০১. সাহস আত্মবিশ্বাসের বিকাশ

বক্তৃতা শিখবেন কীভাবে
ডেল কার্নেগি

‘স্নায়বিক দুর্বলতা কাটিয়ে আত্মবিশ্বাস অর্জন তেমন কঠিন কাজ নয়। সহজে এই ক্ষমতা অর্জন করা যায়। কতিপয় ব্যক্তির প্রতি এটি খোদার বিশেষ দান। চেষ্টা করলে সকলেই এই ক্ষমতা অর্জন করতে পারে।’–ডেল কার্নেগি

‘আত্মবিশ্বাস, সাহস আর জ্ঞানই হচ্ছে বক্তার প্রধান শক্তি।’–তপন রুদ্র

.

প্রসঙ্গ-কথা

অনেক বছর ধরে প্রতিপত্তি ও বন্ধুলাভের সঙ্গে ডেল কার্নেগির নাম সমভাবে পরিচিত। নোবেল বহির্ভূত বইয়ের মধ্যে ডেল কার্নেগির লেখা ‘প্রতিপত্তি ও বন্ধুলাভ’ বইটি সব চাইতে বেশি বিক্রি হয়েছে এবং এই বইটি তার আন্তর্জাতিক খ্যাতি এনে দিয়েছে, কিন্তু ‘প্রতিপত্তি ও বন্ধুলাভ’ তাঁর প্রথম বই নয়।

১৯২৬ সালে ডেল কার্নেগি একটি বই লেখেন। বইটির নাম বক্তৃতা শিক্ষা’ এটা পাবলিক স্পিকিং বা বক্তৃতা শেখার পাঠ্য বই। এবং আজ পর্যন্ত সারা বিশ্বে বক্তৃতা শেখা ও জন সংযোগ বিষয়ে এটি স্বীকৃত পাঠ্যবই। এটি ওয়াই.এম.সি.এ. পাবলিক স্পিকিং ক্লাসেও পড়ানো হত। বিগত দশ বছরে এই বইটির ৬,০০,০০০ কপি বিক্রি হয়েছে এবং মোট বিক্রির সংখ্যা এক কোটি কপিরও বেশি। এটি ২০টিরও বেশি ভাষায় প্রকাশিত হয়েছে এবং হাজার হাজার কপি বিক্রি হয়েছে তবে সাধারণ পাঠকেরা এই বই সম্পর্কে ওয়াকেবহাল নন।

ডেল কার্নেগি কোর্সের দর্শন আজ সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে এবং দশ লাখেরও বেশি লোক এই কোর্সে গ্রাজুয়েশন লাভ করেছে। এই কোর্সে জনগণকে অধিকতর সাহসী করে তোলে, তাদের সুখী ও সমৃদ্ধ জীবন গড়ে তুলতে সাহায্য করে।

ডেল কার্নেগি কোর্সের ছাত্ররা এ বই থেকে যে উপকার পেয়েছে নতুন পাঠকেরাও অনুরূপ উপকার পাবে আমার বিশ্বাস।

ডরোথি কার্নেগি

.

০১. সাহস আত্মবিশ্বাসের বিকাশ

১৯১২ সাল থেকে পাঁচ লাখেরও বেশি নারী পুরুষ সাধারণ ভাষণ কোর্সে অংশ নিয়ে আমার প্রদর্শিত পথ অনুসরণ করেন। তাঁদের মধ্যে অনেকেই লিখিত ভাবে জানিয়েছেন, তারা কেন এই প্রশিক্ষণে অংশ নেন এবং এটা হতে তারা কী পেতে চান। স্বাভাবিক ভাবে তাদের মতামত ভিন্ন ভিন্ন কিন্তু এসব মতামতের মূল বিষয়, সংখ্যা গরিষ্ঠের মূল আকাক্ষা আশ্চর্যজনকভাবে প্রায় এক।”যখন আমাকে কোনো কিছু বলতে আমন্ত্রণ জানানো হয় ব্যক্তির পর ব্যক্তি লিখেছেন, “আমি এত ভীত, আত্মবিস্মৃত হয়ে পড়ি যে কোনো কিছুই পরিষ্কারভাবে চিন্তা করতে পারি না, কোনো কিছুতে মনোনিবেশ করতে পারি না, স্মরণ করতে পারি না আমি কী বলতে ইচ্ছুক। আমি আত্মবিশ্বাস অর্জন করতে চাই, আমি চাই চিন্তার ক্ষেত্রে আত্মনির্ভশীল হতে, সুস্থির হতে। আমি আমার সমস্ত চিন্তাকে যুক্তি সম্মত পদ্ধতিতে ধারাবাহিক ভাবে পেতে চাই আর আমি চাই ব্যবসায়ীদের সমাবেশ, ক্লাব সদস্যদের বৈঠক অথবা অন্য যে কোনো শ্ৰোতৃমণ্ডলীর সামনে আমার সমস্ত যুক্তি পরিষ্কার ও সুষ্ঠুভাবে দৃঢ় প্রত্যয়ের সাথে তুলে ধরে শ্রোতাদের আকর্ষণ করতে ও স্বমতে আনতে।” হাজার-হাজার লোকের মনের কথা এরূপ ভাবেই প্রতিধ্বনিত ও প্রকাশিত হয়েছে।

একটি বাস্তব উদাহরণ উল্লেখ করছি; কয়েক বছর আগে মি. ডি. ডব্লিউ. গেস্ট নামে পরিচিত এক ব্যক্তি ফিলাডেলফিয়ায় আমার সাধারণ ভাষণ কোর্সে যোগদান করেন। উদ্বোধনীর স্বল্পকাল পর তিনি আমাকে ম্যানুফাঁকচারদের ক্লাবে তার সাথে মধ্যাহ্ন ভোজ গ্রহণের আমন্ত্রণ জানান। তিনি ছিলেন মধ্যবয়সী ও কর্মব্যস্ত লোক। তিনি ছিলেন তার উৎপাদন প্রতিষ্ঠানের প্রধান এবং গির্জাও সমাজসেবামূলক কাজের স্থানীয় নেতা। ঐ দিন আমরা খেতে বসলে তিনি ঝুঁকে পড়ে বলেন, “বিভিন্ন সময় বিভিন্ন সভায় আমার প্রতি বক্তৃতা করতে অনুরোধ জানানো হয়ে থাকে, কিন্তু কখনো আমি তা করতে পারি না। এরূপ আহ্বানে আমার মন শূন্য হয়ে যায়, আমি ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠি। তাই আমি জীবনে কখনো বক্তৃতা করতে পারি নি। কিন্তু আমি এখন একটা কলেজের স্ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান। বোর্ডের সভায় আমাকে সভাপতিত্ব করতে হবে। সুতরাং আমাকে কিছু বলতেও হবে। আপনি কি মনে করেন, আমার জীবনের এ সময়ে আমার বক্তৃতা শেখা সম্ভব?”

“আমি তাই মনে করি, মি. গেস্ট।” আমি উত্তর দিলাম, “এটা আমার কল্পনা নয়। আমি জানি আপনি পারবেন এবং আমি বিশ্বাস করি, নির্দেশ সঠিক অনুসরণে কাজ করলে আপনি সফল হবেন।”

তিনি এ কথা বিশ্বাস করতে চাচ্ছিলেন। তবে তার কাছে এটা অতি বেশি আশা করা বলে মনে হল।”আপনি আমার প্রতি অত্যন্ত সদয়” বললেন তিনি, “তাই আপনি আমাকে উৎসাহিত করতে চাচ্ছেন?”

তাঁর প্রশিক্ষণ শেষ হবার পর কিছু কাল আমাদের মধ্যে কোনো যোগাযোগ ছিল না। পরে আমাদের দেখা হয় এবং আমরা ম্যানুফ্যাকচারার ক্লাবে মধ্যাহ্ন ভোজ গ্রহণ করি। প্রথম দিনের মতো সেদিনও আমরা এক কোণার একটি টেবিল দখল করে বসি। আমাদের পূর্ব কথোপকথনের উল্লেখ করে আমি জিজ্ঞেস করলাম, আমার বিশ্বাস সত্য হয়েছে কিনা। তিনি তাঁর পকেট হতে লাল কভার দেওয়া একটি নোট বই বের করে তাতে বিভিন্ন সভায় তার বক্তৃতা করার তারিখ সহ একটা তালিকা দেখালেন। এ সব সভায় তাঁকে বক্তৃতা করতে হবে।”আমি এখন বক্তৃতা করার ক্ষমতা অর্জন করেছি” তিনি স্বীকার করলেন, “এটা করতে আমি আনন্দ পাই, সমাজ সেবামূলক কাজে অংশ নিতে পারি এবং এটা হচ্ছে আমার জীবনের বিশেষ কাজ।”

ঐ সময়ের কিছু আগে ওয়াশিংটনে নিরস্ত্রীকরণ সম্পর্কিত একটি গুরুত্বপূর্ণ নিরস্ত্রীকরণ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ব্রিটিশ প্রধান মন্ত্রী এই সম্মেলনে অংশ নেয়ার পরিকল্পনা করেছেন বলে খবর প্রকাশিত হলে ফিলাডেলফিয়ার যাজক সম্প্রদায় ঐ শহরে একটি জনসভায় ভাষণ দিতে তার প্রতি আমন্ত্রণ জানান। এবং মি. গেস্ট আমাকে জানান, শহরের যাজকেরা ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রীকে জনগণের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে তাঁকে নির্বাচন করেন। এবং তিনি ঐ ব্যক্তি যিনি তিন বছরের কিছু কম সময় আগে একই টেবিলে বসে আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, তিনি কখনো বক্তা হতে পারবেন বলে আমি বিশ্বাস করি কিনা।

তার বক্তৃতা করার দ্রুত এই ক্ষমতা লাভ কি অস্বাভাবিক? মোটেই না। এ ধরণের শত শত প্রমাণ আছে। উদাহরণ স্বরূপ-আরো একটি বিশেষ ঘটনার কথা উল্লেখ করছি। বহু বছর আগে ড. কার্টিস নামে ব্রুকলিনের একজন চিকিৎসক এক শীত মৌসুমে ফ্লোরিডায় গিয়েছিলেন। তার বাসস্থান ছিল ব্যাটবল প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের কাছে। তিনি ব্যাটবল এর একজন বিশেষ অনুরাগী ছিলেন। ফলে তিনি প্রায়ই যেতেন প্রশিক্ষণ দেখতে? নিয়মিত যাতায়াতের দরুণ তিনি হয়ে পড়েছিলেন সদস্যদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ফলে তারা একদিন তাকে তাদের সম্মানে আয়াজিত এক ভোজে অংশ নিতে আমন্ত্রণ জানায়।

কফি ও বাদাম পরিবেশনের পর বহু সংখ্যক গণ্যমান্য অতিথির প্রতি কিছু বলার জন্য অনুরোধ জানান হয়। হঠাৎ শোনা গেল, সভাপতি বলছেন, আজ রাতে আমরা একজন চিকিৎসককে আমাদের মাঝে পেয়েছি। এবং আমি এখানে ডা. কার্টিসকে একজন ব্যাটবল খেলোয়াড়ের স্বাস্থ্য সম্পর্কে কিছু বলতে অনুরোধ জানাচ্ছি।

তিনি কি প্রস্তুত ছিলেন? অবশ্যই তিনি স্বাস্থ্য বিজ্ঞান অধ্যয়ন করেছেন এবং প্রায় শতাব্দীর এক তৃতীয়াংশ সময় ধরে তার ডানে বায়ে বসা রোগীর কাছে তার বিষয়ে বক্তৃতা করতে পারেন, বলতে পারনে। কিন্তু দর্শকদের সামনে, সংখ্যা যত সীমিতই হোক, দাঁড়িয়ে একই বিষয়ে বলা অন্য জিনিস। এটা বোধ শক্তি রহিত করার মতো ঘটনা। এই ঘোষণার ফলে ডাক্তার অত্যন্ত বিচলিত হয়ে পড়েন এবং হত্যন্ত্রের ক্রিয়া দ্রুততর হয়ে উঠে। তিনি জীবনে কখনো কোনো সভায় বক্তৃতা করেন নি! এ সময় তার মনে হতে লাগলো, তিনি যেন সব কিছু বিস্মৃত হয়ে যাচ্ছেন, তার দেহে গজাচ্ছে পাখা।

উপস্থিত শ্রোতারা যত তালি দিয়ে এই ঘোষণাকে অভ্যর্থনা জানায়। সবাই তখন তার দিকে তাকিয়ে ছিল। এখন তিনি কী করেন? তিনি মাথা নাড়েন। এটাকে সম্মতি মনে করে শ্রোতারা আনন্দিত হয়ে হাততালি দিতে থাকে। সবাই চিৎকার দিয়ে বলতে থাকেন। ”ডা. কার্টিস, বলুন, বলুন।”

তিনি অত্যন্ত বেকায়দায় পড়েন। তিনি বুঝতে পারেন, তিনি কিছু বলতে চেষ্টা করলে ব্যর্থ হবেন। অর্ধডজন বাক্যও তিনি পুরোপুরি ব্যক্ত করতে পারবেন না। সুতরাং তিনি উঠে দাঁড়ান এবং একটি শব্দও উচ্চারণ না করে বন্ধুদের প্রতি পৃষ্ঠ প্রদর্শন করেন, অপমানিত ও লাঞ্ছিত হৃদয়ে ধীরে-ধীরে কক্ষ ত্যাগ করেন।

কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এই যে, ব্রুকলিনে ফিরে তিনি সর্ব প্রথম সাধারণ ভাষণ কোর্সে ভর্তি হন। এটিই হয় তার প্রথম কাজ। দ্বিতীয় বার যাতে তাকে এরূপ ভাবে বোকা বনতে না হয় সে উদ্দেশ্য নিয়েই তিনি এই কোর্সে ভর্তি হন।

তিনি অত্যন্ত আগ্রহী ছাত্র হিসাবে শিক্ষকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তিনি কথা বলতে শেখার জন্যই এই কোর্সে অংশ নেন এবং তার আগ্রহে কোনোরূপ কমতি ছিল না। তিনি নিয়মিতভাবে তার পাঠ শিখতেন, অভ্যাস করতেন এবং কখনো ক্লাসে অনুপস্থিত থাকতেন না।

লেখা পড়ায় তিনি এতো অধিক অগ্রগতি সাধন করলেন যে তিনি নিজেও বিস্মিত হল, কেননা, তিনি তাঁর লক্ষ্যমাত্রাও অতিক্রম করে গেলেন। কয়েক সেসনের পর তার স্নায়ুবিক দুর্বলতা দূর হয়ে যায়, আত্মবিশ্বাস দ্রুত বাড়তে থাকে! দু’মাসেই মধ্যেই তিনি তার গ্রুপের শ্রেষ্ঠ বক্তা হয়ে উঠেন। অতঃপর তিনি যত্রযত্র বক্তৃতা করার আমন্ত্রণ গ্রহণ করতে শুরু করেন। বক্তৃতা করা তার কাছে প্রিয় কাজ হয়ে ওঠে, ফলে তিনি নতুন-নতুন বন্ধু পেতে থাকেন।

রিপাবলিকান পার্টির নিউইয়র্ক নগর কমিটির জনৈক সদস্য একবার তার বক্তৃতা শুনে দলীয় নির্বাচনী প্রচারণার কাজে অংশ নেয়ার জন্য ডা. কাটির্সের প্রতি আমন্ত্রণ জানান। মাত্র এক বছর আগে যে ব্যক্তি বক্তৃতা করতে ব্যর্থ হয়ে ভয়ে, দুঃখে ও লজ্জায় একটি ভোজ সভা ত্যাগ করেছিলেন তিনি এখন হয়ে পড়েন রাজনৈতিক বক্তা।

আত্মবিশ্বাস ও সাহস এবং জনসমক্ষে কথা বলার সময় শান্ত ও স্বচ্ছভাবে চিন্তা করার যোগ্যতা অর্জন সম্পর্কে সাধারণ মানুষের যে ধারণা, এ ঘটনা প্রমাণ করে যে আসলে সে ধারণা স্বাভাবিক অবস্থা নয়। এটা শুধু মাত্র কতিপয় ব্যক্তির প্রতি স্বর্গীয় অবদান বা ভগবানের দান নয়। এটা গলফ খেলার মতো যোগ্যতা অর্জনের ব্যাপার। যে কোনো ব্যক্তিই ইচ্ছা করলে চর্চার মাধ্যমে এই যোগ্যতা অর্জন করতে সক্ষম।

আপনি যখন বসে থাকেন তখন যে ভাবে চিন্তা করতে পারেন, ঠিক সেভাবে শ্রোতাদের সামনে দাঁড়িয়ে একই রূপ চিন্তা করতে না পারার কোনো কারণ আছে কি? নিশ্চয়ই আপনার জানা উচিত যে এ রূপ কোনো কারণ নেই। প্রকৃতপক্ষে আপনি যখন জনসমক্ষে দাঁড়ান তখন আপনার চিন্তাধারা আরো স্পষ্ট হওয়া উচিত। শ্রোতাদের উপস্থিতি আপনাকে করবে অনুপ্রাণিত উৎসাহিত। অধিকাংশ বক্তার মত হচ্ছে এই যে, শ্রোতামণ্ডলীর উপস্থিতিতে তাঁদের অনুপ্রাণিত করে এবং তাঁদের মস্তিস্ক অধিকতর পরিষ্কার ও স্পষ্ট ভাবে কাজ করে। হেনরি ওয়ার্ড বেসার বলেছেন, “ধূম উদগীরণের মতো এমন সব তত্ত্ব-তথ্য ঘটনা মুখ দিয়ে নিঃসৃত হয় যা জানবার কথা বক্তা নিজেও কখনো কল্পনা করে নি।” এ সব কথা নিতান্ত স্বাভাবিক ভাবেই বক্তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে। আপনি যদি চর্চা করেন এবং ইচ্ছুক হন তা হলে আপনার পক্ষেও এরূপ যোগ্যতা অর্জন সম্ভব।

যা হোক আপনার সুস্পষ্টভাবে নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন যে, প্রশিক্ষণ চর্চা আপনার শ্রোতা ভীতি দূর করবে এবং আপনার মনে আত্মবিশ্বাস ও অদম্য সাহস যোগাবে।

বিষয়টি স্বাভাবিকভাবে কষ্টকর বলে চিন্তা করবেন না। যে সব ব্যক্তি কালে খ্যাতনামা বক্তা হিসাবে পরিচিত হয়ে ছিলেন তারাও তাদের জীবনের প্রথম দিকে এই ভীতি ও আত্মবিশ্বাসহীনতা থেকে মুক্ত ছিলেন না।

খ্যাতনামা বক্তা উইলিয়াম জেনিং ব্লায়ান স্বীকার করছেন যে প্রথম দিন বক্তৃতা করার চেষ্টা করলে কম্পনের ফলে তাঁর হাটুদ্বয় জোড়া লেগে গিয়েছিল।

মার্ক টোয়েন প্রথম দিন বক্তৃতা করতে উঠে অনুভব করেন যে, তাঁর মুখ গহ্বর তুলা দিয়ে পরিপূর্ণ এবং তার নাড়ির স্পন্দন অস্বাভাবিক রূপে বেড়ে চলেছে।

বিসমার্ক ছিলেন তাঁর সময়ের একজন দক্ষ শ্রেষ্ঠতম সেনাপতি কিন্তু তিনি স্বীকার করেছেন যে, তিনি যখন জন সমক্ষে বক্তৃতা করতে চেষ্টা করতেন তখন তিনি অত্যন্ত বেকাদায় পড়তেন।

জীন জুরিস ছিলেন তাঁর সময়ের ফ্রান্সের শ্রেষ্ঠতম রাজনৈতিক বক্তা। কিন্তু ডেপুটিদের চেম্বারে তিনি একটি বছর বোবার মতো বসে কাটিয়েছেন। অতঃপর তিনি চেষ্টা করেন মুখ খুলতে।

লয়েড জর্জ স্বীকার করেছেন, প্রথমদিন আমি যখন জন সমক্ষে বক্তৃতা করার চেষ্টা করি আমি অত্যন্ত দুঃখে পতিত হই। সত্যি কথা বলতে কী আমি একটি শব্দও উচ্চারণ করতে পারি নি। কেননা আমার মুখ শুকিয়ে যায়, জিহ্বা মুখ গহ্বরের সাথে লেপটে যায় এবং কোনো শব্দই নিঃসৃত হয় না আমার মুখ থেকে।

গৃহযুদ্ধের সময় ইংল্যান্ডের পক্ষ সমর্থক খ্যাতনামা ইংরেজ বক্তা জন ব্রাইট তাঁর প্রথম বক্তৃতা করেন একটি স্কুলে সমবেত একদল অশিক্ষিত জনতার সামনে যেখানে যাত্রা পথে এত ভীত, এত চিন্তিত এবং রুষ্ট হয়ে পড়েন সে সহগামীদের তিনি বলেন, ‘বক্তৃতাকালে আমি যখন অসুবিধায় পড়ব তখন আমি নির্দেশ দেখালে তোমরা হাততালি দিও–।’

খ্যাতনামা আইরিশ নেতা চালের্স স্টাটি পারলেন প্রথম জীবনে বক্তৃতা দান কালে এতই ভীত-সন্ত্রস্থ ও বিমুঢ় হয়ে পড়তেন যে, তিনি অনেক সময়, নখ দিয়ে চিমটি কেটে নিজের মাংস ছিঁড়ে রক্ত বের করে ফেলতেন। এই তথ্য প্রকাশ করেছেন তার ভাই।

ডিজরেলি স্বীকার করেছেন যে, হাউস অব কমন্সে প্রথম দিন বক্তৃতা কালে তার মনে হয়েছিল, বক্তৃতা করার চাইতে সৈন্য বাহিনী পরিচালনা করা অনেক সহজ। প্রথমদিন তিনি পারেন নি একটি শব্দও উচ্চারণ করতে। এই অবস্থা হয়েছিল লেরিভনেরও।

ইংল্যান্ডের খ্যাতনামা বক্তাদের অনেকেই প্রথমদিন বক্তৃতা করতে গিয়ে হয়েছিলেন ব্যর্থ। আজকের পার্লামেন্টে এ ধারণার সৃষ্টি হয়েছে যে, তরুণের বক্তৃতাই তার ভবিষ্যৎ জীবনের পুর্বাভাস। সুতরাং বক্তৃতা শিখতে হলে বা বক্তা হতে হলে প্রয়োজন ধৈর্য ও অধ্যবসায়ের? বহু সংখ্যক খ্যাতনামা বক্তার জীবনী পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে পর্যালোচনা করে গ্রন্থকার এটা উপলব্ধি করেছেন যে, যে ছাত্র প্রথমে যত বেশি ঘাবড়ান তাঁর পক্ষে সাফল্য লাভ করা তত বেশি সহজতর।

শুধুমাত্র দু’ডজন লোকের সামনে পেশকরার উদ্দেশ্যে হলেও বক্তৃতা প্রণয়নে কতিপয় নির্দিষ্ট নিয়ম কানুন মেনে চলা প্রয়োজন। কেননা বক্তব্য তৈরিতে বিশেষ চাপ ও বিশেষ উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। কারণ বক্তা যা কিছু বলবেন তা বলতে হবে তাকে সরাসরি ও সুষ্পষ্টভাবে। অমর সিত্ৰারো দু’হাজার বছর আগে বলে গেছেন, প্রকৃত অর্থবহ সকল সাধারণ বাচন ওদের মুখ দিয়েই নিঃসৃত হয়েছে, যারা কখনো স্নায়বিক দুর্বলতায় আক্রান্ত হন নি।

বেতারে কথিকা পেশকালেও বক্তারা প্রায় একই অনুভূতির স্বীকার হয়। এটাকে বলা হয় মাইক্রোফোন-ভীতি। চার্লি চাপলিন একদা লিখিত বক্তব্য নিয়ে বেতারে পেশ করতেন। এখন তিনি দর্শক, শ্রোতাদের মনোরঞ্জন করে খ্যাতি অর্জন করেছেন। এ নাইট-ইন এ মিউজিক হল খ্যাত ইংল্যান্ডের মঞ্চাভিনেতা তিনি এখন। এতদসত্ত্বেও নেতার ভাষণের সুসজ্জিত কক্ষে প্রবেশ করে তিনি তখন তলপেটে এরূপ যন্ত্রণা অনুভব করেন যে, সে রূপ যন্ত্রণা ফ্রেব্রুয়ারি মাসের ঝড়ের সময় আটলান্টিক অতিক্রম কালে সাধারণত অনুভূত হয়।

খ্যাতনামা চলচ্ছিত্রাভিনেতা ও পরিচালক জেমস ঝিকউডও অনুরূপ অভিজ্ঞতার অধিকারী। মঞ্চ হতে তিনি জনশূন্য ময়দানের উদ্দেশ্যে বক্তৃতা করতে অভ্যস্ত, কিন্তু মঞ্চ হতে নেমে তিনি হয়ে পড়তেন বিচলিত। প্রকাশ্য জনসভায় বক্তৃতা করার চাইতে শক্ত কাজ আর নেই, তিনি মন্তব্য করেন।

কিছু লোক যারা সবসময় বকবক করেন, তাঁরা মনে করেন যে, তাঁরা জনসমক্ষে বক্তৃতা করতে সক্ষম। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে বক্তৃতা করতে দিলে তারা কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে নিস্তব্ধ হয়ে যান।

এমনকি লিংকনও প্রথম কয়েক মুহূর্ত লজ্জানুভব করতেন। তাঁর কৌশলী বন্ধু হার্ডন বলেছেন, ‘প্রথমে তিনি হয়ে পড়তেন হতবুদ্ধি, মনে হত তিনি যেন কঠোর পরিশ্রান্ত, ক্লান্ত! তবে তিনি চেষ্টার ফলে অবস্থা কাটিয়ে উঠতেন এবং বেঢপ অবস্থা হতে নিজেকে মুক্ত করতে পারতেন। আমি প্রায়ই এটা অবলোকন করতাম এবং আমার সহানুভূতি জাগত লিংকন এর প্রতি। যখন তিনি বক্তৃতা শুরু করতেন, তখন তার আওয়াজ অস্পষ্ট হতে স্পষ্ট হত, নিম্ন হতে উচ্চ পর্যায়ে উঠত। অপ্রতিভ ভাব আস্তে-আস্তে হত দুরীভূত। অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি সমস্ত প্রতিকূল অবস্থা নিজের আয়ত্বে আনতে সক্ষম হতেন। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই তাঁর অপ্রতিভ ভাব সম্পূর্ণ দূর হয়ে যেত, এবং তিনি হয়ে পড়তেন একজন দৃঢ়তা সম্পন্ন ব্যক্তি ও সুবক্তা।

আপনার অভিজ্ঞতাও তার মতো হতে পারে।

আপনি যদি একজন জনপ্রিয় বক্তা হতে চান, যদি চান দ্রুত একজন সুবক্তা হতে, তাহলে আপনাকে চারটি অতি প্রয়োজনীয় কাজ করতে হবে :

প্রথমত : অটল বাসনা নিয়ে দৃঢ়তার সাথে যাত্রা শুরু করুন।

আপনি যা অনুভব করেন এটা তার চাইতেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। যদি কোনো শিক্ষক আপনার মন ও হৃদয় পরীক্ষা করেন, তিনি আপনার আকাক্ষা সঠিক ভাবে নির্ধারণ করতে সক্ষম হন এবং এটা তাঁর পক্ষে পূর্বাহ্নেই বলে দেয়া সম্ভব। তা হলে সতোর সাথে আপনি সাফল্য অর্জন করতে পারতেন। যদি আপনার আকাক্ষা হয় নিস্ক্রীয় ও নির্জীব, তবে আপনার সাফল্যও হবে সে রূপ মন্থর। কিন্তু আপনি যদি অধ্যবসায়ের সাথে আপনার বিষয় অনুসরণ করেন, বুলডগ যেভাবে বিড়ালকে তাড়ায় ঠিক সেভাবে চল তা হলে কোনো বাধাই আপনাকে পরাভূত করতে পারবে না।

সুতরাং এই শিক্ষার জন্যে আত্মসচেতন হয়ে উঠুন। এর শুভফল গ্রহণ করুন। মানুষকে স্বমতে আনতে হলে বক্তব্য পেশে কিরূপ আত্মবিশ্বাস ও যোগ্যতা অর্জন করতে হবে সে সম্পর্কে চিন্তা করুন। ডলার ও সেন্টে এর কত মূল্য হতে পারে তা চিন্তা করুন। সামাজিক ভাবে এর মর্যাদা কী, বন্ধুদের কাছে এর দাম কী, ব্যক্তিগত প্রভাব বিস্তারের এর মূল্য কী, নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠায় এর থেকে আপনি কী পাবেন সে সম্পর্কে চিন্তা করুন। এটা আপনাকে আপনার চিন্তা কল্পনা হতে অধিকতর দ্রুত গতিতে নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত করবে।

চাউন্সে এস্ ডেপু বলেছেন, বক্তৃতার মাধ্যমে মানুষকে স্বমতে আনার চাইতে বড় কোনো শক্তি, ব্যক্তির জীবন গঠনে তার ক্ষমতা সম্পর্কে স্বীকৃতি আদায়ে, সহায়ক হতে পারে না। কেননা এই শক্তিই যে কোনো ব্যক্তিকে দ্রুত প্রতিষ্ঠিত করে।

লাখ লাখ লোকের হৃদয় জয় করার পর ফিলিপ ডি. আমায় বলেছেন, আমি বড় পুঁজিপতির চাইতেও বড় বক্তা।

প্রতিটি শিক্ষিত ব্যক্তিই মনে-মনে বক্তৃতা করার ক্ষমতা অর্জনের আশা পোষণ করেন। ডেল কার্নেগীর মৃত্যুর পর প্রাপ্ত কাগজ পত্রের মধ্যে তার নিজস্ব জীবনের একটি পরিকল্পনা পাওয়া গিয়েছিল। এই পরিকল্পনাটি তিনি প্রণয়ন করেছিলেন তার ২৩ বছর বয়সে। তিনি পরিকল্পনা করেছিলেন আর দু’বছরের মধ্যে তার ব্যবসাকে এমন ভাবে সম্প্রসারিত করা হবে যাতে তার বার্ষিক আয় হয় ৫০ হাজার এবং ৩০ বছর বয়সে তিনি অবসর নিয়ে অক্সফোর্ডএ গিয়ে অধ্যয়ন করবেন, বিশেষ করে তিনি সাধারণ ভাষণ বা জনসমক্ষে বক্তৃতা করার উপর বিশেষ গুরুত্ব দেবেন।

এই শক্তি অর্থাৎ বক্তৃতা দিয়ে মোহিত করার শক্তি কতটুকু সন্তুষ্ট করে এবং আনন্দ দান করে তা চিন্তা করার বিষয়। লেখক এই বিশ্বের প্রায় সব এলাকা সফর করেছেন এবং বহুমুখী অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ নিয়েছেন। কিন্তু যে অভিজ্ঞতা তাকে সব চাইতে বেশি সন্তোষ বিধান করেছে তা হচ্ছে বক্তৃতা করার শক্তি। আপনি বক্তৃতা করবেন আর শ্রোতারা আপনার বক্তব্য নিয়ে চিন্তা করবে, চিন্তা করবে আপনার কথা। এই শক্তি আপনার মনকে দৃঢ় প্রত্যয়ী করবে আর আপনি হবেন ক্ষমতার অধিকারী। এই শক্তি অর্জনে সক্ষম হলে আপনি হবেন সমাজে গৌরবান্বিত ব্যক্তি আর আপনার মর্যাদা হবে সমসমাজের সবার উপরে। বই শক্তির মধ্যে যেন জাদু আছে যা আপনাকে সব সময় প্রাণচঞ্চল করে রাখবে। বক্তৃতা শুরু করার দুমিনিট আগে আমি, একজন বক্তা স্বীকার করেছেন “চিন্তা করে নিই গভীর ভাবে এবং শুরু করি সাবলীল ভাষায়, কিন্তু শেষ করার দু’মিনিট আগে আমি আস্তে-আস্তে গতি কমিয়ে দিই ও শেষ করি।”

যে কোনো কাজে যে ব্যক্তি মতি স্থির করতে পারে না সে অর্ধপথে পথ হারিয়ে ফেলে। সুতরাং যে কোনো কাজে সফল হতে লক্ষ্য স্থির করে যাত্রা শুরু করতে হবে এবং লক্ষ্যস্থল সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা নিয়ে স্থির মস্তিষ্কে এগুতে হবে। গভীর আত্মবিশ্বাস নিয়ে কাজ শুরু করলে বাধাবিপত্তি সত্বেও আপনি আপনার লক্ষ্যস্থলে উপনীত হতে সক্ষম হবেন। চড়াই-উত্রাই পেরিয়ে আপনি পৌঁছবেন আপনার লক্ষ্যে। স্বল্প কথায় আপনার লক্ষ্য স্থলে পৌঁছতে হলে সে পথকে মনে করতে হবে সহজ। অর্থাৎ আপনি যা করেছেন তাই হচ্ছে সহজ কাজ, এ কথা মনে করলে সহজে এগুনো যাবে, পশ্চাদপসরণের প্রয়োজন হবে না।

জুলিয়াস কায়জার তার সৈন্যবাহিনী নিয়ে গল প্রণালী অতিক্রম করে ইংল্যান্ডে পৌঁছে কী করেন? কীভাবে তার বাহিনীর বিজয় নিশ্চিত করেন? তিনি অত্যন্ত চালাকীর কাজ করেন, তিনি তার বাহিনীকে ডোবার তীরে অবতরণ করিয়ে সমস্ত জাহাজে আগুন ধরিয়ে দেন। সৈনিকেরা দেখতে পায় যে সব জাহাজে তারা এসেছিল সে সব জাহাজ আগুনের লেলিহান শিখায় পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে। সুতরাং এখান হতে দেশে ফিরে যাবার তাদের আর কোনো পথ নেই। শত্রুর দেশে বেঁচে থাকতে হলে তাদের এগিয়ে যেতে হবে, জয়লাভ করতে হবে। তারা অতঃপর সে কাজেই করে সাফল্যের সাথে।

জয়ের এরূপ আকাঙ্ক্ষাই ছিল কায়জারের মনে। শ্রোতা ভীতি দূর করার জন্য কেন আপনি অনুরূপ মনোভার গ্রহণ করবেন না।

দ্বিতীয়ত : আপনি যে বিষয়ে বলবেন সে বিষয়টি ভালোভাবে জেনে নিন। কোনো ব্যক্তি তার বক্তব্য সম্পর্কে চিন্তা ও পরিকল্পনা না করলে এবং তিনি কী বলবেন তা না জানলে শ্রোতাদের সামনে বক্তব্য পেশ কালে তিনি সহজ ও স্বাভাবিক হতে পারবেন না, তার কাজ হবে একজন অন্ধ কর্তৃক আর একজন অন্ধকে পরিচালনা করার মতো। এই অবস্থায় বক্তাকে হতে হবে আত্মসচেতন। নতুবা তাকে অনুতাপ করতে হবে, পড়তে হবে লজ্জায়।

”১৮৮১ সালের শেষের দিকে আমি আইন পরিষদে নির্বাচিত হই” টেড কেনেডী লিখেছেন তার আত্মজীবনীতে, “এবং আমি নিজেকে তখন পরিষদের সর্ব কনিষ্ট সদস্য রূপে দেখতে পাই। অন্যান্য সকল তরুণ ও অনভিজ্ঞ ব্যক্তির মতো আমি তখন বক্তৃতাতে বিরাট অসুবিধার সম্মুখীন হই। কিন্তু একজন গ্রাম্য বৃদ্ধ ব্যক্তি, যিনি অত্যন্ত সহজ ভাষায় কথা বলতেন, ওয়েলিংটনের মতো এক কথা বারবার বলে মনের ভাব প্রকাশ করতেন, তিনি আমাকে বলেন, তোমার কথা বলা প্রয়োজন এ কথা নিশ্চিত হবার আগে মুখ খুলো না। যখন কথা বলার প্রয়োজন হবে তখন চিন্তা করে নিও, তুমি যে সম্পর্কে বলবে তা তোমার জানা কিনা, যদি নিশ্চিত হও তখন তুমি তোমার বক্তব্য সহজ ও সংক্ষিপ্ত ভাবে পেশ করে বসে পড়বে।”

এই বৃদ্ধ গ্রাম্য লোকটি রুজভেল্টকেও তাঁর স্নায়ুবিক দুর্বলতা হতে মুক্ত হবার পথ দেখিয়েছিলেন। তিনি আমাকে আরো বলেছিলেন, “শ্রোতাদের সামনে বক্তৃতা করার সময় যদি তুমি কিছু দেখাতে পার, ব্লাক বোর্ড বা অন্যত্র কোনো কিছু লিখতে পার, অথবা মানচিত্রে কোনো স্থান নির্দেশ করতে পার, বই পুস্তক, কাগজ পত্র নাড়া চাড়া করতে পার, হাত পা নেড়ে বক্তব্য বিষয় উপস্থাপন করতে পার, তবে তুমি ফাঁকে-ফাঁকে চিন্তা করার সময় পাবে। বক্তব্য সহজতর হবে এবং মনেও তুমি গৃহের পরিবেশ অনুভব করবে।”

এটা সত্য যে, বক্তৃতা কালে সব সময় এরূপ প্রদর্শনী বা অঙ্গ ভঙ্গির সুযোগ হয় না। কিন্তু কখনো কখনো এরূপ সুযোগ আসে। যদি সুযোগ পান এরূপ করবেন। তবে তা করবেন বক্তৃতার প্রাথমিক সময়ে। কেননা শিশু একবার হাঁটতে শিখলে আর সে কোনো কিছুকে অবলম্বন করে হাঁটে না। হাঁটতে চায় না।

তৃতীয়ত : দৃঢ় বিশ্বাস

আমেরিকার খ্যাতনামা মনোবিজ্ঞানী অধ্যাপক উইলিয়ম জেমস লিখেছেন :

যে কোনো কাজের পর জাগে অনুভুতি। কিন্তু বাস্তবে কাজ ও অনুভুতি এক সাথেই চলে। ইচ্ছাশক্তি কাজকে নিয়ন্ত্রণ করে, এবং তদ্বারা আমরা অনুভূতি ও নিয়ন্ত্রণ করতে পারি।

সুতরাং মনে আনন্দ সৃষ্টির সর্বোত্তম পন্থা হচ্ছে এমন কাজ এবং এমনভাবে করা যাতে মনে আনন্দের আবেগ সৃষ্টি হয়, আনন্দ হয়। একবার চেষ্টায় মনে এ আনন্দ আনা না গেলে বারবার চেষ্টা করতে হবে।

অনুরূপ ভাবে, নিজেকে সাহসী বলে ভাবতে হলে যে কোনো কাজ সাহসিকতার সাথে করতে হবে। এই কাজে সর্বশক্তি নিয়োগ করুন, দেখবেন আস্তে-আস্তে ভয় দূরীভূত হয়ে গেছে, সাহস এসেছে মনে।

সাধারণ্যে বক্তৃতা করতে দাঁড়িয়ে আপনি অধ্যাপক জেমস এর উপদেশ অনুসরণে কাজ করুন, ভাবুন এটি শ্রোতাদের সামনে আপনার প্রথম দিন নয়। অবশ্যই আপনি যদি প্রস্তুত না থাকেন তবে আপনি পুরোপুরি সফল হবেন না। আপনাকে অবশ্যই জানতে হবে, শ্রোতাদের সামনে আপনি কী বলতে যাচ্ছেন। বক্তৃতা শুরু করার আগে আপনি দীর্ঘ শ্বাস গ্রহণ করুন। ফুসফুঁসে অধিক অম্লজান আপনাকে অধিক শক্তি জোগাবেও সাহস জোগাবে। জীন ডি রেস্কী সব সময় বলতেন, আপনি দীর্ঘশ্বাস নিন, তা হলে আপনার শক্তি ও সাহস বাড়বে।

সর্বযুগে, সকল দেশে, মানুষ সব সময় সাহসের প্রশংসা করেছে। সুতরাং মঞ্চে দাঁড়িয়ে আপনাকে এমনভাবে বক্তব্য পেশ করতে হবে যাতে শ্রোতারা মনে করে, আপনি যা করছেন তা করছেন দৃঢ় বিশ্বাস ও সাহসিকতার সাথে। প্রমাণ করতে হবে আপনি সাহসী।

শ্রোতাদের চোখে-চোখে সরাসরি তাকিয়ে আপনি এমনভাবে বক্তব্য পেশ করতে শুরু করুন, যেন সকল শ্রোতাই আপনার খাতক। তারা সবাই ঋণী, ধরে নিন যে ঋণের মেয়াদ বাড়াবার আবেদন জানাবার জন্যেই তারা আপনার সামনে সমবেত হয়েছে। এই মনস্তাত্বিক চিন্তার ফল আপনার জন্যে হবে কল্যাণকর।

কোনো অবস্থাতেই ঘাবড়াবেন না। যদি মনে ভীতির সঞ্চার হয়, মন চঞ্চল হয়ে উঠে, শরীরে জাগে কম্পন, তা হলে এটা শ্রোতাও দর্শকদের কাছে গোপন করার জন্যে, আপনার দুটি হাতকে পিছনে নিয়ে যান। একহাতে অন্য হাত ঘর্ষণ করুন, পায়ের বুড়া আঙুল দিয়ে মঞ্চে ঘর্ষণের চেষ্টা করুন, তা হলে শক্তি ফিরে পাবেন।

কোনো আসবারপত্রের পিছনে দাঁড়িয়ে আড়াল থেকে বক্তৃতা করা খারাপ। কিন্তু প্রথম দিকে এরূপভাবে বক্তৃতা করার চেষ্টা আপনাকে সাহস যোগাবে। আপনাকে বক্তৃতা করায় অভ্যস্ত করে তুলবে।

টেডী রুজভেল্ট কীভাবে সাহসী ও আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেছিলেন? তিনি কি প্রকৃতি হতে বিশেষ প্রতিভা নিয়ে জন্মেছিলেন? মোটেই না, “আমি ছিলাম রুগ্‌ণ ও দুর্বল,” তিনি তার আত্মজীবনীতে স্বীকার করেছেন। যৌবনে আমি স্নায়বিক দৌর্বল্য হতে মুক্ত ছিলাম না। আমার সুস্থ, মন উৎফুল্ল করার জন্য আমাকে করতে হয়েছে কঠোর পরিশ্রম।

সৌভাগ্যের বিষয় যে, তিনি কী পদ্ধতি অনুসরণ করেছিলেন তা আমাদের বলেছেন। ”যখন বালক ছিলাম” তিনি লিখেছেন, মেরিয়টের বইতে আমি একটি নিবদ্ধ পাঠ করি, যা আমাকে সব সময় অনুপ্রাণিত করতো। এই নিবন্ধে ব্রিটিশ নৌ বাহিনীর জনৈক সাহসী ক্যাপটেনের কথা বলা হয়েছে। বলা হয়েছে, তিনি কীভাবে তার বাহিনীকে সাহসী ও ভীতি মুক্ত করে তুলে ছিলেন। তিনি বলেছেন, কাজের প্রারম্ভে সকল মানুষই ভয় করে, ইতস্তত করে। কিন্তু কাজে সফল হতে হলে কর্তাকে এমনভাবে কাজ করতে হবে যেন ভয় কাকে বলে তা তিনি জানেন না। এরূপ মনোভাব নিয়ে কাজ শুরু করলে সকল মানুষই ভীতিমুক্ত হতে পারে। কেননা ভয় অনুভব না করলে ভীতি দূর হয়ে যেতে বাধ্য হয়।

আমি এই তত্ত্বই অনুসরণ করেছি। প্রথমে আমি যে কোনো কাজেই ভয় পেতাম কিন্তু সেদিন হতে আমি ভাবতে শুরু করলাম, আমি ভীত নই, ভীতি আমার মন হতে আস্তে-আস্তে দূর হয়ে গেল। এই পদ্ধতি অনুসরণ করলে ভীতি মুক্ত হওয়া সম্ভব।

ইচ্ছা করলে আপনিও এই পদ্ধতি অনুসরণ করতে পারেন। ‘যুদ্ধ’ বলেছেন মার্শাল ফেচ ”প্রতিরক্ষার সর্বোত্তম পন্থা হচ্ছে আক্রমণ।” সুতরাং আপনার ভীতির বিরুদ্ধে আক্রমণ শুরু করুন, প্রতিরোধের চেষ্টা করুন, সগ্রাম করুন, দৃঢ়তার সাথে তা জয় করার চেষ্টা করুন, সাফল্য অনিবার্য।

মঞ্চে দাঁড়িয়ে ভীত হবেন না। বলতে যখন দাঁড়িয়েছেন, বলতে আপনাকে হবেই। আপনি বলবেন, সুতরাং এমনভাবে বলার চেষ্টা করুন যাতে শ্রোতারা বুঝতে না পারে, আপনি ঐ বিষয় সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নন। বিষয়টি নিয়ে চিন্তা করুন। যা বলবেন তা দৃঢ়তার সাথে স্বচ্ছন্দ ভাষায় প্রকাশ করুন, তাহলে শ্রোতারা মুগ্ধ হবে, আপনি জয়ী হবেন।

চতুর্থত: অভ্যাস, অভ্যাস আর অভ্যাস :

এ ক্ষেত্রে আমরা সর্বশেষ যে বিষয়টি উল্লেখ করছি তা হচ্ছে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ, এ পর্যন্ত আপনি যা পড়েছেন তা সম্পূর্ণ ভুলে গেলেও স্মরণ হবেই। বক্তৃতায় আত্মবিশ্বাস সৃষ্টির উপায় হচ্ছে বলা, বলার অভ্যাস করা। এর অর্থ হচ্ছে যে কোনো কিছু সঠিক ভাবে করতে হলে প্রয়োজন অভ্যাস, অভ্যাস আর অভ্যাস। এটিই সাফল্যের পূর্ব শর্ত।

”যে কোনো প্রাথমিক শিক্ষার্থী জড়তায় আক্রান্ত হতে বাধ্য,“ বলেছেন রুজভেল্ট। এই জড়তা হচ্ছে স্নায়বিক দুর্বলতা প্রসূত। এই জড়তার আক্রমণে যে কোনো মানুষই বক্তৃতা করতে দাঁড়িয়ে বিফল হতে পারে। শুধু প্রথম দিন নয়, এই জড়তা কাটাবার চেষ্টা না করলে বারবার এ অবস্থান সৃষ্টি হতে পারে। এই রূপ ক্ষেত্রে বক্তৃার যা প্রয়োজন তা হল সাহস নয়, স্নায়ু নিয়ন্ত্রণ এবং স্থির। মস্তিষ্কে চিন্তা করা। এটা করা অর্থাৎ স্নায়ু নিয়ন্ত্রণ ও স্থির মস্কিষ্কে চিন্তা করা নির্ভর করছে প্রচেষ্টা ও অভ্যাসের উপরে। ইচ্ছা এবং চেষ্টা করলে যে কোনো ব্যক্তিই তাঁর স্নায়ুকে সম্পূর্ণ নিজ নিয়ন্ত্রণে আনতে পারে। এটা হচ্ছে ইচ্ছা শক্তির বারবার প্রয়োগের ব্যাপার। মনোবল যদি দৃঢ় হয় স্নায়ু নিয়ন্ত্রণের ইচ্ছা যদি প্রবল হয়, তবে যে কোনো ব্যক্তির মনই দৃঢ় হতে দৃঢ়তর হবে, তার ইচ্ছা শক্তির জয় হবে।

আপনি কি শ্রোতাভীতি থেকে মুক্ত হতে চান? এর কী কারণ আসুন আমরা তা জানার চেষ্টা করি।

“অজ্ঞতা ও অনিশ্চয়তাই ভীতির উৎস” বলেছেন অধ্যাপক রবিনসন্স, মনের জন্ম বইতে। অন্যভাবে এ কথা বলা যায়, আত্ম বিশ্বাসের অভাবেই ভীতি?

এর ফল কী হয়? আপনি কি করতে চান তা আপনি কি পারেন না? এবং অভিজ্ঞতার অভাবেই আপনি বুঝতে পারেন না, আপনি নিজেই জানতে করতে পারেন। আপনি বার বার সফল হলে আপনার ভীতি দূর হয়ে যাবে। জুলাই মাসের উজ্জ্বল সূর্যালোকের মতো সাফল্য জ্বলজ্বল করবে।

জলে হাবুডুবু খাওয়া ছাড়া সাঁতার শেখা যায় না, এটা সকলের কাছেই নিশ্চিত সত্য। আপনি দীর্ঘদিন হতে এই বই পড়ছেন, সুতরাং কেন চেষ্টা করে দেখছেন না, সাফল্য কতটুকু এল?

আপনি একটি বিষয় বেছে নিন, এমন বিষয় বেছে নিন, যা আপনি জানেন। ওটার ওপর তিন মিনিটের একটি কথিকা লিখুন। কয়েক বার তা নিজে-নিজে প্রকাশ করার চেষ্টা করুন। অতঃপর তা নিয়ে বন্ধুদের সামনে হাজির হোন। তাদের সামনে দৃঢ়তা ও আত্মপ্রত্যয়ের সাথে প্রকাশ করুন। বক্তৃতার ভঙ্গিতে পেশ করুন।

(১) কয়েক হাজার ছাত্র এই গ্রন্থকারের কাছে লিখেছেন তারা কেন জনসমক্ষে বক্তৃতা পেশ শিখতে চান এবং শিক্ষা হতে তাঁরা কী পেতে চান। তাঁদের প্রায় সকলের বক্তব্য হচ্ছে যে কোনো সংখ্যক শ্রোতার সামনে দাঁড়াতে তাঁরা স্নায়বিক দুর্বলতা মুক্ত হতে চান, যা বলবেন সে সম্পর্কে সুস্পষ্ট ভাবে চিন্তা ও আত্মবিশ্বাসের সাথে নিজ বক্তব্য পেশ করে জয়ী হতে চান।

(২) এই রূপ যোগ্যতা অর্জন তেমন কষ্টকর নয়। এটা কতিপয় ব্যক্তির জন্য প্রকৃতির দান নয়। এটা গলফ খেলার যোগ্যতা অর্জনের মতো ব্যাপার। যে কোনো ব্যক্তি পুরুষ বা নারী ইচ্ছা করলে এবং আন্তরিকভাবে চেষ্টা করলে এই যোগ্যতা অর্জন করতে পারেন।

(৩) বহু অভিজ্ঞ বক্তা শ্রোতাদের সামনে যেরূপ সহজ ও সাবলীলভাবে বক্তব্য পেশ করতে পারেন, ব্যক্তি বিশেষের সাথে কথোপকথনে সেরূপ সহজভাবে মনের কথা প্রকাশ করতে পারেন না, এরূপ ক্ষেত্রে বহু সংখ্যক ব্যক্তির উপস্থিতি বক্তাকে উৎসাহিত করে, অনুপ্রাণিত করেন। আপনি যদি এই বই এ উপদেশ যথাযথভাবে অনুসরণ করেন, একদিন দেখবেন, এই অভিজ্ঞতা আপনার ভাণ্ডারেও সঞ্চিত হয়েছে। আপনি সব সময় প্রস্তুত রয়েছেন জনসমক্ষে বক্তৃতা করতে, কেননা, এই বক্তৃতা আপনাকে আনন্দ দেয়।

(৪) যত বেশিই আপনি বক্তৃতা করুন না কেন, সব সময়ই দৃঢ় আত্ম প্রত্যয়ের সাথে বক্তব্য পেশ করার চেষ্টা করুন। তা হলে আপনি কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই ভীতি মুক্ত হতে পারেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *