০৫. মানসিক ভাবধারা গঠনের কথা শুনুন

০৫. মানসিক ভাবধারা গঠনের কথা শুনুন

১৯৫০ সালের একটা ঘটনার কথা আপনাদের শোনাচ্ছি।

আমেরিকার শিকাগো শহরে বিল জোনস নামে একজন লোক প্রচণ্ড মানসিক বিপর্যয়ে পড়ে অর্থাৎ দৈন্যদশার হাত থেকে রেহাই পাবার জন্য আত্মহত্যা করার পরিকল্পনা নেয়। পাঁচতলা একটা বাড়ির ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে। ব্যবসা নষ্ট হয়ে যাওয়ায় পাওনাদার আর অন্যান্যদের ধার শোধ করা তার পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠে নি। নিজের মানসিক যন্ত্রণার কথা সে কিন্তু তার স্ত্রীকে আদৌ বলতে পারে নি। স্ত্রী যদি আঘাত পায় তাই সে তার স্ত্রীকে কথাটা জানাতে পারে নি। একে একে নৈরাশ্যের অন্ধকারে ডুবে যেতে থাকে। এই নৈরাশ্যই তাকে আত্মহননের পথে টেনে নিয়ে যায়। কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছার বিরুদ্ধে বোধ হয় কেউ যেতে পারে না। তাই বিল ঝাঁপিয়ে পড়লেও বাইরে বেরিয়ে থাকা কার্নিশের উপর ওর দেহ পড়ার ফলে কার্নিশ ভেঙে বিল রাস্তার উপর পড়ে যায়। কার্নিশের উপর পড়াতেই তার জীবন রক্ষা পেয়ে গেল।

যখন জ্ঞান ফিরল তখন জোনস দেখলো যে, সে বেঁচে রয়েছে আর ছটফট করে চলেছে। ব্যাপারটা বিল-এর কাছে অলৌকিক বলে মনে হল। সে ভাবতেই পারলো না যে, সে বেঁচে আছে। জীবন ফিরে পেয়ে সে আনন্দে শিহরিত হল। যত শীঘ্র সম্ভব বাড়ি ফিরে গিয়ে স্ত্রীকে সব কথা খুলে বললো। সমস্ত কথা শুনে জোনসের স্ত্রী প্রথমে ভেঙ্গে পড়লেও নিজেকে সামলে নিল। তার দুঃখ হল যে, তার স্বামী কেন তাকে আগে সব কথা বলে নি এই ভেবে। বিল-এর স্ত্রী শান্তভাবে এবারে তার স্বামীকে বিভিন্নভাবে ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা সম্বন্ধে নানা পরামর্শ দিয়ে চললো।

এরপর নতুন উদ্যমে জীবন শুরু করলো বিল জোনস। ওর স্ত্রীর পরামর্শ আর প্রেরণাই জোনসকে পথ দেখাতে চাইল। নানা সমস্যার মধ্যে দিয়েও বিল সমস্ত দুশ্চিন্তা আর বিপদ-আপদ কাটিয়ে উঠলো। দুঃখ আর বাধা সে জয় করেছিল নিজের স্ত্রীকে সমব্যথী হিসেবে পেয়ে। বিল জোনসের এই কাহিনী থেকে এই কথাই প্রমাণ হয় যে, স্ত্রীকে বিশ্বাস করে সব কথাই বলা প্রত্যেক স্বামীর অবশ্য কর্তব্য।

আবার অনেক পরিবারে দেখা যায় যে, স্বামী ক্লান্ত অবস্থায় বাড়ি ফিরে এসে অফিস সংক্রান্ত কোনো কথা স্ত্রীকে বলতে চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। বহু ক্ষেত্রেই একা কোনো সমস্যার ভার বহন অসহনীয় হতে পারে, এক্ষেত্রে স্ত্রীকেই এগিয়ে আসতে হবে। একজন আদর্শ গৃহিণীকে মনে রাখতে হবে, যে কোনো স্ত্রীই ভালো শ্রোতা হয়ে স্বামীকে গভীর প্রশান্তি আর স্বাচ্ছন্দ্য দিতে পারে। স্ত্রী অনেক সময় স্বামীর কাছে সুপরামর্শদায়িনী হতে পারে। স্বামীকেও ধৈর্য সহকারে স্ত্রীর কথা শুনতে হবে। উভয়কেই হতে হবে ভালো শ্রোতা। জনপ্রিয়তা অর্জনের ক্ষেত্রে এর দাম অনেক। অনেক ক্ষেত্রে ভালো শ্রোতা বিরক্তিকর লোকের কাছে প্রভাবিত হতে পারে। বিখ্যাত চিত্রাভিনেত্রী মার্নালয় বলেছিলেন যে, জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক সংস্থায় নানা দেশ থেকে আগত নানা প্রতিনিধির কথা শুনে বিভিন্ন দেশ আর জাতির সমস্যা সম্পর্কে তিনি চমৎকার জ্ঞান লাভ করেন। মিস লয়ে আরও বলেন যে, অনেকেই হয়তো উদ্দেশ্যহীন ভাবে নানা মুখরোচক গল্পে মেতে থাকেন। কিন্তু আমার ধারণা এরকম করার চেয়ে একজন ভালো শ্ৰেতা হওয়া অনেক বেশি কাজের।

কেমন করে ভালো শ্রোতা হবেন?

একজন ভালো জাতের শ্রোতা হতে গেলে মোটামুটি তিনটি গুণ থাকা প্রয়োজন–

১। শুধু কানকে কাজে না লাগিয়ে শ্রোতাকে তারই সঙ্গে কাজে লাগাতে হবে চোখ মুখ আর সারা শরীরকে :

শ্রোতাকে প্রথমত খুব মনোযোগী হতে হবে। অর্থাৎ সমস্ত কাজের ক্ষমতাকে কেন্দ্রীভূত করে তুলতে হবে। আমাদের তাই ভালো শ্রোতা হতে গেলে এমন কাজ করতে হবে যাতে বোঝা যায় শ্রোতার দিকে আমরা আকৃষ্ট হয়েছি। শরীরের ভঙ্গির মধ্যেও সেই ভাবটি পরিস্ফুট করতে হবে।আসল কথা আদর্শ স্বামী আর স্ত্রীকে পরস্পরের কাছে ভালো শোতা হতে হবে।

২। ভালো কার্যকর প্রশ্ন করুন :

প্রশ্ন করা ব্যাপারটা দু’জনের মধ্যে চমৎকার বোঝাঁপড়ার পরিবেশ সৃষ্টি করে। এক্ষেত্রে শ্রোতাই বক্তাকে পরিচালনা করবেন। এমন প্রশ্ন হবে যাকে বলা হয় পরিচালক প্রশ্ন। এই ধরনের পরিচালক প্রশ্ন আলোচনার মনোভাব জাগিয়ে তোলায় সাহায্য করে।

কিন্তু সরাসরি আর পরিচালক প্রশ্ন কী রকম? ধরা যাক কোনো শ্রোতা বক্তাকে প্রশ্ন করল, কাজ নির্বাহ আর কাজ পরিচালনা-এ কাজ দুটি কি একই সাথে করা যায়? এটা হল সরাসরি প্রশ্ন। কিন্তু বক্তা যদি প্রশ্ন করেন, আপনি কি মনে করেন যে ক্ষেত্রবিশেষে কাজ নির্বাহ আর কাজ পরিচালনা-এই দুয়ের সমন্বয় সাধন কী করে সম্ভবপর?’ এই ধরনের প্রশ্নকে বলা হয় পরিচালক প্রশ্ন। কোনো লোক যদি একজন ভালো শ্রোতা হতে চায় তবে তার কাছে এই ধরনের পরিচালক প্রশ্ন করা অবশ্যই চমৎকার নৈপুণ্যের। একজন আদর্শ স্ত্রীর পক্ষে ভালো শ্রোতা হওয়াও খুব কার্যকরী।

কোনো স্বামীকে তার স্ত্রী এই ধরনের পরিচালক প্রশ্ন করতে পারে, যেমন—’আচ্ছা, তোমার কি মনে হয় আরও বিজ্ঞাপন দিলে সত্যিই কি জিনিসের বিক্রি বাড়ে?’ এই ধরনের প্রশ্নের মধ্যে উপদেশ দেওয়ার ভঙ্গি মোটেই থাকে না অথচ এতে চমৎকার কাজ হয়। শ্রোতার উত্থাপন করা ভালো প্রশ্ন খুবই ফলপ্রসূ হয়। যে কোনো মানুষই যখন কোনো ভাব সম্পন্ধে আলোচনা করে তখন বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সে কিছুটা আত্মস্মিত হয়। অবশ্য এ ধরনের ব্যাপার বিষয় বৈচিত্রের উপর নির্ভর করে। এক ভাব অপর ভাবকে আকর্ষণ করে।

৩। কখনও বিশ্বাসঘাতকতা বা প্রতারণা নয় :

আমাদের সমাজে এমন বহু পুরুষ আছেন যারা স্ত্রীর সঙ্গে কোনো রকম আলোচনা করা পছন্দ করেন না। আসলে তারা স্ত্রীকে বিশ্বাস করেন না। তাদের ধারণা স্ত্রী সব কথা বিভিন্ন জনের কাছে প্রকাশ করে ফেলবে। শোনা যায়, একজন কার্য পরিচালক নীতি গ্রহণ করে তার অধীনস্থ সব কর্মচারীকে আদেশ দিতেন যে বাড়ি ফেরার পর স্ত্রী বা কারও সঙ্গে অফিস সংক্রান্ত খোলামেলা আলোচানা বিশেষ করে মহিলা মহলে যদি করা হয় তাহলে প্রচুর ক্ষতির আশংকা থাকে।

এমন উদাহরণও লক্ষ্য করা যায়, যেখানে স্ত্রী স্বামীর প্রত্যেকটি কাজেরই খুঁটিনাটি বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেন। এই ধরনের স্বামী তার স্ত্রী সম্বন্ধে খুবই গর্ব অনুভব করবেন সেটাই স্বাভাবিক। এই ধরনের স্ত্রী বাড়ির পরিবেশকে চমৎকার সুন্দর করে তুলবেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

নিচের তিনটি নিয়ম মেনে চললে যে কোনো গৃহিণী সত্যই ভালো শ্রোতা হয়ে উঠতে পারেন।

১। মুখের কথা অর শারীরিক ক্রিয়ার মাধ্যমে মনোযোগ আকর্ষণ করুন।

২। বুদ্ধিমানের মতো প্রশ্ন করুন।

৩। কখনোই বিশ্বাসঘাতকা বা প্রতারণা করা উচিত নয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *