২০. স্বামীর কাজে উৎসাহ দিন

২০. স্বামীর কাজে উৎসাহ দিন

১৯২৬ সালে জেন ওয়েলস টমাস কার্লাইলকে বিয়ে করেন। তিনি ইচ্ছে করলে যে কোনো উচ্চপদস্থ মানুষকে সহজেই বিয়ে করতে পারতেন। কারণ টমাস কার্লাইল অসাধারণ ধীশক্তি সম্পন্ন মানুষ হলেও প্রায় গ্রাম্য আর কিছু বিচিত্র চরিত্রের। প্রচণ্ড রকম খামখেয়ালী। তাঁর অর্থকরী অবস্থা মোটেই ভালো ছিল না। বলতে গেলে কিছু ভবিষ্যতও ছিল না। থাকার মধ্যে তাঁর যা ছিল তা হল তীক্ষ্ণ বুদ্ধি আর সুপ্ত প্রতিভা।

জেন কার্লইল তাঁর স্বামীর জীবন-যাত্রার মানকে করে তুলতে চান উন্নত। সম্রমকে উন্নতির চরম সীমায় পৌঁছে দিতে চান।

জেন নিজে ছিলেন একজন সত্যিকার ধীশক্তি-সম্পন্ন মহিলা কবি। অথচ স্বামীর কাজে আরও বেশি সময় দেবার উদ্দেশ্যে কবিতা রচনা ত্যাগ করেন। টমাস কার্লাইল ছিলেন একজন স্কটল্যান্ডের মানুষ। জেন কার্লাইল চাইছিলেন এটাই দেখতে যে তার স্বামী এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের লর্ড রেক্টরের পদ অলংকৃত করছেন। এই কারণেই জেন বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয় পরিজনকে ছেড়ে চলে যান সুদূর স্কটল্যাণ্ডের এক নিরিবিলি গ্রামে স্বামীর সঙ্গে। জেন ছিলেন সত্যিকার একজন মিতব্যয়ী গৃহিণী। নিজের পোশাক পরিচ্ছদ তিনি নিজেই বানিয়ে নিতেন। তিনি স্বামীর সেবা শুশ্রূষা করতেন এবং স্বামীর অসন্তোষকে হেসেই উড়িয়ে দিতেন। তাঁর সবচেয়ে যে প্রশংসনীয় গুণটি ছিল তা হল-তিনি কখনোই স্বামীর ব্যক্তিগত মতামত বদল করার চেষ্টা করতেন না। তিনি স্বামীকে তাঁর পছন্দ করা পথেই চলতে দিতে চাইতেন আর পৃথিবীর সকলেই এই মতটাই গ্রহণ করুক এটাই তিনি চেয়েছেন।

এটা সত্যি যে, একজন মানুষকে তার নিজের শক্তির পরিমাণ বুঝতে দেওয়া আর তার শক্তির বাইরে ঠেলে দেওয়া-এই দুটোর মধ্যে যথেষ্ট তফাৎ আছে। প্রত্যেক স্ত্রীর উচিত পুরুষদের শক্তির সীমা বোঝার চেষ্টা করা। এটা সত্যি যে আমরা কখনোই সব সময় অতখানি সচেতন থাকি না। এখনও দেখা যায় যে, অনেকে কারও অধীনস্থ থাকার ফলে চমৎকার কাজ করার দক্ষতা লাভ করে। অথচ তাদের যদি কোনো সময় জোর করে উঁচু পদে দায়িত্বশীল কাজের ভার চাপিয়ে দেওয়া হয় তাহলে তাদের যোগ্যতা কমতে শুরু করে। এদের পরিণতি হয় খুবই করুণ। তারা হয় আলসার, না হয় অন্যভাবে মৃত্যু বরণ করে। কারণ তাদের দেহের গঠনে ওই অতিরিক্ত পরিশ্রম সহ্য হয় না। কৃতকার্যতা নির্ভরশীল যে পরিমাণ কাজ আমাদের মানসিক, শারীরিক আর আভ্যন্তরীণ ধাতু প্রভৃতি সহ্য করতে সক্ষম।

ওরিমান মারডেন বলেন, প্রথম শ্রেণীর ভারবাহকের চেয়ে দ্বিতীয় শ্রেণীর বাহক হওয়া অনেক ভালো।

এটা আমাদের মনে রাখা দরকার যে, প্রকৃতি কখনও কোনো মানুষকে উচ্চপদস্থ মানুষ হওয়ার যোগ্যতা দিয়ে তৈরি করে না। কিন্তু আমরা উঁচু উপাধিকারীদের এই ধরনের অতিরঞ্জিত সম্মানই কিন্তু দিতে অভ্যস্ত।

কোনো মানুষকে সে যে কাজ পছন্দ করে না সে ব্যাপারে যতই উদ্যোগী করে তোলার চেষ্টা করা হোক না কেন, সে ওই কাজ কিছুতেই মন দিয়ে করতে পারে না। উন্নতি জড়িত থাকলেও আবার দেখা যায়, মানুষ তাতেও সফল হয় না আবার কখনও কখনও বেশি এগিয়ে যাওয়ার সুযোগও দুর্ভাগ্যের সূচনা করে বসে।

এ ব্যাপারে একটা উদাহরণ দিচ্ছি। আমেরিকার হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের হনলুলুর পুলিশ বিভাগের ক্লিফোর্ড ওয়েজম্যানের কথাই বলতে চাই। সে ছিল পুলিশের মোটর টহলদারী দলের একজন। সে হাইডেন স্ট্রীটে বাস করে। তার ছোট মেয়ে জন্মানোর সময় তাকে অন্য এক দপ্তরে বদলি করা হয়, এই বদলির ফলে তার মাইনেও বাড়ে। কিন্তু এর ফলে তার পরিশ্রম আর দায়িত্বও অনেক বৃদ্ধি হয়। এর ফলে স্ত্রী আর শিশুকন্যার দেখাশোনা করার মতো সময়ও তার থাকে নি। কিন্তু বাধ্য হয়েই তাকে নতুন কাজের দায়িত্ব পালন করে চলতে হল। এর পরিণামে ওয়েজম্যানের ওজন কমতে শুরু করল। ওয়েজম্যান অবসাদে প্রায় ভেঙ্গে পড়তে লাগলো। শেষ পর্যন্ত তাকে ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হল।

ডাক্তার ওয়েজম্যানের সঙ্গে নানা আলোচনার পর আসল রোগ ধরতে পারলেন। ডাক্তার পুলিশ প্রধানকে জানালেন ওয়েজম্যানকে যেন আগের পদেই কাজ করতে দেওয়া হয়, না হলে তারা একজন দক্ষ পুলিশ কর্মীকে হারাবেন। কারণ ওয়েজম্যান অবসাদগ্রস্ত, পুলিশ প্রধান আবার ওয়েজম্যানকে আগের পদেই ফিরিয়ে আনার পর তার স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটতে লাগল। অবসাদও দূর হয়ে গেল। মাইনের চেয়ে অনেক বেশি মহৎ হল স্বাস্থ্য, সুখ ও তৃপ্তি।

অনেক স্ত্রী আছেন যারা তাদের স্বামীদের চাকরিতে উঁচু পদে দেখতে আগ্রহী। প্রতিযোগিতায় স্বামীদের জয়ই তাদের একমাত্র কাম্য, হঠাৎ কোনোভাবে কোনো স্বামী এই ধরনের উঁচুপদে আসীন হলে পরে কিন্তু নানা সমস্যা পারিবারিক জীবনকে কন্টকিত করে তোলে। এখন স্বামীদের আর আগের জায়গায় ফিরে আনার কোনো উপায় থাকে না। কারণ সেটা তার ক্ষমতার বাইরে এ কথা ঠিক যে অত্যধিক মাত্রায় উচ্চাকাঙ্ক্ষা সাংঘাতিক রকম ক্ষতিকর। নিউইয়র্ক টাইমসের সাম্প্রতিক এক সংখ্যায় একটি খবরের শিরোনাম আমার নজরে পড়েছিল, সেই শিরোনামে জানা যায় যে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের বহু অফিসার উচ্চাকাঙ্ক্ষার কারণে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন।

কিছু ব্যাপারে আমাদের সতর্ক থাকা উচিত। আমরা আমাদের আয়ত্তাধীন কাজের অনবরতই সমালোচনা করি-আর যে কাজ আমাদের বহির্ভূত তারই প্রতি আমাদের আগ্রহ থাকে সব থেকে বেশি। এই মিথ্যার পিছনে ছুটতে চেয়ে আমরা ব্যর্থ হই আর নিজেদের বা স্বামীদের আত্মহত্যার পথ খুলে দিতে চাই। এ বিষয়ে ডাঃ পিটার জে, স্টেইনক্রোন হাউ টু স্টপ কিলিং ইওর সেলফ’ গ্রন্থটিতে এই ধরনের মনোভাবাপন্ন স্ত্রীদের দায়ী করেছেন, যারা আরও সম্মান-অর্থ আর জীবনধারনের জন্য বিলাসিতা আর তারই সঙ্গে প্রতিবেশীদের চেয়ে আরও যশ প্রতিপত্তি লাভ করার জন্য স্বামীদের উৎসাহিত করেন সেই স্ত্রীদের তিনি দোষারোপ করেছেন।

ডা. স্টেইনক্রোন বলেন, ওই ধরনের মহিলারা হয় জন্মসূত্রে বা শিক্ষার ফলে এই ধরনের অতিমাত্রায় উচ্চভিলাসী হয়ে থাকেন। আমাদের একমাত্র উচিত হবে আমাদের স্বামীদের তাদের ক্ষমতার সদ্বব্যবহার করতে দেওয়া আর অযথা ব্ৰিত না করা। স্ত্রী হিসাবে কোনোভাবেই আমাদের উচিত নয় যে, স্বামীদের অনির্ধারিত কোনো কাজের দিকে ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা করা।

বিখ্যাত লেখক এন. ডি. ব্যারোচ তাঁর ‘আর্ট অব লিভিং’ গ্রন্থে বলেছেন যে, “একজন রাষ্ট্রনায়ক কখনোই রাষ্ট্রের সমস্ত সমস্যার সমাধান করতে পারে না। আবার তেমনই একজন ভ্রমণকারী পৃথিবীর সব দেশও ভ্রমণ করতে পারেন না।” এই কারণে প্রয়োজন দেখা দিলে কোনো প্রলোভন মত্ত অনুপযুক্ত ব্যক্তিকেও প্রয়োজন দেখা দিলে কোনো প্রকল্প থেকে সরিয়ে দিতে হয়।

তাই স্ত্রীদের সব সময় মনে রাখা প্রয়োজন, স্বামীর সাফল্য যদি চান তবে তাকে উৎসাহিত করুন, ভালবাসুন ও তার সহকর্মী হয়ে উঠুন। কিন্তু কখনোই, তাঁকে দিয়ে কিছু অতিরিক্ত কাজ করানোর চেষ্টা করা উচিত হবে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *