আমিই কিশোর

ভলিউম ১১৭ – আমিই কিশোর – তিন গোয়েন্দা – রকিব হাসান – সেবা প্রকাশনী

চোখ মেলে বিছানায় উঠে বসলাম। আড়মোড়া ভেঙে হাই তুললাম।

আউ! বাঁ কাঁধ ব্যথা করছে! কাঁধ ডলে দেয়াল ঘড়ির দিকে চাইলাম।

সকাল সাতটা পঁচিশ? চাচা-চাচী আমাকে ডাকেনি কেন? স্কুলে তো দেরি হয়ে যাবে আমার! বিছানা থেকে লাফিয়ে নেমে বাথরুমের দিকে এগোলাম। আয়নায় কাঁধটা দেখে নিলাম। জখমটা গুরুতর, কালশিটে পড়ে গেছে। কীভাবে হলো এটা? গতকালকের ফুটবল প্র্যাকটিসের সময়? নাকি দুএকদিনের মধ্যে বাইক থেকে পড়ে গেছিলাম? মনে করতে পারলাম না।

কাঁধ নিয়ে ভাবতে ভাবতে নীচে নেমে এলাম। রাশেদ চাচা, মেরি চাচী আর ডন টেবিলে ব্রেকফাস্ট করতে বসেছে।

থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম। আমার চেয়ারটা নেই। আমার জন্য খাবারও দেওয়া হয়নি।

আজব তো! বললাম, ফাঁকা জায়গাটার দিকে চেয়ে রয়েছি। ডন, ঠাট্টা করছ আমার সাথে? আমার চেয়ার কোথায় সরিয়েছ? এখন মজার সময় নয়। স্কুলে দেরি হয়ে যাবে।

হঠাৎই অনুভব করলাম ঘরে কীরকম পিনপতন নিস্তব্ধতা নেমে এসেছে। চাচা-চাচী আর ডনের দিকে চাইলাম।

চাচা চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াচ্ছে। চাচী সরে গিয়ে ডনের পিছনে দাঁড়াল। ভাবখানা এমন যেন ওকে রক্ষা করছে! ওরা তিনজন আমার দিকে এমনভাবে চেয়ে রয়েছে, আমি যেন…অচেনা কেউ।

এখানে কী ঘটছে? বলতে শুরু করলাম।

আমরাও সেটাই জানতে চাই, ইয়াং ম্যান, ক্রুদ্ধ কণ্ঠে বলল চাচা। গম্ভীর শোনা তার কথাগুলো।

থমকে গেলাম আমি, চোখ পিটপিট করলাম, হাসার চেষ্টা করলাম।

আগে বলল আমার চেয়ার কই? বললাম।

চাচী ঝুকে পড়ে ডনের কানে কানে কী যেন বলল। মনে হয় ওকে নিজের কামরায় যেতে বলছে।

আমরা যতক্ষণ না আসি ঘরেই থাকিস, চাচীকে বলতে শুনলাম।

ও কি খারাপ লোক, আণ্টি? আমার দিকে আঙুল তাক করে বলল ডন।

হ্যাঁ, আমি খুব খারাপ লোক, বলে কটমট করে চাইলাম ওর দিকে। আমি কিশোর পাশা, খুনে দানব।

ডন, চলে যা! চাচী বলল, এবং ডন চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে উঠে বেরিয়ে গেল কিচেন থেকে।

চাচা ঘুরে দাঁড়িয়ে চাইল আমার দিকে। মুখের চেহারা কঠোর। সরাসরি চোখ রেখেছে আমার চোখে।

শোনো, ইয়াং ম্যান, বলল, আমরা এখানে কোন ঝামেলা চাই। তুমি এক্ষুনি চলে যাও এবাড়ি ছেড়ে। দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাও, আমরাও ভুলে যাব ঘটনাটা, নইলে-

নইলে কী? কী বলছ তুমি এসব, চাচা?

নইলে, চাচী চাচার কথাগুলো শেষ করল, আমরা পুলিস ডাকতে বাধ্য হব। আর আমাদেরকে চাচা চাচী বলা বন্ধ করো। আমরা তোমার চাচা-চাচী নই এবং কোন কিশোর পাশার নামও আমরা শুনিনি!

ঠিক আছে, শ্রাগ করলাম। তোমরা যা বলো। স্বীকার করতেই হবে এটাই এখন অবধি আমাদের সেরা পারিবারিক কৌতুক। কিন্তু আমাকে এর শেষ দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। কারণ এখন বাজে পৌনে আটটা, আর পনেরো মিনিট পর প্রথম ঘণ্টা পড়বে।

ভাবতেই পারছি না আমাকে ব্রেকফাস্ট মিস করতে হচ্ছে, বলে কিচেনের দরজার দিকে এগোলাম। স্কুলে ক্যাফেটেরিয়া থেকে দুই পিরিয়ডের ফাঁকে একটা আপেল খেয়ে নেব।

দরজার কাছে বইয়ের র্যাক। স্কুল ব্যাগ নেওয়ার জন্য দাঁড়ালাম ওখানে। ব্যাগটা নেই। আরেকটা ঠাট্টা?

অনেক হয়েছে, বললাম, কিন্তু আমার স্কুল ব্যাগ কোথায়?

তোমাকে চলে যেতে বলা হয়েছে, কথা কানে যায়নি? চাচা বলল।

বই ছাড়া স্কুলে যাব কীভাবে, চাচা? বললাম।

আর নয়। আমি এবার পুলিস ডাকছি, চাচী বলল, কিচেন ফোনের দিকে পা বাড়াল।

এখুনি বেরিয়ে না পড়লে দেরি হয়ে যাবে। না হয় একদিনের জন্য কোন ক্লাসমেটের বই ধার নিয়ে নেব।

ঠিক আছে, আমি যাচ্ছি, বললাম। রকি বীচ পুলিস ডিপার্টমেন্টকে আমার শুভেচ্ছা। গত বসন্তে সার্জেন্ট কলিন্স আমাকে স্কুল প্রজেক্টে সাহায্য করেছিল। সবাই ভাল থেকো, চলি।

স্কুলে পৌঁছতে আমার যতক্ষণ সময় লাগে, আজকে এসব মশকরার জন্য তার চাইতে আগেভাগে পৌঁছে যেতে হবে।

বাপ রে, চাচা-চাচীকে আগে কখনও এমন করতে দেখিনি। আজকে কি এপ্রিল ফুল? নাহ্, এখন অক্টোবরের মাঝামাঝি। তা হলে ওরা এমন করল কেন?

এর তল বের করতে হলে আমাকে সন্ধে পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। এখন আমার সামনে সারাদিনের ক্লাস এবং তারপর দুঘণ্টার ফুটবল প্র্যাকটিস। সামনে বড় ম্যাচ আমাদের, দলের সেরা পাস রিসিভার হিসেবে অনেক দায়িত্ব আমার। প্রচুর খাটতে হবে।

এসব ভাবছি এসময় এক মিনিভ্যান স্টপ সাইনে এসে দাঁড়াল। ভ্যানটাকে সঙ্গে সঙ্গে চিনতে পারলাম। আমাদের ফুটবল কোচ হেনরির। উনি আমাকে লিফট দিলে দুমিনিটের মধ্যে স্কুলে পৌঁছতে পারব।

হাই, কোচ হেনরি! চেঁচিয়ে উঠে হাত নাড়লাম।

আজকের আবহাওয়া নাতিশীতোষ্ণ। সামনের জানালা খোলা তার। আমার গলা শুনতে পেয়ে ঘাড় ফিরিয়ে চাইলেন। কোচ হেনরি শুধু যে ভাল কোচ তা-ই নয়, ভাল মানুষও। সব সময় শিষ্যদের সাহায্য করতে একপায়ে খাড়া।।

আমাকে লিফট দেবেন? আমার একটু দেরি হয়ে গেছে।

আমাকে অবাক করে দিয়ে কোচ হেনরি আমার দিকে চেয়ে রইলেন দুমুহূর্ত। চিনতে পারার কোন লক্ষণ নেই তাঁর দৃষ্টিতে। মুখে চিরাচরিত হাসি নেই। আমি আবারও গলা ছাড়ার আগেই অ্যাক্সিলারেটরে পা দাবিয়ে রওনা হয়ে গেলেন তিনি।

আমি ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলাম। ভ্যানটা রাস্তা ধরে দূরে স্কুলের দিকে চলে গেল।

আমি কমিনিট দেরি করে স্কুলের মাঠে পৌঁছলাম। ছেলে-মেয়েরা সামনের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে, প্রথম ঘণ্টা পড়ার অপেক্ষা করছে। রকি বীচে এখনই সম্ভবত আমি সেরা সময় কাটাচ্ছি। আবহাওয়া, ফুটবল মৌসুম, বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গ-অসাধারণ।

মুসাকে দেখলাম উপরের ধাপে। ও স্কুল টিমের কোয়ার্টারব্যাক।

আমাদের কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে কথা বলছে ও, তাদের মধ্যে জোয়ান জেনসেনও রয়েছে, সে প্রধান চীয়ারলিডার। মুসা নিশ্চয়ই মজার কিছু বলেছে, কারণ সবাই হাসছে।

অ্যাই! চেঁচিয়ে উঠে সিড়ি ভেঙে দৌড়ে উঠতে লাগলাম। কী খবর তোমাদের?

কেউ আমার দিকে চাইল না। মুসা কথা চালিয়ে যাচ্ছে।

শনিবার হ্যামিল্টনদের মজা দেখাব, বলল মুসা। আমাদের পাস রিসিভাররা ওদের মত ভাল না হলেও আমরা ওদেরকে হারাতে পারব।

পাস রিসিভাররা ওদের মত নয়? মুসা আমাকে ছোট করছে কেন? আমি হ্যামিল্টনদের যে কোন পাস রিসিভারের চাইতে কোন অংশে কম নই।

মুসা, আমি এবছর আটবার টাচডাউন করেছি। সেটা নিশ্চয়ই খুব খারাপ নয়, বললাম।

এই প্রথমবারের মত দলটা ঘুরে দাঁড়িয়ে আমার দিকে চাইল।

অপেক্ষা করলাম মুসা কিছু একটা বলবে। দলের সবাই আমার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে। একটু নার্ভাস বোধ করতে লাগলাম আমি।

কেউ কিছু বলছ না কেন? বললাম।

আমি বলছি, বলল মুসা। এক কদম আগে বেড়ে সরাসরি আমার চোখে চোখে চাইল। ওর চোখের দৃষ্টি দেখে মেরুদণ্ড বেয়ে হিমস্রোত নেমে গেল আমার। তুমি আমাদের চেনো দেখা যাচ্ছে, বলল ও। কিন্তু একটা প্রশ্নের জবাব দাও তো…তুমি কে?

হাসিতে ফেটে পড়লাম। ঠেকাতে পারলাম না।

তোমরা সবাই মিলে মজা করছ! বললাম।

কীসের মজা? প্রশ্ন করল জোয়ান। কে এ?

ওর এবং অন্যদের মুখের চেহারা দেখে মনে হচ্ছে ওরা আমাকে চেনে না।

মুসার দিকে ঘুরে দাঁড়ালাম।

শোনো, মুসা, বাসাতেও মশকরা করে আমার বইয়ের ব্যাগ লুকিয়ে ক্লান্ত হয়েছে। কাজেই ইংরেজি আর বায়োলজি ক্লাসে তোমার বইগুলো আমাকে ধার দিয়ো, কেমন?

মুসারমুখের চেহারায় ব্যঙ্গ ফুটল। এক পা পিছু হটল ও।

কী বলতে শুরু করেছিল, কিন্তু এসময় স্কুলের ঘণ্টা বাজল।

মুহূর্তে সবাই স্কুল বিল্ডিঙের দিকে পা বাড়াল। আমি প্রথমে যাব তিনতলার হোমরুম ক্লাসে। সিঁড়ির দিকে এগোচ্ছি, দেখা হয়ে গেল রবিনের সঙ্গে।

অ্যাই, রবিন, পাশ কাটানোর সময় বললাম। ও আমার দিকে চেয়ে ভ্ৰ কুঁচকাল, কিন্তু চলা থামাল না। কী ব্যাপার, রবিন? কিছু হয়েছে?

রবিন পিছু ফিরে আমার দিকে চাউনি বুলাল। ভ্রূ কুঁচকানো এখনও।

কী আবার হবে? পাল্টা বলল ও। তোমাকে চিনতে পারলাম। সিঁড়ি ভেঙে নেমে গেল ও।

চিনতে পারল না মানে? আজব তো। সিঁড়ির মাথায় থেমে দাঁড়ালাম। মনে হচ্ছে সেভেন্থ গ্রেডের সবাই আমার সঙ্গে তামাশা করছে।

ছেলে-মেয়েরা দ্রুতবেগে আমার পাশ কাটাচ্ছে, শেষ ঘণ্টা পড়ার আগেই পৌঁছতে চাইছে হোমরুমে। উপলব্ধি করলাম আমারও তাই করা উচিত।

রুম নম্বর ২০৩-এ প্রবেশ করলাম। জানালার পাশে, আমার ডেস্কের উদ্দেশে পা বাড়ালাম। ওখানে পৌছে দেখি জো লেমন আমার সিটে বসা।

তুমি মনে হয় ভুল সিটে বসেছ, ডেস্কের পাশে দাড়িয়ে বললাম। জো বিশালদেহী ছেলে, মোটেই বন্ধুভাবাপন্ন নয়। নোটবইতে কী সব টুকছিল।

জো মুখ তুলল। কয়েক মুহূর্তের জন্য আমার দিকে চোখ পিটপিট করে চাইল। এবার ধীরে সুস্থে উঠে দাঁড়াল। ও আমার চাইতে পাক্কা চার ইঞ্চি লম্বা। আমার মুখের উপর আস্তে আস্তে গর্জন ছাড়ল, তুমি…আমাকে…কী…বললে?

গলাটা কেমন শুকনো ঠেকল। কাঁধের ব্যথাটা আবারও শুরু হলো।

বললাম তুমি আমার সিটে বসেছ। তুমি সবসময় আমার এক সিট পিছনে বসো। এটা কোন ব্যাপার না, কিন্তু তুমি সরে গেলে আমি আমার সিটে বসতে পারতাম।

কে এ? বলে চারধারে নজর বুলাল জো। অন্যান্য ছেলে-মেয়েরা আমাদের দিকে চেয়ে রয়েছে। বেশিরভাগ শ্রাগ করল। কেউ কেউ হেসে উঠল।

বিরক্ত লাগতে শুরু করেছে আমার। বাসায় আর ক্লাসের বাইরে ঠাট্টা-ইয়ার্কি মেনে নেয়া যায়। কিন্তু ক্লাস বসতে চলেছে, এখন এসব ভাল লাগছে না। তা ছাড়া জো লেমন আমার বন্ধু নয়। ও কেন মশকরা করবে আমার সঙ্গে? আমি এমনকী ওকে পছন্দও করি না।

দেখো, জো, মশকরা করছ বুঝতে পারছি, কিন্তু আমি এখন আমার সিটে বসতে চাই। তুমি পিছনে গিয়ে-

এসময় শেষ ঘণ্টা পড়ল। মিসেস ফিশার, আমাদের হোমরুম টিচার সবাইকে চুপ করে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে বললেন।

সবাই যার যার সিটে বসে পড়ো, বললেন তিনি। পিছনের দিকে চাইলেন। জো আমার সিটে বসা। আমি ডেস্কের পাশে বোকার মত দাঁড়িয়ে। ওখানে কী হচ্ছে? মিসেস ফিশার প্রশ্ন করলেন।

মিসেস ফিশার, জো লেমন আমার সিটে বসে আছে, ছাড়তে চাইছে না, বললাম।

মিসেস ফিশার করিৎকর্মা মানুষ। আমি জানি এ সমস্যার সমাধান এখুনি হয়ে যাবে।

কিন্তু তুমি কে, ইয়াং ম্যান? প্রশ্ন করলেন তিনি।

চারপাশে নজর বুলিয়ে নিলাম। কমুহূর্ত লেগে গেল উনি কী বলছেন বুঝতে।

আমি কে? বলতে গিয়ে গলা চড়ে গেল সামান্য। মিসেস ফিশার ফিফথ গ্রেড থেকে আমার হোমরুম টিচার।

হ্যাঁ, তোমার নামটা প্লিজ, সাড়া দিলেন তিনি।

মিসেস ফিশারও তামাশায় যোগ দিয়েছেন! ভাল ফ্যাসাদেই পড়া গেছে। কিন্তু মিসেস ফিশার তো কখনও ঠাট্টা করেন না। ঠিক করলাম আমিও খেলে যাব।

আমার নাম কিশোর পাশা, মিসেস ফিশার। মিসেস ফিশার ডেস্কে বসলেন, কিছু কাগজ-পত্র পরীক্ষা করলেন তিনি। এবার মুখ তুলে আমার দিকে চাইলেন।

এই হোমরুমে নতুন কোন স্টুডেন্ট নেয়া হয়েছে এমন কোন ননাটিশ দেয়নি হেড অফিস। তুমি বরং মেইন ফ্লোরে গিয়ে ব্যাপারটা  তাদেরকে চেক করে দেখতে বলল, বললেন মিসেস ফিশার।

ইয়েস, ম্যাম, বললাম। দরজার দিকে এগোলাম। রব মিশেলের পাশ কাটাতে হলো। সামনের দিকে বসা সে। আমাদের ফুটবল টিমের সেন্টার। আজকে প্র্যাকটিসে দেখা হবে, রব, বললাম। রব এমনভাবে আমার দিকে চাইল, আমি যেন মঙ্গলগ্রহ থেকে এসেছি।।

হলওয়ে এখন নির্জন, ছেলে-মেয়েরা সব তাদের হোমরুমে। সিঁড়ি ভেঙে নেমে যাওয়ার সময় মাথায় খেলে গেল এক ঘণ্টা আগে আমি ঘুম থেকে ওঠার পর থেকে কী কী ঘটেছে।

আমি যাদেরকে চিনি তারা সবাই নাটক করছে। তারা আমাকে কেন বেছে নিয়েছে বুঝলাম না। এর শেষ কোথায় তাও জানা নেই আমার। কিন্তু আমাকে ব্যাপারটা জানতে হবে। স্কুল ফ্রন্ট অফিসটা আমার ঠিক সামনে।

অফিসে প্রবেশ করে দেখি মিসেস পোর্টার তাঁর সেক্রেটারি ডেস্কে বসা, কম্পিউটারে কাজ করছেন। মিসেস পোর্টার আমাকে ছোটকাল থেকেই চেনেন।

হাই, মিসেস পোর্টার, বললাম। তিনি মুখ তুলে চেয়ে মৃদু হাসলেন। আমি অনেকখানি স্বস্তি বোধ করলাম।

গুড মর্নিং, বললেন তিনি। আমি তোমার জন্যে কী করতে পারি?

ঠিক জানি না…ব্যাপারটা বেশ মজার। আমার প্রথমে প্রশ্ন করা উচিত-আপনিও কি এই জোকটার সাথে জড়িত?

আমার দিকে চেয়ে রইলেন তিনি।

জোক? কীসের জোক?

ভাল! ওরা মিসেস পোর্টারকে এরমধ্যে জড়াতে পারেনি। মিসেস পোর্টার আমাকে এই রহস্যের সমাধানে সাহায্য করতে পারবেন।

মানে আজ সকাল থেকে দেখছি চাচা-চাচী থেকে শুরু করে যার সাথেই দেখা হচ্ছে তারা সবাই আমাকে না চেনার ভান করছে। মিসেস ফিশার এমনকী আমাকে আপনার কাছে পাঠিয়েছেন ব্যাপারটার জট খোলার জন্য। হাসির ব্যাপার না?

মাথা ঝাঁকালেন মিসেস পোর্টার, আমার দিকে চাইলেন।

তোমার নাম কী?

আমি একদৃষ্টে চেয়ে রইলাম তার দিকে। ঠিক শুনেছি তো?

আহ, মিসেস পোর্টার, আমি ভেবেছিলাম আপনি এই তামাশাটার সঙ্গে নেই, বললাম।

আমি কোন তামাশা করছি না, বললেন মিসেস পোর্টার। কিন্তু তুমি তোমার নাম না বললে আমি তোমাকে কোন সাহায্য করতে পারব না–

আমি কিশোর পাশা, মিসেস পোর্টার, আপনি কে মনে করেছেন? আমি সেভেন্থ গ্রেডার, হোমরুম ২০৩-এ আছি, ফুটবল টিমের প্লেয়ার–

চেঁচাচ্ছ কেন? বললেন মিসেস পোর্টার, কম্পিউটারের কি টিপতে লাগলেন।

আমি একটু আপসেট হয়ে পড়েছি, বললাম, প্রথমে বললেন আপনি জোকটার মধ্যে নেই, কিন্তু এখন দেখছি আছেন।

জোক হচ্ছে এখানে, বললেন মিসেস পোর্টার, কম্পিউটার স্ক্রীনের দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে। কিন্তু জোকটা করছ তুমি।

তার মানে? প্রশ্ন করলাম। কম্পিউটার ফাইলে কিশোর পাশা নামে কারও রেকর্ড নেই। এখন তো নেইই, আগেও ছিল না।

এই প্রথমবারের মত সামান্য আতঙ্ক বোধ করলাম।

কম্পিউটার পারফেক্ট নয়, ভুল করে, বললাম। ঘুরে তাঁর চেয়ারের কাছে এলাম। কম্পিউটার স্ক্রীনের দিকে দৃষ্টি আমার।

নিজেই দেখো, বললেন মিসেস পোর্টার। এখানে K অক্ষরের মধ্যে কোথাও তোমার নাম নেই।

কম্পিউটারের কথা বাদ দিন, মিসেস পোর্টার। আমার দিকে তাকান-আমি কিশোর পাশা, আমাকে আপনি ছোটকাল থেকে দেখছেন! ঠাট্টাটা অনেক বেশি হয়ে যাচ্ছে না, আপনিই বলুন? আমি ক্লাসে ফিরে যেতে চাই, আমার বইগুলো ফিরে পেতে চাই, এবং চাই এই ননসেন্স বন্ধ হোক!

ঘন-ঘন শ্বাস নিচ্ছি এবং আমার কাঁধ এখন রীতিমত টাটাচ্ছে। ইতিকর্তব্য ঠিক করতে পারছি না। কাউকে বিশ্বাস করার উপায় নেই। সবাই আমার সঙ্গে তামাশা করছে। এর চাইতেও খারাপ ব্যাপার…আমার সন্দেহ হচ্ছে এটা আসলেই তামাশা কিনা। কিন্তু এ ছাড়া আর কীই বা হবে। আমি এক সকালে ঘুম থেকে উঠলাম আর তারপর কেউ আমাকে চিনতে পারছে না এটা কীভাবে সম্ভব!

আহ, কিশোর… পিছন থেকে কে যেন বলল।

ঘুরে দাঁড়ালাম। গভীর ভাবনায় এতটাই ডুবে ছিলাম, টেরই পাইনি মিসেস পোর্টার কখন বেরিয়ে গিয়েছিলেন কামরা ছেড়ে এবং এখন ফিরেছেন। তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে মিস্টার লাউয়ি, স্কুলের সাইকোলজিস্ট। সব ছাত্রের সাধারণ পরীক্ষা নেন তিনি, এবং কারও বিশেষ কাউন্সেলিঙের দরকার পড়লে তাও করেন।

মি. লাউয়ি আমার নাম ধরে ডেকেছেন।

বলুন, মিস্টার লাউয়ি? বললাম। অনুভব করলাম বড় ধরনের বিপদের মুখোমুখি হতে পারি। স্কুলের সাইকোলজিস্টকে ডেকে এনেছেন কেন মিসেস পোর্টার?

তুমি আমার নাম জানো? বিস্মিত শোনাল মি. লাউয়ির কণ্ঠ।

অবশ্যই জানি, জবাব দিলাম। আপনি স্কুলের সাইকোলজিস্ট, ছাত্র-ছাত্রীদের ইন্টেলিজেন্স টেস্ট নেন।

ঠিক বলেছ, বললেন মি. লাউয়ি। তা ছাড়া যে সব ছেলে-মেয়ে সামান্য…আপসেট ফীল করে আমি তাদেরকেও হেল্প করি। তুমি কি আপসেট, কিশোর?

ভীষণ আপসেট, মিস্টার লাউয়ি। সবাই বলছে তারা আমাকে চেনে না। আপনি হলেও আপসেট হতেন।

মি. লাঙলিঙের মরবের সাধারণীড়িয়ে মন মরালাম, স্ট্রেই

হ্যাঁ, হ্যাঁ, জানি। কিন্তু, আহ্, মিসেস পোর্টার বলছেন তুমি নাকি নিজেকে এ স্কুলের ছাত্র হিসেবে দাবি করছ। কিশোর, আমরা দুজনই জানি সেটা সত্যি নয়।

আচ্ছা, ওরা এবার স্কুলের সাইকোলজিস্টকেও এ খেলায় জড়িয়েছে।

আমি সিদ্ধান্ত নিলাম নিজের যুক্তি দিয়ে পাল্টা লড়াই করব।

মিস্টার লাউয়ি, আমি যদি এখানকার ছাত্র না-ই হব তা হলে সবার নাম…এমনকী আপনারও নাম জানলাম কীভাবে?

আমরা সেটাই ভাবছি, কিশোর, ঠাণ্ডা গলায় বললেন তিনি। তুমি আমাদের নাম জাননা কীভাবে? আমি তোমার বয়সী এক ছেলের কেসের কথা জানি। সে মরিয়া হয়ে উঠেছিল বিশেষ একটি স্কুলে অ্যাটেও করার জন্যে। সেজন্যে সে সমস্ত ফ্যাকাল্টি মেম্বার আর কিছু ছাত্র-ছাত্রীর নাম মুখস্থ করেছিল। বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে স্কুলটাতে অ্যাটেও করার চেষ্টা করেছিল ও। তবে প্রথম দিনই সে ধরা পড়ে যায়। ব্যাপারটা আসলেই দুঃখজনক।

আপনি বলছেন আমার মাথা খারাপ এবং আমি এখানকার ছাত্র নই।

ঠিক তা না, মৃদু কণ্ঠে বললেন মি. লাউয়ি। কিন্তু, কিশোর, আমরা কখনও কখনও কোন কিছু এত বেশি করে চাই যে কল্পনার লাগাম ছেড়ে দিই।

এটা কি আমার কল্পনা, আমি এবছরের ফুটবল টিমের স্টার্টিং মেম্বার? বলতে গিয়ে গলা চড়ে গেল আমার। মি. লাউয়ি আর মিসেস পোর্টার পরস্পর দৃষ্টি বিনিময় করে আমার দিকে চাইলেন।

তুমি ফুটবল টিমে আছ? মি. লাউয়ি প্রশ্ন করলেন। কণ্ঠস্বর শান্ত। সান্তনা দেয়ার চেষ্টা টের পাওয়া যায়।

হা! টিমের ফটো ঝুলছে এই অফিসের বাইরের দেয়ালে, বললাম আমি।

তা হলে গিয়েই বরং দেখা যাক, বললেন মি. লাউয়ি।

হল ফাঁকা আর চুপচাপ এখনও, তবে শীঘি সরগরম হয়ে উঠবে। প্রথম ক্লাসের ঘন্টা পড়বে যে কোন মুহূর্তে। আমি সোজা এগোলাম ফুটবল টিমের ফটোটার দিকে, ফ্রেমে বাঁধিয়ে যেটা ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে মেইন হলওয়েতে।

আমি রোজ ছবিটার সামনে এসে দাঁড়িয়ে থাকি। গর্ব বোধ হয় আমার। ফুটবল টিমের সদস্য হিসেবে আলাদা এক অনুভূতি কাজ করে, কেননা গায়ে-গতরে অন্যদের মত শক্তিশালী নই কিনা। আমি সামনের সারিতে। সেন্টার রব মিশেল আর কোয়ার্টার ব্যাক মুসার ঠিক মাঝখানে।

মিস্টার লাউয়ি, আমি যদি এ স্কুলের ছাত্র না হই তবে এর কী ব্যাখ্যা দেবেন

কথা বন্ধ হয়ে গেল আমার। ফটোটার দিকে চাইলাম। সামনের সারিতে রয়েছে রব মিশেল। তার পাশে দাঁড়িয়ে মুসা আমান। কিন্তু আমি নেই। ফটো থেকে আমি উধাও!

মি. লাউয়ি উকি মেরে ছবিটা দেখলেন।

তোমাকে দেখতে পাচ্ছি না, কিশোর। তুমি ছবিতে কোথায় দাঁড়িয়েছ?

এক পা পিছু হটলাম।

ওরা-ওরা ছবিতে কারসাজি করেছে। আমি টিমে আছি। আমি স্টার্টিং রাইট এণ্ড। যাকে খুশি জিজ্ঞেস করুন!

কিশোর, তুমি আমার সাথে এসো। আমাদের আরও কথা বলা দরকার, মি. লাউয়ি বললেন। হাত বাড়িয়ে আমার কাঁধে রাখলেন, যে কাঁধটা টাটাচ্ছে।

আউ! চেঁচিয়ে উঠে, সত করে সরে গেলাম। সে মুহূর্তে ঘন্টা বাজল এবং হলগুলো ভরে গেল ছাত্র-ছাত্রীতে। শশব্যঙে ক্লাসরুমের দিকে চলেছে তারা।

মি, লাউয়ির কাছ থেকে সরে পড়ার জন্য ছেলে-মেয়েদের স্রোতকে কাজে লাগালাম। লাউয়ির মনে কী ছিল কে জানে, কিন্তু আমি এতে জড়াতে চাই না।

আমি জানি একজন ফ্যাকাল্টি সদস্য আছেন যিনি অদ্ভুত এই খেলায় নিজেকে জড়াবেন না। মি, হালবার্ট, আমার বায়োলজি টিচার। তিনি আমাদেরকে সব সময় সত্য আর জ্ঞানের শিক্ষা দেন, বায়োলজির পাশাপাশি। মি. হালবার্টের কাছে আমাকে যেতে হবে।

ভাগ্যক্রমে, বায়োলজি আমার প্রথম ক্লাস, তাই দ্রুত পায়ে সায়েন্স ডিপার্টমেন্টের দিকে এগোলাম। কোনা ঘুরতেই দেখতে পেলাম মি. লাউয়ি স্কুলের এক দারোয়ানের সঙ্গে কথা বলছেন।

ঝট করে সরে গেলাম। আমাকে যাতে দেখতে না পায়। আমার ধারণা মি. লাউয়ি লোকটিকে আমার উপর নজর রাখতে বলছেন।

মি. লাউয়ি আর দারোয়ান দুদিকে চলে যেতেই, ক্লাসরুমের দিকে পা বাড়ালাম আমি। শেষ ঘণ্টা পড়ে গেছে ইতোমধ্যে, সুতরাং সবাই এখন যার যার ক্লাসে বসে পড়েছে।

দরজাটা বন্ধ। টান মেরে খুলে প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়লাম ভিতরে।

মিস্টার হালবা–বলতে শুরু করেছিলাম, কিন্তু শব্দটা আটকে গেল আমার গলায়।

মি. হালবার্ট সামান্য স্থূলকায়। মাথায় পাতলা, সাদা চুল, বয়স রাশেদ চাচার মত। কিন্তু ক্লাসের সামনে যিনি দাঁড়িয়ে তিনি সম্পূর্ণ ভিন্ন এক মানুষ। বছর পঁচিশেকের এক মহিলা টিচার। ভদ্রমহিলা হালকা-পাতলা, তেমন লম্বা নন-সম্ভবত চাইনিজ।

আমার দিকে চাইলেন তিনি।

কী চাই? আমার ক্লাসে ডিস্টার্ব করছ কেন? মিস্টার হালবার্ট কোথায়? প্রশ্ন করলাম। কে? মহিলা বললেন। মিস্টার হালবার্ট…যিনি এই ক্লাসটা নেন! বললাম।

অ্যাই, সেই পাগলটা আবার এসেছে, যে বলছিল ফুটবল টিমে আছে, রুমের মাঝখান থেকে একটি কণ্ঠ শোনা গেল।

কণ্ঠস্বর লক্ষ্য করে চাইলাম। মুসা এ কথা বলেছে।

মুসা, আমাকে সাহায্য করো, আমরা না বন্ধু? চেঁচিয়ে উঠলাম। ওরা এমনকী হলওয়ের ছবি থেকেও আমাকে বাদ দিয়েছে।

মিস লি, এর মাথার স্ক্রু ঢিলে।

জোয়ান জেনসেন। জোয়ান! ক্লাসে ও আমার স্টাডি পার্টনার। ও এমন কথা বলতে পারল!

মিস লি আমার দিকে এগিয়ে এলেন।

তুমি ভুল ক্লাসরুমে এসেছ, ইয়াং ম্যান।

আমার মনে হয় ও ভুল গ্রহে এসেছে! বলল মুসা। গোটা ক্লাস হেসে উঠল। আমার বিশ্বাস হলো না। ওরা এমনভাবে আমাকে নিয়ে হাসছে, আমি যেন ভাড়, সঙ!

হাসো, হাসো! চেঁচিয়ে উঠলাম, চোখ জ্বালা করছে অনুভব করলাম। কে তোমাদের চায়! দৌড় দেয়ার জন্য ঘুরে দাঁড়ালাম।

শোনো, মিস লি মৃদু কণ্ঠে বললেন। ঘুরে দাঁড়িয়ে তার দিকে চাইলাম।

বলুন।

আজকে নিজেকে তোমার একদম নতুন মানুষ মনে হচ্ছে, তাই না?

বিস্মিত হলাম। দ্রমহিলা কী বলছেন জিজ্ঞেস করতে চাইলাম। কিন্তু উনি মুহূর্তের জন্য আমার দিকে চেয়ে হাসলেন। এবং তারপর, যেন বাতাসের ধাক্কায়, ক্লাসরুমের দরজাটা দড়াম করে লেগে গেল আমার মুখের উপর। হলওয়েতে একাকী দাঁড়িয়ে রইলাম আমি।

ওই যে ও! আমার উদ্দেশে কে যেন চেঁচিয়ে উঠল। ঘুরে চাইলাম। দারোয়ান আমাকে দেখে ফেলেছে। হঠাৎই সে আর মি. লাউয়ি দৌড়ে আসতে লাগল আমার দিকে। আমাকে পালাতে হবে!

আমি ওদের চাইতে সিঁড়ির কাছাকাছি, তাই এক দৌড়ে দুটো করে ধাপ ভেঙে উঠে গেলাম। একটু পরেই মেইন ফ্লোরে ফিরে এলাম।

মুহূর্তের মধ্যে সদর দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেলাম।

ফিরে এসো! আমরা তোমাকে কিছু করব না, আমরা তোমাকে সাহায্য করতে চাই! মি. লাউয়ি আমার উদ্দেশে চেঁচালেন। স্কুল এন্ট্রান্সের সবচাইতে উঁচু ধাপে দাঁড়িয়ে তিনি, চেয়ে রয়েছেন আমার দিকে।

আমি এখন রাস্তার দিকে হাঁটা দিয়েছি। স্কুলের খেলার মাঠ পেরিয়ে গেছি, কাজেই ওরা কার্যত আমাকে আর ধরতে পারে না।

আপনাদের কাছ থেকে আমি আর সাহায্য চাই না! পাল্টা চেঁচালাম। সাহায্য করতে চাইলে আপনারা এই তামাশাটা বন্ধ করতেন! ব্যাপারটা হয়তো আপনাদের কাছে মজার কিন্তু আমার কাছে!

কীসের তামাশা? বললেন মি. লাউয়ি। সত্যি বলছি তুমি কী বলছ আমি বুঝতে পারছি না।

ওঁর মুখের চেহারা আর কণ্ঠস্বর অত্যন্ত আন্তরিক। উনি কি অন্যদের মত অভিনয় করছেন? আমাকে যেটা খোচাচ্ছে…যদি ওটা অভিনয় না হয়? সত্যিই যদি ওঁরা আমাকে না চেনেন! কিন্তু সেটা তো অসম্ভব…তাই না?

ঘুরে দাঁড়িয়ে দৌড় দিলাম মেইন স্ট্রীটের দিকে। একটু পরে শ্বাস ফিরে পেতে থামলাম। দস্তুরমত হাঁফাচ্ছি।

কাঁধ ডললাম। ভীষণ ব্যথা করছে এমুহুর্তে। মিস লি-র কথা ভাবলাম। ওঁর মধ্যে কী যেন আছে যেটা খুব পরিচিত লেগেছে। তার কথা যত বেশি ভাবছি কাঁধের ব্যথাটাও বাড়ছে। ওঁকে আগে অন্য কোথাও দেখেছি…কিন্তু কোথায়?…কোথায়?

হা-হা-হা-হা! আমার কানে কার যেন জোরাল খলখল হাসি বাজল। এতটাই চমকেছি, পড়েই যাচ্ছিলাম প্রায়। ঘুরে দাঁড়ালাম।

সরাসরি চোখাচোখি হলো ম্যাকের সঙ্গে।

ম্যাক ভবঘুরে ধরনের লোক। কারও ক্ষতি করে না, কিন্তু ওকে দেখলে আমার ভয়-ভয় করে।

কী, ছেলে, স্কুল পালিয়েছ, না? সামনে ঝুঁকে পড়ে বলল ও। চোখজোড়া লাল। কতদিন গোসল করে না কে জানে। পরনের কাপড়চোপড় ময়লা।

ন-না, তুতলে বললাম। আমি…আহ….

আমার কণ্ঠ মিলিয়ে গেল। মিথ্যে ভাল বলতে পারি না আমি। আর সত্যি কথাটা হচ্ছে, আমি তো আসলেই স্কুল পালাচ্ছি।

কোন চিন্তা নেই, আমি কাউকে বলব না, ম্যাক অস্পষ্ট কণ্ঠে বলল। একটা বাদামি ব্যাগ বাড়িয়ে দিল। ভিতরে খাবার-টাবার কিছু আছে। টেস্ট করবে?

না! বলে এক পা পিছু হটলাম। ঘুরে দাঁড়ালাম। এর কাছ থেকে পালাতে চাই।

এই দুনিয়ায় সবচাইতে কঠিন ব্যাপার কি জাননা? প্রশ্ন করল ম্যাক। হঠাৎই পরিষ্কার হয়ে গেল ওর কণ্ঠস্বর। আমি ঘুরে দাঁড়িয়ে ওর দিকে চাইলাম। ওর চোখজোড়া যেন দীপ্তি ছড়াচ্ছে, দেহ কাঁপছে।

না, কী? প্রশ্ন করলাম।

আমরা আসলে কে সেটা জানা। হ্যাঁ, এটাই। তুমি কি জাননা তুমি আসলে কে? বলে জানো? পাগলের মত হাসতে লাগল আবার ও।

এবং আচমকাই দেখতে পেলাম আমি আর ম্যাকের দিকে চেয়ে নেই। ও মিস লি হয়ে গেছে! তিনি ম্যাকের হেঁড়াখোড়া পোশাক পরে আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসছেন!

কাঁধের ব্যথাটার কী অবস্থা, কিশোর? নরম কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন। স্মিত হাসলেন আমার দিকে চেয়ে। আশা করি শীঘ্রি তোমার ব্যথা কমে যাবে।

মৃদু শব্দে হাসতে লাগলেন তিনি। এবার আমি আবার ম্যাকের মুখের দিকে চেয়ে! হাসছে, কাশছে-ওর মুখের চেহারা টকটকে লাল। হাসতে হাসতে আমার দিকে তর্জনী নির্দেশ করছে।

ঘুরে দাঁড়িয়ে দৌড় দিলাম। কোথায় যাচ্ছি নিজেও জানি না। মেইন স্ট্রীটের সামনে গাছ-পালায় ঘেরা এক টুকরো জমি আর তারপর খোলা মাঠ। সেখানে দৌড়ে চলে গেলাম। কেউ দেখতে পাচ্ছে না নিশ্চিত না হওয়া অবধি ছুটে চললাম।

খোলা মাঠের কাছে এক জায়গায় এসে পৌঁছলাম। প্রকাণ্ড এক গাছের গায়ে হেলান দিয়ে বসে পড়ে চোখ বুজলাম। কতক্ষণ ওখানে ছিলাম জানি না, আচমকা চটকা ভেঙে গেল।

ঘড়ি দেখলাম। ১১:৩৫! নিশ্চয়ই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। চোখ ঘষলাম। আউ! কাঁধের কথা ভুলে গিয়েছিলাম। ব্যথার জায়গাটায় হাত বুলিয়ে চারধারে নজর বুলালাম।

দৃষ্টিসীমার মধ্যে কেউ নেই। শুধু বিশাল, ফাঁকা মাঠটা-বাঁ দিকে গাছ-পালার দঙ্গল আর তার পিছনে মেইন স্ট্রীট।

পেটের ভিতরে গুড়-গুড় করে উঠল। সকালে নাস্তা খাইনি এবং এখন প্রায় লাঞ্চের সময়। এতসব অদ্ভুত ঘটনার মধ্য দিয়ে গেলেও খিদে ঠিকই পেয়েছে আমার। কিছু খাওয়া দরকার।

উঠে দাঁড়ালাম। পেটে কিছু গেলে হয়তোবা এই রহস্যের সমাধান খুঁজে পাব। হয়তো সব কিছুই এখন ঠিকঠাক হয়ে গেছে। আমি স্কুলে ফিরে গেলে হয়তো সবাই আমাকে চিনতে পারবে। আর কোন সমস্যা হয়তো থাকবে না!

আমার জন্য নিশ্চয়ই সবার খারাপ লাগবে। ফলে কেউ আর তামাশা করবে না। আমি নিশ্চিত চাচা-চাচী আর ডন আমার জন্য উদ্বেগ বোধ করছে।

এসব ভেবে মনটা একটু ভাল হলো। প্যান্টের ধুলো ঝেড়ে স্কুলের দিকে রওনা হলাম।

কিশোর পাশা! পিছন থেকে কে যেন ডাকল।

আগে কখনও নিজের নামটা এত মধুর শোনায়নি আমার কানে! দুঃস্বপ্নটা তারমানে কেটে গেছে। সব কিছু আবার স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। ঘুরে দাঁড়ালাম কে ডেকেছে দেখার জন্য।

আমার পুলিস ডিপার্টমেন্টের বন্ধু, সার্জেন্ট কলিন্স। স্কুটারে চেপে আমার পিছনে এসে থেমেছে।

হাই, সার্জেন্ট কল–শুরু করতে গেছিলাম, কিন্তু উনি ত্বরিত আমাকে থামিয়ে দিলেন।

গাছে হাত দিয়ে দাঁড়াও। একদম নড়বে না! গর্জে উঠলেন তিনি। এবং হঠাত্র আমি আমার অসহায় বিভ্রান্তির মধ্যে ফিরে এলাম।

সার্জেন্ট কলিন্স যখন নিশ্চিত হলেন আমার কাছে বিপজ্জনক কোন অস্ত্র নেই, তখন আমাকে ঘুরিয়ে তার মুখোমুখি দাঁড় করালেন।

সার্জেন্ট কলিন্স, এমন করছেন কেন? প্রশ্ন করলাম।

আমার দিকে চাইলেন তিনি।

তুমি আমার নাম জানলে কীভাবে?

একদৃষ্টে তাঁর দিকে চেয়ে রইলাম। ওঁর নাম জানলাম কীভাবে!

গত টার্মে আমরা একসাথে স্টুডেন্ট সেফটি ক্যামপেইনে কাজ করেছি। সার্জেন্ট, আমি কিশোর পাশা। একটু আগেই আপনি আমাকে নাম ধরে ডেকেছেন!

নাম ধরে ডেকেছি কারণ তোমার সাথে এক ছেলের বর্ণনা মিলে যাচ্ছে। আজ সকালে রকি বীচ স্কুলে গিয়ে অদ্ভুত আচরণ করে এসেছে সে।

বর্ণনা মিলে যাচ্ছে? মিলবেই, কারণ ওটাই আমি। আর আমি মোটই অদ্ভুত আচরণ করিনি, করেছে অন্যরা!

তাই বুঝি? বললেন কলিন্স। তুমি বলছ আমরা স্কুল সেফটি প্রোগ্রামে একসাথে কাজ করেছি? সত্যি কথাটা হচ্ছে আমি এই একটু আগে প্রথম তোমাকে দেখলাম। এর আগে জীবনেও দেখিনি।

হাঁটুজোড়া কাঁপতে লাগল আমার। বিশ্বাস হচ্ছে না এমনকী পুলিসও এর সঙ্গে জড়িত!

সার্জেন্ট কলিন্স, আস্তে আস্তে বললাম। প্রোগ্রামে ছিল বাইক চালানোর সময় ছাত্র-ছাত্রীরা যাতে কিছু সেফটি রুল মেনে চলে। রাস্তা পার হওয়ার সময়, কিংবা অচেনা লোকের সাথে কথা বলার সময়। এবার মনে পড়েছে?

হ্যাঁ, প্রোগ্রামটা এমনই ছিল। কিন্তু প্রোগ্রামে আমাকে সাহায্য করেছিল মুসা আমান আর জোয়ান জেনসেন।

মুসা আমান কখনোই এটার সাথে ছিল না! প্রায় আর্তচিঙ্কার ছাড়লাম। জোয়ান আর আমি আপনার সাথে কাজ করেছি।

কলিন্স চোখ সরু করে আমার দিকে চেয়ে রইলেন।

তোমার কোন আইডেন্টিফিকেশন আছে?

নেই। আমি স্কুলে কখনও ওয়ালেট নিয়ে যাই না, নিই শুধু বইয়ের ব্যাগ আর লাঞ্চের টাকা। আর আজকে তো এমনকী বইয়ের ব্যাগও নেই!

সঙ্গে নেই, তবে বাসায় আছে।

হ্যাঁ, মিসেস পোর্টার বলেছেন তোমার বাসার ঠিকানা। ওখানে পাশা পরিবার থাকে, কিন্তু কিশোর নামে কাউকে তারা চেনে না।

রাশেদ পাশা আমার চাচা, আর মেরি পাশা চাচী।

দেখো, ছেলে, তুমি কোন আইন ভাঙনি। তাই আমি তোমাকে ধরছি না, কলিন্স বাধা দিয়ে বললেন, ধৈর্য হারাচ্ছেন পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু আমি তোমাকে সাবধান করছি। তোমার কোন আইডি নেই, অস্তিত্ব নেই এমন একজন বলে নিজেকে দাবি করছ, এবং তোমার ব্যাপারে রিপোর্ট এসেছে তুমি পাবলিক নুইসেন্স, বললেন তিনি। কাজেই পরিষ্কার করে একটা কথা বলে দিই। তোমাকে যদি চব্বিশ ঘণ্টা পর রকি বীচে দেখি, তা হলে তোমার প্রমাণ করতে হবে তুমি কে। বোঝা গেছে?

জি; সার, গোমড়া মুখে বললাম। এরচেয়ে অসহায় আর কখনও লাগেনি।

ভাল, বললেন তিনি। কথাটা মনে থাকে যেন। আমার কিন্তু মনে থাকবে।

ঘুরে দাঁড়িয়ে থপথপ করে স্কুটারের কাছে ফিরে গেলেন। কমুহূর্তের মধ্যেই মেইন স্ট্রীটের দিকে রওনা হলেন।

কলিন্সের অপসৃয়মাণ দেহের দিকে চেয়ে রইলাম। এখন কী করব আমি? এটা কি সম্ভব…যে কোনভাবে…আজ সকালে জেগে ওঠার পর থেকে…মিস লি যা বলেছিলেন আমাকে? আমি এক নতুন মানুষ?

এমন কিছু কি ঘটতে পারে?! অসম্ভব। আমি রকি বীচের কিশোর পাশা। সার্জেন্ট কলিন্স কিংবা অন্য কেউ যদি আমার আইডেন্টিফিকেশন দেখতে চায়, আমি জানি কোথায় পাওয়া যাবে। রকি বীচ জেনারেল হাসপাতালে, আমার যেখানে জন্ম, এবং যেখানে আমার বার্থ রেকর্ড রয়েছে।

শশব্যস্তে গাছ-পালা ভেদ করে ফিরে চললাম। শীঘ্রি বেরিয়ে এলাম মেইন স্ট্রীটে। হাসপাতালটা তিন ব্লক পরে।

ঘড়ি দেখলাম। প্রায় দুপুর। আমি একটার মধ্যে আমার পরিচয়ের প্রমাণ দিতে পারব, এই ফালতু তামাশাটার ইতি টেনে, শেষ কটা ক্লাস করে, সাড়ে তিনটায় ফুটবল প্র্যাকটিসে ঠিকই যোগ দিতে পারব।

মেইন স্ট্রীট ধরে সাবধানে হাঁটছি। কারও সন্দেহ জাগাতে চাই। কিছু ক্রেতা বেরিয়েছে। বেশিরভাগই মহিলা এবং বাকিরা রকি বীচের বয়স্ক বাসিন্দা।

বয়স্ক বাসিন্দা! মি. জেসাপের কথা মনে পড়ল। কোনার দিকে তার দোকান। ওখান থেকে আমি প্রায় প্রতিদিন ক্যাণ্ডি কিনি।

উনি আমাদের নাম জানেন না, কিন্তু কে কোন্ ক্যাণ্ডি খাই তা জানেন। তাকে বলে দিতে হয় না। ভিতরে ঢুকলেই কাউন্টারে পছন্দের ক্যাণ্ডি রেখে দেন। উনি জানেন আমার পছন্দ চকোলেটে মোড়া রেইসিন। সপ্তাহে অন্তত পাঁচদিন তাঁর কাছ থেকে এগুলো কিনি।

জেসাপের ক্যাণ্ডি স্টোরের দিকে এগোলাম। এটা হাসপাতালের এক ব্লক আগে। চকিতে ভিতরে উঁকি দিলাম। দিনের এসময়টায় দোকান প্রায় ফাঁকা।

ভিতরে ঢুকলাম। মি. জেসাপ কাউন্টারের পিছনে বসা। চোখে চশমা। কোলের উপর সকালের খবরের কাগজ।

মুখ তুলে আমার দিকে চেয়ে হাসলেন।

হ্যালো, ইয়াং ফেলো, বললেন। এর মধ্যে অস্বাভাবিক কিছু নেই। উনি সব সময়ই এটা বলেন।

আমরা পরস্পরের দিকে চেয়ে রইলাম। পেটের ভিতরে কেমন জানি গুলিয়ে উঠল। উনি আমাকে চেনেন না! আমার ইচ্ছে হলো এক দোকান প্রায় ফাঁকা কিতে ভিতরে এগোলাম। এটা দৌড়ে দোকান থেকে বেরিয়ে, মেইন স্ট্রীট ধরে ছুটতে ছুটতে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করি: বন্ধ করুন.এসব। আপনারা আমাকে এভাবে। কষ্ট দিচ্ছেন কেন?

যেটা সব সময় নাও সেটাই নেবে তো? চওড়া, বন্ধুত্বপূর্ণ হেসে প্রশ্ন করলেন।

মনটা খুশি হয়ে উঠল। উনি আমাকে চেনেন! ওরা মি. জেসাপকে নিজেদের ষড়যন্ত্রে জড়াতে পারেনি। দ্রলোক সাধারণ এক ক্যারি দোকানদার, কিন্তু আমাকে তিনি সাহায্য করতে পারবেন। আমাকে উনি চেনেন!

হ্যাঁ, মিস্টার জেসাপ, যেটা সব সময় নিই, বলে পকেটে হাত ভরে দিলাম পঞ্চাশ সেন্টের জন্য।

দিচ্ছি, বললেন তিনি। তার আগে বলো সবসময় কোটা নাও।

জমে গেলাম আমি। উনি আমাকে চেনেন না! ঘুরেই দৌড় দিলাম।

হাসপাতালে পৌঁছনোর আগ পর্যন্ত ছুটে চললাম আমি। এখানে কয়েকটা এন্ট্রান্স। একটায় লেখা: ইমার্জেন্সি। অনুভব করলাম এটাও একটা ইমার্জেন্সি, কিন্তু জানি এখন মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হবে।

মেইন এন্ট্রান্স দিয়ে ভিতরে ঢুকলাম। ওয়েটিং এরিয়ায় বেশ কিছু মানুষ-জন বসা। জনাকয় ডাক্তার আর নার্স চলাফেরা করছে। ইনফর্মেশন ডেস্ক দেখে এগিয়ে গেলাম।

এক ইউনিফর্ম পরা নার্স বইতে কী সব টুকছে।

মাফ করবেন, বললাম। রেকর্ড ডিপার্টমেন্টটা কোথায় বলতে পারেন?

পাঁচতলায়, ডান দিকে এলিভেটর, আমার দিকে মুখ তুলে চেয়ে বলল।

এলিভেটরের জন্য অপেক্ষা করছি, নানা চিন্তা ঘুরতে লাগল মাথার মধ্যে।

এলিভেটরের দরজা খুলে গেল। মুখোমুখি পড়ে গেলাম সার্জেন্ট কলিন্সের। এক লোককে সাহায্য করছেন তিনি। লোকটির বাহুতে কাস্ট করা।

আপনাকে ধন্যবাদ, সার্জেন্ট, লোকটি বলল। আপনি না থাকলে কে আমাকে হাসপাতালে আনত আর ওই ছিনতাইকারীগুলোকে শায়েস্তা করত!

এটাই তো আমাদের কাজ, মিস্টার লেন, আইনকে উপরে তুলে ধরা, কলিন্স জবাবে বললেন। লোকটিকে কথাগুলো বললেও পুরোটা সময় তার দৃষ্টি স্থির রইল আমার উপরে।

মাফ করবেন, বলে, তার পাশ ঘেঁষে এলিভেটরে উঠলাম।

শরীর খারাপ? কলিন্স আমাকে প্রশ্ন করলেন। এলিভেটর থেকে ঝটপট বেরিয়ে গেলেন।

না, ঠাণ্ডা স্বরে জবাব দিলাম। এক অসুস্থ বন্ধুকে দেখতে এসেছি।

কলিন্স একদৃষ্টে চেয়ে রইলেন আমার দিকে।

চব্বিশ ঘণ্টা, বললেন তিনি। এলিভেটরের দরজা লেগে গেল। এলিভেটর পাচতলায় উঠে এলে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। রকি বীচ পুলিস ডিপার্টমেন্টকে আমি বন্ধু মনে করতাম। নিজেকে অপরাধী ভাবতে ভাল লাগছে না!

দরজা খুলে গেল। বেরিয়ে এলাম আমি। চারধারে নজর বুলালাম। বড্ড চুপচাপ এখানে। লম্বা হলগুলো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন আর উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত। দেয়ালে এক ডিরেক্টরি দেখলাম।

ওতে নির্দেশ করছে হাসপাতাল রেকর্ড, রুম ৪৩৬। কামরাটা খুঁজে না পাওয়া পর্যন্ত হেঁটে চললাম। বন্ধ এক দরজা দেখলাম। নক করতেই ভিতর থেকে শোনা গেল, কাম ইন।

প্রবেশ করলাম। কাউন্টার ডেস্কের পিছনে সাদা কোট পরা এক লোক বসা।

বিরক্তির ছাপ তার চোখে-মুখে। এক স্পোর্টস ম্যাগাজিনের পাতা উল্টাচ্ছে।

হ্যাঁ, তোমার জন্যে কী করতে পারি? প্রশ্ন করল।

আমি কিছু রেকর্ড খুঁজছি, বললাম।

কী ধরনের রেকর্ড?

উম, বার্থ রেকর্ড।

কার? প্রশ্ন করল। এই প্রথম তাকে আগ্রহী মনে হলো। আমার অস্বস্তি লাগছে, কেননা লোকটা গভীর মনোযোগে আমাকে দেখছে।

আমার নিজের, বললাম। আমি আমার বার্থ রেকর্ড জানতে চাই। এই হাসপাতালে আমার জন্ম।

আমার নাম এবং জন্মতারিখ বললাম।

ঠিক আছে, কোন সমস্যা নেই, বলল লোকটা।

স্বস্তির শ্বাস ফেললাম। ভয় হচ্ছিল কোন সমস্যা হবে।

দেখানো যাবে,যোগ করল লোকটা। একুশ বছরের বেশি বয়সী কাউকে নিয়ে এসো আমরা তোমার ফাইল দেখিয়ে দেব। পত্রিকার পাতায় আবারও ডুব দিল সে।

কী? বলে উঠলাম, কেন?

কারণ এটা স্টেট ল, জানাল লোকটা। একুশ বছরের কম বয়সী কেউ অফিশিয়াল বার্থ রেকর্ড দেখতে কিংবা কপি করতে পারে না। কথা শেষ।

লোকটার দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলাম। লোকটা অহঙ্কারী এবং রূঢ়, এ দুটো স্বভাবই অপছন্দ করি আমি। কিন্তু তারচাইতেও বড় কথা ও আমাকে তথ্য পাওয়া থেকে বঞ্চিত করছে।

ওর নেম ট্যাগ দেখলাম।

বিন, জে, পড়লাম।

আপনার সাহায্যের জন্যে ধন্যবাদ, বললাম। বিন ঘোত করে উঠল। আমার দিকে তাকাল না পর্যন্ত।

আমি ঘুরে দাঁড়িয়ে ঘর ছাড়লাম। এলিভেটরে চড়ে নেমে এলাম রিসেপশন ডেস্কে। অন্য এক নার্স এখন ডিউটিতে। আত্মবিশ্বাসী অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তুলতে চেষ্টা করলাম মুখের চেহারায়। ভিতরে ভিতরে পাতার মতন কাপছি।

মাফ করবেন, বললাম।

ইয়েস, মহিলা বলে আমার দিকে চাইল।

আপনাদের রেকর্ড সেকশনে মিস্টার বিন নামে একজন আছে, তাই না?

এক মিনিট, বলে কম্পিউটার অন করল মহিলা, কটা বাটন টিপে পর্দায় চোখ রাখল। হ্যাঁ, জেমস বিন। রেকর্ডস, পাঁচ তলা। কেন?

এক ডাক্তার আপনাকে বলতে বললেন তাকে এখুনি এক্স-রে রূমে দরকার।

আমার দিকে চেয়ে রইল নার্স।

রেকর্ডের লোককে এক্স-রেতে দরকার? এমন কথা কখনও শুনিনি। কেন দরকার?

জানি না। হয়তো এক্স-রের রেকর্ড নেয়ার জন্যে কাউকে তাদের দরকার, বললাম, নিজেও জানি না কী বলছি।

মহিলা মুহূর্তের জন্য ভ্রূ কুঁচকে শ্রাগ করল। রিসিভার তুলে ডায়াল করল কোন নম্বরে।

হ্যালো, মিস্টার বিন? ফ্রন্ট ডেস্ক থেকে বলছি। আপনাকে এক্সরেতে ডেকেছে। জানি না কেন। মনে হয় গেলেই জানতে পারবেন।

রিসিভার রেখে দিল সে। চারপাশে চোখ বুলিয়ে আমাকে খুঁজল। কিন্তু আমাকে পাবে কোথায়। আমি তখন এলিভেটরে চড়ে পাঁচতলার দিকে উঠে যাচ্ছি।

রেকর্ড রুমের দরজায় তালা মারা নেই, কাজেই ভিতরে ঢুকতে কষ্ট হলো না।

আমার জানা নেই কতক্ষণ সময় পাব। ডিরেক্টরীতে দেখেছি সাততলায় এক্স-রে। বিন এলিভেটরে করে ওখানে যাবে, কাউকে জিজ্ঞেস করবে কে ডেকেছে, জানবে কেউ ডাকেনি, এবং তারপর এলিভেটরে করে নেমে আসবে।

বড়জোর তিন কি চার মিনিট সময় পাব, উপলব্ধি করলাম।

বিনকে রেকর্ডস রুম ত্যাগ করতে দেখে এক দরজার আড়াল নিলাম।

এলিভেটরের জন্য অপেক্ষা করল বিন। সে ভিতরে ঢুকতেই, আমি রেকর্ডস রুমে সেঁধিয়ে পড়লাম। বিনের ডেস্কের পাশ দিয়ে গেলাম। ফাইল ক্যাবিনেটগুলো বছরওয়ারি সাজানো। আমার জন্মসাল খুঁজে নিতে কয়েক সেকেণ্ড মাত্র লাগল। ফাইল হ্যাণ্ডল ধরে টানলাম। খুলল না!

ক্যাবিনেটে এক কি-হোল দেখতে পেলাম। চাবি দরকার! চারধারে নজর বুলিয়ে নিলাম, দস্তুরমত হাঁফাচ্ছি। চাবি, চাবি চাই। চাবি কোথায়? নিশ্চয়ই বিনের কাছে আছে!

ওর ডেস্কের কাছে ফিরে গেলাম। ডেস্কের ড্রয়ারে কয়েকটা কিচেইন। প্রথমটা খপ করে চেপে ধরলাম। প্রতিটা চাবিতে একটা করে বছর।

বুক ধড়ফড় করছে, চাবি হাতড়াতে লাগলাম। অল্প-অল্প কাঁপছে আঙুল। এক ফোঁটা ঘাম টপ করে পড়ল শার্টে। আমার জন্মসাল পাওয়া গেছে! ঘুরেই এক দৌড়ে ফিরে এলাম পিছনের কামরায়।

জ্ঞান হারানো চলবে না-অনুভব করলাম আমি দুবেলা খাইনি-সুটে ঢুকিয়ে দিলাম চাবিটা। ঘুরালাম। ফাইলটা খুলে গেল।

অক্ষর অনুযায়ী সাজানো হয়েছে রেকর্ডগুলো। ঝটপট ফাইলের মাঝখানে চলে গেলাম, খুঁজে পেলাম কে, কিশোর পাব যেখানে।

সামনে একটা শব্দ হলো! গলার কাছে উঠে এল যেন হৃৎপিণ্ড। বিন কি এত তাড়াতাড়ি ফিরে এসেছে? ধীরে ধীরে মাথা ঘুরিয়ে চাইলাম। ডাক্তাররা হলওয়েতে কথা বলার জন্য থেমেছিলেন। এবার আবার হাঁটা ধরেছেন। চেপে রাখা খাসটা ছেড়ে, ফাইলে ফের মন দিলাম।

হুড়োহুড়ি করে কে অক্ষরটা দেখে নিলাম। প্রতিটা ফাইলে বাবামার নাম, এবং শিশুর নাম, ওজন, লিঙ্গ এবং জন্মের সময় দেয়া রয়েছে।

আমার ফাইলটা এখুনি দেখতে পাব। আপন মনে কথা বলতে লাগলাম।

কেনি… কেভিন…কেনেথ…

আমার নাম কোথায়? আবারও প্রথম থেকে দেখলাম। হাত কাঁপছে এখন। বিন যে কোন মুহূর্তে ফিরে আসবে। আমাকে আমার ফাইল খুঁজে পেতে হবে। এবং ওটা এখানেই থাকবে, হাসপাতাল বার্থ রেকর্ড হারিয়ে ফেলে না।

কে অক্ষরের আদ্যোপান্ত আবারও দেখে নিলাম। কোন কিশোরের নাম নেই। কিন্তু আমার তো এই হাসপাতালে জন্ম! রেকর্ড

এখানে থাকতেই হবে। নেই কেন?

তুমি যা খুঁজছ তা মনে হয় এক্স-রেতে পাবে,বলল একটি কণ্ঠ।

মুখ তুলে চাইলাম। দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে বিন। আমার দিকে হেঁটে আসছে।

দ্রুত চিন্তা করতে হবে। বিন কমবয়সী এবং চটপটে ধরনের। এবং নিঃসন্দেহে আমার চাইতে শক্তিশালী।

ফাইল চাবিগুলো তুলে ধরলাম।

বিন, এগুলো ধরুন! চেঁচিয়ে উঠলাম। চাবিগুলো হঠাৎই ছুঁড়ে দিলাম ভােলা এক জানালা লক্ষ্য করে।

না! চিৎকার ছাড়ল বিন। জোরে চুঁড়িনি, এমনভাবে ছুঁড়েছি বিন যাতে জানালা দিয়ে পড়ে যাওয়ার আগেই লুফে নিতে পারে।

বিন চাবিগুলো ধরার জন্য ঝাপ দিতেই, ডেস্কের উপর দিয়ে লাফিয়ে এক দৌড়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলাম আমি। আমি জানি মুহূর্তের মধ্যেই নীচে ফোন করে ওদেরকে সতর্ক করে দেবে সে, জানাবে আমি কী করেছি।

কারও চোখে ধরা না পড়ে হাসপাতাল ত্যাগ করতে হবে আমাকে। হলের ওপাশে একটা সাপ্লাই ক্লজিট দেখতে পেলাম। দরজা খুলতেই ভিতরে অ্যাটেনডেন্টের সাদা উর্দি চোখে পড়ল। ওটা হুক থেকে তুলে নিয়ে পরে ফেললাম।

এলিভেটরে চেপে নেমে এলাম মেইন ফ্লোরে, বেরিয়ে আসার পর মেইন ডেস্কের পাশে লোকজনের ছোটাছুটি লক্ষ করলাম। নার্স লরি কথা বলছে সার্জেন্ট কলিরে সঙ্গে।

ও টীনএজার, কালো চুল, কালো চোখ, পাঁচ ফুট আট ইঞ্চি মত লম্বা, আমি তাকে বলতে শুনলাম। আমার বর্ণনা দিচ্ছে কলিন্সের কাছে।

কলিন্সকে মাথা ঝাকাতে দেখলাম। তিনি ঘুরে দাঁড়িয়ে আমাকে চিহ্নিত করার আগেই এক্সিটের দিকে দ্রুতপায়ে এগোলাম আমি। একটা পত্রিকা তুলে নিয়ে খুলে মুখের কাছে ধরলাম, আমার মুখ যাতে লোকেরা দেখতে না পায়।

এবার সদর দরজা দিয়ে হেঁটে বেরিয়ে এলাম। মেইন স্ট্রীটে পৌঁছনোর পর উর্দি খুলে ফেললাম। ওটা আর পত্রিকাটা ছুঁড়ে ফেলে দিলাম ফ্রন্ট লনে। তারপর শশব্যস্ত রাস্তা ধরে এগিয়ে চললাম।

এখন কোথায় যাব? হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে এসেছি আমি, কিন্তু আমার সমস্যা আরও জটিল হয়েছে। হাসপাতালে আমার জন্ম রেকর্ড নেই কেন? চাচা-চাচী কি এত বছর ধরে আমাকে মিথ্যে বলে এসেছে? আমি কি অন্য কোথাও জন্মেছিলাম? যদি তাই হয়, তা হলে আমাকে বলেনি কেন?

মাথা গুলিয়ে গেল। পেটের ভিতরে আতঙ্ক বাসা বাঁধছে। আমার মনে হয় পুলিশে ধরা দেয়া উচিত।

কারণ আমি হয়তো সত্যিকারের কিশোর পাশা নই। আমি হয়তো অন্য কেউ। আমি হয়তো মি. লাউয়ির বর্ণনা করা সেই ছেলেটির মত, চেষ্টা করছি আমি নই এমন কারও ভূমিকা নিতে।

কিন্তু তা-ই যদি হবে, তবে আজ সকালে নিজের বাসায় আমার ঘুম ভাঙল কীভাবে? এবং কেউ আমাকে না চিনলেও আমি সবাইকে চিনছি কী করে?

সবচাইতে বেশি ভয় লাগছে, এখন আর এটাকে নিছক তামাশা মনে করতে পারছি না। ব্যাপারটা তার চাইতে অনেক জটিল আর বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে।

আমি কে প্রমাণ করার নিশ্চয়ই কোন উপায় আছে। স্কুলে লাভ হবে না। হাসপাতালেও না। কোথায় যাব আমি?

বাসায় যাব! জোরে বলে উঠলাম। বাসায় চাচা-চাচীর সঙ্গে আমার প্রচুর ছবি রয়েছে। বই রয়েছে যাতে আমার নাম লেখা। প্রমাণ করার জন্য যথেষ্ট, আমি কে।

ঘড়ি দেখলাম। ১:৩০। চাচা-চাচী আরও কয়েক ঘণ্টা বাইরে থাকবে। নিশ্চয়ই ডনকেও সঙ্গে নিয়ে যাবে। মেইন স্ট্রীট ধরে বাসার দিকে হেঁটে চললাম।

আকাশ হঠাৎই গোলাপী হয়ে গেল। সব কিছু যেন কাঁপছে, এবং কোথায় যেন জোরাল বাজনা শুরু হলো। অদ্ভুত বাজনা, রেডিওতে এমনটা বাজে না।

এক দোকানের সামনে টলতে টলতে গিয়ে দাঁড়ালাম। মেইন স্ট্রীটে আমি ছাড়া কেউ নেই! দু মুহূর্ত পর পর রং বদলাচ্ছে আকাশের। গোলাপী, হলুদ, কমলা, নীল, গোলাপী।

প্রচণ্ড ব্যথা শুরু হলো কাঁধে। দোকানের জানালার দিকে ঘুরে দাঁড়ালাম। সাহায্য আশা করছি। জানালায় চোখ রাখলাম। চকচকে কালো পোশাক পরে, জানালায় দাঁড়িয়ে, আমার দিকে চেয়ে মৃদু হাসছেন-মিস লি!

কী চান? কে আপনি? চেঁচিয়ে উঠলাম।

এবং হঠাই সব কিছু স্বাভাবিক হয়ে এল। মেইন স্ট্রীট আবারও নিজের নির্জন রূপ ফিরে পেল।

ঘুরে জানালাটার দিকে চাইলাম, আমি যেখানে মিস লিকে দেখেছি কিংবা কল্পনা করেছি। এটা নতুন এক চাইনিজ রেস্তোরা, কম দামে ভাল ফাস্ট ফুড পরিবেশনের জন্য নাম কামাতে শুরু করেছে।

মিস লিকে এখন আর দেখা যাচ্ছে না। অন্ধকার জানালা দেখে অনুমান করা যায় এখনও খোলেনি রেস্তোরাঁটা।

রাস্তার দিকে চাইলাম। আমার দিকে ধীরে-ধীরে এগিয়ে আসছে রকি বীচ পুলিশের এক গাড়ি। হাসপাতালের ঘটনাটার পর সার্জেন্ট কলিন্স হয়তো আমাকে খুঁজছেন।

কেটে পড়ব সিদ্ধান্ত নিলাম।

এক গলিতে সাত করে ঢুকে পড়ে মেইন স্ট্রীটের পিছনের গাছগাছালির উদ্দেশে দৌড় দিলাম। মাঠ পেরিয়ে পৌঁছতে হবে বাসায়।

লম্বা পথ পাড়ি দিতে হবে এভাবে গেলে। কাঁধের ব্যথায় মরে যাচ্ছি, এবং খিদেও মরে গেছে। কিন্তু কলিন্সকে এড়াতে হলে এটাই নিরাপদ রাস্তা।

দশ মিনিট বাদে বাসার সামনে এসে দাঁড়ালাম। চারধারে দৃষ্টি বুলিয়ে প্রতিবেশীদের কাউকে দেখতে পেলাম না।

সদর দরজার চাবি ঢোকাতে যাব, এসময় পাশের বাসার মিসেস বার্টন দরজা দিয়ে বেরিয়ে এলেন। হাতে প্লাস্টিকের ময়লা ভরা ব্যাগ।

হাই, মিসেস বার্টন? খোশমেজাজে ডেকে উঠলাম। স্কুল থেকে কেন আগে বাড়ি ফিরেছি তার কারণ জানানোর জন্য মাথা খেলালাম।

কিন্তু এবার ওঁর মুখের চেহারায় যে দৃষ্টি ফুটল সেটি গত কঘন্টা ধরে দেখে আসছি আমি। উনি আমার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে থেকে ভ্রূ কুঁচকালেন।

আহ, হ্যালো, বললেন তিনি, কণ্ঠে বিস্ময়। আমি তোমাকে চিনি?

কী বলব জানি না। আমরা কি কোন খেলা খেলছি? আমি কি পাগল হয়ে যাচ্ছি? নাকি অন্য কিছু? কীভাবে জবাব দেব ওঁকে?

আমি অন্য পথ ধরলাম।

আমি পাশা পরিবারের পরিচিত, বললাম। ওঁরা আমাকে এখান থেকে কিছু জিনিস নিয়ে যেতে বলেছেন।

এর বেশি সে মুহূর্তে আর কিছু মাথায় এল না। গত কঘণ্টার কথা  ভাবলে, আমি যে আদৌ চিন্তা করতে পারছি সেটাই এক বিস্ময়।

ওহ, বললেন তিনি, তবে তাকে খুব একটা সন্তুষ্ট মনে হলো না। ডিসপোসাল বিনের দিকে হাঁটতে শুরু করে হঠাৎই ঘুরে দাঁড়ালেন। আমার দিকে চেয়ে রয়েছেন। আচ্ছা, তুমি আমার নাম জানলে কীভাবে?

দীর্ঘ এক মুহূর্ত তাঁর দিকে চেয়ে রইলাম। আমার চোখ মরিয়ার মত একটা জবাব খুঁজছে। ওঁদের মেইলবক্স দেখতে পেলাম। ওটার দিকে তর্জনী নির্দেশ করলাম।

আপনার নাম ওখানে আছে। বার্টন। তাই ভাবলাম আপনিই তিনি।

বক্সের দিকে দুমুহূর্ত চেয়ে থেকে আমার দিকে চাইলেন তিনি। মাথা ঝাঁকিয়ে ঈষৎ হাসলেন। এবার বিনে ব্যাগটা ফেলে সোজা বাসায় ঢুকে পড়লেন।

আমি শ্বাস নিয়ে, চাবিটা তালায় ঢুকালাম। ঘুরালাম। খুলল না। আমার চাবিতে সদর দরজা খুলছে না। এ কীভাবে সম্ভব? সব সময় খুলেছে, কিন্তু এখন খুলছে না কেন?

চাচা-চাচী কি আমাকে ঢুকতে না দেয়ার জন্য তালা পাল্টেছে? সেটা কি সম্ভব? নাকি আমি যে নিজের বাসায় একজন আগন্তুক এটা তার আরেকটা উদাহরণ?

আমাকে বাসায় ঢুকতে হবে। ওখানে আমার প্রশ্নের জবাব রয়েছে। জানালা ভাঙা সম্ভব নয়। মিসেস বার্টন টের পেয়ে পুলিস ডাকবেন।

জানালা! হ্যাঁ, বেসমেন্টের জানালাটা গত ছমাস ধরে ভাঙা চাচা ঠিক করতে চেয়েছিল, কিন্তু করা হয়নি। আশা করছি ওটা এখনও ওভাবেই রয়েছে।

বাড়ির পিছনে দৌড়ে গেলাম। জানালাটা এখনও ভাঙা, ভিতরে ঢুকতে বেশ কষ্টই হবে, তবে ঢোকা যাবে। একটু পরে শরীর গলিয়ে দিয়ে বেসমেন্টে লাফিয়ে নামলাম।

প্রথমে কিচেনে ছুটে গিয়ে, নিজের জন্য একটা বেলনি আর পনিরের স্যাণ্ডউইচ বানালাম লেটুস আর সর্ষে দিয়ে, সঙ্গে পান করলাম আধ-কোয়ার্ট দুধ।

নিজের পরিচিত কিচেনে বসে চাচীর খাবার খাচ্ছি, খানিকটা নিরাপত্তা বোধ এল। বাসার তুলনা আর কিছুতে হয় না।

কিচেনের দেয়ালের ছবিটায় চকিত চাউনি বুলালাম। গত সামারে ভােলা। সান্তা মণিকা বীচে চাচী, আমি আর ডন। চাচার তোলা ছবি।

স্যাণ্ডউইচটা মাটিতে ফেলে দিলাম। ধীরে সুস্থে উঠে দাঁড়িয়ে দেয়ালের কাছে হেঁটে গেলাম।

ছবিতে চাচী আর ডনকে সৈকতে দেখা যাচ্ছে। আমি নেই। আমি জানি ছবি তোলার সময় আমিও ছিলাম। এতে কোন ভুল নেই। কিন্তু এখন, স্কুলের ফুটবল টিমের ছবিটার মত…আমি স্রেফ উবে গেছি। উধাও।

মাথা ঝিমঝিম করছে। ব্যালান্স বজায় রাখতে দেয়ালে হাত রাখলাম। কাঁদব না আর্তনাদ করব ঠিক করতে পারছি না।

না, মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হবে, নিজেকে বললাম। এসবের নিশ্চয়ই কোন কারণ আছে।

যা-ই হোক না কেন, আমাকে এই রহস্যের সমাধান বের করতে হবে।

লিভিং রুমে গেলাম। এখানে দেয়ালগুলো পারিবারিক ছবি দিয়ে ভরা, আমি অনেকগুলো ছবিতে রয়েছি। বাতি জ্বেলে, বিশাল পিছনের দেয়ালের কাছে হেঁটে গেলাম।

ছবিগুলোর দিকে চেয়ে রইলাম। কোনওটাতেই আমি নেই। চাচা আমার অনেক ছবি তুলেছিল। তার মধ্যে ফুটবল জার্সি পরে তোলা ছবিও ছিল। আরও কিছু ছবি ছিল টিমমেটদের সঙ্গে।

গোটা বিভাগটা উধাও। ফুটবলের ছবিগুলোর বদলে ওখানে শোভা পাচ্ছে ডনের পিউই সকার খেলার ছবি। সেইলবোটে চাচীর ছবি। চাচা-চাচী, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে। আমার কোন ছবি নেই।

আত্মীয়-স্বজন! ডেস্কে রাখা ফোনটার কাছে টলতে টলতে  গেলাম। হয়তো শুধুমাত্র রকি বীচে আমার অস্তিত্ব নেই। অন্যান্য জায়গার মানুষ-জন হয়তো আমাকে চেনে।

রিসিভারটা তুলে নিয়ে শিকাগোতে হিরু চাচাকে ফোন করলাম।

হিরন পাশার অফিস, কানে ভেসে এল হিরু চাচার সেক্রেটারি মিস ক্রেনের পরিচিত কণ্ঠস্বর।

মুহূর্তের জন্য থমকালাম। এটা বড় ধরনের পরীক্ষা। হিরু চাচা যদি আমাকে না চেনে, তা হলে কী করব জানি না আমি।

মিস কেন? প্রশ্ন করলাম।

হ্যাঁ।

মিস ক্রেন, আমি কিশোর। কিশোর পাশা।

ও প্রান্তে বিরক্তি।

কে?

কিশোর পাশা। হিরন পাশার ভাতিজা…গলা বুজে এল আমার।

ওহ, বললেন তিনি। চিনতে পারলাম না। একটু ধরো, তাঁকে দিচ্ছি।

ভয়ে বুকের ভিতরটা জমে গেল। মিস ক্রেনের সঙ্গে বছরের পর বছর ধরে কথা বলেছি আমি। আর এখন তিনি কিনা আমাকে চিনতে পারছেন না।

মুহূর্ত পরে, হিরু চাচার গমগমে কণ্ঠস্বর ভেসে এল।

হ্যালো, হিরন পাশা বলছি। কার সাথে কথা বলছি?

হিরু চাচা? ফিসফিসানির মত শোনাল আমার কণ্ঠ। ভয় পাচ্ছি এরপর না জানি কী শুনব।

কথা বলল, আমি শুনতে পাচ্ছি না, বলল হিরু চাচা। আমি জানি কথা বলা অনর্থক। আমার প্রিয় চাচা আমাকে চিনবে। হয়তো আমার কথা কখনওই শশানেনি। হিরু চাচার মুখ থেকে এ কথা বলে সইতে পারব না আমি।

আমি দুঃখিত, বললাম। আ…আমি মনে হয় রং নম্বরে ফোন করেছি।

ফোন কেটে দিলাম।

কমুহূর্ত নীরবে ডেস্কে বসে রইলাম। এবার আচমকা ঘুষি মারলাম ডেস্ক টপে।

কে আমি? ছাদের উদ্দেশে চেঁচালাম।

কে? কেউ কি বলে দেবে আমাকে? আমার মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে! পাগল হয়ে যাচ্ছি আমি!

দরজায় চাবি ঘোরানোর শব্দ পেলাম। এবার সদর দরজা খুলে যেতে লাগল। কে যেন বাসায় এসেছে।

কে হতে পারে? ঘড়ির দিকে চাইলাম। দুটো বেজে পাঁচ। চাচা-চাচী হতে পারে না। তবে কি ওরা একজন এসে নিশ্চিত হতে চাইছে অচেনা ছেলেটি-আমি-এখানে নেই?

পায়ের শব্দ। প্রথমে মেইন হল-এ, তারপর কিচেনে। কে যেন গুনগুন করছে। গুন-গুন? আজকে বুধবার!

মিসেস ওয়েসলি প্রতি বুধবার আসে অল্প-স্বল্প হাউসকীপিঙের কাজ করতে। কিছুদিন ধরে সে আমাদের হাউসকীপার। মিসেস ওয়েসলি সব সময় গুনগুন করে।

মিসেস ওয়েসলির মত নরম স্বভাবের, ভাল মানুষ দুনিয়ায় কম আছে। অন্যের কষ্ট দেখার চাইতে বরং নিজের হাত কেটে ফেলবে সে।

আমি যদি কোন রসিকতার স্বীকার হয়ে থাকি তবে মিসেস ওয়েসলি হতে পারে তার চূড়ান্ত পরীক্ষা।

দরজার কাছে গিয়ে ধীরে ধীরে ওটা খুললাম।

মিসেস ওয়েসলির পরনে প্যান্ট, সোয়েটার আর অ্যাপ্রন। প্রকাণ্ড এক ব্যাগ থেকে ক্লিনিং সাপ্লাই বের করছে। পুরানো এক লোকগীতির সুর ভাজছে সে।

আমি তাকে ভয় দেখাতে চাই না। কিন্তু আমি নিজেই ভয় পাচ্ছি। ।

এটা আমার জীবনের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত। এক ধরনের বাজি ধরতে হচ্ছে আমাকে।

সাবধানে কিচেনের দিকে এগোলাম। মিসেস ওয়েসলি তার সাপ্লাই বিছিয়ে রাখছে কিচেন টেবিলের উপরে। পুরানো সুরটা গুন-গুন করে চলেছে।

মিসেস ওয়েসলি, মৃদু কণ্ঠে বললাম।

উ করে চেঁচিয়ে উঠে আমার দিকে ঘুরে দাঁড়াল সে। চোখাচোখি হলো আমাদের। মুখের চেহারা স্বাভাবিকের চাইতে লাল হয়ে গেল তার। কিছু বলতে শুরু করেছিল, কিন্তু হাতজোড়া উঠে এল বুকে।

মিসেস ওয়েসলি! আপনি ঠিক আছেন তো? চেঁচিয়ে উঠলাম আমি।।

জবাব দিল না সে। সভয়ে আঁতকে উঠে ধপ করে পড়ে গেল মেঝেতে। তার পাশে দৌড়ে গেলাম। কজি তুলে নিয়ে পালস দেখলাম। দুর্বল আর দ্রুত। মিসেস ওয়েসলির হার্ট অ্যাটাক হয়েছে এবং এর জন্য আমি দায়ী!

এক ছুটে ফোনের কাছে গিয়ে ৯১১ ডায়াল করলাম। বাসার ঠিকানায় তখুনি অ্যাম্বুলেন্স পাঠাতে বললাম। এবার দৌড়ে উপরে গিয়ে, একটা বালিশ খুঁজে নিয়ে নেমে এলাম। মিসেস ওয়েসলির মাথার তলায় খুঁজে দিলাম ওটা।

মহিলার চোখ বোজা। শ্বাস-প্রশ্বাস অনিয়মিত। দূরাগত অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেন কানে এল, নিশ্চিত হলাম মিসেস ওয়েসলি শীঘি চিকিৎসা সেবা পাবে।

কিন্তু ওরা যখন আসবে তখন আমার থাকা চলবে না। আমাকে চলে যেতে হবে।

সদর দরজা খুলে দুদ্দাড় করে বাইরে বেরিয়ে এলাম। রাস্তা ধরে দৌড় দিলাম। অপর দিক থেকে আসা অ্যাম্বুলেন্সের পাশ কাটালাম।

মিসেস ওয়েসলির যত্ন নিয়েন, বললাম, সাইরেনের শব্দে চাপা পড়ে গেল আমার কথাগুলো উপলব্ধি করলাম এটা অনেকটা প্রার্থনার মত শুনিয়েছে।

রাস্তা ধরে দৌড়চ্ছি, এটা গিয়ে মিশেছে মেইন স্ট্রীটে। আর কোথায় যাব জানি না আমি, কী করব তাও জানা নেই।

স্কুলের ফুটবল মাঠের দিকে এগোলাম। আমার কজন টিমমেট, তাদের মধ্যে রব মিশেলও রয়েছে, প্রি-প্র্যাকটিস ক্যাচ করছে।

ওদেরকে দেখার জন্য থেমে দাঁড়ালাম। হঠাৎই ওদের একজন দেখতে পেল আমাকে। ওরা খেলা থামিয়ে চেয়ে রইল আমার দিকে। রব আমার দিকে আঙুল তাক করল। ও কিছু একটা বলতেই হেসে উঠল সবাই।

সেই পাগলটা, হয়তো এটাই বলেছে।

মেইন স্ট্রীটের দিকে দৌড়ে চললাম। জানি না কেন। কিন্তু কিছু একটা ওদিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে আমাকে। অবাক হয়ে লক্ষ করলাম জোরে ছুটছি না, জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছি না, কিন্তু দুগাল বেয়ে ঘাম গড়াচ্ছে।

একটু পরেই টের পেলাম ওটা ঘাম না, অশ্রু।

আমি কাঁদছি এবং সেজন্য লজ্জাও পাচ্ছি না। কাঁদছি কারণ আমার সঙ্গে যে এই মস্ত রসিকতাটা করেছে সে জিতে গেছে। কিংবা কেউ হয়তো কিছু করেনি। আমি নিজেই হয়তো কাজটা করেছি।

আমি হয়তো আমার পাপের শাস্তি পাচ্ছি। কিন্তু কী করেছি আমি? এবং এর শেষ কোথায়? আমি যে আর সইতে পারছি না।

সামনেই মেইন স্ট্রীট। একটু পরেই শেষ ঘণ্টা বাজবে এবং স্কুল ছুটি হয়ে যাবে। শদুয়েক ছেলে-মেয়ে বেরিয়ে আসবে হাসতে হাসতে, ছুটতে ছুটতে বাড়ির দিকে যাবে।

কিন্তু আমি কোথায় যাব? আমি যাদেরকে চিনি তারা তো আমাকে চেনে না। কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই আমার। কোন কিছু আঁকড়ে ধরার উপায় নেই।

আমার হয়তো রকি বীচ ছেড়ে চলে যাওয়া উচিত। অন্য কোন শহরে। না, তা হয় না! আমি যেতে চাই না!

আমি আমার পরিবারকে ফেরত চাই। চাই চাচা-চাচী আবার আমাকে ভালবাসুক। আমি চাই ডন যেন আমাকে ভয় না পায়।

আমি চাই বন্ধুরা আমাকে স্বাগত জানাক এবং আমাকে আবার তাদের জীবনের অংশ করে নিক।

আমি বায়োলজি ক্লাসে বসে মি. হালবার্টকে আবারও দেখতে চাই।।

সার্জেন্ট কলিন্সের সঙ্গে আবারও বন্ধুত্বের সম্পর্ক চাই।

আমি চাই ক্যাণ্ডির দোকানে ঢোকার পর বুড়ো জেসাপ জানুক আমার পছন্দের ক্যাণ্ডি কী।

আমি চাই মিসেস ওয়েসলি সুস্থ হয়ে উঠুক।

কিন্তু আমি এ-ও অনুভব করছি একদিনের মধ্যে যদি আত্মপরিচয় প্রমাণ করতে না পারি তবে সার্জেন্ট কলিন্স আমাকে গ্রেপ্তার করাবেন।

মুখ তুলে চাইলাম। লক্ষ করিনি কখন মেইন স্ট্রীট পেরিয়ে শহরের দূর প্রান্তে চলে এসেছি।

চারধারে চোখ বুলালাম। আশপাশে কেউ নেই। না রাস্তায়, না কোন দোকানে।

ব্যাপারটা অদ্ভুত। হঠাৎ করেই চারদিক নির্জন হয়ে গেছে।

এক ঘণ্টাধ্বনির মৃদু শব্দ কানে এল। ঘুরে দাঁড়ালাম। নতুন চাইনিজ রেস্তোরাঁ থেকে আসছে। রেস্তোরার জানালার দিকে চেয়ে রয়েছি, ঘণ্টাধ্বনি যেন জোরাল হলো।

টলমল পায়ে মেইন স্ট্রীট পেরিয়ে রেস্তোরাটার দিকে এগোলাম। এখনও কাউকে আশপাশে দেখতে পেলাম না। এমনকী রাস্তা দিয়ে কোন গাড়িও যাচ্ছে না।

এই রেস্তোরাটা আমাকে টানছে কেন? চিন্তাটা মাথায় এল। কেন জানি এটাকে পরিচিত লাগছে। কিন্তু কেন?

ঘুরে দাঁড়িয়ে হাঁটা ধরব, কানে তালা লাগিয়ে দিল জোরাল ঘণ্টাধ্বনি।

কানে দুহাত চাপা দিয়ে জানালার দিকে চাইলাম-জানালার ওপাশে দাঁড়িয়ে, আমার দিকে চেয়ে মৃদু হাসছেন মিস লি! আমাকে হাতছানি দিয়ে কাছে ডাকলেন তিনি!

১০

চুম্বকের টানে যেন রেস্তোরার জানালায় সেঁটে গেলাম আমি। মিস লি তখনও আমার দিকে চেয়ে মুচকি হাসছেন।

কী ব্যাপার! আপনি আমার কাছে কী চান? চেঁচিয়ে উঠলাম।

ঘণ্টাধ্বনি সহসা থেমে গেল। পিনপতন নিস্তব্ধতা। দৃষ্টিসীমার মধ্যে কেউ নেই।

তুমি কেন এখানে এসেছ তুমি জাননা, কিশোর, বললেন মিস লি। অন্তত আমার তাই মনে হলো। আমি ওঁর কণ্ঠ শুনেছি, যদিও ঠোট নড়তে দেখিনি এবং তার হাসি বন্ধ হয়নি এবং কাচের জানালার ওপাশে দাঁড়িয়ে রয়েছেন তিনি।

কিশোর? আপনি আমাকে কিশোর বললেন? প্রশ্ন করলাম।

সময় হয়েছে, কিশোর, বললেন তিনি। আবারও গলা শুনলাম তার, কিন্তু ঠোট নড়েনি। মৃদু হাসি ধরে রেখেছেন মুখে।

কীসের সময় হয়েছে? প্রশ্ন করলাম। এই খেলা শেষ হওয়ার সময়? নাকি কী ঘটছে তা জানার সময় হয়েছে?

তোমার ভাগ্য জানার সময় হয়েছে, কিশোর।

সাদা এক ন্যাপকিন খুললেন তিনি। ভিতরে এক ফরচুন কুকি। ন্যাপকিনটা ফেলে দিয়ে কুকিটা তুলে ধরলেন মিস লি।।

ওটার দিকে চাইলাম। দুনিয়ার সবখানে চাইনিজ রেস্তোরায় এরকম ফরচুন কুকি দেখা যায়।

এসব কিছুর পিছনে একটা ফালতু ফল কুকি? জিজ্ঞেস করলাম।

দেখো, কিশোর, জবাব এল। মিস লিক কণ্ঠ আমার মাথার ভিতরটা ভরিয়ে তুলল। ফরচুন কুকিটা ভাঙলেন তিনি। গোটা ঘটনাটা যেন স্লো মোশনে ঘটছে।

কুকিটা খসে পড়ল মেঝেতে। মিস লি ছোট, সাদা কাগজের টুকরোটা তুলে ধরলেন। ওটার দিকে চেয়ে স্মিত হাসলেন। এবার  আবার আমার দিকে চাইলেন।

এখানে তোমার ভাগ্য লেখা আছে, কিশোর। পড়ো। পড়ে দেখো।

কাগজের টুকরোটা কাঁচের জানালায় তুলে ধরলেন তিনি। ছোট ছোট অক্ষরে লেখা পড়া কঠিন। প্রথমটায় পড়তে পারলাম না।

চোখ পিটপিট করে পড়ার চেষ্টা করছি, দূরে একটা ঘণ্টা বাজার শব্দ হলো। স্কুল ছুটি হয়ে গেছে।

ফরচুনটা অস্পষ্ট। আমি মর্মোদ্ধার করতে পারলাম না। এবার হঠাই চোখের সামনে পরিষ্কার হয়ে গেল।

ওতে লেখা: আজ তুমি সম্পূর্ণ নতুন একজন মানুষ হিসেবে দিন শুরু করবে। নতুন মানুষ! উনি তো আগেও এটা আমাকে বলেছিলেন। কী মানে এর?

ওঁর দিকে চাইলাম।

কী বলছেন আপনি? এর মানে কি আমি সম্পূর্ণ নতুন মানুষ? কীভাবে…সেটা কীভাবে সম্ভব?

আমরা আমাদের নিয়তিকে এড়াতে পারি না, কিশোর, আমার মাথার মধ্যে মৃদু কণ্ঠে বলল মিস লির কণ্ঠ। চেষ্টা করলে শয়তান আমাদের পথ আগলে দাঁড়াবে।

এবার আলোর ঝিলিকের সঙ্গে সঙ্গে মিলিয়ে গেলেন তিনি। জানালাটা আবারও অন্ধকার, এবং ফাঁকা হয়ে গেল।

রাস্তার দিকে ঘুরে দাঁড়ালাম। এটাই কি জবাব? এটাই কি আমার নিয়তি যে আমি একদম নতুন মানুষে পরিণত হব? কিন্তু আমি তো তা চাইনি! আমি পুরানো কিশোর পাশাই থাকতে চেয়েছি।

অনেক দেরি হয়ে গেছে, কিশোর।

ঘুরে দাঁড়ালাম।

মিস্টার হালবার্ট! চেঁচিয়ে উঠলাম। কোথায় ছিলেন আপনি?

তোমার জন্যে অপেক্ষা করছি, কিশোর। তোমার এখন সম্পূর্ণ নতুন মানুষ হওয়ার সময় এসেছে। পুরানো কিশোর পাশা এখন…হারিয়ে যাবে। এবং তিনি কর্কশ কণ্ঠে হেসে উঠলেন।

কী? কী বলতে চান? জবাব চাইলাম। এবার মেইন স্ট্রীটের দিকে চাইলাম।

এখনও নীরব, তবে হঠাই রাস্তাটা ভরে উঠল মানুষ-জনে। সবাইকে আমি চিনি। হাঁটছে। রাস্তা ধরে। আমার দিকে। নিঃশব্দে।

একটা বৃত্ত তৈরি করে আমার দিকে এগিয়ে আসছে তারা। আমার চাচা। আমার চাচী। ডন। আমার বন্ধু মুসা, রবিন, টিমমেটরা। হাসপাতালের লোকেরা, মি. জেসাপ, সার্জেন্ট কলিন্স, মিসেস ওয়েসলি (মিসেস ওয়েসলি?), মিসেস বার্টন, মি. লাউয়ি, মিসেস পোর্টার, আমার হিরু চাচা, এবং আরও অনেকে।

বৃত্তটা ক্রমেই কাছিয়ে আসছে। নিঃশব্দে, ধীরে ধীরে ঘিরে ফেলছে আমাকে। বন্দি হয়ে পড়ছি আমি।

সবাই হাসছে, দুহাত বাড়িয়ে রেখেছে, আমাকে ছুঁতে চাইছে, আরেকটু হলেই ছুয়ে দেবে, এবং আমার কাঁধ প্রচণ্ড ব্যথায় দপ-দপ করছে। হঠাৎই সবার মুখ হয়ে গেল মিস লি-র মত! আর্তচিৎকার ছাড়লাম আমি!

১১

সোজা হয়ে বসলাম। আমি আমার বিছানায়, নিজের কামরায়।

কাঁধে সাঙ্ঘাতিক ব্যথা। সারা দেহ ঘামে ভিজে গেছে।

ঘড়ির দিকে চাইলাম। সকাল ৭:২৫।

আচমকা চাচা-চাচী হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকল।

কিশোর, কিশোর, তোর ঘুম ভেঙেছে, তুই ঠিক আছিস, আল্লাকে হাজারও শুকরিয়া! চাচী প্রায় ছুটে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরল।

কেমন ফীল করছিস? রাশেদ চাচা প্রশ্ন করল। ডাক্তার ঠিকই বলেছিল। জ্বরটা শেষমেশ কাটল।

জ্বর? ডাক্তার? বালিশে মাথা রাখলাম। কাঁধের ব্যথায় গুঙিয়ে উঠলাম।

ব্যথাটা কয়েকদিন থাকবে। বিশ্রীভাবে পড়ে গিয়েছিলি কিনা, চাচা বলল।

চাচা, চাচী…কী ঘটছে বলো তো? মনে হচ্ছে আমি…কিছু জিনিস…মিস করছি…।

তবে শোন, বলল চাচী, কালকে ফুটবল প্র্যাকটিসের পর টিমমেটদের সাথে তুই নতুন চাইনিজ ফাস্ট ফুডের দোকানটায় গিয়েছিলি।

ফু লিং? প্রশ্ন করলাম, জানি জবাবটা কী হবে।

হ্যাঁ, চাচা বলল। তোরা কটা এগ রোলের অর্ডার দিয়েছিলি, সস সহ তোদেরকে সেগুলো সার্ভ করা হয়। তুই তোর এগ রোলটায় সস মাখিয়ে দুটো কামড় দিয়েছিলি, তারপরই শুরু হয়ে যায় অ্যালার্জিক রিঅ্যাকশন।

তুই জ্ঞান হারাস, চাচী বলল। পড়ে গিয়ে বাঁ কাঁধে ব্যথা পাস, যে জন্যে ওটা এত টাটাচ্ছে।

ওরা হাসপাতাল থেকে তখুনি অ্যাম্বুলেন্স আনায়। ডাক্তার বলেন ভর্তি করার দরকার নেই। বাসায় শুয়ে ঘুমোলেই ঠিক হয়ে যাবে। উনি বলেন রাতটা হয়তো খারাপ কাটবে, কিন্তু সকালে সব স্বাভাবিক হয়ে যাবে।

চাচী আমার ভ্রূ ঘষল, এখনও ভেজা রয়েছে।

রাতটা কি খারাপভাবে কেটেছে, বাপ? দেখে তো তাই মনে হচ্ছে।

চাচীর দিকে চাইলাম।

চাচী, এত ভাল আমার এর আগে আর কখনও লাগেনি, বলে তাকে জড়িয়ে ধরলাম। তুমি ভাবতেও পারবে না কতটা ভাল লাগছে!

চাচী হেসে উঠে পাল্টা জড়িয়ে ধরল আমাকে।

যা ভয় পাইয়ে দিয়েছিলি! বলল।

আমি নিজেও কম ভয় পাইনি, বললাম।

সত্যিই? কীভাবে? তোর তো জ্ঞানই ছিল না, চাচা বলল।

ওসব কথা থাক, চাচা। এগ রোল সসের অ্যালার্জিক রিঅ্যাকশন অদ্ভুত সব স্বপ্ন দেখায়। আমার শরীর আউট হয়ে গেলেও মন হয়নি।

মাথা ঝাকাল চাচা।

যাক, জ্বরটা কেটে গেছে। দুঃস্বপ্ন আর নেই। বাস্তব দুনিয়ায় ফিরে এসেছিস তুই।

ফিরতে পেরে খুব ভাল লাগছে, বললাম। আমি ক্লান্ত, কিন্তু এত খুশি জীবনে আর কখনও হইনি।

চাচা ঘড়ি দেখল।

অফিসে যাওয়ার সময় হলো। টেক ইট ইযি, চ্যাম্প। ডাক্তার বলেছেন পুরোপুরি সেরে না ওঠা পর্যন্ত ফুটবল বন্ধ।

ঠিক আছে, বলে কাঁধ ডললাম। চাচা বেরিয়ে গেল। চাচী দরজার দিকে এগোল।

আরেকটু ঘুমিয়ে নে, তারপর তোকে নাস্তা দেব, চাচী বলল। বেডরুমের দরজায় থমকে দাঁড়িয়ে আমার দিকে ঘুরে চাইল। ওহ, ভুলেই গেছিলাম। ফু লিঙের লোকেরা এই ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করেছে। চিকিৎসার সমস্ত খরচ ওরা দিতে চেয়েছে আর আমাদেরকে যে কোন সময় ডিনারের দাওয়াত দিয়ে রেখেছে।

ভাল। তবে এর পরেরবার আমি আর এগ রোল সস খাব না, বললাম।

হ্যাঁ, চাচী বলল, ওরা খুব ভাল মানুষ। ওরা এমনকী একটা গেট-ওয়েল গিফটও পাঠিয়েছে। তোর ড্রেসারে রয়েছে।

চাচী বেরিয়ে গিয়ে পিছনে দরজা লাগিয়ে দিল। আমি উঠে বসে চারধারে নজর বুলালাম। গোটা ব্যাপারটাই স্বপ্ন ছিল। কিন্তু এতই বাস্তব যে আমি আর অমন স্বপ্ন দেখতে চাই না।

ড্রেসারের দিকে চাইলাম। চাচী সাদা এক ন্যাপকিন রেখেছে ওটার উপরে। উপহারটা কী কে জানে।

আস্তে আস্তে বিছানা ছেড়ে ড্রেসারের কাছে গেলাম।

ন্যাপকিনটা খুললাম। ভিতরে এক ফরচুন কুকি।

ন্যাপকিনটা মেঝেতে পড়তে দিলাম। কুকিটা তুলে ধরলাম। ভেঙে খুলে ফেললাম ওটাকে। কুকিটা মেঝেতে পড়ে গেলে কাগজটার দিকে চাইলাম।

ওতে লেখা, আজ তুমি সম্পূর্ণ নতুন একজন মানুষ হিসেবে দিন শুরু করবে। অনুভব করলাম নাড়ির গতি দ্রুততর হলো। অস্পষ্ট হাসির শব্দ কানে এল। সরাসরি বেডরুমের আয়নার দিকে চাইলাম। নিজের প্রতিবিম্বটার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে রইলাম।

এসময় তাঁকে দেখতে পেলাম। আমার দিকে চেয়ে মৃদু হাসছেন। মুহুর্তের জন্য। কিন্তু কোন সন্দেহ নেই এটি তিনিই। আয়না থেকে আমার দিকে পাল্টা চেয়ে ছিলেন মিস লি। মুখে স্মিত হাসি।

এবার উধাও হয়ে গেলেন তিনি। হাসির শব্দটা মিলিয়ে গেল।

নড়তে সাহস পাচ্ছি না আমি। আয়নায় নিজের দিকে স্থিরদৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছি। দুঃস্বপ্নটা কি সত্যি শুরু হতে যাচ্ছে? এই ঘর থেকে বেরনোর পর কেউ কি আমাকে চিনবে না?

বেডরুমের দরজা খুললাম। নীচে, কিচেনে চাচী আর ডন কথা বলছে, হাসছে।

ধীরে সুস্থে সিড়ি ভেঙে নেমে গেলাম। নীচে এখন আমি, কিচেনের দরজার কাছে। ভিতরে পা রাখলাম। চাচী আর ডন কথা থামিয়ে আমার দিকে চাইল। চেয়ে রয়েছে একদৃষ্টে।

হাই, আমি বললাম। সামান্য বিরতি, কেউ কিছু বলল না। এবার চাচীর মুখে হাসি ফুটল।

খিদে পেয়েছে? প্রশ্ন করল। ডন দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরল আমাকে।

সে আর বলতে! বললাম। হাতে শক্ত করে ধরে থাকা ফরচুনটা দলা পাকিয়ে ছুঁড়ে মারলাম ওয়েস্ট পেপার বাস্কেটে। দারুণ লাগছে আমার, চাচী, বলে প্রাণ খোলা হাসি দিলাম। মনে হচ্ছে আমি নতুন একজন মানুষ, বলতে গিয়ে চেপে গেলাম।

আমার আসলে পুরানো কিশোর পাশার মতই অনুভূতি হচ্ছে। এবং আমার জন্য সেটাই যথেষ্ট।

***

1 Comment
Collapse Comments

Very excitement book.

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *