০৮. কীভাবে বক্তৃতা শুরু করবেন

০৮. কীভাবে বক্তৃতা শুরু করবেন

আমি একদা নর্থওয়েস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক প্রেসিডেন্টকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, “বক্তা হিসাবে আপনার দীর্ঘ দিনের অভিজ্ঞতা আছে। সুতরাং বলুন, বক্তৃতার সফলতা অর্জনের মূল রহস্য কী?” এক মিনিট নীরব থেকে তিনি উত্তর দিলেন, আকর্ষণীয় ভাষায় বক্তৃতা শুরু, যা শ্রোতাদের দৃষ্টি এবং মনকে টেনে আনে। তিনি বক্তৃতা প্রস্তুতিতে বক্তৃতা শুরু এবং শেষের বাক্য ও শব্দ এমনভাবে চয়ন করতেন যা হত অত্যন্ত আকর্ষণীয়। জন ব্রাইট একই পদ্ধতি অনুসরণ করতেন। একই পদ্ধতি অনুসরণ করতেন গ্লাডস্টোন, ওয়েবেস্টার, লিংকন। বস্তুত পক্ষে সকল জ্ঞানী বক্তাই এই পদ্ধতি অনুসরণ করেন।

কিন্তু নবিশ বক্তারাও কি এই পদ্ধতি অনুসরণ করেন? অবশ্যই না। পরিকল্পনার সময় প্রয়োজন, চিন্তা প্রয়োজন, ইচ্ছা শক্তি প্রয়োজন। মস্তিষ্ক সঞ্চালন একটি বেদনাদায়ক কাজ। এই বিষয়ে টমাস এডিসন তার কারখানার দেয়ালে স্যার জসুয়া রেমন্ডের নিম্নবর্ণিত উদ্ধৃতিটি খোদিত করে রেখেছেন।

এমন কৌশল নেই যাতে মানুষ শ্ৰম হতে মুক্ত থাকতে পারে এবং চিন্তা করাটা হচ্ছে আরো কঠিন শ্রম।

চিন্তার শ্রম হচ্ছে মৃত্তিকা গহ্বর,
চড়াই উতরাই পেরোনো যায় তরতর।

লর্ড নর্থ ক্লিক, যিনি সংবাদ পত্রের সাপ্তাহিক বেতনভূক্ত কর্মচারী হতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সবচাইতে ধনী ও প্রভাবশালী পত্রিকা মালিক হয়েছিলেন, তিনি বলেছেন যে, মাত্র পাঁচটি শব্দ তার জীবনে প্রভাব বিস্তার করে পরিবর্তন এনেছে সে শব্দগুলো হচ্ছে :

ভবিষ্যতের কথা আগে হতে জেনে ফেলা। আপনার বক্তৃতা প্রস্তুতিকালে এটিও একটি উল্লেখযোগ্য আদর্শ হতে পারে। আপনি কীভাবে বক্তৃতা শুরু করবেন তা আগে থেকেই কল্পনার মাধ্যমে জেনে নিন। বুঝে নিন সুস্পষ্টভাবে আপনার বক্তৃতার কী ফল হবে অর্থাৎ আপনি কিরূপ প্রভাব বিস্তার করতে পারবেন শ্রোতাদের ওপর।

অ্যারিস্টটলের যুগ হতেই এই বিষয়ে লিখিত বইতে তিনটি ভাগ আছে, তা হচ্ছে, সূচনা-, মুল বক্তব্য এবং উপসংহার। এখনো এই পদ্ধতি অনুসৃত হচ্ছে। ভূমিকা দিয়ে বক্তা মূল বক্তব্য প্রকাশ করে শ্রোতাদের জানাচ্ছেন তিনি কী বলতে চান, এটা দ্বারা শ্রোতারা বিষয়টি কী উপলব্ধি করেছেন এবং বক্তা এটি দিয়ে তাদের মনে আনন্দও দিচ্ছেন। শত বছর আগে বক্তার দ্বারা যা হত আজ সংবাদপত্র, ম্যাগাজিন; বেতার, টেলিভিশন, টেলিফোন ও মুভিথিয়েটার তাই করছে।

তবে অবস্থার সাংঘাতিক পরিবর্তন হয়েছে, বিশ্বে বিশেষ অগ্রগতি এসেছে, গত একশত বছরে আবিষ্কারের ফলে। মানুষ জীবন্ত বেলসেজার এবং নেবুসেডনেজার আমল হতে বহুগুণ সুসভ্য হয়ে পড়েছে। এই একশত বছরের মধ্যেই আমরা স্বয়ংক্রিয় গাড়ি, উড়োজাহাজ, বেতার, টেলিভিশন পেয়েছি। সুতরাং আজকের বক্তাকেও সময়ের দ্রুত তালের সাথে পদ্ধতি রক্ষা করে চলতে হচ্ছে। সুতরাং আপনি যদি বক্তৃতার সূচনা বা ভূমিকা রাখতে চান তা হলে তা অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত ভাবে দেয়ার চেষ্টা করুন। এটা হচ্ছে আজকের যুগের সকল শ্রোতার কাম্য। আপনি কি কিছু বলতে চান? ঠিক আছে, সংক্ষিপ্ত ভাবে তা বলুন। দীর্ঘ বক্তৃতার দরকার নেই। গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলো বলে শেষ করুন।

ডুবো জাহাজের অংশ গ্রহণ সম্পর্কে কংগ্রেসে বক্তৃতা কালে উড্রো উইলসন মাত্র একুশটি শব্দ প্রয়োগ করে শ্রোতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। তিনি শুরু করেছিলেন, দেশের বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বর্তমানে এমন একটি অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে যার কথা আপনাদের সামনে তুলে ধরা আমার জন্য কর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।

নিউইয়র্কের প্যান সিলভানিয়া সমিতিতে বক্তৃতা কালে চার্লস স্কোয়ার দ্বিতীয় বাক্যেই মূল বিষয়ে প্রবেশ করেন :

মর্কিন নাগরিকদের আজকের মূল প্রশ্ন হচ্ছে : ব্যবসায়ে বর্তমান মন্দার অর্থ এবং এর ভবিষ্যৎ কী? ব্যক্তিগতভাবে আমি অবশ্য আশাবাদী।

ন্যাশনাল ক্যাশ রেজিস্টার কোম্পানির সেলসম্যানেজার এভাবেই তার লোকদের সামনে বক্তৃতা শুরু করেছিলেন, মাত্র তিনটি বাক্যে বক্তৃতার ভূমিকা দিয়েছিলেন এবং বাক্যগুলো ছিল অত্যন্ত সহজ, ফলে শ্রোতাদের বোধগম্য হয়েছিল। উৎসাহব্যঞ্জক বাক্যগুলো ছিল :

আপনারা যারা কোম্পানির পণ্য বিক্রির অর্ডার সংগ্রহ করেন কারখানায় চিমনিতে ধূম্র অব্যাহত রাখা তাদের উপরই নির্ভর করছে। বিগত দুই গ্রীষ্মে অন্ধকারাচ্ছন্ন করে তোলার মতো প্রচুর নয়। এখন দুর্দিন কেটে গেছে এবং ব্যবসা পুনরারম্ভের সময় এসেছে বিধায় আমি আপনাদের জানাচ্ছি, যে, চিমনিতে আমরা অধিক পরিমাণ ধূম্র চাই।

কিন্তু অনভিজ্ঞ বক্তারা কী শুরুতে এরূপ সাফল্য অর্জন করতে পারেন? প্রশিক্ষণ হীন ও আদর্শ হীন বক্তাদের অধিকাংশই এমনভাবে বক্তৃতা শুরু করেন যে কোনো ক্রমেই ভালো পদ্ধতি বলে বিবেচিত হয় না। এখানে আমরা সে সম্পর্কে আলোচনা করব।

নবিশদের অনেকেই বক্তা হিসাবে নিজেরা হাস্যাস্পদ হবেন বলে ধারণা করেন, এটা দুঃখজনক। নবিশ একজন জ্ঞানী হলেও এবং তাঁর জ্ঞানের সীমা সশ্রদ্ধ ভয় উৎপাদক হলেও বক্তা হিসাবে নবিশ বিধায় মঞ্চে বক্তৃতা করতে দাঁড়িয়ে মনে করেন, ধরে নেন অথবা তার মনে এরূপ ভাবের উদ্রেক হয় যে, মার্কটোয়েন যেন তার কাঁধে ভর করেছেন। সুতরাং তিনি কৌতুকপূর্ণ গল্প দিয়ে তাঁর বক্তব্য শুরু করেন, ভোজসভা হলে এরূপ গল্প বলা শ্রোতাদের তেমন অভিভূত করে না। অর্থাৎ তাঁর বক্তব্য হয়ে পড়ে শোনা কথা, তাই এই বক্তব্য শ্রোতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে না। ফলপ্রসু হয় না।

একজন বিনোদনকারী যদি শ্রোতাদের সমক্ষে এরূপ বক্তব্য পেশ করেন, যে বক্তব্য শোনার জন্য শ্রোতারা টিকিট নিয়েছেন, সেরূপ ক্ষেত্রে শ্রোতারা হই চই করেন, শ্লোগান দেন। তবে সাধারণ শ্রোতারা বক্তার প্রতি থাকেন সহনশীল, সহানুভূতিশীল। সুতরাং বক্তার মনেও এরূপ চিন্তা রাখা উচিত, যেভাবেই হোক না কেন, শ্রোতাদের সন্তোষ বিধান করতে হবে। এরূপ চিন্তা মনে থাকলে বক্তা ব্যর্থ হন না। এরূপ চিন্তা মনে থাকলে খারাপ বক্তৃতার জন্যে বক্তা নিজেও অস্বস্তি অনুভব করেন। এরূপ ঘটনা কী আপনি কখানো অবলোকন করেন নি?

বক্তৃতা প্রদানের সবচাইতে কঠিন বিষয় হচ্ছে শ্রোতাদের হাসানো। কৌতুককর বক্তৃতা দিয়ে কী শ্রোতাদের হাসানো যায়? এটা নির্ভর করে বক্তার নিজস্ব ব্যক্তিত্বের উপর।

লিংকন ও জব হেজের বক্তৃতা মালা অধ্যয়ন করলে আপনি এটা জেনে আশ্চর্য হবেন যে, কতিপয় ক্ষেত্রে কৌতুকপূর্ণ গল্প দিয়ে শুরু করে সফল হয়ে ছিলেন। এডউইন জেমস ক্যাটল আমাকে বলেছেন যে, শোতাদের হাসানোর উদ্দেশ্যে তিনি কখনো কৌতুকপূর্ণ গল্প বলতেন না। তার গল্প হত বিষয়ের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ এবং কোনো বিশেষ পয়েন্ট সহজ করে বোঝাবার জন্যই তিনি গল্পের অবতারণা করতেন। গল্প বলতেন তিনি কেক তৈরির মশল্লা হিসাবে; অর্থাৎ তার কৌতুক হত কেকের মশল্লা, কেক নয়।

যুক্তরাষ্ট্রের জনপ্রিয় রসিক বক্তা স্ট্রিকল্যান্ড গিলিল্যান, বক্তৃতার শুরুতে প্রথম তিনি মিষ্টি গল্পের অবতারণা করতেন না। এটা তিনি নিয়ম হিসাবে অনুসরণ করতেন। অতঃপর তিনি যখন উপলব্ধি করতেন গল্প বলা প্রয়োজন তখনই গল্প বলতেন।

এর ফলে তার বক্তব্য হত গুরুগম্ভীর, অর্থবহ ও উদ্দীপনাময়। যে কোনো বক্তৃতায় স্থানীয় কিছু সমস্যার উদ্ধৃতি দেয়া গেলে, অন্য কোনো বক্তার কোনো বক্তব্যের বিশ্লেষণ করা গেলে তা হয় অধিকতর আকর্ষণীয়। বেমানান কিছুকে অতিরঞ্জিত করবেন না। স্মরণ রাখবেন যে, রসিকতার চাইতে কৌতুক অনেক বেশি মূল্যবান।

নিজের সম্পর্কে রসিকাতা দিয়ে শুরু করা সবচাইতে সহজ পথ। মনে করুন যে, আপনি একটি অস্বস্তিকর পরিবেশে পড়েছেন তা হলে আপনি কীভাবে কৌতুক করবেন? কেহ পা ভেঙে ফেললে এস্কিমোরা হাসে। ভবনের দ্বিতলের জানালা দিয়ে পড়ে কোনো কুকুর মরলেও চীনারা হাসে, মুখ টিপে হাসে। আমরা কিন্তু অত সহজে হাসি না, কিন্তু বাতাস কারো মাথায় টুপি উড়িয়ে নিলে অথবা কলার চামড়ায় পা পিছলে কেহ পড়ে গেলেও কি আমরা হাসি না।

যে কোনো বক্তাই অদ্ভুত কথা বলে শ্রোতাদের হাসাতে পারেন। যদি বলা হয়, একজন সংবাদ দাতা, “শিশুদের ঘৃণা করুন, ঘৃণা করেন ডেমোক্রেটদের।” এই বক্তব্য সংগতিহীন বিধায় শ্রোতারা হাসেন।

রুডিয়ার্ড কিপলিং ইংল্যান্ডে তার প্রথম রাজনৈতিক বক্তৃতা কীভাবে শুরু করেছিলেন তা স্মরণ করুন। তিনি তার শুরুতে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা ঠিক এভাবে বলেছিলেন :

মাননীয় মহাশয়, ভদ্রমহিলা ও ভদ্রমহোদয়গণ। তরুণ বয়সে ভারতে অবস্থান কালে আমি বিভিন্ন সংবাদপত্রে অপরাধ সংক্রান্ত প্রতিবেদন পাঠাতাম। এটা আত্যন্ত আকর্ষণীয় কাজ। কেননা এটা আমাকে প্রতারক ও আত্মসাৎকারী, হত্যাকারী ও লুটেরাদের সাথে পরিচিত করে তুলেছিল, কখনো কখনো সংবাদপত্রে তাদের বিচারের খবর প্রকাশের পর আমি জেলে শাস্তি ভোগরত এসব ব্যক্তিদের সাথে দেখা করতে যেতাম। একজনের কথা আমি বিশেষ ভাবে স্মরণ করি, যাকে হত্যার অভিযোগে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়েছিল! সে ছিল অত্যন্ত চালাক বিনয়ী ও সুবক্তা। তার জীবন কাহিনী সে আমাকে বলেছে। সে বলেছে, সংসারে চলার পথে মানুষ যখন বক্রপথ দেখে, যখন দেখে বাধা, তখন সে তার নিজ চলার পথকে সুগম করার জন্যে পথের বাধকে বাধ্য হয়ে অপসারিত করে এবং এভাবে বাধা অপসারণ করেই সে তার লক্ষ্য পথে এগিয়ে যায়। আমাদের মন্ত্রীসভার অবস্থাও বর্তমানে ঠিক অনুরূপ। তার এই বক্তব্যে সভায় ছিল হাসির রোল পড়ে।

মেট্রোপলিটান জীবন বীমা কোম্পানির তত্বাবধায়কদের বার্ষিক ভোজ সভায় উইলিয়াম হারবার্ড টাপ্টও ঠিক এরূপভাবে হাস্য কৌতুক করতেন? একই সময়ে হাস্যকৌতুকের মাধ্যমে তিনি তার শ্রোতাদের কাজে প্রশংসাও করতেন। তিনি বলতেন, “এভাবে,

মি. প্রেসিডেন্ট এবং মেট্রোপলিটান জীবন বীমা কোম্পানির ভদ্রমহোদয়গণ :

নয়মাস আগে আমার বাড়িতে জনৈক ভদ্রলোকদের নৈশভোজ-বক্তৃতা শোনার পর আমি বের হয়েছি এবং এখানো বাড়ির বাইরে আছি। ভোজপর্ব শেষে আয়োজিত অনুষ্ঠানের বক্তৃতার সুবোধ শ্রোতা হচ্ছেন তারাই যারা বুদ্ধিমান এবং সুশিক্ষিত কিন্তু অধোমদোন্মত্ত। (হাসি এবং করতালি) আজ আমি বলছি যে, আজকের শ্রোতারাও ঠিক সেরূপ অর্ধোন্মাদ এবং আমি আর কখনো এরূপ শ্রোতা পাই নি! আমাকে আজ একথা বলতে হচ্ছে যে, (শ্রোতাদের দেখে) মেট্রোপলিটান জীবন বীমা কোম্পানির এই শ্রোতারা আজ এই আসরে তাদের প্রকৃত স্বরূপ (অর্ধোমদোন্মত্ত) নিয়ে উপস্থিত হয়েছেন (হাসি এবং দীর্ঘস্থায়ী করতালি)।

ক্ষমার মাধ্যমে শুরু করা হচ্ছে মারাত্মক ভুল পদ্ধতি। যদি বক্তা বলেন, আমি বক্তা নই। -বক্তৃতার জন্যে আমার প্রস্তুতি নেই।-আমার কিছু বলবার নেই।–

এটা ভুল পদ্ধতি। এটা করবেন না। কিপলিং তার একটি কবিতার প্রথম লাইনে লিখেছিলেন, এগিয়ে যাবার আর কোনো অর্থ হয় না। কোনো বক্তা ঠিক এভাবে শুরু করলে শ্রোতারা হয় বিপদগ্রস্ত!

যাই হোক, আপনার যদি প্রস্তুতি না থাকে, আমাদের মধ্যে কেহ তা বুঝতে পারবে আপনার সাহায্য ছাড়াই। অন্যরা বুঝবে না। যারা বুঝবে না তাদের কেন দৃষ্টি আকর্ষণ করবেন? কেন প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। নি, চিন্তা করেন নি বলে আপনার শ্রোতাদের অপমানিত করবেন? না, না আমরা আপনার ক্ষমা প্রার্থনার কথা শুনতে চাই না। আমরা সমবেত হয়েছি জানতে ও শুনতে। সুতরাং আমাদের জানানো, শোনানো আপনার কর্তব্য একথা স্মরণ রাখবেন।

যে মুহূর্তেই আপনি মঞ্চে দাঁড়াবেন সেই মুহূর্তেই স্বাভাবিক নিয়মে এবং অবশ্যম্ভাবীরূপে শ্রোতাদের দৃষ্টি আপনার উপর পড়বে। প্রথম পাঁচ সেকেন্ডের মধ্যে দৃষ্টি না পড়লেও মিনিটের মধ্যে পড়তে বাধ্য একবার যদি আপনি এই আকর্ষণ ফিরিয়ে দেন, তবে তা পুনরুদ্ধার করা অত্যন্ত কঠিন। সুতরাং আপনার প্রথম বাক্যটি আকর্ষণীয় কিছু দিয়ে শুরু করুন। দ্বিতীয় বাক্য নয় তৃতীয় বাক্যও নয়। প্রথম। প্রথম এবং প্রথম বাক্য আকর্ষণীয় করুন।

কীভাবে? আপনি প্রশ্ন করতে পারেন। এর জন্যে কষ্ট করতে হবে, তা আমি স্বীকার করি। এবং বক্তব্যকে যুক্তিপূর্ণ ও অর্থবহ করতে হলে, আপনার বক্তব্যকে সময় উপযোগী করতে হলে, বেছে নেয়া বিষয়টিকে সুললিত ও সাবলীল করতে অবশ্যই পরিশ্রম করতে হবে। পরিশ্রম করলে শ্রোতারা কী চায় তাও স্মরণ রাখতে হবে। পরের দিকের আলোচনা এইরূপ বক্তৃতা প্রস্তুতির সহায়ক হবে বলে আমরা মনে করি।

কৌতূহল সৃষ্টি করুন :

ফিলাডেলফিয়ার প্যান আটলান্টিক ক্লাবে মি. হাওয়েল হীলি প্রদত্ত একটি বক্তৃতার ভূমিকার এখানে দেয়া হচ্ছে। দেখুন আপনার এটা পছন্দ হয় কি? এটা আপনার আগ্রহ সৃষ্টি করে কি?

বিরাশি বছর আগে, বছরের ঠিক এমনি সময়ে লন্ডনে একটি ছোট বই প্রকাশিত হয়, গল্পটি বিশ্বে অমর হয়ে আছে। অনেকে এটাকে বিশ্বের সবচাইতে ক্ষুদ্রতম বই বলে অভিহিত করেন। এটা প্রথম প্রকাশিত হলে রাস্তায় অথবা পলমল-এ এক বন্ধুর সাথে আর বন্ধুর দেখা হলে একে অপরকে প্রশ্ন করতেন, “তুমি এটি পড়েছে কি? প্রায়ই উত্তর আসতো, হাঁ, ভগবান তাকে দীর্ঘজীবী করুন, আমি পড়েছি।“

প্রকাশের প্রথম দিনেই এই বইটির হাজার কপি বিক্রি হয়। একপক্ষ কালের মধ্যে বিক্রি হয় পনোরো হাজার কপি। অতঃপর বিশ্বের সকল ভাষায় অসংখ্য সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে বইটির। কয়েক বছর আগে মি. জে. পি. মারগান বহুমূল্যে বইটির পাণ্ডুলিপি কিনেছেন এটা এখন তাঁর নিউইয়র্কস্থ আর্টগ্যালারিতে, যাকে তিনি বলেন লাইব্রেরি তাতে আছে অন্যান্য অমূল্য সম্পদের সাথে।

বিশ্ব বিখ্যাত এই বইটি কী? বইটি হচ্ছে ডিকেন্স এর বড়দিনের ভজন গান। এটাকে কী আপনি সফল শুরু বলে বিবেচনা করেন? এটা কী আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করছে, আর আগ্রহ সৃষ্টি করতে সক্ষম? করলে কেন করে? নিলম্বন (সাসপেন্স) হেতু কী আপনার এ আগ্রহ সৃষ্টি হয় নি?

কৌতূহল! কে এর প্রতি আগ্রহী নয়?

আমি বনে পাখি উড়তে দেখি। কৌতূহলবশে আমি অনেক সময় ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাদের গতিবিধি অবলোকন করি, কিন্তু আমি জানি, যে শিকারী পাখি শিকারের জন্যে আলপস পর্বতে যায় সে পাখির গতিবিধি অবলোকন করতে উৎসুক নয়, সে উৎসুক শিকারে। কুকুর মানুষের মনে কৌতূহল জাগায়। কৌতূহল জাগায় অন্যান্য প্রাণীও, কৌতূহল উদ্রেক করে সকল জীব।

সুতরাং আপনার প্রথম বাক্য দিয়ে শ্রোতাদের কৌতূহলী করে তুলুন, তারা আপনার প্রতি আগ্রহী হবে।

লেখক কলেসটমাস লরেন্স এর আরব্য উপন্যাসের গল্পের মতো করে তারা বক্তৃতা শুরু করতেন :

লয়েড জর্জ বলেছেন, কর্নেল লরেন্স আধুনিক কালে একজন রোমান্টিক ও চিত্রবৎ চরিত্র।

এভাবে শুরু করার দুটি সুবিধা আছে, প্রথমত: খ্যতনামা কোনো লোকের কোনো বক্তব্য দিয়ে শুরু করা হলে তার প্রতি শ্রোতারা আকর্ষিত হয়। দ্বিতীয়ত এটা কৌতূহল সৃষ্টি করে। কেন, রোমান্টিক? কেন চিত্রবৎ? এই প্রশ্নগুলো মনে জাগে স্বাভাবিক ভাবে। আমি আগে কখনো তার কথা শুনি নি। তিনি কী করতেন?

লওয়েল টমাস কর্ণেল টমাস লরেন্সের নিম্ন বিবৃতি উদ্ধৃত করে তার বক্তৃতা শুরু করতেন :

একদা আমি জেরুজালেমের খ্রিস্টান পাড়ায় ঘুরছিলাম। এই সময় আমি মূল্যবান পোশাক ও অলঙ্কার সজ্জিত এক ব্যক্তিকে দেখতে পাই। তার কোমরে ঝুলছিল স্বর্ণনির্মিত তরবারি। এরূপ একমাত্র হজরত মোহাম্মদ (দঃ)-এর অনুসারীরা ব্যবহার করেন। কিন্তু এই লোকটি আরব ছিলেন না। তার চেহারা আরবদের মতো নয়। চোখ নীল, কিন্তু আরবদের চোখ নীল নয়, কালো বা ব্রাউন।

এই বক্তব্য কী আপনার মনে কৌতূহল জাগায় না? নিশ্চয়ই আপনি লোকটা সম্পর্কে আরো জানাতে চান। সে কে? কেন সে আরবদের মতো চলতো? সে কী করত? তার কী হল?

যে ছাত্র নিম্ন প্রশ্ন দিয়ে তার বক্তব্য শুরু করে :

আজকের বিশ্বের সতেরটি দেশে যে দাসত্ব প্রথা প্রচলিত তা কী তোমরা জান?

এটা শুধু কৌতুক জাগায় না, শ্রোতাদের মনেও আঘাত দেয়। দাসত্ব আজকের দিনে? সতেরটির দেশে? দেশগুলো নাম কী? কোথায় সে-সব দেশ। নানা প্রশ্ন জাগায়।

বক্তা তার বক্তৃতার মাধ্যমে শুধু কৌতূহল সৃষ্টি নয়, শ্রোতাদের শেষ কালের প্রতি আগ্রহী ও করে তুলতে পারেন। উদাহরণ স্বরূপ, একজন ছাত্র নিম্ন বিবৃতি দিয়ে তার বক্তব্য শুরু করেন :

আমাদের একটি আইন পরিষদের জনৈক সদস্য তার পরিষদের দাঁড়িয়ে যে কোনো স্কুল ভবনের দু’মাইল এলাকার মধ্যে ব্যাঙাচি হতে ব্যাঙ উৎপাদনের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে একটি আইন পাশ করার প্রস্তাব করেন।

আপনি হাসছেন। বক্তা কী কৌতূহল করছেন। কী অসম্ভব। এটা কি সত্যি করা হয়েছিল? হ্যাঁ, বক্তা ব্যাখ্যা করেন।

স্যাটারডে ইভিনিং পোষ্ট এ ”দুর্বৃত্তদল” শীর্ষক এক নিবন্ধ ঠিক এভাবে শুরু করা হয়েছে :

দুর্বৃত্তদল কী সত্যিই সংঘঠিত। নিয়মানুযায়ী তারা সংগঠিত হবার কথা কীভাবে?

মাত্র দশটি শব্দের লেখক তার বিষয় ঘোষণা করেছেন এবং দুর্বৃত্তদল সংঘঠিত কী না সে সম্পর্কে আপনার মনে কৌতূহল সৃষ্টি করেছেন। এটা প্রশংসাযোগ্য। লেখকেরা যেভাবে পাঠকদের আগ্রহ সৃষ্টি করে বক্তাকেও ঠিক সেভাবে বক্তৃতার প্রতি শ্রোতার আগ্রহ সৃষ্টির চেষ্টা করতে হবে। ছাপানো বক্তৃতার চাইতে বক্তৃতা অভ্যাস করা কালে আপনি বেশি জানতে পারবেন, কীভাবে শুরু করা কল্যাণকর হবে।

গল্প দিয়ে শুরু করেন না কেন?

আমরা বক্তার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার বর্ণনা শুনতেই সাধারণত অভ্যস্ত। রামেলোই কনওয়েল তাঁর বক্তৃতাকে অলঙ্কার পূর্ণ করে তুলতেন। তিনি ছয় হাজার বারেরও অধিক এরূপ বক্তৃতা করেছেন এবং হাজার-হাজার টাকা রোজগার করেছেন। তিনি কীভাবে তাঁর জনপ্রিয় বক্তৃতা শুরু করতেন?

১৮৭০ সালে আমরা টাইগ্রিস নদীতে ভ্রমণ করতে যাই। বাগদাদে আমরা একজন পথ প্রদর্শক ভাড়া করি। তাকে সরাসরি নিযুক্ত করি আমাদের পারমিপোলিশ, নাইনবে ও বেবিলন, দেখিয়ে দেওয়ার জন্য।

এখানেই তিনি গল্প শেষ করেন। এই গদ্যাংশ সকলের মনে কৌতূহল সৃষ্টি করে। এই ধরনের সূচনা অত্যন্ত ফলপ্রসু হয়। এরূপ সূচনা বা ভূমিকা কখনো ব্যর্থ হয় না। কারণ শ্রোতারা তখন জানতে চায় অতঃপর কী হল? কী ঘটল? অথবা এর পর কী হতে পারে?

এই বইয়ের তৃতীয় পরিচ্ছেদে গল্প দিয়ে শুরু করার কথা বলা হয়েছে।

সাটারডে ইভিনিং পোস্টের একটি সংখ্যায় প্রকাশিত দুটি গল্পের সূচনা এখানে উল্লেক করা হচ্ছে :

(১) রিভলবারের তীব্র শব্দের আঘাতে সবকিছু স্তদ্ধ হয়ে গেল।

(২) জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে ডেনভারের মন্টভিউ হোটেলে একটি মামুলি ঘটনা ঘটে। ঘটনাটা অত্যন্ত মামুলি বা তুচ্ছ হলেও আবাসিক ম্যানেজার গোয়েবলের কল্যাণে এটি ব্যাপকতা লাভ করে। তিনি হোটেল মালিক স্টেভিফারাডে এবং হোটেলের অন্যান্যদের ঘটনাটি জানান। কর্ণগোচর হওয়ায় স্টেভি সারা গ্রীষ্মকাল নিয়মিতভাবে হোটেল পরিদর্শনে আসতে থাকেন।

এই ধরনের সূচনা অর্থবহ। কারণ এটা শ্রোতার মনে কৌতূহল সৃষ্টি করে। একথা শোনার পর আপনি আবার জানতে চান, বুঝতে চান অতঃপর কী হল, কী ঘটল।

একজন অদক্ষ বক্তাও যদি এরূপ দিয়ে বক্তৃতা শুরু করেন তবে তিনি শ্রোতাদের মনে কৌতূহল সৃষ্টি করতে, প্রশ্ন জাগাতে সক্ষম হবেন। বিশেষ চিত্র দিয়ে শুরু করুন : দীর্ঘক্ষণ ধরে শুষ্ক বক্তৃতা শোনা, মন দিয়ে শোনা বা গভীর মনোনিবেশ সহকারে শোনা সাধারণ শ্রোতাদের জন্য অত্যন্ত কঠিন। চিত্র দিয়ে বোঝানো যেমন সহজ, শ্রোতাদের পক্ষে বোঝাও তেমনি সহজ, তা হলে চিত্র দিয়ে শুরু করেন না কেন? এটা বক্তার পক্ষে অত্যন্ত কঠিন। আমি এটা জানি। আমি চেষ্টা করছি। সাধারণ বক্তারা মনে করেন যে, সাধারণ বিবৃতির মধ্যে সেই বক্তৃতা করা উচিত? চিত্র দিয়ে শুরু করে, শ্রোতাদের কৌতূহলী করে, আগ্রহী করে, সাধারণ বিবৃতি দিলে শ্রোতারা মনে দিয়ে শোনে, বুঝবার চেষ্টা করবে। এই প্রসংগে কোনো উদারহণ দিয়ে চাইলে চতুর্থ পরিচ্ছদের কথা স্মরণ করুন।

এক্ষেত্রে অত্র পরিচ্ছেদ শুরুতে কি কৌশল অবলম্বন করবেন?

কোনো কিছু প্রদর্শন করা :

কোনো কিছু দেখিয়ে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করা সম্ভবত সারা বিশ্বে প্রচলিত সহজতর পন্থা। বন্য বর্বর জাতি এবং এমনকি বানর অথবা রাস্তার কুকুরও কোনো কিছু দেখলে তার প্রতি দৃষ্টি দেয়। এটা বিশেষ মর্যাদাপূর্ণ, শ্রোতাদের ক্ষেত্রেও অত্যন্ত ফলপ্রসূ। উদাহরণ স্বরূপ, ফিলাডেলফিয়ার মি. এম. এস. এলিস একবার তার বক্তৃতা শুরু করেছিলেন বুড়ো আঙুল ও তর্জনীর মধ্যে একটি মুদ্রা রেখে। দুটো আঙুলের মাঝে মুদ্রা রাখায় সবাই স্বাভাবিকভাবে তাঁর দিকে তাকিয়ে ছিলেন। তখন তিনি জানাতে চান : ‘ফুটপাত দিয়ে চলার সময় আপনারা কেহ কী কখনো এরূপ মুদ্রা পেয়েছেন? যদি কেহ পেয়ে থাকেন তবে তা নিয়ে এগিয়ে আসুন, তা উন্নয়ন কাজে লাগানো যেতে পারে।–অতঃপর মি. এলিস এভাবে মুদ্রা সংগ্রহের প্রবণতার নিন্দা করেন।

প্রশ্ন করুন :

মি. এলিসের সূচনায় আরো একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এটা প্রশ্ন দিয়ে শুরু করা হয়েছে, যে প্রশ্ন বক্তার সাথে শ্রোতাকেও ভাবিয়ে তুলেছে, তার সাথে সহযোগিতায় উদ্বুদ্ধ করেছে। উল্লেখ্য যে, সাটারডে ইভিনিং পোস্ট এ দুর্বৃত্তদল সম্পর্কে প্রকাশিত নিবন্ধের প্রথম তিনিট বাক্যে দুটি প্রশ্ন ছিল। দুর্বৃত্তরা কী সত্যিই সংঘটিত? কীভাবে? এই ধরনের প্রশ্ন পদ্ধতি শ্রোতা ও বক্তাকে সহজেই ভাবিয়ে তোলে, অন্য কোনো পদ্ধতি শ্রোতাকে এত সহজে চিন্তান্বিত করে তোলে না।

খ্যাতনামা কোনো ব্যক্তির প্রশ্ন দিয়ে শুরু করেন না কেন?

খ্যাতনামা ব্যক্তিদের কথা সাধারণের কাছে সব সময় বিশেষ মূল্য পেয়ে থাকে। সুতরাং আড়ম্বরপূর্ণ বক্তৃতা শুরু করাও সহজতর পন্থা হচ্ছে সঠিক প্রশ্ন উত্থাপন। ব্যবসায়ে সাফল্য লাভ সম্পর্কে নিম্নবর্ণিত আলোচনা পছন্দ হয় কি?

“বিশ্বে একটি জিনিসের জন্যে অর্থও সম্মান পুরস্কার পাওয়া যায়,“ বলেছেন এলবাট হুয়াট এবং তা হচ্ছে উদ্যোগ। এবং উদ্যোগ কী তা হচ্ছে অন্যে বলে দেয়া ছাড়া সঠিক কাজ করা।

প্রারম্ভিক বাক্য হিসাবে এর আরো কতিপয় বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এই বাক্য আমাদের মনে উৎসুক্য জাগায়, আমাদের আগ্রহী করে তোলে, আমরা কিছু জানাতে চাই। বক্তা যদি এলবাট হুবাট শব্দের পর দক্ষতার সাথে বিরতি দেন তা হলে তা অধিকতর উৎসুক্য সৃষ্টি করতে পারে ”বিশ্ব কী জিনিসের জন্য শ্রেষ্ঠ পুরস্কার দেয়।“ আমরা জানাতে চাই, তাড়াতাড়ি বলুন। আমরা আপনার সাথে একমত নাও হতে পারি, তবুও আপনি আপনার মতামত দিন। দ্বিতীয় বাক্য আমাদের বিষয়টির অভ্যন্তরে নিয়ে যায়? তৃতীয় বাক্যটি একটি প্রশ্ন। এটা শ্রোতাদের প্রতি আলোচনায় অংশ নিতে আহ্বান জানায়, চিন্তা করতে অনুপ্রাণিতে করে। এবং শ্রোতারাও চিন্তা করতে শুরু করেন। চতুর্থ বাক্যে উদ্যোগ এর সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে?–এই সূচনা বা ভূমিকার পর বক্তা মানবিক স্বার্থ সম্পর্কিত গল্প বলতে পারেন, গল্প বলতে পারেন সুস্পষ্ট বিশেষণসহ।

এমনভাবে বলুন যাতে শ্রোতার মনে গভীর আগ্রহ সৃষ্টি হয় :

এমনভাবে শুরু করুন যাতে শ্রোতাদের মনে ব্যক্তিগত আগ্রহ সৃষ্টি হয়। সেটাই হচ্ছে বক্তৃতা শুরু করার সর্বোত্তম পন্থা, এটা নিশ্চিত ভাবেই শ্রোতা মনে আগ্রহ জাগাবে। যা আমাদের হৃদয় আকৃষ্ট করে তা সম্পর্কে আমরা অবশ্যই আগ্রহী হব।

এটা সাধারণ জ্ঞানের কথা, তা নয় কি? অথচ এর ব্যবহার হচ্ছে অত্যন্ত বিরল? উদাহরণ স্বরূপ আমি একজন বক্তাকে সাময়িক স্বাস্থ্য পরীক্ষার প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করে বক্তৃতা শুরু করতে দেখছি। কীভাবে তিনি শুরু করেছিলেন? তিনি শুরু করেছিলেন জীবন সম্প্রসারণ ইনস্টিটিউটের ইতিহাস দিয়ে কীভাবে এটা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে এবং কীভাবে এর কাজ চলছে তা বলে ছিলেন তবে এটা সত্য যে কোথায় কোনো কোম্পানি কীভাবে গঠন করা হয়েছে এবং কীভাবে কোম্পানির কাজ চলছে সে সম্পর্কে আমাদের শ্রোতারা মোটেই আগ্রহী নয়। তারা নিজেদের স্বার্থ সম্পর্কে আগ্রহী।

এই সত্যকে স্বীকার করে নেন না কেন? ঐ কোম্পানিকে তাদের স্বার্থের সাথে সংশ্লিষ্ট সেরূপ আগ্রহ তাদের জাগিয়ে তুলছেন না কেন? এরূপ কিছু দিয়ে শুরু করছেন না কেন? আপনি জানেন জীবন বীমার হিসাব অনুযায়ী আপনি কতখানি বেঁচে থাকবেন? জীবন বীমা কোম্পানির সংখ্যাতাত্ত্বিকদের হিসাব অনুযায়ী আপনার বর্তমান বয়সও আশি বছরের তিনভাগের দু’ভাগ সময় আপনি বাঁচবেন। উদাহরণ স্বরূপ, আপনার বয়স যদি বর্তমান পঁয়ত্রিশ বছর হয় আশি বছর হতে বাকি থাকে ৪৫ বছর, আপনি আশা করতে পারেন বাকি ৪৫ বছরের তিন ভাগের দুভাগ সময় অর্থাৎ ৩০ বছর আপনি বাঁচবেন।–এটাই কী যথেষ্ট? না, না, আমরা সকলেই অধিক দিন বেঁচে থাকতে চাই।

তবে এসব হিসাবে প্রণীত হয়েছে লাখো-লাখো রেকর্ডের ভিত্তিতে, আপনি এবং আমি এই রেকর্ড সময় অতিক্রম করার ইচ্ছা বা আকাঙ্ক্ষা করতে পারি কি? হ্যাঁ, তবে তা করতে হলে যথাযথ প্রস্তুতি প্রয়োজন এবং এই প্রস্তুতির প্রথম পদক্ষেপ আমাদের শরীর পরীক্ষা করিয়ে নিতে হবে।

অতঃপর আমরা যদি ব্যাখ্যা করি সময়-সময় শরীর পরীক্ষা করানো প্রয়োজন কেন, তাহলে শ্রোতারা এই কাজের জন্যে গঠিত কোম্পানি সম্পর্কে জানাতে আগ্রহী হয়ে ওঠবেন। তবে প্রথমেই কোম্পানি সম্পর্কে বলতে শুরু করা যথাযথ পদ্ধতি নয়, এটা ফলপ্রসূ হয় না, বরং শ্রোতাদের বিরক্তি উৎপাদন করে।

আর একটি উদাহরণ শুনুন। আমি একজন বক্তাকে আমাদের বনসম্পদ সংরক্ষণের প্রদান প্রয়োজনীয়তা দিয়ে বক্তৃতা শুরু করতে শুনেছি। তিনি এভাবে শুরু করেন, “আমরা আমেরিকানরা আমাদের প্রাকৃতিকে সম্পদের জন্যে গর্বানুভব করতে পারি।–” অতঃপর তিনি বলতে শুরু করেন, কীভাবে আমরা আমাদের বনজ সম্পদ নির্লজ্জ ভাবে অপচয় করছি। কিন্তু সূচনা ছিল খারাপ, অতি সাধারণ ও অর্থহীন। বক্তা তার বিষয় বস্তুটির প্রতি আমাদের আগ্রহ সৃষ্টি করতে পারেন নি। কারণ তার বক্তব্য ছিল নিজের ব্যবসায়ের প্রতি সংশ্লিষ্ট এবং পরে এর দ্বারা ব্যাংকের ক্ষতি ব্যাখ্যা করেন। কিন্তু যদি তিনি এভাবে বলতেন, “যে বিষয়টি আলোচনা করছি সে বিষয়টি আপনার ব্যবসার ক্ষতি করবে, ক্ষতি করবে মি. আপেল বি-র ব্যবসা, ক্ষতিগ্রস্থ হবে মি. সউল। বস্তুত পক্ষে এই সম্পদ নষ্ট করার ফলে আমাদের অন্য সম্পদের দাম বাড়বে, ভাড়া বাড়াবে। সুতরাং আমাদের সমৃদ্ধি ও কল্যাণ ব্যাহত হবে।“

এটা কী আমাদের বন সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে কিছু বাড়িয়ে বলা? না, মনে করি না। ”ছবিকে বড় করে আঁকলে তার প্রতি শ্রোতার দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়,“ বলে এলবার্ট হুবাড যে অভিমত ব্যক্ত করেছেন এটা তারই অনুসরণ মাত্র।

সংক্ষিপ্ত সার :

(১) বক্তৃতার সূচনা বড় কঠিন। শ্রোতার মনে আকর্ষণ সৃষ্টির জন্যে এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণও। সুতরাং এটা এমন সুচিন্তিতভাবে তৈরি করা প্রয়োজন যাতে শ্রোতাকে আকর্ষণ করা সহজ হয়।

(২) সূচনা বা ভূমিকা সংক্ষিপ্ত হওয়া প্রয়োজন। এটা এক বা দুটি বাক্যে শেষ করা দরকার। সময় সময় এটাকে সংক্ষিপ্ততম করা প্রয়োজন? স্বল্পতম শব্দ দিয়ে আপনার মূল বিষয়টি প্রকাশ করুন। তাহলে কেহই বিরক্ত হবে না।

(৩) নবিশেরা মানবিক কাহিনী বলে অথবা ক্ষমা প্রার্থনার মাধ্যমে বক্তৃতা শুরু করতে চান। এই দুটি পদ্ধতিই অস্বাভাবিক ভুল। খুব কম সংখ্যক লোক, নগণ্যতম লোক মানবিক কাহিনী সাফল্যের সাথে ব্যক্ত করতে পারেন। এই ধরনের প্রচেষ্টা শ্রোতাদের প্রমোদ দানের পরিবর্তে বিরক্ত করে। গল্প বলতে হলে তা বিষয়ের সাথে সম্পর্ক যুক্ত হবে, শুধুমাত্র গল্পের জন্য গল্প বলা হয়। কৌতুক হতে হবে কেকের মসল্লা-স্বরূপ, কেক নয়।কখনো ক্ষমা প্রার্থনা নয়। এটা শ্রোতাদের অপমানিত করার সামিল, আপনি যা বলতে চান সরাসরি তাই বলুন এবং সংক্ষিপ্ত ভাবে বলে শেষ করুন।

(৪) একজন বক্তা সহজেই শ্রোতাদের মন আকর্ষণ করতে পারেন, যদি তিনি :

(ক) ঔৎসুক্য জাগাতে পারলে (উদাহরণ-ডিকেন্স এর বড়দিনের নীতি)।

(খ) মানবিক কাহিনী বলতে পারলে (উদাহরণ হীরা জহরতের কাহিনী)।

 (গ) বিশেষ ব্যাখ্যা দিয়ে শুরু করলে (উদাহরণ-এই বইয়ের ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ)।

(ঘ) কোনো কিছু প্রদর্শন করে (উদাহরণ–মুদ্রা প্রদর্শন);

(ঙ) প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে (উদাহরণ পথ ভ্রমণে কেহ কি এধরণের মুদ্রা পেয়েছেন?

(চ) আকর্ষণীয় কোটেশন দিয়ে শুরু করে (এলবার্ট হুবার্ড এর উদ্যোগ সংক্রান্ত বক্তব্য)।

(ছ) বিষয়টি কীভাবে শ্রোতাদের স্বার্থের সাথে সংশ্লিষ্ট তা উদাহরণ দিয়ে দেখিয়ে, (উদাহরণ–আপনার বর্তমান বয়সও ৮০ বছরের মধ্যে যে ব্যবধান রয়েছে তার তিনভাগের দু’ভাগ সময় আপনি বাঁচবেন বলে আশা করতে পারেন। তবে সময়-সময় শরীর পরীক্ষা করে সঠিক ভাবে চলে আপনি এই সময় বাড়াতে পারেন, প্রভৃতি)।

(জ) অতিখ্যাত তথ্য দিয়ে শুরু করে (উদাহরণ-আমেরিকানরা সভ্য বিশ্বের সবচাইতে জঘন্যতম দুর্বৃত্ত)।

(৫) সুচনায় কোনো কিছুকে অস্বাভাবিক প্রথাসিদ্ধ করার চেষ্টা করবেন না? সূচনাকে স্বাভাবিক গতিশীল ও অবশ্যম্ভাবীরূপে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করুন। এটা করা যায় কোনো কিছু ঘটেছে বা বলা হয়েছে তার উদাহরণ দিয়ে (উদাহরণ, গত কাল এখান হতে বেশি দূরে নয়, এমন একটি শহরের পাশ দিয়ে যখন ট্রেন চলছিল তখন আমার স্মরণ হয়–)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *