২৮. অযথা সময় নষ্ট করবেন না

২৮. অযথা সময় নষ্ট করবেন না

আমরা প্রায় সকলেই বলে থাকি যে সময় নেই, সময়ের খুব অভাব। কিন্তু সারা দিন রাতের এই চব্বিশ ঘন্টা সময় নষ্ট না করে ঠিকমতো কাজে লাগানোই হল আসল কথা। আমেরিকার বিখ্যাত প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের স্ত্রী মিসেস রুজভেল্টকে কেউ কর্মবিমুখ অলস অপবাদ দিতে পারে নি। লেখাপড়ার সাথে সাথে নানারকম কাজ, তারই সঙ্গে বিভিন্ন জাতির মধ্যে সৌহার্দ্য স্থাপন করার জন্য তৎপরতা চালানো এই সমস্ত কাজের মধ্যে তিনি অহরহ ডুবে থাকতেন। এ কথা কখনোই শোনা যায় নি যে সময়ের অভাব হয়েছে।

আশ্চর্যের ব্যাপার মিসেস রুজভেল্টের মতো চব্বিশ ঘন্টা হাতে পেয়েও আমরা কিন্তু নিজের আর সংসারের কাজে লাগে এমন কিছুই করতে পারি না। কিন্তু কেন পারি না? এর উত্তর হল, সংসারের কাজের জন্য।

কোনো মহিলা যদি তার সময়কে সুনির্বাচিতভাবে ব্যয় করেন তবে নিজের এই ফলাফল দেখে আশ্চর্য হয়ে যাবেন। তাই বলা যায়, বিষয়টির তাৎপর্য লক্ষ্য করে নিজেকে দিয়ে ভালো কিছু করার চেষ্টা করুন। এক সপ্তাহের রোজনামচা আর খতিয়ান পর্যালোচনা করলে আপনি স্পষ্ট বুঝতে পারবেন, কীভাবে আপনার জীবনের মূল্যবান সময় বয়ে চলেছে।

এই সাপ্তাহিক হিসেবের আলোয় আপনি আপনার সময়ের বাজেট তৈরি করে নিন। এর মধ্যে থেকেই নির্ধারণ করে নিন, কোন কাজের জন্য দৈনিক কত সময় ব্যয় করবেন। দেখবেন, আপনার সময়ের বৃথা অপচয় আপনার থেকেই বন্ধ হয়ে গেছে।

নিউইয়র্কে ‘নিউ স্কুল ফর সোস্যাল রিসার্চ কর্তৃপক্ষ একটি প্রশিক্ষণ কোর্সের ব্যবস্থা করেছেন। এই কোর্সের নাম হল সমাজের নারীর মানবিক সম্পর্কের কারখানা।’ মিস এলিমা রাইসক নামে একজন ব্যবসায়ী আর শিক্ষিকা এখানে শিক্ষাদান করেন। এই শিক্ষার প্রধান অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল মহিলাদের সমাজে যথোপযুক্ত মর্যাদা আর স্বীকৃতি লাভের জন্য করণীয় বিষয় শেখানো। এই শিক্ষণ ব্যবস্থার প্রথম কাজ হল প্রত্যেক ছাত্রী কীভাবে সময় ব্যয় করছে তার তালিকা তৈরি করা। কেননা, দৈনিক চব্বিশ ঘন্টা সময়ের বরাদ্দ থেকেই এইসব মুহূর্ত নিঃশেষ হয়ে চলে।

এই সব মুহূর্তকে বেশ লাভজনক ভাবেই কাজে লাগান যায়। থিয়োডর রুজভেল্ট যখন আমেরিকার রাষ্ট্র প্রধান ছিলেন তখন তার ডেস্কের ভিতর সবসময় একখানা বই খুলে রেখে দিতেন। কথাবার্তা আর লোকজন ইত্যাদির দেখা সাক্ষাতের মাঝখানে তিনি যে দু’তিন মিনিট সময় পেতেন সেটুকু ওই বই পড়ার কাজে ব্যবহার করতেন। আপনিও চেষ্টা করলে পারেন আপনার জীবনে যে সময়গুলো নষ্ট হয় সেই সময়গুলোকে কাজে লাগাতে। সৃজনশীল লোকেরা যা করেন আপনিও তাই করে দেখতে পারেন। অর্থাৎ আপনার সময়সূচিকে লিপিবদ্ধ করার চেষ্টা করুন। সময় এতই মূল্যবান যে তাকে সৃষ্টি ধর্মী কাজে ব্যবহার করা একান্ত প্রয়োজন।

আপনি নিশ্চয়ই লক্ষ করে থাকবেন যে, আপনার পরিচিত যে সব কর্মব্যস্ত মানুষ ঠিক ঠিক সময়ে তাদের কাজ সম্পন্ন করেন তাদের কিন্তু কখনোই সময়ের অভাব ঘটে না। সম্ভবত, একজন কর্মব্যস্ত স্বামীর তরুণী স্ত্রী যিনি তিন সন্তানের মা, পেশায় তিনি হয়তো মেট্রন, এই সমস্ত কাজের মহা দায়িত্ব পালন করে থাকেন। তাকে নিজের হাতে সংসারের যাবতীয় কাজ করতে হয়, আবার রবিবার দিন তিনি গির্জায় প্রার্থনা সঙ্গীতেও অংশ নেন।

এটা ঠিক যে এই ধরনের মহিলারা অনেক বেশি কর্মশক্তির অধিকারিণী হয়ে থাকে। কারণ তারা কীভাবে নিজেদের সব ব্যবস্থা করার মধ্যে দিয়ে ঘর সংসার গুছিয়ে নিতে হয় সেটা শিখে নিয়েছেন আর সবার উপরে সময়ের মূল্য সম্বন্ধে তারা অত্যন্ত সচেতন আর ওয়াকিবহাল থাকেন। এ কথা সত্য যে, সময়ের অপচয় করা বিপুল অর্থ ব্যয় করা চেয়েও বেশি ক্ষতিকর। যে সময় একবার চলে যায় তাকে আর ফিরে পাওয়া যায় না। কীভাবে সময়ের অপচয় বন্ধ করা যায়, সে সম্পর্কে এখানে কয়েকটি নিয়মের উল্লেখ করছি :

১। সময় জরিপ করুন : প্রত্যহ আপনি যে সময় ব্যয় করেন সে সম্পর্কে নিষ্ঠার সঙ্গে একটা জরিপ করার কাজ করুন। ভালোভাবে অনুধাবন করলেই বোঝা যাবে সময় কোথায় যায়।

২। আগাম প্রতিটি দিনের কাজে জন্য সময় নির্দিষ্ট করে রাখুন : প্রত্যেক সপ্তাহে পরের সপ্তাহের জন্য আগাম প্রতিটি দিনের কাজের জন্য সময় নির্দিষ্ট করে রাখুন। মনে রাখবেন, যুক্তিসঙ্গত সময়ে প্রতিদিনের কাজগুলো সমাধা করলে স্নায়ুর উপর চাপ কমে-ক্লান্তি আর অবসাদও দূর হয়ে যায়।

৩। বিভিন্নভাবে সময় কাজ লাগান : সময়ের অভাবে কাজটি করতে পারেন নি, এমন কোনো কাজ বেছে নিয়ে সেটা শেষ করার ব্যবস্থা করুন। এ কাজটি করবেন আপনার পাওনা অবসর সময়টুকু কাজে বেছে নিয়ে সেটা শেষ করার কোনো কারণ নেই।

৪। একটি ঘণ্টাকে দু’ঘণ্টায় পরিণত করুন : মিসেস গুজার্ডি এটাই করতেন। তিনি স্বামীর বিক্রির অভিযান সফল করার জন্যই করতেন। তিনি একটা কাজে নিবিষ্ট থাকার মধ্যেই অন্য কোনো কাজ করতে থাকেন। অর্থাৎ এক বিষয়ের কথাই মনে মনে চিন্তা করে চলেন। যেমন-শিশুকে পার্কে বেড়াতে নিয়ে যাওয়ার মুহূর্তে অনায়াসেই সেলাইয়ের কাজটি শেষ করে নেওয়া যায়। এভাবেই এক ঘণ্টা দু’ঘণ্টায় পরিণত হতে পারে।

৫। বিশ শতকের সময় রক্ষকের পদ্ধতি : দৈনিক সংবাপত্রের বিজ্ঞাপন, ক্রেতা গবেষণা কেন্দ্রের বুলেটিন, ডাকযোগে বইপত্রের গ্রাহক সংগ্রহ ডাকবিভাগ ও টেলিফোনের ব্যবহার ইত্যাদি নিঃসন্দেহে সময় সংক্ষেপ করার উদ্দেশ্যেই চালু হয়। যে সব জিনিস আগে থেকে ডাকযোগে আনার ব্যবস্থা করা যায়, তা নিঃসন্দেহে সময় বাঁচানোর তাগিদ থেকে উৎপন্ন।

৬। সময় বাঁচানোর জন্য ক্রয় কৌশল শিখুন : আপনার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম জানা থাকা, বিশেষ বিশেষ জিনিস কেনা বা বেচা সম্পর্কে অবহিত থাকা আর একই সময়ে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র যত বেশি কিনে রাখা সম্ভব ক্রেতার পক্ষেও সত্যিই লাভজনক কাজ। সুচিন্তিতভাবে কেনাকাটা একটি বুদ্ধিমানের কাজ। এজন্য অবশ্য সতর্কতার প্রয়োজন। কীভাবে কিনতে হয়, এটা জানা থাকলে আপনি আর্থিক ও সময়ের দুটি দিক থেকেই লাভবান হতে পারেন। নিঃসন্দেহে এটা পৃথিবীর সব দেশেই প্রমাণ হয়েছে।

৭। কাজের প্রতিবন্ধকতা দূর করুন : কাজের সময় যে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয় একটু চেষ্টা করলেই আপনি তা দূর করতে পারবেন।

‘হাউ টু লিভ অন টোয়েন্টিফোর আওয়ার্স এ ডে’ গ্রন্থটিতে লেখক মি. আর্নল্ড লিখেছেন যে সময় সরবরাহ ব্যাপারটা সত্যই অলৌকিক কোনো ব্যাপার…সকালে ঘুম থেকে জেগে ওঠার পর অবাক বিস্ময়ে দেখতে পাবেন যে, আপনার জীবনের চব্বিশটি ঘন্টা মন্ত্রবলেই যেন প্রকৃতি আপনার মূলধনের সঙ্গে একই সঙ্গে গেঁথে দিয়েছেন। আমাদের মধ্যে এমন কেউ নেই যিনি সারা জীবন ধরে বলেন না, আর একটু সময় পেলেই আমি অনেক পরিবর্তন আনতে পারতাম। মনে রাখতে হবে, আমরা আর কখনোই এর চেয়ে বেশি সময় পাবো না। আমাদের হাতে সময় আছে, সবসময় ছিল-আর তা ভবিষ্যতেও থাকবে।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *