১২. ম্যাজিকই শক্তি

১২. ম্যাজিকই শক্তি

আগস্ট মাস চলে এলো। গ্রিমোল্ড প্লেসের চত্বরে অযত্নে বেড়ে ওঠা ঘাসগুলো রোদের তাপে নিস্তেজ এবং বাদামি রঙ ধারণ করেছে। দুপাশের বাড়িঘরের বাসিন্দারা কেউ কখনো ১২ নম্বর বাড়ির কাউকে দেখেনি। এমন কি বাড়িটিকেও দেখেনি। গ্রিমোল্ড প্লেসে বসবাসকারী মাগলরা বহুদিন ধরেই মেনে নিয়েছে যে বাড়ির নম্বর বসানোর ক্ষেত্রে ভুল হয়েছে। ফলে ১১ নম্বর বাড়ির পরেই ১৩ নম্বর বাড়িটি পড়েছে।

তারপরও ওই জায়গাটিতে টুকটাক দর্শনার্থী আসে। তারা আগ্রহ নিয়ে রহস্য খুঁজতে আসে। গ্রিমোল্ড প্লেসে একজন বা দুজন লোক আসে না এমন কোনো দিন খুব একটা দেখা যায় না। অন্য কোনো কারণ ছাড়াই, অন্তত দেখলে তাই মনে হয়-তারা রেলিং এ হেলান দিয়ে ১১ এবং ১৩ নম্বর বাড়িটির সংযোগ স্থলটির দিকে তাকিয়ে থাকে। চুপিচুপি আসা এ বিশেষ লোকগুলোর মধ্যে সাধারণত পরপর দুদিন একজনকে দেখা যায় না, যদিও তাদের সবাইকেই লক্ষ করা যায় যে তারা সাধারণ পোশাক পছন্দ করে না। লন্ডনের অধিবাসীরা যারা এদের পাশ দিয়ে হেঁটে  যায় তারা এদের অপ্রচলিত পোশাকের দিকে খুব একটা খেয়াল করে না। শুধু দু একজন হেঁটে যাওয়ার সময় পিছন দিকে তাকিয়ে একবার দেখে ভাবে, এই গরমের মধ্যে একজন মানুষ লম্বা একটি আলখাল্লা পড়ে আছে কেন?

নজর রাখা লোকগুলোর মধ্যে খুব একটা প্রাপ্তির আনন্দ লক্ষ করা যায় না। হঠাৎ হঠাৎ তাদের কেউ একজন ভীষণ আগ্রহ নিয়ে এমন উত্তেজিতভাবে সামনে এগিয়ে যায় যেন যা খুঁজছে অবশেষে তা পেয়ে গেছে। শেষে যখন আবার ফিরে আসে তখন হতাশ দেখা যায়।

সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম দিন আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি লোককে। চত্ত্বরে দেখা গেল। আলখাল্লা গায়ে দেয়া ছয় জন লোক নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে নজর রাখছে। তারা বারবার ১১ নম্বর এবং ১৩ নম্বর বাড়ির দিকে তাকাচ্ছে। কিন্তু আসল যা খোঁজার জন্য তারা অপেক্ষা করছে সেটা ধরা-ছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাচ্ছে। সন্ধ্যা নেমে এলো। অপ্রত্যাশিত বাতাসের সঙ্গে গুঁড়িগুড়ি বৃষ্টি পড়তে শুরু করল। সপ্তাহের মধ্যে এই প্রথম বৃষ্টি নামল। কী কারণে কে জানে তারা আগ্রহ নিয়ে কিছু একটা দেখতে এগিয়ে গেল। কঠিন চেহারার লোকটি তার পাশের লোকটিকে হাত ইশারায় কিছু একটা দেখালো। পাশের ওই পরিপাটি লোকটি একটু সামনে এগিয়ে যেতে থাকল। একটু পরেই আবার তারা গা ছেড়ে দিয়ে যার যার জায়গায় ফিরে এলো। তাদেরকে হতাশ দেখা গেল।

এদিকে হ্যারি সবেমাত্র ১২ নাম্বার বাড়িটির হলরুমে এসে ঢুকল। সামনের দরোজার সবচেয়ে উপরের সিঁড়িতে অ্যাপারেট করে নামতে গিয়ে হ্যারি প্রায় পড়েই গিয়েছিল। কোনোক্রমে নিজের ভারসাম্য রক্ষা করেছে। ভেবেছিল এই বুঝি ডেথ-ইটাররা ওর ক্ষণিকের জন্য বের হয়ে আসা কনুইটা দেখে ফেলল। হ্যারি সতর্কতার সঙ্গে হলরুমের দরোজাটি বন্ধ করে দিয়ে গায়ের অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার আলখাল্লাটি খুলে ফেলল। সেটিকে ভাঁজ করে হাতের উপর নিয়ে সোজা বেসমেন্ট যাওয়ার দরোজাটির দিকে আগালো। হাতের মুঠিতে সে একটি ডেইলি ফেটের কপি শক্ত করে ধরে আছে।

বরাবরের মতো ফিসফিস করে, সেভেরাস স্নেইপ? বলাতে তাকে এক ধরনের অভ্যর্থনা জানানো হলো। একটা দমকা হাওয়া উঠল। ক্ষণিকের জন্য হ্যারির জিহ্বা গুটিয়ে এলো।

আমি তোমাকে হত্যা করিনি,হ্যারি বলল। যে ধুলোর শরীরটি উঠে এসেছিল সেটি বিস্ফোরিত হলো। হ্যারি দম নেয়ার জন্য খানিক সময় অপেক্ষা করল। উঠে আসা ধুলো পরিষ্কার না হওয়া পর্যন্ত সে অপেক্ষা করল এবং মিসেস ব্ল্যাকের কান সজাগ না হয়ে উঠে ততটা দূরত্ব রেখে সে কিচেনের পথে অর্ধেক সিঁড়ি পর্যন্ত নামল। তখনই কথাটা শুনতে পেল, আমি একটি খবর পেয়েছি, কিন্তু আপনি এটা পছন্দ করবেন না।

কিচেনটি এখন আর ঠিক চেনা যাচ্ছে না। প্রতিটি জায়গা এখন ঝকমক করছে। দস্তার পাত্রগুলো, চকচকে ধোয়ামোছা করা, কাঠের টেবিলের উপরটা ঝকমকে, ডিনারের জন্য যে থালা বাটি টেবিলের উপর রাখা হয়েছে সেগুলোর উপর ঘরে জ্বলতে থাকা আলো পড়ে বেশ ঝিকমিক করছে। খাবারের ডিশ থেকে ধোঁয়া উঠছে। আর কোনো বিশেষ পরিবর্তন দেখা গেল না, শুধু ঘরের ভুতটি দৌড়ে হ্যারির দিকে আসল। পরনে তুষারের মতো সাদা তোয়ালে ধরনের কিছু। ওর কানের উপরের চুলগুলো পরিষ্কার, তুলোর মতো ফুরফুরে। পাতলা বুকের উপর রেগুলাসের লকেটটি ঝুলে আছে।

দয়া করে জুতো খুলুন এবং হাত-মুখ ধুয়ে খাবার খেয়ে নিন প্রভু, ক্রিচার বলল। হ্যারির হাত থেকে অদৃশ্য হওয়ার আলখাল্লাটি নিল এবং ধীর পায়ে হেঁটে গিয়ে দেয়ালের হুকের সঙ্গে ঝুলিয়ে দিল। পাশেই আরেকটি পুরাতন ফ্যাশনের গাউন ঝোলানো রয়েছে। সেটি একেবারে যত্ন নিয়ে ধোলাই করা।

কী ঘটনা? রন গুরুত্ব দিয়ে জানতে চাইল। রন এবং হারমিয়ন এক গাদা কাটাছেঁড়া করা লেখা নোট হতে আঁকা ম্যাপ পরীক্ষা করে দেখছিল। ওগুলো কিচেনে লম্বা টেবিলের এক কোণায় পড়েছিল। কিন্তু এবার ওরা দেখল হ্যারি লম্বা

পা ফেলে ওদের কাছে আসছে। হ্যারি কাছে এসেই হাতের পত্রিকাটি ওদের দেখতে থাকা কাগজগুলোর উপর ছুঁড়ে দিল।

পত্রিকার উপর চোখা নাক, কালো চুলের পরিচিত মানুষটির ছবি। ওদের সবার দিকে তাকিয়ে আছে। তার নিচে বড়বড় করে শিরোনাম লেখা

হোগার্টের প্রধান শিক্ষক হিসেবে
সেভেরাস স্নেইপের নাম ঘোষণা করা হয়েছে

হারমিয়ন এবং রন একই সঙ্গে বলে উঠল, না!

হারমিয়নই আগে হাত বাড়িয়ে কাগজটি ধরল। সে প্রায় ছিনিয়ে নিয়ে জোরে জোরে সবাইকে শুনিয়ে পড়তে থাকল।

উইজার্সি এবং উইচক্রাফটের দীর্ঘদিনের পোশন মাস্টার সেভেরাস স্নেইপকে হেডমাস্টার হিসাবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। বেশ কিছু স্টাফের পরিবর্তনের ধারাবাহিকতায় এই প্রাচীন স্কুল থেকে সাবেক মাগল টিচার পদত্যাগ করায় তার স্থলাভিষিক্ত হচ্ছেন অ্যালেকটো কারো। আর তার ভাই অ্যামিকাস ডিফেন্স এগেইস্ট দি ডার্ক আর্টের প্রফেসরের দায়িত্ব নিচ্ছেন।

আমাদের উইজার্ডের ঐতিহ্য এবং মূল্যবোধ সমুন্নত রাখার সুযোগকে আমি স্বাগত জানাই- আমি মনে করি এটি জনগণের কান কেটে দেয়ার মত, হত্যা করার মতো অপরাধ! স্নেইপ হবে হেডমাস্টার! ডাম্বলডোরের স্টাডিতে গিয়ে স্নেইপ বসবে–মেরলিনের প্যান্ট! সে এমনভাবে শেষের শব্দটি বলার সময় চিৎকার করে উঠল যে হ্যারি এবং রন দুজনই লাফিয়ে উঠল। হারমিয়ন টেবিলের উপর দিয়ে লাফ দিয়ে রুম থেকে বের হয়ে গেল। যাওয়ার সময় পেছন থেকে বলল, এক মিনিটের মধ্যে ফিরে আসছি!

মেরলিনের প্যান্ট? রন হারমিয়নের মতো করে উচ্চারণ করল। অবশ্যই হারমিয়ন খুব আপসেট হয়েছে।

রন নিউজ পেপারটি টেনে নিল এবং স্নেইপের উপর লেখা প্রতিবেদনটি যত্নসহকারে পড়তে থাকল।

অন্য শিক্ষকরা এটার পক্ষে সমর্থন দেবেন না। ম্যকগোনাগল, ফ্লিটউইক এবং উটের মতো শিক্ষকরা প্রকৃত সত্যটা জানেন। তারা ভালো করেই জানেন ডাম্বলডোর কীভাবে নিহত হয়েছেন। তারা স্নেইপকে হেডমাস্টার হিসাবে মেনে নেবেন না। আর এই ক্যারোস বা কে?

হ্যারি বলল, ডেথ-ইটার। ভিতরে ওদের ছবি দেয়া আছে। স্নেইপ যখন ডাম্বলডোরকে হত্যা করে তখন ওরা টাওয়ারের উপরে অবস্থান নিয়েছিল। সুতরাং ওরা সব বন্ধুরা এখন এক। হ্যারি বিরক্তির সঙ্গে একটি চেয়ার টেনে বসল। বলল, এবং শিক্ষকদের ওখানে যথারীতি অবস্থান করা ছাড়া অন্য কিছু করার আছে বলে আমার মনে হয় না। যদি মিনিস্ট্রি এবং ভোল্ডেমর্ট স্নেইপের পিছনে থাকে তাহলে টিচারদের হয় ওখানে থাকতে হবে, নতুবা আজকাবানে তাদের তাদের স্থান।

হবে। আমি মনে করি তাদের সেখানে থেকে বরং শিক্ষার্থীদের স্বার্থ দেখতে চেষ্টা করাটাই উচিত।

ক্রিচার দ্রুতগতিতে টেবিলের কাছে আসল। তার হাতে বড় বাটি। সে অন্য ছোট বাটিগুলোতে সুপ বাড়ল। বাড়ার সময় দুদাঁতের ফাঁক দিয়ে হুস হুস করে শব্দ করল।

ধন্যবাদ ক্রিচার হ্যারি বলল। ডেইলি প্রফেটের কপিটি ভাঁজ করল যাতে স্নেইপের মুখটি না দেখতে হয়। যা হোক, আমরা এখন অন্তত জানতে পারছি যে স্নেইপের অবস্থান কোথায়।

হ্যারি চামচে তুলে সুপ মুখে দিতে থাকল। রেগুলাসের লকেটটি তাকে দেয়ার পর থেকে ক্রিচারের রান্না নাটকীয়ভাবে উন্নত হয়েছে। আজ যে ফ্রেঞ্চ অনিয়ন রান্না করেছে এমন স্বাদ হ্যারি আর কখনো পায়নি।

হ্যারি খেতে খেতে রনের দিকে তাকিয়ে বলল, এখনো একদল ডেথ-ইটার বাড়িটার দিকে লক্ষ রাখছে। দেখেশুনে মনে হচ্ছে ওরা আশা করছে আমরা আমাদের বইখাতা নিয়ে হোগার্ট এক্সপ্রেসে চড়ে স্কুলের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হব।

রন ঘরির দিকে তাকালো।

আমি সারাক্ষণ এই বিষয়টি নিয়ে ভাবছি। ইতিমধ্যেই ছয় ঘণ্টা পার হয়ে গেছে। অবিশ্বাস্য, এ রকম হওয়ার কথা নয়, তাই না?

হ্যারি ওর মনের চোখ দিয়ে রঙ বেরঙের ঝলমলে স্টিম ইঞ্জিনটি দেখল। ঝিকঝিক করতে করতে ক্ষেত, পাহাড় পার হয়ে যাচ্ছে একটি শুয়োপোকার মতো। হ্যারি নিশ্চিত যে ওর ভেতরে এখন জিনি, নেভিল এবং রুনা বসে আছে। হয়তো ওরা ভাবছে হ্যারি, রন এবং হারমিয়ন কোথায় গেল। অথবা তর্কে জড়য়ে পড়েছে কী করে স্নেইপের নতুন আমলকে অস্বীকার করা যায়।

হ্যারি বলল, ওরা আমাকে প্রায় দেখেই ফেলেছিল। আমি সিঁড়ির উপর খুব বাজে ভাবে এসে নেমেছি। গায়ের থেকে অদৃশ্য হওয়ার আলখাল্লাটি স্লিপ করে গিয়েছিল।

আমার সবসময় এমন হয়, ওহ এই যে হারমিয়ন এসেছে। রন বলল। সে নিজের চেয়ারটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে নিয়ে হারমিয়নের কিচেনে প্রবেশ করার দিকে মুখ করে নিল। বলল, মারলিনের নামের সঙ্গে সম্পর্কটা কি?

হারমিয়ন বলল, আমার এটার কথা মনে পরেছিল।

তার হাতে একটা বড় আকারের ফ্রেমে বাঁধানো ছবি। সে ওটাকে নিচু করে দেখালো। তারপর কিচেনের ড্রেসার থেকে ওর ছোট ব্যাগটা টেনে নিল। ব্যাগটা খুলে বড় আকারের পেইনটিং ছবিটা ঠেসে ভরে দিতে থাকল। যদিও বড় ছবিটার তুলনায় ব্যাগটা অতি ছোট, কিন্তু কয়েক সেকেন্ডের ভেতরই ছবিটা ব্যাগের ভেতরে অদৃশ্য হয়ে গেল। ব্যাগের পেটের ভেতর অন্য অনেক কিছুর মতো ঢুকে গেল।

হারমিয়ন ব্যাগটি কিচেন টেবিলের উপর ছুঁড়ে ফেলল। ঝনাৎ করে একটা ধাতব শব্দ উঠল। বলল, পাইনিয়াস নিজেলাস।

রন বলল, সরি, বুঝতে পারলাম না। কিন্তু হ্যারি বিষয়টি বুঝল। পাইনিয়াস নিজেলাস ব্ল্যাক তার ছবিটির সঙ্গে গ্রিমোল্ড প্লেসে হোগার্টের হেডমাস্টারের অফিসে টাঙানো একটি ছবির সংযোগ তৈরি করতে পারে। সম্ভবত বৃত্তের মতো ঘোরানো উপরে টাওয়ারঅলা রুমটিতে এখন স্নেইপ বসে আছে। ডাম্বলডোরের ম্যাজিকের সরঞ্জাম, পাথরের পেনসিভ, সর্টিং হ্যাট এবং গ্রিফিনডোরের তরোয়াল সরিয়ে না নেয়া পর্যন্ত স্নেইপ খুব গর্বের সঙ্গে ওগুলো দখল করার গর্ব অনুভব করবে।

হারমিয়ন নিজের চেয়ারটায় বসে রনকে ব্যাখ্যা করে বলতে শুরু করল, স্নেইপ নিজের স্বার্থে পাইনিয়াস নাইজেলাসকে এই বাড়ির ভেতর খোঁজ করতে পাঠাতে পারে। কিন্তু এখন পাঠাতে দাও। এখন পাইওনাস নাইজেলাসকে পাঠালে সে শুধু হ্যান্ডব্যাগের ভেতরের কালো অংশটাই দেখবে।

রন বিষয়টা বুঝতে পারল। বলল, ভালো চিন্তা করেছ।

থ্যাঙ্ক ইউ, হারমিয়ন মিষ্টি করে হাসল। নিজের সুপের বাটিটা কাছে টেনে নিল। বলল, হ্যারি,তাহলে আজ কী ঘটল বলোত?

হ্যারি বলল, কিছুই না। সাত ঘন্টা ভরে মিনিস্টির দিকে নজর রাখলাম। মহিলাকে দেখা গেল না। তবে তোমার বাবাকে দেখেছি রন। তাকে ভালো আছে বলেই মনে হলো।

রন খবরটির জন্য মাথা ঝাঁকিয়ে ওকে ধন্যবাদ জানালো। ওরা দুজনই একটা বিষয়ে সম্মত হলো যে রনের বাবার সঙ্গে যোগাযোগ করাটা ভয়ানক বিপজ্জনক হতো। কারণ তার চারপাশে সবসময় মিনিস্ট্রির কর্মচারীরা রয়েছে। তাকে এক নজরের জন্য দেখাটাই স্বস্তিদায়ক। তাকে যদি উদ্বিগ্ন দেখা যেত বা সমস্যায় আছে মনে হতো, তারপরও তাকে চোখে দেখতে পাওয়াটাই বড় কথা।

রন বলল, ড্যাড আমাদেরকে সবসময় বলেন, মিনিস্ট্রির অধিকাংশ কর্মচারী অফিসে যাতায়াতে ফু-নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে থাকে। সে কারণেই আমরা আমব্রিজকে কখনো দেখিনি। তিনি কখনো হেঁটে চলাচল করেন না। নিজেকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন।

হারমিয়ন জানতে চাইল, আর ওই নীল গাউন পরা ছোট যাদুকর এবং বৃদ্ধ। মেয়ে যাদুকরের বিষয়টি কি?

রন বলল, ওহ, ওই লোকটা হলো ম্যাজিক্যাল মেইনটেনেন্সের।

হারমিয়ন সুপ মুখে দিতে গিয়েও মাঝপথে থামল। বলল, তুমি জানলে কী করে যে সে ম্যাজিক্যাল মেইনটেনেন্সের হয়ে কাজ করে?

ড্যাড বলেছেন ম্যাজিক্যাল মেইনটেনেন্সের হয়ে যারা কাজ করে তারা প্রত্যেকে নিল গাউন পড়ে।

কিন্তু তুমি তো আমাদেরকে এ কথা কখনো বলনি!

হারমিয়ন হাত থেকে চামচ নামিয়ে রাখল এবং সামনে রাখা নোট ও ম্যাপগুলো নিজের দিকে টেনে নিল। যেগুলো হ্যারি কিচেনে প্রবেশ করার সময় ওরা পরীক্ষা করে দেখছিল।

হারমিয়ন আলুথালু করে ওগুলোর পাতা উল্টাতে উলটাতে বলল, কিন্তু নীল গাউন সম্পর্কে তো এর মধ্যে কিছু লেখা নেই, কিচ্ছু না!

আচ্ছা, এটা কি খুব গুরুত্বপূর্ণ কোনো বিষয়?

রন, এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়! যদি আমরা মিনিস্ট্রিতে ঢুকতে চাই এবং তারা চুপে চুপে ঢোকা লোকদের খোজার সময় ধরা না পড়তে চাই তাহলে সব ক্ষুদ্র বিষয়ই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা এগুলোর ভেতর বারবার সূত্র খুঁজে বের করতে চেষ্টা করছি, আর তুমি যদি একটু মুখ ফুটে বলতে না পার-

এহ্ হারমিয়ন,আমি শুধু একটি ছোট বিষয় বলতে ভুলে গেছি

তুমি কি বুঝতে পারছ না যে এই মুহূর্তে পৃথিবীতে আমাদের জন্য সবচেয়ে বিপদজ্জনক জায়গা হলো এই মিনিস্ট্রি

হ্যারি বলল, আমার মনে হয় আমরা তো আগামীকাল করতে পারি।

হারমিয়ন পাথরের মতো থমকে গেল। সে মুখ হা করে থাকল। রনের মুখের ভেতর সুপ আটকে গেল।

হারময়িন রিপিট করে বলল, আগামীকাল? তুমি কী গুরুত্ব বুঝতে পারছ না হ্যারি?

হ্যারি বলল, বুঝতে পারছি। আমরা আরো একমাস যদি মিনিস্ট্রিতে প্রবেশের জন্য ঘুরধুর করি–তাহলেও আমার মনে হয় না আমরা এখন যতটা প্রস্তুত আছি তার চেয়ে বেশি প্রস্তুত হতে পারব। আমরা যতটা দেরি করব, লকেটটি তত দূরে চলে যাবে। এরই মধ্যে আমব্রিজ হয়তো লকেটটি খুলতে না পেরে ফেলেও দিয়ে থাকতে পারেন।

রন বলল, কখনোই না, যে পর্যন্ত সে খুলতে না পারবে সে পর্যন্ত ওটি নিজের কাছে রেখে দেবে।

হ্যারি কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, তাকে দিয়ে কোনো বিশ্বাস নেই। ওরা সবাই এক। সে ছিল প্রথম শ্রেণীর এক শয়তান।

হারমিয়ন বসে তার ঠোঁট কামড়াচ্ছে। সে গভীরভাবে বিষয়টি চিন্তা করছে।

হ্যারি হারমিয়নের দিকে তাকিয়ে বলল, আমরা জানি সবকিছুই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা জানি যে ওরা মিনিস্ট্রির ভিতরে এবং বাইরে অ্যাপারিশন বন্ধ করে দিয়েছে, মিনিস্ট্রির অতি উচ্চ পর্যায়ের সিনিয়র সদস্যরাই শুধু ফুঁ নেটওয়ার্কের সঙ্গে বাড়ির সংযোগ রাখতে পারেন। কারণ রন এ সম্পর্কে ভয়ানক দুটি অভিযোগ শুনেছে এবং আমরা মোটামুটি আমব্রিজের অফিসটি কোথায় তাও জানি, কারণ তুমি ওই দাড়িওয়ালা লোকটিকে তার বন্ধুর কাছে বলতে শুনেছ-

হারমিয়ন তার শোনা কথাগুলো রিপিট করল, আমি উপরে লেভেল ১-এ যাব, ডলরস আমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন।

হ্যারি বলল, ঠিক, এবং তুমি ওই হাস্যকর কয়েনগুলো বা টোকেন যাই বলো কেন–ওগুলোর ব্যবহার জানো। কারণ আমি ওই যাদুকর মহিলাকে দেখেছি তার বন্ধুর কাছ থেকে কয়েন ধার নিতে-

কিন্তু আমাদের কাছে তো একটি কয়েনও নেই!

হ্যারি শান্ত কণ্ঠে বলল, যদি পরিকল্পনা মতো চলে তাহলে আমাদের কাছেও থাকবে।

আমি জানি না হ্যারি! আমি বলতে পারি না! অনেক বিপদের সম্ভবনা রয়ে যাচ্ছে। আমরা অনেক বেশি চান্সের উপর নির্ভর করছি….

হ্যারি বলল, আমরা যদি প্রস্তুতি গ্রহণ করতে আরো তিন মাস ব্যয় করি সে ক্ষেত্রেও এ কথাটি প্রযোজ্য হবে। সুতরাং এখনই যা করার করতে হবে।

রন এবং হারমিয়নের মুখের দিকে তাকিয়ে হ্যারি বুঝতে পারল ওরা ভয় পেয়েছে। সে নিজেও খুব একটা ভরসা পাচ্ছে না। কিন্তু তারপরও হ্যারির মনে হলো–যে এখনই কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ার সময়।

গত চারটি সপ্তাহ ওরা কাটিয়ে দিয়েছে অদৃশ্য আলখাল্লা প্রস্তুত করতে এবং মিনিস্ট্রির অফিসিয়াল প্রবেশ পথের দিকে গুপ্তচরের কাজ করে। রন ছোটবেলা থেকেই জায়গাগুলো সব চিনত। এজন্য মি. উইসলিকে ধন্যবাদ দেয়া যেতে পারে। ওরা মিনিস্ট্রি কর্মচারীদের পিছু নিয়েছে, তাদের আলোচনাগুলো কান পেতে শুনেছে। প্রতিদিন একই সময়ে হাজির হয়ে খুব মনোযোগ দিয়ে তাদেরকে জানতে হয়েছে। মাঝে মাঝে ফাঁক বুঝে একটি ডেইলি ফেটের কপি, কারো ব্রিফকেস থেকে টুক করে তুলে নিয়েছে। এভাবেই ধীরে ধীরে ওদের একটি নোট এবং ম্যাপ দাঁড়িয়ে গেছে, যেটি এখন হারমিয়নের সামনে রয়েছে।

রন ধীরে ধীরে বলল, ঠিক আছে, ধরো যদি আমরা আগামীকাল যাই..আমার মনে হয় আমি এবং হ্যারির যাওয়াটাই ভালো।

হারমিয়ন নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল, ওহ্ আবার আরম্ভ করলে! আমার ধারণা ছিল আমরা ইতিমধ্যেই বিয়টি চূড়ান্ত করেছি।

আলখাল্লার ভেতর থেকে প্রবেশপথে অপেক্ষা করা এক জিনিস, কিন্তু এটা একটু ভীন্ন হারমিয়ন, রন বলল। সে দশ দিন আগের একটি ডেইলি.প্রফেটের উপর টোকা দিয়ে বলল, তুমি মাগল বর্নদের তালিকার একজন যারা তদন্তের জন্য হাজির হওনি! এবং তুমি বারোতে স্প্যাটারগ্রোয়েটের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছ। যদি কারো যেতে না হয় তাহলে সেটা হ্যারির জন্য প্রযোজ্য। তার মাথার মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ১০ হাজার গ্যালিয়ন-

হ্যারি বলল, ভালো কথা, তাহলে আমি এখানে থেকে যাই। তোমরা কখনো ভোল্ডেমর্টকে পরাস্থ করতে পারলে আমাকে জানিও।

রন এবং হারমিয়ন হেসে উঠল। হ্যারির কপালের স্কারটিতে জ্বালা করতে শুরু করেছে। সে হাত তুলে জায়গাটিতে রাখল। সে দেখল হারমিয়ন বাকা করে তাকিয়েছে। হ্যারি তার নিজের চুলে হাত বুলিয়ে অন্যমস্ক হয়ে থাকতে চাইল।

রন বলতে থাকল, ঠিক আছে, আমরা তিনজনই যদি যাই তাহলে আলাদা আলাদাভাবে ডিস্যাপারেট করব। আমরা তিনজন একসঙ্গে আলখাল্লার ভিতরে ঢুকতে পারব না।

হ্যারির স্কারটিতে আরো যন্ত্রণা বাড়তে থাকল। সে উঠে দাঁড়ালো। সঙ্গে সঙ্গে ক্রিচার দৌড়ে কাছে এলো।

মাস্টার স্যুপ শেষ করেননি। প্রভু কি শাক দিয়ে রান্না করা মাছ পছন্দ করবেন? অথবা প্রভু কি ঝাল জাতীয় পছন্দের কিছু খাবেন?

ধন্যবাদ ক্রিচার, আমি এক মিনিটের মধ্যে ফিরে আসব। একটু বাথরুমে যাব।

হ্যারি জানে হারমিয়ন পেছন থেকে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। হ্যারি সিঁড়ি বেয়ে দ্রুত উপরে হলরুমে উঠে গেল। প্রথম ল্যান্ডিঙে গিয়ে বাথরুমের দরোজা ধাক্কা দিয়ে খুলল। তারপর ভেতর থেকে বন্ধ করে দিল। ব্যথায় কঁকিয়ে উঠে কালো রঙের বেসিনের উপর ঝুঁকে পড়ল। বেসিনের পানির ট্যাপের মুখটি সাপের হাঁ করা মুখের মতো। হ্যারি চোখ বুজল…

হ্যারি নিভু নিভু আসোর একটি রাস্তা দিয়ে ধীর গতিতে হেঁটে যাচ্ছে। দুপাশের ভবনগুলো সুউচ্চ। বাড়িগুলোতে কাঠের রং-এ পালিশ দেয়া। কালো কেকের মতো দেখতে।

সে এমন একটি বাড়ির দিকে এগিয়ে গেল। দেখল তার সাদা হাত দরোজার উপর রেখেছে। দরোজায় টোকা দিল। ভিতরে একটা উত্তেজনা শুরু হয়েছে….

দরোজা খুলে গেল। একজন হাস্যজ্জ্বল মহিলা দরোজায় দাঁড়িয়ে আছেন। তার মুখটি দেখে মনে হলো হ্যারির মুখের ভেতর দেখতে চেষ্টা করছে। মুখ থেকে হাসি উবে গেল, চেহারাটা ভয়ানক হয়ে উঠল…

গ্রেগোরোভিচ? একটি শান্ত কণ্ঠ উচ্চারণ করল।

মহিলা মাথা নাড়লেন। তিনি দরোজাটা বন্ধ করে দিতে চেষ্টা করলেন। একটি সাদা হাত তাকে দরোজা বন্ধ করা থেকে বিরত রাখল। জোর করে দরোজাটা ঠেলে ধরল।

আমি গ্রোগোরোভিচকে চাই।

মহিলা মাথা নেড়ে চিৎকার করে জার্মান ভাষায় বললেন, এর ভল্ট হিয়ার নিক্সট মেয়ার। ভাঙা ভাঙা ভাষায় বললেন এখানে থাকে না! এখানে থাকে না! আমি তাকে চিনি না!

দরোজা বন্ধ করে দেয়ার চেষ্টা বাদ দিয়ে মহিলা অন্ধকার ঘরের ভিতরের দিকে যেতে থাকলেন। হ্যারি তাকে অনুসরণ করল। শান্তভাবে তার দিকে এগিয়ে গেল। তার লম্বা আঙুলওলা হাত দিয়ে যাদুদণ্ড বের করে সামনে ধরল।

সে কোথায়?

দাস ভাইস ইস নিক্সট! অর্থাৎ আমি জানি না। সে চলে গেছে। কোথায় গেছে আমি জানি না!

হ্যারি যাদুদণ্ডটি তুলল। মহিলা চিৎকার করতে থাকল। দুটি ছোট্ট শিশু দৌড়ে হলরুমে প্রবেশ করল। মহিলা বাচ্চা দুটোকে হাত দিয়ে ধরে ঢাল হিসাবে ব্যবহার করতে চেষ্টা করল। একটি সবুজ আলো ঝলসে উঠল

হ্যারি! হ্যারি!

হ্যারি চোখ খুলল। সে মেঝেতে পড়ে আছে। হারমিয়ন দরোজায় জোরে জোরে টোকা দিচ্ছে।

হ্যারি, দরোজা খোলো!

হ্যারি জানে সে চিৎকার করছিল। উঠে দাঁড়িয়ে দরোজা খুলে দিল। হারমিয়ন লাফ দিয়ে ভেতরে ঢুকল। সে কোনক্রমে নিজের ভারসাম্য ঠিক রাখল। সন্দেহ নিয়ে চারদিকে তাকালো। হারমিয়নের ঠিক পেছনেই রন। সে স্থির দাঁড়িয়ে আছে। তার যাদুদণ্ডটি ছোট বাথরুমের এক কোণের দিকে তাক করা।

কঠিন সুরে হারমিয়ন বলল, তুমি কী করছিলে?

হ্যারি নিস্তেজ কিন্তু শক্ত গলায় বলল, তোমার কি মনে হয়, আমি কী করছিলাম?

তুমি চিৎকার করছিলে মাথা গেল বলে। রন বলল।

ওহ, হ্যাঁ আমি বোধ হয় একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, অথবা

 হ্যারি, প্লিজ, আমাদের এতটা নির্বোধ বলে মনে করো না। হারমিয়ন বলল। সে লম্বা করে নিঃশ্বাস নিল। আমরা জানি তোমার স্কারটিতে জ্বালা করছিল। এবং তুমি চাদরের মতো সাদা হয়ে গিয়েছিলে।

হ্যারি বাথরুমের ভেতর একপ্রান্তে বসে পড়ল।

ওকে, আমি এই মাত্র দেখতে পেয়েছি ভোল্ডেমর্ট একজন মহিলাকে হত্যা করছে। এতক্ষণে সম্ভবত মহিলার পুরো পরিবারকে হত্যা করেছে। এই নিষ্ঠুরতার তার প্রয়োজন নেই। সেড্রিক আবার সেখানে, চারদিকে সেড্রিক। ওরা ওখানে…

হ্যারি, তোমার আর এই বিষয়টি আর ঘটতে দেয়া উচিত হচ্ছে না। হার মিয়ন চিৎকার করে উঠল। তার কণ্ঠস্বর বাথরুমে প্রতিধ্বনি তুলল। ডাম্বলডোর চাইতেন তুমি ওকলুমেনসি ব্যবহার করো! তিনি মনে করতেন তোমার এই যোগাযোগকে ভোল্ডেমর্ট ব্যবহার করতে পারে হ্যারি! সে কাউকে হত্যা করছে বা নির্যাতন করছে তা দেখে কী হবে বলো, এতে কাজই বা কী?

হ্যারি বলল, এর মানে হলো অন্তত সে যা করছে তা জানতে পারছি।

তুমি তো চেষ্টা করনি তাকে দেখাটা বন্ধ করতে?

হারমিয়ন, আমি ইচ্ছা করলেই পারি না। তুমি জানো, ওকলুমেনসির ব্যাপারে আমার সমস্যা আছে। আমি কখনো এটাকে আটকে রাখতে পারি না।

হারমিয়ন বলল, তুমি কখনো সত্যিকারের চেষ্টা করনি। আমি বুঝতে পারি না। তুমি নিশ্চই নিজেই এই যোগাযোগ বা সম্পর্ক যাই বল–পছন্দ করো?

 হ্যারি উঠে দাঁড়াল। হারমিয়নের দিকে এমনভাবে তাকালো যে সে একটা হোঁচট খেল।

হ্যারি ঠাণ্ডাভাবে বলল, আমি এটা পছন্দ করি? তুমি হলে কী পছন্দ করতে?

না…না সে কথা নয়…আমি দুঃখিত হ্যারি..আমি আসলে ওভাবে বলতে চাইনি।

আমি এটা ঘৃণা করি! আমি ঘৃণা করি যে সে আমার ভেতরে প্রবেশ করতে পারে এবং সে যখন সবচেয়ে বিপদজ্জনক হয়ে ওঠে তখন তাকে আমার দেখতে হয়। কিন্তু হ্যাঁ বলতে পার, আমি এটাকেই কাজে লাগাতে চাই।

ডাম্বলডোর তো চাইতেন-

ডাম্বলডোরের কথা বাদ দাও। এটা আমার নিজের চয়েস, অন্য কারো নয়। আমি জানতে চাই সে কেন গ্রেগোরোভিচকে খুঁজছে।

সে কে?

হ্যারি বলল, গ্রেগোরোভিচ হলো একজন বিদেশি যাদুদণ্ড প্রস্তুতকারক। সে ক্রমের যাদুদণ্ডটি বানিয়েছে। ক্রমের ধারণা অসম্ভব মেধাবী যাদুদণ্ড বানাতে পারে সে।

রন বলল, কিন্তু তোমার কথামতো ভোল্ডেমর্ট অলিভ্যান্ডারকে কোথাও আটকে রেখেছে। তার হাতে অলিভ্যান্ডারের মতো একজন যাদুদণ্ড নির্মাতা আটক থাকতে তার কেন আরেক জনকে প্রয়োজন হবে?

হয়তোবা সে ক্রমের কথা শুনছে, অথবা সে মনে করছে গ্রেগোরোভিচ অপেক্ষাকৃত উন্নত যাদুদণ্ড বানায়। অথবা সে ভাবছে গ্রেগোরোভিচ হয়তো বলতে পারে ভোল্ডেমর্ট যখন আমার পেছনে ধাওয়া করছিল তখন আমার যাদুদণ্ডটি কী কাজ করেছে। কারণ অলিভ্যাভার সেটি জানত না।

হ্যারি ধুলোমাখা ভাঙা আয়নার দিকে তাকালো। দেখল তার পেছনে রন এবং হারমিয়ন সন্দেহ প্রকাশ করে এক দৃষ্টি বিনিময় করছে।

হারমিয়ন বলল, হ্যারি, তুমি বলে যাচ্ছ তোমার যাদুদণ্ড কি করেছে সেটা। কিন্তু তুমিই তো দন্ডটি দিয়ে করিয়েছ। কেন তুমি তোমার নিজের ক্ষমতার কথাটি স্বীকার করছ না।

কারণ আমি জানি এটা আমি না! হারমিয়ন, ভোল্ডেমর্ট যা করছে, আমরা দুজনই জানি প্রকৃত ঘটনাটা কি!

ওরা এক অপরের দিকে তাকালো। হ্যারি জানে যে সে হারমিয়নকে তার কথা দিয়ে আশ্বস্ত করতে পারেনি। হারমিয়ন হ্যারির বক্তব্য এবং যাদুদণ্ড দুটির বিরুদ্ধেই যুক্তি দাঁড় করাতে চাইল। সে বলতে চাচ্ছে যে হ্যারি নিজেকে ভোল্টেমর্টের ভিতরে দেখতে দিচ্ছে। রন বাধা দেয়ায় হ্যারি পরিত্রাণ পেল।

রন হারমিয়নের দিকে তাকিয়ে বলল, বাদ দাও। এটা ওর ব্যাপার। যদি আমরা আগামীকাল মিনিস্ট্রিতে যাই তাহলে প্ল্যান করার বিষয়টি চিন্তা করছ না কেন?

বিরুদ্ধে ইচ্ছার হারমিয়ন বিষয়টি ক্ষান্ত দিল। যদিও হ্যারি সম্পূর্ণ নিশ্চিত যে হারমিয়ন সুযোগ পেলেই আবার আক্রমণ করবে। ইতিমধ্যে ওরা আবার নিচের কিচেনে নেমে এলো। ক্রিচার ওদের জন্য মাছ এবং শাক-সবজি পরিবেশন করল।

গভীর রাত পর্যন্ত ওরা জেগে থাকল। কয়েক ঘণ্টা ধরে ওরা বারবার পরিকল্পনাটা পরীক্ষা করে দেখল যে পর্যন্ত ওরা প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি বাক্য একে অপরকে সঠিকভাবে বোঝাতে পারল কি না।

হ্যারি সিরিয়ুসের বিছানায় ঘুমাতে গেল। বিছানায় শুয়ে যাদুদণ্ডের আলো জ্বেলে দিল। যাদুদন্ডের আলো গিয়ে পড়ল একটি পুরনো ছবির উপর। যে ছবিতে হ্যারির বাবা, সিরিয়স, লুপিন এবং পেটিগ্রিউকে দেখা যাচ্ছে। হ্যারি বিড়বিড় করে আরো দশ মিনিট পরিকল্পনাটি মুখস্থ করল। সে যখন যাদুদণ্ডের আলোটি নিভিয়ে দিল তখন পলিজিউস পোশন, পুকিং প্যাস্টিলেস অথবা ম্যাজিক্যাল মেইনটেনেন্সের কথা ভাবল না। হ্যারি ভাবতে থাকল যাদুদণ্ড প্রস্তুতকারক গ্রেগোরোভিচকে নিয়ে। ভোল্ডেমর্ট যাকে হন্যে হয়ে খুঁজছে সে কতদিন লুকিয়ে থাকতে পারবে!

মধ্যরাতের পর সকালটা যেন অসম্ভব গতিতে চলে এলো

রন হ্যারিকে জাগাতে রুমে প্রবেশ করে শুভ সকাল জানিয়ে বলল, তোমাকে চিন্তিত দেখাচ্ছে।

হ্যারি আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে বলল, খুব বেশিক্ষণের জন্য নয়।

ওরা দুজন এসে হারমিয়নকে কিচেনে পেল। ক্রিচার তাকে কফি এবং হট রোল পরিবেশন করছে। হারমিয়নের মধ্যে এখনো একটি ভাব আছে যেটি হ্যারি চেনে। পরীক্ষায় রিভিশন দেয়ার সময় এমন হতো।

ওদের দুজনের উপস্থিতি বুঝতে পেরে নার্ভাসভাবে মাথা নেড়ে নিঃশ্বাস ছেড়ে হারমিয়ন বলল, গাউনটা। পোলিজিউস পোশন….ইনভিজিবল আলখাল্লা…ডিকয় ডেটোনেটর….তোমাদের প্রত্যেকের এক জোড়া করে সঙ্গে নেয়া দরকার যদি প্রয়োজন হয়…..পুকিং প্যাস্টেলেস, নোসরিড নোগাট, এক্সটেনডাবল ইয়ারস।

ওরা তাড়াহুড়া করে নাস্তা সেরে উপরের তলায় চলে এলো। ক্রিচার মাথা নুইয়ে বিদায় দিয়ে জানালো ওরা ফিরে আসার পর ওদেরকে স্টিক এবং কলিজা ভুনা খাওয়াবে।

রন আদর করে বলল, তোমাকে আশীর্বাদ করি, এবং আমি অবশ্য মজা করে চিন্তা করি, তোমার গলাটি কেটে দেয়ালের সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখার।

খুব সতর্কতার সঙ্গে ওরা সামনের সিঁড়িতে গেল। ওরা দেখল ঘুম ঘুম চোখের দুটি ডেথ-ইটার হালকা কুয়াশার ভেতরে বাড়িটার দিকে নজর রাখছে। হারমিয়ন প্রথমে রনের সঙ্গে ডিসপারেট করল। তারপর আবার হ্যারির জন্য ফিরে এলো।

একটুখানি সময় গভীর অন্ধকার এবং দম আটকে আসা ভাব হলো। তারপরই হ্যারি নিজেকে একটি সরু গলিতে আবিষ্কার করল। এখানেই ওদের পরিকল্পনার কাজটি প্রথম করতে হবে। জায়গাটি এখনো অনেকটা ফাঁকা। শুধু কয়েকটি খালি কন্টেইনার পড়ে আছে। কর্মচারীরা সাধারণত এখানে সকাল ৮টার আগে আসে না।

হারমিয়ন ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, সব ঠিক আছে। মহিলা পাঁচ মিনিটের মধ্যে এখানে আসার কথা। আমি যখন তাকে স্টান করব।

রন দৃঢ় গলায় বলল, হারমিয়ন, আমরা জানি এবং আমি ভেবেছিলাম মহিলা আসার আগেই আমাদের দরোজা খুলতে হবে?

হারমিয়ন হঠাৎ হুঁশ করে একটা শব্দ করল।

আমি প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম! ঘুরে দাঁড়াও

হারমিয়ন হাতের যাদুদণ্ডটি দরোজার ভারী তালার উপর ধরল। তালাটি বিধ্বস্ত হয়ে গেল। দরোজা খুলতেই ভেতরে অন্ধকার। ওরা আগে থেকেই তদন্ত করে জায়গাটি সম্পর্কে জেনে নিয়েছে। করিডোরটি চলে গেছে সোজা একটি খালি মঞ্চের দিকে। ওরা ভিতরে ঢোকার পর হারমিয়ন ওর পেছনে দরোজাটি আলতো করে বন্ধ করে দিল। যাতে বাহ্যত মনে হয় যে দরোজাটি এখনো বন্ধই আছে।

সরুপথে অন্য দুজনের দিকে ফিরে হারমিয়ন বলল, এখন, আমাদের আবার আলখাল্লা গায়ে দিতে হবে

এবং অপেক্ষা করতে হবে, রন ওর কথা টেনে নিয়ে শেষ করল। সে হার মিয়নের মাথার উপর দিয়ে দিল ঠিক যেন একটি টিয়া পাখির উপর কাপড়ের টুকরা ফেলে দেয়ার মতো এবং হ্যারির দিকে ঘুরে তাকালো।

এক মিনিটের কিছু সময় পর ধুপ করে একটি শব্দ হলো এবং ছোট একটি মহিলা যাদুকর ওদের সামান্য দূরে অ্যাপারেট করল। এখন একটু উজ্জ্বলতা বেড়েছে; সূর্য কেবল একটি মেঘের আড়াল থেকে বের হয়ে এসেছে। সে অপ্রত্যাশিত এই উষ্ণতা উপভোগ করবে, ঠিক তখনই হারমিয়নের স্টানিং স্পেল তার বুকের উপর আঘাত করল এবং মহিলা ছিটকে পড়ল।

মঞ্চের দরোজার পাশের একটি কনটেইনারের পেছন থেকে রন বেরিয়ে এসে বলল, চমৎকারভাবে কাজটি করেছ হারমিয়ন। হ্যারি অদৃশ্য হওয়ার আলখাল্লার ভিতরে থেকে বের হলো। ওরা ধরাধরি করে যাদুকর মহিলাকে অন্ধকার প্যাসেজের পিছনে নিয়ে গেল। হারমিয়ন যাদুকর মহিলার মাথা থেকে কয়েকটি চুল তুলে নিল। এবং তার ব্যাগটির ভেতর থেকে পলিজিউস পোশন বের করে তার সঙ্গে চুলগুলো মেশালো। রন মহিলার ব্যাগের ভেতরে হাতরাতে থাকল।

এ হলো মাফালডা হফকির্ক, রন একটি ছোট আইডেন্টি কার্ড পড়ে বলল। দেখল মহিলা হলো ইমপ্রোপার ইউজ অব ম্যাজিক অফিসের একজন অ্যাসিস্ট্যান্ট। তুমি এগুলো সঙ্গে নাও হারমিয়ন, এই হলো টোকেন।

সে হারমিয়নের কাছে মহিলার ব্যাগ থেকে বের করা কয়েকটি সোনার কয়েন দিল। এগুলোর উপর খোদাই করা তিনটি আক্ষর এম ও এম।

হারমিয়ন পোলিজিউস পোশন পান করল। পোশনের রঙ কিছুটা হেলিওট্রোপ ফুলের আকার ধারণ করেছে। কিছুক্ষণের মধ্যে ওদের সামনে দুজন মাফালডা হফকির্ক দেখা গেল। হারমিয়ন মাফালডার চোখ থেকে চশমা খুলে নিয়ে পড়ল। হ্যারি ঘড়ির দিকে তাকালো।

আমরা দেরি করে ফেলছি। যে কোনো মুহূর্তে মি.ম্যাজিক্যাল মেইনটেনেন্স এখানে চলে আসবে।

 ওরা দ্রুত আসল মাফালডাকে রাখা জায়গাটি বন্ধ করে দিল। হ্যারি এবং রন অদৃশ্য আলখাল্লার ভেতর প্রবেশ করল। কিন্তু হারমিয়ন দৃশ্যমান রয়ে গেল। অপেক্ষা করতে থাকল। কয়েক সেকেন্ডের ভেতর দ্বিতীয়বার ধুপ করে শব্দ হলো। ছোট বিড়ালের মতো দেখতে একটি যাদুকর ওদের সামনে নামল।

আহ্, হ্যালো মাফালডা।

হারমিয়ন একটু কেঁপে যাওয়া গলায় বলল, হ্যালো, আজ কেমন আছ।

বিমর্ষ চেহারা নিয়ে যাদুকরটি বলল, আসলে খুব একটা ভালো নেই।

হারমিয়ন এবং যাদুকরটি প্রধান রাস্তার দিকে হাঁটতে থাকল। হ্যারি এবং রন ওদের পিছনে চুপি চুপি চলতে থাকল।

তুমি এমন অবস্থায় আছ শুনে আমি খুবই দুঃখিত, হারমিয়ন দৃঢ় গলায় যাদুকরকে বলল। যাদুকর তার সমস্যাটি ব্যাখ্যা করতে থাকল। কিন্তু তাকে প্রধান রাস্তায় ওঠা এখনই বন্ধ করা দরকার। নাও, একটা মিষ্টি খাও।

অ্যা, ওহ না, ধন্যবাদ।

হারমিয়ন জোর দিয়ে বলল, আমি বলছি নাও তো,

চকলেটের ব্যাগ তার মুখের সামনে ধরে ঝাঁকি দিয়ে বলল। সতর্কতার সঙ্গে ছোট যাদুকরটি একটি চকোলেট নিল।

মুহূর্তের মধ্যে ফল পাওয়া গেল। চকোলেটটি মুখের মধ্যে পুরতেই যাদুকরটি বমি করতে শুরু করল। এমন ভয়ানক অবস্থা দাঁড়ালো যে সে লক্ষ করতে পারল

হারমিয়ন তার মাথা থেকে টান দিয়ে এক গোছা চুল তুলে নিয়েছে।

যাদুকরটি অসুস্থ হয়ে বমি করতে থাকলে হারমিয়ন বলল, আহা, তোমার বরং আজকের দিনটা বিরতি নেয়াই ভালো!

না! না! যাদুকরটি বমি করে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল। সোজা হয়ে হাঁটতে না পারলেও সে তার পথে হাঁটতে চেষ্টা কর আমাকে অবশ্যই…আজকে অবশ্যই যেতে হবে..

হারমিয়ন সতর্কতার সঙ্গে বলল, কিন্তু এটা ঠিক হবে না! তুমি এই অবস্থায় কাজে যেতে পার না। আমার মনে হয় তোমার সরাসরি সেন্ট মাঙ্গোসে যাওয়া উচিত। এবং তারা তোমাকে কাজে যোগদান থেকে বিরত রাখবে।

যাদুকরটি ভেঙে পড়েছে। কিন্তু প্রচণ্ড চেষ্টা করছে হাঁটতে।

হারমিয়ন বলল, তোমার এই অবস্থায় কাজে যাওযার কোনো উপায় নেই!

অবশেষে মনে হলো সে হারমিয়নের কথা সত্য বলে বুঝতে পারল। তাকে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থা থেকে হারমিয়ন ঠেলে পেছনে নিয়ে গেল। যাদুকরটি জায়গায় দাঁড়িয়ে ঘুরল এবং অদৃশ্য হয়ে গেল। যাওয়ার সময় রন তার হাত থেকে থাবা দিয়ে ব্যাগটি কেড়ে রাখল। কিছু বমির দলা বাতাসে ভাসতে থাকল।

হারমিয়ন ওর গাউনটা একটু উঁচু করে ধরে নিচের বমিগুলো থেকে সরে থাকল। বলল, উর্গ, এর চেয়ে ওকে স্ট্যান করলে বরং ঝামেলা কম হতো।

রন আলখাল্লার ভেতর থেকে বের হয়ে এলো। তার হাতে কেড়ে রাখা ব্যাগটি। বলল, হ্যাঁ, কিন্তু আমি চিন্তা করছি এক গাদা অচেতন দেহের কথা। যেগুলো অ্যাটেনশন তৈরি করতে পারে। কাজের ব্যাপারে খুব সচেতন, তাই না? পোশন আর চুলগুলো দাও, তারপর দেখা যাক।

দুমিনিটের মধ্যে রন ওদের সামনে দাঁড়ালো এক ছোট বিড়ালের মতো যাদুকর হয়ে। পরনে নীল রঙের গাউন। গাউনটি ব্যাগের ভেতরে ভাঁজ করা ছিল।

অবাক ব্যাপার হলো আজ ওর পরনে গাউন ছিল না। অথচ ও কাজে যাওয়ার জন্য কতটা আগ্রহী ছিল। যা হোক, আমি এখন রেড ক্যাটারমোল। অন্তত ওর পিঠের লেখাটি নাম অনুসারে।

হ্যারি এখনো অদৃশ্য আলখাল্লার নিচে আছে। তারপরও অনুমানে হারমিয়ন হ্যারির দিকে তাকিয়ে বলল, এখানে অপেক্ষা করো, আমি তোমার জন্য কিছু চুল নিয়ে ফিরে আসছি।

হ্যারিকে দশ মিনিট অপেক্ষা করতে হলো। কিন্তু এই সময়টাই তার কাছে। লম্বা সময় বলে মনে হলো। একা নিভৃতে বমি করা সরু গলিটাতে থাকতে হলো। পাশেই বন্ধ দরোজার পেছনে স্ট্যান করা অবস্থায় মাফালডা রয়েছে। অবশেষে রন এবং হারমিয়ন ফিরে এলো।

হারমিয়ন হ্যারির হাতে কয়েকটি কোঁকড়ানো, কালো চুল তুলে দিয়ে বলল, আমরা জানি না যে সে কে। কিন্তু সে ভয়ানক রক্ত নাকে নিয়ে বাড়ি ফিরে গেছে। বেশ লম্বা, তোমার একটা লম্বা গাউনের প্রয়োজন হবে।

হারমিয়ন ব্যাগ থেকে টেনে এক সেট লম্বা গাউন বের করল। ক্রিচার এগুলো পরিপাটি করে ভরে দিয়েছে। হ্যারি পোশন হাতে নিল এবং বদলে গেল।

এই কষ্টকর বদলে যাওয়া সম্পন্ন হওয়ার পর দেখা গেল সে ছয় ফুটেরও বেশি লম্বা আর হাত-পা গুলো বেশ পেশীবহুল। তার মুখে কিছু দাড়ি আছে। অদৃশ্য হওয়ার আলখাল্লা এবং নিজের চোখের চশমা গুছিয়ে গাউনের পকেটে রাখল। সে অন্য দুজনের সঙ্গে যোগ দিল।

হ্যারিকে কাছে আসতে দেখে রন বলল, এহ এ তো ভয় পাওয়ার মতো!

হারমিয়ন হ্যারির দিকে তাকিয়ে বলল, মাফালডার টোকেনগুলো নাও। চলো যাই, প্রায় নয়টা বেজে গেছে।

ওরা একসঙ্গে সরু গলি থেকে বের হলো। পঞ্চাশ গজ দূরেই বড় রাস্তার পাশ দিয়ে হাঁটার রাস্তা। প্রচুর লোক। চোখা কালো মাথার স্পাইকের রেলিঙ দিয়ে রাস্তাটি ভাগ করা। একটি রাস্তা ভদ্রমহিলাদের জন্য এবং অন্যটি ভদ্র মহোদয়দের জন্য।

হারমিয়ন নার্ভাসভাবে বলল, তোমাদের সঙ্গে একটু পর দেখা হবে। সে মহিলাদের দলে নেমে গেল।

হ্যারি এবং রন একদল অস্বাভাবিক পোশাকের লোকের সঙ্গে ভদ্রমহোদয় লেখা পথে নিচের দিকে নামল। যে পথটি দেখে মনে হচ্ছে পাবলিক টয়লেটের দিকে নেমে গেছে। দেয়ালে পিচ্ছিল কালো এবং সাদা টাইলস বসানো।

হ্যারি একটি সুটের মধ্যে টোকেন ফেলে দিতেই সামনের বাধা সরে গেল। সে একটি কিউবিকেলে ঢুকল। পাশের কিউবেকেল থেকে গাঢ় নীল রঙের গাউন পড়া একজন উইজার্ড বলে উঠল, গুড মর্নিং রেগ! খামোখা জ্বালাতন বাড়ছে আঁ! আমাদের সবাইকে জোর করে এ পথেই কাজ করতে পাঠানো হচ্ছে, তাই না? কে আমাদের এখানে আসবে বলে এরা মনে করছে, হ্যারি পটার?

যাদুকর একা একাই হাসিতে ফেটে পড়ল। রন তার কথায় জোর করে হাসল। সে বলল, হুম, স্টুপিড, তাই না?

রন এবং হ্যারি কায়দা করে পাশাপাশি কিউবেকেলে দাঁড়ালো।

হ্যারির ডানে এবং বাঁয়ে টয়লেটে ফ্লাশ করার শব্দ হলো। হ্যারি দ্রুত উবু হয়ে কিউবিকেলের নিচের ফাঁকা জায়গাটি দিয়ে উঁকি দিল। কোনো রকমে শেষ মুহূর্তে দেখতে পেল ওর ঠিক পরের কিউবিকেলে এক জোড়া পালিশ করা জুতা টয়েলেটের উপর উঠে গেল। সে বা পাশেরটার দিকে তাকালো। দেখল রন তার। দিকে মিটমিট করে তাকাচ্ছে।

রন ফিসফিস করে বলল, আমাদেরও নিজেদের ফ্লাশ করতে হবে!

তাই তো মনে হচ্ছে, হ্যারিও ফিসফিস করে পাল্টা বলল। ওর গলা বেশ গম্ভীর শোনা গেল।

দুজনেই উঠে দাঁড়ালো। নিজেদেরকে চরম বোকা বলে মনে হলো। হ্যারি টয়লেটের উপর উঠে দাঁড়ালো।

সে সঙ্গে সঙ্গে বুঝে গেল যে ঠিক কাজটিই করেছে। যদিও মনে হচ্ছে সে টয়লেটের পানির উপর দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু তার জুতা, পা এবং পরনের গাউন একেবারে শুকনো রয়েছে। সে চেইনে হাত দিয়ে টান দিল। সঙ্গে সঙ্গে সে যেন ছোট হয়ে ডুবে গেল এবং পরের মুহূর্তেই একটি ফায়ার প্লেসের ভেতর থেকে মিনিস্ট্রি অব ম্যাজিকে বের হয়ে এলো।

হ্যারি সামনের দিকে ঝুঁকে উঠে দাঁড়ালো। সে যে শরীরে অভ্যস্ত তার চেয়ে এখনকার শরীরটা অনেক ভারী। গ্রেট অ্যাট্রিয়ামটা হ্যারি যেমন দেখেছে তার চেয়ে অনেক বেশি অন্ধকার মনে হচ্ছে। এর আগে একটি সোনালি রঙের ঝরনা হলের মাঝখানে ছিল। কাঠের পালিশ করা মেঝে এবং দেয়ালের বিভিন্ন স্পটে আলো ঝলমল করত। এখন সেখানে একটি বিশাল কালো রঙের মূর্তি দেখা যাচ্ছে। এ দৃশ্যটি বরং ভয়ঙ্কর। এই বিশাল মূর্তিটিতে দেখা যাচ্ছে একজন যাদুকর এবং একজন ডাইনী একটি জাঁকালো, বাঁকা করে বসানো সিংহাসনে বসে নিচের ফায়ার প্লেসে কাজ করা মিনিস্ট্রি কর্মীদের দেখছে। মূর্তির পায়ের কাছে এক হাঁটু উঁচুতে খোদাই করে লেখা: ম্যাজিকই শক্তি।

হ্যারি হঠাৎ করে পায়ের পিছনে খুব জোরে আঘাত পেল। ওর পেছনেই অন্য একটি উইজার্ড ফায়ার প্লেসের ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে আছড়ে পড়েছে।

পা থেকে একটু সরে দাঁড়াতে পার না, আরে তুমি, দুঃখিত রানকর্ন!

পরিষ্কার বোঝা গেল ভয় পেয়েছে। সে দ্রুত কাছ থেকে সরে গেল। হ্যারি রামকর্ন নামের যে উইজার্ডের রুপ ধারণ করেছে সে লোকটা ভয় পাওয়ার মত বলে মনে হচ্ছে।

পিসস? একটি কণ্ঠস্বর বলে উঠল। হ্যারি ঘুরে তাকিয়ে দেখল পাতলা ছোটখাটো মহিলা যাদুকর এবং বিড়ালের মতো যাদুকরটি মূর্তির কাছের একটি জায়গা। হ্যারি দ্রুত ওদের সঙ্গে গিয়ে যোগ দিল।

হারমিয়ন ফিসফিস করে বলল, তাহলে ঠিকমতো পৌঁছতে পেরেছ?

 রন বলল, না, সে এখনো গ্রাউন্ডের সঙ্গেই লেগে আছে।

হ্যারি এখনো বারবার তাকিয়ে মূর্তি দেখছে। হারমিয়ন বলল, ওহ, খুবই হাস্যকর…ভয়ানক ব্যাপার, তাই না? তুমি কী দেখেছ ওরা কিসের উপর বসে আছে?

হ্যারি আরো কাছে থেকে দেখল এবং বুঝতে পারল যে কারুকাজ করা সিংহাসন আসলে মানুষের দেহ। নারী-পুরুষ-শিশুর শতশত নগ্ন দেহ। মানুষের দেহ দিয়ে বিশাল গাউন পরা উইজার্ডদের দেহের ভার রক্ষা করা হয়েছে।

হারমিয়ন ফিসফিস করে বলল, মগলদের দেহ, ওদের সঠিক জায়গা। চল যেতে থাকি।

ওরা একদল যাদুকর এবং মহিলা যাদুকরের স্রোতে মিশে গেল। সবাই হলের শেষ প্রান্তে সোনালি রঙের গেটের দিকে যাচ্ছে। যতটা সম্ভব সবার অলক্ষ্যে ওরা চারদিক দেখতে থাকল। কিন্তু কোথাও ডোলোরেস আমব্রিজের বিশেষ শরীরটি দেখা গেল না। ওরা গেট দিয়ে ঢুকে একটি ছোট হলে এসে পড়ল। সেখানে কুড়িটি সোনালি গ্রিলের সামনে লাইন ধরে সবাই দাঁড়াচ্ছে। ওগুলো লিস্ট হিসাবে কাজ করে। ওরা তিনজন কেবল কাছাকাছি একটি লাইনে দাঁড়াতে যাবে এমন সময় একটি কণ্ঠ জোরে বলে উঠল, ক্যাটারমোল!

হ্যারির পেটের ভেতর নড়েচড়ে উঠল। ডাম্বলডোরের মৃত্যুর সময় দেখেছে এমন একটি ডেথ-ইটার ওদের দিকে লম্বা পায়ে এগিয়ে আসছে। ওদের আশেপাশের উইজার্ডরা সব নীরব হয়ে গেল। তারা চোখ নামিয়ে নিয়েছে। হ্যারি ওদের ভিতরে ভয় অনুধাবন করতে পারল। যে লোকটা চিৎকার করে উঠেছে তার মুখটা স্কুল ধরনের। কিন্তু তাকে আলাদা বৈশিষ্ট্যপূর্ণ মনে হচ্ছে তার আকর্ষণীয় গাউনটির জন্য। গাউনটি সোনার সুতা দিয়ে সেলাই করা। ভীড়ের ভিতর থেকে তাকে তোষামোদ করে কেউ একজন বলে উঠল, গুড মনিং ইয়াক্সলি!

কিন্তু ইয়াক্সলি তা গায়ে মাখল না।

ম্যাজিক্যাল মেইনটেনেন্সের কাউকে আমি অনুরোধ করেছিলাম আমার অফিসটি সাফ করতে। ক্যাটারমাল, এখনো সেখানে বৃষ্টি হচ্ছে।

রন চারদিকে তাকালো। আশা করল কেউ তাকে বাধা দিয়ে কিছু বলবে। কিন্তু কেউ কথা বলল না।

বৃষ্টি হচ্ছে…আপনার অফিসে? সেটা…সেটা তো ভালো কথা না, তাই না?

রন নার্ভাসভাবে হাসল। ইয়াক্সলি চোখ বড় করে তাকালো।

তুমি কী মনে করো এটা ফানি? ক্যাটারমল, মনে করো?

দুজন মহিলা যাদুকর লিফটের লাইন থেকে দ্রুত বের হয়ে আসল।

রন তাড়াতাড়ি বলল, না, অবশ্যই না।

তুমি বুঝতে পারছ ক্যাটারমল যে আমি নিচে যাচ্ছি তোমার স্ত্রীর ব্যাপারে তদন্ত করতে। আসলে আমি অবাক হয়েছি, তোমার স্ত্রী সেখানে অপেক্ষা করছে, আর তুমি সেখানে গিয়ে তার হাতটা পর্যন্ত ধরলে না। ইতিমধ্যেই কাজটি ভালো হয়নি ভেবে তাকে তুমি ছেড়ে দিয়েছ? সম্ভবত সেটাই বুদ্ধিমানের কাজ। নিশ্চিত হও, এবং পরবর্তী সময়ে একজন পিওর ব্লাডকে বিয়ে করো।

হারমিয়ন ভয়ে হিক করে একটি শব্দ করল। ইয়াক্সলি তার দিকে ফিরে তাকালো। হারমিয়ন খুকখুক করে কেশে অন্যদিকে ফিরল।

রন তোতলাতে থাকল, আমি…আমি.. ইয়াক্সলি বলল, যদি আমার স্ত্রী মাডব্লাড হিসেবে অভিযুক্ত হতো…অবশ্য তা কখনো হতো না, আমি ভুল করেও কখনো এই নোংরা কাজ করতাম না… আর তখন যদি ডিপার্টমেন্ট অব ম্যাজিক্যাল ল এনফোর্সমেন্টের প্রধানের কোনো কাজের প্রয়োজন হতো–আমি সেটাকে সবচে অগ্রাধিকার দিয়ে করতাম ক্যাটারমল। তুমি কী আমার কথা বুঝতে পেরেছ?

রন ফিসফিস করে বলল, জ্বি।

তাহলে সেটা করো ক্যাটারমল। আর যদি এক ঘণ্টার মধ্যে আমার অফিস পুরোপুরি শুকনো না হয়, তাহলে তোমার স্ত্রীর ব্লাড পরীক্ষা এখন যতটা খারাপ ভাবছ তার চেয়ে অনেক ভয়ানক হবে।

ওদের সামনের সোনালি গেটগুলো খুলে গেল। হ্যারির দিকে তাকিয়ে ইয়াক্সলি একটু মাথা দুলিয়ে একটি অস্বস্তিকর হাসি দিল। সে আশা করল যে ক্যাটারমলের এই সাজাটি সঠিক হয়েছে বলে সবাই সম্মতি দেবে। তারপর অন্য একটি লিফটে ঢুকে গেল। হ্যারি, রন এবং হারমিয়ন একটি লিফটে উঠল। কিন্তু অন্য কেউ ওদের সঙ্গে উঠল না। ভাবটা এমন যেন ওরা সব সংক্রমিত হয়ে গেছে। একটি খট শব্দ করে গ্রিল বন্ধ হয়ে গেল। লিটটি উপরে উঠতে শুরু করল।

রন ভড়কে গেছে বলে মনে হলো। সে অন্য দুজনের কাছে প্রশ্ন করল, এখন আমি কী করব। যদি আমি এখন না যাই, তাহলে আমার স্ত্রী, অর্থাৎ ক্যাটারমলের

হ্যারি বলল, আমরা তোমার সঙ্গে যাব। আমাদের এক সঙ্গে থাকতে হবে। কিন্তু রন অস্থিরভাবে মাথা নেড়ে নিষেধ করল।

সেটা পাগলের কাজ হবে। আমাদের হাতে খুব বেশি সময় নেই। তোমরা দুজন আমব্রিজকে খুঁজে বের করো। আমি গিয়ে ইয়াক্সলির অফিস পরিষ্কার করছি। কিন্তু আমি বৃষ্টি থামাব কীভাবে?

হারমিয়ন সঙ্গে সঙ্গে বলল, ফিনিট ইনকানটাটেম স্পেল দিয়ে চেষ্টা করো। সেটা যদি কোনো অশুভ স্পেলের বৃষ্টি হয়। যদি তাতে কাজ না হয় বুঝতে হবে অ্যাটমোসফেরিক চার্মে কোনো গোলমাল হয়েছে। তাহলে এটা ঠিক করা কঠিন কাজ হয়ে যাবে। ওটা ব্যবহারকালে তুমি ওর জিনিসপত্রগুলো রক্ষার জন্য ইমপারভেসিয়াস স্পেল ব্যবহার করতে পারো।

একটু ধীরে ধীরে আবার বলো- রন বলল। সে হন্যে হয়ে তার পকেট হাতড়াতে লাগল লিখে রাখার জন্য একটি পালকের কলমের জন্য। কিন্তু এরই মধ্যে ঝাঁকি দিয়ে লিস্ট থেমে গেল। একটি দৃশ্য মহিলার কণ্ঠ শোনা গেল, লেভেল চার, ডিপার্টমেন্ট ফর দ্য রেগুলেশন এন্ড কন্ট্রোল অব ম্যাজিক্যাল ক্রিয়েচারস,সঙ্গে রয়েছে বিস্ট, বিঙ এন্ড স্পিরিট ডিভিশন, গবলিন লিয়াসেন অফিস এবং পেস্ট অ্যাডভাইজারি ব্যুরো। গ্রিলের দরোজা খুলে গেল। দুজন যাদুকর ভিতরে প্রবেশ করল এবং লিফটের ছাদের আলোর পাশে রঙিন কাগজের প্লেনগুলো কেঁপে উঠল।

গুড মনিং অ্যালবার্ট, ঘন মোছ-দাড়িঅলা যাদুকরটি হ্যারির দিকে মুচকি হেসে বলল। সে রন এবং হারমিয়নের দিকে একবার ঘুরে তাকালো। লিফট উপরের দিকে উঠতে শুরু করেছে। হারমিয়ন দ্রুত ফিসফিস করে রনকে অল্প কথায় নির্দেশনা দিল। যাদুকরটি হ্যারির দিকে ঝুঁকে দুঃখের হাসি দিয়ে বলল, ডার্ক ক্রেসওয়াল, অ্যাঁ? গবলিন লিয়াসেনের? ভালো কথা। আমি পুরো নিশ্চিত, ওর কাজটি এখন আমি পাব!

সে হ্যারির দিকে চোখ টিপল। হ্যারি উত্তরে মুচকি হাসল। মনে করল ওর সন্তুষ্টির জন্য এটাই করা উচিত। লিস্ট থামলো। দরোজা আবার খুলে গেল। সেই অদৃশ্য মহিলা যাদুকরের কণ্ঠস্বর আবার বলল, লেভের টু, ডিপার্টমেন্ট অব ম্যাজিক্যাল ল এনফোর্সমেন্ট ইনকুডিং দ্য ইমপ্রোপার ইউজ অব ম্যাজিক অফিস, অরোর হেডকোয়ার্টারস এন্ড উইজেনগামোট অ্যাডমিনিস্ট্রেশন সার্ভিস।

 হ্যারি দেখল হারমিয়ন ছোট করে রনকে একটা ধাক্কা দিল এবং রন দ্রুত লিফটের দরোজা দিয়ে বের হয়ে গেল। হারমিয়ন এবং হ্যারি রয়ে গেল। সোন লি দরোজাটি আবার বন্ধ হওয়ার সময় হারমিয়ন ফিসফিস করে বলল, আসলে হ্যারি, আমার মনে হয় রনের পিছনে পিছনে আমার যাওয়া উচিত। আমার মনে হয় না সে কী করতে হবে বুঝতে পেরেছে। সে যদি ধরা পড়ে তাহলে–লেভেল ওয়ান, মিনিস্টার ফর ম্যাজিক এন্ড সাপোর্ট স্টাফ।

সোনালী দরোজাটি আবার খুলে গেল। হারমিয়ন বড় করে নিঃশ্বাস নিল। চারজন মানুষ তাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। দুজন নিজেদের মধ্যে গভীরভাবে আলোচনায় ব্যস্ত। একজন লম্বা চুলের যাদুকর অপূর্ব সুন্দর একটি কালো ও

সোনালি রঙের গাউন পড়ে আছে। এবং আরেকজন মহিলা যাদুকর খাটো, ব্যাঙের মতো দেখতে। তার ছোট ছোট চুলের উপর ভেলভেটের ফিতা পড়ে আছে। একটি ক্লিপবোর্ড বুকের উপর ধরে আছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *