২৮. হারানো আয়না

২৮. হারানো আয়না

হ্যারির পা রাস্তা স্পর্শ করল। সে স্মৃতি বিজড়িত হগসমিডের রাস্তাটার দিকে তাকাল; দোকানগুলো অন্ধকার, গ্রামের বাইরে কালো পাহাড়ের প্রান্ত দেখা যাচ্ছে। রাস্তাটা বেঁকে হোগার্টের দিকে চলে গেছে। প্রি ক্রমস্টিকের জানালাগুলো দিয়ে আলো দেখা যাচ্ছে। হ্যারির বুকটা ছলাৎ করে উঠল। তার মনে পড়ল এক বছর আগে পরিশ্রান্ত ও দুর্বল ডাম্বলডোরকে সঙ্গে নিয়ে কী সুন্দরভাবে এখানে নেমেছিল। নামার এক সেকেন্ডের ভেতর কেবল হারমিয়ন এবং রনের ঘাড়ের উপর তার হাতটা ঢিলে করেছে তখনই বিষয়টি ঘটল।

চিৎকারে বাতাস বিদীর্ণ হয়ে গেল। মনে হল ভোল্ডেমর্ট বুঝতে পেরেছে যে কাপটি যোয়া গেছে। চিৎকার হ্যরির প্রতিটি স্নায়ুকে মনে হল ছিঁড়ে ফেলেছে। এরপর, প্রায় সাথে সাথেই সে বুঝতে পারল যে এই চিল্কারের কারণ তাদের নেমে আসা। সে আলখাল্লার নিচে অন্য দুজনের দিকে তাকাল। কিন্তু ততক্ষণে থ্রি

মস্টিকের দরোজা দড়াম করে খুলে গেল এবং ডজেন খানেক মাথা ঢাকা ডেথ-ইটার বের হয়ে রাস্তায় নেমে এল। ওদের যাদুদণ্ডগুলো তুলে ধরা।

রন তার যাদুদণ্ড উঁচু করতেই হ্যারি তার হাতটা ধরে ফেলল। স্টান করা যাবে

না, ওরা সংখ্যায় অনেক। এমনকি অন্য কোনো পদক্ষেপ নিতে গেলেও তাদের অবস্থান জেনে যেতে পারে। একটি ডেথ-ইটার তার যাদুদণ্ড তুলে নাড়ল এবং চিৎকার দিতে থাকল। সে চিৎকারের শব্দ পাশের পাহাড়ে গিয়ে প্রতিধ্বনি তুলল।

অ্যাকসিও ক্লক! গর্জন করে ডেথ-ইটার বলল।

হ্যারি ঝট করে আলখাল্লার ভাঁজগুলো শক্ত করে ধরে ফেলল। কিন্তু এটির সরে যাওয়ার কোনো ভাব দেখা গেল না। সামনিং চার্ম আলখাল্লার উপর কাজ করেনি।

তাহলে ওটার ভেতরে মোড়ানো নেই, হ্যারি পটার? চিৎকার করে ডেথ ইটার বলল। তারপর তার সঙ্গীদের উদ্দেশে বলল, চারদিকে খোজ! সে এখানেই আছে!

ছয়টি ডেথ-ইটার ওদের দিকে ধেয়ে আসছে। হ্যারি, হারমিয়ন এবং রন যতটা তাড়াতাড়ি সম্ভব রাস্তার এক পাশে নেমে গেল। এক ইঞ্চির জন্য ওরা ডেথ ইটারদের সঙ্গে ধাক্কা খেল না। ওরা অন্ধকারের ভেতর রাস্তার পাশের নিচু জায়গাটায় অপেক্ষা করতে থাকল।

ডেথ-ইটারদের দৌড়াদৌড়ির আওয়াজ পাওয়া গেল। ওদের যাদুদণ্ডের আলোতে রাস্তা ভরে উঠেছে।

হারমিয়ন বলল, চলো আমরা চলে যাই! এখনই ডিসাপ্যারেট করি!

ঠিক বলেছ, আমাদের এখন তাই করা উচিৎ! রন বলল। কিন্তু হ্যারি কোনো উত্তর দেয়ার আগেই একটি ডেথ-ইটার বলল, আমরা জানি তুমি এখানে হ্যারি পটার। পালাবার কোনো উপায় নেই! আমরা তোমাকে ধরবই!

ওরা আমাদের জন্য প্রস্তুত হয়েই ছিল,হ্যারি বলল। ওরা স্পেল প্রস্তুত করে রেখেছিল যে আমরা এখানে আসার সাথে সাথেই ওরা জানতে পারবে। আমার ধারণা ওরা এমন কিছু করে রেখেছে যেন আমাদেরকে এখানে ধরতে পারে, আমাদের আটকে রাখতে।

এরপর শুনতে পেল :

ডেমেনটরদের কী হল? অন্য একটি ডেথ-ইটার বলল। ওদের নিজেদের মত কাজ করতে দাও। ওরা দ্রুত খুঁজে বের করতে পারবে।

ডার্ক লর্ড চান না পটার অন্য কারো হাতে মারা যাক, তিনি নিজে

ডেমেনটররা তো হত্যা করবে না, ডার্ক লর্ড ওর জীবনসহ চায়, ওর আত্মাটাকে তো চায় না। তাকে প্রথম দর্শনেই কিস করা হলে সহজেই মারা যাবে!

এই আলোচনার শব্দ পাওয়া গেল। হ্যারিকে প্রচণ্ড ভয় আকঁড়ে ধরল। ডেমেনটরদের প্রতিরোধ করতে ওদের এখন প্রয়োজন প্যাট্রোনাস তৈরি করা। তাহলে সঙ্গে সঙ্গে ওদের দূর করা যাবে।

আমাদের এখনই ডিসাপ্যারেট করার চেষ্টা করা উচিত হ্যারি! হারমিয়ন ফিসফিস করে বলল।

হারমিয়ন কথা বলার পরপরই হ্যারি অনুভব করল একটি অসম্ভব ধরনের ভৌতিক শীতল বাতাসের স্রোত রাস্তায় প্রবাহিত হতে শুরু করেছে। চারপাশের আলো ও বাতাস শুষে যেন উধ্বাকাশে তারার ভেতর চলে যাচ্ছে। নিকষ অন্ধকারে হ্যারি অনুভব করলো হারমিয়ন ওর হাত চেপে ধরেছে। ওরা তিনজনই একই জায়গার উপর ঘুরল। এখন আর কোনো বাতাস নেই।

এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নড়তে যে বাতাস ওদের প্রয়োজন তা মনে হল নেই। স্থবির হয়ে গেছে। ডেথ-ইটাররা ভাল যাদু করেছে। ঠাণ্ডা হ্যারির শরীরের গভীর থেকে আরো গভীরে প্রবেশ করছে। হ্যারি, রন এবং হারমিয়ন রাস্তার এক পাশে এসে দাঁড়াল। তারপর হাতিয়ে হাতিয়ে কোনো শব্দ না করে দেয়ালের পাশে যেতে চেষ্টা করল। ঠিক তখনই দেখল দশ বা আরো বেশি ডেথ-ইটার ওদের দিকে নিঃশব্দে এগিয়ে আসছে। ওদের দেখা যাচ্ছে কারণ চারপাশের অন্ধকারের চেয়েও আরো বেশি কালো ওদের আলখাল্লাগুলো। ওরা কি এই এলাকার ভেতর ওদের উপস্থিতির বিষয়টি বুঝতে পেরেছে? হ্যারি এ ব্যাপারে নিশ্চিত; ওরা আগের চেয়েও দ্রুত ধেয়ে আসছে।

সে যাদুদণ্ড উপরে তুলল। পরে যাই হয় হবে, ডেমেনটরদের কিস তো সহ্য করা যাবে না। সে রন এবং হারমিয়নের কথা চিন্তা করল। তারপর বিড়বিড় করে বলল, এক্সপেকটো প্যাট্রোনা!

একটি রুপালী হরিণ ওর যাদুদণ্ডের আগা দিয়ে ঝপাস করে বের হল। ডেমেনটররা পথের থেকে ছিটকে এদিক সেদিক গেল। দৃষ্টির বাইরে থেকে ওদের চিৎকার শুনতে পেল।

এখানে! ওই নিচের জায়গাটিতে! সে! আমি ওর প্যাট্রোনাসটা দেখেছি! সেটি একটি মাদী হরিণ!

ডেমেনটরগুলো সরে গেল, স্টারগুলো আবার ফিরে আসতে শুরু করেছে। ডেথ-ইটারদের পায়ের আওয়াজ বাড়তে থাকল। কী করা যায় সিদ্ধান্ত নেয়ার আগেই রাস্তার কাছেই হাতের বাঁয়ে খটাস করে একটি দরোজা খুলে গেল। একটি কর্কশ স্বর বলে উঠল, হ্যারি ভেতরে চলে আসো! তাড়াড়াড়ি!

কোনো দ্বিধা না করেই হ্যারি তার কথা শুনল। তিনজনই একসাথে গাদাগাদি করে দরোজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল।

উপরে চলে যাও, আলখাল্লার নিচেই থাকো, একেবারে চুপচাপ! বিড়বিড় করে লম্বা শরীরটি বলল। এবং সে ওদেরকে অতিক্রম করে রাস্তায় গিয়ে নামল এবং পেছন থেকে দরোজাটি বন্ধ করে দিল।

হ্যারির কোনো ধারণা নেই যে কোথায় এসেছে। কিন্তু হ্যারি দেখল একটি মাত্র মোমবাতি জ্বলছে। ধুলোবালি মাখা একটি হগহেড বার। ওরা দৌড়ে কাউন্টারের পেছনে চলে গেল। দেখল আরেকটি দরোজার ভেতর দিয়ে একটি কাঠের সিঁড়ি উপরে উঠে গেছে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ওরা সেটি বেয়ে উঠে গেল। সিঁড়ি বেয়ে উঠতেই একটি বসার ঘর। কার্পেট পাতা, পাশেই একটি ছোট ফায়ারপ্লেস। ফায়ারপ্লেসের উপরেই একটি তেলরঙ ছবি টাঙানো। ছবিটি একটি সোনালী চুলের মেয়ের। সে রুমটির দিকে তাকিয়ে আছে মিষ্টি চোখে।

নিচের রাস্তা থেকে চিল্কারের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। অদৃশ্য আলখাল্লার নিচে থেকেই ওরা নিচু হয়ে জানালার কাছে গেল এবং নিচের দিকে তাকালো। দেখল ওদের রক্ষাকারী হগহেডের একমাত্র বারম্যানেরই মাথায় লম্বা উঁচু টুপি নেই।

তাতে কি? তিনি চিৎকার করে একটি মাথা ঢাকা শরীরকে বলছেন। তাতে কি? তোমরা আমার রাস্তায় ডেমেনটরদের পাঠিয়েছ। আমিও তাদের বিরুদ্ধে একটি প্যাট্রোনাস পাঠাবো। আমি ওদেরকে আমার কাছাকাছি যেতে দেব না। আমি তোমাকে সেটা বলেছি, এটি আমার!

ওটা তোমার প্যাট্রোনাস না! একটি ডেথ-ইটার বলল। ওটা ছিল একটি হরিণ, হ্যারি পটারের!

হরিণ! বারম্যান গর্জন করে বললেন। তারপর একটি যাদুদণ্ড বের করলেন। হরিণ ইডিয়ট!-এক্সপেকটো প্যাট্রোনাম!

একটি বিশাল শিংঅলা প্রাণী যাদুদণ্ডের থেকে বের হয়ে এল। মাথাটা নিচু করে রাস্তার দিকে এবং চোখের বাইরের কোনো একটা কিছুর দিকে ছুটে গেল।

আমি এটা দেখি নাই! ডেথ-ইটার অনিশ্চয়তার সাথে বলল।

কারফিউ ভাঙা হয়েছে, তুমি সে শব্দ শুনেছ, আরেকটি সঙ্গী ডেথ-ইটার বারম্যানকে বললেন। কেউ একজন আদেশ ভঙ্গ করে রাস্তায় উঠে এসেছিল

যদি আমি আমার বিড়ালটিকে বের করতে চাই, তাহলে আমি তা করবো, ওই কারফিউর ধার ধারি না!

তুমি কি ক্যাটারভোলিং চার্ম ছুঁড়েছো?

তাহলে কী হবে? আমাকে আজকাবানে নিয়ে যাবে? আমি আমার দরোজার সামনে কি হচ্ছে তা দেখার জন্য আমাকে হত্যা করবে? যদি তাই করতে চাও, কর! কিন্তু আমি তোমাকে বলে রাখছি, তুমি নিশ্চয়ই তোমার ডার্ক মার্কটিতে চাপ দেবে না তাকে এখানে ডেকে আনার জন্য। আমার জন্য এবং আমার বিড়ালের জন্য তিনি এখানে ডেকে আনাটা পছন্দ করবেন না, তিনি কি এখন এখানে আসবেন?

আমাদের নিয়ে তোমার চিন্তা করতে হবে না! একটি ডেথ-ইটার বলল। তুমি নিজেকে নিয়ে ভাবো, কারফিউ ভঙ্গ করেছ!

আমার বারটি বন্ধ হয়ে গেলে তুমি পোশন এবং পয়জন পাচার করবে কোথায়? তোমার বাড়তি ব্যবসার কী হবে?

তুমি কী আমাকে ধমক দিচ্ছ?

আমি আমার মুখ বন্ধ রাখি কাউকে বলে দেইনা, সেজন্যই তো তুমি আমার কাছে আসো, তাই না?

আমি এখনো বলছি আমি একটি হরিণ প্যাট্রোনাস দেখেছি! প্রথম ডেথ ইটার বলল।

হরিণ? বারম্যান বললেন। এটি একটি ছাগল ইডিয়ট!

ঠিকাছে, আমরা একটি ভুল করে ফেলেছি, দ্বিতীয় ডেথ-ইটারটি বলল। আবার কারফিউ ভাঙলে আমরা কিন্তু আর কোনো রেহাই দেব না।

ডেথ-ইটারগুলো লম্বা পা ফেলে উঁচু রাস্তার দিকে চলে গেল। হারমিয়ন একটি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। টেনে আলখাল্লার ভেতর থেকে বের হল এবং একটি চেয়ারের উপর আরাম করে বসল। হ্যারি পর্দাটি সতর্কতার সঙ্গে টেনে দিল। তারপর তার এবং রনের উপর থেকে আলখাল্লাটি টেনে সরিয়ে দিল। ওরা নিচে বারম্যানের ফিরে আসার শব্দ পেল। সে বারের দরোজাটি টেনে খুলল। এবং সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে আসতে থাকল।

হ্যারির হঠাৎ ফায়ার প্লেসের উপর একটি জিনিসে নজর পড়েছে। ঠিক ছবিটির নিচে তিনকোণা একটি আয়না উপরে দাঁড় করানো আছে।

বারম্যান রুমে প্রবেশ করলেন।

বোকার হদ্দরা! সবার দিকে তাকিয়ে ক্ষুব্ধ লোকটি বললেন। এখানে এসেছো কী মনে করে!

থ্যাঙ্ক ইউ, হ্যারি বলল। আমরা আপনাকে ধন্যবাদ দিয়ে শেষ করতে পারব না। আপনি আমাদের জীবন রক্ষা করেছেন।

বারম্যান গুমগুম করলেন। হ্যারি লোকটির কাছে এল। তাঁর মুখের দিকে ভালো করে দেখল। সময় নিয়ে দেখতে চেষ্টা করল। ধুসর চুল এবং দাড়ি। তিনি একটি চশমা পরে আছেন। ময়লা লেন্সের পেছনে নীল বুদ্ধিদীপ্ত দুটি চোখ।

আপনার চোখ দুটিই আমি আয়নায় দেখে আসছি।

রুমের ভেতর নিস্তব্ধতা নেমে এল। হ্যারি এবং বারম্যান একে অপরের দিকে তাকালো।

আপনিই ডোবিকে পাঠিয়েছিলেন।

বারম্যান হ্যাঁ সুচক মাথা নাড়লেন এবং ঘরের ভূতটিকে দেখার জন্য চারদিকে তাকালেন।

আমি ভেবেছিলাম সেও তোমাদের সঙ্গে আছে। তাকে কোথায় রেখে এসেছ?

হ্যারি বলল, সে মারা গেছে। বেলাট্রিক্স তাকে হত্যা করেছে।

বারম্যানের মুখটিতে অস্থিরতা দেখা গেল। একটু সময় নিয়ে তিনি বললেন, কথাটা শুনে দুঃখ পেলাম। আমি ওই ঘরের ভূতটিকে ভালো জানতাম।

তিনি অন্য দিকে ঘুরলেন। বাতিটাকে হাতের যাদুদণ্ড দিয়ে ঠেলে দিলেন। তিনি কারো দিকে তাকালেন না।

হ্যারি পেছন থেকে বলল, আপনি হলেন আবারফোর্থ।

তিনি হা-ও করলেন না আবার না-ও করলেন না।

আপনি এটা কোথায় পেলেন? হ্যারি সিরিয়ুসের আয়নাটির কাছে যেতে যেতে বলল। দুটি আয়নার একটি সে দুবছর আগে ভেঙে ফেলেছিল।

আবারফোর্থ বললেন, বছর খানেক আগে আমি এটি ডাঙের কাছ থেকে কিনেছি। অ্যালবাম আমাকে বলেছিল এটা কি জিনিস। এর ভেতর দিয়ে তোমার দিকে চোখ রাখা হয়েছে।

রন একটি নিঃশ্বাস ত্যাগ করল।

আর ওই রুপালী রঙের মাদী হরিণটি? রন উত্তেজনার সঙ্গে জানতে চাইল। সেটা কি আপনি ছিলেন?

আবারফোর্থ বললেন, তোমরা কীসের কথা বলছ?

কেউ একজন আমাদের কাছে একটি মাদী হরিণ প্যাট্রোনাস পাঠিয়েছিল?

এমন মাথা নিয়ে তুমি একটি ডেথ-ইটার হতে পারবে, বাচ্চা, এই একটু আগে আমি কি বুঝাইনি যে আমার প্যাট্রোনাসটি একটি ছাগল? রন বলল, ওহ, হ্যাঁ, ওয়েল, আমি খুবই ক্ষুধার্ত! সে নিজেকে রক্ষা করার জন্য বলল। ওর পাকস্থলীর ভেতর ভয়ানক রকমের মোচড় দিতে শুরু করেছে।

আমার এখানে খাবার আছে, আবারফোর্থ বললেন। এবং তিনি দ্রুত ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন। এক মুহূর্ত পরই তিনি প্রচুর পরিমান পাউরুটি, চিজ, টিনজাত খাবার এবং পানীয় নিয়ে প্রবেশ করলেন। তিনি সেগুলো ফায়ারপ্লেসের সামনে ছোট একটি টেবিলে রাখলেন। সবাই ক্ষুধার্ত, বেশ কিছুক্ষণ ফায়ারপ্লেসে আগুন জ্বলার শব্দ, মগের শব্দ এবং চিবানোর শব্দই শুধু শোনা গেল।

ঠিকাছে, আবারফোর্থ বললেন। সবার পেটপুরে খাওয়া হয়ে গেছে। রন এবং হ্যারি চেয়ারে হেলান দিয়ে বসল। তিনি আবার বললেন, আমাদের চিন্তা করে বের করতে হবে এখান থেকে বের হওয়ার উপায় নিয়ে। রাতে বের হওয়া যাবে না, তোমরা শুনেছ অন্ধকারে বের হলে বা নড়াচড়া করলে কী হয়। ক্যাটারওলিং চার্ম সেট করা আছে। ওরা তোমাদের উপর একেবারে বোট্রাকেলের ডিমের মত চড়ে বসবে। আমার মনে হয় না যে আমি দ্বিতীয়বার একটি হরিণকে ছাগল বলে চালাতে পারব। দিনের জন্য অপেক্ষা কর। দিনের বেলা কারফিউ উঠে গেলে তোমরা অদৃশ্য আলখাল্লার নিচে করে পায়ে হেঁটে হগসমিড থেকে বের হয়ে সোজা পাহাড়ে চলে যাবে। সেখান থেকে তোমরা ডিসাপ্যারেট করতে পারবে। হ্যাগ্রিডের সঙ্গে দেখা হয়ে যেতে পারে। তাকে গ্রেফতার করার চেষ্টার পর থেকে সে গ্রোপকে সাথে নিয়ে এখানে একটি গুহায় লুকিয়ে আছে।

হ্যারি বলল, আমরা এখান থেকে যাচ্ছি না। আমরা হোগার্টে প্রবেশ করব।

 আবারফোর্থ ধমকের সুরে বললেন, বোকামি করো না ছোকরা!

আমাদের ঢুকতেই হবে, হ্যারি বলল।

তোমাদের যা করতে হবে, আবারফোর্থ বললেন। তিনি সামনের দিকে ঝুঁকে এলেন। তাহলে এখান থেকে যতদূরে পারো চলে যাবে।

আপনি বুঝতে পারছেন না। আমাদের হাতে সময় নেই। আমাদের ক্যাসলের ভেতর ঢুকতেই হবে। ডাম্বলডো… মানে আপনার ভাই… আমাদেরকে

আগুনের আলোতে আবারফোর্থের চোখের চশমা ঘোলা দেখা গেল। উজ্জ্বল, সাদা দেখা গেল। হ্যারির সেই অন্ধ বিশাল মাকড়শা অ্যারাগগের কথা মনে পড়ল।

আবারফোর্থ বললেন, আমার ভাই তো অনেক কিছুই চাইত। সে যখন তার পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়ন করতো তখন লোকে দুঃখ পেত। তুমি এ স্কুল থেকে বের হয়ে যাও পটার, পারলে দেশ থেকে বাইরে চলে যাও। আমার ভাইয়ের কথা এবং তার চতুর পরিকল্পনার কথা ভুলে যাও। সে চলে গেছে, এবং এখন কিছুতে সে দুঃখ পাবে না। তোমার এখন তার কাছে কোনো দায় নেই।

হ্যারি আবার বলল, আপনি বুঝতে পারছেন না।

আবারফোর্থ বললেন, ওহ, আমি বুঝতে পারছি না! তুমি কী মনে করো না যে আমি আমার আপন ভাইকে চিনি? তুমি কী মনে করো যে অ্যালবাসকে তুমি আমার চেয়ে ভাল চেন?

আমি সে কথা বলতে চাইনি, হ্যারি বলল। সে এখন খাবার এবং ওয়াইন পান করার পর বেশ অলস এবং ক্লান্ত বোধ করছে। তিনি আমাকে একটি দায়িত্ব দিয়ে গেছেন-

আবারফোর্থ বললেন, তিনি দিয়েছেন, এখন? তাহলে ভাল দায়িত্ব মনে হচ্ছে? আনন্দের? সহজ কাজ? এমন কাজ, যা একটি অযোগ্য উইজার্ড বাচ্চাও করতে পারে কোনো চেষ্টা ছাড়াই?

রন একটি লম্বা হাসি দিল। কিন্তু হারমিয়নকে উদ্বিগ্ন দেখা গেল।

আমি বলছি না যে সহজ, এটা ঠিক খুব সহজ নয়, না, হ্যারি বলল। কিন্তু আমাকে যেতে হবে…

আবারফোর্থ বললেন, যেতে হবে? কেন যেতে হবে? সে তো আর নেই, তার পথ অনুসরণ করার আগে তুমি এ পথ ছাড়োয় নিজেকে বাঁচাও!

আমি পারি না

কেন পারো না?

আমি- হ্যারি দ্বিধান্বিত হয়ে গেল; সে ব্যাখ্যা করতে পারছে না। ফলে সে পাল্টা আক্রমণ করল, কিন্তু আপনিও তো লড়ে যাচ্ছেন, আপনি অর্ডার অব দ্য ফিনিক্সে।

হ্যাঁ, আমি ছিলাম, আবারফোর্থ বললেন। এখন নেই, অর্ডার অব দ্য ফিনিক্স শেষ হয়ে গেছে। ইউ-নো-হু জিতে গেছে, সুতরাং সব চুকে গেছে। যদি কেউ অন্য চিন্তা করে তাহলে সেটা হবে শিশুর মত চিন্তা। আমি তোমার জন্য এখানে কোনোক্রমেই নিরাপদ থাকব না পটার, সে তোমাকে ভয়ানকভাবে খুঁজছে। সুতরাং দূরে চলে যাও লুকিয়ে পড়ো এবং নিজেকে বাঁচাও। ভাল হয় এই দু জনকেও তোমার সঙ্গে নিয়ে গেলে। তিনি আঙ্গুল উচিয়ে রন এবং হারমিয়নকে দেখালেন। ওরা ভয়ানক বিপদে পড়বে। সবাই জানে যে ওরা দুজন তোমার সঙ্গে কাজ করছে।

আমি পিছপা হতে পারি না, হ্যারি বলল। আমি একটি দায়িত্ব নিয়েছি।

দায়িত্বটি অন্য কাউকে দাও!

তা পারা যাবে না। এটা আমাকেই করতে হবে। ডাম্বলডোর সবকিছু ব্যাখ্যা করছেন

ওহ, সে করেছে, এখন? সে কি তোমাকে খুলে সব কথাই বলেছে?

হ্যারি মনের ভেতর থেকে বলতে চাইল, হ্যাঁ, কিন্তু এই সাধারণ শব্দটি কেন যেন তার ঠোঁটে আসলো না। আবারফোর্থকে মনে হল হ্যারি কি চিন্তা করছে তা বুঝে ফেলেছেন।

আমি আমার ভাইকে চিনতাম, পটার। সে আমাদের মায়ের কোলে থাকতে সিক্রেসি শিখেছে। সিক্রেটস এবং মিথ্যার সঙ্গে আমরা বড় হয়ে উঠেছি। এবং অ্যালবাস…সে ছিল এসবে অভ্যস্ত।

বৃদ্ধের চোখ ওই ফায়ারপ্লেসের উপর রাখা ছবিটির উপর গিয়ে পড়ল। হ্যারি চারদিকে তাকিয়ে ভাল করে দেখল। ওই ছবিটিই রুমের ভেতর একমাত্র ছবি। অ্যালবাস ডাম্বলডোর বা অন্য কারো ছবি রুমের ভেতর নেই।

মি. ডাম্বলডোর, হ্যারমিন দুর্বল গলায় বলল। এটা কি আপনার বোন অরিয়ানার ছবি?

আবারফোর্থ থমকে গিয়ে বললেন, হ্যাঁ, তুমি কি রিটা স্কিটারের লেখা পড়েছ? গোলাপি আলোর ভেতরও বোঝা গেল যে হারমিয়ন লাল হয়ে গেছে।

হারমিয়নকে স্বস্তি দিয়ে হ্যারি বলল, এলফিয়াস ডোজে তার কথা আমাদের বলেছে।

ওই বুড়ো বলদটা, আবারফোর্থ আরেকবার গ্লাস থেকে চুমুক ঢোক গিলে বললেন। ভাবে যে আমার ভাইয়ের মুখ দিয়ে সুর্যের আলো বের হতো। ওয়েল অনেক লোকই এমন ভাবে। তোমাদের তিন জনেরও একই ব্যাপার বলে মনে হচ্ছে।

হ্যারি চুপ করে থাকল। সে ডাম্বলডোর সম্পর্কে কোনো সন্দেহ বা অনিশ্চয়তা প্রকাশ করতে চায় না। বিষয়টি এমনিতেই তাকে কয়েক মাস ধরে ভোগাচ্ছে। সে ডোবির কবর খোড়ার সময় সিদ্ধান্ত নিয়েছে অ্যালবাস ডাম্বলডোরের ইঙ্গিত করা পথেই সে চলবে তা যত বিপদজনক হোক। সাধারণভাবে সব বিশ্বাস করে নেবে। আবার তাকে সন্দেহ করার কোনো ইচ্ছা তার নেই। সে এমন কিছু শুনতে চায় না যা তার কাজের পথে বাধা হয়ে দঁড়াবে। সে আবারফোর্থ এর চোখের দিকে তাকালো। তার চোখ দুটি এত বেশি ডাম্বলডোরের মত যে রীতিমতো ধাক্কা লাগে। সেই নীল চোখ দুটিও তার দিকে তাকালো। মনে হল যেন একজন আরেকজনকে এক্সরের মাধ্যমে পরীক্ষা করছে। হ্যারি চিন্তা করল আবারফোর্থ জানেন সে কি চিন্তা করছে। আর সে কারণে হ্যারিকে মনে মনে ভর্ৎসনা করছেন।

হারমিয়ন নিচু স্বরে বলল, প্রফেসর ডাম্বলডোর হ্যারিকে ভীষণ ভালো জানতেন।

সে কি এখনো জানে? আবারফোর্থ বললেন। হাস্যকর, কত লোককে আমার ভাই ভীষণ ভালো জানতেন। অথচ তাদের একা ফেলে সে অমন মন্দ অবস্থায় শেষ করল।

হারমিয়ন বলল, আপনি কী বলতে চাইছেন? সেটা নিয়ে তুমি ভেবো না, আবারফোর্থ বললেন।

কিন্তু সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়! আপনি কি–আপনি কি আপনার বোনের ব্যাপারে কিছু বলছেন?

আবারফোর্থ হারমিয়নের দিকে তাকালেন। এমনভাবে মুখ নাড়লেন যেন তিনি মুখের ভেতর কথাগুলো চিবাচ্ছেন। তারপর তিনি হঠাৎ কথা বলে উঠলেন।

 আমার বোনটির যখন ছয় বছর বয়স ছিল তখন তাকে তিনটি মাগল ছেলে আক্রমণ করেছিল। ওরা দেখেছিল সে ম্যাজিক করছে। বাগানের পেছনের ঝোঁপের থেকে লুকিয়ে ওরা দেখেছিল। সে ছিল একটি বাচ্চা মেয়ে। সে তার যাদু নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। ওই বয়সের কেউই তা পারে না। ওরা যা দেখল তা থেকে ওরা ভয় পেয়েছিল বলে আমার ধারণা। ওরা ঝোঁপের ভেতর থেকে বের হয়ে এসেছিল। এবং সে যখন ওদেরকে কৌশলটি আর দেখাতে পারল না, ওরা তখন চেষ্টা করল তার এই কৌশল থামিয়ে দেয়ার জন্য।

হারমিয়নের চোখ দুটো লাল হয়ে গেল। রনকে মনে হল অসুস্থ হয়ে গেছে। আবারফোর্থ উঠে দাঁড়ালেন। ডাম্বলডোরের মতই তিনি লম্বা। হাঠাৎ তিনি ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছেন এবং ব্যাথায় মন ভরে গেছে।

ওরা যা করেছে তা মেয়েটাকে ধ্বংস করে দিয়েছে : সে আর কখনো ভালো হয়ে উঠতে পারেনি। সে আর ম্যাজিক করতে পারতো না, কিন্তু সে সেটা ভুলতে পারেনি। ব্যাপারটি তার মনের ভেতর ভীষণ নাড়া দেয় এবং সে পাগলের মত হয়ে যায়। সে নিজেকে যখন নিয়ন্ত্রণ করতে পারতো না তখন ভীষণভাবে ক্ষেপে উঠত। ভয়ানক বিপদজনক হয়ে উঠত। কিন্তু এমনিতে সে ছিল মিষ্টি, ভীরু এবং নির্দোষ একটি মেয়ে।

এবং যে বাস্টার্ডরা এ কাজটি করেছে আমার বাবা তাদের খুঁজতে থাকলেন। আবারফোর্থ বললেন। এবং ওদের আক্রমণ করলেন। আর সে কারণে তাকে আজকাবানে আটকে রাখা হল। কিন্তু তিনি কখনো বলেননি কেন তিনি কাজটি করেছেন। কারণ মিনিস্ট্রি যদি অরিয়ানার অবস্থাটা জানতো তাহলে তাকে সুস্থ করার জন্যই সেন্ট মুঙ্গসে আটকে রাখতো। ওরা তাকে ভারসাম্যহীন দেখে ইন্টারন্যাশনাল স্ট্যাচু অব সিক্রেসির জন্য বিপদজনক মনে করতো।

আমাদেরকে তাকে নিরাপদে এবং শান্ত করে রাখতে হতো। আমরা বাড়িটা সরিয়ে ফেললাম। এমনভাবে রাখলাম যেন সে অসুস্থ। আমাদের মা তাকে দেখাশোনা করতেন। তাকে শান্ত ও আনন্দে রাখার চেষ্টা করতেন।

আমি ছিলাম তার প্রিয়, আবারফোর্থ বললেন। তাকে দেখে মনে হল দাড়ির ভেতর দিয়ে একটি স্কুল বালকের চেহারা ভেসে উঠল। অ্যালবাসের সঙ্গে নয়, সে বাড়িতে থাকলে সারাক্ষণ তার রুমটিতে থাকতো। সে সময়ের বিশিষ্ট যাদুর নামগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রাখতো। আবারফোর্থ নাক সিটকালেন। সে অরিয়ানার বিষয় নিয়ে মাথা ঘামাতো না। অরিয়ানা আমাকেই সবচেয়ে ভাল জানতো। মা যখন তাকে খাওয়াতে পারতেন না তখন আমি তাকে খাওয়াতে পারতাম। প্রচণ্ড ক্রুদ্ধ হয়ে উঠলে আমি তাকে শান্ত করতে পারতাম। সে শান্ত হলে আমার সঙ্গে মিলে ছাগলগুলোকে খাওয়াতো।

এরপর…যখন তার বয়স চোদ্দ বছর….দেখ, আমি তখন সেখানে ছিলাম না, আবারফোর্থ বললেন। আমি যদি সেখানে থাকতাম তাহলে তাকে শান্ত করতে পারতাম। সে প্রচণ্ডভাবে ক্ষেপে গেল। আমার মা তখন অরিয়ানার মত অল্প বয়সের ছিলেন না…তখন একটি দুর্ঘটনা ঘটে গেল। অরিয়ানা সেটি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। কিন্তু আমার মা নিহত হলেন।

হ্যারির ভেতরে তীব্র বেদনা এবং ঘৃণার এক মিশ্রন তৈরি হল। সে এ কাহিনী আর শুনতে চায় না। কিন্তু আবারফোর্থ বলতে থাকলেন, এবং হ্যারির মনে হল কত লম্বা সময় ধরে তিনি এসব বলে যাচ্ছেন।

আর সে কারণেই অ্যালবাসের ডোজেকে নিয়ে বিশ্ব ভ্রমনে বের হওয়াটা বাতিল হল। ওরা দুজন আমাদের বাড়িতে ফিরে এল মায়ের শেষকৃত্যের জন্য। তারপর ডোজে তারমত চলে গেল ভ্রমনে, আর অ্যালবাস সংসারের কর্তা হয়ে রইল। হাহ্!

আবারফোর্থ ফায়ারপ্লেসের ভেতর থুথু ফেললেন।

আমিই অরিয়ানার দেখাশোনা করতে পারতাম, আমি তাকে সে কথা বলেছিলামও। আমি আমার স্কুল নিয়ে মাথা ঘামাইনি। আমি ঘরে থেকে কাজটি করতে পারতাম। কিন্তু সে আমাকে বলেছিল যে আমাকে আগে এডুকেশন শেষ করতে হবে, মায়ের দায়িত্বটি সেই নেবে। মি. ব্রিলিয়ান্টের জন্য কাজটি ভালো হলো না, প্রায় অর্ধ উন্মাদ বোনকে দেখা শোনা করার জন্য কোনো প্রাইজ মিলবে না। তাকে প্রতিনিয়ত ভাঙাচোরা করা থেকে বিরত করা কঠিন কাজ। কিন্তু সে কয়েক সপ্তাহ ধরে কাজটি ভালোই করেছে….কিন্তু সেই লোকটি আসা পর্যন্ত।

এবার আবারফোর্থের মুখে অন্য রকম একটি বিপদজনক চাহনি দেখা গেল।

গ্রিনডেলভাল্ড। আমার ভাইও ছিল তার মতই। ওরা একই রকম মেধাবী ছিল। এরপর অরিয়ানাকে দেখাশোনা করাটা শিথিল হয়ে পড়ল। ওরা ওদের পরিকল্পনা, হ্যালোস-এ যাবার বিষয়, একটি নতুন উইজার্ডিং অর্ডার এসব নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল উইজার্ডদের মঙ্গলের জন্য মহত পরিকল্পনা। এত বড় বিশাল মহত্বের কাজ অ্যালবাস করতে যাচ্ছে, সেখানে একটি ছোট মেয়েকে অবজ্ঞা করাটা কোনো ব্যাপার না।

কিন্তু কয়েক সপ্তাহ পর আমার মনে হল যথেষ্ট হয়েছে। প্রায় আমার যোগার্টে ফিরে যাবার সময় হয়ে আসছিল। সুতরাং আমি তাদের বললাম, দুজনকেই মুখোমুখি–ঠিক এখন আমি যেমন তোমার মুখোমুখি বসে আছি, আবারফোর্থ হ্যারির মুখের দিকে তাকালো। মনে হল যেন সে একটা অল্প বয়সের ছেলে। দৃঢ় এবং ক্ষুব্ধ। যেন বড় ভাইয়ের সঙ্গে গোলমাল করছে। আমি তাকে বলেছি, সবচেয়ে ভালো হয় যদি তুমি এখন ওকে ছেড়ে দাও। তুমি অরিয়ানাকে নিয়ে যেতে পারবে না। তার অবস্থা তোমার সঙ্গে যাবার মত নেই। তুমি যত পরিকল্পনাই করো না কেন যত কৌশলেই কথা বলো না কেন তুমি নিজেকে ধরে রাখতে পারবে না। সে আমার কথা পছন্দ করেনি, আবারফোর্থ বললেন। ফায়ারপ্লেসের আগুনে চশমার কাঁচের ভেতর দিয়ে তার চোখ দুটো স্থির দেখা। গেল। গ্রিনডেলভাল্ট সেটা একেবারেই পছন্দ করেনি। সে রেগে গেল। আমাকে বলল যে আমি কত বড় একটি স্টুপিড ছেলে যে তাকে এবং অমন একটি ব্রিলিয়ান্ট ভাইকে কাজে বাধা দিচ্ছি…. আমি কি বুঝতে পারিনি যে তারা দুনিয়াটাকে পাল্টে দিতে গেলে আমার বোনটির কথা আর গোপন থাকবে না?

এরপর আমার সঙ্গে তুমুল ঝগড়া হয়…এবং আমি আমার যাদুদণ্ডটি টেনে বের করি এবং সেও তার যাদুদণ্ডটি টেনে বের করে। আমার ভাইয়ের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু আমার উপর কুসিয়াস কার্স নিক্ষেপ করে। অ্যালবাস তাকে থামাতে চেষ্টা করে। আমরা তিনজন ধস্তাধস্তি করতে থাকি, ঠিক তখনই একটি আলো জ্বলে ওঠে। বিকট একটি শব্দ হয়ে তার উপর গিয়ে পড়ে, আমার বোন আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না…

বিবেকের ধাক্কা খেয়ে আবারফোর্থ-এর মুখের রঙ পাল্টে যেতে থাকল।

আমার ধারণা অরিয়ানা আমাদেরকে থামাতে চেষ্টা করেছিল কিন্তু সে বুঝতেই পারেনি যে কী করছে। এবং আমি জানি না আমাদের মধ্যে কে কাজটি করেছে। হতে পারে আমাদের তিনজনের যে কোনো একজন অরিয়ানা মারা গেল।

শেষ বাক্যটি বলার সময় তার কণ্ঠস্বর ভেঙে গেল। তিনি কাছের চেয়ারটিতে বসে পড়লেন। হারমিয়নের মুখটি চোখের পানিতে ভিজে গেছে। রনের মুখটি প্রায় আবারফোর্থের মত মলিন। হ্যারির ভীষণ তীক্ত লাগল। সে এ কাহিনী না শুনলেই ভালো হতো। ইচ্ছা হল, যদি মন থেকে এ কাহিনী সাফ করে ফেলা যেত।

আমি..আমি খুবই দুঃখিত, হারমিয়ন বলল।

চলে গেল, আবারফোর্থ বললেন। চিরকালের জন্য চলে গেছে।

 তিনি তার নাক মুছলেন এবং গলা পরিস্কার করলেন।

অবশ্যই গ্রিনডেলভাল্ড দ্রুত সরে গিয়েছিল। ইতিমধ্যেই তার দেশে তার নামে অনেক অভিযোগ ছিল, সে চায়নি যে অরিয়ানার বিষয়টিতেও তার নামে অভিযোগ উঠুক। এবং অ্যালবাস মুক্ত হয়েছিল, তাই না? বোনোর দায়িত্ব থেকে মুক্ত। সুযোগ হয়েছিল একজন বিখ্যাত যাদুকর হওয়া

হ্যারি বলল, তিনি কখনো মুক্ত ছিলেন না।

তুমি কী বললে? আবারফোর্থ বললেন।

হ্যারি বলল, কখনোই না। যে রাতে আপনার ভাই মারা গেলেন সে রাতে তিনি পোশণ পান করেছিলেন যা তাকে পুরোপুরি তার মন থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছিল। তিনি চিৎকার করে বলছিলেন, উপস্থিত নেই এমন কারো কাছে আবেদন করছিলেন, ওদেরকে আঘাত করো না, প্লিজ…তারচেয়ে বরং আমাকে ….রন এবং হারমিয়ন হ্যারির দিকে তাকিয়ে থাকল। সে কখনোই লেকের ওই ছোট দ্বীপটিতে কি ঘটেছিল তা বিস্তারিত আলাপ করেনি। ডাম্বলডোর এবং সে হোগার্টসে ফিরে যাবার পর কী ঘটেছিল তা পুরোপুরি অজানা।

তিনি ভেবেছিলেন তিনি গ্রিনডেলভাল্ড এবং আপনাকে সহ সেখানে ফিরে গেছেন। আমি জানি তিনি এমনটাই চিন্তা করেছিলেন, হ্যারি বলল। তার মনে পড়ল ডাম্বলডোরের চিৎকার, আকুতির কথা। তিনি ভেবেছিলেন গ্রিনডেলভান্ড আপনাকে এবং অরিয়ানাকে আঘাত করছে এ দৃশ্য তিনি দেখেছেন…এটা ছিল তার জন্য এক যন্ত্রণা। আপনি যদি তাকে তখন দেখতেন তাহলে বলতে পারতেন। না যে তিনি মুক্ত।

আবারফোর্থকে মনে হল তিনি হতবুদ্ধি হয়ে গেছেন। দীর্ঘ নিরবতার পর তিনি বললেন, তুমি কী করে নিশ্চিত হলে পটার যে আমার ভাই তোমার চেয়ে অন্যের কল্যাণের দিকে বেশি আগ্রহী ছিল না? তুমি কী করে নিশ্চিত হলে যে আমার সেই ছোট বোনটির মতই তুমিও বাতিলযোগ্য নও?

হ্যারির বুকের ভেতর দিয়ে একটি তীব্র শীতলতা ভেদ করে গেল।

আমি এটা বিশ্বাস করি না। ডাম্বলডোর হ্যারিকে ভালবাসতেন, হারমিয়ন বলল।

আবারফোর্থ পাল্টা আক্রমণ করে বললেন, তাহলে সে হ্যারিকে লুকিয়ে পড়তে বলেনি কেন? কেন সে বলেনি যে নিজের দিকে নজর রেখ। এখানে ফী ভাবে বাঁচতে হয় সেটি কেন বলেনি?

হারমিয়ন উত্তর দেয়ার আগেই হ্যারি বলল, কারণ, কখনো কখনো আপনাকে নিজের নিরাত্তার চেয়েও বেশি কিছু নিয়ে ভাবতে হয়। কখনো কখনো অপনাকে বৃহত্তর স্বার্থের কথা চিন্তা করতে হয়। এটি একটি যুদ্ধ!

তোমার বয়স সতেরো বালক!

হ্যারি তার কথাগুলো আবার রিপিট করলো, অর্ডার অব দ্য ফিনিক্স শেষ হয়ে গেছে, ইউ-নো-হু জয়ী হয়ে গেছে এবং এর বাইরে যে চিন্তা করবে সে নিজের সঙ্গেই নিজেকে ধোকা দেবে!

আমি বলিনি যে এসব আমার পছন্দের কথা। কিন্তু এসব সত্যি!

হ্যারি বলল, না, এটা সত্য নয়। আপনার ভাই জানতেন যে কীভাবে ইউ না-হু কে শেষ করা যায়। এভার সে জ্ঞান তিনি আমাকে দিয়েছেন। যে পর্যন্ত সফল না হই সে পর্যন্ত আমি তা গোপন রাখবো। অথবা আমার মৃত্যু হবে। আপনি ভাববেন না যে কীভাবে এটা শেষ হতে পারে আমি তা জানি না। অনেক বছর ধরেই আমি সেটা জানি।

সে অপেক্ষা করলো আবারফোর্থ এর প্রতিবাদন অথবা তর্কের জন্য। কিন্তু তিনি কিছু বললেন না। তিনি গুমগুম করতে থাকলেন।

হ্যারি আবার বলতে শুরু করল, আমাদের হোগার্টে প্রবেশ করতে হবে। যদি আপনি আমাদেরকে সাহায্য করতে না চান, তাহলে আমরা দিন হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করবো। পর আপনাকে শান্তিতে থাকতে দিয়ে আমরা নিজেদের মত করে চেষ্টা করবো একটা পথ বের করতে। আর যদি আপনি আমাদের সাহায্য করতে চান, ওয়েল–তাহলে সেটা জানাবার জন্য এখনই সবচেয়ে ভালো সময়।

আবারফোর্থ চেয়ারে স্থির বসে থাকলেন। হ্যারির দিকে এমন চোখে চেয়ে থাকলেন যে চোখ দুটি অসাধারণভাবে তার ভাইয়ের চোখের মত। তারপর তিনি কাশলেন, উঠে দাঁড়ালেন। এবং পা বাড়িয়ে অরিয়ানার ছবিটির কাছে গেলেন।

তুমি জানো কী করতে হবে, তিনি বললেন।

অরিয়ানা হাসল। ঘুরে হাঁটতে শুরু করল। পোট্রেইটে যেমন সাধারণভাবে যেমন পাশ থেকে সরে যায় তেমন না সে চলে গেল যেখান দিয়ে মনে হল যেন তার পেছনে একটি লম্বা টানেল। ওরা তার শরীরটাকে পাশ থেকে থামতে দেখলো। এবং শেষে অন্ধকারে বিলীন হয়ে গেল।

এই!–কী ব্যাপার? রন বলল।

এখন একটিমাত্র পথ খোলা আছে, আবারফোর্থ বললেন। তোমরা অবশ্যই জানো পুরাতন সিক্রেট প্যাসেজের পথের দুপাশেই আটকে দিয়েছে। ডেমেনটররা দেয়ালের চারদিকে নিয়মিত পাহারা দিচ্ছে বলে আমার সোর্স জানিয়েছে। এই জায়গাটি কখনোই এমন কঠিনভাবে গার্ড দেয়া হয়নি। সেই দায়িত্বে থাকতে এবং ক্যারোজ তার ডেপুটি হিসাবে থাকতে, তোমরা কীভাবে এর ভেতরে ঢুকে কিছু করতে পারবে বলে আশা করা। ওয়েল, এটা তোমাদের দেখার বিষয়। তোমরা বলতে চাচ্ছ তোমরা মৃত্যুবরণ করতে প্রস্তুত।

কিন্তু ওটা….হারমিয়ন অরিয়ানার ছবির দিকে তাকিয়ে চুপ হয়ে গেল।

পেইন্ট করা টানেলের ভেতর একটি ছোট বিন্দুর মত দেখা গেল। এবার অরিয়ানা আবার হেঁটে ওদের দিকে আসছে। সে যত আগাচ্ছে তত ছবিতে বড় হচ্ছে। কিন্তু তার সঙ্গে আরো একজন কেউ আছে। সে অরিয়ানার চেয়ে লম্বা। তাকে উত্তেজিত মনে হচ্ছে। তার চুলগুলো হ্যারি যেমন দেখেছে তার চেয়ে অনেক লম্বা। তার মুখের উপর বেশ কয়েকটি কাটা দাগ, পোষাক ছেঁড়া। শরীর দুটো বড় থেকে আরো বড়ো হতে থাকল। তারপর পোট্রেইটটি এক সময় শুধু তাদের কাঁধ এবং মাথায় ভরে উঠল। তারপর ছবির সবকিছু দেয়ালের উপর গিয়ে পড়ল, দেয়াল পর্যন্ত বিস্তৃত হল। এবং একটি সত্যিকারের টানেলের মুখ দেখা গেল। এর ভেতর থেকেই লোকটির চুল বড় হতে থাকল। মুখে কাটা ছেঁড়া, পরণের কাপড় ছেঁড়া সত্যিকারের নেভিল লংবটম বেরিয়ে এল। সে আনন্দে চিৎকার করে উঠল। ফায়ারপ্লেসের উপর থেকে লাফ দিয়ে নেমে এল। চিৎকার করে বলল, আমি জানতাম তুমি আসবে! আমি জানতাম, হ্যারি!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *