০৩. খ্যাতনামা বক্তাগণ কীভাবে তাঁদের ভাষণ প্রস্তুত করতেন

০৩. খ্যাতনামা বক্তাগণ কীভাবে তাঁদের ভাষণ প্রস্তুত করতেন

আমি একদা নিউইয়র্ক রোটারি ক্লাবের একটি মধ্যাহ্ন ভোজে উপস্থিত ছিলাম, যেখানে প্রধান বক্তা হিসাবে উপস্থিত ছিলেন একজন পদস্থ সরকারি কর্মকর্তা। তার সরকারি পদ তাকে বিশেষ মর্যাদা দিয়েছিল এবং আমরা আনন্দের সথে তার বক্তব্য শোনার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলাম। তিনি আমাদের তার নিজস্ব বিভাগ সম্পর্কে বলার প্রতিশ্রুতি দেন এবং নিউইয়র্কের সকল ব্যবসায়ীই এই বিভাগ সম্পর্কে জানতে আগ্রহী ছিলেন।

তিনি তার বিষয়টি পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে জানতেন। তিনি যে কাজ করতেন, জানতেন তার চাইতে বেশি। কিন্তু তিনি তার বক্তৃতা সম্পর্কে কোনো পরিকল্পনা করেন নি। তিনি তার বক্তব্য কীভাবে পেশ করবেন তাও ঠিক করেন নি। তার বক্তব্যের মূল পয়েন্টগুলোও তিনি সাজিয়ে নেন নি। অধিকন্তু অনভ্যাস ও অনভিজ্ঞতা হেতু তিনি সেদিন অন্ধভাবেই বক্তৃতা করতে শুরু করেন। তিনি জানতেন না কোথায় গিয়ে তার বক্তব্য শেষ হবে। তবু তিনি শুরু করেন।

স্বল্প কথায় বলতে গেলে, তখন তার মনে তালগোল পাকিয়ে গিয়েছিলো বিধায় তিনি যা বলেন তা আমাদের কাছে হয় খিচুড়ি-সদৃশ্য। তিনি প্রথমে পরিবেশন করেন আইসক্রিম। অতঃপর পরিবেশন করে সুপ! এর পর আসে মাছ ও ও বাদাম। পরিশেষে আসে সুপ ও আইসক্রিমের একটি অসামঞ্জস্যপূর্ণ মিক্সচার এবং লবণাক্ত মাছ। আমি কখনো কোথাও অথবা কোনো সময়ে কোনো বক্তাকে এরূপ পুরোপুরি বিভ্রান্ত হতে দেখি নি।

তিনি তখন যেমন তেমন ভাবে কিছু বলে আমাদের সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করেন। কিন্তু তাতেও ব্যর্থ হওয়ায় তিনি পকেট থেকে এক তাড়া চিঠি বের করেন এবং বলেন যে, তার সেক্রেটারি তার জন্যে এগুলি তৈরি করেছেন। তবে তার বক্তব্যের সত্যতা সম্পর্কে কেহ কোনো প্রশ্ন করে নি। চিঠিগুলোও এমন এলোমেলো ছিল যে, এগুলো যেন একটি ফ্লাট গাড়িতে ছড়িয়ে রাখা লোহার টুকরো। তিনি এগুলো অসহায়ভাবে হাতড়িয়ে একের পর এক পৃষ্ঠা দেখে গভীর অরণ্যানী হতে কিছু উদ্ধার করে নিজেকে শক্ত করে নিজেকে কিছু বলার চেষ্টা করেন, কিন্তু তার বক্তব্য হয়ে পড়ে সামঞ্জস্যহীন, অর্থহীন অরণ্যেরোদন সদৃশ্য। তার পক্ষে সুষ্ঠুভাবে কিছু বলা অসম্ভব হয়ে পড়ে। তিনি ক্ষমা চেয়ে পানি চান, কম্পিত হাতে গ্লাস নিয়ে সামান্য পানি পান করে আবার কয়েকিট অসংলগ্ন বাক্য বলে তার চিঠির জঙ্গলের মাঝে মনোনিবেশ করেন। মুহূর্তের পর মুহূর্তে তিনি আরো অধিকতর অসহায় পড়ে পড়তে থাকেন, হতাশ হতে থাকেন, হতবুদ্ধি হতে থাকেন এবং হন অধিকতর কিংকর্তব্যবিমূঢ়। তার কপালে দেখা দেয় ফোঁটা ফোঁটা স্বেদ বিন্দু যা মুছে তার রুমাল হয়ে যায় পূর্ণসিক্ত, যেন চোখের জলে তা ভিজে গেছে। দর্শকের আসনে বসে আমরা তার জন্যে পরম করুণা,অনুভব করতে থাকি, তার প্রতি জাগে আমাদের অন্তরের সহানুভূতি। আমরা নিজেরাও তখন হতবুদ্ধি হয়ে পড়ি। কিন্তু এতৎসত্ত্বেও বক্তা বেশরম ও লোচ্চার মতো তার চিঠি দেখে এলোমেলো বক্তৃতা করতে থাকেন। ক্ষমা চেয়ে ও পানি পান করে পেশ করতে থাকেন অর্থহীন বক্তব্য। তিনি ছাড়া সকলেই দেখতে পান যে, চোখ হতে তার চশমা পড়ে যাচ্ছে। চশমা পড়ে ভেঙ্গে গেলে তিনি বসে পড়েন, আমরা অর্থহীন বক্তব্য শোনা থেকে লাভ করি অব্যাহতি। সেদিন আমি হয়ে ছিলাম সবচেয়ে দুর্ভাগ্য শ্রোতা এবং আমি জীবনে কখনো এরূপ লজ্জাহীন হতবুদ্ধি বক্তার সাক্ষাৎ পাই নি। রুশোর মতো দৃঢ় মনোভাব নিয়ে দাঁড়ালেও কী বলতে চান তা তিনি নিজে জানতেন না এবং কী বলে শেষ করেছেন অথবা তিনি কী বলেছেন তাও তিনি নিজেই জানেন না। এই গল্পের নৈতিক শিক্ষা হচ্ছে এই যখন কোনো মানুষের জ্ঞান যথোপযুক্ত ভাবে সঞ্চিত থাকে না, বলেছেন হারবার্ড স্পেন্সর, “অধিক জ্ঞানী হলেও তার চিন্তা ধারা দ্বিধাগ্রস্ত হতে বাধ্য।“

কোনো বিবেকবান লোকই পরিকল্পনা ছাড়া গৃহ নির্মাণ শুরু করেন না, কিন্তু এই লোকটি কেন কোনোরূপ রুপরেখা ছাড়া বা পরিকল্পনা ছাড়া বক্তৃতা শুরু করেছিলেন।

বক্তৃতা হচ্ছে একটি উদ্দেশ্যমূলক সমুদ্র যাত্রা যার নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন। যে ব্যক্তির শুরুর ঠিক থাকে না তার সমাপ্তির ঠিকানাও পাওয়া যায় না।

আমরা ইচ্ছা যে, আমি নেপোলিয়নের একটি সুবিখ্যাত উক্তিকে বিশ্বের সর্বত্র বক্তৃতা শেখার সকল প্রতিষ্ঠানের দেয়াল-গাত্রে বড় বড় হরফে লাল অক্ষরে খোদিত করে রাখি। নেপোলিয়নের সেই প্রখ্যাত উক্তি হচ্ছে”যুদ্ধ কৌশল হচ্ছে একটি বিজ্ঞান, সুচিন্তিত পদ্ধতিতে যথাযথ হিসাব প্রণয়ন করা না গেলে এতে জয়লাভ অসম্ভব।”

বক্তব্য শিক্ষা সম্পর্কেও এই বক্তব্য সত্য। কিন্তু বক্তারা কি এটা উপলেিব্ধ করেন অথবা যা চিন্তা করেন, তারা কি সব সময় সে ভাবে কাজ করেন? তাঁরা তা করেন না। তারা তা প্রয়োজন মনে করেন না। কেহ কেহ এই সম্পর্কে বহু পরিকল্পনা করেন, কিন্তু তাতে সফলতার নিশ্চয়তা নেই।

কোনো আদর্শ প্রচারের ফলপ্রসু, গ্রহণযোগ্য ও সর্বোত্তম পন্থা কী এ সম্পর্কে পর্যবেক্ষণের আগে কেহই তা বলতে পারেন না। এটা সব সময়ে নতুন সমস্যা। বক্তার মনে জাগে নতুন-নতুন প্রশ্ন। খুঁজে পান নতুন-নতুন জবাব। বক্তার বিষয় সাজানো সম্পর্কে প্রচলিত কোনো নিয়ম বা আইন কানুন নেই। বক্তা নিজেই ইচ্ছানুযায়ী তা সাজিয়ে নিতে পারেন, প্রকাশ করতে পারেন।

একটি পুরস্কার বিজয়ী বক্তৃতা কীভাবে প্রস্তুত করা হয়েছিলো?

এখানে কয়েক বছর আগে ন্যাশনাল এসোসিয়েশন অব রিয়েল স্ট্রেট বোর্ড সমীপে প্রদত্ত একটি ভাষণের উদ্ধৃতি দিচ্ছি। ভাষণটি অপর ২০টি শহর সম্পর্কে প্রদত্ত ভাষণের মধ্যে প্রথম পুরস্কার লাভ করে। এবং আজো এটি সেরূপ মূল্যবান। এই ভাষণটি ছিল তথ্য বহুল, সুচিন্তিত। পরিষ্কার ভাবে, সংক্ষিপ্ত আকারে কিন্তু আকর্ষণীয় পদ্ধতিতে পেশকৃত ভাষণ। এটি ছিল উদ্দীপনাময়, সাবলীল। এটা পাঠ ও অধ্যয়ণের জন্যে খুবই আকর্ষণীয়।

মি. চেয়ারম্যান ও বন্ধুগণ–
আজ হতে ১৪৪ বছর আগে আমার নগর ফিলাডেলফিয়ার এই মহান জাতি, আমেরিকান যুক্তরাষ্ট্রের জন্ম। সুতরাং এরূপ একটি মহান জাতির জন্মদানের ঐতিহাসিক রেকর্ডের অধিকারী শহরের প্রাণ শক্তি ও সেই মহান জাতির মতো উদ্দীপনাময় ও শক্তিশালী। আমার শহরে আজ শুধুমাত্র আমেরিকার একটি শিল্প সমৃদ্ধ শহর নয়। সারা বিশ্বের সুন্দরতম শহরগুলোর অন্যতম।

ফিলাডেলফিয়ার জনসংখ্যা হচ্ছে প্রায় বিশলাখ এবং আমাদের এই শহরের আয়তন হচ্ছে মিলোকী ও বোস্টান, প্যারিস ও বার্লিনের যোগফলের সমান। আমাদের এই শহরে ১৩০ বর্গমাইল এলাকার মধ্যে ৮.০০০ একর উর্বর ভূমি পার্ক স্কোয়ারও উদ্যান পথ নির্মাণের জন্য আমরা ছেড়ে দিয়েছি। সুতরাং আমাদের জনগণ অবসর বিনোদনের জন্যে উপযুক্ত উদ্যান ও বাগান পাচ্ছে, পাচ্ছে বিশুদ্ধ বাতাস, স্বচ্ছ ও সাবলীল আবহাওয়া। প্রত্যেকটি আমেরিকানই এই অধিকারে অধিকারী।

বন্ধুগণ। ফিলাডেলফিয়ার শুধুমাত্র একটি পরিষ্কার ও সুন্দর শহর নয়। একটি বিশ্বের বৃহত্তম কারখানা বলেও পরিচিত। এই শহরের ৯২০০টি শিল্প প্রতিষ্ঠানে ৪ লাখ লোক কর্মরত, তাই এটি আজ বিশ্বের করখানায় একশত হাজার ডলার মূল্যের ব্যবহার্য পণ্যাদি উৎপাদিত হয়। একজন খ্যাতনামা সংখ্যাতাত্বিকের হিসেব মতে ফিলাডেলফিয়া ছাড়া এই দেশের অন্য কোনো শহরে সমপরিমাণ উলের দ্রব্য, বস্ত্র, বয়ন শিল্প, ফেল্টহ্যাট, লৌহজাত দ্রব্য, টুলস, স্টোরেজ, ব্যাটারি, ইস্পাতের জাহাজ এবং অন্যান্য দ্রব্যাদি উৎপাদিত হয় না। রাতদিনের প্রতি দু’ঘণ্টায় আমরা একটি করে রেলের লোকোমোটিব ইঞ্জিন তৈরি করি, এবং এই দেশের জনতার অর্ধাংশের বেশি যে সব গাড়িতে চড়েন তা এই ফিলাডেলফিয়া শহরে নির্মিত। প্রতিমিনিটে আমরা হাজার-হাজার শ্লিপার উৎপাদন করি, গতবছর আমরা আমাদের ১১৫টি, হোসিয়ারী কারখানায় দেশের প্রতিটি পুরুষ, শিশুর জন্যে দু’জোড়া করে মোজা তৈরি করছি। আমাদের তৈরি কার্পেট ও কম্বলের পরিমাণ হচ্ছে গ্রেটব্রিটেন ও আয়ারল্যান্ডে উৎপাদিত পরিমাণের চেয়ে বেশি এবং আমাদের মোট বাণিজ্যিক ও শিল্প লেনদেন এত বেশি যে, গত বছর ব্যাঙ্ক সমূহে ৩৭ শত কোটি ডলার লেনদেন হয়েছে।

কিন্তু বন্ধুগণ, আমরা যেমন আমাদের শিল্প সমৃদ্ধির জন্যে গৌরবানুভব করি, তেমনি আমরা গৌরব বোধ করি আমাদের শহরটি চিকিৎসা, সাহিত্য ও শিক্ষা কেন্দ্র বলে। কিন্তু আমাদের সব চাইতে বেশি গৌরবের বিষয় হচ্ছে আমাদের শহরের গৃহসংস্থান ব্যবস্থা। আমাদের ফিলাডেলফিয়া শহরে তিন লাখ ১৭ হাজার আলাদা বাড়ি রয়েছে এবং এই বাড়িগুলোকে গড়ে ২৫ ফুট ধরে পাশাপাশি এক সারিতে দাঁড় করালে কানসাস শহরের এই সম্মেলন হল অতিক্রম করে ১৮১ মাইল দূরে অবস্থিত ডেনভার শহর পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছবে।

কিন্তু যে বিষয়টির প্রতি আমি আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই সেটি হচ্ছে এই শহরে হাজার হাজার ঘরের মালিক শ্রমিক শ্রেণী। সুতরাং তারা সমাজতন্ত্র বা বলশেভিজমের মতো আমাদানি করা রোগে আক্রান্ত নয় এবং কখনো আক্রান্ত হবে না।

ফিলাডেলফিয়া ইউরোপীয় নৈরাজ্যের উপযুক্ত স্থান নয়। কেননা, আমাদের গৃহ, আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং আমাদের বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠান প্রকৃত আমেরিকান উদ্দীপনার কেন্দ্রস্থল; কারণ এই শহরেই এই জাতির জন্ম এবং অমরা সেই আমেরিকানদেরই উত্তরাধিকারি। ফিলাডেলফিয়া এই মহান দেশের আমেরিকান স্বাধীনতার ঝর্ণা এই শহর হতেই প্রবাহিত। এটি সে শহর যে শহরে প্রথম তৈরি হয় মার্কিন পতাকা, এটি সেই শহর যে শহরে যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেসের প্রথম অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়েছিল, এটি সেই শহর যেখান হতে উত্থিত হয়েছিল প্রথম স্বাধীনতার ধ্বনি, বেজেছিল স্বাধীনতার ঘণ্টা যা আজো লাখো লাখো জনতাকে, আমেরিকার পুরুষ নারী শিশু আবালবৃদ্ধবনিতাকে অনুপ্রাণিত করে। সুতরাং আমরা বিশ্বাস করি যে, আমাদের মিশন হচ্ছে পবিত্র মিশন, যা শুধুমাত্র কল্প পূজা নয়, আমেরিকান মূলনীতি প্রচার এবং স্বাধীনতার বাতি প্রজ্বলিত রাখা যাতে ওয়াশিংটন, লিংকন ও থিওডর রুজভেল্টর সরকার সকল মানুষের অনুপ্রেরণার উৎস হিসাবে টিকে থাকতে পারে, কিন্তু মানব সমাজকে করতে পারে অনুপ্রাণিত।

আসুন আমরা এই বক্তৃতা বিশ্লেষণ করি, আসুন আমরা দেখি কীভাবে এটি প্রণীত হয়েছিল। শ্রোতাদের উপর এটা কিরূপ প্রভাব বিস্তার করেছিল।

প্রথমে আমরা দেখবো শুরু এবং শেষ? এটি এমনভাবে শুরু করা হয় এবং শেষ করা হয় যা অন্যরা সহজে চিন্তা করতে পারে নি? বন্য হাঁস যেভাবে পাখায় ভর করে উড়ে চলে এবং আবহাওয়া পরিবর্তনে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে সাবলীল গতিতে উড়ে যায় এই বক্তৃতাটাও ঠিক সেভাবে শেষ করা হয়েছে, এতে কোথাও বাধা আসে নি।

এই বক্তব্যে নতুনত্ব আছে, ব্যক্তিত্ব আছে, তাঁর নিজ শহর সম্পর্কে কিছু বলেই বক্তৃতা শুরু করেন। যা অন্যান্য বক্তারা পারেন নি, তিনি বলেন যে, তাঁর শহরই সমগ্র জাতির জন্মস্থান।

তিনি বলেন যে, এটা সারা বিশ্বের বৃহত্তম এবং সুরন্দরতম শহরগুলোর একটি। কিন্তু এই দাবি সাধারণ, গতানুগতিক। সুতরাং এই বক্তব্যে অন্যের মন আকর্ষণ করে না, অন্যেকে প্রভাবিত করে না, বক্তা এটা জানতেন তাই তিনি শ্রোতাদের প্রভাবিত করার জন্যে ফিলাডেলফিয়ার আকার বর্ণনা কালে বলেন এই শহরটি মিলাউঁকি, রোস্টার, প্যারিস ও বার্লিনের সম্মিলিত আকারের সমান। এটি একটি বিশিষ্ট উদাহরণ, এটি আকর্ষণীয়। একটি বিশেষ উল্লেখ্য বিষয়। পৃষ্ঠাব্যাপী সংখ্যাতত্ত্ব যা করতে পারতো না, এই একটি বাক্য শ্রোতাদের প্রভাবিত করে।

পরবর্তী বিষয়টি হচ্ছে বক্তার ঘোষণা। তিনি বলেন ফিলাডেলফিয়া বিশ্বের কারখানা বলে সর্বত্র পরিচিত ”এতে অতিকথন আছে, তাই নয় কি?” এটা প্রপাগান্ডার মতো, তার সাথে তিনি পরবর্তী পয়েন্ট যোগ না করলে কোনো শ্রোতার মনেই প্রত্যয় জন্মাত না। সুতরাং তিনি ফিলাডেলফিয়ার উৎপাদিত পণ্যের হিসাব পেশ করেন। তিনি বলেন, উলের দ্রব্য, চামড়া জাত দ্রব্য, বস্ত্র, বয়ন শিল্প, ফেন্টহ্যাট, লৌহজাতদ্রব্য, টুলস, স্টোরেজ, ব্যাটারি, ইস্পাত, জাহাজ নির্মাণে ফিলাডেলফিয়া বিশ্বকে নেতৃত্ব দিচ্ছে।

পরবর্তী বিষয়গুলোও কি প্রপাগান্ডা? প্রচারণা? দিন রাতের প্রতি দুঘণ্টায় ফিলাডেলফিয়ায় একটি করে লোকামোটিভ ইঞ্জিন তৈরি হয় এবং প্রতি দেশের অর্ধেকের বেশি মানুষ এই শহরে তৈরি গাড়িতে চড়ে।

“এই তথ্য আমাদের জানা ছিল না, আমরা ভাবি, “গতকাল আমি যে গাড়িতে চড়েছি সেটিও সম্ভবত এই শহরে তৈরি, আমি কাল অনুসন্ধান করব, আমরা শহরে যে সব গাড়ি চলে সেগুলো কোথাকার তৈরি।”

“প্রতি মিনিটে হাজার সিগার।–এই দেশের প্রত্যেক পুরুষ, নারী শিশুর জন্যে দু’জোড়া করে মোজা।

এর দ্বারা আমরা আরো অভিভূত হই–আমার প্রিয় সিগার হয়তো ফিলাডেলফিয়ার প্রস্তুত আমার পায়ের মোজা হয়তো সেই শহরে তৈরি।

এরপর বক্তা কী করলেন। তিনি ফিলডেলফিয়ার সাইজ সম্পর্কে যে ধারণা দিয়েছিলেন সেই সাইজ বর্ণনায় ভুলে যাওয়া পয়েন্ট নিয়ে কী পুনরায় আলোচনা শুরু করলেন? না মোটেও না।

তিনি তার বক্তব্য পেশ কালে কোনো পয়েন্ট ফেলে গেলে পরবর্তী পয়েন্ট বলে আবার পূর্ববর্তী পয়েন্টে যাবেন, ভুলে যাওয়া বিষয় পুনরাবৃত্তি করবেন, তেমন বক্তা তিনি নন। এ জন্য আমরা এমন বক্তার কাছে কৃতজ্ঞ। যে বক্তা একটি বিষয় বলতে গিয়ে আর একটি বিষয় বলেন, বক্তব্য পেশকালে এগিয়ে আবার পিছনে ফিরে কোনো বিষয়ের পুনরাবৃত্তি করেন তিনি কখনো কি সহজ ভাবে শ্রোতা মন জয় করতে পারবেন? না পারেন না। তবুও বহু বক্তা এরূপ পুনরাবৃত্তি করেন। তার বলার পয়েন্টকে১,২,৩,৫ এভাবে বলে শেষ না করে ২৭, ৩৪, ১৯, ২ এভাবে এগিয়ে নেন, এটা ভালো বক্তব্য বা বক্তৃতা নয়। তার বক্তব্য হয় ২৭, ৩২,২৭, ১১, ২, ৩৪, ১৭,এইভাবে এলোমেলো যা শ্রোতার মনে প্রভাব বিস্তার করে না, মোহিত শ্রোতা হয় না উদ্দীপ্ত।

কিন্তু এই বক্তা নির্দিষ্ট নিয়মে নির্দিষ্ট গতিতে তার বক্তব্য পেশ করেন, কখনো পুনরাবৃত্তি করেন না, থামেন না, ডানে বা বামে হেলেন না। লোকোমোটিভের মতো সোজা পথেই তিনি বলে চলেন তার কথা।

তবে তাঁর বক্তৃতায় একটি দুর্বলতম পয়েন্ট প্রকাশ হয়ে পড়ে। তিনি বলেন, ফিলাডেলফিয়া এই দেশে একটি বৃহত্তম চিকিৎসা, সাহিত্য, ও শিক্ষাকেন্দ্র এটা বলে তিনি অন্য প্রসঙ্গে চলে যান, মাত্র বারোটি শব্দে একথাটি বলেন, কিন্তু ব্যাখ্যা করেন না। ৬৫টি বাক্যের মধ্যে মাত্র বারোটি বাক্য। সুতরাং এটি অস্পষ্ট। এর দ্বারা তার বক্তব্য প্রমাণিত হয় না। কেননা মানুষ এটার দ্বারা এই দাবির যৌক্তিকতা বুঝতে পারে না। তিনি এটির উপর এত অল্প সময় দেন যে, মনে হয়, তিনি নিজেও বিষয়ে নিঃসন্দেহ নন, সুতরাং তার এই কথায় কেহই প্রভাবিত হয় না, অনুপ্রণিত হয় না। অতঃপর তিনি কী করেন? ফিলাডেলফিয়া বিশ্বের কারখানা একথা প্রমাণ করার জন্যে তিনি যে যুক্ত দেখিয়েছেন সেরূপ যুক্তি দিলে তিনি এটা প্রমাণ করতে পারতেন। তিনি তা জানতেন। তিনি আরো জানতে যে, এই প্রতিযোগিতায় তার হাতে আর মাত্র পাঁচমিনিট সময় আছে। এর এক সেকেন্ডও বেশি নেই। সুতরাং তাকে হয়তো এই পয়েন্ট অস্পষ্ট রাখতে হবে নতুবা অন্য পয়েন্ট বাদ দিতে হবে।

বিশ্বের অন্যান্য শহর হতে ফিলাডেলফিয়ার ব্যক্তি মালিকানায় বাড়ির সংখ্যা অনেক বেশি, তিনি বলেন। তিনি কীভাবে তাঁর এই বক্তব্যকে যুক্তি গ্রাহ্য করেন? প্রথমত তিনি এর সংখ্যা বলেন ৩,৯৭,০০০, দ্বিতীয়ত তিনি বলেন, “এই ঘরগুলির প্রত্যেকটিকে ২৫ ফিট ধরে একটি এককে পর পর সাজালে তা ফিলাডেলফিয়া হতে এই কানসাস শহরের সম্মেলন কক্ষ অতিক্রম করে ১৮১ মাইল দূরে অবস্থিত ডেনভার শহরে পৌঁছবে।

তার শ্রোতারা সম্ভবত এই বাক্য শেষ হবার আগে তার দেয়া ঘরের সংখ্যা ভুলে গিয়েছিলেন। ভুলে যাওয়া অস্বাভাবিক নয়! সুতরাং তারা চিন্তা করছিলেন তাঁর শেষ বাক্য যা তাদের মনকে করেছিল মোহিত।

তাঁর বক্তব্য কখনো-কখনো অর্থহীন হয়ে পড়লেও তিনি আবার উস্কানিতে পরিণত করতে সক্ষম ছিলেন। তিনি বলেছেন, শ্রমিকেরাই এ সব বাড়ির মালিক, তারা ”আমদানি করা সমাজতন্ত্র বা বোলশেভিজমের শিকার নয়,“ “ফিলাডেলফিয়াই হচ্ছে আমেরিকার স্বাধীনতার প্রশ্রবণ” “স্বাধীনতা। ম্যাজিকের মতো শব্দ এটি। এই শব্দ উচ্চারিত হলে সকল মানুষই হয় উদ্দীপ্ত। উক্তিটা এমন একটি শব্দ, এমন একটি অনুভূতি, যার জন্যে প্রাণ দিয়েছে লাখোলাখো লোক। এই স্বাধীনতার ঐতিহাসিক ঘটনাবলির পুনরুল্লেখ করে তিনি যখন বলেন, “এটি সেই শহর যেখানে আমেরিকার পতাকা প্রথম নির্মিত হয়; এটি সেই শহর যেখানে যুক্তরাষ্ট্র সংগ্রেসের প্রথম অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। এটি সেই শহর যেখানে আমেরিকার স্বাধীনতার ঘোষণা পত্র স্বাক্ষরিত হয়। মুক্তি ঘন্টা, পবিত্র মিশন, আমেরিকার মূলমন্ত্র প্রচার, স্বাধীনতার স্পৃহাকে জাগ্রত রাখা, ওয়াশিংটন, লিংকন, থিওডোর রুজভেল্টের সরকারের আদর্শ ও অনুপ্রেরণা জনমনে করতে হবে সঞ্চারিত, এটা তখন চরমে পৌঁছে, শ্রোতারা হন বিমোহিত, উদ্দীপ্ত, অনুপ্রাণিত।

বক্তা তাঁর এই বক্তব্যটি আপনার মনের মাধুরী মিশিয়ে প্রণয়ন করেছিলেন এবং শ্রোতা সমীপে পেশকালেও তিনি তাতে মনপ্রাণ ঢেলে দিয়েছিলেন। এই কারণেই তার এই বক্তৃতা শ্রোতাদের কাছে অত্যন্ত হৃদয়গ্রাহী হয়। এতে অনেক দুর্বল পয়েন্ট, দুর্বল দিক থাকা সত্ত্বেও বক্তার বক্তৃতা পেশের কৌশল এটাকে একটি শ্রেষ্ঠ বক্তৃতায় পরিণত করে। এই বক্তৃতা শ্রোতাদের উদ্দীপ্ত করতে, অনুপ্রাণিত করতে, তন্ময় করতে, বিমোহিত করতে সক্ষম হয়। ফলে এই বক্তৃতা প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়, শিকাগো কাপ পুরস্কার লাভ করে।

ডক্টর কনওয়েল যেভাবে বক্তৃতা তৈরি করতেন :

বক্তৃতা প্রণয়নের কোনো ধরা বাঁধা নিয়ম কানুন প্রচলিত নেই, তা আমি আগে বলেছি। এর কোনো ডিজাইন বা স্কীম অথবা চার্ট নেই বা বক্তারা অনুসরণ করতে পারেন। তবু বিভিন্ন বক্তা যে সব নিয়ম অনুসরণ করেছেন তা অনুকরণ করলে কিছুটা উপকার হতে পারে।

খ্যাতনামা লেখক প্রয়াত ডক্টর রাসেল এইচ, কনওয়েল বক্তৃতা প্রণয়নে যে পদ্ধতি অনুসরণ করতেন এ প্রসঙ্গে তা বলছি। একদা তিনি আমাকে তার খ্যাতনামা বক্তৃতা প্রণয়নের রূপরেখা বলেন। তা নিম্নরূপ–

(১) তথ্য প্রকাশ করা।

(২) এর ভিত্তিতে যুক্তি প্রদর্শন।

(৩) অতঃপর কাজের জন্য আহ্বান জানানো।

বহুলোক এই পরিকল্পনাকে নিজেদের জীবনে অত্যন্ত ফলপ্রসু ও উপকারী বলে বর্ণনা করেছেন।

(১) যেটা ভুল সেটা প্রকাশ কর।

(২) এর প্রতিকারের পথ বল।

(৩) প্রতিকারে সহযোগিতা কামনা কর।

অথবা এটিকে অন্যভাবে বলা যায় :

(১) বর্তমানে এই অবস্থা বিদ্যমান যার প্রতিকার প্রয়োজন।

(২) আমরা এই বিষয়ে এই করতে চাই।

(৩) সুতরাং যেই কাজে সকলের সহযোগিতা প্রয়োজন।

এই কাঠামোকে নিম্নলিখিতভাবে গ্রহণ করা যায় :

(১) শ্রোতাদের নিজের বক্তব্যের প্রতি আকর্ষিত করুন।

(২) তাদের আস্থা অর্জন করুন।

(৩) তথ্য প্রকাশ করুন, আপনার প্রস্তাব সম্পর্কে তাদের অবহিত করুন।

(৪) তাদের প্রতি কাজের বা সহযোগিতার আবেদন করুন।

খ্যাতনামা ব্যক্তিরা কীভাবে বক্তৃতা তৈরি করতেন :

প্রাক্তন সিনেটর আলবাট জে, বেভারিজ ‘দি আর্ট অব পাবলিক স্পিকিং’ নামে একটি ক্ষুদ্র বই লিখেছেন। বইটি ছোট হলেও বক্তৃতা শেখার ব্যাপারে অত্যন্ত ফলপ্রসু। ”বক্তাকে তার বিষয়ে মাস্টার হতে হবে, বলেছেন এই খ্যাতনামা রাজনীতিক।“ এর অর্থ হচ্ছে এই যে সকল তথ্য সংগ্রহ করতে হবে, সাজাতে হবে, পর্যবেক্ষণ করতে হবে, হজম করতে হবে, শুধুমাত্র একদিকের তথ্য নহে বিষয়টির ভালোমন্দ সকল দিকের তথ্য নিয়েই এরূপ করতে হবে। নিশ্চিত হতে হবে যে, যা সংগ্রহ করা হয়েছে তা বাস্তব তথ্য, ধারণা প্রসূত তথ্য নয়, অথবা শোনা ঘটনা নয়। সত্যতা সম্পর্কে সুনিশ্চিত হতে হবে।

সুতরাং প্রতিটি আইটেম চেক করতে হবে। পরীক্ষা করে নিতে হবে। এর-অর্থ নিশ্চিত হবার জন্যে কষ্টকর গবেষণা কাজ চালাতে হবে। তা হলে এর থেকে কী পাওয়া যাবে? আপনি কী জনগণকে তথ্য প্রদান, নির্দেশ দান এবং উপদেশ দিতে যাচ্ছেন না? আপনি কী নিজেকে একজন কর্তৃপক্ষ বলে তাদের সামনে পেশ করতে চাচ্ছেন না?

যে কোনো সমস্যার তথ্যাদি নিয়ে পর-পর সাজান, এগুলো নিয়ে নিজে নিজে চিন্তা করে সমাধান বের করুন। তাহলে আপনার বক্তব্যে স্বকীয়তা থাকবে, শক্তি থাকবে। নিজস্ব চিন্তায় আপনার মনে যা উদয় হবে তাই সাজিয়ে লিখে নিন, এই স্বকীয় বক্তব্য হবে শক্তিশালী আকর্ষণীয় বক্তৃতা।

অন্য কথায়, উভয় দিকের তথ্য তুলে ধরুন। অতঃপর সমস্যাদির সমাধান সম্পর্কে নিজ চিন্তা প্রসূত বক্তব্য পেশ করুন।

‘আমি শুরু করি’, বলেছেন উড্র উইলসন, তার অনুসৃত পদ্ধতি সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হয়ে, কতগুলো বিষয়ের তালিকা নিয়ে, সেগুলো সম্পর্কে আমি বলতে চাই, এবং আমি সেগুলোকে তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক অনুযায়ী আমার মনের মধ্যে পর-পর সাজিয়ে নিই। অর্থাৎ আমি বিষয়গুলোকে এমনভাবে সাজিয়ে নিই যাতে একটার সাথে অন্যটার বিষয়বস্তুগুলোর অমিল বা বৈসাদৃশ্য না হয়। অতঃপর আমি সেগুলো সঁট লিপিতে চিট করে নেই। আমি সঁট লিপিতে চিট করতে অভ্যস্ত। কেননা এতে সময়ের অপচয় হয় না। অতঃপর আমি এগুলো টাইপ করে নেই। প্রবচন বদলাই, বাক্য শুদ্ধ করি, চিন্তা করে করে নতুন নতুন বিষয় যোগ করি।

থিওডর রুজভেন্ট রুজভেলিটান পদ্ধতিতেই তার বক্তৃতা প্রস্তুত করতেন। তিনি সকল তথ্য সংগ্রহ করতেন, অতঃপর তা পর্যালোচনা করতেন, পর্যবেক্ষণ করতেন, ব্যাখ্যা করতেন, পরিশেষে তিনি বিষয়টি নিয়ে উপসংহারে উপনীত হতেন, চূড়ান্তভাবে বিষয়টির মীমাংসা করে নিতেন।

অতঃপর চিট সমূহ সামনে নিয়ে বসে তিনি তাঁর বক্তৃতার ডিকটেশান এত দ্রুত দিতেন যে, তিনি মনে করতেন ডিকটেশন দ্রুত হলে তার বক্তব্য হবে স্বতঃস্ফুর্ত ও জীবন্ত।

অতঃপর তিনি টাইপ কপি নিয়ে তা সংশোধন সংযোজন করতেন, কখনো নতুন শব্দ বাক্য যোগ করতেন, বাদ দিতেন। পেন্সিলের দাগে পৃষ্ঠা পূর্ণ হয়ে গেলে তিনি আবার তা ডিকটেট করতেন। কঠোর পরিশ্রম ছাড়া আমি কখনো কিছু লাভ করি নি, বলেছেন থিওডর রুজভেন্ট, ‘পরিকল্পনা প্রণয়ন বা বক্তৃতা প্রণয়ন সব কাজেই আমি সব সময় কঠোর পরিশ্রম করি। তা অনেক আগে থেকেই আমি কাজ শুরু করি।”

অনেক সময় তিনি সমালোচকদের ডেকে পাঠাতেন এবং তারে কাছে তাঁর বক্তব্য পাঠ করতেন, কিন্তু তার সম্পর্কে কোনোরূপ বিতর্কে অংশ নিতেন না।

কারণ তিনি তাঁর বক্তব্য সম্পন্ধে মন স্থির করে নিয়েছেন, তিনি কী বলবেন সে সম্পর্কে কোনো পরামর্শ চাইতেন না, কীভাবে বলবেন সে সম্পর্কেই পরামর্শ চাইতেন। টাইপ করা অনুলিপি তিনি বার বার পড়তেন, কাটতেন, শুদ্ধ করতেন, উন্নত করতেন, এই বক্তব্য সংবাদপত্রে ছাপা হত। অবশ্য তিনি তার এই বক্তব্য মুখস্থ করতেন না। তিনি মৌখিকভাবেই বক্তৃতা করতেন। সুতরাং তিনি যে বক্তৃতা দিতেন যা সংবাদ পত্রের প্রকাশিত হত সময়-সময় তার মধ্যে তারতম্য দেখা দিত। কিন্তু ডিক্টেট করা ও সংশোধন করার মধ্যে যে প্রস্তুতি চলতো তা উত্তম প্রস্তুতি। এর ফলে বিষয়বস্তু তার কাছে পরিচিত হয়ে যেত, তার প্রতিটি পয়েন্ট পর পর তিনি স্মরণ রাখতে পারেন। এরই ফলে তিনি তার বক্তব্য সহজে সচ্ছল গতিতে প্রকাশ করতে সক্ষম হতেন।

স্যার অলিভার লজ আমাকে বলেছেন যে, তাঁর বক্তব্য ডিক্টেট করে দ্রুতগতিতে যেভাবে তিনি জনসমক্ষে ভাষণ দেন ঠিক সে পদ্ধতিতে অর্থাৎ সেরূপ স্বরে ডিক্টেট করে তিনি উপলব্ধি করেছেন এটাই হচ্ছে বক্তৃতা প্রস্তুতি অভ্যাসের সর্বোত্তম পন্থা।

বক্তৃতা কোর্সে বহু সংখ্যক ছাত্র ডিক্টাফোনে তাদের বক্তৃতা ডিক্টেট করাকে উজ্জ্বলতম পন্থা বলে উপলব্ধি করে, কেননা এর ফলে তারা তাদের বক্তৃতা আবার নিজেরা শুনতে পায়। সংশোধন করে নিতে পারে। সুতরাং এই পদ্ধতিকে আমিও গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি মনে করি।

আপনি যা বলতে চান তা লিখতে বসলে বিষয়টি সম্পর্কে আপনি চিন্তা করতে বাধ্য হবেন। ফলে আপনার ধারণা আরো পরিষ্কার হবে, স্মরণ থাকবে। আপনার মনের অস্থিরতা কমবে, আপনার চিন্তা ও বলার শক্তি বাড়বে।

বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন তার আত্মজীবনীতে কীভাবে তিনি তার রচনাশৈলী, শব্দচয়ন এবং চিন্তাধারাকে সুসজ্জিত সুবিন্যস্ত করতেন তার ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁর জীবনের এই কাহিনী পাণ্ডিত্য সাহিত্যপূর্ণ যা অন্যান্য প্রাচীন পাণ্ডিত্যপূর্ণ সাহিত্য কর্মের মতোই সুখপাঠ্য উপভোগ্য। তার এই লেখা অত্যন্ত উন্নতমানের ভাষা ও শব্দ সমৃদ্ধ। যে কোনো হবু লেখক ও বক্তা এটা পড়ে আনন্দ পাবেন, উপকৃত হবেন। আমার মনে হয়, আপনি এটি পড়তে আগ্রহী হবেন, এটি হচ্ছে :

এই সময়ে প্রাচীন পুঁথি স্পেকটেটরের একটি অদ্ভুত খণ্ড আমার হাতে পড়ে। এটি ছিল তৃতীয় খণ্ড। আমি এর আগে বইটির কোনো সংখ্যা দেখি নি। আমি এটি ক্রয় করি এবং বার-বার পড়ে আনন্দ পাই। এর ভাষা ছিল অত্যন্ত আকর্ষণীয়, আমি ভাষার সাথে নিজেকে পরিচিত করতে আগ্রহী হই। এই উদ্দেশ্যে আমি কাগজপত্র নিই, এই বইতে ব্যবহৃত বিভিন্ন বাক্য সম্পর্কে চিট করতে শুরু করি, কয়েকদিন পর আমি বইটি থেকে নিজের ভাষায় বইটিতে ব্যবহৃত ভাব প্রকাশ করি। এই রচনায় আমার কলমে আনা সব শব্দ আমি ব্যবহার করি। অতঃপর আমি আমার লেখা মূল রচনার সাথে মিলিয়ে নিই, কতিপয় স্থানে আমার ভুল ধরা পড়লে আমি তা সংশোধন করি। এই কাজ করতে গিয়ে কতিপয় নতুন শব্দের সাথে আমার পরিচয় হয় যা আমি স্বচ্ছন্দে ব্যবহার করতে সক্ষম হই। এই আগে আমি কোনো কিছু রচনার কাজে হাত দিলে অবশ্যই আমি এ ধরনের নতুন শব্দের সাথে পরিচিত হতে পারতাম, কিন্তু এক বই অনুসরণ ছাড়া অন্য কিছু রচনা করলে এভাবে তা ব্যবহার করা সম্ভব হয় না। এই ঘটনার পর আমি বইটি হতে কতিপয় গল্প সংগ্রহ করি। একই পদ্ধতিতে সেগুলি সম্পর্কে নোট করি। অতঃপর তা নিজের ভাষায় রচনা করি, মূল গল্পের সাথে মিলিয়ে সংশোধন করি। এর ফলে আমি আমার চিন্তাকে স্বচ্ছন্দ গতিতে সাজাবার কৌশল শিখতে পারি। এই পদ্ধতি কিছুদিন অব্যাহতভাবে অনুসরণ করার ফলে আমার ভাষাজ্ঞান উন্নত হয়। আমার ভাষা হয় স্বচ্ছন্দ সাবলীল। ফলে আমি ইংরেজি ভাষার একজন উঁচুদরের না হলেও গ্রহণযোগ্য লেখক হয়ে উঠি এবং আকাঙ্ক্ষা ছিল একজন লেখক হওয়া। ধৈর্যের সাথে নিজের নোট পরীক্ষা করুন : আগের পরিচ্ছেদ আপনাকে নোট করতে উপশে দেয়া হয়েছে। আপনার বিভিন্নমুখী ধ্যান ধারণা নোট করার পর সেসব নোট একত্রিত করে ধৈর্যের সাথে তা পরীক্ষা করুন। বিভিন্ন নোটের সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলি পরপর সাজান। একটি বিষয়ে আপনার মনের যে সব চিন্তা আপনি নোট করেছেন, পারস্পরিক সম্পর্কে যুক্ত পয়েন্টগুলি আপনি পর-পর সাজান, অতঃপর সেগুলি আবার ছোট-ছোট করে নিন, কিছু বাদ দিন, চিন্তা করুন, ফলে আরো কিছু আপনি যোগ করতে পারবেন, যত চিন্তা করবেন তত আপনার মনে নতুন ধারণা আসবে তা নোট করুন, পূর্ণ নোটের সাথে মিলিয়ে তা লিপিবদ্ধ করুন, ফলে আপনার রচনা প্রস্তুত হয়ে যাবে, আপনার বক্তৃতা তৈরি হয়ে যাবে।

একজন বক্তাকে জনসমক্ষে তার বক্তৃতা দেয়ার আগপর্যন্ত এরূপভাবে চিন্তা করতে হবে, নোট করতে হবে, নোট ভিত্তিতে বহু রচনা তৈরি করতে হবে, রচনা তৈরির কালে সংশোধন সংযোজন করতে হবে, ফলে বক্তব্য হবে অর্থবহ, বাক্য হবে সরস, ভাষা হবে প্রাঞ্জল, বলার গতি হবে সাবলীল, প্রকাশ ভঙ্গি হবে অবাধ।

একজন ভালো বক্তা বা সুবক্তা তাঁর বক্তব্য পেশের পর বক্তব্যের চারটি অর্থ বা চারটি দিক খুঁজে পান। সেগুলো হচ্ছে-(১) যে বক্তব্য পেশ করেছিলেন (২) যা জনসমক্ষে বলেছেন (৩) সংবাদপত্রে যা প্রকাশিত হয়েছে এবং (৪) বক্তৃতা শেষে তিনি তার বক্তৃতার অসম্পূর্ণতা সম্পর্কে বা ভাবছেন এবং মনে করেছেন যে তার আরো কিছু বলার ছিল। সুতরাং একই বিষয়ে বক্তৃতা করতে হলে সুবক্তার বক্তব্য দ্বিতীয় বারে আরো ভালো হয়।

বক্তব্য পেশকালে আমি কি চিট ব্যবহার করব?

উপস্থিত বক্তৃতা সক্ষম একজন সুবক্তা হওয়া সত্ত্বেও প্রেসিডেন্ট লিংকন হোয়াইট হাউসে প্রবেশের পর কখনো পূর্ব প্রস্তুতি, যথাযথ নোট ও লেখা ছাড়া কোনো ভাষণ দান করেন নি। এবং এমনকি মন্ত্রী সভায় ঘরোয়াভাবে কোনো আলোচনায়ও অংশ নেন নি। তবে অবশ্য তিনি তার উদ্বোধনী ভাষণ দিয়েছিলেন প্রস্তুতি ছাড়া। কিন্তু এর আগে ইলিয়নয়সে বক্তৃতা প্রদানকালে তিনি কখনো তেমন প্রস্তুতি নিতেন না, সাহায্য নিতেন না টিট এর। এ পদ্ধতি শ্রোতাকে সব সময় শ্রান্ত করে, কখনো বা বিভ্রান্ত করে; একদা তিনি মন্তব্য করেছিলেন।

নোট করুন। প্রস্তুতিকালে এই নোট বক্তব্যকে সঠিক করবে, পুর্ণাঙ্গ করবে। আপনার পকেটে নোট থাকলে শ্রোতার সামনে দাঁড়িয়ে বক্তব্য পেশকালে কোনো পয়েন্ট বিস্মৃত হলেও আপনি বিমূঢ় হবেন না, তবে একেবারে বিপদে পতিত না হলে, অবর্ণনীয় দুর্দশায় পতিত না হলে, সম্পূর্ণরূপে বিপজ্জনক পরিস্থিতির সম্মুখীন না হলে এগুলো বের করবেন না। হাতুড়, করাতি, কুড়াল প্রভৃতি অস্ত্র মানুষ ব্যবহার করে নিতান্ত প্রয়োজনে এবং আপনিও এ সব নোট জরুরি অবস্থায় সাহায্যের জন্যে পকেটে রাখবেন। স্মরণ রাখবেন, এগুলি জরুরি অবস্থার জন্যে প্রয়োজনীয় অস্ত্র।

যা হোক, নোট সম্পর্কে যত কিছুই বলা হোক না কেন, নোট ব্যবহার পদ্ধতি নির্ভর করছে আপনার জ্ঞানের ওপর। কিছু বক্তা এমন আছেন যারা পূর্ণ প্রস্তুতি সত্ত্বেও বক্তৃতার প্রারম্ভে কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে পড়েন, বক্তব্য বিষয় ভুলে যান, ফলে তাঁর শেখা বিষয় ছেড়ে বক্তৃতা শুরু করে আবোল তাবোল বলতে শুরু করেন এসব বক্তার জন্যে পকেটে কিছু নোট রাখা অবশ্য প্রয়োজন। শিশু প্রথম হাঁটতে শিখলে কোনো কিছু ধরে হাঁটে, কিছুদিনপর তাকে আর কিছুর সাহায্য নিতে হয় না, স্বাধীনভাবে হাঁটতে পারে। এমন বক্তা প্রথম অবস্থায় নোটের সাহায্য নিলে পরে সাধারণভাবে বক্তৃতা করতে সক্ষম হন।

জেনারেল গ্রান্টের বিমূঢ়তা :

লি যখন জেনারেল গ্রান্টকে আত্মসমর্পণের দলিল লেখার অনুরোধ জানান তখন ইউনিয়ন বাহিনী প্রধান জেনারেল পার্কারের কাছে গিয়ে লেখার বিষয় জানতে চান। জেনারেল গ্রান্ট তাঁর স্মৃতিতে লিখেছেন, “কাগজে আমি কলম বসাই, কিন্তু আত্মসমর্পণের শর্ত আমার থাকলেও প্রথমে কী শব্দ ব্যবহার করতে হবে তা আমার জানা ছিল না। আমার মনে যা ছিল আমি শুধু তাই জানতাম এবং তা প্রকাশ করাও আমার পক্ষে সহজ ছিল।”

জেনারেল গ্রান্ট, আপনার জন্যে প্রথম কিছু জানার কোনো প্রয়োজন ছিল না। আপনার বিষয়টি সম্পর্কে ধারণা ছিল, বিশ্বাস ছিল, আপনি কী বলতে চান তা আপনার মনে পরিষ্কার ছিল। অর্থাৎ আত্মসমর্পণ সম্পর্কে আপনার মনে যে ধারণা ছিল, বিশ্বাস ছিল তা আপনি স্বচ্ছন্দে প্রকাশ করতে সক্ষম ছিলেন শুধু মাত্র প্রথম শব্দটি ব্যবহার ছাড়া। এটা যে কোনো লোকের জন্যই শুভ লক্ষণ। আপনি যদি এতে সন্দেহ করেন, তা হলে যে কোনো লোককে লাথি মেরে ফেলে দিন, দেখবেন সে উঠতে পারলে আপনাকে কিছু বলতে পারবে না, ভাষা আসবে না। প্রথম শব্দ ব্যবহার করতে না পারাও অনুরূপ ঘটনা।

দুই হাজার বছর আগে হোরাম লিখেছেন,
শব্দ নয়, অনুসন্ধান করা তথ্যও যুক্তি
চিন্তা স্বচ্ছ হলে শব্দ পাবে স্বাভাবিক মুক্তি।

আপনার মনে আপনার ধারণা বদ্ধমূল হলে আপনি আপনার বক্তৃতা প্রথম হতে শেষ পর্যন্ত মহলা দিন। নীরবে করুন নিভৃতে করুন, মনে করুন পানাহারকালে, রাস্তায় চলাফেরার সময়, কোনো ব্যক্তির জন্যে অপেক্ষা করার সময় নীরবে নিভৃতে মহলা দিন। অতঃপর কোনো একটি নির্জন ঘরে একাকী বসে, কাজ করে, এই মহলা দিন। এতে শক্তি প্রয়োগ করুন, বক্তব্য পেশকালে যেরূপ অনুভব করবেন তার মহলা দিন। ক্যান্টার নগরে ক্যানন নক্স লিটল বলতেন, একজন ধর্মপ্রচারক যে ধর্মবিষয়ক বক্তৃতা দেন জনসমক্ষে প্রচারের আগে তিনি তা নিজে অন্তত, অর্ধ ডজন বার মহলা না দিলে তা জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হয় না। আপনার বক্তব্য আপনি বার-বার নিজে মহলা না দিয়ে জনসমক্ষে পেশ করলে হৃদয়গ্রাহী এবং গ্রহণযোগ্য হবে বলে কি আপনি মনে করেন? অভ্যাস কালে, মহলা কালে আপনি মনে করুন আপনার সামনে শ্রোতা আছে। এরূপ কল্পনা করলে মহলা সঠিকভাবে হবে এবং পরবর্তীকালেও কোনো অসুবিধা হবে না।

জোতদারেরা লিংকনকে ‘অলস’ মনে করতেন কেন?

আপনি এভাবে আপনার বক্তৃতা অভ্যাস করলে আপনার দ্বারা খ্যাতনামা বক্তাদের অনুসৃত পথ অনুসরণ করা হবে। লয়েড জর্জ যখন তাঁর নিজ শহর ওলেস্ এর একটি বিতর্ক ক্লাবের সদস্য ছিলেন তখন তিনি অনেক সময় রাস্তায় গিয়ে গাছপালার সামনে গিয়ে বক্তৃতা করে বক্তৃতার মহলা দিতেন।

লিংকন তাঁর প্রথম ব্রেকেন রিজের মতো খ্যাতনামা বক্তাদের বক্তৃতা শোনার জন্যে ৩০ অথবা ৪০ মাইল দূরে চলে যেতেন। বক্তৃতা শুনে এত অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি নিজ কর্মস্থলে ফিরে আসতেন যে, মাঠে তিনি অন্যান্য শ্রমিকদের ডেকে তাদের সামনে বক্তৃতা দিতে শুরু করতেন। ভবিষ্যতে একজন সুবক্তা হবার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা নিয়ে তিনি মাঠে-মাঠে বক্তৃতা করতেন, গল্প বলতেন। এতে তার প্রভু তাঁর উপর সাংঘাতিক অসন্তুষ্ট হতেন এবং বলতেন যে, লিংকন অসম্ভব অলস। তাই সে বক্তৃতা করে বেড়াতে চায় এবং এর ফলে অন্যান্য শ্রমিকেরাও অলস হয়ে পড়ছে।

আসকুইথ প্রথমে অক্সফোর্ডের একটি বিতর্ক ক্লাবে যোগ দেন। এর পরে তিনি নিজেও একটি বিতর্ক সমিতি প্রতিষ্ঠা করেন। উড্র উইলসন একটি বিতর্ক ক্লাবে বক্তৃতা শেখেন। হেনরী ওয়ার্ড বেকারও অনুরূপভাবে বক্তৃতা শিখেছিলেন। সুবক্তা বার্ক ও একইভাবে বক্তৃতা শিখেছিলেন। একই পদ্ধতি অনুসরণ করেছিলেন এ্যান্টানিটা ব্লাকয়েল ও লুস স্টোন। ইলিহুরুট বক্তৃতা শিখেছিলেন নিউইয়র্কের ২৩শতম সড়কের ওয়াই এস সি এর সাহিত্য সমিতিতে।

খ্যাতনামা বক্তাদের জীবনী আলোচনা করুন, একটি বিষয় আপনি সবার মধ্যে সাধারণ দেখবেন। সেটা হচ্ছে, বক্তৃতা শেখা, অভ্যাস করা, মহলা দেয়া। যারা যত বেশি অভ্যাস করেছেন তাঁরা তত তাড়াতাড়ি সাফল্য অর্জন করেছেন।

এর জন্যে কি কোনো সময় প্রয়োজন হয়? জোসেফ সোয়াটে কী পদ্ধতি অনুসরণ করতেন? তিনি সকাল বেলায় একটি সংবাদপত্র কিনতেন। কাজের অবসরে তার একটি নির্দিষ্ট খবর ঠিক করে নিতেন। অতঃপর কাজ শেষ করে সেই বিষয়টি নির্ভর করে বক্তৃতা তৈরি করতেন।

চাউন্সে এম. ডেপু ছিলেন শ্রমিক নেতা এবং মার্কিন সিনেটর। তিনি প্রতি রাতেই একটি করে বক্তৃতা প্রস্তুত করতেন। ”আমি কাউকে আমার কাজে হস্তক্ষেপ করতে দিই না,“ বলেছেন তিনি। ”আমার কর্মশেষে আমি অফিস হতে ঘরে ফিরি এবং রাতে বক্তৃতা প্রস্তুত করি।”

প্রতিদিন আমরা আমাদের নিজেরদের হাতে কয়েক ঘণ্টা সময় পাই, সে সময়টি আমরা আমাদের ইচ্ছানুযায়ী কাজে লাগাতে পারি। শরীর রোগা ছিল বলে ডারউইন ঠিক এভাবে কাজ করতেন। দিনের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে মাত্র তিন ঘণ্টা করে কাজ করে তিনি এত খ্যাত হয়েছেন।

থিউডর রুজভেল্ট প্রেসিডেন্ট থাকাকালে প্রতিদিন পূর্বাহ্নে তিনি হোয়াইট হাউসে বসে পাঁচ মিনিট করে সাক্ষাৎকার দিতেন। এই সময়েও তার সাথে বই থাকতো। একব্যক্তি বা দল নিষ্ক্রান্ত হলে অপর ব্যক্তি বা দল আসতে যে কয়েক সেকেন্ড সময় লাগবে তাও যাতে ব্যর্থ না হয় এই উদ্দেশ্যে তিনি বই রাখতেন।

আপনি যদি ব্যস্ত ব্যক্তি হন এবং আপনার অপচয় করার মতো যদি সময় না থাকে তাহলে আপনি অর্কনেড ব্যানেট এর লেখা বই ”দিনের ২৪টি ঘন্টা কাটানোর উপায়” পড়ুন। আপনি কাজের ফাঁকে যে কয়েকটি মুহূর্ত সময় পাবেন সে মুহূর্তগুলিতে তা পড়ুন। এইভাবে মাত্র ছ’দিনে আমি বইটি পড়ে শেষ করেছি। তা হলে আপনি বুঝতে পারবেন, কীভাবে সময় বাঁচানো যায়। কীভাবে অবসর সময় কাজে লাগিয়ে আরো লাভবান হওয়া যায়।

আপনি ব্যস্ত ব্যক্তি। কাজ থাকলেও আপনার অবসর প্রয়োজন। এই অবসর সময়ে ঘরে বসে আপনি আপনার পরিবারের সদস্যদের সাথে কথা বললেও অনেক কিছু শিখতে পারবেন, যা আপনাকে আপনার বক্তৃতা প্রস্তুতিতে সাহায্য করতে পারে, আপনার বক্তব্যের সহায়ক হতে পারে।

সংক্ষিপ্তসার :

১। ”যুদ্ধের কৌশল”, বলেছেন নেপোলিয়ন, “একটি বিজ্ঞান, সুচিন্তিতভাবে হিসাব করে না-গেলে তাতে সফল হওয়া যায় না”। শিকার করার ক্ষেত্রেও এটি অনুরপ সত্য। বক্তৃতা একটি সমুদ্র যাত্রা বিশেষ সুতরাং এটি নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন। যে বক্তৃতার শুরুর ঠিক থাকে না, সাধারণত তার সমাপ্তিরও কোনো ঠিকানা পাওয়া যায় না।

২। মনের ধ্যান ধারণাকে সঠিকভাবে সাজানো এবং বক্তৃতা প্রণয়ন করার প্রচলিত কোনো আইন কানুন বা বিধি নেই। প্রতিটি বক্তৃতায় থাকে আলাদা-আলাদা সমস্যা।

৩। একজন যখন বক্তৃতা করেন তখন তাঁর বক্তব্যের বিশেষ একটি পয়েন্ট একবারেই ব্যাখ্যা করা উচিত। বক্তৃতাকালে দ্বিতীয় দফে এটির পুনরুল্লেখ ঠিক নয়। এই প্রসঙ্গে ফিলাডেলফিয়ার সংক্ষিপ্ত ভাষণটি উল্লেখ করা যায়। কোনো বক্তৃতায় কোনো বিশেষ পয়েন্টের পুনরুক্তি এবং একবার সামনে একবার পেছনে যাওয়া উচিত নয়।

৪। মৃত ডা. কনওয়ের্ক নিম্ন পরিকল্পনা ভিত্তিতে ভাষণ প্রস্তুত করতেন;

ক। তথ্য প্রকাশ করা।

খ। এর উপর বিতর্ক।

গ। কাজের জন্য আবেদন করুন।

৫। নিম্ন পরিকল্পনা আপনার জন্যে সহায়ক হতে পারে।

ক। ভুল দিকটি তুলে ধরুন।

খ। কীভাবে সংশোধন করা যায় তা বলুন।

গ। কাজের জন্যে আবেদন করুন।

৬। নিম্নটি হচ্ছে একটি উল্লেখযোগ্য পরিকল্পনা :

ক। শ্রোতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করুন।

খ। আস্থা অর্জন করুন।

গ। আপনার তথ্য বর্ণনা করুন।

ঘ। অতঃপর তাদের প্রতি কাজের আহ্বান জানান।

৭। ”আপনার বিষয়ের উভয় দিকের তথ্যাদি বলেছেন প্রাক্তন সিনেটর আলবার্ট জে বেভারিজ, “সংগ্রহ করতে হবে, সাজাতে হবে পর্যালোচনা করতে হবে, হজম করতে হবে। নিশ্চিত হোন যে এসব তথ্য সত্য। অতঃপর এগুলোর উপর চিন্তা করে সমাধানের চেষ্টা করুন।”

৮। বক্তৃতা করার আগেই উপসংহার সম্পর্কে লিংকন যে চিন্তা করে নিতেন তা হত গণিতের হিসাব। চল্লিশ বছর বয়সে যখন তিনি কংগ্রেস সদস্য হন তখন তিনি এই উপসংহার সঠিকভাবে নির্ধারণের জন্যে ইউক্সীড় অধ্যয়ন করেন।

৯। থিউডর রুজভেল্ট যখন কোনো বক্তব্য প্রস্তুত করতেন তখন তিনি চিট ভিত্তিতে অত্যন্ত দ্রুত গতিতে তা ডিক্টেট করতেন, টাইপ অনুলিপি আবার সংকলন সংযোজন করে আবার ডিক্টেট করে নিতেন।

১০। সম্ভব হলে আপনার বক্তব্য পিক্টাফোনে ডিক্টেট করুন এবং নিজে শুনে নিন।

১১। নোট অনেক সময় বক্তৃতা শেখার আগ্রহ নষ্ট করে দেয়। সুতরাং আপনার প্রবণতা যদি সব সময় নোট দেখে বলার প্রতি ঝুঁকে থাকে তা হলে নোট করা পরিত্যাগ করুন। লিখিত বক্তৃতার প্রতি শ্রোতা তেমন আকর্ষিত হয় না সুতরাং যথা সম্ভব লিখিত বক্তৃতা পরিহার করে চলুন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *