৩০. দ্য হোয়াইট টম্ব

৩০. দ্য হোয়াইট টম্ব

স্কুলের সব পড়াশুনো বন্ধ, পরীক্ষা স্থগিত হয়ে গেলো। কিছু কিছু ছাত্রছাত্রী দুএকদিন পরে তাড়াহুড়ো করে তাদের বাবা-মায়ের কাছে চলে গেলো। ডাম্বলডোর মারা যাবার পরের দিন ব্রেকফাস্টের আগে জমজ বোনেরা হোগার্টস থেকে চলে গেলো। জ্যাকেরিয়া স্মিথকে ওর বাবা সিমাস ফিনিগেন এসে হোগার্টস থেকে নিয়ে গেলেন। বিভিন্ন জায়গা থেকে দলে দলে জাদুকর-জাদুকরী ডাম্বলডোরের অন্ত্যেষ্টিতে যোগ দেবার জন্য হসমিডে ভিড় করতে লাগলো। হগসমিডে থাকার জায়গা নেই বললেই চলে।

অল্প বয়সী ছাত্রছাত্রীরা বিরাট একটা বাড়ির মতো নীল রঙের ক্যারেজ বারোটা ডানাওয়ালা ঘোড়া (হালকা সোনালী চামড়া আর সাদা পুচ্ছ ও কেশর) আকাশে উড়তে উড়তে বিকেলের দিকে স্কুলের কাছে অরণ্যের প্রান্তে নামতে দেখে দারুণ উত্তেজিত হয়ে গেলো। আগে ওরা কখনো উড়ন্ত ক্যারেজ দেখেনি।

হ্যারি ওর ঘরের জানালা দিয়ে সেই ক্যারেজ থেকে অতি সুশ্রী লম্বা চওড়া মহিলাকে নামতে দেখলো। মহিলার গায়ের রং অলিভের মতো, মাথার চুল কালো সিল্কের মতো। ক্যারেজ থেকে নেমেই হ্যাগ্রিডের সঙ্গে করমর্দন করলেন। তাছাড়া অন্ত্যেষ্টিতে যোগ দিতে এসেছেন ম্যাজিক মন্ত্রী, তার দপ্তরের জাদরেল আধিকারিকরা। ক্যাসেলে তাদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছে।

হ্যারি ইচ্ছে করেই যারা এসেছেন তাদের এড়িয়ে চললো। বারবার একই প্রশ্ন, ডাম্বলডোর হোগার্টস থেকে কেন গিয়েছিলেন, কোথায় গিয়েছিলেন শুনতে শুনতে ওর বিরক্তি ধরে গেছে।

হ্যারি-রন-হারমিওন আর জিনি এক সঙ্গে গল্প-স্বল্প করে সময় কাটায়, সুন্দর আবহাওয়া হ্যারির মনে আনন্দ আনে না। ডাম্বলডোরের মৃত্যু ওর সব আনন্দ যেন ছিনিয়ে নিয়ে গেছে। অথচ এই সুন্দর আবহাওয়ার জন্য প্রতিটি বছর ও উন্মুখ হয়ে থাকতো, পরীক্ষা শেষে সকলে মিলে আনন্দে দিন কাটাতো। ওর কোনো কিছুই ভাল লাগছে না।

ওরা রোজই দুবার করে হাসপাতালে গিয়ে আহতদের দেখে আসে। নেভিল ছাড়া পেয়ে গেছে, বিল মাদাম পমফ্রের চিকিৎসায় হাসপাতালে রয়েছে। ওর কাটা ছেঁড়া মুখের ঘা এখনো সারেনি। ও দেখতে অনেকটা ম্যড আই মুডির মতো হয়ে গেছে। এমনিতে ওর হাবভাব বিশেষ বদলায়নি তবে খাওয়া দাওয়ার ব্যাপারে একটু অন্যরকম, হঠাৎ মাংসের টুকরো খেতে ভাল লাগছে ওর। ফ্লেউরও খুব খুশি। বলছে আমার খুব ভাগ্য ভালো, বিল আমাকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছে। হারমিওন ইভনিং প্রফেটের পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে বললো, না, স্নেইপকে ধরার প্রচুর চেষ্টা চলছে, কিন্তু কোথায় সে আত্মগোপন করে রয়েছে, কে জানে।

হ্যারি স্নেইপের নাম শুনলেই চাপা ক্রোধে জ্বলে ওঠে। হারমিওনের হাতে ইভনিং প্রফেট দেখে বললো, ভোল্ডেমর্টকে না ধরতে পারলে স্নেইপকে ধরতে পারা অসম্ভব ব্যাপার। ওরা এতদিনেও ভোল্ডেমর্টকে ধরতে পারেনি।

আমাকে ঘুমাতে যেতে হবে, ঢুলু ঢুলু চোখে জিনি বললো, সে ঘটনার সময় থেকে আমার তো তেমন ঘুম হয়নি। সে ঘুমাতে যাওয়ার আগে হ্যারিকে চুমু খেল, অন্য দুজনকে হাত নেড়ে বিদায় নিল। যে মুহূর্তে জিনি চলে যাওয়ার পর দরজা বন্ধ হলো, হারমিওন এগিয়ে এসে হ্যারির দিকে ঝুকলো, এখন তার চেহারায় আগের হারমিওনের ছাপ।

হ্যারি, জানো আজ সকালে আমি লাইব্রেরিতে অদ্ভুত একটা জিনিস পেয়েছি। RAB? হ্যারি সোজা হয়ে বসে বললো।

হ্যারির মনে এখন একই ভাবনা, হরক্রাকসের সত্যতা জানতে হবে। ডাম্বলডোরের অর্ধসমাপ্ত কাজ ওকে একাই করতে হবে। সেই পথ সোজা নয়, অতি দুর্গম পথ।

এখনো চারটে হরক্রাকস ধ্বংস করতে হবে, প্রত্যেকটা তন্ন তন্ন করে খুঁজে বের করতে হবে। তাহলেই মৃত্যু হবে ভোল্টেমর্টের। ও মনে মনে নামগুলো আওড়াতে থাকে, যেন সেগুলো ওর হাতের কাছেই রয়েছে, শুধু হাত বাড়িয়ে ধরার অপেক্ষা। লকেট, কাপ, সাপ, গ্রিফিন্ডর অথবা র‍্যাভেনকুর কিছুর মধ্যে, লকেট, কাপ… সাপ… গ্রিফিন্ডর অথবা র‍্যাভেন ক্ল।

ভাবতে ভাবতে ও ঘুমিয়ে পড়ে, স্বপ্ন দেখে কাপ, লকেট আর কিছু রহস্যময় জিনিসের, যে গুলো ওর নাগালের বাইরে। ডাম্বলডোর ওকে সাহায্যের জন্য একটা দড়ির মই ছুঁড়ে দিচ্ছেন, সেই দড়ির সিঁড়িতে পা রাখলেই সেটা হয়ে যাচ্ছে একটা বিরাট সাপ!

হারমিওনকে ও লকেটের মধ্যে রাখা পার্চমেন্টটা দেখিয়েছিলো।

কি পেয়েছো?

চেষ্টা করছি হ্যারি, RAB সম্বন্ধে জানতো কয়েকজন নামকরা জাদুকর, তাদের পদবী রোসালিন্ড, অ্যান্টিগোন, বাংগস। রুপার্ট একসেবেদার, বুকস্ট্যানটন, না ঠিক নয়। যে হরক্ৰাকস চুরি করেছে ভোল্ডেমর্ট তার নাম জানে। কিন্তু মনে হয় বাংগস অথবা একসিবেঙ্গার নয়। স্নেইপও হতে পারে।

হারমিওন একটু নার্ভাস হয়ে গেলো নামটা বলে। ওর নাম কেন? হ্যারি চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে বললো।

ওয়েল, আমার মনে হয় হাফ-ব্লাড-প্রিন্সের কাজ-কর্ম সম্বন্ধে কিছু জানতে পেরেছি, হারমিওন তার ধারণা হিসেবে কথাটা বললো।

তুমি কি অসাফল্য বারবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছো, হারমিওন? তুমি কি বুঝতে পারছো না আমার মনের অবস্থা?

আরে না না হ্যারি, আমি সেই রকম কিছু মনে করে বলিনি!

হারমিওন একটুও দেরি না করে বললো। কেউ ওদের কথা শুনছে কি না দেখে নিলো। বলছিলাম, আমি নিশ্চিত এলিন প্রিন্স এক সময়ে বইটার মালিক ছিলো, তুমি তো জানেনা, ও স্নেইপের মা ছিলেন।

আমার মনে হয় এই ব্যাপারে তার কোনো কিছু বলার নেই, রন বললো। ওর কথা হারমিওন পাত্তা দিলো না।

পুরনো সব প্রফেটের পাতা উল্টাচ্ছিলাম, ছোট একটা বিজ্ঞাপন চোখে পড়ে, এলিন প্রিন্সের সঙ্গে টোরিয়াস স্নেইপের বিয়ের অ্যানাউন্সমেন্ট, পরে একটা অ্যানাউন্সমেন্ট, ওদের একটা বাচ্চা হয়েছে।

খুনি, হ্যারি খ্যাঁক করে থুথু ফেললো।

ও হ্যাঁ, ঠিকই, হারমিওন বললো। আমার বলতে কোনো দ্বিধা নেই, স্নেইপ নিজেকে হাফ-অ্যা প্রিন্স বলতে গর্বিত হতো, তাই না? প্রফেট লিখছে টোরিয়াস স্নেইপ একজন মাগল ছিলেন।

যথার্থ বলেছো, হ্যারি বললো। ওর পারিবারিক চরিত্র ভোল্টেমর্টের মতো, দরকার মতো তিনি পিওর ব্লাড–যাতে লুসিয়াস ম্যালফয়কে হাত করা যায়, পিওর রাড মায়ের দিক, বাবা মাগল পরিবারের, জন্মসূত্র সম্বন্ধে প্রয়োজনে লজ্জিত, ডার্ক আর্টস ব্যবহার করে ভীতি প্রদর্শন, নিজের নতুন নামকরণ–লর্ড ভোল্ডেমর্ট–দ্য হাফ ব্লড প্রিন্স, ডাম্বলডোর কেমন করে ওকে…?

ও চেয়ার ছেড়ে উঠে জানালা দিয়ে বাইরের মাঠও অরণ্যের দিকে তাকিয়ে স্নেইপের প্রতি ডাম্বলডোরের অগাধ বিশ্বাসের কারণ খুঁজতে লাগলো। কিন্তু এই মাত্র কথায় কথায় মনে করিয়ে দিয়েছে। একই তাদের ভাবনা, সেই বইতে মাঝে মাঝে ছোট ছোট অক্ষরে লেখা স্পেল, যে চালাক ছেলেটা ওকে এতো সাহায্য করছে তার সম্বন্ধে বিরূপ মনোভাব পোষণ করতে চায় না।

ওকে সাহায্য করেছে, মনে হয় অযৌক্তিক, অসঙ্গত চিন্তা, এখন।

আমি বুঝতে পারছি কেন তুমি বইটি ব্যবহার করার জন্য বিরূপ নও, রন বললো। তুমি কোথা থেকে স্পেলগুলো পাচ্ছো তা নিশ্চয়ই তার অজানা ছিলো না।

তিনি জানতেন, হ্যারি তিক্ত স্বরে বললো, আমি সেকটামসে ব্যবহারের পর না জানার তো কোনো কারণ ছিলো না। তার অনুসন্ধানের তো কোনো প্রয়োজন ছিলো না, স্লাগহর্নের কাছ থেকে আগেই সব শুনেছিলেন আমি পোশান তৈরির ব্যাপারে কতোটা পারদর্শী। তিনিইতো কাবার্ডে তার পুরনো বই রেখে দিয়েছেলেন।

কিন্তু তোমাকে এই বইয়ের বিষয়ে বিপদ ফেলেননি কেন?

তিনি খুব সম্ভবত ওই বইটা সম্বন্ধে নিজেকে কোনো রকমভাবে জড়াতে চাননি, হারমিওন বললো। হয়তো জানতে পারলে ডাম্বলডোর খুব একটা খুশি হতেন না। আবার যদি বলতেন হাতের লেখাটা তার নয়, তাহলেও হাতের লেখাটা যে তার স্লাগহর্ন ধরতে পারতেন। সে যাই হোক বইটা স্নেইপের পুরনো ক্লাশরুমে ফেলে রাখা হয়েছিলল, এবং আমি বাজি ধরতে পারি ডাম্বলডোর জানতেন ওর মাকে প্রিন্স বলে সকলে ডাকতো।

বইটা আমার ডাম্বলডোরকে দেখানো উচিত ছিলো, হ্যারি বললো। ভোল্ডেমর্ট যে কতটা অশুভ সব সময়ে তিনি আমাকে বলতেন–যখন ও স্কুলে পড়াশুনো করতো তখন থেকেই স্নেইপও যে একই পথের পথিক ছিলো তারও আমার কাছে যথেষ্ট প্রমাণ ছিল।

অশুভ, কথাটা সত্যি মারাত্মক, হারমিওন খুব আস্তে বললো।

একমাত্র তুমিই তো আমাকে বলতে যে বইটা সর্বনেশে!

হ্যারি, আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি তুমি নিজের ওপর অনেক দোষ চাপিয়ে চলেছে, আমি ভাবি প্রিন্সের খুব একটা নোংরা রসিকতা বোধ আছে, তবে আমি কখনো মনে করি না ও একজন শক্তিশালী খুনি।

দুজনকেই নীরবতায় আচ্ছন্ন করেছিলো। দুজনেই আপন আপন চিন্তাসাগরে ডুবে রইলো। তবে হ্যারি ভাবে আগামীকাল সকালে ডাম্বলডোরের পার্থিব শরীর চিরকালের জন্য শায়িত করা হবে ওরই মতো, নিশ্চই সেই এক কথাই ভাবছে।

এর আগে হ্যারি কোনো শবযাত্রায় অংশগ্রহণ করেনি, সিরিয়স মারা যাবার পর একজনও ছিলো না যে তার মৃতদেহকে কবর দেবে। ও ঠিক বুঝতে পারছে না আগামীকাল ডাম্বলডোরের শেষ কৃত্যের সময় বা সমাপন হবার পর ওর মনের অবস্থা কি হবে। ও ভাবলো শেষকৃত্যের পর কি ডাম্বলডোরের মৃত্যুটা তার কাছে প্রকৃত সত্য হয়ে সামনে দাঁড়াবে। আরো একটা কথা ভেবে ওর আশ্চর্য লাগছে, সবাই এতো নীরব কেন? ক্যাসেলে কারও মুখে একটা শব্দ বার হচ্ছে না কেন। ও বিশ্বাস করতে পারছে না ওর প্রিয় হেডমাস্টার ডাম্বলডোর আর কখনো কোনোদিন ওর সামনে এসে দাঁড়াবেন না, হ্যারি বলে সম্বোধন করবেন না। সিরিয়াসের ক্ষেত্রে যেমন কোনো একটা উপায়ে ফিরে আসুন এমন কথা ভেবেছিলো, ঠিক তেমনই ডাম্বলডোর সম্বন্ধে ভাবতে লাগলো। ও পকেটে হাত ঢোকাল। নকল হরক্রাকসের ঠান্ডা স্পর্শ পেলো। ওটা পকেটে নিয়ে হ্যারি সর্বদা ঘুরছে, মন্ত্রপুত রক্ষা কবচের মতো নয়, একটা স্মৃতি নিয়ে ঘুরছে।

হ্যারি খুব সকালে ঘুম থেকে উঠলো জিনিসপত্র গোছ-গাছ করার জন্য। পরের দিন ভোরবেলা ডাম্বলডোরের শেষকৃত্য সমাপন হবার ঘণ্টা খানেক পরই হোগার্টস এক্সপ্রেসে চেপে লন্ডনে ফিরতে হবে।

নিচতলায় গিয়ে গ্রেট হলে ঢুকে দেখলো গ্রেট হলের মেজাজ কোমলীকৃত নীরবতায় আচ্ছন্ন। সকলেই কালো আলখেল্লা পরেছে, মুখ দেখে মনে হয় না কারও ক্ষিধে পেয়েছে! স্টাফ টেবিলের মাঝখানে প্রফেসর ম্যাকগোনাগল সিংহাসনের মতো ডাম্বলডোরের চেয়ারটা রেখেছেন, সেই চেয়ার শূন্য। হ্যাগ্রিডের চেয়ারও শূন্য। হ্যারির মনে হলো হ্যাগ্রিড ব্রেকফাস্টে অংশগ্রহণ করবেন না বলেই গ্রেট হলে আসেননি। স্নেইপের চেয়ার অলংকৃত করে গম্ভীর মুখে বসে রয়েছেন রুফাস স্ক্রিমগৌর। হ্যারি হলের চারদিক দেখতে দেখতে ইচ্ছে করেই ক্রিমগৌরের। হলুদ বর্ণের চোখের দিকে তাকালো না। ওর মনে হয় সেই চোখ জোড়া যেন। ওকে

খুঁজে বেড়াচ্ছে। ক্রিমগৌরের সঙ্গে যারা ডাম্বলডোরের ফিউনারেলে অংশগ্রহণ করতে এসেছেন তার মধ্যে পার্সি উইসলিকে দেখতে পেলো হ্যারি। ওর মাথার চুল লাল আর চোখে শিং-এর তৈরি রিম-এর চশমা। রন এমন কোনো ভাব দেখালো না যে ও পার্সিকে চেনে।

ও দেখলো অদূরে স্লিদারিনদের টেবিলে পাশাপাশি বসে রয়েছে গোয়েলে আর ক্রাবে। ওদের নায়ক ড্রেকো ম্যালফয় নেই। হ্যারির এখন চরম ক্ষোভ স্নেইপের বিরুদ্ধে। ম্যালফয় সম্বন্ধে চিন্তা করে হ্যারি সময় ব্যয় করতে চায় না। তাহলেও টাওয়ারের উপরে ম্যালয়ের ভয়মিশ্রিত কণ্ঠস্বর আর ডেথইটারদের আসতে দেখে দণ্ড নামিয়ে রাখার দৃশ্যও ভোলেনি। হ্যারি কোনোভাবেই বিশ্বাস করতে পারছে না ম্যালফয় ডাম্বলডোরকে সত্যই খুন করতে পারতো, সবকিছু মিলিয়ে ওর প্রতি ঘৃণামিশ্রিত করুণা ছাড়া আর কিছু মনের মধ্যে এলো না। ম্যালফয় এখন কোথায় আত্মগোপন করে রয়েছে? ভোল্ডেমর্ট কি ওকে অনবরত শাস্তি দিচ্ছেন? ওকে আর ওর মা-বাবাকে হত্যা করার ধমক দিয়ে চলেছেন?

জিনির কনুইয়ের খোঁচায় হ্যারির সম্বিৎ ফিরে এলো। দেখলো প্রফেসর ম্যাকগোনাগল চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছেন। হলের গুঞ্জন হঠাৎ থেমে গেলো।

হাতে আর সময় নেই, ম্যাকগোনাগল বললেন। ছাত্রছাত্রীরা তোমরা সকলে যে যার হাউজ হেডের পেছনে লাইন করে দাঁড়াও। গ্রিফিররা আমার সঙ্গে দাঁড়াও।

হ্যারি দেখলোস্লাগহর্ন স্নিদারিনদের লাইনে হেড হয়ে দাঁড়ালেন। গায়ে গাঢ় পান্না সবুজ রং এর ঝাঁকানো আলখেল্লা, তার মধ্যে রূপোর সুতো দিয়ে কারুকার্য করা। এর আগে হেড অফ দ্য হাফল পা প্রফেসর স্প্রাউটকে ঝকঝকে পোষাকে দেখেনি। তার টুপিতে একটিও প্যাচা নেই। মাদাম পিনসে ফিলচের পাশে পাশে চললেন। তার গায়ে মোটা কালো রং-এর ভেলভেটের আলখেল্লা, সেটা এতো লম্বা যে পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত ঢেকে দিয়েছে।

ওরা সবাই দল বেধে লেকের দিকে চললো। পাথরের সিঁড়ি বেয়ে দরজার গোড়াতে দাঁড়াতেই হ্যারির চোখে পড়লো রৌদ্রউজ্জ্বল সকাল। প্রখর সূর্যের কিরণ সকলের মুখে গায়ে পড়ছে। সামনেই মাঠেতে সাজানো রয়েছে দুটো সারি চেয়ার। দুই সারির মাঝে আইল। সবশেষে একটা মাৰ্বল পাথরের টেবিল সারিবদ্ধ চেয়ারের মুখোমুখি রয়েছে। হ্যারির মনে হয় গ্রীষ্মকালের সবচেয়ে যেন সুন্দর একটি দিন।

চেয়ারে বসে রয়েছেন অনেক মানুষ, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, যুবক-যুবতি। কারও ফ্যাশন দোরস্ত বেশভুষা, কারও বা জীর্ণ। বেশিরভাগ লোকদের হ্যারি চিনতে না পারলেও কয়েকজনকে চিনতে পারলো। তাদের মধ্যে রয়েছেন অর্ডার অফ ফিনিক্সের সভ্যরা; কিংগে শ্যাকেবোল্ট, ম্যাড-আই মুডি, টোংকস–তার চুলগুলো নতুন করে করা গোলাপী রং-এর এবং রেমাস লুপিন মনে হয় টোংকসের হাত ধরে রয়েছেন, মি, আর মিসেস উইসলি, বিলকে ধরে রয়েছে ফ্লেউর, ওদের পাশেই রয়েছে ফ্রেড আর জর্জ। ওরা দুজনেই পরেছে কালো ড্রাগন স্কিনের জ্যাকেট। অদূরে মাদাম মাকসিমকে দেখতে পেলো। তিনি বলতে গেলে আড়াইটে চেয়ার অধিকার করে বসেছেন। আরো রয়েছেন লিকি কলড্রনের মালিক টম অ্যারাবেলা ফিগ (হ্যারির)। জ্যাস গায়িকা যাদুকর গ্রুপের দুই বোন, এরনি প্রাংগ, নাইট বাসের চালক, মাদাম মালকিন (ডিয়াগন এ্যালির রোব শপের মালিক), কিছু মানুষ যাদের নাম জানে না অথচ চেনে–যেমন হগসহেড পানশালার মালিক, এক জাদুকরী হোগার্টস এক্সপ্রেসের ট্রলি ঠেলে। ক্যাসেলের ঘোস্টরাও বাদ যায়নি, উজ্জ্বল সূর্য কিরণে তাদের প্রায় অস্পষ্ট দেখাচ্ছে, নড়লে চড়লে ওদের দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। হাওয়াতে ওরা যেনো ভেসে বেড়াচ্ছে।

লেকের ধারে চেয়ারের শেষ প্রান্তে বসেছে রন, জিনি, হারমিওন আর হ্যারি। লোকেরা ফিসফাস করে কথা বলে চলেছে পরস্পরের সঙ্গে, কথাগুলো মনে হয় ঘাসের ওপর বাতাস বয়ে যাওয়ার শব্দের মতো। অনেক দূরে অরণ্যের মধ্যে পাখিরা তাদের গান গেয়ে চলেছে বেশ জোরে জোরে। ক্রমশ ভিড় বেড়ে চললো, তার এসেছে হোগার্টসের প্রিয় হেড মাস্টারের প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানাতে। হঠাৎ হ্যারির চোখে পড়লো লুনা নেভিলকে একটা সিটে বসিয়ে দিচ্ছে। যে রাতে ডাম্বলডোর মারা গেছেন, হারমিওন সব ডিএ সভ্যদের জানিয়ে দিয়েছে। ওদের আশা আবার হয়তো ডিফেন্স এগেন্সট (ডিএ) ডার্ক আর্টসের প্রশিক্ষণ যথারীতি চলবে।

ওদের পাশ দিয়ে সামনের সিটের দিকে কর্নেলিয়স ফাজ এগিয়ে গেলেন, তার মুখ বেদনায় মুহ্যমান মাথার হ্যাটটা যথারীতি ঘূর্ণির মতো পাক খাচ্ছে। তারপরে হ্যারির চোখে পড়লো রিটা স্কীটারের ওপর, ও শ্যেন পাখির মতো লম্বালম্বা লাল নখওয়ালা হাতে একটা নোটবুকে চেপে ধরে বসে রয়েছে। হ্যারির ওকে দেখে মেজাজ বেখাপ্পা হয়ে গেলো। তারপর আরো বেশি রেগে গেলো ডলারেস আমব্রিজকে বসে থাকতে দেখে। ওর ব্যাঙের মতো ফোলা ফোলা মুখ নির্বিকার। সেনট্যার ফিরেঞ্জকে জলের ধারে প্রহরীর মতো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো হ্যারি। তারপরই অদূরে হন্তদন্ত হয়ে একটা সিটের কাছে এগিয়ে গেলেন।

সবার শেষে বসেছে স্কুলের কর্মীরা। হ্যারির চোখ পড়লো ক্রিমগৌরের দিকে, প্রফেসর ম্যাকগোনাগলের পাশে মানী লোকের মতো বসে রয়েছেন সামনের সারিতে। হ্যারির মনে হলো স্ক্রিমগৌর বা তার অফিসের উচ্চপদস্থ আধিকারিকরা ডাম্বলডোরের মৃত্যুতে আদপেই দুঃখিত হননি। তারপরই ওর কানে এলো অদ্ভুত সুর আর সঙ্গীত। মন্ত্রিসভার প্রতিনিধিরা বিরক্ত হয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে লেকের জলের দিকে তাকালো। ওরা বুঝতে পারছে না লেকের জলের ভেতর থেকে অদ্ভুত সুরে কারা গান গাইছে। গানের মানে তারা কেন, কেউ বুঝতে পারছে না। মনে হয় সকলেই ভয় পেয়ে গেছে।

জিনি হ্যারির কানের কাছে মুখ এনে বললো, ওরা এসেছে। হ্যারি মারপিপলদের সূর্যালোকিত পরিষ্কার সবুজ জলের উপরিভাগের মাত্র ইঞ্চিখানেক তলায় ইনফেরিদের মতো ভেসে ভেসে গান গেয়ে চলতে দেখলো। অদ্ভুত তাদের ভাষা, অদ্ভুত গানের সুর। একমাত্র ডাম্বলডোর জানতেন তাদের ভাষা। বছর দুই আগে হ্যারি ডাম্বলডোরকে মারপিপলদের প্রধানের সঙ্গে কথা বলতে শুনেছিলো। ওরা বেদনামিশ্রিত কণ্ঠে গান গাইতে গাইতে জলের তলায় চলে গেলো। হ্যারি সবুজ জলের দিকে তাকিয়ে রইলো। অতীতের কথা মনে পড়ে গেলো। জিনি আবার ওকে কনুইয়ের খোঁচা দিয়ে সামনে তাকাতে বললো।

হ্যারি দেখলো হ্যাগ্রিড আইল ধরে ধীর পদক্ষেপে চলেছেন সেই শ্বেতপাথরের টেবিলের দিকে। হ্যাগ্রিড তখনো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছেন। চোখের জলে সর্বাঙ্গ ভিজে গেছে। দুহাতে নিয়ে চলেছেন সোনার তারা খচিত লাল ভেলভেটে আবৃত ডাম্বলডোরের মরদেহ। সেই দৃশ্য দেখে হ্যারির সমস্ত শরীর বেদনায় কেঁপে উঠলো। হ্যারি, রন, হারমিওন ও জিনি কাঁদছে। জিনি আর হারমিওনের কোলের ওপর তাদের অশ্রু টপ টপ করে পড়ে কাপড় ভিজিয়ে দিচ্ছে।

ওরা ঝাপসা চোখে দেখতে পাচ্ছে না অদুরে শ্বেত পাথরের টেবিলে কি সব হচ্ছে। হ্যাগ্রিড ডাম্বলডোরের প্রাণহীন দেহ সযত্নে টেবিলের ওপর শায়িত করলেন, তারপর রুমালে মুখ মুছে মুহূর্তে আইল দিয়ে ফিরে আসতে লাগলেন। হ্যাগ্রিড ধীরে ধীরে ওর সৎ ভাই এর পাশে বসলেন। হ্যারি দেখলো পর্বতপ্রমাণ লম্বা চওড়া গ্রপ দাদার মাথায় হাত দিয়ে সান্ত্বনা দিচ্ছে। ওর বিরাট হাতের ভারে হ্যাগ্রিডের চেয়ারের চার পায়া নরম মাটিতে দেবে গেলো।

বেঁটে খাটো কদম ছটওয়ালা অতি সাধারণ আলখেল্লা পরা একজন লোক তার চেয়ার ছেড়ে উঠে আইলপথ দিয়ে শ্বেত পাথরের ওপর শায়িত ডাম্বলডোরের সামনে দাঁড়ালেন। হ্যারি ভালো করে শুনতে পেলো না বেঁটে খাটো লোকটি কি বলছে। তবে মাঝে মাঝে কানে আসতে লাগলো মহান আত্মার অধিকারী, মহান হৃদয় কথাগুলো ্হ্যারির কাছে খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ মনে হলো না। ডাম্বলডোর কি ছিলেন তা অন্যের মুখ থেকে স্তুতি শুনতে রাজি নয় হ্যারি। তবে মনে পড়ে গেলো মাঝে মাঝে ডাম্বলডোর বলতেন সাধারণ লোক, বড় জিনিসের ক্ষুদ্র অংশ, অযথা কাঁদে জোরে টানো, হাসি চেপে বলতেন, আচ্ছা বলতো লোকটির কি হয়েছে?

হ্যারি পকেটে হাত ঢোকালো। পকেটে ছিলো নকল লকেটটা। বরফের মতো ঠান্ডা লকেটটা ও মুঠোর মধ্যে চেপে ধরলো। ও যেনো ভাবতে পারছে না ডাম্বলডোর আর নেই, চিরকালের জন্য চলে গেছেন। খুব শক্ত করে চেপে ধরার জন্য হাতটা ব্যথা করতে লাগলো। দুচোখের অশ্রু ধারা ও রোধ করতে পারছে না। ও মুখ ঘুরিয়ে লেকের শান্ত জলের দিকে তাকালো, সবুজ অরণ্যের দিকে তাকালো, সেই কালো আলখেল্লা পরা বেঁটে খাটো লোকটা অনর্গল কি সব বলে যাচ্ছে যার একটি শব্দও হ্যারির কানে আসছে না। হঠাৎ গাছপালাগুলো নড়তে শুরু করলো, হ্যারি দেখলো সেনট্যাররা তীর-ধনুক নিয়ে সীমান্তে দাঁড়িয়ে রয়েছে। তারপরই ওরা আকাশের দিকে তাকিয়ে অজস্র তীর ছুঁড়তে লাগলো। যারা শোকসভায় বসেছিলেন সেনট্যরদের তীর ছোঁড়া দেখে ভয় পেয়ে গেলেন। সেই দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হ্যারির মনে পড়ে গেলো ওর নিষিদ্ধ অরণ্যে যাওয়ার কথা, ভোস্টেমর্টের সঙ্গে লড়াইয়ের কথা। ডাম্বলডোর বলেছিলেন, লড়াইতে হারজিৎ আছে। আমরা বলেছিলেন, লড়াই, লড়াই করে যাবে, ভয় পেয়ে যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে চলে আসবে না। অশুভকে লড়াই করে পরাস্ত করবে। তাহলেই পৃথিবী থেকে অশুভকে দমন করা যাবে তবে তারা কখনো নির্মূল হবে না।

অরণ্যের দিকে তাকিয়ে অতীতের কথা ভাবতে ভাবতে মনে পড়ে অনেক কথা। যারা তাকে ভালোবাসতেন, বিপদ আপদ থেকে রক্ষা করতেন তারা যেন ওর সামনে এসে দাঁড়ালেন: মা-বাবা, ওর ধর্মপিতা, সবার শেষে ডাম্বলডোর। সকলেই তাকে অশুভ থেকে রক্ষা করার জন্য বদ্ধপরিকর ছিলেন। সবশেষে ছিলেন ডাম্বলডোর… তিনিও চলে গেলেন। রক্ষকরা আর কেউ নেই, ওর আর ভোল্ডেমর্টের মাঝে আর কেউ দাঁড়াবে না। বার বার শিশু অবস্থা থেকেই মনে দানা বেঁধে ছিলো নিরাপদ আশ্রয়ে ও বেঁচে রয়েছে, কারও সাধ্য নেই ওকে আঘাত করে। ওর মনে হলো নিজের শক্তিতে আজ থেকে ওকে দাঁড়াতে হবে। বাস্তব, একমাত্র বাস্তব ওর সামনে রয়েছে। কোনো রক্ষক নেই, সহানুভূতি নেই, ওর জীবনের সবচেয়ে বড় রক্ষক চলে গেছেন, আজ ও একা, এই পৃথিবীতে একা।

সেই বেঁটে লোকটার বক্তৃতা শেষ হয়েছে। এবার হয়তো অন্য কেউ টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে স্তুতি শুরু করবে। এবারে হয়তো মন্ত্রী বা পরিষদরা শুরু করবেন। কিন্তু তারা যেমন বসেছিলেন তেমনই বসে রইলেন।

তারপর হ্যারির কানে এলো কিছু লোকের আতঙ্কিত স্বর। ও সামনে তাকিয়ে দেখলো শুভ্র অগ্নিশিখা ডাম্বলডোরের মরদেহ ও টেবিল থেকে বেরিয়ে আসছে। অগ্নিশিখা একটু একটু করে লেলিহান হয়ে ওপরে উঠছে, ডাম্বলডোরের দেহ আর দেখা যাচ্ছে না। সাদা ধোঁয়াতে চতুর্দিক ভরে গেলো। কুণ্ডলী পাকানো সেই ধোঁয়া নানা রকমের অদ্ভুত অদ্ভুত আকার গঠন করে চলেছে। হ্যারির সেই দিকে তাকিয়ে মনে হলো ওর হৃদয়ের স্পন্দন বন্ধ হয়ে আসছে। নীল আকাশের দিকে তাকালো, দেখলো একটা ফিনিক্স পাখি ডানা মেলে উড়ছে, গান গাইছে, তবে পাখিটা আর দুঃখের সুরে গান গাইছে না। তারপরই আগুন নিভে গেলো, ধোয়াও আর দেখা গেলো না। দেখলো সেই শ্বেতপাথরের টেবিলটা নেই, সেখানে রয়েছে নাতিদীর্ঘ একটি শ্বেতপাথরের স্মৃতিসৌধ, তার ভেতরে রয়েছে ডাম্বলডোরের প্রশান্ত দেহ। মারপিপলদের মতো অরণ্য থেকে চলে গেছে সেনট্যাররা। অরণ্য নিস্তব্ধ, লেকের সবুজ জল টলটল করছে।

হ্যারি ভেবে চলেছে ডাম্বলডোরের অসম্পূর্ণ কাজ ও একাই সম্পূর্ণ করবে। ছটি হরক্রাকসের মধ্যে দুটি ধ্বংস হয়েছে, আরো বাকি রয়েছে চারটি। কোথায় সেগুলো আছে? কাপে, লকেটে, সাপে?

ও পাশে বসে থাকা জিনি, রন, হারমিওনের মুখের দিকে তাকালো। জিনি আর কাঁদছে না। ও কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা হ্যারির দিকে অবিচলভাবে তাকালো।

জিনি শোনো, হ্যারি বললো। আমি আর তোমার সঙ্গে কোনোভাবেই জড়িত থাকবো না। আমাদের আর দেখা সাক্ষাৎ হবে না, আমাদের নিজের পথে চলতে হবে।

জিনি খুব বিদ্রূপ করে হেসে বললো, তোমার ওই বোকার মত মহৎ কারণে? তাই বলতে চাইছো?

হ্যাঁ তাই, একজনের জীবন থেকে অন্য জনের বিচ্ছেদের মত, তোমার সাথে শেষ কয়েক সপ্তাহ… এখন আমাকে একাই কাজটি করতে হবে।

জিনি চুপ করে রইলো।

ভোল্ডেমর্ট শক্রর মিত্রদের ব্যাবহার করে চলেছেন। তোমাকেও একবার টোপ হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন, কারণ তুমি আমার প্রিয় বন্ধুর বোন। তুমি বুঝতে পারছে না, আমার সঙ্গে তুমি জড়িত থাকলে কতোটা বিপদের সম্মুখীন হতে পারো। ও খুজে খুজে তোমাকে বের করবে, তোমার সাহায্যে আমাকে ধরার ঘৃণ্য পরিকল্পনা করে যাবে।

আমি যদি সেটা কেয়ার না করি? জিনি জোর দিয়ে বললো।

তুমি না করলেও আমি করি, তোমার মৃত্যু হলে কেমন করে আমি সহ্য করবো, আমার জন্য হয়তো তোমাকে হত্যা করতে দ্বিধা করবে না।

জিনি হ্যারির দিকে না তাকিয়ে লেকের দিকে তাকিয়ে রইলো, আমি কখনো আমার জীবন থেকে তোমাকে ভিন্ন করে দেখিনি। জিনি বললো, হারমিওন আমাকে বলেছিলো, আমি যেন অন্য কারও সঙ্গে মেলামেশা করি, তোমাকে স্বস্তি তে থাকতে দিই। তুমি হয়তো লক্ষ্য করেছো কখনো আমি তোমার সঙ্গে আলাদাভাবে মন খুলে কথা বলতে পারিনি।

স্মার্ট মেয়ে হারমিওন, হ্যারি বললো, হাসবার চেষ্টা করলো। যত দ্রুত হয় তাই আমি চাই। কিন্তু মাস, বছর, যুগ লেগে যেতে পারে।

আমি অন্তরে অন্তরে বিশ্বাস করি যে দায়িত্ব তোমাকে ডাম্বলডোর দিয়ে গেছেন সেটা সমাপ্ত না করে ফিরলে তুমি খুশি হবে না। যাদুবিশ্বকে রক্ষা করার জন্যই তুমি কাজ করছে।

হ্যারি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। দেখলো জিনি হারমিওনকে জড়িয়ে ধরেছে; হারমিওন ওর মাথায় হাত বুলোচ্ছে। হ্যারির ওদের দিকে তাকিয়ে থাকলে চলবে না। ও পিছন ফিরলো, জিনি ও ডাম্বলডোরের সৌধ পিছনে পড়ে রইলো। ধীরে ধীরে লেকের ধারে হাঁটতে লাগলো। চুপ করে বসে থাকার চাইতে আপন মনে হাঁটতে ওর ভালো লাগলো। ওর মনে এখন একই চিন্তা কতো তাড়াতাড়ি হরক্রাকস গুলো খুঁজে বের করে ধ্বংস করবে, ভোল্ডেমর্টকে হত্যা করবে। বসে থেকে সময় নষ্ট করে কোনো লাভ নেই।

হ্যারি।

হ্যারি ডাক শুনে পেছনে তাকালো। দেখলো রুফাস স্ক্রিমগৌর খোড়াতে খোড়াতে ওর কাছে আসছেন। হাতে ওয়াকিং স্টিক।

আমি তোমার সঙ্গে দুএকটা কথা বলতে চাই হ্যারি, তোমার সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে কথাটা বললে আশাকরি তুমি কিছু মনে করবে না?

হ্যারি উদাসীন ভাবে বললো, না। কথাটা বলে ক্রিমগৌরের সঙ্গে ধীরে ধীরে হাঁটতে লাগলো।

হ্যারি, ডাম্বলডোরকে হত্যা খুবই দুঃখজনক ঘটনা, স্ক্রিমগৌর নরম সুরে বললেন। খবরটা শুনে আমি কতোটা ব্যথিত হয়েছি তা তোমায় বোঝাতে পারবো না। ডাম্বলডোর একজন মহান জাদুকর ছিলেন; আমাদের মধ্যে অবশ্যই মতের অমিল ছিলো, সে কথা হয়তো তুমি জানো। তবে সেই মতের অমিল থাকা সত্ত্বেও আমার চেয়ে ভালো কেউ তাকে জানতো না।

হ্যারি সরাসরি বললো, আপনি কি যেন বলবেন বলছিলেন?

কথাটা শুনে স্ক্রিমগৌর একটু অসম্ভষ্ট হলেন তা ওর মুখে ফুটে উঠলো। সেই মুখোভাব ক্ষণিক, সঙ্গে সঙ্গে মুখে দুঃখের ছাপ ফুটিয়ে তুললেন। একটা বোঝ। পড়ার মধ্যে আসতে চাইছেন যেন।

আমি জানি তুমি কতোটা আঘাত পেয়েছে, স্ক্রিমগৌর বললেন, তুমি তো ডাম্বলডোরের খুব কাছের মানুষ ছিলে, তার সবচেয়ে প্রিয় ছিলে তাও জানি। তোমাদের মধ্যে ছিলো বন্ধন।

আপনি কি বলতে চান? হ্যারি আবার বললো। ও আর কথা বাড়াতে চায় না। হাঁটা বন্ধ করে ক্রিমগৌরের মুখের দিকে তাকালো উত্তরের অপেক্ষায়।

স্ক্রিমগৌর ওয়াকিং স্টিকটা শক্ত করে ধরে দাঁড়িয়ে হ্যারির মুখের দিকে তাকালেন, মুখে চোখে চাতুর্যের ছাপ।

সকলে বলছে সে রাতে উনি স্কুল ছেড়ে যেখানে গিয়েছিলেন তখন তুমি তার সঙ্গে ছিলে, তারপর ফিরে আসার পর তিনি মারা গেছেন।

কথাগুলো কে বলেছে, কারা বলেছে, হ্যারি বললো।

ডাম্বলডোর মারা যাবার পর কেউ একজন টাওয়ারের ওপর থেকে একজন ডেথইটারকে স্টুপিফাই করেছিলো, তাছাড়া সেখানে দুটো ঝাড়ু পাওয়া গেছে। তাহলে মিনিস্ট্রি দুই আর দুই যোগ করতে পারে, হ্যারি। দুই আর দুয়ে চার হয় তাই না?

শুনে সুখী হলাম, হ্যারি বললো। শুনুন আমি ডাম্বলডোরের সঙ্গে কোথায় গিয়েছিলাম, কিসের জন্য গিয়েছিলাম সম্পূর্ণ আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার। ব্যাপারটা সকলে জানুক তিনি চাননি।

হা… হা… তার প্রতি তোমার আনুগত্য সত্যই প্রশংসার যোগ্য সন্দেহ নেই, স্ক্রিমগৌর বললেন। মনে হয় নিজেকে সংযত রাখার যথাসাধ্য চেষ্টা করছেন। বিরক্তি মাখা মুখে বললেন, হ্যারি এখন তো ডাম্বলডোর আর নেই।

যখন এই স্কুলের একজনও তার ওপর অনুগত থাকবে না তখন তিনি অবশ্যই স্কুল ছেড়ে চলে যাবেন, হ্যারি হাসতে হাসতে বললো।

মাই ডিয়ার বয়, এখন তো তার থাকা বা না থাকার কোনো প্রশ্ন নেই।

আমি সে কথা বলতে চাই না, আমি কি বলতে চাই আপনি বুঝবেন না। এর বেশি কিছু আপনাকে আমার বলার নেই।

স্ক্রিমগৌর চুপ করে রইলেন। সামান্য সময় নীরব থেকে ইতস্তত করে খুবই নম্রভাবে বললেন, মিনিস্ট্রি এখন থেকে তোমাকে সব রকমভাবে প্রোটেকশন দিতে চায় হ্যারি, তোমার দেহরক্ষী হিসেবে আমার দুএকজন অরর মোতায়েন করতে চাই।

হ্যারি হাসলো। ভোল্ডেমর্ট নিজের হাতে আমাকে হত্যা করতে চায়, অররদের তাকে বাধা দেবার সাধ্য নেই। যে প্রস্তাবটা আমাকে জানালেন তার জন্য মিনিস্ট্রিকে ধন্যবাদ, আপনাকে নয়।

তাহলে, স্ক্রিমগৌর বললেন। তার গলার স্বর কঠিন। সে অনুরোধটি গত ক্রিস্টমাসে তোমাকে করেছিলাম…।

অনুরোধ? ও হ্যাঁ মনে পড়েছে, পৃথিবীর সবাইকে আমি উচ্চকণ্ঠে বলতে পারি কি দারুণ একটি কাজ আমার জন্য করতে চেয়েছেন, অবশ্য একটা কিছুর বদলে।

সকলের সাহস বাড়াবার জন্য। হ্যারি ক্রিমগৌরের মুখের দিকে তাকালো। স্ট্যান শানপাইকের মুক্তি? স্ক্রিমগৌর আঙ্কল ভার্ননের চাইতে আরো বিশ্রীভাবে হাসলেন।

ওই, তুমি দেখছি…।

একেবারে ডাম্বলডোরের লোক–প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত! হ্যারি একটু যেনো ব্যঙ্গ করে বললো।

স্ক্রিমগৌর হ্যারির মুখের দিকে কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে ওয়াকিং স্টিকে ভর দিয়ে ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে চলে গেলেন।

হ্যারি দেখলো অদূরে পার্সি আর মিনিস্ট্রির লোকেরা তার জন্য অপেক্ষা করছে। হ্যারি অন্য পথে চললো। রন-হারমিওন এক রকম দৌড়তে দৌড়তে হ্যারির দিকে আসছে দেখে হ্যারি ওদের আসার অপেক্ষায় একটা গাছের তলায় দাঁড়ালো। ওই গাছটার তলায় স্কুল জীবনে বহুবার একত্রে বসে হাসি-ঠাট্টা-গল্প করে কাটিয়েছে।

হারমিওন ফিস ফিস করে বললো, স্ক্রিমগৌর কি বললেন?

হ্যারি কাঁধ ঝাঁকুনি দিয়ে বললো, সেই একই কথা, ক্রিস্টমাসে যা বলেছিলেন। উনি চান ডাম্বলডোরের সব গোপন কথা ওকে বলি, আমি মিনিস্ট্রির নতুন পোস্টার বয় হই।

রন কিছু বলার জন্য ছটফট করছিলো। একটু চুপ করে থাকার পর জোরে জোরে হারমিওনকে বললো, এই শোনো, আমি ওদিকে গিয়ে পার্সিকে পিটিয়ে আসি।

হারমিওন রনের হাত ধরে বললো, তুমি কি পাগল হয়ে গেছে রন।

ওকে পেটালে আমার মন শান্ত হবে।

কথাটা শুনে হ্যারি হাসলো, হারমিওনও মিষ্টিভাবে হাসলো। তারপর ও ক্যাসেলের দিকে তাকাতেই হাসি মিলিয়ে গেলো। ভাবতেই পারছি না আর আমরা হোগার্টসে আসতে পারবো না, হোগার্ট বন্ধ হয়ে যাবে!

হয়তো হবে না, রন বললো। বাড়ির চাইতে আমাদের বিপদ এখানে অনেক কম, তাই না? এখন সব জায়গায় বিপদ, আমার মনে হয় সে তুলনায় হোগার্টসে বিপদের সম্ভাবনা অনেক কম, অনেক নিরাপদ। এখানে অনেক জাদুকর আছেন প্রতিরোধ করার জন্য। হ্যারি, বলল ঠিক বলেছি না?

আমি আবার ডার্সলে পরিবারে ফিরে যাচ্ছি। ডাম্বলডোরের আদেশ, হ্যারি বললো। তবে ওখানে বেশিদিন থাকবো না। তারপর চিরকালের জন্য ওখান থেকে চলে যাবো।

স্কুলে আর আসবে না তো কোথায় যাবে?

ভাবছি, ভাবছি আবার আমি গডরিকস হলোতে গিয়ে থাকবো। হ্যারি খুব আস্তে আস্তে বললো। ডাম্বলডোরের মৃত্যুর পর থেকেই গডরিকস হলোতে যাবার কথা ভেবে চলেছে হ্যারি। আমার যাত্রা ওখান থেকেই শুরু করবো এইটুকু বলতে পারি। ওখানে গেলে মা-বাবার কবরে যেতে পারবো। আমার খুব ভালো লাগবে।

তারপর কি করবে শুনি, রন বললো।

বসে থাকবো না নিশ্চই। আমার অনেক কাজ বাকি আছে। বাকি চারটে হরক্ৰাকস খুঁজে বের করে ধ্বংস করতে হবে। ওর দৃষ্টি লেকের জলে। জলেতে ডাম্বলডোরের শ্বেত সৌধের প্রতিবিম্ব পড়ে কাঁপছে। আমাকে ওই কাজগুলো করার কথা বলে গেছেন। ডাম্বলডোরের ভাবনা চিন্তা যদি ঠিক হয়, আমি সে সম্বন্ধে নিশ্চিত, আরো চারটে হরক্ৰাকস আছে। তারপর আমাকে ভোল্টেমর্টের আত্মার সাত টুকরোটা কিন্তু সেটা তো ওর দেহের ভেতর রয়েছে, আমি একমাত্র লোক যে ওকে হত্যা করতে পারবো। হরক্রাকসের খোজে যেতে যেতে যদি আমার সেভেরাস স্নেইপের সঙ্গে দেখা হয়, হ্যারি সামান্য থেমে বললো। আমার পৌষ মাস আর ওর সর্বনাশ।

তিন জনেই নীরব। কারও মুখে একটি শব্দ নেই। শোক সভায় যারা এসেছিলেন তাদের সকলেই চলে গেছেন।

রন হঠাৎ বললো, হ্যারি, আমরাও তোমার সঙ্গে যাবো।

কোথায়?

তোমার আঙ্কল-আন্টির বাড়িতে, রন বললো। তারপর তুমি যেখানে যেখানে যাবে আমরা তোমার সঙ্গে যাবো।

না তা হয় না, হ্যারি সঙ্গে সঙ্গে বললো। ও কিছুতেই রন, হারমিওনকে বোঝাতে পারছে না ও একাই দুর্গম অভিযানে যেতে চায়।

তুমি আগে আমাদের অনেক বার বলেছে, হারমিওন সোজা সাপটা বললো। আমরা যা করবো এক সঙ্গে করবো, সে কথা ভুলে যাচ্ছো কেন?

তুমি যেখানে আমরা সেখানে, বিপদে আপদে সব সময়। যা ভাগ্যে আছে তাই হবে। একটা কথা বন্ধু যাবার আগে তোমাকে আমাদের বাড়ি যেতে হবে, তা আমরা গডরিক হলো বা যেখানেই যাই।

কেন?

কেন আবার? মনে নেই বিল আর ফ্লেউরের বিয়ে? হ্যারি সোজা রনের মুখের দিকে তাকালো, তাহলে কি সবকিছুই স্বাভাবিক হয়ে গেছে? এতো গোলমালের মধ্যে আনন্দ, হৈহৈ?

ঠিক আছে, আমাদের তো সেটা বাদ দিলে চলবে না, হ্যারি সম্মতি জানালো।

ওর হাতটা যন্ত্রচালিতের মতো বরফশীতল ভুয়া হরক্রাকস স্পর্শ করলো। ওর চোখের সামনে ভেসে উঠলো অন্ধকার, উঁচু নিচু, আঁকা বাকা সর্পিল পথ। এক মাস, এক বছর, অথবা দশ বছর হলেও সেই পথে ওকে যেতে হবে। ভোল্টেমর্টের সাথে চূড়ান্ত সাক্ষাৎ একদিন হবে, সেটা মাসও হতে পারে বা বছর বা যুগ, তার আগে ওর জীবনে হারমিওন ও রনের সাথে একদিনের জন্য হলেও শান্তিতে আনন্দ উৎসবে মেতে ওঠার একটা সুযোগ অপেক্ষা করছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *