০৯. লুকানোর জায়গা

০৯. লুকানোর জায়গা

সবকিছু কেমন অস্পষ্ট, মন্থর মনে হচ্ছে। হ্যারি এবং হারমিয়ন লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে যার যার যাদুদণ্ড বের করল। অধিকাংশ লোকই সবে বুঝতে শুরু করেছে যে বিপর্যকর কিছু একটা ঘটেছে। তখনো কেউ কেউ মাথা ঘুরিয়ে বিড়ালের উধাও হয়ে যাওয়া জায়গাটার দিকে তাকাচ্ছে। প্যাট্রোনাস যেখানে নেমেছিল সেখান থেকে ঠাণ্ডা স্রোতের মত নীরবতা চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। ঠিক তখনই কেউ একজন চিৎকার দিয়ে উঠল।

হ্যারি এবং হারমিয়ন দুজনই ছুটাছুটি করা ভিড়ের ভেতর ঢুকে গেল। অতিথিদের অনেকেই এদিক-সেদিক মরণপণ দৌড়াচ্ছেন। অনেকে অদৃশ্য হয়ে গেছেন; বারোকে ঘিরে যাদুমন্ত্র নিরাপত্তা ভেঙে পড়েছে।

রন! হারমিয়ন চিৎকার করে বলল। রন, তুমি কোথায়!

ড্যান্স ফ্লোরের ওপর দিয়ে ছুটে যাওয়ার সময় হ্যারি দেখল আলখাল্লা পড়া, মুখে মাস্ক দেয়া শরীরগুলো ভিড়ের দিকে নেমে আসছে। তার পরপরই সে লুপিন এবং টঙ্কসকে দেখতে পেল, তারা তাদের যাদুদণ্ড তাক করে একসঙ্গে দুজনই বলে উঠল, প্রোটেগো! তাদের এই চিৎকার চারদিক থেকে প্রতিধ্বনিত হলো

রন! রন!, হারমিয়ন ডাকল। হারমিয়ন প্রায় ডুকরে উঠল। আতঙ্কিত অতিথিদের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে খেয়ে হ্যারি এবং হারমিয়ন অগ্রসর হলো। হ্যারি হারমিয়নের হাত ধরল যাতে ওরা বিচ্ছিন্ন হয়ে না যায়। একটি আলোর ঝলক মাথার উপর দিয়ে চলে গেল। হ্যারি বুঝতে পারল না ওটা নিরাপত্তা চার্ম, নাকি অশুভ কিছু।

রনের দেখা পাওয়া গেল। সে দ্রুত হারমিয়নের অন্য হাত ধরল। হারমিয়নের বাঁক নেওয়া অনুভব করল হ্যারি; চোখের সামনে থেকে দৃশ্যগুলো উধাও হয়ে গেল, এরপর আর কোনো শব্দ নেই–অন্ধকার হ্যারিকে চারপাশ থেকে চেপে ধরল। সে শুধু হারমিয়নকে ধরে থাকাটা, আর সময় ও স্থানের পরিবর্তন অনুভব করল। বারো থেকে দূরে চলে যাচ্ছে, ডেথ-ইটারদের থেকে, হয়তোবা খোদ ভোস্টেমর্টের কাছ থেকে অনেক দূরে…

আমরা এখন কোথায়? রনের কণ্ঠস্বর শোনা গেল।

হ্যারি চোখ খুলে তাকাল। এক মুহূর্তের জন্য মনে হলো ওরা এখনো বিয়ের অনুষ্ঠানেই আছে; মনে হলো এখনো লোকের ভিড় আছে।

টোটেনহ্যাম কোর্ট রোড, উল্লসিত কণ্ঠে হারমিয়ন বলল। হাঁটো, শুধু হাঁটতে থাক। আমাদের একটি নিরাপদ জায়গা খুঁজে বের করতে হবে তোমার চেহারাটা পরিবর্তনের জন্য।

হ্যারি ওর কথামতো কাজ করল। ওরা প্রশস্ত, অন্ধকার রাস্তাটা দিয়ে কিছুটা হেঁটে, কিছুটা দৌড়ে গভীর রাতে বার থেকে ফেরা নেশাগ্রস্ত লোকদের মাঝে মিশে গেল। দুপাশে সারি সারি বন্ধ দোকান, মাথার ওপর আকাশে তারা মিটিমিটি করছে। একটি ডাবল ডেকার বাস শব্দ করে পাশ দিয়ে চলে গেল। পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় হৈচৈ করা একদল বার-এ যাওয়া মানুষ ওদের দিকে কৌতূহলের দৃষ্টিতে তাকাল। হ্যারি এবং রন তখনো গাউন পড়ে আছে।

হারমিয়ন পাল্টানোর মতো কোনো পোষাক আমাদের সঙ্গে নেই। রন হার মিয়নের উদ্দেশ্যে বলল। একটি অল্প বয়সের মেয়ে রনকে দেখেই উচ্চস্বরে হেসে উঠল।

আমি কেন খেয়াল করলাম না যে আমার সঙ্গে ইনভিজিবিলিটি আলখাল্লা আছে কি না? হ্যারি বলল। মনে মনে নিজের বোকামির জন্য নিজেকে গালি দিল। গত বছর, সব সময় আমি ওটা নিজের সঙ্গে রেখেছি এবং

কোনো সমস্যা নেই, আমার কাছে আলখাল্লা আছে এবং তোমাদের দুজনের। পড়ার মতো কাপড় আছে। হারমিয়ন বলল। শুধু স্বাভাবিক থাকতে চেষ্টা কর যতক্ষণ পর্যন্ত…. তাতেই হবে।

সে ওদেরকে পথ দেখিয়ে বড় রাস্তা থেকে নেমে একটি অন্ধকার সরু রাস্তায় নিয়ে এলো।

তুমি তখন বললে যে তোমার কাছে আলখাল্লা এবং পোশাক আছে…,হ্যারি বলেই হারমিয়নের দিকে তাকিয়ে চুপ হয়ে গেল। হারমিয়নের সঙ্গে তার ছোট কারুকাজ করা ব্যাগটি ছাড়া আর কিছুই নেই। সে তখন ওই ব্যাগটির ভেতর হাতরাচ্ছে।

হ্যাঁ, ওগুলো এই ব্যাগটির ভেতরই আছে, হারমিয়ন বলল। হ্যারি এবং রন বিস্ময়সুচক শব্দ করল। হারমিয়ন টেনে ভেতর থেকে একজোড়া জিনসের প্যান্ট, একটি সোয়েটার, কিছু মেরুন রঙের মোজা এবং শেষে রুপালি অদৃশ্য হওয়ার আলখাল্লা বের করল।

কীভাবে এই কাণ্ড-?

আনডিটেক্ট্যাবল এক্সটেনশন চার্ম, হারমিয়ন বলল। কৌশল খাটাতে হয়েছে, কিন্তু আমার মনে হয় আমি ঠিক মতোই করতে পেরেছি। যা হোক আমাদের প্রয়োজন হবে এমন জিনিসগুলো ভরে আনতে পেরেছি। সে পাতলা ব্যাগটি হালকা করে ঝাঁকি দিল। এমন শব্দ হলো যেন একটি মালবহনকারী কার্গোর ভিতরে ভারী ভারী জিনিস গড়গড় করে গড়াচ্ছে। ওহ, কপাল! ওগুলো মনে হচ্ছে বইগুলো। সে ব্যাগের ভেতর উঁকি দিয়ে বলল। আমি বইগুলো বিষয় অনুসারে একে একে সাজিয়েছিলাম…আচ্ছা ঠিক আছে, হ্যারি, তুমি তোমার এই ইনভিজিবিলিটি আলখাল্লাটি নাও। রন, তাড়াতাড়ি কর, পাল্টে ফেল….

 মাই গড, তুমি এতসব কাজ কখন করলে? হ্যারি জানতে চাইল। রন তখন তার গাউনটা খুলে পোশাক পাল্টাচ্ছে।

 আমি তোমাদেরকে বারোতে থাকার সময় বলেছিলাম না যে আমার কাছে। কয়েক দিনের জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র প্যাক করা আছে। তৈরী হয়েই ছিলাম যদি আমাদেরকে জরুরিভাবে বেরিয়ে পড়তে হয়। আজ সকালে তুমি যখন অন্যের শরীর ধারণ করলে তখন আমি তোমার রুকস্যাকটা গুছিয়ে নিয়েছিলাম এবং এটার ভিতরে রেখেছিলাম…. আমার কাছে মনে হয়েছিল…।

তুমি একটা বিস্ময়, রন তার হাতে গাউনটা ভাঁজ করে দিতে দিতে বলল।

থ্যাঙ্ক ইউ, হারমিয়ন বলল। ব্যাগের ভেতরে গাউনটা ঠেলে দিতে দিতে একটুখানি হাসল। প্লিজ হ্যারি, ওই আলখাল্লাটা পরে নাও!

হ্যারি ইনভিজিবিলিটি আলখাল্লাটা নিজের কাঁধের ওপর দিয়ে ছড়িয়ে দিল এবং মাথার দিকটা ভেতরে গলিয়ে দিতেই অদৃশ্য হয়ে গেল। এরপর ভাবার চেষ্টা করল সেখানকার কথা।

অন্যদের কী হলো–বিয়েতে উপস্থিত অন্য সবাই-

আমাদের তা নিয়ে এখন ভাবার অবকাশ নেই, হারমিয়ন ফিসফিস করে বলল। ওরা এখন তোমার পিছনে হ্যারি, আমরা ফিরে গেলে ওদের বিপদ শুধু বাড়বেই।

সে ঠিকই বলেছে, রন বলল। রনের মনে হলো হ্যারি বিষয়টি নিয়ে এখনই প্রতিবাদ করবে, যদিও সে হ্যারির মুখ দেখতে পাচ্ছে না। অধিকাংশ অর্ডার সদস্য সেখানে রয়েছে। তারা সবার দিকে নজর রাখবে।

হ্যারি মাথা নাড়ল। কিন্তু তখনই বুঝতে পারল ওরা ওর মাথা নাড়ানোটা দেখতে পাচ্ছে না। বলল হ্যাঁ,। কিন্তু সে জিনির কথা চিন্তা করার সঙ্গে সঙ্গে তার পেটের মধ্যে ভয় এসিডের মতো বুদ্বুদ করে উঠল।

চলো, আমার মনে হয় এখন আমরা রওয়ানা হতে পারি। হারমিয়ন বলল।

ওরা পাশের রাস্তা থেকে ফিরে আবার বড় রাস্তায় চলে এলো। রাস্তার অন্য প্রান্ত দিয়ে একদল লোক গান গাইতে গাইতে ফুটপাতের এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্ত পর্যন্ত যাচ্ছে।

পছন্দের জায়গা হিসাবে টোটেনহাম কোর্ট এলাকাকে বেছে নিলে কেন? রন বলল।

আগের থেকে পরিকল্পনা করে নয়, হঠাৎ করে আমার মাথায় এসেছে। কিন্তু আমি নিশ্চিত, এই মাগল এলাকায় আমরা অনেকটা নিরাপদ। ওরা চিন্তা করতে পারবে না যে আমরা এই এলাকায় আছি।

সত্যি, রন বললো। সে চারদিকে তাকাল। তোমাদের কি মনে হয় না আমরা একটু প্রকাশ্যেই চলাফেরা করছি?

অন্য কোনো জায়গা জানা আছে? হারমিয়ন বলল। রাস্তার অপর প্রান্তে একজন লোক হারমিয়নের দিকে বাজে মন্তব্য ছুঁড়ে দিলে হারমিয়ন তাড়াতাড়ি মুখ ফিরিয়ে নিল।

আমরা হয়তো বড়জোর লিকি করনে রুম ভাড়া করতে পারি, পারি না? এবং গ্রিমোন্ড প্লেসের কথা বাদ দিতে হবে, কারণ স্নেইপ সেখানে চলে আসতে পারে…. আমার মনে হয় আমার বাবা-মায়ের বাড়িতে চেষ্টা করে দেখতে পারি….যদিও সম্ভাবনা আছে ওরা সেখানেও যেতে পারে…..ইশ! হারমিয়ন লোকগুলোর প্রতি বিরক্ত হয়ে বলল, এদের মুখ যদি বন্ধ করে দেয়া যেত!

অল রাইট,ডার্লিং, নেশাগ্রস্ত লোকদের মধ্য থেকে বেশি নেশাগ্রস্ত একজন উচ্চস্বরে বলল। আমার সঙ্গে একটু ড্রিংক করবে? এই ছেলে-ছোকরাদের ছেড়ে চলে এসো, এবং আমার সঙ্গে একটু পান করো!

চলো অন্য কোথাও বসি, হারমিয়ন দ্রুত বলল। রন লোকটিকে ধমক দিয়ে কিছু বলতে যাচ্ছিল। দেখ, এখানে এ রকম হবেই,ঝামেলা করোনা!

একটি ছোট, স্যাঁতস্যাঁতে কফি হাউস। রাতভর খোলা থাকে। ফরমিকার তৈরি টেবিলগুলোর ওপর তেল চিটচিটে আস্তরণ পড়েছে। কিন্তু আর যাই হোক, কফি হাউসটা ফাঁকা। হ্যারি প্রথমে একটি টেবিল নিয়ে বসে পড়ল। তার পাশেই রন বসল হারমিয়নের উল্টো দিকে –মুখোমুখি। হারমিয়নের পেছনে পড়েছে প্রবেশ পথ,বিষয়টি তার মোটেই ভালো লাগছে না। সে মাঝে মাঝেই উঁকি দিয়ে পেছনের দিকে দেখতে চেষ্টা করল। হ্যারির স্থির বসে থাকাটা পছন্দ নয়, আবার বেশি হাঁটাহাঁটি করলে ভাব প্রকাশ হয়ে যাবে যে ওদের কোনো উদ্দেশ্য আছে। হ্যারি অনুভব করল আলখাল্লার নিচে পলিজিউস পোশনের অবশিষ্ট প্রভাব শেষ হয়ে যাচ্ছে। নিজের হাতগুলো আবার স্বাভাবিক দৈর্ঘ্য এবং সঠিক গঠনে ফিরে এসেছে। সে পকেট থেকে তার চশমা বের করে চোখে দিল।

মিনিট দুএক পর রন বলল, তুমি জানো, লিকি কলড্রন থেকে আমরা খুব একটা দূরে না। এই তো চ্যারিং ক্রসেই-

রন, আমরা ওখানে যেতে পারি না!, হারমিয়ন বলল।

সেখানে থাকতে নয়, কিন্তু কি ঘটেছে সেটা জানতে!

আমরা জানি সেখানে কী ঘটেছে। ভোল্ডেমর্ট মিনিস্ট্রি দখল করে নিয়েছে। এর পর আমাদের জানার কী আছে?

ওকে, ঠিক আছে, আমি জাস্ট একটা আইডিয়ার কথা বললাম!

ওদের মধ্যে একটা তীব্র যন্ত্রণাদায়ক নীরবতা নেমে এলো। চুইংগাম চিবাতে চিবাতে ওয়েট্রেস এসে সামনে দাঁড়াল। হারমিয়ন তাকে দুটি কাপুচিনো কফির অর্ডার দিল। যেহেতু হ্যারি অদৃশ্য হয়ে আছে তাই তিনটির অর্ডার দেয়া গেল না, তাহলে অস্বাভাবিক দেখাবে। দুজন মোটাতাজা পেটানো শরীরের মানুষ কফি হাউসে ঢুকল। ওদের পরের চেয়ার টেবিল দখল করে বসল। হারমিয়ন ওর গলার স্বর নামিয়ে ফিসফিস করে কথা বলতে থাকল।

আমি মনে করি সবার চোখের আড়ালে আমাদের গ্রামের দিকে একটি নিরি বিলি জায়গায় যাওয়া দরকার। আমরা ওখানে যেতে পারলে অর্ডারকে মেসেজ পাঠাতে পারতাম।

তুমি কী কথা বলা প্যাট্রোনাস করতে পার? হারমিয়ন বলল।

আমি এ নিয়ে প্র্যাকটিস করছি, আমার মনে হয় পারব। হারমিয়ন বলল।

তাহলে যে পর্যন্ত এটা তাদের কোনো সমস্যায় ফেলবে না, যদিও ইতিমধ্যে তারা গ্রেফতার হয়ে থাকতে পারেন। গড! খুবই বিস্বাদ, রন ফেনা ওঠা ধূসর রঙের কফিতে চুমুক দিয়ে বলল। ওয়েট্রেস মেয়েলোকটি রনের কথা শুনল। সে নতুন কাস্টমারদের কাছ থেকে অর্ডার আনতে যাওয়ার সময় রনের দিকে একটি ক্রুদ্ধ চাহনি দিল। দুই পেটানো শরীরে লোকের মধ্যে সোনালি চুলের সাইজে বড়টিকে হ্যারি দেখতে পেল; ওয়েট্রেসকে সরিয়ে দিতে। সে অপমানিত হয়ে তাকিয়ে থাকল।

চলো এবার আমরা যাই, আমি আর এই আঁঠালো পদার্থ খেতে চাই না। রন বলল। হারমিয়ন, তোমার কাছে মাগলদের টাকা-পয়সা কিছু আছে ওদের বিল পরিশোধ করার?

হ্যাঁ, আমি বারোতে আসার আগে আমার বিল্ডিং সোসাইটি সঞ্চয় মানি সব সাথে নিয়ে এসেছি। আমি নিশ্চিত যে ভাঙতি পয়সাগুলো নিচে আছে। হারমিয়ন ব্যাগের ভেতর হাত ঢুকালো।

ঠিক তখনই শক্তিশালী লোক দুটো একই সঙ্গে নড়ে উঠল এবং হ্যারি মূহূর্তেই ওদের উদ্দেশ্য বুঝে ফেলল। আগন্তুক তিনজনই একই সঙ্গে যাদুদণ্ড বের করল। কী ঘটছে তা বুঝে উঠতে রনের কয়েক সেকেন্ড দেরি হলো সে টেবিলের উপর দিয়ে ঝাঁপ দিয়েই হারমিয়নকে ধাক্কা দিয়ে পাশে সরিয়ে দিল। ডেথ-ইটারদের স্পেল ঠিক রনের মাথা আগে যেখানে ছিল সেই সোজা গিয়ে টাইলের দেয়ালে আছড়ে পড়ল। হ্যারি অদৃশ্য থেকেই চিৎকার করে উঠল, স্টুপিফাই!

বড় সোনালি চুলের ডেথ-ইটারের মুখে লাল আলো গিয়ে আঘাত করল। তার সঙ্গি ডেথ-ইটারটি বুঝতে পারল না কে স্পেলটি ছুঁড়েছে। সে রনের দিকে আবার স্পেল ছুড়ল। তার যাদুদণ্ডের আগা থেকে কালো চিকচিকে দড়ি বের হয়ে রনের পা থেকে মাথা পর্যন্ত পেঁচিয়ে ধরল। ওয়েট্রেস চিৎকার করে দরোজার দিকে দৌড় দিল। যে ডেথ-ইটারটি রনকে বেঁধেছে সেটার নড়াচড়া করা মুখে হ্যারি আরো একটি স্টানিং স্পেল ছুঁড়ে দিল। কিন্তু স্পেলটি লক্ষ্যভ্রষ্ট হল। জানালায় লেগে সেটি ঘুরে ওয়েট্রেসের গায়ে আঘাত করল। সে দরোজার কাছে পড়ে গেল।

এক্সপালসো! ডেথ-ইটারটি চিৎকার করে স্পেল ছুড়লো। যে টেবিলটার পেছনে হ্যারি দাঁড়িয়ে ছিল সেটি চুরমার হয়ে গেল। বিস্ফোরণের ধাক্কায় হ্যারি দেয়ালের সঙ্গে গিয়ে বারি খেল, এবং বুঝতে পারল যে তার যাদুদণ্ডটি হাত থেকে খসে পড়েছে। এবং গায়ের থেকে আলখাল্লা সরে গেছে।

প্যাট্রিফিকাস টোটালাস! চোখের আড়াল থেকে হারমিয়ন চিৎকার করে স্পেল ছুড়ল। ডেথ-ইটারটি একটি মূর্তির মতো সামনের দিকে মাটিতে ভাঙা চিনামাটি, টেবিল এবং কফির উপর ধপাস করে পড়ল। হারমিয়ন হামাগুড়ি দিয়ে বেঞ্চের নিচ থেকে বের হলো। সে মাথা ঝাঁকিয়ে চুল থেকে কাঁচের অ্যাস্ট্রের ভাঙা টুকরা ফেলল। নিজে একটু একটু কাঁপছে।

ডি-ডিফিল্ডো! রনের দিকে যাদুদণ্ড তাক করে হারমিয়ন বলল। হারমিয়নের স্পেলের কারণে রনের জিন্সের প্যান্টে হাঁটুর কাছে বেশ কতকটা জায়গা ছিঁড়ে গেছে। হাঁটুতে গভীর ক্ষত দেখা গেল। রন ব্যথায় কাতরে উঠল। আমি দুঃখিত রন, আমার হাত কাঁপছে! ডিফিন্ডো!

রনের গায়ে জড়ানো মোটা দড়ি ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল। সে পায়ের ওপর উঠে দাঁড়াল। হাতে বল ফিরে পেতে কয়েকবার ঝাঁকি দিল। হ্যারি ওর যাদুদণ্ডটি তুলে নিল এবং ভাঙাচোরা সব ভূপের ভিতর উঠে দাঁড়াল। তার কাছেই হাত-পা ছড়িয়ে বড় সাইজের সোনালি চুলের ডেথ-ইটারটি পড়ে আছে।

ওকে আমার চেনা উচিত ছিল। ডাম্বলডোরের মৃত্যুর রাতে ও সেখানে উপস্থিত ছিল, হ্যারি বলল। সে পা দিয়ে অপেক্ষাকৃত কালো ডেথ-ইটারটিকে উল্টে ফেলল। তার চোখ দুটো দ্রুত একবার হ্যারি একবার রন এবং একবার হার মিয়নের দিকে ঘুরছে।

এ হলো দোহলভ। রন বলল। আমি ওর ছবি একে ধরিয়ে দিন পুরাতন পোস্টারে দেখেছি। আমার মনে হয় বড়টার নাম থর্নফিন রাউলে।

নাম যাই হোক সেটা এখন কোনো ব্যাপার না। হারমিয়ন হাঁপাতে হাঁপাতে বলল। ওরা আমাদের খোঁজ পেল কী করে। এখন আমরা কী করব?

তার এই উদ্বেগের কারণে হ্যারি সচেতন হয়ে উঠল।

দরোজা লাগিয়ে দাও, সে বলল। আর রন, বাতিগুলো নিভিয়ে দাও!

হ্যারি নিচে স্থির হয়ে পড়ে থাকা দোহলভের দিকে তাকাল। হ্যারি দ্রুত চিন্তা করতে থাকল। এরই মধ্যে দরোজা ক্লিক করে বন্ধ করে দেয়া হলো এবং রন ডেলুমিনেটর ব্যবহার করে বাতিগুলো নিভিয়ে দিয়ে কফি হাউসটা অন্ধকার করে ফেলল। হ্যারি দূর থেকে শুনতে পেল আসার পথে যে লোকটি হারমিয়নের দিকে মন্তব্য করছিল সে রাস্তা দিয়ে যাওয়া আর একটি মেয়ের দিকে মন্তব্য করছে। ওদের নিয়ে এখন আমরা কী করব, রন অন্ধকারে ফিসফিস করে হ্যারির উদ্দেশে বলল। তারপর গলা আরো নামিয়ে বলল, হত্যা করব? ওরা তো আমাদের হত্যা করত। এখন ওদেরও উপযুক্ত সাজা পাওয়া উচিত।

হারমিয়ন তখনো কাঁপছে, সে এক পা পিছিয়ে গেল। হ্যারি মাথা নাড়ল।

আমাদের প্রয়োজন শুধু ওদের মাথা থেকে মোমোরি মুছে ফেলা, হ্যারি বলল। সেটাই ভালো। কারণ তাতে ওরা এখান থেকে সরে যাবে। আর যদি আমরা ওদের হত্যা করি, তাহলে প্রমাণ হবে যে আমরা এখানেই ছিলাম।

তুমি এ ব্যাপারে আমাদের বস, রনকে মনে হলো গভীরভাবে ভারমুক্ত হলো। কিন্তু আমি কখনোই মেমোরি চার্ম ব্যবহার করি নাই।

আমিও না, হারমিয়ন বলল। কিন্তু আমি থিওরিটা জানি।

হরমিয়ন গভীর, ঠাণ্ডা একটা নিঃশ্বাস টানল। তারপর হাতের যাদণণ্ডটি দেহলভের কপালের দিকে তাক করে বলল, ওভলিভিয়েট!

সঙ্গে সঙ্গে দোহলভের চোখ দুটো নির্লিপ্ত এবং স্বপ্নময় হয়ে গেল। ব্রিলিয়ান্ট! হ্যারি বলল। হারমিয়নের পিঠ চাপড়ে দিল। অন্যটি এবং ওয়েট্রেসের দিকে নজর রেখো, আমি আর রন সব ঠিকঠাক করছি।

ঠিকঠাক করার দরকার কেন? রন চারদিকে তাকিয়ে দেখে বলল।

তোমার কি মনে হয় না যে ওরা যখন জেগে উঠে চারদিকের এই হাল দেখবে তখন কি ভাববে না যে কী ঘটেছিল? এবং ওরা নিজেদেরকে এমন একটি জায়গায় দেখবে যেখানে মনে হবে যে রীতিমতো বোমা বিস্ফোরণ হয়েছে?

ও, হ্যাঁ, তোমার কথা ঠিক….

রন ওর যাদুদণ্ডটি পকেট থেকে বের করার আগে কাঁধ ঝাঁকি দিল।

আমি তো বের করতে পারছি না, অবাক হওয়ার কিছু নেই হারমিয়ন, তুমি আমার পুরানা জিন্সের প্যান্ট নিয়ে এসেছ। একেবারে টাইট!

আহা, আমি দুঃখিত রন, হারমিয়ন চুকচুক শব্দ করে বলল। সে ওয়েট্রেসকে টেনে জানালার ওপাশে চোখের বাইরে নিয়ে গেল। হ্যারি শুনতে পেল রনকে হারমিয়ন বলে দিচ্ছে তার যাদুদণ্ডটি কোথায় তাক করতে হবে।

কফি হাউসটা আগের মতো অবস্থায় ফিরিয়ে আনার পর ওরা ডেথ-ইটার দুজনকে তুলে নিয়ে মুখোমুখি বসিয়ে দিল।

কিন্তু ওরা আমাদের খোজ পেল কীভাবে? হারমিয়ন স্থির হয়ে থাকা ডেথ ইটার দুজনের দিকে তাকিয়ে বলল। ওরা জানল কী করে যে আমরা কোথায় আছি?

সে হ্যারির দিকে ফিরল।

তোমার কী এখনো ট্রেস আছে বলে মনে কর, হ্যারি?

না, এখন আর সে ওটার মধ্যে পরে না, রন বলল। সতেরো বছর বয়স হয়ে গেলে আর ট্রেস থাকে না। এটাই উইজার্ড জগতের আইন। একজন পূর্ণ বয়স্ক লোকের ওপর তুমি ট্রেস প্রয়োগ করতে পারো না।

বিষয়টা যখন তুমি জানো, হারমিয়ন বলল। কী হবে যদি ডেথ-ইটাররা সতেরো বছর বয়সী কারো ওপর প্রয়োগ করার কোনো উপায় খুঁজে পেয়ে থাকে?

কিন্তু হ্যারি গত ২৪ ঘণ্টায় কোনো ডেথ-ইটারের কাছাকাছি ছিল না। তাহলে কে ওর উপর ট্রেস ব্যবহার করে থাকতে পারে?

হারমিয়ন কোনো উত্তর দিল না। হ্যারি এই যুক্তিতে একটু প্রভাবিত হলো, দ্বিধায় পড়ল: ডেথ-ইটাররা যে খুঁজে পেয়েছে, এটাই কি সে খুঁজে পাওয়ার কারণ?

ওরা আমাদের অবস্থান জেনে যাবে এই কারণে যদি আমি যাদু করতে না পারি, আর যদি একই কারণে তুমি আমার কাছাকাছি থেকে যাদু করতে না পার,সে বলতে শুরু করল।

আমরা কোনো কারণেই আলাদা হব না! হারমিয়ন শক্ত গলায় বলল।

আমাদের লুকিয়ে থাকার জন্য নিরাপদ একটি স্থান দরকার, রন বলল। এ বিষয় নিয়ে আমাদের একটু ভাবার সময় দাও।

গ্রিমোল্ড প্লেস, হ্যারি বলল।

রন আর হারমিয়ন বড় বড় চোখ করে তাকাল।

 এত হেঁয়ালি করো না হ্যারি, স্নেইপও সেখানে যেতে পারে!

রনের বাবা বলেছেন ওরা তার বিরুদ্ধে জিনস্ক স্পেল ব্যবহার করেছেন। যদি তা ঠিক মতো কাজ না করে, হারমিয়ন তর্ক করতে চেষ্টা করলে তাকে বাধা দিয়ে হ্যারি বলতে থাকল। তাতে কী, আমি কসম খেয়ে বলছি স্নেইপের সঙ্গে দেখা হওয়াটাই আমি চাই!

কিন্তু

হারমিয়ন, এছাড়া আর জায়গা কই? এটাই আমাদের জন্য একমাত্র সুযোগ। স্নেইপ তো মাত্র একজন ডেথ-ইটার। আর যদি এখনো আমার উপর ট্রেস থেকে থাকে তাহলে তো আমরা যেখানেই যাই পেছনে একদল ডেথ-ইটার ধাওয়া করবে।

ইচ্ছা থাকা সত্বেও হারমিয়ন তর্ক করতে পারল না। সে কফি হাউসের দরোজা খুলল। রন ডেলুমিনেটরে চাপ দিয়ে কফি হাউসের বাতিগুলো নিভিয়ে দিল। তারপর ওরা তিন ডেথ–ইটারের উপর উল্টো স্পেল চালাল। ওয়েট্রেস বা

ডেথ ইটাররা কেউ ঘুম ঘুম চোখে চোখ মেলে তাকানোর আগে রন, হ্যারি এবং হারমিয়ন এক জায়গায় জড়ো হলো এবং নিকষ কালো অন্ধকারের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল।

কয়েক সেকেন্ড পর ওরা একটি জায়গায় আছড়ে পড়ল। হ্যারি চোখ খুলে তাকাল। দেখল ওরা দাঁড়িয়ে আছে একটি পরিচিত ছোট জীর্ণ চত্বরে। লম্বা ভাঙাচোরা বাড়িগুলো যেন চারপাশ থেকে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে। ১২ নম্বর লেখা বাড়িটি ওরা দেখতে পেল। এই বাড়িটির কথা ডাম্বলডোরের কাছে ওরা শুনেছে। তিনি ছিলেন এটির সিক্রেট কিপার। ওরা সে বাড়িটির দিকে ছুটতে থাকল। আর বার বার ওরা লক্ষ্য রাখল কেউ তাদের অনুসরণ করছে কি-না। একজন আরেক জনের আগে দৌড়ে পাথরের সিঁড়িতে গিয়ে উঠল। হ্যারি ওর যাদুদণ্ডটি দিয়ে দরোজায় একবার ঠেলে দিল। বেশ কয়েকবার ভেতর থেকে ক্লিক ক্লিক করে ধাতব শব্দ হলো। তারপর সেকলের ক্যাচক্যাচ শব্দ হলো। অবশেষে কিচকিচ শব্দ করে দরোজাটি খুলে গেল। ওরা দ্রুত দরোজার চৌকাঠ পার হয়ে ভেতরে প্রবেশ করল।

হ্যারি পেছনে দরোজাটি বন্ধ করে দিতেই পুরনো স্টাইলের গ্যাসের ল্যাম্পটি সতেজ হয়ে ধপ করে জ্বলে উঠল। ঘরের ভেতর কেঁপে কেঁপে আলো জ্বলতে থাকল। জায়গা দেখে হ্যারির মনে হলো —ভুতুরে, চারদিকে মাকড়শার জাল। ঘরের ভিতরে সিঁড়ির রেলিং এ ঘরে বাস করা ভুতের কালো মাথার আবছায়া আলো পড়েছে। লম্বা কালো পর্দা দিয়ে সিরিয়াসের মায়ের একটি ছবি ঢেকে রাখা। শুধু একটি জিনিসই সঠিক জায়গায় নেই; তা হলো একটি ট্রলের পার তৈরি ছাতার স্ট্যান্ড। সেটি পড়ে আছে পাশে,যেন টঙ্কস ওটাকে আবার ফেলে দিয়েছে।

আমার মনে হয় এখানে কেউ আছে, হারমিয়ন ফিসফিস করে বলল। সে ছাতার স্ট্যান্ডটা দেখাল।

অর্ডার চলে যাওয়ার সময়ও এমন হয়ে থাকতে পারে। রন বিড়বিড় করে উত্তর দিল।

সেই স্পেলগুলো কোথায় যেগুলো অর্ডার স্নেইপের বিরুদ্ধে ব্যবহার করেছে? হ্যারি প্রশ্ন করল।

হয়তো এমন হতে পারে যে সে আসলেই ওগুলো শুধু সচল হবে। রন মন্তব্য করল।

ওরা কাছাকাছি একজনের সঙ্গে আরেকজন গায়ে গা মিশিয়ে দরোজার কাছে দাঁড়াল। দরোজার সঙ্গে পিঠ ঠেকিয়ে। সামনে ঘরের দিকে পা এগুতে সাহস হচ্ছে না।

আমরা চিরকাল এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে পারি না, হ্যারি বলল। সে এক পা সামনে এগুল।

সেভেরাস স্নেইপ?

অন্ধকারের ভেতর থেকে ম্যাড-আই মুডির কণ্ঠ ভেসে এলো। ভয়ে তিনজনই পেছনের দিকে লাফ দিল। আমরা স্নেইপ না! হ্যারি চিৎকার করে বলল। তার চিকারের সঙ্গে সঙ্গেই তার মাথার ওপর দিয়ে ঠাণ্ডা বাতাসের মতো কিছু একটা হুশ করে বেরিয়ে গেল। তার জিহ্বা আপনা আপনি পেছনের দিকে বেঁকে গেল। কোনোক্রমেই কথা বলতে পারছে না। মুখের ভিতরে অনুভূতিগুলো বুঝে ওঠার আগেই জিহ্বার ভঁজ আবার খুলে গেল।

অন্য দুজনকেও মনে হলো একই রকম অস্বস্তিকর পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হয়েছে। রন বমির করার মতো শব্দ করল। হারমিয়ন তোতলাতে থাকল। এটা অ…অবশ্যই ট…টঙ্ক-টাইং কার্স ম্যাড-আই স্নেইপের জন্য সেট করেছে।

হ্যারি সতর্কতার সঙ্গে আরেক পা এগুলো। হলরুমটির শেষ প্রান্তে ছায়ার মত কিছু একটা এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে চলে গেল। ওদের মধ্যে কেউ কিছু বলার আগেই কার্পেটের নিচ থেকে একটি শরীর উঠে এলো। লম্বা, ধূলো জড়ানো রঙের ভয়ানক দেখতে সে শরীর। হারমিয়ন চিৎকার দিয়ে উঠল। একই সঙ্গে চিৎকার দিলেন মিসেস ব্ল্যাক। তার সামনে রাখা পর্দাটি উড়ে গেল। ধুসর রঙের শরীরটি ওদের দিকে উড়ে আসতে শুরু করল। দ্রুত থেকে দ্রুততর গতিতে। কোমর পর্যন্ত লম্বা চুল তার পেছনে স্রোতের মত উড়তে থাকল। মুখটা ভিতরের দিকে, মাংস হীন চোখ দুটোর কোটরে গর্ত। এই ভয়নক দৃশ্যটি পরিচিত–এই শরীরটি উড়ন্ত অবস্থায় হ্যারির দিকে একটি হাত উঁচিয়ে তাক করল।

না হ্যারি চিৎকার করে উঠল। যদিও হ্যারি নিজের যাদুদণ্ডটি তাক করেছে, কিন্তু মুখে কোনো স্পেল বলতে পারল না। না! আমরা তোমাকে হত্যা করিনি-

হত্যা শব্দটি উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে দেহটি বিস্ফোরিত হয়ে ধুলার মেঘ তৈরি করল। হ্যারি কাশতে কাশতে ওর চোখ দিয়ে পানি বের হয়ে গেল। সে চারদিকে চোখ ঘুরিয়ে দেখল হারমিয়ন মাথা দুহাত দিয়ে ঢেকে নিচু হয়ে দরোজার কাছে উবু হয়ে আছে। আর রন হারমিয়নের কাঁধ ধরে আছে। তার মাথা থেকে পা পর্যন্ত থরথর করে কাঁপছে। রন বলল, এখন স..সব ঠিক আছে…চ..চলে গেছে।

হ্যারির চারপাশে ধুলাগুলো কুয়াশার মতো উড়ছে। গ্যাসের আলো অস্পষ্ট করে ফেলেছে। মিসেস ব্ল্যাক চিৎকার করতে থাকলেন

মাডব্লাডরা, নোংরা সম্মানজ্ঞানহীন, আমার বাবার বাড়িকে অসম্মান করে

শাট আপ! হ্যারি তার দিকে যাদুদণ্ডটি তাক করে চিৎকার করে বলল। একটি প্রকাণ্ড শব্দ হয়ে এবং লাল আলো বিচ্ছুরিত হয়ে পর্দাটি আবার জায়গায় লেগে গেল। আর তার চিৎকার থেমে গেল।

ওটা…ওটা ছিল… হারমিয়ন বলতে চেষ্টা করল। রন তাকে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করছে।

হ্যাঁ, হ্যারি বলল। কিন্তু এটা আসল সে নয়, তাই না? শুধু স্নেইপকে ভয় দেখানোর জন্য কোনো একটা কিছু।

হ্যারি ভাবতে থাকল,এতে কী কাজ দিয়েছে? স্নেইপ যে জীবিত ডাম্বলডোরকে হত্যা করেছে তার কাছে এই ভূতুরে শরীর ধ্বংস করা কী কঠিন কিছু হবে? হ্যারির নার্ভগুলো এখনো কাঁপছে। হ্যারি দুজনকে পথ দেখিয়ে উপরের দিকে নিয়ে যেতে থাকল। ওরা আশঙ্কা করল আবার কোনো ভয়ঙ্কর কিছু দেখা দেবে। কিন্তু না কোনো কিছুর নড়াচড়া চোখে পড়ল না। শুধু একটি ইঁদুর দ্রুত স্কার্টিং বোর্ডের পাশ দিয়ে দৌড়ে গেল।

সামনে যাওয়ার আগে আমাদের চেক করে নেয়া ভালো, হারমিয়ন বলল। সে হাতের যাদুদণ্ডটি সামনের দিকে ধরে বলল, হোমেনাম রিভেলিও!

কোনো সাড়াশব্দ নেই।

আমরা এই মাত্র একটি বড় ধাক্কা খেয়েছি, নরম সুরে রন বলল। সে ক্ষেত্রে তোমার ওই স্পেল কি কাজ করবে?

আমি যা চেয়েছি সেটাই এই স্পেলে হয়ে গেছে, হারমিয়ন তাকে বাধা দিয়ে বলল। এই স্পেলটি হলো, যদি এখানে কোনো মানুষ থাকে তাহলে তা প্রকাশ হয়ে যাবে। এবং দেখা গেল যে আমরা ছাড়া এখানে আর কেউ নেই।

আর ওই পুরানো ধূলো, কার্পেটের যে অংশ থেকে মৃতদেহের শরীরটি বের হয়ে এসেছিল সেদিকে তাকিয়ে রন বলল।

চলো, আমরা উপরে যাই, হারমিয়ন একই জায়গার দিকে ভয়ে ভয়ে তাকিয়ে বলল। সে পথ দেখিয়ে কচকচ শব্দ করা সিঁড়ি দিয়ে প্রথম তলার ড্রাইং রুমের দিকে নিয়ে গেল।

হারমিয়ন তার যাদুদণ্ডটি তুলে গ্যাসের পুরনো ল্যাম্পটি জ্বালাল। তারপর একটু একটু কেঁপে কেঁপে শুকনো রুমটিতে ঢুকল। সে সোফার উপর বসে পড়ল। হাতদুটো শক্ত করে নিজের শরীরের সঙ্গে জড়িয়ে রেখেছে। রন ওদের পার হয়ে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। ভারী ভেলভেটের পর্দা ইঞ্চিখানেক সরালো।

বাইরে কাউকে দেখা যাচ্ছে না, রন বলল। সুতরাং তোমরা ভাবতে পার, যদি হ্যারির ওপর ট্রেস থাকত তাহলে ওরা আমাদেরকে অনুসরণ করে চলে আসত। আমি জানি ওরা ভিতরে ঢুকতে পারবে না, কিন্তু কী হয়েছে তোমার হ্যারি?

হ্যারি যন্ত্রণায় মুখ কাঁদো কাঁদো করে ফেলেছে। তার স্কারটিতে আবার জ্বালাপোড়া শুরু হয়েছে। পানির ভিতরে উজ্জ্বল প্রতিফলনের মতো তার মনের ভিতরে কিছু একটা জ্বলে উঠেছে। সে দেখতে পেল একটি বিশাল ছায়া। একটি ভয়নক অনুভূতি হলো হ্যারির। সে অনুভূতি নিজের শরীরের ভিতরের কোনো কাঁপুনি থেকে নয়, কিন্তু ছোট করে বৈদ্যুতিক শকের মতো ঝাঁকি দিতে থাকল।

তুমি কী দেখছ হ্যারি? রন হ্যারির দিকে এগিয়ে এসে জানতে চাইল। তুমি কী আমাকে দেখতে পাচ্ছ না, তাকে দেখতে পাচ্ছ?

না, আমি শুধু তার রাগটা অনুভব করছি… সে সত্যিই খুব ক্ষুব্ধ…

 কিন্তু সেটা বারোতে হতে পারে, রন উচ্চস্বরে বলল। এছাড়া আর কি? তুমি কী অন্য কিছু দেখনি? সে কি কারো উপর কার্স করছে?

না, আমি শুধু তার রাগটা অনুভব করছি, আমি বলতে পারব না….।

হ্যারি বিরক্ত হলো, কনফিউজড হলো। যে কারণে হারমিয়ন যা বলল তাতে তার অনুভূতির খুব একটা হেরফের হলো না। হারমিয়ন ভয়ের সঙ্গে বলল, আবার তোমার স্কার? কিন্তু এসব কি ঘটছে? আমি ভেবেছিলাম এই কানেকশনটি বোধহয় বন্ধ হয়ে গেছে!

কিছু সময়ের জন্য বন্ধ হয়েছিল, হ্যারি বিড়বিড় করে বলল। স্কারের জায়গাটিতে এখনো ব্যাথা করছে। যে কারণে হ্যারি মনোযোগ দিতে পারছে না। আমি…. আমার মনে হয় সে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেললেই এটা আবার শুরু হয়। এভাবেই এটা হয়ে থাকে…

তাহলে হ্যারি, তোমার মনটাকে ক্লোজ করতে হবে! হারমিয়ন ক্রুদ্ধ কণ্ঠে বলল। হ্যারি, ডাম্বলডোর তেমার এই কানেকশনটি কখনো পছন্দ করতেন না। তিনি চাইতেন তোমার এই কানেকশনটি বন্ধ হোক। সে কারণেই তোমার অকুপেন্সি ব্যবহার করতে হতো। তা না হলে বিভ্রান্ত করার জন্য ভোল্ডেমর্ট তোমার মনে নকল ইমেজ ঢুকিয়ে দিতে পারে। মনে রেখ

হ্যাঁ, আমার মনে আছে, ধন্যবাদ, হ্যারি দাঁতে দাঁত চেপে বলল। হারমিয়নের মনে করিয়ে দেয়া দরকার নেই যে ভোল্ডেমর্ট একবার তাদের দুজনের মধ্যে সংযোগ ঘটিয়েছিল হ্যারিকে ট্র্যাপে ফেলার জন্য। আর সে কারণে সিরিয়াসের মৃত্যু হয়েছিল। হ্যারির মনে হলো তার মধ্যে কী ঘটছে এবং সে কি দেখছে সেটা ওদের কাছে না বললেই ভাল হতো। এর ফলে ভোল্ডেমর্ট আরো বড় ভীতি হয়ে দেখা দিয়েছে। মনে হয়, সে এত কাছে চলে এসেছে, যেন রুমের জানালার ওপর চাপ দিচ্ছে ভেতরে প্রবেশের জন্য। স্কারের ব্যথা তখনো বেড়েই চলেছে। হ্যারি মোকাবেলা করতে চাইছে। যেন নিজেকে অসুস্থ হয়ে পড়া থেকে প্রতিরোধ করছে।

সে রন এবং হারমিয়নের থেকে পেছন ফিরল। এমন ভাব করল যেন দেয়ালের সঙ্গে কারুকাজ করে, গেঁথে রাখা ব্ল্যাক পরিবারের বংশক্রম মনোযোগ সহকারে দেখছে। ঠিক তখনই হারমিয়ন চিৎকার করে উঠল। হ্যারি দ্রুত ওর যাদুদণ্ডটি বের করে চারদিকে ঘুরালো। দেখল একটি প্যাট্রোনাস জানালার দিয়ে উড়ে এসে ওদের সামনে ফ্লোরের ওপর এসে বসল। গলায় পরিষ্কারভাবে রনের বাবার কণ্ঠে কথা বলতে শুরু করল।

পরিবার নিরাপদ, উত্তর দেওয়ার দরকার নেই, আমাদেরকে নজরে রাখা হয়েছে।

প্যাট্রোনাসটি আবার অদৃশ্য হয়ে গেল।

রন ব্যথিত এবং ক্ষুব্ধ হওয়ার মাঝামাঝি একটি শব্দ করল এবং সোফার ওপর বসে পড়ল। হারমিয়ন কাছে গিয়ে ওর হাত ধরল।

তারা ভালো আছেন, তারা ভালো আছেন! হারমিয়ন ফিসফিস করে বলল। রন সামান্য হেসে ওকে জড়িয়ে ধরল।

হ্যারি, সে হারমিয়নের কাঁধের উপর দিয়ে হ্যারির দিকে তাকিয়ে বলল। আমি-

কোনো সমস্যা নেই, হ্যারি বলল। তার মাথায় প্রচুর ব্যথা হচ্ছে। তোমার পরিবার, অবশ্যই তাদের নিয়ে তুমি উদ্বিগ্ন। আমার হলেও একই অনুভূতি হতো। জিনির কথা মনে পড়ল হ্যারির। আমারও একই রকম অনুভব হচ্ছে।

তার ব্যথা একেবারে চুড়ান্ত পর্যায় পৌঁছে গেল। ঠিক বারোর বাগানে যেমন হয়েছিল। অনেকটা নিস্তেজভাবে সে শুনতে পেল হারমিয়ন বলছে, আমি একা থাকতে পারব না। আমরা কী আজ রাতে এখানে থাকার জন্য ওই শিপিংব্যাগগুলো ব্যবহার করতে পারি না যেগুলো আমি সঙ্গে করে নিয়ে এসেছি?

হ্যারি শুনতে পেল রন সমর্থন জানাচ্ছে। সে আর ব্যথা সহ্য করতে পারছে, মনে হচ্ছে মরেই যাবে।

বাথরুম, হ্যারি বিড়বিড় করে বলল। সে না দৌড় দিয়ে যত তারাতারি সম্ভব ঘর থেকে বের হলো।

সে কোনোক্রমে পৌঁছতে পারল। বাথরুমে ঢুকে সে কাঁপা হাতে দরোজাটা লাগিয়ে দিল। যন্ত্রণা কাতর মাথাটি দু হাত দিয়ে চেপে ধরল এবং মেঝেতে বসে পড়ল। ব্যথায় মনে হলো একটি বিস্ফোরণ ঘটেছে। ভেতরে এমন এক কুদ্ধভাব সে অনুভব করল যা আসলে তার নিজের ভেতরের না। দেখল একটি লম্বা রুম। রুমটি শুধু আগুনের আলোতে আলোকিত। বিশাল সাইজের সোনালি চুলের ডেথ ইটারটি মেঝেতে পড়ে আছে। চিৎকার করছে, কাতরাচ্ছে। একটি হালকা শরীরের কেউ তার উপর দাঁড়িয়ে আছে। যাদুদও ডেথ-ইটারটির দিকে ধরে আছে। আর হ্যারি শীতল, নির্দয়কণ্ঠে কথা বলছে।

রাউলে, এখন শেষ করে দেই, তোকে নাগিনীকে দিয়ে খাইয়ে দেই? লর্ড ভোল্ডেমর্ট এবার নিশ্চিত না যে তোকে ক্ষমা করবেন কি-না….তুই আবার আমাকে ডেকে এনে বলছিস যে হ্যারি পটার আবারো পালিয়ে গেছে? ড্র্যাকো, রাউলেকে আমাদের অসম্ভষ্ট হওয়ার উপযুক্ত একটা দাওয়াই দাও… এখনই দাও, নইলে তুমি নিজে আমার ক্রোধের ঝালটা বুঝবে!

একটি কাঠ আগুনের ভেতর পড়ল। বোয়া ওপরের দিকে ফুঁসে উঠল। বিদ্যুতের মতো আলো ঝলকে উঠল। সেই আলো ভয়ানক একটি সাদা মুখের উপর পড়ল। দীর্ঘক্ষণ গভীর পানির মধ্যে থেকে উঠে আসলে যেমন দম ছাড়ে তেমনি দম ছেড়ে হ্যারি চোখ খুলল।

হ্যারি হাত-পা ছড়িয়ে ঠাণ্ডা কালো মেঝের উপর পড়ে আছে। ওর নাকের কয়েক ইঞ্চি দূরে বাথটাবের সঙ্গে লাগানো সর্পিল লেজের পায়া। সে উঠে বসল। ম্যালফয়ের সরু, ভয়ার্ত মুখটা ওর চোখের ভেতর গেঁথে গেছে। ড্র্যাকোকে ভোল্ডেমর্ট যেভাবে ব্যবহার করছে তা দেখে হ্যারি রীতিমতো অসুস্থ বোধ করছে।

দরোজায় জোরে জোরে আঘাতে হ্যারি লাফিয়ে উঠল। বাইরে থেকে হার মিয়নের গলার আওয়াজ শোনা গেল।

হ্যারি, তোমার কি টুথব্রাশ লাগবে? আমি নিয়ে এসেছি।

হ্যাঁ,অসংখ্য ধন্যবাদ। সে বলল। সে গলা স্বাভাবিক রাখতে চেষ্টা করল। উঠে দাঁড়িয়ে হারমিয়নকে দরোজা খুলে দিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *