল বেঁধে রওনা হলো সবাই। কনভেমশন ফ্লোর থেকে বেরিয়ে প্রথমে বাঁয়ে মোড়, তারপর আরেকবার বাঁয়ে মোড় নিতে লম্বা একটা করিডর পড়ল।

একটা ব্যাপার খেয়াল করেছ? হুফার বলল, কনভেনশন ফ্লোরে এদিক দিয়ে যাওয়ার পথটা বড় জটিল। বেশি ঘোরপ্যাচ।

শেষ মাথায়, ডানে গোল্ড রুমের প্রবেশ পথ। বন্ধ দরজার ওপাশ থেকে আসছে জমজমাট বাজনা। চিৎকার করল একটা মহিলা কণ্ঠ, গান নিয়ে একটা মন্তব্য করল।

বাঁয়ে আরেকটা দরজা, তাতে ডোরনব নেই। ঠেলা দিল কিশোর। নড়ল না পাল্লা। এটা দিয়ে কোথায় যাওয়া যায়? নিজেকেই যেন করল প্রশ্নটা।

এটা একটা ইমারজেন্সি একজিট, ডুফার বলল। জরুরি অবস্থায় বেরোনোর পথ। এর অন্য পাশেই কনভেনশন ফ্লোর।

দরজায় কান পেতে ওপাশে অসংখ্য মানুষের নড়াচড়া আর কোলাহল গুনতে পেল কিশোর। চকচক করে উঠল চোখ। তাহলে এই ব্যাপার। এটা দিয়ে সহজেই কনভেনশন ফ্লোর থেকে ডাকাতি করে বেরিয়ে আসতে পেরেছে ক্রিমসন ফ্যান্টম। মিস্টার ডিকসনের দোকান থেকে খুব কাছেই হবে মনে হয়।

তার পরেও কথা থাকে, প্রশ্ন তুলল হুফার। কাপড় বদলাল কোথায় সে?

যেখানে ডাকাতি করেছে সেখানেই, জবাব দিল কিশোর। পোশাক বদলের ঘর তো ওখানেই তৈরি করে নিয়েছিল। ধোঁয়া ধোঁয়ার মধ্যেই কাজটা সেরেছিল। মিরিনার দিকে তাকাল গোয়েন্দাপ্রধান। ধোঁয়ার ভেতরে তাকিয়ে কি দেখতে পেয়েছিলে তুমি, বলো তো আবার?

শ্রাগ করল মিরিনা। এক ঝলক লাল। মনে হলো কাঁধের ওপর। ধোয়ার ভেতরে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে তখন সে।

মাথা ঝাঁকাল কিশোর। কোন দিকে গিয়েছিল?

ভেবে নিল মিরিনা। তখন তো মনে হয়েছিল, মানে আমি ভেবেছি আরকি, সামনের দরজার দিকেই গেছে। এখন মনে হচ্ছে, এই দরজাটার দিকেও আসতে পারে।

হাসল কিশোর। লাল ঝিলিকের মানে হতে পারে, তখন ওটা খুলে ফেলছিল মরগান, ব্যাগে ঢোকানোর জন্যে। কমিক ভরে আনতে যে ব্যাগটা সাথে করে নিয়ে গিয়েছিল।

ডুফার বলল, কিন্তু ডাকাতির আগের ক্ষণে যে তাকে আমি গোন্ড রুমে দেখেছি..

বাধা দিয়ে বলল কিশোর, তা দেখেননি। ডাকাতির খবর শোনার আগের মুহূর্তে তাকে দেখেছেন, ডাকাতি হওয়ার আগের ক্ষণে নয়।

দ্বিধায় পড়ে গেল ডুফার। তাই তো! এটা তো হতেই পারে…হয়তো ঠিকই বলেছ তুমি বুঝতে পারছি…

আমি পারছি না, মুসা বলল।

সামনের দরজা দিয়ে ডাকাতির খবরটা বাইরে বেরোতে মিনিট দুই লেগে গেছে, বুঝিয়ে দিল রবিন।

ঠিক। কিশোর আরও ব্যাখ্যা করে বোঝাল, পাশের দরজা দিয়ে বেরিয়ে পড়েছিল মরগান, খবরটা হলরুম থেকে বাইরে বেরোনোর আগেই। ছুটে চলে এসেছিল গোন্ড রুমের কাছে। যাতে তাকে লোকে দেখতে পায়, অ্যালিবাই তৈরি হয়, তাকে সন্দেহ না করতে পারে কেউ।

থামল কিশোর। এক আঙুল তুলল। আর একটা ভিন্ন সূত্র রয়ে গেল। সাথে করে ব্যাগটা গোল্ড রুমে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা। ভাবছি, এখনও প্রোজেকটরের গায়ে কোথাও ঝুলছে না তো?

হুফার বলল, গিয়ে দেখলেই তো হয়।

সব চেয়ে ভাল হয়, কিশোর বলল, মরগান যদি যায়। গিয়ে বের করে আনুক ওটা। এক কাজ করা যাক। প্রোজেকশনিস্টকে দিয়ে একটা খবর পাঠানো যাক তাকে।

প্রোজেকটর চালাচ্ছে এখন পিটার, আমার বন্ধু, ডুফার বলল। ওই যে, আমাদের পাশে বসে খাচ্ছিল যে লোকটা সেদিন।

বুঝতে পেরেছি, কিশোর বলল।

তাকে দিয়ে কিছু করানো যায় না?

খবর পাঠাতে চাও তো? যাবে। কি বলতে হবে?

প্রোজেকটর ভীষণ গরম হয়ে গেছে, আগুন লেগে যেতে পারে, হাসল কিশোর, এরকম কিছু?

১৭

ঝটকা দিয়ে খুলে গেল গোল্ড রুমের দরজা। নাছোড়বান্দা কিছু কমিকের ভক্তের ওপর ছড়িয়ে পড়ল আলো। টেরই পেল না ওরা। গভীর ঘুমে অচেতন। যারা জেগে রয়েছে তারা তাকিয়ে রয়েছে পর্দার দিকে। আলো পড়তেই চিৎকার করে উঠল দুচারজন, এই, বন্ধ করো! দরজা বন্ধ কর!

পর্দায় তখন মাকম্যানের রাজা গুঙের সঙ্গে মরিয়া হয়ে লড়ছে এক অ্যাসটারয়েড।

দর্শকদের আপত্তির পরোয়াই করল না দরজায় দাঁড়ানো লম্বা মানুষটা। সোজা এগোল প্রোজেকটরের দিকে। যাওয়ার সময় ঘষা লাগল পিটারের গায়ে। টেবিলে রাখা ক্যানভাসের ব্যাগটা ধরে টান দিল নিজের দিকে। একপাশে সরে গেল প্রোজেকটর, আলো অর্ধেক পড়ছে এখন পর্দায়, বাকি অর্ধেক বাইরে।

দর্শকরা দেখতে পাচ্ছে রে গান বের করছে রক, কিন্তু যার উদ্দেশে বের করেছে, সেই শত্রুই গায়েব। আলো অর্ধেক সরে যাওয়ায় বাইরে পড়ে গেছে গুঙ।

অ্যাই, কি হলো? ছবির কি হলো? চিৎকার করে উঠল কয়েকজন দর্শক। এমনকি যারা ঘুমিয়ে ছিল তারাও জেগে উঠে চেঁচামেচি শুরু করল। লোকটা যখন টান দিয়ে প্রোজেকটরের নিচ থেকে ব্যাগটা বের করল, তখন চিৎকার চরমে উঠেছে। কারণ প্রোজেকটরের আলো তখন পর্দা থেকে এতটাই নিচে নেমে গেছে, রক আর গুঙের কেবল মাথাটা দেখা যাচ্ছে। রকের হেলমেট আর গুঙের মাথার অ্যান্টেনা এপাশ ওপাশ করছে প্রোজেকটরের আলো নড়ার সাথে সাথে।

চেঁচামেচিতে ছবির শব্দই শোনা যায় না। কয়েকজন ভক্ত চেঁচিয়ে উঠল যারা চিৎকার করছে তাদেরকে চুপ করানোর জন্যে। তাতে চিৎকার বাড়লই শুধু, কমল না।

সব চিৎকারকে ছাপিয়ে শোনা গেল আরেকটা তীক্ষ্ণ কর্কশ চিৎকার, অ্যাই, তোমরা চুপ করবে! কিছু তো শুনতে পাচ্ছি না!

নিঃশব্দে এগিয়ে এল ওরা সাতজন, ঘিরে ফেলল টেবিলের কাছে দাঁড়ানো মানুষটাকে। এই সাতজন হলো তিন গোয়েন্দা, ম্যাড ডিকসন, আইজাক হুফার, এডগার ডুফার আর মিরিনা জরডান। আবছা আলোতেও স্পষ্ট চেনা গেল লুই মরগানকে।

ব্যাগটা হাতে আঁকড়ে ধরে একটা মুহূর্ত চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন মরগান। তারপর শ্রাগ করে ব্যাগ থেকে বের করলেন ছোট একটা বল।

থামুন! চিৎকার করে উঠল কিশোর। কিন্তু ততক্ষণে বলটা মেঝেতে পড়ে গেছে।

ঘন ধোঁয়া উঠতে শুরু করল। চিৎকার করে বললেন মরগান, আগুন! আগুন!

আসল ভক্তরা কথাটা কানেই তুলল না। ছবি ঠিক করতে বলছে পিটারকে। ধোঁয়া বাড়ছে, তাতে ঠিক করা ক্রমেই মুশকিল হয়ে উঠছে। যারা একটু কম ভক্ত, তারা গোয়েন্দাদের দলকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দৌড় দিল দরজার দিকে। এই সুযোগটা কাজে লাগালেন মরগান। আক্রমণ করে বসলেন মিরিনাকে। ব্যাগ ঘুরিয়ে বাড়ি মারতে গেলেন।

বাড়ি লাগল না, ধাক্কায়ই টলে উঠে পিছিয়ে গেল মিরিনা। তার পাশ কাটিয়ে খোলা দরজার দিকে দৌড় দিলেন মরগান।

পড়ে যাচ্ছিল মিরিনা, কোমর জড়িয়ে ধরে তাকে আটকাল কিশোর। চিৎকার করে বলল অন্যদেরকে, আসুন! জলদি!

দরজা দিয়ে দৌড়ে বেরোল ওরাও। হলের অর্ধেক পেরিয়ে গেছেন ততক্ষণে মরগান। সামনে কেউ পড়লে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিচ্ছেন। পিছু নিল তিন গোয়েন্দা। সামনে একটা ছেলেকে দেখে সোজা ঘুসি মেরে বসলেন মরগান, সরানর জন্যে। চরকির মত পাক খেয়ে দেয়ালের দিকে চলে গেল ছেলেটা।

লবিতে বেরোলেন মরগান। কোনদিকে না তাকিয়ে সোজা ছুটলেন, লোকজনকে ধাক্কা দিয়ে, কনুইয়ের গুঁতো মেরে সরিয়ে। সাধারণত যেদিক দিয়ে বেরোনর কথা-সামনের দরজা কিংবা এলিভেটরের দিকে না গিয়ে যাচ্ছেন অন্য দিকে।

বুঝে ফেলল কিশোর। সিড়ি! লোহার সিড়ির দিকে যাচ্ছেন তিনি!

আগে চলে গেল মুসা। দ্রুত কমে আসছে তার আর মরগানের মাঝের দূরত্ব। অবাক হয়ে হাঁ করে তাকিয়ে রয়েছে লোকে।

মোড়ের কাছে গিয়ে যেন ব্রেক কষলেন মরগান। পরক্ষণেই ঘুরে গেলেন সিড়ির দিকে। একটু পরেই দড়াম করে সিঁড়ির দরজা বন্ধ হওয়ার শব্দ শোনা গেল।

হ্যাঁঁচকা টানে দরজাটা খুলে ফেলল মুসা। ঢুকে পড়ল ভেতরে। পেছনে বিন্দুমাত্র গতি না কমিয়ে এসে ঢুকল কিশোর আর রবিন। সিঁড়ি দিয়ে নামতে শুরু করল।

মুসা, চেঁচিয়ে বলল কিশোর। সোজা তোমার গাড়িতে গিয়ে উঠবে। মরগানকে ধরার চেষ্টা কোরো না! আগের বার কিভাবে ওদের দৌড়ে পরাজিত করে দিয়েছিলেন কনভেনশন চীফ, মনে আছে তার।

পার্কিং গ্যারেজে নেমে এল ওরা। ওরাও নামল, মরগানও উঠে পড়লেন লাল একটা করভেট গাড়িতে।

ইমপালার দিকে দৌড় দিল তিন গোয়েন্দা। মুসা ইঞ্জিন স্টার্ট দিতে দিতে চলতে শুরু করল করভেট, ঘুরে রওনা হয়ে গেল একজিট র্যাম্পের দিকে। এক্সিলারেটরে পায়ের চাপ বাড়িয়ে গাড়িটার পিছু নিল মুসা।

খোলা রাস্তায় যদি চলে যায়, বলল সে। তাহলে আর ধরতে পারব না। ওর গাড়ির ধুলো খাওয়া ছাড়া তখন আর কিছুই করার থাকবে না আমাদের।

কিন্তু থামাবেই বা কি করে লোকটাকে? র্যাম্পে যেতে কোন বাধা নেই।

তারপর, হঠাৎ করেই কর্কশ আর্তনাদ করে উঠল টায়ার। দেখা গেল, একটা থামের আড়াল থেকে বেরোচ্ছে ম্যাড ডিকসনের সবুজ ভ্যান। মরগানের গাড়ির পথরোধ করতে ছুটল একচোখা সাইক্লপস।

গতি বাড়াল করভেট। শাঁই করে একপাশে কেটে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল সাইক্লপসকে। পুরোপুরি পারল না। ধ্রাম করে এসে ওটার পেছনের ডান ফেন্ডারে গুতো মারল সবুজ ভ্যান।

থামলেন না মরগান। গতিও কমালেন না। ভাঙা ফেন্ডার বিচিত্র শব্দ তুলছে।

কয়েক জায়গায় রঙ চটে গেল সাইক্লপসের। কেয়ারই করল না। তীক্ষ্ণ মোড় নিতে গিয়ে কাত হয়েই আবার সোজা হলো। দুলে উঠল একবার। থামল না। করভেটের লেজে লেগে রইল। কাছাকাছি চলে এল ইমপালা।

সেঞ্চরি বুলভারে বেরিয়েই গতি বাড়াল করভেট। যানবাহনের ভেতর দিয়ে পথ করে ছুটতে গিয়ে যেন মাতালের মত দুলছে। খানিক পর পরই কিইচ কিইচ করে প্রতিবাদ জানাচ্ছে টায়ার। রাস্তায় ঘষা লেগে জ্বলে যাচ্ছে। ডানের ফেন্ডারটা চেপে লেগে রয়েছে চাকার সঙ্গে, ক্ষতি করে চলেছে টায়ারের।

মুসার ভবিষ্যতবাণী ঠিক হয়নি। গতি বাড়িয়ে ওদেরকে ধুলো খাইয়ে সরে পড়তে পারেননি মরগান। গতি বাড়ালেই মাতাল হয়ে যায় গাড়ি, নিয়ন্ত্রণ হারানোর ভয় আছে এভাবে চললে। গতি কমাতে বাধ্য হচ্ছেন তিনি। আশা হলো তিন গোয়েন্দার। ধরার সুযোগ আছে।

করভেটের পেছনে লেগেই রয়েছেন ডিকসন। গালাগাল করছে অন্যান্য ড্রাইভাররা, সরতে বলছে, কানেই তুলছেন না তিনি। থ্রী লেনের দিকে ঘুরে গেল মুসা। সামনে দিয়ে গিয়ে করভেটকে আটকানোর চেষ্টা করল।

আরেকবার গতি বাড়ানোর চেষ্টা করলেন মরগান। আবার বাধা দিল আহত ফেন্ডার। পেছনের বাম্পারে গুতো মারল কয়েকবার সাইক্লপস।

সব রকমে চেষ্টা চালিয়েও করভেটকে থামাতে কিংবা রাস্তা থেকে সরাতে পারল না সাইক্লপস আর ইমপালা। কিছুতেই পাশ কাটিয়ে পেরোতে দিলেন না ওদেরকে মরগান। একবার বাঁ পাশে এগিয়ে প্রায় সমান সমান হয়ে গেল সাইক্লপস। ধা করে এসে ওটাকে বাড়ি মারল করভেট, কয়েক জায়গার রঙ তুলে দিল। তুবড়ে গেল বডির ওসব জায়গা। রাস্তায় এই কাণ্ড চলতে দেখে হতবাক হয়ে গেছে অনেক ড্রাইভার। জোরে জোরে হর্ন বাজাতে শুরু করেছে।

রবিন বলল, করভেট বেচারার স্যালভিজ ইয়ার্ডে যেতে আর দেরি নেই।

ভুল বলেনি সে। চমৎকার গাড়িটার করুণ চেহারা হয়েছে। দুই পাশে রঙ চটে গেছে অনেক জায়গায়, তুবড়ে গেছে শরীর। বাম্পারের একটা পাশ খুলে ঝুলছে, রাস্তায় ঘষা লেগে আগুনের ফুলকি ছিটাচ্ছে। বসে যাওয়া ফেন্ডারের চাপে একনাগাড়ে আর্তনাদ করে চলেছে চাকাটা।

ঘষা লেগে রাবার ক্ষয়ে গিয়ে পাতলা হয়ে এল টায়ার, আর সইতে পারল না। বিকট শব্দ করে ফাটল। পাগল হয়ে গেল যেন করভেট। হুঁশজ্ঞান সবকিছু হারিয়ে রাস্তার গাড়িগুলোকে গুঁতো মারার জন্যে ছুটে যেতে লাগল এদিক ওদিক। সবাই সরে যেতে চাইছে পাগলা গাড়ির নাকের সামনে থেকে। ব্রেক কষার ফলে একাধিক টায়ারের কর্কশ শব্দ হলো। হর্ন বাজল। রাগত চিৎকার শোনা গেল ড্রাইভারদের। অবশেষে গাড়িটাকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এলেন মরগান।

ডান পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল সাইক্লপস। বাঁ পাশে চেপে আসছে ইমপালা। কোণঠাসা করে ফেলল করভেটকে।

এখন আর কিছুই হারানোর নেই মরগানের। দুটো গাড়ির মাঝখান দিয়ে ভয়ানক ভাবে কাঁপতে কাঁপতে চলেছে তাঁর গাড়ি। থামলেন না এত কিছুর পরেও। দুই সারি গাড়িকে মাঝখান দিয়ে কেটে বেরিয়ে চলে যেতে চাইছেন ডানের রাস্তায়। কিন্তু যেতে দিলেন না ডিকসন।

করভেটের গায়ে প্রায় ঘষা লেগে বেরিয়ে গেল সাইক্লপস। সামনে গিয়ে পথ রোধ করে দাঁড়াল লাল গাড়িটার। থামতে বাধ্য হলেন মরগান। তবে সেটা মুহূর্তের জন্যে। পরক্ষণেই শাঁই শাঁই স্টিয়ারিং কেটে নাক ঘোরাতে শুরু করলেন গাড়ির।

ভ্যান থামতে না থামতেই ঝটকা দিয়ে খুলে গেল এক পাশের দরজা। লাফিয়ে রাস্তায় নামল মিরিনা। ভয় পাচ্ছে বোঝা যায়, তবে ছাড়তেও রাজি নয়। টান দিয়ে গা থেকে খুলে ফেলল আলখেল্লা বুলফাইটারদের লাল কাপড়ের মত করে ধরল। তাকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল করভেট। সোজা ওটার ডান উইন্ডশীন্ডে আলখেল্লা ছুঁড়ে মারল সে।

সামনের কিছুই দেখতে পাচ্ছেন না মরগান। মোড় নিতে ব্যর্থ হলেন তিনি। অন্ধের মত রাস্তা হাতড়ে বেড়াতে গিয়ে দড়াম করে লাইটপোস্টে গুতো লাগিয়ে বসল করভেট।

পুলিশ যখন হাজির হলো, দেখল, মরগানকে ঘিরে রেখেছে সাতজন লোক। বিধ্বস্ত চেহারা হয়েছে কনভেনশন চীফের, তবে জখম হয়নি কোথাও। হাতে ধরা রয়েছে তখনও ব্যাগটা, যেটাতে রয়েছে ডাকাতির মাল।

১৮

ডাকাতির দায়ে জেলে যেতে হলো মরগানকে। তবে কনভেনশন টীফের জন্যে কনভেনশন থেমে থাকল না। চলল শেষ দিন পর্যন্ত, যতদিন চলার কথা। রবিবারে তো প্রচন্ড ভিড় হলো, সব চেয়ে বেশি ভিড়। সুমাতো কমিকের স্টল খালি, চুটিয়ে ব্যবসা করল অন্য স্টলগুলো।

বেশি ভিড় হলো ম্যাড ডিসনের দোকানের সামনে, লোক জেনে গেছে, একটা অপরাধ চক্রকে ভাঙতে সাহায্য করেছেন তিনি। বিরাট বিজ্ঞাপন হয়ে গেছে এটা তার জন্যে। বই বিক্রি করে অটোগ্রাফ দিতে দিতে হাঁপিয়ে উঠলেন তিনি, তাঁকে সাহায্য করার জন্যে বাড়তি লোক নিয়োগের পরেও।

এরই মাঝে এক ফাঁকে কতগুলো কমিক উল্টেপাল্টে দেখলেন, কেনার জন্যে। বললেন, আরও ভাল অবস্থায় পেলে ভাল হত। দুটো পাতা দুমড়ে গেছে। মলাটটায় একটু টান লাগলেই খুলে চলে আসবে। আরও যত্ন করে রাখা উচিত ছিল তোমার। কিশোরের দিকে তাকিয়ে হাসলেন তিনি।

পারতাম, হেসেই জবাব দিল কিশোর। একটা সুন্দরী মেয়ের বিপদ তো, সাহায্য করতেই হলো। এগুলোর দিকে আর নজর দিতে পারিনি।

বিশ ডলারের তাড়া বের করে নোট গুনতে শুরু করলেন ডিকসন। কয়েকটা বের করে নিয়ে টেবিলে রাখলেন। এই হলো গে কমিকের দাম, বললেন তিনি। আরও কিছু নোট বের করে সেগুলোর সঙ্গে রেখে বললেন, আর এটা হলো গিয়ে বোনাস।

তাকিয়ে রয়েছে তিন গোয়েন্দা। বিশ্বাস করতে পারছে না যেন। যা ইনভেস্ট করেছিল ওরা কমিকগুলোতে, তার অনেক গুণ বেশি ফেরত পেয়েছে। প্রায় আটশো ডলার!

টাকাগুলো পকেটে রাখতে রাখতে কিশোর বলল, মনে হয় অনেক বেশি দিয়ে ফেললেন, মিস্টার ডিকসন। চাইলে এখনও ফেরত নিতে পারেন। ব্যবসা করতে এসেছি আমরা, গলা কাটতে নয়।

কি যে বল! পনেরো মিনিটেই তুলে ফেলব ওই টাকা! হাসিতে দাঁত বেরিয়ে গেল তাঁর। আশা করছি তোমারগুলো থেকেই তুলে ফেলব। আর যদি লাভ তেমন না-ই হয়, কুছ পরোয়া নেই। ফ্যান ফানটা বিক্রি করে দিয়ে টাকা তুলব। যেটাতে জাল অটোগ্রাফ রয়েছে। ওটার জন্যে তো এখন পাগল হয়ে আছে সংগ্রাহকরা। পুলিশের কাছ থেকে ফেরত এলে আর একটা মিনিটও আটকাতে পারব না। চাই কি, বলেকয়ে হুফারের একটা আসল সইও করিয়ে নিতে পারি। তাহলে দাম আরও চড়ে যাবে।

অতটা আশা কোরো না, পাশ থেকে বলে উঠল হুফার। কখন এসে দাঁড়িয়েছে খেয়ালই করেনি তিন গোয়েন্দা কিংবা ডিকসন। অন্য কমিকে সই করে দিতে রাজি আছি, ওটাতে নয়।

হুফার, প্লীজ, অনুরোধ করলেন ডিকসন। এখন তো আর…

তার মুখের দিকে তাকিয়ে রয়েছে হুফার। মাথা নেড়ে বলল, বেশ, দিতে পারি। তবে লাভের কমিশন দিতে হবে আমাকে।

আজব লোক, এই কমিকের মানুষগুলো, ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেললেন ডিকসন। টাকা ছাড়া আর কিছু বোঝে না। খালি ব্যবসা…

মাঝখান থেকে কিশোর বলল, একমাত্র এডগার ডুফার বাদে। তাকে তো দেখছি না?

হ্যাঁ, মাথা দোলাল হুফার, এডের লোভটোড নেই। গোন্ড রুমে গেলেই পাবে তাকে। রক অ্যাসটারয়েডে ডুবে রয়েছে। প্রোজেকটরটা জায়গামত বসিয়ে ফেলা হয়েছে আবার। গিয়ে দেখগে, লোকের কি ভিড়।

লুকানোর জায়গা খুঁজে বের করেছিল বটে মরগান, রবিন বলল। সব তো ফাঁস হয়ে গেছে। তার দলের এখন কি হবে? বান্দাবাজি করে নিশ্চয় অনেক লোকের পকেট মেরেছে?

তা তো মেরেছেই, ডিকসন বললেন। ভাওতা দিয়ে অনেক লোককে ঠকিয়েছে। টাকা এনেছে অনেক কমিক বিক্রেতা আর সংগ্রাহকের কাছ থেকে। আসল ভেবে সাদা-কালো যে সব কমিক কিনেছিল ওরা, সেগুলোর কথা ভেবে এখন কপাল চাপড়াচ্ছে। ওরা তো ভেবেছিল অনেক কমে অনেক দামি জিনিস পেয়ে যাচ্ছে। এভাবে ঠকবে, কল্পনাও করতে পারেনি।

গম্ভীর হয়ে গেল হুফার। ঠকিয়েই যেত, যদি বেশি লোভ করতে গিয়ে জাল অটোগ্রাফের শয়তানিটা না করত। তবে একটা ব্যাপার ভালই হয়েছে। ধরা না পড়লে আরও অনেক বেশি ঠকানোর ব্যবস্থা করত। রঙিন কমিক ছেপে তাতে জাল অটোগ্রাফ দিয়ে পাইকারী হারে ঠকাত মানুষকে।

ওদেরও দোষ আছে। অনেকেরই, মুসা বলল। শুনেছি, জেনেশুনেই ঠকে ওরা। কয়েকজনকে নাকি গিয়ে বলেছে মরগান, দেখুন তো সইটা জাল কি-না? ওরা দেখেছে, চিনেছেও। বলেনি। জানে, জাল হলে আসলের চেয়ে দাম বেড়ে যাবে। বেশি দাম যদি চেয়ে বসে আবার মরগান, সে জন্যে বলেছে, না আসলই। তারপর তাড়াতাড়ি তার হাতে দামটা ধরিয়ে দিয়ে কেটে পড়েছে। ভেবেছে, আহা কি লাভটাই না করলাম!

ওদের এই লোভের জন্যেই খেলাটা খেলতে পেরেছে মরগান, কিশোর বলল। অনেককেই দলে টেনেছে সে, এমন কি নীল বোরামকেও। ভুলটা করেছে হুফারকে কনভেনশনে দাওয়াত দিয়ে। অটোগ্রাফ দেয়া ফ্যান ফানটা বিক্রি করে দিয়েছে বোরাম, একথা যদি জানত মরগান তখন, তাহলে ভুলটা আর করত না।

মাথা ঝাকাল হুফার। হ্যাঁ, তাহলে বুঝে যেত, ওই অটোগ্রাফ আমার চোখে পড়লেই সব ভেস্তে যাবে।

বইটা কেনার জন্যে দেখলে না, কি রকম পাগল হয়ে গিয়েছিল বোরাম! হাসলেন ডিকসন।

কিন্তু যেহেতু আপনি বেচলেন না, কিশোর বলল। চুরি করতে বাধ্য হলো মরগান। এভাবে এক ঢিলে দুই পাখি মারতে চেয়েছিল সে। হুফারকেও বের করে দিতে চেয়েছিল কনভেনশন থেকে। ডাকাতি হলে সবাই ভাববে, হুফারই কাজটা করেছে। মানে মানে তখন কেটে পড়বে সে, এই ছিল মরগানের ধারণা। যত ভাবে সম্ভব, হুফারকে ঠেকাতে চেয়েছিল, যাতে অটোগ্রাফটা তার চোখে না পড়ে। সে বুঝতে পেরেছিল, পড়লে তার সমস্ত জারিজুরি ফাস হয়ে যেতে পারে। লাটে উঠতে পারে অবৈধ ব্যবসা।

আমি যে এখানে আমার ধান্দায় এসেছি, এটাও জানত না সে, হুফার বলল।

ভুল আরও করেছে, বলল রবিন। ডাকাতির পর আমাদের তিনজনকে, বিশেষ করে কিশোরকে উৎসাহিত করেছিল কেসের তদন্ত করার জন্যে। কিশোর পাশা যে কি চিজ সেটা কি আর ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পেরেছিল। এ কাজ করেছে সে নিজেকে সন্দেহমুক্ত রাখতে। এবং সবচেয়ে বড় ভুলটা করেছে।

তবে ঘোলা পানি কম খাওয়ায়নি আমাদের, স্বীকার করল কিশোর। মিরিনার ব্যাগে কমিকগুলো রেখে তো মহাদ্বিধায় ফেলে দিয়েছিল আমাকে।

হেসে উঠল মুসা, কিন্তু বেচারা জানত না, দ্বিধায় পড়লে যে খেপা বাঘ হয়ে যায় কিশোর পাশা।

তোমরাও কি আর কম নাকি? এক ঘুসি খেয়েই তো পাগল হয়ে উঠলে প্রতিশোধ নেয়ার জন্যে।

অনেক সময় নষ্ট করেছেন ডিকসন। ওদিকে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে তার সেলসম্যানেরা। ওদেরকে সাহায্য করতে যেতে চাইলেন তিনি। ছেলেদের বললেন, যা-ই বলো, তোমাদের মত গোয়েন্দা আমি আর দেখিনি। সাংঘাতিক ছেলে তোমরা তোমাদের সঙ্গে কাজ করতে খুব ভাল লেগেছে আমার। ইয়ে, পুরানো কমিক পেলেই চলে আসবে আমার দোকানে। দোকান তো চেনোই। কেনার মত হলে কিনে নেব। এক এক করে তাকালেন ওদের মুখের দিকে। তো, এখন যে মাপ করতে হয় আমাকে?

নিশ্চয়ই, তাড়াতাড়ি বলল কিশোর। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। কমিকগুলো কিনে নেয়ার জন্যে…

জলদি ভাগ, হেসে রসিকতা করল হুফার। নইলে আবার তোমাদের অটোগ্রাফ চেয়ে বসবে। বাপরে বাপ, এমন ব্যবসায়ী আমি আর দেখিনি!

ডিকসন আর হুফারকে গুড-বাই জানিয়ে দরজার দিকে রওনা হলো তিন গোয়েন্দা। ভিড় ঠেলে কিছুদূর এগোতেই দেখতে পেল ক্যামেরার ফ্ল্যাশারের ঝিলিক। মিরিনা জরডানের ছবি তুলছে উৎসাহী তরুণেরা।

কিশোরকে দেখেই উজ্জ্বল হলো মিরিনার মুখ। কিশোর!

উম‥হাই! কোনমতে বলল কিশোর। এড়িয়েই যেতে চায়। কেস শেষ, মিরিনার ব্যাপারেও তার আগ্রহ শেষ।

কিন্তু এত সহজে তাকে রেহাই দিল না মিরিনা। এগিয়ে এল। আমাকে বিখ্যাত করে দেয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে ওরা, কিশোর। তবে আমি তো জানি, এ সবের পেছনে আসল ক্রেডিটটা কার। তোমার। নইলে বিখ্যাত হওয়া তো দূরের কথা, অপমানিত হয়ে এই হোটেল থেকে বিদেয় হতে হত আমাকে। তুমি আমাকে চুরির অপবাদ থেকে বাঁচিয়েছ, তুমি আমাকে কিডন্যাপ হওয়া থেকে রক্ষা করেছ। মরগানকে ধরার জন্যে ফাঁদটা তুমিই পেতেছ। কিশোর, কি বলব তোমাকে, তোমার মত মানুষ আমি সত্যিই দেখিনি! তুমি একটা লোক বটে!

প্রমাদ গুনল কিশোর। সবার সামনে এখন প্রেম না নিবেদন করে বসে। তাহলে ভীষণ লজ্জায় পড়তে হবে। কৌতূহলী চোখে অনেকেই তাকিয়ে রয়েছে ওর দিকে। পায়ে পায়ে এগিয়ে আসতে শুরু করেছে দুএকজন। কিশোর বলল, থ্যাংকস, মিরিনা। এখন তো আমার সময় নেই। পরে কথা বলব। তা কোথায় থাক তোমরা?

পোর্টল্যান্ডে।

চোখ মিটমিট করল কিশোর। ওরিগনের পোর্টল্যান্ড?

হ্যাঁ।

অনেক দূর…

অত দূরে যেতে হবে না তোমাকে! আরও কিছুদিন লস অ্যাঞ্জেলেসেই আদি আমরা। আর যদি মডেলিঙের কাজটা পেয়েই যাই, তাহলে তো এখানেই থাকতে হবে। দেখা করতে পারব…

ঘিরে ফেলছে ওদেরকে তরুণেরা। আর একটা মুহূর্তও এখানে নয়, ভাবছে কিশোর। বলল, পরে কথা বলব, ঠিক আছে? চলি, গুড বাই।

হলের বাইরে বেরিয়ে হাঁপ ছাড়ল গোয়েন্দাপ্রধান। বাপরে বাপ! বড়। বেঁচেছি!

তুমি যে কি কিশোর, বুঝি না, রবিন বলল। মেয়েদের সঙ্গে কথা বলতে গেলেই…

ওসব কথা থাক। কিশোরের দিকে হাত বাড়াল মুসা। আমার টাকাটা এখনই দিয়ে দাও। পরে ভুলে যাব।

চলো, গাড়িতে গিয়ে দেব, এলিভেটরের দিকে রওনা হলো কিশোর। এখানে বের করলে আবার কে কোনদিক দিয়ে ডাকাতি করে নেয়, ঠিক আছে।

আমাদের টাকা নিয়ে হজম করবে এতই সহজ? বুকে চাপড় দিয়ে বল মুসা, আমরা তিন গোয়েন্দা। মঙ্গল গ্রহে গিয়েও পার পাবে না ব্যাটা। ঠিক ধরে নিয়ে আসব।

তার কথায় হাসল রবিন আর কিশোর।

***

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *