০৮. মধু আহরণে ব্যর্থ হলে মৌচাকের দোষ নেই

০৮. মধু আহরণে ব্যর্থ হলে মৌচাকের দোষ নেই

১৯৩১ সালের ৭ই মে। এই তারিখে নিউইয়র্ক শহরে দেখা গিয়েছিল সবচেয়ে উত্তেজনাপূর্ণ এক মানুষ শিকারের দৃশ্য। প্রাচীন এ শহরটায় এমন দৃশ্য কেউ আগে দেখে নি। কয়েক সপ্তাহ খোঁজ করার পর ‘দু বন্দুকবাজ’ ক্রোলিকে কুজা করেছিল পুলিশ। খুনী ক্রোলির ধূমপানে বা মদ্যপানে আসক্তি ছিল না। সে ধরা পড়ল ওয়েস্ট এন্ড অ্যাভিনিউতে তার প্রেমিকার আবাসে।

প্রায় শত দেড়েক পুলিশ আর গোয়েন্দা তার উঁচুতলার গোপন আবাস ঘিরে ফেলেছিল। ছাদের মধ্যে ফুটো করে তারা পুলিশ খুনকারী’ ক্রোলিকে কাঁদানে গ্যাস ছড়িয়ে বের করার চেষ্টা করছিল। এরপর পুলিশ আশেপাশের বাড়িতে মেশিনগানও বসাল-এরপরেই প্রায় ঘণ্টাখানেক ধরে নিউইয়র্কের বিলাসবহুল আবাসন এলাকা জুড়ে শোনা যেতে লাগাল পিস্তলের শব্দ আর মেশিনগানের আওয়াজ। ক্রোলি মালপত্র বোঝাই একখানা চেয়ারের পিছনে লুকিয়ে এক নাগাড়ে পুলিশের দিকে গুলি চালাচ্ছিল। দশ হাজার উদগ্রীব মানুষ ওই লড়াই দেখে চলল। নিউইয়র্কের রাস্তায় এমন দৃশ্য আগে কখনো চোখে পড়ে নি।

ক্রোলি ধরা পড়ার সবচেয়ে পুলিশ কমিশনার মালরুনি জানান দু-বন্ধুকবাজ লোকটা নিউইয়র্কের ইতিহাসে ধরা পড়া সবচেয়ে সাংঘাতিক অপরাধী। কমিশনার আরো জানান, সে একটা পালক নড়লেও খুন করতে অব্যস্ত। কিন্তু দু-বন্দুকবাজ’ ক্রোলির নিজের সম্পর্কে ধারণা কি রকম? আমরা তা জানতে পেরেছি কারণ পুলিশ যখন তার গোপন আস্তানায় গুলি চালাচ্ছিল সে তখন জনগণকে উদ্দেশ্য করে একটা চিঠি লিখছিল। লেখার ফাঁকে তার দেহের নানা আঘাত থেকে ঝরা রক্তের ধারা কাগজের বুকে লালচে আভা ফুটিয়ে তুলেছিল। চিঠিতে ক্রোলি লিখেছিল : আমার কোটের নিচে ঢাকা আছে এক ক্লান্ত অথচ দয়ার্দ্র হৃদয়–সে হৃদয় কারো ক্ষতি করে না।

এর অল্প কিছুক্ষণ আগে ক্রোলি লং আইল্যান্ডে এক গ্রাম্য রাস্তায় হৈ হুল্লোড়ে মত্ত ছিল। আচমকা একজন পুলিশ রাস্তায় রাখা ওর গাড়ির কাছে এসে বলে, আপনার লাইসেন্সটা একবার দেখি।’

কোনো কথা না বলে ক্রোলি বন্দুক বের করে পুলিশটিকে সীসের গুলিতে ঝাঁঝরা করে দেয়। অফিসারটি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তেই ক্রোলি গাড়ি থেকে নেমে তার রিভলবারটা কেড়ে নিয়ে আরো একঝাঁক গুলি করল। আর এই খুনীই কি-না বলেছিল; ‘আমার কোটের নিচে ঢাকা আছে এক ক্লান্ত অথচ দয়ার্দ্র হৃদয়–সে কারো ক্ষতি করে না।

ক্রোলিকে বৈদ্যুতিক চেয়ারে প্রাণদণ্ড দেয়া হয়। সে যখন সিংসিং কারাগারের মরণ কুঠিতে হাজির হল তখন হয়তো তার বলা উচিত ছিল : মানুষ খুন করার পুরস্কার হিসেবে এটাই পাচ্ছি। কিন্তু না, সে যা বললো তা হল : ‘আত্মরক্ষার বদলে এটাই আমি পেলাম।’

এই কাহিনীর বক্তব্য হল এই : দু-বন্দুকবাজ’ ক্রোলি নিজেকে মোটেই দোষ দিতে চায় নি।

অপরাধীদের মধ্যে এটা কি কোনো অবাস্তব আচরণ মনে করেন আপনারা? তা যদি ভাবেন তাহলে এটা একবার শুনুন।

‘আমার জীবনের সেরা মুহূর্তগুলো মানুষকে আনন্দ দেবার জন্যই ব্যয় করেছি, তাদের নানাভাবে সাহায্য করেছি, বদলে যা পেয়েছি তা হল নিন্দা, আর তাড়া খাওয়া পলাতক কোনো মানুষের জীবন।

এ হল অল ক্যাপোনের কথা। জেনে রাখতে পারেন, সে ছিল এখনো পর্যন্ত আমেরিকার জনগণের এক নম্বর শত্রু-শিকাগোতে সেই ছিল সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ডাকাত দলের নেতা। ক্যাপোনও নিজের দোষ দেখতে পায় নি। সে আসলে নিজেকে জনগণের উপকারী বন্ধু বলেই ভাবত-একজন অপ্রশংসিত আর ভুল ভেবে নেয়া জনসেবক।

ঠিক এই রকমই করেছিল ডাচ সুলজ, নেওয়ার্কে দুর্বৃত্তদলের গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়ার আগে। নিউইয়র্কের অন্যতম একজন জঘন্য ছুঁচো ডাচ সুল খবরের কাগজে এক সাক্ষাৎকারে বলে সে একজন জনদরদী। ও নিজেও তাই বিশ্বাস করত। সিংসিং কারাগারের ওয়ার্ডেন লয়েজের সঙ্গে আমার এই বিষয়ে বেশ কিছু চিত্তাকর্ষক পত্রালাপ হয়। তিনি স্বীকার করেন, ‘সিংসিংয়ের খুব কম অপরাধীই নিজেদের দোষী বলে ভাবে। তারা আমার আপনার মতোই মানুষ। আর সেই কারণেই তারা যুক্তি খাড়া করে বোঝাতে চায়। ওরা বুঝিয়েও দিতে প্রস্তুত তারা কোনো সিন্দুক কেন ভাঙে বা গুলিই বা চালায় কেন। ওদের বেশিরভাগই নানা রকম যুক্তি খাড়া করে তাদের সমাজবিরোধী কাজকর্মের সাফাই দিতে চায়, সে যুক্তি ভুল বা যুক্তগ্রাহ্য যাই হোক। তাদের বেশ জোরাল শেষ কথা হল তাদের কখনই আটক করা উচিত হয় নি।’

যদি অল ক্যাপোন, ‘দু-বন্দুকবাজ’ ক্রোলি, ডাচ সুলজ বা জেলখানার ওই সাংঘাতিক লোকগুলো নিজেদের কোনোভাবেই দোষী বলে না ভাবে-তাহলে আমরা যেসব মানুষের সংস্পর্শে আসি তাদের ব্যাপারটা কি রকম?

পরলোকগত জন ওয়ানামেকার একবার স্বীকার করেন : ‘ত্রিশ বছর আগে উপলব্ধি করেছিলাম কাউকে তিরস্কার করা বোকামি। আমার নিজের দুর্বলতাগুলো দূর করতে আমায় কম ঝামেলা সহ্য করতে হয় নি কারণ এটা না বুঝে উপায় ছিল না সৃষ্টিকর্তা সকলকে সমান বুদ্ধি দেন নি।

ওয়ানামেকার এ শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন বেশ আগে ভাগেই; কিন্তু আমার বেলায় তা হয় নি প্রায় শতাব্দীর এক তৃতীয়াংশ হাতড়ে বেড়াবার আগে আমার উপলব্ধি হয় নি যে শতকরা নব্বই জন মানুষই নিজের দোষ দেখেও কখনো আত্ম-সমালোচনা করতে চায় না।

সমালোচনা করা বৃথা, কারণ এতে মানুষ সাবধানী হয়ে পড়ে আর স্বভাবতই সে নিজের কাজ সমর্থন করার পথ খোঁজে। সমালোচনা মারাত্মক জিনিস যেহেতু এটা মানুষের অহমিকাকে আঘাত করে, তার আত্মগর্বে চিড় ধরে আর তার ফলে যে সেটা ঘৃণার চোখে দেখা শুরু করে।

জার্মান সেনাবাহিনীতে কোনো সৈনিককে কোনো ঘটনা ঘটলে সঙ্গে সঙ্গেই কোনো রকম অভিযোগ পেশ করতে বা সমালোচনা করতে দেয়া হয় না। প্রথমে তার ক্রোধ প্রশমিত করে মাথা ঠাণ্ডা করতে বলা হয়। সে যদি সঙ্গে সঙ্গে কোনো অভিযোগ আনে তাহলে তাকে শাস্তি দেয়া হয়। সৃষ্টিকর্তা জানেন, সাধারণ মানুষের জীবনেও এরকম কিছু লাইন থাকলে ভালো হত–যেমন হতাশাগ্রস্ত বাবা মা, ঘ্যানর ঘ্যানর করা বউ বা ত্রুটি ধরা জনিত আর পরের ছিদ্র খুঁজে ফেরা জঘন্য সব মানুষের জন্য।

ইতিহাসের হাজার হাজার পাতায় এরকম সমালোচনার অসারতার উদাহরণ খুঁজে পেতে পারবেন আপনারা। যেমন উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, থিয়োডোর রুজভেল্ট আর প্রেসিডেন্ট ট্যাফটের বিখ্যাত সেই ঝগড়া–যে ঝগড়ার ফলে রিপাবলিকান দল প্রায় ভেঙে যায় আর উড্রো উইলসন হোয়াইট হাউসে ঢোকার সুযোগ পেয়ে যান। আর এর ফলে বিশ্বযুদ্ধে তিনি আলোকোজ্জ্বল লেখার সৃষ্টি করে ইতিহাসের ধারাটাই বদলে দেন।

সব ব্যাপার একটু খতিয়ে দেখা যাক। ১৯০৮ সালে থিয়োডোর রুজভেল্ট যখন হোয়াইট হাউস ত্যাগ করেন তিনি তখন ট্যাফটকে প্রেসিডেন্ট বানালেন। তিনি এরপর আফ্রিকায় সিংহ শিকার করতে চলে যান। ফিরে এসেই তিনি ফেটে পড়লেন। তিনি ট্রাফটকে তার রক্ষণশীলতার জন্য ভসনা করে নিজেই তৃতীয় বারের জন্য প্রেসিডেন্ট পদে নতুন দল গঠন করে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ব্যবস্থা করে ফেললেন। ঝগড়াটা বেশ ঘোরাল হয়ে উঠল। এর পরেই নির্বাচন এলো, তাতে উইলিয়াম হাওয়ার্ড ট্যাফট আর তার রিপাবলিকান দলের দারুণ পরাজয় ঘটল-তারা মাত্র দুটো রাজ্য দখল করতে পারলেন–ডারমন্ট আর উটা। প্রাচীন দলটার এমন হার কখনো হয় নি।

থিওডোর রুজভেল্ট ট্রাফটকেই দোষ দিয়েছিলেন, কিন্তু প্রেসিডেন্ট ট্যাফট কি নিজেকে দোষ দেন? অবশ্যই না। অশ্রুসজল চোখে ট্যাফট বলেন; আমি বুঝতে পারছি না অন্য আর কিছু আমি করতে পারতাম কি না।’

এখন দোষটা কার? রুজভেল্টের না ট্যাফটের? সত্যি কথা বলতে গেলে আমি সেটা জানি না, গ্রাহ্যও করি না। যে কথাটা বোঝাতে চাই তা হল থিয়োডোর রুজভেল্টের ওই সমালোচনাতেও ট্যাফট নিজেকে দোষী বলে ভাবেন নি। বরং এটা সজল চোখে ট্যাফটকে আত্মসমর্পণ করতে আর ভাবতে বাধ্য করেছিল যে তিন আর কিছু করতে পারতেন কি না।

এছাড়া ধরুন, টিপট ডোম তেল কেলেঙ্কারির কথাটাই। ব্যাপারটা মনে আছে? ব্যাপারটা বছরের পর বছর খবরের কাগজে আলোড়ন তুলেছিল। সারাদেশেই এতে প্রায় কাঁপন ধরেছিল। আজকের দিনে যারা জীবিত আছেন তাঁরা জানেন আমেরিকার জনজীবনে এর চেয়ে সাংঘাতিক কাণ্ড আর কখনো ঘটে নি। সেই কেলেঙ্কারির ব্যাপারটা ছিল এইরকম : হার্ডিংয়ের মন্ত্রিসভার ইন্টিরিয়র সেক্রেটারি অ্যালবার্ট ফলের উপর দায়িত্ব দেয়া হয় এক হিল আর টিপট ডেডামের সংরক্ষিত সরকারি তেল ভাণ্ডার লীজ দিতে–এই তেল ভাণ্ডার নৌবাহিনীর ভবিষ্যৎ ব্যবহারের জন্যই রাখা ছিল। সেক্রেটারি ফল কি প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে দর ডেকেছিলেন মনে হয়? না। তিনি ওই দারুণ লাভজনক চুক্তির ব্যাপারটা তার বন্ধু এডওয়ার্ড এল ডোহেনিকে দিয়ে দেন। ডোহেনি কি করলেন? তিনি তার বন্ধু সেক্রেটারি ফলকে ‘ধার’ হিসেবে দিয়েছিলেন প্রায় লাখ খানেক ডলার। তারপর সেক্রেটারি ফল প্রায় স্বৈরতান্ত্রিক পথে যুক্তরাষ্ট্রীয় নৌবহরকে ওই এলাকায় গিয়ে প্রতিযোগীদের ‘এক হিল’ রিজার্ভে তাদের তৈল স্তূপ ব্যবহার করা নিবৃত্ত করে হটিয়ে দেবার আদেশ দেন। প্রতিযোগীরা বন্দুক আর বেয়োনেটের মুখে হটে গিয়ে বাধ্য হয়েই আদালতের দ্বারস্থ হলেন–আর তার ফলেই টিপট ডোমের দশ কোটে ডলারের কেলেঙ্কারি ফাঁস হয়ে গেল। এর ফলে যে দুর্গন্ধ বেরিয়ে এলো সেটা এতই পচন ধরা যে হার্ডিং শাসন ব্যবস্থাটাই ধ্বংস হয়ে গেল। তা ছাড়াও এরই সঙ্গে সারা দেশটা ঘৃণায় শিউরে উঠল, রিপাবলিকান দলও এসে দাঁড়াল ভাঙনের মুখে আর অ্যালবার্ট বি. ফলের জায়গায় হল কারাগারে।

ফলকে সকলেই প্রচণ্ডভাবে দোষারোপ করল-জনজীবনে এ ধরনের কেউ অভিযুক্ত হয় নি। কিন্তু তাতে তিনি কি অনুশোচনা করেন? কখনো না! বেশ কয়েক বছর পরে হার্বার্ট হুভার এক জনসমাবেশে বক্তৃতায় জানিয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট হার্ডিংয়ের মৃত্যুর কারণ ছিল মানসিক বিপর্যয় আর দুর্ভাবনা কারণ এক বন্ধু তার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে। মিসেস ফল যখন কথাটা শুনেছিলেন তিনি চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে উঠে সজল চোখে নিজের ভাগ্যকেই ধিক্কার জানিয়ে চিৎকার কার ওঠেন : ‘ক্কি! হার্ডিংকে ফল বিশ্বাসঘাতকতা করেছে? কখনো না। আমার স্বামী কোনোদিন কারো সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেন নি। এই বাড়িটা সম্পূর্ণ সোনায় মুড়ে দিলেও আমার স্বামী লোভে পড়তেন না। তারই সঙ্গে আসলে বিশ্বাসঘাতকতা করা হয়েছে আর যূপকাষ্ঠে তাকেই বলি দিতে নিয়ে গিয়ে ক্রুশবিদ্ধ হয়েছে।

এই হল ব্যাপার। মানব চরিত্রের কাজই এই, দোষীরা সবসময়ই নিজেকে ছাড়া সকলকেই দোষারোপ করে চলে। আমরা সকলেই এই রকম। অতএব আপনি বা আমি যখন আজ বা কাল অন্য কাউকে সমালোচনা করার জন্য উৎসাহিত হব তখন আমাদের মনে রাখা দরকার অল ক্যাপোন, ‘দু বন্দুকবাজ’ ক্রোলি আর অ্যালবার্ট ফলকে। আমাদের অনুভব করতে হবে সমালোচনা অনেকটা ঘরে ফেরা পায়রার মতই। এটা সবসময়েই নিজেদের ঘরে ফিরে আসে। আমাদের আরো উপলব্ধি করতে হবে যে, লোককে আমরা ঠিক পথে আনতে চাইছি বা দোষ দিতে চাইছি সে সম্ভবত আত্মপক্ষ সমর্থন করতে আর উল্টে আমাদেরই দোষারোপ করবে। তাছাড়াও, হয়তো বা সেই শান্ত ট্যাফটের মতোই বলবে, ‘আমি বুঝতে পারছি না অন্য আর কিছু আমি করতে পারতাম কি না।’

১৮৬৫ সালের ১৫ এপ্রিলের এক শনিবারের সকালে আব্রাহাম লিঙ্কন সস্তাদরের এক সরাইখানার হলঘরের এক শয়নঘরে মৃত্যুশয্যায় শায়িত ছিলেন। সে ঘর ফোর্ডের নাট্যশালার ঠিক সামনের রাস্তায়, যে নাট্যশালায় রুথ তাকে গুলি করে। লিঙ্কনের দীর্ঘ দেহ ঝুলে পড়া তার পক্ষে অতি ছোট একখানা শয্যায় আড়াআড়ি ভাবে শায়িত ছিল। বিছানার ঠিক মাথার দিকে টাঙানো ছিল অত্যন্ত সস্তা রোসা বনহিউর বিখ্যাত ছবি ‘দি হর্স ফেয়ারের প্রতিলিপি আর ঘরের মধ্যে হলদে আলো ছড়িয়ে চলে ছিল একটা বিষণ্ণ গ্যাসের আলো।

মৃত্যু পথযাত্রী লিঙ্কনের পাশে দাঁড়িয়ে সেক্রেটারি অব ওয়ার স্ট্যানটন বলেছিলেন, ‘ওই যে শায়িত রয়েছেন পৃথিবীর সবার চেয়ে যোগ্য একজন শাসক।‘

জনগণের সঙ্গে যোগাযোগের ব্যাপারে লিঙ্কনের সাফল্যের রহস্য কি? আমি দশ বছর ধরে আব্রাহাম লিঙ্কনের জীবনী পাঠ করেছি আর তারই সঙ্গে তিনি বছর ব্যয় করেছি ‘অজানা লিঙ্কন’ নামে একখানা বই সংশোধন করে লিখতে। আমার বিশ্বাস কোনো মানুষের পক্ষে যা সম্ভব সেই ভাবেই আমি লিঙ্কনের ব্যক্তিত্ব আর পারিবারিক জীবন সম্পর্কে পুঙ্খানুপুঙ্খ আর সম্পূর্ণ জ্ঞান লাভে চেষ্টা করেছি; বিশেষ করে আমি জানার চেষ্টা করেছি লিঙ্কনের জনসংযোগের পদ্ধতিকে; তিনি কি সমালোচনায় বিশ্বাসী ছিলেন? হ্যাঁ, তাই। ইন্ডিয়ানার পিজিয়ন ক্রিক উপত্যকায় তরুণ বয়সে তিনি যে শুধু সমালোচনাই করতেন তা নয় বরং মানুষকে শ্লেষ করার মধ্যে দিয়ে তিনি চিঠি আর কবিতা লিখতেন। চিঠিপত্রগুলো তিনি আবার গ্রাম্য পথের বুকে ছড়িয়েও দিতেন যাতে সেগুলো অবধারিত ভাবেই খুঁজে পাওয়া যায়। এইসব চিঠির মধ্যে একটার জন্য প্রচণ্ড আপত্তি ওঠে আর সেটা সারা জীবনই উত্তর জ্বালার সৃষ্টি করেছিল।

এছাড়াও লিঙ্কন ইলিনয়ের স্প্রিংফিল্ডে একজন ব্যবহারজীবি হিসেবে কাজ শুরু করার পরেও তিনি তার বিরোধীদের খোলাখুলি ভাবেই আক্রমণ করে খবরের কাগজে চিঠি প্রকাশ করতেন। একাজে একবার তিনি অত্যন্ত বাড়াবাড়িই করে ফেলেন।

১৮৪২ সালের শরৎকালে তিনি জেমস্ শিল্ডস্ নামে এক গর্বিত অথচ কলহপ্রিয় আইরিশ রাজনীতিককে ব্যঙ্গ করেন। লিঙ্কন স্প্রিংফিল্ড জার্নালে এক বেনামা চিঠিতে ওই লোকটিকে ঠাট্টা করে কিছু লেখেন। সারা শহরই তাতে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে। স্পর্শ কাতর আর গর্বিত শিল্ডস এতে প্রায় ক্রোধে ফেটে পড়েন। তিনি খুঁজে বের করেন চিঠির লেখককে, তারপর তাঁর ঘোড়ায় চড়ে লিঙ্কনের খোঁজে বেরিয়ে পড়েন। লিঙ্কনকে পেয়েই তিনি তাকে দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান জানালেন। লিঙ্কন অবশ্য লড়াই করতে ইচ্ছুক ছিলেন না। তিনি দ্বন্দ্বযুদ্ধের বিরোধী ছিলেন–কিন্তু এ ব্যাপার থেকে তার বেরিয়ে আসার কোনো সম্ভাবনাই ছিল না কারণ তাঁকে সম্মান বাঁচাতে হত। তাঁকে অস্ত্র বেছে নিতে সুযোগ দেয়া হল। যেহেতু তাঁর বেশ বড় বড় হাত ছিল তিনি অশ্বারোহীর উপযুক্ত চওড়া তরোয়ালই বেছে নিলেন। তারপ ওয়েস্ট পয়েন্টের একজন স্নাতকের কাছে তরোয়াল খেলা শিখতে শুরু করলেন। লড়াইয়ের দিনে লিঙ্কন আর শিল্ডস মিসিসিপি নদীর তীরে বালুকাবেলায় আমৃত্যু লড়াইয়ের জন্য তৈরি হলেন। কিন্তু শেষ মুহূর্তে প্রায় দুজনেরই বন্ধুরা এসে লড়াই বন্ধ করার ব্যবস্থা করল।

লিঙ্কনের জীবনে এটাই বলতে গেলে সবচেয়ে জঘন্য এক ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা। এটাই তার কাছে মানুষের সঙ্গে ব্যবহারের ক্ষেত্রে অমূল্য শিক্ষা। তিনি আর কখনই অপমানজনক চিঠি লেখেন নি বা আর কখনো কাউকে ব্যঙ্গ বিদ্রূপও করেন নি। আর তারপর থেকেই প্রায় কোনোদিন কাউকে তিনি সমালোচনাও করেন নি কোনো কারণে।

গৃহযুদ্ধ চলার দিনগুলোয় লিঙ্কন অটোম্যাকের যুদ্ধে একের পর এক সেনাবাহিনীতে নতুন নতুন সেনাপতি নিয়োগ করেন। সেইসব সেনাপতিদের মধ্যে একের পর এক আসেন ম্যাকেব্লেলান, পোপ বার্নাসাইড হুঁকার। মিড-আর তাদের প্রত্যেকেই লজ্জাজনকভাবে ব্যর্থ হওয়ায় লিঙ্কন হতাশায় প্রায় ভেঙে পড়েন। দেশের প্রায় অর্ধেক মানুষ ওইসব অপদার্থ সেনাধ্যক্ষদের ক্রমাগত দোষারোপ করে চললেও লিঙ্কনের কিন্তু কারো প্রতি কোনো বিষোগার ছিল না, বরং ছিল প্রত্যেকের প্রতিই সদাশয়তা। তিনি শান্তভাবেই সব মেনে নিয়েছিলেন। তার অতি প্রিয় উক্তি ছিল, কারো সমালোচনা করো না, তাহলে নিজেও সমালোচিত হবে না।’

মিসেস লিঙ্কন আর অন্যান্যরা যখন দক্ষিণাঞ্চলের মানুষদের কড়া সমালোচনা করতে চাইতেন, লিঙ্কন জবাব দেন : ‘ওদের সমালোচনা করো না, ওই অবস্থায় পড়লে আমরাও ওই রকমই করতাম।‘

তা সত্ত্বেও, কোনো কারণে যদি কাউকে সমালোচনা করতে হত তিনি ছিলেন নিশ্চয় লিঙ্কনই। একটা উদাহরণ দেখা যেতে পারে :

গেটিসবার্গের যুদ্ধ সংঘটিত হয় ১৮৬৩ সালের জুলাই মাসের প্রথম তিন দিনে। ৪ঠা জুলাই রাতে শত্রু সেনাপতি লি দক্ষিণে পশ্চাদপসরণ করতে শুরু করলে সারাদেশে মেঘে ঢাকা পড়ে প্রচণ্ড বৃষ্টিপাত শুরু হয়। লি যখন পটোম্যাক নদীর কাছে তার পরাজিত সেনাবাহিনীর সঙ্গে হাজির হন তিনি সভয়ে দেখতে পান তাঁর সমানে ফুলে ফেঁপে ওঠা ভয়ঙ্কর এক নদী, যেটা পার হওয়া অসম্ভব, আর তার পিছনে তাড়া করে আসছিল যুক্তরাষ্ট্রীয় বিজয় বাহিনী। ফাঁদে পড়েছিলেন লি, তার পালানোর আর পথ ছিল না। ব্যাপারটা লিঙ্কন বুঝতে পেরেছিলেন। তাঁর হাতে এসেছিল সৃষ্টিকর্তা-প্রেরিত এক সুবর্ণ সুযোগ-লি’র সেনাবাহিনীকে অবরুদ্ধ করে সঙ্গে সঙ্গে যুদ্ধ শেষ করার সুযোগ। অতএব দারুণ আশায় উদ্বুদ্ধ হয়ে লিঙ্কন সেনাপতি মিডকে আদেশ করলেন কোনো সামরিক পরামর্শ সভা না ডেকে সঙ্গে সঙ্গে লিকে আক্রমণ করতে। লিঙ্কন টেলিগ্রাফ করে লিকে আদেশ জানানোর পর বিশেষ এক দূত পাঠিয়েও মিডকে সঙ্গে সঙ্গে কাজ করতে বললেন।

কিন্তু জেনারেল মিড কী করলেন? তাকে যা করার আদেশ দেয়ো হয় তিনি ঠিক তার উল্টোটাই করলেন। তিনি লিঙ্কনের হুকুম সরাসরি অগ্রাহ্য করে সামনিক পরামর্শ সভা ডাকলেন। তিনি ইতস্ততঃ আর দীর্ঘসূত্রতা অবলম্বন করতে চাইলেন। তিনি লিঙ্কনকে টেলিগ্রাফ পাঠিয়ে নানা রকম ওজর আপত্তি তুললেন। তিনি সরাসরি লিকে আক্রমণে অস্বীকৃত জানালেন। শেষপর্যন্ত নদীর পানি কমে গেলে আর লি তার সেনা বাহিনীসহ পটোম্যাক নদী পার হয়ে পালাতে সক্ষম হলেন।

ক্ষেপে আগুন হয়ে গেলেন লিঙ্কন। এসবের উদ্দেশ্য কি?’ লিঙ্কন চিৎকার করে তাঁর ছেলে রবার্টকে বলে উঠলেন। হা বিধাতা! এসবের মানে কি? ওদের আমরা আমাদের মুটোতেই পেয়েছিলাম, শুধু হাত বাড়ালেই ওরা আমাদের হত। তা সত্ত্বেও আমার কথায় বা আদেশে আমার সেনাবাহিনী একটুও নড়ল না। এমন অবস্থায় যে-কোনো সেনাপতিই লিকে পরাজিত করতে পারত। ওখানে আমি থাকলে আমি লি-কে নিজেই চাবকাতে পারতাম।

তিক্ত হতাশায় লিঙ্কন ভেঙে পড়ে তৎক্ষণাৎ নিচের চিঠিটি লিখেছিলেন। একটা কথা মনে রাখবেন, তাঁর জীবনের এসময়ে তিনি অত্যন্ত রক্ষণশীল আর তাঁর বাগবিন্যাসেও যথেষ্ট সতর্কতা ছিল; অতএব ১৮৬৩ সালে লিঙ্কনের কাছ থেকে আসা চিঠিটার মধ্যে আসলে ছিল তীব্র তিরস্কার।

 ‘প্রিয় জেনারেল,

আমার বিশ্বাস হয় না আপনি লি-র পলায়নের মধ্যে যে বিরাট ব্যাপার আর দুর্ভাগ্য জড়িয়ে আছে আদৌ সেটা উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছেন। সে সহজেই আমাদের মুঠোর মধ্যে এসে গিয়েছিল, তাই তাঁর বাহিনীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়লে, আমাদের ইদানীং কালের সাফল্যের পরিপ্রেক্ষিতে যুদ্ধের সমাপ্তিই ঘটতে পারত। কিন্তু বর্তমান অবস্থায় এ যুদ্ধ অনির্দিষ্টকাল ধরেই চলবে। আপনি যদি গত সোমবার নিরাপদে লীকে আক্রমণ না করে থাকতে পারেন তাহলে কীভাবে আপনি তাঁকে নদীর দক্ষিণ দিকে মোকাবিলা করবেন–বিশেষ করে সঙ্গে যখন বেশি সৈন্য নিতে পারবেন না? সেই সেনার সংখ্যা তখনকার তুলনায় দুই তৃতীয়াংশও যখন হতে পারে না! আপনার কাছে এ সম্পর্কে যুক্তিগ্রাহ্য কিছু আশা করাই অন্যায় হবে আর আমি আশাও করি না আপনি বিশেষ কিছু করতে পারবেন। আপনার সুবর্ণ সুযোগ আপনি হারিয়েছেন আর এজন্য আমি আশাতীত রকম দুঃখ লাভ করেছি।’

মিড যখন এ চিঠি পেলেন তখন সেটা পড়ে তিনি কি করেছিলেন বলে আপনাদের মনে হয়?

মিড চিঠিটা আদৌ দেখেন নি। কারণ লিঙ্কন আদৌ তা তাঁকে দেন নি। তাঁর মৃত্যুর পর লিঙ্কনের কাগজপত্রের মধ্যে চিঠিটা পাওয়া যায়।

আমার ধারণা হল-যদিও নিছক একটা ধারণা–যে চিঠিটা লেখার পর লিঙ্কন জানালার বাইরে দৃষ্টি মেলে ধরে স্বগতোক্তি করেছিলেন, এক মিনিট অপেক্ষা করা যাক। মনে হয় আমার এতটা তাড়াহুড়ো করা উচিত নয়। আমার পক্ষে হোয়াইট হাউসের শান্ত পরিবেশে বসে মিডকে আক্রমণ করতে হুকুম দেয়া খুবই সহজ। কিন্তু আমি যদি গেটিবার্গে থাকতাম আর মিড গত সপ্তাহে যে রক্তপাত দেখেছে তা দেখতাম, আহত আর মৃতকল্পদের কাতর আর্তনাদ যদি আমার কানে প্রবেশ করত তাহলে হয়তো আক্রমণ করতে আমিও তেমন উৎসাহবোধ করতাম না। আমার যদি মিডের মতো ভীরুতা মাখা মনোবৃত্তি হত তাহলে সে যা করেছে হয়তো আমিও তাই তরতাম। যাই হোক অনুশোচনা করে লাভ নেই। আমি যদি এ চিঠি ওকে পাঠাই তাতে আমি মানসিক শান্তি পাবো বটে কিন্তু পরিবর্তে মিড যেভাবেই হোক আত্মসমর্পণ করতে চাইবে। এটা হলে সে আমাকে দোষারোপ করতে চাইবে। এর ফলে মনোমালিন্যের সৃষ্টি হবে আর সেনপাতি হিসেবে তার সব যোগ্যতা আর প্রয়োজনও নষ্ট হয়ে যাবে আর খুব সম্ভব এটার জন্য তাকে সেনাবাহিনী থেকে পদত্যাগে বাধ্য হতেও হবে।

অতএব, আমি যা আগেই বলেছি, লিঙ্কন চিঠিটা সরিয়ে রেখে দেন কারণ তিনি বুঝেছিলেন তীব সমালোচনা আর নিন্দা নিঃসন্দেহে ব্যর্থতাতেই পর্যবসিত হয়। থিয়োডোর রুজভেল্ট বলেছিলেন যে, তিনি যখন প্রেসিডেন্ট ছিলেন তখন কোনো গভীর সমস্যার সম্মুখীন হলে তিনি আরাম কেদারায় শরীর জড়িয়ে হোয়াইট হাউসে তাঁর ডেস্কের পিছনে টাঙানো লিঙ্কনের বিশাল ছবিটির দিকে তাকিয়ে নিজেকে প্রশ্ন করতেন : আমার মতো অবস্থায় পড়লে লিঙ্কন কি করতেন? তিনি নিজের সমস্যার সমাধান কী ভাবেই বা করতেন?

কখনো কাউকে কোনো তিরস্কার করার আগে আমাদের উচিত পকেট থেকে একটা পাঁচ ডলারের নোট বের করে লিঙ্কনের ছবিতে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে প্রশ্ন করা এমন সমস্যার সম্মুখীন হলে লিঙ্কন কি করতেন?

আপনার কি এমন কাউকে জানা আছে যাকে পরিবর্তিত করে তার উন্নতি ঘটিয়ে পরিচালিত করতে চান? চমৎকার! খুব ভালো কথা। আমিও মনে প্রাণে সেটা সমর্থন করি। তবে একাজ আপনার নিজেকে দিয়েই শুরু করছেন না কেন? এটাকে বেশ স্বার্থপরতার দৃষ্টিতেই দেখতে পারেন, এটা বরং অন্য কাউকে বদলে দেয়া চেষ্টার চাইতে অনেক বেশি লাভজনক–কথাটা নিছক সত্যি, আর ঢের কম বিপজ্জনকও বটে।

ব্রাউনিং একবার বলেছিলেন, কোনো মানুষ যখন নিজের মধ্যেই সংগ্রাম শুরু করতে চায় তখন বুঝতে হবে তার কিছুটা মূল্য আছে। কাজটা ঠিক এখনই শুরু করলে আগামী বড়দিনের মধ্যেই হয়তো নিজেকে শুধরেও নেয়া যাবে। হয়তো এর পরেই দীর্ঘ অবসরের পর নববর্ষষের দিনগুলোয় অন্যান্য সব মানুষকে আপনি সমালোচনা করতে পারবেন।

তবে আগেই নিজেকে ঠিক করে নিন।

কনফুশিয়াস বলেছিলেন, আপনার পড়শীর ছাদের অবস্থা দেখে অনুযোগ জানাবেন না যখন আপনার নিজের সদরই অপরচ্ছিন্ন।

আমার বয়স যখন অল্প তখন মানুষকে প্রভাবিত করার বেশ চেষ্টা করতে চাইতাম। সেই সময় আমেরিকান সাহিত্যাকাশে সমহিমায় বিচরণ করতে যিনি, সেই রিচার্ড হার্ডিং ডেভিসকে আমি একটা মূখের মতো চিঠি লিখেছিলাম। আমি লেখকদের সম্বন্ধে এক সাময়িক পত্রের প্রবন্ধ রচনা করছিলাম আর এই জন্যই ডেভিসকে অনুরোধ জানাই তাঁর কাজের পদ্ধতি আমায় জানাতে। এর কয়েক সপ্তাহ আগে আমি একজনের কাছ থেক একটা চিঠি পাই, তার তলায় লেখা ছিল ‘এটা শ্রুতিলিখিত, কিন্তু পঠিত হয় নি। আমার দারুণ ভালো লেগেছিল সেটা। আমার মনে হয়েছিল লেখক নিশ্চয়ই মস্ত একজন কেউ, হয়তো খুবই ব্যস্ত আর নামী। কিন্তু ব্যস্ততা আমার কণামাত্রও ছিল না, তা সত্ত্বেও রিচার্ড ডেভিসের মধ্যে আমার সম্পর্কে একটা ধারণা জন্মানোর জন্যই আমার চিঠির শেষে লিখে দিই তিলিখিত, কিন্তু পঠিত নয়।’

তিনি সে চিঠির কোনো উত্তর দেন নি। তিনি শুধু আমার চিঠিটার তলায় এই কথা কয়টি লিখে ফেরৎ দেন : ভদ্রতার কণামাত্রও আপনার জানা নেই। কথাটা সত্যি? আমি খুব বোকামি করেছিলাম, তার ওই গালাগাল আমার পাওয়া ছিল। তবে আমি রক্ত মাংসের মানুষ বলেই সেটা সহ্য করতে পারি নি। আমার বিতৃষ্ণটা এমন স্তরেই পৌঁছে ছিল যে দশ বছর পরে যখন রিচার্ড হার্ডিং ডেভিসের মৃত্যুসংবাদ পাঠ করি তখনো কথাটা আমার মনে ছিল–অবশ্য স্বীকার করতে আমার লজ্জাই হচ্ছে–কথাটা হল, তিনি আমাকে আঘাত দিয়েছিলেন।

ধরুন, আগামীকাল আমার আপনার মধ্যে একটা মনোমালিন্য সৃষ্টি হল–সেটা কিন্তু কয়েক দশক ধরেই জিইয়ে থেকে মৃত্যু পর্যন্তও থাকতে পারে। সামান্য সমালোচনা করে দেখা যাক, আর সেটা যতখানি যুক্তিসঙ্গতই আমরা ভাবি না কেন।

মানুষের সঙ্গে ব্যবহার করার সময় আমাদের মনে রাখা দরকার যে, আমরা যুক্তিসহ কোনো প্রাণীর সঙ্গে ব্যবহার করছি না। আমরা এমন কোনো প্রাণীর সঙ্গে কারবার করছি যাদের রয়েছে ভাবাবেগ–এই প্রাণীরা টগবগ করছে সংস্কার নিয়ে আর তারা চালিত হয়ে চলে অহঙ্কার আর গব নিয়ে। তাছাড়া সমালোচনা ভয়ঙ্কর একটা স্ফুলিঙ্গ-যে স্ফুলিঙ্গ অহমিকার কেন্দ্রবিন্দুতে বারুদের মধ্যে বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে–যে বিস্ফোরণে কখনো কখনো মৃত্যুও ত্বরান্বিত করতে পারে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, জেনারেল লেনার্ড উডকে সমালোচনা করে সেনাবাহিনীর সঙ্গে ফ্রান্সে যেতে দেয়া হয় নি। তার অহমিকায় এর ফলে যে আঘাত লাগে তাতেই বোধ হয় তার জীবন স্বল্পস্থায়ী হয়েছিল।

অত্যন্ত তিক্ত সমালোচনায় ইংরাজি সাহিত্যকে যারা সমৃদ্ধ করেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম এক শ্রেষ্ঠ রত্ন টমাস হার্ডিকে চিরকালের জন্যই উপন্যাস লেকা ছেড়ে দিতে বাধ্য করে। এই সমালোচনাই আবার ইংরাজ কবি টমাস চ্যাটারটনকে আত্মহত্যায় প্ররোচিত করে।

বেঞ্জামিন ফ্র্যাঙ্কলিন যৌবনে খুবই ভোলামনের ছিলেন, অথচ তিনিই আবার কালে কালে এমনই কুশলী আর জনগণের সঙ্গে ব্যবহারে এমনই দক্ষ হয়ে ওঠেন যে তাঁকে ফ্রান্সে আমেরিকার রাষ্ট্রদূত নিয়োগ করা হয়। তাঁর সাফল্যের রহস্যটা কি? ফ্রাঙ্কলিন নিজেই বলেছিলেন : ‘… আমি কাউকেই নিন্দা করব না…সকলের মধ্যে যেটুকু ভালো সেটাই শুধু বলব।

যে-কোনো মূখের পক্ষেই সমালোচনা, নিন্দা বা অভিযোগ জানানো সহজ কাজ–বেশির ভাগ মূর্খই তাই কের।

কিন্তু অপরকে বুঝতে পারা আর ক্ষমাশীলতা পেতে গেলে দরকার চারিত্রিক দৃঢ়তা আর আত্মসংযম।

কার্লাইন বলেছিলেন, কোনো মহান মানুষের মহত্বের প্রকাশ ঘটে তিনি সাধারণ মানুষের সঙ্গে কেমন ব্যবহার করেন তার মধ্য দিয়ে। তাই মানুষকে নিন্দা না করে বরং তাদের বুঝতে চেষ্টা করি আসুন। চেষ্টা করে দেখা যাক তারা যা করে সেটা তারা কেন করে। এটাই সমালোচনার চেয়ে ঢের বেশি লাভজনক আর কিছুটা বিহ্বলতাময়ও আর এর মধ্যে দিয়ে আনে সহানুভূতি, ধৈর্য আর দয়ার্দ্রভাব। ‘সবাইকে জানার অর্থই হল সবাইকে ক্ষমা করা।

ড. জনসন দারুণ একটা কথা বলেছিলেন : ‘স্বয়ং সৃষ্টিকর্তাও হয়তো মানুষকে পুরোপুরি উপলব্ধি করতে পারেন নি।

যে কাজ সৃষ্টিকর্তার অসাধ্য সে কাজ আপনি বা আমি কেমন করে করতে পারব? কাজেই, ক্ষমাই হল মানুষকে জয় করার সঠিক পথ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *