১৬. গোড্রিচ হলো

১৬. গোড্রিচ হলো

পরদিন হ্যারি ঘুম থেকে জেগে উঠল। গতরাতে কী ঘটেছিল তা মনে করতে কয়েক সেকেন্ড সময় পার হয়ে গেল। তারপর অবুঝ শিশুর মত হ্যারির মনে হল ওটা ছিল একটা দুঃস্বপ্ন। ভাবল রন ওদের ছেড়ে যেতে পারে না। তারপরও বালিশ থেকে মুখ তুলে দেখল রনের বিছানাটা খালি পড়ে আছে। চোখ খুলে ঝাপসা মত বিছানাটা দেখে হ্যারির মনে হল যেন সেটি মৃত। হ্যারি নিজের বিছানা থেকে লাফিয়ে নামল। তার চোখ রনের বিছানা থেকে দূরে সরিয়ে রাখল। হার মিয়ন কিচেনে ব্রেকফাস্ট তৈরীতে ব্যস্ত। সে হ্যারিকে দেখে শুভ সকাল জানালো না। হ্যারি পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় সে মুখটা তাড়াতাড়ি অন্যদিকে ঘোরালো। সে চলে গেছে, হ্যারি নিজেকে নিজে বলল। সে চলে গেল। সে হাতমুখ পরিস্কার করে জামাকাপড় বদলাতে বদলাতে একই কথা ভাবতে থাকল। যতই ভাবছে ততই তার বেদনা ও কষ্ট বাড়ছে। আর ফিরে এলো না। কিন্তু রন চলে গেছে এটাই সত্য। হ্যারি জানে তাদের এনচানমেন্ট অনুসারে একবার যখন ফিরে গেছে রন, তার জন্য আবার তাদেরকে খুঁজে পাওয়া অসম্ভব।

হারমিয়ন এবং হ্যারি নিঃশব্দে একত্রে বসে নাস্তা খেলো। হারমিয়নকে দেখে মনে হল সে সারারাত ঘুমায়নি। ওরা ওদের জিনিসপত্র গুছিয়ে নিল। হারমিয়ন ধিরে-সুস্থে কাজ সারল। হ্যারি জানে কেন সে নদীর পারের এই জায়গাটি বার বার ঘুরে আসছে। হারমিয়ন কয়েকবার ঝট করে মুখ তুলে বাইরের দিকে তাকিয়েছে। হ্যারি জানে যে সে মনের ভুলে কয়েকবার মনে করেছে যে বাইরে বৃষ্টির ভেতর পায়ের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু গাছের ভেতর দিয়ে লাল চুলের কোনো মানুষ আসলে ফিরে আসেনি। প্রত্যেকবারই হ্যারি তার দেখাদেখি চারদিকে তাকিয়েছে (কারণ সে নিজেও আশা ছেড়ে দেয়নি)। কিন্তু সে বৃষ্টিভেজা গাছগুলো ছাড়া আর কিছুই দেখতে পায়নি। আরো একটি বিষয় হ্যারির ভেতরে বিস্ফোরণের মত জেগে উঠেছে। সে বারবার তার ভেতর থেকে শুনতে পেয়েছে রন বলছে, আমরা ভেবেছিলাম তুমি জানো যে তুমি কী করতে এসেছ। পেট খালি নিয়ে হ্যারি আবার শক্ত করে জিনিসপত্র গোছাতে শুরু করেছে।

কর্দমাক্ত নদীর জোয়ারের পানি দ্রুত নদীর কিনারার দিকে উপরে উঠতে থাকল। কিছুক্ষণের মধ্যেই হয়তো কিনারায় ওদের জায়গাটিতে চলে আসবে। ক্যাম্পসাইট খালি করার পরও ওরা এক ঘন্টা সময় দেরি করল। তারপর তিনবার ওদের ব্যাগটি শক্ত করে বেধে ফেলল। হারমিয়ন আর দেরি করার মধ্যে কোনো যুক্তি খুঁজে পেল না। হ্যারি এবং হারমিয়ন হাত ধরাধরি করে ডিসাপ্যারেট করল। এবং একটি পাহাড়ের ফুলের গাছের ঝোপঝাড়ের কাছে এসে নামল।

নেমেই হারমিয়ন হ্যারির হাত ছেড়ে দূরে সরে গেল। একটি বড় পাথরের খণ্ডের উপর বসল। সে হাটুর উপর মুখ গুঁজে বসল। শরীরটা একটু একটু কাঁপছে। হ্যারি বুঝতে পারল সে কাঁদছে। হ্যারি ওর দিকে তাকিয়ে একটু অপেক্ষা করল। মনে হল কাছে গিয়ে ওকে শান্ত্বনা দেয়া দরকার। কিন্তু কোনো একটি অজানা কারণে হ্যারি স্থির হয়ে থাকল। তার ভেতরে ঠাণ্ডা এবং জড়োসড়ো লাগল। আবার রনের ঘৃণা মাখা মুখটা দেখতে পেল। হ্যারি লম্বা পা ফেলে ফলের ঝোপটার কাছে গেল। হারমিয়নকে মাঝখানে রেখে বেশ খানিকটা জায়গা নিয়ে সে সার্কেল তৈরি করল। তারপর একটি স্পেল ব্যবহার করল প্রোটেকশনের জন্য, যা সাধারণত হারমিয়ন করে থাকে।

পরবর্তী কয়েকদিন ওরা রনকে নিয়ে কোনো কথা বলল না। হ্যারি দৃঢ়ভাবে সংকল্প করেছে তার নাম মুখে আনবে না। হারমিয়নকে দেখে মনে হল বিষয়টি নিয়ে কথা বলে কোনো লাভ হবে না ধরে নিয়েছে। প্রতিরাতে ওরা ঘুমাতে যাওয়ার পর, হারমিয়ন যখন ভাবে যে হ্যারি ঘুমিয়ে পড়েছে, তখন হ্যারি ওর কান্নার শব্দ শুনতে পেল। ইতিমধ্যে হ্যারি মারাউন্ডার-এর ম্যাপ বের করে যাদুদণ্ডের আলোর মাধ্যমে তা দেখতে শুরু করেছে। সে অপেক্ষা করতে থাকল রনের চিহ্ন কখন হোগার্টের করিডোরে ভেসে ওঠে। তাতে বোঝা যাবে যে সে আরামদায়ক দুর্গে পৌঁছে গেছে। পিওর ব্লড হওয়ার কারণে নিরাপদ আছে। কিন্তু ম্যাপের ভেতর রনের কোনো চিহ্নই ভেসে উঠল না। অল্প কিছুক্ষণ পরেই হ্যারি লক্ষ্য করল, সে মেয়েদের ডরমেটরিতে জিনির নামের উপর তাকিয়ে আছে। ভাবল যে আগ্রহ নিয়ে সে তাকিয়ে আছে তাতে জিনির হয়তো ঘুম ভেঙে যেতে পারে। তাতে জিনি বুঝে যাবে যে সে তাকে নিয়ে চিন্তা করছে। হ্যারি আশা করল যে জিনি নিরাপদ আছে।

দিনের বেলা সর্বক্ষণ ওরা গ্রিফিনডোরের তলোয়ার খোঁজার কাজে ব্যস্ত থাকল। যতই ওরা ডাম্বলডোরের লুকিয়ে রাখার সম্ভাবনার জায়গাটি নিয়ে আলোচনা করল ততই হতাশ হল এবং চিন্তা লোপ পেতে থাকল। শতবার মাথা ঠুকেও হ্যারি মনে করতে পারল না যে ডাম্বলডোর কখনো ওকে কোনোকিছু লুকিয়ে রাখার কথা বলেছিলেন কিনা। সে সময়টিতে হ্যারি বুঝতে পারল না সে রনের এবং ডাম্বলডোর দুজনের মধ্যে কার উপর রাগ হয়েছে। আমরা ভেবেছিলাম তুমি জানো যে তুমি কী করতে যাচ্ছ….আমরা ভেবেছিলাম ডাম্বলডোর তোমাকে বলেছেন যে কী করতে হবে….আমরা ভেবেছিলাম তোমার কাছে নির্দিষ্ট পরিকল্পনা আছে!

নিজের কাছে হ্যারি লুকাতে পারল না যে রনের কথা ঠিক। ডাম্বলডোর বাস্তবে তাকে কিছুই জানিয়ে যায়নি। ওরা একটি হরক্রুক্স হাতে পেয়েছে, কিন্তু এটা ভেঙে ফেলার কোনো ব্যবস্থা ওদের কাছে নেই। অন্যগুলো তো ওদের কাছে ধরাছোঁয়ার বাইরেই রয়ে গেছে। হতাশা হ্যারিকে পুরোপুরি জাপটে ধরল। এখন ওর বন্ধুদের কথাই ওকে দ্বিধায় ফেলে দিয়েছে। সত্যিই যেন খামোখা ওরা এসেছে। হ্যারি কিছুই জানে না, তার কোনো ধারণা নেই। এবং সে সর্বক্ষণ চিন্তায় থাকল যে হারমিয়নও না বলে যে অনেক হয়েছে, সে চলে যেতে চায়।

অনেকগুলো সন্ধ্যা ওরা পাশাপাশি প্রায় নিরবে কাটিয়ে দিল। এরপর হার মিয়ন এক সন্ধ্যায় পাইনিয়াস নাইজেলাসের পোট্রেইটটি বের করল এবং সেটি চেয়ারের সঙ্গে হেলান দিয়ে দাঁড় করালো। হয়তো রনের চলে যাওয়ায় যে শুন্যতা তৈরি হয়েছে সেটাকে একটুখানি ঢাকার জন্য। যদিও তিনি আগেরবার উল্লেখ করেছিলেন যে ওরা ডাকলে আর কখনো আসবেন না, কিন্তু তারপরও তিনি রাজি হলেন দেখা দিতে। হয়তো হ্যারি যে বিষয়টি নিয়ে আছে সেটাকে তিনিও খোঁজার ব্যপারে নিজেকে সংবরণ করতে পারেননি। হ্যারি তাকে দেখে খুশি হল। ওদের দ্বারা অপমানিত এবং হাস্যকর হওয়া সত্ত্বেও তিনি দেখা দিয়েছেন। যদিও নাইজেলাস একজন ইনফরমার না তারপরও ওরা হোগার্টস সম্পর্কে কিছু খবরাখবর পেল। তিনি স্নেইপকে যথেষ্ট মানেন। স্নেইপ হল প্রথম স্লিথারিন হেডমাস্টার। সুতরাং সতর্ক থাকতে হবে। স্নেইপ সম্পর্কে অপ্রাসঙ্গিক কোনো প্রশ্ন করা যাবে না। তাহলে নাইজেলাস সঙ্গে সঙ্গে চলে যাবেন।

কিন্তু নিজেই খণ্ড খণ্ড ইনফরমেশন দিতে থাকলেন। স্নেইপকে মনে হয় ছাত্রদের পক্ষ থেকে একটি ছোটখাটো বিদ্রাহের মুখে পড়তে হয়েছিল। জিনিকে হগসমিয়াডে যাওয়া নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ছাত্রছাত্রীদের কোনো আন অফিসিয়াল সোসাইটিতে তিনজনের বেশি একত্র হওয়া যাবে না, আমব্রিজের এই ডিক্রিকে স্নেইপ আবার পুনর্বহাল করেছে।

এই সব কিছু থেকে হ্যারি সিদ্ধান্তে পৌঁছল যে, জিনি এবং তার সঙ্গে হয়তো লুনা এবং নেভিল ডাম্বলডোরের আর্মিতে কাজ করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এই সংবাদে জিনিকে দেখার জন্য হ্যারির এত বেশি ইচ্ছা হল যে, মনে হল পেটের ভেতর ব্যথা করে উঠছে। কিন্তু একই সঙ্গে এই সংবাদ রন এবং ডাম্বলডোরের কথাও মনে করিয়ে দিল। একই সঙ্গে হোগার্টের কথাও মনে হল যাকে সে প্রায় এক্স গার্লফ্রেন্ডের মত মিস করে। পাইনিয়াস নাইজেলাস যখন স্নেইপের ক্সাকডাউনের কথা বলছিল তখন মুহূর্তের জন্য হ্যারি পাগলের মত কল্পনা করল। স্নেইপের অস্থিতিশীল সময়ে স্কুলে ফিরে গিয়ে অন্যদের সঙ্গে যোগ দেয়ার কথা। অন্যের উপর দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে, খাওয়া দাওয়া করে নরম বিছানায় শুয়ে থাকাকে হ্যারির মনে হল দুনিয়ার সবচেয়ে বড় মজার কাজ। কিন্তু তখনই তার মনে হল তার ধরিয়ে দেয়া তালিকায় নামটি রয়েছে এক নম্বরে। ওর মাথার দাম ধার্য করা হয়েছে ১০ হাজার গ্যালিয়ন। এ অবস্থায় হোগার্টে যাওয়া ম্যাজিক মিনিস্ট্রির ভেতর দিয়ে হাটার মতই সমান বিপদজনক। পাইনিয়াস নাইজেলাস কোনো বিষয় উল্লেখ করে এই কথাটিকেই জোর দিয়ে বললেন। তিনি হ্যারি এবং হারমিয়নের বিষয়ে প্রশ্নগুলো এড়িয়ে গেলেন। তিনি প্রত্যেকবারই এমন করার পর হারমিয়ন তাকে আবার ব্যাগের ভেতর পুরে রাখল। প্রত্যেকবার পাইনিয়াস নাইজেলাস যাবার সময় বলে গেলেন যে আর কখনো দেখা দেবেন না।

শীতের মাত্রা বেড়ে চলেছে। একটি এলাকায় বেশিদিন থাকতে ওরা সাহস করল না। দক্ষিণ ইংল্যান্ডে শক্ত মাটি বরফে জমে উঠছে। এখানে অবস্থান করার বদলে ওরা দেশের নিচের দিকে পাহাড়ি এলাকায় যেতে থাকল। মাটি এখানে এখনো নরম আছে। তাবুর উপর তুষার পড়তে শুরু করেছে। তাবুর নিচের অংশ ঠাণ্ডা পানিতে ভিজে যাচ্ছে। স্কটিশ লেকের ছোট্ট একটি দ্বীপের উপর তাবুটি রাতের বেলা বরফ দিয়ে আচ্ছাদিত হয়ে যাচ্ছে।

ওরা বিভিন্ন বাড়ির জানালা দিয়ে ক্রিসমাস গাছের ছোট ছোট বাতিগুলো টিমটিম করে জ্বলতে দেখল। ওরা আসবার পর এক সন্ধ্যায় হ্যারি বিষয়টি উল্লেখ করলো। তার কাছে আবার মনে হল যে এই বিষয়টি ওদের কাছে অধরা রয়ে গেছে। ওরা সবেমাত্র চমৎকার একটি খাবার খেয়েছে। এমন ভালো খাবার সচরাচর হয় না। হারমিয়ন অদৃশ্য হওয়ার আলখাল্লা পরে পাশের একটি মার্কেটে ঢুকেছিল (নীতির কথা চিন্তা করে অবশ্যই সে পয়সা রেখে এসেছে)। পেট ভরে খাবার পর হ্যারির মনে হল হারমিয়ন এখন আগের চেয়ে নমনীয় আছে, তাকে কথা শোনানো যাবে। হ্যারির এ কথাও মনে ছিল যে কয়েক ঘণ্টা হল ওরা হরক্রুক্সটি গলায় ঝোলায়নি। সেটি ওর পাশে ঝোলানো আছে।

হারমিয়ন?

হুম হারমিয়ন হাতলওয়ালা চেয়ারে বাকা হয়ে হেলান দিয়ে বসে দ্য টেলস অব বিডল দি বার্ড পড়ছে। হ্যারি বুঝতে পারল না যে বইয়ের ভেতর থেকে কতটা হারমিয়ন জানতে পারবে। কারণ বইটি আর বেশিদূর পড়ার বাকী নেই। কিন্তু দেখা যাচ্ছে হারমিয়ন এখনো কিছু খুঁজতে চেষ্টা করছে। কারণ চেয়ারের ওপর এখনো স্পেলম্যান সেলাব্যারি অংশটা খুলে রেখেছে।

হ্যারি কেশে গলা পরিস্কার করল। হ্যারির মনে পড়ল প্রায়ই এমন গলা পরিস্কার করতে হতো। কয়েক বছর আগে ডারসলি পরিবারের পারমিশনের স্বাক্ষর ছাড়া স্লিপে যখন প্রফেসর ম্যাকগোনাগলের কাছে অনুমতি চাইত হোগার্টসে যাবার ব্যাপারে, তখনো এমন করতো।

হারমিয়ন, আমি চিন্তা করে দেখলাম-

হ্যারি, আমাকে একটা বিষয় একটু সাহায্য করতে পারো?

তার কথার ভাবে মনে হলো সে হ্যারির কথা শুনতে পায়নি। সে সামনের দিকে ঝুঁকে দ্য টেলস অব বিডল দি বার্ড মেলে ধরল।

এই চিহ্নটা দেখ, হারমিয়ন বলল। আঙ্গুল দিয়ে বইয়ের পাতার উপরের একটি জায়গা দেখালো। চিহ্নটির উপরে বইয়ের শিরোনাম লেখা। (লেখা পড়তে না পারার কারণে হ্যারি নিশ্চিত হতে পারল না)। ছবিটি দেখতে অনেকটা তিনকোণা চোখের মত। এর উপর একটি আড়াআড়ি লাইন টানা রয়েছে।

আমি কখনো প্রাচীন যাদুচিহ্ন নিয়ে কাজ করিনি হারমিয়ন।

আমি সেটা জানি। কিন্তু এটা কোনো প্রাচীন যাদুচিহ্ন না। সিল্যাবলেও এর কথা উল্লেখ নেই। আমি প্রথমে ভেবেছিলাম এটি একটি চোখের ছবি। কিন্তু আমার এখন মনে হয় না এটা শুধু তাই। এরমধ্যে কালির ছাপ আছে। কেউ একজন এটি এখানে একেছে। এটা বইয়ের আসল অংশ না। চিন্তা করে দেখ, তুমি কী আগে কখনো এই চিহ্নটি দেখেছ?

না…নাহ্…দাঁড়াও, এক মিনিট, হ্যারি আরো কাছে থেকে চিহ্নটি লক্ষ করল। লুনার বাবার গলায়ও এরকমই একটি চিহ্ন ছিল না?

গুড, আমিও একই কথা ভাবছিলাম!

তাহলে এটা গ্রিনডেলভান্ডের চিহ্ন।

হারমিয়ন বিস্ময়ে মুখ হা করে হ্যারির দিকে তাকালো।

কি?

ক্রুম আমাকে বলেছিল

হ্যারি বিয়ে বাড়িতে ভিক্টর ক্রুমের বলা কাহিনী বর্ণনা করল। হারমিয়ন বিস্মিত হোলো।

গ্রিন্ডেলভাল্ডের চিহ্ন?

সে একবার হ্যারির দিকে আবার অদ্ভুত চিহ্নটির দিকে তাকাতে থাকল।

আমি কখনো শুনিনি যে গ্রিন্ডেলভান্ডের কোনো চিহ্ন আছে। তার সম্পর্কে আমি যত জায়গায় পড়েছি তার কোথাও এর কথা উল্লেখ করা নেই।

ঠিকাছে, আমি বলছি ক্রুমের মতে চিহ্নটি ডার্মস্ট্র্যাঙের দেয়ালের সঙ্গে ছিল। গ্রিনডেলভান্ড সেখানে চিহ্নটি একেছিল।

হারমিয়ন পুরাতন আর্মচেয়ারটার পেছন দিকে হেলান দিল। অসম্ভষ্ট দেখা গেল।

এটা খুবই অস্বাভাবিক ব্যাপার। এটি একটি ডার্ক ম্যাজিকের সিম্বল। বাচ্চাদের বইয়ের ভেতর এই সিম্বল কেন?

হ্যাঁ, বিস্ময়কর ব্যাপার, হ্যারি বলল। তুমি মনে রেখ ক্রিমগিয়র এটা জানতেন। তিনি একজন মিনিস্টার ছিলেন। তার ডার্ক বিষয়াদি সম্পর্কে সব জানার কথা।

সেটা আমি জানি…..হয়তো তিনি ভেবেছিলেন এটা শুধুই একটি চোখের ছবি। ঠিক আমি যেমন মনে করেছিলাম। অন্য প্রত্যেকটি গল্পের শিরোনামের সঙ্গে একটি করে ছবি আছে।

হারমিয়ন কথা বলছে না। সে ঝুঁকে বিস্ময়ের সঙ্গে ছবিগুলো দেখতে থাকল। হ্যারি আবার চেষ্টা করল।

হারমিয়ন

হুম?

আমি চিন্তা করছিলাম, আমি ….আমি গোড্রিচ হলোতে যাবো।

হারমিয়ন মুখ তুলে তাকালো। কিন্তু তার চোখে কোনো ভাষা নেই। হ্যারি নিশ্চিত যে হারমিয়ন এখনো বইয়ের ওই রহস্যজনক চিহ্নটি নিয়ে চিন্তা করছে।

হ্যাঁ, হারমিয়ন বলল। হ্যাঁ, আমিও তাই ভাবছিলাম। আমি সত্যিই মনে করি আমাদের তাই করা উচিত।

হ্যারি বলল, তুমি কী আমার কথা ঠিকভাবে শুনতে পেয়েছ?

অবশ্যই আমি শুনতে পেয়েছি। তুমি গোড্রিচ হলোতে যেতে চাও। আমি রাজি আছি। আমাদের তাই করা উচিত। আমি বলতে চাচ্ছি ওটি অন্য কোথাও আছে বলে আমি মনে করি না। যদিও বিপদজনক, কিন্তু যতই আমি চিন্তা করছি ততই মনে হচ্ছে এটি ওখানে আছে।

এই! সেটি কি? হ্যারি বলল।

এ সময় সত্যিই হারমিয়নকে বিস্মিত মনে হল।

ওই তলোয়ারটি হ্যারি! ডাম্বলডোর অবশ্যই জানেন যে তুমি সেখানে যেতে চাও। আমি বলতে চাচ্ছি, গোড্রিচ হলো হচ্ছে গোড্রিচ গ্রিফিনডোরের জন্মস্থান

সত্যিই? গ্রিফিনডোর গোড্রিচ হলো থেকে এসেছেন?

হ্যারি, তুমি কখনো হিস্ট্রি অব ম্যাজিক বইটি খুলে দেখেছ?

অ্যা, হ্যারি বলতে থাকল। হাসল। মনে হলো যেন এক মাসের মধ্যে প্রথম হাসল। মুখের পেশিগুলো যেন স্বাভাবিকের চেয়ে শক্ত হয়ে গেছে। আমি একবারই এটির পৃষ্ঠা খুলেছিলাম, যখন প্রথম বইটি কিনি…ওই একবারের জন্য…

তাহলে শোনো, গ্রামের নামটি তার নামানুসারে হয়েছে। আমার চিন্তা ছিল যে তুমি এরমধ্যে কোনো সংযোগ খুজে পাবে, হারমিয়ন বলল। হারমিয়নের কথাগুলো পরের দিকের অস্বাভাবিক অবস্থার বদলে তার আগের মত স্বাভাবিক শোনালো। হ্যারি ধারণা করল যে সে এখন বলবে যে সে লাইব্রেরিতে গিয়েছিল। গ্রামটি সম্পর্কে হিস্ট্রি অব ম্যাজিকে একটুখানি উল্লেখ আছে, দাঁড়াও…।

সে ব্যাগটি খুলল এবং ভেতরে হাত দিয়ে কিছু একটা খুঁজল। একটু পরেই সে একটি স্কুল টেক্সটবুক বের করে আনল। বাথিলডা বাগশটের লেখা এ হিস্ট্রি অব ম্যাজিক। হারমিয়ন আঙুল দিয়ে একটি নির্দিষ্ট পাতার জন্য উল্টাতে থাকল।

১৬৮৯ সালের আন্তর্জাতিক আইনের স্বাক্ষর অনুসারে উইজার্ডরা ভালোর জন্য লুকিয়ে থাকে। এটা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার যে উইজার্ডরা সমাজের ভেতর নিজেদের মধ্যে ছোট ছোট জোট গড়ে তোলে। অনেক ছোট ছোট গ্রামে ম্যাজিক্যাল পরিবারগুলোকে আকর্ষণ করেছে যে, নিজেদের নিরাপত্তার জন্য এবং একে অন্যকে সমর্থন দেয়ার জন্য সংঘবদ্ধ হয়েছে। যেমন কর্নওয়ালের টিনওয়ার্থ, ইয়র্কশায়ারের আপার ফ্ল্যাগলি এবং সাউথ কোস্টের অটারি সেন্ট উল্লেখযোগ্য। এখানে উইজার্ড ফ্যামিলিগুলো সহিষ্ণুতার সঙ্গে পাশাপাশি অবস্থান করেছে এবং তা কখনো কখনো মাগলবর্নদের জন্য মুশকিল হয়ে দাঁড়িয়েছে। সম্ভবত এই আধাআধি উইজার্ডিং ভিলেজের ওয়েস্ট কাউন্টি ভিলেজে গোড্রিচ গ্রিফিনডোর জন্মগ্রহণ করেছেন, যার নাম পরে হয়েছে গোড্রিচ হলো। এখানেই বোম্যান রাইট প্রথম কামারশালায় গোল্ডেন স্নিচ প্রস্তুত করেন। এখানকার কবরস্থানগুলোতে পুরাতন উইজার্ডিং পরিবারগুলোর নাম দিয়ে ভরা : সে কারণেই এখানকার ছোট চার্চকে শত শত বছর ধরে ভুতুরে কারবার নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হয়।

তোমার এবং তোমার পরিবারের নামোল্লেখ করা হয়নি, হারমিয়ন বইটি বন্ধ করতে করতে বলল। কারণ প্রফেসর ব্যাগশট ১৯ শতকের শেষ দিকের পরের আর কিছু কভার করেননি। কিন্তু তুমি দেখেছ, গোড্রিচ হলো, গোড্রিচ গ্রিফিনডোর, গ্রিফিনডোরের তলোয়ার; তোমার কী মনে হয়না যে ডাম্বলডোর চেয়েছেন যে তোমার এর সঙ্গে একটা যোগাযোগ হোক?

ওহ, হ্যা…

হ্যারি এটা মানতে চায় না যে গোড্রিচ হলোতে যাবার উদ্দেশ্য হিসাবে তলোয়ারটির কথা ভাবেনি। বাথিলডা ব্যাগশটের মতে সে ওই জায়গাটিতে যেতে আগ্রহি কারণ সেখানে ওর বাবা মায়ের কবর রয়েছে। এবং ওখান থেকেই সে কোনোক্রমে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পেয়েছিল।

হ্যারি ঘটনাক্রমে জানতে চাইল, মনে আছে মুরিয়েল কী বলেছিল?

কে?

তুমি জানো, সে দ্বিধা করে বলল। ইচ্ছা করেই রনের নাম মুখে আনল না। জিনির এক দাদী, যে কিনা তোমাকে বলেছিল তোমার স্কিনি অ্যাঙ্কল?

ও, হারমিয়ন বলল।

একটা স্পর্শকাতর মুহূর্ত ছিল এটি। হ্যারি জানে হারমিয়ন বুঝতে পেরেছে রনের নামটি উচ্চারণ করা হল না। হ্যারি আবার বলল, জিনি বলেছিল, বাথিলডা ব্যাগশট এখনো গোড্রিচ হলোতেই বাস করেন।

বাথিলডা ব্যাগশট, হারমিয়ন বিড়বিড় করে নামটি উচ্চারণ করলো। সে এ হিস্ট্রি অব ম্যাজিক বইটির উপর খাঁজ করে লেখা নামটির উপর চোখ বুলালো।

তাহলে আমি মনে করি

হারমিয়ন এমনভাবে দম নিল যে হ্যারি সচকিত হয়ে উঠল। সে মুহূর্তের মধ্যে তার যাদুদণ্ডটি বের করে তাবুতে প্রবেশের জায়গাটির দিকে দ্রুত তাকালো। সে মনে করল এখনি দেখবে একটি হাত তাবু ছিঁড়ে ভেতরে প্রবেশ করতে যাচ্ছে। কিন্তু কিছুই ঘটল না।

কি ব্যাপার? একটু রাগ একটু স্বস্তির সঙ্গেই হ্যারি বলল। তুমি এমন করলে কেন? আমি ভাবলাম তুমি হয়তো একটি ডেথ-ইটার দেখেছ যে তাবু ছিঁড়ে ভেতরে এবেশ করতে যাচ্ছে

হ্যারি, তলোয়ারটি যদি বাথিলডার কাছে থেকে থাকে তাহলে কী হবে। যদি ভালভোর তাকে বিশ্বাস করে তার কাছে রেখে থাকে?

হ্যারি এই সম্ভাবনার কথা মাথায় নিল। বাথিলডা হয়তো এখন একেবারে বৃদ্ধ হয়ে গেছেন। মুরিয়েলের মতে সে এখন ক্ষেপাটে ধরণের। ডাম্বলডোর গ্রিফিনডোরের তলোয়ারটি তার কাছে লুকিয়ে রাখতে পারেন এমন সম্ভাবনা কী আছে? যদি তাই হয়, তাহলে হ্যারি ধারণা করল ডাম্বলডোর একটি সুযোগ রেখে গেছেন। ডাম্বলডোর কখনোই কারো কাছে প্রকাশ করেননি যে তিনি আসল তলোয়ারটি সরিয়ে নকল একটি তলোয়ার সেখানে বসিয়ে দিয়েছিলেন। পাশাপাশি বাথিলডার সঙ্গে তার একটি সম্পর্ক আছে সে কথাও কারো কাছে বলেননি। কিন্তু এখন হারমিয়নের থিওরি নিয়ে সন্দেহ করার সময় নয়। বিশেষ করে সে যখন অবাক করে দিয়ে হ্যারির ইচ্ছার ব্যাপারে মত দিয়েছে।

হ্যাঁ, তিনি হয়তো কাজটি করেছেন! তাহলে আমরা গোড্রিচ হলোতে যাচ্ছি?

হ্যাঁ, কিন্তু বিষয়টি নিয়ে সতর্কতার সঙ্গে চিন্তা করতে হবে হ্যারি, হারমিয়ন উঠে বসল। হ্যারির মনে হলো আবার নতুন করে পরিকল্পনার কারণে তার মতই হারমিয়নও তাজা হয়ে উঠেছে।

আমাদের দুজনের একসঙ্গে অদৃশ্য আলখাল্লার নিচে ডিসাপ্যারেট করার ব্যাপারে প্র্যাকটিস করতে হবে। শুরুতে ডিসইলসনমেন্ট চার্মও খুব স্পর্শকাতর হবে। যদি তুমি মনে করো; আমাদের পুরো সময়টা পলিজিউস পোশন ব্যবহার করতে হবে? তাহলে আমাদেরকে কারো কাছ থেকে চুল সংগ্রহ করতে হবে। হ্যারি, একটু মোটা-সোটা লোকের আকৃতিই মনে হয় ভালো হবে….

হ্যারি বাধা না দিয়ে ওকে কথা বলতে দিল। ও একটু থামতেই হ্যারি মাথা ঝাঁকিয়ে ওকে সায় দিল। কিন্তু মনে মনে নিজে চিন্তা করতে থাকল। হ্যারি প্রথম যখন আবিষ্কার করেছে যে, গ্রিনগোটের ওই তলোয়ারটি নকল তখন থেকেই ভেতরে উত্তেজনা বোধ করছে।

হ্যারি এখন ধরতে গেলে বাড়িতে যাচ্ছে। এমন এক জায়গায় সে যাবে যেখানে ওর একটি পরিবার ছিল। এই সেই গোড্রিচ হলো যেখানে ভল্টেমর্টের বদলে তার বড় হয়ে ওঠার কথা ছিল, স্কুল জীবনে ছুটিতে এখানে সময় কাটতে পারতো। এখানেই হয়তো তার বন্ধুদেরকে বাড়িতে দাওয়াত করার কথা ছিল এখানেই তার ভাইবোনদের থাকার কথা ছিল তার মা ছিলেন, যিনি ১৭তম জন্মদিনে হয়তো কেক তৈরি করতেন। যে জীবন সে হারিয়েছে তা আজকের এই মুহূর্তের মত এত বাস্তব হয়ে তার কাছে কখনো দেখা দেয়নি। রাতে হারমিয়ন বিছানায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়লে হ্যারি হারমিয়নের ব্যাগ থেকে চুপিসারে তার নিজের রুকস্যাকটি বের করে সেখান থেকে ওর বাবা মায়ের ছবিটি বের করল। ছবিটি হ্যাগ্রিড বহু আগে ওকে দিয়েছিল। শেষ কয়েক মাসের ভেতর এই প্রথম হ্যারি তার বাবা মায়ের পুরাতন ছবিটি খুটে দেখতে থাকল। ছবির ভেতরে ওর বাবা মা। হাত তুলে নাড়ছেন, ওর দিকে তাকিয়ে হাসছেন।

হ্যারি পরের দিন খুশির সঙ্গে গোড্রিচ হলোতে যাত্রা করতে প্রস্তুত হল, কিন্তু হারমিয়নের মাথায় আরেকটা চিন্তা এল। ভাবল, ভোল্ডেমর্ট হয়তো ধারণা করে থাকতে পারে যে হ্যারি তার বাবা মায়ের মৃত স্থানটি দেখতে আসবেই। তাই হার মিয়ন নিশ্চিত করতে চাইল যে ওদের ছদ্মবেশটি একেবারে ঠিকভাবে করা হয়েছে। ফলে পুরোপুরি এক সপ্তাহ পার করে ওরা লোকচক্ষুর আড়ালে ক্রিসমাসের শপিং করতে আসা একজন নিরিহ মাগলবর্ন দম্পতির চুল সংগ্রহ করল। এবং একসঙ্গে অদৃশ্য আলখাল্লার নিচে অ্যাপারেট করার এবং ডিস্যাপারেট করার প্র্যাকটিস করল। তারপর হারমিয়ন পুরোপুরি সম্মত হলো রওয়ানা করতে।

ওরা একটি গ্রামের এক কোণে অন্ধকারের ভেতর দিয়ে অ্যাপারেট করল। তারপর দুপুর পার করে দুজনই পলিজিউস পান করলো। ফলে হ্যারি পরিণত হল একজন টাক মাথার মধ্য বয়স্ক পাগল লোক, আর হারমিয়ন পরিণত হল তার ছোটখাটো ইঁদুরমুখী স্ত্রীতে। আটোসাটো হারমিয়নের ব্যাগটির ভেতর ওদের সব জিনিসপত্র। (শুধুমাত্র হরক্রুক্সটি ছাড়া। সেটি হ্যারি গলায় পরে থাকল।) ব্যাগটি রাখা হল হারমিয়নের কোটের নিচে। হ্যারি আবার ওদের উপর অদৃশ্য আলখাল্লাটি দিয়ে দিল। এবং ওরা আবার দম বন্ধ হয়ে আসা অন্ধকারের ভেতর ঢুকে গেল।

হ্যারি চোখ খুলে তাকালো, বুকের ভেতর ধুকধুক করছে। নিল আকাশের মিটিমিটি তারাগুলো দুর্বলভাবে জ্বলছে। হ্যারি এবং হারমিয়ন হাতে হাত ধরে তুষারের উপর দিয়ে হাটছে। রাস্তার দুপাশে কটেজগুলোর জানালা দিয়ে ক্রিসমাসের ছোটছোট বাতিগুলো মিটমিট করে জ্বলতে দেখা যাচ্ছে। ওদের সামনে একটি রাস্তার একটি সোনালী বাতি দেখে বুঝতে পারল যে এটি গ্রামের কেন্দ্রস্থল।

চারদিকে তুষার! হারমিয়ন বলল। আমরা তুষারের কথা চিন্তা করলাম না। কেন? এত সতর্কতার পরও আমরা পায়ের ছাপ রেখে যাচ্ছি! এ দাগগুলো আমাদের তুলে ফেলতে হবে। তুমি সামনে এগিয়ে যাও! আমি এগুলো মুছে ফেলছি

হ্যারি নিঃশব্দ, না বুঝে ঘোড়ার মত গ্রামে প্রবেশ করতে চাইল না। যাদুর মাধ্যমে ওদের চিহ্ন মুছে ফেলার সময় নিজেদের লুকিয়ে রাখতে চেষ্টা করল।

এসো এবার আলখাল্লাটি খুলে ফেলি, হ্যারি বলল। হারমিয়নকে আতঙ্কিত। দেখা গেল। আহ বুঝতে চেষ্টা করো, আমরা এখন আর নিজেদের মত দেখতে নই, এবং আমাদের চারপাশে কোনো লোকজন নেই।

সে আলখাল্লাটি তার জ্যাকেটের ভেতর ভরে ফেলল। কোনো বিঘ্ন ছাড়াই ওরা সামনের দিকে পা বাড়ালো। বাড়িগুলো পার হওয়ার সময় তুষার বাতাস মুখে কাটার মত বিধতে থাকল। এর যে কোনো একটি বাড়ি হতে পারে যেখানে জেমস এবং লিলি এক সময় বাস করতেন, অথবা এখন যেখানে বাথিলডা বাস করেন। হ্যারি সামনের দরোজাগুলোর দিকে তাকালো। তুষারে সাদা হয়ে থাকা চাল, সামনের উঠোনগুলো দেখে ভাবতে থাকল এর কোনো একটি কিনা। নিজের ভেতর থেকে জানে যে সে এ বাড়ি ছাড়ার সময় এক বছরের মত বয়সের ছিল, বাড়িটির কথা মনে করা প্রায় অসম্ভব। এমনকি এ ব্যাপারেও সে নিশ্চিত না যে আদৌ বাড়িটি সে দেখতে পাবে কি না। ফিডেলিয়াস চার্মে মারা যাবার সময় কি ঘটেছিল সে তাও জানে না। হাঁটতে হাঁটতে ওরা সামনে বা দিকে মোড় নিল। এটাই গ্রামের কেন্দ্র। ওরা একটি ছোট চত্বর দেখতে পেল।

চিকন তারের সঙ্গে ওরা রঙিন আলো ঝুলছে দেখতে পেল। মাঝখানের জায়গাটা দেখতে অনেকটা যুদ্ধে নিহতদের স্মৃতিসৌধের মত মনে হল। এর খানিকটা অংশ বাতাসে ঝুলে পড়া একটি ক্রিসমাস গাছের আড়ালে পড়েছে। চারপাশে কয়েকটি দোকান, একটি পোস্ট অফিস, একটি বার এবং ছোট একটি চার্চ রয়েছে। চত্বরের চারদিকে দাগওয়ালা গাছের উপর আলো পড়ে জ্বলজ্বল করছে।

এখানকার বরফগুলো কঠিন ও পিচ্ছিল হয়ে আছে। সারাদিন মানুষের পায়ের চাপে এমন হয়েছে। গ্রামের লোকেরা এখানে এসে ক্রিসক্রস জানায়। ওদের শরীর রাস্তার আলোতে সামান্য দেখা যায়। বারের দরোজা খোলার এবং বন্ধ হওয়ার সময় মানুষের হাসি আর পপ গানের শব্দ বের হয়ে আসছে। এর পরপরই ওরা চার্চে ক্রিসমাসের গানের শব্দ শুনতে পেল।

হ্যারি, আমার মনে হয় আজ ক্রিসমাস ডে! হারমিয়ন বলল।

 তাই নাকি?

হ্যারি তারিখের হিসাব ভুলে গেছে। কয়েক সপ্তাহ ধরে ওদের পত্রিকা দেখা হয়নি।

আমি নিশ্চিত আজ ক্রিসমাস! হারমিয়ন বলল। সে চার্চের দিকে তাকিয়ে আছে। তারা। তারা এখানে আসবেন। তোমার বাবা মা আসতে পারেন না? আমি চার্চের পেছনে গোরস্থান দেখতে পাচ্ছি।

হ্যারি এমন এক পুলক অনুভব করলো যা যে কোনো উত্তেজনাকে ছাড়িয়ে যায়। এই পুলক অনেকটা ভয়ের মত। এই বাস্তবতার সে এতটা কাছাকাছি চলে এসেছে যে এখন ভাবছে নিজেই দেখতে চায় কিনা। সম্ভবত হারমিয়ন তার অনুভূতিটা বুঝতে পেরেছে। কারণ সে এগিয়ে এসে হ্যারির হাত ধরল এবং এই প্রথমবারের মত নিজে ওকে সামনে টেনে নিয়ে গেল। কিন্তু চত্বরটি অর্ধেক পার হয়ে সে পাথরের মত দাঁড়িয়ে পড়ল।

হ্যারি, দেখ!

সে ওই স্মৃতিসৌধটির দিকে আঙুল তুলে দেখালো। ওরা পাশ দিয়ে যাবার সময় এটির আকার বদল হল। পাথরের পিলারের বদলে তিনটি মানুষের মূর্তি ভেসে উঠল। একজন লোকের মাথার চুলগুলো এলোমেলো, একজন মহিলা যার লম্বা চুল এবং মুখটা মায়াবি আর ছোট একটি শিশু বালক মায়ের কোলে বসে আছে। তিনজনের মাথার উপর তুষার পড়ে আছে। মনে হয় যেন মাথায় তুলতুলে সাদা ক্যাপ পরেছে।

হ্যারি সামনে এগিয়ে গেল। ওর বাবা এবং মায়ের দিকে ভাল করে দেখল। সে কখনোই ভাবেনি যে তাদের একটি মূর্তি তৈরি হবে। নিজেকে কপালের উপর স্কার ছাড়া একটি ছোট সুখী বাচ্চার পাথরের মূর্তিতে দেখা কতটা বিস্ময়কর…

সিমন, হ্যারি বলল। ওরা আবার চার্চের দিকে ফিরল। হ্যারি পেছন ফিরে বারবার দেখতে থাকল। ওরা রাস্তা পার হওয়ার সময় লক্ষ করল যে মূর্তি আবার স্মৃতিসৌধে রুপ নিল।

চার্চের কাছে আগাতেই গানের শব্দ আরো স্পষ্ট হল। হ্যারির গলা ধরে এল। তার হোগার্টের কথা মনে হল। গ্রেট হলের ক্রিসমাস ট্রি, ডাম্বলডোরের পরণে বনেট, রন পরে আছে হাতে বুনানো সোয়েটার….

করবস্থানের প্রবেশমুখে একটি বাকানো গেট। হারমিয়ন যতটা সম্ভব শব্দ না করে সেটি ঠেলে খুলল। ওরা ভেতরে ঢুকল। পিচ্ছিল পথের অন্যপ্রান্তে চার্চের দরোজা পর্যন্ত বরফের স্তর পড়ে আছে এবং তাতে কারো পায়ের চিহ্ন পড়েনি। ওরা বরফ ভেঙে এগিয়ে গেল এবং পেছনে গভীর দাগ পড়ে রইল। পুরো বিল্ডিংটার পাশ দিয়ে ওরা গেল। ওরা সুন্দর জানালাগুলোর ছায়া ব্যবহার করল।

চার্চের পেছনে সারি সারি লাইন দেয়া কবরের উপরে পাথর। সেগুলোর উপর এবং বরফের উপর জানালার লাল নীল আলো এসে পড়েছে। জ্যাকেটের পকেটে যাদুদণ্ডটি শক্ত করে ধরে হ্যারি কাছের কবরটির দিকে এগিয়ে গেল।

ওই দেখ! এটি একটি অ্যাবোট, হান্নাহদের বহু আগে মারা যাওয়া কোনো আত্মীয়র অ্যাবোট হবে হয়তো।

হারমিয়ন অনুরোধ করে বলল, তুমি গলার স্বর নিচু করো!

ওরা কবরস্থানের আরো ভেতরের দিকে প্রবেশ করল। ওদের পেছনে বরফের একটি রেখা তৈরি হল। ঝুঁকে পড়ে ওরা একটি পুরাতন পাথরের উপরের লেখা দেখল। একটু পরপর ওরা তীব্র চোখে চারদিকে তাকিয়ে দেখে নিশ্চিত হল যে ওদের সঙ্গে আর কেউ নেই।

হ্যারি! এই যে!

হারমিয়ন দুটি কবরের সারি দূরে রয়েছে। হ্যারি হেঁটে পেছনে ওর কাছে গেল। সে বুকে রীতিমতো হৃদপিণ্ডের একটি ধাক্কা খেল।

এটা কি-

না, কিন্তু লক্ষ করো!

হারমিয়ন ডার্ক স্টোনটির দিকে দেখালো। হ্যারি উবু হয়ে বসে পড়ল এবং

হ্যারি পটার অ্যান্ড দ্য ডেথলি হ্যালোস

ঠাণ্ডা, দাগ পড়ে যাওয়া পাথরের উপর শব্দগুলো লেখা দেখতে পেল। লেখা আছে কেন্দ্রা ডাম্বলডোর; একটু নিচেই জন্ম তারিখ এবং মৃত্যু তারিখ লেখা। তার নিচেই লেখা, এবং তার কন্যা অরিয়ানা। এ নামটির নিচেও উল্লেখ করা আছে :

তোমার সম্পদ যেখানে, তোমার হৃদয়টিও সর্বদা সেখানে থাকবে

 তাহলে রিটা স্কিটার এবং মুরিয়েলের কিছু কথা ঠিক। ডাম্বলডোরের পরিবার এখানেই বাস করতো। এবং এখানেই তাদের পরিবারের কেউ কেউ মারা গেছে।

শোনার চেয়ে কবর দেখাটা আরো বড় ব্যাপার। হ্যারি চিন্তা করতে পারছে যে তার এবং ডাম্বলডোর দুজনেরই শেকড় এই কবরস্থানে রয়েছে। এবং ডাম্বলডোরের এ কথাটি তাকে বলা উচিত ছিল। সে নিজেও কখনো এই সংযোগের কথা চিন্তা করেনি। তারা দুজন একসঙ্গে এই কবরস্থান ভিজিট করতে আসতে পারতো। হ্যারি একবারের জন্য চিন্তা করলো, ডাম্বলডোরের সঙ্গে এখানে এলে কী হতো, কী অর্থ দাঁড়াতো তাতে, কী বাধন তাতে সৃষ্টি হতো। ডাম্বলডোরের কাছে মনে হতো দুজনের আত্মীয়দের কবর পাশাপাশি থাকা একটি গুরুত্বহীন ঘটনা মাত্র। এর সঙ্গে হ্যারিকে দেয়া তার কাজের কোনো সম্পর্ক নেই।

হারমিয়ন বারবার ঘুরে হ্যারির দিকে তাকাচ্ছিল। হ্যারি খুশি হল যে তার নিজের মুখটা ছায়ার ভেতর রয়েছে। সে আবার পাথরের লেখাগুলো পড়ল তোমার সম্পদ যেখানে, তোমার হৃদয়টিও সর্বদা সেখানে থাকবে। এই বাক্যের অর্থ কী তা হ্যারি ঠিক বুঝতে পারল না। অবশ্যই এই বাক্যটি ডাম্বলডোরের দেয়া। তার মা মারা যাবার সময় সেই ছিল পরিবারের বয়োজষ্ঠ।

তুমি কী নিশ্চিত যে তিনি কখনো উল্লেখ করেননি-? হারমিয়ন বলল।

না, হ্যারি দৃঢ়ভাবে বলল। চলো দেখতে থাকি। হ্যারি ঘুরে হাঁটতে থাকল। মনে হলো এসব পাথর না দেখলেই ভাল ছিল। সে তার উপলব্ধিগুলোকে নাড়া দিতে চায়নি।

এই যে! একটু পরেই হারমিয়ন অন্ধকার একটি জায়গা থেকে প্রায় চিৎকার করে বলে উঠল। ওহ না, সরি। আমি ভেবেছিলাম এখানে পটার লেখা আছে।

সে অসম্ভষ্টির সঙ্গে একটি পাথরের উপর থেকে আগাছা ঘষে সরাচ্ছে।

হ্যারি, একটু এদিকে আসো।

সে বরফের উপর দিয়ে আরেকটি রেখা তৈরি করতে চায় না। বিড়বিড় করতে করতে সে আবার হারমিয়নের দিকে আগালো।

কি?

 এটা দেখ!

কবরটি অনেক পুরোনো। এমন অবস্থা হয়ে আছে যে হ্যারি নাম পড়তে পারছে না। হারমিয়ন নিচের দিকের চিহ্নটি দেখালো।

হ্যারি, এটি বইয়ের ভেতরের সেই চিহ্নটি!

হারমিয়নের দেখানো জায়গাটির দিকে হ্যারি তাকালো। পাথরটি এত অস্পষ্ট যে এতে কী আছে বোঝা যায় না। তারপরও মনে হলো যে নামের নিচে তিনকোণা চিহ্নটি রয়েছে।

হ্যাঁ, এটা হতে পারে… হারমিয়ন যাদুদণ্ডের আলো জ্বালল এবং পাথরের উপরের নামটির উপর ধরল।

লেখা আছে, ইগ..ইনোটাস…মনে হয়..

আমি আমার বাবা মায়ের কবর খুঁজতে যাচ্ছি, ঠিকাছে? তার গলায় একটু উম্মা। হারমিয়নকে উবু হয়ে একটি কবর পরিক্ষা করা অবস্থায় রেখে হ্যারি সামনে আগালো।

হোগার্টসের কবরস্থানের অ্যাবোটগুলোর মত এখানে হ্যারি অনেক পরিবারের পারিবারিক নাম দেখতে পেল। কবরস্থানে দু-একটি উইজার্ডিং পরিবারের কয়েক প্রজন্মের প্রতিনিধির কবর রয়েছে। হ্যারি কবরের দিন তারিখ দেখে বলতে পারে যে যারা মারা গেছেন তাদের কোন আত্মীরা গোড্রিচ হলো ছেড়ে চলে গেছেন। হ্যারি যতই ভেতরের দিকে গেল এবং পাথরগুলো দেখল ততই নিজের উপলব্ধি থেকে অস্থির হয়ে উঠল।

হঠাৎ করে যেন অন্ধকার এবং নিস্তব্ধতা নেমে এসেছে। হ্যারি উদ্বিগ্ন হয়ে চারদিকে ঘুরে তাকাল। ভাবল ডেমেনটরদের কথা। তারপর লক্ষ করল চার্চের সঙ্গীত শেষ হয়ে গেছে। সবাই একে একে চত্বরের দিকে চলে গেছে। চার্চের ভেতরে কেউ একজন বাতিটি নিভিয়ে দিয়েছে।

এরপর হারমিয়নের গলা ভেসে এল। তৃতীয়বারের মত সে পরিস্কার তীব্র কণ্ঠে ডাকল কয়েকগজ দূর থেকে।

হ্যারি তাদের কবর এখানে, এই যে এখানে!

এবার হ্যারি ওর কণ্ঠস্বর শুনে বুঝল যে এটা ওর বাবা মায়ের কবর। সে দ্রুত পায়ে হারমিয়নের দিকে গেল। মনে হল বুকের উপর একটি ভার অনুভব হচ্ছে। এই একই রকম অনুভূতি হয়েছিল ডাম্বলডোর মৃত্যু বরণ করার পর। নিজের হার্ট থেকে একটি দুঃখবোধ জেগে উঠেছে।

এই হেডস্টোনটি কেন্দ্রা এবং অরিয়ানার হেডস্টোন থেকে একটু পেছনে। এটিও ডাম্বলডোরের স্মৃতির মত শ্বেত পাথরের তৈরি। সে কারণেই এর উপরের লেখা পড়তে সুবিধা হচ্ছে। অন্ধকারের ভেতরেও যেন পাথরের উপর লেখা চকচক করছে। হ্যারিকে লেখাটা পড়ার জন্য উবু হয়ে বসতে হল না বা খুব কাছে যেতে হল না।

জেমস পটার
জন্ম : ২৭ মার্চ, ১৯৬০
মৃত্যু : ৩১ অক্টোবর, ১৯৮১
লিলি পটার
জন্ম : ৩০ জানুয়ারি, ১৯৬০
মৃত্যু : ৩১ অক্টোবর, ১৯৮১
শেষ শত্রুও ধ্বংস হবে মৃত্যুর মধ্যদিয়ে।

হ্যারি বাক্যগুলো ধীরে ধীরে পড়ল। এমন ভাব যেন সে একবারই পড়ার সুযোগ পাবে। শেষের বাক্যটি হ্যারি শব্দ করে পড়ল।

শেষ শত্রুও ধ্বংস হবে মৃত্যুর মধ্য দিয়ে… একটি ভয়ানক চিন্তা তার ভেতরে অস্থির করে তুলল। এটা একটি ডেথ ইটারদের ধারণা নয়?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *