০৫. যোদ্ধার পতন

০৫. যোদ্ধার পতন

হ্যাগ্রিড?

লোহা-লক্কর ও চামড়ার আবর্জনার ভেতর থেকে উঠে আসার চেষ্টা করে হ্যারি। তার হাত দুটো কাদামাটিতে কয়েক ইঞ্চি ডুবে গেছে। সে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করল। প্রথমেই ওর মাথায় ভাবনা এলো ভোল্টেমর্টের, কোথায় সে! আশঙ্কা করল, যে কোনো সময় ভোল্ডেমর্ট অন্ধকার কুঁড়ে বেরিয়ে আসতে পারে। হ্যারি থুতনির নিচে এবং কপালে গরম এবং ভেজা কিছু একটা বেয়ে পড়ছে অনুভব করল। সে হামাগুড়ি দিয়ে পুকুর থেকে উঠে এলো এবং হোঁচট খেয়ে অন্ধকারে মাটিতে পড়ে থাকা একটি শরীরের অস্পষ্ট ছায়ার সামনে এসে পড়ল। এই ছায়া শরীরকে ওর মনে হল হ্যাগ্রিড।

হ্যাগ্রিড? হ্যাগ্রিড? আমার সঙ্গে কথা বলো

কিন্তু অন্ধকারের শরীরটি একটুও নড়ল না। তখনই অন্ধকার থেকে একটি কণ্ঠস্বর ভেসে আসল।

এখানে কে? হ্যারি পটার? তুমি কী হ্যারি পটার?

হ্যারি লোকটির কণ্ঠস্বর চিনতে পারল না। ঠিক তখনই একজন মহিলা চিৎকার করে উঠল, ওরা আছড়ে পড়েছে টেড, বাগানের মধ্যে পড়েছে।

হ্যারির মাথাটা তখন চারদিকে ঘুরছে।

হ্যাগ্রিড, সে বোকার মতো আবার ডাকল। তার হাঁটুতে ধাতব কোনো কিছু জড়ানো। তারপর আর কিছু মনে নাই।

পরে বুঝতে পারল সে আসলে চিৎ হয়ে শুয়ে আছে। পিঠের নিচে সোফার গদি। পাজর এবং ডান হাতে ব্যথা করছে। তার পড়ে যাওয়া দাঁত আবার পুনস্থাপন করা হয়েছে। কপালের দাগটি জ্বালাপোড়া করছে।

হ্যারি চোখ খুলে তাকাল। দেখল অপরিচিত একটি বসার রুমে সোফার উপর সে শুয়ে। সামান্য একটু দূরে মেঝেতে তার ব্যাগটি। ভেজা এবং কাঁদা লেগে আছে ব্যাগটিতে। একটু দূরে বসা মোটা পেট, মাথায় অল্প চুলের একজন মানুষ উদ্বেগের সঙ্গে তার দিকে তাকিয়ে আছে।

হ্যাগ্রিড? হ্যারি অস্ফুট স্বরে জিজ্ঞেস করল।

হ্যাগ্রিড ভালো আছে মাই সন, লোকটি বলল। তার স্ত্রী দেখাশোনা করছে। তোমার এখন কেমন লাগছে? আর কোথাও ভেঙেছে? আমি তোমার পাঁজর, দাঁত এবং হাত লাগিয়ে দিয়েছি। ও ভালো কথা, আমার নাম টেড। টেড টঙ্কস। আমি ডোরার বাবা।

হ্যারি দ্রুত উঠে বসল। সঙ্গে সঙ্গে তার চোখের সামনে আলো ঝলকে উঠল। নিজেকে অসুস্থ এবং নিস্তেজ মনে হলো।

ভোল্ডেমর্ট

তুমি শান্ত হও, টেড টঙ্কস বলল। সে হ্যারির কাধে হাত দিয়ে তাকে হালকা করে ঠেলে সোফার গদির ওপর শুইয়ে দিল। তুমি ভীষণ আঘাত পেয়েছ। ব্যাপারটা কী হয়েছিল? মটরবাইকে ত্রুটি দেখা দিয়েছিল? আর্থার উইসলি আবার তার ওই অদ্ভুত গাড়িটি দিয়ে ধাক্কা দিয়েছিল?

না, হ্যারি বলল। তার দাগটি ক্ষতের মতো দগদগ করছে। ডেথ ইটাররা..অনেক ডে-ইটার… আমাদের ধাওয়া করেছে…

ডেথ-ইটাররা? টেড তীব্র ভাবে বলল। তুমি কী বলছ, ডেথ-ইটাররা? আমার তো ধারণা ছিল তারা জানেই না যে তুমি আজ রাতে বের হচ্ছে। আমি ভাবছিলাম

না, ওরা জানতই, হ্যারি বলল।

টেড টঙ্কস এমনভাবে মুখ উঁচু করে ছাদের দিকে তাকালো যেন সে ছাদের ভেতর দিয়ে আকাশ দেখতে পারে।

ভালো কথা, কিন্তু আমরা তো আমাদের নিরাপত্তা মন্ত্রগুলো জানি, তাই না? ওরা যে কোনো দিক থেকেই আসুক, একশ গজের ভেতরে আসতে পারবে না।

এবার হ্যারি বুঝতে পারল ভোল্ডেমর্ট কেনো অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল। মটরবাইকটির কাছে আসার সময় অর্ডারের মন্ত্রের ক্ষমতার সীমানা অতিক্রম করার প্রান্তেই সে বিলীন হয়েছে। হ্যারি শুধু আশা করল যে মন্ত্র এখানেও কাজ করবে। সে কল্পনা করল ভোল্ডেমর্ট তাদের মাথার একশ গজ ওপরে ঘোরাফেরা করছে। এবং তাদের কাছে আসার চেষ্টা করছে। হ্যারি এটা স্বচ্ছ বুদ্বুদের ভেতর দিয়ে দৃশ্যটি দেখল।

হ্যারি সোফা থেকে পা নামাল। হ্যাগ্রিড যে বেঁচে আছে তা তার নিজের চোখে দেখতে হবে। সে কোনোক্রমে উঠে দাঁড়িয়েছে, ঠিক তখনই দেখল দরোজা ঠেলে ভেতরে ঢুকল হ্যাগ্রিড। তার মুখ রক্ত আর কাদায় মাখামাখি। কাঁপতে কাঁপতে এলোমেলো পায়ে এগিয়ে আসছে, কিন্তু বিস্ময়করভাবে বেঁচে আছে!

হ্যারি!

হ্যাগ্রিড ওই ঘরে থাকা দুটি টেবিলের ওপর ভর করে দুপা বড় করে ফেলে হ্যারিকে জড়িয়ে ধরে প্রায় টেনে তুলল। হ্যারির সদ্য জোড়া লাগানো পাঁজর প্রায় ভেঙে যাচ্ছিল। আহ হ্যারি! তুমি রক্ষা পেলে কীভাবে। আমি মনে করেছিলাম আমরা দুজনেই গেছি!

হা… আমিও। আমার বিশ্বাস হচ্ছে না…

হ্যারি থামল। সে হঠাৎ লক্ষ্য করল হ্যাগ্রিডের পেছন থেকে একজন মহিলা ভিতরে আসছে।

তুমি! হ্যারি আতঁকে উঠে চিৎকার করে বলল। সে দ্রুত পকেটের ভেতরে হাত ঢুকালো। কিন্তু পকেট খালি।

এই যে তোমার যাদুর কাঠি, মাই সন, টেড বললেন। হ্যারির হাতে যাদুর কাঠিটা তুলে দিলেন। এটা তোমার পাশেই পড়েছিল। আমি তুলে এনেছি। আর তুমি যাকে ধমকালে সে হলো আমার স্ত্রী।

আহ, আমি… আমি দুঃখিত।

মহিলা ভেতরে প্রবেশ করল। মিসেস টঙ্কস দেখতে অনেকটা তার বোন বেলাট্রিক্সের মতোই। তবে সে অনেকটা নিষ্প্রভ। চুল হালকা, একটু বাদামি। চোখ দুটো ডাগর এবং মায়ায় ভরা। তা সত্ত্বেও হ্যারি যখন চিৎকার দিয়ে উঠেছিল তখন তাকে স্থির-অনড় মনে হয়েছিল।

আমাদের মেয়েটির কী হয়েছে, তিনি জিজ্ঞেস করলেন। হ্যাগ্রিড বলল তোমাদের জন্য নাকি ওঁৎ পাতা হয়েছিল এবং হঠাৎ করে আক্রমণ করেছে ওরা, নিমফাডোরা কোথায়?

আমি জানি না, হ্যারি বলল। আমরা কেউ জানি না কার কী হয়েছে।

তিনি এবং মি.টঙ্কস একজন আরেকজনের দিকে তাকালেন। তাঁদের বিচলিত দেখে হ্যারির উদ্বেগ আর অপরাধবোধের একটা মিশ্র অনুভূতি হলো। কারো যদি মৃত্যু হয়, তাহলে সেটার জন্য হ্যারিই দায়ী হবে। সে এই পরিকল্পনাতে রাজি হয়েছিল বলেই তাদেরকে সে তার চুল দিয়েছিল…

পোর্টকি! হঠাৎ তার মনে হলো, আর দেরি করা যাবে না তাকে তো এখনি যেতে হবে। আমাদেরকে বারোতে ফিরে যেতে হবে এবং সকলকে খুঁজে বের করতে হবে.. তখন আমরা আপনাদের সঠিক খবর বলতে পারব। অথবা, অথবা ডোরা ফিরে আসলেই আপনাদের খবর পাঠাতে বলব…।

ডোরা নিরাপদই থাকবে, টেড বলল। সে জানে কখন কি করতে হবে। অবরে তার অনেক স্থান আছে। এখানে একটি পোর্টকি আছে, তিনি হ্যারির দিকে ফিরে বললেন, এটা তিন মিনিটের ভেতর চলে যাবে। তুমি যদি চাও।

হ্যাঁ, আমরা তাই করব, হ্যারি বলল। সে তার ছোট ব্যাগটি তুলে নিল। ব্যাগটি ঘুরিয়ে পেছনে কাঁধের ওপর ফেলল। আমি

সে ঘুরে মিসেস টঙ্কসের দিকে তাকাল। মিসেস টঙ্কসকে বিপদের মধ্যে ফেলার জন্য নিজেকে দায়ী মনে করে ক্ষমা চেয়ে কিছু বলতে চাচ্ছিল। কিন্তু সঠিক এমন কোনো শব্দ বা বাক্য খুঁজে পেল না যা তার কাছে কৃত্রিম বা অর্থহীন বলে মনে হলো না।

আমি টঙ্কসকে বলব… ডোরা… ফিরে আসার সাথে সাথেই, আপনার কাছে খবর পাঠাতে… ধন্যবাদ আমাদের সুস্থ করে তোলার জন্য, আমাদের জন্য অনেক করেছেন আপনারা। আমি রুম থেকে বের হওয়ার পর তাকে খুশি মনে হল। সে টঙ্কসের পেছনে পেছনে অল্প হেঁটে বেডরুমে ঢুকল। হ্যাগ্রিডও তাদের পিছনে পিছনে এলো। দরোজার চৌকাঠে যাতে মাথা ঠুকে না যায় সে জন্য হ্যাগ্রিডকে। মাথা নিচু করতে হলো।

তুমি ওখানে যাও, ওটাই হলো পোর্টকি।

মি. টঙ্কস একটি ছোট সিলভারের হেয়ার ব্রাশ দেখিয়ে বলল। হেয়ার ব্রাশটি ড্রেসিং টেবিলের ওপর পড়ে আছে।

ধন্যবাদ, হ্যারি বলল। সে তার আঙুলগুলো সেটার ওপর রাখল চলে যাওয়ার জন্য।

একটু দাঁড়াও, চারদিকে তাকিয়ে হ্যাগ্রিড বলল। হ্যারি, হেডউইগ কোথায়?

সে… তার আঘাত লেগেছে, হ্যারি বলল।

ব্যাপারটা মনে পড়তেই তার মনে একটি ধাক্কা লাগল। চোখে জল চলে আসায় সে নিজে নিজেই লজ্জা পেল। সে যখন ডারসলেদের বাড়িতে থাকত তখন একমাত্র এই পেঁচাটির মাধ্যমেই তার যাদুর দুনিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ ছিল, ওটাই ছিল তার একমাত্র সঙ্গী।

হ্যাগ্রিড সমবেদনা জানাতে হ্যারির কাঁধে হাত বুলিয়ে দিল।

কষ্ট পেয়ো না, ভেজা কন্ঠে হ্যাগ্রিড বলল। তার ছিল একটা সুন্দর বার্ধক্যের জীবন।

হ্যাগ্রিড! সতর্ক করার জন্য টেড টঙ্কস বলল। ততক্ষনে হেয়ারব্রাশটি উজ্জল নীল হয়ে উঠেছে এবং হ্যারি ঠিক সময়ে সেটার উপর তর্জনী আঙুলটা রাখল।

একটা অদৃশ্য টান পড়তেই নাভির কাছে একটা ঝাঁকি দিয়ে উঠল। হ্যারিকে কী যে একটা টেনে নিচ্ছে কে জানে! নিয়ন্ত্রণহীনভাবে সে ঘুরছে। তার আঙুলগুলো পোর্টকির সঙ্গে লেগে আছে শুধু। সে আর হ্যাগ্রিড প্রচণ্ড গতিতে টঙ্কসের কাছ থেকে দূরে সরে যেতে থাকল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে হ্যারির পা শক্ত মাটিতে আঘাত করল এবং বারোর উঠোনে কনুই আর হাঁটুর ওপর ভর করে আছড়ে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে সে চিৎকারের শব্দ শুনতে পেল। পাশে ছিটকে পড়া হেয়ারব্রাশে এখন আর কোনো উজ্জ্বল আলো নেই। হ্যারি একটু একটু টলতে টলতে উঠে দাঁড়াল। দেখল পেছনের দরোজা দিয়ে মিসেস উইসলি এবং ক্লিনি আসছে। আর হ্যাগ্রিড আছড়ে পড়ার পর পায়ের ওপর ভর করে দাঁড়ানোর জন্য চেষ্টা করছে।

হ্যারি! তুমি কী আসল হ্যারি? কী হয়েছিল? অন্যরা সবাই কোথায়? কান্নাজড়িত কণ্ঠে মিসেস উইসলি বললেন।

কী বলছেন আপনি! ওরা কেউ ফিরে আসেনি? হ্যারি আহতস্বরে বলল।

 মিসেস উইসলির ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া মুখ থেকেই সে উত্তর পাওয়া গেল।

ডেথ ইটাররা আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল, হ্যারি তাকে বলল। আমরা রওয়ানা হতেই ওরা আমাদের ঘিরে ফেলে–ওরা জানত যে আজ রাতেই আমি জানি না অন্যদের ভাগ্যে কী ঘটেছে। চারটি ডেথ-ইটার আমাদের ধাওয়া করেছিল। ওদের চারটির কাছ থেকেই আমরা সরে আসতে পেরেছি, এরপর ভোল্ডেমর্ট আমাদের পিছু নিয়েছিল।

তার নিজের কণ্ঠের ব্যাখ্যাগুলো যেন নিজেই শুনতে পাচ্ছে। আসলে ওরা এখন অন্য কিছু নয় জানতে চায় তার ছেলের বিষয়ে। হ্যারি কিছু বলতে পারে কী না। কিন্তু

যাক, ঈশ্বরকে ধন্যবাদ যে তোমার কিছু হয়নি, তিনি বললেন। হ্যারিকে কাছে টেনে নিয়ে জড়িয়ে ধরলেন। হ্যারির মনে হলো সে এটার যোগ্য নয়।

 তোমার এখানে ব্র্যান্ডি পাওয়া যাবে মলি? হ্যাগ্রিড জানতে চাইল। ওষুধ হিসাবে কাজে লাগানোর জন্য?

ম্যাজিকের মাধ্যমেই তা নিয়ে আসতে পারতেন। কিন্তু তিনি দ্রুত ঘরে ফিরে গেলেন। হ্যারি বুঝতে পারল যে এই সুযোগে তার বিমর্ষ মুখটা লুকাতে চাচ্ছেন। হ্যারি জিনির দিকে ফিরল এবং জিনি তাকে অনেক তথ্য দিল, যা হ্যারি জানত না।

রন এবং টঙ্কসের আগেই ফিরে আসার কথা ছিল। কিন্তু ওরা ওদের পোর্টকি মিস করেছে। ওদের ছাড়াই পোর্টকি ফিরে এসেছে। মাটিতে পড়ে থাকা একটি, তেলের ক্যান দেখিয়ে সে বলল এটি। আর মাটিতে পড়ে থাকা পুরাতন ক্যাম্বিসের জুতা দেখিয়ে বলল, ড্যাড এবং ফ্রেডের দ্বিতীয় পর্যায়ে আসার কথা ছিল। আর হ্যাগ্রিড এবং তোমার তৃতীয়। সে ঘড়ি দেখল। আবার বলল, যদি সব ঠিকঠাক থাকে তাহলে জর্জ এবং লুপেনের এক মিনিটের ভেতর এসে পৌঁছানোর কথা।

মিসেস উইসলি এক বোতল ব্র্যন্ডি নিয়ে ফিরে এলেন। বোতলটি হ্যাগ্রিডের হাতে দিলেন। বোতলটি খুলে হ্যাগ্রিড সরাসরি ঢকঢক করে মুখে ঢালল।

মাম! জিনি চিৎকার করে কয়েক ফুট দূরের দিকে দেখাল।

অন্ধকারের মধ্যে একটি নীল আলো। আলোটি বড়ো এবং আরো উজ্জল হতে থাকল। দেখা গেল লুপিন এবং জর্জ। ভো ভো করে ঘুরে মাটিতে নামছে। হ্যারি সঙ্গে সঙ্গে বুঝল যে একটা খারাপ কিছু ঘটেছে। লুপিন জর্জকে ধরে নামাচ্ছেন। জর্জের জ্ঞান নেই এবং মুখমণ্ডল রক্তে মাখানো।

হ্যারি দৌড়ে কাছে গেল এবং জর্জের ধরে নামতে সাহায্য করল। লুপিনের সঙ্গে ধরাধরি করে তাকে কিচেনের ভেতর দিয়ে বসার ঘরে নিয়ে এলো। একটি সোফার ওপর শুইয়ে দিল। ল্যাম্পের আলো জর্জের মাথায় পড়ল। গিনি বড় করে একটা নিঃশ্বাস ছাড়ল। হ্যারির পেটের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠল–জর্জের একটি কান নেই! জর্জের মাথা এবং গলার পাশে রক্তে ভেজা। একেবারে তাজা লাল রক্ত।

লুপিন তার দুই হাত দিয়ে হ্যারিকে টেনে তোলার সঙ্গে সঙ্গে মিসেস উইসলি তার ছেলের উপর ঝুঁকে পড়লেন। হ্যারিকে একটু শক্ত করে ধরে টেনে নিয়ে লুপিন কিচেনে ফিরে এলো। সেখানে পেছনের দরোজা দিয়ে হ্যাগ্রিড তার মোটা শরীরটা প্রবেশ করানোর চেষ্টা করছে।

হ্যারিকে টেনে নিয়ে আসছো কেন, ওকে ছেড়ে দাও।

লুপিন তার কথা কান দিল না।

 হ্যারি পটার যখন হগোয়ার্টে আমার অফিসে গিয়েছিল তখন এক কোণে কোনো প্রাণী বসেছিল? হ্যারিকে হালকা করে ধাক্কা দিয়ে লুপিন বলল। উত্তর দাও!

একটি ট্যাঙ্কের ভেতর একটি গ্রিন্ডিলো, ঠিক না?

সেটা দিয়ে কী হবে? ঘরঘর করে হ্যাগ্রিড বলল।

আমি দুঃখিত হ্যারি, আমাকে তো সকল বিষয় পরীক্ষা করে দেখতে হবে, রূঢ়ভাবে লুপিন বলল। আমরা বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হয়েছি। ভোল্ডেমর্ট জেনে গিয়েছিল যে আজ রাতেই তুমি সরে যাচ্ছ। একমাত্র এমন কেউ তাকে সেটা জানাতে পারে যে সরাসরি আমাদের পরিকল্পনার সঙ্গে জড়িত ছিল। তোমাদের মধ্যে হয়তো কেউ একজন হতে পারে।

তাহলে তুমি আমাকে পরীক্ষা করছ না কেন? দরোজা দিয়ে ঢুকতে চেষ্টা করতে করতে হ্যাগ্রিড বলল।

তুমি তো হাফ-জায়ান্ট, হ্যাগ্রিডের দিকে তাকিয়ে লুপিন বলল। পলিজুস পোশনটি শুধু মানুষের ব্যবহারের মতো করে প্রস্তুত করা হয়েছে।

আজ রাতে আমরা সরে যাচ্ছি সেটা অর্ডারের কেউ ভোল্ডেমর্টকে বলেনি, হ্যারি বলল। চিন্তাটি তার কাছে অবিশ্বাস্য বলে মনে হলো। সে বিশ্বাস করতে পারে না যে তাদের কেউ এটা করেছে। ভোল্ডেমর্ট একেবারে শেষ মুহূর্তে আমার পিছু নিয়েছে। প্রথম অবস্থায় সে জানত না যে, আসল হ্যারি কোনটি। পরিকল্পনার কথা আগে জেনে থাকলে শুরুতেই ধরে ফেলত যে হ্যাগ্রিডের সঙ্গে আমি ছিলাম।

ভোল্ডেমর্ট তোমার পিছু নিয়েছিল? লুপিন তীব্রভাবে বলল। কী ঘটেছিল? তুমি পালিয়ে আসলে কীভাবে?

হ্যারি সংক্ষেপে বর্ণনা করল। কীভাবে ডেথ-ইটাররা তার পিছু নিল এবং তাকে পরে চিনে ফেলল সত্যিকার হ্যারি বলে, কোন পর্যায়ে তারা ধাওয়া করা থেকে সরে গেল, কীভাবে তারা ভোল্ডেমর্টকে ডেকে আনল এবং টঙ্কসের বাবা মায়ের নিরাপদ আশ্রয়ে পৌঁছানোর পূর্বে কীভাবে ভোল্ডেমর্টে দেখা দিয়েছিল।

ওরা তোমাকে চিনে ফেলেছিল? কিন্তু কীভাবে? তুমি কী করেছিলে?

আমি…. হ্যারি মনে করতে চেষ্টা করল। পুরো ঘটনাটা তার কাছে অস্পষ্ট একটা হুড়োহুড়ি এবং কনফিউশনের মত মনে হলো। আমি স্ট্যান সুনপাইককে দেখলাম… আপনি তাকে চেনেন, যে নাইটবাসের কনডাক্টারের কাজ করে। অন্য কাউকে নিরস্ত্র করার আগে আমি তাকে করার চেষ্টা করেছিলাম… মনে হয়েছিল সে হয়তো জানে না যে সে কি করছে, তাকে হয়তো ইমপেরিউস করা হয়েছিল!

হ্যারির কথায় লুপিন ভয়ানক বিরক্ত হলো।

হ্যারি, নিরস্ত্র করার সময় ছিল না ওটা। ওরা তোমাকে ধরতে অথবা হত্যা করতে এসেছিল। তুমি যদি ওদের হত্যা করতে নাই চাও, তা হলেও অন্তত স্টান করা উচিত ছিল।

আমরা শতাধিক ফুট উপরে ছিলাম। যদি আমি তাকে স্টান করতাম তাহলে সে নিচে পড়ে যেত এবং যার ফলে তার মৃত্যুও হতে পারত। সেটা অভাড়া কেদাভ্রা ব্যবহার করার মতোই বিষয়টি হতো। দুবছর আগে এক্সপেলিয়রমাস মন্ত্রটি ভোল্ডেমর্টের হাত থেকে আমাকে রক্ষা করেছিল। হ্যারি প্রত্যয়ের সাথে বলল। লুপিন হ্যারিকে হাফলপাফ জাকারিয়া স্মিথের মুখ ভেংচি কাটার কথা স্মরণ করিয়ে দিল। হাফলপাফ ডাম্বলডোরের আর্মিকে নিরস্ত্র করা শেখানোর জন্য হ্যারির প্রতি চিৎকার করেছিল।

হ্যাঁ হ্যারি, রাগ চেপে ধীরে ধীরে এমনভাবে বললেন যেন তার কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে, অনেক ডেথ-ইটার এটা ঘটতে দেখেছে। কিছু মনে করবে না, এটা তখন ছিল ভয়ানক মৃত্যুর হুমকির মতো একটা অস্বাভাবিক ঘটনা। সেই একই মন্ত্রের পুনরাবৃত্তি ঘটেছে আজ রাতে, যা ছিল আত্মঘাতী। ডেথ-ইটাররা প্রথমবারের ঘটনাটি হয় নিজেরা দেখেছে অথবা শুনে থাকবে!

তাই আপনার মনে হয় যে স্ট্যান সুনপিককে আমার হত্যা করা উচিত ছিল? রাগতস্বরে হ্যারি বলল।

অবশ্যই না! কিন্তু ওই ডেথ-ইটারদের, সত্যি কথা বলতে কি–অধিকাংশ মানুষ সে সময় আশা করবে তুমি পাল্টা আক্রমণ করবে। এক্সপেলিয়ারমাস অবশ্যই একটি কার্যকর স্পেল, হ্যারি। কিন্তু ডেথ ইটাররা হয়তো মনে করবে এটা তোমারই একমাত্র কৌশল। এবং আমি তোমাকে অনুরোধ করব, তাদেরকে এমন ভাবতে দিও না!

লুপিনের কথায় হ্যারির নিজেকে বুদ্ধিহীন বলে মনে হলো। কিন্তু তারপরও নিজের ভেতর একটি প্রতিবাদের ভাব রয়ে গেল।

আমি আমার পথের সামনের কাউকে ধ্বংস করতে পারি না, শুধু আমার পথের বাধা হয়ে থাকার কারণে। হ্যারি বলল। ওটা ভোল্ডেমর্টের কাজ।

লুপিন কথা বলার আর কোনো যুক্তি খুঁজে পেলেন না। অবশেষে হ্যাগ্রিড তার শরীরটা দরোজা দিয়ে ঢোকাতে সমর্থ হয়েছে। সে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে এসে একটি চেয়ারে বসল। হ্যাগ্রিডের ভারে সেটি ভেঙে পড়ল। তার দুঃখ প্রকাশ করার বিষয়টিতে কান না দিয়ে হ্যারি লুপিনের সাথে কথায় মগ্ন থাকল।

জর্জ সুস্থ হবে তো?

হ্যারির সঙ্গে লুপিনের সব হতাশা প্রশ্নের মধ্যে বিলীন হয়ে গেল।

আমার সেটাই মনে হয়। তার কানটি পুনস্থাপনের কোনো সুযোগ নেই। যেহেতু ক্রুমন্ত্রের কারণে খোয়া যায়

বাইরে কিছু আছড়ে পড়ার শব্দ শোনা গেল। লুপিন ঝাঁপিয়ে পেছনের দরোজা দিয়ে বের হলো। হ্যারি হ্যাগ্রিডের পায়ের উপর দিয়ে লাফিয়ে উঠোনের দিকে ছুটে গেল।

দুটি শরীর নেমে এসেছে উঠোনে। হ্যারি দৌড়ে কাছে যেতেই বুঝতে পারল ওরা দুজন হলো হারমিয়ন এবং কিংসলে। হারমিয়ন ইতিমধ্যেই তার আসল চেহারা ফিরে পেয়েছে। দুজনেই একটি কোট ঝোলানোর হ্যাঙ্গার শক্ত করে ধরে আছে। হারমিয়ন পাক খেয়ে হ্যারির বাহুতে এসে পড়ল। কিংসলে তাদের দেখে আশ্বস্ত হতে পারল না। হারমিয়নের ঘাড়ের উপর দিয়ে হ্যারি দেখল কিংসলে তার যাদু কাঠিটা লুপিনের বুকের দিকে তাক করেছে।

অ্যালবাস ডাম্বলডোর তার শেষ কথাগুলো আমাদের দুজনের কাছে কি বলেছিল?

হ্যারি আমাদের ভরসা, তার প্রতি বিশ্বাস রেখো। শান্তভাবে লুপিন বলল। সুপিনের বিষয়ে আশস্ত হয়ে এবার কিংসলে তার যাদুকাঠিটা হ্যারির দিকে ধরল। সঙ্গে সঙ্গে লুপিন বলল, এই হলো হ্যারি, আমি পরীক্ষা করে দেখেছি।

ও তাই, ঠিক আছে বুঝেছি। কিংসলে বলল। তার যাদুকাঠিটা আলখাল্লার ভেতর গুঁজে রাখল। কিন্তু কেউ একজন আমাদের সঙ্গে বেঈমানি করেছে! ওরা জানত, ওরা জানত আজ রাতের কথা।

তাই তো মনে হয়, লুপিন বলল। কিন্তু সাতটি হ্যারি পটার থাকবে এটা ওরা জানত বলে মনে হয় না।

তাহলেও বিষয়টি খুব স্বস্তির নয়, রাগতস্বরে কিংসলে বলল। অন্য আর কে ফিরে এসেছে?

শুধু হ্যারি, হ্যাগ্রিড, জর্জ এবং আমি।

 হারমিয়ন লম্বা শ্বাস নিল। একটু হাঁফ ছাড়ল।

তোমাদের কী হয়েছিল? লুপিন কিংসলেকে জিজ্ঞেস করল।

পাঁচজন পিছু নিয়েছিল। দুটি আহত হয়েছে, একটি হয়তো মারা গেছে। কিংসলে দ্রুত হিসাব করল। আর আমরা ইউ-নো হু-কে দেখেছি। অর্ধেক পথ পার হওয়ার পর সে যোগ দিয়েছিল। কিন্তু প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ভ্যানিশ হয়ে গেল। রেমুস, সে-

উড়তে পারে, হ্যারি বলল। আমিও তাকে দেখেছি। সে আমার এবং হ্যাগ্রিডের পিছু নিয়েছিল।

ও আচ্ছা! তা হলে সে কারণেই সে সরে গিয়েছিল তোমাদের পিছু নিতে! কিংসলে বলল। আমি বুঝতে পারিনি যে সে কেন ভ্যানিশ হয়ে গেল। কিন্তু সে টার্গেট পাল্টালো কেন?

স্ট্যান সুনপিকের সঙ্গে একটু দয়ালু আচরণ করেছিল হ্যারি। লুপিন বলল।

স্ট্যান? হারমিয়ন বলল। কিন্তু আমি তো ভেবেছিলাম সে আজকাবানে?

কিংসলে রূঢ় হেসে বলল, হারমিয়ন, মন্ত্রণালয়ের আর কিছু গোপন নেই, আর পুরো নিরাপত্তা ব্যবস্থা ভেঙে গেছে। আমি কার্স ছুঁড়ে দেয়ায় ট্রাভারের মাথার ঢাকনা পড়ে গিয়েছিল। তারও তো আজকাবানেই থাকার কথা ছিল। কিন্তু তোমার কি হয়েছিল রেমুস? জর্জ কোথায়?

সে একটা কান খুইয়েছে। সুপিন বলল। সে কান খুইয়েছে? হারমিয়ন উচ্চস্বরে পুনরায় উচ্চারণ করল।

স্নেইপের কাজ, লুপিন বলল। স্নেইপ? হ্যারি চিৎকার করে বলল। আপনি তো আগে বলেননি ধাওয়া করার সময় তার মাথার ঢাকনা পড়ে গিয়েছিল। স্নেইপ সেকটামসের প্রতি বিশেষ দুর্বল ওটাই সে সব সময় ব্যবহার করে। আমি মনে করেছিলাম একই রকম জবাব তাকে দেব। আমি তেমন প্রতিঘাত করতে পারিনি, কারণ জর্জ আহত হওয়ার পর তাকে ব্রুমের উপর ধরে রাখতে হয়েছে। তার অনেক রক্ত ঝরছিল।

 চারজনই আকাশের দিকে তাকিয়ে নীরব হয়ে গেল। আকাশে নড়াচড়ার চিহ্ন নেই। নক্ষত্রগুলো অপলক তাকিয়ে আছে। বন্ধুদের উড়ে আসার কোনো কোনো ছায়া নেই, কোনো পরিবর্তন নেই। রন আকাশের কোথায় ছিল? ফ্রেড আর উইসলি কোথায় ছিল? বিল ফ্লয়ার, টঙ্কস, ম্যাড-আই এবং মুন্ডুস কোথায়?

হ্যারি, আমার দিকে একটা হাত দাও, দরোজার প্রান্ত থেকে ঘরঘর করে হ্যাগ্রিড বলল। সে আবারও সেখানে আটকে গেছে। হ্যারি টেনে তাকে সেখান থেকে বের করল। তারপর কিচেনের ভেতর দিয়ে হ্যারি বসার ঘরে প্রবেশ করল। সেখানে মিসেস উইসলি এবং গিনি জর্জের সেবা-যত্ন করছে। মিসেস উইসলি রক্ত বন্ধ করতে চেষ্টা করছেন। ল্যাম্পের আলোতে হ্যারি পরিষ্কার দেখতে পেল জর্জের কানে একটি গভীর ক্ষত।

এখন কেমন আছে?

মিসেস উইসলি ঘুরে তাকিয়ে বললেন, আমি তো কানটিকে লাগিয়ে দিতে পারছি না। বিশেষ করে ক্ষতটা যখন ডার্ক ম্যাজিকের দ্বারা হয়েছে। কিন্তু বড় কথা হল এরচেয়েও অনেক বড় ক্ষতি হতে পারত… সে বেঁচে আছে।

হ্যাঁ, হ্যারি বলল, ঈশ্বরকে অশেষ ধন্যবাদ। উঠোনে কারো কথার শব্দ শুনতে পাচ্ছি মনে হয়? গিনি জানতে চাইল। হারমিয়ন এবং কিংসলে, হ্যারি বলল।

খুবই ভালো কথা, গিনি ফিসফিস করে বলল। তারা একজন আরেকজনের দিকে তাকাল। তাকে আলিঙ্গন করতে হ্যারির ইচ্ছা হলো।

মিসেস উইসলি যে উপস্থিত আছেন সেটা তখন মনেই এলো না। কিন্তু তার ইচ্ছা পূরণ হওয়ার আগেই কিচেন থেকে একটা বিকট শব্দ এলো।

আমার ছেলেটাকে দেখার পর আমি দেখিয়ে দেব যে আমি কে, কিংসলে, তুমি যদি ভালো চাও তাহলে এখনই বিদায় হও!

হ্যারি কখনো মি. উইসলিকে এমনভাবে চিৎকার করতে দেখেনি।

হনহন করে শোওয়ার ঘরে ঢুকলেন। তার টাক মাথা ঘামে চিকচিক করছে, চোখের চশমাটি তার জায়গা থেকে সরে গেছে। তার পেছনেই ফ্রেড। দুজনেই বিবর্ণ, কিন্তু অক্ষত আছে।

আর্থার! কাঁদো কাঁদো গলায় মিসেস উইসলি বললেন। ওহ! থ্যাঙ্কস গুডনেস!

ও কেমন আছে?

মি. উইসলি জর্জের পাশে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লেন। এই প্রথম হ্যারি মি. উইসলিকে এভাবে দেখল। ফ্রেড কোনো শব্দ উচ্চারণ করতে পারছে না। সে সোফার পেছনে দাঁড়িয়ে তার জমজ ভাইয়ের ক্ষতটা দেখে যেন বিশ্বাস করতে পারছে না।

জর্জ জেগে উঠেছে, হয়তো ভাই আর বাবার আগমনের কোলাহলে। সে নড়েচড়ে উঠল।

তোমার এখন কেমন বোধ হচ্ছে জর্জ? মিসেস উইসলি ফিস ফিস করে বললেন।

জর্জ আঙুলগুলো এলমেলোভাবে মাথার পাশের দিকে নাড়ল।

সেইন্টের মতো, বিড়বিড় করে জর্জ বলল।

ওর কী হয়েছে? কঁকিয়ে উঠল ফ্রেড। তাকে ভয়ার্ত দেখা গেল। ওর মনের উপর প্রভাব পড়েছে?

সেইন্টের মতো, আবার বলল জর্জ। সে চোখ খুলে তাকাল। ভাইয়ের দিকে চোখ রাখল। তুমি দেখেছ…আমি এখন পবিত্র…পবিত্র, বুঝতে পেরেছ?

মিসেস উইসলি অগের চেয়ে অনেক জোরে ডুকড়ে কেঁদে উঠলেন। ফ্রেডের বিবর্ণ মুখটা রক্তিম হয়ে উঠল।

দুঃখজনক, সে জর্জের উদ্দেশ্যে বলল। দুঃখজনক, কান নিয়ে সারা দুনিয়ার রসিকতা এখন তোমার সামনে,আর তুমি কি না পবিত্র?

আহ, বুঝলাম, সে তার ভেজা চোখ মায়ের দিকে তাকিয়ে স্বল্প হাসল। তুমি এখন আমাদের দুজনকে আলাদা করে দেখতে পারবে মাম।

সে চারদিকে তাকাল।

হাই হ্যারি, তুমিই তো হ্যারি ঠিক না?

হ্যাঁ, আমিই, সে সোফার আরো কাছাকাছি সরে এলো।

যাক, অন্তত আমরা তোমাকে ঠিকঠাক মতো ফিরে পেয়েছি। জর্জ বলল। রন আর বিল আমার বিছানার কাছে আসছে না কেন?

ওরা এখনো ফিরে আসেনি জর্জ, মিসেস উইসলি বললেন। জর্জের মুখের হাসি উবে গেল। হ্যারি গিনির দিকে তাকাল এবং ইঙ্গিত করল তার সঙ্গে বাইরে যেতে। কিচেনের ভেতর দিয়ে যাওয়ার সময় গিনি নিচুস্বরে বলল, রন আর ভোরা টঙ্কসের এতক্ষণে ফিরে আসার কথা। ওদের তো বহুদূরের পথ না। আন্টি মুরিয়েল এখান থেকে তেমন দূরে থাকেন না।

হ্যারি কিছু বলল না। বারোতে পৌঁছার পর থেকে হ্যারি তার ভয়কে দূরে সরিয়ে রাখার চেষ্টা করে আসছিল। কিন্তু এখন সে ভয় তাকে জাপটে ধরছে। তার শরীরের চামড়ার ওপরে ভয়ের শীতল স্রোত বয়ে যাচ্ছে। বুকের ভিতরে ধকধক করছে। কণ্ঠনালী আটকে আসতে চাইছে। অন্ধকারে পিছনের সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় গিনি ওর হাতে হাত রাখল।

কিংসলে বড়বড় পা ফেলে একবার পেছনে একবার সামনের দিকে হাঁটছে। একবার ঘুরতেই সে মুখ তুলে আকাশের দিকে তাকাচ্ছে। এ দৃশ্য দেখে হ্যারির আঙ্কল ভেরননের রুমের ভেতর পায়চারির কথা মনে পড়ল, যেন দশ লক্ষ বছর আগের কথা! হ্যাগ্রিড, হারমিয়ন এবং লুপিন কাঁধে কাঁধ মিশিয়ে দাঁড়িয়ে নীরবে উপরের দিকে তাকাচ্ছে। ওরা একমনে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলো, হ্যারি এবং গিনির দিকে কেউ ঘুরে দেখল না পর্যন্ত।

অপেক্ষার মিনিটগুলো এত দীর্ঘ যে মনে হচ্ছে কয়েক বছর। সামান্য একটু বাতাস এলেই ঝোপ অথবা গাছের পাতার দিকে চকিতে ঘুরে তাকাচ্ছে যেন অর্ডারের কোনো সদস্য হয়তো ওই পাতার ভেতর থেকে অক্ষত অবস্থায় লাফিয়ে বের হয়ে আসবে

তখনই একটি ব্রুম ওদের মাথার ওপরে চলে এলো এবং মাটির দিকে নামতে শুরু করল

এই তো ওরা! হারমিয়ন চিৎকার করে উঠল। ডোরা টঙ্কস বেশ খানিকটা জায়গা নিয়ে অবতরণ করল। ল্যান্ডিং-এর সময় ধুলো আর পাথর চারদিকে ছিটকে গেল।

রেমুস! ব্রুম থেকে হোঁচট খেয়ে লুপিনের হাতে এসে পড়তে পড়তে টঙ্কস চিৎকার করে বলল। ওর মুখটা সাদা হয়ে গেছে। সে কথা বলতে পারছে না। রন গিয়ে পড়ল হ্যারি এবং হারমিয়নের দিকে।

তোমরা ঠিক আছ? সে মিনমিন করে বলল। হারমিয়ন দৌড়ে এসে তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল।

আমি ভেবেছিলাম… ভেবেছিলাম

আমার কিছু হয়নি, রন বলল। সে হারমিয়নের পিঠ চাপড়ে দিল। আমি ভালোই

রন কাজের কাজ করেছে! টঙ্কস উত্তেজনার সঙ্গে লুপিনকে ছেড়ে দিতে দিতে বলল। সে ডেথ-ইটারদের সরাসরি মাথার উপর স্টান করেছে, আর তুমি যখন উড়ন্ত ব্রুমের উপর থেকে কোনো চলন্ত কিছুকে টার্গেট করবে।

তাই করেছ? হারমিয়ন রনের দিকে তাকিয়ে বলল। তার হাত তখনো রনের গলা জড়িয়ে আছে।

বিস্ময়কর কিছু যেন লেগেই আছে, সে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে গুমগুম করে বলল। আমরাই কী সবার শেষে এলাম?

না, গিনি বলল। আমরা এখনো বিল এবং ফ্লয়ার,ম্যাড-আই এবং মুভুক্ষুসের জন্য অপেক্ষা করছি। এখন আমি মাম আর ড্যাডকে বলতে যাচ্ছি যে তোমরা ঠিকভাবে পৌঁছে গেছ, রন-

সে দৌড়ে ভেতরে চলে গেল।

তোমাদের কী সমস্যা হয়েছিল, কী ঘটেছিল? টঙ্কসের দিকে কুপিনের গলায় পরিষ্কার ক্ষোভ।

বেলাট্রিক্স, টঙ্কস বলল। সে হ্যারি, রেমুসের সঙ্গে আমাকেও হত্যা করতে চেয়েছিল। আমাকে হত্যা করার জন্য সে কঠিনভাবে চেষ্টা করেছে। আমিও চেয়েছিলাম ওকে ওর পাওনা মিটিয়ে দিতে। কিন্তু আমরা রোডোলফাসকে নিশ্চিতভাবে জখম করতে পেরেছি..

এরপর আমরা রনের আন্টি মুরিয়েলের কাছে চলে যাই। আমরা আমাদের পোর্টকি ধরতে ব্যর্থ হওয়ার জন্য তিনি আমাদের গালমন্দ করেন।

লুপিনের চোয়ালের পেশি ওঠানামা করলেও তিনি মাথা নিচু করে রইলেন কোনো কথা বললেন না।

তারপর তোমাদের সবার কি হলো? হ্যারি, হারমিয়ন এবং কিংসলের দিকে ফিরে টঙ্কস জানতে চাইল।

ওরা ওদের নিজেদের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করল। কিন্তু সবসময় বিল ফ্লয়ার, ম্যাড-আই এবং মুভুক্ষুসের অনুপস্থিতি যেন কঠিন বরফের মতো ওদের উপর চেপে রইল। এই কঠিন বরফের দংশন আরো কঠিন হতে থাকল যা সহ্য করা যায় না।

আমাকে ডাউনিং স্ট্রিটে ফিরে যেতে হবে। আরো এক ঘণ্টা আগে সেখানে যাওয়া উচিত ছিল আমার। শেষবারের মতো আকাশের দিকে তাকিয়ে কিংসলে বলল। ওরা ফিরে এলে আমাকে জানিও।

লুপিন মাথা দোলাল। অন্য সবার উদ্দেশ্যে হাত নেড়ে কিংসলে অন্ধকারে গেটের দিকে হাঁটতে শুরু করল। কিংসলে বারোর সীমানা পার হওয়ার ঠিক পরপরই হ্যারির মনে হলো সে দূর কোথাও থেকে খুব আস্তে একটা গুলির শব্দ শুনতে পেল।

মি, এবং মিসেস উইসলি পেছনের দরোজা দিয়ে দৌড়ে নেমে এলেন। তাদের পেছনে গিনি। মা-বাবা দুজনেই আগে রনকে জড়িয়ে ধরলেন, এরপর লুপিন এবং টঙ্কসের দিকে তাকালেন।

থ্যাঙ্ক ইউ, মিসেস উইসলি তাদের বললেন। আমাদের ছেলের জন্য।

অতটা বলর প্রয়োজন নেই মলি, টঙ্কস বলল।

জর্জ কেমন আছে? লুপিন জানতে চাইল।

ওর এখন সমস্যাটা কি? রন তার প্রশ্নটাও সঙ্গে জুড়ে দিল।

সে তার

কিন্তু মিসেস উইসলির বাক্যের শেষ অংশ একটি চেঁচামেচিতে ঢাকা পড়ল; একটি থ্রেস্ট্রাল কয়েক ফুট দূরে এসে ল্যান্ড করল। বিল এবং ফ্লয়ার ওটার ওপর থেকে নামল। বাতাসে উস্কখুস্ক হয়ে আছে, কিন্তু অক্ষত।

বিল! থ্যাঙ্কস গড! থ্যাঙ্কস গড

মিসেস উইসলি দৌড়ে সামনে গেলেন। কিন্তু বিল তাকে যে জড়িয়ে ধরল তা অনেকটা প্রাণহীন। সে তাকিয়ে আছে তার বাবার দিকে। বলল, ম্যাড-আই মারা গেছে।

কেউ কোনো কথা বলল না। কেউ নড়ল না। হ্যারির মনে হলো তার ভেতর থেকে একটা কিছুর পতন হচ্ছে। পৃথিবী থেকে গুরত্বপূর্ণ কোনো কিছু তাকে চিরতরে ছেড়ে যাচ্ছে।

আমরা দেখেছি, বিল বলল; ফ্লয়ার মাথা নাড়ল। কিচেন থেকে আসা আলোতে দেখা গেল তার গালে চোখের জল চিকচিক করছে। ঘটনাটা ঘটেছে। আমরা ঠিক সার্কেল থেকে ভেঙে বের হওয়ার পর। ম্যাড-আই এবং ডাও আমাদের কাছাকাছিই ছিল। ওরাও উত্তর দিকে যাচ্ছিল। ভোল্ডেমর্ট–সে উড়ে সোজা ওদের কাছে গেল। ডাও আতঙ্কিত হয়ে পড়ল। শুনলাম সে চিৎকার করে কাঁদছে। ম্যাড আই চেষ্টা করল ওকে থামাতে। কিন্তু হঠাৎ সে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। ভোল্ডেমর্ট ম্যাড–আইর ঠিক মুখের উপর কার্স ছুঁড়ে মারল। সে ব্রুম থেকে পেছনের দিকে ছিটকে পড়ল। আমরা কিছুই করতে পারিনি, কারণ তারা ছয়জন আমাদের পিছু নিয়েছিল বিলের গলা ভেঙে এলো।

অবশ্যই তোমাদের কিছু করার ছিল না, লুপিন বললেন।

ওরা একে অন্যের দিকে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছে। হ্যারি কিছু অনুধাবন করতে পারছে না। ম্যাড-আই নেই… এটা হতে পারে না। ম্যাড-আই… সো টাফ, এত সাহসী, এত দক্ষতার সঙ্গে সে টিকে ছিল….

যদিও মুখে কেউ বলল না, কিন্তু সবাই সজাগ হয়ে উঠল, বুঝতে পারল যে এখন আর উঠোনে দাঁড়িয়ে থাকার কোনো মানে নেই। তারা নীরবে মি. এবং মিসেস উইসলির পেছনে বারোতে ফিরে গেল। ভেতরে লিভিংরুমে ঢুকে দেখল জর্জ এবং ফ্রেড হাসাহাসি করছে।

কি হয়েছে! সবার মুখের ভাব দেখে ফ্রেড জানতে চাইল। কী ঘটেছে, কে- ম্যাড-আই, মি. উইসলি বললেন। মারা গেছেন।

দুই ভাইয়ের মুখ ব্যাথায় ভরে উঠল। কেউ বুঝতে পারল না কি করা উচিৎ। টঙ্কস হাতে একটি রুমাল নিয়ে নীরবে কাঁদছে। সে ম্যাড-আইর খুব কাছের মানুষ ছিল। হ্যারি জানে ম্যাজিক মন্ত্রণালয়ে ডোরা তার খুব প্রিয় এবং অনুগত ছিল। হ্যাগ্রিড বসেছে এক কোন মেঝেতে। ওখানে বেশ জায়গা আছে। সে টেবিল ক্লথ আকারের বড় রুমাল দিয়ে চোখ মুছছে।

বিল সাইডবোর্ডের কাছে গেল এবং এক বোতল ফায়ার হুইস্কি আর কয়েকটি গ্লাস বের করে আনল।

এখানে, ওর হাতের যাদুদণ্ডটি দিয়ে বারোটি গ্লাস ভরল এবং সকলের কাছে। পাঠাল, তেরো নাম্বার গ্লাসটি উপরে তুলে ধরল। ম্যাড-আই!

ম্যাড-আই! সবাই বলে উঠল এবং পান করতে থাকল।

 ম্যাড-আই, প্রতিধ্বনির মতো করে হ্যাগ্রিড একটু দেরিতে হিক্কা তুলে বলল।

হুইস্কি হ্যাগ্রিডের গলায় ধরল। তার মনে হলো গলা পুড়ছে। তার ভেতর থেকে আবেগ এবং অপার্থিব ভাব কেটে গেল। এমন ভাব তৈরি হল যেন সে সাহস ফিরে পেয়েছে।

তারপর মুন্ডুঙ্গুস অদৃশ্য হয়ে গেল? লুপিন তার গ্লাস এক চুমুকে খালি করল।

পরিবেশটা সঙ্গে সঙ্গে পাল্টে গেল। সবাইকে খুব উত্তেজিত মনে হলো। সবাই লুপিনের দিকে তাকিয়ে আছে। হ্যারির মনে হলো সবাই একই সঙ্গে চাচ্ছে লুপিন কথা বলুক, আবার ভয়ও পাচ্ছে কী শুনতে হয় তা নিয়ে।

আমি জানি তোমরা কী চিন্তা করছ, বিল বলল, আমিও এখানে আসার পথে এই কথাই ভাবছিলাম। কারণ ওদেরকে মনে হয়েছে ওরা আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল। তাই মনে হয়েছে না ওদের? কিন্তু মুন্ডুঙ্গুস আমাদের সঙ্গে বেঈমানি করতে পারে না। ওরা জানত না যে সেখানে সাতটি হ্যারি পটার থাকবে। আমরা চোখের সামনে চলে আসার পর এই বিষয়টি ওদেরকে কনফিউজড করেছে। তাছাড়া হয়তো তোমরা ভুলে গেছ এই ভাওতা দেওয়ার ব্যাপারে মুভুঙ্গসই পরামর্শ দিয়েছিল। এই গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টটি তাহলে মুন্ডুঙ্গুস ওদের বলেনি কেন? ডাঙ আতঙ্কিত হয়েছিল। এটা খুবই স্বাভাবিক। সে সবার আগে থাকতে চায়নি। কিন্তু ম্যাড-আই তাকে সামনে নিয়ে গেছে। এবং ইউ নো হু সোজা ওদের দিকে ধেয়ে যায়। এটা যে কারো আতঙ্কিত হওয়ার জন্য যথেষ্ট।

ইউ-নো-হু ঠিক তাই করেছিল যা ম্যাড-আই ভেবেছিল। নাক টেনে টঙ্কস বলল। ম্যাড-আই বলেছিল, তারা মনে করবে আসল হ্যারি থাকবে সবচে দক্ষ ও শক্তিশালী অরোর সাথে। তাই সে প্রথম ম্যাড-আইকে চেজ করে এবং মুন্ডুঙ্গুস তাদের ধাওয়া করার পর সে কিংসলের দিকে ফেরে।

হা, সেটা খুবই ভালো কথা, তীব্রভাবে ফ্লয়ার বলল। কিন্তু এখনো ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি যে তারা জানল কিভাবে আমরা হ্যারিকে নিয়ে আজ রাতে সরে যাচ্ছি। কেউ একজন অবশ্যই নিরাপত্তার বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয়নি। কেউ হয়তো বাইরের কারো কাছে দিনক্ষণ বলে দিয়েছে। তাদের তারিখ জানার এটি হলো একমাত্র ব্যাখ্যা। কিন্তু পুরো পরিকল্পনা জানার ব্যাখ্যা নয়।

সে সবার দিকে ঘুরে ঘুরে তাকাল। তার সুন্দর মুখটায় তখনো চোখের জলের রেখা। সবাই নীরব রইল। কেউ তার কথার সঙ্গে দ্বিমত করল না। চারদিকে নিস্তব্ধ। শুধু রুমালে মুখ রেখে হ্যাগ্রিডের সেঁকুর তোলার শব্দ শোনা যাচ্ছে। হ্যাগ্রিড হ্যারির দিকে তাকাল। সে কিছুক্ষণ আগেই হ্যারিকে বাঁচাতে নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়েছে। হ্যাগ্রিড, যাকে সে ভালোবাসে, বিশ্বাস করে। যে একবার ভোল্ডেমর্টকে ড্রাগনের ডিমের পরিবর্তে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়ে প্রতারিত হয়েছিল…

না, হ্যারি উচ্চকণ্ঠে বলল। সবাই হ্যারির দিকে ঘুরে তাকাল। অবাক হল। হুইস্কি তার কণ্ঠস্বর বড় করে দিয়েছে। আমি মনে করি…যদি কেউ ভুল করে থাকে। হ্যারি বলতে থাকল। যদি কারো মাধ্যমে গিয়েও থাকে, আমি জানি সেটা সে করতে চায়নি। এটা তার দোষ নয়। সে আবার পুনরায় উচ্চস্বরে বলল যা সাধারণত সে করে না। আমাদের একজনের আরেকজনকে বিশ্বাস করতে হবে। আমি আমাদের সবাইকে বিশ্বাস করি। আমি বিশ্বাস করি না যে এ ঘরে যারা আছে তাদের কেউ আমাকে ভোল্টেমর্টের হাতে তুলে দিতে চায়।

তার কথার পর আরো নিস্তব্ধতা নেমে হলো। সবাই হ্যারির দিকে তাকিয়ে আছে। হ্যারি আবার একটু উষ্ণতা অনুভব করল। সে আরো একটু পান করল। পান করার সময় সে ম্যাড-আইর কথা ভাবল। ম্যাড-আই সব সময় ডাম্বলডোরের মানুষকে বিশ্বাস করার প্রবণতা নিয়ে সমালোচনা করতেন।

ভালো বলেছ হ্যারি, অপ্রত্যাশিতভাবে ফ্রেড বলল।

হ্যাঁ, শোনো, শোনো জর্জ বলল। কোনোক্রমে সে ফ্রেডের দিকে তাকাল। তার মুখের এক কোনে লাফাচ্ছে।

লুপিন হ্যারির দিকে তাকাল। তার মুখে একটা সমবেদনার অভিব্যক্তি। তুমি মনে করছ আমি এতটা বোকা? হ্যারি বলল।

না, আমি মনে করি তুমি ঠিক জেমসের মত, লুপিন বলল। যে কিনা নিজের বন্ধুদের অবিশ্বাস করাকে ডাইনোসরের মতো কাজ বলে মনে করত।

হ্যারি জানে লুপিনের ভেতর কি কাজ করছে। লুপিনের বাবা পিটার পেটিগ্রিউর সঙ্গে তার বন্ধুরা বেঈমানি করেছে। তার যারপরনাই রাগ হলো এবং লুপিনের বক্তব্যের উত্তর দিতে চাইল, কিন্তু লুপিন অন্য দিকে ফিরলেন। গ্লাসটা টেবিলের উপর রেখে বিলকে উদ্দেশ্য করে বললেন, এখন আমাদের কিছু কাজ করতে হবে। তুমি না পারলে আমি কিংসলেকে বলি

না, সঙ্গে সঙ্গে বিল বলল। আমি করব,আমি আসছি।

তোমরা কোথায় যাচ্ছ? টঙ্কস এবং ফ্লয়ার একসাথে বলে উঠল।

ম্যাড-আইয়ের মৃতদেহ, লুপিন বলল। আমাদের সন্ধান করতে হবে।

এটা করতে যেও না না? মিসেস উইসলি বিলের দিকে আবেদনের সুরে বললেন।

আমরা কি অপেক্ষা করব? বিল বলল। যে পর্যন্ত ডেথ ইটাররা দেহটি নিয়ে যায়?

 কেউ কোনো কথা বলল না। লুপিন আর বিল গুড বাই বলে বের হয়ে গেল।

বাকি সবাই এবার চেয়ারে বসে পড়ল। মৃত্যুর আকস্মিকতা এবং পরিসমাপ্তি ওদের আঁকড়ে ধরল।

শুধু হ্যারি বসল না। সে দাঁড়িয়ে থাকল। আমাকেও যেতে হবে, হ্যারি বলল।

দশ জোড়া চোখ একসঙ্গে তার দিকে তাকাল।

এত হেয়ালি করো না হ্যারি, মিসেস উইসলি বললেন। তুমি কী বলছ?

আমি এখানে বসে থাকতে পারি না।

সে কপাল ঘষল। কপালে জ্বালাপোড়া করছে। এক বছরের মধ্যে এ রকম ব্যথা কখনো হয়নি।

আমি যতক্ষণ এখানে থাকব ততক্ষণ তোমরা সবাই বিপদের মধ্যে থাকবে। আমি চাই না।

এতটা খামখেয়ালি করো না! মিসেস উইসলি বললেন। আজ রাতের সব প্রচেষ্টা ছিল তোমাকে এখানে নিরাপদে পাওয়া। ধন্যবাদ যে সফল হওয়া গেছে। এবং ফ্লয়ার রাজি হয়েছে ফ্রান্সের বদলে এখানে বিয়ের অনুষ্ঠানটি করতে। আমরা সে অনুসারে সব ব্যবস্থা করেছি যাতে আমরা সবাই একসঙ্গে থাকতে পারি এবং তোমার দিকে চোখ রাখতে পারি।

তিনি বুঝতে পারলেন না যে তার কথায় হ্যারির মধ্যে ভালোর বদলে আরো বাজে অনুভূতি হচ্ছে।

যদি ভোল্ডেমর্ট জানতে পারে আমি এখানে– কিন্তু কীভাবে সে জানবে? মিসেস উইসলি জানতে চাইলেন।

এক ডজন জায়গা আছে যেখানে এই মুহূর্তে তুমি থেকে থাকতে পারো হ্যারি, মি. উইসলি বললেন। তার জানার কোনো উপায় নেই যে কোন বাড়িটায় তুমি নিরাপদে আছ।

আমি আমার জন্য চিন্তিত না, হ্যারি বলল।

আমরা সেটা জানি, মি. উইসলি বললেন। কিন্তু তুমি চলে গেলে আমাদের সকল প্রচেষ্টাটাই নিরর্থক হয়ে যাবে।

তুমি কোথাও যাচ্ছ না, গরগর করে হ্যাগ্রিড বলল। আহ্ হ্যারি, তোমাকে তো এখানেই আমরা দেখতে চেয়েছি?

অ্যা, আমার কানের রক্ত পরার কথা কি ভেবেছো? বালিশে ভর দিয়ে উঠে বসতে বসতে জর্জ বলল।

আমি জানি এটা ম্যাড-আই নিজেও চাবেন না

আমি জানি! হ্যারি উচ্চস্বরে বলল।

তার কাছে মনে হলো সে চাপের মধ্যে পড়েছে এবং ব্ল্যাকমেইল হচ্ছে। তারা কি মনে করে যে তার জন্য তারা কি করেছে সেটা সে জানে না? তারা কি বুঝতে পারে না যে তার জন্য যাতে আবার কোনো ভোগান্তি না হয় সেজন্য সে সরে যেতে চাচ্ছে? বেশ খানিকক্ষণ সবাই নীরব থাকল। হ্যারির যন্ত্রণা বোধ হতে থাকল। শেষ পর্যন্ত মিসেস উইসলি নীরবতা ভাঙলেন।

হেডউইগ কোথায় হ্যারি? শান্তভাবে হ্যারিকে জিজ্ঞেস করলেন। আমরা তাকে পিগভিজনের সঙ্গে রাখতে পারি এবং কিছু খাবার দিতে পারি।

ভিতরে ভিতরে হ্যারি পাথরের মতো শক্ত হয়ে গেল। সে তাকে সত্যি কথাটা বলতে পারছে না।

সে ফায়ার হুইস্কির শেষটুকু মুখে দিল তার প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়ার জন্য। এখন এটা এখানেই শেষ হতে দাও এবং পরের আক্রমণ প্রতিরোধের জন্য তৈরি থাক। তুমি তার সাথে লড়েছ এবং নিজেকে রক্ষা করেছ যখন সে আকাশে তোমার উপরে।

আমি করিনি, হ্যারি সাদামাটাভাবে উত্তর দিল। এটা আমার যাদুদণ্ডের কাজ। আমর যাদুদণ্ডটি একা একাই সব করেছে।

কয়েক মুহূর্ত নীরবতার পর হারমিয়ন নরম সুরে বলল, কিন্তু সেটা তো অসম্ভব হ্যারি। বলতে চাচ্ছি তুমি কোনো উদ্দেশ্য না করেই যাদু করেছ; আর সেটা ছিল তোমার সাধারণ প্রতিক্রিয়া মাত্র।

না, হ্যারি বলল। বাইকটি যখন নিচে পড়ে যাচ্ছিল, আমি বলতে পারব না যে ভোল্ডেমর্ট তখন কোথায় ছিল। কিন্তু আমার দণ্ডটি আমার হাতের মধ্যেই ঘুরতে থাকল এবং তাকে খুঁজে নিয়ে তার দিকে স্পেল চালালো। এমনকি আমি একটি স্পেল চালানো বুঝতে পারিনি। আমি এর আগে কখনো সোনালি ধোয়া হতে দেখিনি।

প্রায়শই এমন হয়, মিসেস উইসলি বললেন। তুমি যখন চাপের মধ্যে থাকবে তখন হয়তো কোনো যাদু করে ফেলবে যা তুমি আগে কল্পনাও করনি প্রশিক্ষণ পাওয়ার আগে ছোট বাচ্চাদের ক্ষেত্রে প্রায়ই ব্যাপারটা ঘটে।

বিষয়টা তেমন ছিল না, দাঁতে দাঁত চেপে হ্যারি বলল। তার কপালের দাগটি তে জ্বালাপোড়া করছে। ভেতরে ক্ষোভ এবং হতাশা বোধ করল। সবাই মনে করছে ভোল্টেমর্টের সঙ্গে লড়াই সে নিজে করেছে।

কেউ আর কিছু বলল না। সে জানে যে কেউ তার কথায় বিশ্বাস করছে না। বিষয়টি নিয়ে সে চিন্তা করতে থাকল। সে এর আগে কখনোই শোনেনি যে যাদুদণ্ড স্বয়ংক্রিয়ভাবে কাজ করে।

তার জ্বালাপোড়াটা ছড়িয়ে পড়ছে। সে এখন যা করতে পারে তা হলো উচ্চস্বরে গোঙানো থেকে বিরত থাকতে। খোলা বাতাসের জন্য সে হাতের গ্লাসটা রেখে ঘর থেকে বের হয়ে গেল।

অন্ধকারে উঠান পার হওয়ার সময় এক কঙ্কালসার থ্রেস্ট্রাল মুখ তুলে তাকাল। বাদুরের মতো ডানা দুটো ঝাপটা দিল। তারপর আবার ঘাসে মুখ গুঁজে দিল। হ্যারি বাগানের মধ্যে দিয়ে গেটের সামনে থামল। বাইরে বিশাল বিশাল গাছগুলোর দিকে তাকাল। কপালে জ্বালাপড়া করা জায়গাটিতে হাত দিয়ে ঘষতে ঘষতে ডাম্বলডোরের কথা ভাবতে থাকল।

সে জানে, ডাম্বলডোর হলে তাকে বিশ্বাস করত। ডাম্বলডোর হলে জানত যে কীভাবে এবং কেন হ্যারির যাদুদণ্ডটি নিজেই কাজ করতে শুরু করেছিল। কারণ ডাম্বলডোরের কাছে সব প্রশ্নের উত্তর ছিল। তিনি যাদুদণ্ড সম্পর্কে জানতেন। তিনি একবার হ্যারির কাছে ব্যাখ্যা করেছিলেন ভোল্টেমর্টের সঙ্গে তার যাদুদণ্ডের কেমন একটা রহস্যময় যোগাযোগ আছে… কিন্তু ডাম্বলডোর বা ম্যাড-আই, বা সিরিয়স, বা তার বাবা-মা এবং বেচারা পেঁচা এমন স্থানে চলে গেছে যে হ্যারি আর কখনো তাদের সঙ্গে কথা বলতে পারবে না। তার গলার ভেতরটা পুড়তে থাকল, এটা ফায়ার হুইস্কির পোড়া নয়…

ঠিক তখনই বাইরে কোথাও থেকে নয়, তার কপালের কাটা দাগ থেকে প্রচণ্ড ব্যথা শুরু হলো। সে তার কপাল চেপে ধরে চোখ বুজে ফেলল। তার মাথার ভেতর থেকে একটি কণ্ঠ কথা বলে উঠল।

তুমি আমাকে বলেছিলে যে অন্য একটি যাদুদণ্ড ব্যবহারের মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করা যাবে।

হ্যারির মনের ভেতর সে একটি ছবি দেখতে পেল। অতি কৃষ্ণকায় একজন বৃদ্ধ পাথরের মেঝের ওপর ছালা পেতে শুয়ে আছে। চিৎকার করছে, ভয়ার্ত চিৎকার, যে চিৎকার অসহ্য বেদনার চিৎকার…।

না! না! আমি তোমার কাছে ক্ষমা চাই! আমি ক্ষমা চাই…

তুই লর্ড ভোল্টেমর্টের কাছে মিথ্যা কথা বলেছিস, ওলিভ্যান্ডার!

 আমি বলি নাই… কসম খেয়ে বলছি আমি বলি নাই…

তুই পটারকে আমার কাছ থেকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করেছিস!

আমি কসম খেয়ে বলছি করি নাই… আমি মনে করেছিলাম অন্য একটি যাদুদণ্ড ভালো কাজে আসবে…।

তাহলে বল কি করে লুসিয়াসের যাদুদণ্ডটি ধ্বংস হয়েছে!

আমি বুঝতে পারছি না… যোগাযোগটা … ছিল… তোমাদের দুটি যাদুদণ্ডের মধ্যে…।

মিথ্যা কথা!

দয়া কর! আমি ক্ষমা চাই…

এবং হ্যারি দেখল একটি সাদা হাত যাদুদণ্ড তুলে ধরছে এবং অনুভব করল ভোল্টেমর্টের ক্ষোভের তীব্রতা। দেখল ক্ষীণ শরীরের বৃদ্ধ লোকটি যন্ত্রণায় মেঝের ওপর কাতরাচ্ছে হ্যারি

ঠিক যেমন দ্রুত এসেছিল তেমনি দ্রুত এ দৃশ্য সরে গেল। হ্যারি অন্ধকারের ভেতর বাগানের গেটটা ধরে কেঁপে উঠল। বুকের ভেতর ধুকধুক করছে, কপালের দাগ দপদপ করছে। কয়েক মুহূর্ত পর বুঝতে পারল যে তার পাশে রন এবং হারমিয়ন দাঁড়িয়ে আছে।

হ্যারি, চলো ঘরে ফিরে যাই, হারমিয়ন ফিসফিস করে বলল।

তুমি এখনো চলে যাওয়ার কথা চিন্তা করছ?

তোমাকে থাকতে হবে বন্ধু, রন হ্যারির পিঠ চাপড়ে বলল।

কেমন আছ তুমি? হারমিয়ন বলল। সে এত কাছে এসেছে যে হ্যারির মুখটা দেখতে পাচ্ছে। তোমাকে ভীত দেখাচ্ছে কেন!

হয়তো, হ্যারি বলল। সম্ভবত আমাকে ওলিভ্যান্ডারের চেয়ে ভালো দেখাচ্ছে…

হ্যারি এই মাত্র যা দেখেছে সব ওদের কাছে খুলে বলল। ঘটনা শুনে রনকে অবাক আর হারমিয়নকে মনে হলো ভীত।

কিন্তু এটাকে থামাতে হবে! তোমার দাগের–বন্ধ হওয়া উচিত। এই যোগাযোগ তুমি আর হতে দিও না–ডাম্বলডোর চাইতেন তোমার এই মনকে বন্ধ করতে!

হ্যারি কোনো উত্তর দিল না। হারমিয়ন তার বাহুটা চেপে ধরল। হ্যারি সে মিনিস্ট্রি, নিউজপেপার এবং যাদু দুনিয়ার অর্ধেক নিয়ে নিয়েছে, এখন তোমার মাথার ভেতরেও ঢুকতে দিও না!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *