০২. প্রস্তুতির মাধ্যমে আত্মবিশ্বাস

০২. প্রস্তুতির মাধ্যমে আত্মবিশ্বাস

।প্রতি বছর গড়ে ছয় হাজার বক্তৃতা শোনা ও তার সমালোচনা করা এই গ্রন্থকারের পেশাগত দায়িত্ব এবং আনন্দ। ১৯১২ সাল থেকেই তিনি এটা করে আসছেন। এ সব বক্তৃতা কলেজ ছাত্রদের নয়, বয়স্ক ব্যবসায়ী ও পেশাগত ব্যক্তিদের। সমালোচনা কালে তিনি এসব বক্তৃতার রচনা পদ্ধতি, সুস্পষ্ট ও পরিষ্কার বক্তব্য, যে কথা অন্যদের অনুপ্রাণিত করে, যাতে একটি বিষয় প্রকাশে কোনো গুরুত্বপূর্ণ দিকই অপ্রকাশিত না থাকে, তার কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, আপনার মনের ভাব ভাষা এমনভাবে প্রকাশ করতে হবে যাতে শ্রোতার মন ও হৃদয় আপনার বক্তব্যের প্রতি আকৃষ্ট হয়। শ্রোতার মনের উপর প্রভাব সৃষ্টিই বক্তৃতার সাফল্য।

যখন কোনো বক্তা শ্রোতার মনে প্রভাব সৃষ্টির লক্ষ্য সামনে রেখে বক্তৃতা শুরু করেন, তখন তাঁকে এটা বুঝতে হবে যে, বক্তব্য হতে হবে তাৎপর্যবহ। সুপ্রস্তুত বক্তৃতার প্রস্তুতিতেই দেশের দশভাগের নয় ভাগ কাজ সম্পন্ন হয়ে যায়।

অধিকাংশ ব্যক্তি কেন এই প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে চায় তা প্রথম পরিচ্ছেদে উল্লেখ করা হয়েছে। এই প্রশিক্ষণ গ্রহণের প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে আত্মবিশ্বাস, সাহস ও আত্মপ্রত্যয় লাভ। কথিকা বা বক্তব্য প্রস্তুত না করাই হচ্ছে বক্তৃতার জন্যে মৌলিক ভুল। ভেজা বারুদ ও খালি শেজ নিয়ে অথবা কোনোরূপ অস্ত্রশস্ত্র ছাড়া যুদ্ধ ক্ষেত্রে গিয়ে সৈন্যদলের পক্ষে কি শত্রুর মোকাবেলা করা সম্ভব? একই ভাবে প্রস্তুতি না নিয়ে ভয় ভীতি ও স্নায়বিক দুর্বলতা জয় করা সম্ভব হতে পারে না। স্মরণ রাখতে হবে যে, যখন শ্রোতাদের সামনে দাঁড়ান তখন তিনি আর নিজ বাড়িতে নন। “আমি বিশ্বাস করি” লিংকন হোয়াইট হাউসে বলেছেন “আমি কখনো সংশয় মুক্ত মনে সব কিছু বলে শেষ করতে পারবো না।”

আপনি যদি আত্মবিশ্বাস লাভ করতে চান তা হলে কেন এই আত্মবিশ্বাস লাভের কাজ করেন না? ”প্রকৃত ভালবাসা” লিখেছেন আপোসেল জন ”ভীতি বিতাড়িত করে।“ প্রকৃত প্রস্তুতিও একই কাজ করে। ওয়েরেনটার লিখেছেন তিনি যখন শ্রোতাদের সামনে যাবার কথা ভাবেন তখন তার মনে হয় তিনি অর্ধ উলঙ্গ ও অপ্রস্তুত হয়ে উঠেছেন।

কেন আমরা আমাদের বক্তব্য অধিকতর যত্নসহকার প্রস্তুত করি না? কেন? কেহ কেহ কী প্রস্তুত কীভাবে পরিষ্কার কি তা বুঝতে পারেন না এবং কীভাবে দক্ষতার সাথে প্রস্তুতি গ্রহণ করতে পারেন তাও বুঝে না। অন্যরা সময়াভাবের কথা বলেন। সুতরাং অত্র অধ্যায়ে আমরা এই বিষয়টি বিস্তারিত ভাবে আলোচনা করব।

প্রস্তুতির সঠিক পথ :

প্রস্তুতি কী? বই পড়া। এটি একটি পথ, তবে শ্রেষ্ঠতম পথ নয়। বই পড়া প্রস্তুতিতে সহায়তা করবে, কিন্তু কোনো বক্তা যদি শুধু বই পড়ে, বইতে যাহা আছে সরাসরি বই এর ভাষায় তা পেশ করেন, তা হলে শ্রোতারা সন্তুষ্ট হয় না। সরাসরি বুঝতে না পারলেও তারা একটা কিছুর অভাব অনুভব করেন। বক্তার বক্তব্যে কিসের অভাব আছে স্পষ্টভাবে তারা তা না বুঝলে এই বক্তব্যে তাদের অনুপ্রাণিত করে না। কয়েক বছর আগে এই লেখক নিউইয়র্ক সিটি ব্যাঙ্কের কর্মকর্তাদের জন্য একটি সাধারণ কোর্স পরিচালনা করেন। অনেক বিষয় ছিল যেগুলি সম্পর্কে অংশগ্রহণকারীরা অনেক কিছু জানতে চেয়েছেন। কেননা এত দিন নিজ-নিজ ব্যক্তিগত চিন্তাধারায় কাজ করেছেন নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গিতে সব কিছুর বিচার করেছেন এবং তাদের কর্মপদ্ধিতে অভিজ্ঞতা ছাড়া কোনো কিছু ছিল না। এইভাবে তারা চল্লিশ বছর কাটিয়েছেন। ফলে বাস্তব অবস্থা উপলব্ধি করা তাদের কারো পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়েছে।

পাইন বিষলতার আচ্ছাদনের জন্য পর্বত তাদের দৃষ্টির অগোচরে পড়ে গেছে। এই গ্রুপ প্রতি শুক্রবার ৫টা থেকে ৭টা পর্যন্ত ক্লাসে বসতেন। এক শুক্রবার এই গ্রুপে সাথে এক ভদ্রলোক, যাকে আমরা পরিচিতির জন্য মি. জ্যাকসন বলে অভিহিত করবো, অফিসে বসে ঘড়িতে সাড়ে চারটা বেজেছ দেখতে পেলেন। সেদিন তার বক্তৃতা করার কথা ছিল, কিন্তু তিনি অপ্রস্তুত। এখন তিনি কী করবেন? তিনি আস্তে-আস্তে তার অফিস থেকে বেরিয়ে আসেন, স্টল থেকে ম্যাগাজিনের একটি কপি কেনেন, সংক্ষিপ্ত পথ হেঁটে ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাঙ্কে আয়োজিত ক্লাসে উপস্থিত হন।”সাফল্য লাভে আপনার মাত্র ১০বছর সময় লাগবে।” শীর্ষক তিনি একটি প্রবন্ধ পাঠ করেন। তিনি এই বিষয়টির প্রতি আকৃষ্ট হয়ে এটি পাঠ করে নি, বরঞ্চ তাকে কিছু বলতে হবে এই জন্য তিনি এই নিবন্ধটি পাঠ করেন।

এক ঘণ্টা পর এই নিবন্ধটি ব্যাখ্যা করার জন্য তিনি উঠে দাঁড়ান।

এর ফল কী হল? পরিণতি কী হল, তিনি যা বলতে চাইছিলেন তা সুস্পষ্টভাবে বলতে পারলেন না। শুধু স্পষ্টভাবে বললেন, আমি বলতে চাই যে, তিনি চেষ্টা করলেন, কিন্তু তিনি এই নিবন্ধের বিষয়বস্তু তিনি নিজে বুঝেন নি, হৃদয়ঙ্গম করেন নি সুতরাং তিনি তা ব্যাখ্যা করতে ব্যর্থ হলেন। তিনি যে বিষয়টি বুঝেন নি শ্রোতারা সে বিষয় তার বক্তব্য হতে বুঝে নিবে কীভাবে? এই নিবন্ধের কথা উল্লেখ করে তিনি বারবার বললেন, লেখক এটা বলতে চেয়েছেন, ওটা বলতে চেয়েছে। এই বক্তব্য কিন্তু মি. জ্যাকসনের নয়। সুতরাং গ্রন্থকার বলেন, মি. জ্যাকসন, যে লেখক এই নিবন্ধটি লিখছেন তিনি এখানে উপস্থিত নেই। সুতরাং আমরা তার ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে আমরা আগ্রহী নই, কারণ আমরা তাঁকে দেখছি না কিন্তু আমরা আপনার চিন্তাধারা সম্পর্কে আগ্রহী। আপনি ব্যক্তিগতভাবে কী চিন্তা করছেন বলুন, অন্যে কী বলেছেন তা বলার প্রয়োজন নেই। এখানে মি. জ্যাকসনের বক্তব্য অধিক প্রয়োজন।

যে বিষয়টি আজ পড়েছেন সেটি আগামী সপ্তাহের জন্য নির্ধারিত করুন। তখন নিবন্ধটি আবার পড় ন এবং নিজেকে নিজে জিজ্ঞাসা করুন আপনি লেখকের সাথে একমত অথবা কতটুকু ভিন্নমত পোষণ করেন। তা করতে হলে লেখকের প্রবন্ধটি আপনার অভিজ্ঞতার আলোকে বিশ্লেষণ করতে হবে। যদি আপনি লেখকের সাথে একমত না হন তা হলে কারণ ব্যাখ্যা করুন। এই নিবন্ধের মূল বক্তব্য ধরে নিয়ে আপনার বক্তৃতা শুরু করুন।

মি. জ্যাকসন এই সুপারিশ গ্রহণ করে পুন পাঠ করেন এবং এই অভিমত ব্যক্ত করেন যে, লেখকের সাথে তিনি মোটেও একমত নন। এরপর তিনি পরবরর্তী বক্তৃতা প্রস্তুত করা জন্য তিনি নিজে নিজেই উদ্যোগী হন। এটা যেন তার একটা সন্তান। সন্তান যেভাবে আস্তে-আস্তে বড় হয়ে উঠে মি. জ্যাকসনের বক্তব্য দিন-দিন বড় হয়ে উঠতে থাকে। সংবাদ পত্রে একটি নিবন্ধ পাঠ করলে তিনি সে বিষয়টি নিয়ে এইরূপ গভীরভাবে চিন্তা করেন যে তার জ্ঞানের পরিধি দিন-দিন বাড়তে থাকে। এইভাবে তিনি বিভিন্ন বিষয় নিয়ে চর্চা করতে শুরু করেন। এই বিষয় নিয়ে তিনি বন্ধুবান্ধবের সাথে আলাপ-আলোচনা করতে থাকেন।

পরবর্তী সময় তিনি এমন এক বক্তব্য পেশ করেন যা তার নিজস্ব চিন্তাধারা হতে উদ্ভূত, যেন সেইটি তার নিজস্ব টাকশালে তৈরি মুদ্রা। তার বক্তব্য হয় অত্যন্ত সুস্পষ্ট ও পরিষ্কার। লেখকের সাথে দ্বিমত পোষণ করার ফলে তার এই বক্তব্য হয় পরিপূর্ণ অর্থবহ।

এক পক্ষ কালের মধ্যেই তার বক্তব্যে সুস্পষ্ট বৈসাদৃশ্য পরিলক্ষিত হয়। প্রস্তুতি গ্রহণ করার ফলেই এই বক্তব্যে স্পষ্টতা আসে।

আমরা এই ক্ষেত্রে আর একটি উদাহরণ উল্লেখ করতে পারি। এক ভদ্রলোক যাকে আমরা মি. ফাইন বলে অভিহিত করব, ছিলেন ওয়াশিংটনে আয়োজিত সাধারণ বক্তৃতা কোর্সের ছাত্র। অপরাহ্নে তিনি রাজধানী সম্পর্কে আলোচনায় বললেন। তিনি একটি সংবাদ পত্রের নিবন্ধ অনুসরণে রাজধানী সম্পর্কে বলেন। তার বক্তব্য অসংলগ্ন, সূক্ষ, অর্থহীন বলে প্রতীয়মান হয় কারণ তিনি এই বিষয়টি নিয়ে চিন্তা করেন নি এবং বিষয়টি তাকে আগ্রহী করে নি। বিষয়টি নিয়ে তিনি গভীরভাবে চিন্তা না করায় তার প্রকাশ ভঙ্গিও-হয়ে উঠে নিতান্ত গতানুগতিক সাধারণ। সমস্ত বিষয়টি হয়ে উঠে অনাকর্ষণীয়।

যে বক্তব্য কখনো ব্যর্থ হয় না :

এক পক্ষ কাল পরে এমন একট ঘটনা ঘটলো যা মি. ফ্লাইনের অন্তরে দাগ কাটে। ঘটনাটি হচ্ছে একটি সরকারি গ্যারেজ হতে গাড়ি চুরি। গাড়িটি চুরি হওয়ার পর তিনি পুলিশের কাছে যান এবং উদ্ধারের জন্য পুরস্কার ঘোষণা করেন। কিন্তু তার প্রস্তাব ব্যর্থ হয়। পুলিশ স্বীকার করে যে, তাদের পক্ষে অপরাধ প্রবণতা মোকাবিলা করা এবং গাড়ি উদ্ধার করা অসম্ভব। মাত্র এক সপ্তাহ আগে যে পুলিশ রাস্তায় ১৫ মিনিট অতিরিক্ত গাড়ি রাখার জন্যে মি. ফ্লাইনকে জরিমানা করেছিলেন সে পুলিশই সময়াভাবের প্রশ্ন তুলেন। পুলিশের সময়াভাবের কথা মি. ফ্লাইনকে ক্রোধান্বিত করে তুলে। তিনি অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে পড়েন। তিনি চিন্তা করেন, এখন তকে এমন কিছু বলতে হবে যা শুধু সংবাদ পত্র পুস্তিকায় উদ্ধৃত আছে এমন নয়, তার ব্যক্তিগত জীবনের অভিজ্ঞতা প্রসূত। তিনি নিজে উত্তেজিত হয়ে পড়েন এবং মনে করেন যে, পুলিশকে উত্তেজিত করা গেলে কাজ হতে পারে। তিনি উত্তেজিত কণ্ঠে ওয়াশিংটনের অপরাধের ইতিহাস এবং পুলিশের ব্যর্থতার কথা প্রকাশ করতে থাকেন। এই সময় তিনি এত উত্তেজিত হয়ে পড়েন যে তিনি তাঁর পায়ের আঙুলের উপর ভর দিয়ে পঁড়িয়ে পড়েন এবং তার মুখ গহবর হতে পুলিশের বিরুদ্ধে এইরূপ গালাগলি বেরুতে থাকে যেন বিসুবিয়াসে অগ্ন্যুৎপাত হচ্ছে। এতে কাজ হয়। পুলিশ উত্তেজিত হয়ে অনুসন্ধানের প্রতিশ্রুতি দেয়। মি. ফ্লাইনের বক্তব্য সফল হয়। চিন্তা ও অভিজ্ঞতার ফলে জয় যুক্ত হন মি. ফ্লাইন।

প্রকৃত পক্ষে প্রস্তুতি কী?

একটা বক্তৃতা প্রস্তুতির অর্থ কি কতকগুলো নির্ভুল বাক্য লিখে নেয়া অথবা মুখস্থ করা? না। এর অর্থ কি কিছু-কিছু সাময়িক চিন্তা যা সব সময় আপনার মনে আসে না তার একত্র সন্নিবেশ? মোটেই না। এর অর্থ আপনার চিন্তা, আপনার আদর্শ, আপনার বিশ্বাস, আপনার আগ্রহের একত্র সন্নিবেশ এবং আপনার মধ্যে এরূপ চিন্তা এরূপ আগ্রহ আছে যেইগুলি আপনার প্রতিদিনের নিত্য সঙ্গী, আপনার স্বপ্নেও সহচর। আপনার অস্তিত্ব এই অনুভূতি ও অভিজ্ঞতায় পরিপূর্ণ। সমুদ্রতীরে পাথর যেভাবে স্তরে স্তরে সজ্জিত থাকে এগুলোও অপনার সুপ্তমনে ঠিক সেভাবে সজ্জিত। প্রস্তুতি অর্থ চিন্তা করা, ধ্যান করা, পুনঃস্মরণ করা, যে বিষয়টি আপনার মনের দাগ কাটে তা নির্ধারণ করা। এ সবকে সাজানো। নিজের মনের মাধুরী মিশিয়ে এগুলোকে বিশেষভাবে সাজানো। এইগুলো কিন্তু তেমন কঠিন কর্মসূচি নয়।

এ গুলো কঠিন কী? না, কঠিন নয়। বিষয়টির প্রতি সামান্য মনোযোগ দিয়ে চিন্তা করলেই এ কাজটি সুসম্পন্ন হয়। ডুইট, এল, মুড়ি কীভাবে তাঁর আধ্যত্মিক ইতিহাস সৃষ্টিকারী বক্তৃতা প্রস্তুত করতেন? ”এতে গোপনীয় কিছু নেই,“ প্রশ্নের জবাবে তিনি এরূপ উত্তর দিতেন।

‘যখন আমি কোনো একটি বিষয় ঠিক করি তখন একটি বড় খামের বর্হিভাগে তাঁর নাম লিখে রাখি। আমার এই ধরণের বহু খাম আছে। কোনো বই পড়ার সময় আকর্ষণীয় কিছু দেখলে তা লিখে নিয়ে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের খামের মধ্যেই রেখেছি।

সব সময় আমরা সাথে একটি নোট বই থাকে এবং কোনো ধর্ম উপদেশ মূলক বক্তৃতায় নতুন কিছু শুনলে আমি তা নোট করি? অতঃপর তা আমি সংশ্লিষ্ট বিষয়ের খামের মধ্যে রেখে দেই। এইভাবে এই সব কাগজ পত্র এক বছর অথবা আরো বেশি সময় পড়ে থাকে। যখন আমি ধর্ম উপদেশ মূলক বক্তৃতা দানের সিদ্ধান্ত করি তখন সংরক্ষিত সব কিছু হাতে নিই। এই সব কাগজ পত্রের তথ্য ও চিন্তা ধারা মিলিয়ে আমি আমার নতুন বক্তব্য ঠিক করি। এই বক্তব্য প্রচুর মাল-মসলায় পূর্ণ হয়। আমি সব সময় আমার ধর্ম উপদেশ মূলক বক্তৃতায় কোথাও কিছু যোগ করি। কোথাও বা কিছু বাদ দেই। ফলে আমরা বক্তব্য কখনো পুরোনো হয় না।

লিংকন কীভাবে বক্তৃতা প্রস্তুত করতেন :

লিংকন কীভাবে তার বক্তৃতা প্রস্তুত করতেন? সৌভাগ্যবশত আমরা তা জানি এবং এখানে আপনারা সে পদ্ধতি জানতে পারবেন। লিংকন এক শতাব্দীর প্রায় এক তৃতীয়াংশ কাল কীভাবে বক্তৃতা প্রস্তুত করতেন। বক্তৃতা প্রস্তুতে তিনি যে পদ্ধতি অনুসরণ করতেন ডীন ব্রাইন তর বিভিন্ন ভাষণে তা ব্যক্ত করেছেন। লিংকনের একটি বিখ্যাত ভাষণে তিনি ভবিষ্যদ্বক্তার মতো বলে ছিলেন, আভ্যন্তরীণ কোন্দলে লিপ্ত কোনো ঘর টিকে থাকতে পারে না। আমি বিশ্বাস করি, অর্ধস্বাধীন ও অর্ধদাস কোনো সরকারও স্থায়ীভাবে টিকে থাকতে পারে না। এই বক্তব্য সম্পূর্ণরূপে তাঁর মন হতেই উৎসারিত হয়েছিল। কেননা তিনি তার স্বাভাবিক কাজে, পানাহারের সময়, রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময় গোদোহন কালে দোকনে কেনা কাটার সময়, বাজারে ঘোরার সময় ছোট ছেলেটিকে নিয়ে বসে থাকার সময়, পিতার সাথে আলোচনার সময় দেশ সম্পর্কে, সরকার সম্পর্কে, দেশের অবস্থা সম্পর্কে ভাবতেন, চিন্তা করতেন, সকলের সাথে আলাপ করতেন মত বিনিময় করতেন, এবং এরই ফলশ্রুতিতে তার পক্ষে এই ভবিষ্যৎ বাণী করা সম্ভব হয়েছিল। তবে এই বক্তব্য পেশ কালে লিংকন সম্পূর্ণরূপে নিজের চিন্তাকে নিজের ভাষাতেই প্রকাশ করেন, ফলে ঐটি হয় হৃদয়গ্রাহী।

সব সময় তিনি যা চিন্তা করতেন মনে যা আসত তা হাতের কাছে পাওয়া টুকরো কাগজ, খাম, ভেঁড়া খামের অংশ ইত্যাদিতে লিখে রাখতেন, কখনো লিখতেন পুরো বাক্য কখনে বা কোনো গুরুত্বপূর্ণ একটি পয়েন্ট। অতঃপর এ সব কগজের টুকরো তিনি সাথে নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন এবং সময় ও সুযোগে মতো বসে এগুলোকে সঠিক ভাবে সাজিয়ে নিতেন, লিখতেন, সংশোধন করতেন, সংযোজন করতেন, সম্প্রসারণ করে বক্তৃতা প্রস্তুত করতেন, প্রকাশনার জন্যে উপযোগী করে নিতেন।

১৮৫৮ সালের যৌথ বিতর্ক কালে সিনেটর ডগলাস সর্বত্র একই বক্তব্য পেশ করতে শুরু করেন। কিন্তু লিংকনের নীতি ছিল, নতুন কথা বলা। এক সভায় যা বলেছেন অন্যত্র তার পুনরাবৃত্তি না করা। তাই তিনি সব সময় তার বক্তব্য নিয়ে চিন্তা করতেন, তাই তার পক্ষে নতুন নতুন বক্তব্য পেশ করা সহজতর হত। এই নতুন বক্তব্য শ্রোতাদের কাছে হত অনেক সহজ ও গ্রহণযোগ্য।

হোয়াইট হাউসে প্রবেশের স্বল্প কাল আগে তিন শাসনতন্ত্রের একটি অনুলিপি নেন। অতঃপর তিনি ঐটি নিয়ে স্প্রিংফিল্ড এর একটি কক্ষে প্রবেশ করেন, জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে, শাসনতন্ত্রের উদ্ধৃতি নিয়ে তিনটি বক্তৃতা প্রস্তুত করেন। এভাবেই তিনি হোয়াইট হাউসের উদ্বোধনী বক্তৃতা প্রস্তুত করেন।

লিংকন কীভাবে তার গেটিসবার্গের বিশ্ব বিখ্যাত বক্তৃতা তৈরি করেছিলেন? দুর্ভাগ্য বশত এই ভাষণটি তৈরি করা সম্পর্কে ভুল তথ্য প্রচারিত আছে। কিন্তু এর সত্য ঘটনা হচ্ছে নিম্নরূপ :

গোটিসবার্গ গোরস্থান পরিচালনা কমিশন আনুষ্ঠানিক উৎসর্গানুষ্ঠান পরিচালনার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এডওয়ার্ড এভারেটকে বক্তৃতাদানের জন্য আমন্ত্রণ জানায়। মি. এভারেট বোস্টমেন মন্ত্রী, হারভার্ড এর প্রেসিডেন্ট, নিউইয়র্কের গভর্নর যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটর এবং মন্ত্রী হিসাবে আমেরিকায় বিশেষভাবে পরিচিত, খ্যাতনামা বক্তা। প্রথমে ১৮৬৩ সালের ২৩শে অক্টোবর এই অনুষ্ঠানের তারিখ নির্দিষ্ট করে তাকে আমন্ত্রণ জানান হয়। কিন্তু এভারেট জানান যে এত অল্প সময়ের মধ্যে তার পক্ষে বক্তৃতা প্রস্তুত করা সম্ভব হবে না। সুতরাং তাকে বক্তৃতা প্রস্তুতির সময় দেয়ার নিমিত্তে এই অনুষ্ঠান ১৯ নভেম্বর পর্যন্ত অর্থাৎ প্রায় এক মাস কাল স্থগিত রাখা হয়। মি. এভারেট অনুষ্ঠানের তিনদিন আগে গেটিসবার্গ গমন করে, যুদ্ধক্ষেত্র পরিদর্শন করে, যুদ্ধের প্রতিদিনের ঘটনার সাথে পরিচিত হবার চেষ্টা করেন। ফলে যুদ্ধের প্রকৃত চিত্র তা চোখের সামনে ভেসে ওঠে, তার প্রস্তুতি হয় সম্পূর্ণ।

এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার জন্যে কংগ্রেসের সকল সদস্য, প্রেসিডেন্ট এবং মন্ত্রীসভার সদস্যদের কাছে আমন্ত্রণ পত্র পঠানো হয়। অধিকাংশ সদস্যই উপস্থিত হতে অক্ষমতা প্রকাশ করেন, কিন্তু প্রেসিডেন্ট লিংকন অনুষ্ঠানে উপস্থিত হবেন জানালে কমিটি বিস্মিত হয়। তারা কি প্রেসিডেন্টকে ভাষণ দেবার জন্যে অনুরোধ জানাবেন? তাদের এরূপ কোনো ইচ্ছা ছিল না। আপত্তিও উত্থাপিত হয়। তিনি প্রস্তুতির সময় পাবেন না। অধিকিন্তু সময় পেলেও এরূপ বক্তৃতা প্রণয়নের যোগ্যতা তার আছে কি? দাসতু অথবা শ্রমিক ইউনিয়ন সম্পর্কে বিতর্কে তিনি যক্তিপূর্ণ বক্তব্য পেশে সক্ষম হলেও তাঁকে উৎসর্গমূলক বক্তৃতা প্রদান করতে কেহ কখনো দেখে নি। এটি হচ্ছে একটি গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় অনুষ্ঠান। তাঁরা কি করিবেন তা নির্ধারণ করতে ব্যর্থ হলেন। তাঁরা কি তাকে বক্তৃতা করতে অনুরোধ জানাবেন? তারা শুধু বারবার ভাবতে লাগলেন কী করা যায়। কিন্তু এটা অত্যন্ত আশ্চর্যের বিষয় যে, যে ব্যক্তির যোগ্যতা সম্পর্কে মনে প্রশ্ন জেগেছিল সেই ব্যক্তিরই সেদিনকার ভাষণটি আজ সব চাইতে গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ বলে বিবেচিত ও পরিচিত, কোনো জীবন্ত মানুষের বক্তৃতার মধ্যে একটি শ্রেষ্ঠতম বক্তৃতা বলে গণ্য।

পরিশেষে তারা অনুষ্ঠানের মাত্র এক পক্ষকাল আগে প্রেসিডেন্টের প্রতি যথাযোগ্য মন্তব্য করার বিলম্বিত আমন্ত্রণ জানায়। তাদের আমন্ত্রণের বিষয়টি ছিল ”যথাযোগ্য মন্তব্য” যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের প্রতি এই অমন্ত্রণ।

আমন্ত্রণ প্রাপ্তির পর লিংকন প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন। তিনি এডওয়ার্ড এভারেস্ট কে লিখে তিনি যে বক্তৃতা পেশ করবেন তার একটা অনুলিপি সংগ্রহ করেন। এর দুই একদিন পর ফটো তোলার জন্য একটি স্টুডিওতে গমন করেন। তথায় অবস্থান কালে প্রাপ্ত অবসর সময়ে তিনি এভারেটের বক্তৃতার অনুলিপি পড়ে ফেলেন, অতঃপর তিনি কয়েক দিন ধরে তাঁর বক্তব্য সম্পর্কে চিন্তা করেন।

হোয়াইট হাউস ও যুদ্ধ অফিসে গমন কালে চিন্তা করেন এই বক্তৃতা সম্পর্কে, চিন্তা করেন যুদ্ধ অফিসের কৌচে বসে গভীরভাবে। অফিসে সর্বশেষ তারবার্তার জন্য অপেক্ষা কালে তিনি চিন্তা করেন ধ্যান মগ্ন হয়ে। তিনি তার চিন্তা লিপিবদ্ধ করেন একটি ফুলস্কেপ কাগজের একটি টুকরায়, এটি রাখেন তার উঁচু টুপির মধ্যে। তিনি নিরবচ্ছিন্ন ভাবে এই বিষয়টির ওপর চিন্তা করতে থাকেন, ফলে নতুন নতুন পয়েন্ট তার মনে আসতে থাকে। নির্দিষ্ট তারিখের পূর্ববর্তী রোববার তিনি নোয়া ব্রকসকে বলেন”এটা সঠিকভাবে লেখা হয় নি। এটা এখনো শেষ করাও যায় নি। আমি এটি দু’তিন বারের বেশি লিখেছি, তবে এটা সম্পর্কে আমি নিজে আজো সন্তুষ্ট হতে পারি নি, তাই এখানেনা এটা সম্পর্কে ভাবছি, ভাবছি আত্মসন্তুষ্টির জন্য।

অনুষ্ঠানের আগের রাত্রে প্রেসিডেন্ট লিংকন গেটিসবার্গ পৌঁছেন। ক্ষুদ্র শহরটি তখন জনসমাগমে পূর্ণ। মাত্র তের শো লোকের শহরে তখন ১৪ হাজার লোক উপস্থিত হয়েছে। নারী পুরুষের উপস্থিতিতে সারা শহর গগম্ করছে। লোকের ভিড়ে রাস্তায় চলাচল অসম্ভব। চারিদিকে ব্যান্ড বাজছে, জনতা ‘জন ব্রাউনের, নামের গান গাইছে। মি. উইলসের বাড়িতে লিংকন আতিথ্য গ্রহণ করেন। জনতা তথায় ভিড় করে তাকে কিছু বলতে অনুরোধ জানান! প্রত্যুত্তরে তিনি নিতান্ত সংক্ষিপ্ত বক্তৃতা করেন। তার এই বক্তব্য হতে এটা স্পষ্ট হয়ে পড়ে যে তিনি নির্দিষ্ট অনুষ্ঠানের আগে মুখ খুলতে চান না। শেষ রাতেও তিনি তাঁর বক্তব্যটি সংশোধন, সংযোজন করেন, যেন লেহন করেন। নিকটবর্তী যে ঘরে পররাষ্ট্র সচিব সিওয়ার্ড অবস্থান করেছিলেন, সে গৃহে গিয়ে তিনি তার বক্তব্য তার কাছে পেশ করে সমালোচনা করতে বলেন। পরদিন সকালে প্রাতভোজের পরও তিনি বক্তব্যটি পাঠ করতে থাকেন, যতক্ষণ না তাঁকে জানানো হয় যে শোভাযাত্রা শুরু হয়েছে এবং তাতে তার অংশ নেয়ার সময় সমুপস্থিত। প্রেসিডেন্টকে অনুসরণকারী কর্নেল কার বলেছেন, শোভাযাত্রায় প্রেসিডেন্ট ঘোড়ায় চড়ে অংশ নেন এবং বাহিনী চলার দিকে লক্ষ্য রাখেন। কিন্তু শোভাযাত্রা চলতে শুরু করলে দেখা যায় যে, তার শরীর সামনের দিকে ঝুঁকেছে বাহু শিথিল হয়ে পড়েছে এবং মস্তক অবনত হয়ে গেছে, মনে হল, তিনি তন্ময় হয়ে কিছু ভাবছেন?

এটা হতে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, তিনি তখন তার মাত্র দশটি বাক্যের অবিস্মরণীয় বক্তব্য নিয়ে ভাবছিলেন অর্থাৎ শেষ বারের মতো তিনি তার বক্তব্য চেটে নিচ্ছেলেন।

আধ্যাত্মিক বিষয়ে লিংকন প্রদত্ত অনেক বক্তব্যই ব্যর্থ বলে প্রমাণিত, কিন্তু দাসত্ব এবং রাষ্ট্রনীতি তার সকল বক্তব্যই অবিস্মরণীয়। এ সব বিষয়ে বক্তৃতা প্রদানে তার ক্ষমতা অতুলনীয়। কেন? কারণ তিনি সব সময় এসব বিষয় নিয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে চিন্তা করতেন এবং এগুলি গভীর ভাবে অনুভব করতেন। ইলিয়েসের একটি কক্ষে জনৈক বন্ধু রাতে তার সাথে ঘুমান, পরদিন সকালে তিনি জেগে ওঠে দেখতে পান যে লিংকন দেওয়ালের দিকে মুখ করে বিছানায় বসে গভীর চিন্তার সাথে বলেছেন, “অর্ধ দাস অর্ধ মুক্ত এই সরকার দীর্ঘদিন টিকে থাকতে পারে না।”

যিশুখ্রিস্ট কীভাবে বক্তৃতা প্রস্তুত করতেন? তিনি নিজেকে জনতা হতে বিচ্ছিন্ন করে ফেলতেন, চিন্তা করতেন, ধ্যানমগ্ন হতেন। ভাবতেন, তিনি একাকী নির্জন স্থানে চলে যেতেন, ধ্যান করতেন এবং চল্লিশদিন চলিশ রাত ধরে উপবাহ্রত পালন করতেন।” এই সময়ের পর, বলেছেন সেন্টম্যাথু, যিশু ধর্মপ্রচার শুরু করেন। এই ঘটনার অনতিকাল পরে তিনি একটি বক্তৃতা করেন যা বিশ্ব ইতিহাসে প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। এই বক্তৃতা ”সারমন অন দি মাউন্ট” নামে পরিচিত।

‘আমার এই বক্তব্য অত্যন্ত আকর্ষণীয় তবুও আপনি প্রতিবাদ করতে পারেন কিন্তু অমর বক্তা হবার কোনো আকাঙ্ক্ষা আমার নেই। আমি সময়-সময় জনকল্যাণমূলক কিছু বক্তব্য আপনাদের সামনে পেশ করতে চাই।’

আপনি কী চান তা আমরা উপলব্ধি করি। আপনাদের সে আকাঙ্ক্ষা এবং আপনার মতে যারা চিন্তা করছেন তাদের আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্যেই এই বই। অতীতে খ্যাতনামা বক্তারা যে-ভাবে বক্তৃতা শিখেছেন, বক্তৃতা অভ্যাস করেছেন সে পথ অনুরসণ করে আপনিও উপকৃত হতে পারেন।

কীভাবে আপনার বক্তৃতা প্রস্তুত করবেন :

কী বিষয় নিয়ে আপনি প্রস্তুতি শুরু করবেন? যে কোনো বিষয় যার প্রতি আপনার আগ্রহ জন্মে। একটি সংক্ষিপ্ত বক্তৃতায় বেশি সংখ্যক গুরুত্ব পূর্ণ পয়েন্ট আলোচনা করবেন। শুধুমাত্র একটি বা দুটি পয়েন্ট নিয়ে সংক্ষিপ্ত বক্তৃতায় এক বা দুটি পয়েন্ট সঠিকভাবে ও খোলাখুলি ব্যাখ্যা করা সম্ভব ও সহজতর। শ্রোতাও তা বুঝতে পারে, আকৃষ্ট হয়।

আপনার বক্তব্য বিষয় আগেই ঠিক করুন। তা হলে নির্দিষ্ট সময়ের আগে বিষয়টি নিয়ে চিন্তা ভাবনা করে নিতে পারবেন। বিষয়টি নিয়ে সাতদিন চিন্তা করুন, সাতবার স্বপ্ন দেখুন। ক্লান্ত শরীর বিশ্রাম নেয়ার সময়ে বিষয়টি ভেবে নিন। সকালে দাড়ি গোঁফ কাটবার সময়, স্নান করার সময়, শহরে চলার পথে কোথাও অপেক্ষা করার সময়, মধ্যাহ্ন ভোজ গ্রহণ কালে, কোনো নির্দিষ্ট স্থান গমন কালে, নৈশ ভোজ প্রস্তুত বা রান্না কালেও বিষয়টি নিয়ে ভাবুন। বন্ধুদের সাথে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করুন। ঐটাকে আলোচনার বিষয়বস্তু করে নিন।

বিষয়টি নিয়ে যত প্রশ্ন আপনার মনে আসে তা আপনি নিজেকে জিজ্ঞেস করুন। মনে করুন আপনার বিষয় হচ্ছে বিবাহ-বিচ্ছেদ। আপনি নিজেকে প্রশ্ন করুন, বিবাহ বিচ্ছেদের কারণ কী এর অর্থনৈতিক, সামাজিক ফলাফল কী। এই সৎ কাজ কীভাবে বন্ধ করা যায়? আবার কি একই রূপ বিবাহ-বিচ্ছেদ আইন প্রয়োজন? কেন? অথবা আমরা কি কোনো রূপ বিবাহ-বিচ্ছেদ আইন অনুসরণ করি? বিবাহ-বিচ্ছেদ কি অসম্ভব করে তোলা উচিত? অধিকতর বিধি নিষেধ প্রয়োজন? সহজ করা উচিত?

মনে করুন, আপনি কেন বক্তৃতা শিখছেন এই বিষয়টির ওপর বলবেন। তা হলে আপনি আপনাকে নিম্নরূপ প্রশ্ন করবেন : বক্তৃতা করতে আমার বাধা কী? বক্তৃতা আমি কেন শিখতে চাই? এর দ্বারা আমার কী উপকার হবে? এর ফল কী হয়েছে? একজন ব্যবসায়ীর জন্যে বক্তৃতা শেখা প্রয়োজন বলে কেন আমি মনে করি? যে সব নারী পুরুষ ব্যবসা বাণিজ্যে অথবা রাজনীতিতে উন্নতি করেছে তারা আত্মবিশ্বাসী এবং তাদের বক্তব্য আকর্ষণীয় ও গ্রহণযোগ্য বলে কি আমি বিশ্বাস করি? আমি কি মনে করি যাদের এসব গুণ নেই তারা ব্যবসা বাণিজ্য অথবা রাজনীতি ক্ষেত্রে উন্নতি করতে পারছে না? এটা সম্পর্কে সুস্পষ্ট ভবে বলতে হবে। কোনো ব্যক্তি বিশেষের নামোল্লেখ না করে তাদের সাফল্য ব্যর্থতার কাহিনী বলতে হবে; প্রকাশ করতে হবে।

এভাবে একটি বিষয়ে পরিষ্কার চিন্তা ও স্বচ্ছ ধারণা নিয়ে বক্তৃতা শুরু করলে দুতিন মিনিট বলার পর সব পয়েন্ট একে একে আপনার মুখ দিয়ে এসে যাবে। একটি দুটি বক্তৃতার পর আপনার বক্তৃতা অরো পরিষ্কার হবে, স্বচ্ছ হবে। কেন আপনি বক্তৃতা শিখছেন এ সম্পর্কে বলা অত্যন্ত সহজ হবে। এই বিষয়টি নিয়ে আপনি যদি সামান্য চিন্তা করেন এবং পয়েন্ট গুলি মনে-মনে সাজিয়ে নেন, তা হলে পুরে বিষয়টি আপনার মনে থাকবে এবং বক্তৃতা কালে অপনি স্বচ্ছন্দে আপনার আকাঙ্ক্ষা, আপনার অভিজ্ঞতা সম্পর্কে সহজ ও সরল ভাষায় আপনার বক্তব্য পেশ করতে পারবেন।

অপরদিকে, মনে করুন, আপনি আপনার ব্যবসা অথবা পেশা সম্পর্কে বলবেন। তা হলে কীভাবে আপনি এ ধরনের বক্তৃতা তৈরি করবেন? আপনি জানেন। সুতরাং সেগুলি একের পর এক সাজান। সবগুলো তিন মিনিটের মধ্যে বলে শেষ করার চেষ্টা করবেন না। এটা সম্ভব নয়। এ ধরণের চেষ্টা পরিপক্ক বুদ্ধির পরিচায়ক নয়। একটি পয়েন্ট নিয়ে আলোচনা করুন, ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করুন। উদাহরণ স্বরূপ কেন আপনি বিশেষ ব্যবসা বা পেশা গ্রহণ করবেন সে সম্পর্কে বলুন। এটা কি আকস্মিক অথবা আপনার মনের ইচ্ছা? প্রথম দিনে আপনার অসুবিধা, ব্যর্থতা সাফল্য ও আশার কথা প্রকাশ করুন। আপনার অভিজ্ঞতার বর্ণনা এমনভাবে দিন যাতে তা হৃদয়গ্রাহী হয়। কারো জীবন কাহিনী সঠিকভাবে, হৃদয়গ্রাহীরূপে বর্ণনা করা হলে তা হয় আকর্ষণীয়। এধরণের বক্তব্য হয় ফলপ্রসূ, সুফলদায়ক। অথবা আপনার ব্যবসাকে অন্য দিক থেকে তুলে ধরুন। এর সমস্যাগুলো প্রকাশ করুন, যে তরুণ এই ব্যবসায়ে আসতে চাইছে, নিজ অভিজ্ঞতার আলোকে তাকে কিছু উপদেশ দিন।

অথবা ব্যবসা সূত্রে আপনি যে সব লোকের সংস্পর্শে এসেছেন তাদের কথা বলুন। তাদের সতোর কথা বলুন, বলুন অসৎদের কথা, বলুন আপনার সমস্যার কথা। এই কাজের ভেতর দিয়ে বিশ্বজগৎ সম্পর্কে অপনি অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছেন। যে শিক্ষা পেয়েছেন, তা কী মনের প্রকৃতি। আপনি আপনার পেশার খুঁটিনাটি দিক ব্যাখ্যা করতে চান, তাহলে শ্রোতারা বিরক্ত হবে; কেননা তারা তা বুঝবে না, রস পাবে না। কিন্তু চিন্তাশীল কোনো ব্যক্তিই বক্তৃতা কালে এরূপ ভুল বিষয় নিয়ে শুরু করেন না।

সর্বোপরি আপনার বক্তব্য বিষয়টিকে শুধুমাত্র শুষ্ক প্রচারে পরিণত করবেন না। তা করলে তা বিরক্তি উৎপাদন করবে। আপনার বক্তব্য উদাহরণ ও উদ্ধৃতি দিয়ে বোঝাবার চেষ্টা করুন, যে সব ঘটনা আপনি জানেন তা ব্যক্ত করুন, যা আপনি শিখেছেন তা ব্যাখ্যা করুন। নিজেও উপলব্ধি করুন যে এসব বিশেষ ঘটনা মনে রাখা অত্যন্ত সহজ। প্রকাশ করাও সহজতর তা হলে আপনার বক্তব্যও হবে সহজতর ও হৃদয়গ্রাহী।

এ ক্ষেত্রে একজন লেখকের অভিমত প্রণিধানযোগ্য। ব্যবসা মালিকের ক্ষমতা অধিস্তনদের কাছে হস্তান্তর সম্পর্কে বি. এ. ফরবেস একটি নিবন্ধ লিখেছেন, তাতে তিনি বলেছেন :

আমাদের সময়ের অধিকাংশ বড় বড় প্রতিষ্ঠান এক সময় এক ব্যক্তি পরিচালিত প্রতিষ্ঠান ছিল। এগুলো নিতান্ত ক্ষুদ্র হতেই বৃহতে পরিণত হয়েছে। এর কারণ হচ্ছে এই যে, এক ব্যক্তি যত মেধাসম্পন্নই হোক না কেন অন্যদের সাহায্য সহযোগিতা নিলে সে মেধার শক্তি বাড়ে। এই উপলব্ধি বোধ থেকেই এক ব্যক্তি পরিচালিত ব্যবসা বা শিল্প প্রতিষ্ঠান আজকের বৃহৎ প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত হয়েছে। সহকারীদের সাহায্য সহযোগিতার এটি ফল।

উলওয়ার্থ একদা আমাকে বলেছিলেন যে, তার ব্যবসাটি সুদীর্ঘকাল ধরে এক ব্যক্তিরই ব্যবসা ছিল। দীর্ঘদিন একা কাজ করার ফলে তাঁর স্বাস্থ্য নষ্ট হয়ে যায়। ফলে তাঁকে সপ্তাহের পর সপ্তাহ ধরে হাসপাতলে পড়ে থাকতে হয়। তিনি এই উপলব্ধি করেন যে, তার ব্যবসাটিকে যদি তিনি সম্প্রসারিত করতেন, লোক নিয়োগ করতেন, তা হলে তাকে এরূপ পরিশ্রম করতে হত না, তিনি এরূপ গুরুতর অসুস্থ হতেন না এবং ব্যবসায়েরও দ্রুপ ক্ষতি হত না।

বেথেল হাম স্টিল দীর্ঘকাল একজনের পরিচালিত সম্পত্তি ছিল। চার্লস এম. স্কোয়ার একাই পরিচালনা করতেন। এই সময়ে ইউনিজ জি. গ্রেস, স্কোয়ারের চাইতে অনেক বেশি দক্ষ ও কর্মঠ স্টিল ম্যানে পরিণত হন। কেননা, তার ব্যবসা একব্যক্তি পরিচালিত ছিল না।

ইস্টম্যান কোডাক প্রাথমিক অবস্থায় জর্জ ইস্টম্যান পরিচালিত প্রতিষ্ঠান ছিল। কিন্তু বুদ্ধিমান ছিলেন বিধায় বহুদিন আগেই প্রতিষ্ঠানের ব্যাপক আকারে রূপ দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। শিকাগোর সকল প্যাকিং হাউসই একই রূপ অভিজ্ঞতার অধিকারি। স্টান্ডার্ড ওয়েল কখনো একজন প্রতিষ্ঠানের ছিল না। ফলে ঐটি এক্ষণে এত বেশি বড় হতে পেরেছে।

জি. পি. মর্গান ব্যক্তি স্বার্থে অত্যন্ত সচেতন ব্যক্তি হওয়া সত্ত্বেও নিজ ব্যবসায়ে দক্ষ ব্যক্তিদেরই অংশিদার করেছিলেন, এবং ব্যবসা পরিচালনার দায়িত্বও তাঁদেরকে ভাগ করে দিয়েছিলেন।

আরো বহু সংখ্যাক ব্যবসায়ী আছেন, যারা কখনো নিজ ব্যবসা পরিচলনার দায়িত্ব অন্যদের দিতে ইচ্ছুক ছিলেন না। কিন্তু প্রতিযোগিতার ফলে তারা ব্যবসা সম্প্রসারণের স্বার্থে তা করতে অর্থাৎ পরিচালনার দায়িত্ব ভাগ করে দিতে বাধ্য হয়েছেন।

কিছু লোক তাদের ব্যবসা সম্পর্কে বলতে গেলে শুধুমাত্র নিজেদের স্বার্থের কথাই বলেন, শ্রোতাদের স্বার্থ সম্পর্কে কিছু বলেন না। ফলে শ্রোতারা বিরক্ত হয়। বক্তারা বক্তব্য দ্বারা, শ্রোতারাও উপকৃত হোক, আগ্রহী হোক এটা কি বক্তার লক্ষ্য হওয়া উচিত নয়? তাঁদের স্বার্থের কথা বলা কি উচিত নয়, আগুন কীভাবে প্রতিরোধ করা যায়, তার কথা বলা? যদি তিনি ব্যাংকার হন তবে তার উচিত নয় গ্রাহকদের বিনিয়োগ সম্পর্কে উৎসাহিত করা। যদি বক্তা একটি মহিলা সংগঠনের জাতীয় নেত্রী হন তাহলে কি তার উচিৎ নয় কীভাবে মহিলারা স্থানীয় কর্মসূচির ভিত্তিতে বৃহত্তর জাতীয় আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেন তার কথা বলা?

বক্তৃতা প্রস্তুতি কালে আপনারা শ্রোতাদের কথা স্মরণ রাখবেন। তাদের অভাবের কথা ইচ্ছার কথা, আকাক্ষার কথা ভাবুন। এটা করলেই আপনার বক্তব্যের অর্ধেক সহজেই বুঝতে পারবেন।

কোনো বিষয়ে বক্তব্য প্রস্তুত কালে সে বিষয়টির ওপর লিখিত রচনা পাঠ করুন, তা হলে বিষয়টি নিয়ে অন্যেরা কী চিন্তা করেছে, কী বলেছে তা জানতে পারবেন। তবে বিষয়টি নিয়ে নিজে চিন্তা করার আগে পড়বেন না। এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচনা করবেন। এরপর পাবলিক লাইব্রেরিতে গিয়ে বিষয়টির ওপর আপনি অধ্যয়ন করুন। যে বিষয়ের ওপর বক্তৃতা প্রস্তুত করতে চাচ্ছেন তার কথা বলেই বই সংগ্রহ করুন। সেখানে সাহায্য কামনা করুন। আপনি যদি গবেষক না হন, তা হলে দেখতে পাবেন যে, লাইব্রেরি কর্মচারী আপনাকে যে সাহায্য করছে তা আপনার জন্য বিশেষ ফলপ্রসু হচ্ছে। সম্ভবত তাদের কাছ থেকে আপনি আপনার বিষয়ের কাঠামো ভিত্তি মূলতথ্য বিষয়টির ভালো ও খারাপ দিক, জনতার মনের প্রশ্ন, প্রয়োজনীয় তথ্য, ইতিহাস সবকিছুই পেয়ে যাবেন। ডজন ডজন বই পাবেন যা হতে আপনি সংগ্রহ করতে পারবেন ব্যাপক তথ্য ও তত্ত্ব। এগুলিকে আপনি ঝালাই করে নিয়ে আপনার ইচ্ছানুযায়ী ব্যবহার করতে পারবেন। আপনার বক্তব্য হবে তখন অত্যন্ত সুস্পষ্ট, উদ্দীপনাময় ও তথ্য বহুল, যা করবে শ্রোতাদের মুগ্ধ, বিমোহিত।

গোপন শক্তির উৎস :

লুথার বুরবাক তার মৃত্যুর স্বল্প আগে বলেছিলেন “আমি লাখ লাখ বক্তৃতা প্রস্তুত করেছি, কিন্তু তার মধ্যে নিতান্ত স্বল্প সংখ্যকই হয়েছে হৃদয়গ্রাহী। ফলে আমি বাকিগুলো নিজেই নষ্ট করে দিয়েছি।” এই ধরণের আকাক্ষা নিয়ে, উদ্যম নিয়ে যে কোনো বিষয়ের ওপর বক্তৃতা প্রস্তুত করা উচিত। একশটি চিন্তা করুন নব্বইটি নষ্ট করে দিয়ে দশটি রাখুন।

অধিকতর বিষয়ে তথ্য সংগ্রত করুন, অতঃপর তা সাজাবার চেষ্টা করুন। ফলে আপনি যা প্রস্তুত করবেন তা হবে তথ্য সমৃদ্ধ। এটা নিয়ে আরো ভাবুন, ফলে আপনার বক্তব্য হবে হৃদয় উৎসারিত, এটা হচ্ছে প্রস্তুতির মৌলিক ও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। এতৎসত্ত্বেও বহু বক্তা এই তথ্যকে অবহেলা করে, ফলে তাদের বক্তব্য হয় রসকষহীন।

“আমি শত শত সেলসম্যান ও সেলসওম্যান এবং ক্যানভাসার ও ডেমোনেস্ট্রেটরের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছি” বলেছেন আর্থার ডান এবং আমি তাদের মধ্যে যে মূল দুর্বলতা দেখেছি তা হচ্ছে তারা তাদের দ্রব্য যা অন্যের কাছে বিক্রি করতে চান, সে দ্রব্যটি সম্পর্কে সূক্ষ্মরূপে জানেন না এবং জানার প্রয়োজনও বোধ করেন না, জানার আগেই তা-বিক্রি করার জন্য ছোটেন।

বহু বিক্রয় প্রতিনিধি আমার দপ্তরে এসেছেন এবং জিনিস সম্পর্কে সামান্য বিবরণ দিয়ে, বিক্রির কথা বলে, বিক্রি করার চেষ্টা করে তারা চলে যেতে চেয়েছেন। এ ধরনের বিক্রির প্রতিনিধিদের অনেকে এক সপ্তাহ এবং এমনকি কেহ ৪৮ ঘণ্টার বেশি চাকুরি করার উপযোগী বলে আমার মনে হয় নি। ক্যানভাসার ও বিক্রয় প্রতিনিধিদের, বিশেষ করে খাদ্য সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ করে তোলা প্রয়োজন বলে মনে করি এবং আমি তাদের সেভাবেই শিক্ষার ব্যবস্থা করি। আমি তাদের মার্কিন কৃষি দপ্তর কর্তৃক ইস্যুকৃত খাদ্য তালিকা অধ্যয়ন করতে বাধ্য করি। কারণ এতে কোনো খাদ্যে কী পরিমাণ পানি, দেহসার, অঙ্গার, অম্লজান চর্বি এবং ক্র্যাশ আছে তার বর্ণনা আছে। যে সব উপাদান দিয়ে তাদের বিক্রি যোগ্য পণ্য তৈরি তা সম্পর্কে জানতে আমি তাদের বাধ্য করি। আমি তাদের বাধ্য করি এসব দ্রব্য সম্পর্কে জানাত, স্কুলে গিয়ে পরীক্ষা পাশ করে আসতে। আমি তাদের বাধ্য করি এসব দ্রব্য অন্যান্য বিক্রয় প্রতিনিধিদের কাছে বিক্রি করতে। শ্রেষ্ঠ বিক্রয় প্রতিনিধিকে আমি পুরস্কৃত করি।

আমি অনেক সময় দেখেছি, অনেক বিক্রয় প্রতিনিধি প্রথমদিকে পণ্য সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ দিতে গিয়ে অধৈর্য হয়ে পড়তেন। তাঁরা বলেছেন”একজন খুচরা মুদি দোকানদারের কাছে এসবের বিস্তারিত বিবরণ দেয়ার সময় পাই না। কারণ সে বিক্রির কাজে নিতান্ত ব্যস্ত থাকে। আমি তার কছে দেহসার ও অঙ্গার অম্লজানের কথা বললে সে শোনে না এবং শুনলেও আমি কী বলি তা বুঝতে চায় না।” আমি উত্তর দেই ক্রেতার উপকারের জন্যে আপনার এসবের বিস্তারিত বিবরণের প্রয়োজন নেই, কিন্তু আপনার নিজ প্রয়োজনে এসব জানা দরকার। আপনি আপনার পণ্যের এ হতে জেড অর্থাৎ আগাগোড়া জানলে আপনার মনে যে ভাবের উদয় হবে তা বর্ণনা করা অসম্ভব। ফলে আপনি এরূপ দৃঢ় মনোভাবের অধিকারী হবেন, আপনার মনোবল এত শক্ত হবে যে, আপনি বিক্রি কাজে কখনো ব্যর্থ হবেন না, পেশায় বিফল হবেন না।

স্ট্যান্ডার্ড অয়েল কোম্পানির খ্যাতনামী ইতিহাস লেখিকা মিস ইদা, এম, তারবেল এই গ্রন্থকারকে বলেছেন, বেশ কয়েক বছর আগে তার প্যারিস অবস্থান কালে ম্যাককুরস ম্যাগাজিনের প্রতিষ্ঠাতা মি. এস, ম্যকাকুর আটলান্টিক ক্যাবল সম্পর্কে একটি নিবন্ধ লেখার জন্যে তার কাছে তারবার্তা পাঠান। তারবার্তা পেয়ে তিতি লন্ডন গমন পূর্বক কোম্পানির ইউরোপীয় ম্যানেজারের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন। এই সাক্ষাৎকার হতে তার নিবন্ধের প্রয়োজনীয় মালমশল্লা ও তথ্যাদি তিনি সগ্রহ করতে সক্ষম হন, কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি তথায় থেমে থাকেন নি। তিনি ক্যাবল সম্পর্কে আরো অধিক তথ্য জানতে আগ্রহী হন। তিনি বৃটিশ জাদুঘরে গিয়ে ক্যাবল পরিদর্শন করেন, ক্যাবলের ইতিহাস সম্পর্কিত গ্রন্থাদি অধ্যয়ন করেন এবং লন্ডনের প্রান্তে গিয়ে ক্যাবল উৎপাদিত কারখানায় উৎপাদন পদ্ধতি পরিদর্শন করেন।

তার ব্যবহারে প্রয়োজন থেকে দশগুণ বেশি তথ্য তিনি কেন সংগ্রহ করেন? তিনি মনে করেন, অতিরিক্ত তথ্য তাকে সংরক্ষিত শক্তি প্রদান করবে তাই তিনি তা সংগ্রহ করেন। কারণ তিনি বুঝতে পারেন যে, সংগৃহীত তথ্য প্রকাশ না করলেও তা একদিন তার কাজে লাগবে, ঐটা হবে সংরক্ষিত জ্ঞান।

এডউইন জেমস কার্টেল আনুমানিক তিন কোটি লোকের সমাবেশে বক্তৃতা করেছেন। এতৎসত্ত্বেও তিনি আমাকে বলেছেন যে, বক্তৃতা শেষে বাড়ি ফেরার পথে তিনি তার বক্তৃতা নিয়ে যখন চিন্তা করেন তখন দেখতে পান যে অনেক কিছু অব্যক্ত রয়ে গেছে, তখন তার মনে হয় তার বক্তব্যই রয়ে গেছে অসম্পূর্ণ। কেন? যখন দীর্ঘ অভিজ্ঞতা হতে তিনি এটা বুঝতে পেরেছিলেন যে, সুবক্তব্য হচ্ছে ঐটি যে বক্তব্যে থাকে বহু মূল্যবান গোপন তথ্য যা আগে কখনো প্রকাশিত হয় নি, থাকে সংরক্ষিত তথ্য যা বক্তাই আগে কখনো প্রকাশ করতে পারে নি।

সংক্ষিপ্তসার :

(১) যখন কোনো বক্তা মনে প্রাণে কোনো বিষয় বলার জন্যে প্রস্তুত হন তখন তিনি তা প্রকাশের আকাক্ষা অনুভব করেন। এরূপ আকাঙ্ক্ষিত বক্তব্য হয় ফলপ্রসু। কোনো সুপ্রস্তুত ভাষণ প্রস্তুতিতেই দশ ভাগের নয় ভাগ সুসম্পন্ন হয়ে যায়।

(২) প্রস্তুতি কী? কোনো কাগজে কতিপয় বাক্য লিখে নেয়া? কতিপয় প্রবচন মুখস্থ করা? মোটেই, প্রকৃত প্রস্তুতি হচ্ছে নিজের মন থেকে কিছু ভেবে নেয়া, চিন্তা ধারাকে সুমার্জিত করা, নিজস্ব চিন্তাকে সুশৃঙ্খলভাবে গুছিয়ে নিয়ে নিজের ভাবকে, চিন্তাকে, সাজিয়ে গুছিয়ে নেয়াই হচ্ছে প্রকৃত প্রস্তুতি। অন্যের ভাব নিয়ে শুরু করলে সাফল্যের পরিবর্তে আসে ব্যর্থতা। উদাহরণ স্বরূপ নিউইয়র্কের মি. জেকসনের কথা ধরা যেতে পারে। তিনি ফররেস ম্যাগাজিনের নিবন্ধ দিয়ে শুরু করে ব্যর্থ হয়েছিলেন। কিন্তু তিনি সে নিবন্ধকেই শুরু হিসাবে ধরে নিয়ে যখন নিজের মনের চিন্তা প্রকাশ করেন বক্তৃতায়, তখন তিনি অর্জন করেন সাফল্য।

(৩) বসে বসে শুধুমাত্র ত্রিশ মিনিট সময়ে কোনো বক্তৃতা তৈরি করার চেষ্টা করবেন না। বক্তৃতা মাংস বা মাছের ফালির মতো রন্ধন করার সামগ্রী নয়, এটা তৈরি করতে হবে। সপ্তাহের প্রথম দিকে আপনার বিষয়বস্তু নির্ধারণ করুন, অতঃপর সকল মুহূর্তে বিষয়টি নিয়ে চিন্তা করুন, ভাবুন, ধ্যান করুন, ঘুমে স্বপ্ন দেখুন। বন্ধুদের সাথে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করুন।এটাকে আলোচনার বিষয় বস্তুতে পরিণত করুন। এটা সম্পর্কে যত প্রশ্ন মনে জাগে মনে-মনে তার উত্তরও অনুসন্ধান করুন। আপনার মনে যত প্রশ্ন জাগবে এবং আপনি যত প্রশ্নের উত্তর পাবেন তা কাগজে নোট করে নিন। স্নানাহার কালে, পথ চলতে, খাবার টেবিলে অপেক্ষাকালে অর্থাৎ সকল মুহূর্তে আপনার মনে নির্দিষ্ট বিষয় সম্পর্কে যত ভাব আসবে, সুপারিশ বা উদাহরণ পড়বে তা লিখে রাখুন। এটা ছিল লিংকনের পদ্ধতি; এবং এটা অধিকাংশ সফল বক্তার বক্তৃতার প্রস্তুতির অনুসৃত পন্থা।

(৪) কোনো একটি নির্দিষ্ট বিষয় সম্পর্কে অধ্যায়ন করার পর আপনি লাইব্রেরিতে গিয়ে সেই বিষয়টি সম্পর্কে অধ্যয়ন করুন। গ্রন্থাগারিককে আপনার প্রয়োজনের কথা বলুন। আপনার নির্দিষ্ট বিষয়ে সে আপনাকে যথেষ্ট সাহায্য করতে পারেন। মুক্তমনে স্বাধীন চিন্তার পর অধ্যয়ন হতে প্রাপ্ত তথ্য ভিত্তিক প্রণীত ভাষণ হৃদয়গ্রাহী হয়।

(৫) আপনি যে তথ্য ব্যবহার করতে ইচ্ছুক তার চাইতে বেশি তথ্য সংগ্রহ করুন, লুবার বুরবাকের কথা স্মরণ করুন। তিনি লাইলাক চারা জন্মাতেন, যার মধ্যে দু একটি হত অত্যন্ত ভালো। এক শত চিন্তা একত্রিত করুন, নব্বইটি হেঁটে ফেলে দশটি রাখুন।

(৬) সংরক্ষিত শক্তি অর্জনের উপায় হচ্ছে প্রয়োজনাতিরিক্ত তথ্য সংগ্রহ এবং এসব তথ্য পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে জেনে রাখা। বক্তৃতা প্রস্তুত কালে আর্থার জন যে পদ্ধতিতে তার বিক্রয় প্রতিনিধিদের খাদ্যবস্তু সম্পর্কে শিক্ষা দিতেন সে পদ্ধতি অনুরসণ করুন। আটলান্টিক ক্যাবল সম্পর্কে নিবন্ধ রচনায় ইহা তারবেল যে পদ্ধতি অনুসরণ করেছিলেন না অনুরসণ করুন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *