এনরিকো কারুজো : মূল্যবান কণ্ঠের অধিকারী ছিলেন

এনরিকো কারুজো : মূল্যবান কণ্ঠের অধিকারী ছিলেন

পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা দুর্লভ ও মূল্যবান কণ্ঠের অধিকারী ছিলেন এনরিকো কারুজো। তাঁর বয়স যখন মাত্র দশ, বাবা তাকে স্কুল ছাড়িয়ে এক কারখানায় কাজে ঢুকিয়ে ছিলেন অর্থোপার্জনের জন্য। কিন্তু সঙ্গীতের প্রতি অসম্ভব ঝোঁক ছিল তাঁর। তাই কারখানার কাজ শেষ করে প্রতি দিন সন্ধ্যায় বাড়িতে বসে সঙ্গীতচর্চা করতেন।

বাড়ির কাছে কোথাও গান গাওয়ার সুযোগ পেলে তিনি আনন্দে আটখানা হয়ে যেতেন। কোনো মহিলার জানালার নিচে দাঁড়িয়ে কলকণ্ঠে সঙ্গীত পরিবেশনের জন্য যুবকেরা তাকে ভাড়া করে নিত। নিজের একাগ্র সাধনার ও পরিশ্রমের ফলে অবশেষে যখন তিনি সত্যি সত্যিই অপেরায় গান গাওয়ার সুযোগ পেলেন, তখন মহড়ার সময় এত বেশি ঘাবড়ে গিয়েছিলেন যে শুদ্ধভাবে উচ্চারণ করতে অক্ষম হলেন। তাঁর কণ্ঠস্বর ভাঙা কাঁচের টুকরোর মতো খানখান করে ভেঙে পড়তে থাকল, বেশ কয়েকবার বিফল হয়ে শেষে কেঁদেই ফেললেন। তারপর কাঁদতে কাঁদতে মঞ্চ থেকে পালিয়ে গেলেন।

যখন তিনি প্রথম এক গীতিনাট্য অনুষ্ঠানে জনসমক্ষে আত্মপ্রকাশ করলেন, তখন তিনি ছিলেন মাতাল। তখন তিনি এতই মাতাল ছিলেন যে, শ্রোতারা শিস দিয়ে চিৎকার করে এক মহা হই হুল্লোড় বাধিয়ে দিল। তাদের হট্টগোলের আড়ালে এনরিকোর কণ্ঠস্বর একেবারে তলিয়ে গেল। কোনো এক সন্ধ্যায় গীতিনাট্যের প্রধান অংশগ্রহণকারী নায়ক অসুস্থ হয়ে পড়লেন। এনরিকোও তখন সেখানে ছিলেন না। তাকে খোজার জন্য রাস্তায়-রাস্তায় লোক পাঠানো হল। তাকে খুঁজে পাওয়া গেল মাতাল অবস্থায়। খবর পেয়ে তিনি যথাসাধ্য দ্রুতগতিতে নাট্যমঞ্চের দিকে ছুটে চললেন। যখন তিনি রূদ্ধশ্বাসে এবং উত্তেজনায় নাট্যমঞ্চে পৌঁছলেন, তখন ড্রেসিং রুমের গরম আর মদের নেশায় তাঁর সহ্যক্ষমতা সীমা ছাড়িয়ে গেল। সমস্ত রঙ্গমঞ্চটা তার চোখের সামনে নাগরদোলার মতো ভো ভো করে ঘুরতে লাগল। কারুজো যখন মঞ্চে ঢুকলেন, তাঁর অবস্থা দেখে উত্তেজিত দর্শকরা আরো হট্টগোল বাধিয়ে তুলল, রঙ্গালয়ে বিশৃঙ্খলা দেখা দিল। অনুষ্ঠানের পর তীব্রভাবে তিরষ্কার করা হল। এতে ভগ্নহৃদয়ে ও হতাশমনে সেদিন কারুজো আত্মহত্যা করবেন বলে প্রতিজ্ঞা করলেন।

তাঁর পকেটে তখন ছিল মাত্র একটি লিরা যা কিনা এক বোতল মদের মূল্য। সারাদিন আহার না করে মদ পান করে কাটালেন আর আত্মহত্যার মতলব আঁটতে থাকলেন, কীভাবে আত্মহত্যা করবেন। তিনি যখন আত্মহত্যার পরিকল্পনা করছিলেন তখন হঠাৎ ঝড়ের বেগে এক লোক রঙ্গমঞ্চ থেকে তাঁর কাছে ছুটে এল। সে বলল, ‘কারুজো শিগগির এসো, রঙ্গমঞ্চের লোকজন অন্য গায়ককে পছন্দ করছে না, ওরা তাকে মঞ্চ থেকে তিরস্কার করে তাড়িয়ে দিয়েছে। ওরা শুধু তোমার জন্য চিৎকার করেছে। কারুজো বিশ্বাস করলেন না তার কথা। আশ্চর্য হয়ে বললেন, ওরা তো আমার নামও জানে না। লোকটি হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, ওরা তোমার নাম জানে না। তবু তোমাকেই চায়। চিৎকার করে ঐদিনের মাতালটাকেই খুঁজছে।’

তারপর একটু একটু করে বাড়তে লাগল এনরিকো কারুজোর সুনাম ও জনপ্রিয়তা। পরিণত বয়সে তিনি বনে গেলেন একজন যশস্বী গায়ক।

প্রথম দিকে তার কণ্ঠস্বর এত হালকা ও চিকন ছিল যে তার শিক্ষক তাকে বলেই বসলেন, ‘তোমাকে দিয়ে গান গাওয়া হবে না, জানালার খড়খড়ির ভিতর দিয়ে বয়ে যাওয়া বাতাসের মতো তোমার কণ্ঠস্বর।‘ এতে তার উৎসাহ ও অনুশীলন বেড়ে চলল এবং তা জাদুময় কণ্ঠস্বরে পরিণত হল। তাই খ্যাতির উচ্চশিখরে আরোহণ করে প্রথম জীবনের দুঃখময় ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ও অগ্নিপরীক্ষার কথা মনে পড়ল।

মাত্র পনের বছর বয়সে তার মা মারা যান। মাকে বড় ভালোবাসতেন তিনি। তাই সারা জীবন যেখানেই গেছেন, মায়ের ছবিটা সঙ্গে নিয়ে যেতেন। তার একুশ ভাই বোনদের মধ্যে শৈশবেই আঠারো জন মারা যায়। তার মা ছিলেন একজন সাধারণ মহিলা। সারা জীবন কঠোর পরিশ্রম ও দুঃখ কষ্ট ছাড়া তার ভাগ্যে আর কিছু জোটে নি। এনরিকোর প্রতি অত্যন্ত আশাবাদী ছিলেন তিনি। তাই তাঁকে খুব ভালোবাসতেন। এনরিকো বলেছেন, ‘আমি যাতে গান শিখতে পারি তার জন্য আমার মা জুতো পরা ছেড়ে দিয়েছিলেন।’

ইতালির অন্যসব চাষী পরিবারের মতো তিনিও কুসংস্কারাচ্ছন্ন ছিলেন। জ্যোতিষীর পরামর্শ না নিয়ে কখনো ভ্রমণে বেরোতেন না। তিনি শুক্রবারে নূতন পোশাক পরিধান করতেন না, নূতন জায়গায় ভ্রমণে যেতেন না, নূতন কোনো কাজেও হাত দিতেন না। এগুলো ছাড়া তিনি ছিলেন একজন রুচিশীল ভদ্রলোক।

পৃথিবীর সর্বপেক্ষা দুর্লভ এবং মূল্যবান কণ্ঠের অধিকারী ছিলেন এনরিকো কারুজো। অথচ তিনি একজন প্রকৃত ধূমপায়ী ছিলেন। তিনি বলতেন, ধূমপান তার কণ্ঠস্বরের কোনো ক্ষতি করে না। প্রতিটি অনুষ্ঠানে মঞ্চে ঢোকার আগে দু-এক ঢোক হুইস্কি পান করতেন। তিনি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ডাক টিকেট আর দুষ্প্রাপ্য মুদ্রা সগ্রহ করতেন। ব্যঙ্গচিত্র অঙ্কনে তিনি অসাধারণ সিদ্ধহস্ত ছিলেন।

এনরিকো কারুজো জন্মগ্রহণ করেছেন নেপলসে। তার নিজের শহরের লোকেরা তাঁর গান পছন্দ করত না, পত্রিকায় তার সমালোচনা হত, সেজন্য তার মনে গভীর দুঃখ ছিল বলে নিজে শহরবাসীদেরকে কোনোদিন ক্ষমা করেন নি। জনপ্রিয়তা ও খ্যাতির উচ্চশিখরে আরোহণ করার পর প্রায়ই নেপলসে ফিরে যেতেন কিন্তু তাদের কাছে থেকে গান পাওয়ার প্রস্তাব এলে অত্যন্ত তিক্ততার সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করতেন।

কারুজো যখন মারা যান তখন কয়েক মিলিয়ন ডলারের মালিক তিনি। শুধু ফোনোগ্রাফ রেকর্ড থেকেই কারুজো দুই মিলিয়ন ডলারেরও বেশি উপার্জন করতেন। যৌবনে দারিদ্র্যের অভিজ্ঞতায় তিনি এতই বিতৃষ্ণ হয়েছিলেন যে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত প্রতিটি খরচের হিসেব লিখে গেছেন।

১৯২১ খ্রিস্টাব্দে মাত্র ৪৮ বৎসর বয়সে যখন এনরিকো কারুজো মারা যান তখন সমগ্র ইতালিবাসী শোকে বিমূঢ় হয়ে গিয়েছিল। কারণ তারা জেনেছিল, স্মরণকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ও সুন্দরতম কণ্ঠস্বরটি চিরকালের জন্য নীরব হয়ে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *