০৫. সকল বক্তৃতার প্রয়োজনীয় উপাদান

০৫. সকল বক্তৃতার প্রয়োজনীয় উপাদান

অধ্যবসায়ের প্রয়োজনীয়তা :

যখন আমরা ফরাসি ভাষা অথবা গল্প অথবা জনসভায় বক্তৃতা করণ শেখার মতো নতুন কিছু শিখতে শুরু করি, আমরা কখনো একরূপ ভাবে এগুতে পারি না। আমাদের উন্নতিও ক্রমান্বয়ে হয় না। হঠাৎ কোনো ধাক্কায় আমরা এগিয়ে যাই। অতঃপর আমরা স্থির হয়ে বসি অথবা আমরা পিছিয়ে পড়ি এবং কখনো বা শেষ কোনো কিছু ভুলে যাই, বিস্মৃত হই। এই স্থির অথবা প্রত্যাগতিকাল সম্পর্কে সকল মনোবিজ্ঞানীই ওয়াকেবহাল এবং সচেতন এবং তাঁরা এই জন্যেই এই সময়টাকে ‘শিক্ষার বক্র অধিত্যকা’ বলে অভিহিত করেছেন। ভাষণ কোর্সের শিক্ষার্থীরাও কখনো-কখনো এই অধিত্যকায় আটকা পড়েন। কঠোর পরিশ্রম করেও তাদের পক্ষে এটা অতিক্রম করা সম্ভব হয় না। এই সময়েই দুর্বল ব্যক্তি হতাশ হয়ে পাঠ ছেড়ে দেন। কিন্তু যারা অধ্যবসায়ী, ধৈর্যশীর, তারা দেখতে পান যে, হঠাৎ রাতারাতি তাঁদের অগ্রগতি হয়ে গেছে অকল্পনীয় ভাবে। তারা নিজেরাও বুঝতে পারে না কীভাবে এটা সম্ভব হল। তারা অধিত্যকা হতে বেরিয়ে আসেন বিমানের গতিতে হঠাৎ তারা বক্তৃতা করার এমন শক্তিলাভ করে বসে যা তারা নিজেরাও কখনো কল্পনা করেন নি। হঠাৎ তারা অনেক কিছু শিখে ফেলেন।

আমরা সর্বত্রই একটা কথা বলেছি যে, শ্রোতাদের সামনে বক্তৃতা করতে দাঁড়ালে প্রথম কয়েক মিনিট প্রত্যেকের মনেই ভীতে জাগে, স্নায়বিক দুর্বলতা জাগে, হৃৎকম্প উপস্থিত হতে পারে। কিন্তু আপনি যদি ধৈর্যশীল হন তাহলে ভীতি ছাড়া সব কিছুই আপনার মন হতে সহসা বিদূরিত হবে। কয়েকটি বাক্য বলার পরে আপনি নিজেই আপনাকে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হবেন। তখন আপনি আপনার বক্তব্য আনন্দ ও দৃঢ়তার সথে পেশ করতে পারবেন।

সবসময় অটুট থাকা অনড় থাকা :

আইন অধ্যয়নেচ্ছ একজন তরুণ লিংকনের উপদেশ প্রার্থনা করলে লিংকন লিখেন, আপনি যদি নিজেকে একজন আইনজীবী রূপে গড়ে তোলা দৃঢ় ইচ্ছা পোষণ করে থাকেন তা হলে কাজটি অর্ধেকের বেশি ইতোমধ্যে হয়ে গেছে। সবসময় স্মরণ রাখবেন নিজের ইচ্ছাই সাফল্যের পথে অন্য যে কোনো কিছু হতে গুরুত্বপূর্ণ।

লিংকন জানতেন। ভালো ভাবেই জানতেন। তিনি তার সারা জীবনে এক বছরের বেশি সময় স্কুলে যাবার সুযোগ পান নি। আর বই? লিংকন একবার বলেছেন, তিনি যে কোনো বই ধার করার জন্যে তার বাড়ি হতে পঞ্চাশ মাইল পর্যন্ত হেঁটে যেতেন। তাঁর ঘরে যারা রাতে কাঠ জ্বালাত এবং এই কঠের আলোতে তিনি পড়তেন। কখনো-কখনো পড়তে-পড়তে ঘুমিয়ে পড়তেন, ঘুম থেকে জেগে, চোখ রগড়ে আবার বইটি টেনে নিয়ে পড়তেন, পড়তেন গভীর মনোযোগ দিয়ে।

কোনো বক্তার বক্তৃতা শোনার জন্যে তিনি বিশ ত্রিশ মাইল দূরে চলে যেতেন। বক্তৃতা শুনে ঘরে ফিরে যত্রতত্র-মাঠে, বনে, জেন্ট্রি বিলের মুদি দোকানে বক্তৃতা অভ্যাস করতেন। তিনি নিউসালেম ও স্প্রিংফিল্ডএর সাহিত্য ও বিতর্ক ক্লাবের সদস্য হয়েছিলেন। এবং এখন আমরা যেমন যে কোনো বিষয় নিয়ে কথা বলি আলোচনা করি, তিনি ঠিক সেভাবে সকল বিষয় নিয়ে বক্তৃতা করতেন।

তবে তার মধ্যে সব সময় হীনম্মন্যতা বিরাজ করত। এটা তাকে পীড়া দিত। মহিলাদের উপস্থিতিতে তিনি লজ্জা পেতেন বোবা হয়ে যেতেন। মেরি টটের সাথে প্রণয় কালেও তিনি লাজ নম্রভাবে একান্তে বসে নীরবে তার কথা শুনতেন, কোনো কথা বলতেন না। কিন্তু এই লাজুক নম্র ব্যক্তিই অভ্যাস এবং ঘরে লেখা পড়া করে নিজেকে এরূপ বক্তা হিসাবে গড়ে তুলেছিলেন, যিনি সাফল্যের সাথে প্রতিযোগিতা করেছেন, তকালের মার্জিতরুচি বক্তা সিনেটর ডগলাসের সাথে। তিনিই সেই ব্যক্তি যার গ্যাটিসবার্গের ভাষণ এবং হোয়াইট হাউসের দ্বিতীয় উদ্বোধনী ভাষণ মানবেতিহাসে অলংকারপূর্ণ বাকপটুতার উজ্জ্বল নজির হয়ে রয়েছে।

এটা অত্যন্ত আশ্চর্যের বিষয় যে, যার মন ছিল এরূপ ভারাক্রান্ত, লজ্জাপূর্ণ তিনি লিখেন, “আপনি যদি নিজেকে একজন আইনজীবী রূপে গড়ে তোলার দৃঢ় ইচ্ছা গ্রহণ করে থাকেন, তাহলে কাজটির অর্ধেকের বেশি ইতোমধ্যে হয়ে গেছে।”

প্রেসিডেন্টের দপ্তরে আব্রাহাম লিংকনের একটি সুন্দর ছবি ছিল। ”যখন আমাকে কোনো শক্ত বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয়” বলেছেন থিওডর রুজভেল্ট ”যে বিষয়টি কঠিন, যাতে অধিকারও স্বার্থের সংঘাত আছে, আমি লিংকনের দিকে তাকাই, তাঁকে আমার স্থানে কল্পনা করার চেষ্ট করি, ইে অবস্থায় তিনি কী করতেন তা বের করার চেষ্টা করি। এটা আপনার কাছে শুনতে খারাপ লাগতে পারে, কিন্তু একথা সত্য যে, এটা আমাকে বিপদ হতে উদ্ধার করে এবং আমি সঠিক সমাধানে উপনীত হতে সক্ষম হই।”

রুজভেল্টের পরিকল্পনা কেন পরীক্ষা করব না? আপনি যদি ভালো বক্তা হতে চান তাহলে কেন আপনি জানতে চেষ্টা করবেন না আপনার অবস্থায় পড়লে লিংকন কী করতেন? আপনি জানেন তিনি কী করতেন! সিনেটের নির্বাচনে সংস্কৃতিবান, মার্জিতরুচি স্টেপেন এ ডগলাসের কাছে পরাজিত হবার পর তিনি তাঁর অনুগামীদের উপদেশ দিয়েছিলেন, “একবার নয়, শতবার পরাজয়েও হতাশার কিছু নেই।”

আমি কী আশা করতে পারি যে, হারবার্ডের খ্যাতনামা মনস্তত্ববিদ অধ্যাপক উইরিয়াম জেমস এর নিম্নবর্ণিত কথাগুলো মুখস্থ করা পর্যন্ত এই বইটি প্রতিদিন আপনার প্রাতরাশের টেবিলে খোলা থাকবে।

কোনো তরুণের মনেই সে যে বিষয়েরই ছাত্র হোক না কেন, তার শিক্ষা সম্পর্কে কোনোরূপ দুশ্চিন্তা থাকা উচিৎ নয়। সে যদি তার লেখাপড়া নিয়ে প্রতিটি কাজের দিনে মনে প্রাণে ব্যস্ত থাকে সাফল্য তার নিশ্চিত। সে এ সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারে যে, তার জীবনে ব্যর্থতা আসবে না এবং সে হবে না কলঙ্কিত। মনে এরূপ দৃঢ় আস্থার জন্যে অবশ্যই তাকে কাজের দিনের প্রতিটি ঘণ্টা মনে প্রাণে কাজ করতে হবে।

অধ্যাপক জেমস এর এই বক্তব্য ব্যাখ্যা করে আমি এখন বলতে পারি যে, বক্তৃতা শেখায় আপনি যদি এই অভ্যাস দৃঢ়তা ও বিশ্বস্ততার সাথে অব্যাহত রাখেন, বুদ্ধিমত্তার সাথে বক্তৃতা চর্চা করেন, আপনি নিজ মনে দৃঢ় বিশ্বাস রাখতে পারেন যে, আপনি একদিন আপনার শহর অথবা সমাজের যোগ্য বক্তা হতে পারবেন।

আপনার কাছে শুনতে যেরূপ লাগুক না কেন, সাধারণ নীতি হিসাবে এটা সত্য অবশ্য এতে ব্যতিক্রমও আছে। নিম্নমানের মানসিকতা ও ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন একজন লোক, যার কোনো বিষয়েই তেমন জ্ঞান নেই, যে ডানিয়েল ওয়েব্রেস্টারের মতো বক্তা হবেন, না হতে পারবেন? এ প্রসঙ্গে আমি বাস্তব উদাহরণ দিচ্ছি :

নিউজার্সির প্রাক্তন গভর্নর স্টোককে ট্রেনটনে আয়োজিত একটি বক্তৃতা শিক্ষা কোর্সের সমাপ্তি ভোজে উপস্থিত ছিলেন। তিনি বলেছিলেন যে, ঐ সন্ধ্যায় শিক্ষানবিশ ছাত্ররা যে বক্তৃতা করেছিলেন সে ধরনের বক্তৃতা তিনি ওয়াশিংটনে প্রতিনিধি সভা এবং সিনেটেই শুনছেন। কয়েক মাস আগে যে-সব ব্যবসায়ী শ্রোতা-ভীতিতে বোবা হয়ে যেতেন তারাই সেদিন বক্তৃতা করেছিলেন ট্রেনটনের ভোজে। তাদের মতো একই ধরনের ব্যবসায়ী আমেরিকার সকল শহরেই ছড়িয়ে রয়েছে। ব্যবসা জানলেও বক্তৃতা করা তাদের পক্ষে ছিল অকল্পনীয়, কিন্তু বক্তৃতা কোর্সে অংশ নিয়ে একদিন তাঁরা তাঁদের শহরে সক্ষম বক্তায় পরিণত হন।

বক্তা হিসাবে আপনার সাফল্য অর্জন দুটি জিনিসের ওপর নির্ভর করছে। তা হচ্ছে আপনার ব্যক্তিগত যোগ্যতা এবং বক্তৃতা শেখায় আপনার আগ্রহ ও সে আগ্রহের গভীরতা। প্রায় সকল বিষয়ে বলেছেন অধ্যাপক জেমস, “আপনার আগ্রহ আপনাকে জয়ী করবে। সুফল লাভ আপনার লক্ষ্য হলে আপনি নিশ্চিত ভাবেই তা লাভ করবেন। আপনি ধনী হতে চাইলে ধনী হবেন। জ্ঞানী হতে চাইলে জ্ঞানী হবেন, ভালো হতে চাইলে ভালো হবেন। তবে আপনাকে অবশ্যই তা হতে চাইতে হবে এবং হবার ইচ্ছানুযায়ী কাজ করতে হবে, সাথে অন্য কোনো আকাক্ষা রেখে কাজ করলে চলবে না।” এবং অধ্যাপক জেমস সম গুরুত্বের সাথে সম্ভবত এটাও যোগ করতে পারেন, “আপনি যদি আত্মপ্রত্যয়ী সুবক্তা হতে চান তাহলে তা’হতে পারবেন,তবে আপনাকে অবশ্যই সে ইচ্ছা পোষণ করতে হবে।”

আমি এরূপ হাজার-হাজার পুরুষ ও মহিলাকে জানি যারা সত্যিই আত্মবিশ্বাস অর্জন ও সুবক্তা হবার জন্য চেষ্টা করছেন। এদের মধ্যে সামান্য সংখ্যকই অত্যন্ত মেধাবী। অন্যান্যরা আপনার শহরের সাধারণ মানুষের মতো। তাদের মধ্যে যারা বেশি চটপটে তাদেরই আমি ব্যর্থ হতে দেখেছি বেশি। কারণ তারা টাকা বানানোর কথা বেশি চিন্তা করে? বক্তৃতা শেখায় অখণ্ড মনোযোগ দেয় না। কিন্তু সাধারণদের মধ্যে যারা অখণ্ড মনোযোগ দিয়ে চেষ্টা করে তারাই সাফল্য লাভ করে এবং তাদের স্থান হয় সকলের শীর্ষে।

তাই প্রকৃতগত এবং মানবিক, বাণিজ্য ও পেশার ক্ষেত্রেও কী আপনি সব সময় একই রূপ ঘটনা ঘটতে দেখেন না। রকফেলার বলেছিলেন যে, ব্যবসায়ে সাফল্য লাভের চাবিকাঠি হচ্ছে ধৈর্য। বক্তৃতা শেখার বেলাও এটি প্রথম প্রয়োজন।

মার্শাল ভচ বিশ্বের সর্ববৃহত্তম বাহিনীর বিরুদ্ধে জয়লাভ করে বলেছিলেন, এই সাফল্যের কারণ হচ্ছে হতাশ না হওয়া।

১৯২৪ সালে ফ্রান্স যখন মার্নিতে পশ্চাদপসরণে বাধ্য হয় তখন দু’লক্ষ সৈন্যের অধিনায়ক জেনারেল জোফরি তার অধীন জেনারেলদের প্রতি পশ্চাদপসরণ বন্ধ করে তীব্র আক্রমণ শুরু করার নির্দেশ দেন। এর পর দুদিন স্থায়ী যে যুদ্ধ হয় তা বিশ্ব ইতিহাসে একটি স্মরণীয় ঘটনা। এই নির্দেশের পর জেনারেল ফচ জেনারেল জোফরিকে একটি বাণীতে জানান, “আমার কেন্দ্রের সৈনিকেরা সম্পূর্ণ প্রস্তুত। আমার ভাগে শত্রু নেই। অবস্থা অত্যন্ত অনুকুল। সুতরাং আমি আক্রমণ পরিচালনা করছি।”

এই আক্রমণের ফলেই ফ্রান্স রক্ষা পায়।

সুতরাং যুদ্ধ তখন তীব্র আকার ধারণ করে, পরাজয় যখন প্রায় নিশ্চিত হয়ে উঠে তখন নিজেকে বাঁচাতে হলে শত্রুতে তীব্রতর বেগে আক্রমণ-করতে হবে। প্রতিরোধ নয়, আক্রমণাত্মক যুদ্ধ করতে হবে তাহলে নিজেকে রক্ষা করা, জয়লাভ করা সম্ভব।

ওয়াইলড কায়জার শৃঙ্গে আরোহণ :

কয়েক বৎসর আগের কথা, আমি অস্ট্রিস আল্পস পর্বতের ওয়াইল্ড কায়জার শৃঙ্গে আরোহণের চেষ্টা করি? বেডেকার বলেন যে, এটাতে আরোহণ অত্যন্ত কষ্টসাধ্য এবং শৌখিন আরোহণকারীর জন্য পথপ্রদর্শক প্রয়োজন। আমি ও আমার বন্ধু, আমার দুজন নিশ্চিতভাবেই শৌখিন আরোহণকারী এবং আমাদের কোনো পথপ্রদর্শকও ছিল না। তাই তৃতীয় দল আমাদের প্রশ্ন করে, আমরা সাফল্যলাভ করব বলে চিন্তা করি কী না।

‘নিশ্চয়ই’ আমরা উত্তর দেই।

“কী কারণে আপনারা এরূপ চিন্তা করেন?” তিনি জানতে চান। ”অন্যেরা কোনোরূপ পথ প্রদর্শক ছাড়া সফল হয়েছেন? আমি বলি, সুতরাং আমাদের সফল না হবার কোনো কারণ নেই এবং আমি কখনো পরাজিত হবার কথা চিন্তা করি না।”

আলফাইনা আরোহী হিসাবে আমি সম্পূর্ণ নবিশ কিন্তু আমার ছিল মানসিক প্রস্তুতি। আমি নিশ্চিত ছিলাম সাফল্য সম্পর্কে। সুতরাং বক্তৃতা শেখার সাফল্য অর্জনে এরূপ মানসিক প্রস্তুতি এবং মনোবল থাকলে এভারেস্ট আরোহণে সাফল্য অর্জনের মতো এ ও সহজ সাধ্য।

সাফল্যের কথা চিন্তা করুন। যথাযথ আত্মনিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে আপনি জনসভায় বক্তৃতা করছেন বলে চিন্তা করুন।

এটা সম্পূর্ণরূপে আপনার শক্তির মধ্যে। সাফল্য সম্পর্কে মনে-মনে বিশ্বাস বা আত্মবিশ্বাস পোষণ করুন। এটা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে বিজয়লাভের জন্যে বা প্রয়োজনে ঠিক সেভাবে কাজ করুন।

এডমিরাল ডুপান্ট কেন তাঁর গানবোর্ট চার্লেনটন পোতাশ্রয়ে ভেড়ান নি তার পক্ষে আধাডজন গুরুত্বপূর্ণ যুক্তি দেখিয়েছেন। এডমিরাল ফারাগুট গভীর মনোযোগ দিযে তা শোনেন। কিন্তু আরো একটি কারণ ছিল, তা আপনি উল্লেখ করেন নি? শোনার পর তিনি উত্তর দেন।

‘ওটা কি?’ এডমিরাল ডুপান্ট প্রশ্ন করেন। উত্তর আসে, আপনি তা করতে পারতেন সে বিশ্বাস আপনার ছিল না।

সাধারণ ভাষণ কোর্সে অংশ গ্রহণকারীরা সবাই যে মূল্যবান জিনিসটি প্রশিক্ষণকালে লাভ করেন তা হচ্ছে নিজেদের উপর আস্থা বৃদ্ধি, আত্মবিশ্বাস অর্জন। এবং যে কোনো ভাষায় যে কোনো ক্ষেত্রে সাফল্যের জন্য এটি বিশেষ প্রয়োজন।

বিজয় লাভের ইচ্ছা :

এ ক্ষেত্রে আমি প্রয়াত এলবার্ট এর একটি বিজ্ঞ উপদেশ উল্লেখ করার লোভ সংবরণ করতে পারছি না। সাধারণ মানুষ, নারী বা পুরুষ যদি তাদের নিজস্ব জ্ঞান সঠিকভাবে কাজে লাগান তা হলে সুখ ও সমৃদ্ধি নিশ্চিত।

যখনি আপনি ঘর হতে বের হবেন তখন মনে-মনে গ্লানি রাখবেন না, দৃঢ় পদক্ষেপে চলবেন, বুক ফুলিয়ে হাঁটবেন, কোনো বন্ধুর দেখা পেলে তার সাথে হাসিমুখে কথা বলবেন। কোথাও কোনো কারণে ভীত হবেন না, কাকেও শত্রু মনে করে চিন্তায় সময় নষ্ট করবেন না। আপনি কী করতে চান তা মনে মনে ঠিক করে নেবার চেষ্টা করুন এবং অতঃপর সেই স্থির লক্ষ্য সামনে রেখে এগিয়ে চলুন। যে কাজটি আপনি চান তার উপর আপনার মন স্থির রাখুন, তাহলে আপনি দেখতে পাবেন যে, আপনি নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছে গেছেন, আপনি সাফল্য লাভ করেছেন। সময় ও স্রোত আপনার লক্ষ্য অর্জনে বাধা হয় নি, আপনি যা হতে চান তা কল্পনা করুন, কোনো একজনকে তা হবার আদর্শ হিসাবে কল্পনা করুন, মনে মনে তার ছবি এঁকে নিন। অতঃপর সফলতার লক্ষ্য সামনে রেখে কাজ করুন, সাফল্য আসবে। চিন্তা হচ্ছে বড় শক্তি। দৃঢ় মনোবল নিয়ে অটুট বিশ্বাস নিয়ে আপনার বিষয়টি চিন্তা করুন। এই চিন্তা আপনার মনকে করে তুলবে সৃজনশীল। ইচ্ছানুযায়ী কর্ম হয় এবং সব কর্মেরই ফলোদয় হয়। আমাদের মন যেরূপ আমরাও হই ঠিক সেরূপ। নিজের চিন্তা নিয়ে লক্ষ্য স্থির করে মাথা উঁচু করে চলুন। সাফল্য আসবেই।

নেপোলিয়ন, ওয়েলিংটন, রী, গ্রান্ট, ফোচ–সকল বিখ্যাত সামরিক নেতা স্বীকার করেছেন যে একটি সামরিক বাহিনীর বিজয় অর্জনের ইচ্ছা এবং বিজয় অর্জনের যোগ্যতা সম্পর্কে তার আস্থা বিজয় নিশ্চিত করে।

“নব্বই হাজার বিজিত ব্যক্তি” বলেছেন মার্শাল ফোচ, “নব্বই হাজার বিজয়ী ব্যক্তির আগেই ঝিমিয়ে পড়েন। কেননা, তারা বিজয় লাভ সম্পর্কে হতাশ হন। এই হতাশা তাদের নৈতিক অথঃপতন ঘটায় এবং পরিশেষে তারা পরাজয় বরণ করতে বাধ্য হয়। প্রতিরোধ করতে পারে না ঠেকাতে পারে না।”

অন্যথায়, পরাজিত নব্বই হাজার লোকের সকলেই বেত্রাঘাত প্রাপ্ত নয়। কিন্তু তারা মানসিক ভাবে বেত্রাঘাত প্রাপ্ত, তারা আত্মবিশ্বাস ও সাহস হারা, তাই হয় তারা পরাজিত। আত্মবিশ্বাস ও সাহস হারা বাহিনীর বিজয়ের কোনো পথ নেই। এ ধরনের কোনো মানুষেরও সাফল্যের কোনো আশা নেই।

মার্কিন নৌবাহিনীর প্রাক্তন যাজক ফোজিয়ার প্রথম মহাযুদ্ধ কালে নৌবাহিনীতে যাজক হতে ইচ্ছুক বহু বক্তির সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছিলেন। নৌ-বাহিনীর যাজকের সাফল্যের জন্যে কী কী গুণ থাকা প্রয়োজন মর্মে প্রশ্ন করা হলে তিনি উত্তর দেন –চারটা জি। সেগুলো হচ্ছে গ্রেস, গ্রুমসান, গ্লিট ও গুর্টস অর্থাৎ দয়া, সাধারণ বুদ্ধি, চরিত্রের দৃঢ়তা ও সহন শক্তি।

বক্তৃতায় সাফল্যের জন্যেও এগুলো প্রয়োজন। এগুলোকে আপনার আদর্শ হিসাবে গ্রহণ করুন। রবার্টের নিম্নপদ্যটিকে আপনারা সমর-সঙ্গীত রূপে গ্রহণ করুন।

আপনি যখন হারিয়ে যাবেন বনে
হবেন ভয়ে শিশুর মতো শংকিত–
চোখে মৃত্যুর ছায়া দেখে হবেন আতঙ্কিত
হবেন মর্ম যাতনায় দগ্ধ, নয় বা আকাঙ্ক্ষিত।
হতাশ হৃদয়ে বেষ্টিত হবেন আত্মহত্যায় —
কিন্তু মানব জীবনের নিয়ম–সগ্রাম সর্ব অবস্থায়;
আত্মবিশ্বাস নিষিদ্ধ, বেআইনী কাজ হয়ে —
ক্ষুধা এবং যন্ত্রণা, অবশ্যই সহ্য করা যায়,
প্রাতভোজে শক্ত রুটি। কী নিরূপায়। অসহায়,
খেলায় আপনি অনাসক্ত। কী লজ্জার বিষয়–
তরুণ, সাহসী উজ্জ্বলের তরে এমন হবার নয়।
আপনার মনোভাবে স্থিতি নেই এটা প্রকাশ না হয়,
উঠুন, আগুন, লড়ে যান সদা। অনন্ত হৃদয়–
অতঃপর হবে আপনার বিজয়।
হবেন না যন্ত্র হবেন না পশু, কোনোভাবে।
নিজের পায়ে দাঁড়ান, জয় আপনারই হবে।
মার খেয়ে কাদা, মৃত্যু, সে তো সহজ কাজ বড়–
বাগদা চিংড়ির মতো হামা দেয়া, জড় সড়।
কিন্তু হৃদয়ে হতাশা নয়, সংগ্রাম আর সংগ্রাম
বিজয়ের তরে চালাতেই হবে এই প্রোগ্রাম।
সকল ক্ষেত্রেই হবে তবে জয়–
ঝড় ঝঞ্ঝার নিশ্চিত হবে লয়।
মৃত্যুর আগে মরা সে তো অনেক সহজ কাজ–
বাঁচার মতো বেঁচে থাকাই তো ফরজ আজ।

সংক্ষিপ্ত সার :

(১) আস্তে-আস্তে বা ধাপে-ধাপে আমরা কোনো কিছু শিখি না, তা যে গলফ খেলা, ফরাসি ভাষা শেখা, বক্তৃতা শেখা যাই হোক। হঠাৎ শুরু করে এক ধাক্কায় আমরা এগিয়ে যাই। অতঃপর আমরা স্থির হয়ে বসি অথবা পিছিয়ে পড়ি এবং কখনো বা শেখা কোনো কিছু ভুলে যাই, বিস্মৃত হই। মনোবিজ্ঞানীরা এই স্থিতিকালকে বলেন, শিক্ষার বক্র অধিত্যকা। আমরা কঠোর পরিশ্রম করেও এই ‘অধিত্যকা’ হতে বের হয়ে আসতে পারি না, কখনো বা এগুতে পারলেও আবার পিছিয়ে পড়ি। কিছু লোক, আমাদের অগ্রগতির পদ্ধতি বুঝতে না পেরে অধিত্যকায় পড়ে হতাশ হয়ে চেষ্টা ছেড়ে দেন। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক, তারা যদি চেষ্টা অব্যাহত রাখতেন, অভ্যাস করতেন সতত, তা হলে তারা একদিন দেখতে পেতেন, হঠাৎ তারা বিমানের চাইতেও দ্রুত গতিতে বেরিয়ে আসছেন, রাতারাতি অকল্পনীয় অগ্রগতি ও সাফল্য লাভ করেছেন।

(২) বক্তৃতা শুরু করার প্রারম্ভে আপনি কখনো স্নায়বিক দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে পারেন না। কিন্তু আপনি যদি ধৈর্যশীল হন তাহলে শীঘ্রই আপনি প্রাথমিক ভয় ছাড়া সবকিছু কাটিয়ে উঠতে পারবেন এবং কয়েক মিনিট বক্তৃতা করার পর আপনার ভয় দূরীভূত হবে।

(৩) অধ্যাকি জেনম বলেছেন যে, কারো তার শিক্ষা সম্পর্কে কোনোরূপ উৎকণ্ঠা রাখা উচিৎ নয় এবং সত্যি যদি যে আন্তরিকভাবে চেষ্টা করে একদিন যে তার সামসাময়িকদের মধ্যে দক্ষ ব্যক্তি হয়ে উঠবে, ক্ষেত্র বা বিষয় তার যাই হোক না কেন। এর মনস্তাত্ত্বিক সত্য আপনার ওপর এবং আপনার বক্তৃতা শেখার ক্ষেত্রে প্রয়োগ করুন। আপনার সাফল্য আসবে প্রশ্নাতীত ভাবে। এভাবে যে লোক সফল হয় সে মাত্রাতিরিক্ত মেধার অধিকারী নয়, সাধারণ ধিশক্তিসম্পন্ন। ধৈর্যও দৃঢ় প্রত্যয়ই জয়ের কারণ দৃঢ়তার সাথে চেষ্টা করে সফল হন।

(৪) জনসভায় বক্তৃতা করে সাফল্যলাভের চিন্তা করুন। এই চিন্তা মনে থাকলে সাফল্য অর্জনের জন্যে যা করা প্রয়োজন তা আপনি করতে পারবেন।

(৫) আপনি যদি হতাশ হয়ে পড়েন তাহলে টেডি রুজভেল্টের পরিকল্পনা অনুসরণে লিংকনের ছবির দিকে তাকান এবং নিজেকে প্রশ্ন করুন, আপনার মতো অবস্থায় পড়লে তিনি কী করতেন।

(৬) প্রথম বিশ্বযুদ্ধকালে মার্কিন নৌবাহিনীর জনৈক পদস্থ যাজক, যাজকের সাফল্যের কথায় বলেছেন চারটি শব্দ, চারটি জি, সেগুলো কী?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *