১২. উন্নত শব্দ নির্বাচন

১২. উন্নত শব্দ নির্বাচন

একবার একজন ইংরেজ ফিলাডেলফিয়ায় চাকুরির সন্ধান করছিলেন। আর্থিক সংকটে পড়ে তিনি চাকুরির সন্ধানে একদিন ওই শহরের খ্যাতনামা ব্যবসায়ী মি. পল গিবসনের অফিসে গিয়ে উপস্থিত হন এবং তাঁর সাক্ষাৎ কামনা করেন। মি. গিবসন দূর থেকে আগন্তুককে লক্ষ্য করেন? আগন্তুকের চেহারা ছিল আকর্ষণীয়। পোশাক পরিচ্ছেদ ছিল নিতান্ত অপরিচ্ছন্ন এবং সর্বোপরি তার চলায় ফুটে ওঠেছিল চরম দারিদ্র। কিছুটা উৎসুক্য এবং কিছুটা দয়া পরবশ হয়ে মি. গিবসন আগন্তুককে সাক্ষাৎ দান করতে সম্মত হন। প্রথমে তিনি এক মুহূর্তকাল তার কথা শুনতে চান, অতঃপর মুহূর্ত হয় মিনিট এবং মিনিট হয় ঘণ্টা, তবু আলোচনা অব্যাহত থাকে, অতঃপর মি. রোল্যান্ড টেলরকে টেলিফোন করেন। ফিলাডেলফিয়ার নেতৃস্থানীয় ধনী ব্যক্তি মি. টেলর এই আগন্তুককে মধ্যাহ্ন ভোজে আমন্ত্রণ জানান এবং তার জন্যে একটি মর্যাদাপূর্ণ চাকুরির ব্যবস্থা করেন। অনাকর্ষণীয় চেহারা ও অপরিচ্ছন্ন পোশাক পরিচ্ছদ নিয়ে কীভাবে এই আগন্তুক অল্প সময়ের মধ্যে সমাজের উঁচুস্তরের ব্যক্তিদের মন জয় করেন?

তাঁর এই সাফল্যের গুরুত্ব হচ্ছে ইংরেজি ভাষার উপর দখল। আগন্তুক ছিলেন অক্সফোর্ডের লোক, এই শহরে এসেছিলেন এক ব্যবসা মিশনে। মিশন ব্যর্থ হলে অর্থহীন ও বন্ধুহীন অবস্থায় তিনি ফিলাডেলফিয়ায় আটকা পড়েন। কিন্তু তিনি এত সুন্দরভাবে কথা বলতে পারতেন যে শ্রোতা মুহূর্তে তার ছেঁড়া জুতো, ময়লা কোটও খোঁচাখোঁচা দাড়িপূর্ণ চেহারার কথা বিস্মৃত হয়ে যেতেন। তাঁর বাচন ভঙ্গি ও শব্দ নির্বাচন অর্থাৎ সুবচন তাকে ব্যবসায়ী মহলে পরিচিত করে দেয়, এটা ব্যবসা মহলে প্রবেশের ছাড়পত্র হয়ে যায়।

এই লোকটির কাহিনী একটি অসাধারণ ঘটনা, কিন্তু বাস্তব সত্য হচ্ছে এই যে, আমরা প্রতিদিনই আমাদের বক্তব্য দ্বারা পরিচিতি লাভ করছি। আমাদের শব্দ প্রয়োগ ও ভাষা শুনে শ্রোতারা আমাদের শিক্ষা ও সংস্কৃতি জ্ঞানের কথা উপলব্ধি করতে পারছেন।

চারটি জিনিস দিয়ে আমাদের বিচার করা হয়। আমরা কী করি, কীভাবে তাকাই, কী বলি এবং কীভাবে বলি তা দিয়েই হয় আমাদের বিচার। বহুলোক আছেন, যারা স্কুল ছাড়ার পর আর কোনো নতুন শব্দ শেখেন না, যা শিখেছেন তা দিয়েই কাজ চালিয়ে যান! অপ্রচলিত শব্দই তিনি সাধারণত ব্যবহার করেন। এবং বার-বার ব্যবহার করেন? আরো আশ্চর্যের বিষয় যে, তিনি অনেক সময় ব্যাকরণের নিয়ম কানুন ও লংঘন করেন, এমন ভাষা ব্যবহার করেন যা সাধারণের বোধগম্য হয় না, আকর্ষণীয় হয় না। আমি অনেক স্নাতককে ভুল শব্দ ব্যবহার করতে দেখেছি। এই ধরনের শিক্ষিত লোক যদি ভাষা প্রয়োগে ভুল করেন তবে যে সব ব্যক্তি অর্থনৈতিক চাপে পড়ে শিক্ষা গ্রহণে ব্যর্থ হয়েছেন তারা কী করবেন?

কয়েক বছর আগে একজন ইংরেজের সাথে হঠাৎ আমার পরিচয় হয়। নিজের পরিচয় দিয়ে তিনি নিজের অভিজ্ঞতার বর্ণনা শুরু করেন। তিন মিনিটের মধ্যেই আমি দেখতে পাই যে তিনি ভুল ইংরেজি বলছেন, সকালে তিনি পালিশ করা জুতা পায়ে দেন, ইস্ত্রি করা কাপড় পড়েন। নিজেকে এমন নিখুঁতভাবে সাজান যাতে অন্যের দৃষ্টি তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হয়। তিনি যেন সম্মান পেতে পারেন। কিন্তু তিনি তাঁর ভাষাকে নিখুঁত করার চেষ্টা করে না। কথা বলার সময় কোনো মহিলা টুপি হাতে না নিলে তিনি তাকে লজ্জা দেন, কিন্তু ভুল ভাষা প্রয়োগের জন্যে নিজে লজ্জানুভব করেন না, তাঁর ভাষা প্রয়োগ দেখে শ্রোতারা এটা বুঝতে পারে যে, পোশাকে দুরস্ত হলেও তিনি সংস্কৃতিবান লোক নন।

এক শতাব্দীর তিনভাগের এক ভাগ সময় হারবার্ড -এর সভাপতি থাকার পর ড. চার্লস ডব্লিউ, ইলিয়ট একবার বলেছিলেন, অভিজ্ঞতা থেকে আমি এটা বুঝেছি যে, মাতৃভাষা যথাযথ ভাবে শেখাই হচ্ছে যে কোনো ভদ্রলোক বা মহিলার জন্যে প্রকৃত শিক্ষা। এটা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।

কিন্তু কীভাবে আমরা শব্দকে সুষ্ঠুভাবে প্রয়োগ করে সুন্দর ও যথাযথ বাক্য প্রকাশ করব, এতে অবশ্য কোনো গোপন তথ্য নেই। পদ্ধতিটা ওপেন সিক্রেট। লিংকন সাফল্যের সাথে এই পদ্ধতি অনুসরণ করেছেন। অন্য কোনো আমেরিকানই এত সুন্দর ভাবে ভাষা প্রয়োগ করতে পারেন নি। কারো প্রতি শত্রুতা নয় সকলে প্রতি বদান্যতা। লিংকন, যাঁর পিতা ছিলেন একজন অশিক্ষিত সুতার এবং মাতা ছিলেন একজন অপরিজ্ঞাত মহিলা, প্রকৃতির অফুরন্ত দানে কি তিনি এরূপ শব্দ ভাণ্ডারের অধিকারী হয়েছিলেন? এই ধারণার পক্ষে সমর্থক কোনো প্রমাণ নেই। কংগ্রেসে নির্বাচিত হবার পর তিনি নিজের শিক্ষা সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন, “ত্রুটিপূর্ণ” এই বিশেষণ লিখে। এই রেকর্ড আছে ওয়াশিংটনে। সমগ্র জীবনে তিনি বার মাসেরও কম সময় স্কুলে লেখাপড়া করেছেন। তবে তাঁর জীবন গঠন করেন কে। কেন্টারকীর জাসারিয়া বার্বি ও কালের হ্যাঁজেল ইন্ডিয়ানার আজেল ডোরসে, আন্ড ক্রফোর্ড এবং পিজিয়ন ক্রিক এর অসম্ভব প্রভাব তাঁর ওপর। তবে তিনি সবচাইতে বড় শিক্ষা নিয়েছেন প্রকৃতি থেকে পরিবেশ থেকে।

ইলিওনয়েসের কৃষক ও ব্যবসায়ী, আইনজীবী ও মক্কেলদের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে মিশে তিনি প্রকৃত শিক্ষা গ্রহণ করেছেন। লিংকন কখনো তার চাইতে কম বিদ্যার লোকদের সাথে সময় কাটাতেন না। বিদ্বান, শিক্ষিত ও পণ্ডিত ব্যক্তিদের সাথেই তিনি চলাফেরা করতেন। বার্নস বাইরন ও ব্রাউনের সমগ্র রচনা তিনি মুখস্থ বলতে পারতেন। বার্নস এর উপর তিনি একটি বক্তৃতা লিখেছিলেন, বাইরনের কবিতার একটি কপি তাঁর অফিসে এবং অপর একটি কপি তার বাড়িতে সব সময় মজুদ ছিল। এটা এত বেশি ব্যবহার করতেন যে, অফিসের কপিটি সব সময় খোলাই থাকত। হোয়াইট হাউসে থাকা কালে এবং গৃহযুদ্ধের তীব্র সংকট কালেও তিনি বিশ্রামকালে বিছানায় শুয়ে-শুয়ে হুডস এর কবিতা পড়তেন। কখনো কখনো রাতে ঘুম থেকে হঠাৎ জেগে গেলে তিনি বইয়ের পাতা উল্টিয়ে পড়তেন। কখনো-কখনো তিনি নৈশ পোশাক নিয়ে চটি পায়ে ওঠে পড়তেন, পায়চারী করতেন এবং সেক্রেটারি ঘুম থেকে উঠলে তাকে কবিতা পড়ে শোনাতেন। হোয়াইট হাউসে বসে তিনি শেক্সপিয়ার মুখস্থ করতেন, নায়কদের চরিত্র সম্পর্কে ব্যক্তিগত মতামত লিখতেন। আমি শেক্সপিয়ারের কতিপয় নাটক পড়েছি, নায়ক হ্যাঁক্টেকে তিনি লিখেছিলেন, তবে আমার পেশা পাঠ নয়। আমি লীয়ার, রিচার্ড -৩, হেনরী –৮, হ্যাঁমলেট পড়েছি। আমার মনে হয় ম্যাকবেথের সাথে কোনোটি তুলনীয় নয়। এটা আশ্চর্য সৃষ্টি।

লিংকন সব সময় রচনাকর্মে লিপ্ত থাকতেন, কবিতা লিখতেন। তিনি শুধুমাত্র কোনো বিষয় মুখস্থ করতেন না, নিজে-নিজে ব্যক্তিগতভাবে এবং প্রকাশ্যে আবৃত্তি করতেন, লিখতেন। বোনের বিয়ের সময় তিনি স্বরচিত একটি দীর্ঘ কবিতা পড়েছিলেন। মধ্যরাতে তিনি কবিতা লিখে দীর্ঘ একটি নোট বই পূর্ণ করেছিলেন, কিন্তু নিজের লেখা সম্পর্কে তিনি এতবেশি লাজুক ছিলেন যে নিকটতম বন্ধুকেও তা পড়তে দিতেন না। ”পণ্ডিত ব্যক্তি লিংকন” বইতে রবিনসন লিখেছেন, “এই স্বশিক্ষিত লোকটির মন ছিল অত্যন্ত সংস্কৃতিবান, এটাকে প্রতিভা অথবা মেধা যা-ই বলুন না কেন,” অধ্যাপক এবারটন তার সম্পর্কে বলেছেন, “তিনি স্কুলে যান নি, অব্যাহত প্রচেষ্টার ফলে শিক্ষালাভ করেছেন। নিজস্ব উদ্যোগ ও অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে শিক্ষালাভের এরূপ উদাহরণ নিতান্ত বিরল।”

নিজের উদ্যোগ ও প্রচেষ্টার ফলে, কোনোরূপ শিক্ষকের সাহায্য ও সহায়তা ছাড়া তিনি শুধুমাত্র শিক্ষিত হন নি, একজন খ্যাতনামা বক্তাও হয়েছিলেন, কঠোর পরিশ্রম তাকে এই সুযোগ এনে দিয়েছিল। তাঁর বক্তৃতায় শ্রেষ্ঠ উদাহরণ হচ্ছে গেটিসবার্গের ভাষণ, একটি জীবন্ত কোনো ব্যক্তির শ্রেষ্ঠ বক্তৃতা। যুদ্ধেলিপ্ত একশত ৭০ হাজার লোকের মধ্যে সাত হাজার লোক মৃত্যুবরণ করে। চার্লেস সামার লিংকনের মৃত্যুর অব্যবহিত পর বলেছেন, যুদ্ধের স্মৃতি মানুষ ভুলে গেলেও লিংকনের বক্তৃতা ভুলবে না। এবং এই বক্তৃতার জন্য মানুষ একদিন স্মরণ করবে এই যুদ্ধের কথা। এই ভবিষ্যৎ বাণীর বিশুদ্ধতা সম্পর্কে কেহ কোনোরূপ সন্দেহ করতে পারেন?

এডওয়ার্ড এভারেট গেটিসবার্গে দু’ঘণ্টা ধরে বক্তৃতা করেছিলেন, তার বক্তৃতা মানুষ বহুদিন আগে ভুলে গেছে। লিংকন বক্তৃতা করেছেন দু’মিনিটেরও কম সময়। একজন ফটোগ্রাফার বক্তৃতাকালে লিংকনের ফটো তুলতে চেষ্টা করেন। কিন্তু তার ক্যামেরা ঠিক করার আগেই লিংকন তার বক্তৃতা শেষ করে ফেলেন।

কিন্তু লিংকনের বক্তৃতার ভাষা অত্যন্ত উন্নত ছিল বিধায় ইংরাজি ভাষার আদর্শ হিসাবে তার অনুলিপি অক্সফোর্ডের একটি লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত রাখা হয়েছে। বক্তৃতা কোর্সের সকল ছাত্রই এই বক্তৃতাটি মুখস্থ করেন।

আজ থেকে ৮৭ বছর আগে আমাদের পূর্বপুরুষেরা এই মহাদেশে এমন একটি স্বাধীন জাতির জন্ম দেন যে জাতি বিশ্বাস করতেন যে জন্মসূত্রে প্রত্যেকটি মানুষ স্বাধীন ও সমান। আমরা এক ব্যাপক গৃহযুদ্ধে লিপ্ত। এই গৃহযুদ্ধের মাধ্যমে পরীক্ষা হচ্ছে স্বাধীনতায় বিশ্বাসী এই জাতি বা অন্য কোনো জাতি দীর্ঘদিন টিকে থাকতে পারবে কিনা, আমরা, এই বিরাট যুদ্ধে যারা প্রাণ দিয়েছে, তাদের এক কবরগাহে আজ সমবেত হয়েছি, জাতির ভবিষ্যতের জন্য যারা আত্মাহুতি দিয়েছে তাদের কবর এখানে। আমাদের কর্তব্য হিসাবে আমরা এখানে উপস্থিত হয়েছি আত্মাহুতিদানকারীদের স্মরণ করে এই কবরগাহকে আকর্ষণীয় করে তুলতে পারছি না। জীবিত ও মৃত সাহসী যোদ্ধারা যারা এখানে যুদ্ধ করছেন তারাই এটিকে পবিত্র স্থান পরিণত করছেন, আমাদের ক্ষুদ্র শক্তি তাতে নতুন কিছুই যোগ করতে পারে না। আমরা আজ এখানে কী বলছি তা দীর্ঘদিন কারো স্মরণ থাকবে না। কিন্তু বীরেরা এখানে কী করেছিল তা কেহ কোনোদিন ভুলবে না। সুতরাং এক্ষণে আমাদের কর্তব্য হচ্ছে আত্মাহুতিদানকারী বীর যোদ্ধাদের অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করার জন্য আত্মনিয়োগ করা আমাদের কর্তব্য যাতে তাদের আত্মদান বৃথা যেতে না পারে। কারণ এই জাতি স্বাধীনতার নব অর্থদান করেছে। তাদের দ্বারা গঠিত সরকার হচ্ছে জনগণের সরকার, যা জনগণের দ্বারা জনগণের জন্যে গঠিত। আমাদের চেষ্টা করতে হবে এর অর্থ যেন বিকৃত না হয়।

সাধারণভাবে মনে করা হয় যে, এই বক্তৃতার সমাপ্তিতে লিংকন যে ফ্রেজ প্রয়োগ করেছেন তা তার নিজেরই সৃষ্টি। কিন্তু এটা কি সত্যি? তাঁর আইন অংশীদার হেরনডন বেশ কয়েক বছর আগে লিংকনকে থিওডর পারকারের বক্তৃতা মালার একটি অনুলিপি দিয়েছিলেন। লিংকন এটি পাঠ করেন এবং এই বই এর, “গণতন্ত্র হচ্ছে সকল জনগণের স্বশাসিত সরকার বা সকল জনগণ কর্তৃক সকল জনগণের জন্যে গঠিত” এই অংশের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেন। থিওডর পারকার সম্ভবত এটি ওয়েবেস্টার থেকে ধার করেছিলেন, কেননা, ওয়েবেস্টার আরো চার বছর আগে হেইনের কাছে প্রদত্ত তাঁর বিখ্যাত ভাষণে বলেছিলেন, “জনগণের সরকার হচ্ছে তা যা জনগণের জন্যে গঠিত, জনগণের দ্বারা গঠিত এবং জনগণের কাছে জবাবদিহি করার যোগ্য।” ওয়েবেষ্টার এটি সংগ্রহ করেছিলেন সম্ভবত প্রেসিডেন্ট জেমস মনরের কাছ থেকে। কেননা মনরো এক তৃতীয়াংশ শতাব্দী আগে সরকার সম্পর্কে ঠিক এরূপ মনোভাবই প্রকাশ করেছিলেন এবং কার কাছে জেমস মনরো ঋণী? মনরোর জন্মের পাঁচ সাত বছর আগে ওয়াইক্লিফ তার ধর্মশাস্ত্র বই এর ভূমিকায় লিখেছেন, “এই বাইবেল হচ্ছে জনগণের সরকার জনগণের দ্বারা গঠিত ও জনগণের জন্য।” এবং ওয়াই ক্লিফের জন্মের ও বহু বছর আগে, খ্রিস্টের জন্মের ৪০০ বছরেরও আগে এথেন্স এর জনগণের উদ্দেশ্যে প্রদত্ত এক ভাষণে ক্লিওন”জনগণের, জনগণের দ্বারা, জনগণের জন্যে এক শাসকের কথা প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু কোন প্রাচীন সূত্র থেকে ক্লিওন এই অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন তা বিস্তৃতির অতল তলে তলিয়ে আছে।

তা হলে এটা কীভাবে নতুন হতে পারে। সুবক্তাগণ খ্যাতনামা বক্তা এবং তাদের রচনা পাঠের জন্যে কতটুকু ঋণী।

বই! এটিই হচ্ছে গোপন তথ্য। যে ব্যক্তি শব্দ ভাণ্ডার বাড়াতে পারেন সে ব্যক্তিই সাহিত্য ও সাহিত্য জগতে উত্তরণে সক্ষম হন।”কোনো গ্রন্থাগারে উপস্থিত হলে সব সময় আমার যে কথাটা মনে পড়ে, বুলেছেন জব্রাইট, “তা হচ্ছে জীবন এত সংক্ষিপ্ত যে আমার সামনে ছড়িয়ে থাকা জ্ঞান আহরণ করার সুযোগ আমার নেই।’ ব্রাইট পনের বছর বয়সে স্কুল ত্যাগ করে কাপড় কলে চাকুরি নেন, এবং এর পর তিনি আর কখনো স্কুলে ফেরার সুযোগ পান নি। এতৎসত্ত্বেও তিনি তার সময়ের একজন খ্যাতনামা বক্তা হতে পেরেছিলেন, তিনি খ্যাতি লাভ করেছিলেন, “ইংরেজি ভাষার উপর ব্যাপক দখলের জন্যে। তিনি পড়তেন, লিখতেন, নোট বুকে কপি করতেন এবং বাইরন, মিলটন, ওয়ার্ডসওয়ার্থ, হুইটার, শেক্সপিয়ার ও শেলীর দীর্ঘ কবিতা পড়তেন এবং মুখস্থ করতেন। শব্দ ভাণ্ডার বৃদ্ধির জন্যে তিনি বার-বার, প্রতি বছর প্যারাডাইস পড়তেন।

নিজের স্টাইল উন্নত করার জন্যে চার্লস জেম ফক্স উচ্চস্বরে শেক্সপীয়র পাঠ করতেন। গ্লাডস্টোন তাঁর পড়ার ঘরকে ”শান্তির মন্দির” বলতেন এবং এতে তিনি ১৫,০০০ বই সংগ্রহ করেছিলেন। সেইন্ট অগাস্টাইন, বিশপ বাটলার, দান্তে, অ্যারিস্টোটল ও হোমারের লেখা তাঁকে বিশেষ ভাবে অনুপ্রাণিত করত বলে তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন। ইলিয়ড ওডেসী তাকে যেন দাসত্বে আবদ্ধ করেছিল। হোমারের কবিতা ও হোমারের সময় সম্পর্কে তিনি ছয়টি বই লিখেছিলেন।

পিটের অভ্যাস ছিল গ্রিক বা ল্যাটিন ভাষা বইয়ের এক বা দুটি পৃষ্ঠা পড়া এবং নিজস্ব ভাষায় তা অনুবাদ করা। দশ বছর ধরে দৈনিক তিনি এ কাজ এবং ”অতুলনীয় পদ্ধতিতে নিজস্ব চিন্তা ধারাকে সাবলীল ভাষা ও স্বচ্ছন্দ শব্দে প্রকাশ করার অদ্ভুত শক্তিলাভ করেন।”

ডেমোস্থেনিস থুসিডিভেস এর ইতিহাস আট বার নিজের হাতে নকল করেছিলেন। এই খ্যাতনামা ঐতিহাসিকের ব্যবহৃত পদ্ধতি শেখার জন্যে তিনি তা করেছিলেন। এর ফল কী হয়েছিল? দু’হাজার বছর পরে নিজস্ব স্টাইল উন্নয়নের জন্যে উড্রো উইলসন ডেমোস থেনিসের লেখা পাঠ করেছিলেন। মি. আসকুইথ বিশপ বারকেলের লেখা পাঠে সুষ্ঠু প্রশিক্ষণ পেয়েছিলেন।

টেনিস প্রতিদিনই বাইবেল পাঠ করতেন। টলস্টয় মুখস্থ না হওয়া পর্যন্ত খ্রিস্টের জীবনী বার-বার পড়তেন। রাস্কিনের মতো প্রতিদিনই তার সন্তানকে বাইবেলের দীর্ঘ প্যাসেজ মুখস্থ করতে এবং প্রতি বছর পূর্ণ বাইবেল শব্দ করে পাঠ করতে “প্রতিটি সিলেবল, রহস্যোৎঘাটন পূর্ব পর্যন্ত তাকে পাঠ করতে হত।” এই ভাবে শৃঙ্খলা অনুসরণের ফলে রাস্কিন তার সাহিত্যে উন্নত মানের স্টাইল প্রবর্তনে সক্ষম হয়েছিলেন।

রবার্ট লুই স্টিভেনসন ইংরেজি সাহিত্যের একজন খ্যাতনামা লেখক ছিলেন, তিনি ছিলেন লেখদের লেখক, যে স্টাইল তাঁকে খ্যাতি দিয়েছিল তা তিনি কীভাবে অর্জন করেছিলেন? সে কাহিনী তিনি নিজেই আমাদের বলেছেন। যখন আমি কোনো বই বা রচনা পাঠ করি এবং যা পড়তে আমি আনন্দ লাভ করি, যা আমরা মনেক আকর্ষণ করে, যাতে আমি নতুন আইন দেখতে পাই, আমি তা অনুকরণে সেরূপ গুণ অর্জনের জন্যে তা অনুসরণ করি। আমি ব্যর্থ হই, আবারো চেষ্টা করি, ব্যর্থ হই, আবারো চেষ্টা করি, বার-বার চেষ্টা ও ব্যর্থতার ফলে আমি স্টাইল পুরোপুরি অনুসরণ করতে না পারলেও নতুন শব্দ বুঝতে পারি, শিখতে পারি, প্রয়োগ বা ব্যবহার করতে সক্ষম হই।

তাই আমি হেজলিট, ল্যাম্ব, ওয়ার্ডওয়ার্থ, স্যার টমাস ব্রাউন, ডেফো, হাওর্টনও মন্টেইগনির ব্যবহৃত বহু শব্দ, বহু বাক্য, বহু ছন্দ সাফল্যের সাথে ব্যবহার করতে পারি, ব্যবহার করি।

এবং এটা হচ্ছে লেখা শেখার পদ্ধতি। এর দ্বারা লাভবান হোন বা না হোন, এই পদ্ধতি অনুসরণ করা প্রয়োজন। কীটস এই পদ্ধতিই অনুসরণ করে ছিলেন এবং তার সৃষ্ট সাহিত্য অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাহিত্য সম্পদ।

এই পদ্ধতি অনুসরণ কষ্টকর। এতে ব্যর্থতা আসতে পারে? তবে এটা সত্য যে ব্যর্থতাই সাফল্যের চাবিকাঠি।

আইনজীবী হতে আকাঙ্ক্ষী একজন তরুণকে লিংকন লিখেছিলেন : ‘বই সংগ্রহ কর, তা পাঠ কর এবং যত্ন সহকারে তা অধ্যয়ন কর। কাজ, কাজ এবং কাজই হচ্ছে প্রধান বিষয়।”

কী বই? আর্নল্ড ব্যানেট-এর ‘দিনের চব্বিশ ঘণ্টা কীভাবে কাটাবেন’ বই দিয়ে শুরু করুন। এই বই পড়ে আপনি প্রয়োজনীয় সকল বিষয় জানতে পারবেন। এটা পড়ে জানতে পারবেন, প্রতিদিন কতটুকু সময় আপনি নষ্ট করেছেন, কীভাবে অপচয় বন্ধ করা যায় এবং কীভাবে সময়ের ব্যবহার সম্ভব।

সমগ্র বইটি ১০৩ পৃষ্ঠা বিশিষ্ট। একসপ্তাহে সহজে আপনি এটা শেষ করতে পারবেন। প্রতিদিন সকালে ২০ পৃষ্ঠা কেটে নিয়ে পেছনের পকেটে রাখুন। প্রতিদিন সকালে আপনি যে ২০ বা ৩০ মিনিট কাল সংবাদ পত্র পাঠ করেন তা হতে কিছু সময় কেটে দিয়ে বইটি পাঠ করুন, সহজে পাঠ পর্ব শেষ হবে।

“টেসিটাস ও থুসি ডিভেস এবং নিউটন ও ইউক্লিড পাঠের জন্যে আমি সংবাদ পত্র পাঠ ছেড়ে দিয়েছিলাম।” লিখেছেন থমাস জেফারসন, “এবং আমি অত্যন্ত আনন্দ লাভ করি?” আপনি কী বিশ্বাস করেন যে, সংবাদপত্র পাঠের সময় কমিয়ে উন্নত মানের বই পড়ে আপনি এক মাসের মধ্যে জ্ঞানী ব্যক্তি হয়ে উঠতে পারেন? আপনি এভাবে একমাস চেষ্টা চালান, বাসের জন্যে অপেক্ষা কালে, খাবার টেবিলে বসে খাবার আসার জন্যে অপেক্ষা কালে আপনি পড়েন না কেন?

এভাবে ২০ পৃষ্ঠা শেষ করার পর আরো ২০ পৃষ্ঠা এইভাবে কেটে নিন। এভাবে সমস্ত বই শেষ করার পর খোলা পৃষ্ঠাগুলোকে আবার বাঁধাই করে নিন। অতঃপর মনে মনে বইয়ের সমগ্র বিষয়টি আলোচনা করুন এবং বইটি বুক শেলফ-এ রেখে দিন।

‘দিনের ২৪ ঘন্টা কীভাবে কাটানো যায়’ পাঠ করার পর আপনি একই লেখকের মানব যন্ত্র বই সম্পর্কে আগ্রহী হতে পারেন। এটা পাঠ করাও প্রয়োজন। এই বইতে কী বলা হয়েছে তা দেখার জন্যে এটি পড়তে বলা হচ্ছে না। বরঞ্চ কীভাবে বলা হয়েছে তা দেখার জন্যই এটি পাঠের সুপারশি করা হচ্ছে। এটা পাঠে আপনার ভাষা জ্ঞান নিশ্চিত ভাবেই উন্নত হবে।

আরো কতিপয় প্রয়োজনীয় বইয়ের তালিকা দেয়া হচ্ছে : ফ্রাঙ্ক মরিসের লেখা ”দি অকটোপাস” ‘ও ”দি পিট।” এ দুটি হচ্ছে আমেরিকার শ্রেষ্ঠ উপন্যাস। প্রথমটিতে কালিফোর্নিয়ার গম ক্ষেতে মানব জীবনের যে বিয়োগান্ত ঘটনা ঘটেছিল তা বিবৃত হয়েছে, দ্বিতীয়টিতে শিকাগো বাণিজ্য বোর্ডের সগ্রামের কথা বর্ণনা করা হয়েছে। টমাস হার্ডির লেখা ‘টেল অব দ্য ডি উরবার ভিলস’ হচ্ছে একটি শ্রেষ্ঠ গল্প। নেওয়েল ডুইট হিলির, সমাজে মানুষের মূল্য এবং প্রফেসর উইলিয়াম জেমস এর ‘শিক্ষকদের প্রতি আচরণ’ বই দুটি পাঠের জন্যে অত্যন্ত উপযোগী। আপনার পাঠ্য তালিকায় আন্দ্রে মরিসের লেখা শেলীর জীবনী, বায়রনের শিশুদের তীর্থ যাত্রা এবং রবার্ট লুই স্টিফেনসনের ‘বানর নিয়ে ভ্রমণ’ রাখতে পারেন।

রালফ ওয়ারডো এমারসনকে আপনার নিত্যসঙ্গী করুন। তাঁর ‘আত্মপ্রত্যয়’ লেখাটি পাঠ করুন। এটি থেকে শিক্ষা গ্রহণ করুন। এটিতে লেখা হয়েছে :

যা কিছু শিখবেন তা পরিষ্কার ভাবে, স্বচ্ছভাবে-শিখুন। মুসা, প্লেটো ও মিল্টনের জ্ঞান সম্পর্কে সবাই ওয়াকেবহাল, তাঁদের জ্ঞান সম্পর্কে মানুষ কি বলেন তা বড় কথা নয়, মূল কথা হচ্ছে মানুষ কী চিন্তা করেন। যে আলো মানুষের অন্তরকে স্বচ্ছ করে, হৃদয় উজ্জ্বল করে, সেই আলো সম্পর্কে জ্ঞান আহরণ প্রয়োজন, আমরা যে চিন্তা পরিহার করি সে চিন্তা বার-বার আমাদের মনে ফিরে ফিরে-আসে। এটা আমাদের এই শিক্ষাদান করে যে, কোনো কিছুই ফেলনা নয়, সব কিছুরই একটা প্রভাব মানব জীবন আছে। কোনো সময় কোনো আগন্তুকের অর্থহীন কোনো বাক্যও আমাদের মনকে প্রভাবিত করতে পারে, এবং তা চিরস্মরণীয় হয়ে থাকতে পারে।

মানুষের শিক্ষা জীবনে এমন এক সময় অসে যখন সে এটা বুঝতে পারে যে অজ্ঞানতা শত্রুতার জন্ম দেয়, অনুকরণ আত্মহত্যার সামিল এবং ভালো মন্দ সকল অবস্থার মোকাবেলার জন্যে প্রস্তুত থাকাই হচ্ছে। প্রকৃষ্ট পন্থা। পাঠকের মনে যে ধারণা আছে তা সে নিজে ছাড়া আর কেহ উপলব্ধি করতে পারে না?

স্যার হেনরী ইরভিং একশতটি শ্রেষ্ঠ বই এর নাম লিখতে বললে তিনি উত্তর দেন, ‘একশত বই এর আগে বাইবেল ও শেক্সপীয়র পাঠ করুন।‘ স্যার হেনরীর উত্তর অত্যন্ত সঠিক। ইংরেজি সাহিত্যের এ দুটি প্রশ্নবাণ থেকে অনেক কিছু শেখার আছে।

এভাবে এগুলে কি পুরষ্কার পাবেন? আস্তে-আস্তে আপনার ভাষাজ্ঞান, শব্দ ভাণ্ডার সমৃদ্ধ হবে? কী পড়ছেন তা আমাকে বলুন, বলেছেন গ্যেটে, এবং আমি বলব আপনি কী।

আমি যে পাঠ্য সূচি দিলাম তা দীর্ঘ হলেও তা অনুসরণে আপনার সমৃদ্ধ জ্ঞানভাণ্ডার হবে। আপনি ইচ্ছা করলে ইমারসনের লেখা ও শেক্সপিয়রের নাটকের পকেট কপি কিনতে পারেন।

মার্ক টোয়েন পদ্ধতির গূঢ়তত্ত্ব :

কীভাবে মার্ক টোয়েন তাঁর শব্দ ভাণ্ডার সমৃদ্ধ করেছিলেন? তরুণ বয়সে তিনি ঘোড়ার গাড়িতে করে মিশৌরী থেকে নেভার্দা পর্যন্ত সমস্ত জায়গা ভ্রমণ করেছিলেন। এই গাড়িতে যাত্রী এবং ঘোড়া উভয়েরই খাবার এবং এমনকি পানীয়জলও পরিবহন করতে হত। কাজেই যাত্রীর সাথে লটবহর নেয়া ছিল অত্যন্ত কষ্টকর। এতৎসত্ত্বেও মার্কটোয়েন তার সাথে ওয়েবেস্টারের অভিধান রাখতেন। পার্বত্য পথের চড়াই উতরাই পেরোবার ক্লান্তিকর পরিস্থিতি অথবা মরুভূমি অতিক্রমের অস্বস্তিকর পরিবেশে তিনি গভীর অভিনিবেশ সহকারে অভিধান পাঠ করতেন, নতুন-নতুন শব্দ শিখতেন। এভাবে কঠোর পরিশ্রম করে তিনি তার জ্ঞান সমৃদ্ধ করেছিলেন, শব্দ সম্ভারে সমৃদ্ধ হয়েছিল তার মস্তিষ্ক।

পীট ও লর্ড চাহাম উভয়েই অভিধানের প্রতিটি পৃষ্ঠা, প্রতিটি শব্দ দুবার করে পড়তেন। ব্রাউনিং প্রতিদিনই অভিধান পাঠ করতেন। ‘লিংকন নক্ষত্রালোকে বসতেন’ লিখেন তাঁর জীবনীকার নিকোলে এবং হে, এবং অভিধান পড়তেন যতক্ষণ পর্যন্ত লেখা তাঁর দৃষ্টিগোচর হত। প্রত্যেক খ্যাতনামা লেখক ও বক্তা ঠিক এরূপ পদ্ধতিই অনুসরণ করেন।

উড্রো উইলসন নিশ্চিতভাবেই–একজন জ্ঞানী ইংরেজি ভাষাবিদ। জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা সহ তাঁর কতিপয় লেখা নিশ্চিত ভাবেই বিশ্বসাহিত্যের সম্পদ। তিনি কীভাবে শব্দ ভাণ্ডার সমৃদ্ধ করেছিলেন তা নিম্নে দেয়া হল।

আমার পিতা আমাদের পরিবারের কোনো সভ্য ভুল কথা বলুক তা সহ্য করতেন না। কোনো শিশু ভুল কিছু বললে সাথে-সাথে তা শুদ্ধ করে দেয়া হত। কোনো নতুন শব্দ পাওয়া গেলে তা আমাদের কাছে বার-বার ব্যাখ্যা করা হত, বিভিন্ন বাক্যে তার ব্যবহার শিখিয়ে দেয়া হত। ফলে আমরা সকলেই নতুন নতুন শব্দ শিখতে সক্ষম হতাম।

নিউইয়র্কের একজন বক্তা সারাদিন পরিশ্রম করে বক্তৃতা তৈরি করতেন, রাতে বিশ্রামের আগে অভিধান দেখে শব্দ বদলাতেন। ফলে তাঁর বক্তৃতার ভাষা হয়ে উঠত প্রাঞ্জল ও হৃদয়গ্রাহী? যেদিন তিনি বক্তৃতা তৈরি করতেন না সেদিন তিনি ফারনডলস এর সমর্থক শব্দ, বিপরীতার্থক শব্দ, পদান্বয়ী অব্যয় নির্বাচন করতেন, প্রতিটি শব্দের অর্থ লিখতেন, ব্যবহার লক্ষ্য করতেন, ফলে প্রতিদিনই তিনি নতুন শব্দ শিখতে এবং তা ব্যবহার করতে সক্ষম হতেন। এর অর্থ হচ্ছে এই যে, প্রতিদিন একটি শব্দ শিখলেও বছরে শব্দ ভাণ্ডারে যোগ হয় ৩৬৫টি নতুন শব্দ। তিনি এসব অর্থ সহ পকেট নোটবুকে লিখে রাখতেন এবং অবসর সময়ে তা পাঠ করতেন। ফলে কোনো শব্দই তিনি কখনো ভুলতেন না। কারণ তিনবার ব্যবহার করার পর কোনো শব্দই সহজে বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যায় না।

আপনার ব্যবহৃত শব্দের পশ্চাতে রোমান্টিক কাহিনী :

শুধুমাত্র শব্দের অর্থের জন্যে নয়, উৎপত্তি জানার জন্যে অভিধান ব্যবহার করেন। সংজ্ঞার পরে প্রদত্ত ব্রাকেটে সাধারণত শব্দের ইতিহাস উৎপত্তি প্রভৃতি আলোচিত হয়। কখনো এটা মনে করবেন না যে, আপনি প্রতিদিন যে-সব শব্দ ব্যবহার করেন তা অর্থহীন ধ্বনি মাত্র। তাদের রং আছে, তারা জীবন্ত এবং রোমান্টিক। চিনির জন্যে গ্রাসারকে টেলিফোন করুন এটা ব্যবহারেই শব্দ প্রয়োেগ শেষ নয়। আমরা সাধারণত যে সব শব্দ ব্যবহার করি সে সব শব্দে বিভিন্ন ভাষা ও সভ্যতা থেকে সংগৃহীত শব্দ আছে। টেলি অর্থ দূর এবং ফোন অর্থ ধ্বনি–এই দুটি গ্রিক শব্দ সংযোজনে টেলিফোন শব্দের জন্ম। পুরাতন ফরাসি শব্দ গ্রোসিয়ার থেকে গ্রেসার শব্দের উৎপত্তি এবং ফরাসি গ্রোসিয়ার শব্দটি এসেছে ল্যাতিন গ্রোসারিয়াস থেকে। এর অর্থ হচ্ছে যিনি পাইকারী বা গ্রস হিসাবে বিক্রি করেন। সুগার শব্দটি এসেছে ফরাসি থেকে। ফরাসিতে এটা এসেছে স্পেনিস থেকে, স্পেনিস এটা নিয়েছে আরবি থেকে। আরবিতে এসেছে পার্শি থেকে, আর ফার্শিতে শাকের শব্দ এসেছে সংস্কৃত কারকারা অর্থাৎ আখ থেকে।

আপনি একটি কোম্পানিতে কাজ করেন অথবা কোম্পানির মালিক। পুরাতন ফরাসি শব্দ কম্পানিয়ান থেকে কোম্পানি শব্দের জন্ম। কম্পানিয়ন শব্দের সাহিত্যগত অর্থ হচ্ছে কম উইথ এন্ড পেনিস ব্রেড। অর্থাৎ আপনার কম্পানিয়ন হচ্ছেন ঐ ব্যক্তি যার সাথে আপনি রুটি খান। সুতরাং কোম্পানি শব্দের অর্থ হচ্ছে কতিপয় ব্যক্তির সমিতি যারা একসাথে নিজেদের সকলের রুটি সংগ্রহের চেষ্টা করেন। আপনার বেতনের অর্থ হচ্ছে আপনার লবণের মূল্য প্রদান। রোমান সৈন্যরা লবণের জন্য নির্দিষ্ট হারে একটা ভাতা পেতেন। আপনার হাতে যে বইটি আছে তার সাহিত্যিক অর্থ হচ্ছে বহুদিন আগে ইক্ষু সেক্সসনেরা বিচ গাছ এবং বিচ কাঠে তাদের শব্দ খোদাই করে রেখেছিল। আপনার পকেটে ডলার নামে যে মুদ্রা আছে সে ডলার প্রথম ষষ্ঠদশ শতাব্দীতে ব্যবহার করা হয় এবং তার উল্লেখ দেখা যায় সেন্ট জোয়াসিম এর থালার বা ডেল-এ।

জেনিটর এবং জানুয়ারি-এই শব্দ দুটির উৎপত্তি রোমে বসবাসকারী এটুসকান কামার এর দরজার জন্যে তৈরি থালা ও বন্ট্র থেকে। মৃত্যুর পর তাঁকে দেবতার মতো সম্মান দেয়া হয়। কেননা তিনিই প্রথম মানুষকে দরজা খুলতে ও বন্ধ করতে শিখান। তারই স্মরণে একটি বছরের শেষে নতুন বছরের প্রারম্ভের মাসকে বলা হয় জানুয়ারি। সুতরাং যখনই আমরা জানুয়ারি বলি তখন আমরা এমন একজন লোকের স্মৃতির প্রতি সম্মান দেখাই যিনি খ্রিস্ট জন্মের হাজার-হাজার বছর আগে এই বিশ্বে এসেছিলেন এবং যার স্ত্রীর নাম ছিল জেন।

ইংরেজি বছরের সপ্তম মাস জুলাই নাম হয়েছে জুলিয়াস সিজারের নামানুসারে। সম্রাট আগাস্টাসের নামানুসারে হয়েছে আগস্ট মাস। এই সময় অষ্টম মাস ছিল ত্রিশ দিনে? কিন্তু আগাস্টাস তাঁর নামানুসারে মাস আগস্ট জুলিয়াস থেকে ছোট হোক এটা মানতে রাজি ছিলেন না, সুতরাং ফেব্রুয়ারি থেকে একটি দিন নিয়ে এই মাস অর্থাৎ আগস্টের সাথে যোগ করা হয়। প্রতিটি শব্দের ইতিহাসও ঠিক এইরূপ।

অতএব বিভিন্ন শব্দের ইতিহাস, উৎপত্তি এবং তাৎপর্য জানার জন্য বৃহৎ অভিধানের সাহায্য নিন। এসবের কাহিনী জানুন। আপনার শুধু জ্ঞান বাড়বে না, জানার জন্যে আগ্রহ বাড়বে। আপনি নতুন শব্দ ব্যবহার করতে পেরে আনন্দ পাবেন।

একটি বাক্য একশত চার বার পুনর্লিখন :

আপনি যা বলতে চান তা সংক্ষেপে স্পষ্টভাবে বলতে চেষ্টা করুন। এটা সব সময় তেমন সহজ নয়-অভিজ্ঞ লেখকের জন্যেও এটা সহজ নয়। কেনী হাস্ট আমাকে বলেছিলেন যে, তিনি সময়-সময় তাঁর বাক্যসমূহকে ভাব থেকে একশত বার পর্যন্ত লিখেন। তিনি বলেন, আমার সাথে আলাপের কয়েকদিন আগে তিনি একটি বাক্য একশত চার বার লিখেছেন? মার্বেল উরনার বলেছেন যে, তিনি সময়-সময় দীর্ঘ একটি অপরাহ্নে সংবাদপত্রের একটি মাত্র বাক্য শিখেন।

সঠিক শব্দ চয়নের জন্যে রিচার্ড হার্ডিং ডেভিস কীভাবে চেষ্টা চালাতেন তা মরিস ব্যক্ত করেছেন :

বহু ফ্রেজ নিয়ে তিনি বাক্য বাঁধনের চেষ্টা করতেন এবং সর্বশেষ যেটি তাঁর কাছে অর্থবহ বলে মনে হত সেটিই ব্যবহার করতেন। ফ্রেজ অধ্যায় পৃষ্ঠাটি এবং এমনকি সমগ্র গল্পটি তিনি বারবার লিখতেন। স্মরণ রাখার লক্ষ্য সামনে রেখে তিনি লিখতেন। ফটকের কাছ দিয়ে যে যান বাহনটি চলে গেল তার সম্পর্কে লিখতে গেলে তিনি শুধু সেই যানবাহনটির আকার, রং আকৃতির কথা লিখতেন না, যানবাহনের ইতিহাস লিখতেন যতক্ষণ পর্যন্ত না পাঠকদের সামনে যানবাহনটির ছবি স্পষ্ট করে তুলতে পারতেন ততক্ষণ পর্যন্ত তিনি লিখতেন। এখন কি ছবিটি স্বচ্ছ? তিনি প্রশ্ন করতেন। এতেও স্পষ্ট না হলে তিনি আবারো লিখতেন, নতুন ভাবে নতুন-নতুন শব্দ ব্যবহার করে। ফলে পাঠক তাঁর লেখা পাঠ করে যানবাহন সম্পর্কে সহজে সঠিকভাবে জানতে সক্ষম হত।

আমাদের মধ্যে অনেকেই নতুন-নতুন শব্দ চয়নের সময় দিতে পারি না অথবা তেমন আগ্রহীও হই। উদাহরণগুলো উল্লেখ করে এটা দেখান হল যে নামী লেখকগণ কীভাবে সঠিক শব্দ চয়ন ও তা প্রয়োগ করেন। এটা ছাত্রদের ভাষা শুদ্ধভাবে শিখতে উৎসাহিত করবে বলে আশা করা যায়। তবে বক্তৃতা করার সময় আগে চিন্তা না করে নতুন-নতুন শব্দ ব্যবহারের চিন্তা সুস্থতার লক্ষণ নয়। নতুন শব্দ প্রয়োগ করতে বক্তৃতা মঞ্চে দাঁড়ানোর আগে সে সম্পর্কে চিন্তা করা উচিত। এটা কি সব বক্তা করেন? না, করেন না, করা সম্ভব হয় না।

মিল্টন আট হাজার শব্দ ব্যবহার করেছেন, শেক্সপীয়র ব্যবহার করেছেন পনের হাজার শব্দ। একটি স্টান্ডার্ড অভিধানে আছে ৫০ হাজার শব্দ। সাধারণ হিসাবে প্রতিটি মানুষ গড়ে দুহাজার শব্দ মুখস্থ রাখেন। এর মধ্যে কিছু আছে ক্রিয়াপদ, কিছু সংযোগরক্ষাকারী শব্দ, কিছু বিশেষ্য আর কিছু বিশেষণ। আমি কিছুকাল কলরেডোতে অতিবাহিত করেছি। এই সময়টার কথা আমি কখনো ভুলবো না। একদিন আমি দেখলাম যে একজন মহিলা কুকুরের জন্যে যে বিশষণ ব্যবহার করছেন কনসার্ট পার্টিকেও সেই বিশেষণে ভূষিত করছেন। এর কারণ সীমিত শব্দ ভাণ্ডার। সীমিত শব্দ ভাণ্ডারের জন্যে তিনি কুকুরকেও বলছেন বিউটিফুল, ক্লনসার্ট পার্টিকেও বলছেন বিউটিফুল!

তার শব্দ ভাণ্ডার যদি সীমিত না হত তাহলে তিনি বিউটিফুল এর স্থলে কি শব্দ ব্যবহার করতে পারতেন? তিনি ব্যবহার করতে পারেন বিউটিয়াস, হ্যাঁন্ডসাম, প্রেটি, লাভলী, গ্রেসফুল, এরিজেন্ট, একসকুইজিট, ডেলিকেট, ডেইনটি প্রভৃতি বিশেষণ।

শব্দভাণ্ডার সমৃদ্ধ হলে ঠিক একই অর্থের বিভিন্ন বিশেষণ স্থল ও ক্ষেত্রের সাথে সঙ্গতি রেখে ব্যবহার করা যায়।

এ প্রসঙ্গে আমি রোগেট এর ‘ট্রেজারী অব ওয়ার্ডস’ বই এর কথা বলব। আমি কাজ করার সময় অভিধান যেভাবে ব্যবহার করি এটিও ঠিক সমভাবে ব্যবহার করি।

এটি গ্রন্থাগারের বা পাঠাগারের বুক শেলফ এ ফেলে রাখার মতো বই-নয়। এটা অভিধানের মতো সব সময় ব্যবহার যোগ্য বই? আপনার বক্তৃতা প্রস্তুতি কালে অভিধান ব্যবহার করুন। যে কোনো প্রতিবেদন রচনা কালেও ব্যবহার করুন অভিধান, দৈনিক ব্যবহার করুন, ফরে আপনার শব্দ ভাণ্ডার সহজে বেড়ে যাবে।

জীর্ণ বাগবৈশিষ্ট্য পরিহার :

শুধুমাত্র সঠিক নয়, মূল ব্যবহারের চেষ্টা করুন, যা দেখবেন তা বলার সাহস রাখুন। উদাহরণ স্বরূপ বন্যার পর কতিপয় ব্যক্তি বন্যার ঠাণ্ডাকে শশার সাথে তুলনা করেন। এটা নিতান্ত তাজা বাক্য বিধায় এটা গ্রহণ যোগ্য ও আকর্ষণীয়।

ঠাণ্ডা সম্পর্কে কতিপয় উদাহরণ উদ্ধৃত করা যাচ্ছে। এগুলো কি সহজে গ্রহণযোগ্য ও হৃদয়গ্রাহী নয়?

ব্যাঙের মতো ঠাণ্ডা।
সকালের হট ওয়াটার ব্যাগের মতো ঠাণ্ডা।
ভেড়ার মতো ঠাণ্ডা।
মন্দিরের মতো ঠাণ্ডা।
গ্রীনল্যান্ডের বরফ গলা পাহাড়ের মতো ঠাণ্ডা।
ক্লারিজের মতো ঠাণ্ডা।
লবণের মতো ঠাণ্ডা।
কেঁচোর মতো ঠাণ্ডা।
প্রত্যুষের মতো ঠাণ্ডা।
শরতের বৃষ্টির মতো ঠাণ্ডা।

সুতরাং এভাবে চিন্তা করে ঠাণ্ডা সম্পর্কে আরো বহু অর্থবহ আকর্ষণীয় উদাহরণ দেয়া যেতে পারে।

স্টাইল সম্পর্কে একদা আমি কেথেলিন মরিসকে প্রশ্ন করতে তিনি উত্তর দেন ”খ্যাতনামা লেখকদের গদ্য পাঠ এবং তাতে ব্যবহৃত ফ্রেজ কীভাবে ব্যবহার করা হয়েছে তা দেখে নিজের বাক্যের উন্নয়নই প্রকৃষ্ট পন্থা।”

একজন ম্যাগাজিন সম্পাদক একবার আমাকে বলেছিলেন যে, কোনো লেখক তার কাছে প্রকাশের জন্যে কিছু পাঠালে তাতে একাধিক উদ্ধৃতি দেখলে তা তিনি লেখকের কাছেই ফেরত পাঠাতেন। কারণ তিনি মনে করেন যে প্রকাশের যার মৌলিকত্ত্ব নেই চিন্তারও তার মৌলিকত্ত্ব থাকতে পারে না।

সংক্ষিপ্ত সার :

(১) আমাদের জীবনের চারটি জিনিস বিচার্য। তা হচ্ছে আমরা কী করি, আমরা কীভাবে তাকাই, আমরা কী বলি এবং আমরা কীভাবে করি, বলি। হারভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট চার্লস ডব্লিউ ইলিয়ট একবার বলেছিলেন, “অভিজ্ঞতা থেকে আমি এটা বুঝেছি যে, যে কোনো ভদ্র মহিলা বা ভদ্রমহোদয়ের প্রকৃত শিক্ষা হচ্ছে নিজ মাতৃভাষা সঠিকভাবে জানা।”

(২) আপনার ভাষা আপনার সাথীদের প্রভাবিত করবে। সুতরাং লিংকনের আদর্শ অনুসরণে খ্যাতনামা সাহিত্যিকদের লেখা পড় ন। তাঁর মতো প্রতিদিন বিকেলে শেক্সপিয়ার ও অন্যান্য খ্যাতনামা কবি ও লেখকদের লেখা পাঠ করুন। নিয়মিত ভাবে এটা করলে আপনার ভাষা নিশ্চিত ভাবেই উন্নত হবে এবং আপনার সে ভাষা সাথীদের অবশ্যই প্রভাবিত করবে।

(৩) ”টেলিটাস ও ঠুসি ডিডাস এবং নিউটন ও উইক্লিড পাঠের জন্যে আমি সংবাদ পাঠ ছেড়ে দিয়েছি।” লিখেছেন টমাস জেফারসন, “এবং এতে আমি অধিক আনন্দ লাভ করছি।” কেন এই উদাহরণ অনুসরণ করছেন না। সংবাদ পত্র পাঠ একেবারে ছেড়ে দেবেন না, তবে সংবাদপত্র পাঠে এখন যে সময় ব্যয় করেন, তার কিছু অংশ বই পাঠের জন্যে নিয়ে নিতে পারেন। কোনো বই এর ২০/৩০ পৃষ্ঠা কেটে নিয়ে তা পকেটে রাখুন, দিনের অবসর কালে তা পাঠ করুন।

(৪) আপনার পাশে একটা অভিধান রাখুন। অপরিচিত শব্দ দেখুন। এটার প্রয়োগ লক্ষ করুন, তা হলে সহজে আপনি নতুন শব্দ মনে রাখতে পারেন।

(৫) আপনি যে শব্দ ব্যবহার করছেন তার শুধু অর্থ নয়, ইতিহাসও জানুন। উদাহরণ স্বরূপ সেলারি শব্দের সঠিক অর্থ সল্ট মানি। রোমান সৈন্যদের সল্ট কেনার জন্য একটা ভাতা দেয়া হত। এ থেকে অর্থাৎ সল্ট মানি থেকে সেলারির উদ্ভব।

(৬) দ্ব্যর্থ বোধক শব্দ নয়, অর্থবহ শব্দ ব্যবহার করুন। আপনার ডেস্কে রোজেটের ‘ট্রেজারী অব ওয়ার্ডস’ বইটি রাখুন। চোখে যা দেখছেন তার সব কিছুকে শুধু ”বিউটিফুল” বলবেন না। একই অর্থের অর্থ-একাধিক শব্দ ব্যবহার করলে আপনার বাক্য হবে আরো আকর্ষণীয় এবং অর্থবহ।

(৭) ঠাণ্ডাকে শুধু মাত্র শশার সাথে তুলনা করবেন না। নিজে চিন্তা করে ঠাণ্ডাকে কিসের সঙ্গে তুলনা করলে সহজ অর্থ পাওয়া যায় তা বের করুন।

সুস্পষ্টভাবে সবকিছু প্রকাশ করুন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *